৪৬. ব্রহ্মচারী প্রভৃতির কর্ত্তব্যনির্ণয়

৪৬তম অধ্যায়

ব্রহ্মচারী প্রভৃতির কর্ত্তব্যনির্ণয়

“ব্রহ্মা বলিলেন, ‘হে ঋষিগণ! এক্ষণে আমি তোমাদের নিকট ব্রহ্মচারীদিগের ধর্ম্ম বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

‘স্বধৰ্ম্মনিরত, জিতেন্দ্রিয়, সত্যধর্ম্মপরায়ণ, গুরুহিতৈষী, পরমপবিত্র ব্রহ্মচারিগণ যথাবিধি গুরুগৃহে বেদাধ্যয়ন করিয়া গুরুর আজ্ঞানুসারে প্রসন্নচিত্তে ভিক্ষালব্ধ অন্ন ভোজন করিবেন। পবিত্র ও সমাহিত হইয়া উভয়কালে অগ্নিতে আহুতি প্রদান, বিল্ব বা পলাশদণ্ড ধারণ এবং ক্ষৌম, কার্পাসনিৰ্ম্মিত বস্তু, মৃগচর্ম্ম বা কাষায়বস্ত্র পরিধান করা উঁহাদিগের পরমধর্ম্ম। উঁহারা যজ্ঞোপবীতসম্পন্ন, স্বাধ্যায়নিরত, নিত্যস্নায়ী, অলুব্ধ ও যতব্রত হইয়া কটিদেশে শরমুঞ্জী[শারতৃণ]বিনির্ম্মিত মেখলা [কটিবন্ধ] ও মস্তকে জটাধারণপূৰ্ব্বক সর্ব্বদা পবিত্ৰজলদ্বারা দেবগণের তর্পণ করিবেন। ব্রহ্মচারী এইরূপ ধৰ্ম্মনিষ্ঠ হইলেই সকলের প্রশংসার আস্পদ হইয়া থাকেন।

ব্রাহ্মণগণ এইরূপ ধৰ্ম্মপরায়ণ হইয়া ব্রহ্মচর্য্য সমাপনপূৰ্ব্বক বানপ্রস্থধৰ্ম্ম অবলম্বন করিলে সমুদয় লোক জয় করিয়া পরমগতি লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। উহাদিগকে কখনই আর জন্মগ্রহণ করিতে হয় না।

‘নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীরা ব্রহ্মচর্য্যের পর দারপরিগ্রহ না করিয়াই বানপ্রস্থধৰ্ম্ম অবলম্বন করেন। বনে অবস্থানপূৰ্ব্বক জটাবল্কল ধারণ করিয়া প্রাতঃকাল ও সায়ংকালে স্নান করা বানপ্রস্থাশ্রমী মহাত্মাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। অরণ্য হইতে গ্রামে প্রত্যাগমন করা উঁহাদিগের কদাপি বিধেয় নহে। উহারা বন্য ফল, মূল, পত্র ও শ্যামাকদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ করিয়া যথাকালে অতিথিসৎকার ও উদাসীনদিগকে বাসস্থান প্রদান করিবেন। স্বধৰ্ম্ম অতিক্রম না করিয়া যথানিয়মে বনের [বনের ফুলভক্ষণ], জল পান ও বায়ু সেবন করা উঁহাদিগের আবশ্যক। ভিক্ষার্থীদিগকে ভিক্ষা প্রদান, ফলমূলাদিদ্বারা দেবাৰ্চ্চনা ও অতিথিদিগের সৎকার করিয়া পরিশেষে মৌনাবলম্বনপূৰ্ব্বক ভোজন করা উঁহাদিগের অবশ্য কৰ্ত্তব্য। উঁহারা স্পৰ্দ্ধাবিহীন, যজ্ঞাদিনিরত, পবিত্র, কার্য্যনিপুণ, জিতেন্দ্রিয়, সৰ্ব্বভূতে দয়াবান, ক্ষমাশীল, কেশশ্মশ্রুধারী, হোমনিরত, বেদাধ্যয়নে অনুরক্ত ও সমাহিত হইলে সমুদয় লোক জয় করিতে পারেন।

‘হে ঋষিগণ! এক্ষণে আমি তোমাদিগের নিকট সন্ন্যাসধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“কি গৃহস্থ, কি ব্রহ্মচারী, কি বানপ্রস্থ যে-কোন ব্যক্তি মোক্ষলাভ করিতে বাসনা করেন, সন্ন্যাসধৰ্ম্মগ্রহণ করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। সন্ন্যাসধৰ্ম্মনিরত মহাত্মারা সৰ্ব্বভূতে দয়াবান, জিতেন্দ্রিয় ও কর্ম্মত্যাগী হইবেন। উঁহারা কোন ব্যক্তির নিকট ভক্ষ্যবস্তু যাচ্ঞা না করিয়া অপরাহ্ণে যদৃচ্ছালব্ধ অন্ন ভক্ষণ করিবেন। যখন গৃহস্থদিগের গৃহসমুদয় ধূমশূন্য হয় এবং পরিবারগণ আহারান্তে ভোজনপাত্রসমুদয় পরিত্যাগ করে, সেই সময় আঁহাদিগের গৃহদ্বারে উপস্থিত হইয়া মৌনভাবে দণ্ডায়মান হওয়া সন্ন্যাসীদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। উঁহারা কদাচ লাভে পরিতুষ্ট বা অলাভে দুঃখিত হইবেন না। কেবল শরীরযাত্রানিৰ্ব্বাহের নিমিত্ত উঁহাদিগের উক্ত প্রকারে ভিক্ষা করা আবশ্যক। প্রাকৃত লোকের ন্যায় লাভের আকাঙ্ক্ষা করা উঁহাদিগের কদাপি বিধেয় নহে। উঁহারা নিমন্ত্রিত হইয়া কোন ব্যক্তির গৃহে ভোজন করিবেন না। যে সন্ন্যাসী নিমন্ত্রিত হইয়া ভোজন করেন, তাঁহাকে অবশ্যই নিন্দনীয় হইতে হয়। কটু, তিক্ত, কষায় বা মিষ্ট বস্তু ভক্ষণসময়ে মনঃসংযোগপূৰ্ব্বক আস্বাদগ্রহণ করা সন্ন্যাসীদিগের নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। উহারা কেবল প্রাণধারণের নিমিত্ত যৎকিঞ্চিৎ আহার করিবেন। শরীরযাত্রানিৰ্ব্বাহের নিমিত্ত কোন ব্যক্তিকে কষ্ট প্রদান করা উঁহাদিগের কখনই কৰ্ত্তব্য নহে।

‘উঁহারা কদাচ নীচ লোকের নিকট ভিক্ষালাভের বাসনা করিবেন না, সৰ্ব্বদা স্বধৰ্ম্ম গোপন করিয়া বিজনস্থানে বিচরণ করিবেন। শূন্যাগার, অরণ্য, বৃক্ষমূল, নদীতট অথবা পর্ব্বতগুহায় বাস করাই উহাদিগের কর্ত্তব্য। গ্রীষ্মকালে এক গ্রামমধ্যে এক রাত্রির অধিক বাস করা উহাদের নিতান্ত অনুচিত, কিন্তু উহারা সমুদয় বর্ষাকাল এক গৃহস্থের ভবনে অতিবাহিত করিতে পারেন। সৰ্ব্বভূতে দয়াশীল হইয়া দিবসে কীটের ন্যায় নানাস্থানে বিচরণ করা উহাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। উঁহারা রাত্রিকালে ভ্রমণ করিলে উঁহাদের অজ্ঞাতসারে পদাঘাতে কীটাদি জীবগণের প্রাণনাশ হইতে পারে, এই নিমিত্ত রজনীযোগে পরিভ্রমণ করা উঁহাদের কখনই উচিত নহে। উহারা কদাপি কোন দ্রব্য সঞ্চয় করিয়া রাখিবেন না এবং স্নেহের বশীভূত হইয়া কুত্রাপি অবস্থান করিবেন না। উদ্ধৃত পবিত্ৰজলদ্বারা স্নান ও অন্যান্য কাৰ্য্যসমুদয় সম্পাদন এবং অহিংসানিরত, ব্রহ্মচর্য্যপরায়ণ, সত্যনিষ্ঠ, সরল, ক্রোধশূন্য, অসূয়াবিহীন, শান্তস্বভাব ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া নিষ্পাপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করা তাঁহাদিগের পরমধৰ্ম্ম। উঁহারা নিস্পৃহ হইয়া কেবল প্রাণধারণের নিমিত্ত উপস্থিত ভোজ্যবস্তু গ্রহণ করিবেন। ধৰ্ম্মলব্ধ অন্নভক্ষণ করাই তাঁহাদিগের কর্ত্তব্য। উঁহারা কদাচ কোন বিষয়ে কামনা করিবেন না। গ্রাসাচ্ছাদনের অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা করা উঁহাদিগের নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। উঁহারা কেবল আত্মোদর পূরণের উপযুক্ত ভোজ্য গ্রহণ করিবেন। অন্যের নিমিত্ত প্রতিগ্রহ করা উঁহাদিগের উচিত নহে। আপনাদিগের ভোজ্যবস্তু বিভাগ করিয়া দরিদ্রদিগের প্রদান করা উঁহাদিগের কর্ত্তব্য।

‘অযাচিত হইয়া কাহার নিকট প্রতিগ্রহ করা উহাদিগের কদাপি বিধেয় নহে। উঁহারা একবার উৎকৃষ্ট বস্তু ভোগ করিয়া পুনৰ্ব্বার তাহা ভোগ করিবার অভিলাষ করিবেন না। কোন ব্যক্তির অধিকারস্থ মৃত্তিকা, সলিল, পত্র, পুষ্প ও ফলমূলাদি গ্রহণ করা কখনই উঁহাদিগের কর্ত্তব্য নহে। উঁহারা কদাপি শিল্পকাৰ্য্যদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ ও সুবর্ণলাভের বাসনা করিবেন না। দ্বেষশূন্য, উপদেশবিহীন ও নির্ব্বিকার হওয়া উঁহাদিগের নিতান্ত আবশ্যক। উঁহারা অনুরোধ পরিত্যাগ, পবিত্র বস্তু ভোজন ও নিষ্কাম হইয়া প্রাণীগণের সহিত সদ্ব্যবহার করিবেন। হিংসাযুক্ত কাম্যকৰ্ম্ম ও লৌকিক ধর্ম্মের অনুষ্ঠান বা অন্যকে ঐ সমুদয় কার্য্যানুষ্ঠানে উপদেশ প্রদান করা উঁহাদিগের কদাপি বিধেয় নহে। উঁহারা সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী ও বাহ্যাড়ম্বরবিহীন হইয়া অল্পমাত্র পরিচ্ছদ পরিধানপূর্ব্বক ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিবেন।

‘স্বয়ং উদ্বিগ্ন হওয়া ও অন্যকে উদ্বেগযুক্ত করা উঁহাদিগের ধর্ম্ম নহে। সৰ্ব্বভূতের বিশ্বাসপত্র ও সমাহিত হইয়া অতীত, অনাগত ও উপস্থিত বিষয়ের চিন্তা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মৃত্যুকালের প্রতীক্ষা করা উঁহাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। উঁহারা চক্ষুঃ, মনঃ ও বাক্যদ্বারা কোন বস্তু দূষিত করিবেন না। পরোক্ষে বা প্রত্যক্ষে কাহারও অনিষ্ট করা উঁহাদিগের নিতান্ত অনুচিত। উঁহারা নিরীহ, সৰ্ব্বতত্ত্বজ্ঞ, নির্দ্বন্দ্ব, সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী, কর্ম্মত্যাগী, নির্ম্মম, নিরহঙ্কার, যোগক্ষেমবিহীন, নির্গুণ, প্রশান্তচিত্ত, শঙ্কাবিহীন, নিরাশ্রয় ও নিঃসঙ্গ হইয়া ইন্দ্রিয়সমুদয়কে দেহমধ্যে রুদ্ধ করিতে পারিলে নিঃসন্দেহ মোক্ষলাভ করিতে সমর্থ হয়েন।

‘যাঁহারা রূপরসাদি বিষয়াতীত, নিরাকার, নির্গুণ, সৰ্ব্বভূতস্থ নির্লিপ্ত পরমাত্মাকে দর্শন করিতে পারেন, তাঁহাদিগকে কখনই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে হয় না। পরমাত্মা বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়, দেবতা, বেদ, যজ্ঞ, লোক, তপস্যা ও ব্রতসমুদয়ের অগোচর। জ্ঞানবান্ মহাত্মারা সমাধিবলেই তাঁহার দর্শন লাভ করিয়া থাকেন, অতএব সমাধির বিষয় সবিশেষ অবগত হইয়া উহা আশ্রয় করা জ্ঞানবান্‌দিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। যে ব্যক্তি জ্ঞানবান্ হইয়া গৃহে বাস করেন, জ্ঞানীদিগের ন্যায় ব্যবহার করা তাঁহার নিতান্ত আবশ্যক। তত্ত্বদর্শী মহাত্মারা অমূঢ় হইয়াও মূঢ়ের ন্যায় ব্যবহার করিবেন। যেরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিলে লোকসমাজে অবজ্ঞাস্পদ [ঘৃণার পাত্র] হইতে হয়, সেইরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠানসহকারে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করাই উহাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। সাধু-আচরিত ধৰ্ম্মের নিন্দা করা উঁহাদিগের বিধেয় নহে।

‘যে মহাত্মা এইরূপ ধৰ্ম্মপরায়ণ হয়েন, তিনিই শ্রেষ্ঠ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। যিনি ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়ের বিষয় ও মহাভূতসমুদয় এবং মনঃ, বুদ্ধি, অহঙ্কার, প্রকৃতি ও পুরুষ এই সমুদয় সবিশেষ পরিজ্ঞাত হইয়া একান্তমনে পরব্রহ্মের ধ্যান করেন, তিনিই সৰ্ব্ববন্ধনবিমুক্ত বায়ুর ন্যায় নিঃসঙ্গ ও শঙ্কাবিহীন হইয়া পরব্রহ্মকে লাভ করিতে সমর্থ হয়েন।’ ”