2 of 2

দরজার ওপারে মৃত্যু – সিদ্ধার্থ ঘোষ

দরজার ওপারে মৃত্যু – সিদ্ধার্থ ঘোষ

সব খুন-খারাপির সুরাহা হয় না। কিন্তু তার মানে ঠাণ্ডা মাথার হিসেবী ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান খুনীরাই শুধু রেহাই পায় তা নয়। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত অপকর্মের নায়কও অনেক সময় অবিশ্বাস্যভাবে ধরা পড়ে। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি বা টায়ার পাংচারের এক-আধটা অপ্রত্যাশিত ঘটনাও সব ছক ভেস্তে দিতে পারে। কিংবা ঠিক সময়মত মিহির ঘটকের আবির্ভাব।

সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার পর ঘরের দরজা-জানলা আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ করেও রেহাই পায়নি। শেষ পর্যন্ত টেপরেকর্ডারের শরণাপন্ন হয়েছে। বাইরের কোলাহলের চেয়ে এক পরদা জোরে সরোদ আর সেতারের যুগলবন্দী। দেবতারা মেয়ে ও পুরুষ নির্বিচারে নানা গুণের অধিকারী হয়েও সবাই কালা হয়ে গেলেন কীভাবে তাই নিয়ে একটা গবেষণা শুরু করা যায় কি না ভাবছিল মিহির। বিশ্বকর্মার মতো ডাকসাইটে যন্ত্রবিশারদ তো অন্তত নিজের জন্য একটা হিয়ারিং এড্ তৈরি করতে পারতেন! তা হলে নিশ্চয় আজ স্পিকার ফাটিয়ে রেকর্ডগুলো বাজত না।

লোডশেডিংয়ের একমাত্র উপকারিতার কথা ঠিক সাড়ে আটটায় টের পেল মিহির। অন্ধকারে যে এত শান্তি কে জানত। তিনটে বাড়ি পেরিয়ে চার তলার ফ্ল্যাটে একটা চামচ খসে পড়লেও এখন শুনতে পাবে সে।

ভ্যাপসা গরম না থাকলে হয়তো ইজিচেয়ারে ঘুমিয়েই রাত কেটে যেত। এখনও কারেন্ট আসেনি। এতক্ষণে খেয়াল হয় জানলাগুলো বন্ধ। তৃতীয় জানলাটা খুলে পেছন ফেরার আগেই গায়ের রক্ত হিম করা ভয়ঙ্কর একটা আর্তনাদ তাকে শিউরে দিল। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সেই শব্দ। শুরু না হতেই যেন শেষ। একেবারে আশপাশের ব্যাপার নয়। পাড়ার প্যান্ডেলে মাইক চললে শুনতেও পেত না। কিন্তু দূর থেকে ভেসে এলেও ভয়াবহতা একটুও কমেনি। আতঙ্কে ভরা যেন একটা প্রতিবাদ। নিশ্চয় ব্যর্থ প্রতিবাদ। মুহূর্তের ব্যবধানে পর পর জোরালো হুইসলের আওয়াজ পরিস্থিতিটাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলল।

টর্চের আলোয় রিস্টওয়াচে দেখল দশটা পঁচিশ। চটিতে পা গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল মিহির। একফালি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাববার চেষ্টা করছে শব্দটা কোত্থেকে এল। ওদের রাস্তা থেকে নিশ্চয় নয়! লোডশেডিং হলেও অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে। কোনও জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই পথটায়।

ঘরে ঢুকে চাবিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসে দরজায় তালা দিচ্ছে, ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ কানে এল। ছেঁড়া-ছেঁড়া কয়েকটা কথাও।

মিহির পেছন ফিরে তাকাবার আগেই তার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। দুটো গলা শুনেই চিনেছে। ক্লাবের ছেলে। দলে অবশ্য পাঁচ-ছ’জন আছে।

‘মিহিরদা, শিগগির!’

‘জগুবাবু···’

‘এক্কেবারে শেষ!’

সকলে মিলে ছুটতে শুরু করেছে। মিহির ভাবে, হুইসলের শব্দ শুনেই বোঝা উচিত ছিল যে, পাড়ার ভলান্টিয়াররা টহল দিচ্ছিল। কিছুদিন ধরে বেজায় চুরি শুরু হয়েছে এ-পাড়ায়। নাইট গার্ডের ব্যবস্থা চালু করেছে ক্লাবের ছেলেরাই। তাও প্রায় দিন দশেক হল। নাইট গার্ডরা রাস্তায় ছিল বলেই সঙ্গে-সঙ্গে চোখে পড়েছে ঘটনাটা। তিন তলার ওপর থেকে জগুবাবু ছিটকে পড়েছেন রাস্তার ওপরে।

মিহিরের বাড়ির ঠিক পেছনের রাস্তায় জগবন্ধু রায়ের বাড়ির সামনে পৌঁছবার আগেই আলো এসে গেল। একটা স্ট্রিটল্যাম্পের আলো পড়েছে জগবন্ধুর লণ্ডভণ্ড দেহের ওপর। খালি গা, ধুতিটা ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে। শরীরটা ডান পাশে কিছুটা কাত হয়ে আছে, একটা পা দুমড়ে রয়েছে আর একটার নিচে। বেশ কয়েকজন গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে। ডাক্তার হালদার নিচু হয়ে বসে পরীক্ষা করছেন।

দেখেই বোঝা যায়, করতে হয় তাই করা। জগুবাবুকে আর বাঁচাবার কোনও উপায় নেই।

হালদার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মিহিরবাবু! সরি···’

‘পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে?’ মিহির জিজ্ঞেস করল।

হালদার বললেন, ‘আমার বাড়ি থেকেই ওরা খবর দিয়েছে। পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স। স্পট ডেড। আমি তো মিনিট তিনেকের মধ্যে এসেছি। কিছু করার নেই।’

সমীর মিহিরের হাত টেনে বলল, ‘ওই দেখুন, তিনতলার দরজাটা খোলা, এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে!’

দু’পা পিছিয়ে এসে ওপর দিকে মুখ তুলে তাকাল মিহির।

দোতলা বাড়ি। তিনতলায় শুধু একটা ঘর। মোটর গ্যারাজের মালিক জগবন্ধু রায় বছর ছয়েক হল বাড়ি তৈরি করে এখানে বাস করছেন। কিন্তু বাড়ির কাজ শেষ করতে পারেননি। বাইরের দেওয়ালে কোথাও প্লাস্টার নেই। দোতলা ও তিনতলার কয়েকটা দরজার সামনে লোহার শিকগুলো শুঁড় বার করেই জানান দিচ্ছে যে, এসব জায়গায় বারান্দা হওয়ার কথা ছিল। জগবন্ধু কোথা থেকে মরণঝাঁপ দিয়েছেন সেটার হদিস পাওয়ার জন্য গোয়েন্দার চোখের প্রয়োজন নেই। তিনতলার ঘরটার দরজা খোলা, আর তার সামনেই একটা লোহার শিক থেকে ঝুলছে একফালি সাদা কাপড়। জগবন্ধুর পড়ার সময় ধুতিটা আটকে গিয়েছিল।

ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। মিহির বলল, ‘দীপক, ডেডবডি যেন কেউ টাচ না করে!’

‘আমরা কর্ডন করেই রেখেছি।’

অরুণ বলল, ‘বাড়িতে বোধ হয় কেউ নেই। প্রচুর কলিং বেল টিপেছি। সাড়া পাইনি।’

‘তা ছাড়া পুরো বাড়ি তো ঘুটঘুট করছে।’ সমীর জানাল।

‘ইন ফ্যাক্ট, আমিই আজ এই রাস্তায় তখন টহল দিচ্ছিলাম। বলতে গেলে দুশো গজের মধ্যে এই কাণ্ড ঘটেছে। অবশ্য আমার চোখের সামনে নয়, পেছনে।’ কথাগুলো বলতে-বলতেই যেন গা শিরশির করে দীপকের।

মিহির বলল, ‘আচ্ছা! তারপর কি করলি তুই?’

‘পেছন ফিরেই হুইসল দিয়ে ছুটে এলাম। না না, টাচ করিনি। তারপর অবস্থা দেখে বারবার হুইসল দিতে লাগলাম। তখনও একবার বাড়ির দিকে ভাল করে দেখেছি। কোনও ঘরেই কোনও আলো ছিল না।’

হাতের ইঙ্গিতে দীপক, অরুণ ও সমীরকে নিয়ে রাস্তার অপর পারে অপেক্ষাকৃত নির্জন অংশে সরে এল মিহির।

‘তুই তা হলে জগুবাবুর পড়ার পরমুহূর্ত থেকেই বলতে গেলে বাড়ির সামনেই রয়েছিস?’

‘হ্যাঁ মিহিরদা।’

‘কাউকে বেরোতে দেখিসনি বাড়ি থেকে?’

‘কেউ না। তা ছাড়া মিনিটখানেকের মধ্যেই তো আমাদের পুরো পার্টি এসে পড়েছে। তারপর আলোও এসে গেছে। তা ছাড়া অন্ধকার থাকলেই বা কী। ওই তো সদর দরজা। তার পাঁচ হাতের মধ্যে···’

‘বাড়ি থেকে বেরোবার অন্য কোনও পথ নেই?’

অরুণ ও সমীর সমস্বরে জানিয়ে দেয়, ‘নেই।’

খানিকটা যেন আপন মনেই বলে মিহির, ‘এক, যদি কোনও জানলা-টানলা খুলে কোনও জায়গা দিয়ে·· ’

সমীর বলে, ‘মিহিরদা, মনে হচ্ছে তোমার যেন একটা কিছু সন্দেহ হয়েছে। সুইসাইড নয়?’

মিহিরের হয়েই দীপক যেন উত্তর দিল, ‘জগুবাবুর চিৎকারটা···প্রচণ্ড একটা ভয়···’

ঠিক এই কথাটাই ঘুরছিল মিহিরের মনে, আত্মহত্যা করার সময়েও মানুষ শেষ মুহূর্তে বাঁচার চেষ্টা করে ঠিকই কিন্তু জগুবাবুর আর্তনাদটাকে সে কিছুতেই মেলাতে পারছে না। কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার সময়েই বরং এমন একটা আর্তরব গলা চিরে বেরিয়ে আসাটা স্বাভাবিক। আবার অন্যদিকে শরীরটা যেভাবে পড়ে রয়েছে, ঠিক পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলার মত ভঙ্গি নয়। সেক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়াটাই প্রত্যাশিত। অবশ্য ধুতিটা ফেঁসে গিয়েছিল শিকের সঙ্গে, তার জন্য যদি এক···

একটা সিগারেট ধরিয়ে মিহির বলল, ‘পুলিশ আসার আগে আর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। বাড়ির ভেতর যতক্ষণ না ঢোকা যাচ্ছে···’

‘না মিহিরদা, পুলিশ আসার আগেই বোধ হয় ঢুকতে পারা যাবে। শিউশরণ জগুবাবুর ভাগনেদের ডাকতে গেছে। এক্ষুণি এসে পড়বে।’

মিহির ঠোঁট থেকে সিগারেটটা সরিয়ে ভুরু উঁচু করে তাকাল অরুণের দিকে।

‘চার ভাগনে মিলে আজ যাত্রা দেখতে গেছে। ওই মহাপূজা সমিতির ওখানে। শিউশরণ পাশের রায়দের বাড়ির ড্রাইভার। ও জানত। সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি নিয়ে ছুটেছে খবর দিতে।’

অরুণের কথা শেষ হওয়ার আগেই মোড়ের মাথায় গাড়ির হেডলাইট বাঁক নিল। পর পর দুটো গাড়ি আসছে। পুলিশের জিপ নয়।

গাড়ি থামার আগেই মিহির এক ঝটকায় সিগারেটটা ফেলে অভ্যাসবশত পা দিয়ে সেটা পিষতে-পিষতেই যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল, তারপর বলল, ‘দীপক, অরুণ—আগে আমি ওই বাড়িতে ঢুকব। তোরা দুজন শুধু আমার সঙ্গে থাকবি। তোরা ওদের চিনিস বলেই বলছি। আর সমীর, তুই বাইরের দরজায় থাকবি। পুলিশ এলে বেল দিস।’

সবাই ক্লাবের ছেলে। না হলে এত সহজে তাদের হুকুম উপস্থিত লোকে মানত না। দীপক ও অরুণ প্রায় টেনে এনেছে অমলকে। তারই কাছে বাড়ির চাবি। বাকি তিন ভাই বাইরে রয়েছে। মিহির বলেছে, একজন সঙ্গে থাকলেই যথেষ্ট।

অমলের মুখে কোনও কথা নেই।

এখনও সে হতচকিত। পুরো ব্যাপারটা যেন উপলব্ধি করতে পারছে না। যন্ত্রের মত নির্দেশ পালন করে যাচ্ছে।

ইয়েল লকে চাবি ঢুকিয়ে দরজার পাল্লা ঠেলামাত্র খুলে গেল। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অমল হাত বাড়িয়ে বাঁ দিকের সুইচ বোর্ডে দুটো সুইচ টিপেছে।

একফালি প্যাসেজের সামনে একটা ঘর আর এই প্যাসেজের ডান ধার দিয়েই উঠে গেছে দোতলার সিঁড়ি।

চারধারে চোখ বুলিয়ে মিহির জিজ্ঞেস করল, ‘একতলা ও দোতলায় কি আপনারা চার ভাই থাকেন?’

অমল বলল, ‘না, আমরা সবাই দোতলায় থাকি। একতলায় শুধু একটা বসার ঘর ব্যবহার করা হয়। বাকি সব বন্ধ আছে।’

‘বন্ধ মানে কি চাবি দেওয়া?’

‘না, ছিটকিনি।’

‘দোতলায় আপনারা কি নিজেদের ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়েছিলেন?’

‘না, না, তালা দেওয়া নেই। শুধু বাইরে থেকে বন্ধ। বাড়িতে আছে কে! কাজের লোকও তো নেই।’

‘বেশ!’ সদর দরজাটা টেনে বন্ধ করতে করতেই মিহির বলল, ‘শোন অরুণ, তুই একতলা, আর দীপক, তুই দোতলাটা ইন্সপেক্ট করে আয়। প্রত্যেকটা ঘর, বাথরুম, সব দেখবি। কোথাও কোনও জানলা বা দরজা খোলা আছে কি না।’

অরুণ তড়বড় করে বলল, ‘যেখান দিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে কেউ পালাতে পারে···’

‘হ্যাঁ। সেইটাই উদ্দেশ্য। চলুন, অমলবাবু, আমরা সোজা তিনতলায় যাই।’

অমলকে অনুসরণ করে সিঁড়িতে উঠতেই মিহির শুনল আপন মনে বিড়বিড় করছে অমল, ‘ভাবা যায় না! ভাবা যায় না! অসম্ভব।’

মিহির জিজ্ঞেস করল, ‘জগুবাবু কি তিন তলাতে থাকতেন?’

‘হ্যাঁ।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর।

মিহির বুঝল এ সেই জাতের একজন যাকে খুঁচিয়ে প্রশ্ন না করলে কিছু জানা সম্ভব নয়।

‘আপনার মামার আত্মহত্যা করার কী কারণ থাকতে পারে?’

‘ব্যবসাটা কিছুদিন তেমন ভাল যাচ্ছিল না।’

‘আর কিছু নয়?’

‘আমি তো জানি না।’

‘কিন্তু আপনি তো আজ বেশ অবাক হয়েছেন দেখলাম!’

‘হ্যাঁ, হয়েছি। উইলসন কম্পানী আমাদের বহুদিনের বড় কাস্টমার। তারা অন্য গ্যারাজে চলে যাওয়ায় মামা একটু মুষড়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তা বলে···’

তিনতলায় পৌঁছে ছাতের দরজার ছিটকিনি খুলল অমল। একফালি ছাত পেরিয়ে একপাশে জগুবাবুর ঘর।

মিহির বলল, ‘মামাকে একেবারে তিন তলায় আটকে রেখে সবাই মিলে যাত্রা শুনতে বেরিয়ে গেলেন?’

‘মামাকে খাবার দিয়ে রোজই রাত্তিরে আমরা ছাতের দরজা বন্ধ করে নিচে নেমে যাই।’

জগুবাবুর ঘরের সামনে পৌঁছে মিহির দেখল, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ।

‘বন্ধ!’ বলল মিহির।

অমল এগিয়ে এসে চাবির তোড়া থেকে একটা ঢুকিয়ে দিল ইয়েল লকে। একটা আধপ্যাঁচ, তারপরে একটু ঠেলা, দরজা খুলে গেল।

অমলকে বাধা দিয়ে মিহির নিজে প্রথম ঢুকল ঘরের মধ্যে। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। উলটো দিকের দেওয়ালে সেই ভয়ঙ্কর দরজাটা যেন আবছা একটা আলোর আয়তক্ষেত্র। রাস্তার আলো সরাসরি ঘরে ঢোকার কোনও সুযোগ নেই। ঘরের দুটো জানলা খোলা কিন্তু তাতে দুর্ভেদ্য লোহার গ্রিল।

‘আলোটা জ্বেলে দিন।’ বলল মিহির।

আলো জ্বালার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে দীপক আর অরুণ ধুপধাপ করে ঘরে এসে ঢুকল। একতলা-দোতলা মিলিয়ে পাঁচটা জানলা খোলা ছিল কিন্তু প্রত্যেকটাতেই পদ্মফুলওলা এমন লোহার গ্রিল যে সেখান দিয়ে কারো ঢোকা বা বেরোন সম্ভব নয়।

ঘরের বাঁ দিক চেপে একটা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে ওরা। তারই ঠিক বিপরীতে পশ্চিমের দেওয়ালে দরজা দিয়ে পড়ে গেছেন জগবন্ধু। ঘরটা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। সেই ভাবেই লম্বা করে পাতা রয়েছে খাটটা। খাট না বলে পালঙ্ক বলাই ভাল। প্রাচীন কালের কারুকার্যওলা বিশাল চেহারার বাংলা খাট। ঘরের জানলাগুলো শুধু উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে। পুব এবং পশ্চিমে দুটো করে দরজা। যে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে তার ডান পাশের দরজাটি বাথরুমের। পশ্চিমের দেওয়ালের দ্বিতীয় দরজাটি বন্ধ রয়েছে। তার সামনে এলোমেলো ও ময়লা জামাকাপড় ভরা একটা আলনা। একটা কাঠের আলমারি, ছোট্ট তেপায়া একটা, টেবিল আর খাটের নিচে কয়েকটা স্টিল ট্রাঙ্ক। আর আছে দরজার পাশেই কয়েক জোড়া জুতো। ঘরের শ্রীহীন দশাটা বেশ চোখে পড়ে।

খাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে মিহির লক্ষ্য করল, মশারির ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় কোন দিক দিয়ে জগুবাবু নেমেছিলেন। মশারির ওই একটা পাশই শুধু গোঁজা নেই, ঝুলে পড়েছে।

খাটের পাশ ঘুরে আলনাটার সামনে এসে দাঁড়াল মিহির। জামা-কাপড়ের স্তুপের পেছনে দরজাটা শুধু ছিটকিনি তুলেই বন্ধ নয়, আড়াআড়িভাবে ইংরেজি এক্সের একটা শুধু রেখার ভঙ্গিতে কাঠ আঁটা। ভুলক্রমেও যাতে এই দরজা কেউ না খোলে। পশ্চিমের দুটো দরজা—তার কোনওটার সামনেই বারান্দা তৈরি হয়নি।

অভিশপ্ত দরজাটাকেও একইভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু জগবন্ধু আজ নিজের হাতে সেটিকে মুক্ত করেছেন। তার প্রমাণও চোখের সামনে। দরজা-আঁটা কাঠটা এক পাশে দাঁড় করানো আর মেঝের ওপর গড়াচ্ছে একটা স্ক্রু ড্রাইভার।

চার হাত-পায়ে প্রায় হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে একটু চোখ বোলাতেই মিহির চারটে মরচে ধরা স্ক্রুয়েরও সন্ধান পেয়েছে। দরজার ফ্রেমের ওপর দু’ পাশে দুটো করে লাগানো ছিল। স্ক্রুয়ের চেহারা দেখে মনে হয় বয়সে তারা এই বাড়ির চেয়ে ছোট নয়।

দীপক আর অরুণ নিঃশব্দে অনুসরণ করছে মিহিরকে। অমল দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে আছে।

মিহির স্ক্রুগুলো মেঝের ওপর যথাস্থানে নামিয়ে রেখে বলল, ‘কেউ কোনও জিনিস ভুলেও যেন টাচ করবেন না, তা হলে পুলিশে অকারণে হইচই বাধাবার একটা সুযোগ পাবে।’

মিহিরের পেছনে ছায়ার মত রয়েছে তার দুই চেলা। কোন দিকে তাকাচ্ছে, কি দেখছে—সবটাই নীরবে অনুধাবনের চেষ্টা।

মিহির তেপায়া টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল। ছোট-বড় নতুন ও ধুলো-মলিন শিশি-বোতলের স্তূপ। হোমিওপ্যাথিক ও বায়োকেমিকের অরণ্যে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ রসভঙ্গ করছে। লাল পলিথিনের ঢাকনার নিচে গেলাস ভর্তি জল। তার পাশেই জগুবাবুর স্টিল-ফ্রেমের চশমা।

বাথরুমের দরজার ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকল মিহির। আলোর সুইচটা বাথরুমের ভেতরে ডান দিকে। ছোট বাথরুম কিন্তু খুব পরিষ্কার। দেখে মনে হওয়ার কথা, জগুবাবু নিজের ঘরের চেয়ে বাথরুমের বেশি যত্ন নিতেন।

বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামার শব্দ পাওয়া গেল। তারপরেই কলিং বেলের ডাক। মিহির বলল, ‘অমলবাবু, আপনি নিচে গিয়ে দরজা খুলে দিন। মনে হচ্ছে পুলিশ এসে গেছে।’

অমল পেছন ফিরতেই মিহির বলল, ‘আপনার ভায়েদেরও এবার ডেকে আনুন ওপরে।’

চোখের ইঙ্গিতে দীপক ও অরুণকে অপেক্ষা করতে বলেছে মিহির। এবার অমলের কান এড়িয়ে চাপা গলায় বলল, ‘দেখ তো, ঘরের কোথাও টর্চ বা মোমবাতিটাতি আছে কি না! কোনও জিনিসে কিন্তু হাত নয়!’

বোঝা গেল পুলিশ আসার আগেই কাজ সারতে চাইছে। মিহির নিজেও উঁকিঝুঁকি মারতে-মারতে হঠাৎ খাটের পায়ের কাছে এসে যেন নিশ্চল হয়ে গেল। দীপক জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল মিহিরদা!’

‘নাঃ, তেমন কিছু নয়। খাটের পায়াটা দেখছি নড়ে গেছে। পুরোন দাগ বেরিয়ে পড়েছে পাশ দিয়ে।’

‘এই যে, একটা হ্যারিকেন এখানে!’ অরুণের গলায় আবিষ্কারের আনন্দ। ‘কিন্তু চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না—না, তেল নেই। একেবারে খটখটে। কেরোসিনের গন্ধ পর্যন্ত নেই।’ অরুণ চার হাত-পায়ে ঝুঁকে পড়ে নাক বাড়িয়েছে কিন্তু হাত দেয়নি।

মিনিট দুয়েক সময় পেয়েছিল ওরা। যথেষ্ট। ঘরে বা বাথরুমে কোনও টর্চ বা মোমবাতি নেই। দীপক বলল, ‘আচ্ছা, বিছানাটা তো দেখা হয়নি? বালিশের নিচে···’

মিহির ঘাড় বাঁকিয়ে দীপকের মুখের দিকে তাকাল। কী যেন একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘যাক গে, থাকলেও কিছু যায় আসে না। টর্চের কাজ সেরে বালিশের তলায় রেখে তারপর জগুবাবু লাফ মারলেন···’

‘আপনারা এখানে কী করছেন, অ্যাঁ?’ দু’জন সেপাই সমেত থানার বড়বাবু ঘরের দরজার কাছ থেকেই ধমকে উঠলেন। রুক্ষ বিরক্ত স্বর। সদুত্তর না পেলেই চালান করে দেবেন এক্ষুণি, এরকম একটা ভাব।

মিহির ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, ‘আসুন, আসুন মিস্টার বোস। আমরা মন দিয়ে আত্মহত্যার বিবরণ সংগ্রহের চেষ্টা করছি।’

‘আরে মিস্টার ঘটক! আপনি এসেছেন সেটা তো জানতাম না। ভাবলাম, পাড়ার ছেলেরা আবার এসব ব্যাপারে কেন মাথা গলাচ্ছে!’ মিস্টার বোস এখন নিশ্চিন্ত।

মিস্টার বোসের হাসিভরা হ্যান্ডশেক থেকে ছাড়া পাওয়ার আগেই ইলেকট্রিক শক খাওয়া লোকের মত চেঁচিয়ে উঠল মিহির, ‘না! এক্কেবারে না!’

সবাই তটস্থ। মিহির ধমক লাগাল, ‘একদম ছোঁবে না!’

একটি অতি উৎসাহী সেপাই মাটির ওপর পড়ে থাকা স্ক্রু ড্রাইভারটাকে কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য সবে নিচু হয়েছিল।

মিস্টার বোস বললেন, ‘মনে হচ্ছে, অল রেডি আপনি একটা সন্দেহজনক গন্ধ পেয়েছেন?’

মিহির বলল, ‘দুর্গন্ধ!’

‘আপনি কি মশাই এর মধ্যেও খুন-খারাপি সাস্‌পেক্ট করছেন নাকি! এ তো সিম্পল কেস অব সুইসাইড।’

‘সুইসাইড? হ্যাঁ, তা ঠিক—আত্মহত্যা। তবে খুব কি সরল ব্যাপারটা?’

মিস্টার বোস কী উত্তর দেবেন ভেবে পান না। ‘কই অমল-বিমলদের তো দেখছি না? কোথায় গেল?’ মিহির জিজ্ঞেস করল।

‘আপনি ওদের তলব করেছিলেন বুঝতে পারিনি। আমিই উঠতে দিইনি। বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি।’

‘ভালই হয়েছে। চলুন, আমরাও নিচে যাই। এই ঘরটা আপাতত পাহারাদারের জিম্মায় থাকুক। আমি শুধু আপনার পারমিশন নিয়ে একটা জিনিস নিচ্ছি।’ মিহির কয়েক পা এগিয়ে এসে নিচু হয়ে স্ক্রু ড্রাইভারের ডগাটা ধরে সেটাকে সন্তর্পণে তুলে নিল।

মিহিরের নির্দেশে একতলার বসার ঘরেই ঢুকেছে সকলে। অরুণ ও দীপকের সঙ্গে এখন সমীরও যোগ দিয়েছে।

‘মিস্টার বোস, আপনার উপস্থিতিতেই আমি কয়েকজনকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।’

‘সার্টেনলি! চার ভাইকে কি একসঙ্গে ডাকব, না, আলাদা করে?’

‘না, সকলের আগে শিউশরণকে ডেকে পাঠান। পাশের বাড়ির ড্রাইভার। ওদের চার ভাইকে যে বেরোতে দেখেছিল আজ।’

শিউশরণ পেল্লাই কুর্নিশ ঠুকে ঘরে ঢুকল।

‘বোসো শিউশরণ।’ বলল মিহির, ‘তুমিই তো অমলবাবুদের একটু আগে যাত্রার আসর থেকে ডেকে এনেছ? কী করে জানলে ওরা ওখানে রয়েছে?’

শিউশরণ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই ভাঙা বাংলায় জানাল যে, চার ভাই ওর চোখের সামনেই গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করে। তারপর ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ গাড়ি দাঁড় করায়। কমল জিজ্ঞেস করে, ‘কী শিউশরণ, যাত্রা শুনতে যাবে নাকি? চল আমাদের সঙ্গে। মহাজাতি সমিতিতে জমাটি পালা।’

মিস্টার বোস প্রশ্ন করেন, ‘চার ভাই গাড়িতে ছিল, তুমি দেখেছ?’

‘জি সাহাব!’

‘হয়তো চারজন লোক ছিল কিন্তু তার মধ্যে একজন···’

শিউশরণের ভঙ্গি বিনীত হলেও বক্তব্যে অটল।

‘ঠিক ক’টায় ওরা বেরিয়েছিল?’ মিহিরের পরবর্তী প্রশ্ন।

‘আট বাজকর পঁচ্‌চিশ।’

‘বাবা, তুমি যে একেবারে স্টেশনের ঘড়ির মত হিসেব দিচ্ছ।’ মিস্টার বোসের রসিকতায় কান না দিয়ে মিহির বলে, ‘তোমাকে কি বাবুরা কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, ক’টা বাজে?’

এবারে শিউশরণ অবাক হয়, ‘লেকিন আপ কেইসে···’

‘সেই জন্যই তোমার স্পষ্ট মনে আছে। ঠিক আছে শিউশরণ। ধন্যবাদ।’

শিউশরণের বেরোন আর বিমলের প্রবেশের ফাঁকে মিস্টার বোস মন্তব্য করলেন, ‘মনে হচ্ছে অ্যালিবাই একটা তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সত্যিই ওরা চারজন যাত্রার ওখানে এতক্ষণ ছিল কি না···’

বাধা দিয়ে সমীর বলল, ‘ওটা নিয়ে আর অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। কম-সে-কম জনা-চারেকের সঙ্গে এরই মধ্যে কথা হয়েছে যারা প্রত্যেকে বলেছে, ওরা যাত্রা দেখছিল। আটটা পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ থেকে শিউশরণ ডাকতে না যাওয়া অবধি সারাক্ষণই···’

মিহির হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘আমাদের এখানে তো লোডশেডিং ছিল,ওখানে যাত্রা হচ্ছিল কী করে?’

‘পাশের পাড়া হলেও ওটা বোধ হয় অন্য ফেজে।’

দরজায় টোকা দিয়ে বিমল ঘরে ঢুকল। বেশ আদবকায়দা রপ্ত করেছে। চুলের বাহার ও পোশাকের পরিবর্তন সত্ত্বেও ভাইয়ে-ভাইয়ে মুখের মিল ধরা যায়। বয়সের ফারাকও বেশি নয়। ছাব্বিশ কি আটাশ।

‘জগুবাবুর মৃত্যুতে আপনারা চার ভাই-ই শুধু লাভবান হবেন, তাই না?’ মারকুটে ব্যাটসম্যানের মত শুরু করল মিহির।

বিমল ম্লান হেসে বলল, ‘আমরা ছাড়া তো মামার আর কেউ নেই।’

প্রথম প্রশ্নের খেই ধরে জগুবাবুর ব্যক্তিগত জীবনের কথাও কিছু কিছু জানা গেল। রীতিমত স্ট্রাগ্‌ল করেছেন জীবনে। ট্রাক ড্রাইভার থেকে মেকানিক, তারপর নিজের গাড়ি ও গ্যারাজ। বিয়ে করার আর সুযোগ হয়নি। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, এই চার ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের গাঁ থেকে। নিজের ভাগনেও নয়। কোন দূর সম্পর্কে পিসতুতো দিদির ছেলে।

কথার মোড় ঘুরিয়ে মিহির বলল, ‘আপনারা তো সাড়ে আটটা নাগাদ আজ বেরিয়েছেন। জগুবাবুর সঙ্গে শেষ কখন দেখা হয়?’

‘এই ধরুন, বেরোবার মিনিট পাঁচেক আগেই। ওঁর খাওয়ার থালাটা আনতে গেছলাম। মামা সাড়ে সাতটার মধ্যেই রোজ খাওয়া সেরে নেন।’

‘আপনাদের বাড়িতে তো কাজের লোক নেই। রান্নার···’

‘না, না—রান্নার লোক সব খাবারদাবার বেড়ে ওই সাতটা নাগাদ চলে যায়। আমাদের মধ্যেই কেউ পরে গিয়ে থালা-বাসন নিয়ে আসে। মামা নিচে খেতে নামেন না।’

‘আচ্ছা, আপনি যখন আজ থালাটা আনতে যান, জগুবাবুর কথাবার্তায় অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছিল? উনি নিশ্চয় জেগেই ছিলেন তখনও?’

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করল বিমল, নিচু গলায় চোখ নামিয়ে বলল, ‘তখন তো আর বুঝিনি, এখন মনে হচ্ছে।’ একটু থেমে যোগ করল, ‘মামা বলছিল, ব্যবসাটার দিকে আর-একটু মন দে, বুঝলি? সবাই মিলে···’

মিহিরের গলাটাও এবার ব্যথিত শোনাল, ‘সত্যিই বোঝা দুষ্কর। লোকে কী অর্থে কখন কোন কথাটা বলে! আচ্ছা, রাস্তার দিকের ওই সাঙ্ঘাতিক দরজাটা নিশ্চই বন্ধই ছিল তখন? না হলে তো ঘরে ঢোকা মাত্রই আপনার চোখ পড়ত, তাই না?’

‘বন্ধ ছিল বৈকি। বাড়ি তৈরি হওয়ার পর থেকে যেটা কখনও খোলা হয়নি, হঠাৎ···’

‘না, ধরুন, শুধু কাঠের টুকরোটা খোলা রয়েছে কিন্তু পাল্লা দুটো বন্ধ। ভাল করে ভেবে বলুন।’

একটু সময় নিল বিমল, তারপর দু-তিনবার জোরে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না, আমার স্পষ্ট মনে আছে পুরো বন্ধ ছিল। হ্যাঁ, বন্ধ।’

বিমলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে বলল মিহির। মিস্টার বোসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর ইন্টারভিউয়ের দরকার নেই। তবে ওই অধিকন্তু ন দোষায় না কি যেন বলে, তারই খাতিরে নিয়মরক্ষা করব।’

বিমলকে যে-প্রশ্ন দিয়ে প্রথম আঘাত করেছিল, বাকি তিন ভাইকেও তাই করেছে মিহির। অবশ্য উত্তরদাতাদের প্রতিক্রিয়া এক হয়নি। একজন রেগেছে, একজন বিস্মিত হয়েছে আর শেষজন ব্যথিত। মিহির জনে-জনে বাকি তিন ভাইকে আর-একটি শুধু প্রশ্ন করেছে, ‘রাস্তার দিকের দরজাটা কি খোলা ছিল?’ সকলেই বলেছে, না, তবে তারা মামার ঘরে শেষবারের মত ঢুকেছে বিভিন্ন সময়ে। বিমল থালা নিয়ে আসার পরে নির্মল ঢুকেছিল যাত্রা দেখতে বেরোবার ঠিক আগের মুহূর্তে। সেও জোর দিয়েই বলেছে যে, দরজায় কাঠ সাঁটা ছিল। না হলে, ঠিকই চোখ পড়ত তার।

চতুর্থ ভাইকে বিদায় করার পর মিহির বলল, ‘মিস্টার বোস, আসল কাজ খতম। তবে অদূর ভবিষ্যতে বিচারকদের তুষ্ট করার জন্য দুটি দায়িত্ব আপনি হয়তো পালন করতে পারেন। এক, এই স্ক্রু ড্রাইভারের হাতলের ছাপটা পরীক্ষা। দুই, কমলকে লাক-আপে ভরে আপনাদের স্পেশাল খানাদানার একটু ব্যবস্থা করা। স্বীকারোক্তি।’

মিস্টার বোস একটু অবাক হয়েও প্রশ্ন করলেন, ‘হাতের ছাপের ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু সবাইকে ছেড়ে কমল কেন?’

‘এই চার ভাইয়ের মধ্যে ওইটাই সবচেয়ে ভিতু-দুর্বল প্রকৃতির। ইন্টারোগেশনের মধ্যেই সেটা···’ মিহিরের প্রথম কটু প্রশ্নবাণের তাৎপর্য এবার সকলেই বুঝেছে।

দীপক জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু মিহিরদা, ওরা তো সবাই যাত্রা দেখছিল। জগুবাবুকে কে ঠেলে ফেলল তা হলে?’

‘কেউই ঠেলে ফেলেনি। জগুবাবু স্বয়ং ওই দরজা দিয়ে নিচে···-না, লাফ মেরেছেন বলব না, বলব, পড়ে গেছেন।’

মিহিরের নির্দেশে চার ভাইকেই এবার একসেঙ্গ ডেকে আনা হয়েছে ঘরে। অমল সবচেয়ে সপ্রতিভ। চেয়ার টেনে বসতে যাচ্ছিল। লাফিয়ে উঠল মিহির, ‘বসছিস কী? দাঁড়িয়ে থাক! ওই দেওয়ালে পিঠ রেখে! যা!’

মিহিরের রুদ্রমূর্তি দেখে প্রতিবাদ করতে গিয়েও সামলে নিল অমল। চারভাই যেন ফায়ারিং স্কোয়াডের সম্মুখীন। মিহির তাদের সামনে দিয়ে ঘরের এ-মাথা ও-মাথা টহল দিতে-দিতে ছেঁড়া-ছেঁড়া বাক্যে একের-পর-এক রহস্যের দরজা খুলে চলেছে।

‘প্রথম সন্দেহ ওই আর্তরব। যা আত্মঘাতী মানুষের পক্ষে বেমানান। দ্বিতীয় সন্দেহ, লোহার শিকে কাপড়ের ফালি। শুধু তাই নয়, জগুবাবু পড়ার সময় ওই শিকে ধাক্কা খেয়েছেন। তা না হলে ওইভাবে তিনি পড়তেন না। যে আত্মহত্যা করবে, সে ওটা বাঁচিয়েই করবে। তৃতীয় সন্দেহ, অমল আমাদের নিয়ে জগুবাবুর ঘরের সামনে পৌঁছে নির্দ্বিধায় চাবি ঢুকিয়ে ঘরের দরজা খুলে দিল। দরজায় ইয়েল লক। ভেতর থেকেও তো জগুবাবু বন্ধ করে রাখতে পারতেন। তা হলে চাবি ঘুরিয়েও খুলত না। এতটা নিশ্চিত হল কী করে? বিশেষ করে এরকম দুর্ঘটনার পর? নেক্সট, এবার আর সন্দেহ নয়, প্রমাণ। যে-দরজা জগুবাবুর মৃত্যুর কারণ, সেটা আঁটা ছিল একটা কাঠের ফালি দিয়ে। স্ক্রু লাগিয়ে। মরচে ধরা চারটে স্ক্রুও রয়েছে, রয়েছে একটা স্ক্রু ড্রাইভারও। কিন্তু—’

হঠাৎ চার ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকাল মিহির। না, কোনও বিকার নেই তাদের। মিহির আবার শুরু করল, ‘কিন্তু এতদিনের পুরোন স্ক্রু, অন্ধকারের মধ্যে খুললেন জগুবাবু, তবে তাতে কোনও আঁচড়ের চিহ্নটি নেই। একবারও হাত ফসকে স্ক্রু ড্রাইভার স্লিপ করেনি বা স্ক্রুয়ের মাথায় স্ক্রু ড্রাইভার বসাবার চেরা ঘাটটার বাইরে পড়েনি।’

‘মামাবাবুর মত মেকানিক···’

অমলের ঔদ্ধত্যকে এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দিল মিহির, ‘কিন্তু বিশ্বকর্মাও অন্ধ হলে হাতড়াতে বাধ্য। সাড়ে আটটা থেকে লোডশেডিং। ঘরে কোনও মোমবাতি বা টর্চ নেই। চশমাটা রয়েছে টেবিলে। আত্মহত্যার সব ব্যবস্থা করার পর কেউ নিশ্চয় চশমাটা ঘরের আর-এক প্রান্তে টেবিলের ওপর খুলে রেখে আসে না।’

আবার অমলের অচঞ্চল গলা শোনা গেল, ‘মনে হচ্ছে ঘরে একটা হ্যারিকেন···’

‘আছে, কিন্তু একফোঁটা তেল নেই। বহুদিন হাত পড়েনি। এর থেকে কী দাঁড়াচ্ছে তা হলে ব্যাপারটা? এই চার মক্কেলই আজ যাত্রা দেখতে বেরোবার আগে সব ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। হয় ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছিলেন মামাকে, তারপর ওই দরজাটি খোলা কিংবা জগুবাবু সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ার পর—বাই দ্য বাই, ওই দরজার ছিটকিনিটাতেও দেখবেন তেল দেওয়া হয়েছে। এটা নিশ্চয় আত্মহত্যাকারীর···’

মিস্টার বোস উঠে দাঁড়ান, ‘ঘটক! মিহির!’ উত্তেজনায় সম্বোধনটাও ঠিকভাবে করতে পারেন না। ‘সবই মানছি কিন্তু সাড়ে দশটার সময় জগুবাবু যখন···’

মিস্টার বোসের দিকে পেছন ফিরে মিহির চার ভাইয়ের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে একমুখ হাসি নিয়ে বলল, ‘সত্যি, বাংলা খাটের বেজায় ওজন। ও জিনিস আপনারা একসঙ্গে চার জনে হাত না লাগালে ঘোরাতে পারতেন না।’

একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে কমল মেঝের ওপর পড়ে গেল!

‘কি বলেছি? হত্যাকারীদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল চরিত্র।’

মন্তব্যের সঙ্গে একটা সিগনিফিকেন্ট ইঙ্গিত পাঠিয়ে দিল মিহির থানার বড়বাবুর কাছে।

‘প্লিজ, মিহির, শেষ করুন।’ মিস্টার বোসের অনুরোধ।

‘জগুবাবু ঘুমিয়ে পড়ার পর তাঁর খাটটাকে এই চার খুনে মিলে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আপনি ওপরে গিয়ে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন যে ঘুরিয়ে বসাবার পর খাটের চারটে পায়া ঠিক দাগে-দাগে মেলেনি—মেঝেতে পুরোন দাগের সঙ্গে একটু ছুট হয়ে গেছে। ব্যাপারটা কি বুঝেছেন এবারে? জগুবাবু হোমিওপ্যাথির ভক্ত হলেও ডায়েবিনিজ খান, তার মানে তিনি ডায়েবিটিক। চশমা খুলে শোন। রাত্তিরে নেচারস কলে তাঁকে উঠতেই হয়। আজও উঠেছিলেন, এবং অভ্যাসবশত, খাটের বাঁ দিক দিয়ে নেমে, সামনেই বাথরুমের দরজায় ছিটখিনি খুলে···কিন্তু আজ তিনি তাঁর হিসেবে সব ঠিক করলেও যে-দরজাটা খুলছিলেন সেটা বাথরুমের নয়, মৃত্যুর···’

‘মাই গড! মাই গড!’ কুড়ি বছরের পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মিস্টার বোস বিচলিত। দীপক, অরুণ ও সমীরের কথা না বলাই ভাল।

পরের দিন সন্ধ্যেবেলায় মিস্টার বোসের ফোন পেল মিহির। স্ক্রু ড্রাইভারে জগুবাবুর হাতের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া গেছে। অর্থ জলবৎ। পাঁচ-ছ’বছরের পুরনো স্ক্রু খোলার জন্য যেরকম হাতের মোচড় ও চাপ লাগে তাতে হাতের ছাপ সব ঘষটে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার কথা। জগুবাবু ঘুমিয়ে পড়ার পর তাঁর হাতের ছাপ বসিয়ে নিয়েছিল খুনীরা স্ক্রু ড্রাইভারের হাতলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *