2 of 2

আক্কেল দাঁত – গুরণেক সিং

আক্কেল দাঁত – গুরণেক সিং

আগন্তুকের আনীত চিঠিতে দ্বিতীয়বার চোখ বুলিয়ে নিল অমরেশ, তারপর নবাগত যুবকটির দিকে চেয়ে বলল, আপনিই তাহলে অনিরুদ্ধবাবু?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।····অনিরুদ্ধ সান্যাল।

এক নজরে ভালভাবে খুঁটিয়ে অনিরুদ্ধকে দেখে নিল অমরেশ। তারপর চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে পুরতে পুরতে বলল, সঞ্জয়বাবু লিখেছেন, আপনি তাঁর ভাইপো। আপনাকে সাহায্য করতে অনুরোধ করেছেন উনি। সঞ্জয়বাবু এককালে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন, তাঁর অনুরোধ আমি নিশ্চয়ই রাখব। কিন্তু সব ব্যাপার আমাকে খুলে না বললে তো আমি ঠিক—

—আজ্ঞে হ্যাঁ, সব কথাই আমি বলছি আপনাকে। হয়তো শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে ব্যাপারটা কিছুই নয়—সবই আমার মনের ভুল। কিন্তু সব কথা আপনাকে না বললে, আমি ঠিক স্বস্তিও পাব না।

—কিছু ভাববেন না। শুধু আপনার বক্তব্যটা আপনি বলে যান—কিছু বাদ দেবেন না।

—তাহলে গোড়া থেকেই বলি।····বি-এ পাশ করে আমি বেকার বসেছিলাম। আর পড়বার ইচ্ছাও ছিল না, সঙ্গতিও ছিল না। বহু জায়গায় চাকরির জন্যে আবেদন-নিবেদন আর উমেদারি করেও কোন ফল হয়নি। বর্তমান বাজারে বি-এ মাত্র সম্বল করে যে কোন ভদ্রগোছের চাকরি পাব, সে আশা দুরাশা হয়ে উঠছিল ক্রমেই। এমনি সময় হঠাৎ একদিন দৈনিক ‘বার্তাবহ’ পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল।

—কি ধরণের বিজ্ঞাপন?

—বেশ একটু অদ্ভুত ধরণের একটি বিজ্ঞাপন, কর্মখালি স্তম্ভের মাঝামাঝি জায়গায় ছাপা। আপনার কাজে লাগতে পারে ভেবে বিজ্ঞাপনের কাটিংটা আমি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি।

অনিরুদ্ধ সান্যালের হাত থেকে কাটিংটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল অমরেশ, তারপর সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। বিজ্ঞাপনটি এখানে হুবহু তুলে দিলাম—

কর্মখালি

একজন বলিষ্ঠ কর্মঠ যুবকের প্রয়োজন। কিছু লেখাপড়া জানা থাকিলে ভাল হয়। উপযুক্ত হইলে মাসিক তিনশত টাকা পর্যন্ত বেতন দিতে রাজি আছি। কেবলমাত্র পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন যুবকগণই আবেদন করিবেন।

পোস্ট বক্স ৯১৩

দৈনিক বার্তাবহ পত্রিকা।

একটু কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকালাম অমরেশের দিকে। বললাম, বিজ্ঞাপনটা একটু অদ্ভুতই বটে! লেখাপড়া বা অন্যান্য যোগ্যতা সম্পর্কে বিশেষ কিছু দাবি-দাওয়া নেই, কিন্তু উচ্চতাটি পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি চাই! মাইনের ব্যাপারেও বেশ দিলদরিয়া।

একটু হাসল অমরেশ। অনিরুদ্ধর দিকে ফিরে বলল, তারপর, বলে যান—

—বিজ্ঞাপন পড়ে আমারও অদ্ভুত মনে হয়েছিল। কিন্তু চাকরির সন্ধানে তখন আমি মরিয়া। তাছাড়া এই অদ্ভুত বিজ্ঞাপনটির মধ্যে বিধাতার একটি অদৃশ্য সঙ্কেতও আমার নজরে পড়ল। একটা অদ্ভুত যোগাযোগ ঘটে গেল।

—কি রকম?—বাধা দিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

ম্লান হেসে অনিরুদ্ধ বলল, আমার দৈহিক উচ্চতা একেবারে কাঁটায় কাঁটায় পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি!

—তারপর, আপনি কি আবেদন করলেন?

—আবেদন করলাম সেই দিনই, আর উত্তর পেতেও দেরি হল না। ইন্টারভিউয়ে ডাক পড়ল। দেখলাম, চিঠিতে আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, উচ্চতা পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি না হলে চাকরি পাবার কোন সম্ভাবনাই নেই, সেটা মনে রেখেই আমি যেন ইন্টারভিউয়ে আসি!

—তারপর?

—যথাসময়ে ইন্টারভিউয়ে হাজির হলাম। ইন্টারভিউ ডাকা হয়েছে যে বাড়িতে, সেটি একটি পুরোন ধরণের দোতলা বাড়ি; বড় রাস্তার একেবারে ওপরে না হলেও খুব ভেতরেও নয়। বেশ নির্জন। বাড়িটাতে একমাত্র গৃহকর্তা ছাড়া আর কেউ আছেন বলে মনে হল না। চারদিকে কেমন যেন একটা কেমিকেলের গন্ধ—ভেতরে নাকি কি সব ল্যাবরেটরি আছে। শুনলাম, কর্তা নিজেই নাকি ইন্টারভিউ নেবেন।

—কার কাছে শুনলেন?

—আমার আগে আরো তিনজন প্রার্থী এসে বসেছিলেন, তাঁদের মুখেই শুনলাম। কিছুক্ষণ পরে গৃহকর্তার সঙ্গেও সাক্ষাৎ হল। লম্বা দোহারা চেহারা, কেতাদুরস্ত সাহেবী পোশাক, বয়স আটাশ থেকে বত্রিশের মধ্যে—অথচ সেই বয়সেই মাথায় একটি মাঝারি ধরণের টাক পড়েছে। নাম শুনলাম সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরী।

—ভদ্রলোককে কেমন মনে হল আপনার?

—বদ্ধপাগল না হলেও আধ-পাগলাটে ধরণের লোক। আমার আগে যে তিনজন প্রার্থী এসে বসেছিলেন, তাঁরা বিদ্যায়-বুদ্ধিতে আমার তুলনায় ঢের বেশি উপযুক্ত, কিন্তু দৈহিক দৈর্ঘ কারুর বা পাঁচ ফুট সোয়া নয় ইঞ্চি, আর কারুর বা পাঁচ ফুট পৌনে নয় ইঞ্চি হবার দরুন কেউই চাকরিটা পেলেন না।

—আপনার ইন্টারভিউয়ের কথা একটু বিস্তারিতভাবে বলুন।

—আমাকে ডেকে পাঠানো হল সবার শেষে। ঘরে ঢুকতেই মিস্টার চৌধুরী তীক্ষ দৃষ্টিতে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, মনে হল একটু প্রসন্নই হলেন। লেখাপড়া সম্বন্ধে দু-একটা মামুলী প্রশ্ন করলেন, কিন্তু হাবেভাবে বুঝলাম সেগুলি নেহাই লোক দেখানো ব্যাপার। কিছুক্ষণ পরেই আসল কথা তুললেন। বললেন, আপনাকে আমার মোটামুটি পছন্দ হয়েছে, তবে আপনার উচ্চতাটা একবার মেপে দেখা দরকার। আসুন এদিকে!

ঘরের মধ্যেই উচ্চতা মাপার জন্যে একটা কাঠের দাগ কাটা স্ট্যান্ড ছিল। সেটা এতক্ষণ আমার নজরে পড়েনি। ওটির তলায় দাঁড় করিয়ে খুব সাবধানে উনি আমার উচ্চতাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। দেখলাম, একটা অদ্ভুত সন্তুষ্টির হাসি তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠল। বুঝলাম, চাকরির শেষ পরীক্ষায় আমি সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছি।

একটু থামল অনিরুদ্ধ। কুণ্ঠিতভাবে একবার অমরেশ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাদের নিশ্চয়ই বোরিং লাগছে?

—নিশ্চয়ই না! বরং আপনার গল্পটাতে আমি কেমন যেন একটা অভিনবত্বের গন্ধ পাচ্ছি। বলে যান আপনি। চাকরিটা আপনিই পেলেন তাহলে? কাজটা কি?

—সেইটাই অদ্ভুত, আর সেই জন্যেই আমি আপনার কাছে এসেছি। সত্যিকার কাজ কিছু নেই বললেই চলে।

—সেকি?

—কতকটা সেই রকমই। রাস্তার ধারের দোতলার একটা ঘরে আমার কাজ করবার ব্যবস্থা হল। বহু পুরোন বই ওই ঘরে গাদা করে রাখা হয়েছে দেখলাম, আমার কাজ হল সেগুলির একটা লিস্ট তৈরি করা।

—এরই জন্যে তিনশো টাকা দিয়ে আপনাকে রাখা হল?

—ঠিক এরই জন্যে নয়। আমার চাকরির দুটি প্রধান শর্ত ছিল এই যে, আমি সুখেন্দুবাবুর অনুমতি ছাড়া যখন তখন বাড়ির বাইরে যেতে পারব না—আর রাত্রে আমাকে তাঁর কাছেই থাকতে হবে, তার জন্যে তিনি সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন। রান্নাও আমায় নিজের জন্যে নিজেকেই করে নিতে হবে। সপ্তাহে মাত্র একদিন রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যে আমি বাইরে যাবার অনুমতি পেলাম।

—আশ্চর্য ব্যাপার তো!

—আশ্চর্যই বটে। আর একটি শর্তও ছিল, যেটি আরও অদ্ভুত। প্রতিদিন শনিবার সন্ধ্যার সময় রাস্তার দিককার বারান্দায় ইজিচেয়ার পেতে সুখেন্দুবাবুর জামা-কাপড় পরে আমায় বসে বসে একটা বই পড়বার ভান করতে হবে আধ ঘণ্টাখানেকের জন্যে।

—কেন?

—এই প্রশ্নটা আমিও সুখেন্দুবাবুকে করেছিলাম; উনি হেসে বললেন, এটা তাঁর খেয়াল!

—অদ্ভুত খেয়াল তো!—তা আপনি ক’দিন চাকরি করলেন ওখানে?

—আজ প্রায় আড়াই মাস হল, এখনো ওই চাকরিটা আমি করছি। বেকার জীবনের যে ভয়ঙ্কর চেহারাটা আমি দেখেছি, তাতে মাঝে মাঝে এই প্রায় বন্দী জীবনে ঘেন্না ধরে গেলেও চাকরি ছাড়তে আমি সাহস করিনি।

—মাইনে কি আপনি যথারীতি পেয়ে যাচ্ছেন?

—যথারীতি। প্রতি মাসের পয়লা তারিখে।

—সুখেন্দুবাবু নিজে কি করেন?

—কি একটা রাসায়নিক গবেষণা নিয়ে নাকি উনি ব্যস্ত আছেন। বাড়িতেই একতলার একটি ঘরে তাঁর ল্যাবরেটরি—বেশির ভাগ সময় তিনি ও-ঘরেই ব্যস্ত থাকেন। তবে ওই ঘরে ঢোকবার বা ও-ঘরে কি আছে, তা জানবার সুযোগ আমি কখনো পাইনি।

—কেন?

—যখন উনি কাজ করেন, তখন ল্যাবরেটরির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। আর বাইরে বেরুবার সময় উনি ঘরটাতে তালা দিয়ে যান।

—উনি কি প্রায়ই বেরোন?

—তা প্রায় মাঝে মাঝেই বেরোন। আর শনিবার সন্ধ্যার সময় তিনি প্রতি হপ্তায়ই বেরিয়ে যান, এটা লক্ষ্য করেছি।

—বাড়িতে আর কি কেউ নেই?

—আমি ছাড়া আর কেউ না।

—কেউ দেখা করতেও আসে না সুখেন্দুবাবুর সঙ্গে?

—একজন প্রায়ই আসেন, অন্তত হপ্তায় দু-তিনবার তো বটেই। নাম নিতাই বেরা। পুরোদস্তুর সাহেবী পোশাক, মাথায় ফেল্ট হ্যাট, চোখে কালো চশমা। সামনের দুটি দাঁত ভাঙা—তাই কথা বলেন একটু জড়িয়ে জড়িয়ে। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাতে একটা বেতের ছড়ি।

—উনি কি সুখেন্দুবাবুর বন্ধু?

—খুব সম্ভব বন্ধুই। তবে একটু অদ্ভুত ধরণের বন্ধু বটে।

—কি রকম?

—উনি যখন আসেন, তখন সাধারণত সুখেন্দুবাবু বাড়ি থাকেন না। আমার সঙ্গেও দু’একটি কথা ছাড়া বেশি কথাবার্তা হয় না তাঁর। কড়া নাড়লেই আমি দরজা খুলে দিই, আর উনি সোজা চলে যান সুখেন্দুবাবুর ল্যাবরেটরি ঘরে।

—একটু আগে না বললেন, সুখেন্দুবাবু বেরুবার আগে ল্যাবরেটরিতে তালা দিয়ে যান?

—নিতাইবাবুর কাছে একটা বাড়তি চাবি থাকে।

—সুখেন্দুবাবুর সঙ্গে কি ওঁর সাক্ষাৎ হয়ই না কখনো?

—খুবই কম। গত আড়াই মাসের মধ্যে মাত্র একবার আমি ল্যাবরেটরি ঘর থেকে ওঁদের দুজনের গলার আওয়াজ পেয়েছি। একটি বিশেষ কারণে সে দিনটির কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

—কি রকম?

—হপ্তায় একদিন রাত্রে মাত্র দু’ঘণ্টার জন্যে ছুটি পাই আমি। গত হপ্তায় এইভাবে ফিরে এসে একদিন রাত্রে শোবার আয়োজন করছি, এমন সময় নিচের ল্যাবরেটরি ঘর থেকে দুজনের গলার আওয়াজ পেলাম, কি বিষয়ে যেন তর্ক করছেন তাঁরা।

—তর্কের বিষয়টা কিছু বুঝতে পারলেন?

—ঠিক ধরতে পারিনি। তবে মনে হল কি যেন একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আর টাকা-পয়সা নিয়ে তর্কটা হচ্ছে।

—তারপর?

—রাত্রে শোবার আগে এক কাপ কফি খাওয়া আমার চিরকালের অভ্যেস। তাই ফিরেই কেতলিতে জল চাপিয়ে দিয়েছিলাম। সুখেন্দুবাবু বাড়ি থাকলে তাঁকেও এককাপ কফি দিতাম মাঝে মাঝে। ওঁদের গলা শুনে আরো দুকাপ বেশি জল নিলাম—সুখেন্দুবাবু আর নিতাইবাবুর জন্যে।····মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দু-কাপ ধূমায়িত কফি নিয়ে নিচের ল্যাবরেটরি ঘরের সামনে এসে হাজির হলাম। দরজা যথারীতি ভেতর থেকে বন্ধ। তবে দুজনের তর্কের শব্দটা বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছি। নিতাইবাবু পরপর প্রশ্ন করে চলেছেন আর মাঝে মাঝে সুখেন্দুবাবু তার উত্তর দিচ্ছেন।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দরজায় টোকা দিলাম। এক মুহূর্তে সব কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে সুখেন্দুবাবুর গলার আওয়াজ পেলাম—কে ওখানে?

বললাম, আমি। একটু দরজাটা খুলবেন?

খুব সন্তর্পণে দরজাটা একটু ফাঁক করে গলা বাড়ালেন সুখেন্দবাবু। কর্কশ স্বরে প্রশ্ন করলেন, কি দরকার তোমার?

বললাম, কফি করেছিলাম। ভাবলাম, আপনাকে আর নিতাইবাবুকে এককাপ করে দিয়ে আসি। তাই—

আমার দিকে তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজেকে কিছুটা সংযত করলেন সুখেন্দুবাবু। তারপর সহজ গলায় বললেন, ধন্যবাদ। কিন্তু এত রাতে নিতাইবাবু কফি খান না, আর আমারও আজ দরকার নেই।

বলে আমার মুখের ওপরেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে দুজনের কথাবার্তা আবার আরম্ভ হল। আমি মিনিট খানেক বোকার মত দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ চলে এলাম নিজের ঘরে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমরেশ প্রশ্ন করল, আপনি যে প্রতি শনিবার সন্ধ্যাবেলায় সুখেন্দুবাবুর জামাকাপড় পরে বারান্দায় বসে থাকেন, ওই সময়টুকুর মধ্যে অদ্ভুত কিছু ঘটতে দেখেছেন?

—অদ্ভুত কিছু? আপনি প্রশ্নটা করাতে একটা কথা আমার মনে আসছে। প্রতি শনিবার না হলেও অধিকাংশ শনিবারই আমি নিতাই বেরাকে সুখেন্দুবাবুর বাড়ির সামনে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। বারান্দার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে কয়েকবার তাঁকে পাড়ার বিভিন্ন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেও দেখেছি।

—সব দেখেশুনে আপনার কি মনে হয়?

—আমি কিছুই ঠিক মত বুঝে উঠতে পারছি না অমরেশবাবু। যতই ব্যাপার-স্যাপার দেখছি, ততই কেমন যেন একটা ভয় ধরে যাচ্ছে মনের মধ্যে! কাকাবাবুকে সব কথা খুলে বলেছিলাম। তিনিই পাঠিয়ে দিলেন আপনার কাছে।

—আমাকে আপনি কি করতে বলেন?

—আমি নিজের সম্পর্কে আপনার কাছে একটা পরামর্শ চাই। আমাকে আপনি কি করতে বলেন? আমার কি চাকরি ছেড়ে দেওয়া উচিত?

মিনিট দুই গম্ভীরভাবে কি যেন চিন্তা করল অমরেশ। তারপর অনিরুদ্ধ সান্যালের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, আমি আপনাকে এ ব্যাপারের শেষ পর্যন্ত দেখবার পরামর্শই দেব। রহস্যটা কি জানতে হলে চাকরি ছাড়াটা আপনার উচিত হবে না। দেখাই যাক না কি হয়। নতুন কিছু ঘটলেই আমাকে খবর দেবেন।

ঢং ঢং করে ঘড়িতে দশটা বাজল।

অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়াল। বলল, আমার দু’ঘণ্টা ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে এল, অমরেশবাবু। আবার আমি একদিন সময় করে আপনার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করব।

নমস্কার করে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল অনিরুদ্ধ সান্যাল।

আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশের ঘর থেকে ভৈরব ঠাকুরের তীক্ষ্ণ গলা ভেসে এল, বলি আজ খাওয়া-দাওয়া কিছু হবেন, না গল্প করেই পেট ভরানো হবেন?

অগত্যা উঠতে হল।

এর পরের হপ্তা দুয়েক অমরেশকে বিশেষভাবে ব্যস্ত দেখা গেল। ঘনঘন টেলিফোন করতে লাগল সে, ঘনঘন টেলিফোনও আসত প্রতিদিন। যখন তখন নিরুদ্দেশ হতে লাগল বাড়ি থেকে—একনাগাড়ে আট ঘণ্টা দশ ঘণ্টা তার কোন পাত্তা পাওয়া যেত না। দু’একবার আমি অনিরুদ্ধ-প্রসঙ্গ তোলবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু নানা আজেবাজে কথার জাল বুনে অমরেশ আমাকে স্রেফ এড়িয়ে গেছে! মেজাজ বুঝে আমিও আর ওকে ঘাঁটাইনি।

হপ্তা দুই পরের কথা।

সারাদিন নিরুদ্দেশ থেকে সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে চায়ের টেবিলে হঠাৎ রীতিমত মুখর হয়ে উঠল অমরেশ। বলল, খবর শুনেছিস?

বললাম, বেগ্ সেঞ্চুরি করেও নট আউট আছে।

অমরেশ মুচকি হেসে বলল, ক্রিকেট নয় বন্ধু, আমি অনিরুদ্ধর কথা বলছি! খবর শুনেছিস?

বললাম, কি খবর?

—গত চারদিন ধরে অনিরুদ্ধ নিরুদ্দেশ! সুখেন্দুবাবু থানায় ডায়েরী করেছেন, অনিরুদ্ধ নাকি তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর সোনার ঘড়ি আর দামী ফাউন্টেন পেন সমেত প্রায় হাজার খানেক টাকা চুরি করে নিরুদ্দেশ হয়েছে!

—বলিস কি? এ যে অবাক কাণ্ড!

—অবাক কাণ্ডই বটে! আজ সঞ্জয়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তাঁর মুখেই খবরটা শুনলাম। অনিরুদ্ধর মত আদর্শবাদী ছেলের এ জাতীয় অধঃপতন সঞ্জয়বাবু মোটেই আশা করতে পারেননি—একেবারে মুষড়ে পড়েছেন ভদ্রলোক।

বললাম, মুষড়ে পড়ার মতই ব্যাপার বটে। অনিরুদ্ধকে যতদূর দেখেছি, তাতে সে যে এ ধরণের কাজ করতে পারে, সেটা মোটেই বিশ্বাস হয় না।

অর্থপূর্ণভাবে শুধু একটু হাসল অমরেশ, মুখে কিছুই বলল না।

সেই দিনই রাত্রে।

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেছে। অমরেশের সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শেষ করে সবে বিছানায় গা এলিয়েছি—রাত তখন সাড়ে দশটা—হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল ঝনঝন করে।

অমরেশ রিসিভার তুলে নিল।

—হ্যালো?····হ্যাঁ, কথা বলছি।····বলুন·····সেকি! এইমাত্র খবর পেলেন?····খুব বেশি কি ছড়িয়ে পড়েছে?····কোথায়—হাসপাতালে?·····খুব সাবধান থাকতে হবে কিন্তু! কেউ যেন জানতে না পারে!····কি বললেন····দাঁত? নকল দাঁত?·····হুঁ! যাই হোক, আমরা এখুনি যাচ্ছি।····আপনি আসছেন তো?····আচ্ছা।

রিসিভারটি একরকম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো হাওয়াই শার্টটি টেনে নিলো অমরেশ। বলল, দু’মিনিটের মধ্যে যদি তৈরি হয়ে বেরুতে পারিস আমার সঙ্গে, তাহলে অনিরুদ্ধকে দেখতে পাবি!

—পাওয়া গেছে নাকি? কোথায় আছে?

—আছে····হাসপাতালে। সেখানে গিয়েই সব শুনবি।

আর বাক্যব্যয় না করে জামাটা গায়ে গলিয়ে নিলাম।

অনিরুদ্ধর জায়গায় যে এমন একটি ভীষণদর্শন ভয়াবহ প্রেতমূর্তিকে দেখতে পাবো, সেটা আমি স্বপ্নেও আশা করিনি। বাস্তবিক অনিরুদ্ধকে আগে যারা দেখেছে, হাসপাতালের বেডে শয়ান ওই ব্যক্তিটিকে দেখে কিছুতেই তারা তাকে অনিরুদ্ধ বলে স্বীকার করবে না। সারা মুখটি ফুলে কদাকার আকার ধারণ করেছে—মুখে মাথায় আর দেহে বহু আঘাতের চিহ্ন, চোখে উন্মাদের মত একটা ভয়ার্ত দৃষ্টি। ডাঃ গুপ্তর মুখে শুনলাম, ওর প্রত্যেকটি দাঁত নাকি হাতুড়ি আর সাঁড়াশি জাতীয় কোন জিনিসের সাহায্যে উপড়ে ফেলা হয়েছে; শরীরটাও নানান জায়গায় ভীষণভাবে পুড়ে গেছে। তবে ডাঃ গুপ্ত আশা দিলেন ভয়ের খুব বেশি কারণ নেই—শেষ পর্যন্ত সেরে উঠবে অনিরুদ্ধ। ওর দিকে তাকিয়ে সারা শরীর আমার শিরশির করে উঠল। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

বারান্দায় সি-আই-ডি ডিপার্টমেন্টের তালুকদারবাবুর সঙ্গে দেখা হল। আমি কিছু বলবার আগে অমরেশ ওর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, আগুন দেখতে পেয়েই কি ঢুকেছিলেন ভেতরে? কেউ কি দেখতে পেয়েছে?

—না; আমরা খুব সাবধান ছিলাম, কেউ আমাদের দেখতে পায়নি। তবে খিড়কি দরজাটা একটু জাম থাকায়, বাড়ির ভেতর ঢুকতে আমাদের একটু দেরি হয়ে যায়—আর সামান্য একটু দেরি হয়ে গেলে অনিরুদ্ধবাবুকে জীবন্ত বার করে আনা মুস্কিল হত।

—আগুনটা কি নেভানো হয়েছে?

—না। আগুনটা এত তাড়াতাড়ি সারা বাড়িময় ছড়িয়ে পড়ল যে, দমকলে খবর দেবার আগেই আগুন প্রায় সারা বাড়িটাকে গ্রাস করে ফেলল। দমকল এসে বিশেষ কিছুই করতে পারেনি।

—আপনি কি সব সময় ওখানে ছিলেন?

—সারা দিন; এক মুহুর্তও আমাদের লোক জায়গা ছেড়ে নড়েনি।

—আগুন লাগার আগে বাড়ি থেকে কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখলেন?

—হ্যাঁ; আগুন লাগার আধ ঘণ্টা খানেক আগে নিতাই বেরাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম।

—নকল দাঁতের কথা কি বলছিলেন যেন?

—হ্যাঁ, একপাটি নকল দাঁত অনিরুদ্ধ বাবুর অজ্ঞান দেহের পাশেই পড়েছিল।

—বাঃ, চমৎকার ব্যবস্থা তো, আসল দাঁত গুড়িয়ে ফেলে নকল দাঁত দেওয়া!

—বলেন তো, আজই নিতাই বেরাকে অ্যারেস্ট করি। রিজেন্ট পার্কে ওর বাড়ির ওপর আমাদের লোক কড়া নজর রেখেছে।—সময় বুঝে আবার সরে না পড়ে লোকটা।

—ও পাগলামিটি কদাপি করবেন না, এখুনি আপনার লোক সরিয়ে নিন! ঘুণাক্ষরেও যদি নিতাই বেরা জানতে পারে যে, পুলিশ তার পেছনে লেগেছে, তাহলে ওকে আর পাওয়া যাবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, নিতাই বেরা পালাবে না।

যে গতিতে আমরা হাসপাতালের উদ্দেশে বেরিয়েছিলাম, তার তুলনায় বাড়ি ফিরলাম শম্বুক গতিতে। শীতের গোড়ার দিকের ঠাণ্ডার একটি মিষ্টি আমেজ কলকাতার বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে একটি শান্ত স্নিগ্ধতা; হাসপাতালে এইমাত্র দেখে আসা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নটি মন থেকে ক্রমাগত সরে যেতে লাগল। বললাম, অনিরুদ্ধ তাহলে টাকা চুরি করেনি, সুখেন্দুবাবু তাহলে থানায় ভুল ডায়েরী করেছিলেন?

সানবিম ট্যালবটের গতি আর একটু কমিয়ে দিয়ে আলস্যভরে একটা হাই তুলে অমরেশ বলল, ভুল নয়, মিথ্যা ডায়েরী করেছিলেন সুখেন্দুবাবু। অনিরুদ্ধকে সুখেন্দুবাবুর ল্যাবরেটরি ঘরে পাওয়া গেছে, আর যে অবস্থায় পাওয়া গেছে, সেটা তো স্বচক্ষেই দেখলি!

মনে মনে সেই বীভৎস দৃশ্যটি কল্পনা করে আর একবার শিউরে উঠলাম। বললাম, আগুন লাগার আধ ঘণ্টা খানেক আগে নিতাই বেরাকে সুখেন্দুবাবুর বাড়ি থেকে বেরুতে দেখা গেছে, সেটা তালুকদারের মুখেই শুনেছি। কিন্তু অনিরুদ্ধ যে বাড়ির ভেতরে আছে, সেটা তালুকদার জানলেন কি করে?—সমগ্র ব্যাপারের সন্ধানই তালুকদার পেলেন কি করে, সেটাও তো বুঝতে পারছি না।

—আমিই তালুকদারকে অনুরোধ করেছিলাম, বাড়িটার ওপর নজর রাখতে। বাড়িটাতে যে আগুন লাগতে পারে, আর অনিরুদ্ধ যে ওই সময় বাড়িটার মধ্যে থাকতে পারে, এটাও আমি মোটামুটি অনুমান করেছিলাম। তালুকদারকে বলা ছিল, আগুন লাগলেই উনি যেন গোপনে খিড়কিপথে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে অনিরুদ্ধর খোঁজ করেন।

—গোপনে কেন?

—অনিরুদ্ধ যে বেঁচে আছে, এ খবরটা জানাজানি হলে আমাদের কাজের অসুবিধে হতে পারে। পুলিশ ইতিমধ্যেই প্রচার করে দিয়েছে, পোড়া বাড়িটা থেকে মানুষের একটি পোড়া কঙ্কাল পাওয়া গেছে। অবিশ্যি এখনও পুলিশ সত্যি-সত্যিই পোড়া বাড়িটা ভালভাবে সার্চ করেনি—সার্চ করলে কি পাওয়া যাবে বলা যায় না।

—তাহলে দেখছি, এ সবের জন্যে নিতাই বেরাই দায়ী। লোকটার অ্যারেস্টে বাধা দিয়ে তুই কি ভাল করলি?

—ভালই করেছি। কারণ অনিরুদ্ধকে মারাত্মকভাবে আহত করার অভিযোগে নিতাই বেরার কয়েক বছর জেল হত মাত্র, কিন্তু আমি যে অপরাধে নিতাই বেরাকে গ্রেপ্তার করার জন্যে জিইয়ে রেখেছি, তার জন্যে হয় ফাঁসি, নয় বছর কুড়ির জন্যে শ্রীঘর বাস তো হবেই।

—কিছুই বুঝতে পারলাম না। খুন ছাড়া এত বড় শাস্তি আর কোন অপরাধে হয় বলে আমার জানা নেই।

—সুখেন্দুবাবুকে পুড়িয়ে মারবার জন্যে নিতাই বেরাকে অতি সহজেই অভিযুক্ত করতে পারো তুমি!

—বল কি?

—ঠিকই বলছি। অনিরুদ্ধর পাশে যে নকল দাঁতের পাটি পাওয়া গেছে, ওটি খুব সম্ভব সুখেন্দুবাবুর। হয়তো ব্যাপারটা ঘটেছে এই রকম—নিতাই বেরা কোন কারণে সুখেন্দুবাবুকে হত্যা করে, আর অনিরুদ্ধ বাধা দিতে যাওয়ায় তাকেও ভয়ানকভাবে আহত করে। তারপর নিজের অপরাধ গোপন করবার জন্যে বাড়িতে আগুন লাগাবার ব্যবস্থা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। পরে আগুন লাগলে পর তালুকদার গোপনে বাড়িতে প্রবেশ করেন। কিন্তু আগুন খুব বেশি ছড়িয়ে পড়ায় তাঁর পক্ষে সারা বাড়িটা তন্নতন্ন সার্চ করা আর সম্ভব হয় না—অনিরুদ্ধকে পেয়েই তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তাছাড়া সুখেন্দুবাবু যে ওই বাড়িতে ওই সময় থাকতে পারেন, সেটা ওঁর ধারণাই ছিল না।

—কিন্তু উদ্দেশ্য····মানে মোটিভটা?

—টাকা। খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছি, বছর দুই আগে সুখেন্দুবাবু নিজের জীবনের ওপর পঞ্চাশ হাজার টাকার জীবনবীমা করিয়েছিলেন—দুর্ঘটনার সুবিধাসহ; অথাৎ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে বীমা কোম্পানি ডবল টাকা—মানে এক লাখ টাকা—সুখেন্দুবাবুর ওয়ারিশানকে দিতে বাধ্য থাকবে। সুখেন্দুবাবুর বাড়িটাও পঞ্চাশ হাজার টাকার আগুন বীমা করা আছে।

—কিন্তু তাতে নিতাই বেরার স্বার্থটা আসছে কোথায়?

—কাঁচা দেড় লাখ টাকার স্বার্থ: নিতাই বেরাকেই সুখেন্দুবাবু বীমাপত্রে তাঁর ওয়ারিশ নিযুক্ত করে গেছেন।

গাড়িতে যেন বোমা পড়ল!

এই ঘটনার ঠিক তিন দিন পরে।

অমরেশ একটা জরুরী টেলিফোন পেয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল সকালের দিকে। ফিরল প্রায় বেলা দশটায়। বলল, বিশু, তৈরি হয়ে নে, আজ নিতাই বেরার সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দেব।

বললাম, সেই ব্যবস্থা করতেই বেরিয়েছিলি বুঝি?

—হ্যাঁ, কন্টিনেন্টাল ইন্সিওরেন্সের ম্যানেজার মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করে এই মাত্র ফিরছি। নিতাই বেরা আজ বেলা সাড়ে এগারোটায় আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর দেড় লাখ টাকার দাবী পেশ করতে আসছেন কন্টিনেন্টালের অফিসে। কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে আমিও ম্যানেজারের ঘরে উপস্থিত থাকব—নিতাই বেরা আমাকে আগে দেখেননি—পাশের ঘরে থাকবি তুই আর তালুকদার। বেগতিক হলে তোদের সাহায্যের দরকার হতে পারে।

স্নান-খাওয়া-দাওয়ার পাট সেরে বেরুতে বেরুতে সোয়া এগারোটা বেজে গেল। আমাদের সানবিম যখন কন্টিনেন্টালের অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল তখন এগারোটা কুড়ি।

তালুকদার দেখলাম আগেই এসে হাজির হয়েছেন। আমাকে দেখে হেসে মাথাটা নোয়ালেন একটু। তারপর ব্যস্তভাবে অমরেশের দিকে ফিরে বললেন, ব্যাপারটা ভালভাবে ভেবে দেখেছ তো অমরেশ? সবই নির্ভর করছে প্রমাণের ওপর। যদি আদালতে সুখেন্দুবাবুর মৃত্যুটা প্রমাণ না করা যায়····

বরাভয় মুদ্রায় ডান হাতটা তুলে অমরেশ পরম নিশ্চিন্তভাবে বলল, আর মিনিট দশেকের মধ্যে প্রমাণ সমেত আসামীকে আপনার সামনে হাজির করব!

মিঃ চ্যাটার্জি অভ্যর্থনা করে বসালেন আমাদের। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই তাঁর বেয়ারা ঘরে ঢুকে সেলাম করে একটি স্লিপ দিল তাঁর হাতে। অর্থপূর্ণভাবে মিঃ, চ্যাটার্জি তাকালেন অমরেশের দিকে। বললেন, মিস্টার বেরা বাইরে অপেক্ষা করছেন!

—ঠিক আছে, আপনি বসুন আপনার চেয়ারে। উত্তেজনার ভাবটা দমন করুন। তালুকদারবাবু, আপনি বিশুকে নিয়ে ওই পাশের স্ক্রীনটার আড়ালে অপেক্ষা করুন—দরকার বুঝলেই বেরিয়ে আসবেন সাহায্যের জন্যে।

নিজে মিঃ চ্যাটার্জির পাশে একটা চেয়ারে বসে পড়ল অমরেশ। একটা খোলা ফাইলে মনঃসংযোগ করে বেয়ারাকে ইঙ্গিত করল নিতাই বেরাকে পাঠিয়ে দেবার জন্যে।

কিছুক্ষণ পরে পায়ের শব্দে বুঝলাম নিতাই বেরা ঘরের মধ্যে ঢুকেছেন।

অমরেশের গলার স্বর শুনলাম: আপনিই মিস্টার বেরা? নমস্কার। টেক ইওর সীট প্লীজ— চেয়ার টানার শব্দ। বুঝলাম, নিতাই বেরা বসলেন।

—সিগারেট, প্লীজ!

—নো, থ্যাঙ্কস্। আমার অভ্যেস নেই।

কেমন যেন জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলেন নিতাই বেরা।

—আপনার কেসটাই আমি এতক্ষণ স্টাডি করছিলাম, মিস্টার বেরা। আপনার বন্ধু মিস্টার চৌধুরীর মৃত্যু রিয়েলি ভেরি স্যাড! দেশ একজন প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিককে হারাল।

—হ্যাঁ, সত্যিই খুব দুঃখের বিষয়। একটা যুগান্তকারী কাজে হাত দিয়েছিল সুখেন্দু। রাতদিন ল্যাবরেটরিতে পড়ে থাকত, খাওয়া-পরারও হুঁশ থাকত না। ল্যাবরেটরিতে কাজ করবার সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে আগুন লাগে বলে আমার ধারণা।

—আমরা সত্যিই অত্যন্ত দুঃখিত, মিস্টার বেরা। যত শীঘ্র সম্ভব আমরা আপনার ক্লেম সেটলমেন্টের ব্যবস্থা করব। আশা করি, একটা ফর্মাল ক্লেম ফর্ম আপনি পূরণ করে এনেছেন?

—নিশ্চয়ই। এই যে····এবার আমি আসতে পারি?

আবার চেয়ার টানার শব্দ। অনুমানে বুঝলাম, মিঃ বেরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আর একটা চেয়ার টানার শব্দ হল; বুঝলাম অমরেশও উঠে দাঁড়াল।

—এক মিনিট মিস্টার বেরা, অনিরুদ্ধ সান্যাল নামের কোন লোকের সঙ্গে কি আপনার পরিচয় আছে?

—অনিরুদ্ধ সান্যাল! নামটা আগে শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না!

—তিনি নাকি আপনার মৃত বন্ধু মিস্টার চৌধুরীর সহকারী হিসেবে কাজ করতেন?

—ওহো! যে লোকটা সুখেন্দুর ঘড়ি আর টাকা চুরি করে পালিয়েছিল, তার কথা বলছেন?

—হ্যাঁ। মনে পড়েছে তাহলে? লম্বা দোহারা চেহারা, ব্যাকব্রাশ করা চুল, পাঁচ ফুট ন’ ইঞ্চি উচ্চতা····

—আমি এখন তাহলে আসি····একটা জরুরী কাজ আছে…

মিঃ বেরার কম্পিত গলা আর উত্তেজিত পায়ের শব্দ পেলাম। তারপরই একটা ভারী বস্তু পতনের হুড়মুড় শব্দ।····তীরের মত আমি আর তালুকদার বেরিয়ে এলাম স্ক্রীনের আড়াল থেকে। দেখলাম অমরেশের বজ্ৰবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন নিতাই বেরা। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে তালুকদার সঙ্গে করে আনা হাতকড়াটা পরিয়ে দিলেন নিতাই বেরার হাতে। তারপর তাঁর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের সঙ্গে গড়গড় করে বলতে লাগলেন, মিস্টার বেরা, অনিরুদ্ধ সান্যালকে বিপজ্জনক ভাবে আহত আর সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরীকে হত্যা করার অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল। আমি আপনাকে এই বলে সাবধান করে দিতে চাই যে, এরপর থেকে আপনি যা বলবেন—

হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল অমরেশ। বলল, আরে থামুন, থামুন মিস্টার তালুকদার, একটু ভুল হচ্ছে আপনার। সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরীকে হত্যার অপরাধে আপনি মিস্টার বেরাকে গ্রেপ্তার করতে পারেন না—

—মানে?

—মানে উনি সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরীকে হত্যা করেননি—করতে পারেন না।

—মানে?

—মানে উনি নিজেই সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরী!

ঘরের মধ্যে যেন একটা বোমা পড়ল!

অমরেশের ড্রইংরুম।

ভৈরব ঠাকুরের আনা ধূমায়িত কফির কাপে একটা আরামের চুমুক দিয়ে অমরেশ বলল, সুখেন্দুবাবুর প্ল্যানটা ছিল এক কথায় ওয়াটার টাইট। নিখুঁত। বছর দুই আগে ইন্সিওরেন্স ইত্যাদি সমাধা করে উনি সব তোড়জোড় সম্পূর্ণ করে রেখেছিলেন। তারপর খুব সাবধানে উনি বাছাই করলেন অনিরুদ্ধ সান্যালকে—যার উচ্চতা কাঁটায় কাঁটায় তাঁর নিজের উচ্চতার সমান। সুখেন্দুবাবুর ছিল নকল দাঁত, কিন্তু পাঁচ ফুট ন’ইঞ্চি উচ্চতার সঙ্গে নকল দাঁত—একই ব্যক্তির মধ্যে এই দুটি গুণ আশা করাই দুরাশা। তা তিনি করেননি। অনিরুদ্ধর আসল দাঁত ক’টি হাতুড়ি দিয়ে চুরমার করে, তার পাশে নকল দাঁতের একটি পাটি রেখে অবিশ্যি পরে তিনি সে অভাব পূরণ করেছিলেন। অনিরুদ্ধকে নিজের জামাকাপড় পরিয়ে আধো-অন্ধকার বারান্দায় মাঝে মাঝে বসিয়ে রাখার উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়—পাড়ার লোকের মনে এ ধারণাটা বদ্ধমূল করে দেওয়া যে সুখেন্দুবিকাশ আর নিতাই বেরা সম্পূর্ণ আলাদা লোক। তাই অনিরুদ্ধ যখন সুখেন্দুর বেশে বারান্দায় বসে থাকত, তখন প্রায়ই নিতাই বেরাকে পাড়ার লোকের সঙ্গে সুখেন্দুবেশী অনিরুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করে কথাবার্তা বলতে দেখা যেতো। অনিরুদ্ধের মনেও এই ধারণাটাই উনি বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেন যে সুখেন্দুবিকাশ আর নিতাই বেরা সম্পূর্ণ আলাদা লোক।

তারপর এল ওস্তাদের মারের সময়। অনিরুদ্ধকে বাড়ির একাংশে জোর করে আটকে রেখে উনি থানায় ডায়ারি করিয়ে দিলেন যে সে তাঁর ঘড়ি আর টাকা চুরি করে পালিয়েছে। চালটা খুব সুন্দর। পুলিশ যখন ফেরার অনিরুদ্ধকে অন্যত্র সন্ধান করছে, তখন তিনি ওকে নিজের জায়গায় পুড়িয়ে মারবার উপাদেয় ব্যবস্থা করছেন। আমরা যদি ব্যাপারটা গোড়া থেকে আঁচ না করতে পারতুম, তাহলে কি দাঁড়াত? বাড়িতে আগুন লাগত আর সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবার পর পাওয়া যেত একটি মানুষের কঙ্কাল। কঙ্কালের দৈহিক উচ্চতা, নকল দাঁতের পাটি আর সুখেন্দুর অন্য কয়েকটা ব্যবহৃত জিনিসপত্র থেকে এটা প্রমাণ করা মোটেই শক্ত হত না যে দেহাবশেষটি সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরীরই। অনিরুদ্ধের কথা কারুর মনেই আসত না। কারণ সে ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই চুরির দায়ে ফেরার।

—সব ব্যাপারটা তুই আঁচ করলি কি করে?

—প্রথমেই সন্দেহ হল বিজ্ঞাপনের অদ্ভুত শর্ত দেখে। তারপর যখন অনিরুদ্ধের মুখে শুনলাম যে, সুখেন্দু আর নিতাইকে ও কখনো এক সঙ্গে দেখেনি—তখনি সন্দেহটা দানা বাঁধল। ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলোতে একটু খোঁজ-খবর নিতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল জলের মত। তারপরই আমি মিস্টার তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাল্টা ষড়যন্ত্র করলাম!

তালুকদার এতক্ষণ চুপচাপ সব কিছু শুনছিলেন। বললেন, এ জাতীয় অপরাধ আমাদের দেশে সাধারণত ঘটতে দেখা যায় না—আইডিয়াটা বেশ নতুন বলতে হবে।

আমি বললাম, সবই তো হল, শুধু মাঝখান থেকে ডাহা ক্ষতিটা হয়ে গেল অনিরুদ্ধ সান্যালের দু-পাটি দাঁত আর তিনশো টাকার একটা লোভনীয় চাকরি বেচারার হাতছাড়া হয়ে গেল। এ বাজারে কম ক্ষতি নয়!

অমরেশ হাই তুলে বলল, তার ব্যবস্থাও হয়েছে। কন্টিনেন্টাল ইনসিওরেন্সের মিস্টার চ্যাটার্জি সমান মাইনের একটা চাকরি অনিরুদ্ধকে দিতে সম্মত হয়েছেন আমার বিশেষ অনুরোধে।—এখন ভালোয় ভালোয় অনিরুদ্ধ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেই হয়।····আসল দাঁত অবিশ্যি আর ফেরত পাওয়া যাবে না—নকল দাঁতেই কাজ চালাতে হবে। ওই নকল দাঁতই এখন আক্কেল-দাঁতেরও কাজ দেবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *