1 of 2

তদন্ত – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

তদন্ত – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

নমস্কার। আপনারা তিনজনেই আছেন দেখছি। আমি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে আসছি।

ও, আপনারা বুঝতে পেরেছেন, আমি কেন এসেছি? তা ঠিক, বুঝতে পারাটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আপনাদের সঙ্গে আমার কিছু আলোচনা আছে। বসতে পারি? ধন্যবাদ।

চা? না—দরকার নেই। দেখুন, যে কথাগুলো আজ আমি বলব, তাতে কিছু কিছু অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ থাকবে—হয়তো আপনাদের কারো কারো পারিবারিক জীবন—ইয়ে—এক আধটু এসে পড়বে। সেজন্যে আগে থেকেই মাপ চেয়ে নিচ্ছি। কি করব বলুন, সত্যের সম্মান করতে গিয়ে অনেক আনপ্লেজেন্ট জিনিসই আমাদের ফেস করতে হয়।

যে-রাত্রে আপনাদের চতুর্থ বন্ধু উৎপলকুমার নাগচৌধুরী নিহত হন, সেদিন আপনারা চারজনে এই ঘরে বসে তাস খেলছিলেন। তখন রাত এগারোটা বেজেছে, ক্লাবের একটি মাত্র চৌকিদার বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। তাকে জাগিয়ে চাবি দিতে বলে, আপনারা চারজনেই এক সঙ্গে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের দিকে আসতে থাকেন।

তখন পথে দুধারে দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে—লোক চলাচল নেই বললেই হয়। এমন সময় ‘লোড-শেডিং’য়ের কল্যাণে হঠাৎ রাস্তার আলোগুলো নিবে যায়—আপনাদের আগের জবানবন্দি থেকেই বলছি, আপনারা চারজনেই দাঁড়িয়ে পড়েন। তারপরেই ‘উঃ’ বলে একটা শব্দ শোনা যায়—কেউ যেন দৌড়ে খানিকটা পালালো বলেও মনে হয়—যদিও কাউকে আপনারা দেখেছেন বলে স্মরণ করতে পারেন না।

‘আমাকে ছোরা মেরেছে’ বলে উৎপলবাবু বসে পড়েন। অবনীবাবু দেশলাই জ্বালেন এবং আপনারা তিনজনেই দেখতে পান—একখানা লম্বা ছোরা প্রায় বাঁট পর্যন্ত উৎপলবাবুর বুকে বেঁধানো রয়েছে। প্রতাপবাবু সামনের এক ডাক্তারের বাড়িতে ছুটে যান, এবং অবনীবাবু আর কমলাক্ষবাবু ‘খুন—খুন—পুলিশ—পুলিশ’ বলে চিৎকার করতে থাকেন।

টর্চ নিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে আসেন, পাহারাওলা আসে, অ্যাম্বুলেন্স আসে, উৎপলবাবুকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছবার আগেই উৎপলবাবু মারা যান।

সেই অন্ধকারে ছোরাটা কে মারল? আততায়ী কে হতে পারে? গুণ্ডা নয়, তারা বিনা কারণে খুন-জখম করে না। আপনারা যেন কারো পায়ের শব্দ শুনেছিলেন বলেছেন—যদিও সামান্য কিছুদুর গিয়েই শব্দটা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও গলি নেই—সারি সারি বন্ধ দোকান—লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। উৎপলবাবু যেখানে আঘাত পান—তদন্তে দেখা গেছে সেখানে কয়েকটা ভাঙা ইঁটের টুকরো পড়েছিল—তার একটা ছিল হাত দশেক দূরে। লাথি মেরে ফুটপাথের ওপর দিয়ে ইঁটের টুকরোটাকে গড়িয়ে দিলে পায়ের আওয়াজের একটা ইলিউশন তৈরি হতে পারে—বিশেষ করে আপনাদের সেই মানসিক অবস্থায়।

ছোরাটা পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেটা দুধারী—ফলাটা সাত ইঞ্চির মত লম্বা। খাপের মধ্যেই রাখা ছিল বলে মনে হয়। বাঁটটা আইভরির এবং পুরনো। তাতে কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি। রুমাল কিংবা দস্তানা ব্যবহার করা হয়ে থাকবে।

অবস্থা দেখে বাইরের কোন আততায়ীর চিন্তা বাতিল করে দিতে হয়, বিশেষ করে যখন জানা যায়, উৎপল নাগচৌধুরীর কোন শত্রু ছিল না। তিনি দিলদরিয়া খোশ-মেজাজী মানুষ, ত্রিশ বছর বয়েসে স্ত্রীর মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেননি। এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েটিকে সুপাত্রে দিয়েছেন—সে তার স্বামীর সঙ্গে ইউরোপের এক এমবাসিতে আছে। ছেলে পাঞ্জাবে এঞ্জিনীয়ার—গভর্নমেন্ট সার্ভিসে। নিজে ভাল চাকরি করতেন। পাড়ায় তিনি অসাধারণ জনপ্রিয় ছিলেন। বারোয়ারী পুজোয় একশো টাকা চাঁদা দিতেন। তাঁর পুরোনা ঝি এবং বুড়ো-ঠাকুর মনিবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাঁকে খুন করার পেছনে কারো কোন মোটিভ দেখা যাচ্ছে না। ছেলে বাপের শেষ কাজ করবার জন্যে কলকাতায় এসেছেন—তাঁর কাছ থেকে জানা যায় উৎপলবাবু অজাতশত্রু।

সুতরাং, আমাকে ক্ষমা করবেন, খুনের স্থান-কাল এবং সবদিক বিচার করে আপনাদের তিনজনের ওপরেই সন্দেহটা সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।

না—না, আপনারা উত্তেজিত হবেন না। আপনাদের কারো বিরুদ্ধেই অভিযোগ আমরা আনছি না। আপনাদের জবানবন্দি থেকে এবং আমাদের তদন্তের ফলে অবস্থাটা যা দাঁড়িয়েছে, তা-ই কেবল স্পষ্ট করে বলতে চাইছি আপনাদের কাছে। হয়তো আপনারা সাহায্য করলে, আসল খুনীকে গ্রেপ্তার করা আমাদের পক্ষে একেবারে অসম্ভব হবে না।

কী বলছেন প্রতাপবাবু, সিগার? মাপ করবেন, আমার চলে না—মানে, স্মোকই করি না আমি। থ্যাঙ্ক ইউ।

এখন যা বলছিলুম।

আপনারা তিনজনেই ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একবয়েসী আপনারা নন, প্রতাপবাবু উৎপলবাবুর বছর তিনেকের বড়, অবনীবাবু তাঁর সমবয়েসী আর কমলাক্ষবাবু আট-দশ বছরের ছোট। কিন্তু বয়েসের ব্যবধান যেমনি থাক—মনে প্রাণে আপনারা যে কত এক ছিলেন, তার প্রমাণ ক্লাবের নাম: ‘ফোর হার্টস টুগেদার’। তবু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এই চারটি মিলিত হৃদয়ের মধ্যে সম্ভবত একটি বিশ্বাসঘাতক। দেখা যাক।

প্রতাপবাবু, আপনাকে প্রথমেই বাদ দেওয়া যেতে পারে। আপনি একদা বিপ্লবী দলে ছিলেন, জেল খেটেছেন—লোকে বলে, দেব-চরিত্রের পুরুষ আপনি। পাড়ার প্রতিটি সৎকাজে আপনি অগ্রণী। ব্যাচেলার মানুষ, মেসে থাকেন, অত্যন্ত সরল জীবন যাপন করেন। আপনার মাইনের টাকার প্রায় সবটাই আপনি চ্যারিটিতে দান করে থাকেন, সে খবরও আমরা পেয়েছি। বছর চারেক আগে উৎপলবাবু যখন মরণাপন্ন অসুখে পড়েন, তখন বলতে গেলে আপনার.সেবাযত্নেই তিনি প্রাণ ফিরে পান। যতদূর জানি, উৎপলবাবুকে নিজের ভাইয়ের চাইতেও আপনি বেশি স্নেহ করতেন। আপনি আমাদের সন্দেহের বাইরে।

তাহলে থাকছেন দুজন, অবনীবাবু আর কমলাক্ষবাবু।

প্লীজ! এক্সাইটেড হবেন না, ভয় পাবেন না। আপনারা খুনী, একথা আমি বলিনি। এখনও বলছি না। সত্যই হচ্ছে আমাদের প্রতিপাদ্য। কিভাবে সেই সত্যের দিকে এগোনো যায়, আপাতত সেইটিই আমাদের একমাত্র চেষ্টা।

প্রথমে অবনীবাবুর কথাই বলা যাক।

না—আপনাদের কিছু বলতে হবে না, আমার কথাই শুনুন। অবনীবাবু, আপনি হচ্ছেন ছা-পোষা গৃহস্থ। আপনার বড় সংসার, দায়-দায়িত্ব আছে। যে বিজনেসে আছেন, তার অবস্থা গত কয়েক বছর ধরেই খারাপ। পাড়ার লোকে বলে, বাড়িতে আপনার ঝগড়াঝাঁটি, অশান্তি লেগেই থাকে। ছ’মাস আগে আপনি বাড়ি বদলেছেন, কিন্তু আসবার আগে পুরোন বাড়িওলার সঙ্গে আপনার হাতাহাতি হয়ে গিয়েছিল।

উৎপলবাবু আপনার কলেজ-জীবনের বন্ধু, বলতে গেলে তিনজনের মধ্যে লংগেস্ট স্ট্যান্ডিং ফ্রেন্ডশিপ। কিন্তু কিছুদিন ধরেই এই সম্পর্ক ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত তিক্ত হয়ে উঠেছিল। কারণ?

না, না, আপনি স্থির হয়ে বসুন, আগে বলতে দিন আমাকে। ভুল যদি কিছু করি, পরে শুধরে দেবেন।

উৎপলবাবু খুন হওয়ার মাস তিনেক আগে—ধরুন, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে, আপনি ক্লাব থেকে বেরিয়ে উৎপলবাবুর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে যান। মরালিস্ট প্রতাপবাবু কিংবা ছেলেমানুষ কমলাক্ষবাবু জানেন কিনা বলতে পারি না, আপনার এবং উৎপলবাবুর অল্প-স্বল্প ড্রিঙ্ক করা বহুকালের অভ্যাস। কোন বারে কিংবা পাবলিক প্লেসে নয়, উৎপলবাবুর বাড়িতেই একটু বেশি রাতে আপনাদের আসর বসত।

যেদিনের কথা বলছি, সেদিন রাত বারোটা নাগাদ উৎপলবাবুর ঘর থেকে কিছু চিৎকার শোনা যায়। ঠাকুর কৌতুহলী হয়ে কান পাতে এবং যে-সব কথাবার্তা সে শুনতে পায়, তা আমার এই কাগজপত্র থেকে পড়ে শোনাই। দরকার মত একটু এডিট করে নিতে হয়েছে আমাকে।

উৎপলবাবু: আমি বলছি অবনী, আর কোন সাহায্য তোমায় আমি করতে পারব না।

আপনি: তোমার এত টাকা আছে, আর বন্ধুর জন্যে তুমি সামান্য দশ হাজার মাত্র—

উৎপলবাবু; মাত্র দশ হাজার! কিন্তু আজ পর্যন্ত কত টাকা তোমায় দিয়েছি, সে খেয়াল আছে তোমার?

আপনি: না, সে আমি ভুলিনি। তোমার প্রত্যেকটা পাইপয়সা পর্যন্ত ফিরিয়ে যদি না দিই, তবে আমি অবনী চ্যাটার্জি নই।

উৎপলবাবু ঠাট্টার হাসি হেসে বলেন, টাকা ফেরৎ দেবে তুমি! আই সে অবনী, ব্যবসায় তোমার ব্রেন নেই, কোনদিন তুমি দাঁড়াতে পারবে না। বন্ধু হিসেবে অনেক টাকা তোমায় দিয়েছি, কিন্তু এখন দেখছি সব জলে পড়েছে। সাধ্যমত সাহায্য আমি করেছি—সাধ্য ছাড়িয়েও করেছি, কিন্তু সব জিনিসেরই একটা লিমিট আছে।

আপনি: তাহলে তুমি টাকা দেবে না?

উৎপলবাবু: দিতে পারি। তবে এবার শুধু হাতে নয়, সিকিউরিটি চাই।

আপনি: কি সিকিউরিটি দেব? আমার ব্যবসা?

উৎপলবাবু: তোমার ব্যবসা! ঠ্যাং-ভাঙা ঘোড়া নিয়ে রেস জিতব বলতে চাও? না, ওতে আমার কোন লোভ নেই।

আপনি: কিন্তু আমার কি আছে?

উৎপলবাবু: কেন, টালিগঞ্জের সেই জমিটা।

অবনীবাবু, শুনে আপনার মুখ কালো হয়ে যায়। বছর পাঁচেক আগে জমিটুকু আপনি কিনেছিলেন, স্বপ্ন ছিল আরো কিছুদিন পরে ওখানে একটা ছোটখাটো বাড়ি করবেন। আপনি পাকিস্তানের লোক—দেশ আপনার গেছে, ওই জমিটুকুই ছিল ভরসা। অথচ ব্যবসার যা অবস্থা, তাতে আপনি কিছুতেই সুবিধে করতে পারছিলেন না। অনেক দুঃখেও জমিটা আপনি আঁকড়ে ধরে বসেছিলেন, উৎপলবাবুর কথায় আপনার মাথায় যেন বাজ পড়ে। আপনি এমন ভাবে নড়ে ওঠেন যে হাতের ধাক্কায় একটা সোডার বোতল মেঝেয় আছাড় খেয়ে গুঁড়ো হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আপনি বলেন: ওই সাড়ে তিন কাঠা জমি মর্টগেজ রেখে—

উৎপলবাবু: হাজার তিনেক দিতে পারি।

আপনি: কিন্তু আমার যে দশ হাজারের কমে…

উৎপলবাবু: তাহলে বিক্রি করে দাও। আমিই কিনতে পারি। তোমায় কথা দিচ্ছি, বাজারে যাচাই করে যে ম্যাক্সিমাম দর তুমি পাবে, তার ওপরে অন্তত এক হাজার টাকা তোমায় আমি বেশি দেব।

এরপর আপনার আর ধৈর্য থাকে না। আপনি উৎপলবাবুকে ‘ছোটলোক’ ‘চামার’ এই সব বলে গালাগাল করেন এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। উৎপলবাবুরও নেশা একটু চড়ে গিয়েছিল, তিনি শাসিয়ে বলেন, ‘অন্তত পাঁচ হাজার টাকা তোমার কাছে আমার আগের পাওনা—ঘাড় মুচড়ে আদায় করে নেব।’

এরপরে প্রায় এক সপ্তাহ আপনি ক্লাবে আসেন না। অসুখ করেছিল? মে বী।

কিন্তু আপনি জানেন, উৎপলবাবু মদের ঝোঁকে যা বলেন, তা তাঁর মনের কথা নয়। তিনি আগেকার টাকাগুলো যে ফেরৎ চাইবেন না, বন্ধু হিসেবে আপনাকে দিয়েইছেন, তাও আপনার অজানা ছিল না। তবু আপনি বুঝতে পারেন যে উৎপলবাবু আর টাকা আপনাকে দেবেন না।

বাধ্য হয়ে জমিটা বিক্রি করেন আপনি, উৎপলবাবুকে না জানিয়ে অন্য পার্টির কাছে। এগারো হাজার টাকার মত দর পান। কিন্তু মনের জ্বালা আপনার নিভতে চায় না। ব্যবসার ক্রাইসিস কাটে, কিন্তু জমি বিক্রি করাটা আপনার বুকে বিধতে থাকে কাঁটার মত।

সেটা ফেটে পড়ে এই খুনের চারদিন আগে।

সেদিনও আপনারা দুজনে প্রায় একটা পর্যন্ত ড্রিঙ্ক করেন এবং চেঁচামেচি শুরু হয়। এবার ঠাকুর-চাকর দুজনেই এসে দাঁড়ায় দরজার বাইরে। তারা যা শোনে তা এই রকম:

উৎপলবাবু: তোমার মন এত ছোট? তুমি ভেবেছিলে, জমিটা আমাকে বেচে দিলে আগের পাওনা টাকা কেটে নেব তা থেকে?

আপনি: তোমার পক্ষে সব সম্ভব।

উৎপলবাবু: স্কাউন্‌ড্রেল—আনগ্রেটফুল! অল রাইট, আমিও উৎপল নাগচৌধুরী। ওই পাঁচ হাজার টাকা আদায় করে নিতে পারি কিনা, দেখে নেব। মামলা করব আমি, শেষ করে দেব তোমায়।

আপনারা কিছুক্ষণ পরস্পরকে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করেন। সেগুলো সব এখানে লেখা আছে, তবে তা আর শোনাতে চাইছি না আপাতত। মোট কথা, আসবার আগে আপনি বলে আসেন, ‘তোমাকেও শেষ করে দেব!’

উৎপলবাবু নেশার ঝোঁকে যা বলেন, পরদিন তার অনেকটাই ভুলে যান। কিন্তু অবনীবাবু, আপনি ভোলেননি। ক্লাবে এসেছেন, তাস খেলেছেন, হাসি-গল্পও করে থাকবেন হয়তো, কিন্তু খুনের আগের দিন বিকেলে ডালহৌসি স্কোয়ারের এক দোকানে চা খেতে খেতে কোন পরিচিত ভদ্রলোককে বলেছেন, উৎপল টাকা দিয়ে রসিদ কখনো চায়নি, আমিই ভদ্রতা করে লিখে দিয়েছিলুম ওকে। এখন দেখছি, নিজের মৃত্যুবাণ তুলে দিয়েছি ওর হাতে। বুঝতে পারছি, ও-ই আমায় শেষ করবে।’

তারপর খুনের দিন আপনাকে ক্যানিং স্ট্রীটের একটা দোকানে একখানা ভোজালিও দর করতে দেখা গিয়েছিল। কেনেননি বলছেন, পথ দিয়ে যেতে যেতে শুধুই কৌতূহলে দাম জিজ্ঞেস করেছিলেন? তা হবে, কিন্তু মারাত্মক কো-ইন্‌সিডেন্স যাই বলুন।

না, না, এখনি ভয় পাবেন না। আগে কমলাক্ষবাবুর প্রসঙ্গটা শেষ করা যাক। বাড়ি যেতে চাইছেন অবনীবাবু? মাথা ঘুরছে বললেন? ও কিছু না, একটু চুপ করে বসে থাকুন, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

হ্যাঁ, এবার কমলাক্ষ বসুর ব্যাপারটা সেরে নিই। এটা একটু ডেলিকেট—বলতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছে; বিশেষ করে একটি মহিলা যখন জড়িয়ে আছেন এর সঙ্গে। কিন্তু কি করব বলুন, সত্য জিনিসটা কখনো কখনো বড় বেশি অপ্রীতিকর।

উত্তেজিত হচ্ছেন কমলাক্ষবাবু? মাথা ঠাণ্ডা করুন। উৎপলবাবুর ড্রয়ার থেকে যেসব চিঠি পাওয়া গেছে, সেগুলো আর আপনাদের সামনে আমি তুলে ধরতে চাই না। মনে রাখবেন, আপনি যতটা জানেন, তার চাইতেও পুলিশ হিসেবে আমরা বেশি জানি, জানতে হয়েছে।

ইয়েস, দি ব্রুটাল ট্রুথ ইজ দিস। উৎপল নাগচৌধুরী—যাকে বলে চরিত্রবান—তা ছিলেন না। আপনারা জানেন উৎপলবাবুই তিন বছর আগে কমলাক্ষবাবুর বিয়ে ঠিক করে দেন তাঁরই এক দূর আত্মীয়ের রূপসী মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের কিছুকালের ভেতরেই কমলাক্ষবাবু জানতে পারেন যে···

বী পেশেন্ট কমলাক্ষবাবু, আমাকে অফিসিয়্যাল হতে বাধ্য করবেন না। রিমেম্‌বার, ইট ইজ এ মার্ডার কেস। চুপ করে বসুন। আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পারছি, বাট আফটার অল্-

হ্যাঁ, যেকথা বলছিলুম, বিয়ের পরেই কমলাক্ষ জানতে পারেন, ইট ইজ নট এ ক্লীন অ্যানফেয়ার। এই মেয়েটির দারিদ্রের পুরো অ্যাডভানটেজ উৎপলবাবুই নিয়েছিলেন। ব্যাপারটা যখন বিশ্রী শেপ নেয়, তখন উৎপলবাবুই তাড়াহুড়ো করে কমলাক্ষবাবুর সঙ্গে মেয়েটির বিয়ের বন্দোবস্ত করেন।

আগলি? ইয়ে—স, ভেরি আগলি। কিন্তু জীবন এ-ই। আমরা পুলিশের লোক, কখনো কখনো সমাজের ভেতর এমন অন্ধকার আমাদের চোখে পড়ে যে মনে হয়, এর চাইতে আদিম বর্বরতাও বোধ হয় ছিল ভাল, তার ওপর এরকম ভদ্রতার পালিশ ছিল না। যাই হোক, শান্ত নিরীহ কমলাক্ষবাবুকে দিনের পর দিন দাঁতে দাঁতে সয়ে যেতে হয় বাড়ির নতুন রেডিওগ্রাম, স্ত্রীর নানা ফ্যাশানের গয়না—তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁরই বাড়িতে উৎপলবাবুর নিয়মিত যাওয়া-আসা। দূর একটা আত্মীয়তার সূত্র আছে, জোর করে কোন কথা বলাও যায় না। আরো বিশেষ করে কমলাক্ষবাবু ভীরু টাইপের ভাল মানুষ।

অশান্তি চরমে ওঠে। লাস্টলি কমলাক্ষবাবুর স্ত্রী মাস দুয়েক আগে বম্বে চলে গেছেন তাঁর কী এক আত্মীয়—খুব সম্ভব ইমাজিনারি এক ভদ্রলোকের কাছে। বোধ হয় সিনেমা-স্টার হতেই গেছেন এবং ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বি-এন-আর বম্বে মেলে, ডাবলু-বি. টি. ৯৯৯৯৭২ নম্বর ট্যাক্সি চেপে তাঁকে দিয়ে আসেন কমলাক্ষ নন—স্বয়ং উৎপল নাগচৌধুরী।

কমলাক্ষবাবু, মাপ করবেন, আপনার অ্যাবসেন্সেই আপনার বাড়ি আমাদের সার্চ করতে হয়েছে। আপনার ড্রয়ারে যে ডাইরিটা ছিল, আজ চার-পাঁচদিন হল নিশ্চয় সেটা খুঁজে পাচ্ছেন না। সেটা এখানেই আছে। প্লীজ, ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করবেন না—ওতে লাভ হবে না কিছু। এবার আপনাকে আমি ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আপনি যদি চুপ করে বসে থাকতে না পারেন,বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে আমার কনস্টেবল ডাকব।

এই ডাইরির একটা পাতা আমি পড়ছি:

‘উৎপল নাগচৌধুরী আমার জীবনটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন আত্মহত্যার কথা ভাবছি। মণিমালা পালিয়েছে—ও চুলোয় যাক! কিন্তু নিজে আত্মহত্যা করবার আগে উৎপল নাগকে আমি—

কমলাক্ষবাবু, কী বলতে চান এ সম্পর্কে? ডাইরির তারিখটা হচ্ছে—

হোয়াট—প্রতাপবাবু, উঠে পড়লেন যে? কী বলছেন? কমলাক্ষবাবুকে আর টর্চার করব না? অ্যাঁ! আপনি খুন করেছেন? আপনিই খুন করেছেন প্রতাপবাবু? ঠাট্টা করছেন না? বলছেন, আপনার মেসের গঙ্গাজলের ট্যাঙ্কেই ছোরার খাপটা পাওয়া যাবে? বলছেন, অন্যায় সইতে পারেননি, তাই আইন নিয়েছেন নিজের হাতে? অবনীর জ্বালা আপনাকে বিঁধত, তারও চাইতে বেশি বিঁধত কমলাক্ষের এই গ্লানি? সেই জন্যই প্রাক্তন বিপ্লবী আপনি—

ওকি, নতুন চুরুটটা মুখে দিয়েই যে বসে পড়লেন? অ্যাঁ! একি হল? তাই তো, আপনি যে কেমিস্টের ফার্মে কাজ করেন—চুরুটের সঙ্গে কয়েকটা সায়ানাইডের ক্রিস্টাল—

মাই গড—হি ইজ ডেড!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *