০১. ‘জলপ্রদানিকপর্বাধ্যায়’—ধৃতরাষ্ট্রশোকসান্ত্বনা

১ম অধ্যায়

‘জলপ্রদানিকপর্বাধ্যায়’—ধৃতরাষ্ট্রশোকসান্ত্বনা

নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।

জনমেজয় কহিলেন, হে ব্রহ্মন্! কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন ও উভয়পক্ষের সমুদয় সৈন্যসামন্ত নিহত হইলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ও কৃপ প্রভৃতি মহারথত্রয় কি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলেন? আমি অশ্বত্থামার কাৰ্য্য শ্রবণ করিলাম, অতঃপর সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে যাহা কহিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অন্ধরাজের শতপুত্র নিহত হওয়াতে তিনি পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া মূকের ন্যায় বাক্যালাপ পরিত্যাগপূর্ব্বক চিন্তাকুলচিত্তে কালহরণ করিতে লাগিলেন। মহাত্মা সঞ্জয় তাঁহাকে তদবস্থ অবলোকন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! শোক পরিত্যাগ করুন, শোক করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। এক্ষণে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা নিহত হইয়াছে। বসুমতী জনশূন্যা হইয়াছেন। যেসকল ভূপাল দুৰ্য্যোধনের সাহায্যার্থ নানাদেশ হইতে সমাগত হইয়াছিলেন, তাঁহারা তাঁহার সহিত প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। অতঃপর আপনি পুত্র, পৌত্র, সুহৃদ, জ্ঞাতি, গুরু ও পিতৃগণের যথাবিহিত প্রেতকাৰ্য্য নিৰ্বাহ করুন।”

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পুত্রশোকাৰ্দিত রাজা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের সেই করুণবাক্য শ্রবণ করিয়া বাতাহত দ্রমের [বায়ুতাড়িত বৃক্ষের] ন্যায় সহসা ভূতলে নিপতিত হইয়া কহিলেন, “সঞ্জয়! আমার পুত্র, অমাত্য ও সুহৃদ্‌গণ নিহত হইয়াছে, অতঃপর চিরকালই আমাকে দীনহীনের ন্যায় এই পৃথিবীতে ভ্রমণ করিতে হইবে। এক্ষণে বন্ধুবিহীন হইয়া জরাজীর্ণ পক্ষহীন বিহঙ্গমের ন্যায় আমার জীবনধারণে প্রয়োজন কি? দিবাকর যেমন রশ্মিহীন হইলে নিতান্ত শোভাশূন্য হয়েন, তদ্রূপ আমিও রাজ্যহীন, নেত্রহীন ও বন্ধুবিহীন হইয়া শ্রীভ্রষ্ট হইলাম। পূর্বে পরশুরাম, দেবর্ষি নারদ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়নের হিতবাক্য শ্রবণ করি নাই এবং বাসুদেব সভামধ্যে হিতোপদেশ প্রদান ও ভীষ্মদেব ধর্ম্মসংযুক্ত বাক্য প্রয়োগ করিলে আমি তৎকালে বধিরের ন্যায় অবস্থান করিয়াছিলাম, এক্ষণে সেই অপরাধেই এই অনুতাপ করিতে হইল। হায়! বৃষভতুল্য মহাবীর দুৰ্য্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ ও সূৰ্য্যতুল্য মহাত্মা দ্রোণাচার্য্যের নিধনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। আমি এমন কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি যে, আমাকে এইরূপ দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইতে হইল? নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, আমি পূর্ব্বজন্মে কোন না কোন দুষ্কৰ্ম্ম করিয়াছিলাম, নচেৎ বিধাতা কেন আমাকে এরূপ দুঃখভাগী করিবেন? দৈব প্রতিকূল হওয়াতেই আমাকে এই বৃদ্ধাবস্থায় সমুদয় বন্ধুবান্ধবের বিনাশ দেখিতে হইল। পৃথিবীতে আমার তুল্য হতভাগ্য আর কেহই নাই। অতএব আজই পাণ্ডবগণ আমাকে ব্রহ্মলোকগমনে সুদীর্ঘ পথ আশ্রয় করিতে দর্শন করুক।”

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! তখন মহামতি সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে নিতান্ত শোকাৰ্দিত দেখিয়া সান্ত্বনাবাক্যে কহিলেন, “নরনাথ! আপনি বৃদ্ধগণের মুখে সমুদয় বেদ ও বিবিধ শাস্ত্র শ্রবণ করিয়াছেন। সৃঞ্জয় পুত্রশোকার্ত্ত হইলে মুনিগণ তাঁহাকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, তাহাও আপনার অবিদিত নাই; অতএব শোক পরিত্যাগ করুন। দুৰ্য্যোধন যৌবনমদে মত্ত হইলে আপনি অর্থলালসায় সুহৃদগণের বাক্য গ্রহণ করেন নাই, নিরন্তর কেবল দুঃশীলগণের বাক্যানুরূপ কাৰ্য্য করিতেন। এক্ষণে তাহারই ফলভোগ করিতে হইতেছে। আপনার বুদ্ধি অসিস্বরূপ হইয়া আপনাকেই ছেদন করিতেছে। দুর্ম্মতি দুর্য্যোধন নিতান্ত ক্রূর, অহঙ্কারী, অল্পবুদ্ধি ও অসন্তুষ্ট ছিল। সেই দুরাত্মা দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনি, চিত্রসেন ও মদ্ররাজ শল্যের মন্ত্রণার বশবর্তী হইয়া কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মদেব, গান্ধারী, বিদুর, দ্রোণ, কৃপ, বাসুদেব এবং ব্যাস ও নারদ প্রভৃতি ঋষিগণের বাক্যে কর্ণপাতও করে নাই; সতত কেবল যুদ্ধবাসনাই প্রকাশ করিত। সেই নিমিত্তই সে রাজ্যের সহিত বিনষ্ট হইয়াছে। আপনি বুদ্ধিমান্ ও সত্যবাদী; ভবাদৃশ ব্যক্তির শোক ও মোহের বশবর্তী হওয়া নিতান্ত অবিধেয়। দেখুন, আপনি ধর্ম্মের সমাদর না করিয়া কেবল যুদ্ধাভিলাষী ব্যক্তিদিগকেই প্রশংসা করিতেন, সেই নিমিত্তই যাবতীয় ক্ষত্রিয় বিনষ্ট ও শত্ৰুদিগের যশ পরিবর্ধিত হইয়াছে। আপনি পূর্বে উভয়পক্ষের মধ্যস্থ হইয়াছিলেন, কিন্তু পুত্রগণকে হিতোপদেশ প্রদান বা উভয়পক্ষে সমভাব প্রদর্শন করেন নাই। হে মহারাজ! যে কাৰ্য্য করিলে শেষে অনুতাপ করিতে না হয়, সেই কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হওয়াই মনুষ্যের শ্রেয়ঃকল্প। আপনি পুত্রের প্রীতিসাধনার্থ তাহারই মতানুযায়ী কাৰ্য্য করিয়াছিলেন। সেই নিমিত্তই আপনাকে এক্ষণে অনুতাপ করিতে হইল। যে আপনার পতনবিষয়ে কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া মধুলোভে পৰ্বতে আরোহণ করে, তাহাকে নিশ্চয়ই নিপতিত হইয়া আপনার মত অনুতাপ করিতে হয়। যাহা হউক, এক্ষণে আপনি শোক পরিত্যাগ করুন। শোক অর্থলাভ, ফললাভ, প্রিয়লাভ ও মোক্ষলাভের প্রধান প্রতিবন্ধক। যে ব্যক্তি স্বয়ং অগ্নি উৎপাদন ও বস্ত্রে সংযোগপূর্ব্বক দগ্ধ হইয়া দুঃখাৰ্ত্ত হয়, তাহাকে কখনই পণ্ডিত বলা যায় না। পূর্বে আপনারা পিতা-পুত্রে লোভরূপ ঘৃত ও বাক্যরূপ বায়ুদ্বারা পাণ্ডবরূপ ভীষণ হুতাশন প্রজ্বলিত করিয়াছিলেন। আপনার পুত্রগণ সেই সমিদ্ধ পাবকে শলভকুলের ন্যায় দগ্ধ হইয়াছে। অতএব তাহাদের নিমিত্ত আর শোক করা কর্ত্তব্য নহে। আপনি অশ্রুবর্ষণদ্বারা মুখমণ্ডল প্লাবিত করিতেছেন, উহা কিন্তু নিতান্ত শাস্ত্রবিরুদ্ধ। পণ্ডিতেরা কহেন যে, আত্মীয় ব্যক্তির শোকাশ্রু অনলস্বরূপ হইয়া মৃতব্যক্তিদিগকে দগ্ধ করিয়া থাকে। অতএব আপনি শোক পরিত্যাগপূর্ব্বক ধৈৰ্য্যাবলম্বন করুন।” মহামতি সঞ্জয় রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে এইরূপে আশ্বাসিত করিতে লাগিলেন।