৯০. ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক!

অধ্যায় ৯০

ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক!

শব্দগুলো বাবলুর কানে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। একজন পেশাদার খুনি হিসেবে এ জীবনে অসংখ্যবার গুলি করেছে। ভালো করেই জানে যে গুলি করে আর যে গুলিবিদ্ধ হয় তাদের কেউই পিস্তলের ক্লিক শব্দটা শোনে না। শোনে কানফাটা একটি শব্দ।

কিন্তু ব্ল্যাক রঞ্জুর পিস্তলটায় সাইলেন্সর লাগানো। একটা থুতু ফেলার মতো শব্দ হবে। এর বেশি না। ল্যাপটপের পদ থেকে চোখটা সরিয়ে নিলো সে।

ব্ল্যাক রঞ্জু উদভ্রান্তের মতো পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত আগেও তার মুখে যে কুৎসিত হাসিটা লেগে ছিলো সেখানে এখন অবিশ্বাস আর পরাজয়ের আভাস।

রঞ্জুর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো তার। পঙ্গু লোকটার চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে যেনো।

বাবলুর বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না কি ঘটেছে। রঞ্জুর হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে নিলো সে। ছাদের দিকে তাক করে আরো দু’বার ট্রিগার চাপলো।

ক্লিক! ক্লিক!

তার মুখে ফুটে উঠলো হাসি। পিস্তলটার গুলি ফুরিয়ে গেছে।

এই পিস্তলটা সে নিয়েছে রঙুর লোকজনের কাছ থেকে। ভেতরে কয়টা গুলি ছিলো সে জানতো না। পিস্তলটা হাতে পাবার পর কয়টা গুলি খরচ করেছে সেটারও হিসেব রাখে নি। এখন বুঝতে পারছে পিস্তলে যে কয়টা গুলি ছিলো সব শেষ হয়ে গেছে। আর এই ঘটনাটাই বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে।

পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো বাবলু। রঞ্জুর কলার ধরে টেনে হুইলচেয়ারের উপর বসালো তাকে। চেয়ারটা ঠেলে নিয়ে এলো ল্যাপটপের সামনে।

ল্যাপটপের পর্দায় দেখতে পেলো জেফরি বেগ আর উমা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। তারা এখন কুখ্যাত ব্ল্যাক রঞ্জুকে দেখতে পাচ্ছে ওয়েবক্যামে।

বাবলু টেবিলের উপর তাকালো। ল্যাপটপের কাছেই একটা ম্যাচবক্স আর এক প্যাকেট সিগারেট রাখা ম্যাচবক্সটা তুলে নিলো সে।

ভয়ার্ত চোখে তার দিকে চেয়ে রইলো রঞ্জু। তার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। বলার মতো কিছু নেইও। এই খেলাটায় সে হেরে গেছে। ভালো করেই জানে, জীবনের শেষ মুহূর্তে চলে এসেছে।

বাবলু চলে গেলো বড় বড় ফ্রেঞ্চ জানালাগুলোর সামনে। একটা জানালার পদা বাদে একে একে সবগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। যে পদটা অক্ষত আছে সেটা হাতে পেচিয়ে জোরে একটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেললো।

রঞ্জুর চোখেমুখে মৃত্যু আতঙ্ক।

বাবলু চলে এলো হুইলচেয়ারের সামনে। ল্যাপটপের দিকে চকিতে তাকালো সে। যা ভেবেছিলো তাই। চ্যাটবক্সে ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগের লেখাটা দেখতে পেলো : ডু নট কিল রঞ্জু। প্লিজ!

মুচকি হাসলো সে। ভিডিওতে দেখতে পাচ্ছে জেফরি বেগ আর উমা চেয়ে আছে তার দিকে। আস্তে করে তর্জনি তুলে না-সূচক ভঙ্গি করলো।

রঞ্জুর গায়ে জানালার পর্দাটা জড়িয়ে দিলো বাবলু। ভয়ার্ত আর কোণঠাসা সন্ত্রাসী জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে এখন। মৃত্যু আতঙ্কে তার কণ্ঠরোধ হয়ে গেছে।

পদটা ভালো করে রঙুর গায়ে পেচিয়ে হুইলচেয়ারের পেছনে চলে এলো সে।

পেছন ফিরে তাকাতে গিয়েও তাকালো না রঞ্জু। তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে গেছে। টের পেলো সারা শরীর কাঁপছে।

ফোঁস করে একটা শব্দ হলো পেছন থেকে। তারপরই পঙ্গু লোকটা টের পেলো আগুনের উত্তাপ।

“না!” গগনবিদারি চিৎকার দিলো ব্ল্যাক রঞ্জু।

.

ল্যাপটপের কাছ থেকে সরে গেলো উমা। এরকম দৃশ্য দেখার নার্ভ তার নেই। জেফরি বেগ স্থিরচোখে চেয়ে আছে ল্যাপটপের দিকে। জামান এসে দাঁড়ালো তার পাশে।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে হুইলচেয়ারে বসা রঞ্জু। তার গায়ে আগুন ধরে গেছে। দু’হাতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে সে। মুহূর্তে পুরো হুইলচেয়ারটা পরিণত হলো জ্বলন্ত চিতায়। আর সেই চিতায় জীবন্ত দগ্ধ হচ্ছে ব্ল্যাক রঞ্জু।

জেফরি বেগ আর দেখলো না। মুখটা সরিয়ে নিলো। জামানের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো তার। ছেলেটা কিছু বললো না। বলার কিছু নেইও।

জেফরি আবারো ল্যাপটপের দিকে তাকালো। আগুন ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলো না। জ্বলন্ত হুইলচেয়ারটা এখন উল্টে পড়ে আছে। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে আগুন।

.

মাদার তেরেসা স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুটা পথ হেঁটে পেছনে ফিরে তাকালো বাবলু।

আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাড়িতে। দাউ দাউ করে জ্বলছে সেই আগুন। একটা হোস করে শব্দও শুনতে পেলো, তারপরই আগুনের লেলিহান শিখা উঠে গেলো আরো উপরে।

বুঝতে পারলো বাড়িতে মজুদ করে রাখা কেরোসিনের ড্রামগুলো একসাথে জ্বলে উঠেছে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো রঞ্জুর আর্তনাদ শোনা যায় কিনা। বাড়ি থেকে বের হবার সময় জ্বলন্ত দগ্ধ রঞ্জুর আর্তনাদটা এখনও তার কানে লেগে আছে। যেননা সেটাই আবার শুনতে পেলো।

বাবলু জানে পানি আর আগুনের মৃত্যু সবচাইতে ভয়ঙ্কর। এরকম ভয়ঙ্কর মৃত্যুই রঞ্জুর প্রাপ্য ছিলো।

আবার হাঁটতে শুরু করলো সে। আশেপাশে লোকজনের হৈহল্লার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এখন। দ্রুত এখান থেকে সরে পড়তে হবে। কারোলবাগে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। চলে যেতে হবে বহু দূরে।

না, মনে মনে বললো সে। খুব কাছে।

একটি অপহরণের ব্যবচ্ছেদ

বৃহস্পতিবার বিকেলে সেন্ট অগাস্টিনের বাস্কেটবল কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিলন। গভীর মনোযোগের সাথে কিছু ছাত্রের প্র্যাকটিস দেখেছে সে।

ছয়-সাতজন ছেলে বল নিয়ে কোর্টে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। আড়চোখে বার বার তাকাচ্ছে মিলনের দিকে। মিলন ব্যাপারটা আমলে না নিয়ে একমনে দেখে যাচ্ছে তাদের খেলা। ছেলেগুলো স্বভাবতই অবাক। তাদের স্কুলে যে কেউ যখন তখন ঢুকতে পারে না। এই বহিরাগত লোকটি কে?

মিলন আরো দেখতে পেলো খেলার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের মধ্যে চাপাকণ্ঠে কথা বলছে তারা। মনে মনে মুচকি হাসলো সে।

সে এখন অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ। খেলার প্রতিই তার সব মনোযোগ।

কোর্টে যেসব ছেলেরা প্র্যাকটিস করছে তাদের মধ্যে লম্বামতোন একটা ছেলে দারুণ খেলে, কিন্তু এই ছেলেটার প্রতি মিলনের কোনো আগ্রহ নেই। তার আগ্রহ তুর্য নামের একটি ছেলের দিকে। বাস্কেটবল খেলাটা মোটামুটি খেলে সে কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না। এই ছেলেটাকেই তাদের দরকার।

কিছুক্ষণ আগে ছেলেগুলে মধ্য থেকে একজন এসে তার কাছে জানতে চেয়েছিলো সে কে। অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ শুনে ছেলেটা অবাক হয়েছিলো। বন্ধুদের কাছে ফিরে গিয়ে কথাটা জানাতেই সবার আচরণ বদলে যায়। খেলার প্রতি সিরিয়াস হয়ে ওঠে। কে কার চাইতে সেরা সেটা প্রদর্শন করার প্রতিযোগীতায় মেতে ওঠে তারা।

একটা সময় তুর্য তার কাছে চলে এলে হাত নেড়ে ছেলেটাকে কাছে ডাকলো। একটু কথা বলার সময় হবে কি?

তুর্য একটু অবাক হলেও কাঁধ তুলে জানালো, ঠিক আছে। নো প্রবলেম। মিলন নিজেকে অ্যাঞ্জেলসলাস টিমের কোচ পরিচয় দিয়ে বললো তুর্যের খেলা দেখে তার খুব ভালো লেগেছে। কথাটা শুনে তুর্য যেমন অবাক হলো তেমনি গর্বে ফুলে উঠলো তার বুক।

পর পর দু’বার ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন অ্যাঞ্জেলস টিমে হুট করেই কিছু প্লেয়ারের দরকার হয়ে পড়েছে। একেবারে জরুরি ভিত্তিতে দুএকজন প্লেয়ার না নিলেই নয়। তো, তুর্যের খেলা দেখে তার মনে হচ্ছে তাকে দলে নেয়া যেতে পারে।

আপনি শিওর? অবাক হয়ে জানতে চাইলো তুর্য।

অবশ্যই। কেন নয়। বাস্কেটবলটা তো সে ভালোই খেলে। যদিও স্কুলের সবাই ঐ লম্বু নাফিকেই সেরা মনে করে তবে তার খেলার ধরণটা কি নাফির চেয়ে একটু আলাদা নয়?

সবাই তো আর স্কোরার না। সে একটু পেছনে খেলে, আড়ালেই থাকে, তাই বলে তার পজিশনে কি তার চেয়ে ভালো কেউ আছে এই স্কুলে?

ওকে, নো প্রবলেম। অ্যাঞ্জেলসল্‌স টিম তো তুর্যের ফেবারিটই। ওখানে খেলতে পারলে তার ভালোই লাগবে।

ব্যাপারটা খুব জরুরি। শুধু মুখে বললে তো হবে না, কাগজেকলমে সাইন করতে হবে। আজই অ্যাঞ্জেলস টিম কনফার্ম হতে চায়।

কথাটা শুনে তুর্যের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অ্যাঞ্জেলস টিম তাকে আজই সাইন করাবে!

ব্যাপারটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য লাগলো তার কাছে। মনে মনে ভাবলো কথাটা শুনে তার বন্ধুরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে-বিশেষ করে নাফি হাজ্জাদ নামের বজ্জাতটা?

তুর্য খুশিমনে রাজি হয়ে গেলো। মিলন তার কাঁধে হাত রেখে বললো, গার্জিয়ানদের রাজি করানোর দায়িত্ব তুর্যের। সে যদি তার বাবা-মাকে রাজি করাতে পারে তাহলে আগামী সপ্তাহেই একটা ম্যাচে তাকে নামানো হবে।

বাবা-মা? ওটা কোনো সমস্যাই না। অ্যাঞ্জেলস টিমে চান্স পাবার কথা শুনে তার ক্ষমতাধর মিনিস্টার বাবা বরং খুশিই হবে। মাকে নিয়ে তার তেমন একটা টেনশন নেই। ওকে, ডান।

মিলন খুব খুশি হলো। আড়চোখে চেয়ে দেখলো বাস্কেটবল কোর্টে যেসব ছেলে প্র্যাকটিস করছে তারা অবাক হয়ে চেয়ে আছে তাদের দিকে। মনে মনে হাসলো মিলন। নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান ভাবো, বাবারা।

আচ্ছা। তাহলে তো খুব ভালো হয়। সাইন করাতে আর কোনো বাধাই রইলো না। কিন্তু ফাইনাল কথা বলতে পারবে অ্যাঞ্জেলসের কর্মকর্তা। সে একজন কোচ। প্লেয়ার সিলেক্ট করা তার কাজ হলেও সাইন করার দায়িত্ব কর্মকর্তাদের।

তো এরকম একজন কর্মকতা স্কুলে এসেছে তার সাথে। উনি বসে আছেন গাড়িতে। তার সাথে কথা বললেই সব ফাইনাল হয়ে যাবে।

নো প্রবলেম, কাঁধ তুলে বললো তুর্য।

মিলনের সাথে চলে গেলো স্কুলের পার্কিংলটে। সেখানে একটা প্রাইভেটকারের সামনে এসে তর্যের কাঁধে হাত রেখে মিলন বললো গাড়িতে বসে থাকা ভদ্রলোক হলেন তাদের ক্লাবের কর্মকর্তা। তুর্য যেনো তার সাথে কথা বলে নেয়। গাড়ির দরজা খুলে তুর্যকে ভেতরে আসতে বললো চাপদাড়ি। তুর্য কোনো কিছু না ভেবে ঢুকে পড়লো গাড়িতে।

মিলন দরজাটা বন্ধ করে আশেপাশে তাকালো। সে জানে চাপদাড়ি এখন কি করবে। ঠিক তখনই ঘটলো বিপত্তি।

দূর থেকে মিলনকে কেউ ডাকছে। সে চেয়ে দেখলো পার্কিংলটের পাশে একটা বিল্ডিংয়ের দোতলার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারই পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হাসান সাহেব। জেল থেকে বের হয়ে পলিকে বিয়ে করার পর মাত্র দু’মাস আগে আরামবাগের একটি বাড়ি ভাড়া নেয়। তার ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে এই হাসান নামের লোকটি। তাদের মধ্যে অল্পবিস্তর পরিচয় আছে। দুএকবার বাড়ির ছাদে সিগারেট খেতে খেতে কথাও হয়েছে। কিন্তু এই লোক যে সেন্ট অগাস্টিনে চাকরি করে সেটা মিলন ঘুণাক্ষরেও জানতো না। পরিচয়ের এক পর্যায়ে শুধু বলেছিলো একটা স্কুলে চাকরি করে। মিলন ধরে নিয়েছিলো শিক্ষক হবে হয়তো।

এখন হাসান নামের লোকটি জানালা দিয়ে বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। মিলন বুঝতে পারলো না হাসান তুর্যকে দেখেছে কিনা।

হাসানের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো মিলন, মুখে ফুটিয়ে তুললো কৃত্রিম হাসি। যেনো প্রতিবেশিকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে।

হাসান হাত তুলে কিছু একটা ইশারা করেই জানালা থেকে সরে গেলো। মিলন বুঝতে পারলো লোকটা নীচে নেমে আসছে। দরজাটা একটু ফাঁক করে গাড়ির ভেতরে উঁকি দিলো সে। তুর্য অজ্ঞান হয়ে সিটের উপর পড়ে আছে। নিখুঁত দক্ষতায় চাপদাড়ি ক্লোরোফর্মে ভেজানো রুমাল ব্যবহার করে ছেলেটাকে অজ্ঞান করে ফেলেছে ধারণার চেয়ে দ্রুত সময়ে।

চাপদাড়ি তাকে গাড়িতে উঠে আসার জন্য বললে মিলন সংক্ষেপে জানালো ঘটনাটা। পেছনে ফিরে তাকালো হাসান আসছে কিনা। দ্রুত মাথা খাটাতে লাগলো সে। যে কাজটা করতে যাচ্ছে সেখানে কোনো ঝুঁকি নেয়া যাবে না।

চাপদাড়ি তাকে ইশারায় জানিয়ে দেয় কি করতে হবে। মিলন গাড়ির দরজা বন্ধ করে ঘুরে দেখে হাসান সাহেব তার কাছে এগিয়ে আসছে। স্কুলে মিলনকে দেখে লোকটা যারপরনাই অবাক হয়েছে।

গাড়ি থেকে একটু সরে দাঁড়ালো মিলন, যদিও গাড়িটার গাঢ় কালচে কাঁচ দিয়ে ভেতরের দৃশ্য দেখা সম্ভব নয়।

“আপনি এখানে?” হাসান কাছে এসে জানতে চাইলো।

“ইয়ে মানে…” কী বলবে বুঝতে পারলো না মিলন। কোনোমতে বললো, “একটা কাজে এসেছি।”

“আমাদের স্কুলে?” মিলনকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললো, “তুর্যকে দেখলাম আপনার সাথে…ওর সাথে কি কাজ?”

“ও,” মিলন বুঝতে পারলো সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। তুর্যকে তার সাথে দেখে ফেলেছে এই লোক। “বাস্কেটবল প্লেয়ার হান্ট করতে এসেছি…” অন্য কোনো মিথ্যে বলার সময় পেলো না, আজকের ছদ্মপরিচয়টার কথাই মনে পড়লো শুধু।

“বাস্কেটবল প্লেয়ার হান্ট মানে?”

বিস্মিত হাসানের প্রশ্নে দাঁত বের করে হাসলো মিলন। “আমার এক বন্ধু অ্যাঞ্জেলস টিমের কর্মকতা…ওর সাথে এসেছি।”

“আপনি কি বাস্কেবল টিমের সাথে জড়িত নাকি?” জানতে চাইলো অগাস্টিনের জুনিয়র ক্লার্ক হাসান।

“না, মানে…আছি আর কি…” মিলন বুঝতে পারলো সে ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারছে না। পকেট থেকে সিগারেট বের করে হাসানের দিকে বাড়িয়ে দিলো সে।

হাসান আশেপাশে তাকিয়ে মাথা দোলালো। “আরে না। এখানে সিগারেট খাওয়া যায় না। নো স্মোকিং জোন।”

“ও,” মিলন জানে তাকে কি করতে হবে এখন কিন্তু কিভাবে করবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না। “ট-টয়লেটটা কোথায়…হাসান সাহেব?” টয়লেটের কথাটা তার মুখ ফসকে বের হয়ে গেলো। কেন বের হলো সে নিজেও জানে না।

“ঐ তো, ঐ বিল্ডিংটায়,” পার্কিংলটের ডান দিকে স্কুলের মূল ভবনের দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বললো হাসান। “নীচতলায়, সিঁড়ির পাশে।”

মিলন চেয়ে দেখলো আশেপাশে কোনো লোকজন নেই। কেউ তাদেরকে দেখছে না।

“আপনি কি টয়লেটে গিয়ে স্মোক করতে চাচ্ছেন?” হাসান জানতে চাইলো।

“না, ইয়ে…মানে—”

“অসুবিধা নেই। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। এখন টয়লেটের ওখানে গিয়ে স্মোক করা যাবে। কেউ দেখবে না।”

হাসানের কথাটা শুনে লুফে নিলো মিলন। “তাহলে চলেন। খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। মাথাটা টন টন করছে, বুঝলেন।”

মিলনকে টয়লেটের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো হাসান, “আসলে আমার রুমেই আপনাকে নিয়ে যেতাম কিন্তু ওখানে আমার বস বসে।”

“ও,” বললো মিলন। “সমস্যা নেই, টয়লেটই ঠিক আছে। আমার খুব প্রস্রাব চেপেছে। ভালোই হলো…টয়লেটও করা যাবে সিগারেটও খাওয়া যাবে।”

 “আপনি না বলেছিলেন ফিল্মে কাজ করেন?” মিলনকে নিয়ে স্কুলের মূল ভবনে ঢুকে পড়লো হাসান।

“হ্যাঁ। সেজন্যে প্রায়ই বাড়ির বাইরে থাকতে হয়।”

তারা এসে পড়লো টয়লেটের দরজার সামনে। থমকে দাঁড়ালো হাসান। “এখানেই সিগারেট খাওয়া যাবে…ভেতরে ঢোকার দরকার নেই। আপনি টয়লেট করতে চাইলে সেরে আসুন।”

মিলন একটু ভেবে নিলো। “ঠিক আছে।” বলেই একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলো হাসানের দিকে।

“না। আমি খাবো না। আপনি ধরান, হাসান বললো।

সিগারেটটা ধরালো মিলন। চকিতে চারপাশটা দেখে নিলো। একদম নিরাপদ একটি জায়গা। বাইরে থেকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না তাদেরকে। কাজটা খুব দ্রুত করতে হবে।

“তাহলে আপনি একটু দাঁড়ান, আমি টয়লেট সেরে আসি,” বললো সে।

মাথা নেড়ে সায় দিলো হাসান। টয়লেটের ভেতরে চলে গেলো মিলন।

একটু পরই টয়লেটের ভেতর থেকে মিলনের কণ্ঠটা বলে উঠলো : “হাসান সাহেব?”

টয়লেটের ভেতরে ঢুকে পড়লো হাসান। দেখলো একটা কিউবিকলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিলন।

“কি হয়েছে?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো সে।

“এটার ভেতরে একটা জিনিস…” দরজাটা দেখিয়ে বললো সে।

“কি জিনিস?” কথাটা বলেই হাসান এগিয়ে গেলো দেখার জন্য।

মিলনকে পাশ কাটিয়ে দরজার হাতলে যে-ই না হাত রাখবে অমনি পেছন থেকে তার মাথার চুল একহাতে খপ করে ধরে ফেললো মিলন। চট করে অন্য হাতে থুতনিটা ধরেই এক ঝটকায় ঘাড় মটকে দিলো।

পুরো ব্যাপারটা ঘটলো মুহূর্তে। প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায়, নিখুঁত দক্ষতায় কাজটা করলো মিলন। ডান আর বাম হাতের বিপরীতমুখী বলপ্রয়োগের ফলে ঘাড়টা ভেঙে দিয়েছে সে।

কোনো রকম শব্দ না করেই ঢলে পড়লো সেন্ট অগাস্টিনের জুনিয়র ক্লার্ক হাসান।

মিলন তাকে পেছন থেকে ধরে ফেললো। নিথর দেহটা রেখে দিলো সেই কিউবিকলের ভেতর। তারপর চারপাশে তাকিয়ে দেখলো। না। কেউ নেই। দ্রুত বের হয়ে গেলো টয়লেট থেকে। পার্কিংলটে তাদের গাড়িটার কাছে এসে আরেকবার আশেপাশে তাকালো। পুরো স্কুল ফাঁকা। শুধু বাস্কেবল কোর্টে কিছু ছেলে এখনও দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।

গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে ঢুকে পড়লো সে।

“শেষ?” পেছনের সিট থেকে চাপদাড়ি বললো তাকে। তার পাশেই অচেতন হয়ে পড়ে আছে হোমমিনিস্টারের ছেলে তুর্য।

মাথা নেড়ে সায় দিলো মিলন। হাসানকে মারার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো, কিন্তু কিছু করার নেই। তাদের পরিকল্পনায় কোনো রকম ঝুঁকি নেয়া যাবে না। এটা বাস্তবায়ন করার জন্য যা যা করার দরকার সবই তারা করবে।

গাড়িটা কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই স্কুল থেকে বেরিয়ে গেলো।

বাস্কেটবল কোর্টে তুর্যের সহপাঠীরা যদি জানতো তুর্যের এমন পরিণতি তাহলে তারা তাকে মোটেও ঈর্ষা করতো না।

উপসংহার

তুর্যকে উদ্ধার করার পরদিন সন্ধ্যার পর একটা বিশেষ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া সারাটা বিকেল রেবার সাথে কাটিয়ে দিলো জেফরি বেগ। মেয়েটা যে ট্রমার মধ্যে পড়ে গেছিলো সেটা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে এখন। তবে মিনিস্টারের ছেলেকে উদ্ধার করার অভিযানের কথা কিছুই জানে না।

তুর্যের অপহরণ ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেলেও মিডিয়া জানতে পারে নি কিভাবে ব্ল্যাক রঞ্জু হোমমিনিস্টারের ছেলেকে কিডন্যাপ করে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। একদল লোক হোমমিনিস্টারের ছেলেকে অপহরণ করার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছিলো, কিন্তু হোমিসাইডের ইভেস্টিগেটর জেফরি বেগের

বুদ্ধির কল্যাণে ছেলেটা উদ্ধার পায়-মিডিয়াসহ বাকিরা এই গল্পটাই জানে।

লঞ্চ থেকে ব্ল্যাক রঞ্জুর একজন ঘনিষ্ঠ লোক এরফানকে জীবিত গ্রেফতার করা হয়েছে। অজ্ঞাত পরিচয়ের যে মেয়েটাকে এরফানের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলো জেফরি সে আর কেউ নয়, হোমমিনিস্টারের পিএস আলী আহমেদের বড়মেয়ে আনিকা।

ব্ল্যাক রঞ্জু দারুণ একটি কৌশল খাঁটিয়েছিলো। হোমমিনিস্টারের ছেলেকে কিডন্যাপ করার পাশাপাশি তার ঘনিষ্ঠ সহচর আলী আহমেদের মেয়েকেও জিম্মি করে। উদ্দেশ্য মিনিস্টারকে তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য করা। সত্যি বলতে কি, রঞ্জুর এই কৌশল ভালোই কাজে দিয়েছিলো। ভদ্রলোক মেয়ের জীবনের কথা ভেবে রঞ্জুর হয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়। অবতীর্ণ হয় রঞ্জুর এজেন্ট হিসেবে।

জেল থেকে মুক্ত হয়েও শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেবার জেদের কারণে ব্ল্যাক রঞ্জুকে নির্মম ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। সে যদি বাবলুর পেছনে না লাগতো, দিল্লিতে গিয়ে নিজের হাতে তাকে হত্যা করার মতো বাড়াবাড়ি না দেখাতে তাহলে বহাল তবিয়তে বিদেশের মাটিতে বেশ আরাম আয়েশের সাথে দিনাতিপাত করতে পারতো। হয়তো নিকট ভবিষ্যতে, দেশে ফিরে না এলেও, দূর থেকেই দলটা পরিচালনা করে অসংখ্য মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে আবার।

জেফরি বেগ জীবনেও ভুলবে না ঐ দৃশ্যটা : হুইলচেয়ারে বসা ব্ল্যাক রঞ্জু আগুনে পুড়ে মরছে।

বাবলুকে সে অনুরোধ করেছিলো বদমাশটাকে না মারতে কিন্তু সেও জানতো, এরকম জঘন্য সন্ত্রাসীকে জীবিত রাখাটা কতো বড় ঝুঁকিপূর্ণ আর বিপজ্জনক কাজ হতো।

হোমমিনিস্টারের সাথে গতকাল তার দেখা হয়েছিলো। ভদ্রলোক নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার পিএস আলী আহমেদ তো রীতিমতো দু’হাত ধরে কেঁদেই ফেলেছিলো। এই দু’জন ক্ষমতাবান মানুষের এমন আচরণে বিব্রত বোধ করেছে সে। কিন্তু এমনটি যে হবে সেটা মিনিস্টারের বাড়িতে দ্বিতীয়বারের মতো যাবার আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলো।

মিনিস্টারের সাথে দেখা করার সময় তার সঙ্গে ছিলো মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ। জেফরির জন্য গর্বিত বোধ করেছে ভদ্রলোক।

মিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ বিদায়ের সময় একটি অদ্ভুত কথা বলেছেন তাকে। শীঘ্রই তিনি হোমমিনিস্টারের পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। এরকম পদে থাকার নৈতিক অধিকার নাকি হারিয়ে ফেলেছেন।

মহাপরিচালক ফারুক আহমেদকে অবাক করে দিয়ে জেফরি সায় দিয়ে বলেছে, সেও মিনিস্টারের সাথে একমত পোষণ করে।

নিজের ঘরে বসে যখন এসব ভাবছে তখন রাত প্রায় বারোটা বাজে।

অনেকদিন পর আজকের রাতের ঘুমটা ভালো হবে আশা করলো। তবে এটাও ঠিক, বিরাট কোনো সফলতার পরও ঘুম চলে যায়।

হঠাৎ তার মোবাইলফোনটা বিপ করে উঠলো। হাতে তুলে নিলো সেটা। অজ্ঞাত এক নাম্বার থেকে একটা এসএমএস এসেছে। মেসেজটা ওপেন করে পড়লো :

থ্যাঙ্কস, মি: বেগ!

বাবলু!

ব্ল্যাক রঞ্জুকে আগুনে পুড়িয়ে মারা পর থেকে বাবলুর কোনো খবর নেই। জেফরি ভেবেছিলো সে হয়তো অন্য কোথাও চলে গেছে। কিন্তু এখন সে নিশ্চিত দেশে ফিরে এসেছে বাবলু। মনে মনে আশা করলো, সে যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক। খুনখারাবির মতো কাজ থেকে যেনো বিরত থাকে। একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন তারও প্রাপ্য।

তবে বাবলুর সাথে তার কখনও দেখা হয়ে গেলে সে কী করবে ভেবে পেলো না। এখনও বাবলুর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়ে গেছে। তার পক্ষে কোনো খুনিকে ছাড় দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এটাও অস্বীকার কার করার উপায় নেই, বাবলু তিন তিনজন মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছে, সেইসাথে চিরতরের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছে এক ভয়ঙ্কর খুনিকে।

বাবলু এখন দেশে!

জেফরির খুব ইচ্ছে করলো সবকিছুর জন্য তাকেও একটা ধন্যবাদ জানাতে, কিন্তু কিছুই করলো না। মোবাইলফোনটা বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে সুইচটিপে বাতি বন্ধ করে দিলো সে। কিছুক্ষণ বসে থাকলে বিছানায়। চোখে ঘুম নেই। উঠে জানালার সামনে গিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে চেয়ে থাকলো শূন্য দৃষ্টিতে।

হুডি পরা এক যুবক পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ফাঁকা রাস্তাটা দিয়ে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সে একদম নিশ্চিত এটা….

অস্কুটস্বরে বলে উঠলো জেফরি বেগ, “বাবলু!”

তাকে অবাক করে দিয়ে হুডি পরা যুবক থেমে গেলো। কিন্তু জানালার কাঁচ ভেদ করে সেই আওয়াজ পৌঁছানোর কথা নয়। আস্তে করে পেছনে ফিরে তাকালো, তারপর আবার হাঁটতে শুরু করলো সে।

রাতের কুয়াশায় অবয়বটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো মুহূর্তে।

ফাঁকা রাস্তাটার দিকে চেয়ে রইলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। এটা কি তার হেলুসিনেশন ছিলো নাকি সত্যি সত্যি…

জেফরি বেগ নিশ্চিত হতে পারলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *