2 of 2

রত্নাকরের রক্ত চাই – প্রবীরগোপাল রায়

রত্নাকরের রক্ত চাই – প্রবীরগোপাল রায়

এটি রাজনৈতিক গল্প নয়। কিন্তু পিছনে কিছু রাজনৈতিক পটভূমিকা আছে। তার বিবরণ প্রয়োজনীয়। সেবার পশ্চিমবঙ্গে জনসাধারণের পুঞ্জীভূত অভাব-অভিযোগ আন্দোলনের আকারে, যা সর্বদাই অহিংস ছিল না, ফেটে পড়েছিল। সরকারপক্ষের প্রচুর দমন ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও মোটের ওপর আইন ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছিল। নানা পক্ষ থেকে এ-রাজ্যে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তনের দাবী উঠেছিল। সে-দাবী উপেক্ষিত হল। কেন্দ্রীয় পুলিশ ও মিলিটারীর সাহায্যে আন্দোলনকে তখনকার মত দমন করা হল। অবশ্যই প্রচুর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। পালামেন্টে প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হল।

তখন জানা গেল যে কেন্দ্র একটি বিশেষ ব্যক্তির মতামতের ওপর অত্যন্ত বেশি নির্ভর করেছিল। তিনি কেন্দ্রে ক্যাবিনেট-মন্ত্রী রত্নাকর সেন। তাঁর ভয়ডর নেই। লোকসভায় বিরোধীপক্ষের তুমুল ধিক্কারধ্বনির মধ্যে তিনি জানালেন যে দেশে গণতন্ত্রকে হত্যা ও নৈরাজ্যকে আহ্বান করা অপেক্ষা দু-দশজন আন্দোলনকারীকে হত্যা করাকে তাঁর দল শ্রেয়তর মনে করে।

এইসব কথাবার্তার পর কলকাতা শহর এবং আশেপাশে দেয়ালে কিছু পোস্টার পড়ল: ‘রত্নাকরের রক্ত চাই।’

এসব মাস দুয়েক আগেকার ব্যাপার। আজকাল হঠাৎ কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছে যে রত্নাকর কলকাতায় আসছেন। পরলোকগতা শিল্পী শীলা মেহতার ছবির একটি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে।

আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে শীলা মেহতা একটি অতি শ্রদ্ধেয় নাম। বালিকা বয়সেই তিনি ভারত ত্যাগ করে য়ুরোপে বসবাস আরম্ভ করেন এবং সে দেশেই অকালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সাধনায় আধুনিক য়ুরোপীয় চিত্রকলার সাধনা যুক্ত হয়েছিল।

যৌবনে রত্নাকর যখন ইংলণ্ডে ছাত্র ছিলেন, এক ছুটিতে প্যারিসে শীলার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। বয়সে রত্নাকরই ছোট ছিলেন। কিন্তু অভিজাত এবং প্রতিভাবান। শীলার অসংখ্য প্রেমিক ছিল; রত্নাকরকে তিনি কতটুকু অনুগ্রহ করেছিলেন জানা যায়নি। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁকে লিখিত বিভিন্ন ব্যক্তির পত্রগুচ্ছে রত্নাকরের মোট সতেরোটি পত্র ছাপা আছে। শীলা ইংরাজির চেয়ে ফরাসী ভাল জানতেন, রত্নাকর যদিও ফরাসীর চেয়ে ইংরাজি, কিন্তু শিভ্যালরির খাতিরে পত্রগুলি সবই ফরাসীতে লেখা। রোমান্টিক উচ্ছ্বাস ও ভক্তের আরতিতে পূর্ণ সেগুলি। শীলা সম্ভবত কখনও রত্নাকরকে চিঠি লেখেননি। কিন্তু তেলরঙে একটি পোট্রের্ট এঁকেছিলেন ওঁর। সেটি রত্নাকরের শয়নকক্ষের দেয়ালে টাঙানো থাকে।

সম্প্রতি কলকাতার একটি আর্ট সোসাইটি ভারতবর্ষে শীলার ছবির একটি প্রতিনিধিমূলক প্রদর্শনীর আয়োজন করছিল। ভারতে এই প্রথম। য়ুরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে ছবিগুলি আনানোর ব্যবস্থা করা সহজ ছিল না। রত্নাকর বিশেষ চেষ্টা করে শিক্ষাদপ্তর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার অনুমতি বার করলেন। সেই প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে। রত্নাকর উদ্যোক্তাদের তার করলেন, ‘আমিই উদ্বোধন করব। কোন শিল্পীকে দিয়ে যখন করাচ্ছেন না, তখন আমার চেয়ে যোগ্য লোক পাবেন না।’

উনি না গেলে রাজ্যপাল বা মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়ে প্রদর্শনীটির উদ্বোধন হত—এই নিতান্ত অসঙ্গত কল্পনা নিয়ে রত্নাকর বাড়িতে বন্ধু-বন্ধুনীদের মজলিশে তামাসা করলেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা-দপ্তর রত্নাকরকে খবর দিল যে অনতিদূর অতীতের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া হয়তো নিরাপদ নয়। উনি সংশ্লিষ্ট ফাইলটি চেয়ে পাঠালেন, তাঁর যাওয়া বন্ধ হল না।

কথা হল পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় কোন এনগেজমেন্ট তাঁর হবে না। রাজ্যে তাঁর পদার্পণ ও প্রস্থানের সময় সম্বন্ধে পূর্ব থেকে সংবাদপত্র-বেতারে কোন উল্লেখ হবে না। রত্নাকর জানিয়ে দিলেন যে অনুষ্ঠানে তাঁকে সঙ্গদান করার জন্য ঝুঁকি নিয়ে রাজ্যপাল বা কোন মন্ত্রীকে যেতে হবে না।

প্রদর্শনীর জন্য সবচেয়ে বড় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যে হলটি পাওয়া গিয়েছিল তা কেন্দ্রীয় শিক্ষা-দপ্তরের সম্পত্তি। শহরের অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে সুউচ্চ গাছপালা ও নয়নাভিরাম লনে ঘেরা প্রাসাদোপম অট্টালিকার অংশ ওই হলটি। অন্যান্য অংশে গ্রন্থাগার আছে, শিক্ষা ও সংস্কৃতিমূলক প্রদর্শনী ও কাজকর্ম হয়।

শহরের শিল্পরসিক ও শিল্পীদের বাছা বাছা শ’ দুয়েক জন অনুষ্ঠানের আগের দিন নিমন্ত্রণপত্র পেলেন। আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারী, শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রত্নাকর সেনের দ্বারা প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে। পূর্ব দিকের গেট দিয়ে সকলকে প্রবেশ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে এবং অবশ্যই নিমন্ত্রণপত্রটি সঙ্গে আনতে হবে। প্রতি পত্রে মাত্র একজনেরই প্রবেশাধিকার এবং পত্র হস্তান্তর করা চলবে না।

শৈব্যা মজুমদার এ গল্পের নায়িকা। কেন্দ্রীয় শিক্ষা-দপ্তরের কলিকাতা শাখার কর্মী। প্রদর্শনীর দিন স্বেচ্ছাসেবিকার দায়িত্ব সে যেচে নিয়েছে। তার পারিবারিক ইতিহাসের একটুকরো পুলিশের অজানা। প্রায় আড়াই মাস আগের কথা। ওর ভাই যোলো বছরের সুদেশ কলোনীর একটি ঘরে বসে বোমা তৈরি করার সময় অসতর্কতার দরুন বিস্ফোরণ ঘটে। ওর মুখ ও বুক পুড়ে গেছে, ডান হাতটি কেটে ফেলতে হয়েছে। সে সময় কলোনীর ধারেকাছে এমন কি সাদা পোশাকেও পুলিশবাহিনীর কেউ ছিল না। প্রাণ বাঁচাবার জন্য তারা পশ্চাদপসরণ করেছিল। তাই প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হল, কিন্তু পুলিশ সুদেশকে গ্রেপ্তার করতে দৌড়য়নি। এখন সে শহরের বাইরে আছে।

রত্নাকর আসছেন এ সংবাদ কানে আসা মাত্র শৈব্যা প্রতিজ্ঞা করেছে যে ওঁর জীবনে শেষ সূর্য উঠবে ওই ৮ই ফেব্রুয়ারী। সে তৈরি হচ্ছে। ওদের ক্ষুধিরাম কলোনীতে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারে নিপুণ অনিমেষ মিত্রের কাছে গিয়েছিল সে। শুধু নিপুণ নয়, লোকে বলে অনিমেষ সব্যসাচী এবং অব্যর্থলক্ষ্য। ওর কাছে শৈব্যার প্রার্থনা ছিল দুটি—এক, পিস্তল ব্যবহারের কায়দাটা শিখিয়ে দিতে হবে; দুই, একটি লাইসেন্সহীন পিস্তল যে মূল্যেই হোক জোগাড় করে দিতে হবে।

৭ই ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় অনিমেষের ঘরে দুজনের কথা হচ্ছিল। অনিমেষ বলল, ‘শৈব্যা, তোমার দুটি আবদারই আমি রেখেছি। এই প্রথম ঘটল যে প্রয়োজন কি তা না শুনেই আমি অমন অনুরোধ রাখলুম। কিন্তু আজ যখন খবর পেলুম রত্নাকর তোমাদের ওখানে আসছেন, তখন সব বুঝেছি।’

শৈব্যা চুপ।

‘আমি তোমায় সতর্ক করে দিচ্ছি। অতি তৎপর গোয়েন্দারা এবং ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ ওঁকে ঘিরে রাখবে। দ্বিতীয়ত, শুনেছি রত্নাকরের চোখ শিকারী বাঘের মত এবং এই বয়সেও উনি যে কোন যুবকের মত ক্ষিপ্র।’

দাঁতে দাঁত চেপে শৈব্যা বলল, ‘ওঁর অহঙ্কার আমি চুর্ণ করব।’

‘সাবাশ! কিন্তু তুমি তো পিস্তল চালাতে শিখলে এই দু-চার দিন!’

‘তা হোক।’

‘এবং তোমার হৃদয় কত কোমল, সেখানে কত স্নেহ-প্রেম তা আমি জানি। ব্যক্তিগতভাবে জানার আমার সৌভাগ্য হয়েছে।

‘থাক।’

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ।

অনিমেষ বলল, ‘আমার একটি অনুরোধ। যদি বোঝ যে কৃতকার্য হবার আগেই ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা বা রত্নাকর নিশ্চিতরূপে নাগালের মধ্যে নেই, তাহলে পিস্তল বার করো না।’

কিছুক্ষণ ভেবে শৈব্যা বলল, ‘এ অনুরোধ মনে রাখা সম্ভব কি? বাঙলার মাটিতেই রত্নাকরকে হত্যার এমন সুবর্ণ সুযোগ শীঘ্র আর দ্বিতীয় আসবে না। যদি ওঁকে খুন নাও করা যায়, তার চেষ্টাটাই এই মুহূর্তে খুব দরকারী একটা প্রতিবাদ নয় কি?’

‘তাহলে একটা কথা বলি। তুমি গোঁয়ারতুমি করতে যেও না। যদি উনি তোমার হাতে না মরেন তো আমার হাতে মরবেনই।’

‘সে কি?’

‘আমিও সেখানে থাকব।’

‘না, তা হয় না। আমি তো একজন সাধারণ মেয়ে, কিন্তু তুমি গেলে চলবে কি করে?’

‘চলবেই। আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।’

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর শৈব্যা সসঙ্কোচে এবং ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘নিতান্ত স্বার্থপরের মত তোমায় একটা অনুরোধ করব কিনা ভাবছি।’

‘বল।’

‘যদি দেখ যে আমি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছি, তাহলে আমায় খুন করো।’

অনিমেষ হাসল।

‘হাসলে যে বড়?’

‘ভাবছি তোমার আসল ভয়টা কোথায়।’

‘কোথায়?’

‘পুলিশ জেরা করবে, বিচার হবে, দণ্ড পাবে সে-ভয় নয়। কাগজে কাগজে ছবি, বেরুবে, তুমি মহাবিপ্লবিনী কিংবা শহীদ হয়ে যাবে সে-ভয়ও নয়। কিন্তু কেউ কেউ যে মনে মনে তোমায় ধিক্কার দেবে, বলবে তুমি একটি অ্যামাজন তাতেই ভয়।’

‘আমার অন্যায় অনুরোধ ফিরিয়ে নিলুম।’

‘আমার পরিষ্কার কথা। রত্নাকর যদি তোমার হাতে না মরেন, আমার হাতে মরবেন। তিনি যদি তোমার হাতে মরেন তো তুমি আমার হাতে মরবে। কিন্তু এ হতেই পারে না যে তিনি বেঁচে থাকবেন অথচ তুমি মরবে আমার গুলিতে, আর আমি মরব ফাঁসিকাঠে। অসম্ভব।’

‘সেই কথাই রইল?’

‘রইল।’

‘তাহলে হাতে হাত দাও।’

অনিমেষ হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু শৈব্যা যখন হাতে হাত রাখল দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাল সে। সেই সুডোল বাহু, চাঁপার কলির মত আঙুলগুলির দিকে না তাকানোই ভাল।

পরের দিন, বিকেল সাড়ে চারটে।

শৈব্যা বাথরুমে গিয়ে হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে বার করে ছোট পিস্তলটিকে বাম পঞ্জরাস্থির তলায় ব্লাউজের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে আটকে নিল। গায়ে জড়াল কাজ করা সুতীর স্কার্ফ। দেয়ালপঞ্জিতে এখনও মাঘ মাস, সন্দেহের কোন কারণ নেই।

ও বাড়ি থেকে ভেবে এসেছিল যে গুলি চালাবে যখন রত্নাকর ফিতে কাটবেন। কারণ, তখন তাঁর সামনে কেউ থাকবে না এবং তিনি এক জায়গায় স্থির থাকবেন। মারতে হবে রত্নাকরের পিছনে যে ভিড় দাঁড়িয়ে থাকবে সেইখানে মিশে বা পিছনে হটে ভিড়ের কাঁধের ওপর দিয়ে। শৈব্যার সুবিধা সে বেঁটে নয়।

কিংবা মারতে হবে প্রশস্ত ও সুউচ্চ সোপানশ্রেণীর কোন ধাপে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ পাশ থেকে রত্নাকরের গতিপথের সরলরেখায় এসে। হয় তিনি যখন মোটর থেকে নেমে ওপরে উঠবেন তখন সামনে থেকে, নয়তো অনুষ্ঠানশেষে তিনি যখন নামবেন তখন পিছন থেকে। সোপানশ্রেণীর ওপর মারার সুবিধা এই যে খুব কাছ থেকে গুলি করা যাবে। যদিও তিনি তখন চলন্ত এবং তাঁর পিছনে, হয়তো সামনেও লোক থাকবে।

কোন ভাবনা ছিল না যদি মঞ্চে বক্তৃতারত রত্নাকরকে পাওয়া যেত। কিন্তু কোন বক্তৃতা উনি দেবেন না। প্রদর্শনী-কক্ষের মধ্যে মারায় অনেক অসুবিধা। রত্নাকরের চারদিকেই তখন ভিড় থাকবে এবং তিনি নিজে কখন কোন ছবির দিকে ফেরেন বলা শক্ত। যা ছটফটে মানুষ। এক সমতলে দাঁড়িয়ে শৈব্যা যে সন্দেহ উদ্রেক না করে ভিড় ঠেলে তাঁর সামনে যেতে পারবে সেটাও অসম্ভব।

বাড়িতে বসে অতএব সে ভেবেছিল। কিন্তু সকালে এসে দেখে যে কয়েক শত ফুলের টব রেখে সোপানশ্রেণী প্রায় ঢেকে ফেলা হয়েছে। মানে, সোপানশ্রেণীর ওপর হত্যা করতে গেলে দাঁড়াতে হবে হয় নিচে যেখানে মোটর এসে থামবে, নয়তো ওপরের চত্বরে। দু-জায়গাতেই ওর আশেপাশে প্রচুর লোক থাকবে। পিস্তল বার করা এবং গুলি করা বিদ্যুৎগতিতে সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন।

এখন অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে যা শুনল তাতে খুবই বিচলিত হল শৈব্যা। ব্যবস্থা দেখার জন্য লালবাজার থেকে একজন সিকিউরিটি অফিসারকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি এসে প্রত্যেকটি কর্মীর জন্য সুনির্দিষ্ট কর্ম বণ্টন করে দিয়েছেন। অল্পবয়সী বাঙালী ছেলেমেয়েদের যথাসম্ভব দূরে দূরে রাখা হয়েছে। শৈব্যার ওপর হুকুম, ওকে থাকতে হবে ভারতীয় ভাষাগুলিতে অনুদিত সায়েন্স ও টেকনোলজির ওপর বইগুলির যে স্থায়ী প্রদর্শনী-কক্ষ আছে সেইখানে। সে কক্ষটি গ্রাউণ্ড-ফ্লোরে। সোপানশ্রেণীকে বামে রেখে এগোলে তার প্রবেশপথ।

নিষ্ফল ক্রোধে শৈব্যা ঠোঁট কামড়াল। ওর কক্ষটিতে রত্নাকর আসবেন তার কোনই সম্ভাবনা নেই। দ্বারপথে একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে। এমনিতে তার কাজ নজর রাখা, যাতে দর্শনার্থীরা কেউ কোন বইপত্র সরিয়ে না নিয়ে যেতে পারে। আজ বোধ হয় ওর অতিরিক্ত ডিউটি মিস মজুমদারের ওপর নজর রাখা। বেশ।

বিকেল পাঁচটা। মাসের দ্বিতীয় শনিবার বলে আজ এখনই গ্রন্থাগারটি বন্ধ হয়ে গেল। পাঠক-পাঠিকারা একে একে নেমে আসছে। অনেকেই সোজা বাড়ি চলে গেল। কেউ কেউ সামনের লনে দাঁড়িয়ে বা বসে প্রতীক্ষা করতে লাগল। উদ্দেশ্য—দূর থেকেই উদ্বোধন-অনুষ্ঠানের কিছু দেখার।

শৈব্যা হঠাৎ অনিমেষকে দেখতে পেল। ওর মনে পড়ল যে গ্রন্থাগারের মেম্বারশিপ-কার্ড অনিমেষেরও আছে। সে খোঁজ নিয়ে জেনে থাকবে শৈব্যা কোথায়। সিঁড়ি দিয়ে বই বগলে নেমে শৈব্যা যে-কক্ষে দাঁড়িয়ে তার সামনে দিয়ে এক চক্কর ঘুরে সে সামনের লনে গিয়ে বসল। তারপর বই খুলে যেন তাতে তৎক্ষণাৎ ডুবে গেল। চশমা তো অনিমেষ পরেই। আজ ধুতি-পাঞ্জাবি যেভাবে পরেছে সব মিলিয়ে নিরীহ অধ্যাপক, হয়তো বাঙলারই, বলে মনে হচ্ছে।

বিকেল সওয়া পাঁচটা। শৈব্যা হঠাৎ মনস্থির করে ফেলল। রত্নাকর যখন অনুষ্ঠান-শেষে নেমে আসবেন তখন তাঁর মোটরের সামনে তাঁকে হত্যা করতে হবে। শৈব্যা ওর দারোয়ানটির সঙ্গে কথা বলে দেখেছে যে, সে-মানুষটা খারাপ নয়। শৈব্যা ছেলেমানুষী ভঙ্গিতে তাকে জানিয়েছে যে, এই একটা অ···পূ···র্ব ব্যাপার, সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছেন না বলে তার কি ভী···ষ···ণ দুঃখ হচ্ছে। অনুষ্ঠান-শেষে আর কৌতূহল দমন অসম্ভব, রত্নাকর যেন কোন অবতার যাঁর দর্শন দুর্লভ এই অভিনয় করে সে বেরুবে। আশা করা যায়, দ্রুত পায়ে ও বিনা বাধায় সিঁড়ির পাশ থেকে একেবারে মোটরটার কয়েক গজের মধ্যে সে উপস্থিত হতে পারবে।

বিকেল পাঁচটা কুড়ি। কম্পাউণ্ডে ঢুকে যে-পথ দিয়ে মোটর আসবে, সিঁড়ির চারদিকে, উপরের চত্বর সব আলোয় ঝলমল করে উঠল। নিমন্ত্রিতরা একে একে আসছেন। যাঁরা মোটরে আসছেন তাঁদের গাড়িগুলিকে একটু দূরে এক পাশে রাখতে বলা হচ্ছে। য়ুনিফর্মে ও সাদা পোশাকে কিছু পুলিশ এসে একটু দূরে দূরে দাঁড়াল। তাদের অন্যতম কাজ যাতে লনের ওপর থেকে কেউ মোটর-রাস্তার ওপর উঠে না আসে। লনে ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা খেলা করছে। ওপাশে যে কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরিয়াদের জন্য সারি সারি কোয়ার্টার তৈরি হয়েছে ওরা সেখানেই থাকে। মাদ্রাজী, মারাঠী, বাঙালী, দু-একজন সাদা চামড়ার ছেলেমেয়ে।

অনিমেষ বই মুড়ে রেখে চশমার কাচ রুমালে মুছছে। সেই সঙ্গে মিনিস্কার্ট পরা একটি সুশ্রী কিশোরীর সঙ্গে গল্প জুড়েছে। হন্তদন্ত হয়ে সিকিউরিটি অফিসার নেমে এসে একবার চারদিকে দেখে গেলেন। শৈব্যা ক্রোধে দাঁত ঘষলো।

বিকেল পাঁচটা পচিশ। হঠাৎ চারদিকের একটা চঞ্চলতা দেখে শৈব্যা বুঝল অঘটন কিছু ঘটে থাকবে। সত্যই তাই। একটা মোটর-সাইকেল-আরোহী পুলিশ-অফিসার, তার পিছনে একটা দামী গাড়ি। রত্নাকর এলেন? কি আশ্চর্য, সময়ের আগেই!

হঠাৎ দারোয়ান বলে উঠল, ‘উনি ইদিকেই আসতেছেন।’

‘কি?’

দৌড়তে দৌড়তে সিকিউরিটি অফিসার এসে ঢুকলেন। চারদিক দেখলেন, চোখের ইঙ্গিতে শৈব্যাকে আর একটু দেয়ালের দিকে পিছতে বললেন।

রত্নাকর প্রবেশ করলেন। পিছনে আর্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট শ্ৰীমতী, প্রতিমা মুখোপাধ্যায় এবং এই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানটির ডাইরেক্টর শ্রীযুক্ত কে. আর রাঘবন। সিকিউরিটি অফিসার বেরিয়ে গেলেন। রত্নাকর ইঙ্গিতে তাঁর দেহরক্ষীদের দরজার বাইরে থাকতে বললেন।

শৈব্যা বোধ হয় এই প্রথম রত্নাকরকে দেখল। বয়স প্রায় ষাট। গান্ধীটুপির তলায় কপালের দু-পাশের চুল ধপধপে সাদা। কিন্তু কি যৌবন চঞ্চল দীর্ঘ দেহ। গভীর অনুরণনশীল কণ্ঠস্বর শ্রেষ্ঠ নটেরও ঈর্ষার বস্তু।

কক্ষের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখছিলেন রত্নাকর। শৈব্যা ততক্ষণে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠেছে। বুঝল এমন সুযোগ ছাড়লে চলবে না। পিস্তলের ওপর হাত রাখল সে। কিন্তু এ কি, রত্নাকর যে দ্রুতপদে ওর দিকেই এগোচ্ছেন।

তিনি সামনে এসে বললেন, ‘বাঙালী-কন্যা? কয়টি য়ুরোপীয় ভাষা জানো তুমি? রাশিয়ান? জামান?’

শৈব্যা হকচকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

রত্নাকর হাসলেন।

‘তুমি আমায় নমস্কার করতে ভুলে গেছ। সে কি ভয়ে?’

‘নমস্কার।’

‘মনস্কার। এ ঘরের গাইড হিসেবে তুমি নিতান্ত অযোগ্যা।’

‘ওঁরা ভাবেননি আপনি এ-ঘরে আসবেন।’

রত্নাকর একটি বই হাতে তুলে নিয়ে অনুবাদকের নাম পড়ছিলেন। বললেন, ‘ঠিক কথা। হাতে কয়েক মিনিট সময় পেয়ে এখানে ঘুরে যাবার লোভ ছাড়তে পারলুম না। তুমি জানো কি, ছেলেবেলা থেকে libraries and book-shops are my favourite haunting places.’

শৈবার মনে পড়ল, সাম্প্রতিক একাধিক বক্তৃতায় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে যে মেছোবাজার ও কুস্তির আখড়া করে তোলা হচ্ছে রত্নাকর তার নিন্দা করেছেন।

উনি শৈব্যার হাত ধরে মৃদু আকর্ষণ করলেন। মানে, ওঁকে অনুসরণ করতে হবে। উনি ঘুরে ঘুরে মনোযোগ দিয়ে বইগুলি দেখছিলেন। শ্রীমতী মুখোপাধ্যায় ও রাঘবনও ওঁকে অনুসরণ করছিলেন।

রত্নাকর ওঁদের বললেন, ‘আপনারা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়ান। আমার সঙ্গে ঘুরে কি লাভ।’

রাঘবন সহজভাবে এবং শ্রীমতী মুখোপাধ্যায়, যিনি মেক-আপে বয়স ভাঁড়ান, শৈব্যার প্রতি একটি বিদ্বিষ্ট কটাক্ষ হেনে পিছিয়ে পড়লেন। ইত্যবসরে শৈব্যা আবার পিস্তলে হাত দিয়েছিল।

রত্নাকর গলা নামিয়ে ওকে বললেন, ‘তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি।’

সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে শৈব্যাকে সিদ্ধান্ত নিতে হল সে দু’পা পিছিয়ে গুলি চালাবে কিনা। না, সে হাত সরিয়ে নিল। বলল, ‘কি?’

রত্নাকর শৈব্যাকে নিয়ে আর একটু এগোলেন। বললেন, ‘বেঙ্গল ক্রনিকল-এ তোমার ছবি দেখেছি।’

ওহ, এই। শৈব্যা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। গত হাঙ্গামার সময় ওদের কলোনীতে দুজন কনস্টেবলকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছিল। তারপর এই ক’দিন আগে কলোনীর সরস্বতী-পূজামণ্ডপে একত্রিত পাড়ার তরুণ-তরুণীদের একটি ছবি তুলে বেঙ্গল ক্রনিকল সেটি ছাপিয়ে মন্তব্য করেছে—‘এদেরই আর এক আমোদ মানুষ মারা।’ সংবাদপত্রটি শাসকগোষ্ঠীর মুখপত্র কি না। যাই হোক, ছবিতে প্রথম সারিতেই শৈব্যার উজ্জ্বল সুন্দর মুখ। ভাইয়ের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা সত্ত্বেও।

রত্নাকর হঠাৎ বললেন, ‘বাঙলাদেশে এখনও কি ঠাণ্ডা আছে যে তুমি স্কার্ফ জড়িয়েছ? তোমার শরীর তো অকারণে এত ঢাকাঢুকি দেওয়ার নয়।’

শৈব্যা দাঁড়িয়ে পড়েছে। রত্নাকর আরও দু’পা এগিয়েছিলেন। এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তোমার মুখ যে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।হুঁ। বোমা-পিস্তল কিছু সঙ্গে আছে নাকি?’

শৈব্যা তখন প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজের মুখখানিকে ভাবলেশহীন করতে।

রত্নাকর চাপাস্বরে গর্জন করলেন, ‘তোমাদের সব মাথা গরম, তোমরা ভ্রান্ত। তোমাদের হাতে এ-জাতির ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকার।’

শৈব্যার মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল জবাব যে ‘আপনারা তাকে কোন্ আলোকের পথে নিয়ে যাচ্ছেন স্বাধীনতার পর এই এতকাল ধরে’? কিন্তু সে কিছুই বলল না।

রত্নাকর আবার ঝুঁকে বই দেখছিলেন। বললেন, ‘আজ আমায় হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে। বাইরে তোমার কতজন সঙ্গী দাঁড়িয়ে কে জানে।’

‘কেউ নেই, কেউ নেই।’

‘প্রমাণ হতে পারে যদি আশেপাশে যারা জড়ো হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে সার্চের হুকুম দিই।’

শৈব্যা চুপ।

‘কিন্তু কিছু পাওয়া না গেলে লোক হাসবে। লোকসভায় কথা উঠবে।’

শৈব্যা বলতে পারত, আপনি তো তার ভারি পরোয়া করেন। কিন্তু কিছুই বলল না।

‘তোমায় সার্চ করা হলে অবশ্য কিছু পাওয়া যাবে আশা করি।’

শ্ৰীমতী মুখোপাধ্যায় ও রাঘবন চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। শৈব্যা ও রত্নাকর দুজনেই নিজের নিজের হাতঘড়ি দেখলেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে।

রত্নাকর শৈব্যার হাত ধরে ঘুরে দরজার দিকে চললেন। বললেন, ‘তোমায় গ্রেপ্তার করাব না। করালে, এক, তোমার কেরিয়ার নষ্ট হবে, দুই, এখানে যদি তোমার সঙ্গী থাকে সে সাবধান হয়ে যাবে; তিন, সঙ্গীর হাতে তোমার জীবনের আশঙ্কা আছে। তুমি যতই বিপথ কি কুপথ-গামিনী হও, তোমার ওপর মায়া হচ্ছে। হয়তো তোমার sex appeal সাংঘাতিক।’

একটু হাসলেন রত্নাকর।

শৈব্যা জিদের সঙ্গে বলল, ‘আমার কোন দল নেই, সঙ্গী নেই। সব আমার একার দায়িত্ব।’

কঠিন হয়ে গেল রত্নাকরের মুখ। বললেন, ‘চ্যালেঞ্জ করছ?’

‘করছি।’

‘বেশ। এস আমার সঙ্গে। তোমার কথাই যদি সত্য হয় আজ, কারো কোন ক্ষতি হবে না। যদি মিথ্যা হয়, দুটি জিনিস ঘটতে পারে। তোমার সঙ্গী ধরা পড়বে, অথবা ধরা পড়ার আগে সে আমাদের একজনের প্রাণ নেবে। রাজী?’

‘চলুন।’

শ্ৰীমতী মুখোপাধ্যায় ও রাঘবন এগিয়ে গেছেন। দেহরক্ষী দুজন ও সিকিউরিটি অফিসার দ্বারপথে দাঁড়িয়ে। রত্নাকর শৈব্যার হাত ধরে সেখানে এসে ওই তিনজনকেও এগোতে বললেন। তারা আদেশ পালন করল।

শৈব্যা চেয়ে চেয়ে দেখছিল আলো-ঝলমল চারধার এবং তার ওপারে দাঁড়ানো দীর্ঘশির গাছগুলির দিকে। এই পরিবেশ বর্ষা-শরৎ-বসন্তে ওর যৌবন-বেদনা ও প্রেমের উল্লাসের সাক্ষী। যে-শিশুদের দিকে ও কত অপরাহ্ণে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়েছে তাদের কয়েকটি লনের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে।

রত্নাকর বললেন, ‘আজ অবসর হল আমার নিষ্পাপ যৌবনের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলার। সেই সেকালে শীলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তারপর কি প্রবল ব্যর্থতা। আজ তাই রম্যা যুবতীও আমায় হত্যার জন্য ছুরি শানায়।’

দুজনে এগোলেন।

শৈব্যা দেখল অনিমেষ পথের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাম হাত পাঞ্জাবির পকেটে। ডান বগলে বই। ডান হাতে সিল্কের রুমালটা নিয়ে তার কোণ মুখে পুরে চিবোচ্ছে।

ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় রত্নাকর ফিসফিস করে বললেন, ‘ধৃষ্ট ছোকরাকে দেখেছ। আমি যদি ডেকে কথা বলি তোমারই মত নমস্কার করতে ভুলে যাবে।’

দুজনে পাশাপাশি সিঁড়ি ভাঙছেন। কয়েক ধাপ উঠেছেন। সামনে সিকিউরিটি অফিসার। দেহরক্ষী দুজন সিঁড়ির সর্বনিম্ন ধাপে দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ রত্নাকর অনুভব করলেন যে শৈব্যা এক লাফে পাশ থেকে পিছনে এসে ওঁকে জাপটে ধরেছে। সেই মুহূর্তে পরপর দুবার আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন—

গুড়ুম গুড়ুম! রত্নাকর শুনলেন ওঁর কাঁধে মাথা রেখে শৈব্যার শেষ আর্তনাদ—‘মাগো!’

রত্নাকর মুখ ফেরালেন। শৈব্যার দেহ লুটিয়ে পড়ছিল, উনি দু-হাতে নিয়ে সিঁড়ির ধাপের উপরই বসলেন। ও কি মরে গেছে? এত শীঘ্র? অদূরে অনিমেষকে পুলিশের লোকেরা ধরে ফেলেছে। তার বাম হাতের পিস্তল কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

রত্নাকর গর্জন করলেন, ‘কুকুরটাকে এখানে বেঁধে নিয়ে আয়। ভাল করে দেখুক সে কি করেছে।’

অনিমেষের শান্ত স্বর শোনা গেল, ‘ওকে মারতে গুলি চালাই নি। মেরেছি সেজন্য দুঃখ নেই। নিজের প্রতিজ্ঞা ভুলে সে আপনার প্রাণ বাঁচাতে যায় কি বলে?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *