1 of 2

কল্কেকাশির কাণ্ড – শিবরাম চক্রবর্তী

কল্কেকাশির কাণ্ড – শিবরাম চক্রবর্তী

প্রফুল্ল গোড়া থেকেই বিষন্ন মেরে আছে। হ্যাঁ, ভারি তো কাজ ! তার জন্যে আবার কল্কে-কাশিকে তার ল্যাজে বেঁধে দেওয়া। হোন না গে তিনি একজন নামজাদা ডিটেকটিভ (প্রফুল্ল শুনেছিল কোরিয়া অঞ্চলে কল্কে-কাশির মত অত বড় গোয়েন্দা আর নেই !) তবু এই সামান্য একটা মশা-মারবার ব্যাপারে অত ভারী কামান কাঁধে বয়ে আনতে প্রফুল্লর আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। সত্যি, কামাস্কাটকা থেকে উনি না এলেও কিছু কাজ আটকাত না।

বোম্বের একটা বিখ্যাত রেস্তোরাঁর এক কোণের টেবিলে কল্কে-কাশির মুখোমুখি বসে গুম হয়ে এই সব কথাই প্রফুল্ল ভাবছিল। সামনে চপ-কাটলেট-ডেভিল-ডিম-কেক-পুডিং-এর সমারোহ সত্ত্বেও তার জিভ সরছিল না। বাস্তবিক, এত বড় অপমান হজম করবার পর খেতে কারু রুচি থাকে ?

কিন্তু মিঃ কল্কে-কাশি বেপরোয়া । ডিশের পর ডিশ তিনি সাবড়ে চলেছেন—কাঁটা-চামচের তাঁর কামাই নেই। এক ফাঁকে সামনের ভদ্রলোকের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ে। এ কী ! কল্কে-কাশি একটু অবাকই হন। একজন খুনে একটার পর একটা দশটা খুন করেছে, নিজের চোখেই এরকম দৃশ্য তাঁর জীবনে একাধিকবার তিনি দেখেছেন কিন্তু বিস্মিত হতে পারেননি। কিন্তু এক ভদ্রলোক দশ-দশটা প্লেটের সামনে একেবারে নির্বিকার ! একদম জগন্নাথ হয়ে বসে আছেন, একটাকেও কাবু করতে পারছেন না! তাঁর সুদীর্ঘ জীবনস্মৃতির মধ্যে এবম্বিধ কাণ্ড তাঁর স্মরণে পড়ে না।

বিস্ময়ের ব্যাপারই বটে । কল্কে-কাশির বিরাট বপু-পরিধির তুমুল আন্দোলন (অবশ্য খাবার সময়েই সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ হয়) অকস্মাৎ থেমে যায় ; মাছের চোখের মত ড্যাবডেবে চোখ ঈষৎ প্রসারিত হয়। ‘প্রফুল্লবাবুর প্রফুল্লতর হবার পক্ষে কী বাধা হচ্ছে, জানতে পারি কি ?’ তিনি প্রশ্ন করেন।

বাংলাতেই প্রশ্ন করেন। সোজা পরিষ্কার বাংলাতেই। কামাস্কাটকার লোক হলে কী হবে, বাংলা, হিন্দী, (এবং কোন কোন জানোয়ারের ভাষাও) কল্কে-কাশির ভালভাবেই আয়ত্ত। তবে কামাস্কাটকার ভাষায় তাঁর দখল আছে কি না বলা যায় না। এ বিষয়ে প্রফুল্লর সন্দেহ থাকলেও পরীক্ষক হবার সাহস তার নেই। কেন না সে নিজেও কামাস্কাশিয়ানে অজ্ঞ, দারুণ অজ্ঞ।

প্রফুল্ল আরো বেশি গম্ভীর হয়ে যায় ; মাথা চুলকোতে চুলকোতে উত্তর দেয়, ‘ভাবনায় মশাই, ভাবনায়। কী রকম গুরু দায়িত্ব মাথার ওপরে, বুঝতেই তো পারছেন।’

‘বুঝতে পারছি বৈকি,’ কল্কে-কাশি ঘাড় নাড়েন, ‘মিস্টার ব্যানার্জির কবে এসে ভারতবর্ষে পৌঁছবার কথা, অথচ তিনি কি এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় বিলেতে আটকে আছেন। তিনি আসতে পারলেন না। তাঁর সই-করা নমিনেশন পেপার এয়ার মেলে কাল বিকেলে বোম্বে পৌঁছেছে ; তাঁর অ্যাটর্নি গলস্টোন কোম্পানির আপিসের জিম্মায় আছে। সেই নমিনেশন পেপার আজই সঙ্গে নিয়ে আমাদের কলকাতা ছুটতে হবে। তবেই আঠারো তারিখের আগে সেই নমিনেশন পেপার ফাইল হতে পারবে। আঠারোই হচ্ছে ফাইলিং-এর শেষ দিন। তা নাহলে মিস্টার ব্যানার্জির আর কাউন্সিলে যাওয়া হবে না।’

‘বিলেতে মিস্টার ব্যানার্জির আকস্মিক দুর্ঘটনার মূলে কি কোন রহস্যজনক কারণ আছে আপনি আশঙ্কা করেন ?’ প্রফুল্ল জিজ্ঞাসা করে।

কল্কে-কাশির এর জবাব দেন না। ‘এই নমিনেশন পেপার ডাকে পাঠানো নিরাপদ নয়। কোন কারণে একদিন কিম্বা কয়েক ঘণ্টা লেট হলেই সমস্ত পণ্ড—তার চেয়েও বড় আশঙ্কা হচ্ছে নমিনেশন পেপার মারা যাবার।’

‘মারা যাবার !’ প্রফুল্লর চোখ প্রকাণ্ড হয়, ‘কেন, নমিনেশন পেপার মেরে কার কী লাভ ? ও কি মার্তব্য জিনিস ?’

‘হ্যাঁ, ডাকে পাঠালে, এমন কি রেজিষ্ট্রি করে ইনসিওর করে পাঠালেও যথাস্থানে যথাসময়ে যথাযথ জিনিসটা পৌঁছবে কি না সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কার কী লাভ আপনি জানেন ?’

‘উঁহু,’ প্রফুল্ল বলে, ‘জানি না তো!’

‘এই দুটি দলই কাউন্সিলে ঢুকতে চায়। দু-দলে ভয়ানক রেষারেষি । কাউন্সিলে যে-দল ভারী হতে পারবে তাদেরই সারা বাংলায় আধিপত্য হবে কিনা ! একটি দলের নাম হচ্ছে ফ্লু-ফ্লুকস-ফ্যান, যারা ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভোগে, রেস খেলে আর ফ্যানের তলায় হাওয়া খায়, তারা মিলেই এই দল গড়েছে ; আমেরিকার বিখ্যাত ক্লু-ক্লুকস-ক্ল্যানের সঙ্গে এদের কোন সম্বন্ধ নেই, একমাত্র নামের কতকটা সমিল ছাড়া।’

‘বটে!’ প্রফুল্লর নিশ্বাস পড়ে কি পড়ে না ! ‘আরেকটা দল কারা ?’

‘মিস্টার ব্যানার্জি হচ্ছেন এই ফ্লু-ফ্লুকস-ফ্যান-এর পাণ্ডা। অন্য দলের নাম হচ্ছে বাই হুক অর ক্রুক। এই বাই হুক আর ক্রুক পার্টির নেতা হচ্ছেন মিস্টার সরকার। যেমন করেই হোক নিজের মতলব সিদ্ধ করতে এঁরা সিদ্ধহস্ত।’

‘আপনি কি তাহলে বলতে চান যে সরকারি চালে মিস্টার ব্যানার্জি বিলেতে আটকে পড়েছেন ?’

‘আপাতত আমি ওই কোণের লোকটার দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি।’ কল্কে-কাশি চোখ টিপে ইশারা করেন।

এতক্ষণে কল্কে-কাশির ওপরে প্রফুল্লর কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধার সঞ্চার হয়েছিল। সত্যি, অনেক খবর রাখেন ভদ্রলোক। এইজন্যে অপর দিক থেকে সহসা ‘তুমি’ সম্বোধনেও সে অপ্রসন্ন হতে পারে না, কল্কে-কাশির ইঙ্গিতের অনুসরণ করে সে।

‘ওই যে কাটখোট্টা-গোছের চেহারা, মাথার চুল ক্রপ করা, চোখে কুটিল ভঙ্গি, ওই কোণের ছোট্ট টেবিলে বসে অমলেটের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে—ওকে লক্ষ্য কর, সহজেই বুঝতে পারবে। এ-রকম ফ্যাশনেবল রেস্তোরাঁয় গতিবিধি ওর স্বভাবসিদ্ধ নয়, কাঁটা-চামচের কসরতে এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। খাদ্যের সঙ্গে কাটাকাটি নয় হাতাহাতিতেই ও পরিপক্ক । উনি এখানে এসেছেন তোমার অনুসরণ করে।’

‘আমার।’ প্রফুল্লর বিশ্বাস হয় না, ‘তার মানে ?’

‘একটু কায়দা করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে, চোখ অমলেটের দিকে থাকলেও মনোযোগ ওর আমাদের দিকেই। কলকাতার একটি বিখ্যাত চীজ—ওর মতো কৌশলী এবং ভয়লেশহীন ভদ্র-গুণ্ডা আর দুটি আছে কিনা সন্দেহ। ওই শ্রেণীর ক্রিমিন্যাল ব্রেনের আমেরিকায় জোড়া মিলতে পারে, কিন্তু এদেশে দুর্লভ। মিস্টার ব্যানার্জির পার্টি আমাকে যে তোমার সঙ্গে দিয়েছেন, উনিই হচ্ছেন তার একমাত্র কারণ।’

প্রফুল্লর সহজে বাক্যস্ফূর্তি হয় না, সমস্ত ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করবার চেষ্টা করে বলে, ‘ওর নাম?’

‘ওর নাম হচ্ছে সমাদ্দার ওরফে সমরেশ ঠাকুর, ওরফে গোপাল হাজরা, ওরফে নটেশ্বর রায়, ওরফে পোড়া গণেশ, ওরফে আরো এক ডজন। প্রেসিডেন্সি জেল আর হরিণবাড়ির ফেরতা । আমার সঙ্গে ওর অনেক দিনের পরিচয়,—অনেকটা হৃদ্যতার সম্বন্ধই বলতে পারো। এই কারণে আমাকে তোমার সঙ্গে দেখে ও একটু সঙ্কোচ বোধ করছে, নইলে ও এতক্ষণে তোমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে দ্বিধা করত না।’

প্রফুল্ল চমকে ওঠে, ‘বলেন কী মশাই !’

‘ওই রকমই।’ কল্কে-কাশি যৎসামান্যই হাসেন। ‘সরকারের দল ওকে লাগিয়েছে তোমার পেছনে, ব্যানা‌র্জির নমিনেশন পেপার নিয়ে তুমি যথাসময়ে আগে যথাস্থানে যাতে না পৌঁছতে পারো সেইজন্যই। এজন্যে তোমাকে খুন করতেও ও পেছপা হবে না ; তবে, কৌশলে কাজ উদ্ধার করতেই ও ভালবাসে—খুনোখুনি করার তেমন পক্ষপাতী নয়। এ-বিষয়ে একটু সুরুচিই আছে লোকটার।’

প্রফুল্ল আশ্বস্ত হতে পারে না, ‘আপনি কেন ওকে অ্যারেস্ট করছেন না তাহলে ? গ্রেপ্তার করে ফেলুন ! এক্ষুণি।’

‘এখন পর্যন্ত ও কোন অপরাধ করেনি, কেবল মনের মধ্যে এঁচেছে মাত্র এবং মনে আঁচার জন্যেই যদি গ্রেপ্তার করা শুরু করতে হয় তাহলে এত লোককে ধরতে হয় যে জেলে তার জায়গা কুলোবে কি না সন্দেহ। কেবল মনের মধ্যেকার প্ল্যানের জন্যে কাউকে তো জেলে পোড়া যায় না।’

‘তাহলে—তাহলে তো ভারি মুস্কিল!’ প্রফুল্ল ভীতই হয়, বলে, ‘আমাকে খুন করে ফেলবে তবে?’

‘যদি করেই ফেলে, তখন—হ্যাঁ, তখন ওকে ধরে ফেলতে আমার বিলম্ব হবে না, যদি নিতান্তই পালিয়ে না যায়। তবে, সমাদ্দারের সঙ্গে আমার হৃদ্যতারই সম্বন্ধ; আমাকে দেখে অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরেও তোমাকে একেবারে খতম করবে না। ভয় কী তোমার ?’

বিশেষ ভরসাও পায় না প্রফুল্ল।

‘এজন্যেই বলছিলাম, ভয়ানক গুরু দায়িত্ব তোমার মাথায়। যদি নমিনেশন পেপার নিয়ে আঠারোই এগারোটার মধ্যে কলকাতায় না পৌঁছতে পারো, তাহলে ব্যানার্জির আর কাউন্সিলে যাওয়া হল না—সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দলের দফাও রফা। মিস্টার সরকারের দলেরই একছত্র আধিপত্য হবে কাউন্সিলে, মন্ত্রিসভা ইত্যাদিও দখল করে বসবেন তাঁরাই। সামান্য একটা সই-করা কাগজের ওপরে একটা পার্টির কতখানি নির্ভর করছে ভেবে দেখ। সে যে-সে পার্টি নয়, ফ্লু-ফ্লুকস ফ্যান!’

‘অর্থাৎ আপনার ভাষায়, যারা ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভোগে, রেস খেলে—ইত্যাদি। কিন্তু আমি তো এদের দলের কেউ নই। বিন্দুবিসর্গও জানি না। আমাকে এই মারাত্মক কাজে পাঠাবার মানে ?’ প্রফুল্ল বিরক্তিই প্রকাশ করে।

‘তার মানে, তুমি যে-আপিসের কেরানী, তার বড়কর্তা ওই দলের একজন হোমরা-চোমরা ! তিনি তো ফ্যানের হাওয়া খান, তাহলেই হল। এসব কাজে অজ্ঞ এবং আনাড়িকে পাঠানোই হচ্ছে যুক্তিযুক্ত, নাড়িজ্ঞান-ওয়ালা লোক অনায়াসেই অন্য দলের ঘুষ খেয়ে—বুঝতেই পারছ! তাছাড়া, তোমার ওপর ওদের বিশ্বাস আছে। এত বড় দায়িত্বপূর্ণ কাজ তোমার ওপর দেওয়ায় সেটা প্রমাণ হয় না কি ?’

‘আমার গায়ে জোর যথেষ্ট !’ প্রফুল্ল কোটের হাতা তুলে মাসল কন্ট্রোল করে কল্কে-কাশিকে দেখায়—‘সহজে যে কেউ আমার কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নিতে পারবে তা প্রাণ থাকতে নয়।’

‘এস সমাদ্দারের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই’—কল্কে-কাশি প্রফুল্লকে আহ্বান করেন, ‘কী ছুতোয় যে গায়ে পড়ে তোমার সঙ্গে ভাব জমাবে, ভেবে ভেবে কাহিল হয়ে উঠছে বেচারা।’

‘ওর সঙ্গে আলাপ !’ দারুণ বিস্মিত হয় প্রফুল্ল, ‘বলেন কী!’

‘ক্ষতি কী তাতে ? গিলে ফেলবে না তোমায়।’ কল্কে-কাশি প্রফুল্লকে টেনে নিয়েই চলেন, ‘এই যে সমাদ্দার ! অনেক দিন পরে দেখা—কেমন, ভাল আছ তো ?’

সমাদ্দার চমকে ওঠে, ‘মিস্টার কল্কে-কাশি যে! এখানে এখন এইভাবে আপনাকে দেখতে পাব। আশা করিনি।’

‘আমি কিন্তু আশা করেছিলাম, পরশু সন্ধ্যায় আমাদের বোম্বে মেলে যখন তোমাকে উঠতে দেখলাম।’

‘বটে ?’ সমাদ্দার যেন একটু অপ্রস্তুত হয়, ‘আপনারা তাহলে আজ সকালেই বোম্বে পৌঁছেছেন ? ইনি আপনার বন্ধু বুঝি ?’

‘হ্যাঁ, এই একটু আগেই । নেমে এই রেস্তোরাঁতেই প্রাতরাশের চেষ্টা করছিলাম। এমন সময়ে—হ্যাঁ, কী জিজ্ঞাসা করেছিলে ? ইনি ? ইনি হচ্ছেন বাবু প্রফুল্লকুমার রায়,—কেন যে এঁর বোম্বে আগমন তা তো তোমার ভালমতই জানা আছে।’

‘আমার ?’ সমাদ্দার থতমত খায়, ‘না তো ! তবে, ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলে বিশেষ আপ্যায়িত হব।’

‘তা তো হবেই ! হবার কথাই। বেশ, তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি আমার বন্ধু প্রফুল্লবাবু, আর ইনি হচ্ছেন সমাদ্দার, আমার বন্ধু। অন্তত আমার শত্রু নন। এঁর পরিচয় তো টেবিলে বসেই তোমাকে দিয়েছি। প্রফুল্ল, তুমি সমাদ্দারকে নমস্কার করলে না ? প্রথম পরিচয়ে নমস্কার করাই তো ভদ্র রীতি।’

প্রফুল্ল আর সমাদ্দার বোকার মতো পরকে প্রতি-নমস্কার করে। ‘সুখী হলাম প্রফুল্লবাবুর সঙ্গে আলাপিত হয়ে।’ সমাদ্দার বলে।

‘হবেই তো!’ কল্কে-কাশি যোগ করেন, ‘নিশ্চয়! এইজন্যেই কি কলকাতা থেকে এতটা তোমাকে আসতে হয়নি ? বল ? ভাগ্যিস আমি ছিলাম এখানে ! বন্ধু-বান্ধবের উপকার করতে কখনই আমি পেছপা নই বলেই তোমাদের আলাপ করিয়ে দিলাম।’

‘সেজন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে মিস্টার কল্কে-কাশি !’ সমাদ্দার বিস্ময়ের ভান করে, ‘কিন্তু আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘সত্যি বলছ ?’ কল্কে-কাশি আকাশ থেকে পড়েন। ‘আমার সঙ্গে তুমি জোচ্চুরি করবে বিশ্বাস করতে আমার প্রবৃত্তি হয় না।’

‘সত্যি, আপনার কথার কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এখানকার একটা ফিল্ম স্টুডিয়োয় চাকরির চেষ্টাতেই আমার বোম্বে আসা।’

‘তাই নাকি? তবু তোমাকে বলে রাখছি, যদি তোমার অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে আমার কথাগুলো কাজে লাগবে। এখান থেকে প্রফুল্লবাবু যাবেন গলস্টোন কোম্পানির আপিসে। সেখানে তাঁর কি কাজ আছে। আমি অবশ্য ওঁর সঙ্গে যাচ্ছি না। আরেকটা জরুরী খবর, আমরা উঠেছি তাজমহল হোটেলে। তারপর আজ রাত্রের গাড়িতেই আমরা ফিরছি কলকাতা। আচ্ছা এখন আসা যাক, হোটেলেই আমাদের আবার সাক্ষাৎ হচ্ছে আশা করি ?’

হতভম্ব সমাদ্দারের কাছ থেকে দুজনে বেরিয়ে আসেন। প্রফুল্ল অসন্তোষ প্রকাশ করে—‘মিস্টার কল্কে-কাশি ! আপনি একজন খুব বড় গোয়েন্দা হতে পারেন—’

‘উঁহু উঁহু, আদৌ না ! এই বরাতের জোরেই যা করে খাচ্ছি।’

‘কিন্তু আপনি কি অনেক গুপ্ত সংবাদ ওকে দিয়ে দিলেন না ?’

‘কাকে ? সমাদ্দারকে ?’ কল্কে-কাশি অবাক হন, ‘কী রকম ?’

‘এই, আমার গলস্টোন আপিসে যাবার খবর, এবং তাজমহল হোটেলে ওঠার কথা। তারপর আজ রাত্রেই কলকাতা-মেলে ফেরা—’

‘কেন, কী হয়েছে তাতে ? ওর কত কষ্ট লাঘব হয়ে গেল ! বেচারাকে এসব খুঁজে বের করতে আর হাঙ্গামা পোহাতে হবে না।’

‘সেটা কি ভাল হল ?’ প্রফুল্ল বিরক্তি চাপতে পারে না।

‘আহা ! বুঝতে পারছ না ? যতই ওকে কম হাঙ্গামা পোহাতে হবে, ততই বেশি ও ভাববার সময় পাবে। আর যতই ও ভাবতে পাবে ততই নিজের কাজ মাটি করবে তা জানো ?’

অতঃপর প্রফুল্ল কল্কে-কাশির কাছে বিদায় নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসে। একটু পরেই আরেকখানা ট্যাক্সি প্রফুল্লর গাড়ির পিছু নেয়—এই ট্যাক্সিটা সমাদ্দারের। পরমুহূর্তেই আরো একখানা গাড়ি দূর থেকে দুজনের অনুসরণ করে চলে—এ গাড়িতে আর কেউ নয়, স্বয়ং শ্রীযুক্ত কল্কে-কাশি মহাশয়।

তিনখানি গাড়িই অনেক ঘুরে-ফিরে শহরের উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হয় চারধারে বাগান-ঘেরা প্রকাণ্ড এক বাড়ির ফটকে। গলস্টোন কোম্পানির বড়সাহেবের রেসিডেন্স । প্রফুল্লর গাড়ি ফটকের ভেতর ঢোকে। একটু দূরে সমাদ্দারের গাড়ি থামে—কল্কে-কাশির গাড়ি দ্বিতীয় গাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে অকস্মাৎ যেন থেমে যায়।

‘সমাদ্দার মশাইকে এখানে এ অবস্থায় দেখব আশা করতে পারিনি।’ কল্কে-কাশি বলেন। তাঁর মুচকি হাসিও লক্ষ্য করবার ।

‘এই, একটু শহর দেখতে বেরিয়েছি !’ সমাদ্দার থতমত খায়, ‘হাওয়া খেতেও বটে।’

‘শহর দেখতে শহরের বাইরে ? মন্দ নয় ! ফিল্ম আর্টিস্টের কাজটা তোমার পাকা তাহলে !’ কল্কে-কাশি গলা পরিষ্কার করেন, ‘আমিও তাই আন্দাজ করেছিলাম, যাচাই করে নিতেই এতদূর আসা । যাক, আমার কাজ আছে। শহরেই আমি ফিরলাম।’ তারপর একটু হাসেন, ‘হ্যাঁ, হয়তো তোমার জানাই আছে, তবু খবরটা তোমাকে দিয়ে রাখাই ভালো। ওই বাড়িটাই মিস্টার গলস্টোনের—ব্যানার্জির নমিনেশনের কাগজপত্র আনতে প্রফুল্লবাবু ওখানেই গেছেন। দেখ চেষ্টা করে যদি তোমার বরাত খুলে যায় ! বন্ধুবান্ধবের শুভাকাঙক্ষা করাই আমার দস্তুর, জানোই তো !’

কল্কে-কাশির গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। যে পথে এসেছিল সেই দিকেই ফিরে চলে। সমাদ্দার কোন জবাব দিতে পারে না।

তারপরে আরেক ঘণ্টা সমাদ্দারকে অপেক্ষা করতে হয়। অবশেষে প্রফুল্লর গাড়ি বাইরে বেরোয়। সমাদ্দারের আবার অনুসরণ। প্রফুল্লর ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় তাজমহল হোটেলের সামনে। সমাদ্দারেরও। প্রফুল্ল নেমেই ট্যাক্সিওয়ালার পাওনা চুকিয়ে সটান তের নম্বর ঘরে ঢুকেই খিল আঁটে। সমাদ্দার গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কি বন্দোবস্ত করে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে কল্কে-কাশির অভ্যুদয় হতেই প্রফুল্ল রুদ্ধনিশ্বাসে ছুটে যায়, ‘সর্বনাশ হয়েছে, মিস্টার কল্কে-কাশি !’

কল্কে-কাশি কিছুমাত্র বিচলিত হন না, ‘কী সর্বনাশ ?’

‘সমাদ্দার এসে উঠেছে এখানে! আমাদের পাশের বারো নম্বর ঘরে!’

‘তাই নাকি ? তাহলে তো ওকে মধ্যাহ্ন-ভোজনের নিমন্ত্রণ করতে হচ্ছে ! আমিও ওর শুভাগমন আশা করছিলাম।’

কল্কে-কাশি রসিকতা করছেন, প্রথমটা প্রফুল্ল তাই ভেবেছিল; কিন্তু সত্যিই ডিনারের টেবিলে সমাদ্দারের পাশে বসে নিজের চক্ষু-কর্ণকে ওর বিশ্বাস করতে হল। ওর চিরকালের ধারণা, গোয়েন্দায় আর বদমাইসে মুখোমুখি হলেই ঝটাপটি বেধে যায়। শেষোক্তরা স্বভাবতই পলায়ন-তৎপর এবং প্রথমোক্তরা সর্বদাই ওদের পশ্চাদ্ধাবনে ব্যতিব্যস্ত। মাসিক পত্রের পাতায় আর গোয়েন্দা-গ্রন্থমালার বইয়ে পড়ে এই রকমের একটা বিশ্বাস ওর বদ্ধমূল হয়েছিল। কিন্তু এখন ওদের পরস্পরকে অন্তরঙ্গের মত কথাবার্তা কইতে দেখে তার সে ধারণা দস্তুরমত টলে গেল।

মধ্যাহ্নভোজ প্রফুল্লর মাথায় উঠে গেল, সে মাঝে মাঝে তার কোটের বুকপকেটে হাত দিয়ে গুরুতর বস্তুটির অস্তিত্ব অনুভব করতে লাগল। যে কাগজের টুকরোটির ওপর একটা পার্টির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, তাকে সে যত্নের সঙ্গে কোটের লাইনিং-এর মধ্যে সেলাই করে রেখেছে। জিনিসটার সেখান থেকে অকস্মাৎ উবে যাবার কথা নয় কিছুতেই, তবু সে বারম্বার পরীক্ষা করে আপনাকেই যেন ভরসা দিতে চাচ্ছিল।

ওর হস্তচালনা কল্কে-কাশির নজরে পড়ে একবার। তিনি হাসতে থাকেন—‘ভয় নেই প্রফুল্লবাবু! ও নিরাপদেই আছে, এবং থাকবেও, যদি না তোমার কোট তুমি খোয়াও।’

কল্কে-কাশির কথায় প্রফুল্লর ভারি রাগ হয়, তার মুখ লাল হয়ে ওঠে। কল্কে-কাশি তা বুঝতে পারেন।

‘আমি কি কোন গুপ্তকথা ফাঁস করে দিলাম নাকি ? মোটেই না, প্রফুল্লবাবু ! সমাদ্দার জানত যে কোথায় তুমি নমিনেশন পেপার রেখেছে।—কী হে সমাদ্দার, জানতে না ?’

সমাদ্দার ঘাড় নাড়ে—‘নিশ্চয়ই ! কোটের লাইনিং, ওইখানেই তো রাখবার জায়গা ! সকলেই রাখে এবং সকলেই জানে।’

গোয়েন্দা এবং বদমাইস দুজনে মিলে অকপটে হাসতে থাকে। প্রফুল্ল ভারি মুষড়ে যায়। হতে পারে কোটের লাইনিংই মূল্যবান কাগজ-পত্র রাখার একমাত্র জায়গা এবং সকলেই তা জানে, তবু কী দরকার ছিল মিঃ কল্কে-কাশির সমাদ্দারকে এই খবরটা দেবার ? বরং যাতে সমাদ্দারের মনে এরকম সন্দেহ না জাগে বা জেগে থাকলেও তা দূর হয় সেই চেষ্টা করাই কি তাঁর উচিত ছিল না ? কল্কে-কাশির গোয়েন্দাপনায় সে ঘাবড়ে যায় সত্যিই।

যাক, প্রফুল্লর আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই। যতক্ষণ সে জেগে আছে ততক্ষণ তার কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়া কারো ক্ষমতার বাইরে—এবং রাত্রে, রেলগাড়িতে, হয় সে গা থেকে কোট খুলবেই না, আর খোলেও যদি, তাহলে বালিশের মতই সেটাকে ব্যবহার করবে, সে ঠিক করে রাখল। তার ভারি সজাগ ঘুম, তার মাথার তলা থেকে কোট নেয় কার সাধ্য ?

খাওয়া শেষ হলে কল্কে-কাশি বলেন, ‘এসো সমাদ্দার, একটু দাবা খেলা যাক। প্রফুল্ল, জানো নাকি। দাবা খেলা ?’

‘জানি সামান্যই।’ প্রফুল্ল মুখ গোঁজ করে বলে।

‘আমার আপত্তি নেই।’ সমাদ্দার উত্তর দেয়।

অল্পক্ষণের মধ্যেই খেলা বেশ জমে ওঠে। কল্কে-কাশি ও সমাদ্দারের তো ভালই জানা আছে ; প্রফুল্লও নেহাৎ কম যায় না। ক্রমশই ওর উৎসাহ বাড়তে থাকে, সমাদ্দারের চাল কেড়ে নিয়ে নিজে চাল দেয়। প্রফুল্ল উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ওর গরম বোধ হয়, ও কোট খুলে ফেলে—সমাদ্দারের উপস্থিতি সম্বন্ধে ওর হুঁশই নেই তখন। সমাদ্দারও নিজের কোট খোলে এবং প্রফুল্লর কোটের পাশেই রাখে। খেলা চলতে থাকে।

খানিক বাদে সমাদ্দার উঠে পড়ে, ‘প্রফুল্লবাবু, আপনি ততক্ষণ মিস্টার কল্কে-কাশির সঙ্গে একটু খেলুন। আমি আসছি এক্ষুণি।’

একটু পরেই সমাদ্দার ফিরে আসে, ‘প্রফুল্লবাবু, ভুল করে নিজের কোট ফেলে আপনার কোট নিয়ে গেছি, কিছু মনে করবেন না !’ কোট খুলতে খুলতে সে বলে।

প্রফুল্ল তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে ওঠে, নিজের কোট কেড়ে নেয়। যেখানে নমিনেশন পেপার ছিল সেখানটা অনুভব করে। পরমুহূর্তেই সে সমাদ্দারের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে উদ্যত হয়। কল্কে-কাশি মাঝে পড়ে বাধা না দিলে তার বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে বদমাইসটাকে হয়তো সেইদণ্ডে টুঁটি টিপে খুন করেই বসত !

‘প্রফুল্লবাবু, করছ কী ? কী ব্যাপার ?’

‘ওই চোর—’

‘আহা, গালাগালি কেন ? কী হয়েছে ?’

‘আপনি বুঝতে পারছেন না। এই লোকটা এইমাত্র আমার কোট থেকে নমিনেশন পেপার চুরি করেছে।’

কল্কে-কাশি তেমনই অবিচলিত থাকেন, ‘তাই নাকি হে সমাদ্দার ? তাই নাকি ?’

‘প্রফুল্লবাবু তো সেই রকমই ভাবছেন।’ সমাদ্দার বলে, ‘কিন্তু আমি নিজেই বুঝতে পারছি না কখন করলুম !’

সমাদ্দার উচ্চহাস্য করে, কল্কে-কাশিও হাসতে থাকেন। প্রফুল্ল রেগে আগুন হয়ে ওঠে, কিন্তু একা সে কী করবে ? আপন মনেই সে ফুলতে থাকে। আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটাই তার কেমন-কেমন ঠেকে। সমাদ্দার ও কল্কে-কাশির মধ্যে যে-রকম অন্তরঙ্গতা তাতে ওর নিদারুণ সন্দেহ হতে থাকে। ওরা দুজনে মাসতুতো ভাই নয় তো ?

‘তুমি যদি এখুনি আমার কাগজ না ফিরিয়ে দাও তোমার হাড় ভেঙে আমি ছাতু করব !’ প্রফুল্ল ঘুষি বাগিয়ে প্রস্তুত হয়।

‘আহা, হচ্ছে কী এসব ! মারামারি কি ভদ্রলোকের কাজ ?’ কল্কে-কাশি ওকে সামলাতে যান।

‘আপনি থামুন মশায় ! আপনারা এক গোত্র ! আমি বেশ বুঝেছি। গোড়াতেই ধরতে পেরেছিলাম, কিন্তু—সে যাক। আপনার কোন কথা আমি শুনছি না আর!’ প্রফুল্ল মরিয়া হয়ে ওঠে।

এবার সমাদ্দার কথা বলে, ‘আপনি যদি আমার গায়ে হাত দেন প্রফুল্লবাবু, তাহলে আমি এক্ষুণি হোটেলের ম্যানেজারকে ডেকে আপনাকে পুলিশে দেব। আপনার কাগজ যে আমি নিয়েছি তার প্রমাণ। কী ?’

‘বেশ, আমি তোমাকে সার্চ করব ! তোমার কামরাও !’

‘স্বচ্ছন্দে। এক্ষুণি।’ সমাদ্দার কল্কে-কাশির দিকে ফেরে, ‘আপনিও কি সার্চ করতে চান ? আসুন আমার সঙ্গে, কোন আপত্তি নেই আমার !’

‘বাজে কাজে সময় নষ্ট করি না আমি’—কল্কে-কাশি একটা সিগারেট ধরান। ‘তুমি যদি সত্যিই ও-কাগজ নিয়ে থাকো সমাদ্দার, তাহলে এখন তোমাকে সার্চ করে কোন লাভ নেই। কোথায় তুমি তা রেখেছ তাই যদি ভেবে বার করতে পারি, তাহলে তা পেতে আমার বিলম্ব হবে না।’

‘আপনি কি তাহলে সার্চ করতে প্রস্তুত নন ?’ প্রফুল্ল এবার ক্ষেপে ওঠে।

‘উহুঁ!’ কল্কে-কাশির সংক্ষিপ্ত জবাব। ‘আপাতত না।’

‘বেশ, আমি নিজেই করব তাহলে !’

প্রফুল্ল সমাদ্দারের ঘরে যায়, ওর আপাদমস্তক অনুসন্ধান করে, সবগুলো জামার ভেতরের বাইরের সমস্ত পকেট হাতড়ায়, কোটের যাবতীয় লাইনিং পরীক্ষা করে ; অবশেষে মুহ্যমানের মত যখন নিজের কামরায় ফেরে তখন কল্কে-কাশি জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন। মুখ না ফিরিয়ে তিনি বলেন, ‘তখনই বললাম, প্রফুল্লবাবু,—এখন ওকে সার্চ করে কোনই ফল নেই। কোথায় ও জিনিসটা সরিয়েছে যতক্ষণ তাই না আন্দাজ করতে পারছি—’

সমাদ্দার ফিরতেই কল্কে-কাশির কথায় বাধা পড়ে। প্রফুল্ল কোন জবাব দেয় না। নিজের মধ্যে নিজেই সে নেই তখন, এতই সে দমে গেছে।

‘তবে সত্যি বলতে কী, দোষ তোমার নিজেরই প্রফুল্লবাবু ! তুমিই বল, তোমার আরো সাবধান হওয়া উচিত ছিল কি না?’ কল্কে-কাশি কথাটা শেষ করেন।

কিন্তু এ-কথায় প্রফুল্লর এখন আর সান্ত্বনা কোথায় ? সে গুম হয়ে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ।

কল্কে-কাশি সমাদ্দারকে বলেন, ‘ভারি দমিয়ে দিয়েছ তুমি বেচারাকে ! ওর মুখ দেখলে মায়া হয় !’

সমাদ্দার ঘাড় নাড়ে। স্বভাবতই সে কোমল-হৃদয়, সত্যি সত্যিই দুঃখ হয় ওর। ‘বিজনেস, মিস্টার কল্কে-কাশি!’ সে বলে।

‘সেকথা হাজার বার ! কিন্তু ভেবে দেখ দিকি কী সর্বনাশ হল ওর! হয়ত চাকরিই থাকবে না আর। ও তো ভেঙে পড়েছেই, আমিও খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করছি না।’ কল্কে-কাশি সমাদ্দারের চোখের ওপর চোখ রাখেন, ‘কাগজখানা রাখলে কোথায় হে সমাদ্দার ?’

সমাদ্দার হাসে, ‘আমি যে রেখেছি আমি তো স্বীকার করিনি।’

‘না। এবং তোমাকে স্বীকার করতে বলছিও না । কিন্তু এ কথাও ঠিক, ও-কাগজ নিয়ে সটকাতে পারছ না তুমি। হাওড়ায় নেমেই আমি তোমাকে আটকাব এবং খানাতল্লাসি করাব—যাকে বলে। পুলিশের খানাতল্লাসি।’

সমাদ্দার আতঙ্কিত হয়। ‘সেটা কি সঙ্গত হবে মিস্টার কল্কে-কাশি ? কাগজখানা যে আমার কাছে আছে তার বিন্দুমাত্র প্রমাণও আপনি পাননি।’

‘না পাই। কিন্তু কাগজখানা আমি পেতে চাই।’

কক্লে-কাশির সঙ্কল্প শুনে সমাদ্দারের শঙ্কা হয়। সে তৎক্ষণাৎ নিজের ঘরে যায়, গিয়ে মাথা ঘামাতে থাকে। অনেক ভেবে সে একটা উপায় আবিষ্কার করে। দরজায় খিল আঁটে। তারপর নিজের সুটকেস বার করে এক কোণের একটা গুপ্ত বোতাম টেপে, তার ফলে ডালার দিকে একটা লুকোনো খুপরি খুলে যায়। তার ভেতর থেকে সদ্য-অপহৃত নমিনেশন পেপার বেরিয়ে পড়ে।

সমাদ্দার কাগজটা পরীক্ষা করে। সেই সঙ্গে আরেকখানা অনুরূপ নমিনেশন পেপারও। দ্বিতীয় কাগজখানা ফাঁকা, এখানা তাকে দেওয়া হয়েছে আসল কাগজ চেনার সুবিধের জন্য। সমাদ্দার দ্বিতীয় কাগজের যথাস্থানে প্রথম কাগজের দেখাদেখি ব্যানার্জির সই নকল করে বসিয়ে দেয়। হঠাৎ দেখলে মনে হবে একই কাগজ, হুবহু একই সই—কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করলেই এ সই যে জাল-করা তা স্পষ্টই ধরা পড়ে যাবে।

অবশেষে জাল কাগজখানা গুপ্ত ডালার মধ্যে এঁটে রেখে, আসল কাগজটা একখানা লেফাফায় ভরে। খামের ওপরে লেখে মিস্টার সরকারের নাম আর ঠিকানা। কাগজটা সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয় দেখে রেজিস্ট্রি করে পাঠানোই সে সমীচীন মনে করে। ডাকে গেলেও তার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতায় পৌঁছবে এবং একেবারে তার নিয়োগকর্তার হাতেই, সুতরাং তার অসুবিধের কিছু নেই। তারপর দরজায় তালা লাগিয়ে, কাছাকাছি পোস্ট-আপিসের উদ্দেশে সে রওনা হয়।

প্রফুল্ল ঘরে ঢোকে। আপন মনেই যেন বলে, ‘দরজায় তালা লাগিয়ে সমাদ্দারকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম।’

‘তাই নাকি?’ কল্কে-কাশি সিগারেটের সামান্য অবশেষটা ফেলে দেন, ‘তাহলে তো ওর ঘরটা একবার তল্লাস করতে হয়। এই তো সেরা সুযোগ।’

সব-খোল চাবির সাহায্যে সহজেই তালা খুলে যায়। প্রফুল্লকে নিয়ে তিনি ঢোকেন।

‘কোথায় কোথায় তুমি খুঁজেছিলে ?’

তদুত্তরে প্রফুল্ল তার অনুসন্ধান-বৃত্তান্ত প্রকাশ করে।

‘এই সুটকেসটা দেখেছিলে ?’

‘হ্যাঁ। ওর ভেতরেও দেখছি। ওতে নেই।’

‘দেখেছ ঠিকই, কিন্তু আরেকবার দেখা যাক।’

কল্কে-কাশি সুটকেসটাকে উন্মুক্ত করেন। ভেতরে যা কিছু জিনিস-পত্র সব তাঁর পায়ের কাছে উজাড় হয়।

‘দেখলেন তো ! বললাম ওতে নেই!’ প্রফুল্ল বলে।

কল্কে-কাশি ওর কথায় কান দেন না। খুঁজতে খুঁজতে সেই গুপ্ত বোম আবিষ্কৃত হয়। ‘পেয়েছি প্রফুল্লবাবু, এতক্ষণে পেয়েছি।’

‘কী?’

‘এই দেখ।’ চাবি টিপতেই সেই লুকোনো ডালা ব্যক্ত হয়। তার মধ্যে একটা লম্বা লেফাফা। লেফাফাটা না খুলেই তিনি প্রফুল্লর হাতে দেন। ‘এই নাও। কিন্তু সাবধান, আর যেন খোয়া না যায়।’

প্রফুল্ল কম্পিত হাতে লেফাফা খোলে। কাগজখানা দেখেই সে লাফিয়ে ওঠে। তারপর দু’হাতে কল্কে-কাশির একখানা হাত চেপে ধরে—‘আপনাকে সন্দেহ করেছিলাম, আমাকে মাপ করুন—’

উত্তরে কল্কে-কাশির শুধু একটু মৃদু হাসি দেখা যায়। সমস্ত জিনিস যথাযথ রেখে তেমনি তালা এঁটে তাঁরা বেরিয়ে আসেন।

সমাদ্দার হোটেলে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকেই তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে কল্কে-কাশির কাছে। ‘এটা কি ভালো কাজ আপনার মশাই ? আমার অবর্তমানে আমার ঘরে গিয়ে সুটকেস খুলে—’

কল্কে-কাশি বাধা দেন— ‘আমরাই যে তোমার সুটকেস খুলেছি তার কী প্রমাণ তুমি পেয়েছে ? প্রমাণ ছাড়া তুমি তো চলো না সমাদ্দার !’

প্রফুল্ল এতক্ষণে মন খুলে হাসতে পারে।

সমাদ্দার গজরাতে থাকে, ভয়ানক রাগের ভান করে, কিন্তু সেও মনে মনে হাসে।

আর মিঃ কল্কে-কাশি ? তাঁর মুখে হাসি দেখা যায় না।

সমাদ্দার চলে গেলে প্রফুল্ল মুখ খোলে, ‘একবার বাগাতে পেরেছে, আর পারবে না। এ-কোট আর আমি গা থেকে খুলছি না। রাত্রেও না।’

‘ঠেকে শেখা ভয়ানক শেখা প্রফুল্লবাবু !’ কল্কে-কাশি ঘাড় নাড়েন, ‘এবং একবারই একটা মানুষের পক্ষে যথেষ্ট।’

‘আচ্ছা মিস্টার কল্কে-কাশি, সুটকেসটায় যে একটা গোপন খুপরি আছে কী করে আপনি বুঝলেন ?’

‘তোমার কোটের লাইনিং আছে যেমন করে সমাদ্দার বুঝেছিল।’ কল্কে-কাশি ব্যাখ্যা করে দেন, ‘ও থাকতেই হবে। তোমার কি ডিকেটিভ উপন্যাস একেবারেই পড়া নেই প্রফুল্লবাবু ?’

প্রফুল্ল নিজের বিদ্যাবত্তা জাহির করতে লজ্জা পায়। একেবারেই যে এক-আধখানা ওর পড়া নেই তা নয়, তবু সে সসঙ্কোচেই বলে, ‘এবার থেকে পড়ব কিন্তু।’

কলকাতা ফেরার পরদিনই কল্কে-কাশি সমাদ্দারের আড্ডায় গিয়ে আবির্ভূত হন। ‘আসতে পারি। ভেতরে ?’

‘আসুন, আসুন! আমার কী সৌভাগ্য, আপনি এসেছেন!’ সমাদ্দার শশব্যস্ত হয়ে ওঠে।

‘সরকারদের কাছ থেকে টাকাটা পেয়ে গেছ তো ?’ কল্কে-কাশি জিজ্ঞাসা করেন।

‘হ্যাঁ, কালই দিয়ে দিয়েছে। নগদ পাঁচটি হাজার।’ সমাদ্দার উত্তর দেয়, ‘কেন, কী হয়েছে তার ?’

‘না, এমন কিছু না।’ কল্কে-কাশি তাঁর হাত-ঘড়ির দিকে তাকান। ‘এখন দশটা, আর এক ঘণ্টা পরেই প্রেসিডেন্সি কোর্টে নমিনেশন পেপার দাখিল হবে কিনা ! তোমাকে আমি কেটে পড়তে বলতে এসেছি। বন্ধুবান্ধব হিসেবেই বলতে এসেছি অবশ্যি।’

‘কেটে পড়ব ? আমি ! কেন ?’ সমাদ্দার সচকিত হয় ।

‘সরকারদের পার্টির কাছ থেকে ফাঁকি দিয়ে টাকা নিয়েছ এই জন্যে। ওদের হাতে খুনে গুণ্ডা তো কম নেই, যাদের তুলনায় তুমি আস্ত দেবদূত।’

‘ফাঁকি দিয়ে নিয়েছি কী রকম?’ সমাদ্দার এবার হাসে, ‘আপনি কি এখনো বুঝতে পারেননি মিস্টার কল্কে-কাশি, আমার সুটকেস থেকে যে কাগজ আপনি বের করে নিয়েছিলেন তা আসলে জাল-সই করা ?’

‘আগাগোড়াই তা আমি জানতাম।’ কল্কে-কাশির গলার স্বর গম্ভীর।

‘তবে—’

‘আসলে একটা কথা তুমি নিজেই এখনো বুঝতে পারোনি, সমাদ্দার। প্রফুল্লর পকেট থেকে যে কাগজ তুমি বাগিয়েছিলে তাও জাল ছাড়া কিছু না।’

‘অ্যাঁ ?’ এবার সত্যিই চমকে ওঠে সমাদ্দার। ‘তাই নাকি ?’

‘নিশ্চয়! যে সময়ে তুমি সেই বাগানবাড়ির গেটে প্রফুল্লর জন্যে অপেক্ষা করেছিলে সেই সময়ে আমি শহরে ফিরে গলস্টোন কোম্পানির আপিস থেকে আসল কাগজখানা হস্তগত করি । স্টেশনে নেমেই গলস্টোন সাহেবকে ফোন করে আমি ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম যাতে সাহেবের বাড়ি থেকে প্রফুল্লকে একখানা নকল নমিনেশন পেপার দেওয়া হয়—এখন সব বুঝতে পারছ তো ? যাতে তোমার নজর একেবারেই আমার দিকে না পড়ে সেই জন্যেই আমার এত কাণ্ড করা। প্রফুল্লকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া এবং সব কিছু। অমন মূল্যবান কাগজ আমি নিতান্ত অবহেলাভরে আমার এই কোর্টের পকেটে করে নিয়ে এসেছি, ইচ্ছেমতো জামা খুলেছি, রেখেছি, তুমি তা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারোনি। প্রফুল্লও তা জানে না। কোনদিন জানবেও না । যাক, বেচারা আনন্দেই আছে, ওর বেতন বেড়ে গেছে খবর পেলাম—’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *