১. নীতি ও গণতন্ত্র

নীতি ও গণতন্ত্র

গণতন্ত্র কেন মূল্যবান

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ৬৪ বছর পরেও, গণতন্ত্র ভারতকে কী দিয়েছে, সে-প্রশ্নটার তীক্ষ্ণতা কমেনি। এর কোনও একটা উত্তর হয় না ঠিকই, তবু কিছু ইঙ্গিত এমন পাওয়া যায় যা খুব অর্থবহ। যেমন, ভারতে যাঁরা প্রধান শিল্পপতি, যাঁদের অধিকাংশই উচ্চবর্ণ হিন্দু, তাঁদের যদি প্রশ্ন করা হয় যে কাকে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখতে চান, অধিকাংশই বলবেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিংবা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নাম। এঁরা দু’জনেই ‘ও বি সি’ নীতীশ কুর্মি, নরেন্দ্র মোদী তেলি। ভারত যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখন এমন ‘নিচু’ জাতের কেউ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য বলে বিত্তবান, উচ্চবর্ণ মানুষ মনে করবেন, তা অকল্পনীয় ছিল। আজ তা সম্ভব হয়েছে গণতন্ত্রের জন্যেই। আগে যেসব সম্ভাবনা ওঠার আগেই বাতিল হয়ে যেত, এখন সহজেই গ্রহণ করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্র কাজ করছে বলেই।

দলিতদের নেতৃত্ব যেমন ‘অসম্ভব’ থেকে ‘আকাঙ্ক্ষিত’ হয়ে উঠেছে, তেমনই ঘটেছে মেয়েদের ক্ষেত্রেও। রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েতে দেখা গিয়েছে, যেখানে পরপর দু’বার প্রধান ছিলেন মহিলা, সেখানে মহিলাদের নেতৃত্বে মানুষের আস্থা অনেক বেশি। এই সব পঞ্চায়েতে আসন সংরক্ষিত না থাকলেও মেয়েদের ভোটে লড়াই করে জিতে আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট। অন্তত যেখানে কখনও মহিলা প্রধান ছিলেন না, সেই সব গ্রামের চেয়ে অনেক বেশি। তাই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, বিত্তবান উচ্চবর্ণ-প্রভাবিত শিল্পজগতেই হোক, আর দরিদ্র-প্রধান গ্রামসমাজই হোক, নেহাত কেজো নিয়মগুলো মেনে গেলেও গণতন্ত্র সম্ভব-অসম্ভবের নকশায়, বৈষম্যের চেনা ছবিতে অনেকখানি পরিবর্তন আনতে পারে। সব পরিবর্তন যে ভাল তা বলা চলে না, অনেকে বলবেন মোদীর সাফল্য গণতন্ত্রের ভয়াবহ দিকটাই দেখায়। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগে যে এটা হতে পারত না, এবং হতে পারত না আমাদের বন্ধ মনের জন্য, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে।

গণতন্ত্র থেকে আমাদের অপ্রাপ্তির তালিকা অনেক বড় ঠিকই। কিন্তু গণতন্ত্র কী করতে পারে, করতে পেরেছে, তা-ও চিন্তা করা দরকার। আজ থেকে দশ বছর আগেও সব ছেলেমেয়ের স্কুলে একসঙ্গে মিড-ডে মিল খাওয়া নিয়ে নানা আপত্তি উঠত, আজ আর সেগুলো শোনা যায় না। ভারতের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে হয়তো এই প্রথম একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা কখনও অস্পৃশ্যতা মানেনি, জল-অচল বলে কোনও জাতকে চিনতে শেখেনি। সেই সঙ্গে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, দলিত-জনজাতির শিশুরা প্রায় সকলেই স্কুলে যাচ্ছে। সেখানে তারা আদৌ কিছু শিখছে কি না, কে ক’বছর স্কুলে পড়ছে, তা নিয়ে অসন্তোষ থাকতেই পারে। কিন্তু হাড়ি-ডোম-চামার ঘরের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়াই যে এখন ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে হচ্ছে, সেটা খুব কম কথা নয়।

আমরা বলছি না যে গণতন্ত্র ছাড়া এসব পরিবর্তন কোনও ভাবেই আসতে পারত না। কিন্তু এটা বোধ হয় বলা যায় যে গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভেদাভেদ বেশি দিন চলতে পারে না।

এটাও লক্ষ করা দরকার যে, গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার যে সব নিয়মকানুন রয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠান তার পরিচালনা করে, এত বছরে ভারতে সেগুলির নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা কমেনি, বরং বেড়েছে। আগে ভোটে রিগিং হচ্ছে বলে মাতামাতি হত, তাই গণতন্ত্রের একটা প্রধান শর্তই মার খেয়ে যাচ্ছিল। নির্বাচন কমিশন ভোটদানের বৈধতা বাড়াতে পেরেছে। যার জেতার কথা ছিল না সে জিতেছে, এমন অভিযোগ আজ সহজে কেউ বিশ্বাস করবে না। ১৯৯২ সালে ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের পর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও একটা মর্যাদা পেয়েছে। পঞ্চায়েতের কাজ নিয়ে মানুষের যতই ক্ষোভ থাক, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ ভোট দিচ্ছেন। গ্রামসভায় লোক যতই কম আসুক, সেখানেই গ্রামের উন্নয়নের পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছে। এই সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের নানা অকর্মণ্যতা-অক্ষমতা সত্ত্বেও এগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে কেউ কাজ করতে পারছেন না।

তা বলে গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের ক্ষোভও কম নেই। বিপুল দারিদ্রের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কী পেলাম? গণতন্ত্র মানে যদি হয় মানুষের শাসন তা হলে যে-দেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব, সে-দেশে গরিবের রুটি-কাপড়-বাসস্থান জুটল না কেন? যে দেশের অর্ধেক ভোটার মহিলা সেখানে মেয়েরা কেন অপুষ্টি, রক্তাল্পতায় ভোগে? কেন শিক্ষাহীন, শ্রমসর্বস্ব মানুষদের অধিকাংশ দলিত কিংবা আদিবাসী? যাদের যা প্রাপ্য তাদের যদি তা না-ই দেওয়া গেল, তা হলে কী লাভ হল গণতন্ত্রে?

এই বিরক্তি, ক্ষোভ থেকে সম্প্রতি আন্দোলনের একটা ধারা লক্ষ করা গিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে আদালতকে। খাদ্যের অধিকার আন্দোলনের সময়ে আমরা দেখেছি, কাকে কী দিতে হবে, কতটা দিতে হবে, তা-ও ঠিক করে দিয়েছিল আদালত। আবার প্রাপ্য জিনিস বা পরিষেবা যদি প্রার্থীর কাছে না পৌঁছয়, তার জন্য রাষ্ট্রকে ধমক দিতেও রয়েছে আদালত। এই ভাবধারায় আন্দোলনই বলছে যে, জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির মতো একটি অনির্বাচিত কমিটির সুপারিশে কিছু অনির্বাচিত লোক নিয়ে তৈরি হবে লোকপাল, যা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সরকারি কর্মীদের দ্রুত এবং কঠোর শাস্তি দেবে। এমন আপাদমস্তক অগণতান্ত্রিক একটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো তৈরি করার কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা স্পষ্টতই গণতন্ত্রের উপর ভরসা করতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন না যে, ‘কোথায় কী দুর্নীতি হচ্ছে আমরা সব প্রকাশ করে দেব, তারপর মানুষই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-আমলাদের ব্যবস্থা করবেন, সে ভোটের বাক্সেই হোক আর রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেই হোক।’ বরং অণ্ণা হজারে, জঁ দ্রেজ, অরুণা রায়ের মতো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ নতুন নতুন ‘অধিকার’ তৈরি করে, খানিকটা গণতন্ত্র ডিঙিয়ে, মানুষের কাছে প্রাপ্য পৌঁছে দিতে চাইছেন।

এই কাজ অনেকগুলি দিক থেকে গণতন্ত্রের বিরোধী। এক, বিচারব্যবস্থা দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছেন নাগরিক আন্দোলনের নেতারা। কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার বলেছিলেন যে, খাদ্যের অধিকার বাস্তবে কার্যকর করার ক্ষমতা ভারত সরকারের নেই। তাঁর কথায় কিছু যুক্তি নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক হল না এই অগণতান্ত্রিক চাপের নীতির জন্যই। মানুষের চাহিদা অনুসারে মানুষের প্রতিনিধি নীতি তৈরি করবেন, গণতন্ত্রের এই ‘ক্লাসিকাল’ ধারণা থেকে সরে যাচ্ছেন নেতারা। দুই, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় না গিয়ে তাঁরা নিজেদের মতকে ‘জনমত’ বলে দাবি করছেন, এবং দিল্লিতে ক্রমাগত রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিন, দরিদ্র নাগরিকের অধিকারের উপর জোর দিতে গিয়ে তাঁরা হয়তো খেয়াল করছেন না যে নিরপেক্ষ বিচার পাবার অধিকার গণতন্ত্রে একেবারে প্রাথমিক অধিকার। বিশেষত সরকারি ব্যবস্থার নিচুতলার কর্মীরাও নাগরিক, এবং তাঁদের নানা অনাচার সত্ত্বেও নাগরিক হিসেবে তাঁদের উপযুক্ত বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘জনস্বার্থে’ চটজলদি শাস্তি দিতে হবে, এই ধারণা উত্তর কোরিয়ায় মানানসই, ভারতে নয়।

গণতন্ত্র যা পারে, তা হল মানুষের দাবি নিয়ে সরব হতে। সরকারি হাসপাতালে কম দামে ওষুধ চাই, রেশনে এ পি এল গ্রাহকদেরও গম দিতে হবে, অমুক জনগোষ্ঠীকে ‘জনজাতি’ বলে গণনা করতে হবে, রাতবিরেতে গ্রামে তল্লাশি চলবে না, এই চাহিদাগুলিকে গণতন্ত্র ব্যক্ত করে। অনেকের চাহিদাকে একটি নির্দিষ্ট দাবিতে পরিণত করা, এবং তা পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করা এগুলো গণতন্ত্রের মৌলিক কাজ। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি মেনে রাষ্ট্র যে গরিবের জন্য কিছু প্রাপ্য নির্দিষ্ট করেছে, ভারতে গণতন্ত্র কাজ করছে বলেই হয়তো তা সম্ভব হয়েছে।

সমস্যা হল, একজন গরিব মানুষ যখন তাঁর প্রাপ্য দাবি করেন, সে রেশন দোকানেই হোক বা সরকারি হাসপাতালেই হোক, তখন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি খুব সহজেই তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারে। হবে না, আজ নেই, কখনও পাওয়া যায় না, অমুকের সার্টিফিকেট নিয়ে আসুন এমন নানা অজুহাতের জাল বোনা হয়। এর প্রতিকার কী? গণতন্ত্রে এটার প্রতিকার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রাথমিকভাবে আদালতকে। তা এই আশঙ্কা থেকে যে, একজনের প্রতি বিচার করতে গিয়ে অন্য একজনের প্রতি অন্যায় না হয়ে যায়। ‘জনস্বার্থ’ প্রতিষ্ঠা করার যে গণ-উত্তেজনা, তা থেকে দূরে থেকে ঠান্ডা মাথায় বিচার করবে আদালত। গণতন্ত্রের নামে যেমন আদালতের উপর চাপ সৃষ্টি করা চলে না, তেমনই এমন কোনও বিচারব্যবস্থার সুপারিশও করা চলে না, যেখানে বিচারকই তদন্ত করবেন।

সেই সঙ্গে, ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ দিয়ে সরকারি কর্মীর উপর চাপ সৃষ্টি করা, তাকে শাস্তি দেওয়াটাকেও সমর্থন করা চলে না। অণ্ণা হজারে সংগঠিত ‘গ্রাম সভা’ কিংবা অরুণা রায় সংগঠিত ‘জন সুনওয়াই’ যে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, অকর্মণ্যতা প্রকাশ করেছে, সেটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু অভিযুক্ত প্রধানকে বা সরকারি কর্মীকে বরখাস্ত করে দেওয়াটা ভোটের মাধ্যমে বা আদালতের মাধ্যমেই সম্ভব। স্বনির্বাচিত জনগণের নেতারা জনগণের নামে কারও হাতে মাথা কাটবেন, এটা গণতন্ত্রের পদ্ধতি নয়। এটা নীতিগত সমস্যা। তা ছাড়া বাস্তব সমস্যাও রয়েছে। ‘সংগঠিত প্রতিবাদ’ তৈরি করা কত কঠিন, তা নাগরিক সংগঠন মাত্রই জানেন। একত্র হবার সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগিয়ে মানুষ প্রাপ্য আদায় করবেন, এই ধারণা যদি ঠিক হত তা হলে গ্রাম সভা, স্কুল শিক্ষা কমিটি, রেশন দোকান পরিদর্শন কমিটি, এমন অজস্র তৃণমূল স্তরের জনমঞ্চ এতদিনে গ্রামীণ প্রশাসনের মুখটাই বদলে দিত। এতদিনে বোঝা গিয়েছে যে, যোগদান নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াও জটিল, শ্রমসাধ্য, ব্যয়সাধ্য। সে অমনি হবার নয়। অরুণা রায়, অণ্ণা হজারে যা করেছেন, আটপৌরে জনজীবনে গণতন্ত্র তা করে না। তাই তাঁরা ‘দৃষ্টান্ত’ হলেও ‘মডেল’ নন।

তা হলে শূন্য রেশন ব্যাগ-হাতে গরিব লোকেদের কী হবে? গণতন্ত্র তাঁদের প্রাপ্য লাভ নিশ্চিত করার জন্য কী করতে পারে?

ভারতে আমরা প্রতিনিধিত্ব-মূলক গণতন্ত্র মেনে নিয়েছি। তার মূল কথা, নির্বাচিত প্রতিনিধি দেখবেন, সরকারি কর্মী যাতে মানুষের প্রয়োজনে কাজ করেন, তাঁদের প্রাপ্য তাঁদের কাছে পৌঁছে দেন। আমলাদের কাজের হেরফের গরিবের লাভের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে অনেকটাই। তাঁদের তৎপর, দায়বদ্ধ করা যায় কী করে, সেটা বরাবরই একটা চ্যালেঞ্জ। সরকারি কর্মী যে নিয়মিত নিজেদের কাজ করছে, আলস্য বা দুর্নীতি করে নাগরিককে ঠকাচ্ছে না, তা নিশ্চিত করাই জনপ্রতিনিধিদের কাজ। খাদ্য, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো প্রভৃতি যা কিছু ‘সার্বিক অধিকার’ বলে রাষ্ট্র স্বীকার করেছে, সেই সব প্রাপ্য বস্তু বা পরিষেবা পাবার এটাই উপায়। আজ ‘শিক্ষার অধিকার’ কাল ‘খাদ্যের অধিকার’ এমন নতুন নতুন অধিকার তৈরি করে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে কর্মীদের কাজ করানো গণতান্ত্রিক উপায় নয়। তার প্রধান কারণ (যা আগেই আলোচিত) গণতন্ত্রের মূল ধারণা অভিযুক্তের সুবিচার নিশ্চিত করা। সকলের প্রাপ্য দ্রুত পাইয়ে দেওয়ার স্বার্থে সরকারি কর্মীদের উপর শাস্তির খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখা, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ না দেওয়া, গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এটার পিছনে আছে গণতন্ত্রের মৌলিক কথা। ব্যক্তিস্বার্থ এবং সার্বিক স্বার্থের একটা ভারসাম্য রাখতে হয় গণতন্ত্রে। আমাদের দেশে তা নিশ্চিত করা হয়েছে, ব্যক্তিস্বার্থকে বিচারব্যবস্থার, এবং সার্বিক স্বার্থকে আইন বিভাগ-শাসন বিভাগের বিষয় করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে স্বাতন্ত্র্য এবং ভারসাম্য রাখার মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থ এবং সার্বিক স্বার্থে ভারসাম্য রাখা হবে, এই ধারণাই কাজ করছে ভারতে।

গণতন্ত্রের ধারণা মেনে গরিবের কাছে তার প্রাপ্য পৌঁছতে যা দরকার, তা হল রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা। সমর্থন আদায় করার জন্য যেখানে বিজলি-সড়ক-পানি, কিংবা শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো জনসম্পদ সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলবে, সেখানেই গরিবরা লাভবান হবে সবচেয়ে বেশি। গণতন্ত্রে আমলাদের উপর চাপটা এভাবেই আসার কথা। কিন্তু তা হয় না, কারণ ভোটের লড়াইটা ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধে পাইয়ে দিয়ে, কিংবা ভয় দেখিয়ে সমর্থন আদায় করার প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে গরিবের ক্ষতি বেশি, কারণ অতি সামান্য কিছু দিয়ে তার ভোট আদায় করা সম্ভব।

যেখানে সত্যিই গরিবের উন্নয়নকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মঞ্চে আনা হয়েছে, সেখানে রাজনীতি গরিবের সক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছে। যেমন দলিত-আদিবাসী স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের সাইকেল বিতরণ করে নীতীশ কুমার মেয়েদের শিক্ষাকে রাজনীতির বিষয় করে তুললেন। এখন প্রায় প্রতিটি রাজ্যে দরিদ্র মেয়েদের সাইকেল দেওয়া হচ্ছে, মেয়েদের স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার জন্য যার গুরুত্ব অপরিসীম। গরিবের লাভে নেতার লাভ হওয়ার একটা প্রক্রিয়া তৈরি হল, তাই প্রতিযোগিতায় কাজ হচ্ছে গরিবের।

গরিব তার প্রাপ্য পাবে কি না, তা বুঝতে হলে দেখতে হবে, ভোটের লড়াইকে গরিবের প্রাপ্য পৌঁছে দেওয়ার লড়াইয়ে টেনে আনা যাবে কি না। তামিলনাড়ুতে যে দারিদ্র কমে এসেছে, তার কারণ সেখানে ভোটের লড়াইকে অনেকটাই আনা গিয়েছে সেই ময়দানে। যে অঙ্গনওয়াড়িতে শিশুদের ডিম দেওয়া বন্ধ করবে, যে রেশন ব্যবস্থা সংকুচিত করবে কেবল বি পি এল-দের মধ্যে, সে-ই যে ভোটে হারবে তা প্রায় নিশ্চিত। তামিলনাড়ুতে তাই দ্রুত দারিদ্র কমছে। সে-রাজ্যের নেতারা দুর্নীতিতে কিছু কম যান না, কিন্তু গরিবের উন্নয়ন তাতে আটকায়নি।

এখানে বলা দরকার, মত প্রকাশের অধিকারও গণতন্ত্রে মূল্যবান। নির্ভয়ে রাষ্ট্রের সমালোচনা করা গণতন্ত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বারাসতে এক স্কুল ছাত্রী দুষ্কৃতীদের হাতে হয়রান হলে এক বিধায়ক তার পোশাক নিয়ে মন্তব্য করলেন। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে আর এক নেতা ধর্ষিতা মেয়েটির চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। দু’বারই এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ করে নানা সংগঠন মিছিল, সভা করল। এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ তা শাসকদের কাছে মানুষের ক্ষোভ পৌঁছে দেয়। কিন্তু মিছিল করে নির্যাতিত মেয়েদের ন্যায় বিচার পাওয়ার কাজটা সহজ করতে আমরা পারব না। ধর্ষণের বিচার করতে আদালতে বহু মাস, বছর কেটে যাবে। এতে বিচারব্যবস্থার ঘাটতি আছে বিলক্ষণ, এবং সেই ঘাটতিগুলো নিয়ে সরব হওয়াও গণতন্ত্রের অংশ। কিন্তু আদালতের পাশ কাটানো চলে না, বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা চলে না। তার জায়গায় ‘জন-আদালত’ তৈরি করার চেষ্টা আরও ভয়ানক।

কোনও ব্যক্তির অপ্রাপ্তির প্রতিকার করা বিচারব্যবস্থার কাজ। যাকে অন্যায়ভাবে বন্দি করা হয়েছে, যার উপর নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশ নেয়নি, তার ক্ষেত্রে সেটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে গরিব গ্রাহককে তার প্রাপ্য চাল-কেরোসিন না দিয়ে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে রেশন দোকান, গরিব মেয়েটির স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ঋণ দেয়নি ব্যাঙ্ক, গরিব শিশুটি স্কুলে লেখাপড়া শিখতে পারেনি শিক্ষকের অনুপস্থিতি কিংবা অমনোযোগিতার জন্য। ব্যক্তির কাছে তার প্রাপ্য পৌঁছোনোর ইচ্ছাটা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে জন্মানো ইচ্ছা। কিন্তু তার প্রক্রিয়াতে গণ-আন্দোলনের ভূমিকা যে সীমিত, তা আগেই লেখা হয়েছে।

এ কথাটা অন্যভাবেও বোঝার চেষ্টা করা যায়। প্রশ্ন করা যাক, যেখানে কোনও জনগোষ্ঠী তার প্রাপ্য পেয়েছে, সেখানে কি গণতান্ত্রিক আন্দোলনই তা পাইয়ে দিয়েছে? ধরা যাক দলিত শিশুদের শিক্ষার বিষয়টিই। দলিত ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়াই এখন নিয়ম হয়ে উঠেছে, তাদের পড়াশোনা না-শেখা এখন সমাজের চোখে একটা সমস্যা। ভারতে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে কারণ স্কুলের সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে, দলিত শিশুদের বাড়ির কাছেই তৈরি হয়েছে স্কুল। কিন্তু শিক্ষার জন্য দলিতদের নানা আন্দোলনমূলক কর্মসূচির জন্যই যে তাঁরা অনেক স্কুল পেয়েছেন, কিংবা দলিত-প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিই যে দলিতদের জন্য প্রচুর স্কুল তৈরি করেছে, এমন কিন্তু নয়। যে-কোনও জনপদের এক কিলোমিটারের মধ্যে একটি প্রাথমিক স্কুল থাকতে হবে, এই সরকারি নীতি কাজে পরিণত হওয়ায় সব চাইতে লাভবান হয়েছেন দলিতরা। তাঁদের জনপদগুলিতেই বরাবর সব চাইতে কম স্কুল ছিল, তাই এই নীতি মেনে সব চাইতে বেশি স্কুল পেয়েছেন তাঁরা। এই সরকারি কার্যসূচি নেওয়া হয় ইন্দিরা গাঁধীর আমলে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর যাঁর আস্থা খুব বেশি ছিল না। নিতান্ত আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে প্রাপ্য পাইয়ে দেওয়ার কাজে সফল হতে পারে। এটা অবশ্যই দাবি করা যায় যে ইন্দিরা গাঁধীর দারিদ্র বিষয়ক কর্মসূচি নেওয়ার পিছনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপ ছিল। কিন্তু জনতার চাহিদার চাপ অগণতান্ত্রিক দেশেও রাষ্ট্রপ্রধানকে জনমুখী কার্যসূচি নিতে বাধ্য করতে পারে। ইন্দোনেশিয়াতে সুহার্তোর সময়ে শিক্ষার প্রসার হয়েছিল সর্বাধিক। মোট কথা, গরিবের স্বার্থে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে অতিক্রম করা চলে, দুর্বল করা চলে, এ যুক্তি আমরা মানতে পারছি না।

গরিবের স্বার্থরক্ষায় ভোটের প্রতিযোগিতাকে গরিবের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আনতে হবে। সে-কাজটা অনেকটাই পারে মিডিয়া। মিডিয়াতে রাজনৈতিক নেতাদের কাজের বিষয়ে তথ্য যত বেশি প্রকাশিত হবে, তত বেশি সেই তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন সাধারণ নাগরিক। দিল্লি এবং বিহারে দুটি পরীক্ষানিরীক্ষায় এমনই পাওয়া গিয়েছে। দিল্লির বস্তিবাসী যখন মিডিয়া থেকে জানতে পারছেন কোন নেতা বস্তির জন্য কত টাকা খরচ করেছেন, তখন তাঁরা যে বেশি খরচ করেছে তাকে বেশি ভোট দিচ্ছেন। আবার রেশন দোকান পরিদর্শন কমিটির মিটিং-এ যে নেতা বেশি উপস্থিত থাকছেন, তিনি ভোট পাচ্ছেন বেশি। আরও দেখা যাচ্ছে যে, যিনি ক্ষমতাসীন নেতা তিনি যদি কোটিপতি হন, আর বিরোধী যদি তা না হয়, তা হলে ক্ষমতাসীনের ভোট কমে যাচ্ছে। এই গবেষণাগুলি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, জনসম্পদ কে কেমন খরচ করছেন, বিলিবণ্টন করছেন, সে-বিষয়ে তথ্য ভোটদাতাদের হাতে এলে তাঁদের ভোটের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়। এটা যত বেশি ঘটবে, তত বেশি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আসবে উন্নয়নের প্রতিযোগিতার মঞ্চে। ‘সব নেতাই এক’ এমন একটা আবছা ধারণা কেটে গিয়ে কে কোন কাজে কত খরচ করছে, সে-বিষয়ে তথ্য আসবে হাতে। তখন উন্নয়নের প্রশ্নে ভোট দিতে পারবেন গরিব মানুষ। দলিত, মহিলা, গরিবদের কাছে তাদের প্রাপ্য পৌঁছনোর এটাই গণতন্ত্রের পথ।

অন্য যে-কোনও নাগরিকের মতো, নাগরিক সংগঠনগুলির নেতা-সদস্যদেরও সে-পথে নেতাদের অনুগামী হতে হবে। নেতা ডিঙিয়ে নেতৃত্ব দেবার কাজ তাদের নয়। নেতাদের উপর ছড়ি ঘোরানোর কাজও নয়। নাগরিক সংগঠন যা পারে, তা হল পক্ষপাতহীনভাবে পরখ করে দেখা যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে-পথে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ সে-পথে যথার্থই তার প্রাপ্য পাচ্ছে কি না। নেতার মূল্যায়নের সঙ্গে নাগরিকের অভিজ্ঞতার কোথায় তফাত হয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখিয়ে দেওয়া তার কাজ। এ কাজটা করেছে বেঙ্গালুরুর ‘সিটিজেন্স রিপোর্ট কার্ড’ যা জল, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি প্রধান নাগরিক পরিষেবাগুলি নিয়ে সে-শহরের মানুষের কতটা সন্তুষ্টি, কতটা ক্ষোভ, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে।

নাগরিকদের সমস্যা কোথায় তা জানার পর অনেক সরকারি দফতর, সংস্থা তাদের পরিষেবাকে নতুন করে সাজিয়েছে। নীতি তৈরিতে পরামর্শ দিতে পারে নাগরিক সংগঠন। কিন্তু নীতি নির্ধারণ করা, কিংবা যেন-তেন-প্রকারেণ একটি নীতি পাশ করিয়ে ফেলার জন্য নেতাদের চাপ দেওয়া তাদের কাজ নয়।

গণতন্ত্র যেখানে কাজ করবে, সেখানে মানুষ নিজের জোরে, নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতার জোরে তার প্রাপ্য পাবে। সে প্রাপ্য তার ‘অধিকার’ বলে আইন-আদালত স্বীকার করল কি না, তার পরোয়া করতে হবে না। মাসে চার দিন মিছিল-অবরোধ করতে হবে না। সরকারি দফতরের দৈনন্দিন ফাইলের পাতাগুলোতে তা-ই লেখা হবে, যা গরিব মানুষ চায়। সেই সব লেখাই ক্রমশ তৈরি করবে পরিবর্তনের ছবি। যে-কোনও নাগরিক আন্দোলন কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতার কল্পনার ছবির চাইতে অনেক বৃহৎ, অনেক আশ্চর্য সেই পরিবর্তন।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,

আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ ও ১৫ অগস্ট, ২০১২

তথ্যের সম্মান

২০১২ সালের জয়পুর সাহিত্য উৎসবে সাহিত্যিক সলমন রুশদি আসবেন, তা ঘোষিত হতে দেওবন্দ মাদ্রাসার আব্দুল কাসিম নোমানি ভারতে রুশদির আসার বিরোধিতা করেন। উৎসব কর্তৃপক্ষ শেষ দিনে ভিডিও-সংযোগের মাধ্যমে রুশদির বক্তব্য প্রচারের ব্যবস্থা করেন। নোমানির সমর্থকদের বাধায় তা-ও বন্ধ করে দিতে হয়।

এ বছর জয়পুরের সাহিত্য উৎসব চমৎকার জমে গিয়েছিল। খচখচ করেছে কেবল সেন্সরশিপের কাঁটা। সলমন রুশদি আমন্ত্রিত হলেন, তারপর অনাহুত হলেন। তাঁর হয়ে যাঁরা কথা বললেন, তাঁদের জেলে ভরার হুমকি দিয়ে চুপ করানো হল। ভিডিয়োতে রুশদির কথা শোনানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ অবধি তা রাখা হল না। গোটা ব্যাপারটায় রাজস্থান সরকার যে একবারও দুঃখপ্রকাশ করল না, সেটাই যেন আরও বিশ্রী করে তুলল বিষয়টিকে। সরকারের উদ্বেগ বোঝা কঠিন নয়: কিছু মাথা-গরম মুসলিমকে খেপিয়ে তুললে নানা ক্ষতির সম্ভাবনা-যদি কিছু নিরপরাধ মানুষ আহত হয়, সেই চিন্তা তো থাকেই। কিন্তু আমরা একবারও ‘দুঃখিত’ কথাটা শুনলাম না কেন? রুশদির মতো একজন মস্ত লেখকের কথা শোনার আমাদের সাংবিধানিক অধিকার (এবং রুশদির কথা বলার অধিকার) সরকার যদি রক্ষা করতে না পারে, তা হলে সেই অক্ষমতা স্বীকার করার কি প্রয়োজন ছিল না? অধিকার রক্ষা করার প্রশ্নে সরকার যদি এমন গা ছাড়া ভাব দেখায়, সেটা কি অধিকারের প্রতি অসম্মান নয়?

আমি রুশদি নই। আমাকে চুপ করানোর চেষ্টা করে কেবল আমার ছাত্ররা, যে সব দিনে ক্লাসে আমার লেকচার একটু বেশি রকম দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আর এক ধরনের সেন্সরশিপ কাজ করে, যখন মানুষ কথা শোনে কিন্তু কানে তোলে না: উৎসবে আমাদের আলোচনার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে এক তরুণী খানিকটা উত্তেজিতভাবে হাত তুললেন। আমার বক্তব্যে আমি খানিকটা বিশদে বলেছিলাম, কীভাবে উত্তরপ্রদেশের গ্রাম শিক্ষা কমিটিগুলো বেশির ভাগ কাগজে-কলমেই রয়ে গিয়েছে। তা শুনে বিচলিত ওই তরুণী বলেন, তিনি হরিয়ানায় বেশ কিছু গ্রাম শিক্ষা কমিটির বৈঠকে গিয়ে দেখেছেন সেগুলো রীতিমতো প্রাণবন্ত, অনেক মহিলা এসে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে নানা অভিযোগ জানিয়েছেন। তারপরেই ওই তরুণী প্রশ্ন করলেন, আমার লুকোনো উদ্দেশ্যটা কী? আমি কি সব সরকারি পরিষেবা বাতিল করতে চাই, যাতে সব কিছু বেসরকারি হয়ে যায়?

আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ওই একটা উদাহরণ থেকে খুব বেশি ধরে নেওয়া চলে না। উত্তরপ্রদেশের ওই গল্পটা বলে আমি কেবল এটুকুই বোঝাতে চেয়েছি যে, সদিচ্ছা থাকলেই ভাল একটা প্রকল্প খাড়া করা যায় না। তবে এ দিনের ব্যাপারটা আমাকে একটু ধাক্কা দিয়েছিল, মানতেই হবে। উৎসবের নানা আকর্ষণে হয়তো তরুণীকে ভুলেই যেতাম, যদি না সেদিন সন্ধ্যায় দ্বিতীয় আর একটা কথাবার্তায় জড়াতাম। আমি যখন কোনও মতে কাবাবের প্লেট ব্যালান্স করার চেষ্টা করছি, তখন সদ্য-আলাপী এক ভদ্রলোক তাঁর বন্ধুদের বোঝাচ্ছিলেন, আমি আলোচনায় কী বলেছি। তিনি বললেন, আমি নাকি বলেছি দারিদ্র দূর করার উপায় আঁতেপ্রেনিয়রশিপ। আমার এই ‘বক্তব্য’ তিনি সমর্থন করেন, তা-ও জানালেন ভদ্রলোক। ঘটনা হল, আমি আঁতেপ্রেনিয়র বা উদ্যোগপতিদের কথা একবারও বলিনি, কেবল ছোট চাষিদের সমস্যার কথা উল্লেখ করেছি। গরিবদের ‘আঁতেপ্রেনিয়র’ করে তোলা নিয়ে যে আগ্রহ-উদ্দীপনা আজকাল দেখা যাচ্ছে, আমার নানা লেখায় আমি বরং তাতে জল ঢেলেছি। কিন্তু যেহেতু আমি সরকারি প্রকল্পের সমালোচনা করেছি, তাই ধরেই নেওয়া হল আমি গরিবদের স্ব-উদ্যোগ সমর্থন করি। ওই তরুণীর মতো এই ভদ্রলোকও আমার কথার মধ্যে কোনও অকথিত বিষয় খুঁজছিলেন, যা সব কিছু ব্যাখ্যা করে দিতে পারে। যখন মনে হয়েছে তা পাওয়া গিয়েছে (‘বেসরকারিকরণ’, কিংবা ‘আঁতেপ্রেনিয়রশিপ’) তখন তাঁরা সেখানেই থেমে গিয়েছেন।

যেখানে শ্রোতারা তথ্য, যুক্তি শোনার চাইতে বক্তার মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করে বেশি, সেখানে বক্তার উপরেও চাপ তৈরি হয় শ্রোতাদের সঙ্গে ভাবনাচিন্তা আদানপ্রদানের চাইতে গোড়াতেই কোনও একটা অবস্থান নিয়ে নেওয়ার। তখন সব বক্তব্যই রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে যেতে চায়, কারণ শেষ অবধি শুধু সেটাই টিকবে। সেই জন্যই ওই তরুণীর মনে হয়েছে তাঁর জানা দরকার, ‘গোপন উদ্দেশ্যটা কী?’

বরাবরই কি এমনই ছিল? হয়তো না। সত্তরের দশকে ভারতে দারিদ্র এবং কৃষির উপর সব চাইতে ভাল কাজ যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। টি এন শ্রীনিবাসন সগর্বে নব্য উদারনীতি সমর্থন করতেন, অশোক রুদ্র ছিলেন অ-মার্কসবাদী, আর প্রণব বর্ধন বামপন্থী। কখনও তিনজনে, কখনও কোনও দু’জন একসঙ্গে কাজ করেছেন। কেউ কি তাঁদের প্রশ্ন করেছিল, কোন গোপন উদ্দেশ্যে তিনজন কাজ করছেন? প্রশ্ন করলে তাঁরা কী-ই বা বলতে পারতেন? কেবল বলতেন, ‘কী ঘটছে, আমরা আসলে সেটুকু জানতে চাই।’

কেন আজ আর লোকে তথ্য জানতে আগ্রহী নয়? হয়তো তার একটা কারণ, ভারতে সরকারি তথ্যের মান ক্রমশ পড়ছে। একটা সহজ কিন্তু উদ্বেগজনক উদাহরণ দেওয়া যাক— জাতীয় আয়। কেউ যদি জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যান থেকে তা গণনা করে (যা করা যেতে পারে, যেহেতু এটা প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা), তা হলে যে-সংখ্যা পাওয়া যাবে, তা সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অর্গানাইজেশনের দেওয়া সংখ্যার অর্ধেক। দ্বিতীয়টিই আমরা বিশ্বকে জানাই। যা আরও উদ্বেগের তা হল, জাতীয় আয় নিয়ে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া হিসেবের মধ্যে ফারাক গত ২০ বছর ধরে ক্রমে বেড়েই চলেছে। তা হলে কোন হিসেবটার উপর ভরসা করব?

তবে সমস্যার মূল আরও গভীরে। শিশুদের পড়তে পারা-অঙ্ক কষতে পারার মূল্যায়নের জন্য একটি রিপোর্ট (অ্যানুয়াল সার্ভে অব এডুকেশন রিপোর্ট বা ‘অসর’) তৈরির কাজের তত্ত্বাবধান করেন রুক্মিণী বন্দ্যোপাধ্যায়। শিশুরা কী শিখছে, তা বুঝতে ভারতের ৬০০ জেলার প্রতিটিতে প্রায় হাজার শিশুকে পরীক্ষা করা হয় এই রিপোর্ট বানাতে। সম্প্রতি এক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের সঙ্গে দেখা হয় রুক্মিণীর। তাঁকে সমীক্ষা থেকে পাওয়া কিছু উদ্বেগজনক ফলাফলের কথা বলছিলেন রুক্মিণী (শেখার মান নিচু থেকে আরও নিচু হচ্ছে) যা শুনে ওই অর্থনীতিবিদ হাত নেড়ে বলেন, আপনাদের ফল কেউ বিশ্বাস করে না। ভদ্রলোক কিন্তু এমন বলছেন না যে, তাঁরাও কয়েক লক্ষ ছেলেমেয়েকে নিয়ে একই ধরনের সমীক্ষা করে ভিন্ন ফল পেয়েছেন। স্রেফ, ‘কেউ বিশ্বাস করে না আপনাদের ফল।’ যদিও ‘অসর’ রিপোর্টের ফল অন্য অনেকে ফের পরীক্ষা করেছে, যদিও ‘প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষাতেও ভারতের ফল ‘অসর’-এর ফলের মতোই খারাপ হয়েছে। যদি সততার সঙ্গে সংগৃহীত পরিসংখ্যান, আর তার স্বচ্ছ বিশ্লেষণে উত্তর খুঁজে না পাওয়া যায়, তা হলে আপনার-আমার গোপন অভিসন্ধি ছাড়া থাকে কী?

আমার অন্তত মনে হয়েছে, এবার জয়পুর সাহিত্য উৎসবের সব চাইতে ভাল আলোচনাটি হল সাহিত্য সাংবাদিকতা নিয়ে। বিশ্বের পাঁচজন সেরা সাংবাদিক সেখানে তথ্যকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়ার কথা বললেন। আশা করি অন্তত তরুণ-তরুণীরা সেটা শুনেছেন।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১২

শ্রমের জয়

শ্রম এব জয়তে। স্বর্গে হয়তো এমনটা হতে পারে, এই ভারতে ‘শ্রম’ জিনিসটার স্থান সবার শেষে। আমার যে-বন্ধুরা কর্মী নিয়োগ করেন, তাঁরা নালিশ করেন যে দৌড়োদৌড়ি করে কাজ করার লোক পাওয়াই মুশকিল। সকলেই খোঁজে চেয়ার-টেবিলে বসে করার কাজ। তার মানে কেবল বসে কাজ করতে হবে, এমন নয়। কল সেন্টারে কাজ করতে হয় চেয়ারে বসে, কিন্তু সারাদিনে অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাদের চেঁচামেচি শুনতে হয়। এদেশে পছন্দের কাজ মানে, শান্তিতে টেবিলে বসে ফাইল ঠেলার কাজ। তার জন্য রোজগারে ঘাটতিও মানতে রাজি অনেকে। বেকারত্বের জ্বালায়, বা কিছু টাকার লোভে যাঁরা দৈহিক পরিশ্রমের কাজ শুরু করেন, তাঁদের অধিকাংশ মাস তিনেকের মধ্যে তা ছেড়ে দেন। ফলে নিয়োগযোগ্য লোকের সংখ্যার নিরিখে আমরা চিনকেও ছাড়িয়ে বিশ্বের এক নম্বরে যেতে চলেছি বটে, কিন্তু আমাদের দেশের নিয়োগকর্তারা হন্যে হয়ে এমন লোক খুঁজে চলেছেন যাঁরা কঠোর পরিশ্রমের, বিরক্তিকর বা একঘেয়ে কাজও করতে রাজি আছেন। অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এমন কাজই বেশি।

কেবল কম টাকার কাজকেই বা ধরা কেন? গোটা ব্যবস্থাটাই ঠেলে দিতে চায় শারীরিক পরিশ্রমের উলটো দিকে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সেরা ছাত্ররাও কারখানায় কাজ করার চাইতে ফিনান্স মার্কেটে কাজ করেন (ফিনান্স সংক্রান্ত কোম্পানিগুলো মাইনে যে আপত্তিকর রকম ভাল দেয়, সেটাও সমস্যার একটা অংশ)। কথা ছিল, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা আইটিআইগুলো দেশকে এমন ছেলেমেয়ে দেবে যাদের চিন্তার ক্ষমতা আর হাতেকলমে কাজের দক্ষতা, দুটোই থাকবে। দেখা যাচ্ছে, আইটিআই থেকে যত ছেলেমেয়ে পাশ করে বেরোয়, তার পাঁচগুণ বেরোয় কলেজ গ্র্যাজুয়েট হয়ে। অথচ কলেজে ভর্তি হওয়ার চাইতে আইটিআইতে পড়াশোনার শর্ত অনেক সহজ, তাই অনেক বেশি ছেলেমেয়ে আইটিআইতে আবেদন করতে পারত। ‘আর্টস’ নিয়ে পড়ে যত ছেলেমেয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়, তা আইটিআই-পাশ পড়ুয়াদের দ্বিগুণ। সেটা কি আমাদের ছেলেমেয়েদের ইতিহাস বা সাহিত্যের প্রতি বেশি অনুরাগের জন্য? নাকি ‘হাত নোংরা’-করা কাজ এড়ানোর জন্য?

এ দেশে যা কিছু গোলমাল, তার দায় জাতপাত ব্যবস্থা আর ব্রিটিশ শাসনের ঘাড়ে চাপানোই দস্তুর। দুঃখের বিষয়, আমিও এ ক্ষেত্রে তা-ই করব। যাঁরা গতর খাটিয়ে কাজ করেন, কয়েক হাজার বছর ধরে তাঁদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। মাত্র কয়েক প্রজন্মে এই মনোভাব দূর করা সহজ নয়। হাতের কাজকে অশ্রদ্ধার নিয়ম, আর সেই নিয়ম চাপানোর জন্য গায়ের জোর, এ দুটোই হয়তো আজ আর আগের মতো অত জোরদার নেই। কিন্তু সেই সংস্কৃতির ছাপ রয়েই গিয়েছে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে (না হলে আমিই বা অধ্যাপক হলাম কেন?)। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এই সব আকাঙ্ক্ষায় দাগ বুলিয়ে চলেছে। ব্রিটিশরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল অল্প কিছু কেরানি নিয়োগ করার তাগিদে। তারা এমন লোক চেয়েছিল যারা পরীক্ষায় পাশ করতে ওস্তাদ, প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে উত্তর দিতে পারবে, আর অন্য সময়ে মুখ বন্ধ রাখবে। এখনও শিক্ষাব্যবস্থা সেই উদ্দেশেই কাজ করে চলেছে— অন্তত আমি যখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তখনও করত (সেটা যদিও বেশ কিছুদিন আগে, কিন্তু অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া স্কুল সহজে বদলায় না)। আমরা পড়াশোনায় যথেষ্ট ভাল না করলে, বা আচরণ যথেষ্ট সুবোধ না হলে, আমাদের শিক্ষকরা আমাদের সবার সামনে অপদস্থ করার জন্য বলতেন, স্কুল থেকে আধ কিলোমিটার দূরের ওই আইটিআইতে পড়া লেখা রয়েছে আমাদের কপালে। এরপর আর কে সেখানে পড়তে চাইবে?

হয়তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের জীবন থেকে এই বিশ্বাস পেয়েছেন যে কঠোর শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে সব খামতি, সব বাধা, জয় করা যায়। যদি তাই হয়, তা হলে বলতে হবে যে আমরা, ভারতের অধিকাংশ মানুষ, তাঁর সেই বিশ্বাসের অংশীদার নই। আমরা বরং বারবার চাকরির পরীক্ষায় বসব, বা একটার পর একটা কোর্স করব, এই আশায় যে-কোনও মতে একবার একটা চেয়ার-টেবিলে বসার চাকরি মিলে যাবে। বা অন্তত যে দিন মেনে নিতে হবে যে তেমন চাকরি আর পাব না, সে-দিনটা একটু দূরে ঠেলা যাবে।

সমস্যা হল, ভারতকে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ বা উৎপাদনের কেন্দ্র করে তোলার যে স্বপ্ন মোদী দেখছেন, আমাদের শ্রম-বিমুখতা তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যদি কায়িক পরিশ্রমের কাজ মানুষ করতে না চায়, তা হলে মজুরির হার চড়া থাকবে। ফলে প্রতিযোগিতায় আমরা তেমন এগোতে পারব না।

এ ব্যাপারে কী করা যেতে পারে? প্রথমত, আমরা আমাদের চাহিদায়, পছন্দে, পরিবর্তন আনতে পারি। কেবল মোদীই নয়, তরুণ প্রজন্ম যাঁদের পছন্দ করে সেই সব মানুষদের শ্রমের পক্ষে সওয়াল করতে হবে। যদি ক্রিকেট ছেড়ে হকি নিয়ে বলিউডের ছবি হতে পারে, তা হলে সততা, কঠোর পরিশ্রমের গুণগান গেয়েই বা ছবি হবে না কেন? দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থায় হাতের কাজের চাইতে মাথার কাজকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করতে হবে। বহু সহপাঠীর চাইতে নিজেকে ভাল মনে করার ইচ্ছেটা আমার অনেকটাই কমে যেত, যদি জানতাম যে তারাও কাঠের কাজ বা সেলাইয়ের ফোঁড় তোলায় আমার ডাহা অপদার্থতা দেখছে। অবশ্যই যদি না শিক্ষকরা ‘ও কাজগুলো সময় নষ্ট’ বলে পুরো ব্যাপারটা কাঁচিয়ে দেন। সেটাই তাঁরা করেছিলেন, যখন আমাদের হায়ার সেকেন্ডারি পাঠ্যক্রমে ‘ওয়ার্ক এডুকেশন’ ঢোকানো হল।

তৃতীয়ত, আমাদের রাস্তাঘাট, অফিস-কাছারি আরও নিরাপদ করতে হবে, বাড়ির কাজ সকলের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে হবে, যাতে মেয়েদের প্রতিভা ও কর্মক্ষমতা কাজে লাগাতে পারে আমাদের দেশ। বাংলাদেশের পোশাকের কারখানাগুলোয় শ্রমিকের কাজ করছে প্রধানত মেয়েরা। এদেশেই বা তা হবে না কেন?

শেষ, এবং সব চাইতে কঠিন পদক্ষেপ হল, আমাদের সরকারি চাকুরেদের কম কাজ-বেশি মাইনে দেওয়া বন্ধ করা। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাঙ্কের রিঙ্কু মুরগাই এবং ল্যান্ট প্রিচেট হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন যে, সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা (চুক্তিতে নিযুক্ত নয়, পুরো সময়ের শিক্ষক) গড়ে প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষকদের চাইতে সাতগুণ বেশি মাইনে পান। এটা ঠিকই যে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা গড়ে বেশি। কিন্তু তার জন্য প্রাপ্য বাড়তি সুবিধে যদি হিসেব কষে বাদ দেওয়া হয়, তা হলেও বেতনে তফাতটা দাঁড়ায় প্রায় আড়াইগুণ। তার সঙ্গে পেনশন ও অন্যান্য সুবিধে তো আছেই। অথচ বাড়তি অভিজ্ঞতা থাকলেও তাঁরা যে আরও ভাল পড়াচ্ছেন, তেমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। বরং উলটো প্রমাণই মিলেছে। তাঁদের চাকরি যে সুরক্ষিত, ফলে ভাল পড়ানোর, এমনকী নিয়মিত ক্লাসে আসার কোনও তাগিদ তাঁদের নেই, তা সম্ভবত সেগুলোর প্রতিফলন। (তাঁদের বাড়তি অভিজ্ঞতাকেও এর নিরিখে দেখতে হবে। তাঁদের মতো কর্মীরা প্রাইভেট স্কুল থেকে ছাঁটাই হয়ে যাবেন, অভিজ্ঞতা বাড়ানোর সুযোগই পাবেন না।) সরকারি চাকরির সব সুবিধেগুলো যদি কেউ মিলিয়ে দেখে— বেসরকারি চাকরির চাইতে অনেক বেশি মাইনে, অন্যান্য বাড়তি সুবিধে, চাকরির সুরক্ষা, কাজ করার বাধ্যবাধকতা সামান্য— তা হলে স্পষ্ট হয় আমাদের তরুণ-তরুণীরা গা ঘামিয়ে কাজ করার চাইতে কেন বছরের পর বছর সরকারি চাকরি পাওয়ার ফাটকা খেলেন। আরও একটা কোর্স করলে, আরও একটা পরীক্ষা দিলে, যদি এমন চমৎকার চাকরি পাওয়ার মাত্র এক শতাংশ সুযোগও থাকে, তা ছাড়া যায় নাকি? যে সব কাজ তাঁরা করতে চান না, সেগুলো তো আর পালাচ্ছে না। সরকারি চাকরি পাওয়ার আশা ছেড়ে একদিন ভাঙা মনে তাঁরা সেই সব কাজে নাম লেখাবেন। ততদিন দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির স্বপ্ন না হয় অপেক্ষা করে থাক।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২৭ অক্টোবর ২০১৪

সম্পদ ও সংকট

নব্বই বছর আগে বিশ্বের গড়পড়তা মানুষের জীবন যেমন ছিল, আজ তার চাইতে অনেক ভাল। সত্যি বলতে কী, তার আগে যে-কোনও সময়ের চাইতে আজ সাধারণ মানুষ ভাল আছে। এই ১৯৫৫ সালেও বিশ্বে গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৮ বছর (ওই বছর থেকেই গোটা বিশ্বের তথ্য দিতে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। পেনিসিলিনের মতো শক্তিশালী ওষুধ ব্যাপক হারে ব্যবহারের পরেও এই ছবি ছিল। সুতরাং ১৯২৩ সালে আয়ু আরও কম ছিল নিশ্চয়ই। এখন গড় আয়ু ৭০ বছরের কাছাকাছি। ১৯৫৫ সালে প্রতি সাতজন শিশুর একজন এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যেত। এখন মারা যায় তার এক-তৃতীয়াংশ।

কেবল স্বাস্থ্যই নয়। ১৯৫০ সালেও বিশ্বের ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিরক্ষর ছিলেন। এখন সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশে। যাঁরা তীব্র দারিদ্রে বাস করেন, ১৯৮১ থেকে আজকের মধ্যে তাঁদের অনুপাত ৫০ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

উন্নয়নের এই কাহিনি কেবল চিন আর পূর্ব এশিয়ার নয়। ভারতের মতো দেশেও ১৯২০-র দশকে গড় আয়ু ছিল মাত্র ২৭ বছর। এখন তা ৬৬ বছর। আফ্রিকাতে ১৯৫০-এর দশকে ৩৮ বছর আয়ু থেকে এখন ৫৫ বছরে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার সময়েও ভারতে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ২০ শতাংশ। এখন তা ৭৫ শতাংশ। ভারতের জাতীয় দারিদ্রসীমা (যা বিশ্বব্যাঙ্ক নির্ধারিত দারিদ্রসীমার খুবই কাছাকাছি) অনুসারে এখন ২২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। ১৯৪০-এর দশকের কিছু কিছু এমন হিসেব দেখেছি, যা অনুসরণ করলে দারিদ্রের অনুপাত দাঁড়ায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি।

কিন্তু সম্ভবত যা আরও বেশি বদলে গিয়েছে, তা হল আমাদের বিশ্বকে দেখার চোখ। ১৯২৩ সালে সব জায়গায় আধিপত্য ছিল সাদা লোকেদের— অন্তত যদি জাপানিদের শ্বেতাঙ্গ বলে ধরা হয়, যেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে জাপানে, পাশ্চাত্যেও। যেখানে তাঁরা সরাসরি শাসন করেনি, সেখানেও তাঁরাই বিধিব্যবস্থা ঠিক করত। বেশির ভাগ মানুষ মনে করতেন, এমনই হওয়ার কথা। ১৯২৬ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে স্বরাজ চেয়েছিল, কয়েক দশক আগেই যা দেওয়া হয়ে গিয়েছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াকে, তখন ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য স্পেকটেটর’ সেই দাবিকে বলেছিল ‘পাগলের পরিকল্পনা’।

১৯৩১ সালের গোলটেবিল বৈঠকে গাঁধী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সমানে সমানে দরদস্তুর করছেন দেখে চার্চিল এমনই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি গাঁধীকে ‘অর্ধনগ্ন’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী ফকির’ বলেছিলেন। আজকের দুনিয়াতেও যে কিছু কিছু দেশ মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব খাটাচ্ছে না, তা নয়। তবে সেটা তাদের অর্থনীতির জোরে, সামরিক জোরে, কিংবা অনুদানের টাকার জোরে। উন্নততর সভ্যতার দাবির জোরে নয়। আর ওই সব দেশও ভালই জানে, চিন, ব্রাজিল, কিংবা হয়তো ভারত তাদের জায়গায় চলে আসা কেবল সময়ের অপেক্ষা।

আরও নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে চলেছে দেশের অভ্যন্তরে। ১৯২৩ সালেও অম্বেডকর দলিতদের নেতা হয়ে ওঠেননি। আরও পরে তিনি গাঁধী ও কংগ্রেসের সংশ্রব ত্যাগ করবেন, কারণ ‘তাঁর লোকেদের’ জন্য কংগ্রেস কিছু করতে পারবে, সে-আস্থা তাঁর ছিল না। পরে দেখা গেল, যে সব দলে উচ্চবর্ণের নেতৃত্ব, সেগুলোই জাতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য জারি রাখলেও, পরিবর্তন এল দলিতদের জীবনেও। নিঃসন্দেহে অম্বেডকরের নিজের তৈরি করা নীতির জন্যেও তা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে তফশিলি জাতি, জনজাতির মানুষ অন্যদের চাইতে ৩৬ শতাংশ কম রোজগার করতেন। ২০০৪-০৫ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় দেখা গেল, ওই ফারাক প্রায় অর্ধেক কমে গিয়েছে। তাঁদের যুক্তি ছিল, শিক্ষায় (কত বছর স্কুলে পড়ছে, তার হিসেবে) দলিত-জনজাতির মানুষ অন্যদের কাছাকাছি চলে আসা এই ফারাক কমার অন্যতম কারণ। ভুলে যাওয়া চলে না, ওই ১৯২৩ সালেই মুম্বইয়ের সিডেনহ্যাম কলেজের অধ্যাপকরা আন্দোলন করেছিলেন অম্বেডকরকে কলেজ থেকে বরখাস্ত করার দাবিতে, যে হেতু বর্ণপ্রথা অনুসারে অম্বেডকরের কাছাকাছি যাওয়াই নিষিদ্ধ ছিল তাঁদের জন্য। আজ এ দেশের স্কুলের ক্লাসঘরে সব জাতের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসে খাবার খায়।

এমন পরিবর্তন গোটা বিশ্বেই ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিম ক্রো আইন কার্যকর ছিল ১৯২৩ সালেও। ওই আইন সাদা লোকের ‘সুরক্ষা’ দিত কালো লোকেদের থেকে, তাদের সঙ্গে বাসে-ট্রামে, স্টেশনে-ক্লাবঘরে এক জায়গায় বসার থেকে। ২০১৩ সালে এসে দেখা যাচ্ছে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাঁর আগে, বুশ প্রশাসনে প্রেসিডেন্টের ঠিক পরের পদটি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা কন্ডোলিজা রাইসের। ১৯২০ সাল অবধি কোনও মহিলাই আমেরিকায় ভোট দিতে পারত না, কৃষ্ণাঙ্গ তো দূর অস্ত্‌। ফ্রান্সে ১৯৪৪ সাল অবধি মেয়েদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ভোট দেওয়ার জন্য।

সত্যি বলতে কী, মানুষের ভোটে না জিতলে সরকার তৈরি করা যাবে না, এই ধারণাটাই খুব পুরনো নয়। ১৯২৩ সালে হিটলার আর তাঁর সঙ্গী গুন্ডারা বাভারিয়ার নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিল (তখনকার মতো)। বামপন্থী আর দক্ষিণপন্থী, দু’তরফেই তখন এই ধারণাটাই ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে যে রাষ্ট্রকে হতে হবে সর্বশক্তিমান, আর তা চালানোর দায়িত্বে থাকতে হবে এমন কোনও অভিজাত নেতাকে যিনি ‘বোঝেন’ কী ভাবে দুনিয়াটা চলছে। ১৯২৩ সালে লেনিন ক্ষমতা দখলের দিকে এগিয়ে চলেছেন, মুসোলিনি নিজেকে ১৯২৫ সালে একনায়কতন্ত্রের শাসক বলে ঘোষণা করবেন, হিটলার করবেন ১৯৩৩ সালে। এ সবের জন্য বিশ্ব যতই যন্ত্রণাদীর্ণ হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও প্রায় ৫০ বছর কেটে গেল গোটা বিশ্বের মানুষের, সেই সব ‘মহান নেতা’-র উপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে, যাঁদের বুকে প্রায়ই গাদাগুচ্ছের মেডেল সাঁটা থাকত, যাঁরা নির্বাচন নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না। আজকের বিশ্ব আগেকার চাইতে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক।

এর প্রতিটিকেই মস্ত সাফল্য বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, রাজনৈতিক যোগদান, এমন সব বিষয় নিয়ে বহু সহস্র বছরের ধারণা আমূল বদলে গিয়েছে মাত্র কয়েক দশকে। এমনকী অর্থনৈতিক পরিবর্তন যা ঘটেছে, তারও নজির নেই ইতিহাসে। আমার নিজের (অপেশাদার) ইতিহাস পাঠ থেকে মনে হয়েছে, যদিও গরিবের জীবনযাত্রার মানে এর আগেও নানা হেরফের হয়েছে, কিন্তু গত ৩০ বছরে দারিদ্র যত কমেছে তেমন অতীতে কখনও হয়নি।

কিন্তু আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, হয়তো এই উন্নতি ধরে রাখা যাবে না। এমন এক সংকট আসবে, যা উন্নয়নের সব লাভ ধুয়েমুছে দিয়ে ক্ষতির পাল্লা ভারী করবে। সম্প্রতি সাক্ষ্য মিলেছে যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রায় দুই ডিগ্রি বৃদ্ধি ঘটেছে। যে আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা এতদিন করছিলেন, তা আর এড়ানো যাবে না। এখন আমরা চার ডিগ্রি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়ে খেলা করছি, যা প্রায় নিশ্চিতভাবে এক ভয়ঙ্কর পরিণাম তৈরি করবে। অতিবৃষ্টি, জলস্ফীতি, বন্যার ধ্বংসলীলায় প্রায় অকল্পনীয় প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষতি হবে, বলছেন বিজ্ঞানীরা।

কিন্তু উন্নয়ন চাওয়া মানেই কি এমন ধ্বংসকে ডেকে আনা? যে সব উন্নয়নের খতিয়ান এতক্ষণ দিচ্ছিলাম, মহাপ্লাবন কিংবা প্রবল খরা কি তার অপরিহার্য পরিণতি? অনেকেই ভোগের তাগিদ-চালিত উন্নয়নকে পরিবেশের ভারসাম্যের বিরোধী বলে মনে করেন। সেটা নিয়ে একটু প্রশ্ন থাকে। এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে সমাজ-অর্থনীতিতে পরিবর্তন ও উন্নয়নের যে সব দৃষ্টান্ত, তার অনেকগুলির ক্ষেত্রেই এ যুক্তি চলে না। যে দলিত-আদিবাসীরা নিজেদের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন, যে-মেয়েরা ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেন, যাঁরা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের ভোগবাদ ও তজ্জনিত পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী করা কখনওই চলে না। আবার জনস্বাস্থ্যে, চিকিৎসায় যে উন্নতি হয়েছে, তা পাশ্চাত্যে দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে মহামারি ছড়ানোর ভয়, যুদ্ধে জেতার আগে অসুখে সৈন্য মারা যাওয়ার ভয় থেকেও হয়েছে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য রোগকে আরও ভাল বুঝতে পারার ক্ষমতাও তৈরি হয়েছে। তা হলে ভোগবাদ-তাড়িত হয়েই উন্নয়ন হয়, তাই উন্নয়নকে সমর্থন করা মানেই পরিবেশের সর্বনাশ ডেকে নেওয়া, তা বলি কী করে? এক কথায়, দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে বাধ্য, তা আমি বিশ্বাস করি না।

আসল সমস্যা হল, এখন উন্নয়নের যে মডেলগুলো আমাদের হাতের কাছে রয়েছে, সেগুলো যে সময়ে তৈরি হয়েছিল তখন পুঁজিবাদী, মার্ক্সবাদী, কেউই প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। এখনকার জীবনযাত্রায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে ওঠার আগে যদি আমরা পরিবেশের সংকট বিষয়ে জানতাম, এবং সেই অনুসারে কাজ করতাম, তা হলে হয়তো আজ জীবনটাই অন্য রকম হত। তার মানে এই নয় যে, জীবনে দারিদ্র আরও বেশি থাকত। এ কথাটা মনে রাখা জরুরি, কারণ আমরা যদি মনে করি, কোনও একটা বিকল্প অর্থনীতির মডেলের বিষয়ে সকলে সহমত না হলে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করা যাবে না, সেটা মস্ত ভুল হবে।

যদি নিজেদের বাঁচাবার সুযোগ পেতে হয়, তা হলে আমাদের এখনই কাজে নামতে হবে, এবং তা সকলকে নিয়ে। আর তা করতে হলে আমাদের আজকের সংকট, আজকের সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। গত ৯০ বছরে আমার যা করতে পেরেছি, তার সাফল্য উদযাপন করতে হবে। আর্থিক মন্দা, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, আরও যা যা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো মাথায় রেখেও উদযাপন করতে হবে। কারণ, সাফল্যের সম্পদ থেকে সাহস সঞ্চয় না করলে ত্যাগ স্বীকার করা কঠিন।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দুস্থান টাইমস, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩

দরিদ্রের সংখ্যা, সংখ্যার দারিদ্র

২০১১ সালে যোজনা কমিশন দারিদ্রসীমা ধার্য করে, পাঁচজনের পরিবারের জন্য মাসে ৪৮২৪ টাকা শহরে, আর ৩৯০৫ টাকা গ্রামে। বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন এবং সংবাদমাধ্যম আপত্তি তোলে যে, মাথাপিছু দৈনিক ৩২ টাকায় শহরে জীবনধারণ সম্ভব নয়।

সংখ্যার সম্মান কি আমরা ভুলতে বসেছি? গত এক বছরে দারিদ্রসীমা নিয়ে জনসমাজে যে বিতর্ক হল, তাতে মনে হয় উন্নয়নে সংখ্যার প্রয়োজন কী, প্রয়োজন কেন, তার ধারণা আবছা হয়ে এসেছে। অথচ এই ভারতেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের নেতৃত্বে তাঁর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের কর্মীরা বিশ্বের প্রথম বৃহৎ মাপের সমীক্ষা করেছিলেন। তা থেকেই শুরু হয় জাতীয় নমুনা সমীক্ষা। এই সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যের কিছু কিছু অংশ ব্যবহার করে বার করা হয়েছিল, দেশে কত গরিব মানুষ আছে। দারিদ্রসীমা নির্দিষ্ট করার কাজেও ভারতই প্রথম ছিল। যোজনা কমিশনের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ ১৯৬০-৬১ সালের বাজারদরে মাসে ২০ টাকা ব্যয় ক্ষমতাকে ‘দারিদ্রসীমা’ বলে নির্দিষ্ট করেন। বাঁচার জন্য যে পুষ্টি প্রয়োজন তার জন্য কত খরচ না করলেই নয়, এবং আরও দু-চারটি বিষয়ের হিসেবের ভিত্তিতে, যথেষ্ট চিন্তা আর পরিশ্রম করে তাঁরা এই সীমা নির্দিষ্ট করেছিলেন ১৯৬২ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দারিদ্রসীমা তৈরি করেছিল এর তিন বছর পর, ১৯৬৫ সালে।

দারিদ্রসীমা একটি সংখ্যা। উন্নয়ন সম্পর্কিত এমন নানা সংখ্যা অঙ্ক কষে বের করা অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের কাজ। সেই সংখ্যাকে মর্যাদা দেওয়া মানে, সংখ্যা যাঁরা তৈরি করছেন তাঁদের পেশাদারিত্ব স্বীকার করা। তাঁদের মতামত যা-ই হোক না কেন, যে-প্রশ্নটা তাঁদের করা হয়েছে (যেমন, ভারতে কত গরিব মানুষ আছে?) সেটার নৈর্ব্যক্তিক উত্তর দেওয়াটা যে তাঁদের কাজ, এবং সেই কাজ যে তাঁরা সততার সঙ্গে করছেন, এটা মেনে নেওয়া। অর্থনীতির জগতে সদ্য প্রয়াত সুরেশ তেণ্ডুলকরকে সেই মর্যাদা দেওয়া হত। টি এন শ্রীনিবাসনকে সেই মর্যাদা দেওয়া হয়। এঁদের মতামতের সঙ্গে যাঁদের মতের অমিল রয়েছে, তাঁরাও এঁদের সততা বা সামর্থ্যকে সন্দেহ করেন না। এই ট্র্যাডিশনই এ দেশে তৈরি হয়েছিল।

কিন্তু গত বছর দারিদ্র নিয়ে দেশে বিতর্ক-বিক্ষোভের যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল, তাতে মনে হচ্ছে সেই ঐতিহ্য যেন আমরা হারাতে বসেছি। বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল কয়েকটি সংখ্যা। ভারতে গরিব মানুষ কত শতাংশ, তা ছিল একটা সংখ্যা। আর দুটো সংখ্যা ছিল দৈনিক খরচের। শহরে আর গ্রামে সর্বোচ্চ কত টাকা ব্যয় করলে তাকে গরিব বলা চলে, সেই টাকার অঙ্ক। এই সংখ্যাগুলো কী করে পাওয়া গেল, কী উদ্দেশ্যে এগুলো কষে বার করা হল, কোন দুঃসাহসে এগুলো আনা হল জনসমক্ষে, এমন সব প্রশ্ন তুলে যে হইচইটা বেধে গেল, তাতে বন্যার বছরে ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক, কিংবা নির্বাচনের বছরে ঋণ মকুবের টাকার অঙ্ক ঠিক করার সঙ্গে দরিদ্রের ন্যূনতম মাসিক খরচের টাকার অঙ্ক ঠিক করার কোনও তফাত রইল না। যেন কেউ খেয়ালই করলেন না যে, রাজনীতির অঙ্ক কষার সঙ্গে অর্থনীতির অঙ্ক কষার কোনও তফাত রয়েছে।

এই গোলমালে মিডিয়া, নাগরিক সমাজ আর রাজনীতির নেতারা প্রায় সকলেই দাঁড়ালেন যোজনা কমিশনের বিরুদ্ধে। এমনকী কংগ্রেসেরও দু’-চার জন মন্ত্রী মুখরক্ষার মতো কয়েকটা কথা বলে চুপ করে গেলেন। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি মনমোহন সিংহ নিজে মিডিয়ার কাছে, সংসদে কিংবা জনসভায় দারিদ্রসীমার সপক্ষে একটি কথাও বললেন না। কংগ্রেসের শরিক দলগুলোও সংসদে দারিদ্রসীমাকে আক্রমণ করল, বিরোধীরা তো বটেই। ফলে ‘বাইট’ যাঁরা দিলেন, আর যাঁরা নিলেন, তাঁরা প্রায় সকলে দাঁড়ালেন এক দিকে। অন্য দিকের মুখপাত্র বলতে যোজনা কমিশনের ডেপুটি কমিশনার মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া, যাঁর গ্রহণযোগ্যতা মিডিয়া কিংবা সাধারণ নাগরিকের চোখে কখনওই খুব উঁচু মাপের ছিল না। যোজনা কমিশনের অন্য দু’চারজন কর্তার বক্তব্য উদ্ধৃত হল মিডিয়াতে, তাঁরাও কেউ খুব পরিচিত ব্যক্তি নন। দারিদ্রসীমার সমর্থনে দু’চারজন যাঁরা কলম ধরলেন ইংরেজি পত্রপত্রিকাতে, তাঁরা পেশাদার অর্থনীতিবিদ। অধিকাংশই খোলা বাজারের সমর্থক বলে চিহ্নিত। ইংরেজি কাগজে তাঁদের নিবন্ধগুলো ‘পাবলিক’ খেয়ালও করল না। যোজনা কমিশনের প্রস্তাবিত দারিদ্রসীমা বাতিল হল, নতুন বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হল, আর এক দফা সমীক্ষার পরে (আর্থ-সামাজিক ও বর্ণ সমীক্ষা) নতুন দারিদ্রসীমা ঠিক হবে বলে রফা হয়েছে। সেই সমীক্ষা এখনও চলছে। কে গরিব, তা ঠিক করার কোনও মাপকাঠি দেশের কর্তাদের হাতে এই মুহূর্তে নেই।

এই গোটা ঘটনা থেকে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে। এক, বড় মিডিয়া সংস্থাগুলি প্রায় সব ক’টিই কেন দারিদ্রসীমার ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়াল? এদের মধ্যে অধিকাংশই মূলস্রোতের অর্থনীতির সমর্থক, উন্নয়নের যে ধারণায় দারিদ্র কমানোর পরিকল্পনা করা হয়, তার সঙ্গে টাইমস অব ইন্ডিয়া কিংবা ইন্ডিয়া টুডে কাগজের নীতিগত বিরোধ নেই। দারিদ্রসীমার ধারণা উন্নয়নের সেই মূলস্রোতের নকশার বিরোধী নয়। দারিদ্রসীমা মিডিয়ার কাছে নতুন কোনও ধারণাও নয়, যে ভাবে যোজনা কমিশন তা নির্ধারণ করেছে সেই পদ্ধতিতেও খুব নতুনত্ব কিছু নেই। তা হলে প্রায় গোটা মিডিয়া যোজনা কমিশনের ঘোষিত দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করল কেন?

দুই, রাজনীতির নেতারা প্রায় সকলেই এর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, কিংবা নীরব থাকলেন। কেন? দারিদ্রসীমা প্রয়োগ করলে গরিব রাজ্যগুলো অনেক বেশি টাকা পেত তুলনায় ধনী রাজ্যের চাইতে, কারণ এই সূচক অনুসারে ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, বিহার, অসমের মতো রাজ্যে গরিবের সংখ্যা বেশি থাকত। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বহু দিন ধরে বিহারে দারিদ্র বেশি, এই যুক্তি দেখিয়ে বেশি টাকা দাবি করে আসছেন কেন্দ্রের থেকে। অথচ তাঁর দলের সাংসদ শারদ যাদব দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন সংসদে। বেশি টাকা পাওয়ার চাইতে চিরাচরিত রাজনৈতিক বিরোধিতাই কি তাঁদের কাছে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল? নাকি দারিদ্রসীমা সমর্থন করা মানে দরিদ্রকে অসম্মান করা, এমন কোনও ধারণা চাউর হয়ে যাওয়ায় দারিদ্রসীমাকে সমর্থন করা তাঁদের কাছে রাজনৈতিক ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল?

আর তিন, এই বিতর্ক (নাকি বিতর্কের অভাব?) থেকে দারিদ্র নিয়ে জনসমাজে (public sphere) আলাপ-আলোচনার ধরনধারণ সম্পর্কে কী ছবি স্পষ্ট হল? কী ভাবে ভারতে নীতি বিষয়ক আলোচনার গতিপ্রকৃতি নির্দিষ্ট হয়? তা থেকে আমাদের জনসমাজে, বিশেষত মিডিয়াতে, ডিসকোর্স সম্পর্কে কী বোঝা যায়?

এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে। যোজনা কমিশনের নির্ধারিত দারিদ্রসীমা ঠিক কিনা, সেটা এখানে আলোচনার বিষয় নয়। সাংবাদিকরা, বা রাজনৈতিক বিরোধীরা যে সরকারকে বা যোজনা কমিশনকে সমালোচনা করবে, সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কমিশনের বক্তব্য কী, আর জনসমাজের আলোচনায় সে-সম্পর্কে কী বলা হল, তা মিলিয়ে দেখা দরকার।

আলোচনার গোড়ায় দারিদ্রসীমা সম্পর্কিত ঘটনাপঞ্জি দেওয়া দরকার।

২০১১, ২৯ মার্চ: খাদ্যের অধিকারের বিষয়ে পিপলস ইউনিয়ন অব সিভিল লিবার্টিজ (PUCL) ২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্টে যে-মামলা করেছিল, তারই সূত্রে সুপ্রিম কোর্ট যোজনা কমিশনের কাছে জানতে চায়, ভারতে অপুষ্টির হার খুবই বেশি, কিন্তু যাঁরা স্বল্পমূল্যে রেশন থেকে চাল-গম পেতে পারেন, সেই গরিবদের সংখ্যা কেন সর্বোচ্চ জনসংখ্যার ৩৭.২ শতাংশ বেঁধে রাখা হয়েছে?

১০ মে: তার উত্তরে হলফনামায় যোজনা কমিশন জানায়, সুরেশ তেণ্ডুলকর কমিটি ২০০৯ সালে যে পদ্ধতিতে দারিদ্রসীমা নির্ণয়ের প্রস্তাব করেছিল, যোজনা কমিশন সেটাই মেনে নিয়েছে। ২০০৪-০৫ সালে দারিদ্রসীমা ছিল দৈনিক ভোগ ব্যয় (consumer expenditure) মাথাপিছু শহরে ২০ টাকা এবং গ্রামে ১৫ টাকা। সেই অনুসারে অঙ্ক কষলে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যার ৩৭.২ শতাংশ গরিব। এই দারিদ্রসীমায় বা তার উপরে যাঁরা রয়েছেন, আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থা FAO-র বিধি অনুসারে তাঁদের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরির ঘাটতি হবার কথা নয়।

১৪ মে, ২২ জুলাই: হলফনামা পেশ করার তিন দিন পরে সুপ্রিম কোর্ট বলে, ২০০৪-০৫ সালের দরদাম অনুসারে নির্দিষ্ট দৈনিক ২০ টাকা বা ১৫ টাকায় ২০১১ সালে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সম্ভব নয়। যোজনা কমিশনকে ২০১১ সালের দরদাম অনুসারে মাথাপিছু প্রয়োজনীয় টাকার অঙ্ক নির্দিষ্ট করতে হবে। আবার ২২ জুলাই একটি নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট বলে, ২০০৪-০৫ সালে দারিদ্রসীমা হিসেবে নির্দিষ্ট মাসিক ভোগ ব্যয় (শহরে ৫৭৯ টাকা, গ্রামে ৪৪৭ টাকা) ২০১১ সালের দরদাম অনুসারে নির্দিষ্ট করতে হবে।

২০ সেপ্টেম্বর: যোজনা কমিশন সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিল। কমিশন হিসেব কষল, ২০০৪-০৫ সালের দারিদ্রসীমা মূল্যস্ফীতির পর ২০১১ সালে কত হওয়া উচিত। সেই অনুসারে বলা হল, পাঁচজনের পরিবারের জন্য প্রতি মাসে শহরে ৪৮২৪ এবং গ্রামে ৩৯০৫ দারিদ্রসীমা বলে মানতে হবে। মাথাপিছু হিসেব করলে শহরে তা দাঁড়ায় ৩২ টাকা এবং গ্রামে ২৬ টাকা। এত কম টাকা খরচ করে কেউ দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে পারে কি না, এই প্রশ্নে ঝড় উঠল মিডিয়াতে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৩ অক্টোবর প্রেস কনফারেন্স করলেন মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া, তাতে সমালোচনার ধার কমল না।

২০১২, ১৯ মার্চ: নতুন হলফনামা পেশ করল কমিশন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কোর্টে হলফনামা দেওয়ার সময়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ২০০৯-১০ সালের পারিবারিক ভোগ ব্যয় সমীক্ষার ফল হাতে আসেনি। ২০১২ সালে সেই তথ্য-পরিসংখ্যান হাতে এসে যাওয়ায় তার ভিত্তিতে অঙ্ক কষে দেখা গেল, ২০০৪-০৫ সালের দারিদ্রসীমা ২০০৯-১০ সালে দাঁড়িয়েছে দৈনিক মাথাপিছু শহরে ২৮ টাকা ৬৫ পয়সা, গ্রামে ২২ টাকা ৪৩ পয়সা। এই অঙ্ক অনুসারে ভারতে গরিবের অনুপাত ৩৭.২ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৯.৮ শতাংশে। সংখ্যার হিসেবে গরিব মানুষ ৪০.৭ কোটি থেকে ৩৫.৫ কোটিতে নেমে এসেছে। এই হলফনামা দেওয়ার দু’দিন পরেই (২১ মার্চ) লোকসভায় প্রায় সব দলের নেতারা যোজনা কমিশনকে তুলোধোনা করে এই দারিদ্রসীমাকে উড়িয়ে দিলেন।

২৪ মে: প্রবল সমালোচনার মুখে নতুন একটি বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করা হল অর্থনীতিবিদ সি রঙ্গরাজনের নেতৃত্বে। কমিটি দারিদ্রসীমা নির্ণয় করার পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করছে।

‘নিষ্ঠুর রসিকতা’: দারিদ্র ও মিডিয়া

ইংরেজি কাগজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, একটি সংখ্যাকেই দারিদ্রসীমার আলোচনার কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তা হল মাথাপিছু দৈনিক ব্যয়। ‘দিনে ৩২ টাকায় কী হয়?’ সুপ্রিম কোর্টের কাছে কমিশনের সেপ্টেম্বরের হলফনামার পর এই ছিল মিডিয়ার সমালোচনার মূল সুর। কখনও অবিশ্বাস, কখনও ক্ষোভ, কখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যে দিয়ে এই কথাটিই ঘুরে-ফিরে এসেছে। বত্রিশ টাকা ঠিক কীসের মাপ, সেটাও গুলিয়ে যেতে লাগল। হিন্দুস্তান টাইমস হেডলাইনে লিখল, ‘যোজনা কমিশনের রসিকতা: দিনে ৩১ টাকা পাঁচজনের পরিবারের জন্য যথেষ্ট।’ যদিও দিনে ৩১ টাকা ছিল মাথাপিছু হিসেব, পরিবারের জন্য নয়। টাইমস অব ইন্ডিয়ার হেডলাইন, ‘দিনে ৩২ টাকা খরচ করেন? সরকারের মতে আপনি গরিব নন।’ আউটলুক পত্রিকায় শিরোনাম, ‘কম, আরও কম।’ টেলিভিশন চ্যানেলগুলি দেখাতে লাগল, ৩২ টাকায় (মার্চের হলফনামার পর, ২৮ টাকায়) বাজার থেকে কী কী খাবার কেনা সম্ভব, তাতে কী করে পেট চালানো যেতে পারে।

মিডিয়াতে এই সমালোচনা হয়তো আকস্মিক নয়, নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে এর একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। যাঁদের আবেদনের ভিত্তিতে এই মামলা এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়, সেই PUCL সদস্যরা যোজনা কমিশনের প্রথম হলফনামার পর দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে যোজনা কমিশনের প্রত্যেক সদস্যের নাম করে ২০ টাকার বাজার করে এনেছিলেন। এই বিক্ষোভের ধরনের দু’টি দিক আছে— এক, বক্তব্যের ভাল-মন্দের আলোচনায় না গিয়ে বক্তাকে দোষী ঠাহর করে ব্যক্তিগত আক্রমণ। এবং দুই, বক্তব্যকে বিদ্রুপ করে তাকে ভুল প্রতিপন্ন করার চেষ্টা। ভাবটা এই যে, যদি দেখিয়েই দেওয়া যায় যে ২০ টাকায় হাফ কেজি আলু, চারটে পটল ছাড়া কিছু হয় না, আর তা দিয়ে কারও পেট ভরা সম্ভব নয়, তা হলে আর বলার থাকেটা কী? নাগরিক আন্দোলনের শরিকদের কাছে অবশ্য এই ধরনের স্ট্র্যাটেজি খুব অপ্রত্যাশিত নয়, হয়তো অনভিপ্রেতও নয়। যেখানে কোনও সরকারি নীতি বা গাফিলতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা হয়, সেখানে বিমূর্ত নীতিকে প্রত্যক্ষ চেহারা দেবার একটা তাগিদ থাকে। তাই ‘মৃত’ টেলিফোনের ‘শবযাত্রা’ বার করা হয়, কিংবা ক্রেতা সুরক্ষা আইনে চিকিৎসকদের আনার প্রতিবাদে ডাক্তাররা আলু-পটল বেচেন।

কিন্তু অস্বস্তি জাগে যখন দেখি যে, আন্দোলনে যার নির্মাণ করা হয়েছিল প্রতীকী অর্থে বা বিদ্রুপের অস্ত্র হিসেবে, মিডিয়া যেন তাকেই হুবহু গ্রহণ করল। তাই বাজারের প্রায়-শূন্য থলি, আর ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ, এই দুটোই মিডিয়াতে সব কথাবার্তা ছাপিয়ে উঠল। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখল, চাল-গমের জন্য দিনে সাড়ে পাঁচ টাকা, ডালের জন্য এক টাকা দুই পয়সা কিংবা দুধের জন্য দু’টাকা তেত্রিশ পয়সার বেশি খরচ করলে আপনি দারিদ্রসীমা ছাড়িয়ে যেতে পারেন। গোটা রিপোর্ট (সেপ্টেম্বর ২১, ২০১১) যোজনা কমিশনের হিসেবকে তুলে দিয়েছে, প্রায় কোনও মন্তব্য ছাড়াই, কিন্তু রিপোর্টারদের বক্তব্য স্পষ্ট— দেখে নাও এই হিসেব কতটা আজগুবি। ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার রিপোর্টার (সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১) বেঙ্গালুরুর এক বিধবা গৃহস্থালি কর্মীর সাক্ষাৎকার নিলেন, ৩২ টাকায় বাঁচা যায় কি না। সেই মহিলা চোখের জলে ভেসে বললেন, সনিয়া গাঁধী ৩২ টাকায় বেঁচে দেখাক। টাইমস অব ইন্ডিয়া-র সাংবাদিক দিল্লির নানা বস্তির বাসিন্দাদের প্রশ্ন করলেন, দিনে ৩৪ টাকায় বাঁচলে তাকে গরিব বলা ভুল কি না (২১ মার্চ, ২০১২)। আউটলুক (এপ্রিল ২, ২০১২) পত্রিকার সাংবাদিক নিজে ২৮ টাকায় এক দিন বাঁচার চেষ্টা করে দেখলেন। তিন কাপ চা, দু’টুকরো পাঁউরুটি আর এক প্লেট কুলচা-ছোলার বেশি সারা সকাল কিছু খেতে না পেরে ‘অ্যাংরি অ্যান্ড হাংরি’ অবস্থায় দুপুরবেলা রিপোর্ট লিখলেন তিনি।

সরকারি দাবি পরখ করতে সাংবাদিকদের যে ক’টা অস্ত্র রয়েছে, তার মধ্যে একটা অবশ্যই এই অভিজ্ঞতা দিয়ে মিলিয়ে নেওয়ার পদ্ধতি। বন্যায় ত্রাণ সত্যিই গরিব পাচ্ছে কি না, রেশন সত্যিই মিলল কি না, স্কুল-হাসপাতাল খোলা কি না, এ সবই গ্রামে গিয়ে নিজে দেখে, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রকাশ করলে সরকারি কর্তাদের দাবি কতটা ধোপে টেকে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উন্নয়নের নানা ‘jargon’ (‘women’s empowerment’, ‘participatory democracy’, ‘community ownership’) বাস্তবে কতটা অর্থপূর্ণ হচ্ছে, তা-ও এ ভাবে স্পষ্ট করে দেওয়া যায়। কিন্তু দারিদ্রসীমার ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা, কিংবা গরিবের অভিজ্ঞতা দিয়ে সাংবাদিকরা ঠিক কী চ্যালেঞ্জ করতে চাইছেন, তা হয়তো নিজেদের কাছেই তাঁরা স্পষ্ট করেননি। তাঁরা প্রশ্ন করেননি, যে দৈনিক খরচের অঙ্কে পৌঁছলে বেঙ্গালুরুর গৃহস্থালি কর্মীর (যিনি মাসে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করেন) কিংবা ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিকের (যিনি গৃহস্থালি শ্রমিকের অন্তত দশগুণ রোজগার করেন) অভাবের বোধ থাকবে না, সেই অঙ্কটি কেমন হবে? তাকে দারিদ্রসীমা ধরলে ভারতে প্রায় সব মানুষই কি ‘গরিব’ পর্যায়ভুক্ত হবেন না? আর তা হলে দারিদ্রসীমা তৈরি করারই কি কোনও প্রয়োজন থাকবে?

আউটলুক-এর সাংবাদিক নিজের অর্ধদিন অল্পাহারের পর দাবি করেছেন, দৈনিক ২৮ টাকায় দরিদ্রতম (‘poorest of the poor’) মানুষও বাঁচতে পারে না। খিদের কামড়েই হয়তো খেয়াল করেননি, অন্তত ৩৫-৪০ কোটি এমন মানুষ রয়েছেন এ দেশে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় দারিদ্রসীমার কাছাকাছি মানুষরা কত চাল, ডাল, তেল খান, তার হিসেব স্পষ্টই ধরা রয়েছে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেই তথ্য একবার মেলানো হল না কোনও সাংবাদিকের। অথচ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটা অন্য রকম ‘স্টোরি’ সাংবাদিকরা করতে পারতেন। তা হল, বাস্তবিক যাঁরা দারিদ্রসীমার তলায় রয়েছেন তাঁরা কী খেয়ে রয়েছেন, কেমন করে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন, আমোদ-আহ্লাদও করছেন। দারিদ্রসীমা ২০ টাকা নাকি ২৮ টাকা, নাকি আরও বেশি বা কম, সে-প্রশ্নটার গুরুত্বই নষ্ট হত মানবজীবনের এই বিপুল সংকটের সামনে। দারিদ্রসীমা যে গরিবের সম্পর্কে খুব সামান্যই বলতে পারে, সে-কথাটাই বিপাকে ফেলত সরকারের উন্নয়নের নীতিকে। সংখ্যাটা ফালতু, তা বলার দরকার হত না।

পেটের খিদে, মুখের কথায় একটি সংখ্যাকে বাতিল করার মধ্যে পরিণামচিন্তার অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে এক ধরনের ঔদ্ধত্য— অর্থনীতিবিদরা দারিদ্র সম্পর্কে কিছুই বোঝেন না, তাঁদের অঙ্ক ভুল, অভিপ্রায় মন্দ। ‘ক্যালাস’ আর ‘ক্রুয়েল’ শব্দ দুটো নানা মিডিয়া রিপোর্টে ঘুরে-ফিরে এসেছে। ‘ট্র্যাজিক জোক’, ‘ক্রুয়েল জোক’ কথাগুলো বারবার ব্যবহার করা হয়েছে, শেষের কথাটা হেডলাইনেও ব্যবহার হয়েছে (ইন্ডিয়া টুডে, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১১)। সেই সঙ্গে দারিদ্রসীমার সামান্যতা নিয়ে বিক্ষুব্ধ বিস্ময় যোজনা কমিশনের প্রতি, এবং সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের প্রতি আক্রমণের চেহারা নিয়েছে। এ বিষয়ে মিডিয়াকে একরকম নেতৃত্ব দিয়েছেন সাংবাদিক পি সাইনাথ। মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া বিদেশে ভ্রমণের সময়ে দিনে দু’লক্ষ টাকা খরচ করেন, ইউ পি এ সরকারের মন্ত্রীরা নিজেদের সম্পদ বিপুল হারে বাড়াচ্ছেন প্রতি বছর, এই তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর বক্তব্য, যাঁরা নিজেরা বিপুল বিলাসিতায় রয়েছেন তাঁরাই দেশবাসীকে দৈনিক ২৩ টাকায় জীবন চালাতে বলছেন (দি হিন্দু, ২১ মে, ২০১২)। অর্থাৎ মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতির সীমা নেই বলে তাদের প্রস্তাবিত দারিদ্রসীমাও বাতিল করতে হবে। নানা দৈনিক, সাময়িকীর পাতায় সাংবাদিকরা দাবি করলেন যে দরিদ্রের সংখ্যা কম দেখাতে, দরিদ্রের জন্য বরাদ্দ কমাতে যোজনা কমিশন ‘তেণ্ডুলকর পদ্ধতি’ কাজে লাগিয়ে দারিদ্রসীমা তৈরি করেছে। সুরেশ তেণ্ডুলকর মানুষটি কে, কী তাঁর জীবনের কাজ, তা না জেনেই তাঁকে প্রায় ষড়যন্ত্রকারীর পর্যায়ে ফেলা হল।

এদিকে মিডিয়ার নানা রিপোর্টে কিছু ভুল বারবার উঠে এসেছে, যা এতই মৌলিক যে আশ্চর্য না করে পারে না। যেমন, দৈনিক ১.২৫ ডলার খরচের নীচে বাঁচলে গরিব, বিশ্বব্যাঙ্কের এই নিরিখে অনেকেই ৩২ টাকাকে আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমার কম বলেছেন। এমনকী টাইমস ম্যাগাজিন-এও ৩২ টাকাকে ৬৫ সেন্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে (৪ অক্টোবর, ২০১১)। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার সমতার হিসেবে মার্কিন ডলার ভারতে ১৯ টাকা। সে হিসেবে ভারতের দারিদ্রসীমার সব ক’টি প্রস্তাবিত অঙ্কই ছিল আন্তর্জাতিক সীমার উপরে। আবার, ২০১২ সালে যোজনা কমিশন শহরের দারিদ্রসীমা ২৮.৬৫ টাকা ঘোষণা করার পর মিডিয়াতে অনেক হইচই হল যে, ২০১১ সালের হলফনামার ৩২ টাকার চাইতে কমিশন আরও কমিয়ে দিয়েছে দারিদ্রসীমা। অথচ ৩২ টাকার অঙ্ক ছিল ২০১১ সালের বাজার দর অনুসারে, আর ২৮ টাকার অঙ্ক ২০০৯-১০ সালের দর অনুসারে। নানা সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন যে, তেণ্ডুলকর কমিটির পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে দরিদ্রের সংখ্যা কমাতে। বাস্তব ঠিক উলটো, তেণ্ডুলকর কমিটি গ্রামীণ দারিদ্রসীমা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়, এবং যোজনা কমিশন তা মেনেও নেয়। তার ফলে ২০০৯ সালে গরিবের সংখ্যা বাড়ে প্রায় ১২ কোটি।

এমন নানা ভ্রান্তি কেবল যে মিডিয়ার মনোযোগের অভাব নির্দেশ করে, তা নয়। সংখ্যার প্রতি সম্মানের অভাবও নির্দেশ করে, যা এক বৃহত্তর সমস্যার প্রকাশ। বড় মাপের সমীক্ষা এবং তার ফলের উপর অঙ্ক কষে পাওয়া সংখ্যার অর্থ, বা তার প্রয়োজন সম্পর্কে খুব কিছু চিন্তা না করেই তা নিয়ে মন্তব্য করা, এই সবটাই অবৈজ্ঞানিক মন, প্রশিক্ষণহীন চিন্তার ইঙ্গিত দেয়। এম জে আকবরের মতো শ্রদ্ধেয় সাংবাদিকও এর ব্যতিক্রম নন। ২০০৯ সালে কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে তিনি লিখলেন, ইউ পি এ-র সময়ে ভারতে দারিদ্র বেড়ে গিয়েছে ২০ শতাংশ। বাড়তি ৫৫ মিলিয়ন মানুষ চলে গিয়েছেন দারিদ্রসীমার তলায় (দ্য পায়োনিয়র, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০০৯)। এই গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক বুদ্ধদেব ঘোষ কিন্তু জানিয়েছেন, আকবরের এই তথ্যগুলি তাঁদের বক্তব্য নয়। ‘আমাদের রিপোর্টে ২০০৯-১০ সালের তথ্য-পরিসংখ্যান কিছুই ছিল না। দারিদ্র কত শতাংশ বেড়েছে, বা কত বাড়তি লোক গরিব হয়ে গিয়েছে, তা কিছুই বলার মতো সংখ্যা হাতে ছিল না তখন।’

মিডিয়ার এমন নানা মৌলিক ভ্রান্তি নিয়ে তখন বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ কলম ধরেছিলেন। হিন্দুস্থান টাইমস-এ কিরীট পারিখ, টাইমস অব ইন্ডিয়াতে-এ অরবিন্দ পানাগড়িয়া, ইকনমিক টাইমস-এ স্বামীনাথন আয়ার, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ পার্থ মুখোপাধ্যায়, ডেকান হেরাল্ড-এ অলোক রায় প্রমুখ চেষ্টা করেছেন তেণ্ডুলকর পদ্ধতি এবং দারিদ্রসীমার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে। কিন্তু তাঁদের কথা বুঝতে সময়, ধৈর্য লাগে। সাংবাদিকরাই সেই ধৈর্য দেখাননি, সাধারণ পাঠক-দর্শক দেখাবেন তা আশা করা যায় না। বরং ‘২৮ টাকায় পেট ভরে না’ কথাটা চট করে বোঝা যায়। অর্থনীতিবিদরা পালটা অভিযোগ করেছেন, টি ভি অ্যাঙ্কর আর পত্রিকা সাংবাদিকরা কি মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকার বেশি মাইনে দেন বাড়ির কাজের লোক, ড্রাইভারকে? মনে রাখতে হবে ড্রাইভার তার মাইনেতে চার-পাঁচটা পেট চালায়। রিপোর্টারদের ‘কপট ক্ষোভ’ বিষয়টাকেই গুলিয়ে দিল মানুষের কাছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

‘গরিবদের গুলি করুন, বিষ দিন’: দারিদ্রের রাজনীতি

এমনই নাটকীয় ভাষায় সংসদে দারিদ্রসীমার বিরোধিতা করেছিলেন শারদ যাদব। তিনি সংযুক্ত জনতা দলের সদস্য এবং এন ডি এ-র আহ্বায়ক। তেণ্ডুলকর পদ্ধতি অনুসারে যোজনা কমিশন ২০০৯-১০ সালের জন্য শহরে দারিদ্রসীমা ২৮ টাকা বলে নির্দিষ্ট করায় রাজনৈতিক দলগুলি হইচই জুড়ে দেয়। শরদ যাদব বলেন, ‘এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে কেউ এক মত নয়।’ অথচ আশ্চর্য এই যে, এই তথ্যের সঙ্গে এক মত হওয়ার সব চাইতে বেশি কারণ ছিল বিহার আর উত্তরপ্রদেশের। কারণ দরিদ্রের সংখ্যা অনুপাতে রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পায়। যে রাজ্যে বেশি গরিব, সেই রাজ্যে বেশি টাকা পৌঁছয়। যোজনা কমিশনের দারিদ্রসীমা ধরলে শতাংশের হিসেবে রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বাধিক গরিব রয়েছে বিহারে (জনসংখ্যার ৫৩.৫ শতাংশ, ৫.৪৩ কোটি মানুষ) আর সংখ্যার হিসেবে সর্বাধিক গরিব রয়েছে উত্তরপ্রদেশে (৭.৩৭ কোটি মানুষ, জনসংখ্যার ৩৭.৭ শতাংশ)। অতএব যোজনা কমিশনের পরিসংখ্যান মানলে অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি কেন্দ্রীয় অনুদান আসত বিহার এবং উত্তর প্রদেশে। যদি যোজনা কমিশনের নির্দিষ্ট দারিদ্রসীমা না মানা হয়, কিংবা যদি ৮০ টাকা বা ১০০ টাকা দারিদ্রসীমা ধরা হয়, তা হলে কার্যত সব রাজ্যে গরিবের সংখ্যা এক হয়ে যাবে। তখন রাজ্যগুলির মধ্যে সম্পদবণ্টনের কোনও মাপকাঠি থাকবে না, এক মাত্র উপায় হবে সব রাজ্যে সমান অনুপাতে বণ্টন। হিসেব কষলে দেখা যাবে, সব রাজ্যে সমান অনুপাতে মানুষ বি পি এল ধরে কেন্দ্র অনুদান দিলে যোজনা কমিশনের দারিদ্রসীমা অনুসারে বণ্টনের চাইতে উত্তরপ্রদেশ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম পাবে, বিহার পাবে সাত হাজার কোটি টাকা কম। তাই সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, যোজনা কমিশনের দারিদ্রসীমা মানার জন্য জোর সওয়াল করবেন বিহার, উত্তরপ্রদেশের প্রতিনিধিরা। অথচ সংসদে শারদ যাদব বললেন, ‘বাস্তব থেকে দূরে রয়েছেন আলুওয়ালিয়া। তিনি কথা বললেই গণ্ডগোল বেধে যায়। তিনি কখনও একটা ভাল কথা বলেননি… এ ভাবে দারিদ্র দূর করার চাইতে গরিবদের গুলি করে, বিষ দিয়ে মেরে দেওয়া ভাল।’ উত্তরপ্রদেশের সাংসদ, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং বললেন, যোজনা কমিশন দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। বত্রিশ টাকায় জলখাবারও হয় না, মানুষ তাতে বাঁচবে কী করে? তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উন্নয়নের অনুদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে কেন্দ্রের উপর। দরিদ্রের মোট সংখ্যার বিচারে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে পঞ্চম (২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ), কিন্তু সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্রসীমার বিরোধিতা করে বললেন, যোজনা কমিশনকে আবার পুরো বিষয়টা চিন্তা করতে হবে।

কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী কে ভি টমাস কেরলের মানুষ, তেণ্ডুলকরের হিসেবে তাঁর রাজ্যে গরিব জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ। দারিদ্রসীমা উঠে যেতে রাজনৈতিক ফায়দা হল তাঁর। কোথায় কত গরিব তা যে হেতু আর নির্ধারণ করা যাচ্ছে না, তাই সব রাজ্যে এখন দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে স্বল্পমূল্যের শস্য দেওয়া হবে। অর্থাৎ দারিদ্রসীমা থাকলে কেরল যত শস্য পেত, তার অন্তত আড়াই গুণ বেশি পাবে।

সব রাজ্যকে সমান সুবিধে দেওয়া হবে, এ কথাটা শুনলে আপাতদৃষ্টিতে ন্যায্য বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কিছু নেই। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (২০০৯-১০) অনুসারে বিহারের গ্রামবাসীদের প্রায় ৯০ শতাংশ, আর উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, কর্ণাটক এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাসীদের প্রায় ৮০ শতাংশ বাঁচেন দিনে ৩৫ টাকারও কমে। সেখানে হিমাচল, পঞ্জাব, হরিয়ানা, কেরলে (সম্ভবত দিল্লি আর গোয়াতেও) অর্ধেকেরও কম গ্রামবাসী ওই টাকায় দিন চালান, এ সব রাজ্যে অধিকাংশের ব্যয়ক্ষমতা বেশি। এদেরকেও যদি গরিব রাজ্যদের সঙ্গে সমান করে দেখা হয়, তার মানে দাঁড়াবে এই যে, কেরলে যাঁরা দিনে ৩৫ টাকার বেশি খরচ করতে পারেন এমন অনেক মানুষও সস্তায় চাল-গম পাবেন। আর বিহার-উত্তরপ্রদেশে বহু মানুষ যাঁদের ৩৫ টাকাও খরচের সাধ্য নেই তাঁরা ভর্তুকির চাল-গম পাবেন না। গরিব মানুষটি কেরলে না জন্মে উত্তরপ্রদেশে জন্মেছেন বলে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হলেন, এটা কেমন ন্যায়?

দারিদ্রসীমা যত নীচে নামানো হবে, তত বেশি সহায়তা পাবে গরিব-প্রধান রাজ্যগুলো। যত তা উপরে ওঠানো হবে, দারিদ্রসীমা রাখা হবে ৫০, ৮০ বা ১০০ টাকায়, তত বেশি সুবিধে পাবে তুলনায় ধনী রাজ্যগুলো। দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনা করে যাঁরা গরিবের জন্য দরদ দেখিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য এমন এক নীতির সূচনা হয়েছে যাতে এখন মার খাচ্ছে গরিবই।

নীরবতার শব্দ

ভারতে রাজনৈতিক নেতারা অর্থনীতি বোঝেন না, এমন নয়। দারিদ্রসীমা থেকে খাদ্য নিরাপত্তার প্রকল্পকে বিযুক্ত করে দিলে তার ফল কী হবে, তা-ও তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন। একশো দিনের কাজের পর ইউ পি এ সরকারের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনা খাদ্য নিরাপত্তা আইন। অথচ তার যথাযথ রূপায়ণ করার তাগিদে, কিংবা যোজনা কমিশনের মর্যাদা (বা সুরেশ তেণ্ডুলকরের মর্যাদা) রক্ষার তাগিদে, এমনকী বিরোধীদের আক্রমণ ঠেকাতেও মুখ খুললেন না প্রধান নেতারা। তাই এই বৎসর-ব্যাপী বিতর্কের দিকে তাকিয়ে ‘কী হল, কেন হল’ বোঝার চেষ্টা করলে মনে পড়ে যায় গল্পের গোয়েন্দা শার্লক হোমসের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘কিন্তু কুকুরটা ডাকল না কেন?’ কোথায় ভুল হচ্ছে, কী ভুল হচ্ছে, তা বুঝেও চুপ করে থাকলেন মনমোহন সিংহ, প্রণব মুখোপাধ্যায় কিংবা পি চিদাম্বরমের মতো প্রথম সারির নেতারা। দারিদ্রসীমার প্রয়োজন নিয়ে তাঁরা মিডিয়ার সামনে বিবৃতি দিলে আলোচনার ধারা-প্রকৃতির উপর একটা প্রভাব পড়তে পারত। তাঁদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে মিডিয়া বাধ্য থাকায় দারিদ্রসীমার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কথাগুলো জনসমাজের নজর এড়িয়ে যেতে পারত না।

কেন তাঁরা মুখ খোলেননি, তা আন্দাজ করা অবশ্য কঠিন নয়। ২০১১ ছিল একের পর এক ‘স্ক্যাম’ ফাঁস হওয়ার বছর। টু-জি কাণ্ডে ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার হলেন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা, এপ্রিলে কমনওয়েলথ গেমসে দুর্নীতির দায়ে সুরেশ কালমাডি। এপ্রিলের গোড়ায় অণ্ণা হজারে তাঁর দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন দিল্লিতে, অপ্রত্যাশিত সাড়া জাগাল তাঁর অনশন। দুর্নীতিগ্রস্ত, দরিদ্রের শত্রু বলে সরকারের গায়ে যে দাগ লাগল, ‘গরিব-বিরোধী’ দারিদ্রসীমাকে সমর্থন করে সেই দাগকে আরও গাঢ় করার ঝুঁকি কোনও নেতা নিতে চাইবেন না, সেটাই প্রত্যাশিত। পঞ্চায়েত মন্ত্রী জয়রাম রমেশ কেবল একবার সাংবাদিক বৈঠক করলেন মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়ার সঙ্গে, বললেন রাজ্যগুলো কেন্দ্রের থেকে বেশি করে টাকা আদায় করতে দারিদ্র বেশি দেখাতে চায়। এ নেহাত চাপান-উতোরের কথা, এবং পুরো সত্যি নয়। বেশি টাকাই বিরোধিতার মূল কারণ হলে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ দারিদ্রসীমাকে সমর্থন করত।

তা তারা করেনি, কারণ রাজনৈতিক বিরোধিতা দারিদ্রসীমা বিরোধিতার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, চারটি রাজ্যই রয়েছে বিরোধী জোট এন ডি এ-র শাসনে। ওড়িশায় বিজুর জনতা দল আগে এন ডি এ-র শরিক ছিল, এখন তৃতীয় ফ্রন্টে। উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে সুবিধেমতো হাত মিলিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে কংগ্রেসকে অপদস্থ করে চাপ সৃষ্টি করেছেন। মিডিয়া এবং নাগরিক আন্দোলনের নেতারা যেখানে যোজনা কমিশন এবং সরকারকে শূলে চড়িয়েই রেখেছে, সেখানে সরকারকে সমর্থন করে তাঁরা নিজেদের ঝুঁকি টেনে আনবেন, তার কোনও সম্ভাবনা ছিল কি? বরং একজন দারিদ্রসীমার বিরুদ্ধে সুর চড়ালে অন্যদের আরও সুর চড়ানোই নিরাপদ বলে মনে হওয়া ছিল স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের তত্ত্ব বলে, ভোটদাতার স্বার্থরক্ষাই নেতাদের কাজ। এখানে রাজনীতি ঘুরে গেল উলটো দিকে— গরিব রাজ্যের জনপ্রতিনিধিরা নিজের রাজ্যের অধিকাংশ ভোটদাতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। দারিদ্রসীমার বিরোধিতা করে দরিদ্রের উন্নয়নের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি পাওয়ার সম্ভাবনাকে কার্যত বাতিল করে দিলেন।

গত এক বছরে ভারতের জনসমাজের ডিসকোর্স থেকে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট হয়। অণ্ণা হজারে তাঁর দীর্ঘ আন্দোলনে মহারাষ্ট্রে দুর্নীতি কত কমাতে পেরেছেন, তা প্রায় কেউ জানত না। দুর্নীতি কমানোর যে-দাওয়াই তিনি দিয়েছেন, সেই লোকপাল-এর ঝুঁকি কী, সুবিধে কী, তা নিয়েও মিডিয়া বা জনসমাজে খুব বেশি কিছু আলোচনা হয়নি। তবু তিনিই যে দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের নেতা হয়ে উঠলেন, সে তাঁর সন্ত-সদৃশ জীবনযাত্রার দৌলতে। বহু মানুষের চোখে সততার ‘প্রতীক’ তিনি, তাঁর ইমেজ একটা সময়ে প্রায় সব জননেতাকে অতিক্রম করে গেল। সেই জন্যই তাঁর প্রস্তাবিত ‘লোকপাল বিল’ জনসমাজে মান্যতা পেল। তার ঠিক বিপরীত প্রান্তে রয়েছেন মন্টেক সিংহ আলুওয়ালিয়া। তাঁর জীবনযাত্রায় দারিদ্রের কোনও ছাপ নেই, গরিবের সঙ্গে রুটি ভাগ করে খেতে দেখা যায়নি তাঁকে, আগাগোড়া মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করায় তিনি বামপন্থীদের চক্ষুশূল, ‘গণশত্রু’ বলে এক রকম চিহ্নিতই হয়ে ছিলেন বহুদিন। গরিবের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তিনি গ্রহণযোগ্য নন বলেই তাঁর পেশ করা দারিদ্রসীমা গ্রহণযোগ্য হল না। তিনি যে দারিদ্রসীমার যুক্তি-তর্ক খুব প্রাঞ্জলভাবে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এমন নয়। বরং তাঁর নানা মন্তব্য, যেমন, ‘যে ভাবেই বিচার করো, দারিদ্র কমেছে’ বিরোধীদের আরও চটিয়ে দিয়েছে। তিনি আগাগোড়াই প্রতিপক্ষকে ‘ডিসমিস’ করে দিয়েছেন, বোঝাপড়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু চেষ্টা করলেও ফল হত কি? মন্টেক খারিজ হয়েই ছিলেন, তাই দারিদ্রসীমা খারিজ হল।

এটা ভারতের জনসমাজে ডিসকোর্সের সমস্যা, নীতি তৈরিরও সমস্যা। ঠিক নীতি কী, তা বিচার করতে গেলে ‘কী বলা হচ্ছে’ তা না দেখে ‘কে বলছে’ সেটা বড় হয়ে ওঠে। বক্তার অবস্থানের চাইতে তার অভিব্যক্তি গুরুত্ব পায় বেশি। নীতি বা প্রকল্পের দ্বারা প্রার্থিত ফল কতটা হবে, কেমন করে হবে, সে-বিচারের চাইতে নীতি বা প্রকল্পের উদ্দেশ্যের মহানুভবতা যেন আরও বড় বিচার্য। যে জনস্বার্থ মামলার সূত্রে দারিদ্রনীতি নিয়ে এত বিতর্ক হল, সেই খাদ্য নিরাপত্তার দিকে তাকালেও তা স্পষ্ট হয়ে যায়। গরিব যথেষ্ট পুষ্টি পায় না, তাই তার হাতে প্রতি সপ্তাহে খাদ্যশস্যই তুলে দিতে হবে। পুষ্টির ব্যবস্থা হয়তো আরও সহজে, কম খরচে, দ্রুত করা যেত যদি রাজ্যগুলো তাদের সুবিধে অনুসারে গরিবদের ফুড স্ট্যাম্প দিত, বা টাকা দিত, কিংবা রেশন ব্যবস্থাই চালু রাখত। কিন্তু এমন কেজো সমাধানে কেউ খুশি হয় না। রাশি রাশি চাল-গমই তুলে দেওয়া চাই গরিবের ঝুলিতে, কারণ সরকারের সদিচ্ছার সেরা অভিব্যক্তি হবে সেটাই। যা শুনতে ভাল, যা দেখতে ভাল, যা বলতে ভাল, সেটাই ভাল নীতি। মুশকিল হল, জনসমাজের ডিসকোর্সের এই রীতিতে আর যারই ভাল হোক, গরিবের হয় না। গরিবকে মর্যাদা দিতে হলে তার পছন্দ-অপছন্দ, আশঙ্কা-উচ্চাশা সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য-পরিসংখ্যানকে মর্যাদা দেওয়া চাই। দারিদ্র কমানোর প্রকল্পের কার্যকারিতা বিষয়ে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানকে মর্যাদা দেওয়া চাই। ভাল সংখ্যা না হলে ভাল নীতি তৈরি করা অসম্ভব।

এই উপলব্ধি বিশেষজ্ঞদের একটা ছোট বৃ্ত্তে রয়ে গিয়েছে, জনসমাজের বৃহত্তর পরিধিতে এখনও ছড়িয়ে যায়নি। আমাদের জনসমাজের ডিসকোর্স বৃহৎ সমীক্ষালব্ধ, জটিল বিচারলব্ধ সংখ্যাকেও সম্পদ মনে করে না। বরং তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে তাকে সন্দেহ করে, তাচ্ছিল্য করে। চিন্তার এই দারিদ্রেই নোঙর গেঁথেছে ভারতের দারিদ্র।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য, বারোমাস, ২০১২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *