2 of 2

গুরুবিদায় – নারায়ণ সান্যাল

গুরুবিদায় – নারায়ণ সান্যাল

একদিন হেবোকে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন তার কাকা। হেবো ভেবেছিল, আবার বুঝি এক প্রস্থ উপদেশ বর্ষিত হবে তার ওপর। এখন মাঝে-মাঝেই তাকে ডেকে কাকা নানান উপদেশ দেন, খোঁজ খবর নেন, সে গোয়েন্দাগিরি ছেড়েছে কি না। বই বন্ধ করে হেবো এসে হাজিরা দেয় কাকার ঘরে। কাকা সস্নেহে ডেকে বলেন, ‘আয় বোস।’

সুরটা যেন অন্য রকম লাগছে? মুখ তুলে হেবো দেখতে পায়, ঘরে বসে আছেন কাকা, কাকিমা আর কাকার সেই গোয়েন্দা-বন্ধু প্রবীরকাকু। প্রবীরকাকু বলেন, ‘কেমন আছ হেবো?’

হেবো হাসে, জবাব দেয় না।

কাকা বলেন, ‘তোকে একটি জরুরী কাজে ডেকেছি হেবো। মানে আমরা একটা বিপদে পড়েছি। কী করব স্থির করে উঠতে পারছি না। তোর তো এসব বিষয়ে বেশ বুদ্ধি খোলে, তাই—’

হঠাৎ থেমে পড়েন কাকাবাবু। হেবো মনে মনে উৎফুল্ল হলেও মুখে সে-ভাব প্রকাশ করে না।

প্রবীরবাবু আলোচনার সূত্রটা তুলে নিয়ে বলতে থাকেন, ‘সত্যি করে বলতে কি, তোমার কাকিমা এ কাজে আমার সাহায্য চেয়েছেন। ব্যাপারটা জটিল ; কিন্তু আমি বলেছি, আমার সহকারী হিসাবে যদি শ্রীমান শার্লক হেবো কাজ করে, তবেই এ দায়িত্বটা নিতে পারি।’

হেবো একটু অবাক হয়ে বলে, ‘কাকিমা? তোমার বিপদ?’

প্রবীরকাকু ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিয়ে বলেন, ‘না, বিপদটা ঠিক তোমার কাকিমার নয়—তাঁর ছোট বোন মঞ্জুলা দেবীর। ব্যাপারটা এই—’

আদ্যোপান্ত ঘটনাটা হেবো মন দিয়ে শোনে।

হেবোর কাকিমারা দুই বোন। কাকিমার ছোট বোন মঞ্জুলা দেবীর বিয়ে হয়েছিল কৃষ্ণনগরের একজন নামকরা উকিল সুধাকান্তবাবুর একমাত্র ছেলে নির্মলেন্দুর সঙ্গে। সুকান্তের আর সন্তানাদি নেই। স্ত্রীও দীর্ঘদিন গত। কৃষ্ণনগরের রায়পাড়ায় মস্ত বড় বাড়ি। যথেষ্ট রোজগার করেছেন জীবনে। এখন অবসরপ্রাপ্ত মানুষ। সত্তরের ওপর বয়স। ছেলে নির্মলেন্দুই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র অবলম্বন। শেষ দিকে তন্ত্র-সাধনার দিকে ঝোঁকটা হয়েছে বৃদ্ধের। শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছেন, পূজা-অর্চনাতেই দিন কাটে। নির্মলেন্দুর সঙ্গে মঞ্জুলার বিয়ে হয়েছিল বছর-পাঁচেক আগে। নির্মলেন্দু ছিল দক্ষিণ রেলওয়ের একজন অফিসার। বিয়ের মাস-খানেক আগেই নির্মলেন্দু চাকুরিতে ঢুকেছিল, আর বিয়ের মাস-দুয়েক পরেই সে বদলি হয়ে যায় মাদ্রাজে। ফলে মঞ্জুলার পক্ষে শ্বশুরের ঘর করাটা ঘটেনি। এখন মজা হচ্ছে এই যে, সুধাকান্তবাবুর ধারণা হল, এই অপয়া বউয়ের জন্যই নির্মলেন্দু তার বাপকে ত্যাগ করে গেল। বিনা যুক্তিতে ছেলেমানুষের মত তিনি অভিমান করে রইলেন পুত্রবধূর উপর। বেচারি মঞ্জুলা এ অভিমান ভাঙাবার নানান চেষ্টা করেছে। স্বামীকে ছেড়ে কৃষ্ণনগরে শ্বশুরের কাছে এসে থাকতে চেয়েছে ; কিন্তু তাতেও কোন ফল হয়নি। সুধাকান্ত তো পুত্রবধূর সেবার জন্য কাতর নন, তিনি চাইছেন পুত্রের সান্নিধ্য। অথচ সে বেচারা চাকরি ছেড়ে বারে বারে এতদূর আসেই বা কী করে? শেষ পর্যন্ত নির্মলেন্দু বলেছিল, ‘বাবা, আপনিই কেন আমার ওখানে গিয়ে থাকবেন চলুন না মাদ্রাজ!’ কিন্তু তাতেও সুধাকান্ত রাজি নন। দেশ ঘর ছেড়ে অত দূরে এই বয়সে তিনি যাবেন না। ফলে পিতা, পুত্র আর পুত্রবধূর মধ্যে একটা মন-কষাকষির সূত্রপাত হল।

হেবো বাধা দিয়ে বলে, ‘কিন্তু এর মধ্যে কাকিমার বিপদটা কোথায়?’

প্রবীরবাবু বলেন, ‘বলছি, সবটা শোন আগে।’

ঘটনার গতি কোন দিকে মোড় নিয়েছে এবার তিনি তা বুঝিয়ে দেন।

মাসচারেক আগে হঠাৎ একটা আকস্মিক দুর্ঘটনায় নির্মলেন্দু মারা গেছেন। সুধাকান্ত একেবারে ভেঙে পড়েছেন। তিনি যেন একেবারে অন্য মানুষ,সমস্ত দুনিয়ার ওপর তাঁর একটা বিতৃষ্ণা জন্মেছে। সুধাকান্তের অর্থের অভাব ছিল না। তবু সেই টাকা রোজগারের অভিলাষেই ছেলে যে বাপকে ত্যাগ করে গিয়েছিল এটা তিনি ভুলতে পারেননি। ছেলে নেই—টাকার উপরেই মর্মান্তিক চটে গেছেন তিনি।

মঞ্জুলার একটি সন্তান হয়েছিল ইতিমধ্যে। বছর-খানেকের ছেলেটিকে নিয়ে সে এসে আশ্রয় চাইল শ্বশুরের ভিটায়। আশ্রয় তিনি দিলেন, অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থাও করতে তিনি রাজী ; কিন্তু না পুত্রবধূ, না তার অবোধ শিশুসন্তান—কাউকেই তিনি মনে প্রাণে গ্রহণ করলেন না।

দ্বিতল বাড়ি। উপর তলায় তিনখানি ঘর। একটি ঘরে থাকেন সুধাকান্তবাবু, দ্বিতীয় ঘরটি তালাবন্ধ থাকে। সেটায় ছাত্রজীবনে নির্মলেন্দু থাকত। তৃতীয় ঘরটিতে বর্তমানে আছেন সুধাকান্তের গুরুদেব। মন্ত্ৰদীক্ষা দিতে তিনি এসেছিলেন একদিন, আর ফিরে যাওয়া হয়নি। একতলায় রান্না, ভাঁড়ার, বৈঠকখানা ছাড়াও আর একটি বাড়তি ঘর ছিল। সেটাতেই থাকতে দেওয়া হয়েছিল মঞ্জুলাকে। ঘরটা অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে। এমন একখানা ঘরে তাকে থাকতে দেওয়ার সঙ্গত কারণ দেখিয়েছিলেন গুরুদেব। সুধাকান্ত নাকি পুত্রবধূর বৈধব্যের বেশটা সহ্য করতে পারেন না। না পারাই স্বাভাবিক। মাত্র পাঁচ বছর আগে যাকে আদর করে নিয়ে এসেছিলেন এ বাড়ির লক্ষ্মী করে, সে-ই যদি আজ সাদা থান পরে তাঁর সামনে ঘুরে বেড়ায় তাহলে তাঁর কষ্ট হয় বইকি। গুরুদেব প্রথম দিনেই বলে দিয়েছিলেন, এ বেশে যেন মঞ্জুলা তার শ্বশুরের সামনে না যায়।

প্রথমটায় লজ্জায় সঙ্কোচে আর হতাশায় মাথা নিচু করে এ আদেশ মেনে নিয়েছিল মঞ্জুলা। সুধাকান্তের পুত্র বিয়োগের জন্য যেন সে-ই দায়ী। কিন্তু দু-দশদিন পরে তার খেয়াল হল, এ তো হতে পারে না! এই বেশ বদলাবার কোন সম্ভাবনা যখন নেই তখন সে কি চিরকালই ওই অন্ধ কুঠুরিতে পড়ে থাকবে নাকি? শ্বশুরের সেবাযত্ন করবে না?

গুরুদেব কঠিন হয়ে বললেন, ‘না! এতদিন যদি পুত্রবধূর সেবাযত্ন ছাড়াই চলে গিয়ে থাকে তবে আর কটা দিনও চলবে! ’

বাধ্য হয়ে এই অপমানকর জীবনযাত্রাকে স্বীকার করে নিয়েছিল মঞ্জুলা। নির্বান্ধব পুরীর একতলার ওই অন্ধকার ঘরে ইঁদুর আর আরশোলা তাড়িয়ে পড়ে ছিল কোনক্রমে। তবু সদ্য-বিধবা একটি আশার বীজ সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছিল—একদিন না একদিন সুধাকান্ত তাকে ক্ষমা করে কাছে টেনে নেবেন। তাকে না হলেও অন্তত নির্মলেন্দুর সন্তানটিকে, একদিন তাঁর পাঁজর-সর্বস্ব হাহা-করা বুকে টেনে নেবেনই।

কিন্তু তা হবার নয়। গুরুদেব আর তাঁর চেলাটি পালা করে পাহারা দেয় সুধাকান্তের ঘরের সামনে। ওঁদের ভয়ে খোকনকে উপরে নিয়ে যেতে পারে না কেউ।

মঞ্জুলার চিঠি পেয়ে হেবোর কাকা আর কাকিমা কৃষ্ণনগরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুধাকান্তবাবু তাঁদের কোন আমলই দেননি। প্রথমত তিনি দেখাই করতে চাননি, বলে পাঠিয়েছিলেন, ‘আপনারা বৌমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি নিচের তলায় আছেন।’ কিন্তু হেবোর কাকা নাছোড়বান্দা হয়ে দেখা করেছেন তাঁর সঙ্গে। সুধাকান্তবাবু ভালভাবে ওঁদের সঙ্গে কথাই বলেননি। তবু নকুলবাবুর মধ্যস্থতায় মোটামুটি সাক্ষাৎটা হয়েছে।

বাধা দিয়ে হেবো বলে, ‘নকুলবাবুটি কে?’

হেবোর কাকিমা বলেন, ‘নকুলবাবু হচ্ছেন তায়ইমশায়ের পুরোন মুহুরি। বলতে গেলে ওঁদের সংসারেরই একজন। তাঁরও বয়স সত্তরের কাছাকাছি। তিনি নির্মলেন্দুকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। নির্মলেন্দুকে তিনিও খুব ভালবাসতেন। সেই নির্বান্ধব পুরীতে ওই নকুলচন্দ্ৰই মঞ্জুলার একমাত্র ভরসা। খোকনের মধ্যে তিনি নির্মলকে যেন নূতন করে আবিষ্কার করেছেন।’

হেবো বলে, ‘যাই হোক, তারপর?’

হেবোর কাকা বলেন, ‘আসল সমস্যা হচ্ছে এই যে, আমরা জানি না সুধাকান্তবাবু কোন উইল করে রেখেছেন কি না। করলেও হয়ত তিনি নির্মলের নামে সবকিছু লিখে দিয়ে গেছেন।’

বাধা দিয়ে হেবো আবার বলে, ‘আমি আইনের ব্যাপারটা ঠিক জানি না। যদি নাই করে থাকেন, তাহলে নির্মলবাবুর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী-পুত্রই কি সে সম্পত্তি পাবে না?’

‘হ্যাঁ, তাই পাবে।’ বলেন প্রবীরবাবু, ‘কিন্তু তোমার কাকা আশঙ্কা করেছেন যে, ওই গুরুদেবের পরামর্শে সুধাকান্তবাবু নূতন করে উইল করতে চাইছেন। আর সেই নূতন উইলে তিনি মঞ্জুলা দেবীকে আর তাঁর নাবালক সন্তানকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করতে চান।’

হেবো বলে, ‘এ তো খুব সর্বনাশের কথা! এ কথা কি আপনাদের অনুমান, না প্রমাণ আছে কিছু?’

প্রবীরবাবু বলেন, ‘এটা এখনও অনুমানের পর্যায়েই আছে বটে তবে অনুমানের স্বপক্ষে যথেষ্ট জোরালো যুক্তিও আছে। খবরটা দিয়েছেন নকুলচন্দ্র।’

সে কাহিনীও বিস্তারিত শুনল হেবো।

সুধাকান্তবাবুকে এই পুরাতন ভক্তটি আজও অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। নকুলচন্দ্র ছিলেন তাঁর মুহুরি। সুধাকান্তের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে দু-হাতে পয়সা কামিয়েছেন, ছেলেদের মানুষ করেছেন, মেয়েদের পাত্রস্থ করেছেন। দুজনেই অবসর নিয়েছেন বটে, তবু আজও নকুলচন্দ্র প্রতিদিন আসেন তাঁর ‘বড়বাবুকে’ দেখতে। সংসারের খবরাখবর নিয়ে, পুরাতন দিনের কথা দুটো-চারটে আলোচনা করে, রাত বাড়লে বাড়ি ফিরতেন। সুধাকান্ত কোন কেসে কেমন করে সওয়াল করেছিলেন, কোন আসামীকে ফাঁসির দড়ির নিশ্চিত আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করেছিলেন, কোন ধড়িবাজ বদমায়েসের কূট কৌশল ব্যর্থ করে তাকে কারাকক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন—বলতে বলতে উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন নকুলচন্দ্র। আর মনে মনে খুব উপভোগ করলেও সুধাকান্ত বলতেন, ‘আরে ছেড়ে দাও নকুল! ওসব কথা থাক, সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। আমাদের সময় হাকিমরা ছিল সত্যিকারের মানুষ। সেই ম্যাকফার্লন সাহেবকে মনে আছে তোমার?’

নকুল বলতেন, ‘মনে নেই আবার? ফেয়ারওয়েলের দিন তিনিই না আপনাকে বলেছিলেন, এখান থেকে যেতে আর কোন দুঃখ নেই, শুধু একটা দুঃখ, তোমার মত উকিলের জোরালো সওয়াল আর শুনতে পাব না।’

বাধা দিয়ে সুধাকান্ত বলতেন, ‘আরে ছেড়ে দাও নকুল! ওসব কথায় আর কাজ কী?’

এই দুই প্রাচীন বন্ধুর সামাজিক মর্যাদার আসন উঁচু নিচু কি না বুঝবার উপায় ছিল না। ওঁদের বন্ধুত্বে ভাঁটার টান পড়ল সুধাকান্ত দীক্ষা নেবার পর থেকে। গুরুদেব নকুলচন্দ্রকে পছন্দ করতেন না। ওঁদের সান্ধ্য আসরে প্রায়ই এসে বসতেন তিনি। আর দুজনেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠতেন। ক্রমশ নকুলচন্দ্র অনুভব করেন, তিনি এ বাড়ির কর্তার কাছে অবাঞ্ছিত। তবু দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের অভ্যাসবশত সন্ধ্যাবেলায় একবার দেখা দিয়ে যেতেন।

কিছুদিন আগে সুধাকান্তের হঠাৎ খুব জ্বর হয়। নকুলচন্দ্র তৎক্ষণাৎ খবর পাঠালেন শহরের নামকরা ডাক্তার অনুকুলবাবুকে। ওষুধপত্র পড়তে সামলে নিলেন সুধাকান্ত ; কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়লেন তিনি। বিছানা থেকে নামতে পারেন না। নকুলচন্দ্র সকাল বিকেলে দু-বেলা আসতে শুরু করলেন, খবর নিতে—ব্যবস্থা-পত্র করতে। বয়স হলে কী হবে, নকুলচন্দ্র এখনও বেশ শক্ত আছেন। দোতলায় উঠে গিয়ে তিনি তাঁর বড়বাবুর সঙ্গে রোজ দেখা করেন। সেদিনও গিয়ে যেই বসেছেন, সুধাকান্ত বললেন, “নকুল, ওই লোহার সিন্দুকটা খুলে ডানদিকের উপরের খোপে একটা বন্ধ খাম আছে, বার করে দাও তো !’

দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথা লোহার মজবুত আলমারি। তার চাবিটা সর্বক্ষণ থাকে অসুস্থ সুধাকান্তের বালিশের নিচে। চাবিটা বার করে তিনি নকুলচন্দ্রের হাতে দিলেন। ওঁর চোখের সামনেই ঘটছে সব কিছু। নকুলচন্দ্র চাবি খুলে ওপরের খোপ থেকে একটা সীলমোহর করা খাম বার করে ফিরে এলেন। খাম ও চাবিটা বড়বাবুর হাতে দিতে সুধাকান্ত বললেন, ‘সিন্ধুকটা আবার খোলা রেখে এলে কেন? ওটা বন্ধ করে চাবিটা দাও আমাকে।’

নকুলচন্দ্র বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, খামটা আবার তুলে রাখতে হবে।’

‘না, ওটা এখন বাইরেই থাকবে।’

খামটা বালিশের নিচে রাখলেন সুধাকান্ত।

সিন্দুক বন্ধ করে নকুলচন্দ্র চাবিটা তাঁর হাতে ফিরিয়ে দেবার সময় আর আত্মসংবরণ করতে পারেন না, বলে ফেলেন, ‘কিন্তু এটা কি ভাল হচ্ছে বড়বাবু?’

চমকে উঠে সুধাকান্ত বললেন, ‘কোন্‌টা নকুল?’

‘আমি তো স্যার জানি কী আছে ওই সীলমোহর-করা খামের ভিতরে! বছরদশেক আগে ওটা আমিই তো আপনার সামনে সীলমোহর করেছিলাম। সাক্ষী হিসাবে আমারও সই আছে কাগজটায়।’

সুধাকান্ত কোন জবাব দিলেন না। গুম মেরে বসে রইলেন। কিন্তু নকুলচন্দ্র পাকা লোক। সাক্ষী নীরব থাকলে তাকে ছেড়ে দিতে নেই, আরও ভাল করে চেপে ধরতে হয়—দীর্ঘদিনের কোর্ট-কাছারির অভিজ্ঞতায় এটুকু জানা ছিল তাঁর। তাই হেসে বলেন, ‘আপনি আমার কথার জবাব দিলেন না কিন্তু বড়বাবু।’

সুধাকান্ত ধমকে ওঠেন, ‘উইল পালটাব কিনা তাও কি তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে নাকি?’

নকুল স্লান হাসেন। অনেক দুঃখের সে হাসি। বলেন, ‘আজ্ঞে না। আপনি মস্ত বড় উকিল, আর আমি সামান্য মুহুরি। আপনারই অন্নে পালিত বলতে পারেন। আমার মত লোকের সঙ্গে আপনি কেন এসব বৈষয়িক ব্যাপারে পরামর্শ করবেন? তবে কিনা নিমুকে একদিন কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলাম, তাই তার ওই বাচ্চাটার কথা ভেবে—কিন্তু নাঃ! আমার অন্যায়ই হয়েছে।’

পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে বসে থাকেন সুধাকান্ত।

নকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আর মুশকিল হয়েছে কি জানেন বড়বাবু—আপনি তো চোখে দেখেন না, ওদের ওপরেই আসতে দেন না; কিন্তু আমি তো দেখতে পাই, খোকনবাবু সারা বাড়িটা টলমল করে হেঁটে বেড়ায়। ঠিক নিমুর মত দুষ্ট হয়েছে—মায় হাসিটা পর্যন্ত। তাই ওই ছেলেটির ভবিষ্যৎ ভেবে⋯ কিন্তু আবার পাগলামি করছি আমি। এ সব কথা আলোচনা করার আমার অধিকারই যে নেই! হ্যাঁ, অন্যায়ই হয়েছে আমার, মাপ করবেন আমাকে।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান নকুলচন্দ্র। লাঠিটা তুলে নেন হাতে।

আশ্চর্য, তবু সুধাকান্ত কোন প্রতিবাদ করেন না। জানলা দিয়ে দূর দিগন্তের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে থাকেন পাথরের মূর্তির মত। তিনি যেন ভুলে গেছেন দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে নকুলচন্দ্রের সঙ্গে এ বাড়ির কী সম্পর্ক!

নকুলচন্দ্র ধীর পায়ে বেরিয়ে যেতে চান ঘর থেকে। সুধাকান্ত ফিরে ডাকেন না তাঁকে। দরজার কাছে গিয়ে নকুলচন্দ্র দেখেন, দাঁড়িয়ে আছেন সুধাকান্তের গুরুদেব। লাল চেলি পরা, গলায় গরদের চাদর, কপালে আধুলির মাপে একটা সিঁদুরের টিপ। তন্ত্রসাধক তিনি। কেউ-কেউ বলে তিনি নাকি কাপালিক। চোখদুটো আগুনের ভাঁটার মত জ্বলছে তাঁর। বয়সে ওই গুরুদেবটি সুধাকান্তের চেয়ে বছর বিশেক ছোটই হবেন। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স তাঁর, তবু তিনি অনায়াসে সুধাকান্তের প্রণাম নিয়ে থাকেন।

নকুলচন্দ্র গুরুদেবকে নমস্কারমাত্র না করে বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় শুনতে পান গুরুদেব তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ জোর গলায় সুধাকান্তকে বলছেন, ‘আবার তুমি ওইসব অসৎ কুসঙ্গের সংস্পর্শ করছ? বলেছি না, ওদের দোতলায় উঠতে দেবে না!’

মিনমিনে গলায় সুধাকান্ত কি জবাব দিলেন সেটা আর শুনতে পেলেন না তিনি।

এতক্ষণ তীক্ষ্ণ মনোযোগ দিয়ে হেবো শুনছিল কেস-হিস্ট্রিটা। প্রবীরচন্দ্র থামতেই বলল, ‘বুঝলাম। এখন কী করতে চান আপনারা?’

কাকা বলেন, ‘আমি তো আশার কোনও চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না।’

বাধা দিয়ে হেবো বলে, ‘কেন? এখনই নিরাশ হবার কী আছে? আমি তো আশার লক্ষণ ভালই দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত দেখুন, সুধাকান্ত গুরুদেবের হাতে সিন্দুকের চাবিটা দেননি। নিজে উত্থানশক্তি-রহিত, কিন্তু সিন্দুক খোলার কাজটার জন্য সাহায্য নিয়েছিলেন নকুলবাবুর। দ্বিতীয়ত, নকুলচন্দ্র যখন খোকনের কথা বলেছিলেন তখন তিনি উদাস দৃষ্টি মেলে জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তৃতীয়ত, বোঝা যাচ্ছে গুরুদেব ইতিপূর্বেই নকুলচন্দ্রের দ্বিতলে আসা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে নিষেধ অমান্য করেছিলেন সুধাকান্ত।’

কাকা বলেন, ‘কি জানি বাপু, অত সূক্ষ্ম বিচার আমি বুঝি না। আমি প্রবীরকে বলছিলুম কাজটা হাতে নিতে। এ সাধারণ মানুষের কাজ নয়। পুলিশের সাহায্যও আমরা পাব না, কারণ সুধাকান্ত বে-আইনি কিছু করছেন না। সম্পত্তি সুধাকান্তের নিজের উপার্জন, পৈতৃক নয়। তিনি যদি সজ্ঞানে ও স্ব-ইচ্ছায় তাঁর স্বোপার্জিত সম্পত্তি গুরুদেবকে উইল করে দিয়ে যান তাহলে আইনত আমাদের আপত্তি করবার কিছু নেই। মামলা মোকদ্দমা করে মঞ্জুলা হয়ত তার নাবালক সন্তানের জন্য একটা মোটামুটি খোরপোষ আদায় করতে পারবে—তাও পারবে কিনা জানি না। কিন্তু এত বড় অন্যায়টা সহ্যই বা করে যাওয়া যায় কেমন করে?’

হেবো বলে, ‘সে তো ঠিক কথাই। সুধাকান্তবাবুকে বাধা দেবার আইনগত অধিকার না থাকলেও নীতিগত অধিকার আমাদের আছে। এ যদি অধর্ম না হয়, তবে অধর্ম আর কাকে বলে? কিন্তু প্রবীরকাকু, আপনি কেমন করে কী করবেন?’

আমাদের কিছু করতে হলে সর্বপ্রথম এই দুর্গের ভিতর ঢুকতে হবে। আমার পক্ষে ওই ব্যূহে প্রবেশ করা অসম্ভব। গুরুদেবটিকে আমি চিনি। গভীর জলের মাছ তিনি। বহু বিধবার সম্পত্তি গ্রাস করেছেন আশ্রমের নামে। তাছাড়া চোরাই মাল পাচারের একটা ফলাও ব্যবসা তাঁর আছে। বহুবার ফাঁদ পেতেছে পুলিশ—ধরা পড়েনি একবারও। অত্যন্ত ধড়িবাজ লোক। সেও আমাকে চেনে, আমিও তাকে চিনি। ফলে কোন ছুতো-নাতাতেই আমার পক্ষে ওই ব্যুহে প্রবেশ অসম্ভব।’

হেবো বলে, ‘বুঝেছি। ভীমসেনও ঠিক ওই কথাই বলেছিলেন।’

‘ভীমসেন কে?’

‘মধ্যম পাণ্ডব। দ্রোণাচার্যের চক্রব্যুহ ভেদ করতে পারেননি। শেষ-মেশ আমারই মত একটা বাচ্ছা ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন, তুই ঢোক ওর ভেতর।’

কাকিমা ভয় পেয়ে বলেন, ‘না বাপু, এ সবের মধ্যে হেবোর গিয়ে কাজ নেই। বড়ঠাকুরও বাড়িতে নেই—’

বাধা দিয়ে হেবো বলে, ‘ভয় নেই কাকিমা, অভিমন্যু-বধ পালা অভিনয় করছি না আমরা। বেরিয়ে আমি ঠিকই আসব।’

প্রবীরও আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘তাছাড়া আমি তো থাকবই পিছনে।’

হেবো হেসে বলে, ‘বটেই তো? ভীমসেনও অভিমন্যুকে ওইরকম একটা প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি বলছি, কাজটা টেক আপ্‌ করতে পারতুম, সামনে দুটিও আছে স্কুলের—ক্লাস কামাই হবে না ; কিন্তু আমি ওখানে যাব কোন অছিলায়?’

প্রবীরবাবু বলেন, ‘আমি সেটা আগেই ভেবে রেখেছি। নকুলবাবু আমাদের দলে। তিনি সুধাকান্তবাবুকে বলবেন, তুমি তার ভাইপো বা ভাগ্নে। গাঁয়ে থাকো, ক’দিনের জন্য শহর দেখতে এসেছ।’

হেবো বলে, ‘তাতে দুটি অসুবিধা। প্রথম কথা, নকুলবাবু সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। অথচ সুধাকান্তবাবু আজ পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁকে চেনেন। জেরার মুখে আমি ধরা পড়ে যেতে পারি। মনে করুন, নকুলচন্দ্রের এক ছেলে পাঁচ বছর আগে সাপের কামড়ে মারা গেছে। তাঁর ভাইপোর পক্ষে এত বড় খবরটা জানা থাকা উচিত। সেই প্রসঙ্গ উঠলে আমি কি বলব? দ্বিতীয়ত, নকুলবাবুর বাড়িও কৃষ্ণনগরে। তাঁর ভাইপো বা ভাগ্নে গ্রাম শহর দেখতে এলে তাঁর বাড়িতেই উঠবে। সুধাকান্তের স্কন্ধে তাকে নকুলচন্দ্র চাপাতে চাইবেনই বা কেন, আর তাঁর ভাইপোই বা ভাইবোনদের ছেড়ে ওই নির্বান্ধব পুরীতে থাকতে চাইবে কেন?’

কাকা বলেন, ‘এ কথা ঠিক।’

হেবো বলে, ‘তার চেয়ে আমার মাথায় আর-একটা ফন্দি এসেছে। আচ্ছা, নকুলবাবুর বাড়িতে কে কে আছেন?’

কাকিমা বললেন, ‘ঠিক জানি না। তবে ওঁর অনেকগুলো ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি আছে শুনেছি।’ হেবো বলে, ‘ব্যস্‌ ব্যস্‌, মা ষষ্ঠী রক্ষা করেছেন। বসুন, আসছি আমি—উপায় বার করেছি।’

বলেই বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। একটু পরে ফিরে আসে একখণ্ড টেস্ট পেপার নিয়ে। পাতা উল্টে কি দেখে নিয়ে বলে, ‘নকুলবাবু বলুন, আমার বাবা তাঁর পরিচিত একজন মক্কেল। মামলা-সূত্রে আলাপ। আমি হাঁসখালি উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলের একটি ছাত্র। এবার হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা দেব। আমার সীট পড়েছে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে। পরীক্ষা দিতে শহরে এসেছি। যেহেতু নকুলবাবুর বাড়িতে মা ষষ্ঠীর কৃপায় সারাদিন চ্যাঁ-ভ্যাঁ লেগে আছে, তাই তিনি আমাকে কয়েকদিনের জন্য সুধাকান্তবাবুর বাড়িতে এনে রাখছেন। দ্বিতলের অব্যবহৃত ঘরটায় থেকে আমি পড়াশুনা করব ও পরীক্ষা দেব। ব্যাপারটা বুঝেছেন? আমি তাহলে দোতলাতেই থাকব। সকাল বেলা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাব, তারপর লুকিয়ে থাকব বাড়িতেই। যেহেতু আমি পরীক্ষার্থী তাই কেউ সন্দেহ করবে না যে, পরীক্ষা না দিয়ে আমি বাড়িতেই লুকিয়ে আছি।’

যে কথা সেই কাজ। পরদিন সকালের লালগোলাঘাট প্যাসেঞ্জারে নকুল ও প্রবীরচন্দ্রের সঙ্গে হেবো রওনা দিল কৃষ্ণনগর। হেবোর বাবা-মা ক’দিনের জন্য মধুপুরে গেছেন ঈস্টারের ছুটিতে। হেবোরও স্কুল ছুটি ; ঈস্টার, মহরম আর হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার জন্য লম্বা ছুটি।

নকুলচন্দ্র হেবোকে নিয়ে এলেন সুধাকান্তের বাড়িতে। ঠিক হল প্রবীরচন্দ্র কাছে-পিঠেই কোন একটা বোর্ডিং হাউসে থাকবেন। রোজ সন্ধ্যাবেলা হেবো গিয়ে তাঁকে দৈনন্দিন রিপোর্ট দেবে। সুধাকান্ত নকুলবাবুর পরিচিত এই ছেলেটিকে ক’দিনের জন্য তাঁর বাড়িতে রাখতে রাজী হলেন। ব্যূহ প্রবেশে কোন বেগ পেতে হল না। হেবোর আসল পরিচয়টা নকুলচন্দ্র শুধু জানিয়ে গেলেন মঞ্জুলা দেবীকে।

সুধাকান্তবাবু হেবোকে ডেকে কোন প্রশ্নই করলেন না। এসব দিকে যেন তাঁর খেয়ালই নেই। হেবো লক্ষ্য করে দেখে, তাঁর ঘরের সামনে সর্বক্ষণ একটা টিকিওয়ালা লোক বসে পাহারা দেয়। শুনল, লোকটা গুরুদেবের এক চ্যালা-নাম কেবলানন্দ।

ঘরটার তালা খুলে যে ওকে পৌঁছে দিয়ে গেল সে বাড়ির ঠাকুর। হেবো তার স্বভাবসুলভ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সমস্ত পরিস্থিতিটা বিচার করে দেখে নেয়। দ্বিতলের সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা চওড়া বারান্দা, ডান দিকে অর্থাৎ পূর্ব দিকে দুখানি ঘর। আর সিঁড়ির বাঁয়ে পশ্চিম দিকে আর একখানা কামরা। পূর্ব দিকের প্রথম ঘরখানা এতদিন তালাবন্ধ পড়ে ছিল। পাশের ঘরখানিতে আছেন অসুস্থ গৃহকর্তা। সিঁড়ির ওপাশের পশ্চিমের ঘরখানায় গুরুদেব তাঁর সেই ছেলেটিকে নিয়ে থানা গেড়েছেন। অর্থাৎ ওই পশ্চিমদিকের ঘরখানাই হচ্ছে শত্রুপক্ষের শিবির।

হেবো খুশি হয় মনে মনে। এতে তার সুবিধাই হয়েছে। ঠিক পাশের ঘরেই আছেন সুধাকান্ত। দুটি ঘরের মাঝখানে আছে একটি দরজা, ওপাশ থেকে বন্ধ। দরজার গায়ে বিলাতি বাড়ির কায়দায় গা-তালা লাগানো। গা-তালায় চাবির যে ফুটো আছে তাতে চোখ লাগালে ও-পাশের ঘরের খানিকটা নজরে আসে—খাটের একটু অংশ। লোহার সিন্দুকটা অবশ্য দেখা যায় না। সেটা ঘরের অন্য প্রান্তে। হেবো মনে মনে স্থির করল, প্রথমেই তাকে একখণ্ড সাদা কাচ যোগাড় করতে হবে। ওই ছিদ্রপথে তাকে বারে বারে চোখ লাগাতে হবে ; আর গুরুদেবটি যে রকম ঝান্টু লোক, তাক বুঝে কাঠির খোঁচা মেরে হেবোকে কানা করে দিতে পারেন। একতলার যে ঘরটায় মঞ্জুলা দেবী থাকেন সেটাও দেখল। সেটাও অব্যবহৃত হয়ে পড়েছিল দীর্ঘদিন। দেওয়ালের পলেস্তারা খসে খসে পড়েছে।

ঠাকুর, দরোয়ান, ঝি সকলেই গুরুদেবটিকেও ভাল করে লক্ষ্য করল। কাপালিক বা তান্ত্রিকদের মত দেখতে নয় মোটেই। প্রকাণ্ড তাঁর বপুখানি, মেদের মৈনাক! মাথায় কাঁচা-পাকা বাবরি চুল। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। পেল্লায় একটি ভুঁড়ি, কপালে সব সময়েই একটা লাল সিঁদুরের টিপ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। মেদবহুল ওই চেহারার মধ্যে দেখবার মত বস্তু হচ্ছে তাঁর চোখ দুটো। প্রায় সব সময়েই ফুলো-ফুলো, গালের চর্বির তলায় ঢাকা থাকে, কিন্তু সময়-বিশেষে যেন জ্বলে ওঠে।

প্রথম দর্শনেই হেবোর উপর যেন তাঁর স্নেহের সমুদ্র উথলে উঠল। হেবো ছদ্ম-ভক্তিভরে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল বলেই বোধহয়। গুরুদেব বললেন, ‘কল্যাণ হোক! তোমার নামটি কী বাবা?’

‘আজ্ঞে ভাল নাম বটুকনাথ বটব্যাল, ডাক নাম বটু।’

‘ভাল, ভাল। তা বাবা বটু, তুমি বুঝি হাঁসখালি ইস্কুলের ছাত্র? সায়েন্স, না হিউম্যানিটিজ?’

‘আজ্ঞে সায়েন্স।’

‘খুব ভাল। এটা তো সায়েন্সেরই যুগ! আচ্ছা, এস তুমি। মন দিয়ে পড়াশুনা কর।’

গুরুদেবের চেলা কেবলানন্দ একটু হাবাগোবা ধরণের; কিন্তু বুদ্ধিতে কম হলে কী হবে, লোকটার গায়ে অসুরের শক্তি, আর বুলডগের মত একরোখা।

নিজের ঘরে এসে হেবো তার বইপত্র খুব আড়ম্বর করে সাজিয়ে রাখল টেবিলের ওপর, আর পিছনের একটা কুলুঙ্গিতে লুকিয়ে রাখল তার গোয়েন্দাগিরির সরঞ্জাম-নোটবই, ডায়েরি, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, মাপবার ফিতে।

প্রথম দিনটা গেল পরিস্থিতিটা ঠিকমত আঁচ করে নিতে। যতদূর জানা গেছে সুধাকান্ত তাঁর পুরাতন উইলটি লোহার সিন্দুক থেকে বার করেছেন, সেই উইল-মতে নির্মলেন্দুবাবুরই সমস্ত সম্পত্তি পাওয়ার কথা। যেহেতু নির্মলেন্দু গত হয়েছেন, সুতরাং আইনমত নির্মলেন্দুর স্ত্রী মঞ্জুলা দেবী ও নাবালক পুত্র এখন সেই সম্পত্তির অধিকারী। কিন্তু ভাবগতিক দেখে অনুমান করা যেতে পারে, সুধাকান্ত উইলটি বার করে রেখেছেন সেটা পালটাবার জন্য। আগের উইলটি যদি তিনি নষ্ট করেন তাহলেও ভাবনার কিছু নেই, কারণ আইন বলছে যে, উইল না করে তিনি যদি মারা যান, তাহলেও মঞ্জুলা আর তাঁর সন্তান সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন না। কিন্তু দুর্ভাবনার শেষ তো সেখানেই নয়—সুধাকান্ত আবার যে নূতন উইল করতে চান। তিনি না চাইলেও গুরুদেবটি তাঁকে দিয়ে তাই করাতে চান। যে-কোন কারণেই হোক সুধাকান্ত এখন সম্পূর্ণভাবে ওই গুরুদেবটির করতলগত। কাঁচপোকা যেমন তেলাপোকাকে টেনে নিয়ে যায়, গুরুদেবও তেমনি অনিবার্যভাবে হিড়-হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন সুধাকান্তকে। সুধাকান্তের যেন ব্যক্তিগত বিচার-বিবেচনা, শুভবুদ্ধি বলে কিছু নেই, তিনি যেন কলের পুতুল। ফলে দু-চার দিনের মধ্যেই, অর্থাৎ সুধাকান্তের সই করার ক্ষমতা লুপ্ত হবার আগেই ওই গুরুদেবটি তাঁকে দিয়ে উইলটি পালটিয়ে নিতে চান। আচ্ছা, ইতিমধ্যেই সে দুষ্কর্মটি হয়ে যায়নি তো? হেবো অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত সমাধানে এসেছে-না। কারণ মঞ্জুলা দেবীর কাছ থেকে জানা গেছে, ইতিমধ্যে এক ডাক্তারবাবু ছাড়া বাইরের লোক কেউ আসেনি এ বাড়িতে। উইল পালটাতে হলে সাক্ষী চাই। গুরুদেব সাক্ষী হলে চলবে না। কেবলানন্দ সাক্ষী হলে সেটা খুব জোরদার হবে না। ডাক্তারবাবু যখন আসেন তখন ঠাকুর ব্যাগ হাতে ঘরে থাকে। ফলে উইলটা এখনও পালটানো হয়নি। সাক্ষীর অভাবই তার প্রমাণ।

খাওয়া-দাওয়া সেরে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ার উপক্রম করছে, হঠাৎ মনে হল কে যেন তার দরজায় টোকা দিচ্ছে। টপ্‌ করে খাট থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে হেবো। কে ডাকছে তাকে? সন্তর্পণে দরজা খুলে দেখে অন্ধকারে ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে কেবলানন্দ।

‘বাবা আপনাকে ডাকছেন।’

‘উনি এখনও ঘুমোননি?’

‘না, এখনও তাঁর সেবা হয়নি।’

সেবা হয়নি? কার সেবা হয়নি? হেবো কোন কথা বলে না। ওর পিছনে-পিছনে চলে আসে শত্রুশিবিরে—গুরুদেবের ঘরে। এতক্ষণে মালুম হয় ‘সেবা’ জিনিসটা কী। গুরুদেব নৈশ আহারে বসেছেন। কার্পেটের একটা বড় আসন বেমালুম হারিয়ে গেছে তাঁর বিশাল বপুর অন্তরালে। তাঁর সামনে একটা বড় পাথরের থালায় স্তুপাকার করা গব্য ঘিয়ে ভাজা লুচি। পাশে ম্যাগ্‌নাম-সাইজ একটা জামবাটিতে মাংস—থুড়ি! মহাপ্রসাদ। রূপার একটি মাঝারি বাটিতে দেড়পো আন্দাজ ঘন ক্ষীর, আর রেকাবিতে খান-আষ্টেক সরপুরিয়া। আরও তিনচারটে বাটিতে নানান ব্যঞ্জন। এই হচ্ছে বাবাজীর নৈশ ‘সেবা’!

হেবো এবার আর ছদ্মভক্তিভরে নয়, সত্যিই ভক্তিভরে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল।পঞ্চাশ বছর বয়সে যিনি এই পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী উদরস্থ করবার সাহস রাখেন, তিনি নমস্য বইকি!

গুরুদেব ওকে সামনের আসনে বসতে বললেন। বলার প্রয়োজন ছিল না। ওঁর সেবার রকম-সকম থেকে এমনিতেই সে ধপ্‌ করে বসে পড়েছিল।

মধুর হেসে গুরুদেব বলেন, ‘আহারাদি হয়েছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

গুরুদেব হেবোর হাতে একটি নির্মাল্য দিয়ে বলেন, ‘এই জবাফুলটি সব সময় কাছে কাছে রাখবে। ভয় নেই, ভালভাবেই পাশ করে যাবে তুমি। আর হ্যাঁ, রাত্রে শয়নের পূর্বে এক গ্লাস করে কমলালেবুর সরবত খাবে। রাত জেগে অধ্যয়ন করতে হচ্ছে তো! ওতে পিত্ত প্রকুপিত হতে পারে না।’

হেবো অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। চৈত্র মাসে কমলালেবু কোথায় পাবে প্রশ্ন করতেও ভুলে যায়। গুরুদেব বলেন, ‘বাবা কেবল, ওকে এক গ্লাস সরবত দাও।’

কেবলানন্দ বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে যায়। কুঁজো থেকে ঢেলে একগ্লাস ঠাণ্ডা জল কাঁচের গ্লাসে করে হেবোর সামনে রাখে। ব্যাপারটা হেবো বুঝতে পারে না। ওর সে অবাক চাহনি দেখে গুরুদেব হো হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, ‘ওহো তাই তো’, ওটা তো সাদা জল! দাও গ্লাসটা আমাকে।’

গুরুদেব নিজেই গ্লাসটা টেনে নেন। একটা গামছা দিয়ে সেটাকে ঢেকে দেন। তারপর সেই গামছার ভিতর ডান হাতটা ঢুকিয়ে জলটা স্পর্শ করেন। যেন কিছুই হয়নি। এইভাবে এবার গামছাটা সরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘নাও, এবার খাও!’

স্তম্ভিত হয়ে যায় হেবো। ওর সামনে একগ্লাস কমলা রঙের সরবত! কথা ফোটে না ওর মুখে। দু-এক মিনিট কেটে যাবার পর সম্বিৎ ফিরে পায় একটা অট্টহাসি শুনে। শুনতে পায় গুরুদেব বলছেন, ‘ওরে ও কেবল, আর-একটা খালি গ্লাস দে বাবা। বেচারি ভয় পাচ্ছে। গাঁয়ের ছেলে তো! হাঁসখালি গাঁ ছেড়ে বাইরে আসেনি কখনও বোধহয়।’

যন্ত্রচালিতের মত কেবলচন্দ্র আর একটা খালি গ্লাস এগিয়ে দেয়। কিছুটা সরবত সে-গ্লাসে ঢেলে নিয়ে গুরুদেব অম্লান বদনে সেটা নিশ্বাসে পান করেন। বলেন, ‘খেয়ে নাও বাবা বটুক। ওতে বিষ মাখানো নেই।’

বিনা বাক্যবয়ে হেবো সরবতটা খেয়ে ফেলে। চমৎকার কমলালেবুর সরবত!

ইষ্টদেবকে নিবেদন করে গুরুদেব এবার সেবায় মনোনিবেশ করেন। কাঠের পুতুলের মত বসে থাকে হেবো। বোঝে, কঠিন বিচ্ছুর পাল্লায় পড়েছে সে এবার। মন্ত্রশক্তিতে সে এতদিন বিশ্বাস করত না। অনেক সাধু-সন্ন্যাসী এসব বিভূতির খেলা দেখাতে পারেন শুনেছিল আগে, কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। এখনও বুঝে উঠতে পারছে না, এইমাত্র যা দেখল তা সত্যই অলৌকিক ক্ষমতা না সস্তা মাদারির খেল্‌—ম্যাজিক। কিন্তু গুরুদেব তাকে চিন্তা করবার অবকাশ না দিয়েই বলে ওঠেন, ‘তোমার তো সায়েন্স, নয়?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তা বলে বাঙলা ইংরাজি দুটোকে যেন উপেক্ষা করো না ; জান তো ওই দুটোতেই সায়েন্সের ছেলেরা বেশি ফেল করে। বাঙলায় কেমন নম্বর পেয়েছিলে টেস্ট পরীক্ষায়?’

হেবো অম্লান বদনে বলল, ‘বাষট্টি।’

লুচি দিয়ে মহাপ্রসাদের ছটাকখানেক ওজনের একটি কণিকা জড়িয়ে মুখগহ্বরে নিক্ষেপ করে গুরুদেব বলেন, ‘এসে কী লিখেছিলে?’

‘এসে?’

‘হ্যাঁ গো, এসে—মানে প্রবন্ধ। বাঙলা সেকেণ্ড পেপারে প্রবন্ধ থাকে না তোমাদের?’

গুরুদেব কি টিউশানি করেন নাকি? মায় সেকেণ্ড পেপার পর্যন্ত জানা আছে তাঁর? সামলে নিয়ে বলে, ‘ও এসে! আমাদের ‘এসে’ ছিল, “তোমার প্রিয় লেখক”।

দাঁতের ফাঁক থেকে মহাপ্রসাদের একটা কুচি বার করবার চেষ্টা করতে করতে গুরুদেব বলেন, ‘অ। তা কী লিখেছিলে তুমি? কে তোমার প্রিয় লেখক?’

‘আজ্ঞে রবীন্দ্রনাথের কথা লিখেছিলাম।’

‘আশ্চর্য!’

আশ্চর্য হয় হেবোই। এতে আশ্চর্যের কি আছে রে বাবা? বলেও সে কথা, ‘কেন, আশ্চর্য মনে হচ্ছে কেন?’

‘আমাকে যদি কেউ ও প্রশ্ন দিত, আর আমি যদি তোমার বয়সী ছেলে হতাম, তাহলে আমি লিখতাম, কনান ডয়েল!’

কণ্ঠনালী পর্যন্ত শুকিয়ে ওঠে হেবোর। লোকটা ‘থট রীডিং’ জানে না-কি? মানে হেবোর মনের কথাও ও লোকটা বুঝতে পারছে নাকি? না হলে হঠাৎ কনান ডয়েলের নাম আসে কোথা থেকে? একটা উল্টো চাল চালতে হেবো বলে, ‘কনান ডয়েল কে? কোন সাহেব?’

মহাপ্রসাদের একটি টেংরি চুষতে চুষতে গুরুদেব বলেন, ‘স্যার আর্থার কনান ডয়েল হচ্ছেন শার্লক হোম্‌সের সৃষ্টিকর্তা।’

হেবো এবার স্পিক্‌-টি-নট্‌! কেঁচো খুঁড়তে আবার কোন্‌ সাপ বেরুবে কি জানি! দু-চার মিনিট কোন কথা নেই। হেবো বসে বসে ঘামছে। গুরুদেব নিমীলিত নেত্রে হাড় চুষছেন। হঠাৎ আবার তিনি হাসি-হাসি মুখে বলেন, ‘কই, তুমি তো বললে না শার্লক হোম্‌স্‌ কে? তিনি কোন সাহেব নাকি?’

হেবো এবারও কোন সাড়াশব্দ করে না।

হঠাৎ চোখদুটি খুলে গুরুদেব বলেন, ‘ওহো, তোমার একখানা বই নিয়ে এসেছিলাম। দেখা হয়ে। গেছে। ওটা নিয়ে যাও তুমি।—কেবল বাবা—’

আর কিছু বলতে হল না। কেবলানন্দ গুরুদেবের ঝোলা ঝেড়ে একখণ্ড টেস্ট পেপার এনে হেবোর হাতে দেয়। আবার চোখ বুজে লুচি-মাংসের সেবা করতে করতে গুরুদেব বলেন, ‘বাবা বটু, ওই গ্রন্থের পাঁচশো একত্রিশ পৃষ্ঠাটা খোল তো একবার।’

হেবো দুরু-দুরু বক্ষে নির্দেশমত পৃষ্ঠাটা খোল। গুরুদেব নিমীলিতচক্ষু অবস্থাতেই বলেন, ‘ওটা হাঁসখালি স্কুলের বাঙলার সেকেণ্ড পেপার। তাই নয়?’

হেবো জবাব দেয় না।

‘ছয় নম্বর প্রশ্নটা এবার দেখ। মনে কর তুমি এবার হাঁসখালি স্কুলে টেস্ট পরীক্ষা দিচ্ছ। তোমার সামনে তিনটি অলটারনেটিভ ‘এসে’ আছে—বাংলার বর্ষাকাল, সংবাদপত্র আর ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা। কোন্‌টা লিখবে তুমি?’

খাচ্ছেন গুরুদেব, অথচ গলাটা বুজে গেছে হেবোর। কী বলবে ভেবে পায় না। আবার দু-চার মিনিট আহারপর্ব চালিয়ে ক্ষীরের বাটিটা টেনে নেন গুরুদেব। হঠাৎ যেন খেয়াল হয়েছে সেইভাবে বলে ওঠেন, ‘ওহো! কী ভুলো মন দেখ আমার! তোমাকে বলছি—মনে কর তুমি হাঁসখালি স্কুলের ছাত্র! মনে করার কী আছে, তুমি তো সত্যিই তাই। নয়?’

হেবো ভাবছিল একগ্লাস জল পেলে খেত।

‘আচ্ছা থাক। এবার ঘরে যাও তুমি। সামনে পরীক্ষা, রাত জাগা ঠিক নয়।’

হেবো এবার আর প্রণাম করে না। মাথাটা নিচু করে টেস্ট পেপারখানা বগলদাবা করে রওনা দেয়। দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়েছে, পিছন থেকে গুরুদেব ডাকেন, ‘বাবা হেবো!’

‘আজ্ঞে?’—ঘুরে দাঁড়ায় হেবো।

এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে, প্রচণ্ড ভুল করে বসেছে সে। কিন্তু উপায় নেই, ডাকে সাড়া দিয়ে ফেলেছে যখন তখন আর কী করা যায়! তবু যতদূর সম্ভব ম্যানেজ করে নেবার চেষ্টায় বলে, ‘আমাকে হেবো বলে ডাকলেন যে? আমার নাম বটু।’

‘ওহো! তাই তো! আমার ভারি ভুলো মন। হেবো তো তোমার নাম নয়, শার্লক হোম্‌সের কথা ভাবতে ভাবতে আমি হেবোর কথা ভেবে ফেলেছি! তুমি তো বটুক,—হেবো হবে কেন? তুমি তো হাঁসখালি স্কুলের পাতিহাঁসের মতো লক্ষ্মী ছেলে—আর হেবোটা হচ্ছে একটা হাড়-বজ্জাত বোম্বেটে শয়তান!’

কান দুটো লাল হয়ে ওঠে হেবোর। উপায় নেই। এ অপমান তাকে সহ্য করে যেতে হবে। আজ সে হেবো নয়, সে বটুকনাথ বটব্যাল। মনে মনে ভাবে, শিশুপালের শত গালাগাল সহ্য করতে হয়েছিল স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকে। সেও করবে। তারপর শিশুপাল-বধের সময় হবে এর কড়ায় গণ্ডায় শোধ। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘আর কিছু বলবেন?’

‘হ্যাঁ বাবা ব্যাটবল, বলব। তুমি প্রবীরকে চেন? প্রবীর মুখুজ্জে?’

ধরা যখন পড়ে গেছে তখন আর তাস লুকিয়ে লাভ নেই। সম্মুখ রণক্ষেত্রেই শিশুপাল-বধ করতে হবে তাকে। আর আত্মগোপন নিরর্থক। বললে, ‘হ্যাঁ চিনি। কিন্তু কেন বলুন তো?’

‘পবুকে বোলো, মহাভারতের অভিমন্যু-বধ অধ্যায়টা পড়তে। বোলো আমি বলেছি—মহারথীতে মহারথীতে যেখানে যুদ্ধ হয়, সেখানে অভিমন্যুর মতো চ্যাংড়াকে বলি দিতে পাঠাতে নেই। বড় করুণ ওই অভিমন্যুর চ্যাপ্‌টা হয়ে যাবার চ্যাপ্‌টারটা নয়?’

আর সহ্য করতে পারে না হেবো। সে তো আর শ্রীকৃষ্ণ নয়! ভীমসেনও পারেনি কীচককে ক্ষমা করতে। ছদ্মবেশ ত্যাগ করে বধ করে ফেলেছিল কীচককে! বললে, ‘আপনার বাবা বেঁচে আছেন?’

সরপুরিয়া চিবানো বন্ধ হয়ে যায় গুরুদেবের, চোখদুটো ধ্বক করে জ্বলে ওঠে। বলেন, ‘আছেন, কিন্তু কেন হে ছোকরা? সে খোঁজে তোমার কী প্রয়োজন?’

‘না, তাই বলছিলাম। তাঁর জন্যেই দুঃখ হচ্ছে আমার।’

চর্বণ-কার্য বন্ধ হয়ে গেছে গুরুদেবের।

হেবো দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘দেখুন আপনি বিচার করে। রথী মহারথীর মধ্যে লড়াই হচ্ছিল—অভিমন্যু বয়সে ছোট, তবু ক্ষত্রিয় যোদ্ধা সে। লড়াইয়ে সেও প্রাণ দিল, তাতে দুঃখ নেই। মরল বেটা জয়দ্রথও। তারও রেহাই পাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ও চ্যাপ্‌টারের সবচেয়ে করুণ অধ্যায় কী জানেন? খামোখা ওই পাষণ্ড জয়দ্রথের বাপ বেচারির মুণ্ডু গেল উড়ে।’

বলেই অ্যাবাউট টার্ন!

এবং তৎক্ষণাৎ ফরোয়ার্ড মার্চ!

যতটা কঠিন মনে হয়েছিল সমস্যাটা তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি কঠিন। কঠিন এবং জটিল। গুরুদেব লোকটি পাক্কা খলিফা! খলিফার চেয়েও বড়, একটি ধড়িবাজ ঘড়িয়াল! হেবোর নাড়ীনক্ষত্র বেটা জেনে ফেলেছে। হয়তো প্রবীরকাকুর পেছনে ওর গুপ্তচর ঘুরছে। হয়তো লোকটা একটা পাক্কা আঁধারের কারবারী। এত দুঃখেও একটু গর্ববোধ না করে পারল না হেবো। তাহলে অন্ধকার মহলের কারবারীরাও শার্লক হেবোকে চিনতে শুরু করেছে!

পরদিন সকালে হেবো লক্ষ্য করল একটা সিল্কের চাদর কাঁধের ওপর ফেলে নাটের গুরু তাঁর ঝোলা ও লাঠি নিয়ে কোথায় চলছেন হুড়মুড়িয়ে। তৎক্ষণাৎ চটিটা পায়ে গলিয়ে হেবোও নেমে আসে উপর থেকে। গুরুদেব গেট খুলে বাইরে এসে একটা রিকশা ভাড়া করে কোথায় যেন রওনা হয়ে পড়লেন। হেবো স্থির করল, ওঁকে অনুসরণ করতে হবে। কোথায় যাচ্ছে লোকটা? উদ্দেশ্য কী? দ্বিতীয় একটা রিক্‌শাকে ইঙ্গিত করামাত্র দাড়িওয়ালা একজন রিক্‌শাওয়ালা এগিয়ে এল।

‘কোথায় যাবেন বাবু?’

রিক্‌শায় উঠে বসে হেবো বললে, ‘ওই রিক্‌শাটার পিছু-পিছু চল।’

রিক্‌শাওলা ওকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ রওনা দেয়। আগের রিক্‌শাখানা প্রায় পঞ্চাশ ফুট সামনে চলেছে। গুরুদেব ওকে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেননি। কোথায় চলেছেন উনি? গলি পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়েই সোজা উত্তরমুখো বাঁক নিল। হেবোর রিক্‌শাখানা কিন্তু বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ।

হেবো ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘একি? দাঁড়িয়ে পড়লো কেন?’

মুখটা না ফিরিয়েই রিক্‌শাওয়ালা বলে, ‘এখানে নেমে ফিরে যাও। আমিই ফলো করছি ওকে।’

হেবো অবাক। কী আশ্চর্য! ওই একমুখ দাড়িওয়ালা রিক্‌শাচালককে সে পর্যন্ত চিনতে পারেনি। হেবো নেমে পড়ে সেখানেই। উত্তরমুখো ঘুরে প্রবীরচন্দ্রের রিক্‌শাখানা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায় দৃষ্টির আড়ালে।

সন্ধ্যাবেলায় যথারীতি হোবো হাজিরা দিল প্রবীরচন্দ্রের বোর্ডিং-এ। শুনল গুরুদেব সকালবেলা গিয়েছিলেন পোস্ট অফিসে। একখানি টেলিগ্রাফ করেছেন তিনি। প্রবীরচন্দ্র অনেক কায়দা করে জেনে এসেছেন, সেখানি গেছে কলকাতার একটি সলিসিটর ফার্মের নামে। মিস্টার জি. এন. দে অ্যাডভোকেটকে গুরুদেব আগামী শুক্রবার আসতে অনুরোধ করেছেন।

প্রবীরচন্দ্র বলেন, ‘বুধবার অর্থাৎ পরশুদিনের মধ্যেই আমাদের যা হয় করতে হবে। দে-সাহেব হচ্ছে ওঁর আশ্রমের অ্যাটর্নি। উইলে সাক্ষী থাকতে আসছেন তিনি।’

হেবো বলে, ‘কলকাতায় গিয়ে যদি দে-সাহেবকে সব কথা খুলে বলা যায়?’

‘তাহলেও লাভ নেই। তিনি ওঁর অ্যাটর্নি—ওঁরই স্বার্থ দেখবেন। তাছাড়া কাজটা বেআইনি তো হচ্ছে না কিছু। সুধাকান্তবাবুর স্বাধীন ইচ্ছায় তুমি আমি বাধা দেবার কে?’

সারারাত ঘুম হল না বেচারির। হেরে যাবে সে? অমন একটা ধড়িবাজ বদমায়েসের খপ্পর থেকে একটি বিধবা আর তাঁর নাবালক ছেলেকে রক্ষা করতে পারবে না? লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত, সম্ভবত মন্ত্র-তন্ত্রও জানে। সুধাকান্তকে হয়তো সে সম্মোহিত করে ফেলেছে। একটা রক্তচোষা বাদুড় যেমন দৃঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে শিকারকে শেষ করে দেয়, এই পরিবারটিকে গুরুদেব তেমনি সস্নেহে আলিঙ্গনবদ্ধ করেছেন। শেষ বিন্দু রক্তটি নিঃশেষ হবার আগে তিনি নড়ছেন না।

সারারাত ছটফট করতে করতে ভোর রাত্রের দিকে একটা সূক্ষ্ম চিন্তার ক্ষীণ আভাস এল ওর মাথায়। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল ওর। গত বছর দোলের দিনের কথা। চট করে উঠে বসে হেবো। আলোটা জ্বালে। দোল কী মাসে হয়? ফাল্গুন ; অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল। নোটবইটা খোলে—হ্যাঁ, নোটবইতে টোকা আছে ঘটনাটা। এইতো একটা নূতন সম্ভাবনার সূত্র পাওয়া গেছে! গেছে কি? খুব কঠিন কাজ। ভাগ্যের উপর অনেকটা নির্ভর করতে হবে। কিন্তু ভাগ্য তো তাদেরই সহায়তা করে যারা পুরুষকারকে কাজে লাগায়।

অন্ধকার ঘরে পায়চারি করতে করতে চিন্তা করতে থাকে। ধাপে ধাপে ধীরে ধীরে কার্যক্রমের সোপানগুলি সাজিয়ে নেয় মনে মনে প্রথম কাজ কী? কি কি বাধাবিঘ্ন দেখা দিতে পারে? কি কি তার সমাধান? তারপর দ্বিতীয় পদক্ষেপ। কোন কোন্‌ বিপত্তি আসতে পারে?

হঠাৎ জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। সকাল হয়ে এসেছে। ভোরবেলা একটা লোকাল ট্রেন আছে-কলকাতা যাওয়ার। ওই ট্রেনেই যেতে হবে তাকে। প্রবীরচন্দ্রকে খবর দেওয়ার সময় নেই, প্রয়োজনই নেই। তারও আর পাহারা দেওয়ার কোন দরকার নেই। শুক্রবারের আগে যখন উইল লেখা হবে না তখন এখানে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে কী হবে?

ভোরের ট্রেনেই হেবো ফিরে এল কলকাতায়। এল ওদের বাড়িতে। বাবা মা এখনও ফিরে আসেননি, বাঁচা গেল। কাকাও বাড়ি নেই—কোথায় যেন বেরিয়েছেন। কাকিমা ওকে দেখে বললেন, ‘কী হল রে হেবো, খবর কী?’

‘শিগ্‌গির আমাকে কিছু টাকা দাও দেখি!’

‘টাকা? কত টাকা? কী করবি?’

‘তুমি কী ভেবেছিলে এ কাজ একেবারে ফোকট্‌সে হয়ে যাবে?’

‘কত টাকা লাগবে বল্‌!’

‘আপাতত গোটা-পঞ্চাশ ছাড়ো।’

‘মঞ্জুলা কেমন আছে?’

‘ও সব খেজুরে আলাপ পরে হবে কাকিমা। তাড়াতাড়ি টাকাটা দাও! শিশুপাল-বধ যজ্ঞে আহুতি দিতে হবে।’

‘শিশুপাল-বধ যজ্ঞ! কী সব বলছিস তুই!’

‘আচ্ছা না হয় কীচক-বধ পালাই হল। দাও টাকাটা।’

‘তোর একটা কথাও বুঝি না বাপু। আসল কথা বল। তায়ইমশাইকে বোঝাতে পারলি?’

‘তায়ইমশাই মানে ঐ বুড়োটা তো? ওর ভীমরতি সারবার নয়! বাহাত্তুরে ধরেছে আর কি।’

‘তাহলে?

‘পারি না আর বকবক করতে!’

‘বেশ, নে বাপু!’

রাগ করেই টাকা ক’টা বার করে দেন কাকিমা। আর সেটা পকেটস্থ করেই বেরিয়ে যায় হেবো। চুনো-পুঁটি তো নয়, ঘাই-মারা রাঘববোয়াল সে ছিপে গেঁথে তুলতে চায়। সুতোর জোর থাকা চাই ; টোপটা শুধু লোভনীয় নয়, নিখুঁতও হওয়া চাই। একটু সন্দেহ হলেই রাঘববোয়াল টোপ ঠুকরে ফিরে যাবে—কপাৎ করে গিলবে না।

কৃষ্ণনগরে ফিরে আসে হেবো সেই রাত্রেই।

পরদিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ডাক্তারবাবু যখন সুধাকান্তকে দেখতে এলেন তখন গুরুদেব বাড়ি ছিলেন না। হেবো গুটি-গুটি ঢুকল ঐ ঘরে। সুধাকান্ত বেশ সুস্থই আছেন। উঠে বসেছেন তিনি। হেবো তাঁর বালিশটা ঠিক করে দেবার অছিলায় দেখে নিল, বালিশের নিচে লোহার সিন্দুকের চাবির থোকাটা আছে। আর আছে একটা খাম, মুখটা ছেঁড়া। দেখেই বুঝতে পারে, এর গর্ভেই ছিল আগেকার উইলটা। তার মানে, আগেকার উইলটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ডাক্তারবাবু বলেন, ‘ব্লাড প্রেশার দেখার যন্ত্রটা নিচে আমার গাড়িতে আছে। নিয়ে এস তো!’

হেবো শুনতে না পাওয়ার ভঙ্গি করে জানলার দিকে সরে যায়। জানলার পাশেই সুধাকান্তের লেখবার টেবিল। কিছু ফাইলপত্র, কাগজ-চাপা, বই, কলমদানিতে কলম, ব্লটার ইত্যাদি সাজানো। হেবো সরে যায় টেবিলের দিকে।

হেবো শুনতে পায়নি মনে করে কেবলানন্দই নিচে নেমে যায় রক্তচাপ মাপবার যন্ত্রটা আনতে। মিনিট আড়াই তিন লাগবে ওর ফিরে আসতে, এর মধ্যেই হেবোকে হাতসাফাই করতে হবে ; কিন্তু সুধাকান্ত জেগে বসে আছেন। ডাক্তারবাবুও এদিকে ফিরে বসে আছেন। তবু শেষ চেষ্টা করবে হেবো।

হ্যাঁ, তিন মিনিটের মধ্যেই কেবলানন্দ ফিরে এল বাক্সটা নিয়ে। পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবুর মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়।

সুধাকান্ত বলেন, ‘কি হে ডাক্তার, অত গোমড়া মুখ করলে কেন? সময় কি একেবারেই ফুরিয়ে এসেছে?’

‘না না, তা কেন? তবে প্রেশারটা হঠাৎ খুব বেড়ে গেছে। রাত্রে ঘুম হয়েছিল?’

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সুধাকান্ত বলেন, ‘আর চব্বিশ ঘণ্টা টিকব তো?’

‘সে কি কথা? অনেক দিন বাঁচবেন এখনও!’

‘বাজে কথা বলো না ডাক্তার। আমার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। সবই বুঝছি আমি। কিন্তু বিষয় সম্পত্তির একটা বিলি-ব্যবস্থা না করে যেতে পারলে মরেও আমি শান্তি পাব না। আগামীকাল আমি উইল করব স্থির করেছি। তাই বলছি, আজ রাত্রের মধ্যে কিছু হবে না তো?’

ডাক্তারবাবু বুঝতে পারেন এই প্রবীণ বিচক্ষণ ব্যক্তিটির কাছে গোপন করার কিছু নেই। বলেন, ‘না, সে-রকম কিছু ভয় করার নেই।’

‘তাহলেই হল। বেশ, কাল তাহলে এই সময় এসে আমার উইলে সাক্ষী হিসেবে একটা সই দিয়ে যেও। আমি যে সুস্থ মনে এ উইল করেছি তার একটা প্রমাণ থাকা দরকার। ডাক্তারের সইটা থাকা ভাল।’

যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিয়ে ডাক্তারবাবু বিদায় নেন।

হেবো ঠাকুর দেবতাকে বড় বেশি ডাকে না। পরীক্ষার ঠিক আগে তাঁদের মনে পড়ে বটে—কিন্তু বছরের আর বাকি ক’টা দিন তাঁদের কথা বিশেষ মনে থাকে না। আজকের দিনটা কিন্তু ব্যতিক্রম। ডাক্তারবাবু চলে যেতেই সে ছুটে চলে আসে তার ঘরে। দরজায় খিল দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মনে মনে বলে, ‘হে মা কালী! তুমিই বল, আমি কি কিছু অন্যায় করেছি? আমি নিত্য ডাকাডাকি করে তোমার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটাই না—আর ঐ গুরুদেব রোজ সকাল-সন্ধ্যা তোমাকে পাঁঠার মাংস খাওয়াতে চায়। কিন্তু তাই বলেই কি তুমি ও-দলে যোগ দেবে? যে টোপ পেতে এলাম, ওই রাঘববোয়াল যেন সেটা গিলে ফেলে—এটুকুই তুমি কোরো মা! বাকি খেলিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার। আর ওকে দিয়ে যদি টোপটা তুমি না গেলাও, তবে বলব তুমি মিথ্যে, তুমি মিথ্যে, তুমি মিথ্যে!’

শুক্রবার সকালে হেবোর ঘুম ভাঙল একটা চেঁচামেচিতে। কাল রাত্রে নাকি বাড়িতে চোর এসেছিল। কী আশ্চর্য! স্বয়ং শার্লক হেবো যে বাড়িতে উপস্থিত সে বাড়িতে চোর? অথচ হেবো রাত্রে কিছু টেরই পায়নি? পরীক্ষা করে দেখা গেল চোর একতলা থেকে কিছুই সরায়নি, দোতলার দুটি ঘর থেকেই মাল সরিয়েছে। হেববার স্যুটকেস নেই, গুরুদেবের ঝোলাটিও নেই। গুরুদেব দরোয়ানকে ডেকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন। সে হলপ করে বলল, বাইরে থেকে চোর আসেনি, কারণ সে জেগেই ছিল। কিন্তু বাইরের লোক ছাড়া আর কে চুরি করতে পারে? পুলিশে খবর দেওয়া হবে কি না স্থির করার আগেই ঠাকুর এসে খবর দিল, বাগানের ভিতর ভাঙা স্যুটকেস ও ঝোলা পাওয়া গেছে। আবার নূতন করে হিসাব নেওয়া গেল। না, বেশি কিছু খোয়া যায়নি। হেবোর গেছে একটি টেরিলিনের শার্ট আর গোটা-কুড়ি টাকা। গুরুদেবের ঝুলির সব কিছুই পাওয়া গেছে। দামী কিছুই ছিল না ওতে। দুটো জিনিস একটু দামী ছিল—দুটোই বেহাত হয়েছে। একটা রূপোর কোশাকুশি আর একটা শেফার্স কলম।

হেবো থানায় যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, কিন্তু গুরুদেব বাধা দিলেন। বললেন, ‘যা গেছে তা তো পাওয়া যাবেই না, উপরন্তু ঠাকুরটাকে ধরে নিয়ে যাবে ওরা। আজ কলকাতা থেকে বিশিষ্ট অতিথি আসছেন—ঠাকুর না থাকলে মহা মুশকিল।’

মঞ্জুলা দেবীও সায় দিলেন সে কথায়।

হেবো জনান্তিকে মঞ্জুলা দেবীকে বলে, ‘আসল কথা গুরুদেবের ভয় হয়েছে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুবে। পুলিশের খাতায় হয়তো তাঁর নাম আছে, হয়তো তাঁকেই হাজতে পুরবে পুলিশ!’

বেলা বাড়ল। বেলা দশটা নাগাদ এসে পৌঁছলেন অ্যাডভোকেট জি. দে। সসম্মানে তাঁকে উপরের ঘরে নিয়ে গেলেন গুরুদেব। চা-জলখাবারের পর্ব মিটলে বুলডগটাকে দরজার বাইরে বসিয়ে এঁরা অর্গলবদ্ধ ঘরে পরামর্শে বসলেন। হেবো নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল লাগাল। মাঝের দরজার চাবির ফুটোতে চোখ লাগিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। কান লাগিয়ে বরং দু-একটা কাটা কাটা কথা। শোনা যায়। অ্যাডভোকেট সাহেব বলছেন, ‘এবার ড্রাফ্‌ট্‌খানা নিখুঁত হয়েছে ; আমি ফেয়ার কপি করে ফেলি।’

সুধাকান্ত বাধা দিয়ে বলেন, ‘না, ফেয়ার কপিটা আমি নিজে হাতে লিখব। আজ বেশ সুস্থ আছি আমি।’

গুরুদেব বললেন, ‘কিন্তু তাতে কি কষ্ট হবে না তোমার?’

সুধাকান্তের হাসিটা চোখে না দেখতে পেলেও অনুভব করে হেবো। তিনি হেসে বলেন, ‘কষ্ট হলেও উপায় নেই। আইনের খুঁত আমি রাখব না। আদ্যোপান্ত হাতের লেখাটা আমার হলে আইনগত তার মর্যাদা বাড়বে, না কি বলেন দে-সাহেব?’

দে-সাহেবের জবাবটা শোনা গেল না ; কিন্তু সুধাকান্তের পরবর্তী বক্তব্যটা শোনা যায়, ‘দয়া করে আমার ওই কলমটা দেবেন। নিজের কলম ছাড়া লিখতে পারি না আমি।’

প্রায় মিনিট পনেরো পরে নিচে গেটের সামনে একটা মোটর গাড়ি এসে দাঁড়াল। কেবলানন্দ হন্তদন্ত হয়ে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। বন্ধ ঘরে টোকা দিয়ে বলল, ‘ডাক্তারবাবু এসেছেন।’

হেবোও বেরিয়ে এল ঘর থেকে। দেখে নকুলচন্দ্র আর ডাক্তারবাবু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে আসছেন। ওঁদের পিছনে পিছনে ঢুকে পড়ে রোগীর ঘরে। রোগী আজ বেশ প্রফুল্ল। বলেন, ‘ডাক্তার আমাকে আজ বেশ ভাল করে পরীক্ষা করে দেখ দিকি।’

‘কেন? হঠাৎ আজ ভাল করে পরীক্ষা করতে হবে কেন?’

‘আমি সুস্থ স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় আছি কি না, দেখে বল।’

‘ও! উইলটা করেছেন বুঝি?’

‘হ্যাঁ, একটা সইও দিতে হবে তোমাকে। নকুল, তুমিও দেবে।’

ডাক্তারবাবু রোগীকে পরীক্ষা করেন। তারপর কোন কথা না বলে উইলখানা টেনে নেন। সমস্তটা ধৈর্য ধরে পড়ে কাগজখানা ফিরিয়ে দেন সুধাকান্তবাবুকে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমাকে আপনি মাপ করবেন সুধাকান্তবাবু, আমি এ উইলে সাক্ষী থাকতে পারব না। এ অনুরোধ করবেন না আপনি।’

একটু রুক্ষ স্বরে সুধাকান্ত বলেন, ‘কেন? কারণ কী?’

‘আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়, আপনাকে শ্রদ্ধা করি আমি। তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ আপনি অত্যন্ত অন্যায় করছেন।’

রুক্ষতর স্বরে সুধাকান্ত বলেন, ‘কিন্তু সে বিচারের ভার তো তোমার ওপর নেই ডাক্তার! তুমি ভিজিট নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছ। আমি যে স্বাভাবিক অবস্থায় আছি তার সার্টিফিকেট আমি আইনত দাবি করতে পারি।’

‘না, পারেন না। কারণ আজকের ভিজিট আমি নেব না।’

বাক্স গুছিয়ে উঠে পড়ার উপক্রম করেন ডাক্তারবাবু।

হেবো মুহূর্তমাত্র কালবিলম্ব না করে ছুটে যায় নিচে। মঞ্জুলা দেবীকে খুঁজে বের করে তাঁর হাতদুটি চেপে ধরে, ‘সর্বনাশ হয়েছে কাকিমা, একটা কাজ করতেই হবে আপনাকে! যেমন করে হোক!’

‘কী হয়েছে? অমন করছ কেন তুমি?’

‘ডাক্তারবাবু উইলে সাক্ষী হতে অস্বীকার করেছে। যেমন করে পারেন তাঁকে রাজী করান!’

কেন, কি বৃত্তান্ত কিছুই প্রশ্ন করেন না মঞ্জুলা দেবী। বলেন, ‘বেশ, সেই ব্যবস্থাই করছি।’

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন ডাক্তারবাবু গট্‌-গট্‌ করে নেমে আসছেন দ্বিতল থেকে। মাথায় আঁচলটা তুলে দিয়ে এগিয়ে আসেন মঞ্জুলা দেবী। বলেন, ‘একটা কথা ছিল ডাক্তারবাবু।’

‘বল মা।’

‘আপনি আপত্তি করবেন না। উইলে আপনি সই দিয়ে আসুন।’

ভ্রূ-দুটি কুঁচকে ওঠে ডাক্তারবাবুর, বলেন, ‘কিন্তু কেন বল তো মা? উইল তুমি দেখেছ?’

মঞ্জুলা বলেন, ‘না, দেখিনি। তবে আন্দাজ করতে পারি। আমাদের বিষয় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই তো?’

‘হ্যাঁ, তাই। এতে আমাকে সই দিতে বলছ কেন?’

হেবো ভাবে, এইবার মঞ্জুলা দেবীর আর কোন জবাব নেই। বস্তুত তার মত উপস্থিত-বুদ্ধি-ওয়ালা ছেলের মাথাতেও কোনও ফন্দি বার হল না। কিন্তু হেবো জানত না যে, যারা নিছক সরল ও সহজ তারা অনেক বাধাবিঘ্ন এড়িয়ে যেতে পারে তাদের সারল্যের জন্যেই। যে জবাব হেবোর মুখে জোগায়নি, মঞ্জুলার মুখে তাই জোগাল, আর, সেটা কোন ফন্দি নয়। তাঁর আন্তরিক কৈফিয়তই।

মঞ্জুলা শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি সই না দিলে অন্য কোন ডাক্তারে তা দেবে। শহরে ডাক্তারের অভাব নেই। কিন্তু যতক্ষণ ওই উইল-পর্ব শেষ না হচ্ছে, ততক্ষণ ওঁরা আমাকে বাবার কাছেই যেতে দেবেন না। শেষ সময়ে ওঁর কোন সেবা-যত্নই হচ্ছে না। খোকার বাবা নিশ্চয়ই স্বর্গে থেকেও এজন্য শান্তি পাচ্ছেন না। সম্পত্তি আমি এমনিও পাব না, অমনিও নয়—অন্তত শ্বশুরের শেষ সময়ে সেবা করার অধিকারটুকু আপনি আমাকে দিয়ে যান ডাক্তারবাবু !’

অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ডাক্তারবাবু বলেন, ‘তোমার এ কথায় ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি মা! এমন মেয়েরও সর্বনাশ করেন তিনি? কিন্তু তোমার কথাই ঠিক। ও সম্পত্তি তুমি অমনিতেও পাবে না। নির্মলকে আমিও স্নেহ করতাম। তার আত্মাকে তৃপ্তি দাও তুমি। আমি সই দিয়ে আসছি। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন!’

সিঁড়ি বেয়ে আবার উপরে উঠে যান তিনি।

হেবো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। নকুলচন্দ্রও সই দিলেন, সেটা পরে জানতে পেরেছিল হেবো।

সব খবর শুনে সন্ধ্যাবেলায় মাথায় হাত দিয়ে বসলেন প্রবীরচন্দ্র।

হেবো বললে, ‘কিছু ঘাবড়াবেন না। ওই উইল নির্ঘাত চুরি যাবে। ফাঁদ পেতে এসেছি আমি।’

প্রবীরচন্দ্র ঠিক বিশ্বাস করে উঠেতে পারে না।

পরদিন। শনিবার সকাল। গত রাত্রের শেষ দিকে সুধাকান্তের আবার একটা আক্রমণ হয়েছে। যেন উইলটাতে সই করার জন্যেই তিনি মনের জোরে সুস্থ ছিলেন এতদিন। উইল সম্পাদন করার সঙ্গে সঙ্গেই এসেছে মানসিক অবসাদ, অমনি শয্যা নিলেন তিনি। শেষরাত্রে আক্রমণটা হয়েছে, অথচ বাড়ির কেউ জানতে পারেনি। পারবে কোথা থেকে! ওঁর ঘরে থাকে কেবলানন্দ। আর কারও সে ঘরে ঢোকা মানা। কেবলানন্দ রাত-ভোর নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছে, সকালে সে উঠে জানতে পেরেছে। তাই সাত-সকালেই সোরগোল পড়েছে বাড়িতে। মঞ্জুলা দেবী খবর পেয়ে ছুটে এলেন উপরে। রোগীর ঘর খোলাই ছিল। সুধাকান্ত অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছেন। মঞ্জুলা আর হেবো ঘরে ঢুকতেই গুরুদেব গর্জন করে ওঠেন, ‘আবার তুমি এসেছ উপরের ঘরে! কতদিন না বারণ করেছি। বলেছি না, এ ঘরে আসবে না?’

হঠাৎ কি হল মঞ্জুলার! কোথা থেকে দর্জয় সাহস এল ওরমনে। দৃপ্ত ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে শুধু বললেন, ‘বেরিয়ে যান বলছি!’

একেবারে থতমত খেয়ে যান গুরুদেব। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমতা-আমতা করে বলেন, ‘কী, এত বড় সাহস!’

মঞ্জুলা হেবোকে বলেন, ‘দরোয়ান আর গঙ্গারামকে ডাক তো হেবো, এ দুটো লোককে রোগীর ঘর থেকে বার করে দিতে হবে।’

কাঁপতে কাঁপতে খাট থেকে উঠে দাঁড়ান গুরুদেব। কী করবেন, কী বলবেন স্থির করে উঠতে পারেন না। কেবলানন্দ বাঘের মত থাবা গেড়ে বসে আছে—যেন আদেশ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। মঞ্জুলা এগিয়ে যান সুধাকান্তের মাথার কাছে। বালিশের তলা থেকে লোহার সিন্দুকের চাবিটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দেন গুরুদেবের দিকে, বলেন, ‘এর জন্যেই প্রাণটা পড়ে আছে তো এ-ঘরে? যান, ওটা নিয়ে চলে যান। বাবার মৃত্যু হলে তখন সম্পত্তির দখল নিতে আসবেন। কিন্তু তার আগে ফের যদি এ ঘরে পা বাড়ান, দরোয়ান দিয়ে আপনার ঠ্যাং ভেঙে দেব আমি! যান বলছি।’

অবাক কাণ্ড! অমন প্রবল প্রতাপান্বিত গুরুদেব যেন একেবারে কেঁচোটি হয়ে গেছেন। চাবির গোছাটি তুলে নিয়ে গুটি-গুটি বেরিয়ে যান ঘর থেকে। পোষমানা কাবলি বেড়ালের মত কেবলানন্দ যায় তাঁর পিছু-পিছু।

হেবো এগিয়ে এসে মঞ্জুলা দেবীকে প্রণাম করে।

‘কী হল রে? হঠাৎ প্রণাম কিসের?’

‘সে আমি বোঝাতে পারব না !’

‘শোন্‌। এক কাজ কর্‌। ডাক্তারবাবুকে খবর দে।’

কিন্তু ডাক্তারবাবুকে খবর দিয়েও কিছু লাভ হল না।

ডাক্তারবাবু রোগীকে পরীক্ষা করে বললেন যে আর বড়জোর দু’দিন। এ দু’দিন মঞ্জুলা প্রাণ ঢেলে শ্বশুরের সেবা করলেন। দুর্ভাগ্য সুধাকান্তের। পুত্রবধূর সেবা যে তিনি পেলেন, তা জানতেও পারলেন না। সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে মঞ্জুলা একবারও বার হলেন না ঘর ছেড়ে।

গুরুদেবেরও কি হল, এ ঘরে একবারও মাথা গলালেন না। পরের দিন কাউকে কিছু না বলে গুরুদেব কোথায় চলে গেলেন তাঁর ঝোলাঝুলি নিয়ে। কেবলানন্দ রয়ে গেল।

হেবো বললে, ‘কাকিমা, এবার এর শেষ চেষ্টা করতে হয়। ওঁর ঘরটা একবার খুঁজে দেখতে চাই, চাবিটা পাওয়া যায় কি না। উইলটা নিশ্চয় ওই সিন্দুকেই আছে।’

মঞ্জুলা বলেন, ‘ওসব থাক হেবো। একটা মরণাপন্ন মানুষের শিয়র থেকে তাঁর উইল চুরি করতে পারব না আমি।’

‘আরে, আপনাকে চুরি করতে কে বলছে? যা করবার তা আমিই করব।’

‘না! তাঁর শেষ ইচ্ছায় বাধা দেবার কোন অধিকার ধর্মত আমার নেই।’

হেবো ধমকে ওঠে, ‘থামুন তো আপনি! এই যদি ধর্ম হয়, তবে অধর্ম বলে দুনিয়ায় কিছু নেই। আপনাকে কিছু করতে হবে না। শুধু কেবলানন্দকে ঘণ্টাকয়েকের জন্য এখান থেকে সরিয়ে দিন।’

‘তা কেমন করে সরাব আমি?’

‘ওর হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে বলুন আনন্দময়ীতলায় আপনার শ্বশুরের নামে পুজো দিয়ে আসতে।’

‘আনন্দময়ীতলাটা আবার কোথায়?’

‘বড় জাগ্রত কালী এখানকার। কেবলানন্দ জানে। মায়ের নামে পুজো দেওয়ার কথায় বেটা না বলতে পারবে না। রিক্‌শা করে গেলেও ঘণ্টা-দুয়েক সময় পাওয়া যাবে।’

উইল চুরি করার ব্যাপারে কোন উৎসাহ না থাকলেও আনন্দময়ী মায়ের নামে পুজো পাঠানোতে মঞ্জুলার আগ্রহ ছিল। কেবলানন্দকে সহজেই সরানো গেল।

তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে গেলে হেবো। গুরুদেবের ঘরের প্রত্যেকটি স্থান প্রত্যেকটি কোণা তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে শুরু করল। বাবাজির একটা ঝোলা আছে, একটি টিনের সুটকেস আছে। তালা-বন্ধ নয়। খোলাই। তাড়াতাড়ি করে খুঁজে দেখল হেবো। কাকস্য পরিবেদনা। চাবির থোকা কোথাও নেই।

মঞ্জুলা দেবী এসে বলেন, ‘কী পাগল ছেলে তুমি হেবো! গুরুদেব কখনও চাবিটা এ বাড়িতে রেখে যান? সঙ্গে নিয়েই গেছেন তিনি।’

হেবো গম্ভীর হয়ে বললে, ‘না, কাকিমা। গোয়েন্দাগিরি যদি একটুও শিখে থাকি তবে নিশ্চিত জানি সেটা তিনি নিয়ে যাননি। এ বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রেখে গেছেন।’

মঞ্জুলা বলেন, ‘অসম্ভব!’

ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে ফিরে আসে হেবো। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, উনি চাবিটা হেবোর ঘরেই রেখে গেছেন? একবারে বাঘের ঘরে যদি ঘোঘের বাসা হয়ে থাকে? যদি উনি ভেবে থাকেন হেবো সারা বাড়ি খুঁজবে, কিন্তু নিজের ঘরটা খুঁজবে না?

কী আশ্চর্য! যা ভেবেছে তাই। হেবোর ঘরের ভিতর থেকেই উদ্ধার করা গেল চাবির থোকাটা। উপরের একটা কুলুঙ্গিতে পুরোন বইয়ের পিছনে একটা ভাঙা লক্ষ্মীর ঝাঁপির ভিতর থেকে বার হল সেটা। কী ধড়িবাজ লোক। এক নম্বরের ঘড়েল! কোন সুযোগে হেবোর অলক্ষিতে তারই ঘরে চাবিটা লুকিয়ে রেখে গেছে।

তৎক্ষণাৎ সুধাকান্তের ঘরে চলে আসে হেবো। কেবলানন্দের ফিরতে এখনও দেরি আছে। মঞ্জুলা দেবী রোগীর জন্য পথ্য তৈরি করতে নিচে গেছেন। ঘরে আর কেউ নেই। সুধাকান্ত অচৈতন্য। দরজাটা বন্ধ করে দেয় প্রথমে। দ্রুতগতিতে লোহার সিন্দুকটা খুলে ফেলে হেবো। হ্যাঁ, সামনেই রয়েছে সীলমোহরাঙ্কিত খামটা। সেটা বের করে হেবো আবার সিন্দুকটা বন্ধ করে! খামটা পকেটে ফেলে আবার চাবিটা রেখে আসে সেই ভাঙা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে। আর কালবিলম্ব না করে হেবো তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়ে কলকাতার উদ্দেশে এবার কাকা কাকিমার হাতে উইলটা জমা দিতে হবে। বাবা মা হয়ত মধুপুর থেকে ফিরে এসেছেন। সোমবার থেকে স্কুলও খুলবে। আর দেরি করা উচিত নয়। কাজ যখন হাসিল হয়ে গেল তখন ফিরে যাওয়াই ভাল।

কাকা কাকিমা ওকে দেখে বলেন, ‘কী রে হেবো, কী খবর?’

হেবো বললে, ‘ওয়া গুরুজীকি ফতে!’

‘তার মানে?’

‘তার মানে এই সেই অপয়া উইল যত্ন করে রেখে দাও।’

‘সে কি রে? কেমন করে পেলি?’

‘সে অনেক কথা। সুধাকান্তবাবু এখন অচৈতন্য। ডাক্তার বলেছেন আর তাঁর জ্ঞান ফিরবে না। সুতরাং নূতন করে উইল আর করতে পারবেন না। ব্যস, খেল্‌ খতম!’

কাকিমা বলেন, ‘কিন্তু ওটাকে যত্ন করে রেখে কি লাভ? পুড়িয়ে ফেলি বরং ওটাকে।’

কাকা বলেন, ‘না না, তার আগে খুলে দেখি ওটাই সেই আসল উইল কি না।’

হেবো বললে, ‘এখন নয় কাকা! গুরুদেবকে দেখিয়ে দেখিয়ে তার চোখের সামনেই ওটাকে না পোড়ালে আমার গায়ের ঝাল মিটবে না! বেটা বলে কিনা, বজ্জাত বোম্বেটে শয়তান!’

কাকিমা হেসে ওঠেন, ‘কাকে বলেছে রে? তোকে?’

‘আমাকে বললে তখনই তার নাকটা ভেঙে দিতাম না? বলেছে অন্য একটা ছেলেকে।’

‘তবে তুই অত চটছিস কেন?’

‘সে অনেক কথা।’

‘প্রবীরের খবর কি?’

হেবো চমকে উঠে বলে, ‘ওই যাঃ! তাঁকে তো খবর দিয়ে আসা হয়নি। নাঃ! এটা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে আমার! কাকা, আমি আর একবার যাই বরং।’

‘তা যা। তবে কালকেই ফিরে আসিস। দাদারাও কাল সন্ধ্যায় ফিরে আসছেন। প্রবীর বেচারাকে খবরটা এখনই দেওয়া দরকার।’

হেবো আবার রওনা হয়ে পড়ে কৃষ্ণনগর যাবে বলে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হেবোর, কৃষ্ণনগরে গিয়ে সে প্রবীরকাকুর দেখা পেল না। কারণ হেবো রওনা হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই সুধাকান্ত মারা গেলেন। প্রবীরচন্দ্র খবর পেয়ে হেবোর খোঁজে এসেছিলেন, এবং হেবো কলকাতা চলে গেছে শুনে তিনিও চলে এলেন হেবোদের বাড়িতে।

প্রবীরচন্দ্র যখন পৌঁছলেন তার আগেই সে রওনা হয়ে গেছে। প্রবীরচন্দ্রের কাছে সংবাদ পেয়ে হেবোর কাকা ও কাকিমাও কৃষ্ণনগরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। প্রবীরচন্দ্র হেবোর উইল চুরির কথা শুনে রীতিমত অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘এ হতেই পারে না! আমি বিশ্বাস করতে রাজী নই যে, ওই ঘড়েল শিরোমণি লোহার সিন্দুকে উইল রেখে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, আর যাওয়ার সময় সেই চাবির থোকাটা রেখে যাবে হেববার ঘরেই। হেববার মত পাকা ছেলে এ কথা বিশ্বাস করল কেমন করে?’

কাকিমা বলেন, ‘কিন্তু সে যে উইলটা রেখে গেল আমার কাছে!’

হো-হো করে হেসে উঠে প্রবীরচন্দ্র বলেন, ‘নিয়ে আসুন সেখানা, খুলে দেখুন ভিতরে কী মাল আছে! ওখানা আসল উইল নিশ্চয় নয়। হেবোকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ওখানা ওই হতভাগা বোম্বেটে ওখানে রেখে গেছে। আসল উইল সে সঙ্গে নিয়েই গেছে।’

হেবোর কাকা বলেন, ‘আমারও তাই সন্দেহ হয়েছিল।’

বাধা দিয়ে প্রবীর বলেন, ‘সন্দেহ হয়েছিল না ঘণ্টা! তাহলে এতক্ষণ সেটা খুলে দেখেননি কেন?’

‘হেবোই তো বারণ করলে।’

‘বাদ দিন ওসব ছেলেমানুষী! নিয়ে আসুন সেখানা।’

কাকিমা ভয়ে ভয়ে আলমারি খুলে বন্ধ খামটা নিয়ে আসেন। সীলমোহরগুলি পরীক্ষা করে প্রবীরবাবু বলেন, ‘সীল ঠিকই আছে, তবে ভিতরে কী আছে জানেন?’

‘সাদা কাগজ?’

‘মোটেই নয়। ভিতরে আছে আসল উইলের একটা হুবহু কপি। শুধু সইগুলো জাল। বেটা জানে যে হেবো এটা চুরি করবে এবং পুড়িয়ে ফেলবে। তারপর সুধাকান্তের মৃত্যু হলে আমরা যখন বলব তিনি কখনও কোনও উইল করেননি, তখন সকলের নাকের উপর আসল উইলখানা মেলে ধরবেন তিনি।’

কাকা বলেন, ‘তবে এখানা খুলে দেখি?’

‘নিশ্চয়ই।’ বলে প্রবীরচন্দ্র খুলে ফেলেন খামটা। কাগজের ভাঁজটা খুলে মুখটা লাল হয়ে যায় তাঁর। তাঁর অনুমান সত্য হয়নি। কাগজখানা মেলে ধরেন তিনি। কাগজটায় লেখা ছিল—

‘দুঃখ করো না বাবা হেবো—থুড়ি বটুক! হেলে ধরতে হাত পাকিয়েছ বলে কেউটের গর্তে হাত দিতে যেও না। উইলটা সিন্দুকে রেখে যাওয়া নিরাপদ নয় মনে করে সেটা সঙ্গে করেই নিয়ে গেলাম। পবুকে দুঃখ করতে বারণ কর।’

কাকা চিৎকার করে ওঠেন, ‘ছি ছি ছি! হেবোটা একটা আস্ত গাড়োল!’

প্রবীর বলেন, ‘আপনারাও কিছু কম যান না!’

মুখ কালো করে বসে থাকেন কাকা।

কাকিমা বলেন, ‘সে যা হবার হয়েছে। তোমাদের বুদ্ধি যে কত তা বোঝা গেছে! একরত্তি একটা ছেলেকে ঠেলে দিয়ে এখানে বসে সবাই ল্যাজ নাড়ছ! এতক্ষণে বোধহয় মঞ্জুলাকে ওই গুরুদেব হাত ধরে পথে বার করে দিয়েছে! চল তাকে নিয়ে আসবার ব্যবস্থা করি।’

অগত্যা কাকা কাকিমা আর প্রবীরচন্দ্র ভগ্নহৃদয়ে রওনা হলেন কৃষ্ণনগরের উদ্দেশে।

সুধাকান্তের বাড়িতে পৌঁছে দেখেন, রীতিমত একটা জনসমাবেশ হয়েছে।

সুধাকান্ত লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। শহরের গণ্যমান্য সকলেই এসে হাজির হয়েছেন। মৃতদেহ দাহ করে শ্মশানযাত্রীরাও ফিরে এসেছে।

বাইরের ঘরে বসে কথা হচ্ছে। গুরুদেব ইতিমধ্যে এসে জুটেছেন। হেবোও আছে। শহরের প্রবীণ উকিল গণেশবাবু বলছেন, ‘শহরে একটা ইন্দ্রপতন হয়ে গেল! সুধাকান্তবাবুর সওয়াল শুনতে বার অ্যাসোসিয়েশন ছেড়ে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ত।’

‘অত্যন্ত ক্ষুরধার বুদ্ধি ছিল ওঁর’, নবীন একজন উকিল বলেন, ‘অথচ সেই মানুষেরই শেষ অবস্থায় কী ভীষণ বুদ্ধিভ্রংশ হল দেখুন।’

গণেশবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘মুনিদেরও মতিভ্রম হয় হে ঘোষাল, তা সুধাকান্তবাবু তো সামান্য মানুষ।’

জগন্নাথবাবু বলেন, ‘কেন? মতিভ্রম কিসের?’

গণেশবাবু বলেন, ‘ও, আপনি বুঝি জানেন না?’ ‘সুধাকান্তবাবু একেবারে শেষ অবস্থায় তাঁর উইল পালটিয়ে তাঁর বিধবা পুত্রবধূকে সম্পত্তি থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে গেছেন।’

জগন্নাথবাবুও নামকরা প্রবীণ উকিল, সুধাকান্তের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল যথেষ্টই। তিনি বলে ওঠেন, ‘এ হতেই পারে না! কি নকুলবাবু, এ কথা কি সত্যি?’

নকুলবাবুর সঙ্গে হেবোর চোখাচোখি হয়। হেবোর সঙ্গে তাঁর বোধহয় আগেই কোন কথা হয়ে থাকবে। তিনি অম্লান বদনে বলে বসেন, ‘এঁরা অনেকে তাই বলছেন বটে, তবে আমার তো বিশ্বাস হয় না! তাহলে আমাকে তিনি নিশ্চয়ই বলে যেতেন।’

গুরুদেব ফোড়ন কাটেন, ‘অথবা সাক্ষী রাখতেন। আপনি কি তাঁর শেষ উইলে গত শুক্রবার সই করেন নি?’

‘শুক্রবার? কই? মনে তো পড়ে না!’

গুরুদেব হেসে বলেন, ‘আমি শুনেছি উইলে আপনারও সই আছে।’ নকুল বলেন, ‘ভুল শুনেছেন তাহলে।’

‘তা হবে! হস্তরেখাবিদ সে কথা বলতে পারবে।’

হঠাৎ বাধা দিয়ে অ্যাডভোকেট দে-সাহেব বলে ওঠেন, ‘না। শেষ সময়ে অর্থাৎ গত শুক্রবার তিনি যে উইল করেছিলেন আমি সে উইলে সাক্ষী হিসাবে সই করেছি ; আর—’

‘আর?’

‘আর, জানি না নকুলবাবু কেন অস্বীকার করছেন, তিনি আমার সম্মুখেই সাক্ষী হিসাবে সই দিয়েছিলেন।’

গণেশবাবু বলেন, ‘একি সর্বনেশে কথা মশাই! হ্যাঁ নকুলবাবু, ইনি কী বলছেন?’

নকুলবাবু আবার একবার হেবোর দিকে দেখে নিয়ে বলেন, ‘বেশ তো, উইলটা আনা হলেই বোঝ যাবে।’

হেবো উপর-পড়া হয়ে বলে, ‘উইল করে থাকলে সুধাকান্তবাবু তা তাঁর লোহার সিন্দুকে রেখে থাকবেন, না কি বলেন গুরুদেব?’ গুরুদেব বলেন, ‘তা তো বলতে পারি না বাবা, তবে আমার কাছে ওই সিন্দুকের চাবি আছে। খুঁজে দেখতে পার।’

চাবিটা তিনি দেন হেববার হাতে।

হেবো হেসে বলে, ‘বেশ, আপনারাও তাহলে চলুন, সিন্দুকটা আমরা প্রথমে খুঁজে দেখি।’

প্রবীরবাবু বুঝতে পারেন হেবো একটা প্রচণ্ড ভুল করতে চলেছে। তাই হেববাকে ডেকে বলেন, ‘হেবো, শোন। তোমার সঙ্গে একটা জরুরী কথা ছিল।’

হেবো বললে, ‘আসছি প্রবীরকাকা, আগে সিন্দুকটা খুলে দেখে আসি।’

হেবোর কাকা প্রবীরচন্দ্রকে জনান্তিকে ডেকে বলেন, ‘বাধা দিও না। যা হবার তা তো হয়েছেই। ওর ডেঁপোমির একটু শিক্ষা হওয়া উচিত !’

সদলবলে ওঁরা উপরে উঠে আসেন। হেবো ঝুঁকে পড়ে সিন্দুকটা খুলে ফেলে। ভিতরটা ভাল করে দেখে বলে, ‘কই, উইল বলে তো কিছু মনে হচ্ছে না। গুরুদেব, আপনি একটু খুঁজে দেখবেন?’

গুরুদেব বলেন, ‘না বাবা। আমি তো বলি নি উইল ওখানে আছে। তুমিই বলেছিলে।’

‘তবে উইল কোথায় আছে?’ চালের মাথায় প্রশ্ন করে হেবো।

‘আমার কাছে বাবা। এই দেখ ! ’

ঝোলার ভেতর থেকে ঠিক একই রকমের একখানি সীলমোহর-করা খাম বার করে তিনি গণেশবাবুর হাতে দেন।

গণেশবাবু সেটি গ্রহণ করে বলেন, ‘এইটিই তাহলে সুধাকান্তের শেষ উইল?’

গুরুদেব হেসে বলেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। খুলে দেখুন। সমস্ত সম্পত্তিই তিনি দেবোত্তর করে গেছেন। আমিই তার অছি। তিনজন সাক্ষী আছেন, এবং নকুলচন্দ্র তাঁদের মধ্যে একজন।’

গণেশবাবু বলেন, ‘নকুলবাবু ?’

নকুলবাবুর চক্ষুস্থির হয়ে গেছে ততক্ষণে, আমতা আমতা করে বলেন, ‘হেবো !’

হেবো একেবারে পাথরের মূর্তি যেন। কথা নেই তার মুখে। গুরুদেব খুক-খুক করে হেসে ওঠেন।

গণেশবাবু খামটা খুলবার উদ্যোগ করতেই হেবো বাধা দেয়। বলে, ‘এতই যদি হল তবে গুরুদেব আপনিই খামটা খুলুন। উইলটা পড়ে শোনান আমাদের।’

গুরুদেবের চোখদুটো ধ্বক করে জ্বলে ওঠে। বলেন, ‘বেশ, তাই পড়ে শোনাচ্ছি আমি।’

সাবধানে খামটা খুলে ফেলেন তিনি।

কাগজখানা বার করে ভাঁজটা খুলেই কিন্তু চমকে ওঠেন।

এপিট-ওপিট কয়েকবার দেখে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যান।

অ্যাডভোকেট দে-সাহেব ঝুঁকে পড়েন কাগজটার উপর। তারপর বলেন, ‘একি !’

গণেশবাবু বলেন, ‘কি হল? ব্যাপার কি ?’

গুরুদেবের অবশ হাত থেকে কাগজখানা টেনে নিয়ে এপিঠ-ওপিঠ দেখে বলেন, ‘এ তো একখণ্ড সাদা কাগজ। উইল কই ?’

গুরুদেব কোন জবাব দেন না। গোল মুখখানা লম্বাটে হয়ে গেছে তাঁর। চোয়ালের নিম্নাংশটা ঝুলে পড়েছে।

হেবো খুক-খুক করে হেসে ওঠে।

আর আত্মসংবরণ করতে পারেন না গুরুদেব। ধপ করে বসে পড়েন মাটিতে। গণেশবাবু ব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘কী হল ?’

হেবো তাড়াতাড়ি বলে, ‘আজ্ঞে জয়দ্রথ বধ ! ’

সুধাকান্তের শ্রাদ্ধে বৃষোৎসর্গ করা হবে স্থির হল। মঞ্জুলা দেবী ঘটা করে শ্রাদ্ধ করতে চান। শ্বশুর তো তাঁর জন্য সম্পত্তি বড় কম রেখে যাননি! ভাল করেই খরচ-পত্র করতে মনস্থ করেছেন তিনি।

পরদিনই তল্পি-তল্পা গুটিয়ে গুরুদেব রওনা হচ্ছেন শুনে হেবো ছুটে এল সিঁড়ির মুখে। দাঁড়িয়ে বললে, ‘আপনার শ্রাদ্ধের গুরুবিদায়টা নিয়ে যাবেন না স্যার ?’

গুরুদেব শুধু বললেন, ‘জ্যাঠামো করো না !’

হেবো বললে, ‘অন্তত এ দুটো নিয়ে যান। খুঁজে পাওয়া গেছে। এ দুটো আপনারই।’ হেবো বার করে দেয় একটা রুপোর কোশাকুশি আর একটা কলম।

গুরুবিদায় সমাপ্ত হতেই বাড়ির সকলে ঘিরে ধরল হেবোকে : কাকা, কাকিমা, মঞ্জুলা, নকুলচন্দ্র আর প্রবীর। দরজা বন্ধ করে সবাই মিলে চেপে ধরল হেবোকে। এবার বলতে হবে, কি করে কি হল।

প্রবীরচন্দ্র বলেন, ‘আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।’

হেবো হেসে বললে, ‘কেন পারছেন না জানেন? আপনারা সবচেয়ে সহজ পথটা দেখতে পারছেন না। একটা উদাহরণ দিচ্ছি, তাহলেই সমস্যাটা সহজ হয়ে যাবে।’

‘কী উদাহরণ ? ’

‘আপনাকে তিনটে বানান জিজ্ঞাসা করব। ঠিক খেয়াল করে বানান তিনটে বলুন দেখি।’

‘বেশ, বল।’

‘প্রথম বানান মুমূর্ষু।’

‘ম-য়ে হ্রস্বউ, ম-য়ে দীর্ঘউ আর মূর্ধণ্যষ-এ রেফ হ্রস্বউ।’

হেবো বললে, ‘ঠিক। এবার বলুন—মুহূর্ত।’

‘ম-য়ে হ্রস্বউ, হ-য়ে দীর্ঘউ আর ত-য়ে রেফ।’

হেবো বললে—‘ভুল।’

প্রবীরচন্দ্র বলেন, ‘না হে,ভুল নয়। এখনকার বানান তয়ে রেফ। আগে ছিল তয়ে তয়ে রেফ।’

হেবো আবার বললে—‘ভুল।’

প্রবীরচন্দ্র চটে উঠে বলেন, ‘তবে তুমি ঠিক বানানটা বল শুনি !’

হেবো বললে, ‘ভ-য়ে হ্রস্বউ আর ল।’

থমকে গিয়ে প্রবীরচন্দ্র বলেন, ‘তার মানে ?’

‘তার মানে, প্রথম দুটি বানান আপনার ঠিকই হয়েছে। তৃতীয় বানান যেটার আমি জানতে চেয়েছি সেটা হচ্ছে—“ভুল” ; আপনি বলতে পারছিলেন না।’

হো হো করে হেসে ওঠে সবাই।

প্রবীরচন্দ্র বলেন, ‘স্বীকার করছি, ঠকে গেছি।’

হেবো বললে, ‘গুরুদেবও ঠিক ঐভাবেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি ঠকে গেছেন। গুরুদেব ভেবেছিলেন উইলটা চুরি করতেই আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করব। তাই টোপ ফেলে চার ছড়িয়ে বঁড়শি ছিপ হাতে বসেছিলেন উনি। আসল উইলটা সঙ্গে নিয়ে একটা নকল উইল সিন্দুকে রেখে এবং চাবিটা ফেলে চলে গেলেন। গুরুদেব ভেবেছিলেন নকল উইলটা চুরি করে বোকা হব আমি। কিন্তু উনি যান ডালে ডালে তো আমি যাই পাতায় পাতায়। সব জেনে শুনেও সেই নকল উইল চুরি করলাম আমি। বোকা সাজলাম।’

বাধা দিয়ে প্রবীরচন্দ্র বলেন, ‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু আসল উইলটা কোথায় গেল ?’

‘কেন, যেখানা গুরুদেব পরে বার করলেন।’

‘সেটা তো সাদা কাগজ !’

হেবো হেসে বললে, ‘সেখানাই আসল উইল। আমি কলকাতা গিয়ে কাকিমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিছু মাল-মশলা কিনি। একটা কালো পাইলট কলম, কিছু স্টার্চ আর আইওডিন। স্টার্চের সল্যুশানে কয়েক ফোঁটা আইওডিন ফেলে দিলে ব্লু-ব্ল্যাক রঙের কালি হয়। কিন্তু সেটা ম্যাজিক কালি ; কিছু পরেই লেখা উপে যায়। কাগজে কোন দাগ থাকে না। উইল করার আগের দিন যখন ক্যাবল গেল ডাক্তারবাবুর ব্যাগ আনতে তখন ঐ কালি-ভর্তি কলমটা আমি কলমদানিতে রেখে দিই। আগের রাত্রেই বাড়ির অন্যান্য ফাউন্টেন পেন চুরি গেছে। ফলে আশা করেছিলাম ওই কলমেই উইল লেখা হবে। একমাত্র ভয় ছিল—অ্যাডভোকেট-সাহেব যদি শেষ পর্যন্ত তাঁর পকেট থেকে কলম বার করে বসেন। কিন্তু আমি ভগবানে বিশ্বাস করি। সম্পত্তির কণামাত্র না পেয়েও যখন কাকিমা তার শ্বশুরের সেবা করতে গেলেন তখন ডাক্তারবাবু রাগ করে বলেছিলেন—তোমার কথায় ভগবানে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি মা! আর ঠিক তখনই আমার মনে হয়েছিল, ভগবান ‘আমার কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। সবাই ওই কলমেই সই দিয়েছেন।’

কাকা বলেন, ‘কিন্তু ডাক্তারবাবুও কি তাঁর নিজের কলমে সই করেননি ?’

নকুলবাবু বলেন, ‘না, নিয়ম হচ্ছে দলিলে সকলে একই কলমে সই করবে—যাতে প্রমাণ হয় সাক্ষীরা দলিলকারীর সঙ্গে একই সময়ে সই করেছেন। এ নিয়ম খুব কঠোরভাবে মানা হয় না : কিন্তু সুধাকান্তবাবু পাকা উকিল ; আইনের খুঁত তিনি রাখবেন না। তাই আমি আর ডাক্তারবাবু যখন দ্বিতীয়বার সই দিতে ফিরে গেলাম তখন তিনি তাঁর কলমটা এগিয়ে দিয়েছিলেন।

মঞ্জুলা দেবী বলেন, ‘হেবো, তাই বুঝি তুমি ডাক্তারবাবুকে সই করতে পীড়াপীড়ি করছিলে ?’

হেবো হেসে বলে, ‘ওই মুহূর্তটাই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ। ডাক্তারবাবু যদি সই না দিতেন, তাহলে এঁরা দ্বিতীয় ডাক্তারকে ডাকতে যেতেন—ফলে উইল তখনই সীলমোহর করা হত না। আর ঘণ্টাকয়েক পর দ্বিতীয় ডাক্তারবাবু যখন সই দিতে আসতেন ততক্ষণে লেখা সব আবছা হয়ে যেত। ধরা পড়ে যেতাম আমি।’

প্রবীরচন্দ্র ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘সাবাস হেবো ! বাঙলা সিনেমার তুমি ক্ষুদে নায়ক হতে পার !’

শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ রাখতে এসেছিল হেবো। মঞ্জুলা দেবী ওকে কাছে ডেকে বলেন, ‘শ্রাদ্ধের পর পণ্ডিতবিদায় করতে হয়। তুমি একটি ক্ষুদে পণ্ডিত! এই তোমার পণ্ডিতবিদায়।’

ছোট্ট একটা বাইনোকুলার। অত্যন্ত জোরালো তার লেন্স। বহু দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখা যায়। হেবো জানলার কাছে সরে এসে দেখল, রাস্তার ওপারে যে ভদ্রলোক চায়ের দোকানে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, তার হরফগুলো পর্যন্ত পড়া যাচ্ছে।

জগদ্রথ-বধ পালা বৃষোৎসর্গে শেষ হওয়ায় হেবো আগেই আহলাদে আটখানা হয়েছিল, বাইনোকুলারটা হাতে পেয়ে সে যেন ষোলখানা হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *