১৪. আশ্বমেধিকপর্ব

আশ্বমেধিকপর্ব

॥ আমেধিকপর্বাধ্যায়॥

১। যুধিষ্ঠিরের পুনর্বার মনস্তাপ

ভীষ্মের উদ্দেশে তর্পণের পর ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রবর্তী করে যুধিষ্ঠির গঙ্গার তীরে উঠলেন এবং ব্যাকুল হয়ে অশ্রুপূর্ণনয়নে ভূপতিত হলেন। ভীম তাকে তুলে ধরলে কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, এমন করবেন না। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, ওঠ, তোমার কর্তব্য পালন কর; তুমি ক্ষত্রধর্মানুসারে পৃথিবী জয় করেছ, এখন ভ্রাতা ও সুহৃর্গের সঙ্গে ভোগ কর। তোমার শোকের কারণ নেই, গান্ধারী ও আমারই শোক করা উচিত, আমাদের শতপুত্র স্বপ্নলব্ধ ধনের ন্যায় বিনষ্ট হয়েছে। দিব্যদর্শী বিদুর আমাকে বলেছিলেন-মহারাজ, দুর্যোধনের অপরাধে আপনার কুলক্ষয় হবে; তাকে ত্যাগ করুন, কর্ণ আর শকুনির সঙ্গে তাকে মিশতে দেবেন না, ধর্মাত্ম যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করুন; আর তা যদি ইচ্ছা না করেন তবে স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করুন। দীর্ঘদর্শী বিদুরের এই উপদেশ আমি শুনিনি সেজন্যই শোকসাগরে নিমগ্ন হয়েছি। এখন তুমি এই দুঃখার্ত বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি দৃষ্টিপাত কর।

যুধিষ্ঠির নীরব হয়ে আছেন দেখে কৃষ্ণ তাকে বললেন, মহারাজ, অত্যন্ত শোক করলে পরলোকগত আত্মীয়গণ সন্তপ্ত হন। আপনি এখন প্রকৃতিস্থ হয়ে বিবিধ যজ্ঞ করুন, দেবগণ ও পিতৃগণকে তৃপ্ত করুন, অন্নাদি দান করে অতিথি ও দরিদ্রগণকে তুষ্ট করুন। যাঁরা যুদ্ধে মরেছেন তাদের আর আপনি দেখতে পাবেন না, অতএব শোক করা বৃথা। যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, গোবিন্দ, আমার উপর তোমার প্রীতি ও অনুকম্পা আছে তা জানি; তুমি সন্তুষ্টচিত্তে আমাকে বনগমনের অনুমতি দাও, পিতামহ ভীষ্ম ও পুরুষশ্রেষ্ঠ কর্ণের মৃত্যুর জন্য আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।

ব্যাসদেব বললেন, বৎস, তোমার বুদ্ধি পরিপক নয়, তাই বালকের ন্যায় মোহগ্রস্ত হচ্ছ, আমরা বার বার বৃথাই তোমাকে প্রবোধ দিয়েছি। তুমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম জান, মোক্ষধর্ম রাজধর্ম দানধর্ম এবং প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে উপদেশও সবিস্তারে শুনেছ; তথাপি তোমার সংশয় দূর হয়নি, তাতে মনে হয় আমাদের উপদেশে তোমার শ্রদ্ধা নেই, তোমায় স্মরণশক্তিও নেই। সর্বধর্মের তত্ত্ব জেনেও কেন তুমি অজ্ঞের ন্যায় মোহগ্রস্ত হচ্ছ? যদি নিজেকে পাপী মনে কর তবে আমি পাপনাশের উপায় বলছি শোন। তপস্যা যজ্ঞ ও দান করলে পাপমুক্ত হওয়া যায়, অতএব তুমি দশরথপুত্র রাম এবং তোমার : মন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরতের ন্যায় অশ্বমেধ যজ্ঞ করে প্রচুর দান কর।

যুধিষ্ঠির বললেন, দ্বিজোত্তম, অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে রাজারা নিশ্চয় পাপমুক্ত হন; কিন্তু আমার এমন বিত্ত নেই যা দান করে জ্ঞাতিবধের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি। এখন যে অল্পবয়স্ক নির্ধন রাজারা আছেন তাদের কাছেও আমি কিছু চাইতে পারব না। ব্যাসদেব ক্ষণকাল চিন্তা করে বললেন, কুন্তীপুত্র, তোমার শূন্য কোষ আবার পূর্ণ হবে। মরুত্ত রাজা তার যজ্ঞে যে বিপুল ধন ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছিলেন তা হিমালয় পর্বতে রয়েছে; সেই ধন তুমি নিয়ে এস। যুধিষ্ঠির বললেন, মরুত্ত রাজার যজ্ঞে কি করে ধন সঞ্চিত হয়েছিল? তিনি কোন্ সময়ে বর্তমান। ছিলেন?

২। মরুত্ত ও সংবর্ত

ব্যাসদেব বললেন, সত্যযুগে মনু দণ্ডধর রাজা ছিলেন, তাঁর প্রপৌত্র ইক্ষাকু। ইক্ষাকুরু শত পুত্র হয়েছিল, সকলকেই তিনি রাজপদে অভিষিক্ত করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র বিংশের পৌত্র খনীনেত্র সকলকে উৎপীড়িত করতেন সেজন্য প্রজারা তাকে অপসারিত করে তাঁর পুত্র সুবর্চাকে রাজা করেছিল। সুবর্চা পরম ধার্মিক ও প্রজারঞ্জক ছিলেন, কিন্তু কালক্রমে তার কোষ ও অশ্বগজাদি ক্ষয় পাওয়ায় সামন্তরাজগণ তাকে নির্যাতিত করতে লাগলেন। তখন তিনি তার হস্তে ফুৎকার দিয়ে সৈন্যদল সৃষ্টি করে বিপক্ষ রাজগণকে পরাস্ত করলেন। এই কারণে তিনি করন্ধন (১) নামে খ্যাত হন। ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে তাঁর অবিক্ষিৎ নামে একটি সর্বগুণান্বিত পুত্র হয়েছিল। অবিক্ষিতের পুত্র মহাবলশালী দ্বিতীয় বিষ্ণু স্বরূপ রাজচক্রবর্তী মরুত্ত। ধর্মাত্মা মরুত্ত হিমালয়ের উত্তরস্থ মেরু পর্বতে এক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তার আজ্ঞায় স্বর্ণকারগণ স্বর্ণময় কুণ্ড পায় স্থালী ও আসন এত প্রস্তুত করেছিল যে তার সংখ্যা হয় না।

বৃহস্পতি ও সংবর্ত দুজনেই মহর্ষি অঙ্গিরার পুত্র, কিন্তু তারা পৃথক থাকতেন এবং পরস্পর স্পর্ধা করতেন। বৃহস্পতির উৎপীড়ে সংবর্ত সর্বস্ব ত্যাগ করে দিগম্বর হয়ে বনে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। এই সময়ে অসুরবিজয়ী ইন্দ্র বৃহস্পতিকে নিজের পুরোহিত করলেন। মহর্ষি অঙ্গিরা করন্ধমের কুল-পুরোহিত ছিলেন। করন্ধমের পৌত্র মহারাজ মরুত্তের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ইন্দ্র বৃহস্পতিকে বললেন, আমি ত্রিলোকের অধীশ্বর, আর মরুত্ত কেবল পৃথিবীর রাজা; আপনি আমাদের দুজনের পৌরোহিত্য করতে পাবেন না। বৃহস্পতি বললেন, দেবরাজ, আশ্বস্ত হও, আমি প্রতিজ্ঞা করছি মর্তবাসী মরুত্তের পৌরোহিত্য করব না।

মরুত্ত তার যজ্ঞের আয়োজন করে বৃহস্পতির কাছে এসে বললেন, ভগবান, আপনি পূর্বে আমাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তদনুসারে আমি যজ্ঞের সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করেছি। আমি আপনার যজমান, আপনি আমার যজ্ঞ সম্পাদন করুন। বৃহস্পতি বললেন, মহারাজ, আমি দেবরাজ ইন্দ্রকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে মনুষ্যের যাজন করব না, অতএব তুমি অন্য কাকেও পৌরোহিত্যে বরণ কর। মরুত্ত লজ্জিত ও উদবিগ্ন হয়ে ফিরে গেলেন এবং পথে দেবর্ষি নারদকে দেখতে পেলেন। নারদ তঁকে বললেন, মহারাজ, অগ্নিরার কনিষ্ঠ পুত্র ধর্মাত্মা সংবর্ত দিগম্বর হয়ে উন্মত্তের ন্যায় বিচরণ করছেন, মহেশ্বরের দর্শন কামনায় তিনি এখন বারাণসীতে আছেন। তুমি সেই পুরীর দ্বারদেশে একটি মৃতদেহ রাখ; সংবর্ত সেই মৃতদেহ দেখে যেখানেই যান তুমি তার অনুগমন করবে এবং কোনও নির্জন স্থানে কৃতাঞ্জলি হয়ে তঁর শরণ নেবে। তিনি জিজ্ঞাসা করলে বলবে-নারদ আপনার সন্ধান বলেছেন। যদি তিনি আমাকে অন্বেষণ করতে চান তবে বলবে যে নারদ অগ্নিপ্রবেশ করেছেন।

নারদের উপদেশ অনুসারে মরুত্ত বারাণসীতে গেলেন এবং পুরীর দ্বারদেশে একটি শব রাখলেন। সেই সময়ে সংবর্ত সেখানে এলেন এবং শব দেখেই ফিরলেন। মরুত্ত কৃতাঞ্জলি হয়ে তার অনুসরণ করে এক নির্জন স্থানে উপস্থিত হলেন। রাজাকে দেখে সংবর্ত তার গাত্রে ধূলি কদম শ্লেষ্ম ও নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করতে লাগলেন, তথাপি রাজা নিরস্ত হলেন না। পরিশেষে সংবর্ত বললেন, সত্য বল কে তোমাকে আমার সন্ধান দিয়েছে। মরুত্ত বললেন, আপনি আমার গুরুপুত্র, আমি আপনার পরম ভক্ত; দেবর্ষি নারদ আপনার সন্ধান দিয়েছেন। সংবর্ত বললেন, নারদ জানেন যে আমি যাজ্ঞিক; তিনি এখন কোথায়? মরুত্ত বললেন, তিনি অগ্নিপ্রবেশ করেছেন। সংবর্ত তুষ্ট হয়ে বললেন, আমি তোমার যজ্ঞ করতে পারি। তার পর তিনি কঠোর বাক্যে ভৎসনা করে বললেন, আমি বায়ুরোগগ্রস্ত বিকৃতবেশধারী অস্থিরমতি; আমাকে দিয়ে যজ্ঞ করাতে চাও কেন? আমার অগ্রজ বৃহস্পতির কাছে যাও, তিনি আমার সমস্ত যজমান দেবতা ও গৃহস্থিত সামগ্রী নিয়েছেন, এখন আমার শরীর ভিন্ন নিজের কিছু নেই। তিনি আমার পূজনীয়, তার অনুমতি বিনা আমি তোমার যজ্ঞ করতে পারব না।

মরুত্ত জানালেন যে বৃহস্পতি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তখন সংবর্ত বললেন, আমি তোমার যজ্ঞ সম্পাদন করব, কিন্তু তাতে ইন্দ্র ও বৃহস্পতি তোমার উপর ক্রুদ্ধ হবেন। তুমি প্রতিজ্ঞা কর যে আমাকে পরিত্যাগ করবে না। মরুত্ত শপথ। করলে সংবর্ত বললেন, হিমালয়ের পৃষ্ঠে মুঞ্জবান নামে একটি পর্বত আছে, শূলপাণি মহেশ্বর উমার সহিত সেখানে বিহার করেন; রুদ্র সাধ্য প্রভৃতি গণদেব এবং ভূত পিশাচ গন্ধর্ব যক্ষ রাক্ষসাদি তাকে উপাসনা করেন। সেই পর্বতের চতুষ্পর্শে সূর্যরশ্মির ন্যায় দীপ্যমান সুবর্ণের আকর আছে। তুমি সেখানে গিয়ে মহাদেবের শরণাপন্ন হও, তিনি প্রসন্ন হলে তুমি সেই সুবর্ণ লাভ করবে।

সংবর্তের উপদেশ অনুসারে মরুত্ত মুঞ্জবান পর্বতে গেলেন এবং মহাদেবকে তুষ্ট করে সেই সুবর্ণরাশি নিয়ে যজ্ঞের আয়োজন করতে লাগলেন। তার আদেশে শিল্পিগণ বহু সুবর্ণময় আধার নির্মাণ করলে। মরুত্তের সমৃদ্ধির সংবাদ পেয়ে বৃহস্পতি সন্তপ্ত হলেন, তার শরীর কৃশ ও বিবর্ণ হতে লাগল। তিনি ইন্দ্রকে বললেন, যে উপায়ে হ’ক সংবর্ত ও মরুত্তকে দমন কর। ইন্দ্রের আদেশে বৃহস্পতিকে সঙ্গে নিয়ে অগ্নিদেব যজ্ঞস্থলে এসে মরুত্তকে বললেন, মহারাজ, ইন্দ্র তোমার প্রতি তুষ্ট হয়েছেন, তার আদেশে আমি বৃহস্পতিকে এনেছি, ইনিই যজ্ঞ সম্পাদন করে তোমাকে অমরত্ব দেবেন। মরুত্ত বললেন, সংবর্তই আমার যাজন করবেন; আমি কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করছি, বৃহস্পতি দেবরাজের পুরোহিত, আমার ন্যায় মানুষের যাজন করা তার শোভা পায় না। অগ্নি মরুত্তকে প্রলোভিত করবার বহু চেষ্টা করলেন; তখন সংবর্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, অগ্নি, তুমি চলে যাও, আবার যদি বৃহস্পতিকে নিয়ে এখানে আস তবে তোমাকে ভগ্ম করব।

অগ্নি ফিরে এলে ইন্দ্র তার কথা শুনে বললেন, তুমিই তো সকলকে দগ্ধ কর, তোমাকে সংবর্ত কি করে ভস্ম করবেন ? তোমার কথা অশ্রদ্ধেয়। তারপর ইন্দ্র গন্ধর্বরাজ ধৃতরাষ্ট্রকে মরুত্তের কাছে পাঠালেন। ধৃতরাষ্ট্র নিজের পরিচয় দিয়ে মরুত্তকে বললেন, মহারাজ, তুমি যদি বৃহস্পতিকে পুরোহিত না কর তবে ইন্দ্র তোমাকে বজ্রপ্রহার করবেন; ওই শোন, তিনি আকাশে সিংহনাদ করছেন। সংবর্ত মরুত্তকে বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাক, আমি সংস্তম্ভনী বিদ্যা দ্বারা তোমার ভয় নিবারণ করব। এই বলে সংবর্ত মন্ত্রপাঠ করে ইন্দ্রাদি দেবগণকে আহ্বান করলেন।

অনন্তর ইন্দ্র প্রভৃতি যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন, মরুত্ত ও সংবর্ত তাদের যথোচিত সংবর্ধনা করলেন। মরুত্ত বললেন, দেবরাজ, আপনাকে নমস্কার করছি, আপনার আগমনে আমার জীবন সফল হল। ইন্দ্র বললেন, তোমার গুরু মহাতেজা সংবর্তকে আমি জানি, এঁর আহ্বানেই আমি ক্রোধ ত্যাগ করে এখানে এসেছি। সংবর্ত বললেন, দেবরাজ, যদি প্রীত হয়ে থাকেন তবে আপনিই এই যজ্ঞের বিধান দিন এবং যজ্ঞভাগ নির্দেশ করুন। তখন ইন্দ্রের আদেশে দেবগণ অতি বিচিত্র ও সমৃদ্ধ যজ্ঞশালা নির্মাণ করলেন; মহাসমারোহে মরুত্তের যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হল। ইন্দ্র বললেন, মরুত্ত, আমরা তোমার পূজায় তুষ্ট হয়েছি; এখন ব্রাহ্মণগণ অগ্নির জন্য লোহিতবর্ণ, বিশ্বদেবগণের জন্য বিবিধবর্ণ, এবং অন্যান্য দেবগণের জন্য উচ্ছিশ্ন (উৎ-শিশ্ন) নীলবর্ণ (কৃষ্ণবর্ণ) পবিত্র বৃষ বধ করুন। যজ্ঞ সমাপ্ত হলে মরুত্ত ব্রাহ্মণগণকে রাশি রাশি সুবর্ণ দাল করলেন। তার পর তিনি প্রভূত বিত্ত কোষমধ্যে রক্ষা করে গুরুর আদেশে স্বভবনে ফিরে এলেন এবং সসাগরা পৃথিবী শাসন করতে লাগলেন।

এই ইতিহাস শেষ করে ব্যাস বললেন, যুধিষ্ঠির, তুমি মরুত্তের সঞ্চিত সুবর্ণরাশি নিয়ে এসে যজ্ঞ করে দেবগণকে তৃপ্ত কর।

** (১) যিনি হাতে ফু দেন।

৩। কামগীতা

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, সর্বপ্রকার কুটিলতাই মৃত্যুজনক এবং সরলতাই ব্রহ্মলাভের পন্থা;-জ্ঞাতব্য বিষয় শুধু এই, অন্য আলোচনা প্রলাপ মাত্র। মহারাজ, আপনার কার্য শেষ হয়নি, সকল শত্রুকেও আপনি জয় করেন নি, কারণ নিজের অভ্যন্তরস্থ অহংবুদ্ধি রূপ শত্রুকে আপনি জানতে পারছেন না। বোধহয় সুখ-দুঃখাদির দ্বারা আকৃষ্ট হওয়াই আপনার স্বভাব। আপনি যেসকল কষ্ট ভোগ করছেন তা স্মরণ করে নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করুন। এই যুদ্ধ একাকী করতে হয়, এতে অস্ত্র অনুচর বা বন্ধুর প্রয়োজন নেই। যদি নিজের মনকে জয় করতে না পারেন তবে আপনার অতি দুরবস্থা হবে। অতএব আপনি শোক ত্যাগ করে পিতৃপিতামহের অনুবর্তী হয়ে রাজ্যশাসন করুন। আমি পুরাবিৎ পণ্ডিতগণের কথিত কামগীতা বলছি শুনুন।-

কামনা বলেছেন, অনুপযুক্ত উপায়ে কেউ আমাকে বিনষ্ট করতে পারে না; যে অস্ত্র দ্বারা লোকে আমাকে জয় করতে চেষ্টা করে সেই অস্ত্রই আমার প্রভাবে বিফল হয়। যজ্ঞ দ্বারা যে আমাকে জয় করতে চায় তার মনে আমি জঙ্গমস্থ ব্যক্ত জীবাত্মা রূপে প্রকাশ পাই। বেদ-বেদাঙ্গ সাধন করে যে আমাকে জয় করতে চায় তার মনে স্থাবরস্থ অব্যক্ত জীবাত্মা রূপে আমি অধিষ্ঠান করি। ধৈর্য দ্বারা যে আমাকে পরাস্ত করতে চায় তার মনে আমি ভাব রূপে অবস্থান করি, সে আমার অস্তিত্ব জানতে পারে না। যে তপস্যা করে, তার মনে আমি তপ রূপেই থাকি। যে মোক্ষমার্গ অবলম্বন করে তাকে উদ্দেশ করে আমি হাস্য ও নৃত্য করি। আমি সনাতন এবং সর্বপ্রাণীর অবধ্য।

তারপর কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আপনি শোক সংবরণ করুন, নিহত বন্ধুগণকে বার বার স্মরণ করে বৃথা দুঃখভোগ করবেন না; কামনা ত্যাগ করে বিবিধ-দক্ষিণাযুক্ত অশ্বমেধ যজ্ঞ করুন, তার ফলে ইহইলোকে কীর্তি এবং পরলোকে উত্তম গতি লাভ করবেন।

কৃষ্ণ ব্যাস দেবস্থান নারদ প্রভৃতির উপদেশ শুনে যুধিষ্ঠিরের মন শান্ত হল। তিনি বললেন, আমি মরুত্তের সুবর্ণরাশি সংগ্রহ করে অশ্বমেধ যজ্ঞ করব। আপনাদের বাক্যে আমি আশ্বাসিত হয়েছি; ভাগ্যহীন পুরুষ আপনাদের ন্যায় উপদেষ্টা লাভ করতে পারে না।

॥ অনুগীতাপর্বাধ্যায়॥

৪। অনুগীতা

একদা এক রমণীয় স্থানে বিচরণ করতে করতে অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, কেশব, সংগ্রামের সময় আমি তোমার মাহাত্ম জেনেছিলাম, তোমার দিব্য রূপ ও ঐশ্বর্যও দেখেছিলাম। তুমি সুহৃভাবে আমাকে পূর্বে যে সকল উপদেশ দিয়েছিলে আমি বুদ্ধির দোষে তা ভুলে গেছি। তুমি শীঘ্রই দ্বারকায় ফিরে যাবে, সেজন্য এখন আবার সেই উপদেশ শুনতে ইচ্ছা করি। অর্জুনকে আলিঙ্গন করে কৃষ্ণ বললেন, আমি তোমাকে নিগূঢ় সনাতন ধর্মতত্ত্ব এবং শাশ্বত লোক সম্বন্ধে উপদেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু বুদ্ধির দোষে তুমি তা গ্রহণ করতে পারনি, এতে আমি দুঃখিত হয়েছি। আমি যোগযুক্ত হয়ে পূর্বে যে ব্রহ্মতত্ত্ব বিবৃত করেছিলাম এখন আর তা বলতে পারব না। যাই হ’ক, এক সিদ্ধ ব্রাহ্মণ ধর্মাত্মা কশ্যপকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাই আমি বলছি শোন।

মানুষ পুণ্যকর্মের ফলে উত্তম গতি পায় এবং দেবলোকে সুখভোগ করে, কিন্তু এই অবস্থা চিরস্থায়ী নয়। অতি কষ্টে উত্তম লোক লাভ হলেও তা থেকে বার বার পতন হয়। দেহধারী জীব বিপরীত বুদ্ধির বশে অসৎ কর্মে প্রবৃত্ত হয়; সে অতিভোজন করে বা অনাহারে থাকে, পরস্পরবিরোধী বস্তু ভোজন ও পান করে, ভুক্ত খাদ্য জীর্ণ না হতেই আবার খায়, দিবসে নিদ্রা যায়, অতিরিক্ত পরিশ্রম বা স্ত্রীসংসর্গের ফলে দুর্বল হয়। এইরূপে সে বায়ুপিত্তাদি প্রকোপিত করে এবং পরিশেষে প্রাণান্তকর রোগের কবলে পড়ে। কেউ কেউ উদ্বন্ধনাদির দ্বারা আত্মহত্যা করে।

দেহত্যাগের সময় শরীরস্থ উষ্ম বায়ু দ্বারা প্রকোপিত হয়ে মর্মস্থান ভেদ করে, তখন জীবাত্মা বেদনাগ্রস্ত হয়ে দেহ থেকে নির্গত হন। সকল জীবই বার বার জন্মমৃত্যু ভোগ করে; মৃত্যুকালে যেমন জন্মকালেও তেমন ক্লেশ পায়। সনাতন জীবাত্মাই দেহের মধ্যে থেকে সকল কার্য সম্পাদন করেন। মৃত্যু হলেও তার কৃত কর্মসকল তঁকে ত্যাগ করে না, সেই কর্মবন্ধনের ফলে জীবের আবার জন্ম হয়। চক্ষুষ্মান লোকে দেখে-অন্ধকারে খদ্যোত কখনও প্রকাশিত হচ্ছে কখনও লীন হচ্ছে, সেইরূপ সিদ্ধ পুরুষ জ্ঞানচক্ষু দ্বারা জীবের জন্ম মরণ ও পুনর্বার গর্ভপ্রবেশ দেখতে পান। সংসাররূপ কর্মভূমিতে কর্ম করে কেউ এখানেই ফলভোগ করে, কেউ পুণ্যবলে স্বর্গে যায়, কেউ অসৎ কর্মের ফলে নরকে পতিত হয়; সেই নরক থেকে মুক্তিলাভ অতি দুরূহ। মৃত্যুর পর পুণ্যত্মারা চন্দ্র সূর্য অথবা নক্ষত্রলোকে যান, কর্মক্ষয় হলে আবার তারা মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন; এইরূপ যাতায়াত বারবার ঘটে। স্বর্গেও উচ্চ মধ্যম ও নীচ স্থান আছে।

শুক্র ও শোণিত সংযুক্ত হয়ে স্ত্রীজাতির গর্ভাশয়ে প্রবেশ করে জীবের কর্মানুসারে দেহে পরিণত হয়। দেহের অধিষ্ঠাতা জীবাত্মা অতি সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য, ইনি কোনও বিষয়ে লিপ্ত হন না। ইনিই শাশ্বত ব্রহ্ম এবং সর্বপ্রাণীর বীজস্বরূপ; এঁর প্রভাবেই প্রাণীরা জীবিত থাকে। বহ্নি যেমন অনুপ্রবিষ্ট হয়ে লৌহপিণ্ডকে তাপিত করে, সেইরূপ জীবাত্মা দেহকে সচেতন করেন। দীপ যেমন গৃহকে প্রকাশিত করে, সেইরূপ চেতনা শরীরকে সংবেদনশীল করে।

যত কাল মোধর্মের উপলব্ধি না হয় তত কাল জীব জন্মজন্মান্তরে শুভাশুভ কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে তার ফলভোগ করে। দান ব্রত ব্রহ্মচর্য বেদাভ্যাস প্রশান্ততা অনুকম্পা সংযম অহিংসা, পরধনে অলোভ, মনে মনেও প্রাণিগণের অহিত না করা, পিতামাতার সেবা, গুরু দেবতা ও অতিথির পূজা, শুচিতা, ইন্দ্রিয়সংযম, এবং শুভজনক কর্মের অনুষ্ঠান-সাধুদের এইসকল স্বভাবসিদ্ধ। এইরূপ অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ, তিনি শীঘ্র মুক্তিলাভ করেন। যিনি বুঝেছেন যে সুখদুঃখ অনিত্য, শরীর অপরিত্র বস্তুর সমষ্টি, বিনাশ কর্মেরই ফল, এবং সকল সুখই দুঃখ, তিনি এই ঘোর সংসারসাগর উত্তীর্ণ হতে পারেন। জন্মমরণশীল রোগসংকুল প্রাণিসমূহের দেহে যিনি একই চৈতন্যময় সত্ত্ব দেখেন তিনি পরম পদের অন্বেষণ করলে সিদ্ধিলাভ করেন।

যিনি সকলের মিত্র, সর্ব বিষয়ে সহিষ্ণু, শান্ত ও জিতেন্দ্রিয়, যার ভয় ক্রোধ অভিমান নেই, যিনি পবিত্রস্বভাব এবং সর্বভূতের প্রতি আত্মবৎ আচরণ করেন, জন্ম-মৃত্যু সুখ-দুঃখ লাভ-অলাভ প্রিয়-অপ্রিয় সমান জ্ঞান করেন, যিনি অপরের দ্রব্য কামনা করেন না, কাকেও অবজ্ঞা করেন না, যাঁর শত্রু-মিত্র নেই, সন্তানে আসক্তি নেই, যিনি আকাঙ্ক্ষাশূন্য এবং ধর্ম-অর্থ-কাম পরিহার করেছেন, যিনি ধার্মিক নন অধার্মিকও নন, যাঁর চিত্ত প্রশান্ত হয়েছে, তিনি আত্মাকে উপলব্ধি করে মুক্তিলাভ। করেন। যিনি বৈরাগ্যযুক্ত, সতত আত্মদোষদর্শী, আত্মাকে নিগুণ অথচ গুণভোক্তা রূপে দেখেন, শারীরিক ও মানসিক সকল সংকল্প ত্যাগ করেছেন, তিনিই ইন্ধনহীন অনলের ন্যায় ক্রমশ নির্বাণ লাভ করেন। যিনি সর্বসংস্কারমুক্ত নিৰ্বন্দ্ব, এবং কিছুই নিজের বলে মনে করেন না, তিনিই সনাতন অক্ষর ব্রহ্ম লাভ করেন। তপস্যা দ্বারা ইন্দ্রিয়সকলকে বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে একান্তমনে যোগরত হলে হৃদয়মধ্যে পরমাত্মার দর্শন পাওয়া যায়। যেমন স্বপ্নে কিছু দেখলে জাগরণের পরেও তার জ্ঞান থাকে, সেইরূপ যোগাবস্থায় পরমাত্মাকে প্রত্যক্ষ করলে যোগভঙ্গের পরেও সেই উপলব্ধি থাকে।

তারপর কৃষ্ণ বিবিধ উপাখ্যানের প্রসঙ্গে, সবিস্তারে অধ্যাত্মতত্ত্ব বিবৃত করলেন। পরিশেষে তিনি বললেন, ধনঞ্জয়, তোমার প্রীতির জন্য এইসকল নিগূঢ় বিষয় বললাম; তুমি আমার উপদিষ্ট ধর্ম আচরণ কর, তা হলে সকল পাপ থেকে মুক্ত হয়ে মোক্ষলাভ করবে। ভরতশ্রেষ্ঠ, আমি বহু কাল আমার পিতাকে দেখি নি, এখন তার কাছে যেতে ইচ্ছা করি। অর্জুন বললেন, কৃষ্ণ, এখন হস্তিনাপুরে চল, রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে তুমি দ্বারকায় যেয়ো।

৫। কৃষ্ণের দ্বারকাযাত্রা-মরুবাসী উতঙ্ক

কৃষ্ণ দ্বারকায় যেতে চান শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, পুণ্ডরীকাক্ষ, তোমার মঙ্গল হ’ক; তুমি বহুদিন পিতামাতাকে দেখ নি, এখন তাদের কাছে যাওয়া তোমার কর্তব্য। দ্বারবতী পুরীতে গিয়ে তুমি আমার মাতুল বসুদেব, দেবী দেবকী, এবং বলদেবকে। আমাদের অভিবাদন জানিও, আমাকে ও আমার ভ্রাতৃগণকে নিত্য স্মরণে রেখো, আমার অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় আবার এখানে এসো।

ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, পিতৃম্বসা কুন্তী ও বিদুর নিয়ে কৃষ্ণ তার ভগিনী সুভদ্রার সঙ্গে রথারোহণে যাত্রা করলেন। বিদুর ভীমার্জনাদি ও সাত্যকি তার পশ্চাতে গেলেন। কিছু দূর গিয়ে তিনি বিদুর প্রভৃতিকে নিবর্তিত করে দারুক ও সাত্যকিকে বললেন, বেগে রথ চালাও। কৃষ্ণ ও অর্জুন বহুক্ষণ পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলেন, তার পর রথ দৃষ্টিপথের বাহিরে গেলে অর্জুনাদি হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন।

কৃষ্ণের যাত্রাপথে বহুপ্রকার শুভ লক্ষণ দেখা গেল। বায়ু সবেগে প্রবাহিত হয়ে রথের সম্মুখস্থ পথের ধূলি কঙ্কর ও কণ্টক দূর করলেন, ইন্দ্র সুগন্ধ বারি ও দিব্য পুষ্প বর্ষণ করতে লাগলেন। কিছু দূর যাবার পর কৃষ্ণ মরুপ্রদেশে উপস্থিত হয়ে মুনিশ্রেষ্ঠ উতঙ্কের দর্শন পেলেন। পরস্পর অভিবাদন ও কুশলজিজ্ঞাসার পর উতঙ্ক’। বললেন, শৌরি, তোমার যত্নে কুরুপাণ্ডবদের মধ্যে সৌভ্রাত্র স্থাপিত হয়েছে তো? কৃষ্ণ বললেন, আমি সন্ধির জন্য বহু চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তা সফল হয়নি। বুদ্ধি বা বল দ্বারা দৈবকে অতিক্রম করা যায় না; ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ সবান্ধবে যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করেছেন, কেবল পঞ্চপাণ্ডব জীবিত আছেন, তাঁদেরও পুত্রমিত্র নিহত হয়েছেন। উতঙ্ক ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, কৃষ্ণ, তুমি সমর্থ হয়েও কুরুপুংগবগণকে রক্ষা করনি, তোমার মিথ্যাচারের জন্যই কুরুকুল বিনষ্ট হয়েছে, আমি তোমাকে শাপ দেব। বাসুদেব বললেন, আমি অনুনয় করছি, শাপ দেবেন না। অল্প তপস্যার প্রভাবে আমাকে কেউ পরাভূত করতে পারেন না। আমি জানি যে আপনি কৌমার ও ব্রহ্মচর্য পালন করে তপঃসিদ্ধ হয়েছেন, গুরুকেও তুষ্ট করেছেন; আপনার তপস্যা আমি নষ্ট করতে ইচ্ছা করি না। তি, তারপর কৃষ্ণ তাঁর দিব্য ঐশ্বর্য সকল বিবৃত করলেন এবং উতঙ্কের অনুরোধে বিশ্বরূপ দেখালেন। উতঙ্ক বিস্ময়াপন্ন হয়ে বললেন, হে বিশ্বকর্মা বিশ্বাত্মা বিশ্বসম্ভব, তোমাকে নমস্কার করি, তুমি পদদ্বয় দ্বারা পৃথিবী, মস্তক দ্বারা গগন, জঠর দ্বারা দ্যুলোক-ভূলোকের মধ্যদেশ, এবং ভুজ দ্বারা দিমূহ ব্যাপ্ত করে আছ; দেব, তোমার এই মহৎ রূপ সংবরণ করে পূর্বরূপ ধারণ কর। কৃষ্ণ পূর্বরূপ গ্রহণ করে প্রসন্ন হয়ে বললেন, মহর্ষি, আপনি অভীষ্ট বর প্রার্থনা করুন। উতঙ্ক বললেন, পুরুষোত্তম, তোমার যে রূপ দেখেছি তাই আমার পক্ষে পর্যন্ত বর। যদি নিতান্তই বর দেওয়া কর্তব্য মনে কর তবে এই বর দাও যেন এই মরুভূমিতে ইচ্ছানুসারে জল পেতে পারি। কৃষ্ণ বললেন, জলের প্রয়োজন হলেই আমাকে স্মরণ করবেন। এই বলে কৃষ্ণ প্রস্থান করলেন।

কিছু কাল পরে একদিন উতঙ্ক মরুভূমিতে চলতে চলতে তৃষিত হয়ে কৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। তখন এক দিগম্বর মলিনদেহ চণ্ডাল তার কাছে উপস্থিত হল, তার সঙ্গে কুকুরের দল, হাতে খড়্গ ও ধনুর্বাণ; তার অর্ধেদেশে জলস্রোত (প্রস্রাব) প্রবাহিত হচ্ছে। চণ্ডাল সহাস্যে বললে, ভৃগুবংশজাত উতঙ্ক, তুমি আমার এই জল পান কর। উতঙ্ক পিপাসার্ত হয়েও সেই জল নিলেন না, ক্রুদ্ধ হয়ে তিরস্কার করলেন। চণ্ডাল অন্তর্হিত হল। তার পর শঙ্খচক্রগদাধর কৃষ্ণকে দেখে উতঙ্ক বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, ব্রাহ্মণকে চণ্ডালের প্রস্রাব দেওয়া তোমার উচিত নয়। কৃষ্ণ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আপনাকে অমৃত দেবার জন্য আমি ইন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, মানুষকে অমরত্ব দেওয়া অকর্তব্য; যদি উতঙ্ককে অমৃত দিতেই হয় তবে আমি চণ্ডালের রূপে দিতে যাব, যদি তিনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করেন তবে অমৃত পাবেন না। মহর্ষি, আপনি চণ্ডালরূপী ইন্দ্রকে ফিরিয়ে দিয়ে অন্যায় করেছেন। যাই হ’ক, আমি বর দিচ্ছি, আপনার পিপাসা পেলেই মেঘ উদিত হয়ে এই মরুভূমিতে জলবর্ষণ করবে, সেই মেঘ উতঙ্ক-মেঘ নামে খ্যাত হবে। বর পেয়ে উতঙ্ক প্রীত হয়ে সেখানে বাস করতে লাগলেন। এখনও উতঙ্কমেঘ সেই মরুভূমিতে জলবর্ষণ করে।

৬। উতঙ্কের পূর্ববৃত্তান্ত

জনমেজয় প্রশ্ন করলেন, উতঙ্ক এমন কি তপস্যা করেছিলেন যে তিনি জগৎপ্রভু বিষ্ণুকে শাপ দিতে উদ্যত হয়েছিলেন? বৈশম্পায়ন বললেন, উতঙ্ক (১) অতিশয় গুরুভক্ত ও তপোনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁর গুরু গৌতমও তাকে অন্যান্য শিষ্য অপেক্ষা অধিক স্নেহ করতেন। একদিন উতঙ্ক কাষ্ঠভার এনে ভূমিতে ফেলবার সময় দেখলেন, রৌপ্যের ন্যায় তার একগাছি জটা কাষ্ঠে লগ্ন হয়ে আছে। পরিশ্রান্ত ক্ষুধাতুর উতঙ্ক তার বার্ধক্যের এই লক্ষণ দেখে কাঁদতে লাগলেন। গৌতমের কন্যা দ্রুতবেগে এসে উতঙ্কের অশ্রু অঞ্জলিতে ধারণ করলেন, তাতে তার হস্ত দগ্ধ হল। গৌতম জিজ্ঞাসা করলেন, বৎস, তুমি শোকার্ত হলে কেন? উতঙ্ক বললেন, আমি শতবর্ষ আপনার প্রিয়সাধন করেছি; এতদিন আমার বার্ধক্য জানতে পারি নি, সুখভোগও করি নি। আমার চেয়ে যারা ছােট এমন শত সহস্র শিষ্য কৃতকার্য হয়ে আপনার আদেশে গৃহে ফিরে গেছে। গৌতম বললেন, তোমার শুশ্রুষায় প্রীত হয়ে আমি জানতে পারি নি যে এত দীর্ঘকাল আমার কাছে আছ; এখন আজ্ঞা দিচ্ছি তুমি গৃহে যাও।

উতঙ্ক বললেন, ভগবান, আপনাকে গুরুদক্ষিণা কি দেব? গৌতম বললেন, তুমি আমাকে পরিতুষ্ট করেছ, তাই গুরুদক্ষিণা। তুমি যদি ষোড়শবর্ষীয় যুবা হও তবে তোমাকে আমার কন্যা দান করব, সে ভিন্ন আর কেউ তোমার তেজ ধারণ করতে পারবে না। উতঙ্ক তখনই যুবা হয়ে গুরুকন্যার পাণিগ্রহণ করলেন এবং গৌতমের আদেশ নিয়ে গুরুপত্নীকে বললেন, আপনাকে কি দক্ষিণা দেব বলুন। বারবার অনুরোধের পর অহল্যা বললেন, সৌদাস রাজার মহিষী যে দিব্য মণিময় কুণ্ডল ধারণ করেন তাই এনে দাও। উতঙ্ক কুণ্ডল আনতে গেছেন শুনে গৌতম দুঃখিত হয়ে অহল্যাকে বললেন, সৌদাস বশিষ্ঠের শাপে রাক্ষস হয়েছেন, তার কাছে উতঙ্ককে পাঠানো উচিত হয় নি। অহল্যা বললেন, আমি তা জানতাম না; তোমার আশীর্বাদে উতঙ্কের কোনও অমঙ্গল হবে না।

দীর্ঘশ্মশ্রুধারী শোণিতাক্তদেহ ঘোরদর্শন সৌদাসকে দেখে উতঙ্ক ভীত হলেন না। সৌদাস বললেন, ব্রাহ্মণ, আমি আহার অন্বেষণ করছিলাম, তুমি উপযুক্ত কালে এসেছ।

উতঙ্ক – মহারাজ, আমি গুরুপত্নীর জন্য আপনার মহিষীর কুণ্ডল ভিক্ষা করতে এসেছি; আমি প্রতিজ্ঞা করছি, গুরুপত্নীকে কুণ্ডল দিয়ে আপনার কাছে ফিরে আসব। সৌদাস সম্মত হয়ে বললেন, বনমধ্যে নিঝরের নিকট আমার পত্নীকে দেখতে পাবে।

সৌদাসমহিষী ময়ন্তীর নিকট উপস্থিত হয়ে উতঙ্ক তার প্রার্থনা জানালেন। ময়ন্তী বললেন, দেবতা যক্ষ ও মহর্ষিগণ আমার কুণ্ডল হরণ করবার জন্য সর্বদা চেষ্টা করেন। এই কুণ্ডল ভূমিতে রাখলে সর্পগণ, উচ্ছিষ্ট অবস্থায় ধারণ করলে যক্ষগণ, এবং নিদ্রাকালে ধারণ করলে দেবগণ অপহরণ করেন। এই কুণ্ডল সর্বদা সুবৰ্ণ ক্ষরণ করে, রাত্রিকালে নক্ষত্র ও তারাগণের প্রভা আকর্ষণ করে, ধারণ করলে ক্ষুধা পিপাসা এবং অগ্নি বিষ প্রভৃতির ভয় দূর হয়। ব্রাহ্মণ, তুমি মহারাজের অভিজ্ঞান নিয়ে এস তবে কুণ্ডল পাবে।

উতঙ্ক অভিজ্ঞান চাইলে সৌদাস বললেন, তুমি মহিষীকে এই কথা বলো—আমার এই দুর্গতি থেকে মুক্তি পাবার অন্য উপায় নেই; তুমি তোমার কুণ্ডলদ্বয় দান কর। উতঙ্ক সৌদাসের এই বাক্য জানালে ময়ন্তী তাকে কুণ্ডল দিলেন। উতঙ্ক সৌদাসের কাছে এসে বললেন, মহারাজ, মহিষী কুণ্ডল দিয়েছেন; আমি প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করব না, কিন্তু আজ আপনার সঙ্গে আমার মিত্ৰতা হয়েছে, আমাকে বধ করলে আপনার মিত্রহত্যার পাপ হবে। আপনিই বলুন, আপনার কাছে আবার আসা আমার উচিত কিনা। সৌদাস বললেন, আমার কাছে ফিরে এলে নিশ্চয় তোমাকে মরতে হবে, অতএব আর এসো না।

মৃগচর্মের উত্তরীয়ে কুণ্ডল বেঁধে উতঙ্ক দ্রুতবেগে গৌতমের আশ্রমে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে ক্ষুধিত হয়ে তিনি একটি বিল্ব বৃক্ষে উঠে ফল পাড়তে লাগলেন, সেই সময়ে কুণ্ডলসহ তার উত্তরীয় ভূমিতে পড়ে গেল। ঐরাবতবংশজাত এক সর্প কুণ্ডলদ্বয় মুখে নিয়ে বল্মীকমধ্যে প্রবেশ করলে। বৃক্ষ থেকে নেমে উতঙ্ক তার দণ্ডকাষ্ঠ (ব্রহ্মচারীর যষ্টি) দিয়ে বল্মীক খুঁড়তে লাগলেন, কিন্তু পঁয়ত্রিশ দিন খুঁড়েও তিনি ভিতরে যাবার পথ পেলেন না। তখন ব্রাহ্মণবেশে ইন্দ্র এসে বললেন, নাগলোক এখান থেকে সহস্র যোজন, তুমি কেবল দণ্ডকাষ্ঠ দিয়ে পথ প্রস্তুত করতে পারবে না।এই বলে ইন্দ্র দণ্ডকাষ্ঠে তাঁর বজ্র সংযুক্ত করে দিলেন। তখন উতঙ্ক ভূমি বিদীর্ণ করে সুবিশাল নাগলোকে উপস্থিত হলেন। তার দ্বারদেশে একটি কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব ছিল, তার পুচ্ছ শ্বেত, মুখ ও চক্ষু তাম্রবর্ণ। অশ্ব উতঙ্ককে বললে, বৎস, তুমি আমার গুহ্যদ্বারে ফুৎকার দাও; ঘৃণা করো না, আমি অগ্নি, তোমার গুরুর গুরু। উতঙ্ক ফুৎকার দিলে অশ্বের রোমকূপ থেকে ভয়ংকর ধূম নির্গত হয়ে নাগলোকে ব্যাপ্ত হল। বাসুকি প্রভৃতি নাগগ্ণ ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন এবং উতঙ্ককে পূজা করে কুণ্ডল সমর্পণ করলেন। তার পর উতঙ্ক অগ্নিকে প্রদক্ষিণ করে গুরুগৃহে ফিরে গেলেন এবং অহল্যাকে কুণ্ডল দিলেন।

** (১) আদিপর্ব ৩-পরিচ্ছেদে উতঙ্কের উপাখ্যান কিছু অন্যপ্রকার, তিনি জনমেজয়ের সমকালীন।

৭। কৃষ্ণের দ্বারকায় আগমন-যুধিষ্ঠিরের সুবর্ণসংগ্রহ

দ্বারকায় এসে কৃষ্ণ তাঁর পিতা বসুদেবকে সবিস্তারে কুরুপাণ্ডবযুদ্ধের বিবরণ দিলেন, কিন্তু দৌহিত্র অভিমন্যুর মৃত্যুসংবাদে বসুদেব অত্যন্ত কাতর হবেন এই আশঙ্কায় তা জানালেন না। সুভদ্রা বললেন, তুমি আমার পুত্রের নিধনের কথা গোপন করলে কেন? এই বলে সুভদ্রা ভূপতিত হলেন। বসুদেব শোকার্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তখন কৃষ্ণ অভিমন্যুর মৃত্যুর সংবাদ দিলেন। দৌহিত্রের আশ্চর্য বীরত্বের বিবরণ শুনে বসুদেব শোক সংবরণ করে যথাবিধি শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান করলেন।

হস্তিনাপুরে পাণ্ডবগণও অভিমন্যুর জন্য কাতর হয়ে কালযাপন করছিলেন। বিরাটখানা উত্তরা পতির শোকে দীর্ঘকাল অনাহারে ছিলেন, তার ফলে তার গর্ভস্থ সন্তান ক্ষীণ হতে লাগল। ব্যাসদেব উত্তরাকে বললেন, যশস্বিনী, শোক ত্যাগ কর, তোমার মহাতেজা পুত্র হবে, বাসুদেবের প্রভাবে এবং আমার বাক্য অনুসারে সে পাণ্ডবগণের পরে পৃথিবী শাসন করবে।

তারপর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য উদ্যোগী হলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রপুত্র যুযুৎসুকে রাজ্যরক্ষার ভার দিলেন এবং মরুত্ত রাজার সুবর্ণরাশি আনবার জন্য শুভদিনে পুরোহিত ধৌম্য ও ভ্রাতাদের সঙ্গে সসৈন্যে হিমালয়ের অভিমুখে যাত্রা করলেন। যথাস্থানে এসে যুধিষ্ঠির শিবির স্থাপনের আজ্ঞা দিলেন এবং পুষ্প মোদক পায়স মাংস প্রভৃতি উপহার দিয়ে মহেশ্বরের পূজা করলেন। যক্ষরাজ কুবের এবং তার অনুচরগণের জন্যও কৃশর মাংস তিল ও অন্নাদি নিবেদিত হল। তার পর যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণের অনুমতি নিয়ে ভূমি খননের আদেশ দিলেন। সুবর্ণময় ক্ষুদ্র বৃহৎ বহুবিধ ভাণ্ড ভৃঙ্গার কটাহ এবং শত সহস্র বিচিত্র আধার সেই খনি থেকে উদ্ধৃত হল। তার পর যুধিষ্ঠির পুনর্বার মহাদেবের পূজা করলেন এবং বহু সহস্র উষ্ট্র অশ্ব হস্তী গর্দভ ও শকটের উপর সেই সুবর্ণ-রাশি বন্ধন করে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। গুরুভারপীড়িত বাহনগণ দুই ক্রোশ অন্তর বিশ্রাম করে চলতে লাগল।

৮। পরীক্ষিতের জন্ম

যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যক্ষের কাল আগত হলে কৃষ্ণ তার প্রতিশ্রুতি স্মরণ করলেন এবং বলরামকে অগ্রবর্তী করে কনিষ্ঠ ভ্রাতা গদ, ভগিনী সুভদ্রা, পুত্র প্রদ্যুম্ন চারুদেষ্ণ ও শাম্ব, এবং সাত্যকি কৃতবর্মা প্রভৃতি বীরগণের সঙ্গে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলেন।

সেই সময়ে পরীক্ষিৎ নিশ্চেষ্ট শব রূপে প্রসূত হলেন। পুরবাসিগণের হর্ষধ্বনি উত্থিত হয়েই নিবৃত্ত হল। কৃষ্ণব্যথিত হয়ে সাত্যকির সঙ্গে অন্তঃপুরে গেলেন, কুন্তী দ্রৌপদী সুভদ্রা ও অন্যান্য কুরুনারীগণ সরোদনে তাঁকে বেষ্টন করলেন। কুন্তী বললেন, বাসুদেব, তুমিই আমাদের একমাত্র গতি, এই কুরুকুল তোমারই আশ্রিত। তোমার ভাগিনেয় অভিমন্যুর পুত্র অশ্বত্থামার অস্ত্রপ্রভাবে মৃত হয়ে জন্মেছে, তুমি তাকে জীবিত করে উত্তরা সুভদ্রা দ্রৌপদী ও আমাকে রক্ষা কর এই বালক পাণ্ডবগণের প্রাণ স্বরূপ, এবং আমার পতি শ্বশুর ও অভিমন্যুর পিণ্ডদাতা। তুমি পূর্বে বলেছিলে যে একে পুনর্জীবিত করবে, এখন সেই প্রতিজ্ঞা পালন কর। অভিমন্যু উত্তরাকে বলেছিল-তোমার পুত্র আমার মাতুলগৃহে ধনুর্বেদ ও নীতিশাস্ত্র শিখবে। মধুসূদন, আমরা বিনীত হয়ে প্রার্থনা করছি, তুমি কুরুকুলের কল্যাণ কর।

সুভদ্রা আর্তকণ্ঠে বললেন, পুণ্ডরীকাক্ষ, এই দেখ, পার্থের পৌত্রও অন্যান্য কুরুবংশীরের ন্যায় গতাসু পাণ্ডবগণ ফিরে এসে এই সংবাদ শুনে কি বলবেন? তুমি থাকতে এই বালক যদি জীবিত না হয় তবে তোমাকে দিয়ে আমাদের কোন্ উপকার হবে? তুমি ধর্মাত্মা সত্যবাদী সত্যবিক্রম, তোমার শক্তি আমি জানি। মেঘ যেমন জলবর্ষণ করে শস্যকে সঞ্জীবিত করে সেইরূপ তুমি অভিমন্যুর মৃত পুত্রকে জীবিত কর। আমি তোমার ভগিনী, পুত্রহীনা; শরণাপন্ন হয়ে বলছি, দয়া কর।

সুভদ্রা প্রভৃতিকে আশ্বাস দিয়ে কৃষ্ণ সূতিকাগৃহে প্রবেশ করে দেখলেন, সেই গৃহ শুভ্র পুষ্পমালায় সজ্জিত, চতুর্দিকে পূর্ণকলস রয়েছে, ঘৃত, তিন্দুক (গাব) কাষ্ঠের অঙ্গার, সর্ষপ, পরিষ্কৃত অস্ত্র, অগ্নি ও অন্যান্য রাক্ষসভয়বারক দ্রব্য যথাস্থানে রাখা আছে, বৃদ্ধা নারী ও দক্ষ তিষগণ উপস্থিত রয়েছেন। এইসকল দেখে কৃষ্ণপ্রীত হয়ে সাধু সাধু বললেন। তখন দ্রৌপদী উত্তরাকে বললেন, কল্যাণী, তোমার শ্বশুর অচিন্ত্যাত্মা মধুসূদন এসেছেন। উত্তরা অশ্রু সংবরণ ও দেহ আচ্ছাদন করে করুণস্বরে বললেন পুণ্ডরীকাক্ষ, দেখুন, আমি পুত্রহীনা হয়েছি, অভিমন্যুর ন্যায় আমিও নিহত হয়েছি। দ্রোণপুত্রের ব্রহ্মাস্ত্রে বিনষ্ট আমার পুত্রকে আপনি জীবিত করুন। অশত্থামার অস্ত্রমোচনকালে যদি আপনার বলতেন—এই ঈষীকা প্রসূতির প্রাণনাশ করুক, তবে ভাল হত। গোবিন্দ, আমি নতশিরে প্রার্থনা করছি, এই বালককে সঞ্জীবিত করুন, নতুবা আমি প্রাণত্যাগ করব। দ্রোণপুত্র আমার সকল মনোরথ নষ্ট করেছে, আমার জীবনে কি প্রয়োজন? আমার আশা ছিল পুত্রকে কোলে নিয়ে আপনাকে প্রণাম করব, তা বিফল হল। আমার চঞ্চলনয়ন স্বামী আপনার প্রিয় ছিলেন, তার মৃত পুত্রকে আপনি দেখুন। এর পিতা যেমন কৃতঘ্ন ও নিষ্ঠুর এও সেইরূপ, তাই পাণ্ডবগণের সম্পদ ত্যাগ করে যমসদনে গেছে।

এইপ্রকার বিলাপ করে উত্তরা মূৰ্ছিত হয়ে ভূপতিত হলেন, কুন্তী প্রভৃতি তাকে তুলে কাঁদতে লাগলেন। সংজ্ঞালাভ করে উত্তরা মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে বললেন, তুমি ধর্মজ্ঞের পুত্র হয়ে বৃষ্ণিপ্রবীর কৃষ্ণকে প্রণাম করছ না কেন? তুমি তোমার পিতার কাছে গিয়ে আমার হয়ে বললা-বীর, কাল পূর্ণ না হলে কেউ মরে না, তাই আমি পতিপুত্রহীনা হয়েও জীবিত আছি। আমি ধর্মরাজের অনুমতি নিয়ে ঘোর বিষ খাব বা অগ্নিপ্রবেশ করব। পুত্র, ওঠ, তোমার শোকার্তা প্রপিতামহী কুন্তী এবং আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত কর : তোমার চঞ্চলনয়ন পিতার তুল্য যাঁর মুখ সেই লোকনাথ পুণ্ডরীকাক্ষ কৃষ্ণকে দেখ।

কৃষ্ণ বললেন, উত্তরা, আমার কথা মিথ্যা হবে না; দেখ, সকলের সমক্ষেই এই বালককে পুনর্জীবিত করব। যদি আমি কখনও মিথ্যা না বলে থাকি, যুদ্ধে বিমুখ না হয়ে থাকি, যদি ধর্ম ও ব্রাহ্মণগণ আমার প্রিয় হন, তবে অভিমন্যুর এই পুত্র জীবনলাভ করুক। যদি অর্জুনের সহিত কদাচ আমার বিরোধ না হয়ে থাকে, যদি সত্য ও ধর্ম নিত্য আমাতে প্রতিষ্ঠিত থাকে, যদি কংস ও কেশীকে আমি ধর্মানুসারে বধ করে থাকি, তবে এই বালক জীবিত হ’ক। বাসুদেব এইরূপ বললে শিশু ধীরে ধীরে চেতনা পেয়ে স্পন্দিত হতে লাগল। অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র কৃষ্ণ কর্তৃক নিবর্তিত হয়ে ব্রহ্মার কাছে চলে গেল। তখন বালকের তেজঃপ্রভাবে সূতিকাগৃহ আলোকিত হল রাক্ষসরা পালিয়ে গেল, আকাশবাণী হল -সাধু কেশব, সাধু। বালকের অঙ্গসঞ্চালন দেখে কুরুকুলের নারীগণ হৃষ্ট হলেন, ব্রাহ্মণরা স্বস্তিবাচন করলেন, মল্ল নট দৈবজ্ঞ সূত মাগধ প্রভৃতি কৃষ্ণের স্তব করতে লাগল। উত্তরা পুত্রকে কোলে নিয়ে সহর্ষে কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ বহু রত্ন উপহার দিলেন এবং ভরতবংশ পরিক্ষীণ হলে অভিমন্যুর এই পুত্র জন্মেছে এজন্য তার নাম রাখলেন—পরীক্ষিৎ। পরীক্ষিতের বয়স এক মাস হলে পাণ্ডবগণ ফিরে এলেন, তখন সুসজ্জিত হস্তিনাপুরে নানাপ্রকার উৎসব হতে লাগল।

৯। যজ্ঞাশ্বের সহিত অর্জুনের যাত্রা

কিছুদিনের পরে ব্যাসদেব হস্তিনাপুরে এলে যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, ভগবান, আপনার প্রসাদে আমি যজ্ঞের জন্য ধনরত্ন সংগ্রহ করেছি, এখন আপনি যজ্ঞের অনুমতি দিন। ব্যাস বললেন, আমি অনুমতি দিলাম, তুমি অশ্বমেধ যজ্ঞ করে বহু দক্ষিণা দাও, তার ফলে নিশ্চয় পাপমুক্ত হবে।

যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, যদুনন্দন, তোমাকে জন্ম দিয়ে দেবকী সুপুত্রবতী হয়েছেন, তোমার প্রভাবে আমরা ভোগ্য বিষয় অর্জুন করেছি, তোমার পরাক্রম ও বুদ্ধিতে পৃথিবী জয় করেছি। তুমি আমাদের পরম গুরু, তুমিই যজ্ঞ, তুমিই ধর্ম, তুমিই প্রজাপতি; অতএব তুমিই দীক্ষিত হয়ে আমার যজ্ঞ সম্পাদন কর। কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আপনি কুরুবীরগণের অগ্রণী হয়ে ধর্মপালন করছেন, আপনি আমাদের রাজা ও গুরু। অতএব আপনিই দীক্ষিত হয়ে যজ্ঞ করুন এবং আপনার অভীষ্ট কার্যে আমাদের নিয়োজিত করুন।

যুধিষ্ঠির সম্মত হলে ব্যাসদেব তাকে বললেন, পৈল যাজ্ঞবল্ক্য ও আমি, আমরা তিন জনে যজ্ঞের সকল কর্ম সম্পাদন করব। চৈত্রপূর্ণিমায় তুমি যজ্ঞের জন্য দীক্ষিত হবে। অশ্ববিদ্যাবিশারদ সূত ও ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞীয় অশ্ব নির্বাচন করুন, তার পর সেই অশ্ব মুক্ত হয়ে তোমার যশোরাশি প্রদর্শন করে সাগরাম্বরা পৃথিবী পরিভ্রমণ করুক। দিব্যধনুর্বাণধারী ধনঞ্জয় সেই অশ্বকে রক্ষ করবেন। ভীমসেন ও নকুল রাজ্যপালন এবং সহদেব কুটুম্বগণের তত্ত্বাবধান করবেন। ব্যাসের উপদেশ অনুসারে সকল ব্যবস্থা করে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, মহাবাহু, কোনও রাজা যদি তোমাকে বাধা দেন তবে তুমি চেষ্টা করবে যাতে যুদ্ধ না হয়, এবং তাকে আমার এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করবে।

যথাকালে যুধিষ্ঠির দীক্ষিত হয়ে স্বর্ণমালা কৃষ্ণাজিন দণ্ড ও ক্ষৌমবাস ধারণ করলেন। যজ্ঞের অশ্ব ছেড়ে দেওয়া হল ; অর্জুন শ্বেত অশ্বে আরোহণ করে সেই কৃষ্ণসার (শ্বেতকৃষ্ণ মিশ্রিতবর্ণ) যজ্ঞাশ্বের অনুগমন করলেন। বহু বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় বীর অর্জুনের সঙ্গে যাত্রা করলেন। সকলে বললেন, অর্জুন, তোমার মঙ্গল হ’ক, তুমি নির্বিঘ্নে ফিরে এসো।

১০। অর্জুনের নানা দেশে যুদ্ধ-বভ্রুবাহন উলূপী ও চিত্রাঙ্গদা

ত্রিগর্তদেশের যেসকল বীর কুরুক্ষেত্রযুদ্ধে হত হয়েছিলেন তাঁদের পুত্র-পৌত্রগণ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞশ্ব নেবার জন্য যুদ্ধ করতে এলেন। অর্জুন বিনয়বাক্যে তাঁদের নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করলেন কিন্তু তারা শুনলেন না, অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অবশেষে তারা পরাজিত হয়ে বললেন, পার্থ, আমরা সকলে আপনার কিংকর, আদেশ করুন কি করব। অর্জুন বললেন, আমি আপনাদের প্রাণরক্ষা করলাম, আপনারা আমার শাসনে থাকবেন।

তারপর যজ্ঞীয় অশ্ব প্রাগজ্যোতিষপুরে উপস্থিত হল ভগদত্তের পুত্র বজ্রদত্ত তাকে হরণ করতে এলেন। তিন দিন ঘোর যুদ্ধের পর বজ্রদত্ত তার মহাহস্তী অর্জুনের দিকে ধাবিত করলেন। অর্জুন নারাচের আঘাতে সেই হস্তীকে বধ করে বজ্রদত্তকে বললেন, মহারাজ, ভয় নেই, তোমার প্রাণ হরণ করব না। আগামী চৈত্রপূর্ণিমায় ধর্মরাজের অশ্বমেধ যজ্ঞ হবে, তার আদেশে আমি তোমাকে নিমন্ত্রণ করছি, তুমি সেই যজ্ঞে যেয়ো। পরাজিত বজ্রদত্ত সম্মত হলেন।

অশ্ব সিন্ধুদেশে এলে সেখানকার রাজারা জয়দ্রথের নিধন স্মরণ করে ক্রুদ্ধ হয়ে বিপুল সৈন্য নিয়ে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু যুদ্ধে পরাভূত হলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা জয়দ্রথপত্নী দুঃশলা তার বালক পৌত্রের সঙ্গে রতারোহণে অর্জুনের কাছে এলেন। ধনু ত্যাগ করে অর্জুন বললেন, ভগিনী, আমি কি করব বল। দুঃশলা বললেন, তোমার ভাগিনেয় সুরথের এই পুত্র তোমাকে প্রণাম করছে, তুমি একে কৃপাদৃষ্টিতে দেখ। অর্জুন বললেন, এর পিতা কোথায় ? দুঃশলা বললেন, তুমি যুদ্ধার্থী হয়ে এখানে এসেছ শুনে আমার পুত্র সুরথ অকস্মাৎ প্রাণত্যাগ করেছে। দুর্যোধন ও মন্দবুদ্ধি জয়দ্রথকে তুমি ভুলে যাও, তোমার ভগিনী ও তার পৌত্রের প্রতি দয়া কর। পরীক্ষিৎ যেমন অভিমন্যুর পুত্র, এই বালক তেমন সুরথের পুত্র। অর্জুন অতিশয় দুঃখিত হলেন এবং দুঃশলাকে সান্ত্বনা দিয়ে গৃহে পাঠিয়ে দিলেন।

যজ্ঞশ্ব বিচরণ করতে করতে মণিপুরে এল। পিতা ধনঞ্জয় এসেছেন শুনে। মণিপুরপতি বভ্রুবাহন ব্রাহ্মণগণকে অগ্রবর্তী করে সবিনয়ে উপস্থিত হলেন। অর্জুন রুষ্ট হয়ে তাঁর পুত্রকে বললেন, তোমার আচরণ ক্ষত্রিয় ধর্মের বহির্ভূত; আমি যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞাশ্বের সঙ্গে তোমার রাজ্যে এসেছি, তুমি যুদ্ধ করছ না কেন? অর্জুনের তিরস্কার শুনে নাগকন্যা উলূপী পৃথিবী ভেদ করে উপস্থিত হয়ে বভ্রুবাহনকে বললেন, পুত্র, আমি তোমার মাতা (বিমাতা) উলূপী; তুমি তোমার মহাবীর পিতার সঙ্গে যুদ্ধ কর, তা হলেই ইনি প্রীত হবেন। তখন বভ্রুবাহন স্বর্ণময় বর্ম ও শিরস্ত্রাণ ধারণ করে রথে উঠলেন এবং অনুচরদের সঙ্গে গিয়ে অশ্ব হরণ করলেন। অর্জুন প্রীত হয়ে পুত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তুমুল যুদ্ধের পর অর্জুন শরবিদ্ধ ও অচেতন হয়ে ভূমিতে পড়ে গেলেন। পিতার এই অবস্থা দেখে বভ্রুবাহনও মোহগ্রস্ত হয়ে ভূপতিত হলেন।

মণিপুররাজমাতা চিত্রাঙ্গদা রণস্থলে এসে পতিপুত্রকে দেখে শোকার্ত হয়ে তার সপত্নীকে বললেন, উলূপী, তোমার জন্যই আমার বালক পুত্রের হস্তে মহাবীর অর্জুন নিহত হয়েছেন। তুমি ধর্মশীলা, কিন্তু পুত্রকে দিয়ে পতিকে বিনষ্ট করে তোমার অনুতাপ হচ্ছে না কেন? আমার পুত্রও মরেছে, কিন্তু আমি তার জন্য শোক না করে পতির জন্যই শোকাকুল হয়েছি। আমি অনুনয় করছি, অর্জুন যদি কিছু অপরাধ করে থাকেন তো ক্ষমা করে জীবিত কর। ইনি বহু ভার্যা গ্রহণ করেছেন, কিন্তু পুরুষের পক্ষে তা অপরাধ নয়। এইরূপ বিলাপ করে চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের চরণ গ্রহণ করে প্রায়োপবেশন করলেন।

এই সময়ে বভ্রুবাহনের চেতনা ফিরে এল। তিনি ভূপতিত পিতা ও জননীকে। দেখে শোকার্ত হয়ে বললেন, আমি নৃশংস পিতৃহন্তা, ব্রাহ্মণরা আদেশ দিন আমি কোন্ প্রায়শ্চিত্ত করব। আমার উচিত মৃত পিতার চর্মে আবৃত হয়ে এবং এঁর মস্তক ধারণ করে দ্বাদশ বর্ষ যাপন করা। নাগকন্যা, এই দেখুন, আমি অর্জুনকে বধ করে আপনার প্রিয়সাধন করেছি, এখন আমিও পিতার অনুগমন করব। এই বলে ববাহন আচমন করে তার মাতার সহিত প্রায়োপবিষ্ট হলেন।

তখন উলূপী সঞ্জীবন মণি স্মরণ করলেন; তৎক্ষণাৎ সেই মণি নাগলোক থেকে চলে এল। উলূপী তা হাতে নিয়ে বভ্রুবাহনকে বললেন, পুত্র, শোক করো না, ওঠ; অর্জুন দেবগণেরও অজেয়। ইনি তোমার বল পরীক্ষার ইচ্ছায় যুদ্ধ করতে এসেছেন, তার প্রীতির নিমিত্ত আমি এই মোহিনী মায়া দেখিয়েছি। এই দিব্য মণির স্পর্শে মৃত নাগগণ জীবিত হয়, তুমি পার্থের বক্ষে এই মণি রাখ। বভ্রুবাহন তার পিতার বক্ষে সেই সঞ্জীবন মণি রাখলেন। তখন অর্জুন যেন দীর্ঘনিদ্রা থেকে জাগরিত হলেন এবং মস্তক আঘ্রাণ করে পুত্রকে আলিঙ্গন করলেন।

অর্জুন উলূপীকে বললেন, নাগরাজনন্দিনী, তুমি ও মণিপুরপতির মাতা চিত্রাঙ্গদা কেন এখানে এসেছ? আমার বা বভ্রুবাহনের বা তোমার সপত্নী চিত্রাঙ্গদার কোনও অপরাধ হয় নি তো? উলূপী সহাস্যে বললেন, তোমরা কেউ আমার কাছে অপরাধী নও। মহাবাহু ধনঞ্জয়, তুমি মহাভারতযুদ্ধে অধর্মাচরণ করে শান্তনুপুত্র ভীষ্মকে শিখণ্ডীর সাহায্যে নিপাতিত করেছিলে। আজ পুত্র কর্তক নিপাতিত হয়ে তুমি সেই পাপ থেকে মুক্তি পেলে। এই প্রায়শ্চিত্ত না হলে তুমি মরণের পর নরকে যেতে। ভাগীরথী ও বসুগণ তোমার পাপশান্তির এই উপায় বলেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রও তোমাকে জয় করতে পারেন না; পুত্র আত্মস্বরূপ, তাই তুমি পুত্ৰকর্তৃক পরাজিত হয়েছ।

অর্জুন বললেন, দেবী, তুমি উপযুক্ত কার্য করেছ। তারপর তিনি বভ্রুবাহনকে বললেন, চৈত্রপূর্ণিমায় যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন, তুমি তোমার দুই মাতা এবং অমাত্যগণের সঙ্গে সেখানে যেয়ো। বভ্রুবাহন বললেন, ধর্মজ্ঞ, আমি সেই যজ্ঞে দ্বিজগণের পরিবেশক হব। আজ রাত্রিতে আপনি দুই ভাষার সঙ্গে আপনার এই ভুবনে বিশ্রাম করুন, কাল আবার অশ্বের অনুগমন করবেন। অর্জুন বললেন, মহাবাহু, আমি তোমার ভবনে যেতে পারব না; এই অশ্ব যেখানে যাবে আমাকে সেখানেই যেতে হবে। তোমার মঙ্গল হ’ক, আমি আর এখানে থাকতে পারব না। এই বলে পুত্র ও দুই পত্নীর নিকট বিদায় নিয়ে অর্জুন প্রস্থান করলেন।

যজ্ঞশ্ব মগধে এলে সহদেবপুত্র (জরাসন্ধের পৌত্র) রাজা মেঘসন্ধি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলেন, কিন্তু পরাস্ত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করলে যজ্ঞে উপস্থিত হবার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। তার পর অর্জুন অশ্বের অনুসরণে সমুদ্রতীর দিয়ে বঙ্গ পুণ্ড্র কোশল প্রভৃতি দেশে গিয়ে সেখানকার ম্লেচ্ছাগণকে পরাস্ত করলেন। দক্ষিণে নানা দেশে বিচরণ করে অশ্ব চেদিরাজ্যে এল। শিশুপালপুত্র শরভ পরাজয় স্বীকার করলেন। কাশী অঙ্গ কোশল কিরাত ও তঙ্গন দেশের রাজারা অর্জনের সংবর্ধনা করলেন, এবং দশার্ণরাজ চিত্রাঙ্গদা ও নিষাদরাজ একলব্যের পুত্র যুদ্ধে পরাস্ত হলেন। অর্জুন পুনর্বার দক্ষিণে সমুদ্রের তীর দিয়ে চললেন এবং দ্রাবিড় অন্ধ্র মাহিষক ও কোগিরিবাসী বীরগণকে জয় করে সুরাষ্ট্র গোকর্ণ ও প্রভাস অতিক্রম করে দ্বারকায় এলেন। যাদব কুমারগণ অর্জুনকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু বৃষ্ণি ও অন্ধকগণের অধিপতি উগ্রসেন এবং অর্জুনের মাতুল বসুদেব তাদের নিবারিত করে অর্জুনের সংবর্ধনা করলেন।

তারপর পশ্চিম সমুদ্রের উপকুল এবং সমৃদ্ধ পঞ্চনদ প্রদেশ অতিক্রম করে অশ্ব গান্ধার রাজ্যে এল। গান্ধারপতি শকুনিপুত্র বহু সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করতে এলেন, অর্জুনের অনুরোধেও নিবৃত্ত হলেন না। অর্জুন শরাঘাতে গান্ধার-পতির শিরস্ত্রাণ বিচ্যুত করলেন। গান্ধারপতি ভীত হয়ে সসৈন্যে পলায়ন করলেন, তার বহু সৈন্য অর্জুনের অস্ত্রাঘাতে বিনষ্ট হল। তখন গান্ধাররাজমাতাবৃদ্ধ-মন্ত্রীর সঙ্গে অর্ঘ্যহস্তে অর্জুনের কাছে এসে তাঁকে প্রসন্ন করলেন। শকুনিপুত্রকে সান্ত্বনা দিয়ে অর্জুন বললেন, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে স্মরণ করে আমি তোমার প্রাণহরণ করিনি, কিন্তু তোমার বুদ্ধির দোষে তোমার অনুচরগণ নিহত হল। তারপর অর্জুন শকুনিপুত্রকে যজ্ঞে আসবার জন্য নিমন্ত্রণ করে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন।

১১। অশ্বমেধ যজ্ঞ

মাঘমাসের দ্বাদশী তিথিতে শুভনক্ষত্রযোগে যুধিষ্ঠির তার ভ্রাতাদের ডেকে এনে ভীমসেনকে বললেন, সংবাদ পেয়েছি অর্জুন শীঘ্র ফিরে আসবেন। তুমি যজ্ঞস্থান নিরূপণের জন্য বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের পাঠাও। যুধিষ্ঠিরের আদেশ অনুসারে স্থান নিরূপিত হলে স্থপতিগণ শত শত প্রাসাদ গৃহ স্তম্ভ তোরণ ও পথ সমন্বিত যজ্ঞায়তন নির্মাণ করলেন। আমন্ত্রিত নরপতিগণ বহু রত্ন স্ত্রী অশ্ব ও আয়ুধ নিয়ে উপস্থিত হলেন, তাঁদের শিবিরে সাগরগর্জনের ন্যায় কোলাহল হতে লাগল। যজ্ঞভায় হেতুবাদী বাগ্মী ব্রাহ্মণগণ পরস্পরকে পরাস্ত করবার জন্য তর্ক করতে লাগলেন। আমন্ত্রিত রাজারা ইচ্ছানুসারে বিচরণ করে যজ্ঞের আয়োজন দেখতে লাগলেন। স্থানে স্থানে। স্বর্ণভূষিত যূপকাষ্ঠ, স্থলচর জলচর পার্বত ও আরণ্য বিবিধ পশুপক্ষী ও উদ্ভিদ, অন্নের স্তুপ, দধি ও ঘৃতের হ্রদ প্রভৃতি দেখে তারা বিস্মিত হলেন। এক এক লক্ষ ব্রাহ্মণভোজনের পর দুন্দুভি বাজতে লাগল; প্রতিদিন এইরূপে বহু বার দুন্দুভিধ্বনি শোনা গেল।

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, দ্বারকাবাসী একজন দূত দ্বারা অর্জুন আমাকে এই কথা বলে পাঠিয়েছেন।-কৃষ্ণ, তুমি রাজা যুধিষ্ঠিরকে বলো যেন সমাগত রাজগণের সমুচিত সকার হয়, এবং অর্ঘ্যদানকালে এমন কিছু না করা হয় যাতে রাজাদের বিদ্বেষের ফলে প্রজানাশ হতে পারে (১)। যুধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণ, তোমার কথা শুনে আমি আনন্দিত হয়েছি। শুনেছি অর্জুন যেখানে গেছেন সেখানেই রাজাদের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়েছে। তিনি সর্বদাই দুঃখভোগ করেন, কিন্তু আমি তার দেহে কোনও অনিষ্টসূচক লক্ষণ দেখিনি। কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, পুরুষসিংহ ধনঞ্জয়ের পিণ্ডিকা (পায়ের গুলি) অধিক স্কুল; এই লক্ষণের ফলে তাকে সর্বদা ভ্রমণ করতে হয়; এ ভিন্ন তার দেহে অশুভসূচক আর কিছু আমি দেখি না। যুধিষ্ঠির বললেন, তোমার কথা ঠিক। দ্রৌপদী কৃষ্ণের দিকে অসূয়াসূচক (২) বক্র দৃষ্টিপাত করলেন, কৃষ্ণও সস্নেহে তার সখীর দিকে ফিরে চাইলেন। ভীমসেন প্রভৃতি সকৌতুকে অর্জুনের ওই কথা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।

পরদিন অর্জুন যজ্ঞশ্বসহ হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন এবং ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠির প্রভৃতিকে অভিবাদন করে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করলেন। এই সময়ে মণিপুররাজ বভ্রুবাহনও তার মাতৃদ্বয়ের সহিত উপস্থিত হলেন এবং গুরুজনকে বন্দনার পর পিতামহী কুন্তীর উত্তম ভবনে গেলেন। চিত্রাঙ্গদা ও উলূপী বিনীতভাবে কুন্তী দ্রৌপদী সুভদ্রা প্রভৃতির সহিত মিলিত হলেন। বভ্রুবাহনকে কৃষ্ণ দিব্যাখযুক্ত স্বর্ণভূষিত মহামূল্য রথ উপহার দিলেন; যুধিষ্ঠিরাদিও তাঁকে বিপুল অর্থ দিলেন।

তৃতীয় দিবসে ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে বললেন, যজ্ঞের মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে, আজ থেকে তুমি যজ্ঞ আরম্ভ কর। মহারাজ, এই যজ্ঞে তুমি ব্রাহ্মণগণকে তিন গুণ দক্ষিণা দাও, তাতে তিন অশ্বমেধের ফল পাবে এবং জ্ঞাতিবধের পাপ থেকে মুক্ত হবে। অনন্তর বেদজ্ঞ যাজকগণ যথাবিধি সকল কার্য করতে লাগলেন। বিশ্ব খদির পলাশ এই তিন প্রকার কাষ্ঠের প্রত্যেকের ছয়, দেবদারুর দুই, এবং শ্লেষ্মতক (৩) কাষ্ঠের একটি ঘূপ নির্মিত হল। তা ছাড়া ধর্মরাজের আদেশে ভীম স্বর্ণভূষিত বহু যুপ শোভার জন্য প্রস্তুত করালেন। চারটি অগ্নিস্থান যুক্ত আঠার হাত যজ্ঞবেদী ত্রিকোণ গরুড়াকারে নির্মিত হল। ঋত্বিৰ্গণ নানা দেবতার উদ্দেশে বহু পশু পক্ষী বৃষ ও জলচর আহরণ করলেন। তিন শত পরুশ সঙ্গে যজ্ঞীয় অশ্বও যুপবদ্ধ হল।

অগ্নিতে অন্যান্য পশু যথাবিধি উৎসর্গের পর ব্রাহ্মণগণ শাস্ত্রানুসারে যজ্ঞীয় অশ্ব বধ করে দ্রুপদনন্দিনীকে তার নিকটে বসালেন। তারপর তারা অশ্বের বসা অগ্নিতে দিলেন, ‘যুধিষ্ঠির ও তার ভ্রাতারা সেই সর্বপাপনাশক বসার ধূম আঘ্রাণ করলেন। ষোল জন ঋত্বিক অশ্বের অঙ্গসকল অগ্নিতে আহুতি দিলেন। এইরূপে যজ্ঞ সমাপ্ত হলে সশিষ্য ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরের সংবর্ধনা করলেন। যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণকে সহস্র কোটি নিষ্ক এবং ব্যাসদেবকে বসুন্ধরা দক্ষিণা দিলেন। ব্যাস বললেন, মহারাজ, ব্রাহ্মণরা ধনার্থী, তুমি বসুন্ধরার পরিবর্তে আমাকে ধন দাও। যুধিষ্ঠির বললেন, অশ্বমেধ মহাযজ্ঞে পৃথিবী-দক্ষিণাই বিহিত; অর্জুন যা জয় করেছেন সেই পৃথিবী আমি দান করেছি, আপনারা তা ভাগ করে নিন। এই পৃথিবী এখন ব্রহ্মস্ব, আমি আর তা নিতে পারি না, আমি বনপ্রবেশ করব।

দ্রৌপদী ও ভীমাদি বললেন, মহারাজ যথার্থ বলেছেন। তখন সভাস্থ সকলে রোমাঞ্চিত হলেন, অন্তরীক্ষ থেকে সাধু সাধু ধ্বনি শোনা গেল, ব্রাহ্মণগণ হৃষ্ট হয়ে প্রশংসা করতে লাগলেন।

ব্যাসদেব পুনর্বার বললেন, মহারাজ, আমি তোমাকে পৃথিবী প্রত্যর্পণ করছি, তুমি তার পরিবর্তে সুবর্ণ দাও। কৃষ্ণ বললেন, ধর্মরাজ, আপনি ভগবান ব্যাসের আদেশ পালন করুন। তখন যুধিষ্ঠির ও তার ভ্রাতারা ত্রিগুণ দক্ষিণার কোটি গুণ দান করলেন, ব্যাস তা চার ভাগ করে ঋত্বিকদের মধ্যে বিতরণ করলেন। যজ্ঞায়তনে যে সমস্ত স্বর্ণময় অলংকার তোরণ ঘূপ ঘট স্থালী ইষ্টক প্রভৃতি ছিল, যুধিষ্ঠিরের আদেশে ব্রাহ্মণগণ ভাগ করে নিলেন। অবশিষ্ট দ্রব্য ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ও ম্লেচ্ছগণকে দেওয়া হল। যজ্ঞ সমাপ্ত হলে ব্রাহ্মণরা প্রভূত ধন নিয়ে চলে গেলেন। ব্যাসদেব তাঁর অংশ কুন্তীকে দিলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের সহিত যজ্ঞান্তস্নান করে সমাগত রাজগণকে বহু রত্ন হস্তী অশ্ব স্ত্রী বস্ত্র ও সুবর্ণ উপহার দিলেন এবং বভ্রুবাহনকেও বিপুল ধন দিলেন। রাজারা বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। দুঃশলার বালক পৌত্রকে যুধিষ্ঠির সিন্ধুরাজ্যে অধিষ্ঠিত করলেন। কৃষ্ণ বলরাম প্রভৃতি বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ যথোচিত সৎকার লাভ করে ধর্মরাজের আজ্ঞা নিয়ে দ্বারকায় প্রস্থান করলেন।

**

(১) অর্থাৎ রাজসূয় যজ্ঞের সময় যা ঘটেছিল তেমন যেন না হয়।

(২) বোধ হয় এর অর্থ-কৃত্রিম কোপসূচক।

(৩) বহুবার বা বহুয়ারি।

১২। শক্তদাতা ব্রাহ্মণ-নকুলরূপী ধর্ম

বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে বললেন, মহারাজ, সেই মহাযজ্ঞ সমাপ্ত হলে এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছিল। মহাদানের ফলে যখন ধর্মরাজের যশ সর্ব দিকে ঘোষিত হল এবং আকাশ থেকে তার উপর পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল তখন এক বৃহৎ নকুল যজ্ঞসভায় এল। তার চক্ষু নীল এবং পার্শ্বদেশ (১) স্বর্ণবর্ণ। সে ধৃষ্টভাবে বজ্রকণ্ঠে বললে, ওহে নরপতিগণ, কুরুক্ষেত্রবাসী এক উজীবী বদান্য ব্রাহ্মণ যে শক্তদান করেছিলেন তার সঙ্গে আপনাদের এই যজ্ঞের তুলনা হয় না। নকুলের এই কথা শুনে ব্রাহ্মণরা বললেন, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? কেন এই যজ্ঞের নিন্দা করছ?

নকুল হাস্য করে বললে, দ্বিজগণ, আমি মিথ্যা বলিনি, দর্প করেও বলিনি। ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে এক ব্রাহ্মণ কপোতের ন্যায় উঞ্ছবৃত্তি (২) দ্বারা জীবিকানির্বাহ করতেন। একদা দারুণ দুর্ভিক্ষের ফলে তার সঞ্চয় শূন্য হয়ে গেলে তিনি অতি কষ্টে কিঞ্চিৎ যব সংগ্রহ করে তা থেকে শক্ত প্রস্তুত করলেন। জপ আহ্নিক ও হোমের পর ব্রাহ্মণ সপরিবারে ভোজনের উপক্রম করছেন এমন সময়ে এক ক্ষুধার্ত অতিথি ব্রাহ্মণ এসে আহার চাইলেন। গৃহস্থ ব্রাহ্মণ অতিথিকে সাদরে পাদ্য অর্ঘ্য ও আসন দিয়ে নিজের শর ভাগ নিবেদন করলেন। অতিথি তা খেলেন, কিন্তু তার ক্ষুধানিবৃত্তি হল না। তখন ব্রাহ্মণের পত্নী বললেন, তুমি এঁকে আমার ভাগ দাও।

ব্রাহ্মণ তার ক্ষুধার্ত শ্রান্ত শীর্ণ বৃদ্ধা পত্নীকে বললেন, তোমার ভাগ আমি নিতে পারি না; কীট-পতঙ্গ-মৃগাদিও নিজের স্ত্রীকে পোষণ করে। ধর্ম অর্থ কাম সংসারকার্য সেবা সন্তানপালন সবই ভার্যার সাহায্যে হয়, ভার্যাকে পালন না করলে লোকে নরকে যায়। ব্রাহ্মণী শুনলেন না, নিজের শক্ত অতিথিকে দিলেন। অতিথি তা খেলেন, কিন্তু তথাপি তার তৃপ্তি হল না। তখন ব্রাহ্মণের পুত্র তার অংশ দিতে চাইলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, পুত্র, তোমার বয়স যদি সহস্র বৎসরও হয় তথাপি তুমি আমার দৃষ্টিতে বালক, তোমার অংশ অতিথিকে দিলেন। তথাপি তার ক্ষুধা দূর হল না। তখন ব্রাহ্মণের সাধ্বী পুত্রবধূ নিজ অংশ দিতে চাইলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, কল্যাণী, তোমার দেহ শীর্ণ ও বিবর্ণ, তুমি ক্ষুধার্ত হয়ে আছ, তুমি অনাহারে থাকবে এ আমি কি করে দেখব? পুত্রবধূ শুনলেন না, অগত্যা ব্রাহ্মণ তার অংশও অতিথিকে দিলেন।

তখন অতিথিরূপী ধর্ম বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, তোমার শুদ্ধ দান পেয়ে আমি প্রীত হয়েছি; ওই দেখ, আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, দেব গন্ধর্ব ঋষি প্রভৃতি তোমার দান দেখে বিস্মিত হয়ে স্তব করছেন। ক্ষুধায় প্রজ্ঞা ধৈর্য ও ধর্মজ্ঞান নষ্ট হয়, কিন্তু তুমি ক্ষুধা দমন এবং স্ত্রীপুত্রাদির স্নেহ অতিক্রম করে নিজ কর্ম দ্বারা স্বর্গলোক। জয় করেছ। শক্তদান করে তুমি যে ফল পেয়েছ বহু শত অশ্বমেধেও তা হয় না। দিব্য যান উপস্থিত হয়েছে, তুমি এতে আরোহণ করে পত্নী পুত্র ও পুত্রবধূর সহিত ব্রহ্মলোকে যাও।

অতিথিরূপী ধর্ম এইরূপ বললে ব্রাহ্মণ সপরিবারে স্বর্গে গেলেন। তখন আমি গর্ত থেকে নির্গত হয়ে ভূলুণ্ঠিত হলাম। সিক্ত শক্তৃকণার গন্ধে, দিব্য পুষ্পের মদনে এবং সেই সাধু ব্রাহ্মণের দান ও তপস্যার প্রভাবে আমার মস্তক কাঞ্চনময় হল। আমার অবশিষ্ট দেহও ওইরূপ হবে এই আকাঙ্ক্ষায় আমি তপোবন ও যজ্ঞস্থলে সর্বদা ভ্রমণ করছি। আমি আশান্বিত হয়ে কুরুরাজের এই যজ্ঞে এসেছি, কিন্তু আমার দেহ কাঞ্চনময় হল না। এই কারণেই আমি হাস্য করে বলেছিলাম যে সেই উজীবী ব্রাহ্মণের শক্তদানের সঙ্গে আপনাদের এই যজ্ঞের তুলনা হয় না। নকুল এই কথা বলে চলে গেল। সে অদৃশ্য হলে দ্বিজগণ নিজ নিজ গৃহে প্রস্থান করলেন।

জনমেজয় বললেন, মহর্ষি, আমি মনে করি যজ্ঞের তুল্য পুণ্যফলদায়ক কিছুই নেই; নকুল ইন্দ্রতুল্য রাজা যুধিষ্ঠিরের নিন্দা করলে কেন? বৈশম্পায়ন বললেন, একদা মহর্ষি জমদগ্নি শ্রাদ্ধের জন্য হোমধেনু দোহন করে একটি পবিত্র নূতন ভাণ্ডে দুগ্ধ রেখেছিলেন। সেই সময়ে মহর্ষিকে পরীক্ষা করবার ইচ্ছায় ধর্ম ক্রোধ রূপে সেই ভাণ্ডে প্রবেশ করে দুগ্ধ নষ্ট করলেন। জমদগ্নি ক্রুদ্ধ হলেন না দেখে ধর্ম ব্রাহ্মণরূপে আবির্ভূত হয়ে বললেন, ভৃগুশ্রেষ্ঠ, আমি পরাজিত হয়েছি; ভৃগুবংশীয়গণ। অত্যন্ত ক্রোধী এই অপবাদ মিথ্যা। আমি ভীত হয়েছি, আপনি প্রসন্ন হন। জমদগ্নি বললেন, ক্রোধ, তুমি আমার কাছে কোনও অপরাধ কর নি। আমি পিতৃগণের উদ্দেশে এই দুগ্ধ রেখেছিলাম, তুমি তাদের প্রসন্ন কর। তখন ক্রোধরূপী ধর্ম পিতৃগণের নিকটে গেলেন এবং তাঁদের শাপে নকুলের রূপ পেলেন। শাপমুক্তির জন্য ধর্ম অনুনয় করলে পিতৃগণ বললেন, তুমি ধর্মের নিন্দা কর, তা হলে শাপমুক্ত হবে। নকুল তপোবন ও যজ্ঞস্থানে গিয়ে ধর্মের নিন্দা করতে লাগল। যুধিষ্ঠির সাক্ষাৎ ধর্ম স্বরূপ, সেজন্য তাঁর যজ্ঞের নিন্দা করে নকুল পাপমুক্ত হয়েছিল।

** (১) পরে আছে-মস্তক।

(২) শান্তিপর্ব ২৪-পরিচ্ছেদ পাদটীকা দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *