৫. উন্নয়নের বিতর্ক

উন্নয়নের বিতর্ক

ভর্তুকি কী কাজে লাগে

বিশ্বায়নের একটা সমস্যা হল, ভাল আইডিয়াগুলোর চাইতে খারাপ আইডিয়াগুলো তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়তে চায়। গোড়ায় সব কিছুতে টম্যাটো কেচাপ মাখানো শুরু হল, তারপর চিরকালের হুইস্কি-সোডা ছেড়ে চিনিতে চোবানো ককটেল খাওয়া ধরা হল। আর এখন চলছে এই ধারণাটা যে, গরিবের মর্যাদা রাখতে হলে তাদের জন্য কিছু করা ঠিক নয়, ভাগ্যের উপর তাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত। বরাবরই ভেবেছি, দারিদ্র সম্পর্কে এ দেশের বিত্তবানদের যথেষ্ট পোক্ত ধারণা রয়েছে, তাঁরা এমন বোকা বোকা মার্কিন কথাকে পাত্তা দেবেন না। কিন্তু গত কয়েক দিনে দিল্লিতে বেশ কয়েকবার কথাটা কানে এসেছে। যাঁরা বলেছেন, তাঁরা আর একটু বেশি জানেন বলে আশা ছিল।

ঘটনা হল, পচা আবর্জনার মধ্যে খাবার খোঁজার মধ্যে কোনও মর্যাদা নেই। কিন্তু টাকা না থাকায় অন্যের কাছে টাকা চাওয়াটাও সম্মানের কথা নয় (চাইবার আগেই যাঁরা অন্যকে টাকা দিয়েছেন, তাঁরা কখনও গ্রহীতার চোখের কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি ভুলবেন না)। আমাদের ছেলেবেলার চাইতে এখন দারিদ্র কমেছে, আবর্জনায় খাবার খোঁজার মতো অসম্মানের কাজ করতে হচ্ছে অনেক কম মানুষকে। কিন্তু বাড়ির কাছের শৌচাগারে জল নেই, দুর্গন্ধে টেকা যায় না বলে ভোর চারটেয় উঠে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে মাঠে যাওয়ার মধ্যেই বা কী এমন সম্মান রয়েছে?

গরিবকে ভর্তুকি দেওয়ার বিরুদ্ধে অবশ্যই অনেক ভাল যুক্তি রয়েছে। ভর্তুকি দিলে বাজেটে ঘাটতি বাড়ে, যার ফল মুদ্রাস্ফীতি। টাকার দাম কমলে গরিবের রোজগারও কার্যত কমে, তাই ভর্তুকি থেকে শেষ অবধি গরিবের লাভ হয় সামান্যই। এটা আরও বেশি সত্য হয়ে ওঠে সেই সব ক্ষেত্রে, যেখানে ভর্তুকি যাদের পাওয়ার কথা তারা পায় না। যেমন রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি, যা কার্যত গরিবের জন্য নির্দিষ্ট টাকা বিলি করে মধ্যবিত্তকে। তবে গরিবকে ভর্তুকি দিতে কত টাকা খরচ হচ্ছে, তার চাইতে অনেক বড় প্রশ্ন, কী ভাবে খরচ হচ্ছে টাকাটা। ঠিক মতো ব্যবহৃত হলে ভর্তুকির টাকা গরিব তার সীমিত সুযোগকে আর একটু কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনার ছক যদি ভুল হয়, তা হলে ভর্তুকির টাকা তার সামান্যই কাজে লাগবে, এমনকী পরিস্থিতি আরও খারাপও করে তুলতে পারে।

একটা দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। প্রায় কেউই প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তুকির বিরোধিতা করেন না। এমনকী মিলটন ফ্রিডম্যানের মতো যাঁরা মুক্ত বাজারের কট্টর সমর্থক, তাঁরাও মনে করেন যে গরিব পরিবারে জন্মানোর জন্য কোনও শিশু জীবনে পিছিয়ে পড়বে, এটা মেনে নেওয়া চলে না। তাই সরকারের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু একটা করা দরকার।

প্রাথমিক শিক্ষায় কত সরকারি টাকা খরচ হয়, নানা রাজ্যে তার নানা হিসেব পাওয়া যায়। তবে জাতীয় গড়ের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদনের যত শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষায় এ দেশে খরচ হয়, তা চিনের চাইতে বেশি, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনীয়। এই টাকার একটা বড় অংশ যায় শিক্ষকদের বেতন দিতে। সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা গড়ে যা বেতন পান, তা জাতীয় মাথাপিছু রোজগারের অন্তত চারগুণ। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক, বা সরকারি স্কুলের প্যারাটিচার সেখানে সরকারি শিক্ষকদের এক-তৃতীয়াংশ মতো টাকা পান, যা জাতীয় মাথাপিছু রোজগারের কাছাকাছি। কিন্তু অর্থনীতিবিদ কার্তিক মুরলিধরন এবং তাঁর সহকর্মীদের সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে, প্যারাটিচার বা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা শিশুদের যা শেখান, তার মান অতটাই ভাল, অনেক সময়ে আরও ভাল। যদিও গড় মান খুব কিছু ভাল নয়। ‘অসর’ রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণির অর্ধেক ছেলেমেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য পড়তে পারছে না। সম্ভবত বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক বা প্যারাটিচার আরও ভাল পড়ানোর কারণ, তাঁরা চেষ্টা করেন আর একটু বেশি।

শিক্ষকরা যদি ক্লাসেই না আসেন, বা আসলেও খারাপ পড়ান, তা হলে কেন আমরা তাঁদের এমন ভাল মাইনে দিচ্ছি? একটা উত্তর মেলে, শিক্ষকদের ইউনিয়ন খুব জোরালো। কিন্তু শেষ অবধি যে এই ব্যবস্থাটা চলতে পারছে তার কারণ আমরা এটাতে আপত্তিকর কিছু দেখছি না। ‘শিক্ষা বিশেষজ্ঞ’-দের অনুসরণ করে আমরাও মনে করছি (এবং সরকারও মনে করছে), যে শিক্ষকের পরিচয় তাঁর ডিগ্রি এবং তাঁর বেতনে। তিনি কতটা শেখাতে পারছেন, সেটা দিয়ে তাঁর বিচার হয় না।

শিক্ষকদের বেতন যদি প্যারাটিচারদের বেতনের সমান করা হত, তা হলে মোট জাতীয় উৎপাদনের অন্তত ১ শতাংশ বাঁচত, যা গরিবদের ফিরিয়ে দেওয়া যেত। এতগুলো টাকা যে নষ্ট হচ্ছে, সে-সমস্যা তো রয়েইছে। কিন্তু তা নিয়ে যে রাজনীতিটা হল, সেটা আরও ভয়ঙ্কর। যখন দেখা গেল, সরকারি স্কুলে ছাত্রদের সংখ্যা দ্রুত কমছে (ভারতের গ্রামেও এখন তিনজন শিশুর একজন প্রাইভেট স্কুলে যায়), স্বাভাবিকভাবেই একটা আশঙ্কা দেখা দিল, কত দিন এ ভাবে সরকারি টাকা নেওয়া চলবে। তখন সরকারি শিক্ষক এবং তাঁর বেরাদরি ‘শিক্ষার অধিকার’ নামক কলটি ফেঁদে বসলেন।

ওই আইনে যে কিছু কিছু ভাল আইডিয়া নেই, এমন নয়। কিন্তু তার একটি বড় দাবি হল, বেসরকারি স্কুলগুলোকে সরকারি স্কুলের সমান বেতন দিতে হবে শিক্ষকদের। এই ধারা কার্যকর হওয়ার পর থেকে বেসরকারি স্কুলগুলো বন্ধ হতে শুরু করেছে, কারণ প্রাইভেট স্কুলগুলোর পক্ষে অত বেশি টাকা দেওয়া অসম্ভব। গরিবের জন্য ভর্তুকি এই ভাবে উলটে গরিবকেই মারছে। কারণ গরিবের কথা ভেবে সরকারি শিক্ষককে যে টাকা দিচ্ছে সরকার, তার জেরে গরিবকে পরিষেবা দিত যে সব স্কুল সেগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

তার মানে এই নয় যে গরিবের জন্য ভর্তুকি হল বাজে খরচ। আমরা যদি কেবল এটাই দেখি যে কোন সরকারি প্রকল্প গরিবের অনেকখানি উপকার করেছে (প্রকল্পের জন্য কত খরচ হয়েছে, সেই টাকা আর কোনও ভাবে খরচ করলে বেশি লাভ হত কি না, সে-প্রশ্নগুলো যদি না-ই ধরা হয়) তা হলেও বেশ কিছু সরকারি প্রকল্পের নাম সামনে আসে। যেমন যে সব কৃষি প্রকল্প উচ্চফলনশীল প্রজাতির গম, ও পরে ধান তুলে দেয় চাষিদের হাতে। সত্তর-আশির দশকে গ্রাম-মফস্‌সলে ব্যাঙ্কের শাখার বিস্তার। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের সাইকেল বিলির প্রকল্প বিহার সরকারের। আর সাম্প্রতিক, বিতর্কিত একশো দিনের কাজের প্রকল্প। এমনকী শিক্ষার অধিকার আইনও গরিবের উপকার করতে পারে, যদি নামীদামী বেসরকারি স্কুলগুলোতে গরিবের জন্য এক-চতুর্থাংশ আসন সংরক্ষিত রাখার শর্ত সর্বত্র পালন করা হয়। এখনও অবধি তা হয়নি।

তবে লক্ষ করা দরকার, এই সবগুলি প্রকল্পই কোনও-না-কোনও নির্দিষ্ট, পরিচিত সমস্যার সমাধান করেছে। গরিবের টাকা সঞ্চয়ের সুরক্ষিত জায়গার অভাবের সমস্যা ঘুচিয়েছে ব্যাঙ্কের শাখা। দূরের স্কুলে যাওয়ায় ছাত্রীদের সমস্যা অতিক্রম করেছে সাইকেল। সেই দৃষ্টিতে বিচার করলে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের সরকারি হারে মাইনে দেওয়ার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষত যখন এমন কোনও প্রমাণ মিলছে না যে বেশি বেতনের সরকারি শিক্ষকেরা আরও ভাল পড়াচ্ছেন— বরং বিপরীত সাক্ষ্যই মিলছে।

অর্থাৎ সমস্যাটা ভর্তুকি নয়। সরকারি প্রকল্প কী ভাবে পরিকল্পিত হচ্ছে, কাজ করছে, প্রশ্নটা সেখানে। দুর্বল পরিকল্পনা, ভুল রূপায়ণ অকস্মাৎ হয় না। ‘গরিবের জন্য’ কোনও প্রকল্প তৈরি হলেই সেখানে এমন একটা আত্মম্ভরিতা থাকে, ‘যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে’ এমন মানসিকতা কাজ করে, যে জরুরি প্রশ্নগুলো করা হয় না— এই প্রকল্প করার কি অর্থ হয়? এটা যে কাজ করবে, তার কি কোনও প্রমাণ মিলেছে? আর কোনও ভাবে কাজটা করলে কি এর উদ্দেশ্য আরও ভাল সাধিত হতে পারত?

জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প এর একটা সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। একবার যেই ঘোষণা করা হল যে ক্ষুধার্ত জনগণকে খাবার দেওয়া হবে, আর এই আইনের যাত্রা ঠেকানো গেল না। কেউ প্রশ্ন করল না, এ দেশে অপুষ্টি কি খাদ্যের অভাবের জন্য হচ্ছে, নাকি খাদ্যাভ্যাসে নানা ত্রুটির জন্য? সস্তায় চাল-গম দিলে যে অপুষ্টি কমবে, তার কি প্রমাণ আছে? ওই চাল-গমের টাকা যে আরও মোবাইল ফোন বা অন্যান্য শখের জিনিসে ব্যয় হবে না, তা বুঝব কী করে? কিন্তু বিরোধী বিজেপি অবধি এই প্রশ্নগুলো না তুলে সমর্থন করল আইনকে। অভিযোগ করলেন কেবল কিছু অর্থনীতিবিদ, যাঁরা সব বিষয়েই আপত্তি তোলেন।

হাতের কাছে যা সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, তার সবই এটাই ইঙ্গিত করে যে, খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পে অপুষ্টির সমস্যা প্রায় কিছুই মিটবে না। বরং খাদ্যাভ্যাসের ত্রুটির দিক থেকে নজর সরিয়ে আরও ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু এর কার্যকারিতার কোনও বিচার না করেই আমরা এর জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করলাম।

হয়তো সমস্যার একটা কারণ হল, আমরা ভর্তুকিকে ‘দান’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। দান করার কাজটাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। যে গ্রহণ করল, সে তা নিয়ে কী করল, সে-প্রশ্নটা জরুরি নয়। তাই ভর্তুকিকে ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। আমরা যদি মনে করি যে বর্ণ, জাতি, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইতিহাসে কিছু মানুষ যে ভাবে বঞ্চিত হয়েছে, ভর্তুকি সেই ক্ষতির নিরসন করছে, তা হলে হয়তো আমাদের আত্মম্ভরিতা একটু কমবে। আমরা চিন্তা করতে বাধ্য হব, প্রতিটি শিশু সমান সুযোগ নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারার যে লক্ষ্য, তা বাস্তবিক ঘটছে কি না।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২ অক্টোবর ২০১৪

কেন বিদেশি অনুদান প্রয়োজন

২০১২ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে, ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতকে আর্থিক অনুদান দেওয়া বন্ধ করা হবে।

ভারতে দারিদ্র কমাতে কি বিদেশি অনুদানের দরকার আছে? ব্রিটিশ সরকারের অনুদান সংস্থা ‘ডিফিড’ (ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) এই প্রশ্নে বেশ বিপাকে পড়েছে। ভারতীয় নেতারা প্রাক্তন শাসকদের এক হাত নেওয়ার সুযোগ ছাড়বেন না, ভারতীয় সাংবাদিকরাও ঘুরপথে ঔপনিবেশিক আধিপত্য বজায় রাখার ফন্দির নিন্দে করে সম্পাদকীয় কলাম লিখছেন। ও দিকে ব্রিটেনের খবরের কাগজগুলো শোরগোল তুলছে, পয়সা দিয়েও যদি প্রভাব-প্রতিপত্তি না মেলে তা হলে খয়রাতি করে লাভ কী?

অনুদানের যুক্তি একটাই হতে পারে। তা হল, গরিব মানুষেরা যে-ই হন, যেখানেই বাস করুন, তাঁদের নিয়ে আমরা চিন্তিত। এ দেশের রইস আদমিরা যা-ই বলুন, ভারতের ৩০ শতাংশ মানুষ এখনও অত্যন্ত দরিদ্র। দু’দশক ধরে ভারতের অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধি হয়েছে, বলিউডে একাধিক বিলিয়নেয়ার তৈরি হয়েছে, মহাকাশে যান পাঠানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও ভারতের মাথাপিছু রোজগার কার্যত ব্রিটেনের মাথাপিছু রোজগারের দশ শতাংশ। এটাই কি ডিফিড-এর এ দেশে কাজ করার যথেষ্ট যুক্তি নয়? দু’দশকে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠার যে কথা চলছে (যা একটু বাড়াবাড়ি, কারণ বৃদ্ধির হার ইতিমধ্যেই কমে আসছে), তা এই কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছে যে এই বৃদ্ধির প্রধান কারণ, ভারতের জনসংখ্যা ততদিনে ১৫০ কোটি দাঁড়াবে, যাঁদের অর্ধেক বেড়ে উঠবে অর্ধাহারে, সিকি-শিক্ষিত হয়ে।

যার মানে দাঁড়ায়, ব্রিটিশ সরকার যে সহায়তা করতে পারবে তা হবে সীমিত। ইচ্ছে থাকলেও অত টাকা তারা জোগাতে পারবে না। আমাদেরই ভারতের অধিকাংশ সমস্যা সমাধানের কাজটা করতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আমি বরাবরই ধনীদের উপর বেশি কর চাপানোর পক্ষপাতী (যেমন, বিত্তকর বসিয়ে)। কিন্তু পুঁজি কত সহজে অন্য দেশে পাচার হয়, এবং কর আদায় করতে যা হ্যাপা, তা মাথায় রাখলে আশঙ্কা হয়, নিকট ভবিষ্যতে কর থেকে মোট জাতীয় আয় অল্প কয়েক শতাংশ বড়জোর বাড়তে পারে। টাকার অঙ্কে সেটা অনেক বড়, কিন্তু সমস্যাও খুব কম নয়— শিক্ষার দশা করুণ, স্বাস্থ্য পরিষেবাও তথৈবচ, আর পরিকাঠামোর কথা না-ই বা তুললাম। পুষ্টির বিষয়টাই ধরা যাক— ভারতের শিশুদের অর্ধেকেরই অপুষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যার মানে, কয়েক কোটি শিশু। এ সবের সামনে দাঁড়িয়ে যে-কোনও সহায়তাই মূল্যবান মনে হয় না কি? কিছু নাক-উঁচু লোকের ‘ব্রিটিশ দাক্ষিণ্যে’ গোঁসা হয় বলে আমরা অনুদান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেব?

বিদেশি অনুদানের বিরুদ্ধে যুক্তি অবশ্য এখানেই শেষ হয় না। অনেক গবেষক (এবং বেশ কিছু সম্পাদকীয় লেখক) মনে করেন যে ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে দেওয়া হলেও, বিজাতীয় বলেই অনুদান কাজ করে না। অর্থনীতির আরও অনেক ধারণার মতোই, এ ধারণাটারও সমর্থনে বা বিপক্ষে যথেষ্ট সাক্ষ্য নেই। তাই এর উপর ভর করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে না বলেই মনে হয়। উন্নত দেশেও দারিদ্র কমানোর অনেক প্রকল্প ব্যর্থ হয়। বিদেশি অনুদানের টাকায় চলা প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে, এমন অনেক দৃষ্টান্ত মিলবে। যেমন মিলবে সরকারি টাকায়, বা অন্য সূত্রে মেলা অনুদানে রূপায়িত প্রকল্পে ব্যর্থতার বহু দৃষ্টান্ত। বিদেশি অনুদানের টাকায় চলা প্রকল্পগুলোই ব্যর্থ হচ্ছে বেশি, এমন কোনও প্রমাণ হাতে নেই।

ভারতে ডিফিড যে-প্রকল্পগুলোর জন্য টাকা দিয়েছে, তাতে বিদেশি অনুদান-প্রাপ্ত প্রকল্পের পরিচিত ঝুঁকিগুলো এড়িয়েছে। গরিবের সব সমস্যার জন্য একটাই সমাধান চাপানোর চেষ্টা করেনি ডিফিড। মূলত পুষ্টি, শৌচাগার আর মা-শিশুর স্বাস্থ্যের উপর জোর দিয়েছে। কাজ করেছে বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশে, যেখানে বেশি সংখ্যায় গরিব থাকে। আর যা সবচেয়ে জরুরি কথা তা হল, তারা ‘রেডিমেড’ সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেনি। তাদের কাজের মূল কথাই ছিল, ‘আমরা জানি না কেন এই সমস্যাগুলো হচ্ছে, এবং সেই কারণের অনুসন্ধান সমস্যার সমাধান বার করার একটি প্রধান উপায়।’

এই শেষের বিষয়টিই ভারতে বিদেশি অনুদানের প্রধান অবদান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ভারতের বিভিন্ন সরকারি দফতরে যে কর্মসংস্কৃতি, তাতে কী করলে কাজটা ঠিকমতো হবে, তার চাইতেও বড় হয়ে ওঠে, কী করা সুবিধে সেই প্রশ্নটা। কাজের যে পদ্ধতি-প্রক্রিয়া সম্পর্কে আগে থেকে একটু জানাশোনা আছে, সেটাই কাজে লাগানোর ঝোঁক দেখা যায়। এই মানসিকতা হল ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অবদান। ভারতে সরকারি দফতরের কর্মীরা তাঁদের কাজের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, অধিকাংশই এক বছর কি দু’বছর কাজ করে অন্য দফতরে চলে যাবেন। ফলে কঠিন সমস্যাগুলোর সমাধানে কী করা দরকার, তা বোঝার সময়, ইচ্ছে, ক্ষমতা, কোনওটাই তাঁদের নেই। যদি বা তাঁদের কারও ইচ্ছে থাকে কাজটা ঠিকমতো করার, রাজনীতির চরিত্র এমনই যে ক্ষমতাসীন নেতারা নতুন কিছু করে ভুল প্রতিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নন। বৃহৎ প্রকল্প শুরু করার উচ্চাশায় লাগাম পরিয়ে, ছোট পরিসরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে রাজি নন।

এইখানেই অনুদানের ভূমিকা। যে হেতু ভারতে ক্ষমতা সামলানোর দায় নেই, তাই ডিফিড-এর মতো বিদেশি অনুদান সংস্থা কোনও একটি বা দুটি সমস্যাকে চিহ্নিত করে, ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রচেষ্টা-ভ্রান্তির মাধ্যমে সমাধানের দিকে এগোতে পারে। হাতে সময় নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারে। সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে থেকে যে ধরনের সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়, এমন দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার দ্বারা অনুদান সংস্থা সেই সমাধানের দিকে এগোতে পারে। এবং তাদের সেই কাজের সংস্কৃতি থেকে হয়তো এদেশে প্রশাসনের এমন একটা মডেল, একটা সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব, যা শেষ অবধি ভারতীয়দের নিজেদের সমস্যা সমাধানে সমর্থ করে তুলবে। ব্রিটিশ সরকার ভারতকে যে টাকা দিচ্ছে, শেষ বিচারে সেটা সব চাইতে জরুরি নয়। যা জরুরি, তা হল ব্রিটিশ সরকারের অনুদান সংস্থার ধৈর্য ধরার ক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও গুরুত্বের সঙ্গে সমাধান খোঁজার ক্ষমতা। ফাঁপা জাতীয়তাবাদের কবলে পড়ে তা হারালে আফশোস করতে হবে।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২

‘নিরাপত্তা’ কতটা নিরাপদ

খাদ্য নিরাপত্তা অর্ডিনান্স পাশ করল ইউ পি এ। সবাই বুঝল, দেশের সব নাগরিক যাতে যথেষ্ট খাবার পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকার এখন আইনত বাধ্য। তবে তাতে হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তদের নতুন করে কী লাভ হল, তা ঠিক বোঝা গেল না।

ভারতে খাদ্যনীতি বলতে বোঝায়, গরিবের কাছে সস্তায় চাল-গম পৌঁছে দেওয়ার নীতি। সেই ষাটের দশক থেকে আজ পর্যন্ত আগাগোড়াই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজার দরের চাইতে কম দামে খাদ্যশস্য বিতরণের ব্যবস্থা করলে তাতে দেশে অপুষ্টি কমবে। ভারতে অপুষ্টি তীব্র এবং ব্যাপক, তাই দেশ জুড়ে প্রায় ৫০ লক্ষ রেশন দোকান তৈরি করে তাতে বিপুল পরিমাণ চাল-গম সরবরাহ করতে হবে, এমন যুক্তির উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে খাদ্যনীতি। আজ পর্যন্ত এই ধারণাকে কখনও কেউ প্রশ্ন করেনি।

অথচ সস্তায় চাল-গম দিলে অপুষ্টি কমে, সেই ধারণার সপক্ষে কোনও প্রমাণ মিলছে না। গরিব মানুষকে সস্তায় চাল-গম দিলে তাঁর যে-টাকা বাঁচে, ধরেই নেওয়া হয় তা দিয়ে তিনি বাড়তি খাদ্যশস্য কিংবা অন্য পুষ্টিকর খাবার কিনবেন। বাস্তবে গরিব মানুষ তাই করেন কি না, সেটা কখনও দেখা হয় না। ধরুন আপনি পরিবারের জন্য মাসে চল্লিশ কিলোগ্রাম গম কেনেন বাজারদরে, তাতে আপনাদের চাহিদা কোনও মতে মেটে। আপনাকে বিশ কিলোগ্রাম গম খুব কম দামে দেওয়া হল। আপনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন, কারণ আপনার মনে হবে, হাতে কিছু টাকা রয়েছে। নিজেকে একটু কম গরিব মনে হবে। কিন্তু ওই বাড়তি টাকা দিয়ে কি বাড়তি কুড়ি কিলোগ্রাম গমই কিনবেন? নাকি ছেলেমেয়ের জন্য লজেন্স-চানাচুর কিনবেন, বাড়ির মেয়েদের জন্য শখের টুকিটাকি, বা আপনার মোবাইলের টকটাইম? রেশনে চালের দাম যদি দু’টাকাও হয়, বাজারে দাম ২২-২৬ টাকাই থাকবে। তাই শেষ চার-পাঁচ কিলোগ্রাম চাল কেউ বাজারদরে কিনবেন, নাকি ওই টাকাটা অন্য কাজে খরচ করবেন, সেই সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতেই হবে।

দশ বছর অন্তর গোটা দেশে একটা সমীক্ষায় দেখা হয়, নানা রাজ্যের শহরে-গ্রামে পরিবারগুলি কীসে কত খরচ করে (জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার মাসিক ভোগব্যয় সমীক্ষা)। সেই সমীক্ষায় যে-ছবি উঠে আসে, তা থেকে স্পষ্ট হয় যে, কেবল অতি-দরিদ্র পরিবারগুলিই বেশি টাকা পেলে বেশি খাদ্যশস্য কিনছেন। তার চাইতে কিছু বেশি টাকা যাঁদের আছে, তাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে থাকলেও হাতে টাকা থাকলে খরচ করছেন চিনি, মাছ-মাংস, তেল কিনতে। অতি-দরিদ্র পরিবার জনসংখ্যার কমবেশি ১০ শতাংশ। অপুষ্টি তার চেয়ে অনেক, অনেক ব্যাপক। অন্তত ৪২ শতাংশ শিশুর ওজন যে কম, সে-কথা তো ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীই কবুল করেছেন। যার মানে, কেবল খাবার কেনার অক্ষমতা দিয়ে অপুষ্টির ব্যাখ্যা করা চলে না। একটা শিশুর পেট ভরাতে কতটাই বা চালডাল দরকার হয়? যে-বাড়িতে টিভি চলে, মোবাইল বসানো আছে চার্জে, সাইকেল ঠেস দেওয়া দাওয়ার গোড়ায়, চালডালের দামই কি তার সন্তানের অপুষ্টির কারণ? আফ্রিকার দক্ষিণের যে সব দেশে গড় আয় ভারতের চাইতে অনেক কম, সেখানেও শিশুদের পুষ্টি ভারতের শিশুদের পুষ্টির চেয়ে অনেক ভাল। কী করে হয়? তার একটা কারণ এই যে, ভারতে সামান্য টাকাতেও নানা লোভনীয় জিনিস কেনা যায়। পাঁচ টাকা-দশ টাকাতেই পাওয়া যায় প্লাস্টিকের চিরুনি, শ্যাম্পুর খুদে প্যাকেট, টিপের পাতা। ভারতের দেশ-জোড়া মস্ত বাজার রয়েছে, তাই অনেক কম-দামি জিনিস তৈরি হয়, বিক্রি হয়। আফ্রিকার গরিব দেশগুলিতে এ সব শখের জিনিস গরিবের নাগালের বাইরে। খাদ্যশস্য ছাড়া খুব কিছু গরিব মানুষ কিনতে পারেন না। তাঁদের ‘চয়েস’ কম, পুষ্টি বেশি।

ভারতে ছয় দশক ধরে সস্তায় চাল-গম দিয়ে অপুষ্টি মেটেনি। এখন বলা হচ্ছে, আরও সস্তায় আরও বেশি চাল-গম দিলে অপুষ্টি কমবে। গোড়ায় গলদ হচ্ছে কি না, মানে নীতিটাই ভুল কি না, তা কেউ ভাবতে রাজি নন।

যেমন ভাবতে রাজি নন পদ্ধতি নিয়ে। রেশন ব্যবস্থার মতো দুর্নীতি-জর্জরিত, অপচয়-বহুল ব্যবস্থা ভারতেও কম রয়েছে। কত চাল-গম নষ্ট হয় প্রতি বছর, তার আন্দাজ করতে গেলেও তাজ্জব হতে হয়। গোটা অস্ট্রেলিয়ায় যত গম উৎপন্ন হয়, ভারতের গুদামগুলোতে তা নাকি নষ্টই হয় প্রতি বছর। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত চার বছরে ভারতে ৭৯৪২ কোটি টন গম নষ্ট হয়েছে, যা উৎপাদনের ৯ শতাংশ। তার সঙ্গে রয়েছে চুরি। প্রতি বছর অর্ধেকেরও বেশি গম, আর প্রায় ৪০ শতাংশ চাল, গরিবের কাছে পৌঁছনোর আগেই গায়েব হয়ে যায়। ২০০৬-০৭ সালে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই ১৯০০ কোটি টাকার চাল চুরি হয়েছিল, উত্তরপ্রদেশে ৩০০০ কোটি টাকারও বেশি। সরকারি হিসেবেই এই দশা। এখন আরও, আরও চাল-গম রেশন দোকানের মধ্যে দিয়ে বিতরণ হবে, শুনলে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই লাইন:

এ যেন দিবারাত্রে

জল ঢেলে ফুটোপাত্রে

বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে।

কেন তা হলে রেশন ব্যবস্থা দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা?

বলা হচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা এখন ‘অধিকার,’ তাই তা নিশ্চিত করতে সরকার দায়বদ্ধ। বাস্তব কিন্তু এই যে, রেশন দোকান পর্যন্ত খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়াতেই সরকারের ‘খাদ্যের অধিকার’ বিষয়ে আইনি দায় শেষ হয়। ঠিক যেমন স্কুলের ক্লাসরুম-শৌচাগার তৈরি করে, শিক্ষক নিয়োগ করে, শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে ‘শিক্ষার অধিকার’ নিশ্চিত করার দায় শেষ হয়।

ছেলেমেয়েরা আদৌ অঙ্ক কষতে, বাক্য লিখতে শিখল কি না, তা জানবার কোনও পদ্ধতি সরকারের হাতে নেই। গরিব পরিবারগুলি পুষ্টিকর খাবার যথেষ্ট পরিমাণে খেল কি না, তা টের পাওয়ার কোনও উপায়ও নেই সরকারের হাতে। ‘আমি যখন দিচ্ছি, তখন ওরা নিশ্চয়ই পাচ্ছে,’ এমন একটা আলগা ধারণার ওপর ভিত্তি করে বছরের পর বছর প্রকল্পগুলো কাজ করে, যদিও সমস্ত তথ্য-পরিসংখ্যান, অভিযোগ-অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় সেই ধারণার বিপরীতে।

গরিবকে শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার দেওয়া হলে ঠিক কী দেওয়া হয়? যাঁরা অধিকার-আন্দোলনের শরিক, তাঁরা বলবেন, আইনি অধিকার পেলে আমজনতা আদালতে গিয়ে হকের পাওনা দাবি করতে পারেন। রাষ্ট্র সেই দাবিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য। কথাটা ভুল নয়। কিন্তু কে আদালতে যায় মেয়ের স্কুলে শৌচাগার তালা-আঁটা রয়েছে বলে? কে পুলিশে নালিশ করে, রেশনে ৩৫০ গ্রাম চাল কম পেলে? কিংবা বেলা ১২টায় রেশন দোকান বন্ধ হয়ে গেলে? আর সত্যিই যদি হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তদের অধিকারভঙ্গের প্রতিটি অভিযোগ দায়ের হয় আদালতে, বিচারব্যবস্থা কি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে না?

অনেকে বলবেন, অধিকার-টধিকার কথার কথা, এ হল ভোটের রাজনীতি। খুব সস্তায় অনেক চাল দেব, এ কথাটা বললে গরিব মানুষ ভোট দেবে, আর কে না জানে ভারতে গরিবের ভোটই বেশি। এটুকু বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বোঝা গেল না ইউ পি এ সরকার কী করে খাদ্য নিরাপত্তা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা আশা করছে। চাল-গমের বদলে গরিবের ভোট, এই হিসেব সে সব রাজ্যেই কাজ করবে যেখানে রেশনব্যবস্থা মোটামুটি ভাল কাজ করে। তার মধ্যে রয়েছে ছত্তিশগড়, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ। এই রাজ্যগুলি দীর্ঘ দিন ‘দু’টাকায় চাল’-এর রাজনীতি করেছে, এদের রেশনব্যবস্থাও অন্যদের তুলনায় ভাল। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ ছাড়া অন্য রাজ্যগুলো চালাচ্ছে ইউ পি এ-র বিরোধী দলগুলো। তামিলনাড়ু বা ছত্তিশগড় যদি বা খাদ্যের বদলে ভোট ফর্মুলা কাজে লাগায়, তাতে ইউ পি এ-র সুবিধে কী? তামিলনাড়ুতে এক টাকায় ইডলি বিক্রির প্রকল্প চালু করে বিপুল জনপ্রিয়তা কুড়োচ্ছেন জয়ললিতা। ছত্তিশগড়ে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহকে লোকে বলে ‘চাওল বাবা।’

বরং ইউ পি এ-শাসিত রাজ্যগুলির সমস্যা তীব্র হতে পারে। বিপুল পরিমাণে চাল-গম কিনবে সরকার, সেই প্রত্যাশায় বাজারে শস্যের দাম বেড়ে যাবে। এদিকে সস্তার চাল-গম মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে লেগে যাবে বেশ কয়েক মাস। এর মাঝের সময়টা গাঁটের কড়ি খরচ হবে বেশি। সেই রাগ গিয়ে পড়তে পারে ইউ পি এ সরকারের উপরেই। তা আন্দাজ করেই হয়তো সনিয়া-রাহুলের আগ্রহ সত্ত্বেও কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের রাজ্যে তড়িঘড়ি খাদ্য নিরাপত্তার প্রকল্প শুরু করতে গররাজি।

অনেকে অবশ্য খাদ্যের অধিকারকে কেবল কার্যকারিতার প্রশ্নে বেঁধে রাখতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, রাষ্ট্র যে নাগরিকের কাছে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ, সে-কথাটা আরও জোরালো করতেই শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার তৈরি করা দরকার। মুশকিল হল, এতে গরিবের চেয়ে নেতাদের সুবিধে বেশি। আইন পাশ করে ‘অধিকার’ তৈরি করেই নৈতিকতার পরীক্ষায় পাশ করে যান তাঁরা। কাজটা আর করে দেখাতে হয় না। খাদ্যের অধিকার আইন হওয়ার আগে যে রেশনে চাল পায়নি, আইন হওয়ার পরে সে কী করে চাল পাবে? শিক্ষার অধিকার আইন হওয়ার আগে যে স্কুলে গিয়েও নাম লিখতে শেখেনি, আইন হওয়ার পরে সে কী করে শিখবে? এমন প্রশ্নগুলো স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যাওয়া যায়। অধিকার-আন্দোলন দায়বদ্ধতা বাড়াতে গিয়ে আসলে দায় এড়ানোর পথ তৈরি করে দিচ্ছে।

যে দিক দিয়েই দেখা যাক, খাদ্যের নিরাপত্তা আইন ইউ পি এ সরকারের ঝুঁকি আরও বাড়িয়েই দিচ্ছে। গরিবের ঝুঁকিও কিছু কমাচ্ছে না। বেচারি গরিব। ‘নিরাপত্তা’-ও তার পক্ষে আর নিরাপদ নয়।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ জুলাই ২০১৩

আধার কী পারে

২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আধার কার্ড বিলি শুরু করে। ২০১৩ সালের পয়লা জানুয়ারি আধার কার্ডের নম্বর ব্যবহার করে ভর্তুকি, পেনশন, স্কলারশিপ প্রভৃতি সরকারি অনুদানের টাকা উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছনোর কাজ শুরু হয়। বর্তমানে একশো কোটি মানুষের কার্ড রয়েছে বলে দাবি করেছে সরকার।

আজ থেকে কিছু কিছু এলাকায় আধার কার্ড দিয়ে সরকারি প্রকল্পের উপভোক্তাদের টাকা দেওয়া শুরু হবে, এই ঘোষণা শুনে রাজনৈতিক মহল বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বহু বছর পর সরকার এমন কোনও পদক্ষেপ করল, যা নিয়ে জমিয়ে তর্ক করা চলে। ব্যাপারটা ভাল না মন্দ, তা নিয়ে গলা ফাটানো যায়। অর্থনীতির লোকজন বলছেন, আধার খেলাটাই বদলে দিতে পারে। আর খাদ্যের অধিকার আন্দোলনের সমর্থকরা ফের জোট বাঁধছেন, ‘আধার কার্ড আর রেশনে খাবারের বদলে টাকা’ বিলির বিরুদ্ধে।

কিন্তু আধার নিয়ে যেটা একেবারে মূল প্রশ্ন, তা নিয়ে দু’পক্ষের কেউ কথা বলছে না। তা হল— ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার এই যে নতুন প্রযুক্তি হাতে এল, তা দিয়ে এবার পছন্দের প্রকল্পগুলোকে কী করে আরও কার্যকরী করা যায়? যাঁরা আধার-বিরোধী, তাঁদের অনেকের কাছে অবশ্য নতুন প্রযুক্তি জিনিসটাই সন্দেহজনক। তাঁরা মনে করেন, রেশন কার্ড চুরি যেতে পারে, ভিজে যেতে পারে, হারাতে পারে, ছিঁড়ে যেতে পারে, কিন্তু জিনিসটা অনেক দিনের পরিচিত তো বটে, তাই সেটাই ভাল। হতে পারে, রাম একটু চেষ্টা করলেই স্থানীয় পঞ্চায়েত বা পুরসভার সাহায্যে রঘুর নামে রেশন কার্ড করিয়ে নিতে পারে (সেই সঙ্গে তার নিজের নামেও একটা কার্ড থাকতে বাধা নেই)। সেই রঘু হয়তো মারা গিয়েছে, কিংবা জন্মই হয়নি তার। রেশন কার্ড থেকে পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দুঃসাধ্য।

আমার কাছে আধার কার্ডের এটাই মস্ত সুবিধে বলে মনে হয়। শেষ অবধি অন্তত আমার চোখের তারা, আর আঙুলের ছাপ, এ দুটোকে নিজের বলে দাবি করা যায়। আর কেউ নিজেকে আমি বলে দাবি করতে পারবে না, আমিও নিজের পরিচয় প্রমাণ করতে প্রায় সব সময়েই পারব। ফলে রাম রঘুর নামে কার্ড করে রঘুর বরাদ্দের কেরোসিন তুলতে পারবে না। রঘুর ফুটো ছাদ দিয়ে জল এসে কার্ড নষ্ট করে দিলেও রঘুর চাল-গম মার যাবে না। সেই সঙ্গে, যে হেতু সব ধরনের সরকারি অনুদান একটি কার্ডে গ্রথিত থাকবে, তাই আইন যদি নিষেধ করে, তা হলে রাম একই সঙ্গে ভর্তুকির কেরোসিন, আর ভর্তুকির গ্যাস সিলিন্ডার পেতে পারবে না।

ভারতে কোনও কিছুই একেবারে ঠিকঠাক, নিয়মমাফিক কাজ করে না। আধার কার্ডের ব্যবস্থাও করবে না। কারও কারও কাছে ঘুস চাওয়া হবে। তবে রেশন কার্ড যেমন নির্দিষ্ট ডিলারের সঙ্গেই যুক্ত, আধার কার্ড করানোর ক্ষেত্রে অন্য জায়গা থেকেও তা করানো চলে। সেটা কিছুটা সামাল দেবে ঘুসের দাপটকে। সরকারি নিয়ম, আধার কার্ড করতে চাইলে কারওকে ফেরানো চলবে না। তবু অনেককে হয়তো ফিরে যেতে হবে— কারও আঙুলের ছাপ উঠবে না, কারও ক্ষেত্রে কম্পিউটার আটকে যাবে, নেটওয়ার্ক কাজ করবে না। তবে আধার কার্ড তৈরি করতে কতটা হয়রানি হচ্ছে, তার তুলনা করতে হলে করা দরকার রেশন কার্ড বা পাসপোর্টের মতো অন্য সরকারি পরিচয়পত্র তৈরির অভিজ্ঞতার সঙ্গে। তাতেও ঝামেলা যে কিছু কম হয় না, সে তো জানা কথা।

আসলে আধারের প্রতি আপত্তির অনেকটাই কেবল এই কারণে নয় যে তা কাজ না-ও করতে পারে। রেশনে চাল-গম না দিয়ে, উপভোক্তার কাছে সরাসরি টাকা পৌঁছে দিতে পারে আধার কার্ড— সেই সম্ভাবনাতেই আপত্তি। বলা হচ্ছে, যে মানুষ নগদ টাকা চান না, তাঁরা কেরোসিন, খাদ্যশস্যই চান। জঁ দ্রেজ এবং রীতিকা খেরার একটি সমীক্ষায় এমন চাহিদাই নাকি ধরা পড়েছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই ফলে সে ভাবে আস্থা রাখতে পারছি না। গবেষকদের প্রতি আমার অনাস্থা নেই, তাঁরা অত্যন্ত দক্ষ। কিন্তু এই ধরনের সমীক্ষায় কী উত্তর মিলবে, তা অবশ্যই নির্ভর করে কী ভাবে প্রশ্নগুলো তৈরি করা হচ্ছে, জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তার উপর। আমি চাল-গম চাইব, না নগদ চাইব, তা নির্ভর করে আমার ধারণার উপর— কতবার রেশন ডিলার আমাকে বরাদ্দ না দিয়ে ফিরিয়ে দেবে, আমার প্রাপ্য টাকা আমার কাছে পৌঁছনোর আগেই গায়েব হবে কি না, চালের দাম বাড়লে সরকার টাকা বাড়াবে কি না, এমন অনেক বিষয়ে ধারণা, যার অনেকগুলো সম্পর্কেই কোনও স্পষ্ট তথ্য কারও কাছে নেই। ফলে আমার উত্তরটা নির্ভর করবে, যে ভাবে আমার কাছে নানা সম্ভাবনা তুলে ধরা হচ্ছে তার ভিত্তিতে আমার ধারণার উপর।

নগদ আর খাদ্যশস্যের মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ পেলে মানুষ বাস্তবিক কী করছেন, সেই সমীক্ষায় আমার ভরসা বেশি। গাঁধীবাদী শ্রমিক সংগঠন ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ (সেবা) দিল্লির কিছু বস্তিতে সমীক্ষা করে দেখেছে, শস্যের বদলে টাকা দিলে লোকেদের চাল-গম খাওয়ার পরিমাণে হেরফের হচ্ছে না, তবে হঠাৎ চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সাহায্য হচ্ছে। মদ বেশি খাওয়া, বা অন্যান্য খারাপ আশঙ্কার কোনও সত্যতা মেলেনি। দেখা গিয়েছে, যে ১০০ জনকে খাদ্যের বদলে নগদ দেওয়া হচ্ছিল, ছ’মাস পরে ফের খাদ্যশস্য নেওয়ায় ফিরে আসার সুযোগ দিলে কেবল চার জন তাতে ফিরে গিয়েছে। এটা অবশ্য খুবই ছোট একটা সমীক্ষা, এবং অন্য নানা পরিস্থিতির রদবদল, যা সমীক্ষার ফলে প্রভাব ফেলে থাকতে পারে, সেগুলোকে এড়ানোর কোনও চেষ্টাও সে ভাবে করা হয়নি। আরও বিধিসম্মত, আরও ভাল সমীক্ষার ফলের জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

তবে সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা আসার বিষয়ে যে সব আশঙ্কা রয়েছে, তা-ও যে অনেকটা অমূলক তা দেখাচ্ছে আর একটি সমীক্ষা। অন্ধ্রপ্রদেশে একটি সমীক্ষায় অর্থনীতিবিদ কার্তিক মুরলীধরন ও তাঁর সহকর্মীরা দুটি প্রকল্পের টাকা স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মজুরি, এবং সামাজিক সহায়তা প্রকল্পের ভাতা। এই প্রকল্পে অবশ্য স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে টাকা দেওয়ার সরকারি ব্যবস্থায় দুটি পরিবর্তন আনা হয়। এক, স্মার্টকার্ডে প্রাপকদের ‘বায়োমেট্রিক’ তথ্য (মুখের ছবি ও আঙুলের ছাপ) রাখা হয়। আর দুই, ডাকঘর থেকে টাকা সংগ্রহ করার রীতি বদলে, প্রতি এলাকায় স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে টাকা বণ্টন করা হয়। তাঁর কাছে একটি ছোট যন্ত্র থাকে, যা দিয়ে তিনি স্মার্টকার্ডের আঙুলের ছাপ মিলিয়ে নিয়ে টাকা দেন। রশিদ ছেপে বার করে দেয় ওই যন্ত্রই। ওই সমীক্ষা প্রকল্পে দেখা গিয়েছে, স্মার্টকার্ডের ব্যবহারে আরও দ্রুত টাকা পৌঁছনো যাচ্ছে উপভোক্তাদের কাছে, টাকা হাপিশ হচ্ছে কম, উপভোক্তাদের সন্তুষ্টিও বেশি। প্রকল্পটি যে সব এলাকায় করা হয়, সেখানকার প্রায় ৭০ শতাংশ উপভোক্তা একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মজুরি স্মার্টকার্ডে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের ৭৮ শতাংশ উপভোক্তা স্মার্টকার্ড বেছে নেন। যাঁরা মনে করছেন, রেশনে চাল-গম দেওয়াই ভাল, নগদ দেওয়া ভাল নয়, তাঁরাও কেন চিন্তা করবেন না, কী ভাবে আধার কার্ডের মাধ্যমে শস্য বণ্টন প্রক্রিয়া আরও উন্নত, দক্ষ করা যায়?

তবে আধার কার্ডের বিরোধিতার আরও গভীর একটা কারণ রয়েছে। তা হল, ‘নাগরিক সমাজ’ বলতে যা আমরা বুঝি তার একটা বড় অংশ মনে করে, রাষ্ট্র অত্যন্ত দরিদ্র-বিদ্বেষী। তাই রাষ্ট্র আগ্রহ নিয়ে কোনও কিছু করতে চাওয়া মানে, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’। এক একদিন সকালে কাগজ খুললে খানিকটা আন্দাজ করা যায়, কেন তাঁরা এমন মনে করছেন। তবে শেষ অবধি কথাটা বিশ্বাস করা চলে না। ভারতে রাষ্ট্রের উপর বরাবরই নানা দিক থেকে নানা পক্ষ প্রভাব কায়েম করতে চেয়েছে। সেই প্রতিযোগিতা হয়তো আগের চাইতে এখন আরও বেশিই তীব্র। গরিবের কাছে রাষ্ট্রের সম্পদ পৌঁছে দেওয়ার যে ব্যবস্থা এখন চলছে, তা যে অতীতেও কল্যাণকামী এক রাষ্ট্র বরাবর গরিবের জন্য চালিয়ে এসেছে, তা তো নয়। ইন্দিরা গাঁধী ‘গরিবি হঠাও’ ডাক দিয়েছিলেন, আবার তুর্কম্যান দরজাও বানিয়েছিলেন। রাষ্ট্র যে গরিবকে সম্পদ দিচ্ছে, তা বহু লড়াইয়ের ফল, যা গরিব মানুষ ও তাঁদের সমর্থকেরা লড়েছেন। আর সেই সঙ্গে ভোটে জেতার দায় থেকে মাঝেমাঝে খয়রাতি। রাষ্ট্র বরাবরই কোনও-না-কোনও চাপের মুখে গরিবকে কিছু দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আধার কার্ডের চিন্তার মধ্যে এমন কী অন্তর্নিহিত সমস্যা আছে, যে তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিতর্ক, পরামর্শে যাওয়া চলে না? অন্য কোনও সরকারি উদ্যোগের মতো, আধার কার্ডের সুযোগকেও ভাল উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো চলে না?

আমাদের মতো যাঁরা আধার নিয়ে উৎসাহী, তাঁদের ক্ষেত্রেও সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনের প্রসঙ্গটি প্রযোজ্য। এটা হয়েই গিয়েছে বলে ধরে নেওয়া চলে না। ঠিক যেমন ধরে নেওয়া যায় না যে, সরকারি প্রকল্পে যা কিছু সমস্যা রয়েছে আধার সব ঠিক করে দেবে। আধার কার্যকর হলেও দেখতে হবে, কী করে বিপিএল তালিকায় অযোগ্য লোক ঢোকানো থেকে রাজনৈতিক নেতা আর তাঁদের বন্ধুদের আটকানো যায়। ওই কাজটাকে আরও কঠিন করার জন্য কী ভাবে নজরদারি আরও জোরদার করা যায়? আরও কেজো চিন্তা রয়েছে। তা হল, সরকারি প্রকল্পে প্রয়োগের আগে কি আধার কার্ডের ব্যবহারে কতটা কী সমস্যা হচ্ছে তা পরীক্ষামূলকভাবে দেখে নিলে ভাল হত না? মোবাইল ফোন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আধার কার্ডের সংযোগ কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা বোঝা গেলে ধারণা করা যেত, কী ভাবে একে কার্যকর করা যায়।

আর একটু দূর অবধি চিন্তা করলে আরও কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। আধার ব্যবস্থা যদি কার্যকর হয়, তা হলে একটা বোতাম টিপেই লক্ষ লক্ষ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো যাবে। ভোটের মরশুমে কিছু বাছাই নির্বাচন ক্ষেত্রের বাসিন্দাদের অ্যাকাউন্টে যদি আরও, আরও বেশি টাকা পাঠাতে থাকে ক্ষমতাসীন দল? টাকা দিয়ে ভোট কেনার জনমোহিনী রাজনীতিকে কী করে আটকানো যাবে? তা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও এটাই সময়। নগদেই হোক আর জিনিসপত্রেই হোক, জাতীয় আয়ের কত অংশ মানুষের মধ্যে বণ্টন করা যাবে, সে-বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে একটা ঐক্যমত্যে আসতে হবে। সরকার যদি আরও বেশি নগদ সরাসরি মানুষকে দিতে চায়, তা হলে কোথাও একটা তাকে খরচ কমাতে হবে। হয়তো তখন সরকার বাধ্য হবে বিত্তবানের অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি কাটছাঁট করতে।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ১ জানুয়ারি ২০১৩

গরিবের টাকা

একটা সময় ছিল, যখন গরিবকে অনেকে দেখত করুণার চোখে। আজকাল দেখে একটু বাঁকা নজরে। স্রেফ গরিব বলেই কি না পাচ্ছে লোকগুলো। জলের দরে চাল-গম পাচ্ছে, ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে মাঠে গেলেই ১৭০ টাকা মজুরি জমা পড়ছে ব্যাঙ্কে। হাসপাতালে বাচ্চা হলে হাতে কড়কড়ে টাকা, তারপর বাচ্চার অঙ্গনওয়াড়ির খিচুড়ি থেকে মিড-ডে মিলের ভাত-ডাল, ইস্কুলের জুতো-জামা-বই-সাইকেল, মেয়ে হলে ইস্কুল শেষে ২৫ হাজার টাকা, সরকার হাত উপুড় করেই রয়েছে।

এত দেওয়া কি ভাল?

কেবল ঈর্ষার জ্বালা থেকে নয়, গরিবের ভাল চেয়েও প্রশ্নটা তোলা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা যেমন চিরকালই জোর গলায় বলে এসেছেন, গরিবকে দয়া করা মানে চিরকালের জন্য সরকার-নির্ভর করে তোলা। আর পাঁচজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রোজগারের তাগিদটাই তো হারিয়ে ফেলবে সে। অলস, অদক্ষ কিছু মানুষ তৈরি করাই কি সরকারের কাজ? আজ প্রায় সেই একই সুরে কথা বলেন এ দেশের মাঝারি চাষিরা। একশো দিনের কাজে গিয়ে দাঁড়ালেই টাকা মেলে যদি, ধান রোয়া, ধান কাটার কাজ করতে লোকে আসবে কেন? টাকা দিয়েও খেতমজুর মিলছে না।

তা ছাড়া, টাকাটা যে জন্য দেওয়া, সত্যিই কি সে কাজে লাগে? দু-টাকা কিলো চাল বাজারে ১৪ টাকায় বিক্রি হয়ে চোলাইয়ের ঠেকে খরচ হচ্ছে, এমন হরদম শোনা যায়। একশো দিনের মজুরির টাকার কতটা বিড়ি-মদে উড়ে যাচ্ছে, কে দেখছে? করদাতার টাকা গরিবকে দিয়ে ভোট-কুড়োনো নেতাদের লাভ হতে পারে, দেশের লাভ কী?

এমন উদ্বেগ কতটা ধোপে টেঁকে? তা বুঝতে অর্থনীতির বেশ কিছু গবেষক খতিয়ে দেখেছেন, যখন গরিবকে টাকা (বা অধিক রোজগারের উপায়) দেওয়া হচ্ছে, তখন তা আদৌ কাজে লাগছে, না কি নষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া থেকে পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে সাতটি প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য-পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, টাকাটা নষ্ট হচ্ছে না, কাজেই লাগছে। সেই লাভ কেবল তাৎক্ষণিক, এমনও নয়। পাঁচ-সাত বছর পরেও দেখা যাচ্ছে, টাকা পাওয়ার পর যারা রোজগার বাড়িয়েছিল, তারা তা ধরে রাখতে পেরেছে। ফের গরিব হয়ে যায়নি।

উদাহরণ আছে এ রাজ্যেই। ওই ছ’টি প্রকল্পের একটি হয় মুর্শিদাবাদে। অতি গরিব ৩০০টি পরিবারকে বেছে নিয়ে, তাদের রোজগার বাড়াতে ছাগল, শুয়োর, গোরু বিলি করা হয়েছিল বছর আট-দশ আগে। অন্য ভাবে রোজগার বাড়াতে চাইলে তার উপকরণও (যেমন ধান ভানার ঢেঁকি) দেওয়া হয়েছিল। এই পরিবারগুলিকে এক বছর ধরে দৈনিক ২১ টাকা করে দেওয়া হয়, যাতে অভাবের তাড়নায় তারা ছাগল-গোরু বিক্রি করে না ফেলে। সেই সঙ্গে প্রাণীপালন, টাকা-পয়সা জমা-খরচের ট্রেনিং, সাহস-সহায়তা জোগাতে প্রতি ৫০ পরিবার পিছু একজন প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়। ‘বন্ধন’ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার (এখন ব্যাঙ্ক) এই প্রকল্পের শেষে দেখা গেল, ৯৪ শতাংশ পরিবারই বাড়তি আয় করছেন। নিয়মিত ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে তা শোধ করে ফের ঋণ নেওয়ার চক্রে চলে এসেছেন। সাত বছর পরে মূল্যায়ন করে দেখা গিয়েছে, কেউ আগের অতি-দারিদ্রে ফিরে যাননি। এককালীন সম্পদ ও প্রশিক্ষণ দীর্ঘমেয়াদী ফল দিচ্ছে।

উত্তর উগান্ডায় প্রায় এমন ভাবেই অতি-দরিদ্র মেয়েদের হাতে দেওয়া হয়েছিল দেড়শো ডলার, ব্যবসার প্রশিক্ষণ। ব্যবসা শুরুর পর কিছুদিন দেখভালও করেন প্রশিক্ষক। তার ১৬ মাস পরে দেখা গেল, এই মেয়েদের রোজগার প্রায় ডবল হয়েছে, ব্যবসাও বেড়েছে দ্বিগুণ। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, পেরুতে অতি-দরিদ্রদের অনুদান ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার সাতটি প্রকল্প থেকে দেখা যাচ্ছে, বছরখানেক পর থেকেই রোজগার বাড়ছে, তিন-চার বছর পরেও সেই উন্নতি বজায় থাকছে। যার একটা লক্ষণ, আগের চাইতে ভাল খাওয়াদাওয়া করছে পরিবারগুলি। যাঁরা দিনে দু’বার খেতেন, দেখা যাচ্ছে তাঁরা আরও একবার খাচ্ছেন। কোথাও বা গবেষকরা মেপে দেখেছেন, আগের চাইতে দিনে ৭০০ ক্যালোরি বেশি খাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। খাবারের জন্য খরচ হচ্ছে বেশি।

অনুদান দিয়ে দারিদ্র কমানোর এই যে মডেল, তার পথিকৃৎ কিন্তু বাংলাদেশ। সে দেশের একটি অসরকারি সংস্থা (BRAC) গ্রামীণ বাংলাদেশের ৪০টি এলাকায় অতি-দরিদ্র, অক্ষরপরিচয়হীন মেয়েদের তাদের পছন্দের কাজের জন্য (ছাগল-মুরগি পালন, ছোটখাটো মুদির দোকান) এককালীন টাকা দেয়, সেই সঙ্গে প্রায় দু’বছরের প্রশিক্ষণ আর নজরদারি চলে। ২০০৭ সালে শুরু এই প্রকল্পের বেশ কয়েকবার মূল্যায়ন হয়েছে। তাতে কেবল যে বাড়তি রোজগার (৩৮ শতাংশ) ধরা পড়েছে তাই নয়। দেখা যাচ্ছে, এই মেয়েদের জীবনযাত্রাও বদলেছে। এলাকার মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির কাছাকাছি তাদের জীবনশৈলী।

যে গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের এই প্রকল্পটির উপর নজর রাখছেন, তাঁরা লিখছেন, “এই গবেষণায় স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে যে অতি-দরিদ্রদের যে রোজগারের জন্য বা অন্যান্য কারণে, অ-গরিবদের উপর নির্ভর করতেই হবে এমন নয়। গ্রামীণ সমাজে গরিবদের অবস্থান যে নির্দিষ্ট, অপরিবর্তনীয়, এমনও নয়। যদি তাঁদের জন্য যথেষ্ট পুঁজি এবং দক্ষতার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে অন্যান্য বাধা (সামাজিক বিধিনিষেধ, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব, ক্ষতিকর অভ্যাস, বিনিয়োগ-লাভ বিষয়ে ভুল বা অস্পষ্ট ধারণা) এত বড় হয়ে দাঁড়ায় না, যে তা অতি-বঞ্চিত মেয়েদের স্বাধীন, সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা আটকাতে পারে।” এ কথাটা যে সব দেশে, সব সংস্কৃতিতে সত্য, গত বছর দশেকে তার যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে।

আরও কয়েকটা চালু ধারণায় ধাক্কা দিয়েছে এই প্রকল্পগুলি। সাধারণত মনে করা হয়, এক সঙ্গে বেশি টাকা দিলে গরিব সামলাতে পারবে না। কিছু কিছু করে দেওয়াই ভাল। নানা প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য খতিয়ে দেখে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, মাসে মাসে কিছু টাকা দিলেও রোজগার বাড়ে, কিন্তু তুলনায় সামান্য। এক সঙ্গে বেশি টাকা দিলে রোজগার বরং এক লাফে অনেকটা বাড়ছে।

টাকা পেলে গরিব অলস হয়ে যায় কিনা, তারও উত্তর মিলেছে। এক কথায় সে উত্তর— না। যারা প্রকল্পে টাকা পেয়েছে, আর যারা পায়নি, তাদের কাজের সময়ে (বাইরে ও ঘরে) হেরফের মেলেনি। বাংলাদেশে দেখা গিয়েছে, টাকা-ট্রেনিং পাওয়া মেয়েরা বরং আগের চাইতে অনেক বেশি সময় পরিশ্রম করছে। তবে মজুরি খাটার সময় কমিয়ে, প্রাণীপালনের মতো স্বরোজগারের কাজে বেশি সময় দিচ্ছে তারা। তাই বাইরে থেকে মনে হতে পারে, টাকা পেলে গরিব কাজে আসে না। আসলে হয়তো তারা আরও লাভজনক কাজ করছে।

তবে দুটো বিষয় খেয়াল করতে হবে। এক, এই সব প্রকল্পে গরিবকে যে টাকাটা গোড়ায় দেওয়া হচ্ছে, সেটা অনুদান। ফেরত দেওয়ার কোনও শর্ত সেখানে নেই। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ব্যাবসা করে গরিব দারিদ্র এড়াতে পারে কিনা, সে প্রশ্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে বলা চলে যে, বাজারের নিয়মে এই ধরনের কাজ হবে না। সরকার বা অসরকারি সংস্থাকে দারিদ্র নিরসনের লক্ষ্যে গোড়ার পুঁজিটা দিতে হবে গরিবকে।

আর দুই, টাকার সঙ্গে সহায়তাও প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ, নিয়মিত কাজের খোঁজখবর, পরামর্শ, বেশ কয়েক মাস এটা চালাতে হবে।

কিন্তু যখন প্রশিক্ষণের প্রশ্ন নেই? যখন খাদ্যের জন্য, কিংবা সন্তানের পড়াশোনার জন্য স্রেফ টাকা দিচ্ছে সরকার? তখন কি মদ তামাকে নষ্ট হয় না টাকাগুলো?

উত্তর খুঁজতে বিশ্বব্যাঙ্কের গবেষক ডেভিড ইভান্স নানা দেশের ১৯টি এমন প্রকল্প দেখেছেন, যেখানে শর্তসাপেক্ষে (যেমন, সন্তানকে স্কুলে পড়ানোর জন্য), কিংবা শর্ত ছাড়াই, টাকা দেওয়া হচ্ছে গরিবকে। তিনি বলছেন, একজনও ওই টাকা মদ খেয়ে ওড়াচ্ছে না, তা বলা চলে না। কিন্তু তারা অতি সামান্য, হিসেবে আসে না। বাড়তি টাকা পাওয়ার পর মদ-তামাকের খরচ বাড়েনি, এমনই দাবি করছেন ইভান্স। “পেরুতে দেখা গিয়েছে বটে, হাতে টাকাটা এলেই লোকের রোস্টেড চিকেন, কিংবা চকোলেট কেনার একটা ঝোঁক থাকে। কিন্তু আশা করি পোড়-খাওয়া কর্তারাও সে জন্য গরিবকে দুষবেন না,” লিখছেন তিনি।

গত বছর দশ-বারো ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় স্পষ্ট হয়েছে, গরিবকে টাকা দেওয়া ‘বাজে খরচ’ নয়। বরং হাতে টাকা পেলে খাবারের জন্য সে বেশি খরচ করে। সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নতি হয়। আর যদি এককালীন টাকার সঙ্গে প্রশিক্ষণও মেলে, তা হলে বাড়তি রোজগার করে আর্থ-সামাজিক অবস্থানে কয়েক ধাপ উঠে আসে সে। কয়েক বছরের মধ্যেই।

এমন ভাল খবরে মধ্যবিত্তের মন ভাল হবে কি? গরিবের রোজগার বাড়া মানে তার মজুরি, মাইনে বাড়া। সেই সঙ্গে তার সামাজিক উত্থানটাও অনেকে ভাল চোখে দেখেন না। সে দিনই এক ‘কাজের মাসি’ দুঃখ করছিলেন, তিনি ছুটি চাইলে বাড়ির মালকিন বলেছেন, “তা হলে তোমার মেয়েকে পাঠিয়ে দিও।” মেয়ে কলেজে পড়ে, বলতে মালকিনের প্রশ্ন, “তাতে কী হয়েছে?” গরিব যে বংশানুক্রমে খেতমজুরি, দিনমজুরি, ঝি-গিরি করবে, সেটাই ধরে নিয়েছেন পাকাবাড়ির কর্তা-গিন্নিরা। বর্ণব্যবস্থা আর দারিদ্র সেই ধারণাটা পোক্ত করেছে। এ বার হয়তো ধারণাটা নড়বড়ে হবে। গরিবের হাতে টাকা এলে সে অন্তত তার অনাদর করবে না।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ জুন ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *