৫৮. উতঙ্কের অভীষ্ট কুণ্ডলদ্বয়লাভ

৫৮তম অধ্যায়

উতঙ্কের অভীষ্ট কুণ্ডলদ্বয়লাভ

বৈশম্পায়ন বলিলেন, সৌদাসরাজমহিষী ময়ন্তী এইরূপে ভর্ত্তার অভিজ্ঞান প্রার্থনা করিলে, মহাত্মা উতঙ্ক তৎক্ষণাৎ সৌদাসের নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! রাজ্ঞী আপনার অভিজ্ঞান ভিন্ন আমাকে কুণ্ডল প্রদান করিবেন না; অতএব আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে কোন অভিজ্ঞান প্রদান করুন।”

মহাত্মা উতঙ্ক এই কথা কহিলে মহারাজ সৌদাস তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ব্রহ্মন্! আপনি রাজ্ঞীর নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলিবেন যে, সৌদাস কহিয়াছেন, প্রিয়ে! আমি যেরূপ দুরবস্থায় অবস্থিত রহিয়াছি, কখন যে ইহা হইতে নিষ্কৃতি পাইব, আমার এরূপ প্রত্যাশা নাই, অতএব তুমি আমার মঙ্গলবিধানার্থ এই ব্রাহ্মণকে তোমার মণিময় কুণ্ডলদ্বয় প্রদান কর।”

মহারাজ সৌদাস এই কথা কহিবামাত্র মহাত্মা উতঙ্ক মুদয়ন্তীর নিকট গমনপূৰ্ব্বক ভূপতির বাক্য অবিকল কীৰ্ত্তন করিলেন। রাজ্ঞীও উতঙ্কের মুখে ভর্ত্তার অভিজ্ঞানস্বরূপ সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া তৎক্ষণাৎ উতঙ্ককে স্বীয় কুণ্ডলদ্বয় প্রদান করিলেন। তখন মহাত্মা উতঙ্ক সেই কুণ্ডলযুগল গ্রহণপূৰ্ব্বক পুনরায় সৌদাসের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ! আমি রাজ্ঞীর নিকট আপনার অভিজ্ঞানবাক্য কীৰ্ত্তন করিবামাত্র তিনি আমাকে এই কুণ্ডলদ্বয় প্রদান করিয়াছেন। এক্ষণে আমি আপনার সেই অভিজ্ঞানবাক্যের প্রকৃত অর্থ বুঝিতে পারি নাই, অতএব আপনি আমার নিকট উহার তাৎপর্য্য কীৰ্ত্তন করুন।”

তখন সৌদাস কহিলেন, “ভগবন্! ক্ষত্রিয়েরা চিরকালই ব্রাহ্মণদিগের পূজা করিয়া থাকেন; কিন্তু ব্রাহ্মণগণ সৰ্ব্বদাই উঁহাদিগের অনিষ্টাচরণে প্রবৃত্ত হয়েন। এই দেখুন, আমি ব্রাহ্মণের প্রতি একান্ত ভক্তিপরায়ণ হইয়াও ব্রাহ্মণের শাপেই এইরূপ দুরবস্থায় নিপতিত হইয়াছি। আমি কখন যে এই অবস্থা হইতে বিমুক্ত হইয়া ইহলোকে সুখে অবস্থান ও পরলোকে স্বর্গলাভ করিতে পারিব, আমার এরূপ প্রত্যাশা নাই। ফলতঃ কোন রাজাই ব্রাহ্মণের সহিত বিরোধ করিয়া ইহলোকে বা পরলোকে সুখভোগ করিতে সমর্থ হয় না। আমি এইরূপ বিচার করিয়াই আমার, একান্ত প্রিয় এই মণিময় কুণ্ডলদ্বয় আপনাকে প্রদান করিলাম। এক্ষণে আপনি আমার সহিত যে নিয়ম করিয়াছেন, তাহা প্রতিপালন করুন।” ভূপতি সৌদাস এই কথা কহিলে মহর্ষি উতঙ্ক তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আমার প্রতিজ্ঞা কদাচ অন্যথা হইবার নহে। আমি অবশ্য পুনরায় আপনার নিকট সমুপস্থিত হইব। এক্ষণে আপনার নিকট কোন বিষয় জিজ্ঞাসা করিব; আপনি তাহার উত্তর প্রদান করুন।”

তখন সৌদাস কহিলেন, “ভগৱন্! আপনি অচিরাৎ আমার নিকট স্বীয় জিজ্ঞাস্য বিষয় ব্যক্ত করুন, আমি অবশ্যই যথাসাধ্য উহার উত্তর প্রদান করিব।”

উতঙ্ক কহিলেন, “মহারাজ! ধর্ম্মতত্ত্ববেত্তা পণ্ডিতেরা ব্রাহ্মণদিগের সত্যবাদী হওয়া উচিত বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন, সুতরাং আমি আপনার নিকট যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহা লঙ্ঘন করিতে আমার বাসনা নাই, আমার বাক্য কদাচ মিথ্যা হইবে না। কিন্তু আজ আপনার সহিত আমার মিত্রভাব উৎপন্ন হইয়াছে। অতএব আমাকে বিনাশ করিলে আপনার মিত্ৰবিনাশজন্য পাতক হইবে। শাস্ত্রে কথিত আছে যে, মিত্রের অনিষ্টাচারণ করিলে সুবর্ণচৌর্য্যজনিত পাপে লিপ্ত হইতে হয়; সুতরাং আমাকে বিনাশ করা আপনার কখনই কর্ত্তব্য নহে। আপনি যখন রাক্ষভাবাপন্ন হইয়াছেন, তখন বোধ হয়, আমি আপনার নিকট প্রত্যাগত হইলেই আপনি আমাকে সংহার করিবেন। আপনার নিকট আমার প্রত্যাগমন করা কর্ত্তব্য কি না, আমি আপনাকেই এই প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিতে অনুরোধ করিতেছি। আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক আত্মমত কীৰ্ত্তন করুন।”

মহাত্মা উতঙ্ক এই কথা কহিলে, মহারাজ সৌদাস তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! আমার নিকট প্রত্যাগমন করিলে আপনাকে অবশ্যই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে হইবে; অতএব আপনি কদাচ আর আমার নিকট প্রত্যাগমন করিবেন না।”

নাগকর্ত্তৃক উতঙ্কের কুণ্ডল অপহরণ

সৌদাসরাজা এইরূপে উতঙ্ককে প্রত্যাগমন করিতে নিষেধ করিলে মহাত্মা উতঙ্ক পরম পরিতুষ্ট হইয়া রাজমহিষী মদয়ন্তীর বাক্যানুসারে তৎপ্রদত্ত কুণ্ডলযুগল স্বীয় উত্তরীয় কৃষ্ণাজিনে বন্ধনপূর্ব্বক মহাবেগে মহর্ষি গৌতমের আশ্রমাভিমুখে ধাবমান হইলেন। কিয়দ্দূর গমন করিতে করিতে তাঁহার ক্ষুধার উদ্রেক হইল। তখন তিনি সেই পথিমধ্যস্থিত ফলভারাবনত এক বিল্ববৃক্ষে আরোহণপূৰ্ব্বক উহার শাখাতে সেই কুণ্ডলসম্বলিত মৃগচর্ম্ম বন্ধন করিয়া বিল্বলসমুদয় ভূতলে নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় তাঁহার অনবধানতাবশতঃ কতকগুলি বিল্বফল সেই অজিনে নিপতিত হওয়াতে উহার বন্ধন শ্লথ ও উহা সেই কুণ্ডলদ্বয়ের সহিত ভূতলে নিপতিত হইল।

ঐ সময়ে ঐরাবতবংশসম্ভূত একটি ভুজঙ্গ সেই স্থানে উপস্থিত ছিল। সে ঐ ব্যাপার দর্শন করিবামাত্র তরুতলে সমুপস্থিত হইয়া মুখদ্বারা সেই কুণ্ডলদ্বয় গ্রহণপূর্ব্বক বল্মীকমধ্যে প্রবেশ করিল। তখন মহাত্মা উতঙ্ক সেই ব্যাপারদর্শনে নিতান্ত কোপাবিষ্ট ও খিদ্যমান হইয়া অবিলম্বে বিল্ববৃক্ষ হইতে অবতরণপূর্ব্বক নাগলোকের পথ প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত দণ্ডকাষ্ঠদ্বারা সেই বল্মীক খনন করিতে লাগিলেন। ক্রমে ক্রমে পঞ্চত্রিংশদ্দিবস অতীত হইল; তথাপি উতঙ্ক ঐ পথ প্রস্তুত করিতে পারিলেন না। তাঁহার দণ্ডকাষ্ঠতাড়নে বসুন্ধরা নিতান্ত কাতর হইয়া সহ্য করিতে না পারিয়া সাতিশয় বিচলিত হইতে লাগিল।

তখন দেবরাজ ইন্দ্র মহাত্মা উতঙ্কের দুঃখে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া রথারোহণপূর্ব্বক স্বর্গ হইতে ভূতলে আগমন করিলেন এবং অচিরাৎ ব্রাহ্মণবেশধারণপূৰ্ব্বক উতঙ্কের নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ব্রহ্মন্‌! এ স্থান হইতে নাগলোক সহস্রযোজন অন্তর; সুতরাং আপনি এই দণ্ডকাষ্ঠদ্বারা পৃথিবী বিদারণ করিয়া কখনই তথায় গমন করিতে পারিবেন না।”

ব্রাহ্মণরূপী ইন্দ্র এই কথা কহিলে, উতঙ্ক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভগবন্! যদি আমি নাগলোকে গমন করিয়া কুণ্ডলদ্বয় লাভ করিতে না পারি, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আপনার সমক্ষে প্রাণত্যাগ করিব।”

কুণ্ডল-অন্বেষণার্থ উতঙ্কের নাগলোকগমন

উতঙ্ক এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিলে বজ্ৰপাণি সুররাজ তাঁহার দৃঢ়সঙ্কল্প অবগত হইয়া তাঁহার দণ্ডের অগ্রভাগে বজ্ৰাস্ত্র সংযোজিত করিয়া দিলেন। তখন সেই বজ্রের প্রহারে পৃথিবী অচিরাৎ বিদীর্ণ হওয়াতে নাগলোকগমনের দিব্যপথ প্রস্তুত হইল। মহাত্মা উতঙ্ক তদ্দর্শনে মহা-আহ্লাদিত হইয়া সেই পথদ্বারা অবিলম্বে নাগলোকে প্রবেশপূৰ্ব্বক দেখিলেন ঐ লোক বহুযোজনবিস্তৃত, উহার চতুর্দ্দিকে সুবর্ণ ও মণিমুক্তাদি বিবিধ রত্নবিভূষিত দিব্যপ্রাকারনিচয়, স্ফটিকসোপানসুশোভিত দীর্ঘিকা, নির্ম্মল সলিলপূর্ণ নদী ও বিহঙ্গমমুখরিত বিবিধ বনস্পতিসমুদয় বিরাজিত রহিয়াছে। ঐ নাগলোকের দ্বারদেশ ঊর্ধে শতযোজন এবং বিস্তারে পঞ্চযোজন। ঐ সুবিস্তৃত নাগলোক দর্শন করিবামাত্র উতঙ্ক একান্ত বিষণ্ন হইয়া কুণ্ডলপ্রত্যাহরণবিষয়ে নিতান্ত নিরাশ হইলেন। ঐ সময় এক তেজঃপুঞ্জকলেবর অশ্ব তাঁহার নেপথে নিপতিত হইল। ঐ অশ্বের পুচ্ছ শ্বেত ও কৃষ্ণলোমে বিভূষিত এবং মুখ ও নেত্রযুগল রক্তবর্ণ। অশ্ব অচিরাৎ উতঙ্কের নিকট আগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “উতঙ্ক! তুমি আমার গুহ্যদ্বারে ফুৎকার প্রদান কর, তাহা হইলেই কুণ্ডললাভে সমর্থ হইবে। ঐরাবতসদ্ভূত এক নাগ তোমার কুণ্ডল আনয়ন করিয়াছে। তুমি আমার গুহ্যদ্বারে ফুকারদানে ঘৃণা করিও না, তুমি পূৰ্ব্বে মহর্ষি গৌতমের আশ্রমে বারংবার ঐ কাৰ্য্য করিয়াছ।”

তখন উতঙ্ক কহিলেন, “তুরঙ্গম! উপাধ্যায়ের আশ্রমে কিরূপে তোমার সহিত আমার সন্দর্শন হইয়াছিল, তাহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত বাসনা হইতেছে।”

অশ্ব কহিল, “বিপ্র! আমি তোমার উপাধ্যায়েরও গুরু, আমার নাম অগ্নি। তুমি গুরুর প্রীতির নিমিত্ত সৰ্ব্বদা আমাকে অৰ্চ্চনা করিয়াছ, এই নিমিত্ত তোমার হিতসাধন করিতে আমার একান্ত অভিলাষ হইয়াছে; অতএব তুমি শীঘ্র আমার বাক্যানুরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান কর।”

উতঙ্কের কুণ্ডল উদ্ধার—গুরুদক্ষিণা প্রদান

অশ্বরূপী ভগবান্ হুতাশন এই কথা কহিলে উতঙ্ক তৎক্ষণাৎ তাঁহার আদেশানুরূপ কার্য্যানুষ্ঠান করিলেন। তখন হুতাশন উতঙ্কের প্রতি সাতিশয় প্রীত হইয়া উঠিলেন। ঐ সময় তাঁহার রোমকূপ হইতে অতি ভীষণ ধূমরাশি বিনির্গত হইতে লাগিল। ঐ ধূম ক্রমশঃ পরিবর্দ্ধিত হওয়াতে নাগলোক একেবারে অন্ধকারময় হইয়া গেল। ঐরাবতগৃহে হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল। নাগরাজ অনন্ত ও অন্যান্য সর্পগণের গৃহসকল ধূমে পরিপূর্ণ হওয়াতে নীহারসমাচ্ছন্ন পৰ্ব্বত ও বনপ্রদেশের ন্যায় নিতান্ত দুর্লক্ষ্য হইয়া উঠিল। তখন নাগগণ হুতাশনের তেজঃপ্রভাবে সকলেই একান্ত উত্তপ্ত ও ঐ ধূমপ্রভাবে আরক্তনেত্র হইয়া উহার তথ্যানুসন্ধানার্থ উতঙ্কের নিকট আগমন করিলেন এবং তাঁহার মুখে উহার সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে তাঁহাকে পূজা করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ভগবন্! আমরা আপনার কুণ্ডলদ্বয় প্রদান করিতেছি; আপনি আমাদের প্রতি প্রসন্ন হউন।” নাগগণ এইরূপে উতঙ্ককে প্রীত করিয়া পাদ্য-অর্থ্যাদি প্রদানপূর্ব্বক সেই অপহৃত দিব্যকুণ্ডলদ্বয় প্রত্যর্পণ করিলেন।

হে মহারাজ! নাগগণ এইরূপে প্রবলপ্রতাপশালী উতঙ্ককে পূজা করিলে পর তিনি হুতাশনকে প্রদক্ষিণ করিয়া গুরুগৃহাভিমুখে ধাবমান হইলেন এবং অচিরাৎ আশ্রমে উপস্থিত হইয়া গুরুপত্নীকে কুণ্ডল প্রদানপূর্ব্বক গুরুর নিকট আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলেন।

হে মহারাজ! মহাত্মা উতঙ্ক এইরূপে বহু স্থান পরিভ্রমণ করিয়া দিব্য কুণ্ডলদ্বয় আহরণ করিয়াছিলেন। এই আমি তোমার নিকট উতঙ্কের আশ্চর্য্য তপঃপ্রভাব কীৰ্ত্তন করিলাম।