1 of 2

প্রেমলতার হাসি – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

প্রেমলতার হাসি – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

প্রেমলতা হেসে উঠলেন।

হাসলে নাকি মানুষকে খুব সুন্দর দেখায়। কিন্তু কেউ যদি পাগলের মতন হাসে? হাসতে হাসতে কারও চোখের তারায় যদি আগুন জ্বলে ওঠে? ঠোঁট দুটি যদি বিদ্রূপে, ঘৃণায় বেঁকে যায়? তবু কি তাকে খুব সুন্দর দেখাবে?

প্রেমলতার চোখে আগুন জ্বলছিল। বিদ্রূপে, ঘৃণায় তাঁর ঠোঁট দুটি টানা-টানা ; নাকটি টিকোলো। সব চাইতে সুন্দর তাঁর ভুরু। দেখলে মনে হতে পারে, চোখের উপরে একটা ছোট্ট পাখি যেন ডানা মেলে দিয়েছে। সেটা অবশ্য ঈশ্বরের নয়, মেক-আপ ম্যানের কৃতিত্ব। কিন্তু মেক-আপ ম্যান তো কত মেয়েরই ভুরু এঁকে দেয়। কই, তাদের তো এত সুন্দর দেখায় না। প্রেমলতা সত্যিই সুন্দরী। ভুরুর উপরে তুলির ছোঁয়া না লাগলেও তাঁকে সুন্দর দেখাত।

প্রেমলতার বয়স কত হল? সিনেমা-থিয়েটারের কাগজগুলো বলে তিরিশ। তারা ঠিক কথা বলে না। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে তিনি মঞ্চে নেমেছিলেন। তখনই তাঁর বয়স ছিল কুড়ি। সুতরাং অঙ্কের হিসেবে, তিনি চল্লিশে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু তাতে কী, যৌবন তাঁর শরীর থেকে আজও বিদায় নেয়নি। আজও যখন তিনি মঞ্চের উপরে গিয়ে দাঁড়ান, দর্শকের চোখে পলক পড়ে না।

তা না পড়ুক, এই মুহূর্তে, হোটেলের এই ঘরের মধ্যে তাঁকে ভীষণ বিচ্ছিরি লাগছিল। হাসলে নাকি সবাইকেই খুব সুন্দর দেখায়। প্রেমলতাকে দেখাচ্ছিল না। তিনি হাসছিলেন। কিন্তু ঘনশ্যাম দেখছিল যে, তাঁর চোখের তারায় আগুন জ্বলছে। বিদ্রূপে, ঘৃণায় তাঁর ঠোঁট দুটি হঠাৎ বেঁকে গিয়েছে।

সিগারেটের কৌটোটাকে পকেট থেকে বার করে সেন্টার টেবিলের উপরে রাখল ঘনশ্যাম। কৌটো খুলে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল।

প্রেমলতা বললেন, ‘আমাকে একটা দিন।’

‘আমি জানতুম না আপনার চলে।’ কৌটোটাকে প্রেমলতার দিকে এগিয়ে দিয়ে যেন প্রায় ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল ঘনশ্যাম।

‘আপনি অনেক কিছুই জানেন না।’

ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর থেকে লাইটার বের করে সিগারেট ধরালেন প্রেমলতা। অভিজ্ঞ ধূমপায়ীর মতন ধোঁয়াটাকে অন্তত পাঁচ সেকেন্ডের জন্যে মুখের মধ্যে ধরে রাখলেন। তারপর নাক দিয়ে সেই ধোঁয়াটাকে গলগল করে বার করে দিয়ে আবার আগের মতই হেসে উঠলেন তিনি। ঘনশ্যাম বুঝল না, প্রেমলতা তাকে ঠাট্টা করছেন কিনা। সে শুধু লক্ষ্য করল যে, হাসির দমকে তাঁর ঠোঁট দুটি আবার বেঁকে যাচ্ছে!

হাসলে সবাইকেই সুন্দর দেখায়। কিন্তু প্রেমলতাকে দেখায় না। অন্তত তখন দেখায় না, হাসতে হাসতে তাঁর চোখের তারায় যখন আগুন জ্বলে ওঠে, ঠোঁট দুটি হঠাৎ বিদ্রূপে, ঘৃণায় বেঁকে যায়।

কাকে ঘৃণা করেন প্রেমলতা? কামিনীকে? কেন? রতনলাল তাকে ভালবাসত, তাই? প্রেমলতা কি তাহলে রতনলালকে ভালবেসে ছিলেন? রতনলালকে কি তিনি বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন? আশ্চর্য। প্রেমলতাকে তো কেউ কখনও বেঁধে রাখতে পারেনি। তিনি তাহলে রতনলালকে বাঁধতে চেয়েছিলেন কেন?

‘অনেক রাত হল ঘনশ্যামবাবু। আপনি এবারে বাড়ি যান।’

প্রেমলতার কথায় চমক ভাঙল ঘনশ্যামের। কিন্তু চেয়ার থেকে সে উঠল না। সেন্টার টেবিলে তার সিগারেটের কৌটোটা খোলাই ছিল। রুপোর কাজ-করা মস্ত বড় কৌটো। সিগারেট রাখবার জন্যে এত বড় কৌটো কেউ সাধারণত ব্যবহার করে না। ঘনশ্যাম করে। সে এমন অনেক-কিছুই ব্যবহার করে, অন্য অনেকের যা পছন্দ নয়। কৌটো থেকে সে আর একটা সিগারেট তুলে নিল। পুরোন সিগারেটটাকে অ্যাসট্রের উপরে পিষে দিয়ে নতুন সিগারেটটাকে ধরিয়ে নিল। তারপর বলল, ‘বাড়ি তো যেতেই হবে, কিন্তু তার আগে আমার প্রশ্নের একটা জবাব পাওয়া দরকার। আপনি এখনও জবাব দেননি।’

‘জবাব আমি পুলিশকে অন্তত পঁচিশবার দিয়েছি।’ লঘু, তরল গলায় প্রেমলতা বললেন, ‘শুধু পুলিশ কেন, প্রত্যেকেই জানে যে, গত সোমবার রাত সাতটা থেকে ন’টার মধ্যে কোনও সময়েই আমি রতনলালের হোটেলে যাইনি। সে-হোটেলের ধারে-কাছেও আমি তখন ছিলাম না।’

‘কোথায় ছিলেন আপনি?’

‘নটরাজ থিয়েটারে।’

‘আমি বিশ্বাস করি না।’

আবার হেসে উঠলেন প্রেমলতা। বললেন, ‘আপনি না-করতে পারেন, কিন্তু আদালত করবে। নটরাজ থিয়েটারের ম্যানেজার থেকে শুরু করে প্রম্টার পর্যন্ত সবাই সাক্ষ্য দেবে যে, সেদিন সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত আমি নটরাজ থিয়েটারেই ছিলাম।’

‘তারা আপনার নিজের লোক।’

‘আর দর্শকরা? তারাও কি আমার নিজের লোক নাকি? ঘনশ্যামবাবু, সে-রাতে যারা নটরাজ থিয়েটারে আমার অভিনয় দেখেছে, তাদের কথা আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন? তারা জানে, সাতটা থেকে ন’টার মধ্যে প্রায় প্রতিটি দৃশ্যেই আমি মঞ্চে উপস্থিত ছিলাম। মাঝখানে অবশ্য মিনিট দশেকের বিরতি ছিল। কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যে নিশ্চয়ই নটরাজ থিয়েটার থেকে তিন মাইল দূরের একটা হোটেলে গিয়ে কাউকে খুন করে আবার থিয়েটারে ফিরে আসা যায় না। না ঘনশ্যামবাবু, রতনলালকে আমি খুন করিনি, এবং আদালতকে সে-কথা বিশ্বাস করানো আমার পক্ষে খুবই সহজ হবে।’

‘আমাকে বিশ্বাস করানো খুব সহজ হবে না।’ ঘনশ্যাম খুব শান্ত গলায় বলল।

‘কেন?’

‘রতনলালের ঘরে একটা রুমাল পাওয়া গেছে। তার কোণায় লেখা আছে ‘K’।

‘তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? ‘K’ তো আমার নামের আদ্যক্ষর নয়। আমার নাম তো প্রেমলতা!’

‘সেটা আপনার থিয়েটারী নাম। আপনার আসল নাম তো কৃষ্ণা। তাই না?’

আবার হেসে উঠলেন প্রেমলতা। বললেন, ‘এ খবর আপনি কোত্থেকে পেলেন?’

‘যেখানেই পাই, তাতে কিছু আসে-যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে, কথাটা সত্যি কিনা।’

‘সত্যি। কিন্তু রুমালটা তাই বলে আমার নয়। খুব সম্ভব কামিনীর। ভুলে যাবেন না যে তারও নামের আদ্যক্ষর ‘K’। আর তাছাড়া····’

কী যেন বলতে গিয়ে বললেন না প্রেমলতা। চুপ করে রইলেন। ঘনশ্যাম বলল, ‘থামলেন কেন? বলুন! আর তা ছাড়া কী?’

‘আমার উকিল আমাকে জানিয়েছেন যে, রুমালটা যদি কামিনীর নাও হয়, তবু আমার উপরে কারও সন্দেহ পড়তে পারে না। পড়া উচিত নয়।’

‘নয় কেন?

‘এই জন্যে যে, আমার অ্যালিবাইটা পাকা।’ ঘনশ্যামের কৌটো থেকে নিজেই আর একটা সিগারেট তুলে নিলেন প্রেমলতা। তারপর বললেন, ‘সকলেই আমার হয়ে সাক্ষ্য দেবে। সকলেই বলবে যে, সেদিন রাত সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত আমি নটরাজ থিয়েটারে ছিলাম। ম্যানেজার বলবে, অন্যান্য অ্যাক্টররা বলবে, প্রম্টার বলবে। সেদিন যারা আমার অভিনয় দেখেছে, সেই দর্শকরাও বলবে।’

কথাটা মিথ্যে নয়। তবু কেন সন্দেহ যাচ্ছে না ঘনশ্যামের? আজ সকালেই সে পুলিশ ইন্সপেক্টর আয়েঙ্গারের সঙ্গে দেখা করেছিল। আয়েঙ্গারও ঠিক এই বলেছেন। ঘনশ্যামকে তিনি জানিয়েছেন যে, প্রেমলতার অ্যালিবাইকে ধসিয়ে দেওয়া অসম্ভব। তবে? তবে কেন প্রেমলতাকে সন্দেহ করছে ঘনশ্যাম?

সে কি এই জন্যে যে, সে নিজেও সেদিন নটরাজ থিয়েটারে গিয়েছিল, এবং নায়িকার ভূমিকায় প্রেমলতার অভিনয় দেখে হতাশ হয়েছিল? একা ঘনশ্যাম কেন, আরও অনেকে সেদিন হতাশ হয়েছে। প্রেমলতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ তাঁর কণ্ঠ। সেই কণ্ঠ সেদিন অত ভাঙা ভাঙা শোনাচ্ছিল কেন? ঘনশ্যামের পাশের সীটে যিনি বসেছিলেন, তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় ঠাণ্ডা লেগেছে মশাই।’

হয়তো তাই। কিন্তু ঠাণ্ডা লাগা সত্ত্বেও প্রেমলতা মঞ্চে নামলেন কেন? জনপ্রিয়তা নষ্ট হবার ভয়ে নামকরা অভিনেত্রীরা এসব ক্ষেত্রে মঞ্চে নামেন না ; আন্ডারস্টাডি দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়া হয়। প্রেমলতা কি তা জানেন না? নিশ্চয় জানেন। জেনেও তিনি ভাঙা গলায় মঞ্চে নেমেছিলেন কেন? এই নিয়ে যদি ঘনশ্যামের চিত্তে একটু অস্বস্তি দেখা দিয়ে থাকে, তবে নিশ্চয়ই তাকে খুব দোষ দেওয়া যায় না।

পরদিন সকালে সেই অস্বস্তিই হঠাৎ সন্দেহে রূপান্তরিত হল, কাগজ খুলে ঘনশ্যাম যখন জানতে পারল যে, সেঞ্চুরি থিয়েটারের মালিক রতনলাল তার হোটেলের কামরায় খুন হয়েছে। প্রেমলতা, মাত্র কয়েক মাস আগেও, ছিলেন সেঞ্চুরি থিয়েটারের হিরোইন। শুধুই থিয়েটারের নয়, তার মালিকেরও। পরে, কামিনীকে যখন সেঞ্চুরির হিরোইন করা হয়, প্রেমলতা তখন সেঞ্চুরি ছেড়ে দিয়ে নটরাজ থিয়েটারে যোগ দেন। কিন্তু প্রেমলতা কি তাঁর অপমান ভুলতে পেরেছিলেন? প্রেমলতাকে সরিয়ে দিয়ে কামিনীকে হিরোইন করেছিল রতনলাল; এই অপরাধ কি তিনি ক্ষমা করতে পেরেছিলেন?

যদি না-পেরে থাকেন? না, ঘনশ্যামের সন্দেহ একেবারে অকারণ নয়। সন্দেহ আরও প্রবল হয়েছে ওই রুমালের কথা শুনে। রুমালের কোণে লেখা রয়েছে ‘K’। আর তারই সূত্র ধরে পুলিশ গিয়ে কামিনীকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু কামিনী কেন খুন করবে রতনলালকে? সাইড পার্টের অমর্যাদা থেকে তুলে এনে রতনলাল তাকে, প্রায় রাতারাতি, হিরোইন বানিয়ে দিয়েছিল। সেই রতনলালকে কেন খুন করবে কামিনী? কোন মোটিভই তো তার নেই। তাহলে? না, ‘K’ অক্ষরটার অর্থ নিশ্চয়ই ‘কামিনী’ নয়। অর্থ হয়ত ‘কৃষ্ণা’। এবং প্রেমলতার নাম যে আসলে কৃষ্ণা, সে-কথা আর কেউ না জানুক, ঘনশ্যাম জানে।

প্রেমলতাই কি খুন করেছেন রতনলালকে? মোটিভটা খুবই পরিষ্কার, কিন্তু·····

কিন্তু মুশকিল বাধিয়েছে ওই অ্যালিবাই। এবং অ্যালিবাইটা যে দুর্ভেদ্য, ঘনশ্যামেরও তা স্বীকার না করে উপায় নেই। ডাক্তার বলছেন, রতনলাল খুন হয়েছে রাত সাতটা থেকে ন’টার মধ্যে; খুব সম্ভব আটটা নাগাদ। এদিকে অন্তত দশজন লোক হলফ করে বলতে রাজী আছে যে, সাতটা থেকে ন’টার মধ্যে প্রেমলতা ছিলেন নটরাজ থিয়েটারে। ঘনশ্যাম নিজেও তার সাক্ষী। তবে?

দুটো উত্তর আছে এই প্রশ্নের, প্রেমলতার সামনে বসে নতুন আর একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘনশ্যাম ভাবল। এক, প্রেমলতা রতনলালকে খুন করেননি। দুই, নটরাজ থিয়েটারে ভাঙা ভাঙা গলায় যিনি সেদিন অভিনয় করেছিলেন, তাঁর চেহারা ঠিক প্রেমলতারই মতন, কিন্তু আসলে তিনি প্রেমলতা নন।

কোনটা যে ঠিক উত্তর, কোনদিনই তা জানা যাবে না। হয়তো দ্বিতীয় উত্তরটাই ঠিক। কিন্তু নটরাজ থিয়েটারের ম্যানেজার তা স্বীকার করবে না। অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীরাও না। তার কারণ, সেঞ্চুরি থিয়েটার তাদের শত্রু। তার মালিক রতনলালও তাদের বন্ধু ছিলেন না। সুতরাং সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হলফ করে তারা বলবে যে, সোমবার রাত্রি সাতটা থেকে ন’টার মধ্যে প্রেমলতা সারাক্ষণ নটরাজ থিয়েটারেই ছিলেন। কথাটা হয়তো সত্য নয়। সেক্ষেত্রে তারা মিথ্যে সাক্ষ্য দেবে। প্রেমলতার অ্যালিবাইকে তারা ভাঙতে দেবে না।

অনেক রাত হয়েছে। আর এখানে বসে থাকা ঠিক নয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ঘনশ্যাম। বলল, ‘চলি।’

আর ঠিক তখনই আবার হেসে উঠলেন প্রেমলতা। হাসলে নাকি সবাইকেই খুব সুন্দর দেখায়। প্রেমলতাকে দেখাল না। ঘনশ্যাম দেখল, তাঁর চোখের তারায় আগুন জ্বলছে ; বিদ্রূপে, ঘৃণায় তাঁর ঠোঁট দুটি বেঁকে গিয়েছে।

প্রেমলতা বললেন, ‘বসুন ঘনশ্যামবাবু। সত্যি কথাটা তাহলে শুনেই যান।’

‘বলুন।’

‘রুমালটা আমারই।’

চমকে উঠে ঘনশ্যাম বলল, ‘অর্থাৎ?’

‘রতনলালকে আমিই খুন করেছি।’

‘নটরাজ থিয়েটারে তাহলে কে সেদিন অভিনয় করল?’

‘হেমলতা। আমার বোন।’

হো হো করে আবার হেসে উঠলেন প্রেমলতা। বললেন, ‘আপনাকে সব খুলে বললাম। তার কারণ, আপনাদের সবাইকে যে আমি বোকা বানাতে পেরেছি, এই কথাটা আপনাদের না জানিয়ে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আর তাছাড়া, সব জেনেও তো আমাকে ধরা আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার অ্যালিবাই কি আপনি ভাঙতে পারবেন? পারবেন না। আপনি যদি বলেন যে, নটরাজ থিয়েটারে সেদিন আমি অভিনয় করিনি, আমার বোন হেমলতা করেছে, তো সবাই আপনাকে পাগল বলবে। কী জানেন, অ্যালিবাই শুধু যে আমার আছে, তা নয় ; হেমলতারও আছে। আমার হয়ে সবাই বলবে যে, আমিই সেদিন নটরাজ থিয়েটারে অভিনয় করেছিলাম। আর হেমলতার হয়ে অন্তত তিনজন লোক সাক্ষ্য দেবে যে, সেদিন রাত্রি সাতটা থেকে ন’টার মধ্যে সে জীবনকিশোরের বাড়িতে বসেছিল। জীবনকিশোরকে চেনেন তো? মুনলাইট স্টুডিয়োর মালিক। হেমলতার জন্যে মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে তার আটকাবে না। শুধু জীবনকিশোর কেন, তার ড্রাইভার আর দরোয়ানও ওই একই সাক্ষ্য দেবে।’

বলতে বলতে আবার হো হো করে হেসে উঠলেন প্রেমলতা। তাঁর চোখের তারায় আগুন জ্বলতে লাগল ; তাঁর ঠোঁট দুটি আবার ঘৃণায়, বিদ্রূপে বেঁকে গেল। তিনি বললেন, ‘রতনলাল আমাকে অপমান করেছিল ; তাকে খুন করে সেই অপমানের আমি শোধ নিয়েছি। কিন্তু তা আপনারা প্রমাণ করতে পারবেন না, ঘনশ্যামবাবু ; আমার অ্যালিবাই আপনারা ভাঙতে পারবেন না।’

চুপ করে সব শুনে যাচ্ছিল ঘনশ্যাম। প্রেমলতার কথা শেষ হবার পরে সেন্টার টেবিলের উপর থেকে সে তার সিগারেটের কৌটোটা তুলে নিল। তার ঢাকনা বন্ধ করল। তারপর, কৌটোটাকে পকেটে পুরে বলল, ‘পারব।’

‘কী করে পারবেন? আপনাকে যা বললাম, ভবিষ্যতে আর কারো কাছেই তা তো বলব না আমি। সবই তো আমি অস্বীকার করব।’

‘তাতে কোন লাভ হবে না, প্রেমলতা দেবী।’ শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় ঘনশ্যাম বলল, ‘আমার এই সিগারেটের কৌটোটা আসলে একটা মিনিয়েচার ডিক্টোফোন। আপনার প্রতিটি কথাই এর মধ্যে ধরা রইল। আপনার অ্যালিবাই ভাঙবার জন্যে আমাদের আর কিছু বলতে হবে না ; যা বলবার এই যন্ত্রটাই বলবে। না, না, আপনি পালাবার চেষ্টা করবেন না। পুলিশ ইন্সপেক্টর আয়েঙ্গার এই হোটেলটাকে ঘিরে রেখেছেন ; পালাবার কোন পথই তিনি রাখেননি।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ঘনশ্যাম। বলল, চলি!’

প্রেমলতা আর হাসছিলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *