2 of 2

রিপুসংহার – হীরেন চট্টোপাধ্যায়

রিপুসংহার – হীরেন চট্টোপাধ্যায়

বালিশে কান ঢেকে পড়ে থাকবার চেষ্টা করলাম কয়েক সেকেণ্ড, তারপর চোখ বন্ধ করেই হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিলাম।

সাত সকালে ঘ্যানঘ্যান না করলে বিশ্বশুদ্ধ লোকের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষকে একটু শান্ত হয়ে ঘুমোতে দে না বাপু! রবিবারগুলোও নিশ্চিন্তি নেই।

বালিশে মুখ ঢুকিয়ে আয়েস করে শুলাম।

কাল রাত দুটো পর্যন্ত যে মেয়েটা বেলেল্লাপনা করছিল, তার মুখটা মনে পড়ছিল। ছুঁড়িগুলো পারেও বাবা—এমন ছোঁক ছোঁক করছিল যেন জীবনে এই প্রথম একটা পুরুষের সন্ধান পেয়েছে। আঠার মত আটকে ছিল সর্বক্ষণ, চোখের আড়াল করলেই সর্বনাশ—ম্যাক চৌধুরীর মত লোক যেন জীবনে আসবে না একটাও আর।

নিজের নামটা নিজে মনে মনে উচ্চারণ করে হাসি পেল। আমি, শ্রীযুক্ত মোহন চৌধুরী—মানে তোমরা যাকে বল ম্যাক চৌধুরী, একেবারে শালা গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা! চারদিন আগে যার সঙ্গে মাল খেয়েছি, আজ তার একটা কথা মনে করতে পারলে তোমার ফোরটিন পুরুষের সৌভাগ্যি। সেই ম্যাক চৌধুরীকে কিনা তোর মনে হল স্বর্গ থেকে সদ্য ডেসপ্যাচড দেবদূত! ছুঁড়িগুলো কেন যে আমাকে নিয়ে এত মাতামাতি করে! আরে, আমি শালা একটা বড়লোকের বখাটে ছেলে, সাতকূলে কেউ নেই, নেহাৎ গাড্ডায় পড়ে গিয়ে কলেজের বন্ধু পুলিশ অফিসারের দৌলতে আই-বি ডিপার্টমেন্টে চাকরি নিয়ে পড়ে আছি। টাকা যা পাই সে তো আমার এক সন্ধ্যের খরচ—

ধুৎ, কেন যে সব মাঝরাত্তিরে রিং করে! চোখ জ্বালা করছিল, ঘুম আসছিল না, পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছি—মোটর সাইকেলের আওয়াজ পেলাম।

নাও, আর শুতে হবে না—মূর্তিমান শনি এসে গেছেন!

ঠিক তাই। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনেই বুঝেছি—নক্ করার জন্য অপেক্ষা না করেই দুয়ার খুলে ভুরু কুঁচকে তাকালাম।

‘কি ব্যাপার, মেজাজ খুব শান্ত নয় মনে হচ্ছে!’

‘রাত দুপুরে উৎপাত আরম্ভ করলে কেউ খুশি হয় না।’

‘রাত দুপুর?’ শুভেন্দু হাত উল্টে ঘড়ি দেখল, আমাকে সরিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘আমার ঘড়ি ঠিক চলছে তো? সকাল আটটায় যদি বলিস—’

‘আমার ঘড়িটা একটু আলাদা—’বিছানাতেই আধশোয়া হয়ে একটা সিগারেট টেনে নিলাম, ‘এনি ওয়ে, ব্যাপার কি বল, রাত্তিরে ট্রাঙ্কল করে যে কেসটা বলেছিলি, সেইটেই তো?’

‘অনেকটা তাই।’

‘কৃষ্ণনগরের একটা হোটেল থেকে রিং করেছিলি, খুন হয়েছে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ—এইটুকু মনে আছে, বাকিটা—’ আমি সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ‘দশটার পর সব কথা আমার কানে ঢোকে না।’

‘আবার বলছি—’ শুভেন্দু পা দুটো একটু ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আটটা নাগাদ কৃষ্ণনগর থেকে খবরটা লালবাজারে আসে। আমাকে যাবার জন্য অনুরোধ করলে আমি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যাই।’

‘মেক ইট ব্রীফ—’ আমি বললাম, ‘ঘটনাটা কি?’

‘একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরকে কৃষ্ণনগরের এক হোটেলে গুলি করে মারা হয়েছে।’

‘চিনিস?’

‘না। কলকাতার লোক, ঠিকানা দেখে বুঝেছি। তবে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশনের ব্যাপারে শুধু কলকাতাতেই এত লোক আছেন যে সকলকে চেনা মুশকিল।’

‘নাম কি?’

‘ভূদেব সিংহ রায়।’

‘কলকাতার ঠিকানায় গিয়েছিলি?’

‘হ্যাঁ। তিন ভাই একসঙ্গে থাকেন। ভূদেববাবু মেজো, এখনও বিয়ে করেননি। ওঁরা বললেন, পরশুদিন ভূদেববাবু বাড়ি থেকে যান।’

‘হোটেল কি বলল?’

‘পরশুদিন বিকেলে উনি হোটেলে উঠেছিলেন। অনেক রাতে ফিরেছেন। পরদিন খুব সকালেই বেরিয়ে যান—ফেরেন সন্ধ্যোবেলা। ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অ্যাটাকড্ হন। গুলির শব্দ শুনে সকলে সচকিত হয়ে দৌড়ে তাঁর ঘরে যান, কিন্তু তখন আর কিছু করবার ছিল না।’

‘হোটেলটা ক’তলা!’

‘দোতলা হোটেল, দোতলাতেই তিনি ছিলেন।’

‘হত্যাকারীকে নিশ্চয়ই ধরা যায়নি?’

‘না, কিন্তু হোটেলের মালিক ও অনেকেই তাকে রেন পাইপ বেয়ে নামতে ও পালাতে দেখেছে।’

‘তাহলে অবশ্য হোটেলের অন্য লোকদের জেরা করে বিশেষ লাভ হবে না, তাও তুই করেছিস বোধ হয়?’

‘হ্যাঁ, মনে হয় কেউ ইনভলবড্ নয়।’

‘খুব স্বাভাবিক— পিটার চা নিয়ে এসেছিল, বেশ ভাল করে একটা চুমুক দিয়ে ঘুমটা ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর বললাম, ‘ভদ্রলোক কেন ওখানে গিয়েছিলেন জানা গেল?’

‘না।’ শুভেন্দু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তবে কে ওঁকে অ্যাপয়েন্ট করেছে, সেটা জানতে পেরেছি।’

‘হাউ?’

‘চারশো টাকার একটা চেক এর পার্সে ছিল। সইটা বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু সকাল ছ’টা নাগাদ কলকাতায় ফিরে সেই অ্যাকাউণ্টারধারীর সন্ধান করেছি।’

‘চমৎকার!’ আমি বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকালাম, ‘তুই যে দেখছি, আমার চেয়েও প্রম্পট্ হয়ে উঠলি! কি করে সন্ধান পাওয়া গেল?’

‘ব্র্যাঞ্চ-ম্যানেজারকে কনট্যাক্ট করে ব্যাপারটার আর্জেন্সি বুঝিয়ে দিলাম,উনি নিজে গিয়ে সব ব্যবস্থা করলেন।’

বিশ্বাস হচ্ছিল না। শুভেন্দুকে অবশ্য আমি চিনি, ছোটবেলা থেকেই ভীষণ সিরিয়াস ও। কিন্তু এক্ষেত্রে যে তৎপরতার পরিচয় ও দিয়েছে, ভারতবর্ষে তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া শক্ত। রাত আটটায় জীপ নিয়ে কৃষ্ণনগর যাওয়া, সেখানকার ডিউটি সেরে ছ’টার মধ্যে কলকাতায় ফেরা এবং ব্যাঙ্কে এই ধরণের খবর সংগ্রহ করে আবার আমার কাছে আসা।

সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘ভদ্রলোক কোথায় থাকেন?’

‘কালীঘাটে। নাম বিরূপাক্ষ ভদ্র। বয়স প্রায় সত্তর, বলতে গেলে ইনভ্যালিড।’

‘কি বললেন ভদ্রলোক, কেন অ্যাপয়েন্ট করেছিলেন প্রাইভেট গোয়েন্দা?’

‘কিছু বললেন না।’

‘কারণ?’

‘কারণ, শুভেন্দু আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে বলল, ‘হি ইজ ডেড। কাল রাত্রেই মারা গেছেন।’

আমি বিছানার ওপর সোজা হয়ে উঠে বসলাম। শুভেন্দু সাধারণত ভাল কেস না হলে আমার কাছে আসে না। কিন্তু এটা যেন তার মধ্যেও একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে।

পিটারকে চেঁচিয়ে ডাকলাম, আর এক কাপ করে চা দিতে বলে আর একটা সিগারেট ধরালাম। বললাম, ‘কি ধরণের মৃত্যু?’

‘ন্যাচারাল ডেথ। অন্তত ডাক্তারের মতে।’

‘ডাক্তার ছিলেন তখন?’

‘তখনই এসেছিলেন। শুভেন্দু সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলল, ‘আমি ওখানে গিয়ে পৌঁছই সাতটা নাগাদ। সকাল ছ’টায় চাকর চা দিতে গিয়ে প্রথম মৃতদেহ আবিষ্কার করে। ভয় পেয়ে সে খবর দেয় ওঁর পুত্রবধূকে—তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানকে ফোন করেন। ডক্টর সান্যালকে আমিও একটু আধটু চিনি। আমি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে তিনি বললেন, ভদ্রলোক অনেকদিন ধরে ভুগেছিলেন—দু’বার স্ট্রোক হয়ে গেছে, অ্যাকিউট হার্ট পেশেন্ট। এই ধরণের মৃত্যুই এক্সপেক্টেড ছিল।’

‘তিনি জোর দিয়ে বলছেন, এটা ন্যাচারাল ডেথ?’

‘বলছেন এবং এও বলছেন যে, তিনিই পুলিশে খবর দিতে বারণ করেছেন।’

‘পুলিশে খবর দিতে বলেছিল কে?’

‘বিরূপাক্ষবাবুর পুত্রবধূ গীতা দেবী। শুভেন্দু জোরে একবার সিগারেটে টান দিয়ে বলল, ‘বুঝতে পারছিস নিশ্চয়ই কেসটা, কিরকম ইন্টারেস্টিং! বিরূপাক্ষবাবু কোন অজ্ঞাত কারণে অ্যাপয়েণ্ট করলেন একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। তাঁর মত একজন ইনভ্যালিড বৃদ্ধের যে এরকম কি কারণ থাকতে পারে, সে কথা বোঝা খুবই মুশকিল। যাই হোক, সেই ইনভেস্টিগেটর, আই মীন ভূদেববাবু মারা গেলেন কাল কৃষ্ণনগরে এক আততায়ীর হাতে এবং এদিকে রাত্রের কোন সময় মারা গেলেন ভদ্রলোক নিজে। ডাক্তার বলছেন এটা ন্যাচারাল ডেথ, কিন্তু মন কি বলে।’

‘আর কিছু?’

‘ভদ্রলোক প্রচণ্ড টাকা-পয়সার মালিক—ব্রাঞ্চ-ম্যানেজার যেরকম আভাষ দিলেন, লাখ দশেকের মত অ্যাকাউন্ট রয়েছে ব্যাঙ্কে।’

‘বাড়িতে আর কে কে আছেন?’

বাড়িতে সর্বসমেত লোক এখন তিনজন—বিরূপাক্ষবাবু বাদে অবশ্য। একমাত্র মেয়ে-জামাই বাড়িতেই থাকেন, পুত্রবধূ গীতা দেবীর কথা আগেই বলেছি। তিনি বিধবা, স্বামী প্রশান্ত ভদ্র বিরূপাক্ষবাবুর ছোটছেলে—কি করে মারা যান সেকথা অবশ্য জানি না। বিরূপাক্ষবাবুর বড় ছেলে সুশান্ত ভদ্র কাজ করেন বোম্বেতে, সপরিবার সেখানেই থাকেন—তাঁকে আসবার জন্য ওয়্যার করা হয়েছে।’

‘দিস মাচ?’

‘ইয়েস।’

‘আমায় কি করতে হবে?’

‘বারো ঘণ্টার পর ঘুরছি—প্লাস রাত্রি জাগরণ। আজকে আর আমার দ্বারা কিছু করা সম্ভব নয়। একমাত্র তোর ওপর কেসটার ভার ছেড়ে দিতে পারি—চিন্তা করে দ্যাখ।’

সিগারেটের অনেকখানি ছাই ঝেড়ে ফেলে বললাম, ‘পুলিশ পাহারা আছে?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘ভূদেববাবুর ডেডবড়ি?’

‘মর্গে। আজ বিকেলে রিপোর্ট পাওয়া যাবে।’

আমি ঘাড় নাড়বার সঙ্গে সঙ্গে শুভেন্দু আমাকে ঠিকানাটা এগিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘আমি তোকে পৌঁছে দিয়ে আসব?’

‘দরকার নেই, তুই নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারিস বাড়ি গিয়ে।’

‘সিওর?’

‘সিওর।’

তৈরি হতে আমার মিনিট পনেরোর বেশি লাগবে না, সেই অবসরে গোটা ব্যাপারটা চিন্তা করে নেবার চেষ্টা করলাম।

দুটো মৃত্যুর মধ্যে একটা যোগ আছে, এইটাই শুভেন্দুর ধারণা। যদি প্রমাণিত হয় বিরূপাক্ষবাবুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক, তাহলে আমার আর কিছু করবার থাকছে না।

দুটো মৃত্যুর মধ্যে যদি কোন যোগাযোগ থাকে, তাহলেও দুটি ক্ষেত্রে হত্যাকারী এক লোক হতে পারে না। কৃষ্ণনগরে প্রথম রাতে একটা মার্ডার করে কালীঘাটে সেই রাতেই আর একটা মার্ডার—সময় যদি কোনরকম করে পাওয়াও যায়, কোন মানুষের সেরকম নার্ভ থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

সেভ করতে করতে মনে হল, বুড়োকে মেরে কার কি লাভ হতে পারে! বুড়ো যদি কোন অদ্ভুত ধরণের উইল টুইল না করে থাকে, তাহলে দুই ছেলে এবং এক মেয়েই আইনত সম্পত্তির উত্তরাধিকার পাবে, সুতরাং এদের মধ্যে কারও মোটিভ খুব স্ট্রং নয়। ডাক্তারটি বলছে, এটা ন্যাচারল ডেথ, শুভেন্দু নিজেও তাকে চেনে বলেছে— আপাতদৃষ্টিতে ডাক্তারকে মিথ্যাবাদী ভাবার কোন কারণ পাওয়া যাচ্ছে না।

শুভেন্দু যাওয়ার আধঘণ্টা পরেই আমি কালীঘাট পৌঁছে গেছি।

মাঝারি ধরণের দোতলা বাড়ি। সামনে পুলিশ পাহারা ছিল, ভেতরে ঢুকেই একজন সাব-ইন্সপেক্টরের দেখা পাওয়া গেল।

‘আসুন স্যার, ও-সি আমায় চার্জ দিয়ে গেছেন।’

‘ধন্যবাদ। বাড়ি থেকে কেউ যায়নি তো?’

‘না স্যার।’

‘ডেডবড়ি কোথায়?’

‘ওপরের ঘরে, যাবেন?’

‘চলুন।’

সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকের একেবারে শেষ ঘরটায় গিয়ে থামলাম। বেশ বড়সড় ঘর। এক দিকের দেওয়ালের সঙ্গে প্রায় লাগান খাট। পাশেই বিরাট বুককেস, মন্দ বই নেই তাতে।

এদিকে একটি সোফাসেট ও গোটা দুয়েক চেয়ার—চেয়ার দুটো নিয়ে আসা হয়েছে মনে হল। সোফাসেটে দুজন ভদ্রমহিলা বসেছিলেন। একটি চেয়ারে প্রায় বছর চল্লিশের পরিপাটি এক ভদ্রলোক। ভদ্রমহিলাদের বয়স আন্দাজ করার ক্ষমতা আমার নেই—কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে যাহোক একটা কিছু হবে। একজন বিধবা, অপরটি সধবা—এই মাত্র বলতে পারি।

সাব-ইন্সপেক্টর ছোকরাটি পরিচয় করিয়ে দিল, ‘ডক্টর সান্যাল, গীতা দেবী আর উনি কুসুম দেবী—মিস্টার ভদ্রর মেয়ে।

মৃতদেহ দেখবার আগেই ডক্টর সান্যাল একবার রূঢ় দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। বললেন, ‘কি ব্যাপার বলুন তো? একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে পুলিশ একেবারে হৈচৈ লাগিয়ে দিয়েছে!’

হাসলাম। বললাম, ‘পুলিশ এটাকে সামান্য মনে করছে না।’

‘কিন্তু কেন?’ প্রায় গর্জন করে উঠলেন ডক্টর সান্যাল, ‘আমি আজ চার মাস ধরে ওঁর ট্রিটমেন্ট করছি—আমি যেখানে সার্টিফাই করছি উনি মারা গেছেন খুব স্বাভাবিক কারণে, হার্টফেল করে—সেই মতটার কোন গুরুত্ব নেই?’

‘অবশ্যই গুরুত্ব আছে— আমি সিগারেটের প্যাকেট বার করে বললাম, ‘আপনি সিওর এটা ন্যাচারাল ডেথ?’

‘হানড্রেড পার্সেন্ট। আমি তো বলেই দিয়েছিলাম হি মাইট ডাই এনি মোমেন্ট। এত ভ্যারিয়েবল ব্লাডপ্রেসার এবং ইররেগুলার পাল্‌স্‌বিট যে মানুষের, তার হার্ট ফেলিওর তো মোটেই আশ্চর্য ব্যাপার নয়।’

‘আমি একবার ডেডবডি দেখলে কি আপনার আপত্তি আছে?’

‘দেখুন না।’

ডাক্তারটি নেহাৎ মিথ্যে বলেন নি, ভদ্রলোকের মুখে-চোখে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোন ছাপ নেই। দেহের সর্বাঙ্গ অক্ষত, গলায় কোনরকম কালশিটের দাগ নেই। বার বার চোখ বুলিয়েও তার অন্য কোন কারণ লক্ষ্য করা গেল না।

মৃতদেহ ঢাকা দেবার পর চেয়ারে এসে বসলাম। বললাম, ‘মিস্টার ভদ্র রাত্রে শোবার সময় স্লীপিং ট্যাবলেট খেতেন?’

‘হ্যাঁ, আমিই প্রেসক্রাইব করেছিলাম। রোজ রাত্রে দুটো করে খেতেন, কালকেও তাই খেয়েছেন।’

‘কে খাইয়েছেন?’

‘আমি।’ বিধবা ভদ্রমহিলা বললেন, ‘রোজ রাতে ওঁকে কিছুক্ষণ করে মহাভারত পড়ে শোনাতে হত। তারপর স্লীপিং ট্যাবলেট খাইয়ে আলো নিবিয়ে আমি চলে আসতাম। কালকেও তাই করেছি।’

‘দরজা খোলাই থাকত?’

‘হ্যাঁ। অসুস্থ শরীর, ডাকলে যাতে আমরা শুনতে পাই সেজন্যেই এই ব্যবস্থা।’

‘আপনি কোন ঘরে শুতেন?’

‘ঠিক আগের ঘরটা।’

‘কাল যখন চলে আসেন, তখন কিছু বুঝতে পারেননি?’

‘কিচ্ছু না।’

‘রাতে কোন শব্দও শুনতে পাননি?’

‘না!’

এবার ফিরলাম অন্য ভদ্রমহিলার দিকে। কি যেন নাম, কুসুম না কি—বললাম, ‘আপনি কোন ঘরটায় থাকেন?’

‘একেবারে বাঁদিকে।’

‘আপনিও কিছু বুঝতে পারেননি?’

‘কিচ্ছু না।’

‘আপনার স্বামীকে দেখছি না? তিনি বাড়িতে নেই?’

‘আছেন, মানে—’ কুসুম একটু ইতস্তত করল, ‘শনিবার উনি মাঠে যান, একটু আধটু ড্রিঙ্ক করেন, সকালে উঠতে অসুবিধে হয়—’

অথাৎ, রেসের মাঠে এমন কীর্তি করেন যে সকালে বাবু ঘোড়ার স্বপ্ন দেখেন। মালটি চেনা হবার চান্স আছে। খুব একটা মহাপুরুষ যে নয় তাও আন্দাজ করতে পারছি। কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলাম, সেই অবসরে ডক্টর সান্যাল বললেন, ‘তাহলে কি ডিসাইড করলেন?’

‘কিসের?’

‘ডেডবডি ছেড়ে দিন, আর কতক্ষণ রেখে দেবেন, ওঁদের তো এখন অনেক কিছু করণীয় আছে—’

‘আয়্যাম সরি ডক্টর—’ আমি বললাম, ‘মৃতদেহ একবার মর্গে পাঠানো দরকার বলে আমার মনে হচ্ছে, একটা অটপ্সি করতে হবে।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ ডাক্তার আপন মনে গজরাতে লাগলেন, ‘এসব ব্যাপারেও কি আপনারা আমার চেয়ে ভাল বোঝেন নাকি?’

‘ভাল বোঝার কথা নয়, দিস ইজ ইম্পর্টান্ট—’ ঘরে অ্যাসট্রে দেখতে না পেয়ে আমি সিগারেটের টুকরোটা বাইরে ছুঁড়ে দিলাম, ‘কারণ এই মৃত্যুর সঙ্গে আরেকটা মৃত্যু জড়িয়ে আছে। কালকে ভূদেব সিংহ রায় বলে একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর খুন হয়েছেন।’

‘কে ভূদেববাবু? আমরা তাঁকে চিনি না।’

‘কিন্তু মিস্টার ভদ্র তাঁকে চিনতেন, তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্সও তিনি সিক করেছিলেন।’

‘ওসব গাঁজাখুরি গল্প আমি শুনতে চাই না। আমি এঁদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান, আমার মত ইগনোর করে আপনি ডেডবডি মর্গে পাঠাচ্ছেন সেকথা মনে রাখবেন। যদি আপনি কিছু না পান, তাহলে আমি আপনার নামে আদালতে নালিশ করতে বাধ্য হব।’

ডাক্তারের মুখের দিকে তাকালাম। ওকে জানিয়ে দেব, আমার নাম ম্যাক চৌধুরী—অত ছোটখাটো হুমকিতে আমি ভয় পাই না। যাক, দরকার নেই। আমার বরং হাসিই পাচ্ছিল, বললাম, ‘একশোবার। আপনি সম্মানিত লোক, মানহানি করার চেষ্টা করলে আপনি ছেড়ে দেবেন কেন! তবে আপাতত আপনার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই।’

এস-আই-এর দিকে চেয়ে বললাম, ‘ডেডবড়ি মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে নিচে আসুন, জবানবন্দিটা নোট করবেন।’

প্রথমে এল চাকর, যে প্রথম ডেডবডি লক্ষ্য করেছে। দুটো একটা মামুলি প্রশ্ন করে তাকে ছেড়ে দিলাম।

ঠাকুরকে দেখেও আমার সন্দেহজনক কিছু মনে হল না। এস-আই ছোকরাটি কিছু উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করল, সেই সুযোগে আমি আর একটা সিগারেট ধরালাম।

গীতা দেবীকে দেখে আমি সোজা হয়ে বসলাম। বললাম, ‘কয়েকটা অত্যন্ত ইনফরম্যাল প্রশ্ন করব, যদি কিছু মনে না করেন।’

‘বলুন না।’

‘আপনার বিয়ে হয়েছে কতদিন আগে?’

‘মাস ছয়েক হবে।’

‘মাত্র?’ সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বললাম, আপনার স্বামী মারা যান কতদিন আগে?’

‘বিয়ের মাসখানেক পর। বেড়াতে গিয়েছিলাম কালিম্পং, সেখানে একটা উঁচু টিলা থেকে পা পিছলে পড়ে যান উনি—ডাক্তাররা চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি।’

‘স্যাড।’ আমি সমবেদনা জানালাম। ‘আপনার শ্বশুরমশাই-এর এইরকম স্বাস্থ্যই আপনি দেখছেন এসে থেকে?’

‘হ্যাঁ, তখনই ওঁর দুটো স্ট্রোক হয়ে গেছে।’

‘আপনার কি মনে হয়, ওঁর মৃত্যু ন্যাচারাল?’

‘তাই তো মনে হয়।’

‘তাহলে পুলিশে খবর দিতে বলেছিলেন কেন?’

‘সেইটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল, সন্দেহের যদি নাও থাকে, পুলিশে একবার জানিয়ে রাখাটা খারাপ কিসের।’

‘রাইট। এই মৃত্যু সম্বন্ধে আর কোন খবর দিতে পারেন?’

‘ঠিক বুঝতে পারছি না। বাবার প্রতিদিনের যে রুটিন, তার তো একটুও নড়চড় হয়নি, কোন অস্বাভাবিক কিছুও দেখিনি।’

‘ঠিক আছে, আপনি এখন আসুন।’

কুসুমের সঙ্গে কথা বললাম মিনিট দশেক। খুব চাপা মেয়ে। কিছু চাপতে চেষ্টা করছে কিনা বুঝতে পারলাম না, তবে নতুন কোন তথ্য পাওয়া গেল না।

নতুন মুখের দেখা পেলাম তার পরেই।

ওই মেয়েটার স্বামী, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

পুরোপুরি একটি মদ্যপ। রেসের মাঠে লোকটাকে নিশ্চয়ই দেখেছি। যদিও কবে কোনখানে দেখেছি, ঠিক মনে করতে পারছি না। তখনও চোখ লাল। মনে হয়, রাত্রে ফিরে পোশাকও পাল্টাননি।

বললাম, ‘খবর শুনেছেন?’

‘শুনলাম বৈকি।’ ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে আমার প্যাকেট থেকে বেমালুম একটি সিগারেট ঠোঁটে রাখলেন। ‘তা এই নিয়ে এত হৈ-চৈ কেন, শ্বশুরমশাই তো গঙ্গাজলে একপা ডুবিয়ে বসেছিলেন!’

‘তা ছিলেন। তবে পুলিশের সন্দেহ, নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই তাঁর গঙ্গাপ্রাপ্তির ব্যাপারটা কেউ সহজ করে দিয়েছেন। জ্বলন্ত সিগারেট থেকে আর একটি ধরিয়ে নিয়ে বললাম, এই কাজটা করার ব্যাপারে কারও স্বার্থ আছে বলে আপনার মনে হয়?’

ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘দেখুন মশাই, আমাকে যত গুরুত্ব আপনি দিচ্ছেন ততটা এ বাড়িতে কেউ দেয় না। দেবেই বা কি করে বলুন, মান-সম্মান বলতে কি আর আছে আমার। নিজে যেচে যখন ঘরজামাই হয়েছি, তখন বুঝতেই পারছেন আমি ফুঁকো নবাব। উপার্জনের কোন ক্ষমতা নেই, নেশা-ভাং করি, পয়সাকড়ির ধান্দায় রাতদিন ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছি—তবে হ্যাঁ, চোখ আর কান এ দুটো ঠিক খোলা আছে। সেদিক থেকে বলতে পারি, ও বুড়োকে খুব একটা ভাল চোখে কেউ দেখত না।’

‘সে কি? ওঁরই বাড়িঘর সম্পত্তি অথচ—’

‘ওই তো, বলে কে! আমি যদ্দিন এখানে আছি—তা ধরুন, নয় নয় করে আজ পাঁচ-ছ’ বছর, ওই এক কেস দেখে আসছি। আমার শ্বশুড়ীঠাকরুণ নাকি মারা গেসলেন, কুসুম—মানে আমার পরিবারের পাঁচ বছর বয়সে। থাকবার মধ্যে ওই বুড়ো। তা, বড়ছেলে তো এই পাঁচ-ছ’বছরে এখানে পা দিয়েছে মাত্র একবার। ছোট শালাটি আবার বাড়িতেই থাকত খুব কম—ক’মাস আগে দুম করে কি একটা রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে করল, আবার অ্যাকসিডেন্টে মারাও গেল। আর, ওদের কথাই বা কি বলি, আমার পরিবারটিকেও তো বিশেষ মাড়াতে দেখতাম না ওদিক—’

‘আপনি নিজে?’

‘আমি?’ ভদ্রলোক হেসে ফেললেন, ‘দূর মশাই, আমি হচ্ছি গিয়ে একটা অপদার্থ কুষ্মাণ্ড! আমাকে কারও ভাল লাগতে পারে? বুড়ো আমাকে বিশেষ দেখতে পারত না।’

‘যা জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি খেই ধরিয়ে দিলাম, ‘বুড়ো মরলে কারও সুবিধে আছে বলে আপনার মনে হয়?’

‘দেখুন, সুবিধে বলতে আমি বুঝি আর্থিক সুবিধে—মনটা ছোট তো! না, সে সুবিধে কারও আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, বুড়ো ইদানীং ওই ডাক্তারটিকে খুব সুনজরে দেখত না।’

‘সেকি! কেন?’

‘কি জানি, একদিন আমি বলতে শুনেছিলাম—তোমাকে দিয়ে আর চলছে না ডাক্তার, আমি অন্য কাউকে দেখাব এবার।’

‘কারণটা আপনি জানেন। জানেন না?’

ভদ্রলোক একটু চোখ পিটপিট করে বললেন, ‘ধরেছেন ঠিকই, তবে বলি শুনুন—’ গলাটা একটু নামিয়ে বললেন, ‘ওই ডাক্তারবাবুটি হচ্ছেন বিধবা, কিন্তু লোভ পড়েছে এই বাড়ির বিধবার ওপর। সেইটেই বুড়ো ভাল চোখে দেখতে পারছিল না বোধ হয়।’

একটু আন্দাজ যে না করেছিলাম এমন নয়, এখন ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হল। কিন্তু সেকথা বুঝতে না দিয়ে বললাম, ‘সেকি মশাই, গীতা দেবীকে তো বেশ নিষ্ঠাবতী বলেই মনে হয়!’

‘ওই তো মজা মশাই, সবাই দিব্বি সতী—’

কথার মাঝখানেই অকস্মাৎ ডাক্তারের প্রবেশ। বেশ উষ্মামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে এলাম। অপমান আমাকে যা করবার সবই তো করলেন—এখন রুগী ক’টা রাখতে দেবেন, না সেও তাড়াবেন?’

‘মানে?’

‘আমি এখন ফিরতে পারি?’

‘ব্যাপারটার মীমাংসা না হলে কি করে ফিরবেন?’

‘তার মানে?’

‘মানে খুব সহজ, অটপ্সি না হওয়া পর্যন্ত কাউকে এ বাড়ি থেকে বেরোতে দেয়া হবে না।’

‘হোয়াট ডু ইউ মীন!’ গর্জে উঠলেন ভদ্রলোক, ‘জানেন, আপনার এই জুলুমের জবাব কি?’

‘পরে জেনে নেব’, আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, আপাতত, যার প্রয়োজন সে পুলিশ-পাহারায় কিছুক্ষণ ঘুরে আসতে পারে এবং সে নির্দেশ না মানলে তাকে পুলিশলকআপে থাকতে হবে।’

সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘জবানবন্দিটা শুভেন্দুর কাছে পাঠিয়ে দেবেন। অন্তত ছ’ জন আর্মড গার্ড রাখবেন বাড়িতে। শুভেন্দুর কাছ থেকে পারমিশন না পাওয়া পর্যন্ত এ বাড়ির কাউকে বেরোতে গেলে পুলিশ সঙ্গে থাকবে।’

আহত বাঘের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি অবজ্ঞা করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। অনেকটা রিস্ক নেওয়া হয়েছে, তা হোক। মার্ডারের মোটামুটি ছক আমার কাছে এখন একটু পরিষ্কার। সারা দুপুর আমায় ভাবতে হবে, তার আগে বলে আসতে হবে অটপ্সি খুব আর্জেন্ট—সন্ধ্যের মধ্যে সারা চাই। আপাতত, গলাটা খুব শুকিয়ে উঠেছে, একবার পার্ক স্ট্রীট হয়ে গেলে মন্দ হয় না।

ঘড়ির কাঁটা নয় ছুঁই ছুঁই। লালবাজারে বসে পুরোন অপরাধীদের খাতা তন্নতন্ন করে খুঁজছিলাম।

হঠাৎ দৃষ্টি আটকে গেল, কোন ভুল নেই।

বর্ণনাটা দ্রুত পড়ে ফেললাম।

নিখুঁতভাবে মিলে যাচ্ছে আমার ছকের সঙ্গে।

পড়া তখনও শেষ হয়নি, অটপ্সির রিপোর্ট হাতে এল।

সাফল্যের ছোঁয়া পেলে বুকের মাঝখানে যে অনুভূতি জাগে, ঠিক সেই অনুভূতি এখন স্পষ্ট।

একটা সিগারেট ধরিয়ে শুভেন্দুকে রিং করলাম।

শুভেন্দু যখন এসে হাজির, তখন আমার বক্তব্য আমি সব ঠিক করে ফেলেছি।

‘হ্যালো ম্যাক! এনি সাকসেস?’

‘আমার যা করণীয় ছিল করে রেখেছি, এখন তোর ব্যাপার, তুই বোঝ।’

‘অথাৎ?’

‘তোর ফার্স্ট কোয়্যারী ছিল, মৃত্যুটা ন্যাচারাল কিনা, তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘রিপোর্ট বলছে, মৃত্যু আনন্যাচারাল, অর্থাৎ মার্ডার।’

‘ফাইন। মৃত্যুর কারণ?’

‘মৃত্যুর কারণ ক্লিনিক্যাল নয়, ডক্টর ওয়াজ রাইট। ক্লিনিক্যালি কিছু ডিটেক্ট করার উপায় নেই। মৃতদেহের চুল কেটে ব্যাপারটা ধরা গেছে। বাঁ কানের ঠিক ওপরে খুব ধারালো অথচ ছোট্ট কোন অস্ত্র—ধর তুরপুণ বা চাল খোঁচানো বোমাব মত সূক্ষ্ম অস্ত্র দিয়ে ব্রেনে হেমারেজ ঘটানো হয়েছে। সম্ভবত স্লীপিং পিল খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটেছে। ফলে, অসুস্থ মানুষ, বাধা দেবার সুযোগ পাননি।’

‘কি সর্বনাশ!’ শুভেন্দু বলল, ‘এত বড় প্ল্যানড্ মার্ডার!’

‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম, ‘ঘটনা যখন রাত্রে ঘটেছে, সে অস্ত্রটাও এখন খুব বেশি দূরে যায়নি। তন্নতন্ন করে খুঁজলে সেটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।’

‘যদি বাড়ির পাঁচশো গজের মধ্যে থাকে, আমি নিশ্চয়ই বার করব।’ শুভেন্দু বলল, কিন্তু বিনা রক্তপাতে ব্যাপারটা ঘটল কি করে?’

‘যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে রক্তপাত বাইরে খুব বেশি হবে না। আমি প্যাকেট বার করলাম, ‘একটু আধটু যা হয়েছে, তা নিশ্চয়ই মুছে ফেলা হয়েছে।’

শুভেন্দু আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে দেখে আমি হেসে ফেললাম। বললাম, কি ভাবছিস? এবার গিয়ে দুম করে ডাক্তারকে অ্যারেস্ট করবি?’

শুভেন্দু কথা বলল না। আমি সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ‘ঘটনাটা কি ঘটেছে তোকে আমি বলতে পারি, কিন্তু প্রমাণের দায়িত্ব তোর। ডাক্তার বেচারী প্রেম করে মরেছে—তাকে আজ রাত্রেই ছেড়ে দে। তোর আসল কালপ্রিট গীতা দেবী।’

‘গীতা দেবী! শুভেন্দু অবাক, ‘বাড়ির মধ্যে ওঁকেই তো একটু রিজেনেবল্ বলে মনে হল!’

‘তাই হয়।’ আমি বললাম, ‘ডাক্তারের সাহায্য পাবার জন্য ভদ্রমহিলাকে একটু প্রেমের অভিনয় করতে হয়েছে। সাহায্য অবশ্য শেষ পর্যন্ত ওঁর দরকার হয়নি।’

‘ভদ্রমহিলা অভিনয়-পটিয়সী বল তাহলে!’

‘অবশ্যই, আজ থেকে তো অভিনয় করছেন না!’ আমি অপরাধী সনাক্তকরণের বই-এর আসল পাতাটা খুলে দিয়ে বললাম, ‘চিনতে পারিস?’

‘কি আশ্চর্য। হুবহু গীতা দেবী।’

‘হ্যাঁ। এর আগেও কয়েকবার অন্য নাম নিয়ে কুকীর্তি তিনি করেছেন। তার মধ্যে একবার মার্ডারের চেষ্টাও করেছেন, ঠিক এই একই উপায়ে। সুতরাং প্রমাণ জোগাড়ের জন্য খুব পরিশ্রম তোকে করতে হবে না।’

‘একটু জট পাকিয়ে যাচ্ছে—’ শুভেন্দু বলল, ‘খুনের মোটিভ যেমন পরিষ্কার হচ্ছে না, কৃষ্ণনগরের ব্যাপারটাও ট্যাকল্ করতে পারছি না।’

‘এই ভদ্রমহিলা, গীতা দেবী বলাই ভাল—শী হ্যাজ এ কম্‌পেনিয়ান, হতে পারে স্বামী অথবা অন্য কেউ। এঁদের উদ্দেশ্য বিচিত্র উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করা। তুই এই অপরাধীদের হিষ্ট্রিবুক থেকেই এসব জানতে পারবি। এদের লেটেস্ট ভিকটিম ছিলেন মিস্টার ভদ্র। মিস্টার ভদ্র অগাধ সম্পত্তির মালিক, তার সিকি অংশও লাখ চার-পাঁচের কম হবে না। ভদ্রলোকের দুটো স্ট্রোক হয়ে গেছে, সুতরাং জীবিত থাকতে থাকতে কোন রকমে সংসারে ঢুকতে পারলে বছর খানেকের মধ্যে বিরাট অ্যামাউন্ট হাতে চলে আসার সম্ভাবনা। তাই মাস ছয়েক আগে এই নাটকের যবনিকা উত্তোলিত হল বলা যায়। গীতা দেবী মোটামুটি সুন্দরী—মেয়েদের সৌন্দর্য বলতে আমার দৃষ্টি অবশ্য একটু সংকীর্ণ, সেই অর্থেই বলছি। ছোটছেলেকে ট্র্যাপ করার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হল। ছেলে ট্র্যাপে পা দিল, তাই হয় অবশ্য। অতঃপর হনিমুনে নিয়ে গিয়ে তাকে সরানোর ব্যবস্থা। আমি জানি না, এই কেসটা কিভাবে ট্রিট করা হয়েছিল, তবে এটা মার্ডার—এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।

এনিওয়ে, সে ব্যাপারটা বোধ হয় এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। নেক্সট, বুড়োর কাছাকাছি থাকবার ও ইন্টিমেট হবার চেষ্টা গীতা দেবী করেছে। এক্সট্রা প্রিকশান হিসেবে ডাক্তারের সঙ্গে একটা অ্যাফেয়ার তৈরি করেছে, যাতে পরে তাকে কাজে লাগানো যায়।

কিন্তু ইতিমধ্যে ঘটল অঘটন। জানি না, কেমন করে বুড়োর মনে গীতা দেবী সম্বন্ধে সন্দেহের উদয় হয়। বুড়োর চোখ তো, বাইরে যতই ছানি পড়ক অভিজ্ঞতায় তা পূর্ণ হয়ে যায়। নিজে ইনভ্যালিড, কিন্তু ফোন হাতের কাছেই থাকে, খবর দিলেন ভূদেববাবুকে। ভূদেববাবু নিশ্চয়ই খবর এনেছিলেন, মিস্টার ভদ্রর অনুমান বোধ হয় সঙ্গত। সেই ইনফরমেশান তুই বিরূপাক্ষবাবুর কনফিডেনশিয়াল জায়গা খোঁজ করলে পাবি। গীতা দেবীর কাউন্টারপার্ট তখন অবশ্যই কৃষ্ণনগরে, সুতরাং খবর সংগ্রহের জন্য তাঁকে যেতে হল কৃষ্ণনগর।

গীতা দেবীর সমস্ত প্ল্যান বানচাল হবার জোগাড়। ভূদেববাবুর খবর তিনি জানিয়ে দিলেন কৃষ্ণনগরে এবং আর অপেক্ষা না করে একবার যে চেষ্টা সামান্য ত্রুটিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেই চেষ্টা আবার করলেন।

অবাক হোস না, গীতা দেবী একদিকে যেমন বাণ্ডল অব সেক্স, অন্যদিকে সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তার পক্ষে অসম্ভব বলে কিছুই নেই।

আমার ধারণা, সকালে সে ডাক্তারের কাছে উলসে উঠেছিল, পুলিশের হাঙ্গামা হলে কি করব—এই জাতীয় ন্যাকামিও করে থাকতে পারে। ফলে আদরে উথলে উঠে ডাক্তার ন্যাচারাল ডেথের ব্যাপারে এত জেদাজেদি করেছে। ডাক্তার কিছু জানে না, আয়্যাম সিওর।

গীতা দেবীকে ধরবার বেশি প্রমাণ তোর দরকার হবে না। ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে এখানে মিলিয়ে দেখলেই তোর কাজ হবে। অ্যালিবি, মোটিভ, পাস্ট হিষ্ট্রি—সবই তোকে সমর্থন করবে। আশা করি, এই কাজগুলোর জন্যে আর আমাকে দরকার হবে না?’

শুভেন্দু হাসল, হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্কস এ লট।’

‘নো মেনশন—’ আমি বললাম, একটা কথা মনে রাখিস, তুই এখন ফ্রেশ, বাট আয়্যাম টায়ার্ড। আসলে শারীরিক পরিশ্রমে আমার কোন ক্লান্তি নেই তুই জানিস, কিন্তু ঘরে বসে ছক কাটা—ইট মেক্‌স্ মী সিক। যাকগে, দশটা হল প্রায়, মূলাঁরোজ এখনও খোলা আছে—আই ওয়ান্ট দ্যাট চিলি সস—যে মেয়েটাকে কাল ছেড়ে দিয়ে এসেছি। আশা করি, আজ রাতে আর কোনও রকম ডিসটার্ব করবি না।’

শুভেন্দু আমার কাঁধে একটা থাপ্পড় মেরে বলল, ‘তুই শালা একটা আস্ত বিচ্ছু—’

বাউ করে বললাম, ‘থ্যাঙ্কিউ ফর দা কমপ্লিমেন্ট।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *