1 of 2

ঝাউবীথি—বেলা তিনটে – যজ্ঞেশ্বর রায়

ঝাউবীথি—বেলা তিনটে – যজ্ঞেশ্বর রায়

বিপ্রদাস ঢালাই-লোহার বিরাট গেটটার সামনে এসে নেম-প্লেটটার দিকে তাকালেন : রায় বাহাদুর সূর্যনারায়ণ চৌধুরী, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, ব্লু ব্র্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড। নামের সেই সুদৃশ্য মর্মর-ফলকের দিকে না তাকিয়েও বিপ্রদাসের বুঝতে বাকি ছিল না যে, এই প্রাসাদোপম বাড়িখানাই বিখ্যাত শিল্পপতি সূর্যনারায়ণ চৌধুরীর। দূর থেকেই পথিকের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাড়িখানা। ব্যস্ত পথিকও মুহূর্তের জন্যে তার দিকে না তাকিয়ে পারে না—বাড়িখানার নির্মাণ-শৈলীই এমন অপূর্ব। বিপ্রদাস বহুদর্শী, তিনিও মুগ্ধ হলেন। সাম্প্রতিক কালের দৈত্যাকৃতি ইমারতগুলির মধ্যে কোনও শিল্প-রুচির পরিচয় মেলে না। আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও এ বাড়িখানা বিংশ শতাব্দীর শেষপাদের সেই রুচিবিকারের একটি ছন্দোবদ্ধ প্রতিবাদ।

বিপ্রদাস ঘড়ির দিকে তাকালেন। ঠিক তিনটে। ঘড়ির মর্যাদা রক্ষা করে চলতে তিনি সর্বদাই অভ্যস্ত। এক্ষেত্রে আরও একটু সতর্ক ছিলেন, কারণ সময় সম্পর্কে সতর্ক হবার নির্দেশ ছিল রায় বাহাদুরের পত্রে। পকেট থেকে পত্ৰখানা বার করে আর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন বিপ্রদাস :

রায় বাহাদুর সূর্যনারায়ণ চৌধুরী
শ্ৰীযুত বিপ্রদাস আচার্য ২, ঝাউ-বীথি

প্রিয় মহাশয়, কলিকাতা

কিছুদিন হইতে ব্লু ব্র্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস-এর কয়েকটি বিখ্যাত ঔষধ জাল হইতে থাকায় কোম্পানি অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছে। ইহার প্রতিকারোদ্দেশ্যে শ্ৰীযুত সূর্যনারায়ণ চৌধুরী আপনার সহিত পরামর্শ করিতে ইচ্ছুক। আপনি যদি আগামী কল্য (বুধবার) বেলা তিন ঘটিকার সময় উপরোক্ত ঠিকানায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন, তাহা হইলে তিনি অতিশয় আনন্দিত হইবেন। ওই সময়ে কোম্পানির কতিপয় ডিরেক্টরও উপস্থিত থাকিবেন। অতএব নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে আপনি অবহিত হইবেন। ইতি—

আপনার বিশ্বস্ত
শ্রীজ্যোতির্ময় দত্ত,
সেক্রেটারি

চিঠিখানা পকেটে রেখে বিপ্রদাস কম্পাউন্ডে ঢুকলেন। সুদৃশ্য ও বিচিত্র রঙের নানাবিধ বিলিতি গাছ লতা ও গুল্মের কেয়ারি করা আইল্যান্ডকে বেষ্টন করে কাঁকর-বিছানো প্রশস্ত পথ। পথের অদূর প্রান্তে মার্বেল পাথরের অর্ধচন্দ্রাকৃতি সোপান। সোপানশ্রেণী অতিক্রম করে বিপ্রদাস এসে দাঁড়ালেন দরজার সামনে।

দরজার গায়ে একটি ইলেকট্রিক বোতাম, তার তলায় কালো প্ল্যাস্টিক প্লেটে সাদা ইংরেজি হরফে লেখা—‘কল্‌’। বিপ্রদাস বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে গৃহাভ্যন্তরে কোথায় যেন ছন্দ-মধুর জলতরঙ্গ বেজে উঠল।

বিপ্রদাস তারিফ করলেন, সুদৃশ্য বাড়িখানার সঙ্গে ছন্দ-মধুর কলিং বেলের শব্দের সামঞ্জস্য অতুলনীয়। একটু পরে খট করে আওয়াজ হয়ে দরজা খুলে গেল ; কিন্তু দ্বার-রক্ষক তাঁকে যাবার জন্যে পথ ছেড়ে দিল না—হাত পেতে কার্ড চাইল।

বিপ্রদাস তাঁর নামাঙ্কিত কার্ডখানা না দেখিয়ে দেখালেন রায় বাহাদুরের কাছ থেকে পাওয়া আমন্ত্রণ পত্ৰখানা। সঙ্গে সঙ্গে দ্বার-রক্ষক সেলাম জানিয়ে সসম্রমে পথ ছেড়ে দিল তাঁর। সিঁড়ি দেখিয়ে বললে, ওপরে চলে যান।

কিন্তু বিপ্রদাস সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েই থমকে দাঁড়ালেন, সিঁড়ির অদূরে তিনটে বুলডগ্ একযোগে ঘেউ-ঘেউ করে উঠল তাঁকে দেখে। তাদের শিকলের ঝনঝন শব্দে তাঁর মনে হল, বুঝি-বা শিকল ছিঁড়ে বাঘা কুকুর তিনটে এক্ষুণি এসে তাঁর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে। কিন্তু না, শক্ত শিকল ছিঁড়তে তারা পারল না।

আশ্বস্ত হয়ে বিপ্রদাস ওপরে উঠে এলেন। একটা মস্ত হলঘরের এক প্রান্তে এসে সিঁড়ি শেষ হয়েছে। তারই নিকটে একসেট সোফা। গুটি পাঁচেক সাহেবী পোশাক-পরা পদস্থ লোক বসে আছেন সেখানে—নিঃসন্দেহে ডাইরেক্টারবর্গ। এদের মধ্যে ম্যানেজিং ডাইরেক্টার আছেন কিনা বুঝতে পারলেন না বিপ্রদাস। তিনি তাঁকে কখনো দেখেননি।

একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। এক ভদ্রলোেক তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ বিপ্রদাস নিকটস্থ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন, আপনি আমাকে চিনবেন না, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।

একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির সৌহার্দ্য স্থাপনের চেষ্টা দেখে বিপ্রদাসের ভ্রূ কুঁচকে আসছিল, কিন্তু অভ্যস্ত কৌশলে বঙ্কিম রেখাগুলিকে হাস্যে রূপান্তরিত করে তিনি নীরবে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোকের দিকে।

ভদ্রলোক বললেন, সাউথ ক্যালকাটার দারোগা কৃতান্তবাবু আপনার বিশিষ্ট বন্ধু। আলিপুরে যখন প্র্যাক্‌টিস করতাম তখন তার সঙ্গে আমারও বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তাঁর কাছেই আপনার অনেক গল্প শুনেছি। ক্রাইম ডিটেক্‌শনে আপনার অসাধারণ প্রতিভার অনেক কাহিনী বলেছেন তিনি আমাকে। আলিপুরে প্র্যাকটিস করার সময় আমি আপনাকে কয়েকবার কোর্টেও দেখেছি ; কিন্তু আলাপ করবার সৌভাগ্য হয়নি। বর্তমানে আমি হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করি। ব্লু ব্র্যান্ড ফার্মাসিউটিকাল ওয়ার্কসের লিগ্যাল অ্যাডভাইসার আমি। আমার নাম যতীন্দ্রবিমল গাঙ্গুলি। আর এঁরা চারজন হলেন কোম্পানির ডাইরেক্টার।

ডিরেক্টরদের দিকে মুখ ফিরিয়ে যতীন্দ্রবিমল বললেন, ইনিই হলেন সেই বিখ্যাত ডিটেকটিভ এবং ক্রিমিনোলজিস্ট বিপ্রদাস আচার্য।

তাঁরা উঠে বিপ্রদাসের নিকটে এলেন এবং একে একে হাত বাড়িয়ে দিতে লাগলেন। বিপ্রদাস করমর্দন করতে লাগলেন, যতীন্দ্রবিমলও একে একে তাদের পরিচয় দিতে লাগলেন তাঁর কাছে : ইনি হচ্ছেন সুবোধকুমার বক্সী, হার্ডওয়্যার মার্চেন্ট ; ইনি জনার্দন সোম, ব্যাঙ্কার অ্যান্ড জমিন্দার ; ইনি ইন্দ্রনারায়ণ সামন্ত, কেমিস্ট, আর ইনি হচ্ছেন ভবানীপ্রসাদ শাসমল, জেনারেল ম্যানেজার বি-বি-পি-ডব্লু।

আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আনন্দিত হলাম। আরও আগে আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া উচিত ছিল।—আসন গ্রহণ করে বললেন বিপ্রদাস।

সেইটে আমাদের তরফ থেকেই আরও আগে হওয়া উচিত ছিল, মিস্টার আচার্য। তবু একেবারে না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়াও ভাল। কয়েক লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে মিঃ আচার্য, কিন্তু আর নয়। এবার আমরা বদ্ধপরিকর। জালিয়াতি বন্ধ করবই, যে করেই হোক ধরব জালিয়াৎকে। সেইজন্যেই আজ এ সময়ে আমাদের এখানে আগমন, আপনারও আমন্ত্রণ।

কিন্তু আপনাদের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, তিনি কোথায়? সময় সম্পর্কে আমাকে সতর্ক করে নিজেই অসতর্ক হয়ে পড়েছেন দেখছি। আমাকে তিনি তিনটায় দেখা করবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন ।

তিনটার সময় মিটিং হবার কথা জানিয়ে তিনি আমাদের তিনটের একটু আগেই আসবার জন্যে পত্র দিয়েছিলেন।—জানালেন সুবোধবাবু।

তবে? তিনি কি কোন জরুরী প্রয়োজনে বাইরে গেছেন কোথাও?

না।—হলের অপর প্রান্তের একটা ঘরের দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করে বললেন জনার্দনবাবু, ওই ঘরেই আছেন তিনি। এটা তাঁর বিশ্রামের সময়। মধ্যাহ্ন-ভোজনের পরে এখানে তিনি ঘণ্টা দুই পড়াশোনা করেন এবং তারই ফাঁকে একটু ঘুমিয়েও নেন কখনো কখনো।

আমাকে ডেকে পাঠিয়েও ঘুমোবেন নাকি তিনি? আপনাদের ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের সেক্রেটারিটি কোথায়—যিনি আমাকে পত্র পাঠিয়েছিলেন?

আমাদেরও তিনিই পত্র পাঠিয়েছিলেন।

আমাদের তিনটের সময় ডেকে পাঠিয়ে তিনিও সেইটে ভুলে গেলেন নাকি? কোথায় তিনি?—শুধালেন বিপ্রদাস।

ওই তো, রায় বাহাদুরের লাইব্রেরি-রুমের পাশের রুমে।—বললেন যতীন্দ্রবিমল।

ডাকুন না তাঁকে। আমার জানা দরকার আরও পরে আসব, না আর একটু বসব।

একজন দারোয়ান অদূরে ছিল, সেক্রেটারিকে ডাকবার জন্যে তাকে ইঙ্গিত করলেন যতীন্দ্রবিমল।

দারোয়ান গিয়ে বন্ধ দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল, বাবু····

হ্যাঁ, এই আসছি—আসছি। উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন জ্যোতির্ময় দত্ত। এবং সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন।

বাবুর উঠবার সাড়া পেয়ে দারোয়ান দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়াল। জ্যোতির্ময় দত্ত দুই বগলে দুটি বিরাট ফাইল নিয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, ওকি! আপনারা সব ওই কোণায় বসে বসে কি করছেন?·····এই দারোয়ান, সোফা টেবিল ইধার লে আও।

ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। দুটি দারোয়ান ছোটাছুটি করে কয়েক মিনিটের মধ্যে হলের মাঝখানে সোফা সেট পেতে দিল। জ্যোতির্ময় দত্ত তাঁর বগলের ফাইলগুলো টেবিলের ওপর রেখে শুধোলেন, কি ব্যাপার, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এখনও বেরোননি নাকি?

বেরোবেন কি, বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন।—বললেন সুবোধকুমার।

বোধ হয় কি, নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু আপনারা ডাকেননি কেন? এ যে প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে—। বলে জ্যোতির্ময় নিজেই এগিয়ে গেলেন। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু টোকা দিলেন, কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া এল না। তখন তিনি ডাকতে লাগলেন, স্যার, তিনটে যে বেজে গেছে—

এবার অসন্তুষ্ট কণ্ঠের তীক্ষ্ণ সাড়া এল : সে আমি জানি। বিরক্ত কর না—আমি একটু ব্যস্ত আছি। ওঁদের আরও এক ঘণ্টা বসতে বল।

জ্যোতির্ময় নিঃশব্দে দুয়ার থেকে ফিরে এলেন তাঁদের কাছে। বললেন, রায় বাহাদুর⋯·

বিরক্ত ইন্দ্রনারায়ণ বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, থাক, আর ফিরে শোনাতে হবে না। আমরা কালা নই।

জ্যোতির্ময় একটা সোফায় বসে পড়ে পকেট থেকে সিগারেটের টিন বার করতে করতে বললেন, বিরক্ত হবার কথাই বটে। তবু আমার ওপরে চটে লাভ কি? নিন, সিগারেট খান।—বিপ্রদাসেরও দিকে একটা বাড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, নিন বিপ্রদাসবাবু।

যতীন্দ্রবিমল দিয়াশলাই জ্বালিয়েছিলেন। নিজেরটা ধরিয়ে, কাঠিটা তিনি বিপ্রদাসের দিকে এগিয়ে ধরলেন।

বিপ্রদাস উঠে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা ধরালেন, কিন্তু আর বসলেন না। ঘুরে ঘুরে হলের চারদিকে বেড়াতে লাগলেন। মস্ত হল। দক্ষিণ দিকের তিনখানা ঘর বাদে সমগ্র দ্বিতলটাই একটা হল বলে মনে হল তাঁর। রায় বাহাদুর নিজের কোম্পানি ছাড়াও আরও অনেক কাজ-কারবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সে-সবের ডিরেক্টর-বোর্ডের সভা, ম্যানেজিং কমিটির সভা বোধ হয় এখানেই হয় ; অন্তত মনের মধ্যে সেই মতলব রেখেই হলটাকে করা হয়েছে। বেশ সুসজ্জিত ও সুচিত্রিত হল। ছবির কালেকশনের মধ্যেও উচ্চ শিল্প-রুচির পরিচয় মেলে। দেখে মনে হয়, রায় বাহাদুর শুধু আর্থিক উন্নতিই করেননি, রুচিবোধেরও উন্নতি সাধন করেছেন। এ যে পরম নিষ্ঠায় জাতীয়-সংস্কৃতির সাথে পরিচয় রাখার ফল—তাতে সন্দেহ রইল না বিপ্রদাসের। গৃহাভ্যন্তর থেকে এইমাত্র যে ব্যক্তির কর্কশ কণ্ঠ শুনে ইন্দ্রনারায়ণ বিরক্তি প্রকাশ করলেন, তিনি যে এখানে শুধু ঘুমানই না—মনোযোগ দিয়ে, পড়াশুনাও করেন, ভেবে মনে মনে বিপ্রদাস তাঁর প্রতি শ্রদ্ধান্বিত না হয়ে পারলেন না।

কিন্তু পায়চারি করে করে বিপ্রদাসের ভাল লাগছিল না। টেবিলের নিকটে এসে তিনি আর একটা সিগারেট তুলে নিলেন। যতীন্দ্রবিমলকে বললেন, দেখি দিয়াশালাইটা।

যতীন্দ্রবিমল একটা কাঠি জ্বেলে ধরলেন তাঁর মুখের সিগারেটের ওপরে।

সিগারেট ধরিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বিপ্রদাস সিলিং-এর দিকে তাকালেন। সেখানে রাজহাঁস, হরিণ, গাছ প্রভৃতির ঝাঁঝরি-কাটা চিত্রের ফোকর দিয়ে অনবরত ফুরফুরে হাওয়া এসে হলটাকে শীতল করে রাখছিল। ফ্যান আর ফ্যাশন নয় আজকাল। ইলেকট্রিক সাকারের সাহায্যে বাতাস আকর্ষণ করে, এমোনিয়াম ওয়াটার-লোশনের মধ্য দিয়ে চালিয়ে তাকে শীতল করে পরিবেশন করা হয়। আধুনিক বিজ্ঞান ধনীদের মস্তিষ্ক শীতল রাখবার, টাকার গরম কমিয়ে দেবার কি চমৎকার ব্যবস্থা করেছে। ইলেকট্রিক আলোগুলোই কি কম সুন্দর। সিলিং থেকে যেন থোকা থোকা আঙ্গুর ঝুলে আছে। দেয়ালের আলোগুলো যেন এক-একটা এক-এক জাতের মৌসুমী ফুল।

বিপ্রদাস চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠে বললেন, নাঃ, বসে বসে আর ভাল লাগছে না। আমি একটু ঘুরে আসি জ্যোতির্ময়বাবু। আমার একটা জরুরী কাজও সারা হবে, সময়ও কাটবে।

আরে বসুন, এই পাথর-গলা চৈত্রের রোদ্দুরে আবার কোথায় যাবেন?

বসে বসে শীতল বাতাস খাওয়ার ভাগ্য নিয়ে আসিনি যতীনবাবু। রোদ-বর্ষা সমানে মাথায় করে ছুটোছুটি করতে হয়—তবে দু’মুঠো জোটে।—বললেন বিপ্রদাস।

কিন্তু ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসে রায় বাহাদুর যদি আপনাকে খোঁজেন?—বললেন জ্যোতির্ময়।

এক ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি দেরি করব না। তার মানে, ওঁর বেরোবার আগেই আমি এসে পৌঁছে যাব।—বলে নেমে এলেন বিপ্রদাস। কুকুরগুলো তাঁকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। দারোয়ান ধমক দিতে আবার থেমে গেল।

বিপ্রদাস শুধোলেন, কুকুরগুলো মানুষ দেখলে এমন চেল্লায় কেন?

মানুষ দেখলেই চীল্লায় না বাবু, নয়া মানুষ দেখলে চীল্লায়। আপনাকে নয়া দেখছে, তাই—

কিন্তু এই চেন-বকলেশ দেখে তো মনে হচ্ছে কুকুরগুলোও পুরোন নয়।

নয়াই তো হুজুর। দু’ মাহিনা হল খরিদ হয়েছে। লেকিন এর মধ্যেই অনেক লোক চিনে ফেলেছে—তাদের দেখে এখন আর চীল্লায় না।

দু’ মাহিনা আগে যে কুকুর ছিল, সে কোথায়?

দু’ মাহিনা আগে তো কুকুর ছিল না বাবু। এ বাড়িতে ক্যভি কুকুর ছিল না।

কেন?

বড়বাবু—রায় বাহাদুর, সমঝেছেন? কুত্তা-বিলাই কুচ পছন করেন না। বিলাই তো একদম দেখতেই পারেন না, ওয়াক থু বমি করেন। কুত্তাসে ভি বহৎ ঘেন্না।

তবে এই কুত্তা কেন?

বাড়িতে চোর ঢুকেছিল, সেই দোতলায় উঠে গিয়েছিল। দো-তিনদিন এই কাণ্ড। তখন আর কি করেন, সবাইর পরামর্শে এই ডালকুত্তা খরিদ হল বাবু।

হুঁ, বহুৎ আচ্ছা সিং জী।—বলে বিপ্রদাস বেরিয়ে এলেন।

এলেন সোজা নিজের অফিসে। সেখানে সহকারী স্নেহাংশু দাসকে কতিপয় প্রয়োজনীয় উপদেশ-নির্দেশ দিয়ে, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বিপ্রদাস। কিন্তু শত চেষ্টা করেও চারটার আগে হাতের জরুরী কাজগুলি শেষ করে উঠতে পারলেন না। নিজের অফিসে তিনি যখন পুনরায় ফিরে এলেন, তখনই চারটা বেজে গেছে।

এক ভদ্রলোককে নিয়ে বিপ্রদাসের অপেক্ষায় স্নেহাংশু অফিসে বসেছিল। তার সংগৃহীত কয়েকটি জরুরী সংবাদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে লোকটিকে নিয়ে বেরোতে বেরোতে বিপ্রদাস প্রায় সওয়া চারটে সেখানেই বাজিয়ে ফেললেন।

বিপ্রদাস যখন সূর্যনারায়ণের বাড়ির গেটের কাছে গাড়ি থামালেন, তখন তাঁর ভ্রূ সহসা অতিশয় বঙ্কিম হয়ে উঠল। যাবার সময়-তিনি চারজন ডিরেক্টরের চারখানা গাড়ি দেখে গিয়েছিলেন, এখন সেখানে ছ’খানা। দু’খানা গাড়ি বেড়ে গেছে বলে মনের মধ্যে এই সংশয়িত জিজ্ঞাসা নয় বিপ্রদাসের। তাঁর ভ্রূ-ভঙ্গির কারণ ঘটেছিল পুলিশের একখানা জীপ আর ডাঃ সরকারের রেড-ক্রশ আঁকা সিডানখানা দেখে। ডাইরেক্টর-বোর্ডের সভায় পুলিশ আর ডাক্তারের প্রয়োজনটা তিনি খাপ খাওয়াতে পারলেন না। মুখে তাঁর একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল। বেশ একটু অন্যমনস্কই হয়ে গেলেন তিনি।

গাড়ি থেকে নেমে বিপ্রদাস তাঁর পাশের ভদ্রলোককে বললেন, গাড়িতেই বসে থাকুন হীরালালবাবু, আমি হয়তো এক্ষুণি এসে যাব। কিছু বিলম্ব ঘটলেও বিরক্ত হবেন না। খুব বেশি বিলম্ব ঘটবে মনে হলে আমি আপনাকে ওপরে ডেকে নিয়ে যাব।

হীরালালবাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। বিপ্রদাস আর বিলম্ব না করে দীর্ঘ পদক্ষেপে লাল কাঁকরের পথ ধরে অগ্রসর হলেন। এবার আর কলিং বেল টিপতে হল না, তাঁকে দেখে দ্বাররক্ষী আগেই দরজা খুলে অপেক্ষা করছিল। বিপ্রদাস নিকটে এলে সেলাম জানিয়ে সে একপাশে সরে দাঁড়াল। বিপ্রদাসের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তাঁর মন একটা বিশেষ বিষয়ের মধ্যে মগ্ন, নিবদ্ধ হয়ে গেছে বলে মনে হল। তিনি তরতর করে দ্বিতলে উঠে গেলেন। হলের মধ্যে একদল নিঃশব্দ শোকার্ত মানুষের সঙ্গে চোখোচোখি হল তাঁর।

কি ব্যাপার?—শুধালেন বিপ্রদাস।

যতীন্দ্রবিমল অভিভূত কণ্ঠে বললেন, রায় বাহাদুর নেই।

মানে?

ডাঃ সরকার বললেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন ।

সেকি! কখন?

তা ঘণ্টাখানেক কি তার কিছু বেশিই হবে।

তার মানে?—বিপ্রদাস তাঁর হাত-ঘড়ির দিকে তাকালেন, এখন সাড়ে চারটে বাজে, তাহলে সাড়ে তিনটেয় কি সওয়া তিনটেয় তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলতে চান?

হ্যাঁ, আমি মৃতদেহ পরীক্ষা করেছি।

কিন্তু সওয়া তিনটেয় তো তিনি ঘরের ভেতর থেকে কথা বলছিলেন না জ্যোতির্ময়বাবু? আপনি দরজায় টোকা মেরে ডাকলে তিনি রাগ করে বলে উঠেছিলেন না—‘সে আমি জানি। বিরক্ত কর না, আমি একটু ব্যস্ত আছি। ওঁদের আরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে বল।’

সুবোধ বক্সী, জনার্দন সোম, ইন্দ্রনারায়ণ সামন্ত—সবাই একযোগে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

জনার্দন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, আশ্চর্য! তিনি আত্মহত্যা করলেন, অথচ আমরা এমনি কানের মাথা খেয়ে বসেছিলাম যে, একটু টেরও পেলাম না!

টের পাবার কথা বলছেন কেন?

বারে, রিভলবারের গুলির শব্দ হবে না?

রায় বাহাদুর রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেছেন?

হ্যাঁ—জবাব দিলেন ডাক্তার, আসুন না, দেখবেন!

বিপ্রদাসকে নিয়ে পুনরায় সকলে ঘরে ঢুকলেন। বিপ্রদাস ঘরে ঢুকলে দু’জোড়া চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হল তাঁর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিলেন : মিস প্রতিমা রায়, রায় বাহাদুরের প্রথম পক্ষের মেয়ে। মিসেস জ্যোৎস্না রায়, রায় বাহাদুরের বর্তমান সহধর্মিণী।

প্রতিমার মতই চেহারা মিস প্রতিমা রায়ের। রায় বাহাদুরের প্রথম পক্ষের স্ত্রী অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন বোঝা গেল। পাতলা গড়ন বলে প্রতিমাকে একটু রোগা দেখায় ; কিন্তু গায়ের রংয়ে সুস্বাস্থ্যের সুষমা দৃষ্টি এড়ায় না। বয়স বাইশ-তেইশ। চোখে চশমা ব্যবহার করে। এখন নেই। আলুথালু বেশ সংযত করে একপাশে সরে দাঁড়াল সে।

মিসেস জ্যোৎস্না দেবীও স্বামীর পাশ থেকে উঠে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। বয়স তাঁর তিরিশ-পঁয়ত্রিশ। একটু স্থূল আর কালো তিনি। কিন্তু প্রসাধন-পারিপাট্যের ফলে রঙটা অপেক্ষাকৃত ফর্সা দেখাচ্ছে। ভদ্রমহিলা যে খুব বিলাসী, তা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই বলা যায়। হাল্কা আসমানী-রঙের অর্গেন্ডির ব্লাউজের নিচে থেকে শুভ্র ভেস্ট সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গালে-গলায়-কপালে আর কানের পিঠে রঙীন পাউডারের সূক্ষ্ম ছোঁয়াচ বিপ্রদাসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারল না। শ্যাম্পু-করা চুলের মৃদু গন্ধও নাকে গেল তাঁর। মনে হবে তিনি বোধ হয় কোথাও কোন পার্টিতে বা জলসায় যাবার জন্যে বেরোবেন, এমন সময় এই দুর্ঘটনা। কিন্তু বিপ্রদাস অভিজ্ঞ ব্যক্তি। বুঝলেন, কোথাও না বেরোলেও সজ্জা-পারিপাট্যে তাঁর শৈথিল্য নেই—এ তাঁর নিত্যকার অভ্যস্ত সজ্জা।

প্রতিমার সজ্জায় পারিপাট্য নেই, কিন্তু অভিজাত-সম্প্রদায়-সুলভ স্টাইলটি পরিষ্কার প্রতীয়মান হয়। জ্যোৎস্না দেবীর মত অলঙ্কারের অহঙ্কার নেই দেহের কোথাও। গলায় সরু মফ্‌চেন, হাতে সোনার সরু বালা মাত্র দু’গাছা। পরনে রেশমজাতীয় উজ্জ্বল তন্তুর শুভ্র শাড়ি, আধ ইঞ্চি চওড়া সোনালী জড়ির পাড় বসানো তাতে। পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে অত্যন্ত অভিভূত হয়ে সে যে আছাড়ি-পিছাড়ি করে কাঁদছিল কিছুক্ষণ, তা তার চোখ-মুখ-চুল ও পোশাক দেখে বুঝতে বাকি থাকে না। জ্যোৎস্না দেবীও খুব অভিভূত হয়ে পড়েছেন ; কিন্তু প্রতিমার মত বয়স তাঁর অল্প নয় বলে এবং বাইরের লোক সামনে বলে হয়ত সামলে রয়েছেন তিনি—তার মত এমন আত্মবিস্মৃত আবেগ প্রকাশিত হয়নি তাঁর।

বিপ্রদাস এবার মৃতের ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। কপালের দক্ষিণ পার্শ্বে গুলিবিদ্ধ হয়ে রায় বাহাদুরের মৃত্যু ঘটেছে। ক্ষতের চারধারে বারুদের চিহ্ন থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, গুলি খুব নিকট থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। জানলার তলায় রায় বাহাদুর এলোমেলো হয়ে পড়েছিলেন। বোধ হয় জানলার ওপরে তিনি ভর করে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, অসমর্থ হয়ে পড়ে গেছেন। তখনই হয়তো শিথিল হাত থেকে রিভলবারটা ছিটকে গিয়ে থাকবে। হাতখানেক দূরে একটা আলমারির ধারে রিভলবারটা দেখে তাই মনে হয়।

বিপ্রদাস মৃতের সামনে থেকে উঠে এবার জানলাটা পরীক্ষা করলেন। জানলার ঠিক বিপরীত দিকে একটা ফ্যাক্টরির সুউচ্চ প্রাচীর, একেবারে নিরন্ধ্র নিরেট। ফ্যাক্টরি আর বাড়ির মাঝখানে একটি অনতিপরিসর রাস্তা। বেশি ভিড় নেই। কোলাহলও নেই বেশি। ফ্যাক্টরির দিকের ফুটপাথটা একটু প্রশস্ত ; সেধার দিয়েই পয়দলে চলে লোকজন। এধারের সরু ফুটপাথে কোন পথিকের সচরাচর পা পড়ে না। কাছে-দূরে কাউকে দেখলেনও না বিপ্রদাস ; শুধু ডান দিকে সেক্রেটারির ঘরের জানলা বরাবর ফুটপাথে একটা কুকুর কি একটা কালো বস্তু নিয়ে খেলা করছে।

পথ থেকে ঘরের মধ্য ঘাড় ফেরাবার কালে জানলার ডান দিকের দেয়ালে রক্তের ছিটা নজরে পড়ল বিপ্রদাসের। গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্ত ফিনকি দিয়ে ছুটেছিল, তারই চিহ্ন।

দারোগাবাবু বললেন, আর কি দেখছেন বিপ্রদাসবাবু, এ পরিষ্কার আত্মহত্যা, হত্যাকাণ্ড নয়।

ডাঃ সরকার ঘাড় কাৎ করলেন : আমিও দারোগাবাবু সঙ্গে একমত।

দারোগাবাবু বললেন, একমত না হয়ে কারো উপায় নেই। এই ঘরে একটি মাত্র দরজা, প্রবেশ-প্রস্থানের একটিমাত্র পথ! এই বিরাট জানলাটির শিক নেই বটে, কিন্তু এ পথেও কারো ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়। কারণ জানলার বিশ গজের মধ্যেও কোন পাইপ নেই। রাস্তার ওপারের ফ্যাক্টরির প্রাচীরেও কোন জানলা, নেই যে সেখান থেকে কেউ রায় বাহাদুরকে গুলি করবে।

তা করলেও এত দূরের থেকে গুলি লাগলে তার ক্ষত এমন হয় না।—বললেন ডাঃ সরকার।

দারোগাবাবু দরজার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, তাহলে একমাত্র পথ থাকে দরজা, যে পথে আততায়ী ঘরে ঢুকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আততায়ীর পক্ষে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে ঘরে ঢোকা এবং হত্যা করে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষত যখন বেলা তিনটে থেকে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হলে বসে আছেন।

আমাদের চারজন ডাইরেক্টর তো পৌনে তিনটে থেকে উপস্থিত। তিনটের সময় বিপ্রদাসবাবু স্বয়ং এসেছেন।—যোগ দিলেন জ্যোতির্ময় : বিপ্রদাসবাবু অবশ্য মিনিট কুড়ি থেকে চলে যান।

তার পরেই আসেন অম্বিকাবাবু—আমাদের আর একজন ডাইরেক্টর।—বললেন সুবোধকুমার : আর প্রথমাবধি আমরা সবাই হলঘরে। এঘরে কাউকে ঢুকতে বা বেরিয়ে যেতে আমরা দেখিনি।

আপনারা গুলির শব্দ শুনেছিলেন?

না, তাও কেউ শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।

অথচ এত কাছে থেকে রিভলবারের শব্দ আপনাদের কানে আসা উচিত ছিল না কি?

জনার্দ্দন সোম বললেন, দরজা ভাল করে বন্ধ করে দেওয়া থাকলে গুলির শব্দ শোনা নাও যেতে পারে, কি বলেন দারোগাবাবু?

তা না হলে তো আপনারা শুনতেই পেতেন।—জবাব দিলেন দারোগাবাবু।

দরজা কি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল?—শুধোলেন বিপ্রদাস।

না, এয়ারকন্ডিসন করা ঘরের দরজার ভারী পাল্লা আপনা থেকে চেপে বন্ধ হয়ে থাকে, তাই ছিল।—বললেন একজন।

রায় বাহাদুর আত্মহত্যা করেছেন, কে দেখলেন সর্বপ্রথম?

চারটে বাজার পরেও রায় বাহাদুরের আসার নাম নেই দেখে আমরা জ্যোতির্ময়কে বললাম, রায় বাহাদুর হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন, আপনি গিয়ে ডেকে তুলন।—যতীন্দ্রবিমল বলে চললেন, জ্যোতির্ময় গিয়ে প্রথমে দরজায় টোকা দিলেন, সাড়া না পেয়ে উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন বার দুই, তখনও রায় বাহাদুর সাড়া দিলেন না দেখে জ্যোতির্ময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে গিয়েই একেবারে আর্তস্বরে চিৎকার করে ওঠেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ছুটে যাই। সোরগোল পড়ে যায়। তিনতলা থেকে ওঁরা নেমে আসেন, কেউ ডাক্তার ডাকে, কেউ পুলিশে খবর দেয়·····

বিপ্রদাস একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

দারোগাবাবু বললেন, এ আত্মহত্যা ছাড়া কিছু নয় বিপ্রদাসবাবু। এর মধ্যে আর নাক গলিয়ে লাভ নেই আপনার।

বিপ্রদাস, একটা বুকসেল্‌ফ-এর ওপরে কনুই রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, আত্মহত্যা ছাড়া আপাতদৃষ্টিতে একে আর কিছু মনে হয় না ঠিকই দারোগাবাবু।

হ্যাঁ, এ আত্মহত্যাই। দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন দারোগাবাবু।

বিপ্রদাস কোন জবাব দিলেন না। তাঁর শূন্য দৃষ্টি বার বার একজনের মুখের ওপর থেকে আর একজনের মুখের ওপরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু তিনি যে ঠিক কাউকে দেখছিলেন বা কারো মনোভাব বোঝবার চেষ্টা করছিলেন, তা নয়। মনে হচ্ছিল, তিনি তাঁর নিজের মনের মধ্যে ডুবে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছেন, সেখানে কি একটা হারানো বস্তু তিনি প্রাণপণে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। কখনো সেটা বুঝি হাতে ঠেকছে, কখনো বা ফস্‌কে যাচ্ছে। তাই ক্ষণে ক্ষণে তাঁর ললাট ভ্রূকুটিকুটিল হয়ে উঠছে।

বিপ্রদাসের এই মগ্ন অন্যমনস্ক অবস্থার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ প্রতিমা উঠে এসে তাঁর হাত দুটো চেপে ধরল। বলল, একে আত্মহত্যা বলে আপনি যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। আপনার মনের কোথায় যেন একটা সংশয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে বড় বেশি করে আপনাকে নাড়া দিচ্ছে। আমারও সেই সংশয়, বিপ্রদাসবাবু। আমারও কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, বাবা আত্মহত্যা করেছেন। আমি আপনাকে কোনদিন দেখিনি, কিন্তু নাম শুনেছি—বাবাকেই বার বার আপনার নাম করতে শুনেছি আমি। তিনি আমাকে বলেছেন, আপনি একজন বিচক্ষণ গোয়েন্দা। আপনার সাহায্য নেওয়া তাঁর বিশেষ প্রয়োজন বলে কয়েকবার তিনি উল্লেখ করেছেন।

হঠাৎ বিপ্রদাসের চোখ চকচক করে উঠল। শুধোলেন, কবে থেকে আপনার বাবা আমার নাম বারবার উল্লেখ করেছেন, মনে করতে পারেন কি মিস রায়?

হ্যাঁ, গত দু’মাস থেকে।

বাড়িতে চোর ঢোকার পর থেকে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন! তাহলে কি সে চোর নয় বিপ্রদাসবাবু? খুনে? বাবাকে খুন করতে এসেছিল? বাবা সেইজন্যেই বোধ হয় খুব জোয়ান-মদ্দ দেখে তিনটে ডালকুত্তা কিনে এনেছিলেন—যদিও কুকুর-বেড়াল দু’চক্ষের বিষ ছিল তাঁর। তবে কি কেউ তাঁকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করছে, এই আশঙ্কায় বাবা আপনার কথা বারবার বলতেন?

কি জানি! কিন্তু ঔষধ জালের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করবার জন্যেই তিনি আজ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

হয়তো সেই সঙ্গে তাঁর মনের সংশয়ের কথা বলে বাবা আপনার সাহায্য চাইতেন। বেঁচে থেকে সে-সাহায্য চাইবার তাঁর অবসর হয়নি। তাই বলে আপনি যেন চলে যাবেন না বিপ্রদাসবাবু। হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্যে তাঁর মেয়ে বেঁচে আছে। আপনি দয়া করে তাকে সাহায্য করুন। আমি আপনাকে আমার গোয়েন্দা নিযুক্ত করছি।

তাঁর চিঠিটাকেই আমি নিয়োগ-পত্র মনে করে নিয়েছিলাম মিস রায়। কিন্তু সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, কিসে আপনার সন্দেহ হল আপনার বাবা আত্মহত্যা করেননি?

আমার বাবা অতি দরিদ্র অবস্থা থেকে আজকের এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছিলেন। তাঁর জীবনের ওপর দিয়ে বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা, দুঃখ-বিপদ গেছে। মায়ের মুখে শুনেছি, আমার জ্ঞান হবার পরেও দেখেছি, তিনি সর্ব অবস্থাতেই অটল অবিচল রয়েছেন। তাঁর অসাধারণ ধৈর্য ছিল, চিত্তের দৃঢ়তা ছিল অপরিসীম। তিনি কোন বিপদকেই বিপদ বলে গ্রাহ্য করতেন না, এমনি ছিল তাঁর জেদ। অকারণ হতাশায়, সংশয়ে তিনি আত্মহত্যা করবেন, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিনি বিপ্রদাসবাবু।

সত্যিই তাঁর আত্মহত্যার কারণ কি কেউ অনুসন্ধান করেছেন আপনারা?

দারোগাবাবু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, পুলিশকে আপনারা—ডিটেকটিভরা ভারি ঘৃণা করেন। তারা বোকা, কিচ্ছু বোঝে না—এই আপনাদের ধারণা। কিন্তু সব সময় তা নয়।—পকেট থেকে একগাদা কাগজ বার করে তিনি বিপ্রদাসের সামনে মেলে ধরলেন : আমি এসেই এগুলি হস্তগত করেছি।

কি এগুলো? বিপ্রদাস হাত বাড়িয়ে কাগজগুলো নিলেন।

দারোগাবাবু বললেন, এই টেলিগ্রাম তিনখানা আজ সকালে এসেছে। আসাম থেকে আসামের স্টকিস্ট পাঠিয়েছে একখানা, সিংহলের সোল এজেন্ট পাঠিয়েছে দু’খানা, আর এই চিঠিখানা আরাকানের এজেন্টের। তারা এই খালি মোড়কটাও পাঠিয়েছে। কোম্পানির বিরুদ্ধে তাদের মস্ত অভিযোগ। তাদের মতে, কোম্পানিই ভেজাল চালাচ্ছে আজকাল। নইলে ওষুধের মোড়কে ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের স্বাক্ষর থাকা সত্ত্বেও তা জাল হয় কি করে? ওষুধের বদলে থাকে খড়ির গুঁড়ো।

মোড়কের স্বাক্ষরটা দেখি!—হাত বাড়ালেন বিপ্রদাস।

দারোগাবাবু স্বাক্ষরটা দেখিয়ে মোড়কটা বিপ্রদাসের হাতে দিলেন।

বিপ্রদাস ডাইরেক্টরদের দিকে তাকিয়ে শুধোলেন, প্রত্যেক মোড়কে রায় বাহাদুর নিজে স্বাক্ষর করতেন?

অম্বিকা মুখার্জি বললেন, আমাদের টাইফয়েড ক্যাপসুলটা অত্যন্ত কার্যকরী ওষুধ—অত্যন্ত দামীও বটে। কিন্তু খুবই জনপ্রিয়। অসাধারণ কাটতি দেখে বাজারে এর ব্যাপক জাল বেরোতে শুরু করে, নানা দিক থেকে নানারকম অভিযোগও আসতে থাকে। তখন আমাদের ডাইরেক্টর-বোর্ডের এক সভায় সাব্যস্ত হয়, অতঃপর এই ওষুধের প্রত্যেক মোড়কে রায় বাহাদুর নিজে সই করবেন, তবে মাল বাজারে ছাড়া হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই সইকরা মোড়কের মধ্য থেকেও ভেজাল ওষুধ বেরোচ্ছে।

মোড়কের এই স্বাক্ষর রায় বাহাদুরের নিজের কিনা জানেন?—শুধোলেন বিপ্রদাস।

অম্বিকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এ স্বাক্ষর যে রায় বাহাদুরের, তাতে আমাদের কারো সন্দেহ নেই।

জ্যোতির্ময় একটা ফাইল থেকে রায় বাহাদুরের স্বাক্ষর করা একখানা চিঠি হাতে দিলেন বিপ্রদাসের। মোড়কের স্বাক্ষর আর এ চিঠির স্বাক্ষর একই ব্যক্তির বলেই মনে হল বিপ্রদাসের। শুধোলেন, মোড়কে ওষুধ ভরার পর রায় বাহাদুর স্বাক্ষর করতেন, না আগে?

সুবোধবাবু হেসে বললেন, আগে স্বাক্ষর করবার কোন অর্থ হয় নাকি? মাল ভরে এলে তবে তিনি স্বাক্ষর করতেন। তারপর মাল বাজারে ছাড়া হত।

দারোগাবাবু হেসে বললেন, এখন আত্মহত্যার অর্থ বুঝলেন তো বিপ্রদাসবাবু? ওরা সবাই শাসিয়েছে, মামলা করবে। মামলা করলে কোথাকার জল কোথায় দাঁড়াবে ঠিক নেই বলে রায় বাহাদুর আত্মহত্যা করে মানরক্ষা করেছেন।

প্রতিমা প্রতিবাদ করে উঠল, মৃতের প্রতি এ অত্যন্ত অপমানসূচক উক্তি।

দারোগাবাবু হাত জোড় করে বললেন, আমার উক্তির জন্যে আমি দুঃখিত। কিন্তু এ ছাড়া আর কি সিদ্ধান্তই বা করা যায় বলুন?

বিপ্রদাস বললেন, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি নে, আমাকে ডেকে পাঠালেন, অথচ আমার সঙ্গে একটা কথাও না বলে তিনি সাত-তাড়াতাড়ি আত্মহত্যা করে বসলেন কেন?

আপনার সঙ্গে পরামর্শ করে আত্মহত্যা করবেন, এমন কোন চুক্তি তাঁর সঙ্গে আপনার ছিল নাকি বিপ্রদাসবাবু?

বোধ হয় ছিল, নয়তো এ চিঠি তিনি লিখতেন না।—বিপ্রদাস পকেট থেকে চিঠিখানা তুলে দারোগাবাবুর হাতে দিলেন। বললেন, এই পত্রখানাকেই নিয়োগপত্র ধরে নিয়ে, গতকাল সকালে পত্রখানা পেয়েই রায় বাহাদুরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার অপেক্ষায় না থেকে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করি। বিষয়টা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ওয়াকিবহাল হয়ে থাকার ইচ্ছেটাই ছিল তার পেছনে। তখন বুনো হাঁস খোঁজার মত এলোপাথারি কিছু তদন্ত করেছি ; কিন্তু আজ বেলা তিনটেয় এখানে এসে আবহাওয়াটাকে খুব স্বাভাবিক বলে বোধ হল না আমার। একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ যেন বড় উগ্র হয়ে এসে নাকে লাগল। আমার মন ছটফট করে উঠল, আমি আর থাকতে পারলাম না। জ্যোতির্ময়ের জিজ্ঞাসার জবাবে ঘরের ভেতর থেকে রায় বাহাদুর আমাদের যখন আরো এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে বললেন, সেই অবসরে আমি একটা বিশেষ সূত্র ধরে তদন্ত করবার জন্যে বেরিয়ে পড়ি। তদন্তের ফল এমনই সন্তোষজনক হল যে, ফিরে এসে যখন আপনাদের কাছে শুনলাম রায় বাহাদুর আত্মহত্যা করেছেন, আমি মনে মনে আদৌ বিস্মিত হলাম না। কারণ এমন একটা সূত্রের সন্ধান পেয়েছিলাম যার থেকে আমার ধারণা হয়েছিল, রায় বাহাদুর হয় ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন অথবা যে কোন মুহূর্তে হবেন। সুতরাং এই নিষ্ঠুর সত্য আমার কাছে আকস্মিকতার কোন বিস্ময় বহন করে আনেনি। আপনারা শুনে বিস্মিত হবেন, রায় বাহাদুরের হত্যাকারীকে আমি দেড় ঘণ্টা আগে থেকে অনুসন্ধান করছিলাম। আমার সৌভাগ্য আমি তাকে সনাক্ত করতে পেরেছি। আমি এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও আমার আবিষ্কৃত সূত্রগুলি সংযোজিত করে একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি মনের মধ্যে আনতে পারছিলাম না, সূত্রগুলি যথার্থ অর্থে আমার কাছে ধরা দিচ্ছিল না, তাই আমি একটু বিভ্রান্ত বিচলিত বোধ করছিলাম। আমার সে-দ্বিধা এইমাত্র কেটে গেছে, আমার মনের সংশয়ের কুয়াশা ভেদ করে সত্য সূর্যের মত প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। আমি আপনাদের সকলের সমক্ষে ঘোষণা করছি, দারোগাবাবুর সিদ্ধান্ত ভুল। রায় বাহাদুর আত্মহত্যা করেননি—তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এ একটি সুপরিকল্পিত নিখুঁত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু হত্যাকারীর দুর্ভাগ্য ‘রঞ্জনরশ্মি-চক্ষু’ বিপ্রদাস এখানে উপস্থিত। আপনারা জেনে আরও বিস্মিত হবেন যে, এখানে উপস্থিত আপনাদের মধ্যেই হত্যাকারী লুকিয়ে আছে। দারোগাবাবু, লক্ষ্য রাখবেন, এখান থেকে কেউ যেন না গা-ঢাকা দিয়ে সরে পড়ে।

অকস্মাৎ ঘরের মধ্যে যেন বজ্রাঘাত হল। নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে গেল সকলের। ক্ষণেকের জন্যে মনে হল, ঘরের মধ্যে কোন জীবিত প্রাণী নেই। সেই মৃত্যুর মত নিঃসাড় নীরবতা ভঙ্গ করে দারোগাবাবু বললেন, বেশ, প্রমাণ করুন।

কৌতূহলী ডাক্তার বললেন, আর অপেক্ষা কেন বিপ্রদাসবাবু, হত্যাকারীকে নির্দেশ করুন, দারোগাবাবু হাতে হাতকড়া পরান, আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কিন্তু আমার দিকে আঙুল তুলবেন না যেন। বন্দুক-ফন্দুক চালাতে আমি কস্মিন কালেও জানি না—ফুঁড়তে-ফাঁড়তে জানি। কিন্তু ফোঁড়া-ফাঁড়া দূরে থাক, গত ছ’মাসে এক বিন্দু ওষুধও আমি রায় বাহাদুরকে খেতে দিইনি।

বিপ্রদাস সে-রসিকতায় সাড়া দিলেন না। দ্বারের অদূরে এক দারোয়ান উপস্থিত ছিল, তাকে বললেন, আমার গাড়িতে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, তাঁকে নিয়ে তুমি এই জানলার নিচে যাও ।—বলে তিনি রায় বাহাদুরের ঘরের জানলা দেখিয়ে দিলেন এবং নিজেও জানলার নিকটে গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালেন।

বিপ্রদাসের দেখাদেখি কৌতূহলী জনতা এসে ঝুঁকে পড়ল জানলার ওপরে। কেউ সেখানে উল্লেখযোগ্য কিছু দেখতে পেল না। কেবল শূন্য ফুটপাথটায় একটা কুকুর কালো একটা কি বস্তু নিয়ে সাগ্রহে নাড়াচাড়া করছে ; কিন্তু তা দেখবার আগ্রহ হল না কারো, তবু ব্যাপার কি দেখবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই।

দারোয়ান বিপ্রদাসের লোকটিকে নিয়ে জানলার নিচে এল। বিপ্রদাস তাঁকে বললেন, বিড়াল-ছানাটাকে নিয়ে ওপরে চলে আসুন।

বিড়াল-ছানা নিয়ে হীরালাল উপরে এলে বিপ্রদাস সেটাকে টেবিলের’পরে রাখলেন। তারপর প্রতিমাকে উদ্দেশ্য করে শুধোলেন, আপনার বাবা বেড়ালকে ভারি ঘৃণা করতেন, না?

ভয়ানক।—জবাব দিল প্রতিমা, বেড়াল-ছানা দেখলে তিনি ভয়ানক রেগে যেতেন। দৈবাৎ যদি তার সামনে কখনো বেড়াল-ছানা পড়ত, তার আর রক্ষা থাকত না। তুলে ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। যেখানে গিয়ে পড়ত, সেখান থেকে কুড়িয়ে তাকে আরো দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসবার জন্যে হুকুম দিতেন চাকর-বাকরদের।

তিনি কুকুর পছন্দ করতেন?

উঁহু, তবে বেড়ালের মত অত বিজাতীয় ঘৃণা ছিল না কুকুরের ওপরে। আমাদের বাড়িতে কোনদিন কুকুর ছিল না, কেবল সম্প্রতি বার দুই বাড়ির মধ্যে সন্দেহজনক লোকজনের আনাগোনা দেখে বাবা তিনটে বুলডগ কিনেছেন।

বেশ, এবার আসুন, আমরা একটা হত্যাকাণ্ডের অভিনয় করি। দারোগাবাবু, আপনি রায় বাহাদুরের ভূমিকায় অভিনয় করবেন। ভয় নেই, আপনাকে কেউ হত্যা করবে না। হত্যার অভিনয় করা হবে মাত্র। আপনি এ ঘরের এই জানলার কাছে দাঁড়ান, বেড়াল-ছানায় মিউ মিউ ডাক শুনেই তেড়ে যাবেন সেটাকে ধরে ছুঁড়ে মারতে। বেড়াল-ছানাটাকে বগলে করে বিপ্রদাস বললেন, চলুন, আমরা সবাই সেক্রেটারি-বাবুর ঘরে যাই।

রায় বাহাদুরের ঘরে ঢুকতে ডানদিকে যে ঘর, সেই ঘরে গিয়ে ঢুকলেন সকলে। সেক্রেটারির টেবিলের ওপরে মুরগীর পালকে তৈরি একটা ধূলা-ঝাড়নী ছিল। সেটা হাতে নিয়ে সবাইকে সম্বোধন করে বিপ্রদাস বললেন, এ ঘরটাও ঠিক রায় বাহাদুরের লাইব্রেরি-ঘরটার মতই, না? একটা মাত্র দরজা, জানলাও একটা এবং সেইরকমই বড়। আপনারা শুনে অবাক হবেন, এ ঘর থেকেই আততায়ী রায় বাহাদুরকে হত্যা করেছে।

—এ অসম্ভব! বলে উঠলেন ডাক্তার।

সেই অসম্ভবের অভিনয়ই করব এখন! আসুন।—বলে বিপ্রদাস ঝাড়নকাঠিটার ওপরে বেড়াল-ছানাটাকে বসিয়ে জানলার বাইরে দিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন রায় বাহাদুরের জানলার দিকে। পড়ে যাবার ভয়ে ঝাড়ন-কাঠিটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে বেড়াল-ছানাটা মিউ মিউ করে ডাকতে লাগল।

বিপ্রদাস বললেন, বেড়াল-ছানার ডাক শুনে রায় বাহাদুর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে এলেন—ওই যেমন এখন দারোগাবাবু করছেন, ছানাটাকে ধরে ফুটপাথে ছুঁড়ে দেবার জন্যে শরীরের সম্মুখভাগ জানলা দিয়ে ঈষৎ বার করে যেমন হাত বাড়িয়েছেন, এমনি করে রায় বাহাদুরও হাত বাড়িয়েছিলেন। আততায়ী সেই সময়ে রায় বাহাদুরের মাথা তাক্‌ করে গুলি ছোঁড়ে। গুলি তাঁর কপালের ডান দিকে লাগতেই তিনি পড়ে যান। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও কত সহজে সম্পন্ন হয়েছে। হত্যা করার পরে বেড়াল-ছানাটাকে ঝাড়ন-কাঠি থেকে ঝেড়ে নিচে ফেলে দিয়েছে হত্যাকারী। কি সৌভাগ্য যে কুকুরটা সেটা নিয়ে খেলা করছিল, নইলে এই হত্যাকাণ্ডটি আজ প্রমাণ করা সম্ভব হত কিনা সন্দেহ। গুলি করবার সময় রায় বাহাদুরের মাথা রিভলবারের থেকে হাত দেড়েক দুই-এর বেশি দূরে ছিল না। ঠিক সেই কারণেই হত্যাকাণ্ডটাকে আত্মহত্যার মত প্রতীয়মান হচ্ছে, তাই না? এখন দেখুন গে সবাই, গুলি খেয়ে জানলা থেকে গড়িয়ে যেভাবে পড়া স্বাভাবিক, ঠিক সেইভাবেই এখনও রায় বাহাদুর পড়ে আছেন।

অভিভূত ডাঃ সরকার বললেন, হত্যাকাণ্ড তিনটের আগে কিছুতেই ঘটেনি, অথচ তার কিছু আগে থেকেই ঘরের বাইরে হলে কোম্পানির পাঁচজন ডাইরেক্টর উপস্থিত ছিলেন, মুহূর্তের জন্যও তাঁরা স্থানত্যাগ করেননি, গুলির শব্দও শোনেননি কেউ। তাছাড়া জ্যোতির্ময়বাবুর ঘর থেকে আততায়ীকে বার হয়ে আসতে দেখতেন না তাঁরা? সে কি জানলা গলে দোতলা থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে উধাও হল?

দারোগাবাবু বিদ্রূপের হাসি হেসে বললেন, আপনিও যেমন, এও কি সম্ভব নাকি? বিপ্রদাসবাবু, আপনি গোয়েন্দাগিরি রেখে নাটক লেখা ধরুন, নাম করতে পারবেন ; কিন্তু বোকা বোঝাতে আসবেন না। আততায়ী এঘর থেকে হত্যা করে ওঘরে গিয়ে মৃতের সামনে রিভলবার রেখে নিরাপদে পালিয়ে গেল, এতগুলো লোক, আর্দালি, দারোয়ান, চাকর, মালী কেউ দেখল না—এ কথা কোন উন্মাদেও বিশ্বাস করবে না!

করবে না বলেই আততায়ী এই অভিনব পন্থা গ্রহণ করেছিল। তার প্রতিভাকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। এমন নিখুঁত হত্যাকাণ্ড আমি খুব কমই দেখেছি। কিন্তু আততায়ী নিজের হাতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেই নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছে। নইলে আজ তাকে ধরা একটু কঠিন হত। সে ভেবেছিল, বিপ্রদাসের নাকের ওপরে হত্যা করে হত্যার ইতিহাসে একটা রেকর্ড সৃষ্টি করবে ; কিন্তু বড় বেদনার সে আকাঙক্ষা নিষ্ফল হয়ে গেল। কি বলেন জ্যোতির্ময়বাবু? কি মনে হয় আপনার?

কি করে বলব বিপ্রদাসবাবু? অথচ যখন তিনটে বেজে যাবার পরেও রায় বাহাদুর বেরোচ্ছেন না দেখে তাঁকে ডাকতে গেলাম, তিনি তো বেশ সুস্থ শরীরেই আমার ডাকে সাড়া দিলেন। কি বলেন আপনারা?—জ্যোতির্ময় ডাইরেক্টরদের দিকে তাকালেন: তাঁর গলা শুনতে পাননি?

হ্যাঁ, শুনেছি। কেন, বিপ্রদাসবাবুও তো শুনেছেন!

শুনেছি বৈকি। আচ্ছা আসুন, আমরা তারও একটা মহড়া দিই এবার।

হলে এসে সকলে আসন গ্রহণ করলেন। বিপ্রদাস বললেন, হীরালালবাবু, এবার আপনার ঐন্দ্রজালিক বাণী শোনান।

হীরালাল প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। বললেন, ভেন্ট্রিলোকুইজম্‌—যাকে বিপ্রদাসবাবু নাম দিয়েছেন ঐন্দ্রজালিক বাণী, সে আর কিছুই নয়, স্বরবিক্ষেপণ কৌশল। মনে করুন, আমার একটা চাকর আছে, তার নাম রঘু।

হীরালালবাবু চিৎকার করে ডেকে উঠলেন, র-ঘু-উ—

মনে হল, অনেক দূর থেকে লোকটি জবাব দিচ্ছে : যা-চ্ছি বা-বু!

হীরালালবাবু আবার ডাকলেন। এবার অপেক্ষাকৃত নিকট থেকে জবাব এল : যাচ্ছি বাবু।—আবার ডাকলেন হীরালালবাবু। এবার একেবারে কাছ থেকে জবাব এল : এই যে এসেছি আমি, আজ্ঞা করুন।—শ্রোতাদের মনে হল, রঘু যেন অদৃশ্য দেহে তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে। হীরালাল বললেন, তুমি ওই ঘরটার মধ্যে যাও। গেছো?—উত্তর এল : আজ্ঞে বাবু। হীরালালবাবু আবার ডাকলেন : রঘু! জবাব এল : আজ্ঞে আমি ঘরের ভেতরে।

শুনে শ্রোতাদের বিস্ময়ের অবধি রইল না। ঠিক ঘরের ভেতর থেকেই তো জবাব আসছে।

বিপ্রদাস বললেন, এই যাদু জ্যোতির্ময়ও জানেন।

সে কি জ্যোতির্ময়বাবু! আপনি—আপনি·····

দারোগাবাবু বলে উঠলেন, তবে রিভলবারের শব্দ শুনলেন না কেন কেউ?

কি করে শুনবেন?—জবাব দিলেন বিপ্রদাস : এই সোফা সেট তো তখন সিঁড়ির গোড়ায় ছিল। আপনি খোঁজ নিলে জানবেন, আগন্তুক দেখলে সিঁড়ির গোড়ায় চেন-বাঁধা বুলডগ্‌গুলো কি রকম ঘেউ ঘেউ করে। তিনটের সময় আমাকে দেখে সেইরকম ঘেউ ঘেউ করে উঠেছিল কুকুরগুলো। তাদের গম্ভীর তীক্ষ্ণ আওয়াজ বন্ধ দরজার ওধারের থেকে ভেসে-আসা রিভলবারের ক্ষীণ আওয়াজ ছাপিয়ে ডাইরেক্টরদের কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু আপনি শুনলেন কি করে?

কি শুনলাম? রিভলবারের শব্দ? না তো, আমি কি করে শুনব? ও, তাহলে এই কাণ্ডটা অনুমান করলাম কি করে?

একটু থেমে বিপ্রদাস বলে চললেন, আমাদের নিমন্ত্রণ করে এনে রায় বাহাদুর নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন বা অন্য কাজ করছেন, এটা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হল। সন্দেহ দৃঢ় হল জ্যোতির্ময় যখন রায় বাহাদুরকে ডাকতে গেলেন। তখনই আমার মনে হল এটা ভেন্ট্রিলোকুইজম্‌ ছাড়া আর কিছুই নয়। হয় রায় বাহাদুর ঘরে নেই, অথবা সেখানে তিনি মরে পড়ে আছেন। তক্ষুণি আমি বেরিয়ে পড়লাম। জ্যোতির্ময় সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করা সর্বাগ্রে কর্তব্য বলে মনে হল আমার। ঘণ্টা দেড়েক ঘুরেই আমি তাঁর অতীত জীবনের ইতিহাস সংগ্রহ করতে পারলাম। সে-ইতিহাস নিয়ে এসে এ বাড়িতে ঢুকেই যা শুনলাম, তাতে আমার সন্দেহ সত্যে পরিণত হল : রায় বাহাদুর খুন হয়েছেন। এবারে আপনারা জ্যোতির্ময়ের কাহিনী শুনুন : জ্যোতির্ময় দত্ত নামে আপনাদের সামনে এই যে লোকটিকে দেখছেন, এর আসল নাম খগেন ঘোষ। রায় বাহাদুরের দ্বিতীয়া স্ত্রী জ্যোৎস্না দেবীর গ্রামের লোক। জ্যোৎস্না দেবীর সঙ্গে তার কৈশোর থেকে প্রণয়। ১৯৩০ সালে আই-এ পাশ করার পরে ঢাকায় এক ম্যাজিসিয়ানের সাহচর্যে আসে এবং তার সঙ্গে কিছুকাল থাকে সে। সেখানে সে ম্যাজিক ও ভেন্ট্রিলোকুইজম্‌ শেখে এবং খুব ভালভাবেই আয়ত্ত করে ; কিন্তু একজন জালিয়াতের সংস্পর্শে এসে সে ম্যাজিক ছেড়ে হস্তাক্ষর জাল করতে শেখে এবং পাকা হয়ে বড়লোকদের নাম জাল করে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা মারতে থাকে। একবার এই অভিযোগে সে ধৃত হয়, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ অভাবে ছ’মাস হাজতবাস করে মুক্তি পায়। সেখান থেকে দেশের গ্রামে যায় এবং একদিন রাত্রির অন্ধকারে জ্যোৎস্না দেবীকে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু পথেই গ্রামের ছেলেরা খগেন ও জ্যোৎস্নাকে ধরে ফেলে। খগেনকে অশেষ লাঞ্ছনা দিয়ে তারা গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। জ্যোৎস্না দেবীকে গ্রামে নিয়ে আসে। এর কয়েক বছর পরে বিপত্নীক সূর্যনারায়ণ তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। খগেন তখন কলকাতায় জ্যোতির্ময় দত্ত নাম নিয়ে একটা ওষুধ কোম্পানির প্রচারসচিব। খবর পেয়ে সে জ্যোৎস্না দেবীর সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে, তারপরে এখানে তার চাকরি। আমার ধারণা এই ঔষধ জালের পেছনে জ্যোতির্ময় আছে। রায় বাহাদুরের স্বাক্ষর জাল করে সে এ ব্যবসা চালাচ্ছিল। যখন সে জানল, কোম্পানি জালিয়াতি ধরবার জন্যে গোয়েন্দা নিযুক্ত করতে যাচ্ছে, তখন সে অনন্যোপায় হয়ে রায় বাহাদুরকে হত্যা করেছে। অবশ্য এর জন্যে গত দু’মাস থৈকেই সে মহড়া দিচ্ছিল, কারণ সে জানত তার কাজের জন্য একদিন তাকে কঠিন বিপদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। সেই বিপদ এড়ানোর জন্যেই আজ একটা উপযুক্ত অবসরে জ্যোতির্ময় এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছে।

বিপ্রদাসের কথা শুনে বিহ্বল হতবাক উপস্থিত মানুষগুলি ফ্যালফ্যাল করে একবার জ্যোতির্ময়ের দিকে, আর একবার বিপ্রদাসের দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু কর্তব্যপরায়ণ দারোগাবাবুর নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলে চলে না, তিনি বাঁশি বাজিয়ে দিলেন। নিচের জীপ থেকে দু’জন পুলিশ ছুটে এল।

দারোগাবাবু জ্যোতির্ময়কে দেখিয়ে বললেন, হাতে হাতকড়া লাগাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *