১২. শান্তিপর্ব

শান্তিপর্ব

॥ রাজধর্মানুশাসনপর্বাধ্যায়॥

১। যুধিষ্ঠির-সকাশে নারদাদি

মৃতজনের তর্পণের পর পাণ্ডবগণ অশৌচমোচনের জন্য গঙ্গাতীরে এক মাস বাস করলেন। সেই সময়ে ব্যাস নারদ দেবল প্রভৃতি মহর্ষিগণ এবং বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, স্নাতক ও গৃহস্থগণ তাদের সঙ্গে দেখা করে কুশলজিজ্ঞাসা করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি ব্রাহ্মণদের অনুগ্রহে এবং কৃষ্ণ ও ভীমার্জুনের শৌর্যে পৃথিবী জয় করেছি, কিন্তু জ্ঞাতিক্ষয় এবং পুত্রদের নিধনের পর আমার এই জয়লাভ পরাজয়ের তুল্য মনে হচ্ছে। আমরা জানতাম না যে কর্ণ আমাদের ভ্রাতা, কিন্তু কর্ণ তা জানতেন, কারণ আমাদের মাতা তাকে বলেছিলেন। তথাপি তিনি কৃতজ্ঞতা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য দুর্যোধনকে ত্যাগ করেননি। আমাদের সেই সহোদর ভ্রাতা অর্জুন কর্তৃক নিহত হয়েছেন। দুর্যোধনের হিতৈষী কর্ণ যখন দূতসভায় আমাদের কটুবাক্য বলেছিলেন তখন তার চরণের সঙ্গে আমাদের জননীর চরণের সাদৃশ্য দেখে আমার ক্রোধ দূর হয়েছিল, কিন্তু সাদৃশ্যের কারণ তখন বুঝতে পারিনি।

দেবর্ষি নারদ কর্ণের জন্ম ও অস্ত্রশিক্ষার ইতিহাস বিকৃত করে বললেন, কর্ণের বাহুবলের সাহায্যেই দুর্যোধন কলিঙ্গরাজ চিত্রাঙ্গদের কন্যাকে স্বয়ংবরসভা থেকে হরণ করেছিলেন। তারপর কর্ণ মগধরাজ জরাসন্ধকে দ্বৈরথযুদ্ধে পরাজিত করলে জরাসন্ধ প্রীত হয়ে তাকে অঙ্গদেশের মালিনী নগরী দান করেন। দুর্যোধনের কাছ থেকে তিনি চম্পা নগরী পালনের ভার পেয়েছিলেন। পরশুরাম ও একজন ব্রাহ্মণ তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, ইন্দ্র তার কবচকুণ্ডল হরণ করেছিলেন, ভীষ্ম অপমানিত হয়ে তাঁকে অর্ধরথ বলেছিলেন, শল্য তাঁর তেজোহানি করেছিলেন। এইসকল কারণে এবং বাসুদেবের কূটনীতির ফলে কর্ণ যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, তার জন্য শোক করা অনুচিত।

কুন্তী কাতর হয়ে বললেন, যুধিষ্ঠির, আমি কর্ণের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, তার জনক দিবাকরও স্বপ্নযোগে তাকে অনুরোধ করেছিলেন, তথাপি আমরা তোমার সঙ্গে কর্ণের মিলন ঘটাতে পারি নি। যুধিষ্ঠির বললেন, কর্ণের পরিচয় গোপন করে আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। মহাতেজা যুধিষ্ঠির দুঃখিত-মনে অভিশাপ দিলেন-স্ত্রীজাতি কিছুই গোপন করতে পারবে না।

২। যুধিষ্ঠিরের মনস্তাপ

শোকসন্তপ্ত যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, ক্ষত্রিয়াচার পৌরুষ ও ক্রোধকে ধিক, যার ফলে আমাদের এই বিপদ হয়েছে। আমাদের জয় হয়নি, দুর্যোধনেরও জয় হয়নি; তাঁকে বধ করে আমাদের ক্রোধ দূর হয়েছে, কিন্তু আমি শোকে বিদীর্ণ হচ্ছি। ধনঞ্জয়, আমার রাজ্যে প্রয়োজন নেই, তুমিই রাজ্যশাসন কর; আমি নিদ্বন্দ্ব নির্মম হয়ে তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য বনে যাব, চীর ও জটা ধারণ করে তপস্যা করব, ভিক্ষান্নে জীবিকানির্বাহ করব। বহু কাল পরে আমার প্রজ্ঞার উদয় হয়েছে, এখন আমি অব্যয় শাশ্বত স্থান লাভ করতে ইচ্ছা করি।

অর্জুন অসহিষ্ণু হয়ে ঈষৎ হাস্য করে বললেন, আপনি অমানুষিক কর্ম সম্পন্ন করে এখন শ্রেষ্ঠ সম্পদ ত্যাগ করতে চান! যে ক্লীব বা দীর্ঘসূত্রী তার রাজ্যভোগ কি করে হবে? আপনি রাজকুলে জন্মেছেন, সমগ্র বসুন্ধরা জয় করেছেন, এখন মূঢ়তার বশে ধর্ম ও অর্থ ত্যাগ করে বনে যেতে চাচ্ছেন! মহারাজ, অর্থ থেকেই ধর্ম কাম ও স্বর্গ হয়, অর্থ না থাকলে লোকের প্রাণযাত্রাও অসম্ভব হয়। দেবগণও তাদের জ্ঞাতি অসুরগণকে বধ করে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন। রাজা যদি অন্যের ধন হরণ না করেন তবে কি করে ধর্মকার্য করবেন? এখন সর্বদক্ষিণাযুক্ত যজ্ঞ করাই আপনার কর্তব্য, নতুবা আপনার পাপ হবে। মহারাজ, আপনি কুপথে যাবেন না।

ভীম বললেন, মহারাজ, আপনি মন্দবুদ্ধি বেদপাঠক ব্রাহ্মণের ন্যায় কথা বলছেন। আপনি আলস্যে দিনযাপন করতে চান তাই রাজধর্মকে অবজ্ঞা করছেন। আপনার এমন বুদ্ধি হবে জানলে আমরা যুদ্ধ করতাম না। আমাদেরই দোষ, বলশালী কৃতবিদ্য ও মনস্বী হয়েও আমরা একজন ক্লীবের বশে চ’লেছি। বনে গিয়ে মৌনব্রত ও কপট ধর্ম অবলম্বন করলে আপনার মৃত্যুই হবে, জীবিকানির্বাহ হবে না।

নকুল-সহদেবও যুধিষ্ঠিরকে নানাপ্রকারে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তারপর দ্রৌপদী বললেন, মহারাজ, তোমার ভ্রাতারা চাতক পক্ষীর ন্যায় শুষ্ক কণ্ঠে অনেক কথা বললেন, কিন্তু তুমি উত্তর দিয়ে এঁদের আনন্দিত করছ না।

স ত্বৎ ভ্রাতৃনিমান্ দৃষ্টিবা প্রতিনন্দস্ব ভারত।

ঋষভানিব মন্মত্তান্  
গজেন্দ্রানূর্জিতানিব।।

অভ্যন্তরীণ সর্বে শত্রুসাহাঃ পরন্তপা।

একোহপি হি সুখায়ৈষাং মম সাদ্যিতি মে মতিঃ।।

কিং পুনঃ পুরুষব্যাঘ্র পতয়ো 
মে নরর্ষভাঃ।

সমস্তানীন্দ্রিয়াণীব শরীরস্য 
বিচেষ্টনে।।..

য়েষামুন্মত্তকো জ্যেষ্ঠঃ সর্বে তেহপানুসারিণঃ।

তবোন্মাদান্ মহারাজ সোন্মাদাঃ সর্বপান্ডবাঃ।।

যদি হি স্যুরনুন্মত্তা ভ্রাতরস্তে নরাধিপ।

বধ্বা ত্বাং নাস্তিকৈঃ সার্ধং প্রশাসেযুর্বসুন্ধরাম।।

-এঁরা সকলেই দেবতুল্য, এঁদের প্রত্যেকেই আমাকে সুখী করতে পারেন। পঞ্চেন্দ্রিয় যেমন মিলিত হয়ে শরীরের ক্রিয়া সম্পাদন করে সেইরূপ আমার পঞ্চ পতি কি আমাকে সুখী করতে পারেন না? ধর্মরাজ, তুমি উন্মত্ত হয়েছ, তোমার ভ্রাতারাও যদি উন্মত্ত না হতেন তবে তোমাকে বেঁধে রেখে রাজ্যশাসন করতেন। নৃপশ্রেষ্ঠ, ব্যাকুল হয়ো না, পৃথিবী শাসন কর, ধর্মানুসারে প্রজাপালন কর।

অর্জুন পুনর্বার বললেন, মহারাজ, রাজদণ্ডই প্রজা শাসন করে, ধর্ম অর্থ কাম এই ত্রিবর্গকে দণ্ডই রক্ষা করে। রাজার শাসন না থাকলে তোক বিনষ্ট হয়। ধর্মত বা অধৰ্মত যে উপায়েই হ’ক আপনি এই রাজ্য লাভ করেছেন, এখন শোক ত্যাগ করে ভোগ করুন, যজ্ঞ ও দান করুন, প্রজাপালন ও শত্রুনাশ করুন।

ভীম বললেন, আপনি সর্বশাস্ত্রজ্ঞ নরপতি, কাপুরুষের ন্যায় মোহগ্রস্ত হচ্ছেন কেন? আপনি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন, এখন নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করুন। পিতৃপিতামহের অনুসরণ করে রাজ্যশাসন ও অশ্বমেধ যজ্ঞ করুন, আমরা এবং বাসুদেব আপনার কিংকর রয়েছি।

যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, অজ্ঞ লোকে নিজের উদরের জন্যই প্রাণিহিংসা করে, অতএব সেই উদরকে জয় কর, অল্পাহারে উদরাগ্নি প্রশমিত কর। রাজারা কিছুতেই সন্তুষ্ট হন না, কিন্তু সন্ন্যাসী অল্পে তুষ্ট হন। অর্জুন, দুইপ্রকার বেদবচন আছে-কর্ম কর, কর্ম ত্যাগ কর। তুমি যুদ্ধশাস্ত্রই জান, ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্বে প্রবেশ করতে পারবে না। মোক্ষার্থিগণ সন্ন্যাস দ্বারাই পরমগতি লাভ করেন।

মহাতপা মহর্ষি দেবস্থান ও ব্যাসদেব বহু উপদেশ দিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মন শান্ত হল না। তিনি বললেন, বাল্যকালে যাঁর ক্রোড়ে আমি খেলা করেছি সেই ভীষ্ম আমার জন্য নিপাতিত হয়েছেন, আমার মিথ্যা কথার ফলে আচার্য দ্রোণ বিনষ্ট হয়েছেন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্ণকেও আমি নিহত করিয়েছি, আমার রাজ্যলোভের জন্যই বালক অভিমন্যু প্রাণ দিয়েছে, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র বিনষ্ট হয়েছে। আমি পৃথিবীনাশক পাপী, আমি ভোজন করব না, পান করব না, প্রায়োপবেশনে শরীর শুষ্ক করব। তপোধনগণ, আপনারা অনুমতি দিন, আমি এই কলেবর ত্যাগ করব।

অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, মাধব, ধর্মপুত্র শোকার্ণবে মগ্ন হয়েছেন, তুমি এঁকে আশ্বাস দাও। যুধিষ্ঠিরের চন্দনচর্চিত পাষাণতুল্য বাহু ধারণ করে কৃষ্ণ বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, শোক সংবরণ করুন, যাঁরা যুদ্ধে মরেছেন তাদের আর ফিরে পাবেন না। সেই বীরগণ অস্ত্রপ্রহারে পূত হয়ে স্বর্গে গেছেন, তাদের জন্য শোক করা উচিত নয়। ব্যাসদেব বললেন, যুধিষ্ঠির, তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম অনুসারেই ক্ষত্রিয়দের বিনষ্ট করেছ। যে লোক জেনে শুনে পাপকর্ম করে এবং তার পর নির্লজ্জ থাকে তাকেই পূর্ণ পাপী বলা হয়; এমন পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই। কিন্তু তুমি শুদ্ধস্বভাব, যা করেছ। তা দুর্যোধনাদির দোষে অনিচ্ছায় করেছ এবং অনুতপ্তও হয়েছ। এরূপ পাপের প্রায়শ্চিত্ত মহাযজ্ঞ অশ্বমেধ; তুমি সেই যজ্ঞ করে পাপমুক্ত হও।

তারপর ব্যাসদেব নানাপ্রকার পাপকর্ম এবং সে সকলের উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত বিবৃত করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ভগবান, আমি রাজধর্ম, চতুর্বর্ণের ধর্ম, আপকালোচিত ধর্ম প্রভৃতি সবিস্তারে শুনতে ইচ্ছা করি। ব্যাস বললেন, তুমি যদি সর্বপ্রকার ধর্ম জানতে চাও তবে কুরুপিতামহ ভীষ্মের কাছে যাও, তিনি তোমার সমস্ত সংশয় ছেদন করবেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি জ্ঞাতিসংহার করেছি, ছল করে ভীষ্মকে নিপাতিত করেছি, এখন কোন্ মুখে তার কাছে গিয়ে ধর্মজিজ্ঞাসা করব?

কৃষ্ণ বললেন, নৃপশ্রেষ্ঠ, ভগবান ব্যাস যা বললেন তাই আপনি করুন। গ্রীষ্মকালের অন্তে লোকে যেমন মেঘের উপাসনা করে সেইরূপ আপনার প্রজারা, হতাবশিষ্ট রাজারা এবং কুরুজাঙ্গলবাসী ব্রাহ্মণাদি চতুবর্ণের প্রজারা প্রার্থী রূপে আপনার কাছে সমবেত হয়েছেন। আপনি আমাদের সকলের প্রীতির নিমিত্ত লোকহিতে নিযুক্ত হন।

কৃষ্ণ, ব্যাস, দেবস্থান, ভ্রাতৃগণ, এবং অন্যান্য বহু লোকের অনুনয় শুনে মহাযশা যুধিষ্ঠিরের মনস্তাপ দূর হল , তিনি শান্তিলাভ করে নিজের কর্তবহিত হলেন। তারপর ধৃতরাষ্ট্রকে পুরোবর্তী করে এবং সুহৃঙ্গণে পরিবেষ্টিত হয়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সমারোহ সহকারে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলেন।

৩। চার্বাকবধ-যুধিষ্ঠিরের অভিষেক

রাজভবনে প্রবেশ করে যুধিষ্ঠির দেবতা ও সমবেত ব্রাহ্মণগণের যথাবিধি অর্চনা করলেন। দুর্যোধনের সখা চার্বাক রাক্ষস ভিক্ষুর ছদ্মবেশে শিখা দণ্ড ও জপমালা ধারণ করে সেখানে উপস্থিত ছিল। ব্রাহ্মণদের অনুমতি না নিয়েই সে যুধিষ্ঠিরকে বললে, কুন্তীপুত্র, এই দ্বিজগণ আমার মুখে তোমাকে বলছেন—তুমি জ্ঞাতিহা কুনৃপতি, তোমাকে ধিক। জ্ঞাতি ও গুরুজনদের হত্যা করে তোমার রাজ্যে কি প্রয়োজন? মূত্যই তোমার পক্ষে শ্রেয়। যুধিষ্ঠির ব্যাকুল হয়ে বললেন, বিপ্রগণ, আমি প্রণত হয়ে বলছি, আপনারা প্রসন্ন হন; আমার মরণ আসন্ন, আপনারা ধিক্কার দেবেন না।

ব্রাহ্মণগণ জ্ঞানচক্ষু দ্বারা চার্বাককে চিনতে পেরে বললেন, ধর্মরাজ, এ দুর্যোধনসখা চার্বাক রাক্ষস। আমরা আপনার নিন্দা করি নি, আপনার ভয় দূর হ’ক। তার পর সেই ব্রহ্মবাদী বিপ্রগণ ক্রোধে অধীর হয়ে হুংকার করলেন, চার্বাক দগ্ধ হয়ে ভূপতিত হল।

কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, পুরাকালে সত্যযুগে এই চার্বাক রাক্ষস বদরিকাশ্রমে। তপস্যা করে ব্রহ্মার নিকট অভয়বর লাভ করেছিল। বর পেয়ে পাপী রাক্ষস দেবগণের উপর উৎপীড়ন করতে লাগল। দেবগণ শরণাপন্ন হলে ব্রহ্মা বললেন, ভবিষ্যতে এই রাক্ষস দুর্যোধন নামক এক রাজার সখা হবে এবং ব্রাহ্মণগণের অপমান করবে; তখন বিপ্রগণ রুষ্ট হয়ে পাপী চার্বাককে দগ্ধ করবেন। ভরতশ্রেষ্ঠ, সেই পাপী চার্বাকই। এখন ব্রহ্মতেজে বিনষ্ট হয়েছে। আপনার জ্ঞাতি ক্ষত্রিয়বীরগণ নিহত হয়ে স্বর্গে। গেছেন, আপনি শোক ও গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে এখন কর্তব্য পালন করুন।

তারপর যুধিষ্ঠির হৃষ্টচিত্তে স্বর্ণময় পীঠে পূর্বমুখ হয়ে বসলেন। কৃষ্ণ ও সাত্যকি তাঁর সম্মুখে এবং ভীম ও অর্জুন দুই পার্শ্বে উপবিষ্ট হলেন। নকুল-সহদেবের সহিত কুন্তী এক স্বর্ণভূষিত গজদন্তের আসনে বসলেন। গান্ধারী যুযুৎসু ও সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের নিকটে আসন গ্রহণ করলেন। প্রজাবর্গ নানাপ্রকার মাঙ্গলিক দ্রব্য নিয়ে ধর্মরাজকে দর্শন করতে এল। কৃষ্ণের অনুমতিক্রমে পুরোহিত ধৌম্য একটি বেদীর উপর ব্যাঘ্রচর্মাবৃত সর্বতোভদ্র নামক আসনে মহাত্মা যুধিষ্ঠির ও দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণাকে বসিয়ে যথাবিধি হোম করলেন। কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য শঙ্খ থেকে জল ঢেলে যুধিষ্ঠিরকে অভিষিক্ত করলেন, প্রজাবৃন্দসহ ধৃতরাষ্ট্রও জলসেক করলেন। পণব আনক ও দুন্দুভি বাজতে লাগল। যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদের প্রচুর দক্ষিণা দিলেন, তাঁরা আনন্দিত হয়ে স্বস্তি ও জয় উচ্চারণ করে রাজার প্রশংসা করতে লাগলেন।

যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা ধন্য, কারণ, সত্য বা মিথ্যা যাই হ’ক, ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠগণ পাণ্ডবদের গুণকীর্তন করছেন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আমাদের পিতা এবং পরমদেবতা, আমি এঁর সেবা করব সেজন্য জ্ঞাতিহত্যার পরেও প্রাণধারণ করে আছি। সুহৃঙ্গণ, যদি আমার উপর তোমাদের অনুগ্রহ থাকে তবে তোমরা ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি পূর্বের ন্যায় ব্যবহার করবে। ইনি তোমাদের ও আমার অধিপতি, সমস্ত পৃথিবী ও পাণ্ডবগণ এঁরই অধীন। আমার এই কথা তোমরা মনে রেখো।

পুরবাসী ও জনপদবাসীদের বিদায় দিয়ে যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তিনি বিদুরকে মন্ত্রণা ও সন্ধিবিগ্রহাদির ভার, সঞ্জয়কে কর্তব্য-অকর্তব্য ও আয়ব্যয় নিরুপণের ভার, নকুলকে সৈন্যগণের তত্ত্বাবধানের ভার, শত্রুরাজ্যের অবরোধ ও দুষ্টদমনের ভার, এবং পুরোহিত ধৌম্যকে দেবতাব্রাহ্মণাদির সেবার ভার দিলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে সহদেব সর্বদা নিকটে থেকে তাকে রক্ষা করতে লাগলেন। অন্যান্য কর্মে উপযুক্ত লোক নিযুক্ত করে ধর্মরাজ বিদুর সঞ্জয় ও যুযুৎসুকে বললেন, আমার পিতা রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সকল কার্যে আপনারা অবহিত থাকবেন এবং পুরবাসী ও জনপদবাসীর কার্যও তার অনুমতি নিয়ে করবেন।

যুধিষ্ঠির নিহত যোদ্ধাদের ঔর্ধ্বদেহিক সকল কর্ম সম্পাদন করে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী প্রভৃতি এবং পতিপুত্রহীনা নারীগণকে সসম্মানে পালন করতে লাগলেন। তিনি দরিদ্র অন্ধ প্রভৃতির ভরণপোষণের যথোচিত ব্যবস্থা করলেন এবং শত্রুজয়ের পর অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সুখে কালযাপন করতে লাগলেন।

ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে যুধিষ্ঠির ভীমকে দুর্যোধনের ভবন, অর্জুনকে দুঃশাসনের ভবন, নকুলকে দুর্মর্ষণের ভবন এবং সহদেবকে দুমুখের ভবন দান করলেন। তিনি পুরোহিত ধৌম্য ও সহস্র স্নাতক ব্রাহ্মণকে বহু ধন দিলেন, ভৃত্য আশ্রিত অতিথি প্রভৃতিকে অভীষ্ট বস্তু দিয়ে তুষ্ট করলেন, কৃপাচার্যের জন্য গুরুর উপযুক্ত বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন, এবং বিদুর ও যুযুৎসুকেও সম্মানিত করলেন।

৪। ভীষ্ম-সকাশে কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরাদি

একদিন যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের গৃহে গিয়ে দেখলেন, তিনি পীত কৌষেয় বস্ত্র পরে দিব্যাভরণে ভূষিত হয়ে বক্ষে কৌস্তুভ মণি ধারণ করে একটি বৃহৎ পর্যঙ্কে আসীন রয়েছেন। ধর্মরাজ কৃতাঞ্জলি হয়ে সম্ভাষণ করলেন, কিন্তু কৃষ্ণ উত্তর দিলেন না, ধ্যানস্থ হয়ে রইলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, কি আশ্চর্য, অমিতবিক্ৰম মাধব, তুমি ধ্যান করছ! ত্রিলোকের মঙ্গল তো? ভগবান, তুমি নিবাতনিষ্কম্প দীপ এবং পাষাণের ন্যায় নিশ্চল হয়ে আছ। যদি গোপনীয় হয় এবং আমি যদি শোনবার যোগ্য হই তবে তোমার এই ধ্যানের কারণ আমাকে বল।

ঈষৎ হাস্য করে কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, শরশয্যাশায়ী ভীষ্ম আমাকে ধ্যান করছেন। সেজন্য আমার মন তার দিকে গিয়েছিল। এই পুরুষশ্রেষ্ট স্বর্গে গেলে পৃথিবী চন্দ্রহীন রাত্রির তুল্য হবে। আপনি তার কাছে গিয়ে আপনার যা জানবার আছে জিজ্ঞাসা করুন। যুধিষ্ঠির বললেন, মাধব, তোমাকে অগ্রবর্তী করে আমরা ভীষ্মের কাছে। যাব। কৃষ্ণ সাত্যকিকে আদেশ দিলেন, আমার রথ সজ্জিত করতে বল।

এই সময়ে দক্ষিণায়ন শেষ হয়ে উত্তরায়ণ আরম্ভ হয়েছিল। ভীষ্ম একাগ্রচিত্তে তার আত্মাকে পরমাত্মায় সমাবিষ্ট করে কৃষ্ণের ধ্যান করতে লাগলেন। ব্যাস নারদ অসিত বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র বৃহস্পতি শুক্র কপিল বাল্মীকি ভার্গব কশ্যপ প্রভৃতি ভীষ্মকে বেষ্টন করে রইলেন।

কৃষ্ণ, সাত্যকি, যুধিষ্ঠির ও তার ভ্রাতারা, কৃপাচার্য, যুযুৎসু, এবং সঞ্জয় রথারোহণে কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। তারা দেখলেন, ওঘবতী নদীর তীরে পবিত্র স্থানে ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে আছেন, মুনিগণ তার উপাসনা করছেন। ব্যাসাদি মহর্ষিগণকে অভিবাদন করে কৃষ্ণ কিঞ্চিৎ কাতর হয়ে ভীষ্মকে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে প্রশ্ন করলেন। তার পর কৃষ্ণ বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি যখন সুস্থদেহে সমৃদ্ধ রাজ্যে বাস করতেন তখন সহস্র নারীতে পরিবৃত হলেও আপনাকে ঊর্ধ্বরেতা দেখেছি। আপনি ভিন্ন অপর কেউ মৃত্যুকে রোধ করে শরশয্যায় শুয়ে থাকতে পারে এমন আমরা শুনিনি। সর্বপ্রকার ধর্মের তত্ত্ব আপনার জানা আছে; এই জ্যেষ্ঠপাণ্ডব জ্ঞাতিবধের জন্য সন্তপ্ত হয়েছেন, এঁর শোক আপনি দূর করুন।

কুরুপ্রবীর, আপনার জীবনের আর ছাপ্পান্ন (১) দিন অবশিষ্ট আছে, তার পরেই আপনি দেহত্যাগ করবেন। আপনি পরলোকে গেলে সমস্ত জ্ঞানই লুপ্ত হবে এই কারণে যুধিষ্ঠিরাদি আপনার কাছে ধর্মজিজ্ঞাসা করতে এসেছেন।

ভীষ্ম কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, নারায়ণ, তোমার কথা শুনে আমি হর্ষে আপ্লুত হয়েছি। বাকপতি, তোমার কাছে আমি কি বলব? সমস্ত বক্তব্যই তোমার বাক্যে নিহিত আছে। দুর্বলতার ফলে আমার বাশক্তি ক্ষীণ হয়েছে, দিক আকাশ ও পৃথিবীর বোধও লোপ পেয়েছে, কেবল তোমার প্রভাবেই জীবিত রয়েছি। কৃষ্ণ, তুমি শাশ্বত জগৎকর্তা, গুরু উপস্থিত থাকতে শিষ্যতুল্য আমি কি করে উপদেশ দেব?

কৃষ্ণ বললেন, গঙ্গানন্দন ভীষ্ম, আমার বরে আপনার গ্লানি মোহ কষ্ট ক্ষুৎসিপাসা কিছুই থাকবে না, সমস্ত জ্ঞান আপনার নিকট প্রকাশিত হবে, ধর্ম ও অর্থের তত্ত্ব সম্বন্ধে আপনার বুদ্ধি তীক্ষ হবে, আপনি জ্ঞানচক্ষু দ্বারা সর্ব জীবই দেখতে পাবেন। কৃষ্ণ এই কথা বললে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল , বিবিধ বাদ্য বেজে উঠল, অপ্সরারা গান করতে লাগল, সুখস্পর্শ সুগন্ধ বায়ু প্রবাহিত হল। এই সময়ে পশ্চিম দিকের এক প্রান্তে অস্তগামী দিবাকর যেন বন দগ্ধ করতে লাগলেন। সন্ধ্যা সমাগত দেখে মহর্ষিগণ গাত্রোত্থান করলেন, কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরাদিও ভীষ্মের নিকট বিদায় নিয়ে প্রস্থান করলেন।

** (১) মূলে আছে-‘পঞ্চাশতং ষট্ চ কুরুপ্রবীর শেষং দিনানাং তব জীবিতস্য। এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। অনুশাসনপর্ব ২১-পরিচ্ছেদে ভীষ্ম তার মৃত্যুর সময়ে বলেছেন তিনি আটান্ন দিন শরশয্যায় শুয়ে আছেন।

৫। রাজধর্ম

পরদিন কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরাদি ও সাত্যকি পুনর্বার ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন। নারদপ্রমুখ মহর্ষিগণ এবং ধৃতরাষ্ট্রও সেখানে এলেন। কৃষ্ণ কুশলপ্রশ্ন করলে ভীষ্ম বললেন, জনার্দন, তোমার প্রসাদে আমার সন্তাপ মোহ ক্লান্তি গ্লানি সবই দূর হয়েছে, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সমস্তই আমি করতলস্থ ফলের ন্যায় প্রত্যক্ষ দেখছি, সর্বপ্রকার ধর্ম আমার মনে পড়ছে, শ্রেয়স্কর বিষয় বলবার শক্তিও আমি পেয়েছি। এখন ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির আমাকে ধর্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করুন।

কৃষ্ণ বললেন, পূজনীয় গুরুজন ও আত্মীয়বান্ধব বিনষ্ট করে ধর্মরাজ লজ্জিত হয়েছেন, অভিশাপের ভয়ে ইনি আপনার সম্মুখে আসতে পারছেন না। ভীষ্ম বললেন, পিতা পিতামহ ভ্রাতা গুরু আত্মীয় এবং বান্ধবগণ যদি অন্যায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন তবে তাদের বধ করলে ধর্মই হয়। তখন যুধিষ্ঠির সম্মুখে গিয়ে ভীষ্মের চরণ ধারণ করলেন। ভীষ্ম আশীর্বাদ করে বললেন, বৎস, উপবিষ্ট হও, তুমি নির্ভয়ে আমাকে প্রশ্ন কর। যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, ধর্মজ্ঞরা বলেন যে নৃপতির পক্ষে রাজধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম; এই ধর্ম জীবলোকের অবলম্বন। রশ্মি যেমন অশ্বকে, অঙ্কুশ যেমন হস্তীকে, সেইরূপ রাজধর্ম সকল লোককে নিয়ন্ত্রিত করে। অতএব আপনি এই ধর্ম সম্বন্ধে বলুন।

ভীষ্ম বললেন, মহান ধর্ম, বিধাতা কৃষ্ণ ও ব্রাহ্মণগণকে নমস্কার করে আমি শ্বাশ্বত ধর্ম বিবৃত করছি। কুরুশ্রেষ্ঠ, দেবতা ও দ্বিজগণের প্রীতিসম্পাদনের জন্য রাজা শাস্ত্রবিধি অনুসারে সকল কর্ম করবেন। বৎস যুধিষ্ঠির, তুমি সর্বদা উদ্যােগী হয়ে কর্ম করবে, পুরুষকার ভিন্ন কেবল দৈবে রাজকার্য সিদ্ধ হয় না। তুমি সকল কার্যই সরলভাবে করবে, কিন্তু নিজের ছিদ্রগোপন, পরের ছিদ্রান্বেষণ, এবং মন্ত্রণাগোপন বিষয়ে সরল হবে না। ব্রাহ্মণকে শারীরিক দণ্ড দেবে না, গুরুতর অপরাধ করলে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করবে। শাস্ত্রে ছয় প্রকার দুর্গ উক্ত হয়েছে, তারমধ্যে নরদুর্গই সর্বাপেক্ষা দুর্ভেদ্য; অতএব প্রজাগণের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে যাতে তারা অনুরক্ত থাকে। রাজা সর্বদা মৃদু হবেন না, সর্বদা কঠোরও হবেন না, বসন্তকালীন সূর্যের ন্যায় নাতিশীতোষ্ণ হবেন। গর্ভিণী যেমন নিজের প্রিয় বিষয় ত্যাগ করে গর্ভেরই হিতসাধন করে, রাজাও সেইরূপ নিজের হিতচিন্তা না করে প্রজারই হিতসাধন করবেন। ভৃত্যের সঙ্গে অধিক পরিহাস করবে না; তাতে তারা প্রভুকে অবজ্ঞা করে, তিরস্কার করে, উৎকোচ নিয়ে এবং বঞ্চনার দ্বারা রাজকার্য নষ্ট করে, প্রতিরূপকের (জাল শাসনপত্রাদির) সাহায্যে রাজাকে জীর্ণ করে। তারা বেতনে সন্তুষ্ট থাকে না, রাজার অর্থ হরণ করে, লোককে বলে বেড়ায়, আমরাই রাজাকে চালাচ্ছি।

যুধিষ্ঠির, রাজ্যের সাতটি অঙ্গ আছে—অমাত্য সুহৃৎ কোষ রাষ্ট্র দুর্গ ও সৈন্য। যে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, গুরু বা মিত্র হলেও তাকে বধ করতে হবে। রাজা কাকেও অত্যন্ত অবিশ্বাস বা অভ্যন্ত বিশ্বাস করবেন না। তিনি সাধু লোকের ধন হরণ করবেন না, অসাধুরই ধন নেবেন এবং সাধু লোককে দান করবেন। যার রাজ্যে প্রজাগণ পিতার গৃহে পুত্রের ন্যায় নির্ভয়ে বিচরণ করে সেই রাজাই শ্রেষ্ঠ। শুক্রাচার্য তার রামচরিত আখ্যানে এই শ্লোকটি বলেছেন-

রাজানং প্রথমং বিন্দেৎ ততো ভার্যাং ততো ধনম্।

রাজন্যসতি লোস্য কুতো ভার্যা কুততা ধনম্।

-প্রথমেই কোনও রাজার আশ্রয় নেবে, তার পর ভার্যা আনবে, তার পর ধন আহরণ করবে; রাজা না থাকলে ভার্যা কি করে ধনই বা কি করে থাকবে?

ভীষ্মের উপদেশ শুনে ব্যাসদেব কৃষ্ণ কৃপ সাত্যকি প্রভৃতি আনন্দিত হয়ে সাধু সাধু বললেন। যুধিষ্ঠির সজলনয়নে ভীষ্মের পাদস্পর্শ করে বললেন, পিতামহ, সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, কাল আবার আপনার কাছে আসব।

৬। বেণ ও পৃথু রাজার কথা

পরদিন যুধিষ্ঠিরাদি পুনর্বার ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হলেন। ব্যাস প্রভৃতি ঋষি ও ভীষ্মকে অভিবাদনের পর যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, পিতামহ, রাজা’শব্দের উৎপত্তি কি করে হল তা বলুন। রাজা কি প্রকারে পৃথিবী রক্ষা করেন? লোকে কেন তার অনুগ্রহ চায় ?

ভীষ্ম বললেন, নরশ্রেষ্ঠ, সত্যযুগের প্রথমে যেভাবে রাজপদের উৎপত্তি হয় তা বলছি শোন। পুরাকালে রাজা ছিল না, রাজ্য ও দণ্ডও ছিল না, দণ্ডাৰ্হ লোকও ছিল না, প্রজারা ধর্মানুসারে পরস্পরকে রক্ষা করত। ক্রমশ মোহের বশে লোকের ধর্মজ্ঞান নষ্ট হল , বেদও লুপ্ত হল তখন দেবতারা ব্রহ্মার শরণ নিলেন। ব্রহ্মা এক লক্ষ অধ্যায়যুক্ত একটি নীতিশাস্ত্র রচনা করে তাতে ধর্ম-অর্থ-কাম এই ত্রিবর্গ এবং মোক্ষবিষয়ক চতুর্থ বর্গ বিবৃত করলেন। এই শাস্ত্রে তিন বেদ, আন্থীক্ষিকী (তর্কবিদ্যা), বার্তা (কৃষিবাণিজ্যাদি বৃত্তি), দণ্ডনীতি, সাম দান দণ্ড ভেদ উপেক্ষা এই পঞ্চ উপায়, সন্ধিবিগ্রহাদি, যুদ্ধ, দুর্গ, বিচারালয়ের কার্য, এবং আরও অনেক বিষয় বর্ণিত হয়েছে। মানুষ অল্পায়ু, এই বুঝে মহাদেব সেই নীতিশাস্ত্রকে সংক্ষিপ্ত করলেন, তার পর ইন্দ্র বৃহস্পতি ও যোগাচার্য শুক্র ক্রমশ আরও সংক্ষিপ্ত করলেন।

দেবগণ প্রজাপতি বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বললেন, মানুষের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ হবার যোগ্য তা বলুন। বিষ্ণু বিরজা নামে এক মানসপুত্র সৃষ্টি করলেন। বিরজার অধস্তন পুরুষ যথাক্রমে কীর্তিমান কদম অনঙ্গ নীতিমান (বা অতিবল) ও বেণ। বেণ অধার্মিক ও প্রজাপীড়ক ছিলেন, সেজন্য ঋষিগণ মন্ত্রপূত কুশ দিয়ে তাকে বধ করলেন। তার পর তারা বেণের দক্ষিণ ঊরু মন্থন করলেন, তা থেকে এক খবদেহ কদাকার দগ্ধকাষ্ঠতুল্য পুরুষ উৎপন্ন হল। ঋষিরা তাকে বললেন, “নিষীদ’-উপবেশন কর। এই পুরুষ থেকে বনপর্বতবাসী নিষাদ ও ম্লেচ্ছ সকল উৎপন্ন হল। তার পর ঋষিরা বেণের দক্ষিণ হস্ত মন্থন করলেন, তা থেকে ইন্দ্রের ন্যায় রূপবান একটি পুরুষ উৎপন্ন হলেন। ইনি ধনুর্বাণধারী, বেদ-বেদাঙ্গ-ধনুর্বেদে পারদর্শী এবং দণ্ডনীতিজ্ঞ। দেবতা ও মহর্ষিগণ এই বেণপুত্রকে বললেন, তুমি নিজের প্রিয়-অপ্রিয় এবং কাম ক্রোধ লোভ মান ত্যাগ করে সর্বজীবের প্রতি সমদর্শী হবে এবং ধর্মভ্রষ্ট মানুষকে দণ্ড দেবে; তুমি প্রতিজ্ঞা কর যে কায়মনোবাক্যে বেদ-নির্দিষ্ট ও দণ্ডনীতিসম্মত ধর্ম পালন করবে, দ্বিজগণকে দণ্ড দেবে না এবং বর্ণসংকরদোষ নিবারণ করবে। বেণপুত্র প্রতিজ্ঞা করলে শুক্রাচার্য তার পুরোহিত হলেন, বালখিল্য প্রভৃতি মুনিরা তার মন্ত্রী হলেন এবং গর্গ তার জ্যোতিষী হলেন।

এই বেণপুত্র পৃথু বিষ্ণু থেকে অষ্টম পুরুষ। পূর্বোৎপন্ন সূত ও মাগধ নামক দুই ব্যক্তি পৃথুর স্তুতিপাঠক হলেন। পৃথু সূতকে অনূপ-দেশ (কোনও জলময় দেশ) এবং মাগধকে মগধ দেশ দান করলেন। ভূপৃষ্ঠ অসমতল ছিল, পৃথু তা সমতল করলেন। বিষ্ণু, ইন্দ্রাদি দেবগণ ও ঋষিগণ পৃথুকে পৃথিবীর রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। পৃথুর রাজত্বকালে জরা দুর্ভিক্ষ ব্যাধি তস্কর প্রভৃতির ভয় ছিল না, তিনি পৃথিবী দোহন করে সপ্তদশ প্রকার শস্য ও বিবিধ অভীষ্ট বস্তু উৎপাদন করেছিলেন। ধর্মপরায়ণ পৃথু প্রজারঞ্জন করতেন সেজন্য রাজা’, এবং ব্রাহ্মণগণকে ক্ষত (বিনাশ বা ক্ষতি) থেকে ত্রাণ করতেন সেজন্য ক্ষত্রিয়’ উপাধি পেয়েছিলেন। তার সময়ে মেদিনী ধর্মের জন্য প্রথিত (খ্যাত) হয়েছিলেন সেজন্যই পৃথিবী’ নাম। পৃথুর রাজ্যে ধর্ম অর্থ ও শ্রী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

যুধিষ্ঠির, স্বর্গবাসী পুণ্যাত্মার যখন পুণ্যফলভোগ সমাপ্ত হয় তখন তিনি দণ্ডনীতিবিশারদ এবং বিষ্ণুর মহত্ত্বযুক্ত হয়ে পৃথিবীতে রাজা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। পণ্ডিতগণ বলেন, নরদেব (রাজা) দেবতারই সমান।

৭। বর্ণাশ্রমধর্ম-চরনিয়োগ—শুল্ক

ভীষ্ম বললেন, ব্রাহ্মণের ধর্ম ইন্দ্রিয়দমন বেদাভ্যাস ও যাজন। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম দান যজন বেদাধ্যয়ন প্রজাপালন ও দুষ্টের দমন; তিনি যাজন ও অধ্যাপন করবেন না। বৈশ্যের ধর্ম দান, বেদাধ্যয়ন, যজ্ঞ, সদুপায়ে ধনসঞ্চয়, এবং পিতার ন্যায় পশুপালন। প্রজাপতি শূদ্রকে অপর তিন বর্ণের দাসরূপে সৃষ্টি করেছেন, তিন বর্ণের সেবা করাই শূদ্রের ধর্ম। শূদ্র ধনসঞ্চয় করবে না, কারণ নীচ লোকে ধন দিয়ে উচ্চশ্রেণীর লোককে বশীভূত করে; কিন্তু ধার্মিক শূদ্র রাজার অনুমতিতে ধনসঞ্চয় করতে পারে। শূদ্রের বেদে অধিকার নেইষ ব্রাহ্মণাদি তিন বর্ণের সেবা এবং তাদের অনুষ্ঠিত যজ্ঞই শূদ্রের যজ্ঞ।

ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য বানপ্রস্থ ও ভৈক্ষ্য-ব্রাহ্মণের এই চার আশ্রম। মোক্ষকামী ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মচর্যের পরেই ভৈক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেন। ক্ষত্রিয়াদি তিন বর্ণ চতুরাশ্রমের সবগুলি গ্রহণ করেন না। যে ব্রাহ্মণ দুশ্চরিত্র ও স্বধর্মভ্রষ্ট তিনি বেদচর্চা করুন বা না করুন, তাকে শূদ্রের ন্যায় ভিন্ন পঙক্তিতে খেতে দেবে এবং দেবকার্যে বর্জন করবে। যে শূদ্র তার কর্তব্য কর্ম করেছে এবং সন্তানের জনক হয়েছে, সে যদি তত্ত্বজিজ্ঞাসু ও সদাচারী হয় তবে রাজার অনুমতি নিয়ে ভৈক্ষ্য ভিন্ন অন্য আশ্রমে প্রবেশ করতে পারে।

যুধিষ্ঠির, সমস্ত জন্তুর পদচিহ্ন যেমন হস্তীর পদচিহ্নে লীন হয় সেইরূপ অন্য সমস্ত ধর্ম রাজধর্মে লীন হয়। সকল ধর্মের মধ্যে রাজধৰ্মই প্রধান, তার দ্বারাই চতুর্বর্ণ পালিত হয়। সর্বপ্রকার ত্যাগই রাজধর্মে আছে এবং ত্যাগই শ্রেষ্ঠ ও প্রাচীন ধর্ম। সর্বপ্রকার ভোগ উপদেশ ও বিদ্যা রাজধর্মে আছে, সকলেই রাজধর্মের আশ্রয়ে থাকে। রাজা যদি দণ্ড না দেন, তবে প্রবল মৎস্য যেমন দুর্বল মৎস্যকে ভক্ষণ করে সেইরূপ প্রবল লোকে দুর্বলের উপর পীড়ন করবে। রাজার ভয়েই প্রজারা পরস্পরকে সংহার করে না।

রাজা প্রথমেই ইন্দ্রিয় জয় করে আত্মজয়ী হবেন, তারপর শত্ৰুজয় করবেন। যারা জড় অন্ধ বা বধিরের ন্যায় দেখতে, এবং ক্ষুধা পিপাসা ও শ্রম সইতে পারে, এমন বিচক্ষণ লোককে পরীক্ষার পর গুপ্তচর করবেন। অমাত্য মিত্র রাজপুত্র ও সামন্তরাজগণের নিকটে এবং নগরে ও জনপদে গুপ্তচর রাখবেন। এই চরেরা যেন পরস্পরকে জানতে না পারে, এবং তারা কি করছে তা দেখবার জন্য অপরলোক নিযুক্ত করতে হবে। যাঁরা সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞ এমন লোককে রাজা বিচারক নিযুক্ত করবেন। খনি, লবণ-উৎপাদন, পার-ঘাট, ধৃত বন্য হস্তী এবং অন্যান্য বিষয়ের শুল্ক আদায়ের জন্য বিশ্বস্ত লোক রাখবেন। প্রবল শত্রু আক্রমণ করলে রাজা দুর্গ মধ্যে আশ্রয় নেবেন এবং সমস্ত শস্য সংগ্রহ করবেন। দুর্গের মধ্যে আনা অসম্ভব হলে ক্ষেত্রের শস্য পুড়িয়ে ফেলবেন। নদীর সেতু ভেঙে ফেলবেন, পানীয় জল অপসৃত করবেন অথবা তাতে বিষ দেবেন।

মহর্ষি কশ্যপ পুরূরবাকে বলেছিলেন, পাপী লোকে যখন স্ত্রীহত্যা ও ব্রাহ্মণহত্যা করেও সভায় সাধুবাদ পায়, রাজাকেও উপেক্ষা করে, তখন রাজার ভয় উপস্থিত হয়। লোকে অত্যন্ত পাপ করলে রুদ্রদেব উৎপন্ন হন, তিনি সাধু অসাধু সকলকেই সংহার করেন। এই রুদ্র মানবগণের হৃদয়েই থাকেন এবং ইনিই নিজের ও পরের দেহ বিনষ্ট করেন।

তস্কর যদি প্রজার ধন হরণ করে এবং রাজা তা উদ্ধার করতে না পারেন, তবে সেই অক্ষম রাজা নিজের কোষ থেকেই প্রজার ক্ষতি পূরণ করবেন। ধর্মরাজ, তুমি যদি সর্বদাই মৃদুস্বভাব, অতিসৎ, অতিধার্মিক, ক্লীবতুল্য উদ্যমহীন ও দয়ালু হও তবে লোকে তোমাকে মানবে না।

৮। রাজার মিত্র-দণ্ডবিধি-রাজকর-যুদ্ধনীতি

যুধিষ্টির বললেন, পিতামহ, অন্যের সাহায্য না নিয়ে রাজকার্য সম্পাদন করা অসম্ভব। রাজার সচিব কিপ্রকার হবেন? কিপ্রকার লোককে রাজা বিশ্বাস করবেন?

ভীষ্ম বললেন, রাজার মিত্র চতুর্বিধা-সমার্থ (যাঁর স্বার্থ রাজার স্বার্থের সমান), ভজমান (অনুগত), সহজ (আত্মীয়) এবং কৃত্রিম (অর্থ দ্বারা বশীভূত)। এ ভিন্ন রাজার পঞ্চম মিত্র-ধর্মাত্মা; তিনি যে পক্ষে ধর্ম দেখেন সেই পক্ষেরই সহায় হন, সংশয়স্থলে নিরপেক্ষ থাকেন। বিজয়লাভের জন্য রাজা ধর্ম ও অধম দুইই অবলম্বন করেন; তাঁর যে সংকল্প ধর্মবিরুদ্ধ তা ধর্মাত্মা মিত্রের নিকট প্রকাশ করবেন না। পূর্বোক্ত চতুর্বিধ মিত্রের মধ্যে ভজমান ও সহজই শ্রেষ্ঠ, অপর দুজন আশঙ্কার পাত্র। একই কার্যের জন্য দু-তিন জনকে মন্ত্রী করা উচিত নয়, তারা পরস্পরকে সইতে পারবেন না।

কোনও রাজকর্মচারী যদি রাজধন চুরি করে, তবে যে লোক তা জানাবে তাকে। রাজা রক্ষা করবেন, নতুবা চোর-কর্মচারী তাকে বিনষ্ট করবে। যিনি লজ্জাশীল ইন্দ্রিয়জয়ী সত্যবাদী সরল ও উচিতবক্তা, এমন লোকই সভাসদ হবার যোগ্য। সংশজাত বুদ্ধিমান রূপবান চতুর ও অনুরক্ত লোককে তোমার পরিজন নিযুক্ত করবে। অপরাধীকে তার অপরাধ অনুসারে দণ্ড দেবে, ধনীর অর্থদণ্ড করবে এবং নির্ধনকে কারাদণ্ড দেবে। দুবৃত্তগণকে প্রহার করে দমন করবে এবং সজ্জনকে মিষ্ট বাক্যে এবং উপহার দিয়ে পালন করবে। রাজা সকলেরই বিশ্বাস জন্মাবেন, কিন্তু নিজে কাকেও বিশ্বাস করবেন না, পুত্রকেও নয়।

রাজা ছয় প্রকার দুর্গের আশ্রয়ে নগর স্থাপন করবেন-মরুদুর্গ, মহীদুর্গ, গিরিদুর্গ, মনুষ্যদুর্গ, মৃদুর্গ ও বনদুর্গ। প্রত্যেক গ্রামের একজন অধিপতি থাকবেন, তার উপরে, দশ গ্রামের এক অধিপতি, তার উপরে বিশ গ্রামের, শত গ্রামের এবং সহস্র গ্রামের এক-এক জন অধিপতি থাকবেন। এঁরা সকলেই নিজ নিজ অধিকারে উৎপন্ন খাদ্যের উপযুক্ত অংশ পাবেন। রাজা নানাবিধ কর আদায় করবেন, কিন্তু করভাবে প্রজাদের অবসন্ন করবেন না। ইঁদুর যেমন ধারাল দাঁত দিয়ে ঘুমন্ত লোকের পায়ের মাংস কুরে কুরে খায়, পা নাড়লেও ছাড়ে না, রাজা সেইরূপ প্রজার কাছ থেকে ধীরে ধীরে কর আদায় করবেন। যদি শত্রুর আক্রমণের ভয় উপস্থিত হয় তবে রাজা সেই ভয়ের বিষয় প্রজাদের জানিয়ে বলবেন, “তোমাদের রক্ষার জন্য আমি ধন। প্রার্থনা করছি, ভয় দূর হলে এই ধন ফিরিয়ে দেব; শত্রু যদি তোমাদের ধন কেড়ে নেয় তবে তা আর ফিরে পাবে না। তোমরা স্ত্রীপুত্রের জন্যই ধনসঞ্চয় করে থাক, কিন্তু সেই স্ত্রীপুত্ৰই এখন বিনষ্ট হতে বসেছে; আপকালে ধনের মায়া করা উচিত নয়।

ক্ষত্রিয় রাজা বর্মহীন বিপক্ষকে আক্রমণ করবেন না। তিনি শঠ যোদ্ধার সঙ্গে শঠতার দ্বারা এবং ধার্মিক যোদ্ধার সঙ্গে ধর্মানুসারে যুদ্ধ করবেন। ভীত বা বিজিত লোককে প্রহার করা উচিত নয়। বিষলিপ্ত বাণ বর্জনীয়, অসৎ লোকেই এরূপ অস্ত্র প্রয়োগ করে। যার অস্ত্র ভগ্ন হয়েছে বা বাহন হত হয়েছে, অথবা যে শরণাগত হয়েছে, তাকে বধ করবে না। আহত শত্রুর চিকিৎসা করবে অথবা তাকে নিজের গৃহে পাঠাবে। চিকিৎসার পর ক্ষত সেরে গেলে শত্রুকে মুক্তি দেবে।

চৈত্র বা অগ্রহায়ণ মাসেই সৈন্যসজ্জা করা প্রশস্ত; তখন শস্য পক্ক হয়, অধিক শীত বা গ্রীষ্ম থাকে না। বিপক্ষ বিপদগ্রস্ত হলে অন্য সময়েও সৈন্যসজ্জা করা যেতে পারে। বৃষ্টিহীন কালে রথাশ্ববহুল সৈন্য এবং বর্ষাকালে পদাতি ও হস্তিবহুল সৈন্য প্রশস্ত। যদি শান্তিস্থাপন সাধ্য হয় তবে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া অনুচিত। সাম দান ও ভেদ নীতি অসম্ভব হলেই যুদ্ধ বিধেয়। যুদ্ধকালে রাজা বলবেন, “আমার লোকেরা বিপক্ষসৈন্য বধ করছে তা আম প্রিয়কার্য নয়, আহা, সকলেই বাঁচতে চায়।’ শত্রুর সমক্ষে এইরূপ বলে রাজা গোপনে নিজের যোদ্ধাদের প্রশংসা করবেন, এতে হত ও হন্তা উভয়েরই সম্মান হবে।

যুধিষ্ঠির, আত্মকলহের ফলে গণভেদ (১) ও বংশনাশ হয়, রাজ্যের মূল উচ্ছিন্ন হয়, সেজন্য তার প্রতিবিধান করা আবশ্যক। এই আভ্যন্তরিক ভয়ের তুলনায় বাহ্য শত্রুর ভয় তুচ্ছ। স্বপক্ষের সংঘবদ্ধতাই রাজ্যরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়।

** (১) স্বপক্ষের মধ্যে ঐক্যের অভাব।

৯। পিতা মাতা ও গুরু-ব্যবহার-রাজকোষ

ভীষ্ম বললেন, পিতা মাতা ও গুরুর সেবাই পরম ধর্ম। দশ জন শ্রোত্রিয় (বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ) অপেক্ষা পিতা শ্রেষ্ঠ, দশ পিতা বা সমস্ত পৃথিবী অপেক্ষা মাতা শ্রেষ্ঠ। কিন্তু আমার মতে পিতা মাতা অপেক্ষাও গুরু শ্রেষ্ঠ। মানুষের নশ্বর দেহ পিতা মাতা হতে উৎপন্ন, কিন্তু আচার্যের উপদেশে যে জন্মলাভ হয় তা অজর অমর।

যুধিষ্ঠির, ক্রোধাবিষ্ট লোক যদি টিটিভ পক্ষীর ন্যায় কর্কশ বাক্য বলে তবে তা গ্রাহ্য করবে না। যে পুরুষাধম নিন্দিত কর্ম করে আত্মপ্রশংসা করে তাকেও উপেক্ষা করবে। দুষ্ট খলের সঙ্গে বাক্যালাপ করাও উচিত নয়। মনু বলেছেন, যার দ্বারা প্রিয় বা অপ্রিয় সকল লোকের প্রতিই অপক্ষপাতে দণ্ডপ্রয়োশ করে প্রজাপালন করা যায় তারই নাম ধর্ম। দণ্ডের ভয়েই লোকে পরস্পরের হানি থেকে বিরত থাকে। সম্যকরূপে ধর্মের নির্ধারণকেই ব্যবহার (আইন) বলে। বাদী-প্রতিবাদীর মধ্যে একজন বিশ্বাস উৎপাদন করে জয়ী হয়, অপর জন দণ্ডলাভ করে; এই ব্যবহারশাস্ত্র রাজাদের জানা বিশেষ আবশ্যক। ব্যবহার দ্বারা যা নির্ধারিত হয় তাই বেদ, তাই ধর্ম, তাই সৎপথ। যে রাজা ধর্মনিষ্ঠ তার দৃষ্টিতে মাতা পিতা ভ্রাতা ভাষা পুরোহিত কেউ দণ্ডের বহির্ভূত নন।

রাজকোষ যদি ক্ষয় পায় তবে রাজার বলক্ষয় হয়। আপকালে অধর্মও ধর্মতুল্য হয় এবং ধর্মও অধমতুল্য হয়। সংকটে পড়লে ব্রাহ্মণ অযাজ্য লোকেরও যাজন করেন, অভোজ্য অন্নও ভোজন করেন। সেইরূপ ক্ষত্রিয় রাজা আপৎকালে ব্রাহ্মণ ও তপস্বী ভিন্ন অন্যের ধন সবলে গ্রহণ করতে পারেন। অরণ্যচারী মুনি ভিন্ন আর কেউ হিংসা বর্জন করে জীবিকানির্বাহ করতে পারে না। ধনবান লোকের অপ্রাপ্য কিছু নেই, রাজকোষ পূর্ণ থাকলে রাজা সকল বিপদ থেকে উত্তীর্ণ হন।

॥ আপদধর্মপর্বাধ্যায়॥

১০। আপদগ্রস্ত রাজা-তিন মৎস্যের উপাখ্যান

যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, যে রাজা অলস ও দুর্বল, যাঁর ধনাগার শূন্য, মন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে এবং অমাত্যরা বিপক্ষের বশীভূত হয়েছে, তিনি অন্য রাজা কর্তৃক আক্রান্ত হলে কি করবেন?

ভীষ্ম বললেন, বিপক্ষ রাজা যদি ধার্মিক ও শুদ্ধস্বভাব হন তবে শীঘ্ৰ সন্ধি করা উচিত। সন্ধি অসম্ভব হলে যুদ্ধই কর্তব্য। সৈন্য যদি অনুরক্ত ও সন্তুষ্ট থাকে তবে অল্প সৈন্যেও পৃথিবী জয় করা যায়। যদি যুদ্ধ করা নিতান্ত অসম্ভব হয় তবে রাজা দুর্গ ত্যাগ করে কিছুকাল অন্য দেশে থাকবেন এবং পরে উপযুক্ত মন্ত্রণা করে পুনর্বার নিজ রাজ্য অধিকার করবেন।

শাস্ত্রে আছে, আপদগ্রস্ত রাজা স্বরাজ্য ও পররাজ্য থেকে ধনসংগ্রহ করবেন এবং বিশেষত ধনী ও দণ্ডাহঁ লোকের ধনই নেবেন। গ্রামবাসীরা যদি পরস্পরের নামে অভিযোগ করে তবে রাজা কাকেও পুরস্কার দেবেন না, তিরস্কারও করবেন না। কেবল সদুপায়ে বা কেবল নিষ্ঠুর উপায়ে ধনসংগ্রহ হয় না, মধ্যবর্তী উপায়ই প্রশস্ত। লোকে ধনহীন রাজাকে অবজ্ঞা করে। বস্ত্র যেমন নারীর লজ্জা আবরণ করে ধনও সেইরূপ রাজার সকল দোষ আবরণ করে। রাজা সর্বতোভাবে নিজের উন্নতির চেষ্টা করবেন, বরং ভগ্ন হবেন কিন্তু কখনও নত হবেন না। দস্যুরা যদি মর্যাদাযুক্ত (ভদ্রভাবাপন্ন) হয় তবে তাদের উচ্ছিন্ন না করে বশীভূত করাই উচিত। ক্ষত্রিয় রাজা দস্যু ও নিষ্ক্রিয় লোকের ধন হরণ করতে পারেন। যিনি অসাধু লোকের অর্থ নিয়ে সাধুদের পালন করেন তিনিই পূর্ণ ধর্মজ্ঞ।

যুধিষ্ঠির, কার্যাকার্যনির্ধারণ সম্বন্ধে আমি একটি উত্তম উপাখ্যান বলছি শোন।—কোনও জলাশয়ে তিনটি শকুল (শোল) মৎস্য বাস করত, তাদের নাম অনাগতবিধাতা (১), প্রত্যুৎপন্নমতি (২) ও দীর্ঘসূত্র (৩)। একদিন জেলেরা মাছ ধরবার জন্য সেই জলাশয় থেকে জল বার করে ফেলতে লাগল। ক্রমশ জল কমছে দেখে দীর্ঘদর্শী অনাগতবিধাতা তার দুই বন্ধুকে বললে, জলচরদের বিপদ উপস্থিত হয়েছে, পালাবার পথ বন্ধ হবার আগেই অন্য জলাশয়ে চল; যে উপযুক্ত উপায়ে অনাগত অনিষ্টের প্রতিবিধান। করে সে পিন্ন হয় না। দীর্ঘসূত্র বললে, তোমার কথা যথার্থ, কিন্তু কোনও বিষয়ে ত্বরান্বিত হওয়া উচিত নয়। প্রত্যুৎপন্নমতি বললে, কার্যকাল উপস্থিত হলে আমি কর্তব্যে অবহেলা করি না। তখন অনাগতবিধাতা জলস্রোতে নির্গত হয়ে অন্য এক জলাশয়ে গেল। জল বেরিয়ে গেলে জেলেরা নানা উপায়ে সমস্ত মাছ ধরতে লাগল, অন্য মাছের সঙ্গে দীর্ঘস্ত্র এবং প্রত্যুৎপন্নমতিও ধরা পড়ল। জেলেরা যখন সমস্ত মাছ দড়ি দিয়ে গাঁথছিল তখন প্রত্যুৎপন্নমতি দড়ি কামড়ে রইল, জেলেরা ভাবলে তাকেও গাঁথা হয়েছে। তার পর জেলেরা দড়িতে গাঁথা সমস্ত মাছ অন্য এক বৃহৎ . জলাশয়ে ডুবিয়ে ধুতে লাগল, সেই সুযোগে প্রত্যুৎপন্নমতি পালিয়ে গেল। মন্দবুদ্ধি দীর্ঘসূত্র বিনষ্ট হল।

যুধিষ্ঠির, যে লোক মোহের বশে আসন্ন বিপদ বুঝতে পারে না সে দীর্ঘসূত্রের ন্যায় বিনষ্ট হয়। যে লোক নিজেকে চতুর মনে করে পূর্বেই প্রস্তুত না হয় সে প্রত্যুৎপন্নমতির ন্যায় সংশয়াপন্ন থাকে। অনাগতবিধাতা ও প্রত্যুৎপন্নমতি উভয়েই সুখী হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘসূত্র বিনষ্ট হয়। যাঁরা বিচার করে যুক্তি অনুসারে কার্য সম্পাদন করেন তারাই সম্যক ফললাভ করেন।

** (১) যে ভবিষ্যতের জন্য ব্যবস্থা করে বা প্রস্তুত থাকে।

(২) যে পূর্বে প্রস্তুত না থেকেও কার্যকালে বুদ্ধি খাটিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা করে।

(৩) যে কাজ করতে দেরি করে, অলস।

১১। মার্জার-মূষিক-সংবাদ

ভীষ্ম বললেন, অবস্থাভেদে অমিত্রও মিত্র হয়, মিত্রও অমিত্র হয়; দেশ কাল বিবেচনা করে স্থির করতে হয় কে বিশ্বাসের যোগ্য এবং কার সঙ্গে বিরোধ করা উচিত। হিতার্থী পণ্ডিতগণের সঙ্গে চেষ্টা করে সন্ধি করা উচিত, এবং প্রাণরক্ষার জন্য শত্রুর সঙ্গেও সন্ধি করা বিধেয়। যিনি স্বার্থ বিচার করে উপযুক্ত কালে অমিত্রের সঙ্গে সন্ধি এবং মিত্রের সঙ্গে বিরোধ করেন তিনি মহৎ ফল লাভ করেন। এক পুরাতন উপাখ্যান বলছি শোন।-

কোনও মহারণ্যে এক বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। পলিত নামে এক মুষিক সেই বটবৃক্ষের মুলে শতদ্বার গর্ত নির্মাণ করে তাতে বাস করত। লোমশ নামে এক মার্জার সেই বটের শাখায় থাকত এবং শাখাবাসী পক্ষীদের ভক্ষণ করত। এক চণ্ডাল পশুপক্ষী ধরবার জন্য প্রত্যহ সেই বৃক্ষের নীচে ফাঁদ পেতে রাখত। একদিন লোমশ সতর্কতা সত্ত্বেও সেই ফাঁদে পড়ল। চিরশত্রু বিড়াল আবদ্ধ হলে মূষিক নির্ভয়ে বিচরণ করতে লাগল। সে দেখলে, ফাঁদের মধ্যে আমিষ খাদ্য রয়েছে; তখন সে মনে মনে বিড়ালকে উপহাস করে ফদের উপর থেকে আমিষ খেতে লাগল। সেই সময়ে এক নকুল (বেঁজি) এবং এক পেচকও সেখানে উপস্থিত হল। মূষিক ভাবলে, এখন আমার তিন শত্ৰু সমাগত হয়েছে, আমি নীতিশাস্ত্র অনুসারে বিড়ালের সাহায্য নেব। এই মূঢ় বিড়াল বিপদে পড়েছে, প্রাণরক্ষার জন্য সে আমার সঙ্গে সন্ধি করবে। মূষিক বললে, ওহে মার্জার, তুমি জীবিত আছ তো? ভয় নেই, তুমি রক্ষা পাবে; যদি আমাকে আক্রমণ না কর তবে আমি তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করব। আমিও সংকটাপন্ন, ওই নকুল আর পেচক লোলুপ হয়ে আমাকে দেখছে। তুমি আর আমি বহুকাল এই বটবৃক্ষের আশ্রয়ে বাস করছি, তুমি শাখায় থাক, আমি মূলদেশে থাকি। যে কাকেও বিশ্বাস করে না এবং যাকে কেউ বিশ্বাস করে , পণ্ডিতরা তেমন লোকের প্রশংসা করেন না। অতএব তোমার আর আমার মধ্যে প্রণয় হ’ক, তুমি যদি আমাকে রক্ষা কর তবে আমিও তোমাকে রক্ষা করব।

বৈদূর্যলোচন মার্জার মূষিককে বললে, সৌম্য, তোমার কল্যাণ হ’ক। যদি উদ্ধারের উপায় জান তবে আর বিলম্ব করো না, তুমি আর আমি দুজনেই বিপদাপন্ন, অতএব আমাদের সন্ধি হ’ক। মুক্তি পেলে আমি তোমার উপকার ভুলব না। আমি মান বিসর্জন দিয়ে তোমার শরণাপন্ন হলাম।

মূষিক আশ্বস্ত হয়ে বিড়ালের বক্ষস্থলে লগ্ন হল তখন নকুল ও পেচক হতাশ হয়ে চ’লে গেল। মূষিক ধীরে ধীরে বিড়ালের পাশ কাটতে লাগল। বিড়াল বললে, সখা, বিলম্ব করছ কেন? আমি যদি পূর্বে কোনও অপরাধ করে থাকি তবে ক্ষমা কর, আমার উপর প্রসন্ন হও। মূষিক উত্তর দিলে, সখা, আমি সময়জ্ঞ। যদি অসময়ে তোমাকে বন্ধনমুক্ত করি তবে আমি তোমার কবলে পড়ব। তুমি নিশ্চিন্ত হও, আমি তোমার পাশের সমস্ত তন্তু কেটে ভেলেছি, কেবল একটি অবশিষ্ট রেখেছি; চণ্ডালকে আসতে দেখলেই তা কেটে ফেলব, তখন তুমি ত্রস্ত হয়ে বৃক্ষশাখায় আশ্রয় নেবে, আমিও গর্তে প্রবেশ করব।

রাত্রি প্রভাত হলে বিকটমূর্তি চণ্ডাল কুকুরের দল নিয়ে উপস্থিত হল। মূষিক তখনই বিড়ালকে বন্ধনমুক্ত করলে, বিড়াল বৃক্ষশাখায় এবং মূষিক তার গর্তে গেল। চণ্ডাল হতাশ হয়ে চ’লে গেল। ভয়মুক্ত হয়ে বিড়াল মূষিককে বললে, সখা, তুমি আমার প্রাণরক্ষা করেছ, এখন বিপদ দূর হয়েছে, তবে আমার কাছে আসছ না। কেন? তুমি সবান্ধবে আমার সঙ্গে এস, আমার আত্মীয়বন্ধুগণ সকলেই তোমার সম্মান করবে। তুমি বুদ্ধিতে শুক্রাচার্য তুল্য; আমার অমাত্য হও এবং পিতার ন্যায়। আমাকে উপদেশ দাও।

তখন সেই পলিত নামক মূষিক বললে, হে লোমশ, মিত্রতা ও শত্রুতা স্থির থাকে না, প্রয়োজন অনুসারে লোকে মিত্র বা শত্রু হয়; স্বার্থই বলবান। যে কারণে আমাদের সৌহার্দ হয়েছিল সেই কারণ আর নেই। এখন কিজন্য আমি তোমার প্রিয় হতে পারি ? তুমি আমার শত্রু ছিলে, স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিত্র হয়েছিলে, এখন আবার শত্রু হয়েছ। আমাকে ভক্ষণ করা ভিন্ন তোমার এখন অন্য কর্তব্য নেই। তোমার ভাষা আর পুত্রেরাই বা আমাকে নিষ্কৃতি দেবে কেন? সখা, তুমি যাও, তোমার কল্যাণ হ’ক। যদি কৃতজ্ঞ হতে চাও তবে আমি যখন অসতর্ক থাকব তখন আমার অনুসরণ করো না, তা হলেই সৌহার্দ রক্ষা হবে।

উপাখ্যান শেষ করে ভীষ্ম বললেন, যুধিষ্ঠির, সেই মূষিক দুর্বল হলেও একাকী বুদ্ধিবলে বহু শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল। যারা পূর্বে শত্রুতা করে আবার মৈত্রীর চেষ্টা করে, পরস্পরকে প্রতারণা করাই তাদের উদ্দেশ্য। তাদের মধ্যে যে অধিক বুদ্ধিমান সে অন্যকে বঞ্চনা করে, যে নির্বোধ সে বঞ্চিত হয়।

১২। বিশ্বামিত্র-চণ্ডাল-সংবাদ

যুধিষ্টির বললেন, পিতামহ, যখন ধর্ম লোপ পায়, লোকে পরস্পরকে বঞ্চনা করে, অনাবৃষ্টির ফলে খাদ্যাভাব হয়, জীবিকার সমস্ত উপায় দস্যুর হস্তগত হয়, সেই আপকালে কিরূপে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা উচিত? ভীষ্ম বললেন, আমি এক ইতিহাস বলছি শোন।

ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের সন্ধিকালে দ্বাদশবর্ষব্যাপী ঘোর অনাবৃষ্টি হয়েছিল। কৃষি ও গোরক্ষা অসম্ভব হল , চোর এবং রাজাদের উৎপীড়নে গ্রাম নগর জনশূন্য হল গবাদি পশু নষ্ট হয়ে গেল, মানুষ ক্ষুধিত হয়ে পরস্পরের মাংস খেতে লাগল। সেই সময়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্র স্ত্রীপুত্রকে কোনও জনপদে ফেলে রেখে ক্ষুধার্ত হয়ে নানা স্থানে পর্যটন করতে লাগলেন। একদিন তিনি চণ্ডালবসতিতে এসে দেখলেন, ভগ্ন কলস, কুকুরের চর্ম, শূকর ও গর্দভের অস্থি, এবং মৃত মনুষ্যের বস্ত্র চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে। কোথাও কুকুট ও গর্দভ ডাকছে, কোথাও চণ্ডালরা কলহ করছে। বিশ্বামিত্র খাদ্যের অন্বেষণ করলেন, কিন্তু কোথাও মাংস অন্ন বা ফলমূল পেলেন না; তখন তিনি দুর্বলতায় অবসন্ন হয়ে ভূপতিত হলেন। এমন সময়ে তিনি দেখতে পেলেন, এখ চণ্ডালের গৃহে সদ্যোনিহত কুকুরের মাংস রয়েছে। বিশ্বামিত্র ভাবলেন, প্রাণরক্ষার জন্য চুরি করলে দোষ হবে না। রাত্রিকালে চণ্ডালরা নিদ্রিত হলে বিশ্বামিত্র কুটীরে প্রবেশ করলেন। সেই কুটীরস্থ চণ্ডাল জাগরিত হয়ে বললে, কে তুমি মাংস চুরি করতে এসেছ? তোমাকে আর বাঁচতে হবে না।

বিশ্বামিত্র উদবিগ্ন হয়ে বললেন, আমি বিশ্বামিত্র, ক্ষুধায় মতেপ্রায় হয়ে তোমার কুকুরের জঘনমাংস হরণ করতে এসেছি। আমার বেদজ্ঞান লুপ্ত হয়েছে, আমি খাদ্যাখাদ্য বিচারে অক্ষম, অধর্ম জেনেও আমি চৌর্যে প্রবৃত্ত হয়েছি। অগ্নি যেমন সর্বভূক, আমাকেও এখন সেইরূপ জেনো।

চণ্ডাল সসম্ভ্রমে শয্যা থেকে উঠে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললে, মহর্ষি, এমন কার্য করবেন না যাতে আপনার ধর্মহানি হয়। পণ্ডিতদের মতে কুকুরু শৃগালেরও অধম, আবার তার জঘনের মাংস অন্য অঙ্গের মাংস অপেক্ষা অপবিত্র। আপনি ধার্মিকগণের অগ্রগণ্য, প্রাণরক্ষার জন্য অন্য উপায় অবলম্বন করুন। বিশ্বামিত্র বললেন, আমার অন্য উপায় নেই। প্রাণরক্ষার জন্য যে কোনও উপায় বিধেয়, সবল হয়ে ধর্মাচরণ করলেই চলবে। বেদরূপ অগ্নি আমার বল, তারই প্রভাবে আমি অভক্ষ্য মাংস খেয়ে ক্ষুধাশান্তি করব। চণ্ডাল বললে, এই কুকুরুমাংসে আয়ুবৃদ্ধি হয় না, প্রাণ তৃপ্ত হয় না। পঞ্চনখ প্রাণীর মধ্যে শশকাদি পঞ্চ পশুই দ্বিজাতির ভক্ষ্য, অতএব আপনি অন্য খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করুন, অথবা ক্ষুধার বেগ দমন করে ধর্মরক্ষা করুন।

বিশ্বামিত্র বললেন, এখন আমার পক্ষে মৃগমাংস আর কুকুরুমাংস সমান। আমার প্রাণসংশয় হয়েছে, অসৎ কার্য করলেও আমি চণ্ডাল হয়ে যাব না। চণ্ডাল বললে, ব্রাহ্মণ কুকর্ম করলে তার ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হয়, এজন্য আমি আপনাকে নিবারণ করছি। নীচ চণ্ডালের গৃহ থেকে কুকুরুমাংস হরণ করলে আপনার চরিত্র দূষিত হবে, আপনাকে অনুতাপ করতে হবে। বিশ্বামিত্র বললেন, ভেকের চিৎকার শুনে বৃষ জলপানে বিরত হয় না; তোমার উপদেশ দেবার অধিকার নেই।

বিশ্বামিত্র চণ্ডালের কোনও আপত্তি মানলেন না, মাংস নিয়ে বনে চ’লে গেলেন। আগে দেবগণকে তৃপ্ত করে তার পর সপরিবারে মাংস ভোজন করবেন এই স্থির করে তিনি যথাবিধি অগ্নি আহরণ ও চরু (১) পাক করে দেবগণ ও পিতৃগণকে আহ্বান করলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র প্রচুর বারিবর্ষণ করে ওষধি ও প্রজাগণকে সঞ্জীবিত করলেন। বিশ্বামিত্রের পাপ নষ্ট হল , তিনি পরমগতি লাভ করলেন।

আখ্যান শেষ করে ভীষ্ম বললেন, চরুর আস্বাদ না নিয়েই বিশ্বামিত্র দেবগণ ও পিতৃগণকে তৃপ্ত করেছিলেন। বিপদাপন্ন হলে বিদ্বান লোকের যেকোনও উপায়ে আত্মরক্ষা করা উচিত; জীবিত থাকলে তিনি বহু পুণ্য অর্জুন ও শুভলাভ করতে পারবেন।

যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি যে অশ্রদ্ধেয় ঘোর কর্ম কর্তব্য বলে নির্দেশ করলেন। তা শুনে আমি বিষাদগ্রস্ত ও মোহাচ্ছন্ন হয়েছি, আমার ধর্মজ্ঞান শিথিল হচ্ছে। আপনার কথিত ধর্মে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। ভীষ্ম বললেন, আমি তোমাকে বেদাদি শাস্ত্র থেকে উপদেশ দিচ্ছি না, পণ্ডিতগণ বুদ্ধিবলে আপৎকালের কর্তব্য নির্ণয় করেছেন। ধর্মের কেবল এক অংশ আশ্রয় করা উচিত নয়, রাজধর্মের বহু শাখা। উগ্র কর্ম। সাধনের জন্য বিধাতা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। শুক্রাচার্য বলেছেন, আপকালে অশিষ্ট লোকের নিগ্রহ এবং শিষ্ট লোকের পালনই ধর্ম।

**

(১) হব্য। এখানে কুকুরের মাংস।

১৩। খড়গের উৎপত্তি

খড়্গযুদ্ধবিশারদ নকুল বললেন, পিতামহ, ধনুই শ্রেষ্ঠ প্রহরণ রূপে গণ্য হয়, কিন্তু আমার মতে খড়্গই প্রশংসার যোগ্য। খড়্গধারী বীর ধনুর্ধর ও গদা-শক্তিধর শত্রুগণকে বাধা দিতে পারেন। আপনার মতে কোন্ অস্ত্র উৎকৃষ্ট? কে খড়্গ উদ্ভাবন করেছিলেন?

বললেন, পুরাকালে হিরণ্যাক্ষ হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদ বিরোচন বলি প্রভৃতি দানবেন্দ্রগণ অধর্মরত হয়েছিলেন। প্রজারার নিমিত্ত ব্রহ্মা ব্রহ্মর্ষিগণের সঙ্গে হিমালয়শঙ্গে গিয়ে সেখানে এক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করলেন। সেই যজ্ঞে হুতাশন থেকে এক আশ্চর্য ভূত উত্থিত হল তার বর্ণ নীলোৎপলতুল্য, দন্তসকল তীক্ষ্ম, উদর কৃশ, দেহ অতি উন্নত। এই দুর্ধর্ষ অমিততেজা ভূতের উত্থানে বসুন্ধরা বিচলিত এবং মহাসাগর বিক্ষুব্ধ হল , উল্কাপাত এবং নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখা গেল। ব্রহ্মা বললেন, জগতের রক্ষা এবং দানবগণের বিনাশের নিমিত্ত আমি অসি নামক এই বীর্যবান ভূতকে চিন্তা করেছিলাম। ক্ষণকাল পরে সেই ভূত কালান্তকতুল্য ভীষণ খুরধার নির্মল নিস্ত্রিংশ (১) রূপে প্রকাশিত হল। ব্রহ্মা সেই ধর্মনিবারক তীক্ষ্ম অস্ত্র ভগবান রুদ্রকে দিলেন। রুদ্র সেই খড়গের আঘাতে সমস্ত দানব বিনষ্ট করলেন এবং জগতে ধর্ম সংস্থাপন করে মঙ্গলময় শিবরূপ ধারণ করলেন। তার পর তিনি সেই রুধিরাক্ত অসি ধর্মপালক বিষ্ণুকে দিলেন। বিষ্ণুর কাছ থেকে ক্রমে ক্রমে মরীচি, মহর্ষিগণ, ইন্দ্র, লোকপালগণ, সূর্যপুত্র মনু, মনুর পুত্র ক্ষুপ, তার পর ইক্ষাকু পুরূরবা প্রভৃতি, তার পর ভরদ্বাজ, দ্রোণ, এবং পরিশেষে কৃপাচার্য সেই অস্ত্র পেয়েছিলেন। কৃপের কাছ থেকে তুমি ও তোমার ভ্রাতারা সেই পরম অসি লাভ করেছ। মাদ্রীপুত্র, সকল প্রহরণের মধ্যে খড়্গই প্রধান। ধনুর উদ্ভাবক বেণপুত্র পৃথু, যিনি ধর্মানুসারে প্রজাপালন এবং পৃথিবী দোহন করে বহু শস্য উৎপাদন করেছিলেন; অতএব ধনুও আদরণীয়। যুদ্ধবিশারদ বীরগণের সর্বদা অসির পূজা করা উচিত।

**

 (১) যে খড়্গ লম্বায় ত্রিশ আঙুলের বেশী।

১৪। কৃতঘ্ন গৌতমের উপাখ্যান

ভীষ্মের কথা শেষ হলে যুধিষ্ঠির গৃহে গেলেন এবং বিদূর ও ভ্রাতাদের সঙ্গে ধর্ম অর্থ ও কাম সম্বন্ধে বহু আলাপ করলেন। পরদিন তারা পুনর্বার ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন।

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, কিপ্রকার লোক সাধু? কার সঙ্গে পরম প্রীতি হয় ? বর্তমানকালে এবং ভবিষ্যতে কারা হিতকারী হয় ? আমার মনে হয়, হিতবাক্য শোনে এবং হিতকার্য করে এমন সুহৃৎ দুর্লভ। ভীষ্ম বললেন, যারা লোভী ক্রুর ধর্মত্যাগী শঠ অলস কুটিল গুরুপত্নীধর্ষক বন্ধুপরিত্যাগী নির্লজ্জ নাস্তিক অসত্যভাষী দুঃশীল নৃশংস, যে মিত্রের অপকার করে, অপরের অর্থ কামনা করে, অকারণে ক্রোধ এবং হঠাৎ বিরোধ করে, যারা সুরাপায়ী প্রাণিহিংসাপরায়ণ কৃতঘ্ন এবং জনসমাজে নিন্দিত, এমন লোকের সঙ্গে মিত্রতা করা উচিত নয়। যাঁরা সকুলজাত জ্ঞানী রূপবান গুণবান আলোভী কৃতজ্ঞ সত্যসন্ধ জিতেন্দ্রিয় ও জনসমাজ খ্যাত, তাঁরাই রাজার মিত্র হবার যোগ্য। যাঁরা কষ্ট স্বীকার করেও সুহৃদের কার্য করেন, তারাই বিশ্বস্ত ও ধার্মিক হন এবং সুহৃদ্গণের প্রতি সর্বদা অনুরক্ত থাকেন। কৃতঘু ও মিত্রঘাতক নরাধমগণ সকলেরই বর্জনীয়। আমি এক প্রাচীন ইতিহাস বলছি শোন।-

গৌতম নামে এক ব্রাহ্মণ ভিক্ষার জন্য এক ভদ্রস্বভাব দস্যুর গৃহে এসেছিলেন। দস্যু তাকে নূতন বস্ত্র এবং একটি বিধবা যুবতী দান করলে। গৌতম দস্যুদের আশ্রয়ে বাস করতে লাগলেন এবং তাদেরই তুল্য হিংস্র ও নির্দয় হলেন। কিছুকাল পরে এক শুদ্ধস্বভাব বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ সেই দস্যুগ্রামে এলেন; ইনি গৌতমের স্বদেশবাসী ও সখা ছিলেন। গৌতমের স্কন্ধে নিহত হংসের ভার, হস্তে ধনুর্বাণ এবং তার রাক্ষসের ন্যায় রুধিরাক্ত দেহ দেখে নবাগত ব্রাহ্মণ বললেন, তুমি প্রসিদ্ধ বেদজ্ঞ বিপ্রের বংশে জন্মগ্রহণ করে এমন কুলাঙ্গার হয়েছ কেন? গৌতম বললেন, আমি দরিদ্র ও বেদজ্ঞানশূন্য, অভাবে পড়ে এমন হয়েছি। আজ তুমি এখানে থাক, কাল আমি তোমার সঙ্গে চ’লে যাব। দয়ালু ব্রাহ্মণ সম্মত হয়ে সেখানে রাত্রিযাপন করলেন, কিন্তু গৌতম বার বার অনুরোধ করলেও আহার করলেন না।

পরদিন ব্রাহ্মণ চ’লে গেলে গৌতমও সাগরের দিকে যাত্রা করলেন। তিনি একদল বণিকের সঙ্গ নিলেন, কিন্তু বন্য হস্তীর আক্রমণে বহু বণিক বিনষ্ট হল , গৌতম একাকীই অরণ্যপথে যেতে লাগলেন এবং এক সুরম্য সমতল প্রদেশে উপস্থিত হলেন। সেখানে এক বৃহৎ বটবৃক্ষ দেখে গৌতম তার পাদদেশে সুখে নিদ্রা গেলেন। সন্ধ্যাকালে সেখানে ব্রহ্মার প্রিয় সখা কশ্যপপুত্র পক্ষিশ্রেষ্ঠ নাড়ীজঙ্ নামক বকরাজ ব্রহ্মলোক থেকে অবতীর্ণ হলেন। ইনি ধরাতলে রাজধর্মা নামে বিখ্যাত ছিলেন। রাজধর্মা গৌতমকে বললেন, ব্রাহ্মণ, আপনার কুশল তো? আপনি আমার আলয়ে অতিথি হয়েছেন, আজ এখানেই রাত্রিযাপন করুন।

রাজধৰ্মা গঙ্গা থেকে নানাপ্রকার মৎস্য এনে অতিথিকে খেতে দিলেন। গৌতমকে ধনাভিলাষী জেনে রাজধৰ্মা পরদিন প্রভাতকালে বললেন, সৌম্য, আপনি এই পথ দিয়ে যান, তিন যোজন দূরে আমার সখা বিরূপাক্ষ নামক রাক্ষসরাজকে দেখতে পাবেন; তিনি আপনার সকল অভিলাষ পূর্ণ করবেন।

বিরূপাক্ষ গৌতমকে সসম্মানে গ্রহণ করে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। গৌতম কেবল তার গোত্র জানালেন, আর কিছুই বললেন না। বিরূপাক্ষ বললেন, ব্রাহ্মণ, আপনার নিবাস কোথায়? কোন্ গোত্রে বিবাহ করেছেন? সত্য বলুন, ভয় করবেন না। গৌতম বললেন, আমার জন্ম মধ্যদেশে, এখন শবরালয়ে থাকি; আমি এক বিধবা শূদ্রাকে বিবাহ করেছি। রাক্ষসরাজ বিষগ্ন হয়ে ভাবলেন, ইনি কেবল জাতিতেই ব্রাহ্মণ; যাই হ’ক, আমার সুহৃৎ মহাত্মা বকরাজ এঁকে পাঠিয়েছেন, অতএব এঁকে আমি তুষ্ট করব। আজ কার্তিকী পূর্ণিমা, সহস্র ব্রাহ্মণের সঙ্গে এঁকেও ভোজন করাব, তার পর ধনদান করব। এ ব্রাহ্মণভোজনের পর বিরূপাক্ষ সকলকেই স্বর্ণময় ভোজনপাত্র এবং প্রচুর ধনরত্ন দক্ষিণা দিলেন। সকলে সন্তুষ্ট হয়ে প্রস্থান করলেন, গৌতম তঁর স্বর্ণের ভার কষ্টে বহন করে শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পূর্বোক্ত বটবৃক্ষের নিকট ফিরে এলেন। মিত্রবৎসল বিহগশ্রেষ্ঠ রাজধৰ্মা পক্ষদ্বারা বীজন করে গৌতমের শ্রান্তি দূর করলেন এবং ভোজনের আয়োজন করে দিলেন। ভোজনকালে গৌতম ভাবলেন, আমি অনেক সুবৰ্ণ পেয়েছি, বহু দূরে আমাকে যেতে হবে, পথের জন্য খাদ্যসামগ্রী কিছুই নেই। এই বকরাজের দেহে প্রচুর মাংস আছে, একেই বধ করে নিয়ে যাব। রাজধৰ্মা বটবৃক্ষের নিকটে অগ্নি জ্বেলে তারই নিকটে নিজের ও গৌতমের শয়নের ব্যবস্থা করলেন। রাত্রিকালে দুরাত্মা গৌতম রাজধৰ্মাকে বধ করলেন এবং তাঁর পক্ক মাংস ও সুবর্ণভার নিয়ে দ্রুতবেগে প্রস্থান করলেন।

পরদিন রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষ তাঁর পুত্রকে বললেন, বৎস, আজ আমি রাজধর্মাকে দেখিনি, তিনি প্রতিদিন প্রভাতকালে ব্রহ্মাকে বন্দনা করতে যান, আমাকে না দেখে গৃহে ফেরেন না। তুমি তার খোঁজ নিয়ে এস। দুরাচার গৌতম তার কাছে গেছে সেজন্য আমি উদবিগ্ন হয়েছি। বিরূপাক্ষের পুত্র তার অনুচরদের নিয়ে বটবৃক্ষের কাছে গিয়ে রাজধৰ্মার অস্থিত দেখতে পেলেন। তার পর তিনি দ্রুতবেগে গিয়ে গৌতমকে ধরে ফেললেন এবং তাকে মেরুব্রজ নগরে বিরুপক্ষের কাছে নিয়ে গেলেন। রাজধৰ্মার মৃতদেহ দেখে সকলেই কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলেন। বিরূপাক্ষ বললেন, এই পাপাত্মা গৌতমকে এখনই বধ কর, এর মাংস রাক্ষসরা খাক। রাক্ষসরা বিনীত হয়ে বললে, মহারাজ, একে দস্যুর হাতে দিন, এর পাপদেহ আমরা খেতে পারব না। বিরূপাক্ষের আদেশে রাক্ষসরা গৌতমকে খণ্ড খণ্ড করে দস্যদের দিলে, কিন্তু দস্যুরাও খেতে চাইল না। মিত্রদ্রোহী কৃতঘ্ন নৃশংস লোক কীটেরও অভক্ষ্য। এ বিরূপাক্ষ যথাবিধি রাজধৰ্মার প্রেতকার্য করলেন। সেই সময়ে দক্ষকন্যা পয়স্বিনী সুরভি ঊর্ধ্বে অবির্ভূত হলেন, তার মুখ থেকে দুগ্ধফেন নিঃসৃত হয়ে চিতার উপর পড়ল। বকরাজ রাজধৰ্মা পুনর্জীবিত হলেন। তখন ইন্দ্র এসে বললেন, পুরাকালে রাজধৰ্মা একবার ব্রহ্মার সভায় যাননি; ব্রহ্মা রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তারই ফলে রাজধর্মার নিধন হয়েছিল।

রাজধর্ম ইন্দ্রকে বললেন, দেবরাজ, যদি আমার উপর দয়া থাকে তবে আমার প্রিয় সখা গৌতমকে পুনর্জীবিত করুন। গৌতম জীবন লাভ করলে রাজধৰ্মা তাঁকে আলিঙ্গন করে ধনরত্নের সহিত বিদায় দিলেন এবং পূর্বের ন্যায় ব্রহ্মার সভায় গেলেন। গৌতম শবরালয়ে ফিরে এলেন এবং পুনর্ভূ (দ্বিতীয়বার বিবাহিতা) শূদ্রা পত্নীর গর্ভে দুষ্কৃতকারী বহু পুত্রের জন্ম দিলেন। দেবগণের শাপে কৃতঘ্ন গৌতম মহানরকে গিয়েছিলেন।

আখ্যান শেষ করে ভীষ্ম বললেন, কৃতঘ্ন লোকের যশ সুখ ও আশ্রয় নেই, তারা কিছুতেই নিষ্কৃতি পায় না। মিত্র হ’তে সম্মান ও সর্বপ্রকার ভোগ্য বস্তু লাভ করা যায়, বিপদ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। বিচক্ষণ লোকে মিত্রের সমাদর করেন। এবং মিত্রদ্রোহী কৃতঘ্ন নরাধমকে বর্জন করেন।

॥ মোক্ষধর্মপর্বাধ্যায়॥

১৫। আত্মজ্ঞান ব্রাহ্মণ-সেনজিৎ-সংবাদ

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি রাজধর্মের অন্তর্গত আপদ্ধর্ম বিবৃত করেছেন, এখন যে ধর্ম সকলের পক্ষেই শ্ৰেয় তার উপদেশ দিন। ধনক্ষয় হলে অথবা স্ত্রীপুত্রাদির মৃত্যু হলে যে বুদ্ধি দ্বারা শোক দূর করা যায় তার সম্বন্ধেও বলুন।

ভীষ্ম বললেন, ধর্মের নানা দ্বার আছে, ধর্মকার্য কখনও বিফল হয় না। লোকের যে বিষয়ে নিষ্ঠা হয় তাকেই শ্রেয় জ্ঞান করে, অন্য বিষয়ে তার প্রবৃত্তি হয় না। সংসার অসার এই জ্ঞান হলে বৈরাগ্যের উদয় হয়, তখন বুদ্ধিমান লোকের আত্মমোক্ষের জন্য যত্ন করা উচিত। শোকনিবারণের উপায় আত্মজ্ঞান লাভ। আমি এক প্রাচীন কথা বলছি শোন। –

রাজা সেনজিৎ পুত্রের মৃত্যুতে অত্যন্ত কাতর হয়েছিলেন। এক ব্রাহ্মণ তাকে এই কথা বলে প্রবোধ দিয়েছিলেন। রাজা, তুমি নিজেই শোচনীয়, তবে অন্যের জন্য শোক করছ কেন? আমি মনে করি, আমার আত্মাও আমার নয়, আবার সমগ্র পৃথিবীই আমার। এইরূপ বুদ্ধি থাকায় আমি হৃষ্ট হই না ব্যথিতও হই না। মহাসাগরে যেসকল কাষ্ঠ ভাসে তারা কখনও মিলিত হয় কখনও পৃথক হয়; জীবগণের মিলনবিচ্ছেদও সেইরূপ। পুত্রাদির উপর স্নেহ করা উচিত নয়, কারণ বিচ্ছেদ অনিবার্য। তোমার পুত্র অদৃশ্য স্থান থেকে এসেছিল, আবার অদৃশ্য স্থানেই চ’লে গেছে; সে তোমাকে জানত না, তুমিও তাকে জানতে না, তবে কেন শোক করছ? বিষয়বাসনা থেকেই দুঃখের উৎপত্তি হয়। সুখের অন্তে দুঃখ এবং দুঃখের অন্তে সুখ হয়, সুখদুঃখ চক্রের ন্যায় আবর্তন করে। জীবন ও শরীর একসঙ্গেই উৎপন্ন হয়, একসঙ্গেই বিনষ্ট হয়। তৈলকার যেমন তৈলযন্ত্রে তিল নিপীড়িত করে, অজ্ঞানসম্ভূত ক্লেশসকল সেইরূপ জীবগণকে সংসারচক্রে নিপীড়িত করে। মানুষ স্ত্রীপুত্রাদির জন্য পাপকর্ম করে, কিন্তু সে একাকীই ইহলোকে ও পরলোকে পাপের ফল ভোগ করে। বুদ্ধি থাকলেই ধন হয় না, ধন থাকলেই সুখ হয় না।-

যে চ মূঢ়তমা লোকে যে চ বুদ্ধেঃ পরং গতাঃ।

তে নরাঃ সুখমেধন্তে ক্লিশ্যত্যন্তরিতো জনঃ ॥

যে চ বুদ্ধিসুখং প্রাপ্তা দ্বন্দ্বাতীতা বিমৎসরাঃ।

তান্নৈবার্থী ন চানৰ্থা ব্যথয়ন্তি কদাচন।

অথ যে বুদ্ধিমপ্রাপ্তা ব্যতিক্রান্তাশ্চ মূঢ়তাম্।

তেহতিবেলং প্রহৃষ্যন্তি সন্তাপমুপন্তি চ৷৷

সুখং বা যদি বা দুঃখং প্রিয়ং বা যদি বাপ্রিয়।

প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতঃ।

-জগতে যারা মূঢ়তম এবং যারা পরমবুদ্ধি লাভ করেছে তারাই সুখভোগ করে, যারা মধ্যবর্তী তারা ক্লেশ পায়। যাঁরা রাগদ্বেষাদির অতীত এবং অসূয়াশূন্য হয়ে পরমবুদ্ধিজনিত সুখ লাভ করেছেন, অর্থ ও অনর্থ (ইষ্ট ও অনিষ্ট) তাঁদের কদাচ ব্যথিত করে না। আর, যাঁরা পরমবুদ্ধি লাভ করেননি অথচ মূঢ়তা অতিক্রম করেছেন, তারাই অত্যন্ত হর্ষ ও অত্যন্ত সন্তাপ ভোগ করেন। সুখ বা দুঃখ, প্রিয় বা অপ্রিয়, যাই উপস্থিত হ’ক, অপরাজিত (অনভিভূত) হয়ে হৃদয়ে মেনে নেবে। ব্রাহ্মণের নিকট এইপ্রকার উপদেশ পেয়ে সেনজিৎ শান্তিলাভ করলেন।

১৬। অজগরব্রত-কামনাত্যাগ

ভীষ্ম বললেন, শম্পাক নামে এক ব্রাহ্মণ তার পত্নীর আচরণে এবং অন্নবস্ত্রের অভাবে কষ্ট পেয়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, মানুষ জন্মাবধি যে সুখদুঃখ ভোগ করে, সে সমস্ত যদি সে দৈবকৃত মনে করে তবে হৃষ্ট বা ব্যথিত হয় না। যার কিছুই নেই তিনি সুখে শয়ন করেন, সুখে উত্থান করেন; তার শত্রু হয় না। রাজ্যের তুলনায় অকিঞ্চনতারই গুণ অধিক। বিদেহরাজ জনক বলেছিলেন, আমার বিত্তের অন্ত নেই, তথাপি আমার কিছুই নেই; মিথিলারাজ্য দগ্ধ হয়ে গেলেও আমার কিছু নষ্ট হয় না।

দানবরাজ প্রহ্লাদ এক ব্রাহ্মণকে বলেছিলেন, আপনি নির্লোভ শুদ্ধস্বভাব দয়ালু জিতেন্দ্রিয় অসূয়াহীন মেধাবী ও প্রাজ্ঞ, তথাপি বালকের ন্যায় বিচরণ করেন। আপনি লাভালাভে তুষ্ট বা দুঃখিত হন না, ধর্ম অর্থ ও কামেও আপনি উদাসীন। আপনার তত্ত্বজ্ঞান শাস্ত্র ও আচরণ কিরূপ তা আমাকে বলুন। ব্রাহ্মণ বললেন, প্রহ্লাদ, অজ্ঞাত কারণ থেকে জীবগণের উৎপত্তি ও বিনাশ হয়; মহাকায় ও সূক্ষ্ম, স্থাবর ও জঙ্গম সকল জীবেরই মৃত্যু হয়; আকাশচারী জ্যোতিষ্কগণেরও পতন হয়। সকলেই মৃত্যুর বশীভূত এই জেনে আমি সুখে নিদ্রা যাই। যদি লোকে দেয় তবে উক্তৃষ্ট খাদ্য প্রচুরপরিমাণে খাই, না পেলে অভুক্ত থাকি। কখনও অন্নের কথা, কখনও পিণ্যাক (তিলের খোল), কখনও পলান্ন খাই; কখনও পর্যঙ্কে কখনও ভূমিতে শুই; কখনও চীর কখনও মহামূল্য বস্ত্র পরি। স্বধর্ম থেকে চ্যুত না হয়ে রাগদ্বেষাদি ত্যাগ করে পবিত্রভাবে আমি অজগরব্রত আচরণ করছি। অজগর সর্প যেমন দৈবক্রমে লব্ধ খাদ্যে তুষ্ট থাকে, আমিও সেইরূপ যদৃচ্ছাগত বিষয়েই তুষ্ট থাকি। আমার শয়ন ভোজনের নিয়ম নেই, আমি সুখের অনিত্যতা উপলব্ধি করে পবিত্রভাবে আত্মনিষ্ঠ হয়ে এই অজগরব্রত পালন করছি।

যুধিষ্ঠির, কশ্যপবংশীয় এখ ঋষিপুত্র কোনও বৈশ্যের রথের নীচে পড়ে আহত হয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি প্রাণত্যাগের সংকল্প করলেন। তখন ইন্দ্ৰ শৃগালের রূপ ধারণ করে তার কাছে এসে বললেন, তুমি দুর্লভ মানব-জন্ম, ব্রাহ্মণত্ব ও বেদবিদ্যা লাভ করেছ। তোমার দশ-অঙ্গুলিযুক্ত দুই হস্ত আছে, তার দ্বারা সকল কর্ম করতে পার। সৌভাগ্যক্রমে তুমি শৃগাল কীট মূষিক সর্প বা ভেক হওনি, মনুষ্য এবং ব্রাহ্মণ হয়েছ; এতেই তোমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আমার অবস্থা দেখ, আমার হস্ত নেই, দংশক কীটাদি তাড়াতে পারি না; আবার আমার চেয়েও নিকৃষ্ট জীব আছে। অতএব তুমি নিজের অবস্থায় তুষ্ট হও। রসজ্ঞ নয় তাতে তার কামনা হয় না। মদ্য ও ট্রাক (চড়াই) পক্ষীর মাংস অপেক্ষা উত্তম ভক্ষ্য কিছুই নেই, কিন্তু তুমি এই দুইএর স্বাদ জান না এজন্য তোমার কামনা নেই। অতএব ভক্ষণ স্পর্শন দর্শন দমিত করাই শ্রেয়স্কর। তুমি প্রাণবিসর্জনের সংকল্প ত্যাগ করে ধর্মাচরণে উদযোগী হও। এইপ্রকার উপদেশ দিয়ে ইন্দ্র নিজ রূপ ধারণ করলেন, তখন ঋষিপুত্র দেবরাজকে পূজা করে স্বগৃহে চলে গেলেন।

১৭। সৃষ্টিতত্ত্ব সদাচার

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, স্থাবরজঙ্গম সমেত এই জগৎ কি থেকে সৃষ্ট হল , প্রলয়কালে কিসে লয় পাবে, মৃত্যুর পরে জীব কোথায় যায়, এইসব আমাকে বলুন। ভীষ্ম বললেন, ভরদ্বাজের প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি ভৃগু যা বলেছিলেন শোন।–মানস নামে এক দেব আছেন, তিনি অনাদি অজর অমর অব্যক্ত শাশ্বত অক্ষয় অব্যয়; তা হতেই সমস্ত জীব সৃষ্ট হয় এবং তাতেই লীন হয়। সেই দেবই মহৎ অহংকার আকাশ সলিল প্রভৃতির মূল কারণ। মানসদেবের সৃষ্ট পদ্ম হ’তে ব্রহ্মার উৎপত্তি। ব্রহ্মা উৎপন্ন হয়েই ‘সোহহং’ বলেছিলেন, সেজন্য তিনি অহংকার নামে খ্যাত হয়েছেন। পর্বত মেদিনী সাগর আকাশ বায়ু অগ্নি চন্দ্র সূর্য প্রভৃতি তারই অঙ্গ। অহংকারের যিনি স্রষ্টা, সেই আত্মভূত দুয়ে আদিদেবই ভগবান অনন্ত-বিষ্ণু।

আকাশের অন্ত নেই। যে স্থান থেকে চন্দ্রসূর্যও দেখা যায় না সেখানে স্বয়ংদীপ্ত দেবগণ বিরাজ করেন। পৃথিবীর অন্তে সমুদ্র, তার পর অন্ধকার, তারপর সলিল, তার পর অগ্নি। আবার রসাতলের পর সলিল, তার পর সর্প-লোক, তার পর পুনর্বার আকাশ জল প্রভৃতি। এই সকলের তত্ত্ব দেবগণেরও দুর্জ্ঞেয়।

জীবের বিনাশ নেই, দেহ নষ্ট হলে জীব দেহান্তরে যায়। কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে গেলে অগ্নি যেমন অদৃশ্যভাবে আকাশ আশ্রয় করে, শরীরত্যাগের পর জীবও সেইরূপ আকাশের ন্যায় অবস্থান করে। শরীরব্যাপী অন্তরাত্মাই দর্শন শ্রবণ প্রভৃতি কার্য নির্বাহ করেন এবং সুখদুঃখ অনুভব করেন।

সত্যই ব্রহ্ম ও তপস্যা, সত্যই প্রজাগণকে সৃষ্টি ও পালন করে। ধর্ম ও অর্থ হ’তেই সুখের উৎপত্তি হয়, যার শারীরিক ও মানসিক দুঃখ নেই সেই সুখ অনুভব করে। স্বর্গে নিত্য সুখ, ইহলোকে সুখদুঃখ দুইই আছে, নরকে কেবল দুঃখ। সুখই পরমপদার্থ।

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আমি সদাচারের বিধি শুনতে ইচ্ছা করি। ভীষ্ম বললেন, সদাচারই সাধুদের লক্ষণ, অসাধুরা দুরাচার। প্রাতঃকালে শৌচের পর দেবতাদের তর্পণ করে নদীতে অবগাহন করবে। সূর্যোদয় হলে নিদ্রা যাবে না। সায়ংকালে ও প্রাতঃকালে পূর্ব-ও পশ্চিম-মুখ হয়ে সাবিত্রীমন্ত্র জপ করবে। হস্ত পদ মুখ আর্দ্র করে মৌনী হয়ে ভোজন করবে। অতিথি স্বজন ও ভৃত্যদের সঙ্গে সমানভাবে ভোজন করাই প্রশংসনীয়। ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট জননীর হৃদয়ের ন্যায় অমৃততুল্য। যিনি মাংসভক্ষণ ত্যাগ করেছেন তিনি যজ্ঞে সংস্কৃত মাংসও খাবেন না। উদীয়মান সূর্য এবং নগ্না পরস্ত্রীকে দেখবে না। সূর্যের অভিমুখে মূত্রত্যাগ, নিজের পুরীষ দর্শন এবং স্ত্রীলোকের সঙ্গে একত্র শয়ন ও ভোজন করবে না। জ্যেষ্ঠদের ‘তুমি’ বলবে না।

তারপর যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে ভীষ্ম অধ্যাত্মযোগ, ধ্যানযোগ, জপানুষ্ঠান ও জ্ঞানযোগ সম্বন্ধে সবিস্তারে বললেন।

১৮। বরাহরূপী বিষ্ণু-যজ্ঞে অহিংসা-প্রাণদণ্ডের নিন্দা

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, কৃষ্ণ তির্যগাঁযোনিতে বরাহরূপে কেন জন্মেছিলেন তা শুনতে ইচ্ছা করি। ভীষ্ম বললেন, পুরাকালে নরক প্রভৃতি বলদর্পিত অসুরগণ দেবগণের সমৃদ্ধি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিল। তাদের উৎপীড়নে বসুমতী ভারাক্রান্ত। ও কাতর হলেন। তখন ব্রহ্মা দেবগণকে আশ্বাস দিলেন যে বিষ্ণু দানবগণকে সংহার করবেন। তারপর মহাতেজা বিষ্ণু বরাহের মূর্তি ধারণ করে ভূগর্ভে গিয়ে দানবদের প্রতি ধাবিত হলেন। তাঁর নিনাদে ত্রিলোক বিক্ষুব্ধ হল , দানবগণ বিষ্ণুতেজে মোহিত ও গতাসু হয়ে পতিত হল। মহর্ষিগণ স্তব করলে বরাহরূপী বিষ্ণু রসাতল থেকে উত্থিত হলেন। সেই মহাযোগী ভূতভাবন পদ্মনাভ বিষ্ণুর প্রভাবে সকলের ভয় ও শোক দূর হয়েছিল।

তারপর যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম বিবিধ দার্শনিক তত্ত্ব বিবৃত করে অহিংসা সম্বন্ধে এই উপদেশ দিলেন।-পুরাকালে রাজা বিচষ্য গোমে-যজ্ঞে নিহত বৃষের দেহ দেখে এবং গোসকলের আর্তনাদ শুনে কাতর হয়ে এই আশীর্বাদ। করেছিলেন—গোজাতির স্বস্তি হ’ক। যারা মূঢ় ও সংশয়গ্রস্ত নাস্তিক তারাই যজ্ঞে পশুবধের প্রশংসা করে। ধর্মাত্মা মনু সকল কর্মে অহিংসারই উপদেশ দিয়েছেন। সর্বভূতে অহিংসাই সকল ধর্মের শ্রেষ্ঠ গণ্য হয়। ধূর্তেরাই সুরা মৎস্য মাংস মধু ও কৃশরান্ন ভোজন প্রবর্তিত করেছে, বেদে এসকলের বিধান নেই। সকল যজ্ঞেই। বিষ্ণুর অধিষ্ঠান জেনে ব্রাহ্মণগণ পায়স ও পুষ্প দ্বারাই অর্চনা করেন। শুদ্ধস্বভাব মহাত্মাদের মতে যা কিছু উত্তম গণ্য হয় তাই দেবতাকে নিবেদন করা যেতে পারে।

যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও লোককে বদদণ্ড না দিয়েও রাজা কোন উপায়ে। প্রজাশাসন করতে পারেন? ভীষ্ম বললেন, আমি এক পুরাতন ইতিহাস বলছি শোন।—দ্যুমৎসেনের আজ্ঞায় বধদণ্ডের যোগ্য কয়েকজন অপরাধীকে সত্যবানের নিকট আনা হলে সত্যবান বললেন, পিতা, অবস্থাবিশেষে ধর্ম অধর্মরূপে এবং অধর্ম ধর্মরূপে গণ্য হয়, কিন্তু বধ কখনই ধর্ম হতে পারে না। দ্যুমৎসেন বললেন, দস্যুদের বধ না করলে নানা দোষ ঘটে; দুষ্টের দমনের নিমিত্ত বধদণ্ড আবশ্যক, নতুবা ধর্মরক্ষা হয় না। অন্য উপায় যদি তোমার জানা থাকে তো বল।

সত্যবান বললেন, ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্রকে অধীন করা কর্তব্য। কেউ যদি ব্রাহ্মণের বাক্য না শোনে তবে ব্রাহ্মণ রাজাকে জানাবেন, তখন রাজা তাকে দণ্ড দেবেন। অপরাধীর কর্ম নীতিশাস্ত্র অনুসারে বিচার না করে বধদণ্ড দেওয়া অন্যায়। একজনকে বধ করলে তার পিতা মাতা পত্নী পুত্র প্রভৃতিরও প্রাণ-সংশয় হয়। অসাধুলোকেও পরে সচ্চরিত্র হতে পারে, অসাধুরও সাধু সন্তান হতে পারে, অতএব সমূলে সংহার করা অকর্তব্য। অপরাধের শাস্তি অন্য রূপেও হতে পারে, যথা ভয়প্রদর্শন, বন্ধন (কারাদণ্ড), বিরূপকরণ প্রভৃতি। অপরাধী যদি পুরোহিতের শরণাগত হয়ে বলে-আর এমন কর্ম করব না, তবে তাকে প্রথম বারে মার্জনা করাই উচিত। মান্যগণ্য লোকের প্রথম অপরাধ ক্ষমার্হ, বার বার অপরাধ দণ্ডনীয়।

দ্যুমৎসেন বললেন, পূর্বে লোকেরা সুশাস্য সত্যনিষ্ঠ ও মৃদুস্বভাব ছিল, ধিক্কারেই তাদের যথেষ্ট দণ্ড হত। তার পর বাগদণ্ড (তিরস্কার) ও অর্থদণ্ড প্রচলিত হয়, সম্প্রতি বধদণ্ড প্রবর্তিত হয়েছে। এখন অপরাধীকে বধদণ্ড দিয়েও অন্যান্য লোককে দমন করা যায় না। কথিত আছে, দস্য কারও আত্মীয় নয়, তার সঙ্গে কোনও লোকের সম্বন্ধ নেই। যারা শ্মশান থেকে শবের বস্ত্রাদি এবং ভূতাবিষ্ট লোকের ধন হরণ করে, শপথ করিয়ে তাদের শাসন করা যায় না।

সত্যবান বললেন, যদি অহিংস উপায়ে অসাধুকে সাধু করা অসাধ্য হয় তবে যজ্ঞ দ্বারা তাদের সংহার করুন। কিন্তু যদি ভয় দেখিয়ে শাসন করা সম্ভবপর হয় তবে ইচ্ছাপূর্বক বধ করা অকর্তব্য। রাজা সদাচারী হলে প্রজাও সেইরূপ হয়, শ্রেষ্ঠ লোকে যেমন আচরণ করেন ইতর লোকে তারই অনুসরণ করে। যে রাজা নিজেকে সংযত না করে অন্যকে শাসন করতে যান তাঁকে লোকে উপহাস করে। নিজের বন্ধু ও আত্মীয়কেও কঠোর দণ্ড দিয়ে শাসন করা উচিত। আয়ু শক্তি ও কাল বিচার করে রাজা দণ্ডবিধান করবেন। জীবগণের প্রতি অনুকম্পা করে স্বায়ম্ভুব মনু বলেছেন, যিনি সত্যার্থী (ব্রহ্মলাভেচ্ছু) তিনি মহৎ কর্মের ফল কদাচ ত্যাগ করবেন না।

১৯। বিষয়তৃষ্ণা-বিষ্ণুর মাহাত্ম-জ্বরের উৎপত্তি

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আমরা অতি পাপী ও নিষ্ঠুর, অর্থের নিমিত্ত আত্মীয়গণকে সংহার করেছি। যাতে অর্থতৃষ্ণা নিবৃত্ত হয় তার উপায় বলুন।

ভীষ্ম বললেন, তত্ত্বজিজ্ঞাসু মাণ্ডব্যকে বিদেহরাজ জনক এই কথা বলেছিলেন। আমার কিছুই নেই, তথাপি সুখে জীবনযাপন করি। মিথিলা দগ্ধ হয়ে গেলেও আমার কিছু নষ্ট হয় না। সকল সমৃদ্ধিই দুঃখের কারণ। সমস্ত ঐহিক সুখ এবং স্বর্গীয় সুখ তৃষ্ণাক্ষয়জনিত সুখের ষোড়শাংশের একাংশও নয়। বৃষের দেহবৃদ্ধির সঙ্গে যেমন তার শৃঙ্গও বৃদ্ধি পায়, সেইরূপ ধনবৃদ্ধির সঙ্গে বিষয়তৃষ্ণাও বর্ধিত হয়। সামান্য বস্তুতেও যদি মমতা হয় তবে তা নষ্ট হলে দুঃখ হয়; অতএব কামনা ত্যাগ করাই উচিত। জ্ঞানী লোকে সর্বভূতকে আপনার তুল্য মনে করেন এবং কৃতকৃতা ও বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে সবই ত্যাগ করতে পারেন। মন্দবুদ্ধি লোকের পক্ষে যা ত্যাগ করা দুঃসাধ্য, দেহ জীর্ণ হলেও বা জীর্ণ হয় না, যা আমরণস্থায়ী রোগের তুল্য, সেই বিষয়তৃষ্ণাকে যিনি ত্যাগ করেন তিনিই সুখী হন।

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, লোকে আমাদের ধন্য ধন্য বলে, কিন্তু আমাদের চেয়ে দুঃখী কেউ নেই। কবে আমরা রাজ্য ত্যাগ করে সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করতে পারব যাতে সকল দুঃখের অবসান হবে?

ভীষ্ম বললেন, মহারাজ, ঐশ্বর্যকে দোষজনক মনে করো না। তোমরা ধর্মজ্ঞ, ঐশ্বর্য সত্ত্বেও শমদমাদি সাধন দ্বারা যথাকালে মোক্ষলাভ করবে। উদ্যোগী পুরুষের অবশ্যই ব্রহ্মলাভ হয়। পুরাকালে দৈত্যরাজ বৃত্র যখন নির্জিত রাজ্যহীন ও অসহায় হয়ে শত্রুগণের মধ্যে অবস্থান করছিলেন তখন শুক্রাচার্য তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দানব, তুমি পরাজিত হয়েছ কিন্তু দুঃখিত হওনি কেন? বৃত্র বললেন, আমি সংসার ও মোক্ষের তত্ত্ব জানি সেজন্য আমার শোক বা হর্ষ হয় না। পূর্বে আমি ত্রিলোক জয় করেছিলাম, তপস্যা দ্বারা ঐশ্বর্য লাভ করেছিলাম, কিন্তু আমার কর্মদোষে সব নষ্ট হয়েছে। এখন আমি ধৈর্য অবলম্বন করে শোকহীন হয়েছি। ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধের সময় আমি ভগবান হরিনারায়ণ সনাতন বিষ্ণুকে দেখেছিলাম, যাঁর কেশ মুঞ্জতৃণের ন্যায় পীতবর্ণ, শ্মশ্রু পিঙ্গলবর্ণ, যিনি সর্বভূতের পিতামহ। আমার সেই পুণ্যের ফল এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে, তারই প্রভাবে আপনাকে প্রশ্ন করছি—ব্রহ্ম কোথায় অবস্থান করেন? জীব কি প্রকারে ব্রহ্মত্ব লাভ করে?

এই সময়ে মহামুনি সনৎকুমার সেখানে উপস্থিত হলেন। শুক্র তাঁকে বললেন, আপনি এই দানবরাজের নিকট বিষ্ণুর মাহাত্ম কীর্তন করুন। সনকুমার বললেন, মহাবাহু, এই জগৎ বিষ্ণুতেই অবস্থান করছে, তিনিই সমস্ত সৃষ্টি এবং লয় করেন। তপস্যা ও যজ্ঞ দ্বারা তাকে পাওয়া যায় না; যিনি ইন্দ্রিয়সংযম ও চিত্তশোধন করেছেন, যাঁর বুদ্ধি নির্মল হয়েছে, তিনিই পরলোকে মোক্ষলাভ করেন। স্বর্ণকার যেমন বহুবার অগ্নিতে নিক্ষেপ করে অতি যত্নে স্বর্ণ শোধন করে, জীবও সেইরূপ বহুবার জন্মগ্রহণ করে কর্ম দ্বারা বিশুদ্ধি লাভ করে। যেমন অল্প পুষ্পের সংস্পর্শে তিলসর্ষপাদি নিজ গন্ধ ত্যাগ করে না, কিন্তু বার বার বহু পুষ্পের সংস্পর্শে নিজ গন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে পুষ্পগন্ধে বাসিত হয়, সেইরূপ বহুবার জন্মগ্রহণ করে মানুষ আসক্তিজনিত দোষ থেকে মুক্ত হয়। যাঁর চিত্ত শুদ্ধ হয়েছে তিনি মন দ্বারা অনুসন্ধান করে চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার এবং অক্ষয় মোক্ষপদ লাভ করেন।

সনৎকুমারের উপদেশ শোনার পর দানবরাজ বৃত্ৰ যোগস্থ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে পরমগতি লাভ করলেন।

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, সনৎকুমার যাঁর কথা বলেছিলেন, এই জনার্দন কৃষ্ণই কি সেই ভগবান? ভীষ্ম বললেন, এই মহাত্মা কেশব সেই পরমপুরুষের অষ্টমাংশ। ইনিই জগতের স্রষ্টা এবং প্রলয়কালে সমস্ত বিনষ্ট হলে ইনিই পুনর্বার জগৎ সৃষ্টি করেন; এই বিচিত্র বিশ্ব এঁতেই অবস্থান করছে। ধর্মরাজ, তোমরা শুদ্ধ ও উচ্চ বংশে জন্মেছ, ব্রতপালনও করেছ। মৃত্যুর পরে তোমরা দেবলোকে যাবে, তারপর আবার মর্ত্যলোকে আসবে; পুনর্বার দেবলোকে সুখ-ভোগ করে সিদ্ধগণের পদ লাভ করবে। তোমাদের ভয় নেই, সকলে সুখে কালযাপন কর।

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, বৃত্র ধার্মিক ও বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, তিনি ইন্দ্র কর্তৃক নিহত হলেন কি করে? ভীষ্ম বললেন, যুদ্ধকালে বৃত্রের অতি বিশাল মূর্তি দেখে ভয়ে ইন্দ্রের ঊরুস্তম্ভ হয়েছিল। তিনি বৃত্র কর্তৃক নিপীড়িত হয়ে মূৰ্ছিত হলে বশিষ্ট তার চৈতন্য সম্পাদন করলেন। তারপর ইন্দ্রাদি দেবগণ ও মহর্ষিগণ বৃত্রবধের জন্য মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। মহাদেব ইন্দ্রের দেহে নিজের তেজ এবং বৃত্রের দেহে জ্বররোগ সংক্রামিত করে বললেন, দেবরাজ, এখন তুমি বজ্র দ্বারা তোমার শত্রুকে বধ কর। তখন ইন্দ্র বজ্রপ্রহার করে বৃত্রকে পাতিত করলেন। মহাদেব যখন দক্ষযক্ষ নষ্ট করছিলেন তখন তার ঘর্মবিন্দু থেকে একটি পুরুষ উৎপন্ন হয়েছিল, তারই নাম জ্বর। ব্রহ্মার অনুরোধে মহাদেব জ্বরকে নানা প্রকারে বিভক্ত করেছিলেন। হস্তিমস্তকের তাপ, পর্বতের শিলাজতু, জলের শৈবাল, ভুজঙ্গের নির্মোক, গোজাতির খুররোগ, ভূমির ঊষরতা, পশুর দৃষ্টিরোধ, অশ্বের গলরোগ, ময়ুরের শিখোদূভেদ, কোকিলের নেত্ররোগ, মেষের পিত্তভেদ, শুকের হিক্কা, এবং শার্দুলের শ্রম, এই সকলকে জ্বর বলা হয়।

২০। দক্ষযজ্ঞ

মহাভারতবক্তা বৈশম্পায়নকে জনমেজয় বললেন, মহর্ষি, বৈবস্বত মন্বন্তরে প্রচেতার পুত্র প্রজাপতি দক্ষের অশ্বমেধ যজ্ঞ কিরূপে নষ্ট এবং পুনর্বার অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা আপনি বলুন।

বৈশম্পায়ন বললেন, পূরাকালে হিমালয় পর্বতের পৃষ্ঠে পবিত্র গঙ্গাদ্বারে দক্ষ প্রজাপতি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞে দেব দানব গন্ধর্ব, আদিত্যগণ বসুগণ রুদ্রগণ প্রভৃতি, ইন্দ্রাদি দেবগণ, এবং ব্রহ্মার সহিত ঋষিগণ ও পিতৃগণ আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। জরায়ুজ অণ্ডজ স্বেদজ ও উদভিজ্জ এই চতুর্বিধ জীবও সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। সমাগত সকলকে দেখে দধীচি মুনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, যে অনুষ্ঠানে মহেশ্বর রুদ্র পূজিত হন না তা যজ্ঞও নয় ধর্মও নয়। ঘোর বিপদ আসন্ন হয়েছে, মোহবশে তা কেউ বুঝতে পারছে না। এই বলে মহাযোগী দধীচি, ধ্যাননেত্রে হরপার্বতী এবং তাদের নিকটে উপবিষ্ট নারদকে দেখলেন। দধীচি বুঝলেন, সকলে একযোগে মন্ত্রণা করে মহাদেবকে নিমন্ত্রণ করেননি। তখন তিনি যজ্ঞস্থান থেকে সরে গিয়ে বললেন, যে লোক অপুজ্যের পূজা করে এবং পূজ্যের পূজা করে না সে নরহত্যার সমান পাপ করে। আমি সত্য বলছি, এই যজ্ঞে জগৎপতি যজ্ঞভোক্তা পশুপতি আসছেন, তোমরা সকলেই দেখতে পাবে।

দক্ষ বললেন, এখানে শূলপাণি জটাজুটধারী একাদশ রুদ্র উপস্থিত রয়েছেন, আমি মহেশ্বর রুদ্রকে চিনি না। দধীচি বললেন, তোমরা সকলে মন্ত্রণা করেই তাকে বর্জন করেছ। শংকর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দেবতা আমি জানি না। তোমার এই বিপুল যজ্ঞ পণ্ড হবে। দক্ষ বললেন, যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুই যজ্ঞভাগ গ্রহণের অধিকারী; আমি এই সুবর্ণপাত্রে রক্ষিত মন্ত্রপূত হবি আঁকেই নিবেদন করব।

এই সময়ে কৈলাসশিখরে দেবী ভগবতী ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, আমি কিরূপ দান ব্রত বা তপস্যা করব যার ফলে আমার পতি যজ্ঞের অর্ধ বা একতৃতীয় ভাগ পেতে পারেন? মহাদেব বললেন, দেবী, তুমি কি আমাকে জান না? তোমার মোহের জন্যই ইন্দ্রাদি দেবগণ এবং ত্রিলোক মোহাবিষ্ট হয়েছে। সকল যজ্ঞে আমারই স্তব করা হয়, আমার উদ্দেশেই সামগান হয়, ব্রহ্মবিৎ ব্রাহ্মণগণ আমারই অর্চনা করেন, অধ্বর্যগণ আমাকেই যজ্ঞভাগ দেন। দেবী বললেন, অতি প্রাকৃত (অশিক্ষিত গ্রাম্য) লোকেও স্ত্রীলোকের কাছে নিজের প্রশংসা ও গর্ব করে। মহাদেব বললেন, আমি আত্মপ্রশংসা করছি না, যজ্ঞের জন্য আমি যা সৃষ্টি করছি দেখ। এই বলে মহাদেব। তার মুখ থেকে এক ঘোরদর্শন রোমহর্ষকর পুরুষ সৃষ্টি করলেন; তাঁর মুখ অতি ভয়ংকর, শরীর অগ্নিশিখায় ব্যাপ্ত, বহু হস্তে বহু আয়ুধ। বীরভদ্র নামক এই পুরুষ কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, কি আজ্ঞা করছেন? মহেশ্বর বললেন, দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস কর।

বীরভদ্র তাঁর রোমকূপ থেকে রৌম্য নামক রুদ্রতুল্য অসংখ্য গণদেবতা সৃষ্টি করে তাদের নিয়ে যজ্ঞস্থলে যাত্রা করলেন। মহেশ্বরীও ভীমরূপা মহাকালীর মূর্তি ধারণ করে বীরভদ্রের অনুগমন করলেন। এঁরা যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলে দেবগণ এস্ত হলেন, পর্বত বিদীর্ণ ও বসুন্ধরা কম্পিত হল বায়ু ঘূর্ণিত এবং সমুদ্র বিক্ষুব্ধ হ’তে লাগল, সমস্ত জগৎ তিমিরাচ্ছন্ন হল। বীরভদ্রের অনুচরগণ যজ্ঞের সমস্ত উপকরণ চূর্ণ উৎপাটিত ও দগ্ধ করে সকলকে প্রহার করতে লাগল। তারা অন্ন মাংস পায়স প্রভৃতি খেয়ে ও নষ্ট করে, দেবসৈন্যগণকে ভয় দেখিয়ে হতবুদ্ধি করে, এবং সুরনারীদের ছুড়ে ফেলে দিয়ে খেলা করতে লাগল। রুদ্রকর্মা বীরভদ্র যজ্ঞস্থল দগ্ধ এবং যজ্ঞের (১) শিরচ্ছেদন করে ঘোর সিংহনাদ করলেন।

ব্ৰহ্মাদি দেবগণ ও প্রজাপতি দক্ষ কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, আপনি কে? বীরভদ্র উত্তর দিলেন, আমি রুদ্র নই, ইনিও দেবী ভগবতী নন; আমরা ভোজনের জন্য বা তোমাদের দেখতে এখানে আসিনি, এই যজ্ঞ নষ্ট করতেই এসেছি। ভগবতীকে ক্ষুব্দ দেখে মহাদেব ক্রুদ্ধ হয়েছেন। আমি রুদ্রকোপে উৎপন্ন বীরভদ্র, ইনি ভগতীর কোপ হ’তে বিনিঃসৃত ভদ্রকালী। দক্ষ, তুমি দেবদেব উমাপতির শরণ নাও; অন্য দেবতার নিকট বরলাভ অপেক্ষা মহাদেবের ক্রোধে পড়াও ভাল।

দক্ষ প্রণিপাত করে মহেশ্বরের স্তব করতে লাগলেন। তখন সহস্র সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান মহাদেব অগ্নিকুণ্ড থেকে উত্থিত হয়ে সহাস্যমুখে দক্ষকে বললেন, বল, কি চাও। দক্ষ ভয়ে আকুল হয়ে সাশ্রনয়নে বললেন, ভগবান, এই যজ্ঞের জন্য বহু যত্নে আমি যেসকল উপকরণ সংগ্রহ করেছিলাম তা দগ্ধ ভক্ষিত ও নাশিত হয়েছে; যদি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে এই বর দিন-আমার যজ্ঞ যেন নিষ্ফল না হয়। ভগবান বিরূপাক্ষ বললেন, তথাস্তু। তখন দক্ষ নতজানু হয়ে অষ্টোত্তর সহস্র নাম পাঠ করে ভগবান বৃষভধ্বজের স্তব করলেন।

** (১) সৌপ্তিকপর্ব ৭-পরিচ্ছেদে আছে, যজ্ঞ মৃগরূপে পালিয়েছিলেন।

২১। আসক্তিত্যাগ-শুক্রের ইতিহাস

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আমার ন্যায় রাজারা কিরূপে আসক্তি থেকে মুক্ত হ’তে পারেন তা বলুন। ভীষ্ম প্রকৃত সুখ, স্নেহপাশে বদ্ধ মূঢ় লোকে তা বুঝতে পারে না। যখন দেখবে যে পুত্রেরা যৌবন পেয়েছে এবং জীবিকানির্বাহে সমর্থ হয়েছে তখন তাদের বিবাহ দেবে, এবং নিজে সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যথাসুখে বিচরণ করবে। পুত্রবৎসলা বৃদ্ধা ভার্যাকেও গৃহে রেখে মোক্ষের অন্বেষণে যত্নবান হবে। পুত্র থাকুক বা না থাকু, প্রথমে যথাবিধি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করা পর সংসার ত্যাগ করে নিস্পৃহ হয়ে বিচরণ করবে। যদি মোক্ষের অভিলাষ থাকে তবে আমার অভাবে পরিবারবর্গ কি করে জীবিকানির্বাহ করবে-এমন চিন্তা করবে না। জীব স্বয়ং উৎপন্ন হয়, স্বয়ং বর্ধিত হয়, এবং স্বয়ং সুখদুঃখ ভোগ করে পরিশেষে মৃত্যুর কবলে পড়ে। সকল জীবই পূর্বজন্মের কর্ম অনুসারে বিধাতা কর্তৃক বিহিত ভক্ষ্য লাভ করে। মানুষ মৃৎপিণ্ডের তুল্য এবং সর্বদা পরতন্ত্র, তার পক্ষে স্বজনপোষণের চিন্তা করা বৃথা। মরণের পর তুমি স্বজনের সুখদুঃখ কিছুই জানতে পারবে না; তোমার জীবদ্দশায় এবং তোমার মরণের পর তারা স্বকর্ম অনুসারে সুখদুঃখ ভোগ করবে, এই বুঝে তুমি নিজের হিতের চেষ্টা কর। জঠরাগ্নিই ভোক্তা এবং ভোজ্য অন্ন সোম স্বরূপ—এই জ্ঞান যার হয়, এবং যিনি নিজেকে এই দুই হ’তে স্বতন্ত্র মনে করেন, যিনি সুখদুঃখে লাভালাভে জয়পরাজয়ে সমবুদ্ধি, যিনি জানেন যে ইহলোকে অর্থ দুর্লভ এবং ক্লেশই সুলভ, তিনিই মুক্তিলাভ করেন।

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, দেবর্ষি উশনা (শুক্র) কেন দেবতাদের বিপক্ষে থেকে অসুরদের প্রিয়সাধন করতেন, তার শুক্র নাম কেন হল তিনি (গ্রহরূপে) আকাশের মধ্যদেশে যেতে পারেন না কেন, এইসকল বিবৃত করে আপনি আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করুন। ভীষ্ম বললেন, বিষ্ণু শুক্রের মাতা (১) কে বধ করেছিলেন সেজন্য শুক্র দেবদ্বেষী হন। একদিন তিনি যোগবলে কুবেরকে বদ্ধ করে তার সমস্ত ধন হরণ করলেন। কুবেরের অভিযোগ শুনে মহাদেব শূলহস্তে শুক্রকে মারতে এলেন, তখন শুক্র শূলের অগ্রভাগে আশ্রয় নিলেন।

মহাদেব শুক্রকে ধরে মুখে পুরে গ্রাস করে ফেললেন। তার পর তিনি মহাহ্রদের জলমধ্যে দশ কোটি বৎসর তপস্যা করলেন, তার জঠরে থাকায় শুক্রেরও উৎকর্ষলাভ হল। মহাদেব জল থেকে উঠলে। শুক্র বহির্গত হবার জন্য বার বার প্রার্থনা করলেন, অবশেষে মহাদেব বললেন, তুমি আমার শিশ্ন দিয়ে নির্গত হও। শিশ্নপথে নির্গত হওয়ায় উশনার নাম শুক্র হল এবং তিনি আকাশের মধ্যস্থলে যেতে অসমর্থ হলেন। শুক্রকে দেখে মহাদেব ক্রুদ্ধ হয়ে তার শূল উদ্যত করলেন। তখন ভগবতী বললেন, শুক্র এখন আমার পুত্র হল , তোমার উধর থেকে যে বহির্গত হয়েছে সে বিনষ্ট হতে পারে না। মহাদেব সহাস্যে বললেন, শুক্র যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন।

** (১) ভৃগুপত্নী। দেবগণের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য অসুরগণ এঁর আশ্রমে শরণ নিয়েছিলেন। দেবতারা সেখানে প্রবেশ করতে পারেন নি, এজন্য বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে ভৃগুপত্নীর শিরচ্ছেদ করেন।

২২। সুলভা-জনক-সংবাদ

যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম সাংখ্য যোগ গৃহস্থাশ্রম তপস্যা প্রভৃতি সম্বন্ধে। বহু উপদেশ দিয়ে সুলভ ও জনকের এই প্রাচীন ইতিহাস বললেন।-সত্যযুগে মিথিলায় জনক (২) নামে এক রাজা ছিলেন, তার অন্য নাম ধর্মধ্বজ। তিনি সন্ন্যাসধর্ম মোক্ষশাস্ত্র ও দণ্ডনীতিতে অভিজ্ঞ ছিলেন এবং জিতেন্দ্রিয় হয়ে রাজ্য-শাসন করতেন। সুলভ নামে এক ভিক্ষুকী (সন্ন্যাসিনী) রাজর্ষি জনকের খ্যাতি শুনে তাকে পরীক্ষা করবার সংকল্প করলেন এবং যোগবলে মনোহর রূপ ধারণ করে মিথিলার রাজসভায় উপস্থিত হলেন। তার সৌন্দর্য দেখে রাজা বিস্মিত হলেন এবং পাদ্য অর্ঘ্য আসন ভোজ্য প্রভৃতি দিয়ে সংবর্ধনা করলেন। তার পর সুলভ যোগবলে নিজের সত্ত্ব বুদ্ধি ও চক্ষু জনকের সত্ত্ব বুদ্ধি ও চক্ষুতে সন্নিবিষ্ট করলেন (৩)।

সুলভার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে জনক তাঁকে নিজের মনোমধ্যে গ্রহণ করে সহাস্যে বললেন, দেবী, তুমি কার কন্যা, কোথা থেকে এসেছ? তোমার সম্মানের জন্য আমি নিজের তত্ত্বজ্ঞানলাভের বিষয় বলছি শোন। বৃদ্ধ মহাত্মা পঞ্চশিখ আমার গুরু, তার কাছেই আমি সাংখ্য যোগ ও রাজধর্ম এই ত্রিবিধ মোক্ষতত্ত্ব শিখেছি। আসক্তি মোহ ও সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হয়ে আমি পরমবুদ্ধি লাভ করেছি। যদি একজন আমার দক্ষিণ বাহুতে চন্দন লেপন করে এবং অপর একজন আমার বাম বাহু ছেদন করে তবে দুজনকেই আমি সমদৃষ্টিতে দেখব। নিঃস্ব হলেই মোক্ষলাভ হয় না, ধনী হলেও হয় না, জ্ঞান দ্বারাই মোক্ষলাভ হয়। সন্ন্যাসিনী, তোমাকে সুকুমারী সুন্দরী ও যুবতী দেখছি, তুমি যোগসিদ্ধ কিনা সে বিষয়ে আমার সংশয় হচ্ছে। কার সাহায্যে তুমি আমার রাজ্যে ও রাজভবনে এসেছ, কোন্ উপায়ে আমার হূদয়ে প্রবেশ করেছ? তুমি ব্রাহ্মণী, আমি ক্ষত্রিয়; তুমি সন্ন্যাসিনী হয়ে মোক্ষের অন্বেষণ করছ, আমি গৃহস্থাশ্রমে আছি; আমাদের মিলন হতে পারে না। যদি তোমার পতি জীবিত থাকেন তবে আমার পক্ষে তুমি অগম্যা পরপত্নী। তুমি আমাকে পরাজিত করে নিজের উন্নতি করতে চাচ্ছ। স্ত্রী-পুরুষের যদি পরস্পরের প্রতি অনুরাগ থাকে তবেই তাদের মিলন

** 
২) মিথিলার সকল রাজাকেই জনক বলা হত।

(৩) অর্থাৎ সুলভা তার সূক্ষ্মশরীর দ্বারা জনকের দেহে ভর করলেন। জিয়া।

অমৃতকুল্য হয়, নতুবা তা বিষতুল্য। অতএব আমাকে ত্যাগ করে তোমার সন্ন্যাসধর্ম পালন কর।

জনকের কথায় বিচলিত না হয়ে সুলভ বললেন, মহারাজ, যেমন কাষ্ঠের সঙ্গে লাক্ষা এবং ধূলির সঙ্গে জলবিন্দু, সেইরূপ শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয় প্রাণীর সহিত সংশ্লিষ্ট থাকে। চক্ষু প্রভৃতি ইন্দ্রিয়কে কেউ পরিচয় জিজ্ঞাসা করে না, ইন্দ্রিয়গণেরও নিজের সম্বন্ধে জ্ঞান নেই। চক্ষু নিজেকে দেখে না, কর্ণ নিজেকে শোনে না, একত্র হলেও পরস্পরকে জানতে পারে না। তুমি যদি নিজেকে এবং অন্যকে সমান জ্ঞান কর তবে আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করছ কেন? এই বস্তু আমার, এই বস্তু আমার নয়—এই দ্বন্দ্ব থেকে তুমি যদি মুক্ত হয়ে থাক, তবে তোমার প্রশ্ন নিরর্থক। তুমি মোক্ষের অধিকারী না হয়েই নিজেকে মুক্ত মনে কর। কুপথ্যভোজীর যেমন ঔষধসেবন, সমদৃষ্টিহীন লোকের মোক্ষের অভিমান সেইরূপ বৃথা। তুমি যদি জীবন্মুক্ত হও তবে আমার সংস্পর্শে তোমার কি অপকার হবে? পদ্মপত্রে জলের ন্যায় আমি নির্লিপ্তভাবে তোমার দেহে আছি; এতে যদি তোমার স্পর্শজ্ঞান হয় তবে পঞ্চশিখের উপদেশ বৃথা হয়েছে। আমি তোমার সজাতি, রাজর্ষি প্রধানের বংশে আমি জন্মেছি, আমার নাম সুলভা। যোগ্য পতি না পাওয়ায় আমি মোক্ষধর্মের সন্ধানে সন্ন্যাসিনী হয়েছি, সেই ধর্ম জানবার জন্যই তোমার কাছে এসেছি। নগরমধ্যে শূন্য গৃহ পেলে ভিক্ষুক যেমন সেখানে রাত্রিযাপন করে, সেইরূপ আমি তোমার শরীরে এক রাত্রি বাস করব। মিথিলারাজ, তোমার কাছে আমি সম্মান ও আতিথ্য পেয়েছি; তোমার শরীরের মধ্যে এক রাত্রি শয়ন করে কাল আমি প্রস্থান করব।

সুলভার যুক্তিসম্মত ও অর্থযুক্ত বাক্য শুনে জনক রাজা উত্তর না দিয়ে নীরবে রইলেন। রইলেন।

২৩। ব্যাসপুত্র শুক-নারদের উপদেশ

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, ব্যাসের পুত্র ধর্মাত্মা শুক কিপ্রকারে জন্মগ্রহণ ও সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তা বলুন। ভীষ্ম বললেন, পুরাকালে মহাদেব ও শৈলরাজসূতা ভবানী ভীমদর্শন ভূতগণে পরিবেষ্টিত হয়ে সুমেরুর শৃঙ্গে বিহার করতেন। ব্যাসদেব পুত্রকামনায় সেখানে তপস্যায় রত হয়ে মহাদেবের আরাধনা করতে লাগলেন। মহেশ্বর প্রসন্ন হয়ে বললেন, দ্বৈপায়ন, তুমি অগ্নি বায়ু জল ভূমি ও আকাশের ন্যায় পবিত্র পুত্র লাভ করবে, সে ব্রহ্মপরায়ণ হয়ে নিজ তেজে ত্রিলোক আবরণ করে যশস্বী হবে।

বরলাভ করে ব্যাস অগ্নি উৎপাদনের জন্য দুই খণ্ড অরণি কাষ্ঠ নিয়ে মন্থন করতে লাগলেন। সেই সময়ে ঘৃতাচী অপ্সরাকে দেখে ব্যাস কামাবিষ্ট হলেন। তখন ঘৃতাচী শুক পক্ষিণীর রূপ ধারণ করলেন। ব্যাস মনঃসংযম করতে পারলেন না, তার শুক্র অরণিকাষ্ঠের উপর স্থলিত হল ; তথাপি তিনি মন্থন করতে লাগলেন। সেই অরমিতে শুকদেব জন্মগ্রহণ করলেন। শুক্রের মন্থনে উৎপন্ন এজন্য তার নাম শুক হল। তখন গঙ্গা মূর্তিমতী হয়ে সুমেরুশিখরে এসে শিশুকে স্নান করালেন, শুকের জন্য আকাশ থেকে ব্রহ্মচারীর ধারণীয় দণ্ড ও কৃষ্ণাজিন পতিত হল এবং দিব্য বাদ্যধ্বনি ও গন্ধর্ব-অপ্সরাদের নৃত্যগীত হতে লাগল। মহাদেব ভগবতীর সঙ্গে এসে সদ্যোজাত মুনিপুত্রের উপনয়ন-সংস্কার করলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাকে কমণ্ডলু ও দিব্যবস্ত্র দিলেন। বহু সহস্র হংস, শতপত্র (কাঠঠোকরা), সারস, শুক, চাষ (নীলকণ্ঠ) প্রভৃতি শুভসূচক পক্ষী বালককে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। জন্মমাত্র সমস্ত বেদ শুকের আয়ত্ত হল। তিনি বৃহস্পতির নিকট সকল শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন।

শুকদেব তাঁর পিতাকে বললেন, আপনি মোক্ষধর্মের উপদেশ দিন। ব্যাস তাকে নিখিল যোগ ও কাপিল (সাংখ্য) শাস্ত্র শিখিয়ে বললেন, তুমি মিথিলায় জনক রাজার কাছে যাও, তিনি তোমাকে মোক্ষধর্মের উপদেশ দেবেন। শুকদেব সুমেরু-শৃঙ্গ থেকে যাত্রা করে ইলাবৃতবর্ষ হরিবর্ষ ও হৈমবতবর্ষ অতিক্রম করলেন এবং চীন হূণ প্রভৃতি দেশ দেখে ভারতবর্ষে আর্যাবর্তে এলেন। তার পর মিথিলার রাজ-ভবনে উপস্থিত হয়ে দুই কক্ষা (মহল) অতিক্রম করে তিনি অমরাবতীতুল্য তৃতীয় কক্ষায় প্রবেশ করলেন। সেখানে পঞ্চাশ জন রূপবতী বারাঙ্গনা তাকে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে পূজা করে সস্বাদ অন্ন নিবেদন করলে। জিতেন্দ্রিয় শুকদেব সেইসকল নারীগণে পরিবৃত হয়ে নির্বিকারচিত্তে এক দিবারাত্র যাপন করলেন।

পরদিন জনক রাজা মস্তকে অর্ঘ্য ধারণ করে তার গুরুপুত্র শুকদেবের কাছে এলেন। যথাবিধি সংবর্ধনা ও কুশলজিজ্ঞাসার পর শুকদেবের প্রশ্নের উত্তরে জনক ব্রাহ্মণের কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন। শুক বললেন, মহারাজ, যার মনে। রাগদ্বেষাদি দ্বন্দ্ব নেই এবং শাশ্বত জ্ঞানবিজ্ঞান উৎপন্ন হয়েছে, তাকেও কি ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য ও বানপ্রস্থ এই তিন আশ্রমে বাস করতে হবে? জনক বললেন, জ্ঞানবিজ্ঞান বিনা মোক্ষ হয় না এবং গুরুর উপদেশ ভিন্ন জ্ঞানলাভও হয় না। যাতে লোকাচার ও কর্মকাণ্ডের উচ্ছেদ না হয় সেজন্যই ব্রহ্মচর্যাদি চতুরাশ্রম বিহিত হয়েছে। একে একে চার আশ্রমের ধর্ম পালন করে ক্রমশ শুভাশুভ কর্ম ত্যাগ করলে মোক্ষলাভ হয়। কিন্তু বহু জন্মের সাধনার ফলে যাঁর চিত্তসুদ্ধি হয়েছে তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমেই মোক্ষলাভ করেন, তার অপর তিন আশ্রমের প্রয়োজন হয় না।

তারপর জনক মোক্ষবিষয়ক বহু উপদেশ দিলেন। শুকদেব আত্মজ্ঞান লাভ করে কৃতার্থ হয়ে হিমালয়ের পূর্ব দিকে তাঁর পিতার নিকট উপস্থিত হলেন। ব্যাসদেব সেখানে সুমন্ত্র বৈশম্পায়ন জৈমিনি ও পৈল এই চার শিষ্যের সঙ্গে শুকদেবকেও বেদাধ্যয়ন করাতে লাগলেন। শিক্ষা সমাপ্ত হলে শিষ্যগণ এই বর প্রার্থনা করলেন, ভগবান, আমরা চার জন এবং গুরুপুত্র শুক—এই পাঁচ জন ভিন্ন আর কেউ যেন বেদের প্রতিষ্ঠাতা না হয়। ব্যাসদেব সম্মত হয়ে বললেন, তোমরা উপযুক্ত শিক্ষার্থীকে উপদেশ দিয়ে বেদের বহু প্রচার কর; শিষ্য ব্রতচারী ও পুণ্যাত্মা ভিন্ন অন্য কোনও লোককে, এবং চরিত্র পরীক্ষা না করে বেশিক্ষা দান করবে না। শিষ্যগণ তুষ্ট হয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন এবং ব্যাসকে প্রণাম করে প্রস্থান করলেন এবং অগ্নিহোত্রাদির মন্ত্র রচনা, যজ্ঞানুষ্ঠান ও অধ্যাপনা করে বিখ্যাত হলেন।

শিষ্যগণ চলে গেলে ব্যাসদেব তার পুত্রের সঙ্গে নীরবে বসে রইলেন। সেই সময়ে নারদ এসে বললেন, হে বশিষ্ঠবংশীয় মহর্ষি, বেদধ্বনি শুনছি না কেন, তুমি নীরবে ধ্যানস্থ হয়ে রয়েছ কেন? ব্যাস বললেন, শিষ্যগণের বিচ্ছেদে আমার মন নিরানন্দ হয়েছে। নারদ বললেন, বেদের দোষ বেদপাঠ না করা, ব্রাহ্মণের দোষ ব্রত না করা, পৃথিবীর দোষ বাহীক (১) দেশ, স্ত্রীলোকের দোষ কৌতকূল। অতএব তুমি পুত্রের সঙ্গে বেদধ্বনি কর, রাক্ষসভয় দূর হ’ক।

নারদের বাক্যে হৃষ্ট হয়ে ব্যাসদেব তার পুত্রের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে বেদপাঠ করতে লাগলেন। সেই সময়ে প্রবলবেগে বায়ু বইতে লাগল; অনধ্যায়কাল বিবেচনা করে ব্যাস তার পুত্রকে নিবারণ করলেন। শুকদেব তার পিতাকে বললেন, এই বায়ু কোথা থেকে এল? আপনি বায়ুর বিষয় বলুন। ব্যাসদেব তখন সমান উদান ব্যান অপান ও প্রাণ এই পাঁচ বায়ুর ক্রিয়া বিবৃত করে তাদের অন্য পাঁচ নাম বললেন-সংবহ উহ বিবহ আবহ ও প্রবহ। তিনি আরও দুই বায়ুর নাম বললেন-পরিবহ ও পরাবহ। তার পর তিনি বললেন, এই সকল বায়ু দ্বারাই মেঘের সঞ্চরণ, বিদ্যুৎপ্রকাশ, সমুদ্র হ’তে জলশোষণ, মেঘের উৎপত্তি, বারিবর্ষণ, ঝঞা প্রভৃতি সাধিত হয়।

বায়ুবেগ শান্ত হলে ব্যাসদেব তার পুত্রকে আবার বেদপাঠের অনুমতি দিয়ে গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন। শুকদেব নারদকে বললেন, দেবর্ষি, ইহলোকে যা হিতকর আপনি তার সম্বন্ধে উপদেশ দিন। নারদ বললেন, পুরাকালে ভগবান সনৎকুমার এই বাক্য বলেছিলেন।-

নাস্তি বিদ্যাসমং চক্ষুাস্তি সত্যসমং তপঃ।

নাস্তি রাগসমং দুঃখং নাস্তি ত্যাগসমং সুখ ৷৷

নিত্যং ক্রোধাৎ তপো রক্ষেচ্ছ্বিয়ং রক্ষেচ্চ মৎসরাৎ।

বিদ্যাং মানাপমানাভ্যামাত্মানং তু প্রমাদতঃ।।

আনৃশংস্যং পরো ধর্মঃ ক্ষমা চ পরমং বল।

আত্মজ্ঞানং পরং জ্ঞানং ন সত্যান্ বিদ্যতে পরম্ ৷৷

সত্যস্য বচনং শ্রেয়ঃ সত্যাদপি হিতং বদেৎ।

যভূতহিতমত্যন্তমেতৎ সত্যং মতো মম।

-বিদ্যার তুল্য চক্ষু নেই, সত্যের তুল্য তপস্যা নেই, আসক্তির তুল্য দুঃখ নেই, ত্যাগের তুল্য সুখ নেই। ক্রোধ হ’তে তপস্যাকে, পরশ্রীকাতরতা হতে নিজের শ্রীকে, মান-অপমান হ’তে বিদ্যাকে এবং প্রমাদ হ’তে আত্মাকে সর্বদা রক্ষা করবে। অনৃশংসতাই পরম ধর্ম, ক্ষমাই পরম বল, আত্মজ্ঞানই পরম জ্ঞান; সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই। সত্যবাক্য শ্রেয়, কিন্তু সত্য অপেক্ষাও হিতবাক্য বলবে; যা প্রাণিগণের অত্যন্ত হিতকর তাই আমার মতে সত্য।

ন হিংস্যাৎ সর্বভূতানি মৈত্ৰায়ণগতশ্চরেৎ।

নেদং জন্ম সমাসাদ্য বৈরং কুর্বীত কেনচিৎ৷৷

মৃতং বা যদি বা নষ্টং যোহতীতমনুশোচতি।

দুঃখেন লভতে দুঃখং দ্বাবনর্থেী প্রপদ্যতে৷৷

ভৈষজ্যমেত দুঃখস্য যদেতন্নানুচিন্তয়েৎ

চিন্ত্যমানং হি ন ব্যেতি ভুয়শ্চাপি প্রবর্ধতে।

-কোনও প্রাণীর হিংসা করবে না, সকলের প্রতি মিত্ৰতুল্য আচরণ করবে; এই মানবজন্ম পেয়ে কারও সঙ্গে শত্রুতা করবে না। যদি কেউ মরে, বা কোনও বস্তু নষ্ট হয়, তবে সেই অতীত বিষয়ের জন্য যে শোক করে সে দুঃখ হ’তেই দুঃখ পেয়ে দ্বিগুণ অনর্থ ভোগ করে। চিন্তা না করাই দুঃখনিবারণের ঔষধ; চিন্তা করলে দুঃখ কমে না, আরও বেড়ে যায়।

ব্যাধিভিমথ্যমানাং ত্যজং বিপুলং ধনম্।।

বেদনাং নাপকর্যন্তি যতমানাশ্চিকিৎসকাঃ

তে চাতিনিপুণা বৈদ্যাঃ কুশলাঃ সভৃতৌষধাঃ।

ব্যাধিভিঃ পরিকৃষ্যন্তে মৃগা ব্যাধৈরিবার্দিৰ্তাঃ।।

কে বা ভুবি চিকিৎসন্তে রোগাৰ্তান্ মৃগপক্ষিণঃ।

শ্বাপদানি দরিদ্রাংশ্চ প্রায়ো নার্তা ভবন্তি তে ৷৷

ঘোরানপি দুরাধান্ নৃপতীনুগ্রতেজসঃ।।

আক্রম্যাদদতে রোগাঃ পশূন্ পশুগণা ইব।

-ব্যাধিতে ক্লিষ্ট হয়ে যাদের বিপুল ধন ত্যাগ করতে হয়, চিকিৎসকগণ যত্ন করেও তাদের মনোবেদনা দূর করতে পারেন না। অতিনিপুণ অভিজ্ঞ বৈদ্যগণ, যাঁরা ঔষধ সঞ্চয় করে রাখেন, ব্যাধ কর্তৃক নিপীড়িত মৃগের ন্যায় তারাও ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হন। পৃথিবীতে রোগার্ত মৃগ পক্ষী শ্বাপদ ও দরিদ্র লোককে কে চিকিৎসা করে? এরা প্রায়ই পীড়িত হয় না। পশু যেমন প্রবলতর পশু কর্তৃক আক্রান্ত হয়, অতি দুর্ধর্ষ উগ্রতেজা নৃপতিও সেইরূপ রোগের কবলে পড়েন।

দেবর্ষি নারদ শুকদেবকে এইপ্রকার অনেক উপদেশ দিলেন। শুকদেব ভাবলেন, স্ত্রীপুত্ৰাদি পালনে বহু ক্লেশ, বিদ্যার্জনেও বহু শ্রম; অল্প আয়সে কি করে আমি শাশ্বত স্থান লাভ করব যেখান থেকে আর সংসারে ফিরে আসতে হবে না? শুকদেব স্থির করলেন, তিনি যোগবলে দেহ ত্যাগ করে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করবেন। তিনি নারদের অনুমতি নিয়ে ব্যাসদেবের কাছে গেলেন। ব্যাস বললেন, পুত্র, তুমি কিছুক্ষণ এখানে থাক, তোমাকে দেখে আমার চক্ষু তৃপ্ত হ’ক। শুকদেব উদাসীন স্নেহশূন্য ও সংশয়মুক্ত হয়ে পিতাকে ত্যাগ করে কৈলাস পর্বতের উপরে চলে গেলেন। সেখান থেকে তিনি যোগাবলম্বন করে আকাশে উঠে সূর্যের অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বে গিয়ে ব্রহ্মত্ব লাভ করলেন।

ব্যাসদেব স্নেহবশত পুত্রের অনুগমন করলেন এবং সরোদনে উচ্চস্বরে শুক বলে ডাকতে লাগলেন। সর্বব্যাপী সর্বাত্মা সর্বতোমুখ শুক স্থাবরজঙ্গম অনুনাদিত করে ‘ভোঃ’ শব্দে উত্তর দিলেন। তদবধি গিরির প্রভৃতিতে কিছু বললে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

শুকদেব অন্তর্হিত হলে ব্যাসদেব পর্বতশিখরে বসে তার পুত্রের বিষয় চিন্তা করতে লাগলেন। সেই সময়ে মন্দাকিনীতীরে যে অপ্সরারা নগ্ন হয়ে ক্রীড়া করছিল তারা ব্যাসকে দেখে ত্রস্ত ও লজ্জিত হল কেউ জলমধ্যে লীন হয়ে রইল, কেউ গুল্মের অন্তরালে গেল, কেউ পরিধেয় বস্ত্র গ্রহণে ত্বরান্বিত হল। এই দেখে পুত্রের অনাসক্তি এবং নিজের আসক্তি বুঝে ব্যাসদেব প্রীত (২) ও লজ্জিত হলেন। অনন্তর পিনাকপাণি ভগবান শংকর আবির্ভূত হয়ে পুত্রবিরহকাতর ব্যাসদেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তোমার পুত্রের ও তোমার কীর্তি চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। মহামুনি, তুমি আমার প্রসাদে সর্বদা সর্বত্র নিজ পুত্রের ছায়া দেখতে পাবে।

** (১) কর্ণপর্ব ১২-পরিচ্ছেদে বাহীকদেশের নিন্দা আছে।

 (২) ব্যাস জানতেন যে অপ্সরারা জিতেন্দ্রিয় নির্বিকার শুকের সমক্ষে লজ্জিত হত না।
 

২৪। উঞ্ছতধারীর উপাখ্যান

যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি মোক্ষধর্য বিবৃত করেছেন, এখন আশ্রমবাসীদের ধর্ম সম্বন্ধে বলুন। ভীষ্ম বললেন, সকল আশ্রমের জন্যই স্বর্গদায়ক ও মোক্ষফলপ্রদ ধর্ম বিহিত আছে। ধর্মের বহু দ্বার, ধর্মানুষ্ঠান কখনও বিফল হয় না। যার যে ধর্মে নিষ্ঠা, সেই ধর্মই তিনি অবলম্বন করেন। পুরাকালে দেবর্ষি নারদ ইন্দ্রকে যে উপাখ্যান। বলেছিলেন তা শোন।

গঙ্গার দক্ষিণ তীরে মহাপদ্ম নগরে এক ধার্মিক জিতেন্দ্রিয় ব্রাহ্মণ বাস করতেন, তার অনেক পুত্র ছিল। তার এই ভাবনা হল -বেদোক্ত ধর্ম, শাস্ত্রোক্ত ধর্ম, এবং শিষ্টাচারসম্মত ধর্ম, এই তিনের মধ্যে কোটি তার পক্ষে শ্রেয়। একদিন তার গৃহে একজন ব্রাহ্মণ অতিথি এলে তিনি যথাবিধি সকার করে নিজের সংশয়ের বিষয় জানালেন। অতিথি বললেন, এ সম্বন্ধে আমিও কিছু স্থির করতে পারিনি। কেউ মোক্ষের প্রশংসা করেন, কেউ বা যজ্ঞ, বানপ্রস্থ, গার্হস্থ্য, রাজধর্ম, গুরুনির্দিষ্ট ধর্ম, বাকসংযম, পিতামাতার সেবা, অহিংসা, সত্যকথন, সম্মুখযুদ্ধে মরণ, অথবা উঞ্ছবৃত্তিকেই শ্রেষ্ঠ মার্গ মনে করেন। আমার গুরুর নিকট শুনেছি, নৈমিষক্ষেত্রে গোমতীতীরে নাগাহয় (নাগ নামক) নগর আছে, সেখানে পদ্মনাভ নামে এক মহানাগ বাস করেন। তাঁর কাছে গেলে তিনি তোমার সংশয় ভঞ্জন করবেন।

পরদিন অতিথি চলে গেলে ব্রাহ্মণ নাগনগরের অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং বহু বন তীর্থ সরোবর প্রভৃতি অতিক্রম করে পদ্মনাভের পত্নীর নিকট উপস্থিত হলেন। ধর্মপরায়ণা নাগপত্নী বললেন, আমার পতি সূর্যের রথ বহন করবার জন্য গেছেন, সাত আট দিন পরে ফিরে আসবেন। ব্রাহ্মণ বললেন, আমি গোমতীতীরে। যাচ্ছি, সেখানে অল্পাহারী হয়ে তার প্রতীক্ষা করব। পদ্মনাভ যথাকালে তার ভবনে ফিরে এলে নাগপত্নী তাকে জানালেন যে তার দর্শনার্থী এক ব্রাহ্মণ গোমতীতীরে অনাহারে রয়েছেন, বহু অনুরোধেও তিনি আহার করেননি, তার কি প্রয়োজন তাও বলেননি। পদ্মনাভ তখনই ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে তাঁর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, আমার নাম ধৰ্মারণ্য; কৃষক যেমন জলধরের প্রতীক্ষা করে সেইরূপ আমি এত দিন তোমার প্রতীক্ষা করেছি। আমার প্রয়োজনের কথা পরে বলব, এখন তুমি আমার এই প্রশ্নের উত্তর দাও-তুমি পর্যায়ক্রমে সূর্যের একচক্র রথ বহন করতে যাও, সেখানে আশ্চর্য বিষয় কি দেখেছ?

পদ্মনাভ বললেন, ভগবান রবি বহু আশ্চর্যের আধার। দেবগণ ও সিদ্ধ মুনিগণ তার সহস্র রশ্মি আশ্রয় করে বাস করেন, তার প্রভাবেই সমীরণ প্রবাহিত হয়, বর্ষায় বারিপাত হয়; তার মণ্ডলমধ্যবর্তী তেজোময় মহান আত্মা সর্বলোক নিরীক্ষণ করেন। তিনি বর্ষিত জল পবিত্র কিরণ দ্বারা আট মাস পুনর্বার গ্রহণ করেন, তাঁর। জন্যই এই বসুন্ধরা বীজ ধারণ করে, তার অনাদি অনন্ত পুরুষোত্তম বিরাজ করেন। এইসকল অপেক্ষা আশ্চর্য আর কি আছে? তথাপি আরও আশ্চর্য যা দেখেছি তা শুনুন। একদিন মধ্যাহ্নকালে যখন ভাস্কর সর্বলোক তাপিত করছিলেন তখন তার অভিমুখে দ্বিতীয় আদিত্যতুল্য দীপ্তিমান অপর এক পুরুষকে আমি যেতে দেখলাম। সূর্যদেব তাঁর দিকে দুই হস্ত প্রসারিত করে সংবর্ধনা করলেন, সেই তেজোময় পুরুষও সসম্মানে নিজের দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে সূর্যের রশ্মি-মণ্ডলে প্রবিষ্ট হলেন। উভয়ের মধ্যে কে সূর্য তা আর বোঝা গেল না। আমরা সূর্যকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভগবান, দ্বিতীয়সূর্যতুল্য ইনি কে? সূর্য বললেন, ইনি অগ্নিদেব নন, অসুর বা পন্নগও নন; ইনি উঞ্ছবৃত্তি (১)-ব্রতধারী সমাধিনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলেন, অনাসক্ত এবং সর্বভূতহিতে রত হয়ে ফলমূল জীর্ণপত্র জল ও বায়ু ভক্ষণ করে প্রাণধারণ করতেন। মহাদেবকে তুষ্ট করে ইনি এখন সূর্যমণ্ডলে এসেছেন।

ব্রাহ্মণ বললেন, নাগ, তোমার কথা আশ্চর্য বটে। আমি প্রীত হয়েছি, তোমার কথায় আমি পথের সন্ধান পেয়েছি, তোমার মঙ্গল হ’ক, আমি এখন প্রস্থান করব। পদ্মনাভ বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, কোন্ প্রয়োজনে আপনি এসেছিলেন তা না বলেই যাবেন ? বৃক্ষমূলে উপবিষ্ট পথিকের ন্যায় আমাকে একবার দেখেই চলে যাওয়া আপনার উচিত নয়। আমি আপনার প্রতি অনুরক্ত, আপনিও নিশ্চয় আমাকে স্নেহ করেন, আমার অনুচরগণও আপনার অনুগত, তবে কেন যাবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন? ব্রাহ্মণ বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ ভূজঙ্গম, তোমার কথা যথার্থ। তুমিও যে, আমিও সে, তোমার আমার এবং সর্বভূতের একই সত্তা। তোমার কথায় আমার সংশয় দূর হয়েছে, আমি পরমার্থলাভের উপায় স্বরূপ উঞ্ছবৃত্তিই গ্রহণ করব। তোমার মঙ্গল হ’ক, আমি কৃতার্থ হয়েছি। এই বলে ব্রাহ্মণ প্রস্থান করলেন এবং ভৃগুবংশ-জাত চ্যবনের নিকট দীক্ষা নিয়ে উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বন করলেন।

**

(১) ক্ষেত্রে পতিত ধান্যাদি খুঁটে নেওয়া; অর্থাৎ অত্যল্প উপকরণে জীবিকানির্বাহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *