1 of 2

অদ্ভুত হত্যা – রজনীচন্দ্র দত্ত

অদ্ভুত হত্যা – রজনীচন্দ্র দত্ত

কৃত্রিম-মুদ্রা প্রস্তুত করিবার অপরাধে অভিযুক্ত কোন ব্যক্তির সম্বন্ধে বিশেষ অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে ময়মনসিংহ অঞ্চলে যাইতে হইয়াছিল। প্রায় সপ্তাহ কাল তথায় থাকিয়া সে মোকদ্দমার যথাসম্ভব প্রমাণাদি সংগ্রহ করিয়া গোয়ালন্দ-ট্রেনে রাত্রে কলিকাতা প্রত্যাবর্তন করি। পরদিন প্রাতঃকালে কাগজপত্র গুছাইয়া রিপোর্টাদি লিখিয়া নিজের কোন প্রয়োজন বশত জনৈক বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে যাইবার উদ্যোগ করিতেছি, সময় সময়ে একজন কনেস্টবল যথারীতি লম্বা সেলাম ঠুকিয়া, একখানা সরকারী চিঠি আমার হস্তে প্রদান করিল। চিঠির উপরে লাল কালিতে বড় বড় ইংরেজি অক্ষরে লিখিত ‘অতি দরকারি’—এ দুটি কথা সর্ব-প্রথমে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। কনেস্টবলকে বিশ্রাম ঘর দেখাইয়া দিয়া, ত্রস্ত হস্তে চিঠি খুলিয়া পত্র পড়িতে লাগিলাম। পত্রে প্রধান কর্মচারী যাহা লিখিয়া পাঠাইয়াছেন, তাহার সারমর্ম এই—

‘আজ চারি দিবস গত হইল, মির্জাপুর স্ট্রিটের একটি ছাত্রাবাসে মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একটি ছাত্র অতি আশ্চর্যরূপে হত হইয়াছে। পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও এ পর্যন্ত খুনের কিনারা করিতে পারে নাই। তুমি মুহূর্তমাত্র গৌণ না করিয়া উক্ত হত্যা ব্যাপারের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবে। মুচিপাড়া থানার পুলিশ কর্মচারী হত্যা ব্যাপারে প্রথম অনুসন্ধান করিয়াছে।’

পত্রখানি পাঠ করিয়া আমার বন্ধুদর্শনবাসনা পলকে বিলুপ্ত হইল। সেই কৃত্রিম মুদ্রার জটিল মোকদ্দমার গুরুভার হইতে মুক্ত হইতে না হইতে আবার এক হত্যাকাণ্ডের গুরুতর ভার মস্তকে বহন করিতে হইবে ভাবিয়া মন অবসন্ন হইয়া পড়িল। কিন্তু উর্ধ্বতন কর্মচারীর আদেশ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমাকে প্রতিপালন করিতে হইবে, সুতরাং আর ইতস্তত না করিয়া কনেস্টবলকে বিদায় দিয়া গাড়োয়ানকে গাড়ি প্রস্তুত করিতে আদেশ করিলাম এবং কিঞ্চিৎ জলযোগান্তে অবিলম্বে মুচিপাড়া থানায় উপস্থিত হইলাম। সেখানকার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে বড় সাহেবের লিখিত পত্রের মর্ম জ্ঞাত করাইলে তিনি আমাকে উক্ত হত্যা ব্যাপারের প্রধান অনুসন্ধানকারী কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া দিলেন। অনুসন্ধানকারী কর্মচারীর নাম সুশীলবাবু; সুশীলবাবু আমার পূর্ব পরিচিত। ইনি আমাকে হত্যা সম্বন্ধে নিজ তদন্তে যতদূর তথ্য সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিলেন, তাহা একে একে সন্তুষ্টির সহিত সমস্ত বর্ণনা করিলেন। হত্যাসংক্রান্ত আমূল বিবরণ শুনিয়া আমি বুঝিতে পারিলাম, এ ব্যাপারের কিনারা করা বড় সহজ-সাধ্য নহে। পুলিশানুসন্ধানে এ সম্বন্ধে যতদূর জানা গিয়াছে, তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রকটিত হইল—

‘মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি বিক্রমপুর অঞ্চলের বজ্রযোগিনী গ্রামে। ইঁহার পিতার নাম ৺হরপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। মহেশ কলিকাতা সিটি কলেজের দ্বিতীয়-বার্ষিক শ্রেণীতে অধ্যয়ন করিতেন। মির্জাপুরের এক স্টুডেন্ট মেসে ইঁহার বাসা ছিল। ৺শ্রীশ্রীদুর্গা পূজার বন্ধে সেই মেসের অধিকাংশ ছাত্রই বাড়ি চলিয়া গিয়াছিল, কেবল তিনজন বি. এ. পরীক্ষার্থীর সহিত মহেশচন্দ্র বন্ধের সময়ও সেই মেসেই ছিলেন। মেসের দালানটি দ্বিতল; উপরে চারিটি ঘর, নিচে দুটি। মেসে অধিক ছাত্র না থাকায়, পড়াশুনার সুবিধার নিমিত্ত চারিটি ঘরে চারিজন ছাত্র শুইবার বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছিলেন। নিচের একটি ঘরে রান্না; এবং অপরটিতে খাওয়া-দাওয়ার কার্য সম্পন্ন হইত। মেসে এক্ষণে একটি মাত্র ব্রাহ্মণ দ্বারাই সর্ব কার্য চালিত হয়। ব্রাহ্মণটি রাত্রে মেসে থাকে না। ২৬শে আশ্বিন রাত্রিতে, মহেশচন্দ্রকে অন্যান্য রাত্রির ন্যায় সকলে সুস্থ শরীরে আপন ঘরে পড়িতে দেখিয়াছেন। পর দিবস প্রত্যূষে, অতুলবাবু নামে ওই মেসেরই অন্যতম ছাত্র যখন মহেশচন্দ্রের ঘরের মধ্য দিয়া নিম্নতলে যাইতেছিলেন, তখন তাহাকে ছিন্ন-কণ্ঠ, রক্তাক্ত কলেবর দেখিতে পাইয়া উচ্চ চিৎকারে সকলকে সেখানে একত্র করেন। পরে, তথায় উপস্থিত সকলের পরামর্শ মত অগৌণে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ অনুসন্ধান করিয়া সে ঘরে একখানা রক্ত-রঞ্জিত বড় কাটারি ও একপাটি নাগ্‌রা জুতা প্রাপ্ত হইয়াছেন। এগুলি ইতিপূর্বে মেসের কেহ কখনও দেখে নাই। হত্যাকারীর এ পর্যন্ত কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। আশ্চর্যের বিষয়, হত্যাগৃহের একটি সামান্য জিনিস কিম্বা একটি কপর্দকও স্থানান্তর হয় নাই। মহেশের চাবি তাহার পকেটে পাওয়া গিয়াছে; উক্ত চাবি দ্বারা পুলিশ মহেশের পোর্টমেন্ট ও হাত বাক্স খুলিয়া টাকা পয়সা মহেশের লিখিত হিসাবের মিল মতনই পাইয়াছেন।

‘মহেশের সহিত যে সে মেসে কাহারও মনোমালিন্য বা বিবাদ ছিল, এমনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনটি ছাত্র ও ব্রাহ্মণের ‘জবানবন্দি’তে হত্যার অনুসন্ধানে কার্যকরী হইতে পারে, এরূপ কোন কথাই প্রকাশ পায় না। ইঁহাদের কেহ কাহাকে মহেশের হত্যাকারী বলিয়া সন্দেহ করেন না। পরন্তু মহেশের সহিত সকলেরই সদ্ভাব ছিল বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায়।’

পুলিশের এই রিপোর্ট দেখিয়া এবং ব্রাহ্মণ ও ছাত্রত্রয়ের জবানবন্দি আনুপর্বিক মনোযোগ সহকারে পাঠ করিয়া অনুসন্ধানের কোন সূত্রই বাহির করিতে পারিলাম না। তবে জুতা ও কাটারিখানা দেখিতে হইল। সুশীলবাবু তৎক্ষণাৎ সেগুলি আমার সমক্ষে উপস্থিত করিলেন। আমি তখন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পাইলাম, রক্তাক্ত কাটারিখানা অপূর্বব্যবহৃত। জুতাখানিও একেবারে অব্যবহৃত বলিয়াই বোধ হইল। উহা পায়ে দেওয়ার কোন চিহ্নই পরিলক্ষিত হইল না। সুতরাং এগুলি অনুসন্ধানের পক্ষে কোন সহায়তা করিবে, এরূপ মনে করিতে পারিলাম না। আমি সেখানে আর বেশি সময় অপেক্ষা না করিয়া সেই মেসটি দেখিতে মনস্থ করিলাম এবং সুশীলবাবুর সহিত সেই মেসে যাইয়া উপস্থিত হইলাম।

তখন পূজোপলক্ষে স্কুল কলেজাদি বন্ধ ছিল, সুতরাং সকলকেই বাসায় প্রাপ্ত হওয়া গেল। আমি প্রথমে হত্যাগৃহ এবং তৎপরে মেসের অন্যান্য স্থান যথারীতি পরীক্ষা করিলাম; কিন্তু হত্যা সম্বন্ধে কোন নূতন তথ্যই সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলাম না। পরিশেষে আমি হত্যাগৃহে প্রথম উপস্থিত সেই অতুলবাবুকে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং উত্তর আমার নোট-বহিতে লিখিয়া লইলাম।

আমি। আপনি সে দিন প্রাতেই প্রথম সে কক্ষে পদার্পণ করিয়াছিলেন, না, রাত্রে সে কক্ষের ভিতর দিয়া আর কোন বার নিচে নামিয়াছিলেন?

অতুলবাবু। না, সেই প্রথম আমি সে কক্ষে প্রবেশ করি।

আমি। যে রাত্রে মহেশ খুন হয়, সে রাত্রে সর্বশেষ তাহাকে কে জীবিত দেখিয়াছিলেন?

অ বাবু। সর্বশেষ কে জীবিত দেখিয়াছিলাম, মনে নাই। আমরা সকলেই একসঙ্গে নিচের ঘর হইতে উপরে আসিয়া আপন আপন কক্ষে পড়িতে বসিয়াছিলাম।

আমি। আপনারা সেদিন শয়ন করিবার পূর্বে আর নিচে যান নাই?

অ বাবু। আমি সেদিন আর নিচে যাই নাই।

আমি তখন আর দুজনকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম, তাঁহারা তদুত্তরে বলিলেন; সে রাত্রে তাঁহাদের কাহারও নিচে যাইবার প্রয়োজন হয় নাই। আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম:

‘আপনাদের মেসের ছাত্রগণ ব্যতীত অন্য কাহারও সহিত মহেশবাবুর বিশেষ জানাশুনা ছিল বলিয়া আপনারা জানেন?’

অ বাবু। মহেশবাবুর বিশেষ বন্ধু তো কেহ দেখিতে পাই না।

আমি। মহেশবাবুর কাহারও সহিত শত্রুতা বা মনোবিবাদ ছিল, বলিতে পারেন?

অ বাবু। না, মহাশয়, তাঁহার সহিত কাহারও শত্রুতার কথা আমরা পরিজ্ঞাত নহি।

আমি। হত্যার দিনে মহেশবাবু সমস্ত দিবস কি মেসেই ছিলেন, না, কোথাও বাহির হইয়াছিলেন?

অ বাবু। (খানিক চিন্তার পর) হ্যাঁ, মহেশবাবু সেদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পরে বাহিরে গিয়াছিলেন।

আমি। কোথায় গিয়াছিলেন, বলিতে পারেন?

অ বাবু। না, তাহা বলিতে পারি না।

আমি। মহেশবাবুর কি বেড়াইবার অভ্যাস ছিল?

অ বাবু। মধ্যে মধ্যে বেড়াইতে যাইতেন বৈকি!

আমি। হত্যার তারিখে কোন্‌ সময়ে বাসায় প্রত্যাবর্তন করেন?

অ বাবু। বোধ হয় রাত্রি ৭॥টা, কি ৮টার সময়।

আমি। মহেশবাবুর স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল, আপনার বিশ্বাস?

অ বাবু। (একটু বিরক্তির সহিত) ওগুলি কি বলিব?

আমি তখন অপেক্ষাকৃত গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলাম, ‘দেখুন, আপনারা সকলেই বিদ্বান ও বুদ্ধিমান। অবশ্য বুঝিতে পারিতেছেন, এ হত্যার কিনারা করা বড় সহজ সাধ্য নহে। কেহ অর্থলোভে এ নৃশংস কাণ্ড সম্পন্ন করিয়াছে, অবস্থা পর্যবেক্ষণে, এমন বিশ্বাস আমি করিতে পারিতেছি না। ঈর্ষামূলেই বোধহয় এ লোমহর্ষণ হত্যা সংসাধিত হইয়াছে। এক্ষণে যদি আমি হত ব্যক্তির সম্বন্ধে সমস্ত কথা অবগত হইতে না পারি, তবে প্রকৃত দোষীর অনুসন্ধান কিরূপে করিতে সমর্থ হইব? আর অবশ্য ইহাও আপনারা বুঝিতে পারিতেছেন, যদি কোন প্রকারেই এ হত্যার কূল-কিনারা করা না যায়, তবে পুলিশ শেষ কালে আপনাদের লইয়াই টানাহিচ্‌ড়া করিতে পারে। কে জানে, আপনাদের কেহ এ ব্যাপারে বিজড়িত নহেন? এ বাড়িতে অপর কেহ বাস করে না,মহেশবাবুর সহিত অন্য কাহারও শত্রুতা ছিল না একথা আপনারাই বলিতেছেন; এমতাবস্থায় কাহার উপর প্রথম সন্দেহদৃষ্টি পড়িতে পারে, তাহা আপনারাই ভাবিয়া দেখুন। হত্যাগৃহে প্রাপ্ত কাটারিখানি সম্পূর্ণ নূতন, সুতরাং হত্যাকারী যে পুরাতন-পাপী নহে, ইহাই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তবে—একপাটি নাগরাজুতা পাওয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু কে বলিতে পারে ইহা আপনাদের চালাকি নয় ?’

আমি এতদূর বলিলে ছাত্রবাবুটি অপেক্ষাকৃত কাতরস্বরে বলিলেন, ‘ক্ষমা করুন মহাশয়, আমি যাহা জানি, বলিতেছি। আমার বিশ্বাস মহেশবাবু নিষ্কলঙ্ক চরিত্র ছিলেন না।’

আমি। কাহার সঙ্গে, কোথায়, মহেশবাবুর আসা যাওয়া ছিল, বলিতে পারেন?

অ বাবু। সে সম্বন্ধে কিছুই বলিতে পারি না। তবে তিনি মধ্যে মধ্যে অনেক রাত্রির পর বাসায় আসিতেন এবং মাঝে মাঝে একটি ঝি শ্রেণীর স্ত্রীলোক তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিত।

আমি। ঝির ঠিকানা আপনি জানেন?

অ বাবু। না, মহাশয়, ঠিকানা জানি না।

আমি। ঝিকে দেখিলে চিনিতে পারিবেন?

অ বাবু। হ্যাঁ, পারিব বৈকি? হত্যার তারিখেও দিনের বেলায় ঝি তাহার নিকট আসিয়াছিল।

আমি। যেদিন হত্যার কথা জানিতে পান, সেদিন প্রথমে কে সদর দরজা খুলিয়াছিলেন?

অ বাবু। সম্ভবত সদর দরজা খোলা ছিল।

আমি। সদর দরজার খিলান তো অভগ্ন; তবে হত্যা কিরূপে সংঘটিত হইল, আপনাদের বিশ্বাস?

অ বাবু। সদর দরজা মধ্যে মধ্যে খোলাও থাকে। বোধ হয় সে রাত্রে আমরা কেহ দরজা ভেজাই নাই। বামনটি চলিয়া গেলে, কোনদিন দরজা ভেজান যায়, কোনদিন বা যায় না।

আমি। বামনটি কেমন, কতদিন যাবৎ এখানে কাজ করিতেছে?

অ বাবু। অনেক দিন। বামনটি খুব বিশ্বাসী; সে আমাদের বড় যত্ন করে।

আমি এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিয়া লইয়া সুশীলবাবুর সহিত মেস হইতে বহির্গত হইলাম। তখন বেলা ১টা বাজিয়া গিয়াছে। সুতরাং আর থানায় না যাইয়া, সুশীলবাবুকে আমহার্স্ট স্ট্রিটে গাড়ি হইতে নামাইয়া দিয়া, বরাবর বাসাভিমুখে অগ্রসর হইতে গাড়োয়ানকে আদেশ করিলাম।

আমি অনুসন্ধানের সূত্র উদ্ভাবনার্থ যতই চিন্তা করিতে লাগিলাম, প্রথমে ততই নিরাশা-সাগরে নিমগ্ন হইতে আরম্ভ করিলাম। আমি বুঝিয়া উঠিলাম না, এ হত্যা কাহার দ্বারা সাধিত হইয়াছে। ধনাপহরণ মানসে কি এ হত্যা সংঘটিত হওয়া সম্ভব? তাহা হইলে এক গাছি তৃণেরও বিপর্যয় ঘটিল না কেন? শুনিয়াছি, মহেশের চরিত্র ভাল ছিল না, তবে কি অপর কোন মন্দ-চরিত্র প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বারা এ কার্য সম্পন্ন হইয়াছে? অসম্ভব কি? কিন্তু সে ব্যক্তির অনুসন্ধান কিরূপে করিব? মেসের কেহ তো কুচরিত্র নহে? সদর দরজার খিলান অভগ্ন; এমতাবস্থায় সহজে বাহিরের লোকে কিরূপে ভিতরে প্রবেশ করিবে? কিন্তু যদি সদর দরজা সে রাত্রে খোলাই থাকে, তবে এই এক কথার উপর নির্ভর করিয়া মেসস্থ ছাত্রদিগকে দোষী সাব্যস্থ করা তো যুক্তিযুক্ত নহে। আচ্ছা, একটা লোক একই বাড়িতে খুন হইল, আর বাড়ির অপর কেহই ইহার বিন্দু বিসর্গও জানিতে পারিল না, ইহা বা কি প্রকারের কথা? হত্যাগৃহে একখানা নাগরা জুতা প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, তবে কি হত্যাকারী কোন হিন্দুস্থানী? কিন্তু তাহা হইলে জুতাখানি একেবারে অব্যবহৃত থাকিবার কারণ কি? এ জুতা পায়ে দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তো। কিছুতেই বোধ হয় না।

মেসের ছাত্র হইতে জানিলাম, একটি ঝি মহেশের কাছে আসা যাওয়া করিত, হত্যার তারিখেও আসিয়াছিল; সে ঝি কে? তাহার সন্ধানের উপায় কি?—এবম্বিধ নানা প্রশ্ন ক্রমে ক্রমে মনে উদিত ও লয়প্রাপ্ত হইতে লাগিল। শেষে যখন আর ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছু স্থির করিতে পারিলাম না; কোন্ সূত্রাবলম্বনে অনুসন্ধান কার্য আরম্ভ করিব, তাহার কিছুই নির্ধারণ করিতে সমর্থ হইলাম না; তখন অগত্যা তখনকার মত এই সিদ্ধান্ত করিলাম যে, আজ রজনীযোগে গুপ্তভাবে মির্জাপুরের সেই ছাত্রাবাসে ছাত্রদিগের কথাবার্তা শুনিতে চেষ্টা পাইব। যদি প্রকৃত প্রস্তাবে ইহারা হত্যা ব্যাপারে সংসৃষ্ট থাকে কিম্বা এ সম্বন্ধে কিছু পরিজ্ঞাত থাকে, তবে খুব সম্ভবত ইহাদিগের মধ্যে আজ এ বিষয়ের গোপনীয় কথাবার্তা চলিতে পারে। তখন বোধ হয়, হত্যা সম্বন্ধে কিছু না কিছু সন্ধান পাইতে পারিব।

এইরূপ স্থির করিয়া স্নানাহার সমাপনান্তে শয্যায় পড়িয়া একটু বিশ্রাম ভোগ করিতেছি, এমন সময়ে হঠাৎ মনে পড়িল, এ হত্যা সম্বন্ধে ডাক্তার সাহেব কি অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা আমি এ পর্যন্ত জানিতে পারি নাই। অনুসন্ধান কার্য আরম্ভ করিবার পূর্বে এ তথ্যটি জানিয়া লওয়া আমার পক্ষে একান্ত কর্তব্য;—এই মনে করিয়া তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান পূর্বক ‘ধরা চূড়া’ পরিধান করিয়া পুনরায় মুচিপাড়া থানাভিমুখে রওনা হইলাম।

যথাকালে মুচিপাড়া থানায় পহুঁছিয়া সরকারি ডাক্তারের রিপোর্ট পাঠে যাহা অবগত হলাম, তাহাতে সন্দেহ আরো বর্ধিত হইল। ডাক্তার বলেন, মৃত্যুর পূর্বে হত ব্যক্তিকে ক্লোরোফর্ম প্রয়োগে হৃতচেতন করা হইয়াছিল। পরে অজ্ঞানাবস্থায় তীক্ষ অস্ত্রাঘাতে ইহাকে হত্যা করা হইয়াছে। কি ভয়ানক কথা! জীবিতাবস্থায় হত্যা করিলে পাছে আহত ব্যক্তির আর্তনাদে অন্যান্য লোক জাগরিত হইয়া পড়ে, এজন্য পূর্বাহ্নে সাবধান হইয়া হত্যাকারী ইহার উপর বিষ প্রয়োগ করিয়াছিল! হত্যাকারী তবে তো নিতান্ত সামান্য ব্যক্তি নহে! মেসেরই কোন ছাত্র কি তাহা হইলে আন্তরিক বিদ্বেষবশে, গুপ্ত কারণে, অপর সকলের অজ্ঞাতে এরূপ সাবধানতা সহকারে হত্যাকাণ্ড সমাধা করিল? সন্দেহ ক্রমে দৃঢ় হইতে লাগিল। এ সময়ে একবার মহেশের মৃতদেহ দেখিতে ইচ্ছা হইল, কিন্তু সে সুবিধা ঘটিয়া উঠিল না। আমার কলিকাতা পহুঁছিবার বহু পূর্বেই, ডাক্তারের পরীক্ষার পর উক্ত মৃতদেহের সৎকার হইয়া গিয়াছিল।

নানা বিষয়িণী চিন্তার পর অবশেষে আমি প্রথম অনুসন্ধানকারী কর্মচারী সুশীলবাবুর সহিত পুনর্বার সাক্ষাৎ করিলাম। এবং তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সুশীলবাবু, কি সূত্রে অনুসন্ধান কার্য আরম্ভ করিব?’

সুশীলবাবু হাসিয়া উত্তর করিলেন, ‘সূত্র বাহির করিবার জন্যই তো টিক্‌টিকির প্রয়োজন।’

সুশীলবাবু ডিটেকটিভকে টিক্‌টিকি বলিতেন। আমি পুর্নবার জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনি সেদিন ঘর তল্লাসের সময় কাহারও কাছে ক্লোরোফর্ম আছে কি না, অনুসন্ধান করিয়াছিলেন কি?’

সুশীল বলিলেন, ‘না, আমরা তো তখন জানিতাম না যে হত ব্যক্তির উপর প্রথমে ক্লোরোফর্ম প্রযুক্ত হইয়াছিল।’

আমি তখন হাসিয়া বলিলাম, ‘অনুসন্ধানের সকল সুযোগ আমি কলিকাতা আসিবার পূর্বেই শেষ হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং এখন এ অদ্ভুত হত্যা সম্বন্ধে তদন্ত করিয়া কৃতকার্যতার আশা করা বিড়ম্বনা মাত্র।’

ইহার উত্তরে সুশীলবাবু বলিলেন, ‘ভাল মনে পড়িল—সেদিন মহেশচন্দ্রের হাতবাক্স অনুসন্ধানের সময় ইহার ভিতরের কতকগুলি চিঠি পত্র আমি সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিলাম, অবকাশাভাবে সেগুলি এ পর্যন্ত পড়ি নাই। আপনার ইচ্ছা হইলে আপনি তাহা পড়িয়া দেখিতে পারেন, যদি কোন সূত্র বাহির হয়।’

এই বলিয়া তিনি কতকগুলি বিশৃঙ্খল চিঠিপত্র আনিয়া আমার সম্মুখস্থ টেবিলে ফেলিয়া চলিয়া গেলেন। আমিও তখন আর কিছু করিবার নাই ভাবিয়া সেগুলি হইতে এক-একখানি পত্র লইয়া আগ্রহ সহকারে আপন-মনে পড়িতে লাগিলাম। পাঁচ-সাতখানি চিঠির পর একখানি চিঠি পাঠ করিয়া আমি একেবারে চমকিয়া উঠিলাম। চিঠিখানি অবিকল এইরূপ—

—নং হাড়কাটা গলি।

২৬শে আশ্বিন।

প্রাণের মহেশ,

তুমি’আর এখন আসিতেছ না কেন? বিধুবাবুর সহিত ঝগড়া করিয়া আমায় পরিত্যাগ করা কি তোমার উচিত? আজ যা হয়, একটা হইয়া যাইবে। বিধুবাবু বাড়াবাড়ি করিলে, তাহাকে আমার কাছে আসিতে বারণ করিব। আমার কুন্তলীন একেবারে ফুরাইয়া গিয়াছে। দেলখোস নামে নাকি এক প্রকার নূতন এসেন্স বাহির হইয়াছে, দেখিতে পাই কি? ঝিকে পাঠাইলাম, তুমি আজ অবশ্য অবশ্য আসিবে, অন্যথা না হয়। ইতি।

তোমারই ভালবাসার।

নলি—।’

পত্রখানা দুইবার পড়িয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। পত্রের তারিখ দেখিয়া অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পাইল। এ পত্রে ঝির সন্ধান পাইলাম। বিধুবাবু নামে কোন ব্যক্তির সহিত মহেশের মনোমালিন্য ছিল, পত্র পড়িয়া বুঝিতে পারিলাম। এক্ষণে যেন অনুসন্ধানের কিছু কিছু সূত্র বাহির হইল, মনে করিলাম। আমি আর বিলম্ব না করিয়া ধড়াচূড়া ছাড়িয়া একটি ফিট্‌ বাঙ্গালী বাবু সাজিলাম। তাহার পর চিঠিখানা পকেটে পুরিয়া, আমার প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত গড়োয়ানকে সেখানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া পদব্রজে রাস্তায় বাহির হইলাম।

হাড়কাটা গলির সেই বাড়ি খুঁজিয়া বাহির করিতে বিশেষ বিলম্ব হইল না। আমি একেবারে ‘সপাসপ’ উপরে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। তখন অপরাহ্ন পাঁচটা—সন্ধ্যার প্রাক্কাল। গৃহকর্ত্রী বেশভূষা পরিপাটি করিতেছে। আমি চির-পরিচিতের ন্যায় একখানা কেদারা টানিয়া বসিয়া পড়িলাম। যুবতী তখন আমার অভ্যর্থনার্থ তাড়াতাড়ি আপন কার্য সমাধা করিয়া ঝিকে তামাক আনিবার নিমিত্ত আদেশ করিল।

আমি ইত্যবসরে আপন মনে অনুচ্চস্বরে বলিতে লাগিলাম, ‘বিধুবাবুর এতক্ষণ এখানে আসিবার কথা ছিল, কই, তিনি যে আসিলেন না !’

যুবতী উত্তরচ্ছলে বলিল, ‘কই, সে তো আজ কয়দিন আসিতেছে না। সেই যে সে দিন মহেশের সঙ্গে মারা মা—’ এ পর্যন্ত বলিয়া যুবতী আমার মুখের দিকে চাহিল। আমি যেন নিতান্ত অন্যমনস্কভাবে উত্তর করিলাম, ‘তা কাজটা কি ভাল হয়েছিল ? আমি সমস্তই শুনিতে পাইয়াছি। বিধু আমার পরম বন্ধু।’

যুবতী। কই, আপনাকে তো একদিনও এখানে দেখি নাই।

আমি । এতদিন আসিবার প্রয়োজন পড়ে নাই ; তাই আসি নাই ; কিন্তু সেদিনকার ঘটনার পর বিধু প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, সে আর কখনও এখানে একাকী আসিবে না।

যুবতী। তা মহাশয়, আমার দোষ কি বলুন ? বাস্তবিক, সেদিন মহেশের কাজটা ভারি অন্যায় রকমের হয়েছিল। ভদ্রলোকের গায়ে হাত তোলা, জুতো মারা, এগুলি নেহাত ছোটলোকের কর্ম।

এই বলিয়া যুবতী স্বহস্তে প্রস্তুত পানের খিলি দুটি আমাকে প্রদান করিল। আমি সমস্ত ব্যাপার ইতিমধ্যে বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। এক্ষণে আমার মনে হইতে লাগিল, এ জুতোমারা কাণ্ডের প্রতিশোধ লইতে বিধুবাবু নামক ব্যক্তির পক্ষে মানসিক উত্তেজনা-প্রাবল্যে মহেশের জীবনলীলা সাঙ্গ করা একেবারে অসম্ভব নহে। ইহা ২৬শে আশ্বিনেরই ঘটনা। যাহা হউক, অধুনা আমার পক্ষে এই বিধুবাবুর অনুসন্ধান লওয়া বিশেষ প্রয়োজন হইয়া পড়িল ; কিন্তু এখানে আমি বিধুবাবুর বন্ধু বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছি, সুতরাং সোজাসোজি ইহাকে সে কথা জিজ্ঞাসা না করাই যুক্তিযুক্ত মনে করিলাম। ইতিমধ্যে, ঝি-মূর্তি, একটি রূপার হুকা হাতে করিয়া সেই কক্ষে প্রবিষ্ট হইল। এবং আমাকে দেখিয়া বলিল—

‘এটি যে নূতন বাবু!’

যুবতী তদুত্তরে বলিল ‘ইনি বিধুভূষণের বিশেষ বন্ধু !’

ঝি। কোন্‌ বিধুভূষণ ?

যুবতী। অ্যাঁ—নেকি ? মুখুয্যে বিধু—সেই ২১ নম্বর কলুটোলার।

এতক্ষণে সহজেই আমার কার্য সিদ্ধ হইয়াছে ;—আমি ঘটনাক্রমে বিধুর ঠিকানা অবগত হইলাম। সুতরাং আর সেখানে অপেক্ষা করিবার দরকার নাই ভাবিয়া, ঝির কথার উত্তরচ্ছলে অন্যমনস্কভাবে বলিলাম, ‘বিধুবাবুর তো এখনই এখানে আসিবার কথা ছিল, দেরি হইতেছে কেন, বুঝিতে পারিতেছি না। তা, আমি একটু দেখিয়া আসিতেছি এই বলিয়া আমি ‘২১ নং কলুটোলা’ ঠিকানাটা মনে রাখিয়া সে বাড়ি হইতে বহিষ্কৃত হইলাম। এবং অবিলম্বে মুচিপাড়া থানায় আসিয়া পঁহুছিলাম।

তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। আমি আসিয়া দেখি, সুশীলবাবু আমার প্রতীক্ষায় বসিয়া আছেন। আমি যথাসম্ভব সংক্ষেপে তাঁহাকে সকল ঘটনা বুঝাইয়া বলিলে, তখনই বিধুর সম্বন্ধে তদন্ত করা উচিত বলিয়া পরামর্শ স্থির হইল। দুই জন পুলিশ কনেস্টবল, পুলিশ-পোশাক পরিহিত সুশীলবাবু এবং বাঙ্গালীবাবু আমি—শকটারোহণে অগৌণে কলুটোলায় যাইয়া উপস্থিত হইলাম। বলিয়া রাখা ভাল, হত্যাগৃহে প্রাপ্ত কাটারি এবং নাগরা জুতা আমাদিগের সঙ্গে লইয়াছিলাম।

তাহাদিগকে গাড়িতে পথের উপর অপেক্ষা করিতে বলিয়া আমি একাকী সেই ২১নং বাড়িতে প্রবেশ করিলাম। এটি একটি ডিসপেন্সারি। অনুসন্ধানে জানিলাম, সুধীরবাবু নামে জনৈক ভদ্রলোক এ ডিসপেন্সারির স্বত্বাধিকারী। তিনি সপরিবারে ইহারই উপরতলে বাস করেন, নিচের ঘরে ডাক্তারখানা। আরো জানিলাম, সত্য সত্যই বিধুভূষণ নামে উক্ত সুধীরবাবুর এক ভাইপো এ বাড়িতে বাস করেন। তিনি এক্ষণে বেকার অবস্থায়ই আছেন।

আমি যে সময় সেখানে উপস্থিত হইয়াছিলাম, সে সময় ডাক্তারবাবু বাসায় ছিলেন না। সুতরাং ডাক্তারখানার কম্পাউণ্ডারকে বিধুবাবুকে সংবাদ দিতে বলিয়া নীরবে সেখানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

কম্পাউণ্ডার উপরে চলিয়া গেল, এবং অল্প সময়ের মধ্যে আরক্তনয়ন, বিষাদ-বদন, রুক্ষ-কেশ এক যুবক সমভিব্যাহারে সেকক্ষে প্রবিষ্ট হইল। যুবকের মুখাকৃতি ও ভাবগতি সন্দর্শনে আমার মনের দারুণ সন্দেহ একেবারে বিশ্বাসে পরিণত হইল।

আমি একটু ত্রস্ততার সহিত অথচ মৃদুস্বরে যুবককে বলিলাম, ‘আমি হাড়কাটা গলি হইতে আসিয়াছি। পথে গাড়িতে ‘নলি’ অপেক্ষা করিতেছে, আপনি একটু বাহির হইতে পারেন ?’

যুবক সংক্ষেপে উত্তর করিল, ‘আমি আজ বড় অসুস্থ।’

আমি তখন ব্যগ্রভাবে বলিলাম, ‘তবে আপনি একটু এখানেই অপেক্ষা করুন, আমি তাহার নিকট হইতে এই আসিতেছি।’ এই বলিয়া ত্বরিতপদে সদর রাস্তায় আসিয়া পড়িলাম, এবং কয়েক মুহূর্তের পর দলবলসহ সুশীলকে সে বাড়িতে উপস্থিত হইতে উপদেশ দিয়া, পুনরায় ডাক্তারখানায় প্রবেশ করিলাম। এবারে তাড়াতাড়ি আসিয়াই আমি দৃঢ়মুষ্টিতে বিধুর দক্ষিণ হস্ত ধারণ করিয়া, বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে সেই নাগরা জুতাখানি বাহির করিয়া বলিলাম, ‘দেখ দেখি বিধু, তুমি এ জুতা সেদিন রাত্রিকালে মহেশের হত্যাগৃহে ফেলিয়া আসিয়াছিলে কি না!’

আমার কথা শুনিয়া ও ভাবভঙ্গি দেখিয়া বিধু ফ্যাল্‌ফ্যাল্‌ করিয়া আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিল এবং স্বীয় হস্ত ছাড়াইয়া লইবার চেষ্টা পাইল। তখন আমি আমার মুষ্টি দৃঢ়তর করিয়া বলিলাম, ‘সে চেষ্টা বৃথা ; তুমি মহেশের হত্যাকারী, তোমাকে আমি গ্রেপ্তার করিলাম।’

ইত্যবসরে কনেস্টবলসহ সুশীলবাবু সে গৃহে প্রবেশ করিলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম, ‘আসামী গ্রেপ্তার হইয়াছে, এক্ষণে থানায় চলুন।’

বিধু এ সকল দেখিয়া শুনিয়া একেবারে দমিয়া গেল। আমি তাহাকে লক্ষ্য করিয়া পুনর্বার বলিতে লাগিলাম, ‘দেখ বিধু, আমি সমস্তই জানিতে পারিয়াছি ; তুমি হাড়কাটা গলিতে ‘নলির’ বাড়ি মহেশ কর্তৃক প্রহৃত ও অবমানিত হইয়া প্রতিশোধ লইবার মানসে, উত্তেজনাবশে, সেদিনই মহেশকে খুন করিয়াছ। এ বিষয়ের সমস্ত প্রমাণাদি আমি সংগ্রহ করিয়াছি, এক্ষণে চল, তোমাকে হাজতে লইয়া যাইব।’

আমি এতটুকু বলিয়া দেখিলাম, বিধু আমার সমস্ত কথা শুনিতেছে কি না সন্দেহ। কারণ, ক্রমে যেন তখন তাহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইতে আরম্ভ করিল।

তদনন্তর আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘বিধু, তুমি এক্ষণে কি বলিতে বা করিতে চাও ? ’

সে ভাঙা ভাঙা স্বরে উত্তর করিল, ‘মহাশয়, আমার কিছু বলিবার বা করিবার নাই। পাপ গোপনে থাকে না। পাপের ফল অবশ্যই ভুগিতে হইবে ; চলুন, আমি কোথায় যাইব।’

আমি বলিলাম, ‘তুমি হত্যাপরাধ স্বীকার করিতেছ ? ’

সে উত্তর করিল, ‘আর মিথ্যা বলিব না ; আমি হত্যা করিয়াছি।’

আমরা সেখানে বসিয়াই উপস্থিত কতিপয় ভদ্রলোক সমক্ষে বিধুর স্বীকারোক্তি এবং তৎকর্তৃক বর্ণিত হত্যার আমূল বিবরণ লিপিবদ্ধ করিলাম।

অবমানিত হইয়া, উত্তেজনা-বশে যে এ ভীষণ কার্যে ব্রতী হইয়াছিল ; মহেশ যাহাতে চিৎকার করিতে না পারে, তজ্জন্য যে পূর্বাহ্নেই ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করিয়াছিল ; অনুসন্ধানকারীকে বিপথে চালিত করিবার জন্য যে হত্যাগৃহে স্বেচ্ছাপূর্বক নাগরাজুতা রাখিয়া আসিয়াছিল, একে একে এ সমস্তই বিধু স্বীকার করিল। এইরূপে বিধুর জবানবন্দি সমাপ্ত হইলে আমরা তাহাকে থানায় লইয়া চলিলাম।

বলা বাহুল্য, এই অদ্ভুত-হত্যার মোকদ্দমা দায়রা সোপর্দ হইল, এবং দায়রায়, জজ সাহেব ও জুরির বিচারে, বিধুভূষণ চিরনির্বাসন দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *