৫৭. উতঙ্ক-ভক্ষণোদ্যত রাক্ষস সৌদাসসহ সন্ধি

৫৭তম অধ্যায়

উতঙ্ক-ভক্ষণোদ্যত রাক্ষস সৌদাসসহ সন্ধি

বৈশম্পায়ন বলিলেন, এদিকে মহাত্মা উতঙ্ক বনমধ্যে গমন করিতে করিতে মনুষ্যশোণিতলিপ্তকলেবর, সুদীর্ঘ শ্মশ্রূধারী বিকৃতদর্শন মহারাজ, সৌদাসকে নিরীক্ষণ করিলেন। সৌদাসের সেই ভীষণমূৰ্ত্তি, দর্শনে উতঙ্কের মনে কিছুমাত্র ভয় বা দুঃখ উপস্থিত হইল না; প্রত্যুত তিনি অসাধারণ সাহসসহকারে তাঁহার সম্মুখে সমুপস্থিত হইলেন। তখন কৃতান্তের ন্যায় ভীষণ মহারাজ সৌদাস উতঙ্ককে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “তপোধন! দিবসের ষষ্ঠকাল আমার আহারকাল বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে; এক্ষণে সেই ষষ্ঠকাল উপস্থিত হওয়াতে আমি ভক্ষ্যদ্রব্য অনুসন্ধান করিতেছিলাম। আপনি ভাগ্যক্রমে আমার সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়াছেন।”

সৌদাস এই কথা কহিলে উতঙ্ক তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আমি গুরুদক্ষিণা-আহরণার্থ এই স্থানে সমুপস্থিত হইয়াছি। পণ্ডিতেরা কহিয়া থাকেন যে, গুরুদক্ষিণা আহরণার্থী ব্যক্তিকে হিংসা করা কর্ত্তব্য নহে। অতএব আপনি আমাকে বধ করিবেন না।” তখন সৌদাস কহিলেন, “তপোধন! দিবসের ষষ্ঠভাগ আমার আহারকাল বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। এক্ষণে আমি ক্ষুধায় একান্ত কাতর হইয়াছি; অতএব এসময়ে আমি আপনাকে কদাচ পরিত্যাগ করিতে পারিব না।”

উতঙ্ক সৌদাসের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে পুনরায় সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! যদি আমাকে ভক্ষণ করিতে আপনার একান্ত অভিলাষ হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমার তদ্বিষয়ে অসম্মতি নাই; কিন্তু এক্ষণে আমার একটি বাক্য আপনাকে রক্ষা করিতে হইবে। দেখুন, আমি গুরুদক্ষিণা আহরণার্থে নির্গত হইয়াছি; এক্ষণে সেই দক্ষিণা সংগ্রহ করিয়া গুরুকে প্রদানপূৰ্ব্বক পুনরায় আপনার নিকট আগমন করিব। আর আমি গুরুর নিকট যাহা প্রদান করিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছি, তাহা আপনারই আয়ত্ত। এক্ষণে আমি আপনার নিকট সেই অর্থ প্রার্থনা করিতেছি। আপনি ব্রাহ্মণগণকে প্রতিনিয়ত অত্যুৎকৃষ্ট রত্নসমুদয় প্রদান করিয়া থাকেন। এই ভূমণ্ডলে দাতা বলিয়া আপনার বিলক্ষণ প্রতিপত্তি আছে। অতএব আপনি আমাকে অভিলষিত দ্রব্য প্রদান করুন। আমি আপনার নিকট হইতে গুরুদক্ষিণা সংগ্রহ করিয়া গুরুকে প্রদানপূৰ্ব্বক পুনরায় এই স্থানে আগমন করিব। হে মহারাজ! আমি আপনার নিকট এই সত্য প্রতিজ্ঞা করিলাম। আমার বাক্য কখনও মিথ্যা হইবার নহে। আমি ধৰ্ম্মবিষয়েও কখন মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করি না।”

মহাত্মা উতঙ্ক এই কথা কহিলে, মহারাজ সৌদাস তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “তপোধন! যদি আপনার গুরুদক্ষিণা আমারই আয়ত্ত হয়, তবে তাহা অবশ্যই আপনি প্রাপ্ত হইবেন। এক্ষণে আমার নিকট প্রতিগ্রহ করা যদি আপনার কর্ত্তব্য হয়, তাহা হইলে আপনাকে কি প্রদান করিতে হইবে, তাহা ব্যক্ত করুন।”

তখন উতঙ্ক কহিলেন, “মহারাজ! আমি প্রতিগ্রহের উপযুক্ত পাত্র, এই নিমিত্তই আপনার নিকট মণিকুণ্ডলদ্বয় ভিক্ষা করিতে আগমন করিয়াছি।”

সৌদাস কহিলেন, “তপোধন! আপনি যে মণিকুণ্ডলদ্বয় প্রার্থনা করিতেছেন তাহা আমার পত্নীর অধিকৃত। অতএব এক্ষণে অন্য কোন বস্তু প্রার্থনা করুন, আমি তাহা আপনাকে অবশ্যই প্রদান করিব।”

তখুন উতঙ্ক কহিলেন, “মহারাজ! যদি আমাকে দান করা আপনার অভিপ্রেত হয়, তাহা হইলে ঐরূপ ছল প্রদর্শন করিবার আবশ্যকতা নাই। আপনি অনতিবিলম্বেই সেই কুণ্ডলদ্বয় প্রদান করিয়া সত্য প্রতিপালন করুন।”

মহারাজ সৌদাস উতঙ্ককর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া পুনরায় তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “তপোধন! আপনি এক্ষণে আমার মহিষীর নিকট গমনপূৰ্ব্বক তাহাকে আমার অনুরোধ জ্ঞাপন করিয়া কুণ্ডলযুগল প্রার্থনা করুন। তিনি আমার অনুরোধ শ্রবণ করিলে নিশ্চয়ই আপনাকে কুণ্ডলদ্বয় প্রদান করিবেন।”

উতঙ্ক রাজা সৌদাসের মুখে এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আমি কোন স্থানে আপনার পত্নীর সন্দর্শন পাইব, আর আপনি স্বয়ংই বা কি নিমিত্ত তাঁহার নিকট গমন করিতেছেন না?”

তখন সৌদাস কহিলেন, “তপোধন! অদ্য আপনি তাঁহাকে এই কাননের কোন নির্ঝর-সমীপে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইবেন। আমি দিবসের ষষ্ঠকালে তাঁহার সহিত স্বয়ং সাক্ষাৎ করিতে পারিব না।”

মহারাজ সৌদাস এই কথা কহিলে, মহাত্মা উতঙ্ক অবিলম্বে রাজমহিষী মদয়ন্তীর নিকট গমন করিয়া তাঁহার সন্নিধানে আপনার প্রয়োজন ও সৌদাসের অনুরোধ ব্যক্ত করিলেন। দীর্ঘলোচনা মদয়ন্তী উতঙ্কের মুখে স্বামীর অনুরোধ শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! মহারাজ আপনাকে কুণ্ডলদ্বয় প্রদান করিবার নিমিত্ত আমাকে যে অনুরোধ করিয়াছেন, তাহা ত’ মিথ্যা নহে? যাহাই হউক, আপনি এক্ষণে আমার বিশ্বাসের নিমিত্ত তাঁহার নিকট হইতে কোন অভিজ্ঞান আনয়ন করুন। দেবতা, যক্ষ ও মহর্ষিগণ আমার এই মণিময় কুণ্ডলযুগল অপহরণ করিবার নিমিত্ত প্রতিনিয়ত ছিদ্রান্বেষণ করিয়া থাকেন। কুণ্ডলযুগল ভূতলে সংস্থাপন করিলে রত্নলোলুপ ভুজঙ্গেরা, অশুচি হইয়া ধারণ করিলে যক্ষেরা এবং ধারণ করিয়া নিদ্রার বশবর্ত্তী হইলে দেবতারা উহা অপহরণ করিতে পারেন। এই নিমিত্ত সতত সাবধান হইয়া আমাকে ইহা ধারণ করিতে হয়। এই কুণ্ডলদ্বয় দিবারাত্রি অনবরত সুবর্ণ উৎপাদন করে। রজনীযোগে ইহার প্রভায় গ্রহনক্ষত্ৰসমুদয়ের প্রভা তিরোহিত হইয়া যায়। ইহা পরিধান করিলে ক্ষুৎপিপাসাজনিত যন্ত্রণা এককালে নিবারণ হয় এবং বিষদ ও অগ্নিদ প্রভৃতি দুরাত্মা ব্যক্তিগণ হইতে কিছুমাত্র ভয় থাকে না; খর্ব্বকায় ব্যক্তি এই কুণ্ডল ধারণ করিলে ইহা খৰ্ব্ব ও দীর্ঘকায় ব্যক্তি ধারণ করিলে ইহা দীর্ঘ হইয়া থাকে। আমার এই কুণ্ডলের গুণ ত্রিলোকে প্রথিত আছে। এক্ষণে আপনি মহারাজের অভিজ্ঞান আনয়ন করুন, তাহা হইলেই আমি আপনাকে ইহা প্রদান করিব।”