১২. নাট্য ও সঙ্গীত

দ্বাদশ অধ্যায় – নাট্য ও সঙ্গীত

১. রঙ্গমঞ্চ ও অভিনয়

নাট্য-সাহিত্য সম্বন্ধে পূর্বেই বলা হইয়াছে যে বর্তমানকালে আমরা নাটক বলিতে, যাহা বুঝি, ইংরেজীসাহিত্যের অনুকরণেই তাহার সৃষ্টি হয়। প্রাচীন হিন্দুযুগেও নাটক রচিত ও অভিনীত হইত ইহাতে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু সে-যুগের রঙ্গমঞ্চ ও অভিনয়প্রণালী কিরূপ ছিল তাহা আমাদের জানা নাই। সংস্কৃত যবনিকা’ শব্দ হইতে অনুমান করা যাইতে পারে, যবন অর্থাৎ গ্রীকদের অনুকরণে রঙ্গমঞ্চ প্রস্তুত হইত। কিন্তু ইহা অনুমানমাত্র-যবনিকা বা পর্দা থাকিলেও দৃশ্যপটের ব্যবহার, পটপরিবর্তন প্রভৃতি ছিল কিনা তাহা সঠিক কিছু বলা যায় না। বর্তমানকালের ন্যায় রঙ্গমঞ্চ, দৃশ্যপট, প্রেক্ষাগৃহ প্রভৃতি ইংরেজরাই এদেশে প্রচলিত করে। সুতরাং কলিকাতায় ইংরেজদের রঙ্গমঞ্চ ও নাট্যাভিনয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রথমেই বর্ণনা করা প্রয়োজন।

(ক) কলিকাতায় বিলাতী রঙ্গালয়

১৭৫৩ সনের পূর্বেই বর্তমান লালদীঘির অনতিদূরে Old Play House নামে একটি রঙ্গালয় কলিকাতাবাসী ইংরেজেরা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে স্ত্রী-পুরুষ সকল ভূমিকার অভিনেতাই ছিলেন পুরুষ ও অবৈতনিক (amateur)। বিলাতের খ্যাতনামা অভিনেতা ডেভিড গ্যারিকের নিকট হইতে তাহারা বহু উপদেশ ও নানাপ্রকার সাহায্য পাইয়াছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কলিকাতা-অধিকার উপলক্ষে যে সংঘর্ষ হয় তাহাতেই এই রঙ্গালয়টি ধ্বংস হয় (১৭৫৬)। ইহার সম্বন্ধে আর কোন বিবরণ জানা যায় না।

১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমানে Writers Building-এর পশ্চাতে নূতন এক রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহা Calcutta Theatre ও The New Play House, এই দুই নামে অভিহিত হইত। নিলাম বিভাগের অধ্যক্ষ জর্জ উইলিয়ামসন প্রায় লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই রঙ্গালয় নির্মাণ করেন এবং হাজার টাকার ১০০ শেয়ার বিক্রয় করিয়া এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ওয়ারেন হেষ্টিংস, ইম্পে প্রভৃতি সর্বোচ্চ ইংরেজ কর্মচারীদের অনেকেই ইহার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এবারেও নটরাজ গ্যারিক বিলাত হইতে শিল্পী ও দৃশ্যপট পাঠাইয়া এই প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করেন। এখানেও শিল্পীরা সকলেই ছিলেন অ্যামেচার সম্ভ্রান্ত ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। অভিনয় খুব সুন্দর হইত। মিসেস ফে নামক একজন ইংরেজ মহিলা এক পত্রে লিখিয়াছিলেন, এখানকার অভিনয় ইউরোপীয় অভিনেতাদের তুলনায়ও নিন্দনীয় বলিয়া মনে হইবার কোন কারণ নাই। বেঙ্গল গেজেটেও এইরূপ মন্তব্য দেখা যায়। এই রঙ্গালয়ের প্রবেশমূল্য ছিল একটি সোনার মোহর, তাহা সত্ত্বেও দর্শকের অভাব হইত না। লর্ড কর্ণওয়ালিস সরকারী কর্মচারীর অভিনয়ে যোগদান বন্ধ করার ফলে উৎকৃষ্ট অভিনেতার অভাবে রঙ্গালয়টির অবনতি ঘটে। এই রঙ্গালয়ে স্ত্রী-চরিত্রের ভূমিকায়। পুরুষ-শিল্পীরাও এমন দক্ষতা দেখাইতেন যে, একজন ইংরেজ মহিলা লণ্ডনেও এই ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তিত হইলে তিনি সুখী হইবেন–এরূপ মত প্রকাশ করে। প্রায় ৩৩ বৎসর শেক্সপীয়র ও অন্যান্য খ্যাতনামা ইংরেজ কবির নাটক অভিনয় করিয়া সুনাম অর্জন করিলেও ইহার আর্থিক ক্ষতির জন্য ১৮০৮ সনে এই রঙ্গালয়টি বন্ধ হইয়া গেল।

ইতিমধ্যে দুইটি প্রতিযোগী রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু কোনটিই খুব বেশীদিন চলে নাই। কলিকাতায় ইংরেজ-সমাজে সুন্দরী এবং সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় পটীয়সী মহিলা মিসেস ব্রিষ্টো ১৭৭৯ সনে একটি Private Theatre প্রতিষ্ঠিত করেন। এখানে স্ত্রীলোকেরা কেবল স্ত্রী নয়, পুরুষ-চরিত্রের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হইতেন। সে-যুগের কলিকাতা সম্বন্ধে বিশিষ্ট গ্রন্থের প্রণেতা Busteed লিখিয়াছেন, ‘জুলিয়াস সীজার’ নাটকে Lucius-এর ভূমিকায় মিসেস ব্রিষ্টো অসাধারণ সাফল্য (triumph) লাভ করেন। কিন্তু ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দের জানুআরি মাসে তিনি ইংলণ্ডে চলিয়া যাওয়ার রঙ্গালয়টি বন্ধ হইয়া যায়।

১৭৯৭ সনে হোয়েলার প্লেস থিয়েটারের (Wheler Place Theatre) প্রতিষ্ঠা হয়। খুব জাঁকজমকের সঙ্গে আরম্ভ করিলেও ইহা অল্পদিনের মধ্যেই বন্ধ হইয়া যায়।

‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ বন্ধ হওয়ার চারি বৎসর পরে সার্কুলার রোড ‘এথেনিয়াম থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হয় (৩০শে মার্চ, ১৮১২ খ্রী.)। কিন্তু এটি বিশেষ সফলতা লাভ করিতে পারে নাই, অল্পকাল পরেই বন্ধ হইয়া যায় (১৮১৪)।

ইতিমধ্যে, ১৮১৩ সনের ২৫শে নভেম্বর ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছুদিন পূর্বেও দক্ষিণ কলিকাতার যে রাস্তাটি থিয়েটার রোড নামে পরিচিত ছিল, সেই রাস্তা ও চৌরঙ্গীর সংযোগস্থলেই এই রঙ্গালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়–”থিয়েটার রোড’ নামটি তাহারই স্মৃতিজ্ঞাপক। সেকালের বহু প্রসিদ্ধ ব্যক্তি এবং দুইজন বিখ্যাত পণ্ডিত এই রঙ্গালয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন–তাঁহারা সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক হোরেস হেম্যান উইলসন এবং ইংরেজী সাহিত্যে, বিশেষতঃ শেক্সপীয়রের নাটক বিষয়ে, হিন্দু কলেজের লব্ধপ্রতিষ্ঠ অধ্যাপক ডি. এল. রিচার্ডসন। রাজনারায়ণ বসু তাঁহার আত্মচরিতে লিখিয়াছেন : “রিচার্ডসন শেক্সপীয়ার যেমন পাঠ করিতেন ও বুঝাইতেন এমন আর কাহাকেও দেখি নাই।” তাঁহার শেক্সপীয়রের আবৃত্তি শুনিয়া মেকলে বলিয়ছিলেন, “ভারতের আর সবই ভুলিতে পারি কিন্তু আপনার শেক্সপীয়ারের আবৃত্তি ভুলিতে পারিব না।”

সে-যুগে যে শিক্ষিতসমাজের সহিত রঙ্গালয়ের নিকট-সম্বন্ধ ছিল, উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলি হইতে তাহা বুঝা যাইবে। দ্বারকানাথ ঠাকুরও এই রঙ্গালয়ের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ইংলণ্ডের সম্রাট চতুর্থ উইলিয়মের পুত্র জর্জ ফিজক্লেয়ারেন্স তখন কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। তিনিও চৌরঙ্গী রঙ্গালয়ের পরিচালকবৃন্দের সঙ্গে যোগ দেন।

অনেক উৎকৃষ্ট নাট্যকুশল অভিনেতা ও অভিনেত্রী এই রঙ্গালয়ে যোগ দিয়াছিলেন। অভিনেতারা ছিলেন অবৈতনিক, কিন্তু অভিনেত্রীরা বেতন পাইতেন এবং রঙ্গালয়-গৃহেই তাঁহাদের বাসের ব্যবস্থা ছিল। প্রথম উদ্বোধন-রজনীতে বড়লাট লর্ড ময়রা ও তাঁহার পত্নী এবং কলিকাতার বহু গণ্যমান্য লোক প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত ছিলেন। ইহাতে অসংখ্য দর্শকের সমাগম হইয়াছিল। সমসাময়িক সংবাদপত্রে অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু ইহাসত্ত্বেও ক্রমশঃই আর্থিক অবস্থার অবনতি ও বিস্তর ঋণ হওয়ায় ১৮৩৩ সনে, প্রথমে এক ইতালীয় কোম্পানি এবং পরে এক ফরাসী কোম্পানিকে এই রঙ্গালয় মাসিক হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হইল। তারপর প্রকাশ্য নিলামে এই রঙ্গালয় বিক্রীত হয় (১৮৩৫ খ্র.)। দ্বারকানাথ ঠাকুর ৩০,১০০ টাকায় ইহা ক্রয় করিলেন এবং রঙ্গালয়টি চালাইবার নূতন ব্যবস্থা করিলেন। কিছুদিন ইহা চলিল। কিন্তু ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে মে মধ্যরাত্রে আগুন লাগিয়া ২৬ বৎসরের পুরাতন রঙ্গালয়টি একেবারে ধ্বংস হইয়া গেল।

ইহার অল্পকাল পরেই ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’-এর খ্যাতনামা অভিনেত্রী মিসেস লীচ এবং অন্যান্য কয়েকজন পৃষ্ঠপোষক ও প্রসিদ্ধ অভিনেতা-অভিনেত্রীর উদ্যোগে ১৮৩৯ সনের ২১ আগষ্ট ‘সাঁ সুসি (Sans Souci)’ নামে লালদীঘির কাছে নূতন এক রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম প্রথম এটিও খুব জনপ্রিয় ছিল। পার্ক স্ট্রীটে এখন যেখানে St. Xaviers College সেখানে ইহার নিজস্ব বাড়ী নির্মিত হইল। কেহ কেহ এই সুপরিসর ও সুরম্য গৃহকে উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রঙ্গালয়, এবং রঙ্গালয়ের ইতিহাসে নব অভ্যুদয়’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ১৮৪১ সনের ৮ই মার্চ এই নূতন রঙ্গালয়গৃহের দ্বারোঘাটন উপলক্ষে যে নাটক অভিনীত হয় তাহাতে বড়লাট সদলবলে উপস্থিত ছিলেন। ১০ই মার্চের ‘হরকরা’ পত্রিকায় লেখা হয় : “প্রেক্ষাঘরের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সব আসনই ভর্তি হইয়া যায়। কোনখানে তিলধারণের জায়গা ছিল না, এমনকি, ভিতরের চলাফেরার রাস্তাটুকুও খালি ছিল না। প্রধানতঃ মিসেস লীচের উদ্যোগেই যে এই রঙ্গালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। ১৮২৬ সনে ষোল বৎসর বয়সে চৌরঙ্গী থিয়েটারে তাঁহার প্রথম অভিনয় দর্শনেই শ্রোতারা মুগ্ধ হন। তিনি সেখানে প্রতি রাত্রের অভিনয়ের জন্য দেড়শত টাকা পাইতেন এবং প্রতি বৎসর তাহার জন্য অনুষ্ঠিত এক বিশেষ অভিনয়ে লব্ধ সমস্ত অর্থই তাহাকে দেওয়া হইত। ১৮৩৮ সনে বিলাত যাওয়ার প্রাক্কালে চৌরঙ্গী থিয়েটারে তাঁহার শেষ অভিনয়-রজনীতে তিনি ছন্দোবদ্ধ কবিতায় রচিত হৃদয়ের আবেগপূর্ণ যে সুদীর্ঘ বিদায়-সম্ভাষণটি আবৃত্তি করেন তাহার মাধুর্য সকলকে মুগ্ধ করিয়াছিল। ‘Sans Souci’ রঙ্গালয়ের নূতন গৃহে প্রথম রজনীতে বিশিষ্ট অতিথি, অভ্যাগত এবং দর্শকদের স্বাগত জানাইয়া তিনি যে সুদীর্ঘ কবিতাটি আবৃত্তি করেন, তাহাতে নাট্যজগতের অনেক পুরাতন কথার উল্লেখ ছিল, দর্শকবৃন্দও তাহা শুনিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন। সেকালের রঙ্গালয়ের একটি বৈশিষ্ট্য হিসাবে এই দুইটি কবিতার যথেষ্ট ঐতিহাসিক মূল্য আছে।

এই নূতন রঙ্গালয়েও বহু নূতন অভিনেতা ও অভিনেত্রী বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন এবং Macbeth প্রভৃতি নাটক খুব নৈপুণ্যের সহিত অভিনীত হয়। ১৮৪৩ সনের ২রা নভেম্বর খুব জাঁকজমকের সহিত Merchant of Venice নাটকের অভিনয় হয়। শাইলক ও পোর্শিয়ার অভিনয়ে দর্শকেরা বিমুগ্ধ হইয়াছিল। অবিচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতার মধ্যে যবনিকা-পতন হইলে একটি প্রহসনের অভিনয়মাত্র আরম্ভ হইয়াছে, এমন সময় মঞ্চের উপরের একটি বাতির শিখায় মিসেস লীচের পরিচ্ছদে আগুন লাগে এবং তিনি দারুণভাবে আহত হন। ১৮ই নভেম্বর মাত্র ৩৪ বৎসর বয়সে এই অপূর্ব প্রতিভাশালিনী অভিনেত্রীর মৃত্যু হয়।

মিসেস লীচের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে “সাঁ সুসি”র সৌভাগ্যও যেন অস্তমিত হইল। ফলে আর-একজন প্রসিদ্ধ অভিনেত্রী মিসেস ডিকলও চলিয়া গেলেন। ক্রমশঃই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাইল। কিন্তু স্তিমিতপ্রায় এই রঙ্গালয়ের ১৮৪৮ সনের একটি ঘটনা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। মহারাজা রাধাকান্ত দেব, মহারাজা বৈদ্যনাথ রায়, মহারাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ প্রভৃতি সেকালের কলিকাতার অভিজাত বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের কয়েকজনের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বিশিষ্ট অভিনয়ের আয়োজন হইল। ১০ই আগষ্ট এই অনুষ্ঠানে ওথেলো নাটকের ভূমিকায় নায়িকা ডেসডিমোনা সাজিবেন মিসেস্ লীচের কন্যা, আর নায়ক ওথেলোর ভূমিকা গ্রহণ করিবেন একজন বাঙ্গালী–এইরূপ ঘোষণাপত্র বাহির হইল। এই সংবাদে কলিকাতার দেশীয় ও সাহেবমহলে বিশেষ উত্তেজনা দেখা দিল, ফলে অভিনয় রজনীতে প্রেক্ষাগৃহের সম্মুখে বিষম ভীড় হইল। কিন্তু রঙ্গালয়ের দরজা খুলিল না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়া দর্শকেরা ফিরিয়া গেলেন। কারণ, নির্বাচিত অভিনেতাদের মধ্যে সৈনিক বিভাগের কয়েকজন কর্মচারী ছিলেন। হঠাৎ শেষমুহূর্তে দমদমের সৈন্যাধ্যক্ষ (কমাণ্ডিং অফিসার) তাহাদিগকে অভিনয় করিতে নিষেধ করায় এই বিভ্রাট ঘটিল। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে নূতন শিল্পীর সাহায্যে ওথেলো নাটক মঞ্চস্থ হইল। ওথেলোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছিলেন বৈষ্ণবচরণ আঢ্য। ইংরেজী ও বাংলা সমসাময়িক পত্রিকার বিবরণে দেখা যায় যে, ‘প্রেক্ষাগৃহে তিলধারণের স্থান ছিল না। ওথেলো মঞ্চে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত দর্শকবৃন্দ করতালিধ্বনি দ্বারা তাহাকে সম্বর্ধনা করেন। বৈষ্ণবচরণও এই ভূমিকায় বিশেষ সাফল্য লাভ করেন। বেঙ্গল হরকরার’ মতে তাঁহার এই প্রথম আবির্ভাবে কোন সঙ্কোচ বা জড়তা ছিল না এবং ইংরেজী উচ্চারণও ছিল একজন বিদেশীর পক্ষে বিশেষ প্রশংসনীয়। বিভিন্ন ইংরেজী সংবাদপত্র উচ্ছ্বসিত ভাষায় এই ‘হিন্দু ওথেলোর’ অভিনয়-নৈপুণ্যের প্রশংসা করিয়াছিল। কিন্তু প্রদীপ উচ্চশিখায় জ্বলিয়াই নিবিয়া গেল। ১৮৪৯ সনে ২১শে মে ‘স সুসি’র শেষ অভিনয় হইয়া চিরদিনের মত যবনিকা পতন হইল। এই রাত্রের অভিনয়ের গোড়াতেই রঙ্গালয়ের অধ্যক্ষ ব্যারী সাহেব একটি মর্মস্পর্শী বিদায়সম্ভাষণসূচক কবিতা আবৃত্তি করেন। ইহার আরম্ভ এইরূপ :

“Let down the curtain, put the candles out”
(নিবাইয়া দাও বাতি, ফেল যবনিকা)

‘সাঁ সুসি’র পর উনিশ শতকের শেষার্ধে ‘সেন্ট জেমস থিয়েটার’, মিসেস লিউইস এর থিয়েটার ‘অপেরা হাউসে মিসেস্ ইংলিস-এর রঙ্গালয়, ফোর্ট উইলিয়মে ‘থিয়েটার রয়্যাল’ এবং গ্যারিসন’ থিয়েটার, প্রভৃতি অনেকগুলি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, কিন্তু এইসব রঙ্গালয়ে অনেক শিল্পী অভিনয়ে খ্যাতিলাভ করিলেও ইহার কোনটিই দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই। ১৮৭৬ সনের ১লা জানুয়ারি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যুবরাজ ও ভবিষ্যৎ সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের উপস্থিতিতে ‘অপেরা হাউসে’ (বর্তমান গ্লোব সিনেমা) খুব জাঁকজমকের সহিত একটি অভিনয় হইয়াছিল।

উপসংহারে বলা আবশ্যক, বাংলা দেশে কলিকাতার বাহিরেও, ব্যারাকপুর ও বহরমপুরে, ইংরেজেরা নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। [১]

(খ) কলিকাতার বাঙ্গালী নাট্যশালা

১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে সর্বপ্রথম বাংলা নাটক আধুনিক প্রথানুযায়ী নির্মিত রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়। কিন্তু ইহার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হেরামিস লেবেডেফ (Herasim Lebedeff) নামে একজন রাশিয়ান। সমসাময়িক পত্রিকা হইতে জানা যায়, রঙ্গমঞ্চটি বাঙ্গালার রীতিতে সজ্জিত করা হয় (decorated in the Bengali style)। কিন্তু এই রীতিটি কী এবং পূর্ব অনুচ্ছেদে বর্ণিত ইংরেজী ধরণের রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে ইহার কী প্রভেদ ছিল, তাহা বুঝা যায় না। লেবেডেফ দুইখানি ইংরেজী নাটকের বঙ্গানুবাদ করেন। ইহার একখানি ২৭শে নভেম্বর মঞ্চস্থ হয়। পরের বৎসর অর্থাৎ ১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দের ২১ মার্চ এই নাটকের পুনরভিনয় হয়। এদেশীয় অভিনেতা ও অভিনেত্রীরাই সকল ভূমিকায় অভিনয় করেন। প্রথমবারের অভিনয়ে দুইশত আসন ছিল। প্রবেশমূল্য উচ্চশ্রেণীর (Box-Pit)- আট টাকা, গ্যালারী চারি টাকা। দ্বিতীয় অভিনয়ে প্রবেশমূল্য ছিল একটি সোনার মোহর।

লেবেডেফ স্বদেশে ফিরিয়া গেলে এই নাট্যশালাটিও বন্ধ হইয়া যায়। ইহার পর চল্লিশ বত্সরের মধ্যে বাংলা দেশে আর কোনও রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। লেবেডেফের নাট্যশালা বাঙ্গালীদের মন যে এই নূতন ধরণের অভিনয়ের দিকে আকৃষ্ট করিবে ইহা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু, যে-কোন কারণেই হউক তাহা হয় নাই। কারণ পরবর্তী কালে বাংলা সাময়িকপত্রে ইংরেজী নাট্যশালার অনুরূপ নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব থাকিলেও লেবেডেফের বাংলা নাট্যাভিনয়ের কোন উল্লেখ নাই।২ ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় ১৮২৬ সনে লেখা হয় : “ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা যাহাতে একত্র হইয়া ইংরেজদের মত ‘শেয়ার’ (share) গ্রহণ করিয়া একটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন, তাহা নিতান্তই বাঞ্ছনীয়। এইরূপে শ্রেণী-নির্বিশেষে সমাজভুক্ত সকলেরই আনন্দবৃদ্ধি হইবে।”৩

১৮৩১ সনের ১৭ সেপ্টেম্বর একটি পত্রিকায় লিখিত হইয়াছে : “কিয়ৎকালাবধি কলিকাতাস্থ এতদ্দেশীয়েরদের মধ্যে এক নর্তনাগার গ্রন্থননিমিত্ত আন্দোলন হইতেছে। তদর্থ বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুরের অনুরোধে” কয়েকজন বিশিষ্ট লোককে লইয়া একটি কমিটি হয়। “ঐ নর্তনশালা ইংলণ্ডীয়েরদের রীত্যনুসারে প্রস্তুত হইবেক এবং তন্মধ্যে যে সকল নাটকের ক্রীড়া হইবে সে সকলি ইঙ্গলণ্ডীয় ভাষায়।”৪

সেই চেষ্টার ফলে ১৮৩১ সনের ২৮শে ডিসেম্বর প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বাগানে ‘হিন্দু থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। এই উপলক্ষে শেকস্পীয়রের ‘জুলিয়াস সীজার’ নাটকের এক অংশ এবং ভবভূতির উত্তর রামচরিতের’ ইংরেজ অনুবাদ অভিনীত হইয়াছিল। এই প্রসঙ্গে সমসাময়িক দেশীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত কয়েকটি মন্তব্য বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক। প্রথমতঃ, দুইজন লেখকই এই নাটককে যাত্রার ইংরেজী সংস্করণ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। দ্বিতীয়তঃ অভিনয় করাকে ‘পাঠ করা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ইহাদের একজন হিন্দু থিয়েটার’-এর প্রথম রজনীর অভিনয় সম্বন্ধে লিখিয়াছেন : “শ্রীযুক্ত ডাক্তার উইলসন সাহেব কর্তৃক সংস্কৃত রামচরিত্র-বিষয়ক ইঙ্গরেজীতে ভাষান্তরীকৃত সুসজ্জ যাত্রানুষ্ঠায়ি কর্তৃক উচ্চারিত হইল। পরিশেষে জুলিয়শ সিজর নামক এক কাব্যের শেষ প্রকরণ পাঠ হইল।”

আর-একজন লেখকের বিস্তৃত মন্তব্যের কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি : “রামলীলা নাটকের মত যাহা যাহা ইঙ্গরেজী ভাষায় তরজমা হইয়াছে হিন্দু বালকেরা তরজমা ভাষাভ্যাস করিয়া সেই সকল বাক্য উচ্চারণ পূৰ্ব্বক রাম, লক্ষ্মণ, সীতা ইত্যাদি সং সাজিয়া যাত্রা করিয়াছেন…এদেশে পূৰ্ব্বকালে রাজারা নানাপ্রকার যাত্রা দর্শন করিতেন তপ্রমাণ নাটক গ্রন্থ সকল বর্তমান আছে এক্ষণে কেবল কালীয়দমন রামযাত্রা চণ্ডীযাত্রা যাহা রাঢ় দেশীয় ক্ষুদ্রলোকের সন্তানেরা করিয়া থাকে তাহাতেই দেখা যায়। এক্ষণে ভদ্রলোকের সন্তানেরা ঐ ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন ইহা অবশ্যই উত্তমরূপে হইতে পারিবেক। অধিকন্তু সুখের বিষয় ইহারা ধনিলোকের সন্তান হারদিগকে প্রতিপদে পেলা দিতে হইবেক না।”

ইংরেজীর অনুকরণে এই নূতন প্রণালীর যাত্রা যে পুরাতন যাত্রার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, উক্ত লেখক তাহার আর-এক নিদর্শন দিয়াছেন : “ইহারা নিজ অর্থ ব্যয় করিয়া নানা প্রকার বেশভূষণ প্রস্তুত করিয়াছেন এবং একজন ইঙ্গরেজ শিক্ষক রাখিয়া ঐ বিদ্যাভ্যাস করিয়াছেন আমারদিগের দেশীয় অধিকারী ও বেশকারী বেটারা চিরদিন এক রকম বেশ করিয়া দেয় কেবল থরকাটা প্রেমাদ কতগুলিন বাইআনা বেশের সৃষ্টি করিয়াছে মাত্র ইরেজাধিকারী তাহা হইতে সহস্রগুণে শ্রেষ্ঠ তাহাতে সন্দেহ কি তাহারা যে যে সং সাজাইয়া দিবেন তাহা অবিকল হইবেক ইহা বিশ্বাসযোগ্য কথা।”৬

‘সমাচার দর্পণে এক সুদীর্ঘ পত্রে জনৈক লেখক নূতন নাট্যাভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া মন্তব্য করিয়াছেন যে, ইংরেজেরা বলেন, তাঁহারা যেরূপ সভ্য, হিন্দুরা কখনও সেরূপ হইতে পারিবে না, ইহা অতি হাস্যাস্পদ কথা, কারণ ঈশ্বর পক্ষপাতী নহেন। তাহার পর লিখিয়াছেন : “যদি ইহাতে ঐ শ্ৰেষ্ঠাভিমানিরা ক্ষান্ত না হন তবে হিন্দুর নাট্যশালা এবং হিন্দুর ঐচ্ছিক যাত্রাকারিরা কিরূপে তত্ত কৰ্ম্ম সম্পন্ন করিবেন তাহা দৃষ্টি করুন। অল্পকালের মধ্যে বুঝি হিন্দু ঐচ্ছিক যাত্রাকারিরা চৌরঙ্গীর ঐচ্ছিক যাত্রাকারিদের তুল্য হইবেন।”৭।

ইংরেজী নাট্যশালাপ্রসঙ্গে অ্যামেচার’ (অবৈতনিক) অভিনেতাসম্বন্ধে পুনঃপুনঃ উল্লেখ আছে। উক্ত লেখক ‘ঐচ্ছিক যাত্রাকারি’ দ্বারা সম্ভবতঃ তাঁহাদিগকেই নির্দেশ করিয়াছেন, অর্থাৎ যাঁহারা পেশাদার অভিনেতা নহেন, স্বেচ্ছায় রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হইয়াছেন। বস্তুতঃ হিন্দু থিয়েটার ও তাহার অনুকরণে বহু বৎসর যাবৎ কলিকাতায় যেসব নাট্যামোদীর দল নূতন নূতন সম্প্রদায় গঠন করিয়া বাংলা নাট্যশালার উন্নতি সাধন করিয়াছিল, ঐসব রঙ্গালয়ের সদস্যেরা সকলেই ‘ঐচ্ছিক ছিলেন এবং দুই উপায়ে পরবর্তীকালের পেশাদারী থিয়েটার প্রচলনের পথ প্রশস্ত করিয়াছিলেন। প্রথমতঃ, পুনঃপুনঃ অনুশীলনের দ্বারা অভিনয়-শিল্পের ও শিল্পীর উৎকর্ষসাধন, ও দ্বিতীয়তঃ বর্তমান প্রণালীর নাট্যশালা ও নাট্যাভিনয়ের প্রতি শিক্ষিত বাঙ্গালীর অনুরাগ বৃদ্ধি। ইহার ফলে যখন পেশাদারী নাট্যশালা গঠিত হইল তখন উৎকৃষ্ট অভিনেতা ও প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে অভিনয়-দর্শনেচ্ছুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাইল।

হিন্দু থিয়েটারের পরে ‘ঐচ্ছিক’ বা সখের অভিনয় অনুষ্ঠানের জন্য বহুসংখ্যক দলের সৃষ্টি হয়। ইহাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।

১। এখন যেখানে শ্যামবাজারের ট্রামের ডিপো, সেখানে বা তাহারই সন্নিকটে নবীনচন্দ্র বসু নিজের বাড়ীতে একটি রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত করেন (১৮৩৩ খ্র.)। এখানেই সর্বপ্রথমে বাঙ্গালীর চেষ্টায় বাংলা নাটক অভিনীত হন। ১৮৩৫ সনের ২২শে অক্টোবর বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের অভিনয় হয় এবং কে কোন ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহার পরিচয়ও সর্বপ্রথম এই উপলক্ষেই পাওয়া যায়। দেখা যায়, তিনজন মহিলা বিদ্যা, বিদ্যার সখী, এবং রাণী ও মালিনীর ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন।

‘সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ নামক পত্রিকায় একজন লিখিয়াছেন (১৮৩৫ নভেম্বর) যে, নবীনচন্দ্র বসু মহাশয় যাহাদিগকে অভিনয় দর্শনের জন্য আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন তাঁহারা ছাড়াও অনেকে অভিনয় দেখিতে বিশেষ উৎসুক ছিলেন। সুতরাং “নবীনচন্দ্র বসু বাবুর প্রতি নিবেদন যে ভবিষ্যতে অনাহুত দর্শক ভদ্রসন্ত নিদিগের প্রতি কোন নিয়ম স্থির করেন।”৮

২। সম্ভবতঃ এই নিবেদনের ফলেই পূর্বোক্ত নবীনচন্দ্র বসুর ভ্রাতুস্পুত্র প্যারীমোহন বসু যখন ‘জোড়াসাঁকো থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ‘জুলিয়াস সীজারের’ অভিনয় হয় (৩রা মে, ১৮৫৪) তখন জনসাধারণের জন্য প্রবেশমূল্যের ব্যবস্থা হয়–অর্থাৎ এখনকার ভাষায় টিকিট বিক্রয় করিয়া নাটক দেখার ব্যবস্থা হয়।

৩। নবীনচন্দ্র বসুর রঙ্গমঞ্চের অবসান এবং তাঁহার ভ্রাতুস্পুত্রের দ্বারা ‘জোড়াসাঁকো থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠার মধ্যবর্তী সুদীর্ঘ ব্যবধানকালে অনেক স্কুল কলেজের সৌখীন রঙ্গমঞ্চে নাট্যাভিনয় হইত, কিন্তু সবগুলিই ইংরেজীভাষার নাটক। এই শ্রেণীর সৌখীন থিয়েটারের মধ্যে ডেভিড হেয়ার স্কুলের রঙ্গমঞ্চ ও ‘ওরিয়েন্টাল থিয়েটার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কলিকাতা মাদ্রাসার ইংরেজ অধ্যাপক এই উভয় রঙ্গমঞ্চেই এবং এলিস নামে একজন ইংরেজ মহিলা শেষোক্ত রঙ্গমঞ্চে অভিনয়কৌশল শিক্ষা দিতেন। ১৮৫৩ সনে প্রথমটি ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ ও দ্বিতীয়টি ‘ওথেলো’র অভিনয় দিয়াই রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন করে।

৪। ১৮৫৭ সনে জ্ঞানপ্রদায়িনী সভার সদস্যগণ সাতুবাবু নামে খ্যাত আশুতোষ দেবের বাড়ীতে একটি এবং কালীপ্রসন্ন সিংহের প্রতিষ্ঠিত ‘বিদ্যোৎসাহিনী’ সভার সদস্যেরা আর-একটি রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন করেন। প্রথম রজনীতে যথাক্রমে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’ ও ‘বেণীসংহার’-এই দুইখানি সংস্কৃত নাটকের বাংলা

অনুবাদ অভিনীত হয়। ঐ বৎসরই বড়বাজারের গদাধর শেঠের বাড়ীতে কুলীন কুলসর্বস্ব নাটক অভিনীত হয়। দর্শকদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কিশোরীমোহন মিত্র প্রভৃতি কলিকাতার প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা ছিলেন। বিদ্যোৎসাহিতী’ রঙ্গমঞ্চে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি, ভারত সরকারের প্রধান সেক্রেটারী প্রভৃতি দর্শক উপস্থিত ছিলেন। ১৮৫৭ সনে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বেই এই তিনটি অভিনয় অনুষ্ঠিত হইয়াছিল।

৫। পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ এবং তাঁহার ভ্রাতা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বেলগাছিয়ায় তাঁহাদের বাগানবাড়ীতে যে নাট্যশালা স্থাপন করেন, এ-যুগে তাহাই বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। রামনারায়ণ তর্করত্নের বাংলা “রত্নাবলী” অভিনয়ের দ্বারা বেলগাছিয়া নাট্যশালার উদ্বোধন (৩১ জুলাই, ১৮৫৮) হয়। ইহা কলিকাতার অভিজাত মহলে খুব উৎসাহ ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে, কারণ ইহার সাজসজ্জা, দৃশ্যপট প্রভৃতি উচ্চ শিল্পজ্ঞানের পরিচায়ক ছিল। বিভিন্ন ভূমিকায় ইংরেজীশিক্ষিত যুবকেরা খুব সুন্দর অভিনয় করেন এবং রাজা ঈশ্বরচন্দ্র স্বয়ং একটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিদূষকের ভূমিকায় উৎকৃষ্ট অভিনয়ের জন্য কেশবচন্দ্র গাঙ্গুলী খুবই প্রশংসালাভ করেন। এমনকি, তাঁহাকে বাংলার গ্যারিক বলিয়া অভিহিত করা হয়। লেফটেনান্ট গভর্নর, রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র, মাইকেল মধূসূদন প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা রত্নাবলী’র অভিনয় দেখিতে আসিয়াছিলেন। প্রায় তেইশ বৎসর সুখ্যাতির সহিত অভিনয় করিয়া রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের অকালমৃত্যু হওয়ায় এই রঙ্গমঞ্চ বন্ধ হইয়া গেল। বাংলার নাট্যশালার ইতিহাসে ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’র দান অবিস্মরণীয়।

৬। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর-বংশের আদি বাসভবনে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের উদ্যোগে একটি রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৫৯ ও ১৮৬০ সনে ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটক অভিনীত হয়। তাঁহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা স্বনামধন্য মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর নিজ বাটিতে ‘নবরঙ্গমঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৮৬৫ সনের ডিসেম্বর মাসে বিদ্যাসুন্দর’ পালার অভিনয় দ্বারা ইহার উদ্বোধন হয়। এই অভিনয় দেখিয়া রেওয়ার মহারাজা এত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন যে অভিনেতাবর্গকে তিন হাজার টাকা এবং প্রত্যেক অভিনেতাকে একখানা করিয়া কাশ্মীরী শাল উপহার দেন। কিন্তু শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত বংশসম্ভুত অভিনেতাগণ এই ‘দান’ গ্রহণ করেন নাই। ১৮৭৩ সনের ২৫শে ফেব্রুআরি বড়লাট লর্ড নর্থব্রুক পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ীতে আগমন করিলে তাহার সম্মানার্থ ‘রুক্মিণী হরণ’ নাটক ও ‘উভয় সঙ্কট’ প্রহসনের অভিনয় হয়।

৭। উনিশ শতকের সপ্তম দশকে অর্থাৎ ১৮৬০ হইতে ১৮৭০ সনের মধ্যে আরও যে কয়েকটি রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় তাহাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-রাজা দেবীকৃষ্ণ বাহাদুরের ভবনে স্থাপিত ‘শোভাবাজার প্রাইভেট থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটি, বহুবাজারের ‘বঙ্গনাট্যালয়’ ও ‘বাগবাজার এমেচার থিয়েটার এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ী’র রঙ্গমঞ্চ।

জোড়াসাঁকোর ‘ঠাকুর বাড়ী’ সাহিত্য, শিল্প, নৃত্য, সঙ্গীত, নাট্যাভিনয় প্রভৃতি সংস্কৃতির নানা বিভাগে বাংলা দেশে যে উচ্চস্থানের অধিকারী, জগতের ইতিহাসে সেরূপ আর কোন একটি পরিবারের পরিচয় পাওয়া কঠিন। অভিনয়ের উপযোগী, অথচ লোকশিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারের সহায়ক নাটকের অভাব বোধ করিয়া এই শ্রেণীর নূতন নাটক লিখাইবার জন্য তাঁহারা উপযুক্ত পুরস্কার দানের ঘোষণা করেন। ‘বহু বিবাহ’, ‘হিন্দু মহিলাদের দুরবস্থা’, ও ‘পল্লীগ্রামস্থ জমিদারদের অত্যাচার’ প্রভৃতি বিষয় নির্দিষ্ট হয়। রামনারায়ণ তর্করত্ন ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’ নাটকে কৌলীন্যপ্রথার কলুষতা বর্ণনা করিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন এবং এই নাটক বহুস্থানে অভিনীত হয়। তিনিই ‘বহু বিবাহ’ বিষয়ে ‘নব নাটক’ লিখিয়া দুইশত টাকা পুরস্কারপ্রাপ্ত হন। ইহা ঠাকুরবাড়ীর রঙ্গমঞ্চে ১৮৬৭ সনে আট-নয় বার অভিনীত হইয়াছিল। কিন্তু অপর বিষয়ে পুরস্কৃত নাটকগুলি অভিনীত হইবার পূর্বেই এই রঙ্গমঞ্চের দ্বার রুদ্ধ হয় (১৮৬৭)।

এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, সামাজিক কুসংস্কার দূর করিবার উদ্দেশ্যে আরও অনেক নাটক রচিত ও অভিনীত হইয়াছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের সময় রচিত উমেশচন্দ্র মিত্রের ‘বিধবা বিবাহ’ নাটকটি (১৮৫৬) স্বনামধন্য কেশবচন্দ্র সেন সদলবলে মেট্রোপলিটান কলেজগৃহে বিশেষ জাঁকজমকের সহিত একাধিকবার অভিনয় করেন এবং “কলিকাতায় এই নাট্যাভিনয় প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি করিয়াছিল।”

বাংলার নাট্যশালার ইতিহাসে পূর্বোক্ত বাগবাজার এমেচার থিয়েটারও একটি কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যে-সকল অভিনেতার সাহায্যে পরবর্তী যুগে প্রসিদ্ধ পেশাদার থিয়েটারগুলির সৃষ্টি ও উন্নতি সম্ভবপর হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে অনেকে এই দলেই প্রথম অভিনয় করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ গিরিশচন্দ্র ঘাষ ও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফীর নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই দল শ্যামবাজার ‘নাট্য সমাজ’ নাম গ্রহণ করিয়া নানাস্থানে অভিনয় করেন এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রমুখ সে-যুগের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের উদ্যোগে প্রথমে চুঁচুড়ায় এবং পরে কলিকাতায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’ অভিনয়ের দ্বারা সমসাময়িক পত্রিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করেন। স্বয়ং গ্রন্থকার ইহাদের নাট্যাভিনয় দেখিয়া মুগ্ধ হন।

এই সমুদয় সৌখীন সম্প্রদায়ের অভিনয়ের সাফল্যে তকালে জনসাধারণের মনের ভাব এডুকেশন গেজেট’-এ প্রকাশিত একখানি পত্রে নিম্নলিখিত মন্তব্য হইতে বেশ বুঝিতে পারা যায় : “আমার বোধ হয় এই নাটকাভিনেতৃগণ মনোযোগ করিলে এমন একটি দেশীয় নাট্যশালা সংস্থাপন করিতে পারেন, যেখানে লোকে ইচ্ছা করিলে টিকিট ক্রয় করিয়া যাইতে পারেন এবং দেশেরও অনেকটা সামাজিকতার পরিচয় হয়।”

সমসাময়িক পত্রিকার সম্পাদকদের ও বহু পত্রলেখকের এইরূপ প্রস্তাবে উৎসাহিত হইয়া পূর্বোক্ত শ্যামবাজার নাট্য সমাজের কয়েকজন সদস্য ন্যাশনাল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭২ সনের ৭ই ডিসেম্বর চিৎপুরে একটি ভাড়াটিয়া বাড়ীতে ‘নীলদর্পণে’র অভিনয় দ্বারা ইহার উদ্বোধন হইল। প্রবেশমূল্য ধার্য হইল এক টাকা ও আট আনা। সমসাময়িক অনেক পত্রিকাই এই উদ্যমের প্রশংসা ও ইহার স্থায়িত্ব কামনা করিল। এই রঙ্গমঞ্চে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ ছাড়াও ‘জামাই বারিক’, ‘সধবার একাদশী’, নবীন তপস্বিনী’, ‘লীলাবতী’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ প্রভৃতি নাটক প্রথমে প্রতি শনিবারে ও পরে প্রতি সপ্তাহে শনি ও বুধবারে অভিনীত হইত।১০।

ন্যাশনাল থিয়েটারের অনুকরণে শ্যামবাজারে কৃষ্ণচন্দ্র দেবের বাড়ীতে ‘ওরিয়েন্টাল থিয়েটার’ নামে একট সাধারণ রঞ্চমঞ্চ স্থাপিত হয় (১৮৭৩)। ইহার কিছুকাল পরে ঐ বৎসরই ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই নিজস্ব স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ নির্মাণ করে। পূর্বোক্ত আর কোন থিয়েটারই ইহা পারে নাই। ইহার আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই, স্ত্রীলোকেরাই নারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতেন। ইহাদের মধ্যে ছিলেন জগত্তারিণী, গোলাপ (সুকুমারী), এলোকেশী ও শ্যামা। সমসাময়িক পত্রিকাগুলিতে এই অভিনব প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দাবাদ দেখা যায়। এই রঙ্গালয়ের আর-একটি বৈশিষ্ট্য, মধুসূদন দত্তের সহায়-সম্বলহীন সন্তানদের সাহায্যার্থে ইহার উদ্বোধন হয়। এই উপলক্ষে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের অভিনয় হয় (১৬ অগষ্ট, ১৮৭৩)। পরে ইহার অনুকরণে বাংলার রঙ্গালয়ে অনেক ‘সাহায্য রজনীর’ অভিনয় হইয়াছিল।

‘বেঙ্গল থিয়েটার’ বহুদিন স্থায়ী হইয়াছিল। ১৮৮৪ সনের ডিসেম্বর মাসে রাজকৃষ্ণ রায়ের প্রহ্লাদ চরিত্র অভিনয়ে দর্শকের ভীড় বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা-ইহার অনতিকাল পূৰ্ব্বে ষ্টার থিয়েটারে অভিনীত ‘চৈতন্যলীলা’র জনপ্রিয়তাই কেবলমাত্র ইহার সঙ্গে তুলনীয়।”

‘প্রহ্লাদ চরিত্র’ অভিনয় উপলক্ষে বেঙ্গল থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের ব্যবহারে অপমানিত বোধ করিয়া নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায় মেছুয়াবাজার স্ত্রীটে ‘বীণা রঙ্গালয় স্থাপন করেন (ডিসেম্বর, ১৮৮৭)। তিন বৎসর পরেই ইহা বন্ধ হয়। সম্ভবতঃ নারীর ভূমিকায় পুরুষ-অভিনেতার অভিনয়ই ইহার কারণ। বেঙ্গল থিয়েটারের সুদীর্ঘ জীবনের মধ্যে বাংলার রঙ্গমঞ্চের অনেক উন্নতি হয়।

ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর উনিশ শতকে ‘ওরিয়েন্টাল’ ও ‘বেঙ্গল’ থিয়েটার ছাড়া আরও কয়েকটি পেশাদার রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহাদের ধারাবাহিক ইতিহাস দেওয়া সম্ভবপর নহে। কারণ ইহার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, দলের মধ্যে অন্তর্বিরোধ এবং তাহার ফলে সুদক্ষ অভিনেতাদের দলাদলি ও এক রঙ্গালয় ছাড়িয়া স্বতন্ত্র রঙ্গালয় গঠন অথবা অন্য রঙ্গালয়ে যোগদান। এই যুগের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ–একাধারে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও অভিজ্ঞ নাট্যশিক্ষক ও পরিচালক গিরিশচন্দ্র ঘোষ নিজেই ৪। ৫টি বিভিন্ন রঙ্গালয়ে একাধিকবার যোগদান করিয়াছেন। সুতরাং সাধারণভাবেই এই যুগের রঙ্গালয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিব।

এক বৎসরের ধ্যেই একদল ন্যাশনাল থিয়েটার ছাড়িয়া হিন্দু ন্যাশনাল (পরে ‘গ্রেট ন্যাশনাল’) থিয়েটার’ নামে আর-একটি থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করিল। উভয় দলই কলিকাতায় অভিনয় করা ছাড়াও বাংলা দেশের মফঃস্বলের নানা স্থানে এবং ১৮৭৫ সনে পশ্চিমভারতে কাশী, লক্ষ্ণৌ, দিল্লী, মীরাট, লাহোর প্রভৃতি শহরে অভিনয় করে। ইহার পর ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের এক অংশ স্বতন্ত্রভাবে ‘ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলা দেশের বহু প্রসিদ্ধ অভিনেতা ও অভিনেত্রী-গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী, অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধামাধব কর, অমৃতলাল মিত্র এবং কাদম্বিনী, ক্ষেত্রমণি, যাদুমণি, হরিদাসী, রাজকুমারী প্রভৃতি ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনয় করেন। ন্যাশনাল থিয়েটারের পর পাঞ্জাবী গুরুমুখ রায় বিডন স্ট্রীটে ‘ষ্টার থিয়েটার’ নামে এক নূতন রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৮৩ খ্র.)। গিরিশচন্দ্র ও অমৃতলালের মত অভিনেতা এবং বিনোদিনী, গঙ্গামণির মত অভিনেত্রীরা মিলিয়া গিরিশচন্দ্রের ‘চৈতন্যলীলার’ যে অপূর্ব অভিনয় করেন (২রা অগষ্ট, ১৮৮৪) তাহাতেই ষ্টার থিয়েটার রাতারাতি প্রসিদ্ধ হইল। স্বয়ং শ্রীশ্রীরাকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই অভিনয় দেখিয়া মুগ্ধ হন। নিমাই-এর ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় অসাধারণ সাফল্য লাভ করিয়াছিল।

গুরুমুখ রায়ের মৃত্যুর পর কয়েকজন বাঙ্গালী অভিনেতা ‘ষ্টার থিয়েটার’ ক্রয় করেন (১৮৮৭ খ্র.)–কিন্তু তাঁহারা অর্থাভাবে এই রঙ্গালয় চালাইতে পারিলেন না। মতিলাল শীলের বংশধর গোপালচন্দ্র শীল ইহা কিনিয়া লইয়া এমারেল্ড থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। গিরিশচন্দ্র ঘোষ মাসিক ৩৫০ টাকা বেতন এবং এককালীন নগদ বিশ হাজার টাকা অগ্রিম বোনাস বাবদ লইয়া এই থিয়েটারে যোগ দিলেন এবং এই বোনাসের টাকা হইতে ১৬,০০০ টাকা ষ্টার থিয়েটারের নূতন জমি ক্রয় করিবার জন্য দান করিলেন। পুরাতন ষ্টার থিয়েটারের একদল অভিনেতা তখন অর্থসংগ্রহের অভিপ্রায়ে মফঃস্বলে অভিনয় প্রদর্শন করিয়া ঘুরিতেছিলেন। এই যৌথ উপায়ে উপযুক্ত অর্থ সংগ্রহ হইল এবং তাহারা হাতীবাগানে নূতন বাড়ি নির্মাণ করিয়া আবার ‘ষ্টার থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করিলেন। গিরিশচন্দ্রও ‘এমারেল্ড থিয়েটার’ ছাড়িয়া ‘ষ্টার থিয়েটারে যোগ দিলেন এবং ইহা আবার বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করিল। গোপালচন্দ্র শীল ‘এমারেল্ড থিয়েটার’ ছাড়িয়া দিলে নূতন একদল ইহার ইজারা লইলেন। ১৮৯৬ সনে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত এমারেল্ড রঙ্গমঞ্চ ভাড়া লইয়া ক্লাসিক থিয়েটার’ খোলেন। কলিকাতার সন্ত্রান্ত বংশীয় বিখ্যাত অ্যাটর্নি ও দার্শনিক পণ্ডিত হীরেন্দ্রনাথ দত্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অমরেন্দ্রনাথ পেশাদার থিয়েটার খোলায় কলিকাতায় অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। অমরেন্দ্রনাথ নিজে সুদক্ষ অভিনেতা ছিলেন। কুসুমকুমারী নামে প্রসিদ্ধ একজন অভিনেত্রীও তাঁহার সঙ্গে যোগ দেন। অমরেন্দ্রনাথের এক ভাগিনেয় খুব নৃত্যকুশল ছিলেন। ইহাদের সম্মিলিত চেষ্টায় ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘আলিবাবা’ নাটকের অভিনয় যেরূপ দীর্ঘকাল যাবৎ জনপ্রিয় ছিল, ইহার পূর্বে সেরূপ সৌভাগ্য বা প্রতিপত্তি আর কোন অভিনয়ের হয় নাই। কিছুদিনের জন্য গিরিশচন্দ্রও এই রঙ্গালয়ে যোগদান করেন। বিংশ শতকের প্রথম দশকেও ক্লাসিক থিয়েটারের বিশেষ সুখ্যাতি ও প্রতিপত্তি ছিল। অমরেন্দ্রনাথ রঙ্গমঞ্চ সম্বন্ধে ‘রঙ্গালয়’ নামে একখানি সাপ্তাহিক ও নাট্যমন্দির’ নামে একখানি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন।

এমন সময়ে বিডন স্ট্রীটে অবস্থিত ‘মিনার্ভা থিয়েটার’ও প্রসিদ্ধি লাভ করে। গিরিশচন্দ্রও একাধিকবার এই রঙ্গালয়ে যোগদান করেন, পুনরায় ইহা ছাড়িয়া ‘ক্লাসিক থিয়েটার’ ও ‘ষ্টার থিয়েটারে যোগ দেন। প্রকৃতপক্ষে উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের প্রারম্ভে কলিকাতায় মাত্র এই তিনটি পেশাদার থিয়েটারই প্রসিদ্ধ ছিল। ইহাদের মধ্যে ষ্টার থিয়েটার’ ও ‘মিনার্ভা থিয়েটার’ পুরানো নামে পুরানো রঙ্গালয়ে এখন পর্যন্ত টিকিয়া আছে। অপরটি হস্তান্তর হইয়া পরিবর্তিত নামে কিছুদিন টিকিয়া ছিল, পরে লোপ পাইয়াছে।

এই তিনটি থিয়েটারকে বঙ্গীয় নাট্যশালায় প্রথমযুগের প্রগতির সীমানির্দেশক বলা যাইতে পারে। গিরিশচন্দ্র ঘোষই ছিলেন এই যুগের অভিনয়শিল্পের নির্দেশক ও নিয়ামক। তিনি নিজে ছিলেন উৎকৃষ্ট অভিনেতা এবং অভিনয়ের প্রয়োজনবোধে বহুসংখ্যক সামাজিক ও ধর্মমূলক নাটক রচনা করিয়াছিলেন। এই যুগে বিশিষ্ট সাহিত্যিকগণ অনেক ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ভক্তিমূলক নাটক রচনা করিয়া বাংলা নাট্যজগতে নূতন রস ও প্রাণের সঞ্চার করিয়াছিলেন। গিরিশচন্দ্র, অমরেন্দ্রনাথ, অমৃতলাল (বসু ও মিত্র) প্রভৃতির নিপুণ অভিনয়ের দ্বারা তাহা দর্শকের সম্মুখে জীবন্ত হইয়া উঠিত। সমসাময়িক রাজনীতি ও সামাজিক ঘটনা লইয়া অনেক ব্যঙ্গাত্মক নাটক রচিত হয়। হাস্যরসের দুইজন প্রসিদ্ধ অভিনেতা অমৃতলাল বসু ও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী অভিনয়ের দ্বারা তাহা জনপ্রিয় করিয়া তোলেন। গিরিশচন্দ্রের রচিত নাটক, দীনবন্ধু, মধুসূদন প্রভৃতি প্রসিদ্ধ নাট্যকারদের নাটক এবং বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রভৃতির উপন্যাসগুলির নাট্যরূপায়ণ এই যুগের রঙ্গমঞ্চের প্রধান উপজীব্য ছিল। নাট্যশালার কল্যাণে বাংলাসাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার সাধারণ বাঙ্গালীর নিকট পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। বিস্মৃতপ্রায় নৃত্যশিল্পও রঙ্গালয়ের মাধ্যমেই বাংলায় পুনর্জন্ম লাভ করে। বঙ্গীয় নাট্যশালার এই দুইটি অবদানও বিশেষভাবে স্মরণীয়।

কলিকাতার অভিজাত সম্প্রদায় সঙ্গীত ও নাট্যাভিনয়ের ভক্ত এবং অনুরাগী ছিলেন। তাঁহারা একাধিক সৌখীন নাট্যসম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। কিন্তু, যখন সাধারণ রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার ফলে সৌখীন নাট্যসম্প্রদায়গুলি বিলুপ্তপ্রায় হইল, তখন অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষভাগে কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ ও ‘রঙ্গমঞ্চে’র গৃহে ‘সঙ্গীত সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হইল। শীঘ্রই ইহার প্রধান উদ্যোক্তা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং এবং আরও অনেক সদস্য পৃথকভাবে ভারত সঙ্গীত সমাজ প্রতিষ্ঠা করিলেন, এবং পূর্বোক্ত ‘সঙ্গীত সমাজ’ ‘সঙ্গীত সমিতি’ নামে পরিচিত হইল। এদেশীয় রাজা, মহারাজা, জমিদার, বিলাতফেরৎ ডাক্তার, ও ব্যারিষ্টার অনেকে সঙ্গীত সমাজের সভ্য ছিলেন। সঙ্গীতচর্চার সঙ্গে এখানে নাট্যাভিনয়েরও ব্যবস্থা ছিল। সুতরাং ইহা নৃত্য, গীত ও অভিনয় এই তিনটি সুকুমার শিল্পচর্চার কেন্দ্রস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল।

‘সঙ্গীত প্রকাশিকা’ নামে স্বরলিপি-বহুল একখানি মাসিকপত্র ‘ভারত সঙ্গীত সমাজে’র মুখপত্র ছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উচ্চশিক্ষিত অভিনেতাদের শিক্ষা দিতেন এবং রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচিত অনেক নাটক এই সমাজেই প্রথম অভিনীত হয়। ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় যথাক্রমে কেদার ও অবিনাশের ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন।

২. লোকগীতি

আলোচ্য যুগের কাব্যবৰ্ণনাপ্রসঙ্গে পূর্বেই নবম অধ্যায় বলা হইয়াছে, ভারতচন্দ্র ও ঈশ্বর গুপ্ত, এই দুই কবির অন্তর্বর্তীকালে উচ্চশ্রেণীর কোন বাংলা কাব্য রচিত হয় নাই–কবিগান, পাঁচালী, যাত্রা, কথকতা কীর্তন প্রভৃতি লোকগীতিই তখন কবিতার আশ্রয়স্থল ছিল। এগুলি এখনও একেবারে লুপ্ত হয় নাই। গ্রামে বা ছোট শহরে, অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোকই এখন ইহার প্রধান পৃষ্ঠপোষকতবে ক্রমশঃ শহর অঞ্চলেও প্রধানতঃ যাত্রা ও কীর্তন আবার প্রচলিত হইতেছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি বা শেষ পর্যন্ত এক শতাব্দীরও অধিককাল পূর্বোক্ত বিভিন্ন শ্রেণীর লোকগীতি খুবই জনপ্রিয় ছিল। সম্ভ্রান্ত ও ধনী সম্প্রদায় হইতে আরম্ভ করিয়া সকল শ্রেণীর লোকই এইগুলির বিশেষ ভক্ত ছিল। সুতরাং ইহাদের সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত আলোচনা করার প্রয়োজন আছে।

(ক) যাত্রাগান

যাত্রাগান এখনও প্রচলিত, সুতরাং ইহার সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা সকলেরই আছে। ইহা নাট্যাভিনয়ের অনুরূপ–তবে ইহার জন্য পৃথক রঙ্গমঞ্চ বা দৃশ্য পরিবর্তনের ব্যবস্থা নাই। খোলা জায়গায়, চতুর্দিকে বিস্তৃত শ্রোতার দলের মধ্যবর্তী অপ্রশস্ত একটু চতুষ্কোণ আসরে, যাত্রাদলের গায়ক ও বাদ্যকরেরা বসিত। প্রয়োজনমত যথোচিত বেশভূষায় সজ্জিত অভিনেতারা বাহিরের নিকটবর্তী সাজঘর হইতে দর্শকদলের মধ্যবর্তী সরু পথ দিয়া আসরে প্রবেশ করিত। জাঁকজমকপূর্ণ পোষাকের জন্য যাত্রাদলের রাজা, ও বস্ত্রাবৃত কাষ্ঠখণ্ডে নির্মিত বিশাল ভীমের গদা প্রভৃতি যাত্রাদলের বৈশিষ্ট্যের চিহ্নগুলি লোকের মুখে-মুখে ফিরিত। আর-একটি বিশেষত্ব ছিল, অভিনেতা গভীর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে করুণ সুরে বা তেজঃব্যঞ্জক ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করিতে করিতে অকস্মাৎ থামিয়া গেল, অমনি চতুর্দিক হইতে গায়কের দল সেই ভাবব্যঞ্জক কোন গান গাহিতে আরম্ভ করিল। পনের-কুড়ি মিনিট ধরিয়া এই ‘জুরী গান’ চলিত। ততক্ষণ অভিনেতার কোন কাজ নাই, নিশ্চিন্ত মনে দাঁড়াইয়া থাকিত অথবা বসিয়া তামাক খাইত। যাত্রার দলে তখন পুরুষই স্ত্রীলোকের ভূমিকা গ্রহণ করিত। সুতরাং, কেবল কৃষ্ণ নহে, রাধিকাও অনেক সময় তামাক খাইতেছেন-ওদিকে লোকে মুগ্ধ হইয়া জুরী গান শুনিতেছে–এরূপ দৃশ্য যাত্রার একটি স্বাভাবিক অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইত। যাত্রাগান সাধারণত দিনে হইত, তবে পূজাপার্বণোপলক্ষে সন্ধ্যার পর আরম্ভ হইয়া প্রায় সারা রাত্রি চলিত। প্রধানতঃ রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের কাহিনী অবলম্বনেই যাত্রাগানের ‘পালা’ রচিত হইত। যাত্রার অধ্যক্ষ অর্থাৎ ‘অধিকারী হস্ত লিখিত (পরবর্তীকালে মুদ্রিত) পুঁথি হইতে প্রত্যেক অভিনেতাকে তাঁহার বক্তব্য অংশ মুখস্থ করাইতেন এবং অভিনয়ের উপযোগী অঙ্গচালনা ও আবৃত্তি বিষয়ে তালিম দিতেন। সকলের সমক্ষে অভিনয় করিতে হইত, থিয়েটারের ন্যায় দৃশ্যপটের অন্তরাল হইতে অভিনেতাকে বক্তব্য জোগাইবার, অর্থাৎ প্রম্পট (prompt) করার সুযোগ ছিল না বলিয়াই প্রতিটি অভিনেতাকে তাহার বক্তব্য অংশ ভালভাবে মুখস্থ করিতে হইত। এইসব যাত্রার পালা’ প্রচুর পরিমাণে রচিত হইত এবং অভিনয়ের উৎকর্ষ দ্বারাই এগুলি জনপ্রিয়তা অর্জন করিত। সুতরাং খ্যাতিটা বেশীরভাগই যাত্রার অধিকারী পাইতেন, পালা-রচয়িতার নাম খুব কম লোকেই জানিত। যাত্রার গানগুলি অভিনয়ের পরেও বহুকাল লোকের মুখে-মুখে শোনা যাইত। কিন্তু যাত্রাগানের ও পালার রচয়িতার কেহ সন্ধান রাখিত না। এইজন্যই তাঁহাদের নাম বিস্মৃতির সাগরে ডুবিয়া গিয়াছে।

(খ) পাঁচালি

পাঁচালি গান বর্তমান যুগে বিলুপ্তপ্রায় হইলেও ইহা যাত্রার ন্যায়, অনেক স্থলে তাহা অপেক্ষাও, বেশী জনপ্রিয় ছিল। দূরদূরান্তর হইতে উচ্চ নীচ সকল শ্রেণীর লোকই পাঁচালি শুনিতে আসিত। ইহার বিষয়বস্তু ছিল হিন্দুশাস্ত্রের ও ধর্মের, বিশেষতঃ শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবদেবীর কাহিনী বা আখ্যান। ইহা ছন্দোবদ্ধ কবিতায় রচিত হইত এবং সভায় সুর তান লয় সহযোগে গীত হইত। এইজন্য ইহার বিশেষত্ব ছিল, কবিতার উৎকর্ষ ও সঙ্গীতনৈপুণ্য। সুতরাং, যাত্রার পালালেখকদের তুলনায় পাঁচালিকারদের অনেকের নামই এককালে সুপরিচিত ছিল এবং পাঁচালির পুঁথিও খুবই প্রচলিত ছিল। গ্রামের ছোট আসর হইতে শহরে বড় বড় বৈঠকে পাঁচালি গানের অনুষ্ঠান সহজেই সম্ভব হয়, কারণ ইহাতে যাত্রার ন্যায় সাজপোষাক ও অন্যান্য সরঞ্জামের প্রয়োজন হইত না, একজন সুদক্ষ গায়ক অথবা আবৃত্তিকারক এবং পাঁচালির পুঁথি সংগ্রহ হইলেই পাঁচালির আসর বসান যাইত।

সে-যুগের পাঁচালি-রচয়িতাদের মধ্যে দাশরথি রায় বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার সাহিত্যিক প্রতিভা সম্বন্ধে পূর্বেই কিছু মন্তব্য করা হইয়াছে। দশরথির পৈতৃক বাড়ী ছিল বর্ধমান জিলার অন্তর্গত বাদামুড়া গ্রামে, কিন্তু তিনি বাল্যকালে মামাবাড়ীতে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। তিনি নীলকুঠির কেরানী ছিলেন এবং আকাবাই নামে একটি রমণীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে বিবাহ করেন। আকাবাই একটি ওস্তাদী কবিয়াল দল গঠন করেন এবং দাশরথি চাকুরী ছাড়িয়া এই দলের বাঁধনদার (অর্থাৎ কবিতায় পদরচয়িতা) নিযুক্ত হন। অতঃপর দাশরথি পাঁচালিগান রচনা আরম্ভ করিলেন। দাশু রায়ের পাঁচালি’ সারা বাংলা দেশে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করিল। তাঁহার অনেক পাঁচালিগান গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইয়াছে।

দাশরথি যে অসাধারণ কবিত্বশক্তির অধিকারী ছিলেন তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। বর্তমান রুচি অনুসারে দাশরথির অনেক উক্তি অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট। নলিনী ভ্রমরোক্তি’ গ্রন্থে ফুল ও ভ্রমরের ব্যঞ্জনায় কবি ও আকাবাইয়ের প্রেমকলহটি বর্ণিত হইয়াছে, অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট বলিয়া ইহা এখন আর ভদ্রসমাজে প্রচলিত নাই। কিন্তু দোষ কেবল দাশরথির নহে, সে-যুগের তর্জা কবিগান পাঁচালি প্রভৃতি লোকসাহিত্যে এই অশ্লীলতা অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। তখনকার দিনে সমাজে যাহা বিশেষভাবে আদরণীয় ছিল, তাহার শ্লীলতা ও অশ্লীলতার ধারণা বর্তমান যুগের মাপকাঠিতে নির্ধারণ করা সঙ্গত নহে। ঊনবিংশ শতকের সর্বপ্রকার লোকসাহিত্যের আলোচনায় এই কথাটি বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে হইবে। একবার কবির লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বাঁধনদার ছড়া বাঁধিয়া দাশরথিকে অতি অশ্রাব্য গালাগালি করে। তাহাতে মাতার নির্বন্ধানুযায়ী দাশরথি প্রতিজ্ঞা করিলেন যে আর কখনও কবিগান রচনা করিবেন না।

দাশরথির শ্যামাসঙ্গীত ও অন্যান্য কয়েকটি গান এই দোষ হইতে মুক্ত। এগুলি উচ্চাঙ্গের ভক্তিভাবপূর্ণ সঙ্গীত হিসাবে খুবই মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। তবে তাঁহার অন্যান্য রচনায় যথেষ্ট কলানৈপুণ্যের নিদর্শন থাকিলেও, ইহা নিছক সাহিত্যহিসাবে খুব উচ্চশ্রেণীর বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য নহে। পূর্বে নবম অধ্যায় এই শ্রেণীর একটি কবিতা উদ্ধৃত হইয়াছে। তাহার গানের সরল ও মধুর সুর এবং যমক ও অনুপ্রাসপূর্ণ ভাষা শ্রোতাদের মন মুগ্ধ করিত। পূর্বেই বলিয়াছি, কেহ কেহ তাঁহার রচনায় কালিদাস, নৈষধ ও ভারবির বিশিষ্ট গুণের একত্র সমাবেশ দেখিতে পাইতেন। আবার কেহ কেহ তাহার কবিতা অগভীর শব্দসর্বস্ব বলিয়া নিন্দা করিয়াছেন। দাশরথি যে-সকল পাঁচালির পালা রচনা করিয়াছিলেন, তাহার সংগ্রহগুলি দশ খণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে। দাশরথির পাঁচালি অপ্রচলিত হইলেও তাঁহার কয়েকটি ভক্তিমূলক গান এখনও প্রসিদ্ধ। দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘হৃদিবৃন্দাবনে বাস যদি কর কমলাপতি’, ‘দোষ কারো নয় গো শ্যামা প্রভৃতি উল্লেখ করা যাইতে পারে। তাঁহার রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী’ ও ‘শ্রীরামচন্দ্রের দেশাগমন’ প্রভৃতি পাঁচালির গান এখনও গীত হইয়া থাকে।

দাশরথির পাঁচালিপ্রসঙ্গে আর-একটি কথার উল্লেখ করা প্রয়োজন, যদিও আঠারো-উনিশ শতকের লোকগীতির সকল শ্রেণীর সম্বন্ধেই ইহা অল্প-বিস্তর প্রযোজ্য। এই লোকগীতির মধ্যদিয়াই আমরা সর্বপ্রথম মধ্যযুগ হইতে আধুনিক যুগের বাংলাসাহিত্যের বিবর্তনের অস্কুট পরিচয় পাই। মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্যের একমাত্র উপজীব্য ছিল ধর্মমূলক পৌরাণিক কাহিনী। কবিরা যে-সমাজে বাস করিতেন তাহার কোন আভাস তাঁহাদের রচনায় প্রতিফলিত হয় নাই। দাশরথি বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ সমর্থনের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করিয়া ‘বিধবার বিবাহ’ নামক একখানি পাঁচালির পালা রচনা করিয়াছিলেন। ভাষার গুণে উহা এবং অন্যান্য অনেক ব্যঙ্গোক্তি সে-যুগে খুব উপভোগ্য হইয়াছিল।

দাশরথি ব্যতীত আরও অনেকে পাঁচালির পালা রচনা করিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে ব্রজমোহন রায়, ঠাকুরদাস দত্ত, মনোমোহন বসু, রসিকচন্দ্র গোস্বামী, রসিকচন্দ্র রায়, নন্দলাল রায় এবং কৃষ্ণকমল গোস্বামীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(গ) কবিগান

যিনি কবিতা রচনা করেন তিনিই কবি নামের অধিকারী। কিন্তু আলোচ্য যুগে ‘কবিওয়ালা’ নামে এক বিশিষ্ট কবিশ্রেণীর উদ্ভব হইয়াছিল। তাঁহাদের রচিত কবিতা বা গান-কবি গান’ এই সংজ্ঞা দ্বারা চিহ্নিত হইত। যাত্রাগানের ন্যায় একটি খোলা জায়গায় কবিওয়ালারা (অন্ততঃ দুইজন) তাঁহাদের দলবল লইয়া উপস্থিত থাকিতেন। যাত্রাগানের ন্যায় কোন বিষয়বস্তু পূর্ব হইতে নির্দিষ্ট থাকিত না। আসরে বসিয়াই জমিদার বা যাঁহার বাড়ীতে গান হইত, তিনি অথবা অন্য কেহ এমন কোন একটি বিষয় প্রস্তাব করিতেন–যাহার স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বলিবার সুযোগ আছে-তখন দুই কবিওয়ালা বিভিন্ন পক্ষ অবলম্বন করিতেন। প্রথমে একজন যাহা বলিতেন তিনি শেষ করিয়া বসিবার পরই আর-একজন উঠিয়া তাহার প্রতিবাদ ও যুক্তি খণ্ডন করিয়া নিজের পক্ষের সমর্থনমূলক গান করিতেন। এমনও হইত যে এক কবি একটি সমস্যা উপস্থিত করিয়া অপরকে তাহার সমাধান করিবার জন্য দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করিতেন। উত্তর-প্রত্যুত্তর সকলই গানের মধ্যদিয়া হইত। মূল গায়েন বা কবি এক এক পদ গাহিতেন, অমনি তাহার দোহার বা সঙ্গীগণ একাধিকবার তাহার পুনরাবৃত্তি করিতেন। সুতরাং শ্রোতাদের পক্ষে এইসব উত্তর-প্রত্যুত্তর বুঝিবার পক্ষে কোন অসুবিধা হইত না। তাই কবিওয়ালার কেবল কবিত্বশক্তি নহে, প্রত্যুপন্নমতিত্বেরও বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এইসব উত্তর ও প্রত্যুত্তরকে বলা হইত ‘চাপান’ ও ‘উতোর। প্রথম কবি ‘চাপান’ দিতেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কবি ‘উতোর’ গাহিতেন। প্রথমেই কবিওয়ালা নিমন্ত্রণকারী বাবুকে ধন্যবাদ দিতেন, অনেক স্থলে প্রতিপক্ষ ইহারও ‘উতোর’ দিতেন। একটি বিখ্যাত দৃষ্টান্ত দিতেছি।

যজ্ঞেশ্বর নামে এক কবি জমিদারবাবুদের তোষামোদে তুষ্ট করিবার জন্য প্রথমেই জাড়া নামক তাঁহাদের গ্রামের উচ্চপ্রশংসা করিয়া ইহাকে বৃন্দাবনের তুল্য বলিয়া বর্ণনা করিলেন। প্রত্যুত্তরে অপর কবি আরম্ভ করিলেন : কেমন করে বললি জগা জাড়া গোলক বৃন্দাবন’- এইটিই হইল ‘ধুয়া’, অর্থাৎ কবিতায় বিপক্ষের এক-একটি যুক্তি খণ্ডনের পরই দোহারেরা এই লাইনগুলি গাহিত। প্রথমেই কবির উক্তির বিরুদ্ধে এই যুক্তি দেখান হইল, যদি ইহা বৃন্দাবন হয় তবে বৃন্দাবনের প্রসিদ্ধ স্থানগুলি কোথায়? তিনি গাহিলেন, “কোথায় রে তোর শ্যামকুণ্ড কোথায় রে তোর রাধাকুণ্ড–কেবল আছে মুলার ক্ষেত করগে তাহা দরশন।” উপসংহারে গাহিলেন, কবি গাবি পয়সা নিবি, খোসামুদি কি কারণ। ইহার প্রতিটি লাইন পুনঃপুনঃ উচ্ছ্বাসভরে দোহারেরা গাহিত, দর্শক ও শ্রোতারা বিপুল আনন্দ উপভোগ করিতেন। কিন্তু অনেক সময় এই উত্তর-প্রত্যুত্তরের মধ্যদিয়া এক কবি আর-এক কবিকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করিতেন, এমনকি অশ্রাব্য গালাগালি করিতেন। কবিওয়ালা দাশরথি প্রসঙ্গে তাহা বলিয়াছি।

কবিগানের চারিটি শ্রেণীবিভাগ ছিল : (১) মালসা’; (২) সখী সংবাদ’; (৩) ‘বিরহ’; (৪) “খেউড়’। মালসা’ দেবদেবী-বিষয়ক গান বুঝাইত, ‘সখী সংবাদ’ ও ‘বিরহ’-রাধাকৃষ্ণের প্রণয়মূলক, এবং ব্যক্তিগত নিন্দা ও অশ্লীল গালাগালিই ‘খেউড়ের উপজীব্য ছিল। কিন্তু ইহার প্রথম তিনটির মধ্যদিয়া পরবর্তীকালের ‘রোমান্টিক সাহিত্যে’রও আভাস পাওয়া যায়, অর্থাৎ কেবল ধর্মশাস্ত্র বা পৌরাণিক কাহিনী নহে, মানুষের সাধারণ মনোবৃত্তির বিচার ও বিশ্লেষণ দ্বারা ইহা প্রভাবান্বিত হইত। বহুকাল পূর্বে একটি কবির লড়াই শুনিয়াছিলাম। বিষয় ছিল-লক্ষ্মী বড়, না সরস্বতী বড়। লক্ষ্মীর সমর্থনে এক কবি বর্তমান যুগে ধনসম্পদ সমাজে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করিয়াছে তাহা, এবং আর এক কবি বিদ্যা বা জ্ঞানের দ্বারা জগতের এবং মনুষ্যজাতির কী অদ্ভুত উন্নতি হইয়াছে–তাহার বর্ণনা করিলেন।

‘সখী সংবাদ’ ও ‘বিরহের’ মধ্যদিয়া কেবল যে বৈষ্ণবগ্রন্থের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী- মিলন, বিচ্ছেদ, উৎকণ্ঠা, প্রতীক্ষা প্রভৃতি বর্ণিত হইত তাহা নহে, সাধারণ নরনারীর চিরন্তন প্রেম ইহার মধ্যদিয়া রূপায়িত হইয়া শ্রোতাগণকে মুগ্ধ করিত। খেউড়ের মধ্যদিয়া সোজামুজি ব্যক্তি ও সমাজের আলোচনা, প্রধানতঃ নিন্দা হইত।

কবিদের মধ্যে সময়ের ক্রমানুসারে প্রথমেই গোজলা গুইর নাম উল্লেখ করিতে হয়। ইহার তিনজন কবিওয়ালা শিষ্য ছিলেন- রঘুনাথ দাস, লালু নন্দলাল ও রামজী দাস। তাহাদের শিষ্য-প্রশিষ্যেরাই এদেশে কবিগানকে জনপ্রিয়তা ও মর্যাদার উচ্চশিখরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- নীলু, নৃসিংহ, রামপ্রসাদ ঠাকুর, হরেকৃষ্ণ দীর্ঘাঙ্গী (হরু ঠাকুর), ভোলা ময়রা, নিতাই বৈরাগী, রামানন্দ নন্দী, ভবানী বণিক এবং রাম বসু। অন্যান্য কবিদের মধ্যে কেষ্ট মুন্সী, ঠাকুরদাস সিংহ, ঠাকুরদাস চক্রবর্তী, গদাধর মুখোপাধ্যায়, রূপচাঁদ পক্ষী, রামনিধি গুপ্ত এবং অ্যান্টনি ফিরিঙ্গীও কবিওয়ালা হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন।

কাহারও কারও মতে কেবল কবিত্বশক্তির দিক দিয়া বিচার করিলে উপরোক্ত কবিদের মধ্যে রাম বসুকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হয়। কারণ, তিনি ‘সখী সংবাদ’ ও ‘বিরহ’ পর্যায়ের গানগুলির মধ্যদিয়া নরনারীর প্রেমের তীব্র আকুতি ও গভীরতা আন্তরিকতার সহিত রূপায়িত করিয়াছেন। একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি :

“ওগো চিনেছি চিনেছি দেখে ঐ বটে সে কালিয়ে
চরণে চাঁদ ছাঁদ আছে দীপ্ত হয়ে
সে চরণ ভজে ব্রজেতে আমায় ডাকে কলঙ্কিনী বোলিয়ে।
ভুবনমোহন না দেখি এমন ঐ বই
রূপ কি অপরূপ আ মরি সই
কুলে শীলে কালি দিয়েছি আমি কালরূপ নয়নে হেরিয়ে।”

কবিওয়ালা রামনিধি গুপ্তের নামও এককালে লোকের মুখে-মুখে ফিরিত ‘নিধুবাবুর টপ্পা’ আজও তাঁহার স্মৃতি বহন করিতেছে। তিনি ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কেরানী ছিলেন এবং ৯৭ বৎসর (১৭৪১-১৮৩৮) জীবিত ছিলেন।

হরু ঠাকুরও এককালে খুব বিখ্যাত কবিওয়ালা ছিলেন। তাঁহার সম্বন্ধে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে, তাহা নানা কারণে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তাঁতীজাতীয় পূর্বোক্ত রঘুনাথ দাসের নিকট কবিগান রচনা শিক্ষা করিতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নাই, কিন্তু কবিওয়ালার মর্যাদা সম্বন্ধে তাঁহার খুব উচ্চধারণা ছিল। কথিত আছে, একবার শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণের বাড়ীতে একদল কবিওয়ালা গান করেন। হরু ঠাকুরের গানে রাজা খুশী হইয়া তাহাকে একখানা শাল উপহার দিতেই হরু উহা তাঁহার ঢুলীর মাথায় জড়াইয়া দিলেন। রাজা অপমানিত বোধ করিয়া কৈফিয়ৎ চাহিলে, তিনি বলেন যে, তিনি সখের কবি, পেশাদার নন-গান গাহিয়া উপহার নেওয়া তাঁহার আত্মসম্মানে বাধে। রাজা ইহাতে সন্তুষ্ট হইয়া হরুকে নানাভাবে বিশেষ অনুগ্রহ করিতে লাগিলেন। ইহাতে তাঁহার সভাস্থ পণ্ডিতেরা খুব ক্ষুব্ধ হইলেন। তাঁহাদিগকে কিঞ্চিৎ শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে রাজা পণ্ডিতদিগকে একটি সমস্যা পূরণ করিতে বলিলেন। পণ্ডিতেরা কয়েকদিনের সময় চাহিলেন। রাজা তৎক্ষণাৎ হরুকে ডাকাইয়া আনিয়া সমস্যাটি দিলেন, হরুও তৎক্ষণাৎ একটি গানের মাধ্যমে তাহা পূরণ করিলেন। চারিদিকে ধন্য-ধন্য পড়িয়া গেল, পণ্ডিতেরাও তাঁহাকে যথোচিত সম্মান দিলেন।

কবিওয়ালাদের মধ্যেও রেষারেষির ভাব যথেষ্ট ছিল। হরু ঠাকুরেরই শিষ্য রাম বসু প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া একটি বিদ্রোহীদল গঠন করেন এবং পদে পদে হরু ঠাকুরকে হেয় প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করেন। হরু ঠাকুরের বিরুদ্ধে রাম বসু, নীলু ঠাকুর প্রভৃতি বিদ্রোহী শিষ্যদের প্রধান অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি তাঁহার অপর এক শিষ্য ভোলানাথকে বেশী ভালবাসিতেন এবং কবিগানের সমস্ত গূঢ়তত্ত্ব তাঁহাকেই শিখাইয়াছিলেন। এই বিশ্বাসের মূলে যাহাই থাকুক, ভোলানাথ যে সে যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি বলিয়া গণ্য হইতেন তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ভোলানাথ জাতিতে ছিলেন মোদক এবং প্রাচীন কবিওয়ালাদের মধ্যে ভোলা ময়রার খ্যাতি আজও একেবারে লুপ্ত হয় নাই। তিনি ও তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী পর্তুগীজ জাতীয় অ্যান্টনির নাম ও গান কেবল অশিক্ষিত গ্রাম্যজনের নহে, শিক্ষিত সমাজেও প্রচলিত ছিল। ইঁহাদের রচিত কয়েকটি সুপরিচিত গান সেই যুগের ধর্ম ও সমাজের উপর নূতন আলোকপাত করে। অ্যান্টনি পর্তুগীজ হইলেও এক ব্রাহ্মণজাতীয়া বিধবাকে বিবাহ করেন এবং হিন্দুর পূজা-পার্বণ, দোল দুর্গোৎসব প্রভৃতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করিতেন। তাঁহার ভ্রাতা একজন ধনী ব্যবসায়ী হইলেও অ্যান্টনি কবিগানের প্রতি আসক্ত ছিলেন। প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে তিনি কবিগানে অংশগ্রহণ করিতেন, পরে নিজেই আলাদা দল গড়েন। সাহেব কবিওয়ালা বাঙ্গালী পোশাকে কবিগান গাহিতেছেন–ইহা সে-যুগে এক অভিনব দৃশ্য ছিল। বলা বাহুল্য, গানের আসরে বিপুল জনসমাগম হইত।

একবার খ্যাতনামা কবিওয়ালা ঠাকুর সিংহ আসরে ‘চাপান’ দিলেন :

‘বলহে অ্যান্টনি আমি একটি কথা জানতে চাই।
এসে এ দেশে এ বেশে তোমার গায়ে কেন কোর্তা নাই ॥’

অ্যান্টনি ‘উতোর’ দিলেন :

‘এই বাংলায় বাঙ্গালীর বেশে আনন্দে আছি
হয়ে ঠাকরে সিংহের বাপের জামাই কোর্তা টুপি ছেড়েছি ॥’

অর্থাৎ, প্রতিপক্ষকে ‘শ্যালক’ প্রতিপন্ন করিলেন এবং দর্শকেরাও খুব উপভোগ করিল।

কিন্তু এইসব গ্রাম্য রসিকতার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতর ভাবের কবিতার দৃষ্টান্তও আছে।

একবার রাম বসু অ্যান্টনিকে ‘চাপান’ দিলেন :

‘সাহেব! মিথ্যে তুই কৃষ্ণপদে মাথা মুড়ালি,
ও তোর পাদরী সাহেব শুনতে পেলে গালে দেবে চূণ কালি।

অ্যান্টনি “উতোর’ গাহিলেন :

‘খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই।
শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও কোথা শুনি নাই ॥
আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে
ঐ দেশ শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে
আমার মানব জনম সফল হবে যদি ঐ রাঙ্গা চরণ পাই।’

আর একবার অ্যান্টনি গাহিলেন :

‘আমি সাধন ভজন জানিনা মা জাতিতে ফিরিঙ্গী।
দয়া করে তরাও মোরে হে শিবে মাতঙ্গী ॥’

জবাব হইল (খুব সম্ভব ভোলা ময়রাই গাহিলেন) :

‘আমি পারব নারে তরাতে আমি পারব নারে তরাতে
যীশু খ্রীষ্ট ভজগে তুই শ্রীরামপুরের গির্জাতে।’

জাতি ও ধর্ম তুলিয়া কটাক্ষ করিতে কবিওয়ালারা অভ্যস্ত ছিলেন। ভোলা ময়রাকে একজন কবি ব্যঙ্গ করিয়া নামসাদৃশ্যে ভোলানাথকে শিবের সঙ্গে তুলনা করিলে ভোলা ময়রা জবাব দিলেন :

‘আমি সে ভোলানাথ নই, আমি সে ভোলানাথ নই।
আমি ময়রা ভোলা, হরুর চেলা, শ্যামবাজারে রই।
চিন্তামণির চরণ চিন্তি
ভাজনা খোলায় ভাজি খই।
আমি যদি সে ভোলানাথ হই।’

ইহার শেষ লাইটির মধ্যে একটু অশ্লীলতার আভাস আছে বলিয়া উদ্ধৃত করিলাম না, ইহার মর্মার্থ–

‘তোরা সবাই শিবের মত আমায় পুজলি কই?’

কবিওয়ালাদের যে প্রধান গুণ বা বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব যে-কোন প্রশ্নের তৎক্ষণাৎ জবাব দেওয়া, ভোলা ময়রার তাহা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।

একবার এক ধনীব্যক্তির বাড়ীর আসরে কর্তা ভোলা ময়রাকে আদেশ দিলেন, বাংলা দেশের উৎকৃষ্ট দ্রব্যগুলি কী এবং কোথায় পাওয়া যায় তাহার বর্ণনা কর। এরূপ উদ্ভট প্রশ্নের জন্য কেহ প্রস্তুত থাকে না, ইহার উত্তর দেওয়াও খুবই কঠিন। কিন্তু ভোলা ময়রা দমিলেন না, তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন :

‘ময়মনসিংহের মুগডাল, খুলনার ভাল খই।
ঢাকার ভাল পাতক্ষীর, বাঁকুড়ার ভাল দই ॥
কৃষ্ণনগরের ক্ষীরপুরী (সরপুরিয়া) ভাল, মালদহের ভাল আম।
উলোর ভাল বাঁদর-বাবু, মুর্শিদাবাদের জাম ॥
রংপুরের শ্বশুর ভাল, রাজসাহীর জামাই।
নোয়াখালির নৌকা ভাল, চট্টগ্রামের ধাই ॥
শান্তিপুরের শালী ভাল, গুপ্তিপাড়ার মেয়ে।
মাণিককুণ্ডের মুলো ভাল, চন্দ্রকোণার ঘিয়ে ॥
দিনাজপুরের কায়েৎ ভাল, হাবড়ার ভাল শুঁড়ি।
পাবনা জেলার বৈষ্ণব ভাল, ফরিদপুরের মুড়ি ॥
বর্ধমানের চাষী ভাল, চব্বিশ পরগণার গোপ।
পদ্মানদীর ইলিশ ভাল, কিন্তু বংশ লোপ ॥
হুগলীর ভাল কোটাল লেঠেল, বীরভূমের ভাল ঘোল।
ঢাকের বাদ্যি থামলেই ভাল-হরি হরি বোল ॥’

ভোলা ময়রার অনেক গানেই সমসাময়িক সমাজের নানা চিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছে। ভোলানাথ ও অ্যান্টনি, দুইজনের মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু কবির আসরে কেহ কাহাকেও খাতির করিতেন না। একটি আসরে ভোসলা অ্যান্টনিকে লক্ষ্য করিয়া গাহিলেন :

‘পেদরু ফিরিঙ্গি বেটা পেরু কাটা।
ব্যাটা কি সাহেব ফলিয়েছে।
ব্যাটা ছিল ভালো সাহেব ছিলো, হলো বাঙ্গালী।
এখন কবির দলে এসে মিলে ব্যাটা পেটের কাঙ্গালী ॥’ ইত্যাদি।

ভোলানাথ ছিলেন ময়রা। এক আসরে অ্যান্টনি ছোটজাতের উল্লেখ করিয়া তাঁহাকে বিদ্রূপ করায় ভোলানাথ নিম্নলিখিত যে উত্তর দেন, সে-যুগের সামাজিক চিত্রহিসাবে তাহা বিশেষ মূল্যবান।

বামুন বলে আমি বড়’ কায়েৎ বলে ‘দাস’।
বদ্যি বলে ‘দ্বিজ আমি’ ঢাকা জেলায় বাস ॥
যুগী বলে ‘যোগী আমি’, চাষা বলে ‘বৈশ্য’।
শূদ্রও ‘শূদ্রত্ব’ ছাড়ে যথা কালীঘাটের নস্য ॥
বলে উগ্র ‘নহি শূদ্র ধরি তলোয়ার।
হলে রাত্রি উগ্ৰক্ষত্ৰী ভয়ে পাগল পার’।
চাষা ধোপা ‘সচ্চাষী’ বলে কৈবর্ত ‘মাহিষ্য’।
সবাই বড় হতে চায় কেউ কারো নয় বশ্য ॥

অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী বাচ্ছা, না আছে তার কাছা কচ্ছা, ব্যাটা বড় নচ্ছারের শেষ।
(তোর) বাপ মায়ের খবর নিলে কিছু না মেলে ধরাতলে ব্যাটার
যেমন ধর্ম কর্ম তেমন তার বেশ ॥
আমি ময়রা ভোলা ভিজাই খোলা ময়রাই বারমাস।
জাতি পাতি নাহি মানি, ওগো মোর কৃষ্ণপদে আশ ॥

এই ‘ছত্রিশ জাতি’ অধ্যুষিত বাংলা দেশে সুপরিচিত জাতিবিদ্বেষের একটি নিখুঁত বাস্তব চিত্রের উপসংহারে ভোলার এই সর্বশেষ উক্তি সে-যুগের পক্ষে অনন্যসাধারণ সরল উদার মনের পরিচায়ক এবং অনাগত ভবিষ্যতের অস্ফুট আদর্শের পূর্বাভাষ বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।

ভোলানাথের জন্মতারিখ ও জন্মস্থান সম্বন্ধে অনেকে গবেষণা করিয়াছেন, কিন্তু এ-সম্বন্ধে কোন স্থির সিদ্ধান্ত করা খুবই কঠিন। মনে হয় কলিকাতার বাগবাজারেই ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার জন্ম হয়। সেখানেই তাঁহার নিজের হাতে তৈরী লুচি সন্দেশ খই মুড়কি প্রভৃতির দোকান ছিল। বাল্যকালে তিনি কিছুদিন পাঠশালায় পড়াশুনা করিয়াছিলেন, ক্রমে বহু অর্থ উপার্জন করিয়া গ্রে স্ট্রীটে একটি বাড়ী নির্মাণ করেন। কেহ কেহ বলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁহার বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। সম্ভবতঃ ৭৬ বৎসর বয়সে তাঁহার মৃত্যু হয় (১৮৫১)।

যাত্রা ও পাঁচালির ন্যায় কবিগানও বাংলা দেশের একটি নিজস্ব সম্পদ এবং আলোচ্য যুগে বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে ইহার একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। এই শ্রেণীর লোকগীতি কত প্রাচীন তাহা নির্ণয় করা কঠিন। কাহারও কাহারও মতে অন্ততঃ তিনশত বৎসর পূর্বেও কবিগান প্রচলিত ছিল। সুখের বিষয়, এ-সম্বন্ধে অনেকে আলোচনা ও গবেষণা করিয়াছেন, উৎসুক পাঠক পাদটীকায় উল্লিখিত গ্রন্থপঞ্জী হইতে অনেক তথ্য জানিতে পারিবেন।১১

বাংলা দেশের আর-একটি নিজস্ব লোকগীতি–‘আখড়াই গান’–কবিগানেরই একপ্রকার অপেক্ষাকৃত আধুনিক সংস্করণ। বোধ হয় অষ্টাদশ শতকে ইহার প্রচলন হয়। প্রথমে নদীয়া, শান্তিপুর ও পরে কলিকাতায় এবং ইহার নিকটবর্তী অঞ্চলে ইহা জনপ্রিয় হইয়া ওঠে। প্রথমে কবিগানের ন্যায় ইহাতেও অশ্লীলতা দোষ যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। রামনিধি গুপ্ত, অর্থাৎ বিখ্যাত টপ্পাগায়ক নিধুবাবু, ইহাকে অনেকটা সুসংস্কৃত করেন এবং উচ্চশ্রেণীর সঙ্গীতে পরিণত করেন। কিন্তু জনপ্রিয় না হওয়ায় ইহার কিছু পরিবর্তন করিয়া অনেকটা লঘু সুরের হাফ-আখড়াই প্রবর্তিত হয়। কবিগানের ন্যায় দুইদলের লড়াই ইহাকে জনপ্রিয় করিয়াছিল।১২

৩. সঙ্গীত

বাংলা দেশে যে প্রাচীন অর্থাৎ হিন্দুযুগেও সঙ্গীতের বিশেষ চর্চা হইত তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। চর্যাপদগুলি যে গীত হইত তাহা এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে[১৩] উল্লেখ করা হইয়াছে। ‘রাজতরঙ্গিনী’র একটি শ্লোকে (৪। ৪২৩) বাংলা দেশের এক মন্দিরে সঙ্গীতের উল্লেখ আছে (৮ম শতক) এবং চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বর তাঁহার ‘মানসোল্লাস’ গ্রন্থে (১১২৭-৩৮ খ্রী.) কৃষ্ণের লীলাবিষয়ক কয়েকটি বাংলা গীতের অংশ উদ্ধৃত করিয়াছেন।

চর্যাপদের গানগুলি কোন রাগরাগিণীতে গীত হইত, প্রত্যেকটি পদের পূর্বে তাহার উল্লেখ আছে। ইহার মধ্যে ‘ভৈরবী’, ‘পটমঞ্জরী’, ‘মল্লারী’, ‘কামোদ’, ‘মালশী’ প্রভৃতি রাগের সঙ্গে কেবল একটিমাত্র পদে (৪৩ সংখ্যক) বঙ্গাল’-রাগের উল্লেখ আছে। ইহা হইতে অনুমিত হয়, বর্তমানকালের ‘কীর্তন’, ‘বাউল’, ‘রামপ্রসাদী’ প্রভৃতি বাংলার নিজস্ব ও স্বতন্ত্র সুরগুলির ন্যায় সে-যুগেও সঙ্গীতে বাংলার নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে সেটির লক্ষণ কী তাহা বুঝিবার কোন উপায় নাই। কিন্তু ৫০টি চর্যাপদের মধ্যে কেবল একটি পদে এই রাগের ব্যবহার দেখিয়া মনে হয়, ইহা বাংলা দেশেও খুব প্রসিদ্ধ ছিল না, এবং বাঙ্গালীরা ভারতের অন্যত্র উদ্ভূত বা প্রচলিত অনেক রাগরাগিণীর সহিত পরিচিত ছিল। উপরে উল্লিখিত প্রমাণগুলি হইতে ইহাও অনুমান করা যায় যে সঙ্গীতগুলি প্রধানতঃ ধর্মমূলক ছিল এবং মন্দিরের দেবদাসীরা উচ্চাঙ্গের রাগরাগিণীর ধারা প্রচলিত রাখিত।

হিন্দুযুগের শেষে রচিত জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের পদগুলি রাগ ও তালের সহিত গীত হইত। রাগগুলির মধ্যে কর্ণাট, গুর্জরী, মালব, প্রভৃতি দেশসূচক নাম হইতেও পূর্বোক্ত অনুমান সমর্থিত হয়। প্রবাদ আছে, জয়দেবের প্রণয়িনী পদ্মাবতী নৃত্যসহযোগে গান করিতেন। সুতরাং হিন্দুযুগের শেষ পর্যন্ত যে বাংলা দেশে নৃত্যগীতের খুব প্রচলন ছিল এবং বহির্বঙ্গের অন্য প্রদেশের রাগ ও তানের সহিত বাঙ্গালীর পরিচয় ছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

মধ্যযুগে চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ গ্রন্থের পদগুলি জয়দেবের প্রবর্তিত কৃষ্ণলীলাবিষয়ক প্রবন্ধ-সঙ্গীতের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিল। অনতিকাল পরে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে পদাবলী কীর্তন-গানের এত প্রচার হইয়াছিল যে ‘কানু ছাড়া গীত নাই’- ইহা বাংলায় প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছে। কীর্তনগান এখনও বাংলা দেশে সুপরিচিত, তাই তাহার রসমাধুর্যের বা বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দেওয়া অনাবশ্যক। শ্রীচৈতন্যের লীলা ও তপ্রবর্তিত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ইতিহাসের সহিত বাংলার এই নিজস্ব সঙ্গীতের ধারা অঙ্গাঙ্গীভাবে সংবদ্ধ।

শ্রীচৈতন্যদেব কৃষ্ণভক্তির ভাবাবেশে যে-সঙ্গীতে নবদ্বীপবাসীদের এবং পরে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে ভক্তদের মাতাইয়াছিলেন, সেই সঙ্গীত সংকীর্তন’ নামে সুপরিচিত। সন্ন্যাসগ্রণের অব্যবহিত আগে নবদ্বীপে শ্রীবাসের গৃহে সংকীর্তন এবং নবদ্বীপের পথে পথে তাঁহার নগর-সংকীর্তন বাংলায় প্রেমধর্ম প্রচারের ইতিহাসে স্মরণীয় হইয়া আছে। এই সংকীর্তন কেবলমাত্র নামকীর্তন অর্থাৎ ‘নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ। গোপাল গোবিন্দরাম শ্রীমধুসূদন’ ইত্যাদির পুনঃপুনঃ আবৃত্তি। ধ্রুব-মন্ত্রের মত কৃষ্ণের নাম অবলম্বন করিয়া ভাবে আত্মহারা শ্রীচৈতন্য সংকীর্তন গাহিতেন। পুরীতে অবস্থানকালে রথযাত্রা উৎসবের সময় রথাগ্রে এই সংকীর্তনসহযোগে শোভাযাত্রার কথাও সুবিদিত।

কিন্তু পরবর্তীকালের সঙ্গীতজগতে যাহা ‘পদাবলী কীর্তন’ নামে প্রচলিত হয়, তাহা প্রণালীবদ্ধভাবে সুগঠিত একটি সঙ্গীতরীতি। মর্মস্পর্শী সুরমাধুরী ও বৈষ্ণবীয় ভক্তিরসের আবেদনে পূর্ণ হইলেও পদাবলী কীর্তন একটি সাধনা-সাপেক্ষ সঙ্গীত পদ্ধতি। তৎকালীন উত্তরভারতে সঙ্গীতের যে রীতি ও চর্চার ধারা প্রচলিত ছিল, তাহারই সাক্ষাৎ প্রভাবে বাংলার পদাবলী কীর্তন প্রবর্তিত হয়। শ্রীগৌরাঙ্গের তিরোধানের (১৫৩৩ খ্রী.) পঞ্চাশ বৎসর পরে নরোত্তম ঠাকুর এই সুসংস্কৃত কীর্তনপদ্ধতির প্রবর্তন করেন।

শ্রীচৈতন্য-পরবর্তী কালের গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজের তিনজন নেতার অন্যতম নরোত্তম ঠাকুর রাজশাহীর খেতরি গ্রামের ভূম্যধিকারীর একমাত্র সন্তান ছিলেন। প্রথম যৌবনেই সাংসারিক সুখসম্পদ ত্যাগ করিয়া বৃন্দাবনে যান এবং সেখানে শ্রীচৈতন্যের শিষ্য লোকনাথ গোস্বামীর নিকটে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত সন্ন্যাসী হন। বৃন্দাবন শুধু পবিত্র তীর্থস্থান ছিল না, সেকালের ধ্রুবপদ সঙ্গীতচর্চার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। স্বামী হরিদাস, স্বামী কৃষ্ণদাস প্রমুখ সাধক সঙ্গীত গুণীরা বৃন্দাবনে ধ্রুবপদ সঙ্গীতের যে ধারা প্রবর্তন করিয়াছিলেন নরোত্তম তাহার সংস্পর্শে আসেন। তিনি একজন সুকণ্ঠ গায়ক ছিলেন এবং তৎকালীন অনেক সাধুসন্তের ন্যায় তাহার ধর্মসাধনা ও সঙ্গীতসাধনা অঙ্গাঙ্গী ছিল। বৃন্দাবনে সঙ্গীতশিক্ষাপ্রাপ্ত নরোত্তম পরে ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দে খেতরিতে শ্রীচৈতন্যের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে এক বিরাট বৈষ্ণব-সম্মেলন অনুষ্ঠিত করিয়াছিলেন। খেতরির মহোৎসব নামে প্রসিদ্ধ সেই সম্মেলনে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়ার উপস্থিতিতে নরোত্তম এই নব্যরীতির পদাবলী কীর্তন প্রথম পরিবেশন ও পরিচালনা করেন। ধাতু, রাগ ও তালসমন্বিত এবং ধ্রুব প্রবন্ধগানের ভিত্তিতে গঠিত সেই পদাবলী কীর্তনগান গড়েরহাট পরগণার খেতরিতে অনুষ্ঠান করার জন্য গড়েরহাটি বা গরাণহাটি কীর্তন নামে সুপরিচিত হয়।

খেতরির মহোৎসবে নরোত্তমের নেতৃত্বে যে বিলম্বিত লয়ের কীর্তন পদাবলী গীত হইয়াছিল, তাহার দুইটি অংশ : অনিবদ্ধ ও নিবদ্ধ। প্রথমটিতে আলপ্তি বা আলাপ, অর্থাৎ কীর্তনের পদ বা কথাবর্জিত শুধু সঙ্গীতস্বরের বিন্যাস। কীর্তনের সেই আলাপ-অংশে ছন্দ ও তাল নাই। কীর্তনের দ্বিতীয় অর্থাৎ নিবদ্ধ অংশে পদ বা কথাবস্তুর সঙ্গে সুরের মিলন এবং তাহার ভিত্তিস্বরূপ আছে তাল। তাহার সুরের গঠন বিভিন্ন রাগকে অবলম্বন করে, যদিও কীর্তনের রাগ-রূপায়ণে কোন কোন ক্ষেত্রে রাগসঙ্গীতের সঙ্গে পার্থক্য দেখা যায়। কীর্তন পদাবলীর মূল পালাগানের বিষয়বস্তু প্রধানতঃ গীতগোবিন্দের রাধাকৃষ্ণ-তত্ত্বের আদর্শ হইতে গৃহীত; যথা–মান, দান, খণ্ডিতা, মাথুর, রাস, নৌকাবিলাস ইত্যাদি।

খেতরির সেই পদাবলী কীর্তনের প্রথম অনুষ্ঠানে অনিবদ্ধ অংশ গান করেন গোকুলানন্দ। তাঁহার আলপ্তি বা আলাপ–উদারা, মুদারা, তারা এই তিন গ্রামে বিন্যস্ত ছিল। গোকুলানন্দের আলাপের পরে শ্রীখণ্ডের রঘুনন্দন ঠাকুর অভিনন্দনস্বরূপ নরোত্তম ঠাকুরের কণ্ঠে মাল্যদান করেন। কীর্তনগানের পূর্বে গায়ককে মাল্যদানের প্রথা সেই অবধি প্রচলিত। অতঃপর নরোত্তম কীর্তনের নিবদ্ধ অংশ সুমধুর কণ্ঠে ভক্তিভাবের সঞ্চারে পরিবেশন করেন। পদাবলী কীর্তনের মনোরম আদর্শ সেই অনুষ্ঠান হইতে বাংলা দেশের সঙ্গীতজগতে প্রবর্তিত হয়। সেই কীর্তনের আর-একটি বৈশিষ্ট্য ছিল- মূল কৃষ্ণপদ গানের পূর্বে গৌরচন্দ্রিকা অর্থাৎ গৌরচন্দ্র চৈতন্যদেবের স্তুতি। শ্রীচৈতন্যের ভাবমূর্তি ও স্মৃতিকে জাগাইবার মন্ত্র স্বরূপ এই গৌরচন্দ্রিকা আনুষ্ঠানিক পদাবলী কীর্তনের অঙ্গরূপে প্রথম হতেই প্রচলিত হয়।

নরোত্তম ঠাকুর এইভাবে যে পদাবলী কীর্তনগানের প্রবর্তন করেন তাহা গরাণহাটি কীর্তন নামে পরে সুপ্রসিদ্ধ হয়। কালক্রমে চারিটি স্থানের নামানুসারে মনোহরশাহী, রেণেটি, মন্দারিণী ও ঝাড়খণ্ডী রীতির কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পদাবলী কীর্তনগান প্রচলিত হয়।

সমগ্রভাবে পদাবলী কীর্তন উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত একটি প্রাণবন্ত সঙ্গীত-রীতিরূপে বাংলার সঙ্গীতজগতে প্রচলিত ছিল। পদ্ধতিগত পদাবলী কীর্তনধারার পরবর্তী পর্যায়ে সহজ সুরের লৌকিক কীর্তনের রূপ জনসাধারণের মধ্যে চলিত হয়, একথাও উল্লেখযোগ্য।

বাউল-সম্প্রদায়ের বিবরণ এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে দেওয়া হইয়াছে। বাউলেরাও প্রধানতঃ গীতের সাহায্যে তাহাদের ধর্মমত প্রচার করিত। এই সকল গীতের যে একটি বিশিষ্ট সুর ও তাল ছিল, কীর্তনের ন্যায় এখন পর্যন্তও তাহা বাংলা দেশের একটি অমূল্য সম্পদ এবং অতিশয় জনপ্রিয়। কীর্তন ও বাউল গান এখনও বাংলা দেশের গ্রামে ও ঘাটে পথে তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর লোকের মুখেও গীত হইয়া থাকে।

পরবর্তীকালে–মধ্যযুগের শেষভাগে ও আধুনিক যুগের প্রারম্ভে-শ্যামাসঙ্গীত প্রভৃতি ধর্মমূলক গান রামপ্রসাদের ন্যায় সাধকদের কণ্ঠে আঁহাদেরই প্রবর্তিত অভিনব সুরে গীত হইয়া, বাংলা দেশের সঙ্গীতে বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য আনয়ন করিয়াছে। বাউল ও এইসকল সাধকের নিজস্ব রীতিতে রচিত গীতে অতি উচ্চশ্রেণীর জীবন-দর্শন ও আধ্যাত্মিক তত্ত্ব অতীব সরল ভাষায় এবং অশিক্ষিত গ্রামবাসীর পক্ষে সহজবোধ্য উপমার সাহায্যে বর্ণিত হইয়াছে। সাধকশ্রেণীর স্বকীয় স্বতন্ত্র রীতিতে রচিত গীত ও সুর এবং পদাবলী কীর্তন ও বাউলের গান উনিশ শতক পর্যন্ত তিন-চারিশত বৎসর একাধারে আনন্দ দান ও বাঙ্গালীর কৃষ্টি ও ধর্মভাবপ্রসারে সহায়তা করিয়াছে।

উনিশ শতকে বাংলা দেশে কীভাবে নানাক্ষেত্রে নবজাগরণের সূত্রপাত হয় তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। সঙ্গীতেও এই নবজাগরণের পরিচয় পাওয়া যায়। কলিকাতা শহরই সর্বভারতীয় রাগসঙ্গীতের নূতন সৃষ্টি ও পুনরুজ্জীবনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। সৃষ্টিশীল বহুসংখ্যক সঙ্গীতজ্ঞ সমবেত হইয়া এই উভয়দিকেই খুব সাফল্য অর্জন করেন। ইহার ফলে রাজনীতির ন্যায় সঙ্গীতক্ষেত্রেও ভারতীয় ঐক্যবোধের প্রতিষ্ঠা হয়। বাংলার রাগসঙ্গীত-সাধনা ভারতীয় সঙ্গীতের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হইয়া তাহার ঐশ্বর্যসম্ভার আহরণ ও আত্মস্থ করিয়া পুষ্টিলাভ করে। অপরদিকে ভারতীয় সঙ্গীতের পুনরুজ্জীবন-ক্রিয়া বাঙ্গালী মনীষার সৃজনশীলতার সংস্রবে নূতন প্রেরণা লাভ করে। ইহারই ফলস্বরূপ বাংলার ধ্রুপদ, টপ্পা ও খেয়াল রীতির চর্চা আরম্ভ হয়। বাঙ্গালী শিক্ষার্থীরা বাংলার বাহিরে, বিশেষতঃ উত্তরপ্রদেশের হিন্দু ও মুসলমান কলাবতের অধীনে, শিক্ষা লাভ করেন। আবার অভিজাত সম্প্রদায়ের নিমন্ত্রণে বাংলায় সমাগত পশ্চিমদেশীয় গুণীগণের শিক্ষাধীনে বাঙ্গালীরা সঙ্গীতচর্চার সুযোগ গ্রহণ করেন। নিধুবাবু নামে সুপরিচিত রামনিধি গুপ্ত (১৭৪১-১৮৩৮) ও কালিদাস চট্টোপাধ্যায় (আ. ১৭৫০-১৮২০) প্রথমোক্ত উপায়ে এবং রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬) এবং রামশঙ্কর ভট্টাচার্য (১৭৬১-১৮৫৩) দ্বিতীয় উপায়ে রাগসঙ্গীতের এক এক অঙ্গের অধ্যায়ে আত্মনিয়োগ করেন। এইভাবে প্রথমোক্ত দুইজন ‘টপ্পা’, তৃতীয় জন ‘খেয়াল’ এবং শেষোক্ত জন ধ্রুপদ’ সাধকরূপে বাংলা দেশে রাগসঙ্গীতের এই তিন অঙ্গের পথিকৃৎ হইলেন। ইহাদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ পূর্বোক্ত রামনিধি গুপ্ত। ১৭৭৬ হইতে ১৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৮ বৎসর বিহারের ছাপরায় চাকুরীসূত্রে অবস্থানকালে স্থানীয় কলাবতের শিক্ষাধীনে টপ্পা-সঙ্গীতে অভিজ্ঞ হইয়া কলিকাতায় আসেন, এবং বিভিন্ন সঙ্গীতের আসরে স্বরচিত গান গাহিয়া ‘টপ্পা’কে জনপ্রিয় করেন। হিন্দুস্থানী টপ্পার দ্রুত লয় ও প্রায় প্রতিকথায় জমজমা, গিটকিরি অলঙ্কারের আধিক্য না মানিয়া তিনি মধ্যলয় এবং অল্প দোলায়িত তানের সহযোগে অভিনব বাংলা টপ্পা শুনাইয়া শ্রোতাগণকে মুগ্ধ করিতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘মায়ার খেলা’ প্রভৃতি রচনার সময় পর্যন্ত নিধুবাবুর সঙ্গীত বাংলার কাব্যসঙ্গীত-রচনাকেও প্রভাবান্বিত করিয়াছিল। ৯৬ বৎসর বয়সে নিধুবাবু স্বীয় গানের সংকলন-পুস্তক ‘গীতরত্ন’ প্রকাশ করেন। তিনি যে একজন কবিওয়ালা ছিলেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। সাধারণে কালী মির্জা নামে পরিচিত কালিদাস চট্টোপাধ্যায় কাশী ও লক্ষ্ণৌ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ওস্তাদগণের নিকট দশ-বারো বৎসর শিক্ষার পর ১৭৮০-৮১ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা দেশে টপ্লাগানের যে-ধারা প্রচলিত করেন তাঁহার শিষ্য-প্রশিষ্যগণ তাহা আরও প্রসারিত করেন।

বর্ধমানের রাজা তেজচাঁদ তাঁহার দেওয়ান রঘুনাথ রায়কে রাগসঙ্গীত শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে দরবারে পশ্চিমা কলাবৎ নিযুক্ত করেন। রঘুনাথ শুধু খেয়ালগানের চর্চা করেন নাই, চারি তুক বা কলিবিশিষ্ট অসংখ্য বাংলাগানও রচনা তিনি করিয়াছিলেন।

বিষ্ণুপুরের রামশঙ্কর ভট্টাচার্য ১৭৮১-৮২ খ্রীষ্টাব্দে আগ্রা, মথুরা প্রভৃতি অঞ্চল হইতে বিষ্ণুপুর রাজসভায় সমাগত পণ্ডিতজী নামক জনৈক হিন্দু শিক্ষাচার্যের নিকট ধ্রুপদসঙ্গীত চর্চা করেন এবং একদল কৃতী শিষ্য গঠন করিয়া বিষ্ণুপুরে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধ্রুপদরীতি অনুশীলনের সঙ্গীত-সম্প্রদায় গঠন করেন। কেহ কেহ মনে করেন যে রাজা রামমোহন রায় বঙ্গদেশে ধ্রুপদ সঙ্গীত প্রচলন করন। এই অনুমান সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক (প্রবাসী ১৩৬৯, ফাল্গুন, পৃষ্ঠা ৬৩১-৩২)।

আঠারো শতক শেষ হইবার পূর্বেই বাংলা দেশে যে টপ্পা, খেয়াল ও ধ্রুপদের প্রবর্তন হয়, উনিশ শতকে অনেক গুণী তাহার চর্চা অব্যাহত রাখিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। ইহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ধ্রুপদ-গায়ক বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী (১৮০৪-১৯০০), গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায় (১৮০৮-৭৬), রামদাস গোস্বামী (জন্ম ১৮২০), টপ্পাসাধক মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (জন্ম আ. ১৮৩১) এবং সমসাময়িক, একধারে ধ্রুপদ, খেয়াল ও টপ্পা সঙ্গীতে গুণী গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী ও লক্ষ্মীনারায়ণ বাবাজী। ইঁহাদের মধ্যে বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী কৃষ্ণনগর রাজসভার আনুকূল্যে কয়েকজন মুসলমান কলাবতের নিকট ধ্রুপদ শিক্ষা করিয়া ৫০ বৎসরেরও বেশী নিয়মিতভাবে ব্রাহ্মসমাজে গান করিবার কার্যে নিযুক্ত ছিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীতে পারিবারিক সঙ্গীতশিক্ষক নিযুক্ত হইয়া তিনি বালক রবীন্দ্রনাথ ও তাঁহার প্রাপ্তবয়স্ক জ্যেষ্ঠভ্রাতাদের সঙ্গীত শিক্ষাগুরুর গৌরবময় পদ লাভ করিয়াছিলেন। ৯৬ বৎসর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন।

গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মূল ধ্রুপদ পদ্ধতির সাধক, বাংলা দেশে সেই কেন্দ্রীয় সঙ্গীতধারার প্রচারক ও বাহক এবং বাংলায় সঙ্গীতচর্চার গুরুত্বপূর্ণ পর্বে আচার্যস্থানীয়। তাঁহার কৃতী শিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে প্রসিদ্ধ স্বনামধন্য যদুভট্ট (জন্ম ১৮৪০) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। গঙ্গানারায়ণের ধ্রুপদসাধনায় ও শিক্ষাদানের ফলে রাগসঙ্গীতের প্রধান রীতির চর্চা প্রস্তুতিপর্ব হইতে কিশোরযুগে উত্তীর্ণ হয় এবং যদুভট্ট সেই পরিণতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।

বাংলার সঙ্গীতশিল্পে পূর্বোক্ত ধ্রুপদী রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের শিষ্য চন্দ্রকোণার ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর (১৮২৩-৯৩) অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বেলগাছিয়া নাট্যশালায় ‘রত্নাবলী’ অভিনয় উপলক্ষে (১৮৫৮) তিনি যদুনাথ পালের সহযোগিতায় ভারতে প্রথম ‘ঐকতান বাদ্য’ প্রবর্তন করেন এবং বাদকদের ব্যবহারের জন্য দণ্ডমাত্রিক প্রণালীতে যে স্বরলিপি রচনা করেন, ভারতবর্ষে তাহাই প্রথম স্বরলিপি-১৮৭২ সনে ‘ঐকতানিক স্বরলিপি’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সঙ্গীতবিষয়ে তিনি আরও কয়েকখানি গ্রন্থ প্রকাশ করেন–’সঙ্গীতসার’ (১৮৬৯), ‘গীতগোবিন্দের স্বরলিপি’ (১৮৭১), ‘কণ্ঠ-কৌমুদী’ (১৮৭৫), এবং ‘আশুরঞ্জনী তত্ত্ব’ (১৮৮৫) অর্থাৎ এস্রাজ যন্ত্রসঙ্গীত-শিক্ষার পুস্তক। বাংলায় সঙ্গীতবিষয়ক প্রথম মাসিক পত্রিকা ‘সঙ্গীত সমালোচনী’ (১৮৭২) সম্ভবত তাঁহারই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর-পরিবারের শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) সঙ্গীতবিদ্যায় ক্ষেত্রমোহনকেই গুরুর পদে বরণ করিয়াছিলেন। এই বিদ্যার প্রসারে গুরুর ন্যায় শিষ্যের অবদানও অবিস্মরণীয়। তিনি যে কত বিভিন্ন রকমে বাংলার সঙ্গীতবিদ্যা-প্রসারে সহায়তা করিয়াছিলেন তাহা সবিস্তারে বর্ণনা করা এই গ্রন্থে সম্ভবপর নহে, কেবলমাত্র সংক্ষেপে ইহার উল্লেখ করিব।

সঙ্গীতের ইতিহাস, বিভিন্ন যন্ত্রসঙ্গীত ও নানা রীতির আলোচনার জন্য গ্রন্থরচনা; স্বরলিপি প্রচলনের জন্য পুস্তক প্রণয়ন; প্রণালীবদ্ধভাবে সঙ্গীত শিক্ষাদানের জন্য প্রথম সুপরিকল্পিত বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা; ইংরেজীতে পুস্তকাদি রচনা ও প্রকাশ করিয়া পাশ্চাত্ত্য জগতে ভারতীয় সঙ্গীতের প্রচার তথা মর্যাদালাভের প্রচেষ্টা; প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রাদির মূল্যবান সংগ্রহশালা স্থাপন (শৌরীন্দ্রমোহন কর্তৃক বহুব্যয়ে সংগৃহীত যন্ত্রগুলি লইয়াই পরে কলিকাতার সরকারী মিউজিয়মের বাদ্যযন্ত্র বিভাগটি গঠিত হয়); কলাবতের শিক্ষাধীনে স্বয়ং সঙ্গীতচর্চার সঙ্গে প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের বিদ্যালাভের সুযোগ দান; বহু গুণীর পৃষ্ঠপোষকতা; প্রথম আলোচনাভিত্তিক সর্বভারতীয় সঙ্গীত-সম্মেলনের প্রবর্তনা; দক্ষ শিল্পীদের দ্বারা রাগবাগিণীর চিত্রাবলী অঙ্কন ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা; সংস্কৃত সঙ্গীতশাস্ত্র গ্রন্থের সংগ্রহ ও পুনর্মুদ্রণের আয়োজন; স্বলিখিত ও স্বপ্রকাশিত প্রন্থাবলী বিনামূল্যে সঙ্গীতপ্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ ইত্যাদি শৌরীন্দ্রমোহনের সঙ্গীতজীবনের সংক্ষিপ্ত কর্মপঞ্জী।

শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, এই দুইজনের অক্লান্ত চেষ্টা যে উনিশ শতকে বাংলায় সঙ্গীতবিদ্যার প্রতিষ্ঠা বা পুনরুজ্জীবনের বিশেষভাবে সহায়তা করিয়াছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এই প্রসঙ্গে সমকালীন কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি প্রথমজীবনে ক্ষেত্রমোহনের ছাত্র ছিলেন। সঙ্গীতবিজ্ঞানের নানা শাখায় তাহার গভীর ও মৌলিক গবেষণা ভারতীয় সঙ্গীতের মূল্যায়ন ও পুনরুদ্ধারে বিশেষ সহায়করূপে গণনীয়। ১৮৮৫ ৮৬ খ্রীষ্টাব্দে দুই খণ্ডে প্রকাশিত তাহার ‘গীতসূত্রসার’ উনিশ শতকের তাবৎ ঔপপত্তিক সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্থাদির মধ্যে শ্রেষ্ঠ রচনা। ১৮৬৮ সালে মুদ্রিত ‘সেতার শিক্ষা’ পুস্তকটি উক্ত যন্ত্রসঙ্গীত-শিক্ষা সম্পর্কে প্রথম গ্রন্থ। তাঁহার রচিত ‘বঙ্গৈকতান’ পুস্তকে প্রকাশিত (১৮৬৭) স্বরলিপিগুলি ভারতে প্রথম মুদ্রিত স্বরলিপি। কৃষ্ণধনের সেই স্বরলিপি ইউরোপীয় রেখামাত্রা প্রণালী অনুসারে লিপিবদ্ধ হওয়ায় ভারতীয় সঙ্গীতের সেবকসমাজে গৃহীত হয় নাই; কিন্তু স্বাধীন চিন্তামূলক গবেষণারূপে ইহার যথেষ্ট মূল্য আছে। সমগ্রভাবে সেকালের তাত্ত্বিক আলোচনা ভারতীয় সঙ্গীতকে শিক্ষিত সমাজে যে অধিকতর আদরণীয় করিয়াছিল, কৃষ্ণধনের গবেষণা তাহার অন্যতম বিশিষ্ট কারণ। তিনি সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় ক্রিয়াসিদ্ধ চর্চাও করিয়াছিলেন।

সঙ্গীতের আলোচনার উপসংহারে সঙ্গীতের সহায়ক বাদ্যযন্ত্র সম্বন্ধেও কিছু বলা প্রয়োজন।

প্রাচীন কাল হইতেই বাংলা দেশে নানাপ্রকার বাদ্যের প্রচলন থাকায় যন্ত্রসঙ্গীতে যথেষ্ট বৈচিত্র্য ছিল। ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে বাদ্যযন্ত্রগুলিকে চারটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা হইয়াছে। (১) তত = তন্ত্রজাতীয় অর্থাৎ তন্ত্র বা তাঁত বা তার সহযোগে যেসব বাদ্য বাদিত হয়। (২) শুধির = বায়ুর সাহায্যে যেসব যন্ত্র বাদিত হয়। (৩) আনদ্ধ বা বিতত = চর্মবাদ্য। এবং (৪) ঘন = ধাতুনির্মিত যন্ত্র।

বাংলায় উক্ত চারি প্রকার বাদ্যযন্ত্রের বহুল ব্যবহার ছিল। তন্ত্রজাতীয় বাদ্যরূপে বিভিন্ন বীণাযন্ত্রের প্রচলন ছিল। শুধির জাতীয় বাদ্যের মধ্যে বাঁশীই প্রধান ছিল। আনদ্ধ বা চর্মবাদ্য শ্রেণীতে ছিল মুরজ, মৃদঙ্গ, মর্দল, দুন্দুভি ইত্যাদি। ঘন বা ধাতুতে গঠিত বাদ্যের মধ্যে মন্দিরা, করতাল, কাঁসর ইত্যাদি যন্ত্রের প্রচলন ছিল।

উনিশ শতকে পাখোয়াজ ও সেতারবাদ্যে কয়েকজন বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন। উত্তর প্রদেশের ভারতবিখ্যাত পাখোয়াজগুণী লালা কেবলকিষণের শিষ্য শ্রীরাম চক্রবর্তী বাংলার সর্ববৃহৎ পাথোয়াজবাদক গোষ্ঠীর আদিগুরু ছিলেন। তাঁহার বহু শিষ্য-শিষ্যেরা এই বিদ্যায় খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন।

আঠারো শতকে আখড়াই গানের অনুষ্ঠানে ঐকতান বাদনের অন্যান্য যন্ত্রের মধ্যে সেতারেরও চলন ছিল। উনিশ শতকের প্রথমভাগে একক বাদ্যযন্ত্ররূপে সেতারের চর্চা ঢাকা, বিষ্ণুপুর ও কলিকাতায় স্বতন্ত্রভাবে প্রচলিত হয়। ঢাকায় ইহর পথিকৃৎ ছিলেন হরিচরণ দাস। বিংশ শতাব্দীতে ঢাকার প্রখ্যাতনামা সেতারবাদক ভগবান দাস তাঁহারই প্রপৌত্র। বিষ্ণুপুরের সেতারবাদনে অগ্রণী ছিলেন পূর্বোক্ত যদুভট্টের পিতা মধুসূদন দত্ত। ধনকুবের রামদুলাল সরকারের জ্যেষ্ঠপুত্র এবং সাতুবাবু নামে সুপরিচিত আশুতোষ দেব (১৮০৫-৫৬) কলিকাতায় একক সেতারবাদকের প্রথমযুগে খুব খ্যাতিলাভ করেন। পশ্চিমাঞ্চলের এক বিখ্যাত সেতারবাদক রেজা আঁকে দীর্ঘকাল নিজের সঙ্গীতসভায় নিযুক্ত রাখিয়া তিনি রীতিমতভাবে সেতারবাদক শিক্ষা করেন।

পরবর্তীকালে সেতার, বীণা ও মৃদঙ্গ বাদনে বাংলা দেশে অনেকে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। সঙ্গীত ও বাদ্যবিষয়ে অনেকে বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ লক্ষ্মীনারায়ণ বাবাজীর নাম করা যাইতে পারে (জন্ম আনুমানিক ১৮৩০ খ্র.)। তিনি একাধারে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরি গায়ক এবং বীণা, পাখোয়াজ ও তবলা প্রভৃতি যন্ত্রবাদকরূপে খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন।১৪

পাদটীকা

১. এই অনুচ্ছেদটি প্রধানতঃ শ্রীঅমল মিত্র প্রণীত “কলকাতায় বিদেশী রঙ্গালয়” (প্রকাশ ভবন, ১৩৭৪) গ্রন্থ অবলম্বনে লিখিত। বিস্তৃত বিবরণের জন্য এই গ্রন্থখানি দ্রষ্টব্য।

২. শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ (সং সে ক) দ্বিতীয় সংস্করণ, ৬৯১ পৃ.।

৩. শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য প্রণীত “বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস” (নাট্য সাহিত্য প্রথম খণ্ড, ৫৮৫ পৃ.)।

৪. সং সে ক, দ্বিতীয় খণ্ড, ২০৪ পৃ.।

৫. সং সে ক, ২০৫ পৃ.।

৬. ঐ ২০৬ পৃ.।

৭. ঐ।

৮. ঐ (দ্বিতীয় সং ৬৯১ পৃ.)।

৯. ‘নাট্য সাহিত্য’-১। ৫৯৩।

১০. এই রঙ্গমঞ্চের প্রতিষ্ঠাকাল হইতে গণনা করিয়া ১৯৭২ সনে ‘বঙ্গীয় নাট্যশালা’র শতবার্ষিকী উৎসব অনুষ্ঠিত হইয়াছে। ১৯২২ সনে ইহার ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ অনুষ্ঠিত হইয়াছিল।

১১. লোকগীতি সম্বন্ধে নিম্নে লিখিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১২. এই অনুচ্ছেদটি প্রধানতঃ শ্রীনকুল চট্টোপাধ্যায় লিখিত একটি প্রবন্ধের সারমর্ম।

১৩. বাংলা দেশের ইতিহাস–প্রাচীন যুগ (পঞ্চম সং)।

১৪. এই অনুচ্ছেদটি প্রধানতঃ শ্রীদিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘সঙ্গীত’ শীর্ষক একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ অবলম্বনে লিখিত। এই অপ্রকাশিত প্রবন্ধের অনেক অংশ স্থানাভাবে এই অনুচ্ছেদে ব্যবহার করা সম্ভবপর হয় নাই এবং বাংলা দেশে প্রাচীন যুগের সঙ্গীত সম্বন্ধে তাঁহার মত সর্বত্র গৃহীত হয় নাই। আধুনিক যুগের সঙ্গীত সম্বন্ধে আলোচনা ও মতামতের দায়িত্ব প্রধানতঃ তাঁহারই।

১. গ্রন্থ

১. ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-কবিজীবনী। শ্রীভবতোষ দত্ত সম্পাদিত, কলিকাতা, ১৯৫৮।

২. দীনেশচন্দ্র সেন-বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, ৮ম সংস্করণ, ১৩৫৬।

৩. মদনমোহন গোস্বামীরায় গুণাকর ভারতচন্দ্র। কলিকাতা, ১৯৫৫।

৪. নিরঞ্জন চক্রবর্তী-উনবিংশ শতাব্দীর কবিওয়ালা ও বাংলা সাহিত্য, কলিকাতা ১৯৫৮।

৫. C. S. K. De, Bengali Literature in the Nineteenth Century. (কবিগানের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে উল্লিখিত ৪নং গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)

২. প্রবন্ধ

১. গোপালচন্দ্র শাস্ত্রী-ভোলা ময়রা, ভারতী, ১৩০৪, বৈশাখ।

২. পূর্ণচন্দ্র দে–ভোলা ময়রা, মাসিক বসুমতী, কার্তিক, মাঘ, ১৩৬৬। এতদ্ব্যতীত Rev. J. Long প্রণীত A Descriptive Catalogue of Bengali Works গ্রন্থে অনেক আদিরসাশ্রিত গান ও বইয়ের উল্লেখ আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *