2 of 2

জানোয়ার – অমল রায়

জানোয়ার – অমল রায়

কি  বললে?

দোলা হাতের ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর আগের কথার পুনরাবৃত্তি করল, প্রণবেশ আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে।

সিতাংশু সবিস্ময়ে বলল, গোয়েন্দা!

হ্যাঁ, সস্তা প্রাইভেট ডিটেকটিভ আর কি!

কি করে বুঝলে?

ক’দিন ধরে একটা লোককে দেখছি আমার পেছনে ঘুরঘুর করছে, যেখানে আমি যাচ্ছি সেখানে ওকেও দেখতে পাচ্ছি। আসলে কোথায় যাচ্ছি, কি করছি, কার সঙ্গে মিশছি—এই সব দেখছে।

তোমার ধারণা ভুলও তো হতে পারে?

প্রথমে আমারও তাই মনে হয়েছিল।—দোলার কণ্ঠে রাগ, কিন্তু শেষে বুঝলাম ভুল আমার হয়নি।

সিতাংশু হেসে বলল, কি করে বুঝলে?

প্রণবেশকে আমি জিজ্ঞাসা করেছি।

স্বীকার করল?

পরিষ্কার ভাবে স্বীকার করল না বটে, তবে বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি।

সিতাংশু গম্ভীর হয়ে গেল। পাইপে টিপে টিপে তামাক ভরতে ভরতে বলল, তার মানে প্রণবেশ তোমায় সন্দেহ করছে।

আর কতদিন প্রণবেশকে সহ্য করতে হবে বলতে পার, সিতাংশু?—দোলার কণ্ঠস্বরে ক্লান্তি ঝরল, একটা কিছু কর।

সিতাংশু হাসল। পাইপের তামাকে আগুন জ্বেলে বার কয়েক ধোঁয়া টেনে একমুখ ধোঁয়া বাইরে ছেড়ে বলল, আজকের পরিকল্পনার কথা কি তুমি ভুলে গেছ, দোলা?

দোলার পাতলা ঠোঁট দুটির ফাঁকে একটুকরো ম্লান হাসি ফুটলো। এই হাসি নির্ভরহীনতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। সে বলল, গত ছ’মাস ধরে তো কত পরিকল্পনার কথাই শোনালে, কিন্তু কি হল বলতে পার?

সিতাংশু বলল, চেষ্টার কোন ত্রুটি আমি রাখিনি, কিন্তু কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না।

তুমি নিজে এগোলে কিছু নিশ্চয়ই করা যেত। তোমাদের দুজনের মাঝে পড়ে আমি শেষ হতে বসেছি।

আশা করি আজ রাতেই তোমার স্বামীর বন্ধন থেকে তোমায় মুক্তি দিতে পারব।

দোলা মাথা ঝাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, আসলে তুমি একজন অপদার্থ পুরুষ।

সিতাংশু আবার হাসল। নিভে যাওয়া পাইপের তামাক আবার ধরাল, তারপর বার কয়েক টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তোমাকে যা আনতে বলেছিলাম, এনেছ?

দোলা বলল, এনেছি।

সিতাংশু সোফায় বসে পড়ে বলল, গুড।

সাগ্রহে সিতাংশুর দিকে তাকাল দোলা। মানুষটার মুখের ভাষা পড়ে বোঝবার চেষ্টা করে বলল, সত্যি বলছ সব ব্যবস্থা করে ফেলেছ?

সত্যি। আজ রাতেই প্রণবেশকে সরিয়ে দিচ্ছি।

সরিয়ে দেবে! মানে?

এ পৃথিবী থেকে ওকে সরতে হবে।—সিতাংশু সেই সাপের হাসি হাসল, তোমাকে বিরক্ত করবার সুযোগ সে আর পাবে না।

দিনের শেষ হয়েছে। কিন্তু রাতের শুরু এখনো হয়নি। সময়টা কেমন যেন বিষণ্ণ। আলো-আঁধারের সন্ধিক্ষণ বুঝি সব সময়েই এমন বিষণ্ণ হয়। মনকে ভারী করে তোলে। দোলা চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে রইল। তার মুখটা মনের আকাশের মতই থমথম করছে, সেই সঙ্গে চোখের দৃষ্টিতে জড়িয়ে আছে বিরক্তির প্রাচুর্য।

সিতাংশু বলল, অমন মুখ ভার করে থেকো না দোলা, আমার ভাল লাগে না।

দোলার সুন্দর চোখ দুটি অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল। কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল। মাথা নিচু করল সে, নিজেকে সামলে নিতে চাইল।

দোলার কান্না সিতাংশুর চোখ এড়াল না। সে সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে দোলার পিছনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত রাখল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না।

দিনের শেষ আলো এসে পড়েছে দোলার সারা শরীরে। রূপবতী দোলাকে আরও অপরূপা দেখাচ্ছে। বিয়ের পর আরও সুন্দরী হয়েছে দোলা। এ রূপ যে কোন পুরুষকে পুড়িয়ে মারার পক্ষে যথেষ্ট।

সিতাংশু বলল, শোন দোলা, অধিকার আর অনধিকারের যে প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তার ফয়সালা হওয়া দরকার।

দোলা কিছু বলল না।

এই লুকোচুরি আর ভাল লাগছে না।—সিতাংশু আবার বলল।

তাহলে আমার কথা ভাবো।—দোলা বলল, প্রতিটি দিন যে কিভাবে কাটছে।

আর একটু ধৈর্য ধর।

আর পারছি না।—এক বুক হাওয়া গ্রহণ করে দোলা বলল, যা করবার আজ রাতেই কর।

জলে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দুটো আঁচলে মুছে বাইরে তাকাতেই দোলা দেখতে পেল সেই লোকটাকে, যে ক’দিন হল তার পিছনে ঘুরছে ছায়ার মত, গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। দোলার ভ্রূ যুগল কুঁচকে গেল। তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।

সিতাংশু, ওই লোকটাকে দেখ।—দোলা বলল, যে লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে !

সিতাংশু দোলার ঘাড়ের পাশ দিয়ে নিচে রাস্তার দিকে তাকাল। ঢালু রাস্তার পাশে কালো ট্রাউজার আর কোট পরে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক। মাথায় একটা ফেল্ট হ্যাট। এমন ভাবসাব দেখাচ্ছে যেন রক্ত-রাঙা পশ্চিমাকাশের সৌন্দর্য ভোগ করছে খুব মন দিয়ে। আসলে লোকটি এই জানলার দিকেই তাকিয়ে আছে।।

চেনো লোকটাকে?—দোলা জিজ্ঞাসা করল।

না।—সিতাংশু ঘাড় নেড়ে বলল, হয়তো কোন ট্যুরিস্ট—

না । এ সেই লোক। আমাকে চোখে চোখে রাখছে।

ওকে একটু নেড়েচেড়ে দেখব নাকি?

দরকার নেই।—দোলা সভয়ে বলল, এমনও তো হতে পারে, লোকটা গুণ্ডা। তোমাকে খুন করবার জন্যেই প্রণবেশ ওকে লাগিয়েছে।

এসব করে তোমার স্বামী কোন সুবিধে করতে পারবে না।

প্রণবেশকে অত সহজ ভেবো না, সিতাংশু। আমাদের মিলন হোক তা সে চায় না।

গুলি মারো ওর চাওয়া।—সিতাংশু হেসে উঠে বলল, তুমি চাও আমি চাই, এই যথেষ্ট।

মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। মানুষ যত পায় তত চায়। প্রণবেশের দেওয়া সিঁদুর সিঁথিতে জড়িয়ে, তার কাছে স্ত্রী হিসেবে সম্মান, ভালবাসা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেয়েও আরও কিছু পেতে চায় দোলা, তাই তার সুপ্ত মন মাঝে মাঝে নাড়া দেয় তাকে, জেগে উঠে তার বর্তমান জীবন-পরিক্রমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বলে। কিন্তু দোলার জীবন তো পরিপূর্ণ, অভাব বলতে কিছু নেই। বিদ্বান আর ভাল চাকুরে স্বামী এবং সুস্থ সংসার তার আছে, যে সংসারে সে, প্রণবেশ আর তাদের আত্মজা সোমা প্রতিনিয়ত আবর্তিত হচ্ছে।

বিয়ের পর ছ’টা বৎসর একটা অজানা নেশার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে দোলা। সুদর্শন এবং স্বাস্থ্যবান প্রফেসর স্বামীর হাত ধরে, প্রথমে আসানসোলে গিয়ে সংসার পেতেছিল। এখানকার কলেজে প্রণবেশ চাকরি করত। বাংলা পড়াত। একটা বৎসর ঘুরতে না ঘুরতে দোলা মা হল, সোমা পৃথিবীর আলো দেখল। যে অভাব অপূর্ণ ছিল তাও পূর্ণ হল। মনের অন্যান্য অভাবগুলো ছিল আপেক্ষিক, অভাব মনে করলেই অভাব, নইলে অভাব নেই। ছ’টা বৎসর বেশ সুখেই ছিল দোলা। নেশার অপর নাম যদি সুখ হয় তবে সে সুখে ছিল বৈকি। সুখের সেই চিহ্নগুলো দোলার সারা শরীরে ফুটে উঠে তাকে আরও সুন্দরী করে তুলেছিল। কিন্তু দার্জিলিং কলেজে বদলী হয়ে আসার পরই সুখ যেন পাখি হয়ে তার মনের খাঁচা থেকে উড়ে গেল, আর সেই শূন্য খাঁচায় রাহুর অনুপ্রবেশ ঘটল।

সেই রাহু সিতাংশু বোস। দার্জিলিংয়ের সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডাক্তার। বৎসর দুয়েক হল এখানে বদলী হয়ে এসেছে। এখনও অবিবাহিত। মিশুকে মানুষ এই সিতাংশু বোস। মিষ্টি কথা বলে মানুষের মন জয় করতে ওস্তাদ। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির আড়ালে তার প্রথম যৌবনের মুখের আদল হারিয়ে গেছে। যে মানুষটা প্রথম যৌবনে হৈচৈ করতে ভালবাসতো, আজ সে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছে।

ওই সিতাংশুর সঙ্গে দোলার পরিচয় কুমারী জীবনে। তখন সে সবে চাকরিতে ঢুকেছে। তার দাদাও সিতাংশুর সঙ্গে পড়ত। যুবকটির অবাধ গতি ছিল দোলাদের বাড়িতে। কিছুক্ষণ হৈচৈ করে, দোলার সঙ্গে খুনসুটি করে আর তার মায়ের কাছে আব্দার করে আবার ফিরে যেত হোস্টেলে। দুর্ঘটনায় দাদার মৃত্যুর পর সিতাংশু বোস পুত্রহারা বাপ-মায়ের কাছে সন্তানের আসন লাভ করল, সময় পেলেই মোটর-বাইক হাঁকিয়ে চলে আসত, দিনের শেষে আবার ফিরে যেত। দুপুর, সন্ধ্যা আর রাত্রির বিধি-নিষেধ ছিল না। দোলা লক্ষ্য করত, সিতাংশু এলে তার মায়ের ব্যস্ততার অন্ত থাকত না, বাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন। কিন্তু স্নেহপরায়ণ দুটি বয়স্ক নরনারীর দৃষ্টির আড়ালে যে আর একটি নাটক অভিনীত হচ্ছিল, সে খবর কেউ রাখত না। কবে যে প্রথম যৌবনের শায়রে সন্তরণরত দুটি যুবক-যুবতী পরস্পরকে ভালবেসেছে দুজনের কেউই জানে না। প্রয়োজনও হয়নি। দুজনেই তো বাধা-বন্ধনহারা।

কিন্তু বাধা ছিল। সেই বাধা তৈরি ছিল বিশ্বাস দিয়ে আর ভালবাসা দিয়ে। যে সিতাংশুকে মৃত সন্তানের স্থলাভিসিক্ত করেছিলেন দোলার বাবা-মা, সেই সিতাংশু যে বিষাক্ত ফণা উঁচিয়ে ছোবল দিয়ে তাদের একমাত্র কন্যা সন্তানের দেহমন বিষাক্ত করে তুলতে পারে, একথা তাঁরা ভুলেও ভাবতে পারতেন না। তার আসন তাঁদের মনে ছিল অনেক উঁচুতে। সিতাংশু নিজেই জানত না যে সাধু সেজে ভণ্ডামি করতে করতে প্রকৃতই সাধু বলে পরিচিত হয়ে গেছে, তার পক্ষে এখন আর অসাধু হওয়া সাজেও না, সম্ভবও নয়। মনের উচ্চাসন থেকে সে নামতে চাইছিল, কিন্তু পারছিল না। তাই যখন দোলার বিয়ের কথা চলছিল, সিতাংশু অস্থির হয়ে উঠেছিল। দোলাকে হারাবার ভয় তাকে অস্থির করে মারছিল।

সে দোলাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমার বিয়ে তাহলে পাকা?

দোলা মুখ নিচু করে বলেছিল, তাই তো শুনছি। কে এক প্রোফেসর—

সিতাংশু বলল, তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না।

কি করতে চাও?

আমরা বিয়ে করব।

কিন্তু আমার বাবা-মা—

ওদের জানাই।

ন, না।—দোলা যেন আঁতকে উঠেছিল।

ওঁদের না জানালে বুঝবেন কি করে?—সিতাংশু অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে চেয়েছিল।

যা বলবার আমি বলব।—দোলা ব্যস্ত হয়ে বলেছিল, তুমি শুধু আমাকে কিছু সময় দাও।

সময় দিয়েছিল সিতাংশু। সময় দিয়ে সাগ্রহে প্রতীক্ষা করেছে দোলার আহ্বানের। সেই প্রতীক্ষা হয়েছে ব্যর্থ। অনেক প্রস্তুতির পরও নিজের দাবী বাবা-মায়ের কাছে তুলে ধরতে না পেরে সন্তর্পণে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বাবাকে সিতাংশুর দাবীর কথা বলবার সুযোগ পেয়েও বলতে পারেনি। কিন্তু প্রণবেশের সঙ্গে বিয়ের পাকা কথা হওয়ার আগের দিন রাতে বাবা এসেছিলেন দোলার ঘরে, এই বিয়েতে মেয়ের মত কতটা আছে তাই জানতে।

দোলা চুপ করে ছিল।

বাবা বলেছিলেন, তোর দিক থেকে যদি কোন আপত্তি থাকে তাহলে আমায় বল।

দোলা ইতস্তত করে বলেছিল, সিতাংশুদা বলছিল—

সিতাংশুর কোন আপত্তি নেই। বোনের বিয়েতে তার আনন্দই দেখছি সবচেয়ে বেশি।

বাবা!

সিতাংশু আছে বলেই তোর দাদার অভাব ভুলতে পেরেছি।—বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, পরের ছেলেটা যে কবে কেমন করে নিজের ছেলে হয়ে গেল!

অনেকক্ষণ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল দোলা। তাঁর চোখে-মুখে কি এক আনন্দময় স্বর্গীয় দীপ্তি। সে কথা বলবার চেষ্টা করতে বুঝতে পেরেছিল তার জিভ অসাড় হয়ে গেছে, অনেক চেষ্টা করেও সিতাংশুর দাবীর কথা একটি বারের জন্যেও উচ্চারণ করতে পারেনি। অশ্রু দোলার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা করে ফেলেছিল। বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছিল সে।

বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, কিছু বলবি, মা?

দোলা অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিল, না বাবা।

সস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা চলে গিয়েছিলেন। যে কথা বলবার জন্যে মনে মনে অত প্রস্তুতি, সেই কথা শেষ পর্যন্ত অনুচ্চারিত থেকে গিয়েছে।

পরদিন সকালে মোটর বাইকের শব্দ শুনেই হিম হয়ে গিয়েছিল দোলার শরীর-মন। সিতাংশু যে তার কাছেই এসেছে শেষ কথা শুনতে তা বুঝতে বাকি থাকেনি। মানুষটার সামনে সিতাংশুকে দাঁড়াতে হয়েছিল শূন্য হাতে।

দোলা বলেছিল, আমি বাবাকে বলতে পারিনি।

সিতাংশু চমকায়নি। সে গম্ভীর গলায় বলেছিল, জানতাম তুমি বলতে পারবে না।

আসলে উঁচু আসন থেকে তোমায় নিচে টেনে নামাতে পারলাম না।

মিথ্যে কথাগুলো গুছিয়ে নাই বা বললে, দোলা।

বিশ্বাস কর, মিথ্যে কথা নয়—

কেঁদে ফেলেছিল দোলা ; সিতাংশু কিছুক্ষণ অবিশ্বাস ভরা নীরব দৃষ্টিতে তার কান্না দেখেছিল, তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছিল বাড়ি থেকে। মোটর-বাইকের যান্ত্রিক আর্তনাদ জানিয়ে দিয়েছিল যে সিতাংশু বোস ব্যতিক্রম ঘটিয়ে চলে গেল।

কিন্তু সিতাংশু বোস একেবারে উধাও হয়ে যায়নি। তারপরেও সে দোলাদের বাড়িতে এসেছে। এমনকি দোলার বিয়েতে হৈচৈ কম করেনি। যে পিঁড়িতে বসিয়ে তাকে সাত পাক ঘোরানো হয়েছিল, তাতেও হাত লাগিয়েছিল। তারপর বিয়ের ঝামেলা চুকে যাওয়ার পর গভীর রাতে যখন সবাই শ্রান্ত-ক্লান্ত, তখন দোলাকে কাছে ডেকে নিয়ে তার মধ্যকার শয়তানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।

সিতাংশু চাপা গলায় বলেছিল, তোমাকে সুখী হতে আমি দেব না।

দোলা অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিল, সিতাংশুদা!

আজ আমি হাত পেতে তোমায় পেলাম না বটে, তবে আবার আমি হাত পেতে তোমার সামনে দাঁড়াব, তখন জানবে এত সহজে আমাকে ফেরাতে পারবে না।

তুমি এমন করে বল না।

তারপর সিতাংশু হারিয়ে গেল দোলার জীবন থেকে। সামান্যতম যোগাযোগও রইল না তার সঙ্গে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হারিয়ে তো আর কেউ যায় না, কিছুদিনের জন্যে দৃষ্টির আড়াল হয় মাত্র। তারপর আবার একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে সাক্ষাৎ ঘটে।

স্বামীর সঙ্গে আসানসোলে এসে ঘর বাঁধল দোলা। সুখের আবর্তে আবর্তিত হয়ে তার জীবন কাটতে লাগল। প্রথম প্রথম সিতাংশুর কথা তার মনে পড়ত, বিশেষ করে প্রণবেশ যখন কাছে থাকত না কিম্বা কোন নির্জন মুহূর্তে। ইটের পর ইট সাজিয়ে যে ভালবাসার ইমারৎ গড়ে তুলেছিল দুজনে সবার অলক্ষ্যে, সামাজিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে, সেই ভালবাসার ইমারৎ শয়নে স্বপনে মাঝে মাঝে পীড়া দিত তাকে। মনে হত সেই ইমারৎ আকাশ ছোঁয়া লম্বা হয়ে পাহারা দিচ্ছে তাকে। বিবেকের দংশন কিছুদিন দোলাকে পীড়িত করেছিল। কিন্তু প্রণবেশের ভালবাসা তাকে দিয়েছিল স্বর্গসুখ। কি এক ঐশ্বরিক আনন্দের আবেশে সে ধীরে ধীরে ভুলে গেছিল সিতাংশুকে। একটা বৎসর ঘুরতে না ঘুরতে সে পেল তাদের ভালবাসার ফল সোমাকে। সিতাংশুর ক্ষীণ অস্তিত্বও কবরস্থ হল।

স্মৃতির পাতা ঝাপসা হলেও মানুষের অস্তিত্ব মুছে যায় না। কোন একদিন তাদের মধ্যে আবার দেখা হয়, সে দেখা যত আকস্মিক হোক না কেন। এটাই নিয়ম। এই নিয়মের ব্যতিক্রম দোলার জীবনেও ঘটেনি। আসানসোলে ছ’টা বৎসর কাটাবার পর দার্জিলিং শহরে বদলী হয়ে এসে আকস্মিক ভাবে সিতাংশুর দেখা পেল দোলা। তখন তার চেহারার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখেছে আর সরল চোখের দৃষ্টিতে শয়তান বাসা বেঁধেছে পাকাপাকি ভাবে।

সেদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে সিতাংশুর সঙ্গে সেন দম্পতির দেখা হয়েছিল ম্যাল রোডের ভিড়ে। স্বামীর পাশাপাশি মেয়ের হাত ধরে হাঁটছিল দোলা। ঠিক তখন বিপরীত দিক থেকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে আসছিল সিতাংশু।

আরে, দোলা না!—সিতাংশুই তাদের প্রথম আবিষ্কার করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

দোলা সবিস্ময়ে বলেছিল, সিতাংশুদা!

প্রণবেশও কম অবাক হয়নি। সে হাসি মুখে বলেছিল, বিয়ের রাতে সেই যে পালালেন, তারপর আর আমরা আপনার পাত্তা পেলাম না।

সিতাংশু হেসে বলেছিল, ইচ্ছে থাকলেও যে ডাক্তাররা পাত্তা দিতে পারে না।

তবু বলব, বোনের সংসার দেখতে একদিন আসানসোলে আসতে পারতেন।

হ্যাঁ, পারা উচিত ছিল।

দোলা আবদারের সুরে বলেছিল, তুমি কত সহজে আমাদের ভুলে গেলে সিতাংশু।

সিতাংশু রহস্যময় হাসি হেসে বলেছিল, কিন্তু ভুলতে আমি চাইনি।

আজ দোলার বারবার মনে হয়, সেদিন সিতাংশুর সঙ্গে দেখা না হলেই যেন ভাল ছিল। মানুষটার চোখের দিকে তাকালে অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পায় সে। সেই ছায়া কেমন যেন থরথর করে কাঁপে। ম্যাল রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক গল্প করেছিল তারা, গত পাচ-ছ’বৎসরের বিক্ষিপ্ত এবং টুকরো টুকরো ঘটনা ছিল গল্পের কেন্দ্র-বিন্দু।

প্রণবেশ একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, এখনও বিয়ে করেননি কেন?

সিতাংশু হেসে বলেছিল, বিয়ে করবার কোন ইচ্ছে নেই বলে।

আপনি কি ব্যর্থ প্রেমিক?

না, মানে—

কেউ আপনার ভালবাসার অসম্মান করেছে নিশ্চয়ই।

তা করেছে একজন।—সিতাংশু দোলার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলেছিল, তার সঙ্গে বোঝাপড়া না করে বিয়ে করব না ঠিক করেছি।

প্রণবেশ হেসে উঠেছিল। তার হাসি যেন আর ফুরোয় না। কিন্তু পাশে হাঁটতে হাঁটতে হিম হয়ে গেছিল দোলা, পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়েছিল, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছিল। মেয়ের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরেছিল।

বাড়ি ফিরে প্রণবেশ আবার হেসেছিল। সে বলেছিল, তোমার সিতাংশুদা কি অদ্ভুত পুরুষ!

দোলা বলেছিল, কি রকম?

অতীতকে আঁকড়ে ধরে থেকে বর্তমানকে হারাচ্ছেন। স্রেফ বোকামি।

বোকামি বলছ?

বোকামি নয়?

দোলা ভেবেছিল, দেবতা সিতাংশু দেবতাই থেকে যাবে, শয়তান হতে চাইলেই কি শয়তান হওয়া যায়? কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেবতা সিতাংশু হারিয়ে গিয়ে তার জায়গায় শয়তান সিতাংশু অধিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানের সিতাংশুকে দেখলে মনটা শঙ্কিত হয়ে পড়ে।

একদিন ভরা দুপুরে সিতাংশু এসে হাজির হল দোলাদের কোয়ার্টার্সে, তখন প্রণবেশ কলেজে আর দোলা ভাত-ঘুমে আচ্ছন্ন।

দোলা বলেছিল, হঠাৎ এই অসময়ে এলে যে!

তোমাকে একা পাওয়ার জন্য।—সিতাংশু বলেছিল, প্রফেসর সেনের ক্লাস আছে বিকেল চারটে পর্যন্ত।

তুমি তাহলে আটঘাট বেঁধেই এসেছ?

তা বলতে পার।

কি চাও তুমি?

তোমাকে।—সিতাংশু বলেছিল।

তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি পরস্ত্রী।

কিন্তু তোমাকে আমি ভুলতে পারছি না।

আমি তোমায় ভুলে গেছি।—দোলা রুক্ষ কণ্ঠে বলেছিল, এই মুহূর্তে তুমি চলে যাও, সিতাংশুদা।

সিতাংশুদা শয়তানের হাসি হেসেছিল। ড্রইংরুম থেকে বেড়রুমে যেতে যেতে বলেছিল, চলে যাব বলে তো আসিনি।

দোলা কঠিন কণ্ঠে বলেছিল, তুমি নির্বোধের মত কথা বলছ।

শোন দোলা, যদি একান্তই তুমি আমাকে চলে যেতে বাধ্য কর, তাহলে তোমার জীবনের সুখ আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব।

আমার সুখ ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই।

আছে।—সিতাংশু বলেছিল, আমাকে লেখা তোমার প্রেমপত্রগুলো এখনও আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি।

দোলা বোধ হয় চিঠিগুলোর কথা ভুলে গেছিল, তাই চিঠির প্রসঙ্গ উঠতেই সে চমকে উঠেছিল। প্রায় ককিয়ে উঠে বলেছিল, সিতাংশুদা!

ভয় পাচ্ছ?

তুমি আমায় ব্ল্যাকমেল করতে চাইছ?

সিতাংশু নরম বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বলেছিল, তোমার সুখ ছিনিয়ে নিতে গেলে যা যা করা প্রয়োজন, সবই করব ঠিক করেছি। তুমি যদি বল, আজই আমি চিঠিগুলো প্রফেসর সেনকে পড়িয়ে যেতে পারি।

না, না! তুমি আমার এতবড় ক্ষতি করো না।

প্রণবেশকে বুঝি খুব ভালবেসে ফেলেছে?—সিতাংশু থেমে থেমে বলেছিল, সুখের সংসারটার ওপর তোমার বড় মায়াও পড়ে গেছে, কি বল?

আমার সংসার ভেঙে তোমার কি লাভ?

অন্য কোন লাভ নেই, তবে সংসার ভাঙতে পারায় বোধ হয় আনন্দ আছে। দোলা, সেই আনন্দ আমি উপভোগ করব।

দোলা ভেঙে পড়েছিল, তুমি কি নিষ্ঠুর সিতাংশুদা!

এইভাবে প্রায় প্রতিদিনই সিতাংশু ভরা দুপুরে দোলার কাছে আসত। তাকে নিষেধ করতে ভয় পেত দোলা। সে বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল শয়তানের কাছে ধরা না দিয়ে উপায় নেই। সিতাংশু তার ওপর জোর খাটাবে, দেহটা নিয়ে টানাটানি করবে। তাই বোধ হয় একদিন দেখা গেল, দোলা ধরা দিয়েছে সিতাংশু বোসের কাছে। স্বামীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছে। সে দ্বিচারিণী হল। স্ত্রী চরিত্র বড়ই বিচিত্র, অন্তত দোলা সেনকে দেখলে তাই মনে হয়। সিতাংশু তার প্রথম ভালবাসা বলেই কি দোলার এই অধোগতি? পাঁচ-ছ’টি বৎসর সে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু সিতাংশুকে নাকি ক্ষণিকের জন্যও ভুলতে পারেনি। ভুলতে চেয়ে ভুলতে পারেনি বলেই প্রণবেশকে বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। নইলে দোলা কি নিয়ে বাঁচত, টিকে থাকত কি করে? সিতাংশু অভিমান করে জনারণ্যের মাঝে যদি হারিয়ে না যেত, তাহলে সে অনেক আগেই তার প্রথম ভালবাসার জনের কাছে ছুটে চলে যেত। সিতাংশুকে সে অনেক খুঁজেছে, কিন্তু কোথাও তার হদিশ পায়নি।

একদিন দোলা বলল, তুমি কি চাও, আমি শ্রীকৃষ্ণের রাধিকা হয়ে বাঁচি?

না?—সিতাংশু বলল, এ সংসারে তুমি বড় বেমানান, তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব।

কবে?

একটু সময় দাও আমাকে।

আমার মেয়ে সোমার কি হবে?

তুমি যা চাইবে তাই হবে।

প্রণবেশের কোন চিহ্ন আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব না।

তাই হবে।

যা করবার তাড়াতাড়ি কর।

নারীর মন বড় বিচিত্র। দোলা সেনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে তাই মনে হয়। কত সহজে স্বামীর কাছে থেকে দূরে ছিটকে সরে যেতে চাইছে। গত ছ’টা বৎসর যে মানুষটাকে স্বামী বলে মেনে সুখে-দুঃখে ঘর করেছে, তাকে আর সইতে পারছে না। নদীর এক কূল ভাঙে, আর এক কূল গড়ে। সিতাংশুকে পেয়ে প্রণবেশকে আর ভাল লাগছিল না দোলার। কি এক দুর্বার আকর্ষণে সে প্রতিদিন বিকেলে ছুটে আসতে লাগল সিতাংশুর একক জীবনের নির্জন ফ্ল্যাটে। তার সাজানো সংসার নয়-ছয় হতে লাগল, প্রণবেশ আর সোমা পড়ে রইল পেছনে। এইভাবে কি দোলা একজন স্ত্রীর মায়া, একজন মায়ের মায়া একটু একটু করে ছিন্ন করতে চাইছে?

দোলা মাঝে মাঝে অবাক মন নিয়ে প্রণবেশকে দেখত, তার কথা ভাবত। মানুষটা যেন শিবের মত, চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, সংসারের কাজকর্ম করছে, কর্মজীবনের দাবী পালন করছে নিষ্ঠার সঙ্গে, তবু মনে হয় সে ধ্যানস্থ। কিছুই সে দেখছে না, দেখলেও বোঝার চেষ্টা করছে না। মাঝে মাঝে দোলার ইচ্ছে হয় প্রণবেশ তার পথ আগলে দাঁড়াক, বলুক ঘরের বউয়ের অমনভাবে চলাফেরা চলবে না, হাজার হাজার প্রশ্ন করুক, বিধিনিষেধ আরোপ করুক—কিন্তু কিছুই সে করে না। মাঝে মাঝে দোলার মনে হয়েছে, প্রণবেশ সব জানে, জেনেও না-জানার ভান করছে, দেখছে দোলা কতদূর যেতে পারে। নির্লিপ্ত মানুষটার প্রতি দোলা রাগে ফেটে পড়তে চায়, কিন্তু পারে না। কোন সমস্যার ফয়সালা তো একতরফা হয় না।

সেদিন প্রণবেশের সঙ্গে মুখোমুখি বসে চা খেতে খেতে দোলা বলেছিল, ভাবছি সোমাকে হোস্টেলে রাখব।

কেন?—চায়ে চুমুক দিয়ে প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করেছিল, কোন কারণ ঘটেছে নাকি?

ওর দেখাশোনা ঠিক মত হচ্ছে না। বিকেলের দিকে ঘরে থাকতে পারছি না।

আমি তো থাকছি।

তুমি থিসিস নিয়ে ব্যস্ত থাকো।

সোমার কথা আমায় ভাবতে দাও।

প্রণবেশ কি বিস্মিত হয়েছিল দোলার ইচ্ছার কথা শুনে? হয়তো হয়েছিল, কিন্তু বোঝবার উপায় ছিল না তার মুখের চেহারা দেখে। মানুষ বলে, মুখ নাকি মনের আয়না। একথা আর যার বেলায় প্রযোজ্য হোক না কেন, প্রণবেশের বেলায় মোটেই প্রযোজ্য নয়।

প্রণবেশের মত না থাকলেও দোলা শোনেনি। একরকম জোর করেই সোমাকে কনভেন্টের হোস্টেলে রেখে এল। প্রণবেশ শুধু গম্ভীর হয়ে গেল, স্ত্রীকে কিছু বলল না। মানুষটাই তো ওইরকম, দেখে আর শোনে বেশি—কথা বলে কম। অনেক প্রশ্নের ভিড় মনে জড়ো হলেও কোন প্রশ্ন স্ত্রীকে করে না।

শুধু একদিন দোলাকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিল প্রণবেশ। কিন্তু উত্তরের জন্যে বিশেষ পীড়াপীড়ি করেনি। একদিন গভীর রাতে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছিল। সেই কান্না শুনে তার ঘুম ভেঙে গেছিল। বিয়ের পর স্ত্রীকে সে এই প্রথম কাঁদতে দেখে কম বিস্মিত হয়নি।

কাঁদছ কেন, দোলা?—প্রণবেশ জানতে চেয়েছিল, কি হয়েছে তোমার?

দোলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলেছিল, কিছু হয়নি।

তুমি কি নিজেকে অসুখী মনে করছ?

না

তবে কাঁদছ কেন?

মনে হল, কাঁদলে আমার ভাল লাগবে।

প্রণবেশ স্ত্রীর চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছিল। তার অবিন্যস্ত চুল হাত বুলিয়ে বলেছিল, জীবনের চরম ফয়সালার আগে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তুমি যদি সেরকম বিভ্রান্ত হয়ে থাকো তাহলে আমায় বল ; পথ বলে দেব।

দোলার বুকের ভেতরটা অসাড় হয়ে এসেছিল। মনে হয়েছিল তার জীবনের সব লুকোচুরি বুঝি প্রণবেশ জানে, সিতাংশুর অস্তিত্ব তার অজ্ঞাত নয়। দোলার আরও মনে হয়েছিল তার স্বামী তার হৃদয়ের কথা বৈদ্যুতিক আলোয় পড়ে ফেলছে। সে কাঁপা স্বরে বলেছিল, আলোটা নিভিয়ে দাও।

সেই রাতেই দোলা একটা স্বপ্ন দেখেছিল। একটা চোখ তাকে তাড়া করছে, ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত। সেই চোখটি আর কারও নয়—প্রণবেশের। তার তৃতীয় নেত্র। স্বপ্নের মধ্যে ছুটতে ছুটতে দোলার মনে হয়েছিল, এই ছোটার বুঝি আর শেষ হবে না। প্রণবেশের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে গেলে তাকে অনন্তকাল ছুটতে হবে।

আর একটা চোখ প্রণবেশকে অনুসরণ করছিল প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। তার অমঙ্গল কামনা করছিল, চিরকালের জন্য তাকে সরিয়ে দিতে চাইছিল এই পার্থিব জগৎ থেকে। কিন্তু রাখে কৃষ্ণ, মারে কে? সিতাংশুর সব চেষ্টাই একের পর এক লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। ফলে, সিতাংশুর মন-গহনে বিচরণশীল শয়তানটা আরও হিংস্র হয়ে উঠতে লাগল, ব্যর্থতার আক্রোশ আরও অশান্ত করে তুলল তাকে। শেষপর্যন্ত সিতাংশু ঠিক করেছে প্রণবেশের সামনাসামনি নিজেই দাঁড়াবে, তাকে খুন করবে নিজ হাতে। সুতরাং প্রফেসর সেনের আর রেহাই নেই। তাকে শুধু দোলার জীবন থেকে নয়, এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিতে হবে।

শহরের ইলেকট্রিক আলোগুলো দুটো-একটা করে জ্বলতে শুরু করেছে। একটু পরে ছোট পাহাড়ী শহরটা আলোয় আলোয় সেজে উঠবে। এখান থেকে নিচে বাজারটা দেখা যাচ্ছে। মানুষের চলাফেরার বিরাম নেই। সিজন বলে দোকানপাটগুলো সাজানো হয়েছে।

ঘরের আলোগুলো এবার জ্বালা দরকার। আঁধারে ঢেকে গেছে ঘর। কিন্তু দুটি নরনারীর একজনও তাগিদ অনুভব করছে না। এই আঁধারে শরীর ডুবিয়ে তারা আপন আপন চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে।

রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত প্রণবেশ স্টাডিরুমে থাকে। পড়াশোনা করে। সামনের বছর থিসিস জমা দেবে, তাই খাটতে হচ্ছে। রান্না করে যে নেপালী মেয়েটা, সে তার কাজ চুকিয়ে ঘরে ফিরে যায় রাত আটটার মধ্যে। তারপর থেকে যতক্ষণ না দোলা ফিরছে, প্রণবেশ অতবড় কোয়াটার্সে একেবারে একা। আগে তবু সোমা থাকত পাশের ঘরে ঘুমিয়ে, কিন্তু এখন সে হোস্টেলে। তাই রাত আটটার পর থেকে প্রণবেশের সঙ্গী শুধু একটা টেবিল-ল্যাম্প, কিছু বই-খাতা আর একটা পেন। দোলার কাছে সব শোনার পর সিতাংশু ঠিক করেছে, রাত আটটা থেকে ন’টাই হবে উপযুক্ত সময়, যখন সে কাজ হাসিল করে ফিরে আসতে পারবে। কেউ তাকে দেখতে পাবে না, কেউ কিছু শুনতে পাবে না। সাইলেন্সার যুক্ত পিস্তলের দুটো বুলেট প্রণবেশকে উপহার দিলেই যথেষ্ট হবে।

সিতাংশু জিজ্ঞাসা করল, সদর দরজা খোলা পাব তো?

পাবে।—দোলা বলল, আমি না ফেরা পর্যন্ত খোলাই থাকে।

স্টাডিরুমের দরজা কি ভেতর থেকে বন্ধ থাকে?

না, ভেজিয়ে রাখা হয়। ঠেললেই খুলে যাবে।

তাহলে তো কেরামতি করার কিছু নেই।

কাজ হাসিল কি আজই করতে চাও?

কাল আমরা কি তাই ঠিক করলাম না?

খুন-পর্বটা দু’দিন পরে করলে হত না?

তাতে কি আমাদের কোন লাভ আছে?

না, তা নেই।

তবে ঝামেলা আজই মেটাব।—সিতাংশু স্থির কণ্ঠে বলল, তোমাকে প্রণবেশের পিস্তলটা আনতে বলেছিলাম, এনেছ?

কাঁপা স্বরে দোলা বলল, এনেছি।

দাও।

আলো জ্বালল দোলা। তারপর বিছানার ওপর পড়ে থাকা ব্যাগটা কাছে টেনে নিয়ে শাড়ির আঁচলে হাত ঢেকে নিয়ে সাইলেন্সরযুক্ত পিস্তলটা বের করে বিছানার ওপর রাখল। সিতাংশু রুমালের সাহায্যে আগ্নেয়াস্ত্রটা হাতে তুলে নিল।

দোলা বলল, ছ’টা গুলিই ভরা আছে।

সিতাংশু পিস্তলের চেম্বার খুলে ভেতরটা দেখল। সত্যিই ছ’টা গুলি মজুত আছে। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এই ছ’টা গুলিই প্রণবেশকে উপহার দিয়ে আসতে পারবে।

দোলা বলল, পিস্তলের গায়ে নিজের আঙুলের ছাপ কখনোই রাখবে না।

সিতাংশু বলল, তোমার আঙুলের ছাপ এর গায়ে নেই তো?

না। ফায়ার করার আগে একজোড়া গ্লাভস হাতে পরে নিও।

নেব।—সিতাংশু বাধ্য ছেলের মত বলল, আমি কোন প্রমাণ পিছনে ফেলে রেখে আসতে চাই না

মনে রেখ, খুনটাকে স্রেফ আত্মহত্যা বলে সাজাতে হবে।—দোলা বলল, তাই প্রণবেশ খুন হয়ে গেলে পিস্তলটা তার হাতে ধরিয়ে দেবে।

দেব।

কোন হাতে ধরাবে?

ডান হাতে।

না। প্রণবেশ বাঁ হাত বেশি চালায়।

তাহলে বাঁ হাতেই ধরিয়ে দেব।

স্টাডিরুমের এক কোণে দেখবে একটা ঝাড়ু রাখা আছে।

সিতাংশু হেসে বলল, এর মধ্যে ঝাড়ুপ্রসঙ্গ আসছে কেন, দোলা?

দোলা ম্লান হেসে বলল, স্টাডিরুমের ফ্লোর থেকে আর সিঁড়ি থেকে তোমার পায়ের চিহ্ন তুলে ফেলতে হবে। ঝাড়ুর সাহায্যে পায়ের চিহ্নগুলো মুছতে মুছতে তোমায় নিচে নেমে আসতে হবে।

তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না, দোলা।

আমার বুদ্ধির তারিফ করবার সুযোগ অনেক পাবে, যদি কৃতকার্য হয়ে ফিরতে পার।

হাসল সিতাংশু। দোলার কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে তার নরম গালে টোকা মারল। তারপর তাকে বুকের কাছে টেনে আনার চেষ্টা করল।

দোলা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, আঃ, ছাড়ো, ভাল লাগছে না।

কিছু বলল না সিতাংশু। তরী কূলে এসে পৌঁছেছে, এমন অহেতুক জোর খাটাতে গিয়ে সেই তরী ডুবিয়ে দিতে পারে না। সুতরাং ধৈর্য ধরতে হবে। প্রণবেশকে সরিয়ে দিয়ে আগে নিজের হাতদুটো ধুয়ে ফেলতে হবে, তারপর এই হাতদুটো দোলার শরীর জরীপ করবে, গত ছ’ বৎসর মনে মনে যে আকাঙক্ষা পোষণ করে এসেছে, তা এবার চরিতার্থ হবে।

অনেকক্ষণ দুটি নরনারী চুপ করে রইল। ঘরের নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন ঘরের মধ্যে চেপে বসেছে। বাইরের পরিবেশকে অন্ধকার গ্রাস করেছে।

দোলার বুক তোলপাড় করে দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

সিতাংশু যেন চমকে উঠল। সে জিজ্ঞাসা করল, কি হল, দোলা?

কিছু না।—দোলা ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, আলোটা নিভিয়ে দাও।

আলো ভাল লাগছে না?

সইতে পারছি না।

দোলা, আসলে তুমি ভয় পেয়েছ।

হ্যাঁ, আমার ভয় করছে। আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ভয় করে।

আমি তো আছি তোমার পাশে।

হ্যাঁ, তুমি আছ আমার পাশে, তবু আমি ভয় পাচ্ছি।

প্রণবেশের কথা ভাবছ?

প্রণবেশের কথা ভাবছি না।—দোলা বলল, ভাবছি সোমার কথা। বড় হয়ে ও যখন শুনবে বাবার মৃত্যুর কথা—কিভাবে মৃত্যু হয়েছে—

জানবে না।

জানবে। সত্য কখনও গোপন থাকে না।

বলছি তো তোমার মেয়ে কিছুই জানতে পারবে না।—রহস্যময় হাসি হাসল সিতাংশু।

তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না, সিতাংশু।

তুমি যেমন চাও না, প্রণবেশের কোন স্মৃতি তোমার সঙ্গে আমার কাছে আসুক, তেমনি আমিও চাই না—

তাহলে সোমার কি হবে?

হয় সে তার বাপের মত মরবে—

না !

তা নাহলে কোন অনাথ আশ্রমে ফেলে দিলেই হবে।

ওই শিশুর ওপর তুমি এত কঠিন হতে পারবে?

পারব। আমি অনেক কিছু পারি, দোলা।

দোলা কোন কথা বলল না। স্থাণুর মত বসে রইল। দু’ চোখে বোবা দৃষ্টি।

ঘড়ির কাঁটা সাতটার ঘর পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। একটু চা পেলে ভাল লাগত। দোলা ভাবল। কিম্বা এক কাপ কফি। শরীরটা যেন আর নিজের আওতায় থাকতে চাইছে না। এখনও অনেক পথ পেরিয়ে যেতে হবে। সিতাংশুর চাকর ধনবাহাদুরের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটা কি বাড়িতে নেই?

দোলা জিজ্ঞাসা করল, ধনবাহাদুর কি বাড়িতে নেই?

আছে।—সিতাংশু বলল, তুমি তো জানো, এই সময় সে কিচেনে থাকে।

গলাটা শুকিয়ে গেছে, এক কাপ চা বা কফি পেলে ভাল লাগত।

ধনবাহাদুরকে আমি বলে আসছি।

সিতাংশু ঘর ছেড়ে চলে গেল।

দোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তার সেই লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার হাত থেকে রুমালটা নিচে পড়ে গেল। অপরিচিত লোকটা রুমালটা কুড়িয়ে নিয়ে একটু হাসল, তারপর দ্রুতপদে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দোলা ।

কে?

সিতাংশু কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি দোলা। সে বলল, লোকটার কাণ্ড দেখলে?

দেখলাম।—সিতাংশু বলল, রুমালটা তুমি ফেললে কেন?

ফেললাম কোথায়, হাত থেকে পড়ে গেল।

রূপসীদের রুমাল সব পুরুষই কুড়িয়ে নিতে চায়।

আসলে লোকটা পাগল।

পাগল হয়েছে তোমার রূপ দেখে।

আঃ, কি যে বলছ!

ধনবাহাদুর ঘরে ঢুকল। তার হাতেধরা ট্রেতে সাজানো কফির সরঞ্জাম আর এক বোতল হুইস্কি আর একটা সুদৃশ্য কাচের গ্লাস। টেবিলের ওপর ট্রে রেখে সে বলল, মেমসাহেবের টেলিফোন এসেছে।

টেলিফোন!—সিতাংশু সবিস্ময়ে বলল, কে করছে?

নাম বলেননি।

আমি দেখছি।—সিতাংশু এক পা এগিয়ে গেল।

দোলা তাকে বাধা দিয়ে বলল, আমার টেলিফোন আমাকেই ধরতে দাও।

দোলা জানে প্যাসেজে ফোন রাখা আছে। সে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

ধনবাহাদুর মদের বোতলের ঢাকা খুলে গ্লাসে খানিকটা মদ ঢালল। জল বা সোডা মিশিয়ে মদ পান করে না সিতাংশু তা সে জানে, তাই মদপূর্ণ গ্লাসটা মনিবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

এক ঢোক মদ পান করল সিতাংশু। মনটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠতে চাইল। ধনবাহাদুর ঠিক জানে কখন তার মালিকের কি দরকার।

দোলা কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। সিতাংশু ভাবল। কেমন যেন ছটফট করছে। নিয়মের ব্যতিক্রম কোন মেয়েই সহ্য করতে পারে না। স্বামী কথাটার সঙ্গে অনেক সংস্কার জড়িয়ে থাকে। পুলিশী ঝামেলা না কাটা পর্যন্ত দোলা সহজ হতে পারবে না। কিন্তু বেচারা তো জানে না যে তার নিরাপত্তার জন্যে সিতাংশু বোস কতদূর এগিয়ে গেছে।

আফ্রিকার হীরের খনিতে চাকরি পাওয়ার সংবাদ এখনও দোলাকে জানায়নি সিতাংশু। সব কাজ চুকে গেলে দোলাকে নিয়ে সোজা আফ্রিকায় পাড়ি জমাবে, তারপর আর কখনও ভারতে ফিরে আসবে না। বিদেশকে তারা স্বদেশ করে নেবে। দরকার হলে দোলাকেও একটা ভাল চাকরিতে ঢুকিয়ে দেবে।

প্রথম যৌবনে দোলাকে হারাবার পর মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল সিতাংশু, একথা মিথ্যে নয়। দোলাকে ভুল বুঝেছিল একথাও সত্য। কিন্তু তার ক্ষতি করবার কামনা সিতাংশুর মনে কখনও জাগেনি। কিন্তু দোলাকে দেখবার পর তার মনটা লোভাতুর হয়ে উঠল, সে যেন পাল্টে যেতে লাগল। সিতাংশু ঠিক করল, যে ভালবাসা সে হাত পেতে পায়নি, তা ছিনিয়ে নিতে হবে। এ জগতে জোর না খাটালে কিছু পাওয়া যায় না। মানুষ সভ্য হয়েছে একথা ঠিক, কিন্তু আদিম প্রবৃত্তি থেকে সে আজও মুক্ত হতে পারেনি।

গম্ভীর মুখে ফিরে এল দোলা। সোফায় বসে হাতের চুড়িগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল।

সিতাংশু জিজ্ঞাসা করল, প্রণবেশ ফোন করেছিল বুঝি?

দোলা মাথা নেড়ে বলল, না।

তবে?

সুনন্দ রায়।

সে আবার কে?

একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। একেই আমার পেছনে লাগিয়েছে।

তার মানে যে লোকটা এতক্ষণ নিচে দাঁড়িয়েছিল?

হ্যাঁ।

অবজ্ঞার হাসি হাসল সিতাংশু। এক ঢোক মদ পান করে বলল, তা সেই ডিটেকটিভ কি বললেন?

কে যেন আমার মেয়েকে আজ বিকেলে খুন করবার চেষ্টা করেছিল।

সোমাকে? কিন্তু—

তুমি কি সোমার পেছনে লোক লাগিয়েছ, সিতাংশু?—দোলা কাতর কণ্ঠে বলল।

না, তবে—

তোমার দুটি পায়ে পড়ি, সোমার কোন ক্ষতি তুমি করো না।

সিতাংশুকে চিন্তিত দেখাল। সে বিড়বিড় করে বলল, সুনন্দ রায় লোকটা তোমাকে ভুল খবর দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে, দোলা। সোমার সম্পর্কে আমি কোন স্থির সিদ্ধান্ত এখনও নিইনি।

দোলা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, আমি এখন কি করব বলতে পার?

কোন কথা বলল না সিতাংশু। গ্লাসের বাকি মদটুক গলায় ঢেলে দিয়ে সেটা টেবিলের ওপর রেখে দিল। তারপর নিজেই দোলার জন্যে এক কাপ কফি তৈরি করে দিল।

কফিতে চুমুক দিয়ে দোলা চোখ বুজল।

ধনবাহাদুর আবার ঘরে ঢুকল।

সিতাংশু জিজ্ঞাসা করল, আজ রাতে কি রাঁধছ, ধনবাহাদুর?

যদি বলেন মুরগী কাটতে পারি।—ধনবাহাদুর বলল।

কাটো। তোমার মেমসাহেব এখানে খাবেন।

দোলা ব্যস্ত হয়ে বলল, সে কি করে হবে, অনেক রাত হয়ে যাবে না?

খেয়ে যাও।—সিতাংশু বলল, পুলিশী ঝামেলা শুরু হলে খাওয়ার সুযোগ পাবে না।

আজ আমায় কিছু খেতে বল না।—দোলা অনুনয়ের সুরে বলল, আমার কিছুই ভাল লাগছে না।

মনকে শক্ত কর, দোলা।

সিতাংশু, তুমি আমাকে বুঝতে চাইছ না।

আমি বলছি তুমি খেয়ে যাবে।

ধনবাহাদুর নিঃশব্দে ঘর থেকে চলে গেল।

কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। দোলা আবার কফিতে চুমুক দিল। সিতাংশু গ্লাসে মদ ঢালল, তারপর দেওয়ালে টাঙানো ফ্ৰেমাবদ্ধ কালী মায়ের ফটোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

দোলা কফিতে চুমুক দিয়ে সিতাংশুর দিকে তাকাল। মানুষটা মুখে যতই বড়াই করুক না কেন, মনে মনে ঠিকই ভয় পেয়েছে, নিজের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। কোন ঝামেলায় পড়লে সিতাংশু কালী মায়ের ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে শক্তি খুঁজতে চায়, মনে মনে মায়ের কাছে প্রার্থনা জানায়। ঠিক এই মুহূর্তে হয়তো প্রার্থনাই করছে।

দোলা বলল, আজ বেশি মদ খেয়ো না সিতাংশু, দুর্বল হয়ে পড়বে, কাজে ভুল করবে।

সিতাংশু কাছে এসে বলল, মদ আমার পেটে না পড়লে আমি শক্তি পাই না।

তবু বলব একটু কম খাও।

আজ মায়ের চোখ দুটো দেখলাম খুব উজ্জ্বল।

তাতে কি প্রমাণ হয়?

আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। মা আমার ওপর সন্তুষ্ট।

দোলা কোন কথা বলল না। শূন্য কাপ টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল।

দেওয়াল ঘড়িতে রাত আটটা বাজবার সময় সঙ্কেত হল। সিতাংশু চমকে ঘড়ির দিকে তাকাল, তারপর তাকাল দোলার দিকে। দোলা চমকে মুখ তুলে সিতাংশুকে দেখল।

দোলা অস্ফুট কণ্ঠে বলল, কি হল?

সিতাংশু বলল, সময় হয়েছে। এবার যেতে হবে।

সিতাংশু!—দোলা যেন আর্তনাদ করে উঠল।

হাসল সিতাংশু, চাপা হাসি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় বাঁধা টাইটা ঠিক করতে করতে বলল, দেখবে কাজ হাসিল করে ঠিক ফিরে আসব।

দোলা ঢোক গিলল। তার পাতলা ঠোঁট দুটি থরথর করে কাঁপল। টেবিলে পাতা টেবিল-ক্লথ শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল।

পিস্তলটা রুমালে জড়িয়ে কোটের ভেতর পকেটে রাখল সিতাংশু। তারপর দোলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমি এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসছি।

এক ঘণ্টার মধ্যে যদি ফিরতে না পার?—দোলা ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল।

আমাকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না।

আমার ভয় করছে।—সিতাংশুর একখানা হাত চেপে ধরল দোলা, বুকের মধ্যে কেমন করছে।

মা কালীর ওপর ভরসা রাখ, সব ঠিক হয়ে যাবে।

সিতাংশু আর একবার ফটোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ভক্তিভরে কালী-মাকে প্রণাম করে দোলার দিকে এক ঝলক হাসি ছড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পথে নামল।

কালো আকাশের বুকে এখন অনেক তারার ভিড়। তারা যেন সিতাংশুর দিকেই বিস্ময় জড়ানো চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। দেখছে, সভ্য দেশের একজন শিক্ষিত পুরুষ ষড়রিপুর প্রভাবে কেমন দৃঢ় সঙ্কল্পপরায়ণ হয়ে দানবে রূপান্তরিত হয়ে আর একজন পুরুষের অধিকার খর্ব করতে চলেছে—তাকে বঞ্চিত করতে চলেছে। একজন আর একজনের শরীরকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মানুষ নিজেকে যতই সভ্য এবং শিক্ষিত বলে দাবী করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে মানুষ আজও আদিম খুনের ঐতিহ্য মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। আদিম প্রবৃত্তি তার রক্ত-অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে। এ যেন প্রকৃতির এক চরম অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে মানুষের মুক্তি নেই।

প্রফেসরস কোয়ার্টার্সের সামনে এসে দাঁড়াল সিতাংশু। রাস্তার পাশ থেকে সরু সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। সিঁড়িটা শেষ হয়েছে একখণ্ড সমতল জমির ওপর। এরই ওপর পর পর কয়েকটি দোতলা কোয়ার্টার্স। এর একটিতে থাকে প্রফেসর প্রণবেশ সেন। সিতাংশু কোয়ার্টার্সের সামনে এসে দাঁড়াল। নিচের তলা অন্ধকার, দোতলায় একটা ঘরে আলো জ্বলছে। ওটা স্টাডিরুম, ওখানেই প্রণবেশ আছে।

দু’ হাতে উলের গ্লাভস পরে নিল সিতাংশু। পেনসিল-টর্চ জ্বেলে সিঁড়ির ধাপগুলো পেরিয়ে সে ওপরে উঠে এল। একটা সরু প্যাসেজ পার হয়ে স্টাডিরুমের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের দরজা খোলাই রয়েছে। নিবিষ্ট মনে প্রণবেশ পড়ছে।

পায়ের শব্দে প্রণবেশ মুখ তুলে তাকাল। সিতাংশুকে সামনে দেখে বিস্মিত হলেও হাসল।

আসুন, মিস্টার বোস। প্রণবেশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

সিতাংশু ঘরে ঢুকে প্রণবেশের সামনে দাঁড়াল।

প্রণবেশ বলল, দোলা এখনও ফেরেনি।

আমি দোলার কাছে আসিনি।—সিতাংশু তার হিংস্র চোখের দৃষ্টি প্রণবেশের নরম চোখের ওপর রাখল। পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে সাইলেন্সার লাগিয়ে শিকারের দিকে নল তুলে ধরল।

এসব কি, মিস্টার বোস!—প্রণবেশ অস্ফুট কণ্ঠে বলল, আপনি কি—

পর পর দু’বার ফায়ার করল সিতাংশু। প্রণবেশের কণ্ঠের শেষ কথাগুলো আর শোনা গেল না। সে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

নিঃশব্দ হাসি হাসল সিতাংশু। মৃত প্রণবেশের বাঁ হাতে পিস্তলটা ধরিয়ে দিল। তারপর ঘরের কোণে রাখা ঝাড়ুটা নিয়ে ধীরে ধীরে পায়ের ছাপ মেলাতে মেলাতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। ঝাড়ুটা অন্ধকারে ফেলে দিল। হাত থেকে গ্লাভস জোড়া খুলে রুমালে মুখ মুছল। দরদর করে ঘামছে। বুক ভরে হাওয়া গ্রহণ করল।

হাতঘড়িতে সময় দেখল সিতাংশু। রাত পৌনে ন’টা বাজে। ঠিক সময়ে ফিরতে পারবে বলেই মনে হয়। দোলা তার পথ চেয়ে আছে। এবার দোলা সম্পূর্ণভাবে আমার, মনে মনে ভাবল সিতাংশু, ও আমার প্রথম যৌবনের ভালবাসা।

একটা সিগারেট ধরাল সিতাংশু। হঠাৎ তার মনে হল, প্রণবেশের কোয়ার্টার্সে কারও চলাফেরার শব্দ হচ্ছে। সে দ্রুতপদে রাস্তায় এসে দাঁড়াল, ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল।

খুব সহজেই কাজ মিটে গেল। দোলার সাহায্য না পেলে এত সহজে কাজ মিটত না। প্রথম দিকে দোলা রাজী হয়নি, খুন-খারাপি চায়নি। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাকে রাজী হতেই হল। সিতাংশু জানত, দোলা রাজী হবেই, কারণ প্রথম যৌবনের ভালবাসা কি কেউ হারাতে চায়, নাকি পারে? ভালবাসা আর শ্রদ্ধা এক জিনিস নয়। প্রণবেশকে দোলা শ্রদ্ধা করেছে, কিন্তু ভালবাসতে পারেনি। তাই অনেক অনেক সংস্কার কাটিয়ে সে তার সামনে এসে দাঁড়াতে পেরেছে সাহসে বুক বেঁধে।

রাত বারোটার মধ্যে দোলা কোয়ার্টার্সে ফিরবে। এক হৃদয়-বিদারক দৃশ্যের মুখোমুখি হবে। তারপর তার ভয়ার্ত চিৎকারে আশপাশের কোয়ার্টার্স থেকে লোকজন ছুটে আসবে, প্রত্যক্ষ করবে প্রণবেশের পরিণতি, তারপর পুলিশ আসবে, তদন্ত হবে? সিতাংশু হাসল। কিন্তু আততায়ীর কোন হদিস তারা করতে পারবে না। শেষপর্যন্ত পুলিশ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে যে অজ্ঞাত কারণে প্রফেসর প্রণবেশ সেন আত্মহত্যা করেছে। সত্য যে কিভাবে মিথ্যায় পর্যবসিত হয় তা সে দেখাবে। তারপর সব যখন চুপচাপ হয়ে যাবে, দোলাকে নিয়ে সিতাংশু আফ্রিকায় রওনা হবে।

নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে সিতাংশু দেখল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দোলা নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে ভেতরে বসে আছে। বেচারা!

সিতাংশু কলিংবেলের ‘পুস’ বটমে চাপ দিল। কানে এল সুরেলা ঘণ্টার আওয়াজ।

দরজা খুলে গেল।

ঘরে ঢুকে সিতাংশু দেখল অনেক মানুষের ভিড় এখানে। দোলা দূরে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাকে একটু আগে নিজের হাতে খুন করে এল, সেই প্রণবেশ বহালতবিয়তে সোফায় বসে আছে। দুজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। আর ফেল্ট হ্যাট মাথায় সেই লোকটা তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।

সুনন্দ বলল, আসুন মিস্টার বোস, আমরা আপনার আগমনের প্রতীক্ষায় রয়েছি।

সিতাংশু অস্ফুট কণ্ঠে বলল, এসব কি, দোলা?

মিসেস সেন নয়, যা বলবার আমিই বলছি।—সুনন্দ। বলল, আমাদের পাতা জালে আপনি ধরা পড়ে গেছেন, মিস্টার বোস। মিস্টার আর মিসেস সেন ঠিক সময়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে আজ আপনাকে জালে তোলা গেল। দোলা সেনের নিখুঁত অভিনয়কে প্রথম থেকে আপনি সত্য বলে ভেবে এসেছেন।

সিতাংশু বলল, পিস্তলটাও আমার সঙ্গে অভিনয় করেছে বলতে চান?

কতকটা তাই। ব্ল্যাঙ্ক কার্তুজ ভরে আমিই পিস্তলটা মিসেস সেনকে দিয়েছিলাম।

সিতাংশু দোলাকে দেখল। তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু চোখে সেই নরম দৃষ্টি নেই, চোখ জ্বলছে ; সিতাংশুকে যেন গ্রাস করতে চাইছে। এই মুহূর্তে তার মনে হল এই দোলাকে সে চেনে না, আগে কখনও দেখেনি। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দোলার একটা হাত ধরতে গিয়ে সে থমকে গেল।

দোলা ঘৃণা-মিশ্রিত কণ্ঠে ডান হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমাকে তুমি ছোঁবে না, সিতাংশু!

দোলা!

জানোয়ার।

দেওয়ালে টাঙানো মা কালীর ছবির দিকে নজর পড়ল সিতাংশুর। দোলার তুলে ধরা ডান হাতে কালীর খাঁড়াটাই দেখতে পেল সে। সভয়ে চোখ বুজল।

প্রণবেশ হাসি মুখে বলল, বসুন মিস্টার বোস।

সিতাংশু দোলার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

দোলা কঠিন। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সিতাংশুকে দেখতে লাগল। তার পাতলা ঠোঁট দুটির ফাঁকে আবছা হাসি। চোখের কোণ দুটো অশ্রুপূর্ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *