1 of 2

দিনে ডাকাতি

দিনে ডাকাতি – শরচ্চন্দ্র সরকার

গোয়াবাগানে শ্রীহরিমোহন দত্ত নামে একজন ধনাঢ্য লোক বাস করিতেন। পুত্র কন্যায় তাঁহার প্রায় পাঁচ ছয়টি অপত্য জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটি কন্যা ব্যতীত সকলেই অকালে কালগ্রাসে পতিত হয়। সুতরাং হরিমোহনবাবু, কন্যা মৃণ্ময়ীর প্রতি সাতিশয় স্নেহশালী ছিলেন। একদণ্ডও তাহাকে চক্ষের অন্তরাল করিতেন না।

কাল সহকারে মৃণ্ময়ী বয়ঃপ্রাপ্ত হইল। তাহাকে পরের ঘরে পাঠাইয়া হরিমোহনবাবু ও তাঁহার পত্নী কি প্রকারে জীবনধারণ করিবেন তাহাই বিশেষ চিন্তার বিষয় হইয়া উঠিল। যখন মৃণ্ময়ীর বয়ঃক্রম একাদশ বর্ষ উত্তীর্ণপ্রায়, তখন একদিন হরিমোহনবাবুর পত্নী তাঁহাকে কহিলেন, ‘আর কতদিন মেয়ের মায়ায় আবদ্ধ থাকিবে? আর তো বিবাহ না দিলে ভাল দেখায় না, লোকে বলিবে কি?’

‘লোকে তো আর আমার ব্যথা বুঝে না! তারা তো জানে না, আমি কতকগুলিকে খাইয়া, কত ঠাকুর দেবতার পূজা দিয়া তবে ওই সবেধন নীলমণিটিকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছি। এ লক্ষ্মীকে আমি কার ঘরে পাঠাইয়া দিব বল?’

‘তুমি যে মেয়েমানুষের মত কথাবার্তা কহিতে আরম্ভ করিলে? যে সকল কথা আমার মুখ দিয়া বাহির হওয়া উচিত ছিল, তোমার মুখে সেই সকল কথা।’

হরিমোহনবাবু একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিলেন।

অল্প দিনের মধ্যেই পাত্র স্থির হইল, হরিমোহনবাবু পাকা দেখিয়া আসিলেন এবং তৎপরদিন বরপক্ষ হইতে মৃণ্ময়ীকে পাকা দেখিতে আসিবে একথা গৃহিণীকে শুনাইলেন।

গৃহিণীর আর আনন্দ ধরে না।

যথা সময়ে বর পক্ষ হইতে পাঁচ-ছয়জন ভদ্রলোকের শুভাগমন হইল, অন্তঃপুরে কন্যা সাজাইবার জন্য একটা মহা গণ্ডগোল পড়িয়া গেল, হীরে জরহৎ, মণি মুক্তা ও স্বর্ণালঙ্কারে মৃণ্ময়ীর দেহ আপাদমস্তক ভরিয়া গেল। মৃণ্ময়ীর মাতা কহিলেন, ‘তোরা ওই ক’খানা গয়নাতেই মেয়ের গা’ ভরাইয়া দিলি, আর সব হীরে জহরতের গয়না পরাইবি কোথায়?’

একজন প্রতিবেশিনী কহিল, ‘এর উপর আর বেশি গয়না পরাইতে গেলে, একপাও চলিতে পারিবে না।’

মৃণ্ময়ীর যত রকমের অলঙ্কার ছিল, তাহা সমস্ত তাহাকে পরাইতে পারা গেল না দেখিয়া, গৃহিণী কিছু দুঃখিতা হইলেন। ওদিকে বাহিরে বড় ডাকাডাকি পড়িয়া গেল, মৃণ্ময়ীকে পাঠাইয়া দিবার জন্য চাকরের উপর চাকর আসিতে লাগিল, কাজে কাজেই আভরণ-বিভূষিতা মৃণ্ময়ী বাহিরে গেল। প্রশ্নের পর বরকর্তা মৃণ্ময়ীর হস্তে দশটি মোহর দিয়া পাকা দেখা কার্য সমাপন করিলেন। ভীতা, সঙ্কুচিতা মৃণ্ময়ী তখন ধীর পাদ-বিক্ষেপে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। হরিমোহনবাবু ভাবী কুটুম্বগণের যথারীতি অভ্যর্থনা ও আহারাদির বন্দোবস্ত করিবার জন্য ব্যস্ত হইলেন।

সেই সময় বাড়ির ভিতরে একটা মহা গোলযোগ হইল সংবাদ পাইয়া হরিমোহনবাবু দৌড়াইয়া অন্তঃপুরে আসিলেন; শুনিলেন, তাঁহার এক প্রতিবেশিনী মূর্ছাগত হইয়াছেন। তিনি কহিলেন, ‘তোমরা এত গোল করিও না। বাহিরে যাঁহারা আসিয়াছেন, তাহা হইলে, তাঁহারা আহারাদি না করিয়াই চলিয়া যাইবেন, আমার এত আয়োজন সমস্তই বিফল হইবে। ওঁর দেখিতেছি মূর্ছাগত বাই আছে; লোকের ভিড়ে গোলমালে হঠাৎ সেই রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন; মুখে হাতে জল দিলেই এখনি সচেতন হইবেন।’

অন্যান্য প্রতিবেশিনী রমণীগণ তখন আর গোলমাল না করিয়া, সেই মূর্চ্ছাগতা রমণীর মুখে জলশেচ করিতে লাগিলেন।

আভরণ-বিভূষিতা মৃণ্ময়ী সেই গোলমালে পড়িয়া, সেই স্থলে দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। হরিমোহনবাবু তাহাকে দেখিয়া কহিলেন, ‘মা! এক গা গয়না পরিয়া তুমি হেথায় দাঁড়াইয়া কেন? গয়না টয়না সব উপরে তোমার ঘরে খুলিয়া রাখিয়া বাক্সবন্দী করিয়া, ফিরিয়া আসিয়া এখানে দাঁড়াইও।’

হরিমোহনবাবু বহির্বাটিতে চলিয়া গিয়া আবার বর-পক্ষীয় ভদ্রলোকগণের আদর অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন। যেন কিছুই হয় নাই, যেন উদ্বেগের কোন কারণই নাই।

ফিরিয়া আসিয়া দেখে, সেই মূর্ছাগত রমণীর চৈতন্য হইয়াছে, তিনি চক্ষুরুন্মীলন করিয়াছেন, কিন্তু তখনও কথা কহিতে পারিতেছেন না।

বর-পক্ষীয় ভদ্রলোকগণের পান ভোজনাদি সমাপ্ত হইলে পর তাঁহারা বিদায় গ্রহণ করিলেন। হরিমোহনবাবুও অন্তঃপুরে আসিলেন।

অন্তঃপুরে আসিয়া, তিনি যাহা শুনিলেন, তাহাতে তাঁহার মস্তক ঘূর্ণায়মান হইল, তিনি অন্ধকার দেখিলেন।

হরিমোহনবাবু শুনিলেন যে, তাঁহার কন্যা মৃণ্ময়ীর সমস্ত অলঙ্কার, (যাহার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা, যাহা মৃণ্মময়ী তাড়াতাড়ি খুলিয়া সম্মুখস্থ একটা টিনের বাক্সের মধ্যে রাখিয়া, নিজ কক্ষে চাবি দিয়া নিচে নামিয়া গিয়াছিল) সেই টিনের বাক্সটি, সমস্ত অলঙ্কার সমেত অপহৃত হইয়াছে। ঘরের দরজা মৃণ্ময়ী যেমন আবদ্ধ করিয়া রাখিয়া গিয়াছিল ঠিক সেইরূপই আবদ্ধ রহিয়াছে, অথচ বাক্স সমেত অলঙ্কার নাই।

হরিমোহনবাবু মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। গৃহিণী ও মৃণ্ময়ী তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে হরিমোহনবাবু একটু প্রকৃতিস্থ হইলে, তিনি কহিলেন, ‘থাক্‌, তোমরা এখন কেহ কিছু গোলযোগ করিও না। আমি বাড়ির দুই দরজা বন্ধ করিয়া দিবার হুকুম দিতেছি, কোন লোক আমার অনুমতি ভিন্ন বাহিরে যাইতে না পায়। তারপর যাহা করিবার তাহা আমি করিতেছি।’

এই বলিয়া তিনি বাহিরে চলিয়া গেলেন। তাঁহার আদেশ মত বাড়ির অন্তঃপুর ও বাহিরের দরজা বন্ধ হইয়া গেল। বাটিতে যাহারা ছিল তাহারা আর কেহ বাহির হইতে পাইল না। হরিমোহনবাবু একজন বিশ্বস্ত কর্মচারীর হস্তে একখানি পত্র দিয়া কহিলেন, ‘তুমি একখানি সেকেন্ড ক্লাস গাড়ি ভাড়া করিয়া এখনি ডিটেকটিভ (গোয়েন্দা) আফিসে যাও এবং সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেবকে আমার এই পত্রখানি দাও। পত্র পাঠ করিলেই তিনি তোমার সঙ্গে একজন সুদক্ষ গোয়েন্দা পাঠাইয়া দিবেন। তুমি সেই গোয়েন্দাকে লইয়া যত শীঘ্র সম্ভব ফিরিয়া আসিবে।’

কর্মচারী ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া চলিয়া গেল। হরিমোহনবাবু পুনরায় মস্তকে হাত দিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন।

যথা সময়ে সে ফিরিয়া আসিল। অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কই, তোমার সঙ্গে আর কেহ আসেন নাই?’

সে লোক উত্তর দিল, ‘না।’

হরিমোহনবাবু বিস্মিত হইয়া কহিলেন, ‘সে কি?’

‘তা আমি বলিতে পারি না মহাশয়! এই পত্রের জবাব দিয়াছেন।’ এই বলিয়া সেই লোকটি তাহার জামার পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া হরিমোহনবাবুর হস্তে প্রদান করিল।

অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে তিনি পত্রের আবরণ উন্মোচন করিয়া পাঠ করিতে লাগিলেন:

‘মহাশয়,

আপনার পত্রে সমস্ত বিবরণ অবগত হইলাম। আপনি বিশেষ চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন হইবেন না। অল্পক্ষণ মধ্যেই একজন গোয়েন্দা আপনার সাক্ষাৎ করিবেন। তিনি যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহার উত্তর দিতে কোন প্রকার সঙ্কোচ করিবেন না। তিনি গোয়েন্দাগিরিতে একজন সুদক্ষ ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালী ব্যক্তি। আমি আশা করি, তাঁহার বুদ্ধিমত্তায় অচিরে আপনি অপহৃত অলঙ্কারগুলি পুনঃপ্রাপ্ত হইবেন।’

পত্র পাঠ করিয়া হরিমোহনবাবু তাঁহার সেই বিশ্বস্ত লোকটিকে বিদায় দিলেন। সে চলিয়া যাইবামাত্রই অপর একজন অপরিচিত ব্যক্তি সেই গৃহ মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।

যথারীতি অভ্যর্থনা করিয়া আগন্তুক ভদ্রলোকটিকে উপযুক্ত আসনে বসাইয়া, হরিমোহনবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি কি গোয়েন্দা আপিস্ হইতে আসিতেছেন?’

উত্তর। হ্যাঁ।

প্রশ্ন। আপনার নাম?

উত্তর। হরিদাস।

হরিমোহনবাবু তখন অলঙ্কার অপহরণের কথা হরিদাস গোয়েন্দাকে বলিলেন। তিনি সমস্ত কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনার এ বাটীখানি কতটা জমির উপর নির্মিত?’

হরিমোহন। কেন, একথা জিজ্ঞাসা করিবার কারণ?

হরিদাস। কারণ আছে। না থাকিলে, আপনাকে একথা জিজ্ঞাসা করিব কেন?

হরিমোহন। জমি প্রায় চারি বিঘা হইবে।

হরিদাস। বাটীতে পুষ্করিণী আছে?

হরিমোহন। আছে।

হরিদাস। আপনাদের এ বাটীতে পরিবার কয়জন?

হরিমোহন। চাকর লোকজন বাদে নয় জন।

হরিদাস। চাকর লোকজন কতজন?

হরিমোহন। সতের জন।

হরিদাস। আমি একবার অন্তঃপুরে যাইতে ইচ্ছা করি।

হরিমোহন। চলুন। বাড়ির ভিতরে আমি আপনার যাইবার জন্য পূর্ব হইতেই বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছি।

হরিদাস। কি বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছেন?

হরিমোহন। আত্মীয়-স্বজন, যাঁহারা আমার কন্যার বিবাহের ‘পাকা দেখা’ উপলক্ষে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের সকলকেই একটি ঘরে বসিয়া থাকিতে বলিয়াছি।

হরিদাস। কি প্রকার?

হরিমোহন তখন বন্দোবস্তের কথা বলিলেন।

হরিদাস। তাহা হইলে আমার আসার কথাটা সকলেই জানিতে পারিয়াছেন?

হরিমোহন। সকলেই যে জানিতে পারিয়াছেন একথা আমি বলিতে পারি না। তবে আমার স্ত্রীকে একথা বলিয়াছি বটে।

হরিদাস। তিনি হয়তো অপরের নিকট বলিতে পারেন।

হরিমোহন। তাহা বোধ হয় বলিবেন না।

হরিদাস। না বলিলেও আপনি যে হুকুম জারী করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহাদের এরূপ অনুমান করাও বিচিত্র নহে।

হরিমোহন। এখন তাহা বুঝিতে পারিয়াছি।

হরিদাস। আপনার আত্মীয় কুটুম্বগণকে এ প্রকারে আবদ্ধ করিয়া রাখাটা আমার বিবেচনায় অত্যন্ত গর্হিত কার্য হইয়াছে।

হরিমোহন। তবে কি করিব?

হরিদাস। তাঁহারা যে যেখান হইতে আসিয়াছেন, তাঁহাদের সেইখানে যাইবার জন্য খিড়কির দ্বার খুলিয়া দিন।

হরিমোহন। আপনার খানা-তল্লাসি বা কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার আবশ্যক নাই।

হরিদাস গোয়েন্দার কথা শুনিয়া অগত্যা হরিমোহনবাবু তাহাই করিলেন। অনেকেই বাটী ফিরিয়া যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন, কেবল হরিমোহনবাবুর পত্নী তাঁহাদিগকে নানা কথা বলিয়া ভুলাইয়া রাখিয়াছিলেন। এখন কর্তার হুকুম পাইয়া বিদায় দিলেন।

যখন বাড়ি প্রায় খালি হইয়া আসিল, সেই সময় হরিমোহনবাবু হরিদাসকে লইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। যে ঘরে মৃণ্ময়ী শয়ন করিত, প্রথম সেই ঘরেই হরিদাস গোয়েন্দাকে লইয়া হরিমোহনবাবু উপস্থিত হইলেন।

একটি গবাক্ষ প্রদেশের নিকটবর্তী হইয়া হরিদাস জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এই যে পাশে পুষ্করিণী দেখা যাইতেছে, উহা কি আপনার এই বাটীর সামিল?’

হরিমোহন। হ্যাঁ।

হরিদাস। পুষ্করিণীর জলের অবস্থা কি প্রকার?

হরিমোহন। বড় ভাল নহে।

হরিদাস আবার সেই দিকে চক্ষু ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘পুষ্করিণীর চতুর্দিকে যে নানাপ্রকার গাছপালা দেখা যাইতেছে, ওগুলিও আপনার সম্পত্তির মধ্যে পরিগণিত?’

হরিমোহন। আজ্ঞে হ্যাঁ।

হরিদাস। আপনার কন্যা যে টিনের বাক্সটির মধ্যে সমস্ত অলঙ্কার আনিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই বাক্সের মত আর অন্য কোন বাক্স আপনার বাড়িতে আছে?

হরিমোহন। আছে।

হরিদাস। আমাকে একবার দেখাইতে পারেন?

হরিমোহন। পারি।

হরিদাস। তবে দেখান।

হরিমোহন। এইখানে লইয়া আসিতে বলিব?

হরিদাস। অন্য কাহাকেও হুকুম করিবার আবশ্যক নাই—আপনি স্বহস্তে তাহা লইয়া আসুন।

হরিমোহনবাবু ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া দ্রুতপদে কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। হরিদাস এই অবসরে সেই গৃহটির যেখানে যাহা কিছু ছিল তাহা উত্তমরূপে দেখিয়া লইলেন।

হরিমোহনবাবু টিনের বাক্সটি লইয়া আসিলে, হরিদাস গোয়েন্দা কহিলেন, ‘আচ্ছা, বাক্সটি এখন আপনি যথাস্থানে রাখিয়া আসিতে পারেন।’

হরিমোহন। আর কি করিতে হইবে আজ্ঞা করুন।

হরিদাস। আপনার কন্যা মৃণ্ময়ীকে একবার এইখানে ডাকিয়া আনিতে আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে তাহাকে একবার আমার নিকটে ডাকিয়া আনিবেন কি?

হরিমোহন। গোপনে ডাকিয়া আনিব?

হরিদাস। না, প্রকাশ্যেই সকলের সম্মুখে ডাকিয়া আনাই উত্তম পরামর্শের কাজ।

হরিমোহনবাবু তাহাই করিলেন। মৃণ্ময়ী আসিয়া হরিদাসের সম্মুখে দাঁড়াইল।

হরিদাস জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মা! তুমি গায়ের সব গয়নাখুলিয়া এই ঘরের একটা টিনের বাক্সের ভিতর রাখিয়াছিলে, না?’

ছলছল চক্ষে মৃণ্ময়ী হরিদাসের মুখের পানে চাহিয়া কহিল, ‘হ্যাঁ—’

হরিদাস। তখন ঘরে কে ছিল?

মৃণ্ময়ী। কেহ না।

হরিদাস। তুমি যখন উপরে উঠিয়াছিলে তখন আর কাহাকেও দেখিয়াছিলে?

মৃণ্ময়ী। না।

হরিদাস। কেহ তোমার সঙ্গে উপরে উঠেন নাই?

মৃণ্ময়ী। না।

হরিদাস। তুমি পশ্চাত ফিরিয়া দেখিয়াছিলে?

মৃণ্ময়ী। হ্যাঁ।

হরিদাস। অলঙ্কারগুলি তাড়াতাড়ি টিনের বাক্সর ভিতর রাখিয়া বাক্সর চাবি বন্ধ করিয়াছিলে?

মৃণ্ময়ী। করিয়াছিলাম।

হরিদাস। তারপর আবার ঘরে চাবি দিয়া নিচে নামিয়া গিয়াছিলে?

মৃণ্ময়ী। হ্যাঁ।

হরিদাস। যাবার সময় চাবি টানিয়া দেখিয়াছিলে?

মৃণ্ময়ী। হ্যাঁ, দেখিয়াছিলাম।

হরিদাস জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি যখন ঘরে চাবি দিয়া নামিয়া গিয়াছিলে, তখন নিচে সেই মূর্ছাগত রমণীর অবস্থা কি ঘটিল জানিবার জন্য তুমি অতিশয় ব্যগ্র হইয়াছিলে না?’

মৃণ্ময়ী। আজ্ঞে হ্যাঁ।

হরিদাস। ঘরের জানালাগুলি, সেই তাড়াতাড়িতে বন্ধ করিয়া যাইবার সময় পাও নাই?

মৃণ্ময়ী। না।

হরিদাস। জানালাগুলি এখন যেমন খোলা রহিয়াছে, তখনও এইরূপ খোলা ছিল?

মৃণ্ময়ী। হ্যাঁ জানালাগুলি বন্ধ করিয়া যাইবার আমার কোন আবশ্যক ছিল না।

হরিদাস। কেন?

মৃণ্ময়ী। জানালায় সব লোহার গরাদে দেওয়া আছে, ওখান দিয়া তো আর চোর আসিতে পারে না।

হরিদাস। তাহলে জানালা বন্ধ করিবার কথাটা তোমার তখন মনে উদয় হইয়াছিল?

মৃণ্ময়ী। না।

হরিদাস। তবে চোর আসিবার কথাটা মনে হইল কেমন করিয়া?

মৃণ্ময়ী। তাহাও কিছু মনে উদয় হয় নাই।

হরিদাস। তবে কেন তুমি এই সকল কথা বলিতেছ?

মৃণ্ময়ী। তা’ কেন। জানালায় লোহার গরাদে দেওয়া না থাকিলে, যে সময় আমি ঘরে ও বাক্সয় চাবি দিয়াছিলাম সেই সময় জানালা বন্ধ করিবার কথাও নিশ্চয় মনে পড়িত। আমার সে সম্বন্ধে কোন কথাই মনে উদয় হয় নাই।

হরিদাস। তুমি এখন যাইতে পার।

যখন মৃণ্ময়ী চলিয়া গেল, তখন হরিমোহনবাবু হরিদাসের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, ‘আমি ভাবিতেছিলাম—এই—যে—আপনি—’

হরিদাস গোয়েন্দা কহিলেন, ‘আপনি আমতা আমতা করিতেছেন কেন? আমার নিকট কোন কথা লুকাইয়া আপনার লাভ নাই। বরং সকল কথা পরিষ্কার করিয়া বলিলে আপনার পক্ষেই ভাল। কি বলিতে ইচ্ছা করিয়াছেন স্বচ্ছন্দে বলিয়া ফেলুন।’

তখন হরিমোহনবাবু কহিলেন, ‘না, এমন কিছু নয়। তবে কি জানেন, আপনি এতক্ষণ আমার কন্যাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, তাহাতে আমার বোধ হইতেছিল, আপনি বৃথা সময় নষ্ট করিতেছেন।’

হরিদাস। কেন, আমার কথাগুলি কি আপনার বাজে কথা বলিয়া বোধ হইতেছিল?

হরিমোহনবাবু নিরুত্তর রহিলেন; কি উত্তর দিবেন স্থির করিতে পারিলেন না।

হরিদাস গোয়েন্দা তখন বলিলেন, ‘আর এঘরে আমার বিশেষ কোন কার্য নাই। আমি এখন বাটীর বাহিরে যাইতে ইচ্ছা করি।’

হরিমোহন। যে আজ্ঞা, কোন দিকে যাইতে চাহেন বলুন?

হরিদাস। ওই যে জানালার বাহিরে একতালার ছাদ দেখা যাইতেছে, উহা কি আমায় বলুন?

হরিমোহন। ওটি আমার রান্নাবাড়ির ছাদ। উহার বাম দিকে চাকরদিগের মহল এবং দক্ষিণ দিকে দাসীগণের মহল।

হরিদাস। এক একটি মহলে কয়টি করিয়া ঘর আছে?

হরিমোহন। রান্নাবাড়িতে দুইটি বড় এবং দুইটি ছোট ঘর আছে।

হরিদাস। দুইটি বড় ঘরে কি হয়?

হরিমোহন। একটি নিরামিষ ও অপরটি আমিষ পাকশালা। দুই ঘরে দুইজন ব্রাহ্মণ রন্ধন করিয়া থাকে।

হরিদাস। ছোট দুইটি ঘরে কি হয়?

হরিমোহন। দুইটি ঘরে উক্ত দুইজন ব্রাহ্মণ শয়ন করে।

হরিদাস। ব্রাহ্মণেরা কি বাড়ির ভিতর আসিয়া ভাত দিয়া যায়?

হরিমোহন। পুরুষগণকে দিয়া যায় বটে, কিন্তু স্ত্রীলোকগণের জন্য স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত।

হরিদাস। আপনাদের আহারাদি কোথায় হইয়া থাকে?

হরিমোহন। সকলেই একস্থানে আহার করেন না। পুরুষগণ বাইরে এবং স্ত্রীলোকগণ অন্তঃপুরে আহার করিয়া থাকেন।

হরিদাস। বাহির মহলে যে স্থানে পুরুষগণ আহার করিয়া থাকেন, আমি সেই স্থানটি একবার দেখিতে ইচ্ছা করি।

হরিমোহনবাবু, ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া হরিদাস গোয়েন্দাকে লইয়া মৃণ্ময়ীর ঘর হইতে বাহির হইলেন এবং পার্শ্ববর্তী একটি শুঁড়ি পথ দিয়া বহির্বাটীর আহার করিবার ঘরে উপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘এই আমাদের খাবার ঘর।’

হরিদাস গোয়েন্দা দেখিলেন যে তিনি যে ঘরে উপস্থিত হইয়াছেন, ঠাকুর দালানের এক প্রান্তদেশ। ঠাকুর দালানগুলি সাধারণত উচ্চ হইয়া থাকে; এমন কি, কাহারো কাহারো চক মিলান দ্বিতল কক্ষগুলির সহিত, ঠাকুর দালান সমান উচ্চ করিয়া, ছাদ মিলান হয়। হরিমোহনবাবুর ঠাকুর দালানটিও উচ্চ—দ্বিতল ঘরগুলির সহিত সমান। বহির্বাটীর চকবন্দী ঘরগুলি ছাদের সহিত ঠাকুর দালানের ছাদ সমান করিয়া নির্মিত।

ঠাকুর দালানের দুইপার্শ্বে দ্বিতলে দুইটি হলঘর। সেই হলঘরের সম্মুখ দিয়া, বহির্বাটীও ভিতরবাটী গমনাগমনের পথ। দালানের দুই পার্শ্বেই এইরূপ ব্যবস্থা। হরিদাস গোয়েন্দা সেই হলঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, তাহার পশ্চিম দিকে একটি দ্বার খোলা রহিয়াছে। তৎক্ষণাৎ তিনি সেই দ্বার দিয়া বহির্গত হইয়া সম্মুখস্থিত বারান্দায় দাঁড়াইলেন। দেখিলেন, সেই টানা বারান্দা, বরাবর সদরবাটী হইতে ভিতরবাটী পর্যন্ত যোগাযোগ রহিয়াছে। তিনি সেই বারান্দা দিয়া বরাবর অগ্রসর হইতে লাগিলেন। বারান্দার খানিকটা দূর গিয়াই একটি একতল ছাদের সহিত মিশিয়া গেল।

হরিমোহনবাবু কহিলেন, ‘এইটি আমার চাকরদের মহল। নিচে যে ঘরগুলিতে আমার চাকরেরা থাকে, ইহা তাহারই ছাদ।’

হরিদাস। ইহার উপরে উঠিবার সিঁড়ি কই?

হরিমোহন। দাস দাসীগণের মহলে ছাদে উঠিবার সিঁড়ি নাই। দাসীগণের মহলের সহিত অন্তঃপুরে যাইবার ও আসিবার জন্য স্বতন্ত্র আছে। দাসীগণের মহল হইতে অন্তঃপুরে যাতায়াতের কোন উপায় নাই—অন্তঃপুরে তাদের প্রবেশ করিবার হুকুম নাই। তাহারা এই দিক দিয়া বহির্বাটীতে যাতায়াত করে।

এই বলিয়া হরিমোহনবাবু হরিদাস গোয়েন্দাকে নিম্নতলের দিকে একটি দ্বার নির্দেশ করিয়া দেখাইলেন।

হরিদাস। দাস দাসীগণের ও রান্নাবাড়ির এই তিন মহলে কোন যোগাযোগ আছে?

হরিমোহন। না। তবে এই তিনটি মহলের বহির্দেশ দিয়া অর্থাৎ পুষ্করিণীর দিকে, সকলেরই এক একটা দরজা আছে। দাসীগণের ও অন্য মহলের ব্যবধানে পুষ্করিণীর দিকে লম্বা টানা পাঁচিল দেওয়া থাকাতে, আত্মীয় পরিজন সকলেই অন্তঃপুর হইতে সেই মহল দিয়া পুষ্করিণীতে যাতায়াত করিয়া থাকেন। এই কারণে দাসীগণের মহলের সহিত রান্নাবাড়ি ও দাসগণের মহলের সহিত কোন যোগাযোগ নাই। তবে রান্নাবাড়ি ও দাসগণের মহলের এতদুভয়েরই পুষ্করিণীর দিকে এক একটি দরজা থাকাতে এক প্রকার গোলযোগ আছে বলা যাইতে পারে অর্থাৎ ন দাসগণের মহল হইতে পুষ্করিণীর দিকের দরজা দিয়া বাহির হইয়া রান্নাবাড়ি হইতে দাসগণের মহলেও আসা যায়। আমার চাকরগণ সকলেই ঠিক বেলা একটার সময় রান্নাবাড়ির দরদালানে পাত পাতিয়া বসে, আর ব্রাহ্মণগণ তাহাদিগকে অন্ন ব্যঞ্জন পরিবেশন করেন। আহার কার্য ব্যতীত দাসগণের সহিত রান্নাবাড়ির আর কোন সম্পর্ক নাই। দাসীগণ অন্তঃপুরে আহার করে, সুতরাং তাহাদিগের সহিতও ব্রাহ্মণগণেরএবং দাসগণের মহলের সহিত কোন সম্পর্ক নাই।

হরিদাস। এই তিনটি মহলের ছাদে উঠিবার কি সিঁড়ি ওই একটি মাত্র?

হরিমোহন। হ্যাঁ। দাস দাসীগণের মহল হইতে ছাদে উঠিবার সিঁড়ি নাই। কেবল পাকশালার মহল হইতে ছাদে উঠা যায়। এই সিঁড়ি দিয়া উঠিয়াই ব্রাহ্মণগণ বহির্বাটীতে যে হলঘর দেখিয়া আসিয়াছেন, সেই ঘরে আহার্য বস্তু লইয়া গিয়া পরিবেশন করে।

হরিদাস গোয়েন্দা এইরূপ কথা কহিতে কহিতে ব্রাহ্মণগণের (অর্থাৎ পাকশালার) মহলের ছাদে আসিয়া দাঁড়াইলেন। এদিক ওদিক চারিদিক দেখিয়া হরিদাস জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এই দক্ষিণ দিকে আপনার অন্তঃপুরের মহল, কেমন?’

হরিমোহন। আজ্ঞা হ্যাঁ।

হরিদাস। এইটি মৃণ্ময়ীর ঘর, না? এই ঘরেই আমরা এইমাত্র প্রবেশ করিয়াছিলাম, কেমন?

হরিমোহন। আজ্ঞা হ্যাঁ।

হরিদাস। চলুন, আমার কার্য শেষ হইয়াছে, আর আমার কিছু দেখিবার আবশ্যক নাই।

তখন তাঁহারা উভয়ে বহির্বাটীর ঘরে আসিয়া বসিলেন।

হরিমোহন জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি কিছু স্থির করিতে পারিয়াছেন কি?’

হরিদাস। আপনার অলঙ্কার রাশি পাওয়া যাইতে পারে। বোধ হয় আমি চোর ধরিতে পারি।

হরিমোহনবাবু অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলেন, ‘আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। আমার বোধ হইতেছিল, আপনি এতক্ষণ বৃথা কার্যে কালাতিপাত করিতেছেন।’

হরিদাস গোয়েন্দা মৃদু হাসিয়া কহিলেন, ‘গোয়েন্দাগণ বৃথা কার্যে সময় নষ্ট করে না একথা আপনার মনে থাকা উচিত। সামান্য এক ফোঁটা রক্তের চিহ্ন দেখিয়া আমরা খুনী-আসামী ধরিয়া থাকি; সামান্য একগাছি চুল দেখিয়া আমরা ডাকাতির সন্ধান করিতে পারি; কত সামান্য বিষয় হইতে আমরা আমাদের কার্যের সূত্র বাহির করিয়া লই।’

হরিদাস আরও কি কথা বলিতে যাইতেছিলেন কিন্তু হরিমোহনবাবু অধিকতর ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আমার বাটীতে এদিক ওদিক ঘুরিয়া ফিরিয়া আপনি এমন কি সূত্র পাইলেন, যাহাতে আপনি এতদূর আশা ভরসা করিতেছেন?’

হরিমোহন। সে কথা আমি এখন আপনাকে কিছু বলিতে পারিতেছি না।

হরিদাস। তবে আপনি এখন কি করিবেন?

হরিমোহন। কি করিব, তাহাও আপনাকে আমি এখন কিছু বলিতে পারি না।

এই বলিয়া হরিদাস হরিমোহনবাবুর নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।

হরিমোহনবাবু হরিদাস গোয়েন্দার ভাব গতিক দেখিয়া কিছুই সিদ্ধান্ত করিতে পারিলেন না। হরিদাস গোয়েন্দার সুখ্যাতি তিনি সংবাদপত্রে পাঠ করিয়াছেন সুতরাং গোয়েন্দা অফিস হইতে তাঁহার কর্মে হরিদাস গোয়েন্দাকে পাঠানোতে বড় আনন্দ হইয়াছিল। এমন কি, তিনি স্থির করিয়াছিলেন যে হরিদাস গোয়েন্দা আসিবা মাত্রই অলঙ্কার রাশি বাহির করিতে পারিবেন; কিন্তু তিনি যখন বাটীতে উপস্থিত আত্মীয়স্বজনকে বিদায় দিতে বলিলেন এবং বাটীর কোন ঘরে খান্নাতল্লাসি না করিয়া চলিয়া গেলেন, তখন হরিমোহনবাবুর হরিদাসের কার্যকলাপের উপর বিশেষ সন্দেহ হইল।

হরিমোহনবাবু ভাবিতে লাগিলেন, এ অবস্থায় আর কোন গোয়েন্দা নিযুক্ত করা উচিত কিনা? অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া তিনি স্থির করিলেন, যখন একজনের উপর নির্ভর করিয়াছেন, তখন অন্য লোককে সে কার্যের ভার দিলে কার্যহানি হইবার সম্ভাবনা; আরো বিশেষত তাহাতে হরিদাস গোয়েন্দা বিরক্ত হইয়া তাঁহার কার্য পরিত্যাগ করিলেও করিতে পারেন, সুতরাং বিশেষ বিবেচনা করিয়া হরিমোহনবাবু আর কোন বন্দোবস্ত করিতে সাহস করিলেন না।

হরিদাস আপনার বাসায় ফিরিয়া আসিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত সন্ধ্যা না হইল ততক্ষণ অন্য নানা প্রকার কার্য শেষ করিতে লাগিলেন।

সন্ধ্যার কিছু পূর্বেই তিনি ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া আবার হরিমোহনবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলেন। এবার আর তিনি হরিমোহনবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসেন নাই, সুতরাং বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন না। বাটীর সম্মুখে রাস্তার ধারে, একটি মুদীর দোকানে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।

মুদী জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি কি চাও গো?’

হরিদাস পুরো মেদিনীপুর জেলার লোকের কথা ও স্বর অনুকরণ করিয়া উত্তর দিলেন, ‘আমি এইখানে আমার একজন চেনা লোককে খুঁজিতেছি।’

মুদী। যাহাকে খুঁজিতেছ তার নাম কি?

হরিদাস কিয়ৎক্ষণ মাথা চুলকাইয়া, আমতা আমতা করিতে করিতে উত্তর দিলেন, ‘তাইতো—নামটা আমার ঠিক মনে আসিতেছে না—’

মুদী বলিল, ‘তুমি তো আচ্ছা মেড়াকান্ত! নামটাও মনে নাই? আমরা কি হাত গুণে তোমার চেনা লোক কোথায় থাকে বলিয়া দিব না কি?’

হরিদাস তাঁহার পরিচিত ব্যক্তির নামটি স্মরণ করিবার ছলে, কিয়ৎক্ষণ ধরিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন। প্রকৃত পক্ষে, তিনি যাহা চিন্তা করিতেছিলেন, তাহা মুদীর কল্পনাতীত।

এইরূপ ক্ষণকাল চিন্তার পর, হরিদাস কহিলেন, ‘না, নামটি আমার এখন কিছুতেই মনে আসিতেছে না। আমি এখন এইখানে একটু বসি—বড় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি। এই পয়সা নাও; আমায় দু’পয়সার জলপান দাও। জলপান খাইতে খাইতে যদি নামটি মনে পড়ে তোমাদের বলিব। আর যদি একান্তই মনে না পড়ে, তাহলে যে মুখে আসিয়াছিলাম, সেই মুখেই ফিরিয়া যাইব।’

মুদী, ছদ্মবেশী হরিদাস গোয়েন্দার হাতে দু’পয়সার জলপান দিয়া কহিল, ‘আচ্ছা, সেই ভাল। তুমি ওইখানটায় গিয়া বসিয়া জলপান খাওগে। খাওয়া হইলে, তোমায় জল দেব। আর ইতিমধ্যে রাস্তার দিকে ঠিক চাইয়া থাকিও, যদি তোমার আলাপী লোক যায়, তাহলে তাকে ডাকিতে পারিবে। তাছাড়া এখানেও অনেক লোকের যাতায়াত আছে, তাদের দিকেও নজর রাখিও, যদি তার ভিতর তোমার চেনা লোক কেউ বাহির হইয়া পড়ে।’

হরিদাস এ সকল কথার কোন উত্তর দিলেন না। তিনি মুদীর কথায় কেবল দুই চারি বার মাথা নাড়িয়া, জলপান খাইতে আরম্ভ করিলেন।

এমন সময়ে মুদীর দোকানে একজন ব্রাহ্মণ কি দ্রব্য ক্রয় করিতে আসিল। হরিদাস আড়নয়নে তাহার প্রতি চাহিয়া রহিলেন।

মুদী জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হে ভূতনাথ! তোমার বাবুর জিনিসের কিছু কিনারা হল?’

ভূতনাথ এদিক ওদিক চাহিয়া উত্তর করিল, ‘কই, কিনারা তো কিছু বুঝিতে পারি না।’

মুদী। তোমার বাবু কি করিতেছেন?

ভূতনাথ। কি আর করিবেন—শুনেছি গোয়েন্দা লাগাইয়াছেন।

হরিদাস বুঝিলেন, সে লোকটি হরিমোহনবাবুর নিয়োজিত ব্রাহ্মণ। সুতরাং তাহার কথাবার্তায় তাঁহার কৌতূহল জন্মিল। কিন্তু পাছে তাঁহার অন্তরের ভাব কেহ জানিতে পারে, এইজন্য সে দিকে স্পষ্টত কিছুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া, ঘাড় হেঁট করিয়া জলপানে রত রহিলেন। তাঁহার সাজগোজ, চালচলন, আকারপ্রকার সন্দর্শনে কাহারো সন্দেহ করিবার কিছুই ছিল না; কেহ সন্দেহ করিল না।

মুদী কহিল, ‘গোয়েন্দা লাগাইয়া আর কি হইবে? আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, বাড়ির লোকের দ্বারাই একাজ হইয়াছে।’

ভূতনাথ। বল তো ভাই! নইলে কি ঘরের ভিতর থেকে, অমন দামী জিনিসগুলো আসমানে উড়িয়া গেল নাকি?

মুদী। আর এ তো বড় আশ্চর্যের কথা! ঘরের ভিতর জিনিস রাখিয়া ঘরে চাবি দিয়া চলিয়া গেল, তার ভিতর থেকে কেমন করিয়া চুরি করিলে ভাই? এরকম তো কখনো শুনি নাই।

ভূতনাথ। শুধু কি তাই? আবার গয়নাগুলো নাকি বাবুর মেয়ে একটা বাক্সর ভিতর পুরিয়া, চাবি দিয়া নিচে নামিয়া গিয়াছিলেন। একেবারে সে বাক্সকে বাক্স শুদ্ধ লোপাট! যেন ভোজবাজির খেল!

মুদী। চোরের বাহাদুরী আছে বটে! একবাড়ি লোক গিসগিস করিতেছে, তারি ভিতর থেকে, তালাবন্দী দরজা খুলিয়া, মাল বাহির করিয়া নিয়া গিয়াছে, অথচ দরজায় যেমন চাবি দেওয়া তেমনি রহিয়াছে! বড় আশ্চর্যের কথা, ভূতনাথ! যেন মন্তরে সব কাজ সারিয়াছে।

ভূতনাথ। আর আমায় বললে কি হবে দাদা! আমারও তাক লাগিয়া গিয়াছে! এখন যেন সব অসম্ভব সম্ভব বলিয়া বোধ হইতেছে।

মুদী। আচ্ছা ভূতনাথ! তোমার কারুর উপর সন্দেহ হয় না?

ভূতনাথ। সন্দেহ আর কার উপর করব বল? বাবুর বাড়ির ভিতর তো কোন পুরুষ ঢুকিতে পায় না—কারুর যাবার হুকুমও নাই। সব কড়াকড়ি বন্দোবস্ত? এর ভিতর থেকে কোন পুরুষ চোর যে গিয়া একাজ করিবে, তা তো আমার বিশ্বাসই হয় না। তবে যদি—

এই কথা বলিয়া ভূতনাথ একটু থামিয়া গেল। তারপর একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, কেহ তাহার কথায় কর্ণপাত করিতেছে কি না। হরিদাস গোয়েন্দা যেমন জলপান করিতেছিলেন, সেই ভাবেই নতমুখে আহার করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে সন্দেহ করিবার যদি কোন কারণ থাকিত, তাহা হইলেও বা একটা কথা ছিল, কিন্তু তাঁহার ছদ্মবেশ কেহই অনুমান করিতে পারে নাই বলিয়া, মুদী ও ভূতনাথের কথাবার্তা পূর্ববৎই চলিতে লাগিল।

ভূতনাথ যখন চারিদিক উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিয়া বুঝিতে পারিল যে সেই সকল কথা শুনিবার জন্য কেহই কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া নাই, তখন সে আবার বলিতে লাগিল, ‘কি জানো ভায়া। বড় ঘরের বড় কথা! তুমি আমি সে কথা কয়ে কি ফাঁসি যাব? এই জন্যে সাবধান হয়ে কথা কইতে হয়; কি জানি যদি কেউ শুনিয়া ফেলে—’

বাধা দিয়া মুদী কহিল, ‘আ! শুনিলে তো বড় বয়েই গেল! এত টাকার গয়না চুরি গিয়াছে, দেশ শুদ্ধ রাষ্ট্র হইয়া গেল—যার তার মুখে ওই কথা শুনা যাচ্ছে, আর আমরা সেই কথা কইলেই বুঝি যত দোষ? আমরা তো আর চুরি করি নাই— তা’র ভয়টা কি?

ভূতনাথ। তোমার আর ভয় কি? তুমি তো আর কারুর চাকর নও! ভয় যা কিছু আমাদেরই—

মুদী। কেন? তোমাদেরই বা ভয় কিসের? দোষ থাকিলে তো ভয় করিবে, শুধু শুধু ভয় করবে কেন?

ভূতনাথ। ভয় নেই? তুমি কি বুঝিবে বল? বাবুদের তো আর গুণের ঘাট নাই—বলিলেই হইল, অমুক চুরি করেছে—

মুদী। এটি ভাই তোমার অন্যায় কথা! সকল বিষয়েরই একটা সম্ভব অসম্ভব আছে তো? অমনি যা হয় একটা বলিলেই তো আর হইবে না—

এই প্রকার কথা হইতেছে, এমন সময় একজন দাসী তথায় আসিল। তাহাকে দেখিয়া মুদী সহসা চুপ করিল; ব্রাহ্মণ যে দ্রব্য ক্রয় করিতে আসিয়াছিল, তাহা লইয়া চলিয়া গেল। মুদী জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি গো মঙ্গলা! গয়না টয়নাগুলোর কিছু সন্ধান হইল না?’

দাসী। কই আর হল বল? সে কি আর মানুষে নিয়েছে যে সন্ধান হবে।

মুদী হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘মানুষে নেয় নাই তো নিলে কে?’

দাসী। কি জানি বাছা! বাক্সয় চাবি দেওয়া—ঘরে চাবি দেওয়া—গয়নাগুলো কি আর মন্তরে উড়ে গেল? ভূতে নিয়াছে! ভূতে নিয়াছে! একি মানুষের কম বাছা?

এইরূপ কথা বলিয়া, মঙ্গলা মুদীকে দুই তিনটি ভৌতিক গল্প শুনাইল। মুদী দাসীর কথা শুনিয়া হাসিয়া অস্থির হইল। যখন মঙ্গলা দেখিল, তাহার মূল্যবান কথাগুলির কোন সুফল দর্শিল না, তখন সে বিরক্ত হইয়া চলিয়া গেল। মুদীর তখনো হাসি থামিল না।

অনেকক্ষণ পরে হাসির বেগ একটু কমিয়া আসিলে পর মুদী হরিদাস গোয়েন্দার দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হে তোমার জলপান খাওয়া হইল?

হরিদাস তখন ঘাড় তুলিয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ ভাই! এইবার একটু জল দিতে বল। অনেকটা পথ ঘুরিয়া ঘুরিয়া বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেম, তাই জিরিয়ে জিরিয়ে, দুটি চারটি করিয়া জলপানগুলি খাচ্ছিলেম—’

হরিদাসের এই প্রকার কথা শুনিয়া মুদীর প্রাণে একটু দয়ার সঞ্চার হইল। সে বলিল, ‘আহা! বটে! বটে! তা তুমি না হয় আর একটু বিশ্রাম কর। আমাদের এ দোকান রাত্তির দুপুর পর্যন্ত খোলা থাকে। তুমি স্বচ্ছন্দে ততক্ষণ বসিয়া জিরোতে পার। আর এর মধ্যে যদি তোমার সেই চেনা লোকটিকে দেখতে পাও, তাহলে ভালই হইবে। আমার বোধ হয় তুমি ভুল করিয়াছ। হয়তো এ পাড়ায় তোমার চেনা লোক কেউ নাই। নইলে আমার দোকানে কত লোক আসা যাওয়া করে—এই তোমার সামনেই কত লোক আসিল গেল—যদি সে লোক এ পাড়ার হইত, তাহলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই তুমি দেখিতে পাইতে। তার নামটি কি তোমার মনে হইল না? যদি নামটি বলিতে পারিতে, তাহলে আমি তোমায় এখনি তার সন্ধান বলিয়া দিতে পারিতাম। তোমাদের দেশের লোকের মধ্যে আমি এখানকার প্রায় সকলকেই চিনি। তাদের গোটাকতক নাম করিব? তাহলে যদি তোমার মনে হয়—’

হরিদাস মুদীর কথায় বাধা দিয়া কহিলেন, ‘না থাক, তার আর কাজ নাই। আর খানিকটা দূর গেলেই আমার আর একজন আলাপী লোকের সঙ্গে দেখা হইবে। আমি তার বাসায় আজ রাত্তিরে থাকিব। সেই আমায় সব ঠিকঠাক বলিয়া দিতে পারিবে।’

এইরূপ কথা কহিতে কহিতে, রাস্তায় একজন লোককে চলিয়া যাইতে দেখিয়া, তিনি সহসা উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

মুদী তাঁহাকে সহসা এইরূপভাবে উঠিয়া দাঁড়াইতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘ও কি? তুমি জল খাইলে না? অমনি অমনি চলিয়া যাইতেছ যে?’

হরিদাস গোয়েন্দা তখন একেবারে দোকানের সেই বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। মুদীর কথায় একটা উত্তর না দিলে, পাছে তাহার মনে কোন প্রকার সন্দেহ হয়, এইজন্য তিনি কহিলেন, ‘থাক, আমার তত তেষ্টা পায় নাই—আমি চললেম—কাল বোধ হয় আবার তোমাদের এদিকে আসিতে হইবে—তখন কথা হইবে এখন।’

এই বলিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন। মদী তখন বিস্মিতের ন্যায় দোকানের আর একটি লোকের পানে চাহিয়া বলিল, ‘এ কি! লোকটা পাগল না কি?’

যে লোকটির দিকে চাহিয়া মুদী এই কথা বলিয়াছিল, সে হরিদাসের জন্য এক ঘটি জল লইয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সেও তাঁহার এই অলৌকিক ব্যবহারে আশ্চর্যান্বিত হইয়া উত্তর করিল, ‘আমি তাই ভাবিতেছি, লোকটা পাগল না কি?’

এই সময়ে দোকানের আর একজন লোক বলিল, ‘ওহে, দেখ, এদিকে চাহিয়া দেখ, লোকটা যে দু’পয়সার জলপান কিনিয়াছিল, তার কিছুই খায় নি। সবই প্রায় এইখানে ছড়াইয়া ফেলিয়া রাখিয়া গিয়াছে।’

তখন দোকানের আর যে যে ছিল, সকলেই উঠিয়া সেইখানে দেখিতে আসিল। দেখিল, সত্য সত্যই লোকটি জলপান খাইবার ভান করিয়া বসিয়াছিল মাত্র, কিন্তু তাহার কিছুমাত্র আহার করে নাই। লোক দেখাইবার মত দুই একবার গালে তুলিয়াছিল মাত্র, কিন্তু অধিকাংশ পার্শ্বদেশে ফেলিয়া দিয়াছে। তখন সেই সকল লোকগুলির মধ্যে যে বয়োজ্যেষ্ঠ, সে বলিল, ‘এ লোকটা নিশ্চয়ই গোয়েন্দার চর! ও এখানে কাউকে খুঁজিতে আসে নাই। ন্যাকামি করিয়া বসিয়াছিল, আর কে কি বলে তাই শুনিতেছিল, এ আমি নিশ্চয় বলিতে পারি।’

আর একজন বলিল, ‘ঠিক বলেছ ভাই! আমারও তাই বোধ হইতেছে। গোয়েন্দার চর না হইলে কি এমন সাফ এতগুলো লোকের চক্ষে ধুলো দিয়া যাইতে পারে?’

একজন বলিল, ‘আচ্ছা ও যদি গোয়েন্দাই হইবে, তাহলে অমন করিয়া সাজিয়া আসিবে কেন?’

‘তা না আসিলে লোকে টের পাইবে। যে চোর, সে সন্ধান পাইলে যে সাবধান হইয়া যাইবে। গোয়েন্দারা কত রকম সাজিয়া বেড়ায় তা তুই কি জানবি?’

‘আচ্ছা ভাই! অমন মেদিনীপুরের লোকের মত কথা কহিলে কেমন করিয়া?’

‘তা গোয়েন্দারা সব পারে।’

‘বাহাদুরি আছে, বলিতে হইবে!’

মুদীর দোকানের লোকগুলি তো এইরূপে ছদ্মবেশী হরিদাসের কথা লইয়া আন্দোলন করিতে থাকুক, ইতিমধ্যে হরিদাস কাহার সন্ধানে কোথায় গেলেন, কৌতূহলাক্রান্ত পাঠকগণের সন্তোষার্থে তাহা বিবৃত করা উচিত। কিন্তু সে কথা, তিনি নিজে যেরূপ বর্ণনা করিয়াছিলেন, সেইরূপ ভাবে লিখিত হইলেই পাঠকগণের পক্ষে, অধিকতর তৃপ্তিজনক হইবে, এই বিবেচনায়, পর পরিচ্ছেদে অবিকল তাঁহার মুখের কথাই উদ্ধৃত হইল।

‘মুদীর দোকান হইতে সহসা নিষ্ক্রান্ত হইবার আমার বিশেষ কোন কারণ ছিল। কোন একটি লোককে, মুদীর দোকানের সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইতে দেখিয়া সহসা আমি অত তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া পড়িয়াছিলাম। তাহার পিছনে পিছনে আমাকে অনেক দূর যাইতে হইয়াছিল। সিমলা কাঁসারি পাড়া, চোরবাগান হইয়া সে লোকটি ক্রমাগতই অগ্রসর হইতে লাগিল। আমিও তাকে সহজে ছাড়িলাম না। ঠিক তাহার পশ্চাতে, অথচ একটু দূরে রহিলাম। সে মাঝে মাঝে পিছন ফিরিয়া দেখিতে লাগিল, কিন্তু আমি যে তাহার পিছু লইয়াছি, তাহা বোধ হয় অনুভব করিতে পারিল না।

‘চোরবাগানের মোড় ছাড়াইয়া সে বাঁশতলার গলির ভিতর প্রবেশ করিল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়াই দেখিলাম, রাস্তায় একজন লোকের সহিত সাক্ষাৎ হওয়াতে, পথিমধ্যে সেই লোকটি তাহার সহিত কথাবার্তা কহিতে লাগিল। আমি ভাবিলাম, যদি সে অবস্থায় আমিও দণ্ডায়মান হই, তাহা হইলে আমার কার্য-কলাপের উপর সে সন্দেহ করিতে পারে। অন্তত বুঝিতে পারে যে, আমি তাহার পিছু লইয়াছি। কাজে কাজেই আর কোন উপায়ান্তর না দেখিয়া, আমিও অগ্রসর হইলাম। যাইবার সময় শুনিলাম, সে বলিতেছে, ‘পাগল আর কি?’

‘একথা শুনিয়া, তাহাদিগের কি কথাবার্তা হইতেছিল, তাহা ঠিক অনুমান করা গেল না। আমি যখন তাহাদিগকে ছাড়াইয়া খানিকটা দূর চলিয়া গিয়াছি, তখন তাহারা ছাড়াছাড়ি হইল। আমি যাহার পিছু লইয়াছিলাম, সে সম্মুখস্থ গলির ভিতর প্রবেশ করিল আর অপর লোকটি আমি যেখানে দাঁড়াইয়াছিলাম সেই দিকে আসিতে লাগিল। তাহাকে দেখিয়া আমি নিকটস্থ একটি অন্ধকার গলির মধ্যে প্রবিষ্ট হইলাম। সে লোকটি গলি পার হইয়া চলিয়া গেলে পর, আমি ছদ্মবেশ পরিবর্তনের চেষ্টা করিলাম। যে শতগ্রন্থি মলিন বসন পরিধান করিয়াছিলাম, তাহার অভ্যন্তরে মালকোচা মারা ভাল কাপড় পরা ছিল। সেই কাপড়ের ভিতর একজোড়া হালকা তালতলার চটিও ছিল। কোমরে চাদর জড়াইয়া রাখিয়াছিলাম। একটি পাতলা (সুইস) কাপড়ের জামাও সেই চাদরের সহিত ভাঁজ করা ছিল। গোয়োন্দাগিরি করিতে গেলে, কখন কি আবশ্যক হয়, তাহা তো বলা যায় না, সুতরাং পূর্ব হইতেই এই প্রকার আয়োজন করিয়া, আমায় বাটী হইতে বহির্গত হইতে হইয়াছিল।

‘দুই চারি মুহূর্তের মধ্যে, মেদিনীপুরের চাষা জংলী, একজন ফিট্ বাবুতে পরিণত হইল! আর তখন আমাকে চিনিবার উপায় নাই! এমন কি, যে মুদীর দোকানে বসিয়া কিছুক্ষণ পূর্বে জলপান লইয়া আহার করিতেছিলাম, সেও আমায় দেখিলে আর চিনিতে পারিত কিনা সন্দেহ। মুখে, হাতে, পায়ে একটু বিলাতী রং মাখানও ছিল, তাহাও সেই ছিন্ন ভিন্ন বসনে মুছিলাম। দুই হাত দিয়া, মাথার চুলে চিরুণী ব্রুসের কার্য সারিয়া লইলাম।

‘দুই চারি মুহূর্তের পরেই আমি সেই গুপ্তস্থান হইতেই বহির্গত হইয়া (আমি যাহার পিছু লইয়াছিলাম সে যে গলিতে প্রবেশ করিয়াছিল) সেই গলিতে প্রবেশ করিলাম। কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।

‘গলিটার মধ্যে, দূরে দূরে, দু’একটা তেলের আলো জ্বলিতেছিল; সেই আলোকে যতদূর সম্ভব দেখিলাম, কিন্তু কাহাকেও পাইলাম না। একটা বাড়ির বহির্দেশের কক্ষে মিটিমিটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল, আর সেই আলোকের সম্মুখে বসিয়া দুইজন লোক কথা কহিতেছিল। আমি তদ্দর্শনে গবাক্ষের ফাঁক দিয়া যেমন দেখিতে যাইব, অমনি পশ্চাদ্দিক হইতে সহসা একজন আমার মুখ টিপিয়া ধরিল আর একজন একখানা চাদরে আমার মুখ চোখ বাঁধিয়া ফেলিল। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও তাহাদের হাত ছাড়াইতে পারিলাম না। বোধ হইল, দুইজনে আমার হস্ত আর দুইজনে আমার পা ধরিয়াছে। উপায়ান্তর না দেখিয়া আমি নিরস্ত হইলাম। তাহারা আমায় শূন্যে শূন্যে (ছেলেবেলায় দুই ছাত্রকে গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় যেরূপ চ্যাংদোলা করিয়া লইয়া যায়, সেইরূপ) লইয়া চলিল। আমার নিশ্বাস প্রশ্বাস প্রায় বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছিল, অথচ আমি কিছু বলিতে পারিতেছিলাম না। অনেক বিপদে পড়িয়াছি কিন্তু এরূপ অসহায় অবস্থা কখনো ঘটে নাই। তাহারা আমায় বহন করিয়া সেই অন্ধকার গলির ভিতর কিয়দ্দূর লইয়া গিয়া, একটা বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল। একজন বলিল, ‘ওরে, আমার সেই বড় ভুঁজিয়ালী (ছোরা) খানা নিয়া আয় তো। আজ বেটার পেট ফাঁসাইয়া দিব।’

‘এই কথা শুনিবামাত্র আমি শিহরিত হইলাম। কিন্তু বিপদে ধৈর্য ধারণ করা আমার অভ্যাস, সুতরাং অধীর না হইয়া, স্থির ভাবে রহিলাম। মুটেরা মালের বস্তা নামাইতে হইলে, যেমন ধপাস করিয়া ফেলিয়া দেয়, তাহারাও সেই প্রকার আমার দেহটিকে মমতাশূন্য হইয়া ধপাস করিয়া একটা ঘরের মেঝের উপর ফেলিয়া দিল। আমার শরীরে তাহাতে দারুণ আঘাত লাগিল বটে, কিন্তু অতিকষ্টে তাহা সহ্য করিলাম। তাহারা আমাকে স্থিরভাবে পড়িতে দেখিয়া বিস্মিত হইল। একজন বলিল, ‘ও কি রে! ব্যাটা যে নড়ন চড়ন রহিত! অক্কা পেলে না কি?’

‘আর একজন উত্তর করিল, ‘তা হইতে পারে, তুই যে করে মুখ বাধিয়াছিলি, হয়তো দম আটকাইয়া মারা গিয়াছে।’

‘আমি ভাবিলাম, এ অবস্থায় এ সুযোগ মন্দ নয়। স্থির করিলাম, যদি ইহারা, আমার মৃত্যু হইয়াছে কি না দেখিতে আসে, তাহা হইলে এমনভাবে নিশ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ করিয়া থাকিব যে, ইহারা আমায় মৃত বলিয়া স্থির করিবে।

‘তাহাদের মধ্যে দুই একজন আমাকে দেখিতে আসিল। আমি কাটাপনা হইয়া পড়িয়া রহিলাম। একজন একটি দিয়াশলাই জ্বালিয়া আমার মুখের কাছে ধরিল, আর একজন বুকে ও নাকে হাত দিয়া দেখিল। সকলেই তখন সিদ্ধান্ত করিল আমার মৃত্যু হইয়াছে।

যাহাকে ছোরা আনিতে বলা হইয়াছিল, সে সেই সময় আসিয়া পঁহুছিল। একজন বলিল, “আর ছোরার দরকার নাই। অমনি অমনি ব্যাটা কৃষ্ণ পাইয়াছে। এখন এর একটা উপায় কি করা যায় বল দেখি?”

‘সে লোকটা প্রথমে তাহাদিগের কথায় বিশ্বাস করিল না। সে একটি দিয়াশালাইয়ের কাঠি জ্বালিয়া আমার সর্বাঙ্গ নিরীক্ষণ করিল।

‘তাহার দেখা শেষ হইলে দলের একজন জিজ্ঞাসা করিল, ‘দেখ সাক্ষাৎ জ্যান্ত মানুষটাকে খুন করিয়া ফেলা গেল—এখন উপায়?’

“আচ্ছা লোকটা কে বল দেখি?”

‘ও এক ব্যাটা গোয়েন্দা না হইয়া আর যায় না। বামনাটা বলছিল না, যে একটা গোয়েন্দা তার পিছু নিয়াছে।’

‘তা ও যদি অন্য লোক হয়। আহা! তাহলে একটা নির্দোষ মানুষকে খুন করে ফেলা হইয়াছে।’

‘আহা! তোমার আর অত দয়ায় কাজ নেই।’

‘না, তা বলতেছি না। তবে কি জান, ও যদি সেই গোয়েন্দা না হয়—তাহলে—’

“তাহলে—তাহলে—তাহলে আর হইবেটা কি? ও অমন করে উঁকি ঝুঁকি মারছিল কেন? ওর দোষেই ও মরেছে—”

‘আর এই যে ছোরা নিয়ে পেটটা ফাঁসিয়ে দেবে বলছিলে।’

‘আরে বললেমই বা। করতুম কিনা, তা তুই কি করে জানবি।’

‘না তা তোমার সে গুণে ঘাট নেই। পেট ফাঁসিয়ে নাড়ি ভুঁড়ি বার করে দিতে তুমি খুব মজবুত। এই ক’দিনের ভিতর প্রায় পাঁচ ছ’টা পাচার করলে।’

‘যাক, সে কথা যাক—এখন কি করা যায় বল?’

‘যা বরাবর করে আসছ তাই করবে। ওর আর জিজ্ঞাসা করছ কি?’

‘একবার বামনাটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে হয় না?’

‘সে তো এসেই বলেছে একজন লোক তার পিছু নিয়েছে।’

‘তবু একবার তাকে ডেকেই দেখ না? অন্তত এই লোকটাই তার পিছু নিয়েছিল কি না জানা যাবে এখন।’

‘তাহারা ভিন্ন ভিন্ন জনে এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন কথা কহিতে লাগিল। আমি কাহকেও চিনিতাম না, সুতরাং কাহারো নাম দিতে পারিলাম না।

‘আমার বোধ হইল তাহারা গুণ্ডা। লোকের নিকট অর্থ লইয়া, তাহার হুকুম মত কাজ করে। তাহাতে প্রাণের মায়া দয়া রাখে না। আমি কি করিয়া এইরূপ মায়া-মমতাহীন নরপিশাচগণের হস্ত হইতে উদ্ধার পাইব, তাহার কোন উপায় স্থির করিতে পারিলাম না। আসন্ন বিপদ বুঝিয়াও ধৈর্যাবলম্বন করিয়া রহিলাম; কিন্তু প্রাণে বড় ভয় হইতে লাগিল। কি জানি যদি এই অসহায় অবস্থায় এক ঘা ছোরা বসাইয়া দেয়।

‘অনেক তর্ক বিতর্কের পর তাহারা “বামনাটাকেই” ডাকা সাব্যস্থ করিল। আমি যেমন চুপ করিয়া ছিলাম, সেই রকমই রহিলাম। একজন একটা প্রদীপ আনিতে ও আর একজন সেই “বামনাটাকে” ডাকিতে গেল।

‘আমি জানিতাম, আমি যাহার পিছু লইয়াছিলাম সে যদি সেই “বামনা” হয়, তাহা হইলে কখনোই আমায় চিনিতে পারিবে না। কারণ সে আমায় যে ভাবে ও যে প্রকার মলিন শত-গ্রন্থিবিশিষ্ট বসন পরিধৃত দেখিয়াছিল, এখন সে সমস্তই বিলুপ্ত হইয়াছে। তাহার চিহ্নমাত্রও নাই। সুতরাং তাহার পক্ষে আমায় চিনিয়া লওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব।

একটা লোক, একটি প্রদীপ লইয়া আসিল এবং বোধ হইল তাহার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি লোকও প্রবেশ করিল। একজন জিজ্ঞাসা করিল, ‘কই দেখি? আমি দেখিলেই ঠিক বলিতে পারিব।’

এই কথা বলিয়া সে আমার নিকটবর্তী হইল। সঙ্গে সঙ্গে আরও চারি পাঁচ জনও আসিল। সে বলিল, “না, এ কখনোই নয়। এ তোরা কাকে খুন করেছিস। এ একজন অপর লোক। আহা, একে কেন মারলি—”

‘থাক, তোমায় আর দুঃখের কান্না কাঁদতে হবে না। যা করে ফেলেছি তার তো আর কোন উপায় নাই। তারপরে বিহিত করা যাবে।’

‘আমি বুঝিলাম, সে লোকটি, তাহাদের কথিত “বামনাই” বটে। আমাকে সে চিনিতে পারিল না, সুতরাং বিনা বাক্য-ব্যয়ে ফিরিয়া গেল।

‘মুদীর দোকানে হরিমোহনবাবুর পাচক ব্রাহ্মণ যেরূপভাবে অলঙ্কার অপহরণের কথা কহিতেছিল, তাহাতে তাহার উপর আমার সন্দেহ হয়। সে সন্দেহের কারণ যে কেবল তাহার কথাবার্তা শুনিয়াই জন্মিয়াছিল তাহা নহে। তাহার উপর সন্দেহ হইবার অন্য কারণও ছিল। হরিমোহনবাবুর বাড়িতে আমি এমন কোন সূত্র পাইয়াছিলাম যাহাতে আমার পাচক ব্রাহ্মণগণের উপর সন্দেহ হইতে পারে।

পাচক ব্রাহ্মণ মুদীর দোকানে কথা কহিতে কহিতে, মঙ্গলা দাসীকে দেখিয়া সরিয়া যায়। কিয়ৎক্ষণ পরেই তাহাকে অবস্থাপোযোগী ফিটফাট বাবু সাজিয়া ত্বরিতপদে মুদীর দোকানের সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইতে দেখিয়া, আমি তাহার অনুগামী হই। তারপর যে যে ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা পাঠকগণ সমস্তই জানেন। এই “বামনাই” সেই ব্রাহ্মণ!

“বামনা” চলিয়া গেলে, গুণ্ডাগণ আমার ‘বিহিত’ করিতে লাগিল।

একজন বলিল, ‘লাশ রাস্তায় ফেলিয়া দাও।’

আর একজন উত্তর করিল, ‘সুবিধার কথা নয়! এ ইংরাজের রাজত্ব!’

‘তা বয়ে গেল কি? কে খুন করিয়াছ তা কে জানে?’

‘কাজ কি বাবা, অত গোলমালে! সাদাসিধে কাজ রফা কর না।’

‘না—খবরদার! রক্তারক্তিতে কাজ নাই! যখন একাজে গোয়েন্দা লাগিয়াছে, তখন ইহার চিহ্ন মাত্র রাখা হইবে না। কি জানি, কিসে কি হয়।

তারপর তাহারা চুপি চুপি কি পরামর্শ করিল, আমি ভাল শুনিতে পাইলাম না। তবে যে দু’একটা কথা আমার কানে গিয়াছিল, তাহাতেই বুঝিলাম, আমায় সেই বাটীর ভিতরকার পাতকূয়ায় ফেলিয়া দিবে।

একজন বলিল, ‘তবে এখন এই রকমই থাক। রাত্রি একটার সময় সে কাজ হবে এখন। এখন ওখানে ‘বামনাটা’ কি রকম ভাগ বাঁটরা করছে দেখা যাক চল। তেমন দু’পয়সা না পাওয়া যায়, তাহলে তা’কেও—’

সকলেই তাহাতে সন্তুষ্ট হইল এবং একে একে সে কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া চলিয়া গেল। তাহারা চলিয়া গেলে, আমিও বাহির হইলাম।

আমি দেখিলাম, তাহারা খানিকটা দূর গিয়া একটা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল। আমি আর সে বাড়ির দিকে না গিয়া, সেই গলির ভিন্ন দিক দিয়া বড় রাস্তায় বাহির হইলাম। সম্মুখেই একজন ঘাঁটির পাহারাওয়ালা দণ্ডায়মান ছিল, তাহাকে ডাকিয়া একটু আড়ালে লইয়া গিয়া সমস্ত কথা সংক্ষেপে বলিলাম এবং আত্মপরিচয় প্রদান করিলাম। সে বড় বড় দুই চারিটি সেলাম বাতাইয়া হুকুম প্রার্থনা করিল। আমি তাহাকে আবশ্যক মত উপদেশ প্রদান করিয়া ত্বরিতপদে অপর রাস্তা দিয়া ঘুরিয়া আসিয়া, যে স্থলে আমার ছিন্ন ভিন্ন মলিন বসন লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম, সেই স্থানে ফিরিয়া আসিলাম। তথায় আমার দুইটি ছোট পিস্তলও লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম। বিশেষ কোন আবশ্যক হইবে না ভাবিয়া তাহা লইয়া যাই নাই। এখন তাহার প্রয়োজন হওয়াতে দুই হস্তে দুইটি গ্রহণ করিয়া পাহারাওয়ালাগণের আগমন প্রতীক্ষায় অন্ধকারে লুক্কায়িত ভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম।

পনেরো বা কুড়ি মিনিটের মধ্যেই ছদ্মবেশী পাহারাওয়ালাগণ একে একে অসম্বদ্ধভাবে চলিয়া যাইতে লাগিল। আমি তাহাদিগের একজনকে দেখিবামাত্রই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, দলবল সমেত তাহারা উপস্থিত হইয়াছে। আর অপেক্ষা করিবার কোন আবশ্যক দেখিলাম না বলিয়া, পিস্তল দুইটি চাদর জড়াইয়া কোমরে রাখিলাম। তারপরেই গুপ্তস্থান হইতে বহির্গত হইয়া, সেই গলিতে প্রবেশ করিলাম।

দেখিলাম, যেরূপ উপদেশ দিয়াছিলাম, পাহারাওয়ালাগণ ঠিক সেইরূপ কার্য করিতেছে। আমাকে গলিতে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কেহ কিছু বলিল না কিন্তু আমার সম্মুখ দিয়া আর একজন গলি হইতে বহির্গত হইবামাত্রই একজন ছদ্মবেশী পাহারাওয়ালা তাহার পিছু লইল।

আর মুহূৰ্তমাত্র অপেক্ষা না করিয়া, যে বাটীতে আমার আক্রমণকারীগণকে প্রবেশ করিতে দেখিয়াছিলাম, সেই বাটীতে একক প্রবেশ করিলাম। সহসা এক ধাক্কা মারিয়া দ্বার উন্মোচন করিয়া ফেলিতেই, যে কয়জন কক্ষমধ্যে মুখোমুখি করিয়া বসিয়াছিল তাহারা সকলেই আমার দিকে চাহিল। দুই একজন, অলঙ্কারগুলি সরাইয়া ফেলিবার উপক্রম করিল। আমি তদ্দর্শনে কঠোর স্বরে কহিলাম, ‘খবরদার! একখানি গয়নাতেও হাত দিও না।’

আমাকে একক দেখিয়া দুই চারিজন লাঠি সোঁটা ও ছোরা ছুরি লইয়া ভীষণ মূর্তিতে উঠিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিবামাত্র, আমি কটিদেশ হইতে দুই হস্তে দুইটি পিস্তল বাহির করিয়া ‘দমাস্‌’ ‘দমাস্‌’ করিয়া শূন্যে দুইটি আওয়াজ করিলাম। যে যে উঠিবার চেষ্টা করিতেছিল, মৃত্যু ভয়ে ভীত হইয়া তাহারা বসিয়া পড়িল।

ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টর সাহেব দলবল লইয়া উপস্থিত হইলেন।

আমি পুনরায় পিস্তল উঠাইয়া বলিলাম, ‘খবরদার! যে একটু নড়িবে চড়িবে, এখনি তার প্রাণ যাইবে।’ পিস্তলের আওয়াজ শুনিয়া আর পুলিশের দলবল দেখিয়া সকলেই হতভম্ব হইয়া গেল।

আমার ইঙ্গিতমত, দুই দুই জন পাহারাওয়ালা, এক একজন লোকের উপর লাফাইয়া পড়িল। অতি সহজেই সে ঘরে যে কয়জন বসিয়াছিল তাহারা বন্দী হইল। বোধ হয়, তাহারা দুই এক মু্হূর্ত ভাবিবার সময় পাইলে, এত সহজে ধরা দিত না। অন্তত পুলিশের হাত হইতে আত্মরক্ষাৰ্থ একবার প্রাণপণে চেষ্টা করিত।

যখন সকলের হাতে হাতকড়ি পড়িল, তখন বজ্রগম্ভীর স্বরে চোখ মুখ রাঙ্গাইয়া আমি সেই পাচক ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এ ছাড়া আর কোন অলঙ্কার আছে?’

সে প্রথমে আমার কথায় উত্তর দিল না। তারপর ইন্সপেক্টর সাহেবের রুলের গুঁতো বড় মিষ্ট লাগাতে, কাঁদো কাঁদো স্বরে কহিল, ‘না।’

অলঙ্কারগুলি বাক্সবন্দী করিয়া চাবি দিয়া আমি তাহা নিজ হস্তে লইলাম। বন্দীগণকে চালান দিবার ও অন্য কার্যের ভার ইন্সপেক্টর মহাশয়ের উপর দিয়া আমি গলির মোড়ে আসিয়া একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া একেবারে হরিমোহনবাবুর বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। অলঙ্কারগুলি পাইয়া হরিমোহনবাবু যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইলেন এবং সমস্ত গহনা তাহাতে আছে কি না জানিবার জন্য বাক্সসমেত বাড়ির ভিতর লইয়া গেলেন।

অল্পক্ষণ পরেই ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ‘সমস্ত গহনাই পাওয়া গিয়াছে, কিছুই খোয়া যায় নাই।’

তখন আমি তাঁহাকে সমস্ত ঘটনা বলিলাম। তিনি তাহা শ্রবণে কখনো পুলকিত, কখনো বিস্মিত এবং কখনো বা শিহরিত হইতে লাগিলেন। শেষে বলিলেন— ‘সার্থক আপনাদের বুদ্ধিবল! সামান্য একটি বাঁশ দেখিয়া আপনি এই সমস্ত পূর্ব হইতেই অনুমান করিয়াছিলেন!’

হরিমোহনবাবুর বাটীর অবস্থা ও মৃণ্ময়ীর ঘর দেখিয়া এবং সমস্ত বৃত্তান্ত শুনিয়া, কেমন করিয়া অলঙ্কার চুরি হইল তাহা অনুমান করা বড়ই দুঃসাধ্য। আমি প্রথমে মনে করিয়াছিলাম কোন আত্মীয় স্ত্রীলোক কিম্বা দাসীগণের মধ্যে কেহ অপহরণ করিয়াছে। কিন্তু মৃণ্ময়ীর ঘরের উন্মুক্ত বাতায়ন পথে দণ্ডায়মান হইয়া যখন আমি হরিমোহনবাবুকে পুষ্করিণীর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, সেই সময়েই প্রকৃত সূত্র অবগত হই।

আমি দেখিতে পাই, মৃণ্ময়ীর ঘরের পার্শ্বে একটি একতলা ছাদের উপর একটি সরু বাঁশ পড়িয়া আছে। তখনই আমার মনে হয় যে সেই বাঁশটি জানালার গরাদের ভিতর গলাইয়া, কক্ষাভ্যন্তরস্থ বাক্সের কড়ায় পরাইয়া দিয়া, তাহা উঠাইয়া জানালার ধার অবধি আনা যায় কিনা এবং তারপর সেই বাক্স কাত করিয়া জানালার ভিতর হইতে বাহির করিয়া লওয়া সম্ভব কি না। বাক্সটির খাড়াই (উচ্চতা) কতটুকু তাহা জানিবার জন্য হরিমোহনবাবুর নিকট হইতে সেইরূপ আর একটি বাক্স দেখিতে চাই, এবং সেই বাক্স দেখিয়াই আমি বুঝিতে পারি যে উহা অনায়াসে জানালার গরাদের ভিতর হইতে গলাইয়া লওয়া যাইতে পারে। তারপর হরিমোহনবাবুর সঙ্গে পাকশালার ছাদে গিয়া আমি যখন দেখিলাম যে, সে ছাদে আর জনপ্রাণীরও আসিবার সম্ভাবনা নাই, তখন স্থির সিদ্ধান্ত করি যে, পাচক ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কেহই তাহা অপহরণ করে নাই।

এইরূপ একটি সামান্য সূত্র হইতে আমি এই অত্যাশ্চর্য অলঙ্কার অপহরণ বৃত্তান্তের সমাধান করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *