1 of 2

গহনার বাক্স – জগদানন্দ রায়

গহনার বাক্স – জগদানন্দ রায়

আমি ডিটেক্‌টিভ অফিসে প্রবেশ করিবার প্রায় ছয় মাস পরে, একদিন বড়বাবু আফিসের সেই নির্জন কক্ষে আমাকে ডাকিয়া, বর্ধমানের এক ভয়ানক খুনের আমূল পরিজ্ঞাত ঘটনা বিবৃত করিলেন, এবং এই হত্যা সম্বন্ধীয় সমস্ত কাগজপত্র আমার হাতে দিয়া তৎক্ষণাৎ বর্ধমান যাত্রা করিয়া তথায় গুপ্ত হত্যাকারীর অনুসন্ধান করিবার জন্য আদেশ প্রদান করিলেন।

প্রায় তিন সপ্তাহ বর্ধমানে অবস্থান করিলাম, হত্যাস্থানের চারিদিকের অধিবাসীগণের সহিত তৎপ্রসঙ্গে অনেক আলাপাদিও করা গেল, কিন্তু হত্যাকারীর বিশেষ কোন সন্ধান পাইলাম না। তবে স্থানীয় পুলিশ ভূষণদাস নামক যে জনৈক হোটেলওয়ালাকে এই হত্যা ব্যাপারের সহিত জড়িত বলিয়া যে সন্দেহ করিয়াছিলেন, তাহা আমার নিকট এবং স্থানীয় অধিবাসীদের নিকট বেশ যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বোধ হইয়াছিল, তাছাড়া আমি ভূষণদাসের হোটেল ঘর অনুসন্ধান করিয়া যে তিনখানি গোপনীয় পত্র আবিষ্কার করিয়াছিলাম, তাহার মর্মে উক্ত ব্যক্তিই যে প্রকৃত হত্যাকারী তাহাতে আর আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বহু চেষ্টা করিয়াও, ভূষণের আবাসস্থান স্থির করিতে পারিলাম না, হত্যাকাণ্ডের দিন হইতে সে নিরুদ্দেশ !

এই প্রকার অবস্থায় তথায় অবস্থান করা বৃথা এবং কষ্টকর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল, কিন্তু আর অধিককাল আমায় সেখানে থাকিতে হইল না, অবিলম্বে কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিবার আদেশসহ বড়বাবুর একখানি টেলিগ্রাম পাইলাম। বাঁচা গেল, সেই দিনই পূর্বাহ্নে আহারাদি সম্পন্ন করিয়া কলিকাতা যাত্রা করিলাম, হত্যাকারীর অনুসন্ধান এইখানেই শেষ হইয়া গেল।

চারিটার সময় কলিকাতায় পৌঁছিয়া, বাসায় না গিয়াই আমার ত্রিসাপ্তাহিক অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের ফল, সেই ভূষণদাসের জীর্ণ ও নীরস চিঠি কয়েকখানি সহ একেবারে আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং আমার অনুসন্ধানের আমূল বিবরণ বিবৃত করিলাম ।

আমার কথায় বাবু বিশেষ বিরক্ত হইয়াছেন বলিয়া বোধ হইল না, তিনি ধীরভাবে বলিলেন, ‘বর্ধমানের হত্যাব্যাপারের শেষ যে এই দাঁড়াইবে, তাহা প্রথমে পুলিশ রিপোর্ট হইতেই বুঝেছিলুম, তবুও একবার দেখা গেল। যাহা হউক তুমি এসেছ, বেশ হয়েছে ; কালই তোমাকে দেওঘরে যেতে হবে। আজ কয়েক দিন হল সেখানে বনমালী চৌধুরী নামক জনৈক বড়লোকের বাড়িতে অনেক টাকার গহনা চুরি হয়ে গেছে ; তার অনুসন্ধানের জন্য একটা লোক পাঠাইবার জন্য তিনি স্বয়ং আমাকে লিখেছেন। তোমাকেই যেতে হবে।’

অবিলম্বেই দেওঘরে যাইতে প্রস্তুত হইলাম । নমস্কার করিয়া বিদায় গ্রহণের পূর্বে বড়বাবু আবার বলিলেন, ‘দেখ, এই চুরি ব্যাপারটা একটু নূতন রকমের ! বাড়ির কর্তার বিশ্বাস, তাঁহার পরিবারস্থ কোন এক ব্যক্তি ইহাতে লিপ্ত, এজন্য তাহাকে লইয়া একটা প্রকাশ্য গোলযোগ করা তাহার অভিপ্রেত নয়। যাহা হউক, তুমি সেখানে গেলেই সব শুনিতে পাইবে, কিন্তু খুব সাবধান।’

পরদিন কলিকাতা ত্যাগ করিয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে দেওঘরে পৌঁছিলাম। বনমালী চৌধুরীর বাড়ি অনুসন্ধান করিতে বিলম্ব হইল না, শহরে লোকটার বেশ মান প্রতিপত্তি আছে, শুনিলাম বহুকাল সরকারী আমীনের কাজ করিয়া পেনসন প্রাপ্তির পর তিন চারি বৎসর হইতে তিনি সপরিবারে বৈদ্যনাথে বাস করিতেছেন। নগদ টাকা যথেষ্ট, এবং উচ্চ সুদে কর্জ দিয়া তদ্দ্বারাও প্রচুর আয়ের সংস্থান হয়। সন্ধ্যার পর বনমালী চৌধুরীর বাটীতে উপস্থিত হইলাম, কিন্তু তখন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল না ; কর্তা তখনও আহ্নিকের ঘরে রহিয়াছেন, শুনিলাম বাহিরের ঘরে আসিতে অর্ধ ঘণ্টা বিলম্ব হইবে । দেখিলাম বাসায় লোকজনের সংখ্যা খুব অধিক নয়, একজন খানসামা, একজন বেহারা, একটি মুহুরী আর এক পাচক ব্রাহ্মণ। মুহুরীর নাম শ্রীশ্যামলাল রায়, লোকটা মিষ্টভাষী, আমাকে প্রথমে দেখিয়াই, অর্থকৃচ্ছতায় তাড়িত ঋণগ্রহণেচ্ছু বিপন্ন ব্যক্তি ঠাহরাইয়াছিলেন, এবং অচিরাৎ ভূসম্পত্তি বন্দক রাখিয়া আমি কর্তার ‘মহামহিম’ পদবীর প্রসার বৃদ্ধি করিব, আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারও যৎকিঞ্চিৎ দক্ষিণার ব্যবস্থা করিব, তাহাতে আর তাঁহার সন্দেহ ছিল না। আমি আত্মগোপনের এই সুযোগ ছাড়িতে পারিলাম না, দুই সহস্র মুদ্রা ঋণগ্রহণ সম্বন্ধে কর্তার সাহায্য প্রার্থনা আমার আগমনের কারণ বলিয়া প্রকাশ করিলাম। লোকটা আমার কথায় বেশ বিশ্বাস করিয়া ফেলিল, এবং আশু কার্য সিদ্ধিতে তিনি যে বিশেষ সচেষ্টা থাকিবেন, একথা বলিতেও ছাড়িল না।

কর্তা বাহিরে আসিলে, একাকী আমি তাঁহার নির্জন কক্ষে গিয়া, বড়বাবু প্রদত্ত আমার নিয়োগ পত্রখানি দেখাইলাম। তিনি পত্রখানি আগ্রহ সহকারে পাঠ করিয়া ধীরে ধীরে চশমাখানি খুলিয়া বলিলেন, ‘সাহেব আপনাকে চুরির অনুসন্ধান করিতে পাঠাইয়াছেন, ভালই। অনুসন্ধান আরম্ভের পূর্বে আপনাকে একটা কথা বলিয়া দেওয়া ভাল বোধ করিতেছি। আজ চারি দিন হল আমার প্রায় পাঁচ হাজার টাকার গহনা চুরি গিয়াছে, কিন্তু এ পর্যন্ত একথা গৃহিণী ব্যতীত অপর কাহারও নিকট প্রকাশ করি নাই, কেবল গোপনে পুলিশে সংবাদ দিয়া রাখিয়াছি। আপনি আমার এই ব্যবহারের কথায় হয়তো বিস্মিত হইতেছেন, কিন্তু সব শুনিলে আমার সঙ্কট বুঝিতে পারিবেন। আমার বিশ্বাস অলঙ্কারগুলি আমার হতভাগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র রজনী চুরি করিয়াছে। গৃহিণীরও এই মত। হতভাগাকে, পিতার মৃত্যুর পর হতে ছেলের মত পালন করে আসিতেছি, লেখাপড়া শিখায়েছি—’

আমি এইখানে তাঁহাকে বাধা দিয়া বলিলাম, ‘মহাশয়, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রের কথা পরে শুনিলেই চলিবে, এখন চুরিটা কি প্রকারে হয়েছিল, আগে তাহাই বলুন।’

কর্তা তখন বলিতে লাগিলেন, ব্যাপারটা হচ্ছে, সেই চুরির দিন কতকগুলি গহনা বন্ধক রাখিয়া, কয়লা খাদের এক ঠিকাদার আমার নিকট তিন হাজার টাকা কর্জ লইয়া গিয়াছিল, গহনাগুলা আমার এই বৈঠকখানা ঘরে একটা বড় হাত বাক্সে রাখিয়াছিলাম, তাড়াতাড়ি বশত লোহার সিন্দুকে তুলিয়া রাখা হয় নাই। এই ঘরে রাত্রিতে কেহই থাকে না, সেই হতভাগা, শুনিলাম সেদিন রাত্রে এখানে শুইয়াছিল। প্রাতঃকালে কি রাত্রে কখন সে উঠে গেছে, কেহ জানে না, আমি যথাসময়ে প্রভাতে উঠিয়া আর বাক্স দেখি নাই। চোর যে কে তাহা বুঝিতে আর বিলম্ব হইল না, তাই একটা ঘরোয়া গোলযোগ হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য, বাক্সটা আমি বাড়ির মধ্যে রাখিয়াছি বলিয়া প্রকাশ করিয়াছিলাম। এখন যাহাতে বিনা গোলযোগে পরের অলঙ্কারগুলি হস্তগত হয়, তাহার উপায় করুন।’

বহু কষ্টে চুরির এই সামান্য ইতিহাস সংগ্রহ করিয়া আপাতত পরিতৃপ্ত থাকিতে হইল, কারণ কর্তার সহিত আর যাহা কথা হইল, তাহাতে ভ্রাতুষ্পুত্র রজনীনাথের উদ্দেশে অজস্র গালিবর্ষণ এবং নিজের আকস্মিক গ্ৰহবৈগুণ্যের জন্য অদৃষ্টের প্রতি ধিক্কার ভিন্ন আমার ডিটেকটিভ বুদ্ধি প্রয়োগের উপযোগী কিছু পাওয়া গেল না। সে যাহা হউক, কর্তার বিশেষ অনুরোধে, কার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত তাহার বাসাতেই থাকার ব্যবস্থা হইল। আত্মগোপন মানসে আমি যে ঋণ গ্রহণেচ্ছু ব্রাহ্মণ সন্তান বলিয়া চাকরদিগের নিকট পরিচয় দিয়াছিলাম, সে কথাটা কর্তাকে বলিয়া দিলাম।

পরদিন প্রাতঃকালে, আবার কর্তার সহিত চুরি সম্বন্ধে অনেক কথোপকথন হইল। তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র ব্যতীত অপর কোনও ব্যক্তির উপর সন্দেহ হয় কি না জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি বলিলেন, ‘আমার পরিবারস্থ মুহুরী, বেহারা, চাকর, ব্রাহ্মণ সকলই বিশ্বাসী পুরাতন ভৃত্য। যে ব্যক্তি এই সর্বনাশ করিয়াছে, আমি বহুপূর্বে তাহার আভাস দিয়াছি । আর কাহারো উপর আমার সন্দেহ নাই।’

সেইদিনই, ঘটনার পরিজ্ঞাত বিবরণসহ, বড়বাবুকে একখানি পত্র লিখিলাম। লোকটা যখন ভ্রাতুষ্পুত্রের উপর এতটা সন্দেহ করিতেছে, একবার তাহার অবস্থাটা অনুসন্ধান করা ভাল বলিয়া বোধ হইল ; শুনিলাম সে বৈদ্যনাথের নিকটেই মধুপুর স্টেশনে কি একটা চাকরি করে, কিন্তু হঠাৎ এই কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে সাহস হইল না। পত্রোত্তরে বড়বাবুর পরামর্শের অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

পরদিন প্রাতঃকালে, স্নানাহ্নিক সমাপন করিয়া কর্তা যথারীতি মহাদেব দর্শন করিতে বহির্গত হইলেন এবং আমাকেও যাইতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু সে সময়ে আমার মন বড়ই উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছিল, তাছাড়া বড়বাবুর চিঠিও পাইবার সম্ভাবনা ছিল, এই সকল কারণে, কোন প্রকারে কর্তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিয়া, বাসাতেই থাকিয়া গেলাম।

সেদিন কর্তা বাহির হইয়া যাবার কিছুক্ষণ পরেই মুহুরী মহাশয়ও একটা কাজে চলিয়া গেলেন। আমি একলা বৈঠকখানায় বসিয়া আছি, এমন সময় ডাকপিয়ন আসিয়া কতকগুলি পত্র আমার হাতে দিয়া গেল। বড়বাবুর নিকট হইতে পত্র পাইবার সম্ভাবনা ছিল, আমি তাড়াতাড়ি সেই পত্র খুঁজিতে লাগিলাম, কিন্তু আমার নামীয় কোন পত্রই পাইলাম না। তখন আমি একে একে সেই পত্রগুলির শিরোনামা পাঠ করিতে লাগিলাম, কোন প্রকারে সময় ক্ষেপণ করা ব্যতীত এই কার্যের অপর কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। পত্রগুলির মধ্যে শ্যামলাল রায় মুহুরী মহাশয়ের নামীয় একখানি চিঠি ছিল, তাহার শিরোনামা পড়িবার সময় লেখাটা যেন আমার কোনও পরিচিত লোকের বলিয়া বোধ হইল, ডাকঘরের ছাপটা বড় অপরিষ্কার-পড়িতে পারিলাম না। হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, বর্ধমানের হত্যাকারী ভূষণদাসের লেখা কি এই প্রকার নয়? অনেক নিদ্রাহীন স্তব্ধরাত্রি ভূষণের কয়েকখানি পত্র নাড়াচাড়া করিয়া অতিবাহিত করিয়াছি, তাহার হস্তক্ষরের প্রত্যেক টান তখনও আমার চক্ষে প্রত্যক্ষবৎ ছিল। মুহুরী মহাশয়ের পত্রখানি যে সেই ভূষণদাস কর্তৃক লিখিত তাহাতে আর আমার সন্দেহ রহিল না। পত্রগুলি অপ্রয়োজনীয়বোধে বড়বাবুকে দিই নাই, সেগুলা আমার পোর্টমান্টোস্থ একটা জামার পকেটে ছিল। তাড়াতাড়ি বাক্স হইতে পত্রগুলি বাহির করিয়া তাহার অক্ষরের সহিত, মুহুরী মহাশয়ের নামীয় পত্রের শিরোনামার অক্ষরের সহিত মিলাইয়া দেখিলাম অবিকল একই হাতের লেখা ! অপর চিঠিগুলা টেবিলের উপর রাখিয়া, একটা নির্জন স্থানে গিয়া, সেই পত্রখানি খুব সাবধানের সহিত পড়িলাম। চিঠিখানি যশোহর হইতে প্রেরিত, লেখা ছিল।

কল্যাণবরেষু —আমি কিছুদিন হতে তোমার পত্র না পাইয়া উদ্বিগ্ন আছি। পূজার জিনিস পত্র সঙ্গে লইয়া আসিবে, এবং ছুটিতে আসিবার সময় কলিকাতায় গিয়া শ্ৰীমতী মৃণালিনীর জন্য সেই বহুবাজারের এইচ্‌, বসুর এক শিশি কুন্তলীন, আর একশিশি দেল্‌খোস, অবশ্য করিয়া আনিবে। শীতকালে সাহেব বিবির নাচ দেখতে, সে কলিকাতায় যাবে বলছে। সদর রাস্তায়, এইচ্‌, বসুর খুব বড় দোকান। গোবর্ধন ভাল আছে, ঠাকুরের জ্বর হইয়াছে। কলিকাতার কাঠগোলায় তোমার কাকার সহিত একবার দেখা করিও। আমি ভাল আছি।

আশীর্বাদক

শ্রীকালীকান্ত রায়।

পুঃ—মিনি শীঘ্র বেশ লিখ্‌তে শিখেছে, সে কিছুতেই ছাড়লে না, তার হিজিবিজি হাতের লেখা পত্রের সঙ্গে পাঠাইলাম, তুমি আসিলে ভাল লেখা দেখাইবে । কুন্তলীন ও দেল্‌খোস্‌ না আনিলে, বড় গোলযোগ বাধাইয়া তুলিবে ।’

তারপর পত্রের সহিত মোড়ক করা একখণ্ড পৃথক কাগজে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা :—

‘খ, চ, খ, ক, ক, গ, খ, জ, খ, ক, ঙ, খ, গ, ঙ, জ।’

পত্র পাঠ করিয়া প্রায় সকল আশাই নির্মূল হইতে চলিল। কিন্তু ভূষণদাসের হস্তাক্ষরের সহিত চিঠিখানির প্রত্যেক অক্ষরের ঐক্যতা সহজে মন হইতে বিদূরিত হইল না, বিশেষত বালিকাকন্যা মিনির যথেষ্ট লিখিত আঁকা বাঁকা অক্ষরগুলিতেও যেন দুই একটা পাকা হাতের টান দেখিতে পাইলাম।

সে যাহা হউক, চিঠিখানি আর সেই ক্ষুদ্র কাগজখণ্ড আমার নিকটেই থাকিল, মুহুরী মহাশয়ের প্রতি একটু খরদৃষ্টি রাখিলাম, কিন্তু তাঁহার ব্যবহারে সন্দেহজনক কিছুই দেখা গেল না। আহারাদির পর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিয়া, আবার চিঠিখানি লইয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিলাম। হঠাৎ মনে হইল টুকরা কাগজে যে কয়েকটি অক্ষর লেখা আছে, হয়তো তাহার সাহায্যে পত্রখানি পড়িতে হইবে । আশ্চর্যের বিষয় আমার অনুমান ঠিক হইল, এবং এই কয়েকটি কথা তখন পত্রের মধ্যে স্পষ্ট পড়িতে পারিলাম। ‘আমি জিনিস লইয়া কলিকাতায় বহুবাজারের দেল্‌খোস বিবির গোবর্ধন ঠাকুরের কাঠগোলায় আছি, শীঘ্র না আসিলে গোলযোগ।’

বর্ধমানের হত্যাকারী ও দেওঘরের চুরির সহায়ক ভূষণদাসকে উক্ত পত্রস্থ লুক্কায়িত বাক্য দ্বারা ধৃত করিবার সম্ভাবনা দেখিয়া, আমার মানসিক অবস্থা কি প্রকার হইয়াছিল, পাঠক পাঠিকাগণ অনায়াসেই অনুমান করিতে পারেন। আমি পত্রখানি সাবধানে পকেটস্থ করিয়া, কর্তার নিকট গিয়া বলিলাম, ‘আপনার চুরির বোধহয় একটা কিনারা হইবে, আমাকে এখনই একবার মধুপুরে যাইতে হইবে। কথাটা যেন প্রকাশ না হয়।’ গোলযোগের আশঙ্কায় আমার প্রকৃত গন্তব্যস্থান যে কলিকাতা তাহা আর প্রকাশ করিলাম না।

সাতটার গাড়িতেই যাওয়া স্থির করিলাম, দেখিতে দেখিতে ছয়টা বাজিয়া গেল, আমি কিছু অগ্রেই স্টেশনে যাত্রা করিলাম। যাইবার সময় মুহুরী মহাশয় আমার হঠাৎ গমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি বলিলাম, ‘যেসকল সম্পত্তি বন্ধক রাখিয়া কর্তা আমাকে টাকা কর্জ দিবেন, তৎসম্বন্ধীয় কাগজপত্র ভুলে বাড়িতে ফেলিয়া আসিয়াছি, কল্যই দলিলপত্র লইয়া আবার ফিরিতেছি।’

প্রাতঃকালে কলিকাতায় পৌঁছিয়াই মুচীপাড়ার থানার ইন্সপেক্টর সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দশজন পুলিশ কনস্টেবল সঙ্গে লইয়া দেল্‌খোস বিবির লেনে উপস্থিত হইলাম। গোবর্ধন ঠাকুরের কাঠগোলা বাহির করিতে বিলম্ব হইল না, ভূষণকে সনাক্ত করিয়া গ্রেপ্তার করাও সহজে হইয়া গেল, কারণ বর্ধমানে অবস্থানকালীন তাহার আকারাবয়বের বিশেষত্বগুলি পরিচিত লোকদিগের মুখে শুনিয়া লিখিয়া রাখিয়াছিলাম। প্রথমে দেওঘরের চুরির ব্যাপারের সকল কথাই ভূষণ অস্বীকার করিয়াছিল, কিন্তু তারপর হাজতে রাখিয়া দুই একটি তাড়া দিবার পর সে সকলই স্বীকার করিল এবং অপহৃত গহনাগুলিও কাঠগোলাতে পাওয়া গেল।

আমার এই অপরাধী ধরিবার আমূল ইতিহাস শুনিয়া বড়বাবু বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন এবং সেই রাত্রেই দেওঘরে যাত্রা করিয়া চৌর্য কার্যের সাহায্যকারী সেই মুহুরী শ্যামলাল রায়কে গ্রেপ্তার করিবার জন্য আদেশ করিলেন। এই প্রকার অসম্ভাবিত উপায়ে কৃতকার্যতা লাভ করিয়া, শ্রমক্লিষ্ট ক্ষীণ শরীরে যেন চতুর্গুণ বল প্রাপ্ত হইলাম এবং একজন সাহায্যকারী ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে লইয়া সেই রাত্রেই পুনরায় দেওঘরে যাত্রা করিলাম।

পরদিন প্রাতে দশটার সময় দেওঘরে পৌঁছিয়া, স্থানীয় থানা হইতে কয়েকজন কনস্টেবল সঙ্গে লইয়া, বনমালী চৌধুরীর বাসায় উপস্থিত হইলম। শ্যামলাল রায় মুহুরী মহাশয় তখন একজন দেনদারের সুদের হিসাব করিতেছিলেন ; আমি তাঁহাকে আইন মত অপরাধের কথা বলিয়া গ্রেপ্তার করিলাম। এ কথা কর্তার কর্ণগোচর হইতে অধিক বিলম্ব হইল না। তিনি কতকগুলা বাজে কথা বলিয়া আমাদিগকে নিরস্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। আমি তাঁহাকে পার্শ্বের ঘরে লইয়া গিয়া, চুরির আমূল ইতিহাস বর্ণন করিলাম এবং মুহুরী মহাশয়ের নামীয় সেই চিঠিখানিও দেখাইলাম । বলা বাহুল্য, সেই পত্র হইতে কি প্রকারে আমি ভূষণদাসের সন্ধান পাইয়াছিলাম তাহা প্রথমে বুঝিতে পারেন তারপর ‘খ চ খ ক ক ইত্যাদি’ অক্ষরাঙ্কিত সেই কাগজখণ্ডের সাহায্যে যে পত্রখানি পড়িতে হইবে তাহা বুঝাইয়া দিলাম, বাঙ্গালা বর্ণমালার দ্বিতীয় অক্ষর ‘খ-এর অর্থ প্রথম ছত্রস্থ দ্বিতীয় শব্দ ‘আমি’ এবং তৎপরবর্তী বর্ণমালার ষষ্ঠ অক্ষর ‘চ’ যে পত্রের দ্বিতীয় ছত্রস্থ ষষ্ঠ শব্দ ‘জিনিস’ বুঝাইতেছে এবং এই প্রকারে যে পত্র পাঠ করিতে হইবে, চৌধুরী মশায়কে বেশ বুঝাইয়া দিলাম। কর্তা তখন স্বয়ং পত্রের প্রত্যেক ছত্র হইতে পূর্বোক্ত প্রকারে নিদিষ্ট শব্দগুলি বাহির করিয়া পত্র পাঠ করিয়া আমার বুদ্ধির যথেষ্ট প্রশংসা করিলেন।

অপরাধী শ্যামলাল রায়কে হাজতে পাঠাইয়া, আমরা সেদিন চৌধুরী মহাশয়ের বিশেষ অনুরোধে দেওঘরে অবস্থান করিলাম।

পরদিন কলিকাতায় গিয়া শুনিলাম, বর্ধমানের হত্যাকারী এবং দেওঘরের চোর ধৃত করার পুরস্কার স্বরূপ, একটি সত্তর টাকা মাহিয়ানার পদে আমার উন্নতি হইয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *