০১. নিতান্ত সাধারণ একটি প্রাণীর গল্প

আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৩শ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং (Big Bang) নামে পরিচিত এক মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় পদার্থের, উৎপত্তি লাভ করে শক্তি, সূচনা ঘটে সময়ের আর রচিত হয় মহাশূন্য। জ্ঞানের যে শাখা মহাবিশ্ব সম্পর্কিত এসব মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তাকে আমরা বলি পদার্থবিজ্ঞান।

পদার্থ এবং শক্তি তৈরি হওয়ার প্রায় ৩ লক্ষ বছর পর তারা একত্রিত হয়ে পরমাণু (Atom) নামে একটি জটিল কাঠামো গঠন করে। পরমাণু হল মৌলের ক্ষুদ্রতম একক, যা সরাসরি রাসায়নিক পরিবর্তনে অংশ নিতে পারে। এই পরমাণুগুলো পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত হয়ে আরো জটিল প্রকৃতির কাঠামোর সূচনা করে, যা অণু নামে পরিচিত। পরমাণু, অণু ও তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার গল্পই হলো রসায়ন।

এরও অনেক পরে, আজ থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে, এই মহাবিশ্বের পৃথিবী নামক একটি গ্রহে নির্দিষ্ট কিছু অণু মিলিত হয়ে বড় আকারের ও আরো জটিল ধরনের বিশেষ কিছু কাঠামো গঠন করে। এদেরকে আমরা এক কথায় বলি ‘জীব’। সমস্ত জীবজগৎ ও তাদের কার্যপ্রণালী নিয়ে আলোচনা করে যে শাস্ত্র তার নাম জীববিজ্ঞান।

প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, সমস্ত জীবজগতের মাঝে হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens) নামের একটি বিশেষ প্রজাতি সম্মিলিতভাবে সংস্কৃতি (Culture) নামে একটি ধারণার সূত্রপাত ঘটায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, কোনো একটি প্রজাতির ব্যবহৃত সকল বাস্তব উপকরণ, খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ, উৎপাদন পদ্ধতি এবং আচার-আচরণকে একসাথে বলা হয় তার সংস্কৃতি। আর হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের সংস্কৃতির ক্রমাগত পরিবর্তনের গল্পকেই বলা হয় ইতিহাস।

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ইতিহাসকে আজকের অবস্থানে এনে দিয়েছে। প্রথমটি হল বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব (Cognitive revolution), যা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসের ভিত্তি স্থাপন করে। এরপর বিকাশ ঘটে কৃষিভিত্তিক বিপ্লবের (Agricultural Revolution), যা প্রায় ১২ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসকে দেয় নতুন গতি। সবশেষে, মাত্র ৫০০ বছর আগে সূচনা হয় বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের (Scientific Revolution)। এই বিপ্লব রাতারাতি পাল্টে দিয়েছে ইতিহাসের গতিপথ। হয়তো একদিন বিজ্ঞানের এই বিপ্লব মানুষের ইতিহাসের ইতি টেনে সূচনা করবে সম্পূর্ণ নতুন কোনো যুগের। এই বইয়ে আমরা এই তিন বিপ্লবের প্রভাবে মানুষ এবং জীবজগতের অন্যান্য সদস্যদের পাল্টে যাবার গল্পটাই জানার চেষ্টা করব।

বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ ইতিহাসের সূচনার বহু আগে থেকেই পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ ছিল। আধুনিক মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রথম আবির্ভাব ঘটে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে। এর আগে হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে মানুষের পূর্বপুরুষেরা অন্য দশটা সাধারণ প্রাণীর মতোই জীবন যাপন করে এসেছে। তাদের ছিল না হাতির মত বিশাল আকার-আকৃতি, আলাদা করে চেনার মতো প্রখর বুদ্ধিমত্তা কিংবা খাদ্যশৃঙ্খলে একক কোনো আধিপত্য।

২০ লক্ষ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকার কোনো গ্রামে হাঁটতে বেরোলে মানুষের চরিত্রের চিরচেনা রূপটাই হয়তো আপনার চোখে পড়ত। আপনি দেখতেন ছোট বাচ্চাদের বুকে আগলে রাখা উদ্বিগ্ন মাকে আর কাছেপিঠেই খেলাধুলায় মেতে থাকা ছোট ছেলেমেয়েদের। দেখতে পেতেন সমাজের নিয়ম ভাঙা সাহসী তরুণদের কিংবা এমন সব বুড়োদের যারা বাকি জীবনটা কোনোরকমে শান্তিতে কাটাতে পারলেই খুশি। হয়তো দেখতেন শারীরিক শক্তি বা বীরত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে সুন্দরী নারীর মন ভোলাতে ব্যস্ত কিছু যুবককে আর জীবনভর এই সবকিছু দেখে আসা কোনো সবজান্তা, অশীতিপর বৃদ্ধাকেও। এই প্রাচীন মানুষেরা ভালোবেসেছে, খেলাধুলা করেছে, গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। একই কাজ করেছে শিম্পাঞ্জি, বেবুন এবং হাতিও। মানুষ তখন কোনোভাবেই প্রাণীকুলের অন্যদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। এ রকম কোন লক্ষণই তখন তাদের মধ্যে দেখা যায়নি যেটা দেখে কেউ অনুমান করতে পারবে যে তাদেরই সুদূর বংশধরেরা একদিন চাঁদের বুকে হাঁটবে, পরমাণুকে দ্বিখণ্ডিত করবে, ডিএনএর রহস্য উন্মোচন করবে অথবা ইতিহাসের বই লিখবে। সুতরাং, প্রাগৈতিহাসিক মানুষ সম্পর্কে জানার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে তা হলো, তখন মানুষ খুবই গুরুত্বহীন একটা প্রাণী ছিল। বনমানুষ, মাছি বা পেঙ্গুইনের থেকে পৃথিবীর উপর বেশি প্রভাব মানুষের ছিল না। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ইতিহাস তাই প্রাণিবিদ্যা বইয়ের সাধারণ একটি অধ্যায় ছাড়া আর কিছুই নয়।

জীববিজ্ঞানীরা জীবজগতকে বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত করেছেন। দুটি প্রাণী মিলনের মাধ্যমে যদি সফলভাবে বংশধর তৈরি করতে সক্ষম হয়, তবে তাদেরকে একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। দুটো উদাহরণ থেকে আমরা বিষয়টি আরেকটু সহজ ভাবে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। আমরা জানি, বিবর্তনের পরম্পরায় একই পূর্বপুরুষ থেকে গাধা এবং ঘোড়ার উৎপত্তি হয়েছে এবং সে কারণেই তাদের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের মাঝে যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু, তারা একে অপরের প্রতি খুব কমই যৌন আকর্ষণ বোধ করে। মানুষ চেষ্টা করলে তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের মিলনের ফলে উৎপাদিত সন্তান হয় বন্ধ্যা, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। এদেরকে আমরা ‘খচ্চর’ নামে চিনি। উৎপাদিত সন্তান বন্ধ্যা হবার কারণ হল, গাধার রূপান্তরিত ডিএনএ কখনই ঘোড়ার ডিএনএর সাথে ভালোভাবে খাপ খায় না, ঘোড়ার ডিএনএ র ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একারণে গাধা ও ঘোড়া একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হলেও তারা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি, বিবর্তনের সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে তাদের দুজনের যাত্রা। অন্যদিকে বুলডগ এবং স্প্যানিয়েল দেখতে সম্পূর্ণ আলাদা বলে তাদেরকে ভিন্ন প্রজাতির মনে হলেও আসলে তারা কিন্তু একই প্রজাতির সদস্য। কারণ, তারা দুজনেই একই রকম ডিএনএ বহন করছে। তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই যৌনক্রিয়ায় আবদ্ধ হতে পারবে, তাদের খুব সুন্দর বাচ্চা হবে এবং সেই বাচ্চারাও পরিণত বয়সে অনেক বাচ্চার জন্ম দিতে পারবে।

যেসব প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে তাদেরকে একই ‘গণ’ বা ‘জাতি’র (Genus, বহুবচন Genera) অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। সিংহ, বাঘ, চিতা এবং জাগুয়ার এরা প্রত্যেকেই প্যানথেরা (Panthera) নামক জাতের আলাদা আলাদা প্রজাতি। জীববিজ্ঞানীরা প্রাণীদের নামকরণ করেন দুইটি পৃথক ল্যাটিন শব্দের মাধ্যমে। আগে গণ বা জাতির নাম, পরে প্রজাতির নাম। যেমন, সিংহের নাম প্যানথেরা লিও (Panthera leo) যার অর্থ প্যানথেরা শ্রেণীর সিংহ প্রজাতি। ধরে নেওয়া যায়, এ বই যারা পড়বে তাদের প্রত্যেকেই হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens) অর্থাৎ মানুষ (Homo অর্থ মানুষ) শ্রেণীর জ্ঞানী (sapiensঅর্থ জ্ঞানী) প্রজাতির।

কয়েকটি ‘গণ’ আবার একটি ‘পরিবার’ (Family) তৈরি করে। যেমন- সিংহ, চিতা বাঘ, পোষা বিড়াল – এরা বিড়াল পরিবারভুক্ত; নেকড়ে, খেঁকশিয়াল এবং শেয়াল – এরা কুকুর পরিবারের সদস্য এবং হাতি, ম্যামথ, মাসটোডোন – এরা হাতি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। একই পরিবারের সমস্ত সদস্য অতীতের কোনো পিতৃতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী থেকে বিকাশ লাভ করেছে বা বিবর্তিত হয়েছে। গৃহস্থের আদরের পোষা বিড়াল এবং বনের হিংস্র বাঘ আসলে একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভুত, প্রায় আড়াই কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ছিল যাদের বসবাস।

জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীদের মতো মানুষও অনেকগুলো গণ বা জাতি নিয়ে গঠিত একটি পরিবারের অংশ। আশ্চর্যজনকভাবে, এই নিতান্ত সাধারণ ব্যাপারটিকে অদ্ভুত কারণে মানুষ বারবার গোপন করতে চেয়েছে। হোমো সেপিয়েন্স নামের এই প্রাণীটি বরাবরই নিজেদেরকে বাকি প্রাণিজগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখতে চায়, দেখে এসেছে। ভাবখানা এমন, যেন তারা অনাথ একটা প্রজাতি, তারা কোনো পরিবারের অংশ নয়, তাদের কোনো ভাই-বোন নেই, এমনকি পিতা-মাতা বা অন্য কোনো পূর্বপুরুষও নেই। তা কিন্তু একেবারেই সত্য নয়। পছন্দ করুন আর নাই করুন, আমরা গ্রেট এপ (Great Ape) নামের বিশাল জনবহুল এক পরিবারের অংশ। আমাদের পরিবারের জীবিত নিকটাত্মীয়দের মধ্যে শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাং-ওটাং উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে শিম্পাঞ্জিরা আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে এক নরবানর (Ape) মায়ের দুটি কন্যা সন্তান ছিল। এদের একজন সমস্ত শিম্পাঞ্জির আদিমাতা এবং অন্যজন হল আধুনিক মানুষের প্রাচীনতম নানী।

গল্প বলা কঙ্কাল

হোমো সেপিয়েন্স আরও বিব্রতকর একটা সত্য এতদিন গোপন করে এসেছে। সেপিয়েন্সের যে কেবল অনেকগুলো অসভ্য, বন্য জ্ঞাতিভাই আছে তাই নয়, ইতিহাসের একটা পর্যায়ে আমাদের বেশ কিছু আপন ভাই বোনও ছিল। আমরা এতদিন নিজেদেরকেই একমাত্র মানুষ হিসেবে জেনে এসেছি, কারণ গত ১০ হাজার বছর ধরে শুধুমাত্র এই সেপিয়েন্সরাই পৃথিবীতে মানুষ গোত্রের প্রাণী হিসেবে টিকে আছে। আমরা ইতোমধ্যে যে জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি দেখেছি সেই পদ্ধতি অনুযায়ী ‘মানুষ’ শব্দটার সত্যিকার মানে হল ‘হোমো (Homo) গণের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী’। অতীতে এই ‘হোমো’ নামক গণটির আরও অনেক প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল। এই বইয়ের শেষের অধ্যায়ে আমরা দেখব, অদূর ভবিষ্যতেও হয়তো আমাদের এই হোমো গণের অন্য প্রজাতির মানুষদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। এই নামকরণের ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য, আমরা অধিকাংশ সময়ই ‘সেপিয়েন্স’ বলতে শুধু হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটিকে বুঝাবো, আর ‘মানুষ’ শব্দটা হোমো গণের সব প্রজাতির মানুষের জন্য সংরক্ষিত রাখব।

মানুষের প্রথম সন্ধান মেলে পূর্ব আফ্রিকায়, প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে। তারা কিন্তু শূন্য থেকে আসে নি, প্রথম দিককার নরবানরের একটি শ্রেণী অস্ট্রালোপিথেকাস (Australopithecus) থেকে বিবর্তনের মাধ্যমেই তাদের উদ্ভব। এ জটিল আকারের নামের সাথে কিন্তু ভূগোলের অস্ট্রেলিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অস্ট্রালোপিথেকাস এর শাব্দিক অর্থ হলো দক্ষিণের নরবানর (Southern ape)। প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে কিছু মানুষ পূর্ব আফ্রিকা ত্যাগ করে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেকটি নতুন জায়গায় এরা বিরূপ অবস্থা, নতুন ধরনের আবহাওয়া ও জলবায়ু, ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থা, নতুন নতুন প্রাণী, অচেনা গাছপালা ইত্যাদির সম্মুখীন হয়। এতসব অচেনা অবস্থার সাথে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষ বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। অনেক অনেক বছর ধরে এরকম চলার পর মানুষের অনেকগুলো আলাদা আলাদা প্রজাতি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করে এবং পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিকেরা নিজেদের মত করে সবগুলো প্রজাতির আলাদা আলাদা ল্যাটিন নামকরণ করেন।

কাল্পনিক পুনর্গঠন অনুসারে আমাদের হারিয়ে যাওয়া সহোদরেরা (বাম থেকে ডানে): হোমো রুডলফেনসিস (পূর্ব আফ্রিকা), হোমো ইরেক্টাস (পূর্ব এশিয়া), এবং হোমো নিয়ান্ডার্থালেনসিস (ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া)। এরা সবাই মানুষ।

পশ্চিম ইউরেশিয়ায় (ইউরোপ এবং এশিয়া) মানুষের যে প্রজাতি বিকাশ লাভ করে বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন হোমো নিয়ান্ডার্থালেনসিস (Homo neanderthalensis) বা সংক্ষেপে নিয়ান্ডার্থাল (Neanderthals)। এর সহজ মানে হল- নিয়ান্ডার উপত্যকার মানুষ। নিয়ান্ডার্থালরা আমাদের থেকে আকারে অনেক বড়সড় এবং পেশীবহুল ছিল। এরা বরফ যুগে পশ্চিম ইউরেশিয়ার ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে নিজেদের খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছিল। এশিয়ার একদম পূর্বের দিকে মানুষের যে প্রজাতি বিকাশ লাভ করে তাদের নাম হোমো ইরেকটাস (Homo erectus) বা ‘খাড়া মানুষ’। এরা প্রায় ২০ লক্ষ বছর পৃথিবীর বুকে বিচরণ করতে পেরেছে। মানুষের আর কোনো প্রজাতি পৃথিবীতে এত বেশি দিন টিকে থাকতে পারে নি। আজকের আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সও এই ২০ লাখ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের পক্ষে আরও এক হাজার বছর পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব হবে কিনা সেটাই প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়, লাখ লাখ বছর তো অনেক দূরের ব্যাপার!

এবারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে মানুষের আরেকটি প্রজাতি বিকাশ লাভ করে যাদেরকে বলা হয় হোমো সলোয়েনসিস (Homo soloensis) বা সলো উপত্যকার মানুষ। এদিকে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস নামের ছোট্ট একটি দ্বীপে তখন লেখা হচ্ছে ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিকাশ হচ্ছে ছোট আকারের এক প্রজাতির মানুষের, সেপিয়েন্স প্রজাতির বিজ্ঞানীরা অনেক পরে যার নাম দেবেন হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস (Homo floresiensis) বা ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ। মানুষ যখন প্রথম ফ্লোরেস দ্বীপে পৌঁছায় তখন সমু্দ্রের পানির উচ্চতা ছিল একেবারেই কম। ফলে মানুষ সহজেই ফ্লোরেস থেকে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াত করতে পারত। সময় যতই অতিবাহিত হল সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে থাকল। একসময় ফ্লোরেস দ্বীপ মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এর ফলে কিছু লোকজন ফ্লোরেস দ্বীপেই আটকা পড়ে গেল। ফ্লোরেস ছিল খুবই ছোট একটি দ্বীপ। এরকম ছোট একটি দ্বীপে অনেক লোকের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবারের সরবরাহ থাকে না। ফলে লম্বা এবং মোটা-তাজা লোকজন, বেশি বেশি খাবার ছাড়া যাদের চলে না, প্রথমেই তারা খাবারের অভাবে মারা পড়ল। কিন্তু ছোট-খাট লোকজন এবং প্রাণী, যাদের বেঁচে থাকার জন্য কম খাবারের প্রয়োজন হয় তারা কোনোরকমে বেঁচে থাকল।

অনেক অনেক বছর ধরে এই ঘটনা ঘটে চলল। ছোট আকারের মানুষদের কম খাবার খেয়েও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি ছিল। এ কারণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছোট আকারের মানুষরাই বেশি সংখ্যায় টিকে থাকল। এভাবে ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ একসময় বামনে (ছোট আকারের মানুষ) পরিণত হল। হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস সর্বোচ্চ এক মিটার (৩ ফুট) উচ্চতার এবং ২৫ কিলোগ্রাম ওজনের হত। কিন্তু, আকারে ছোট হলেও তারা মানুষের অন্যান্য প্রজাতির মতই বর্শাসহ পাথরের নানারকম হাতিয়ার তৈরি করতে পারত এবং এসব হাতিয়ার দিয়ে তারা মাঝে মাঝে হাতিও শিকার করত! যদিও, সত্যি কথা বলতে কী, সেই হাতি অন্যান্য এলাকার হাতির মত দশাসই আকারের হাতি ছিল না, ছিল বামন হাতি! এই হল বামনরাজ্য ফ্লোরেস এর গল্প।

২০১০ সালে বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় খননকাজ চালাতে গিয়ে মানুষের একটি আঙ্গুলের ফসিলের সন্ধান পান যা কিছুদিন পর আমাদের সামনে নিয়ে আসে মানুষের হারিয়ে যাওয়া আরেকটি প্রজাতিকে। জিনগত গবেষণা থেকে বোঝা যায়, এই ফসিলটি থেকে প্রাপ্ত জিন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত মানুষের সবগুলো প্রজাতির থেকে আলাদা। বিজ্ঞানীরা মানুষের নতুন এই প্রজাতির নাম দিয়েছেন হোমো ডেনিসোভা (Homo denisova) বা ডেনিসোভা গুহার মানুষ। কে জানে- কোন দেশে, কোন অচেনা গুহায়, কোন নির্জন দ্বীপে মানুষের নাম না জানা কত প্রজাতির নিদর্শন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আবিষ্কৃত হওয়ার প্রত্যাশায়।

যখন ইউরোপ এবং এশিয়ায় বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের এসব নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে, তখন পূর্ব আফ্রিকাতেও কিন্তু বিবর্তন থেমে থাকে নি। সেখানেও মানবজাতির আঁতুড়ঘরে জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন প্রজাতি। তৈরি হয়েছে হোমো রুডলফেনসিস (Homo rudolfensis) বা রুডলফ হ্রদের মানুষ, হোমো ইরগেস্টার (Homo ergaster) বা কর্মঠ মানুষ এবং সব শেষে তৈরি হয়েছে আমাদের প্রজাতি, নিজেদেরকে যারা হোমো সেপিয়েন্স বা জ্ঞানী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা মানুষের বিভিন্ন প্রজাতিগুলোর মাঝে কিছু ছিল বিশাল আকারের, কেউ ছিল বামন। কেউ কেউ ছিল তুখোড় শিকারী আবার কেউ শুধু ফল-মূল খেয়েই বেঁচে থাকত। কোনো প্রজাতি একটি দ্বীপের মধ্যেই সারাটা জীবন কাটিয়েছে, কেউ আবার ভ্রমণ করেছে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ। কিন্তু তারা সকলেই ছিল এক মানব জাতির অংশ। তারা সবাই ছিল মানুষ।

মানুষের এই বিভিন্ন প্রজাতিগুলোর উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা হল, মানুষের একাধিক প্রজাতি একটি নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীতে কখনোই একসাথে বসবাস করেনি, বরং প্রজাতিগুলোর একটি থেকে অপরটির জন্ম হয়েছে। যেমন, ইরেকটাস এর জন্ম হয়েছে ইরগেস্টার থেকে, নিয়ান্ডার্থালের জন্ম হয়েছে ইরেকটাস থেকে এবং নিয়ান্ডার্থাল থেকে আমরা এসেছি। মানুষের একটি প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির তৈরি হবার এই ধারণা আমাদের এটা ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে যে, মানুষের একের অধিক প্রজাতি কখনও একসাথে পৃথিবীর বুকে বসবাস করে নি, একটি নতুন প্রজাতি মানুষের পূর্ববর্তী আরেকটি প্রজাতির উন্নত সংস্করণ মাত্র। কিন্তু বাস্তবতা হল, ২০ লাখ বছর আগে থেকে শুরু করে ১০ হাজার বছর আগেও পৃথিবী ছিল মানুষের অনেকগুলো প্রজাতির বাসভূমি। কেন নয়? আজকের পৃথিবীতে একই সময়ে অনেক প্রজাতির শেয়াল, ভালুক আর শুকর বসবাস করছে। একইভাবে এক লাখ বছর আগের পৃথিবীতে একই সাথে মানুষরে অন্তত ছয়টি প্রজাতি হেঁটে বেড়িয়েছে, বসবাস করেছে পৃথিবীর বুকে। প্রাণীজগতে অন্যান্যদের দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, একসাথে একাধিক প্রজাতির সহাবস্থানের ব্যাপারটাই স্বাভাবিক, বরং আজকের আধুনিক বিশ্বে যে মানুষের কেবল একটি প্রজাতি বসবাস করছে সেই ব্যাপারটি অস্বাভাবিক, খাপছাড়া। একটু পরেই আমরা দেখব, আধুনিক মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থেই মানুষের অন্যান্য প্রজাতিগুলোর ইতিহাস ধামাচামা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

মগজের মাশুল

এতক্ষণ আমরা মানুষের বিভিন্ন প্রজাতি এবং তাদের নানারকম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানলাম। মানুষের এই প্রজাতিগুলোর মাঝে আকার-আকৃতি, আচরণ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি অনেক বিষয়ে নানারকম পার্থক্য থাকলেও তাদের সকলের মাঝেই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এগুলোর মাঝে যেটা সবার আগে চোখে পড়ে, সেটা হল বড় আকারের মস্তিষ্ক। দৈহিক গঠন অনুপাতে মানুষের মস্তিষ্কের আকার অন্য যে কোন প্রাণীর থেকে বেশ বড়। সাধারণত ষাট কিলোগ্রাম ওজনের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্ক গড়পড়তায় দুইশ ঘনসেন্টিমিটার হয়। অন্যদিকে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর আগের আধা-মানুষদের মস্তিষ্কের আকার ছিল প্রায় ছয়শ ঘনসেন্টিমিটার। বর্তমানের আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের আকার প্রায় এক হাজার দুইশ থেকে এক হাজার চারশ ঘনসেন্টিমিটার। মানুষের আরেকটি প্রজাতি নিয়ান্ডার্থালের মস্তিষ্ক এর চেয়েও বড় আকারের ছিল।

আমরা জানি, যে সকল বৈশিষ্ট্য কোন প্রাণীকে টিকে থাকার জন্য বেশি সুবিধা দেয়, সেই বৈশিষ্ট্যগুলোই সাধারণত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিকশিত হয়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এ কথা মনে হতেই পারে যে, মাথা বড় মানে বেশি বুদ্ধি, বেশি চিন্তাভাবনা করার সুযোগ এবং বেশি চিন্তাভাবনা করতে পারলে টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং, প্রাকৃতিক বিবর্তনে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বড় মাথার মানুষগুলোই টিকে থাকবে। কিন্তু, এ অনুমান যদি সত্যি হতো, তাহলে মানুষের পাশাপাশি বিড়াল, বাঘ, সিংহ এদের মাঝেও বিবর্তনের মাধ্যমে বড় বড় গণিতবিদ বা বিজ্ঞানী তৈরি হত। বাস্তবে তা হয় নি, কেবলমাত্র মানুষই বিশাল আকারের চিন্তাশীল মগজের অধিকারী হয়েছে এবং তাদের মাঝেই তৈরী হয়েছে গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, কবি এবং দার্শনিক। প্রশ্ন হল, কেন?

এক কথায় বলতে গেলে- ‘যত মাথা, তত ব্যথা’। অর্থাৎ, বড় আকারের মগজ শুধু নিরবচ্ছিন্ন সুবিধাই দেয় না, সাথে সাথে নানারকম সমস্যা ও সংকটেরও সৃষ্টি করে। বড় মগজের কাজ করার জন্য বেশি শক্তি দরকার, যেটা আসে খাদ্য থেকে। আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক দেহের মোট ওজনের ২-৩ শতাংশ, কিন্তু মানুষ যখন বিশ্রামে থাকে, তখন দেহের মোট শক্তির শতকরা ২৫ ভাগ শুধু মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্যই ব্যয় হয়। অন্যদিকে, বিশ্রামকালীন সময়ে অন্যান্য নরবানরদের মস্তিষ্ক পরিচালনার জন্য দেহের মোট শক্তির মাত্র ৮ শতাংশ ব্যয় করতে হয়। এই বড় আকারের মগজের মাশুল প্রাচীনকালের মানুষদের দুইভাবে দিতে হয়েছে। প্রথমত, বড় মস্তিষ্কের জন্য খাদ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাদেরকে খাদ্য খোঁজার জন্য অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মস্তিষ্কের বড় হওয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তাদের পেশীর ক্ষয় হয়েছে, শারীরিক সামর্থ্য কমে এসেছে। সরকার যেমন সামরিক খাত থেকে বাজেট কমিয়ে শিক্ষা খাতে দেয়, তেমনি মানুষও পেশী কে শক্তিশালী না করে নিউরনকে পুষ্ট করেছে। মানুষের শিকারী-সংগ্রাহক জীবনে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এটা মোটেই কোনো ভালো কৌশল ছিল না। কারণ, সেকালের একটি শিম্পাঞ্জি কখনও মানুষের সাথে তর্কে জিততে পারত না ঠিকই, কিন্তু ঐ শিম্পাঞ্জিটিই শারীরিক শক্তির কারণে একটি মানুষকে নিমেষে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারত।

তবে আনন্দের কথা এই, বড় মস্তিষ্কের জন্য অনেক কাল আগে নেয়া ঝুঁকিটা আজকের এই আধুনিক সমাজে আমাদের বেশ কাজে আসছে। এর কারণে আমরা এখন গাড়ি বানাতে পারি, বন্দুক বানাতে পারি। গাড়ি আমাদেরকে শিম্পাঞ্জিদের থেকে অনেক দ্রুত চলাচল করতে সাহায্য করে আর বন্দুকের কারণে আমরা এখন শিম্পাঞ্জিদের সাথে হাতাহাতি লড়াইয়ে না গিয়েই দূর থেকে গুলি করে তাদেরকে মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু মানুষের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে, গাড়ি কিংবা বন্দুক আবিষ্কার তো এই সেদিনের কাহিনী। এর আগে প্রায় ২০ লক্ষ বছর ধরে মানুষের মস্তিষ্কের আকার ও ক্ষমতা ক্রমাগত বেড়েছে। কিন্তু সেই বড়সড় মগজ দিয়ে তারা শুধুমাত্র কিছু বাহারি চাকু আর কিছু বর্শা ছাড়া আর তেমন কিছুই তৈরি করতে পারেনি। উপরন্তু, বড় মস্তিষ্ক অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরী করেছে। সুতরাং, বিবর্তনের নিয়মানুযায়ী যেহেতু মানুষের বড় মস্তিষ্ক টিকে থাকার ক্ষেত্রে তাদেরকে তেমন কোনো সুবিধা দেয় নি, সেহেতু মগজ বড় হবার বৈশিষ্ট্যটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়ানোর ও বিকাশ লাভ করার কথা নয়। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেটাই হয়ে এসেছে। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনও জানি না।

বড় মস্তিষ্কের পর মানুষের সব প্রজাতির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যে বৈশিষ্ট্যটি আমরা দেখতে পাই তা হল, তারা সবাই দুই পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটে। মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ফলে আশপাশের শত্রু বা শিকারের সন্ধান করা অনেকটা সহজ হয়ে গেল। এছাড়াও এর ফলে আমাদের দুটো হাত হাঁটার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে পাথর ছুঁড়ে মারা বা অন্যকে ইশারা দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে লাগল। যার হাত যত বেশি দক্ষ, সমাজে তার টিকে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি। সে কারণে, বহু বছরের বিবর্তনের ফলে ক্রমাগত সূক্ষ্ম পেশী, অধিকতর স্নায়ু সংযোগ, সূক্ষ্ম কাজের জন্য উপযুক্ত হাতের তালু ও আঙ্গুল সমৃদ্ধ মানুষের বিকাশ হতে থাকল। ফলশ্রুতিতে মানুষ তার হাত দিয়ে অনেক সূক্ষ্ম কাজ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে শিখল। বিশেষ করে, উন্নত এই হাত তাদেরকে অনেক সূক্ষ্ম অস্ত্র তৈরি এবং ব্যবহারের সুযোগ করে দিল। সবচেয়ে পুরনো এরকম যে হাতিয়ারটি পুরাতত্ত্ববিদেরা পেয়েছেন সেটা প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগের। এ থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, ঐ সময় থেকেই হাতে বানানো হাতিয়ারের প্রচলন ছিল।

কিন্তু সোজা হয়ে হাঁটার কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে। আমাদের শরীরের কঙ্কালটা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে একটা চার-পেয়ে, অপেক্ষাকৃত ছোট মাথার প্রাণীর শরীরকে বহন করার জন্য। সুতরাং হঠাৎ করেই সেই কঙ্কালের পক্ষে একটি দুই পায়ে দাঁড়ানো, বড় মস্তিষ্কের প্রাণীকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্যই ছিল। আর এই কষ্টসাধ্য কাজের মূল্যও মানুষকে দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। মানুষ তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর দক্ষ হাতের বিনিময়ে কিছু কষ্ট স্বীকার করে নিয়েছে- সেগুলো হল পিঠ আর ঘাড়ের ব্যথা।

মেয়েেদেরকে আরো অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে হলে কোমর হতে হবে চিকন, যা জন্ম নালীকে সরু করে দেয়। তারুপর সেটা এমন সময়ে ঘটল যখন নবজাতক বাচ্চাদের মাথার আকার বড় থেকে আরও বড় হচ্ছিল। ফলে জন্মকালীন মৃত্যুর হার আশংকাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল। যেসব মহিলা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাচ্চা প্রসব করতে সমর্থ হয়েছে তারাই বেঁচে থাকল এবং আরো বাচ্চা নিতে সমর্থ হলো। সেইসব বাচ্চার মস্তিষ্ক এবং মাথা পুরোপুরি বড় হয়ে ওঠেনি। বিবর্তনের ধারা এইসব সময়ের পূর্বে প্রসবকারীদের প্রাধান্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখল। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানব শিশু পরিপূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই জন্মগ্রহণ করে। জন্মলাভ করার সময় বেশিরভাগ শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার যথেষ্ট সময় পায় না। একটি অশ্বশাবক জন্মের পর পরই দৌড়াতে পারে, একটি বিড়াল শাবক জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাকে ছেড়ে নিজের মতো বাঁচতে থাকে। সে তুলনায় মানব শিশুরা খুবই অসহায়- বেঁচে থাকা, নিরাপত্তা এবং শিক্ষার জন্য বড়দের কাছে অনেক বছর তাদেরকে নির্ভরশীল থাকতে হয়।

এই সত্যটি মানব জাতির সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। নিঃসঙ্গ মায়েরা তাদের এবং বাচ্চাদের জন্য যথেষ্ট খাবার যোগাড় করতে পারে না। বাচ্চাকে বড় করতে হলে পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং প্রতিবেশীদের সাহায্যের প্রয়োজন হয় সবসময়। একটি মানব শিশুকে বড় করতে একটি গোত্রের প্রয়োজন হয়। বিবর্তন তাদেরই সহায়তা করেছে যারা নিবিড় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছে। আর তাছাড়া, মানুষ যেহেতু অপরিপক্ব অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে তাই অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষকে অনেক সহজে প্রয়োজন মত শিখিয়ে নেওয়া যায় এবং সামাজিক প্রাণী হিসেবে গড়ে তোলা যায়। ইট, মাটির পাত্র, চুনাপাথর ইত্যাদি পোড়ানো বা শুকানোর জন্য ব্যবহৃত চুল্লি থেকে যেভাবে চীনামাটির পাত্র বের হয় ঠিক সেভাবে বেশির ভাগ স্তন্যপায়ীর জরায়ু থেকে বাচ্চা বের হয়ে আসে। এটা একটা পরিপক্ক এবং তৈরি অবস্থায় বের হয়ে আসে। এখন আপনি যদি এই চীনামাটির ফুলদানির আকারের কোন পরিবর্তন করতে চান তবে এটাতে হয় দাগ ফেলতে হবে না হয় ভাঙতে হবে। অন্যদিকে মানুষ বের হয়ে আসে মায়ের জরায়ু থেকে ঠিক যেমন কাঁচ বের হয়ে আসে চুল্লি থেকে প্রায় গলিত অবস্থায়। চুল্লি থেকে কাঁচ বের হবার সময় বেশ নমনীয় একটা অবস্থায় থাকে বলে বের করে আনার পরও এটাকে প্যাঁচানো বা লম্বা করা কিংবা যে রকম ইচ্ছা আকার দেয়া যায়। একই ঘটনা ঘটে মানব শিশুর ক্ষেত্রেও। জন্মের পর তাকে আপনি শিক্ষাদান করতে পারেন এবং সামাজিক রীতি নীতিতে গড়ে তুলতে পারেন। আর এ জন্যই আজ আমরা একজন মানব শিশুকে চাইলেই খ্রিষ্টান কিংবা বৌদ্ধ, পুঁজিবাদী কিংবা সাম্যবাদী, যুদ্ধপ্রিয় বা শান্তিপ্রিয় হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।

আমরা সাধারণত অনুমান করি যে, বড় একটা মস্তিষ্ক থাকা, হাতিয়ার বা যন্ত্র বানানো এবং ব্যবহার করা, জটিল সমাজ থাকা – এগুলো বিশাল সুবিধার ব্যাপার। এটাও খুব স্পষ্ট যে, এমন সব সুযোগ সুবিধা তৈরি করার ক্ষমতা মানবজাতিকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মানুষ আসলে এই সমস্ত সুযোগ সুবিধা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করেছে প্রায় ২০ লক্ষ বছর ধরে যখন তারা দূর্বল ও সাধারণ একটা প্রজাতি হিসেবে টিকে ছিল। সুতরাং প্রায় লক্ষ বছর আগে যেসব মানুষ বসবাস করত, বড় আকারের মস্তিষ্ক আর পাথরের ধারালো অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তারা সারাক্ষণ হিংস্র জন্তুর ভয়ে তটস্থ থাকত। খুব কম ক্ষেত্রেই বড় প্রাণী শিকার করতে পারত তারা। বেশির ভাগ সময়ই তারা নানা রকম ফলমূল সংগ্রহ করে কিংবা ছোট খাটো প্রাণী শিকার করে বা কীটপতঙ্গ খুঁজে বের করে খেয়ে অথবা কোনো বড় প্রাণীর শিকারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকত।

একদম প্রথম দিককার যেসব পাথরের তৈরি হাতিয়ার পাওয়া যায় সেগুলো মূলত হাড় ভেঙ্গে মজ্জা বের করার জন্যই বেশি ব্যবহৃত হতো। কিছু কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে, এই অস্থিমজ্জা খাওয়াটা মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রত্যেক প্রাণীরই এরকম একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যেটা দিয়ে তাকে আলাদা করে চেনা যায়। কাঠঠোকরার বিশেষ বৈশিষ্ট্য যেমন গাছের কাণ্ড থেকে পোকামাকড় খুঁজে বের করা, ঠিক তেমনি প্রথম দিককার মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল হাড় ভেঙ্গে তার থেকে অস্থিমজ্জা বের করে খাওয়া। মজ্জা কেন? কল্পনা করুন দশ লাখ বছর আগের কথা। ধরে নিন, আপনি সেই সময়ের একজন মানুষ। আপনি দেখলেন একদল সিংহ একটি জিরাফকে শিকার করেছে। আপনার খুব ইচ্ছে হলো জিরাফের সুস্বাদু মাংস খাওয়ার। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত সিংহের আশে-পাশে যাবেন না। কারণ, সেটা করলে শেষমেশ জিরাফের মতো আপনিও সিংহের খাবারে পরিণত হতে পারেন। সুতরাং আপনি দূরে লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করতে থাকবেন। সবার আগে আয়েশ করে জিরাফের মাংস খেয়ে গেল সিংহ মামা। কিন্তু তখনও আপনার পালা আসেনি। সিংহের পর আসলো হায়েনা আর হিংস্র শেয়ালেরা। তারা সিংহের ফেলে যাওয়া সব খাবার খেয়ে নিল। এরপর আপনার খাবারের পালা। কিন্তু, এতক্ষণে আপনার জন্য জিরাফের হাড়ের ভেতরের অস্থিমজ্জা ছাড়া খাওয়ার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

এই হলো দশ লাখ বছর আগেকার মানুষের অবস্থা। আজকের দিনেও মানুষের ইতিহাস এবং মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রায় বিশ লাখ বছর আগের কাছাকাছি সময়ে মানুষ ছিল খাদ্যচক্রের মাঝামাঝি পর্যায়ের প্রাণী। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমরা খাদ্যচক্রের এই মাঝামঝি অবস্থানেই অবস্থান করেছি। এটা ঠিক যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কচ্ছপ, পাখি সহ আরো ছোট ছোট প্রাণী যা পেত সব সময়ই শিকার করত। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তারা অন্য বড় হিংস্র প্রাণীর শিকার হতো। মাত্র চার লাখ বছর আগে, নিয়ান্ডার্থালের মত কিছু প্রজাতির মানুষ নিয়মিতভাবেই বড় প্রাণী শিকার করা শুরু করে। আর আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে- হোমো সেপিয়েন্সের উত্থানের সময়টাতে- মানুষ হঠাৎ করে খাদ্যচক্রের একদম উপরে উঠে যায়।

খাদ্যচক্রের মধ্যম অবস্থান থেকে একলাফে মানুষের শীর্ষে ওঠার এই ঘটনা একটা বড় প্রভাব ফেলে পরবর্তীকালের পৃথিবীতে। সিংহ কিংবা হাঙরের মত খাদ্য চক্রের উপরের দিকে থাকা প্রাণীরা খুব ধীরে ধীরে তাদের ঐ অবস্থানের জন্য বিবর্তিত হয়েছিল। ঐ অবস্থানে যেতে তাদের লক্ষ লক্ষ বছর সময় লেগেছে। এর ফলে সমস্ত বাস্তুতন্ত্রটাও যথেষ্ট সময় পেয়েছিল নিজেই এমন কিছু ব্যবস্থা করতে যাতে সিংহ কিংবা হাঙরেরা সমস্ত বাস্তুতন্ত্রটা লণ্ডভণ্ড করে ফেলতে না পারে। সিংহের হিংস্রতা বাড়ার সাথে তাল মিলিয়ে, হরিণগুলোও শিখে নিয়েছে আরও দ্রুত দৌড়াতে, হায়েনারা অভ্যস্ত হয়েছে একে অন্যকে সাহায্য করার রীতিতে আর গণ্ডারও হয়ে উঠেছে ক্রমশ বদমেজাজী। অন্যদিকে মানুষেরা এত দ্রুত খাদ্যচক্রের উপরে উঠে এলো যে, তার সাথে তাল মিলিয়ে বাস্তুতন্ত্র সবকিছু মানিয়ে নেয়ার সুযোগই পেল না। এমনকি মানুষ নিজেকেও ঠিকমত মানিয়ে নিতে পারল না এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে। এর আগে যেসব প্রাণীরা এই শীর্ষ আসনে বসেছে তারা সবাই ছিল বেশ অভিজাত, রাজকীয় প্রাণী। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অর্জন করা আধিপত্য তাদেরকে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল। অন্যদিকে, সেপিয়েন্স ছিল অনেকটা ভুঁইফোড় একনায়ক। কদিন আগেই তৃণভূমিতে চরে বেড়ানো এক মামুলি প্রাণী থেকে হঠাৎ শীর্ষে ওঠার ফলে তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ভয় আর উৎকণ্ঠা কাজ করত নিজেদের অবস্থান হারানোর কথা ভেবে। এই অনিশ্চয়তা তাদের করে তুললো আরও নৃশংস ও ভয়ংকর। ভয়ংকর যুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ইতিহাসের বড় বড় বিপর্যয়ের অনেকগুলোই সংঘটিত হয়েছে মূলত খাদ্যচক্রে মানুষের এই অপ্রত্যাশিত লাফের কারণে।

আগুনের কেরামতি, রান্নার জাদু

শীর্ষে পৌঁছানোর জন্যে মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল আগুনকে বশীভূত করা। আমরা এখনও সঠিকভাবে জানি না ঠিক কখন, কোথায় এবং কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা আগুনকে আয়ত্তে এনেছে। প্রায় আট লাখ বছর আগে হয়তো কিছু কিছু মানুষ মাঝে মধ্যে আগুন ব্যবহার করত। কিন্তু প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেকটাস, নিয়ান্ডারথাল আর হোমো সেপিয়েন্সের পূর্বপুরুষরা প্রায় প্রত্যেকদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেই আগুনের ব্যবহার করেছে। আগুন অন্ধকারে আলো দিয়েছে, ঠান্ডায় দিয়েছে উষ্ণতা। এমনকি সিংহ এবং ভালুকের মত বিপদজনক প্রাণীদের ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্রও ছিল আগুন। এর কিছুদিন পরেই মানুষ তার আশে পাশের বন-জঙ্গল আগুন দিয়ে পোড়ানো শুরু করে। একবার বন পোড়া শেষ হলে এবং আগুনের শিখা নিভে গেলে মানুষ অনায়াসে সেখান দিয়ে রাস্তা করে যেতে পারত। পাওয়া যেতো আগুনে পোড়া অনেক প্রাণী যেগুলো অনায়াসে খাওয়া যেত। খাদ্যের সহজ সমাধান ছিল এই বন পোড়ানো। এটা ছিল আগুনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি সুবিধা।

কিন্তু, মানুষকে রান্না করার ক্ষমতা দেয়াটাই সম্ভবত আগুনের সবচেয়ে গুরুত্বপূ্র্ণ অবদান ছিলো। আমরা সাধারণত মানব জাতির ইতিহাসে রান্নাকে খুব বড় একটা পদক্ষেপ বা উন্নতি হিসেবে দেখি না। অথচ ভেবে দেখলে, মানুষের ইতিহাসে রান্নার গুরুত্ব অপরিমেয়। রান্নার ফলে প্রকৃতির খাদ্য সম্ভারে নতুন নতুন খাবারের একটি বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়। প্রকৃতিতে এমন অনেক খাবারই ছিল যেগুলো রান্না করা ছাড়া খেয়ে মানুষ হজম করতে পারত না। উদাহরণস্বরূপ, গম, আলুর মতো খাবারগুলোই মানুষ রান্না করা ছাড়া খেতে পারত না। রান্না শেখার ফলে মানুষ অনেক নতুন নতুন খাবার খাওয়া শুরু করল। আরেকটি সুবিধা হলো রান্নার ফলে জীবাণু এবং পরজীবী প্রাণী মারা যায়। বিশেষ করে মাংসের ক্ষেত্রে। অন্যান্য আরও অনেক খাবারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। ফলে একবার যখন মানুষ রান্না করে খাবার খাওয়া শুরু করল, তখন থেকে অনেক রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে তারা রক্ষা পেল। অন্যথায় নানা রকম জীবাণু তাদের শরীরে প্রবেশ করত, বসবাস করত, বংশবৃদ্ধি করত এবং মানুষের মৃত্যুর কারণ হতো। রান্না করার ফলে খাবার চিবানোর সময় কিংবা হজমের সময়টাও গেল কমে। আমাদের খুব কাছের আত্মীয়, শিম্পাঞ্জি গড়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা খাবার চিবোয় । তাদের পরিপাকতন্ত্র যাতে সহজে এ খাবার হজম করতে পারে এর জন্যই তারা এমনটি করে। যারা আগুন দিয়ে খারার রান্না করে খায় তাদের জন্য সারাদিনে এক ঘণ্টাই এ কাজের জন্য যথেষ্ট এবং খাবার হজম করার জন্যও তাদের অনেক কম শক্তি ব্যয়ের প্রয়োজন হয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রান্নার আবিষ্কারের ফলে মানুষের খাবার হজমের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। ফলে মানুষ ছোট ছোট দাঁত, অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী চোয়াল এবং ছোট খাদ্যনালী বা অন্ত্র (intestine) দিয়েও অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারল। কিছু কিছু বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে রান্না করে খাবার খাওয়া শুরুর সাথে মানুষের অন্ত্র বা খাদ্যনালী ছোট হওয়া এবং মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধির সরাসরি যোগাযোগ আছে। যেহেতু দীর্ঘ অন্ত্র আর বড়সড় মস্তিষ্ক- দুটোরই অনেক বেশি বেশি শক্তির দরকার হতো চলার জন্য, তাই ও দুটো একসাথে থাকাটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার। তাই, অন্ত্রের আকার ছোট করে তার শক্তির ব্যবহার কমিয়ে রান্না আমাদের আরও বড় মস্তিষ্কের অধিকারী প্রাণীতে রূপান্তরিত হওয়ার পথ সুগম করে দিল। আর তার ফলেই পরবর্তীতে নিয়ান্ডার্থাল আর সেপিয়েন্সের উদ্ভব হল।

আর এ জন্যই বহু বিজ্ঞানী বলে থাকেন যে, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে প্রথম যে বড় রকম পার্থক্য তৈরি হয় সেটা আগুনের কারণেই। আগুনকে আয়ত্তে এনেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেদেরকে উঁচু পর্যায়ে উপনীত করেছে। প্রকৃতিতে প্রায় সমস্ত প্রাণীর শক্তিই মূলত তাদের শারীরিক শক্তির উপর নির্ভর করে। আর শরীরের শক্তি নির্ভর করে তার পেশীর শক্তিমত্তা কিংবা দাঁতের আকারের উপর। প্রাণীটি যদি পাখি হয় তাহলে ডানার আকৃতিও তার শক্তি জানান দেয়। যদিও এটা সত্য যে, নিজের শারীরিক শক্তির বাইরে কিছু কিছু প্রাণী প্রাকৃতিক শক্তিকেও কাজে লাগাতে পারে, কিন্তু সেটার উপর কোন নিয়ন্ত্রণ তাদের থাকে না। যেমন, ঈগলেরা খুব সহজাতভাবেই চিহ্নিত করতে পারে কোনো জায়গায় গরম বাতাস বইছে কিনা। তখন তারা সেখানে তাদের পাখা মেলে ধরে যাতে গরম বাতাস তাদেরকে ঠেলে উপরের দিকে তোলে। কিন্তু গরম বাতাসের এই স্তরগুলো কোথায় এবং কখন তৈরি হবে এ ব্যাপারে ঈগলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি যখন পাখা মেলে তারা এই গরম বাতাস ব্যবহার করে উপরের দিকে ওঠে তখনও তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না এই বাতাসের উপর। বাতাসের কতটুকু শক্তি তারা কাজে লাগতে পারবে এটা নির্ভর করে তাদের ডানার বিস্তারের উপর, তাদের ইচ্ছের উপর নয়।

মানুষ যখন আগুনকে আয়ত্তে আনতে শিখল, তখন তারা এমন একটি শক্তির নিয়ন্ত্রণ হাতে পেলো, যার সম্ভাব্য ব্যবহার অফুরন্ত। ঈগলের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই গরম বাতাসের স্তরের উপর। কিন্তু মানুষ যে কোনো সময় চাইলেই আগুন জ্বালাতে পারে। এটা মানুষের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার চেয়ে বড় কথা হলো আগুনের শক্তি মানুষের শারীরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। একজন মাত্র মহিলা যে একটি বাতি বা চকমকি পাথর ব্যবহার করতে পারে, সে চাইলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুরো একটি বন জ্বালিয়ে দিতে পারে। বস্তুত আগুনকে আয়ত্তে আনাটা ছিল মানুষের ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা পূর্বাভাস মাত্র। সে সময় আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল আজকের আণবিক বোমা বানানোর পথে প্রথম পদক্ষেপ!

হারানো ভাই-বোনের খোঁজে

আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করার পরেও প্রায় দেড় লাখ বছর আগের মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের থেকে নিজেদের খুব একটা আলাদা করে তুলতে পারেনি। হ্যাঁ, আগুনের বদৌলতে তাদের ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু দক্ষতা- তারা এখন সিংহকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না, শীতের রাতে কৃত্রিম উত্তাপ উপভোগ করে, এমনকি ছোটখাট একটা জঙ্গল জ্বালিয়ে দিতেও পারে। তারপরও, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ আর আইবেরীয় উপদ্বীপে (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল অঞ্চল) তখন সব মিলিয়ে মোট ১০ লাখ মানুষও ছিলো না। বিশাল বাস্তুতন্ত্রের মাঝে সেটা ছিলো নিতান্ত নগণ্য।

এ সময়টাতে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি পৃথিবীতে টিকে থাকলেও তাদের সম্পূর্ণ উপস্থিতি ছিলো কেবল আফ্রিকার এক কোণে। বিবর্তনের ঠিক কোন পর্যায় থেকে এই প্রাণীটিকে হোমো সেপিয়েন্স বলে ডাকা যায় সেটা ঠিকঠাক নির্ণয় করা যায় না। তবে এখন থেকে প্রায় দেড় লাখ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকার মানুষগুলো দেখতে যে ঠিক আমাদের মতোই ছিলো- এ ব্যাপারে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই একমত। তখনকার একটা মানুষের মৃতদেহ যদি ঘটনাচক্রে আজকের কোনো মর্গে চলে আসে, সে মৃতদেহকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে কেউ বলতে পারবে না সেটা এখনকার না দেড় লাখ বছর আগের। সেই দেড় লাখ বছর আগেই মানুষের দাঁত ও চোয়াল ছোট হয়ে এসেছে, আর মস্তিষ্ক হয়েছে অনেক বড়। এর পুরো কৃতিত্ব হলো আগুনের।

বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারেও একমত যে, প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে কিছু সেপিয়েন্স পূর্ব আফ্রিকা থেকে আরব উপদ্বীপে পৌঁছে। সেখান থেকে তারা খুব দ্রুত পুরো ইউরেশিয়ায় বিস্তার লাভ করে। ইউরেশিয়া হলো ইউরোপ এবং এশিয়ার একত্রিত এলাকা।

সেপিয়েন্স যখন মধ্য প্রাচ্যে আসে তখন ইউরেশিয়ার বেশির ভাগ এলাকা অন্যান্য প্রজাতির মানুষে ভরপুর। পরবর্তী সময়ে কোথায় হারালো মানুষের অন্যান্য প্রজাতির সদস্যরা? এ ব্যাপারে দুটো পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব আছে। তার একটা হলো সঙ্কর প্রজনন (Interbreeding) তত্ত্ব। এই তত্ত্ব নিজের প্রজাতির সদস্য এবং অন্য প্রজাতির সদস্যদের সাথে একটি প্রাণীর প্রজনন সম্বন্ধে আলোচনা করে। এ তত্ত্ব অনুসারে, আফ্রিকার মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এক প্রজাতির মানুষ আরেক প্রজাতির মানুষের সাথে প্রজননে লিপ্ত হয়। আর আজকের আধুনিক মানুষ এই সঙ্কর প্রজননের ফলাফল।

উদাহরণ স্বরূপ, যখন সেপিয়েন্স মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে পৌঁছল তখন তাদের দেখা হলো নিয়ান্ডার্থালদের সাথে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি, নিয়ান্ডার্থালরা পেশীবহুল ছিল। তারা সেপিয়েন্সদের চেয়ে ঠান্ডা আবহাওয়ায় অনেক ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল। তাদের মস্তিষ্কের আকারও সেপিয়েন্সদের চেয়ে বড় ছিল। তারা অস্ত্রের ব্যবহার জানত, আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারত এবং সবরকম শিকারে তারা সেপিয়েন্সদের চেয়ে অনেক বেশি পারদর্শী ছিল। পুরাতাত্ত্বিকেরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অনেকদিন বেঁচে থাকা নিয়ান্ডার্থাল মানুষের দেহাবশেষ পেয়েছেন, যা থেকে ধারণা করা যায় তারা অসুস্থ ও দুর্বলদের যত্ন নিত। এখনকার বিভিন্ন ব্যাঙ্গচিত্রে নিয়ান্ডার্থালদেরকে অসভ্য, নির্বোধ পশুতুল্য গুহামানব রূপে চিত্রিত করা হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক প্রমাণ মোটেই তা বলে না।

সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব বলে, যখন সেপিয়েন্স নিয়ান্ডার্থালদের এলাকায়, মানে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ল তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটল। সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালেরা মিলে সন্তান উৎপাদন শুরু করল। এভাবে দুটি প্রজাতি মিলে মিশে একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হলো। সত্যি যদি এ ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের লোকেরা বিশুদ্ধ সেপিয়েন্স নয়, সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালের মিশ্রণ। একইভাবে সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব অনুযায়ী যখন সেপিয়েন্সরা ৬০ হাজার বছর আগে চীনে পৌঁছে তখন সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। তারা স্থানীয় হোমো ইরেক্টাসদের সাথে মেশে এবং সন্তান উৎপাদন শরু করে। ফলে চীন এবং পূর্ব এশিয়ার লোকজনও খাঁটি সেপিয়েন্স নয়, স্থানীয় হোমো ইরেক্টাস এবং নবাগত সেপিয়েন্সদের সংমিশ্রণ।

মোটামুটি এই হল সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব বা Interbreeding Theory। এই তত্ত্বের বিপরীতে আরেকটা তত্ত্ব আছে যেটার নাম প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বা Replacement Theory। এই প্রতিস্থাপন তত্ত্ব পুরো বিপরীত ধরনের একটি গল্প বলে আমাদের। এ গল্প অসহিষ্ণুতার, এ গল্প ঘৃণার এবং সম্ভবত গণহত্যারও।

প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী সেপিয়েন্সের সাথে অন্য কোন প্রজাতির মানুষের, নিয়ান্ডার্থাল বা ইরেক্টাস কারো সাথে কোনো প্রকার যৌন সম্বন্ধ সংঘটিত হয়নি। সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালদের দেহের গঠন ভিন্ন ছিল এবং তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা যৌনমিলন প্রক্রিয়া ছিল। এমনকি তাদের শরীরের গন্ধও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। অন্য কোন প্রজাতির সাথে যৌন মিলনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতি তাদের খুব কমই আগ্রহ ছিল। যদি কোন নিয়ান্ডার্থাল রোমিও সেপিয়েন্স জুলিয়েটের প্রেমে পড়েও এবং তাদের যদি কোনো সন্তানও হয়- প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী এ শিশুটি হবে বন্ধ্যা (Infertile)। ঠিক যেভাবে গাধা এবং ঘোড়া মিলিত হতে পারে, কিন্তু তারা শুধু প্রজনন-অক্ষম খচ্চরেরই জন্ম দিতে পারে। একইভাবে নিয়ান্ডার্থাল রোমিও এবং সেপিয়েন্স জুলিয়েট কেবল প্রজনন-অক্ষম সঙ্কর প্রজাতিরই সৃষ্টি করতে পারে।

সুতরাং, প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থাল এই দুই জনসমষ্টি স্পষ্টভাবে আলাদা হয়েই রইল। তারপর যখন নিয়ান্ডার্থালরা মারা গেলো, কিংবা খুন হয়ে গেলো, তাদের জিন (Gene) গুলোও শেষ হয়ে গেলো। নিয়ান্ডার্থাল মানুষের বিবর্তনও থেমে গেলো তখনই।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সেপিয়েন্স অন্যান্য প্রজাতিগুলোর সাথে কোনো রকম সম্পর্ক স্থাপন না করেই তাদের স্থান সম্পূর্ণ দখল করে নিল। এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে বলা যায় যে, আজকের পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ সেই ৭০ হাজার বছর আগেকার পূর্ব আফ্রিকার মানুষেরই বংশধর, আমরা সবাই নির্ভেজাল হোমো সেপিয়েন্স।

হোমো সেপিয়েন্স পুরো পৃথিবীকে জয় করে ফেলল

বিবর্তন প্রক্রিয়াটি এত ধীরগতির যে এর জন্য ৭০ হাজার বছর আসলে খুবই কম সময়। প্রতিস্থাপন তত্ত্ব যদি সত্যি হয়, তবে এখনকার সব মানুষের সব জিন ঘুরে ফিরে কমবেশি একই রকম হবে। কাজেই ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে জিনগত পার্থক্য হবে খুবই সামান্য। আবার সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব সত্য হলে আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষের জিনে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যাবে, যে পার্থক্যের সূচনা হয়েছে হাজার হাজার বছর আগে।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর পক্ষে জোরালো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মিলেছে আর এই তত্ত্ব রাজনৈতিক দিক থেকে অধিক উপযোগী (আর বিজ্ঞানীরাও আধুনিক মানুষের জিনের ভিন্নতা দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক কলহ তৈরি করতে চাননি)। কিন্তু ২০১০ সালে তা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। চার বছর চেষ্টার পর নিয়ান্ডার্থাল জিনোম (Genome) প্রকাশের ফলে তা আর চাপা থাকেনি। জিন-বিশেষজ্ঞরা ফসিল থেকে যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের ডিএনএ সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছেন। এই ডিএনএর সাথে সমকালীন মানুষের ডিএনএ তুলনা করে যে ফলাফল পাওয়া গেলো তা চমকে দেওয়ার মতো।

সমীক্ষায় দেখা গেলো, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বর্তমান মানুষের ১ থেকে ৪ শতাংশ মৌলিক ডিএনএ হলো নিয়ান্ডারর্থাল ডিএনএ। মিলের পরিমাণটা খুব বেশি না হলেও একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কয়েক মাস পর আরও বড় একটি চমক আসে। ডেনিসোভা গুহায় প্রাপ্ত জীবাশ্মে রূপান্তরিত মানুষের আঙুলের ডিএনএ মানচিত্র তৈরী করা হয়। ফলাফলে দেখা গেলো, আধুনিক মেলানেসিয়ান এবং অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ডিএনএর সাথে ডেনিসোভা মানবের ডিএনএ প্রায় ৬ শতাংশ মিলে যায়।

তবে এখনই কোনো উপসংহার না টানাই উচিত, কারণ এ গবেষণা এখনও শেষ হয়নি, শেষ পর্যন্তু এই ফলাফল নাও টিকতে পারে। যদি এই ফলাফলগুলোই টিকে থাকে, তবে সঙ্কর প্রজনন তত্ত্বের সমর্থকদের দাবি আরেকটু জোরালো হবে। তাই বলে প্রতিস্থাপন তত্ত্বকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। আজকের মানুষের জিনে নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা মানুষের জিনের পরিমাণ খুবই অল্প, তা থেকে বোঝা যায় সেপিয়েন্সদের সাথে অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলোর ‘মিশে যাওয়ার’ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সেপিয়েন্সদের সাথে মানুষের অন্যান্য প্রজাতির জিনের পার্থক্য এত বেশি ছিল না যাতে তাদের সন্তান জন্মদান ব্যাহত হয়, কিন্তু তারপরেও এমন ঘটনা ছিল বিরল।

তাহলে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সেপিয়েন্স, নিয়ান্ডার্থাল আর ডেনিসোভার মধ্যকার সম্পর্ক কীভাবে বুঝব? এটা পরিষ্কার যে এরা ঘোড়া এবং গাধার মতো সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতি নয়, আবার এরা বুলডগ ও স্প্যানিয়েলের মতো একই প্রজাতির আলাদা সদস্যও ছিল না। জীববিদ্যায় পার্থক্যগুলো সবসময় সাদা-কালোর মতো স্পষ্ট হয় না, এর মাঝে কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার স্যাপার ও থাকে। একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত ঘোড়া এবং গাধা এক সময় একই প্রজাতির দুটি ভিন্ন ধরণের সদস্যই ছিল, ঠিক বুলডগ ও স্প্যানিয়েলের মতোই। তাহলে নিশ্চয়ই এমন একটা সময় ছিল যখন এই দুই ধরনের প্রাণীর আন্তঃপ্রজননে প্রজননক্ষম সন্তান জন্ম নিতে পারত। তারপর তাদের জিনের কোনো একটা পরিবর্তনের (Mutation) কারণে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল, আর এই দুটি প্রাণীকে বিবর্তন এগিয়ে নিয়ে গেল দুটি ভিন্ন পথে।

তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এমন যে, প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে সেপিয়েন্স, নিয়ান্ডার্থাল এবং ডেনিসোভা ঠিক এমন একটা পরিবর্তনের মুখে পড়েছিল। তারা পুরোপুরি না হলেও প্রায় আলাদা আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হচ্ছিল। পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব, ততদিনে সেপিয়েন্স প্রজাতিটি নিয়ান্ডার্থাল এবং ডেনিসোভা প্রজাতির সদস্যদের থেকে শুধু শারিরীক বা জিনগত দিক দিয়েই নয় বরং সামাজিক কার্যকলাপ এবং চিন্তাচেতনার দিকে থেকেও অনেকটা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিরল ঘটনা হলেও, তখনও সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডার্থালের মিলনে প্রজননক্ষম সন্তান জন্মদান সম্ভব ছিল। ফলে দুই প্রজাতির মানুষ একসাথে মিশে গেল না ঠিকই, কিন্তু কিছু নিয়ান্ডার্থালের খুব সামান্য পরিমাণ জিন সেপিয়েন্সের দেহে সফলভাবে জায়গা করে নিল। এটা চিন্তা করা একই সাথে অস্বস্তিকর এবং রোমাঞ্চকরও যে হোমো সেপিয়েন্স কোনো এক সময়ে অন্য একটি ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সাথে মিলিত হয়েছে এবং সন্তানেরও জন্ম দিয়েছে।

একটি নিয়ান্ডার্থাল শিশুর কাল্পনিক পুনর্গঠন। জিনগত প্রমাণাদি থেকে আন্দাজ করা যায় যে, অন্তত কিছু সংখ্যক নিয়ান্ডার্থাল মানুষেরা উজ্জ্বল চামড়া আর চুলের অধিকারী ছিল।

নিয়ান্ডার্থাল আর ডেনিসোভা মানুষ না হয় সেপিয়েন্সদের সাথে মিশে গেল না, কিন্তু তারা হারিয়ে গেল কেন? একটা সম্ভাবনা হলো সেপিয়েন্সরাই তাদের বিলুপ্ত করে দিয়েছে। ধরা যাক নিয়ান্ডার্থালদের কয়েক হাজার বছরের আবাস বলকান উপত্যকায় একদিন একদল সেপিয়েন্স এসে পৌঁছাল। তারা ওখানে গিয়েই খাদ্যের জন্য হরিণ শিকার আর গাছের ফলমূল সংগ্রহ করতে লাগল। এগুলোই ছিল নিয়ান্ডার্থালদের প্রধান খাবার। সেপিয়েন্সরা শিকার ও সংগ্রহে অনেক বেশি দক্ষ ছিল, কারণ তাদের প্রযুক্তি ছিল উন্নত আর সামাজিক বন্ধনও ছিল দৃঢ়। ফলে তাদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি হতে থাকল। অন্যদিকে নিয়ান্ডার্থালদের পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করা এবং বেঁচে থাকা দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ল। তাদের মৃত্যুহার বেড়ে গেলো, আস্তে আস্তে তারা সংখ্যায় কমতে কমতে বিলুপ্তির কাছাকাছি চলে গেল। কে জানে, নিয়ান্ডার্থালদের শেষ কয়েকজন হয়তো সেপিয়েন্সদের দলেই মিশে গিয়েছিল।

আবার এমনও হতে পারে, যখন সেপিয়েন্স আর নিয়ান্ডার্থালদের মধ্যে খাদ্য নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলো, তখন এক দলের মানুষ অন্য দলের মানুষকে হত্যা করতে শুরু করল। সহিষ্ণুতা জিনিসটা সেপিয়েন্সদের মধ্যে বরাবরই কম। আজকের দিনেও গায়ের রঙ, সংস্কৃতি কিংবা ধর্মের পার্থক্যের কারণে যারা অনায়াসে নিজ প্রজাতির অন্য দলের উপর খড়্গহস্ত হয়, তারা কি ভিন্ন প্রজাতির মানুষের জন্য এর চেয়ে বেশি সহনশীলতা দেখাবে? কাজেই এমনটা হতেই পারে যে, নিয়ান্ডার্থালদের সাথে সেপিয়েন্সদের দ্বন্দ্বের ফলেই ঘটে ইতিহাসের প্রথম গোষ্ঠীগত গণহত্যা (Ethnic-cleansing)।

বিলুপ্তি যেভাবেই ঘটুক, নিয়ান্ডার্থাল এবং অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলো ‘কী হতো যদি’ নামে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখে গেছে আমাদের সামনে। কী হত যদি নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা প্রজাতির মানুষেরাও সেপিয়েন্সদের সাথে বাস করত আজকের পৃথিবীতে? কেমন হতো ভিন্ন প্রজাতির মানুষের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সেই সমাজের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো? কীভাবে গড়ে উঠত তাদের ধর্মবিশ্বাস? ধর্মগ্রন্থগুলো কি নিয়ান্ডার্থালদেরকেও আদম ও ইভের বংশধর বলে স্বীকৃতি দিত? যিশুখ্রিস্ট কি ডেনিসোভা প্রজাতির মানুষের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করতেন? কোর’আনে বর্ণিত জান্নাতে কি প্রজাতি নির্বিশেষে সকল পূণ্যবান মানুষই স্থান পেতেন? রোমান সেনাবাহিনী কিংবা চীনের বিশাল রাজতন্ত্রে কি নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতির কোনো কর্মচারীকে দেখা যেত? আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে কি ‘সকল প্রজাতির মানুষকেই সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে’- এ কথাটাকে সত্য বলে ধরে নেওয়া হতো? কার্ল মার্ক্স কি সব প্রজাতির মানুষের জন্যই প্রচার করতেন সাম্যবাদ?

বিগত ১০ হাজার বছর ধরে এই হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি নিজেদেরকে পৃথিবীর একমাত্র মানব প্রজাতি বলে ভেবে আসছে। তাদের এই ধারণা এতই বদ্ধমূল যে তারা এ ব্যাপারে কোনো রকম ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। মানুষের অন্যান্য প্রজাতির উপস্থিতিকে অস্বীকার করে মানুষ খুব সহজে নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা জীব এবং অন্য সবরকম প্রাণী থেকে আলাদা ভাবতে পারে। চার্লস ডারউইন যখন বললেন, মানুষ আর দশটা প্রাণীর মতোই আরেকটি প্রাণী, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া মোটেই ভালো হয়নি। আজকের দিনেও সে অবস্থা তেমন পাল্টায়নি। নিয়ান্ডার্থালরা যদি আজও টিকে থাকত, তাহলেও কি আমরা নিজেদেরকে সমগ্র প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা করে দেখতাম? সম্ভবত এটাই আমাদের পূর্বসূরীদের হাতে নিয়ান্ডার্থালদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণ। তাদের সাথে আমাদের মিল এত বেশি ছিল যা অস্বীকার করা কঠিন, আবার পার্থক্যও এত বেশি যে তাদের সাথে সহাবস্থান করতেও রাজি হয়নি সেপিয়েন্স।

সেপিয়েন্স দায়ী হোক বা না হোক, এটা দেখা গেছে যে তারা যখনই কোনো নতুন জায়গায় পৌঁছেছে তখন সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হোমো সলোয়েনসিসের সর্বশেষ অস্তিত্ব নির্ণয় করা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে। তার কিছু পরেই হোমো ডেনিসোভা প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়। নিয়ান্ডার্থালদের বিলুপ্তি ঘটে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে। সর্বশেষ বিলুপ্ত হয় ফ্লোরেন্স দ্বীপের বামনাকৃতি মানুষের প্রজাতিটি, প্রায় ১২ হাজার বছর আগে। মানুষের এইসব প্রজাতি হারিয়ে গেছে, কিন্তু তারা পৃথিবীতে রেখে গেছে তাদের দেহাবশেষ, পাথরের হাতিয়ার, আমাদের ডিএনএর মাঝে কিছু জিন আর অনেক অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন। আর রেখে গেছে আমাদের, মানুষের সর্বশেষ প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্সকে।

সেপিয়েন্সদের এই বিপুল সাফল্যের রহস্য কী ছিল? কীভাবে মানুষ এত দ্রুত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো? কীভাবে এতরকম ভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকল তারা? মানুষের অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে নিশ্চিহ্নই বা করল কীভাবে? শক্তসমর্থ, বুদ্ধিমান, শীতসহিষ্ণু নিয়ান্ডার্থালরাই বা কেন টিকতে পারল না সেপিয়েন্সদের আক্রমণের মুখে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলছে অন্তহীন বিতর্ক। এসব প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে ভাষা। ভাষার মত অনন্যসাধারণ একটি বৈশিষ্ট্যই সেপিয়েন্সদের সাহায্য করেছে পৃথিবী জয় করতে।


তথ্যসূত্র

1 Ann Gibbons, ‘Food for Thought: Did the First Cooked Meals Help Fuel the Dramatic Evolutionary Expansion of the Human Brain?’, Science 316:5831 (2007), 1,558–60.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *