1 of 2

জরাসন্ধ-বধ – মণি বর্মা

জরাসন্ধ-বধ – মণি বর্মা

ট্রেন ছাড়তে প্রতুল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

এবার শুধু ওঠার পালা। সমতল পৃথিবী পড়ে রইল পায়ের তলায়। কর্ম-কোলাহল, অতিব্যস্ত জনতার কলরব এখানে স্তব্ধ।

অন্তত অবকাশের সাতটা দিন নিবিড় শান্তিতেই কাটবে। খুশি মনে একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রতুল চোখ ফেরাল প্রকৃতির দিকে। দার্জিলিং-এ সে এই প্রথম যাচ্ছে না; কিন্তু শীতে হিমালয়ের রূপ সত্যিই অভিনব!

গাঢ় কুয়াশা পুঞ্জীভূত মেঘের মতই পাথরের বুক আঁকড়ে দুলছে—নিচ্ছিদ্র—সীমাহীন। তবু তারই বুক ভেদ করে, মন্থরগামী সরীসৃপের মতই ট্রেন চলেছে এঁকেবেঁকে। মনে হয়, এ যেন অনন্ত যাত্রা—অজ্ঞাতের উদ্দেশে।

দগ্ধপ্রায় সিগারেটটুকু বাইরে ছুড়ে দিয়ে প্রতুল ফিরে তাকাতেই টিকিট-চেকার হাঁকলেন; টিকিট?

পকেট থেকে টিকিটখানা বার করে প্রতুল তাঁর হাতে দিল। ভদ্রলোক সাড়ম্বরে সেখানা ‘পাঞ্চ’ করে ফিরিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে প্রতুলের মনে হল, নিপুণ ভাবে ভাঁজকরা একটুকরো কাগজও যেন তার হাতের মধ্যে এসে গেছে।

বিস্মিত হল প্রতুল। কিন্তু বাইরে সে-ভাব প্রকাশ না করে, অতি ধীরে-সুস্থে সে কাগজের টুকরোটা খুলে পড়তে শুরু করল।

এরকম দিনে দার্জিলিং-এর পথে আপনার দেখা পাওয়া ভগবানের আশীর্বাদ। মগনলালের খুনের বিবরণটা নিশ্চয়ই কাগজে পড়ে থাকবেন। হত্যাকারী ‘জরাসন্ধ’ দার্জিলিং-এ যাচ্ছে তার দলবলের সঙ্গে মিলতে। খবরটা আমাদের পাকা, কারণ পৃথিবীতে বিশ্বাসঘাতকদের অভাব কোনদিনই হয়নি।

সুতরাং চোখ দুটো একটু খুলেই রাখবেন ; আর ‘স্নো ভিউ’ হোটেলে গিয়ে গোয়েন্দা ‘জন্মেজয়ে’র সঙ্গে যদি যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন, তাহলে বাধিত হব। এই অকালে আর কোন হোটেল খোলা নেই।

জন্মেজয় পাকা লোক, তবে প্রতুল লাহিড়ীর প্রতিভা তার নেই। যে কোন প্রকারেই হোক, হত্যাকারী জরাসন্ধকে জীবন্ত গ্রেপ্তার করতেই চাই আমরা—যা মহাভারতের যুগেও ঘটেনি। শুধু মনে রাখবেন, মহাভারতের সেই অমিতবিক্ৰম রাজাটির মতই আমাদের জরাসন্ধও দুর্ধর্ষ।

পাছে কেউ সন্দেহ করে, তাই ইচ্ছে করেই আপনার সঙ্গে নিউ জলপাইগুড়িতে দেখা করিনি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, ‘জরাসন্ধ-বধ’ যেন নতুন করেই আবার দার্জিলিং-এ রচিত হয়। ইতি—

আপনারই পুরোনো বন্ধু

সুচারু সেন।

চিঠি পড়ে প্রতুল রীতিমত চিন্তিত হয়ে উঠল। কানপুরের বিখ্যাত ধনী মগনলালের হত্যা-কাহিনীটা সে শুধু কাগজেই দেখেনি, লালবাজার থেকেও অনেক কিছু শুনেছে। জরাসন্ধই যে হত্যাকারী—এও সে জানে। এই তার প্রথম অপরাধ নয়, ইতিপূর্বে বহু ‘খুনী কেসে’ তাকে সন্দেহ করা হয়, কিন্তু সন্তোষজনক কোন প্রমাণই তার বিরুদ্ধে পাওয়া যায়নি। এবার পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু গ্রেপ্তার করার আগেই অতি অকস্মাৎ সে উত্তরপ্রদেশ থেকে নিরুদ্দিষ্ট হয়।

অবশেষে পুলিশ খবর পেয়েছে দার্জিলিং-এ হাজির হয়েছে সে। কিন্তু দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে এই প্রচণ্ড শীতের দিনে দার্জিলিং-এ কেন?

এ প্রশ্নের একটা উত্তরের আশাতেই যেন সে কামরার সহযাত্রীদের পানে ফিরে তাকাল।

তার বিপরীত দিকের বার্থে খর্বাকৃতি একজন জাপানী ভদ্রলোক বসে। তাঁর ভাবে-ভঙ্গিতে মনে হয় ভারতবর্ষে তিনি এই প্রথম এসেছেন বেড়াতে এবং দেশটা যে তাঁকে বিমোহিত করেছে, সেটা না জানাতে পারা পর্যন্ত স্বস্তি বোধ করছেন না। পাছে এখনই আলাপ শুরু করে দেন, এই ভয়ে প্রতুল তাড়াতাড়ি দৃষ্টি ফিরিয়ে, তাকাল পাশের বৃদ্ধ লোকটির পানে। বয়স হয়েছে তাঁর। মাথার চুল প্রায় সবই সাদা। বাঁকা নাক, লম্বা কান চেহারায় একটা বৈশিষ্ট্য এনেছে। হাতের আঙুলগুলো দেখলে মনে হয়, তুলি চালাতে বা অস্ত্রোপচার করতেই দক্ষ তিনি।

কোণের দিকে বসে তিনজন লোক তাস পিটছিল। চেহারা এবং বেশভূষা তাদের প্রায় একই রকম। মনে সম্ভ্রম জাগায় না—জাগায় বিচিত্র এক অস্বস্তি। এ পরিবেশে যেন তারা বেমানান।

আর একজন মাত্র যাত্রী কামরায় ছিল। দীর্ঘাঙ্গী একটি তরুণী। চেয়ে থাকবার মত তার রূপ; কিন্তু সে রূপে শুধু চোখই ঝলসায়, রক্তে নাচন জাগায় না। রেখাহীন মুখে সে বাইরের কুয়াশার পানে তাকিয়ে ছিল।

ট্রেন ঘুম স্টেশন থেকে ছাড়তেই প্রতুলের আশঙ্কা সত্যে পরিণত হল। জাপানী ভদ্রলোক আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। জানালেন, নাম তাঁর নাগোচি কাইসা। দেশভ্রমণে বেরিয়েছেন। আগ্রার তাজমহল থেকে কলকাতার অক্টারলোনি মনুমেন্ট—সবই তাঁকে মুগ্ধ করেছে। হিমালয় সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছেন, তাই কিছু প্রত্যক্ষ পরিচয় পেতে চলেছেন দার্জিলিং।

প্রতুল শুধু শুনেই গেল; জবাব দেধার কোন উৎসাহ দেখাল না। অগত্যা ভদ্রলোক আলাপ জমাবার চেষ্টা করলেন রূপসী তরুণীটির সঙ্গে। কিন্তু সব চেষ্টাই যখন তাঁর পাথরে প্রতিহত হয়ে ফিরে এল, একান্ত দুঃখের সঙ্গেই তিনি তখন সকরুণ কণ্ঠে প্রতুলকে বললেন, আপনাদের দেশের মেয়েরা দেখছি নিজের সম্বন্ধে মোটেই সচেতন নন। একলা বেড়াবার দুর্ভোগটুকু তাঁকে কিছুতেই বোঝাতে পারলুম না।

পাছে কোন মন্তব্য করতে হয়, তাই প্রতুল তাড়াতাড়ি তার মুখ ফিরিয়ে নিল।

‘স্নো ভিউ’ হোটেলের ম্যানেজার সুধাংশু মিত্র প্রতুলকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল, অসময়ে এসেছেন—হয়তো কিছু অসুবিধে হবে। সত্যি বলতে কি, এ সময়ে এতগুলো অতিথি আমায় বেশ খানিকটা অবাক করে দিয়েছে—

আন্তরিকতার পরিচয় তার কথার সুরে। তবু প্রতুলের মনে হল, লোকটার মুখে-চোখে যেন একটা দুশ্চিন্তার ছায়া।

কামরার সেই লোক তিনজন ইতিমধ্যেই তাস পিটতে শুরু করে দিয়েছে। রূপসী তরুণীটি বারান্দার এককোণে একা বসে। চোখে সেই শূন্য দৃষ্টি।

সুধাংশু মিত্র আপ্যায়িত করবার জন্যেই চুপি চুপি প্রতুলকে বলল, ভদ্রমহিলা প্রত্যেক বছরই এসময়ে আসেন। ওঁর স্বামী নাকি এক দুর্ঘটনায় দার্জিলিং-এ মারা যান। আর ওই বুড়ো মতন ভদ্রলোক—উনি হচ্ছেন ডাক্তার দেশাই। বম্বের নামকরা সার্জন।

আর ওঁরা তিনজন? প্রতুল আঙুল বাড়িয়ে খেলারত দলটিকে দেখিয়ে দিল।

সুধাংশু মিত্রের মুখে আবার সেই দুশ্চিন্তার ছায়া দেখা দিল। একটু ইতস্তত করে সে বলল, ভবঘুরের দল বলেই বোধ হচ্ছে। ঘুরে বেড়ানোটাই হয়তো নেশা—

এই সময় মিঃ কাইসাকে দেখা গেল অদূরে। প্রতুলের পাশে দাঁড়িয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে তিনি বললেন, ডাক্তার দেশাইয়ের সঙ্গে আলাপ হল। বম্বের খুব নামকরা ডাক্তার শুনলুম। কিসের জন্যে নাকি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন····

কথার সঙ্গে সঙ্গে সন্ধানী আলোকের মতই দৃষ্টি দুটো তাঁর ফিরছিল। অকস্মাৎ খুশির উচ্ছ্বাসে চপল হয়ে উঠলেন তিনি। কারণটা কি জানবার জন্যে প্রতুল ফিরে তাকাতেই দেখল, বারান্দার এককোণে সেই রূপসী তরুণীটি এসে দাঁড়িয়েছে।

মিঃ কাইসা গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে ফিসফিস করে প্রতুলের কানে কানে বললেন, বেয়ারার কাছ থেকে ওঁর নামটাও জেনে ফেলেছি। মিসেস সিনহা। এখানেই এক দুর্ঘটনায় ওঁর স্বামী মারা যান—তাই প্রতি বছরই একবার করে না এসে পারেন না। বেচারা! আমরা যদি ওঁর মনটাকে একটু প্রফুল্ল করার চেষ্টা না করে····

হাসি গোপন করে প্রতুল বলল, আমি হলে কিন্তু সে চেষ্টা করতুম না!

কিন্তু পরোপকার করার প্রবৃত্তিটা মিঃ কাইসার এমনই প্রবল যে তিনি নিরুৎসাহ হলেন না মোটেই। দ্রুতপায়ে মিসেস সিনহার পাশটিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। কি যে বললেন, প্রতুল সেটা ঠিক শুনতে পেল না। কিন্তু পরমুহূর্তে মিঃ কাইসা আবার ফিরে এলেন। আক্ষেপের সুরে বললেন, চিনতে পারলুম না আপনার দেশের মেয়েদের। মনের চারদিকে এমন একটা পাঁচিল তুলে রেখেছেন যে····ওহো, আপনার নামটাই যে এখনো জানা হয়নি।

প্রবোধ পাকড়াশী। কলকাতায় আমার কাঠের কারবার। সস্মিত মুখে জবাব দিল প্রতুল।

ঘনিষ্ঠতায় উপচে উঠলেন মিঃ কাইসা। একখানা কার্ড প্রতুলের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, যদি কোনদিন জাপানে যান, নিশ্চয়ই আমার বাড়িতে উঠবেন। আদর অভ্যর্থনার কোন ত্রুটী হবে না।

কার্ডখানা পকেটে ভরতে ভরতে অপ্রস্তুতের অভিনয়ে প্রতুল বলল, ‘ভারি লজ্জা দিলেন। আমার কোন কার্ড নেই যে আপনাকে দিই—

রাত্রে শোবার সময় প্রতুল সুচারু সেনের চিঠিখানা আর একবার খুলে পড়ল। আপন মনেই বলে উঠল, যদি কোন রকমে····বিচিত্র নয়····যদি কোন রকমে····

পরদিন সকালে প্রাতরাশ নিয়ে ঘরে ঢুকল গদাধর। হোটেলের বয়, বেয়ারা, পরিচারক—একধারে সে-ই সব। বিনীতের ভঙ্গিতে বলল, ‘চা’টা হয়তো একটু জুড়োনই পাবেন, হুজুর। এত শীত যে কোন জিনিসই গরম রাখা যাচ্ছে না—

প্রতুল সস্মিত হাসি হেসে বলল, প্রকৃতি দেবীর জুলুম। মাথা পেতে নিতেই হবে—

নির্বোধের হাসি হেসে গদাধর দরজার দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু বেরিয়ে না গিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে সে একবার বাইরেটা দেখে নিল। তারপর দোরে খিল দিয়ে প্রতুলের কাছে এসে চাপা গলায় বলল, আপনিই তো প্রতুলবাবু? আমি জন্মেজয়—

প্রতুল মৃদু হেসে জবাব দিল, আমিও তাই সন্দেহ করেছিলুম।

গলায় চাপা উত্তেজনার সুর ফুটে উঠল জন্মেজয়ের। বলল, কাল রাত্রে মস্ত দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে সবিস্ময়ে প্রতুল বলে উঠল, কি ধরণের দুর্ঘটনা?

তুষার ঝড়ে রেল লাইন উপড়ে ফেলেছে। রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য মানুষের কাজও হতে পারে। তবে কাজ যারই হোক, মোট কথা, বাইরের জগতের সঙ্গে দার্জিলিং-এর সব যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। দিন দুই-চারের আগে যে সারানো হবে, তা মনে হয় না—

তত্রাচ প্রতুলের মুখে কোন রেখাপাত হল না। অনুচ্চ কণ্ঠে শুধু বলল, খবরটা বেশ চাঞ্চল্যকর বলেই মনে হচ্ছে—

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জন্মেজয় বলল, শুধু তাই নয়। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে আমাদের বড়কর্তা মানে সুচারুবাবু যে সংবাদটা পেয়েছেন, সেটা পাকা। জরাসন্ধের বৈঠক বসবে এখানে। যাতে কোন বিঘ্ন না ঘটে, সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা।

প্রায় আজগুবি গল্পের মত শোনাচ্ছে না?

জন্মেজয় সায় দিয়ে তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, ঠিক তাই। আমার তো বিশ্বাস, জরাসন্ধ লোকটা শুধু খুনেই নয়, আস্ত পাগল।

প্রতুল একটু চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু এখানেই যখন তার বৈঠক আর পথ-ঘাট যখন বন্ধ করে দিয়েছে, তখন নিশ্চয়ই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে জরাসন্ধ স্বয়ং দার্জিলিং-এ হাজির।

তাতে কোন সন্দেহই নেই।

আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। হঠাৎ এক সময় প্রতুল প্রশ্ন করল, ডাক্তার দেশাইকে আপনার কিরকম মনে হয়? তিনি কি ছদ্মবেশী জরাসন্ধ হতে পারেন?

জন্মেজয় মাথা নেড়ে জবাব দিল, না, ডাক্তার দেশাইয়ের ছবি দু-একবার আমি কাগজে দেখেছি। তার সঙ্গে ওঁর চেহারার যথেষ্ট মিল আছে।

কিন্তু পুলিশের চোখেই যে ধুলো দিতে চায়, সে নিশ্চয়ই ছদ্মবেশের সাহায্য নেবে—

সেটা তো স্বাভাবিক; কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তার চেহারার বিশদ বিবরণ এখনো আমার হাতে এসে পৌঁছয়নি। তবে শুনেছি, লোকটা মাঝারি গোছের, বেশ জোয়ান; আর বয়েস ত্রিশের কাছাকাছি।

বাঁকা ঠোঁটে অবজ্ঞার রেখা ফুটিয়ে তুলে প্রতুল বলল, যে কোন লোকের সঙ্গেই তো এ বর্ণনা মিলে যেতে পারে। আচ্ছা, মিস্টার কাইসা⋯.

বাধা দিয়ে জন্মেজয় বলে উঠল, ওঁর কথা আমিই আপনাকে জিজ্ঞেস করব ভাবছিলুম। বিদেশী হলেও ওঁর ছাড়পত্রে কিন্তু কোন রকম গোলমাল কিছু নেই। তবে আপনিই মিশেছেন, কাজেই আমার চেয়ে ভালই বলতে পারবেন—

ভ্রূ কুঞ্চিত করে প্রতুল জবাব দিল, আপাতদৃষ্টিতে তো সন্দেহজনক কিছু পাইনি, এক পরোপকার করার অতি উৎসাহ ছাড়া। ওঁকে বাদ দিলেও আরো যে তিনজন এসেছে····

জন্মেজয় গভীর উত্তেজনার সঙ্গে বলে উঠল, আমি হলফ করতে বলতে পারি, ওরা জরাসন্ধের দলের লোক। যে কোন একজনের জরাসন্ধ স্বয়ং হওয়াও বিচিত্র নয়।

প্রতুল মনে মনে স্মরণ করবার চেষ্টা করল মুখ তিনখানা। সৌন্দর্যের গর্ব অবশ্য কেউই করতে পারে না। যে কোন একজন জরাসন্ধ স্বয়ং হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই; কিন্তু একসঙ্গে দার্জিলিং আসার পেছনে কোন যুক্তি খাড়া করা যায় না। বৈঠক যেখানে খুশি তারা বসাতে পারত; তার জন্যে তুষারাবৃত এই হিমের দেশে ছুটে আসার কি কারণই বা থাকতে পারে?

সন্তুষ্ট হতে পারল না প্রতুল। সংশয়াচ্ছন্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল, হোটেলের লোকজন সবাইকেই কি আপনি চেনেন?

কৃপার হাসি ফুটে উঠল জন্মেজয়ের ঠোঁটের কোণে: লোকজন বলতে তো এক বুড়ো রাঁধুনি আর তার বুড়ি স্ত্রী—যে ঝি’য়ের কাজও করে। আর একজন বয়—যার বদলে আমি কাজ করছি—

ম্যানেজার সুধাংশুবাবু নিশ্চয় আপনার পরিচয় জানেন?

নিশ্চয়ই। তাঁর সাহায্য তো আমাকে গোড়াতেই নিতে হয়েছে।

আচ্ছা, আপনি লক্ষ্য করেছেন, তাঁকে দেখলে যেন মনে হয় বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত?

প্রশ্নটা যেন নতুন করেই জন্মেজয়কে ভাবিয়ে তুলল। প্রতুল পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, আপনার কি মনে হয় সেটা নিছক পুলিশের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার ভয়েই?

আপনি কি বলতে চান ভদ্রলোক আরো অনেক কিছু জানেন?

আমার তো তাই বিশ্বাস।

হতেও পারে।—মুহূর্তকাল স্তব্ধ থেকে জন্মেজয় বলে উঠল, সুধাংশুবাবুর মনে কি আছে, সেটা জানবার চেষ্টা করলে কেমন হয়?

মাথা নাড়ল প্রতুল। দ্বিধাভরা কণ্ঠে বলল, আমার মনে হয় খোঁচাখুচি না করাই ভাল। আমরা যে কিছু সন্দেহ করেছি, সেটা বুঝতে না দিয়ে শুধু সতর্ক দৃষ্টি মেলে রাখাই আমাদের উচিত।

জন্মেজয় দোরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করল, আপনার বিশেষ কোন নির্দেশ আছে?

বর্তমানে না। আমি এখনো ভেবেই পাচ্ছি না, ওদের এখানে বৈঠক বসাবার উদ্দেশ্যটা কি হতে পারে?

টাকার ভাগ-বাটোয়ারা; কারণ মগনলালের খুনের সঙ্গে বহু লাখ টাকা উধাও হয়—

তবু প্রতুল যেন সন্তুষ্ট হতে পারল না। আপন মনেই বলল, কিন্তু ভাগ-বাটোয়ারার জন্যে দার্জিলিং কি করে প্রশস্ত জায়গা হল? এখানে লোক আসতে পারে এক সুন্দরী নারীর সঙ্গে মিলিত হবার····

কথা তার শেষ হবার আগেই জন্মেজয় চট করে তার কাছে সরে এল। উদগ্র কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন করল, আপনার কি মনে হয় মিসেস সিনহার সঙ্গে জরাসন্ধের কোন সম্বন্ধ আছে? এরকম সম্ভাবনা কিন্তু আমার মনে একবারও····

বাধা দিয়ে প্রতুল বলল, নারী চিরদিনই অঘটন-ঘটন-পটিয়সী। আর এমন পরিবেশ ছাড়া আর কোথাই বা তাদের মিলন ঘটতে পারে?

জন্মেজয় কতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে প্রতুলের মুখের পানে তাকিয়ে রইল। তারপর এক সময় খিল খুলে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সারাটা দিন নিরুপদ্রবেই কেটে গেল।

হোটেলে প্রচুর পরিমাণে রসদ মজুত ছিল, তাই ম্যানেজার সুধাংশু মিত্র সকলকে অভয় বাণী শোনাল, উপবাসে মরতে হবে না।

মাঝখানে একবার প্রতুল ডাঃ দেশাইয়ের সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দুর্ভেদ্য বর্মের আড়ালে থেকে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ডাক্তারী শাস্ত্রের চর্চাই তাঁর জীবনের একমাত্র বিলাস এবং সে সম্বন্ধে আনাড়ীর সঙ্গে কোন আলোচনা করতে তিনি প্রস্তুত নন।

অতঃপর প্রতুল গিয়েছিল রান্না-বাড়িতে। বুড়ো রাঁধুনি হরিধন তখন স্ত্রী করালীর সঙ্গে তরকারিতে মশলা দেওয়া নিয়ে বচসা শুরু করেছিল। সুযোগ বুঝে প্রতুল মিশে গিয়েছিল তাদের সঙ্গে। তারপর এক সময় সহজ সুরেই প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা, গদাধর কাজে ভর্তি হওয়ার আগে তো চাকর একজন ছিলই, না?

মুখভঙ্গি করে অনুকম্পার সুরে হরিধন জবাব দিয়েছিল, হ্যাঁ, অর্জুন। ওই নামটাই সর্বস্ব। যেমন কুঁড়ে, তেমনি আনাড়ী।

কতদিন ছিল?

বড়জোর হপ্তাখানেক। তারপরই জবাব হয়ে গেল। তার জন্যে হোটেলের দুর্নাম তো আর হতে পারে না।

প্রতুল সায় দিয়ে বলেছিল, বটেই তো। লোকটা গেল কোথায়?

ঝাঁঝালো গলায় করালী ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছিল এবার, যে চুলো থেকে এসেছিল—

কেউ তাকে যেতে দেখেছে?

অভিনব প্রশ্ন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে ছিল তার মুখের পানে।

প্রতুল আর কিছু না বলে বেরিয়ে এসেছিল সেখান থেকে। চলতে চলতে নজর পড়েছিল ওপরের দিকে। হোটেলের বাড়িটা বেশ বড়ই বলতে হবে। ক’জনই বা অতিথি? তাই পেছন দিকের প্রায় সবটাই তালাচাবি দেওয়া।

মোড় ঘুরতে গিয়ে তার সঙ্গে প্রায় মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল ত্রয়ীর একজনের সঙ্গে। মুহূর্তের জন্য লোকটার সামনের কয়েকটা দাঁত বিকশিত হয়ে উঠেছিল—যেমন শিকার দেখলে হিংস্র প্রাণীদের হয়।

কোন কথা না বলে প্রতুল পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসেছিল।

রাত্রে সকাল সকালই শুয়ে পড়ল প্রতুল। লেপের তলায় ঘুম আসতেও দেরি হল না। অকস্মাৎ এক সময় ধড়মড় করে উঠে বসল সে। মনে হল, কে যেন দরজা খোলবার চেষ্টা করছে। বেডসুইচটা টিপে সে আলো জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল ত্রয়ীর দলটি। মনে হল, ঈষৎ মত্ত তারা। হাতে শাণিত ছোরা।

সবচেয়ে জোয়ান লোকটি বীভৎস হাসি হেসে বলল, ব্যাটা টিকটিকি, এখানেও এসেছ আমাদের জ্বালাতে!

প্রতুল তখনও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি। বিকট উল্লাসে তিনজন এগিয়ে গেল তার দিকে: আজ হোরি হায়! আর একজনের মতন এর মুখ থেকেও আগে মাংসটা কেটে নিই আয়—

বিজলী বাতিতে চকচক করে উঠল তাদের শোণিতলিপ্সু ছোরাগুলো। আর একমুহুর্ত! ঠিক সেই সময় দরজা গোড়া থেকে জলদগম্ভীর স্বর শোনা গেল, হাত তোল মাথার ওপর!

চকিতে ঘুরে দাঁড়াল দলটি। দেখল, উদ্যত পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে মিঃ কাইসা। পুনরায় তিনি হুঙ্কার দিলেন, হাত তোল বলছি! শিকার আমার ফসকায় না…., কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া টিপলেন তিনি। চকিতে একটা বুলেট জোয়ান লোকটির পাশে কাঠের দেওয়াল ভেদ করে গেল।

তৃতীয়বার আর বলবার প্রয়োজন হল না। তিনজোড়া হাত নিঃশব্দে উঠে গেল মাথার ওপর।

এক লাফে প্রতুল তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হাত থেকে কেড়ে নিল অস্ত্রগুলো। তার পর দেহগুলো পরীক্ষা করে দেখল, গোপন কোন অস্ত্র আছে কিনা।

মিঃ কাইসা এবার হুকুম করলেন, ওই আলমারিটার ভেতরে গিয়ে ঢোক সব। জানলা নেই বলে অসুবিধে হবে না।

বিনা প্রতিবাদে তিনজনে আলমারির ভেতর অদৃশ্য হল। প্রতুল দরজা বন্ধ করে চাবি দিয়ে দিল।

ততক্ষণে হাতের পিস্তল নামিয়ে মিঃ কাইসা বসে পড়েছেন সামনের চেয়ারখানায়। খুশির উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়ে বললেন, দেশ থেকে বেরোবার সময় আমায় সবাই ঠাট্টা করেছিল, সুন্দরবনে শিকার করতে যাচ্ছ নাকি? তবে এমন ভাবে যে কাজে লাগবে, ভাবতেও পারিনি।

প্রতুল তাঁর করমর্দন করে কৃতজ্ঞতা ভরে বলে উঠল, আপনি ঠিক সময়ে না এসে পড়লে, এতক্ষণ হয়তো বিয়োগান্ত নাটক ঘটে যেত। আপনার ঋণ····

বাধা দিয়ে মিঃ কাইসা সলজ্জ কণ্ঠে বললেন, ওটার উল্লেখ না করলেও চলবে। এখন বন্দী তিনজনকে নিয়ে কি করা যায় বলুন। উচিত পুলিশের হাতে দিয়ে দেওয়া; কিন্তু পুলিশ পাচ্ছি কোথায়? চলুন, তার চেয়ে বরং ম্যানেজারের সঙ্গে একটা পরামর্শ····

এবার বাধা দিল প্রতুল, না, না। পরামর্শ যদি করতেই হয় তো চাকর গদাধরের সঙ্গেই করা উচিত। কারণ, আসলে সে পুলিশের কর্মচারী—গোয়েন্দা····

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফারিত চোখে মিঃ কাইসা আর্তনাদ করে উঠলেন, ওঃ! সেই জন্যেই তাঁর এ অবস্থা করেছে⋯.

কার? কি অবস্থা?

আপনি তো এদের দ্বিতীয় শিকার। আগে তারা গদাধরকে জখম করেছে····

গদাধরকে!

আসুন আমার সঙ্গে। ডাক্তার দেশাই তাঁকে দেখতে গেছেন, আমি জানি।

জন্মেজয়ের ছোট ঘরখানা ওপরে ছাদের এক কোণে। ডাঃ দেশাই আহত লোকটির মুখে নিপুণ হাতেই ব্যান্ডেজ করছিলেন। তারা ঢুকতেই ডাঃ দেশাই ফিরে তাকালেন। স্বস্তির সুরে বললেন, ওঃ! আপনারা! মানুষ যে এমন নৃশংস হতে পারে, না দেখলে ভাবাও যায় না।

মিঃ কাইসা ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, প্রাণের কোন ভয় নেই তো?

না, তা নেই। তবে চুপচাপ পড়ে থাকতে হবে এখন কিছুদিন। ঘা বিষাক্ত হবার অবশ্য কোন ভয় নেই।

তিনজনে একসঙ্গেই বেরিয়ে এলেন। মিঃ কাইসা প্রতুলকে জিজ্ঞাসা করলেন, গদাধর কি সত্যিই পুলিশের গোয়েন্দা?

প্রতুল নীরবে শুধু মাথা নাড়ল।

কিন্তু এখানে কি করতে এসেছেন উনি?

খুনী আসামী একজনের সন্ধান পেয়ে।—সংক্ষেপেই প্রতুল তাঁদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল।

ডাঃ দেশাই উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, জরাসন্ধের নাম আমি কাগজে দেখেছি। লোকটার সঙ্গে যদি একবার দেখা হত! আমাদের শাস্ত্রের চমৎকার ‘কেস’। তার শৈশব কালটা কিভাবে কেটেছে, জানতে ভারি আগ্রহ হচ্ছে আমার।

প্রতুল বলল, আমার কিন্তু আগ্রহ হচ্ছে—এই মুহূর্তে লোকটা কোথায় আছে, সেটাই সঠিক জানতে····

মিঃ কাইসা বলে উঠলেন, আমাদের বন্দী তিনজনের ভেতর নেই তো?

আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না। অসন্তোষের সঙ্গে জবাব দিয়ে প্রতুল ফিরতে গেল; কিন্তু অকস্মাৎ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল মেঝের কার্পেটের ওপর। হালকা গোলাপী রঙের কার্পেটের খানিকটা অংশ গাঢ় বাদামি রং ধারণ করেছে।

গভীর উত্তেজনার সঙ্গেই সে বলে উঠল, পায়ের ছাপ—পায়ের ছাপ রক্তে ভেজা। হোটেলের অব্যবহার্য অংশের দিক থেকে আসছে। ছুটে আসুন—আর দেরি নয়—ছুটে আসুন—

তাঁরা বন্ধ দরজা ঠেলে ধুলো ভরা বারান্দা পার হয়ে ছুটলেন। সেই রক্তে ভেজা পায়ের ছাপ। সকলে এসে দাঁড়ালেন একখানা ঘরের সামনে। প্রতুল ভেজানো দরজাটা এক ঠেলায় খুলে ফেলল। এবং সঙ্গে সঙ্গে আর্তধ্বনি বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে। পিছনে আর দুটি প্রাণী স্তম্ভিতের মত দাঁড়িয়ে রইলেন।

ঘরের মেঝেয় একটি মৃতদেহ পড়ে। কঠিন আঘাতে তার মাথা মুখ থেঁতলে বীভৎস আকার ধারণ করেছে। সর্বাঙ্গে অসংখ্য ছোরার আঘাতের চিহ্ন। এ ঘরেই যে লোকটি বাস করত, সেটা বোঝা যায় বিছানার দিকে তাকালে। টেবিলের ওপর একজনের মত খাবার অস্পৃষ্টই পড়ে আছে।

মিঃ কাইসা অব্যক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, কে? কে উনি?

আমার মনে হয়—, জবাব দিল প্রতুল, এই হতভাগ্যই হচ্ছে অর্জুন—হোটেলের চাকর। আনাড়ী বলে যার জবাব হয়েছিল····

ডাঃ দেশাই ততক্ষণে মৃতদেহের পাশে বসে পড়েছিলেন পরীক্ষা করবার জন্যে। কিন্তু তার আগেই মৃতদেহের বুকে পিন দিয়ে আঁটা একটুকরো কাগজ তাঁর নজরে পড়েছিল।

কালি দিয়ে লেখা দুটি ছত্র।

কাগজখানা খুলে নিয়ে ডাঃ দেশাই প্রতুলের হাতে দিলেন। প্রতুল পড়ল:

‘জরাসন্ধ ইহজীবনে আর কাউকে হত্যা করবে না। ঠকাবে না তার বন্ধুদের।’

মিঃ কাইসা সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এই তাহলে জরাসন্ধ! কিন্তু এখানে কি করে এল? আর আপনিই বা অৰ্জুন বললেন কেন, প্রবোধবাবু?

প্রতুল জবাব দিল, ওই নামেই পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। চাকরিতে জবাব হবার পর সকলেই ভেবেছিল তিনি ফিরে গেছেন; কিন্তু কেউই তাঁকে যেতে দেখেনি।

ডাঃ দেশাই ধীর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কারণটা কি বলে আপনার মনে হয়?

প্রতুল বলল, হোটেলের ম্যানেজারের মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া কেন—এর থেকে তার জবাবটা পাব, আশা করি। জরাসন্ধ নিশ্চয়ই হোটেলের এই গোপন জায়গায় লুকিয়ে থাকবার জন্যে মোটা ঘুষ দিয়েছিল তাকে।

অর্থাৎ জরাসন্ধ তারপর থেকে লুকিয়ে ছিল এখানে?

অসম্ভব নয়····বুঝতেই তো পারছেন····

ডাঃ দেশাই অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলেন, কিন্তু কে জরাসন্ধকে খুন করল? কেনই বা করল?

মিঃ কাইসা ফিরে তাকিয়ে জবাব দিলেন, উত্তরটা তো খুবই সোজা। দলের লোকজনকে বখরা দেবার কথা ছিল এখানে! কিন্তু জরাসন্ধ নিশ্চয়ই দিতে চায়নি। ভেবেছিল, এখানে লুকিয়ে তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে। কিন্তু ভুল হয়েছিল তার। যে করেই হোক, খবর পেয়ে দলের লোকজন শিকারী কুকুরের মতই তাকে ধাওয়া করে এখানে; তারপর····, জুতোর ডগা দিয়ে মৃতদেহটা স্পর্শ করে তিনি আবার বললেন, এই ভাবেই হিসেব নিকেশ শেষ হয়েছে।

প্রতুল অস্ফুট কণ্ঠে বলল, অবশ্য এ ধরণের বৈঠক আমরা ঠিক কল্পনা করতে পারিনি।

ধৈর্য হারিয়ে ডাঃ দেশাই বললেন, কল্পনা কি করতে পেরেছেন না পেরেছেন, তার চেয়ে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বাস্তবটা নিয়ে মাথা ঘামাবার। এখানে একটা লাশ। আমার হাতে একজন মরণাপন্ন রুগী; অথচ ওষুধপত্র বিশেষ কিছুই নেই। কবে যে আবার রাস্তাঘাট আর রেললাইন মেরামত হবে····

সঙ্গে সঙ্গে মিঃ কাইসা বললেন, আর আলমারির ভেতর চাবি দেওয়া তিনজন খুনে····

ডাঃ দেশাই ক্ষিপ্তের মত চিৎকার করে উঠলেন, কি করা যায় এখন?

জবাব দিল প্রতুল, আগে ম্যানেজার সুধাংশু মিত্রকে ধরতে হবে। টাকার লোভ ছাড়া লোকটা আর কোন পাপে পাপী নয় বলেই মনে হয়। এ ধরণের লোক স্বভাবতই ভীতু হয়। আমরা যা বলব, ঠেলতে সাহস করবে না। হরিধনের কাছ থেকে কিছু দড়িদাড়া যোগাড় করে বন্দী লোক তিনজনকে বেঁধে ফেলে এমন জায়গায় রাখা উচিত, যেখান থেকে আমরা সর্বদা চোখ রাখতে পারব। মিস্টার কাইসা, পুলিশ না আসা পর্যন্ত, পিস্তল হাতে স্বচ্ছন্দে পাহারাদারের কাজটা করতে পারবেন····

আর আমি? অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলেন ডাঃ দেশাই, আমি কি করব?

প্রতুল ভারী গলায় উত্তর দিল, রুণীর জন্যে ডাক্তারের যা করা উচিত, আপনি তাই করবেন। আর আমরা করব অপেক্ষা—যতক্ষণ না বাইরে থেকে সাহায্য আসে।

তৃতীয় দিন ভোরের দিকে একটি বিরাট দল এসে হানা দিল হোটেলের সামনে।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল প্রতুলই প্রথম। হাসি মুখে অভ্যর্থনা করল, আসুন, মিস্টার সেন।

সুচারু সেন এগিয়ে এলেন। সাগ্রহে প্রতুলের হাত দুটো চেপে ধরে বললেন, কিভাবে যে ক’টা দিন কেটেছে! নিচে বসে আমরা তাকিয়ে আছি ওপরের দিকে। অথচ করবার কিছুই নেই। সত্যিই কি জরাসন্ধ এবার বন্ধ হয়েছে?

প্রতুল মৃদু হেসে জবাব দিল, জরাসন্ধ সত্যিই।

সকলে হোটেলের ভেতরে এসে দাঁড়ালেন। লোকজনের সাড়া পেয়ে ড্রেসিং গাউনের কোমর বন্ধটা বাঁধতে বাঁধতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মিঃ কাইসা। মুখে অব্যক্ত ধ্বনি, কি হল? কি হল আবার?

প্রতুল তখন মিঃ সেনের সঙ্গে ওপরে উঠছে। হেসে বলল, সাহায্য এসে গেছে। ওপরে আসুন আমাদের সঙ্গে। এত বড় সুযোগ হারাবেন না—

অনুসরণ করতে করতে মিঃ কাইসা বললেন, জন্মেজয়ের কাছে যাচ্ছেন নাকি? কেমন আছে ভদ্রলোক?

ডাঃ দেশাইয়ের মতে ভালই—

সকলে জন্মেজয়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভেজানো দরজাটা সশব্দে খুলে দিয়ে, প্রতুল বলল, এই ঘরে রয়েছে আপনাদের জরাসন্ধ। জীবন্ত গ্রেপ্তার করতে চেয়েছিলেন, করুন। আশা করি, ফাঁসির মঞ্চকে ফাঁকি দিতে পারবে না।

বিছানার ওপর ব্যান্ডেজ বাঁধা মুখ নিয়ে যে লোকটি পড়েছিল, চকিতে সে উঠে বসল। কিন্তু নড়বার আগেই সদলে সুচারু সেন তাকে ঘিরে ফেললেন।

মিঃ কাইসা বিস্ময় রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, কিন্তু উনি তো গোয়েন্দা জন্মেজয়—গদাধর সেজে যিনি হোটেলে চাকরি নিয়েছিলেন····

প্রতুল জবাব দিল, গদাধর ঠিকই, তবে জন্মেজয় নন। জন্মেজয় হচ্ছেন অর্জুন—হোটেলের সেই আনাড়ী চাকরটি যাঁকে খুন করা হয়েছে। যে রাত্রে আমার ওপর খুনের চেষ্টা হয়, সেই রাত্রেই জরাসন্ধ তাঁকে খুন করেছে।

চায়ের টেবিলে বসে মিঃ কাইসা হাঁ করে প্রতুলের বিবৃতিটুকু গিলতে লাগলেন।

কতগুলো জিনিস আমাদের জানতেই হয়—জানতে হয় ‘পেশা’ বলে। পুলিশের গোয়েন্দা আর খুনী আসামীর ভেতর যে পার্থক্য, সেটা আমাদের চোখে গোপন থাকে না।

গদাধর যে হোটেলের চাকর নয়, সেটা যেমন আমি প্রথম দর্শনেই বুঝেছিলুম, তেমনই বুঝেছিলুম যে সে পুলিশের গোয়েন্দাও নয়। বাইরের লোকের চোখে সে গোয়েন্দা সাজতে পারে, কিন্তু যে নিজে গোয়েন্দা, তার চোখে ফাঁকিটুকু ধরা পড়বেই।

কাজেই আমায় সতর্ক হতে হল। সন্ধ্যার সময় কফিটুকু খেতেও আমার ভরসা হল না। ভুল যে আমি করিনি, তার প্রমাণ পেলুম খানিকটা পরেই। ওই তিনটি লোকের একজন আমার ঘরে এসে ঢুকল। আশা করেছিল, কফিতে মেশানো ওষুধ খেয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। খোঁজ করতে করতে সে আমার জামার পকেট থেকে মিস্টার সেনের চিঠিখানাও বার করে নিল। পরদিন সকালেই গদাধর চা নিয়ে এল আমার ঘরে। নিজের অংশটুকু সে ভালই অভিনয় করে গেল। কিছু সে যে বিষম ভয় পেয়েছে, সেটা বুঝতে আমার বাকি ছিল না। ফাঁদে পড়েছে ভেবে যেমন তর উৎকণ্ঠা····

মিঃ কাইসা আর থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেন, কিন্তু ছুঁচোটা গর্তে মাথা গলিয়েছিলই বা কেন?

না গলিয়ে তার উপায় ছিল না; কারণ এমন একটা গোপন জায়গা দরকার, যেখানে বিশেষ দরকারে লোক বিশেষের সঙ্গে দেখা করা চলে····

সে লোক বিশেষটি কে?

ডাক্তার দেশাই।

ডাক্তার দেশাই? মিঃ কাইসা চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন।—তিনিও কি ওদের দলের একজন?

না। বিখ্যাত সার্জন তিনি। বিশেষত অস্ত্রোপচার করে মুখের চেহারা বদলে দিতে অদ্বিতীয়। সেই জন্যেই জরাসন্ধ ডেকে পাঠায় তাঁকে এখানে। মুখের চেহারা বদলাতে না পারলে আত্মরক্ষার আর কোন পথ ছিল না তার। ডাক্তার দেশাই-রাজী হলেন টাকার লোভে; কারণ বম্বে থেকে বিদায় নিয়ে অত্যন্ত অভাবে পড়েছিলেন তিনি। ঠিক হল অস্ত্রোপচার হবে এই হোটেলে। এই সময় লোকজনের ভিড় কম। টাকা খেয়ে ম্যানেজার সাহেবও রাজী হলেন। কিন্তু প্ল্যানটার একটু গোলমাল হয়ে গেল যখন দলের তিনজন, যাদের পাহারা দেবার কথা ছিল, ঠিক সময়ে এসে পৌছতে পারল না। জরাসন্ধকে অবশেষে যুদ্ধে নামতে হল একলাই। গোয়েন্দা জন্মেজয় খবর পেয়ে আগেই এসে হোটেলের চাকর সেজে ছিলেন। জরাসন্ধ তাঁকে গুম করে নিজেই চাকর সেজে রইল। চাই কিছু সময়, তাই তার দলবল রেললাইন ওপড়াল; রাস্তা কেটে দিল। এদিকে জরাসন্ধ জন্মেজয়কে খুন করে তার বুকে কাগজ এঁটে দিল সকলের চোখে ধুলো দেবার জন্যে। জরাসন্ধই বধ হয়েছে ভেবে পুলিশ নিশ্চিন্ত হত। ডাক্তার দেশাইও আর দেরি না করে তার মুখে অস্ত্রোপচার করলেন। কোন দিকে আর চিন্তা করবার কিছু রইল না, এক প্রতুল লাহিড়ীকে পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া। সেই জন্যেই আমার ঘরে অভিযান। সে রাত্রে আপনি যদি ঠিক সময়ে হাজির না হতেন মিস্টার কাইসা····

বিস্ময়ে মুখব্যাদান করে মিঃ কাইসা বলে উঠলেন, আপনিই তা হলে প্রতুল লাহিড়ী? প্রবোধ পাকড়াশী নন?

মিথ্যে বলার জন্যে মার্জনা করবেন, বিদেশী বন্ধু।

আপনি তাহলে গোড়া থেকেই সব জানতেন? জরাসন্ধ যে মারা যায়নি, সেটা বুঝেছিলেন?

নিশ্চয়ই।

কিন্তু বলেননি কেন?

প্রতুল ভারী গলায় জবাব দিল, কারণ আমি চেয়েছিলুম জীবন্ত জরাসন্ধকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। নতুন করেই মহাভারত লেখা হোক—এই ছিল আমার একমাত্র বাসনা। ‘জরাসন্ধ-বধ’ তার আদি পর্ব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *