৩২. মমতাত্যাগে সমতাবোধ—জনকদ্বিজসংবাদ

৩২তম অধ্যায়

মমতাত্যাগে সমতাবোধ—জনকদ্বিজসংবাদ

“বিপ্র বলিলেন, “হে প্রিয়ে! অতঃপর আমি ব্রাহ্মণ জনকসংবাদনামক এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

পূৰ্ব্বকালে মহারাজ জনকের রাজ্যে এক ব্রাহ্মণ কোন গুরুতর অপরাধ করাতে জনকরাজ তাঁহাকে শাসন করিবার নিমিত্ত কহিয়াছিলেন, “হে ব্ৰহ্মন্! আপনি আমার অধিকারমধ্যে বাস করিতে পারিবেন না।” মহাত্মা জনক এইরূপ আজ্ঞা করিলে ব্রাহ্মণ তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! কোন কোন স্থানে আপনার অধিকার আছে, আপনি তাহা নির্দ্দেশ করুন; আমি অবিলম্বেই আপনার বাক্যানুসারে সেসমুদয় স্থান পরিত্যাগ করিয়া অন্য রাজার রাজ্যে গমন করিব।”

‘ব্রাহ্মণ এই কথা কহিলে মহারাজ জনক তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মৌনভাবে চিন্তা করিতে করিতে অকস্মাৎ রাহুগ্রস্ত দিবাকরের ন্যায় মহামোহে সমাক্রান্ত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁহার মোহ অপনীত হইলে তিনি ব্রাহ্মণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! যদিও এই পুরুষপরম্পরাগত রাজ্য আমার বশীভূত রহিয়াছে, তথাপি আমি বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম পৃথিবীস্থ কোন পদার্থেই আমার সম্পূর্ণ অধিকার নাই। আমি প্রথমে সমুদয় পৃথিবীতে, তৎপরে একমাত্র মিথিলানগরীতে ও পরিশেষে স্বীয় প্রজামণ্ডলিমধ্যে আপনার অধিকার অন্বেষণ করিলাম, কিন্তু কোন পদার্থেই আমার সম্পূর্ণ সত্ত্ব প্রতীত হইল না। এইরূপে আমি কোন পদার্থেই আপনার অধিকার নাই দেখিয়া মোহে আক্রান্ত হইয়াছিলাম। এক্ষণে আমার মোহ নির্ম্মুক্ত হওয়াতে আমি নিশ্চয় বুঝিতে পারিয়াছি যে কোন পদার্থেই আমার অধিকার নাই অথবা আমি সমুদয় পদার্থেরই অধিকারী। আমার আত্মাও আমার নহে অথবা সমুদয় পৃথিবীই আমার। ফলতঃ ইহলোকে সকল বস্তুতেই সকলের সমান অধিকার বিদ্যমান রহিয়াছে; অতএব আপনি নিরুদ্বেগে যথা ইচ্ছা অবস্থান ও যথা ইচ্ছা ভোজন করুন।”

তখন ব্রাহ্মণ কহিলেন, “মহারাজ! আপনার এই পিতৃপিতামহোপযুক্ত বিশালরাজ্য বশীভূত থাকিতে আপনি কিরূপে সমুদয় পদার্থে মমতাবিহীন হইয়াছেন এবং কিরূপ বুদ্ধিপ্রভাবেই বা আপনার রাজ্যসম্পর্ক ভিন্ন অন্য পদার্থসমুদয় আপনার বলিয়া জ্ঞান করিতেছেন, তাহা বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করুন।”

‘জনক কহিলেন, “ভগবন্‌! সমুদয় পদার্থই অচিরস্থায়ী বলিয়া আমার বোধ হইতেছে এবং শাস্ত্রানুসারে কোন পদার্থেই কাহার অধিকার নাই, এই নিমিত্তই কোন পদার্থ আপনার বলিয়া প্রতীতি হইতেছে না। আমি এইরূপ বুদ্ধি আশ্রয় করিয়াই সমুদয় বিষয়ে মমতাবিহীন হইয়াছি। এক্ষণে যে বুদ্ধিপ্রভাবে আমি স্বয়ং সমুদয়, বিষয়ের অধিকারী বলিয়া আমার বিবেচনা হইতেছে, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। আমি আত্মতৃপ্তির নিমিত্ত গন্ধঘ্রাণ, রসাস্বাদন, রূপদর্শন, স্পর্শানুভব, শব্দশ্রবণ ও মন্তব্যবিষয়ে সমালোচনা করি না। এই নিমিত্তই পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ ও মনঃ আমার সম্পূর্ণ বশীভূত হইয়াছে, সুতরাং ঐ সমুদয় বিষয়েই আমার অধিকার আছে। ফলতঃ আমি আত্মতৃপ্তির নিমিত্ত কোন কার্য্যেরই অনুষ্ঠান করি না। জগতের সমুদয় পদার্থই দেবতা, পিতৃলোক, ভূত ও অতিথিগণের নিমিত্ত সৃষ্ট হইয়াছে বলিয়া বিবেচনা করি।”

‘মহাত্মা জনক এই কথা কহিলে- ব্রাহ্মণ তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আমি ধৰ্ম্ম, আজ তোমাকে, পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত ব্রাহ্মণবেশে তোমার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে নিশ্চয় বুঝিলাম, এই ভূমণ্ডলমধ্যে তুমিই সত্ত্বগুণরূপ নেমিযুক্ত ব্ৰহ্মলাভরূপ দুষ্পরিচাল্য চক্রের প্রধান পরিচালক।