৩৪. পরব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার

৩৪তম অধ্যায়

পরব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার

“ব্রাহ্মণ এইরূপে ব্রাহ্মণীকে আশ্বাস প্রদান করিলে ব্রাহ্মণী তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, নাথ! আপনি সংক্ষেপে যেরূপ সুবিস্তীর্ণ জ্ঞানগর্ভ উপদেশ প্রদান করিলেন, উহা হৃদয়ঙ্গম করা অল্পবুদ্ধি ও অকৃতাত্মা ব্যক্তিদিগের নিতান্ত দুঃসাধ্য। সুতরাং আমার বুদ্ধিও কোনরূপে উহার মৰ্ম্মগ্রহণে সমর্থ হইতেছে না। এক্ষণে কি উপায়ে আপনার ন্যায় জ্ঞানাত্মিকা বুদ্ধি লাভ করা যায় এবং ঐরূপ বুদ্ধি কোন কারণ হইতেই বা সমুৎপন্ন হইয়া থাকে, তাহা শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে, অতএব আপনি উহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।’

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “প্রিয়ে! বুদ্ধি প্রথম অরণীকাষ্ঠ এবং গুরু দ্বিতীয় অরণীকাষ্ঠ স্বরূপ। বেদান্তশ্রবণ ও জ্ঞানদ্বারা ওই উভয় কাষ্ঠ মথিত হইলে ঐ কাষ্ঠদ্বয় হইতে জ্ঞানাগ্নির উদ্ভব হয়।’

“ব্রাহ্মণী কহিলেন, ‘নাথ! জীব ব্রহ্মের অধীন, তবে কিরূপে লোক জীবকে ব্রহ্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করে?

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, প্রিয়ে! জীব নির্গুণ ও দেহপরিশূন্য, কেবল ভ্রান্তবুদ্ধি ব্যক্তিরা ভ্রমবশতঃ উহাকে সগুণ ও দেহযুক্ত বলিয়া গণনা করে। এক্ষণে যাহাতে ভ্রম দূর হয় ও জীবকে ব্রহ্ম বলিয়া জানিতে পারা যায়, আমি সেই উপায় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কৰ্ম্মনিরত ব্যক্তিরা ভ্রমবশতঃ আত্মাকে অঙ্গবান্ বলিয়া জ্ঞান করে; কিন্তু ভ্রমর যেমন পুষ্পের উপরিভাগে ভ্রমণ করিতে করিতে তন্মধ্যস্থিত মধু লক্ষ্য করে, তদ্রূপ যোগীরা শ্রবণমননাদি উপায় দ্বারা শরীরস্থিত আত্মাকে পৃথকভাবে লক্ষ্য করিয়া থাকেন। যে মহাত্মারা মোক্ষধৰ্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাঁহাদিগের পক্ষে কর্মীদিগের ন্যায় কোন বিষয়েই বিধি বা নিষেধ ব্যবস্থা নাই। ইহলোকে সাধ্যানুসারে পৃথিব্যাদি যত প্রকার ব্যক্ত ও অব্যক্ত পদার্থ জ্ঞাত হইতে পারা যায় তৎসমুদয়ই অবগত হওয়া কৰ্ত্তব্য। পৃথিব্যাদি পদার্থসমুদয় উত্তমরূপে অবগত হইয়া পরিশেষে যে পদার্থকে ওই সমুদয়ের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া বোধ হইবে, তাহারই নাম পরব্রহ্ম। শমদমাদির অভ্যাসনিবন্ধনই ওই পরম সাক্ষাৎকার হইয়া থাকে।’

বাসুদেব কহিলেন, “ধনঞ্জয়! ব্রাহ্মণ এইরূপে তত্ত্বজ্ঞানের উপদেশ প্রদান করিলে, ব্রাহ্মণীর জীবোপাধিজ্ঞান তিরোহিত ও ব্রহ্মজ্ঞান আবির্ভূত হইল।”

তখন অৰ্জ্জুন কহিলেন, “বাসুদেব! যে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী এইরূপে সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন, এক্ষণে তাঁহারা উভয়ে কোন্ স্থানে অবস্থান করিতেছেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

বাসুদেব কহিলেন, “অৰ্জ্জুন! আমার মনঃ ব্রাহ্মণ, বুদ্ধি ব্রাহ্মণী এবং আমিই ক্ষেত্রজ্ঞ।”