০৩. লেফটেনান্ট গভর্নরের অধীনে বাংলা দেশ (১৮৫৪-১৯০৪)

তৃতীয় অধ্যায় – লেফটেনান্ট গভর্নরের অধীনে বাংলা দেশ (১৮৫৪-১৯০৪)

১. বিক্ষোভ ও বিপ্লব

(ক) অসন্তোষ ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিপ্লব

পলাশির যুদ্ধের ফলে যখন সিরাজদ্দৌল্লার পরিবর্তে মীর জাফর বাংলার নবাব হইলেন, এবং ইংরেজের ক্ষমতা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হইতে লাগিল, তখন সাধারণ লোক বিশেষ ক্ষুণ্ণ বা বিচলিত হয় নাই; কারণ এরূপ রাষ্ট্রবিপ্লবে তাহারা অভ্যস্ত ছিল। মাত্র ১৭ বৎসর পূর্বে নবাব সরফরাজ খাঁকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করিয়া আলিবর্দি নবাব হইয়াছিলেন, তাঁহার দৌহিত্রকে বধ করিয়া মীর জাফর মসনদে আরোহণ করিলেন, মীর জাফরকে সরাইয়া মীর কাশিম নবাব হইলেন, আবার মীর জাফর নবাব হইলেন। এই সকলই স্বাভাবিক রাজনীতিক পরিবর্তন বলিয়া লোকে গ্রহণ করিল। তাহারা ভালভাবেই জানিত :

এক রাজা যাবে পুনঃ অন্য রাজা হবে।
বাংলার সিংহাসন শূন্য নাহি রবে ॥

মীর জাফরের মৃত্যুর পর যখন তাহার উত্তরাধিকারীরা নামেমাত্র নবাব রহিলেন, প্রকৃত ক্ষমতা ইংরেজের হাতে চলিয়া গেল–তখন নানা কারণে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মনে অসন্তোষ জন্মিল। মুসলমান নবাবের অধীনে মুসলমানগণ অনেক উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত হইত, তাহাদের মক্তব মসজিদ রাষ্ট্রের সাহায্য পাইত এবং হিন্দুর তুলনায় তাহাদের সামাজিক ও রাজনীতিক পদমর্যাদা অধিক উন্নত ছিল। ইসলাম ধর্ম ও আইনের প্রতিপত্তি ছিল। ইংরেজের শাসন যতই দৃঢ়তর হইতে লাগিল ততই এ-সকল সুযোগ ও সুবিধা হ্রাস পাইতে লাগিল। সুতরাং মুসলমানেরা ক্ষুব্ধ হইল।

ঠিক এই সমুদয় কারণেই হিন্দুরা ইংরেজরাজ্য প্রীতির চক্ষে দেখিতে লাগিল। ইংরেজেরা তাহাদের ধর্মে কোনপ্রকার হস্তক্ষেপ করিত না, হিন্দুর ধর্ম ও আইনের মর্যাদা রাখিত, এবং কোন বিষয়েই মুসলমানকে হিন্দুর অপেক্ষা অধিক সুবিধা ও সম্মান দিত না। কিন্তু আর্থিক ব্যাপারে হিন্দুরা মুসলমানদের তুলনায় অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হইল।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা দেশ ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধিশালী ছিল। ইহার উর্বর জমিতে শস্য প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হইত এবং নানাবিধ শিল্পদ্রব্য ও ব্যবসায়ের দ্বারা বাঙ্গালী হিন্দুরা বিশেষ সমৃদ্ধিশালী হইয়াছিল। এ-সম্বন্ধে দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে।

ইংরেজ বণিক-কোম্পানি যখন বাংলার রাজশক্তি হাতে পাইল তখন কোম্পানি ও তাহার কর্মচারিগণ ব্যক্তিগতভাবে জোর ব্যবসায় চালাইতে লাগিল। অনেক ব্যবসায় তাহারা একচেটিয়া করিয়া নিল। এদেশীয় বণিকদের উপর শুল্ক বসান হইল, কিন্তু ইংরেজ ব্যবসায়ীদের শুল্ক দিতে হইত না। তাহারা রাজশক্তির অপব্যবহার করিয়া তাঁতিদের জোর করিয়া দাদন দিত এবং স্বল্পমূল্যে তাহাদের উৎপন্ন বস্ত্রাদি ক্রয় করিয়া প্রচুর লাভ করিত। এইরূপে নানা অসৎ উপায় অবলম্বনপূর্বক ইংরেজেরা এদেশের শিল্প ও বাণিজ্যের সর্বনাশ করিল। বাংলা। দেশে বস্ত্রশিল্প বিশেষ সমৃদ্ধ ছিল–কিন্তু বিলাতী মিলের কাপড়ের প্রতিযোগিতায় তাহা ধ্বংস হইল। পলাশির যুদ্ধের পর প্রত্যেক নবনিযুক্ত নবাবের নিকট হইতে তাহাকে মসনদ দিবার বিনিময়ে উচ্চপদস্থ ইংরেজ রাজকর্মচারীরা এত উৎকোচ বা। উপঢৌকন আদায় করিত যে বাংলার নবাবের অতুল ঐশ্বর্য নিঃশেষিত হইল। যে বাংলা দেশ এতদিন ধন-ঐশ্বর্যে ভারতে অতুলনীয় ছিল–এইরূপে সেদেশের অভাব ও দারিদ্র্য দেখা দিল। শিল্প ও বাণিজ্য ধ্বংস হওয়ার ফলে অনেকেই। কৃষিকার্যে যোগ দিল-ফলে কৃষকদের অবস্থাও খারাপ হইতে লাগিল। নূতন রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থায় সাময়িক ইজারাদারগণ প্রজাগণের নিকট হইতে অল্প সময়ের মধ্যে যতদূর সম্ভব আদায় করিবার জন্য তাহাদিগকে উৎপীড়ন করিত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইহার কতকটা উপশম হইল। কিন্তু অনেক জমিদার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রাজস্ব দিতে না-পারায় তাহাদের জমিদারি নিলাম হইল। নূতন নূতন জমিদার প্রজাদের স্বত্ব-নির্ধারণ ও খাজানা সম্বন্ধে যেসব নিয়মকানুন ছিল তাহা পালন না-করায় কৃষক প্রজাদের দুর্গতির সীমা রহিল না। অবশ্য আদালতে তাহারা নালিশ করিতে পারি, কিন্তু তাহা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য ছিল বলিয়া অনেক প্রজাই কোন প্রতিকার পাইত না। ইংরেজেরা বাঙ্গালীদিগকে অসভ্য বর্বর মনে করিত এবং সাধারণ লোকের সহিত কোনপ্রকার সামাজিক সম্বন্ধ রক্ষা করিত, বরং অনেক সময় তাহাদের সহিত অভদ্র ব্যবহার করিত। ইংরেজ মিশনারীগণ খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য হিন্দুধর্মের দেবদেবীকে গালাগালি দিত–তাহারা রাজার জাতি, সুতরাং ভয়ে কেহ তাহাদিগের প্রতিবাদ করিতে সাহস পাইত না।

এই সমুদয় কারণে বাঙ্গালীরা ক্রমে ক্রমে ইংরেজের প্রতি বিরূপ হইয়া উঠিল। ইংরেজ সরকার যে নূতন শাসনপ্রণালী ও নূতন আইনের প্রচলন করিল, বাঙ্গালীরা তাহাতে অভ্যস্ত না-থাকায় ইহাও অসন্তোষ ও বিরাগের সৃষ্টি করিল।

কিন্তু বাংলা দেশে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ থাকিলেও জনসাধারণ নূতন রাজ্যশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নাই। তবে বিপ্লব যে একেবারে হয় নাই তাহা নহে। কয়েকটি গুরুতর বিপ্লবের বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করিতেছি।

বাংলায় ইংরেজরাজত্বের প্রথমভাগে হেস্টিংসের আমলে ‘সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ’ ও ‘রংপুরের বিদ্রোহের’ সংক্ষিপ্ত বিবরণ পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে।

হেস্টিংসের পরেও এই শ্রেণীর বিপ্লব আরও অনেক হইয়াছে। বিষ্ণুপুর ও বীরভূম অঞ্চলে অসম্ভব খাজনা বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রজাগণের দুর্দশার সীমা ছিল নাদায়ে ঠেকিয়া অনেকে দস্যুবৃত্তি আরম্ভ করিল। ১৭৮৪ সনে সৈন্য পাঠাইয়া এইসব ডাকাত দমন করিতে হয়। ইহা সত্ত্বেও ডাকাতেরা সরকারী কোষাগার পুনঃপুনঃ লুট করে। ১৭৮৮-১৭৮৯ সনে সরকারী পুলিশের ব্যুহ ভেদ করিয়া দলে দলে দস্যুগণ গ্রাম বাজার লুট করে। নিঃস্ব উৎপীড়িত প্রজাগণও তাহাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ইহার ফলে গুরুতর বিপ্লব নানা স্থানে ছড়াইয়া গড়ে এবং কিছুদিনের জন্য ইংরেজশাসনের চিহ্ন একেবারে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু ক্রমে প্রজা ও দস্যগণের মধ্যে বিরোধ হয় এবং প্রজারা গভর্নমেন্টের সহায়তা করে। অবশেষে ১৭৯০ সনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসে। কিন্তু এই বিপ্লবের ফলে প্রায় সাত লক্ষ টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়।

মানভূম জিলায় ও নিকটবর্তী স্থানে চুয়ার জাতি বহুবার বিদ্রোহ করে। বাঁকুড়া জিলার অন্তর্গত রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিংহের রাজস্ব যথাকালে জমা না হওয়ায় তাহার জমিদারি নিলাম হয়। ইহাতে তাঁহার অনুচর প্রায় ১৫০০ চুয়ার রায়পুর আক্রমণ করিয়া বাজার ও কাছারিবাড়ী পুড়াইয়া দেয়। ফলে যে-ব্যক্তি নিলামে ঐ জমিদারি কিনিয়াছিল সে ইহার দখল নিতে পারিল না। দুর্জন সিংহকে গ্রেপ্তার করা হইল–কিন্তু তাহার বিরুদ্ধে সাহস করিয়া কেহ সাক্ষী দিতে না আসায় সে খালাস পাইল। অতঃপর দুর্জন সিংহ চুয়ারদের সাহায্যে বাঁকুড়া জিলার বহু পরগণা লুটপাট করিয়া ফিরিতে লাগিল। ১৭৯৯ ও ১৮০০ সনে মেদিনীপুর জিলায় চুয়ারদের বিপ্লব এত গুরুতর ও বিস্তৃত হয় যে বহু সৈন্য পাঠাইতে হয়। স্থানীয় বহু জমিদার এই বিপ্লবের নায়ক ছিলেন এবং তাঁহাদের দমন করিতে গভর্নমেন্টকে বহু বেগ পাইতে হইয়াছিল।

শ্রীহট্টের দুঃস্থ প্রজাগণ রাজস্ব-আদায়কারী কর্মচারীদিগকে বাধা দেয় এবং ১৭৮৭ সনে রাধারামের নায়কত্বে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করে। অনেক গ্রাম লুট ও অনেক লোক হতাহত হয়। রাধারামকে গ্রেপ্তার করার সময় একজন পুলিশ কর্মচারী ও তাহার কুড়ি জন লোক নিহত হয়।

১৭৯৯ সনে আগা মুহম্মদ রেজা শ্রীহট্ট হইতে আসিয়া কাছাড় দখল করে এবং ১২০০ অনুচরসহ কোম্পানির একটি থানা আক্রমণ করে। সিপাহীদের সহিত যুদ্ধে তাহার পরাজয় ঘটে। তাহার ৯০ জন অনুচর ও পাঁচটি ছোট কামান ধরা পড়ে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে মৈমনসিংহ জিলার শেরপুর শহরে করম শাহ গারো ও হাজং জাতির নায়ক হইয়া সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শে ‘পাগল’ বা ‘ভাই সাহেব’ নামে এক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার পুত্র টিপু দুঃস্থ উৎপীড়িত প্রজাগণের সাহায্যে লুটপাট করিয়া একটি বড় দল গঠন করেন এবং ঘোষণা করেন যে, জমির খাজনা বিঘা প্রতি এক আনার বেশী কোন প্রজা দিবে না। ১৮২৫ সনের জানুআরি মাসে প্রায় সাতশত অনুচর লইয়া তিনি শেরপুরের জমিদারবাড়ী আক্রমণ ও লুট করেন। জমিদার পলাইয়া যান। টিপু গড়জরিপা নামে এক দুর্গে নিজেকে রাজা বলিয়া ঘোষণা করেন। টিপু শীঘ্রই ধৃত হইলেন, কিন্তু গভর্নমেন্ট পাগলা ফকিরদের বিদ্রোহ সহজে দমন করিতে পারে নাই। বৃহৎ একদল সৈন্য পাঠাইয়া ১৮৩৩ সনে বিদ্রোহীদের দুর্গ ও আশ্রয়স্থানগুলি ধ্বংস করা হয় এবং পাগলা ফকিরদের বিদ্রোহেরও অবসান হয়।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে বাংলায় মুসলমানদের দুইটি বিপ্লব জনসাধারণের মনে বিশেষ ভীতি ও উদ্বেগের সঞ্চার করিয়াছিল। আরবে আবদুল ওয়াহাব নামক এক ব্যক্তি (১৭০৩-১৭৮৭ খ্রী.) মুসলমান ধর্মের সংস্কারের জন্য এক আন্দোলন উপস্থিত করেন। তাঁহার প্রবর্তিত সম্প্রদায় ‘ওয়াহাবি’ নামে প্রসিদ্ধ। ভারতবর্ষেও ওয়াহাবি ধর্মমত প্রচারিত হইয়াছিল (১৮২০-৭০ খ্রী.) এবং প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল খুব প্রসার লাভ করিয়াছিল। বেরিলি শহর নিবাসী সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬-১৮৩১ খ্রী.) ভারতে ইহার প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু সমগ্র উত্তরভারতে এই আন্দোলন শক্তিশালী হইবার পূর্বেই বাংলা দেশে দুইজন মুসলমান ইহার অনুরূপ আন্দোলন আরম্ভ করেন। ধর্মসংস্কারের জন্য আরম্ভ হইলেও ক্রমে ইহা ইংরেজ রাজ্য ও জমিদারদিগের বিরুদ্ধে প্রজাদিগকে উত্তেজিত করে। ইসলামধর্মমতে অমুসলমান রাজ্য (দার-উল-হার্ব) মুসলমানদের বাসের অযোগ্য, সুতরাং বিধর্মী ইংরেজকে তাড়াইয়া ভারতে মুসলমান রাজ্য (দার-উল-ইসলাম) পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এই সমুদয় সম্প্রদায়ের প্রধান লক্ষ্য হইয়া দাঁড়াইল। ক্রমে ক্রমে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধেও তাহাদের অত্যাচার আরম্ভ হইল। প্রায় একই সময়ে যশোহর ও নদীয়া জিলায় তিতুমির নামে প্রসিদ্ধ মির নসির আলি এবং ফরিদপুর জিলায় শরিয়উল্লা এই আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং দরিদ্র নিম্নশ্রেণীর বহু লোক দলে দলে তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

তিতুমির মক্কায় পূর্বোক্ত সৈয়দ আহমদের সহিত পরিচিত হন এবং তাহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁহার বহু অনুচর ছিল, অধিকাংশই তাঁতি ও জোলা সম্প্রদায়ভুক্ত। জমিদার কৃষ্ণ রায় ইহাদের ব্যবহারে উত্যক্ত হইয়া তাঁহার রায়দের মধ্যে যে-কেহ ওয়াহাবী আন্দোলনে যোগ দিবে তাহাকে বার্ষিক আড়াই টাকা খাজনা দিতে হইবে–এইরূপ আদেশ দেন এবং পুর্ণা নামক গ্রামের অধিবাসীদের নিকট হইতে ইহা আদায় করেন (১৮৩১ সন)। তিতুমির চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত নারিকেলবেড়িয়াতে একটি সুদৃঢ় বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন এবং পাঁচশত অনুচরসহ জিহাদ ঘোষণা করিয়া পুর্ণা গ্রাম আক্রমণ করেন। সেখানে তাঁহার অনুচরেরা একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে হত্যা করে, গোহত্যা করিয়া গোরক্ত মন্দিরে ছড়াইয়া দেয়, দোকানপাট লুট করে, হিন্দুদের উপর নানাবিধ অত্যাচার করে এবং যেসব মুসলমান তাহাদের সম্প্রদায়ে যোগ দেয় নাই তাহাদেরও নানাভাবে লাঞ্ছনা করে। তাহারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে, বৃটিশরাজ্য শেষ হইয়াছে এবং মুসলমানরাজ্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। তিতুমিরের অনুচরগণ প্রায় বিনাবাধায় নদীয়া, ২৪ পরগণা ও ফরিদপুর জিলায় এইরূপ অত্যাচার করিতে থাকে। একজন ইউরোপীয় সেনানায়ক কলিকাতার মিলিশিয়ার একদল সৈন্য লইয়া তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযান করেন, কিন্তু তিতুমিরের সেনানায়ক গোলাম মসুম তাঁহাকে পরাস্ত করেন এবং তাঁহার বহু সৈন্য হত হয়। অবশেষে বহু অশ্বারোহী, পদাতিক ও গোলন্দাজ সৈন্য তিতুমিরের বিরুদ্ধে প্রেরিত হয় (১৮৩১ খ্র.)। নারিকেলবেড়িয়া দুর্গের সম্মুখে তিতুমির বীরবিক্রমে যুদ্ধ করিয়া নিহত হন এবং তাহার ৩৫০ জন অনুচর বন্দী হয়। তাহাদের মধ্যে একজনের প্রাণদণ্ড এবং ১৪০ জনের কারাদণ্ড হয়।

শরিয়তুল্লার সম্প্রদায়ের নাম ছিল ফরাজী। ইহার অধিকাংশই ছিল জমিদার কর্তৃক উৎপীড়িত প্রজা এবং বাংলার শিল্প ধ্বংস হওয়ার ফলে বেকার শ্রমিকদল। তাঁহার সম্বন্ধে ১৮৩৭ সনের ২২শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ পত্রিকায় একখানি পত্র প্রকাশিত হয়। ইহাতে প্রথমে “তিতুমির নামক একজন বাদশাহি লওনেচ্ছায় দলবদ্ধ হইয়া” কিরূপে প্রথমে “গোবরডাঙ্গা নিবাসী বাবু কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের ধন প্রাণ আঘাত” ও পরে “আর হিন্দুদিগের জাতি প্রাণ ধ্বংস করণে প্রবর্ত হইলে” কলিকাতা হইতে প্রেরিত “অশ্বারূঢ় ও পদাতিক সৈন্যের” হাতে “এককালীন নিপাত হইল” তাহার উল্লেখ আছে। ইহার পরের অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি :

“ইদানীং জিলা ফরিদপুরের অন্তঃপাতি শিবচর থানার সরহদ্দে বাহাদুর গ্রামে সরিতুল্লা নামক এক জবন বাদশাহি লওনেচ্ছুক হইয়া ন্যূনাধিক ১২০০০ জোলা ও মোসলমান দলবদ্ধ করিয়া নূতন এক সরা জারী করিয়া নিজ মতাবলম্বি লোকদিগের মুখে দাড়ি কাছা খোলা কটি দেশে চৰ্ম্মের রজ্জ্ব ভৈল করিয়া তৎচতুগর্দিস্থ হিন্দুদিগের বাটী চড়াও হইয়া দেবদেবীর পূজার প্রতি অশেষ প্রকার আঘাত জন্মাইতেছে এবং এই জিলা ঢাকার অন্তঃপাতি মলকতগঞ্জ থানার সরহদ্দে রাজনগর নিবাসী দেওয়ান মৃত্যুঞ্জয় রায়ের স্থাপিত দ্বাদশ শিবলিঙ্গ ভাঙ্গিয়া নদীতে বিসর্জন দিয়াছে এবং ঐ থানার সরহদ্দে পোরাগাছা গ্রামে একজন ভদ্রলোকের বাটীতে রাত্রিযোগে চড়াও হইয়া সৰ্বস্ব হরণ করিয়া তাহার গৃহে অগ্নি দিয়া অবশিষ্ট যে ছিল ভস্মরাশি করিলে একজন জবন ধৃত হইয়া ঢাকার দওরায় অর্পিত হইয়াছে।…আর শ্রুত হওয়া গেল সরিতুল্লার দলভুক্ত দুষ্ট জবনেরা ঐ ফরিদপুরের অন্তঃপাতি পাটকান্দা গ্রামের বাবু তারিণীচরণ মজুমদারের প্রতি নানা প্রকার দৌরাত্ম অর্থাৎ তাঁহার বাটীতে দেবদেবী পূজার আঘাত জন্মাইয়া গোহত্যা ইত্যাদি কুকৰ্ম্ম উপস্থিত করিলে মজুমদার বাবু জবনদিগের সহিত সম্মুখ যুদ্ধ অনুচিত বোধ করিয়া ঐ সকল দৌরাত্ম ফরিদপুরের মাজিষ্ট্রেট সাহেবের হজুরে জ্ঞাপন করিলে ঐ সাহেব বিচার পূর্ধ্বক কএক জন জনকে কারাগারে বদ্ধ করিয়াছেন এবং এ বিষয়ের বিলক্ষণ অনুসন্ধান করিতেছেন। হে সম্পাদক মহাশয়, দুষ্ট জবনেরা মফঃস্বলে এ সকল অত্যাচার ও দৌরাত্মে ক্ষান্ত না হইয়া বরং বিচারগৃহ আক্রমণ করিতে প্রবৃত্ত হইল। শ্রুত হওয়া গেল ফরিদপুরের মাজিষ্ট্রেট সাহেবের হজুরে যে সকল আমলা ও মোক্তারকারেরা নিযুক্ত আছে তাহারা সকলেই সরিতুল্লা জবনের মতাবলম্বি তাহারদিগের রীতি এই যদি কাহার নামে মিথ্যা অভিযোগ করিতে হয় তবে কেহ ফরিয়াদী কেহ বা সাক্ষী হইয়া মোকদ্দমা উপস্থিত করে সুতরাং ১২০০০ হাজার লোক দলবদ্ধ ইহাতে ফরিয়াদী সাক্ষির ত্রুটি কি আছে। শুনিয়া পরমাপ্যায়িত হইলাম ফরিদপুরের বর্তমান মাজিষ্ট্রেট ধর্মাবতার শ্ৰীযুত রবার্ট গ্রট সাহেব এমত প্রকার কএক মোকদ্দমা অগ্রাহ্য করিয়া জবনেরদিগকে শাস্তি দিয়াছেন কিন্তু জবন দল ভঙ্গের কিছু উপায় উদ্যোগ করিয়াছেন কি না শ্রুত হই নাই…। আমি বোধ করি সরিতুল্লা জবন যে প্রকার দলবদ্ধ হইয়া উত্তর উত্তর প্রবল হইতেছে অল্প দিনের মধ্যে হিন্দুধৰ্ম্ম লোপ হইয়া অকালে প্রলয় হইবেক। সরিতুল্লার জোটপাটের শত অংশের এক অংশ তিতুমির করিয়া ছিল না। অতএব আমরা শ্রীল শ্ৰীযুতের নিকট এই প্রার্থনা

করিতেছি তিনি হিন্দুধর্ম ও দেশরক্ষার নিমিত্ত উক্ত ব্যক্তির দল ভঙ্গের বিহিত আজ্ঞা করুন। ইতি সন ১২৪৩ সাল তারিখ ২৪ চৈত্র।

জিলা ঢাকা নিবাসি দুঃখি
তাপিগণস্য।”

এই পত্রখানি হইতে জানা যায় যে ১৮৩৭ সনেও শরিয়তুল্লা জীবিত ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র মুহম্মদ মুসিন (১৮১৯-১৮৬০ খ্র.) এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও বিধিবদ্ধভাবে গঠিত করেন। তিনি দুধু মিয়া নামে পূর্ববঙ্গে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। তিনি বাহাদুরপুরে কেন্দ্র স্থাপন করিয়া পূর্ববঙ্গ কয়েক ভাগে বিভক্ত করেন, এবং প্রতি বিভাগে বা হল্কায় একজন ডেপুটি বা খলিফা নিযুক্ত করেন। তিনি কৃষকসম্প্রদায়কে অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ করেন। কোন রায়ৎ তাঁহার সম্প্রদায়ে যোগ দিতে অনিচ্ছুক হইলে তাঁহাকে একঘরে করা হইত। রায়দের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ বাধিলে তিনি নিজেই তাহার বিচার করিতেন এবং হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান যে-কোন রায়ৎ তাহার নিকট অভিযোগ না করিয়া আদালতে নালিশ করিলে তাহাদের শাস্তি দিতেন। তিনি ঘোষণা করিলেন যে জমি ভগবানের, সুতরাং জমিদারদের খাজনা আদায় করার কোন অধিকার নাই। বিংশ শতাব্দীর অসহযোগ আন্দোলনের অনেক পূর্বাভাস দুধু মিয়ার আন্দোলনে পাওয়া যায়। জমিদার ও নীলকরেরা তাঁহার এই সমুদয় প্রচারের ফলে ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া তাহার নামে লুটপাট, অনধিকার প্রবেশ, প্রভৃতি বহু অত্যাচারের জন্য বহুবার আদালতে অভিযোগ করে, কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবার লোক না-থাকায় তিনি প্রতিবারই খালাস পান। অবশেষে ১৮৫৭ সনে তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়া রাজবন্দীরূপে রাখা হয়। ১৮৬০ সনে বাহাদুরপুরে তাঁহার মৃত্যু হয়।

বাংলা দেশের এই দুই আন্দোলন এবং ওয়াহাবি আন্দোলনকে অনেকে ভারতের স্বাধীনতালাভের জন্য প্রথম জাতীয় আন্দোলন বলিয়া মনে করেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের দিক হইতে ইহা সত্য হইলেও হিন্দুসম্প্রদায় যে ইহাকে সম্পূর্ণরূপে অন্য চোখে দেখিত, এই পত্রখানি হইতে তাহার সম্যক ধারণা করা যাইবে। পরবর্তীকালে যখন ওয়াহাবি আন্দোলন উত্তরভারতে প্রবল শক্তিশালী হইয়াছিল তখনও বাংলা দেশের মুসলমানেরা ধন-জনের দ্বারা ইহার বিশেষ সাহায্য করিয়াছিল। কিন্তু হিন্দুরা ইহাতে যোগদান করে নাই। সে আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল বাংলা দেশ হইতে বহুদূরে, ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পার্বত্য প্রদেশে। সুতরাং বাংলা দেশের ইতিহাসে ইহার বিস্তৃত বর্ণনা অনবাশ্যক।

(খ) সিপাহী ও জনসাধারণের বিদ্রোহ

ভারতীয় বিদ্রোহের কারণ ও প্রক্রিয়া

১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুআরি মাসে ডালহৌসীর স্থানে ভাইকাউন্ট ক্যানিং (১৮৫৬ ১৮৬২ খ্রী.) বড়লাট হইয়া আসিলেন। এক বৎসর যাইতে-না-যাইতেই ভারতের নানা স্থানে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হইল। প্রায় শতবৎসরকাল বিদেশী ইংরেজগণের জবরদস্ত শাসনের ফলে ভারতব্যাপী সর্বসাধারণের মধ্যে এই সময় একটা ঘোর অসন্তোষের এবং নানা আশঙ্কার ভাব বিরাজ করিতেছিল। দেশের রাজারা দেখিতেছিলেন, একটির-পর-একটি করিয়া দেশীয় রাজ্যগুলি ইংরেজগণ অধিকার করিতেছে। ইহাতে প্রত্যেকেরই আশঙ্কা হইতে লাগিল যে, এইবার বুঝি তাহার নিজের পালা আসিবে। ভারতীয় জনসাধারণ রেলওয়ে ও টেলিগ্রাফ, সামাজিক সংস্কার ও ইংরেজি শিক্ষা এবং অন্যান্য নূতন বিধানের প্রবর্তনে ভীষণ সন্দিগ্ধ হইয়া ভাবিতেছিল যে, বৃটিশ সরকার সমস্ত ভারতবাসীকে খ্রীষ্টান করিবার উদ্দেশ্যেই এইসকল কার্য করিতেছে। অযোধ্যা ও অন্যান্য রাজ্য বৃটিশসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ঐ সমুদয় প্রদেশের বহু যুদ্ধব্যবসায়ী বেকার হইয়া পড়িয়াছিল। এইসকল লোক দেশের মধ্যে ইংরেজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বিস্তারের সহায়তা করিতেছিল। এদেশীয় সিপাহীরা নানা অসুবিধা ও অবিচার ভোগ করিয়া বহুদিন হইতেই ইংরেজসরকারের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। অবশেষে সৈন্যদলের মধ্যে এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন সিপাহীদের বিদ্রোহের সাক্ষাৎ কারণ হইয়া দাঁড়াইল। এই রাইফেলে টোটা ভরিবার পূর্বে তাহার একাংশ দাঁত দিয়া কাটিয়া লইতে হইত। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের জানুআরি মাসে সৈন্যদলের মধ্যে গুজব রটিয়া গেল যে, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জাতি নষ্ট করিবার জন্য টোটার মধ্যে শূকর ও গরুর চর্বি মিশ্রিত হইয়াছে। পরবর্তী অনুসন্ধানে দেখা গিয়াছিল যে, ঐ টোটা তৈয়ারি করিতে সত্যই শূকর অথবা গরুর চর্বি ব্যবহৃত হইত।

চর্বিমিশ্রিত টোটার বিবরণ প্রচারিত হওয়ার পরেই প্রথমে বহরমপুরে (মুর্শিদাবাদ) এবং পরে কলিকাতার নিকটবর্তী বারাকপুরের সৈন্যগণ ঐ টোটা ব্যবহার করিতে অস্বীকার করিল। মঙ্গল পাণ্ডে নামক বারাকপুরের একজন সিপাহী প্রকাশ্যে বিদ্রোহী হইল এবং একজন ইংরেজ সৈন্যাধ্যক্ষ বাধা দেওয়ায় তাহাকে আক্রমণ করিয়া আহত করিল (২৯শে মার্চ ১৮৫৭ খ্রী.)। এখানকার বিদ্রোহ শীঘ দমিত হইলেও ইহা চারিদিকে ছড়াইয়া গেল। ১০ই মে মীরাটের কতক সিপাহী টোটা ব্যবহার করিতে অস্বীকার করায় কারারুদ্ধ হইল। ইহাতে অন্য সিপাহীরা একযোগে বিদ্রোহী হইয়া কারারুদ্ধ সহকর্মীদের উদ্ধার করিয়া আনিল। সঙ্গে সঙ্গে বহু ইউরোপীয় কর্মচারীকে হত্যা করিয়া এবং তাহাদের ঘরবাড়ী জ্বালাইয়া দিয়া দিল্লী অভিমুখে রওনা হইয়া গেল। সেখানেও সিপাহীরা ইউরোপীয়গণকে হত্যা করিল, ও তাহাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করিয়া ফেলিল। তাহারা মুঘল সম্রাট-বংশীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলিয়া ঘোষণা করিল।

বিদ্রোহের প্রসার ও দমন

শীঘ্রই অন্যান্য স্থানে সিপাহীরা বিদ্রোহ করিল এবং দিল্লীতে আসিয়া মিলিত হইল। তাহাদের সাফল্যের সংবাদ প্রচারিত হইলে বিদ্রোহ শীঘ্রই উত্তরপ্রদেশ, বুন্দেলখণ্ড ও মধ্য-ভারতের নানা স্থানে বিস্তৃত হইয়া পড়িল। দিল্লী, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, বেরিলী ও ঝান্সী বিদ্রোহের প্রধান প্রধান কেন্দ্রস্থল হইল। আম্বালা হইতে ইংরেজসৈন্য অগ্রসর হইয়া দিল্লীর উত্তরস্থ পাহাড় অধিকার করিল। পঞ্জাব হইতে আরও সৈন্য আসিয়া যোগ দেওয়ায় দিল্লী অধিকার করা সম্ভব হইল। ১৪ই সেপ্টেম্বর তারিখে দিল্লীর কাশ্মীর ফটক বারুদে উড়াইয়া দেওয়া হইল এবং ২০শে সেপ্টেম্বর ইংরেজসৈন্য দিল্লী নগর অধিকার করিল। ইংরেজ সেনানায়ক জন নিকলসন এই যুদ্ধে নিহত হইলেন।

লক্ষ্ণৌর সিপাহীরা ৩০শে মে বিদ্রোহ করিলে চীফ কমিশনার সার হেনরী লরেন্স ঐস্থানের সমস্ত ইউরোপীয় অধিবাসীকে লইয়া ইংরেজ রাজপ্রতিনিধির বাসভবনে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। একদল সিপাহী ইংরেজদের পক্ষে রহিল; কিন্তু বহু সিপাহী বিদ্রোহী হইয়া এই আবাসভবনে ইংরেজদিগকে অবরুদ্ধ করিল। একদিন হঠাৎ গোলার আঘাতে সার হেরীর মৃত্যু হইল, কিন্তু ইংরেজগণ বিশ্বস্ত সিপাহীদের সাহায্যে প্রাণপণে আত্মরক্ষা করিতে লাগিল। ইতিমধ্যে কলিকাতা হইতে একদল সৈন্য পশ্চিমদিকে অগ্রসর হইল এবং এলাহাবাদ অধিকার করিল। এই সৈন্যদলের অধ্যক্ষ নীল সাহেব সারাপথে নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করেন। এই সৈন্যদলের এক অংশ কানপুর ও লক্ষ্ণৌ উদ্ধার করিতে অগ্রসর হয়। হ্যাঁক ও আউটরামের নায়কতায় নূতন সৈন্যদল আসিয়া পৌঁছিলে এই অবরুদ্ধ ইংরেজগণের দুঃখের অবসান হইল (২৫শে সেপ্টেম্বর)। নভেম্বর মাসে সার কলিন্ ক্যাম্বেল আসিয়া অবরুদ্ধ ইংরেজগণকে মুক্ত করিলেন এবং তাহারা লক্ষ্ণৌ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। অবশেষে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে বিদ্রোহীরা সম্পূর্ণ পরাজিত হইলে লক্ষ্ণৌ পুনরধিকৃত হইল।

কানপুরের বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন দ্বিতীয় বাজী রাওর দত্তকপুত্র নানা সাহেব। তিনি কানপুরের নিকট বিঠুরে বাস করিতেন এবং নিজেকে পেশোয়া বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন। কানপুরের প্রায় এক হাজার ইংরেজসৈন্য ও ইংরেজ অধিবাসী একটা কাঁচা দেওয়ালের আড়ালে আশ্রয় লইয়া অতিকষ্টে আত্মরক্ষা করিতেছিল। নানা সাহেব আশ্বাস দিলেন যে, তিনি তাহাদিগকে নিরাপদে এলাহাবাদে যাইতে দিবেন। এই আশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া তাহারা নদীর ধারে যাইবামাত্র নীল সাহেবের অত্যাচারে উত্তেজিত সিপাহীরা গুলিবর্ষণ করিয়া তাহাদের অধিকাংশকেই হত্যা করিল। যাহারা বাঁচিয়া রহিল, তাহারা সকলে বন্দী হইল। বিজয়ী ইংরেজসৈন্য কানপুরের নিকট পৌঁছিলে বিদ্রোহীরা দুইশতেরও অধিক বন্দী রমণী ও শিশুকে হত্যা করিয়া নিকটবর্তী একটি কূপে তাহাদের দেহ নিক্ষেপ করে (১৫ই জুলাই)। ১৭ই জুলাই তারিখে হ্যাভলক কানপুর উদ্ধার করিলেন এবং নানা সাহেব ও তাঁহার দলের সহিত মিলিত বিদ্রোহী সেনাগণের নায়ক মারাঠা ব্রাহ্মণ তাঁতিয়া টোপিয়া সরিয়া গেলেন। পরে কানপুর আর-একবার বিদ্রোহীদের হস্তগত হয়, এবং সার কলি ক্যাম্বেল ৬ই ডিসেম্বর তারিখে ইহা পুনরুদ্ধার করেন। পরাজিত তাঁতিয়া টোপি পলাইয়া গিয়া ঝালীর রাণী লক্ষ্মীবাঈর সঙ্গে যোগ দিলেন।

রোহিলখণ্ডের অন্তর্গত বেরিলীর সিপাহীরা মে মাসে বিদ্রোহী হইয়া হেস্টিংসের আমলে রোহিলাযুদ্ধে হত রোহিলা-নায়ক হাফিজ রহমৎ খাঁর পৌত্রকে নবাব বলিয়া ঘোষণা করিয়া দিল। এক বৎসর পরে সার্ কলিন্ ক্যাম্বেল এই নগর পুনরায় অধিকার করেন (মে, ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ)।

জুন মাসে ঝালী অঞ্চলের সিপাহীগণ বিদ্রোহী হইয়া ইউরোপীয়গণকে হত্যা করিল এবং দিল্লীর দিকে রওনা হইল। লর্ড ডালহৌসী ঝান্সী রাজ্য বৃটিশসাম্রাজ্যভুক্ত করায় ঝান্সীর ত্ৰয়োবিংশতিবর্ষ বয়স্কা বিধবা রাণী লক্ষ্মীবাঈ ইংরেজসরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু তিনি প্রথমে বিদ্রোহে যোগ দেন নাই। তবু ইংরেজসরকার তাঁহাকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া শাস্তিপ্রদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলে রাণী লক্ষ্মীবাঈ বিদ্রোহীদের নেত্রীত্ব গ্রহণ করিলেন। তাঁতিয়া টোপি তাহার সহিত যোগ দিলেন। বিদ্রোহীদের মধ্যে যত নায়ক দাঁড়াইয়াছিলেন, সাহসে ও বীর্যবত্তায় লক্ষ্মীবাঈর সহিত তাঁহাদের একজনেরও তুলনা হইতে পারে না। ইংরেজসৈন্য ঝান্সী আক্রমণ করিলে তিনি বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেন। কিন্তু ঝান্সী ইংরেজের হস্তগত হইল এবং লক্ষ্মীবাঈ পলাইয়া গেলেন। অতঃপর তিনি তাঁতিয়া টোপির সহযোগে গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়াকে বিতাড়িত করেন এবং নানা সাহেব পেশোয়া বলিয়া ঘোষিত হন। কিন্তু অনতিবিলম্বে সার হিউ রোজ গোয়ালিয়র পুনরুদ্ধার করিতে অগ্রসর হন। এইসময় সৈনিক পুরুষের বেশে সজ্জিত হইয়া অশ্বপৃষ্ঠে লক্ষ্মীবাঈ স্বয়ং সৈন্যচালনা করিতে করিতে সমরক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেন (১৭ই জুন, ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ)। তাহার পরই গোয়ালিয়র পুনরায় অধিকৃত হয়।

সিপাহীদের বিদ্রোহের সফলতায় উৎসাহিত হইয়া বর্তমান উত্তর প্রদেশ, বিহার প্রভৃতি কয়েকটি স্থানের সাধারণ জনগণ ও জননায়কেরা, বিশেষত অযোধ্যার তালুকদার ও প্রজারা, বিদ্রোহ করে এবং বহুদিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালায়। ইহাদের কেহ কেহ এই সুযোগে ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধি করে। আবার কেহ কেহ ইংরেজদের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিশোধ লইতে চেষ্টা করে। এই দলের মধ্যে বিহারের আরা জেলার অন্তর্গত জগদীশপুরের তালুকদার কুমার সিংহের (কুয়োয়ার সিং নামেও তিনি পরিচিত) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অসীম সাহসে ও অপূর্ব কৌশলে বহুদিন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে। ঝালীর রাণী ছাড়া বিদ্রোহের কোন যোগ্য নায়ক বা পরিচালক ছিল না। নানাসাহেব কানপুর হইতে নেপালের জঙ্গলে পলাইয়া গেলেন এবং তাঁহার কোন খোঁজই পাওয়া গেল না। তাহার সেনাপতি তাঁতিয়া টোপি ঝালীর রাণীর মৃত্যুর পরেও বহুদিন অপূর্ব বীরত্বসহকারে যুদ্ধ করিলেন। অবশেষে তাঁহারই এক সহচর বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাহাকে ইংরেজের হাতে ধরাইয়া দিলে তাঁহার ফাঁসি হইল। যে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে বিদ্রোহীরা দিল্লীতে সম্রাট বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিল, তিনি জীবনের অবশিষ্ট কাল রেঙ্গুনে নির্বাসিত অবস্থায় কাটাইলেন। তাঁহার দুই পুত্র এবং পৌত্র লেটেনান্ট হড়সন কর্তৃক ধৃত ও নিহত হইলেন।

বিদ্রোহের স্বরূপ

প্রধান প্রধান দেশীয় রাজ্যের রাজগণ কেহই বিদ্রোহে যোগদান করেন নাই। বিদ্রোহ অবসানের পর এজন্য তাঁহারা উপযুক্ত প্রশংসা ও পুরস্কার প্রাপ্ত হইলেন। শিখগণ বিদ্রোহে যোগদান করে নাই। পঞ্জাবের শাসনকর্তা সার জন্য লরেস পঞ্জাব হইতে যে শিখ ও ইংরেজ সৈন্যদল পাঠাইয়াছিলেন, তাহাদের সাহায্যে দিল্লী অধিকৃত হওয়ায় বিদ্রোহের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া যায়। মোটের উপর এই যুদ্ধ প্রধানত সৈন্যগণের বিদ্রোহ। পরে বর্তমান উত্তরপ্রদেশে এবং ইহার সংলগ্ন পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণস্থ কোন কোন অঞ্চলের জনসাধারণও ইহার সঙ্গে যোগান করিয়াছিল। অনেকে মনে করেন ইহা ভারতের প্রথম জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম; কিন্তু ভারতের এক অংশে সীমাবদ্ধ এই সমুদয় খণ্ড খণ্ড বিপ্লবকে ইংরেজশাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতের জাতীয় সংগ্রাম বলিয়া গণ্য করা অনেকে সঙ্গত মনে করেন না। কারণ ভারতীয় জনসাধারণের অধিকাংশ, বিশেষত শিক্ষিত সম্প্রদায় এই বিদ্রোহের প্রতি বিশেষ কোন সহানুভূতি দেখায় নাই। বিভিন্ন বিদ্রোহী নায়ক ও সৈন্যদলের মধ্যে একযোগে কার্য করার কোন ব্যবস্থা ছিল না এবং জাতীয়তা-ভাবে প্রণোদিত হইয়া দেশের স্বাধীনতা লাভ করাই যে তাহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, এরূপ মনে করিবার কোন কারণ নাই। কিন্তু তথাপি ১৮৫৭-৫৮ খ্রীষ্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। কারণ ইহার স্মৃতি পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যথেষ্ট প্রেরণা যোগাইয়াছিল।

এই বিদ্রোহে সিপাহীরা ও নানাসাহেবের মতো এদেশীয় নায়কগণ যেমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড করিয়াছিলেন, বিদ্রোহ দমন করিবার জন্য ইংরেজসৈন্য এবং সেনানায়করাও সেইরূপ পৈশাচিক নৃশংসতার পরিচয় দিয়াছেন। কিন্তু বিদ্রোহ সংক্রান্ত সকল বিষয়ের ব্যবস্থায়ই লর্ড ক্যানিং অসাধারণ ধৈর্য ও বুদ্ধি-কৌশলের পরিচয় দিয়াছেন। হীন প্রতিহিংসার বশবর্তী হইয়া বিদ্রোহিগণের প্রতি তিনি কঠোর শাস্তিবিধান করেন নাই। কিন্তু ঐ যুগের অদূরদর্শী ইংরেজরা রক্তপাতের বিনিময়ে রক্তপাতের জন্য চীৎকার জুড়িয়া দিয়াছিল, এবং তাহারা ক্যানিংকে উপহাস করিয়া ‘দয়ার অবতার ক্যানিং’ (Clemency Canning) এই আখ্যা দিয়াছিল।

বিদ্রোহের ফলাফল

এই বিদ্রোহের ফলে ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ভারতশাসন-পরিচালনার ক্ষমতা চিরদিনের মত লোপ পাইল। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে ২রা আগস্ট তারিখে বৃটিশ পালামেন্টের নূতন এক আইন অনুসারে বৃটিশরাজের হস্তে ভারতশাসনের সম্পূর্ণ ভার অর্পিত হইল। বোর্ড অব কনট্রোলের প্রেসিডেন্টের স্থানে ভারতবর্ষের জন্য সেক্রেটারী অব স্টেট নামে একজন মন্ত্রী নিযুক্ত হইলেন এবং কোর্ট অব ডিরেক্টার্সের স্থান কাউন্সিল অব ইণ্ডিয়া বা ভারত-পরিষদ্ গ্রহণ করিল। এখন হইতে ভারতের বড়লাটের আখ্যা হইল ভাইসরয় (Viceroy) বা রাজপ্রতিনিধি।

১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর তারিখে ভারতশাসন-বিধানের এই সকল গুরুতর পরিবর্তন মহারাণী ভিক্টোরিয়ার এক ঘোষণাপত্র ভারতীয় জনসাধারণ ও দেশীয় রাজন্যবর্গের নিকট বিজ্ঞাপিত করে। ইহাতে বলা হয়-বড়লাট লর্ড ক্যানিং প্রথম ভাইসরয় নিযুক্ত হইলেন। কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীদিগকে নিজ নিজ পদে বহাল রাখা হইল। বিভিন্ন রাজ্যের সহিত প্রচলিত সমস্ত সন্ধি বলবৎ রহিল। ইংরেজরাজের যে আর রাজ্যবিস্তৃতির আকাক্ষা নাই, তাহাও বিশেষভাবে বলা হইল। ভারতীয় প্রজাগণের ধর্মে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা হইবে না। ভারতের প্রাচীন আচার-ব্যবহার, সামাজিক নিয়ম এবং দেশ-প্রচলিত প্রথাসমূহের প্রতি সমুচিত সম্মান প্রদর্শিত হইবে, এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে অপক্ষপাতে উপযুক্ত ভারতীয়গণকে সরকারী কর্মে নিযুক্ত করা হইবে। বিদ্রোহীরা অস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নিজ নিজ কর্মে পুনরায় রত হইলে তিনি তাহাদিগকে ক্ষমা করিবেন। কেবল যাহারা ইংরেজ নরনারীর হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত ছিল এবং বিদ্রোহের নায়কতা করিয়াছিল, তাহাদিগকে যথাযোগ্য শাস্তি দিবার ব্যবস্থা হইবে।

সিপাহী বিদ্রোহ ও শিক্ষিত বাঙ্গালী

সিপাহী বিদ্রোহ বাংলা দেশে আরম্ভ হইলেও এখানে খুব বিস্তৃতি লাভ করে নাই। ১৮ই নভেম্বর চট্টগ্রামের একদল সিপাহী বিদ্রোহ করে, কিন্তু অন্য একদল সিপাহী কর্তৃক পরাজিত হইয়া তাহারা শ্রীহট্ট ও কাছাড়ে যায়। সেখানে পুনরায় পরাজিত হইয়া তাহারা পূর্বদিকে অগ্রসর হয় এবং কাছাড়বাসী মণিপুরের কয়েকজন বিদ্রোহী নায়ক তাহাদের সঙ্গে যোগ দেয়। বৃটিশের অনুরোধে মণিপুরের রাজা। তাহাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। একদল বিদ্রোহী সৈন্য বন্দী হয় এবং অবশিষ্ট সিপাহীরা পর্বতে ও জঙ্গলে পলাইয়া যায়। ২২শে নভেম্বর ঢাকার একদল সিপাহী বিদ্রোহ করে, কিন্তু পরাজিত হইয়া জলপাইগুড়ি প্রস্থান করেন। সেখানে ও মাদারিগঞ্জে দুইদল অশ্বারোহী সিপাহী সৈন্য বিদ্রোহ করে। অবশেষে এই সকল দলই পরাজিত হইয়া নেপালে আশ্রয় গ্রহণ করে। বর্ধমান বিভাগে ছোটনাগপুরের সীমান্তে প্যাঁচেতের জমিদার বিদ্রোহী মনোভাবের পরিচয় দেয়। ইহা ভিন্ন বাংলা দেশে আর কোন উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ ঘটে নাই।

বাংলা দেশের জনসাধারণ বিদ্রোহী সিপাহীদের প্রতি কোন সহানুভূতি দেখায় নাই। তকালীন শিক্ষিত বাঙ্গালী সমাজও এই বিপ্লব কেবলমাত্র সিপাহীদের বিদ্রোহ বলিয়াই গণ্য করিয়াছে–ইহাকে কোন জাতীয় অভ্যুত্থান বা ইংরেজের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রাম বলিয়া মনে করে নাই। সে-যুগের একজন প্রসিদ্ধ বাঙ্গালী নায়ক কিশোরীচাঁদ মিত্র, ১৮৫৮ সনে অর্থাৎ সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরেই লিখিয়াছেন : “এই বিপ্লব মূলতঃ সৈনিকদের বিপ্লব-এক লক্ষ সৈন্যের বিদ্রোহ ইহার সহিত জনসাধারণের কোন সংস্রব নাই। যাহারা এই বিদ্রোহীদলে যোগ দিয়াছে তাহাদের সংখ্যা গভর্নমেন্টের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন লোকের সংখ্যার অনুপাতে অতিশয় নগণ্য। প্রথম দলের সংখ্যা কয়েক সহস্র-দ্বিতীয় দলের সংখ্যা কয়েক কোটি।” বাংলার আর দুইজন মনীষী-শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হরিশচন্দ্র মুখার্জীও অনুরূপ মন্তব্য করিয়াছেন। এ সম্বন্ধে দুইজন প্রত্যক্ষদর্শী বাঙ্গালীর বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। যাহারা সিপাহী বিদ্রোহকে স্বাধীনতার সমর বলিয়া গৌরববোধ করেন তাঁহাদের অবগতির জন্য ইহার কিঞ্চিৎ উল্লেখ আবশ্যক। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজন সৈনিক বিভাগের কর্মচারী বেরিলীতে বিদ্রোহের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং সৈন্যবিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় তাঁহার পক্ষে প্রকৃত তথ্য জানিবার অনেক সুবিধা ছিল। তিনি বলেন যে, বিদ্রোহী সিপাহীদের মধ্যে কোনপ্রকার নিয়ম বা শৃঙ্খলা ছিল না। তাহারা দোকানপাট এবং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের ধনসম্পত্তি লুট করিত। অনেক সিপাহী এই উপায়ে প্রভূত ধন উপার্জন করিয়া স্বীয় গৃহে ফিরিয়া গিয়াছে। লোকের উপর অকথ্য অত্যাচার ও শারীরিক উৎপীড়ন করিয়া তাহারা টাকা আদায় করিয়াছে। হিন্দুদিগকে গোমাংস এবং মুসলমানদিগকে শূকরের মাংস বলপূর্বক খাওয়াইবার ভয় দেখাইয়া গুপ্তধনের সন্ধান বলিয়া দিতে বাধ্য করিয়াছে। কখনও কখনও ইহার জন্য গৃহস্থকে জ্বলন্ত তৈলপূর্ণ কটাহের উপর বসাইয়াছে। চুরি, ডাকাতি, লুট এবং নারীধর্ষণ নিত্যকার্য হইয়া উঠিয়াছিল। বেরিলী শহরে একজন ধনী নর্তকী পান্না সিপাহীদের হস্তে কিরূপ নিগ্রহ ও যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল তাহা পাঠ করিলেও নিদারুণ মনোকষ্ট হয়। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধও তীব্র আকার ধারণ করিয়াছিল। মুসলমানেরা হিন্দুদের গায়ে থুথু দিত এবং প্রকাশ্য দিবালোক হিন্দুদের গৃহপ্রাঙ্গণে গরুর হাড় ফেলিত এবং গৃহের প্রাচীরে গো-রক্ত ছড়াইত। ইহার ফলে হিন্দু সিপাহীদের সঙ্গে মুসলমান গুণ্ডাদের সংঘর্ষের কয়েকটি ঘটনা বিবৃত হইয়াছে। মুসলমান কর্তৃক উৎপীড়িত হিন্দুগণ বিদ্রোহের সাফল্যের সম্ভাবনায় ভীত হইয়া প্রতিদিন ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিত, ইংরেজ যেন জয়ী হইয়া আবার ফিরিয়া আসে। অনেক মুসলমানও অনুরূপ প্রার্থনা করিত। বহুসংখ্যক লোক মাসিক পাঁচ, ছয় কি সাত টাকা বেতনের লোভে বিদ্রোহী সিপাহীদের সঙ্গে যোগ দিত। বিদ্রোহীরা বেরিলীর বাঙ্গালী অধিবাসীদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করিয়াছিল। বিদ্রোহী সিপাহীরা বহু বাঙ্গালীকে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করিত এবং কেবলমাত্র সন্দেহের বশে, কোনরূপ বিচারের ভান না করিয়া সাতজন বাঙ্গালীকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করিয়াছিল।

যদুনাথ সর্বাধিকারী নামে একজন সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালী, সিপাহী বিদ্রোহের সময় কাশীতে ছিলেন। তিনি তাঁহার ‘তীর্থভ্রমণ’ নামক গ্রন্থে কাশীধামে ও অন্যত্র বাঙ্গালী ও অন্যান্য লোকের উপর বিদ্রোহী সিপাহীদের অত্যাচারের অনেক বিবরণ দিয়াছেন।

ঋষি অরবিন্দের মাতামহ রাজনারায়ণ বসু সে-যুগের একজন প্রসিদ্ধ লোক। বাঙ্গালীর জাতীয় জাগরণে তাঁহার অসামান্য অবদান পরে উল্লিখিত হইবে। তিনি বিদ্রোহের সময় মেদিনীপুরের উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁহার আত্মজীবন-চরিতে তিনি লিখিয়াছেন যে, স্থানীয় সিপাহীদের বিদ্রোহের সম্ভাবনা সমুদয় শহরবাসীর মনে বিষম আতঙ্কের সৃষ্টি করিয়াছিল। তিনি নিরাপত্তার জন্য নিজের পরিবারবর্গ কলিকাতায় পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। মেদিনীপুরের অনেক ভদ্রলোক সদাসর্বদাই নৌকা প্রস্তুত রাখিতেন, যাহাতে বিদ্রোহের সূচনা দেখিলেই কলিকাতা পলায়ন করিতে পারেন। একদিন স্কুলের সময় সংবাদ আসিল যে সিপাহীরা দলবদ্ধ হইয়া রাস্তায় বাহির হইয়াছে। অমনি ছাত্রেরা আত্মরক্ষার জন্য টেবিল ও বেঞ্চের তলে লুকাইল। পরে শোনা গেল যে ইহা কোন ধর্মানুষ্ঠান উপলক্ষে শোভাযাত্রা মাত্র। সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল।

তখন কলিকাতায় বৃটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (British Indian Association) ও মহমেড্যান অ্যাসোসিয়েশন (Mahammadan Association) এ দুইটিই ছিল হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান। সিপাহী বিদ্রোহের প্রারম্ভে এই উভয় প্রতিষ্ঠানই সিপাহী বিদ্রোহের তীব্র নিন্দা করিয়া এই মর্মে মন্তব্য পাশ করিল যে, তাহারা আশা করে যে–বিদ্রোহীরা জনসাধারণের কোনপ্রকার সাহায্য বা সহানুভূতি পাইবে না। সে-যুগের প্রসিদ্ধ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ এবং পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘সম্বাদ ভাস্কর’ বাংলার সমসাময়িক পত্রিকার মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছিল। এই দুইখানি পত্রিকায় সিপাহী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে যে সমুদয় মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহাতে শিক্ষিত বাঙ্গালী জনসাধারণের মনোভাবই প্রকট হইয়াছিল এরূপ মনে করা অসঙ্গত হইবে না। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁহার কবিতায়ও সিপাহী বিদ্রোহের যথেষ্ট নিন্দা করিয়াছেন।

১৮৫৭ সনের ২০শে জুন সংবাদ প্রভাকরের সুদীর্ঘ সম্পাদকীয় মন্তব্য হইতে কিয়ংদশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“কয়েকদল অধাৰ্মিক–অবাধ্য-অকৃতজ্ঞ হিতাহিত-বিবেচনা-বিহীন এতদ্দেশীয় সেনা অধার্মিকতা প্রকাশ পূৰ্ব্বক রাজবিদ্রোহী হওয়াতে রাজ্যবাসি শান্তস্বভাব অধন সধন প্রজামাত্রেই দিবারাত্র জগদীশ্বরের নিকট এই প্রার্থনা করিতেছে, “এই দণ্ডেই হিন্দুস্তানে পূৰ্ব্ববৎ শান্তি সংস্থাপিত হউক, রাজ্যের সমুদয় বিঘ্ন বিনাশ হউক। হে বিঘ্নহর! তুমি সমুদয় বিঘ্ন হর,-সকল উপদ্রব নিবারণ কর…যাহারা গোপনে গোপনে অথবা প্রকাশ্যরূপে এই বিষমতর অনিষ্ট ঘটনার ঘটক হইয়া উল্লেখিত জ্ঞানান্ধ সেনাগণকে কুচক্রের দ্বারা কুপরামর্শ প্রদান করিয়াছে ও করিতেছেন তাহার দিগ্যে দণ্ড দান কর। তাহারা অবিলম্বেই আপনাপন অপরাধবৃক্ষের ফলভোগ করুক।”–ইহার কারণ কী তাহারও ব্যক্ত করিয়াছেন- “এই রাজ্যই তো রাম রাজ্যের ন্যায় সুখের রাজ্য হইয়াছে, আমরা যথার্থরূপ স্বাধীনতা, পদ, মান, বিদ্যা এবং ধৰ্ম্ম, কর্মাদি সকল প্রকার সাংসারিক সুখে সুখি হইয়াছি; কোন বিষয়েই ক্লেশের লেশমাত্র জানিতে পারি না, জননীর নিকট পুত্রেরা লালিত ও পালিত হইয়া যদ্রপ উৎসাহে ও সাহসে অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া অন্তঃকরণকে কৃতার্থ করেন, আমরাও অবিকল সেইরূপে পৃথিবীশ্বরী ইংলণ্ডেশ্বরী জননীর নিকটে পুত্রের ন্যায় প্রতিপালিত হইয়া সৰ্ব্বমতে চরিতার্থ হইতেছি।…যবনাধিকারে আমরা ধৰ্ম্মবিষয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্ত হই নাই, সৰ্ব্বদাই অত্যাচার ঘটনা হইত। মহরমের সময়ে সকল হিন্দুকে গলায় “বদি” অর্থাৎ যাবনিক ধৰ্ম্মসূচক একটা সূত্র বান্ধিয়া দর্গায় যাইতে হইত, গমি অর্থাৎ নীরব থাকিয়া “হাঁসন” “হোঁসেনের” মৃত্যু জন্য শোকচিহ্ন প্রকাশ করিতে হইত। কাছা খুলিয়া কুর্নিস করিয়া “মোর্চ্চে” নামক গান করিতে হইত। তাহা না করিলে শোণিতের সমুদ্র প্রবাহিত হইত। এইক্ষণে ইংরাজাধিকারে সেই মনস্তাপ একেকালেই নিবারিত হইয়াছে, আমরা অনায়াসেই “চর্চ্চ” নামক খ্রীষ্টিয় ভজনামন্দিরের সম্মুখেই গভীরম্বরে ঢাক, ঢোল, কাড়া, তাসা, নহবৎ, সানাই, তুরী, ভেরী, বাদ্য করিতেছি; “ছ্যাড়্যাং” শব্দে বলিদান করিতেছি, নৃত্য করিতেছি, গান করিতেছি, প্রজাপালক রাজা তাহাতে বিরক্ত মাত্র না হইয়া উৎসাহ প্রদান করিতেছেন। এই কল্পে ছোটবড় সকলকে সমভাবে স্বাধীনতা প্রদান করিতেছেন।” এই সঙ্গে সম্পাদকীয় স্তম্ভে একটি সুদীর্ঘ কবিতা প্রকাশিত হয়। ইহার কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করিতেছি।

জয় জয় জগদীশ, জগতের সার।
লই লহ লহ নাথ, প্রণাম আমার ॥
করি এই নিবেদন, দীন দয়াময়।
বাঞ্ছাফল পূর্ণ কর, হয়ে বাঞ্ছাময় ॥
চিরকাল হয় যেন, ব্রিটিশের জয়।
ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী, স্থির যেন রয় ॥
••• ••• ••• •••
বিদ্রোহি সেফাইগণ, করি নিবেদন।
ছাড় দ্বেষ রণবেশ কর সম্বরণ ॥
••• ••• ••• •••
কার কথা শুনে সবে, সেজেছ সময়ে?
পিপীড়ার পাখা উঠে, মরিবার তরে ॥
এখনই ছেড়ে দেও, মিছে ছেলেখেলা।
আকাশের উপরেতে, কেন মারো ঢেলা॥

সম্বাদ ভাস্কর ঠিক ঐ তারিখেই লিখিয়াছে : “হে পাঠক সকল, ঊৰ্দ্ধবাহু হইয়া পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া জয়ধ্বনি করিতে করিতে নৃত্য কর…আমারদিগের প্রধান সেনাপতি মহাশয় সসজ্জ হইয়া দিল্লী প্রদেশে প্রবেশ করিয়াছেন, শত্ৰুদিগের মোর্চা সিবিরাদি ছিন্নভিন্ন করিয়া দিয়াছেন, তাহারা বাহিরে যুদ্ধে আসিয়াছিল আমার দিগের তোপমুখে অসংখ্য লোক নিহত হইয়াছে, রাজসৈন্যেরা ন্যূনাধিক ৪০ তোপ এবং সিবিরাদি কাড়িয়া লইয়াছেন, হতাবশিষ্ট পাপিষ্ঠেরা দুর্গ প্রবিষ্ট হইয়া কপাট রুদ্ধ করিয়াছে, আমারদিগের সৈন্যেরা দিল্লীর প্রাচীরে উঠিয়া নৃত্য করিতেছে…বৃটিসাধিকৃত ভারতবর্ষবাসি প্রজাসকল নির্ভর হও ‘ছেল্যেধরা’ একটা কথামাত্র শুনিয়াছিলেন, সিপাহি ধরা প্রত্যক্ষ কর, গত বুধবারে গঙ্গাতীরে বহুলোক দণ্ডায়মান ছিলেন, তাঁহারা দেখিয়াছেন হাতে হাতকড়ী, পায়ে বেড়ী, পাঁচশত সিপাহী ধৃত হইয়া আসিয়াছে, কলিকাতাবাসিদিগের আর ভয় নাই…যে সকল বিদ্রোহিরা দিল্লী প্রদেশে সিবির স্থাপন করিয়াছিল তাহারা দুইবার বাহির হইয়া গাজীউদ্দীন স্থানে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিল, রাজসৈন্যেরা তাহারদিগকে কচুকাটা করিয়াছে, অবশিষ্টেরা রণে হারিয়া পলায়ন-পর হইয়াছে।”

কলিকাতার “সম্ভ্রান্ত মহাশয়েরা” ২৬শে মে হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজে এক প্রকাশ্যসভা করেন। রাজা রাধাকান্ত দেব সভাপতি ছিলেন এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ, হরেন্দ্র ঘোষ প্রভৃতি সভায় উপস্থিত ছিলেন। সিপাহীদিগের নিন্দা ও গভর্নমেন্টকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিসূচক কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সংবাদ প্রভাকরে এই সভার বিবরণ ও প্রস্তাবগুলি প্রকাশিত হয়।

বিদ্রোহী সিপাহীদের বিরুদ্ধে এইপ্রকার মনোভাব কেবল বাঙ্গালীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সিপাহী বিদ্রোহের প্রধান নায়ক বলিয়া যাঁহারা বর্তমান যুগে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন সেই বাহাদুর শাহ, নানা সাহেব, এবং ঝালীর রাণী প্রভৃতি বিদ্রোহী সিপাহীদের তীব্র নিন্দা করিয়াছেন।

বিংশ শতাব্দীতে রাজনীতিক আন্দোলনের ফলে সিপাহী বিদ্রোহ সর্বপ্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছে। কিন্তু সমসাময়িক বাঙ্গালীরা ইহাকে কী চোখে দেখিত এবং ইহার তথাকথিত অন্যদেশীয় অনেক নায়কেরাও যে এই বিদ্রোহকে ঐরূপ কোন সম্মান দেন নাই, পূর্বোল্লিখিত বিবরণ হইতে তাহা

স্পষ্টই বোঝা যাইবে। সুতরাং অন্ততঃ বাংলা দেশের ইতিহাসে সিপাহী বিদ্রোহের বিস্তৃত বর্ণনা অনাবশ্যক। অতএব খুব সংক্ষেপে দিল্লী, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, বেরিলী, ঝালী প্রভৃতি কয়েকটি প্রধান কেন্দ্রের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হইল।

(গ) নীলচাষীর বিদ্রোহ

সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরেই বাংলা দেশের নীলচাষীরা এক অভূতপূর্ব উপায়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও বিপ্লব ঘটায়। ইহার বিস্তার সীমাবদ্ধ এবং ইহা স্বল্পকাল স্থায়ী হইলেও নানা কারণে ইহা বাংলার তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। অর্ধশতাব্দী পরে মহাত্মা গান্ধী রাজনীতির ক্ষেত্রে যে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করেন, নীলচাষীদের বিদ্রোহে তাহার পূর্বাভাস পাওয়া যায়।

ইংরেজেরা জাত-ব্যবসায়ী। বাংলায় রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়া কিরূপে তাহার সাহায্যে বাংলার শ্রমশিল্পের ও বাণিজ্যের ধ্বংস সাধন করিয়াছিল তাহা অষ্টম অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু এই বণিক-বুদ্ধি কৃষির ক্ষেত্রেও মহা-অনর্থের সৃষ্টি করিয়াছিল। বাংলার উর্বর ভূমিতে সুলভ চাষী ও মজুরীর সাহায্যে খাদ্য-ফসলের পরিবর্তে বাণিজ্য-ফসল উৎপাদন করিলে বিপুল লাভের সম্ভাবনা তাহাদিগকে এ বিষয়ে আকৃষ্ট করে এবং ইহা হইতেই নীলচাষের সূত্রপাত হয়।

যতদূর জানা যায়, ১৭৭২ সনে প্রথমে চন্দননগরের কাছে গোদলপাড়া গ্রামে একজন ফরাসী প্রথমে নীলচাষ আরম্ভ করেন। ক্রমে ইংরেজ কোম্পানি ও ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা নানা স্থানে নীলকুঠি স্থাপন করেন এবং বাংলা দেশে নীলের চাষ খুব বাড়িতে থাকে। কারণ, যে দামে এই ব্যবসায়ীরা এদেশে নীল উৎপন্ন করাইতেন বা ক্রয় করিতেন, লণ্ডনের বাজারে তাহার তিন-চারিগুণ মূল্যে ইহা বিক্রয় হইত। ১৮১৯-২০ হইতে ১৮২৬-২৭ সনের মধ্যে প্রতি বৎসরে কোম্পানি প্রায় ১০। ১২ লক্ষ টাকা লাভ করিতেন। সুতরাং বাংলার বহু স্থানে বিশেষতঃ নদীয়া, যশোহর, বর্ধমান, মেদিনীপুর, বীরভূম, হাওড়া ও হুগলী জিলায় নীলচাষ আরম্ভ হয়।

কিন্তু এই নীলচাষ উপলক্ষে নীলকর সাহেবেরা বাংলার কৃষকদের উপর যে অত্যাচার করেন, জমিদার, পত্তনীদার এবং ইজারাদার প্রভৃতির অত্যাচারও তাহার তুলনায় অনেক কম। এই অত্যাচারের যে সমুদয় কাহিনী সমসাময়িক পত্রিকা ও বিশ্বাসযোগ্য সরকারী তদন্তের রিপোর্ট হইতে জানা যায় তাহা একমাত্র নিগ্রোদাসদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের সঙ্গে তুলনীয়। শ্রীযুক্ত বিনয় ঘোষ ইহা হইতে কিছু কিছু উদ্ধৃত করিয়াছেন এবং মন্তব্য করিয়াছেন: “উনিশ শতকের বাংলা ও ইংরেজী সাময়িকপত্রে নীলকরদের দৌরাত্ম্য ও দুর্বিনীত আচরণের কাহিনী এত প্রকাশিত হয়েছে যে শুধু বাংলা পত্রিকার রচনাগুলি সংকলন করলে একটি হাজার পৃষ্ঠার বড় বই হতে পারে।” প্রধানতঃ বিশ্বস্ত প্রমাণ ও সরকারী রিপোর্টের উপর নির্ভর করিয়াই আমরা ইহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।

দুইটি প্রণালীতে এই নীলচাষের কার্য চলে। নিজ-আবাদী প্রথায় নীলকর সাহেবেরা নিজেদের জমিতে নিজেদের খরচায় ও নিজেদের তত্ত্বাবধানে নীল চাষ করাইতেন। রায়তী-প্রথায় নীলকরের চাষীদের চুক্তিতে আবদ্ধ করিয়া তাহাদের জমিতে নীল চাষ করাইতেন। চুক্তি অনুসারে চাষীকে দাদন অর্থাৎ অগ্রিম কিছু টাকা দেওয়া হইত এবং উৎপন্ন নীলের দাম চাষী কী হারে পাইবে তাহারও উল্লেখ থাকিত। এই চুক্তির শর্তগুলি প্রজাদের বিশেষ অনিষ্টকর হইলেও নীলকর সাহেবেরা পাইক-বরকন্দাজের সহায়তায় চাষীদিগকে জোর করিয়া এই শর্ত অনুসারে নীল চাষ করিতে বাধ্য করিতেন। এই চুক্তি দ্বারা চাষী কিরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হইত, সরকারী নথিপত্র ও অন্যান্য বিশ্বস্ত প্রমাণ হইতে তাহার স্পষ্ট ধারণা করা যায়।

চাষীদিগকে যে হারে নীলের মূল্য দেওয়া হইত তাহা বাজারদর অপেক্ষা অনেক কম। সরকারী তদন্ত রিপোর্ট হইতে জানা যায় যে যখন বাজারে নীলের দাম প্রতিমণ দশ হইতে ত্রিশ টাকা তখন চুক্তি অনুসারে চাষী পাইত মাত্র চারি টাকা। ইহা হইতে আবার বীজের দাম, চুক্তিপত্রের ষ্ট্যাম্পের মূল্য এবং নীল আনিবার গাড়ীভাড়া বাবদ অনেক টাকা কাটিয়া রাখা হইত এবং নীলকুঠির নায়েব গোমস্তা পাইক প্রভৃতি চাষীদের নিকট হইতে তহুরী অর্থাৎ বসিস আদায় করিত; চাষীদের নীল ওজন করার সময় মাপের গোলমাল করিয়া তাহাদের ঠকান হইত আর চুক্তিতে যে-পরিমাণ জমিতে নীল চাষ করিবার কথা, অন্যায়রকমে মাপ করিয়া তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী জমিতে নীল চাষ করিতে হইত। চাষীদের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট জমিতে নীল চাষ করিতে হইত। যে-সকল ফসলে বেশী লাভ, জমিতে সেইসব ফসলের চাষ করিলে তাহা লাঙ্গল চষিয়া নষ্ট করিয়া পুনরায় নীল চাষ করিতে হইত। ফলে দাদনের সামান্য টাকা ছাড়া নীলচাষীরা আর কিছুই পাইত না–অনেক সময় ঘরের কড়ি দিয়া গোমস্তা পাইকের ঘুষ জোগাইতে হইত, নচেৎ তাহাদের হাতে বহু লাঞ্ছনা ও অত্যাচার সহ্য করিতে হইত। একজন সাহেবের রিপোর্ট হইতে জানা যায় যে, ১৮৫৮-৫৯ সনে বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানির ৩৩,২০০ চাষীর মধ্যে মাত্র ২,৪৪৮ জন উৎপন্ন নীলের বাবদ দাদন ছাড়া সামান্য কিছু নগদ টাকা পাইয়াছিল।

চুক্তির শর্ত ছিল উৎপন্ন নীলের মূল্য হইতে দাদনের টাকা কাটিয়া রাখা হইবে। উৎপন্ন নীলের মূল্য হইতে যে-সকল চাষীর দাদনের টাকা শোধ হইবে না–চুক্তির শর্ত অনুসারে ভবিষ্যতে অর্থাৎ আগামী প্রতি বৎসর নীল চাষ করিয়া সেই বকেয়া টাকা শোধ দিতে হইবে। ইহার ফলে একবার যে চাষী নীলের বাবদ দাদন লইয়াছে, পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে তাহাকে তাহার সর্বোৎকৃষ্ট জমিতে নীলচাষ করিতে হইত এবং বাজার দরের অর্ধেক বা তিন ভাগেরও কম মূল্যে তাহা নীলকরের নিকট বিক্রয় করিতে হইত।

এইসব সত্ত্বেও চাষীদের নীল চাষ করিতে হইত। কারণ তাহা না করিলে নীলকর সাহেবেরা তাহাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করিত। একদল লাঠিয়াল ও নিজেদের পাইক-বরকন্দাজসহ গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া নীলচাষে অনিচ্ছুক চাষীদের ঘরবাড়ী জ্বালাইয়া দিত, গরু-বাছুর কাড়িয়া নিত, জোয়ান পুরুষদের ধরিয়া নিয়া নীলকুঠিতে অন্ধকারকক্ষে মাসের-পর-মাস আটক করিয়া রাখিত ও বেত্রাঘাতে জর্জরিত কারত এবং আরও নানাপ্রকার শারীরিক দণ্ড দিত; চাষী মেয়েদের উপরও অত্যাচার করিত। আমেরিকার নিগ্রো দাসদের যে লাঞ্ছনা ও উৎপীড়ন সর্বজনবিদিত, বাংলার নীলচাষীদের অদৃষ্টেও তাহাই ঘটিত। মফঃস্বলেশহর, কাছারী, থানা হইতে বহুদূরে-সাহেবদের এই অত্যাচারে বাধা দিবার বা কোনপ্রকার প্রতিকার লাভ করিবার উপায় চাষীদের হাতে ছিল না। অবশ্য কয়েকজন বাঙ্গালী নীলচাষীদের উপর এই অমানুষিক অত্যাচারের কথা সর্বসাধারণের ও গভর্নমেন্টের কর্ণগোচর করিয়াছেন। ইহাদের মধ্যে হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ ও অমৃতবাজার পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ইহাতে কোন ফল হইত না। যেসব ইংরেজ কর্মচারী ঘটনাস্থলে তদন্তে যাইতেন তাঁহারা ‘জাতভাই’ নীলকরদের আতিথ্য গ্রহণ করিতেন এবং তাঁহাদের কথা বিশ্বাস করিয়াই তদনুযায়ী রিপোর্ট দিতেন। অবশ্য কৃচিৎ কদাচিৎ দুই-একজন নিরপেক্ষ কর্মচারীও তদন্ত করিতেন এবং প্রধানতঃ তাহাদের রিপোর্ট হইতেই আমরা এই অত্যাচারের বিবরণ জানিতে পারি।

দুইটি কারণে এই অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়া যায় ও বিনাবাধায় চলিতে থাকে। প্রথমতঃ, অনেকস্থলে জমিদার তাঁহার রায়ত নীলচাষীদের পক্ষ অবলম্বন করিয়া তাহাদিগকে রক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেন। এইজন্য নীলকরেরা নানা উপায়ে ঐ সকল জমির জমিদারিস্বত্ব ক্রয় করিত। দ্বিতীয়তঃ, গভর্নমেন্ট অনেক সময় এই সমুদয় নীলকর সাহেবদিগকেই অনারারি ম্যাজিষ্ট্রেট করিতেন, সুতরাং নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ হইলে অপর এক অত্যাচার নীলকরই তাহার বিচার করিতেন।

নীলকরদের নিষ্ঠুর অত্যাচার কিরূপ ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়াছিল তাহার বহু সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। মিষ্টার টাওয়ার (E.w. L. Tower) নামক একজন ম্যাজিষ্ট্রেট সরকারী নীল-তদন্ত কমিশনে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বলিয়াছিলেন : “আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি কয়েকজন রায়কে বর্শা দ্বারা বিদ্ধ করা হইয়াছে। অন্য কয়েকজনকে গুলি করিয়া মারা হইয়াছে। আর কয়েকজনকে প্রথমে বর্শায় বিদ্ধ করিয়া পরে গুম করা হইয়াছে।”

হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় নীলকরদের অনেক অত্যাচারের বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সিরাজগঞ্জ মহকুমার এক নীলকর একশত লাঠিয়াল লইয়া গাবগাছি গ্রামে যান। সেখানকার লোকেরা নীলচাষ করিতে অস্বীকৃত হওয়ায় তাহাদের শায়েস্তা করিবার আদেশ দিয়া সাহেব চলিয়া আসেন। লাঠিয়ালেরা বাড়ীঘর পোড়ায়, ১০০ গরু-বাছুর নিয়া যায় এবং গ্রামবাসীদিগকে নির্দয়ভাবে প্রহার করে-ফলে একজন নিহত হয় ও দুইজন গুরুতর আঘাত পায়। ইহার বিরুদ্ধে অভিযোগ হইল কিন্তু সাহেবের কিছুই হইল না, কেবল তিনজন লাঠিয়ালের সামান্য দণ্ড হইল। কৃষ্ণনগর হইতে ছয় মাইল দূরে এক নীলকুঠিতে রায়তদিগকে আটক করিয়া বেত্রাঘাত করা হইত, তাহার বিবরণও হিন্দু পেট্রিয়টে আছে। এইরূপ ছয়জন কয়েদীর মধ্যে পাঁচজনকে ত্রিশ করিয়া ও একজনকে ষাট বেত্রাঘাত করা হইয়াছিল।

প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক দীনবন্ধু মিত্র ‘নীল দর্পণ’ নামক নাটকে নীলকরদের অত্যাচারের যে-চিত্র আঁকিয়াছেন, রঙ্গমঞ্চে তাহা দেখিয়া লোকে এত উত্তেজিত হইত যে, স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নীলকরের ভূমিকায় যে অভিনয় করিতেছিল তাহাকে উদ্দেশ করিয়া পায়ের চটি জুতা ছুঁড়িয়া মারিয়াছিলেন। এই গ্রন্থের একখানি ইংরেজি অনুবাদ মিশনারি লং সাহেবের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হওয়ায় নীলকর সাহেবেরা ও অন্যান্য ইংরেজরা বিষম ক্রুদ্ধ হন এবং আদালতে মোকদ্দমা করেন। ইহাতে লং সাহেবের একহাজার টাকা জরিমানা ও একমাস কারাদণ্ড হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ এই জরিমানার টাকা আদালতে দাখিল করেন।

বাংলার নীলচাষীগণ অর্ধশতাব্দীকাল নীলকরদের অত্যাচার সহ্য করিয়াছিল। কিন্তু অবশেষে ১৮৫৯-৬০ সনে তাহারা বিদ্রোহ করিল। পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধী যেরূপ অসহযোগ আন্দোলন করেন, বাংলার নীলচাষীদের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ (Passive Resistance) তাহার পূর্বাভাস বলা যাইতে পারে। যশোহর জিলার চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন। তাঁহারা প্রথমে নীলকুঠির দেওয়ান ছিলেন, কিন্তু নীলকরগণের অত্যাচারে ব্যথিত হইয়া প্রজাগণকে ইহার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করিলেন। প্রথমে তাহাদের গ্রামের প্রজারা দলবদ্ধ হইয়া প্রতিজ্ঞা করিল যে তাহাদের গৃহ, সম্পত্তি এমনকি প্রাণ গেলেও তাহারা আর নীল চাষ করিবে না। তাহার পর আর-একটি গ্রামের লোক ঐরূপ প্রতিজ্ঞা করিল। নীলকর সাহেব হাজার লাঠিয়াল লইয়া ঐ গ্রাম আক্রমণ করিল। রায়তেরাও লাঠিয়াল নিযুক্ত করিয়াছিল, কিন্তু তাহারা সংখ্যায় কম ছিল, সুতরাং হারিয়া গেল। নীলকরেরা গ্রাম লুঠ করিল ও গ্রাম জ্বালাইয়া দিল। একজন গ্রামবাসী নিহত হইল। জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রজাদের পক্ষ লওয়ায় তাহাকে বদলি করা হইল। নীলকররা চুক্তিভঙ্গ করায় রায়তদের বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ করিয়া ডিক্রী পাইল। বিষ্ণু ও দিগম্বর এই খেসারতের টাকা দিল, রায়তদের স্ত্রী ও শিশুদের রক্ষার সুবন্দোবস্ত করিল। ইহার ফলে আরও বহু গ্রামের চাষীরা নীলচাষের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে যোগ দিল। শিশিরকুমার ঘোষ নদীয়া জিলার ৯২টি গ্রামের প্রতিনিধিদের এক সম্মিলনের ব্যবস্থা করিলেন–ইহারা নীল চাষ করিবে না এইরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইল। নীলকরেরা রাজকর্মচারীদের সহায়তায় নানারূপ অত্যাচার করিতে লাগিল, কিন্তু রায়তেরা প্রতিজ্ঞায় অটল রহিল এবং ক্রমে ক্রমে বিশলক্ষ লোক এই প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিল। নীলকরদের সংঘ (Planters’ Association) গভর্নমেন্টের নিকট আবেদন করায় ১৮৬০ সনের ৩১শে মার্চ এক নূতন আইন পাশ করা হইল। প্রজারা শর্তের চুক্তি ভঙ্গ করিলে সরাসরি বিচারের ব্যবস্থা হইল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রায়তদের অভিযোগের সত্যতা নির্ধারণ করার জন্য একটি তদন্ত কমিশন স্থাপনেরও ব্যবস্থা হইল।

এই নূতন আইন পাশ হওয়ায় রায়তেরা নীল চাষ করার বিরুদ্ধে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইল এবং লাঠিয়ালসহ কয়েকটি নীলকুঠি আক্রমণ করিয়া ধ্বংস করিল। পাবনা জিলায় মিলিটারী পুলিশসহ একজন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটকে হটাইয়া দিল। ১৮৬০ সনের ১৭ই সেপ্টেম্বর লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার পিটার গ্র্যান্ট একটি মন্তব্যে (Minute) লিখিয়াছেন: “আমি জলপথে ষ্টীমারে কুমার ও কালীগঙ্গা নদী দিয়া নদীয়া, যশোহর ও পাবনা জিলার মধ্য দিয়া যাইতেছিলাম–পথে নদীর দুই ধারে সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬০। ৭০ মাইল রায়তেরা কাতারে কাতারে দাঁড়াইয়া প্রার্থনা করিতে লাগিল, তাহাদের যেন আর নীল চাষ করিতে বাধ্য করা না হয়। তাহাদের মধ্যে অনেক স্ত্রীলোক ও শিশুও ছিল। এইসকল লোকেরা দুইধারের বহু দূরদূরান্তরের গ্রাম হইতে আসিয়াছিল।”

স্যার পিটার গ্র্যান্ট এই দৃশ্যে খুব বিচলিত হইয়াছিলেন। ইহার অনতিকাল পরেই গভর্নমেন্টের এক বিজ্ঞপ্তিতে রায়তদিগকে জানান হয় যে, ভবিষ্যতে এমন ব্যবস্থা করা হইবে যাহাতে তাহারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীলচাষ করিতে বাধ্য না হয়।

কিন্তু চাষীদের প্রতিজ্ঞা অটল রহিল এবং উভয়পক্ষেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলিতে লাগিল। এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করিয়া হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় ১৮৬০ সনের ১৯শে মে নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশিত হয়

“এই বিদ্রোহে রায়তেরা অসীম কষ্ট সহ্য করিয়াছে। তাহারা প্রহৃত, কারারুদ্ধ, অপমানিত, গৃহ হইতে বিতাড়িত হইয়াছে তাহাদের সম্পত্তি নষ্ট হইয়াছে, অনেকদিন অনশনে কাটিয়াছেকল্পনায় যতরকম অত্যাচার সম্ভব তাহা তাহাদের কপালে ঘটিয়াছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালান হইয়াছে, পুরুষদের ধরিয়া নিয়াছে, স্ত্রীলোকদের চরম লাঞ্ছনা করিয়াছে, ঘরের সঞ্চিত শস্য নষ্ট করা হইয়াছে। কিন্তু প্রজারা ইহাতেও দমে নাই–যে স্বাধীনতায় তাহাদের ধর্মত, আইনত ও জন্মগত অধিকার আছে তাহার লাভের জন্য আন্দোলন হইতে তাহারা বিরত হয় নাই।”

১৮৬১ সনে হরিশচন্দ্র মুখার্জীর মৃত্যু হইলে নিম্নলিখিত ছড়াটিতে বাঙ্গালীর সমবেদনা ফুটিয়া উঠিয়াছে।

“নীল বানরে সোণার বাংলা করলো এবার ছারেখার
অসময়ে হরিশ ম’ল, লঙের হল কারাগার
প্রজার আর প্রাণ বাঁচানো ভার।”

ওদিকে নীল তদন্ত কমিশন ১৮৬০ সনের ২৭শে অগষ্ট তাঁহাদের রিপোর্ট পেশ করিলেন। ইহাতে রায়তদের প্রতি অন্যায়-অত্যাচার যাহাতে বন্ধ হয় তাহার ব্যবস্থা করা হইল। কিন্তু নীলকরদের চুক্তি করিবার অধিকার এবং রায়তেরা ইহার শর্ত ভঙ্গ করিলে শাস্তির ব্যবস্থা অনুমোদন করা হইল। এই মর্মে একটি আইনও প্রস্তাবিত হইল-বিলাতের কর্তৃপক্ষ ইহা নাকচ করিয়া দিলেন। কিন্তু গভর্নমেন্টের চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলায় নীলচাষ ক্রমে ক্রমে খুব কমিয়া গেল। সংঘবদ্ধ রায়তদেরই জয় হইল। ১৮৬৮ সনে নীলচুক্তি আইন রদ করা হইল। তারপর ১৮৯২ সনে বৈজ্ঞানিক উপায়ে নীল ও অন্যান্য রং প্রস্তুত হওয়ার ফলে বাংলায় নীলচাষ প্রায় বন্ধ হইয়া গেল।

(ঘ) টালার হাঙ্গামা

নীলচাষীদের বিদ্রোহ ছাড়া সিপাহী বিদ্রোহের পর ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা দেশে গুরুতর কোন বিক্ষোভ বা বিপ্লব ঘটে নাই। ছোটখাট দাঙ্গাহাঙ্গামা অবশ্য ঘটিয়াছে। ইহার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কলিকাতায় ও নিকটবর্তী টালায় মুসলমানদের হাঙ্গামা। মোকদ্দমায় জয়লাভ করিয়া ডিগ্রী জারি করিবার জন্য মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কর্মচারী টালায় একখণ্ড জমি দখল করিতে গেলে স্থানীয় মুসলমানেরা বাধা দেয়। তাহারা বলে যে, এই জমির উপর যে ছোট একখানি চালাঘর আছে তাহা মসজিদরূপে ব্যবহৃত হয়, সুতরাং তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিলে তাহাদের ধর্মের অপমান হয়। ১৮৯৭ সনের ৩০শে জুন এই দখল নিবার সময় বহুসংখ্যক নিম্নশ্রেণীর মুসলমান ঐ স্থানে সমবেত হইলে পুলিশ ও একদল ইংরেজসৈন্য তাহাদিগকে তাড়াইয়া দেয়। কিন্তু তাহাদের একদল নিকটবর্তী জলের কলের পাম্প ও চৌবাচ্চা আক্রমণ করে–পুলিশ যাইয়া ইহা রক্ষা করে। রাত্রিতে কলিকাতার হ্যারিসন রোডে একদল মুসলমান হাঙ্গামা করে এবং তাহাদিগের উপর গুলি চালাইতে হয়। ১লা জুলাই সকালেও পুলিশের ডেপুটি কমিশনার হাঙ্গামাকারীদের উপর গুলি চালাইতে বাধ্য হন। অতঃপর হাঙ্গামা থামিয়া যায়। এই দুইদিনে হাঙ্গামাকারীদের এগার জন নিহত ও প্রায় কুড়িজন আহত হয়। পুলিশদলের ৩৪ জন আহত হইয়া হাসপাতালে যাইতে বাধ্য হয়। এই হাঙ্গামায় কলিকাতায় খুব ভীতির সঞ্চার হয় এবং ৩০শে জুন রাত্রে Calcutta Volunteer Light Horse শহরের নানা স্থানে পাহারা দেয়। হাঙ্গামা শেষ হইবার পর কয়েকজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান ক্ষুদ্র এক পুস্তিকার সাহায্যে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, যে কুঁড়েঘরখানি ভাঙ্গা লইয়া গোলমাল আরম্ভ হয় তাহা কোনকালেই মসজিদ বলিয়া গণ্য করা হয় নাই। হাঙ্গামাকারীদের ৮৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৮১ জনের শাস্তি হয়।

২. যুদ্ধ ও রাজ্য বিস্তার

যদিও মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রে বলা হইয়াছিল যে, ভারতে ইংরেজের আর রাজ্যবিস্তৃতির আকাক্ষা নাই, তথাপি সিপাহী বিদ্রোহের পরেও ভারতে বৃটিশসাম্রাজ্যের বিস্তার একেবারে বন্ধ হয় নাই।

(ক) দ্বিতীয় আফগানযুদ্ধ ও সীমান্ত অভিযান

ইংরেজদের সহিত আফগানিস্থানের আমীরের প্রথম যুদ্ধের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। এই যুদ্ধে প্রথমে কিছু সফলতা লাভ করিলেও পরিণামে ইংরেজসৈন্যের বিপুল ক্ষতি ও চরম দুর্দশা হয় এবং পরাজিত ও বন্দী আমীর দোস্ত মুহম্মদ পুনরায় কাবুলের সিংহাসন অধিকার করেন (১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দ)।

১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে দোস্ত মুহম্মদের মৃত্যু হইলে তাঁহার পুত্রগণের মধ্যে সিংহাসনের দাবি লইয়া যুদ্ধ হয়। ইহারা ইংরেজ গভর্নমেন্টের সাহায্য প্রার্থনা করেন; কিন্তু বড়লাট সার জন লরেন্স (১৮৬৪-১৮৬৯ খ্রী.) কাহাকেও সাহায্য করেন নাই। অবশেষে দোস্থ মুহম্মদের তৃতীয় পুত্র শের আলি প্রতিদ্বন্দ্বীদিগকে হারাইয়া সমগ্র কাবুলের অধিপতি হন (১৮৬৮ খ্রী.)। তিনি রাশিয়ার আক্রমণ হইতে আফগানিস্থান রক্ষার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধির প্রস্তাব করেন, কিন্তু ইংরেজ সরকার ইহা প্রত্যাখ্যান করে। তখন বাধ্য হইয়া শের আলি রাশিয়ার সহিত মিত্রতা স্থাপনের চেষ্টা করিলেন। একদিকে মধ্য-এশিয়ায় রাশিয়ার রাজশক্তির দ্রুত প্রসার এবং অপরদিকে আফগানিস্থান ও রাশিয়ার মিত্রতা ভারতে বৃটিশসাম্রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলকর নহে, এই ধারণায় বিলাতের কর্তৃপক্ষের সহিত একমত হইয়া বড়লাট লর্ড লিটন (১৮৭৬-১৮৮০ খ্রী.) প্রথম হইতেই আফগানিস্থানের দিকে তীব্ৰদৃষ্টি রাখিতে লাগিলেন। তিনি খেলাতের খার সহিত বন্দোবস্ত করিয়া সামরিক হিসাবে বিশেষ মূল্যবান কোয়েটা নামক স্থান অধিকার করিলেন (১৮৭৬ খ্রী.)। ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে শের আলি রাশিয়ার রাজদূতকে অভ্যর্থনা করিয়া এবং ভারতের বড়লাট কর্তৃক প্রেরিত দূতকে প্রত্যাখ্যান করিয়া রাশিয়ার প্রতি তাঁহার মিত্রতার প্রকাশ্য প্রমাণ দিলেন। ইহার ফলে ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে আফগানিস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষিত হইল এবং তিনদল বৃটিশসৈন্য তিনদিক হইতে ঐদেশের দিকে অগ্রসর হইল। শের আলি রাশিয়ায় পলাইয়া গেলেন এবং সেইখানে তাহার মৃত্যু হইল। শের আলির পুত্র ইয়াকুব খাঁ বৃটিশের সহিত সন্ধি করিয়া যুদ্ধ শেষ করিলেন। গণ্ডামুকের এই সন্ধির শর্ত অনুসারে কাবুলে যাইবার গিরিসঙ্কটগুলি বৃটিশের অধিকারে আসিল, এবং স্থির হইল যে, আফগানিস্থানের বৈদেশিক নীতি কাবুলে অবস্থিত ইংরেজ রাজপ্রতিনিধির পরামর্শ অনুসারে পরিচালিত হইবে (১৮৭৯ খ্রী.)। এই বন্দোবস্ত অনুসারে ঐ বৎসর জুলাই মাসে সার্ লুই ক্যাভেনরী কাবুলে বৃটিশ প্রতিনিধিরূপে প্রেরিত হইলে অনতিবিলম্বেই তিনি নিহত হইলেন। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য লর্ড লিটন সৈন্য প্রেরণ করিলেন এবং কাবুল ও কান্দাহার বৃটিশসৈন্য কর্তৃক অধিকৃত হইল। এই সময়ে বিলাতে গ্লাস্টোন প্রধানমন্ত্রী হইয়া আফগান নীতি উল্টাইয়া দিলেন। ইহাতে বিরক্ত হইয়া লর্ড লিটন পদত্যাগ করিলেন এবং তাহার স্থানে লর্ড রিপন (১৮৮০-১৮৮৪ খ্র.) বড়লাট হইয়া আসিলেন। কিন্তু তখনই মাইবান্দ নামক স্থানে শের আলির পুত্র আয়ুব খাঁ ইংরেজসৈন্যকে পরাজিত করিলেন। ইহার ফলে ইংরেজসৈন্য কান্দাহারে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইলে (জুলাই, ১৮৮০ খ্রী.) সেনাপতি রবার্টস্ কাবুল হইতে কান্দাহারে আসিয়া দুঃস্থ সৈন্যদলকে উদ্ধার করিলেন। অবশেষে শের আলির ভ্রাতুস্পুত্র আব্দুর রহমান আফগানিস্থানের সিংহাসন লাভ করিলে তাহার সহিত ইংরেজ সরকারের নূতন এক সন্ধি হইল। কাবুলে যাইবার গিরিসঙ্কটগুলিতে বৃটিশের অধিকার স্বীকৃত হইল। স্থির হইল, ইংরেজ সরকার কাবুলের আমীরকে বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা বৃত্তি দিবে এবং আমীর ইংরেজ গভর্নমেন্টের উপদেশ অনুসারে তাহার বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করিবেন (বৃত্তির পরিমাণ পরে বাড়াইয়া ১৮ লক্ষ টাকা করা হইয়াছিল)। ইংরেজ গভর্নমেন্ট বৈদেশিক আক্রমণ হইতে আফগানিস্থান রক্ষা করিবেন এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিলেন।

দ্বিতীয় আফগানযুদ্ধের পর প্রায় ৪০ বৎসর পর্যন্ত আফগানিস্তানের সহিত ইংরেজদের মিত্রতা অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু আফগানিস্থান ও বৃটিশশাসিত ভারতের মধ্যবর্তী ভূভাগে যে-সকল দুর্ধর্ষ পার্বত্য পাঠানজাতি বাস করিত তাহারা চিরকালই ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ঢুকিয়া লুঠতরাজ করিত। তাহাদের উপর আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টায় এই সীমান্তে ইংরেজদের বহু যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল। কাবুলের আমীর এইসকল স্বজাতীয় ও মুসলমান পাঠানদের উপর প্রভুত্বের দাবি করিতেন–কিন্তু বস্তুতঃ এইসকল স্বাধীনতাপ্রিয় পার্বত্য জাতি কাহারও অধীনতা স্বীকার করিত না। তথাপি তাহাদের উপর ইংরেজের আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা আমীর ভাল চক্ষে দেখেন নাই এবং ইহার ফলে উভয়ের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হইয়াছিল। ইহা দূর করিবার অভিপ্রায়ে আমীর ও ইংরেজরাজ্যে মধ্যবর্তী সীমান্ত রেখা নির্দিষ্ট করা হইল। ইংরেজের পক্ষে সার মটিমার ডুরাণ্ড কাবুলের আমীরের সম্মতিক্রমে এই সীমারেখা নির্দেশ করেন; এইজন্য ইহাকে ডুরাণ্ড লাইন বলা হয়।

এই সীমারেখা অনুসারে যে সমুদয় পার্বত্য জাতি ভারতের অধীনস্থ হইল তাহারা সহজে এই ব্যবস্থা অর্থাৎ ইংরেজের অধীনতা মানিয়া লয় নাই। আফ্রিদি, ওয়াজিরি, মাসুদ, মোমাণ্ড ও অন্যান্য বহু জাতি পুনঃপুনঃ বিদ্রোহ করিয়াছে এবং তাহাদের দমনের জন্য ইংরেজকে সামরিক অভিযান প্রেরণ করিতে হইয়াছে। চিত্রলের যুদ্ধ ইহাদের মধ্যে সমধিক প্রসিদ্ধ। চিত্রলের ভৌগোলিক অবস্থিতি সামরিক হিসাবে খুব মূল্যবান এবং এইজন্য ইংরেজ ইহা হস্তগত করিবার জন্য বিশেষ ব্যগ্র ছিল। ১৮৯১ সনে চিত্রলের সিংহাসনের অধিকার লইয়া দুইপক্ষে বিবাদ বাধিলে ইংরেজ এক পক্ষ অবলম্বন করিয়া তাহার সাহায্যের জন্য সৈন্য পাঠাইল। অপরপক্ষের প্ররোচনায় পার্শ্ববর্তী সমস্ত পাঠানজাতি মিলিত হইয়া ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করিল। ভারতীয় ইংরেজ ও শিখ সৈন্যদল চিত্রলের দুর্গে অবরুদ্ধ হইল এবং প্রায় দেড়মাস অবরুদ্ধ থাকিবার পর নূতন ভারতীয় সৈন্য গিয়া তাহাদের উদ্ধার করিল। চিত্রলে ইংরেজদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হইল।

১৮৯৭-৯৮ সনে বহু পাঠানজাতি একযোগে ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিল। তাহাদের দমন করিতে ইংরেজকে বহু অভিযান পাঠাইত হয়।

বড়লাট লর্ড কার্জন সীমান্তপ্রদেশ শাসনের জন্য এক নূতন নীতি অবলম্বন করিলেন। তিনি অধিকাংশ ইংরেজসৈন্য পার্বত্য পাঠান-অধ্যুষিত অঞ্চল হইতে পঞ্জাবের সীমানায় সরাইয়া নিলেন এবং তাহাদের পরিবর্তে ইংরেজ কর্মচারী দ্বারা শিক্ষিত পাঠানসৈন্যের হাতেই নিজ নিজ গ্রামের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার ভার দিলেন। লর্ড কার্জন ডুরাণ্ড লাইন ও পঞ্জাবের মধ্যবর্তী ভূভাগ এবং পঞ্জাবের পশ্চিম সীমাস্থিত হাজরা, পেশোয়ার, কোহাট, বানু এবং ডেরা ইসমাইল খান এই কয়টি জিলা লইয়া উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (North-West Frontier Province) নামে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করিলেন। প্রত্যক্ষভাবে ভারত সরকারের অধীনস্থ একজন চীফ কমিশনারের উপর ইহার শাসনভার ন্যস্ত হইল।

লর্ড কার্জনের নীতিতে প্রথম প্রথম সুফল হইয়াছিল এবং পাঠানজাতি অনেকটা শান্ত ছিল। কিন্তু ইহা বিশ বৎসরের বেশী স্থায়ী হয় নাই।

(খ) তৃতীয় ব্রহ্মযুদ্ধ

১৮২৪ ও ১৮৫২ সনে দুইটি যুদ্ধের ফলে ব্রহ্মদেশের অধিকাংশ ইংরেজসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ইহার ফলে এবং অন্যান্য কারণে ব্রহ্মরাজের সহিত ইংরেজ সরকারের মনোমালিন্য বাড়িয়াই চলিতেছিল। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে ফরাসিজাতি কোচিন-চীন ও টঙ্কিন প্রদেশ অধিকার করিয়া ব্ৰহ্মদেশের নিকটবর্তী প্রদেশে স্বীয় ক্ষমতা বিস্তার করে। ইংরেজের প্রভুত্ব প্রতিরোধ করিবার জন্য ব্রহ্মরাজ ফরাসিদের সহিত বন্ধুত্ব করিয়াছেন, এইরূপ ধারণার ফলে ইংরেজরা ভীত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। এই সময়ে একটি ইংরেজ বণিক কোম্পানি ব্রহ্মে কাঠের ব্যবস্থা করিত। তাহারা বেআইনি কাজ করিয়াছে এই অভিযোগে ব্রহ্মরাজ তাহাদের ২৩ লক্ষ টাকা জরিমানা করেন। ইহাতে বড়লাট লর্ড ডাফরিন (১৮৮৪-১৮৮৮ খ্রী.) ক্রুদ্ধ হইয়া ব্রহ্মরাজকে এমন কতকগুলি শর্তে সন্ধি করিতে বলিলেন, যাহাতে ব্রহ্মরাজের স্বাধীনতা অনেক পরিমাণে খর্ব হইয়া যায়। ব্রহ্মরাজ থিব এইরূপ সন্ধি করিতে অস্বীকৃত হইলে ডাফরিন ব্রহ্মদেশে সৈন্য প্রেরণ করিলেন এবং অল্পায়াসেই রাজধানী মান্দালয় অধিকার করিলেন (১৮৮৫ খ্র.)। ব্রহ্মরাজ থিব সপরিবারে ভারতে নির্বাসিত হইলেন এবং সমগ্র উত্তর ব্রহ্মদেশ ইংরেজরাজের অধিকারে আসিল (১৮৮৬ খ্র.)। এইরূপে তিনটি যুদ্ধের ফলে সমগ্র ব্রহ্মদেশ বৃটিশসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল।

(গ) মণিপুর

আসামের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ক্ষুদ্র মণিপুর রাজ্য প্রথম ব্ৰহ্মযুদ্ধের পর ইয়ান্দাবোর সন্ধির শর্ত অনুসারে ব্রহ্মদেশের অধীনতাপাশ হইতে মুক্ত হইল। কিন্তু ইংরেজ গভর্নমেন্টের একজন প্রতিনিধি (Political Agent) ঐ রাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করার ফলে মণিপুরের উপর ইংরেজের কিছু প্রভাব ছিল। ১৮৯০ সনে মণিপুররাজের ভ্রাতা ও সেনাপতি টীকেন্দ্রজিৎ রাজ্যের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার জন্য ইংরেজ গভর্নমেন্ট তাঁহার প্রতি বিরূপ ছিল এবং রাজ্যের এক আভ্যন্তরিক গোলযোগের সুযোগে তাঁহাকে গোপনে বন্দী করিবার ব্যবস্থা করিল। ১৮৯১ সনের ২৪শে মার্চ শেষরাত্রে অকস্মাৎ ইংরেজসৈন্য তাঁহার বাসস্থল আক্রমণ করিয়া অনেক পুরুষ ও স্ত্রীলোককে হত্যা করিল এবং বহু দ্রব্য লুণ্ঠন করিল; কিন্তু টীকেন্দ্রজিৎকে ধরিতে পারিল না। ইহাতে উত্তেজিত হইয়া মণিপুরের সৈন্যদল ইংরেজ প্রতিনিধির উপর গোলাগুলি বর্ষণ করায় ইংরেজপক্ষের কয়েকজন প্রধান ব্যক্তি রাত্রে রাজপ্রাসাদে আসিয়া টীকেন্দ্রজিতের সঙ্গে একটি মিটমাটের চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনরকম আপস করা সম্ভব হইল না। তখন টীকেন্দ্রজিৎ বিশ্রামের জন্য বিদায় লইলেন এবং তাঁহার ভ্রাতাকে নির্দেশ দিলেন যেন ইংরেজ কর্মচারীদিগকে তিনি নির্বিঘ্নে রাজপ্রাসাদের বাহিরে পৌঁছাইয়া দেন। কিন্তু সেইদিন প্রাতঃকালে ইংরেজসৈন্যের অর্তকিত আক্রমণে বহুলোক ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল। ফলে বিক্ষুব্ধ জনগণ ইংরেজ কর্মচারীরা দেউড়িতে পৌঁছিবার পূর্বেই তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিল। একজন আহত ও তিনজন ইংরেজ কর্মচারী এবং তাঁহাদের সঙ্গী একজন বাদ্যকর (bugler) বন্দী হইলেন। এই সংবাদ পাইয়া টীকেন্দ্রজিৎ আসিয়া রাত্রের জন্য তাহাদের রক্ষার সুবন্দোবস্ত করিয়া নিজের কক্ষে ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু তিনি নিদ্রিত হইলে মণিপুর রাজ্যের একজন কর্মচারী তোঙ্গোল সেনাপতি চারিজন বন্দী ইংরেজ এবং তাহাদের সঙ্গী বাদ্যকরকে হত্যা করিলেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আসামের চীফ কমিশনার ও মণিপুরের ইংরেজ প্রতিনিধি ছিলেন।

এই হত্যার প্রতিশোধ লইবার জন্য তিনদিক হইতে তিনদল ইংরেজসৈন্য মণিপুর আক্রমণ করিয়া রাজপ্রাসাদ অধিকার করিল। মণিপুরের রাজা, টীকেন্দ্রজিৎ, অন্যান্য রাজভ্রাতারা এবং তোঙ্গোল সেনাপতি পলাইয়া গিয়াছিলেন, কিন্তু শীঘ্রই ধৃত হইলেন। একটি বিশেষ আদালতে রাজপরিবারের এবং দুইজন ইংরেজ কর্মচারীর নিকট অন্য সকল অভিযুক্তগণের বিচার হইল। বিচারের ফলে মণিপুরের রাজা কুলচন্দ্র, টীকেন্দ্রজিৎ, তাঁহাদের আর এক ভ্রাতা এবং তোঙ্গোল সেনাপতির প্রাণদণ্ডের আদেশ হইল। টীকেন্দ্রজিৎ ও তোঙ্গোল সেনাপতির ফাসী হইল। বড়লাট কুলচন্দ্র ও তাঁহার অন্য ভ্রাতার প্রাণদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীন দ্বীপান্তরের আদেশ দিলেন। টীকেন্দ্রজিৎ যে ইংরেজ কর্মচারীদের হত্যার ব্যাপারে কোনরকম লিপ্ত ছিলেন তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। তাহার শক্তি ও জনপ্রিয়তাই যে ইংরেজদের বিরাগের কারণ এবং ইংরেজের চক্ষে তাহার প্রধান অপরাধ বলিয়া গণ্য হইত এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই এবং একজন ইংরেজ মন্ত্রীও তাহা প্রকাশ্যে স্বীকার করিয়াছিলেন।

অতঃপর ইংরেজ গভর্নমেন্ট মণিপুরের ভূতপূর্ব এক রাজার প্রপৌত্র পাঁচবছরের শিশু চূড়াচাঁদকে এক সনদ দিয়া মণিপুরের রাজসিংহাসনে বসাইলেন। সনদের শর্ত অনুসারে মণিপুরের রাজা ইংরেজকে বার্ষিক কর দিতে এবং শাসন ও অন্য বিষয়ে ইংরেজ গভর্নমেন্টের নির্দেশমত কার্য করিতে বাধ্য থাকিলেন।

রাজা যতদিন নাবালক থাকিবেন ততদিন নূতন ইংরেজ প্রতিনিধি (Political Agent) মণিপুর রাজ্য শাসন করিবেন এইরূপ ব্যবস্থা হইল।

(ঘ) ভুটান

আসাম ও বাংলার জলপাইগুড়ি জিলার উত্তরে এবং সিকিম ও দার্জিলিং জিলার পূর্বে অবস্থিত পার্বত্য ভুটান রাজ্যের দক্ষিণ পর্বতমালার নিম্নভূমিতে একটি অপ্রশস্ত দীর্ঘ উর্বর ভূমিখণ্ড আছে। পূর্বে আসামের ধনসিরি হইতে পশ্চিমে বাংলার তিস্তা নদী পর্যন্ত এই বিস্তৃত ভূখণ্ড প্রায় কুড়ি মাইল চওড়া এবং ইহার পরিমাণ একসহস্র মাইল বর্গক্ষেত্র। এই অঞ্চলের মধ্যদিয়া পার্বত্য ভুটান হইতে সমতল বাংলায় যাইবার এগারোটি এবং আসাম যাইবার সাতটি সংকীর্ণ পথ আছে। ইহাদিগকে ‘দুয়ার’ বলা হয়। এই কারণে সমস্ত অঞ্চলটি ‘ভুটান দুয়ার’ নামে খ্যাত। এই ভূখণ্ড উৎকৃষ্ট শ্রেণীর তুলা ও কাঠের জন্য প্রসিদ্ধ। ইউরোপীয়দের বসবাসের পক্ষেও খুবই উপযুক্ত। সুতরাং আসাম জয় করিবার পর এই ‘দুয়ার অঞ্চলের উপর ইংরেজদের লোলুপ দৃষ্টি পতিত হইল। তাহারা দাবি করিল যে দরাং জিলায় ‘দুয়ারের যে-অংশ তাহা আসামের অন্তর্গত-ভুটান তাহা অন্যায়রূপে দখল করিয়াছে। ভুটানরাজ সামান্য কর দিতে স্বীকৃত হইয়া আপস করিলেন। কিন্তু এই কর নিয়মিত না-দেওয়ায় এবং ভুটিয়ারা বৃটিশরাজ্যে লুটতরাজ করায় আবার গোলমাল আরম্ভ হইল। বিবাদের কোন মীমাংসা না হওয়ায় ১৮৪১ সনে ইংরেজ গভর্নমেন্ট আসামের ‘দুয়ার’ অঞ্চল দখল করিল ও শান্তিরক্ষার জন্য ভুটানকে বাৎসরিক দশ হাজার টাকা দিতে স্বীকৃত হইল। কিন্তু ইহার পরেও ভুটিয়ারা মাঝে মাঝে বাংলা দেশে ঢুকিয়া লুটপাট করিত।

১৮৬৩ সনে ইংরেজ গভর্নমেন্ট ক্ষতিপূরণের দাবি করিবার জন্য সার অ্যাসলী ইডেনকে (Sir Ashley Eden) দূত নিযুক্ত করিয়া ভুটানে পাঠাইল। কিন্তু ভুটানরাজ প্রকাশ্য দরবারে ইডেনকে অপমান করিলেন মুক্তির মুল্যস্বরূপ তাহাকে দিয়া-আসামের ‘দুয়ার’ অঞ্চল ভুটানকে ফিরাইয়া দিবে–এই মর্মে এক সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করাইয়া লইলেন। ইডেন কোনমতে পলাইয়া ১৮৬৪ সনের এপ্রিল মাসে দার্জিলিং পৌঁছিলেন। ভুটানকে যথোচিত শাস্তি দিবার জন্য তাহার বার্ষিক বৃত্তি বন্ধ করা হইল এবং একদল ইংরেজসৈন্য ভুটান আক্রমণ করিল। ১৮৬৫ সনের ১১ই নভেম্বর সন্ধি হইল। বাংলা ও আসামের ‘দুয়ার’ অঞ্চল ইংরেজরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। ইহার পরিবর্তে ইংরেজ ভুটানকে বার্ষিক বৃত্তি দিতে স্বীকার করিল। প্রথম তিন বৎসর যথাক্রমে ২৫,০০০, ৩৫,০০০, ৪৫, ০০০ এবং পরে প্রতি বৎসর ৫০,০০০ টাকা বৃত্তি নির্ধারিত হইল। কিন্তু স্থির হইল ভুটিয়ারা ইংরেজরাজ্যে লুটতরাজ করিলে এই বৃত্তি বন্ধ করা হইবে এবং ভুটানের সহিত সিকিম বা কোচবিহারের বিবাদ হইলে ভুটান ইংরেজ গভর্নমেন্টের সালিসী মানিয়া লইবে। এইরূপে সমগ্র ‘দুয়ার’ অঞ্চল বাংলার অন্তর্ভুক্ত হইল।

(ঙ) সিকিম

লর্ড ডালহৌসী যে বলপূর্বক সিকিমের এক-তৃতীয়াংশ অধিকার করিয়াছিলেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

১৮৬০ সনে সিকিমের দেওয়ান কয়েকজন বৃটিশপ্রজাকে অপহরণ করে। সিকিমরাজ তাহাদিগকে প্রত্যর্পণ না-করায় ক্যাম্পবেল ক্ষুদ্র একদল অশিক্ষিত সৈন্য লইয়া অগ্রসর হন, কিন্তু পরাজিত হইয়া ফিরিয়া আসেন। পরে একদল সুশিক্ষিত সৈন্য সিকিম আক্রমণ করে এবং বিনাবাধায় রাজধানী তুমলুং পৌঁছে (১৮৬১ খ্র.)। সিকিমের রাজার সহিত নূতন সন্ধি হয়–ইহার ফলে তাঁহার স্বাধীনতা অনেকাংশে খর্ব হয় এবং তাঁহাকে বহু টাকা ক্ষতিপূরণরূপে দিতে হয়।

১৮৮৬ সনে তিব্বত সিকিম আক্রমণ করে। সিকিমের অধিবাসীরা বেশীর ভাগই তিব্বতের পক্ষে এবং তাহারা তিব্বতের বিরুদ্ধে ইংরেজের সাহায্য প্রার্থনা করিল না। কিন্তু সিকিমের মধ্যদিয়াই ভারতের সহিত তিব্বতের বাণিজ্যের রাস্তা। দার্জিলিংয়ের চা-বাগানগুলিও সিকিমের সীমান্তে। সুতরাং সিকিম তিব্বতের অধীন হইলে ইংরেজদের অনেক অসুবিধা। এই কারণে বিনা-আমন্ত্রণেই ইংরেজ-সরকার সিকিমের তিব্বতীয় আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাইল, তিব্বত পরাজিত হইয়া সন্ধি করিতে বাধ্য হইল। ১৮৯০ সনে চীন ও ইংরেজের মধ্যে যে সন্ধি হইল তাহাতে তিব্বত ও সিকিমের সীমানা নির্দিষ্ট করা হইল এবং সিকিম ইংরেজের আশ্রিত রাজ্যে (British Protectorate) পরিণত হইল। অর্থাৎ সিকিমের আভ্যন্তরিক শাসন ও বৈদেশিক নীতি পরিচালনে ভারত-সরকারের অব্যাহত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হইল। ব্যবসাবাণিজ্যেরও অনেক সুবিধাজনক ব্যবস্থা করা হইল।

(চ) গারো অভিযান

একদিকে আসাম ও অন্যদিকে ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট জিলার মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলের পশ্চিমপ্রান্তে গারো জাতি বাস করিত। তাহাদের মধ্যে একদল কোন শাসন মানিত

এবং মাঝে মাঝে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে হানা দিয়া লুটপাট করিত। তাহাদিগকে দমন করিবার জন্য সৈন্য ও সশস্ত্র পুলিশ পাঠান হইলে তাহারা বিনাবাধায় বশ্যতা স্বীকার করিল (১৮৭২ খ্রী.)।

৩. শাসন প্রণালীর সংস্কার

আলোচ্য সময়ের মধ্যে ১৮৬১ ও ১৮৯২ সনে দুইটি আইনদ্বারা শাসনব্যবস্থার গুরুতর পরিবর্তন সাধিত হয়।

১৮৫৩ সনে আইন প্রণয়নের জন্য যে নূতন ব্যবস্থা হয় তাহাতে কয়েকটি ত্রুটি লক্ষিত হইল :

প্রথমতঃ, নবগঠিত আইন পরিষদ্ কেবলমাত্র নূতন আইন প্রণয়নে নিযুক্ত না থাকিয়া সাধারণ শাসনব্যাপারেও নানাপ্রকারের হস্তক্ষেপ করিতে আরম্ভ করে।

দ্বিতীয়তঃ, আইন প্রণয়নের অধিকার কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় পরিষদে থাকায়, বম্বে ও মাদ্রাজ বিক্ষুব্ধ হয়।

তৃতীয়তঃ, সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭ খ্র.), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭-৫৮ খ্রী.) এবং নীলকর আন্দোলন (১৮৬০ খ্রী.) প্রভৃতি বিপ্লব ও বিক্ষোভের কারণ অনুসন্ধান করিয়া অনেকেই এইরূপ মত প্রকাশ করেন যে, ভারতের জনমত সম্বন্ধে সরকার অবহিত নহেন এবং কেন্দ্রীয় পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি না রাখিলে, বিদ্রোহ বা গুরুতর বিক্ষোভ ব্যতীত প্রজার অসন্তোষ ও অভিযোগ সম্বন্ধে পূর্বে জ্ঞাত হইয়া যথোচিত ব্যবস্থা করা সম্ভবপর নহে।

এই সমুদয় ত্রুটি দূর করিবার জন্য ১৮৬১ সনের আইনে নিম্নলিখিত পরিবর্তন করা হইল :

১। গভর্নর জেনারেলের পরিষদের সদস্যসংখ্যা চারি হইতে বাড়াইয়া পাঁচ করা হইল।

২। আইন প্রণয়নের জন্য এই পরিষদে গভর্নর জেনারেল অন্যূন ছয় ও অনধিক বারো জন অতিরিক্ত সদস্য মনোনীত করিতে পারিবেন। অন্ততঃ ইহার অর্ধেক সংখ্যক বেসরকারী হইবেন। সেনাপতি এবং যে-প্রদেশে এই পরিষদের অধিবেশন হইবে তাহার গভর্নর বা লেফটেনান্ট গভর্নর ইহার অতিরিক্ত সদস্য হইবেন। এই বর্ধিত পরিষদ আইন-প্রণয়ন ব্যতীত অন্য কোন বিষয় আলোচনা করিতে পারিবে না। এই পরিষদ্ যে আইন প্রণয়ন করিবে বড়লাটের সম্মতি ব্যতীত তাহা আইন বলিয়া গৃহীত হইবে না এবং বিলাতের কর্তৃপক্ষ তাহা নাকচ করিয়া দিতে পারিবেন।

৩। সপারিষদ্ বোম্বাই ও মাদ্রাজের গভর্নর আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ফিরিয়া পাইল। কেবলমাত্র আইন প্রণয়নের জন্য এই পরিষদে অন্যূন চারি ও অনধিক আটজন অতিরিক্ত সদস্য গভর্নর মনোনীত করিতে পরিবেন। অ্যাডভোকেট জেনারেলও পদানুরোধে ইহার সদস্য থাকিবেন। বড়লাট ইচ্ছা করিলে এই পরিষদে প্রণীত যে-কোন আইন নাকচ করিতে পরিবেন এবং প্রয়োজন বোধ করিলে সপারিষদ্ গভর্নর জেনারেল সমগ্র ভারতের জন্য আইন করিতে পারিবেন।

৪। বাংলা, পঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের জন্য এইরূপ আইন-পরিষদ গঠন করিতে বড়লাটকে নির্দেশ দেওয়া হইল।

৫। গভর্নর জেনারেল নিজের ইচ্ছায় যে-কোন অর্ডিন্যান্স (Ordinance) জারী করিতে পারিবেন–ছয় মাস পর্যন্ত ইহা আইন বলিয়া স্বীকৃতি পাইবে।

উল্লিখিত ৪-সংখ্যক ধারা অনুসারে ১৮৬২ সনের ১৮ই জানুআরি বাংলা দেশে লেজিস্লেটিভ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হইল। ইহাতে লেফটেনান্ট গভর্নর বারোজন সদস্য মনোনীত করিবার অধিকার পাইলেন। তিনি চারিজন ইউরোপীয় ও দুইজন ভারতীয় কর্মচারী এবং চারিজন ইউরোপীয় ও দুইজন ভারতীয় বেসরকারী সদস্য নিযুক্ত করিলেন। ১৮৬২ সনের ১লা ফেব্রুআরি তারিখে এই আইন-পরিষদের প্রথম অধিবেশন হইল।

১৮৬১ সনের আইন অনুসারে যে আইন-পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হইল তাহাতে ভারতীয়েরা সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই–কারণ অল্পসংখ্যক যে কয়েকজন ভারতীয় সদস্য ছিলেন তাঁহারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন না–গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হইতেন এবং তাহাদের অধিকাংশই অযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন এবং গভর্নমেন্টের নির্দেশ অনুসারেই ভোট দিতেন। ইহার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন হইল এবং ১৮৮৫ সনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস স্থাপিত হইলে শাসনব্যাপারে ভারতীয় প্রজাগণের অধিকার বৃদ্ধি করিবার জন্য আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করিল। ইহার ফলে ১৮৯২ সনে নূতন আইন বিধিবদ্ধ হইল।

ইহাতে নিম্নলিখিতরূপ পরিবর্তন হইল :

গভর্নর জেনারেলের আইন-পরিষদের অতিরিক্ত সদস্যসংখ্যা বাড়াইয়া ১৬ করা হইল। ইহার মধ্যে অনধিক দশজন বেসরকারী হইবেন। ইহাদের মধ্যে চারিজন চারিটি প্রাদেশিক বিধান-পরিষদের বেসরকারী সদস্যদের এবং একজন কলিকাতা চেম্বার অফ কমার্সের (Chamber of Commerce) সুপারিশে ও বাকী পাঁচজন গভর্নর জেনারেল কর্তৃক সোজাসুজি মনোনীত হইবেন। এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, প্রাদেশিক বিধান পরিষদের মাত্র আটজন সদস্য মিউনিসিপ্যালিটি, জিলা বোর্ড (District Board), জমিদার, বিশ্ববিদ্যালয় ও চেম্বার অফ কমার্সের সুপারিশে মনোনীত (বা নির্বাচিত) হইতেন।

৪. বাংলা দেশের আভ্যন্তরিক শাসনব্যবস্থা

বাংলা দেশের জন্য পৃথক একজন শাসনকর্তার নিয়োগে যে আভ্যন্তরিক শাসনব্যবস্থার অনেক উন্নতি হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। কারণ ইহার পূর্বে সপারিষদ্ বড়লাট রাজ্যশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করিলেও এ-বিষয়ে অখণ্ড মনোযোগ দিতে পারেন নাই। নবনিযুক্ত লেফটেনান্ট গভর্নর বা ছোটলাট কেবলমাত্র বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের শাসনকার্য পরিচালনা করিতেন, সুতরাং পূর্বাপেক্ষা শাসনকার্য অধিকতর যোগ্যতার সঙ্গে সম্পন্ন হইত।

বাংলা দেশের প্রথম তেরজন ছোটলাট ছিলেন :

(১) সার ফ্রেডারিক জেমস্ হ্যাঁলিডে (১৮৫৪-৫৯ খ্রীষ্টাব্দ)

(২) সার জন পিটার গ্রান্ট (১৮৫৯-৬২ খ্রীষ্টাব্দ)

(৩) সার সিসিল বিডন (১৮৬২-৬৭ খ্রীষ্টাব্দ)

(৪) সার উইলিয়ম গ্রে (১৮৬৭-৭১ খ্রীষ্টাব্দ)

(৫) সার জর্জ ক্যাম্পবেল (১৮৭১-৭৪ খ্রীষ্টাব্দ)

(৬) সার রিচার্ড টেম্পল (১৮৭৪-৭৭ খ্রীষ্টাব্দ)

(৭) সার অ্যাসলি ইডেন (১৮৭৭-৮২ খ্রীষ্টাব্দ)

(৮) সার অগস্টা রিভার্স টম্পসন (১৮৮২-৮৭ খ্রীষ্টাব্দ)

(৯) সার স্টুয়ার্ট কলভিন বেলী (১৮৮৭-৯০ খ্রীষ্টাব্দ)। ইনি ১৮৭৯ সনের ১৫ই জুলাই হইতে ১লা ডিসেম্বর পর্যন্ত অস্থায়ী ছোটলাট ছিলেন।

(১০) সার চার্লস অ্যালফ্রেড ইলিয়ট (১৮৯০-৯৫ খ্রীষ্টাব্দ)

(১১) সার অ্যালেকজাণ্ডার মেকেঞ্জি (১৮৯৫-৯৮ খ্রীষ্টাব্দ)

(১২) সার জন উডবার্ণ (১৮৯৮-১৯০২ খ্রীষ্টাব্দ)।

(১৩) সার অ্যান্ড্রু হেণ্ডারসন লিথ ফ্রেসার (১৯০৩-০৫ খ্রীষ্টাব্দে)।

১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার শাসনবিভাগে একজন মাত্র সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। পৃথক লেফটেনান্ট গভর্নর হওয়ার পরে সার উইলিয়ম গ্রের সময়ে একজন ও সার অ্যাসলি ইডেনের সময় আর-একজন সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। ইহারা বিচার, রাজস্ব ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন। পরে ইহাদের মধ্যে একজন প্রধান (Chief) সেক্রেটারী নিযুক্ত হন।

প্রথম ছোটলাট হ্যাঁলিডের সময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা (১৮৫৭ খ্রী.), ঈষ্ট ইণ্ডিয়া রেলওয়ে লাইনের আরম্ভ (১৮৫৫ খ্র.), সিপাহী বিদ্রোহ ও তাহার ফলে ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পরিবর্তে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার স্বহস্তে ভারতের শাসনভার গ্রহণ, বিধবা-বিবাহ আইন, ও ১৮৫৯ সনে কৃষকগণের খাজনা আইন প্রচলিত।

দ্বিতীয় ছোটলাটের সময় বাংলা দেশে প্রথম লেজিশ্লেটিভ কাউনসিল গঠন এবং নীলচাষীদের বিদ্রোহ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ১৮৬২ সনে কলিকাতা হাইকোর্টের প্রতিষ্ঠা হয়। কোম্পানির আমলের সুপ্রীম কোর্ট, সদর দেওয়ানী ও সদর নিজাম আদালতের সমস্ত ক্ষমতা এই হাইকোর্টকে দেওয়া হয়।

আভ্যন্তরিক শাসনপদ্ধতি বিষয়ে ১৮৫৯ সনে যে নূতন ব্যবস্থা হয়, ইংরেজশাসনের শেষপর্যন্ত প্রায় তাহাই প্রচলিত ছিল। এই নূতন ব্যবস্থায় একই ব্যক্তি ম্যাজিষ্ট্রেট ও কলেক্টরের পদে নিযুক্ত হন এবং তিনিই জিলার শাসনের সকল বিভাগে সর্বেসর্বারূপে বিরাজ করেন। পুলিশ ও জেল তাঁহার অধীনস্থ করা হয় এবং ফৌজদারী মোকদ্দমাও প্রথম অবস্থায় তিনিই বিচার করেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয় এবং ম্যাজিষ্ট্রেট কলেক্টরের হাত হইতে বিচারের ভার সরাইয়া নিবার জন্য বহুদিন যাবৎ তীব্র আন্দোলন হয়। বিলাতেও ভারতশাসন বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং পার্লিয়ামেন্টের কয়েকজন ইংরেজ সভ্য এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করিয়া সেক্রেটারী অব ষ্টেটের নিকট এক আবেদনপত্র পাঠান। ইহাতে তাঁহারা বলেন যে একই ব্যক্তির উপর ম্যাজিষ্ট্রেট, পুলিশের অধ্যক্ষ, পাবলিক প্রসিকিউটর (Public Prosecutor), ফৌজদারী মামলার বিচারক, রাজস্ব-সংগ্রাহক প্রভৃতি পদের দায়িত্ব এবং রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলার আপিল শুনানির ভার দেওয়া সত্যই অতি অদ্ভুত। কিন্তু ইংরেজশাসনে এবং স্বাধীন ভারতের গণতন্ত্র শাসনের বিশ বৎসর কালেও এই ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নাই। এস্থলে বলা আবশ্যক যে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ইংরেজ আমলে বহুবার ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছেন।

১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দের বিধান অনুসারে ভারতের সরকারী উচ্চপদে কেবল সনদপ্রাপ্ত কর্মচারীরাই (Covenanted Civilian) নিযুক্ত হইতে পারিতেন। সমস্ত দায়িত্বপূর্ণ উচ্চপদেই এই সকল ইংরেজ কর্মচারীরা অধিষ্ঠিত ছিলেন, অবশ্য ছোটখাট নীচের পদে ভারতীয়দিগকে নিয়োগ করা হইত। ১৮২৪ সনে মুনসিফ ও সদর আমিন এবং সাত বৎসর পরে প্রধান সদর আমিনের পদের সৃষ্টি হয়। ইহাদের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ১৭৬৮ সনে এই সমুদয় পদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়। ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টরের নিয়োগ পূর্বোক্ত বিধানের বিরোধী হওয়ায় ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে নূতন এক বিধানদ্বারা ইহা অনুমোদিত হয়।

সনদপ্রাপ্ত ইংরেজ কর্মচারী প্রথমে বিলাতের কর্তৃপক্ষেরা মনোনীত করিতেন এবং ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরদের আত্মীয়স্বজনেরাই সাধারণতঃ মনোনীত হইতেন। এইসব কর্মচারীরা এদেশে আসিয়া ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে উপযুক্ত শিক্ষালাভ করিয়া কার্যে যোগ দিতেন। পরে বিলাতে লণ্ডনের নিকটবর্তী হেইলিবেরী (Haileybury) নামক স্থানে তাঁহাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানকার শিক্ষা সমাপ্ত হইলে একটি পরীক্ষায় পাশ করিবার পর কলিকাতায় আসিয়া তাহারা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে ভারতীয় ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষালাভ করিতেন।

১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে চার্টার অ্যাক্টে এই প্রথা বিলুপ্ত করিয়া কেবলমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষাদ্বারাই সনদপ্রাপ্ত কর্মচারী নিযুক্ত করার নিয়ম হইল। সকলেই এই পরীক্ষা দিতে পারি, কিন্তু কেবলমাত্র লণ্ডনে এই পরীক্ষা গৃহীত হওয়ায় ভারতীয় যুবকদের পক্ষে এই পরীক্ষা পাশ করা খুবই কষ্টকর ছিল। তথাপি ক্রমে ক্রমে অল্পসংখ্যক ভারতীয় এই পরীক্ষা পাশ করিয়া এই সনদপ্রাপ্ত পদে নিযুক্ত হইতে লাগিল। এই সর্বোচ্চ পদের নাম পরিবর্তিত হইয়া ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (Indian Civil Service) হইল। এই সার্ভিসের লোকেরাই প্রকৃতপক্ষে দেশশাসন করিত।

নিম্ননির্বাহক পদ (Subordinate Executive Service) দুইটি শাখায় বিভক্ত ছিল। উচ্চতর শাখায় ডেপুটি কালেক্টর এবং নিম্নতর শাখায় সাব-ডেপুটি কালেক্টর,

১৮৮২-৮৩ খ্রীষ্টাব্দে নিম্ননির্বাহক পদে (Subordinate Executive Service) নিয়োগের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষাদ্বারা নির্বাচনের প্রথা প্রচলিত হয়। পূর্বেও এইপ্রকার পরীক্ষা নেওয়া হইত এবং যাহারা উত্তীর্ণ হইত তাহাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হইত; কিন্তু বৎসরে কতজন কর্মচারীর নিয়োগ হইবার সম্ভাবনা তাহার দিকে লক্ষ্য রাখা হইত না। ফলে প্রায় ৩০০ জন পদপ্রার্থীর নাম তালিকাভুক্ত হইল, সুতরাং পরীক্ষাগ্রহণ বন্ধ হইল। ১৮৮২-৮৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রবর্তিত নিয়ম অনুসারে যে কয়টি পদ খালি হওয়ার সম্ভাবনা কেবলমাত্র সেইসংখ্যক পদপ্রার্থীই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলিয়া গৃহীত হইত। ইহার অতিরিক্ত কর্মচারী প্রয়োজন হইলে লেফটেনান্ট গভর্নর তাহাদিগকে মনোনীত করিতেন। কিন্তু শীঘ্রই এই প্রথার পরিবর্তন হইল। কারণ দেখা গেল যে কেবলমাত্র পরীক্ষার ফলাফলের দ্বারা নির্বাচিত হইলে, বাঙ্গালী হিন্দুরাই প্রায় সকল পদ দখল করিবে, মুসলমানদের বা বাংলার অন্তর্ভুক্ত বিহার ও উড়িষ্যার অধিবাসীদের এবং বিশিষ্ট বা অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত লোকের নিয়োগ খুবই কম হইবে। অতএব স্থির হইল (১৮৮৮-৮৯ খ্রী.) যে, অতঃপর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ প্রার্থীরা খালি পদের অর্ধেক পাইবে, এক চতুর্থাংশ পদে যে-সকল প্রার্থী উক্ত পরীক্ষায় মোট নম্বরের অন্ততঃ এক-তৃতীয়াংশ পাইয়াছে তাহাদের মধ্য হইতে মনোনীত হইবে, এবং বাকী এক-চতুর্থাংশ নিম্নতর শাখা হইতে উচচতর শাখায় উন্নীত হইবে। নিম্নতর শাখায় নিয়োগের জন্যও মোটামুটি এই প্রথাই গৃহীত হইল।

বৃটিশ আমলের প্রারম্ভ হইতেই দেশে চুরি-ডাকাতির যথেষ্ট প্রাদুর্ভাব ছিল। পুলিশের অকর্মণ্যতা সম্বন্ধে বহু অভিযোগ ছিল, চোর ডাকাত বড় একটা ধরা পড়িত না এবং অনেক স্থলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রায় লোপ পাইয়াছিল। ইহার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং ইহার মতানুসারে পুলিশ সম্বন্ধে নূতন ব্যবস্থা হয়। সমস্ত প্রদেশের পুলিশের অধ্যক্ষ হইবেন একজন Inspector General of Police-সনদপ্রাপ্ত কর্মচারী (Covenanted Service) এবং তাঁহার অধীনে থাকিবেন কয়েকজন Deputy Inspector General-ইহারা প্রত্যেকে এক-একটি এলাকার (Range) ভার গ্রহণ করিবেন। এই উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশ কয়েকটি এলাকায় ভাগ করা হয়। প্রতি জিলায় পুলিশের একজন অধ্যক্ষ থাকিবেন–Superintendent of Police। এই সমুদয় কর্মচারীদের জন্য একটি পৃথক নিখিল ভারতীয় পদের (All India Police Service) সৃষ্টি হইল এবং বিলাতের কর্তৃপক্ষ ইহাদের নিয়োগ করিতেন। আভ্যন্ত রিক ব্যবস্থায় পুলিশ কর্মচারীদের কতকটা স্বাধীনতা থাকিলেও ইহারা সর্বতোভাবে জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও বিভাগীয় কমিশনারের অধীন ছিল।

প্রতি জিলার সর্বনিম্ন পুলিশ স্টেশন ছিল থানা। প্রতি থানার অধীনে অনেকগুলি গ্রাম ছিল এবং ইহাদের শান্তিরক্ষার জন্য একজন দারোগা থাকিত। প্রতি গ্রামে শান্তিরক্ষার জন্য চৌকিদার নিযুক্ত হইত। ১৮৫৬ সনে চৌকিদারী আইন পাশ হয়। ইহার ফলে প্রতি গ্রামে অন্ন পাঁচজন সদস্য লইয়া একটি পঞ্চাইতি গঠিত হইত। ইহারা সকলেই জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট দ্বারা মনোনীত হইত এবং চৌকিদারের বেতনের জন্য গ্রামবাসীদের উপর কর ধার্য করিত। ম্যাজিস্ট্রেটই চৌকিদার নিযুক্ত করিতেন। চৌকিদারেরা থানার দারোগাকে গ্রামের সংবাদ সরবরাহ করিত। এই ব্যবস্থায় সুফল না-পাওয়ায় ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে নূতন এক আইন হয়। ইহাতে শান্তিরক্ষার জন্য পঞ্চাইতদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব বৃদ্ধি করা হয়। চৌকিদার নিয়োগের ভার তাহাদের হস্তে ন্যস্ত হয়, কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমোদন ব্যতীত তাহারা কোন চৌকিদারকে বরখাস্ত করিতে পারিত না।

পুলিশ বিভাগের কার্য তদন্তের জন্য ১৮৬০ সনে ভারত-সরকার একটি কমিশন গঠিত করে। ইহাদের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতি জিলায় একজন ইউরোপীয় পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট এবং বড় বড় জিলার জন্য একজন ইউরোপীয় সহকারী সুপারিটেনডেন্ট নিযুক্ত হইলেন। ইহাদের অধীনে ইনসপেক্টর, হেড কনষ্টেবল, ও সার্জেন্ট থাকিত। বিভাগীয় কমিশনারের পরিবর্তে জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশের কর্তা হইলেন। সৈনিকদিগকে পুলিশের বড় পদে নিযুক্ত করা বন্ধ হইল এবং প্রথমে মনোনয়ন ও পরে প্রতিযোগিতা পরীক্ষা দ্বারা পুলিশের বড় কর্মচারী নিযুক্ত করার ব্যবস্থা হইল। ১৯০২ সালে একটি কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী পুলিশ কর্মচারীদের নির্দিষ্ট গ্রেডে বিভক্ত করা হইল এবং ‘ইনপেক্টর’ ও ‘ডেপুটি ইনসপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ’ পদের সৃষ্টি হইল। রেলওয়ের জন্য নূতন পুলিশ বিভাগ হইল, কিন্তু মিউনিসিপালিটি ও ক্যান্টনমেন্টের পৃথক পুলিশ বিভাগ রদ করা হইল। কলিকাতার জন্য আলাদা পুলিশের বন্দোবস্ত হইল।

এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, ইংরেজশাসনের প্রথম হইতেই দেশে স্থলপথে ও জলপথে ডাকাতির খুব প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল। সরকারী রিপোর্ট বলা হইয়াছে যে, দুই কারণে ডাকাতি দমন করা খুব কষ্টসাধ্য ছিল। প্রথম, সাধারণ লোকের মধ্যে ডাকাতদের প্রতিরোধ করিবার ইচ্ছা বা শক্তির অভাব। দ্বিতীয়, জমিদাররাই ডাকাতির প্রশ্রয় দিতেন। বাংলা দেশে জমিদারেরা যে অনুচরবর্গ লইয়া ডাকাতি করিতেন তাহার অসংখ্য কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত ছিল। সরকার ডাকাতি দমনের জন্য একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ইহার প্রচেষ্টায় ডাকাতির সংখ্যা অনেক কমিয়া যায়। ১৮৫২, ১৮৫৬, ১৮৫৮ ও ১৮৫৯ সনে ডাকাতির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫২০, ২৯২, ১৯০ ও ১৭১। বাংলা দেশে আর-একটি উপদ্রব ছিল। পূর্ব সীমান্তের আদিম অসভ্য জাতিরা মাঝে মাঝে অভাবের তাড়নায় চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলে হানা দিত।

১৮৬২ সনে জুরী প্রথার প্রবর্তন হয়। প্রথমে কয়েকটি জিলায় এবং নির্দিষ্ট অপরাধের বিচারের জন্য ইহা প্রবর্তিত হয়, কিন্তু ক্রমে ইহা অন্যান্য জিলায় বিস্তৃত হয়। যে সমুদয় অপরাধের জন্য জুরীর বিচার হইবে তাহার সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়।

১৮৭৪ সনে আসাম প্রদেশ বাংলা হইতে পৃথক হইয়া চীফ কমিশনারের অধীনে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হয়।

১৮৫৯ সনের খাজনা আইনে (Bengal Rent Act) রায়তদের কিছু সুবিধা হয়। ইহা দ্বারা নির্দিষ্ট খাজনার অতিরিক্ত দাবি এবং বাকী খাজনার জন্য জমিদার কর্তৃক প্রজার অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করিবার অধিকার অনেক হ্রাস পায়। জমিদার প্রজার মামলা সাধারণ দেওয়ানী আদালত হইতে কালেক্টর ও তাঁহার সহযোগীদের দ্বারা পরিচালিত রাজস্ব আদালতে স্থানান্তরিত করা হয় (কিন্তু দশবৎসর পরে পূর্বব্যবস্থা প্রচলিত করা হয়)। প্রজাদিগকে জোর করিয়া জমিদারী কাছারীতে হাজিরা দিতে বাধ্য করার প্রথা রহিত করা হয়।

কিন্তু ইহা সত্ত্বেও প্রজা ও জমিদার উভয়পক্ষেরই কয়েকটি গুরুতর অসুবিধা ছিল। ইহার সম্বন্ধে প্রায় বারো বৎসর যাবৎ তর্ক ও আন্দোলনের ফলে ১৮৮৫ সনে এক নূতন আইন হয়। জমিদারী প্রথায় কোন রায়ত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোন জমি ভোগদখল করিলে তাহাতে তাহার চিরস্থায়ী রায়তী স্বত্ব জন্মিত-জমিদার সহজে তাহাকে ঐ জমি হইতে বেদখল করিতে পারিত না। ইহা এড়াইবার জন্য জমিদার নির্দিষ্টকাল পূর্ণ হইবার পূর্বেই রায়তকে গ্রামের এক জমি হইতে উঠাইয়া আর এক জমির দখল দিতেন। ইহার ফলে প্রজা কোন জমিতেই রায়তী স্বত্বের দাবি করিতে পারিত না। ১৮৮৫ সনের আইন অনুসারে ১২ বৎসর যাবৎ এক গ্রামের মধ্যে যে-কোন জমি দখলে থাকিলেই তাহাতে প্রজার রায়তী স্বত্ব জন্মিবে। আর প্রজা ১২ বৎসর এইরূপে কোন জমির দখলকারী ছিল কিনা তাহা প্রমাণ করিবার যে দায়িত্ব এতদিন প্রজার উপর ছিল, নূতন আইনে জমিদারের উপর সেই দায়িত্ব অর্পিত হইল। ইংরেজ আদালতে কোন অধিকার প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার এবং গরীব প্রজার পক্ষে প্রবল জমিদারের বিরুদ্ধে নিজের অধিকার প্রমাণ করা খুবই দুরূহ ছিল। নূতন ব্যবস্থায় রায়তদের অনেক সুবিধা হইল।

অন্যদিকে জমিদারদেরও কিছু সুবিধা হইল। জমির উৎপন্ন শস্যের দাম বৃদ্ধি হইলে সেই অনুপাতে জমিদার খাজনা বৃদ্ধি করিতে পারিতেন। কিন্তু প্রজারা ন্যায্য বৃদ্ধি দিতেও স্বীকার করিত না। আদালতে উৎপন্ন শস্যের দাম যে-অনুপাতে বাড়িয়াছে খাজনাও সেই অনুপাতে বাড়ান হইয়াছে ইহা প্রমাণ করিতে বেগ পাইতে হইত। নূতন আইনে উৎপন্ন শস্যের মুল্যের তালিকা প্রস্তুত করার ব্যবস্থা হইল। সুতরাং ন্যায্য খাজনা বৃদ্ধি করিবার পক্ষে জমিদারের কোন বাধা রহিল না। জমিদার ও রায়তদের মধ্যে মামলা যাহাতে অল্প সময়ে ও সহজে নিস্পত্তি হয় নূতন আইনে তাহারও ব্যবস্থা করা হইল।

জমিদার ও প্রজার সংঘর্ষ প্রায় সর্বত্রই ঘটিত। কারণ জমিদারেরা অনেক স্থলে ন্যায্য খাজনার অতিরিক্ত অনেক দাবি করিতেন এবং প্রজাদের নিকট হইতে জোর করিয়া আদায় করিতেন। মাঝে মাঝে এই সংঘর্ষ গুরুতর হইয়া দাঁড়াইত। ১৮৭২ সনে পাবনা জিলার অনেক রায়ত একজন নেতার অধীনে দলবদ্ধ হইয়া ‘বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ক্রমে ক্রমে এই দলের সংখ্যা বৃদ্ধি হয় এবং তাহারা অনেক ঘরবাড়ী জ্বালাইয়া দেয় এবং লুটপাট করে। গভর্নমেন্ট এক ইস্তাহার জারি করিয়া প্রজাদিগকে এইসব হাঙ্গামা বন্ধ করিতে এবং জমিদারদিগকেও অন্যায্য দাবি প্রত্যাহার করিতে বলেন। সরকারের এই নিরপেক্ষ ব্যবহারের ফলে হাঙ্গামা থামিয়া যায়। কিন্তু প্রজাগণ দলবদ্ধ হইয়া আন্দোলন করিতে অভ্যস্ত হয়। ইহাতে গভর্নমেন্ট শঙ্কিত হইয়া ওঠেন এবং পূর্বোক্ত ভূমি-রাজস্ব আইন বিধিবদ্ধ করার ইহাও একটি কারণ।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা দেশে কয়েকবার ভীষণ ঘূর্ণবাতের (Cyclone) ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকের গুরুতর দুর্দশা ঘটিয়াছিল। ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই অক্টোবর, প্রবল ঘূর্ণবাত ও সামুদ্রিক জলোচ্ছাস হয়। কোন কোন স্থলে নদীর তরঙ্গ ৩০ ফুট উচ্চ হইয়া নদীর দুই কূলে ৮ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। কলিকাতার ১০০ পাকা বাড়ী ধ্বংস এবং পাঁচ-ছয়শত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪০,৬০০ খড়ের ঘর পড়িয়া যায়। হাওড়া, মেদিনীপুর ও চব্বিশ পরগণা জিলায় যথাক্রমে ২০০০ মানুষ ও ১২,০০০ পশু; ২০,০০০ মানুষ ও ৪০,০০০ পশু এবং ১০,০০০ মানুষ ও শতকরা ৮০টি পশু নিহত হয়। সাগরদ্বীপ একেবারে বিধ্বস্ত হয়, ইহার ৬০০০ অধিবাসীর মধ্যে ১৫০০ রক্ষা পায়। ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে ১৫-১৬ই অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গে ভীষণ ঘূর্ণবাতের ফলে মেদিনীপুর জেলার ৩০৪৯ জন মানুষ এবং ১৭,৫০০ গবাদি পশু নিহত হয়। বর্ধমান জিলায় খানা জংশনের কাছে একটি রেলওয়ে ট্রেন বাতাসের বেগে লাইনচ্যুত হয়, এবং ২১,০০০ গৃহ ধ্বংস হয়। হুগলী, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া ও রাজসাহী জেলায় যথাক্রমে ৯, ২৯, ২৭, ৭, ও ৪ জন লোকের মৃত্যু হয়। এই ঘূর্ণবাত গঙ্গা পার হইয়া রাজসাহীর দিকে যায় এবং গঙ্গানদীতে বহু নৌকা ডুবিয়া যায়। সরকারী বিবরণ অনুসারে মৃতদের সংখ্যা ছিল মোট ৩৩৯২, কিন্তু সম্ভবতঃ আরও অনেক বেশীসংখ্যক লোকের মৃত্যু হইয়াছিল। [১]

১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে অক্টোবর মেঘনা নদীর মোহনার নিকটে নদীর দুইতীরে এবং সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও দক্ষিণ শাবাজপুর প্রভৃতি দ্বীপে ঘূর্ণবাত ও ঝড়ের বেগে সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে নদীর ঢেউ ১০। ১২ ফুট বা তাহার চেয়েও উঁচুতে ওঠায় তিন হাজার বর্গমাইল পরিমিত স্থানের ১০,৬২,০০০ অধিবাসীদের মধ্যে ২,১৫,০০০ –সম্ভবতঃ আরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়। মৃত গবাদি পশুর সংখ্যাও ছিল খুব বেশি। কোন কোন গ্রামের মোট অধিবাসীদের শতকরা ৩০, ৫০, এমনকি ৭০ জনেরও প্রাণনাশ হইয়াছিল।

১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলায় ঘূর্ণবাত ও উচ্চ নদীতরঙ্গের ফলে ১৪,০০০ লোকের ও ১৫,০০০ গবাদি পশুর মৃত্যু হয়।

১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই জুন সমগ্র বঙ্গদেশে যে ভীষণ ভূমিকম্প হয় ইহার পূর্বে আর কখনও সেরূপ হইয়াছিল বলিয়া জানা যায় না। উত্তরবঙ্গে ইহার প্রকোপ ছিল খুব বেশি। ১৩৫ জন লোকের মৃত্যু হয়। বহু ঘরবাড়ী ধ্বংস হয়।

১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা দেশের নিম্নশ্রেণীর অবস্থা নির্ণয় করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত করা হয়। ইহাতে দেখা যায় যে বাংলার শ্রমজীবীগণের অবস্থা মোটামুটি ভাল এবং তাহাদের মোটা ভাত মোটা কাপড়ের সংস্থান আছে। তাহাদের তুলনায় বিহারের ঐ শ্রেণীর লোকের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। [৩]

কিন্তু ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় বাংলা দেশের কোন কোন অঞ্চলেও মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত এবং তাহার প্রতিরোধের জন্য ভারত-সরকার নানারূপ ব্যবস্থা করিতেন। ১৮৬৭, ১৮৭৩-৪, এবং ১৮৯৬-৭ খ্রী. ব্যাপকভাবে দুর্ভিক্ষ হয়। বর্ষাকালে যথেষ্ট বৃষ্টি না-হওয়াতে ফসলের অপ্রাচুর্যই এই সমুদয় দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ কারণ। কিন্তু প্রকৃত কারণ এই যে, সমুদয় স্বাভাবিক দৈব দুর্বিপাকের জন্য পূর্বেই প্রস্তুত থাকার মত শস্য বা অর্থ সঞ্চয় সাধারণ লোকের সাধ্য ছিল না।

১৮৬১-৬২ সনের শেষে ইষ্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ের হাওড়া হইতে মুঙ্গের পর্যন্ত লাইন খোলা হয়। ১৮৬২ সনে কলিকাতা হইতে কুষ্ঠিয়া ও ক্যানিং টাউন পর্যন্ত দুইটি পৃথক রেললাইন ভোসলা হয়। ১৮৭১-৭২ সনে উত্তরবাংলার মধ্যদিয়া দার্জিলিং পর্যন্ত রেললাইন খুলিবার প্রস্তাব মঞ্জুর হয় ও কার্য আরম্ভ হয়। ১৮৮১ ৮২ সনের পূর্বেই নিম্নলিখিত রেলওয়ে লাইনগুলি ভোসলা হয়।

১। Northern Bengal State Railway (ইহা পরে দিনাজপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়)।

২। Darjeeling Himalayan Railway.

৩। Calcutta and South-Eastern State Railway (ইহা পরে ডায়মণ্ডহার্বার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়)।

৪। Central Bengal Railway (যশোহর হইয়া খুলনা পর্যন্ত)। ১৮৮৭ সনের পূর্বেই কুমিল্লা হইতে কাছাড়, বৈদ্যবাটি-তারকেশ্বর, বর্ধমান কাটোয়া, মেদিনীপুর-পুরী, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-মৈয়মনসিং প্রভৃতি রেলওয়ে লাইন খোলা হয় এবং নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ ষ্টীমার লাইন খোলা হয়। মোটের উপর বাংলা দেশের প্রায় সবগুলি রেললাইনই ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হইবার আগে খোলা হয়।

৫. পৌর প্রতিষ্ঠান ও স্বায়ত্তশাসন

(ক) কলিকাতা শহরের উন্নতি

সতরো শতকের শেষভাগে গঙ্গার তীরবর্তী তিনখানি গ্রামের জমিদারীস্বত্ব ক্রয় করিয়া ইংরেজ কোম্পানি কলিকাতা শহরের পত্তন করে তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তারপর ধীরে ধীরে নূতন নূতন পার্শ্ববর্তী গ্রাম ইহার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় আঠারো ও উনিশ শতকে কলিকাতা বড় হইয়া বর্তমান আকার ধারণ করিয়াছে। ১৭৭৯ সনেও দক্ষিণে খিদিরপুর নালা, পশ্চিমে গঙ্গা এবং পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ‘মারহাট্টা ডিচ’ (বর্তমান সার্কুলার রোড) ছিল ইহার সীমানা। ‘ডিহি পঞ্চান্নগ্রাম’ এই নামটি কলিকাতা শহরের পূর্ব অবস্থা স্মরণ করাইয়া দেয়। এন্টালি, বেনিয়াপুকুর, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ প্রভৃতি অনেক অঞ্চল উনিশ শতকে কলিকাতা নগরের সীমানাভুক্ত করা হয়। [৩]

কলিকাতা প্রথমে খুব অস্বাস্থ্যকর স্থান ছিল। এখন যেখানে গড়ের মাঠ সেখানে জঙ্গলে হিংস্র জন্তুর আবাস ছিল। চোর-ডাকাতের ভয়ও ছিল। এখন যেখানে চৌরঙ্গী রোড, সেই পথ দিয়া কলিকাতা হইতে দক্ষিণে কালীঘাটের দিকে যাইতে হইলে শান্ত্রী পাহারা ছাড়া পথচলা নিরাপদ ছিল না। সমুদ্রের লোনা জল বর্তমান শহরের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত আসিত এবং এখান হইতে একটি ক্ষুদ্র নালা দিয়া গঙ্গানদীতে পড়িত। বর্তমান কালের Salt Lake ও Creek Row নামক ক্ষুদ্র গলি (সুবোধ মল্লিক পার্কের পূর্বে) এখনও তাহার স্মৃতি বহন করিতেছে। শহরের নর্দমাগুলি প্রায়ই ময়লা জলে ভর্তি থাকিয়া স্বাস্থ্যের হানি ঘটাইত। কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখিয়াছেন : “দিনে মশা, রেতে মাছি, এই নিয়ে কলকাতায় আছি।”

সাহেবরা যে-পাড়ায় থাকিতেন তাহা অপেক্ষাকৃত ভাল ছিল। ১৮৪৯ সনে সম্বাদ ভাস্বর লিখিয়াছে : “বাঙ্গালী পাড়ার প্রতি পথের পার্শ্বে পার্শ্বে নর্দমার কত ময়লা উদ্ধৃত হইয়াছে; এক এক পথের উভয় পার্শ্বে স্থানে স্থানে পৰ্ব্বতাকার এমত ময়লা রহিয়াছে পথিকেরা এরূপ কখন দেখেন নাই…শিমলার পরিসর পথের উভয় পার্শ্বেই যখন নর্দমার ময়লায় পরিপূর্ণ হইয়াছিল, তখন গলিপথের দশা সহসাই বোধগম্য হইবে।” [8]

১৫ বৎসর পরেও-যে স্বাস্থ্যের দিক দিয়া কলিকাতায় বিশেষ উন্নতি হয় নাই ১৮৬৪ সনে স্বাস্থ্য কমিশনের সভাপতি সার জন ষ্ট্ৰাচীর মন্তব্য হইতে তাহা বোঝা যায়। ইহার সারমর্ম উদ্ধৃত করিতেছি :

“কলিকাতা শহরের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা সম্বন্ধে বহুদিন হইতেই অভিযোগ শোনা যাইতেছে। কিন্তু বর্তমানে ইহা চূড়ান্তে পৌঁছিয়াছে। দক্ষিণ কলিকাতায় যে অঞ্চলে বড় বড় বাড়ীতে সাহেবরা থাকেন তাহার অবস্থাও অতিশয় খারাপ। আর উত্তর কলিকাতা যেখানে লক্ষাধিক এদেশীয় লোকে বাস করে সেখানকার শোচনীয় অবস্থা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। ভারতের অন্যান্য শহরে বা পৃথিবীর যে-কোন শহরের সবচেয়ে নোংরা যে-অঞ্চল আমি দেখিয়াছি তাহার সহিত এক মুহূর্তের জন্যও কলিকাতার কুৎসিত অবস্থার তুলনা হইতে পারে না। যদি উত্তর কলিকাতার রাস্তার খোলা নর্দমায় যেভাবে ময়লা জমিয়া পচিয়া পূতিগন্ধময় বায়ুর সৃষ্টি করে তাহার সঠিক বিবরণ বিলাতের কোন কাগজে প্রকাশিত হয় তবে লোকে তাহা বিশ্বাস করিবে না। শহরের অবস্থা যেমন, যে নদীর তীরে ইহা অবস্থিত তাহার অবস্থাও তদ্রূপ। এই নদীর জলই শহরের অধিকাংশ লোক পান করে, অথচ প্রতি বৎসর পাঁচ হাজার মৃতদেহ কলিকাতা হইতে নদীগর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়। সরকারী হাসপাতাল হইতেই এক বছর দেড় হাজার মৃতদেহ ঐ নদীতে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছিল। আরও কত রকমে যে এই নদীর জল কলুষিত হয় তাহার, বর্ণনার প্রয়োজন নাই। ব্রিটিশ ভারতবর্ষের রাজধানী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহরের অন্যতম কলিকাতা কোন সুসভ্য জাতির পক্ষে নিন্দা ও লজ্জার বিষয় এবং ইহা সভ্য মানবজাতির বাসের অযোগ্য।” [৫]

কলিকাতার অধিবাসিগণও এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং এ-সম্বন্ধে অনেক আন্দোলন করেন। ইহার ফলে ১৮৮৪ সনের ১৪ই অগষ্ট গভর্নর একটি কমিটি নিয়োগ করেন এবং ইহার রিপোর্ট অনুযায়ী শহরের অনেক উন্নতি হয়। ১৮৮৮ সনে এক নূতন আইনের দ্বারা সাতটি শহরতলী কলিকাতা মিউনিসিপালিটির অন্তর্গত করা হয় এবং ইহার আয়তন ৬ বর্গমাইল হইতে ১১.৫ বর্গমাইল, অধিবাসীর সংখ্যা চারি লক্ষ হইতে ৫ লক্ষ ৮২ হাজার, এবং আয়ের পরিমাণ ২৮ লক্ষ হইতে ৩৪ লক্ষ টাকা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। [৬]

১৮৭০ সনে কলিকাতা শহরে কলের জল সরবরাহের ব্যবস্থা হয়। ইহার পূর্বের পাঁচ বৎসরে কলিকাতায় ১৮,৪২২ জন কলেরায় মারা যায়–কিন্তু পরের পাঁচ বৎসরে মৃত্যুসংখ্যা কমিয়া মাত্র ৫৯২২ হয়।

১৮৭৪ সনে হাওড়া পুলের (পুরাতন–অধুনা বিলুপ্ত) নির্মাণকার্য শেষ হয়। ইহাতেও কলিকাতা শহরের অশেষ উন্নতি সাধিত হয়।

কলিকাতা শহরের ক্রমশঃ উন্নতি বিধান বৃটিশরাজত্বে বাংলা দেশের ইতিহাসে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি কলিকাতার বাড়ীঘর ও গাড়ীর সংখ্যা সংবাদ প্রভাকরে এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে :৭

কলিকাতা নগরে ১৮৫০ সালে সর্বশুদ্ধ ২৬৫৬৫ বাটী নিরূপিত হয়। তদ্বিশেষ।

একতলা বাটী – ৫৯৫০

দোতালা বাটী – ৬৪৩৮

তেতালা বাটী – ৭২১

চৌতালা বাটী – ১০

পাঁচতলা বাটী – ১

খড়ুয়া ঘর – ৪৯৪৪৫

ভূমি – ১৫১৪৪/বিঘা

ইহাতে প্রজার সংখ্যা – ৩৬১৩৬৯

দুই অশ্বে যোজিত চারিচাকার গাড়ী – ৬৭৬

এক অশ্বে যোজিত – ১৬৮৯

ছেকড়া ও অন্যান্য গাড়ী – ১৩৯১

দুই চাকার গাড়ী – ৮৬৪

সোয়ারি পনি ঘোড়া – ৪২৬

গাড়ী টানা বড় ঘোড়া – ২৮৫০

গাড়ী টানা টাটু ঘোড়া – ২০০৩

ইহার তিন বৎসর পরে সংবাদ প্রভাকরের নিম্নলিখিত মন্তব্যটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য কারণ ইহা হইতে বোঝা যায় যে একশত বৎসর পূর্বেও পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীরা শহরের অন্তর্ভুক্ত হইবার জন্য খুব ব্যগ্র ছিল না।

“আমারদিগের বর্তমান গবরনর জেনারেল সাহেব সংপ্রতি এরূপ মানস করিয়াছেন যে কলিকাতা নগরের সীমাবৃদ্ধি করিবেন। ভবানীপুর, কালীঘাট, চক্ৰবেড়ে, শিবাদহ, ইন্টালি, বৈঠকখানা, বরাহনগর, কাশীপুর, চিৎপুর, পাকপাড়া প্রভৃতি গ্রাম সকল নগরভুক্ত হইবেক। চারিজন ম্যাজিষ্ট্রেট চারি ভাগে অবস্থান পূৰ্ব্বক শান্তিকাৰ্য্য নিৰ্বাহ করিবেন। ছোট আদালতের বিচারপতিদিগের ক্ষমতা বাড়িবেক…কিন্তু এক বিষয়ে আমারদিগের শঙ্কা উপস্থিত হইতেছে, কলিকাতা নগরীর বসত বাটীর টেক্স গ্রহণের যে নিয়ম চলিত আছে ঐ নিয়ম উল্লেখিত গ্রামাদিতে প্রচলিত হইলে প্রজারা সুখানুভব করিবেন না। আর নাগৰ্য্য কমিসনের মহাশয়েরা যে সমস্ত বায়না অর্থাৎ নিয়মাদি এতন্নগরে প্রচার করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহারা নিরানন্দ হইবেন। পৰ্বাহ সময়ে আমারদিগের খোদাবন্দ প্রধান ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব যে যে হুকুম জারি করিয়া থাকেন তাহাতে তাহারা ক্লেশ বোধ করিবেন। এই কয়েক বিষয়ে নগরবাসিরা যে ক্লেশ ভোগ করিতেছে পার্শ্ববর্তি গ্রামনিচয় নিবাসি লোকেরা তাহা এ পর্যন্ত জানিতে পারেন নাই, কিন্তু মহানগর কলিকাতার সীমাবৃদ্ধি হইলেই তত্তাবৎ তাঁহারদিগকে অনুভব করিতে হইবেক।…

“নগরের সীমাবৃদ্ধি হইলে টেক্স অফিসের আয় বৃদ্ধি হইবেক, অতি কষ্টে প্রজাদিগকে টেক্সের টাকা প্রদান করিতে হইবেক, না দিলে তাহাদিগের রক্ষা থাকিবেক না, এদিকে রাস্তা মেরামত, নরদমা পরিষ্কার, আলোক প্রদান ও জল সেচন প্রভৃতি যে যে বিষয়ে রাজপুরুষেরা আইন নিবন্ধন দ্বারা প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, তাহা কিছুই হইবেক না, অতএব আমারদিগের গবরনর জেনারেল সাহেব নগরের সীমাবৃদ্ধি করণের যেরূপ মহদভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়াছেন সেইরূপ ইহার শোভা বৃদ্ধি বিষয়ে বিশিষ্টরূপ মনোযোগী হউন।…” [৮]

এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক ছিল না, কারণ বহু বৎসর পর্যন্ত কলিকাতা নগরে শাসন ও সংরক্ষণের সুব্যবস্থা হয় নাই।

(খ) স্বায়ত্তশাসন

প্রথমে কোম্পানির একজন কর্মচারী কলিকাতা শাসন করিতেন–তাহাকে বলা হইত জমিদার। ১৭২৭ সনে একজন মেয়র (Mayor) ও নয়জন অল্ডারম্যান (Aldermen) লইয়া গঠিত একটি পৌরসভা (Corporation) এবং একটি “Mayor’s Court” অর্থাৎ বিচারালয় স্থাপিত হয়। ১৭৯৪ সনে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক নিযুক্ত কয়েকজন জাষ্টিসেস্ অফ দি পিস্ (Justices of the Peace) বিচারকার্য ছাড়াও শহরের স্বাস্থ্যরক্ষা ও পুলিশের ব্যবস্থা করিতেন। তাঁহারা চৌকিদার, ঝাড়দার, মেথর প্রভৃতি নিযুক্ত করিতেন এবং শহরের বাড়ী ও জমির উপর কর আদায় করিয়া ইহার ব্যয় বহন করিতেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জাষ্টিসেরা এ-বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিতেন না এবং একজন চীফ ম্যাজিষ্ট্রেট এবং তাহার সহযোগী পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টকেই সব কাজ করিতে হইত। এইজন্য ১৮৪৭, ১৮৫২ ও ১৮৫৬ সনের আইনে কলিকাতা মিউনিসিপালিটির কার্যভার কয়েকজন বেতনভোগৗ কমিশনারের উপর ন্যস্ত করা হয় এবং বাড়ী, গাড়ী ও জল সরবরাহের উপর ট্যাক্স ধার্য করা হয়। ১৮৫৬ সনের আইনে কলিকাতায় গ্যাসের বাতি ও নর্দমার ব্যবস্থা করা হইল। ইহাতেও সুফল না-পাওয়ায় ১৮৬৩ সালের আইনে কলিকাতায় মিউনিসিপাল কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হইল। সকল জাষ্টিসেস অফ দি পিস্ ইহার সভ্য হইলেন কিন্তু কার্যকরী ক্ষমতা ইহার চেয়ারম্যানের হস্তে ন্যস্ত হইল। ইনি গভর্নমেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হইতেন এবং পুলিশ কমিশনারের কাজও করিতেন। সার স্টুয়ার্ট হগ চেয়ারম্যান হইয়া বাড়ী ও জলের কলের উপর কর বসাইয়া শহরের নর্দমা পরিষ্কার ও জল সরবরাহের সুব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু অন্য সদস্যেরা বিশেষ কোন কার্য না-করায় ১৮৭৬ সালে নূতন এক আইনে জাষ্টিসদের বদলে করদাতাগণের নির্বাচিত ৪৮ ও গভর্নমেন্ট মনোনীত ২৪ মোট ৭২ জন কমিশনার কলিকাতা কর্পোরেশনের সদস্য হইলেন। ১৮৮২ সালে নির্বাচিত কমিশনারের সংখ্যা দুইজন বাড়াইয়া ৫০ করা হইল এবং কলিকাতা শহরতলীর কতক অংশ কর্পোরেশনের অধিকারের মধ্যে আনা হইল।

বড়লাট লর্ড কার্জনের আমলে ১৮৯৯ সনে যে নূতন আইন হয় তাহাতে নির্বাচিত কমিশনারের সংখ্যা অর্ধেক করা হইল। বাকী ২৫ জনের মধ্যে বাংলা গভর্নমেন্ট ১৫ জন, বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স ও কলিকাতা ট্রেডস্ অ্যাসোসিয়েসন প্রত্যেকে চারিজন এবং কলিকাতা পোর্ট কমিশনার দুইজন মনোনীত করিবেন এইরূপ ব্যবস্থা হইল। গভর্নমেন্ট নিযুক্ত চেয়ারম্যানের হাতে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হইল এবং মিউনিসিপাল ট্যাক্সের পরিমাণ নির্ধারণ এবং সাধারণভাবে শাসনপ্রণালীর আলোচনা ছাড়া কর্পোরেশনের হাতে আর কোনও ক্ষমতা রহিল না। এইভাবে করদাতা নাগরিকগণের ক্ষমতা খর্ব করায় বিষম বিক্ষোভ উপস্থিত হইল। কংগ্রেসের সভাপতি রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁহার অভিভাষণে এবং স্বনামধন্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলে এইরূপে কলিকাতা নগরীর স্বায়ত্তশাসনের বিলোপের তীব্র প্রতিবাদ করিলেন। এই আইনের প্রতিবাদস্বরূপ কর্পোরেশনের ২৮ জন কমিশনার পদত্যাগ করিলেন। সুরেন্দ্রনাথও ইঁহাদের একজন ছিলেন। অমৃতলাল বসু “সাবাস আটাশ” নামে একখানি ক্ষুদ্র নাটকে হঁহাদের অভিনন্দন জানাইলেন। ইহা কলিকাতা রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইল। অদৃষ্টের অপূর্ব পরিহাসের দৃষ্টান্তস্বরূপ এস্থলে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, প্রায় পঁচিশ বৎসর পরে সুরেন্দ্রনাথই বাংলা দেশের মন্ত্রীরূপে কলিকাতা কর্পোরেশনে নাগরিকদের ক্ষমতা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য নূতন আইন প্রণয়ন করিয়াছিলেন।

১৮৫০ সনের ২৬ সংখ্যক আইনে কলিকাতার বাহিরেও কোন কোন শহরে মিউনিসিপ্যালটির প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৬৪ সনের ৩নং আইনে এবং ১৮৬৭ সনের পরিবর্তনে (amendment) ইহাদের সম্বন্ধে সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা হয়। সরকারের মনোনীত অন্যূন ৭ জন অধিবাসী, এবং বিভাগীয় কমিশনার, জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেন্ট ও একজিকিউটিভ ইঞ্জিনীয়ার, মিউসিপাল সভার সদস্য এবং জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট সভাপতি (Chairman) হন। বাড়ী, ঘর, জায়গা, জমি, গাড়ী, ঘোড়া, ব্যবসাবাণিজ্য প্রভৃতির উপর ট্যাক্স বসাইবার ক্ষমতা মিউনিসিপ্যালিটিকে দেওয়া হয়।

কলিকাতার বাহিরে মফঃস্বলের উন্নতি বিষয়ে গভর্নমেন্ট প্রথমে খুব দৃষ্টি দেন নাই। ইংরেজ সরকার প্রথম প্রথম রাজস্ব-আদায় ও শান্তিরক্ষার দিকেই মনোযোগ দিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াতের ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি ছিল না এবং কতকটা অর্থের অভাবেও বিশেষ কিছু করা সম্ভব হয় নাই। বেন্টিঙ্কের আমলে শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু তৎপরতা দেখা যায়। অবশেষে স্থির হয় যে লোকের নিকট হইতে, রাস্তা ঘাট নির্মাণ, শিক্ষাবিস্তার ও স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কর আদায় করিয়া তাহাদের হাতেই ইহার ভার দেওয়া হউক। এই উদ্দেশ্যে ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে এক আইন পাশ হয়। ইহাতে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, প্রতি জিলায় ম্যাজিষ্ট্রেট একট জিলা বোর্ড গঠিত করিবেন-ইহার সদস্যেরা ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক মনোনীত হইবে –কিন্তু ইহার এক-তৃতীয়াংশের বেশি সরকারী কর্মচারী হইবে না। এই কমিটি রোডসেস্ (পথ কর) আদায় করিয়া রাস্তাঘাট নির্মাণ করিবেন। ম্যাজিষ্ট্রেট ইহার সভাপতি থাকিবেন।

এইগুলির মধ্যদিয়া যাহাতে ভারতবাসী স্বায়ত্তশাসন প্রণালী শিক্ষা করিতে পারে তাহার জন্য বড়লাট লর্ড রিপন নির্বাচিত বেসরকারী সদস্যের সংখ্যা বাড়াইয়া যাহাতে প্রতি বোর্ডে তাহাদেরই সংখ্যাধিক্য থাকে এইরূপ ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। তিনি এই অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করিয়াছিলেন যে, যথাসম্ভব বেসরকারী ব্যক্তিরাই এই সমুদয় বোর্ডের চেয়ারম্যান হইবেন। কিন্তু সাধারণতঃ জিলা ম্যাজিষ্ট্রেটই ইহাদের উপর কর্তৃত্ব করিতেন–সুতরাং লর্ড রিপনের মহান উদ্দেশ্য সফল হয় নাই। তথাপি ১৮৮২ সালে এই বিষয়ে লর্ড রিপন যে বিস্তৃত মন্তব্য করেন তাহাই ভবিষ্যতে বাংলা তথা ভারতের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের আদর্শ ও মূল ভিত্তিরূপে গৃহীত হইয়াছে।

লর্ড রিপনের মন্তব্য কার্যে পরিণত করিবার জন্য ১৮৮৫ সনে এক নূতন আইন পাশ হয়। ইহাতে প্রতি জিলায় জিলা বোর্ড এবং ইহার অধীনে অনেক মহকুমায় লোকাল বোর্ড স্থাপনের প্রস্তাব হয়। লোকাল বোর্ডের সদস্যদের তিন চতুর্থাংশ নির্বাচিত হইবে এবং লোকাল বোর্ড জিলা বোর্ডের অন্তত অর্ধেক সদস্য নির্বাচন করিবে। জিলা বোর্ডের হাতে রাস্তাঘাট ও হাসপাতাল, দুর্ভিক্ষে সাহায্য প্রভৃতি বিষয়ে অনেক ক্ষমতা দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থাও করা হয়। ট্রামওয়ে, রেলপথ, জলের কল এবং সরকারী গৃহ নির্মাণের ক্ষমতা এবং প্রাথমিক ও মধ্য বাংলা বিদ্যালয় চালাইবার সম্পূর্ণ ভারও জিলা বোর্ডের হাতে দেওয়া হয়। যদিও চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল তথাপি বরাবরই জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট জিলা বোর্ডের এবং মহকুমা-ম্যাজিষ্ট্রেট লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হইতেন।

৬. ইংরেজী শিক্ষার প্রসার

বাংলা দেশে একজন লেটেনান্ট গভর্নরের অধীনে স্বতন্ত্রভাবে শাসনের ব্যবস্থা হইবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিলাতের কোর্ট অব ডিরেক্টরস্ বঙ্গদেশে তথা ভারতে যে নূতন শিক্ষানীতির প্রবর্তন করেন তাহা এদেশে শিক্ষার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া আছে। ১৮৫৪ সনের ১লা মে বাংলার প্রথম লেফটেনান্ট গভর্নর সারু ফ্রেডারিক জেম্স্ হ্যাঁলিডে কার্যভার গ্রহণ করেন। ঐ বৎসর ১৯শে জুলাই বিলাতে বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি সারু চার্লস্ উড (Sir Charles Wood) তাঁহার প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিষয়ক অনুশাসন (Education Despatch) লিপিবদ্ধ করেন। ইহাতে এদেশে ইংরেজী ও দেশীয় ভাষায় শিক্ষার উন্নতি ও প্রসারের উদ্দেশ্যে যে সমুদয় প্রস্তাব করা হয় তাহা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ হইল :

(১) শিক্ষার জন্য একটি পৃথক শাসন-বিভাগের (Separate Department of the administration for education) সৃষ্টি।

(২) কলিকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।

(৩) সকল শ্রেণীর বিদ্যালয়ের (School) শিক্ষকের শিক্ষার নিমিত্ত নূতন প্রতিষ্ঠান স্থাপন।

(৪) বর্তমানে যে-সকল সরকারী স্কুল ও কলেজ আছে তাহার পরিচালনার সুব্যবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে তাহাদের সংখ্যা বৃদ্ধি।

(৫) নূতন নূতন মাধ্যমিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা।

(৬) প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যে-সকল পাঠশালা আছে তাহাদের উন্নতি সাধন।

(৭) বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারী অর্থসাহায্য দানের ব্যবস্থা। ইহা কোন বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ে আবদ্ধ হইবে না।

(৮) সাধারণ লোকের জীবিকা উপার্জনের উপযোগী কারিগরী শিক্ষার ব্যবস্থা।

(৯) মেধাবী ছাত্রেরা যাহাতে ক্রমশঃ উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারে তাহার জন্য বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা।

(১০) উচ্চশিক্ষা ইংরেজীভাষার মাধ্যমে এবং প্রাথমিক ও নিম্নশ্রেণীর শিক্ষা বাংলাভাষার মাধ্যমে দেওয়া হইবে।

(১১) স্ত্রী-শিক্ষার উন্নতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ও সরকারী সাহায্য দান।

(১২) সরকারী পদে নিয়োগের জন্য শিক্ষার প্রাধান্য স্বীকার–অর্থাৎ সকলপ্রকার সরকারী চাকুরীতেই অশিক্ষিত অপেক্ষা শিক্ষিতের অধিকতর দাবী থাকিবে।

এই সমুদয় প্রস্তাব অনুসারে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইল। এখানে সাধারণ শিক্ষা (Arts), আইন, ডাক্তারী ও ইঞ্জিনীয়ারিং শিক্ষার জন্য পরীক্ষা গ্রহণ ও ডিগ্রী প্রদানের ব্যবস্থা করা হইল। কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজকে আদর্শ কলেজে পরিণত করার জন্য ইহার অনেক উন্নতি সাধিত হইল।

১৮৫৯ সনের ৭ই এপ্রিল তারিখের শিক্ষাসম্বন্ধীয় বিবরণী হইতে জানা যায় যে, বিগত পাঁচবৎসরে বাংলা দেশে সরকারী সাহায্যে ইংরেজী উচচ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উন্নতি হইয়াছে ও সংখ্যা বাড়িয়াছে, কিন্তু সাধারণের আগ্রহের অভাবে প্রাথমিক শিক্ষার কোন উন্নতি বা প্রসার হয় নাই। ইহার প্রতিকারের জন্য লেফটেনান্ট গভর্নর সার জন পিটার গ্র্যান্ট দেশীয় ২৫ জন ভদ্রলোকের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া এক সুদীর্ঘ মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন (১৯শে অক্টোবর ১৮৬০ খ্র.)। তিনি স্বীকার করেন যে এই সমুদয় প্রাথমিক পাঠশালার ঘরগুলির অবস্থা শোচনীয়; ‘গুরু’দিগের বিদ্যাবুদ্ধি যে-পরিমাণে কম, কুসংস্কার সেই পরিমাণে বেশি; পাঠ্যপুস্তকের অভাব; শিক্ষার মান খুবই নিম্ন ও শিক্ষার্থীদের দারিদ্র্য খুবই বেশি। কিন্তু তথাপি তিনি যে ৩০,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে তাহা উঠাইয়া না দিয়া প্রতি জিলায় কতকগুলি (গড়ে একশত) বিদ্যালয়কে সরকারী দানের সাহায্যে উন্নত করা এবং ৬টি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন ও চারি জন সাব ইনসপেকটর নিয়োগের প্রস্তাব করেন। ইহার জন্য প্রতিবৎসর মোট ১২,০০০ টাকা নিম্নলিখিতরূপে ব্যয়ের বরাদ্দ হয়—

১০০ স্কুলে সাহায্য … — ৫০০০ টাকা

৬টি আদর্শ বিদ্যালয় মাসিক ৩০ টাকা হি. — ২১৬০ টাকা

৪ জন সাব-ইনসৃপেকটর মাসিক ১০০ টাকা — ৪৮০০ টাকা

১২,৯৬০ টাকা

ইহা ছাড়া প্রতি বিদ্যালয়ে সস্তায় পুস্তক সরবরাহ করারও ব্যবস্থা হয়। এ-পর্যন্ত যাহা কেবল মুখে-মুখে শিক্ষা দেওয়া হইত–এই সকল পুস্তকের সাহায্যে ছাত্রেরা তাহা শিখিতে পারিবে। অর্থাৎ ইহাতে গণিত, কৃষি ও ব্যবসায় সংক্রান্ত সহজ হিসাব, চুক্তিপত্র, খত, দলিল ও সাধারণ চিঠিপত্র লেখা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা থাকিবে।

কয়েক বৎসর পরে এইসকল বিদ্যালয়ের গুরুদিগের শিক্ষার জন্য বর্ধমান, কৃষ্ণনগর ও যশোহরে নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

লেফটেনান্ট গভর্নর সার জর্জ ক্যাম্পবেল (১৮৭১-৭৪ খ্রী.) প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি-বিধানের জন্য অনেক চেষ্টা করেন। তিনি প্রতি গ্রাম্য পাঠশালায় মাসিক পাঁচ টাকা সাহায্য করেন, এবং যেখানে পাঠশালা নাই সেখানে নূতন পাঠশালা ঐ পরিমাণ অর্থব্যয়ে স্থাপন করেন। ১৮৭২ সনের ৩১শে মার্চ সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত পাঠশালার সংখ্যা ছিল ২৪৫১ এবং মোট ছাত্রসংখ্যা ছিল ৬৪,৭৭৯। মোট সরকারী ব্যয়ের পরিমাণ ছিল বার্ষিক ১,৩০,০০০ টাকা। সার জর্জ আরও চারি লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেন। ১৮৭৩ সনের শেষে মোট প্রাথমিক শিক্ষার ব্যয়ের পরিমাণ ছিল আট লক্ষ টাকা-১০,৭৮৭ গ্রাম্য পাঠশালায় ২,৫৫,৭২৮ জন ছাত্র পড়িত। পর বৎসরে ইহাদের সংখ্যা বাড়িয়া হয় যথাক্রমে ১২,২২৯ এবং ৩,০৩,৪৩৭। ১৮৭৫-৭৬ সনে এই সংখ্যা ছিল ১৫,৯৬০ ও ৪,৯৫,৫৮৫; এবং ১৮৯৩ সনে ৪৭,৫২৫ ও ১১,২২,৯৩০।

ভারত-সরকার ইংরেজী স্কুলের শিক্ষার ব্যয় কমাইবার জন্য ছাত্রদের বেতনবৃদ্ধির প্রস্তাব করেন–কিন্তু বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর ইহার প্রতিবাদ করেন। মোটের উপর বাংলার গভর্নমেন্ট শিক্ষার উন্নতি সম্বন্ধে সর্বদাই যত্নশীল ছিলেন এবং প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে টেকনিক্যাল স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন। হুগলী ও ঢাকায় সার্ভে স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়। লেফটেনান্ট গভর্নর সার রিচার্ড টেম্পল (১৮৭৪-১৮৭৭ খ্রী.) বিজ্ঞানশিক্ষার উন্নতির ব্যবস্থা করেন এবং শিল্পবিদ্যালয়ের (School of Art) সঙ্গে একটি ছবির গ্যালারী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮০ সনে প্রেসিডেন্সী কলেজের ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগ তুলিয়া দিয়া শিবপুরে বর্তমান ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়।

১৮৮২ সনে ভারত-সরকার শিক্ষার অবস্থা সম্বন্ধে তদন্ত করিবার জন্য একটি কমিশন নিযুক্ত করেন। ইহার সভাপতি ছিলেন সার উইলিয়ম উইলসন হান্টার (Sir William Wilson Hunter)। ১৮৮৩ সনে এই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ইহাতে বাংলা দেশে শিক্ষার ব্যবস্থার গুরুতর কোন পরিবর্তন হয় নাই। বহরমপুরে ও মেদিনীপুরে যে দুইটি সরকারী কলেজ ছিল তাহা বেসরকারী কলেজে পরিণত হয়। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বাৎসরিক দশ লক্ষ টাকা ব্যয়ের প্রস্ত বি আপাততঃ মুলতুবী রাখা হয়।

১৮৯৬-৯৭ সনে শিক্ষাবিভাগের চাকুরীর নূতন ব্যবস্থা হয়। উচ্চতর বিভাগের নাম হয় “ভারতীয় শিক্ষা বিভাগ” ও নিম্নতর বিভাগের নাম হয় “প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগ”। উচ্চতর বিভাগের কর্মচারীরা বিলাতে নিযুক্ত হইতেন। প্রাদেশিক শিক্ষাবিভাগেরও আবার দুইটি স্তর ছিল–উভয় স্তরের কর্মচারীকেই এদেশের গভর্নমেন্ট নিযুক্ত করিত। ভারতীয় শিক্ষাবিভাগের কর্মচারীরা অধ্যাপক (Professor) ও ইনসপেকটর (Inspector) পদে নিযুক্ত হইতেন এবং তাঁহাদের বেতনের হার ছিল–প্রথম পাঁচ বৎসর অস্থায়ী ভাবে (on probation) থাকাকালীন মাসিক ৫০০-৫০-৭০০; পরে ৭৫০-৫০-১০০০। ইহা ছাড়া কোন কোন পদের অতিরিক্ত ভাতা (allowance) ছিল মাসিক ২৫০ হইতে ৫০০ টাকা। উচ্চতর প্রাদেশিক স্তরের বেতন ধার্য হইল প্রতি মাসে ১৫০ হইতে ৭০০ টাকা ইঁহারা অধ্যাপক, ইনসপেকটর ও সহকারী ইনসপেকটর পদে নিযুক্ত হইতেন। জিলা স্কুলের হেডমাষ্টার, ডেপুটি ইনসপেকটর প্রভৃতি নিম্ন প্রাদেশিক স্তরের কর্মচারীদের সর্বোচ্চ বেতন ছিল মাসিক ২০০ কি ২৫০ টাকা। [৯]

এই ব্যবস্থার ফলে কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রয়ের মত মনস্বীরাও প্রাদেশিক বিভাগে নিযুক্ত হইয়াছিলেন–বিলাত হইতে সদ্য আগত, অনেক স্থলেই অখ্যাত, তরুণবয়স্ক ইংরেজ অধ্যাপকগণ উচ্চতর বিভাগে নিযুক্ত হইয়া তাঁহাদের উপর কর্তৃত্ব করিতেন। ভারতীয় মাত্রেই এই কুব্যবস্থার তীব্র প্রতিবাদ করিতেন এবং কোন কোন উচ্চপদস্থ বিলাতী রাজকর্মচারীও ইহার অযৌক্তিকতা সম্বন্ধে মন্তব্য করিয়াছেন। তথাপি এই ব্যবস্থা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল–তাহার পরেও কোন কোন স্থলে ব্যতিক্রম ঘটিলেও, সাধারণতঃ সাহেবরাই ভারতীয় শিক্ষাবিভাগে নিযুক্ত হইতেন–প্রভেদের মধ্যে কোন কোন ভারতীয় অধ্যাপক বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিলে পরিণত বয়সে ভারতীয় শিক্ষাবিভাগে উন্নীত হইতেন।

১৮৮৩ সনে স্ত্রীলোকদিগকে মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষালাভের অধিকার দেওয়া হয়। সার রিচার্ড টেম্পলের আমলের (১৮৭৪-৭৭ খ্রী.) এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং সাধারণের অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু ইহা কার্যে পরিণত হয় নাই। ১৮৮২ সনে পুনরায় প্রস্তাবটি আলোচিত হয়। জনসাধারণ ইহার অনুকূলে মত দিলেও এবং কয়েকজন ভদ্রলোক তাহাদের কন্যাদিগকে ভর্তি করিতে চাহিলেও Medical College Council স্ত্রীলোকদিগকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিতে অসম্মত হন। তখন লেফটেনান্ট গভর্নর সার রিভার্স টমসন (১৮৮২-৮৭ খ্র.) স্ত্রীলোকদিগের ভর্তির প্রস্তাব সমর্থন করিয়া সুদীর্ঘ মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। ইহার ফলে মেয়েরা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হইবার অধিকার লাভ করে।

***

পাদটীকা

১। Buckland, C. E.- Bengal under the Lieutenant Governor & pp. 298-9, 621..

২। ঐ, p. 864

৩। বিনয় ঘোষ, সাময়িক পত্রে সমাজ চিত্র, ১৫১৫-৬

৪। ঐ, ৩। ২৭৭

৫। Buckland p. 281

৬। ঐ, p. 820

৭। ঘোষ, ১।১৭৫

৮। ঐ, ১। ১৯৭

৯। Buckland, p.927

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *