৭০. ব্ল্যাক রঞ্জু

অধ্যায় ৭০

ব্ল্যাক রঞ্জু ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু তুর্যকে মুক্তি দেয়া হয় নি। হোমমিনিস্টার অসহায় হয়ে পড়েছেন। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে মন্ত্রীত্ব তো যাবেই এমন কি তার বিরুদ্ধে মামলাও হবে। এতোদিনের অর্জিত রাজনৈতিক অবস্থান ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে এই এক ঘটনায়।

আর ভাবতে পারলেন না। বাড়িতেই আছেন তিনি, তুর্য কিডন্যাপ হবার পর থেকেই বলতে গেলে কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। সচিব আর প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ে চাপা ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে তাকে নিয়ে-মিনিস্টার সাহেবকে এতো মনমরা দেখায় কেন? কী হয়েছে তার?

রঞ্জুর কথামতো সব করেছেন, পুরো ব্যাপারটা গোপন রেখেছেন, কিন্তু এখন? সব দাবি মিটিয়ে দেবার পরও ওরা তুর্যকে ছাড়ছে না। এমনকি যে লোকটা ফোনে যোগাযোগ রাখতো সেও ফোন করছে না। তাহলে কি ঐ ইনভেস্টিগেটর, মি: বেগের কথাই ঠিক?

দুপাশে মাথা দোলালেন মিনিস্টার। তিনি যে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছেন সেটা বুঝতে পারছেন। গভীর এক খাদ। শুধুমাত্র তার ক্যারিয়ার নয়, ব্যক্তি জীবনটাও ধ্বংস হয়ে যাবে। সব শেষ হয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবেন তিনি।

তার সামনে পিএস আলী আহমেদ বসে আছে। সেও বুঝতে পারছে না কী করা উচিত এখন।

“এরকম কেন হলো?” পিএসের দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো বললেন মিনিস্টার।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আলী আহমেদের বুকের ভেতর থেকে।

“মি: বেগ সব গুবলেট করে দিয়েছে, স্যার।”

“কি??” কথাটা বলেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন মিনিস্টার।

“আমি নিশ্চিত সে ঐ বাস্টার্ডকে সব জানিয়ে দিয়েছে। রঞ্জুর দল ওকে খুঁজে পায় নি হয়তো। ওরা যদি ওকে খুঁজে না পায় তাহলে কি হবে বুঝতে পারছেন?”

“কিন্তু বাস্টার্ড কোথায় আছে এটা তো ওই লোক জানে না। তাহলে সে কিভাবে ওর সাথে যোগাযোগ করলো?”

আলী আহমেদ যে জেফরি বেগের পেছনে এক লোক লাগিয়ে রেখেছে সে কথাটা বললো না। “যেভাবেই হোক সে জেনে গেছে,” একটু থেমে আবার বললো, “বাস্টার্ডকে এটা জানিয়ে দিয়ে আমাদের যে কতো বড় সমস্যায় ফেলে দিয়েছে সেটা যদি ঐ লোক বুঝতো…”

ঢোক গিললেন মিনিস্টার। “এখন আমার তুর্যের কি হবে?”

শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো পিএস। দীর্ঘদিন ধরে মিনিস্টারকে নানান ধরণের পরামর্শ দিয়ে এসেছে, বিভিন্ন সমস্যায় উপায় বাতলে দিয়েছে কিন্তু এখন তার মাথায়ও যেনো কিছুই ঢুকছে না। তার অবস্থা মিনিস্টারের চেয়েও করুণ কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারছে না।

“কিছু একটা বলো?” তাড়া দিলেন হোমমিনিস্টার।

পিএস দু’পাশে মাথা দোলালো আক্ষেপের সাথে। পুরো ব্যাপারটা এমন অবস্থায় চলে এসেছে…কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

কপালে হাত দিলেন মিনিস্টার। “আমার ছেলেটার কী হবে?” কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন তিনি।

ছলছল চোখে চেয়ে রইলো পিএস।

“আমি তো এখন কাউকে কিছু বলতে পারছি না!” মিনিস্টার আস্তে করে বললেন। “নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গেছি।”

পিএস আলী আহমেদের চোখ দুটোও ছলছল করে উঠলো। কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখনই ড্রইংরুমে ঢুকলো এক কাজের লোক।

ছেলেটার দিকে তাকালেন মিনিস্টার। তার স্ত্রী হয়তো ঘুম থেকে জেগে উঠেছে, কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে আবার। তুর্যের কথা জানতে চাইছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কি হয়েছে?”

“স্যার, অমূল্য বাবু নীচের রুমে ওয়েট করছেন…”

কথাটা শোনামাত্রই পিএসের দিকে তাকালেন মাহমুদ খুরশিদ। তারপরই একান্ত অনিচ্ছায় তাড়া দিয়ে বললেন, “উনাকে উপরে নিয়ে আসো।”

ছেলেটা চলে যেতেই পিএস অবাক হয়ে বললো, “অমূল্য বাবু এ সময়ে?”

মৃদু কাঁধ তুললেন মিনিস্টার।

অমূল্য বাবু তার এমন একজন বন্ধু-শুভাকাক্ষি যাকে না বলা যায় না। ব্যবসায়িক কাজ থেকে শুরু করে রাজনীতি-সবখানেই এই লোকের বুদ্ধিপরামর্শকে তিনি খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এই জীবনে এতো ঠাণ্ডা মাথার মানুষ আর দেখেন নি। তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ এই লোক হঠাৎ কি মনে তার বাড়িতে চলে এলো?

এই প্রশ্নের জবাবটা তিনি পেলেন কয়েক সেকেন্ড পরই।

“আপনার ফোন বন্ধ…তাই না এসে পারলাম না, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ মৃদুস্বরে বললো অমূল্য বাবু।

হোমমিনিস্টার উঠে দাঁড়ালেন। “আসুন, আসুন…”

বাবু কাছে এসে মিনিস্টারের দিকে ভালো করে তাকালো, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়লো তার পাশে।

“আ-আপনি হঠাৎ?” মাহমুদ খুরশিদ তোতলালেন।

“তুর্যকে ওরা এখনও ছাড়ে নি দেখছি…”

হোমমিনিস্টার আর পিএস স্থিরচোখে চেয়ে রইলো বাবুর দিকে। ঘরে নেমে এলো সুকঠিন নীরবতা। অমূল্য বাবু এ কথা জানলো কি করে?

পরক্ষণেই মাহমুদ খুরশিদ আর তার পিএস বুঝতে পারলো জেফরি বেগ অবশ্যই বাস্টার্ডকে সব বলে দিয়েছে। তার কাছ থেকেই শুনেছে ভদ্রলোক।

“আপনি যদি আমাকে সত্যিকারের বন্ধু ভাবতেন, ঘটনাটা প্রথমেই জানাতেন তাহলে আজ এমন পরিস্থিতি হতো না,” আস্তে করে বললো মৌনব্রত পালন করা লোকটি।

দু’চোখ বন্ধ করে মিনিস্টার কেবল মাথা দোলালেন। এই লোকের কাছে মিথ্যে বলা খুব কঠিন হবে তাই চুপচাপ মেনে নিলেন কথাগুলো।

অমূল্য বাবু এবার পিএস আলী আহমেদের দিকে তাকালো অন্তর্ভেদি দৃষ্টিতে। আপনার অবস্থাও দেখছি খুব একটা ভালো না।”

পিএস ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। “ইয়ে, মানে…”

“আমি ভেবেছিলাম আপনার মাথাটা অন্যদের মতো নয়, কিছু কাণ্ডজ্ঞান আছে।” বলেই আক্ষেপে মাথা দোলালো বাবু।

“ওর কোনো দোষ নেই,” পাশে বসে থাকা অমূল্য বাবুর একটা হাত ধরে বললেন মিনিস্টার। “আমি আসলে কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি শুধু তুর্যকে বাঁচানোর জন্য যা করার…” আর বলতে পারলেন না তিনি।

“ক্রিমিনালদের সাথে কিভাবে ডিল করতে হয় আপনি জানেন না,” আস্তে করে বললো বাবু। “আর কিডন্যাপাররা হলো সবচাইতে জঘন্য ক্রিমিনাল।”

মাথা নেড়ে সায় দিলেন মাহমুদ খুরশিদ। এখন তিনি এটা ভালো করেই জানেন। জঘন্য আর পিশাচ তারা!

“যে ছেলেটা আপনাদের এতো বড় উপকার করলো তাকে রঞ্জুর হাতে এভাবে তুলে দিলেন?”

মাহমুদ খুরশিদ ফ্যাল্যফ্যাল করে চেয়ে রইলেন অমূল্য বাবুর দিকে, কিছু বলতে পারলেন না।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় ডুবে রইলো, তারপরই জানতে চাইলো বাবু, “রঞ্জু এখন কোথায়?”

মিনিস্টার আর পিএস একে অন্যের দিকে তাকালো, তারা দু’জনেই বুঝতে পারছে না কী বলবে।

“দেশের বাইরে,” পিএস আলী আহমেদ বললো অবশেষে।

কথাটা শুনে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অমূল্য বাবু।

মিনিস্টার মাহমুদ খুরশিদ এই প্রথম দেখতে পেলেন কম কথা বলা মানুষটির চোখে যেনো আগুন জ্বলছে।

অধ্যায় ৭১

জ্বরটা পুরোপুরি না গেলেও এখন আর বিছানায় শোয়া নেই। নিজের ঘরে পায়চারি করছে বাবলু। একটা অবিশ্বাস্য কথা জানতে পেরেছে কয়েক ঘণ্টা আগে।

ব্ল্যাক রঞ্জু জেনে গেছে সে দিল্লিতে আছে। বদমাশটা জামিনে মুক্তি পেয়ে গেছে!

এই অসম্ভব কাজটা কিভাবে সম্ভব হলো?

খোদ হোমমিনিস্টারের ছেলেকে নাকি অপহরণ করেছে তার দল। মুক্তিপণ হিসেবে নিজের মুক্তি আদায় করে নেবার পাশাপাশি আরেকটা জিনিস বাগিয়ে নিয়েছে দিল্লিতে তার অবস্থানের কথা।

এসবই বলেছে এমন এক লোক যে তাকে ধরার জন্য হন্যে আছে। এই লোকটাই আহত অবস্থায় ব্ল্যাক রঞ্জু আর তাকে গ্রেফতার করেছিলো। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করানোর জন্য, তাদের অপরাধের শক্ত প্রমাণ জোগার করার জন্য লোকটা দৃঢ়প্রতীজ্ঞ।

ঐ ইনভেস্টিগেটর তাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উমার কাছে গিয়েছিলো! মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তার ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করেছে। ফোন বন্ধ পেয়েও সে হাল ছেড়ে দেয় নি। শেষে বিকেলে আবারো ফোন করে তাকে পেয়ে যায়।

বাবলু অবশ্য লোকটার কথা এতো সহজে বিশ্বাস করে নি। ইনভেস্টিগেটর ফোন রাখতেই উমাকে ফোন করে সে। মেয়েটা তাকে আশ্বস্ত করে জানায়, ইনভেস্টিগেটরের কথা সে বিশ্বাস করেছে।

উমার মতো সহজ-সরল মেয়েকে বিশ্বাস করানো কঠিন কাজ নয়। জেফরি বেগের মতো স্মার্ট লোকের পক্ষে এটা মামুলি ব্যাপার। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য সে হাজার মাইল দূরে অমূল্য বাবুকে ফোন করেছিলো একটু আগে।

সব শুনে অমূল্য বাবুও যে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে সেটা হাজার মাইল দূর থেকেও বুঝতে পেরেছে সে।

“তুমি এসব কী বলছো?” বাবু বলেছিলো সব শুনে। “এটা কি সম্ভব?”

“আমার কাছেও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে…” বাবলু একমত পোষণ করে বলেছিলো।

“তোমাকে ঐ ইনভেস্টিগেটর কিভাবে খুঁজে পেলো?”

বাবুর এ কথায় চুপ মেরে যায় বাবলু।

“মানে, তোমার ফোন নাম্বার সে পেলো কি করে?”

“আ-আমার একজন…ঘনিষ্ঠ লোকের কা-কাছ থেকে…” অবশেষে এই জীবনে প্রথমবারের মতো তোতলায় বাবলু।

কথাটা বলামাত্রই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে নীরবতা নেমে আসে।

অমূল্য বাবু তাকে বার বার বলে দিয়েছিলো, দিল্লিতে তার অবস্থানের কথা যেনো ঘুণাক্ষরেও কেউ না জানে। কিন্তু বাবুর কথা পুরোপুরি রাখতে পারে নি সে।

“ঐ নার্স মেয়েটা?” আস্তে করে বলেছিলো কম কথার মানুষটি।

বাবলু বরফের মতো জমে যায় কথাটা শুনে। বাবু কী করে এটা জানলো? তারপরই মনে পড়ে গেলো, অমূল্য বাবু এমন একজন মানুষ যার পক্ষে এসব জানা মোটেও কঠিন কোনো কাজ নয়।

“কাজটা তুমি ঠিক করো নি,” বাবলুর জবাবের অপেক্ষা না করেই বলে বাবু। তারপর যথারীতি মৌনতা।

“আমার মনে হচ্ছে ঐ ইনভেস্টিগেটর একটা ফাঁদ তৈরি করেছে…” প্রসঙ্গটা পাল্টানোর জন্য বলেছিলো বাবলু।

“না। মনে হচ্ছে ঐ ইনভেস্টিগেটর ঠিকই বলেছে।”

বাবুর এ কথা শুনে সে একমত হতে পারে নি। “ঐ ইনভেস্টিগেটর হয়তো ফোন নাম্বার দেখে বুঝতে পেরেছে আমি দিল্লিতে আছি…।

“হুম,” ছোট্ট করে বলে বাবু। ফোনের অপর পাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় সে। “ঐ ইনভেস্টিগেটর বলেছে হোমমিনিস্টার তোমার দিল্লির ঠিকানা রঞ্জুকে দিয়ে দিয়েছে,..”

“হ্যাঁ, কিন্তু…” বাবলু তখনও বুঝতে পারে নি অমূল্য বাবু কি বোঝাতে চাইছে। আবারো ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায় সে।

“শুনেছি প্রেমে পড়লে নাকি পুরুষমানুষের কাণ্ডজ্ঞান কমে যায়,” আস্তে করে বলে বাবু। “এখন দেখছি কথাটা সত্যি।”

বাবলু বিব্রত হয়ে ওঠে। কোনো কথা বের হয় না তার মুখ দিয়ে।

“তুমি যে দিল্লিতে আছে সেটা হোমমিনিস্টার ভালো করেই জানে…সে-ই এটার ব্যবস্থা করেছে।”

ঠিক তখনই ব্যাপারটা ধরতে পারে বাবলু। এটা তার আগেই বোঝা উচিত ছিলো। মি: বেগ যদি ধাপ্পাবাজি করে থাকে, কিংবা তার ফোন নাম্বার দেখে বুঝে থাকে তাহলে এটা কিভাবে বলা সম্ভব হলো? জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসার পর তার দিল্লিতে চলে আসার কথা হোমমিনিস্টার জানে-এটা ঐ ইনভেস্টিগেটরের পক্ষে জানা অসম্ভব, যদি না হোমমিনিস্টার মি: বেগকে এ কথা বলে থাকে। কিন্তু মিনিস্টার কেন ঐ লোককে এটা বলতে যাবে?

“বুঝতে পেরেছি,” আস্তে করে বলে বাবলু। যদিও পুরোপুরি বুঝতে পারছিলো না সে।

“খুশি হলাম। এখনও কিছু কাণ্ডজ্ঞান আছে তাহলে…”

একটু শ্লেষের সাথে বলে অমূল্য বাবু। এটা তার চারিত্রিক বৈশিষ্টের বাইরে একটা কাজ।

“ঐ ইনভেস্টিগেটর কি হোমমিনিস্টারের সাথে দেখা করেছিলো?” বাবলু জানতে চায় বাবুর কাছে। “যদি দেখা করে থাকে…মানে, মিনিস্টার তাকে কথাটা বলে থাকে, তাহলে মি: বেগের কথাই সত্যি।”

“হুম।” একটু চুপ থেকে বাবু আবারো বলে ওঠে। “কিন্তু হোমিসাইডের ঐ ইনভেস্টিগেটরকে মিনিস্টার কেন এটা বলতে যাবে? যদি ধরেও নেই তার ছেলেকে ব্ল্যাক রঞ্জু কিডন্যাপ করেছে তারপরও হিসেব মিলছে না। ঐ ইনভেস্টিগেটর তো অপহরণ কেস দেখাশোনা করে না। সে কিভাবে এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়লো?”

“আমারও একই প্রশ্ন। সে কি করে আবারো জড়িয়ে পড়লো।”

একটু ভেবে বাবু বলে ওঠে, “ঠিক আছে, আমি দেখছি। যা শুনলাম তা সত্যি কিনা নিশ্চিত হতে হবে।”

“কিন্তু কিভাবে নিশ্চিত হবেন?”

তার এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাবু শুধু বলে, “আমি তোমাকে একটু পর ফোন করছি।”

তারপরই ফোনটা রেখে দেয়া হয় ওপাশ থেকে।

একটু আগে বাবু তাকে ঠিকই ফোন করেছিলো। কোনো রকম ব্যাখ্যা না দিয়ে শুধু বলেছে, ঐ ইনভেস্টিগেটরের কথা পুরোপুরি সত্যি। বাবলু ইচ্ছে করলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে।

বাবলুর মনে হয়েছে অমূল্য বাবু যেনো বলতে চাচ্ছিলো রঞ্জুর দলকে বিনাশ করে দিতে, কিন্তু কথাটা বলতে পারে নি স্বল্পভাষী লোকটা। শুধু বলেছে, “অবশ্য আমি ভালো করেই জানি তুমি পালাবে না।”

এ কথাটা বলেই বাবু ফোন রেখে দেয়।

বাবুর মতো ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগও মনে করে সে পালাবে না। রঞ্জুর দলকে মোকাবেলা করবে।

তার একটা বাড়তি সুবিধা আছে-সে জেনে গেছে ব্ল্যাক রঞ্জুর লোকজন সুদূর দিল্লিতে এসে গেছে তাকে হত্যা করার জন্য।

নীচের লাইব্রেরির গুলিন্দর সিং বলেছে, দুপুরের পর এক লোক এসেছিলো তাকে খুঁজতে। তার মানে এরইমধ্যে রঞ্জুর লোকজন নিশ্চিত হয়ে গেছে এই বাড়ির চিলেকোঠার উপর সে থাকে।

দিল্লিতে বাংলাদেশী দূতাবাসের যে দু’জন লোক তার অবস্থানর কথা জানে তাদের মধ্যে কয়েক দিন আগে একজনের বদলী হয়ে গেছে নেপালে। অন্য লোকটাকে ফোন করলে সে জানায় দূতাবাস থেকে তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করার প্রশ্নই ওঠে না।

ব্ল্যাক রঞ্জু তাহলে আবার উদয় হয়েছে! আগুনের ভষ্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো বদমাশটা জেগে উঠেছে। আগের চেয়েও নাকি ভয়ঙ্কর আর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তার দল, অন্তত জেফরি বেগ তা-ই মনে করে।

হুইলচেয়ার ছাড়া যে লোক চলতে পারে না সে এখন তাকে শিকার করার জন্য হাজার মাইল দূরে লোকজন পাঠিয়েছে। যেকোনো সময় তারা আঘাত হানবে।

বাবলু ভেবে পাচ্ছে না এখন সে কী করবে। তার হাতে কোনো অস্ত্র নেই। এই দিল্লি শহরে এমন কেউ নেই যে তাকে এরকম কিছু জোগার করে দিতে পারবে। তাছাড়া একজন বাংলাদেশী হিসেবে কারো কাছে অস্ত্রের কথা বললেই তাকে সন্দেহ করবে উগ্রপন্থী ইসলামী দলের সদস্য হিসেবে। দেখা যাবে, সেই লোক পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে আর দিল্লির অ্যান্টি টেরোরিস্ট ব্যাটেলিয়ন ছুটে এসেছে তাকে ধরার জন্য।

তারচেয়েও বড় কথা তার হাতে একদম সময় নেই।

ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে সে। আগের সেই বাবলু, লোকজন যাকে বাস্টার্ড নামে চিনতো, সে আর এখন নেই। এই কয়েক মাসে তার মধ্যে বাস করা খুনি বাস্টার্ড নেতিয়ে পড়েছে। মানসিকভাবে খুনখারাবির মতো কর্মকাণ্ডে নিজেকে আর জড়াবে না বলেই পণ করেছিলো। হাসপাতালের প্রিজনসেলে বসে একটা প্রতীজ্ঞাই করেছিলো সে : বের হতে পারলে জীবনটাকে সম্পূর্ণ নতুন করে সাজাবে। সেখানে তার অতীত থাকবে না। থাকবে স্বাভাবিক একজন মানুষের জীবন। আট-দশজন মানুষ যেভাবে জীবনযাপন করে সেও ঠিক তাই করবে।

এই প্রতীজ্ঞাটা শুধু নিজের কাছেই সে করে নি। উমাকেও কথা দিয়েছিলো-এই জীবনে আর খুনখারাবির মতো কাজে নিজেকে জড়াবে না। এখন থেকে সে শুধুই বাবলু। তার জীবন থেকে বাস্টার্ডকে হয়তো মুছে ফেলা যাবে না, তবে তাকে আর জেগে উঠতেও দেবে না কখনও।

কিন্তু এখন সেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর ঠাণ্ডা মাথার খুনি বাস্টার্ডই পারে তাকে বাঁচাতে।

যেকোনো কাজের দক্ষতা নির্ভর করে চর্চার উপর। দীর্ঘদিন চর্চা না করার ফলে দক্ষতার উপর মরচে পড়ে যায়।

তবে এটাও ঠিক, সাঁতার কিংবা সাইকেল চালানোর মতো ব্যাপারও আছে। দীর্ঘদিন সাঁতার না কাটলে, সাইকেল না চালালেও সেটা কেউ ভুলে যায় না। নতুন করে শিখতেও হয় না।

পায়চারি করতে করতে মাথা খাটাতে লাগলো সে। হাতে খুব বেশি সময় নেই। ব্ল্যাক রঞ্জুর দল ঠিক কখন হানা দেবে সে জানে না। যেকোনো সময় ঘটতে পারে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এসে পড়বে।

সবচাইতে সহজ বুদ্ধি হলো, এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যাওয়া, যেমনটি অমূল্য বাবু তাকে বলে দিয়েছে। অন্য কোনো রাজ্যে যাওয়ার দরকার নেই, দিল্লির মতো বড় শহরে পালিয়ে থাকার জন্য অসংখ্য জায়গা রয়েছে। ইচ্ছে করলে আজরাতটা অন্য কোথাও কাটিয়ে আগামীকাল ভারতের অন্য কোনো শহরেও চলে যেতে পারে। এখানকার এয়ারলাইন্সের টিকেট খুবই সহজলভ্য। মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পাঁচ-ছয়শ’ মাইল দূরের কোনো শহরে চলে গেলে ব্ল্যাক রঞ্জু তার টিকিটাও খুঁজে পাবে না।

কিন্তু এটা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট নয়। পালিয়ে যাওয়ার লোক সে কখনও ছিলো না।

আমি পালাবো না।

যারা তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদেরকে তুমি তাড়িয়ে বেড়াও! ভেতর থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। শিকার না, শিকারী হও!

পরিস্থিতিটা সহজ-সরলভাবে ভাবতে শুরু করলো এবার।

ব্ল্যাক রঞ্জু তার একটি ঘাতক দলকে পাঠিয়েছে দিল্লিতে। বাবলু কোথায় আছে সে খবর এরইমধ্যে জেনে গেছে ওরা। এখন যেকোনো সময় আঘাত হানা হবে।

তাদের কাছে অবশ্যই অস্ত্র থাকবে, অন্যদিকে তার কাছে কিছুই নেই। অস্ত্র থাকলে নিজেকে এতোটা অসহায় মনে হতো না। নিরস্ত্র বাবলু কী করে ভয়ঙ্কর একদল লোকের বিরুদ্ধে লড়াই করবে?

হঠাৎ ঘরটা অন্ধকারে ডুবে যেতেই একটা বিপ করে শব্দ হলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো বাবলু। তারপর নিয়মিত বিরতি দিয়ে বিপটা বেজে চললো।

অন্ধকার ঘরের এককোণে তাকালো সে। ছোট্ট একটা লাল বিন্দু জ্বলছে নিভছে, সেইসাথে বিপ বিপ করে শব্দ করছে।

লোডশেডিং। দিল্লি শহরে মাঝেমধ্যে দশ মিনিটের জন্যে লোডশেডিং হয়ে থাকে। এর বেশি না। ঠিক দশ মিনিট পরই বিদ্যুৎ চলে আসবে।

অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে থেকে লাল আলোক বিন্দুটার দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপরই মাথায় একটা আইডিয়া চলে এলো তার। এতো দ্রুত এলো যে, নিজেই অবাক হয়ে গেলো। কঠিন চাপের মধ্যে মাথা ঠাণ্ডা রাখলে এ রকম দারুণ আইডিয়া চলে আসে তার মাথায়। মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র আর হয় না, সেই মস্তিষ্কটা তার আছে।

ঘরের এককোণে রাখা ডেস্কটপ কম্পিউটারটার কাছে এগিয়ে গেলো সে।

বিপ করতে থাকা লাল বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে। এই জিনিসটার ভিন্নধর্মী ব্যবহার খুব ভয়াবহ হতে পারে। শব্দহীন একটি মারণাস্ত্র!

দারুণ! মনে মনে বলে উঠলো বাবলু।

অধ্যায় ৭২

সন্ধ্যার পর কিছুটা নির্ভার হয়েই অফিস থেকে বের হয়ে গেলো জেফরি বেগ। বাবলুকে ফোনে যা বলার বলে দিয়েছে, কিন্তু টেলিফোনের ওপাশ থেকে বাবলুর যে প্রতিক্রিয়া সে পেয়েছে তাতে খুব একটা আস্থা রাখতে পারছে না। বাবলুকে সংক্ষেপে সব বলে দেবার পর ছোট্ট একটা অনুরোধ করেছে। সম্ভব হলে এইটুকু উপকার যেনো সে করে। বাবলু হ্যাঁ-না কিছুই বলে নি। চুপচাপ শুনে গেছে শুধু।

এর বেশি সে আর কীইবা করতে পারতো? দিল্লি আসলেই বহু দূর-বিশেষ করে শত্রুর আস্থা অর্জন করবার জন্য।

এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তার আশংকা, তুর্যকে হয়তো এরইমধ্যে হত্যা করা হয়েছে। ছেলেটার জন্য খুব মায়া হচ্ছে তার।

অফিসের গাড়ি কখনও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে না জেফরি। আজও করলো না। গাড়িটা রেখে একটা রিক্সা নিয়ে সোজা চলে এলো রেবার বাসার সামনে। আজ রিক্সায় করে ঘুরে বেড়াবে। বাসার সামনে এসে ফোন করার মিনিটখানেক বাদে রেবা বের হয়ে এলো।

“মুড অফ কেন?” রেবা জানতে চাইলো।

“মুড অফ?” হেসে বললো সে। না। একটু টায়ার্ড লাগছে হয়তো,” ছোট্ট করে বললো! জেফরি সাধারণত নিজের কাজের ব্যাপারে রেবার সাথে খুব বেশি কথা বলে না।

“কোনো কেস নিয়ে আপসেট?” রেবা ঠিকই ধরতে পেরেছে।

মেয়েটার দিকে তাকালো সে। কোনো রকম সাজগোজ করে নি, তবে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। “কিছুটা।”

জেফরির বাহুটা ধরে বললো রেবা, “টেক ইট ইজি।”

জেফরির ঠোঁটে কাষ্ঠহাসি দেখা গেলো। মাথা নেড়ে সায় দিলো শুধু।

“খুব বেশি আপসেট?”

“বুঝতে পারছি না।”

“ওকে, অফিসের চিন্তা অফিসে কোরো…এখন তুমি আমার সাথে ডেট করছো। ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগকে রেখে আমার প্রেমিক হবার চেষ্টা করো।”

“কোথায় রাখবো ওকে?” হেসে জানতে চাইলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।

“আমার কাছে।” কথাটা বলেই হাত পাতলো রেবা। “এখানে রেখে দাও। আমি যত্ন করে রেখে দেবো ওকে। যখন তোমার দরকার হবে আবার ফিরিয়ে দেবো।”

রেবার হাতে কল্পিত কিছু রাখার ভান করলো জেফরি। “রাখলাম। কিন্তু তুমি ওকে কোথায় রাখবে?”

কামিজের গলার ফাঁকে রেখে দেবার ভান করলো রেবা। “এখানে।”

“সর্বনাশ!” কৃত্রিম বিস্ময়ে বলে উঠলো সে।

“সর্বনাশ? কেন?”

“ওখানে রাখলে কি সে আর বের হতে চাইবে,” মাথা দোলাললা জেফরি। মরে গেলেও বের হতে চাইবে না। স্বর্গ থেকে কোন পাগল বের হতে চায়, বলো?”

“বের হতে না চাইলে বের হবে না,” রেবাও নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো।

“বাপরে!” হাফ ছাড়লো সে। “ঐ ইনভেস্টিগেটরের জন্যে এতো দরদ?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে হাসলো রেবা। “কেন হিংসে হচ্ছে?”

“অবশ্যই হচ্ছে। ওই হারামজাদা ওখানে থাকবে আর আমি রিক্সায় পাশে বসে হাওয়া খাবো…হিংসে হবে না?”

“তোমাকে হাওয়া খেতে বলেছে কে?”

“তাহলে কি চুমু খাবো?”

রেবা আশেপাশে তাকালো। তারা এখন ইডেন কলেজের সামনে আছে। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা, কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্নও। আচমকা জেফরিকে অবাক করে দিয়ে খপ করে চুমু খেয়ে বসলো সে। একেবারে স্বল্প দৈর্ঘের চুমু। তারপর সঙ্গে সঙ্গে ভদ্র মেয়ের মতো সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো, যেনো কিছুই হয় নি।

জেফরি কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো রেবার দিকে। তারপরই লক্ষ্য করলো সামনের দিকে তাকিয়ে রেবা মিটিমিটি হাসছে।

“দিলে তো ক্ষিদেটা বাড়িয়ে…” বলেই রেবার কানের কাছে মুখ এনে বললো, “এখন তো আমাকে মন ভরে চুমুর ডিনার করতে হবে।”

“চুপচাপ ভদ্রছেলের মতো বসে থাকো,” তার দিকে তাকিয়ে বললো রেবা।

“তাই তো ছিলাম, কিন্তু যা করেছে তারপর কি আর ভদ্র থাকা যায়?”

“তোমাকে ভদ্র থাকতে বলেছে কে?”

জেফরি ভিমরি খেলো। তারপর কাছে এসে চুমু খাবার চেষ্টা করতেই বাধা দিলো রেবা।

“এতোক্ষণ রাস্তা খালি ছিলো, কিন্তু এখন না,” বলেই রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করলো।

তারা এখন নিউমার্কেট-নীলক্ষেতের চার রাস্তার মোড়ে চলে এসেছে। যানবাহন আর লোকজনের ভীড়।

“ইউ জাস্ট মিস দ্য ট্রেন!” রেবা হেসে বললো।

হেসে ফেললো জেফরিও। “কিন্তু আমি এখনও প্রাটফর্মেই দাঁড়িয়ে আছি…যেকোনো সময় আরেকটা ট্রেনে উঠে পড়তে পারবো।”

“আশা করি তোমার আশা পূরন হবে।” মুখ চাপা দিয়ে হেসে ফেললো রেবা।

তাদের রিক্সাটা সায়েন্স ল্যাবরেটরি ছাড়িয়ে চলে এলো ধানমণ্ডি চার নাম্বারে।

“অ্যাই রিক্সা, সামনে ডানে গিয়ে রেখে দাও,” হাসতে হাসতেই রিক্সাওয়ালাকে বললো জেফরি।

“এখানে কী করবে?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো রেবা।

“চুমু তো খেতে পারলাম না তাই চটপটি খাবো,” বললো জেফরি।

তাদের রিক্সাটা ডানে মোড় নিয়ে ফুটপাতের উপর একটা চটপটির দোকানের সামনে এসে থামলো। বেশ কিছু চেয়ার পাতা। মাত্র একজোড়া ছেলেমেয়ে বসে গল্প করছে। চটপটির দিকে তাদের মনোযোগ নেই।

রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ালো জেফরি, মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাবে, ঠিক তখনই ব্যাপারটা তার চোখে পড়লো।

রাস্তার ওপারে, ঠিক তাদের বিপরীতে একটা মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। মোটরসাইকেল আরোহীর মাথায় সানক্যাপ। লোকটা তাদের দিকেই চেয়ে ছিলো, কিন্তু চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে ফেললো সে।

সেটুকুই যথেষ্ট। জেফরির গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো মুহূর্তে। রাস্তার ওপার থেকে কাউকে দেখে চট করে চেনার কথা নয়, যদি না বিপরীত দিক থেকে আসা কোনো বাসের হেডলাইটের আলো এসে পড়তো মোটরসাইকেল আরোহীর উপর।

কয়েক সেকেন্ডের মতো হেডলাইটের আলোটা পড়েছিলো, তাতেই সানক্যাপের নীচে জ্বলজ্বলে চোখ দুটো ধরা পড়ে তার কাছে।

এই চোখ ভোলার মতো নয়।

মিলন!

“স্যার?”

রিক্সাওয়ালা ডাকলে সম্বিত ফিরে পেলো সে। রেবা কিছু বুঝতে পারে নি। সে রিক্সা থেকে নেমে ওড়নাটা ঠিকঠাক করছে।

মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলো জেফরি কিন্তু চোখ রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেল আরোহীর দিকে।

“কতো রাখমু, স্যার?”

“রাখো,” রিক্সাওয়ালার দিকে না তাকিয়েই বললো জেফরি।

“অ্যাই, কি দেখছো?” রেবা তার বাহু ধরে জিজ্ঞেস করলো।

চট করে তাকালো মেয়েটার দিকে। “তুমি বসো…আমি আসছি।” আবারো তাকালো রাস্তার ওপারে। মোটরসাইকেল আরোহী একটুও নড়ছে না, তবে এখন সে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরানোর চেষ্টা করছে।

রেবা রাস্তার ওপারে তাকালো, তার চোখে কিছুই ধরা পড়লো না। কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না সে। চুপচাপ ফুটপাতের উপর চটপটির দোকানের সামনে রাখা একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়লো।

রিক্সাওয়ালা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। কতো ভাড়া রাখবে, কতো ফেরত দেবে বুঝতে পারছে না। তার দিকে চট করে তাকিয়ে জেফরি চলে যেতে ইশারা করলো হাত নেড়ে। লোকটা পঞ্চাশ টাকা নিয়েই চলে গেলো।

রেবার পাশে এসে বসলো জেফরি, কিন্তু বার বার চোখ চলে যাচ্ছে। ওপারে।

“অ্যাই, কি হয়েছে তোমার?” রেবা আবারো জানতে চাইলো। কিছু একটা বুঝতে পারছে সে।

“উমমম…” রেবার দিকে তাকালো। “কিছু না। তুমি অর্ডার দাও,” বলেই আবার তাকালো রাস্তার ওপারে। মোটরসাইকেলটা দেখা যাচ্ছে না কারণ সেটার সামনে একটা বাস এসে থেমেছে। একটু পরই বাসটা চলে গেলে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।

মোটরসাইকেলটা নেই!

চমকে উঠলো সে। রাস্তার এদিক ওদিক তাকালো। দেখতে পেলো না। রেবার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলেও বার বার রাস্তার দিকে তাকাতে লাগলো জেফরি বেগ।

হয়তো কিছুই না, সে খামোখাই আশংকা করছে। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো।

“আমি ফুচকা খাবো। তুমি কি নেবে?” রেবা জানতে চাইলো। দোকানি ছেলেটা তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

“চটপটি,” ঝটপট বলেই আবারো তাকালো রাস্তার দিকে। কোনোভাবেই সে আশ্বস্ত হতে পারছে না।

রেবা দোকানিকে অর্ডার দিয়ে জেফরির দিকে তাকালো। “তুমি এভাবে রাস্তায় কী দেখছো?”

“কিছু না। এক পরিচিত লোককে দেখেছি মনে হয়, চিনতে পারছি না…”

“ও,” কথাটা বলেই ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে মোবাইলফোনটা বের করলো। ওটা ভাইব্রেট করছে। “ওহ্, মোবাইলটা হাতে তুলে নিলো সে। “বাবা ফোন করেছে…একটু…” বলেই রেবা কলটা রিসিভ করলো।

জেফরি আবারো তাকালো রাস্তার দিকে। রেবার ফোনালাপের দিকে তার একটুও মনোযোগ নেই। অজানা আশংকা জেঁকে বসেছে তার মনে।

রেবা নীচুস্বরে তার বাবার সাথে কথা বলে যাচ্ছে।

জেফরি চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে গেলো। সে কোনোভাবেই চিন্তামুক্ত হতে পারছে না। তার ধারণা মিলন আশেপাশেই আছে। হয়তো একা নয়। তাদের উপর নজর রাখছে। রেবা সঙ্গে না থাকলে এতোটা চিন্তিত হতো না। এখন যদি রিক্সা করে ফিরে যাবার চেষ্টা করে তাহলে সহজ টার্গেট হয়ে যাবে। বাইকের লোকটা যদি সত্যি মিলন হয়ে থাকে তাহলে সে রেবাকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে গেছে।

তার মাথায় অন্য একটা আইডিয়া এলো।

ফোনটা রাখতেই রেবা দেখলো জেফরি রাস্তার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। “কী ব্যাপার…তোমার হয়েছে কি?” দারুণ অবাক হয়ে বললো সে।

হাসি হাসি মুখে জেফরি তাকালো রেবার দিকে। হঠাৎ তাকে অবাক করে দিয়ে চেয়ারটা টেনে একটু সামনে এগিয়ে এসে তার কানের পাশে চুলে হাত বোলাতে লাগলো। “তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে তো!”

জেফরি বেগের এমন দ্রুত পরিবর্তনে যারপরনাই অবাক হলো রেবা। আশ্চর্য! হঠাৎ কী এমন হলো? মনে মনে ভাবলো সে।

.

মিলন দাঁড়িয়ে আছে একটা কসমেটিক শপের ভেতর। কাঁচের দরজার পাশে থরে থরে সাজানো পণ্য নেড়ে চেড়ে দেখে যাচ্ছে সে। কাউন্টারে বসা দোকানি মনে করছে খুব মনোযোগ দিয়ে ওগুলো দেখছে একজন কাস্টমার।

কিন্তু মিলনের তীক্ষ্ণ চোখ কাঁচের দরজার ভেতর দিয়ে রাস্তার ওপারে নিবদ্ধ। ধানমণ্ডি চার নাম্বারের ফুটপাতে যে চটপটির দোকানটা আছে সেখানে বসে আছে জেফরি বেগ আর তার প্রেমিকা।

একটু আগে রিক্সা থেকে নামার সময় জেফরি বেগের সাথে অনেকটা চোখাচোখি হয়ে গেছিলো তার। তবে তার ধারণা ঐ ইনভেস্টিগেটর তাকে দেখে চিনতে পারে নি। না পারারই কথা। হয়তো একটু সন্দেহ হয়েছিলো, এই যা।

সামনে একটা বাস এসে দাঁড়ালে মিলন দ্রুত তার মোটরবাইকটা নিয়ে সটকে পড়ে পাশের একটা গলিতে। ভাগ্য ভালো, পাঁচগজ সামনেই গলিটা ছিলো। তিন-চারটা প্রাইভেটকারের পাশে বাইকটা রেখে এই কসমেটিক শপে ঢুকে পড়েছে সাইডদরজা দিয়ে। শপের আরেকটা দরজা আছে মেইনরোডের দিকে মুখ করে। সেটা দিয়েই এখন তার টার্গেটকে দেখে যাচ্ছে সে।

তার ধারণাই ঠিক, জেফরি বেগের মনে একটু সন্দেহ তৈরি হলেও এখন সে পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত। প্রেমিকাকে নিয়ে চটপটি-ফুচকা খাবে। লজ্জাশরম ভুলে প্রকাশ্যেই প্রেমিকার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। মেয়েটার চুলে হাত বোলাচ্ছে, তার কানে কানে কী যেনো বলছে। কথাটা শুনে মেয়েটা লজ্জা পেলো। জেফরি বেগকে আলতো করে ধাক্কা মেরে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মোবাইলফোনটা বের করে কানে ধরলো সে। কেউ হয়তো কল করেছে তাকে। মেয়েটার চোখেমুখে চাপা হাসি। কিন্তু ইনভেস্টিগেটর মেয়েটার গালে আলতো করে টোকা দিলে কৃত্রিম রাগ দেখালো সে। তাদের সময় খুব ভালো যাচ্ছে।

এই দৃশ্য দেখে মিলনের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। পলির মুখটা ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়।

তারাও এভাবে ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত উপভোগ করেছে। এভাবে একে অন্যেকে পাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। হয়তো শপিং করতে বের হয়েছে দুজন, ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পলিকে খুব কাছে পাবার ইচ্ছে জেগে উঠতো। সব কিছু বাদ দিয়ে ফিরে যেতো বাড়িতে। তারপর প্রেমের চূড়ান্ত মুহূর্তে ডুবে যেতো তারা।

কিন্তু এসবই এখন অতীত। আর কখনও পলির সাথে ওভাবে কোনো মুহূর্ত কাটানো হবে না। ভালোবাসার তীব্রতায় মেয়েটা কখনও তার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলবে না : “আমাকে আরেকটু আদর করো!”

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেললো সে। এখন এসব ভাবার সময় নয়। তবে একটু পর যে কাজ করবে তার জন্যে এরকম আবেগের, ক্রোধের দরকার আছে। প্রতিশোধের স্পৃহা না জাগলে কাজটা ভালোমতো করতে পারবে না।

জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে হাত ঢোকালো। সাইলেন্সার পিস্তলটার অস্তিত্ত্ব টের পেলো আরেকবার। আজকের জন্যে এটাই ব্যবহার করবে। গুলির শব্দ হোক, লোকজন ভয়ে ছোটাছুটি করুক সেটা তার কাম্য নয়। নীরব ঘাতকের মতো দ্রুত কাজ করে সটকে পড়বে। ঐ ইনভেস্টিগেটর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে।

কী করবে না করবে সেটা আরেকবার গুছিয়ে নিলো মনে মনে। দ্বিতীয় কোনো সুযোগ সে পাবে না। সুতরাং মাথা ঠাণ্ডা রেখে, সুন্দরভাবে কাজটা করতে হবে। কোনো ভুল করা চলবে না। আগামীকালই দেশ ছেড়ে চলে যাবে। বহু দূরে গিয়ে শুরু করবে এক নতুন জীবন।

মিলন যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিলো সে দরজা দিয়েই বের হয়ে গেলো। বাইকটা নিয়ে মেইনরোডের দিকে না গিয়ে সোজা চলে গেলো আবাসিক এলাকার ভেতরে। একটু ঘুরপথে চলে আসবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। মূল কাজটার জন্য মাত্র পাঁচ সেকেন্ড সময় বরাদ্দ রেখেছে।

এতেই হবে, মনে মনে বললো সে।

.

রেবা প্রথমে বুঝতে পারে নি। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলো। কিন্তু কানের কাছে মুখ এনে জেফরি যখন বললো-”মুখে হাসি হাসি ভাব করে রাখো। আমার কথার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে না- তখন সে বুঝতে পেরেছিলো বিরাট কোনো সমস্যা হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করার উপায় ছিলো না। বরং জেফরির কথামতো মুখে হাসি ধরে রেখে সে জানতে চেয়েছিলো কি হয়েছে।

দাঁত বের করে হেসে জেফরি বলেছিলো, “পরে বলছি। এখন তুমি মোবাইল ফোন বের করে জামানকে একটা কল করবে…কিন্তু ভাব করবে যেনো তোমার ফোনে কল এসেছে।”

মুখ টিপে রেবা জানতে চায় তখন, “তুমি কি খারাপ কিছু”।

রেবার কথা শেষ না হতেই তার কানে মুখ এনে জেফরি বলে, “এখন কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। যা বলছি তাই করো।”

রেবা জানতে চায়, “জামানকে কী বলবো?” তার মুখের অভিব্যক্তি একেবারেই বিপরীত।

“বলবে, জামান যেনো ধানমণ্ডি থানার পেট্রলকারকে এক্ষুণি চার নাম্বারের এই চটপটির দোকানের কাছে চলে আসতে বলে। ইমার্জেন্সি।”

কথাটা শুনে রেবার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলেও সে হাসি হাসি মুখে মাথা নেড়ে সায় দেয়। জেফরিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে জামানের নাম্বারে ডায়াল করে সে।

পা দোলাতে দোলাতে রেবার গালে আলতো করে টোকা মারে জেফরি। “বলবে, আমার ব্যাকআপের দরকার। একটুও যেনো দেরি না করে।”

ভেতরে ভেতরে রেবা ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেও মুখে দুষ্টুমিমাখা হাসি এঁটে বলে, “ঠিক আছে।”

ওপাশ থেকে জামান কলটা রিসিভ করে যারপরনাই অবাক হয়। খুব প্রয়োজন না পড়লে রেবা তাকে কখনও ফোন করে না। জেফরি নিশ্চিত, জামান ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।

জেফরির শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো একদমে বলে যায় রেবা, তবে তার মুখে এমন অভিব্যক্তি লেগে থাকে যে কেউ বুঝতেই পারবে না কী বিষয় নিয়ে সে কথা বলছে।

ফোনটা রেখে যথারীতি হাসি হাসি মুখে বলে রেবা, “আমার খুব ভয় করছে!”

“ভয় পেয়ো না। আমি আছি,” তাকে আশ্বস্ত করে রেবার হাতটা ধরে হাসি হাসি মুখে বলে জেফরি বেগ। “উল্টাপাল্টা কিছু হলে সোজা মাটিতে শুয়ে পড়বে।” ভয়ঙ্কর এই কথাটা এমনভাবে সে বলে যেনো মজার কোনো জোক বলেছে।

চটপটি আর ফুচকা চলে এলো তাদের সামনে। দোকানি ছেলেটা একটা টুল টেনে এনে তার উপর প্লেট দুটো রেখে চলে গেলো। দুজনের কেউই ফুচকা-চটপটি নিয়ে ভাবছে না এখন।

জেফরি জানে, ধানমণ্ডি থানার কোনো পেট্রলকার যদি আশেপাশে থাকে তাহলে কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে আসতে পারবে। কিন্তু এই কয়েক মিনিটই হচ্ছে সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ।

তাদের সামনের রাস্তায় যানবাহনগুলো উত্তর দিক থেকে আসছে, সুতরাং সেদিকেই তীক্ষ্ণ নজর রাখলো জেফরি বেগ। সারি সারি প্রাইভেটকার আর বাস-মিনিবাস আসছে। একটা মোটরবাইককে দূর থেকে চিহ্নিত করাটা সহজ কাজ নয়।

এমন সময় সবগুলো যানবাহন থেমে গেলো একে একে।

সিগন্যাল পড়েছে।

তাদের সামনে অসংখ্য প্রাইভেটকার আর বড় বড় বেশ কয়েকটি বাস দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বাতি জ্বলার অপেক্ষায়। জেফরি বেগ টের পেলো রেবা আস্তে করে তার একটা হাত ধরেছে। সে ফিরে তাকালো মেয়েটার দিকে। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। “ভয় পেয়ো না।” আশ্বস্ত করলো তাকে।

“আমরা এখান থেকে চলে যাই…চলো,” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো সে।

“হ্যাঁ, চলে যাবো। একটু অপেক্ষা করো।” কথাটা বলেই থেমে থাকা যানবাহনের দিকে তাকালো আবার। মিলনের টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, সে হয়তো ভুল দেখেছে। ওটা মিলন ছিলো না।

সিগন্যাল বদলে গেলে যানবাহনগুলো আবার চলতে শুরু করলো। প্রথমে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো থেমে থাকা গাড়িগুলো।

একটা বাস তাদেরকে অতিক্রম করতেই হঠাৎ দেখতে পেলো সেটার পেছন থেকে একটা মোটরসাইকেল বেরিয়ে আসছে। খুব বেশি হলে তাদের থেকে মাত্র দশ গজ দূরে।

জেফরি বেগ নিশ্চিত, এই বাইকটাই একটু আগে দেখেছিলো রাস্তার ওপারে। আরোহীর মুখটা এবার নির্ভুলভাবে চিনতে পারলো। মাথায় সানক্যাপ।

মিলন!

জেফরি বেগ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় শোল্ডারহোলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করে আনলো।

“শুয়ে পড়ো, রেবা?” পেছনে না তাকিয়েই চিৎকার করে বলে উঠলো সে।

দেখতে পেলো মিলন একহাতে বাইকটার হ্যাঁন্ডেল ধরে রেখেছে, তার অন্য হাতে একটা পিস্তল। তাদের দিকেই তাক করা!

প্রথম গুলিটা করলো মিলন। চলন্ত বাইক থেকেই। একেবারে ভোতা একটি শব্দ। জেফরি একটুও না সরে পাল্টা গুলি চালালো মিলনকে লক্ষ্য করে। প্রচণ্ড শব্দে প্রকম্পিত হলো চারপাশ। কিন্তু কারোর লক্ষ্যই ভেদ হলো না।

দ্বিতীয় গুলিটা যখন মিলন করবে তখন তাদের দুজনের মধ্যে মাত্র কয়েক গজের দূরত্ব। মিলন তার বাইকের গতি না কমিয়েই জেফরিকে অতিক্রম করার সময় গুলিটা চালালো।

ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো জেফরি বেগ। একটা পাস্টিকের চেয়ারসহ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। তবে সে নিশ্চিত, গুলিটা তার গায়ে লাগে নি। সঙ্গে সঙ্গে তাকালো রাস্তার দক্ষিণ দিকে।

মিলনের বাইকটা ততোক্ষণে ত্রিশ-চল্লিশ গজ দূরে চলে গেছে। রাস্তার লোকজন গুলির শব্দ শুনে আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিয়েছে। জেফরি উঠে দাঁড়ালেও আর গুলি করলো না। ভালো করেই জানে কোনো লাভ হবে না। মাঝখানে ক্ৰশফায়ারে পড়ে নিরীহ লোকজনের প্রাণহানি হবার আশংকা রয়েছে।

রাগেক্ষোভে তার শরীর কাঁপতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো রেবার কথা। এক ঝটকায় পেছনে ফিরে তাকালো সে। দৃশ্যটা দেখে তার হৃদস্পন্দন কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেলো।

রেবা উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। একটুও নড়ছে না সে।

“রেবা!” বুকের ভেতর থেকে চিৎকারটা ভেসে এলো জেফরি বেগের।

অধ্যায় ৭৩

বড়জোর দুই মিনিট পরই ধানমণ্ডি থানার একটি টহলগাড়ি এসে পড়লেও ততোক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। সন্ত্রাসী মিলন দু’ দুজন মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে পালিয়ে গেছে।

টহল গাড়ি থেকে পুলিশ নেমে এলে তোকজনের ভীড়টা সরে গেলো। কেউ কেউ পুলিশ দেখে কেটে পড়লো ঘটনাস্থল থেকে। একজন সাব ইন্সপেক্টর ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এসে দেখতে পেলো জেফরির কোলে

অচেতন রেবা। গ্লাস থেকে পানি নিয়ে তার মুখে ঝাঁপটা দিচ্ছে।

রেবাকে উপুড় হয়ে থাকতে দেখে জেফরি বেগ চিৎকার দিয়ে মাটিতে হাটু গেঁড়ে বসে পড়েছিলো। সে ভেবেছিলো রেবা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তার হৃদস্পন্দন কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায় তখন। কিন্তু দু’হাতে জড়িয়ে ধরে রেবার মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। শরীরে কোনো গুলির আঘাত নেই।

রেবা আসলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। ঠিক সময়ে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে গেছে সে। কারণ মিলনের দুটো গুলিই বিদ্ধ হয়েছে রেবা যেখানে বসেছিলো ঠিক তার পেছনে। তবে মানসিক চাপটা নিতে পারে নি। মাটিতে ঝাঁপ দিয়েই জ্ঞান হারায়।

পুরো ঘটনায় ভীষণ মুষড়ে পড়েছে রেবা। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে বেঁচে গেছে সে।

টহল পুলিশের জিপে করে রেবাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার সময় একটা বিষয় নিয়ে জেফরি ভেবে গেছে : মিলন তাকে এতো কাছে পেয়েও লক্ষ্যভেদ করতে পারলো না কেন? তার দু দুটো গুলি ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এরচেয়ে অনেক দূর থেকে সে জেফরির বাম বুকে, ঠিক হৃদপিণ্ড বরাবর গুলি চালিয়েছিলো।

তাহলে কি রেবাই ছিলো টার্গেট?

না। মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিলো সে। রেবাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে এলো হোমিসাইডে।

জামান তার জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো। বেশিরভাগ কর্মকর্তা কর্মচারি চলে গেছে। হাতে গোনা কয়েকজন রাত্রিকালীন ডিউটি দিচ্ছে এখন। আজকে জামানের নাইট-ডিউটি ছিলো না, বাড়ি থেকে সোজা চলে এসেছে এখানে। রেবাকে দিয়ে যখন তাকে ফোন করানো হয়েছিলো তখন সে নিজের বাড়িতেই ছিলো।

মানসিকভাবে যতোটা বিদ্ধস্ত তারচেয়েও বেশি ক্ষুব্ধ জেফরি বেগ। ব্ল্যাক রঞ্জুর দল, বিশেষ করে মিলন তার পথে বাধা হিসেবে যে-ই আসুক না কেন তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে একটুও পিছ পা হচ্ছে না। প্রথমে তার সহকারী জামানকে গুলি করলো ঠাণ্ডা মাথায়, তার বুকেও গুলি চালালো, ভাগ্যের গুণে সে বেঁচে গেছে। এরপর হোমিসাইডে পলিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে আসা হলে ফোন করে রীতিমতো হুমকি দিতে শুরু করে। এখন আবার তার উপর হামলা চালালো। আরেকটুর জন্যে রেবাসহ সে নিজেও বড় কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে যেতে পারতো।

জামানকে নিয়ে নিজের অফিসে এসে বসতেই তার ফোনে রিং হলো। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল করা হয়েছে। জেফরির স্বজ্ঞা বলছে, এটা মিলনের ফোন!

কলটা রিসিভ করলো সে, তবে কিছু বললো না। ওপাশ থেকে কয়েক মুহূর্ত কোনো সাড়া নেই। তারপরই সেই পরিচিত কণ্ঠটা বলে উঠলো :

“চোখের সামনে প্রেমিকাকে খুন হতে দেখে কেমন লাগছে?”

জেফরি ভুরু কুচকে তাকালো জামানের দিকে। ছেলেটা বিস্ময়ে চেয়ে আছে। মিলন মনে করছে রেবা মারা গেছে। তাহলে মিলনের টার্গেট ছিলো রেবা?

মাইগড! কিন্তু রেবা কেন?

মোবাইল ফোনটা লাউস্পিকার মোড়ে দিয়ে দিলো জেফরি বেগ “মিলন…আমি তোকে ছাড়বো না!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো সে।

“আরে আমিই তো তোকে ছাড়বো না, শূয়োরের বাচ্চা!”

“তুই খুব জলদিই আমার দেখা পাবি, বানচোত!” জেফরির মুখ থেকে সচরাচর গালি বের হয় না তবে আজ তার ব্যতিক্রম হলো।

“ইচ্ছে করলে তোকে খুব সহজেই মেরে ফেলতাম, কিন্তু মারি নি। আমি চাই তুইও আমার মতো কষ্ট পা…”।

মিলনের এ কথাটা শুনে জেফরি একটু ধন্দে পড়ে গেলো। মানে কি?

“প্রেমিকার লাশ দেখতে কেমন লাগছে এখন?”

জেফরি চুপ মেরে রইলো।

“খুব খারাপ লাগছে?” মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করলো মিলন।

“আমারও ঠিক এরকম খারাপ লেগেছিলে।”

“মানে?” জেফরি কথাটা না বলে পারলো না।

“মানেটা এখনও বুঝতে পারছিস না?” কথাটা বলামাত্রই উন্মাদগ্রস্তের মতো হাসি দিলো সে। “তুই আমার পলিকে খুন করেছিস, আমি তোরটাকে খুন করলাম। ভেবেছিস হিসেব চুকে গেছে?” আবারো উন্মাদগ্রস্তের হাসি। “না, না! হিসেব এখনও বাকি আছে…”

লাইনটা কেটে দিলো মিলন।

জেফরি চেয়ে রইলো জামানের দিকে। “মাইগড! জামান…মিলনের দ্বিতীয় স্ত্রী পলি নাকি আমার হাতে মারা গেছে!”

“কিন্তু কিভাবে? কখন?” জামানও কথাটা শুনে অবাক হলো।

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”

“স্যার, পরিস্থিতি খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে,” জামান আতঙ্কিত হয়ে বললো। “এভাবে বসে থাকলে হবে না। আমাদেরকে রিঅ্যাক্ট করতে হবে।”

গম্ভীরমুখে জেফরি বেগ মাথা নেড়ে সায় দিলেও বুঝতে পারলো না কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে।

“স্যার?” জেফরিকে চুপ থাকতে দেখে বললো জামান।

মুখ তুলে তাকালো সে।

“আমি ব্ল্যাক রঞ্জুর মালিকানাধীন দুটো লঞ্চের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলাম…”

কথাটা শোনা মাত্রই জেফরির মনে পড়ে গেলো, জামানকে এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলেছিলো সে। “হ্যাঁ, হ্যাঁ…কিছু পেয়েছো?”

পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে নিলো জামান। “লঞ্চ মালিক সমিতি থেকে জেনেছি, লঞ্চ দুটোর নাম হলো, এমভি আকাশ আর এমভি মেঘ…”

“মালিক সমিতি কি করে নিশ্চিত হলো ঐ দুটো লঞ্চ রঞ্জুর?” জেফরি জানতে চাইলো।

“লঞ্চ দুটোর মালিকানা রঞ্জুর বড় ভাই মঞ্জুর নামে…তাছাড়া বরিশাল লাইনে লঞ্চ দুটো এনলিস্ট করার জন্য ব্ল্যাক রঞ্জু নাকি সমিতির প্রেসিডেন্টকে চাপ দিয়েছিলো।”

“আচ্ছা,” বললো জেফরি। “তাহলে তাদের অনুমানই ঠিক। ও দুটো অবশ্যই রঙুর লঞ্চ। তার অনেক ব্যবসাই ভায়ের নামে ছিলো।”

“জি, স্যার…মালিক সমিতির অনেকেই এটা জানে। কাগজপত্রে মালিকানা রঞ্জুর ভাই মঞ্জু, যে বাস্টার্ডের হাতে খুন হয়েছে…”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “লঞ্চ দুটো এখন কোথায় আছে?”

“মালিক সমিতি এ ব্যাপারে কিছু জানে না তবে…”

“তবে কি?” জেফরি কিছুটা আশান্বিত হয়ে বলে উঠলো।

“সমিতির প্রেসিডেন্ট জানিয়েছে, লঞ্চ দুটো অবশ্যই কোনো ডকইয়ার্ডে অ্যাঙ্কর করা আছে।”

“কোন ডকইয়ার্ডে থাকতে পারে?”

জামান কাঁধ তুললো। “নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারে নি। আমরা যেমন ধারণা করেছিলাম, ঢাকা কিংবা নারায়ণগঞ্জের কোনো ইয়ার্ডেই হবে।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জেফরি। “ওটা ঢাকায়…নারায়ণগঞ্জে না। আমি নিশ্চিত।”

জামানও উঠে দাঁড়ালো। “জি, স্যার। সেন্ট অগাস্টিন থেকে নারায়ণগঞ্জ অনেক দূরের পথ…” একটু চুপ করে থেকে বললো, “স্যার কি বাসায় যাবেন এখন?”

জামানের দিকে চেয়ে রইলো জেফরি। “হুম।”

“একটা কথা বলবো, স্যার?”

“বলো।”

“স্টোররুম থেকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটা নিয়ে যান।”

সহকারীর দিকে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ।

“প্লিজ,” বললো জামান।

“ঠিক আছে,” মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো জেফরি।

জামান স্টোররুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটা নিয়ে ফিরে ফিরে এসে দেখলো তার বস কী যেনো ভেবে যাচ্ছে।

“স্যার?”

অন্যমনস্কভাবটা কাটিয়ে উঠে সহকারীর দিকে তাকালো জেফরি। বুলেটপ্রুপ জ্যাকেটটা জামানের হাত থেকে নিয়ে নিলো সে। অফিস থেকে বের হয়ে যাবে ঠিক তখনই কী মনে করে যেনো থেমে গেলো।

“জামান, আজ রাতে তোমার ডিউটি নেই, তাই না?”

“জি, স্যার।”

“কিন্তু আমি চাই তুমি আজরাতে অফিসেই থাকো।”

জামান প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না। চুপচাপ বসের কথা মেনে নিলো। “ওকে, স্যার।”

আর কোনো কথা না বলে অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় জেফরি বেগ টের পেলো খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। কিন্তু সে জানে না, আজকের রাতটা তার জীবনে একেবারেই অন্যরকম একটি রাত হতে যাচ্ছে।

অধ্যায় ৭৪

কারোলবাগে রাত নেমে এসেছে। বেড়ে গেছে শীতের তীব্রতা। লোকজন যে যার ঘরে ফিরে এসে রাতের খাবার খেয়ে টিভি দেখছে নয়তো গল্পগুজব করছে। কিছু কর্মহীন বয়স্ক মানুষ বাড়ির বাইরে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে গায়ে মোটা উলের সোয়েটার কিংবা কাশ্মিরি শাল চাপিয়ে। তবে বাবলু যেখানে থাকে সেই গলিতে কোনো চায়ের দোকান নেই। রাত দশটার মধ্যেই গলিটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। অবশ্য গলি থেকে এগিয়ে গেলে একটু সামনেই দুএকটি চা আর ফলের জুসের দোকান রয়েছে, সেখানটায় কিছু। লোকজনের দেখা মিলবে।

বাবলুর বাড়ির নীচে যে লাইব্রেরিটা আছে সেটা আর সব দিনের মতো রাত নটার পরই বন্ধ হয়ে গেছে। তার বাড়ির আশেপাশে কোনো দোকানপাট না থাকার কারণে গলিটা বেশ সুনশান।

একটা গাঢ় নীল রঙের মাইক্রোবাস এসে থামলো তার বাড়ির সামনে। গাড়ির কাঁচ একেবারে গাঢ় কালচে। ভেতরের বাতি নিভিয়ে রাখার কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রায় মিনিটখানেক পর সাইড দরজাটা আস্তে করে খুলে গেলে তিনজন যুবক বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। তাদের সবার পরনে ফুলস্লিভ আর হাই কলারের কালো গেঞ্জি, তার উপর কালচে রঙের ব্লেজার আর কালো গ্যাবাডিনের ফুলপ্যান্ট। একজনের মাথায় সানক্যাপ। বাকি দু’জনের মধ্যে একজনের মাথাভর্তি কোকড়া চুল, অন্যজনের মাথার চুল একদম ছোটো ছোটো করে ছাটা। পুরু গোঁফ আছে মুখে।

তিনজন যুবকের শারিরীক গঠন বেশ ভালো। লম্বা আর সুগঠিত পেশি। সানক্যাপ বাকি দু’জনের দিকে তাকিয়ে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলে কোকড়া চুলের যুবকটি ঢুকে পড়লো বাবলুর বাড়িতে। এই বাড়িতে কোনো দাড়োয়ান নেই। তিনটি ফ্লোরের মধ্যে নীচের ফ্লোরটার প্রায় পুরোটাই মুলিন্দরের লাইব্রেরি। দোতলা আর তিনতলা একটি কসমেটিকস ফ্যাক্টরির গোডাউন। বাবলু থাকে তিনতলার উপর চিলেকোঠায়।

মেইন গেটটা খোলা দেখতে পেয়ে কোকড়াচুল অবাক হলো। সে ভেবেছিলো এটার তালা আগে খুলতে হবে। মুচকি হেসে ফিরে তাকালো পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জনের দিকে, তারপর ঢুকে পড়লো ভেতরে। একটু পর গোঁফওয়ালা যুবকটিও অনুসরণ করলো তাকে। তবে সানক্যাপ দাঁড়িয়ে রইলো মাইক্রোটার সামনে।

তার নজর তিনতলার উপরে চিলেকোঠার দিকে। রাস্তার দিকে মুখ করে যে জানালাটা আছে সেটা দিয়ে দেখতে পেলো ঘরে টিভি চলছে-বিভিন্ন রঙের আলোর দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।

মুচকি হাসলো সে। তারা এখন নিশ্চিত, বাস্টার্ড ঘরেই আছে। প্রথমে যখন তার খোঁজে এখানে লোক পাঠালো তখন খুব হতাশ হয়েছিলো। মনে করেছিলো বানচোতটা বোধহয় আগেভাগে খবর পেয়ে সটকে পড়েছে। তবে মিনিস্টারের পিএস দূতাবাসের মাধ্যমে খবর নিয়ে জেনেছে, বাস্টার্ড তার নিজের ঘরেই আছে। একদম পাক্কা খবর। কোনো ভুল নেই।

সানক্যাপ জানে, ভুল হবার ঝুঁকিটা কতো বড় হতে পারে। হাতঘড়িতে সময় দেখলো। ইতিমধ্যেই তার দু’জন লোক তিনতলায় চলে গেছে হয়তো। কাজটা খুব একটা কঠিন নয়। বিশেষ করে টার্গেট যখন কিছুই জানে না-এবং নিরস্ত্র। তারপরও সতর্ক থাকা দরকার। সহজ কাজেই গোলমাল বাধে বেশি।

একটু পায়চারি করলো সে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাটা সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে। তাছাড়া দিল্লির শীতটাও শরীরে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। মাইক্রোর ড্রাইভার ছেলেটাকে ইশারা করে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো সে। একটু সময় লাগবে, কারণ তিনতলার উপর বাস্টার্ডের চিলেকোঠায় যেতে হলে একটা লোহার গ্রিলের দরজা খুলতে হবে। এর আগে যাকে পাঠিয়েছিলো, সেই কোকড়াচুলের ছেলেটা জানিয়েছে তিনতলার উপর সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে গ্রিলের গেটটার কথা। যদিও বাস্টার্ড ঘরে আছে তারপরও গ্রিলের দরজায় তালা মারা থাকতে পারে। তালাটা নিঃশব্দে কাটার জন্য সরঞ্জাম রয়েছে তাদের কাছে। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। তারপরই খেল খতম।

মাইক্রো থেকে দশ গজ দূরে গিয়েই আবার ঘুরে দাঁড়ালো সানক্যাপ। আস্তে আস্তে এক পা দু’পা করে মাইক্রোর সামনে আসতেই মাথায় মাঙ্কিক্যাপ, গলায় মাফলার, চশমা পরা এক ভদ্রলোক তার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো। লোকটার কাঁধে শান্তি নিকেতনি ধরণের কাপড়ের ব্যাগ। হাতে চামড়ার দস্তানা। ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট ধরে রেখেছে।

“ভাইসাব, আপকো পাস ম্যাচেস হায়?” দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালানোর ভঙ্গি করে বললো লোকটি।

হাত নেড়ে না করে দিলো সানক্যাপ। একটু সামনে এগিয়ে তাকালো তিনতলার উপরে। ভদ্রলোক এবার মাইক্রোবাসের ড্রাইভারের কাছে গিয়ে তার কাছেও একই ভঙ্গিতে দেয়াশলাই চাইছে।

সানক্যাপ ভালো করেই জানে কোনো রকম ধস্তাধস্তি হবে না। এই দিল্লিতে বাস্টার্ডের কাছে কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু তাদের তিনজনের কাছেই অস্ত্র রয়েছে। যদিও সে নিশ্চিত, অস্ত্র ব্যবহার করার দরকার পড়বে না আজ।

ঘুরে আবারো মাইক্রোবাস থেকে একটু দূরে চলে গেলো হাঁটতে হাঁটতে। বাস্টার্ডের সাথে তার নিজেরও কিছু লেনদেন রয়ে গেছে। আজ সব লেনদেন চুকিয়ে ফেলা হবে।

রাত যতো বাড়ছে দিল্লির শীত ততো তীব্র হচ্ছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে দু’হাত ঘষলো। মাইক্রো থেকে বিশ গজ দূরে গিয়ে আবারো ঘুরে গাড়িটার দিকে এগোতে লাগলো সানক্যাপ। সিগারেট হাতে লোকটাকে আর দেখতে পেলো না। হয়তো ড্রাইভার তার সিগারেট ধরিয়ে দিয়েছে। তাদের ড্রাইভার একজন চেইনস্মোকার। গাড়ি চালানোর সময়ও ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট রাখে।

পায়চারি করতে করতে অস্থির হয়ে গেলো সানক্যাপ। মাইক্রোটার সামনে এসে তিনতলার উপরে তাকালো অধৈর্য হয়ে। এখনও জানালা দিয়ে টেলিভিশনের রঙবেরঙের আলো দেখা যাচ্ছে। এতোক্ষণে তিনতলার ছাদে যে গ্রিলের দরজাটা আছে সেটার তালা খুলে ফেলার কথা।

অবশ্য ঐ বাস্টার্ড হারামজাদা যদি নিজের ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করে রাখে তাহলে আরেকটু সময় লাগবে। এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে কি করতে হবে সেটাও শিখিয়ে দেয়া হয়েছে লোক দুটোকে।

তারপরও সানক্যাপের কাছে মনে হচ্ছে বেশ সময় নিয়ে নিচ্ছে ছেলে দুটো। মেজাজ কিছুটা বিগড়ে গেলো তার। পায়চারি বন্ধ করে মাইক্রোর গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বার বার তাকাতে লাগলো তিনতলার উপরে বাস্টার্ডের চিলেকোঠার জানালার দিকে।

“ইয়ে আপকা গাড়ি হায়?”

কণ্ঠটা শুনে সানক্যাপ চমকে তাকালো। সেই মাঙ্কিক্যাপ পরা লোকটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। হিন্দি ভাষাটা বুঝলেও মুখে বলতে গেলে তার সমস্যা হয়।

“ইয়ে তো হাটানা পারে গা,” লোকটি হেসে বললো তাকে।

গাড়িটা সরাতে বলছে কেন? সানক্যাপ একটু চুপ থেকে বললো, “প্রবলেম কেয়া হায়?”

গলায় মাফলার পেচিয়ে রাখার কারণে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। লোকটি আঙুল তুলে তার পেছন দিকে ইঙ্গিত করলো। বুঝতে না পেরে পেছনে তাকালো সানক্যাপ, সঙ্গে সঙ্গে খিচুনি দিতে শুরু করলো সে। মাঙ্কিক্যাপ চেয়ে রইলো তার দিকে। সানক্যাপের কাঁধে একটা কলমের মতো জিনিস ঠেসে রেখেছে সে। মৃদু বিন্ হবার শব্দ শোনা গেলো এবার।

মাত্র দশ সেকেন্ড। তারপরই সানক্যাপ লুটিয়ে পড়তেই মাঙ্কিক্যাপ তাকে মাইক্রোবাসের সাথে ঠেসে ধরে ফেললো।

.

তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে কোনো সমস্যাই হয় নি। যে বাড়িতে দাড়োয়ান থাকে না সেই বাড়িতে প্রবেশ করা কী আর এমন ঝামেলার।

কোকড়া চুলের যুবকটির নাম যাদব, বিহারের ছেলে, থাকে দিল্লিতে। তার সঙ্গি শাকিল অবশ্য দিল্লির ছেলে। তিনতলার উপরে চিলেকোঠায় যাবার পথে একটাই বাধা-গ্রিলের দরজাটা।

তারা দু’জন সেই গ্রিলের দরজার সামনে এসে ভেতরে উঁকি মেরে দেখে নেয়। সামনের কিছুটা অংশ তিনতলার ছাদের খোলা জায়গা। দরজার বাম পাশে একটা চিলেকোঠা। সেখানেই তাদের শিকার আছে। নিজের ঘরে বসে টিভি দেখছে সে। ভলিউম একটু চড়া। কান পাতার দরকার হলো না, দরজার বাইরে থেকেই শুনতে পেলো হিন্দি সিনেমার গান বাজছে।

।যাদব আর শাকিল সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে পড়ে। কাজটা তেমন কঠিন কিছু না। একটা মাঝারি সাইজের তালা খুলতে হবে। তবে ঝামেলা হলো, তালাটা ভেতর থেকে লাগানো।

সেটাই স্বাভাবিক। ঘরের লোকটি ভেতরে আছে, তাই ভেতর থেকেই তালা লাগাবে। অবশ্য গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে তালাটা খোলা যাবে, শুধু একটু সময় লাগবে, এই যা।

যাদব তালা খোলার কাজে লেগে পড়লে শাকিল চারপাশটা লক্ষ্য রাখতে শুরু করে। যাদবের কাছে এ ধরণের তালা খোলার জন্য মাস্টার কি আছে।

পাঁচ মিনিট পর তালাটা খুলে গেলো।

তারা দু’জন ঢুকে পড়লো ভেতরে। পা টিপে টিপে বাবলুর চিলেকোঠার সামনে চলে এলো দু’জন। দরজাটা বন্ধ নয়। একটু ফাঁক হয়ে আছে। শাকিল আর যাদব একে অন্যের দিকে তাকালো। তাদের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। তাদের শিকার বেশ নিশ্চিন্তে ঘরে বসে টিভি দেখছে।

যাদব কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে হাতে তুলে নিলেও শাকিল পকেট থেকে একটা ছোটো শিশি আর রুমাল বের করে শিশি থেকে কিছু তরল ঢেলে রুমালটা সাবধানে ভিজিয়ে নিলো।

দরজাটার সামনে গিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো যাদব। শাকিল অন্যপাশে এসে যাদবকে ইশারা করলে যাদব মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দরজাটা একটু ফাঁক করে ভেতরে উঁকি মারলো। বিছানাটা দেখা যাচ্ছে কিন্তু সেখানে কেউ নেই। ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো সে। তার পেছন পেছন শাকিল।

অন্ধকার ঘর, জানালা দিয়ে বাইরের আলো আসছে, কিন্তু সেই আলোকে ছাপিয়ে গেছে টিভির পর্দা থেকে ঠিকরে বের হওয়া আলো। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘরে কেউ নেই।

শাকিল আর যাদব বিস্মিত হয়ে একে অন্যের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণের জন্য ভড়কে গেলো তারা। তারপরই একটা শব্দ শুনতে পেলো, সেটা টিভি থেকে আসছে না।

পানি পড়ার শব্দ!

শাকিল ঘরের ডান দিকে অ্যাটাচড বাথরুমের দরজার দিকে তাকালো। দরজার নীচ দিয়ে আলো দেখতে পেলো সে। বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। দু’জন একসাথে বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে কান পাতলো।

তাদের শিকার এখন বাথরুমে!

দরজার দু’পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তারা।

তিন মিনিট পর যাদব আর শাকিল কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠলো। সন্দেহ হতে লাগলো তাদের। কিন্তু কী করবে বুঝতে পারলো না। আরো দুমিনিট পর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না তারা। শাকিল আস্তে করে দরজাটায় ধাক্কা মারতেই সেটা খুলে গেলো।

দরজাটা বন্ধ করা ছিলো না?!

দারুণ অবাক হলো তারা, কিন্তু তারচেয়ে বেশি অবাক হলো ভেতরে কেউ নেই দেখে।

দু’জনেরই ভিমরি খাবার জোগার হলো। একে অন্যের দিকে তাকালো অবাক হয়ে। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না। তবে এটা বুঝতে পারলো কিছু একটা গড়বড় হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হবার জন্যে পা বাড়ালো তারা।

কিন্তু দরজার বাইরে আসতেই পর পর দুটো ভোতা শব্দ শোনা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়লো পান্ডা দু’জন। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মাঙ্কিক্যাপ। তার হাতে সাইলেন্সর পিস্তল। পুরো মুখটা ঢাকা, শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। সেই চোখে হিমশীতল হিংস্রতা।

বাম হাতে মাঙ্কিক্যাপটা খুলে ফেললে বেরিয়ে এলো পেশাদার খুনি বাস্টার্ডের মুখটা।

অধ্যায় ৭৫.

মাইক্রোবাসটা যখন বাবলুর বাড়ির সামনে এসে থামে তখন সে নিজের ঘরেই ছিলো না। বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখেছে।

মাইক্রো থেকে নেমে আসে তিনজন যুবক। তিনজনের পোশাকই কালো। তবে একজনের মাথায় ছিলো সানক্যাপ। লোকটাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারে নি। যাইহোক, তিনজনের মধ্যে দু’জন তার বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লে সানক্যাপ মাইক্রোর সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। মাইক্রোর ড্রাইভার গাড়িতেই ছিলো, সে একবারের জন্যেও নামে নি।

একটু পর সানক্যাপ মাইক্রোর সামনে পায়চারি করতে থাকলে সে ঠিক করে কাজে নেমে পড়তে হবে, কারণ সময় খুব বেশি নেই। বড়জোর দশ পনেরো মিনিট।

উলের সোয়েটারের উপর শার্ট পরার কারণে একটু মোটা দেখাচ্ছিলো তাকে, সেইসাথে মাথার মাঙ্কিক্যাপ, চোখে চশমা, গলায় মাফলার আর কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখার ফলে গেটআপটা একদম বদলে যায়। কাপড়ের ব্যাগটি মুলিন্দর তাকে দিয়েছিলো, এরকম একটি ব্যাগ সব সময় ব্যবহার করে সে। কিন্তু এতোদিন এটা ব্যবহার করার মতো উপলক্ষ্য পায় নি বাবলু। এই ব্যাগটি শুধু গেটআপ বদলানোর জন্য ব্যবহার করে নি, এটার ভেতরেই আছে। হঠাৎ করে আবিষ্কার করা মারণাস্ত্রটি।

১২০০ ভোল্টের একটি ইউপিএস!

তার ঘরে একটি ডেস্কটপ কম্পিউটার আছে। ঢাকার মতো না হলেও দিল্লিতে মাঝেমধ্যে লোডশেডিং হয়, তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা করে বিদ্যুতের ভোল্টেজের ওঠানামা। এ কারণে কম্পিউটারের সাথে একটি ইউপিএস রেখেছে। ১২০০ ভোল্টের এই ইউপিএসটিই হঠাৎ করে হয়ে উঠেছে তার একমাত্র অস্ত্র।

নিরাপদ, নিঃশব্দ আর কার্যকরী একটি হাতিয়ার।

যখন মনে হচ্ছিলো তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই তখনই ইউপিএসটা মৃদু প্রতিবাদের সুরে বিপু করে ওঠে।

দশ মিনিটের লোডশেডিংটা তাকে নতুন আর ভয়ঙ্কর একটি অস্ত্রের সন্ধান দিয়েছে।

১২০০ ভোল্টের ইউপিএসটা শক্তিশালী কম্পিউটার আর মনিটরকে টানা পনেরো মিনিট বিদ্যুত সরবরাহ করতে পারে। এক পাউন্ড পাউরুটির আকারের এই জিনিসটা ওজনে একটু ভারি হলেও খুব সহজেই বহন করা যায় একটা ব্যাগে।

এরপর কিভাবে কি করতে হবে সেসব বুদ্ধি খুব দ্রুত চলে আসে তার মাথায়।

ইউপিএসটার আউটপুট ক্যাবলের শেষ প্রান্তটি কেটে তিনটি তার বের করে ফেলে সে। লাল রঙের তারটি বাদে বাকি দুটো তার স্কচটেপ দিয়ে মুড়িয়ে রাখে। লাল রঙের তারটি পজিটিভ, এটা দিয়েই বিদ্যুত প্রবাহিত হয়। তারটা একটু চেছে ভেতরের অংশ বের করে একটা ক্রু ড্রাইভারের ধাতব অংশে পেচিয়ে সেটাতে স্কচটেপ লাগিয়ে নেয় যেনো খুব সহজে বিচ্ছিন্ন না হয়। এবার ইউপিএসটা কাপড়ের ব্যাগে ভরে নেয় সে। ব্যাগের যে দিকটায় ইউপিএসের পাওয়ার বাটনটা পড়ে সেই জায়গাটিতে ছোট্ট করে একটা ফুটো করে নেয় ব্যাগের বাইরে থেকে সুইচ অন-অফ করার জন্য।

ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে প্রায় একগজ লম্বা আউটপুট ক্যাবলটি শরীরের পাশ ঘেষে, বগলের নীচ দিয়ে বাহুর সাথে আটকে নেয় স্কচটেপের সাহায্যে। ক্রু ড্রাইভারটি তার হাতের তালুতে এমনভাবে রাখে যাতে ফুলহাতার শার্ট পরার পর হাত মুঠি করে রাখলে সেটা দেখা না যায়। ইলেক্ট্রক শক থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য হাতে পরে নেয় চামড়ার দস্তানা।

স্ক্রু ড্রাইভারের ধাতব অংশটি সাধারণ কোনো সিগারেটের চেয়ে সামান্য বড়। সেটার উপর সাদা কাগজের রোল পেচিয়ে আটকে রাখে। ফলে, আঙুলের ফাঁকে সিগারেট আটকে রেখেছে মনে হলেও আদতে সেটা ক্রুড্রাইভারের ধাতব অংশ। রোল করা কাগজটি একটুখানি সরালেই বেরিয়ে আসবে আধ ইঞ্চির মতো ধাতব অংশ। সেটুকুই তার কাজের জন্য যথেষ্ট।

সানক্যাপের কাছে গিয়ে প্রথমে দেয়াশলাই চায়, লোকটা হাত নেড়ে তাকে না করে দিলে মাইক্রোবাসের ড্রাইভারের কাছে যায়। প্রথমে ড্রাইভারের কাছে গেলে সানক্যাপ হয়তো সন্দেহ করতো। যাইহোক, ড্রাইভার লোকটার হাতে সিগারেট ছিলো। দেয়াশলাই চাইতেই লোকটা তার সিগারেট বাড়িয়ে দেয়। সিগারেটটা নিতে গিয়েই লোকটার হাতে ক্রুড্রাইভারের ধতব অংশটা ঠেসে ধরে। অবশ্য তার ঠিক আগেই ইউপিএসের পাওয়ার বাটনটা অন করে নিয়েছিলো। বাম পাশে তাকিয়ে দেখে সানক্যাপ উল্টো দিকে হেঁটে যাচ্ছে। এদিকে ড্রাইভার লোকটি খিচুনি দিতে দিতে অসাড় হয়ে পড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে।

লোকটা নিস্তেজ হয়ে ড্রাইভিং সিটের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকলে সে আস্তে করে মাইক্রোর বিপরীত দিকে চলে যায় কারণ সানক্যাপ ঘুরে গাড়ি কাছে চলে আসছিলো। লোকটা মাইক্রোর সামনে চলে এলে তার আশংকা হতে থাকে, ড্রাইভারকে বুঝি দেখে ফেলবে। দেখে ফেললে একটু সমস্যা হয়ে যেতো তার জন্য। এক এক করে কাবু করার পরিকল্পনাটা একটু এলোমেলো হয়ে যেতো।

কিন্তু না, সানক্যাপের নজর ছিলো তিনতলার উপরে, তার চিলেকোঠার দিকে। লোকটা মাইক্রোর গায়ে হেলান দিয়ে উপরে চেয়ে থাকে অধৈর্যের সাথে। ড্রাইভারের দিকে ফিরেও তাকায় নি।

এটা দেখে এবার হাফ ছেড়ে বাঁচে। আস্তে করে সানক্যাপের অলক্ষ্যে চলে আসে তার পাশে। লোকটাকে চমকে দিয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করে এটা তার গাড়ি কিনা।

সানক্যাপ চমকে তার দিকে তাকায়। মাথা নেড়ে সায় দেয় শুধু।

“ইয়ে তো হাটানা পারে গা,” হেসে বলে ছদ্মবেশি বাবলু।

“প্রবলেম কেয়া হায়?” সানক্যাপ অবাক হয়ে বলে।

বাবলু পেছন দিকে হাত তুলে দেখালে নোকটা সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে তাকায়, আর ঠিক তখনই তার ঘাড়ে ঝুঁড্রাইভারের ধাতব অংশটা চেপে ধরে। ভয়ঙ্করভাবে খিচুনি দিতে দিতে লোকটা যখন ঢলে পড়বে তখন ইউপিএসের পাওয়ার বাটনটা অফ করে দিয়ে তাকে দু’হাতে ধরে ফেলে তাকে।

মাইক্রোবাসের সাইডদরজাটা খুলে সানক্যাপকে সিটের উপর শুইয়ে দিয়ে কাপড়ের ব্যাগ থেকে দড়ি আর স্কচটেপ বের করে নেয়। দ্রুত লোকটার হাত পা বেধে মুখে টেপ লাগিয়ে সিটের উপর ফেলে রাখে। মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকেও পেছনের সিটে টেনে এনে একইভাবে বেধে ফেলে সে। সানক্যাপের কোমর থেকে একটা সাইলেন্সর পিস্তল খুঁজে পেলে অনেকদিন পর কালো ধাতব জিনিসটার শীতলতা হাতে টের পায়। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে ইউপিএসের ব্যাগটা গাড়িতে রেখে সানক্যাপের হাত-মুখ-পা বেধে ফেলে, তারপর দরজা বন্ধ করে তিনতলার উপরে চিলেকোঠার দিকে তাকায় সে। তার বিশ্বাস ঐ দুজন লোক এখন তার ঘরেই আছে। না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। একটা সাইলেন্সার পিস্তল তার কাছে আছে। তাদের সাথে যদি সিঁড়িতে দেখা হয়ে যায় তাহলে গুলি চালাতে একটুও দেরি করবে না।

আগের চেয়ে দ্বিগুন আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাবলু সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরের কাছে চলে আসে পা টিপে টিপে।

তার ঘরের ভেতরে লোক দুটো আছে বুঝতে পেরে দরজার পাশে পিস্তল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

গুলি করার পর পান্ডামতো দু’জন লোককে নিজের ঘরে টেনে এনে বাতি জ্বালিয়ে দেখে নেয়। না। এদেরকে সে চেনে না। লোকগুলোর কোমর থেকে আরো দুটো সাইলের পিস্তল খুঁজে পেলে সেগুলোও নিয়ে নেয়। তবে খেয়াল করে, গোঁফওয়ালা লোকটার হাতে একটা রুমাল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে ক্লোরোফর্ম মেশানো আছে তাতে। লোকটার পকেট থেকে ক্লোরোফর্মের একটা ছোটো শিশিও খুঁজে পায়। শিশিটা হাতে নিয়ে একটু ভাবে। নতুন আরেকটি সত্য আবিষ্কার করে বাবলু।

এরপর দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নীচের মাইক্রোবাসে গিয়ে ড্রাইভারের হাত-পা-মুখ কাপড় দিয়ে বেধে রেখে সানক্যাপ পরা লোকটাকে কাঁধে করে নিয়ে আসে উপরে।

বিছানার উপর হাত-পা-মুখ বাধা সানক্যাপকে নামিয়ে রাখতেই লোকটার মুখ এই প্রথমবারের মতো স্পষ্ট চোখে পড়ে তার। সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে সানক্যাপটা খুলে ফেলতেই চিনে ফেলে তাকে।

ঝন্টু।

এর আগেও এই ঝন্টুকে সে নিজের কজায় নিয়ে নিয়েছিলো। সেদিনও লোকটা তাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছিলো, আজও তাই করবে। তারচেয়েও বেশি করতে হবে। নইলে…

.

প্রথমে ঝাপসা দেখলেও কয়েক মুহূর্ত পর যে দৃশ্যটা ঝন্টু দেখতে পেলো সেটা একেবারেই অচিন্তনীয়। আৎকে উঠে চিৎকার দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।

তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই ভয়ঙ্কর খুনি বাস্টার্ড!

এটা কি দুঃস্বপ্ন? মনে মনে ভাবলো সে। কোনো কিছু মনে করতে পারলো না হুট করে। শেষ যে কথাটা তার মনে আছে, মাইক্রোর গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এক লোক এসে গাড়িটা সরাতে বলে তাকে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

টের পেলো তার হাত-পা-মুখ শক্ত কিছু দিয়ে বাধা। একটা ঘরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। ভালো করে ঘরটার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো একটু দূরেই যাদব আর শাকিলের নিথর দুটি দেহ পড়ে আছে। একদম নড়ছে না। মেরে ফেলেছে? হায় আল্লাহ!

ভয়ে আতঙ্কে কেঁপে উঠলো সে। নড়াচড়া করার চেষ্টা করতেই বাস্টার্ড নামক খুনিটা তার মাথার চুল খপ করে ধরে ঝাঁকুনি দিলো।

“একদম নড়বি না…” কথাটা বলেই তার মুখের কাছে মুখ এনে মুচকি হাসলো সে।

ঝন্টু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো। সে জানে, এই আজরাইলটার হাত থেকে আজ আর রক্ষা পাবে না। জ্ঞান ফেরার পর থেকে খুব দুর্বল অনুভূত হচ্ছে। এই খুনি কি ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করেছে বুঝতে পারলো না। তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্নও নেই।

চোখের সামনে ভয়ঙ্কর লোকটাকে দেখে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। তাকে কি চিনতে পেরেছে!

“অনেক দিন পর আবার দেখা হলো আমাদের,” আস্তে করে বললো বাবলু। “এখনও তুই রঞ্জুর সাথেই আছিস,” কথাটা বলে আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়লো। “মনে হচ্ছে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তুই রঞ্জুকে ছাড়তে পারবি না।”

নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে গেলো ঝন্টুর। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে কোটর থেকে যেনো ঠিকরে বের হতে উদ্যত হলো। আমি শেষ! মনে মনে চিৎকার করে বললো সে।

বাবলু উঠে দাঁড়ালো, ঘরের এককোণে রাখা ক্লোজেট খুলে একটা কিচেন নাইফ আর মাংস কাটার চাপাতি বের করলো।

গা শিউড়ে উঠলো রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোকটির।

হায় আল্লাহ…এই খুনি কি করবে! আর্তনাদ করে উঠলো ঝন্টু কিন্তু সেটা আর কেউ শুনতে পেলো না।

পেছন ফিরে হাত-পা-মুখ বাধা ঝন্টুকে দেখে নিলো এক পলক। খুব সম্ভবত প্যান্ট নষ্ট করে ফেলেছে এই জঘন্য সন্ত্রাসীটা। সে জানে, অচিরেই ঝন্টু তার জীবনের সবচাইতে বড় দুঃস্বপ্ন দেখবে।

খুব জলদি!

ব্ল্যাক রঞ্জুর এই চ্যালাটাকে নিয়ে সে কী করবে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে। এখন সেই পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করবে। তবে একটু সময় নিয়ে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজটা করতে হবে। কারণ নতুন একটি সত্য আবিষ্কার করেছে।

ঝন্টুর দিকে তাকালো সে। ছেলেটার অবস্থা এমন, আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাক করেই বুঝি মারা যাবে। কিন্তু সেটা হতে দেয়া যাবে না। রঞ্জুর এই শূয়োরটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য।

ব্ল্যাক রঞ্জু তাকে শেষ করার জন্য দিল্লিতে কিছু লোক পাঠিয়েছে, খবরটা জেফরি বেগের কাছ থেকে পাওয়ার পর প্রথমে বিশ্বাসই করে নি। পরে যখন বিশ্বাস হলো ঐ ইনভেস্টিগেটরের কথা সত্যি তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়েছিলো তার। কিন্তু সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য। তারপরই নিজের ভেতরে ঝিমিয়ে থাকা বহু অভিজ্ঞ আর পুরনো মানুষটা মুহূর্তেই জেগে ওঠে। আর এখন, সব কিছু তার নিয়ন্ত্রণে!

হাত-পা বাধা অবস্থায় ঝন্টু পড়ে আছে ঘরের এককোণে। তার চোখেমুখে জান্তব ভীতি। রঙুর ব্যক্তিগত জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য সে নিজেই এখন খুন হতে চলেছে। এর আগেও একবার তাকে বাগে পেয়েছিলো বাবলু, তখন হত্যা করে নি। কিন্তু আজ আর কোনো সুযোগ দেবে না।

এদিকে ঝন্টুর মাথায় ঢুকছে না কিভাবে বাস্টার্ড আগেভাগে সব জেনে গেলো। কে তাকে জানালো? এই অসম্ভব কাজটা কিভাবে সম্ভব হলো?

টের পেলো প্রচণ্ড মানসিক চাপে কানে ভো ভো শব্দ হচ্ছে। ঘরে টিভি চললেও সেটার আওয়াজ গুলিয়ে যাচ্ছে।

মৃত্যুর কথা ভাবতেই দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো তার। এর সামনে কেঁদে ফেলা ঠিক হবে না জেনেও কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না নিজেকে।

“কাঁদছিস কেন?” ঝন্টুর সামনে হাটু গেড়ে বসে জানতে চাইলো বাবলু।

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো সন্ত্রাসী।

“কাঁদবি না,” বললো বাবলু। “আমি তোকে মেরে ফেলার কথা ভাবছি। সত্যি কথা বললে তোকে জানে মারবো না। কিন্তু মিথ্যে বললে…” বিছানার উপর রাখা চাপাতি আর চাকুটার দিকে তাকালো। “…ওগুলো ব্যবহার করবো।”

ঝন্টু ফ্যালফ্যাল করে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কেবল।

মুচকি হেসে ঝন্টুর গালে মৃদু একটা চাপড় মেরে তার মুখের বাধনটা খুলে দিলো। “আমি জানি ব্ল্যাক রঞ্জু এখন দিল্লিতে আছে। দিল্লিতে এসে মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছে ঐ বানচোতটা।” বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। “তোরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবার জন্যে এসেছিলি…তাই না?”

“রঞ্জু এখন কোথায় আছে আমি জানি…” হরবর করে বলে উঠলো ঝন্টু।

“অবশ্যই জানিস।”

“আপনি চাইলে আমি আপনারে ওইখানে নিয়া যামু।”

মুচকি হাসলো বাবলু। “এই কাজটা তোদের গাড়ির ড্রাইভার খুব ভালোমতোই করতে পারবে। এর জন্য তোকে আমার দরকার হবে না।” ঝন্টু জানে কথাটা ঠিক। মাত্র গতকাল দিল্লিতে এসেছে, রঞ্জু যে বাড়িতে আছে সেটা চিনলেও এখান থেকে পথঘাট চিনে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে না। বাস্টার্ডও এটা বুঝে গেছে। তাহলে তার কাছ থেকে কী জানতে চাইছে বদমাশটা?

ঝন্টুর মাথার চুল খপ করে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিলো সে। “এখন যা জানতে চাইবো একদম ঠিক ঠিক জবাব দিবি। মিথ্যে বললে কি করবো তা কল্পনাও করতে পারবি না।”

“আপনি যা জানতে চান বলেন,” ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো ঝন্টু। “আমি সত্যি কথাই বলবো, বিশ্বাস করেন।”

“তুই যদি ভেবে থাকিস এতো দূর থেকে তোর দেয়া ইনফর্মেশনটা আমি চেক করতে পারবো না তাহলে বিরাট ভুল করে ফেলবি।”

অধ্যায় ৭৬

জেফরি বেগ নিজের ঘরে এসে রেবার সাথে ফোনে একঘণ্টার মতো কথা বলে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে। যে ট্রমার মধ্যে নিপতিত হয়েছিলো সেটা থেকে মেয়েটাকে বের করার দায়িত্ব তারই। রেবা এখন সেই ধকল থেকে কিছুটা সেরে উঠলেও নতুন এক দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত হয়েছে। তার এই দুশ্চিন্তার নাম জেফরি বেগ।

তার ধারণা যেকোনো সময় তার উপর আবার আঘাত নেমে আসতে পারে। ভয়ঙ্কর সব লোকজন তার পেছনে লেগেছে। কথাটা মিথ্যে নয় কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব টেনশনে পড়ে গেছে রেবা।

জেফরি তাকে আশ্বস্ত করেছে সে অনেক বেশি সতর্ক এখন। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা গ্রহণ করা হয়েছে হোমিসাইডের পক্ষ থেকে। যদিও এরকম কিছুই করা হয় নি। রেবাকে আশ্বস্ত করার জন্য সত্যি-মিথ্যা যা বলার সবই বলেছে।

নিজের ঘরে একা একা বসে ভাবছে ব্ল্যাক রঞ্জুর দল আর কি করতে পারে।

মিলন যতোক্ষণ বাইরে ঘুরে বেড়াবে ততোক্ষণ তার আর রেবার কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। যেকোনো সময় বানচোতটা আবার আঘাত হানবে। এখনও সে জানে না রেবা বেঁচে আছে। জানামাত্রই যে আবার চেষ্টা করবে সে ব্যাপারে জেফরির মনে কোনো সন্দেহ নেই। খুব দ্রুত এই ব্যাপারটা সমাধান করতে হবে।

ব্ল্যাক রঞ্জু ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। যদিও মিনিস্টার আর তার পিএস বলে নি কোথায় গেছে, কিন্তু তার দঢ় বিশ্বাস ঐ জঘন্য খুনি দিল্লিতে গেছে। প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত সে। হয়তো নিজের হাতেই বাবলুকে হত্যা করে মনের জ্বালা মেটাবে।

এদিকে মিনিস্টারের ছেলে তুর্য এখনও মুক্তি পায় নি। হয়তো এতোক্ষণে ছেলেটাকে খুন করে গুম করে ফেলেছে রঙুর লোকজন। আর যদি বেঁচেও থাকে, আজ রাতের মধ্যেই ছেলেটাকে হত্যা করে ফেলবে তারা। জেফরি যতোই চেষ্টা করুক, ছেলেটাকে বাঁচাতে পারবে না। অথচ তুর্যের সম্ভাব্য অবস্থান প্রায় বের করে ফেলেছে, শুধু একটা দিন যদি বাড়তি পেতো তাহলে ছেলেটাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হতো।

তবে ছেলেটাকে বাঁচানোর একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে, আর সেই সম্ভাবনাটা অনেকগুলো যদি’র উপর নির্ভর করছে এখন।

বাবলু যদি তার সব কথা বিশ্বাস করে থাকে; রঞ্জুর দলের ভয়ে পিছু না হটে সে যদি তাদের মোকাবেলা করে; শেষ পর্যন্ত একদল ভয়ঙ্কর লোকের হাত থেকে যদি বেঁচে যেতে পারে; যদি রঞ্জুর দলের…

হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠলে তার ভাবনায় ছেদ পড়লো। কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার মনে হলো, মিলন ফোন করেছে।

কিন্তু ডিসপ্লেতে যে নাম্বারটা ভেসে উঠেছে সেটা ভারতের। জেফরির সারা শরীরে উত্তেজনা বয়ে গেলো।

“হ্যালো!”

“মি: বেগ…” সুদুর দিল্লি থেকে বাবলুর কণ্ঠটা বলে উঠলো। “…আপনার জন্য আমার কাছে একটা দামি তথ্য আছে।”

.

রাতের এই সময়টায় পথঘাট সব ফাঁকা। ঘর কুয়াশা পড়ছে। দশ গজ সামনের দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে না। হুডি পরা এক লোক পার্কের বাউন্ডারি গ্রিলের সামনে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। তিন ফুট উঁচু গ্রিলটা টপকালেই ফুটপাত। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাস্তার ওপারে ছয় তলার একটি অ্যাপার্টমেন্টের দিকে।

তিনতলার কর্নার ফ্ল্যাটটার বড় বড় জানালা দিয়ে আলো আসছে। তার মানে তার শিকার এখনও জেগে আছে। কোমরের পিস্তলটায় হাত রাখলো সে। এখন আর কেউ তাকে থামাতে পারবে না। ব্ল্যাক রঞ্জু চলে গেছে দেশের বাইরে। এতোক্ষণে হয়তো বাস্টার্ডকে নিয়ে নির্মম খেলা শুরু করে দিয়েছে। প্রতিশোধের আগুন উগলে দিচ্ছে তার উপর।

সেও উগলে দেবে। মনের ভেতর যে আগুন জ্বলছে আজ দুদিন ধরে সেই আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে একজনকে।

অ্যাপার্টমেন্টের মেইনগেটটায় দাড়োয়ান আছে। সেটা কোনো ব্যাপার। তবে এখনও দুএকজন বাসিন্দা রাত করে বাড়ি ফিরছে। হয়তো কাজ শেষে কিংবা ক্লাব-পার্টি থেকে ফিরে আসছে নিজের ঘরে।

মিলন আরেকটু অপেক্ষা করবে। তার টার্গেট বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেই সে কাজে নেমে পড়বে। সময় কাটানোর জন্য একটা সিগারেট ধরালো। পার্কের এদিকটায় কোনো মানুষ ভুলেও আসবে না, সুতরাং নিশ্চিন্তে গাছে হেলান দিয়ে সিগারেট খেতে লাগলো সে।

হঠাৎ লক্ষ্য করলো পকেটে রাখা মোবাইলফোনটা ভাইব্রেট করছে। ফোনটা বের করে দেখলো একটা ইনকামিং মেসেজ এসেছে। ওপেন করলো সেটা। বোনাস টকটাইমের একটি অফার।

ফোনটা পকেটে রেখে আবারো সিগারেটে টান দিলো সে। তিনতলার বড় একটা জানালার দিকে চোখ যেতেই একটা জিনিস দেখতে পেলো। জানালার পর্দা একটু ফাঁক থাকার কারণে স্পষ্ট বুঝতে পারলো নোকটা কে। তার টার্গেট জেফরি বেগ।

কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলছে আর পায়চারি করছে ঘরের মধ্যে।

আজ রাতটাই তোমার শেষ রাত, বানচোত! মনে মনে বললো মিলন। সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে দিলে তার সামনের দৃশ্যটা কিছুক্ষণের জন্য ঝাপসা হয়ে এলো।

.

রাত বারোটার কিছু পরে হোমিসাইডের কমিউনিকেশন্স রুমে বসে আছে জামান। একটু আগে তার বস ফোন করে একটা নাম্বার ট্র্যাকডাউন করতে বলেছিলো এখন সেই কাজটাই করছে।

জেফরি বেগ যখন তাকে বলেছিলো আজরাতে ডিউটি দিতে হবে তখন সেটার কারণ খুলে বলে নি। জামানের মনে প্রশ্ন জেগেছিলো কিন্তু বসকে কিছু জিজ্ঞেস করে নি সে। এখন বুঝতে পারছে কেন তাকে হঠাৎ করে আজরাতে ডিউটি দিতে বলেছিলো।

নাম্বারটা নাকি ঐ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী মিলনের। তার বস এটা কোত্থেকে জোগার করলো এতো রাতে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। তার বস একটু পরই হোমিসাইডে আসছে বলেও জানিয়েছে। জামান মনে মনে কিছু একটা আশংকা করছে।

যাইহোক, জেফরি বেগ তাকে বলে দিয়েছে ফিশিং করে সেলফোনটার লোকেশন জানতে হবে। জামান এখন সেটাই করছে। বোনাস কলরেটের খবর দিয়ে একটা সার্ভিস মেসেজ পাঠিয়েছে সে। এক মিনিটের মতো সময় লাগবে।

জামানের সামনে বিশাল প্লাজমা স্ক্রিন, তাতে ঢাকা শহরের ভার্চুয়াল মানচিত্রটি দেখা যাচ্ছে। অস্থির হয়ে কিবোর্ডের পাশে আঙুল দিয়ে তাল ঠুকে। গেলেও তার চোখ স্ক্রিন থেকে সরছে না।

বিপ!

এই শব্দটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো। মানচিত্রের একটি জায়গায় লাল টকটকে বিন্দু জ্বলছে-নিভছে, সেই সাথে বিপ বিপ করে শব্দ করছে।

জামান মানচিত্রটা ব্লোআপ করলো মিলন এখন কোথায় আছে সেটা জানার জন্য।

কিছুক্ষণ পর যে দৃশ্যটা ভেসে উঠলো সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। জামান টের পেলো তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনটা নিয়ে জেফরি বেগকে একটা কল করলো সে।

রিং হচ্ছে।

একবার।

দু’বার।

তিনবার।

কেউ ধরছে না।

আবারো কল করলো সে। একই ফল।

উত্তেজনার চোটে উঠে দাঁড়ালো জামান। তাহলে কি দেরি হয়ে গেছে?

হায় আল্লাহ! জামান বুঝতে পারলো না কী করবে। কমিউনিকেশন্স রুম থেকে এক দৌড়ে বের হয়ে গেলো। যেতে যেতে একটা কথাই তার মনে। ঘুরতে লাগলো। জেফরি বেগ ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে গেছে।

অধ্যায় ৭৭

মিলন পর পর চারটা সিগারেট শেষ করার পর দেখতে পেলো জেফরি বেগের ঘরে বাতি জ্বলছে না। তার শিকার বিছানায় গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে হয়তো।

আরেকটু অপেক্ষা করবে সে তারপর কাজে নেমে পড়বে। পঞ্চম সিগারেটটা জ্বালিয়ে টান দিলো। তাকে এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ধীরস্থিরভাবে কাজটা করতে হবে। সিগারেট টানতে টানতে নিজের ভেতরে জমে থাকা উত্তেজনাটা প্রশমিত করলো। পরিকল্পনাটা গুছিয়ে নিলো শেষবারের মতো। কোনো ভুল করা যাবে না। জেফরি বেগকে শেষ করে দেবার দ্বিতীয় কোনো সুযোগ সে আর পাবে না।

রঞ্জু এখন দিল্লিতে, ঝন্টু আছে তার সাথে। তাদের পুরো মিশনটা সফলভাবেই শেষ হয়েছে। তাকেও দ্রুত ঢাকা ছাড়তে হবে, পাড়ি দিতে হবে ব্যাঙ্ককে। মাঝরাতের আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে। এরইমধ্যে তাদের নেটওয়ার্কের অনেকেই চলে গেছে, এখন যদি জেফরি বেগকে কিছু করতে না পারে তাহলে আর কোনো দিন হয়তো সুযোগটা পাবে না।

রঞ্জু বলেছে তারা বাকি জীবন ব্যাঙ্ককেই কাটিয়ে দেবে। দিল্লির কাজ শেষ করে ব্যাঙ্ককে চলে আসবে সে। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে থাকবে কিছুদিন। রঞ্জু বলেছে, ব্যাঙ্ককে তাদের জীবনটা আনন্দ আর ফুর্তিতে কেটে যাবে। টাকা-পয়সার কোনো অভাব থাকবে না।

হাতঘড়িটা মুখের কাছে এনে সিগারেটে জোরে টান দিয়ে আগুনের আলোয় ঘড়িটা দেখে নিলো। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। শিকারের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার মধ্যে এক ধরণের রোমাঞ্চ আছে। কিছুক্ষণ পর প্রতিশোধের আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে সব কিছু। নিজের ভেতরে আগুন জ্বালানোর জন্য পলির কথা ভাবলো সে। কিভাবে মেয়েটা মারা গেলো সেসব কথা ভাবলো। টের পেলো সমস্ত শরীর রাগে কাঁপছে। এ মুহূর্তে এটাই দরকার।

সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। তারপর তিনফুট উঁচু গ্রিলের বেড়াটা টপকে রাস্তাটা পার হয়ে গেলো মিলন।

জেফরি যে অ্যাপার্টমেন্টটায় থাকে সেটা এর আগেরদিনই রেকি করে গেছে। সবকিছু তার নখদর্পণে। একটা সুবিধা হলো, অ্যাপার্টমেন্টটা ব্যক্তি মালিকানাধীন। এর মালিক নিজেই এটা ডেভেলপ করে ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দিয়েছে। ফলে অন্যসব অ্যাপার্টমেন্টের মতো নিরাপত্তা-ব্যবস্থা অতোটা কড়াকড়ি না। বাউন্ডারি দেয়ালগুলো যেমন নীচু তেমনি মেইনগেটটার পাশে যে ছোট্ট একটা গেট আছে সেটা একেবারেই হাস্যকর। গেটটা গ্রিলের তৈরি। মাত্র ছয়-সাত ফুটের মতো উঁচু। এটা একটা মইয়ের মতোই কাজ করবে।

মিলন সেই গ্রিলের গেটটার কাছে এসে ভেতরে উঁকি দিলো। বাম দিকে, মেইনগেটের পাশে ছোট্ট একটা ঘর আছে, সেটাতেই দাড়োয়ান থাকে। মধ্য বয়সী এক লোক। খুব সহজেই তাকে কাবু করা যাবে। দাড়োয়ানকে গেটের পাশে দেখতে পেলো না। সম্ভবত নিজের ঘরে শুয়ে আছে।

দারুণ, মনে মনে বললো মিলন। গ্রিলের গেটটা বেয়ে টপকে গেলো সে। ঢুকে পড়লো ভেতরে। সতর্কভাবে চেয়ে দেখলো চারপাশ। পার্কিংলটে বেশ কিছু গাড়ি আছে। আস্তে করে এগিয়ে গেলো সিঁড়িঘরের দিকে। এই অ্যাপার্টমেন্টে কোনো লিফট নেই।

তিনতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে এসে থামলো। একশ’ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। ডান দিকের দেয়ালে সুইচবোর্ড থেকে সুইচ টিপে বাতিটা নিভিয়ে দিলো। হাতের বাম দিকের দরজাটাই জেফরি বেগের। পকেট থেকে মাস্টার কিটা বের করে খুব সহজেই লকটা খুলে ফেললো সে। দরজাটা একটু ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিলো মিলন। ঘন অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দরজাটা আরেকটু ফাঁক করে নিঃশব্দে ঢুকে পড়লো ভেতরে।

দরজা বন্ধ করে কোমর থেকে সাইলেন্সার পিস্তলটা হাতে তুলে নিলো এবার। একটু অপেক্ষা করলো অন্ধকারে চোখ সয়ে নেবার জন্য। কয়েক মুহূর্ত পর, ফ্ল্যাটের ভেতরটা আবছা আবছা দেখতে পেলো।

সে এখন দাঁড়িয়ে আছে ড্রইংরুমে। তার সামনে ডানে আর বামে দুটো দরজা। দুটোই পুরোপুরি ভোলা।

বাইরে থেকে যে জানালা দিয়ে জেফরি বেগকে দেখেছিলো সেটা বাম দিকের ঘর হবে। তারপরও নিশ্চিত হবার জন্য পা টিপে টিপে প্রথমে ডান দিকের দরজাটার কাছে চলে এলো। চোখ কুচকে ভালো করে তাকালো। কোনো বিছানা নেই। সোফা আর কিছু চেয়ার। দুদিকের দেয়ালে বড় বড় দুটো শেলফ।

এবার বাম দিকের দরজার কাছে এলো সতর্কতার সাথে। ভেতরে উঁকি দিতেই চোখে পড়লো শোবারঘরের বেডটা। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে জেফরি বেগ।

মিলন তার সাইলেন্সর পিস্তলটা সামনের দিকে তাক করে আরেকটু এগিয়ে গেলো। বিছানা থেকে তিন-চার ফুট দূরে যখন তখনই প্রথম গুলিটা চালালো সে।

ভোতা একটি শব্দ!

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা শব্দ হলো। এই শব্দটা প্রকম্পিত করে তুললো ছোট্ট বেডরুমটা। মিলন কিছুই বুঝতে পারলো না। তার কাছে মনে হলো কেউ তাকে ধাক্কা মেরেছে পেছন থেকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো বিছানার উপর। টের পেলো কম্বলের নীচে কোনো মানুষ নেই। উদভ্রান্তের মতো হাতরে দেখলো কম্বলের নীচে একটা কোলবালিশ। পিস্তলটা যে তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেছে সেটা খেয়ালই করলো না।

সঙ্গে সঙ্গে বাতি জ্বলে উঠলে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। তার কাছে মনে হচ্ছে নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলছে।

শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে চিৎ হতেই দেখতে পেলো তার সামনে অদ্ভুত এক গগল্স পরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার হাতে পিস্তল। গগলসটা খুলে ফেলতেই চেহারাটা চিনতে পারলো।

জেফরি বেগ!

মিলনের নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে গেলো। এবার বুঝতে পারলো ঘটনাটা। সে শুলিবিদ্ধ হয়েছে।

“তু-তুই!…” আর কিছু বলতে পারলো না। মুখ দিয়ে রক্তবমি করে ফেললো। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো জেফরির দিকে। সে এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। যেনো পাথরে খোদাই করা কোনো মূর্তি।

গুলিটা লেগেছে পিঠে, বুকের উল্টো দিক দিয়ে ঢুকে বাম দিকের একপাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে সেটা।

কয়েক মুহূর্ত পরই মিলনের চোখ জোড়া স্থির হয়ে রইলো জেফরি বেগের দিকে, তবে সেই চোখে কোনো প্রাণ নেই।

জেফরি বেগ মিলনের নিষ্প্রাণ দেহটার কাছে ঝুঁকে দেখলো। নিশ্চিত হবার জন্য মিলনের ঘাড়ের শিরায় হাত রেখে পরীক্ষা করতে যাবে অমনি অদ্ভুত একটা শব্দ হলো। চমকে উঠে লাফ দিয়ে সরে গেলো সে। সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলটা তাক করলো মিলনের দিকে।

একটা গুঞ্জনের শব্দ। কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার মনে হয়েছিলো মিলন বুঝি মরার ভান করে পড়ে ছিলো কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলো ব্যাপারটা।

মিলনের নিশ্চল দেহটা একটুও নড়ছে না। জেফরি তার পকেট হাতরে মোবাইলফোনটা বের করে আনলো। ফোনটা ভাইব্রেট করছে।

কোনো কিছু না ভেবেই কলটা রিসিভ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। ওপাশ থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠ কথা বলে উঠলো :

“হ্যালো?”

ওপাশ থেকে যে কণ্ঠটা সে শুনতে পেলো সেটা হোমমিনিস্টারের পিএসের। বোঝাই যাচ্ছে মিলনের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। অথচ এর আগে তাকে বলা হয়েছিলো রঞ্জুর দলের লোকজনের সাথে তাদের একতরফা যোগাযোগ হয়। একেক সময় তারা একেক নাম্বার থেকে ফোন করে। তাহলে কি তুর্যের কিডন্যাপারদের সাথে আলী আহমেদ জড়িত?

“হ্যালো? কথা বলছো না কেন?”

জেফরি চুপ মেরে রইলো। রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে সে।

“হ্যালো?” ওপাশ থেকে আবারো তাড়া দিলো কণ্ঠটা।

“আলী আহমেদ সাহেব,” অবশেষে বললো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “আমি জেফরি বেগ?”

অধ্যায় ৭৮

হুইলচেয়ারের মোটরটা গুঞ্জন করছে। চেয়ারটা নিয়ে বিশাল ঘরের এ মাথা থেকে ওমাথা চক্কর দিচ্ছে বার বার, অস্থির হয়ে উঠেছে ব্ল্যাক রঞ্জু। অপারেশন চলার সময় ফোন করা তার স্বভাব নয়, তারপরও খুব ফোন করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। তার কাছে কোনো ফোনই নেই। আজকের অপারেশনটা খুব দ্রুত শেষ করে চলে যাবে ব্যাঙ্ককে, সেখান থেকে সিঙ্গাপুরে, সুতরাং দু’একদিনের জন্য মোবাইলফোন রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নি। এখন বুঝতে পারছে ফোন থাকাটা দরকার ছিলো।

নিজের মনকে প্রবোধ দিলো, হয়তো বাস্টার্ড হারামজাদা তার ঘরে নেই। বাইরে কোথাও গেছে। ঝন্টু তার দল নিয়ে অপেক্ষা করছে। বদমাশটা ফিরে এলেই দ্রুত কাজ সেরে চলে আসবে।

দিল্লির মাদার তেরেসা স্ট্রিটের একটি দোতলা বাড়ির নীচ তলায় আছে সে। বাড়ির মালিক কোলকাতার এক ব্যবসায়ী। রঞ্জুর অন্য একটি ব্যবসার পার্টনার। লোকটার আজকের যে অবস্থান তার অনেকটাই রঞ্জুর কারণে। পেছন থেকে প্রচুর পরিমাণে টাকার জোগান দিয়েছে সে। তার ব্যবসা বাণিজ্যের ষাট ভাগ মালিকানাই রঞ্জুর। কিছুদিন আগে বিশাল এই বাড়িটা কেনা হয়েছে, উদ্দেশ্য মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং নির্মাণ করে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করবে।

তার নিজের সাম্রাজ্যটা কতত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত সেটা খুব কম লোকেই জানে। অপারেশন ক্লিনহার্টের কারণে যদি কোলকাতায় পালিয়ে না আসতো তাহলে এই সাম্রাজ্যটি ঢাকা শহরের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকতো। তার জন্যে দেশান্তরি হওয়াটা শাপে বর হয়েছে। হিজরত না করলে ভাগ্য বদল হয় না, তার বেলায়ও সত্যি হয়েছে এই পুরনো প্রবাদটি।

আবারো হাতঘড়িতে সময় দেখলো। ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলেও রেডিয়াম ডায়ালটা স্পষ্ট দেখতে পেলো। ঘরের একমাত্র যে বাতিটি জ্বলছে সেটা মৃদু আলোর ডিমলাইট। হালকা লালচে আভা ছড়িয়ে আছে পুরো ঘরে। যেনো একটু পর যে ভয়ঙ্কর কাজটা করবে সেটার আবহ ফুটিয়ে তোলার জন্য এই ব্যবস্থা।

তার আর তর সইছে না। বাস্টার্ডের সাথে মুখোমুখি হলে কী দারুণ শিহরণ বয়ে যাবে ভাবতেই পুলকিত হয়ে উঠলো। ঐ হারামিটাকে শুধু ভয়াবহ শারিরীক যন্ত্রণা দিয়ে মারবে না, তার জন্য তীব্র মানসিক যন্ত্রণা দেখারও ব্যবস্থা রেখেছে। রঞ্জু জানে, শারিরীক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেও যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করবে তার জন্যে বাস্টার্ড মোটেও প্রস্তুত নয়। এই পৃথিবী ছেড়ে যাবার আগে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে রঞ্জু কতোটা নির্মমভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে।

বাস্টার্ড তার দলের অসংখ্য লোককেই শুধু খুন করে নি, খুন করেছে তার আপন বড় ভাই, স্ত্রীসহ ঘনিষ্ঠ অনেক লোককে। তারচেয়েও বড় কথা এই লোকের কারণেই বিশাল একটি পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে গেছিলো। আর সে নিজে পরিণত হয় হুইলচেয়ারে বন্দী অথর্ব একজন মানুষে।

না! মনে মনে বলে উঠলো। সে মোটেই অথর্ব নয়। হুইলচেয়ারটা নিয়ে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়ালো। খুব জলদিই সে উঠে দাঁড়াবে। হাঁটতে পারবে। ডাক্তার বলেছে, তার সেরে ওঠার সম্ভাবনা বেশ জোরালো। শুধু টাকা খরচ করতে হবে। এই জিনিসটা তার কাছে বেশ ভালো পরিমাণেই আছে।

মুচকি হাসলো সে। অচল রঙুই যদি এতোবড় একটা কাজ করতে পারে তাহলে সচল রঞ্জু দেশের বাইরে থেকে কি করতে পারবে তা কেউ জানে না।

ঘরের এক কোণে টেবিলের উপর একটা ল্যাপটপ রাখা, সেটার পাশেই রয়েছে এক প্যাকেট সিগারেট। সময়ক্ষেপন করার জন্য সিগারেট খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ল্যাপটপের পর্দায় দেখা যাচ্ছে ইয়াহু মেসেঞ্জারটা অনলাইনে আছে। ভিডিও বক্সের ইমেজটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে।

প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে ধরালো। জোরে জোরে টান দিয়ে হুইলচেয়ারটা নিয়ে চলে গেলো ফ্রেঞ্চ জানালার সামনে।

আর মাত্র কিছুক্ষণ পরই তার শিকার চলে আসবে তার হাতের মুঠোয়। বাস্টার্ড! আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি!

অধ্যায় ৭৯

গাঢ় নীল রঙের মাইক্রোবাসটা কারোলবাগ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। গাড়ির গতি দেখে মনে হতে পারে কোনো তাড়া নেই, আয়েশী ভঙ্গিতে ছুটে চলেছে। গন্তব্যের দিকে। এর কারণ গাড়িটার গন্তব্য মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। রাতের এ সময়টাতে রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা, ইচ্ছে করলে দ্রুতগতিতে ছোটা সম্ভব কিন্তু ড্রাইভার গতি বাড়াতে পারছে না। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গাড়ি চালাচ্ছে সে।

মাদার তেরেসা স্ট্রিটের একটি দোতলা বাড়ির সামনে এসে অল্প একটু সময়ের জন্য থামলো গাড়িটা। বাড়িতে লোকজন আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ির ভেতর থেকে কোনো লোক বের হয়ে এলো না। একটু পরই গাঢ় নীল মাইক্রোবাসটা চলতে শুরু করলো আবার। দোতলা বাড়ি থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে ডান দিকে মোড় নিলো। খুব ধীরগতিতে তিন-চারটা বাড়ি পেরিয়ে আবারো ডানে মোড় নিয়ে একটা উঁচু পাচিলের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে পড়লো সেটা।

অনেকক্ষণ পর মাইক্রোবাস থেকে কালো পোশাকের এক লোক বেরিয়ে এলো। তার মাথায় মাঙ্কিক্যাপ। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।

মাইক্রো থেকে নেমে দোতলা বাড়িটার দিকে তাকালো এক ঝলক। এটা বাড়ির পেছন দিক।

মাইক্রোবাসের ড্রাইভিংসিটের দরজাটা খুলে সেটার উপর পা দিয়ে গাড়ির ছাদে উঠে পড়লো লোকটা। গাড়ি থেকে দোতলা বাড়ির বেষ্টনি দেয়ালটি মাত্র দুই ফুট উঁচু হবে, কোনো কাটা তার নেই। খুব সহজেই দেয়ালের উপর উঠে গেলো সে। তারপর উপুড় হয়ে দু’হাতে দেয়াল ধরে শরীরটা ঝুলিয়ে দিলো দেয়ালের ওপাশে, আস্তে করে হাতটা ছেড়ে দিতেই দেয়াল সংলগ্ন ঘাসের জমিনে নেমে পড়লো। ধুপ করে একটা শব্দ হলো কেবল।

ঝন্টুর মতে, এই বাড়িতে রঞ্জু ছাড়া কমপক্ষে আরো তিনজন আছে। তিনজনই সশস্ত্র। তাদেরকে কিভাবে মোকাবেলা করবে সেটা আগেই ঠিক করে রেখেছে সে। কোমর থেকে সাইলের পিস্তলটা বের করে নিলো। জিনিসটা রঞ্জুর লোকদের কাছ থেকে নেয়া।

দোতলা বাড়িটার পেছন দিকে এক চিলতে সবুজ ঘাসের লন, একটা মাত্র ইলেক্ট্রক বাল্ব জ্বলছে সেখানে। বাড়ির ভেতর থেকে মৃদু টেলিভিশনের শব্দ ভেসে আসছে।

একটু পুরনো দিনের দোতলা বাড়ি। চারদিকে বারান্দা। বাড়ির পেছন দিকটা যে ব্যবহার করা হয় না সেটা বোঝা গেলো। বেশ কয়েকটি পরিত্যাক্ত গাড়ি আর শত শত তেলের ড্রাম রাখা। ড্রামগুলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় কেরোসিনের গন্ধ টের পেলো। সম্ভবত কেরোসিনের গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাড়িটা।

মাটিতে যে ঘাস দেখতে পেলো সেগুলো আগাছায় পরিপূর্ণ। অনেকদিন ঘাস কাটা হয় নি। কিছু ঝোঁপঝাঁড়ও গজিয়ে উঠেছে এখানে সেখানে। মৃদু আলোতে স্পষ্ট বোঝা গেলো বাড়িটার রঙ বিবর্ণ হয়ে পড়েছে অনেক আগেই।

পা টিপে টিপে বাবলু এগিয়ে গেলো বাড়িটার কাছে।

একটা জানালার সামনে এসে কান পাতলো সে। টিভির আওয়াজটা এই ঘর থেকেই আসছে। কিন্তু জানালার কাঁচ এতো ঘোলা যে ভেতরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। তিন চার ফুট দূরে আরেকটা জানালা আছে, সেটার কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলো এবার। এই জানালাটার কাঁচ ঘোলা হলেও একটা কাঁচ ভাঙা, সেই ভাঙা কাঁচ দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলো ভেতরে দু’জন লোক চেয়ারে বসে টিভি দেখছে। তাদের হাতে বিয়ারের ক্যান। পায়ের কাছে আরো দশ বারোটা বিয়ারের ক্যান রাখা। তারা বিয়ারে চুমুক দিচ্ছে আর টিভিতে একটা হিন্দি সিনেমা দেখছে। তাদের কোমরে কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু সে জানে তাদের কাছে অস্ত্র রয়েছে।

আরেকটু ভালো করে দেখলো ঘরের ভেতরটা। টিভির কাছে একটি টেবিলের উপর দুটো পিস্তল রাখা। তারা খারাপ কিছুর আশংকা করছে না, সুতরাং আয়েশ করে টিভি দেখছে। কিন্তু আরেকজন লোক কোথায়?

উত্তরটা পেয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ড পরই।

ঘরের দরজার কাছে আরেকজন লোকের আবির্ভাব ঘটলো। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ছেলেটা হিন্দিতে কী যেনো বললো চেয়ারে বসে থাকা লোক দুটোকে। তারপর ঘরে ঢুকে দুটো বিয়ারের ক্যান নিয়ে চলে গেলো!

বাবলু জানালা থেকে সরে গিয়ে বাড়ির সামনে যাবার জন্য পা বাড়ালো। তার টার্গেট বাইরের ছেলেটা।

পা টিপে টিপে বাড়ির সামনে আসতেই দেখতে পেলো দুটো বিয়ার নিয়ে অল্পবয়সী ছেলেটা মেইনগেটের কাছে এসে চেয়ারে বসে একটা ক্যান খুলছে।

দারুণ! মনে মনে বললো বাবলু।

অল্পবয়সী ছেলেটা আয়েশ করে বিয়ারে চুমুক দিচ্ছে আর পা নাচাচ্ছে। তার কোমরে কিংবা হাতের কাছে কোনো অস্ত্র নেই। মুচকি হেসে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলো সে। একে নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এর দিক থেকে কোনো সমস্যা হবার সম্ভাবনা নেই।

জানালার ফুটো দিয়ে আবারো তাকালো ভেতরে। একই দৃশ্য। টিভি দেখছে আর বিয়ার খাচ্ছে দু’জন পান্ডা।

মনে মনে ঠিক করে নিলো কি করবে। দ্রুত আর ক্ষিপ্রগতিতে ঘরে ঢুকেই দুজনকে শেষ করে ফেলতে হবে। জানালা থেকে যে-ই না সরে যাবে অমনি শুনতে পেলো অন্য আরেকটা কণ্ঠ।

“অর্জুন!”

পাশের আরেকটা ঘর থেকে আওয়াজটা এসেছে। চতুর্থ আরেকজন আছে!

সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে গেলো তার। অবশ্যই আছে।

“অর্জুন!” আবারো ডাকটা শোনা গেলো।

বাবলু লক্ষ্য করলো টিভি দেখতে থাকা দুজনের মধ্যে একজন কিছুটা বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।

নিজের পরিকল্পনাটা একটু বদলে নিলো বাবলু।

.

প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটা এই বাড়ির সবচাইতে বড় ঘর। ড্রইংরুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

ডিমলাইটের মৃদু লোয় একটা হুইলচেয়ারে বসে আছে ব্ল্যাক রঞ্জু। ঘরের শেষমাথায় একটি বিশাল ফ্রেঞ্চ জানালা দিয়ে চেয়ে আছে ড্রাইভওয়ের দিকে। এখান থেকে বাইরের মেইনগেটটা দেখা না গেলেও ড্রাইভওয়েটা পরিস্কার দেখা যায়। বিগত এক ঘণ্টায় কম করে হলেও পঞ্চাশবার এই জানালার সামনে এসে দেখেছে। তার লোকগুলো দেরি করছে বলে অস্থির হয়ে আছে সে।

অর্জুন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাকারি দিলে রঞ্জু তার দিকে ফিরে তাকালো।

“বিয়ার হায়?”

“কিতনে চাইয়ে, ভাই?” জানতে চাইলে অর্জুন।

“দো।”

“আতি হু,” বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে।

রঞ্জু আবারো ফ্রেঞ্চ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো।

একটা বাজার চলতি হিন্দি গান গুনগুন করে গাইতে গাইতে অর্জুন চলে এলো নিজের ঘরে। দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখতে পেলো তার সঙ্গি, একটু আগেও যে বসে বসে বিয়ার খাচ্ছিলো সে এখন বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।

মাথা দুলিয়ে মুচকি হাসলো অর্জুন। “কেয়া হুয়া?…খালাস?” বলেই উপুড় হয়ে মেঝে থেকে দুটো বিয়ার তুলতে গেলো সে, হঠাৎ তার মনে হলো পেছনে কেউ আছে, কিন্তু ঘুরে দেখার আগেই থুতু ফেলার শব্দ হলো কেবল।

একটা অস্ফুট আওয়াজ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো অর্জুন।

মাথার পেছন থেকে, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালিয়েছে বাবলু।

অর্জন ঘরে থেকে বের হতেই সে দ্রুত এই ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দরজার কাছে আসতেই চেয়ারে বসা লোকটি চমকে যায় তাকে দেখে। কিন্তু কিছু বলার আগেই গুলি চালিয়ে বসে সে। চেয়ার থেকে হুমড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়তেই বাবলু ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলে। বিছানার উপর উপুড় করে রেখে দেয় তাকে, যেনো দেখে মনে হয় লোকটা ঘুমাচ্ছে। তারপর দরজার পেছনে লুকিয়ে থাকে অর্জুনের জন্য।

এবার ঘর থেকে বের হয়ে মেইনগেটের দিকে পা বাড়ালো সে। অল্পবয়সী ছেলেটা দ্বিতীয় বিয়ারে চুমুক দিচ্ছে এখন। একটা খালি বিয়ারের ক্যান তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

একেবারে নিঃশব্দে বড় বড় পা ফেলে অল্পবয়সী ছেলেটার পেছনে চলে এলো। মৃত্যুর আগে ছেলেটা যেনো কিছু টের না পায়, কোনো রকম শব্দ না করে। আস্তে করে সাইলেন্সার পিস্তলটা তাক্‌ করলো মাথার ঠিক পেছনে। গুলি করার আগে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে।

তারপর শুধু থুতু ফেলার মতো ভোতা একটি শব্দ।

অল্পবয়সী ছেলেটা ঘোৎ করে আওয়াজ করে চেয়ার থেকে ঢলে পড়ে গেলো কংক্রিটের ফ্লোরে। বাবলু তাকে ধরলো না। ছেলেটার মুখ রক্তে একাকার। সদ্য পান করা বিয়ার বমি হয়ে বের হয়ে এলো।

ছেলেটাকে মারার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো না কিন্তু নিজের জীবনের ঝুঁকি রাখার কোনো মানে হয় না। ভালো করেই জানে লোকগুলো কতোটা ভয়ঙ্কর।

মেইনগেট থেকে রঙুর ঘরের দিকে যাবার সময় তার শরীর দিয়ে এক ধরণের উত্তেজনা বয়ে গেলো। সে জানে, এই দূর দেশে, বিশাল এই বাড়িতে রঞ্জু এখন একা। একা এবং অথর্ব। একটা হুইলচেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে তার জন্য। প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত রঞ্জু ঘুণাক্ষরেও জানে না সে আসলে কিসের জন্য অপেক্ষা করছে।

দরজার সামনে আসতেই তার মনে হলো, তাকে এভাবে দেখে রঞ্জু কতোটা বিস্মিত হবে। কিন্তু বাবলুর কোনো ধারণাই নেই, তার নিজের জন্যে কতোটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে সেখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *