1 of 2

আর এক ছায়া – সমরেশ বসু

আর এক ছায়া – সমরেশ বসু

এই ছোট মফঃস্বল শহরে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সংবাদটা রটে গেল, অনন্ত ঘোষদস্তিদারের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুধা, বিজনবাবুদের আলসেহীন চারতলার ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছে। এবং স্বয়ং অনন্তই নাকি পাশে বসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে সুধাকে। এবং সুধাকে ধাক্কা দিয়ে চারতলার ওপর থেকে ফেলে দেওয়ার পর, ছাদের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে, মৃগী রুগীর মত কাঁপতে থাকার ভান করেছিল।

সুধাকে বিয়ে করার মাত্র দু’ মাস আগে, অনন্তর প্রথম পক্ষের স্ত্রী বিমলা, কোন এক অজ্ঞাত কারণে আত্মহত্যা করেছিল। গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল সে। একটি চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিল, ‘বাঁচতে সাধ নেই। মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।—বিমলা।’

তখন প্রত্যক্ষ ভাবে কেউ অনন্তকে সন্দেহ না করলেও, পরোক্ষে একটা সংশয়ের ছায়া থেকে গিয়েছিল প্রতিবেশীদের মনে, হয়তো, কোন অতলস্পর্শী অন্ধকারে অনন্তর হাত রয়েছে এই আত্মহত্যায়। কেন এই সংশয় ছিল, তা কেউ পরিষ্কার করে বলতে পারত না হয়তো। তবে সংশয়ের মূলে সম্ভবত অনন্তর বিচিত্র চরিত্র।

অনন্ত একটি কারখানার স্টোরকীপার। মাইনে মোটামুটি মন্দ নয়। স্বামী-স্ত্রী, চাকর নিয়ে তার সংসার। কিন্তু সে বরাবরই একটি মস্ত বড় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থেকেছে। তার প্রথম পক্ষের এক বছরের বিবাহিত জীবনের মধ্যে, বিমলার কাছে সে-অভিযোগ অনেকেই শুনেছে, অতবড় বাড়িতে সে টিকতে পারে না। কিন্তু অনন্ত বাড়ি বদলায়নি। লোকের সঙ্গে মেলামেশা প্রায় নেই তার। কারো কারো বাড়ি সে বেড়াতে যায় ; তাও খুব কম। গাড়ি-ঘোড়ায় কেউ কোনদিন তাকে চাপতে দেখেনি। চেঁচিয়ে কথা বলতে শোনেনি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি কোনদিন। হঠাৎ, সামান্য কারণে চমকে ওঠা একটা বাতিকের মত তার।

তাছাড়া অনন্তর চেহারার মধ্যেও ধরাছোঁয়ার বাইরে কি একটা চাপা রয়ে গিয়েছে যেন। সেটা তার চোখের জন্যও হতে পারে। তার ডান চোখের পাতা খানিকটা প্যারালাইজড্। সে চোখটি কখনোই পুরোপুরি খোলে না। সামান্য একটু শাদা অংশ দেখা যায় মাত্র। বাঁ চোখটি পরিপূর্ণ খোলা। আয়ত, হয়তো সুন্দরও, কিন্তু সব সময় অপলক। মাংসল এবং খানিকটা ভাবলেশহীন মুখে, এই চোখ দুটি, একটি অদ্ভুত ছাপ ফুটিয়ে তুলেছে। ঢাকা-পড়া চোখের মতই, আরো অনেক কিছু যেন ঢাকা পড়ে আছে তার মুখে। তার মনের মধ্যেও। সেই সঙ্গে অত্যন্ত নিচু গলায়, অল্প কথা বলার বিচিত্র ধরণ-ধারণে, একটি অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ বলেই সবাই জানে তাকে।

চলে সে ধীরে। কথা বলে আস্তে। বলার চেয়ে একটা চোখের অপলক চাউনি মেলে, চিন্তিত চোখে চেয়ে থাকে সে অনেকক্ষণ। যেন সে কিছু ভাবে।

সবটা মিলিয়েই তার বৈশিষ্ট্য, আর এই বৈশিষ্ট্যই, বিমলার অজ্ঞাতকারণে আত্মহত্যার পেছনে একটা সন্দেহের উদ্রেক করেছিল অনন্তর প্রতি।

কিন্তু কোন প্রমাণ ছিল না। পুলিশও কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি।

তারপর বিমলার আত্মহত্যার মাত্র দু’ মাস বাদেই সুধাকে বিয়ে করে নিয়ে আসতে দেখে, লোকের কাছে আরো খারাপ লেগেছিল। আর সুধাকেও বিয়ে করেছে মাত্র ছ’ মাস।

আজ ছ’মাস তেরো দিন বিয়ে হয়েছে। আজই ছাদ থেকে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলেছে তার স্বামী অনন্ত।

বিজনবাবুর বারো বছরের মেয়ে ডলি বলেছে, সে ছাদের ধারে অনন্ত কাকা আর সুধা কাকীকে বসে থাকতে দেখেছিল। সুধা মরবার আগে বলে গিয়েছে, তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।

কে ফেলেছে ধাক্কা দিয়ে, সে-কথা বলার অবস্থা তার ছিল না। আর ভূত প্রেত কিছু যদি আবিষ্কার করা না যায়, তাহলে অনন্ত ছাড়া ধাক্কা দেবার আর কেউ ছিল না। আর সে প্রমাণও ডলি দিয়েছে।

এতদিনে সকলের সন্দেহ যেন একটা বাস্তব রূপ ধরে উঠল। অনন্ত ঘোষদস্তিদারকে হাতে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু কেন, ভেতরের সেই রহস্যটাই সবাই জানতে চায়।

থানায় বড় দারোগার সামনেই বসেছিল অনন্ত। তার বন্ধু কারখানার হেড ক্লার্ক বিজনবাবু বসেছিলেন অনেক দূরে। যেন ইচ্ছে করেই অনন্তর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দূরে বসেছেন। ডলি তার বাবার পাশেই। একটু দূরেই মেঝের ওপর, রক্তমাখা কাপড়ে ঢাকা, হাড়গোড় ভাঙা সুধার মৃতদেহ।

বড় দারোগা দীনেশবাবুর পাশেই মহকুমার নর্থ বিভাগের গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর বিবেকবাবু বসেছিলেন। তাঁর পাশে একজন পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর। সাব ইন্সপেক্টর একটি ছোট ধারালো ছুরি নিয়ে পেন্সিল কাটছিল, আর মাঝে মাঝে শুনছিল এদিকের কথাবার্তা।

বাইরে পাড়ার লোকজন অনেক ছিল। দীনেশবাবু কাউকেই ঢুকতে দেননি। তারা সব বাইরেই গণ্ডগোল করছিল।

বিবেকবাবু যেন প্রায় নির্বিকার ভাবেই তাকিয়ে ছিলেন অনন্ত ঘোষদস্তিদারের দিকে। মনে মনে একটু অবাক হচ্ছিলেন শুধু এই ভেবে, অনন্ত সাব ইন্সপেক্টরের পেন্সিল কাটার দিকে এত ঘন ঘন তাকাচ্ছে কেন?

বড় দারোগা দীনেশবাবুর চোখ আরক্ত। বোঝা যাচ্ছে, উনি ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। অনন্তকে ঘৃণা করতে শুরু করেছেন ইতিমধ্যেই। বিমলার আত্মহত্যার কেসটাও ওঁর হাতেই ছিল। অনন্তকে মনে-প্রাণে উনি সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও, কোন ক্লু খুঁজে পাননি। আজ শিকারকে অনেকখানি হাতের মুঠোয় পেয়ে উনি খুশি নন। বরং একটা জাতক্রোধ বাড়ছে ক্রমেই।

বিজনবাবুরও সেই অবস্থা। রাগের চেয়ে ওঁর ভয়ই বেশি। বিস্মিত ভয়ে তিনি ভাবছিলেন, কি করে এই সাংঘাতিক লোকটির সঙ্গে এতদিন সম্পর্ক রেখেছিলেন। কেমন করে এতখানি অন্ধ হয়ে ছিলেন।

অনন্ত বসেছে সামনের দিকে তাকিয়ে। তার অপলক বাঁ চোখের পাশে, ডান চোখের অনড় পাতাটা ক্রমেই যেন আরো মুদে আসছে। সে যেন আপ্রাণ চেষ্টা করছে, চোখের পাতাটা তোলবার। তাতে শুধু তার ডান দিকের গালের মাংসল পেশী কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু তার ভাবলেশহীন মাংসল মুখে কোন উত্তেজনা টের পাওয়া যায় না। ভয় কিংবা দুঃখ, কিছুই যেন ছায়াপাত করে না তার মুখে।

বিবেকবাবু দেখছিলেন, অনন্তর মুঠি পাকানো। ডান হাতের মুঠি সে ঘন ঘন খুলছে, বন্ধ করছে। আর সাব ইন্সপেক্টরের পেন্সিল কাটা ছুরির দিকে, যেন কোন অদৃশ্য শক্তি বারে বারে তার অপলক এক চোখের দৃষ্টি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কেন?

দীনেশবাবু বিজনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ, তারপর বলুন।

বিজনবাবু বললেন, হ্যাঁ, ওঁদের (অনন্তদের) বেড়াতে আসার কারণ জিজ্ঞেস করছিলেন তো? কোন কারণ নেই। এমনি, যেরকম সহকর্মীকে বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করা হয়, সেইভাবেই নিমন্ত্রণ করেছিলাম।

দীনেশবাবু—এরা ছাদে গিয়ে বসেছিলে কেন? বিজনবাবু—ছাদে বসেই চা খাবার কথা হয়েছিল। গরম কাল। আমার স্ত্রী বলল, ‘চল, ছাদে গিয়ে চা খাই। আমাকে বলল, তুমি অনন্তবাবু আর সুধাকে নিয়ে—’ মানে আমার স্ত্রী এর স্ত্রীকে নাম ধরেই ডাকত কিনা। বলল, ‘এদের নিয়ে তুমি ছাদে গিয়ে বস। আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি ঠাকুরকে দিয়ে। চা’টা নিজের হাতে করে নিয়ে যাচ্ছি।’ কিন্তু আমার তখনো গা ধোয়া হয়নি। সুধা, মানে এর স্ত্রী, আমিও তাকে নাম ধরেই ডাকতুম। সে আমাকে দাদা বলে ডাকত। আমার স্ত্রীকে বলত দিদি। মেয়েটি, কি বলব আপনাকে দারোগাবাবু, এমন মেয়ে—

বলতে বলতে বিজনবাবুর গলা ভয়ে ও দুঃখে ধরে এল। রক্তাক্ত মৃতদেহের দিকে একবার ফিরে দেখলেন।

দীনেশবাবু অনন্তর দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, বিজনবাবুকে বললেন, হ্যাঁ, সুধার কথা কি বলছিলেন?

বিজনবাবু—সুধা আমাকে বলল, ‘দাদা, আপনি গা ধুয়ে আসুন, দিদি চা করুক, আমরা ততক্ষণে ছাদে গিয়ে বসি।’ এ (অনন্ত) বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা তাই বসিগে, আপনারা তৈরি হয়ে আসুন।’ তারপরেই এরা ছাদে চলে গেছল।

ক’তলা ছাদ?

চারতলা।

এরকম সান্ধ্য চা-পান অতীতেও হয়েছে আপনাদের?

হ্যাঁ, আরো বার তিনেক হয়েছে।

তখনো কি এরা (অনন্তরা) একলা এরকম ছাদে গিয়ে বসেছে?

না। আমরা সব সময়ই সঙ্গে ছিলুম।

হুঁ। এই অনন্ত ঘোষদস্তিদারকে আপনি কতদিন ধরে জানেন?

পাঁচ বছর।

আলাপ কোথায়?

অফিসে।

এর প্রথম স্ত্রী বিমলাকে আপনি দেখেছিলেন?

হ্যাঁ। আমাদের বাড়ি বেড়াতেও আসত।

যেরকম সুধাও আসত?

না, অতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না তার সঙ্গে।

দীনেশবাবু চুপ করে খানিকক্ষণ লিখলেন।

সাব ইন্সপেক্টর তখন পেন্সিল কাটা রেখে, ছুরি দিয়ে নখ কাটছে। বিবেকবাবু দেখলেন, অনন্তর ডান হাতটা যেন ঠিক ছুরি ধরার ভঙ্গিতে শক্ত হয়ে উঠেছে।

বিবেকবাবু হঠাৎ বলে উঠলেন সাব ইন্সপেক্টরকে, অরুণবাবু, হাত কাটবেন।

অরুণবাবু চমকে গিয়ে, হেসে ফেলল। বলল, আপনার আবার এদিকেও নজর পড়ে গেল?

বিবেকবাবু হেসে বললেন, ভয় হল, হাত-টাত কেটে ফেলবেন শেষটায়। থাক না।

বিবেকবাবু বুঝতে পারছিলেন, অনন্ত তার একটি চোখের অপলক দৃষ্টিতে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে।

আর আশ্চর্য! অরুণ ছুরিটা বন্ধ করতেই, অনন্তর হাতের মুঠি শিথিল হয়ে গেল।

বিবেকবাবু ঠোঁট টিপে, আঙুল দিয়ে টেবিলে আপন মনে লিখলেন, yes!

দীনেশবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন বিজনবাবুকে, আপনি সুধার চিৎকার শুনতে পেয়েছিলেন?

বিজনবাবু—হ্যাঁ। আমি বাথরুমে ছিলাম। বাথরুমের কাছে খিড়কির উঠোনের শানের ওপরেই পড়েছিল সুধা। চিৎকার ঠিক নয়, মনে হয়েছিল, ছাদের ওপরেই যেন কে চেঁচিয়ে উঠল। পর মুহূর্তেই ধূপ করে শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখলুম—

বিবেকবাবু বলে উঠলেন, এক মিনিট! আপনি সুধাকে দেখলেন পড়ে আছে?

বিজন—হ্যাঁ।

বিবেক—ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন?

বিজন—হ্যাঁ। দেখলুম, অনন্তবাবু তাকিয়ে আছেন। অনেকক্ষণ পর নেমে আসেন।

বিবেক—এসে?

বিজন—সুধার গায়ে হাত দেন, আস্তে আস্তে ডাকেন। কিন্তু সুধা জবাব দেয়নি। তার মুখের কষ দিয়ে তখন রক্ত পড়ছে। মাথার চুলের গোছা ভেদ করে, ভলকে ভলকে রক্ত বেরোচ্ছে। কিন্তু চোখ তাকিয়েছিল, স্থির চোখে, যেন দৃষ্টি নেই। তার হাত-পা যেমন পড়েছিল, তেমনি ছিল। সে নাড়তে পারেনি। সুধা তখন মারা গেছে।

বিবেক—অনন্তবাবু আসবার আগে সুধা দেবী কতক্ষণ বেঁচে ছিলেন আর কি বলেছিলেন?

বিজনবাবু বললেন, পাঁচ মিনিট বেঁচেছিল। সুধা ঠোঁট নাড়ছিল। আমার স্ত্রী তাড়াতাড়ি তার মুখে একটু জল ঢেলে দেয়। জলটা খেয়েছিল বোধ হয়। তারপর হঠাৎ চোখ বড় বড় করে, জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে চেষ্টা করে। আমরা ঝুঁকে পড়েছিলুম তার দিকে। সুধা ভাঙা ভাঙা চাপা চাপা গলায় শুধু বলেছিল, ‘ধাক্কা, ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। ধাক্কা—ধাক্কা—’ তারপরে আর কথা বলতে পারেনি। পাঁচ মিনিট পরেই সুধা মারা যায়।

দীনেশবাবুর কলম দ্রুত চলেছে।

বিবেকবাবু দেখলেন, অনন্ত ভাবলেশহীন মুখে বিজনবাবুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু বাঁ চোখটা আরো বড় হয়ে উঠেছে যেন তার। ডান হাতটা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে। যেন বিজনবাবুর দিকে এগিয়ে নিতে চাইছে।

বিবেকবাবুর সঙ্গে সাব-ইন্সপেক্টরের চোখাচোখি হল। দুজনেই তাকিয়েছিল অনন্তর দিকে।

বিবেকবাবু ডলির দিকে ফিরে বললেন, তুমি ছাদে গিয়ে কি দেখেছিলে খুকি?

ডলি প্রথমে কথাই বলতে পারল না। কেশে কেশে, ঢোক গিলে গিলে বলল, আমি, বুণ্টু, খোকন, মীনু—সবাই উঠেছিলুম।

বিরেকবাবু—অত উঁচু ছাদ, আলসে নেই, তোমরা উঠেছিলে কেন? বাবা মা বারণ করেন না?

ডলি—হ্যাঁ। অনন্ত কাকা আর সুধা কাকী ছিলেন, তাই গেছলুম। আমি সিঁড়ি ঘরের দেয়ালের পাশে লুকিয়েছিলুম। বুণ্টুরা চুপি চুপি এসে যেই আমাকে ধরেছে, ঠিক সেই সময়—

বিবেকবাবু—তোমরা ওঁদের দুজনের কাছ থেকে কতদূরে ছিলে?

ডলি—অনেকখানি দূরে।

বিবেকবাবু—তুমি যেখানে লুকিয়েছিলে সেখান থেকে ওঁদের দেখতে পেয়েছিলে?

ডলি—হ্যাঁ।

ডলির মুখ একটু লাল হল যেন। যদিও তার মাত্র বারো বছর বয়স। বিজনবাবুর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নত করে বলল, সুধা কাকীর হাত ধরেছিলেন অনন্ত কাকা। সুধা কাকী হাসছিলেন যেন কেমন করে।

বিবেক—কেমন করে?

ডলি—যেন লজ্জা লজ্জা মতন।

বিবেক—তারপর?

ডলি—তারপর দেখলুম, সুধা কাকী পড়ে গেল, যেমনি ওরা এল। আমরা হাসছিলুম, চেঁচাচ্ছিলুম, আর সেই সময় সুধা কাকী ‘আঁ!’ করে উঠল। আর অনন্ত কাকার হাতটা তোলা ছিল।

বিবেক—কিরকম?

ডলি—এমনি করে।

বলে ডলি তার হাতটা কাঁধ বরাবর তুলে দেখাল। প্রায় যেন ট্রাফিক পুলিশের মত।

বিবেক—তারপর?

ডলি—উনি উঁকি দিয়ে দেখলেন যেন।

বিবেক—তারপর?

ডলি—উনি ছাদের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কিরকম করছিলেন।

বিবেক—কি রকম?

ডলি—যেন কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে মুখ ঘষছিলেন। যেন ফেলে দিয়ে, তারপর ভয় হয়েছিল অনন্তকাকার।

বিবেক—তারপর?

ডলি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। বিবেকবাবু বললেন, তোমরা কি করলে?

ডলি—আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে ছিলুম। দুড়দাড় করে নিচে, মা’র কাছে ছুটে গেছলুম।

বিবেক—হুঁ।

দীনেশবাবু তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন অনন্তের দিকে। অনন্ত তাকিয়ে ছিল ডলির দিকে। ডলি সেই এক চোখের দৃষ্টি থেকে ভয়ে মুখ ফিরিয়ে ছিল।

দীনেশবাবু অনন্তকে জিজ্ঞেস করলেন, এসব কথা সব সত্যি?

অনন্ত ঘাড় কাত করে সায় দিল।

দীনেশ—তাহলে, স্ত্রীকে মারার জন্যেই ছাদে নিয়ে গেছলেন?

অনন্ত বলল, না।

দীনেশ—ছাদে গিয়ে মতলব এঁটেছিলেন তাহলে?

অনন্ত—কিসের?

দীনেশ—খুন করবার?

অনন্ত—না।

দীনেশ—তবে কখন মতলব করেছিলেন?

অনন্ত—কিসের?

দীনেশবাবুর চোখ দপদপিয়ে উঠল। চাপা গলায় প্রায় হিসিয়ে উঠলেন, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবার?

অনন্ত—মতলব করিনি।

অনন্তর সুরহীন গোঙা-স্বরের মত গলায় যেন নিষ্ঠুর ও যান্ত্রিক জবাবদিহি। নির্ভয় শুধু নয়, নির্বিকারও বটে।

দীনেশ—তবে ধাক্কা দিয়েছিলেন কেন?

অনন্ত—ধাক্কা তো আমি দিইনি!

দীনেশ—তবে পড়ল কেমন করে?

অনন্ত—কি জানি!

বোধ হয় প্রচণ্ড রাগেই দীনেশবাবুর মুখ থেকে কয়েক মুহূর্ত কথা বেরোল না। তারপরে বললেন, আপনার স্ত্রী যে বলেছিলেন ‘ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে’ সেটা আপনিও শুনেছিলেন?

অনন্ত—না।

দীনেশ—সেটা কি মিথ্যে কথা?

অনন্ত—জানি নে।

দীনেশ—জানতে পারবেন।

অনন্ত—আজ্ঞে?

দীনেশবাবু বিবেকের দিকে তাকালেন। বললেন, তাহলে আজকের রাতটা থানার কাস্টোডিতেই রাখা যাক, আগামী কাল সাবডিভিশনাল—

বিবেক হঠাৎ বললেন, না, ছেড়ে দিন। বাড়িতে যাক।

সকলেই বিস্ময়ে চমকে উঠল। দীনেশ বললেন, বেল দিতে বলছেন?

বিবেক—হ্যাঁ।

দীনেশ—তারপর?

বিবেক—দেখা যাক।

কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ। বিবেকের চোখের দিকে তাকিয়ে দীনেশবাবু আর আপত্তি করলেন না। উকিল ডাকিয়ে বেল দেবার ব্যবস্থা হল।

বিবেক বললেন অনন্তকে, বাড়ি যেতে পারেন।

অনন্ত বিজনবাবুর দিকে ফিরে বলল, এখন আর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না বিজনবাবু। আজকের রাতটা আপনার বাড়িতেই থাকতে দিন আমাকে।

বিজনবাবু যেন উদ্যত যমকে দেখে আঁতকে উঠলেন, আমার বাড়িতে?

অনন্ত তেমনি সুরহীন গলাতেই যেন অনেক দূর থেকে বলল, হ্যাঁ, আমার বাড়িতে আজ একলা থাকতে বড় কষ্ট হবে।

বিজনবাবু অসহায়ের মত তাকালেন দীনেশবাবুর দিকে।

বিবেকবাবু বললেন অনন্তকে, কষ্ট হলেও আজ আপনাকে আপনার বাড়িতেই যেতে হবে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে অনন্ত তাকিয়ে রইল বিবেকবাবুর দিকে। তারপর বললে, ও, আচ্ছা।

সুধার মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

তিন দিন পরে।

বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষের রাত। রাত প্রায় বারোটা। দখিনা বাতাস যেন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে রাতের এই নিরালা অন্ধকারে। কোথায় একটা রাতের পাখি টেনে টেনে দুর্বোধ্য কাকলী গাইছে।

বিবেকবাবু এসে দাঁড়ালেন অনন্তর বাগানওয়ালা সেকেলে মস্ত বড় বাড়িটার সামনে। এসে দেখলেন, সদর দরজাটা হাট করে খোলা। একটু অবাক হলেন। তারপর ঠোঁট টিপে হাসলেন।

সাব ইন্সপেক্টর অরুণ সঙ্গে ছিল। সে বড় বড় চোখে ফিসফিসিয়ে বলল, মালী তাহলে ইচ্ছে করেই দরজা খুলে রেখেছে?

বিবেক—বোধ হয়।

অরুণ—আন্দাজ করেছে তাহলে আপনি আসতে পারেন।

বিবেক—হয়তো। আপনি চলে যান অরুণবাবু।

অরুণ—আপনি?

বিবেক—আমি ভেতরে যাব।

অরুণ—একলা? একটা বিপদ-আপদ যদি কিছু ঘটে?

বিবেক—এখন কিছু ঘটবে না। আপনি যান।

বলে বিবেক সদর দরজা পেরিয়ে বাগানে ঢুকলেন।

কোন দরজা-জানলাতেই আলো দেখা যায় না। মস্ত বড় বাড়িটা যেন কিম্ভুতাকৃতি প্রেতের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বিবেক দেখলেন, বৈঠকখানার দরজাও খোলা। টর্চ জ্বেলে দেখলেন, দোতলায় ওঠবার সিঁড়ির দরজাও বন্ধ নেই। এদিক-ওদিক দেখে ওপরে উঠলেন বিবেক। দোতলার বারান্দা-সংলগ্ন তিনটি ঘর। মনে হল তিনটি ঘরেরই দরজা খোলা।

বিবেকের ভ্রূ কুঁচকে উঠল : পালাল নাকি?

প্রথম ঘরটায় ঢুকলেন তিনি। বসবার ঘর। টর্চের আলোয় চারদিকটা দেখে নিয়ে ঘরের এক কোণে টেবিলের ওপর তাকালেন বিবেক। দুটো ফটো। একটা অনন্ত আর সুধার। অনন্তর মুখটা ফটোগ্রাফার কায়দা করে এমন অ্যাঙ্গেল থেকে নিয়েছে, যাতে ডান চোখটা দেখা না যায়। কিন্তু আর একটা ফটো কার? একটি যুবকের ফটো, মুখখানি সব মিলিয়ে বেশ ভালই।

বিবেকের মনে হল, কোথায় যেন একে দেখেছেন। চেনা-চেনা লাগছে মুখখানি। এই অঞ্চলেরই ছেলে কিনা, খেয়াল করতে পারলেন না ঠিক। অনন্তর আত্মীয় কিংবা ভাই হওয়ারও কথা নয়। কারণ, তার কেউ নেই বলেই সবাই জানে। যার ফটো, সে নিশ্চয়ই আপন। নইলে স্বামী-স্ত্রীর ফটোর পাশে এর জায়গা মিলত না।

বিবেক ফটো থেকে মুখ ফিরিয়ে, দরজার দিকে ফিরতেই, চমকে উঠলেন। দরজায় মানুষের মূর্তি। চকিতে ডান হাত পকেটে ঢুকিয়ে, মূর্তির মুখের ওপর টর্চের আলো ফেললেন।

অনন্ত।

অনন্ত হাত দিয়ে চোখ ঢাকা দিল। সুইচের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, কে?

বিবেক বললেন, আমি।

অনন্ত সুইচ টিপে বিবেকের দিকে তাকাল। বিবেক দেখলেন, ঘুম থেকে উঠে আসার মত অবস্থা নয় মোটেই অনন্তর। যদিও চুল উস্কোখুস্কো। কোঁচাটা মাটিতে লুটোচ্ছে। ঢোলা হাতা আদ্দির পাঞ্জাবিটার সোনার বোতামগুলি খোলা।

ডান চোখটা তার এখন একেবারেই বোজা। বাঁ চোখটা যেন অনেক বেশি বড় আর সাপের মত অপলক মনে হল। অনন্ত বলল, আপনি?

বিবেক—হ্যাঁ।

অনন্তর সেই একই সুরহীন, দূরাগত ধ্বনির মত গলা। বলল, আমি মনে করেছিলাম চোর।

বিবেক বললেন, না, চোর নই ; তবে চোরের মতই এসেছি!

অনন্তর ডান দিকের গালের পেশী কেঁপে উঠল। বলল, খুনীকে ধরতে?

বিবেক হেসে বললেন, না, কথা বলতে। আপনার দরজা খোলা দেখে আর ডাকিনি। নইলে ডাকতুম। কিন্তু এভাবে খুলে রেখেছেন, চোর তো আসতে পারত।

অনন্ত বলল, তা আসতে পারত। তবে আমি তো জেগেই থাকি। ঘুম আসে না।

বিবেক—কেন?

অনন্ত সুরহীন নির্বিকার গলায় বলল, সুধার কথা মনে পড়ে।

বিবেক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইলেন অনন্তর দিকে। অনন্ত তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে বলল, বসবেন, না অন্য ঘরে যাবেন?

বিবেক বললেন, আপনার শোবার ঘরে একবার যেতে চাই।

চলুন।

অনন্ত আগে আগে গেল একেবারে শেষ কোণের ঘরটায়। আলো জ্বালল।

বিবেক এলেন। এদিক-ওদিক দেখে আলমারির মধ্যে একটি অদ্ভুত ফটো ওঁর নজরে পড়ল। এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, একটি পুরুষ পিছন ফিরে বসে আছে। তার পিঠে হেলান দিয়ে একটি মেয়ে, সামনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। মেয়েটি সুধাই। মাথায় তার ঘোমটা নেই।

বিবেক ফটোটা দেখিয়ে বললেন, আপনার স্ত্রী না?

হ্যাঁ।

ভদ্রলোকটি কে?

আমি।

বিবেক সন্দিগ্ধ চোখে অনন্তর দিকে ফিরে বললেন, আপনি?

হ্যাঁ।

যেন পিছন-ফেরা পুরুষ মূর্তিটার সঙ্গে অনন্তকে মেলাবার চেষ্টা করলেন বিবেক। কিন্তু মেলাতে পারলেন না। বললেন, কে তুলেছিল ফটোটা?

সুধার জামাইবাবু।

কোথায় থাকেন তিনি?

পাটনা।

নাম?

কিষণলাল ঝা।

ঝা! বিহারী?

মৈথিলী।

কি করেন ভদ্রলোক?

ব্যবসা করেন।

কিসের ব্যবসা?

ঠিক জানি নে।

আপনি কখনো পাটনায় যাননি?

একবার। বিয়ে করতে। কিষণবাবুর বাড়িতেই বিয়ে হয়েছিল।

কিষণলাল আপনার স্ত্রীর ছোট বোনের স্বামী?

না, বড় বোনের। শুনেছি প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল।

হুঁ। ঝা কতবার এসেছেন এখানে?

বার তিনেক।

এই ছ’ মাসের মধ্যে?

হ্যাঁ।

হুঁ।

একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন বিবেক, আপনার প্রথম স্ত্রীর কোন ফটো নেই? আছে, অন্য ঘরে।

চলুন, একটু দেখি! আপনি যখন জেগেই থাকেন, তখন এত রাত্রে বিরক্ত হচ্ছেন না নিশ্চয়?

অনন্ত কোন জবাব দিল না।

মাঝের ঘরে এসে বিমলার ফটো দেখতে দেখতে হঠাৎ বিবেক জিজ্ঞেস করলেন, বৈদিকপাড়ার গেনুকে চেনেন আপনি?

গেনু?

প্রশ্ন করতেই অনন্ত মুখটা অন্যদিকে ফেরাল। বলল, গেনু কি?

বিবেক অনন্তর পিছন দিকেই তাকিয়ে বললেন, গেনু ওরফে জ্ঞান পাঠক।

অনন্ত খুব নিচু অথচ পরিষ্কার গলায় বলল, চিনি নে।

আপনার প্রথম স্ত্রী বিমলা দেবী চিনতেন?

জানি নে।

বিবেক পরিষ্কার গলায় প্রায় হুকুমের সুরে বললেন, অনন্তবাবু, আপনি দয়া করে এদিকে ফিরে কথা বলুন।

অনন্ত ফিরল, কিন্তু তার একটি চোখের দৃষ্টি বিবেকের দিকে নয়। সামনে, দেয়ালের দিকে।

বিবেক বললেন, বিমলা দেবী তো বৈদিকপাড়ারই মেয়ে ছিলেন?

হ্যাঁ।

গেনুবাবু কি আপনার স্ত্রীর বাল্যের বন্ধু ছিলেন না?

জানি নে।

লুকোচ্ছেন কেন? বিমলা দেবীর সঙ্গে গেনুবাবুর যুগল ফটো দেখেননি আপনি কোনদিন? বিমলা দেবীর সুটকেশ থেকে সেটা তো আপনি আবিষ্কার করেছিলেন, নয় কি?

আমি জানি নে।

বিবেক হাসলেন। বললেন, না জানলে চলবে কি করে অনন্তবাবু। গেনুবাবু তো বিয়ের পর প্রথম প্রথম আপনার বাড়িতেও এসেছেন।

নিরুত্তেজ গলাতেই বলল অনন্ত, এসে থাকলেও, আমি জানি নে।

জানেন। বিমলা দেবী সহ, গেনুবাবুর সঙ্গে আপনি সিনেমায় গেছেন বার দুয়েক।

মনে পড়ছে না।

মনে পড়ত, যদি না আপনি গেনু পাঠককে ঘৃণা করতেন। গেনু আপনার স্ত্রীর প্রেমিক ছিলেন।

অনন্ত সরে গিয়ে, একটি চেয়ারে বসল। বলল, এসব কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না।

তা স্বাভাবিক। তবে, আপনার চাপবার কিছু নেই। দেখুন তো, এই হাতের লেখা চিনতে পারেন?

অনন্তর এক চোখের নজর পড়ল কাগজের গোছার ওপর। আর ডান দিকের গালের মাংসপেশী কেঁপে উঠল। বলল, চিনি, বিমলার।

কাকে লেখা নিশ্চয় জানেন?

না।

জানেন, বলতে চান না। গেনুবাবুকেই লেখা। আর, বিমলা দেবী মরবার আগে, দুটি চিঠি দিয়ে গিয়েছিলেন। একটি ‘মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’, অপরটি আজো অনাবিষ্কৃত রয়েছে। নয় কি?

অনন্ত বলল, কি করে জানব বলুন!

আপনার কাছে নেই তো?

না।

থাকলেও আপনি দেখাতে চান না। কিন্তু অসুখ-বিসুখ হলে, ডাক্তারকে যেমন সব কথা পরিষ্কার খুলে বলা ভাল, এখানেও তাই হওয়া উচিত।

অনন্ত উঠে দাঁড়াল। বিবেকের মুখের দিকে তার এক চোখের দৃষ্টি পড়ল সার্চলাইটের মত। বলল, নইলে বিমলার মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করবেন, এই তো?

না, সরাসরি দায়ী করা যায় না। তবে, দায় আপনার একটু থেকে যায়!

বলে বিমলার একটি চিঠির এক জায়গা পড়লেন বিবেক, ‘আমি যার জ্বালার কারণ, আমি মরলেই যে মানুষ মুক্তি পায়, তাকে আমি আসল কথাটি জানাতে চাই। মুখে নয়, লিখে। যে-কথা তোমাকে লিখে লাভ নেই।’ হয়তো আপনি সেই ‘মানুষ’ অনন্তবাবু, যার ‘জ্বালা’ ছিল, ‘মুক্তির’ও প্রয়োজন ছিল, যাকে বিমলা দেবী আসল কথাটি লিখে রেখে গেলেন। ‘যে-মানুষকে’ মনে করা যায়, ‘জ্বালা’ জুড়োবার জন্য এবং ‘মুক্তির’ জন্য, বিমলা দেবীকে গলায় দড়ি দিতে বাধ্য করেছে সে। হয়তো সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই সেই ‘মানুষ’ বিমলা দেবীর গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলা দেখেছে।

বিবেক কথাগুলি বলছিলেন অনন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে। তিনি দেখছিলেন, অনন্তর ডান দিকের গালের মাংসের দ্রুত কম্পন। আর খোলা চোখের অপলক চাউনিটাকে কেমন যেন কুৎসিত মনে হতে লাগল। যদিও বাঁ চোখটাই কুৎসিত অনন্তর। আর বাঁ চোখটার জন্যেই ডান চোখটা অনেক বড়, ঠাণ্ডা নির্নিমেষ কিন্তু কঠিন বলে মনে হয়।

অনন্তর গলার স্বরটা যেন আরো মোটা ও গোঙা শোনাল। বলল, তাহলে সেইটেই প্রমাণ করার চেষ্টা করুন।

বিবেক বললেন, তার জন্যে কোন আজেবাজে কিছু প্রমাণ করতে চাই নে। সত্যটাকেই প্রমাণ করতে চাই। তাতে আপনার সাহায্য চাই। আচ্ছা, আপনি অফিসে যাচ্ছেন না কেন?

ভাল লাগে না।

একটু চুপ করে থেকে বিবেক, বললেন, আচ্ছা অনন্তবাবু, ডলি যে বলছিল, সুধা দেবীও পড়ে গেলেন আর আপনার হাতটা উঠে ছিল,তখনও, এটা কি ঠিক?

অনন্ত কি ভেবে যেন বলল, বোধ হয়।

আজ আপনি কি স্থির নিশ্চিত, ধাক্কা দেননি?

অনন্ত নীরব।

বলুন অনন্তবাবু।

কি বলব?

আপনি নিশ্চিত জানেন, আপনি ধাক্কা দেননি?

আমি ধাক্কা দিলে, আমি জানব না?

তাহলে দেননি?

না।

আচ্ছা, আপনার ভায়রাভাই কিষণলাল ঝায়ের সঙ্গে আপনার আলাপ কেমন?

প্রশ্নের দ্রুত পরিবর্তনে সহসা খেই পাওয়া যায় না।

অনন্ত—মোটামুটি।

ছ’মাসের মধ্যেই, তিনবার এসেছিলেন কেন? শালীর সান্নিধ্যের জন্যে, না আপনার?

মানে?

মানে, সুধা দেবীর সঙ্গে কি রকম ভাব ছিল কিষণলালবাবুর?

যে-রকম থাকা উচিত।

অর্থাৎ শালী ভগ্নিপতির মতই, না? আপনার কি রকম লাগত তাকে?

ভাল।

আপনার সঙ্গে সুধা দেবীর বিয়ের আগেও কি এ অঞ্চলে যাতায়াত ছিল এই কিষণলালের?

জিজ্ঞেস করিনি।

এসে ক’দিন থাকতেন?

দু-একদিন।

আপনার শালী, অর্থাৎ সুধা দেবীর দিদিও সঙ্গে আসতেন?

একবার এসেছিলেন।

বিবেকবাবু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আচ্ছা, চলি। একেবারে এভাবে সব খুলে রাখবেন না। সত্যি সত্যি চুরি-চামারি হতে পারে। যা দিনকাল।

বিবেক চলে গেলেন। অনন্ত তেমনি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

রাত্রি দুটোর ঘণ্টা বাজল পেটা ঘড়িতে।

বিজনবাবুর বাড়ি। বাইরের ঘরে বিজনবাবু, তাঁর স্ত্রী যমুনা আর বিবেক বসেছিলেন।

বিবেক বললেন, আপনারা তো অনেকদিন ধরেই চেনেন অনন্তকে। বিমলার আত্মহত্যার ব্যাপারে সকলের মনেই একটা খটকা ছিল। আপনাদের ছিল না?

বিজনবাবু বললেন, দেখুন, সত্যি কথা বলতে কি, বিমলার আত্মহত্যার একটা কারণ আমরা মোটামুটি জানি।

বিবেক—যথা?

বিজন—শুনেছিলুম, বৈদিকপাড়ার গেনু পাঠকের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। তাকে না পাওয়ার দরুনই সে আত্মহত্যা করেছে, আমাদের ধারণা।

বিবেক—কিংবা ধরুন, অনন্ত তাকে মরতে বলেছিল। হিংসায় ও রাগে, সে হয়তো গলায় দড়ি দিতে বাধ্য করেছিল বিমলাকে।

বিজনবাবু ও যমুনা একসঙ্গে সভয়ে বলে উঠলেন, এখন তো আমাদের সেই সন্দেহই হচ্ছে।

বিবেক—কবে থেকে মনে হচ্ছে?

যমুনা—সুধার ব্যাপারের পর থেকে।

বিবেক—আচ্ছা, সুধারও এরকম গেনুবাবু কেউ ছিল না তো?

ওঁরা স্বামী-স্ত্রীতে একবার চোখাচোখি করলেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। যমুনা বললেন, না, কখনো কিছু টের পাইনি তো!

বিবেক—সুধার ভগ্নিপতিকে আপনারা চিনতেন?

বিজন—হ্যাঁ।

বিবেক—এসেছেন কখনো আপনাদের বাড়িতে?

যমুনা—একবার এসেছেন।

বিবেক—আচ্ছা, উনি সুধার বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে, পাটনা থেকে তিনবার এখানে এলেন কেন, কিছু বলতে পারেন? বিশেষ কিছু না থাকলে, শুধু শুধু পাটনা থেকে এতবার আসা, কেমনতর নয় কি?

যমুনা—ঠিক বলতে পারি নে। তবে সুধার মুখে শুনেছি, উনি এদিকে আগেও আসতেন। কি সব ব্যবসা নাকি তাঁর আছে।

বিবেক—কিসের ব্যবসা?

যমুনা—সেটা কোনদিন বলেননি, আমি জিজ্ঞেস করিনি। তবে, কিষণলালবাবু নাকি সুধাকে বলতেন, ‘মিচ্‌কী, তোর এখানে বিয়ে হয়ে, ভায়রাভাইয়ের দৌলতে আমার হোটেল খরচাটা বেঁচে যাচ্ছে।’ তবে—

যমুনা বিজনবাবুর দিকে তাকালেন।

বিবেক বললেন, তবে কি, বলুন। চাপবেন না কিছু।

যমুনা—সুধা ওর জামাইবাবুর ব্যবসাটা ভাল চোখে দেখত না। সুধাকে বলতে শুনেছি, ‘কোন্‌দিন হাতকড়া পড়বে দেখছি।’

বিবেক হেসে বললেন, গাঁজা নাকি?

ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অবাক হয়ে বললেন, গাঁজা?

বিবেক—আপনারা ‘গাঁজা’ ছাড়েননি আমাকে। আমি কিষণলালের কথাই বলছি। মৈথিলী যখন, তখন দ্বারভাঙ্গা জেলাতেই নিশ্চয় বাড়ি। আর দ্বারভাঙ্গার পরেই নেপাল সীমানা, গাঁজারই রাজ্য। ওদিকের লোকেরা গাঁজা স্মাগ্‌ল সিদ্ধহস্ত। সেই ভেবেই বলছি। সেসব যাকগে, সুধার কাছ থেকে কখনো এমন কিছু শুনেছেন, যা সন্দেহজনক মনে হয়?

যমুনা বললেন, শুনেছি। আগে সন্দেহ হত না, এখন হয়।

বিবেক—যেমন?

যমুনা—যেমন ধরুন, সুধা একদিন বলেছিল, ‘দেখুন যমুনাদি, আপনার দেওরটি (অনন্তর) মাথায় একটু গোলমাল আছে।’ আমি বললুম, ‘কেন?’ সুধা বললে, ‘সেদিন চান করে কাপড়টা পাকাচ্ছি উঁচু তারে ছুঁড়ে দেব বলে। উনিও (অনন্ত) আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। যেই একটু লাফ দিয়ে উঠে কাপড়টা ছুঁড়েছি, অমনি উনি আমাকে এমন ল্যাং মেরেছেন যে আমি ছিটকে পড়ে গেছি। আর একটু হলে আমার মাথা ফেটে যেত।’

বিবেকের দুই চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। বললেন, তারপর?

যমুনা—আমি বললুম, ‘সেকি?’ সুধা বলল, ‘হ্যাঁ, আমার ভীষণ লেগেছিল। খুব রাগ হয়েছিল আমার। এ আবার কেমন ঠাট্টা! কিন্তু উনি (অনন্ত) হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন, যেন কিছুই জানেন না। কেমন যেন ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে কাঁপতে লাগলেন। জানেন যমুনাদি, উনি যেন কেমন। সত্যি তো আর উনি আমাকে মারতে পারেন না। আর মেরে মিথ্যে কথাই বা বলবেন কেন শুধু শুধু? কিন্তু আমি ভাবি, কে তাহলে এরকম মারল আমাকে? আমি যে স্পষ্ট দেখলুম, উনি মারলেন। তারপর নিজেরই হাসি পেতে লাগল।’ আমি বললুম, ‘তোমার বোধ হয় মাথা ঘুরে গেছল সুধা।’ সুধা বলল, ‘তাই হবে।’

বিবেক যদিও তাকিয়ে ছিলেন যমুনার দিকে, তবু তাঁর চোখে চিন্তার ঘোর। চিন্তিত সুরেই জিজ্ঞেস করলেন, এতে আপনি সন্দেহজনক কি দেখতে পাচ্ছেন যমুনা দেবী?

যমুনা দৃঢ়স্বরে বললেন, আমার বিশ্বাস, অনন্ত সুধাকে ইচ্ছে করেই ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিল। আপনি ওদের বাড়ির ভেতরের শান বাঁধানো উঠোন দেখেননি। কী ভীষণ পেছল! এমনিতেই মনে হয়, পড়ে গেলে হাড়গোড় ভেঙে যাবে। তাছাড়া, আরো এরকম ঘটেছে।

বিবেক উৎসুক হয়ে উঠলেন। বললেন, বলুন।

যমুনা বললেন, ওদের দোতলার বারান্দার দক্ষিণ দিকে একটা স্বর্ণচাঁপা গাছ আছে। সুধাই আমাকে বলেছিল, ‘দেখুন যমুনাদি, আজকে সারাদিন রাগারাগি হয়েছে আমাদের।’ আমি বললুম, ‘কেন?’ সুধা বললে, ‘এ কিরকম মাথা খারাপ লোক দেখুন দিকিনি! জামাইবাবু কিষণলাল বসেছিলেন বারান্দার চেয়ারে। আমি রেলিং-এ বুক চেপে ঝুঁকে, একটা চাঁপা ফুল হাত দিয়ে নাগাল পাবার চেষ্টা করছি। উনি (অনন্ত) আমার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি যত বলছি, তুমি সরো ; উনি তত আমার দিকে চেপে আসছেন, আর বলছেন, তুমি ছেড়ে দাও, আমি দেখছি। আমি ওঁর কথা শুনিনি। হাত বাড়িয়ে আমি একটা সরু ডাল তখন ধরেছি। জামাইবাবু হাসছিলেন। ডালটাকে ধরে ধরে টেনে টেনে, অনেকটা কাছে এনেছি, আর উনি (অনন্ত) যেন কিরকম শক্ত হয়ে উঠছিলেন। ফুলটা প্রায় এসে গেছে হাতের কাছে, ধরব-ধরব করছি, এমন সময় হঠাৎ ডালটা মট করে ভেঙে গেল। আমি যেই চমকে গেছি, আর উনি (অনন্ত) আমাকে এমন জোরে ধাক্কা দিয়েছেন যে আমি বারান্দার ওপর ধপাস করে পড়ে গেছি। এই দেখুন না, আমার কপাল ঠুকে গেছে। ঊরুতেও কিরকম ব্যথা হয়েছে। আমি ওঁকে বললুম, ধাক্কা দিলে কেন? উনি বোকার মত তাকিয়ে দেওয়ালের গায়ে চেপে কাঁপতে লাগলেন, আর বললেন, কোথায় ধাক্কা দিলুম?····এসবের মানে কি যমুনাদি? যদি আমি নিচের দিকে পড়তুম তাহলে তো মারা যেতুম। উনি কি আমাকে মেরে ফেলতে চান? আমি রাগ করে কথা বলিনি। জামাইবাবু ধাক্কা দিতে দেখেননি, তাই উনি বোকার মত চুপ করে ছিলেন।’ যমুনা একটু দম নিয়ে বললেন, আমি বললুম সুধাকে, ‘তারপর রাগ কমল কি করে?’ সুধা বললে, ‘কি করে আবার! উনি (অনন্ত) আমার কাছে বারে বারে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। বললেন, ‘বিশ্বাস করো সুধা, কিভাবে হয়তো লেগে গেছে, আমি তোমাকে ধাক্কা দিইনি। তারপরে অবশ্য আমারও মনে হতে লাগল, সত্যিই তো, শুধু শুধু উনি আমাকে ধাক্কা দিতে যাবেন কেন? মাথা খারাপ তো নয়। তারপর আঁকশি তৈরি করে নিজেই ফুলটা পেড়ে দিয়েছেন।’

যমুনা না থেমেই বললেন, আমি বেশ বুঝতে পারছি, সুধাকে মারবার প্ল্যান অনন্তর আগে থেকেই ছিল। নইলে ওরকম ভাবে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে না। আর মৃগী রুগীর মত ভাবটা ওর নির্ঘাৎ বদমায়েসি। কই, আমাদের সামনে তো কখনো ওসব হয় না। তারপরে হয়তো ভেবেছে, ওখানে সুবিধে হবে না। আরো উঁচু জায়গা চাই। তাই, এ বাড়ি বেছে নিয়েছিল।

বিবেক যমুনা ও বিজনবাবুর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বললেন, আপনাদের দৃঢ় বিশ্বাস, অনন্ত সুধাকে মারতেই চেয়েছিল?

বিজন—নইলে এসবের মানে কি থাকতে পারে বিবেকবাবু? এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে, আমাদের ছাদের ঘটনার সাদৃশ্য নেই কি?

বিবেক—নিশ্চয় আছে। খুব বেশি রকম আছে। একই ঘটনা, কেবল স্থান বদলানো হয়েছে। কখনো শান-বাঁধানো উঠোনে, কখনো দোতলার বারান্দায়, শেষ পর্যন্ত চারতলার ওপরে। কিন্তু একই ব্যাপার। কিন্তু কেন বলতে পারেন?

বিজন—কিসের কেন?

বিবেক—এই সুধাকে মেরে ফেলার ইচ্ছে? কেন অনন্ত সুধাকে মারতে চেয়েছিল?

বিজন—সেটা তো আমরাও ভেবে পাচ্ছি নে।

যমুনা—এমন কি, বিমলার মত সুধার কোন গোলমাল ছিল না।

বিবেক—কি করে জানলেন?

যমুনা—মেয়েমানুষেরা সেটা সহজেই বুঝতে পারে বিবেকবাবু। আমি বুঝতে পারছি, আপনি কিষণলালবাবুকে সন্দেহ করছেন। কিন্তু আমি বলছি, কিষণলালের প্রতি সুধার কিছুমাত্র আসক্তি ছিল না। বরং অপছন্দই করত।

বিবেক—অনন্ত হয়তো সন্দেহ করত।

যমুনা—তাহলে বলতে হবে, সে একটি গাড়ল।

বিবেক গালে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ ভাবলেন। তারপরে হঠাৎ বললেন, ডলিকে একটু ডেকে দিন।

ডলি এল।

বিবেক—আচ্ছা ডলি, তুমি লুকিয়েছিলে দেয়ালের পাশে, কেমন?

ডলি—হ্যাঁ।

বিবেক—একেবারে চুপটি করে, না?

ডলি—হ্যাঁ।

বিবেক—তারপরে বুণ্টুরা এল, কেমন?

ডলি—হ্যাঁ।

বিবেক—এসেই ওরা চিৎকার করে উঠল, ‘পেয়েছি পেয়েছি’, না?

ডলি—হ্যাঁ, হ্যাঁ।

বিবেক—তুমিও খুব জোরে হেসে উঠলে?

ডলি—হ্যাঁ।

বিবেক—হঠাৎ, মানে আচমকা তোমরা সবাই হেসে চিৎকার করে উঠেছিলে, কেমন?

ডলি—হ্যাঁ, আচমকা।

বিবেক—আর ঠিক তখুনি····

ডলি—সুধা কাকী পড়ে গেল।

বিবেক—আর অনন্ত কাকার হাতটা ওঠানো।

ডলি—হ্যাঁ।

বিবেক—তারপর?

ডলি—তারপর উনি ছাদের ওপর পড়ে কেমন করতে লাগলেন।

বিবেক—হুঁ। আচ্ছা, তুমি যাও।

বিজনবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন বিবেকবাবু, আচ্ছা, কতক্ষণ পর অনন্তবাবু ছাদ থেকে নেমে এসেছিলেন?

বিজন—প্রায় কুড়ি মিনিট পর, যখন আমি ডাকলাম। তখনো অনন্ত যেন ধরা পড়ার ভয়ে কিরকম করছিল।

আবার খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন বিবেক। তারপর বললেন, অদ্ভুত!

যমুনা—কি অদ্ভুত?

বিবেক—এই অনন্ত ঘোষদস্তিদার।

বিজন—অদ্ভুত কি মশাই, সর্বনেশে!

বিবেক—তাই বটে। ভয়ে আমি সেই জন্যেই ওকে কাস্টোডিতেই রাখার অর্ডার দিয়েছি পরশু। কারণ পালাবার কথা ও ভাবছিল।

যমুনা—কোন্‌ সাহসে আপনি ওকে বাইরে রেখেছিলেন, তাইতেই অবাক হচ্ছিলাম।

বিবেক—ওকে একটু ভাল করে বোঝবার জন্যে। কিন্তু এ জায়গা অনন্ত ছাড়বার প্ল্যান করছিল। হয়তো লোয়ার কোর্টেই ওর শাস্তিবিধান হয়ে যাবে। হায়ার কোর্টে আপীলের সুযোগ দেওয়া হবে না। কারণ, ব্যাপারটাকে সবাই cold blooded murder বলেই মনে করছেন। আচ্ছা, আরেকটা কথা, দোতলায় উঠে প্রথম ঘরেই, অনন্ত আর সুধার ফটোর কাছে, আরেকজন কার ফটো রয়েছে, জানেন?

যমুনা—দেখতে বেশ ভাল একটি ছেলের তো?

বিবেক—হ্যাঁ।

যমুনা—ওটা তো অনন্তরই।

বিবেক—অনন্তর?

যমুনা—হ্যাঁ, তাই তো জানি। ঢাকায় তোলা ফটো, অনন্তর বি· এ· পরীক্ষার সময়।

বিবেক—তখন তো অনন্তর চোখ এরকম ছিল না!

বিজন—সে আরেক কাহিনী। মাজদিয়ার বিখ্যাত ট্রেন কলিশনের কথা আপনার মনে আছে?

বিবেক—ঢাকা মেল আর নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস তো?

বিজন—হ্যাঁ। সেই ট্রেনে অনন্ত ছিল। অনন্তর বাবা, মা, একমাত্র দাদা আর বউদি। অ্যাক্সিডেন্টে সবাই মারা যায়। অনন্তকে উদ্ধার করা হয়, অজ্ঞান অবস্থায়। তখনো ওর কাঁধে একটা কাঠের গোঁজা বিঁধেছিল। অনন্ত আস্তে আস্তে ভাল হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু তিন মাস ও চোখের পাতা খুলতে পারেনি। ডাক্তাররা নাকি বলেছিল, অজ্ঞান হবার আগে এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেছিল অনন্ত যে, ভয়ে সেই যে চোখ বন্ধ করেছে, আর খুলতে চায়নি। হয়তো ও অন্ধ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তিন মাস বাদে যখন অনন্ত একটু একটু করে চোখ খুলতে লাগল, তখন টের পাওয়া গেল, ওর ডান চোখের পাতাটা প্যারালাইজড্‌ হয়ে গেছে। অনেকদিন ওষুধ-বিষুধ ম্যাসেজ করা হয়েছে, কিন্তু ফল হয়নি। এখনো আশা ছাড়েনি, কি একটা ওষুধ মাখে যেন চোখের পাতায়।

বিবেক একেবারে নির্বাক। ক্রমেই যেন গাঢ় চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিলেন। কেবল বললেন, নতুন কথা শোনালেন।

একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, আচ্ছা, শুনেছি অনন্ত রেলগাড়ি কিংবা বাসে চাপে না, সত্যি?

যমুনা—হ্যাঁ। রিক্সাতেই চাপতে চায় না। চাপলেও, রিক্সাওয়ালাকে আগেই বলে নেয়, খুব আস্তে চালাতে হবে।

বিজন—অর্থাৎ স্পীড সহ্য করতে পারে না।

বিবেক—হুঁ। আচ্ছা, চলি। আপনারা কাল কোর্টে আসতে ভুলবেন না।

ইতিমধ্যে মামলার কয়েকদিন শুনানী হয়ে গিয়েছে।

মহকুমা হাজত। আন্ডার ট্রায়াল সেল। অনন্ত চুপ করে বসে আছে। বিবেক এলেন নিঃশব্দে। পিছন থেকে, হঠাৎ ভীষণ জোরে হেঁচে ফেললেন।

অনন্ত চমকে উঠল।

বিবেক হাসলেন। বললেন, ক্ষমা করবেন। বিশ্রী সর্দি হয়েছে। আপনার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি অনন্তবাবু।

অনন্ত মুখ ফিরিয়ে, সুরহীন গলায় বলল, দু’বার ফাঁসি দিতে যাতে পারেন, সেই আর্জি?

বিবেক—না। আপনি হয়তো আমার ওপর চটেছেন অ্যারেস্ট করার জন্য। কিন্তু সরে পড়তে আপনি চেয়েছিলেন কিনা বলুন।

অনন্ত—আপনি সরে পড়ার যে-অর্থ করছেন, সেই অর্থে নয়। আমি অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে চাইছিলুম, যতদিন আপনাদের বিচার শেষ না হয়।

বিবেক—আপনি এটা যত সহজে বলছেন, আমরা তত সহজে ভাবতে পারি নে।

অনন্ত—যাকগে, আপনার আর্জির কথা বলুন।

বিবেক—সেইটেই বলছি। অনন্তবাবু, আপনি বিশ্বাস করুন, আমি আপনার মঙ্গলাকাঙক্ষী। হয়তো, এর ভেতরের ব্যাপারটা আমি বুঝতে পেরেছি।

অনন্ত—কি বুঝতে পেরেছেন?

বিবেক—সেটা এখন আমি বলতে পারব না। আপনি শুধু দয়া করে আমাকে বিমলা দেবীর দ্বিতীয় চিঠিটা দিন।

অনন্ত—আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, বিমলার দ্বিতীয় চিঠির সঙ্গে সুধার ব্যাপারের কোন যোগাযোগ নেই।

বিবেক—আমি আন্তরিক ভাবেই তা বিশ্বাস করি। আর সেইটে প্রমাণের জন্যও চিঠিটা আপনি দয়া করে দিন।

অনন্ত—সেটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত, আইনের কাছে তার কোন মূল্যই নেই।

বিবেক—আছে, আছে অনন্তবাবু, বিশ্বাস করুন।

বলতে বলতে বিবেকবাবুর গলা গম্ভীর হয়ে উঠল। বললেন, অনন্তবাবু, সুধাকে আপনি মেরে ফেলেছেন ঠিকই। আমি জানি নে, হয়তো আপনি নিজেও নিজের প্রাণের মূল্য অল্প জ্ঞান করছেন। করতে পারেন। কিন্তু বিমলার মৃত্যুর দায় যদি আপনার ওপর থেকে উঠে যায়, তবে সুধার মৃত্যুর দায় থেকেও আপনি রেহাই পেতে পারেন।

অনন্ত—কি করে?

বিবেক—সেটা আমি এখন বলব না। দোহাই অনন্তবাবু, প্রাণের চেয়েও কলঙ্ক অনেক বড়। আপনি বিমলা দেবীর চিঠিটা দিন আমাকে।

অনন্ত তার একটি অপলক চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল বিবেকের দিকে। তারপরে বলল, আপনি যে কি বলছেন, বুঝতে পারছি নে।

বিবেক—পরে বুঝতে পারবেন।

অনন্ত মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার শোবার ঘরে, আলমারিতে, একটা মোরাদাবাদী পেতলের ফুলদানির তলায় চাপা দেওয়া আছে চিঠিটা।

বিবেক এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন।

দীনেশবাবু আর অরুণকে সঙ্গে করে বিবেকবাবু এলেন অনন্তর বাড়িতে। চাবি চাকরের কাছেই ছিল। বিবেক আগে চিঠিটা বার করলেন। তারপর পড়তে পড়তে ওঁর মুখ হাসিতে ভরে উঠল।

ও-সি দীনেশ বললেন, কি ব্যাপার? কি যেন প্রমাণ করবেন বলছিলেন?

বিবেক বললেন, করব, করব দীনেশবাবু। আমি এইটিই আশা করেছিলুম। শুনুন বিমলার চিঠি : প্রিয়তমেষু,

এ নামে তোমাকে ডাকার অধিকার আমার নেই। কোনকালেই ছিল না। আজ শেষবারের জন্য ডেকে গেলাম, কারণ, তুমি তো এ মুখপুড়িকে সত্যি ভালবেসেছিলে। কিন্তু এত ভালবাসার প্রতিদানে, আর কতদিন তোমাকে প্রবঞ্চনা করব? গেনুর ব্যাপার তো তুমি জানই। তোমার বুক অষ্টপ্রহর জ্বলছে। তোমার মত মানুষ কখনো মুখ ফুটে সে-কথা তার স্ত্রীকে বলতে পারে না। তাছাড়া, তুমি যে সত্যি ভালবেসেছ। কেমন করে, গেনুর কথা উচ্চারণ করবে তুমি। তাই তোমাকে মুক্তি দিতে চাই আমি। কারণ, তোমার স্ত্রী হয়েও অকপটেই বলছি, গেনুর হাতছানি আমি ফেরাতে পারিনি। কিন্তু গেনুরও সাহস নেই, আমাকে নিয়ে সে ঘর করে। একদিকে এক ভীরু পুরুষের প্রতি আমার আকর্ষণ, অন্যদিকে প্রেমিক স্বামীকে প্রতিদিন বঞ্চনা, এ চলতে পারে না। তাই, এই সর্বনাশীকে বিদায় দাও।

প্রথম প্রথম তোমাকে অনেক রকম সন্দেহ করেছি। মনে আছে, সেই রিক্সায় ওঠার কথা? তুমি আর আমি। রিক্সাটা মোড় বেঁকতেই সামনে লরী। তুমি হঠাৎ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে। লোকে এসে আমাকে তুলল। তুমি বললে, মোটেই ধাক্কা দাওনি। আমার সন্দেহ হয়েছিল, তুমি বুঝি আমাকে মেরে ফেলতেই চাও। পরে বুঝেছি, ওসব মিথ্যে। তুমি আমাকে ধাক্কা দিতে পার না—

পড়তে পড়তে থেমে গেলেন বিবেক। বললেন, ব্যস, আর পড়ার দরকার নেই। বুঝতে পারছেন এবার, বিমলার ব্যাপারে অনন্তর কোন প্রোভোকেশন্ নেই?

অরুণ—তা বুঝতে পারছি স্যার। কিন্তু ধাক্কাটা?

বিবেক—ধাক্কাটা অবশ্য দিয়েছিল অনন্ত।

দীনেশ—তাতে তো বিমলা লরীর তলায় গিয়ে মরে যেতে পারত?

বিবেক—হ্যাঁ , তাও পারত।

দীনেশ—তবে?

বিবেক—এবার সেইটেই দেখতে হবে। সেই জন্যেই, কাল সকালে, আমি অনন্তকে নিয়ে জীপে করে বেরোব। দীনেশবাবু থাকবেন আমার সঙ্গে। অরুণ, তুমি ঠিক দশটা চল্লিশ মিনিটে, বৈকুণ্ঠপুরের নিউ কর্ড রোডের মসজিদের কাছে, ডেড কার্ভের উল্টো দিক থেকে, হেভি ট্রাকটা আস্তে আস্তে চালিয়ে নিয়ে আসবে। তুমি আসবে, আমিও কার্ভে ঢুকে যাব। তারপর একেবারে ডেড স্টপ। কেমন?

অরুণ—আচ্ছা, স্যার।

মহকুমা হাজতের বাইরের লনে জীপ দাঁড়িয়ে। অফিসের ভেতর বিবেক বললেন দীনেশকে, আপনি গাড়ির পিছনে বসবেন। কিন্তু খুব সাবধান। হুঁশিয়ার থাকবেন, অনন্তর ওপর থেকে একবারো চোখ সরাবেন না। ওকে ঠিক সময়ে ধরে ফেলবেন।

একজন সেপাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে এল অনন্ত।

বিবেক বললেন, চলুন, একবার আপনার বাড়ি যাব।

অনন্ত—কেন?

বিবেক—দরকার আছে।

অনন্ত সন্দিগ্ধ চোখে, এক চোখের ঠাণ্ডা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সবাইকে একবার দেখে নিয়ে বলল, চলুন।

বিবেক বাইরে এসে বললেন,উঠুন গাড়িতে।

অনন্ত যেন অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল। বলল, জীপে?

বিবেক—হ্যাঁ।

অনন্ত পিছন দিকে উঠতে গেল। বিবেক বললেন, না, না, সামনে চাপুন, আমার পাশে।

অনন্ত থমকে দাঁড়িয়ে বলল, পালাব না মশাই। কিন্তু সামনে উঠতে পারব না।

বিবেকের সঙ্গে দীনেশের চোখাচোখি হল। দীনেশ রাশভারী গলায় বললেন, বিবেকবাবু যা বলছেন, তাই করুন।

বিবেক বললেন শান্ত গলায়, ভয় নেই, উঠুন, আমি খুব আস্তে চালাব। জানি, আপনি স্পীড সহ্য করতে পারেন না।

অনন্তর ভাবলেশহীন মুখে কোন ভাবই ফোটে না। তবু তার একটি চোখে যেন শঙ্কার ছায়া দেখতে পেলেন বিবেক। হাতের ঘড়ি দেখলেন, ঠিক সাড়ে দশটা।

অনন্ত যেন হেঁচড়ে হেঁচড়ে গাড়িতে উঠল। বিবেক বসলেন ড্রাইভ করতে। দীনেশ পিছনের সীটে।

গাড়িটা প্রথমে আস্তে আস্তে চলল। কিন্তু বিবেক দেখলেন, অনন্তর হাত মুঠি পাকিয়ে উঠেছে। গাড়ি চলছে, চলছে, হঠাৎ সামনে একটা সাইকেল রিক্সা।

অনন্ত বিবেকের গায়ের কাছে চেপে এল।

বিবেক বললেন, ভয় পাচ্ছেন?

অনন্ত অত্যন্ত মোটা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, না।

বিবেক স্পীড দিলেন। পথের ওপরে একটি ছোট ছেলে। বিবেক হর্ন দিলেন না। গাড়িটা যেন সোজা ছেলেটার দিকেই এগোচ্ছে।

বিবেক অনুভব করলেন, অনন্তর কনুইটা ওঁর পাঁজরে চেপে বসছে আস্তে আস্তে। আরো দেখলেন, স্টার্টারের ওপর ওঁর পায়ের পাশে অনন্তর পা এগিয়ে এসেছে।

ছেলেটা সরে যাবার আগেই বিবেক বলে উঠলেন, অনন্তবাবু, আপনি আমার পাঁজরে কনুই খোঁচাচ্ছেন।

অনন্ত তাড়াতাড়ি কনুই সরিয়ে বলল, কই, না তো।

ছেলেটা রাস্তা পার হল। বিবেক গাড়ি দাঁড় করালেন। আঙুল দিয়ে পায়ের দিকে দেখিয়ে বললেন অনন্তকে, দেখুন, আপনি আমার পা মাড়াচ্ছেন।

চট করে পা’টা সরিয়ে বলল অনন্ত, কই, না তো!

বিবেকবাবু কিছু না বলে ঘড়ি দেখলেন, দশটা সাঁইত্রিশ।

হঠাৎ হাই স্পীডে গাড়ি বাঁক নিয়ে, এক মিনিটের মধ্যে বৈকুণ্ঠপুর নিউ কর্ড রোডে এসে পড়ল। সামনে ফাঁকা রাস্তা। ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে গাড়ি চালালেন বিবেক।

অনন্ত ততক্ষণে বিবেকের গায়ে ঠেসে এসেছে, আর তার হাত দুটি অবিকল স্টিয়ারিং হুইল ধরবার ভঙ্গিতে উঠে পড়েছে।

বিবেক একবার বললেন চাপা গলায়, অনন্তবাবু, আপনি আমাকে ঠেসছেন।

অনন্ত বলল, কই, না তো।

কিন্তু সে একটুও সরল না। উপরন্তু বিবেকের পায়ের ওপর অনন্তর একটি পা যেন ধনুষ্টঙ্কার রোগীর মত বেঁকে এসে পড়ল।

বিবেক—অনন্তবাবু, পা সরান।

পা সরল না। অনন্ত বলল, চাপা আর্তগলায়, পা ঠিকই তো আছে।

গাড়িটা যেন উড়ছে। বনেট কাঁপছে থরথর করে।

সামনে মসজিদের ডেড কার্ভ। রাস্তা দেখা যায় না, শুধু মসজিদের দেয়াল।

অনন্ত সামনের দিকে ঝুঁকল। হাত তার হুইলের কাছে।

ট্রাকের হর্ন শোনা গেল উল্টো দিক থেকে। কিন্তু ট্রাক দেখা যাচ্ছে না। জীপ তবু এগোচ্ছে একই স্পীডে। সোজা দেয়াল বরাবর চলেছে।

হঠাৎ সামনে ট্রাক।

বিবেক চিৎকার করে উঠলেন, গেলাম। সর্বনাশ!

আর, ঠিক সেই মুহূর্তেই অনন্তর ডান হাতের মুঠিটা সজোরে এসে পড়ল বিবেকের ওপর, এবং এক ধাক্কায় তিনি অনেকখানি সরে গেছেন।

কিন্তু গাড়ি তখন ডেড স্টপ!

দীনেশবাবু যদিও তখন দু-হাতে জাপটে ধরেছেন অনন্তকে, বিবেকবাবুর চোয়ালের দাঁত ততক্ষণে নড়ে গেছে। মুখের কষে রক্ত। গালে হাত চেপে বললেন, চোখের পলকে কত তাড়াতাড়ি অনন্তবাবুর হাত উঠে এল, আপনি টেরও পেলেন না দীনেশবাবু।

দীনেশ বোকার মত বললেন, তাই তো।

অনন্ত তখন কাঁপছে ঠকঠক করে, আর তার অপলক একটি চোখ আরো বড় হয়ে উঠেছে। ঘেমে নেয়ে উঠেছে আর হাঁপাচ্ছে ঘন ঘন। কেবল হাতটা তখনো ট্রাফিক পুলিশের মত তোলা। এত শক্ত যেন কিছুতেই নামবে না।

বিবেকের সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। বিবেকও তাকিয়ে ছিলেন।

কয়েক মুহূর্ত একেবারে স্তব্ধ, শূন্য। অনন্ত হাত নামাল।

বিবেকবাবু অনন্তর কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বললেন, অনন্তবাবু, সুধার অনুরোধেই আপনি আলসের ধারে বসেছিলেন, না?

নিস্তেজ কিন্তু সুরহীন গলায় সেও প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, হ্যাঁ।

আপনার ভয় লাগছিল, না?

হ্যাঁ।

সুধার জন্য, না?

হ্যাঁ।

আর ঠিক সেই সময়েই বাচ্চারা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠেছিল?

হ্যাঁ।

সুধা চমকে আপনাকে ধরতে আসছিল?

হ্যাঁ।

আপনি ঠিক সে সময়েই চমকে, সুধাকেই ধাক্কা দিয়েছিলেন কেমন?

হ্যাঁ।

আর দেখলেন, সুধা পড়ে গেল।

অনন্ত দু’হাতে মুখ ঢাকল।

বিবেক অনন্তর কাঁধে হাত রেখে সস্নেহে বললেন, আপনার জন্য বড় কষ্ট হয় অনন্তবাবু। ডাক্তারবাবুরা কি বলবেন জানি নে, আপনি মারাত্মক রকম অসুস্থ। এই ব্যাধি আপনার কোনদিন সারবে কিনা জানি নে। আধুনিক ডাক্তারেরা এ রোগের কি নাম দেবেন, তাও জানি নে।

অনন্ত তবু মুখ তুলল না।

বিবেক আবার বললেন, সুধাকে ধাক্কা দিয়ে আসার পর, থানায় বসে আপনি যখন অরুণের হাতে ছুরি দেখে মুঠি পাকাচ্ছিলেন, তখুনি আমার সন্দেহ হয়েছিল। আজ তার সুরাহা হল। মাঝে বিমলা দেবীর চিঠিটাই গোল পাকিয়েছিল। হাতেও আপনারই সবচেয়ে বড় নির্দোষ সার্টিফিকেট আছে। আপনার ব্যাধিই সুধাকে মেরেছে, আপনি নন।

অনন্তবাবুর ভাঙা ভাঙা গলায় জবাব এল, বলুন।

বিবেক—সেই জন্যেই আপনি বড় ঘর ভালবাসেন, অনেক বড় জায়গা চান, ধীরে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াবার মত, বসবার মত অনেকখানি space চান, যাতে কখনো হঠাৎ কারোর সঙ্গে ধাক্কা না লাগে। গায়ে গায়ে চাপাচাপি করতে না হয়, না?

হ্যাঁ।

চিৎকার গোলমাল বা কোন উত্তেজনাকর কিছু দেখলেই, আপনি নিজেরই অজান্তে সাংঘাতিক রকম ইনভল্ভড হয়ে পড়েন। আপনার হাত-পা আপনার অনিচ্ছায় কাজ করে যায়, নয়?

হ্যাঁ।

বিবেক দু’হাত দিয়ে অনন্তের মুখের ঢাকনা খুলে বললেন, বাড়ি যান অনন্তবাবু।

অনন্তর মুখ নত। বলল, আমার বিচার?

বিবেক বললেন, আপনার বিচার চিকিৎসা।

অনন্তর চোখের কূল ছাপিয়ে জল এল। বলল, না বিবেকবাবু। বিমলা গলায় দড়ি দিয়েছে। সুধাকে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। আর আমার এই দুরারোগ্য ব্যাধি। আমি আর বাঁচতে চাই নে। আপনারা আমাকে খুনীর শাস্তি দিন।

বিবেক বললেন, তার মানে? আপনাকে মেরে, আমরা খুনী হব, না?

হেসে উঠে বললেন, চলুন ভাই, আমরা সবাই আপনার আরোগ্য কামনা করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *