০১. দেরি করে ফেলেছে লালা

নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১২

.

উৎসর্গ :

পার্থ সরকারকে…
নেমেসিস এবং কন্ট্রাক্ট-এর ভক্ত, সিনেমা পাগল এক তরুণ। একদিন নিশ্চয় সিনেমা বানাবে সে।

.

মুখ বন্ধ

শীতের পড়ন্ত বিকেল, নরম হয়ে আসছে রোদের প্রকোপ কিন্তু নাফি হাজ্জাদের গা পুড়ে যাচ্ছে। উত্তাপে নয়, তার গা পুড়ে যাচ্ছে ঈর্ষায়। উদভ্রান্তের মতো বলটা বার বার বাস্কেটে ছুঁড়ে মারছে কিন্তু একবারও পড়ছে না। রাগে ক্ষোভে শরীর কাঁপতে না থাকলে দশ বারের মধ্যে আটবারই বাস্কেটে পড়তো বলটা। এই স্কুলের সবাই সেটা জানে। সেন্ট অগাস্টিনের সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড় সে। কিন্তু একটু আগে তার সেই স্বীকৃতিটা মারাত্মক হোঁচট খেয়েছে। সবার আরাধ্য যে অ্যাঞ্জেলস টিম, তার কোচ তাকে বাদ দিয়ে বেছে নিয়েছে এমন একজনকে যার সাথে তার কোনো তুলনাই চলে না। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা ঘাপলা আছে-নাফি একদম নিশ্চিত। কিন্তু সেটা কী, কাউকে বলে বোঝাতে পারছে না।

অন্যসব দিনের মতো স্কুল শেষে তারা বাস্কেটবল কোর্টে প্র্যাকটিস করছিলো, হঠাৎ লক্ষ্য করে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ত্রিশোর্ধ এক ভদ্রলোক বেশ আগ্রহভরে তাদের খেলা দেখে যাচ্ছে। তাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটা খুবই অভিজাত, এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই কড়া, বাইরের লোকজন সহজে ঢুকতে পারে না। একটু অবাক হয়েছিলো নাফি। তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু শুভকে ইশারা করে জানতে চেয়েছিলো লোকটা কে। শুভ কাঁধ তুলে অপারগতা জানায় কিন্তু পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি হবার পরও তাদের দলে সবচাইতে বেটে আর পরিশ্রমী হিসেবে পরিচিত ইফতি আগ বাড়িয়ে বলে ঐ লোকটা অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ।

অ্যাঞ্জেলস!

বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের কাছে এই টিমের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। পর পর দু’বার ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন তারা। কথাটা শুনেই নাফি সচেতন হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় তার খেলার ভঙ্গি। যতরকম গিমিক আর কৌশল আছে দেখাতে শুরু করে সে। বেশ দূর থেকে বল থ্রো করে বাস্কেটেও ফেলতে সক্ষম হয় বার কয়েক। বুঝুক, এই স্কুলের সেরা খেলোয়াড়টা কে। তার বন্ধুদের মধ্যেও উৎসাহের কমতি ছিলো না। তারাও সচেতন হয়ে ওঠে। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরই দেখতে পায় তুর্য নামের ছেলেটাকে ডেকে ঐ কোচ ভদ্রলোক কথা বলছে।

তুর্য!

আজব!

তুর্যও বাস্কেটবলটা ভালো খেলে কিন্তু কোনোভাবেই নাফির সাথে তুলনা করা যায় না তাকে। নাফি তো নাফি, এমন কি শুভর সাথেও তাকে তুলনা করাটা অন্যায়। বাস্কেটবল সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে যার সে এ কাজ করবে না। কি উচ্চতায় কি টেকনিকে, তুর্য তাদের স্কুলে প্রথম তিনজনের মধ্যেও আসে না। অথচ অ্যাঞ্জেলস টিমের মতো চ্যাম্পিয়ন একটি দলের কোচ কিনা তাকে ডেকে নিয়ে কথা বলছে!

তার অন্য সঙ্গিরাও ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখে নি। তাদেরও রাগ হয়। তবে দশ মিনিট পর সেই রাগ বিস্ময়ে পরিণত হয় যখন তুর্য এসে জানায় অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ তাকে দলে নিতে চাচ্ছে। আজই তাকে সাইন করাবে। এসএসসি পরীক্ষা দেবার আগেই এরকম একটা সুযোগ পেয়ে গেলো ছেলেটা! এই সুযোগ তো পাবার কথা ছিলো তার নিজের।

তুর্যের চোখেমুখে অহংকারের যে ছটা দেখতে পেয়েছে সেটা আরো বেশি পীড়াদায়ক। ছেলেটা এমন ভাব করলো, যেনো সবাই তাকে হিংসা করুক। হিংসা করতে করতে কয়েক রাত নিদ্রাহীন থাকুক তারা।

এরপর মন খারাপ করা বিকেলে একে একে সবাই নিজেদের বাড়িতে চলে গেলেও নাফি বাস্কেটবল কোর্টে একা রয়ে গেলো। যাবার আগে তার বন্ধু দিপ্রো সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলে গেছে, আজকে যখন অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ এসেছে, এরপর নিশ্চয় ওদের রাইভাল টিমের কোচও আসবে প্লেয়ার হান্ট করার জন্য। বাস্কেটবলের খেলোয়াড় তো আর সবখানে পাওয়া যায় না। হাতে গোনা কয়েকটি অভিজাত স্কুল ছাড়া খেলোয়াড় পাবে কোথায়? নাফি অবশ্য অভিমানের সুরে বলেছে, সে কোনো রানার্সআপ টিমের হয়ে খেলবে না। সে খেলবে চ্যাম্পিয়ন টিমের হয়ে। দিপ্রো তারপরও দমে যায় নি। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলেছে, রানার্সআপ টিম যে কখনও চ্যাম্পিয়ন হবে না সেটা কে বলেছে। আজব। মন খারাপ করার কী দরকার। এভরিথিং উইলবি ওকে, দিপ্রো যাবার আগে বলে গেছিলো।

দিপ্রোর অকাট্য যুক্তি শুনে গেছে নাফি, কিছুই বলে নি। তারপরও কিছুই ভালো লাগছে না তার। একা একা সারা কোর্ট দাবড়ে বেড়াচ্ছে। বাস্কেটে অনবরত বল ফেলছে, বাড়ি যাবার নাম নেই। একটু আগে দাড়োয়ান আজগর এসে অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলে গেছে তাকে এখন চলে যেতে হবে। শালার অজগরের বাচ্চা, আমাকে ঝাড়ি মারে!

বিকেল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা। ক্লান্ত শ্রান্ত নাফি বলটা হাতে তুলে নিলো। স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রওনা দিলো বাড়ির দিকে। অন্যসব দিন হলে বলটা মাটিতে ড্রপ করতে করতে চলে যেতো কিন্তু এখন মাথা নীচু করে স্কুল থেকে বের হয়ে গেলো সে।

আজকের দিনটা তার জন্যে পরাজয়ের। স্কুলে সবাই জানে বাস্কেটবলের সেরা খেলোয়াড় সে, কিন্তু স্কুলের ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতিটা পেয়ে গেলো এমন একজন যাকে দুচক্ষেও দেখতে পারে না সে। সহপাঠী হলেও তুর্য নামের বদমাশটার সাথে তার কখনও বনে না। এই ছেলে সব সময় তার ক্ষমতাবান বাপের গরম দেখায়।

মাত্র ষোলো বছর বয়সেই নাফি হাজ্জাদ এ সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে, এই দেশে সত্যিকারের প্রতিভার কোনো মূল্যায়ন হয় না। ফালতু লোকজন বসে আছে গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায়। তাদের নিজেদেরই যোগ্যতা নেই, তারা কী করে যোগ্য লোক খুঁজে বের করবে?

স্কুলের বড় গেটটার মধ্যে ছোটো যে গেটটা আছে সেটা দিয়ে উপুড় হয়ে মাথা নীচু করে বের হবার সময় নিজেকে আরো বেশি পরাজিত মনে হলো তার।

অধ্যায় ১

আজ আবারো দেরি করে ফেলেছে লালা। কাল রাতে একটু বেশিই পান করে ফেলেছিলো। পান করার ব্যাপারে কোনো সময়ই তার লাগাম থাকে না। তবে পূর্ণিয়ার সাথে সারা রাত কাটানোর সময় মাত্রাজ্ঞান ঠিক রাখতে পারে নি। অকেজো স্বামীকে ঘরে রেখে মেয়েটা যখন চিরকুমার লালার ঘরে এসে ঢুকলো তখনই বুঝতে পেরেছিলো আজ রাতে ঘুমের বারোটা বাজবে।

রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত সজাগ ছিলো তারা। পূর্ণিয়া যে তাড়নায় এসেছিলো সেটা চরিতার্থ হবার পর তাড়ি খেয়ে দুজনে গল্প করেছে সারা রাত। এখন এই সকালবেলায় বাধ্য হয়েই কাজে ছুটে আসতে হয়েছে। ভেবেছিলো শরীর খারাপের কথা বলে ডিউটি থেকে নাগা দেবে কিন্তু সেটা করা সম্ভব হয় নি। এই মাসে দুবার এই অজুহাতে নাগা করেছে সে।

আজ শুক্রবার হলেও তাকে কাজ করতে হবে কারণ সুইপারদের কোনো ছুটি নেই। মানুষ তো আর ছুটির দিনে হাগা-মুতা বন্ধ রাখে না। যদিও তাদের স্কুলটা এদিন বন্ধই থাকে, সেদিক থেকে দেখলে শুক্রবারটা তার জন্যে ছুটির দিন হতে পারতো কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো এই দিনেই সবচাইতে বেশি কাজ থাকে। অন্যসব দিনে মোটামুটি সাফ সুতরো হলেই চলে কিন্তু শুক্রবারে পুরো স্কুল-কম্পাউন্ডের সবগুলো টয়লেট পরিস্কার করে মেনহোলগুলোতে বাখারি মেরে ক্লিয়ার করে রাখতে হয়।

স্কুলের মেইন গেট দিয়ে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো দাড়োয়ান আজগর মিয়ার। তাদের মধ্যে সখ্যতা আর খুনসুটি দুটোই চলে। অম্ল-মধুর সম্পর্ক।

তার দিকে ভুরু কুচকে চেয়ে আছে আজগর।

“আরে, ঢাকার নওয়াব লালা বাহাদুর যে,” আজগর মিয়া টিটকারি মেরে বললো। |||||||||| “আরেকটু দেরি কইরা আইতেন, সমস্যা কি! নওয়াবগো তো একটু আরাম-উরাম করনই লাগে, নাকি?”

লালা কিছু বললো না। চুপ থাকাই ভালো। কোমর থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করে একটা বিড়ি তুলে দিলো আজগর মিয়ার হাতে। তার মুখটা অন্তত কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকুক।

“নিজে তো সারা রাইত মাল টানছো আর আমারে দিতাছো বালের এই হুগনা বিড়ি!”

লালা কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেলো স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতর।

“আর বিড়ি-ফিরি দিয়া কাম অইবো না…এইরহম দেরি করলে আমি কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে বিচার দিমু, অ্যাঁ!”

পেছন থেকে আজগর জোরে জোরে বললেও লালা ফিরেও তাকালো না। |||||||||| “তুমি ছিড়বা আমার বাল”, বিড়বিড় করে বললো সে। পরনের লুঙ্গিটা হাটু অবধি তুলে গিট দিয়ে নিলো। কাজে নামার সময়ে লুঙ্গিটা এভাবেই পরে থাকে। তার ফ্যাকাশে লাল রঙের টি-শার্টের বাম বুকের দিকটায় যে লিপস্টিকের দাগ লেগে রয়েছে সেটা দেখে মুচকি হাসলো। পুর্ণিয়া কালরাতে খুব সাজগোজ করে এসেছিলো। সাজলে খুব সুন্দর দেখায় তাকে। লালার এতো ভালো লেগেছিলো যে বলে বোঝাতে পারবে না। খুশির চোটে মেয়েটাকে অনেক আদর করেছে। পুর্ণিয়াও বেশ ক্ষেপে গিয়েছিলো। পাগলের মতো তাকে মহব্বত করেছে।

ভাগ্য ভালো আজগর এটা খেয়াল করে নি, করলে তার মুখে খিস্তির ফোয়ারা ছুটতো। টয়লেটের ভেতর ঢোকার আগেই টের পেলো মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। পা দুটোও স্বাভাবিকভাবে ফেলতে পারছে না। এক হাড়ি তাড়ি খাওয়ার ফল!

*

ছিপছিপে শরীরের লালাকে স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতর চলে যেতে দেখে আজগর মিয়া বিড়িতে আগুন ধরালো। এই হারামজাদার বয়স বাড়ে না ক্যান! মনে মনে বললো সে। এটা ঠিক, লালা নামের এই সুইপারের বয়স পঞ্চাশের উপরে হলেও তাকে অনেক কম বয়স্ক দেখায়, এমন কি সবেমাত্র চল্লিশে পা দেয়া আজগরের চেয়েও তাকে তরুণ বলে মনে হয়। ব্যাপারটা সবার কাছেই বিস্ময়কর ঠেকে। প্রথম প্রথম অনেকে মনে করতো লালা তার বয়স বাড়িয়ে বলে। কিন্তু বহু পুরনো একটা গ্রুপ ছবিতেও লালাকে যখন ঠিক এখনকার মতোই দেখা গেলো তখন সবাই বুঝতে পারলো, এই লোকের দৈহিক গড়নটাই এমন। বয়স ধরে রাখার এই রহস্য কী করে সম্ভব সেটা একদিন কথাচ্ছলে। লালাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আজগর। পান চিবোতে চিবোতে লালা বলেছিলো, সে নাকি জীবনে কখনও দুশ্চিন্তা করে না। এটাই তার চিরতারুণ্যের রহস্য।

আজগর মিয়াও জানে দুশ্চিন্তা হলো বয়সের এক নাম্বার শত্রু। লালার সেই শত্রু নেই। তাই পঞ্চাশোর্ধ এই তরুণকে ঈর্ষা করে সে। এখনও মাথার চুল পাকে নি। সুন্দর করে তেল মেখে ব্যাকব্রাশ করে রাখে লালা, পাতলা গোঁফটা দেখে একেবারে ষাটের দশকের কোনো নায়কের মতোই লাগে। গায়ের রঙ ফর্সা হলে সত্যিকারের নায়কের মতোই লাগতো তাকে। মানুষ হিসেবেও লালা খুব ভালো। কারো সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে না। কারো বদনাম বা খারাপ কথা তার মুখে কখনও কেউ শোনে নি। একটু চুপচাপ স্বভাবের লালা খুবই সাহসী একজন মানুষ। ভয়ডর বলতে কিছু নেই তার মধ্যে। আজগর মিয়াকে সে বলেছে, অমাবস্যা রাতেও বিরান গোরস্তানের ভেতর একা একা হেঁটে যেতে তার ভয় করে না।

তবে দোষের মধ্যে একটাই দোষ-সারা রাত সুইপার কলোনিতে বসে মাল খাবে। একদিন আজগরকেও নাকি সেই মাল খাওয়াবে, বলেছিলো লালা, কিন্তু সেই দিন আর আসে না।

আজগর মিয়া বিড়ি টানতে টানতে মেইন গেটের কাছে বড়সড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে টুলের উপর বসে পড়লো। মেইনগেটের পাশে ছোটো গেটটা দিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো সে। রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা। শুক্রবারের সকাল ৭টা বাজে কে আর বাইরে বের হতে যাবে। ঢাকা শহরের লোকজন এখন নিজেদের বিছানায় আরাম করছে। তার মতো পোড়া কপালের লোকজনই শুধু আরাম আয়েশ বাদ দিয়ে ডিউটি করে যাচ্ছে এ সময়। তাদের জীবনে ছুটি বলতে তেমন কিছু নেই। দুই ঈদে মোট এক সপ্তাহের ছুটি জোটে কপালে। সেই ছুটি যে কিভাবে কতো দ্রুত শেষ হয়ে যায় বুঝতেই পারে না।

উদাস হয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো আজগর। বিড়িতে জোরে জোরে আরো কয়েকটা টান মেরে যেই না থোয়া ছাড়তে যাবে অমনি স্কুলের ভেতর থেকে ভয়ার্ত এক চিৎকার শোনা গেলো। চমকে উঠলো সে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। চিৎকারটা যে লালা দিয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কী এমন ঘটনা ঘটলো যে লালার মতো সাহসী একজন গগনবিদারি চিৎকার দিতে যাবে!

স্কুল কম্পাউন্ডের মেইন বিল্ডিংয়ের টয়লেটের দিকে ছুটে গেলো আজগর মিয়া। লালার চিৎকারটা ওখান থেকেই এসেছে। সেই চিঙ্কারে মিশে আছে এক জান্তব ভীতি।

টয়লেটের খুব কাছে আসতেই উদভ্রান্ত লালার মুখোমুখি হলো আজগর মিয়া। আরেকটু হলে দুজনের মধ্যে ধাক্কা লেগে গেছিলো।

“হায় ভগবান!” ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো লালা। |||||||||| “এটা আমি কি দেখলামরে!”

অধ্যায় ২

জেফরি বেগ জানে চারপাশে কোনো আলো নেই, একেবারে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। তবে এমন পরিবেশেও সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে, আর সেটা সম্ভব হচ্ছে অত্যাধুনিক নাইটভিশন গগল্স পরে থাকার কারণে।

চুপিসারে আরো একবার চারপাশটা দেখে নিলো। জনমানুষের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। তার হাতে অদ্ভুত একটা অস্ত্র। আগে কখনও এটা ব্যবহার করে নি। ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না। সে ব্যবহার করে ওয়াল্টার লুথার নাইন এমএম পিস্তল। অদ্ভুত এই অস্ত্রটা একটু আগেই হাতে পেয়েছে।

এখন পরিত্যাক্ত এক ভবনের নীচতলার পাকিংলটে আছে। কোনো গাড়ি পার্ক করা নেই। কিছু কার্ডবোর্ড বাক্স রয়েছে এখানে সেখানে। তবে সে জানে কমপক্ষে সাতজন ‘দুষ্কৃতিকারী’ আছে আশেপাশে। ওৎ পেতে রয়েছে তারা। তাদের নোংরা বুলেট থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কভার নেয়ার জন্যে বড় বড় কয়েকটা কাগজের কার্টনবাক্স পড়ে আছে সামনে। সেটাই যথেষ্ট। এক দৌড়ে বাক্সগুলোর দিকে ছুটে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারটা ভোতা শব্দ গর্জে উঠলো।

তার গায়ে কটকটে রঙের প্লাস্টিকের যে জ্যাকেটটা আছে সেটার দিকে তাকালো। সে জানে একটা নোংরা বুলেটও তাকে ‘হিট’ করতে পারে নি। বুকের দিকে তাকিয়ে কোনো রঙ দেখতে পেলো না। না, লাগে নি! মনে মনে বললো সে। যদি বুলেট তার গায়ে লাগতো নাইটভিশন গগল্‌সে হালকা সবুজ তরল দেখতে পেতো। এই গগলস পরলে চারপাশটা কেমন যেনো অচেনা হয়ে ওঠে। এক ধরণের ভীতিকর সবুজাভ হয়ে ওঠে সবকিছু।

বাক্সের আড়াল থেকে এই প্রথম দেখতে পেলো তার ঠিক দশ গজ দূরে, একটা পিলারের পেছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। গুলিটা তাহলে সে-ই করেছে! জেফরি বেগ পিস্তলটা তুলে নিলো চোখ বরাবর। অন্যদের চেয়ে তার একটি বাড়তি সুবিধা আছে : এই ঘন অন্ধকারেও বেশ ভালোমতো দেখতে পাচ্ছে চারপাশটা। তবে বাড়তি সুবিধা কাজে লাগানোর জন্যে তাকে খুব দ্রুত কাজ করতে হবে মাত্র পাঁচ মিনিটে। এটাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ। হাতঘড়িটার রেডিয়াম। ডায়ালের দিকে তাকালো। ইতিমধ্যে দুই মিনিট সময় পেরিয়ে গেছে। ভবনের ভেতর প্রবেশ করার জন্যে মাত্র দেড় মিনিট সময় ভেবে রেখেছিলো। হাতে আছে তিন মিনিট। ঠিক আছে, দ্রুত বাকি কাজগুলো করে ফেলতে হবে। জেফরি বেগ আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো কার্ডবোর্ডবাক্সগুলোর পেছন থেকে। বেড়ালের মতো চুপিসারে এগোতে লাগলো সামনের দিকে। ভালো করেই জানে। শব্দ হলেই দুষ্কৃতিকারীরা টের পেয়ে এলোপাতারি ফায়ার করবে। তার একটা সমস্যা আছে, এলোপাতারি ফায়ার করা যাবে না। সুতরাং যতোদূর সম্ভব শব্দহীন পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো সামনের মোটা পিলারটার দিকে। এখানে একজন আছে। পিলারের ঠিক কাছে এসেই ডান দিকে সরে গেলো সে। ঘাপটি মেরে থাকা ‘দুষ্কৃতিকারী’ পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। জেফরি বেগ এখন তার ঠিক পেছনে। লোকটা একদম টের পায় নি। এটাই সে চেয়েছিলো । লোকটাকে লক্ষ্য করে একটা গুলি করেই দ্রুত সরে গেলো আরো ডান দিকে। গুলিবিদ্ধ লোকটা বেশ জোরে শব্দ করতেই সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটা গুলির শব্দ হলো ভবনটার ভেতর।

জেফরি আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো, পাল্টা ফায়ার করলো যেখান থেকে দুস্কৃতিকারীরা গুলি করেছে। স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে সামনের দশ গজ দূরে, সিঁড়ি আর লিফটের কাছ থেকে দুজন গুলি করেছে। আরেকটা বড় পিলারের আড়ালে তারা কভার নেবার আগেই জেফরি গুলি করলো। সে নিশ্চিত দুজনকেই ঘায়েল করেছে। কারণ কোনো রকম পাল্টা গুলি করা হচ্ছে না। আবারো নিশ্চিত হয়ে নিলো সে নিজে গুলিবিদ্ধ হয় নি।

তিনজন। তার মানে আরো চার জন রয়েছে এখন। হাতে সময় বোধহয় দুমিনিটও নেই। এই সময়ের মধ্যে তাকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আরো কয়েকজনকে মোকাবেলা করতে হবে। আস্তে আস্তে পা টিপে সিঁড়ির কাছে এসে প্রথম তিনটি ধাপের উপর শরীরটা ফেলে দিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে রইলো। হাতের অস্ত্রটা সামনের দিকে তাক করা।

স্পষ্ট দেখতে পেলো সিঁড়ির উপরের ল্যান্ডিংয়ে একজন অস্ত্রধারীর আর্বিভাব ঘটেছে। গুলি চালালো না জেফরি। যদিও টার্গেট একেবারে ‘সিটিং ডাক পজিশনে আছে। শিকারীর ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করলো সে। লোকটা ল্যান্ডিংয়ের উপর থেকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে নীচে কোনো মুভমেন্ট হচ্ছে কিনা। জেফরি জানে বেশি সময় নেয়া যাবে না। লোকটার চোখ অন্ধকার সয়ে উঠলে আবছা আবছা দেখতে পাবে, তার পজিশনটাও চাউড় হয়ে যাবে তার কাছে। তারপরও আরেকটু অপেক্ষা করলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।

হঠাৎ করে ল্যান্ডিংয়ের উপর আরেকজন অস্ত্রধারীর উদয় হতেই পর পর চারটা গুলি চালালো জেফরি। তার সাইলেন্সার পিস্তলের কোনো শব্দ হলো না। অস্ত্রধারী দু’জন ‘নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। জেফরি তবুও উঠে দাঁড়ালো না। হামাগুড়ি দিয়েই সিঁড়ির উপর উঠে এলো কিছুটা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ল্যান্ডিংয়ে পড়ে রয়েছে দু’জন। তাদের চোখ খোলা। কিছুটা নড়ছে। তবে জেফরি আর গুলি চালালো না। দরকারও নেই। ল্যান্ডিংয়ের উপর এসে উঠে দাঁড়ালো সে। বাকি সিঁড়িটুকু আস্তে আস্তে নিঃশব্দে ভেঙে এগিয়ে গেলো। ডান দিকের দরজাটা খোলা। সেই খোলা দরজার কাছে এসে সকভাবে ভেতরে উঁকি দিলো। ভেতরে দু’জন অস্ত্রধারী ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে তারা তাকে দেখতে পাচ্ছে না। লোকগুলো একে অন্যের কাছ থেকে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে জেফরি বেগ একটু সময় নিলো। খোলা দরজার পাশে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ঠিক করে নিলো সামনের পাঁচ সেকেন্ড কি করবে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে এক ঝটকায় ঘরের ভেতর ঢুকেই হাটু গেড়ে বসে পড়লো আর সঙ্গে সঙ্গে চালালো গুলি। একেকজনকে লক্ষ্য করে দুটো গুলি করবে সে-এটা আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলো, কিন্তু দ্বিতীয় জনের বেলায় এসে বুঝতে পারলো তার গুলি শেষ। ধ্যাত্!

হঠাৎ চারপাশের রঙ আচমকা বদলে গেলো। নাইটভিশন গগল্সটা খুলে ফেললো জেফরি, সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড আলোয় চোখ কুচকে ফেললো সে।

“ওভার!” ভারি একটা কণ্ঠ গর্জে উঠলো।

একটু আগে বুক ভরে যে নিঃশ্বাস নিয়েছিলো তার সবটাই আক্ষেপের সাথে বের করে দিলো জেফরি বেগ। |||||||||| “সরি…”

মাথায় সানক্যাপ পরা মোটামতো এক লোক এগিয়ে এলো তার দিকে, সেই সাথে দু’জন লোকের মধ্যে যে লোকটা গুলিবিদ্ধ হয়েছে সেও উঠে দাঁড়ালো।

“গুলির হিসেব রাখাটা জরুরি, মি. বেগ, সানক্যাপ পরা লোকটি বললো।

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। |||||||||| “আসলে যে অস্ত্রটা আমি সব সময় ব্যবহার করি তাতে দশটা বুলেট থাকে আর এটাতে ছিলো নয়টা,” হাতের অদ্ভুত অস্ত্রটা তুলে ধরে বললো সে।

“নো এক্সকিউজ।”

‘সরি,” জেফরি বেগ কথাটা বলেই ক্যাপ পরা লোকটার হাতে নাইটভিশন গগলটা তুলে দিলো। |||||||||| “ভালো জিনিস…বেশ ভালো।”

গগল্‌সটা হাতে নিয়ে ক্যাপ পরা লোকটি মুচকি হাসি দিলো। |||||||||| “তবে অভ্যস্ত হতে হয়, নইলে যে বাড়তি সুবিধা পাবেন সেটা কাজে লাগানো যাবে না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি।

“রেজাল্ট একেবারে খারাপ না, খুব অল্প সময় বেধে দেয়া ছিলো। হিটম্যানের সংখ্যাও একজনের পক্ষে মোকাবেলা করা বেশিই বলতে পারেন। তবে সবটাই করা হয় একটু বেশি দক্ষতা তৈরি করার জন্যে। বাস্তবে হয়তো আপনি এরচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন…আবার এমনও হতে পারে এরেচেয়ে, কঠিন পরিস্থিতিতেও পড়ে গেলেন…কে জানে?”

“তা ঠিক, শমসের ভাই,” বললো জেফরি।

“আপনাকে কেউ হিট করতে পারেনি সেটাই অনেক বড় ব্যাপার। বেঁচে থাকার চেয়ে বড় সাফল্য আর নেই।” কথাটা বলেই শমসের নামের লোকটা হেসে ফেললো।

এবার জেফরির মুখেও ফুটে উঠলো চওড়া হাসি।

শুটিং অ্যান্ড অ্যামুনিশন ইন্সট্রাক্টর শমসের হাবিব ঘরের সবাইকে চলে যাবার ইশারা করলে দুজন লোক চলে গেলো ঘর থেকে। জেফরি লক্ষ্য করলো তাদের একজনের পরনে প্লাস্টিকের জ্যাকেটের বুকের কাছে হলুদ রঙ লেগে আছে। তার অব্যর্থ নিশানার নির্দশন। তার হাতে যে অদ্ভুত অস্ত্রটা আছে সেটা ডামি গান। এর বুলেট থেকে এক ধরণের হলুদ রঙের তরল বের হয়। এটা মার্কার হিসেবে কাজ করে।

শমসের হাবিবের সাথে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো সে। এই ভবনটা শুটিংরেঞ্জেরই অংশ। ভবন, গলি, সিঁড়ি, রাস্তা এবং ঘরের ভেতর শুটিং প্র্যাকটিস করার জন্যে এটা বানানো হয়েছে। শুধু হোমিসাইড নয়, এ দেশের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অফিসারদের শুটিং প্র্যাকটিসের জায়গা হিসেবে এটা ব্যবহৃত হয়। কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করে শুটিং প্রাকটিস করা হলে ভালো কাজে দেয়। অফিসারদের শুটিং দক্ষতা এবং নিজের আত্মরক্ষা দুটোই শেখা যায় এখানে।

কিছুদিন আগে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট অত্যাধুনিক নাইটভিশন গগলস নিয়ে এসেছে। তবে অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তিতে অফিসারদের অভ্যস্ত হবার জন্যে প্রচুর প্র্যাকটিসের দরকার। আজই প্রথম জেফরি বেগ এই জিনিসটা ব্যবহার করে প্র্যাকটিসে অংশ নিলো। তাকে আরো পাঁচটি সেশনে অংশ নিতে হবে।

সিঁড়ি দিয়ে নীচের পাকিং এরিয়ায় আসতেই দেখতে পেলো সহকারী জামান দাঁড়িয়ে আছে। শমসের হাবিবই সবার আগে জামানকে দেখতে পেয়েছে। শুটিংরেঞ্জে জামানের আসার কথা নয়। তার মতো জুনিয়রদের সেশন হবে আরো পরে।

“মনে হচ্ছে আরেকটা খুনখারাবি ঘটে গেছে,” জেফরির দিকে ফিরে বললো ইন্সট্রাক্টর।

নেক্সাস

জেফরি কিছু না বলে প্লাস্টিকের জ্যাকেটটা খুলতে খুলতে জামানের দিকে এগিয়ে গেলো। |||||||||| “কি ব্যাপার?”

কাঁধ তুলে ঠোঁট উল্টালো জামান। |||||||||| “ক্রাইম-সিনে যেতে হবে, স্যার।”

প্লাস্টিকের জ্যাকেটটা সামনে থাকা কার্ডবোর্ডের বাক্সের উপর রেখে দিলো জেফরি । |||||||||| “কোথায়?”

“সেন্ট অগাস্টিন স্কুলে।”

একটু অবাক হলো সে। সেন্ট অগাস্টিন ঢাকা শহরের সবচাইতে অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। |||||||||| “স্টুডেন্ট?”

“না। এক জুনিয়র ক্লার্ক।”

একটু থেমে জামানের দিকে চেয়ে রইলো। |||||||||| “আজকাল দেখছি স্কুলেও খুনখারাবি শুরু হয়ে গেছে।”

জামান কিছু বললো না।

“কখন হয়েছে?”

“মনে হচ্ছে গতকাল…আজ সকালে টয়লেটের ভেতরে লাশটা দেখতে পেয়েছে সুইপার।”

আনমনে একটু মাথা দুলিয়ে জেফরি বেগ তার সহকারী জামানকে ইশারা করলো ভবন থেকে বের হবার জন্যে।

জেফরি হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো : সকাল দশটা বেজে ছয় মিনিট। আরেকটা খুন, আরেকটা ইনভেস্টিগেশন । তার জন্যে আরেকটা নতুন। চ্যালেঞ্জ। জেফরি বেগ সেই চ্যালেঞ্জ নেবার জন্যে এগিয়ে চললল ।

আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। দুপুরে রেবার সাথে লাঞ্চ করবে বলে ঠিক করে রেখেছিলো, এখন মনে হচ্ছে সেটা পিছিয়ে দিয়ে বিকেলে নিয়ে যেতে হবে।

আপাতত ডেটিংয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে কাজে মনোযোগ দাও, গাড়িতে উঠতে উঠতে নিজেকে বললো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ।

অধ্যায় ৩

স্বল্প পরিসরের টয়লেটের হাই কমোডটার পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। লোকটা কিন্তু তার জমাটবদ্ধ চোখ সরাসরি জেফরি বেগের দিকে নিবদ্ধ।

বীভৎস একটি দৃশ্য । প্রথমে দেখে বোঝা যাবে না কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। লোকটার ঘাড় এমনভাবে মটকে দেয়া হয়েছে যে, সেটা প্রায় একশ’ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেছে। ফলে উপুড় হয়ে পড়ে থাকলেও তার মাথাটা বেঁকে চলে এসেছে সামনের দিকে। স্থির হয়ে থাকা খোলা চোখ দুটো ঘোলাটে দেখাচ্ছে এখন। নাকের কাছে কিছু মাছি ভন ভন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হাসান নামের লোকটা সেন্ট অগাস্টিন স্কুলের একজন ক্লার্ক। বয়স আনুমানিক ত্রিশের মতো হবে। বেশ পরিপাটী শার্ট-প্যান্ট আর কালো পাম সু পরা । গায়ের পোশাক এতোটা অক্ষত থাকার কারণ সম্ভবত খুনি কিংবা খুনিদের সাথে তার কোনোরকম ধস্তাধস্তি হয় নি, যদিও লোকটা শারিরীকভাবে বেশ শক্ত-সামথ্য। পড়ে থাকা অবস্থায়ই জেফরি আন্দাজ করতে পারলো ভিকটিমের উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির নীচে হবে না। তার মানে যে বা যারা খুন করেছে তারা শারীরিকভাবে আরো বেশি শক্তিশালী ছিলো।

অথবা অনেক বেশি দক্ষ!

গতকালই হয়তো শেভ করেছিলো হাসান নামের ক্লার্কটি। মুখ একদম পরিস্কার। মাথার তালুর দিকে কিছু জায়গা ছাড়া চুলগুলো সুন্দর করে আচড়ানো। দৃশ্যটা কল্পনা করতে পারলো জেফরি বেগ : মাথার তালুর চুলগুলো শক্ত কোনো হাত খামচে ধরেছিলো; তারপর অন্য হাতটা দিয়ে হয়তো থুতনীটা ধরে সজোরে মোচড় মেরে কাজটা সম্পন্ন করা হয়েছে । লাশের সুরতহাল দেখে তার আরো ধারণা হলো, এ কাজটা করা হয়েছে লোকটার পেছন থেকে। ভিকটিমের মুখটা অল্প একটু হা হয়ে আছে। মুখের চোয়াল ডান দিক থেকে বাম দিকে খানিকটা বেঁকে আছে সেজন্যে । একটু কাছে এসে চোয়ালটা ভালোমতো দেখে নিলো। হ্যাঁ। তার ধারণাই ঠিক। লোকটার ডান চোয়ালের থুতনীর উপরে দুটো আঁচড়ের দাগ বেশ স্পষ্ট।

হোমিসাইডের ফটোগ্রাফার অনেকটা নিঃশব্দেই লাশের ছবি তুলে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ আর ফ্ল্যাশের ঝলকানি ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে অনেকগুলো ছবি তোলা হবে। পরে এইসব ছবি দেখে তারা বিশ্লেষণ করবে। অনেক সময় শুধুমাত্র ছবি বিশ্লেষণ করেও দুর্দান্ত কু পাওয়া যায়।

জেফরি টের পেলো ফটোগ্রাফার তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে । ছবি তুলছে না। বুঝতে পেরে সরে গেলো একটু।

“স্যার, ফিঙ্গারপ্রিন্ট টিম কাজ শেষ করে ফেলেছে,” পাশে থেকে সহকারী জামান বললো। |||||||||| “আপনার কি কোনো ইন্সট্রাকশন আছে?”

“টয়লেটের সবখানে প্রিন্ট নেয়া হয়েছে?” লাশের দিকে চেয়েই বললো জেফরি বেগ।

“জি, স্যার।”

“টয়লেটের মেইনগেটে?”

“জি, স্যার।”

“টয়লেটের ভেতরটা চেক করে দেখেছো?”

“জি, স্যার, একদম ক্লিন। শুধু একটি আধখাওয়া সিগারেট পাওয়া গেছে গেটের কাছে । ওটা কালেক্ট করেছি।”

“গুড।” সন্তুষ্ট হলো জেফরি । তার এই সহকারী ছেলেটা এখন বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে। খুব বেশি কিছু বলতে হয় না । তদন্ত কাজের প্রসিডিংগুলো সে ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে।

“ভিক্টিমের পকেট চেক করে মানিব্যাগ, মোবাইল যা যা আছে সব কালেক্ট করে ফেলো ।”

“লাশটা কি মর্গে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবো, স্যার?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। টয়লেটটা ভালো করে আরেকবার দেখে নিলো। সরকারী স্কুলের মতো নয়, বেশ আধুনিক আর পরিস্কার । টয়লেটে ঢুকলে প্রস্রাবের যে কটু গন্ধ নাকে আসে সেটা আসছে না। খুব বেশি হলে পাঁচ-ছয় বছর আগে এটা নির্মাণ করা হয়েছে। বিশাল বড় একটা ঘর, তাতে সারি সারি কিউবিকল সদৃশ্য টয়লেট। আয়তনে চার ফুট বাই আট ফুট করে হবে একেকটা। কোনো ছাদ নেই । গুনে দেখলো মোট দশটা আছে এরকম দরজা সংবলিত টয়লেট। অন্য পাশে প্রস্রাবের জন্যে একসারি ইউরিনাল-প্যান। আরেক দিকে বেশ কয়েকটা বেসিন । ফ্লোরে টাইলস লাগানো হয় নি তবে বেশ পরিস্কার আর মসৃণ। টয়লেটের দরজাটা বেশ বড়, ভেতরে কোনো জানালা নেই। আট-নয় ফুট উপরে শক্ত গ্রিলের ছোটো ছোটো ভেন্টিলেটর আছে বেশ কয়েকটা।

ফটোগ্রাফার, ফিঙ্গারপ্রিন্ট টিম আর এভিডেন্স ভ্যানের কর্মীদের রেখেই চুপচাপ টয়লেট থেকে বের হয়ে গেলো জেফরি বেগ ।

স্কুল কম্পাউন্ডে তিন-চারটা পুলিশের জিপ এলোমেলোভাবে পার্ক করা। আছে। প্রায় দশ বারোজন পুলিশের লোক জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে মূল ভবনের সামনে। হোমিসাইডের এভিডেন্স ভ্যানটাকে স্কুলের পার্কিংলটে দেখতে পেলো জেফরি ।

সকালবেলায় লালা নামের যে সুইপার টয়লেটের ভেতর লাশটা আবিষ্কার করেছে সে হাটু মুড়ে মাটিতে বসে আছে মূল ভবনের সামনে খোলা জায়গায় । তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের দাড়োয়ান । এখানে ঢোকার সময় জেফরির সাথে লোক দুটোর পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এখন সময় এসেছে তাদের সাথে কথা বলার।

“সালাম সাব,” সুইপার লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে বললো।

“তোমার নামটা যেনো কি?”

“সাব, লালা।”

“আর তোমার?” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দাড়োয়ানের দিকে চেয়ে বললো জেফরি ।

“আজগর।”

“স্কুলের নাইটগার্ড কে?”

“হাকিম,” ছোট্ট করে বললো আজগর নামের দাড়োয়ান লোকটা ।

“সে এখন কোথায়?”

“ঐ যে, স্যার।” দাড়োয়ান একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কালোমতো এক লোককে দেখিয়ে বললো ।

“তাকে ডাকো।” দাড়োয়ান লোকটা হাত নেড়ে ইশারা করে হাকিমকে ডাকলো।

স্কুলগুলোতে নাইটগার্ডরা সাধারণত কম্পাউন্ডের ভেতরেই বসবাস করে। সেন্ট অগাস্টিনও এর ব্যতিক্রম নয়। নাইটগার্ডের কাছ থেকে কিছু তথ্য জানা দরকার ।

“স্কুলের অফিসে যারা কাজ করে তাদের ডিউটি শেষ হয় কখন?”

জেফরির প্রশ্নটা শুনে আজগরের দিকে তাকালো লালা ।

“স্যার, বিকাল পাঁচটায়।”

“হাসান সাহেবকে বের হতে দেখেছিলে তুমি?”

দাড়োয়ান একটু আমতা আমতা করলো । |||||||||| “স্যার, হাজার হাজার ছাত্রশিক্ষক যাওয়া আসা করে…আমি খেয়াল করি নাই।”

জেফরি জানে স্কুলের দাড়োয়ান কারোর ঢোকার সময় যতোটা সতর্ক থাকে বের হবার সময় ততোটা থাকে না। প্রায় সব জায়গাতেই এমনটি ঘটে। ঢোকার সময় চেকিং, পাস কিংবা টিকেট দেখা হয়, আর বের হবার সময় এসবের কোনো বালাই নেই । সিনেমাহলগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো তার । এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এখানে এতো বেশি সংখ্যক লোক আসা যাওয়া করে যে কে এলো আর কে বের হয়ে গেলো সেটা মনে রাখা সত্যি কঠিন । অবশ্য এ বিষয়টা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সে নিশ্চিত, খুনটা হয়েছে বিকেলের দিকে। কেরাণী লোকটা ডিউটি শেষ করে বাড়ি যাবার সময়ই এটা ঘটেছে। সুতরাং এটা বিকেলের কোনো এক সময়ের ঘটনা। তারপরও জেনে নিতে হবে।

হাসান নামের কেরাণী লোকটা স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বের হয় নি। বের হবার আগেই সে মারা পড়েছে । সমস্যা হলো আজ শুক্রবার, স্কুল বন্ধ। তাকে কথা বলতে হবে স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক আর কর্মচারিদের সাথে।

“তোমার নাম কি?” নাইটগার্ড জেফরির সামনে এসে দাঁড়ালে প্রশ্ন করলো সে।

“হাকিম,” লোকটার দু’চোখ জুড়ে ঘুম ভর করেছে। তবে চোখেমুখে ভয়টাই বেশি।

“তুমি ক’টা থেকে ডিউটি দাও?”

“সন্ধ্যা সাতটার পর থিইকা ।”

“সন্ধ্যার পর কি তুমি টয়লেটে গেছিলে?”

হাকিম এবার ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো যেনো । ঢোক গিলে তাকালো আজগরের দিকে। একটা অভয় পেতে চাচ্ছে সে ।

“স্যার, টয়লেটে তো যাইতেই অয়…আমিও তো ডিউটি শেষ কইরা গেছি,” বললো আজগর মিয়া।

“তুমি টয়লেটে কিছু দেখো নি তখন?”

“আমি পেচ্ছাব করতে গেছিলাম…ছোটো ঘরগুলার ভিতরে ঢুকি নাই…”

মাথা দোলালো জেফরি। |||||||||| “তুমিও গেছিলে, তাই না?”

হাকিম মাথা নেড়ে সায় দিলো।

“কিছু দেখো নি?”

“না, স্যার । যেইটাতে লাশ পাওয়া গেছে সেইটাতে ঢুকি নাই…অইন্যটাতে ঢুকছিলাম।”

এটা ঠিক, টয়লেটের সবগুলো দরজা খুলে চেক করে না দেখলে লাশটা দেখার কথা নয়। কাকতালীয়ভাবে ঐ নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে কেউ ঢুকলেই কেবল লাশটা আবিষ্কৃত হতো। যেটা সকালবেলা লালা নামের সুইপার করেছে।

“রাতের বেলায় কোনো অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছিলো তোমার?”

“না, স্যার,” দৃঢ়ভাবে জবাব দিলো হাকিম।

“তুমি কখন ডিউটি শেষ করেছো?” এবার প্রশ্নটা করা হলো আজগরকে।

“আমার ডিউটি শেষ অয় সন্ধ্যা সাতটার পর।”

একটু চুপ থেকে জেফরি আবার বললো, “স্কুল থেকে সবার শেষে কে বের হয়েছিলো?”

“কিছু ছাত্র…”

“কয়জন?”

“উমমম…সাত-আটজন অইবো?”

“তারা কেন সবার শেষে স্কুল থেকে বের হলো?”

“ওরা রোজই বাস্কেটবল কোটে পেকটিস করে, স্যার।”

“ও,” কথাটা বলেই জেফরি তাকালো স্কুলের ভেতরে থাকা বাস্কেটবল কোর্টের দিকে । ভাবলো, কতোদিন বাস্কেটবল খেলা হয় না! আপন মনে মুচকি হাসলো সে। |||||||||| “তারপর তুমি কি করলে?”

“প্রতিদিন যা করি, স্যার। সবগুলা রুমের দরজা তালা মাইরা বারিন্দার বাত্তি জ্বালাইয়া দিই। তারপর হাকিম আইলে আমি আমার ঘরে চইলা আসি।”

“তুমি কি টয়লেটটাও চেক করেছিলে?”

“না, স্যার…টয়লেট তো চেক করি না। ওইটা ভোলাই থাকে সব সময়।”

জেফরি এবার ফিরলো সুইপারের দিকে। |||||||||| “লালা, তুমি কি স্কুলেই থাকো?”

“না, সাব। সুইপার কলোনিতে থাকি,” লালা বললো । |||||||||| “ক’টা থেকে তোমার ডিউটি?”

“সকাল ছয়টা থিকা, সাব ।”

“তাহলে তুমি সকাল ছ’টা বাজে লাশটা দেখতে পেয়েছো?” মাথা চুলকালো লালা । |||||||||| “না, সাব…সাতটার পরে হইবো।”

“স্যার, ওই তো শুক্কুরবারে দেরি কইরা আসে,” আগ বাড়িয়ে বললো আজগর ।

“ও,” জেফরি বললো। লালা নামের সুইপারের দিকে ভালো করে তাকালো সে। লোকটার দু’চোখ লাল টকটকে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেললো। হালকা একটা দুর্গন্ধ এসে লাগলো তার নাকে । বুঝতে পারলো, এটা বাংলা মদের গন্ধের মতো ।

“তুমি মদ খেয়েছো?”

লালা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। ভয়ে ঢোক গিললো সে।

“স্যার, ওই প্রতিদিন রাইতে একটু তাড়ি খায়,” আজগর আবারো এগিয়ে এসে লালার হয়ে কথা বললো।

লজ্জায় কাচুমাচু লালা নামের হরিজন সম্প্রদায়ের লোকটা।

জেফরি বেগ লক্ষ্য করলো লালার ফ্যাকাশে লাল টি-শার্টের বুকের কাছে। লালচে একটা ছোপ। মেয়েমানুষের লিপস্টিকের দাগ? হতে পারে।

রেবার সাথে তার প্রেম হবার শুরুর দিকে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো তার। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে ডেটিং করতো তারা। সন্ধ্যার দিকে রিক্সা নিয়ে ফুলার রোডে খামোখাই চক্কর দিতো আর পাগলের মতো চুমু খেতো দু’জনে । রেবার প্রিয় একটা কাজ ছিলো জেফরির বুকে মুখ ঘষা । এক পহেলা ফাল্গুনের সন্ধ্যায় তারা রিক্সায় করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছিলো আর ফাঁকে ফাঁকে চলছিলো চুম্বন । হলুদ শাড়ি পরে বেশ সেজেগুজে এসেছিলো রেবা । খখাপায় ছিলো বেলি ফুলের মালা । তো ডেটিং শেষে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে তাদের বাপ-ছেলের যে বাড়ি ছিলো সেখানে ফিরে যেতেই মুখোমুখি হলো ফাদার হোবার্টের । ফাদার বাই-ফোকাল লেন্সের চশমার উপর দিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। জেফরি প্রথমে বুঝতে পারে নি। সে তো বাড়ি ফেরার আগে ভালো করে রুমালে মুখ মুছে এসেছে, রেবার প্রেমের কোনো স্মারকচিহ্ন বয়ে আনার প্রশ্নই ওঠে না!

একটু পরই তার ভুল ভাঙলো। ফাদার জেফরি হোবার্ট তাকে ডেকে শার্টের বাম বুকের কাছে ছোপ ছোপ লাল রঙের দাগ দেখিয়ে গম্ভীর মুখে বলেছিলো, “হু ডিড ইট, জেফ?” দারুণ ভড়কে গেছিলো জেফরি বেগ। তবে কিছু বলার আগেই ফাদার মুচকি হেসে বলেছিলো, “আই ওয়ান্ট টু মিট দ্যাট ক্রেজি লিটল লেডি!” কথাটা বলেই জেফরির বুকে আলতো করে একটা পাঞ্চ মেরে হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিলো ফাদার ।

“স্যার?”

জামানের কথায় বাস্তবে ফিরে এলো জেফরি বেগ।

“স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেন।”

অধ্যায় ৪

সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও নিজের অফিসে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে ভদ্রলোকের, যেনো এই মুহূর্তে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। দেখতে মোটাসোটা হলেও মনের দিক থেকে একেবারেই দুর্বল একজন মানুষ। জেফরি আর জামান তার

অফিসে ঢুকতেই ভদ্রলোক ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।

“উনি আমাদের চিফ ইনভেস্টিগেটর,” প্রিন্সিপ্যালের উদ্দেশ্যে বললো জামান। খেয়াল করলো প্রিন্সিপ্যাল ভদ্রলোক জেফরির দিকে চেয়ে আছেন একদৃষ্টে ।

“আমি-”

“আরে জেফ…তুমি!” হাত বাড়িয়ে নিজের নামটা বলার আগেই জেফরিকে অবাক করে দিয়ে প্রিন্সিপ্যাল বলে উঠলেন ।

প্রিন্সিপ্যালের বয়স চল্লিশের বেশি হবে না, তবে ভুড়ি আর মাথর চুল কমে যাওয়ার কারণে তাকে আরো বেশি বয়স্ক দেখায়। জেফরিকে সরাসরি তুমি বলায় সে কিছুটা অবাক হলো। পত্রপত্রিকার বদৌলতে তাকে অনেকেই চেনে কিন্তু তাই বলে তুমি সম্বোধন করবে!

“আমাকে চিনতে পারো নি?” প্রিন্সিপ্যাল এবার হেসে বললেন ।

“সরি?” জেফরি চিনতে পারছে না।

“আমি!…তোমার অরুণদা!” কথাটা বলেই জেফরির হাত ধরে জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিলেন তিনি, যেনো ঝাঁকুনি দিয়ে তার ঘুমন্ত স্মৃতিটা জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। |||||||||| “এইটি-সিক্স ব্যাচ…ডিবেটিংক্লাবের প্রেসিডেন্ট…তোমাকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিলাম?”

চট করে স্মৃতির পাতা ভেসে উঠলো জেফরির চোখের সামনে। হালকা পাতলা গড়নের এক তরুণ; মাথা ভর্তি ঘন কোকড়া চুল; স্কুলের সিনিয়র ভাই; বেশ ভালো ছাত্র; ডিবেটিংক্লাবের প্রেসিডেন্ট…আরো কতো কি । তাকে স্কুল কম্পাউন্ডে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিলেন। খুব স্নেহ করতেন। তার বাবা ফাদার জেফরি হোবার্টের প্রিয় ছাত্র।

“কিন্তু আপনাকে দেখে তো চেনাই যাচ্ছে না, অরুণদা!” এবার জেফরির মুখে হাসি ফুটে উঠলো ।

“কী করে চিনবে?…এতো বছর পর দেখা…আগের চেয়ে কতো মোটা হয়ে গেছি, মাথার সব চুলও পড়ে গেছে । আমার বন্ধুরাই তো আমাকে চিনতে পারে না প্রথম দেখায়!” বলেই হেসে ফেললেন অরুণদা নামের প্রিন্সিপ্যাল লোকটা ।

এরপর নিজের চেয়ারে বসলেন প্রিন্সিপ্যাল, জেফরি আর জামান বসলো তার বিপরীতে। টানা দশ মিনিট ধরে চললো দু’জনের কথাবার্তা । সেইসব কথাবার্তার বেশীরভাগ জুড়েই থাকলো পুরনো স্মৃতি রোমন্থন । জেফরি দু’বছরের জন্যে দেশের বাইরে ছিলো, তারও প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকে অরুণদার সাথে তার কোনো যোগাযোগ হয় নি । তিনিও দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে শিক্ষকতা করেছেন । জেফরির বাবা, ফাদার জেফরি হোবার্টের মৃত্যুর কথা দেশে এসেই শুনেছিলেন; খুব কষ্ট পেয়েছেন; ফাদার কতো ভালো মানুষ ছিলেন সেসব কথা বলতে লাগলেন তিনি।

জামান চুপচাপ শুনে গেলো তাদের কথাবার্তা । প্রিন্সিপ্যাল লোকটাকে প্রথমে দেখে গুরুগম্ভীর মনে হয়েছিলো তার কিন্তু এখন মনে হচ্ছে লোকটা বেশ প্রাণখোলা । কিছুক্ষণ পরই তাদের কথাবার্তা মোড় নিলো বর্তমান সঙ্কটের দিকে।

“আমি ভাবতেই পারছি না আমার স্কুল কম্পাউন্ডে আমারই একজন কর্মচারি এভাবে খুন হলো…মাইগড!” এবার হাসি হাসি ভাবটা উধাও হয়ে গেলো প্রিন্সপ্যালের মুখ থেকে। |||||||||| “ঢাকা শহরে যতোগুলো স্কুল আছে তার মধ্যে আমার স্কুলের নিরাপত্তাই সবচেয়ে কড়া। এখানে হুটহাট করে কেউ ঢুকতে পারে না।”

“আমিও সেরকমই জানি। ভিআইপি লোকজনের সন্তানেরা পড়াশোনা করে। নিরাপত্তাও বেশ ভালো, জেফরি সায় দিয়ে বললো।

“এই স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত ছোটোখাটো কোনো ঘটনাও ঘটে নি। সামান্য মারামারি পর্যন্ত না । বোঝো এবার, কি সমস্যায় পড়েছি!”

“হুম,” জেফরি আর কিছু বললো না। ক্রাইমসিনে পরিচিত লোকের দেখা পেলে তার মধ্যে একধরণের অস্বস্তি তৈরি হয়। কারণ পরিচিত লোকজন তার কাছ থেকে বাড়তি আনুকূল্য পাবার আশা করে। এদিকে নিজের প্রফেশনের ব্যাপারে কোনো আপোষকামীতা জেফরির মধ্যে দেখা যায় না, ফলে একটা টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়।

“বাইরে থেকে যারা আসে, আই মিন, ভিজিটরদের কি রেজিস্টার করার ব্যবস্থা আছে এখানে?” জেফরির পাশে বসা জামান প্রশ্নটা করলো প্রিন্সিপ্যালকে। এরকম পরিস্থিতিতে জেফরি বেগ যে অস্বস্তিতে পড়ে সেটা তার সহকারী ভালো করেই জানে।

“আহা, এটা তো কোনো অ্যাপার্টমেন্ট না…এখানে প্রায় দু’হাজারের মতো ছাত্র আছে, আরো আছে একশ’র মতো শিক্ষক, কর্মচারির সংখ্যাও ত্রিশের নীচে হবে না। তারপর ধরো গার্জিয়ানরা তো আছেই…” প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও দু’পাশে মাথা দোলালেন।

জামানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এই লোকটা তাকেও তুমি করে সম্বোধন করছে! তার স্যারের সাথে না হয় আগে থেকে পরিচয় আছে, তার সাথে তো নেই। যাকে তাকে যখন তখন তুমি বলতে অভ্যস্ত এই লোক, বুঝতে পারলো জামান।

“তাহলে স্কুলে ঢোকার সময় কিভাবে চেকিং করা হয়?” আস্তে করে বললো জেফরি ।

“সবার কাছেই থাকে,” বললেন অরুণ রোজারিও।

“ছাত্রদেরও?” জামান বললো।

“সাবার কাছেই আইডি-কার্ড থাকে। কার্ড না থাকলে কাউকে স্কুলে ঢুকতে দেয়া হয় না। এ ব্যাপারে আমি খুব কড়া । আমার আগের প্রিন্সিপ্যাল এসব খুব একটা তোয়াক্কা করতেন না কিন্তু আমি অনেক স্ট্রিক্ট ।” চোখেমুখে কাঠিন্য ভাব চলে এলো প্রিন্সিপ্যালের।

“ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারি আর গার্জিয়ান ছাড়া অন্য কোনো লোক কি স্কুলে ঢুকতে পারে না?” জানতে চাইলো জেফরি বেগ।

“উমমম…পারে, তবে সেক্ষেত্রে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসতে হয়।”

“গতকাল কি এরকম কেউ এসেছিলো?” জামানের কথার জবাবে প্রিন্সিপ্যাল চট করে জবাব দিলেন, “না।”

“কোনো শিক্ষক কিংবা কর্মচারির সাথে তাদের পরিচিত লোকজন দেখা করতে হলেও কি আপনার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিতে হয়?”

জেফরি বেগের এই প্রশ্নটা শুনে প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও চুপ মেরে গেলেন। এটা তার মাথায়ই ছিলো না। ভেবে পাচ্ছেন না কী বলবেন।

“এটা মনে হয় এর আগে ভাবেন নি, অরুণদা?” ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল ।

এটাই হয়, মনে মনে বললো জেফরি । নিরাপত্তার বিষয়টা এতো সহজ না। এটার জন্যে এক্সপার্টদের সাহায্য নিতে হয় । কিন্তু এ দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিষয়ক ব্যাপারগুলো কর্তাব্যাক্তিরাই ঠিক করে দেন, ফলে অনেক ফাঁকফোকর থেকে যায় সেই ব্যবস্থায়। সেন্ট অগাস্টিনের মতো অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বেলায়ও সেটাই ঘটেছে। এখানকার কর্তাব্যক্তি, তার গ্রেগোরিয়ান ভাই নিজেই ঠিক করেছিলেন কি ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে । হয়তো খুনি কিংবা খুনিরদল এই ফাঁকফোকর ব্যবহার করেই এখানে ঢুকে পড়েছে।

“হাসান সাহেব লোক হিসেবে কেমন ছিলেন?” জেফরি জানতে চাইলো ।

“খুব ভালো…চুপচাপ স্বভাবের…স্কুলের সবাই তাকে পছন্দ করতো।”

“স্কুলের কারো সাথে কি তার কোনো ঝগড়া-বিবাদ হয়েছিলো কখনও?”

“না।” ছোট্ট করে বললেন প্রিন্সিপ্যাল। বুঝতে পারলেন না মিথ্যেটা বলে ভুল করলেন কিনা।

“তার পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলতে হবে,” জেফরি আনমনে বললো কথাটা।

“কলিগদের সাথেও।”

অনেকক্ষণ চুপ থেকে প্রিন্সিপ্যাল জানতে চাইলেন, “খুনটা কে করতে পারে বলে মনে করছো?”

“এখনও তদন্ত শুরুই করি নি, এই মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয় । আগে তদন্ত করে দেখি…” বললো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ।

 “তবে আমি নিশ্চিত, বাইরে থেকে কেউ ভেতরে ঢুকে এ কাজ করে নি। দাড়োয়ানদের সাথেও কথা বলেছি। তারাও আমাকে জানিয়েছে গতকাল কোনো বহিরাগত এখানে ঢোকে নি।” বেশ জোর দিয়ে বলে গেলেন প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও।

তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ। “তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন খুনটা করেছে স্কুলের ভেতরের কেউ?”

প্রিন্সিপ্যাল যেনো ভিমরি খেলেন। নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন তিনি। “না, না। স্কুলের কেউ এ কাজ করতে যাবে কেন?”

“আপনিই তো বললেন গতকাল কোনো বহিরাগত এখানে প্রবেশ করে নি। তাহলে কাজটা নিশ্চয় ভেতরের কেউ করেছে?”

“না, না। আমার স্কুলে খুনখারাবি করার মতো কোনো লোক থাকবে এটা অবিশ্বাস্য! প্রশ্নই ওঠে না।”

“তাহলে খুনটা কে করলো?”

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব কী জবাব দেবেন বুঝে উঠতে পারলেন না।

“এটা নিয়ে আপনি ভাববেন না, আমরা দেখি তদন্ত করে…খুনি অবশ্যই ধরা পড়বে।”

“কিন্তু আমার স্কুলের রেপুটেশনের কী হবে, ভাই?” অসহায়ের মতো বললেন প্রিন্সিপ্যাল।

এটা একটা বিরাট সমস্যা। জেফরি জানে এই খুনের ঘটনা আগামীকাল পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হবার আগেই স্কুলের সুনাম মারাত্মকভাবে হোঁচট খাবে । হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকেরা ছুটে আসবে এখানে। বিকেল কিংবা সন্ধ্যার খবরে সবাই জেনে যাবে সেন্ট অগাস্টিন স্কুলের ভেতরে তাদেরই এক কর্মচারি ভয়ঙ্করভাবে খুন হয়েছে।

“অরুণদা, মিডিয়ার ব্যাপারটা আমার হাতে নেই। ওদেরকে কিভাবে সামলাবেন আপনিই ঠিক করে নিন,” জেফরি বললো।

“তুমি বুঝতে পারছো আমার স্কুলের কি হবে? ঐ সেনসেশন-মঙ্গার জর্নালিস্টরা এই স্কুলের বারোটা বাজিয়ে দেবে!”

জেফরি নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো । সেও জানে কথাটা ঠিক। কিন্তু সাংবাদিক সামলানোর মতো কাজ সে নিজেও ভালোমতো করতে পারে না।

“আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, আমাদের হোমিসাইডের পক্ষ থেকে মিডিয়ার কাছে কিছু বলা হবে না,” আস্তে করে বললো জেফরি বেগ ।

দু’পাশে মাথা দোলাতে লাগলেন প্রিন্সিপ্যাল।

“আই অ্যাম ফিনিশড!”

“অরুণদা, একটা কথা বলি?” জেফরির দিকে মুখ তুলে তাকালেন ভদ্রলোক। “এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আমাদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগীতা করুন…খুনটা কে বা কারা করেছে সেটা বের করতে দিন…তাহলেই মনে হয় ড্যামেজ কন্ট্রোল করা সম্ভব হবে । ভুলেও কয়েক দিনের জন্যে স্কুল বন্ধ করার মতো বোকামি করবেন না। একেবারে স্বাভাবিক আচরণ করুন।” একটু চুপ থেকে আবার বললো সে, “এছাড়া আর কোনো সহজ পথ দেখছি না।”

“তুমি যা বললে তাই হবে। আমি তোমাকে সব ধরণের সহযোগীতা করবো, জেফ,” বললেন প্রিন্সিপ্যাল ।

“আজ তো স্কুল বন্ধ, আমি আগামীকাল আসবো, এখানকার সমস্ত কর্মচারি আর ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে কথা বলবো।”

অরুণ রোজারিওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

“ছাত্র?!” অস্থির হয়ে বললেন তিনি, “ছাত্রদের আবার এরমধ্যে টেনে আনার কী দরকার? এমনিতেই স্কুলের রেপুটেশন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার উপর এখানকার অল্পবয়সী ছাত্রদের যদি খুনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাহলে কী হবে বুঝতে পারছো?”

জেফরি চুপ মেরে রইলো। কথাটা ঠিক। এই স্কুলে পড়াশোনা করে সমাজের সবচাইতে ধনী আর ক্ষমতাবানদের সন্তানেরা। তারা নিজেদের অল্পবয়সী সন্তানদেরকে এমন অবস্থার মুখোমুখি করতে চাইবে না।

“দয়া করে আমার ছাত্রদের কি এসব থেকে দূরে রাখা যায় না?”

অরুণ রোজারিওর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে জেফরির মায়া লেগে  গেলো। “ঠিক আছে, তাদেরকে আপাতত জিজ্ঞেস করবো না কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে যদি আমার কাছে মনে হয় কিছু ছাত্রকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার দরকার আছে তখন…?”

কপালের ডান পাশটা চুলকে নিলো প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও। “এরকম কিছুর দরকার হবে না, আমি নিশ্চিত । আর যদি হয়, সবার আগে আমাকে জানাবে । আমার সামনে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তুমি।”

একটু ভেবে নিলো জেফরি । কথাটার প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলো সে কিন্তু আগেভাগে এ নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। প্রয়োজন পড়লে জেফরি যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, এরজন্যে কারোর কোনো অনুমতি নেবার দরকার নেই।

“ঠিক আছে, যখন প্রয়োজন পড়বে তখন দেখা যাবে,” বললো সে। “তবে আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, তদন্ত কাজটা এমনভাবে করবো যেনো স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত না হয়। কোনো রকম ভীতি ছড়াক সেটা আমিও চাইবো না । এই তদন্ত কাজটা করার সময় আমার কাছে এই স্কুলের দু’হাজার ছাত্রের স্বার্থ অগ্রাধিকার পাবে, এটা আমি আপনাকে বলতে পারি।”

“থ্যাঙ্কস, ভাই,” প্রিন্সিপ্যাল কিছুটা আশ্বস্ত হলেন।

“এখন আপনাকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শুনুন। মিডিয়া এবং গার্জিয়ানদের কাছে বলবেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও এখানে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। সেটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। স্কুলের ছাত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আশংকা নেই। আগের চেয়ে আরো কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থার সাথে স্কুল কর্তৃপক্ষ সর্বাত্মক সহযোগীতা করে যাচ্ছে আসল ঘটনা বের করার জন্যে। এ কাজে সবাই যেনো সহযোগীতা করে ।”

এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো জেফরি । যেনো পুরোটাই তার মুখস্ত করা ছিলো। পাশে বসা সহকারী জামানের কাছে মনে হলো তার বস কোনো প্রেসরিলিজ পড়ে শোনাচ্ছে।

নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিলেন প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও।

“ভুলেও বলবেন না খুন হয়েছে । ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে, জেফ ।”

“তাহলে আমরা এখন উঠি?”

নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে করমর্দন করলেন প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও। বিদায় দেবার আগে নিজেদের মধ্যে ফোন নাম্বার বিনিময় করে নিলো তারা ।

.

পাঁচ মিনিট পর জেফরি আর তার সহকারী জামান সেন্ট অগাস্টিন স্কুলের বাইরে এসে দাঁড়ালো। জুম্মার নামাজের আজান দেয়া হচ্ছে। রাস্তায় ইতিমধ্যেই কিছু মুসল্লিকে দেখা যাচ্ছে মসজিদের দিকে যেতে । এরা মসজিদে গিয়ে খুতবা শোনার জন্যে আগেভাগে রওনা হয়েছে।

“স্যার, এখন কি অফিসে যাবেন?”

সহকারী জামানের দিকে ফিরে তাকালো জেফরি ।

“না । আমি বাসায় যাবো। শুটিংরেঞ্জ থেকে তো এখানে চলে এসেছি, গোসল করা হয় নি।”

“তাহলে আপনি বাসায় চলে যান, আমি লাশ নিয়ে মর্গে যাই, ডাক্তারকে কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়ে আমিও বাড়িতে চলে যাবো। আজ বোধহয় জুম্মার নামাজ কাজা হয়ে যাবে।”

জেফরি জানে জামান নিয়মিত নামাজ না পড়লেও জুম্মার নামাজ ঠিকই পড়ে। “এক কাজ করো, অফিসের গাড়িটা তুমি নিয়ে যাও। তাহলে তাড়াতাড়ি কাজ করে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে, হয়তো নামাজ পড়ারও সময় পাবে। কাল অফিসে আলাপ হবে, ওকে? “

“স্যার, আপনি কিভাবে যাবেন?”

“আমি একটা রিক্সা নিয়ে চলে যাবো।”

জামান আর কিছু বললো না। সে জানে তার বস্ একবার এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সেটা আর পাল্টায় না। এর আগে অনেকবারই এরকম হয়েছে । চুপচাপ অফিসের গাড়িতে উঠে বসলো সে।

জামানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে চার রাস্তার মোড়ে চলে এলো জেফরি। একটা খালি রিক্সা পেয়ে তাতে উঠে বসতেই পকেটে থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে রেবাকে একটা মেসেজ পাঠালো সে ।

প্রোগ্রাম চেঞ্জ। ৪টা বাজে। ওকে?…এল.ইউ!

রিক্সাটা কিছুদূর যেতেই তার মোবাইলটা বিপ্ করে উঠলো। রেবার রিপ্লাই!

আই হেইট ইউ!

অধ্যায় ৫

অরুণ রোজারিও স্মরণ করতে পারলেন না ঠিক কতো দিন পর চার্চে এলেন। কাকরাইলের ক্যাথলিক চার্চের ভেতর ঢুকেই তার মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। মনে মনে ভাবলেন, নিয়মিত চার্চে আসা উচিত ছিলো তার। অন্তত মনের প্রশান্তির জন্যে হলেও।

চার্চের তরুণ ব্রাদার এরিক গোমেজ বেদীর সামনে দাঁড়িয়ে ঝাড়ামোছার কাজ তদারকি করছিলেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন চার্চের প্রধান দরজা দিয়ে কেউ ঢুকছে । ফিরে তাকাতেই অবাক হলেন ব্রাদার।

অরুণ রোজারিও!

কিছুদিন আগে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন, সেইসূত্রে নিজের এক ভাগ্নেকে সেন্ট অগাস্টিনে ভর্তি করানোর জন্যে তার সাথে দেখাও করেছিলেন, ফলে লোকটাকে তিনি ভালোমতোই চেনেন। তবে তাকে কখনও চার্চে দেখেন নি । মনে করেছিলেন আজকালকার অনেক শিক্ষিত খৃস্টানের মতো অরুণ রোজারিও ঈশ্বরবিমুখ একজন মানুষ।

“কেমন আছেন, স্যার?” অরুণ রোজারিওকে চার্চের বেদীর সামনে আসতে দেখে ব্রাদার এরিক নিজেই এগিয়ে এসে বললেন।

“ভালো না, ব্রাদার,” বিমর্ষ হয়ে বললেন প্রিন্সিপ্যাল সাহেব। তার কথা শুনে ভুরু কুচকালেন এরিক গোমেজ।

“মনে হচ্ছে আপনার ঈশ্বরের আশীর্বাদের প্রয়োজন আমার।”

“আমার ঈশ্বর আপনারও ঈশ্বর, স্যার। তিনি আমাদের সবার প্রভু,” বুকের কাছে দু’হাত জোর করে স্মিত হেসে বললেন ব্রাদার।

“আমাদের সবারই তার আশীবাদের প্রয়োজন রয়েছে।”

“কিন্তু আমার এখন ভীষণ প্রয়োজন,” দৃঢ়ভাবে বললেন অরুণ রোজারিও।

প্রিন্সিপ্যালের সাথে করমর্দন করে তাকে একটা বেঞ্চিতে বসতে দিলেন ব্রাদার । “কি হয়েছে, স্যার?”

তার স্কুলে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটা সংক্ষেপে জানালেন তিনি। দুপুরের পর থেকে কমপক্ষে বিশটা ফোন পেয়েছেন বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকদের কাছ থেকে। তারপর থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছেন। একেবারে মুষড়ে পড়েছেন তিনি। এমন আপদের সময় মনটা একটু ধীরস্থির করার জন্যে বৌয়ের পরামর্শে চলে এসেছেন চার্চে, সেটাও বললেন ব্রাদারকে ।

“ভালো করেছেন, স্যার,” অভয় দিয়ে বললেন ব্রাদার এরিক। “মনের প্রশান্তির জন্যে প্রভুর কাছে আত্মসমর্পনের কোনো বিকল্প নেই। আশা করি তিনি আপনার সমস্ত অশান্তি আর দূর্যোগ দূর করে দেবেন।”

“ব্রাদার, আমি একটা কনফেশন করতে চাই,” বেশ শান্তকণ্ঠে বললেন। অরুণ রোজারিও।

এরিক গোমেজ একটু অবাক হলেন। কনফেশন করতে চাইলে চুপচাপ কনফেশনাল বুথে চলে গেলেই তো হয়। তাকে কেন জিজ্ঞেস করছে! “আমাদের ফাদার আছেন, আপনি কনফেশনাল বুথে গিয়ে তার কাছে-”

“না, না । আমি আপনার কাছেই কনফেশন করতে চাই,” ব্রাদারের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন অরুণ রোজারিও। “ব্যাপারটা ওরকম আনুষ্ঠানিক কিছু না। শুধু আপনার কাছে কথাটা বলে মনের ভার কিছুটা লাঘব করতে চাইছি।”

একটু চুপ থেকে ব্রাদার এরিক বললেন, “ঠিক আছে, বলুন কী বলবেন।”

“ব্রাদার, আজকের খুনের ঘটনায় তদন্তকারী অফিসারের কাছে আমি একটা মিথ্যে বলে ফেলেছি।”

ব্রাদার এরিক একটু চুপ করে থেকে বললেন, “আপনি কি জানেন খুনটা কে করেছে?”

“আরে না, না। ব্যাপারটা সেরকম কিছু না। অফিসার আমার স্কুলের এক জুনিয়র ভাই। তার নানান প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে একটু মিথ্যে বলতে হয়েছে আমাকে…কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই মিথ্যেটা আমার জন্যে বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। এটা ভেবে আমার মন অস্থির হয়ে উঠেছে।”

মাথা নেড়ে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলেন ব্রাদার। “এটার তো খুব সহজ সমাধান আছে…” অরুণ রোজারিও কপালে ভুরু তুললেন। “…যার কাছে। মিথ্যেটা বলেছেন তাকে গিয়ে সত্যটা বলে দিন । আশা করি তিনি ব্যাপারটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন।”

আক্ষেপে নিঃশ্বাস ফেললেন সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল । “ব্রাদার, দু’ঘণ্টা আগেও এই কাজটা করা আমার জন্যে খুব সহজ ছিলো কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়।”

“কারণটা কি আমি জানতে পারি?”

স্থিরচোখে ব্রাদারের দিকে চেয়ে রইলেন অরুণ রোজারিও। কিছুক্ষণ ভেবে দু’পাশে মাথা দুলিয়ে অবশেষে বললেন, “না, ব্রাদার…আপনি শুধু আমার জন্যে আশীর্বাদ করতে পারেন। রাইট নাও, দ্যাট ইস দ্য অনলি থিং ইউ ক্যান ডু ফর মি…জাস্ট প্রে ফর মি, ব্রাদার।”

অধ্যায় ৬

পেপের জুসে স্ট্র দিয়ে একটা ঘূর্ণি সৃষ্টি করে যাচ্ছে রেবা। তার মুড অফ। জেফরি বুঝতে পারছে না, তাদের ডেটিংয়ের সময়টা সামান্য পিছিয়ে দেয়ার কারণে রেবা এতোটা মনোক্ষুণ্ণ হচ্ছে কেন। শাড়ি পরে আসার কথা ছিলো, সেটাও পরে নি। একেবারে সাধারণ সালোয়ার-কামিজ পরে চলে এসেছে । জেফরি বুঝতে পারছে না ঠিক কী কারণে রেবা এমন করছে। দেখা হবার পর থেকেই তাকে অন্যমনস্ক লাগছে ।

“সরি।”

রেবা কিছুটা চমকে উঠলো কথাটা শুনে। তারা বসে আছে একটা দোতলা রেস্টুরেন্টের এককোণে। বিশাল কাঁচের দেয়াল দিয়ে নীচের রাস্তার যানবাহনের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ধীরে ধীরে বাড়ছে। লোকজনের আনা গোনা ।

“সরি কেন?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো রেবা ।

“আসলে হঠাৎ করে খবর এলো একটা খুন হয়েছে, তাই…বুঝতেই পারছো…”।

“কোথায় খুন হয়েছে, অনেকটা নির্লিপ্তভাবে জানতে চাইলো রেবা । তার চোখ আবার নিবদ্ধ জুসের গ্লাসের দিকে ।

“সেন্ট অগাস্টিন স্কুলে।”

“ও।” জুসের গ্লাসের দিকে তাকিয়েই বললো সে।

অবাক হলো জেফরি । সাধারণত নতুন কোনো কেসের ব্যাপারে রেবার খুব আগ্রহ থাকে। অনেক কিছু জানতে চায়। কিন্তু আজকে তার আচরণ মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।

“কোনো কারণে কি তোমার মুড অফ?” আস্তে করে মাথা নেড়ে সায় দিলো রেবা, এখনও সে চোখ তুলে তাকালো

“কি হয়েছে?”

এবার চোখ তুলে তাকালো রেবা কিন্তু সেই চোখ আদ্র।

“আহা, এরকম কোরো না, প্লিজ। আমাকে বলল কি হয়েছে,” রেবার একটা হাত ধরে বললো জেফরি ।

“বাবা…”

একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “আবার কোনো ঝামেলা করেছেন?”

দু’পাশে মাথা দোলালো রেবা ।

“তাহলে?”

“বাবার ডায়াগনোসিসের রেজাল্টে খুব খারাপ একটা…” রেবার কণ্ঠটা ধরে এলো।

“খারাপ কি?” চিন্তিত হয়ে উঠলো জেফরি ।

“থ্রোট ক্যান্সার ধরা পড়েছে।” রেবার আদ্র চোখ এবার পাবিত হলো । ওহ! “কখন জানতে পারলে?”

“রিপোর্টটা বাবা পেয়েছিলেন আরো তিন-চার দিন আগে…আমাদের কিছু বলেন নি। লুকিয়ে রেখেছিলেন।”

“তারপর?”

“দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করার কিছুক্ষণ পরই রিপোর্টটা মা খুঁজে পান। এখন তো মনে হচ্ছে বাবার চেয়ে মা-ই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”

রেবাকে কাছে টেনে এনে রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে দিলো জেফরি। অনেক শান্ত্বনা দিয়ে বোঝালো এমন সময় রেবাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। তাকে শক্ত হতে হবে। ভালো চিকিৎসা পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তার বাবার এখন বেটার ট্রিটমেন্টের দরকার ।

এভাবে চলে গেলো দশ মিনিট। জুসের গ্লাস দুটো পড়ে রইলো টেবিলের উপর । নতুন কোনো খাবারের অর্ডারও দেয়া হলো না আর। অনেকক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলো তারা দুজন।

}

অধ্যায় ৭

শনিবার দিন হোমিসাইডে আসার আগেই জেফরি বেগ সকালের পত্রিকা পড়ে জেনে গেছে সেন্ট অগাস্টিন স্কুলের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মিডিয়া কি রকম প্রতিক্রিয়া করেছে। অবাক হয়েছে সে, গতকাল সন্ধ্যার পর কোনো টিভি চ্যানেলে খবরটা দেখানো হয় নি। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এমন খবর মিস্ করলো কি করে, ভেবে পায় নি। তবে শেষ রাতে টিভিতে একটা খবর দেখে সবটাই বুঝতে পেরেছিলো।

গতকাল শুক্রবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার কারারুদ্ধ স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন। সবাই জানে এর আগেরবার ক্ষমতায় থাকার সময় স্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে তার স্বামী যে দুর্নীতি করেছে, যার কারণে জনগনের কাছে ধিকৃত হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আর তার দল, সে কারণেই এই ডিভোর্স। কিন্তু আসল সত্যিটা হাতেগোনা কয়েকজন লোকই জানে, আর জেফরি বেগ জানে তারচেয়েও বেশি।

একটি জঘন্য রাজনৈতিক হত্যার ষড়যন্ত্র।

এই লোকের দুর্নীতির কারণে দল আর সরকারের ভরাডুবি ঘটে, পরের নির্বাচনে বিরোধীদল চলে আসে ক্ষমতায় । তারপর থেকেই দুর্নীতির অভিযোগে জেল খাটতে শুরু করে মি: টেন পার্সেন্ট খ্যাত প্রধানমন্ত্রীর স্বামী হায়দার আলী। অনেকে অবশ্য তাকে বাবর আলী নামেও ডাকতো।

অবৈধ পথে অর্জিত হাজার কোটি টাকার মালিক হায়দার আলী দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর জেল খাটার পর যখন বুঝতে পারে তার স্ত্রী তাকে ডিভোর্স করার চিন্তাভাবনা করছে এবং সামনের নির্বাচনে ভদ্রমহিলা জয়লাভ করতে পারবে না, তখনই ভয়ঙ্কর এক ষড়যন্ত্র ফেঁদে বসে।

গত নির্বাচনের ঠিক আগে, জেলে বসে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ব্ল্যাক রঞ্জুকে দিয়ে। এরফলে স্ত্রীকে যেমন সরিয়ে দেয়া যেতো সেইসাথে জনগনের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয় লাভও করা সম্ভব হতো। কিন্তু সবটাই ভণ্ডুল হয়ে যায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এক ঘনিষ্ঠ লোকের পাল্টা এক ষড়যন্ত্রে । দৃশপটে আর্বিভূত হয় ঠাণ্ডা মাথার এক পেশাদার খুনি বাস্টার্ডের। সেই খুনি ব্ল্যাক রঞ্জুর দলকে একাই বিনাশ করতে শুরু করে। বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে জেফরি বুঝতে পারে এরমধ্যে কিছু একটা আছে। তবে শেষ পর্যন্ত সে নিজেও ঢুকে পড়ে বিরাট সেই ষড়যন্ত্রের ভেতরে।

শেষ পর্যন্ত সফলভাবে ব্ল্যাকরঞ্জু আর সেই পেশাদার খুনি বাস্টার্ডকে জীবিত ধরতে সক্ষম হয় জেফরি বেগ । কিন্তু কয়েক মাস জেল খাটার পরই পেশাদার খুনি বাস্টার্ড ক্ষমতাসীন দলের আনুকূল্য পেয়ে জামিনে মুক্ত হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। জেফরির ধারণা বিদেশে চলে গেছে সে। তবে চলতে ফিরতে অক্ষম ব্ল্যাক রঞ্জু এখন জেলে, হুইলচেয়ার তার নিত্যসঙ্গি, বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছে।

বাস্টার্ডের মুক্তিতে ভীষণ চটে গেছিলো জেফরি বেগ। এক পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দেবারও সিদ্ধান্ত নেয়। যাইহোক, হোমিসাইডের মহাপরিচালক তাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করে।

বর্তমান সরকারপ্রধান নিজের স্বামীকে সেই মামলায় না জড়িয়ে বহুল আলোচিত দুর্নীতির মামলায় বিচার করার চেষ্টা করছে। কোনো সিটিং প্রাইমমিনিস্টার নিজের স্বামীকে ডিভোর্স দেয়ার ঘটনা ইতিহাসে এর আগে হয়েছে কিনা জেফরি জানে না, তবে খবরটা গতকাল সবচাইতে আলোচিত ঘটনা ছিলো। টিভি চ্যানেলগুলো এই সংবাদ নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে, সেন্ট অগাস্টিনের টয়লেটে হতভাগ্য এক কেরাণীকে কে বা কারা হত্যা করলো সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি কেউ । অরুণদার ভাগ্য ভালো, ভাবলো জেফরি।

এমন কি আজকের প্রধান প্রধান তিন-চারটি পত্রিকায় সেন্ট অগাস্টিনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে খবর বের হয়েছে সেটাও খুব একটা গুরুত্ব পায় নি । সবগুলো পত্রিকায় ভেতরের পৃষ্ঠায় এক কলামে ঠাঁই পেয়েছে সেটা। তারচেয়ে বড় কথা, কোনো রিপোর্টারই এটিকে সরাসরি হত্যাকাণ্ড বলে নি, সম্ভাব্য আত্মহত্যা হিসেবেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

সকালে নাশতা করার সময় এই খবরগুলো পড়ে জেফরির মুখে এক চিলতে হাসি দেখা দিয়েছিলো । কোনো রকম পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ছাড়াই সে জানে, হাসান নামের কেরাণীকে বেশ দক্ষতার সাথেই হত্যা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই।

অফিসে ঢুকে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলো জেফরি । গতকাল বিকেলে রেবার কাছ থেকে তার বাবার অসুখের কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। যদিও রেবাকে সে শক্ত হতে বলেছে, ভালো কোথাও চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়েছে, তারপরও সে জানে, ভদ্রলোকের সেরে ওঠাটা একদমই অনিশ্চিত। থ্রোট ক্যান্সারের কিছু স্টেজ থাকে, ভাগ্য ভালো থাকলে আর সুচিকিৎসা দেয়া হলে রোগী সেরে উঠতে পারে। তবে রেবার বাবা নাকি ফোর্থ স্টেজে আছেন । দেশে চিকিৎসা করা প্রায় অসম্ভব । হয়তো সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাঙ্কক যাবে।

ডেস্কের উপর পেপার ওয়েটটা নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করার সময় সহকারী জামান এসে ঢুকলো ঘরে। সালাম দিয়ে জেফরির বিপরীতে একটা চেয়ারে বসলো সে।

“স্যার, আপনি কি সেন্ট অগাস্টিনে এখনই যাবেন?

একটু ভেবে বললো জেফরি, “না। দুপুরের পর যাবো…” তারপর আনমনা ভাবটা কাটিয়ে উঠে বললো, “ফিঙ্গারপ্রিন্টের কি অবস্থা?”

“টয়লেটের ভেতর অসংখ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছিলো, স্যার…আমার ধারণা ওগুলোর বেশিরভাগই ছাত্রদের । কয়েকটা ট্রাই করে দেখা গেছে…রেজাল্ট জিরো।”

মাথা দোলালো জেফরি । স্কুলের ছাত্রদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ করবে না, কারণ হোমিসাইডের ডাটাব্যাঙ্কে শুধু ভোটার আইডি কার্ডধারীদের আঙুলের ছাপ আর যাবতীয় তথ্য রাখা আছে । আঠারো বছরের নীচে এবং ভোটার আইডিকার্ড নেই এরকম লোকের আঙুলের ছাপ ম্যাচ করবে না।

“কিউবিকলের দরজায় কোনো প্রিন্ট পাওয়া যায় নি?”

“ওখানেও অনেকগুলো পাওয়া গেছে…কিছু প্রিন্ট ম্যাচিং করে দেখা হয়েছে, স্যার,” বললো জামান। “একটা ভিকটিমের সাথে ম্যাচ করেছে, অন্য একটা ওই সুইপারের, বাকিগুলো মনে হয় ছাত্রদের।”

আবারো মাথা দোলালো জেফরি ।

“সবগুলো ম্যাচিং করবো, স্যার?”

“দরকার নেই।”

“আমারও তাই তো মনে হচ্ছে, স্যার।”

“যেভাবে কেরাণী ছেলেটার ঘাড় মটকে দিয়েছে, সেটা কোনো সাধারণ লোকের কাজ না,” বললো জেফরি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান।

“আঙুলের ছাপ যেনো না পড়ে সে ব্যাপারেও সতর্ক ছিলো মনে হচ্ছে।”

“প্রফেশনাল কেউ হবে, স্যার,” জামান বললো ।

“হুমমম…এটাই সমস্যা । ওইরকম একটা স্কুলে, ওরকম সাধারণ একজন কেরাণীকে খুন করার জন্য পেশাদার লোক ব্যবহার করা হলো কেন?”

“আমার মনে হচ্ছে এটা ব্যাক্তিগত কোনো শত্রুতার কারণে হয়েছে, জামান নিজের অভিমত প্রকাশ করলো।

“তাই যদি হয় তাহলে স্কুলের ভেতর কাজটা করা কি বেশি কঠিন না?…হোয়াই নট আউটসাইড অব দি স্কুল কম্পাউন্ড?”

জামান মাথা নেড়ে সায় দিলো। “হয়তো স্কুলের ভেতরে কেউ জড়িত আছে…”

জেফরি নিজেও এরকম সন্দেহ করছে। একটু চুপ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো।

“পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট কবে পাবো?”

“আগামী সোমবারের আগে না ।”

“ভিকটিমের কাছে থাকা মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন, এসব চেক করে দেখেছো?”

“জি, স্যার। মানিব্যাগে কিছু টাকা, একটা লাইটার, একগোছা চাবি আর লোকটার বউয়ের ছবি ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। একেবারে ক্লিন। মোবাইল ফোনটা চেক করে দেখা হচ্ছে।”

“তার মানে লোকটা বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ছিলো?” জেফরি বললো।

“জি, স্যার।”

অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে, পরিস্কারপরিচ্ছন্ন লোকজন নিজেদের মানিব্যাগ বেশ পরিস্কার রাখে। খুব বেশি কাগজপত্র, নোট কিংবা অন্য কিছু রাখে না। তাদের মানিব্যাগই বলে দেয় ব্যক্তি হিসেবে তারা যথেষ্ট পয়পরিস্কার থাকতে পছন্দ করে।

“মোবাইল ফোন থেকেও কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আমি কিছুটা চেক করে দেখেছি। ফোনবুকে মাত্র বারোটি নাম্বার। তার মানে লোকটার পরিচিত লোকজনের সংখ্যা কম। গত এক সপ্তাহে কল করেছে মাত্র এগারোটি…তার মধ্যে সাতটাই তার বউকে । বাকি চারটা কলের মধ্যে স্কুলের হেডক্লার্ক নামে সেভ করা নাম্বারে করেছে তিনটি। আর লিটু নামে সেভ করা নাম্বারে একটি। এই লিটু হলো হাসানের শ্যালক।”

একনাগারে বলে যাওয়া জামানের কথাগুলো চুপচাপ শুনে গেলো জেফরি । সে ভালো করেই জানে এই কেসটা কঠিন হবে। তার অভিজ্ঞতা বলে, বিরাট হোমরাচোমরাদের খুনখারাবির কেস খুব সহজে সমাধান করা যায়, সবচাইতে কঠিন হয় হাসানের মতো সাধারণ লোকজনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে। তাদের শত্রু কে সেটা বের করাই কঠিন হয়ে ওঠে। খুবই নিরীহগগাছের লোকজন খুন হয় তখনই যখন বিরাট কোনো ঘটনায় মধ্যে তারা অজ্ঞাতসারে কিংবা ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়ে। তাহলে কি সেন্ট অগাস্টিনের হত্যাকাণ্ড বিরাট কোনো ঘটনার সূচনা?

কে জানে!

অন্যমনস্কভাব কাটিয়ে উঠে জামানকে জিজ্ঞেস করলো জেফরি, “ঢাকায় ভিক্টিমের পরিবার কোথায় থাকে? কারা কারা আছে?”

জামান অফিসে আসার আগেই পুলিশের কাছ থেকে এ বিষয়ে জেনে নিয়েছে। “আরামবাগে, স্যার । বউ আর এক শ্যালকসহ।”

“মুরুব্বি টাইপের কেউ নেই?”

“হাসান সাহেবের শ্বশুর থাকেন রাজশাহীতে…স্কুল শিক্ষক। উনি খবর পেয়েছেন। আজ বিকেলে লাশ দাফন করার আগেই এসে পড়বেন।” জেফরিকে কিছু বলতে না দেখে জামান আবার বললো, “আপনি কি আজ ঐ বাড়িতে যাবেন?…ওদের সাথে কথা বলবেন?”

মাথা দোলালো জেফরি । “অবশ্যই যাবো তবে এখন না । লাশ দাফন হবার পর।

অধ্যায় ৮

মিডিয়া যতোই তুচ্ছ করে দেখাক না কেন, সেন্ট অগাস্টিনে যে একটা খুন হয়েছে সেটা বোঝা গেলে ভেতরে ঢুকেই । মেইন গেটের বাইরেই কিছু পুলিশ বসে আছে কাঠের বেঞ্চে। তাদের মধ্যে কোনো সিরিয়াস ভঙ্গি নেই। অলস সময় পার করছে। কারো কারো অভিব্যক্তিতে বিরক্তিও দেখতে পেলো জেফরি বেগ। গেটের দাড়োয়ান আজগর দায়িত্বে থাকলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ এখন আর তার উপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারছে না বোধহয়। সঙ্গে এক কনস্টেবলকে দিয়ে দিয়েছে তাকে সাহায্য করার জন্য।

জামানকে নিয়ে ঢোকার সময় জেফরিকে থামানোর চেষ্টা করলো সেই কনস্টেবল। সঙ্গে সঙ্গে আজগর বাধা দিয়ে তার পরিচয় জানিয়ে দিলো তাকে। কনস্টেবল কাচুমাচু খেলো একটু। যদিও জেফরি ব্যাপারটা আমলেই নিলো না। সে চলে গেলো প্রিন্সিপ্যালের রুমের দিকে। স্কুলের ভেতরে ছাত্রছাত্রিদের থমথমে মুখ দেখে তার একটু খারাপ লাগলো। মাঠে কেউ খেলছে না। জায়গায় জায়গায় ছোটো ছোটো দলে জোটবদ্ধ হয়ে চাপা কণ্ঠে কথা বলছে তারা। কী নিয়ে কথা বলছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার।

কিছু ছাত্রি জেফরিকে আপাদমস্তক মেপে নিলো। মনে মনে হাসলো সে। বয়সের তুলনায় একটু বেশিই পেকে গেছে এরা। নাকি বখে গেছে?

এর আগে কো-এডুকেশন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঢোকে নি, বিশেষ করে স্কুল চলাকালীন সময়ে। তার নিজের স্কুল সেন্ট গ্রেগোরি একটি বয়েজ স্কুল, তাই কো-এডুকেশন স্কুল কেমন সেটা তার অভিজ্ঞতায় নেই।

তিন-চারজন ছাত্রি, বয়স চৌদ্দ-পনেরো হবে, জটলা বেধে ফিসফাস করছে মেইন বিল্ডিংয়ের কাছে, জেফরি আর জামান তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় একেবারে ছেলেদের মতো করে নিখুঁত শিষ বাজালো তদের মধ্যে কেউ। এরকম দক্ষতা কে প্রদর্শন করলো সেটা দেখার জন্য ফিরে তাকালো জেফরি । সঙ্গে সঙ্গে এক মেয়ের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেলো। মেয়েটা ভুরু নাচিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করলো যে ভিমড়ি খাবার জোগার হলো তার । পেছনে থাকা জামানও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। তার চোখ কপালে উঠে গেলো।

এতোদিন জেফরির ধারনা ছিলো এডামটিজিং শব্দটা নিছক কাগুঁজে ব্যাপার। এখন অবশ্য বুঝতে পারলো ঘটনা না ঘটলে, অস্তিত্ত্ব না থাকলে সেটাকে প্রকাশ করার জন্য কোনো শব্দের জন্ম হয় না । চোখ নামিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

.

অরুণ রোজারিও একজন শিক্ষকের সাথে কথা বলছিলেন, জেফরিকে ঢুকতে দেখে নিজেই উঠে এলেন।

“কি অবস্থা, অরুণদা?” জানতে চাইলো জেফরি । যদিও জানে অবস্থা বেশি ভালো না হবারই কথা।

“আর অবস্থা…” কথাটা বলেই জেফরি আর জামানকে বসতে বললেন । সামনে বসে থাকা শিক্ষককে ইশারা করতেই ঘর থেকে চলে গেলো ভদ্রলোক।

জেফরির কাছে মনে হলো একরাতেই অরুণ রোজারিওর ওজন পাঁচ কেজি কমে গেছে। চোখের নীচে কালচে আভা ।

“বাইরে পুলিশ দেখলাম,” চেয়ারে বসে বললো জেফরি ।

“আমি আনতে চাই নি কিন্তু বাধ্য হয়েই আনতে হয়েছে,” অরুণ রোজারিও বললেন।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ ।

“গার্জেনদের চাপে,” ছোট্ট করে বললেন সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল।

“খবরটা কিন্তু কমই গুরুত্ব পেয়েছে, সেদিক থেকে দেখলে আপনার ভাগ্য ভালোই বলতে হয়।”

জেফরির কথাটা শুনে খুশি হতে পারলেন না অরুণ রোজারিও। “হুমম…আমিও সেরকমই ভেবেছিলাম কিন্তু গার্জেনরা যেভাবে রিঅ্যাক্ট করা শুরু করেছে, মনে হচ্ছে এখানে টুইন টাওয়ারের মতো কোনো ঘটনা ঘটে গেছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি । “ভিআইপি লোকজনের ছেলেমেয়ে পড়ে…তাই একটু বাড়াবাড়ি করছে হয়তো।”

“সেটাই,” কথাটা বলেই কেমন জানি উদাস হয়ে গেলেন অরুণ রোজারিও।

“ছাত্রছাত্রিদের মধ্যে এই ঘটনার কী রকম প্রভাব পড়েছে?”

জেফরির দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন প্রিন্সিপ্যাল। “দে আর প্যানি…”

“কয়েক দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে, এ নিয়ে চিন্তা করবেন না ।

অরুণ রোজারিও আস্তে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “তাই যেনো হয়।”

জেফরি বুঝতে পারছে, ভদ্রলোকের মানসিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। পাশে বসে থাকা জামানের দিকে তাকালো সে। ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে। এখানে ঢোকার পর থেকে কোনো কথা বলে নি।

“অরুণদা,” আস্তে করে বললো জেফরি ।

“কি?” অনেকটা সম্বিত ফিরে পেলেন যেনো ।

“হাসানের ঘনিষ্ঠ কলিগদের সাথে একটু কথা বলতে চাই।”

“হুম, “ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ডেস্কের উপর থেকে ইন্টারকমটা তুলে সন্ন্যাল বাবু নামের কাউকে আসতে বলে দিলেন। “ছেলেটা খুব লাজুক আর চুপচাপ স্বভাবের ছিলো, কারো সাথে তেমন মিশতো না। আমি জানি না এই স্কুলে তার সে রকম ঘনিষ্ঠ কেউ আছে কিনা।”

“তার পরিবারের কারো সাথে কথা হয়েছে আপনার?”

“হুম…ওর এক শ্যালক…কলেজে পড়ে। সেই ছেলেটার সাথে কথা হয়েছে।”

“ও,” জেফরি আর কিছু বললো না। অরুণ রোজারিওর দিকে চেয়ে রইলো। হাসানের লাশটা যেদিন সকালে আবিষ্কার করা হলো তারচেয়ে আজকে অনেক বেশি বিমর্ষ আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে তাকে।

“অপনি খুব টেনশনে আছেন মনে হচ্ছে।”

“তা তো আছিই…আসলে এরকম পরিস্থিতিতে পড়ি নি কখনও। এটা আমার জন্য একদমই নতুন সমস্যা। বুঝতে পারছি না কিভাবে সব সামলাবো।”

“আপনি যতোটা স্বাভাবিক থাকবেন পরিস্থিতি ততো দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলেন অরুণ রোজারিও কিন্তু কিছু বলার আগেই রুমে ঢুকলো মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক । পরিপাটি শার্ট-প্যন্ট আর পাম-সু পরা। মাথার আধপাকা চুল ব্যাক ব্রাশ করে রেখেছে। মাঝারি উচ্চতার লোকটির মুখে চাপ দাড়ি। চোখে মোটা চশমা ।

“বসুন,” ভদ্রলোককে বললেন সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল। তারপর জেফরির দিকে ফিরে পরিচয় করে দিলেন। “জেফ, এ হলো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল, আমাদের হেডক্লার্ক।”

বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল নামের লোকটা জেফরির দিকে তাকিয়ে দু’হাত জোড় করে বললো, “নমস্কার ।” অরুণ রোজারিও ইশারা করলে জেফরি আর জামানের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো ভদ্রলোক।

“আর এ হলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ । আমার স্কুলের ছোটো ভাই,” কথাটা বলেই একটু থামলেন অরুণ রোজারিও।

“হাসান তার সহকারী ছিলো। বাবুর রুমেই বসততা ছেলেটা।”

“আপনি ভালো আছেন?” সৌজন্যতার খাতিরে বললো জেফরি।

“হ্যা…আপনি ভালো আছেন?” সৌজন্যতার জবাব দিলো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল।

“বাবু, হাসানের ব্যাপারে আপনার সাথে জেফরি একটু কথা বলবে।”

জেফরির কাছে মনে হলো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল একটু ভয় পেয়ে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। একে তো পুলিশের লোক তার উপরে খুনের কেসে জিজ্ঞাসাবাদ।

“হাসানকে আপনি কতোদিন ধরে চিনতেন?” একেবারে হালকা চালে বললো কথাটা।

“দুতিন বছর তো হবেই।”

“আপনার সাথে তার কেমন সখ্যতা ছিলো?”

“বয়সে আমার অনেক ছোটো ছিলো, আমাকে খুব শ্রদ্ধা করতো, সখ্যতা বলতে যা বোঝায় সেটা বোধহয় ছিলো না, শুধু ওয়ার্কিং রিলেশন, বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল আস্তে আস্তে বলে গেলো।

“তাহলে এই স্কুলের এমন কেউ নেই যার সাথে তার সখ্যতা ছিলো?”

“সেরকম কেউ বোধহয় নেই।”

জেফরি একটু অবাক হলে তার এই অভিব্যক্তি দেখে অরুণ রোজারিও এগিয়ে এলেন।

“আসলে ছেলেটা একেবারে চুপচাপ আর শান্তশিষ্ট ছিলো । খুব বেশি কথা বলতো না।”

“হ্যাঁ, স্যার ঠিকই বলেছেন,” বললো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল ।

“একেবারে নিরীহ একটা ছেলে ছিলো। স্কুলের কারো সাথে আড্ডা মারতেও দেখি নি কখনও।”

“এই স্কুলের কারো সাথে কি তার কখনও কোনো ঝামেলা হয়েছিলো?”

জেফরি লক্ষ্য করলো কথাটা শুনে বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল অরুণ রোজারিওর দিকে চোরা চোখে তাকালো। তাদের দুজনের মধ্যে কিছু একটা ভাব বিনিময় হলো যেনো । কিন্তু কেন সেটা বুঝতে পারলো না সে।

“না, আস্তে করে বললো হেডক্লার্ক। “এরকম কথা কখনও শুনি নি। তাই না, স্যার?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। হাসানের মতো নিরীহ ছেলের সাথে কার ঝামেলা হতে যাবে?” অরুণ রোজারিওর ভাবভঙ্গি জেফরির কাছে একটু খটকা লাগলো। তার এই সিনিয়র ভাই খুব ভালো অভিনয় জানে না। অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে একদম আনাড়ি।

“অদ্ভুত,” জেফরি বললো। জামানের দিকে তাকালো এবার। “এরকম নির্বিবাদি একটা ছেলে বীভৎসভাবে খুন হয়ে গেলো!”

জামান শুধু চেয়ে রইলো, কিছু বললো না।

এবার বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের দিকে ফিরলো আবার।

“হাসান সাহেবকে ঐদিন ঠিক ক’টা বাজে শেষবারের মতো দেখেছিলেন?”

একটু মনে করার চেষ্টা করলো হেডক্লার্ক।

“পাঁচটার পরই তো চলে গেলো। এরপর আর দেখা হয় নি।”

“চলে গেলো মানে স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বের হয়ে যাবার কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তুহাসান সাহেব তো ঐ দিন স্কুল কম্পাউন্ড থেকে বেরই হয় নি। কোনো কারণে হয়তো টয়লেটে গেছিলো। সেখানেই খুন হয়।”

“আসলে আমাদের অফিসটা দোতলায়, সেখান থেকে পাঁচটার পর হাসান চলে গেলে আমি আরো আধঘণ্টা কাজ করার পর অফিস থেকে বাসায় চলে যাই । সুতরাং হাসান আমার রুম থেকে বের হয়ে কোথায় গেছে সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব না। আমি ধরে নিয়েছিলাম সে বাসায় চলে গেছে।”

“হুম,” একটু ভেবে বললো জেফরি, “ঐ দিন কাজ করার সময় তার মধ্যে কোনো রকম টেনশন খেয়াল করেছেন? মানে অস্বাভাবিক কিছু?”

বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল ভুরু কুচকে একটু ভেবে দৃঢ়ভাবেই বললো, “হ্যাঁ। একটু টেনশনে ছিলো।”

“টেনশনে ছিলো কেন?”

“আমি জিজ্ঞেস করলে সে বললো তার শেয়ারের দাম নাকি অনেক পড়ে গেছে।”

“শেয়ার?…হাসান সাহেব কি শেয়ার বিজনেস করতো?”

“হ্যাঁ। তবে তেমন কিছু না। একটু বাড়তি ইনকামের জন্য টুকটাক করতো আর কি। একটা ব্যাঙ্কের কিছু শেয়ার ছিলো তার। ঐ শেয়ারটার প্রাইস পড়ে যাওয়াতে টেনশনে ছিলো।”

“আচ্ছা, একটু ভেবে আবার বললো জেফরি, “আর কিছু?”

“না। আর কোনো কিছু মনে পড়ছে না। অন্যসব দিনের মতো যেমন থাকে তেমনি ছিলো।”

পাশে বসা জামানের দিকে চেয়ে আবার অরুণ রোজারিওর দিকে ফিরলো জেফরি ।

“অরুণদা, হাসান সাহেব যে রুমে বসে কাজ করতো সেটা একটু দেখতে চাই।”

“ওকে ফাইন,” কথাটা বলেই বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের দিকে তাকালো।

“বাবু, ওকে আপনার রুমে নিয়ে যান। যা যা দেখতে চায় দেখাবেন। নো প্রবলেম। আই মিন, ফুললি কোঅপারেশন করবেন।”

বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল উঠে দাঁড়ালো। “ঠিক আছে, স্যার।” এবার জেফরির দিকে ফিরে বললো, “আসুন আমার সাথে।”

.

সেন্ট অগাস্টিনের মূল ভবনের পাশে আরেকটা ছোটো ভবনে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অফিস। এর পাশেই খেলার মাঠটি অবস্থিত। বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের সাথে সেখানে চলে এলো জেফরি বেগ আর জামান। হেডক্লার্কের রুমটি বড়জোড় পনেরো বাই পনেরো ফুটের একটি ঘর । বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের ডেস্কের একটু কাছেই ছোটো একটা ডেস্কে বসততা হাসান নামের ক্লার্ক।

অফিসঘরে ঢুকে জেফরি ভালো করে চেয়ে দেখলো । একেবারে ছিমছাম । তিন-চারটি ফাইল ক্যাবিনেট ছাড়া তেমন কোনো আসবাব নেই । অন্যান্য অফিসের সাথে এর পার্থক্য বেশ স্পষ্ট চোখে পড়ে, তার কারণ সেন্ট অগাস্টিনের অফিশিয়ালি কাজকর্ম কম্পিউটারাইজ করা হয়েছে। হাসানের ডেস্কে একটি পিসি থাকলেও বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের ডেস্কে কোনো পিসি দেখতে পেলো না।

“আপনি কম্পিউটার ব্যবহার করেন না?”

জেফরির প্রশ্নটা শুনে বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল একটু বিব্রত হলো। “না।”

ভদ্রলোক এতো আস্তে কথা বলে যে শুনতে বেগ পেলো জেফরি । “কেন?” ঘরের ভেতরে ঢুকে হাসানের ডেস্কের কাছে চলে এলো সে। “আপনারা তো কম্পিউটারেই সব কাজকর্ম করেন, নাকি?”

“আসলে আমরা পুরোপুরি কম্পিউটারাইজড হই নি,” বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল বললো। “বলতে পারেন সেমি-কম্পিউটারাইজড। এখনও অনেক কিছু হয় কাগজে কলমে।”

জেফরি বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। বেশিরভাগ বয়স্ক লোকের মতো বিশ্বজিৎ সন্ন্যালেরও কম্পিউটারের ব্যাপারে এক ধরণের অনীহা আছে। নতুন করে কিছু শেখার ব্যাপারে পঞ্চাশোর্ধ লোকজনের অনাগ্রহ একটু বেশিই থাকে।

চট করে জামানের দিকে ফিরলো জেফরি । “আচ্ছা, হাসানের ডেস্কটার চাবি নিশ্চয় ওর পকেটে ছিলো?”

“জি, স্যার,” কাছে এগিয়ে এসে বললো সে। “উনার পকেটে যেসব জিনিস ছিলো তার মধ্যে একগোছা চাবিও আছে। খুব সম্ভবত এই ডেস্কের চাবিই হবে।”

“চাবিটা তোমার সাথে আছে?”

“জি, স্যার।”

সন্ন্যাল বাবুর দিকে ফিরলো জেফরি ।

“এই ডেস্কটার ড্রয়ারগুলো খুলে একটু চেক করতে হবে। এই কম্পিউটারটাও ওপেন করে দেখতে চাই।”

বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল কয়েক মুহূর্ত ভেবে জবাব দিলো, “অফিশিয়াল ডকুমেন্ট আছে…প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অনুমতি নিয়ে করলে ভালো হতো না?”

জেফরি মুচকি হাসলো। “মি: সন্ন্যাল, অরুণদা আপনাকে বলেছে ফুললি কো-অপারেট করতে…সুতরাং ধরে নিন উনার অনুমতি আছে।”

সন্ন্যাল বাবু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।

“জামান,” সহকারীর দিকে ফিরলো জেফরি । “চেক করো।”

কাজে লেগে গেলো জামান।

বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে জেফরি বেগ আস্তে করে হাসানের ডেস্কের পেছনে যে জানালাটা আছে সেখানে চলে এলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো খেলার মাঠটা বিরান পড়ে আছে। অন্য দিন হলে হয়তো ছাত্রছাত্রিরা খেলায় মেতে থাকতো। কিন্তু খুনের মতো ঘটনা ঘটে। যাওয়াতে স্কুলের পরিবেশ একটু থমথমে।

অন্যসব মিশনারি আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মতো সেন্ট অগাস্টিনেও একটি বাস্কেটবল কোর্ট আছে। একটু স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লো জেফরি বেগ। সেন্ট গ্রেগোরিজ স্কুলের বাস্কেটবল কোর্টে কতো দাপাদাপি করেছে। কতো বিকেল কাটিয়ে দিয়েছে বাস্কেটবল খেলতে খেলতে । তখন দু’চোখে স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে একদিন ম্যাজিক জনসন হবে। শৈশবে অনেক কিছুই হতে ইচ্ছে করে। যতো বড় হতে থাকে ততোই অপশন কমতে থাকে। এক পর্যায়ে এটা সর্বনিম্নে চলে যায়। মুচকি হাসলো সে।

“আপনারা দেখতে থাকুন, আমি একটু টয়লেট থেকে আসি।”

বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের কথাটা শুনে জেফরি জানালা থেকে ফিরে তাকালো । মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

সন্ন্যাল বাবু একটা ফাইল কেবিনেটের পাশে ছোট্ট দরজা খুলে ঢুকে পড়লো । ঘরে ঢোকার পর এর আগে এই দরজাটা জেফরির চোখেই পড়ে নি ।

একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো টয়লেটের দরজার দিকে, কিন্তু জানে না কেন।

ড্রয়ারটা চেক করার পর জামান এখন কম্পিউটার ওপেন করে দেখছে। সেও ব্যাপারটা খেয়াল করলো । চেয়ে রইলো টয়লেটের দরজার দিকে।

“স্যার?”

জেফরি অনেকটা সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো জামানের দিকে। “এখানে অ্যাটাচড টয়লেট আছে দেখছি।”

জামান আবারো টয়লেটের দরজার দিকে তাকালো। “জি, স্যার।”

“হাসান এখান থেকে পাঁচটা বাজার পর পরই অফিসের কাজ শেষ করে চলে যায়। অবশ্য সে স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে যেতে পারে নি…নীচের টয়লেটের একটি কিউবিকলে তাকে হত্যা করা হয়, তাই না?”

“জি, স্যার,” জামানও কৌতূহলী হয়ে উঠলো। সে বুঝতে পারছে তার বসের চোখে কিছু একটা ধরা পড়েছে।

“হাসান সাহেব নীচের টয়লেটে কেন গেলো?”

জামান সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ধরতে পারলো । যার নিজের অফিসে অ্যাটাচড টয়লেট আছে সে কেন অফিস থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হবার পর নীচ তলার কমন টয়লেট ব্যবহার করতে যাবে?

“বুঝতে পেরেছি, স্যার,” বললো জামান। কম্পিউটারটা শাট-ডাউন করে দিলো সে। স্কুলের ডকুমেন্ট ছাড়া তেমন কিছু নেই।

“হাসান সাহেব নীচের টয়লেটে কেন গেলো?”

কম্পিউটার ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়ালো জামান। “জি, স্যার। তার তো নীচের টয়লেটে যাবার কোনো দরকারই ছিলো না।”

“কিন্তু সে গেছে,” কথাটা বলেই কপালের বাম পাশটা চুলকালো জেফরি । “আর সেটাই হয়েছে তার জন্যে কাল।”

টয়লেটের দরজা খুলে গেলে বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল বেরিয়ে এলো।

“মি: সন্ন্যাল, জেফরি বললো। “ঐদিন হাসান যখন অফিসের কাজ শেষ করে চলে গেলো তার দশ মিনিট আগে সে কি করেছিলো, আপনার মনে আছে?”

বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল একটু মনে করার চেষ্টা করলো। বুঝতে পারলো জেফরি, বয়সকালে লোকটির স্মৃতিশক্তি হয়তো কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। “সব কিছু গোছগাছ করলো…কম্পিউটারটা অফ করলো…আর যেনো কী করলো…?” স্মৃতি হাতরে বলতে লাগলো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল।

“হাসান কি অফিস থেকে চলে যাবার আগে টয়লেট ব্যবহার করেছিলো?” প্রশ্নটা করলো জামান।

“হ্যাঁ।”

জামান আর জেফরি একে অন্যের দিকে তাকালো। কিন্তু বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল বুঝতে পারলো না টয়লেট ব্যবহার করার কথা শুনে এই দুই ইনভেস্টিগেটর ইঙ্গিতপুর্ণভাবে দৃষ্টি বিনিময় করছে কেন।

“আমিও অফিস থেকে বের হবার আগে সব সময় টয়লেট সেরে বের হই…হাসানও তাই করতো,” কথাটা বলে ভদ্রলোক অনেকটা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

“সেটাই তো স্বাভাবিক,” বললো জেফরি বেগ ।

“তাহলে জিজ্ঞেস করলেন যে?” বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল এখনও বুঝতে পারছে

“মি: সন্ন্যাল, হাসান নীচের টয়লেটের ভেতরে খুন হয়েছে।”

“হ্যাঁ, সেটা তো সবাই জানে।”

“তার মানে সে টয়লেটে গেছিলো…আর ওখানেই তাকে কেউ খুন করে,” জেফরি বললো।

“ওহ্, বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল এবার বুঝতে পারলো ।

“আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপারটা হয়তো অস্বাভাবিক মনে নাও হতে পারে, কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখলে এটা অবশ্যই স্বাভাবিক না।”

“তাই তো মনে হচ্ছে এখন,” অনেকটা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে বললো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল।

“আচ্ছা মি: সন্ন্যাল, ঐ সময়, মানে হাসান যখন অফিস থেকে বের হলো তখন এই কম্পাউন্ডে কতোজন কর্মকর্তা-কর্মচারি ছিলো?”

জামানের প্রশ্নটা শুনে ভদ্রলোক চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। “সেটা তো বলতে পারবো না, তবে মনে হয় না আর কেউ ছিলো।”

“হাসান পাঁচটার পর পরই বের হয়ে থাকলে অনেকেরই তো থাকার কথা, তাই না?” জেফরি জানতে চাইলো।

“পরীক্ষা কিংবা অ্যাডমিশনের সিজন বাদে আমাদের এখানকার কর্মচারিরা সাড়ে চারটার পর থেকে চলে যেতে শুরু করে । হাসান বের হয়েছিলো পাঁচটার পর পর। সুতরাং আমি ছাড়া অন্য কারো থাকার কথা নয়।”

“আচ্ছা,” জেফরি বললো। “তাহলে বাকিরা সবাই সাড়ে চারটার পর পরই চলে যায়?”

“সাড়ে চারটার পর থেকে যাওয়া শুরু করে আর কি…তবে পাঁচটার আগেই সবাই চলে যায়।”

“হাসান সাহেব দেরি করে যেতো?” জামান জানতে চাইলো ।

“না। কাজ না থাকলে সাড়ে চারটার পরই চলে যেতো।”

“তাহলে ঐদিন দেরি করলো কেন?” জেফরি তাদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়লো ।

“ওর কম্পিউটারটায় কী যেনো প্রবলেম হচ্ছিলো, ওটা ঠিক করতে করতে । দেরি হয়ে যায়। তবে অন্য সময় সেও সাড়ে চারটার দিকে চলে যেতো।”

“আর আপনি কয়টার দিকে যান?”

জেফরির প্রশ্নটা শুনে ভদ্রলোক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো । “আমি…মানে, আমি একটু দেরি করেই বাসায় যাই।”

“সেটাই তো জানতে চাচ্ছি…কেন দেরি করে যান?”

একটু যেনো বিব্রত হলো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল। জেফরি লক্ষ্য করলো তার সহকারী জামান ভদ্রলোকের দিকে রীতিমতো সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।– “আপনার কি বলতে অসুবিধা আছে?” জেফরি আস্তে করে বললো তাকে।

“না, বলতে অসুবিধা হবে কেন,” একটু ইতস্তত করলো হেডক্লার্ক। “আসলে এমনি এমনি আমি দেরি করে বাসায় ফিরি।” জেফরির সপ্রশ্ন দৃষ্টি দেখে বললো, “আমার স্ত্রী বছরখানেক আগে মারা গেছে, বাড়িতে কেউ নেই। একটা মেয়ে ছিলো, বিয়ে হয়ে গেছে…আগেভাগে বাড়িতে যাবার কোনো তাড়া আমার নেই।”

জেফরি লক্ষ্য করলো জামান খুব আশাহত হয়েছে কথাটা শুনে। সে হয়তো অন্য কিছু শোনার প্রত্যাশা করেছিলো। অবশ্য সে নিজেও যে কিছুটা আশাহত হয়েছে সেটা প্রকাশ করলো না।

“আচ্ছা, ঠিক আছে,” অনেকটা আপন মনে বললো জেফরি বেগ। বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে। “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

“ঠিক আছে,” বললো বিশ্বজিৎ সন্ন্যাল।

জামানকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

অধ্যায় ৯

সেন্ট অগাস্টিনের জুনিয়র ক্লার্ক হাসানের লাশ দাফন হবার পরদিন তার বাড়িতে গেলো জেফরি বেগ আর জামান। ইচ্ছে করেই একটু দেরিতে যাওয়ার কারণ, হাসানের অল্পবয়সী স্ত্রীর শোক যেনো কিছুটা প্রশমিত হয়ে আসে। কিন্তু নিহতের বাড়িতে এসে বুঝতে পারলো দু’তিন দিনে শোকের প্রকোপ তেমন একটা কমে নি।

হাসানের স্ত্রী মলির বয়স আনুমানিক একুশ কি বাইশ হবে। মাত্র দু’বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর রাজশাহীতেই ছিলো, ঢাকায় এসেছে তিন মাস আগে। মলির এক ছোটো ভাই লিটুও থাকে তাদের সাথে । মলি, হাসান আর লিটু-এই ছিলো তাদের পরিবার। এখানে আসার আগেই সহকারী জামানের কাছ থেকে এসব তথ্য জেনে নিয়েছে জেফরি বেগ ।

আরামবাগের অলিগলির ভেতরে একটা চার তলা বাড়ির দোতলায় ছোটো ছোটো দুটো ঘর নিয়ে থাকে তারা। প্রতি তলায় দুটো করে ইউনিট। একটা বড়, অন্যটা ছোটো । সিঁড়ি দিয়ে উঠলে হাতের ডান দিকের ছোটো ইউনিটটি হাসানের।

জেফরি আর জামান বসে আছে লিটু নামের ছেলেটির ঘরে, কারণ এদের কোনো ড্রইংরুম নেই। সবেমাত্র ঢাকার একটি সরকারী কলেজে ভর্তি হওয়া লিটু ঘরের এককোণে চুপচাপ বসে আছে। তার পাশে আছে তার বৃদ্ধ বাবা।

ভদ্রলোক একজন স্কুল শিক্ষক। মেয়ের এই সর্বনাশের কথা শুনে রাজশাহী থেকে ছুটে এসেছেন। জেফরিকে বার বার বলে যাচ্ছেন, কে এমন ঘটনা ঘটালো? এরকম নিরীহ একটা ছেলেকে কে খুন করলো? যে এরকম জঘন্য কাজ করেছে আল্লাহ্ তার বিচার করবে।

জেফরি আর জামান অপেক্ষা করছে হাসানের স্ত্রী মলির জন্য । এইমাত্র তাকে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো চলে আসবে।

জেফরি শুরু করলো লিটুকে দিয়ে।

“হাসান সাহেবের সাথে কারো কোনো সমস্যা ছিলো?” একেবারেই সহজ আর সাদামাটা প্রশ্ন।

“না। ভায়ের সাথে কারো কোনো সমস্যা ছিলো না,” ছেলেটা বিমর্ষ চোখেই জবাব দিলো ।

জেফরি বুঝতে পারলো লিটু তার বোন জামাইকে ভাই বলে সম্বোধন করে। দুলাভাই বলার রেওয়াজ কি তাহলে কমে আসছে? যাইহোক চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে পরের প্রশ্ন করলো।

“তোমরা তো এখানে এসেছো দু’তিন মাস হবে, তাই না?”

“জি, ভাই আর আপা এসেছে তিন মাস আগে…আমি এসেছি দু’মাস হলো।”

“তার আগে হাসান সাহেব কোথায় থাকতেন?”

“পুরানা পল্টনের একটা মেসে,” বললো লিটু ।

“তুমি জায়গাটা চেনো?”

“জি, আমি বেশ কয়েকবার ওখানে গেছি।”

জামানের দিকে ফিরে বললো জেফরি, “ওর কাছ থেকে ঠিকানাটা নিয়ে নাও। এটা আমাদের দরকার হতে পারে।”

হাসানের শ্বশুর, বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক পিটপিট করে চশমার ভারি কাঁচের ভেতর দিয়ে জেফরিকে দেখে যাচ্ছেন ।

“আচ্ছা, স্যার, জেফরি এবার হাসানের শ্বশুরকে বললো, “হাসান তো আপনার এলাকারই ছেলে ছিলো, তাই না?”

“আমার আপন ফুপাতো বোনের ছেলে, ওদের বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামেই,” বৃদ্ধ বেশ স্পষ্ট উচ্চারণে কথাগুলো বললেন।

“ও,” জেফরি একটু ভেবে আবার বললো, “গ্রামে কি তার কোনো শত্রু ছিলো?” যদিও জানে গ্রামের শত্রু ঢাকা শহরের সেন্ট অগাস্টিনের মতো স্কুলে এসে হাসানকে খুন করার কথা স্বপ্নেও ভাববে না, তারপরও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে। সবগুলো সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা দরকার।

“না। মলি ঢাকায় আসার আগে মাসে-দুমাসে দুএকদিনের জন্য গ্রামে যেতো হাসান কিন্তু ঘর থেকে বেরই হতো না। সারাদিন বাড়িতেই থাকতো । তাছাড়া ও ছিলো শান্তশিষ্ট একটা ছেলে । কারো সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ হয়েছে এরকম কথা কখনও শুনি নি।”

জেফরি আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। এরা থাকে রাজশাহীতে। হাসানের ব্যাপারে তেমন তথ্য দিতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো। এখানে আসার পর পনেরো মিনিট পার হয়ে গেছে। হাসানের স্ত্রী মলির এখনও দেখা নেই।

লিটুকে কিছু বলতে যাবে অমনি দরজা দিয়ে আস্তে করে অল্পবয়সী এক মেয়ে ঘরে ঢুকলো। সালোয়ার-কামিজ পরা। মাথায় ওড়না দিয়ে রেখেছে। চোখমুখ এখনও ফোলা ফোলা। চেহারা দেখেই বোঝা যায় স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে অবিরাম কেঁদে চলেছে। মেয়েটাকে দেখে জেফরির খুব মায়া হলো । এতো অল্প বয়সে স্বামীহারা হতে হয়েছে তাকে।

জেফরিকে সালাম দিলো মলি। লিটু নামের ছেলেটা উঠে তার বোনকে বসতে দিলো নিজের চেয়ারে। ঘরে আর কোনো চেয়ার নেই। লিটু ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ ।

জেফরি লক্ষ্য করলো বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক সদ্য বিধবা হওয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ।

“আপনার মানসিক অবস্থা কেমন সেটা আমরা জানি, কিন্তু খুনটার তদন্ত করতে হলে আপনার সাথে কথা বলতেই হবে, না বলে উপায় নেই। জানি এ মুহূর্তে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে আপনার ভালোও লাগবে না। তবে আমাদেরকে যদি সহযোগীতা করেন, হাসান সাহেবের হত্যাকারীদের ধরতে খুব সাহায্যে আসবে।”

মলি ফোলা ফোলা চোখে তাকালো জেফরির দিকে। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও মেয়েটা দেখতে ভারি মিষ্টি। এখনও চোখেমুখে সরলতার ছাপ মুছে যায় নি। “আপনার যা জিজ্ঞেস করার বলেন, আমি চেষ্টা করবো জবাব দিতে,” আস্তে করে বললো সে। নিজের শোককে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলো যেনো।

“ধন্যবাদ,” কথাটা বলেই জেফরি একটু থেমে আবার বলতে লাগলো, “এই খুনের ব্যাপারে আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?”

মলি চেয়ে রইলো জেফরির দিকে। “না। সন্দেহ করার মতো কেউ নেই। এরকম কিছু ঘটেও নি। ও খুবই নিরীহ একটা ছেলে ছিলো।”

“পরিচিত কেউ, কিংবা বন্ধুবান্ধবের সাথে ঝামেলার কথা জানেন?”

“না,” দুপাশে মাথা দুলিয়ে বললো মলি । “ওর তো কোনো বন্ধুই ছিলো না।”

আজব কথা, ভাবলো জেফরি বেগ। ঢাকা শহরে একটা ছেলে চাকরিবাকরি করে, বউ নিয়ে সংসার করে, তার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই? যেখানে সে চাকরি করতো সেই স্কুলেও তার কোনো ঘনিষ্ঠ কলিগ নেই। অদ্ভুত!

“ঐ দিন কি হাসান সাহেবের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছিলেন?”

মলি একটু ভেবে জবাব দিলো। “খুব টেনশনে ছিলো।”

“কি জন্যে?”

“ওর কিছু শেয়ার ছিলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোবাইলফোনে শেয়ার মার্কেটের খোঁজখবর নিতো সব সময়। ঐদিনও তাই করেছিলো । ওর শেয়ারের দাম নাকি অনেক পড়ে গেছে, তাই খুব দুশ্চিন্তায় ছিলো সকাল থেকেই।”

আশাহত হলো জেফরি । বিশ্বজিৎ সন্ন্যালও একই তথ্য দিয়েছে।

“সকালে স্কুলে চলে যাবার পর আপনার সাথে তার কোনো কথা হয় নি?”

“হয়েছে,” আস্তে করে কথাটা বলেই স্কুল শিক্ষক বাবার দিকে আড়চোখে তাকালো। “দুপুরের খাবারের সময় আমি ফোন করেছিলাম।”

“কেন ফোন করেছিলেন?”

মাথা নীচু করে বললো, “লাঞ্চ করেছে কিনা জানতে।”

“ও।”

“হাসান সাহেবের সাথে পরিচয় ছিলো, মানে কথাবার্তা হতো এমন কারোর কথা কি জানেন?” জেফরিকে চুপ থাকতে দেখে জামান প্রশ্নটা করলো ।

“না।” ছোট্ট করে জবাব দিলো মলি ।

“আমি যতোটুকু জানি, হাসান ঢাকা শহরে কারো সাথে মিশতো না । অফিস থেকে বাড়ি চলে আসতো সোজা,” কথাটা বললেন হাসান সাহেবের শ্বশুর।

“জি, আব্বা ঠিকই বলেছেন,” ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা লিটু সমর্থন করলো তার বাবাকে।

“আড্ডাবাজি তো দূরের কথা, ছেলেটা এমন কি বিড়ি-সিগারেটও খেতো না,” স্কুল শিক্ষক শ্বশুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।

কথাটা শুনে চেয়ে থাকলো জামান। জেফরিও কিছু একটা ধরতে পেরে জামানের দিকে তাকালো ।

“হাসান সাহেবের পকেটে যেসব জিনিস পেয়েছে তার মধ্যে একটা লাইটার ছিলো না?” জেফরির কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান।

“আপনি নিশ্চিত, হাসান সাহেব স্মোকার ছিলেন না?”

বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষকের হয়ে জবাবটা দিলো মলি। “না । ও সিগারেট খেতো না।”

“তাহলে পকেটে লাইটার ছিলো কেন?”

জেফরির এ কথায় কেউ কোনো জবাব দিলো না।

“ব্যাপারটা কেমন জানি হয়ে গেলো না,” সবার দিকে তাকিয়ে বললো জেফরি । “যে লোক সিগারেট খায় না তার পকেটে লাইটার কেন থাকবে!”

“কিরে মা, জামাই কি মাঝেমধ্যে সিগারেট খেতো নাকি?”

বাবার প্রশ্নে মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো মলি। “খেতো না, বাবা। তবে…”

“তবে কি?” জেফরি বললো।

“ঢাকায় আসার পর একদিন বুঝলাম টয়লেটে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায়। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে একটু কাচুমাচু খেয়ে আমাকে বলে মাঝেমধ্যে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে করলে দুএকটা খায়…কিন্তু নিয়মিত না।”

“আচ্ছা,” বললো ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। “তাহলে মাঝেমধ্যে সিগারেট খেতেন?”

“না। ওই ঘটনার পর আমি খুব নিষেধ করি তাকে…আমাকে কথা দেয় আর কখনও সিগারেট খাবে না । তারপর থেকে কোনোদিন সিগারেট খেতে দেখি নি।”

কপালের বাম পাশটা চুলকালো জেফরি বেগ। জামান জানে, এর মানে তার বস্ বুঝতে পারছে না এরপর কী বলবে । তার কাছেও এই কেসটা কেমন জানি দুর্বোধ্য ঠেকছে। হাসান নামের নিরীহ গোবেচারা একজনকে সেন্ট অগাস্টিনের মতো অভিজাত স্কুলের ভেতর কে বা কারা খুন করতে গেলো-জামান অনেক ভেবেছে, কোনো সম্ভাব্য উত্তরও তার মাথায় আসে নি । হাইপোথেটিক্যালি কিছু দাঁড় করাতেও ব্যর্থ হয়েছে সে। তার ধারনা, জেফরি বেগের অবস্থাও তার মতোই।

তবে জামানের এই ভাবনাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। জেফরি বেগের অবস্থা তারচেয়ে খারাপ । এই কেসের ব্যাপারে একটা সামান্য কু হাতে পেয়েছিলো বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের অফিস ঘরের টয়লেটটা দেখতে পেয়ে । ভেবেছিলো এটা নিয়ে কাজ করলে অনেক কিছু বের করা যাবে । কেন একজন লোক নিজের অফিসের অ্যাটাচড টয়লেট থাকার পরও সাধারণ ছাত্রছাত্রিদের টয়লেটে যাবে-এই প্রশ্নের উত্তর পেলে হয়তো অনেক কিছু জানা যেতো। সেই উত্তরটা এখন পেয়ে গেছে। আর সেটাই তাকে হতাশায় ডুবিয়ে দিচ্ছে। কারণ, সেন্ট অগাস্টিনের টয়লেটে একটা আধ খাওয়া সিগারেটের টুকরো পেয়েছিলো তারা। এভিডেন্স হিসেবে সেটা জব্দ করা হয়েছে। জেফরি এখন প্রায় নিশ্চিত, হাসান নামের ক্লার্ক ছেলেটি সিগারেট খাওয়ার জন্যেই নীচের ঐ টয়লেটে গেছিলো। এর মধ্যে আর কোনো রহস্য নেই। জটিলতা নেই।

“স্যার?”

জামানের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো সে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।

“তাহলে কি হাসান সাহেব সিগারেট খাওয়ার জন্যই নীচের টয়লেটে গেছিলেন?”

জামানের প্রশ্নটা শুনে জেফরি খুশিই হলো । তার এই সহকারী বেশ উন্নতি করেছে। ঠিক তার মতো করেই ভাবতে পারে এখন। এই হতাশার মধ্যে এটাই একমাত্র আশার কথা ।

“হুম…তাই তো মনে হচ্ছে,” মলি আর তার বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো তারা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। “সন্ন্যাল বাবু অনেক সিনিয়র মানুষ, সরাসরি তার বস, সেজন্যে হয়তো হাসান সাহেব নীচের টয়লেটে গেছিলেন সিগারেট খেতে…”।

“ও লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেতো!” বিস্ময়ে বললো মলি। “আমি বিশ্বাস করি না।”

“ভুলে যাবেন না, উনার পকেট থেকে একটা লাইটার পাওয়া গেছে,” বললো জামান। “উনি হয়তো লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝেমধ্যে দুএকটা সিগারেট খেতেন?”

“না। আমার তা মনে হয় না।”

মলির দৃঢ়তায় অবাক হলো জেফরি । “কেন মনে হচ্ছে না, আপনার?”

“কারণ ও আমার মাথা ছুঁয়ে কসম খেয়েছিলো আর সিগারেট খাবে না।”

জেফরি কী বলবে বুঝতে পারলো না। সে নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটু আধটু সিগারেট খেতো, রেবা একদম পছন্দ করতো না। সিগারেটের গন্ধ তার কাছে অসহ্য লাগতো। রেবা তাকে দিয়ে কম করে হলেও পঞ্চাশ বার কসম খাইয়েছে সিগারেট ছাড়ার জন্য কিন্তু সে লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিকই খেতো। শুধু গভীরভাবে চুমু খাওয়ার সময় ধরা পড়ে যেতো রেবার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতো তাকে। আবার নতুন করে প্রতীজ্ঞা করার খেলা শুরু হতো। সিগারেট সে ঠিকই ছেড়েছিলো তবে সেটা রেবার কারণে নয়। মৃত্যুশয্যায় ফাদার যেদিন তার হাত ধরে বললো এই ফালতু জিনিসটা কি না খেলেই নয়, সেদিন থেকে আর সিগারেট খায় নি জেফরি ।

মলির গভীর বিশ্বাস, তার মাথা ছুঁয়ে যেহেতু কসম খেয়েছে তাই হাসানের পক্ষে সিগারেট খাওয়া একেবারেই অসম্ভব । মেয়েটার সরলতায় মুগ্ধ হলো সে। কিন্তু জেফরি জানে, বেশিরভাগ পুরুষ মানুষ এরকম প্রতীজ্ঞা ভাঙতে বিন্দুমাত্রও পরোয়া করে না ।

“তবে আমি নিশ্চিত, হাসান সাহেব মাঝেমধ্যে সিগারেট খেতেন।”

জেফরির কথাটা শুনে মাথা দোলাতে লাগলো মলি । সে কোনোভাবেই এটা বিশ্বাস করতে পারছে না।

ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা লিটু তার বোনকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আপা, উনি ঠিকই বলেছেন । ভাইয়া মাঝেমধ্যে সিগারেট খেতেন।”

একটু বিস্মিত হলো মলি। “তুই জানলি কি করে?”

“ছাদে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেতেন ভাইয়া । আমি কয়েকবার দেখেছি। আমাকে দিয়েও একবার সিগারেট আনিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের মিলন সাহেবের সাথে সিগারেট খেয়েছিলেন।”

“এ কথা আমাকে কেন বলিস নি?”

“ভাইয়া বলেছিলেন কথাটা যেনো তোমাকে না বলি…” লিটু অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে ফেললো।

“ওয়েট অ্যা মিনিট, জেফরি বেগ বললো লিটুকে ।

“তুমি হাসান সাহেবকে পাশের ফ্ল্যাটের মিলন নামের একজনের সাথে সিগারেট খেতে দেখেছিলে?”

“জি,” মুখ তুলে বললো লিটু।

“তার মানে ঐ মিলনের সাথে হাসান সাহেবের ভালোই খাতির ছিলো?”

“ইয়ে মানে, খাতির ছিলো কিনা জানি না, তবে দুএকবার উনার সাথে ভাইয়াকে সিগারেট খেতে দেখেছি, কথাবার্তা বলতেও দেখেছি…”

“কিন্তু আমি তো কখনও দেখি নি,” অবাক হয়ে বললো মলি ।

লিটু কিছু বললো না।

“তুমি বলেছো, এখানে তুমি এসেছো দু’মাস আগে…তাহলে এটা কবে দেখেছো?”

“আমি আসার পর পরই।”

“তুই কি ঠিক বলছিস?” মলি জানতে চাইলো তার ভায়ের কাছে। “আমি তো কখনও দেখি নি মিলন সাহেবের সাথে কথা বলতে।”

“আমিও খুব একটা দেখি নি…বললাম না, ছাদে দুএকবার দেখেছি…ভাইয়ার সাথে সিগারেট খেতে খেতে কী নিয়ে যেনো কথা বলছিলো।”

“কী জানি, আমি এসবের কিছু জানি না। হাসান আমাকে কখনও বলে নি । ও কখনও ছাদে গেছে কিনা তাও আমি জানি না।”

ব্যাপারটা জেফরি বুঝতে পারলো । হাসান সাহেব লুকিয়ে লুকিয়ে যেহেতু সিগারেট খেতেন তাই এই ব্যাপারটা মলিকে বলেন নি।

“আচ্ছা, ঐ মিলন সাহেব কি বাসায় আছেন?” প্রশ্নটা করলো লিটুকে।

“তা তো বলতে পারবো না । দুএকদিন ধরে তাকে দেখি নি। অবশ্য মাঝেমধ্যেই তিনি ঢাকার বাইরে যান।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমরা তাহলে আজ উঠি,” কথাটা বলেই জেফরি উঠে দাঁড়ালো। “পরে কখনও দরকার পড়লে আবার আসবো।”

হাসান সাহেবের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো জেফরি ।

“এটাই তো মিলন সাহেবের ফ্ল্যাট, তাই না?” পাশের ফ্ল্যাটের দরজা দেখিয়ে জামানকে বললো সে।

“জি, স্যার…ওরা তো তাই বললো।”

“ভদ্রলোক আছে কিনা দেখি…”

মিলন সাহেবের দরজায় কোনো কলিংবেল নেই তাই টোকা দিলো জেফরি । বেশ কয়েক বার টোকা দেবার পরও কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না। অথচ ভেতরে মানুষজন আছে এটা নিশ্চিত, কারণ চড়া ভলিউমে হিন্দি সিনেমার গান বাজছে ।

জামান এগিয়ে এসে দরজায় বেশ কয়েক বার জোরে জোরে ধাক্কা দিলে ভেতর থেকে একটা নারী কণ্ঠ বাজখাই গলায় জবাব দিলো এবার : “কে?!”

জামান আবারো জোরে জোরে ধাক্কা দিলো ।

“আরে গেট তো দেহি ভাইঙ্গা হালাইবো!” বাজখাই নারী কণ্ঠটা রেগেমেগে বললো। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ করে খুলে গেলো দরজাটা।

প্রথমেই নজরে পড়লো মহিলার বিশাল বক্ষ। সালোয়ার-কামিজ পরে থাকলেও বুকে ওড়না নেই । বেশ নাদুসনুদুস শরীরের মহিলা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভুরু কুচকে ।

জেফরি আর জামানকে আপাদমস্তক দেখার পর মহিলার ভাবভঙ্গি পাল্টে গেলো । চোখেমুখে ফুটে উঠলো অদ্ভুত এক ভঙ্গি।

“কি চাই?” কথাটা টেনে টেনে বললো মহিলা।

“মিলন সাহেব বাসায় আছেন?” বললো জামান।

মহিলা একবার জামানের দিকে আরেকবার জেফরির দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। “মিলন সাহেব!” কথাটা বলেই শরীর দোলাতে লাগলো । “হেরে চাইতাছেন?”

“জি।”

“ক্যান?”

“একটু দরকার ছিলো।”

“আমারে কওন যায় না?”

মহিলার ভাবভঙ্গি দেখে জেফরির মনে হলো খুব একটা সুবিধার নয়। দু দু’জন অপরিচিত পুরুষ মানুষের সামনে বিশাল বক্ষা উঁচিয়ে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলছে ।

“আপনি মিলন সাহেবের কি হন?”

“বউ!” কথাটা এমনভাবে বললো যেনো বাতাসে কিছু ফুঁ দিলো।

“ও,” বললো জামান।

“ও কি?” মহিলার ভাবভঙ্গি জেফরি আর জামানের জন্য খুবই বিব্রতকর ঠেকছে এখন।

“কিছু না…মিলন সাহেবের সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম…উনি কি বাড়িতে আছেন?” দ্রুত বললো জামান।

“নাই,” মহিলা শরীর দুলিয়ে জবাব দিলো, কিন্তু তার চোখের পলক পড়ছে না। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে জেফরি আর জামানের দিকে।

“কে এসেছে, আপা?” ভেতর থেকে আরেকটা মেয়েলী কণ্ঠ বলে উঠলো। তবে এই কণ্ঠটা শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে।

মিলনের স্ত্রী পেছন ফিরে বাজখাই গলায় জবাব দিলো, “আমি কার লগে কথা কই তা দিয়া তুমার কাম কি…” তারপর গজগজ করতে করতে চাপাকণ্ঠে বললো, “ব্যাটা মানুষের গন্ধ পাইলে আর হুঁশ থাকে না!”

জেফরি আর জামান মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

খোলা দরজার সামনে এক তরুণীর আবির্ভাব ঘটলো এ সময় । লম্বা ছিপছিপে, বেশ আধুনিক সাজগোজ। জিন্সের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা । তরুণীটি দেখতে বেশ সুন্দরী আর স্মার্ট ।

দরজার কাছে এসে জেফরি আর জামানকে ভালো করে দেখে নিলো সেই তরুণী । দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিলন সাহেবের স্ত্রীকে আমলে না নিয়ে প্রশ্ন করলো, “কাকে চান?”

মিলন সাহেবের স্ত্রী দরজার সামনে থেকে একটু সরে জায়গা করে দিলো তরুণীর জন্য। তবে তার চোখেমুখে বিরক্তি । রাগে গজগজ করছে এখনও। যেনো এই তরুণীর উপস্থিতি সহ্য হচ্ছে না।

এবার জেফরি জবাব দিলো, “মিলন সাহেবকে একটু চাচ্ছিলাম।”

“কোত্থেকে এসেছেন?”

“আপনি কে?” বললো জামান।

“আমি ওর ওয়াইফ।”

“কি?!” অবাক হয়ে বলে উঠলো জামান।

জেফরি দেখতে পেলো, পাশে দাঁড়ানো মিলন সাহেবের স্ত্রী মুখ বেঁকিয়ে অন্য দিকে চেয়ে আছে । থ বনে গেলো জেফরি আর জামান। মিলন সাহেবের স্ত্রী পরিচয় দেয়া মহিলা মুখ বেঁকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেনো বলতে বলতে ভেতরে চলে গেলো।

“আপনিও মিলন সাহেবের স্ত্রী?” জামান বললো তরুণীকে।

“জি।” স্বাভাবিকভাবে বললো তরুণীটি।

“তাহলে উনি যে বললেন…” দরজার ভেতরে ইশারা করলো জামান।

“উনি প্রথমজন…”।

“আপনাদের স্বামী মিলন সাহেব তাহলে বাসায় নেই?” জিজ্ঞেস করলো জামান ।

“না, নেই।”

“উনি কখন ফিরবেন?” জানতে চাইলো জেফরি বেগ।

“ঠিক করে বলতে পারবো না,” কথাটা বলেই পেছন ফিরে ভেতরের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপা, ও কোথায় গেছে তুমি জানো?”

আবার দরজার কাছে চলে এলো মিলনের প্রথম স্ত্রী। তার আগে কন, হেরে ক্যান দরকার?”

সহকারীর দিকে তাকালো জেফরি।

“পাশের ফ্ল্যাটে হাসান সাহেব খুন হয়েছেন, জানেন নিশ্চয়?” বললো জামান।

মিলনের দুই স্ত্রী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ।

“হ, জানি,” প্রথমজন বললো।

“আমরা সেই মার্ডার কেসের তদন্ত করছি…”

“আপনেরা পুলিশ!” একটু ভড়কে গেলো প্রথমজন। দ্বিতীয়জন আস্তে করে ভেতরের ঘরে চলে গেলো।

“জি, পুলিশ,” কথাটা বলেই দাঁত বের করে কৃত্রিমভাবে হাসলো জামান। “আমরা দুজনেই পুলিশ। ইনি আমার স্যার ।”

প্রথমজন জেফরির দিকে হা করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। “মিলনরে ক্যান খুঁজতাছেন?” একটু নরম সুরে জানতে চাইলো অবশেষে।

“উনার সাথে একটু কথা বলতে হবে হাসান সাহেবের কেসের ব্যাপারে,” জামান উত্তর দিলো।

মহিলা একটু চুপ থেকে বললো, “হে তো বাসায় নাই।”

“জি, এটা আমরা এরইমধ্যে জেনে গেছি। এখন বলুন, কখন বাসায় ফিরবেন?”

“কখন ফিরবো সেইটা তো জানি না। কইয়া গেছে ঢাকার বাইরে যাইতাছে। কবে ফিরবো কিছু কয় নাই।”

“উনি কি করেন?” জেফরি জিজ্ঞেস করলো ।

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো মহিলা ।

“আপনার স্বামী মিলন সাহেব কি করেন?” জামান তাড়া দিলো তাকে।

“বিজনিস করে,” বললো মিলনের স্ত্রী ।

“কিসের বিজনেস করে?” একটু রেগে বললো জামান।

“সেইটা তো জানি না,” মহিলা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো জেফরি আর জামানের দিকে।

“হোয়াট!” জামান ফিরে তাকালো তার বস্ জেফরি বেগের দিকে ।

এই স্টুপিড মহিলা বলে কী! নিজের স্বামী কি করে সেটা জানে না! আজব! এমন কথা কেউ বাপের জনমে শুনেছে?

“বিশ্বাস করেন, আসলেই জানি না হে কি করে।”

জামান আবারো তাকালো তার বসের দিকে। তাকে হাত তুলে থামিয়ে জেফরি বেগ মহিলাকে বললো, “আচ্ছা, ঠিক আছে, আপনার স্বামীর ফোন নাম্বারটা আমাদেরকে দিন।”

ঢোক গিললো মিলনের স্ত্রী।

মহিলার এমন আচরণে জামান অধৈর্য হয়ে বললো, “আপনি নিশ্চয় বলবেন না, হাজবেন্ডের ফোন নাম্বারটাও আপনার কাছে নেই?”

ঢোক গিলে বললো মহিলা। “নাই তো?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *