০৪. অগণন মানুষের স্রোত

বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের আগে মানুষের সবগুলো প্রজাতিরই বসবাস আফ্রো-এশিয়ান ভূখণ্ডের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ কথা সত্যি, তখন সাঁতরে কিংবা ভেলায় চড়ে যাওয়া যায় এমন কিছু ভূখণ্ডেও মানুষ ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন বলা যায়, ফ্লোরেস দ্বীপে মানব-সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় সাড়ে আট লক্ষ বছর আগে। তবে মানুষ তখনও আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মত ভূখণ্ড বা মাদাগাস্কার, নিউজিল্যান্ড আর হাওয়াইয়ের মত দ্বীপগুলোতে পৌঁছাতে পারেনি।

শুধু যে মানুষই আফ্রো-এশিয়ান এলাকায় আটকে ছিল তা নয়, অন্যান্য সব প্রাণীও আটকে পড়েছিল সেখানে। আর তার একটা বড় কারণ ছিল সমুদ্র পার হওয়ার বাধা। এ কারণেই অস্ট্রেলিয়া বা মাদাগাস্কারের মত জায়গাগুলোতে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তনের ধারা ছিল আলাদা, সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোও ছিল আকৃতি-প্রকৃতিতে আফ্রো-এশিয়ান প্রজাতির চেয়ে অন্যরকম। এইভাবেই পুরো পৃথিবীটা নিজস্ব উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমারোহে গড়ে ওঠা কয়েকটা পৃথক বাস্তুতন্ত্রে বিভক্ত ছিল। এরপর মানুষ এই স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল।

বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর মানুষের হাতে যে শুধু প্রযুক্তি আর সাংগঠনিক দক্ষতা এল তাই নয়, সেই সাথে আফ্রো-এশিয়ান ভূখণ্ড ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে যাত্রা করার জন্য প্রয়োজনীয় দূরদর্শিতাও পেল তারা। তাদের অর্জন শুরু হল ৪৫ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। বিশেষজ্ঞদের জন্য এটা ব্যাখ্যা করাটা একটু কঠিন, কারণ কাজটা মানুষের জন্য মোটেই সহজ ছিল না। অস্ট্রেলিয়াতে পৌঁছাতে মানুষকে পার হতে হয়েছে ছোট-বড় অনেক সামুদ্রিক প্রণালী, আর তারপর খুব দ্রুত নিজেদের খাপ খাওয়াতে হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশে।

এ বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ধারণাটা অনেকটা এমন- প্রায় ৪৫ হাজার বছর আগে যেসব মানুষ ইন্দোনেশিয়ান আর্কিপেলাগোতে (এশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে সরু প্রণালী দিয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জ) বসবাস করত, তারাই প্রথম সমুদ্রপথে যাতায়াত শুরু করে। তারা সমুদ্রে চলার উপযোগী নৌকা তৈরি করতে শেখে। তারপর মাছ ধরতে, ব্যবসা করতে কিংবা আবিষ্কারের জন্য আরো দূরে যেতে শুরু করে। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় কিছু অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে। সিল, সামুদ্রিক গরু বা ডলফিনের মত সকল সমুদ্রচারী স্তন্যপায়ী প্রাণীই বহুযুগের বিবর্তনে পেয়েছে জলজ জীবনের উপযুক্ত শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার মানুষেরা সম্পূর্ণ নতুন এক উপায় আবিষ্কার করল। তারা ছিল আফ্রিকান তৃণভূমির নরবানরের (ape) বংশধর। সমুদ্র পাড়ি দিতে তাদের মাছের মত পাখনা কিংবা তিমির মত মাথার প্রয়োজন হল না। বরং তারা শিখে ফেলল কীভাবে নৌকা বানাতে হয়, আর কীভাবে সেটা চালাতে হয়। এই নতুন অর্জিত দক্ষতাই একদিন তাদের পৌঁছে দিল অস্ট্রেলিয়ায়।

এটা ঠিক যে পুরাতত্ত্ববিদেরা এখনও ৪৫ হাজার বছর আগের কোনো নৌকা, দাঁড় কিংবা কোনো জেলেগ্রামের নিদর্শন এখনও খুঁজে পাননি। অবশ্য পাওয়া খুব সহজও নয়, কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির কারণে সেই প্রাচীন ইন্দোনেশিয়ার তটরেখা আজ কয়েকশ মিটার পানির নিচে। তবু এই ধারণার পক্ষে জোরালো প্রামাণ্য যুক্তি আছে। অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপনের কয়েক হাজার বছরের মধ্যে মানুষ উত্তরের অনেক ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দ্বীপে উপনিবেশ তৈরি করে। এর মধ্যে বুকা (Buka) আর মানুস (Manus) এর মত কিছু দ্বীপ ছিল নিকটতম ভূখণ্ড থেকেও প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে। উন্নত ধরণের নৌকা ও তা চালানোর দক্ষতা ছাড়া সেখানে যাওয়াটা অবিশ্বাস্য। একই ধরনের সামুদ্রিক যাতায়াতের প্রমাণ পাওয়া যায় নিউ আয়ারল্যান্ড আর নিউ ব্রিটেন দ্বীপের মাঝেও।

মানুষের অস্ট্রেলিয়া যাত্রা ইতিহাসের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কলম্বাসের আমেরিকা যাওয়া বা অ্যাপোলো এগারোর চাঁদে যাওয়ার চেয়ে সেটা কোনো অংশে কম নয়। ওটাই প্রথমবারের মত কোনো মানুষের তথা কোনো স্থলচারী স্তন্যপায়ী প্রাণীর আফ্রো-এশিয়ান ভূখণ্ডের বাইরে কোথাও যাওয়া। তবে ঘটনাটা তার চেয়েও বেশি গুরুত্ববহ অন্য একটা কারণে। এই অভিযানের মধ্য দিয়েই শিকারি মানুষ খাদ্যশৃঙ্খলের সবচেয়ে উপরে উঠে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করল পৃথিবীর নৃশংসতম প্রাণীরূপে।

এতদিন পর্যন্ত মানুষ নিজেকে পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলেছে, পরিবেশকে নিজের মতো করে পালটে দেবার তেমন কোনো চেষ্টা করেনি। পরিবেশের বড় কোনো পরিবর্তন না করেই বিভিন্ন রকম স্থান ও পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার ব্যাপারে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে মানুষ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ‘জয়’ করা এই মানুষেরা শুধু নিজেরাই বদলাল না, সাথে সাথে আমূল পাল্টে দিল অস্ট্রেলিয়ার আদিম পরিবেশও।

অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রতীরের বালিতে মানুষের আঁকা প্রথম পদচিহ্নটি সাথে সাথেই মুছে দিয়েছিল সমুদ্রের স্রোত, কিন্তু পরবর্তীকালে এই মানুষেরাই সেখানে রেখে এসেছে এমন এক চিহ্ন, যা সময়ের স্রোত মুছতে পারবে না আর কখনোই। অস্ট্রেলিয়া তখন এক অদ্ভুত অকল্পনীয় জগৎ। সেখানে তখন ঘুরে বেড়াত দুইশ কেজি ওজনের দুই মিটার লম্বা ক্যাঙ্গারু, আর এখনকার বাঘের মতোই বড় আকারের মার্সুপিয়াল সিংহ ছিল সেখানকার সবচেয়ে বড় শিকারি প্রাণী। বিশাল আকারের কোয়ালার দেখা মিলত গাছে, তবে এখনকার মত তারা ছোটখাট আদুরে চেহারার ছিল না মোটেই। উটপাখির দ্বিগুণ আকারের উড়তে-না-পারা পাখিরা ছুটে বেড়াত খোলা প্রান্তরে, ড্রাগনের মত গিরগিটি আর মিটার-পাঁচেক লম্বা সাপেরা কিলবিলিয়ে চলত গহীন বনের তলে। জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াত প্রকাণ্ড ডিপ্রোটোডন আর আড়াই টন ওজনের উমব্যাট। পাখি আর সরীসৃপ ছাড়া বাকি সব প্রাণীই ছিল মার্সুপিয়াল। মার্সুপিয়াল বলা হয় সেইসব স্তন্যপায়ী প্রাণীদের যারা ক্ষুদ্র অপরিণত শিশুর জন্ম দিয়ে তাদের পরিপুষ্ট করে তুলত পেটের সামনের থলিতে রেখে। আফ্রিকা আর এশিয়াতে এমন কোনো প্রাণী ছিলই না, অথচ অস্ট্রেলিয়াতে তারাই ছিল সর্বেসর্বা।

পরের কয়েক হাজার বছরে এই দানবাকৃতি প্রাণীদের সবাই একরকম হারিয়েই গেল। পঞ্চাশ কিলোগ্রামের বেশি ওজন হয় এমন চব্বিশটি প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে তেইশটিই বিলুপ্ত হয়ে গেল। ভেঙে পড়ল অস্ট্রেলিয়ার খাদ্যশৃঙ্খল, আবার তা গড়েও উঠল নতুন করে। অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশে লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল এটাই। এর দায় কি সবটুকুই মানুষের?

মানুষের দায়

অনেক বিশেষজ্ঞই এই বিলুপ্তির দায় বরাবরের মত জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের উপরে চাপিয়ে মানুষকে নির্দোষ দেখাতে চান। তবে মানুষ যে সম্পূর্ণ নির্দোষ, এই কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনটি প্রমাণের ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর দোষ চাপানো যুক্তিগুলো ধোপে টেকে না, বরং সেটা এসে পড়ে আমাদেরই পূর্বপুরুষদের উপর।

প্রথমত, ৪৫ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ুতে যে পরিবর্তন হয় তা এমন কোনো আকাশ-পাতাল পরিবর্তন ছিল না। আর শুধুই জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য এই বিপুল বিলুপ্তি – এটা কষ্টকল্পনা। ইদানিং সবকিছুর জন্যই জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হলেও, এটা সত্য যে পৃথিবীর জলবায়ু কখনোই স্থির ছিল না। পরিবর্তনের ধারা এখানে চিরন্তন। ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনাই কোনো না কোনো জলবায়ু পরিবর্তনের সাক্ষী।

আমাদের এই গ্রহটিকে অসংখ্য তাপ-শৈত্যের চক্রের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। গত দশ লক্ষ বছরের মধ্যে প্রতি লক্ষ বছরে গড়ে একবার করে বরফ যুগ পার করে এসেছে পৃথিবী। এর মধ্যে সর্বশেষটি শুরু হয় প্রায় ৭৫ হাজার বছর আগে, আর সেটা চলেছিল ১৫ হাজার বছর আগ পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবী শীতলতম অবস্থায় পৌঁছেছিল দুবার- একবার প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, আরেকবার প্রায় ২০ হাজার বছর আগে। অস্ট্রেলিয়ায় ডিপ্রোটোডনের আবির্ভাব হয় ১৫ লক্ষ বছর আগে, অন্তত দশটি বরফ যুগ পার করেও টিকে ছিল তারা। এমনকি ৭০ হাজার বছর আগের সর্বশেষ বরফ যুগের শীতলাবস্থার সময়ও ডিপ্রোটোডনের অস্তিত্ব ছিল। তাহলে ৪৫ হাজার বছর আগে তাদের আর দেখা গেল না কেন? শুধু ডিপ্রোটোডনই যদি বিলুপ্তির শিকার হত, তাহলেও হয়তো সেটাকে কাকতাল বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু শুধু তো ডিপ্রোটোডন নয়, একই সাথে হারিয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার প্রাণিকুলের ৯০ শতাংশেরও বেশি। মানুষও অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাল, আর ঠিক সেই সময়টাতেই সেখানকার এতগুলো প্রাণী মারা যাচ্ছিল ঠাণ্ডায়- এও কি কাকতালীয়? নিশ্চয়ই নয়।

দ্বিতীয় যুক্তি হল, জলবায়ু পরিবর্তনেই যদি এই সর্বগ্রাসী বিলুপ্তি এসে থাকে তবে তা জলে-স্থলে একসাথেই আসার কথা। কিন্তু ৪৫ হাজার বছর আগে কোনো সামুদ্রিক প্রাণীর বিলুপ্তির চিহ্ন মেলে না। কাজেই মানুষের আগমন এর একটা কারণ হতে পারে বৈকি। কারণ সমুদ্র-বিচরণে তখনো পটু হয়ে না উঠলেও তখনকার মানুষ ডাঙায় ছিল এক প্রবল হুমকি।

তৃতীয়ত, অস্ট্রেলিয়ার মত একই রকম ঘটনা পরের সহস্রাব্দগুলোতেও ঘটেছে- আর সেগুলো ঘটেছে সে সব জায়গাতেই যেখানে মানুষ গেছে। কাজেই সেক্ষেত্রেও মানুষ দায়মুক্ত হতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নিউজিল্যান্ডের প্রাণিকুলের কথা। ৪৫ হাজার বছর আগের তথাকথিত ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ যাদের কিছুই করতে পারেনি, তারাই একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেল মানুষ ঐ দ্বীপে পা রাখতেই। নিউজিল্যান্ডের প্রথম জনগোষ্ঠী মাওরিরা ওখানে পৌঁছায় প্রায় ৮০০ বছর আগে। এর পরের কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই ওখানকার প্রাণীদের বেশিরভাগ বিলুপ্ত হয়, যার মধ্যে ছিল সকল পাখি প্রজাতির ৬০ শতাংশ।

একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল উত্তর মহাসাগরে সাইবেরিয়ার উপকূল থেকে ২০০ কিলোমিটার উত্তরের র‍্যাঙ্গেল (Wrangel) দ্বীপের ম্যামথগুলোকেও। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে উত্তর গোলার্ধের অনেকটা জুড়ে ছিল এই ম্যামথরা। কিন্তু মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তেই তারা আস্তে আস্তে সরে পড়ল – প্রথমে ইউরেশিয়ায়, পরে উত্তর আমেরিকায়। ১০ হাজার বছর আগেও র‍্যাঙ্গেল এবং উত্তর মেরুর কাছের কয়েকটা দ্বীপ ছাড়া আর কোথাও ম্যামথ ছিল না। র‍্যাঙ্গেল দ্বীপের ম্যামথরা আরো কয়েক হাজার বছর টিকে ছিল। তারপর, ৪ হাজার বছর আগে মানুষ সেখানে যেতেই তারাও হারিয়ে গেল।

এই ঘটনাগুলো শুধু অস্ট্রেলিয়ায় ঘটলেও সেটাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে নিয়ে মানুষকে হয়তো ছাড় দেওয়া যেত। কিন্তু সামগ্রিক ইতিহাস বিবেচনা করে হোমো সেপিয়েন্সকে একটি খুনী প্রজাতি বলেই মনে হয়।

এখন প্রশ্ন হল, সেই প্রস্তর যুগের হাতিয়ারকে সম্বল করে মানুষ কীভাবে অস্ট্রেলিয়াতে এত বড় একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাল? এর তিনটা মানানসই উত্তর পাওয়া যায়।

অস্ট্রেলিয়ায় বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীদের বেশিরভাগ ছিল বড় বড় প্রাণী। এসব বড় প্রাণীর বংশবৃদ্ধি ঘটে ধীরগতিতে। এদের গর্ভধারণকাল হয় দীর্ঘ, আর প্রতিবার গর্ভধারণে এরা জন্ম দেয় স্বল্পসংখ্যক শিশুর। কাজেই মানুষ যদি কয়েক মাসে একটা করেও ডিপ্রোটোডন হত্যা করে, তাতেও এদের মৃত্যুহার জন্মহারের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার কথা। এভাবেই পরের কয়েক হাজার বছরে সংখ্যায় কমতে কমতে এক সময় পৃথিবীর সর্বশেষ ডিপ্রোটোডনটিও মারা গেল।

আকারে প্রকাণ্ড হলেও অস্ট্রেলিয়ার ডিপ্রোটোডন ও অন্যান্য বড় প্রাণীগুলোকে হত্যা করা মানুষের জন্য খুব কঠিন হয়নি। এই দোপেয়ে আততায়ীর আচমকা আক্রমণে তারা বরাবরই ধরাশায়ী হতো। আফ্রো-এশিয়ান ভূখণ্ডে ২০ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে মানুষ, অর্জন করেছে শিকারের সর্বোচ্চ দক্ষতা। সেই শাণিত দক্ষতা কাজে লাগিয়েই প্রায় চার লক্ষ বছর আগে থেকে মানুষ বড় প্রাণী শিকার করতে শুরু করে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে আফ্রিকা আর এশিয়ার বড় প্রাণীগুলো মানুষের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে শিখেছিল। এজন্যই তারা মানুষ কিংবা মানুষের মত দেখতে সকল প্রাণীদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখত। অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীগুলো এই পালিয়ে বাঁচার ব্যাপারটা শিখে নেওয়ার সময়ই পায়নি। মানুষকে দেখে ক্ষতিকর প্রাণী মনে হওয়ার কোনো কারণই ছিল না। লম্বা ধারালো দাঁত কিংবা পেশিবহুল ক্ষিপ্র শরীর- এমন কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য মানুষের ছিল না যে তাকে দেখে ভয় পেতে হবে। কাজেই পৃথিবীর বৃহত্তম মার্সুপিয়াল প্রাণী ডিপ্রোটোডন প্রথমবার ক্ষুদ্র মানুষকে দেখেও হয়তো পাতা চিবানোতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছিল। মানুষকে দেখে ভয় পেতে হবে- এই বোধটা বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হওয়ার কথা, কিন্তু বিবর্তিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পায়নি অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীগুলো।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা হল, অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগেই মানুষ আগুনের ব্যবহার আয়ত্ব করেছিল। নতুন এক প্রতিকূল পরিবেশে ঝোপঝাড় আর ঘন জঙ্গলের মাঝে পথ বের করে নিতে তারা সেটাই ব্যবহার করল। আবার আগুন দেখে আকৃষ্ট হওয়া প্রাণীগুলোও পরিণত হল মানুষের সহজ শিকারে। সবকিছু মিলে পরের কয়েক হাজার বছরে অস্ট্রেলিয়ার বাস্তুতন্ত্র আমূল বদলে গেল।

এই কারণটার পক্ষে একটা জোরালো প্রমাণ হল অস্ট্রেলিয়ার উদ্ভিজ্জ জীবাশ্ম। ৪৫ হাজার বছর আগের অস্ট্রেলিয়ায় ইউক্যালিপটাস গাছ ছিল বিরল। কিন্তু মানুষের আগমনের পর থেকে শুরু হল ইউক্যালিপটাসের স্বর্ণযুগ। ইউক্যালিপটাস গাছ আগুন প্রতিরোধী, তাই মানুষের সাহায্যে অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে শুরু হল ইউক্যালিপটাসের একচ্ছত্র রাজত্ব।

উদ্ভিদ জগতের এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ল প্রাণিজগতে – তৃণভোজী ও মাংসাশী উভয়ের উপর। কোয়ালাদের প্রধান খাদ্য ছিল ইউক্যালিপটাসের পাতা, তাই তাদের আর খাবারের কোনো অভাবই রইল না, কিন্তু বেশির ভাগ প্রাণীই পড়ল মহাবিপদে। খাদ্য-খাদকের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক ভেঙে পড়ল, ফলে দুর্বল প্রজাতিগুলো আরো এগিয়ে গেল বিলুপ্তির পথে।

তৃতীয় ব্যাখ্যাটা বলে- অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীবিলুপ্তিতে মানুষের শিকার ও আগুনের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য কারণ হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটাকেও একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। ৪৫ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ুতে চলমান পরিবর্তন সেখানকার পরিবেশের ভারসাম্যকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল, যা প্রাণীদেরকেও ঠেলে দিয়েছিল একটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। সাধারণ অবস্থায় তারা হয়তো ওখান থেকেও অন্যান্যবারের মত ঘুরে দাঁড়াতে পারত, কিন্তু এবারে মানুষের উপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরো সংকটময় করে তোলে। প্রতিকূল আবহাওয়া আর শিকারী মানুষের দ্বিমুখী আক্রমণে তাদের আর শেষরক্ষা হয়নি। টিকে থাকার কোনো কৌশল আয়ত্বে আনার আগেই শেষ হয়ে গেল তারা।

এই তিনটি কারণের মধ্যে কোনটা যে সত্যিই দায়ী, সেটা আরো বেশি তথ্য-প্রমাণ হাতে না পেলে নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু তারপরও এটুকু বলা যায় যে, যদি মানুষ অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতিতে এতখানি হস্তক্ষেপ না করত, তাহলে হয়তো আজও সেখানে মার্সুপিয়াল সিংহ, ডিপ্রোটোডন কিংবা বিরাট আকারের ক্যাঙ্গারুর দেখা পাওয়া যেত।

শ্লথদের বিলুপ্তির পথে যাত্রা

অস্ট্রেলিয়ার প্রাণিবিলুপ্তি সম্ভবত পৃথিবীতে মানুষের প্রথম বড় ‘কীর্তি’। পরবর্তীতে আমেরিকাতেও একই রকম বিপর্যয় ঘটেছে, আরো বড় আকারে। মানব প্রজাতিগুলোর মধ্যে হোমো সেপিয়েন্সই প্রথম পশ্চিমে পৌঁছায় প্রায় ১৬ হাজার বছর আগে, অর্থাৎ ১৪ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। তারা পৌঁছেছিল পায়ে হেঁটে, কারণ তখন সমুদ্রপৃষ্ঠ নিচু ছিল বলে উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়া ও উত্তর-পশ্চিম আলাস্কাকে জুড়ে দেওয়া পথটুকু তখনও পানিতে ডুবে যায়নি। তাই বলে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার চেয়ে একটুও সহজ ছিল না এই যাত্রা। মানুষকে তখন টিকে থাকতে হয়েছে মেরুবলয়ের চরম আবহাওয়ায়, যেখানে শীতে সূর্যের দেখাই পাওয়া যায় না আর তাপমাত্রা মাঝে মাঝে শূন্যের নিচে পঞ্চাশ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়।

এর আগে মানুষের কোনো প্রজাতিই উত্তর সাইবেরিয়ার মত শীতল জায়গায় যেতে পারেনি, এমনকি শীতসহিষ্ণু নিয়ান্ডার্থালরাও নয়। অথচ আফ্রিকার তৃণভূমির গরমে অভিযোজিত হোমো সেপিয়েন্সরাই তাদের উদ্ভাবনী কৌশলে সেই বরফের দেশে টিকে গেল। শীতল আবহাওয়ায় যেতে যেতেই তখনকার যাযাবর মানুষ পশম আর চামড়া সেলাই করে বরফের উপর চলার জুতা আর পোশাক তৈরি করতে শিখল। তাদের শিকারের অস্ত্র ও কৌশল দুইই উন্নত হল, আর সেটা কাজে লাগল ম্যামথের মত বড় প্রাণী শিকার করতে। গরম কাপড় আর উন্নত শিকার কৌশল – এই দুইয়ের উপর ভরসা করেই মানুষ আরো শীতল স্থানে যেতে সাহস করল, আর তারা যতই উত্তরে গেল, তাদের দক্ষতাগুলোও বাড়তে লাগল তাল মিলিয়ে।

কিন্তু কেন? কেন সাইবেরিয়ার শীতে মানুষের এই স্বেচ্ছা-নির্বাসন? তাদের কেউ হয়তো গিয়েছিল যুদ্ধ থেকে পালিয়ে, কেউ জনসংখ্যার চাপে, কেউ আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে। আবার অনেকে ঠিক পালিয়ে নয়, বরং উত্তরে গিয়েছিল প্রাণিজ আমিষের প্রাচুর্য দেখে। তখনকার মেরুবলয়জুড়ে ছিল প্রচুর হৃষ্টপুষ্ট ম্যামথ আর বল্গাহরিণ। একটা ম্যামথ মানেই প্রচুর পরিমাণে মাংস। আর সেটা দীর্ঘকাল সংরক্ষণের জন্য বরফও ছিল অঢেল। তার সাথে পাওয়া যেত চর্বি, পশম আর মূল্যবান দাঁত। সাঙ্গিরের (Sungir, মস্কো থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পূর্বে প্রাচীন মানুষের বসতি) প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, ওখানকার ম্যামথ-শিকারী মানবসমাজ কষ্টেসৃষ্টে নয়, রীতিমত প্রাণপ্রাচুর্যে বিকশিত হয়েছিল। সময়ের সাথে মানুষের দল ছড়িয়ে পড়ল নানা দিকে। তার ফলশ্রুতিতে ম্যামথ, ম্যাস্টোডন, গণ্ডার আর বল্গাহরিণ পরিণত হতে লাগল তাদের খাদ্যে। ১৪ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এই প্রাণীদের ধাওয়া করতে করতেই মানুষ উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে পৌঁছে গেল আলাস্কায়। আর এভাবেই যে নতুন একটা মহাদেশ আবিষ্কৃত হল, মানুষ বা ম্যামথ কেউই সেটা বুঝতে পারেনি।

শুরুর দিকে এই পথটা বন্ধ করে রেখেছিল বিরাট হিমবাহ, তাই খুব বেশি মানুষ তার ওপারে যেতে পারেনি। তবে ১২ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রকোপে সেই বরফ গলে গিয়ে আলাস্কা যাবার পথ খুলে যায়। সেই নতুন পথে মানুষ দলে দলে পাড়ি জমায় নতুন মহাদেশে। মেরু অঞ্চলের শীতে অভ্যস্ত মানুষ দ্রুতই নতুন পরিবেশ আর আবহাওয়াতে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। সাইবেরিয়ার মানুষের বংশধরেরা বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বদিকের ঘন জঙ্গল, মিসিসিপির বদ্বীপের জলাভূমি, মেক্সিকোর মরুভূমি আর মধ্য আমেরিকার বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন করল। আবার কেউ কেউ চলে গেল আমাজন নদীবিধৌত এলাকায়, আন্দেজ পর্বতমালার উপত্যকায় কিংবা আর্জেন্টিনার পাম্পাস সমভূমিতে। পুরো মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে মানুষের সময় লেগেছিল বড়জোর দুই হাজার বছর। ১০ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই মানুষ দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণের তিয়েরা দেল ফুয়েগো (Tierra del Fuego) দ্বীপে পৌঁছায়। মানুষ এত দ্রুত আমেরিকার আদ্যোপান্ত দখল করতে পারার মূল কারণ তাদের অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তা ও অভিযোজন ক্ষমতা। কার্যত বড় ধরনের কোনো জিনগত পরিবর্তন ছাড়াই আর কোনো প্রাণী এতরকম বৈচিত্র্যময় পরিবেশে এত দ্রুত নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি।

তবে মানুষের আমেরিকা দখলের প্রক্রিয়াটি মোটেই রক্তপাতহীন ছিল না। ১৪ হাজার বছর আগে আমেরিকার প্রাণিজগৎ এখনকার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ছিল। আলাস্কা থেকে দক্ষিণে, কানাডা ও পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রের সমভূমিতে এগিয়ে যাবার পথে মানুষ সামনে পেল ম্যামথ ও ম্যাস্টোডন, ভালুকের মত বড় আকারের ইঁদুর, ঘোড়া ও উটের পাল আর বিশালাকায় সিংহ। আরো ছিল এমন কিছু বিশাল প্রাণী যা আজ আর দেখা যায় না। এদের মধ্যে ছিল লম্বা দাঁতওয়ালা ভয়ঙ্করদর্শন বিড়াল আর প্রায় ছয় মিটার লম্বা, আট টন পর্যন্ত ওজনের স্থলচর শ্লথ। দক্ষিণ আমেরিকার প্রাণিকুল ছিল আরো বেশি বৈচিত্র্যময়। সেখানেও ছিল নানা রকম স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ আর পাখি। দুই আমেরিকাই ছিলো প্রাণপ্রাচুর্যে বিকশিত বিবর্তনের আদর্শ লীলাভূমি, যার প্রাণী ও উদ্ভিদগুলো ছিল আফ্রিকা ও এশিয়ার জীবসম্ভার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

কিন্তু এ সবই মানুষ ওখানে যাওয়ার আগের কথা। মানুষ যাওয়ার দুই হাজার বছরের মধ্যেই এদের বেশিরভাগ প্রজাতিই হারিয়ে গেল। এখনকার হিসাব বলে, এই অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর আমেরিকার সাতচল্লিশটি প্রজাতির মধ্যে বিলুপ্ত হয় চৌত্রিশটি, আর দক্ষিণ আমেরিকায় ষাটের মধ্যে পঞ্চাশটি। তিন কোটি বছর ধরে টিকে থাকা লম্বা দাঁতের বিড়াল বিলুপ্ত হল, একই পরিণতি হল বিশাল শ্লথ আর সিংহের, আমেরিকান প্রজাতির ঘোড়া আর উটের, বিশাল ইঁদুর আর ম্যামথের। তার সাথে বিলুপ্ত হল হাজার হাজার প্রজাতির ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি, এমনকি পোকামাকড় আর পরজীবীও (ম্যামথ বিলুপ্ত হওয়ার পর ম্যামথের সবরকম উকুনও বিলুপ্ত হয়)।

দশকের পর দশক ধরে এসব প্রাণীর জীবাশ্ম আর দেহাবশেষের খোঁজে দুই আমেরিকার পাহাড় ও সমতলে চষে বেড়াচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। যখনই তাঁরা কোনো কিছু খুঁজে পাচ্ছেন পরম যত্নে সেগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছেন গবেষণাগারে। সেটা হতে পারে প্রাচীন আমেরিকান উটের হাড় কিংবা সেই বিরাট শ্লথের বিষ্ঠা। সেখানে প্রতিটি নমুনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে তাদের বয়স নির্ণয় করা হয়। সব গবেষণার ফল পাওয়া গেছে একই রকম – সাম্প্রতিকতম নমুনাগুলোও সেই সময়ের, যখন মানুষ প্রথম আমেরিকায় আসে, অর্থাৎ ১২ হাজার থেকে ৯ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। এর পরবর্তী সময়ের নমুনা পাওয়া গেছে কেবল কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপে, নির্দিষ্ট করে বললে কিউবা ও হিসপানিওলায়। সেখানে পাওয়া শ্লথের বিষ্ঠা মোটামুটি ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের – ঠিক যে সময়ে মানুষ ক্যারিবিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে ওখানে পৌঁছায়।

এর পরেও কিছু বিশেষজ্ঞ এইসবের জন্য মানুষের বদলে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করতে চান (সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় যে, ৭ হাজার বছর ধরে পশ্চিমের সব জায়গার আবহাওয়া বদলে গেলেও কোনো ‘রহস্যময় কারণে’ ক্যারিবিয়ান দ্বীপে বদলায়নি)। কিন্তু আমেরিকায় পাওয়া প্রমাণকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আমরাই যে এই বিলুপ্তির জন্য দায়ী – এ সত্যকে কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। যদি জলবায়ুর পরিবর্তন এখানে কোনো ভূমিকা রেখেও থাকে, তবু মানুষের ভূমিকা ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি।

নূহের নায়ে ঠাঁই হবে কাদের?

অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার মত মহাদেশ আর কিউবার মত দ্বীপে প্রাণীদের যে গণবিলুপ্তি ঘটেছিল, তার চেয়ে একটু কমই ঘটেছিল আফ্রো-এশিয়ান এলাকায়। সেখানে বিলুপ্ত প্রজাতিগুলোর মধ্যে হোমো সেপিয়েন্স বাদে মানুষের অন্য প্রজাতিগুলোও ছিল। এই ছোট-বড় বিলুপ্তির ঘটনাগুলোকে এক সুতোয় গাঁথলে বোঝা যায় যে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একটা পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল মানুষের কাছ থেকেই। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বড় বড় লোমশ প্রাণীগুলো। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের সময়ে এই পৃথিবী প্রায় দুইশ রকমের বড় (পঞ্চাশ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের) স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাস ছিল, আর কৃষিবিপ্লব আসার পর ছিল শ’খানেকের মত। লেখালেখি করতে শেখা, চাকা আবিষ্কার কিংবা লোহার জিনিস বানাতে শেখার অনেক আগেই মানুষ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণীদের অর্ধেকটা।

কৃষি বিপ্লবের পরও সেই একই নাটক বারবার মঞ্চস্থ হয়েছে পৃথিবীর অসংখ্য দ্বীপে, আরেকটু ছোট আকারে। বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় সে গল্পই বারবার উঠে আসে আমাদের সামনে। সে নাটকের প্রথম দৃশ্যের কুশীলব নানা রকমের প্রাণী- মানুষের কোনো ভূমিকা সেখানে নেই। দ্বিতীয় দৃশ্যে ঘটে মানুষের আগমন (যার প্রমাণ মেলে মানুষের হাড়, বর্শার ফলা কিংবা মাটির পাত্রের টুকরোয়), আর তৃতীয় দৃশ্যে মঞ্চজুড়ে কেবলই মানুষ, আর ছোট-বড় অনেক প্রাণী তখন উধাও।

একটা ভালো উদাহরণ পাওয়া যায় আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ৪০০ কিলোমিটার পূর্বের দ্বীপ মাদাগাস্কারে। লক্ষ বছরের বিবর্তনে এই বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছিল সেখানকার স্বতন্ত্র প্রাণিজগৎ। সেখানে ছিল ‘এলিফ্যান্ট বার্ড’ নামের উড়তে না পারা পাখি, তিন মিটার উচ্চতা আর আধা টন ওজন নিয়ে এরাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি। সাথে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেরুদণ্ডী প্রাণী প্রকাণ্ড লেমুর। দেড় হাজার বছর আগে এরকম অনেকগুলো বড় প্রাণী একেবারে হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গেল – ঠিক মানুষ ওখানে পা রাখার পরপরই।

দুটি প্রকাণ্ড শ্লথ (মেগাথেরিয়াম) আর তাদের পিছনে দুটি প্রকাণ্ড আর্মাডিলো। অধুনালুপ্ত এই আর্মাডিলো লম্বায় প্রায় তিন মিটার আর ওজনে দুই টন পর্যন্ত হতো। শ্লথগুলোর উচ্চতা ছয় মিটার পর্যন্তও হতো, আর ওজন হতো প্রায় আট টন।

প্রশান্ত মহাসাগরে গণবিলুপ্তির প্রথম আঘাতটা আসে প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। এ সময়েই পলিনেশিয়ার কৃষকেরা সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি আর নিউ ক্যালিডোনিয়ায় বসতি স্থাপন করে। তারাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শত শত প্রজাতির পাখি, পোকামাকড়, শামুকসহ স্থানীয় নানা প্রাণীকে শেষ করে ফেলে। এই বিলুপ্তির ঢেউ এগিয়ে যায় উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বে – আর মুছে দিয়ে যেতে থাকে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোর প্রাণীদের। ক্রমশ এর ফলাফল দেখা যায় ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সামোয়া ও টোঙ্গায়, প্রথম খ্রিস্টাব্দে মার্কুইস দ্বীপপুঞ্জে, ৫০০ খ্রিস্টাব্দে ইস্টার দ্বীপ, কুক দ্বীপপুঞ্জ ও হাওয়াইয়ে, আর সবশেষে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে নিউজিল্যান্ডে।

ঠিক একই রকমের ঘটনা ঘটেছে আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, উত্তর মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরো হাজার হাজার দ্বীপে। পুরাতত্ত্ববিদেরা একেবারে ছোট ছোট দ্বীপগুলোতেও এর প্রমাণ পেয়েছেন। সেসব দ্বীপেও এমন সব পাখি, পোকা আর শামুকের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থেকেও মানুষের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু হাতে গোনা কয়েকটা অত্যন্ত দুর্গম দ্বীপ আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষের নজর এড়িয়ে ছিল। এমনই একটা বিখ্যাত দ্বীপ গালাপাগোস, ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত মানুষ সেটাকে দেখেনি। সেখানকার প্রাণীজগৎ তখনও মানুষের হাতে পড়েনি, তাই সেখানে পাওয়া গেল বিশাল আকারের কচ্ছপ, যারা প্রাচীন ডিপ্রোটোডনের মতই মানুষ দেখে ভয় পায় না।

যে বিলুপ্তির প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল শিকারী মানুষের হাত ধরে, তারই দ্বিতীয় ধাক্কাটা আসে কৃষক মানুষের কাছ থেকে। সেটা দেখে তৃতীয় ধাক্কাটার আভাস পাওয়া যায়, সেটা এখন চলমান আছে, এই শিল্পযুগে। পরিবেশবাদীরা যতই বলুক আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রকৃতির প্রতি বৈরী ছিল না, কথাটা মোটেই ঠিক নয়। আজকের এই শিল্পযুগ আসার অনেক আগেই মানুষ বহু প্রাণী ও উদ্ভিদকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে। নৃশংসতার বিচারে পৃথিবীর আর একটি প্রাণীও মানুষের সমকক্ষ নয়।

বিলুপ্তির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে মানুষ যদি আরও একটু সচেতন হতো, তাহলে হয়তো তৃতীয় পর্যায়টা নিয়ে তারা এত নির্বিকার থাকতে পারত না। মানুষ যদি জানত কতগুলো প্রজাতির প্রাণীকে তারা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, তাহলে এখনও যেগুলো টিকে আছে তাদের বাঁচাতে তারা আরও একটু সচেষ্ট হতো। মহাসাগরের বড় প্রাণীগুলোর জন্য এই কথাটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। বুদ্ধিভিত্তিক ও কৃষিভিত্তিক বিপ্লবের সময়ে ডাঙার প্রাণীদের তুলনায় জলের প্রাণীদের ক্ষতি হয়েছে সামান্যই। কিন্তু এই শিল্পযুগের দূষণ আর সামুদ্রিক সম্পদে লোভী মানুষের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের কারণে তাদের অনেকেই আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এভাবে চলতে থাকলে সাগরের তিমি, হাঙর, টুনা আর ডলফিন হয়তো একদিন সেই প্রাচীন ডিপ্রোটোডন, শ্লথ আর ম্যামথের পরিণতিই বরণ করবে। তারপর উত্তাল স্রোতের মত অসংখ্য মানুষই কেবল পৃথিবীতে রাজত্ব করবে, আর সেই অগণিত মানুষের মহাপ্লাবনে নূহের নৌকার প্রাণীদের মতই টিকে থাকবে মানুষেরই পোষ মানা কিছু প্রাণী।

—————–

তথ্যসূত্র

1 James F. O’Connel and Jim Allen, ‘Pre-LGM Sahul (Pleistocene Australia – New Guinea) and the Archaeology of Early Modern Humans’, in Rethinking the Human Revolution: New Behavioural and Biological Perspectives on the Origin and Dispersal of Modern Humans, ed. Paul Mellars, Ofer Bar-Yosef, Katie Boyle (Cambridge: McDonald Institute for Archaeological Research, 2007), 395–410; James F. O’Connel and Jim Allen, ‘When Did Humans First Arrive in Greater Australia and Why is it Important to Know?’, Evolutionary Anthropology 6:4 (1998), 132–46; James F. O’Connel and Jim Allen, ‘Dating the Colonization of Sahul (Pleistocene Australia – New Guinea): A Review of Recent Research’, Journal of Radiological Science 31:6 (2004), 835–53; Jon M. Erlandson, ‘Anatomically Modern Humans, Maritime Voyaging and the Pleistocene Colonization of the Americas’, in The First Americans: The Pleistocene Colonization of the New World, ed. Nina G. Jablonski (San Francisco: University of California Press, 2002), 59–60, 63–4; Jon M. Erlandson and Torben C. Rick, ‘Archaeology Meets Marine Ecology: The Antiquity of Maritime Cultures and Human Impacts on Marine Fisheries and Ecosystems’, Annual Review of Marine Science 2 (2010), 231–51; Atholl Anderson, ‘Slow Boats from China: Issues in the Prehistory of Indo-China Seafaring’, Modern Quaternary Research in Southeast Asia 16 (2000), 13–50; Robert G. Bednarik, ‘Maritime Navigation in the Lower and Middle Paleolithic’, Earth and Planetary Sciences 328 (1999), 559–60; Robert G. Bednarik, ‘Seafaring in the Pleistocene’, Cambridge Archaeological Journal 13:1 (2003), 41–66.

2 Timothy F. Flannery, The Future Eaters: An Ecological History of the Australasian Lands and Peoples (Port Melbourne: Reed Books Australia, 1994); Anthony D. Barnosky et al., ‘Assessing the Causes of Late Pleistocene Extinctions on the Continents’, Science 306:5693 (2004): 70–5; Barry W. Brook and David M. J. S. Bowman, ‘The Uncertain Blitzkrieg of Pleistocene Megafauna’, Journal of Biogeography 31:4 (2004), 517–23; Gifford H. Miller et al., ‘Ecosystem Collapse in Pleistocene Australia and a Human Role in Megafaunal Extinction’, Science 309:5732 (2005), 287–90; Richard G. Roberts et al., ‘New Ages for the Last Australian Megafauna: Continent Wide Extinction about 46,000 Years Ago’, Science 292:5523 (2001), 1,888–92.

3 Stephen Wroe and Judith Field, ‘A Review of Evidence for a Human Role in the Extinction of Australian Megafauna and an Alternative Explanation’, Quaternary Science Reviews 25:21–2 (2006), 2,692–703; Barry W. Brook et al., ‘Would the Australian Megafauna Have Become Extinct if Humans Had Never Colonised the Continent? Comments on “A Review of the Evidence for a Human Role in the Extinction of Australian Megafauna and an Alternative Explanation” by S. Wroe and J. Field’, Quaternary Science Reviews 26:3–4 (2007), 560–4; Chris S. M. Turney et al., ‘Late-Surviving Megafauna in Tasmania, Australia, Implicate Human Involvement in their Extinction’, Proceedings of the National Academy of Sciences 105:34 (2008), 12,150–3.

4 John Alroy, ‘A Multispecies Overkill Simulation of the End-Pleistocene Megafaunal Mass Extinction, Science, 292:5523 (2001), 1,893–6; O’Connel and Allen, ‘Pre-LGM Sahul’, 400–1.

5 L. H. Keeley, ‘Proto-Agricultural Practices Among Hunter-Gatherers: A Cross-Cultural Survey’, in Last Hunters, First Farmers: New Perspectives on the Prehistoric Transition to Agriculture, ed. T. Douglas Price and Anne Birgitte Gebauer (Santa Fe: School of American Research Press, 1995), 243–72; R. Jones, ‘Firestick Farming’, Australian Natural History 16 (1969), 224–8.

6 David J. Meitzer, First Peoples in a New World: Colonizing Ice Age America (Berkeley: University of California Press, 2009).

7 Paul L. Koch and Anthony D. Barnosky, ‘Late Quaternary Extinctions: State of the Debate’, Annual Review of Ecology, Evolution, and Systematics 37 (2006), 215–50; Anthony D. Barnosky et al., ‘Assessing the Causes of Late Pleistocene Extinctions on the Continents’, 70–5.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *