1 of 2

বহুরূপী (বাঁকাউল্লার দপ্তর) – কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়

বহুরূপী (বাঁকাউল্লার দপ্তর) – কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়

চেহারা জাল! আকার জাল! মানুষ জাল!

চাকরি করিবার সময় আমি কৃষ্ণনগরেই অনেকদিন ছিলাম। বাসা ছিল চাঁদসড়কে। আমাদের বাসার নিকটেই তারণ তাঁতির বাস। তাঁতি নাই; একটি সতের আঠার বৎসর বয়সের পুত্র আর পঁচিশ বৎসরেরএক বিধবা কন্যা স্ত্রীর গলায় রাখিয়া তারণ পরলোকে গমন করিয়াছে; সোনার সংসার কষ্টের সংসার হইয়াছে। তারণ, পুত্রকে দিনকতক পড়িতেও দিয়াছিল, ছেলেটি মানুষ হয় নাই। গোপাল সারাদিনই এখানে ওখানে ঘুরিয়া বেড়ায়—গায়ে সামর্থ্য আছে, গুণ্ডামী-ষণ্ডামী করে; নেশা ভাং করিতেও শিখিয়াছে। থাকেও এক মাগীর আটচালায়। গোপাল উপার্জন করে না, বরং মধ্যে মধ্যে বাটী আসিয়া উপদ্রব করে, যাহা পায় লইয়া যায়,—কিছু দিন দেখাই দেয় না। গোপাল আমাকে বড় মান্য করে, উপদ্রব কালে আমার নাম করিলে সে ক্ষান্ত হয়। দেখা হইলে, তাহাকে দুই একটি উপদেশ দি। বুড়া মা, বিধবা ভগ্নী গলায়; প্রতিপালন করিবার উপায় অবলম্বন করিতে বলি। গোপাল একটু নরম হয়। বাসায় আসিলেই সকলের আগে গোপালদের সংবাদ লই। চলাচলের কথা জিজ্ঞাসা করি। গোপাল দাদা বলিয়া ডাকে, সে সূত্রে আত্মীয়তাও জন্মিয়াছে।

সেদিন তদন্ত হইতে বাসায় ফিরিয়া গোপালের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। প্রায় তিন মাস ছিলাম না; দীর্ঘকালের সরেওয়ার সংবাদ লইবার জন্য গোপালের বিধবা ভগ্নী সুখময়ীকে ডাকিলাম। সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘আজ তিন মাস তাহার সংবাদ নাই। সে যে কোথায় গিয়াছে, কেহ জানে না! মা সেই হইতেই অন্নজল ত্যাগ করিয়াছে।’

ভাল হউক মন্দ হউক—পুত্র তো বটে।—অন্নজল ত্যাগ করিবারই কথা; কিন্তু সুখী এ বলে কি? তিন মাস গোপাল এখানে নাই? হতভাগা তবে গেল কোথায়?

সুখময়ী বলিল, ‘দাদা, তুমি তো কোম্পানির লোক, তুমি আমার ভাইকে আনিয়া দাও। তুমি মনে না করিলে তাহাকে পাওয়া যাইবে না।’

আমি কোথায় পাইব? তথাপি তাহাকে প্রবোধ দিয়া বিদায় করিলাম। বাস্তবিকই ছোঁড়া তবে গেল কোথায়? চিন্তিত রহিলাম।

শহরে গিয়াছিলাম। শহর মুর্শিদাবাদে গিয়াছিলাম। বড় সাহেব আসিয়াছিলেন, ঠগী ও ডাকাতি নিবারণ জন্য গোপনে প্রকাশ্যে যে সকল পুলিশ নিযুক্ত আছে, বড় সাহেবকে সেলাম দিবার জন্য তাহারা শহরে একত্র হইয়াছিল, ‘আমিও গিয়াছিলাম, সাত আট দিন ছিলাম।

খাগড়া হইতে সওদাবাদ যে রাস্তা গিয়াছে, সেই রাস্তা দিয়া একদিন খাগড়া হইতে সওদাবাদের দিকে যাইতেছি; সম্মুখেই দেখি গোপাল! গোপালের সঙ্গে আরও তিন চারটি লোক। বহুদিনের চেনা পরিচয়, আমাকে দেখিয়াই গোপাল মুখ ফিরাইল। মুখ ফিরাইতেই গোপালের সঙ্গীরা তাহাকে ধরিয়া লইয়া একটু দ্রুতপদে চলিল। আমি ডাকিলাম, ‘গোপাল!’ গোপাল উত্তর দিল না, আরও দ্রুত চলিতে লাগিল। আমিও দ্রুতপদে চলিলাম। ভাবিতে লাগিলাম, গোপাল বাড়ি হইতে পলাইল কেন? আমাকে দেখিয়াই বা কথা কহিল না কেন? কুকার্য করিয়াছে, না বলিয়া বাড়ি হইতে চলিয়া আসিয়াছে—হঠাৎ আমার সম্মুখে পড়িয়া হয়তো বড় লজ্জিত হইয়া পড়িয়াছে। লজ্জার খাতিরে কথা কহিতে পারে নাই। যাহা হউক, ধরিতে হইবে। হতভাগাকে বাড়ি লইয়া যাইতে হইবে। প্রাণপণে গোপালের অনুসরণ করিতে লাগিলাম।

সঙ্গীরা চলিতেছে। চলিতে চলিতে পিছন ফিরিয়া ফিরিয়া দেখিতেছে, আবার চলিতেছে। ইহারা কতদূর যাইবে? সওদাবাদ ছাড়াইলাম। সন্ধ্যা হয়—আর বিলম্ব নাই; আর কতদূর যাইব? বাসা ছাড়িয়া প্রায় তিন ক্রোশ পথ আসিয়াছি, আর কতদূর যাইব? পথিক লোকের সঙ্গে বাসাড়ে লোক আমি—কতদূর যাইব? ভাবিতেছি, কিন্তু চলিতেছি! কোনও পক্ষেরই হাঁটার বিরাম নাই! অবিরাম গতিতেই চলিয়াছি।

নশীপুরের ভিতর আসিয়া সঙ্গীসহ গোপাল হারাইয়া গেল। চারি ক্রোশ আন্দাজ পথ সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া এতক্ষণে লক্ষ্য ব্যর্থ হইল; পাইলাম না। সেই পাড়ায় কোনো রাহী লোকজন আসিয়াছে কিনা অনুসন্ধান লইতে লাগিলাম; এক ময়রা বলিল, ‘আসিয়াছেন। বিরাজবাবুর পোডড়া বাড়িতে একজন বাবু আসিয়াছেন। ছেলেপুলে লোকলস্কর সব সঙ্গে আছে। এই যে নিকটে—একটা মোড় ঘুরিলেই বামদিকে বড় দোতলা।’

রাত্রি হইয়াছে। তত রাত্রে গোপালের সহিত সাক্ষাৎ করা ভাল বলিয়া বুঝিলাম না, ময়রার দোকানে রাত্রিবাস করিলাম। পরদিন প্রাতে গিয়া দেখা করিলাম। বরাবর উপরে গিয়া গোপালকে আহ্বান করিলাম; সে মুখ মুড়িতে পারিল না। নিকটে আসিল। একটু অন্তরালে লইয়া গিয়া গোপনে পলায়নের কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। গোপাল সে কথার তেমন কিছু উত্তর দিল না। মোটের উপর বলিল, ‘আমি এখন আছি বেশ। টাকাকড়ি আর কিছুদিন পরে পাঠাইব। এখন এদের দল ছাড়িলে অমঙ্গল ঘটিবে। আপনি আমাকে লইয়া যাইবার জন্য আর জিদ্‌ করিবেন না। এ দলের লোকেরা খুব ভাল।’

দল? গোপাল দুই তিনবার বলিল, এদের দল? এদের দল আবার কিসের দল! শুনিলাম, বাবু। বাবুর আবার কিসের দল? জিজ্ঞাসা করিলাম। গোপাল সে কথাও কিছু ভাঙিল না, সঙ্গে আসিতেও চাহিল না।

কথা হইতেছে, এমন সময় একটি বৃদ্ধলোক দ্বারদেশে আসিয়া দাঁড়াইল। খুব পাকা পাকা গোঁপ চুল, ততোধিক পাকা দীর্ঘ দাড়ি। লোকটি আসিয়াই কটমট চাউনিতে আমার দিকে একবার চাহিল। চাহিয়াই চলিয়া গেল। লোকটি বৃদ্ধ, কিন্তু দৃষ্টি যুবার ন্যায় তীক্ষ্ণ। বৃদ্ধ লোকের চক্ষু তেমন সতেজ হইতে পারে না। কেমন একটা ধাঁধা লাগিল। কথাবার্তা শেষ করিয়া নিচে নামিয়া আসিলাম। নিচেরই একটা ঘরের সম্মুখ দিয়া পথ। ঘরের ভিতর কেহ নাই—খুব অন্ধকার। আমি চলিয়া গিয়াছি ভাবিয়া, গোপাল আর সেই বৃদ্ধটি কি বলিতে বলিতে নিচে নামিয়া আসিতেছে। সেই কথোপকথনের মধ্যে আমার নামের উল্লেখও শুনিলাম। কৌতূহল হইল, তাড়াতাড়ি সেই অন্ধকার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। বৃদ্ধ ও গোপাল কথা কহিতে কহিতে আসিয়া আমার একটু দূরে রোয়াকের এক দিকে আসিয়া বসিল।

বৃদ্ধ লোকটি বলিল, ‘তুমি পাছে লোকটার কাছে বল, এই জন্যই আমি গিয়াছিলাম। লোকটার নাম আমি জানি। বড় বদ্ লোক! কোনও সন্দেহ করে নাই তো?’

‘কিছু না। তোমাকে চিনিতেই পারে নাই। তুমি যখন যেমন সাজো, আমরাই তখন চিনিতে পারি না; বাহিরের লোক কি করিয়া চিনিবে। সে পথে তুমি নিশ্চিন্ত থাক।’

‘না, না, তুমি বুঝ না। লোকটা বড় বদ্‌। এখান হইতে তো উঠিতেই হইতেছে, তবে আর বিলম্ব করিয়া কাজ নাই। কাশীর পত্র যখন আসিয়াছে তখন আর এদেশে থাকাই নয়; তবে যাহারা দেশে গিয়াছে, তাহাদের জন্য যে দুই চারি দিন অপেক্ষা; সে অপেক্ষা বরং অন্যত্র থাকিয়া করা যাইবে; এখানে আর তিলার্ধও নয়।’

‘তবে আমার ভাগ। খাঁ সাহেবের মুখে শুনিলাম, দেশে বড় কষ্ট হইয়াছে। ভাগের টাকাটা তাহাদিগকে না দিয়া আমি যাইতে পারিব না। তাহারা অনাহারে মারা যাইতেছে।’

‘টাকা কাশীতে গিয়া দিব। তুমি যখন অবিশ্বাস করিতেছ, তখন আমি বা না করিব কেন? তুমি বলিতেছ, টাকা না পাইলে আমি যাইব না; আমি বলিতেছি, তুমি না গেলে টাকা পাইবে না। সেখানে গেলে টাকা বহিয়া আনিতে পারিবে না। সরকারে—দেশের লোকে সেখানে মনান্তর ঘটিয়াছে। এই সময়েই তো সুযোগ। যত দোষ সব দেশের লোকের ঘাড়ে পড়িবে। আমরা গিয়া পৌঁছিলে তাহারা সাহস পাইবে। কোনো গতিকে একবার মালখানা লুঠিতে পারিলেই আজীবন পায়ের উপর পা দিয়া কেন বসিয়া খাও না। চল, টাকার ভাবনা কি?’

‘না, তা আমি যাইব না। আগের ভাগ না পাইলে আমি আর তোমাদের দলে থাকিব না।’

‘আমাদের হাতছাড়া হইলে তুমি কোথায় যাইবে? কোথায় গিয়া পরিত্রাণ পাইবে? আমরাই তোমাকে বিপদে ফেলিব। প্রাণ লইব। তুমি আমাদের সবই জান; তোমাকে কি আমরা অমনি ছাড়িতে পারি?’

‘একা বলিয়াই এত কথা বলিতেছ; এ দলে আমার দিকে দাঁড়ায়, এমন কেহ নাই বলিয়াই এত কথা বলিতে সাহস করিতেছ; কিন্তু যদি কেহ থাকিত, তবে তোমাকে একবার বুঝিয়া লইতাম।’

‘আমি আছি।’ দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া বুড়াকে জড়াইয়া ধরিলাম, বলিলাম, ‘গোপাল,আমি আছি—ভয় কি?’

সে তত বুড়া নয়, নবীন যুবা। অক্লেশে আমার বাহু হইতে মুক্ত হইল, আবার ধরিলাম। দুজনে রীতিমত ধস্তাধস্তি। সহসা মস্তকে আঘাত পাইলাম—জ্ঞান হারাইলাম।

সংজ্ঞা লাভ করিয়া দেখি, আমি দোতলায় একটি ঘরে ভূমি-শয্যায় পড়িয়া আছি। কেহ কোথাও নাই—ঘরেও কিছু নাই। বাড়িটা নিস্তব্ধ। অতি কষ্টে উঠিয়া বসিলাম। ভয়ানক তৃষ্ণা। খুঁজিয়া খুঁজিয়া জল পাইলাম—পান করিলাম; চাদর ছিঁড়িয়া মাথায় বাঁধিলাম। বেলা তখন বড় বেশি নাই।

বাড়িতে জনমানব নাই। জিনিসপত্রও কিছু নাই। দল পলাতক। গোপাল তবে গেল কোথা? বাহিরে আসিয়া অনুসন্ধান লইলাম; বাবুর দল জিনিসপত্র লইয়া আহারান্তেই চলিয়া গিয়াছে। শরীর অত্যন্ত দুর্বল—মানসিক অবস্থা আরও ভয়ানক; সারাদিন অনাহার। মাথার আঘাত তেমন গুরুতর নয়, তবে কাহিল করিয়াছে খুবই। পাল্‌কী করিয়া শহরে আসিলাম।

কাশী যাইব। নিশ্চয়ই যাইব। হয় মরিব, না হয় ধরিব। একটু সুস্থ হইয়া নিজ বাসায় আসিলাম। কতদিন হইবে জানি না; সুতরাং বাসার চলাচলের বন্দোবস্ত করিলাম। সুখময়ীকে, গোপালের জননীকে আশা দিলাম। সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলাম। সুখময়ী সঙ্গে যাইতে চাহিল। সঙ্গে গেলে আর কিছু হউক না হউক, কাশীদর্শন হইবে। সুখীর ইচ্ছা, যদি গোপালকে দেশে আনিতে পারা যায়, তবেই সে দেশে ফিরিবে, না হয় জীবনের শেষ সময় কাশীর ছত্রে ছত্রে ভিক্ষা করিয়া দিন যাপন করিবে। অনুরোধ ত্যাগ করিতে পারিলাম না, সঙ্গে লইতে হইল।

আমরা শহরে আসিলাম। এখান হইতেই কাশীতে গহনার নৌকা যাতায়াত করে। বড় বড় নৌকা; একশত দেড়শত যাত্রী এক-একখানা ভড়ে বোঝাই হয়। সেই রকম একখানা নৌকায় দুজনে কাশী যাত্রা করিলাম।

খুব সুবাতাস বহিলেও কাশী পৌঁছিতে দেড় মাস লাগে। দেড় মাস কাল একত্র বাস; অনেক যাত্রীর সহিত ভাব হইল। নৌকায় এক সাধু ছিলেন, তিনি বড় ভদ্রলোক। অতি অমায়িক—অতি সদালাপী—অতি সাধু। অধিক সময় সাধু-সঙ্গ, হিন্দুশাস্ত্রের অনেক কথাই এই নৌকা যাত্রার খাতিরে শিখিয়া লইলাম।

একদিন ঝড়। ভয়ানক ঝড়। গঙ্গা সেখানে তেমন প্রশস্ত নহে, কিন্তু ঝড়ের তোড়ে গঙ্গার মুর্তি বড় ভীষণ বোধ হইল। যাত্রী মহলে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল। বিভ্রাটের একশেষ—কখন নৌকা ডুবিয়া যায়—সকলে কেবল সেই প্রতীক্ষাই করিতেছে। নৌকা আর থাকে না। মাঝি মাল্লারা নৌকা রাখিতে পারিতেছে না। সকলেই ভীত—আসন্ন মৃত্যুর চিন্তায় সকাতর।

নৌকা বানচাল হইল। ঝড়ের তোড়ে চড়ায় লাগিয়া গহনার নৌকা ফাঁসিয়া গেল। চারিদিকে হা-হাকার। জল সেখানে এক কোমর। চড়ার উপর বেশি জল নাই। যাত্রীরা লাফাইয়া লাফাইয়া সেই কোমর জলে নামিয়া দাঁড়াইতে লাগিল। সকলেরই অগ্রে নামিবার চেষ্টা—সুতরাং মহাগোল। সঙ্গে স্ত্রীলোক, বিপদে পড়িলাম। তত গোলের মধ্যে স্ত্রীলোক লইয়া নামা অসম্ভব; অপেক্ষা করিতে হইল। অপেক্ষায় আছি, একটু ভিড় কমিলেই নামিব বলিয়া অপেক্ষায় আছি, হঠাৎ মস্তকে আঘাত। ঘুরিয়া পড়িয়া গেলাম। চৈতন্য হারাইলাম।

যখন জ্ঞান হইল, তখন ঝড় থামিয়া গিয়াছে। এক নৌকা জল, চড়ায় বাঁধিয়া জলপূর্ণ নৌকা আটকাইয়া গিয়াছে; মাঝিরা গালে হাত দিয়া ভাবিতেছে; আর আমি সুখময়ীর সেবায় একটু খাড়া হইয়া বসিয়াছি। যাত্রীরা সব তীরে উঠিয়াছে।

সুখময়ী বলিল, ‘আমি দেখিয়াছি। সেই সাধু লোকটি মাথায় বাড়ি দিয়াছে। পেছন হইতে সেই লোকটিই লাঠি মারিয়াছে।’ বিশ্বাস হইল না। তেমন জ্ঞানী লোক, সে কি নির্দোষ লোকের মাথায় লাঠি মারিতে পারে?

আঘাত তেমন সাংঘাতিক নয়, সহজেই সারিয়া উঠিলাম। একখানা ছোট নৌকা ভাড়া রাখিয়া দেশে যাইতেছিল; যাহারা সমর্থ, তাহারা দ্বিগুণ ভাড়া দিয়া সেই নৌকায় কাশী যাত্রা করিল। গরীব লোকেরা সেদিন নদী তীরেই রহিল। আমরা ছোট নৌকাতেই চলিলাম। সাধু যখন ছোট নৌকায় উঠিয়াছে, তখন আমাদেরও উঠা চাই। লোকটার বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় একটু ভাল করিয়াই লওয়া চাই।

সাধুটিকে বেশ ভাল করিয়াই দেখিলাম। চেলাগুলির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও লক্ষ্য করিলাম। ক্রমে সন্দেহ বাড়িল। সুখময়ী আরও বলিল, ‘এইরকম সাধু—ঠিক এই চেহারা—কয়েকদিন চাঁদসড়কে ঘুরিয়াছিল।’ স্ত্রীলোক, ভস্মভূষণ দেখিলেই ভাবে সাধু। এক প্রকার বেশভূষণ, ভ্রম হইবার সম্ভাবনা। সুখময়ী এখনও সেই কথাই বলিল। সে জিদ করিয়া বলিতে লাগিল, ‘এই সাধুই চাঁদসড়কে গিয়াছিল। গোপালের সঙ্গে দেখা করিয়াছিল। একদিন আমাদের বাড়ি অতিথিও হইয়াছিল।’

ক্রমে ক্রমে—দেখিতে দেখিতে গোপাল মিলিল। খুব দাড়ি, চুল, মাথায় জটা, গায়ে ছাই, চেহারায় কিছুমাত্র চেনা যায় না; তথাপি বুঝিলাম, যে শিষ্যটি সর্বদাই মৌনী হইয়া ঘাড় গুঁজিয়া বসিয়া থাকে, সেইটিই গোপাল। হাঁ তো, গোপালই তো। সুখময়ীও বলিল, সেই-ই বটে। সুখময়ীর ইচ্ছা, সে এখনি ভ্রাতার গলা জড়াইয়া ধরিয়া একবার কাঁদে। ভাবে ভঙ্গিতে বুঝিতে পারিয়া নিবারণ করিলাম। এখন যে আমরা অসহায়।

সন্ধ্যার সময় অসিঘাটে গিয়া নৌকা লাগিল। সকলেই নামিল—আমরাও নামিলাম। চেলাদের লইয়া সাধু অগ্রগামী হইলেন। হাসিয়া বিদায় লইলেন। গমনকালে আশীর্বাদও করিলেন। গোপাল দুই তিনবার ভয়ে ভয়ে আমাদের দিকে চাহিল। বুঝিলাম, গোপালই বটে। সাধুর পশ্চাতে পশ্চাতে চলিয়াছি। কতক দূর গিয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখি, পশ্চাতে এক লগুড় হস্তে চেলা। ভাবেই বুঝিলাম, চেলা আমাদের অনুসরণ করিতেছে। কোথায় আমরা অনুসরণ করিব, না বিপরীত। এখন যাই কোথা! সঙ্গে স্ত্রীলোক।

ভয় হইল। সাধুসঙ্গ ত্যাগ করিয়া অন্য রাস্তা ধরিলাম, চেলা পাছ ছাড়িল না। সাধু চলিয়া গিয়াছে, চেলারাও গিয়াছে, এ চেলাটি যায় না কেন? ক্রমে বাঙালীটোলায় আসিলাম। চাঁদসড়কেরই একটি আলাপী লোক এখানে—এই বাঙালীটোলায় থাকেন, বিষয় কার্য করেন, তাঁহারই আশ্রয়ে আসিয়া দাঁড়াইলাম। একটু পরে বাহিরে আসিয়া দেখি, চেলা নাই। হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। বাবুটি সপরিবারেই আছেন, দেশের মেয়েমানুষ পাইয়া গৃহিণী সন্তুষ্ট হইলেন, সুখময়ীর দায় হইতে এক্ষণে অব্যাহতি পাইলাম। সে রাত্রি থাকিলাম।

কাশীর অবস্থা বাবুর মুখেই শুনিলাম। পথে ঘাটে এখন লোক চলাচল প্রায় বন্ধ হইয়া আসিয়াছে। টাকাকড়ি লইয়া এখন আর কেহ পথ চলিতে সাহস করে না। রাহাজানি, লুঠতরাজ, কাশীতে নিত্য ঘটিতেছে। শত চেষ্টা—নিবারণ হইতেছে না।

শরীর বড় অসুস্থ। মাথার বেদনা এখনও খুবই আছে। দুই দিন বাবুর বাসায় থকিয়া একটু সুস্থ হইলাম। তৃতীয় দিন প্রাতেই শুনিলাম, রামনগরে ডাকাতি হইয়াছে। একটা মানুষও খুন হইয়াছে। সেদিন একটু ভাল আছি, প্রাতেই এই গল্প শুনিয়া স্নান করিতে গিয়াছি, পথে দেখি, চেলা গোপাল। চিমটার ধ্বনি করিতে করিতে গোপাল বরুণার দিক হইতে আসিতেছে। হঠাৎ গোপালের হাত ধরিলাম। দৃঢ় মুষ্টিতে ধরিলাম। বলিলাম, ‘গোপাল, তোমাকে আমি যে চিনিয়াছি। সুখময়ী এখানে আছে। চল, দিদির সঙ্গে দেখা করিবে চল।’

গোপাল প্রথমে অভ্যাসমত দুই এক কথা হিন্দিতে কি বলিল, গ্রাহ্য করিলাম না। হাত ধরিয়া বাবুর বাসায় লইয়া অসিলাম। সুখময়ী সংবাদ পাইয়া বাহিরে আসিল। গোপালের গলা ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল। গোপালকে আর যাইতে দিলাম না।

বৈকালে রাস্তায় মহাগোল। দেখিতে বাহিরে আসিলাম। দেখিলাম, পুলিশের লোক। আমি কেবল বাসার দরজায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছি, অমনি সেই গোলের ভিতর হইতে একজন কে বলিয়া উঠিল, ‘ওই—ওই লোকটি ওই দরজায়—ওই ডাকাত!’ তৎক্ষণাৎ আমাকে গেরেপ্তার। গোল শুনিয়া গোপালও বাহিরে আসিল। এখন আর সে জটাজুটে ঢাকা চেলা না, সেও আসিবামাত্র সেই লোকটির সনাক্ত মতে গেরেপ্তার। দুজনে চকের থানায় চলিলাম। গমন মাত্র চালান। আমাদের হাজত গারদ।

পরদিনই বিচার আরম্ভ। তিন চারিজন লোক আমাদিগকে সনাক্ত করিয়া বলিল যে, রামনগরে ডাকাতি আমরাই করিয়াছি। পলাইয়া আসার সময় তাহারা আমাদিগকে দেখিয়াছে, সঙ্গ লইয়া বাসা পর্যন্ত আসিয়াছে, ডাকাত লোক আমরা—ধরিতে সাহস করে নাই। থানায় গিয়া সংবাদ দিয়াছে।

আমি নিজের পরিচয় দিলাম। হুকুম হইলে বিশ্বাস জন্মাইবার জন্য বাবুর বাসা হইতে হুকুমনামা আনাইয়াও দেখাইতে পারি, বলিলাম। হুকুম হইল। তখন একজন পদাতিক বাবুর বাসায় আমার ব্যাগ আনিতে গেল। ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘বাসায় ব্যাগ নাই। একটু পূর্বে একজন পুলিশ পদাতিক আসিয়া সে ব্যাগ লইয়া গিয়াছে।’ মাথায় বজ্রাঘাত। হাকিম চটিলেন। আমার কথায় বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। এদিকে কড়া শাসনেরও দরকার হইয়াছে। হাকিম আমাদর দুজনেরই প্রতি কঠিন দণ্ড দিলেন। কারাবাসের আদেশ দিলেন, সাত সাত বৎসর। অদৃষ্টের লেখা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলাম।

গারদ-রক্ষকের অনুমতি লইয়া, কৃষ্ণনগরে পত্র লিখিলাম। ব্যাপারটা আগর্ভ জানাইয়া, নিজের দুরবস্থার কথা লিখিয়া, শেষে সাহায্য চাহিয়া পাঠাইলাম। তিন মাস পরে সাহায্য আসিল। মুক্তি পাইলাম।

গোপালের সন্ধান মতে সাধুর সকল আড্ডাই অনুসন্ধান হইল, সাধুর সাক্ষাৎ মিলিল না। যাহারা সাক্ষী দিয়াছিল, তাহাদিগকেও আর দেখিতে পাওয়া গেল না। তিন মাসের ঘটনা, কোনও ফল ফলিল না। অগত্যা গোপাল ও সুখময়ীকে লইয়া দেশে ফিরিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *