৬০. ছোট্ট একটা ঘরে

অধ্যায় ৬০

ছোট্ট একটা ঘরে আজ কয়দিন ধরে বন্দী হয়ে আছে বুঝতে পারলো না তুর্য। সব সময় হাত আর মুখ বেধে রাখা হয়। এভাবে অন্ধকার ঘরে দিনের পর দিন পড়ে থাকা যে কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা সেটা কেউ বুঝতে পারবে না। যখনই দরজা খুলে লোকগুলো তার ঘরে ঢোকে তখনই মৃত্যুর বিভীষিকা তাকে গ্রাস করে। অসাড় হয়ে আসে হাত-পা।

ভয়ঙ্কর লোকগুলো তাকে নিয়ে কী করতে চাচ্ছে সেটা তার কাছে একদম স্পষ্ট নয়। হোমমিনিস্টারের ছেলে সে, তার বাবার অগাধ ক্ষমতা, তারপরও এই লোকগুলো তাকে দিনের পর দিন আটকে রেখেছে অথচ তার বাবা কিছুই করছে না! বাবার উপর খুব রাগ হলো তার। ইচ্ছে করলে চিৎকার করে কাঁদবে, কিন্তু কান্না চেপে রাখলো। ভয়ঙ্কর লোকগুলো কান্নাকাটি করলে ঠিকমতো খেতে দেয় না। বিশেষ করে চাপদাড়িওয়ালা লোকটা কথায় কথায় তাকে চড়-থাপ্পড় মারে। সাকার্সের পশুদের যেভাবে চাবুক পেটা করে বশ মানানো হয় তাকেও ঠিক সেভাবে রেখেছে।

এ কয়দিনে গোসল করা হয় নি, শরীর থেকে বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে। শীতের দিনে কয়েক ঘণ্টা জুতা-মোজা পরে থাকলে যেখানে উটকো গন্ধ বের হতে থাকে সেখানে আজ কয়দিন ধরে যে গোসল করতে পারে নি তারও কোনো হিসেব নেই।

যে ঘরে বন্দী হয়ে আছে সেটার জানালাগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। খালি ঘরে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে থাকে একটা তোষকের উপর। মাঝেমধ্যে দু’তিনজন লোক এসে তাকে ঘরের এককোণে রাখা একটা চেয়ারে বসায় হাত-পা বেধে, তারপর টেবিলের উপর ল্যাপটপ চালিয়ে তার ভিডিও করে। লোকগুলো যেভাবে বলে ঠিক সেভাবেই তাকে কথা বলতে হয়। না করতে চাইলে চড় থাপ্পর কিলঘুষি জোটে, আর এ কাজটা সব সময় করে চাপদাড়িওয়ালা বদমাশ।

সেন্ট অগাস্টিন থেকে তাকে ধরে আনার পর কয় দিন কেটে গেছে হিসেব করার চেষ্টা করলো আবার। পাঁচ দিন? ছয় দিন? নাকি এক সপ্তাহ? কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারলো না।

আগে যেখানে চার বেলা খাবার খেতো এখন সেখানে মাত্র দু’বেলা খাবার দেয়া হচ্ছে তাকে। তার ধারণা শরীরের ওজনও অনেক কমে গেছে।

মাঝে মাঝে মনে হয় পুরো ঘরটা দুলে উঠছে। ভূমিকম্প? প্রথম যখন টের পেলো তখন খুব ভয় পেয়েছিলো। কিন্তু এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার ধারণা ঘরটা আসলে দোলে না, ক্ষিদের চোটে তার মাথা ঘোরায়।

প্রতিদিন তাকে একটা করে ইনজেকশন দেয়া হয় আর তারপরই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কততক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে সেটাও জানে না। ঘুম থেকে উঠলে কিছু খেতে দেয়া হয়। একেবারে যাচ্ছেতাই খাবার। তার বাড়ির চাকর-বাকরেরাও এরচেয়ে ভালো খাবার খায়।

ইনজেকশনের প্রভাব কেটে গিয়ে ঘুম ভেঙে গেলেও আজ সে শব্দ করে নি। ভয়ঙ্কর লোকগুলোও আজ তার ঘরে ঢুকে উঁকি মারে নি। তাদের সাড়াশব্দও পাচ্ছে না। তারা হয়তো আশেপাশে নেই।

লোকগুলো শেষ পর্যন্ত তার সাথে কী করবে সে জানে না। তাদের ভাবভঙ্গি দেখলে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। তাকে মেরে ফেলবে? কথাটা ভাবতেই ভয়ে তার গা কাটা দিয়ে উঠলো। বুক ফেটে কান্না বের হতে চাইলেও জোর করে আটকে রাখলো তুর্য।

আব্দু…আম্মু…আমাকে বাঁচাও!

অধ্যায় ৬১

বানরের গাড়িটা ঢুকতেই পুরো মহল্লায় হৈচৈ শুরু হয়ে গেলো। আতঙ্কিত বাসিন্দারা ছাদ থেকে ছাদে, রাস্তা থেকে ল্যাম্পপোস্টে, বাড়ির কার্নিশ থেকে লাফিয়ে চলে গেলো যে যেদিকে পারে।

একটু নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে অপেক্ষাকৃত সাহসী আর মুরুব্বি টাইপের ‘বাসিন্দারা থমকে দাঁড়িয়ে ভুরু কুচকে দেখার চেষ্টা করছে পরিস্থিতি। হয়তো নিশ্চিত হতে চাইছে, এটাই বানরের গাড়ি কিনা।

দুদিন ধরে জ্বরের ঘোরে পড়েছিলো বাবলু। তাকে দেখার মতো কেউ নেই এখানে। একা একা দুটো দিন ঘরের মধ্যেই কাটিয়ে দিয়েছে। আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই টের পেলো ভালো বোধ করছে। হৈচৈয়ের শব্দে ঘুম ভাঙার পর থেকে তার ঘরে জানালার সামনে বসে এসব দেখে যাচ্ছে সে।

এই বানরের গাড়িটা এলেই মহল্লায় এমন দৃশ্যের অবতাড়না হয়। পুরো এলাকাটি প্রাণচাঞ্চল্য খুঁজে পায় যেনো। নইলে, বাকি সময়টাতে এখানকার সত্যিকারের বাসিন্দারা নির্জীব-নিষ্প্রাণ জীবনযাপনেই অভ্যস্ত।

বাবলুর ঘরটা তিন তলার উপর একটি চিলেকোঠা। নীচে একটা বইয়ের লাইব্রেরি আছে। দোতলা আর তিনতলা একটি কসমেটিকসের গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

তার বিল্ডিংয়ের আশেপাশের বাড়িগুলো একতলা নয়তো দোতলা। ফলে তার ঘরের চারদিকে বিশাল বড় বড় চারটি জানালা দিয়ে যথেষ্ট আলো বাতাসের আনাগোনা। বাড়িটার দু’দিকে এল আকৃতির দুটো রাস্তা চলে গেছে। জানালা দিয়ে সেসব রাস্তার দৃশ্যও দেখা যায়। এখানে আসার পর থেকে জানালার পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার কর্মকাণ্ড দেখা তার অবসরের একমাত্র বিনোদন হয়ে উঠেছে। আর অবসর নামক জিনিসটা এখন তার দিনমান জুড়েই বিরাজ করে।

বানরের গাড়িটা ঠিক তার বাড়ির নীচে এসে থামলো। ড্রাইভারের পাশে যে লোকটা বসে আছে উপর থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু বাবলু জানে ওখানে কে বসে আছে।

দরজা খুলে নেমে এলো চল্লিশ বছরের হ্যাংলা মতো দেখতে এক লোক। ছোটো করে চুল ছাটা, মুখে পাতলা গোঁফ, গায়ের রঙ গাঢ় শ্যামবর্ণ। পান। চিবোচ্ছে সে। হাতে একটা বেত।

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সোজা তাকালো উপরের দিকে। বাবলুর সাথে চোখাচোখি হতেই হাত তুলে সালাম জানালে বাবলুও তার জবাব দিলো।

“ক্যায়সে হায়, তওফিক ভাই?” চিৎকার করে হিন্দিতে বললো লোকটা।

“থি তো হাম বুড়া, লেকিন আপকো দেখুকার সব কুছ আচ্ছা হো গায়া,” নিখুঁত হিন্দিতে বললো সে। এ কয়েক মাসে ভাষাটা বেশ রপ্ত করে ফেলেছে।

পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে হাসি দিলো রমেশ মিশ্রা।

বাবলুর সাথে রমেশের বেশ সখ্যতা তৈরি হয়ে গেছে এই অল্প কদিনেই। কাজ ছাড়াও মাঝেমধ্যে আড্ডা মারতে চলে আসে।

বাবলু এখানে তওফিক নামে পরিচিতি। তার আসল পরিচয় বাংলাদেশের দূতাবাসের মাত্র দুজন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জানে না।

অমূল্য বাবুর চাপাচাপিতেই নতুন সরকারের হোমমিনিস্টার তাকে জেল থেকে মুক্তি দিতে অনেকটা বাধ্য হয়। এই মিনিস্টার লোকটাই মি: টেন পার্সেন্টের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য তাকে লেলিয়ে দেয় ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের পেছনে।

রঞ্জুর গুলির আঘাতে আরেকটুর জন্য তার ভবের লীলা সাঙ্গ হতে বসেছিলো। জেলে ঢোকার সাথে সাথেই অমূল্য বাবু তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন পর্দার আড়াল থেকে। নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে বাবু আর দেরি করেন নি। এক জাঁদরেল উকিল নিয়োগ করেন। সেই উকিল আদালতে প্রমাণ করে সে অন্য একজন ব্যক্তি-পেশাদার খুনি বাস্টার্ড নয়। ভুল করে তাকে ধরা হয়েছে। বাবলুর ধারণা, এটা অমূল্য বাবুর আইডিয়া।

যাইহোক, জামিনে মুক্ত হতেই অমূল্য বাবু তাকে কিছুদিনের জন্য বিদেশে চলে যেতে বলে। প্রথমে সে রাজি ছিলো না। কিন্তু বাবু তাকে বোঝাতে সক্ষম হন, ইনভেস্টিগেটর মি: বেগ তার পিছু ছাড়বে না। লোকটা নাকি তার জামিন লাভের কথা শুনে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো। তাছাড়া মামলাগুলো পুরোপুরি তুলে নেবার আগে তার একটু দূরে থাকাই ভালো।

অবশেষে বাবলু রাজি হয়। তবে খুব বেশি দূরে যেতে চায় নি। কেন যেতে চায় নি সেটা অবশ্য অমূল্য বাবুকে বলে নি। কারণটা ছিলো উমা। ভারতে থাকলে খুব সহজেই বর্ডার পাড়ি দিয়ে দেশে আসা যাবে-উমার সাথে দেখা করা যাবে মাঝেমধ্যে।

বাবু অবশ্য এ নিয়ে আপত্তি করে নি। কোলকাতায় তার থাকাটা নিরাপদ হবে না, কারণ ওখানে ব্ল্যাক রঞ্জুর অনেক কন্ট্যাক্ট আছে, সুতরাং দিল্লিতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

এখানে থাকার সমস্ত আয়োজন অমূল্য বাবুই করেন হোমমিনিস্টারের মাধ্যমে। বাংলাদেশের দূতাবাসের এক উর্ধতন কর্মকর্তা কারোলবাগের এই বাড়িটি ভাড়া করে দেয় তার থাকার জন্য। এখানকার যাবতীয় ব্যয় বহন করছে দূতাবাস। সত্যি বলতে কি, তাকে দূতাবাসের একটি ছোটোখাটো পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে পুরো ব্যাপারটি আড়াল করার জন্য। যদিও টাকা নামক জিনিসটা তার কাছে বেশ ভালো পরিমাণেই আছে তারপরও দিল্লিতে যতো দিন থাকবে তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে অমূল্য বাবু আর হোমমিনিস্টার।

তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, আর মাত্র দু’তিন মাস পরই দেশে ফিরতে পারবে সে। নতুন সরকার আগের সরকারের করা অসংখ্য মামলা প্রত্যাহারের কাজ সবে শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে, খুব জলদিই সবকটি মামলা থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। তখন সে মুক্ত মানুষ হিসেবে দেশে ফিরে যাবে। উমাকে নিয়ে সংসার পাতবে। দিল্লির অধ্যায় খুব দ্রুতই শেষ হতে যাচ্ছে তার জন্য।

ভারতের রাজধানীর দিল্লির এই আবাসিক এলাকাটির নাম কারোলবাগ। এখানেই দিল্লিবাসীর নতুন গর্ব মেট্রো রেলের সেন্ট্রাল স্টেশন। কাছেই বড় বড় অসংখ্য শপিংমল আর বেশ কিছু আবাসিক হোটেল।

কারোলবাগ এলাকাটি বেশ অভিজাত তা বলা যাবে না। তবে এটা পুরনো দিল্লির মতো ঘিঞ্জি এলাকা নয়, আবার নতুন দিল্লির আবাসিক এলাকার মতো পশ এরিয়াও বলা যাবে না একে।

অপেক্ষাকৃত পুরনো এই এলাকাটি বেশ ছিমছাম আর চমৎকার। বেশ কয়েকটি মহল্লা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই আবাসিক এলাকাটি। বাড়িগুলো গায়ে গায়ে লেগে না থাকলেও রাস্তাগুলো বেশ সরু। দিল্লির পুরনো বাসিন্দারাই মূলত এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে এ ব্যাপারে বাবলু নিশ্চিত নয়। আরেকদল ‘বাসিন্দা’ আছে পুরো মহল্লায়। বাবলুর ধারণা তারাই এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী। রমেশ আর তার গাব্বার-বাসন্তি জুটি হলো এদের বড় শত্রু।

পরিহাসের বিষয় হলো, বানর দুটোর নাম যে জনপ্রিয় সিনেমা থেকে নেয়া হয়েছে সেখানে বাসন্তি নায়িকা হলেও গাব্বার কিন্তু তার নায়ক ছিলো না। সে ছিলো খলনায়ক।

রমেশ কাজ করে দিল্লির মিউনিসিপ্যালিটিতে। তার পদবীর চেয়ে কাজটা অনেক বেশি অদ্ভুত-দুটো প্রশিক্ষিত বানরের কেয়ারটেকার। গাব্বার আর বাসন্তি নামের দুটো বড় বড় হুলো বানরের ওস্তাদ সে। তার কথায় এরা দু’জন ওঠে আর বসে।

বানরের গাড়ি থেকে গাব্বার আর বাসন্তিকে বের করে আনলো রমেশ। কাজে নামার আগে দুটো কলা খেতে দিলো তাদেরকে। গপাগপ সাবাড় করে দিলো কলা দুটো। বাবলুর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রমেশ আবারো হাসলো, তারপর হাক দিলো : “গাব্বার! বাসন্তি! তওফিক ভাই কে স্যালুট কার…”

সঙ্গে সঙ্গে গাব্বার আর বাসন্তি চমকে উপরের দিকে তাকালো। বাবলুকে দেখামাত্রই মিলিটারি স্টাইলে সেলুট দিলো প্রশিক্ষিত বানর দুটো।

বাবলু হেসে সেলুটের জবাব দিলো।

রমেশ এবার আশেপাশে বাড়িঘরের ছাদে তাকালো। এখনও দূর থেকে অনেক বানর ভীতসন্ত্রস্ত চোখে চেয়ে আছে তাদের দিকে। তুড়ি বাজালো রমেশ। বানর দুটোকে তাড়া দিয়ে বললো, “কাম্ পে লাগ যা! কাম্ পে লাগ যা!”

গাব্বার আর বাসন্তি দাঁত বের করে অদ্ভুত এক শব্দ করতে করতে ছুটে গেলো গলির দুদিকে। আশেপাশে শুরু হয়ে গেলো কানফাটা হৈচৈ। বিভিন্ন বাড়ির ছাদে যেসব বানরের দল জড়ো হয়েছিলো তারা নিজেদের বীরত্ব ভুলে যে যেদিকে পারলো কাপুরুষের মতো পালাতে শুরু করলো।

ল্যাম্পপোস্ট বেয়ে গাব্বার আর বাসন্তি উঠে পড়লো বাসা বাড়ির ছাদে। তাদের ভাবভঙ্গি মারাত্মক রকমেরই আগ্রাসী। আক্রমণের ভঙ্গিতে ছুটে গেলো পশ্চাদধাবন করা বানরের দলের দিকে।

যথারীতি বাবলু দেখতে পেলো মাত্র দুটো বানরের ভয়ে পুরো মহল্লার সব বানর কিভাবে লেজ গুটিয়ে প্রাণপণে পালাতে শুরু করছে। এক সপ্তাহের মধ্যে আর নিজ এলাকায় ফিরে আসবে না বানরের দলটি।

পনেরো মিনিটের অভিযান সফলতার সাথে শেষ করে বীরদর্পে ফিরে এলো গাব্বার আর বাসন্তি। রমেশ তাদের জন্য অনেকগুলো কলা খেতে দিলে বিজয়ী সেনানায়কের মতো গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে কলা খেতে শুরু করলো প্রাণী দুটো।

পুরনো ঢাকার অনেক মহল্লার মতো দিল্লির অনেক এলাকায়ই অযাচিত বাসিন্দা হিসেবে অসংখ্য বানরের দেখা পাওয়া যায়। শত শত বছর ধরেই এরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে বসবাস করে আসছে। মাঝেমধ্যে খাবার চুরি করা, শুকাতে দেয়া জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটলেও এখানকার বাসিন্দারা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রায়ই তাদের সংখ্যা বেড়ে যায়। অধিকহারে প্রজননের ফলে নয়তো আশেপাশের এলাকা থেকে খাবারের সন্ধানে আসা বানরের কারণে এই সংখ্যাটা ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে বানরের উৎপাতও বেড়ে যায়। এলাকার লোকজন খুব দ্রুতই অতীষ্ঠ হয়ে পড়ে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা বাইরে বেরোতে পর্যন্ত পারে না। খাবার কেড়ে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে অহরহ। একে ওকে খামচে দেয়া, দল বেধে লোকজনকে দাবড়ানো যেনো বানরের দলের জন্য বিনোদন হয়ে ওঠে।

এলাকার লোকজন ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষকে ব্যাপারটা জানালে রমেশের ডাক পড়ে। বানর তাড়ানোর জন্যে সে ছুটে আসে দু দুটো প্রশিক্ষিত বানর নিয়ে। আকারে এবং স্বভাবে এরা মহল্লার বানরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি বড় আর আগ্রাসী।

মজার কথা হলো, এই প্রশিক্ষিত বানর দুটো রমেশের মতোই দিল্লি মিউনিসিপ্যালের কর্মচারি! কথাটা একদম সত্যি। তাদের পদবী আছে, বেতন ভাতাও রয়েছে।

রমেশ ঠাট্টা করে বলে, এরা হলো ভারত সরকারের নতুন বুরোক্র্যাট!

তবে দিল্লির বাসিন্দারা অন্য বুরোক্র্যাটদের চাইতে এই নতুন বুরোক্র্যাট দুটোকে বেশি পছন্দ করে। কারণটা খুব সহজ : এসিরুমে অফিস করা, সুট টাই পরা বুরোক্র্যাটরা সরাসরি কোন উপকারে আসে তা নিয়ে সবার সন্দেহ থাকলেও গাব্বার আর বাসন্তির সার্ভিস নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই।

কিছু মহিলা বাসা থেকে খাবার-দাবার নিয়ে এসে রমেশের হাতে তুলে দিলো গাব্বার আর বাসন্তিকে দেবার জন্য। খাবার পেয়ে প্রাণী দুটো মানুষের ভঙ্গিতে সেলুট জানালো মহিলাদেরকে। সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে জড়ো হওয়া মানুষ হাত তালি দিয়ে উঠলো।

বানর দুটোর ভাবভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো বাবলু। যখনই বানর পর্যবেক্ষণ করে তখনই তার মনে হয়, চার্লস ডারউইন বোধহয় সঠিকভাবেই মানুষের পূর্বপুরুষদের চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন।

ঘড়িতে দেখলো ৯টা বাজে। তার মানে দেশে এখন সাড়ে নয়টা। উমা তার কাজে চলে গেছে। তার ডিউটি শুরু হয় সকাল আটটা থেকে। খুব ইচ্ছে করছে উমাকে ফোন করতে কিন্তু তার ফোনে ব্যালান্স নেই। দুদিন ধরে জ্বরের কারণে বাইরে গিয়ে ব্যালান্স ভরারও সুযোগ পায় নি। নাস্তা করে ব্যালান্স ভরে নেবে তারপর সন্ধ্যার পর উমা ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরলে ফোন করবে তাকে।

আজ দু’দিন ধরে মেয়েটার সাথে তার যোগাযোগ নেই। হয়তো খুব দুশ্চিন্তা করছে। তাকে নিয়ে ভাবার মতো লোক পৃথিবীতে এখন ওই একজনই আছে।

বাবলু টের পেলো খুব খিদে পেয়েছে। দু’দিন ধরে ঘরে থাকা দুধ আর পাউরুটি খেয়েছে। তার ঘরেই ছোট্ট মাইক্রোওভেনে গরম করে নিয়েছে সেগুলো।

ঘরটার দিকে তাকালো। যাচ্ছেতাই অবস্থা। সব এলোমেলো হয়ে আছে। ঠিক করলো আজ দিল্লির সবচাইতে প্রসিদ্ধ রেস্তোরাঁ করিম-এ নাস্তা করবে। ইচ্ছেমতো কাবাব আর পরোটা খাবে। শরীরটা খুব দুর্বল হয়ে গেছে জ্বরের কারণে।

বাথরুমে ঢুকে পড়লো বাবলু।

অধ্যায় ৬২

সকালে হাসপাতালে এসে রুটিনমাফিক কিছু কাজ করে ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে এলো উমা। চার তলায় উঠে সুদীর্ঘ করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এখন। গত দু’দিন ধরে বাবলুর কোনো ফোন পায় নি। অথচ বিদেশ চলে যাবার পর কয়েক দিন আগে যখন হুট করে একদিন হাজির হলো, তার পরের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একসাথে এক ঘরে কাটালো, সেই ঘটনার পর থেকে বাবলু তাকে নিয়মিত প্রতিদিনই ফোন করে আসছে। ইদানিং ছুটির দিনগুলোতে ভিডিও চ্যাটিংও করে তারা।

তাহলে কি তার শরীর খারাপ? হতে পারে। বিদেশে একা একা আছে। জ্বরটর হলে তাকে দেখার মতো কেউ থাকবে না। বাবলুই তাকে সব সময় ফোন করে, তবে এর আগে মাত্র একবার বাবলুকে ফোন করেছিলো সে। বাবলু আচমকা দেশে আসার পরের ঘটনা সেটি। তার মনটা খুব খারাপ ছিলো। মা-বাবা বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছিলো তখন। সে ভেবে পাচ্ছিলো না কী করবে। তখন নিজে থেকেই বাবলুকে সে ফোন করে। খুব অবাক হয়েছিলো বাবলু। কিছুটা ভয়ও পেয়ে গেছিলো তার ফোন পেয়ে।

মনে মনে ঠিক করলো আজ বিকেলের পর, বাসায় ফেরার পথে বাবলুকে ফোন করবে।

উমা প্রায়ই আশায় থাকে, হয়তো আবারো বাবলু হুট করে হাজির হবে তার সামনে। তাকে সারপ্রাইজ দেবে। ভালোবাসার তীব্রতা নিয়ে কাটিয়ে দেবে সারাটা দিন।

মুচকি হাসলো সে। ভালো করেই জানে, এটা খুব সহসা ঘটবে না। তবে সে জানে, বাবলু নিজেও তার মতোই ব্যাকুল। তাদের মধ্যে শারিরীক মিলন হবার পর থেকে বাবলুর মধ্যে যেনো ব্যাকুলতা আরো বেড়ে গেছে। এখন সে প্রতিদিনই কথা বলতে চায়, তাকে পেতে চায়। তার সঙ্গে সময় কাটাতে চায়।

উমা হেসে ফেললো। বাবলুর মধ্যে এতো তীব্র ভালোবাসা আছে সেটা কি অন্য কেউ বিশ্বাস করবে?

হঠাৎ দূরে, একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোর দিয়ে একজনকে আসতে দেখে তার গা ছমছম করে উঠলো।

বাবলু!

ভালো করে তাকালো। চেহারাটা এবার দৃষ্টির গোচরে এলে থমকে দাঁড়ালো সে।

“কেমন আছেন?”

জেফরি বেগের প্রশ্নটা শুনে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো উমা। “আপনি?”

“অবাক হয়েছেন?” বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।

উমা কোনো জবাব দিলো না। তার মনে আশংকা, কিছু দিন আগে বাবলু যে দেশে এসে তার সাথে দেখা করে গেছে সে খবর হয়তো এই লোকটা জেনে গেছে। এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছে। কিন্তু উমা দৃঢ়প্রতীজ্ঞ, সে একটুও মুখ খুলবে না।

“আপনি আমার কাছে এসেছেন?” জানতে চাইলো উমা।

“হ্যাঁ।”

“কি জন্যে?”

“বলছি, কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলবো?” একটু থেমে আবার বললো সে, “কোথাও বসতে পারি আমরা?”।

একটু ভেবে নিলো উমা। এই লোকের সাথে যতো বেশি কথা বলবে ততোই বিপদ। “আসলে আমি ডিউটিতে আছি…বুঝতেই পারছেন। যা বলার এখানেই বলুন।”

জেফরি বেগ চুপ করে রইলো কয়েক মুহূর্ত। উমাও কিছু বললো না। সে অপেক্ষা করলো হোমিসাইডের লোকটা কী বলে শোনার জন্য।

“মিস্ উমা, বাবলু খুব বিপদের মধ্যে আছে,” সরাসরি বললো জেফরি বেগ। “ভয়ানক বিপদে!”

উমা শুধু চেয়ে রইলো, কিছু বললো না।

অধ্যায় ৬৩

ব্ল্যাক রঞ্জু তার হুইলচেয়ারটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে। জেল থেকে বের হবার পর নতুন এই হুইলচেয়ারটা পেয়েছে সে। তার খুব পছন্দ হয়েছে জিনিসটা। বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে আগেই কিনে রাখা হয়েছিলো এটি। ইলেক্ট্রক এই চেয়ারটি যেনো ছোটোখাটো কোনো মটরগাড়ি। বাচ্চারা খেলনা হাতে পেলে যেমনটি করে রঞ্জু এখন তেমনই করছে। সারা ঘর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হুইলচেয়ারটা নিয়ে। জেলখানায় খুব কমই তাকে হুইলচেয়ারে বসতে দেয়া হতো। দিনের বেশিরভাগ সময় ছোট্ট সেলের ভেতরে শুয়ে থেকে থেকে হাপিয়ে উঠেছিলো সে।

জেলখানায় বসে যে পরিকল্পনা করেছিলো তাতে দারুণভাবেই সফল হয়েছে। একটি অসম্ভব পরিকল্পনা কতো সুন্দরভাবেই না সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পুরো পরিকল্পনার একমাত্র ত্রুটি হলো সেন্ট অগাস্টিনের ক্লার্ক ছেলেটিকে হত্যা করা। এর ফলে হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর আবারো ঢুকে পড়েছে এই ঘটনায়। রঞ্জুর সমস্ত পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেবার ক্ষমতা রাখে এই জেফরি বেগ। এরইমধ্যে মিলনের নাগাল পেয়ে গেছে সে। অল্পের জন্যে ছেলেটা বেঁচে গেলেও তার ভালোবাসার মানুষটি রক্ষা পায় নি। ইনভেস্টিগেটরের বুলেট মেয়েটার জীবন কেড়ে নিয়েছে।

বিশাল এই ঘরে মিলন ছাড়াও আছে রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোক ঝন্টু। তারা বসে আছে সোফায়। রঞ্জু দেশ ছাড়ার আগে তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার জন্য সবাই একত্রিত হয়েছে এই গোপন আস্তানায়। শেষবারের মতো পুরো পরিকল্পনাটি গুছিয়ে নেয়া দরকার। তার পরিকল্পনা সফলভাবে এগিয়ে গেলেও শেষ মুহূর্তে এসে মিলনের উপর কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ সে। প্রতিশোধ নিতে চাইছে ঐ ইনভেস্টিগেটরের উপর। অনেকক্ষণ ধরেই তাকে বুঝিয়ে চলেছে রঞ্জু। কিন্তু মিলন হ্যাঁ-না কিছুই বলছে না।

রঞ্জু চাচ্ছে মিলন যতোদ্রুত সম্ভব দেশ ছাড়ক। তা না হলে ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে। এরইমধ্যে মারাত্মক একটি ভুল করে ফেলেছে। পলিকে মুক্ত করার জন্য ছেলেমানুষির মতো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটরকে হুমকি দিয়েছিলো; তার পরিণতি পলির মর্মান্তিক মৃত্যু।

রঞ্জুর মাথায় এখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আগামীকাল দেশ ছাড়ার পরই বাস্টার্ড হারামজাদা চলে আসবে তার হা ঠায়। ইতিমধ্যেই একটা দল চলে গেছে দিল্লিতে। তারা খুব জলদিই খবর পাঠাবে বাস্টার্ড কোথায় আছে। বাস্টার্ডকে শেষ করা এখন সময়ের ব্যাপার। তারপর তারা সবাই চলে যাবে ব্যাঙ্ককে। ওখানেই শুরু হবে তাদের দ্বিতীয় জীবন। এসব জানার পরও মিলন অবুঝের মতো আচরণ করছে।

হুইলচেয়ারে বসা রঙুর দিকে তাকালো মিলন। ঘরের এককোণে জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে। মিলনের পাশে বসা ঝন্টু কয়েক পেগ হুইস্কি খেয়ে ঝিম মেরে আছে।

আজ থেকে কয়েক মাস আগে ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে মিলনের দেখা হয় জেলখানায়। রঞ্জু তখন কিছুটা সুস্থ হয়ে জেলহাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। কিছুদিন পরই ঈদুল ফিতর চলে এলে জেলের কয়েদিরা সবাই একসাথে নামাজ পড়েছিলো ঐদিন। নামাজ শেষে একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করার সময়ই রঞ্জুর সাথে তার দেখা হয়ে যায়। রঞ্জুই প্রথমে তাকে দেখে চিনতে পেরেছিলো। হুইলচেয়ারে চলাফেলা করা রঞ্জুকে দেখে সে চিনতেই পারে নি। প্রায় আট-নয় বছর আগে ব্ল্যাক রঞ্জু দেশ ছাড়ার পর থেকে তার সাথে মিলনের আর দেখা হয় নি।

অবশ্য তাদের পরিচয়টা দীর্ঘদিনের। একই এলাকায় বসবাস করেছে। ব্ল্যাক রঞ্জু ছিলো পুরনো ঢাকার এক সময়কার হোমরাচোমড়া রঞ্জু ভায়ের ডান হাত আর মিলন ছিলো সেই রঞ্জু ভায়ের প্রতিবেশী। সেই সময়টাতে কারাতে আর মাশাল আর্ট নিয়ে মগ্ন ছিলো মিলন। মজার ব্যাপার হলো ব্ল্যাক রঞ্জু তার কাছেই কিছুদিন মার্শাল আর্ট শিখেছিলো। তখনই তাদের মধ্যে পরিচয়। সেই সূত্রে ঘনিষ্ঠতা। তবে রঞ্জু ভাইকে খুন করে ব্ল্যাক রঞ্জু যখন সর্বেসর্বা হয়ে গেলো তখন মিলন বিদেশে চলে যায়। কিছুদিন অবৈধভাবে জাপানে থেকে ধরা পড়ে যায় দুভার্গ্যক্রমে। নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসে দেশে।

ব্ল্যাক রঞ্জু তখন পুলিশের তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী। বিশাল একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলেছে। ঢাকা শহরে সবচাইতে সুসংগঠিত সন্ত্রাসী চক্রের প্রধান হয়ে উঠেছে সে। বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক রঞ্জু চলচ্চিত্রেও লগ্নি করতে শুরু করেছে তখন। এছাড়াও বেনামে অসংখ্য ব্যবসা-বাণিজ্য তো ছিলোই।

দেশে ফিরে আসার পর এক দিন ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে সে দেখা করে। কোনো রকম সাহায্য চাওয়ার আগেই রঞ্জু তাকে প্রস্তাব দেয়, চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য। সে তো ভালো ফাইট জানে, তাহলে একটা ফাইটিং গ্রুপ করছে না কেন?

ব্যস, শুরু হয়ে গেলো তার অন্য রকম একটি ক্যারিয়ার। ব্ল্যাক রঞ্জুর আশীর্বাদ পেয়ে দ্রুত চলচ্চিত্র জগতে ঠাঁই করে নেয় মিলন। ‘সুনামি’ নামের একটি ফাইটিং গ্রুপ গঠন করে ফেলে তার আরো দুই বন্ধু সুহাস আর নাহিদকে নিয়ে।

এক অন্যরকম জগতের বাসিন্দা হয়ে যায় সে টাকা আর গ্ল্যামারের স্বপ্নময় দুনিয়া। উঠতি নায়িকা আর এক্সট্রা মেয়েদের সাথে লাগামহীন যৌনতায় মেতে থাকা, আস্তে আস্তে মদ-গাঁজা, ফেন্সিডিল সেবন করতে শুরু করা, আউটডোর লোকেশনে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শুরু করে মাঝেমধ্যে বিদেশেও ঘুরে বেড়ানো, এফডিসিতে মাস্তানি করা, ভালোই চলছিলো সব। কিন্তু হুট করে এক এক্সট্রা মেয়ের সাথে ঝামেলা পাকিয়ে ফেলায় তাকে বাধ্য হয়েই বিয়ে করতে হয়। মেয়েটার পেটে নাকি তার সন্তান এসে গেছিলো। পরে অবশ্য পেটের বাচ্চাটি মৃত প্রসব হয়েছিলো। মিলনের বিশ্বাস, ওটা তার নিজের ছিলো না।

তার প্রথম বউ আম্বিয়া খুবই ধূর্ত প্রকৃতির এক মহিলা, এফডিসির এক্সট্রা মেয়েদের লিডার ছিলো সে। চলচ্চিত্র শিল্পের অনেকের সাথেই তার ছিলো অন্যরকম সম্পর্ক। বিভিন্ন ছবিতে অভিনয় করতো ছোটোখাটো ভ্যাম্প চরিত্রে। অশ্লীল ছবি করার অপরাধে তাকে দুএকবার এফডিসি থেকে নিষিদ্ধ করাও হয়েছিলো কিন্তু ব্ল্যাক রঞ্জুর তিন নাম্বার বউ মিনার আত্মীয় হবার সুবাদে বার বার সে পার পেয়ে যায়। চলচ্চিত্রে কাজ করার পাশাপাশি ফেন্সিডিল, পেথেড্রিন থেকে শুরু করে মেয়েদের দিয়ে দেহব্যবসাও চালাতো। সে নিজেও পেথেড্রিনে আসক্ত।

এরকম একটা মেয়েকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই উঠতো না যদি ব্ল্যাক রঞ্জুর তিন নাম্বার বউয়ের সাথে আছিয়ার ভালো সম্পর্ক না থাকতো। রঞ্জুর স্ত্রী মিনার দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলো আম্বিয়া। তারচেয়েও বড় কথা মিনার দেহব্যবসার সাথে জড়িত ছিলো সে। উঠতি নায়িকা হবার স্বপ্ন নিয়ে যেসব মেয়ে এফডিসিতে আসতো তাদের মধ্যে থেকে কাউকে কাউকে মিনার অন্ধকার দুনিয়ায় পৌঁছে দিতে এই আম্বিয়া।

যাইহোক, মিনা আর রঞ্জুকে খুশি করার জন্যেই আম্বিয়াকে বিয়ে করা হয়েছিলো, কিন্তু বিয়ের প্রথম দিন থেকেই তার সাথে বনিবনা হচ্ছিলো না। প্রায়ই তারা মারামারি করতো। মিনা তাদের দু’জনকে ডেকে ধমক দিয়ে ভালোমতো সংসার করতে বলতো। ধমক খেয়ে বড়জোর এক সপ্তাহ ঠিক থাকতো আম্বিয়া, তারপরই ফিরে আসতো পুরনো রুপে।

পেথেড্রিনে আসক্ত আম্বিয়ার মেজাজ খিটখিটে থাকতো সব সময়। মিলনকে সন্দেহ করতো অন্য কোনো মেয়ের সাথে লটরপটর করছে কিনা। বাড়িতে এলেই তার শার্টের গন্ধ শুকতো, মেয়েমানুষের চুল খুঁজে বেড়াতো। এ নিয়ে শুরু হতো বিশ্রি ভাষায় গালাগালি। কিন্তু মিলন এরকম জঘন্য জীবন চায় নি। এরকম নোংরা আর বাজে মুখের একটা মেয়ে তার বউ, ব্যাপারটা ভাবতেই ঘেন্না লাগতো। কিন্তু কিছু করার ছিলো না। অবস্থা বেগতিক হয়ে উঠলে এক পর্যায়ে আলাদা থাকতে শুরু করে তারা।

ঠিক তখনই পরিচয় হয় নায়িকা হবার স্বপ্ন নিয়ে এফডিসিতে আসা পলির সাথে। মিলন জানতো মেয়েটার দিকে কতোগুলো মানুষের কুনজর পড়েছে। তাদের হাত থেকে অভাবি এই মেয়েটাকে সে রক্ষা করে। বেশ কয়েকটি ছবিতে সাইড নায়িকা হিসেবে কাজ জুটিয়ে দেয় মিলন। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্কও তৈরি হয়। মিলন তখন আম্বিয়ার সাথে এক বাড়িতে থাকতো না, সুতরাং পলিকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে ওঠায়।

খবরটা আম্বিয়ার কানে গেলে সে কিছু করার সাহস পায় নি কারণ তার খুঁটি ততোদিনে নড়বড়ে হয়ে গেছে। ব্ল্যাক রঞ্জু অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় দেশ ছেড়ে কোলকাতায় আশ্রয় নেয়। অবশ্য রঙুর স্ত্রী মিনা মিলনকে এ ব্যাপারে অনেক শাসিয়েছিলো। পলিকে ছেড়ে দিয়ে আম্বিয়ার কাছে যেনো ফিরে আসে সে, কিন্তু মিলন তাতে কান দেয় নি। ততো দিনে পলিতে দারুণ মজে গেছে মিলন। আম্বিয়াকে তালাক দিয়ে পলিকে বিয়ে করার প্রস্ততি নিলে মিনা বাগড়া দেয়। মিলনকে জানিয়ে দেয়, আম্বিয়াকে ডিভোর্স করার কথা যেনো ভুলেও চিন্তা না করে। তো, বিয়ে না করেই পলির সাথে বসবাস করতে শুরু করে মিলন। এক পর্যায়ে চলচ্চিত্র শিল্পে মন্দা নেমে এলে ইয়াবার ব্যবসায় নামে তারা দু’জন। সবই ভালো চলছিলো। আম্বিয়ার সাথেও একটা অলিখিত বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গিয়েছিলো তার। পলির সাথে মিলন থাকতে পারবে কিন্তু তাকে বিয়ে করতে পারবে না। আর আম্বিয়াকে যাবতীয় ভরণপোষণ দিতে হবে মাসে মাসে।

মিলন তাই করে যাচ্ছিলো। আম্বিয়া তার স্ত্রী হলেও সে বসবাস করতো পলির সাথে। কিন্তু এই ব্যবস্থায় পলি খুশি হতে পারে নি। সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তাকে বিয়ে না করলে সে মিলনের সন্তান ধারণ করবে না। আগে বিয়ে তারপর সন্তান। মিলন পলিকে বোঝায়, আর কটা দিন অপেক্ষা করতে। এভাবে বেশ কিছুটা সময় চলে যায়। নানান টানাপোড়েন, ঝগড়া-ঝাটির পরও মিলন-পলির সম্পর্ক অটুট থাকে। তবে পলি আর মিলন দু’জনেই ইয়াবা আসক্ত হয়ে পড়ে।

এক সময় ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়ে তারা দু’জন। পলিকে জামিনে মুক্ত করা গেলেও মিলন বের হতে পারে নি। কারণ তার কাছে পিস্তল পাওয়া গেছিলো। জেলে বসে দিন গুণছিলো সে। আর বাইরে বেরিয়ে এসে পলি খুব চেষ্টা করতে থাকলেও মিলনকে বের করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। হাইকোর্ট সুমকোর্টের লাখ টাকা দামের ব্যারিস্টার ছাড়া এটা সম্ভব হতো না।

ঠিক তখনই জেলের ভেতর ব্ল্যাক রঞ্জুর সাথে মিলনের দেখা হয়ে যায়। তারপর নতুন করে সখ্যতা গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগে নি।

ব্ল্যাক রঞ্জুর পুরো দলটার কোমর ভেঙে দিয়েছিলো বাস্টার্ড নামের এক প্রফেশনাল কিলার। দেশে তার দলের সব হোমরাচোমরাকে খুন করে বদমাশটা কোলকাতায় গিয়ে হানা দেয়। কথাটা শোনার পর মিলনের বিশ্বাসই হতে চাইছিলো না। ব্ল্যাক রঞ্জুর মতো একজনকে খুন করার জন্যে কোলকাতায় চলে গেছে। এরকম লোকও আছে এ দুনিয়াতে?

ঐ বাস্টার্ডও নাকি পুলিশের কাছে ধরা পড়ে জেলে ছিলো। রঞ্জুর গুলিতে আহত হলেও হারামির বাচ্চাটা জানে বেঁচে যায়। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের আশীর্বাদ পেয়ে জামিনে মুক্ত হয়ে বিদেশে চলে যায় বাস্টার্ড।

স্বাভাবিকভাবেই মিলন জানতে চায়, বাস্টার্ড কেন তার দলের বিরুদ্ধে লাগলো? আর নতুন সরকারই বা কেন এরকম এক খুনিকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো?

রঞ্জু তখন সব খুলে বলে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জেলেবন্দী স্বামী নিবার্চনের আগে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলো, আর সেই দায়িত্ব দিয়েছিলো রঙুর উপর। কথাটা শুনে মিলন দারুণ অবাক হলেও রঞ্জুর প্রতি সমীহটা আরো বেড়ে যায়।

রঞ্জুর ধারণা, পেছন থেকে কেউ কলকাঠি নেড়েছে। তাদের পরিকল্পনার কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে পাল্টা এক ষড়যন্ত্র করে বাস্টার্ডকে তাদের বিরুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছিলো পর্দার আড়ালে থাকা এক লোক। যদিও ব্ল্যাক রঞ্জু জানে কে সেই লোক তবে মিলনকে সেটা বলে নি।

যাইহোক, বাস্টার্ডের কারণেই রঞ্জুর এই অবস্থা। পঙ্গু, হুইলচেয়ারে বন্দী এক লোক। তার তৈরি করা বিশাল নেটওয়ার্কটি প্রায় ভেঙে পড়েছে। হাতেগোনা যে কয়জন বাইরে ছিলো তারাও পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তখন। কিন্তু ব্ল্যাক রঞ্জুর বিশাল সাম্রাজ্যটা তো আর কতোগুলো লোকের সমাহারে তৈরি হয় নি, তৈরি হয়েছে রঞ্জুর মতো দুঃসাহসী একজন সন্ত্রাসী আর বিপুল পরিমাণের টাকার মাধ্যমে।

সেই রঞ্জু বেঁচে আছে, তারচেয়েও বড় কথা তার কাছে যে বিপুল পরিমাণ টাকা আর সহায়সম্পত্তি ছিলো সেগুলো অক্ষত আছে, সুতরাং জেলে পচে মরার চাইতে শেষ একটা চেষ্টা করবে না কেন?

টাকা যা লাগে লাগুক, রঞ্জুর চাই মুক্তি। মুক্তি পেলে সে নিজের অসুস্থ শরীরটা ভালো করতে পারবে। আবার শুরু করতে পারবে সব কিছু। হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়া তখন কোনো ব্যাপারই না।

কিন্তু জেল থেকে রঞ্জুর মুক্তিলাভ কিভাবে সম্ভব? ব্যাপারটা এমন নয় যে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নামি-দামি ব্যারিস্টার ধরলেই তার মুক্তি মিলে যাবে। তাহলে?

ঠিক তখনই রঞ্জু তার পরিকল্পনার কথা জানায় মিলনকে। প্রথমে সবটা শুনে ভড়কে গেছিলো। কিন্তু রঞ্জু যখন জানালো এর জন্যে সে কোটি কোটি টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করবে না, তখন মিলন ভরসা পায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ ঝন্টুকে জেল থেকে মুক্ত করা হয় প্রচুর টাকা খরচ করে নামি এক ব্যারিস্টার ধরে। ঝন্টু জেল থেকে বের হয়েই একে একে বের করে আনে মিলনসহ অনেককে। বাইরে এসে তারা সুসংগঠিত করে পুরো দলটি। প্রচুর নতুন লোককে দলে ভেড়ায়। আগের মতো স্বল্পশিক্ষিতদের বদলে অপেক্ষাকৃত স্মার্ট আর আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত লোকজনকে জোগার করতে শুরু করে ঝন্টু আর মিলন।

বিশাল অঙ্কের টাকা লগ্নি করে রঞ্জু। জেলে থেকে সব ধরণের কলকাঠি নাড়তে থাকে সে। বাইরে থেকে সবকিছু গুছিয়ে নেয় মিলন আর ঝন্টু। মূলতঃ তারা দুজনেই হয়ে ওঠে রঞ্জুর দুটো হাত-সত্যিকার অর্থে রঞ্জুর অকেজো হওয়া দুটো পা। তাদের সাহায্যেই অকেজো আর বন্দী রঞ্জু সচল হয়ে ওঠে। খুব দ্রুত, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে মিলন আর ঝন্টু একেবারে নতুন একটি দল তৈরি করে ফেলে। পুরনোদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন বাদে এই দলের সদস্যরা একে অন্যেকে ঠিকমতো চেনেও না। প্রত্যেককে নিজেদের কাজ ভাগ করে দেয়া হয়। যারা তথ্য জোগার করে তারা জানে না ক্যাডারগ্রুপে কারা কাজ করে। আবার ক্যাডার গ্রুপের কাছেও তথ্য সংগ্রহকারী গ্রুপটি একেবারে অদৃশ্য।

বিশাল এক কর্মীবাহিনী। প্রত্যেকের জন্য মাসে মাসে মোটা অঙ্কের বেতন আর সব ধরণের সুযোগ সুবিধা। ধরা পড়লে লাখ টাকা দামের ব্যারিস্টার মাঠে নেমে পড়বে সময়ক্ষেপন না করেই। বিনিময়ে যা করতে বলা হবে বিনা বাক্য ব্যয়ে তা পালন করতে হবে সবাইকে। একেবারে রোবটের মতো।

অনেকগুলো স্তরে বিভক্ত এই দলটি কোনো গুপ্ত সংস্থার মতোই। দলের সাথে বেঈমানি করলে মৃত্যুদণ্ড, আর দলের হয়ে কাজ করলে ভোগ-বিলাসের সব উপকরণই মিলবে।

কাউকে কারো কাছে কিছু চাইতে হয় না। যার যা পাওনা পৌঁছে যায় নিজেদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে। কাজের অর্ডার চলে আসে ফোনে কিংবা ই-মেইলে। দেখা সাক্ষাতের খুব একটা দরকারও পড়ে না। সুতরাং ধরা পড়লে পুলিশের কাছে খুব বেশি ফাঁস করার ঝুঁকিও নেই।

মিলন আর ঝন্টু দিনরাত পরিশ্রম করে দলটি তৈরি করেছে। তারপর ব্ল্যাক রঞ্জুর কথামতো নিজেদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে তারা ভালোমতোই সফল হয়। হোমমিনিস্টারের ছেলেকে কিডন্যাপ করে সেন্ট অগাস্টিন স্কুল থেকে। উদ্দেশ্য খুব সহজ-সরল : জেলে বন্দী ব্লাক রঞ্জকে মুক্তি দিতে হবে। তাকে বিদেশে চলে যেতে কোনো রকম বাধা দেয়া হবে না। সেইসাথে ঐ বাস্টার্ড কোথায় আছে সেই তথ্য জানাতে হবে।

তাদেরকে অবাক করে দিয়ে হোমমিনিস্টার খুব দ্রুতই সব দাবিদাওয়া মেনে নিয়েছে। মুক্তি পেয়েছে রঞ্জু। আর কয়েক ঘণ্টা পরই সে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। তারপর বাস্টার্ডকে হাতে মুঠোয় নিয়ে ইচ্ছেমতো প্রতিশোধ নেবে সে।

“প্রতিশোধের ফল কখন সুস্বাদু হয় জানো?” হঠাৎ মিলনের উদ্দেশ্যে বললো রঞ্জু। হুইলচেয়ারটা নিয়ে তার সামনে চলে এলো। “পুরনো হলে। এটা স্প্যানিশ প্রবাদ। কথাটা সব সময় মনে রাখবে।”

মাথা নীচু করে মিলন চুপচাপ শুনে গেলো, কোনো প্রতিবাদ করলো না।

“আমরা যে ধরণের কাজ করি সেখানে কোনো একটা মেয়ের জন্য এভাবে মরিয়া হয়ে যাওয়াটা মানায় না, মিলন।”

কথাটা শুনে মিলন তাকালো রঙুর দিকে।

“আমার বউ মিনা, মঞ্জুভাইসহ কতোজনকে ঐ বানচোতটা খুন করেছে। তুমি জানো?” কথাটা বলে রঞ্জু মাথা দোলালো। হুইলচেয়ার থেকে বসেই মিলনের হাতটা ধরলো সে। “কিন্তু আমি অপেক্ষা করেছি। কারণ এসব খেলা কিভাবে খেলতে হয় সেটা আমি ভালো করেই জানি।”

মিলনও এসব জানে কিন্তু একবার ব্যাঙ্ককে চলে গেলে এই জীবনে আর দেশে ফিরে আসতে পারবে কি না কে জানে। তার প্রতিশোধটা আর কখনই নেয়া হবে না।

“তুমি চেয়েছিলে পলিকে নিয়ে দেশে থাকতে…আমি তো মানা করি নি। করেছি?”

মিলন মাথা দোলালো।

“কিন্তু স্কুলের ঐ ছেলেটা খুন হয়ে যাবার পর মি: বেগ তোমার পেছনে লাগলো, আর তুমিও মাথা গরম করে লোকটার পেছনে লাগতে গেলে,” দু’পাশে মাথা দোলালো আক্ষেপে। “মাঝখান থেকে মারা গেলো পলি।” একটু থেমে আবার বললো, “পুলিশ তোমার পেছনে লেগেছে। এখানে থাকলে বিশাল বিপদে পড়ে যাবে।”

মিলনকে চুপ থাকতে দেখে রঞ্জুর মেজাজ কিছুটা খারাপ হয়ে গেলো। সে তাকালো ঝন্টুর দিকে। মদ খেয়ে ঝিমুচ্ছে সে।

“ঝন্টু, তুই ওরে একটু বোঝা।”

চোখে টেনে ঝন্টু তাকালো মিলনের দিকে। “আরে আমি তো কইছি…তোমার এইখানে থাকন যাইবো না। ব্যাঙ্ককে যাইতেই অইবো… ওইখানে গেলে কতো মাইয়া মানুষ পাইবা…খামোখা এইসব পাগলামি করতাছে ক্যান…আজব!”।

“আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। তোমাকে কালই ব্যাঙ্ককে চলে যেতে হবে। টিকেট রেডি। সব কিছু ঠিকঠাক করা আছে। বড়ভাই হিসেবে এটা আমার অর্ডার।”

“ডাইরেক্ট অর্ডার,” কথাটা বলেই ঢেকুর তুললো ঝন্টু। “সব ফাইনাল…খালি প্লেনে উঠবা…আর ফোঁস!” টেনে টেনে কথাটা বলেই হাত দিয়ে প্লেন ওড়ার ভঙ্গি করলো সে।

“আমার ভাই, অবুঝ হয়ো না,” বললো রঞ্জু। মিলন কোনো জবাব দিলো না। শুধু মুখ তুলে তাকালো। “তোমার টিকেট পাসপোর্ট সব রেডি আছে। সোজা ব্যাঙ্ককে চলে আসো। মাথা গরম করে কিছু কোরো না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মিলন।

রঞ্জু এবার ঝন্টুর দিকে ফিরলো। “কিরে…সব ঠিক আছে তো?”

ঝন্টু চোখ টেনে তাকালো তার দিকে। “পুরা ঠিক আছে, ভাই।”

মুচকি হাসলো রঞ্জু। “বাস্টার্ডকে হাতে পাওয়ার পর সব ক্লিয়ার করে ফেলতে হবে…” কথাটা বলেই চোখেমুখে অন্যরকম একটা ইঙ্গিত করলো সে।

বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে হাই-ফাইভ করলো ঝন্টু। “আপনে টেনশন নিয়েন না। সময়মতো সব অয়া যাইবো।”

মিলন দারুণ অবাক হলো। রঞ্জু কি হোমমিনিস্টারের ছেলেকেও খুন করার কথা ভাবছে নাকি!

“আপনি ওই ছেলেটাকেও?–”

মিলনের কথা শেষ হবার আগেই রঞ্জু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো, “এর কি কোনো দরকার আছে, ভাই?”

“আছে।” কথাটা বলেই ইলেক্টক হুইলচেয়ারটা নিয়ে ঘরের মধ্যে একটা চক্কর দিলো রঞ্জু। “ওই ছেলেটার বাপই বাস্টার্ডকে ভাড়া করেছিলো।”

কথাটা শুনে মিলন চুপ মেরে রইলো। এটা সে জানতো না। এর আগে রঞ্জু তাকে এ কথাটা বলে নি। তবে রঞ্জু কোত্থেকে এটা জানতে পেরেছে সেটা আর জিজ্ঞেস করলো না। ব্ল্যাক রঞ্জুর কতো মিত্র আছে এটা তারা নিজেরাও জানে না। যে লোকের শত্রুরা প্রকাশ্য কিন্তু বন্ধুরা একেবারেই গোপন তার ক্ষমতা আন্দাজ করা খুব কঠিন।

“আমি চাই ওই মিনিস্টার আগামী কয়েকটা দিন শোকে বিপর্যস্ত থাকুক।”

তারপরই নিঃশব্দ হাসি দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরতে লাগলো রঞ্জু। ইলেক্ট্রক হুইলচেয়ারের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কিছু শোনা গেলো না।

অধ্যায় ৬৪

সব শুনে উমা চুপ মেরে আছে। তারা এখন বসে আছে নার্সদের ক্যান্টিনে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে জেফরি বেগ, অনেকক্ষণ কথা বলে তার গলা শুকিয়ে গেছে।

উমা বুঝতে পারছে না, তার সামনে বসা লোকটি সত্যি বলছে নাকি তাকে ফাঁদে ফেলে বাবলুকে ধরার চেষ্টা করছে।

একটু আগে এই লোক যা বলেছে সেটা কি বিশ্বাস করার মতো?

ব্ল্যাক রঞ্জু নাকি জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে জামিনে। আর এ কাজে সাহায্য করেছে স্বয়ং হোমমিনিস্টার। একজন মিনিস্টার কেন এ কাজ করতে যাবে-সেই প্রশ্নের জবাবে এই লোক যা বলেছে সেটা আরো বেশি লোমহর্ষক। হোমমিনিস্টারের ছেলেকে নাকি ব্ল্যাক রঞ্জুর দল অপহরণ করেছে

“আপনি বলছেন, মিনিস্টার রঞ্জুকে সব বলে দিয়েছে?…মানে বাবলু কোথায় থাকে?” উমা অবশেষে বললো।

“হ্যাঁ।” ছোট্ট করে বললো জেফরি।

“কিন্তু মিনিস্টার আপনাকে বলে নি বাবলু কোথায় আছে?”

“আমি জানতে চেয়েছিলাম, উনি বলেন নি।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেফরি আবার বললো, “উনার ছেলে তুর্য মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত এসব ব্যাপারে মুখ খুলবেন না।”

উমা একটু ভেবে নিলো। “আপনি তো বাবলুকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে আছেন…আপনি কেন তাকে বাঁচাতে চাইছেন এখন?”

মুচকি হাসলো জেফরি। সে জানতো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

“আমি বাবলুকে ধরতে চাই সেটা ঠিক…কিন্তু আমি চাই না ব্ল্যাক রঞ্জুর মতো জঘন্য কোনো খুনি-সন্ত্রাসীর হাতে সে মারা যাক।”

উমা চেয়ে রইলো ইনভেস্টিগেটরের দিকে, কিছু বললো না। এই ইনভেস্টিগেটরের কথা বিশ্বাস বরকে কিনা বুঝতে পারছে না। তার মনের একটা অংশ বলছে বিশ্বাস করতে, কিন্তু অন্য অংশটা সতর্ক।

একটু থেমে আবার বললো জেফরি, “আপনার জন্যে যেটা জরুরি সেটা হলো বাবলুকে বাঁচাতে হবে। আমাদের হাতে একদম সময় নেই। যা করার দ্রুত করতে হবে। দেরি করলে বাবলুকে আর জীবিত পাবেন না।”

উমা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো জেফরির দিকে।

.

জেফরি আর উমা যে টেবিলে বসে কথা বলছে তার থেকে একটু দূরে, কর্নারের একটি টেবিলে বসে চা খাচ্ছে এক লোক, তবে চায়ের কাপে তার মনোযোগ নেই, তার সমস্ত মনোযোগ হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর আর নার্স মেয়েটির উপর নিবদ্ধ।

গতকাল থেকেই সে ইনভেস্টিগেটরের পেছনে লেগে আছে। একটা বিরক্তিকর কাজ কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তাকে কিছু বলা হয়, তবে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছে, কাজটার গুরুত্ব আছে।

যারা মানুষের পেছনে লেগে থাকে তাদের পেছনে লেগে থাকাটা নিশ্চয় কোনো সাধারণ ঘটনা নয়!

।অধ্যায় ৬৫

জেফরি বেগ অফিসে ফিরে এলো ব্যর্থমনোরথে। উমাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে পারলেও কাজ হয় নি। বাবলুর ফোন বন্ধ। উমার সামনেই কয়েক বার চেষ্টা করে দেখেছে।

ফোন বন্ধ দেখে উমার মতো সেও চিন্তায় পড়ে গেছে-তাহলে কি রঞ্জুর দল এরইমধ্যে বাবলুকে?…

না। অসম্ভব। ব্ল্যাক রঞ্জু গতপরশু ছাড়া পেয়েছে। তবে এটাও তো ঠিক, বদমাশটা জেলে বসে থেকেই তার দলটা নতুন করে তৈরি করে নিয়েছে। এখন তারা আগের চেয়েও শক্তিশালী, আরো বেশি ভয়ঙ্কর, উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যেকোনো কিছু করতে মরিয়া। কোলকাতায় তার লোকজনও আছে, তারা খুব সহজেই দিল্লি চলে যেতে পারবে।

উমা তাকে জানিয়েছে, ইদানিং বাবলুর সাথে তার মাঝেমধ্যে ভিডিও চ্যাটিংও হয় তবে সেটা সব সময়ই ছুটির দিনে নয়তো রাতের বেলায়। ফোনে আগে থেকে ঠিক করে নেয় কখন চ্যাটিং করবে।

জেফরি সঙ্গে সঙ্গে তার মোবাইল থেকে বাবলুকে একটা ই-মেইল করে সব জানিয়ে দিয়েছে। ভাগ্য ভালো থাকলে রঞ্জুর দলের হাতে মারা পড়ার আগেই বাবলু ওটা পড়ে নেবে। কিন্তু জেফরি নিশ্চিন্ত হতে পারছে না, তার আশংকা এরইমধ্যে কিছু একটা হয়ে গেছে।

“স্যার, কখন এসেছেন?” জামান দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো।

“এই তো এলাম,” বললো সে।

“আজ এতো দেরি করলেন যে?”

জেফরি আসল কথাটা বলতে চাইছে না তবে সে ভালো করেই জানে অফিসের গাড়িতে করে পিজি হাসপাতালে গেছিলো, কথাটা হয়তো গোপন নাও থাকতে পারে। “এক বন্ধুকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম, তাই দেরি হয়ে গেছে।”

জামান তার সামনের চেয়ারে বসে পড়লো। “মিনিস্টারের সাথে কী কথা হলো, স্যার?”

“সবই স্বীকার করেছেন, আর বলে দিয়েছেন আমরা যেনো এ ব্যাপারে কোনো কিছু না করি।”

“তাই নাকি?”

“হুম,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো জেফরি বেগ। “এই হলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অবস্থা।”

জামান একটু চুপ থেকে বললো, “স্যার, আমি একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছি…বলবো?”

“বলো।”

“হাসান সাহেব তুর্যের কিডন্যাপের ব্যাপারে মিলনকে সাহায্য করেছিলো। কাজ শেষ হবার পর মিলন কোনো সাক্ষী না রাখার জন্য হাসানকে খুন করে।”

জেফরি তার সহকারীর দিকে চেয়ে রইলো। খুব একটা খারাপ বলে নি ছেলেটা। “হতে পারে।” কথাটা বলেই হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর চুপ মেরে গেলো। তার মাথায় এখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

“আপনি তাহলে কি করবেন, স্যার?” অনেকক্ষণ পর বললো জামান।

“যা আমরা করছিলাম…” একটু থেমে আবার বললো সে, “আমি মিনিস্টারকে বলে দিয়েছি, তুর্যের কিডন্যাপ হওয়ার ঘটনা নিয়ে আমরা তদন্ত করছি না। আমরা তদন্ত করছি অগাস্টিনের ক্লার্ক হাসানের হত্যাকাণ্ডটি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। “তুর্যের খবর কি?”

“এখনও মুক্তি দেয় নি।”

“বলেন কি!” বিস্মিত হলো জামান। “ব্ল্যাক রঞ্জু তো গত পরশু ছাড়া পেয়ে গেছে, তাহলে ওরা তুর্যকে ছাড়ছে না কেন?”

জেফরি পুরো ঘটনাটা খুলে বললো জামানকে। সব শুনে ছেলেটা চুপ। মেরে রইলো কিছুক্ষণ।

“আমরা এখন কি করবো, স্যার?”

“মিলনকে ট্র্যাক ডাউন করবো।”

“কিভাবে? আপনার কাছে কি নতুন কোনো ইনফর্মেশন আছে?”

“আছে।”

কথাটা শুনে জামান সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে। “কি রকম?”

“তুর্যকে ধরার পর ভিডিও পাঠিয়েছে ওরা, মিনিস্টার বলছেন প্রতিদিনই আপগ্রেড ভিডিও পাঠাচ্ছে। আমরা ওই ভিডিওগুলো দেখে অ্যানালিসিস করে দেখতে পারি, ওটা দিয়ে মিলনকে ট্র্যাক ডাউন করা যায় কিনা…”

জেফরির কথাটা শুনে জামান মাথা নেড়ে সায় দিলো। “কিন্তু ভিডিও অ্যানালিসিস করার দরকার নেই, স্যার। আমরা খুব সহজেই বের করতে পারবো ভিডিওটা কোত্থেকে আপলোড করা হয়েছে…কোন ওয়েবসাইট থেকে এটা ব্রডকাস্ট করা হচ্ছে।”

“ওরা ইউ-টিউব ব্যবহার করছে, জামান,” জেফরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।

“কি!”

“আমার মনে হয় না এতো সহজে ওটা ট্র্যাক ডাউন করা যাবে…ওরা অনেক বেশি স্মার্ট।”

“তাহলে ভিডিও দেখে কী করবেন, স্যার?”

“আগে তো, দেখি…তারপর বোঝা যাবে কিছু পাওয়া যায় কিনা। মিনিস্টারের ওখানে ভিডিওটা ভালো করে দেখার সুযোগ পাই নি।”

জেফরির কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান।

ডেস্কের উপর ল্যাপটপটা ওপেন করে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিলো সে। “আমি নিশ্চিত, ওরা ছেলেটাকে মেরে ফেলবে…” ল্যাপটপটা চালু করে ইন্টারনেটে ঢুকে বললো জেফরি বেগ।

জামান কিছু বললো না তবে সেও জানে কথাটা সত্যি হবার সম্ভাবনাই বেশি। আজকাল খুব কম কিডন্যাপ কেসেই জিম্মিকে জীবিত অবস্থায় মুক্তি দেয়া হয়।

“পাশে এসে বসো,” জামানকে বললো জেফরি। ইউ-টিউবের একটা লিঙ্ক টাইপ করলো সে।

জামান চেয়ারটা তুলে নিয়ে তার বসের পাশে বসে ল্যাপটপের পদার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

ভিডিওটা বাফারিং হবার আগেই চা চলে এলো কিন্তু দু’জনের কেউই কাপটা ছুঁয়ে দেখলো না। তাদের দৃষ্টি ল্যাপটপের পদায় নিবদ্ধ।

ইউ-টিউবের কালো ভিডিও স্ক্রিনটায় একটা ছবি ভেসে উঠলো :

তুর্য বসে আছে একটা চেয়ারে। তার চারপাশের ঘরটা বেশ অদ্ভুত। ঠিক পরিচিত কোনো ঘরের মতো মনে হয় না। ভিডিওটা প্রথম দেখার সময়ও জেফরির এটা মনে হয়েছিলো।

তুর্যের চোখেমুখে আতঙ্ক। মাথার চুল এলোমেলো। ঠোঁটের এককোণ ফোলা। ছবিটা সচল হলো এবার।

তুর্য চিৎকার করে বললো : “প্লিজ, আমাকে মারবেন না। প্লিজ!”

হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত চেপে ধরলো তুর্যের মুখ। হাত আর বুকের কিছু অংশ ছাড়া লোকটাকে দেখা গেলো না। লোকটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে তুর্য। উদভ্রান্তের মতো হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হলো না। এতো শক্ত করে বাধা যে একটুও নড়াতে পারলো না। এমনকি চেয়ারটাও নড়ে উঠলো না, যেনো শক্ত কোনো কিছু দিয়ে সেটা আটকে রাখা হয়েছে।

পেছন থেকে তুর্যের মুখ ধরে রাখা হাতটা হঠাৎ করেই ছেড়ে দিলো। হাফিয়ে উঠলো ছেলেটা। চিৎকার করে বলে উঠলো : “বাবা, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে…বাবা আমাকে বাঁচাও!”

দৃশ্যটা ফ্রিজ হয়ে গেলো। ভিডিওটা এখানেই শেষ। ছোট্ট আর ভয়ঙ্কর এক দৃশ্য, বিশেষ করে ছেলেটার বাবা-মায়ের জন্য।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে পাঁচচল্লিশ সেকেন্ডের ভিডিওটা পর পর তিনবার দেখে গেলো জেফরি আর জামান।

অবশেষে জামানের দিকে ফিরলো সে। “কি বুঝলে?”

“ঘরটা খুবই অদ্ভুত…” বললো জামান।

জেফরি খুশি হলো। ছেলেটার অবজার্ভেশন দিন দিন তীক্ষ্ণ হচ্ছে। “গুড।”

“দেখে মনে হয় না এটা কোনো বাসাবাড়ি।”

“হুম।”

“ছেলেটা চিৎকার করলে মুখ চেপে ধরেছে কিডন্যাপারদের কেউ। তার মানে জায়গাটা একেবারে আইসোলোটেড নয়।”

জেফরি অবশ্য এটা মনে করে না। তার ধারণা, হোমমিনিস্টারকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার জন্য এটা করা হয়েছে। তারপরও সহকারীর কথাটা গুরুত্ব দিলো সে।

“ভিডিওটা আপলোড করার টাইম আর ডেটটা দেখেছো?”

জামান ল্যাপটপের পদার দিকে তাকালো। “গত বৃহস্পতিবার ছেলেটা কিডন্যাপ হবার দিনই এটা আপলোড করা হয়েছে, স্যার…”

“হুম।” আর কিছু বললো না। দেখতে চাচ্ছে জামান কতোটুকু বের করতে পারে।

“টাইমিং বলছে, ৫: ৪৮…”

“আরেকটা টাইমিং মিস্ করেছো তুমি,” বললো জেফরি বেগ।

জামান পর্দার দিকে তাকালো। তুর্যের আর্তনাদরত ছবিটা ফ্রিজ হয়ে আছে। সে কিছু ধরতে পারলো না।

জেফরি ভিডিওটা চতুর্থবারের মতো প্লে করলো। “এবার খেয়াল করো…”

জামান ভালো করে চেয়ে রইলো। পাঁচচল্লিশ সেকেন্ডের ভিডিওটা শেষ হবার আগেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

“স্যার, কিডন্যাপারের হাতঘড়ির সময়টা?” উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো সে। যেনো মজার কোনো ধাঁধার উত্তর দিতে পেরেছে।

হাসলো জেফরি বেগ। “ঠিক ধরেছো। কিডন্যাপারের হাতঘড়িতে সময়টা বলছে ৫: ৩৬।”

“তার মানে ভিডিওটা আপলোড করতে বারো মিনিট সময় লেগেছে,” বললো জামান।

“আমি আপলোডের সময় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।”

জামান কিছু বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো তার দিকে। “তাহলে?”

“আমি ভাবছি তুর্যকে কিডন্যাপ করার কতোক্ষণ পর ভিডিওটা করা হয়েছে?”

জামান এবার ধরতে পারলো। এখানেই একজন দক্ষ আর নবীন ইনভেস্টিগেটরের মধ্যে পার্থক্য। অসংখ্য গলি আছে তোমার সামনে কিন্তু তুমি জানো না কোন গলিটা দিয়ে বের হতে পারবে। ভুল গলিতে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।

“আমাদের কাছে হাসানের খুন হবার ফরেনসিক রিপোর্ট আছে, স্যার। ওখানে বলা আছে, হাসানের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে আনুমাণিক সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে,” বললো জামান।

“যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে হাসান খুন হবার পরই তুর্যকে কিডন্যাপ করে মিলন আর তার সঙ্গি স্কুল থেকে বের হয়ে গেছে। মনে রেখো, ওরা প্রাইভেটকার ব্যবহার করেছিলো।”

“জি, স্যার।”

“আমরা যদি সাড়ে চার আর পাঁচের মধ্যে গড় করে ধরে নেই চারটা পাঁচচল্লিশে ওরা স্কুল থেকে বের হয়ে গেছিলো তাহলে কতো সময় পরে ওরা নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছালো?”

জামান একটু হিসেব করে নিলো মনে মনে। “প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের মতো হবে, স্যার।”

“এ থেকে তুমি আরো দশ মিনিট কেটে দিতে পারো। তুর্যকে নিরাপদ আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার পর ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটার চালু করতে, ছেলেটার হাত-পা বেধে নিতে এটুকু সময় নিশ্চয় লাগবে?”

“জি, স্যার…তাহলে আমাদের হাতে থাকে চল্লিশ মিনিট।”

“আমার আরেকটা অনুমাণ হলো, ওরা তুর্যকে স্কুল থেকে অপহরণ করার সময় ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করেছে। তুর্যের চোখমুখ দেখে এটা আমার মনে। হয়েছে। তাছাড়া, এটা ব্যবহার না করলে ছেলেটা বেশ ভোগাতো ওদের।”

“ঠিক বলেছেন, স্যার,” বললো জামান। “তাহলে আমরা কি আরো দশ মিনিট কেটে দিতে পারি?…তুর্যের হুঁশ ফেরানোর জন্য এটুকু সময় তো লাগতেই পারে?”

“অবশ্যই।”

“তার মানে ত্রিশ মিনিট, স্যার!”

“মাত্র ত্রিশ মিনিট। ঢাকা শহরের জ্যামের মধ্যে ত্রিশ মিনিটে তুমি কততদূর যেতে পারবে, জামান?”

জেফরির কথাটা শুনে নড়েচড়ে বসলো তার সহকারী। “তুর্যকে এই ঢাকা শহরেই আটকে রাখা হয়েছে!”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “এবং সেটা সেন্ট অগাস্টিন স্কুল থেকে মাত্র ত্রিশ মিনিটের পথ!”

“মাইগড!” অবাক হয়ে বললো জামান। “একেবারে মেইন সিটিতেই!”

“তুর্যের স্কুলটা আসাদ গেটের খুব কাছে…সেখান থেকে মাত্র ত্রিশ মিনিটের কোনো গোপন জায়গায় ছেলেটাকে আটকে রাখা হয়েছে।” আপন মনে বলে গেলো জেফরি বেগ। “এখন আসো তোমার প্রথম কথাটা নিয়ে ভাবি।”

“জি, স্যার। ঘরটা খুবই অদ্ভুত,” বললো জামান।

“অদ্ভুত কেন মনে হচ্ছে?”

যদিও ভিডিওতে খুব বেশি দেখা যায় নি তবুও এটা স্পষ্ট ঘরটার দেয়াল ইট কিংবা কংক্রিটের নয়। তুর্যের পেছনে বেশ কিছুটা খালি জায়গা আছে, সেখানে দেখা গেছে ছাদটাও বেশ নীচু। “স্যার দেয়ালগুলো ইটের তৈরি না, ছাদটাও বেশ নীচু মনে হয়েছে।”

“গুড। তার মানেটা কি দাঁড়ালো?”

“বুঝতে পারছি না, স্যার।”

“সম্ভবত ঘরটা পোর্টেবল কিংবা কোনো ফ্যাক্টরির অফিসরুম,” বলে গেলো জেফরি বেগ। “তবে এটা নিশ্চিত, ঘরটা সাধারণ কোনো বাসাবাড়ি নয়।”

“একদম ঠিক বলেছেন, স্যার।”

জেফরি একটু ভাবতে লাগলে জামান আবার বললো, “স্যার, ভিডিওটা আরেকবার দেখি?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ভিডিওটা পঞ্চম বারের মতো প্লে করলো সে।

জামান একটু এগিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলো ভিডিওটা। জেফরির চোখ ভিডিওর দিকে নিবদ্ধ থাকলেও তার মনোযোগ অন্যখানে।

ভিডিওটা শেষ হবার আগেই ব্যাপারটা জেফরির চোখে ধরা পড়লো। এর আগে যে কয়বার দেখেছে এটা তার চোখে তেমনভাবে ধরা পড়ে নি। অথচ এখন খুব একটা মনোযোগ না থাকা সত্ত্বেও ব্যাপারটা চোখে পড়েছে।

“জামান?”

ভিডিও থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকালো ছেলেটা। “কি, স্যার?”

ভিডিওটা এখনও শেষ হয় নি। চলছে। “তুর্যকে ভালো করে লক্ষ্য করো!”

জেফরির কথার মধ্যে কীসের যেনো একটা তাড়না অনুভব করতে পারলো জামান। ল্যাপটপের পদায় আবার তাকালো। বোঝার চেষ্টা করলো তার বস কিসের ইঙ্গিত করছে।

কিন্তু ভিডিওটা শেষ হবার পরও জামান কিছু ধরতে পারলো না। “স্যার, ঘটনাটা কি?”

“ভালো করে খেয়াল করেছো?”

“জি, স্যার।”

“কিছু ধরতে পারো নি?” মাথা দোলালো সে।

“তুর্য ছোটার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু…” নিজের ভাবনায় ডুবে গেলো যেনো জেফরি বেগ।

“ওর হাত-পা চেয়ারের হাতলের সাথে বাধা, স্যার।”

“হ্যাঁ, সেটা ঠিক…কিন্তু চেয়ারটা একটুও নড়ে নি! আজব ব্যাপার!”

জামান এখনও বুঝতে পারলো না। হাত-পা বাধা থাকলে নড়বে কিভাবে?

“স্যার, ছেলেটার হাত-পা তো বাধা, নড়বে কিভাবে?”

যেনো সম্বিত ফিরে পেলো জেফরি বেগ। জামানের দিকে সরাসরি তাকালো। “তুর্যের হাত-পা বাধা কিন্তু চেয়ারের তো বাধা নয়। চেয়ারটা কেন একটুও নড়লো না??”

তাই তো! জামান এবার বুঝতে পারলো। “কারণটা কি, স্যার?”

“চেয়ারটা ফ্লোরের সাথে আটকানো!”

এবার বুঝতে পারলো জামান। কিন্তু এটা আর এমন কি? তার বস যেরকম আচরণ করছে তাতে মনে হচ্ছে বিশাল একটি কু পেয়ে গেছে।

“তাই হবে, স্যার। সেজন্যেই চেয়ারটা নড়ে নি।”

জেফরি বুঝতে পারলো তার সহকারী এখনও ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। “জামান, খুব কম জায়গাতেই ফ্লোরের সাথে চেয়ার-টেবিল আঁটকানো থাকে!”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো জামান। এটা তার আরো আগেই বোঝা উচিত ছিলো, কারণ তার দেশের বাড়ি বৃহত্তর বরিশাল জেলায়!

অধ্যায় ৬৬

দুপুরের লাঞ্চের পর জামান আর জেফরি বেগ আবারো বসলো অফিসে। বেলা বারোটার আগেই দারুণ একটি জিনিস জানতে পেরেছে তারা : খুব সম্ভবত হোমমিনিস্টারের ছেলে তুর্যকে কোনো জাহাজ কিংবা বড়সড় লঞ্চের ভেতরে আটকে রাখা হয়েছে।

একমাত্র লঞ্চ আর জাহাজের কিছু ভিআইপি কেবিনে চেয়ার টেবিল আটকানো থাকে। কিন্তু ঢাকা শহরে লঞ্চ থাকলেও জাহাজ পাওয়া যাবে না, এ ব্যাপারে জেফরি নিশ্চিত। জামান অবশ্য জানিয়েছে, বরিশালগামী বড় বড় লঞ্চে মালিকপক্ষের জন্য বিশেষ কিছু কেবিন থাকে, সেগুলো বেশ বড় আর দেখতে অনেকটাই তুর্যের ভিডিওতে দেখা ঘরটার মতো হয়।

“স্যার, আমি নিশ্চিত বরিশালগামী কোনো লঞ্চই হবে,” আবারো নিজের অভিমত প্রকাশ করলো জামান। “ঐ লাইনে আমি চলাচল করি…বেশ বড় বড় কিছু লঞ্চ আছে।”

“তাহলে লঞ্চটা এখন কোথায় থাকতে পারে?” জেফরি বললো।

“সেটাই সমস্যা। অসংখ্য লঞ্চ আছে। কোন্ লঞ্চে তুর্যকে আটকে রেখেছে কে জানে।”

 “জামান, আমি নিশ্চিত, লঞ্চটা কোথাও স্টেশন করা আছে। ওটা চলছে না। মনে রেখো, লঞ্চ থেকে নিয়মিত ভিডিও আপলোড করা হয়েছে, যোগাযোগ করা হচ্ছে রঞ্জুর লোকজনের সাথে।”

“তাহলে লঞ্চটা বুড়িগঙ্গার কোথাও নোঙর করা হয়েছে,” বললো জামান।

“আসাদ গেট থেকে বুড়িগঙ্গা…” আপন মনে বললো জেফরি। “দূরত্বটা কি ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের পথ?”।

“এটা নির্ভর করে আপনি কিভাবে যাচ্ছেন।”

“ওরা প্রাইভেট কার ব্যবহার করেছে। ধরে নাও গাড়িটা আর বদল করে নি, কারণ তুর্য ছিলো তাদের সাথে। অপহৃত একজনকে ট্রান্সপোর্ট করা খুবই ঝামেলার, সুতরাং তারা গাড়ি বদল করে নি।”

জামান একটু ভেবে বললো, “সেক্ষেত্রে ত্রিশ মিনিটে বুড়িগঙ্গায় যাওয়া অসম্ভব। আসাদ গেট থেকে সদরঘাট…নট পসিবল।”

একটু ভেবে বললো জেফরি বেগ, “কোনো শর্টকাট নেই?”

“আমার জানামতে নেই,” কথাটা শেষ করতেই আবার বলে উঠলো সে, “না, স্যার। ভুল বলেছি। একটা শর্টকাট আছে।”

“সেটা কি?”

“আসাদ গেট মানে মোহাম্মদপুর, ঠিক আছে?”

“হুম।”

“মোহাম্মদপুরের পশ্চিম দিক ঘেষে বুড়িগঙ্গা চলে গেছে।”

“গুড। সেন্ট অগাস্টিন থেকে খুব দ্রুত আর কম সময়ে মোহাম্মদপুর যাওয়া যাবে।”

“সেখান থেকে তারা যদি গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে নদীপথ ব্যবহার করে তাহলে সদরঘাটের আশেপাশে থাকা লঞ্চগুলোর কাছে খুব সহজেই পৌঁছানো যাবে।”

একটু ভেবে জেফরি বললো, “নদীপথে এতো তাড়াতাড়ি যাওয়া কি সম্ভব?”

“সম্ভব, যদি স্পিডবোট ব্যবহার করা হয়,” বললো জামান।

“অনেক বেশি ‘যদি কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়। তারপরও তোমার কথায় যুক্তি আছে। স্পিডবোট তারা ব্যবহার করতেই পারে।”

“জি, স্যার। তারা যদি দ্রুত লঞ্চের কাছে পৌঁছাতে চায় তাহলে অবশ্যই স্পিডবোট ব্যবহার করেছে।” একটু থেমে আবার বললো জামান, “আমি নিশ্চিত, তারা আসাদগেট থেকে গাড়িতে করে সদরঘাটে যায় নি। তার কারণ, গাড়ি থেকে তুর্যকে নামিয়ে লঞ্চে ওঠানোটা খুব সহজ কাজ হবে না। বিশেষ করে তুর্য যদি অজ্ঞান থাকে…”

“স্পিডবোট থেকে তুর্যকে লঞ্চে তোলাটা কি বেশি সুবিধাজনক?” জানতে চাইলো জেফরি।

“জি, স্যার,” কথাটা বলে হেসে ফেললো জামান। “প্রতি ঈদে দেশের বাড়িতে যাবার সময় আমি নিজেও এ কাজটা করি…”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি বেগ।

“…টার্মিনাল দিয়ে হাজার হাজার লোকজনের ভীড় ঠেলে লঞ্চে ওঠাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন। তাছাড়া অনেক লঞ্চ নদীর মাঝখানে নোঙর করে রাখা হয়। সেগুলোর সিট দখল করার জন্য অনেকেই ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে মাঝনদীতে গিয়ে লঞ্চে উঠে পড়ে।”

“হ্যাঁ, আমি পত্রপত্রিকা আর টিভিতে এরকম ছবি দেখেছি,” বললো জেফরি।

“আমার ধারণা কিডন্যাপাররা স্পিডবোটে করে তুর্যকে কোনো লঞ্চে তুলেছে।”

“ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটে কি কাজটা করা সম্ভব?”

“সম্ভব।”

ঠিক আছে, ভাবলো জেফরি। তাহলে বুড়িগঙ্গার বুকে কোনো লঞ্চের ক্যাবিনে তুর্যকে আটকে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে ওয়েবক্যামের মাধ্যমে তুর্যের ভিডিও রেকর্ড করে ইউটিউবে আপলোড করা হয়। ভিডিওটা কোত্থেকে আপলোড করা হয় সেটা ট্র্যাক ডাউন করা সম্ভব। যদিও জেফরির ধারণা ব্ল্যাক রঞ্জুর এই দলটি এতো কাঁচা কাজ করবে না তারপরও ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে দোষ কী।

“জামান, তুমি ইউটিউবের ভিডিওটা কোত্থেকে আপলোড করা হয় সেটা ট্র্যাক ডাউন করার চেষ্টা করো।”

কথাটা শুনে জামান মাথা নেড়ে সায় দিলো। “এখনই করছি, স্যার।”

“আমার ধারণা এ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না, তবে ওরা যদি ভুল করে থাকে সে সুযোগটা তো আমাদের নেয়া উচিত, তাই না?”

“অবশ্যই, স্যার,” দৃঢ়ভাবে বললো জামান। কথাটা বলেই সে চলে গেলো কমিউনিকেশন্স রুমে।

জেফরি অনেকটা নিশ্চিত, আজ তুর্যকে ব্ল্যাক রঞ্জুর দল মুক্তি দেবে না। যদি না দেয় তার একটাই অর্থ : তুর্যকে খুন করে গুম করে ফেলা হবে।

হাতে যদি আর কয়েকটা দিন সময় থাকতো, মনে মনে আক্ষেপ করে উঠলো জেফরি।

অধ্যায় ৬৭

পুরনো দিল্লির প্রসিদ্ধ করিম হোটেল থেকে নাস্তা করে মেট্রোরেল দিয়ে খামোখাই দিল্লি শহরটা ঘুরেছে সময় কাটানোর জন্য। এই শহরে সময় কাটানোটাই হচ্ছে তার জন্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা। অবশেষে আবারো জ্বর জ্বর লাগতে শুরু করলে ফিরে আসে কারোলবাগে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে ঘুমাতে। শরীরটা এখনও দুর্বল। তার উচিত ছিলো ডাক্তার দেখানো। দিল্লির শীত অনেক বেশি তীব্র। এখানে যখন এসেছিলো তখন ছিলো গ্রীষ্মকাল। শীতের প্রকোপ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। ঠাণ্ডা লেগে সর্দি-জ্বর হয়ে গেছে। মনে মনে ঠিক করলো, আগামীকাল যদি জ্বরটা সেরে না ওঠে তাহলে ডাক্তারের কাছে যাবে।

তার বাড়ির নীচে একটা লাইব্রেরি আছে। এখানে ইংরেজি বই ধারে পাওয়া যায়। বেশিরভাগই পেপারব্যাক সংস্করণ। মাত্র দশ রুপিতে একটা পেপারব্যাক বই এক সপ্তাহ নিজের কাছে রাখতে পারে লাইব্রেরির সদস্যরা। তবে বিদেশী পর্যটকেরাও এই সুবিধা পেতে পারে, সেক্ষেত্রে বইটার গায়ের মূল্যের পুরোটাই জামানত হিসেবে রাখতে হবে। বই ফেরত দিলে দশ রুপি রেখে বাকি টাকাটা ফেরত নেয়া যাবে।

বাবলু লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত বই নিলেও তাকে কোনো টাকা-পয়সা দিতে হয় না। কারণ এর মালিক মুলিন্দার সিংয়ের সাথে তার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বয়সে তার চেয়ে পাঁচ-ছয় বছরের বড় হবে মুলিন্দার, তবে একেবারেই প্রাণখোলা। বাবলুর সাথে তার কথোপকথন চলে ইংরেজিতে, খুব কমই হিন্দি বলে সে।

বাবলু দেখতে পেলো মুলিন্দর তার লাইব্রেরির কাউন্টারে বসে আছে। তাকে দেখতে পেয়ে মুলিন্দর ডাকলো। ইংরেজিতেই চললো তাদের কথোপকথন।

“আরে তওফিক ভাই, আপনি কখন ফিরে এলেন?” মুলিন্দর তাকে দেখে যারপরনাই বিস্মিত। “আপনি না শহরের বাইরে গেছিলেন?”

গত সপ্তাহে বাবলু আগ্রায় গিয়েছিলো তাজমহল দেখতে। তিনদিন আগে রাতে জ্বর নিয়ে সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসে। মুলিন্দরের লাইব্রেরিটা তখন বন্ধ ছিলো।

“আমি তো ফিরেছি দুদিন হলো।”

“বলেন কি? তাহলে এ দুদিন আপনাকে দেখলাম না যে?”

“জুর ছিলো…” বললো বাবলু। “আগ্রা থেকে জ্বর নিয়ে ফিরেছি। দু’দিন ঘর থেকে বেরই হই নি।”

“তাই নাকি,” বললো মুলিন্দর। “আহ, আগে জানলে তো দেখতে যেতাম আপনাকে।”

বাবলু কাষ্ঠ হাসি দিলো।

“এখন কি অবস্থা?”

“ভালো।” ছোট্ট করে বললো সে।

“যাক, শুনে খুশি হলাম।” একটু থেমে আবার বললো মুলিন্দর, “এখন কোত্থেকে এলেন?”

“করিমে গিয়েছিলাম নাস্তা করার জন্য। তারপর অ্যাম্বাসিতে জরুরি একটা কাজ করে চলে এলাম।”

মিথ্যে বললো সে। আসলে এই শহরে তার কোনো কাজ নেই। প্রথম দিকে ঘরে বসে বই পড়ে, ইন্টারনেটে সময় কাটাতো, এখন আর ভালো লাগে না। মাঝেমধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই দিল্লির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে আগ্রা, ফারিদাবাদ কিংবা জয়পুরে গিয়ে ঘুরে আসে।

“আমি তো ভেবেছিলাম আপনি দিল্লির বাইরেই আছেন,” বললো মুলিন্দর। “আপনাকে খুঁজতে এক লোক এসেছিলো একটু আগে…”

কি?! আকাশ থেকে পড়লো বাবলু। তাকে এখানে কেউ কোনো দিন খুঁজতে আসে নি। আসার কথাও না। তার এই জায়গার কথা শুধুমাত্র দূতাবাসের দুএকজন জানে। কিন্তু তাদের কারো এখানে আসার কথা নয়।

“কখন?” বিস্মিত হবার ভাবটা লুকিয়ে জানতে চাইলো সে।

“এই তো একটু আগেই,” বললো মুলিন্দর সিং।

“দেখতে কেমন? কি বললো?”

“বয়স আপনার মতোই হবে, দেখতে মাঝারি গড়নের, গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ…গোঁফ আছে। বললো, তওফিক সাহেব উপরতলায় থাকেন কিনা। আমি তাকে বলে দিয়েছি আপনি শহরের বাইরে আছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই,” কথাটা বলেই হা হা করে হেসে ফেললো মুলিন্দর। “কিন্তু এখন তো দেখছি আপনি দুদিন আগেই ফিরে এসেছেন।”

ভাবনায় পড়ে গেলো বাবলু। কে তার খোঁজে এসেছিলো?

“দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন,” বললো মুলিন্দর। “নতুন কিছু বই তুলেছি, নিয়ে যাবেন নাকি একটা?”

গায়ে এখনও জ্বর আছে, বই পড়তে ইচ্ছে করছে না। “থ্যাঙ্কস, পাজি…” পাঞ্জাবি স্টাইলে বললো সে। কাউন্টারের সামনে একটা টুলের উপর বসে পড়লো।

“চা খাবেন?”

“না। চা খেয়েই এসেছি।” বাবলুর মাথায় একটাই চিন্তা, এতোদিন ধরে এখানে আছে, তাকে কেউ খুঁজতে আসে নি, এখন হঠাৎ করে কে খুঁজতে এলো? দূতাবাসের কেউ? হলেও হতে পারে।

বাবলুকে আনমনা দেখে মুলিন্দর সিং তার দিকে চোখ কুচকে তাকালো। “কোনো কিছু হয়েছে, তওফিক ভাই? মানে দেশ থেকে খারাপ কোনো সংবাদ?”

মুলিন্দর সিং জানে বাবলু বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন মাঝারিগোছের কর্মকর্তা।

“না। সেরকম কিছু না। হয়তো দূতাবাস থেকে নতুন কোনো কর্মচারি এসেছিলো আমার সাথে দেখা করতে।” উঠে দাঁড়ালো সে। “এখন যাই, শরীরটা ভালো লাগছে না। পরে এসে গল্প করবো।”

মুলিন্দর সিংয়ের লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে এলো সে। জ্বরের কারণে দুদিন ধরে তার মোবাইল ফোনটাও বন্ধ রেখেছে, সুতরাং দূতাবাস থেকে কেউ হয়তো ফোন করে তাকে পায় নি, তাই খোঁজ নিতে চলে এসেছে তার বাড়িতে।

ঘরে ঢুকে মোবাইল ফোনটার পাওয়ার অন করে রাখলো। তার ফোনে মিস কল্ড অ্যালার্ট অপশনটি অফ করে রাখা। এটার কোনো প্রয়োজনীয়তা

এর আগে অনুভব করে নি। কারণ একমাত্র উমা ছাড়া আর কারো সাথে তার ফোনে যোগাযোগ হয় না। দেশে শুধুমাত্র মেয়েটার কাছেই তার ফোন নাম্বার থাকলেও এর আগে দু’একবার ছাড়া উমা ফোন করে নি, সে নিজেই উমাকে ফোন করে প্রতিদিন। ফোনটা চালু রাখলো এই আশায়, হয়তো তাকে যে খুঁজতে এসেছিলো সে আবার ফোন করতে পারে।

জ্বরটা পুরোপুরি যায় নি। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। গায়ে চাদর টেনে শুয়ে পড়লো বাবলু।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটা কথাই তার মাথায় ঘুরতে লাগলো : কে এসেছিলো তাকে খুঁজতে?

অধ্যায় ৬৮

ইউ-টিউবের ভিডিও লিঙ্কটা ট্রাক-ডাউন করে কিছুই পাওয়া গেলো না। ভিডিওটা আপলোড করা হয়েছে কোনো মোবাইল ফোন কোম্পানির ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ভিডিও ফাইলটা হয়তো ল্যাপটপ থেকে আপলোড করা হয়েছে।

জেফরি জানতে এমনটাই হবে। এই ব্যাপারটা নিয়ে তার মধ্যে বাড়তি কোনো উচ্চাশা ছিলো না। রঞ্জুর দল বুঝে গেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কিভাবে কাজ করে। এখন বেশ সতর্ক আর সাবধানী তারা।

নিজের অফিসে বসে আছে শেষ বিকেলে। মন মেজাজ ভালো নেই। একবার ভাবলো রেবাকে ফোন করে দেখা করার কথা বলবে, পরক্ষণেই বাতিল করে দিলো সেটা। কিছুই ভালো লাগছে না। অনেক তথ্য তার কাছে আছে কিন্তু সময় নামক জিনিসটা একদম নেই। আর যদি একটু সময় পেতো, তাহলে হয়তো তুর্যকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করতে পারতো। ঐ ভয়ঙ্কর মিলনকেও ধরা সম্ভব হতো।

সে এখন মোটামুটি নিশ্চিত, হোমমিনিস্টারের ছেলেকে এই ঢাকা শহরের কোথাও আটকে রাখা হয়েছে। খুব সম্ভবত বুড়িগঙ্গা নদীতে স্টেশন করা কোনো লঞ্চ। জামান মনে করছে, বরিশালগামী কোনো লঞ্চই হবে সেটা। ঐ লাইনের লঞ্চগুলো আকারে বেশ বড় হয়ে থাকে।

একটু আগে তারা ব্ল্যাক রঞ্জুর পুরনো ফাইল ঘেঁটে দেখেছে, রঞ্জুর বিভিন্ন ব্যবসার মধ্যে লঞ্চ ব্যবসাও আছে। বরিশাল লাইনে তার দুটো লঞ্চ ছিলো, তবে বছরখানেক ধরে ওই দুটো লঞ্চ যাত্রি বহন করছে না। বিআইডটিসি’তে খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে জামান। তবে লঞ্চ দুটি এখন কোথায় থাকতে পারে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কিছু জানাতে পারে নি। নারায়ণগঞ্জ আর ঢাকা, এই দুই জায়গা লঞ্চ মেরামতের জন্য কিছু ডকইয়ার্ড আছে, হয়তো লঞ্চ দুটো সেখানেই আছে, রিপেয়ারিংয়ের কাজ করানো হচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিত তথ্য না পেলে কোনো কিছুই করা যাবে না।

তারপরও জামানকে বলে দিলো, ব্ল্যাক রঞ্জুর লঞ্চ দুটোর নাম কি, সেগুলো এখন কোথায় আছে সেটা যেনো খুঁজে বের করে।

ঘড়িতে সময় দেখলো : বিকেল ৫টা ১৫। তুর্যকে মুক্তি দেবার কথা ছিলো আজই। রঞ্জুর দল কি ছেলেটাকে মুক্তি দিয়েছে?

না। মুক্তি দিলে অন্তত পিএস তাকে জানাতো। তাদের মধ্যে সেরকমই। কথা হয়েছে।

ঠিক তখনই জেফরির ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে বের করে দেখলো রেবা ফোন করেছে।

“হ্যালো, কেমন আছো?” বললো সে।

“এই তো, তুমি কি করছো?” জানতে চাইলো রেবা।

“কিছু না। অফিসে বসে আছি।”

“আসবে?”

“কোথায়?”

“তুমি বলো…”

“আজ রিক্সায় করে ঘুরে বেড়াবো। তারপর যেখানে খুশি সেখানে থেমে খেয়ে নেবো।”

“ঠিক আছে। তুমি তাহলে আমার বাসার সামনে চলে এসো।”

“ওকে।”

কলটা শেষ হলে মুচকি হাসলো সে। তার ইচ্ছে ছিলো না আজ দেখা করার কিন্তু রেবা নিজ থেকে বলাতে মন ভালো হয়ে গেলো মুহূর্তে।

অফিস থেকে বের হবার আগে কী মনে করে যেনো ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো, বাবলুকে আরেকবার ফোন করার চেষ্টা করবে কিনা। এর আগে তার ফোনটা বন্ধ পেয়েছিলো।

দিল্লির নাম্বারটা ডায়াল করলো সে।

.

উমা হাসপাতাল থেকে একটু আগেভাগে ছুটি নিয়ে বের হয়ে পড়েছে। বাবলুর কি হলো সে চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে সকাল থেকে। ইনভেস্টিগেটর মি: বেগ ফোন করে পায় নি। ফোনটা বন্ধ ছিলো। আশ্চর্য, ফোন বন্ধ থাকবে কেন? তারচেয়ে বড় কথা বাবলু দুদিন ধরে তাকে ফোন করে নি। ঘটনা কি? তার মন বলছে, বাবলুর খারাপ কিছু হয়েছে। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছে

তারা এখন থাকে সেগুনবাগিচায়, পিজি হাসপাতাল থেকে হেঁটেই বাড়ি পৌঁছায় উমা। আজও তাই করলো। শিশুপার্ক আর টেনিস কপ্লেক্সের পাশ দিয়ে রমনা পার্কের ভেতর ঢুকে পড়লো। পার্কের পূর্ব দিকের প্রবেশপথ দিয়ে বের হলেই সেগুনবাগিচা। প্রতিদিন সে এ পথটাই ব্যবহার করে।

পার্কের ভেতর দিয়ে যাবার সময় ফোনটা বের করে বাবলুর নাম্বারে ডায়াল করলো সে।

রিং হচ্ছে!

খুশিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ফোনটা কানে চেপে পার্কের নির্জন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লো সে। কয়েক মুহূর্ত বাদে তার মুখের উজ্জ্বলতা ফিকে হয়ে গেলো। আশংকা আর ভয় জেঁকে বসলো তার মধ্যে।

রিং হচ্ছে অথচ বাবলু তার কলটা ধরছে না!

এটা তো অসম্ভব!

অধ্যায় ৬৯

ছোট্ট একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে খোলা মাঠে। চারপাশে জনমানুষের কোনো চিহ্ন নেই। ছেলেটা অবাক হয়ে চারপাশ দেখছে। প্রবল বাতাস বয়ে যেতে লাগলো। একটা ঝড় আসন্ন। ভয় পেয়ে গেলো ছেলেটি। কেঁদে উঠলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। একবার সামনে দৌড়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো, পরক্ষণেই পিছু হটে তাকালো ডানে-বায়ে। কাউকে খুঁজছে। কারোর আশ্রয় পেতে চাইছে। কিন্তু তার চারপাশে কেউ নেই।

বাতাসের তীব্রতা বাড়তে শুরু করলো। ধূলোর ঝড় ধেয়ে আসলো ছেলেটার দিকে। এবার জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো ছেলেটি।

“মা!”

চিৎকারটি প্রতিধ্বণিত হলো। তারপর প্রবল বাতাস সেটা উড়িয়ে নিয়ে গেলো দূরে কোথাও।

“মা!”

ছেলেটার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভয়ে উপুড় হয়ে মাটিতে বসে পড়লো সে। বাতাস আরো প্রবল বেগে বইছে এখন। দু’হাতে মাথাটা ঢেকে কুকঁড়ে গেলো ছেলেটি। শুনতে পাচ্ছে বাতাসের শো শো আওয়াজ। . ভয়ে কাঁপতে লাগলো সে। তার বোবা কান্নার শব্দ শোনা গেলো না। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো।

হঠাৎ কেঁপে উঠলো সে। টের পেলো তার পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। মুখ তুলে তাকালো ছেলেটা। সাদা ধবধবে শাড়ি পরা এক তরুণী তার দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটে মৃদু হাসি। সেই হাসি যেনো তাকে আশ্বস্ত করছে।

“মা” এবার আনন্দে বলে উঠলো ছেলেটা।

তরুণী তাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। শক্ত করে মাকে ধরে রাখলো ছেলেটি।

এমন সময় আবার বাতাসের শব্দটা জোরালো হতে শুরু করলে ছেলেটা চোখ বন্ধ করে ফেললো। শো শো শব্দটা এখন তীক্ষ্ণ হতে হতে কানের পর্দা বিদীর্ণ করে ফেলছে যেনো। ছেলেটা দারুণ ভয় পেয়ে গেলো। চোখ খুলবে কিনা বুঝতে পারছে না। শব্দটা আরো জোরালো হতেই চোখ খুলে দেখে সে বসে আছে ভোলা মাঠে। তার মা উধাও হয়ে গেছে। বিশাল শূন্যতায় ডুবে গেলো সে। বুকটা হু হু করে উঠলো।

চিৎকার দিয়ে উঠলো আবার, “মা!”

কিন্তু তার চিৎকারকে ছাপিয়ে গেলো বাতাসের তীক্ষ্ণ শব্দটা।

বিছানায় লাফ দিয়ে উঠে বসলো বাবলু। ঘেমেটেমে একাকার। দম ফুরিয়ে হাপাচ্ছে। টের পেলো হৃদস্পন্দন লাফাচ্ছে রীতিমতো। কিন্তু অবাক করার বিষয় তীক্ষ্ণ শব্দটা এখনও হচ্ছে।

বালিশের পাশে মোবাইলফোনটায় যে রিং হচ্ছে সেটা বুঝতে আরো কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো তার।

ঝটপট ফোনটা তুলে নিতেই দেখতে পেলো একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কলটা করা হচ্ছে। আর কলটা এসেছে বাংলাদেশ থেকে!

কিন্তু এটা তো উমার নাম্বার নয়!

অবশ্য অন্য কোনো নাম্বার থেকেও উমা ফোন করে থাকতে পারে। দ্বিধা ঝেড়ে কলটা রিসিভ করলো সে।

বরাবরের মতোই নিজে থেকে কিছু বললো না।

“হ্যালো?”

ওপাশ থেকে যে পুরুষ কণ্ঠটা বলে উঠলো সেটা খুবই পরিচিত বলে মনে হলো তার কাছে। তারচেয়েও বড় কথা, কণ্ঠটা যেনো খুব তাড়ার মধ্যে আছে। কে? কিছু বললো না বাবলু। অপেক্ষা করলো।

“হ্যালো…বাবল?” ওপাশ থেকে বললো উদ্বিগ্ন একটি কণ্ঠ।

“কে?” আস্তে করে বললো সে।

“প্লিজ, কলটা কেটে দিও না…ব্যাপারটা খুবই জরুরি!” তারপর বুক ভরে দম নিয়ে আবার বললো, “তুমি ভয়ানক বিপদে আছে”।

“কে?!” কথাটা শেষ করার আগেই আবারো জানতে চাইলো সে। তার কাছে খুবই চেনা চেনা লাগছে কণ্ঠটা, কিন্তু ধরতে পারছে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওপাশ থেকে কণ্ঠটা বললো : “আমি জেফরি বেগ।”

“কি!” বাবলু যারপরনাই বিস্মিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *