১১. দেশাত্মবোধ ও রাজনীতিক আন্দোলন

একাদশ অধ্যায় – দেশাত্মবোধ ও রাজনীতিক আন্দোলন

(ক) প্রথম পর্ব (১৮০০-১৮৫৮)

রাজনীতিক চেতনার উদ্বোধন

উনিশ শতকে বাংলায় নূতন যে জাতীয় জাগরণের সূত্রপাত হয় তাহার প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্য : জাতীয়তা-ভাবের স্ফুরণ ও রাজনীতিক চেতনার উদ্বোধন। ইংরেজীতে nationalism (জাতীয়তা) বলিলে যাহা বুঝায় ভারতবর্ষে তাহার অস্তি ত্ব মধ্যযুগে ছিল না, প্রাচীন হিন্দু আমলেও ছিল কিনা সন্দেহ। এই জাতীয়তার ভিত্তি ও বিশিষ্ট লক্ষণ অথবা উপাদান কী, সে-সম্বন্ধে বহু মতভেদ আছে। কেহ কেহ মনে করেন, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় সহাবস্থান, এক রাজার শাসনে বাস ও ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সমাজ প্রভৃতির ঐক্যই জাতীয়তার মূল ভিত্তি

পরাধীন হইলে তাহার পরিবর্তে স্বাধীনতা-প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই ইহার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আবার অনেকে মনে করেন যে, এই উপাদানগুলি বাঞ্ছনীয় হইলেও, ইহার কোন-কোনটির অভাবসত্ত্বেও জাতীয়তার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব নহে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে, সুইজারল্যাণ্ডে তিনটি বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত আছে, ইউরোপের অনেক দেশে বিরোধী, এমনকি বিবদমান ধর্মসম্প্রদায় আছে অথবা কিছুদিন পূর্বেও ছিল, আইরিশ জাতি পরাধীন ছিল, তাহাদের একাংশের ভাষাও ইংরেজীভাষা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। অথচ এই সকল দেশে জাতীয়তা ছিল ও আছে। এইরূপ বিভিন্ন মতবাদ থাকিলেও মোটামুটি সকলেই স্বীকার করেন যে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী এক দেশে বসবাস করিলেও ইহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত তিনটি মনোবৃত্তির অভাব থাকিলে তাহাদিগের মধ্যে জাতীয়তা-ভাবের অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না।

প্রথমতঃ, এই বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর পরস্পরের মধ্যে এমন সহানুভূতি ও ঐক্যবোধ থাকা চাই, যাহা ইহার অন্তর্ভুক্ত কোন গোষ্ঠী বা ইহার বহির্ভূত কোন গোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমান নাই এবং এই কারণে উক্ত গোষ্ঠীবর্গ সকলে মিলিত হইয়া তাহাদের গণ্ডীর বহির্ভূত যে-কোন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একযোগে কার্য করিতে সর্বদাই ইচ্ছুক ও তৎপর থাকিবে।

দ্বিতীয়তঃ, এই বিভিন্ন গোষ্ঠীর একই রাজ্যশাসনের অধীনে থাকিবার ইচ্ছা।

তৃতীয়তঃ, রাজ্যশাসনের ক্ষমতা এই গোষ্ঠীসমূহের সকলের বা ইহাদের কতকের হস্তে থাকিবে, কিন্তু ইহাদের বহির্ভূত কোন গোষ্ঠীর সে-বিষয় কোন অধিকার থাকিবে না, এই আকাঙ্ক্ষা পোষণ।

জাতীয়তার এই সংজ্ঞা মানিয়া লইলে ইহা স্বীকার করিতেই হইবে যে, আঠারো শতকের শেষে বা উনিশ শতকের প্রথমে ভারতে জাতীয়তা-ভাবের অস্তি ত্ব ছিল না। নিম্নলিখিত কয়েকটি অবিসংবাদিত তথ্যের সাহায্যে ইহা সহজেই প্রতিপন্ন হইবে।

প্রথমতঃ, ভারতের রাজনীতিক ঐক্যসম্বন্ধে ইহার অন্তর্গত কোন প্রদেশই সচেতন ছিল না। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে (১৮২৪ সনে) বিশপ হিবার উত্তরভারতের সর্বত্র ঘুরিয়া মন্তব্য করিয়াছেন যে, হিন্দুস্থানীরা বাঙ্গালীদিগকে ইংরেজের মতই বিদেশী মনে করে, বাঙ্গালীরাও হিন্দুস্থানীদের সম্বন্ধে অনুরূপ মনোভাব পোষণ করে।

ইহার ঐতিহাসিক প্রমাণও আছে। আঠারো শতকে মারাঠী বর্গী-সৈন্য বাংলা দেশে যে উপদ্রব ও অত্যাচার করিয়াছিল তাহার ফলে যে বাঙ্গালীরা মারাঠাদিগকে ইংরেজের ন্যায় বিদেশী এবং ইংরেজের অপেক্ষাও অধিকতর ঘৃণা ও বিদ্বেষের চোখে দেখিবে ইহা খুবই স্বাভাবিক। মারাঠীরাও ইংরেজদের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া একযোগে বাংলা দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করিয়াছিল। তখন ভারতের অন্য প্রদেশের ন্যায় বাঙ্গালীরাও পাঞ্জাবী, হিন্দুস্থানী মারাঠী, মাদ্রাজী, আসামী, ওড়িয়া প্রভৃতির উল্লেখ করিত কিন্তু ভারতীয় বলিয়া কোন সম্প্রদায় সম্বন্ধে তাহাদের কোন ধারণা ছিল না। বাঙ্গালী নেতাদের মনেও একই প্রকার ধারণা ছিল। যখন বাংলায় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়া ইংরেজ, মারাঠী শক্তিবর্গ ও নেপাল, পঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্য অধিকার করিতে যুদ্ধযাত্রা করিত তখন বাঙ্গালী নেতারা ইংরেজদের বিজয়ের জন্য ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিতেন এবং যুদ্ধে ইংরেজদের অর্থসাহায্যের জন্য অগ্রসর হইতেন। উনিশ শতকের গোড়ায় ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী রাজা রামমোহন রায়ও এই দলভুক্ত ছিলেন।

দ্বিতীয়তঃ, বাঙ্গালীর সহিত কেবল যে ভারতের অন্য প্রদেশের অধিবাসীদের ঐক্যবোধ ছিল, না তাহা নহে। বাংলা দেশে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভেদবুদ্ধি বিশেষভাবে বর্তমান ছিল। প্রধানত ধর্মবিশ্বাস, ধর্মানুষ্ঠান, সামাজিক প্রথা, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সুরু হইতেই যে গুরুতর মৌলিক প্রভেদ ছিল সাতশত বৎসর একত্রে বাস ও বাংলার বহু হিন্দু মুসলমানধর্ম গ্রহণ করিলেও তাহার বিশেষ হ্রাস হয় নাই। আমরা বাল্যকালেও দেখিয়াছি, বাংলা দেশে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আহার বিহার বৈবাহিক প্রভৃতি কোনপ্রকার সামাজিক সম্বন্ধ ছিল না; হিন্দুরা মুসলমানদিগকে অস্পৃশ্য জ্ঞান করিত; ভোজ্য তো দূরের কথা, তাহাদের স্পর্শে পানীয়ও দূষিত বলিয়া বিবেচিত হইত এবং কোন মুসলমান-যতই শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত হউন না কেন–হিন্দুর সঙ্গে ভোজন ও তাহার শয়নগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারিতেন না। শিক্ষা ও সাহিত্যের ব্যাপারেও উভয়ের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য অটুট রহিল। হিন্দুর ধর্ম ছিল বহু দেবদেবীর মূর্তি গড়িয়া পূজা করা, মুসলমানেরা কেবল যে ইহাতে বিশ্বাসী ছিল না তাহাই নহে, তাহাদের ধর্মমতে হিন্দুর মন্দির ও দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করা পুণ্যকার্য ছিল। আরবী ও ফারসী ছিল মুসলমানদের সাহিত্যের ভিত্তি, হিন্দুদের অনেকে ফারসী জানিলেও সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যই ছিল তাহাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি। বহুকাল একসঙ্গে বাস করায় এবং বহুসংখ্যক হিন্দু মুসলমান-সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার ফলে ছোটখাট দৈনন্দিন আচার-ব্যবহার ও অনেক লৌকিক বিশ্বাস, সংস্কার প্রভৃতি এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু উভয়ের ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে যে গুরুতর মৌলিক প্রভেদের কথা এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে১ বর্ণিত হইয়াছে, উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত তাহার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয় নাই। বিংশ শতকে হিন্দুনেতারা রাজনীতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইহা স্বীকার না করিলেও এই ঐতিহাসিক সত্য সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। মুসলমান পণ্ডিত আলবেরুণী একাদশ শতকের প্রথমভাগে এই মৌলিক প্রভেদের উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিলেন : “অন্য সকল জাতির মধ্যে যে সমুদয় বিষয়ের মতের ঐক্য আছে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে তাহার সকলগুলিতেই মতের প্রভেদ। ধর্ম বিষয়ে এই মতানৈক্য চরমে পৌঁছিয়াছে, কারণ আমরা যাহা বিশ্বাস করি হিন্দুরা তাহা বিশ্বাস করে না, এবং হিন্দুরা যাহা বিশ্বাস করে আমরা তাহা বিশ্বাস করি না।”২ নয়শত বৎসর পরে (১৯৩৫ সনে) পাকিস্তানের পরিকল্পক রহমৎ আলি ইহার প্রতিধ্বনি করিয়া বলিয়াছেন : “হিন্দু ও মুসলমান দুইটি সম্পূর্ণ বিভিন্ন জাতি। আমাদের ধর্ম, কৃষ্টি, ইতিহাস, প্রাচীন কিংবদন্তী (tradition), সাহিত্য, অর্থনীতিক ব্যবস্থা, উত্তরাধিকার আইন, বিবাহ-বিধি প্রভৃতির মধ্যে মূলতঃ প্রভেদ বর্তমান। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপারেও এই প্রভেদ দেখা যায়। আমরা–হিন্দু ও মুসলমানেরা-পরস্পরের সঙ্গে আহার করি না, আমাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ হইতে পারে না, আমাদের জাতীয় আচার ও প্রথা, বর্ষগণনার রীতি (calendars) এমন কি খাদ্য ও পোষাক পরিচ্ছদও পৃথক।”৩ এই প্রভেদের ভিত্তির উপরই জিন্নার দ্বিজাতিমূলত রাজনীতি ও পাকিস্ত নের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে।

তৃতীয়তঃ, বিদেশী ইংরেজশাসনের প্রতি বাঙ্গালী হিন্দুর কোন বিদ্বেষভাব ছিল না। উনিশ শতকের গোড়ায় প্রসিদ্ধ নেতা রাজা রামমোহন রায় ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে অনন্যসাধারণ উদার মত পোষণ করিতেন। কিন্তু তিনিও মুসলমানরাজ্যে হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার, অবিচার প্রভৃতির উল্লেখ করিয়া ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়াছেন যে, তিনি ইংরেজদিগকে ভারতে পাঠাইয়া হিন্দুদিগকে নয়শত বর্ষব্যাপী মুসলমানদের লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের হাত হইতে উদ্ধার করিয়াছেন। উপসংহারে তিনি ইংরেজশাসনের বহু প্রশংসা করিয়াছেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরও প্রকাশ্যে ব্যক্ত করিয়াছেন যে, হিন্দুদের সর্ববিধ দুঃখ-দুর্দশা ও অবনতির মূল কারণ মুসলমান-রাজ্যশাসন নীতি। প্রসন্নকুমার ঠাকুরও বলিয়াছেন, ভগবান যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি স্বাধীনতা চাও, না ইংরেজের অধীন হইয়া থাকিতে চাও, আমি মুক্তকণ্ঠে ইংরেজের অধীনতাই বর বলিয়া গ্রহণ করিব।

এইরূপ মনোভাব কেবল মুষ্টিমেয় হিন্দুনেতা ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, হিন্দু বাঙ্গালী জনসাধারণও উনিশ শতকে এই মতই দৃঢ়ভাবে পোষণ করিত।

সমসাময়িক পত্রিকাগুলিতে মুসলমান-শাসনের অনিয়ম ও অত্যাচারের সঙ্গে তুলনা করিয়া ইংরেজশাসনের উৎকর্ষ সম্বন্ধে বহু মন্তব্য দেখা যায়। শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৪০ সনে বিজ্ঞানদায়িনী সভায় বলেন :

“যবন নৃপতিগণের অধীনে বাঙ্গালীরা যপ দুর্দশা সাগরে নিমগ্ন ছিল, তাহা স্মরণ করিতে হইলে কঠিন হৃদয় একেবারে বিদীর্ণ হইয়া যায়, তাঁহারা এদেশের রাজা ছিলেন বটে, কিন্তু প্রজারা প্রায় তাঁহারদিগের অধীনে সুখি ও সুস্থির চিত্ত থাকিতে পারিতেন না বরং নিয়তই অনিয়ম ও অত্যাচারের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন, যেহেতু প্রথমতঃ যবন রাজাদিগের রাজকীয় বিষয়ে বর্তমান দেশাধিপতিদিগের ন্যায় সুচারু নিয়ম ও ঐক্য ছিল না, …যবনাধিকারে এতদ্দেশীয় মনুষ্যগণ শান্তির সহিত প্রায় কখনই সাক্ষাৎ করেন নাই, একে রাজার দৌরাত্ম তাহাতে আবার দুর্দান্ত ও দুরাচারি লোকেরা অনায়াসে দিবসে নির্ভয়ে ডাকাইতি করিয়া সৰ্ব্বস্ব হরণ করিত, এবং এক এক বার বর্গির হ্যাঁঙ্গামায় লোকেরদিগের ধনপ্রাণ প্রভৃতি সমুদয় বিষয়ে যদ্রপ দুর্দশা ঘটিত, তাহা স্মরণ মাত্রে আমারদিগের হৃৎকম্প উপস্থিত হয়, কোন সময়ে কি বিপদ ঘটিবে, এই দুর্ভাবনাতেই লোকেরা দিবারাত্র সশঙ্কিত থাকিত।”৫

‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ১৮৪২ সনে মুসলমানরূপী পিশাচ কর্তৃক বিবিধ অত্যাচারের কথা বর্ণিত হইয়াছে এবং “ইংরেজদের প্রাদুর্ভাবে ৮০০ বছর পর্যন্ত যে দুঃখ এদেশে সঞ্চিত হইয়াছে তাহা ক্রমে দূরীকৃত হইতেছে” এইরূপ মন্তব্য করা হইয়াছে।৫ক

১৮৫০ সনে ‘সর্বশুভকরী’ পত্রিকায় উক্ত হইয়াছে।

“এই দেশ যখন দুরন্ত যবনজাতি দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিল তৎকালে ঐ দুবৃত্তজাতির দৌরাত্মে আমাদিগের সুখ সম্পত্তির একেবারেই লোকাপত্তি হইয়াছিল …দুশ্চরিত্র যবনজাতির ভয়ে স্ত্রীলোকদিগের প্রকাশ্য স্থানে গমনাগমন ও বিদ্যানুশীলন সম্পূর্ণরূপে স্থগিত হইয়া গেল। সকলেই আপনাপন জাতি প্রাণ কুলশীল লইয়া শশব্যস্ত, স্ত্রী জাতিকে বিদ্যাদান করিবেক কি পুরুষদিগেরও শাস্ত্রালোচনা মাথায় উঠিল। তদবধি স্ত্রীদিগের অন্তঃপুর নিবাস ও বিদ্যাভ্যাস নিরাশ হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে জগদিশ্বরের কৃপায় আমাদিগের আর সে দুরবস্থা নাই, অত্যাচারী রাজা নাই। শুভদিন পাইয়া সকল শুভকর্মেরও অনুষ্ঠান করিতেছি। আমাদিগের লুপ্তপ্রায় অন্যান্য সদ্ব্যবহার সকল পুনরুদ্ধার করিতেছি।”

১৮৭০ সনে ‘সোমপ্রকাশে’ লেখা হইয়াছে :

“…মুসলমানদিগের রাজত্বকালে প্রজাদিগকে যে সমস্ত অত্যাচার ও পীড়া সহ্য করিতে হইয়াছিল, এক্ষণে ঐ সকল অত্যাচারের কথা শুনিলে হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকাল স্মরণ হইলে শরীরের শোণিত শুষ্ক হইয়া যায়। সে সম্বন্ধে ব্রিটিশ রাজ্যকে “রাম রাজ্য” বলিলে বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না। অত্যাচারের কথা দূরে থাকুক এক্ষণে কেহ কাহাকে একটি উচ্চ কথা বলিতে সমর্থ হয় না। প্রজাগণ নিশঙ্কচিত্তে ও পরম সুখে ব্রিটিশ রাজ্যে বাস করিতেছেন। এই সকল বিষয় পর্যালোচনা করিয়া দেখিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ভারতবর্ষের সৌভাগ্য সূর্য ক্রমশঃ উদয় হইতেছে।”৭

এরূপ আরও বহু উক্তি নানা গ্রন্থে ও সাময়িক পত্রিকায় দেখিতে পাই। এই সমুদয় উক্তির মধ্যে যে অসত্য ও অতিরঞ্জন আছে সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু উনিশ শতকের হিন্দুগণ মুসলমান-রাজ্যশাসন সম্বন্ধে যে কিরূপ ধারণা পোষণ করিতেন তাহা এই সমুদয় উক্তি হইতে বেশ বুঝা যায়। রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রভৃতি হিন্দুনেতৃবৃন্দও যে ঠিক এইরূপ মনোভাব ব্যক্ত করিয়াছেন তাহাও উল্লিখিত হইয়াছে। বর্তমানকালে একদল রাজনীতিক এবং অনেক বিশিষ্ট নেতাও প্রকাশ্যে এইরূপ মনোভাব ব্যক্ত করিয়াছেন যে, ইংরেজ-অধিকারের পূর্বে হিন্দুরা কখনও স্বাধীনতা হারায় নাই। কিন্তু উপরে যাহা বলা হইল নিরপেক্ষভাবে তাহা বিচার করিলে এ-সম্বন্ধে সন্দেহ মাত্র থাকে না যে উনিশ শতকের হিন্দু জনসাধারণ ইহার বিপরীত মতই পোষণ করিত। কোন্ মত সত্য এখানে তাহা বিচারের প্রয়োজন নাই। কিন্তু পূর্বোক্ত আলোচনা হইতে ইহা স্বতঃই প্রমাণিত হইবে যে জাতীয় চেতনা বা স্বাধীনতার প্রেরণা অন্ততঃ বাংলা দেশে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ছিল না। ক্রমে ক্রমে কিরূপে বাংলা দেশে এই উভয়েরই উদ্ভব হইল অতঃপর তাহাই আলোচনা করিব।

রাজা রামমোহন রায় ও তাঁহার সহযোগিগণ ইংরেজশাসনের অনুরক্ত ভক্ত হইলেও ইহার কোন কোন ব্যবস্থার তীব্র প্রতিবাদ করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। ১৮২৩ সনে যখন সংবাদপত্রে স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্ষমতা খর্ব করিবার অভিপ্রায়ে এক নূতন বিধি (Press Ordinance) প্রচলিত হয় তখন রামমোহন রায় ও তাঁহার সহযোগিগণ যে ইহার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন করেন, উনিশ শতকের রাজনীতিক ইতিহাসে তাহা একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। চারি বৎসর পরে বিচারকার্যে হিন্দু ও মুসলমান জুরীদের ক্ষমতা হ্রাস করিয়া যে নূতন আইন (Jury Act) হয় রামমোহন তাহার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেন। ইহা ছাড়াও রামমোহন ইংরেজশাসনের নানাবিধ সংস্কারের দাবি করেনদৃষ্টান্তস্বরূপ, কৃষকের খাজনার উচ্চতম বৃদ্ধির পরিমাণ নির্ধারণ, ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজী ভাষায় বিচারালয়ের কার্য পরিচালনা, জজ ও ম্যাজিষ্ট্রেটের অফিস পৃথককরণ, আইন বিধিবদ্ধকরণ, জুরী ও অ্যাসেসর (assessor) প্রথার প্রবর্তন ইত্যাদির উল্লেখ করা যাইতে পারে।

কিন্তু, এইসব প্রাচীন নেতৃবর্গ ইংরেজশাসনের বিলোপ হোক–কখনও এরূপ মনোভাব পোষণ করেন নাই। হিন্দু কলেজের ছাত্রগণ রাজনীতিক আদর্শের দিক দিয়া আরও একটু অগ্রসর হইয়া কোন কোন বিষয়ে রামমোহনের জীবিতকালেই তাঁহার মতের বিরোধিতা করে। রামমোহনের ধারণা ছিল, ভারতে একদল ইংরেজের স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করিলে এদেশের উন্নতি হইবে। হিন্দু কলেজের একটি সমিতির অধিবেশনে এই বিষয়টি আলোচিত হয় এবং লিখিত প্রবন্ধে একটি ছাত্র ইহার তীব্র প্রতিবাদ করে। এই প্রবন্ধটি ১৮৩০ সনের ১২ই ফেব্রুআরি ইণ্ডিয়া গেজেটে প্রকাশিত হয়। ইহাতে প্রাচীন ও বর্তমান যুগের ইউরোপীয় উপনিবেশের দোষ দেখাইয়া বিদ্রূপ করিয়া বলা হয় যে, অবশ্য সুরাপান ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক আমোদ-প্রমোদের প্রবর্তনের ফলে ঐসব দেশের অসভ্য বর্বর অধিবাসীরা শীঘই পাশ্চাত্ত্য প্রভাবে সভ্য ও সংস্কৃত হইয়া উঠিয়াছিল।৮

হিন্দু কলেজের ছাত্রগণ যে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রভাবে, বিশেষতঃ ডিরোজিওর অনুপ্রেরণায়, ইংরেজশাসনের দোষত্রুটি সম্বন্ধে সচেতন হয়, এমনকি তাহারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিত সে-বিষয়ে কিছু কিছু প্রমাণ আছে। আঠারো শতকের শেষভাগে ফরাসী বিদ্রোহ ও ১৮৩০ সনে ইউরোপের নানা দেশে স্বাধীনতা লাভের জন্য যে-সকল গণ-আন্দোলন হয় হিন্দু কলেজের ছাত্রগণ তাহার সংবাদ রাখিত এবং তাহার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইত। কাশীপ্রসাদ ঘোষ ১৮৩০ সনে এবং তাহার কাছাকাছি সময়ে যে কয়েকটি দেশপ্রেমাত্মক কবিতা ইংরাজিতে লিখিয়াছিলেন বাংলা দেশে তাহাই দেশাত্মবোধের প্রথম সূচনা বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য। কিন্তু ইহা নিছক কবির কল্পনা ও উচ্ছ্বাসমাত্র, তাহা তরুণ ছাত্র-সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কাশীপ্রসাদ নিজেই একটি কবিতায় লিখিয়াছেন যে, তাঁহার জীবিতকালে দেশের স্বাধীনতা-স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হইবার কোন সম্ভাবনাই নাই।

হিন্দু কলেজের ছাত্রগণ পূর্বোক্ত হিন্দুনেতাদের ন্যায় ইংরেজশাসনের সম্পূর্ণ অনুরাগী ছিল না, বরং ইহার দোষত্রুটি সম্বন্ধে অধিকতর সচেতন ছিল এবং পূর্বোল্লিখিত তাহাদের পরিচালিত পত্রিকায় ও প্রকাশ্য সভায় ইহার আলোচনা করিত।

‘হিন্দু পাইওনিয়ার’ (Hindu Pioneer) পত্রিকায় স্বাধীনতা’, ‘বিদেশীর অধীন ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি প্রবন্ধ প্রকাশিত হইত। এই শেষোক্ত প্রবন্ধে ভারতে ইংরেজশাসন সম্বন্ধে যে মন্তব্য করা হইয়াছে তাহার কিয়দংশের মর্ম বাংলায় অনুবাদ করিয়া দিতেছিঃ

“ইংরেজ সরকার এক অভিজাত সম্প্রদায়। আইন প্রণয়নে বিধান পরিষদে এ দেশীয় লোকের কোন স্থান নাই। সরকারী চাকুরীতে ইংরেজের একচেটিয়া অধিকার, বিচার বিভ্রাট, কর্মচারীগণের ঔদ্ধত্য, শাসনকার্যে অত্যধিক ব্যয়, ভারতে ধনরত্ন সঞ্চয় করিয়া ইংরেজদের স্বদেশে প্রস্থান, অতিরিক্ত করভার প্রভৃতি অনিষ্টগুলি এতই সুপরিচিত যে তাহার বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক। মুসলমানদের আমলে রাজারা গুণের আদর করিতেন, কিন্তু প্রাচীন হিন্দুযুগের ন্যায় ইংরেজ আমলে শাসনকর্তারা একটি পৃথক সম্প্রদায়ভুক্ত। বলপ্রয়োগের দ্বারা এদেশে বিদেশী শাসন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং এদেশে জনসাধারণকে সৰ্ব্বপ্রকার শাসনক্ষমতা ও উচ্চ রাজপদের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে। রাজনীতিক বা বাণিজ্যের দ্বারা যেটুকু ইষ্ট হইয়াছে তাহার বিনিময়ে পূর্বোক্ত অনিষ্টগুলির সমর্থন করা যায় না।”১০

হিন্দু কলেজের ছাত্রগণের রাজনীতিক চিন্তা ও আদর্শ যে আরও কতদূর অগ্রসর হইয়াছিল নিম্নে তাহার কয়েকটি নিদর্শন দেওয়া হইল।

হিন্দু কলেজের একজন প্রসিদ্ধ ছাত্র এবং জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকার সম্পাদক রসিককৃষ্ণ মল্লিক (১৮১০-১৮৫৮) কলিকাতার পুলিশ এবং ইংরেজ আমলের বিচারপদ্ধতির তীব্র নিন্দা করিয়া বলেন যে “সুশাসন বলিতে যাহা বোঝা যায় এ দুই বিভাগেই তাহার সম্পূর্ণ অভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক গভর্নমেণ্টেরই প্রাথমিক কর্তব্য পক্ষপাত-শূন্য সুবিচারের ব্যবস্থা করা। যে গভর্নমেন্ট সম্পূর্ণভাবে প্রজার স্বার্থ ও মঙ্গলকে নিজের স্বার্থ ও মঙ্গল বলিয়া মনে করে ইহা কেবল সেই গভর্নমেন্টের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু ভারতবর্ষে এরূপ কোন গভর্নমেন্ট নাই-একদল বণিকেরাই কেবল তাহাদের নিজের লাভের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াই এদেশ শাসন করে।”১১

হিন্দু কলেজের আর-একজন প্রসিদ্ধ ছাত্র দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রচার করেন যে “ভগবান” সকল মানুষকে সমান অধিকার দিয়া জগতে পাঠাইয়াছেন। রাজ্যশাসনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বহুলোকের কল্যাণ, মুষ্টিমেয়ের ইষ্টসাধন নহে। শাসনকর্তা বিদেশী হইলে তাহারা নিজ জাতির স্বার্থই সাধন করেন, এদেশীয় লোকের স্বার্থ সাধনরূপ মহানুভবতা তাহাদের মধ্যে কৃচিৎ প্রত্যক্ষ করা যায়। বিদেশী শাসনই ভারতের দারিদ্র্যের কারণ।”১২

হিন্দু কলেজের ছাত্রদের স্বাধীন ও বলিষ্ঠ মনোবৃত্তির পরিচয়স্বরূপ আর-একটি ঘটনার উল্লেখ করিয়াই এই প্রসঙ্গ শেষ করিব। তাহাদের প্রতিষ্ঠিত “ Society for the Acquistition of General Knowledge” সভার একটি অধিবেশনে (৪ঠা ফেব্রুআরি, ১৮৪৩) দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বাংলা প্রেসিডেন্সীতে ফৌজদারী আদালত ও পুলিশ এই সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। হিন্দু কলেজের আর একটি প্রসিদ্ধ ছাত্র তারাচাঁদ চক্রবর্তী ছিলেন সভাপতি। প্রবন্ধটি যখন প্রায় আধাআধি পড়া হইয়াছে তখন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ রিচার্ডসন সাহেব (D. L. Richardson) বাধা দিয়া বলিলেন যে, এরূপ রাজদ্রোহসূচক প্রবন্ধ তিনি এই কলেজের হলে পাঠ করিতে দিবেন না। সভাপতি তারাচাঁদ ইহার প্রতিবাদে বলিলেন, “কাপ্তেন রিচার্ডসন, আমি যথাবিহিত সম্মান পুরঃসর নিবেদন করিতেছি যে আপনার এই উক্তি ও আচরণ অত্যন্ত অসঙ্গত ও অশোভন এবং আমাদের সভার পক্ষে অসম্মানজনক। আপনি যদি আপনার উক্তি প্রত্যাহার না করেন আমরা ইহা হিন্দু কলেজের কমিটিকে, এবং প্রয়োজন বোধ করিলে, গভর্নমেন্টকে জানাইব। আমরা কমিটির নিকট হইতে এই কক্ষে সভা করিবার অনুমতি আনিয়াছি,আপনার ব্যক্তিগত কোন অনুগ্রহের উপর নির্ভর করি নাই। আপনি এখানে একজন দর্শক ও শ্রোতা মাত্র এবং আমাদের সভার কোন সদস্যকে তাহার স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করিতে বাধা দেওয়ার কোন অধিকার আপনার নাই। আমি আশা করি কাপ্তেন রিচার্ডসন স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই প্রবন্ধের লেখক ও এই সভার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিবেন।”১৩।

পাশ্চাত্য জ্ঞানের প্রভাবে ও হিন্দু কলেজের শিক্ষার ফলে একদল বাঙ্গালী যুবক ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধেই কিরূপ স্বাধীন রাজনীতিক চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিল উপরোক্ত ঘটনাটি তাহার একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন।

ঐ বৎসরই হিন্দু কলেজের ছাত্রগণ টাউনহলে সভা করিয়া বিলাতে কর্তৃপক্ষের নিকট এক আবেদনপত্র প্রেরণ করে। ইহাতে তারাচাঁদ চক্রবর্তীর প্রস্ত বি অনুযায়ী প্রার্থনা করা হইল, শিক্ষিত ভারতীয়েরা যেন উচ্চতর সরকারী চাকুরীতে নিযুক্ত হন। এই উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দ্বারা সিভিল সার্ভিসের কর্মচারী নিয়োগের সপক্ষে অনেক যুক্তি দেখান হইল।

রামমোহন রায় ও তাঁহার সহযোগীবৃন্দ শাসনসংস্কারের যে দাবী তুলিয়াছিলেন হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে কেহ কেহ বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া এ-বিষয়ে তাঁহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া পরবর্তী যুগের নেতৃত্বপদ গ্রহণ করিলেন। Young Bengal’ বা ‘যুব-বাঙ্গালী নামে পরিচিত এই তরুণদল নানাবিধ সংস্কার সাধনের দিকে গভর্নমেন্ট ও জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার ছাড়াও কেবল পুঁথিগত বিদ্যা নহে, হাতে-কলমে অর্থকরী বৃত্তির উপযোগী বিদ্যাশিক্ষা যে গভর্নমেন্টের প্রধান কর্তব্য, দেশে শান্তিরক্ষা করাই যে তাহাদের একমাত্র কাৰ্য্য নহে, সাধারণ লোকের জীবনযাত্রার মান উচ্চতর করাও যে অবশ্যকরণীয়, তারাচাঁদ চক্রবর্তী তাহা প্রচার করেন। অক্ষয়কুমার দত্ত লিখিলেন, শিক্ষার প্রসার ব্যতীত দেশের সামাজিক, রাজনীতিক ও অর্থনীতিক দুর্দশা কখনও দূর হইবে না। এমনকি কয়েক বৎসর পরে (১৮৫৫ সনে) তিনি ১৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত বালকদের বিনাবেতনে বাধ্যতামূলক শিক্ষা দিবার প্রস্তাবও করেন ও সামরিক ব্যয় কমাইয়া ইহার খরচ চালাইবার যুক্তি দেন। তিনি শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের যে প্রণালী নির্দেশ করেন তাহাতে কৃষি, ইঞ্জিনিয়ারিং জাহাজ নির্মাণ ও অন্যান্য নানাবিধ কারিগরী শিক্ষার (Vocational and technical education) ব্যবস্থাও ছিল। কৃষকদের অবস্থার উন্নতির জন্য রসিককৃষ্ণ মল্লিক ও অক্ষয়কুমার দত্ত তীব্র আন্দোলন করেন।১৪

কতকগুলি রাজনীতিক সংস্কার বিষয়ে এদেশে গুরুতর মতভেদ ছিল। রামমোহন রায় প্রস্তাব করিয়াছিলেন যে, ভারত গভর্নমেন্টের পরিবর্তে বিলাতের পার্লিয়ামেন্টই ভারতবর্ষ সম্বন্ধে আইন প্রণয়ন করিবেন। আর এক দলের মত ছিল, আইন প্রণয়নের জন্য ভারতে একটি স্বতন্ত্র বিধানসভা প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে আর-একটি দাবী করা হইল, কয়েকজন ভারতীয় প্রতিনিধিকে বিলাতের পার্লিয়ামেন্টের সদস্য করা হউক। দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রস্তাব করিলেন-বাংলা, বম্বে ও মাদ্রাজ, এই তিন প্রেসিডেন্সী হইতে দুইজন করিয়া প্রতিনিধি পাঠান হউক।

শাসন-সংস্কার সম্বন্ধে উপরোক্ত মতামত, অনুরূপ অন্যান্য উক্তি ও আন্দোলন বিশেষ কোন ফল প্রসব করে নাই, কিন্তু তথাপি পাশ্চাত্ত্যশিক্ষার ফলে উনিশ শতকের দ্বিতীয়পর্বে বাংলা দেশে যে রাজনীতিক চেতনার নবজাগরণ হইয়াছিল ইহার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।

ইহার আরও পরিচয় পাওয়া যায় সংবাদপত্রের মাধ্যমে ও স্থায়ী সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা দ্বারা শিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে রাজনীতিক মতামত ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টায়। বলাবাহুল্য, এই দুইটি উপায় অবলম্বনও পাশ্চাত্ত্য অনুকরণের ফল। সংবাদপত্রের সাধারণ বিবরণ পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দেওয়া হইয়াছে। অনেক সংবাদপত্রে অন্যান্য প্রসঙ্গের সহিত রাজনীতিক বিষয়, বিশেষতঃ ইংরেজ-শাসনের ত্রুটি ও ইহার সংস্কার বিষয়ে আলোচনা থাকিত। কিন্তু প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রধানতঃ রাজনীতিক আন্দোলনের বাহন বা মুখপত্র হিসাবে ‘Reformer’ নামে এক পত্রিকা প্রকাশিত করেন। ইহাই প্রথম ভারতীয় পরিচালিত ইংরেজি সংবাদপত্র। ইহাতে সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, আইন, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হইলেও রাজনীতিক বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হইত। মিশনারী ডাফ’, ‘এই পত্রিকা খানি জনসাধারণের হইলেও ধনে মানে খ্যাতিসম্পন্ন রামমোহন রায়ের অনুগামী বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের মনোভাবের পরিচয় দেয়, এইরূপ মন্তব্য করিয়াছিলেন। ১৮৩৩ সনে ইহার গ্রাহকসংখ্যা ছিল ৪০০। সে-যুগে Bengal Hurkaru-র গ্রাহকসংখ্যা ছিল ৯৩৪-কিন্তু আর-কোন সংবাদপত্রের ৪০০ অপেক্ষা অধিক গ্রাহক ছিল না।

দ্বারকানাথ ঠাকুর এক নূতন পদ্ধতি অবলম্বন করিলেন। নূতন কাগজ বাহির না করিয়া তিনি প্রভাবশালী ইংরেজী পত্রিকার স্বত্বের অনেক অংশ (Share) ক্রয় করিয়া ইহার মাধ্যমে স্বীয় মত ও নীতি প্রচারের ব্যবস্থা করিলেন। তিনি India Gazette কিনিয়া ইহার সহিত প্রথমে Bengal Chronicle ও পরে Bengal Hurkaru যুক্ত করিলেন এবং ইহার মাধ্যমে John Bull নামক পত্রিকায় ভারতীয়দের যে নিন্দা ও কুংসা বাহির হইত তাহার জবাব দিতেন।

অন্যান্য যে-সকল কাগজে রাজনীতিক চর্চার প্রাধান্য ছিল তাহাদের মধ্যে Parthenon (১৮৩০), Bengal Spectator (১৮৪২), এবং Hindu Pioneer বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকার কথা পূর্ব-পরিচ্ছেদেই উল্লেখ করা হইয়াছে। কেবলমাত্র সংবাদপত্র প্রচারের উপর নির্ভর না করিয়া বাঙ্গালী রাজনীতিক আন্দোলনকারীগণ স্থায়ী সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিলেন।

১৮৩৬ সনে বাংলায় সর্বপ্রথম বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ নামে এইরূপ একটি সভার প্রতিষ্ঠা হয়। ইহা প্রায় বিস্মৃতির অতল গর্ভে ডুবিয়া গিয়াছে। কিন্তু ইহার যেটুকু বিবরণ পাওয়া যায় তাহা বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক। এই সভায় প্রথমে ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হইত এবং প্রতি বৃহস্পতিবার ইহার অধিবেশন হইত। জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকার ১৮৩৬ সনের ১৭ ডিসেম্বরের সংখ্যায় পূর্বের বৃহস্পতিবারের সভায় উপস্থিত একজন পত্রপ্রেরক যাহা লিখিয়াছেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“পূৰ্ব্বে এই সভার লোকসংখ্যা যেরূপ ছিল আমি গত বৃহস্পতিবারে দেখিলাম তদপেক্ষা দশগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে।… সভাপতি শ্রীযুক্ত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ পূৰ্ব্ব সপ্তাহে স্থিরীকৃত আলোচনার বিষয় জ্ঞাপন করিলেন- ‘দুঃখ হইতে সুখ জন্মে কি সুখ হইতে দুঃখ উৎপন্ন হয়।

“তাহাতে শ্ৰীযুত বাবু রামলোচন ঘোষ কহিলেন এই প্রশ্নের উত্তরে শেষ অদৃষ্ট পর্যন্ত মানিয়া ধর্ম বিষয়ে বিচার করিতে হইবেক কিন্তু সভার দশম নিয়মে লিখিত আছে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাতে ধৰ্ম্মবিষয়ক বিচার হইবেক না অতএব আমার বোধ হয় এই প্রস্তাব ঘটিত বিচার না করিয়া নীতি এবং রাজকাৰ্য্যাদি সংক্রান্ত বিষয় যাহাতে আমারদিগের ইষ্টানিষ্টের সম্পর্ক আছে তাহা বিবেচনা করিলে দেশের অনেক উপকার হইবেক ইহাতে শ্ৰীযুত বাবু কালীনাথ রায় ও শ্রীযুত বাবু মহেশচন্দ্র সিংহ পোষকতাবিষয় নানা দৃষ্টান্ত দর্শাইয়া যেরূপ বক্তৃতা করিলেন তাহা শ্রবণে সভাময় ধন্যবাদ ধ্বনি উপস্থিত হইল তৎপরে শ্ৰীযুত বাবু কালীনাথ রায় কহিলেন রাজসংক্রান্তাদি বিবিধ বিষয় যাহাতে দেশের অনিষ্ট হইতেছে তর্কদ্বারা স্থিরীকৃত হইলে এই সভায় তাহা নিবারণের চেষ্টা করেন অতএব এমত নিয়ম স্থির করা যায় যে রাজদ্বারে আবেদন বা অন্য উপায় যাহাতে দেশের অনিষ্ট নিবারণ হয় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা মনোযোগপূৰ্ব্বক তাহা করিবেন ইহাতে সকল সভ্য ঐ বাবুকে ধন্যবাদপূৰ্ব্বক স্ব স্ব সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। … পরে শ্ৰীযুত বাবু রামলোচন ঘোষ ইংলণ্ডীয় লোকেরদের সভাতে সভ্যেরা চৌকিতে উপবিষ্ট এবং মধ্যস্থলে টেবিল রাখিয়া থাকেন আর সভ্যেরা গাত্রোত্থান পূর্বক বক্তৃতা করেন তবে এ সভাতে সেরূপ করণের বাধা কি ইহাতে শ্ৰীযুত পূর্ণচন্দ্রোদয় সম্পাদকের সহিত অনেক তর্ক বিতর্কের পর সকল সভ্যেরাই স্থির করিলেন চৌকিতে উপবিষ্ট হইয়া গাত্রোত্থান পূৰ্ব্বক বক্তৃতা করিতে হইবেক।… অনেক বিষয়ে বহু সভ্যের বক্তৃতার পর শ্ৰীযুত বাবু রামলোচন ঘোষ কহিলেন সংপ্রতি শাসনকর্তারা নিষ্কর ভূমির কর স্থাপন আরম্ভ করিয়াছেন অতএব আগামী সভার বিবেচনাৰ্থ এই প্রশ্ন স্থির করা যায় যে রাজকর্তৃক নিষ্কর ভূমির কর গ্রহণ করা উচিত কিনা তাহাতে শ্ৰীযুত বাবু কালীনাথ রায়ের ও সভাপতির পোষকতানুসারে সকল সভ্যই সম্মত হইলেন এবং সভার নিয়মানুসারে চারি ব্যক্তির প্রতি উত্তর লিখনের ভারার্পণ হইল অনন্তর দশ ঘণ্টা রাত্রির পর সভা ভঙ্গ করিলেন।”১৫

এই প্রস্তাবানুযায়ী নিষ্কর ভূমির কর গ্রহণ সম্বন্ধে বহু আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হয়। নদীয়া জিলার প্রধান সদর আমীন পূর্বোক্ত শ্ৰীযুক্ত রায় রামলোচন ঘোষ বাহাদুর গভর্নমেন্টের নীতির সমর্থন করেন এবং তাঁহার যুক্তিতর্ক লিপিবদ্ধ করিয়া বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সম্পাদকের নিকট প্রেরণ করেন। অন্য কেহ কেহ ‘সংবাদপ্রভাকরে’ (এবং সম্ভবতঃ অন্য পত্রিকায়) রামলোচনবাবুর যুক্তির অসারতা প্রতিপাদন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ইহার মধ্যে একটি উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। সমালোচক বলিয়াছেন, রামলোচনবাবু গভর্নমেন্টের চাকরী করেন, সুতরাং অন্যায় জানিয়াও ভয়ে বা অনুগ্রহে লাভের আশায় গভর্নমেন্টের নীতি সমর্থন করিয়াছেন। তবে “ইহাতে আমরা ঘোষজ বাবুকে কদাচ দুষ্য করিত পারি না কেননা প্রতিপালকের বিরুদ্ধ বক্তৃতায় পাপের সম্ভাবনা।”

এইপ্রকার আলোচনার ফলে প্রস্তাব করা হইল যে গভর্নমেন্টের নীতির বিরুদ্ধে চারি-পাঁচ হাজার লোকের স্বাক্ষরিত এক দরখাস্ত রাজদ্বারে পাঠান উচিত কিনা তাহার বিবেচনা করার জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দ্বারা এক সভা আহ্বান করা হউক। এই উদ্দেশ্যে এক অনুষ্ঠানপত্র লিখিত হইল এবং স্থির হইল, কর্তৃপক্ষ “এই অনুষ্ঠান পত্র ছাপিয়া সর্বত্র প্রেরণ করিবেন এবং তাহাতে হিন্দু মোসলমান সাধারণ সকলের নাম স্বাক্ষর হইলে সভার স্থান ও দিন স্থির করিয়া সমাচার পত্রে বিজ্ঞাপন দিবেন।”

এই সভার অধিবেশন হইয়াছিল কিনা এবং হইয়া থাকিলে কী কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করা হইয়াছিল তাহার সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। তবে বিশেষ কিছু হয় নাই বলিয়াই মনে হয়, কারণ ইহার নয়মাস পরে ১৮৩৭ সনের ১৪ অক্টোবর নিম্নলিখিত সংবাদটি প্রকাশিত হয় :

“নূতন সমাজ। কথিত আছে যে দেওয়ান শ্ৰীযুক্ত রামকমল সেন এক নূতন সমাজ স্থাপন করিতে নিশ্চয় করিয়াছেন তাহার অভিপ্রায় যে নিষ্কর ভূম্যধিকারিদিগের পক্ষে এবং রাজকীয় কর্মে বঙ্গভাষা চলন হওন বিষয়ে এক আবেদন পত্র ইংলণ্ড দেশে প্রেরণ করেন।”১৬

উনিশ শতকে যে-প্রণালীতে রাজনীতিক আন্দোলনের জন্য নানা সভা সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়, ১৮৩৭ সনে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ই তাহার পথ প্রদর্শন করে। এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হইয়া এই শ্রেণীর আরও কতকগুলি সভা হয়–কিন্তু কোন সভাই বিশেষ কার্যকরী হয় নাই। এ-সম্বন্ধে ১৮৫২ সনের ২রা মার্চ তারিখে সংবাদ প্রভাকরে’ সভাগুলির ব্যর্থতার আলোচনা করা হইয়াছে। বঙ্গভাষা প্রকাশিকার’ পূর্বোক্ত নিষ্কর ভূমির কর গ্রহণ সম্বন্ধে আন্দোলনের প্রশংসা করিয়া মন্তব্য করা হইয়াছে : “কিন্তু কেবল একতার অভাবে ঐ সভার উচ্ছেদ হইয়াছে। বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার পতন কারণ স্মরণ হইলে আমারদিগের অন্তঃকরণে কেবল আক্ষেপ তরঙ্গ বৃদ্ধি হয়, ঐ সভার পরে মৃত মহাত্মা বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর মহাশয়ের বিশেষ প্রযত্নে ভূম্যধিকারী সভা নামে অপর এক সভা স্থাপিত হয়, মেম্বর মহাশয়েরা যদি (ও) অনেক প্রকার সকর্ম সাধনের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত গভর্নমেন্টের পত্রাদি লেখা চলিয়াছিল, দশ বিঘা পর্যন্ত ব্রহ্মত্র ছাড় দিবার নিয়ম ঐ সভার উদ্যোগেই হইয়াছে, তাছাড়া তাহা স্থায়ী হয় নাই, দ্বারকানাথ বাবুর পতনেই সভার পতন হইয়াছে। বিজ্ঞ সম্পাদক মহাশয় আপনি উদ্যোগী হইয়া ‘দেশ হিতৈষিণী সভা’ নামে এক সভা করিয়াছিলেন ঐ সভায় সমুদয় বাঙ্গালা পত্র সম্পাদকদিগের সংযোগ হইয়াছিল, যোড়াসাঁকোর কমল বসুর বাটীতে যে কয়েকবার তাহার প্রকাশ্য সভা হয়, সেই সকল বারেই সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য লোকেরা আগমন করিয়াছিলেন, নিয়মাদি নির্ধারিত হইয়াছিল, কিন্তু কি আক্ষেপ ঐ সভার দ্বারা এমত কোন কাৰ্য্য হয় নাই যদ্বারা তাহা আমারদিগের স্মরণীয় হইতে পারে, তদন্তর ইয়ং বাঙ্গাল মতাবলম্বিদিগের দ্বারা বাঙ্গাল ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সভা স্থাপিত হয়, মান্যবর মেং জর্জ তামসন সাহেব এখানে আসিয়া ঐ সভায় কয়েক দিবস বক্তৃতা করিয়া মহা ধুমধাম করিয়াছিলেন, বাঙ্গাল স্পেক্টেটর নামে ঐ সভার মতপোষক একখানা পত্র প্রকাশ হইয়াছিল, সাধারণের সাহায্য ও সংযোগ বিরহে তাহাও স্থায়ী হইল না, ইতিপূৰ্বে বাগবাজার নিবাসী মৃত বাবু কাশীনাথ বসু ‘ভূম্যধিকারী সভার’ পুনর্জীবন দানে দৃঢ় সংকল্প করিয়া যে উদ্‌যোগ করিয়াছিলেন তাহার শুভ চিহ্নের মধ্যে বসু বাবু রাজদত্ত আশাষোটা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন অন্য উপকার কিছুই দর্শে নাই, এইরূপ এতদ্দেশীয় লোকেরা রাজকীয় বিষয়ের বিবেচনার জন্য যে কয়েকটা সভার অনুষ্ঠান করিয়াছেন একতা ও যত্নের অভাবে তত্তাবতেরই পতন হইয়াছে, রাজকীয় বিষয়ের চিন্তা করা যদ্যপি এতদ্দেশীয় লোকেরা অতি কর্তব্য বিবেচনা করিতেন এবং তাহার প্রতি তাঁহারদিগের মনোযোগ থাকিত তবে ঐ সকল সভার পতন না হইয়া বরং তাহার স্থায়িত্ব হওয়া সম্ভব হইত।…” ১৭

সংবাদ প্রভাকর’ সমসাময়িক লোকের দৃষ্টিভঙ্গীতে যাহা ব্যর্থ প্রয়াস বলিয়া মনে করিয়াছিল তাহার মধ্যেই যে ভবিষ্যৎ সার্থকতার বীজ নিহিত ছিল–আজ আমরা তাহা অনেকটা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারি। এইসব ব্যর্থতার মধ্যে বাঙ্গালীর রাষ্ট্রচেতনার যে উন্মেষ হইয়াছিল তাহা কালক্রমে সার্থক রাজনীতিক সভা-সমিতির সৃষ্টি করিতে সক্ষম হইয়াছিল। ইহা আলোচনা করিলে রবীন্দ্রনাথের সেই প্রসিদ্ধ সঙ্গীতটির কথা স্মরণ করাইয়া দেয়

“জীবনে যত পূজা হল না সারা,
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।
যে-ফুল না ফুটিতে,
ঝরেছে ধরণীতে
যে-নদী মরুপথে হারালো ধারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।”

‘সংবাদ প্রভাকরে’ যে ‘ভূম্যধিকারি সভা’ ও ‘বাঙ্গাল ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সভা’র কথা উল্লিখিত হইয়াছে ইহাদের সম্বন্ধে আলোচনা করিলেই এই উক্তির যাথার্থ্য প্রমাণিত হইবে।

১. ভূম্যধিকারী সমাজ

ভূম্যধিকারীদের “সমাজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা ও ইহা উচিত কিনা” এই বিষয়ের আলোচনার জন্য রাধাকান্ত দেব, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রভৃতির চেষ্টায় ১৮৩৭ সনে ১২ নভেম্বর হিন্দু কলেজে একটি বৈঠক হয়। ইহার ঔচিত্য ও প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হইলে “এই সমাজের এক পাণ্ডুলেখ্য ও বিধিসকল নিৰ্ব্বন্ধ-করণার্থ ক্ষণেকের নিমিত্ত এক কমিটি স্থাপন করেন অর্থাৎ শ্ৰীযুত রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর এবং শ্ৰীযুত বাবু রামকমল সেন এবং শ্ৰীযুত বাবু ভবানীচরণ মিত্র ও শ্ৰীযুত বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর। এই কমিটি মহাশয়েরদিগকে কেবল এই উপদেশ জ্ঞাপন করা গেল যে সমাজের বিধান প্রস্তুতকরণ সময়ে ইহা স্মরণ করিবেন যে এই সমাজ জাতি কি দেশ কি বর্ণ বিভেদ না করিয়া সৰ্ব্বপ্রকার লোকের নিমিত্ত স্থাপন হইল অতএব তাহার বহির্ভূত কেহই থাকিবেন না এই সমাজের এমত সাধারণ নিয়ম হইবে যে তদ্বারা সর্বপ্রকার ব্যক্তিই তাহাতে প্রবিষ্ট হইতে পারেন। এবং দেশের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি ভূমি সম্পর্কীয় হন তিনি স্বচ্ছন্দে ঐ সমাজের অন্তঃপাতী হইতে পারেন। এই কমিটির কাৰ্য্য সমাপন হইলে পর ঐ সকল বিধির বিবেচনার্থ ও সমাজ স্থাপনার্থ সাধারণ এক বৈঠক হইবে।”১৮

তখনকার দিনেও পরবর্তীকালের ন্যায় ইংরেজীভাষাতেই এই সকল সভায় কাৰ্য্য নির্বাহ হইত। উপরের উদ্ধৃতিতে বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়, ইংরেজী অনুবাদ বাংলায় অপরিচিত ভাব ও সংজ্ঞা প্রকাশের জন্য নূতন নূতন শব্দের চয়ন–অর্থাৎ একটি পরিভাষা গঠন। উপরের উদ্ধৃতিতে যে-কয়টি শব্দ অধধারেখ করা হইয়াছে তাহা নিম্নলিখিত ইংরেজী বাক্যের অনুবাদ বলিয়াই মনে হয়- “A provisional committee was appointed to prepare the draft of a prospectus and a set of rules, regulations and bye-laws”। ইহার সুষ্ঠু বাংলা প্রতিশব্দ আজপর্যন্তও আবিষ্কৃত হয় নাই–যদিও ১৩০ বৎসর যাবৎ এই চেষ্টা চলিতেছে।

১৮৩৮ সনের মার্চ মাসে পূর্বোক্ত প্রস্তাবানুসারে ‘শিষ্টবিশিষ্ট মান্য জমিদারদের এক বৈঠক হয়। উপস্থিত ‘মান্যবরদের মধ্যে শ্রীযুক্ত মুনসী আক্ষির’ নামে একজন মুসলমান এবং তিনজন ইংরেজ-ডিকিন্স, প্রিন্সেপ ও হেয়ার ছিলেন। অবশিষ্ট সকলেই ছিলেন বাঙ্গালী হিন্দু। তাঁহাদের মধ্যে প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুর, সত্যচরণ ঘোষাল, রামকমল সেন প্রভৃতি অনেক সুপরিচিত সম্ভ্রান্ত নাম দেখিতে পাওয়া যায়।

শ্রীযুক্ত রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর এই সভার সভাপতি পদে বৃত হইলেন। তিনি এই নবপ্রতিষ্ঠিত ভূম্যধিকারী সভার উদ্দেশ্য বিবৃত করিয়া বলিলেন, ইংরেজশাসনে “প্রথমতঃ লোক সকল বিলক্ষণ সুখে কালযাপন করিতেন কিন্তু এইক্ষণে নিষ্কর ভূমি বাজেয়াপ্ত করণ বিষয়ে অত্যন্ত ভয় জন্মিয়াছে এবং ভূম্যধিকারীরাও উদ্বিগ্ন আছেন।” আরও যে দুই-একটি সরকারী বিধানে জমিদার ও প্রজাদের অনিষ্ট হইয়াছে তাহার উল্লেখ করিয়া বলিলেন, “অতএব সময় মতে আমাদের এক সমাজ স্থাপন করা উচিত হয়। এইরূপ সমাজের দ্বারা উপকার কেবল কলিকাতার মধ্যে হইবে এমত নহে কিন্তু তাবৎ দেশেরই হইবেক যেহেতুক দেশের নানা জিলার সঙ্গে এই সমাজের লিখন পঠন চলিতে পারিবে। এই সমাজের দ্বারা যাহার যে অনিষ্ট বিষয় অনায়াসে গভর্নমেন্টের নিকট জ্ঞাপন করা যাইতে পারে। এমত উক্ত আছে যে একগাছি তৃণ অঙ্গুলির দ্বারা অনায়াসে ছিন্ন হইতে পারে কিন্তু অনেক তৃণ একত্র করিলে তদ্বারা মত্ত হস্তি বন্ধন করিতে পারা যায়। অতএব প্রজা লোকের ঐক্য বাক্য হওয়া অতি উচিত এবং গভর্নমেন্টের কৰ্ম্ম-কারকদের উপর চৌকি দেওনের নিমিত্ত এবং গভর্নমেন্টের নিকটে আমাদের দরখাস্ত জ্ঞাত করণের নিমিত্ত এমত এক সমাজ স্থাপন করা উপযুক্ত বোধ হয়।”

অতঃপর যথারীতি প্রস্তাব’ ও ‘প্রতিপোষকতার পরে সর্বসম্মতিক্রমে “ভূম্যধিকারী সভা নাম্নী এক সভা” প্রতিষ্ঠিত ও “তাহার নিয়ম সকল নির্ধার্য্য করা হইল। অতঃপর ডিকিন্স সাহেব ‘অতি উত্তম’ বক্তৃতা করিলেন। রামকমল সেন বলিলেন, “এই বৈঠকের তাবৎ ব্যাপার বঙ্গভাষাতে প্রকাশ করিতে আমাদের কল্প আছে”। অতঃপর তাঁহার প্রস্তাবে ও কালীনাথ চৌধুরীর পোষকতায় ১২ জন সদস্য লইয়া একটি কর্মনির্বাহাৰ্থ কমিটি গঠিত হইল। “অপরাহ্র চারি ঘণ্টা সময়ে বৈঠক আরম্ভ হয়”, “আর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময়ে শ্ৰীযুত সভাপতির নিকটে বাধ্যতা স্বীকার পূৰ্ব্বক সভা ভঙ্গ হইল”। বর্তমান সভা-প্রণালীর নিয়মকানুন–এমনকি Vote of Thanks-সকলই অনুসৃত হইল।১৯।

বাংলা দেশের সর্বপ্রথম না হইলেও উল্লেখযোগ্য প্রধান রাজনীতিক “সমাজ” (Political Association) হিসাবে ১৮৩৮ সনে প্রতিষ্ঠিত এই ভূম্যধিকারী সভা বাংলার, তথা, আধুনিক যুগের রাজনীতিক ইতিহাস একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। বর্তমানকালে আমরা যাহাকে “জনসাধারণ’ বলি তাহারা ইহার পশ্চাতে ছিল না। প্রধানত ভূম্যধিকারীর স্বার্থেই ইহার প্রতিষ্ঠা হয়। অবশ্য সমাজের মূল বিধানে বলা হইয়াছে যে “এই সমাজ জাতি কি দেশ কি বর্ণ কিছু বিভেদ না করিয়া সৰ্ব্বপ্রকার লোকের নিমিত্ত স্থাপন হইল অতএব তাহার বহির্ভূত কেহই থাকিবে না এবং দেশের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি ভূমি সম্পর্কীয় হন তিনি স্বচ্ছন্দে ঐ সমাজের অন্তঃপাতী হইতে পারেন। কিন্তু কার্যতঃ ভূমি সম্পর্কীয় অর্থে এখানে জমিদার, প্রজা নহে। সমাজের প্রত্যেক সদস্যকে ৫ টাকা প্রবেশিকা এবং বার্ষিক ২০ টাকা চাঁদা দিতে হইত। সেকালে এই টাকা দিয়া কোন সাধারণ প্রজার সদস্য হইবার সাধ্য বা সম্ভাবনা খুব বেশী ছিল না। সুতরাং এই সমাজ প্রধানতঃ যে জমিদারদের স্বার্থের দিকেই দৃষ্টি রাখিত সে-বিষয় কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই স্বার্থের সহিত সংঘর্ষ না হইলে প্রজাদের ও সাধারণভাবে জনসাধারণের উপকার করাও যে সমাজের আদর্শ ও অভিপ্রায় ছিল এবং তাহা কিয়ৎপরিমাণে সিদ্ধ হইয়াছিল সে বিষয়েও সন্দেহ নাই।

মোটামুটিভাবে এই সমাজের কার্যপদ্ধতি গণতন্ত্র-পদ্ধতিতেই পরিচালিত হইত। প্রতি তিন মাসে অন্ততঃ একবার সদস্যেরা সকলে মিলিত হইতেন। ইহাদের গোপন ভোটে (Ballot) ১২ জন সদস্য কর্মকারী সমিতির সভ্য নির্বাচিত হইতেন। প্রতি বৎসর ইহাদের মধ্যে চারিজন পদত্যাগ করিতেন এবং আবার সকল সদস্যদের গোপন ভোট দ্বারা তাঁহাদের স্থান পূর্ণ করা হইত। প্রত্যেক জিলায় এই সমাজের শাখা প্রতিষ্ঠার জন্যও চেষ্টা করা হইত। মোটের উপর বাংলা দেশে, তথা ভারতে, রাজনীতিক সভা বা সমাজ’ যে-প্রণালীতে গঠিত ও পরিচালিত হইত ভূম্যধিকারী সভা’ তাহার পথপ্রদর্শক ছিল বলিলে কিছুমাত্র অতিরঞ্জন হইবে না।

নবপ্রতিষ্ঠিত সমাজের নাম ছিল প্রথমে Zamindary Association। পরে ইহার নাম হয় Landholders Society। ইহার প্রথম যুগা অবৈতনিক (Honorary) সম্পাদক ছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও Englishman পত্রিকার সম্পাদক William Cold Hurry। বস্তুতঃ রাজনীতিক্ষেত্রে ইংরেজ ও বাঙ্গালীর একযোগে কার্য করা এই সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল-এ-বিষয়েও ইহা পরবর্তীকালের পথপ্রদর্শক।

সে-যুগের বাঙ্গালী নেতারা এই রাজনীতিক সমাজ’ সম্বন্ধে কিরূপ উচ্চধারণা পোষণ করিতেন ১৮৬৮ সনে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের একটি ভাষণের নিম্নলিখিত উক্তি হইতে তাহা কতকটা অনুমান করা যায় : “এই সমাজই সৰ্ব্বপ্রথমে জনসাধারণকে বিধিসঙ্গত উপায়ে (Constitutionally) নিজেদের স্বার্থসংরক্ষণ ও ন্যায্য অধিকারের দাবি করা এবং এ-বিষয়ে প্রকাশ্যে স্বাধীন মত প্রকাশের পথ প্রদর্শন করে। বাহ্যতঃ জমিদারের স্বার্থের দিকেই ইহার দৃষ্টি ছিল, কিন্তু জমিদার ও প্রজাদের স্বার্থ এমনভাবে বিজড়িত যে একের উপকারে অন্যের উপকার, একের অপকারে অন্যের অপকার। সুতরাং এই সমাজের দ্বার পরোক্ষে প্রজাদেরও স্বার্থ রক্ষা হইত।” এই উক্তি সব সত্য বলিয়া মানিয়া না লইলেও ভূম্যধিকারী সমাজের প্রতিষ্ঠাকে এদেশের রাজনীতিক আন্দোলন ও তাহার ফলে যে মুক্তিসংগ্রামের উদ্ভব হয় তাহার অগ্রদূত বলা যাইতে পারে। কারণ এই সমাজ দ্বারা যে শিক্ষিত বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের রাজনীতিক লক্ষ্য ও আদর্শ অনেক প্রগতিশীল হয় সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ইহার সমর্থনে ১৮৩৯ সনের ৩০ নভেম্বর এই সমাজের অধিবেশনে ইংরেজ টার্টন যে বক্তৃতা করেন তাহার এক অংশ উদ্ধৃত করা। যাইতে পারে :

“ভারতীয়েরা ব্রিটিশের অধীনস্থ থাকে ইহা আমার ইচ্ছা নহে; তাহারা যাহাতে ইংরেজের সহিত সমান অধিকার লাভ করিয়া সৰ্ব্বপ্রকারে তাহাদের সমকক্ষ ও সহযোগী হইয়া ইংরেজ রাজ্যের অন্য প্রজার ন্যায় জীবন ধারণ করিতে পারে তাহাই আমার কামনা। প্রাচীন রোম যেমন বিজিত রাজ্যের অধিবাসীদিগকে রোম নগরীর অধিবাসীর সমান অধিকার দিয়া ঐ সমুদয় রাজ্য রোমের অন্তর্ভুক্ত করিয়া এক বিরাট সাম্রাজ্য গঠিত করিয়াছিল, ইংলণ্ডও যাহাতে সেই মহান আদর্শ অনুসরণ করে তাহাই আমার ইচ্ছা।”২০

স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যে Durham Report-এর ভিত্তির উপর ব্রিটিশরাজ্যের অন্তর্গত কানাডা প্রভৃতি উপনিবেশগুলি Dominion Status লাভ করে তাহা এই বক্তৃতার সময়ে প্রকাশিত হয় নাই। সুতরাং টার্টন সাহেবের বক্তৃতা যে দূরদৃষ্টির পরিচায়ক এবং শিক্ষিত ভারতবাসীর মনে যে এই আদর্শ গভীরভাবে অঙ্কিত হইয়াছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। পরবর্তী একশত বৎসর কাল পর্যন্ত ভারতীয় নেতাদের রাজনীতিক দাবি এই Dominion Status ছাড়াইয়া যায় নাই। ভূম্যধিকারী সমাজেই ১৮৩৯ সনে যে এই বাণী প্রচারিত হইয়াছিল তাহা একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।

আর একদিক দিয়াও ভূম্যধিকারী সমাজ’ ভারতের রাজনীতিক আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে। ১৮৩৯ সনে রামমোহন রায়ের বন্ধু মি. অ্যাডাম (Adam) ও জর্জ টমসন (George Thompson) ভারতীয়দের অবস্থার উন্নতির জন্য British India Society প্রতিষ্ঠিত করেন। ইংলণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডের অনেক বড় বড় শহরে ইহার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৪১ সনে অ্যাডাম সাহেবের সম্পাদনায় ‘British India Advocate’ নামে একখানি মাসিক-পত্র প্রকাশিত হয়।

দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ‘ভূম্যধিকারী সমাজের প্রাণস্বরূপ। তাঁহার অনুপ্রেরণায় এই সমাজ বিলাতের British India Societyর সহিত যোগ-স্থাপন করে এবং নিম্নলিখিত বিষয়গুলির প্রতি ইহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে :

১। নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্তকরণের ব্যবস্থা রহিত করা।

২। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ব্রিটিশের ভারতীয় রাজ্যে সর্বত্র প্রচলিত করা।

৩। সর্বসাধারণের সুখ, সুবিধা ও আত্মরক্ষার দিকে দৃষ্টি রাখিয়া, বিচার, পুলিশ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার সাধন করা।

৪। পতিত জমিগুলি সুবিধাজনক শর্তে ইজারা দেওয়া।

এস্থলে বলা আবশ্যক যে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রস্তাবটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস বহুবার, প্রায় প্রতি বাৎসরিক অধিবেশনেই গভর্নমেন্টের নিকট পাঠাইয়াছে। চতুর্থ প্রস্তাবটি সম্প্রতি, ১৩০ বৎসর পরে, স্বাধীন ভারতে বাংলার গভর্নমেন্ট কার্যে পরিণত করার চেষ্টা করিতেছে।

২. বেঙ্গল ব্রিটিশ-ইণ্ডিয়া সোসাইটি (Bengal British India Society)

দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪২ সনে বিলাত গিয়া বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেন। কিন্তু, তিনি ভারতের শাসনসংস্কারের কথা প্রচার করিতে ভুলেন নাই। অনেকটা এই উদ্দেশ্যেই তিনি পূর্বোক্ত জর্জ টমসনকে ভারতে আনিবার ব্যবস্থা করেন। দুইজনেই এক জাহাজে ১৮৪২ সনের ডিসেম্বর মাসে ভারতে পৌঁছেন।

১৮৪৩ সনের ১১ জানুআরি জ্ঞানোপার্জিকা সভা’র মাসিক অধিবেশনে টমসন সাহেব এক সুদীর্ঘ বক্তৃতা করেন। ইহা ছাড়াও তিনি বাংলা দেশে আসিয়া অনেকগুলি বক্তৃতা করেন। সৌভাগ্যের বিষয়, এগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ সমসাময়িক পত্রিকাতে প্রকাশিত হইয়াছিল এবং তাহার অনেকগুলি এখনও দুর্লভ নহে। এই সকল বক্তৃতা হইতে বেশ বুঝা যায় যে, টমসন সাহেব সত্যই ভারতের হিতাকাঙ্ক্ষী ও দরদী বন্ধু ছিলেন। তিনি তাহার বক্তৃতায় বলেন, যাহাতে ব্রিটিশশাসনের সকল ত্রুটি দূর করিয়া ভারতীয় প্রজাদের সুখ, শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি পায় ইহার জন্য সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন, ভারতের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে ইংলণ্ডের লোকের অজ্ঞতা দূর করা। ইংলণ্ডের লোকেই পালিয়ামেন্টের সভ্য নির্বাচন করে এবং ভারতশাসন বিষয়ে পালিয়ামেন্টই সর্বময় কর্তা। ইংলণ্ডের লোকেরা ভারতের কল্যাণ কামনা করে, “কিন্তু তাহারা এদেশের বিশেষ বৃত্তান্ত অবগত না থাকায় এদেশে ইংরেজ শাসনের দোষ শোধনের উপায় করণে অক্ষম।”

“এখানকার গভর্নমেন্ট এদেশের লোকদিগের সুখের নিমিত্ত আবশ্যক নিয়ম করণে অক্ষম অথবা অনিচ্ছুক; অতএব মহাপরাক্রান্ত পার্সিয়ামেন্টের কাৰ্য্য সকল যাঁহাদিগের মতানুসারে নিষ্পন্ন হয় ঐ বিষয়ে তাহাদিগের মনোযোগ আকর্ষণ করিলে মহৎ পরিবর্তন হইতে পারে কেন না রাজকীয় ব্যাপারে তত্রস্থ প্রজাদিগের ক্ষমতা আছে এবং তাহারাই পার্লিয়ামেণ্টের সভ্য নিযুক্ত করেন ইহাতে ঐ পার্লিয়ামেন্টে স্বাধীন ও বুদ্ধিমান একত্রিত বহু প্রজার ন্যায্য প্রার্থনা অধিককাল অগ্রাহ্য করিতে পারেন না।

“আমি ভরসা করি ইংলণ্ডের লোকেরা অধীনস্থ প্রজার সুখ বৃদ্ধি বা উন্নতির নিমিত্ত তাহাদের কর্তব্য বুঝিতে পারিয়া যকালে তদ্রপ ব্যবহার করিবেন সেই সময় অতি শীঘ্রই উপস্থিত হইবে। ইহার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছি। আমি এদেশের প্রাকৃতিক শোভা ও প্রাচীন আশ্চৰ্য্য দ্রব্যাদি দর্শনের জন্য এদেশে আসি নাই। এদেশের বর্তমান অবস্থা এবং বর্তমানে ও ভবিষ্যতে কি উপায়ে ইহার মঙ্গল হইতে পারে তাহা প্রত্যক্ষ জানিবার জন্যই আমি ভারতবর্ষে আসিয়াছি।

“আমরা এতদ্দেশে আগমনের আর এক তাৎপর্য এই, এদেশের যদি কোন দুঃখজনক বিষয় বা নিয়ম থাকে এবং যদি ব্যবস্থাপকদের দ্বারা তন্নিবারণ হইবার সম্ভব হয় তবে এখানকার বুদ্ধিমান লোকেরা যাহাতে স্বয়ং আত্মদুঃখ বর্ণন করেন তদ্বিষয়ে তাঁহাদিগকে উৎসাহ প্রদান করিব। … অতএব আমি আপনাদিগকে ব্যগ্রতা পূৰ্ব্বক কহিতেছি আপনারা স্বদেশের মঙ্গলার্থে বিদ্যাবুদ্ধি প্রকাশ করিয়া স্বয়ং চেষ্টা করুন এবং এদেশের তাবৎ বৃত্তান্ত সঙ্কলন পূৰ্ব্বক শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া প্রথমে এখানকার গভর্নমেন্টের নিকট বিজ্ঞাপন করিয়া পরে ইংলণ্ডের লোকদিগের নিকট প্রেরণ করুন, কিন্তু এ বিষয়ের জন্য সকলে একমত হইয়া এক সভা স্থাপন করা আবশ্যক বোধে আমি কহিতেছি, আপনারা বিবেচনা করুন নানা বিষয়ের অনুসন্ধানার্থে একটা সভা স্থাপন করা কর্তব্য কিনা তাহাতে আপনারা বিবিধ বিষয়ের সন্ধান পাইবেন এবং আপনাদের পরস্পর মিল ও ঐক্য থাকিবেক।”২১

টমসন সাহেব এদেশের রাজনীতিক চেতনা ও প্রয়াস বিষয়ে যাহা বলিয়াছেন উনিশ শতকে আরও কয়েকজন সদাশয় ভারতবন্ধু ইংরেজও তাহার পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন। উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত এদেশের রাজনীতি-আন্দোলনের ধারা তাঁহাদের প্রদর্শিত পথেই প্রবাহিত হইয়াছে। ইহা অপেক্ষা অধিকদূর অগ্রসর হয় নাই।

১৮৪৩ সনের ৬ এপ্রিল তারিখে পুনরায় টমসন কলিকাতায় একটি বক্তৃতায় একটি নূতন রাজনীতিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কল্পনা ব্যক্ত করেন। ইহা কেবল ভূম্যধিকারীর সভা না হইয়া শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সভা হইবে, ইহার উদ্দেশ্য হইবে সর্বশ্রেণীর প্রজার ন্যায্য অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠাদ্বারা তাহাদের অবস্থার উন্নতি সাধন, এই উদ্দেশ্যে প্রজাদের প্রকৃত অবস্থা ও ভারতের শাসনযন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগ সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ ও প্রচার এবং অন্য যে-কোন ন্যায্য ও আইনসঙ্গত পন্থা অবলম্বন করা। টমসনের বক্তৃতার পরে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ইহার সমর্থন করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি কলিকাতার বাহিরে বিচারবিভ্রাট, গভর্নমেন্ট কর্তৃক নানা বিষয় পুনঃপুনঃ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং ১৮৩৩ সনের অনুশাসনসত্ত্বেও উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ না হওয়া প্রভৃতির উল্লেখ করিয়া বলেন, প্রবল জনমতের সৃষ্টি না হইলে ইংরেজশাসনের এইসকল গুরুতর দোষত্রুটির সংশোধনের কোন আশা নাই বলিয়াই এইরূপ জনমত গঠন করাই প্রস্তাবিত নূতন সমাজগঠনের উদ্দেশ্য।

ইহার ফলে ১৮৪৩ সনের ২০ এপ্রিল টমসনের সভাপতিত্বে এক প্রকাশ্য সভায় ‘Bengal British India society’ নামক নূতন এক রাজনীতিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইল। ইহার সভাপতি হইলেন জর্জ টমসন। G.E. Remfrey ও রামগোপাল ঘোষ ইহার সহকারী সভাপতি এবং প্যারীচাঁদ মিত্র সম্পাদক নির্বাচিত হইলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের সহিত সভার কার্য চালাইতেন এবং ভারত-সরকার ও লণ্ডনের British Indian Society–উভয়ের সহিত বহু পত্রালাপ করিতেন। অনেকে মনে করেন যে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগপ্রাপ্ত এবং অন্য কয়েকটি শাসনসংস্কার প্রধানতঃ এই নূতন রাজনীতিক সমাজের চেষ্টারই সুফল। সরকারী কার্যে আরও অধিকসংখ্যক ভারতীয় নিয়োগ এবং আদালতে দেশীয় ভাষার ব্যবহার প্রভৃতি সংস্কারের জন্য সরকারের নিকট আবেদন করা হয়।

প্যারীচাঁদ মিত্র জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য করেন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রায়তগণের দুরবস্থা বাড়িয়াছে, এই মর্মে প্রবন্ধ লেখেন। সম্ভবতঃ এই কারণে রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি Bengal British India Society স্থাপনে কোনপ্রকার সাহায্য করেন নাই এবং ১৮৪৩ হইতে ১৮৫০ সন পর্যন্ত এই সমাজ ও পূর্বে প্রতিষ্ঠিত Landholders Society (ভূম্যধিকারী সমাজ) অনেকটা পরস্পরবিরোধী ছিল। টমসন উভয়ের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।

৩. ব্রিটিশ-ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (British Indian Association)

১৮৫০ সনে ইহার কোনটিই বিশেষ কার্যকরী ছিল না। কিন্তু দুইটি ঘটনায় বাংলার মুমূর্ষ রাজনীতিক আন্দোলন আবার সক্রিয় হইয়া উঠিল। প্রথমটি হইল ১৮৪৯ সালের কালো আইন’।

এযাবৎ ইংরেজজাতীয় কেহ বাংলা দেশে বাস করিলে কলিকাতা সুপ্রীম কোর্ট ভিন্ন অন্য কোন আদালতে তাহার বিচার হইত না। ইহার ফলে ইংরেজরা কোন অবৈধ কার্য করিলেও মফঃস্বলের লোকেরা তাহার প্রতিকার পাইত না, কারণ সে সময়ে কলিকাতায় আসিয়া অভিযোগ করা যেমন ব্যয়সাধ্য তেমনই আয়াসসাধ্য ছিল। অধিকাংশ লোকের পক্ষেই তাহা সম্ভব ছিল না এবং নীরবে অত্যাচার সহ্য করা ভিন্ন তাহাদের গত্যন্তর ছিল না। এই কুব্যবস্থা রহিত করিবার জন্য আইনসদস্য মি. বেথুন (Bethune) ১৮৪৯ সনে চারিটি নূতন আইনের খসড়া (Bill) উপস্থাপিত করেন। কিন্তু ইংরেজগণ এই কালো আইনের’ (Black Act) বিরুদ্ধে এমন তুমুল আন্দোলন আরম্ভ করিল যে গভর্নমেন্ট এই বিলগুলি প্রত্যাহার করিতে বাধ্য হইলেন। শিক্ষিত বাঙ্গালীরা ইহাতে মর্মাহত হইল এবং ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতিক আন্দোলনের মূল্য বুঝিতে পারিল।

দ্বিতীয় ঘটনাটি হইল কোম্পানির নূতন সনদপ্রাপ্তি।

ব্রিটিশ পার্লিয়ামেন্টের যে সনদের বলে ঈষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত শাসন করিতেন তাহার মিয়াদ থাকিত মাত্র বিশ বৎসর। সুতরাং প্রতি বিশ বৎসর অন্তর নূতন সনদ দেওয়া হইত। ১৮৩৩ সনে যখন শেষ সনদ দেওয়া হয় তাহার কিছু পূর্বে রামমোহন রায় বিলাত যান এবং অনেকটা তাঁহারই চেষ্টায় ঐ সনদে ভারতবাসীর সুবিধাজনক কয়েকটি ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং ১৮৫৩ সনে পুনরায় নূতন সনদ দিবার পূর্বে ভারতবাসীর অভাব-অভিযোগগুলি ব্রিটিশ পার্লিয়ামেন্টের নিকট উপস্থিত করিতে পারিলে অনেক সুফল হইবার সম্ভাবনা। তাহা ছাড়া ঐক্যবদ্ধভাবে কোন বিশিষ্ট রাজনীতিক সংস্থার পক্ষ হইতে শাসনসংস্কারের দাবি না করিলে বিশেষ কোন ফল হইবে না, এই চিন্তা বাঙ্গালীর রাজনীতিক উদ্যম পুনরুজ্জীবিত করিল।

ইহার ফলে ১৮৫১ সনের ১৪ সেপ্টেম্বর (মতান্তরে ১৯ সেপ্টেম্বর) National Association বা জাতীয় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইল। ইহার দেড়মাস পরে (২৯ অক্টোবর, ১৮৫১) British Indian Accociation (ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন) প্রতিষ্ঠিত হইল। দুইটিরই সম্পাদক ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথমটির সম্বন্ধে আর বিশেষ কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। কিন্তু দ্বিতীয়টি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। এখন পর্যন্ত তাহা অন্ততঃ নামে মাত্র হইলেও, টিকিয়া আছে। সুতরাং মনে হয়, এই দুইটি একই ‘সমাজ’, কেবল নামের পরিবর্তন হইয়াছিল মাত্র। অনেকের মতে ‘জাতীয়’ এই শব্দটি প্রাচীনপন্থী জমিদারেরা পছন্দ করিতেন না, কারণ ইহাতে ইংরেজশাসন হইতে মুক্তিলাভ করিবার ইঙ্গিত আছে, বিশেষতঃ এই সমাজের প্রতিষ্ঠাপত্রে ‘রাজভক্তিসূচক’ কোন কথার উল্লেখ ছিল না। দ্বিতীয় ‘সমাজের উদ্দেশ্যসূচক পত্রে বিধিসঙ্গতভাবে ইংরেজশাসনের সংস্কারের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। আর-একটি প্রভেদও লক্ষ্য করিবার বিষয়। প্রথমটিতে এবং ইহার পূর্বে, এই জাতীয় সভায় বা সমাজে ইংরেজ-সভ্য ছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয়টিতে কোন ইংরেজই যোগদান করেন নাই। পূর্বোক্ত ‘জাতীয় সমাজ এবং দ্বিতীয়টির প্রতিষ্ঠা সম্ভবতঃ ‘কালো আন্দোলনে ইংরেজ ও ভারতীয়দের বিরোধিতার ফল। মনে হয় এই কারণেই পূর্বোক্ত ভূম্যধিকারী সমাজ’ ও Bengal British India Society-ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উপযোগিতা উপলব্ধি করিয়া ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সহিত যুক্ত হয়। অন্ততঃ তাহাদের পৃথক অস্তিত্বের আর কোন বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না।

ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম উদ্বোধনী সভায় ইহার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হয় যে, ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সনদ-দান সম্বন্ধে বিলাতের পার্লিয়ামেন্টের বিচারবিতর্কের সময় যাহাতে ভারতের শাসনসংস্কার হয় এবং লোকের সুখ সমৃদ্ধির বৃদ্ধি হয় সে-সম্বন্ধে আবেদন করা, এবং এই উদ্দেশ্যে ভারত ও ইংরেজ গভর্নমেন্টের নিকট মাঝে মাঝে আবেদনপত্র প্রেরণ করা। ইহার প্রধান কর্মকারক ছিলেন : সভাপতি-রাজা রাধাকান্ত দেব; সহকারী সভাপতি-রাজা কালীকৃষ্ণ দেব (শোভাবাজার); সম্পাদক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর; সহকারী সম্পাদক- দিগম্বর মিত্র। কার্যকরী সমিতির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, ভূকৈলাসের রাজা সত্যচরণ ঘোষাল, উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ মুখার্জী, রামগোপাল ঘোষ, হরিমোহন সেন প্রভৃতি।

রাধাকান্ত দেব তাঁহার মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই সভার সভাপতি ছিলেন, পরে ১৮৬৭ সনে প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং তাঁহার মৃত্যুর পর দ্বারকানাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রমানাথ ঠাকুর সভাপতি হন (১৮৬৯-১৮৭৯)। দেবেন্দ্রনাথের পরে পাইকপাড়ার ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদক ছিলেন। প্রসিদ্ধ কৃষ্ণদাস পাল প্রথমে সহকারী সম্পাদক, পরে ১৮৭৯ হইতে ১৮৮৪ সন পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন। তাঁহার কার্যকারিতায় এই অ্যাসোসিয়েশন বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ করে। হরিশ্চন্দ্র মুখার্জীও ইহার সহিত সংসৃষ্ট ছিলেন এবং তাঁহার সম্পাদিত Hindu Patriot পত্রিকা ইহার মুখপত্ররূপে পরিগণিত হইত। এই অ্যাসোসিয়েশনের অনুরোধে ও অনুপ্রেরণায় মাদ্রাজ ও বম্বেতে অনুরূপ ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। মাদ্রাজের প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে কলিকাতার ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের শাখারূপেই কল্পিত হইয়াছিল, পরে স্বতন্ত্র হয়।

১৮৫২ সনে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বিলাতে পার্লিয়ামেন্টের নিকট ভারতের নানাবিধ শাসনসংস্কারের প্রস্তাবসম্বলিত এক সুদীর্ঘ আবেদনপত্র প্রেরণ করে। ভারতের রাজনীতিক আন্দোলনের ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ইহা একখানি অমূল্য দলিলপত্র বলিয়া বিবেচিত হইবার যোগ্য। কারণ উনিশ শতকের মধ্যভাগেসিপাহী-বিদ্রোহ অথবা ভারতের প্রথম মুক্তিসংগ্রামের ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠার পাঁচ বৎসর আগে বা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনের ৩৩ বৎসর পূর্বে বাংলার রাজনীতিক চেতনা কতদূর প্রবুদ্ধ হইয়াছিল এবং পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকাল পর্যন্ত ভারতের রাজনীতিক চিন্তার উপর তাহা কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল-এই আবেদনপত্রখানিতে তাহার স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। এ স্থলে ইহাও স্মরণ রাখা কর্তব্য যে ভারতের ব্রিটিশশাসিত বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে একযোগে রাজনীতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা এবং ইহা

কার্যে পরিণত করিবার উদ্দেশ্যে ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ এই নাম গ্রহণ এবং মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রদেশের সহিত এ-বিষয়ে সহযোগিতা-স্থাপন যে উন্নত রাজনীতিক মনোবৃত্তির পরিচয় দেয় ইহার পূর্বে ভারতে তাহার কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। এইজন্য এই আবেদনপত্রে যে-সকল শাসনসংস্কারের দাবি করা হইয়াছিল বিভিন্ন দফায় তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি। বলা বাহুল্য, আবেদনপত্রখানি এত সুদীর্ঘ যে মূল পত্রখানি উদ্ধৃত করা সম্ভব নহে এবং তাহা পাঠ না করিলে এ-সম্বন্ধে পর্যাপ্ত ও যথার্থ ধারণা করা যাইবে না।২২

ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং অন্যান্য ভারতীয়গণের পক্ষ হইতে ১৮৫২ সনে এই মর্মে বিলাতে পার্সিয়ামেন্টে আবেদন করা হয় যে, ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতশাসনের জন্য নূতন সনদ দিবার পূর্বে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি যেন বিবেচনা করা হয়।

১। যাহাদের হাতে শাসনের দায়িত্ব তাহাদের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকিলে প্রজার স্বার্থের হানি হয়, সুতরাং এই দুইটি পৃথক করা দরকার। আইন প্রণয়নের জন্য যে পৃথক বিধান পরিষদ গঠিত হইবে তাহার মধ্যে জনসাধারণের প্রতিনিধি রাখা আবশ্যক, যাহাতে ইহা লোকের দুঃখ, অভাব, অভিযোগ প্রভৃতি বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা জানিতে পারে।

বর্তমানে আইনপ্রণয়ন, করনির্ধারণ প্রভৃতি ব্যাপারে লোকের কোন মতামত নেওয়া হয় না এবং তাহাদের অভিযোগ, প্রতিবাদ প্রভৃতিতে কর্ণপাত করা হয় না। সুতরাং ব্রিটিশ সম্রাটের অন্যান্য উপনিবেশগুলিতে আইনপ্রণয়নের জন্য যেরূপ বিধান পরিষদ (legislature) আছে ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষেও সেইরূপ পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। অতএব আবেদনকারীরা প্রস্তাব করিতেছে যে ১৭ জন সদস্য লইয়া কলিকাতায় এরূপ একটি বিধান পরিষদ গঠিত হউক। বাংলা, বম্বে, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ হইতে তিনজন করিয়া ভারতীয় নির্বাচিত হইবেন এবং প্রতি গভর্নর একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী মনোনীত করিবেন। ব্রিটিশরাজ একজন আইনজ্ঞ তোক মনোনীত করিবেন। তিনিই বিধান পরিষদের সভাপতি হইবেন। যাহাতে সদস্যেরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করিতে পারে তাঁহার জন্য এরূপ নিয়ম থাকিবে যে, প্রতি সদস্য পাঁচবৎসরের জন্য নিযুক্ত হইবেন, নিয়মিত বেতন পাইবেন, অন্য কোন চাকুরী করিতে পারিবেন না, এবং এই পাঁচবৎসরের মধ্যে ব্রিটিশরাজাও তাহাদিগকে পদচ্যুত করিতে পারিবেন না। তবে কোন সদস্য অপরাধ করিলে ফৌজদারী আদালতে তাহার বিচার হইতে পারিবে। এই পরিষদের অধিবেশন ও আলোচনা প্রকাশ্যভাবে হইবে। বর্তমানে সপারিষদ বড়লাটের হাতে আইনপ্রণয়নের যে ক্ষমতা আছে এই পরিষদেরও তাহা থাকিবে–তবে তাহাদের প্রণীত আইনগুলি সপারিষদ বড়লাটের অনুমোদন-সাপেক্ষ হইবে। তাহারা অনুমোদন না করিলে পরিষদ ইচ্ছা করিলে ব্রিটিশ পার্লিয়ামেন্টের নিকট আপীল করিতে পারিবে। যতদিন পর্যন্ত ভারতীয়েরা নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করিতে অক্ষম বলিয়া বিবেচিত হইবে, ততদিন পর্যন্ত গভর্নমেন্ট এই বিধান পরিষদের সদস্যদিগকে মনোনীত করিবে। তবে কোন মনোনীত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে জনসাধারণ আপত্তি করিতে পারিবে এরূপ লিখিত নিয়ম থাকিবে।

এই বিধানসভা যে-সকল আইন প্রণয়ন করিবে ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরেরা তাহা নাকচ করিতে পারিবেন না। সে-ক্ষমতা কেবল ব্রিটিশ পালিয়ামেন্টের হাতে থাকিবে। কিন্তু পার্লিয়ামেণ্ট এইরূপ নাকচ করিবার বা ভারত-সম্বন্ধে নূতন আইন প্রণয়ন করিতে হইলে এক বৎসর পূর্বে ইহার বিজ্ঞপ্তি দিবেন যাহাতে ভারতীয় বিধানসভা ও ভারতের অধিবাসীরা এ-বিষয়ে মতামত ব্যক্তি করিবার সুযোগ পায়।

২। অর্থের অভাবের অজুহাতে অনেক প্রয়োজনীয় সংস্কার স্থগিত রাখা হইয়াছে। বড়লাট, তাঁহার পরিষদের সদস্য, এবং ছোটলাটদের বেতন ও ভ্রমণ প্রভৃতির জন্য যে টাকা ব্যয় হয় তাহা বহুলাংশে কমাইলেও শাসনকার্যের কোন অবনতি হইবার সম্ভাবনা নাই। দেশীয় রাজ্যগুলির রেসিডেন্টদের (Resident) জন্য অযথা বহু খরচ হয়। এই ব্যয় কমাইলে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য অর্থ পাওয়া যাইবে।

বর্তমানে বড় ইংরেজ কর্মচারীর সংখ্যা অত্যধিক, দেশীয় কর্মচারীরা অতিশয় কম বেতন পান। প্রথমটি কমাইয়া দ্বিতীয়টির বৃদ্ধি করাই সঙ্গত। দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে, উচ্চ ইংরেজ কর্মচারীরা মাসিক পাঁচ হইতে আট হাজার টাকা বেতন পান, আর গরীব ভারতীয় কেরানীরা পায় ত্রিশ টাকা।

৩। যে ব্যক্তি ম্যাজিষ্ট্রেটরূপে পুলিশের কার্য তদন্ত করেন তাঁহারই হাতে ফৌজদারী মামলার বিচারভার থাকায় বিচারবিভ্রাট হয়। সুতরাং এই ব্যবস্থা রহিত করা আবশ্যক।

৪। লবণ নিত্যব্যবহার্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য। ইহার ব্যবসায়ে গভর্নমেন্টের একচেটিয়া অধিকার থাকায় লোকের নানারূপ ক্ষতি হয় এবং লবণের দর অযথা বৃদ্ধি পায়। ইহার ফলে বিলাতী লবণের আমদানি বাড়িতেছে। লোনা জলের নিকটবর্তী জমি চাষের অযোগ্য অথচ প্রজারা লবণ তৈরী করিলে তাহাদের গুরুতর অর্থদণ্ড দিতে হয়।

৫। রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য আবকারি দোকানের লাইসেন্স দেওয়ার ফলে মাদকদ্রব্য ব্যবহারের প্রসার হয়। ইহা দুর্নীতির পরিপোষক। মোকদ্দমা করিতে হইলে ষ্ট্যাম্প কিনিতে হয়। দরিদ্রের পক্ষে বিচারের জন্য আদালতের আশ্রয়লাভে ইহা যথেষ্ট বাধা সৃষ্টি করে।

৬। ভারতে ইংরেজের সংখ্যা খুবই কম–হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশি। সুতরাং সাধারণ রাজস্ব হইতে খ্রীষ্টধর্মের গির্জা, বিশপ ও অন্যান্য পাদ্রীদের ব্যয় বহন করা অসঙ্গত। ইহা রহিত করা হউক। এককথায় Secular State হউক, অর্থাৎ গভর্নমেন্ট কোন ধর্মকেই আর্থিক সাহায্য করিবে না।

উপরোক্ত বিষয়গুলি ছাড়াও আবেদনপত্রে আরও বহু প্রয়োজনীয় শাসনসংস্কার সাধনের জন্য প্রার্থনা করা হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য : রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস; ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিসাধন; দেশের উৎপাদন-শক্তি বৃদ্ধির জন্য নানারূপ সরকারী প্রচেষ্টা; বিচার-বিভাগে উপযুক্ত লোকের নিয়োগ; ধনপ্রাণ রক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিমাণে যোগ্য ব্যক্তি পুলিশ-বিভাগে গ্রহণ; শিক্ষার বিস্তার; অন্যান্য সভ্য দেশে জনসাধারণের যে-সকল আইনগত অধিকার আছে। তাহার প্রবর্তন।

এই আবেদনপত্রে ৫,৯০০ লোকের স্বাক্ষর ছিল। ১৮৫৩ সনের এপ্রিল মাসে ইহা বিলাতের পার্টিয়ামেন্টে দাখিল করা হয়।

বোম্বে ও মাদ্রাজ হইতেও ভিন্ন ভিন্ন আবেদনপত্র পাঠান হইয়াছিল। এই আবেদনপত্রের জন্য ফল বিশেষ কিছু হয় নাই, তবে এগুলি একেবারে নিষ্ফল হইয়াছিল এরূপ মনে করিবারও কারণ নাই। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকটি দাবি বা প্রার্থনা আংশিকভাবে ১৮৫৩ সনের নূতন সনদে গৃহীত হইয়াছিল। ইহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতেছি :

(১) প্রার্থনা ছিল যে প্রতি ২০ বৎসরের পর না হইয়া প্রতি ১০ বৎসর অন্তর ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সনদ পরিবর্তন হউক।

ফল–এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন সময়ের উল্লেখ করা হইল না।

(২) বড়লাট পরিষদ হইতে স্বতন্ত্র বিধানসভার প্রার্থনা মঞ্জুর হইল, কিন্তু ইহাতে ভারতীয় সভ্য থাকিবে এরূপ কোন নির্দেশ ছিল না।

(৩) প্রার্থনা ছিল যে, বাংলার জন্য একজন স্বতন্ত্র গভর্নর করা হউক (এতদিন পর্যন্ত বড়লাটই ইহার শাসনকর্তা ছিলেন)। নূতন সনদে বাংলার জন্য একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগের ব্যবস্থা হইল।

(৪) সুপ্রীম কোর্ট ও সদর দেওয়ানী আদালত একত্র করার প্রার্থনা মোটামুটি গৃহীত হইল।

বিফলমনোরথ হইলেও অ্যাসোসিয়েশন তাহাদের প্রস্তাবিত এবং অন্যান্য নানাবিধ সংস্কার, বিশেষতঃ নূতন বিধানসভায় ভারতীয় সদস্যনিয়োগ সম্বন্ধে পুনঃ পুনঃ আবেদন করিতে বিরত হইল না। বিলাতে এই আন্দোলন চালাইবার জন্য তাহারা এজেন্ট নিয়োগ করিল। প্রথম তিন বৎসরে এই বাবদ বিশ হাজার টাকা ব্যয় হইয়াছিল।

ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রধানতঃ শিক্ষিত অভিজাত হিন্দুসম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র ছিল। গভর্নমেন্ট ইহাকে যথেষ্ট মর্যাদা দিত। অন্ততঃ কিছুকাল পর্যন্ত, যদিও জমিদারশ্রেণীর প্রভাব খুব বেশী ছিল, তথাপি জমিদারদের বিশেষ স্বার্থ ছাড়া সাধারণভাবে রাজনৈতিক সংস্কার দ্বারা জনসাধারণের সর্ববিধ উন্নতিসাধন, এবং তাহাদের রাজনীতিক চেতনা ও শাসন ব্যাপারে ক্ষমতাবৃদ্ধির দিকে সর্বদাই ইহার লক্ষ্য ছিল। এতদসত্ত্বেও দুই শ্রেণীর বাঙালী ইহার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না।

প্রথমতঃ, একদল শিক্ষিত বাঙ্গালী মনে করিত, নিম্নবিত্ত ও কৃষক সম্প্রদায় সংখ্যায় দেশের শতকরা নব্বইজন হইলেও তাহাদের এই সভায় কোন স্থান ছিল না এবং তাহাদের প্রকৃত স্বার্থ সম্বন্ধে ইহা যথেষ্ট সচেতন ও সক্রিয় ছিল না। এই মনোবৃত্তির ফলেই ক্রমে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে আরও নূতন নূতন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়। এ-বিষয় পরে আলোচনা করা হইবে।

দ্বিতীয়তঃ, মুসলমান-সম্প্রদায় ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনকে তাহাদের প্রতিনিধি বলিয়া স্বীকার করিত না। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে রাজনীতিক ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে দিবার প্রস্তাবেই সর্বপ্রথম হিন্দু-মুসলমান সমস্যা দেখা দেয়। উক্ত অ্যাসোসিয়েশনের প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র বিধানসভা সম্বন্ধে ১৮৫২ সনে পার্লিয়ামেন্টে সাক্ষ্যদানকালে মি. হালিডে বলেন যে এরূপ বিধান পরিষদের সদস্য হইবার উপযুক্ত ভারতীয় আছেন, কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রভেদ এত গুরুতর যে, কোন ব্যক্তিকেই সমগ্র ভারতের প্রতিনিধি বলিয়া গ্রহণ করা কঠিন। লর্ড এলেনবরা এই মন্তব্য অনুমোদন করিয়া প্রস্তাব করেন যে আইন প্রণয়নের জন্য হিন্দু ও মুসলমানের দুইটি পৃথক পরামর্শ সমিতি গঠন করা হউক। প্যারীচাঁদ মিত্র ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলেন, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ধর্ম ও সমাজের ব্যাপারে গুরুতর প্রভেদ থাকিলেও যে-সকল শাসনসংক্রান্ত নীতি আইন-পরিষদে আলোচিত হইবে তাহাতে হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনই তফাৎ নাই। কিন্তু হ্যাঁলিডের মত যে কেবল মুষ্টিমেয় ইংরেজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাহা নহে, এদেশের মুসলমান-সম্প্রদায়ও ইহা বিশ্বাস করিত। ইহার ফলেই পৃথকভাবে কেবল মুসলমানদের জন্য কলিকাতার মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন (Muhammadan Association of Calcutta) প্রতিষ্ঠিত হইল। আরও বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ১৮৫৬ সনের ৩১ জানুয়ারী এক প্রস্তাবে এই মুসলমান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে আনন্দ প্রকাশ করিল, এবং কিছুদিন পরে ইহার সহযোগিতার জন্যও ধন্যবাদ দিল। প্যারীচাঁদ মিত্র যাহাই বলুন, বাংলার সর্বপ্রধান রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান পরোক্ষভাবে প্রকাশ্যে স্বীকার করিল যে রাজনীতি-সংক্রান্ত ব্যাপারেও হিন্দু-মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের স্বার্থ, আদর্শ, ও উদ্দেশ্য অভিন্ন নহে। ইহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছুই নাই। কারণ উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলার সাময়িকপত্র হিন্দু মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য ও মধ্যযুগের মুসলমান-শাসনের বিরুদ্ধে একটি কঠোর মনোভাবের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। বিংশ শতকে হিন্দুনেতাগণ গদ্গদ ভাষায়। আবহমান কাল হইতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে ভ্রাতৃভাব পরিকল্পিত করিয়া উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিতেন তাহা যে কতবড় মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত, উনিশ শতকের বাংলার সাহিত্য ও ইতিহাস তাহার সাক্ষ্য দেয়। এ-সম্বন্ধে পূর্বে বিস্তৃত আলোচনা করা হইয়াছে, পরেও হইবে।

(খ) দ্বিতীয় পর্ব (১৮৫৮-১৯০৫)

১. জাতীয়তাভাবের বিকাশ

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যে জাতীয়তাভাবের উন্মেষের পরিচয় পাওয়া যায়, শেষার্ধে তাহা প্রায় পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। এই জাতীয়তাভাব ও রাজনীতিক আন্দোলন অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্বন্ধ। একের বৃদ্ধিতে অপরের গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। সুতরাং প্রথমে এই জাতীয়তাভাবের বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করিব।

জাতীয়তাভাবের বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ কী তাহা পূর্বে আলোচিত হইয়াছে। কতকগুলি কারণে ধীরে ধীরে উনিশ শতকের শেষার্ধে ইহার স্ফুরণ হইতে থাকে। ইহার মধ্যে ইংরেজীশিক্ষার প্রসার, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, পোষ্টঅফিস প্রভৃতির দ্বারা এই বিশাল উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে গমনাগমন ও পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপনের সুবিধা সর্বপ্রধান বলা যাইতে পারে। ইহার ফলে বহু প্রদেশের মধ্যে বিভিন্ন ভাষার দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান দূর হইয়া পরস্পরের মধ্যে স্বচ্ছন্দে মনোভাব ব্যক্ত করা সম্ভবপর হয় এবং প্রত্যক্ষভাবে সাক্ষাৎ ও আলাপ করার সুযোগ-সুবিধা হয়। এইরূপে ভারতবাসীর মধ্যে যে ঐক্যের ভাব, এতদিন যাহা কেবলমাত্র একটি ভাবগত আদর্শমাত্র ছিল, বাস্তব জীবনে তাহা রূপায়িত হইতে থাকে। একই ইংরেজশাসনের অধীনে থাকায় ও তাহার সর্বপ্রকার সুবিধা, অসুবিধা ও সুখদুঃখের তুল্য অংশীদার হওয়ায় এই ঐক্যের ভাব আরও বৃদ্ধি পায়।

আরও একটি বিশেষ কারণে হিন্দু ও মুসলমান, এই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই জাতীয়তা ও ঐক্যের ভাব জাগিয়া ওঠে। অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকেও মুসলমানেরা ভারতবর্ষের অধিকাংশ ভাগের উপর আধিপত্য করিত, হিন্দুরা তাহাদের অধীন ছিল। এই ঐতিহাসিক স্মৃতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে কিরূপ ঐক্য, জাতীয়তা ও স্বাধীনতালাভের প্রেরণা জোগাইয়াছিল, ওয়াহাবী আন্দোলনে তাহার প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। উনিশ শতকের প্রথমভাগে মারাঠা ছাড়া অন্য কোন হিন্দুর মনে এইরূপ কোন ঐতিহাসিক স্মৃতি ছিল না। বাংলা হইতে রাজস্থান পর্যন্ত প্রায় সমগ্র উত্তরভারতবর্ষে মারাঠারা হিন্দুর উপর যে অত্যাচার করিয়াছিল তাহার নির্মম স্মৃতি হিন্দুস্থানে মারাঠার গর্বে গর্ব করিবার পক্ষে বিষম অন্তরায় ছিল। কিন্তু উনিশ শতকের শেষার্ধে, প্রধানতঃ ইউরোপীয়দের চেষ্টায়, মুসলমান-আক্রমণের পূর্বে হিন্দুদের যে গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল তাহার লুপ্তস্মৃতি পুনরায় জাগরূক হয়। বিপুল সংস্কৃতসাহিত্যের আলোচনার ফলে ম্যাক্সমুলার প্রভৃতি ইউরোপীয় মনীষিগণ প্রাচীন হিন্দুর সহিত ইতিহাসপ্রসিদ্ধ প্রাচীন গ্রীক ও রোমক এবং বর্তমানকালের ইউরোপের ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান প্রভৃতি জাতির জ্ঞাতিত্ব সম্বন্ধ উদ্ঘাটিত করিয়া জগতের এই সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মনুষ্যগোষ্ঠীর মধ্যে হিন্দুর বেদ যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সাহিত্য, এবং উপনিষদ প্রভৃতির মধ্যদিয়া প্রাচীন হিন্দু যে একদিন মানবজাতির শিক্ষাগুরুর পদে অধিষ্ঠিত ছিল, এই সত্য প্রচার করেন। তাহার ফলে আসমুদ্রহিমাচল এই বিশাল দেশের কোটি কোটি হিন্দুর মধ্যে প্রাচীন গৌরবসূত্রের অচ্ছেদ্য বন্ধন স্থাপিত হয় ও তাহা সমগ্র হিন্দুজাতির ঐক্য ও জাতীয় ভাবের দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। ২২০০ বৎসর পূর্বে মৌর্যসম্রাট অশোক প্রায় সমগ্র ভারত ও হিন্দুকুশ পর্যন্ত ভূভাগ শাসন করিতেন, এই তথ্য বহুসংখ্যক শিলাস্তম্ভ ও পর্বতগাত্রে উত্তীর্ণ লিপিদ্বারা লোকচক্ষুর সম্মুখে প্রকটিত হয় এবং তাহারই ফলে সেই সুদূর প্রাচীনকালে যে এক ভাষা, এক লিপি, এক ধর্ম ও এক রাজ্যশাসন সমগ্র ভারতে প্রচলিত ছিল, এই সত্যও প্রমাণিত হয়। প্রত্নানুসন্ধানের ফলে ভূগর্ভ হইতে অপরূপ শিল্পকলার নিদর্শনস্বরূপ মন্দির, দেবমূর্তি, স্তম্ভ, ভাস্কর্য প্রভৃতির আবিষ্কারে হিন্দুদের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি মহামহিমময় চিত্র জগতের সম্মুখে প্রতিভাত হয়, হিন্দুর অতীত ঐশ্বর্য ও গৌরবও সমগ্র জগতে স্বীকৃতি লাভ করে। ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য ও জাতীয়তার ভাবও এইজন্য বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে এই জাতীয়তাভাবের পরিচয় পাওয়া যায় সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরেই। এই কালগত সম্বন্ধ ছাড়া এই দুইটির মধ্যে যে ভাবগত কোন সম্বন্ধ ছিল এরূপ মনে করিবার কোন সঙ্গত কারণ নাই। এই প্রসঙ্গে বলা যাইতে পারে, যে রাজনারায়ণ বসু বাংলায় প্রথম প্রকাশ্যে এই জাতীয়তার ভাব প্রচার করেন, তিনি সিপাহীদের বিদ্রোহ সম্বন্ধে বিদ্বেষভাবই পোষণ করিতেন। পূর্বেই আমরা ইহা আলোচনা করিয়াছি।

১৮৬৬ সনে রাজনারায়ণ বসু “Society for the Promotion of National Feeling among the Educated Natives of Bengal” (77891013 ota 3 স্বদেশানুরাগ-সঞ্চারিণী সভা)২২-এই নামে একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করিয়া একখানি ক্ষুদ্র ইংরেজী অনুষ্ঠান-পত্র প্রচার করেন। সে-যুগের বাঙ্গালীর মনে ইহা কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, ১৮৭৬ সনে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘স্বদেশানুরাগ’ নামক একটি প্রবন্ধ হইতে তাহার কতকটা ধারণা করা যায়। ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

ইংরেজীশিক্ষার ফলে স্বদেশানুরাগ কিরূপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতেছে সে-সম্বন্ধে প্রবন্ধকার লেখেন :

“প্রথমে যখন ইংরাজী শিক্ষা এতদ্দেশে প্রবর্তিত হয় তখন ইংরাজীতে কৃতবিদ্যাব্যক্তিরা হিন্দুধর্ম ও হিন্দু আচার ব্যবহারের প্রতি বিলক্ষণ বিদ্বেষ করিতেন। কিন্তু হিন্দুধর্ম ও হিন্দু আচার ব্যবহার সকলই অপকৃষ্ট নহে ইহা এখনকার ইংরাজীতে কৃতবিদ্যা লোকেরা ক্রমে অনুভব করিতেন। এক্ষণে ভারতের প্রাচীন মহিমা এবং হিন্দু ধর্মের ও হিন্দু আচার ব্যবহারের প্রশংসাসূচক বক্তৃতা হইলে তাহারা উৎসাহে উন্মত্ত হইয়া উঠেন। এক্ষণকার লোকে প্রতীতি করিতে সমর্থ হইয়াছে যে, হিন্দুশাস্ত্রে ঈশ্বর বিষয়েও এমত সকল ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায় যাহা অন্য কোন জাতির ধর্মপুস্তকে পাওয়া যায় না, এবং এমন সকল সুরীতি হিন্দুদিগের মধ্যে প্রচলিত আছে যাহা অন্য কোন জাতির মধ্যে প্রচলিত নাই। লোকের মনে স্বদেশানুরাগ ক্রমে বিলক্ষণরূপে সঞ্চারিত হইতেছে। দেশীয় ধর্ম ও আচার ব্যবহারের প্রতি পূৰ্ব্বকার বিদ্বেষভাব ক্রমে তিরোহিত হইতেছে। এই পরিবর্তনের কারণ আমরা নিম্নে নির্দেশ করিতেছি।

“প্রায় দ্বাদশ বৎসর হইল, শ্রীযুক্ত প্রধান আচাৰ্য্য মহাশয়ের উৎসাহে ও যত্নে “ন্যাশন্যাল পেপর” অর্থাৎ “স্বজাতীয় সম্বাদপত্র” প্রথম প্রকাশিত হয়। ঐ সংবাদপত্রকে তিনিই উক্ত নাম প্রদান করেন। ঐ আখ্যা প্রদান অল্প কাৰ্য্যকর হয় নাই। তৎপরে প্রায় দশ বৎসর হইল “স্বজাতীয় ভাব ও স্বদেশানুরাগ সঞ্চারিণীসভা সংস্থাপনের প্রস্তাব” নামক একটি প্রস্তাব ইংরাজীতে প্রকাশিত হয়। তাহাতে হিন্দু ব্যায়াম, হিন্দু সঙ্গীত, হিন্দু চিকিৎসা বিদ্যা এবং সংস্কৃত ও বাঙ্গালা ভাষার অনুশীলনী, যত পারা যায় বাঙ্গালা শব্দ ব্যবহার করিয়া আমাদিগের কথোপকথনের ভাষার বিশুদ্ধতা সম্পাদনা, বাঙ্গালা ভাষায় পরস্পর পত্রলেখা এবং বাঙ্গালীর সভাতে বাঙ্গলায় বক্তৃতা করা, সুরাপানাদি বিদেশীয় অনিষ্টকর প্রথা এতদ্দেশে যাহাতে প্রচলিত না হয় তাহার উপায় অবলম্বন করা, হিন্দুশাস্ত্র অবলম্বন করিয়া সমাজ সংস্কার কার্য সম্পাদন করা, স্বদেশীয় সুপ্রথা সকল রক্ষা করা, নমস্কার প্রণামাদি স্বদেশীয় শিষ্টাচার পালন করা, বিদেশীয় রীতিতে পরিচ্ছদ পরিধান ও আহার কার্য সম্পাদন পরিত্যাগ করা, দেশীয় ভাষায় নাটকাদি অভিনয় করা ইত্যাদি বিবিধ বিষয় আলোচিত হয়। এ প্রস্তাবটি সমুদায় আমরা এই পত্রিকায় উদ্ধৃত করিয়া দিয়াছিলাম। উক্ত পুস্তিকায় উল্লিখিত বিষয় সকল প্রস্তাবিত হইয়াছিল মাত্র। প্রস্তাবলেখকের প্রস্তাবসকল কখনই কার্যে পরিণত হইত না যদ্যপি হিন্দুমেলা ও জাতীয় সভাসংস্থাপক মহাশয় উহা অবলম্বন করিয়া হিন্দুমেলা ও জাতীয় সভা সংস্থাপন না করিতেন। উক্ত পুস্তিকা প্রকাশিত হইবার পূৰ্ব্বেও কোন উপলক্ষে সমস্ত হিন্দুবর্গকে মধ্যে মধ্যে একত্রিত করিবার এবং তদ্বারা তাহাদিগের মধ্যে সদ্ভাব ও ঐক্য সঞ্চার করিবার ভাব হিন্দুমেলা সংস্থাপকের মনে উদিত হইয়াছিল। জাতীয় সভায় অভিব্যক্ত বক্তৃতা সকলের দ্বারা বিশেষতঃ হিন্দুধর্মের শ্ৰেষ্ঠতা বিষয়ক বক্তৃতা দ্বারা বিস্তর উপকার সাধিত হইয়াছে। হিন্দুমেলা ও জাতীয় সভা সংস্থাপন জন্য তৎসংস্থাপক মহাশয় কতদূর প্রশংসাযোগ্য তাহা বলা যায় না। শ্ৰীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা বিরচিত স্বদেশানুরাগোদ্দীপক সঙ্গীত আমাদিগের দেশের লোকের মনে স্বদেশানুরাগ উদ্দীপন কাৰ্য্যে অল্প সহকারিতা করে নাই।”২৩

অতঃপর এই প্রবন্ধে আমাদের জাতীয়তার অভাবসূচক বিষয়গুলি এবং কিভাবে তাহার সংশোধন করা উচিত তাহার বিস্তৃত আলোচনা আছে। যাহারা বাংলা দেশে জাতীয়তার উন্মেষ ও বিকাশের পরিচয় জানিতে চাহেন তাঁহারা এই প্রবন্ধ পাঠ করিলে অনেক তথ্য অবগত হইতে পারিবেন।

এই প্রবন্ধে রাজনারায়ণ বসুর চেষ্টার পরিপোষকরূপে যে হিন্দুমেলার উল্লেখ আছে, বাংলা দেশে জাতীয় ভাবের জাগরণের ইতিহাসে তাহা একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। এই বাত্সরিক মেলাটি আরম্ভ হয় ১৮৬৭ সনে এবং ১৮৮০ সন পর্যন্ত, মোট ১৪ বার ইহার বার্ষিক সম্মিলন হইয়াছিল।২৪

ইহার উৎপত্তি সম্বন্ধে রাজনারায়ণ বসু লিখিয়াছেন, “শ্রীযুক্ত বাবু নবগোপাল মিত্র মহোদয় আমার প্রণীত জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভার’ অনুষ্ঠানপত্র পাঠ করাতে হিন্দু মেলার ভাব তাঁহার মনে প্রথম উদিত হয়। ইহা তিনি আমার নিকট স্পষ্ট স্বীকার করিয়াছেন। ঐ হিন্দু মেলা সংস্থাপনের পর উহার অধ্যক্ষতা করিবার জন্য মিত্র মহাশয় জাতীয় সভা’ সংস্থাপন করেন। উহা আমার প্রস্তাবিত ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভার আদর্শে গঠিত হইয়াছিল।”২৫

জোড়াসাঁকোর প্রসিদ্ধ ঠাকুরবাড়ীর সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা যে ইহার পশ্চাতে ছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর “আমার বাল্য কথা” গ্রন্থে লিখিয়াছেন : “আমি বোম্বায়ে কাৰ্যারম্ভ করবার কিছু পরে কলিকাতায় এক ‘স্বদেশী মেলা’ প্রবর্তিত হয়। বড়দাদা (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর) নবগোপাল মিত্রের সাহায্যে মেলার সূত্রপাত করেন, পরে মেজদাদা (গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর) তাহাতে যোগদান করায় প্রকৃতপক্ষে তার শ্রীবৃদ্ধি সাধন হল। কলিকাতার প্রান্তবর্তী কোন একটি উদ্যানে বৎসর বৎসর তিন চার দিন ধরে এই মেলা চলত। সেখানে দেশী জিনিসের প্রদর্শনী, জাতীয় সঙ্গীত, বক্তৃতাদি বিবিধ উপায়ে লোকের দেশানুরাগ উদ্দীপ্ত করবার চেষ্টা করা হত। এই মেলা উপলক্ষে মেজদাদা কতকগুলি জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেন, আর সেই মেলাই ভারত-সঙ্গীতের জন্মদাতা

মিলে সব ভারত সন্তান
একতান মনঃ প্রাণ
গাও ভারতের যশোগান।”২৫ক

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি”তে লিখেছেন : “আমাদের বাড়ির সাহায্যে হিন্দুমেলা বলিয়া একটি মেলা সৃষ্ট হইয়াছিল। নবগোপাল মিত্র মহাশয় এই মেলার কর্মকর্তারূপে নিয়োজিত ছিলেন। ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম হয়। মেজদাদা সেই সময় বিখ্যাত জাতীয় সংগীত “মিলে সব ভারত সন্তান রচনা করিয়াছিলেন। এই মেলায় দেশের স্তবগান গীত, দেশানুরাগের কবিতা পঠিত, দেশী শিল্প ব্যায়াম প্রভৃতি প্রদর্শিত ও দেশী গুণী লোক পুরস্কৃত হইত।”২৬

কিশোর রবীন্দ্রনাথও এই মেলায় তাঁহার স্বরচিত কবিতা পাঠ করিয়াছিলেন। রাজনারায়ণ বসুর অনুপ্রেরণা ও ঠাকুরবাড়ীর সহযোগিতা থাকিলেও হিন্দুমেলার কৃতিত্ব যে প্রধানতঃ নবগোপাল মিত্রেরই প্রাপ্য সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার বাল্যকথায়’ নবগোপাল বাবুকেই ইহার প্রধান উদ্যোগী বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন।২৭ শেষপর্যন্ত যে এই হিন্দুমেলার অনুষ্ঠান বিশেষ জাঁকজমকের সহিত সম্পাদিত হইত, সংবাদ প্রভাকরের’ ১২৮৬ সালের ১০ই ফাল্গুনের (২১-২-১৮৭৯ সন) সংখ্যায় ইহার বিস্তৃত বিবরণ হইতে তাহা জানা যায়। এইজন্য ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিলাম :

“বিগত মাঘ সংক্রান্তির দিবস উক্ত জাতীয় মেলা টালার রাজার বদনৰ্চাদের উদ্যানে আরম্ভ হইয়া গত সোমবারে সমাপ্ত হইয়াছে।

… বাবু চন্দ্রশিখর বসু হিন্দু ধৰ্ম্মের সারবত্তা সম্বন্ধে এবং পদ্মনাভ ঘোষাল ভারতবর্ষের ইতিহাস নবীনরূপে লেখা আবশ্যক সম্বন্ধে এক বক্তৃতা করেন।… মেলার দ্বিতীয় দিবস ১২ই ফেব্রুয়ারী বুধবার বৈকালে ন্যাসনাল স্কুলে নর্মাল স্কুল, চাঁপাতলা স্কুল এবং ন্যাসনাল স্কুলের ছাত্রগণ নানাবিধ ব্যায়াম প্রদর্শন করেন।

…তৃতীয় দিবস বৃহস্পতিবার এক সভা হয়, বাবু রাজনারায়ণ বসু সভাপতির আসন পরিগ্রহ করেন। মেলার সুযোগ্য সহসম্পাদক বাবু নবগোপাল মিত্র ছাত্রবৃন্দকে লক্ষ্য করিয়া অনেকগুলি সারযুক্ত উক্তি দ্বারা নীতিগর্ভ উপদেশ দান করেন।….

… মেলার প্রধান দিবস রবিবারে উপরোক্ত উদ্যানে পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব বর্ষের ন্যায় নানাবিধ প্রদর্শনী, ক্রীড়া, গীত, বাদ্য এবং অগ্নি ক্রীড়া হইয়াছিল। সৰ্ব্ব প্রথমে বেলা সাৰ্দ্ধ নবম ঘটিকার সময় ২১১ কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট হইতে মহা সমারোহে মেলাস্থলে যাত্রারম্ভ হয়। পতাকা, আশা, সেটা এবং জাতীয় কীৰ্ত্তন করিতে করিতে মেলার অনুষ্ঠাতা এবং হিতসাধকগণ বরাবর মেলাস্থলে গমন করেন। এতদ্দর্শনার্থ সহস্র সহস্র লোক রাজপথে সমবেত এবং অসংখ্য নরনারী নিজ নিজ বাটীর গবাক্ষাদি হইতে দেখিতে থাকেন। এ দৃশ্যটি পরম রমণীয় হইয়াছিল। মেলাস্থল নানাবিধ পতাকা, পত্র এবং পুষ্পদিতে পরম রমণীয়রূপে শোভিত হইয়াছিল। দ্বারদেশে হিন্দু প্রথামত কদলী বৃক্ষাবলী রোপিত হইয়াছিল। মেলাস্থলে নানাপ্রকার ক্রীড়া এবং ব্যায়াম প্রদর্শিত হইয়াছিল। একজন বাঙ্গালীর সহিত একজন পঞ্জাবী পালোয়ানের কুস্তী হইয়াছিল,…

…. ইতিহাস যে বাঙ্গালী ও পঞ্জাবীকে শৃগাল এবং সিংহরূপে প্রভেদ করিত, সেই বাঙ্গালী যে এখন পঞ্জাবীর সহিত কুস্তী করিতে সমর্থ হইল, ইহাই প্রশংসার বিষয়। … মেলাস্থলে নানাবিধ দ্রব্য প্রদর্শিত হইয়াছিল। কৃষি বিভাগে নানাবিধ ফল, মূল, পুষ্প এবং বৃক্ষাদি বহুল পরিমাণে আনীত হইয়াছিল। সূচিকাৰ্য্য কারুকাৰ্য্য এবং নানাস্থানের বহুবিধ প্রস্তর ও মৃত্তিকার দ্রব্য প্রদর্শিত হইয়াছিল। বিখ্যাত বিদুষি রমাবাই ভারতীয় ভাষাশিক্ষা আবশ্যক, হিন্দু ললনাদিগকে ধৰ্ম্ম শিক্ষা দেওয়া কর্তব্য এবং পুরাকালের আৰ্য্য নারীদিগের স্বাধীনতা সম্বন্ধে অনর্গল বক্তৃতা করেন, তাঁহার বক্তৃতা শ্রবণে দর্শকমাত্রেই বিমোহিত হইয়া তাঁহাকে অগণ্য ধন্যবাদ দান করেন। রজনীতে অগ্নি ক্রীড়ার পর মেলা ভঙ্গ হয়। দিবা ভাগে বৃষ্টি হওয়ায় আশামত লোক সমবেত হয় নাই। বলা বাহুল্য যে মেলার সুযোগ্য সম্পাদক বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সহকারী সম্পাদক বাবু রাম (?) নবগোপাল মিত্রের যত্নে, শ্রমে এবং অধ্যবসায়ে এই মেলা জাতীয় মান রক্ষা করিতেছে।”২৮

হিন্দুমেলার চতুর্থ অধিবেশনের পরে নবগোপাল মিত্র National Society অর্থাৎ ‘জাতীয় সভা’ প্রতিষ্ঠিত করেন। ইহার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য ও জাতীয় ভাব সঞ্চারিত করা। প্রতি মাসে ইহার একটি অধিবেশন বসিত ও ঐ সম্বন্ধে বক্তৃতা হইত। ইহারই এক অধিবেশনে রাজনারায়ণ বসু ‘হিন্দু ধর্মের শ্ৰেষ্ঠতা সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন। এই বক্তৃতার সারাংশ পুস্তিকা-আকারে প্রকাশিত হইলে বঙ্কিমচন্দ্র ১২৭৯ সালের চৈত্র মাসের বঙ্গদর্শনে ইহার সমালোচনা করেন। তিনি বক্তৃতার নিম্নলিখিত অংশ উদ্ধৃত করিয়াছেন :

“আমার এইরূপ আশা হইতেছে, পূর্বে যেমন হিন্দু জাতি বিদ্যা, বুদ্ধি, সভ্যতা জন্য বিখ্যাত হইয়াছিল, তেমনি পুনরায় সে বিদ্যা, বুদ্ধি, সভ্যতা, ধর্ম জন্য সমস্ত পৃথিবীতে বিখ্যাত হইবে।”

অতঃপর মিল্টন তাঁহার স্বজাতির উন্নতি সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন তাহার এক অংশ উদ্ধৃত করিয়া রাজনারায়ণ বাবু বলেন : “আমিও সেইরূপ হিন্দুজাতি সম্বন্ধে বলিতে পারি, আমি দেখিতেছি, আবার আমার সম্মুখে মহাবলপরাক্রান্ত হিন্দুজাতি নিদ্রা হইতে উত্থিত হইয়া বীরকুণ্ডল পুনরায় স্পন্দন করিতেছে এবং দেববিক্রমে উন্নতির পথে ধাবিত হইতে প্রবৃত্ত হইতেছে। আমি দেখিতেছি যে এই জাতি পুনরায় নবযৌবনান্বিত হইয়া পুনরায় জ্ঞান, ধৰ্ম্ম, ও সভ্যতাতে উজ্জ্বল হইয়া পৃথিবীকে সুশোভিত করিতেছে; হিন্দু জাতির কীর্তি, হিন্দু জাতির গরিমা পৃথিবীময় পুনরায় বিস্তারিত হইতেছে। এই আশাপূর্ণ হৃদয়ে ভারতের জয়োচ্চারণ করিয়া আমি অদ্য বক্তৃতা সমাপন করিতেছি।”

(অতঃপর রাজনারায়ণবাবু “মিলে সব ভারত সন্তান, একতান মনঃ প্রাণ, গাও ভারতের যশোগান। ভারতভূমির তুল্য আছে কোন স্থান?”) এই সুদীর্ঘ সুপ্রসিদ্ধ সঙ্গীতটি আদ্যোপান্ত পাঠ করেন।

উল্লিখিত বক্তৃতার এই অংশ উদ্ধৃত করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করিয়াছেন : “রাজনারায়ণ বাবুর লেখনীর উপর পুষ্প চন্দন বৃষ্টি হউক। এই মহাগীত ভারতের সর্বত্র গীত হউক। হিমালয়কন্দরে প্রতিধ্বনিত হউক। গঙ্গা যমুনা সিন্ধু নর্মদা গোদাবরীতটে বৃক্ষে বৃক্ষে মর্মরিত হউক। পূর্ব পশ্চিম সাগরের গম্ভীর গর্জনে মন্দ্রীভূত হউক। এই বিংশতি কোটি ভারতবাসীর হৃদয়যন্ত্র ইহার সঙ্গে বাজিতে থাকুক।”২৯

রাজনারায়ণ বসুর বক্তৃতা এবং নবগোপাল মিত্রের হিন্দুমেলা ও ইহার মুখপাত্র ‘National Paper’ সম্বন্ধে তৎকালে অনেকে মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, এইসকল বক্তব্য হিন্দু সম্বন্ধে প্রযোজ্য সুতরাং ইহাকে জাতীয়’ আখ্যা দেওয়া সঙ্গত নহে। ইহার উত্তরে নবগোপাল মিত্র ‘National Paper’-এ লেখেন : “হিন্দু নিঃসন্দেহে একটি স্বতন্ত্র জাতি।” তিনি তাঁহার নানা লেখায় ইহার সমর্থনকল্পে বলিয়াছেন : “ঐক্যই জাতির ভিত্তি। নানা সূত্রে ও বিভিন্ন রকমে এই ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। দেশপ্রেম গ্রীকদের, মোসেসের বাণী ইহুদিদের, খ্যাতি ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা রোমের ও স্বাধীনতাপ্রীতি ইংরেজদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি। সেইরূপ ধর্ম হিন্দুদের জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তি। হিন্দু জাতি বাংলা সীমাবদ্ধ নহে–সমগ্র ভারতের যেখানে হিন্দু আছে–তাহাদের লইয়াই হিন্দু জাতি।”৩০

পূর্বোক্ত সমালোচনা হইতেই বুঝা যায় যে বাংলা দেশের একটি সম্প্রদায় নবগোপাল মিত্রের ন্যায় হিন্দু এক পৃথক জাতি ইহা স্বীকার না করিয়া সমগ্র ভারতবাসীই যে এক জাতি, এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াছিল। ক্রমে ক্রমে এই আদর্শ অধিকতর লোক গ্রহণ করিলেও, হিন্দু জাতি’র আদর্শ কখনও একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই। প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, হিন্দুধর্ম যে এদেশে জাতীয়তার মূল ভিত্তি, এই ধারণার প্রভাব বরাবরই ছিল এবং এখনও আছে। এই সত্য অপ্রিয় হইলেও অস্বীকার করা কঠিন। তবে কেবলমাত্র হিন্দু নহে, মুসলমানেরাও যে প্রথম হইতে নিজেদের একটি পৃথক জাতি বলিয়া মনে করিত, ওয়াহাবী আন্দোলনই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

ঊনিশ শতকের শেষার্ধে যে এই দ্বিজাতিমূলক রাজনীতি প্রভাবশালী হইয়াছিল তাহার মূলে ছিল উভয় সম্প্রদায়ের সাহিত্য, ঐতিহ্য ও কতক পরিমাণে মুসলমানের রাজনীতিক স্বার্থ। বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্যরচনায়, হেমচন্দ্র, রঙ্গলাল, নবীনচন্দ্র প্রভৃতির উদ্দীপনাময় কবিতায় একদিকে যেমন দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উদ্দীপ্ত হইয়াছিল, অন্যদিকে তেমনি তাহা হিন্দুদের মনে পৃথক জাতীয়তাভাবের ইন্ধন যোগাইতেছিল।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ যে প্রধানতঃ হিন্দুদের উদ্দেশ্যেই লিখিত হইয়াছিল, কালীমাতার প্রতিমূর্তিই তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ। মৃণালিনী ও রাজসিংহ-এই দুই উপন্যাসের পটভূমি মুসলমান আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে হিন্দুর আত্মরক্ষার নিমিত্ত যুদ্ধ। বিপিনচন্দ্র পাল তাঁহার আত্মজীবনীতে লিখিয়াছেন : “দুর্গেশনন্দিনীই আমার মনে প্রথম দেশপ্রেম জাগরিত করে। কিন্তু আমাদের সম্পূর্ণ সহানুভূতি ছিল বীরেন্দ্র সিংহের দিকে। বীরেন্দ্র সিংহের মৃত্যুর প্রতিশোধে সদ্য বিধবা বিমলা মুসলমান আক্রমণকারীকে ছুরিকার আঘাতে বধ করে-এই চিত্র আমার মনে গভীর রেখাপাত করিয়াছিল।”৩১

কমলাকান্তের দপ্তরে বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন :

“আমি কেন দিবস গণিব? গণিব। আমার এক দুঃখ, এক সন্তাপ, এক ভরসা আছে। ১২০৩ সাল হইতে দিবস গণি। যে দিন বঙ্গে হিন্দু নাম লোপ পাইয়াছে, সেই দিন হইতে দিন গণি। হায়! কত গণিব! দিন গণিতে গণিতে মাস হয়, মাস গণিতে গণিতে বৎসর হয়, বৎসর গণিতে গণিতে শতাব্দী হয়, শতাব্দীও ফিরিয়া ফিরিয়া সাতবার গণি… যাহা চাই তাহা মিলাইল কই?… শ্রীহর্ষ কই? ভট্টানারায়ণ কই? হলায়ুধ কই? লক্ষ্মণ সেন কই? আর কি মিলিবে না?” “আমার এই বঙ্গদেশের সুখের স্মৃতি আছে–নিদর্শন কই? …সুখ মনে পড়িল, কিন্তু চাহিব কোন দিকে? সে গৌড় কই? সে যে কেবল যবন-লাঞ্ছিত ভগ্নাবশেষ… চাহিবার এক শ্মশানভূমি আছে-নবদ্বীপ। সেইখানে সপ্তদশ যবনে বাঙ্গালা জয় করিয়াছিল। বঙ্গমাতাকে মনে পড়িলে, আমি সেই শ্মশানভূমি প্রতি চাই।”

ইহার পর বঙ্কিমচন্দ্র কল্পনায় মুসলমানের নবদ্বীপ-আক্রমণের যে বীভৎস চিত্র আঁকিয়াছেন, আজিও তাহা পড়িলে বাঙ্গালী হিন্দুর রক্ত খরতর প্রবাহে বহিতে থাকে। মৃণালিনীর চতুর্থ খণ্ডের পঞ্চম পরিচ্ছেদের শেষে ‘বিংশতি সহস্র যবন কর্তৃক নবদ্বীপ জয়” বর্ণনা করিয়া তিনি মন্তব্য করিয়াছেন : “যে সূৰ্য্য সেই দিন অস্ত গিয়াছে, আর তাহার উদয় হইল না, আর কি উদয় হইবে না?” নবদ্বীপ জয় করিবার পর মুসলমান-সৈন্যের পৈশাচিক অত্যাচারের বর্ণনা অতি আধুনিক যুগের হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। “ক্ষুদ্রকায় যবন কহিল, যেখানে যাহাকে পাও বধ কর।”… “ভয়ানক শব্দে নৈশাকাশ পরিপূর্ণ হইতে লাগিল… মাতার রোদন, শিশুর রোদন, বৃদ্ধের করুণাকাঙ্ক্ষা, যুবতীর কণ্ঠবিদার।”

১৮৭২ সনে বঙ্কিমচন্দ্র “ভারতকলঙ্ক-ভারতবর্ষ পরাধীন কেন?” এই শিরোনামায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। ইহাতে তিনি যে ‘Nationality বা Nation– এই অর্থে জাতি’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন ইহা প্রবন্ধের পাদটীকায় লিখিয়াছেন। সুতরাং ‘হিন্দু জাতি’ এই শব্দ পুনঃপুনঃ ব্যবহার করায় তিনি যে হিন্দুকে একটি পৃথক জাতি মনে করিতেন সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না, বিশেষতঃ যখন তিনি হিন্দুগণকে “যবন স্লেচ্ছ প্রভৃতি অপর ধর্মাবলম্বী জাতিগণ” হইতে পৃথকভাবে উল্লেখ করিয়াছেন।

পূর্বোক্ত প্রবন্ধে হিন্দুজাতির প্রতিষ্ঠা ও মঙ্গল সম্বন্ধে তিনি যে বিচার ও বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহা বাংলা দেশে হিন্দুদের জাতীয়তাভাবের উদ্বোধনের মূল দার্শনিক তত্ত্ব বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। ১৮৭২ সনে বা তাহার পূর্বে এই বিষয়ে আর কেহ এইভাবে চিন্তা করিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। সুতরাং এই সুদীর্ঘ প্রবন্ধের কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“আমি হিন্দু, তুমি হিন্দু, রাম হিন্দু, যদু হিন্দু, আরও লক্ষ লক্ষ হিন্দু আছে। এই লক্ষ লক্ষ হিন্দু মাত্রেরই যাহাতে মঙ্গল, তাহাতেই আমার মঙ্গল। যাহাতে তাহাদের মঙ্গল নাই, আমারও তাহাতে মঙ্গল নাই। অতএব সকল হিন্দুদের যাহাতে মঙ্গল হয়, তাহাই আমার কর্তব্য। যাহাতে কোন হিন্দু অমঙ্গল হয়, তাহা আমার অকর্তব্য। যেমন আমার এইরূপ কর্তব্য আর এইরূপ অকর্তব্য … সকল হিন্দুরই তদ্রূপ। সকল হিন্দুরই যদি একরূপ কার্য হইল, তবে সকল হিন্দুর কর্তব্য যে এক পরামর্শী, এক মতাবলম্বী, একত্র মিলিত হইয়া কার্য করে, এই জ্ঞান জাতি প্রতিষ্ঠার প্রথম ভাগ, অর্ধাংশ মাত্র। হিন্দুজাতি ভিন্ন পৃথিবীতে অন্য অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গলমাত্রেই আমাদের মঙ্গল হওয়া সম্ভব নহে। অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল, সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাহাতে না হয়, আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতিপীড়ন করিতে হয় করিব। অপিচ যেমন তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে, তেমনি আমাদের মঙ্গলে তাহাদের অমঙ্গল হইতে পারে। হয় হউক, আমরা সেজন্য আত্মজাতির মঙ্গল সাধনে বিরত হইব না; পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিত হয় তাহাও করিব। জাতি প্রতিষ্ঠার এই দ্বিতীয় ভাগ।

“দেখা যাইতেছে যে, এইরূপ মনোবৃত্তি নিষ্পাপ পরিশুদ্ধ ভাব বলিয়া স্বীকার করা যাইতে পারে।…

“স্বজাতীয় প্রতিষ্ঠা ভালই হউক বা মন্দই হউক, যে জাতিমধ্যে ইহা বলবতী হয় সে জাতি অন্য জাতি অপেক্ষা প্রবলতা লাভ করে।

… … …

“ইতিহাসকীর্তিত কালমধ্যে কেবল দুইবার হিন্দু সমাজমধ্যে জাতি প্রতিষ্ঠার উদয় হইয়াছিল। একবার মহারাষ্ট্রে শিবাজী এই মন্ত্র পাঠ করিয়াছিলেন… দ্বিতীয় বারের ঐন্দ্রজালিক রণজিৎ সিংহ…।

“যদি কদাচিৎ কোন প্রদেশ খণ্ডে জাতি প্রতিষ্ঠার উদয়ে এতদূর ঘটিয়াছিল, তবে সমুদয় ভারত একজাতীয় বন্ধনে বদ্ধ হইলে কি না হইতে পারিত?

… … …

“ইংরেজ ভারতবর্ষের পরমোপকারী। ইংরেজ আমাদিগকে নূতন কথা শিখাইতেছে। … সেই সকল শিক্ষার মধ্যে অনেক শিক্ষা অমূল্য। যে সকল অমূল্য রত্ন আমরা ইংরেজের চিত্ত ভাণ্ডার হইতে লাভ করিতেছি, তাহার মধ্যে দুইটির আমরা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করিলাম–স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা এবং জাতিপ্রতিষ্ঠা। ইহা কাহাকে বলে, তাহা হিন্দু জানিত না।”

বঙ্কিমচন্দ্র অন্যত্র লিখিয়াছেন, “আমরা Independence শব্দের পরিবর্তে স্বতন্ত্রতা এবং Liberty শব্দের স্থানে স্বাধীনতা শব্দ ব্যবহার করিয়াছি।”৩২

“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়।
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে।
কে পরিবে পায়।”

শতাধিক বর্ষ যাবৎ রঙ্গলালের এই প্রসিদ্ধ কবিতা প্রতি শিক্ষিত বাঙ্গালীর মুখে মুখে ফিরিতেছে। কিন্তু ইহা আক্রমণকারী মুসলমানের বিরুদ্ধে রাজপুতের উদ্দীপনা অবলম্বনে রচিত।

কবিবর নবীনচন্দ্র সেন যুবরাজ (পরবর্তী সম্রাট) এডওয়ার্ডের ভারত-আগমন উপলক্ষে যে প্রসিদ্ধ কবিতা লিখিয়াছিলেন তাহাতে হিন্দুজাতির অতীত কীর্তির কথা আছে :

“এই ধরাতলে আদি হিন্দু জাতি,
ধরাতলে আদি হিন্দু সিংহাসন,
… … …
আজি হিন্দুস্থান হিন্দুর শ্মশান।”

তারপর রাজপুত, মারাঠা ও শিখ জাতির অতুল বিক্রমের ও স্বাধীনতার জন্য প্রাণদানের কাহিনী অপূর্ব কবিতৃসহকারে উদ্দীপনাময় ভাষায় উল্লেখ করিয়াছেন :

“যাও যুবরাজ! রাজপুতনায়
বীর ইতিহাসে পরিপূর্ণ যার
প্রতি পদ;…
এখনো ‘চিতোরে’ স্মৃতির নয়নে
দেখিবে ‘পদ্মিনী’ চিতার অনল;
সেই স্মৃতি তব দয়ার্দ্র নয়নে।
আনিবে কি আহা এক বিন্দু জল?”

মহারাষ্ট্র সম্বন্ধে :

মহারাষ্ট্র জাতি, … নিদ্রাতেও যার
শিয়রে তুরঙ্গ কটিবন্ধে অসি;
হলো অস্তমিত বিক্রমে যাহার,
মোগলের বিশ্বাস অর্ধ-শশী’!
… … …
স্বাধীনতা তরে মত্ত সিংহপ্রায়
যুঝিল যে জাতি প্রাণপণ করে,
যুবরাজ! আজি সে জাতি কোথায়?

শিখদের সম্বন্ধে :

সেই শিখ জাতি-বীরের আতঙ্ক।
যুবরাজ! আজি সে জাতি কোথায়?

রাজপুত, মারাঠা, শিখ প্রভৃতি বীরজাতির উল্লেখ আছে, কিন্তু মারাঠা প্রসঙ্গে মোগলের পরাজয়ের কথা ছাড়া মুসলমানদের কোন উল্লেখ পর্যন্ত নাই। ভারতীয় মুসলমানদেরও মহান ঐতিহ্য ও অতীত গৌরবের নিদর্শন আছে; তাহাদের মধ্যেও বাবর, শেরশাহ, আকবর প্রভৃতি জন্মিয়াছিলেন, কিন্তু নবীনচন্দ্রের কবিতা পড়িলে মনে হইবে না যে ভারতবর্ষে মুসলমান বলিয়া এক সম্প্রদায় আছে এবং তাহাদেরও একটা ঐতিহ্য আছে।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারত বিলাপ’, ‘ভারত সঙ্গীত’ প্রভৃতি বহু কবিতা বাঙ্গালীর মনে স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতার বীজ বপন করিয়াছিল, কিন্তু তাহার মধ্যেও যবন কর্তৃক হিন্দুর পরাজয় প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। যে ভারত সঙ্গীত বহুবর্ষ ধরিয়া বাঙ্গালীকে জাতীয়তাভাবে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে, তাহার নিম্নলিখিত পংক্তি কয়টি প্রত্যেক বাঙ্গালীর কণ্ঠস্থ ছিল ও প্রাণে বিপুল সাড়া জাগাইত।

“বাজরে শিঙ্গা বাজ এই রবে,
সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে,
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে
ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়।”

কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য যাহাই হউক কবি মুঘল কর্তৃক মারাঠা দেশের আক্রমণ উপলক্ষ করিয়া সেই পটভূমিতে দেশের জন্য বিলাপ করিলেন। সুতরাং তাঁহার কবিতায় দেখিতে পাই

“বিংশতি কোটি মানবের বাস
এ ভারতভূমি যবনের দাস?
রয়েছে পড়িয়া শৃঙ্খলে বাঁধা।
আর্যাবর্ত জয়ী পুরুষ যাহারা
সেই বংশোদ্ভব জাতি কি ইহারা?
… … …
ধিক হিন্দুকুলে। বীর ধর্ম ভুলে
আত্ম অভিমান ডুবায়ে সলিলে
দিয়াছে সঁপিয়া শত্রু করতলে
সোনার ভারত করিতে ছার।”

যুবরাজের ভারত-আগমন উপলক্ষে হেমচন্দ্র ভারত ভিক্ষা’ নামে যে কবিতা লিখিয়াছিলেন, তাহাতে প্রাচীন হিন্দুরাজ্য ধ্বংসের সঙ্গেই ভারতের ধ্বংস হইল না কেন, তাহার জন্য আক্ষেপ করিয়াছেন :

“হায় পাণিপথ, দারুণ প্রান্তর,
কেন ভাগ্য সনে হলিনে অন্তর?
কেন রে চিতোর, তোর সুখ-নিশি
পোহাইল যবে, ধরণীতে মিশি
অচিহ্ন না হলি-কেন রে রহিলি?
জাগাতে ঘৃণিত ভারত-নাম?

সারাটি কবিতায় কেবল হিন্দুর প্রাচীন গৌরবের কথাই আছে, মুসলমানদের নামগন্ধও নাই।

আবার ‘ভারত-বিলাপ’ নামক কবিতাতে হেমচন্দ্র লিখিয়াছেন যে, বিধাতা যদি ভারতকে সম্পদশালিনী না করিয়া মরুভূমি করিতেন তাহা হইলে ভাল হইত–কারণ,

“তা হলে এখানে করিত না গতি
পাঠান, মোগল, পারস্য দুর্ম্মতি,
হরিতে ভারত-কিরীটের ভাতি,
অভাগা হিন্দুরে দলিতে পায়।”

পূর্বোক্ত সমস্ত গদ্যরচনা ও কবিতার মধ্যদিয়াই যে একটি সুর প্রধানতঃ কর্ণে বাজে তাহার স্পষ্ট ইঙ্গিত এই যে, ভারতবর্ষ হিন্দুর দেশ, মুসলমানেরা অনধিকারী, অবাঞ্ছিত, অত্যাচারী, বিদেশী, বিজেতামাত্র। ইহা ঐতিহাসিক সত্য সন্দেহ নাই। কিন্তু যদি কোন মুসলমান ইহা পাঠ করিয়া হিন্দুর সহিত ভ্রাতৃত্ববন্ধন ও সৌহার্দ্য স্থাপনপূর্বক এক জাতি বলিয়া পরিচয় দিতে ব্যগ্র না হয়, তবে তাহার এই মনোবৃত্তি যে অতি স্বাভাবিক এবং অন্ততঃ তাহা যে গুরুতর অপরাধ বলিয়া গণ্য করা অসঙ্গত-ইহাও অনুরূপ সত্য।

বঙ্কিমচন্দ্র, রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের রচনার যে-কয়েকটি নমুনা উদ্ধৃত হইল, উনিশ শতকের শেষার্ধের বাংলাসাহিত্যে ইহার অনুরূপ বহু দৃষ্টান্ত আছে। এগুলি যে বাংলায় জাতীয়তাভাবের এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনায় যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছিল, এবং যে জাতীয়তা উনিশ শতকের প্রথমে বাংলার সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল তাহা প্রসার করিয়া রাজপুতানা, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ লইয়া মহাদেশ ভারতবর্ষের জাতীয় ঐক্যের দিকে বাঙ্গালীর দৃষ্টি ফিরাইয়াছিল –ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। এ-বিষয়ে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙ্গালীর যে দৃষ্টিভঙ্গী ছিল, শেষার্ধে যে তাহার আমূল পরিবর্তন হইয়াছিল, তাহার জন্য বাংলাসাহিত্যের অবদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু ইহাও অনস্বীকার্য যে ইহার প্রভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে হিন্দুর জাতীয়তার আদর্শ হিন্দুধর্মের গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার একটি বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিল।

সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ এই সঙ্কীর্ণ ভাব দূর করিয়া সমগ্র ভারতবাসীর মনে এক অখণ্ড জাতীয়তার ভাব সঞ্চার করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন–সে কথা পরে বলা হইবে। বাংলাসাহিত্যেও-কবিতা, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতিতে-সমগ্র ভারতবাসীর বর্তমান দুর্দশা ও পরাধীনতার কলঙ্ক দূর করিবার আকাক্ষা প্রতিধ্বনিত হইয়াছে।

কিন্তু কেবল যে হিন্দুদের মধ্যেই এই সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক জাতীয়তার ভাব বিদ্যমান ছিল তাহা নহে। ঠিক অনুরূপ কারণে, অর্থাৎ ধর্ম, সমাজ ও ঐতিহ্যের প্রভাবে মুসলমানদের মধ্যেও তাহারা যে হিন্দু হইতে বিভিন্ন এক স্বতন্ত্র জাতি–এই ধারণা বরাবরই ছিল, বরং উনিশ শতকের শেষার্ধে তাহা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেছিল। কারণ হিন্দুনেতাগণ যেমন জাতীয়তার গণ্ডী ক্রমশঃ বাড়াইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন–সৈয়দ আহমদ প্রমুখ মুসলমান নেতাগণ তেমনি স্বতন্ত্র জাতীয়তার দিকেই মুসলমানদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিতে লাগিলেন। ফলে উনিশ শতকের শেষার্ধে যেমন দেশপ্রেম, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি ক্রমশঃ বাড়িতে লাগিল তেমনি হিন্দু ও মুসলমানের একজাতীয়ত্ববোধ ক্রমশঃই কমিতে লাগিল।

যে মারাঠা বীর মুসলমানদের সাম্রাজ্য ধ্বংস করিয়া হিন্দুর রাজ্য ও ধর্ম রক্ষা করিবার ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তাহাতে কতক সফলতাও লাভ করিয়াছিলেন, হিন্দুরা যে তাঁহাকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করিবে, ইহা খুবই স্বাভাবিক। লোকমান্য তিলক ‘শিবাজী উৎসব অনুষ্ঠান করিয়া তাহার দৃষ্টান্ত বর্তমান যুগে ভারতবাসীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন–ইহার জন্য তিনি হিন্দুর ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা অর্জন করিয়াছেন। বাংলা দেশেও এই উৎসব অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে যে কবিতা লিখিয়াছিলেন, যতদিন বাংলাভাষা বিদ্যমান থাকিবে ততদিন তাহা বিস্মৃতির গহ্বরে ডুবিবে না। কিন্তু শিবাজী মারাঠাজাতি সৃষ্টি করিয়াছিলেন, এবং তাহাই মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসের কারণ–এই সাধারণ জ্ঞান যে-মুসলমানের আছে সে যদি শিবাজী-উৎসবে যোগদান না করে, এমনকি ইহার বিরোধী হয়, তবে তাহাকে খুব দোষ দেওয়া যায় না। এইরূপ মুহম্মদ বিন কাশিম, গজনীর মামুদ, বক্তিয়ার খিলজী, বাবর, ঔরংজেব প্রভৃতি মুসলমান বীরগণের কাহিনী একদিকে যেমন মুসলমানদের মনে গর্ববোধ, হিন্দুদের মনে তেমনি পরাজয়ের লাঞ্ছনা ও অপমান এবং পরাধীনতার বিষাদস্মৃতি জাগাইয়া তুলিবে, ইহা খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং ইহাদের উৎসব যদি মুসলমানেরা অনুষ্ঠান করিত, তবে তাহাতে হিন্দুরা খুব উৎফুল্ল হইয়া যোগ দিত– অন্ততঃ ১৯০৫ সনের পূর্বে ইহা কদাচ সম্ভবপর ছিল বলিয়া মনে হয় না।

ধর্ম ও সমাজের যে গুরুতর ব্যবধান হিন্দু ও মুসলমানকে পৃথক করিয়াছে, ঐতিহাসিক ঘটনা সেই বিভেদ আরও সুদৃঢ় করিয়াছে। ইহার ফলে হিন্দু ও মুসলমান যদি স্বীয় সম্প্রদায়কে একটি স্বতন্ত্র জাতি মনে করে, তবে তাহা নিতান্ত দুঃখের বিষয় হইলেও অযৌক্তিক বা অস্বাভাবিক মনে করার কোন কারণ নাই। সুতরাং সাহিত্যে যে এই মনোবৃত্তি প্রতিফলিত হইবে ইহাতে আশ্চর্যের বিষয় কিছুই নাই।

হিন্দুদের বাংলাসাহিত্যে প্রাচীন কীর্তি এবং গৌরবের স্মৃতি ও কাহিনীর মধ্যে যেমন মুসলমানদের কোনো স্থান নাই, উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের উর্দুসাহিত্যেও তেমনি হিন্দু বা ভারতবর্ষের কোন স্থান ছিল না। আরব ও পারস্য দেশের ঐতিহ্যেই ইহার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ ছিল। উর্দু কবিরা ফার্সী কবিতার ভাবেই বিভোর ছিলেন, তাঁহাদের কল্পনা ও কাহিনী আরব ও পারস্য দেশের ঐতিহাসিক ঘটনা ও নৈসর্গিক দৃশ্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাঁহাদের কবিতা পারস্যের প্রদেশ, শহর, নদ, নদী, পাহাড়, পর্বত, ফুল, ফল প্রভৃতির কথায় ভরা, কিন্তু ভারতের কোন শহর, নদ, নদী, পাহাড় বা ফুল, ফলের উল্লেখ মাত্র নাই–প্রাচীন হিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনী তো দূরের কথা। যে দেশে তাঁহাদের জন্ম, যে দেশে তাঁহারা বহুশত বর্ষ বাস করিয়াছেন, সে দেশ সম্বন্ধে তাঁহাদের কোন কৌতূহল ছিল না, সে দেশের প্রাকৃতিক শোভা তাঁহাদের মনে কোন রেখাপাত করিত না। একজন উর্দু কবি স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, জন্মভূমি হইলেও সে দেশ নাপাক’ (অপবিত্র)।”৩৩

বিংশ শতকে যে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে এবং যাহার ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়–উনিশ শতকের জাতীয় জাগরণের মধ্যে যে তাহার বীজ নিহিত ছিল, এ সত্য অস্বীকার করা কঠিন।

২. রাজনীতিক আন্দোলন

সংঘবদ্ধভাবে যে রাজনীতিক আন্দোলন ১৮৫৮ সনের পূর্বেই আরম্ভ হইয়াছিল তাহার একটি বিশিষ্ট লক্ষণ ছিল যে, ইহা ক্রমশঃই আভিজাত্যের নেতৃত্ব হইতে শিক্ষিত জনসাধারণের নেতৃত্বের দিকে অগ্রসর হইতেছিল। পূর্বোক্ত ভূম্যধিকারী সমাজ’ (Landholders Society), Bengal British India Soceity ও British Indian Association–পর পর এই তিনটির প্রতিষ্ঠাই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

১৮৫৮ সনের পর জাতীয়তাভাবের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই বিশিষ্ট লক্ষণটি আরও স্পষ্ট হইল। ইহার ফলে উনিশ শতকের শেষার্ধে বাংলা দেশে ইণ্ডিয়ান লীগ, ভারত সভা (Indian Association) ও জাতীয় কনফারেন্স (National Conference), এবং পরিশেষে নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানতঃ প্রথম তিনটি অবলম্বন করিয়াই বাংলার রাজনীতিক আন্দোলন গড়িয়া ওঠে, সুতরাং প্রথমেই এই তিনটির সম্বন্ধে আলোচনা করা প্রয়োজন।

(ক) ইণ্ডিয়ান লীগ (Indian League)

ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এদেশের শাসনবিধির যে-সকল সংস্কার দাবি করিয়াছিল তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে ইংরাজীশিক্ষার প্রসার ও শিক্ষিত বাঙ্গালীর ইংলণ্ডে যাতায়াত ও সেখানকার শাসনপ্রণালীর সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে শিক্ষিত বাঙ্গালীর রাজনীতিক দৃষ্টিতে কেবল উচ্চতর সরকারী পদ ও শাসনকার্যে কিছু পরিমাণে অধিকারলাভই পর্যাপ্ত মনে হইল না। ১৮৬৭ সনে ২৫ জুলাই ব্যারিষ্টার উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী (W.C. Bonnerjee) ভারতে প্রতিনিধিমূলক nyitoglot stocare stata (Representative and Responsible Government of India) সম্বন্ধে ইংলণ্ডে এক বক্তৃতা করেন।৩৪ ১৮৭৩ সনে আনন্দমোহন বসুও ইংলণ্ডের ব্রাইটন শহরে অনুরূপ প্রস্তাব করেন। ১৮৭৪ সনে কৃষ্ণদাস পাল ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ কাগজে ভারতে স্বায়ত্তশাসন (Home Rule) প্রতিষ্ঠার সমর্থনে এক প্রবন্ধ লেখেন। তিনি বলেন, সমস্ত ইংরেজ উপনিবেশেই এইরূপ শাসন প্রচলিত আছে, এবং যাহারা কর দেয় তাহাদের হাতেই শাসনভার ন্যস্ত থাকিবে, এই নীতি অনুসৃত হয়। কেবল ভারতে ইহার অন্যথা হইবে কেন? ৩৫

ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এইরূপ রাজনীতিক চেতনাসম্পন্ন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অগ্রগতির সহিত তাল রাখিতে পারিল না। কারণ ইহার সহিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না এবং রাজনীতিক চেতনা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে লোকমত গঠন করার জন্য আন্দোলন, ইহাদের কার্যসূচীর অন্তর্গত হয় নাই। বিশেষতঃ, তখনও এই অ্যাসোসিয়েশন অভিজাত সম্প্রদায়ের সভা বলিয়াই সাধারণের বিশ্বাস ছিল, এবং এই বিশ্বাস একেবারে অমূলক বলা যায় না। ইহার প্রমাণস্বরূপ বলা যাইতে পারে, ১৮৭২ সনে ইহার বার্ষিক চাঁদা ৫০ টাকা হইতে কমাইয়া ১০ টাকা কি ৫ টাকা করার প্রস্তাব হইয়াছিল। কিন্তু ইহা গৃহীত হয় নাই। এই প্রসঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁহার আত্মচরিতে সুরেন্দ্রনাথ ও আনন্দমোহনের উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন :

“আনন্দমোহন বাবু বিলাত হইতে আসার পর হইতেই আমরা একত্র হইলেই এই কথা উঠিত যে, বঙ্গদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য কোন রাজনৈতিক সভা নাই। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ধনীদের সভা, তাহার সভ্য হওয়া মধ্যবিত্ত মানুষদের কৰ্ম্ম নয়, অথচ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকের সংখ্যা যেরূপ বাড়িতেছে, তাহাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপযুক্ত একটি রাজনৈতিক সভা থাকা আবশ্যক। আমরা তিন জনে কথাবার্তার পর স্থির হইল যে, অপরাপর দেশহিতৈষী ব্যক্তিগণের সহিত পরামর্শ করা কর্তব্য।”

শিবনাথ শাস্ত্রী লিখিয়াছেন যে অতঃপর শিশিরকুমার ঘোষ, মনোমোহন ঘোষ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহিত পরামর্শ করা হয়।৩৬

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী তাঁহার আত্মচরিতে লিখিয়াছেন, তিনি ও আনন্দমোহন এই উদ্দেশ্যে ভারত সভা স্থাপনের প্রধান উদ্যোগী ছিলেন, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীও বিশেষ সাহায্য করিয়াছিলেন। তিনি আরও বলেন, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনও এই প্রকার সভার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিতেন বলিয়াই ইহার কয়েকজন বিশিষ্ট সভ্য এই ‘ভারত সভার’ উদ্বোধন উৎসবে যোগদান করিয়াছিলেন। কিন্তু ভারত সভা প্রতিষ্ঠার মাত্র দশ মাস পূর্বে ঠিক একই উদ্দেশ্য লইয়া এবং একই প্রণালীতে ১৮৭৫ সনে ২৫ সেপ্টেম্বর ‘ইণ্ডিয়ান লীগ’ নামে একটি সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন শিশিরকুমার ঘোষ। আনন্দমোহন বসু এই শ্রেণীর একটি সভা প্রতিষ্ঠার বিষয় চিন্তা করিতেছিলেন অথচ তাঁহার অনুপস্থিতিকালে এই সভার প্রতিষ্ঠা করায় কোন কোন পত্রিকা শিশিরকুমারকে নিন্দাও করিয়াছিলেন। কিন্তু সাধারণী পত্রিকার সম্পাদক ইহাতে মন্তব্য করিলেন–”আনন্দমোহনকে আমরা শ্রদ্ধা করি, কিন্তু দেশে কি তিনি ছাড়া আর কোন লোক নাই? তাঁহাকে ছাড়া কিছু করা যাইবে না এরূপ চিন্তা বাঙ্গালীর পক্ষে কলঙ্ক।”

আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে সুরেন্দ্রনাথ ভারত সভা’র প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে অনেক কথা লিখিয়াছেন কিন্তু শিশিরকুমার ঘোষের সহযোগিতা বা ইহার পূর্বে ‘ইণ্ডিয়ান লীগের প্রতিষ্ঠার কথা বিশেষ কিছুই বলেন নাই। তাঁহার বর্ণনা হইতে মনে হয় যে ‘ভারত সভা’র পূর্বে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিমূলক এই শ্রেণীর আর কোন সভা ছিল না। কিন্তু তিনি অন্যত্র ইহার অস্তিত্ব প্রকারান্তরে স্বীকার করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন যে ভারত সভা প্রতিষ্ঠার উদ্বোধনী সভায় খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা কালীচরণ ব্যানার্জী এই সভার প্রতিষ্ঠায় আপত্তি করেন এই কারণে যে কয়েক মাস পূর্বেই ইণ্ডিয়ান লীগ” নামক এই শ্রেণীর আর-একটি সভা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সুরেন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন : “আমি তাহার যুক্তির জবাব দিলাম এবং সাধারণ সভায় ‘ভারত সভা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হইল।” সুরেন্দ্রনাথ কী জবাব দিয়াছিলেন তাহার আভাস দেন নাই। তবে এই প্রসঙ্গে মন্ত ব্য করিয়াছেন যে “ইণ্ডিয়ান লীগ অনেক ভাল কাজ করিয়াছিল এবং ইহার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন শিশিরকুমার ও মতিলাল ঘোষ এবং Rais and Rayyet পত্রিকার সম্পাদক শম্ভুচন্দ্র মুখার্জী।

পূর্বোক্ত বিবরণগুলি পড়িয়া মনে হয়, প্রথমে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ একযোগে এইরূপ একটি সভা স্থাপনের কল্পনা করিতেছিলেন। কিন্তু কোন কারণে ইহাদের মধ্যে দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল গড়িয়া ওঠে। একটির নেতা শিশিরকুমার ঘোষ; অন্যটির নেতা আনন্দমোহন বসু অথবা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। সহসা প্রথম দল ‘ইণ্ডিয়া লীগ প্রতিষ্ঠা করিলেন, এবং ইহাতে কিছু পরিমাণে মনোমালিন্য ও অসন্তে ষ দেখা দিলেও দ্বিতীয় দল–অর্থাৎ আনন্দমোহন বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী প্রমুখ নেতাগণ–এই লীগে যোগ দিলেন। কিন্তু শীঘ্রই এই দুইজন এবং আরও অনেকে। পদত্যাগ করিলেন। শ্রীযোগেশচন্দ্র বাগল বলেন যে, লীগের সভাপতি শম্ভুচন্দ্র মুখার্জীর উদ্ধত ব্যবহারই এই সকল সদস্যের পদত্যাগের কারণ, কিন্তু তিনি কোন প্রমাণ দেন নাই, তাই ইহা সম্ভব বলিয়া মনে হয় না। কারণ পদত্যাগকারী সদস্যদল ১৮৭৬ সনের ২৬ জুলাই ভারত সভা প্রতিষ্ঠা করিলেন, অথচ ইহার বহু পূর্বেই, জানুয়ারি মাসে শম্ভুচন্দ্র মুখার্জী লীগের সভাপতি পদ ত্যাগ করেন। প্রস্তাবিত কার্যপ্রণালী ও উদ্দেশ্যের দিক দিয়া এই দুই সভার মধ্যে বিশেষ কোন প্রভেদ ছিল না। বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয়, উভয় সভাই ভারতীয়’ (Indian) এই বিশেষণটি ব্যবহার করিয়াছে। অর্থাৎ পূর্ববর্তী ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের দৃষ্টি ছিল ব্রিটিশভারতে সীমাবদ্ধ-নব্য মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায় তাহার স্থানে সমগ্র ভারতবর্ষের ঐক্যের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করিতে প্রয়াস পাইলেন।

রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ‘ইণ্ডিয়ান লীগ’-এর বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজনীয়তা সকলেই অনুভব করিত। এমনকি Englishman পত্রিকাও ইহাকে ভারতের এই প্রান্তে জাতীয় জাগরণের প্রথম বিশেষ নিদর্শন’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছিল। লীগও দেশের নানা হিতকর কার্যে হাত দিয়াছিল। কলিকাতা পৌরসভার সদস্য যাহাতে জনসাধারণ দ্বারা নির্বাচিত হয় তাহার আন্দোলন, এবং কারিগরী শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় (Technical Institute) প্রতিষ্ঠা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান সোসাইটি লীগকে পছন্দ করিত না, এবং পৌরসভার সদস্য নির্বাচন প্রস্তাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে। মোটের উপর লীগের প্রচেষ্টা যে জাতীয় চেতনায় একটি নূতন সাড়া জাগাইয়াছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ভারত সভা প্রতিষ্ঠার পর একই উদ্দেশ্য ও প্রণালীতে গঠিত দুইটি পৃথক সভার অনাবশ্যকতা ও ইহার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশঙ্কা অনেকের মনেই দেখা দিল। সুতরাং এই দুইটি মিলিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেকেই অনুভব করিলেন। ফলে ইণ্ডিয়ান লীগ উঠিয়া গেল এবং ইহার সভাপতি কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি, শিশিরকুমার ঘোষ প্রভৃতি অধিকাংশ প্রধান প্রধান সদস্য ‘ভারত সভায় যোগ দিলেন।

‘ইণ্ডিয়ান লীগ’ স্বল্পকাল স্থায়ী হইলেও বাংলার রাজনীতিক আন্দোলনের ইতিহাসে ইহার একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। “শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণীর রাজনৈতিক সচেতনতার প্রথম সংঘবদ্ধরূপ ‘ভারত সভা’–একথা সুরেন্দ্রনাথ বারংবার বলিয়াছেন”৩৭ কিন্তু ঐতিহাসিক সত্যের অনুরোধে বলিতেই হইবে যে “ইণ্ডিয়ান লীগ’-ই এই গৌরবের যথার্থ দাবি করিতে পারে।

(খ) ভারত সভা (Indian Association)

১৮৭৬ সনের ২৬ জুলাই গোলদীঘির নিকটবর্তী অ্যালবার্ট হলে ‘ভারত সভা প্রতিষ্ঠার উদ্বোধন-সভা হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঠাকুর ল লেকচারার ও ব্যবস্থা-দর্পণ’ প্রণেতা শ্যামাচরণ শর্মা সরকার সভাপতির আসন গ্রহণ করেন এবং সভায় প্রায় সাত-আট শত ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের দুইজন বিশিষ্ট নেতা-মহারাজ নরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব ও কৃষ্ণদাস পাল সভায় যোগদান করেন। এইদিন প্রাতঃকালে প্রধান উদ্যোক্তা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর একমাত্র পুত্রের মৃত্যু হয়, কিন্তু ইহা সত্ত্বেও তিনি সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং সভার প্রারম্ভে যখন ‘ইণ্ডিয়ান লীগের পৃষ্ঠপোষক রেভারেণ্ড কালীচরণ ব্যানার্জী এইপ্রকার আর-একটি সভা প্রতিষ্ঠা করার বিরোধিতা করেন তখন সুরেন্দ্রনাথই তাহার জবাব দেন ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

সভায় মোট তিনটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রথম প্রস্তাবে সভার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, দ্বিতীয় প্রস্তাবে ইহার নামকরণ, ও তৃতীয় প্রস্তাবে কার্যকরী সমিতির গঠন অনুমোদিত হয়।

প্রথম প্রস্তাবটির মূল শব্দগুলি জানা যায় না। তবে সুরেন্দ্রনাথ তাঁহার জীবনচরিতে প্রধানতঃ চারিটি উদ্দেশ্যের উল্লেখ করিয়াছেন : (১) দেশে জনমত গঠন করা; (২) রাজনীতিক স্বার্থ ও লক্ষ্যের ঐক্যকে ভিত্তি করিয়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা; (৩) হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রীর প্রসার; (৪) রাজনীতিক আন্দোলনে যাহাতে অশিক্ষিত জনসাধারণও যোগ দেয় তাহার ব্যবস্থা করা।

তৃতীয় উদ্দেশ্যটি বিশেষ লক্ষণীয়। ইহাতে প্রকারান্তরে অন্ততঃ রাজনীতিক বিষয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিরোধ বা ব্যবধান স্বীকার করা হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, এই উদ্দেশ্যের সফলতার কিছু নিদর্শনস্বরূপ দেখিতে পাওয়া যায় যে এই সভার দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে নবাব মীর মহম্মদ আলি সভাপতির আসন গ্রহণ করেন।

দ্বিতীয় প্রস্তাব সম্বন্ধে সুরেন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন, “ম্যাসিনির (Mazzini) অনুপ্রেরণায় সমগ্র ভারতবাসীকে এক রাজনীতিক গোষ্ঠীতে সংঘবদ্ধ করার মহান আদর্শ তখন বাংলার নেতাগণের মনে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল–সেইজন্যই আমরা ‘ভারত সভা নাম গ্রহণ করিলাম। এস্থলেও স্মরণ রাখা আবশ্যক যে ইহার পূর্বেই ‘ইণ্ডিয়ান লীগ’ এই নামে এক সভা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল এবং তাহা তখনও বিদ্যমান ছিল। সুতরাং এই নামকরণ বিষয়ে নূতন সভার উদ্যোক্তারা কোন মৌলিকতা বা নূতন আদর্শ অবলম্বনের কৃতিত্ব দাবি করিতে পারেন না।”

‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের ন্যায় ভারত সভা আজ পর্যন্তও, নামেমাত্র হইলেও, টিকিয়া আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ইহা বাংলার, তথা ভারতের, একটি বিশিষ্ট রাজনীতিক সংস্থা বলিয়া পরিগণিত হইত। একথা বলিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হইবে না যে, প্রথম দশবৎসরে অর্থাৎ ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ভারতে রাজনীতিক সচেতনতার যে অপূর্ব বিকাশ হয়। এবং যাহার জন্য কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হইয়াছিল–তাহার প্রধান কৃতিত্ব এই ‘ভারত সভা’র এবং বিশেষভাবে ইহার প্রধান কর্মী সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীরই প্রাপ্য। তাহা বর্ণনা করার পূর্বে সুরেন্দ্রনাথের জীবনী সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন।

১৮৪৮ সনে সুরেন্দ্রনাথ কলিকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বি, এ, পাস করিয়া তিনি রমেশচন্দ্র দত্ত ও বিহারীলাল গুপ্তের সহিত একত্রে বিলাত যান এবং তিনজনেই ১৮৬৯ সনে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাস করেন। নিয়মানুযায়ী দুই বৎসর প্রোবেশনারী করিয়া দেশে ফিরিয়া আসেন এবং সিলেটের অ্যাসিষ্ট্যান্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের পদে নিযুক্ত হন (১৮৭১)। তিন বৎসর পর আফিসের কার্যে সামান্য একটি ত্রুটির জন্য তাঁহাকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি বিলাতে যাইয়া এই আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করেন, কিন্তু কোন ফল হয় না। ব্যারিষ্টারীর জন্য ভর্তি হইবার আবেদনও অগ্রাহ্য হয়। হতাশ হৃদয়ে দেশে ফিরিয়া তিনি মেট্রপলিটন কলেজে অধ্যাপকের কার্য গ্রহণ করেন।

এই উপলক্ষে বিলাতে থাকিতেই তিনি ইউরোপের নানা দেশে উনিশ শতকে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিষয়ে বহু গ্রন্থ পাঠ করেন। সর্বত্র এই আন্দোলনগুলিতে তরুণ ছাত্রদের একটি বিশিষ্ট অংশগ্রহণ তাঁহার মনে গভীর রেখাপাত করে। দেশে ফিরিয়া তিনি আনন্দমোহন বসু প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা ছাত্র সভা’তে (Calcutta Students’ Association) যোগদান করেন এবং ইহার প্রাণস্বরূপ বলিয়া গণ্য হন। শীঘ্রই তিনি অসাধারণ বাগ্মিতার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং নানা ঐতিহাসিক বিষয়ে ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা করিয়া তরুণ সম্প্রদায়ের মনে দেশের প্রতি অনুরাগের উদ্দীপনা সৃষ্টি করেন। তাঁহার এইসব বক্তৃতায় যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে কী উন্মাদনার সৃষ্টি হইয়াছিল তদানীন্তন ছাত্র এবং পরবর্তীকালের প্রসিদ্ধ দেশনায়ক বিপিনচন্দ্র পাল তাঁহার ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে তাহার কিছু আভাস দিয়াছেন। শিখ জাতির অভ্যুদয় এবং ম্যাসিনি ও যুব-ইটালী (Joseph Mazzini and the Young Itally Movement) এই দুইটি বক্তৃতা তাঁহার শ্রোতাদের মনে কিরূপ স্বদেশের প্রতি অনুরাগ ও ইংরেজের প্রতি বিরাগের গভীর অনুভূতি জাগাইয়াছিল, বিপিনচন্দ্র নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতে তাহার চমৎকার বর্ণনা করিয়াছেন। এই সমুদয় বক্তৃতার ফলে ভারতীয় যুবকদের মনে পরাধীন ইটালীর প্রতি সমবেদনা ও তাহার মুক্তিসংগ্রামের সহিত সহানুভূতি জাগিয়া উঠিল এবং কলিকাতার ছাত্রসমাজে ইটালীর অনুকরণে কতকগুলি গুপ্ত বিপ্লব-সমিতির সৃষ্টি হইয়াছিল। বিপিনচন্দ্র বলেন, সম্ভবতঃ সুরেন্দ্রনাথ নিজেও এইরূপ কয়েকটি গুপ্ত সমিতির সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ইহা সত্য হইলেও সুরেন্দ্রনাথ ছাত্রদের সম্বোধন করিয়া প্রকাশ্যে যেসব বক্তৃতা দিতেন তাহাতে স্পষ্ট বলিতেন যে, আমাদের দুর্দশা দূর করিবার জন্য হিংসাত্মক কার্য বা বলপ্রয়োগের প্রয়োজন নাই। অন্য দেশ জোরজবরদস্তি করিয়া রাজ্যশাসনের যে-সকল সুবিধা বা অধিকার আদায় করিয়াছে আমরা আইনসম্মত আন্দোলন (Constitutional agitation) দ্বারাই তাহা লাভ করিতে পারিব। কিন্তু শান্তির পথ হইলেও ইহা আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে, এই আন্দোলন আমাদের সম্মুখের একটি কঠোর কর্তব্যরূপে বিদ্যমান, আর এই কর্তব্যপালনে বিমুখতা ভগবান ও মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল্য।

সুরেন্দ্রনাথ যে জাতীয়তা প্রচার করিতেন তাহা সর্বভারতীয়। নানকের দৃষ্টান্ত স্মরণ করাইয়া তিনি শ্রোতাগণকে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, পার্শী, শিখ প্রভৃতি ভারতের সকল সম্প্রদায়ের ঐক্য ও প্রীতির বন্ধনের উপর জাতীয়তা স্থাপনের জন্য উদাত্তস্বরে আহ্বান করিয়া বলিয়াছিলেন, আইস আমরা পুরাতন কলহ বিবাদ বিসম্বাদ প্রভৃতি বিস্মৃত হইয়া পরস্পর ভ্রাতৃভাবে আলিঙ্গনবদ্ধ হইয়া আমাদের সকলের প্রিয় মাতৃভূমির দুঃখ ঘুচাইবার জন্য একযোগে কার্যক্ষেত্রে অগ্রসর হই।’৪০ পূর্বে হিন্দু ও মুসলমানদের যে স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধের উল্লেখ করা হইয়াছে তাহার বহু ঊর্ধ্বে উঠিয়া সুরেন্দ্রনাথ আজীবন ভারতে ভাষা, জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে এক অখণ্ড জাতীয়তা প্রচার করিয়াছেন। এই নূতন আদর্শ যে বিংশ শতকে অন্ততঃ হিন্দুদের মধ্যে প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল, তাহার কৃতিত্ব অনেক পরিমাণে সুরেন্দ্রনাথেরই প্রাপ্য।

সুরেন্দ্রনাথ যে-সময়ে রাজনীতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন তখন বাংলা দেশে ধর্ম ও সমাজের সংস্কার লইয়া তুমুল আন্দোলন চলিতেছিল। সুরেন্দ্রনাথ রাজনীতিক উন্নতির দিকে দেশের দৃষ্টি ফিরাইলেন। বাংলার শিক্ষিত যুবকগণ যে ক্রমশঃ ধর্ম ও সমাজের সংস্কার অপেক্ষা দেশের রাজ্যশাসনে অধিকার স্থাপনেই বেশী আগ্রহশীল হইল, তাহার প্রধান কারণ সুরেন্দ্রনাথ তাঁহার অসাধারণ বাগ্মিতা সহকারে এক নূতন বাণী ও নূতন আদর্শ তাহাদের হৃদয়ে গভীরভাবে অঙ্কিত করিলেন। ইহাই বাংলার নবজাগরণে সুরেন্দ্রনাথের বিশিষ্ট এবং হয়ত সর্বশ্রেষ্ঠ দান। বিপিনচন্দ্র পাল নিজে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং এই সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন, বাগ্মীবর কেশবচন্দ্র সেন কর্তৃক অনুপ্রাণিত ব্রাহ্মসমাজের চেষ্টায় বঙ্গদেশে ধর্ম ও সমাজ-বিপ্লবের যে প্রবল স্রোত বহিয়াছিল তাহা অপেক্ষা সুরেন্দ্রনাথের রাজনীতিক প্রচার ক্রমেশই অধিকতর সংখ্যায় যুবকদলকে আকৃষ্ট করিল।৪১ ব্রাহ্মসমাজের জনপ্রিয়তা হ্রাসের ইহাও একটি অন্যতম কারণ, এরূপ সিদ্ধান্ত করা অসঙ্গত নহে।

‘ভারত সভা’ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই সুরেন্দ্রনাথ রাজনীতিক প্রচারের কার্যে তাঁহার সমগ্র শক্তি নিয়োগ করিলেন। ইহার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া সম্ভবপর নহে। মাত্র কয়েকটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ করিব।

১৮৭৬ সনে বিলাতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সম্বন্ধে এক নূতন বিধি প্রবর্তিত হইল। ইহার ফলে পরীক্ষার্থীদের উধ্বর্তন বয়স ২১ বৎসর হইতে কমাইয়া ১৯ বৎসর করা হইল। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার ফলে ক্রমশঃ অধিক সংখ্যায় ভারতবাসী এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া এতদিন পর্যন্ত যে-সকল উচ্চ রাজপদে কেবলমাত্র ইংরেজই নিযুক্ত ছিল তাহা অধিকার করিবে এই সম্ভাবনা দেখা দিল। ইহা দূর করিবার জন্যই যে নূতন বিধান প্রচলিত হইয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ অনধিক ১৯ বৎসর বয়স্ক কোন ভারতীয় ছাত্রের পক্ষে সুদূর বিলাতে সম্পূর্ণ অভিনব প্রণালীতে শিক্ষালাভ করিয়া এবং তদনুযায়ী পরীক্ষায় ইংরেজ ছাত্রদিগের সহিত প্রতিযোগিতা করিয়া সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার, ইহা সহজেই বুঝা যায়। সুতরাং, যে একটিমাত্র উপায়ে ভারতীয়েরা ইংরেজশাসনে উচ্চপদ অধিকার করিতে পারিতেন তাহা বিশেষভাবে সঙ্কোচ করা হইল। ইহাতে ভারতের শিক্ষিত মহলে বিশেষ ক্ষোভের সৃষ্টি হইল। ভারত সভা ইহা ভারতের জাতীয় চেতনা বৃদ্ধির এক অপূর্ব সুযোগ মনে করিয়া এ-বিষয়ে তুমুল আন্দোলন আরম্ভ করিল। ১৮৭৭ সনের ২৪ মার্চ ভারতসভার উদ্যোগে আহূত এক প্রকাশ্য সভায় এই নূতন বিধির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করা হইল। এই আন্দোলনকে একটি নিখিল-ভারতীয় রূপ দিবার জন্য ভারতসভার তরফ হইতে ভারতে বিভিন্ন প্রদেশের নেতাদের মতামত জানিবার প্রার্থনা করিয়া চিঠি লেখা হইয়াছিল। ইহার উত্তরে যেসব চিঠি ও টেলিগ্রাম আসিয়াছিল উক্ত সভায় তাহা পাঠ করা হইল। এই অভিনব পন্থা পরবর্তীকালে রাজনীতিক আন্দোলনে খুব সুপরিচিত হইলেও ভারতসভাই এই উপলক্ষে ইহার প্রথম প্রবর্তন করে। সমগ্র ভারত হইতে প্রতিবাদের অনুমোদন পঠিত হইলে উক্ত সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হইল যে, বিলাতে পার্লিয়ামেন্টে এই মর্মে একটি আবেদনপত্র (Memorial) পাঠানো হউক যাহাতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা একই সময়ে লণ্ডনে এবং ভারতবর্ষে দুই-একটি কেন্দ্রে গ্রহণ করা হউক এবং পরীক্ষার্থীদের ঊর্ধ্বতন বয়স ২২ বৎসর নিরূপিত হউক। এই-যে আন্দোলন আরম্ভ হইল, উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের বহুবৎসর যাবৎ ইহা চলিয়াছিল। অবশেষে সুদীর্ঘকাল পরে ইংরেজ সরকার এই। প্রস্তাব মোটামুটিভাবে কার্যে পরিণত করিতে বাধ্য হয়।

ভারতসভা কেবল সভা-সমিতিতে প্রতিবাদ এবং পার্লিয়ামেন্টে আবেদনপত্র পাঠাইয়াই ক্ষান্ত হইল না। সমগ্র ভারত এই নূতন বিধানের বিরুদ্ধে একমত হওয়ায় যাহাতে এই সুযোগে সমগ্র ভারতে একই অসুবিধা ও অভিযোগ এবং একই রাজনীতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত একটিমাত্র রাজনীতিক গোষ্ঠীর, এবং সেই ভিত্তির উপর একটি নিখিল ভারতীয় রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করা যায় সেইদিকে ভারতসভা দৃষ্টি দিল। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সুরেন্দ্রনাথকে ভারতসভার বিশেষ প্রতিনিধিরূপে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে পাঠানো হইল। ১৮৭৭ সনের ২৬ মে সুরেন্দ্রনাথ কলিকাতা হইতে যাত্রা করিয়া উত্তরভারতের বারাণসী, এলাহাবাদ, কানপুর, লক্ষ্ণৌ, আলিগড়, দিল্লী, আগ্রা, মীরাট, অমৃতসর ও লাহোর এবং পরবর্তী বৎসরে বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রদেশের বহু স্থান পরিভ্রমণ করিলেন। প্রতিটি স্থানেই তাহার বক্তৃতা শুনিবার জন্য প্রকাশ্য সভায় বহু লোকের সমাগম হইত এবং কলিকাতার সভায় যে-প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল তাহাও অনুমোদন করা হইত। আলিগড়ের সভায় প্রসিদ্ধ মুসলমান নেতা সৈয়দ আহমদ সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন।

বিভিন্ন স্থানে যে-সকল রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ছিল, সুরেন্দ্রনাথ তাহাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করিয়া একই পদ্ধতিতে কার্য করিবার ব্যবস্থা করিলেন এবং এলাহাবাদ, কানপুর, লক্ষ্ণৌ, মীরাট ও লাহোরে তিনি কলিকাতার ভারতসভার সহিত একযোগে কার্য করার জন্য নূতন নূতন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করিলেন। এইরূপে ভারতের রাজনীতিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে কার্য করিবার যে সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হইল, উনিশ শতকের ইতিহাসে তাহা একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা, ভারতের মুক্তিসংগ্রামে ইহা ভারতসভা ও সুরেন্দ্রনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য।

সুরেন্দ্রনাথের ভারত-ভ্রমণের প্রসঙ্গে পরবৎসর সিভিল সার্ভিসের কর্মচারী হেনরী কটন (Henry Cotton) মন্তব্য করিয়াছিলেন, ২৫ বৎসর পূর্বে কেহ কল্পনাও করিতে পারে নাই যে পঞ্জাবে বাঙ্গালী কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে, কিন্তু আজ সুরেন্দ্রনাথের নাম ঢাকা হইতে মুলতান পর্যন্ত সমান উৎসাহ সৃষ্টি করে, আর বাঙ্গালী বাবুরাই এখন পেশওয়ার হইতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত লোকমত গঠন করে। সুরেন্দ্রনাথের এই সার্থক রাজনীতিক সফরের ফলে প্রমাণিত হইল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে এমন একটি ঐক্যসূত্রের বন্ধন আছে যাহা পূর্বে কেহ কল্পনাও করে নাই, এবং ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের আন্দোলন অপেক্ষা রাজনীতিক আন্দোলনই জনসাধারণের চিত্র বেশী আকৃষ্ট করিতে পারে। সুরেন্দ্রনাথের অনুকরণে ১৮৭৮ সনের প্রথমভাগে পুনা ও পঞ্জাবের রাজনীতিক নেতারা কলিকাতায় আসিলেন। ঐক্যবদ্ধভাবে সমগ্র ভারতে একটি রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের পথ সুগম হইল।

এই সময়ে গণ-আন্দোলনের আর-একটি সুযোগ উপস্থিত হইল। ১৮৭৮ সনের ১৪ মার্চ বড়লাট লর্ড লিটনের আমলে দেশীয় সংবাদপত্র আইন (Vernacular Press Act) আইন পরিষদের একদিনের অধিবেশনে পাশ হইয়া গেল। জাতীয় চেতনার উদ্বোধক ও বাহক দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির কণ্ঠরোধ করাই এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল। ইহার অব্যবহিত পরেই জনসাধারণের পক্ষে অনিষ্টকর আরও দুইটি আইন পাশ হইল। প্রথমটি, অন্ত্র আইন (Arms Act)–যাহার ফলে কোন ভারতীয় বিনা লাইসেন্সে বন্দুক, পিস্তল প্রভৃতি রাখিলে দণ্ডনীয় হইবে। দ্বিতীয়, লাইসেন্স আইন (License Act)। ইহার ফলে ব্যবসায়ীদিগকে টাকা দিয়া লাইসেন্স লইতে হইবে।

ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশ্য জনসভার আহ্বান করিয়া এইসব আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করিল। দেশীয় সংবাদপত্র আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন খুব তীব্র আকার ধারণ করিল। কলিকাতায় টাউন হলে যে বিরাট প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হইল (১৮৭৮, ১৭ই এপ্রিল) তাহাতে প্রায় পাঁচহাজার লোক উপস্থিত ছিল। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ছাড়া আর সকল রাজনীতিক সম্প্রদায় এই সভায় প্রতিবাদ প্রস্তাব সমর্থন করিল। এই জনসভার প্রস্তাব পূর্বেই অন্য সব প্রদেশের নেতাদিগকে জানান হইয়াছিল। বিভিন্ন স্থান হইতে বহু সমর্থনসূচক চিঠি ও টেলিগ্রাম আসিয়াছিল। রাজনীতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব যে অভিজাত সম্প্রদায়ের হাত হইতে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতশ্রেণীর হাতে গিয়া পড়িতেছিল, এইসব সভা-সমিতির অধিবেশন তাহার স্পষ্ট নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।

পূর্বোক্ত কলিকাতা টাউন হলের জনসভার নির্দেশমত দেশীয় সংবাদপত্র আইনের বিরুদ্ধে একটি দরখাস্ত বিলাতে পালিয়ামেণ্ট মহাসভায় সরকারের বিরোধীপক্ষের নেতা প্রসিদ্ধ রাজনীতিক গ্লাডস্টোনের (Gladstone) নিকট পাঠানো হইল। গ্লাডস্টোন এই আইনের বিরুদ্ধে পালিয়ামেন্টে একটি প্রস্তাব আনিলেন। ইহা লইয়া বহু বিচার বিতর্ক ও অবশেষে ভোট লওয়া হইল। গ্লাডষ্টোনের প্রস্তাবের সপক্ষে ছিলেন ১৫২ ও বিপক্ষে ছিলেন ২০৮ জন। ইহাতে বেশ বুঝা গেল, বিলাতের একটি বড় রাজনৈতিক দল ভারতবাসীর বিরোধিতা সমর্থন করিয়াছিল। ইহার পূর্বে এরূপ সমর্থন আর কখনও পাওয়া যায় নাই। এই আন্দোলনেও ভারতের রাজনীতিক ঐক্যবদ্ধতার আর-একটি নিদর্শন পাওয়া গেল। আর এই আন্দোলন একেবারে নিষ্ফল হয় নাই কারণ ইহার ফলে গভর্নমেন্ট দেশীয় সংবাদপত্র আইনের কিছু পরিবর্তন করিয়াছিল।

এই সংঘবদ্ধতায় অনুপ্রাণিত হইয়া ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন আর-একটু অগ্রসর হইল। পূর্বেই বলা হইয়াছে, সুরেন্দ্রনাথ ভারতের নানাস্থানে জনসভায় বক্তৃতা করেন, ফলে সর্বত্র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের বয়স কমানোর প্রতিবাদমূলক একটি আবেদনপত্রের খসড়া গৃহীত হয়। ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন স্থির করল, এই আবেদনপত্র ডাকে না পাঠাইয়া তাহাদের একজন প্রতিনিধিকে এই আবেদনপত্র দাখিল করিবার জন্য বিলাতে পাঠানো হইবে যাহাতে তিনি এ বিষয়ে বক্তৃতার সাহায্যে ভারতবাসীর মনোভাব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করিতে পারেন। প্রসিদ্ধ ব্যারিষ্টার লালমোহন ঘোষ এই প্রতিনিধি নিযুক্ত হইলেন এবং প্রাতঃস্মরণীয়া কাশিমবাজারের দানশীলা মহারাণী স্বর্ণময়ী তাঁহার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করিতে স্বীকৃত হইলেন। বিলাতের পার্লিয়ামেন্ট ভরনের একটি কক্ষে (Wills’s Rooms) একটি জনসভা হইল, সভাপতি ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ নেতা জন ব্রাইট (Jobn Bright)। এই সভায় লালমোহন ঘোষ অপূর্ব বাগ্মিতাসহকারে ভারতবাসীর অভিযোগ ব্যাখ্যা করিয়া যে বক্তৃতা করিলেন তাহাতে ইংরেজ শ্রোতারা বিস্মিত ও মুগ্ধ হইল। ইহার ফলও হাতে-হাতে পাওয়া গেল। এই বক্তৃতার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই Statutory Civil Service-এর নিয়মাবলী বিলাতের কমন্সসভায় পেশ করা হইল। এ সম্বন্ধে পূর্বেই বলা হইয়াছে।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লালমোহন ঘোষ বিলাত হইতে ফিরিবার পথে বোম্বাই শহরের লোকেরা তাহাকে এক প্রকাশ্য সভায় অভিনন্দিত করে। এই সভার সভাপতি লালমোহনকে অভ্যর্থনা করিয়া বলেন, লালমোহন কলিকাতা হইতে প্রতিনিধিরূপে বিলাত গিয়াছিলেন। আমরা কিন্তু তাঁহাকে কেবল কলিকাতার নহে, সমস্ত পশ্চিমভারতেরও প্রতিনিধি বলিয়া অভ্যর্থনা করিতেছি। সুরেন্দ্রনাথ ভারতময় যে রাজনীতিক ঐক্যের বীজ বপন করিয়াছিলেন তাহা কিরূপে দ্রুত অঙ্কুরিত হইয়াছিল, বম্বে শহরে লালমোহনের অভ্যর্থনা তাহার একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন। লালমোহনের একটি উক্তিও বিশেষ স্মরণীয়। তিনি বলিয়াছিলেন, “ভারতের যে জনমত আজ ক্ষীণকায় স্রোতে প্রবাহিত হইতেছে, আমাদের সমবেত চেষ্টায় তাহা একদিন জাতীয় সচেতনতার বেগবতী বিশাল নদীতে পরিণত হইবে।” অল্প কয়েক বৎসরের মধ্যেই তাঁহার এই ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইয়াছিল।

ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন রাজ্যশাসন-সংক্রান্ত ব্যাপারে খুব তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিত এবং ভারতবাসীর স্বার্থহানিজনক কোন ব্যাপার ঘটিলে সভা ডাকিয়া তাহার প্রতিবাদ করিত। দ্বিতীয় আফগানযুদ্ধের ব্যয়ভার ভারতের উপর চাপানো এবং বিলাতে ম্যাঞ্চেষ্টারের বস্ত্রশিল্পের স্বার্থে বিলাতী বস্ত্রের আমদানি-কর হ্রাস করিয়া দেশীয় বস্ত্রশিল্পের অনিষ্ট সাধন–এই দুইয়ের তীব্র প্রতিবাদ জানাইতে যে সভা আহূত হয় তাহাতে প্রায় তিন হাজার লোক উপস্থিত ছিল। উপরন্তু এই সভার উদ্দেশ্যের সহিত সহানুভূতি জানাইয়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে বহু চিঠি ও টেলিগ্রাম আসিয়াছিল। দেশের শাসনকার্যে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা দেওয়া এবং তাহার সফলতার সোপানস্বরূপ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে, অর্থাৎ মিউনিসিপ্যালিটি, জিলা বোর্ড প্রভৃতি পরিচালনায় সরকারী কর্মচারীর প্রভাব কমাইয়া দেশীয় সদস্যদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, ইত্যাদি নানা বিষয়ে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন আন্দোলন করে ও কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন জানায়। এইসব আন্দোলনের ফলে একদিকে জাতীয় সচেতনতার এবং অন্যদিকে সর্বভারতীয় রাজনীতিক ঐক্যের বৃদ্ধি হয়।

(গ) ইলবার্ট বিল

১৮৮৩ সনে ইলবার্ট বিল আন্দোলনে এই জাতীয়তা ও ঐক্যবোধ সহসা অসম্ভব রকমে জাতীয় চেতনায় সাড়া জাগায়। এই সময় ইংরেজ বিচারক ভিন্ন আর কেহ, এমনকি এদেশীয় সিভিলিয়ান ম্যাজিষ্ট্রেটও, ইংরেজ অপরাধীর বিচার করিতে পারিত না। ১৮৪৯ সনে গভর্নমেন্ট এইরূপ অসঙ্গত অধিকার রহিত করার জন্য আইন পাশ করিবার চেষ্টা করিলেও এদেশীয় ইংরেজ-সম্প্রদায়ের বিরোধিতায় সেই “কালো আইন” (Black Acts) প্রত্যাহার করিতে বাধ্য হয়–ইহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। ১৮৮৩ সনে বড়লাটের সভার আইনসদস্য ইলবার্ট সাহেব আবার এই কুপ্রথা বিলোপ করার জন্য আইন প্রণয়ন করেন। ইহার প্রতিবাদে এদেশের সকল শ্রেণীর ইংরেজ অত্যন্ত জঘন্য রকমের যে তুমুল আন্দোলন করে এবং টাউন হলে প্রকাশ্য সভায় প্রতিবাদ উপলক্ষে যে কুৎসিত ভাষা ও অভদ্র আচরণ করে তাহার তুলনায় পূর্ববারের আন্দোলন অতিশয় নগণ্য বলিয়াই মনে হইবে। কিন্তু ১৮৪৯ সনের তুলনায় ১৮৮৩ সনে বাঙ্গালীর জাতীয় চেতনা অনেক বেশী জাগ্রত হইয়াছিল বলিয়া তাহারাও পাল্টা জবাব দেয়। ইংরেজ ও বাঙ্গালী ব্যারিষ্টারের মধ্যেও অভদ্র ভাষায় গালাগালি চলিতে থাকে। কবিবর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপলক্ষে যে চমৎকার একটি বিদ্রুপাত্মক কবিতা লেখেন, তাহা তখন বাঙ্গালীর মুখে-মুখে ফিরিত। ইহার আরম্ভ এইরূপ :

“গেল রাজ্য, গেল মান,    ডাকিল ইংলিশম্যান,
ডাক ছাড়ে ব্রাশন্ কেশুয়িক মিলার–
‘নেটিবের কাছে খাড়া,     নেভার-নেভার।
… … …
হিপ হিপ হিপ হুরে     হ্যাট কোট বুট পরে
সরা ভাবে জগতেরে–তাদের বিচার।
নেটিবের কাছে হবে?     “নেভার-নেভার”।।
“নেভার”–সে অপমান    হতমান বিবিজান,
নেটিবে পাবে সন্ধান আমাদের “জানানা”?
দেহে প্রাণ, বিবিজান! কখনো তা হবে না।”

ইংরেজরা প্রায় দেড় লক্ষ টাকা চাঁদা তুলিয়া ভারতের নানা স্থানে প্রতিরক্ষা সমিতি (Defence Association) গড়িল এবং ভারতীয়দের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটাইতে লাগিল। হেমচন্দ্রের কবিতায় যে ব্রানশনের নাম আছে তিনি ছিলেন একজন ব্যারিষ্টার। কদর্য ভাষায় ভারতীয়দের কুৎসা গাহিয়া তিনি কলিকাতায় বিশেষ কুখ্যাত হইয়াছিলেন, আর বাঙ্গালী ব্যারিষ্টার লালমোহন ঘোষও ইহার “উতোর” (উত্তর) অর্থাৎ পাল্টা জবাব দিয়াছিলেন।

ইংরেজের দল ক্ষেপিয়া গিয়াছিল। তাহারা বড়লাট রিপনকে কলিকাতা রাজভবনের তোরণের সম্মুখে অপমান করে। রিপন যখন দার্জিলিং হইতে ফিরিতেছিলেন তখন নীলকর ইংরেজের দল এক রেলওয়ে ষ্টেশনে উচ্চৈঃস্বরে তাঁহার প্রতি অশিষ্ট মন্তব্য করে। কটন সাহেব লিখিয়াছেন, সরকারী কর্মচারী ছাড়া আর সকল শ্রেণীর ইংরেজই ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে যোগদান করে এবং তাহাদের মধ্যে একদল গোপনে ষড়যন্ত্র করে যে, বড়লাট এই আইন পাশ করার সঙ্কল্প ত্যাগ না করিলে তাহারা রাজভবনে ঢুকিয়া তাঁহাকে চাঁদপাল ঘাটে এক ষ্টীমারে জোর করিয়া উঠাইয়া বিলাত পাঠাইয়া দিবে। কটন লিখিয়াছেন যে, সরকারী ইংরেজ কর্মচারী, এমনকি উচ্চপদস্থ সিভিলিয়ানরা, পরোক্ষে এই বিরোধী আন্দোলনের সমর্থন করিত; অর্থাৎ এক কথায় নীলকর, ব্যবসায়ী, ব্যারিষ্টার ও কর্মচারী–সকল ইংরেজই ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে একজোট হইয়াছিল। ইহার ফলে বড়লাট লর্ড রিপন ইচ্ছা থাকিলেও ইলবার্ট বিল পাশ করিতে ভরসা পাইলেন না। উক্ত আইনের খসড়া এমনভাবে পরিবর্তন করা হইল যে মূল উদ্দেশ্যের কিছুই সিদ্ধ হইল না।

(ঘ) নিখিল ভারতীয় জাতীয় সম্মেলন

বিশেষ করিয়া বাঙ্গালীর ইহাতে মর্মান্তিক আঘাত পাইল, এই কারণে যে সাহেব ও ভারতীয়ের এই দ্বন্দ্ব বাংলাতেই বেশী এবং বম্বেতে কিছু পরিমাণে হইয়াছিল। ভারতের অন্য প্রদেশে এই আন্দোলন বেশী ছড়ায় নাই।

কিন্তু একদিক দিয়া ইহা শাপে বর হইল। ইংরেজদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তি দেখিয়া বাঙ্গালীরাও ইহার মূল্য বুঝিতে পারিল এবং এই ঘটনায় জাতীয় সচেতনতা ও রাজনীতিক ঐক্যবোধের প্রেরণা অসম্ভব রকমে বাড়িয়া গেল। ইহার আর একটি অবান্তর ফল হইল এই যে, বিলাত-ফেরৎ একদল বাঙ্গালী–যাহারা মনেপ্রাণে সাহেবী ভাবে ডুবিয়া সাহেবদের সমাজে ময়ূরপুচ্ছাধারী কাকের মত মিশিবার জন্য ব্যগ্র ছিলেন–তাঁহাদের এই বিদেশীয়ানার ভাব অনেকটা শিথিল হইল। এই শ্রেণীর বাঙালীর আত্মচেতনা অনেক পরিমাণে ফিরিয়া আসিল এবং এইভাবে ইংরেজ ও বাঙ্গালী সমাজের মধ্যে একটি গুরুতর ব্যবধানের সৃষ্টি হইল।

ইলবার্ট বিলের আন্দোলনে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা শেষ হইতে–হইতে আর-একটি ঘটনা, কেবল বাংলা দেশে নহে, ভারতের জাতীয় জীবনে বিষম আলোড়নের সৃষ্টি করিল। হাইকোর্টের জজ নরিস সাহেব একটি মোকদ্দমায় একজন হিন্দুকে তাঁহার বাড়ীর শালগ্রাম শিলা আদালতে আনিবার আদেশ দেন। ইহার বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ তাঁহার সম্পাদিত ‘বেঙ্গলী’ (Bengalee) কাগজে তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি নরিসকে ইংলণ্ডের ইতিহাসে কুখ্যাত বিচারক জেফ্রির (Jeffreys) সহিত তুলনা করেন এবং মন্তব্য করেন যে নরিস জজের পদের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। ইহাতে নরিস সাহেব আদালতের অবমাননা (Contempt to Court) করার অপরাধে সুরেন্দ্রনাথকে অভিযুক্ত করেন। সুরেন্দ্রনাথ ক্ষমা প্রার্থনা করা সত্ত্বেও ইংরেজ জজেরা তাহাকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া দুইমাস কারাদণ্ডের আদেশ দেন, একজন মাত্র দেশীয় জজ যিনি ছিলেন তিনি ইহাতে আপত্তি করেন।

জজ নরিস সাহেব ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধ আন্দোলনের একজন প্রধান পাণ্ডা ছিলেন। অনেকটা এই কারণেও প্রথম হইতেই এই বিচারপৰ্ব তুমুল আন্দোলন সৃষ্টি করে। বিচারের সময় আদালতে লোক ধরিত না এবং দণ্ডের আদেশ শুনিয়া বিপুল জনতার এক অংশ-বেশীর ভাগ ছাত্রের দল-উত্তেজিত হইয়া আদালতকক্ষের জানালা ঢিল ছুড়িয়া ভাঙ্গিয়া দেয় এবং পুলিশের গায়েও ঢিল মারে। ব্যাপার এত গুরুতর হইয়া দাঁড়ায় যে সুরেন্দ্রনাথকে প্রকাশ্যে কয়েদীর গাড়ীতে নিতে ভরসা না পাইয়া পুলিশ পশ্চাতের দ্বার দিয়া ঠিকা গাড়ীতে সুরেন্দ্রনাথকে জেলে নিয়ে যায়।

ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে ইংরেজদের আন্দোলনের ন্যায় সুরেন্দ্রনাথের কারাদণ্ডও শাপে বর হইল। এই দণ্ডাদেশ সমস্ত বঙ্গদেশে যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি করিল, ইতিপূর্বে কখনও সেরূপ দেখা যায় নাই। সমস্ত কাজকর্ম দোকান-পাট বন্ধ হইল এবং বাংলার প্রতিটি শহর ছাড়াও বাংলার বাহিরে বহুসংখ্যক প্রতিবাদসভা হইল। কখনও কখনও শ্রোতার সংখ্যা এত অধিক হইত যে বাহিরে খোলা জায়গায় সভা করিতে হইতে। ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক আয়োজিত সভার অধিবেশন হয় কলিকাতার বিডন স্কোয়ারে (১৮৮৩ সনের ১৬ মে)। এই সভায় প্রায় বিশ হাজার লোক সমবেত হইয়াছিল-কলিকাতায় এত বড় সভা পূর্বে কখনও হয় নাই। মফঃস্বলের বহু প্রতিনিধি সভায় যোগদান করিয়াছিলেন এবং বহু চিঠি ও টেলিগ্রাম আসিয়াছিল। স্বদেশীয় আন্দোলনের পূর্বে বাংলাদেশে এরূপ জনবিক্ষোভের পরিচয় পাওয়া যায় না। আর কেবল বাংলা দেশে নহে, ভারতের সর্বত্র-আগ্রা, ফৈজাবাদ, অমৃতসর, লাহোর, পুনা প্রভৃতি শহরে-সুরেন্দ্রনাথের প্রতি সহানুভূতি ও তাঁহার কারাদণ্ডের প্রতিবাদ জানাইবার জন্য জনসভা আহত হয়। কাশ্মীরে ইংরেজীতে অনিভজ্ঞ একজন পণ্ডিত “আমাদের ভাই সুরেন্দ্রনাথ আজ জেলে” এই বলিয়া সভাস্থলে কাঁদিয়া ফেলিলেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের ভাব কিরূপ বিস্তৃত হইয়াছিল এই সকল সভা-সমিতি হইতে তাহা বুঝা যায়।

১৮৮৩ সনের ৪ঠা জুলাই সুরেন্দ্রনাথ মুক্তিলাভ করিলেন। ১৭ই জুলাই তাঁহার অভিনন্দনের জন্য এক বিরাট সভা হয়। দশ হাজারের বেশী লোক সমবেত হইয়াছিল। এই সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় যে ভারতে ও বিলাতে রাজনীতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে বিধিসম্মত প্রণালীতে আন্দোলন (constitutional agitation) চালাইবার জন্য একটি জাতীয় তহবিল (National Fund) গঠন করা হউক। এই তহবিলে প্রায় কুড়ি হাজার টাকা চাঁদা উঠিল এবং ইহা রাজনীতিক কার্যের জন্য ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের হাতে দেওয়া হইল।৪৩

ইলবার্ট বিলের সপক্ষে ও সুরেন্দ্রনাথের কারাদণ্ডের প্রতিবাদে যে উত্তেজনাময় ব্যাপক আন্দোলন হয় তাহাতে ছাত্রগণ একটি সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তাহারা সভার অনুষ্ঠানে নানাপ্রকার সাহায্য করিত এবং গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ প্রদর্শন করিত। কোন কোন স্থলে তাহারা যে আইনের সীমা লঙ্ন করিয়া ঢিল ছোঁড়া, জানালা ভাঙ্গা প্রভৃতি হিংসাত্মক কার্যেও ব্রতী হইত তাহা পূর্বে বলিয়াছি। বিশ শতকে, বিশেষতঃ বিগত ষষ্ঠ ও সপ্তম দশকে, ইহা খুব সাধারণ ও সুপরিচিত নিত্য ঘটনা হইলেও ১৮৮৩ সনের পূর্বে ইহার পরিচয় পাওয়া যায় নাই। সুতরাং ছাত্রগণের রাজনীতিক আন্দোলনে প্রকাশ্যে ও সক্রিয়ভাবে যোগদান করার ইহাই প্রথম ঐতিহাসিক নিদর্শন।

ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন সমগ্র ভারতের সহিত রাজনীতিক সম্বন্ধ স্থাপন করিলেও ইহা ছিল একটি প্রাদেশিক প্রতিষ্ঠান মাত্র। সুতরাং ইহার সাফল্যে উৎসাহিত হইয়া অনেকেই একটি নিখিল ভারতীয় রাজনীতিক সংঘের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিতেছিলেন। ইলবার্ট বিলের প্রতিরোধের জন্য সমগ্র ভারতের ইংরেজ অধিবাসীরা মিলিয়া যে একটি প্রতিরক্ষা সমিতি গঠিত করে এবং যাহার ফলে তাহাদের সাফল্যের পথ অনেক পরিমাণে সুগম হয়, সম্ভবত তাহাও এই প্রয়োজনীয়তার দিকে ভারতীয়গণের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়াছিল। ইলবার্ট বিল ও সুরেন্দ্রনাথের কারাদণ্ডে ভারতময় যে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল ইহাই এইরূপ সংঘ প্রতিষ্ঠার অপূর্ব সুযোগ মনে হইল। ১৮৮৩ সনে গভর্নমেন্ট কলিকাতায় এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর (International Exhibition) ব্যবস্থা করিয়াছিল। এই উপলক্ষে বহু প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ভারতের নানা প্রদেশ হইতে কলিকাতায় আসিবেন–সুতরাং ইহাও এইরূপ সংঘ প্রতিষ্ঠার অনুকূল হইবে। এই সমুদয় বিবেচনা করিয়া ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন উত্তরভারতে তাহাদের সভার শাখাগুলি এবং বম্বে ও মাদ্রাজের রাজনীতিক সভাগুলির নিকট হইতে অনুমোদন ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পাইয়া ১৮৮৩ সনের ২৮, ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর কলিকাতায় একটি জাতীয় মহাসভা (National Conference) আহ্বান করিল।

এই সভার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সুরেন্দ্রনাথ বলেন, দেশের বিভিন্ন রাজনীতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন করে, ফলে অযথা শক্তি ক্ষয় হয়। যদি একই কেন্দ্র হইতে পরস্পর আলোচনা করিয়া আমরা একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি স্থির করিতে পারি তাহা হইলে সফলতার সম্ভাবনা অনেক বৃদ্ধি পায়। এই উদ্দেশ্যেই ‘জাতীয় মহাসভা আহূত হইয়াছে। ইহা কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা কোন প্রদেশের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি না রাখিয়া সমগ্র ভারতের যাহাতে কল্যাণ হয় কেবলমাত্র তাহারই চেষ্টা করিবে।

কলিকাতা অ্যালবার্ট হলে ১৮৮৩ সনের ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় মহাসভার প্রথম অধিবেশন আরম্ভ হইল। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের অধিবাসী-মারাঠি, পঞ্জাবী, মাদ্রাজী, হিন্দুস্থানী, বিহারী ও ওড়িয়া–হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের শতাধিক প্রতিনিধি এই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। রামতনু লাহিড়ী, কালীমোহন দাস, ও অন্নদাচরণ খাস্তগীর যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন। জাতীয় সঙ্গীত দ্বারা সভার উদ্বোধন করা হইল। আলোচনার প্রধান প্রধান বিষয় ছিল : (১) কারিগরী শিক্ষা (Industrial and Technical Education); (২) সিভিল সার্ভিসে অধিকতর সংখ্যায় ভারতীয়ের নিয়োগ (Covenanted and Statutory Civil Service); (৩) বিচার ও শাসন বিভাগ পৃথক্করণ; (৪) জনসাধারণের প্রতিনিধিগণ কর্তৃক রাজ্যশাসনের ব্যবস্থা (Representative Government) (৫) একটি জাতীয় তহবিল (National Fund) সংগঠন ও (৬) অস্ত্র আইন (Arms Act) রহিতকরণ।

প্রত্যেকটি বিষয় একজন প্রস্তাব ও একজন সমর্থন করিলে আলোচনা হইত ও অতঃপর ভোটে পাশ হইত। প্রস্তাব উত্থাপক ও সমর্থনকারী এবং বক্তাদের মধ্যে ছিলেন মাদ্রাজের ধনকোটি রাজ, বম্বের শ্রীপদ বাবাজী ঠাকুর, আনন্দমোহন বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মনমোহন ঘোষ ইত্যাদি।

এই মহাসভার অধিবেশনে দুইজন ইংরেজ উপস্থিত ছিলেন। ইহাদের একজন, ব্লান্ট (Wilfrid Scawen Blunt), India under Ripon নামক তাঁহার বিখ্যাত গ্রন্থে এই অধিবেশনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়াছেন। ইহার এক অংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“বেলা বারোটায় আমি এই জাতীয় মহাসভার প্রথম অধিবেশনে উপস্থিত হইলাম। ইহার গুরুত্ব খুব বেশী, কারণ অনেক বড় বড় শহরের প্রতিনিধিরা সমবেত হইয়াছিলেন এবং আনন্দমোহন বসু তাঁহার উদ্বোধনী বক্তৃতায় যথাথই মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, ইহাই জাতীয় পার্লিয়ামেণ্ট গঠনের প্রথম স্তর। সভার প্রধান উল্লেখযোগ্য বিষয়-Convenated Civil Service-এর বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথের আক্রমণ। ইহা অপেক্ষা সুন্দর বক্তৃতা আমি জীবনে শুনি নাই এবং তাহার মতের সহিত আমার মতের সম্পূর্ণ মিল আছে। অন্য বক্তৃতাগুলিও মোটের উপর ভালই। তবে (সুরেন্দ্রনাথ) ব্যানার্জী ও (আনন্দমোহন) বসু খুবই উচ্চশ্রেণীর বক্তা। সভায় প্রায় একশত জন উপস্থিত ছিলেন এবং সভার কার্য বেশ প্রশংসাজনক ভাবেই পরিচালিত হইয়াছিল।”

এই অধিবেশনের সাফল্যে উৎসাহিত হইয়া এই মহাসভাকে স্থায়ী রূপ দিবার জন্য ১৮৮৪ সনে সুরেন্দ্রনাথ আবার উত্তরভারত পরিভ্রমণ করিলেন এবং লাহোর, অমৃতসর, মুলতান, রাওলপিণ্ডি, অম্বালা, দিল্লি, আগ্রা, আলিগড়, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, এলাহাবাদ, বারাণসী ও বাঁকিপুর প্রভৃতি স্থানে ভারতের রাজনীতিক ঐক্যের প্রচার করিলেন। ইহার ফলে এই জাতীয় কন্ফারেসের বা জাতীয় মহাসভার লক্ষ্য ও আদর্শ জনপ্রিয়তা লাভ করিল এবং ইহার পুনরায় অধিবেশনের পথ সুগম হইল।

১৮৮৫ সনের ২৫, ২৬, ও ২৭ ডিসেম্বর ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের গৃহে “জাতীয় মহাসভার” দ্বিতীয় অধিবেশন হইল। ইহার প্রথম অধিবেশনে (১৮৮৩ সনে) ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন যোগদান করে নাই, এবারে তাহারা শুধু যোগ দিল না, ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ও কেন্দ্রীয় মুসলমান (Central Muhammadan) অ্যাসোসিয়েশন’-কলিকাতায় এই তিনটি প্রসিদ্ধ রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান মিলিত হইয়া জাতীয় মহাসভা আহ্বান করিল। এই অধিবেশনে অভিজাত সম্প্রদায়ের কয়েকজন প্রতিনিধিও যোগদান করিয়াছিলেন–ইহাদের মধ্যে দ্বারভাঙ্গার মহারাজা, নেপালের রাজদূত, মহারাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব, রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ দেব, দুর্গাচরণ লাহা, জয়কৃষ্ণ মুখার্জী, রায় বদ্রীদাস বাহাদুর, প্যারিমোহন মুখার্জী, কুমার দেবেন্দ্র মল্লিক, কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেব প্রভৃতির নাম করা যাইতে পারে। কলিকাতার বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে মহেন্দ্রলাল সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রী, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, কালীশঙ্কর সুকুল, আমীর আলী, গুরুদাস ব্যানার্জী, কালীমোহন দাস এবং আরও অনেকে ছিলেন।

প্রথম অধিবেশনের ন্যায় এবারেও প্রতিদিনের জন্য একজন সভাপতি নির্বাচিত হইতেন। দুর্গাচরণ লাহা, জয়কৃষ্ণ মুখার্জী এবং মহারাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় দিনের সভাপতি ছিলেন। সর্বপ্রথমে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী আইনসভার পুনর্গঠন (Reconstitution of the Legislative Councils) সম্বন্ধে প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। যাহাতে পরিণামে এদেশের বিলাতের ন্যায় পার্লিয়ামেন্টের শাসন প্রবর্তিত হইতে পারে এই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বিধান পরিষদগুলিতে অধিকতর সংখ্যায় ভারতীয় সদস্য নিযুক্ত করা প্রয়োজন এবং কী উপায়ে ইহা সম্ভবপর হয় তাহার নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন –ইহাই ছিল প্রস্তাবটির মূলকথা। সুরেন্দ্রনাথের এই প্রস্তাব ১৩ জন প্রতিনিধি সমর্থন করেন এবং ১৯ জনকে লইয়া একটি কমিটি গঠিত হয়। ইহার সদস্যেরা সকলেই পরবর্তীকালে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। অন্যান্য আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য :

(১) অস্ত্র আইন রহিত করণ; (২) সামরিক ও সাধারণ প্রশাসনিক বিভাগ এবং হোম চার্জ (Home change) প্রভৃতি দফায় ব্যয় হ্রাস করার সম্ভাব্যতা ও প্রয়োজনীয়তা; (৩) সিভিল সার্ভিস্ পরীক্ষার সংস্কার এবং ভারতে ও লণ্ডনে একসঙ্গে ঐ পরীক্ষা গ্রহণ; (৪) বিচার ও শাসন বিভাগ পৃথক্করণ।

তৃতীয় দিনের অধিবেশনে স্থির করা হইল যে, প্রতি বৎসর ভারতের এক একটি বড় শহরে এইরূপ জাতীয় সভার অধিবেশন করা হউক।

কিন্তু এই প্রস্তাব কার্যে পরিণত হয় নাই। জাতীয় কনফারেসের (National Conference) দ্বিতীয় অধিবেশন কলিকাতায় শেষ হয় ২৭ ডিসেম্বর (১৮৮৫)। ঠিক তাহার পরদিনই বম্বে শহরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন আরম্ভ হইল। কলিকাতায় জাতীয় কনফারেসের শেষ অধিবেশনের পর উপস্থিত প্রতিনিধিদের পক্ষ হইতে কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতি জানাইয়া এক তারবার্তা প্রেরণ করা হইল। একই উদ্দেশ্যে গঠিত এই দুই রাজনীতিক সভার অধিবেশন প্রায় একই সময়ে কেন হইল, এবং অতঃপর কেন কলিকাতার জাতীয় কনফারেসের আর কোন অধিবেশন হইল না বরং ইহা কংগ্রেসের অঙ্গীভূত হইল–ইহা একটি রহস্যময় ব্যাপার। কলিকাতায় জাতীয় কনফারেসের কথা কংগ্রেসের কর্তৃপক্ষ জানিতেন–অথচ একই সময়ে অধিবেশন করিলেন এবং জাতীয় কনফারেসের প্রবর্তক ও প্রাণস্বরূপ সুরেন্দ্রনাথকে দলে নেওয়া তো দূরের কথা, এ-বিষয়ে পূর্বে কিছুই জানাইলেন না–ইহা খুবই বিস্ময়কর সন্দেহ নাই।

সুরেন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন :

“আমরা যখন কলিকাতায় জাতীয় কনফারেসের অধিবেশনে ব্যস্ত ছিলাম তখন একই উদ্দেশ্যে, কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে বোম্বাই শহরে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। ইহার নির্বাচিত সভাপতি উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী (W.C. Bonnerjee) আমাকে ইহাতে যোগ দিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। আমি বলিলাম যে আমি জাতীয় কনফারেন্স অধিবেশনের ব্যবস্থার জন্য খুব বেশী কাজ করিয়াছি, এবং এখন ইহা বন্ধ করিবার সময় নাই–সুতরাং ইহা ত্যাগ করিয়া আমার পক্ষে বম্বে যাওয়া সম্ভব নহে।”

অন্যত্র সুরেন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন, “জাতীয় কনফারেন্স ও জাতীয় কংগ্রেস একই উদ্দেশ্যে গঠিত-উভয়ের মত, অভিযোগ ও আশা একই–উভয়েরই অধিবেশন এক সময়ে হইল। অতঃপর যাহারা আমাদের সঙ্গে কাজ করিত তাহারা কংগ্রেসে যোগ দিল এবং সম্পূর্ণভাবে ইহার সহযোগিতা করিল।” সুরেন্দ্রনাথের আর-একটি উক্তি হইতে মনে হয়, তিনি বুঝিয়াছিলেন যে ইংরেজ-জাতি, ক্ষীণ দুর্বল বাঙ্গালী অপেক্ষা হিন্দুস্থান ও পঞ্জাবের সামরিক অধিবাসীদের বেশী মর্যাদা দেয় –সুতরাং বাঙ্গালীর দ্বারা অনুষ্ঠিত জাতীয় কনফারেন্স অপেক্ষা, একজন ইংরেজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মতামতকে বেশী মূল্য দিবে। সম্ভবতঃ এই কারণেই জাতীয় কনফারেসের দল। লইয়া তিনি কংগ্রেসে যোগ দিলেন। এইরূপ স্বার্থত্যাগ প্রকৃত দেশপ্রেমের লক্ষণ।

যদিও জাতীয় কনফারেন্স খুব অল্পকাল স্থায়ী হইয়াছিল, তথাপি নিখিল ভারতের প্রথম রাজনীতিক সম্মেলন এবং পরবর্তীকালে সুপ্রসিদ্ধ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পথপ্রদর্শকরূপে ইহা আধুনিক যুগের ভারতের ইতিহাস চিরদিনই একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিবে। আর ইহাই ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সর্বপ্রধান কীর্তি বলিয়া বিবেচিত হইবে।

(ঙ) নিখিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (Indian National Congress)

১৮৮৫ সনের পর হইতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসই রাজনীতিক আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র হইল। বাংলা দেশের ইতিহাসে ইহার উৎপত্তি ও কার্যাবলীর বিস্তৃত বিবরণ দিবার কোন প্রয়োজন নাই। তবে এ-প্রসঙ্গে বাংলার দিক হইতে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা আবশ্যক।

প্রথমতঃ উপস্থিত সদস্যসংখ্যা ও আলোচনার বিষয় প্রভৃতির দিক হইতে ১৮৮৫ সনের কংগ্রেস অধিবেশন-কলিকাতার জাতীয় কনফারেসের দ্বিতীয় অধিবেশন তো দূরের কথা, ইহার প্রথম অধিবেশন অপেক্ষাও কম গুরুত্বপূর্ণ, ইহা অস্বীকার করা যায় না।

১৮৮৬ সনে কলিকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনের সময় হইতেই ইহার প্রতিপত্তি বাড়িতে থাকে এবং সুরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি বাঙ্গালী নেতাদের সহযোগিতাই যে ইহার মূলে ছিল তাহাতেও সন্দেহ করিবার কোন সঙ্গত কারণ নাই। এই সিদ্ধান্ত ভারতের অন্য প্রদেশের অনেকেই মানিবে না, সুতরাং ইহার সপক্ষে কয়েকটি যুক্তি দিতেছি।

১। কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে সুরেন্দ্রনাথকে বিশেষ আমল দেওয়া হয় নাই। কিন্তু কলিকাতায় দ্বিতীয় অধিবেশনের পূর্বে কংগ্রেসের প্রধান উদ্যোক্তা হিউম সাহেব সুরেন্দ্রনাথের সাহায্য লাভ করিবার জন্য ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ চেষ্টা করেন৪৫ এবং সুরেন্দ্রনাথও এই অধিবেশনের সফলতার জন্য বিশেষ আগ্রহ সহকারে যত্ন ও পরিশ্রম করেন।

২। প্রথম অধিবেশনে মাত্র ৭২ জন লোক ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত ছিল, কিন্তু কলিকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে যোগদান করিবার জন্য বিভিন্ন স্থানের প্রকাশ্য সভায় প্রায় পাঁচশত প্রতিনিধি নির্বাচিত হইয়াছিলেন, ৪৩৪ জন তাঁহাদের নির্বাচনপত্র দেখাইয়া নাম রেজেষ্ট্রী করাইয়াছিলেন। ইহার আর-একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, জনসাধারণের দর্শকরূপে অধিবেশনে যোগদানের ব্যবস্থা করা। ইহা ছাড়া, কী কী প্রস্তাব এই অধিবেশনে উপস্থিত করা হইবে এবং কী কী বিষয় ইহাতে আলোচনার যোগ্য, সে-সম্বন্ধে পূর্বেই প্রতিনিধিদের নিকট সার্কুলার পাঠানো হইয়াছিল। মোটের উপর ইহা সকলেই স্বীকার করেন যে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অপেক্ষা কলিকাতায় দ্বিতীয় অধিবেশনে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও জাতীয়তার ভাব অনেক বেশী দেখা গিয়াছিল।

৩। এইগুলি যে বাংলার অধিকতর জাতীয় সচেতনতার প্রতিক্রিয়ামাত্র তাহার একটি পরোক্ষ প্রমাণ এই যে, দ্বিতীয় অধিবেশনের পর হইতে জাতীয় কংগ্রেসকে অনেকেই বাঙ্গালীর প্রতিষ্ঠান বলিয়াই মনে করিত। অনেকেই বিশ্বাস করিত যে কংগ্রেসের দাবি বাঙ্গালীর দাবির প্রতিধ্বনি মাত্র। এইরূপ এক মন্তব্য শুনিয়া ডেরা ইসমাইল খানের প্রতিনিধি মালিক ভগবান দাস বলিয়াছিলেন, “আমাকে কি বাঙ্গালীবাবুর মত দেখায়? কংগ্রেস যে শাসন-সংস্কারের দাবি করিতেছে, বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রেই তাহা চায়।”

কিন্তু অনেক বড় বড় লোকেরাও বিশ্বাস করিতেন, কংগ্রেস-আন্দোলনটা বাঙ্গালীর ব্যাপার। আলিগড়ের সৈয়দ আহমদ খান কংগ্রেসের ঘোর বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। ইহা যে মুসলমানের স্বার্থবিরোধী, তিনি ইহা প্রকাশ্যে প্রচার করিতেন। যাহাতে মুসলমানেরা কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যোগদান না করে তাহার জন্য তিনি প্রচারকার্য ছাড়াও অন্যান্য অনেক উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের এক বৃহৎ অংশ তাহার প্রভাবে কংগ্রেসে যোগদান করে নাই। মাদ্রাজে কংগ্রেসের তৃতীয় অধিবেশন হইবার অব্যবহিত পূর্বে তিনি এক সভায় বলিয়াছিলেন : “যদি তোমরা চাও যে বাঙ্গালীরা এদেশে প্রভুত্ব করুক এবং দেশের উৎপীড়িত লোকেরা বাঙ্গালীর জুতা চাটুক, তবে ভগবানের নাম নিয়ে রেলগাড়ীতে চড়ে সোজা মাদ্রাজ চলে যাও।”৪৬

ভারতের বড়লাট লর্ড ডাফরিন ১৮৮৭ সনের ৪ঠা জানুয়ারি, অর্থাৎ কলিকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনের অব্যবহিত পরে, বিলাতে সেক্রেটারী অব ষ্টেটকে লিখিয়াছিলেন : “আপনি লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন যে মুসলমানেরা কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদান করে নাই।… তাহারা বেশ বুঝিয়াছে যে বাঙ্গালীর শাসনে (Under a Bengali Constitution) তাহাদের অবস্থা আরও খারাপ হইবে।” ইহার তিন বৎসর পরে “সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস” লেখক প্রসিদ্ধ ম্যালিসন সাহেব (Malleson) মন্তব্য করেন, “গলাবাজিতে পটু বাঙ্গালীরাই কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাহারা যে প্রকার গণতন্ত্র-শাসন (representative intitution) দাবি করে, ভারতের সামরিক জাতি-শিখ, রাজপুত, রোহিলা, জাঠ এবং সীমান্তে র পাঠান–সকলেই তাহা ঘৃণা করে।”৪৭

১৮৮৪ সনে, অর্থাৎ কলিকাতায় প্রথম জাতীয় কনফারেসের পরে এবং দ্বিতীয় কনফারেন্স ও জাতীয় কংগ্রেসের পূর্বে-সুরেন্দ্রনাথ যে উত্তরভারতের নানা স্থানে ঘুরিয়া রাজনীতিক বক্তৃতা করিয়াছিলেন তাহা পূর্বে লিখিয়াছি। এই প্রসঙ্গে তিনি তাঁহার ‘আত্মজীবন চরিতে’ লিখিয়াছেন : “এই ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে ঐক্য এবং বিশেষ করিয়া বাঙ্গালীদের সাথে উত্তরের সামরিক জাতিদের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপন। সে যুগে আমাদের কেহই গণ্য করিত না; সৰ্ব্বদাই কানে কেবল এই কথাই শুনিতে হইত যে আমাদের সমুদয় রাজনীতিক দাবি, তাহা কেবল গঙ্গানদীর মোহনায় যাহারা বাস করে–সৈন্যদলে যাহাদের একজনও নাই এবং উত্তরের সামরিক জাতি হইতে যাহারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র–তাহাদেরই দাবি। আজ কংগ্রেসের গঠনে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে স্বদেশভক্তিমূলক রাজনীতিক প্রচেষ্টায় পূর্বোক্ত উক্তি মিথা ও অসার প্রতিপন্ন হইয়াছে।”৪৮

এই উক্তিতে সুরেন্দ্রনাথ যে মনোভাবের পরিচয় দিয়াছেন সম্ভবতঃ তাহার প্রভাবেই বাঙ্গালীর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কনফারেসের প্রাচীনত্বের দাবি থাকিলেও ইহার পরিবর্তে তাহারই অনুকরণে পরে গঠিত জাতীয় কংগ্রেসে তিনি যোগদান করিয়াছিলেন। ইহা সত্যই মহানুভবতার পরিচায়ক। কিন্তু অনেকে মনে করেন, ইহাতে বাংলার অগ্রগতি ব্যাহত হইল। বিপিনচন্দ্র পাল বলেন, সুরেন্দ্রনাথ কংগ্রেসে যোগদান করিয়া রাজনীতিক ‘হারিকিরি’ (আত্মহত্যা) করিলেন।৪৯

এই সকল মন্তব্যের মূলে যে মনোভাব ছিল, তাহা একেবারে তুচ্ছ বলিয়া অগ্রাহ্য করা যায় না। কংগ্রেস বৎসরে একবারমাত্র তিনদিনের জন্য সমবেত হইত, বাকি সারা বৎসরে রাজনীতিক আন্দোলনের বড় একটা ধার ধারিত না। আর কংগ্রেসের সর্বভারতীয় ব্যাপারই আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল–কোন প্রদেশের কোন সমস্যা গুরুতর হইয়া উঠিলেও কংগ্রেসে ইহার সম্বন্ধে কোন আন্দোলন হইতে পারিত না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে, যখন বাংলা দেশের প্রতিনিধিরা চা-বাগানের কুলিদের দুর্দশা ও তাহাদের প্রতি অত্যাচারের বিষয় কংগ্রেসে উত্থাপন করিতে চাহিলেন তখন ইহা কেবলমাত্র প্রাদেশিক ব্যাপার বলিয়া ইহার আলোচনা নিষিদ্ধ হইল।

এই সমুদয়ের প্রতিবিধানের জন্য বাংলা দেশে কংগ্রেসের অধীনে প্রাদেশিক কনফারেন্স (Bengal Provincial Conference) প্রতিষ্ঠিত হইল। ইহাতে বাংলা দেশের বিভিন্ন জিলার প্রতিনিধিগণ সমবেত হইয়া অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বিশেষভাবে বাংলা দেশের সমস্যাগুলির আলোচনা করিতেন। ১৮৮৭ সনে ইহার প্রথম অধিবেশন হইল। ইহার বৈঠকও বৎসরে একবার করিয়া হইত। ইহার পরে অনেক জিলায়ও প্রতি বৎসর একটি রাজনীতিক কনফারেন্স্ হইত। ওদিকে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনও নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়া পূর্বের ন্যায় রাজনীতিক আন্দোলন চালাইত। কংগ্রেস কর্তৃপক্ষের অভিপ্রায় ছিল যে অতঃপর কংগ্রেসই ভারতের রাজনীতিক আন্দোলনের কেন্দ্র হইবে এবং অন্যান্য রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলি কেবল তাহার সহযোগী হইবে। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ইহাতে সম্মত হইল না। ইহা পূর্বের ন্যায় স্বতন্ত্রভাবে দেশের কল্যাণকর কার্যে আত্মনিয়োগ করিল। স্থির হইল যে মাঝে মাঝে কনফারেন্স্ ডাকিয়া ভারতীয় ও বিদেশী প্রসিদ্ধ লোকদের সঙ্গে দেশের শাসনসংক্রান্ত নানা ব্যাপার আলোচনা করিবে। ১৮৯৬ সনের ১৫ ফেব্রুআরি প্রথম কনফারেসের অধিবেশন হয়। ইহাতে লাখেরাজ কর (Cess), জুরীপ্রথা ও মফঃস্বলের জলকষ্টের সম্বন্ধে আলোচনা হয়। ২১ ফেব্রুআরি আলাপ-আলোচনার জন্য একটি বৈঠক হয়। ইহাতে বাংলার ছোটলাট, বড়লাটের সভার সদস্যবৃন্দ, হাইকোর্টের জজ, অনেক বড় বড় সরকারী কর্মচারী ও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। ১৮৯৭ সনে কংগ্রেস ও বাংলা প্রভিসিয়াল কনফারেন্‌সে প্রেরিত প্রতিনিধিদের উপর নির্দেশ ছিল যে, বিধান পরিষদ (Legislative Council) এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ের আলোচনায় তাহারা যোগ দিবে না।

ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন কংগ্রেসের ন্যায় ব্যাপকভাবে রাজনীতিক আন্দোলন ও শাসনসংস্কারের প্রস্তাব না করিলেও দেশের কল্যাণ সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন ছিল না। গভর্নমেন্টের নিকট ইহার খুব প্রতিপত্তি ছিল ও গভর্নমেন্ট অনেক বিষয়ে ইহার মত জানিতে চাহিত। অ্যাসোসিয়েশন স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়াও অনেক বিষয়ে গভর্নমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করিত ও মতামত ব্যক্ত করিত। গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতবাসীর প্রতি শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের বিষয় অ্যাসোসিয়েশনকে লিখিলে, অ্যাসোসিয়েশন গান্ধীর সমর্থন করিয়া এ-বিষয়ে ভারত গভর্নমেন্টের নিকট তীব্র প্রতিবাদ করে, এবং তিলকের কারাদণ্ড হইলে বিক্ষোভ প্রকাশ করে। ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে কেন্দ্র স্বীকার করিয়া তাহার সহযোগিতা করে এবং বিশেষভাবে বাংলা দেশের অভাব-অভিযোগ ও সমস্যাগুলির সম্বন্ধেই আলোচনা ও আন্দোলন করে। বাংলা দেশের নানা স্থানে ইহার শাখা প্রতিষ্ঠিত করিয়া জনসাধারণের মধ্যে রাজনীতিক সচেতনতার সঞ্চার ও অন্যান্য নানাপ্রকার হিতকর কার্যে ইহারা ব্রতী হয়।

চা-বাগানের কুলিদের প্রতি অমানুষিক অত্যাচারের বিষয় সরেজমিনে অনুসন্ধান ও তাহার প্রতিকারের জন্য আন্দোলন ইহার একটি বিশেষ প্রশংসনীয় উদ্যম। বাংলার প্রাদেশিক কনফারেসের বার্ষিক অধিবেশনের ব্যবস্থাও বহুদিন ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনই করিত, এইসব অধিবেশনে দেশের শাসনসংক্রান্ত নানা প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্বন্ধে আলোচনা হইত। বাংলা ও ভারত গভর্নমেন্ট শাসনসংক্রান্ত বড় বড় ব্যাপারে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মতামত ও পরামর্শ চাহিয়া পাঠাইত। বাংলার রাজনীতিক সচেতনতা এতদূর অগ্রসর হইয়াছিল যে, নবপ্রতিষ্ঠিত কংগ্রেসের কার্যপদ্ধতি অনেক বাঙ্গালী নেতার মনঃপূত হইত না। ১৮৯৭ সনে অমরাবতী শহরে কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনে বরিশালের সুপ্রসিদ্ধ নেতা অশ্বিনীকুমার দত্ত ইহাকে তিনদিনের তামাসা’ বলিয়া বিদ্রূপ করিয়াছিলেন।৫০

কংগ্রেস যে আবেদন করা ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে না এবং কংগ্রেসের সহিত জনসাধারণের যে কোন যোগাযোগ ছিল না, বাঙ্গালীরা ইহাই তাহার সর্বপ্রধান ত্রুটি বলিয়া মনে করিত। এ-বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার সরস ভাষায় অনেক ব্যঙ্গ করিয়াছেন। কমলাকান্তের পত্রে’, ‘পলিটিকস’ এবং লোক রহস্যের ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল’–ইহার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। শ্রীঅরবিন্দের সমালোচনার কথাও পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। ১৮৯৭ সনে অশ্বিনীকুমার দত্ত ভারতে গণতন্ত্রমূলক শাসনব্যবস্থা (Representative System of Government) প্রতিষ্ঠার জন্য বিলাতের পার্লিয়ামেন্টে এক আবেদনপত্র পাঠান। ইহাতে চল্লিশ হাজার লোকের স্বাক্ষর ছিল, আর স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে কৃষক, তাঁতি, ছুতার, মুচি, দোকানদার প্রভৃতি সকল শ্রেণীর লোকই ছিল।৫১

বাংলা দেশের অনেক পত্রিকায় কংগ্রেসের তীব্র নিন্দা দেখা যায়। ভারতবাসী (১৮৮৬, ১১ ডিসেম্বর) মন্তব্য করে যে, জনসাধারণের স্বার্থের দিকে কংগ্রেসের লক্ষ্য নাই, সুতরাং ইহাকে জাতীয় কংগ্রেস বলা যায় না। ইহা কেবল ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কংগ্রেস। গরীব’ নামক পত্রিকাও ঐরূপ মন্তব্য করে (১৮৮৬, ২৯ ডিসেম্বর)। ১৮৮৭ সনের ৯ জানুআরি সংখ্যা ‘দৈনিক পত্রিকা কংগ্রেসের নেতাগণকে ‘ভাবপ্রবণ বাক্যবাগীশ বাবুর দল’ বলিয়া বিদ্রূপ করে। ঢাকা গেজেটে’ (১৮৮৮, ২৩ জুলাই) বলা হয় যে, যাহাদের পেটে অন্ন নাই, গায়ে বস্ত্র নাই, তাহাদের পক্ষে রাজনৈতিক দাবির মূল্য কী? “হিতকারী” (২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯০), বঙ্গনিবাসী’ (৯ জানুআরি, ১৮৯২) প্রভৃতি পত্রিকাও জনগণের সহিত কোন সংস্রব না-রাখার জন্য কংগ্রেসের সমালোচনা করিয়া যাহাতে মফঃস্বলের সাধারণ লোকের সঙ্গে ইহার যোগসূত্র স্থাপিত হইতে পারে তাহার জন্য অনুরোধ করে। ১৮৯০ সনের ২৭ ডিসেম্বর সংখ্যায় বঙ্গবাসী’ পত্রিকায় লেখা হয়, “ভিক্ষা দ্বারা কিছু লাভ করা যায় না। আগে মানুষ হওঁ, তারপর রাজনীতিক অধিকারের দাবি করিও।” বঙ্গবাসী পত্রিকা সাধারণত কংগ্রেসকে “কঙ্গ-রস” এই বিদ্রুপাত্মক সংজ্ঞায় অভিহিত করিত।

কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনের (১৮৮৬) উদ্বোধনে যুবক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার স্বরচিত “আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে…” এই গানটি গাহিয়াছিলেন। কিন্তু দশ বৎসর পরে অন্যান্য অনেক শিক্ষিত বাঙ্গালীর ন্যায় তাঁহার মতও কিরূপ পরিবর্তন হইয়াছিল, পুত্রের লিখিত তাঁহার পিতৃস্মৃতি” গ্রন্থে বর্ণিত (১১-১২ পৃ.) নিম্নলিখিত কাহিনীতে তাহার আভাস পাওয়া যায়।

১৮৯৬ সনে কলিকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিন দিন নানা প্রদেশের বড় বড় নেতারা দেশোদ্ধার সম্বন্ধে অনেক ওজস্বিনী বক্তৃতা করেন। ইহার পরে শ্রীতারক পালিত হঁহাদের সকলকে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করেন। রবীন্দ্রনাথকেও নিমন্ত্রণ করিলেন এবং গান গাহিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। রবীন্দ্রনাথ ধুতি পরিধান করিয়া সেই হ্যাট-কোটধারী নেতৃবর্গের সঙ্গে ভোজন করিলেন। বিলাতী প্রথামত আহারান্তে বক্তৃতা আরম্ভ হইল। ইহার মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে গান গাহিবার জন্য অনুরোধ করিলে রবীন্দ্রনাথ গাহিলেন :

“আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা?
এ যে নয়নের জল, হতাশের শ্বাস, কলঙ্কের কথা, দরিদ্রের আশ,
এ যে বুকফাটা দুখে গুমরিছে বুকে গভীর মরম বেদনা।
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা?
এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি, কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি–
মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!
কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ, কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ–
কাতরে কাঁদিবে, মায়ের পায়ে দিবে সকল প্রাণের কামনা?
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা?”

কাহিনীটির উপসংহার এইরূপ : “গান শুনে সকলে স্তব্ধ। ডিনার পার্টি মাটি হয়ে গেল। মুখ বিষণ্ণ করে একে একে সবাই চলে গেলেন।”

কিন্তু কংগ্রেসের সমর্থকও বাংলা দেশে অনেক ছিল। সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় কংগ্রেসকে “নিদ্রামগ্ন জাতির নবজাগরণের প্রথম সূচনা, দেশমাতৃকার পূজার প্রথম বোধন, এবং হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, পার্শী, শিখ প্রভৃতি দেশজননীর বহু সন্তানের মিলন ক্ষেত্র” বলিয়া অভিনন্দিত করা হয়। জনসাধারণের সহিত কংগ্রেসের যোগ না থাকিলেও সর্বদেশে ও সর্বকালে যে শিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর লোকেরাই সাধারণ লোকের উন্নতির পথ প্রশস্ত করিবার জন্য অগ্রসর হয় তাহার দৃষ্টান্ত দেখাইয়া ‘সঞ্জীবনী’ মন্তব্য করে যে, এই দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখিলে কংগ্রেস যে ভারতবাসীর প্রতিনিধিমূলক সভা ইহা স্বীকার করিতেই হইবে। উইলবারফোর্স নিজে ক্রীতদাস ছিলেন না, গ্ল্যাডষ্টোনও আইরিশ ছিলেন না, কিন্তু তাহারা ইহাদের মুক্তিসংগ্রামের নেতা ছিলেন। কংগ্রেস যে কেবল আবেদন নিবেদন করে–ইহার সমর্থনে বলা হয় যে, কংগ্রেস স্বাধীনতা চায় না, শাসনের উন্নতি চায়, সুতরাং বিদ্রোহ বা সংগ্রামের পরিবর্তে আবেদন ও আন্দোলনই অবলম্বন করে।

সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে উত্তরভারতের অনেক মুসলমানই যে কংগ্রেসের বিরোধী ছিল তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ইহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছু নাই। কারণ উনিশ শতকের গোড়া হইতেই যে রাজনীতিবিষয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে চিন্তা ও আদর্শের মৌলিক প্রভেদ দেখা যায়, তাহার ফলে এই দুই সম্প্রদায় পৃথক প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে স্বতন্ত্রভাবে রাজনীতিক আন্দোলন করে এবং হিন্দুরা যে এইরূপ প্রভেদ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মনে করিয়া তাহাতে আনন্দ প্রকাশ করে, বিধান পরিষদের প্রস্তাব হইলে দুই সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক দুইটি সমিতি করার জন্য লর্ড এলেনবরোর প্রস্তাব ও তাহার বিরুদ্ধে প্যারীচাঁদ মিত্রের আপত্তি–এ সমুদয়ই পূর্বে বলা হইয়াছে। উনিশ শতকের শেষার্ধে এই ভেদবুদ্ধি আরও প্রসার লাভ করে। ১৮৬৩ সনে আবদুল লতিফ কলিকাতায় মুসলমান সাহিত্য সমাজ (Mohammedan Literary Society) প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক রাজনীতি, জ্ঞান ও চিন্তা প্রচার করাই ছিল ইহার উদ্দেশ্য। নবগোপাল মিত্র হিন্দুমেলা ও জাতীয় সভা (National Society) স্থাপন করার পরে ১৮৭৭ সনে সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনীতিক চেতনার উদ্বোধন ও ঐক্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে নবাব আমির আলি খান National Muhammadan Association প্রতিষ্ঠা করেন।

এই ভেদবুদ্ধি ক্রমশঃ কিরূপ বিস্তার লাভ করিয়াছিল ১৮৮৩ সনে তাহার দুইটি স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রথমতঃ, ইলবার্ট বিলের আন্দোলনে মুসলমানেরা হিন্দুদের সহিত যোগ দেয় নাই। এই সময়ে পূর্বোক্ত ব্লান্ট সাহেব (Blunt) কলিকাতায় ছিলেন, তিনি বহু মুসলমান নেতাদের সঙ্গে দেখা করিয়া নানারূপ যুক্তি প্রদর্শনদ্বারা মুসলমানেরা যাহাতে হিন্দুর সহিত একযোগে ইলবার্ট বিলের প্রতিবাদ করে তাহার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু মুসলমানদের রাজি করাইতে পারিলেন না। তিনি লিখিয়াছেন যে ভারতবর্ষে পদার্পণ করিবার পর হইতেই মুসলমানেরা তাঁহার নিকট হিন্দুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতে থাকে।৫২

দ্বিতীয়তঃ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধে আইনপ্রণয়নের সময় এই সাম্প্রদায়িক ভেদ আরও প্রকট হইয়া ওঠে। প্রেসিডেন্সি বিভাগের কমিশনার তাহার রিপোর্টে লেখেন যে, এ-বিষয়ে হিন্দুরাই আন্দোলনকারী এবং তাহাদের প্রস্তাব অনুযায়ী যদি ‘লোকাল বোর্ড’ স্থাপিত হয় তাহা হইলে নির্বাচিত প্রায় সকল সদস্যই হইবে হিন্দু। এই মন্তব্য সমর্থন করিয়া মুহম্মদ ইউসুফ ১৮৮৩ সনে ৩রা মে বিধানসভায় (Legislative Council) বলেন, “অধিকাংশ স্থানে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ–সুতরাং সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য কয়েকটি সদস্যের পদ সংরক্ষিত (reserved) করা হউক।”

১৮৫২ সনে লর্ড এলেনবরো ও আরও কয়েকজন ইংরেজ এইরূপ মত প্রকাশ করিয়াছিলেন। মাত্র একজন হিন্দু ইহার প্রতিবাদ করিয়াছিলেন ও মুসলমানেরা কিছুই বলেন নাই। কিন্তু এবারে মুসলমানেরাই এইরূপ দাবি করিলেন।৫৩

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে এই প্রভেদ চরমে পৌঁছিয়াছিল। ইহার নেতা ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ ও ইহার প্রধান কেন্দ্র ছিল আলিগড়। ইহার বিশেষ কারণও ছিল। কংগ্রেস প্রতিনিধিমূলক শাসনতন্ত্রের দাবি করিত। প্রতিনিধিরা জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবে। ভারতে মুসলমানেরা সংখ্যায় হিন্দুর চারি ভাগের এক ভাগ। সুতরাং নির্বাচনের ফলে শাসন পরিষদে বা বিধানসভায় মুসলমানেরা চিরকালই সংখ্যায় কম থাকিবে। এবং যেহেতু ভোটের দ্বারাই সব বিষয় নিরূপিত হইবে, ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল হইবে যে মুসলমানদের চিরকালই হিন্দুর অধীন হইয়া থাকিতে হইবে। এই আশঙ্কা যে একেবারে ভিত্তিহীন ছিল এরূপ মনে করিবার কোন সঙ্গত কারণ নাই।

৩. ইংরেজশাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষের বৃদ্ধি

উনিশ শতকের শেষার্ধে একদিকে যেমন জাতীয়তাভাব ক্রমশঃ বাড়িয়া উঠিল অন্যদিকে তেমনি ইংরেজ ও বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও অভিযোগেরও বৃদ্ধি হইল। এ-দুয়ের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ আছে। উনিশ শতকের প্রথমে জাতীয়তাভাবের জাগরণের পূর্বে হিন্দুনেতাগণ মুসলমানশাসনের পরিবর্তে ইংরেজশাসনকে বিধাতার আশীর্বাদ বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলেন, ইহা পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে। প্রসন্নকুমার ঠাকুর বলিয়াছিলেন যে, তিনি স্বাধীনতা অপেক্ষা ব্রিটিশের অধীনতাই পছন্দ করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে এই মনোভাবের পরিবর্তন হইল। বাঙ্গালীর মনে স্বাধীনতার আশা ও আকাক্ষা জাগিয়া উঠিল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী ইংরেজের শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল। ইংরেজশাসনের কুফল এবং তাহাতে দেশের যে অনিষ্ট হইতেছে, সে-সম্বন্ধে বাঙ্গালীরা ক্রমশঃ অধিকতর সচেতন হইল। অন্যদিকে ইংরেজশাসনে দেশের অভাব ও অভিযোগ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাভাবেরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হইল। সুতরাং এই দুইটি মনোবৃত্তি যে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্বদ্ধ তাহা অস্বীকার করা কঠিন।

অবশ্য উনিশ শতকের শেষার্ধেও যে বাঙ্গালীরা ইংরেজশাসনের গুণ ও উপকারিতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু সমসাময়িক পত্রিকাগুলি পড়িলে বেশ বুঝা যায় যে পূর্বের ন্যায় ইংরেজশাসনের গুণকীর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিরুদ্ধ মনোভাবও ক্রমশঃ পরিস্ফুট হইতেছে। বস্তুতঃ একটু প্রণিধান করিলেই দেখা যায় যে, বিংশ শতকের আরম্ভে ভারতের রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ ব্যক্তিগতভাবে এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনীতিক সভার মাধ্যমে ইংরেজশাসনের যেসব ত্রুটি, বিচ্যুতি ও সংস্কার সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছেন, ৭০৮০ বৎসর পূর্বেই তাহার প্রায় সবগুলিই বাংলা দেশের নানা সাময়িক পত্রিকায় আলোচিত হইয়াছে।৫৪

১৮৫০ সনের ১লা মে সংবাদ প্রভাকরের’ সম্পাদক “ব্রিটিশ জাতি এ দেশের যথার্থ হিতকারী কিনা” এই বিষয়ে যে সুদীর্ঘ মন্তব্য করিয়াছেন তাহা সাধারণ জনমতের একটি উৎকৃষ্ট সারসঙ্কলন বলিয়া গৃহীত হইতে পারে। তিনি প্রথমেই স্বীকার করিয়াছেন যে, “এই প্রস্তাব লইয়া অনেকেই বাদানুবাদ করিয়া থাকেন, এবং কেহ বা ইহার অনুকূলে এবং কেহ বা ইহার প্রতিকূলে অভিমত ব্যক্ত করেন।” ইহা হইতে বুঝা যায় যে, ঐ সময়ে দেশের শাসনসংক্রান্ত ব্যাপারে শিক্ষিত জনসাধারণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছিল। জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশানুরাগের সূচনার ইহা একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন।

পূর্বোক্ত সংবাদ প্রভাকরের’ সম্পাদকীয় মন্তব্যে ব্রিটিশশাসনের উপকারিতা ও অনিষ্ট এই দুইয়েরই যে বিবরণ আছে নিম্নে তাহার সারমর্ম দিতেছি।

উপকারিতা

১। উৎকৃষ্ট শাসনপ্রণালী ও তাহার ফলে দেশে শান্তিস্থাপন ও প্রজার ধনপ্রাণ রক্ষা।

২। যাতায়াতের উত্তম ব্যবস্থা, Post অর্থাৎ ডাক গমনাগমন।

৩। বিদ্যাশিক্ষার উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা

“কিন্তু এই উপকারের বিনিময়ে ব্রিটিশ জাতি ভারতবর্ষ হইতে যে উপকার পাইতেছেন তাহা অনেক গুণে বেশি।”

অনিষ্টতা

১। ভারতের অর্থলুণ্ঠন।

“ভূমিকা, স্টাম্পের কর, আদালতের খরচা, লবণের কর, আফিমের কর, বাণিজ্য দ্রব্যের মাসুল ইত্যাদি নানা উপায় দ্বারা যে বিপুলার্থ উপার্জন হইয়া থাকে তাহার অধিকাংশ গভর্নমেন্ট সংক্রান্ত প্রধান প্রধান কর্মকারকগণ ও তাঁহারদিগের জ্ঞাতি কুটুম্বদিগের উদরেই যায়, … এইরূপে এদেশের অনেক টাকা সিবিলদিগের গর্ভেই যায়, এতদ্ভিন্ন মিলিটরী অর্থাৎ সেনাদিগের ব্যয় ও জাহাজ বিষয়ক ব্যয় আছে তাহাতেও ইংরেজরা অনেক টাকা পাইয়া থাকেন, এতদ্দেশীয় ব্যক্তিদিগের মধ্যে সিপাহী ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তি তাহার অংশ প্রাপ্ত হয় না।”

২। লবণের ও আফিমের একচেটিয়া বাণিজ্য

“একে রাজার বাণিজ্য করাই অন্যায় ও অনীতিসূচক তাহাতে আবার একচেটিয়ারূপে বাণিজ্য করা কত বড় অন্যায় তাহা বিজ্ঞ মণ্ডলী বিবেচনা করিবেন, অতএব যে রাজা স্বীয় শক্তি প্রচার পূর্বক একচেটিয়া বাণিজ্য করেন সেই রাজা কিরূপে প্রজার যথার্থ হিতবৰ্ধকরূপে গণ্য হইতে পারেন এইস্থলে আমরা সাহসপূৰ্ব্বক বলিতে পারি যে ব্রিটিশ রাজপুরুষেরা যদ্যপি এই দেশ হইতে অর্থ গ্রহণ করণ পরিত্যাগ করেন ও সিবিলিয়ানদিগের বেতন কৰ্ত্তন করিয়া দেন ও ঘৃণিত একচেটিয়া বাণিজ্য পরিত্যাগ করেন, এতদ্দেশীয় ব্যক্তিদিগের পদোন্নতি করিয়া দেন ও সাধারণের হিতবর্ধনে বিহিত যত্ন ও অনুরাগ করেন তবে তাঁহারা এই ভারতবর্ষের যথার্থ হিতকারি বন্ধু বলিয়া গণ্য হইতে পারেন।”৫৫

১৮৮১ সনে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় “ইংরেজ অধিকারে ভারত সুখী কি অসুখী” এ-সম্বন্ধে সুদীর্ঘ মন্তব্য ও এই প্রসঙ্গে পরবর্তী সংখ্যাগুলিতে ক্রমান্বয়ে অনেকগুলি আলোচনা আছে। ইহাতে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক ইংরেজের মত উদ্ধৃত হইয়াছে এবং “হাইণ্ডম্যান সাহেব (Hyndman) দেশীয় রাজ্যের প্রজার সহিত ইংরেজ রাজ্যের প্রজার অবস্থার তারতম্য করিয়া” যাহা বলিয়াছেন তাহার সারমর্ম উদ্ধৃত হইয়াছে।৫৬ ইহার মধ্যে প্রজাদের করভারের আধিক্য ও ইহা আদায়ের জন্য উৎপীড়ন, দেওয়ানী আদালতের ভয়ানক সর্বস্বান্তকারী খরচ, বাৎসরিক বিশ কোটি টাকা ভারত হইতে ইংলণ্ডে প্রেরণ, পুনঃ পুনঃ দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব, ও প্রজাদের চরম দারিদ্র্য প্রভৃতি–এবং এগুলি সম্বন্ধে সম্পাদকীয় মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আফগান যুদ্ধের ব্যয়ভারের এক অংশও ইংরেজ সরকার দিতে অস্বীকার করায় তাহার বিরুদ্ধে সুকঠোর মন্তব্য করা হইয়াছে। কিন্তু এসকল সত্ত্বেও ইংরেজশাসন দূর করার কথা তখন কোন হিন্দু কল্পনাও করে নাই।

তবে ১৮৮২ সনে ‘সোমপ্রকাশে’ জাতীয় উন্নতি সম্বন্ধে সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়।৫৭ কয়েকটি বিষয়ে ইংরেজজাতির প্রতি বিরুদ্ধভাব পুনঃ পুনঃ প্রতিধ্বনিত হইয়াছে।

ইংরেজ পাদ্রীগণের ছলে বলে কৌশলে সুকুমারমতি হিন্দু কিশোরগণকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা করান, চা-বাগানের কুলি ও নীলচাষীদের উপর সাহেবদের অত্যাচার, এবং অন্যান্য ইংরেজদের বিশেষতঃ সিভিলিয়ান ও গোরা সৈন্যের এদেশীয়দের প্রতি দুর্ব্যবহার, মুসলমানদের প্রতি সরকারের পক্ষপাত,৫৮ উচ্চ রাজকার্যে উপযুক্ত হইলেও দেশীয় লোককে নিযুক্ত না-করা,৫৯ ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি দ্বারা দেশের আর্থিক অবস্থার উৎকর্ষসাধনে সরকারের ঔদাসীন্য ও কোন কোন স্থলে বিরোধিতা,৬০ ছলে বলে কৌশলে দেশীয় রাজ্যগুলি অধিকার, ইত্যাদি। খ্রিষ্টান মিশনারীদের দুর্ব্যবহার সম্বন্ধে রামমোহন রায়ের ও জনসাধারণের যে অভিমত পূর্বে খ্রীষ্টধর্ম প্রসঙ্গে আলোচিত হইয়াছে ষষ্ঠ অধ্যায়ে তাহার অনুরূপ উক্তি উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত সাময়িক পত্রিকায় প্রতিধ্বনিত হইয়াছে।

মফঃস্বলে সিভিলিয়ানদের বহু অত্যাচার ও অবিচারের কাহিনী সমসাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে এবং সম্পাদক ও পত্রপ্রেরকরা এ-বিষয়ে কঠোর মন্ত ব্য করিয়াছেন। ১৮৫০ সনের নূতন এক নিয়ম অনুসারে যে-কোন সিভিলিয়ান কোন ব্যক্তির ৫০ টাকা জরিমানা অথবা ১৫ দিন কারাবাসের দণ্ড বিধান করিলে তাহার বিরুদ্ধে কোন আপীল চলিত না। ইহাতে তাহাদের অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়া যায়। নড়াইলের সুপ্রসিদ্ধ এক জমিদার এইরূপ বিনাদোষে দণ্ডিত হইয়া বহু অর্থব্যয় ও আয়াসের পর নিষ্কৃতি পান। ১৮৫৪ সনে ‘সংবাদ প্রভাকরের’ সম্পাদক লিখিয়াছেন :

“অশিক্ষিত সিবিলিয়ানদের অত্যাচার ও অবিচারে মফঃসলবাসি নিরিহ প্রজাকুল ত্রাহি ত্রাহি শব্দ করিতেছেন, যদিও এই বিষয়ে অনেক প্রমাণ ইংরাজী ও বাংলা সংবাদপত্রে প্রকাশ হইয়াছে তথাচ আমারদিগের রাজপুরুষগণের এমত পক্ষপাত যে তাহার প্রতি দৃকপাতও করেন নাই।”৬১

অন্যান্য শ্বেতাঙ্গেরাও ‘নেটিভদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার করিতেন। হিন্দু কলেজের প্রধান অধ্যাপক লজু সাহেব একবার তাঁহার সহিসকে চাবুক মারেন। সহিস নালিশ করিলে ম্যাজিষ্ট্রেট লজুকে ‘মিষ্ট ভর্ৎসনা করেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার সহিসকে প্রহার করায় সহিসও তাহার প্রত্যুত্তরে “সপাৎ করিয়া সেলামি দাখিল করিয়াছিল” এবং অধিকন্তু নালিশও করিয়াছিল। ম্যাজিষ্ট্রেট উক্ত সাহেবের এক টাকা দণ্ড করিলেন।৬২

শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র নন্দী খ্রীষ্টধর্মের বিরুদ্ধ এক মাসিক-পত্র প্রকাশ করিতেন। তাঁহার সরকার ইহার একখণ্ড দিবার মানসে হরেকষ্ণ আঢ্যের স্কুলে গমন করিলে ডাক্তার ন্যাস (Nash) নামে উক্ত বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক “সহসা আগমনপূর্বক ঐ নির্দোষি সরকারকে স্বহস্তে বেত্রাঘাত করিয়াছেন।” উক্ত সরকার বিদ্যালয়ের কর্তার নিকট এই ব্যাপার জানাইলে তিনি উত্তর করিলেন, “আমি কি করিব সাহেব মারিয়াছেন।”৬৩

চা-বাগানের কুলিদের প্রতি অমানুষিক অত্যাচার বাংলা দেশে প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছে। ১৮৮৬ সনে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক মন্তব্য করিয়াছেন:

“কুকুট হত্যার ন্যায় কুলিহত্যাও চা-কর সাহেবদের অভ্যস্ত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। নরহত্যা করিতে পাষণ্ডদিগের প্রাণে একটু আঘাত লাগে না। ইংরাজ বিচারকও আবার এমনি মনুষ্যত্ববান যে স্বজাতি বলিয়া তাঁহারা হত্যাকাণ্ডে অপরাধীকেও নিষ্কৃতি দিয়া থাকেন। পাঠক কি কখন কুলিহত্যার জন্য কোন সাহেবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে দেখিয়াছেন? অথচ ইংরাজের এই কুলিহত্যার কথা শুনিতে শুনিতে আপনাদেরও কর্ণ বধির হইয়া যাইতেছে। আসাম প্রদেশ কুলির বধ্যভূমি, চা-কর ও নীলকর সাহেব বাহাদুর সেই বধ্যভূমির জুহ্লাদ। অনবরতই কুলির প্রাণ সেই আসামের বধ্যভূমিতে প্লীহা ফাটিয়া বাহির হইতেছে। কুলি একটু রূঢ় কথা কহিলে, মনিব গরম হইয়া অমনি তাহার বুকে জুতার সহিত লাথি প্রহারে তাহার অনাবশ্যকীয় ঘৃণ্য জীবন বাহির করিয়া ফেলেন, কুলি ঘরে যাইবার প্রস্তাব করিলে মনিবের দোদুল্যমান চাবুক পৃষ্ঠের উপর পঞ্চাশ বার পতিত হইয়া দরিদ্রকে ইহজগতের পরপারে রাখিয়া সে কুলির রমণী লইয়া সাহেব বিহার করিতে লাগিল। কালানিগার যদি আপত্তি করিতে আসে দোনলা বন্দুকের একটি শব্দ শুনিয়া অমনি তাহার প্লীহা ফাটিয়া যায়।”৬৪

এই মন্তব্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ চা-কর হেনরী সাহেব কর্তৃক লালা মাটুনকে আঘাত ও তাহার ফলে তাহার মৃত্যুর কাহিনী ও বিচারবিভ্রাটের বিষয় বর্ণিত হইয়াছে।

আসামের ডেপুটি কমিশনার “দুই ঘণ্টার মধ্যে এই খুনী মকদ্দমার বিচার করিয়া সামান্য অপরাধে হেনরীর একশত টাকা জরিমানা করেন।” ইহার পর হাইকোর্টের আদেশে সেসনসে ইহার পুনর্বিচার হয়। “সোমপ্রকাশের সম্পাদক লিখিয়াছেন :

“মকদ্দমা সেসনগৃহ চা-কর সাহেবে পরিপূর্ণ হইয়া যায়। পাঁচজন জুরি বসিয়া বিচার আরম্ভ করে। জুরিরা স্থির করিলেন লালা মাটুনের মৃত্যু হইয়াছে। হেনরি তাহাকে আঘাত করিবার কিয়ৎক্ষণ পরে মাটুন মূৰ্ছা যায়। সেই মূৰ্ছাতেই তাহার প্রাণ বিয়োগ হয়। ডাক্তারেরা বলিলেন প্লীহা ফাটিয়া মাটুনের মৃত্যু হইয়াছে। কিন্তু কোন আঘাতে যে তাহার প্লীহা ফাটিয়াছে একথা বলিতে তাঁহারা প্রস্তুত নহেন। জুরি ও জজ বাহাদুর একে বুদ্ধির বৃহস্পতি, তাহাতে আবার স্বজাতি প্রেম তাঁহাদের হৃদয়ে উদ্বেলিত, স্বজাতীর সহচরগণ চতুঃপার্শ্বে ঘেরিয়া বসিয়া আছে। কাযেই তাঁহাদের একটা সূক্ষ্ম বিচার করিতে হইল। লালা মাটুনের প্লীহা রোগ ছিল, সে হেনরির হস্তে আঘাত প্রাপ্ত হইয়া অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া উঠে। ক্রোধেই সে অচৈতন্য হইয়া ভূমিতে পড়িয়া যায়, সেই ক্রোধের বেগেই তাহার প্লীহা ফাটিয়া প্রাণ বাহির হয়। হেনরি প্রহার অথবা ভূমিতে পড়িয়া যাইবার কারণে তাহার জীবন বহির্গত হয় নাই। হেনরি হত্যাপরাধে কোনমতেই অপরাধী হইতে পারেন না। সুতরাং ডেপুটি কমিশনার যে বিচার করিয়াছেন তাহা নিতান্ত অন্যায় হইয়াছে। জুরিদের এই সুন্দর বিচারে হেনরি অব্যাহতি পাইবেন।”৬৫

‘সোমপ্রকাশের সম্পাদক মন্তব্য করিয়াছেন :

“আজ যদি বিলাতে এইরূপ একটা নরহত্যা রাজদ্বারে উপেক্ষিত হইত, তিনশত ওয়াট টাইলার উদ্ভূত হইয়া তাহার প্রতিবিধানে যত্নবান হইত। ভারতে ইংরাজের সে ভয় নাই, সুতরাং পিশাচের সম্মুখে নরহত্যার দ্বার নিয়তই উঘাটিত।”৬৬

এই সুদীর্ঘ উক্তি ও মন্তব্যে এদেশীয়দিগের প্রতি সাহেবদের মনোভাব, এবং বাঙ্গালীর মনের যে ক্ষুব্ধ নিষ্ফল বেদনাবোধ ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা যে উনিশ শতকের এই উভয় সম্প্রদায়ের সুপরিচিত মনোবৃত্তির যথার্থ পরিচয় সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। প্লীহা-ফাটানো ছাড়াও যে চা-বাগানের কুলি ও কুলিরমণীর উপর কতরকম অত্যাচার হইত, তাহার বর্ণনা বহু স্থানে আছে।৬৭

চা-করদের অপেক্ষাও নীলকরদের অত্যাচার আরও ব্যাপক ও দুর্বিসহ ছিল। অন্যত্র তৃতীয় অধ্যায় এ-সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে। সমসাময়িক পত্রিকায় এই সম্বন্ধে বহু কাহিনী ও মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছে।৬৮ আমেরিকায় ক্রীতদাসদের উপর অত্যাচার সমস্ত বিশ্বের সহানুভূতি আকর্ষণ করিয়াছে। কিন্তু ভারতে চা-কর ও নীলকর সাহেবের দুষ্কৃতি তাহা অপেক্ষা কোন অংশে হীন না হইলেও ভারতের বাহিরে প্রচারিত হয় নাই। তবে ইহা অনস্বীকার্য যে, যে-সকল কারণে ইংরেজশাসনের বহু গুণ থাকা সত্ত্বেও তাহাদের জনপ্রিয়তা ক্রমশঃ হ্রাস পাইয়া বিদ্বেষে পরিণত হইয়াছিল, চা-কর ও নীলকরদের অত্যাচার তাহাদের মধ্যে গুরুতর স্থান অধিকার করে।

মফঃস্বলে পুলিশ, কনস্টেবল, দারোগা প্রভৃতির অত্যাচারের বহু কাহিনী সাময়িকপত্রে বর্ণিত হইয়াছে, ইহাও উনিশ শতকের বিশেষ সুপরিচিত কাহিনী।

পাদটীকা

১. বাংলা দেশের ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড দ্রষ্টব্য।

২. E.C. Sachau, English Translation of Alberuni’s account, pp. 17, 19.

৩. Halide Edib, Inside India, History of Freedom Movement in India by R.C. Majumdar, Vol. III. p 573

৪. Reformer’ quoted in the India Gazette of 4 July, 1831. Quoted in R.C. Majumdar, History of Political Thought, pp. 186-87.

৫. বিনয় ১১৬০-৬১

৫ক. বিনয় ২।৩৯৩-৯৪

৬. ঐ, ৩৫৪৫

৭. ঐ, ৪৫৩২

৮. R.C. Majumdar, Glimpses of Bengal in the Nineteenth century, pp. 40-41

৯. ঐ

১০. ঐ, পৃ. ৩৯

১১. ঐ, পৃ.৪১

১২. ঐ, পৃ. ৪১-৪২

১৩. ঐ, পৃ. ৪২

১৪. ঐ, পৃ. ৮২

১৫. সং সে ক ২৯০ পৃ.

১৬. ঐ, ২।২৯২

১৭. ঐ, ২৯১-৯২

১৮. ঐ, ২৯৩

১৯. ঐ (দ্বিতীয় সং) ৪০৭ পৃ.

২০. B. Majumdar, op. cit.p. 164

২১. বিনয় ৩২৩৫-৩৬

২২. মূল আবেদনপত্রখানির জন্য B. Majumdar, op. cit.pp. 474-89 দ্রষ্টব্য।

২২ক. তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার অনুবাদ। রাজনারায়ণ বসু স্বয়ং ইহার অনুবাদ করিয়াছেন “জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা”।

২৩. বিনয় ২। ২৬৫-৬৬।

২৪. বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় (৬৭ বর্ষ ২য় সংখ্যা ১৩৬৭, পৃ. ১০২) রাজনারায়ণ বসুর পুস্তিকা প্রকাশের যথার্থ তারিখের আলোচনা ও হিন্দুমেলার বিস্তৃত বিবরণ আছে। Modern Review (June, 1944, pp. 444 ff.) পত্রিকায় মূল পুস্তিকা মুদ্রিত হইয়াছে।

২৫. রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত, ২০৮ পৃ.।

২৫ক. বিনয় ১। ৫২২

২৬. রবীন্দ্রনাথ, জীবনস্মৃতি (১৩৪০), ১৪৬ পৃ.

২৭. বিনয়, ২। ৬৩৪

২৮. বিনয়, ১। ৪৭৬-৭৮। হিন্দুমেলার বিস্তৃত বিবরণের জন্য সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা (১৩৬৭), পৃ. ১০২ দ্রষ্টব্য।

২৯. বঙ্কিম গ্রন্থাবলী (সাহিত্য পরিষদ সংস্করণ), “বিবিধ”, ৩২৯-৩১ পৃ.

৩০. B. Majumdar, op. cit. pp.293-94.

৩১. B.C. Pal, Memoris of My Life and Times, 1.p. 227.

৩২. বঙ্কিম গ্রন্থাবলী (সাহিত্য পরিষদ সংস্করণ), কমলাকান্তের দপ্তর, ৬৯, ৭১, ৭২ পৃ. মৃণালিনী, ১০৪, ১০৬; বিবিধ প্রবন্ধ, ১৪১-১৪৪, ১৪৭ পৃ.।

৩৩. History and Culture of the Indian People (HCIP), Vol, X, p. 214,

৩৪. Bengal Celebraities, p. 41. HCIP. X. p. 499

৩৫. HCIP, X, p. 500.

৩৬. বিনয়, ১। ৫২৫

৩৭. ঐ, ৫২৬

৩৮. ইহার বিস্তৃত বিবরণের জন্য নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি দ্রষ্টব্য : Jogesh Chandra Bagal History of the Indian Association, 1876-1951, HCIP, X. pp. 500 506.

৩৯. B.C. Pal, Memoris of my Life and Times. I. pp. 242-48.

৪০. Speeches and Writings of surendra Nath Banerjea, pp. 277-31.

৪১. B.C.Pal, op. cit, p. 235.

৪২. Sir Henry Cotton, New India (1907 Edition) p. 23 (এই গ্রন্থ ১৮৮৫ সনে প্রথম প্রকাশিত হয়)।

৪৩. Surendra Nath Banerjea, A Nationa in Making, pp. 76-81, HCIP Vol. X. pp. 510-11

৪৪. ইহার বিস্তৃত বিবরণের জন্য এই গ্রন্থগুলি দ্রষ্টব্য : J.C. Bagal, op. cit. pp. 80-81; S.N. Banerjea op. cit, p. 85, 98-99, R.C. Majumdar, Glimpses of Bengal in the Nineteenth Century, pp. 97-104, HCIP X. pp. 512-15.

৪৫. বিপিনচন্দ্র পাল তাঁহার আত্মজীবনীতে (২য় খণ্ড ১৪ পৃ.) লিখিয়াছেন : “কংগ্রেসের উদ্যোক্তা হিউম সাহেব দ্বিতীয় অধিবেশনের আয়োজনের জন্য কলিকাতায় আসিয়া দেখিলেন যে বাঙ্গালী নেতাদের সহযোগিতা ও সহানুভূতি লাভ করিতে হইলে সুরেন্দ্রনাথকে কংগ্রেস হইতে বাদ দিলে চলিবে না। সুতরাং তিনি সুরেন্দ্রনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহাকে কংগ্রেসে যোগদান করিতে সম্মত করাইলেন”।

৪৬. Sayid Ahmad, “On the Present State of Indian Politics, pp. 11-12

৪৭. Malleson, G.B, The Indian Mutiny of 1857, p. 412.

৪৮. S.N Banerjea, op. cit, p. 87

৪৯. Studies in the Bengal Benaissance, Edited by Atulchandra Gupta, p. 169.

৫০. ঐ, ১৭০ পৃ.

৫১. ঐ।

৫২. HCIP, x, p. 299

৫৩. ঐ, ৩০২ পৃ.

৫৪. বিনয়, ১। ৭৪

৫৫. বিনয়, ৭৫

৫৬. ঐ, ৪। ৩৯২-৯৭

৫৭. ঐ, ৪০৭-০৮

৫৮. ঐ, ৩৪৩

৫৯. ঐ, ৩। ৯৫, ১২১, ১৩১, ১৩৭, ১৪১, ১৭১, ১৯৩, ৩৬৭

৬০. ঐ, ১। ১৮৬

৬১. ঐ, ২০৬, ৪৫২

৬২. ঐ, ৩৩০– ৩১

৬৩. ঐ ১৮৮-৮৯

৬৪. ঐ, ৪। ৪৫৬-৫৭

৬৫. ঐ, ৪৫৭-৫৮

৬৬. ঐ, ৪৫৮

৬৭. ঐ, ৪৬১

৬৮. ঐ, ১। ৭৩-৭৪, ৮১-৮২, ৯৮, ১০২-০৪, ১০৬, ১০৯-১৩; ৪। ৫৫-৫৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *