০৩. আদম হাওয়ার দিনলিপি

আমরা যদি নিজেদের স্বরূপ, ইতিহাস ও মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে একটা ভালোরকম ধারণা পেতে চাই, তাহলে আগে আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের চিন্তার জগতটা সম্পর্কে অবশ্যই ভালোভাবে জানতে হবে। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে হোমো সেপিয়েন্সরা শিকারি হিসেবেই বসবাস করেছে! একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, এই যে দলে দলে মানুষের ক্রমাগত শহরমুখী হবার প্রবণতা, শ্রমিক বা চাকুরিজীবী হয়ে শহরে জীবনযাপন করার সংস্কৃতি এসব কিন্তু মাত্র সেদিনের কথা। বড়জোর ২০০ বছর হবে। তারও আগের ১০ হাজার বছর তারা কৃষিকাজ ও ক্ষেত-খামারে কাজ করেই কাটিয়েছে। মজার ব্যাপার হল, সেপিয়েন্সের অনেক অনেক দিন ধরে চলে আসা শিকারি জীবনের সময়কালের সাথে তুলনা করলে এই কৃষিকাজ ও শহুরে জীবনযাপনের প্রায় ১০ হাজার দুইশ বছরের সময়কাল নেহায়েত একটা মুহূর্ত ছাড়া আর কিছুই নয়!

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার থেকে আমরা জানতে পারি, আমাদের এখনকার সামাজিক আচার-আচরণ এবং মানসিক প্রবণতার অনেক কিছুই আসলে তৈরি হয়েছিল কৃষিভিত্তিক সমাজেরও আগের সেই লম্বা সময়টাতে। এমনকি আজও, এইসব বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন যে, আমাদের মস্তিষ্ক ও শরীর উভয়ই আসলে অভিযোজিত হয়েছে শিকারি-সংগ্রাহক জীবনের জন্য। আমাদের এখনকার খাদ্যাভ্যাস, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কিংবা আমাদের যৌনতা- এসবই আসলে গড়ে উঠেছে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে গড়ে ওঠা উত্তরাধুনিক পারিপার্শ্বিকতার সাথে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আমাদের শিকারি মনের নিয়ত মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী এই নতুন পরিবেশ ছিল বড় বড় শহর, বিমান, টেলিফোন আর কম্পিউটারে ভরপুর। এই পরিবেশ আমাদের আরও বেশি বস্তুগত সম্পদ দিয়েছে, দীর্ঘায়িত জীবন দিয়েছে যা আমরা সেই আগেকার জীবনে পাইনি। কিন্তু একই সাথে এই পরিবর্তিত পরিবেশ আমাদের দিয়েছে একাকীত্ব, হতাশা এবং নানা ধরনের মানসিক চাপ। কেন এমন হল সেটা বুঝতে হলে, আমাদের সেই শিকারি জীবনের আরও গভীরে যেতে হবে, যে জীবন আমরা এখনও যাপন করি আমাদের অবচেতনে।

একটা সহজ উদাহরণ দেখা যাক। আমরা জানি খাবারের অতিরিক্ত ক্যালরি আমাদের কোন উপকারে তো আসেই না, বরং ক্ষতি করে। কিন্তু এটা জানার পরও আমরা ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার লোভ সামলাতে পারি না। এদিকে এই লোভের কারণে শারীরিক স্থূলতা প্রায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে আজকের উন্নত দেশগুলোতে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও খুব দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের খাদ্যাভ্যাসটা ভালো করে খেয়াল না করি তাহলে এই বেশি বেশি মিষ্টি ও চর্বিযুক্ত খাবারের প্রতি আমাদের লোভের কারণটা একটা রহস্যই থেকে যাবে। যে সমস্ত তৃণভূমি কিংবা জঙ্গলে তারা বসবাস করত, সেখানে খাবার ছিল অল্প। বিশেষ করে মিষ্টিজাতীয় (শর্করা সমৃদ্ধ) খাবার তো খুবই অল্প। ৩০ হাজার বছর আগের একজন সাধারণ শিকারির একমাত্র যে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার সুযোগ ছিল তা হল পাকা ফলমূল। এই কারণেই প্রস্তরযুগের একজন নারী চলতে চলতে হঠাৎ কোন ফলে ভরা ডুমুর গাছ দেখতে পেলে মোটেই দেরি না করে তৎক্ষণাৎ যতখানি সম্ভব ডুমুরের ফল খেয়ে ফেলত। কারণ সে জানত, দেরী করলে এলাকার বেবুনের দল সেই গাছটা উজাড় করে ফেলবে। সেই সময় থেকে, বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার প্রতি লোভ আমাদের একদম মজ্জাগত। আজ হয়তো বাস্তবে আমরা সুউচ্চ ভবনে থাকি, আমাদের ফ্রিজ ভর্তি খাবার দাবার থাকে, কিন্তু আমাদের ডিএনএ এখনও মনে করে আমরা তৃণভূমিতেই আছি। এই কারণেই আমরা এখন এক বাক্স আইসক্রিম এক নিমেষে খেয়ে ফেলতে পারি, এমনকি সাথে একটা বড়সড় কোকাকোলাও!

এই লোভী জিন (gorging gene) তত্ত্ব সর্বজনীনভাবে গৃহীত। এ ব্যাপারে আরও কিছু তত্ত্ব আছে কিন্তু সেগুলো বেশ তর্কসাপেক্ষ। যেমন, কিছু কিছু বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী বলেন, প্রাচীন গোষ্ঠীগুলো আসলে একবিবাহের রীতিতে তৈরি ছোট ছোট পরিবার দিয়ে গঠিত ছিল না বরং শিকারিরা এমন এক সমাজে বসবাস করত যেখানে ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে কিছু ছিল না। সেখানে একবিবাহ কিংবা পিতৃত্বের ধারণাটাই ছিল না! এরকম একটা গোষ্ঠীতে একজন নারী একইসাথে একাধিক পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত হতে পারত এবং পুরো গোষ্ঠীর সকল প্রাপ্তবয়স্করাই সব ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্বটা নিত। যেহেতু কোনো পুরুষই নির্দিষ্ট করে জানত না কোন শিশুটি আসলে তার, তাই তারা সকল শিশুর প্রতিই সমান গুরুত্ব দিত।

মানুষের ক্ষেত্রে এরকম একটা সামাজিক কাঠামো আপাতদৃষ্টিতে আজগুবি মনে হলেও অন্যান্য অনেক প্রাণীদের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। প্রাণিজগতে আমাদের খুব কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জি কিংবা বোনোবোর মধ্যেও এই রীতি দেখা যায়। এমনকি, এখনও একাধিক মানব সমাজ আছে যেখানে যৌথ বা গোষ্ঠীগত পিতৃত্বের চর্চা দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, বারি ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের (Barí Indians) কথা বলা যায়। এ সম্প্রদায়ের লোকজন বিশ্বাস করে, একটি মাত্র পুরুষের শুক্রাণু থেকে আসলে একটি শিশুর জন্ম হয় না বরং তা হয় নারীর গর্ভে অনেকগুলো পুরুষের শুক্রাণুর পুঞ্জীভূত হওয়ার মাধ্যমে। এই কারণে একজন সচেতন মা হয়তো বিভিন্ন পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্কে যুক্ত হওয়াটা উপযুক্ত মনে করেন, বিশেষ করে যখন তিনি গর্ভবতী। তিনি চান তার সন্তান যেন শুধু সেরা শিকারিই নয় বরং সাথে সাথে সেরা গল্প বলিয়ে, শক্তিশালী যোদ্ধা ও স্নেহময় প্রেমিকের গুণাবলিও পায়। এটা যদি খুব অদ্ভুত শোনায়, তাহলে মনে করিয়ে দেয়া ভালো- আধুনিক ভ্রূণতত্ত্বের বিকাশের আগ পর্যন্ত কিন্তু মানুষের কাছে কোনো নিশ্চিত প্রমাণ ছিল না যে, একটি শিশু সবসময় একজন মাত্র পিতার ঔরসেই জন্মায়, অনেকজনের নয়।

এই ‘প্রাচীন বহুগামী সমাজে’র ধারণার প্রস্তাবকদের মতে, আমাদের আধুনিক একবিবাহভিত্তিক সমাজে বৈবাহিক সম্পর্কের যে টানাপোড়েন, দাম্পত্য কলহ, অনাস্থা ও বিবাহ-বিচ্ছেদের উচ্চ হার এবং সেই সাথে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে যে নানা ধরনের মানসিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে সে সবের অন্যতম কারণ হল মানুষকে একটি মাত্র সঙ্গীর সাথে ছোট পরিবারে বসবাস করতে বাধ্য করা, যেটা তার দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সত্তার সাথে একেবারেই মেলে না।

অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞই প্রবলভাবে এই তত্ত্বের বিরোধিতা করেন। তাঁদের যুক্তি হল, একবিবাহ ও ছোট ছোট পরিবার আসলে একেবারেই সাধারণ মানবিক আচরণ। যদিও একথা ঠিক যে, প্রাচীন শিকারি মানুষেরা এখনকার আধুনিক মানুষের তুলনায় ঢের বেশি গোষ্ঠীবদ্ধ ও সাম্যে বিশ্বাসী ছিল, তারপরও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, তাদের গোষ্ঠীগুলো এখনকার মতোই এক একটি ঈর্ষাকাতর দম্পতি ও তাঁদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে গঠিত ছোট ছোট পরিবারের সমন্বয়েই গড়ে উঠত। এই কারণেই একবিবাহ ও ছোট পরিবারের চর্চা এখনকার বেশিরভাগ সংস্কৃতিতেই দেখা যায়। নারী পুরুষ উভয়েই যে তার সঙ্গীর উপর খুব অধিকার খাটাতে চায় সে কারণটাও ভিন্ন নয়। বলা বাহুল্য, এই ছোট পরিবারের চর্চার সাথে গোষ্ঠীর নেতৃত্বের উত্তরাধিকারের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে সেই আদি কাল থেকেই। আর সেটাই, এমনকি আজও, বিভিন্ন আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ক্ষমতায় পরিবারতন্ত্রের রূপে দেখা যায়। উত্তর কোরিয়া কিংবা সিরিয়া তার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।

নানারকম তত্ত্বের মাঝে এইসব বিরোধ মেটানোর জন্য এবং আমাদের যৌনতা, সমাজ ও রাজনীতিকে ভালোভাবে বোঝার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন যাপন সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানাটা বেশ জরুরি। আর সেটা জানলেই আমরা বুঝতে পারব কীভাবে সেপিয়েন্স প্রজাতি সেই ৭০ হাজার বছর আগের বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের সময় থেকে বিকশিত হয়ে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করল।

দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের জীবনের খুব অল্প কিছু বিষয় সম্পর্কেই আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। সেই ‘প্রাচীন বহুগামী সমাজ’ কিংবা ‘গোড়া থেকেই একবিবাহ’ তত্ত্বের মধ্যকার বিতর্কও আসলে নেহায়েতই কিছু নড়বড়ে সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কাছে সেই শিকারি যুগের কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। প্রত্নতত্ত্ববিদরাও প্রমাণ বলতে যা কিছু পান সেগুলো মূলত কিছু ফসিল কিংবা পাথরের হাতিয়ার। পচনশীল জিনিস দিয়ে তৈরি কোনো দ্রব্যসামগ্রী যেমন, কাঠ, বাঁশ কিংবা চামড়ার তৈরি জিনিসপত্র শুধুমাত্র বিশেষ পরিবেশেই অক্ষত থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে এরকম পচনশীল জিনিসের কোনো নমুনা প্রায় নেই বললেই চলে। এইসব একপেশে প্রত্নতত্ত্বীয় প্রমাণাদির কারণেই সাধারণভাবে আমাদের মনে হয়, কৃষিভিত্তিক সমাজের আগে বুঝি মানুষ পাথরের যুগে বসবাস করত। এই ধারণাটা ভ্রান্ত হবার সম্ভাবনাই আসলে বেশি। যেটাকে আমরা ‘প্রস্তর যুগ’ বলে জানি সেটাকে আসলে বলা উচিত ‘কাঠের যুগ’ (Wood age)। কারণ শিকারি মানুষদের বেশির ভাগ হাতিয়ারই সম্ভবত কাঠের তৈরি ছিল।

এখানে আমরা বারবার ‘সম্ভাবনা’ শব্দটা ব্যবহার করছি। এর কারণ, মানুষের শিকারি-সংগ্রাহক জীবনের সময়কালের যেসব প্রমাণাদি আমরা পাই সেগুলো থেকে সে সময়ের মানুষদের জীবনযাপনের গল্পটা নিশ্চিতভাবে আবিষ্কার করা আসলে খুবই দুরূহ ব্যাপার। সেইসব শিকারিদের সাথে তাদের উত্তরাধিকারীদের (যারা কিনা কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজে বসবাস করত) একটা পার্থক্যই খুব স্পষ্টত দৃশ্যমান। সেটা হল, শিকারি মানুষদের কাছে শুরুতে খুব অল্প সংখ্যক হাতে তৈরি জিনিস ছিল। এটা বেশ বড় একটা প্রভাব ফেলেছিল তাদের জীবনে। আধুনিক সচ্ছল সমাজের একজন মানুষ তার সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় প্রায় লক্ষাধিক জিনিস ব্যবহার করে। গাড়ি বাড়ি থেকে শুরু করে ন্যাকড়া কিংবা দুধের বয়াম- এরকম অজস্র জিনিস। আমাদের এমন কোনো কর্মকাণ্ড, বিশ্বাস কিংবা অনুভূতি পাওয়া যাবে না যার সাথে আমাদের নিজেদের তৈরি কোনো জিনিসের সম্পর্ক নেই। উদাহরণস্বরূপ, শুধু আমাদের খাওয়া দাওয়ার জন্যই যে আমরা কত বিভিন্ন রকম জিনিস ব্যবহার করি ভাবলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। চামচ থেকে শুরু করে কাপ পিরিচ কিংবা জিন প্রকৌশল গবেষণাগার, এমনকি বিশালাকার জাহাজ সবই আমরা ব্যবহার করেছি। খেলাধুলার জন্যও আমরা একগাদা খেলনা ব্যবহার করি, প্লাস্টিক কার্ড থেকে শুরু করে লক্ষাধিক লোকের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়াম- সবই লাগে আমাদের। আমাদের প্রণয়ের কিংবা যৌন সম্পর্কগুলোও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় আংটি, বিছানা, সুন্দর জামা কাপড়, যৌনাবেদনময় অন্তর্বাস, কনডম, কেতাদুরস্ত রেস্টুরেন্ট, সস্তা মোটেল, এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ, কমিউনিটি সেন্টার কিংবা খাদ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ধর্মগুলো আমাদের জীবনে আধ্যাত্মিক জগতকে নিয়ে আসে; সেটাও আবার খ্রিস্টানদের চার্চ, মুসলমানদের মসজিদ, হিন্দুদের আশ্রম, নানান পবিত্র গ্রন্থ, তিব্বতের প্রার্থনা-চাকা, পুরোহিতের বিশেষ পোশাক, মোমবাতি, আগরবাতি, ক্রিসমাস ট্রি, বিশেষ খাবার, সমাধিসৌধ আর নানান রকম চিহ্নের মাধ্যমে।

আমরা আসলে খেয়ালই করি না আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে আমরা কি বিপুল পরিমাণ জিনিস ব্যবহার করি। যখন আমাদের বাসা বদলাতে হয় তখন আমরা ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পারি। কিন্তু আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষেরা কখনো এক জায়গায় বেশি দিন থাকত না। তারা প্রায় প্রতি মাসে কিংবা সপ্তাহে বাসা বদলাতো, এমনকি মাঝে মাঝে তো প্রতিদিন! দরকারী জিনিসপাতিগুলো তারা কাঁধে করে নিয়ে যেত। তখন তো আর কোনো কোম্পানি ছিল না কিংবা মজুরও ছিল না যে তাদের জন্য এসব বয়ে নিয়ে যাবে। এমনকি তাদের গাধাও ছিল না ভার বওয়ার জন্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের খুব সামান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দিয়েই দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে নিতে হত। সুতরাং এটা মনে করলে খুব একটা ভুল হবে না যে, তাদের মানসিক, ধর্মীয় কিংবা সামাজিক জীবনের একটা বড় অংশ কোনোরকম হাতে তৈরি জিনিস ছাড়াই চলে যেত। আজ থেকে এক লক্ষ বছর পরের কোনো এক প্রত্নতত্ত্ববিদ হয়তো একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ থেকে পাওয়া জিনিসপত্র দিয়ে আমাদের এই সময়ের মুসলমানদের জীবনযাপনের গল্পটা মোটামুটি ভালোই আঁচ করতে পারবেন। কিন্তু আমরা আসলে আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের সামাজিক বিশ্বাস বা রীতিনীতির ধারণা পাওয়ার ব্যাপারে তেমন একটা সুবিধা করতে পারিনি। ভবিষ্যতের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদও হয়তো এরকমই সমস্যায় পড়বেন। তিনি হয়তো একুশ শতকের একজন তরুণের মনস্তত্ত্ব বুঝতে চেষ্টা করবেন শুধুমাত্র টিকে থাকা কিছু কাগজে লেখা চিঠির মাধ্যমে, কারণ ততদিনে হয়তো তাদের টেলিফোনের কথোপকথন, ইমেইল, ব্লগ কিংবা টেক্সট মেসেজ – কোনো কিছুরই হদিস পাওয়া যাবে না।

সুতরাং আমরা যদি শুধু হাতে তৈরি জিনিস থেকেই শিকারি মানুষের জীবন সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি সেটা বড্ড একপেশে একটা গল্প হবে। অন্য একটা উপায় হতে পারে আজকের শিকারি জনগোষ্ঠীদের দিকে তাকানো। প্রত্নতত্ত্বীয় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের ব্যাপারে সরাসরি জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। কিন্তু এই আধুনিক শিকারি সমাজের জীবন থেকে প্রাচীন শিকারি সমাজের জীবন সম্পর্কে অনুমান করতে গেলেও খুব সতর্ক হওয়ার অনেক কারণ আছে।

প্রথমত, যে সমস্ত শিকারি জনগোষ্ঠী এখনও টিকে আছে তারা তাদের আশেপাশের কৃষিভিত্তিক কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের এখনকার বাস্তবতার সাথে হাজার হাজার বছর আগের বাস্তবতার মিল খুঁজতে যাওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে।

দ্বিতীয়ত, এখনকার শিকারি জনগোষ্ঠীগুলো টিকে আছে মূলত বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশে যেখানে কৃষিকাজ বেশ কঠিন বা অসম্ভব। যেসব গোষ্ঠী দক্ষিণ আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমির মতো এরকম প্রচণ্ড প্রতিকুল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছে, তারা আসলে অপেক্ষাকৃত অনেক উর্বর ইয়েংজি নদীর তীরের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারবে না। বিশেষ করে বলতে গেলে, কালাহারি মরুভূমির তুলনায় প্রাচীন ইয়েংজি নদীর আশেপাশে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল অনেক বেশি। আর সেই সময়ের গোষ্ঠীগুলোর আকার এবং তাদের ভিতরকার সম্পর্কগুলোকে বোঝার জন্য এই ধরনের তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তৃতীয়ত, প্রাচীন শিকারি গোষ্ঠীগুলোর একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, এক একটা গোষ্ঠী অন্য একটা গোষ্ঠী থেকে অনেকটাই আলাদা। তারা যে শুধু পৃথিবীর এক এক এলাকায় এক এক রকম তা-ই নয় বরং একই এলাকাতেও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কথা। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা যখন প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছান, সেখানকার আদিবাসীদের মধ্যে তারা ব্যাপক বৈচিত্র্যের সন্ধান পান। ব্রিটিশদের দখলের কিছু আগেও এ অঞ্চলে ২০০ থেকে ৬০০ উপজাতিতে প্রায় ৩ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষের মাঝামাঝি সংখ্যক শিকারি বসবাস করত, যাদের প্রত্যেকটির মধ্যে আবার একাধিক গোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রত্যেকটা উপজাতিরই নিজেদের মত ভাষা, ধর্ম ও রীতিনীতি ছিল। এখনকার দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া বা অ্যাডিলেডের কাছাকাছি তখন বসবাস করত কিছু পিতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠীগুলো মিলে ছিল একটা উপজাতি যেটা কিনা ভৌগোলিক সীমারেখার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল। উল্টোদিকে উত্তর অস্ট্রেলিয়ার দিকের উপজাতিগুলো আবার মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাসী ছিল। সেখানে একজন ব্যাক্তির পরিচয় তার টোটেম দিয়ে হত, ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে নয়। টোটেম হল একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র প্রতীক। মূলত অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকার উপজাতিদের মধ্যে পশুপাখির আদলে এই প্রতীক নির্বাচনের প্রচলন ছিল।

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, প্রাচীন শিকারি মানুষদের মধ্যে ব্যাপক নৃতাত্ত্বিক কিংবা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ছিল। কৃষি বিপ্লবের সময়ে যে ৫০ থেকে ৮০ লক্ষ শিকারি মানুষেরা বসবাস করত তারা হাজারটা আলাদা আলাদা ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে হাজারটা বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত ছিল। এটা আসলে বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের অন্যতম বড় অর্জন। এজন্য মানুষের কল্পনা শক্তিকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। এই কল্পনা শক্তির কারণেই একই রকম পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে একই রকম শারীরবৃত্ত্বীয় গঠনের মানুষগুলোও সম্পূর্ণ আলাদা কাল্পনিক বাস্তবতায় বসবাস করতে পারত। আর তার ফলেই আসলে তাদের মধ্যে আলাদা আলাদা সামাজিক আচার কিংবা রীতিনীতি তৈরি হয়েছিল।

উদাহরণস্বরূপ, আজকের অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় যে জায়গায় অবস্থিত, তিরিশ হাজার বছর আগে সেই দুই জায়গার মানুষ হয়তো সম্পূর্ণ আলাদা ভাষায় কথা বলত। একটা গোষ্ঠী হয়তো ছিল খুব যদ্ধংদেহী, অন্যটা হয়তোবা বেশ শান্তিপ্রিয়। এমনও হতে পারে, ক্যামব্রিজ গোষ্ঠী হয়তো ছিল গোষ্ঠীগত সমাজে বিশ্বাসী আর অক্সফোর্ড গোষ্ঠী হয়তো ছোট ছোট পরিবারে বিভক্ত। ক্যামব্রিজের লোকেরা হয়তো তাদের দেবতাদের মূর্তি তৈরি করত কাঠে খোদাই করে আর অক্সফোর্ডের লোকেরা হয়তো পূজা করত নৃত্যের মাধ্যমে। প্রথম দলটা হয়তো পুনর্জন্মে বিশ্বাস করত আর অন্যরা হয়তো ভাবত এইসব গাঁজাখুরি গল্প। কোনো একটা সমাজে হয়ত সমকামিতাকে মেনে নেয়া হত যেখানে অন্যটায় তা ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ।

অন্য কথায়, যদিও আধুনিক শিকারিদের উপর নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ আমাদের প্রাচীন শিকারিদের সম্ভাব্য জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু প্রাচীন বাস্তবতার সম্ভাব্য জগতটা আরও বিস্তৃত যার বেশিরভাগই আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়ে গেছে। হোমো সেপিয়েন্সের প্রাকৃতিক জীবন ধারণ পদ্ধতি নিয়ে যত জমজমাট বিতর্ক সেগুলোর সবগুলোতেই এই সত্যটা অনুপস্থিত। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে সেপিয়েন্সের কোনো একটি মাত্র প্রাকৃতিক জীবন ধারণ পদ্ধতি ছিল না। ছিল অসংখ্য বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সম্ভার থেকে কোনো একটিকে আপন করে নেয়ার সুযোগ।

প্রকৃত প্রাচুর্যময় সমাজ

কৃষিপূর্ব সমাজ সম্পর্কে তাহলে আমরা কী রকম সর্বজনীন ধারণা পেলাম? তখনকার সমাজের বেশিরভাগ সদস্যই হয়তো কয়েক ডজন থেকে কয়েকশ সদস্যের ছোট ছোট উপজাতিতে বসবাস করত। বলা বাহুল্য, এইসব উপজাতির সকল সদস্যই ছিল মানুষ। এই শেষ কথাটা খেয়াল করাটা জরুরি। সাধারণভাবে এটা মনে হতে পারে যে, সমাজ তৈরি হবে মানুষ নিয়ে- এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায়, কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজ কেবলমাত্র মানুষ নিয়ে গঠিত নয় বরং এইসব সমাজ গড়ে উঠেছে মূলত মানুষ ও কিছু গৃহপালিত জীব-জন্তুর সমন্বয়ে। অবশ্যই তারা তাদের প্রভুদের সমকক্ষ বা তাদের সমান মর্যাদার নয়, কিন্তু তারপরও তারা এখনকার সমাজের অনিবার্য সদস্য। উদাহরণস্বরূপ, আজকের ‘নিউজিল্যান্ড’ নামের সমাজটা প্রায় ৪৫ লক্ষ সেপিয়েন্স আর প্রায় ৫ কোটি ভেড়ার সমন্বয়ে গঠিত!

‘কৃষিপূর্ব সমাজের গোষ্ঠীগুলো কেবলমাত্র মানুষের সমন্বয়ে গঠিত’- এই সাধারণ নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল কুকুর। কুকুরই আসলে হোমো সেপিয়েন্সের পোষ মানানো প্রথম গৃহপালিত পশু। ঘটনাটা ঘটেছিল কৃষি বিপ্লবেরও আগে। বিশেষজ্ঞরা নির্দিষ্ট দিন তারিখের ব্যাপারে যদিও একমত হতে পারেন না, কিন্তু, ১৫ হাজার বছর আগেও যে গৃহপালিত কুকুরের অস্তিত্ব ছিলো সে কথা নিশ্চিতভাবেই জানা যায়। এমনও হতে পারে, তারা হয়তো আরও হাজার খানেক বছর আগে থেকেই মানুষের সাথে বসবাস করতে শুরু করেছে।

কুকুরকে সেই সময়ে অনেকভাবে কাজে লাগানো হত। যেমন, তারা শিকারের কাজে সাহায্য করতে পারত। আবার তাদেরকে বন্য পশু কিংবা অন্য মানুষের আক্রমণ সম্পর্কে আগে ভাগে জানার জন্যে সতর্ক সংকেতের মতোও কাজে লাগানো যেত। প্রজন্মান্তরে, মানুষ ও কুকুর এই দুটি প্রজাতি সহ-বিবর্তনের* মাধ্যমে নিজেদের বোঝাপড়ার অনেক উন্নতি করে ফেলল। যেসব কুকুর তাদের প্রভুর প্রয়োজন কিংবা অনুভুতির ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল তারা একটু বাড়তি খাবার ও আদর-যত্ন পেতে লাগলো। স্বাভাবিকভাবেই তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বেড়ে গেল। একইসাথে, কুকুরগুলোও তাদের নিজেদের প্রয়োজনে মানুষদেরকে ব্যবহার করা শিখে ফেলল। কুকুরের সাথে মানুষের ১৫ হাজার বছরের এই মজবুত বন্ধন, অন্য যে কোনো প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি আবেগের ও গভীর বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি করে ফেলল। সে কারণে এখন তো বটেই, আরও আগেও কখনও কখনও পোষা কুকুরের মৃতদেহ দাফন করা হত ঠিক মানুষের মতই।

যেহেতু সে সময়কার গোষ্ঠীগুলো আকারে বেশ ছোট ছিল, তার ফলে প্রত্যেক সদস্য অন্য প্রায় সব সদস্যকেই খুব কাছ থেকে চিনত। বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন নিয়ে মিলেমিশে কাটত তাদের জীবন। একাকীত্ব কিংবা গোপনীয়তা ছিল খুবই দুর্লভ। পাশাপাশি বসবাস করা গোষ্ঠীদের মধ্যে হয়তো সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল। তারা হয়তো নিজেদের মধ্যে সদস্য অদল-বদল করত, হয়তো একসাথে শিকার করতো, হয়তো দুর্লভ সৌখিন জিনিসপত্র নিয়ে বাণিজ্য করত, রাজনৈতিক মৈত্রী তৈরি করত কিংবা একই সাথে ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করত। এরকম সহযোগিতা আসলে হোমো সেপিয়েন্সের অন্যতম মৌলিক গুণ যেটা তাদেরকে টিকে থাকার জন্য অন্যান্য মানব প্রজাতির তুলনায় একটু বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। কখনও কখনও প্রতিবেশী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এতটাই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যে তারা একসাথে মিলে একটি নতুন গোষ্ঠী গঠন করেছিল। সেই নতুন গোষ্ঠীতে ছিল একইরকম ভাষা, একই পৌরাণিক কাহিনী আর একই সামাজিক আচার।

তাই বলে অবশ্য এই প্রতিবেশীর সাথে বাহ্যিক সম্পর্কটাকে নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করারও কিছু নেই। যদিও সময়ে সময়ে প্রতিবেশী গোষ্ঠীগুলো কাছাকাছি থেকেছে কিংবা একসাথে শিকার করেছে, তারপরও, তারা আসলে তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে, নিজেদের মত করে। বাণিজ্যের ব্যাপারটাও ঝিনুক, রঙিন পাথর কিংবা কাঁচা রঙের মত কিছু সৌখিন সামগ্রীর মধ্যেই সীমিত ছিল। ফলমূল কিংবা মাংসের মত দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাণিজ্য করার তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কোনো একটা গোষ্ঠী যে অন্য কোনো একটা গোষ্ঠীর উপর বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর জন্য পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল এমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় না। সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্কগুলোও কদাচিৎই দেখা যেত। একটি উপজাতি আসলে একটি পুরোপুরি স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে কখনও গড়ে উঠতে পারেনি। যদিও মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে আলোচনার জন্য কিছু জায়গা ছিল কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট স্থায়ী শহর কিংবা প্রতিষ্ঠান ছিল না। একজন সাধারণ সদস্য হয়ত বহু মাস ধরে নিজের গোষ্ঠীর বাইরে অন্য কাউকে না দেখেই কাটিয়ে দিয়েছে। সে হয়তো তার সারা জীবনে মাত্র কয়েকশ মানুষকে নিজ চোখে দেখেছে। আসলে সেপিয়েন্স জনগোষ্ঠী খুব ছাড়া ছাড়া ভাবে বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। তবে সত্যি কথা হল, কৃষি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ছিল এখনকার মিশরের কায়রোর জনসংখ্যার চেয়েও কম!

প্রথম পোষা প্রাণী? উত্তর ইসরায়েলে প্রায় ১২,০০০ বছরের পুরনো একটা কবর পাওয়া গেছে। সেখানে ৫০ বছর বয়স্ক একজন নারীর কঙ্কাল পাওয়া গেছে. আর তার পাশেই ছিল একটি কুকুরছানার কঙ্কাল (ছবিতে নিচে বাম দিকে)। কুকুরছানাটাকে ঐ নারীর মাথার কাছাকাছিই কবর দেয়া হয়েছিল। তার বাম হাতটা কুকুরটার উপরে এমনভাবে রাখা যেটা একরকম আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ। অবশ্যই অন্যরকম ব্যাখ্যাও থাকতে পারে। এমনও হতে পারে যে কুকুরছানাটা হয়তো পরকালের দরজার প্রহরীর জন্য একটা ছোট্ট উপহার।

বেশিরভাগ সেপিয়েন্স গোষ্ঠীই ছিলো যাযাবর। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াত খাবারের সন্ধানে। তারা কখন কোথায় যাবে সেটা ঠিক তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করত না। বরং নির্ভর করত ঋতু পরিবর্তনের উপর, বিভিন্ন প্রাণীদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বসতি স্থানান্তরের উপর কিংবা বিভিন্ন গাছপালার জীবনচক্রের উপর। তারা সাধারণত বাড়ির আশেপাশের কয়েক ডজন কিংবা বড়জোর কয়েকশ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যেই ঘুরে বেড়াত।

মাঝে মধ্যে, গোষ্ঠীগুলো হয়ত সম্পূর্ণ নতুন একটা এলাকায় এসে পড়ত। সেটা বিভিন্ন কারণেই হতে পারে। যেমন, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, ভয়ংকর দাঙ্গা, জনসংখ্যার চাপ কিংবা কোনো এক নতুন নেতার দুর্দান্ত কোনো সিদ্ধান্ত। এরকম হঠাৎ হঠাৎ প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে উদ্দেশ্যহীনভাবে নতুন কোনো এক জায়গায় চলে যাওয়াটাই আসলে মানুষের এই দুনিয়াব্যাপী সম্প্রসারণের পিছনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। যদি একটা শিকারি গোষ্ঠী প্রতি চল্লিশ বছরে একবার করে ভেঙ্গে যায় এবং এর ভাঙ্গা অংশগুলো যদি পূর্ব দিকে প্রায় শ খানেক কিলোমিটার দূরে সম্পূর্ণ নতুন কোনো এলাকায় যায়, তাহলে পূর্ব আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত দূরত্ব পাড়ি দিতে প্রায় ১০ হাজার বছর সময় লাগার কথা।

কিছু দুর্লভ সময়ে, যখন কোন এলাকায় খাবারের যথেষ্ট যোগান থাকত, তখন হয়ত গোষ্ঠীগুলো একটা ঋতুর জন্য কিংবা স্থায়ীভাবেই বসতি গাড়তো কোনো এলাকায়। খাবার শুকানো ও ঠান্ডা রাখার নানা পদ্ধতিও তখন মানুষ আবিষ্কার করেছিল, যার ফলে একটু বেশি সময়ের জন্য খাবার জমিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যেত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীতে ভরপুর নদী কিংবা সাগরের আশেপাশে মানুষ স্থায়ী জেলে গ্রাম তৈরি করে ফেলেছিল। এইসব জেলে গ্রামই ছিল ইতিহাসের প্রথম স্থায়ী বসতি। এই ঘটনা কিন্তু কৃষি বিপ্লবেরও অনেক আগেকার কথা। এরকম জেলে গ্রাম হয়তো ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে প্রায় ৪৫ হাজার বছর আগে দেখা গিয়েছিল। এরকম কোনো গ্রামই হয়তো পরবর্তীতে হোমো সেপিয়েন্সকে সমুদ্রযাত্রার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল- যার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল তাদের প্রথম অস্ট্রেলিয়া যাত্রা।

বেশিরভাগ এলাকাতেই সেপিয়েন্সরা তখন থেকেই নানা ধরনের খাবারে অভ্যস্ত ছিল। তারা সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী যখন যে খাবার পাওয়া যেত, সেটাই সংগ্রহ করত। তারা পোকামাকড় হাতিয়ে নিত, গাছ থেকে ফলমূল পাড়ত, গর্ত করে শেকড় যোগাড় করত, খরগোশ ধরত আর বাইসন কিংবা বিশাল ম্যামথ শিকার করত। যদিও প্রাচীন পূর্বপুরুষ বলতে আমাদের চোখের সামনে একজন বীর শিকারি পুরুষের ছবিটাই প্রথমে ভেসে ওঠে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন সেপিয়েন্সের প্রধান কাজ ছিল আসলে খাবার সংগ্রহ করা, শিকার করা নয়। আর সংগ্রহ করা খাবার দিয়েই তাদের বেশিরভাগ ক্যালরির যোগান হতো। এই খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েই তারা চকমকি পাথর, কাঠ আর বাঁশের মত বিভিন্ন দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সন্ধান পেত।

সেপিয়েন্স যে শুধু খাবার আর জিনিসপত্রের জন্যই ঘুরে ঘুরে খোঁজ করে বেড়াত তা নয়। তথ্য সংগ্রহ করাও তাদের অন্যতম একটা উদ্দেশ্য ছিল। বেঁচে থাকার জন্য বসতির চারপাশটা সম্বন্ধে একটা ভালো ধারণা তাদের খুব দরকার ছিল। প্রতিদিনের খাবারের সন্ধানটা আরও দক্ষতার সাথে করার জন্য তাদের ওই এলাকার গাছপালা ও প্রাণীদের জীবন চক্র ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান দরকার ছিল। তাদের জানতে হতো কোন খাবারগুলো পুষ্টিকর, কী খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা অন্যান্য কোন খাবার ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তাদের আরও জানা দরকার ছিল ঋতুচক্র সম্বন্ধে, ঝড়বৃষ্টি কিংবা খরার আগের বিপদ সংকেত সম্বন্ধে। তারা সব নদী কিংবা জলপ্রবাহ, সব আখরোট গাছ, সব ভালুকের গুহা আর সব চোখা পাথরের সংগ্রহই ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করত। তাদের প্রায় প্রত্যেক সদস্যকেই জানতে হতো কীভাবে পাথর দিয়ে চাকু বানাতে হয়, কীভাবে পুরনো ছেঁড়া আলখাল্লা মেরামত করতে হয়, কীভাবে খরগোশ ধরার ফাঁদ পাততে হয় কিংবা তুষারঝড় বা ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে পড়লে কী করতে হয় অথবা সাপের কামড় খেলেই বা কী করতে হয়। এগুলোর যে কোনোটাতেই দক্ষতা অর্জন করতে হলে একজনকে অনেক দিন ধরে শিখতে ও চর্চা করতে হয়। একজন সাধারণ প্রাচীন শিকারি কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা পাথর দিয়ে বর্শার মাথা বানিয়ে ফেলতে পারত। আমরা যদি এখন এই একই কাজ করার চেষ্টা করি, তাহলে আমরা নিঃসন্দেহে খুব বাজেভাবে ব্যর্থ হব। কারণ,আমাদের বেশিরভাগেরই চোখা এবং শিকারের উপযোগী পাথর সম্পর্কে কিংবা ওগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করার বিষয়ে তেমন কোনো জ্ঞান নেই।

অন্য কথায় বলতে গেলে, সেই সময়কার সাধারণ একজন শিকারি তার আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে অনেক জ্ঞান রাখত। সেই তুলনায় তাদের এখনকার উত্তরাধিকারীরা বরং একেবারেই আনাড়ি। আজকের শিল্পভিত্তিক সমাজে বেশির ভাগ মানুষেরই টিকে থাকার জন্য তার আশেপাশের প্রকৃতি সম্বন্ধে আসলে তেমন কিছু জানার প্রয়োজন হয় না। এখনকার সময়ে একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, বিমা কর্মকর্তা, ইতিহাসের শিক্ষক কিংবা কারখানার শ্রমিক হিসেবে টিকে থাকার জন্য আসলে আপনার কী জানা দরকার? আপনাকে আপনার নিজের কাজের ছোট জগতের অনেক খুঁটিনাটি সম্পর্কে অনেক বেশি কিছু জানা দরকার, কিন্তু জীবনের বেশির ভাগ প্রয়োজন মেটাতেই আপনাকে অন্য সব মানুষের উপর নির্ভর করতে হবে যারা নিজেরা আবার তাদের কাজের ছোট্ট জগতের বাইরে তেমন কিছু জানে না। যদিও সামগ্রিকভাবে মানুষ এখন তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে অনেকে বেশি জানে কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিন্তা করলে আসলে প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক মানুষেরাই ইতিহাসে সবচেয়ে জ্ঞানী ও দক্ষ মানুষ ছিল।

এমন কিছু তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায় যেটা ইঙ্গিত করে যে, এখনকার গড়পড়তা সেপিয়েন্সের মস্তিষ্কের আকার সেই শিকারি সময়ের তুলনায় একটু কমে এসেছে। সেইসময়ে টিকে থাকার জন্য প্রত্যেকেরই প্রচণ্ড মানসিক দক্ষতার দরকার ছিল। যখন থেকে কৃষি কিংবা শিল্পের আবির্ভাব হল, মানুষ বেশি বেশি করে টিকে থাকার জন্যে অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে থাকল। আর এভাবেই বোধ বুদ্ধি কম হয়েও টিকে থাকার সুযোগ তৈরি হল। স্রেফ পানি বয়ে কিংবা কারখানার সাধারণ একজন শ্রমিক হওয়ার পরও আপনি দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন আর আপনার একেবারেই সাধারণ জিনগুলো আপনার বংশধরদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন।

শিকারি পূর্বপুরুষেরা যে শুধুমাত্র তাদের চারপাশের প্রাণী, গাছপালা আর ব্যবহার্য জিনিসপত্র সম্পর্কেই জ্ঞান লাভ করেছিল তাই নয়, বরং তারা তাদের শরীর ও অনুভূতি সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল। তারা ঘাসের উপর সামান্য নড়াচড়া থেকেই টের পেয়ে যেত কোনো সাপ ওঁত পেতে আছে কিনা। তারা গাছের পাতাগুলো খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করত যার ফলে সহজেই ফলমূল, মৌমাছির চাক কিংবা পাখির বাসা খুঁজে পেত। তারা একেবারেই কম কষ্টে ও নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারত। তারা দ্রুততা ও দক্ষতার সাথে বসতে, হাঁটতে কিংবা দৌড়াতে পারত। সারাটা সময় নানা ধরনের ব্যবহারের ফলে তাদের শরীর একজন ম্যারাথন দৌড়বিদের মতই একদম সুস্থ-সবল থাকত। তাদের শরীর এত নিপুণ ছিল যে এখনকার মানুষেরা বছরের পর বছর ধরে যোগব্যায়াম কিংবা তাইচি চর্চা করেও সেটা অর্জন করতে পারবে না।

এইসব শিকারি-সংগ্রাহকদের জীবন জায়গা ভেদে কিংবা ঋতু ভেদে যদিও এক এক রকম ছিল কিন্তু তারা সকলেই আসলে অনেক সুস্থ ও আরামদায়ক জীবন যাপন করত। বরং তাদের উত্তরাধিকারী কৃষক, রাখাল, দিনমজুর কিংবা অফিস কর্মচারীদের জীবনই অনেক বেশি কষ্টের।

যেখানে আজকের প্রাচুর্যপূর্ণ সমাজেও মানুষজন সপ্তাহে গড়পড়তা প্রায় চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ ঘণ্টা কাজ করে, উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ষাট এমনকি আশি ঘণ্টা কাজ করে, সেখানে কালাহারি মরুভূুমির মতো প্রতিকুল পরিবেশেও আজকের দিনের শিকারি-সংগ্রাহকরা সপ্তাহে মাত্র পঁয়ত্রিশ কি পঁচিশ ঘণ্টা কাজ করে। তারা প্রতি তিন দিনে একদিন শিকার করে। অন্যান্য খাবার সংগ্রহের কাজটা করতে তিন থেকে ছয় ঘণ্টা নেয় বড়জোর। সাধারণত একটা গোষ্ঠীর জন্য এটাই যথেষ্ট হয়। এমনও হতে পারে যে, এখনকার কালাহারি মরুভূমির চেয়েও বেশি উর্বর জায়গায় প্রাচীন শিকারি মানুষেরা খাবার বা বিভিন্ন কাঁচামাল জোগাড় করার জন্য অনেক কম সময় ব্যয় করত। তার উপর, শিকারি-সংগ্রাহকদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য অনেক কম কাজ করতে হতো। তাদের থালা-বাটি ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা, বাচ্চার কাঁথা বদলানো বা বিল পরিশোধ করার মত বিরক্তিকর কাজগুলো করতে হতো না।

আসলে কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজের চেয়ে শিকারি-সংগ্রাহক মানুষেরা অনেক বেশি মজার জীবন যাপন করত। আজকের একজন চীনা শ্রমিক ঘর থেকে বের হয় সকাল ৭ টার সময়, তারপর নানারকম দূষণে ভরপুর রাস্তা দিয়ে গিয়ে পৌঁছায় তার অস্বাস্থ্যকর কাজের জায়গায়, তারপর একইভাবে একই যন্ত্র চালায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, তাও দিনে প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে। তারপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘরে ফিরে থালা বাসন ধোয়া কিংবা কাপড় চোপড় পরিষ্কারের কাজে লেগে যায়। এদিকে, তিরিশ হাজার বছর আগে একজন চীনা শিকারি হয়তো তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে সকাল ৮ টার দিকে ঘর থেকে বের হতো। তারা হয়তো আশেপাশের বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। ব্যাঙের ছাতা, খাওয়ার মত শিকড় কিংবা ব্যাঙ ধরত। মাঝে মাঝে হয়তো বাঘের তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালাত। বিকেলের বেশ আগেই তারা খাবারের জন্য ঘরে ফিরত। এর ফলে তাদের হাতে অনেক সময় থাকত গল্প করার, ছেলেমেয়েদের সাথে খেলা করার কিংবা নেহায়েতই উদ্দেশ্যহীনভাবে সময় কাটানোর। মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই তাদের বাঘে ধরে খেয়ে ফেলতো কিংবা সাপে কামড় দিত কিন্তু অন্যদিকে ভাবলে, তাদেরকে তো অন্তত গাড়ি-ঘোড়ার দুর্ঘটনা কিংবা শিল্পকারখানার দূষণের কারণে মরতে হত না।

বেশিরভাগ জায়গায় এবং বেশিরভাগ সময়ে, ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করাই মানুষকে আদর্শ পুষ্টির জোগান দিয়েছে। এতে অবাক হবার কিছু তো নেই-ই বরং হাজার হাজার বছর ধরে এটাই মানুষের সাধারণ খাদ্যাভ্যাস ছিল। তার ফলে মানুষের শরীর এই খাদ্যাভ্যাসের সাথেই খাপ খাইয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন ফসিল থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্ত এটারই ইঙ্গিত দেয় যে, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের অপুষ্টি কিংবা দুর্ভিক্ষে মরার সম্ভাবনা বেশ কম ছিল বরং সাধারণত তাদের কৃষক বংশধরদের চেয়ে তারা বেশি লম্বা ও স্বাস্থ্যবান ছিল। গড় আয়ু তখন ছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ বছর, কিন্তু এর জন্য মূলত দায়ী অতিরিক্ত শিশু মৃত্যুহার। যেসব শিশুরা বিপদসঙ্কুল প্রথম বছরগুলো পার করে ফেলতে পারত তাদের বেশ ভালো সম্ভাবনা ছিল ষাট বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচার। কেউ কেউ তো হয়তো আশি বছর পর্যন্তও বাঁচতো। আর এখনকার শিকারি-সংগ্রাহক জনগোষ্ঠীতে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী একজন মহিলা আরও বিশ বছর বাঁচার আশা করতে পারেন যেখানে পুরো জনগোষ্ঠীর ৫ থেকে ৮ শতাংশ হল ষাটোর্ধ্ব।

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে এই বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসই শিকারি-সংগ্রাহকদের দুর্ভিক্ষ কিংবা অপুষ্টি থেকে রক্ষা করেছিল। অন্যদিকে কৃষকরা খুব সীমিত আর ভারসাম্যহীন খাবার খেতো। বিশেষ করে পূর্বাধুনিক যুগে বেশির ভাগ ক্যালরির জোগানই হত একটি মাত্র উৎস থেকে- গম, আলু কিংবা ধান। এই উৎসগুলোর একটা সমস্যা হল এগুলোতে বেশ কিছু মৌলিক উপাদান যেমন ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদানের যথেষ্ট ঘাটতি আছে যেগুলো আবার মানুষের শরীরের জন্য দরকার। প্রাচীন চীনের একজন সাধারণ কৃষক সকাল, দুপুর কিংবা রাত সবসময় শুধু ভাতই খেতো। তার কপাল ভালো থাকলে সে পরদিনও একই খাবার খাওয়ার কথাই ভাবত। অন্যদিকে, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকরা নিয়মিতভাবে প্রায় ডজনখানেক ভিন্ন ভিন্ন রকম খাবার খেত। কোনো এক প্রাচীন কৃষকের কোনো এক পূর্বপুরুষ হয়তো সকালের খাবার হিসেবে খেত লিচু আর ব্যাঙের ছাতা, তারপর দুপুরের খাবার হিসেবে ফলমূল, শামুক আর কচ্ছপের মাংস আর তারপর রাতের বেলা হয়তো খেতো বুনো পেঁয়াজের সাথে খরগোশের মাংস। পরদিনের খাবার হয়তো হতো একেবারেই অন্যকিছু। আর এই বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসই প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের সবরকম প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করেছিল।

এছাড়াও, কোনো একটা নির্দিষ্ট খাবারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না হওয়ার ফলে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে তাদের অনেক কম ভুগতে হতো। অপরদিকে কৃষিভিত্তিক সমাজগুলো দুর্ভিক্ষে প্রায় ধ্বংস হয়ে যেত। খরা, দাবদাহ বা ভূমিকম্পের মত বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের ধান কিংবা আলুর ক্ষেত লণ্ডভণ্ড করে দিত। অবশ্য শিকারি-সংগ্রাহকদের যে এইসব প্রাকৃতিক দূর্যোগে কোনো সমস্যাই হতো না- এরকম ভাববার কোনো কারণ নেই। তাদেরও সমস্যা হতো, তারাও অনেক সময় না খেয়ে থাকত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল তাদের জন্য এই ধরনের দুর্যোগ থেকে উত্তরণটা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। তাদের কোনো একটা নিয়মিত খাবারের উৎস যদি ধ্বংসও হয়ে যেত তারা তখন অন্য কোনো কিছু দিয়ে কাজ চালিয়ে নিত অথবা অন্য কোথাও চলে যেত।

আরও মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন শিকারী সংগ্রাহকরা সংক্রামক রোগে অনেক কম আক্রান্ত হতো। কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজে যে সমস্ত রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল (যেমন গুটিবসন্ত, হাম, যক্ষ্মা) সেগুলোর বেশিরভাগেরই উৎপত্তি আসলে গৃহপালিত পশুপাখি থেকে। এইসব রোগজীবাণু পরবর্তীতে মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হয় মূলত কৃষি বিপ্লবের পরে, আগে নয়। যেসব প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকরা শুধুমাত্র কুকুরকে পোষ মানিয়েছিল তারাও কিন্তু এইসব পরিণতি থেকে মুক্ত ছিল। তাছাড়া, কৃষি বা শিল্পভিত্তিক সমাজের বেশিরভাগ মানুষই বসবাস করত খুব অস্বাস্থ্যকর, ঘনবসতিপূর্ণ চিরস্থায়ী বসতিতে- যেগুলো ছিল রোগজীবাণুর আদর্শ বাসস্থান। অন্যদিকে শিকারি-সংগ্রাহকরা ছোট ছোট গোষ্ঠীতে আলাদা আলাদাভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। তার ফলে কোনো রোগই মহামারীর আকার ধারণ করতে পারত না।

একটি সম্পূর্ণ ও বৈচিত্র্যে ভরপুর খাদ্যাভ্যাস, অপেক্ষাকৃত কম কাজের সময় আর সংক্রামক রোগের অনুপস্থিতিই অনেক বিশেষজ্ঞকে অনুপ্রাণিত করেছে কৃষি-পূর্ব সমাজকেই প্রকৃত “প্রাচূর্যপূর্ণ সমাজ” হিসেবে আখ্যায়িত করতে। অবশ্য এই প্রাচীন গোষ্ঠীকেই আদর্শ মনে করাটা আমাদের ভুল হবে। যদিও তারা কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজের মানুষের তুলনায় অনেক ভালো জীবন যাপন করত, তারপরও তাদের জীবনে অনেক রুক্ষতা ও নির্দয়তা ছিল। অভাব ও কাঠিন্য মোটেই দুর্লভ ছিল না তাদের জীবনে, শিশু মৃত্যুহারও ছিল বেশি। সে সময় হয়তো সংখ্যালঘুর অস্তিত্বই রাখা হতো না। বেশিরভাগ লোক হয়তো নিজেদের কাছাকাছি সম্পর্কটা উপভোগ করত কিন্তু যেসব দুর্ভাগারা অন্য সদস্যদের বিরাগভাজন হয়ে যেত তাদের কপালে ভালো দুঃখ ছিল। এমনকি আধুনিক শিকারি-সংগ্রাহকেরাও মাঝে মাঝেই তাদের দুর্বল বা অক্ষম সদস্যদের ত্যাগ করত কিংবা মেরেই ফেলত কারণ সেইসব সদস্য তাদের গোষ্ঠীর সাথে একই তালে চলতে পারত না। অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুদেরও হয়তো নিঃশেষ করে ফেলা হতো। এমনকি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার জন্য মানুষ উৎসর্গ করার কথাও শোনা যায়।

১৯৬০ সালের আগ পর্যন্ত যে অ্যাচে (Aché) গোষ্ঠী প্যারাগুয়ের জঙ্গলে বসবাস করতো তারাও ছিল শিকারি-সংগ্রাহক। তাদেরকে দেখে আমরা শিকারি-সংগ্রাহক জীবনের কিছু ভয়ংকর দিক সম্পর্কে জানতে পারি। যখনই অ্যাচেদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মারা যেত তখন তারা একটা ছোট কন্যাশিশুকে বলি দিত আর তারপর তাদের দুজনকে একসাথে কবর দিত। কয়েকজন নৃতত্ত্ববিদ অ্যাচে গোষ্ঠীর লোকেদের সাথে কথাবার্তা বলে ভয়ংকর কিছু ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন। একবার একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষকে তার গোষ্ঠী ত্যাগ করল। কারণ হল সেই লোকটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় অন্যদের সাথে চলতে পারছিল না। তাকে তারা একটা গাছের তলায় রেখে চলে যায়। শকুনেরা তার মাথার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছিল ভরপেট খাবারের আশায়। কিন্তু সেই মানুষটা আশ্চর্যজনকভাবে অসুস্থতা কাটিয়ে উঠে দ্রুত হেঁটে তার গোষ্ঠীতে ফিরে যেতে পেরেছিল। তার শরীর ঢাকা ছিল শকুনের বিষ্ঠায়, তাই তার নাম রাখা হলো শকুনের উচ্ছিষ্ট।

যখনই কোনো একজন অ্যাচে নারী দলের জন্য বোঝা হয়ে যেত তখন একজন জোয়ান পুরুষ চুপিচুপি তার পিছনে এসে কুড়ালের এক আঘাতে তার মাথাটা আলাদা করে ফেলত। একজন অ্যাচে পুরুষ তার জঙ্গল জীবনের প্রথম দিককার কথা নৃতত্ত্ববিদদের শুনিয়েছিল- “আমি প্রথা অনুসারে বয়স্ক মহিলাদের হত্যা করতাম … আমি সাধারণত চাচি খালাদের মারতাম … এইজন্য মহিলারা আমাকে বেশ ভয় পেত … এখন, এইখানে এই সাদা চামড়াদের সাথে থেকে আমি দুর্বল হয়ে গেছি”। যেসব শিশুরা চুল ছাড়া জন্মগ্রহণ করতো তাদের অপুষ্ট মনে করা হতো এবং সাথে সাথেই মেরে ফেলা হতো। একজন নারী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন তার প্রথম কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলা হয়েছিল কারণ গোষ্ঠীর পুরুষেরা আরও একটি কন্যাসন্তান চায়নি তখন। অন্য এক সময় একজন পুরুষ একটি ছোট্ট শিশুকে মেরে ফেলেছিল কারণ তার তখন বেজায় মেজাজ গরম ছিল আর শিশুটা শুধু কাঁদছিল। আবার অন্য একটি শিশুকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল, কারণ সে নাকি খুব অদ্ভুত দেখতে ছিল আর অন্যান্য শিশুরা তাকে দেখে হাসত!

তাই বলে এইসব গল্প শুনে তাড়াতাড়ি করে অ্যাচেদের সম্পর্কে ভয়ংকর একটা ধারণা করে ফেলা কিন্তু একদম ঠিক হবে না। যেসব নৃতত্ত্ববিদেরা তাদের সাথে বসবাস করেছেন তারা বলেছেন প্রাপ্তবয়স্ক অ্যাচেদের মধ্যে গণ্ডগোল মারামারি আসলে খুবই কম হতো। আবার নারী পুরুষ উভয়েই নিজের ইচ্ছা মত সঙ্গী বদলাতে পারত। তারা একই সাথে হেসে খেলে থাকত, তাদের নেতৃত্ব নিয়ে খুব বেশি মাথা ব্যথা তো ছিলই না বরং তারা মাতব্বর ধরনের লোকজনকে একদম পাত্তা দিত না। তারা তাদের অল্প সহায় সম্পত্তি নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট ছিল আর মোটেই সাফল্য কিংবা সম্পদের জন্য হা-হুতাশ করত না। যে জিনিসগুলোকে তারা জীবনে সবচেয়ে গুরুত্ব দিত তা হলো সুন্দর সামাজিক সম্পর্ক আর খুবই ভালো বন্ধুত্ব। তারা শিশু, অসুস্থ লোকজন আর বয়স্কদের হত্যা করাটা অনেকটা এখনকার গর্ভপাত কিংবা স্বেচ্ছামৃত্যুর মত করে দেখত। আরেকটা কথা এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, এইসব অ্যাচেদেরকে কিন্তু প্যারাগুয়ের সাধারণ কৃষকরা খুব নির্মমভাবে হত্যা করত। শত্রুদের থাবা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তাই অ্যাচে গোষ্ঠী দলের দুর্বল সদস্যদের প্রতি বেশ রুক্ষ আচরণ করতে বাধ্যই হতো বলা যায়।

সত্যি কথা বলতে কি, অন্য সব মানব সমাজের মতই অ্যাচে সমাজও আসলেই খুব জটিল ছিল। সুতরাং তাদের সম্পর্কে এই সামান্য ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে আদর্শ মনে করার কোনো কারণই নেই। অ্যাচেরা ফেরেশতাও ছিল না আবার শয়তানও ছিল না- তারাও মানুষই ছিল। আর বলাই বাহুল্য, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকেরাও সেই মানুষই ছিল।

জ্বীন-পরীদের গল্প

আচ্ছা, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক মানুষদের আধ্যাত্মিক বা মানসিক জীবন যাপন সম্পর্কে আমরা কী বলতে পারি? সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়াটা খুব একটা সহজ নয়। আমরা যদি শিকারি-সংগ্রাহকদের অর্থনৈতিক অবস্থানটা বোঝার চেষ্টা করি তাহলে তার জন্যে আমাদের সেই সময়কার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সম্পর্কে জানতে হবে। খুবই ভালো হয় যদি সেগুলো পরিমাপ করা যায়। যেমন, আমরা হিসেব কষতে পারি একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিদিন ঠিক কত ক্যালরির দরকার হয়, এক কেজি আখরোট থেকে কত ক্যালরি পাওয়া যায় আর জঙ্গলের এক বর্গকিলোমিটার থেকে কতগুলো আখরোটই বা জোগাড় করা যায়। এই সমস্ত তথ্য আমাদের হাতে থাকলে সেই সমাজের খাদ্যাভ্যাসে আখরোটের গুরুত্ব কতখানি সেটা মোটামুটি বুঝতে পারবো।

কিন্তু তারা কি আসলে আখরোটকে উপাদেয় মনে করত নাকি পানসে বিরক্তিকর কিছু মনে করত? নাকি তারা মনে করত আখরোট গাছগুলোতে আত্মারা ভর করে থাকে? তাদের কাছে কি আখরোট গাছের পাতাগুলোকে সুন্দর লাগতো? তাদের সমাজের কোনো তরুণ তার প্রেমিকাকে একটা রোমান্টিক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সময় কি আখরোট গাছতলার ছায়াঘেরা পরিবেশটার কথা ভাবত? তাদের এইসব চিন্তার বা অনুভুতির জগত সম্পর্কে জানাটা আসলে নেহায়েতই কিছু সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না।

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই একমত হন যে, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক সমাজে সর্বপ্রাণবাদ বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস খুব সাধারণ একটা ব্যাপার ছিল। সর্বপ্রাণবাদ মানে হল এমন এক বিশ্বাস যাতে মনে করা হয়, সকল জায়গা, প্রাণী, গাছপালা আর সকল প্রাকৃতিক ঘটনারই আসলে সচেতন সত্তা আছে, অনুভূতি আছে এবং তারা মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে। সুতরাং একজন সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী লোক মনে করতেই পারে যে, পাহাড়ের উপরের যে বড় পাথরটা আছে ওটারও চাওয়া পাওয়া কিংবা প্রয়োজন থাকতে পারে। পাথরটা হয়তো মানুষের কোনো কাজের জন্যে রেগে যেতে পারে কিংবা আনন্দিতও হতে পারে। পাথরটা মানুষদের খুব তিরস্কারও করতে পারে আবার মানুষের কাছে সাহায্যও চাইতে পারে। এদিকে মানুষেরাও হয়তো পাথরটার কোনো নাম দিতো পাথরটার স্তুতি কিংবা ভর্ৎসনা করার জন্যে। শুধু পাথরই নয়, পাহাড়ের গোড়ার দিকের ওক গাছগুলোও এমন জীবন্ত হতে পারে, এমনকি পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলপ্রবাহটা কিংবা জঙ্গলের পথের পাশের ঝর্ণাটা, তার চারপাশে বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড়, মাঠের ইঁদুর, শেয়াল আর গরু যারা সেই ঝর্ণায় পানি খায়- এই সবকিছুই হতে পারে এক একটা জীবন্ত সত্তা। সর্বপ্রাণবাদের জগতে শুধু যে জীব কিংবা বস্তুকেই জীবন্ত মনে করা হতো তাই নয়, সেখানে অবস্তুগত সত্তাও ছিল। যেমন মৃত মানুষের আত্মা কিংবা ভালো বা খারাপ কিছু সত্তা- ঠিক আমাদের শয়তান, পরী কিংবা ফেরেশতার মতন।

সর্বপ্রাণবাদীরা মনে করে মানুষ আর অন্যান্য সত্তার মধ্যে কোনো বিভেদের দেয়াল নেই। তারা চাইলেই কথা কিংবা নাচ গান আর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। একজন শিকারি হয়তো একদল হরিণকে ডেকে বলল যেন তাদের একজন নিজেকে উৎসর্গ করে। শিকার সফল হলে শিকারি হয়তো মৃত প্রাণীর কাছে ক্ষমা চাইবে। কেউ যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে হয়তো একজন পুরোহিত অসুখের জন্য দায়ী আত্মার সাথে যোগাযোগ করত। আর তারপর সে সেই আত্মাকে তাড়িয়ে দেওয়ার কিংবা সংশোধন করার চেষ্টা করত। প্রয়োজন পড়লে পুরোহিত হয়তো অন্য কোনো আত্মারও সাহায্য নিত। এইসব যোগাযোগের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, যে সমস্ত সত্তার সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে তারা সবই কোনো একটা নির্দিষ্ট স্থানের বা অঞ্চলের। তারা কোনো বৈশ্বিক ঈশ্বর না, বরং কোনো একটা নির্দিষ্ট হরিণ বা একটা নির্দিষ্ট গাছ, একটা নির্দিষ্ট ঝর্ণা কিংবা একটা নির্দিষ্ট আত্মা।

মানুষ আর সেইসব সত্তার মধ্যে যেমন কোনো বিভেদ ছিল না, তাদের মধ্যে সম্পর্কের ঠিক নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম কানুনও ছিল না। মানুষ ছাড়া অন্যান্য সব সত্তাগুলো শুধু যে মানুষের চাওয়া পুরণের জন্য ছিল এমন নয়, আবার তারা যে ইচ্ছামত দুনিয়া চালানোর মতো সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ছিল- তাও নয়। তাদের পুরো দুনিয়াটা মোটেই শুধু মানুষকে কেন্দ্র করে বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট সত্তাকে কেন্দ্র করেও আবর্তিত হত না।

সর্বপ্রাণবাদ কোনো একটা নির্দিষ্ট ধর্ম না। এটা আসলে হাজারটা বিভিন্ন রকমের ধর্ম বা বিশ্বাসের একটা সাধারণ নাম মাত্র। তাবৎ দুনিয়া কোথা থেকে এলো আর তাতে মানুষের স্থানই বা কোথায়- এরকম সব ব্যাপারে সেই সকল ধর্ম কিংবা বিশ্বাসের একটা মোটামুটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা তাদেরকে এক করে সর্বপ্রাণবাদ নামে ডাকতে পারি। কিন্তু প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদেরকে যদি আমরা হুট করে সর্বপ্রাণবাদী বলে বসি সেটা খুব একটা ভালো কাজ হবে না। কেন, সেটা বোঝানোর জন্য একটা তুলনা করা যেতে পারে। ধরুন আমরা বললাম যে, একটু সেকেলে গোছের কৃষকরা সবাই মূলত আস্তিক ছিল। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। আস্তিকতা (যার ইংরেজি ‘Theist’ শব্দটা এসেছে গ্রিক ‘theos’ বা ‘god’ থেকে) হলো এমন একটা ধারণা যেটা বলে, সমগ্র মহাবিশ্ব চলছে আসলে মানুষ ও অল্প কিছু উচ্চমার্গীয় সত্তার দ্বারা যাদেরকে ঈশ্বর বা দেবতা নামে ডাকা হয়। এটা অবশ্যই সত্য যে, সেকেলে কৃষকরা বেশিরভাগই আস্তিক ছিল। কিন্তু এর থেকে আমরা নির্দিষ্ট করে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারি না। আঠারো শতকের পোল্যান্ডের ইহুদি র‍্যাবাইরা, ম্যাসাচুসেটসের সপ্তাদশ শতকের ডাইনি পুড়ানো পিউরিটানরা, পঞ্চদশ শতকের মেক্সিকোর অ্যাজটেক পুরোহিতরা, দ্বাদশ শতকের ইরানের সুফি সাধকরা, দশম শতকের ভাইকিং যোদ্ধারা, দ্বিতীয় শতকের রোমান বাহিনী কিংবা প্রথম শতকের চীনা আমলারা- এদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে আড়াল করে সবগুলোকে এক নামে ‘আস্তিকতা’ বললে আসলে অনেক কিছুই চাপা পড়ে যায়। এদের প্রত্যেকেই অন্যদের আচার ও বিশ্বাসকে একদম উদ্ভট ও লৌকিকতা বিবর্জিত মনে করত। একইভাবে প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক সেই সব সর্বপ্রাণবাদীদের মধ্যকার আচার ও বিশ্বাসের পার্থক্যও হয়তো এতটাই বিশাল মাপের ছিল। তাদের ধর্মীয় জীবন হয়ত সবসময় উদ্বেল ছিল নানা রকম দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

কিন্তু এ কথাও সত্য যে, আমাদের সীমার মধ্যে আমরা যতদূর অবধি জানতে পারি তা দিয়ে ঐ সাধারণীকরণে গিয়েই থামতে হয়। প্রাচীন, অপ্রচলিত আধ্যাত্মিকতা নিয়ে যে কোনো রকমের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করাটা নেহায়েতই অনুমান নির্ভর হবে। কারণ আমাদের হাতে তেমন কোনো তথ্য প্রমাণই নেই। আর সামান্য যা কিছু বা আছে, যেমন হাতে তৈরি জিনিসপত্র কিংবা গুহাচিত্র- এসব থেকে আসলে হাজার রকম ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব। যেসব বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে তারা জানতে পেরেছেন সেই শিকারি-সংগ্রাহকরা ঠিক কেমন অনুভব করত, তাঁদের নানারকম তত্ত্ব আসলে যতটা না প্রস্তর যুগের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারটা খোলাসা করে তার চেয়ে ঢের বেশি তাঁদের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরে।

অল্প কিছু সমাধির ধ্বংসাবশেষ, গুহাচিত্র আর হাড়ের তৈরি মূর্তি থেকে পাহাড়সম নানান তত্ত্ব খাড়া করবার চেয়ে বরং একটু অকপট হয়ে এটা মেনে নেওয়াই ভালো যে প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে আমাদের যে ধারণা আছে তা খুবই অস্পষ্ট। আমরা অনুমান করতে পারি সেই সময় হয়তো সর্বপ্রাণবাদীরা ছিল, কিন্তু সেটা খুব একটা তথ্যপূর্ণ হলো না। আমরা জানি না তারা ঠিক কোন দেবতার কাছে প্রার্থনা করত, কী কী উৎসব উদযাপন করত কিংবা কী কী বিষয় নিষিদ্ধ ছিল তাদের সমাজে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, আমরা আসলে জানি না তারা ঠিক কীরকম গল্প বলত। এটাই আসলে আমাদের মানব ইতিহাস সম্পর্কে জানাশোনার সবচেয়ে বড় সংকীর্ণতা।

শিকারি-সংগ্রাহকদের সামাজিক-রাজনৈতিক জগৎ সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা ব্যাক্তিগত সম্পত্তির উপস্থিতি, একক পরিবার কিংবা একটি মাত্র সঙ্গীর মত খুব মৌলিক কিছু ব্যাপারেও একমত হতে পারেননি। এটা হতেই পারে যে বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন রকম নিয়ম মেনে চলত। কোনো একটা গোষ্ঠী হয়তো তাদের প্রতিবেশী শিম্পাঞ্জিদের মতই সুগঠিত, উত্তেজিত ও হিংস্র ছিল। অন্যদিকে হয়তো অন্য কোনো গোষ্ঠী ছিল পার্শ্ববর্তী বোনোবোদের মত অলস, শান্তিপ্রিয় আর কামুক।

ল্যাসকাউ গুহার (Lascaux Cave) প্রায় ১৫,০০০ – ২০,০০০ বছর পুরনো একটা গুহাচিত্র। আমরা এখানে ঠিক কী দেখতে পাচ্ছি আর এই চিত্রটির মানেই বা আসলে কী? কেউ কেউ বলে আমরা এখানে দেখতে পারি একটা বুনো মোষ একজন মানুষকে মারছে যার মাথাটা একটা পাখির মতন আর লিঙ্গ উত্থিত। মানুষটার নিচে আমরা আরেকটা পাখি দেখতে পাচ্ছি যেটা হয়তো মৃত্যুর পর মুক্ত হওয়া আত্মার প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে ছবিটা নেহায়েতই একটা গতানুগতিক শিকার সংক্রান্ত দুর্ঘটনার ছবি নয় বরং এই জগৎ থেকে অন্য জগতে যাওয়ার কথাও আমরা এখানে দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের জানার কোনো উপায় নেই যে আসলে এই সমস্ত ধারণা আদৌ সত্য কিনা। এটা অনেকটা রোর্সাক পরীক্ষার (Rorschach test) মত কাজ করে যেটা আধুনিক বিশেষজ্ঞদের পূর্বসংস্কারকেই বেশি উন্মোচিত করে, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের বিশ্বাসকে নয়।

১৯৯৫ সালে রাশিয়ার সুঙ্গির অঞ্চলে, প্রত্নতত্ত্ববিদেরা প্রায় ৩০ হাজার বছর পুরনো একটা কবরস্থান আবিষ্কার করেন যেটা ছিল কিছু ম্যামথ-শিকারি গোষ্ঠীর। এখানকার একটি কবরে তারা খুঁজে পান পঞ্চাশ বছর বয়স্ক একজন পুরুষের কঙ্কাল। কঙ্কালটা ম্যামথের দাঁতের ৩ হাজারটা পুঁতি দিয়ে গাঁথা একটা মালা দিয়ে ঢাকা ছিলো। মৃত মানুষটির মাথায় শেয়ালের দাঁত দিয়ে সাজানো একটা টুপি ছিল আর তার কবজি জুড়ে ছিল ম্যামথের দাঁতের তৈরি পঁচিশটা চুড়ি। একই এলাকার অন্যান্য কবরগুলো খুঁড়ে কিন্তু এতকিছু পাওয়া যায়নি। এখান থেকে বিশেষজ্ঞরা এই যুক্তি দাঁড় করালেন যে সুঙ্গির এলাকার ম্যামথ-শিকারিরা নিশ্চয় একটা সুগঠিত সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করত। সম্ভবত ঐ মৃত মানুষটি ছিল তাদের গোষ্ঠীর প্রধান। অথবা এমনও হতে পারে যে, সে আসলে ছিল অনেকগুলো গোষ্ঠী মিলে গঠিত পুরো একটি উপজাতিরই প্রধান। কারণ একটা মাত্র গোষ্ঠীর অল্প কয়েক ডজন সদস্য মিলে কবরের ভিতরের এত এত সরঞ্জাম বানিয়েছে এটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।

শিকারি-সংগ্রাহকেরা এই হস্তচিত্র তৈরি করেছিল প্রায় ৯ হাজার বছর আগে আর্জেন্টিনায় “হাতের গুহা” (Hands Cave) নামে খ্যাত একটি গুহায়। দেখে কেন যেন মনে হয় এই মৃত লম্বা হাত গুলো ঐ পাথরের ভেতর থেকে বের হয়ে আমাদের দিকে এগুচ্ছে। প্রাচীন শিকারি সমাজের ধ্বংসাবশেষ বা নিদর্শন যা কিছু পেয়েছি আমরা তার মধ্যে এটা অন্যতম নাড়া দেয়ার মত একটা ছবি – কিন্তু কেউ জানে না এর মানে কি।

প্রত্নতত্ববিদেরা এরপর আরও মজার একটা কবর খুঁজে পেলেন। এর মধ্যে ছিল মাথায় মাথায় লাগানো দুটো কঙ্কাল। একটা ছিল ১২-১৩ বছরের একটা ছেলের আর আরেকটা ছিল ৯ বা ১০ বছরের কোনো একটা মেয়ের। ছেলেটা ঢাকা ছিল প্রায় ৫ হাজার হাতির দাঁতের পুঁতি দিয়ে। তার মাথায় একটা শেয়ালের দাঁতওয়ালা টুপি ছিল আর একটা বেল্ট ছিল যাতে প্রায় ২৫০টা শেয়ালের দাঁত ছিল (অন্তত ষাটটা শেয়ালের সকল দাঁত উপড়ে ফেলতে হয়েছে অতগুলো দাঁত জোগাড় করার জন্য)। আর মেয়েটাকে সাজানো হয়েছিলো ৫,২৫০টা পুঁতি দিয়ে। দুইজনেরই চারপাশে অনেক ভাস্কর্য ও হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসপত্র ছিল। একজন খুব দক্ষ শিল্পীরও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগবে ওরকম একটা পুঁতি তৈরি করতে। অন্যভাবে বলতে গেলে, বাকি সব জিনিসগুলোর কথা বাদ দিয়েও ঐ দুজন ছেলেমেয়েকে শুধুমাত্র ১০ হাজার পুঁতি দিয়ে সুসজ্জিত করতে প্রায় ৭ হাজার পাঁচশো ঘণ্টার নিরলস পরিশ্রমের দরকার হয়েছিল। তার মানে একজন অভিজ্ঞ শিল্পীর প্রায় তিন বছরের কঠোর পরিশ্রম! ভাবা যায়?

এই যে ছেলেমেয়ে দুটো, তারা নিশ্চয় অত ছোট বয়সেই নেতা হয়ে যায়নি কিংবা পাকা ম্যামথ-শিকারিও হয়নি। তাহলে কেন তাদের ওরকম বাড়াবাড়ি রকমের সাজসজ্জা করে কবর দেয়া হয়েছে সেটা আসলে শুধুমাত্র তাদের সাংস্কৃতিক আচার-বিচার থেকেই জানা যাবে। একটা তত্ত্বমতে, তারা হয়তো উত্তরাধিকারসূত্রে তাদের বাবা মায়ের পদমর্যাদার ভাগীদার ছিল। সম্ভবত, তারা গোষ্ঠীর দলপ্রধানের ছেলেমেয়ে ছিল এবং সেটা এমন একটা সমাজে যেখানে পারিবারিক কিংবা উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতা হস্তান্তরের চল ছিল। অন্য আরেকটা তত্ত্ব অনুসারে, ঐ ছেলেমেয়ে দুটোকে হয়তো জন্মের সময়ই কোনো মৃত আত্মার পুনরুত্থান হিসেবে দেখা হয়েছে। তৃতীয় একটা তত্ত্ব বলে, তাদের কবরের এত এত কারুকাজ আসলে সমাজে তাদের অবস্থান নয় বরং তাদের মৃত্যুর ধরনটাই জানান দেয়। তাদেরকে হয়তো রীতি অনুযায়ী বলি দেয়া হয়েছিল, হয়তো বা তাদের দলপ্রধানের দাফনের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবেই। তারপর দাফন করা হয়েছিল মহা ধুমধামের সাথে।

একদম সঠিক উত্তর যাই হোক না কেন, ৩০ হাজার বছর আগেও যে সেপিয়েন্স এমন সামাজিক রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে সমর্থ ছিল তার একটা দুর্দান্ত প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে এই সুঙ্গির ছেলেমেয়ে দুটোর কবর। সেপিয়েন্সের এই বৈশিষ্ট্যটা পরবর্তীতে বহু দূর অব্দি গড়িয়ে একটা আচরণগত বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়ে আমাদের ডিএনএর মধ্যে পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছে! শুধু আমাদেরই না, আমাদের মত অন্যান্য কিছু প্রাণীর ডিএনএতেও এই বৈশিষ্ট্যটা জায়গা করে নিয়েছে।

যুদ্ধ নাকি শান্তি?

এতক্ষণ আমরা আমাদের পূর্বসূরী শিকারী-সংগ্রাহকদের জীবনযাপন, খাদ্যাভাস, ধর্মীয় আচার-আচরণ, সমাজ কাঠামো এইসব ব্যাপারে জানলাম। এরপর যে কঠিন প্রশ্নটা আমাদের সামনে চলে আসে তা হল- শিকারি-সংগ্রাহক সমাজে যুদ্ধের ভূমিকা ঠিক কেমন ছিল? কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের সমাজ ছিল একদম স্বর্গসুখে ভরপুর। তারা দাবি করেন, যুদ্ধ আর হিংস্রতার উদ্ভবই হয়েছিল কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে, যখন মানুষ ব্যাক্তিগত সম্পত্তি জমা করতে শুরু করেছিল। আবার, অন্যকিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের জগতটা ছিল খুব নির্দয় আর ভয়ংকর রকমের হিংস্র। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই দুই দলের চিন্তাভাবনাই আসলে শূন্যের ওপর তৈরি প্রাসাদের মত, যেটা মাটির সাথে যুক্ত হয়েছে খুবই সরু এক সূতো দিয়ে। আর সেই সরু সুতো হল কিছু দূর্বল প্রত্নতত্ত্বীয় ধ্বংসাবশেষ আর আধুনিক শিকারি-সংগ্রাহকদের উপর নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ।

নৃতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো খুব আগ্রহোদ্দীপক কিন্তু খুবই ঝামেলাপূর্ণও বটে। এখনকার শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠীগুলো মূলত পরস্পরের সাথে বিচ্ছিন্ন ভাবেই বসবাস করে। তার উপর, তাদের বসবাসের জায়গাগুলোও খুবই প্রতিকূল- যেমন, উত্তর মেরু অথবা কালাহারি মরুভূমি যেখানে মানুষের বসতি প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং অন্য মানুষের সাথে মারামারি করার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। এছাড়া ইদানিংকালের শিকারি-সংগ্রাহকেরাও রাষ্ট্রের সীমারেখার বাইরে নয়, ফলে বড়সড় দাঙ্গা লাগার সম্ভবনাও থাকে না। ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞরা মাত্র দুটো সুযোগ পেয়েছেন বড় কিংবা অপেক্ষাকৃত ঘনবসতিপূর্ণ স্বাধীন শিকারি-সংগ্রাহক সমাজকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার। সে দুটোর একটা হল উনিশ শতকে উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আর আরেকটা হল উনিশ শতকের শেষ বা বিশ শতকের গোড়ার দিকে উত্তর অস্ট্রেলিয়ায়। অ্যামেরিন্ডিয়ান (Amerindian) আর অ্যাবোরোজিনাল অস্ট্রেলিয়ান (Aboriginal Australian) সংস্কৃতি দুটোই খুব ঘন ঘন সশস্ত্র যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে। এটা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ যে এখান থেকে কি আমরা কোনো সাধারণ সময়ের চিত্র পেলাম, নাকি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব দেখতে পেলাম।

প্রত্নতত্ত্বীয় আবিষ্কারগুলো নেহায়েতই অপ্রতুল ও অস্পষ্ট। দশ হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনো এক যুদ্ধের কী-ই বা তথ্য-প্রমাণ থাকবে? সেই সময়ে তো দূর্গ কিংবা দেয়ালের চল ছিল না। এমনকি সৈন্যদের ব্যারাক বা ঢাল তলোয়ারও ছিল না। প্রাচীন কোনো একটা বর্শা পেলে আমরা মনে করতে পারি সেটা হয়তো বা যুদ্ধে ব্যবহার করা হত, কিন্তু ওটা আবার শিকারের কাজের জন্যেও ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। এদিকে আবার ফসিলে পরিণত হয়ে যাওয়া মানুষের হাড় থেকে তথ্য উদ্ঘাটন করাও কম দুরূহ কাজ নয়। সেই হাড়ে যুদ্ধের কারণেও চিড় ধরতে পারে, আবার কোনো দূর্ঘটনার কারণেও হতে পারে। আমরা যদি প্রাচীন কোনো কঙ্কাল পাই আর আবিষ্কার করি সেটার কোনো হাড় ভাঙা বা ফাটা নয় আর তাতে কোনো কাটার দাগও নেই, তারপরও আসলে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি না যে মানুষটা কোনো নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি। মানুষটা চূড়ান্ত আতঙ্কেও মারা যেতে পারে যেটা হাড়ে কোনো প্রমাণ রাখবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, শিল্প বিপ্লবের আগের যেসব যুদ্ধ হতো, তাতে যারা মারা যেত তাদের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগই মারা যেত আসলে দুর্ভিক্ষে, শীতে আর নানা রকম রোগে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ববিদেরা যখন এইসব মৃত মানুষের কঙ্কালের সন্ধান পাবে তারা হয়তো খুব সহজেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে যে এই সব মানুষগুলো হয়তো কোনো এক বিরাট প্রাকৃতিক দূর্যোগে মারা গিয়েছিল। কিভাবে আমরা বুঝতে পারব যে ওরা আসলেই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল?

সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ব্যাপারে সমস্ত সতর্কতার বিষয়টা পরিষ্কার করার পর এখন আমরা কিছু প্রত্নতত্ত্বীয় আবিষ্কারের দিকে তাকাতে পারি। পর্তুগালে কৃষি বিল্পব শুরুর ঠিক আগেকার প্রায় ৪০০ কঙ্কাল নিয়ে একসময় একটা জরিপ করা হয়। সেখানে মাত্র দুটো কঙ্কালে স্পষ্ট আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। একইরকম ভাবে একই সময়ে ইসরায়েলের দিকে আরও ৪০০ কঙ্কালের উপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায় মাত্র একটা কঙ্কালে একটা মাত্র গর্ত যেটাকে আসলে মানুষের প্রতিহিংসার চিহ্ন বলা যায়। তৃতীয় আরেকটা জরিপ চালানো হয় কৃষি-পূর্ব দানিয়ুব উপত্যকায় আরও ৪০০ টা কঙ্কালের উপর। সেখানে ১৮ টা কঙ্কালে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। ৪০০ টার মধ্যে ১৮ সংখ্যায় খুব কম শোনালেও এটা আসলে বেশ বড় একটা শতকরা অংশ। যদি সত্যিই ১৮জন প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মারা গিয়ে থাকে তার মানে শতকরা প্রায় ৪.৫ ভাগ মৃত্যু হয়েছিল মানুষের প্রতিহিংসার কারণে। আজকের দিনে সারা পৃথিবীতে প্রতিহিংসায় মৃত্যুহার শতকরা মাত্র ১.৫ ভাগ, তাও যুদ্ধ আর অন্যান্য নৃশংসতা সব ধরে। বিংশ শতাব্দীতে সকল মানব মৃত্যুর মধ্যে মাত্র শতকরা ৫ ভাগ হল মানুষে মানুষে প্রতিহিংসার কারণে- সেটাও আবার এমন এক শতাব্দীতেই যেটাতে ভয়ংকর সব যুদ্ধ আর গণহত্যা দেখেছে বিশ্ব। সুতরাং বলা যায় সেই প্রাচীন দানিয়ুব উপত্যকার মানুষেরা আমাদের এখনকার বিংশ শতাব্দীর মানুষের মতই হিংস্র ছিল।**

এরকম হতাশাজনক আবিষ্কার যে শুধু দানিয়ুব উপত্যকাতেই পাওয়া গেছে তা নয়, আরও নানান জায়গাতেই এই একই অবস্থা। সুদানের জাবেল সাহাবাতে (Jabl Sahaba), ১২ হাজার বছরের পুরনো একটা কবরস্থানে ৫৯টা কংকাল পাওয়া গিয়েছিল। শতকরা হিসাবে এর প্রায় ৪০ শতাংশ, মানে ২৪টা কঙ্কালের গায়ে তীর বা বর্শার মাথার অংশটুকু গেঁথে থাকতে দেখা গেছে। একজন নারীর দেহাবশেষে তো ১২টা আঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেছে। বাভারিয়ার ওফনেট গুহায় (Ofnet Cave in Bavaria) প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ৩৮ জন শিকারি-সংগ্রাহকের দেহাবশেষ উদ্ধার করেন যাদের বেশিরভাগই ছিল নারী ও শিশু। তাদের সবাইকে দুটো আলাদা গর্তে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। সে সবের প্রায় অর্ধেক দেহাবশেষেই মানুষের তৈরি অস্ত্রের দ্বারা আঘাতের চিহ্ন বেশ স্পষ্ট। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল একেবারে ছোট শিশু। কিছু কিছু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জঘন্য রকমের নৃশংশতার নিদর্শন পাওয়া যায়। সব রকমের সম্ভাব্যতার কথা বিবেচনা করেই, এসব আলামত থেকে এটা স্পষ্ট যে, একটা পুরো শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠী এই জায়গায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

তাহলে কোনটা আসলে প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের জগত সম্পর্কে ভালো ধারণা দেয়- ইসরায়েল আর পর্তুগালে আবিষ্কার করা শান্তিময় কঙ্কালগুলো, নাকি জাবেল সাহাবা আর ওফনেটের ঐসব কসাইখানা? আসলে কোনোটাই সঠিক উত্তর হবে না! প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকেরা যেমন হাজারটা ভিন্ন রকম ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা করত, তাদের মধ্যে নৃশংসতার মাত্রাটাও ছিল তেমনি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। কিছু কিছু জায়গা যেমন ছিল শান্ত স্নিগ্ধ, আবার এমন কিছু জায়গাও ছিল যেখানে হরহামেশাই লেগে থাকত ভয়ংকর সব দাঙ্গা।১০

কবি যেখানে নীরব

প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক জীবনের একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র বের করা যদি কঠিন হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হবে, সেই সময়কার কোনো একটা নির্দিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা পাওয়াটাও প্রায় অসম্ভব। যখন একটা সেপিয়েন্স গোষ্ঠী সর্বপ্রথম কোনো একটা নিয়ান্ডার্থাল অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করেছিল, তার পরের কয়েক বছর নিশ্চয় সেখানে খুব শ্বাসরুদ্ধকর এক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত সেই বিশাল ঘটনার তেমন কিছুই আজ আর অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। বড়জোর কিছু ফসিলে রূপান্তরিত হাড় আর কিছু পাথরের তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া যেতে পারে। যেগুলোর গভীর সব অনুসন্ধানও আমাদের বিশেষ কিছু জানান দিতে পারবে না। আমরা বড়জোর মানুষের শারীরিক গঠন, মানুষের তৈরি প্রযুক্তি, খাদ্যাভ্যাস আর সামাজিক গঠন সম্পর্কে কিছু ধারণা পেতে পারি। কিন্তু সেসব থেকে আমরা পাশাপাশি অবস্থান করা সেপিয়েন্স গোষ্ঠীর মধ্যকার রাজনৈতিক জোট সম্পর্কে কিছু জানতে পারিনা। সেই জোটকে আশীর্বাদ করা আত্মা আর সেই আশীর্বাদ রক্ষার জন্য দলের পুরোহিতকে গোপনে দেয়া হাতির দাঁতের তৈরি পুঁতিগুলো সম্পর্কেও তেমন কিছু জানতে পারি না।

এই নীরবতার পর্দা প্রায় দশ হাজার বছরের ইতিহাসকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে। এই বিশাল সময়ে হয়তো অনেক যুদ্ধ আর বিপ্লব হয়েছে, দারুণ সব ধর্মীয় আন্দোলন হয়েছে, গভীর সব দার্শনিক তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে কিংবা অতুলনীয় সব শৈল্পিক নিদর্শন তৈরি হয়েছে। শিকারি-সংগ্রাহকেরা হয়তো তাদের মধ্যে বিশ্বজয়ী নেপোলিয়নকে খুঁজে পেয়েছে, যে হয়তো লুক্সেমবার্গের অর্ধেক আকারের কোনো সাম্রাজ্য শাসন করেছে। হয়তো মহা প্রতিভাধর বেথোভেনকে খুঁজে পেয়েছে তারা, যে হয়তো অর্কেস্ট্রা নয় বরং বাঁশের বাঁশির সুরমূর্ছনায় মানুষের চোখে জল এনে দিতে পারত। তারপর হয়তো মহিমান্বিত নবী কিংবা পথপ্রদর্শকের দেখা পেয়েছে যারা সারা বিশ্বের একক স্রষ্টার বদলে হয়তো এলাকার কোনো একটা ওক গাছের কাছ থেকে পাওয়া পবিত্র বাণী প্রচার করতো। কিন্তু এসব আসলে শুধুই অনুমান। নীরবতার পর্দাটা এতোই মোটা যে, আমরা নিশ্চিতও হতে পারি না এরকম কিছু ঘটেছিল কি না, বিশদ ব্যাখ্যা তো অনেক দূরের কথা।

বিশেষজ্ঞরা সাধারণত সেসব প্রশ্নই করেন যেগুলোর একটা মোটামুটি উত্তর তারা দিতে পারেন। উপযুক্ত গবেষণা উপকরণ বা পদ্ধতি না পেলে আমরা সম্ভবত কখনই জানতে পারব না প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকেরা ঠিক কী বিশ্বাস করত অথবা কীরকম রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ হত তাদের সমাজে। এরপরও আমাদের সেইসব প্রশ্ন করতে হবে যেগুলোর কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই। তা না হলে, আমরা হয়তো প্রায় ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার বছরের ইতিহাস আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিতে অনুপ্রাণিত হব এই অজুহাত দিয়ে যে, “সেই সময়কার মানুষজন তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছুই করেনি”।

সত্যিটা হল তারা আসলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজই করেছে। বিশেষ করে বলতে গেলে, যতটা না বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারে, তার চেয়েও ঢের বেশি মাত্রায় বদলে ফেলেছিল তারা আমাদের চারপাশের জগৎটাকে। সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল, মধ্য অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি এলাকা আর আমাজনের জঙ্গলের অভিযাত্রীদের বিশ্বাস তারা এমন কিছু আদিম জায়গায় প্রবেশ করতে পেরেছেন যেখানে কোনো মানুষের স্পর্শ পড়ার সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু এটা আসলে একটা ভ্রম মাত্র। শিকারি-সংগ্রাহকেরা আমাদের বহু আগে এই পৃথিবীতে বসবাস করে গেছে। এটা হতেই পারে যে তারা পৃথিবীর গভীরতম জঙ্গল কিংবা সবচেয়ে জনমানবশুণ্য এলাকাতেও নিজেদের বসতি গেড়ে নিজেদের মত করে পরিবর্তন এনেছে। এর পরের অধ্যায়ে আমরা জানতে পারব কিভাবে প্রথম কৃষিনির্ভর গ্রাম প্রতিষ্ঠার বহু আগেই সেইসব শিকারি-সংগ্রাহকেরা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র বদলে দিয়েছিল। কল্পকাহিনী তৈরি করতে পারা আর ঘুরে ঘুরে বেড়ানো সেইসব সেপিয়েন্স গোষ্ঠীগুলোকেই আসলে বলা যায় প্রাণিজগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ধ্বংসাত্মক শক্তি।

——————

* জীববিজ্ঞানে সহ-বিবর্তন বলতে বোঝায়- “কাছাকাছি সম্পর্কযুক্ত অন্য কোনো একটা জীবের কারণে কোনো একটা জীবের যে রূপান্তর সংঘটিত হয়”। অন্য কথায় বলতে গেলে, যখন অন্তত দুটো আলাদা প্রজাতির জিনগত পরিবর্তন একে অপরকে পারস্পারিকভাবে প্রভাবিত করে তখন আমরা বলি যে তাদের মধ্যে সহ-বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে।

** দানিয়ুবের ঐ পুরো ১৮ টা কংকালই যে প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মারা গেছে সেটাও কিন্তু তর্কসাপেক্ষ। কেউ কেউ শুধু আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। অবশ্য আমরা যদি নানান রকমের অজ্ঞাত আতঙ্কের কারণে মৃত্যুর কথা বিবেচনা করি তাহলে ব্যাপারাটা কাটাকাটি হয়ে যায়।

—————-
তথ্যসূত্র

1 Christopher Ryan and Cacilda Jethá, Sex at Dawn: The Prehistoric Origins of Modern Sexuality (New York: Harper, 2010); S. Beckerman and P. Valentine (eds.), Cultures of Multiple Fathers. The Theory and Practice of Partible Paternity in Lowland South America (Gainesville: University Press of Florida, 2002).

2 Noel G. Butlin, Economics and the Dreamtime: A Hypothetical History (Cambridge: Cambridge University Press, 1993), 98–101; Richard Broome, Aboriginal Australians (Sydney: Allen & Unwin, 2002), 15; William Howell Edwards, An Introduction to Aboriginal Societies (Wentworth Falls, NSW: Social Science Press, 1988), 52.

3 Fekri A. Hassan, Demographic Archaeology (New York: Academic Press, 1981), 196–9; Lewis Robert Binford, Constructing Frames of Reference: An Analytical Method for Archaeological Theory Building Using Hunter-Gatherer and Environmental Data Sets (Berkeley: University of California Press, 2001), 143.

4 Brian Hare, The Genius of Dogs: How Dogs Are Smarter Than You Think (Dutton: Penguin Group, 2013).

5 Christopher B. Ruff, Erik Trinkaus and Trenton W. Holliday, ‘Body Mass and Encephalization in Pleistocene Homo’, Nature 387 (1997), 173–6; M. Henneberg and M. Steyn, ‘Trends in Cranial Capacity and Cranial Index in Subsaharan Africa During the Holocene’, American Journal of Human Biology 5:4 (1993): 473–9; Drew H. Bailey and David C. Geary, ‘Hominid Brain Evolution: Testing Climatic, Ecological and Social Competition Models’, Human Nature 20 (2009): 67–79; Daniel J. Wescott and Richard L. Jantz, ‘Assessing Craniofacial Secular Change in American Blacks and Whites Using Geometric Morphometry’, in Modern Morphometrics in Physical Anthropology: Developments in Primatology: Progress and Prospects, ed. Dennis E. Slice (New York: Plenum Publishers, 2005), 231–45.

6 Nicholas G. Blurton Jones et al., ‘Antiquity of Postreproductive Life: Are There Modern Impacts on Hunter-Gatherer Postreproductive Life Spans?’, American Journal of Human Biology 14 (2002), 184–205.

7 Kim Hill and A. Magdalena Hurtado, Aché Life History: The Ecology and Demography of a Foraging People (New York: Aldine de Gruyter, 1996), 164, 236.

8 Ibid., 78.

9 Vincenzo Formicola and Alexandra P. Buzhilova, ‘Double Child Burial from Sunghir (Russia): Pathology and Inferences for Upper Paleolithic Funerary Practices’, American Journal of Physical Anthropology 124:3 (2004), 189–98; Giacomo Giacobini, ‘Richness and Diversity of Burial Rituals in the Upper Paleolithic’, Diogenes 54:2 (2007), 19–39.

10 I. J. N. Thorpe, ‘Anthropology, Archaeology and the Origin of Warfare’, World Archaeology 35:1 (2003), 145–65; Raymond C. Kelly, Warless Societies and the Origin of War (Ann Arbor: University of Michigan Press, 2000); Azar Gat, War in Human Civilization (Oxford: Oxford University Press, 2006); Lawrence H. Keeley, War before Civilization: The Myth of the Peaceful Savage (Oxford: Oxford University Press, 1996); Slavomil Vend, ‘Stone Age Warfare’, in Ancient Warfare: Archaeological Perspectives, ed. John Carman and Anthony Harding (Stroud: Sutton Publishing, 1999), 57–73.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *