৫৩. শাপপ্ৰদানোদ্যত উতঙ্কের প্রতি কৃষ্ণের বিনয়

৫৩ম অধ্যায়

শাপপ্ৰদানোদ্যত উতঙ্কের প্রতি কৃষ্ণের বিনয়

বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহারাজ! এইরূপে ভগবান্ বাসুদেব অনুগামিগণকে প্রস্থান করিতে আদেশ করিলে, অনুযাত্রিগণ তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া সকলেই তথা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। অর্জ্জুন বারংবার তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া যতক্ষণ নয়নগোচর করিতে পারিলেন, ততক্ষণ দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলেন। মহাত্মা মধুসূদনও প্রিয়সখা ধনঞ্জয়কে নির্নিমেষনয়নে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর পরস্পর পরস্পরের দৃষ্টির বহির্ভূত হইলে অর্জ্জুন অতিকষ্টে তথা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। মহামতি বাসুদেবও সুহৃদ্বিচ্ছেদনিবন্ধন অনতিপ্রফুল্লচিত্তে গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় কৃষ্ণের গমনমার্গে বহুবিধ শুভলক্ষণ আবির্ভূত হইতে লাগিল। পবনদেব প্রবলবেগে বাসুদেবের পুরোভাগে প্রবাহিত হইয়া ধূলি, কর্কর [কাঁকর] ও কণ্টকসমুদয় দূরীভূত করিতে আরম্ভ করিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার সম্মুখে সুগন্ধ বারি ও দিব্যকুসুমসমুদয় বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে ভগবান্ বাসুদেব গমন করিতে করিতে ক্রমে মরুধন্বপ্রদেশে উপস্থিত হইলেন। ঐ স্থানে মহর্ষি উতঙ্কের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎকার হইল। তখন তিনি অচিরাৎ রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া, সেই মহর্ষিকে পূজা করিয়া তাঁহার কুশলজিজ্ঞাসা করিলেন। তখন মহর্ষি উতঙ্ক তাঁহার যথেষ্ট সমাদর করিয়া সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বাসুদেব! তুমি ত’ কুরুপাণ্ডবদিগের সমীপে গমনপূর্ব্বক তাহাদিগের পরস্পর সন্ধি ও অকৃত্রিম সৌভ্রাত্র সংস্থাপন করিয়া প্রতিনিবৃত্ত হইয়াছ? তাহারা ত’ সকলেই এক্ষণে তোমার সহিত পরমসুখে বিহার করিতে সমর্থ হইবে? কৌরবগণ এখন ত’ শান্তভাব অবলম্বন করিয়াছে? নরপতিগণ এখন স্ব স্ব রাজ্যমধ্যে পরমসুখে অবস্থান করিতে পারিবে? আমি এত দিন যে প্রত্যাশা করিয়া রহিয়াছি, তাহা ত’ সফল হইয়াছে?”

মহর্ষি উতঙ্ক এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে, মহাত্মা বাসুদেব তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ঋষিবর! আমি পাণ্ডবদিগের সহিত কৌরবদিগের সন্ধিসংস্থাপনের নিমিত্ত বিশেষ যত্নবান হইয়াছিলাম, কিন্তু কৌরবগণকে কোনক্রমেই তদ্বিষয়ে সম্মত করিতে পারি নাই। এক্ষণে তাহারা সকলেই সবান্ধবে নিহত হইয়াছে। বুদ্ধি বা বলদ্বারা কেহ কখন অদৃষ্টকে অতিক্রম করিতে পারে না। পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতবাসের পর মহাবীর ভীষ্ম, বিদুর ও আমি, আমরা সকলেই কৌরবগণকে বারংবার সন্ধি করিবার পরামর্শ প্রদান করিয়াছিলাম; কিন্তু তাহারা আমাদের বাক্যে কর্ণপাত না করিয়া পাণ্ডুনন্দনদিগের সহিত সমরসাগরে অবগাহনপুৰ্ব্বক শমনসদনে গমন করিল। ঐ যুদ্ধে পাণ্ডবদিগের পুত্রগণও নিহত হইয়াছে; এক্ষণে কেবল যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতা জীবিত আছেন।”

ভগবান্ বাসুদেব এই কথা কহিলে, মহর্ষি উতঙ্ক ক্রোধে অধীর হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “কেশব! তুমি বলপূর্ব্বক কৌরবগণকে নিবারণ ও তাহাদের পরিত্রাণসাধনে সমর্থ হইয়াও তদ্বিষয়ে বিমুখ হইয়াছ এবং বিনষ্ট হইতে আরম্ভ হইলেও তুমি তাহাতে উপেক্ষা করিয়াছ। ফলতঃ তোমার কপটতাপ্রভাবেই কুরুকুল ধ্বংস হইয়াছে। অতএব আমি অচিরাৎ তোমাকে শাপ প্রদান করিব।”

তখন বাসুদেব কহিলেন, “তপোধন! আমি অতি বিনীতভাবে কহিতেছি, আপনি আমাকে শাপ প্রদান করিবেন না। এক্ষণে আমি আপনার নিকট বিস্তারিতভাবে অধ্যাত্মবিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, আপনি উহা শ্রবণপূৰ্ব্বক ক্রোধ সংবরণ করুন। সামান্য তপঃপ্রভাবে আমাকে পরাভব করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। আপনি যে কৌমার ব্রহ্মচর্য্যব্রত অবলম্বন করিয়া অতি নির্ম্মল তপোলাভ এবং ঐকান্তিক ভক্তিপ্রভাবে গুরুর তৃপ্তিসাধন করিয়াছেন, তাহা আমি সবিশেষ অবগত আছি। এক্ষণে আপনি আমাকে শাপপ্রদান করিলে আপনার সেই বহুশ্রমর্জ্জিত তপস্যার ক্ষয় হইবে। অতএব আপনি ক্ষান্ত হউন। আপনার তপস্যা বিনষ্ট হওয়া আমার অভিমত নহে।”