1 of 2

আমার প্রিয়সখী – সন্তোষকুমার ঘোষ

আমার প্রিয়সখী – সন্তোষকুমার ঘোষ

আমার প্রিয়সখীর কথা লিখছি।

সকালে খবরের কাগজটা খুলেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার হাত কাঁপছিল। আমার মুখও বিবর্ণ হয়ে গিয়ে থাকবে। আমি তো দেখতে পাইনি, রিফ্রেশমেন্ট-রুমে আর যারা ছিল তারা বলতে পারবে। চায়ের পেয়ালা ফসকে পড়েছিল, কোনক্রমে সামলে নিলাম। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম চেয়ার ধরে। দাম দিয়েছিলাম কি দিইনি, এখন আর মনে নেই। অস্ফুট গলায় একবার বলেছিলাম, বনরেখা, বনরেখা।

আমার এখনই রেল-পুলিশকে খবর দেওয়া উচিত—এখনই, এখনই, এখনই।

আমি যে অতটা ভেঙে পড়েছিলাম, তার অনেকটাই ভয়ে আর ক্লান্তিতে। সারারাত ঘুমোতে পারিনি। ওয়েটিং-রুমে সমস্তক্ষণ আলো জ্বলছিল, কোথা থেকে ফিরে ফিরে আসছিল দু-তিনটে মশা, আমার কানে গোপন কোন কথা বলতে চাইল ; কী সে-কথা, আমি জানি না। ওদের ভাষা আমি বুঝতে পারিনি। হেলানো চেয়ারটাও আরামপ্রদ ছিল না। পিঠ আর কাঁধের কাছটা টন্‌টন্‌ করে উঠেছিল। ছারপোকার চোরা ছুরি তো ছিলই।

আরও একটা জিনিস দেখলাম, প্ল্যাটফর্মটা কখনও ঘুমোয়নি। মাঝে মাঝে দূর-পাল্লার গাড়ি এসে দাঁড়ায়, হাঁপায়; মনে হয় রেগে আছে। ওরা রেগেই থাকে, নিশান পেয়ে চলে, সেও যেন রাগত ভাবে।

আমি চোখের পাতা খুলেছি আর দেখেছি। একবার প্ল্যাটফর্মটায় পায়চারি করেও এলাম। তখন সব ঠাণ্ডা, নিথর। কয়েকজন কুলি কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়েছিল, দপ্দপ্ করে সিগন্যালের আলো। তার বাবু সোজা হয়ে বসে টরেটক্কা করছিলেন।

আবার এসে শুয়েছি হেলানো চেয়ারে। অস্বস্তি যায়নি। অস্থিরতা বোধ করছি। এ কী অনিদ্রা রোগ আমাকে পেয়ে বসল। কেন ঘুমোতে পারছি না, কেন এই ভয়? ওয়েটিং-রুমে মাঝে মাঝে কারা আসছিল, খানিক বসে হাত-পা ছড়িয়ে, ঘুমিয়ে কিংবা না ঘুমিয়ে ওরা চলে যাচ্ছিল। খুব মৃদু স্বরে কথা বলছিল কেউ কেউ, কী বলছিল আমি বুঝতে পারছিলাম না। প্রতিটি পায়ের শব্দে পিট্‌পিট্‌ করে তাকিয়েছি, আচ্ছন্ন চেতনা, আবিল দৃষ্টি, সব ছায়া-ছায়া দেখছি। ভয়ে আড়ষ্ট, আমি ভেবেছি, ওরা সরে যায় না কেন। আবার সরে গেলেও চমকে উঠেছি। একাকিত্ব নামে ভয়ঙ্কর একটা রাক্ষস এই ঘরের কোথাও লুকিয়ে আছে, হয়তো ওই হ্যাটর‍্যাকটার পিছনে, কিংবা মানুষ-প্রমাণ টেবিলটার তলায়, সে আমাকে এবার গ্রাস করবে। ভাগ্যিস, কারা ভারী-ভারী মেলব্যাগ এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি ঠেলে নিয়ে গেল, সেই ঘর্ঘর শব্দে আমি ভরসা পেলাম, নইলে বুঝি বা মূর্ছাই যেতাম।

সকালে উঠেই চোখে-মুখে ভাল করে জল ছিটিয়ে দিয়েছি। চেহারা দেখেছি আয়নায়। ছি, ছি, চোখের কোলে এত কালি।

তারপর চায়ের ঘরে কী ঘটল আগেই বলেছি। আমার হাত থেকে খবরের কাগজটা পড়ে গেল, চেয়ার থেকে আমি পড়ে যাচ্ছিলাম। চোখে সূচ্যগ্র বিরক্তি আর বিস্ময় নিয়ে ওরা আমার দিকে চেয়েছিল। আমার মনের ভিতরে কী ঘটছিল বলতে পারব না, আমি এ ব্যাপারটা জানতুম। কাল সারা রাত জুড়ে আমার মনে কালো পিঁপড়ের মত ভয় ঝাঁকে ঝাঁকে এসে বসেছে, ছেয়ে ফেলেছে, দংশন করেছে। সেই ভয়ের উৎসে আমি নিমেষে পৌঁছে গেলাম।

আচ্ছন্ন অভিভূতের মত আমি চায়ের ঘর থেকে উঠে এসেছি। খেয়াল হতে দেখি, বসে আছি রেল-পুলিশের ঘরে। আমার সুটকেসটা আমারই সামনে রাখা, টেবিলের ওপরে।

মনে আছে, পুলিশ অফিসারটি মাথা নিচু করে কী লিখলেন, আমাকে দেখে মাথা তুললেন। একটু অবাক হয়ে থাকবেন, কিন্তু আমাকে বুঝতে দিলেন না, ইঙ্গিতে একটা চেয়ার দেখিয়ে আবার লিখে চললেন।

আমি বসে আছি। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে, দেখছি ঘড়ির কাঁটা সরছে, ওঁর লেখা আর শেষ হয় না। একজন সেপাই এসে দাঁড়াল, সেলাম করল, ক্লিক করল গোড়ালিতে গোড়ালি মিলিয়ে, শুনতে পেলাম। লেখা কাগজটা তার হাতে তুলে দিয়ে অফিসার আমার দিকে চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে ভারী-ভরী গলায় বললেন, বনরেখা রায়ের মৃত্যু সম্পর্কে কী বলবেন, এবার বলুন।

এবার অবাক হবার পালা ছিল আমার। অফিসারটিও সে কথা বুঝে থাকবেন। হেসে বললেন, ভাবছেন, এ বিষয়েই আপনি কথা বলতে এসেছেন কী করে বুঝলাম? ওয়েল, আমরা সবাই শার্লক হোমস নই, কিন্তু হতে সাধ সবারই অল্প-বিস্তর আছে। ছোটখাটো চমক দেওয়া আমার অভ্যাস। অথচ আমরা সামান্য পুলিশ, আপনাদের ডিটেকটিভ বইয়ে যারা মূঢ়, হাসি-ঠাট্টার পাত্র। গোয়েন্দা-গল্প পড়ে নিশ্চয় আপনাদের ধারণা হয়েছে আমরা ইট-কাঠের মতই নিরেট, খুন-টুনের কিনারা এ দুনিয়ায় শুধু সখের গোয়েন্দারাই করে। তা নয়, শ্রীলা দেবী, আমরাও করি। সামান্য যা বুদ্ধি-বিবেচনা আছে, তাই খাটাই। আর মনে মনে মানবেতর জীব বলে গালাগাল দিতে চান দিন, কিন্তু আমাদের, অর্থাৎ পুলিশের, পশুর মত ইনটুইশন,—মানে সহজাত বোধও আছে। তা দিয়েই অনেক সময় অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ি, দু-চারটে লেগে যায়।

অফিসারটি সিগারেট ধরিয়ে আবার বললেন, আপনার নাম জানতে অবিশ্যি বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হয়নি, আর ও বস্তুটি ইনটুইশন দিয়েও জানা যায় না। সামুদ্রিক বিদ্যা দিয়েও হয়তো যায়, তবে আমি চোখ দিয়ে জেনেছি। নেহাত নিরক্ষর তো নই, আপনার সুটকেসের ওপরেই যে লেবেল লাগিয়েছেন তাতে আপনার নাম লেখা আছে। এবার বলবেন, বনরেখা রায়ের সম্পর্কে আপনি কিছু বলতে চান, ধরলুম কী করে? ফ্রাঙ্কলি বলব, ওটা আন্দাজ। খানিকটা, পুরোপুরি নয়। আপনার নামের নিচে লেখা আছে পাটনা। বনরেখাও ওখানে থাকতেন। দিলাম ঢিল ছুঁড়ে। লাগল। না লাগলে আপনি প্রতিবাদ করতেন। এখনও করেননি।

আমার কপালে ঘাম ফুটছিল। অফিসারটি বললেন, আর দেখুন, রেলপুলিশের ঘরে মেয়েরা সচরাচর আসে না। আপনি এলেন। এই জংশনে আজ গোলমেলে কিছু ঘটেনি, ঘটলে হৈ-চৈ হত, আমরা এমনিতেই জানতাম। অতএব আপনি এমন কোন বিষয়ে কিছু বলতে চান, সেটা এখানে নয়, অন্য কোথাও ঘটেছে। যে ঘটনার কথা আপনি এইমাত্র জানতে পেরেছেন। সেটা কি হতে পারে? আপনাদের যাত্রীদের জানবার একটা উপায়, প্রায় একমাত্র উপায়, খবরের কাগজ। সেই কাগজেই শ্ৰীলা দেবী, আজ বনরেখা রায়ের মৃতদেহ আবিষ্কার ছাড়া চাঞ্চল্যকর খবর আর কিছু নেই।

সিগারেট নিভিয়ে অফিসারটি পাখাটাকে আরও জোরে চালিয়ে দিলেন। বললেন, অবশ্য, আন্দাজ আমার ঠিক নাও হতে পারত। কিন্তু ঠিক যখন হয়েছে, তখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এবার আপনার কথা বলুন।

তখনকার মত আমি শুধু বলতে পারলাম, এক গ্লাস জল।

সমস্ত গ্লাসটা ঢক্‌ঢক্‌ করে নিঃশেষ করে আমি অফিসারটির হাতেই তুলে দিলাম। আমার হাত তখনও থরথর করে কাঁপছিল।

শ্ৰীলা দেবী, আপনি অত্যন্ত বিচলিত হয়েছেন। তবু আপনাকে স্থির হতে হবে। অফিসারটির গম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পেয়েছি, একটু সাহসও যেন পেয়েছি।

বনরেখা রায়কে আপনি কতদিন থেকে জানতেন?

তিনি আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন।

আর?

মনে আছে, গুছিয়ে বলতে পারিনি, আমার গলা বারে বারেই কেঁপে গিয়েছে, কখনও অকারণে উঠেছে উচ্চগ্রামে, কখনও একেবারে নিচের পর্দায় নেমেছে। তবু জানতাম, আমাকে বলতে হবে। বলতে হবেই। যখনই খেই হারিয়ে গিয়েছে, মাথা তুলে চেয়েছি অফিসারটির দিকে। ওঁর পেন্সিলটা অক্লান্ত চলছিল। মাথার ওপর পাখাটাও অক্লান্ত চলছিল, আর গম্গমে স্টেশন-ইয়ার্ডে মালগাড়ির শান্টিং-এর বিরাম ছিল না।

বনরেখা আমার বাল্যসখী। কলকাতায় একই পাড়ায় আমাদের বাসা ছিল, একই স্কুলে পড়েছি একই ক্লাশে। সে ফার্স্ট হত, আমি হতাম সেকেন্ড।

আপনি কোনবার ফার্স্ট হননি?

না, একটু লজ্জা পেয়েছি যেন। আবার বলেছি, একবারও না। আমি সেকেন্ড হতাম বটে, কিন্তু বনরেখা আমার চেয়ে ঢের ভাল মেয়ে ছিল। একটু থেমে আমি আবার যোগ করলাম, শুধু লেখা পড়ায় নয়, সব বিষয়ে।

অফিসারকে বলতে শুনলাম, অর্থাৎ?

আমি এসেছি প্রাণের তাগিদে, অদৃশ্য কোন দৈবশক্তির প্রেরণায়। বলতেই তো এসেছি, তবু লোকটা জেরা করছে কেন? বিরক্ত গলায় বলেছি, অর্থ আপনিই করে নিন। আভাসে বললে আপনি তো বোঝেন না। বেশ, সোজাসুজি বলছি, লিখে নিন। বনরেখা রূপে শুধু আমাকে কেন, বাংলাদেশের অনেক মেয়েকেই হার মানাতে পারত। ওদের বাড়ির অবস্থা খুবই ভাল। যে-মামার বাড়িতে আমি খেয়ে-পরে মানুষ, তিনি ওদেরই ভাড়াটে ছিলেন। ওই পাড়াতেই ওদের আরও দু-তিনটে বাড়ি ছিল বলে শুনেছি। আমার নিজের পড়ার বই প্রায়ই কেনা হত না, বনরেখার কাছ থেকে ধার করে এনে পড়তাম। বরাবরই ওর খুব উদার মন, কখনও কিছু মনে করত না। এমন কি আমাকে অনেকবার বলেছে, তোর নিজের বই নেই বলেই তুই ফার্স্ট হতে পারিস না। থাকলে আমাকে নিশ্চয় হারিয়ে দিতিস। টিফিনের সময় ওর জলখাবার আমরা দু’জনে ভাগ করে খেতাম। এ ছাড়া মাঝে মাঝে কত ছোটখাট প্রেজেন্ট ও আমাকে দিয়েছে তার হিসেব নেই। বড় হয়েও আমাদের বন্ধুত্ব যায়নি। আমরা কলেজেও একই সঙ্গে পড়ি। সেখানেও আমাকে ও অনেক সাহায্য করেছে। তবে আমাদের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে পড়েছিল তো, আমি সকালে-বিকালে দুটো টুইশানি নিয়েছিলাম। তাই কোনক্রমে পাসকোর্সে বি-এ পাশ করলাম, ও উঁচু অনার্স পেল। পরে ও এম-এ আর বি-টিও পাশ করেছিল।

আর আপনি?—বিয়ে করলেন?

অফিসারটির অশোভন প্রশ্নে বিব্রত, একটু বিরক্তও হয়ে উঠেছিলাম। আমি এসেছি বনরেখার শোচনীয় মৃত্যু সম্পর্কে কিছু বলব বলে, অপ্রয়োজনীয় নানা প্রসঙ্গ তুলে ওর লাভ কী? সময় নষ্ট করতে পুলিশের জুড়ি নেই।

তবু মনের ভাব গোপন করতে হল। বিরক্তিটা যথাসাধ্য চেপে বললাম, না। বরং বনরেখাই বিয়ে করেছিল।

কবে শ্রীলা দেবী, কতদিন আগে?

পড়তে পড়তেই।

কাকে বিয়ে করলেন বনরেখা দেবী? কোনও সহপাঠীকে?

লোকটার কিছু সহজাত বুদ্ধি আছে স্বীকার করতেই হবে। বললাম, হ্যাঁ। তার নাম প্রসাদ রায়। আপনি তাকে চিনতেন?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললাম, চিনতাম। ঠিক ঠিক বলতে গেলে, প্রসাদের সঙ্গে আমিই বন-র আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম।

ঘটকালি?

এ-কথাটার উত্তর দিলাম না। নির্লজ্জ, না-ছোড় লোকটা আবার বলল, এইবার বলুন তো শ্ৰীলা দেবী, এই বিয়ে কি সুখের হয়েছিল?

এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। ঝোঁকের সঙ্গে বলে উঠেছি, মাপ করবেন, অন্যের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে খবর রাখা আমার বৃত্তি নয়।

লেখা থামিয়ে অফিসারটি টেবিলের উপর পেন্সিলটা বাজালেন। মনে হল, হয়ত একটু অপ্রতিভ হয়েছেন। একটু পরে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন, সত্যিই আমার অপরাধ হয়েছে শ্রীলা দেবী। আপনি ক্লান্ত, শোকাতুর, সে কথাটা মনে ছিল না।

ভাবলাম, এবারে উনি বলবেন, আচ্ছা যেতে পারেন। ছুটি পেয়ে আমি নির্জন কোন একটি কোণ খুঁজে নিয়ে একটু কাঁদব, একটু ঘুমিয়ে নেব।

অতটা আশা করা ভুল হয়েছিল। অফিসারটি আমাকে ছুটি দিলেন বটে, কিন্তু সাময়িকভাবে। বললেন, আপনি ওয়েটিং-রুমেই ফিরে যান শ্ৰীলা দেবী। শুধু একটি অনুরোধ আছে। পরের গাড়িতেই যেন পাটনায় চলে যাবেন না। আমাদের চীফ্, পূর্ণেন্দু মৌলিকের নাম শুনেছেন? তিনি খবর পেয়ে গিয়েছেন ধানবাদে। ওই সেকটরেই খুনটা হয়েছিল কিনা। অকুস্থলের তদন্ত সেরে বোধ হয় শিগগিরই ফিরে আসবেন, এখানেই। তিনি হয়তো আপনার সঙ্গে দেখা হলে হাতে স্বর্গ পাবেন।

চীফ্ মৌলিক সাহেব সত্যিই ভদ্রলোক। অসাধারণ চেহারা। অনেকদিন বাড়িতে রাখা পাকা আমের মত রঙ। বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ শ্ৰীলা দেবী। আপনি নিজে থেকে আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন, কী ভাবে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না। আমাদের পক্ষে আপনিই হবেন মেটিরিয়াল উইটনেস।

বলতে বলতে পকেট থেকে কাগজপত্র বার করলেন মৌলিক সাহেব। খাপ থেকে চশমা বার করে নাকের যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট করে বললেন, বাড়ি সার্চ করে, মৃতের জিনিসপত্র ঘেঁটে, কলকাতায় আর পাটনায় তার করে আমরা সামান্য কিছু কিছু খবর সংগ্রহ করেছি, আপনাকে পেয়ে ভালই হল। আমরা মোটামুটি যে তথ্য দাঁড় করিয়েছি, আপনাকে বলছি। আপনি কনফার্ম করবেন। যেখানে মনে হবে আমাদের ভুল হচ্ছে, শুধরে দেবেন। শুনুন।

মৃত বনরেখা রায়ের বয়স আঠাশ কি ঊনত্রিশ, এম-এ, বি-টি। পাটনার ‘গার্লস ওন স্কুলের’ প্রধানা শিক্ষয়িত্রী। পাটনাতেই স্বামীর সঙ্গে বাস করতেন। স্বামী বিশেষ কিছু করে বলে মনে হয় না। শ্ৰীলা দেবী, ঠিক বলছি?

আমি বললাম, ঠিক।

প্রসাদ আর বনরেখার বিয়ের পরের ঘটনা আমার মনে ছবির মত ভাসছিল। ওরা গোপনে বিয়ে করবার পরেও অনেকদিন ঘটনাটা জানাজানি হতে দেয়নি। যখন হল, তখন কী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল ওদের রক্ষণশীল পরিবারে! বাড়ির সেরা মেয়ে বনরেখা, তার জন্যে ওঁরা রাজপুত্র গড়বার ফরমাস দেবেন ভাবছিলেন, সেই সময়ে এই বিপত্তি। মা কেঁদেছিলেন, বনরেখা টলেনি। বাবা তর্জন করেছিলেন, ও ভাঙেনি। সেই সময় ওর অসামান্য মনের জোর দেখেছি। ওর দাদা নাকি ঠাট্টা করে বলেছিলেন, প্রসাদটা তো একটা লোফার। তোর বন্ধু শ্ৰীলার সঙ্গেই ঘুরত বলে শুনেছি। ছি-ছি, বন, তুই একটা বাজে লোকের—

দাদা! বনরেখা শালীনতা ভুলে চেঁচিয়ে উঠেছিল।

ওর দাদাও সমানে গলা চড়িয়ে বলেছিলেন, ঠিকই বলছি। আমি জানি, ও কী চায়। তোকে নয়, আমাদের টাকা।

বনরেখার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। ও কাঁপছিল। ওর বিষয়ে কাকা তখন বলেছিলেন, এখনও উপায় আছে। এ বিয়ের বিচ্ছেদ হতে পারে! তুই মনটাকে যদি শক্ত করিস, আমি উকিলের পরামর্শ নিতে পারি।

বনরেখা তার মন শক্তই করেছিল। যারা লোফার বলেছে প্রসাদকে, যারা তাকে সন্দেহ করেছে অর্থ-লোলুপ বলে, তার মনুষ্যত্বকে এক কড়ার মর্যাদাও দেয়নি, এক কাপড়ে সেদিনই তাদের আশ্রয় ছেড়ে এসেছে।

মনে মনে ওর মনের জোরকে সেদিন নমস্কার জানিয়েছি। বারবার কামনা করেছি, ওরা যেন জয়ী হয়। প্রসাদ আমার প্রতি সুবিচার করেনি, তবুও।

কলকাতায় প্রথম দু’বছর দেখেছি, কী কায়ক্লেশে কেটেছে ওদের সংসার। প্রসাদ অনেক ঘোরাঘুরি করেও একটা কাজ জোটাতে পারেনি। বনরেখা গোটা তিনেক টুইশানি নিয়েছিল, অবসর সময়টুকুতে বিশ্রাম না নিয়ে পড়া তৈরি করেছিল এম-এ পরীক্ষার। পরে বি-টিও ভালভাবে পাশ করল।

বাপের বাড়ি থেকে কতবার ওকে ফিরিয়ে নিতে লোক এসেছে, যায়নি। গেল, একেবারে শেষের দিন, পাটনার স্কুলটিতে হেড-মিসট্রেসের পোস্টটা পেয়ে মাকে এসে প্রণাম করে।

আমি নিজে তখনও অকূল পাথারে ভাসছি। সেই টুইশানিই করছি, একটা যায়, আরেকটা ধরি। আমার বিদ্যের দৌড় তো বি-এ অবধি। শুধু ওইটুকু সম্বল করে এখনকার মেয়েরা আর ভাল কিছু জোটাতে পারে না। নির্ভরযোগ্য একটা বর পর্যন্ত না।

মনে পড়ল, শেষ টুইশানিটাও যেদিন হাতছাড়া হল, মামীমা বেশি রাত করে বাসায় ফেরবার জন্যে খোঁটা দিলেন, ঠাণ্ডা ভাতের থালা এগিয়ে দিলেন, সেদিন আমিও ঠিক করে ফেললাম, আর নয়।

পাটনার একটা টিকিট কিনে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম।

বনরেখা বদলায়নি। একটু ভারিক্কী হয়েছে, পদোচিত গাম্ভীর্য এসেছে মুখে কিন্তু মনের প্রসন্নতা যায়নি। একটি সুস্থ-সুন্দর শরীরে মধ্য-যৌবনকে ধরে রেখেছে।

আমাকে দেখে খুশি হল। সব শুনে বললে, তাই তো, কী করি। যাক্‌, দু’চার দিন এখানে থাক তো। ব্যবস্থা একটা হবেই।

এবং ব্যবস্থা সে একটা করে দিলও। ওদেরই স্কুলে। কোন টিচারের পোস্ট তখন খালি নেই, একটা কেরানির কাজ ছিল। সেইটে আমাকে দিতে ওর কত সঙ্কোচ! বারবার বলেছে, শ্রীলা, এ-কাজ তোর যোগ্য নয়। কিন্তু বিশ্বাস কর, সুবিধে পেলেই তোকে—

কৃতজ্ঞতায় অভিভূত, উপকৃত আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছি, বন, তুই আমার জন্য যা করলি, সেই ঋণ আমি জীবনেও শোধ দিতে পারব না।

আজও কি পেরেছি?

ওর পাশাপাশি একটা বাসায় আমার থাকবার জায়গা ঠিক করে দেয় বন। পুরো কোয়ার্টার নয়, ছোট একখানা ঘর।

যদি সেই সময়ে আমার মনে কিছু ছায়া ফেলে থাকে, তবে সেটা ওদের দাম্পত্য জীবনের ছোটখাটো ছবি। গোয়েন্দাগিরি আমার স্বভাব নয়, তবু হঠাৎ মাঝে মাঝে যেটুকু চোখে পড়েছে, তা থেকে আমার বুঝতে বাকি থাকেনি যে, ওরা সুখী হয়নি। বন কিছু বলতে চাইত না। প্রসাদও আমাকে কিছু বলেনি। সত্যি কথা বলতে কি, আমাকে প্রসাদ যেন একটু এড়িয়েই চলত, মুখোমুখি পড়ে গেলে জড়সড় হয়ে যেত। ও বুঝি তখনও ভুলতে পারেনি ; আমাকে অকস্মাৎ একদিন ছেড়ে দিয়ে ও বনরেখাকে অবলম্বন করেছিল।

সে সব তো কবেকার কথা কবেই চুকে গিয়েছে। আমিও কি সেই আঘাতের বেদনা একেবারে ভুলে থাকতে চাইনি?

ওদের ঝগড়া প্রায়ই হত। নিষ্ঠুর কুৎসিত বচসা। আমি টের পেতাম। কতদিনই তো দেখেছি, বনরেখার মুখ থমথমে, গম্ভীর। শক্ত মেয়ে, তাই। অন্য কেউ হলে কেঁদে-কেটে অনর্থ করত।

প্রসাদ পাটনায় এসেও সুবিধা করতে পারেনি। জুয়া খেলত, রাত কাটাত বাইরে। রেস খেলত। যেদিন জিতত, সেদিন হাত উপুড় করে খরচ করত, হারলে, বনরেখার কাছেই সেই হাত হয়ত চিত করত।

তখনই অনর্থ শুরু হত।

কতদিন শুনতে পেয়েছি, বনরেখা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছে, দেব না, আর এক পয়সাও দেব না আমি। প্রসাদ বলেছে, আলবাত দেবে। আরও বিশ্রী সব ইঙ্গিত করেছে, সেক্রেটারির ছেলে মহাবীরের সঙ্গে বনরেখার গূঢ় সম্পর্কের ইঙ্গিত করে। চটে গেলে, বিশেষত মদ খেলে, ওর হুঁশ থাকত না, মুখের আগলও না।

বনরেখাকে বলতে শুনেছি, বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও তুমি।

প্রসাদ বেরিয়ে যেতও। ঠিক তখনই নয়। হয়তো কিছু পরে। কলকাতায় এসে দিন কতক গা-ঢাকা দিয়ে থাকত। পরে হয়তো আট দশ দিন পরে, কোন শনিবারে রেসে কিছু টাকা রোজগার করে নির্লজ্জ লোকটা আবার পাটনায় আবির্ভূত হত।

বনরেখার জন্য গভীর মমতা বোধ করেছি।

ওদের দাম্পত্য সম্পর্কের ফাঁকিটা শহরসুদ্ধ একরকম জানাজানি হয়ে গিয়েছিল, এ সব বেশিদিন চাপা থাকে না।

দু-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওকে বিবাহ-বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছে। আমরণ একটা দুর্গ্রহের জের টেনে চলে লাভ কী।

কিন্তু রহস্যময় কোন টানে, বা অন্য কী কারণে, জানি না, বনরেখা কোনদিন রাজী হয়নি। বলত, না-না, ছি ছি। আমরা শিক্ষা বিভাগের লোক। এসব স্ক্যান্ডাল হলে সব মান খোয়াব। লোকের কাছে কি মুখ দেখাতে পারব?

যুক্তিতে জোর ছিল। তবু, আমার বারবার মনে হয়েছে, ওর অনিচ্ছার কারণ অন্য। যে আকর্ষণে একদিন সব ছেড়ে প্রসাদের সঙ্গে চলে এসেছিল, সেটা ক্ষয়ে এসেছে বটে, কিন্তু ফুরোয়নি।

মৌলিক সাহেবকে আভাসে এ-সব কথাই বলতে হল। উনি জেরা করে করে জেনে নিলেন। চেয়ারটাকে দেয়ালে ঠেকিয়ে অবশেষে বললেন, আমরা কিছু কিছু জেনেছিলাম। বাকিটাও নিশ্চয়ই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমাদের গোচরে আসত। শ্রীলা দেবী, আপনার কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য কিছু খবর পেয়ে ভালই হল। থ্যাঙ্কস্, থ্যাঙ্কস্ এ লট্।

কিন্তু তখনও ওঁর জিজ্ঞাসা ফুরোয়নি। একটু জিরিয়ে নিয়ে, আমাকেও একটু জিরোতে দিয়ে আবার একটি একটি করে অনেক কথা জানতে চাইলেন। আমাকে আবার যা জানি, বলতে হল।

এবার পূজার ছুটিতে আমরা একসঙ্গেই কলকাতা এসেছিলাম। বাপের বাড়ির সঙ্গে খানিকটা বোঝাপড়া তো হয়েই গিয়েছিল, ওখানে বনরেখার উঠতে আর বাধা ছিল না। আমার মামার বাসাও কাছেই। রোজই আমাদের দেখা হত।

এখানে মৌলিক সাহেব বাধা দিয়ে বললেন, বনরেখার স্বামী? প্রসাদ রায়? সে আসেনি?

একবার ইতস্তত করে বললাম, না। শ্বশুরবাড়িতে ওকে কেউ পছন্দ করে না, সে বোধটুকু ওর ছিল।

মৌলিক সাহেব ভ্রূকুঞ্চিত করে কথাটা শুনলেন।—আই সী। বেশ, বলে যান।

বললাম, ছুটি ফুরিয়ে এল। ঠিক ছিল এক সঙ্গেই আমরা পাটনা ফিরব। কিন্তু সাতদিন আগে আমাকে আদ্রা যেতে হল। বনরেখাকে বললাম, আমার ফিরতে একটু দেরি হবে ভাই। তুই আলাদাই যা। সে বলল, তা কেন শ্রীলা। তুই শনিবার আসানসোলে এসে থাকবি, আমি ওখান থেকে তোকে তুলে নেব।

বন্দোবস্তে ফাঁক ছিল না, আদ্রার কাজ চুকিয়ে আমি কাল সকালেই ফিরতে পেরেছি —

আদ্রায় আপনার কী দরকার ছিল? অবশ্য গোপনীয় কিছু হলে জানতে চাইব না।

একটুখানি চুপ করে থেকে বললাম, না, বলতে কোন বাধা নেই। চাকরির একটা ইন্টারভিউ ছিল। নিজের অজ্ঞাতসারেই কখন চোখ দু’টি জলে ভরে গিয়েছে, হঠাৎ টের পেলাম। উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠেছি, এ খেদ আমার মরলেও যাবে না। ইন্টারভিউ দিলাম, কিন্তু চাকরিটা আমার বোধহয় হবে না। অথচ একসঙ্গে এলে, জানি না, হয়তো, হয়তো বনরেখা বাঁচত, অন্তত এভাবে তার মৃত্যু হত না।

মৌলিক সাহেব মন দিয়ে কথাটা শুনলেন। বললেন, সবই বিধিলিপি। বাকিটা বলুন।

তাও বললাম।

বিকেলের দিকে এক্সপ্রেসটায় বনরেখা এল। আমি প্ল্যাটফর্মেই ছিলাম। ও জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। আমি বললাম, এ-গাড়ি কেন রে, এটা মেন লাইনের নয়, গ্রান্ড কর্ড দিয়ে যাবে। বনরেখা হেসে বলল, জানি। আমি এখানে নামছি না। বরাকরে যাচ্ছি দাদার ওখানে। শুধু দেখা করেই ফিরে আসব ; সন্ধ্যার পরে যে-কোন একটা গাড়িতে তুই এখানেই থাকিস, আমরা রাত্রে পাঞ্জাব মেল ধরব। বললাম, আচ্ছা।

মৌলিক সাহেব, মনে হচ্ছিল, ঝিমুচ্ছেন। কিন্তু পরে বুঝলাম, কান দুটি তার সজাগই ছিল। থামতেই বললেন, তারপর? নিজেই হাসলেন। আপনাকে আর বলতে হবে না। আমিই বলছি মিলিয়ে নিন। বিকেল গেল, সন্ধ্যা হল, বনরেখা ফিরল না। রাত্রি হল। আপনি একের পর এক ডাউন ট্রেন দেখছেন, বনরেখা কোনটাতেই নেই। তারপর একের পর এক আপ মেল আর এক্সপ্রেসগুলোও এল, গেল। পাঞ্জাব মেলও যথা সময়ে চলে গেল। আর আশা নেই দেখে আপনি—খুব সম্ভব ওয়েটিংরুমেই ফিরে এলেন। তাই না?

আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম, ঠিক তাই।

তারপর আজ সকালের কাগজে দেখলেন, সীতারামপুর আর বরাকরের মাঝামাঝি জায়গায় ওই এক্সপ্রেস গাড়ির একটি প্রথম শ্রেণীর কামরায় কোন মহিলার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। রেলেরই একজন বড় অফিসার ওই গাড়িতে সীতারামপুর থেকে উঠেছিলেন। এই এক্সপ্রেসটার ওখানে দাঁড়াবার কথা নয়, তবু কাল দাঁড়িয়েছিল। অফিসারটির ধানবাদে জরুরী কাজ, সুবিধা পেয়ে তিনি টপ করে ওই গাড়িতে উঠে পড়লেন। কামরার আলো নেবানো, সুইচ টিপলেন। ট্রাঙ্কটাকে সীটের নিচে রাখবেন বলে ভিতরের দিকে ঠেললেন। ট্রাঙ্কটা ঢুকল না। আবার ঠেললেন, এবার আরও জোরে। ট্রাঙ্কটা যেন স্প্রিংয়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। এবার অফিসারটি সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করলেন ; তাঁর কপালে শরতের শেষের দিকেও ঘাম জমে উঠল। তবু ট্রাঙ্ক সরে না। তখন হাঁটু ভেঙে নিচে বসলেন তিনি, যা দেখলেন, তাতে তাঁর রক্ত জমে জমে বরফ হয়ে যেতে পারত। সীটের নিচে একটি মহিলার মৃতদেহ। ওখানে বসেই তিনি নিজের বুকের রক্ত চলাচলের ধ্বনি যেন শুনতে পেলেন। গাড়ি পূর্ণবেগে চলছে। বরাকরের ব্রীজ সামনেই। সমস্ত সাহস, দৃঢ়তা, ইচ্ছা একত্রে গ্রথিত করে অফিসারটি চেন টানলেন, গাড়ি থামল। এল গার্ড, সামনের ছোট স্টেশনে খবর গেল। তারে তারে খবরটা রাষ্ট্র হল। ওখানেই লাশ নামান হল। তার টিকিট থেকে এবং ব্যাগ হাতড়ে নাম-ধাম, পরিচয় পাওয়া গেল। শ্ৰীলা দেবী, এ সমস্তই আপনি কাগজে পড়েছেন। তবু ভয় পাচ্ছেন কেন? নিন, এই কফিটা খেয়ে নিন, অনেকটা সুস্থ বোধ করবেন।

যন্ত্রচালিতের মত গরম কফির কাপটা হাতে নিলাম। চুমুক দিলাম। অবসন্ন গলায় বললাম, এবার যাই?

মৌলিক সাহেবও যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলেন। সচকিত হয়ে উঠে বসে বললেন, আপনি আমাদের অনেক উপকার করলেন শ্রীলা দেবী, কাজ অনেক সহজ হল। আপনি এই তুফানেই ফিরছেন? ঠিকানাটা রেখে যান, কেস উঠলে আপনাকে হয়তো দরকার হবে। সাক্ষী দেবেন। ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ।

আমাকে দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন মৌলিক সাহেব। নমস্কার করে বললেন, আবার দেখা হবে।

হঠাৎ কী হল, আমি এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বললাম, বনরেখা এখন কোথায়?

মৌলিক সাহেব খুব অবাক হয়েছেন, এমনভাবে বললেন, সে কী। সব জেনে এই কথা বলছেন? আঙ্গুল তুলে তিনি আকাশটা দেখিয়ে দিলেন।

অপ্রতিভ হয়ে বললাম, না, না, সে কথা বলিনি।

ও, দেহটা? ওঁর আত্মীয়-স্বজনেরা খবর পেয়ে গেছেন, তাঁরা বোধ হয় পরের গাড়িতে সবাই আসছেন। শুধু ওঁর স্বামীর কোন খোঁজ পাইনি। শ্ৰীলা দেবী, আপনি আন্দাজ করতে পারেন, প্রসাদ রায় এখন কোথায়?

বললাম, না। তবে যতদূর জানি, সে হয়তো পাটনাতেই।

কাল আপনার সঙ্গে যখন বনরেখা দেবী জানলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তখন ওঁর কামরায় আর কেউ ছিল?

আবার সেই জেরা। জেরার পর জেরা। ওঁর হাত থেকে রেহাই পেতে মুখে যা এল তাই যেন বলে দিলাম—ছিল। যতদূর জানি মনে পড়ছে, একজন ছিল। একেবারে ওধারের সীটে, একজন ভদ্রলোক।

কেমন দেখতে তিনি, কী পোশাক পরেছিলেন?

বললাম, বলতে পারব না। ওদিকে মুখ ফিরিয়ে তিনি শুয়েছিলেন, এইটুকু মনে আছে। আমি ভাল করে দেখতে পাইনি, ওর কামরায় তখনও আলো জ্বালানো হয়নি, ভদ্রলোকের পরনে পা-জামা ছিল, যতটা মনে করতে পারছি, বেশ লম্বা-চওড়া, সুপুরুষ।

আচ্ছা শ্রীলা দেবী, প্রসাদ রায় দেখতে কেমন?

কেন, বেশ লম্বা চওড়া সুপুরুষ—

মৌলিক সাহেব হেসে উঠলেন। সেই হাসির ধরণটা আমার একেবারে ভাল লাগল না। বিশেষ করে মৌলিক সাহেব হাসি থামিয়ে যখন বললেন, আপনি কি শপথ করে বলতে পারবেন, শ্রীলা দেবী যে, যাকে শুয়ে থাকতে দেখেছেন সে প্রসাদ রায় নয়?

আমার মুখ শুকিয়ে গেল। অজ্ঞাতসারে, অসতর্কভাবে আমি কি তবে প্রসাদকে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে ফেললুম। ছিঃ, তাই যদি হয়, তবে আমার অনুশোচনার যে অবধি থাকবে না। কম্পিত গলায় বললাম, মিস্টার মৌলিক, আমি তো শুধু লম্বা-চওড়া, আর সুপুরুষ বলেছি। ওরকম ভাসা-ভাসা বর্ণনা থেকে আপনি তো হাজার হাজার লোককে সনাক্ত করে বসবেন?

মৌলিক সাহেব হা-হা করে হাসলেন।—ওখানেই ভুল করলেন। সনাক্ত আমি কাউকে করছি না। তবে হ্যাঁ, সন্দেহের একটা দিক আছে, সেটা ভেবে দেখতে হয় বৈকি। আমরা কী ভাবে সন্দেহ করি জানেন?

ভয়ে ভয়ে বললাম, কী ভাবে?

ডাক্তার যে-ভাবে রোগ নির্ণয় করেন, সেই ভাবে। অর্থাৎ লক্ষণ আর নজির মিলিয়ে। শতকরা আশিটি ক্ষেত্রে তাতে ভুল হয় না। ধরুন আমরা প্রথমে বিচার করি, মৃতের শত্রু কে বা কারা ছিল। কার সঙ্গে তার তুমুল কলহ হয়েছিল, বা হয়ে থাকে। মৃত্যুর ক’দিন আগে। তার পরে প্রশ্ন ওঠে, মৃত্যুতে কার বা কাদের লাভ হল। কার পথের কাঁটা দূর হল, কে পাবে উইল বা ইন্সিওরেন্সের টাকা। শ্ৰীলা দেবী, এখানেই আসে আত্মীয় কুটুম্বের কথা। এই ‘হূডানিটে’র অর্থাৎ ‘কে করেছে’র পদ্ধতির পরের প্রশ্ন, কার সুযোগ সবচেয়ে বেশি ছিল। কে বা কারা অকুস্থলে ঘটনার সময়ে ছিল, কে কে ছিল না। যারা ছিল না, তারা বেকসুর খালাস। তবে এই অনুপস্থিতি বা আমরা যাকে বলি alibi, প্রমাণ করা শক্ত, এতটুকু সন্দেহের অবকাশ থাকলে চলবে না। আর একটা ছোট প্রশ্ন থাকে, সেটা জানলে তদন্তের সময় আমাদের সুবিধে হয় ; মৃতকে সবচেয়ে শেষে কে জীবিত দেখেছে। আর, মৃতদেহটি প্রথমে কার চোখে পড়ে, সৌভাগ্যক্রমে আমরা এ দু’জনকেই জানি। বনরেখাকে শেষবার জীবিত দেখেছেন আপনি, আসানসোলে মৃতদেহ প্রথম চোখে পড়ে রেলওয়ে অফিসারটির। অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে নিঃসন্দেহে জানা গেল, ঘটনাটা আসানসোল থেকে সীতারামপুরের মধ্যেই কোথাও ঘটেছে। শ্রীলা দেবী, আপনার সাক্ষ্য যদি নির্ভুল হয়, তবে ওই সময়টুকুর মধ্যে কামরায় লম্বা, চওড়া বলে যাকে বর্ণনা করেছেন, সে ছাড়া কেউ ছিল না। সেই লোকটি যদি দেখতে প্রসাদের মত হয়, তবে অবশ্যই আমরা খোঁজ নেব, প্রসাদ সেই সময়ে পাটনায় ছিল, না কলকাতায়, না ওই গাড়িতেই।

স্পষ্ট যেন দেখতে পেলাম, প্রসাদকে ঘিরে একটি জাল ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। মরিয়ার মত বলে উঠলাম, কাজটা তো অপরিচিত লোকেরও হতে পারে।

মৌলিক হাসলেন। পারে। তবে সেক্ষেত্রে উদ্দেশ্য বা লাভের কথাটা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং মোটা। নগদ টাকার লোভে গুণ্ডা ধরণের লোকেরা এসব করে বটে, কিন্তু বনরেখা দেবীর সঙ্গে টাকা গহনা ইত্যাদি সামান্যই ছিল। আর, যতদূর বুঝেছি, আততায়ী একটি গহনাও স্পর্শ করেনি, সুতরাং লোভের প্রশ্ন এখানে অবান্তর। তবে ওঁর হাতব্যাগ থেকে দুশো টাকা উধাও হয়েছে। টাকাটা সামান্য, এর জন্য কেউ মানুষ খুন করবে বলে মনে হয় না। আর একটা কথা আপনাকে বলি শ্ৰীলা দেবী, যার হাতে বনরেখার প্রাণ গিয়েছে, সে অপরিচিত ছিল না।

কিসে বুঝলেন?

তাহলে ধস্তাধস্তির চিহ্ন থাকত। যে একাজ করেছে, তাকে বনরেখা চিনতেন, পাশে বসতে দিয়েছিলেন, হয়তো মুখোমুখি বসে গল্প করেও থাকবেন। তারপর সুযোগ বুঝে আততায়ী ঝাঁপিয়ে পড়ে, এবং বনরেখাকে আত্মরক্ষার সুযোগটুকুও না দিয়ে গলা টিপে হত্যা করে। কণ্ঠনালীতে গভীর দুটি দাগ আছে। থাক বলব না, আপনি আবার ভয় পেয়েছেন। আপনার মন এত দুর্বল? যাক, অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি, আপনি একটা শুধু খবর বলুন। আপনার মনে আছে, বনরেখা কী রঙের জামাকাপড় পরেছিলেন?

ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, আছে। সবুজ জর্জেটের শাড়ি; আর লাল ওভারকোট।

আশ্চর্য, মৌলিক বললেন, আশ্চর্য। ঠিকই মিলছে। মৃতদেহে ওই পোশাকই ছিল। আপনি ছাড়া এই স্টেশনেই ওঁকে আর একজন দেখেছে, গাড়ির কন্ডাক্টর গার্ড। তাকে ডেকে দাঁড় করিয়ে বনরেখা বরাকর থেকে ফেরবার গাড়ি কখন কখন আছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন।

এর মধ্যে আশ্চর্য কোনটা?

আশ্চর্য এই পোশাকটা। শ্রীলা দেবী, এই অক্টোবরের শেষে, দিনের বেলায় এই অঞ্চলে এখনও পাখা চালাতে হয়, কেউ কি ওভারকোট পরে?

বনরেখা ভারি শীতকাতুরে ছিল। আমি বললাম।

মৌলিক আমাকে নিজে গাড়িতে বসিয়ে দিলেন। ছাড়বার ঘণ্টা পড়ল, উনি আস্তে আস্তে বললেন, প্রসাদকে আমরা স্বভাবতই সন্দেহ করব, শ্রীলা দেবী। কিছু মনে করবেন না, পুরনো কথা আপনি হয়তো একেবারে ভুলতে পারেননি, প্রসাদকে এখনও স্নেহ করেন, বা প্রীতির চোখে দেখেন—

না—না, আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম।

সে কথায় কর্ণপাত না করে মৌলিক বলে গেলেন, তাই তাকে বাঁচাতে চাইছেন। আর, আপনি হয়তো জানেন, গোয়েন্দা কাহিনীতে প্রথমে এবং সহজেই যার ওপর সন্দেহ আসে, সে সাধারণত অপরাধী হয় না। আসল জীবনে কিন্তু ঠিক তার উলটো। অন্তত আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাই বলে। প্রথম অনুমানটাই খাঁটি হয়। অতএব, শ্রীলা দেবী, প্রসাদ রায়কে আমরা খুঁজে বার করবই। এইটুকু জানি, গতকাল সে পাটনায় ছিল না। কলকাতায় ছিল কিনা, তাও জানতে আমাদের দেরি হবে না।

গাড়ি ছেড়েছিল। উনি কয়েক পা সঙ্গে সঙ্গে এলেন। হাত তুলে নমস্কার করে বললাম, আবার দেখা হবে।

উনি বললেন, নিশ্চয়ই।

যত তাড়াতাড়ি দেখা হবে ভেবেছিলাম, তার চেয়েও কিছু আগেই হল। বোধ হয় দু’তিন দিন পরে স্কুল থেকে ফিরে দেখি, মৌলিক সাহেব। সেই শালপ্রাংশু উন্নত দেহ, কিন্তু বিনয়ানত ভঙ্গি। বললেন, নমস্কার।

এই সন্ধ্যাবেলা পুলিশের লোক—আগন্তক হিসাবে বিশেষ বাঞ্ছনীয় মনে হল না।

তবু বসতে বললাম। কলঘরে গেলাম তাড়াতাড়ি। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে যেন সাহস ফিরিয়ে আনতে চাইলাম। ফিরে এসে দেখলাম, উনি ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখছেন। বললেন, এনকোয়ারিতে এসেছি। ভাবলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।

বললাম, বেশ তো, বসুন।

উনি বসলেন। দেখি, উত্তর দিকের জানলাটার দিকে বারবার চাইছেন। তাড়াতাড়ি বললাম, ওদিকেই বনরেখার কোয়ার্টার।

বললেন, জানি।

আমি আবার বললাম, আজকাল বন্ধ করে রাখি।

মৌলিক সাহেব কিছু বললেন না। খানিকক্ষণ আমিও না। শেষে নীরবতা ভাঙ্গতেই জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু কিনারা হল?

উনি যেন অন্যমনস্ক ছিলেন। বললেন, কিনারা? হ্যাঁ, কিনারা প্রায় করে এনেছি। এখন শুধু হাতকড়া পরাতে পারলেই—

কে? অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা তীব্র চিৎকার আমার গলা চিরে বেরিয়ে এল। কে, মৌলিক সাহেব, প্রসাদই কি?

মৌলিক রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন, প্রসাদ? হ্যাঁ, প্রসাদ হতে পারে। আরও দু’একটা খবর নিচ্ছি। আপনি কিন্তু একটা জিনিস আমাদের কাছে লুকিয়ে গেছেন, শ্রীলা দেবী। এই পূজার ছুটিটায় প্রসাদ কলকাতাতেই ছিল।

ছিল?

মৌলিক ধীরে ধীরে বললেন, ছিল। এও জানি, বনরেখার সঙ্গে ওর প্রায়ই দেখা হত। বনরেখা দেখা করতে চাইত না, কিন্তু জুয়াড়ী লম্পট লোকটা নাছোড়। মাঝে মাঝে দশ-বিশ টাকা কলকাতাতেও চেয়ে নিত।

আমি জানি।

জানেন, কিন্তু আমাদের বলেননি। আপনি প্রসাদকে বাঁচাতে চেয়েছেন। গম্ভীর গলায় মৌলিক বলে উঠলেন, আপনাকে সেদিন বলিনি শ্রীলা দেবী, প্রত্যক্ষ সন্দেহ যার ওপরে পড়ে অধিকাংশ বাস্তব ক্ষেত্রে অপরাধী সেই হয়? তবে শুনুন। প্রসাদের মোটিভেরও অকাট্য প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আপনি চেপে গিয়েছেন, কিন্তু জেনেছি, শেষের দিকে ওদের কোনরকম দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল না বললেই হয়। ডিভোর্স ঘটিত স্কান্ডালের ভয়ও বনরেখা অতিষ্ঠ হয়ে শেষ অবধি জয় করেছিলেন। এবার কলকাতায় আইনজ্ঞের পরামর্শ নিতেই এসেছিলেন। উকিলের বাড়িতে গোপনে যখন যেতেন, তখন সঙ্গে কে থাকত জানেন?

কে ?

আপনাদের স্কুলের সেক্রেটারির ছেলে মহাবীর। হয়তো—হয়তো বিবাহটা বিচ্ছিন্ন হলে বনরেখাকে সেই বিয়ে করত। আপনি এদিকটা সম্পর্কে আমাকে বিশেষ কিছুই বলেননি, শ্রীলা দেবী।

আমার রুচিতে বেঁধেছিল।

অর্থাৎ সত্য গোপন করেছেন। যাক, আমার মুখেই তবে শুনুন। মহাবীরও পূজার ছুটির বেশির ভাগ সময়েই কলকাতায় কাটিয়েছে। ব্যাপারটা প্রসাদও অনুমান করে থাকবে। ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে সেও কলকাতায় যায়।

তারপর?

মোটিভের কথা বলছিলাম। কলকাতায় গিয়ে বনরেখাকে অনেক বোঝায় প্রসাদ, অনেক কাকুতি-মিনতি করে। কিন্তু বনরেখা অটল ছিল। প্রসাদকে সে দয়া করে দশ-বিশ টাকা দিয়েছে বটে, কিন্তু আমল দেয়নি।

ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, আমার ঘরের পর্দা কাঁপছে, জড়সড় হয়ে চৌকিতে বসলাম। কম্বলটা টেনে দিলাম পায়ের ওপর। বললাম, অর্থাৎ বলতে চান, হিংসার বশেই প্রসাদ—

উঁহু। শুধু হিংসা নয়। শ্ৰীলা দেবী, জেনুইন মোটিভও ছিল। বনরেখা রায়ের দশ হাজার টাকার ইন্সিওরেন্সের কথাটা ভুলছেন কেন? এই টাকাটার নমিনি প্রসাদ, বিবাহ বিচ্ছিন্ন হলে নিশ্চয়ই নমিনি বদলাত, টাকাটাও বেহাত হত।

সেই মুহূর্তে টের পেলাম, প্রসাদের আর কোন আশা নেই, ফাঁসটা ওর গলায় ক্রমশ আঁট হয়ে বসেছে। দু’হাতে চোখ ঢেকে আস্তে আস্তে বললাম, ওকে কি আপনারা গ্রেপ্তার করেছেন?

না, শ্রীলা দেবী। একটুখানি মুস্কিল আছে যে। লোকটার মোটিভ যেমন আছে, alibiটাও তেমনি যে জোরালো। সেদিন ও যে ওই গাড়িতে ছিল, তার কোন প্রমাণ নেই। বরং শনিবার ওকে কলকাতায় রেসের মাঠে বিকেল বেলাতেও দেখা গিয়েছে—অন্তত ছ’সাতজন লোক তার সাক্ষী। ও একটা বড় পেমেন্টও পেয়েছে। ডবল টোটের দুটো লেগই মিলিয়েছিল। সন্ধ্যেবেলা প্রকাশ্যে একটা ক্লাবে বন্ধুদের নিয়ে হল্লা করেছে। একই সময়ে লোকটা দিব্য দেহধারী না হলে দুটো জায়গায় হাজির থাকতে পারে না। ক্রাইম ডিটেকশনে শ্রীলা দেবী, অলৌকিকের স্থান নেই।

সুতরাং?

সুতরাং আপাতত যতদূর মনে হচ্ছে লোকটা নির্দোষ। তবে কলকাতার পুলিশ ওকে এখনও নজরে রেখেছে। আসলে কেসটার এখন তদন্ত করছে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, আমরা রেল-পুলিশ তদন্তে সহায়তা করছি মাত্র!

সম্মোহিতের মত শুনছিলাম। হাওয়া আরও জোরাল, আরও কনকনে হয়ে উঠেছিল। বাইরের রাস্তায় কয়েকটা কুকুর বিশ্রী সুরে ডাকছিল। বললাম, এখন আপনাদের তবে কাকে সন্দেহ, মহাবীরকে?

মৌলিক বললেন, আপনি বুদ্ধিমতী। মহাবীরকেও সন্দেহ করা যায় বৈকি! বিশেষত, ওর একটা আচরণ তো রীতিমত রহস্যজনক। আপনি কি জানেন, বনরেখার মৃত্যুর দিন থেকে লোকটা উধাও হয়েছে? এখানে নেই, কলকাতায়ও নেই।

নেই?

না। আরও শুনুন, ওর নামে ওই গাড়িতেই একটা বার্থ রিজার্ভ করা হয়েছিল। তবে ও যে স্টেশনে এসেছে বা গাড়িতে উঠেছে, তার কোন প্রমাণ নেই। প্ল্যাটফর্মে রিজার্ভ বার্থের যাত্রীদের নামের লিস্ট যার কাছে থাকে, সেও কিছু বলতে পারে না। অবশ্য তাতে কিছু প্রমাণ হয় না, কেননা, ওরা অনেক সময় ভুল করে।

তবে কি ওই অপরাধী?

হতে পারে। মৌলিক চুরুট ধরিয়ে বললেন, ঠাণ্ডার দিনে এই জিনিসটা আরামপ্রদ। হ্যাঁ, মহাবীর অপরাধী হতে পারে। তবে কী জানেন, ওর alibi অর্থাৎ অনুপস্থিতির জোরাল কোন প্রমাণ নেই বটে, কিন্তু মোটিভও তো তেমন কিছু নেই। বনরেখার মৃত্যুতে ওর লাভ কিসে? হয়তো, হয়তো—মৌলিক ইতস্তত করে বললেন, আরও এমন কিছু রহস্য আছে, যা আমরা জানতে পারিনি।

বলতে বলতে মৌলিক ওঁর চেয়ারটা আমার চৌকির কাছে নিয়ে এলেন, কানের কাছে মুখ এনে বললেন, শ্রীলা দেবী, আপনিও আমাদের সব কথা বলেননি!

আমি দেয়ালের দিকে সরে গিয়ে সিলিঙের শিকারী টিকটিকিটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলেছি, কী,কী বলিনি?

ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল, মৌলিক উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এলেন। ফিরে এসে স্থির কণ্ঠে বললেন, সবই বলব।

উনি এগিয়ে এসেছিলেন। আমি সরে গিয়েছিলাম চৌকিটার একেবারে ওপাশে,জানলায় ঠেস দিয়ে বসেছিলাম। বন্ধ জানলা, ও পাশেই বনরেখার কোয়ার্টার ছিল।

মৌলিককে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, চোখ বন্ধ করে ছিলাম। আমার ছোট্ট ঘরটা জুড়ে একটি গম্ভীর কণ্ঠ, নিষ্কম্প, অবিচলিত, অন্য কোন অস্তিত্ব নেই।

সবার আগে আপনাকে আমাদের ছোট একটা ভুলের খবর দিয়ে শুরু, শ্রীলা দেবী। বনরেখা আসানসোল আর সীতারামপুরের মধ্যে নিহত হননি। হয়েছিলেন বর্ধমান আর আসানসোলের মাঝামাঝি কোনখানে।

অবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে উঠলাম, সে কি!

মৌলিক হাত তুলে আমাকে ইঙ্গিতে থামতে বললেন। ব্যস্ত হবেন না। হ্যাঁ, বনরেখা সম্ভবত অণ্ডালের কাছাকাছি কোন জায়গায় খুন হয়েছিলেন। অন্তত আমাদের ডাক্তারি রিপোর্ট তাই বলে। আসানসোলের পরে যদি খুন হতেন, তবে সীতারামপুরেই তো ওঁর দেহ আবিষ্কৃত হয়, অত তাড়াতাড়ি রিগর মর্টিস আসত না, শরীরটা শক্ত, ঠাণ্ডা আর ভারী হয়ে যেত না। আরও গরম থাকত।

কিন্তু আমি বলে উঠলাম, আমি যে ওকে এখানে, এই স্টেশনেই দেখেছি মিস্টার মৌলিক। সে যে আমার সঙ্গে কথাও বলেছে।

মৌলিক সাহেব আবার বললেন, আস্তে। আপনি দেখেছেন। ওখানেই তো যত খটকা শ্ৰীলা দেবী। আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিলেন। পরে কিন্তু ব্যাপারটার মীমাংসা হয়ে গেল। আপনি দেখেছেন। বনরেখা রায়কে এই স্টেশনে একমাত্র আপনিই দেখেছেন শ্রীলা দেবী, আর কেউ দেখেনি।

অত্যন্ত জোর দিয়ে বলে উঠলাম, মিথ্যে কথা। আপনি নিজেই বলেছেন, অন্তত আর একজন দেখেছে। এক্সপ্রেসের কন্ডাক্টার গার্ড। বনরেখার সঙ্গে সে কথা বলেছে, আপনি নিজেই বলেছেন।

চোখ দুটি অতিশয় ছোট করে মৌলিক সাহেব বললেন, সে যদি আপনাকেই দেখে থাকে, শ্ৰীলা দেবী?

হেসে উঠলাম, সেই হাসি দেয়াল থেকে দেয়ালে ঘা খেয়ে আবার আমার কানেই ফিরে এল। তখন বললাম, আপনি পাগল, মৌলিক সাহেব। কন্ডাক্টার কি লাল ওভারকোট দেখেনি?

উচ্চহাসি দিয়ে মৌলিক সাহেব আমার হাসিটারই যেন জবাব দিলেন। শ্রীলা দেবী, বুদ্ধিমতী হয়েও আপনি একটা যুক্তিহীন কথা বললেন। পোশাকটা তো আসলে খোলস। এক রঙের খোলস কি দুটো মানুষের হয় না?

এবার আমার গলা কেঁপে গিয়েছে, তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠে দুর্বলতাকে চাপা দিতে চেয়েছি। কী, কী বলতে চান আপনি?

আমার চোখ দিয়ে ঘৃণা, আতঙ্ক ফুলঝুরির মত ঝরছিল। হিসহিস করে বললাম, অভদ্র কোথাকার!

মৌলিক সাহেব দরজার পাশে দাঁড়ালেন। নির্বিকার গলায় বললেন, কোয়াইট। কিন্তু হত্যাকাবী নই। শ্রীলা দেবী, আপনার প্রিয় সখী বনরেখা রায়কে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করার অভিযোগে আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করলাম।

কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল মনে নেই। হয়তো জ্ঞান হারিয়ে থাকব। সম্বিত ফিরে এলে দেখি, ঘরে আরও অনেক লোক, তাদের আমি চিনি না। একজন ভদ্রলোক আমার নাকের কাছে স্মেলিং সল্টের শিশি ধরে আছেন।

মৌলিক সাহেবকেও দেখতে পেলাম। হেলান চেয়ারে কাত হয়ে পা.দুটো শূন্যে তুলে রেখেছেন। ইঙ্গিতে ওঁকে আমি কাছে ডাকলাম। উনি এলেন।

তখনও আমি অবসন্ন। ক্ষীণ গলায় বললাম, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

বলুন। স্নেহার্দ্র কণ্ঠ, পূর্ব উত্তাপের লেশ মাত্র নেই।

ওদের চলে যেতে বলুন।

মনে আছে, সকলে চলে গিয়েছে, বালিশে মাথা রেখে আমি শুয়ে আছি। মৌলিক সাহেব চেয়ার টেনে এনে কাছে বসেছেন।

কী বলবেন বলুন?

বললাম। নির্বোধের মত শোনাল জানি, তবু বললাম—কী করে—কথাটাকে আমি সম্পূর্ণ করতে পারলাম না।

উনি সহায়তা করলেন। কী করে ধরলাম জানতে চাইছেন তো? সত্যি বলতে কি, প্রথমে আমার প্রসাদকেই অপরাধী মনে হয়েছিল। কিন্তু খটকা লেগেছিল পোশাকটায়। একে লাল রঙ, তাতে অকালে ওভারকোট, এমন অদ্ভুত পোশাক বনরেখা কেন পরবেন? যেই পরে থাক, সে নিজের প্রতি অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল, সন্দেহ রইল না। তখন ভাবলাম, কেন, কেন? কোন সদুত্তর পেলাম না। তখনও জানতাম না, ঘটনাটা আসানসোলের পশ্চিমে ঘটেনি। ডাক্তারি রিপোর্টে যখন নিশ্চিত ভাবে জানা গেল, বনরেখা অণ্ডালের কাছাকাছি কোথাও নিহত হয়েছেন, তখন খটকা আরও বাড়ল। লাল ওভারকোট পরা মহিলাকে আসানসোলে দেখা গিয়েছে, তিনি যদি বনরেখা নন, তবে কে? তখন জিজ্ঞাস্য হল, তাঁকে কে কে দেখেছে? দেখেছে কন্ডাক্টার গার্ড, কিন্তু বনরেখাকে সে চেনে না, সে শুধু পোশাকটাকেই মনে করে রেখেছে।

আর দেখেছেন আপনি। আপনি মৃত মহিলাটির আবাল্য বন্ধু, শুধু পোশাক দিয়ে আপনার চোখে ধুলো দেওয়া তো সহজ নয়। তবে, তবে কি—

আমার ভাবনা সেই প্রথম স্পষ্ট সন্দেহের রূপ নিল। যে বর্ধমানের পর বনরেখাকে হত্যা করেছে, সেই পরে লাল ওভারকোট পরে আসানসোলে জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু আপনার চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারত না। সে যে স্ত্রীলোক, তাতে সন্দেহ নেই, কেননা পুরুষ মেয়ের কোট পরবে না, এবং অস্পষ্টভাবে যেন বুঝতে পারলাম, হয় আপনি তাকে বাঁচাতে চান, নয়ত সে-ই আপনি। কেননা আগে বলেছি, আসানসোলেও বনরেখা যে জীবিত ছিলেন একথার একমাত্র নির্ভরযোগ্য সাক্ষী আপনি।

তবে একটা খটকা তখনও ছিল। হত্যাকারীকে বনরেখা চিনতেন! সে তাঁর সঙ্গে পাশাপাশি বসেছে। এ ব্যাপারটা যদিও আপনার দিকেই আঙ্গুল দেখিয়ে দেয়, তবু নিঃসন্দেহ হতে পারছিলাম না একটা কারণে। যিনিই হত্যা করে থাকুন, তাঁর গায়ে তো অনেক জোর হবে। কেননা, বনরেখা সহজেই পরাভূত হয়েছিলেন, কোন ধস্তাধস্তির চিহ্ন দেখিনি। আপনি তো তেমন বলশালী নন। তবে?

এই তবেরও উত্তর পেলাম পোস্টমর্টেম রিপোর্টে। বনরেখার ফুসফুসে ক্লোরফর্মের গন্ধ ছিল। আততায়ী কৌশলে ক্লোরফর্ম ব্যবহার করে বনরেখাকে আচ্ছন্ন করেছিল। বনরেখাকে কেউ কোনদিন লাল ওভারকোট পরিহিত অবস্থায় দেখেনি। ওটা তবে হয়তো আপনার। লাল ওভারকোটটা আপনি যে দর্জিকে দিয়ে করিয়েছিলেন তার ঠিকানা সংগ্রহ করেছি শ্রীলা দেবী। কিন্তু ক্লোরফর্ম পেলেন কোথা থেকে, জানাবেন?

উত্তর দিলাম না।

মৌলিক নিজেই বলে গেলেন, শেষ যে প্রশ্নটার মীমাংসা বাকি ছিল, এবার সেটাকে নিয়ে পড়লাম। আপনার alibi। হত্যা যদি অণ্ডালে ঘটে থাকে, আপনি সেখানে কি করে গেলেন! সকালেই তো আদ্রা থেকে আপনি আসানসোলে এসেছেন।

আবার অনুসন্ধান। শ্ৰীলা দেবী, দেখলুম আপনার স্টেটমেন্টের এই অংশটুকুও সত্য নয়। আপনি আদ্রা থেকে আসানসোলে তো ফেরেননি, আগের রাত্রে বি এন আর লাইন দিয়ে ফিরেছিলেন হাওড়ায়। তারপর বনরেখার সঙ্গে একই এক্সপ্রেসে উঠেছেন, সম্ভবত বর্ধমান পর্যন্ত অন্য কামরায়। পরে, বর্ধমানে যখন বনরেখার গাড়িতে এলেন, তিনি নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েই আপনাকে ডেকে নিয়েছিলেন। শ্রীলা দেবী, মহাবীরের নামে হাওড়া থেকে ভুয়ো বার্থ রিজার্ভেশন—সেও কি আপনি করিয়েছিলেন? শুধু সন্দেহটাকে নানা পাত্রে ছড়িয়ে দেবার জন্যে?

এবারও কোন উত্তর দিলাম না।

আপশোস সূচক একটা অব্যয় উচ্চারণ করে মৌলিক বললেন, এত প্ল্যান, এত সতর্ক আয়োজন কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারলেন না শ্রীলা দেবী। সেই স্টেশনে আপনাকে সকালে তো কেউ দেখেনি। অনুমান করছি, কন্ডাক্টার গার্ডের সঙ্গে কথা বলে আপনার প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আপনি উল্টো দিকের দরজা দিয়ে অলক্ষ্যে নেমে পড়েছিলেন। তার আগে আপনি নিজের লাল কোটটি খুলে মৃতদেহে জড়িয়ে দিয়েছেন, তাকে ঠেলে দিয়েছেন সিটের নিচে। নেমে এসে নিজের পোশাকে ঢুকেছেন ওয়েটিংরুমে। তখন সমস্ত রাত্রি অনেকেই আপনাকে ওখানে দেখেছে। হত্যাকাণ্ডটা আসানসোলের পশ্চিমে ঘটেছে, এটা যদি প্রমাণ হত, তাহলে শ্রীলা দেবী আপনাকে ছোঁয়া যেত না। আপনার alibi পাকা হত।

আস্তে আস্তে বললাম, আপনি ভুলে যাচ্ছেন, ওই কামরায় লম্বা-চওড়া সুপুরুষ এক ভদ্রলোক ছিলেন।

শ্ৰীলা দেবী, সেও ভুয়ো। আর কেউ নাও থাকতে পারে। আপনার মুখের কথা ছাড়া তার অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই। তাকে আপনি সৃষ্টি করেছিলেন, বোধহয় প্রসাদ রায় বা মহাবীরের পিছনে আমাদের ছুটিয়ে হয়রান করে দেবার জন্যে। না, শ্রীলা দেবী, আর মিথ্যে বাড়াবেন না। আমরা ক্লান্ত, ক্লান্ত আপনিও।

আশ্চর্য, আমার ক্লান্তি কিন্তু দূর হয়েছিল। আমি সোজা হয়ে বসেছিলাম। হেসেছিলাম, হ্যাঁ, তখনও হাসতে পেরেছিলাম। একটু ঠাট্টাও করেছিলাম মৌলিক সাহেবকে।

ওঁর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলেছি, আমার অপরাধ এখনও কিন্তু প্রমাণ হয়নি। এত দীর্ঘ বক্তৃতাতেও মোটিভ বা উদ্দেশ্যের প্রসঙ্গটা কৌশলে এড়িয়ে গেলেন। অথচ, আপনিই বলেছেন, উদ্দেশ্যেরও একটা সন্তোষজনক প্রমাণ থাকা চাই। বনরেখা আমার বন্ধু, নানাভাবে তার কাছে উপকার পেয়েছি। তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অবধি নেই। তাকে গভীর শ্রদ্ধা করতাম, ভালবাসতাম। আমিই তার মৃত্যু ঘটাব, অন্য যত প্রমাণই আপনার কাছে থাক, এ কথাটা ব্যাখ্যা করে আদালতকে বোঝানো আপনার পক্ষেও সহজ হবে না।

গভীর আত্মপ্রত্যয়ে যে হাসি ফোটে, সেই হাসি মৌলিক সাহেবের মুখে দেখলাম।

সে ব্যাখ্যাও আছে বৈকি শ্রীলা দেবী। ব্যাখ্যা আছে গূঢ় মনস্তত্ত্বে! আপনি নিজেই জানেন, বনরেখাকে আপনি ভালবাসতেন না।

না। ঘৃণা করতেন। নিজের মনের ভেতরটায় একবার চেয়ে দেখুন, শ্রীলা দেবী। আশৈশবকালের কি তীব্র হিংসা সেখানে তীব্রতর ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল। তাকে আপনি ভালবাসার ভাল-মানুষি কাপড়ে ঢেকে রেখেছিলেন মাত্র। আমাদের চেয়ে যারা শ্রেষ্ঠ, তাদের আমরা শ্রদ্ধা করতে পারি, কিন্তু ভালো কোনদিনও বাসতে পারি নে। একটা হিংসা অহরহ মনটাতে ছোবল মারে, ও কেন এত বড়, এত উদার, এত ভাল? কেন, কেন?

অপরাধতত্ত্ব বলে, পৃথিবীর বহু হীন কাজ এই হীনমন্যতা থেকে। যে ছোট, সে মুখে বশ্যতা স্বীকার করে, কিন্তু তলে তলে প্রতিহিংসার অছিলা খোঁজে। শ্রীলা দেবী, আপনিও সেই নিয়মের বাইরে নন।

নিতান্ত শিশুকাল থেকে দেখে আসছেন, আপনাদের পরিবারে নিত্য অনটন, ওদের যথেষ্ট সাচ্ছল্য। একটু বড় হয়ে জানলেন, বনরেখা আপনার চেয়ে লেখাপড়ায় ভাল। ওকে হটিয়ে আপনি একবারও পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারলেন না। আরও বড় হয়ে আয়নায় দেখে আর নানা লোকের কথা শুনে টের পেলেন, বনরেখা আপনার চেয়ে রূপসীও। আগে শুধু ঈর্ষা ছিল, তখন থেকেই ঘৃণার শুরু, এই ঘৃণার বিষ হয়তো আপনার সচেতন মনের অগোচরে একটু একটু করে জমতে থাকল। ভাবতেন, ও যেন কোথায় আপনাকে বঞ্চনা করে, আপনাকে সব বিষয়ে হারিয়ে দিচ্ছে। সেই ঘৃণার পাত্র ছাপিয়ে পড়ল সেইদিন, যেদিন আপনারই বন্ধু প্রসাদ রায়কেও বনরেখা ছিনিয়ে নিল। প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রেও বনরেখা? সেদিন ওর চেয়ে বড় শত্ৰু আপনার কেউ ছিল না শ্রীলা দেবী।

আপনার গ্লানি চরমে পৌঁছল তখন, যখন বনরেখারই দয়ার দান একটা চাকরি আপনাকে হাত পেতে নিতে হল। সেখানেও সে হেড মিস্ট্রেস্, আপনি কেরানি মাত্র। সেখানে সে অনেক বড়, ঢের ওপরে। তার কাছে আপনার কৃতজ্ঞতা যত, তার প্রতি বিদ্বেষও তত। দেখুন, এই কৃতজ্ঞতার বোঝা যত বাড়ে, তত দুর্বহ হয়। যাকে ঘৃণা করি তার করুণা যেন ফাঁস হয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। তখন—তখন শ্রীলা দেবী, মনে হয় চিরজীবন একজনের কাছে ছোট হয়ে থাকার মত গ্লানি আর নেই। যারা মুখ বুঁজে সয়ে যেতে পারে, তারা বেঁচে যায়। যারা তা পারে না, তারা মুক্তির উপায় খোঁজে। যেমন আপনি খুঁজেছেন। ঘৃণায় অন্ধ আপনারই একটা সত্তা স্থির করেছে, আর নয়, ওকে যদি কোনক্রমে সরিয়ে দিতে পারি, তবে আবার মাথা তুলতে পারব সহজে।

অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলে উঠেছি, মৌলিক সাহেব, আমি একটা পশু।

না। মৌলিক সহানুভূতি দিয়ে আমার মাথায় হাত রেখেছেন। বললেন, না। আপনিও মানুষ। মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার বাসনাই আপনাকে নিষ্ঠুর আর অকৃতজ্ঞ করেছে—

শুনে অঝোরে কাঁদছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থন করে একটি কথাও বলিনি। আমার অপরাধ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে। তবু, জানি না কেন, হয়তো আমি স্ত্রীলোক বলেই, আমার প্রতি আদালতের করুণা হল, হয়তো প্রথম অপরাধ বলেও ; তিনি আমাকে প্রাণদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ দিলেন।

সেও আজ কত বছর হয়ে গেছে। আজ আমার কারও প্রতি কোন দ্বেষ নেই। মনে পড়ে পূর্ণেন্দু মৌলিককে, সেই ধীরোন্নত, বুদ্ধিদীপ্ত রূপ। না, তাঁর বিরুদ্ধে আমার কোন নালিশ নেই। বনরেখাকেও মনে পড়ে, তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছি বটে, কিন্তু তারপর থেকে সত্যিই তাকে ভালবাসতে পেরেছি।

সেই ভালবাসার প্রেরণাতেই তো আজ নির্জন সেলে বসে, লুকিয়ে কাগজ-কলম আনিয়ে লিখে দিলাম এই কাহিনী। আমার প্রিয়সখীর মৃত্যুর কাহিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *