2 of 2

রহস্যভেদী সদাশিব – মঞ্জিল সেন

রহস্যভেদী সদাশিব – মঞ্জিল সেন

ব্যারিস্টার সদাশিব মিত্র ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে দিলেন। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন কাঁটায় কাঁটায় দশটা। ট্রামে-বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে আপিস চলেছে দলে দলে মানুষ। একটা স্বাধীন দেশে দিনের পর দিন হাতে প্রাণ নিয়ে এমনভাবে মানুষকে চলাফেরা করতে হয়, এ যেন ভাবাই যায় না। সদাশিব আপন মনেই দুপাশে ঘাড় নাড়লেন।

বড় রাস্তা ছেড়ে ডান দিকের একটা গলিতে তিনি ঢুকে পড়লেন। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টার সমর গুহ এ গলিটার কথাই ফোনে বলেছিল। ট্যাক্সিটা তিনি ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিয়েছেন। চারপাশটা তিনি ভাল করে দেখে নিতে চান, অর্থাৎ পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হতে চান তিনি।

লাল রঙের দোতলা বাড়িটার সামনে এসে তিনি দাঁড়ালেন। বাড়ির সামনে কিছু লোক জমা হয়েছে, গেটে পুলিশ। একটা কালো রঙের ভ্যানও চোখে পড়ল। তিনি এগিয়ে গিয়ে নিজের নাম বললেন। একজন কনস্টেবল সেলাম দিয়ে বলল, ‘আমার সঙ্গে আসুন স্যার, গুহ সায়েব বলে দিয়েছেন, আপনি এলেই ভেতরে নিয়ে যেতে।’

সদাশিবকে দেখেই সমর গুহ এগিয়ে এল, বলল, ‘আপনাকে বোধ হয় মিছিমিছি কষ্ট দিলাম, সুইসাইডের কেস মনে হচ্ছে।’

সমর গুহের মুখে অপরাধী ভাবটা লক্ষ্য করে সদাশিব তাকে আশ্বস্ত করার জন্যই বললেন, ‘কি করতেন ভদ্রলোক?’

‘মহাজনী ব্যবসা ছিল, নাম অবিনাশ সামন্ত। বাড়িটা পৈতৃক। দোতলার দুটো ফ্ল্যাট দুজন পরিবারের কাছে ভাড়া দিয়েছিলেন ; একতলার এই ফ্ল্যাটে নিজে থাকতেন আর অন্যটা এক পাবলিশার্সের দোকান আর আপিস।’

‘ভদ্রলোকের বউ, ছেলে-মেয়ে?’

‘স্ত্রী মারা গেছেন অনেকদিন, ছেলে-পুলে নেই!’

‘ও।’ সদাশিব চিবুকে হাত বুলোলেন। ‘তা যখন এসেই পড়েছি, চলুন, ডেডবডিটা একবার দেখেই যাই।’ মৃদু কণ্ঠে তিনি বললেন।

‘চলুন।’ সমর গুহ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বুড়ো ভদ্রলোককে মিছিমিছি হয়রান করার জন্যে সত্যিই খারাপ লাগছিল ওর।

দুটো ঘর। ভেতরের ঘরে সদাশিবকে নিয়ে এল সমর। একটা চেয়ারে বসার ভঙ্গিতে সামন্তের মৃতদেহ চোখে পড়ল সদাশিবের। ঘাড়টা বাঁ দিকে কাৎ হয়ে আছে, কিন্তু মুখটা একটু হাঁ করা। মাথার ওপর ঝোলানো ইলেকট্রিক তারে একটা বাল্ব জ্বলছে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে, মাথার সব চুল সাদা, অকালপক্ক নয়।

‘আলোটা কি আপনারা জ্বালিয়েছেন, না আগে থেকেই জ্বলছিল?’ বাল্বের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন সদাশিব।

‘আগে থেকেই জ্বলছিল, আমরা এসে দেখেছি।’ সমর গুহ জবাব দিল।

সদাশিব ভুরু কোঁচকালেন : ‘কেন বলুন তো?’

‘কি—কেন?’ গুহ ঠিক বুঝতে পারে না।

‘বাল্ব জ্বলছে কেন?’

‘হয়তো অন্ধকারে আত্মহত্যা করতে সাহসে কুলোচ্ছিল না ভদ্রলোকের।’ গুহ একটু রসিকতা করার চেষ্টা করল।

সদাশিব ঘাড় নাড়লেন : ‘নিজের জীবনই যে শেষ করতে যাচ্ছে, তার আবার অন্ধকারে ভয় কি কিন্তু আত্মহত্যাই বা বলছেন কেন আপনি?’

মৃতদেহের পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা রিভলবারের দিকে আঙুল দেখিয়ে গুহ বলল, ‘ওই রিভলবারের গুলিতেই ভদ্রলোকের মৃত্যু হয়েছে। গুলিটা মুখের ভেতর দিয়ে তালু ভেদ করে চলে গেছে। আত্মহত্যা ছাড়া এমন মৃত্যু সম্ভব নয়, কারণ অন্য কাউকে গুলি করার সুযোগ দেবার জন্য কেউ হাঁ করে না। আর জোর করে কাউকে হাঁ করিয়ে মুখে গুলি করা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। তবু তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই এটা খুনের ব্যাপার, তবে অনুমান করতে হবে যে খুনী মিস্টার সামন্তকে বলেছিল, আপনি দয়া করে হাঁ করুন, আমি গুলি করব। আর মিস্টার সামন্তও বিনা প্রতিবাদে হাঁ করা মুখ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।’ পরিহাসতরল কন্ঠে শেষের কথাগুলো বলল গুহ : ‘কোনরকম বাধা দেবার চিহ্ন যখন চোখে পড়ছে না, তখন এ ছাড়া অন্য কোন যুক্তি আমার তো মাথায় আসছে না।’

সদাশিব তাঁর রেশমের মত সাদা চুলে হাত বুলোলেন। গুহর যুক্তি ফেলে দেয়া যায় না। জোর করে কারো মুখ হাঁ করিয়ে গুলি করা সত্যিই বাস্তবসম্মত নয়, আর মহা কাপুরুষও স্বেচ্ছায় অমন সুযোগ কোন খুনীকে দেবে বলে মনে হয় না।

‘মিস্টার সামন্তের নিশ্চয়ই রিভলবারের লাইসেন্স ছিল? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ।’

‘লাইসেন্স খুঁজে পেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, এই টেবিলের ওপর রেখেছি।’

সদাশিব লাইসেন্সটা হাতে তুলে নিলেন। রিভলবারের নাম্বার লেখা আছে কে-৩০৫৪। তিনি রুমাল দিয়ে আলগা ভাবে মাটি থেকে রিভলবারটা তুলে নিলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওটা দেখে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। নাম্বারটা কেউ যেন ঘষে তুলে ফেলেছে, ঘষার দাগ স্পষ্ট।

কে এই কাজ করল, কেনই বা করল?

‘রিভলবারে কোন আঙুলের চিহ্ন পাওয়া যায় নি?’

‘হ্যাঁ, মিস্টার সামন্তের আঙুলের ছাপ।’

‘একটা জিনিস আপনি হয়তো লক্ষ্য করেননি।’ মৃদুকণ্ঠে বললেন সদাশিব।

‘কি বলুন তো?’

‘লাইসেন্সে লেখা আছে পয়েন্ট থ্রি টু, আর এটা হল পয়েন্ট টু-টু।

সমর গুহের মুখ এবার একটু হাঁ হল।

রিভলবারটা সদাশিবের হাত থেকে নিয়ে বলল, ‘তাই তো! ছি ছি, এটা আমার আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল।’

‘ফায়ার আর্মস নিয়ে পড়াশোনা করা আমার একটা বাতিক।’ সদাশিব মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, ‘লক্ষ্য করে দেখুন, নাম্বারটা ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে। তার একমাত্র কারণ হল, নাম্বার দেখে যাতে মালিকের খোঁজ না পাওয়া যায়। এখন বুঝতে পারছেন তো, ব্যাপারটা আত্মহত্যা বোধ হয় নয়, আমাদের ধোঁকা দেবার জন্যে আত্মহত্যার একটা রূপ দেয়া হয়েছে মাত্র। মিস্টার সামন্ত যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন, তবে এত লুকোচুরির কারণ কি থাকতে পারে? যার একটা রিভলবারের লাইসেন্স আছে, তিনি কেন বে-আইনীভাবে আরও একটা রিভলবার বাড়িতে লুকিয়ে রাখবেন?’

‘তাই তো! ব্যাপারটা জটিল হয়ে দাঁড়াল দেখছি।’ মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল গুহ।

‘ভদ্রলোকের থ্রি-টু রিভলবারটাই বা কোথায় গেল?’ সদাশিব ঘরের চারদিকে চোখ বুলোতে বুলোতে বললেন।

দেয়ালে গাঁথা একটা আয়রন সেফের দিকে তিনি তাকালেন।

‘ওটা এখনও খোলা হয় নি।’ সদাশিবের দৃষ্টি লক্ষ্য করে গুহ বলল। ‘চাবির একটা রিং অবশ্য ভদ্রলোকের জামার পকেটে পাওয়া গেছে।’

‘খুলুন, দেখি।’

সমর গুহ একটার পর একটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করার পর সেফটা খুলে গেল। কিছু কাগজ-পত্তর ছাড়া ভেতরটা ফাঁকা।

‘মনে হচ্ছে, কেউ যেন সব হাতিয়েছে।’ সদাশিব স্বগতোক্তির মত বললেন।

‘হয়তো কিছু ছিল না।’ গুহ তর্কের খাতিরে বলল।

‘তবে বাড়িতে আয়রনসেফ রাখার কারণ কি?’ সেফের ভেতর থেকে একটা ব্যাঙ্কের পাশবই বার করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সদাশিব মৃদুকণ্ঠে বললেন। তারপরই হঠাৎ একটু অবাক হবার সুরে বলে উঠলেন, ‘ভদ্রলোক মহাজনী কারবার করতেন, অথচ পাশবইয়ে দেখা যাচ্ছে মাত্র একশো টাকা জমা আছে! গত বছরের এন্‌ট্রিতে দেখা যাচ্ছে ভদ্রলোক পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলেছিলেন। ব্যাপারটা একটু রহস্যময় মনে হচ্ছে, আপনি ব্যাঙ্কে ফোন করুন তো!’

গুহ বাইরের ঘরের দিকে পা বাড়াল, ওখানেই টেলিফোন আছে। টেবিলের ওপর মৃতের টুকিটাকি জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। সদাশিব চামড়ার মানিব্যাগটা তুলে নিলেন। ভেতরে এক টাকার কয়েকটা নোট আর একটা ভাঁজ করা কাগজ। সদাশিব কাগজটা খুললেন, ছোট্ট একটা চিরকূট। তিনি পড়লেন :

প্রিয় মিঃ সামন্ত,

আগামীকাল যাওয়া হয়ে উঠবে না। পরশু সকাল দশটার পর এক সময় গিয়ে আপনাকে দেখে আসব। ইতি—আপনার বিশ্বস্ত

ডাঃ চৌধুরী

চিঠিতে গত পরশুর তারিখ ছিল। সদাশিব কাগজটা আবার ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন।

গুহ এসে ঘরে ঢুকল। সদাশিবের সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে সে বলল, ‘ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হল। মিস্টার সামন্ত গত বছর পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলেছিলেন। ম্যানেজারকে নাকি তিনি বলেছিলেন, ব্যাঙ্কের ওপর তাঁর আর বিশ্বাস নেই—টাকা বাড়িতেই সিন্দুকে রাখবেন। ম্যানেজার অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, অত টাকা বাড়িতে রাখার বিপদের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মিস্টার সামন্ত তাঁর সিদ্ধান্ত বদল করেননি।’

‘অর্থাৎ দেয়ালের সেফে মোটা টাকা ছিল।’ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে গুহর দিকে তাকিয়ে সদাশিব মন্তব্য করলেন।

পুলিশ সার্জন এসে পড়লেন। মৃতদেহ পরীক্ষা করতে করতে তিনি বললেন, ‘রিভলবারের নল মুখের ভেতর ঢুকিয়ে কিংবা মুখের খুব কাছে নলটা রেখে ট্রিগার টেপা হয়েছে। মুখের ভেতর বারুদের চিহ্ন স্পষ্ট।’

‘মৃত্যুর আনুমানিক সময় ক’টা হবে? সদাশিব প্রশ্ন করলেন।

‘পোস্টমর্টেম না করে ঠিক বলতে পারছি না।’ সার্জন জবাব দিলেন, ‘তবে অনুমান করা যেতে পারে ঘণ্টা বারো থেকে চোদ্দর মধ্যে।’

‘অর্থাৎ গতকাল রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যে।’ সদাশিব মনে মনে হিসেব করে বললেন।

পুলিশ সার্জন বিদায় নেবার পর সদাশিব জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডেডবডি কে প্রথম দেখেছিল?’

‘ঝি। সকাল আটটার সময় কাজ করতে এসে বসবার ঘরের দরজা ঠেলতেই খুলে যায়। মিস্টার সামন্ত নাকি খুব সাবধানী মানুষ ছিলেন, কখনো অমন করে দরজা খুলে রাখতেন না। তাই ও একটু অবাকই হয়। শোবার ঘরে উঁকি মারে। তারপরই বাবুকে ওই অবস্থায় দেখে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। ওর চিৎকারে ওপরের ভাড়াটেরা ছুটে আসেন, তারপরই আমাদের খবর দেওয়া হয়।’

‘ঝিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন?’

‘হ্যাঁ, এর বেশি আর কিছু ও বলতে পারে নি।’

‘ও আছে এখানে?’

‘হ্যাঁ, বসিয়ে রেখেছি।’

‘চলুন, ওর সঙ্গে দুটো কথা বলে আসি।’

ঝি রান্নাঘরে বসেছিল। সে যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। সদাশিব লক্ষ্য করলেন, ওর বয়স হয়েছে।

ওদের দেখে সে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সদাশিব বললেন, ‘বসো, তুমি।’

ও ধপ করে আবার মাটিতে বসে পড়ল।

‘কি নাম তোমার?’ সদাশিব মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করলেন।

‘মানদা।’

‘কতদিন এখানে কাজ করছ?’

তা বাবু, গেল অথের আগের অথে কাজে নেগিছিলাম।’

‘ক’টার সময় কাজে আসো?’

‘সকাল সাতটায় আসি। আজ এট্টু দেরি হয়ে গেইছিল। বাসন মেইজে, ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে আটটায় চইলে যাই, আবার দশটায় এস্যে বাবুর আন্না করে দিই। যেতি যেতি বেলা সাড়ে এগারোটা হইয়ে যায়। আবার সাঁঝে ছ’টায় আসি, বাবুর এঁটো বাসন মেইজে আত্তের আন্না করে খাবার ঢাকা দিয়ে চলে যাই।’

‘রাত্তিরে কখন যাও?’

‘তা বাবু আটটার আগে হয় না।’

‘বাজার কি তুমিই করতে?’

‘না, এজ্ঞে, বাবু বড় কেপ্পন ছিল। এট্টু বেলায় বাজারে গেলে সস্তায় মাছ পাওয়া যায়···তাই নিজেই বেলাবেলি বাজারে যেত।’

সদাশিব মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘বাবুর কাছে অনেক লোকজন আসত?’

‘তা আসত।’

‘বাবু কোথায় টাকা রাখতেন জান?’

‘শোবার ঘরেই রাখত মনে হয়।’

‘মনে হয় বলছ কেন?’

‘এজ্ঞে, আমার সুমুখে বাবু কখনও বাক্স খুলে টাকা বের করতনি, তবে যারা আসত তাদের অনেককে টাকা দিতে আবার তাদের কাছ থেইকে টাকা নিয়ে ওই ঘরে যেইতে দেখেছি, তাই বলছি।’

‘আচ্ছা, বাবু তোমার সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা কিছু বলত?’

‘না বাবু, আমি ঝি মানুষ, আমার সঙ্গে ওসব কথা কেন বলবে?’

‘তা বটে! আচ্ছা, তোমার বাবুকে কালকে কেমন দেখেছিলে?’

‘রোজই যেমন দেখি। তবে এদানি বাবুর শরীল ভাল চলছিল না, ডাক্তারবাবু আসতেন।’

‘ডাক্তারবাবু কি রোজই আসতেন?’

‘তা পেরায়ই আসতেন, সকাল-সাঁঝ দুবারই আসতেন।’

‘হুঁ! কতদিন হল বাবুর শরীর এমন খারাপ চলছিল?’

‘তা ঠিক দিনক্ষণ বলতে পারবনি, তবে পাঁচ-ছয় মাস হয়তো হবে।’

সদাশিব আর প্রশ্ন করলেন না। বাইরের ঘরে এসে বললেন, ‘মিস্টার সামন্তর যিনি চিকিৎসা করছিলেন, তিনি হয়তো এখুনি এসে পড়বেন। তাঁর কাছ থেকে ভদ্রলোকের অসুখ আর মানসিক অবস্থার কথা জানা যাবে।’

ওপরের ভাড়াটেদের দুজনের নাম সুজন ঘোষ আর কল্যাণ বেরা। মিঃ ঘোষ এল-আই-সি’তে কাজ করেন আর মিঃ বেরা, ব্যাঙ্কে। সন্ধ্যের পর থেকে তাঁরা বাড়িতেই ছিলেন, কোন গুলির আওয়াজ পাননি। অবশ্য রিভলবারে সাইলেন্সর লাগানো ছিল বলেই শব্দ হবার কথা নয়। তাছাড়া দুজনের ঘরেই রেডিও চলছিল। একতলার বইয়ের দোকান যথারীতি আটটার মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তবে মিসেস বেরার মুখে একটা খবর পাওয়া গেল। তাঁর মাথা ধরেছিল বলে ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। ন’টার কিছু পরে একজন ভদ্রমহিলাকে তিনি গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন। ভদ্রমহিলার হাতে একটা অ্যাটাচি কেস ছিল। তিনি ভেবেছিলেন ভদ্রমহিলা বোধ হয় পাশের ফ্ল্যাটে মিঃ ঘোষের বাড়ি এসেছিলেন, মিঃ সামন্তর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক তিনি ভাবেননি।

মিঃ ঘোষ অবশ্য জানালেন, তাঁর ফ্ল্যাটে গত রাতে কেউ আসেনি।

সদাশিব চিন্তামগ্ন হলেন। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই তবে সামন্তর ফ্ল্যাট থেকেই বেরিয়েছিলেন। পুলিশ সার্জনের অনুমান যদি ঠিক হয়, তবে সামন্ত হয়তো ততক্ষণে মারা গেছেন। ভদ্রমহিলা অ্যাটাচি কেসে কি নিয়ে গিয়েছিলেন? আয়রন সেফে রাখা টাকা! তবে ধরে নিতে হবে ভদ্রমহিলা মিঃ সামন্তর চাবির গোছা দিয়ে আয়রন সেফ খুলেছিলেন, তারপর টাকা সরিয়ে সেফ আবার বন্ধ করে চাবির রিংটা মৃতের জামার পকেটে রেখে দিয়েছিলেন।

সদাশিব গুহকে নিয়ে আবার শোবার ঘরে ঢুকলেন। সেটা ভাল করে পরীক্ষা করেও কিন্তু কোন আঙুলের চিহ্ন পাওয়া গেল না। ভদ্রমহিলা যে বেশ সেয়ানা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সদাশিব এবার ঘরের মেঝের দিকে নজর দিলেন। দেয়ালে টাঙানো একটা আয়নার ঠিক নিচে মেঝের ওপর তাঁর দৃষ্টি হঠাৎ থমকে গেল। গুঁড়ো গুঁড়ো কি যেন পড়ে আছে। সদাশিব উপুড় হয়ে ঝুঁকে দেখতে লাগলেন। গোলাপী রঙের ফেস পাউডার। তবে কি ভদ্রমহিলা এই ঘরে প্রসাধন করেছিলেন! অসাধারণ নার্ভ ভদ্রমহিলার, সদাশিব চমৎকৃত হলেন।

তাঁর নির্দেশে গুহ মানদাকে ডেকে পাঠাল।

সদাশিবের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, না, কোন মেয়েছেলেকে বাবুর কাছে কখনও সে আসতে দেখেনি।

সে আরও বলল, তার মনিব কেপ্পন ছিল বটে, কিন্তু চরিত্রে দাগ ছিল না।

বাইরের ঘরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারি ব্যাগ হাতে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক গেট দিয়ে ভেতরে এসে ঢুকলেন। সুপুরুষ, কমনীয় চেহারা, একটু বেঁটে, দাড়ি গোঁফ নিখুঁত কামানো।

ভদ্রলোকের একটু যেন বিমূঢ় ভাব। গুহকে লক্ষ্য করেই তিনি বললেন, ‘আমি মিস্টার সামন্তর হাউস ফিজিসিয়ান, আজ এই সময় আসার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশ কেন? ‘আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘মিস্টার সামন্ত মারা গেছেন।’ গুহ জবাব দিল, ‘আপনি বোধ হয় ডাক্তার চৌধুরী।’

‘হ্যাঁ।’ অপরিচিতের মুখে নিজের নাম শুনে ডাঃ চৌধুরী যেন সামান্য বিস্মিত হলেন! ‘মিস্টার সামন্ত মারা গেছেন! ভদ্রলোকের শরীর কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি মারা যাবেন ভাবি নি।’

‘মারা গেছেন ঠিকই’, গুহ আবার বলল, ‘তবে স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, রিভলবার দিয়ে মুখে গুলি করা হয়েছে।’

ডাঃ চৌধুরীর দুই ভুরু ওপর দিকে উঠে গেল, মুখ দিয়ে বিস্ময়সূচক একটা শব্দ বেরোল।

নিজেকে সামলে তিনি বললেন, ‘আই সী! স্যুইসাইড!’

একটা বড় নিশ্বাস টেনে তিনি মন্তব্য করলেন, ‘ভেরী স্যাড! ভদ্রলোক অবশ্য স্নায়বিক রোগে ভুগছিলেন, আমি ওঁকে বেশি চিন্তা করতে বারণ করেছিলাম, কিন্তু ভাবি নি যে···’

‘আপনি কি মৃতদেহ দেখতে চান?’ গুহ বলল।

‘তা, হ্যাঁ, দেখতে পারি। বাইরে অ্যাম্বুলেন্স এসেছে দেখলাম, আপনারা বোধ হয় বডি রিমুভ করবেন এখন। আমায় কি একটা ডেথ সার্টিফিকেট দিতে হবে?’

ডাঃ চৌধুরী বোধ হয় পেশাগত কর্তব্যবোধে কথাটা বললেন।

‘আমাদের পুলিশ সার্জনই সে ব্যবস্থা করবেন, আপনি আসুন আমার সঙ্গে।’

ডাঃ চৌধুরীকে গুহ ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল।

সদাশিব তাঁর রেশমী চুলে হাত বুলোতে লাগলেন। কোথায় যেন কি একটা অসঙ্গতি রয়ে গেছে, ঠিক ধরতে পারছেন না।

ঘণ্টাখানেক পর। মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুলিশ মিঃ সামন্তর ফ্ল্যাট তালাবন্ধ করে দিয়েছে।

বড় রাস্তায় পড়ার আগে গলির মুখে একটা পানের দোকান। সেই দোকানীকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, গতকাল রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ একজন মেয়েছেলেকে ছোট একটা সুটকেশ হাতে সে যেতে দেখেছে। ঘোমটা একটু নামানো ছিল, মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। একটা ট্যাক্সি থামিয়ে তাকে সে ট্যাক্সি চাপতে দেখেছে। ট্যাক্সির নম্বর দোকানী লক্ষ্য করেনি।

মিঃ সামন্তর টেবিলের ড্রয়ারে একটা খাতা পাওয়া গেল, তার মধ্যে সব খাতকের নাম, ঠিকানা, আর কার কাছে কত পাওনা সব লেখা আছে। সদাশিবের পরামর্শ মত গুহ খাতাটা নিয়ে গেল। প্রত্যেকের সম্বন্ধে খোঁজ খবর করবে। তাদের মধ্যেই কেউ এই মৃত্যুর জন্য দায়ী হলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

কিন্তু দুটো প্রশ্ন সদাশিবকে ভাবিয়ে তুলল।

ভদ্রমহিলা কে, এবং মিঃ সামন্ত বিনা প্রতিবাদে মুখ হাঁ করে খুনীকে গুলি করার সুযোগ দিলেন কেন?

দু-দিন কেটে গেছে, মিঃ সামন্তর মৃত্যু এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। পুলিশ সার্জেনের অনুমান প্রায় ঠিক—মৃত্যুর সময় রাত পৌনে ন’টা থেকে দশটা।

সেদিন সন্ধ্যের সময় ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সমর গুহ এল সদাশিব মিত্রের বাড়ি। দাশু এসে দুটো রেকাবিতে ফিশ ফ্রাই আর কফি দিয়ে গেল।

সদাশিবের প্রশ্নের উত্তরে গরম ফ্রাইয়ের টুকরো মুখে পুরতে পুরতে গুহ জানাল : মিঃ সামন্তর ডায়েরিতে লেখা ঠিকানা দেখে প্রত্যেকের সঙ্গে সে দেখা করেছে। তাদের কাউকে মৃত্যর ব্যাপারে দায়ী করা যায় না। কারণ, ঘটনার দিন রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যে তারা যে অন্যখানে ছিল, তার সাক্ষী সমেত প্রমাণ রয়েছে।

‘হুঁ!’ সদাশিব ছোট্ট একটা উক্তি করলেন।

‘যেদিক দিয়েই এগোচ্ছি,’ গুহ একটু নিরাশ কণ্ঠে বলল, ‘অন্ধ গলিতে আমি বাধা পাচ্ছি।’

‘যে রিভলবারটা পাওয়া গেছে, তার মালিকের হদিশ পাওয়া গেল না?’ সদাশিব প্রশ্ন করলেন।

‘না। নম্বরটা ঘষে একেবারে তুলে ফেলা হয়েছে, তা তো আপনি দেখেছেন। তাছাড়া আজকাল ফায়ার আর্মসের ছড়াছড়ি, বেআইনী ভাবে কতজন যে রিভলবার-বন্দুক রেখেছে, তার হিসেব নেই। ওটার লাইসেন্স আছে কিনা, সে বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে।’

‘তা বটে।’ সদাশিব চিন্তিত মুখে বললেন।

‘কর্নেল চৌধুরীর কাছেও আমি গিয়েছিলাম, যদি তিনি কিছু নতুন সূত্রের সন্ধান দিতে পারেন···’

‘কর্নেল চৌধুরী!’ সদাশিব একটু বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করলেন।

‘মানে ডাক্তার চৌধুরী—মিস্টার সামন্তর হাউজ ফিজিসিয়ান। তিনি আসলে একজন এ-এম-সি, মিলিটারিতে ছিলেন।’

‘আই সী’, সদাশিব যেন স্বগতোক্তি করলেন। ‘এ-এম-সি—মানে আর্মি মেডিকেল কোরের ডাক্তার। তা ওঁর রিটায়ারের বয়স হয়েছে বলে তো মনে হয় না!’

‘উনি নাকি আগেই স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন। বাইরে বাইরে ঘুরতে আর ভাল লাগছিল না, তাই ভলান্টারি রিটায়ার করে এখানে প্র্যাকটিশ শুরু করেছেন।’

‘ও। কতদিন হল উনি কলকাতায় প্র্যাকটিশ করছেন?’

‘বললেন তো বছর দুই।’

‘মিস্টার সামন্তর সঙ্গে পরিচয় হল কেমন করে?’

‘সামন্তরই একজন বন্ধুর মাধ্যমে।’

‘হুঁ, কর্নেল চৌধুরী তবে মিলিটারি থেকে বছর দুই আগে অবসর নিয়েছেন। স্ট্রেঞ্জ!’

গুহ অবাক হয়ে সদাশিবের মুখের দিকে তাকাল। সদাশিবের পরের প্রশ্নে সে একটু হকচকিয়ে গেল।

‘ভদ্রমহিলার কোন সন্ধান পেলেন?’

‘না। তিনি এখনো রহস্যময়ীই রয়ে গেছেন।’

সদাশিব একটা চুরুট ধরালেন। বারকয়েক ধোঁয়া ছেড়ে তিনি বললেন, ‘আমি বোধ হয় অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছি। ওই মহিলাটিই মনে হচ্ছে এই রহস্যের নায়িকা। আপনি বরং কাল সকালে একবার আসুন।’

গুহ আর কথা বাড়াল না, কৌতূহল দমন করেই বিদায় নিল। সদাশিবের গ্রে সেল কাজ শুরু করে দিয়েছে—এটাই তার কাছে মস্ত আশার কথা।

গুহ বিদায় নিতেই সদাশিব দিল্লিতে একটা ট্রাঙ্ককল বুক করলেন।

পরদিন সকালে গুহ এসে দেখে, সদাশিব বেরোবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন। গুহকে তিনি বললেন, ‘চলুন, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।’

‘কোথায় যাবেন?’ সমর গুহ অবাক না হয়ে পারে না।

‘কর্নেল চৌধুরীর ওখানে। ভদ্রলোককে কয়েকটা প্রশ্ন করা দরকার। ভাল কথা, উনি কি ম্যারেড?’

‘না, বিয়ে করেননি।’

কর্নেল চৌধুরী বাড়িতেই ছিলেন। বাড়ি অর্থে দু-কামরার একটা ফ্ল্যাট। বাইরের ঘরটায় তাঁর চেম্বার, ভেতরটা শোবার ঘর। চেম্বারে তখন কোন রুগী ছিল না।

অসময়ে তাঁদের দেখে কর্নেল চৌধুরী বিস্মিত হলেন, তাঁর চোখে-মুখে সে-ভাবটা স্পষ্ট ফুটে উঠল ।

সদাশিবই কথা শুরু করলেন ; ‘আচ্ছা, মিস্টার সামন্তর অসুখটা কি ছিল, বলুন তো?’ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন।

কর্নেল চৌধুরীর চোখ-মুখের ভাব আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। বললেন, ‘লো প্রেসারে ভুগছিলেন। একটা মেলান্‌কোলিয়া ভাব এসে গেছিল।’

‘ও। আচ্ছা, ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন? আই মীন রোগীরা, বিশেষ করে যারা মেলান্‌কোলিয়ায় ভোগেন, তাঁরা অনেক সময় ডাক্তারদের কাছে ব্যক্তিগত বিষয় বলেন শুনেছি।’

কর্নেল চৌধুরীর মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল।

‘না।’ তিনি জবাব দিলেন, ‘তেমন কোন কথা আমাকে তিনি বলেন নি। ভদ্রলোক কাজেও যেমন কৃপণ ছিলেন, কথাবার্তাতেও তাই।’

‘আপনি ওঁকে প্রায়ই দেখতে যেতেন, দু’বেলা?’

‘হ্যাঁ, কিছুদিন ধরে তাই যাচ্ছিলাম, হি ওয়াজ ইনসিসটিং।’

‘যেদিন রাতে উনি মারা গেলেন, সেদিন যেতে পারবেন না বলে চিঠি পাঠিয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কাকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন?’

‘কেন, ডাকে?’

‘চিঠি পাঠাতে গেলেন কেন? ওঁর তো ফোন ছিল?’

‘আমার নেই, কিন্তু আপনার প্রশ্নগুলো বড় বেশি পার্সোন্যাল হয়ে যাচ্ছে না কি?’

‘প্লিজ ডু রিমেমবার দ্যাট উই আর ট্রাইং টু সলভ্‌ এ মার্ডার কেস।’ সদাশিবের কণ্ঠস্বর শান্ত অথচ দৃঢ়।

‘মার্ডার কেস!’ কর্নেল চৌধুরী যেন একটু দিশেহারা হয়ে পড়লেন।

‘কেন, আপনি কি ভেবেছিলেন আত্মহত্যা?’ সদাশিবের কণ্ঠস্বর একটু তীক্ষ্ণ শোনাল।

‘তাই তো ভেবেছিলাম আমি।’

‘ভেবেছিলেন, না সবাই তাই ভাবুক, এটাই চেয়েছিলেন?’

‘কি বলছেন আপনি? আর ইউ ম্যাড?’

‘আর্মিতে থাকার সময় আপনার একটা পয়েন্ট টু টু রিভলবার ছিল। সেটা কি কলকাতায় আসার পর আর রিনিউ করেন নি? ’

কর্নেল চৌধুরী যেন চমকে উঠলেন, সমর গুহ হতভম্ব।

‘আমার রিভলবার ছিল, এ কথা আপনাকে কে বলেছে?’ নিজেকে সামলে কর্নেল চৌধুরী বললেন।

‘ডি. জি. এ এফ এম-এস-এ আমার খুব পরিচিত এক অফিসার আছেন। তাঁকে আমি ফোন করেছিলাম, তিনিই বলেছেন।

‘ও। বাট দ্যাট হ্যাজ বিন স্টোলেন, এখানে আসার পরই সেটা চুরি হয়ে গেছে।’

কর্নেল চৌধুরীর গলা কেমন যেন বিকৃত শোনাল।

পুলিশকে জানিয়েছিলেন?’

‘না···মানে, ঝামেলায় পড়ব ভেবে আর জানাই নি।’

‘আই সী। আপনি মিস্টার গুহকে বলেছেন ভলান্টারি রিটায়ার করেছেন, কিন্তু মাই ইনফরমেশান ইজ দ্যাট ইউ ওয়্যার ফোর্সড টু রিজাইন। টাকা পয়সা সংক্রান্ত কি একটা বিচ্ছিরি ব্যাপারে আপনি জড়িত হয়ে পড়েছিলেন।’

‘মিথ্যে করে আমাকে জড়ানো হয়েছিল।’ কর্নেল চৌধুরী প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

সমর গুহের মনে হল তাঁর গলার স্বরটা যেন মেয়েলি কণ্ঠের আর্তনাদের মত শোনাল।

‘মিথ্যে হলে আপনি সরকারকে ছেড়ে কথা কইতেন না। বরং আপনার বিরুদ্ধেই কর্তৃপক্ষ দয়া করে আদালতে যান নি। যাক সে কথা, এবার আমরা মিস্টার সামন্তের কথায় ফিরে আসি। উনি যে রিভলবারের গুলিতে মারা গেছেন সেটা হল পয়েন্ট টু-টু, অথচ ওঁর নিজেরটা ছিল পয়েন্ট থ্রি-টু, আর আপনার রিভলবারটা কিন্তু পয়েন্ট টু-টু। কি আশ্চর্য কোইনসিডেন্স! আসলে আপনি জানতেন না যে মিস্টার সামন্তেরও, রিভলবার ছিল, তাই আপনারটা দিয়েই খুন করে আত্মহত্যার রূপ দিতে চেয়েছিলেন। খুনের পরিকল্পনা আপনার আগেই মাথায় এসেছিল, আকস্মিক কিছু ঘটনা নয়, তার প্রমাণ রিভলবারের নম্বর আপনি ঘষে তুলে ফেলেছিলেন, যাতে ওটার সঙ্গে আপনার সংশ্রব কেউ এসটাব্লিশ করতে না পারে।’

‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে···’ কর্নেল চৌধুরী চিৎকার করে উঠলেন।

সদাশিব ডান হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে চললেন, ‘খুনের পর মিস্টার সামন্তের রিভলবারটা আপনি আবিষ্কার করেন। তখন ওটা সরিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আপনার। পয়েন্ট থ্রি-টুর বোর আর পয়েন্ট টু-টুর বোর এক নয়, তাই টু-টুর কার্তুজ থ্রি-টুতে ব্যবহার করা যায় না। মিস্টার সামন্তের থ্রি-টু রিভলবারটা মাটিতে ফেলে রাখলে গুলি থেকে পুলিশের বুঝতে কষ্ট হবে না যে ব্যাপারটা সাজানো, এ কথা ভেবেই আপনি পূর্বপরিকল্পনা মত নিজের রিভলবারটা মাটিতে ফেলে রেখেছিলেন আর সরিয়ে ফেলেছিলেন মিস্টার সামন্তের রিভলবারটা। কিন্তু লাইসেন্সে যে ফায়ার আর্মসের ডেসক্রিপশন থাকে, সেটা আপনি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন কিংবা খেয়াল করেন নি। ওই ছোট্ট একটা ভুলই সমস্ত ব্যাপারটা যে সাজানো, মিস্টার সামন্ত আত্মহত্যা করেন নি, তা প্রমাণ করে দিয়েছে। অন্তত লাইসেন্সটাও আপনার সরিয়ে ফেলা উচিত ছিল। তা যদি করতেন, তবে নম্বর তুলে ফেলা আপনার রিভলবারটা পুলিশকে বিপথগামী করতে কিছুটা সাহায্য নিশ্চয়ই করত।

‘রিভলবারটা আপনি সরিয়ে ফেলেছেন কিনা জানি না, কিন্তু মিস্টার সামন্তের দেয়াল সিন্দুক থেকে যে পঞ্চাশ হাজার টাকা আপনি সরিয়েছেন এবং তা এখানেই আছে, তা আমি হলপ করে বলতে পারি। এত তাড়াতাড়ি অতগুলো টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে নিজের ওপর সন্দেহ টেনে আনবেন, অত বোকা নিশ্চয়ই আপনি নন। আপনার বাড়ি আমরা সার্চ করব, ইন্সপেক্টর গুহের সঙ্গে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে।’ অম্লান বদনে শেষের কথাটা সদাশিব বললেন আর গুহ চমকিত হল।

কর্নেল চৌধুরী কিন্তু এবার ভেঙে পড়লেন, কোন রকম প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তিনি যেন হারিয়ে ফেলেছেন।

সদাশিবের অনুমান মিথ্যে হল না। শুধু টাকাই নয়, সামন্তের রিভলবারটাও কর্নেল চৌধুরীর শোবার ঘরে একটা ট্রাঙ্কের তলায় পাওয়া গেল।

পরদিন সন্ধ্যেবেলা সদাশিবের লাইব্রেরিতে বসে কথা হচ্ছিল।

‘কর্নেল চৌধুরীকে আপনি সন্দেহ করলেন কেন?’ গুহ জানতে চাইল। তার কাছে ব্যাপারটা তখনও পরিষ্কার হয় নি।

‘প্রথম দিনই আমার মনে একটা খটকা লেগেছিল,’ সদাশিব মৃদু হেসে বলতে শুরু করেন, ‘ডাক্তার চৌধুরীর চিরকুটটা মূল্যবান সম্পত্তির মত মিস্টার সামন্তের পার্সে স্থান পেল কেন? মনে রাখবেন, তখনও আমরা ডাক্তার চৌধুরীকে কর্নেল চৌধুরী বলে জানি না। আমার কাছে ওটা কেমন যেন অসঙ্গতি মনে হচ্ছিল। একমাত্র যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা যা হতে পারে তা হল, ওটা যাতে সহজেই চোখে পড়ে তাই অমন যত্ন করে রাখা। ডাক্তার লিখেছেন, তিনি সেদিন যেতে পারবেন না, মামুলি একটা চিঠি। কিন্তু সামন্তের মৃত্যর পর পুলিশ যখন তার জিনিসপত্তর পরীক্ষা করবে, পার্সটা নিশ্চয়ই তাদের চোখে পড়বে, আর সেই সঙ্গে চিরকূটটা। অর্থাৎ মৃত্যর দিন ডাক্তার যে সামন্তের বাড়ি যান নি এই অকাট্য প্রমাণ তিনি রাখতে চেয়েছিলেন, আবার ওই চিরকুটটাই যে তাকে প্রমিনেন্ট করে তুলতে পারে এটা তিনি ভাবেন নি। আমার কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন বিসদৃশ ঠেকেছিল, যেন ইচ্ছে করেই এবং উদ্দেশ্য নিয়েই ওটা পার্সে রাখা হয়েছিল।

‘দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, তা হল সামন্তের মুখে গুলি করার ব্যাপারটা। আপনি ঠিকই বলেছিলেন, কেউ হাঁ করে খুনীর রিভলবারের নলের সামনে মুখ বাড়িয়ে দেয় না, কিন্তু ডাক্তারের কাছে দেয়। মিস্টার সামন্তের মাথার ওপর বালব্‌ জ্বলতে দেখে আমি একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম। আত্মহত্যার বেশির ভাগ ঘটনাই দেখবেন ঘটেছে অন্ধকারে, উজ্জ্বল আলোয় নয়। আপনি অবশ্য বলেছিলেন, হয়তো অন্ধকারে আত্মহত্যা করতে সাহসে কুলোচ্ছিল না মিস্টার সামন্তের। ও যুক্তি ধোপে টেঁকে না, বরং ব্যাপারটা একেবারে উল্টো। তাছাড়া আমি বলেছিলাম, আত্মহত্যাই যে করবে ঠিক করেছে, তার আবার অন্ধকারে ভয় কি! অবশ্য তখনও আমি ডাক্তার চৌধুরীকে অতটা সন্দেহ করি নি, ইট ওয়াজ টেকিং এ ফরম ওনলি। আসল ব্যাপার কি ঘটেছিল, তা আমি পরে অনুমান করেছি। ডাক্তার চিঠি পাঠিয়েছিলেন আসবেন না বলে, সেটা কি কারণে তা আগেই বলেছি। ডাকে চিঠি পাঠান ব্যাপারটাও আমার কাছে কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। যা হোক, রাত সাড়ে আটটার পর অর্থাৎ মানদা চলে যাবার পর তিনি সামন্তের বাড়ি যান। একতলায় পাবলিশার্সের দোকান আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দোতলা থেকে কেউ তাকে নজর করছে না, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়েই তিনি সামন্তের দরজায় নক করেছিলেন। মিস্টার সামন্ত নিশ্চয়ই তাকে দেখে মোটেই অবাক হন নি, কারণ ডাক্তার আসলে কোন চিঠিই পাঠান নি।’

‘সেকি!’ গুহ সবিস্ময়ে বলে উঠল।

‘একটা দারুণ চাল চেলেছিলেন ডাক্তার চৌধুরী,’ সদাশিব মৃদু হেসে বললেন, ‘হি ট্রায়েড টু ক্রিয়েট অ্যান ইম্প্রেশান দ্যাট হি হ্যাড সেন্ট লেটার, বাট হি ওয়াজ অ্যাক্‌চুয়েলি ক্যারিং ইট উইথ হিম। আলোর তলায় মিস্টার সামন্তকে বসিয়ে, ডাক্তার স্বাভাবিক ভাবেই পেশেন্টের জিভ দেখছিলেন ; এবং সেই কারণেই মিস্টার সামন্ত বিনা আপত্তিতে মুখ যথাসাধ্য হাঁ করেছিলেন। অতর্কিতে ডাক্তার হাঁ করা মুখের মধ্যে রিভলবারের নল ঢুকিয়ে গুলি করেন। সামন্ত বোধ হয় ব্যাপারটা বুঝতেই পারে নি। ডাক্তারের হাতে হয় দস্তানা ছিল, নয় গুলির পর রুমাল দিয়ে রিভলবারে তাঁর আঙুলের ছাপ মুছে, তিনি সামন্তর আঙুলগুলো রিভলবারের বাঁটের ওপর চেপে ধরেছিলেন ; ফলে রিভলবারে তাঁর আঙুলের ছাপই পাওয়া গেছে। আত্মহত্যার পক্ষে একটা জোরালো যুক্তি। এবার ডাক্তার চিরকুটটা সাবধানে ভাঁজ করে মিস্টার সামন্তর পার্সে রেখে দিলেন। তিনি যে সেদিন আসেন নি তার প্রমাণ আর ওটা যে সত্যিই তিনি পাঠান নি তেমন সন্দেহ করার কোন কারণ থাকতে পারে না।

‘আপনার মুখে কর্নেল চৌধুরী নামটা শুনেই আমার মনে পড়ে গেল, বছর দুই আগে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারে এক কর্নেল চৌধুরীর বরখাস্তের খবর পড়েছিলাম কাগজে। সেই রাত্তিরেই ডি. জি. এ এফ এম এস-এ আমার এক পরিচিতের কাছে দিল্লিতে ফোন করলাম···

‘ভাল কথা,’ গুহ বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘কর্নেল চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের দিনেও আপনি ওই নামটার উল্লেখ করেছিলেন। পুরো নাম কি ওটার?’

‘ডাইরেক্টার জেনারেল আর্মড্‌ ফোরসেস মেডিক্যাল সার্ভিস।’ সদাশিব জবাব দিলেন, ‘আর্মির সব ডাক্তারের পোস্টিং ওখান থেকেই হয়। আমাদের কর্নেল চৌধুরী যে কাগজে প্রকাশিত সেই কর্নেল চৌধুরী, তা দু-চার কথাতেই বুঝতে পারলাম। তাঁর একটা পয়েন্ট টু-টু রিভলবার ছিল, এটা জানবার পর আমার আর কোন সন্দেহ রইল না। কর্নেলের যখন চাকরি যায়, তখন তিনি দিল্লিতেই সদর দপ্তরে ছিলেন, তাই রিভলবারের কথাটা আমার পরিচিতের অজানা ছিল না।’

‘কিন্তু সামন্তকে খুন করল কেন কর্নেল চৌধুরী?’ গুহ প্রশ্ন করে।

‘টাকার লোভে। রোগীদের ডাক্তারদের ওপর একটা সহজাত দুর্বলতা থাকে—গোপন কথা বেফাঁস করে ফেলে। মিস্টার সামন্তর যে ব্যাঙ্কের ওপর আস্থা নেই, সব টাকা বাড়িতে আয়রন সেফে রেখেছেন, তা নিশ্চয়ই কোন দুর্বল মুহূর্তে ডাক্তারের কাছে তিনি বলে ফেলেছিলেন আর সেটাই হল তাঁর কাল।

‘কর্নেল চৌধুরী মনে মনে মতলব এঁটে এগোচ্ছিলেন। ওই দিন রাত সাড়ে আটটার পর তিনি চুপিসাড়ে মিস্টার সামন্তর বাড়ি আসেন। মিস্টার সামন্ত ভেবেছিলেন, ডাক্তার যেমন তাঁকে দেখতে আসেন তেমন এসেছেন। কাজ হাসিল করে ডাক্তার যখন বেরোলেন, তখন তাঁর অন্য চেহারা—এক নারীর ছদ্মবেশ। লক্ষ্য করে দেখেছেন নিশ্চয়ই, কর্নেল চৌধুরীর চেহারার মধ্যে একটা কমনীয়তা আছে? মেয়েদের সাজে তাঁকে ভালই মানায়। অ্যাটাচি কেসের মধ্যে ছদ্মবেশের উপকরণ তিনি নিয়ে এসেছিলেন। ওখান থেকে বেরোবার সময় নোটের বাণ্ডিল, নিজের পোশাক সব ওই অ্যাটাচিতে ভরে শাড়ি আর পরচুলা পরে নেন। আয়নার নিচে মাটিতে গুঁড়ো গুঁড়ো ফেস পাউডার পড়েছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে তিনি মেকআপ করেছিলেন অনুমান করলে অন্যায় হবে না। তিনি জানতেন, ওই ছদ্মবেশে কেউ না কেউ তাকে দেখবে, ফলে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার সুবিধে হবে। অস্তিত্ব নেই এমন এক মহিলার খোঁজে তারা দিশেহারা হয়ে পড়বে। চালটা ভদ্রলোক খেলেছিলেন ভালই।

‘আরো একটা ব্যাপার আমার কাছে বেসুরো ঠেকেছিল। মিস্টার সামন্ত মারা গেছেন শুনেই কর্নেল চৌধুরী বলে উঠলেন আত্মহত্যা। তাছাড়া ডেথ সার্টিফিকেট দেবার আগ্রহটা তাঁর যেন বড় বেশি প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। এসব ক্ষেত্রে দায়িত্ব যে পুলিশ সার্জনের, তা একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের অজানা থাকার কথা নয়। নিজের ওপর থেকে সন্দেহ দূরে রাখার জন্য তিনি ওভার অ্যাকটিং করে ফেলেছিলেন।

‘আমার মনে হয় পার্সের মধ্যে চিরকূট রাখাটাই তাঁর মস্ত ভুল হয়েছে। ওটা না করলে পসিবলি হি উড্‌ হ্যাভ রিমেইণ্ড অবসকিওরড্‌। দ্বিতীয় মস্ত ভুল হল নিজের রিভলবার দিয়ে খুন করা। অবশ্য উনি ভাবতেও পারেন নি যে ওঁকে আমরা সন্দেহ করব। কিন্তু রিভলবারের সূত্রটা আমার মনে হয় গোপন রাখা যেত না। দিল্লি থেকে যখন উনি আসেন তখন নিশ্চয়ই রিভলবারের লাইসেন্স ছিল। সার্ভিসে থাকার সময় বিনা লাইসেন্সে রিভলবার রেখেছিলেন এমন কাজ নিশ্চয়ই তিনি করবেন না। লাইসেন্স রিনিউ একবার অন্তত তিনি করেছিলেন ; ওঁর নামে খোঁজ করলেই লালবাজারের আর্মস্‌ রিনিউয়াল ডিপার্টমেন্টে সেকথা বেরিয়ে পড়ত। লাইসেন্সের নাম্বারটা ঘষে তুলে দিলেই কি সবকিছু গোপন করা যায়?

‘আসল ব্যাপারটা কি জানেন,’ সদাশিব দার্শনিকের মত বললেন, ‘লোভই যে মানুষকে বুদ্ধিভ্রংশ করে, এই কেসটা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।’

দাশু ট্রে’তে কফি আর ডিমের বড়া সাজিয়ে ঘরে ঢুকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *