৫. কলকাতার বাঙালি

কলকাতার বাঙালি

কলকাতার বাঙালিবাবুর গল্প বলার আগে একটা বিলেতি গল্প বলে নিই। এক স্কচ লন্ডনে গেছেন। উদ্দেশ্য: ব্যবসা এবং শহর দেখা দুই-ই। ফিরে আসামাত্র পাড়া-পড়শিরা সব ছেঁকে ধরল, হ্যাঁ ভাই, লন্ডন কেমন দেখলে? ইংরেজরা সব লোক কেমন? স্কচদের মতো কি? ভদ্রলোক চমকে উঠলেন প্রশ্ন শুনে, ‘তাই তো, লন্ডন তো ভালই দেখেছি, কিন্তু ইংরেজ তো চোখে পড়েনি। কথাবার্তা যাদের সঙ্গে হয়েছে, তারা তো সব ব্যবসায়ী।’

কলকাতার বাঙালিও তাই। অন্তত অষ্টাদশ শতকে তাই ছিল। সুতরাং আগেই বলে রাখি, এখানে কলকাতার বাঙালির এই গল্প বঙ্গদেশের বাঙালি নামক জাতির গল্প নয়।

রামমোহন বাঙালিকে ভাগ করেছিলেন তিনটে শ্রেণীতে। এক: পেঁয়ো বাঙালি বা রাজনারায়ণ বসুর ভট্টাচার্য বাঙালি। সমস্ত ‘বুনো রামনাথেরা’ এই শ্রেণীতে পড়ে। গিন্নি উতলানো ডালকে সামান্য ক’ ফোঁটা তেলে বশ মানাতে পারেন দেখে এঁরা, গল-লগ্নীকৃতবাসা হইয়া করজোড়ে ব্রাহ্মণীকে বলেন: কে তুমি আমার গৃহে অধিষ্ঠিতা? বল, অবশ্য কোনও দেবী হইবে। দ্বিতীয় শ্রেণী: কর্মজীবী বাঙালি৷ এঁরা সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী এবং উকিল-মোক্তার, মুনসি প্রভৃতি। এঁরা কোম্পানির কিংবা তস্য কর্মচারীদের হাউসে কিংবা দেশি জমিদারের কাছে চাকরি করেন। এঁদের কাছে পথ এবং বিপথ, ধর্ম এবং অধর্ম সমান। রামমোহন এঁদের সমর্থনে বলেছেন, ‘অন্য কোনও পথে জীবিকা সংস্থান করতে না পেরেই এঁরা এমনিভাবে চলতে বাধ্য হন।’ এঁদের বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে আর একটি শ্রেণী। রামমোহনের সমাজ-বিন্যাসে তাঁরা বাঙালিকুলে দ্বিতীয়। আমার বর্তনান হিসাবে তৃতীয়। এঁরা শহুরে বাঙালি।

‘হুতোম’ অনুযায়ী এই শহরে বাঙালিকে আবার ভাগ করতে পারি আমরা চার ভাগে: ১। বড়মানুষ, ২। দালাল ও মোসাহেব, ৩। বেকার জয়কেতু, এবং ৪। শিল্পী বা বাইজি, খেমটাওয়ালি, কবি, যাত্রাওয়ালা, বৈষ্ণব, গোঁসাই পুরুত প্রভৃতি। তার বাইরে অবশ্য রয়েছে কৃষক, শ্রমিক, কারিগর,—এক কথায় গ্রামবাসী বিরাট বাঙালি সমাজ। তাঁরা নন, আলোচ্য এখানে শহুরে বাঙালি।

হুতোম থেকেই এই চার শ্রেণীর পরিচয় নেওয়া ভাল। প্রথমে ধরুন বড়মানুষের কথা। কীভাবে তাঁরা বড় হলেন, তা আমরা সন্ধান করব না। কারণ শাস্ত্রে বলে বীর, নদী এবং নারীর উৎস সন্ধান করতে নেই। কলকাতার বড়মানুষেরা যথার্থই বড়, এবং সেই অর্থে বীরতুল্য। সুতরাং সেইদিকে দৃষ্টি না দেওয়াই ভাল। হুতোম অবশ্য দিয়েছেন। কিন্তু আমরা দেব না। কারণ ‘ভালুকের নোম বেছে’ নিজেদের বড় হওয়ার কাহিনী শুনতে আমাদের ভাল লাগে না। আমরা শুধু শুনব: তাঁরা গোলাপ-জলে জল-শৌচ করতেন, ঢাকাই কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে পরতেন। বলা বাহুল্য, পাছে কোমরের কোমল চর্মে জরির পাড়ের চোট লাগে, তাই এই ব্যবস্থা। হাটখোলার দত্ত বংশের তনুবাবু নাকি এজন্যে বিলক্ষণ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তনুবাবু অবশ্য একমাত্র বাবু ছিলেন না। আরও সাতজন ছিলেন প্রায় সমপর্যায়ের। আটজনে মিলে তাঁরা ছিলেন ‘আটুবাবু’। এঁরা মুক্তাভস্ম দিয়ে পান খান, কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করেন, যাত্রায় নোট ছছাড়েন, গায়ে তেল মেখে ভেঁপু বাজিয়ে চার ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে স্নান করতে যান। আজ্ঞা-হুজুর উঁচু গদি, কার্তিকের মতো বাউরিকাটা চুল, এক পাল বরাখুরে মোসাহেব, রক্ষিতা বেশ্যা পোষেন। এঁরাই সমাজের রক্ষক, বারোয়ারি বা বার-ইয়ারি পুজোর প্রধান পেট্রন, শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। হুতোমের মতে: ইংল্যান্ডের কুইন এলিজাবেথের আমলে যেমন কবি ও গ্রন্থকর্তা জন্মায়, তাঁর আমলে (অর্থাৎ রাজা নবকৃষ্ণ প্রভৃতির আমলে) তেমনই রাম বসু, হরু, নিলু, রামপ্রসাদ ঠাকুর ও জগা প্রভৃতি কবি জন্মায়। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার রিফর্মারও ছিলেন বটে। রামমোহন তখনও দেখা দেননি। তার আগেই বাগবাজারে ‘রামমোহন’ হয়ে উঠলেন একজন। তিনি শিবচন্দ্র ঠাকুর। শিবচন্দ্র বাগবাজারের রামমোহন, কেননা পক্ষীর দল গড়ে তিনি বাগবাজারেদের উড়তে শেখান। তাঁর আটচালায় বাগবাজারের ছেলেরা পক্ষী হত, উড়ত।

বড়মানুষদের পরেই দালাল এবং মোসাহেবেরা শহরের দর্শনীয়। দালাল এবং মোসাহেবে পার্থক্য অতি সামান্য। দালালই মোসাহেব, আবার মোসাহেবই দালাল। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য ফেল মেরে কেউ কেউ দালালি ধরেন, আবার কেউ কেউ মোসাহেবি করতে করতে পাকা দালাল বনে যান। এটাকে খুব বড়-রকমের পদোন্নতি ভাববেন না। হুতোমের পদ্মলোচন এর অনেক নিচু থেকে এর চেয়ে অনেক উঁচুতে উঠেছিলেন। পদ্মলোচন প্রথমে ছিলেন বাবুর ফাইফরমাসি বয়। কাপড় কোঁচান, ঠাকুরের অনুপস্থিতিতে লুচি পাকানো ছিল তাঁর কাজ। এ কাজে হাত পাকিয়ে নাম হয় তার ‘মেকার পদ্মলোচন’। মেকার পদ্মলোচন বাবুদের ধরাধরি করতে করতে জনৈক বাবুর আনুকূল্যে প্রথমে নিযুক্ত হন তাঁদের হাউসের ‘শিপ-সরকার’ বা ওজনবাবু। সেখান থেকে ক্রমে সদমমেট, তারপর মুৎসুদ্দি এবং অবশেষে ‘হঠাৎ অবতার’। তবে সকলকেই এই ইভলিউশনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে। এমন নয়, কেউ কেউ বর্ন-ব্রোকার বা জাত-দালাল। কিংবা জাত মুৎসুদ্দি। দু’কাজেই সমান পসার। দালালিতে কাজ সামান্য। কার বাড়ি বিক্রি হবে, কার বাগানের দরকার, কে টাকা ধার করবে তার খবর রাখাই দালালের প্রধান কাজ। এজন্যে অনেক চোটাখোর বেনে ও ব্যাভার বেনে শহুরেবাবুই দালাল চাকর রাখতেন। তারা শিকার ধরে আনত, বাবুরা আড়ে গিলতেন। মাইনে ছাড়াও এ-কাজে পয়সা বিস্তর। সুতরাং কলকাতার দালাল ব্রাউহাম গাড়ি চড়ে, ‘কলাগেছে থাম ফেঁদে বসে।’

মোসাহেব আরও করিৎকর্মা। তার একমাত্র কাজ ‘বাবুর ল্যাজ ফোলান। এজন্যে বাবু বুঝে তাদের মাইনে এবং মাসোহারা বরাদ্দ করা আছে।’ নিজের থাকবার ঘর পর্যন্ত নেই, ‘মাসীর বাড়ি অন্ন লুটেন, ঠাকুরবাড়ি শোন, আর সেনেদের বাড়ি বসবার আড্ডা।’

তৃতীয় দলের যারা: তারা শহরের বেকার যুবক দল। হুতোম এদের বলেছেন, ‘বেকার জয়কেতু। এঁরা ভদ্রলোকের ছেলে। অনেকে লেখাপড়া জানেন, তবে কেউ কেউ মূর্তিমতী মা। যার যখন নতুন বোলবোলাও হয়, তখন তাঁরা সেইখানে মেশেন, তাকেই জগতের শ্রেষ্ঠ দেখান ও অন্য মনে তারই উপাসনা করেন, আবার কেউ যদি তার চেয়ে উঁচু হয়ে পড়েন তবে তাকে পরিত্যাগ করে উঁচুর দলে মিশেন।’ ব্যক্তিগতভাবে এঁরা প্রত্যেকেই আজকালকার যুবকদের মতোই বিশেষ আদর্শে আস্থাবান, বিশেষ বিশেষ দলে বিভক্ত। অর্থাৎ এরা মোটামুটিভাবে ‘গোখুরী’,ঝকমারী এবং পক্ষীর দলে বিভক্ত।”

প্রত্যেকেই এই তিন দলের কোনওটির না কোনওটির ভল্যানটিয়ার, অর্থাৎ দোহার। এদের আরও গুণ আছে। ‘এরা ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে স্নানে যেতে গিয়ে বাজারের মেয়ের অভাবে ঘরের পিসিকে সহযাত্রিণী করে।’ মত্ত অবস্থায় বৃদ্ধ পিতাকে আহত করে মাকে সান্ত্বনা দেয়: ‘ও, ওল্ড ফুল মারা যাক না কেন, একে আমরা চাইনে, এবারে মা, এমন বাবা এনে দেব যে, তুমি, নতুন বাবা ও আমি একত্রে তিনজনে বসে হেলথ ড্রিংক করবো।’

কলকাতার বাঙালির প্রধান প্রধান তিন শ্রেণীর এই হচ্ছে সংক্ষিপ্ত পরিচয়। চতুর্থ শ্রেণী অর্থাৎ কবিওয়ালা বা খেমটাওয়ালি প্রভৃতি শিল্পীদের কাহিনী এখানে বাদ দিচ্ছি। এই তিন শ্রেণীর একটা পাঁচমিশেলি সান্ধ্য মজলিসের কথা ভাবুন। তারপর ভেবে দেখুন, এদের বাহবা পেতে হলে কী গান গাওয়া দরকার, দরকার কেমন তালে নাচা। তা হলেই বুঝতে পারবেন শহরের শিল্পীদের হালত।

কলকাতার বাঙালিদের এসব দেখে দেখে ইংরেজরা তাঁদের সম্বন্ধে মোটামুটি যে এস্টিমেশন দাঁড় করিয়েছিলেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। বাঙালি-চরিত্র সম্পর্কে তাঁদের পাঠের কিঞ্চিৎ পরিচয় না দিলে কলকাতার বাঙালি-পরিচয় শেষ হয় না।

এই সেদিনের কথা। এক সাহেবি কাগজ লিখছেন:

‘We have found a timid Bengali Baboo capable of performing one of the bravest acts of gallantry, under circumstances, repugnant to his nature, opposed to his caste principles and contrary to his inbred scruples, if not indeed to his religious belief. We refer to the man known as “Bengali Hero”.

ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯০৭ সালে। ম্যানহোল থেকে একটা কুলিকে বাঁচাতে গিয়ে নফর কুণ্ডু প্রাণ দিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়। সারা শহরে ‘ধন্য ধন্য’ রব উঠেছে। সাহেবরাও তাতে যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু এই ভূমিকা সহ। কারণ, তাঁদের কাছে বাঙালি ভীরুতার মূর্ত বিগ্রহ (perfection in timidity)। নানাভাবে এই কলকাতা শহরে না খেয়ে মরতে দেখা গেছে তাদের, কিন্তু কখনও অন্যকে বাঁচাবার জন্যে নয়। তাই তাদের মতে নফর কুণ্ডু কলকাতার প্রথম ‘বঙ্গবীর’। এবং বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে এই বীরের আবির্ভাবকাল বিংশ শতকের প্রথম দশকে, অর্থাৎ আমার বাঙালি-পরিচয়ের একশো বছর পরে।

একশো বছর আগে শহুরে বাঙালির যে পরিচয় আমরা পাই, তাতে তাকে ভীরু বলা ভুল। হুতোম বলেছেন: সে নিজের ছায়া দেখে নিজে আঁতকে ওঠে, ভয় পায়। আর এক সাহেব মন্তব্য করেছিলেন: বাঙালিবাবুর একটি সন্তান হলে তিনি পরম আত্মপ্রসাদ লাভ করেন এই ভেবে যে, তার পৌরুষ অক্ষুন্ন আছে।

এহেন বাঙালি বাবু ইংরেজের কাছে সরকারের কাজ করেন। সাহেব একদিন কোনও কারণে রেগে তেড়ে এলেন তাঁকে মারতে। বাবু নিরুপায় হয়ে চিৎকার করে উঠলেন: Master can die, Master can live, অর্থাৎ প্রভু, আমার জীবন আপনার হাতে, ইচ্ছে করলে মারতে পারেন। ফল হল উলটো। মনিব উঠলেন আরও চটে। কী? যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা? Master can die! দেখাচ্ছি তোমাকে বলে লাঠি নিয়ে তেড়ে এলেন। সরকার দেখল বেগতিক, নিশ্চয় কোথাও গোলমাল হয়ে গেছে। তখন প্রাণভয়ে সে চিৎকার করে উঠল Stop there. অর্থাৎ অনুগ্রহ করে থামুন। প্রভু Die me, ইচ্ছে করলে তো আপনি আমাকে মেরে ফেলতে পারেনই। কিন্তু—

If master die, then I die, if my cow die, my black stone die, my fourteen generation die.

অর্থাৎ, আমার মনিব মরলে আমি মারা পড়ব, আমার গরুটি মারা যাবে, আমার ব্ল্যাক স্টোন অর্থাৎ বাড়ির শালগ্রাম ঠাকুর মারা যাবেন এবং আমার ফোরটিন জেনারেশন অর্থাৎ চৌদ্দ পুরুষ নিপাত যাবে, সুতরাং প্রভু আমায় রক্ষা করুন।

স্লেভ, স্লেভ, বাঙালি মানে স্লেভ। স্টিভেনস (G. W. Steevens) নামে এক সাহেব অনেক গবেষণা করে বললেন, বাঙালি মানে স্লেভ। দেখছ না এদের পা-গুলো। স্বাধীন মানুষের পা থাকে সোজা, লম্বা আর বাঙালির পাগুলো দেখো. কেমন হাড্ডি-চর্মসার, আগাগোড়া এক মাপের। উরু গোল, মেয়েদের মতো। স্লেভদের এমনই থাকে। স্লেভ এরা চিরকাল ছিল, চিরকাল থাকবেও। স্লেভদের সব গুণই দেখতে পাওয়া যাবে এদের মধ্যে। যেমন প্রভুভক্ত, তেমনই বাক্‌বিচক্ষণ।

স্টিভেনস সাহেব কথিত বাঙালির এই ‘বাক্-বিচক্ষণতা’র একটা উদাহরণ দিয়েছেন ম্যাকর‍্যাবি সাহেব। ম্যাকবেরি ছিলেন স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিসের সেক্রেটারি। তিনি দেশে চিঠি লিখছেন: এখানে ঘরে বাইরে প্রতি মুহূর্তে আমরা প্রতারিত হচ্ছি। এইমাত্র কলিংস একটা সরকারকে গালাগালি করছিল। শুধুমাত্র হিসেবের হেরফের করে ব্যাটা এক্ষুনি আমাদের প্রায় দেড়শো পাউণ্ড ঠকিয়েছিল আর কি। ধরা পড়ে কী বলছে জান?

ও হোঃ, সাহেব তা হলে বের করে ফেলেছেন?

তা হলে তুমি স্বীকার করছ যে—

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আলবত স্বীকার করব, হুজুর যেখানে বলছেন, আমি সেখানে অস্বীকার করতে পারি? কী যে বলেন হুজুর?

তবে?

আর তবে! আমার হিসেবই হুজুর ভুল হিসেব। হুজুরের হিসেব রাইট হিসেব। Very right what master say, my way bad way, master account right! আমার কায়দাটাই হুজুর ভুল।

এসব দেখে-শুনে চার্লস গ্রান্ট (১৭৯২) বলেছিলেন: ইউরোপের নিকৃষ্টতম অঞ্চলেও এমন বহু লোক পাওয়া যাবে, যারা সৎ, সরল ও বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন। কিন্তু বাংলাদেশে এমন লোক বিরল।… নিজ স্বার্থ ছাড়া অন্য সকল বিষয়েই হিন্দুরা উদাসীন।… দেশাত্মবোধ কাকে বলে তা তারা জানে না।

‘দেশাত্ববোধ। দেশাত্মবোধ তো দূরের কথা, মিথ্যে ছাড়া ব্যাটারা কী জানে শুনি।’

কথায় কথায় মিথ্যাবাদী প্রবঞ্চক ইত্যাদি বলে গালাগালি করতেন নাকি জাস্টিস ওয়েলস সাহেব আমাদের।

শুনে শুনে একদিন হঠাৎ রাগ চেপে গেল বাঙালি বাবুদের। অষ্টাদশ শতক তখন শেষ হয়ে গেছে। ওয়েলস সাহেবদের খোঁচায় খোঁচায় কেঁচো বাঙালি সাপ হয়ে উঠল। তারা প্রতিজ্ঞা করল সভা করবে। উপরে দরখাস্ত পাঠাবে। কিন্তু গোটা শহরে বাঙালি সভার ঠাঁই নেই। ‘টাউন হল সাহেবদের, নিমতলার ছাতখোলা গভর্নমেন্টের, প্রসন্নকুমার ঠাকুর বাবুর ঘাটের চাঁদনীতে হতে পারে, কিন্তু ঠাকুর বাবুর পাঁচজন সাহেব-সুবার সঙ্গে আলাপ আছে।…শেষে রাজা রাধাকান্ত বাহাদুরের নবরত্নের নাটমন্দিরে সভা হবে স্থির হল।’

স্থির হলেই সভা হয় না। কারণ ‘শহরের অনেক বড়মানুষ তাঁরা যে বাঙালির ছেলে ইটি স্বীকার কত্তে লজ্জিত হন, রাজা রাধাকান্তের নাটমন্দিরে ওয়েলসের বিপক্ষে বাঙালিরা সভা করবেন শুনে তাঁরা বড়ই দুঃখিত হলেন।’ তাঁরা সভা পণ্ড করার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি করলেন না। তবুও সভা হল। বাংলাদেশের ইজ্জতের নামে কলকাতার দশ লক্ষ বাঙালি দরখাস্ত লিখল সে সভাতে। হুতোম সভার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন: বাঙালির যে কথঞ্চিৎ সাহস জন্মেছে, এই সভাতে তার কিছু প্রমাণ পাওয়া গেল।

এই সাহসকে ভর করেই ‘জয় মা কালী কলকেত্তাওয়ালী’ বলে কলকাতার বাঙালি পা দিল উনিশ শতকের কলকাতায়।

বাঙালিটোলায় এক চক্কর

দু’ ধরনের খবর আছে। তাজা খবর আর বাসী খবরের কথা হচ্ছে না। এ জাতিভেদ অন্য অর্থে। যাকে বলা যায় খুচরো খবর, আর পাইকারি খবর। পাইকারি আর খুচরো কারবার অবশ্য সব কিছুরই হতে পারে। খুন-খারাপি থেকে টোকাটুকি—কোনও কিছুতেই আপত্তি নেই। তবে আপাতত আমাদের আলোচনা পাইকারি আর খুচরো সন্দেশ নিয়েই। অভিধানকার অবশ্য বলবেন পাইকার মানেও খুচরো বিক্রেতা। চলন্তিকার পাতা উলটালে দেখা যাবে সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে ‘পাইকার’ অর্থ যে দোকানদার খুচরো বেচে, ফেরিওয়ালা। তাতে কিছু যায় আসে না। পাইকার বলতে আমরা বুঝি যার দোকানে অনেক মাল। তার মধ্যে বিস্তর আইনের চোখে অসিদ্ধ এবং নিষিদ্ধ বস্তু থাকাও অসম্ভব নয়। অন্য দিকে খুচরো মানে খিলি পানের মতো ‘দেখি একটা মিষ্টি পান।’ কিংবা ‘একটা গায়েমাখা সাবান দাও তো।’

সেদিক থেকে ভাবলে, ভারী ভারী ইতিহাসের বইগুলো বড়বাজারের মহাজনের গদির মতো এত খবর, এত এত সন তারিখ, এত নামধাম, এমন সব ভারী ভারী তথ্য আর তত্ত্ব—পেশাদার পড়ুয়াও মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠতে বাধ্য। শোনা যায়, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ তখন নিশ্বাস টানার জন্য বই ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। পালছেঁড়া নৌকোর মতো পথে পথে ভেসে বেড়ান। কেউ বা গিন্নির নয়তো ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে কোনও উপন্যাস বা ভূতের গল্প ধার নিয়ে পড়তে বসে যান। এ-জাতীয় সংকটমুহূর্তে আমার কৌশল একটু অন্য রকম। আমি তখন বইয়ের পাতা থেকে চট করে নেমে আসি ফুটনোটের এলাকায়। অর্থাৎ দোকান ছেড়ে ফুটপাতে ফেরিওয়ালাদের ভিড়ে। সেখানে এক এক সময় এমন জিনিস মিলে যায় যে, ভাবা যায় না। অথচ সস্তার চূড়ান্ত। পরিশ্রম নামমাত্র। এই সেদিন যেমন হল। ধনতন্ত্রের একটা ইতিহাস পড়ছিলাম। স্বভাবতই এক সময় পালিয়ে যেতে হল ফুটনোটের এলাকায়। সেখানে ছোট্ট একটি খবর: এই যে ডাবল-এনট্রি অ্যাকাউন্টস বুক, তারও প্রথম নকশা রেখে গেছেন কিন্তু লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। জানা ছিল, এরোপ্লেন কিংবা বাইসাইকেল থেকে শুরু করে লিওনার্দো অনেক বিষয়েই প্রথম, কিন্তু হিসাবের খাতার বিবর্তনেও যে তাঁরই অবদান রয়েছে, সে খবর কে জানত? ভাগ্যিস, ফুটপাতে নেমেছিলাম, ফুটনোটের কাছে হাত পেতেছিলাম, তাই না এই পদরেণুটুকু মিলে গেল।

এভাবে খুদকুঁড়ো কুড়োতে কুড়োতে হঠাৎ একদিন হাতে পড়ে গেল ছোট্ট একখানা বাংলা বই, যার পুরোটাই বলতে গেলে ফুটনোট। তার পাতায় পাতায় হরেক রকম খুচরো খবর। প্রত্যেকটি খবর উপাদেয়। এবং এই কলকাতা শহরের ইতিহাসে নেশাগ্রস্তদের পক্ষে প্রত্যেকটি খবর মূল্যবানও বটে। কেননা, বইটি সেই সেকালের কলকাতা-সমাচার। যখন রাস্তায় গ্যাসের নয়, রেডির তেলের আলো জ্বলত, যখন হরিনাভি কিংবা বারুইপুর থেকে লোকেরা হেঁটে কলকাতায় এসে আপিস করতেন, বায়ু-পরিবর্তনের জন্য কলকাতার মানুষ বর্ধমানে যেতেন এবং মেয়েরা যখন জোড়াসাঁকোর মাথাঘসা গলি থেকে মশলা আনিয়ে অঙ্গ-মার্জনা করতেন। কলকাতার ঘরে ঘরে তখন ঢেঁকি, পালকি, চরকা। তারপরই কি বলতে হবে, খবরের আর এক নাম কেন সন্দেশ?

রেকাবি থেকে তুলে কিছু বিতরণ করা যাক।

যদি জিজ্ঞেস করি, প্রথম কবে কয়লা এল কলকাতায়? তার উত্তর নিশ্চয় স্কুলের ছেলের ‘জ্ঞানের আলো’য় নেই। ছুটতে হবে কোল মাইনস অথরিটির কাছে। তাঁরাও হয়তো সময় চাইবেন। অথচ কত সহজে খবরটি পাওয়া যাচ্ছে এখানে।

‘ইংরাজী ১৮৭৫ বা ’৭৬ সালে গ্যাস ঘরেতে-পাথুরে কয়লার চলন হইল এবং লোকের বাটিতে গাড়ি করিয়া বিনামূল্যে দিত। কিন্তু উনান কীরকম করিয়া জ্বালান হইবে তাহা জানা ছিল না। অনেক কষ্ট করিয়া লোহার সিক দিয়া উনান হইল। ক্রমে কয়লার এক আনা করিয়া ‘মণ’ হইল এবং সাধারণ্যে প্রচলন হইল।’

কয়লার উনুন যে শুধু শহরের আকাশ-বাতাসকে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে তাই নয়, গৃহস্থের জীবনে ডেকে আনে অন্য সমস্যা। ‘মাঝ বরাবর সময়ে লোকের তামাক খাইবার বড় কষ্ট হইল। কিন্তু মানুষের এমন বুদ্ধি যে, মানিকতলায় মুসলমানরা কাঠকয়লা গুঁড়াইয়া চাকতি চাকতি করিয়া একপ্রকার জিনিস বাহির করিল। প্রথমে লোকে তাহা দেখিয়া ‘কালবাতাসা’ নাম দিল এবং মুসলমানের হাতের জল বা ফ্যান আছে বলিয়া যাঁহারা গোঁড়া হিন্দু তাঁহারা ছুঁইতেন না। কিছুদিন একটা সমস্যা হইল যে, মুসলমানের জল ছোঁয়া যাইতে পারে কিনা? কিন্তু এমন আবশ্যকীয় জিনিস যে, ক্রমে ক্রমে তাহা চলিয়া গেল, গোঁড়াদের আপত্তি চলিল না।’ শুধু কি তাই? মফঃস্বল থেকে যারা কলকাতায় কাজ করতে আসত, তারা দেশে ফেরার সময় নাকি খান কয়েক কালোবাতাসা সঙ্গে নিয়ে যেত অন্যদের দেখাবার জন্য। এসব খবরের পরই ছোট্ট টীকা—‘টিকে এবং দেশলাই ১৮৭২ বা ১৮৭৩তে প্রথম উঠে।’

প্রথম কে? প্রথম কবে? এ ধরনের তথ্যের জন্য যাঁদের নোলা ছোঁক ছোঁক করে, তাঁদের জন্য অবশ্য পুঁথিটিতে রাশি রাশি নাম আর সন তারিখ নেই। তবে অন্য লক্ষণে প্রথম-খবর মেলাই আছে। যেমন নেমন্তন্ন বাড়িতে রান্নায় নুন না দেওয়ার প্রথা প্রথম কখন উঠে গেল, কিংবা প্রথম কখন রাবড়ি, আলু, ফুলকপি কিংবা রসগোল্লার চল হল। ক’জন জানেন। ‘আলু তখন কাঠের জাহাজ করিয়া বোমবাই হইতে আসিত এবং সেইজন্যে বোমবাই আলু বলিত।’ কিংবা প্রথম ‘রাবড়ির প্রচলন লক্ষ্ণৌতে হয়।’ অথবা ১৮৭৩ বা ১৮৭৪ সালে প্রথম রসগোল্লা হয় এবং তিলকুটও সেই সময়কার। আম সন্দেশ কামরাঙা সন্দেশও প্রায় ওই সময়েই হয়। তারপর হঠাৎ ইংরেজি পড়ার ঠেলায় একদিন নুন দেওয়া ছোলার ডাল বাহির হইলেন এবং নতুন দেওয়া আলুর দম প্রকাশ পাইলেন এবং আলুনী ঠাণ্ডামূর্তি কুমড়ার ছক্কা গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন, তিনি আর ভদ্রলোকের পাতে প্রকাশ পাইতেন না।

বিয়ে বাড়িতে এখন বিভ্রাট বাধায় যদি লোডশেডিং, তখন উৎপাত ছিলেন ‘মুরুব্বি’ নামে কিছু লোক। তাদের বলা হত ‘ভোজপণ্ডে’। খেতে বসে তাঁরা নিমন্ত্রণকর্তার বংশের কোনও কুৎসা রটিয়ে ভোজের আসর পণ্ড করে দিতেন। আর তাদের ঠাণ্ডা করার জন্যই নাকি বাড়ির গিন্নিদের বদলে রান্নার দায়িত্ব দেওয়া হয় পাচক ব্রাহ্মণদের হাতে। কেননা ‘তাহারা রন্ধন তেমন করিতে না পারিলেও ভোজপণ্ডেকে গালাগাল দিতে বিশেষ পটু ছিল।’ ঝগড়া বিবাদে গালাগাল দেওয়ার জন্য অনেক সময় আবার নিয়োগ করা হত ‘ঝুমুরওয়ালী’কে। ‘কাহারও সঙ্গে ঝগড়া হইলে দুষ্টু লোক ঝুমুরওয়ালীকে তাহার দোরে বসাইয়া দিত। ঝুমুরওয়ালী অতি অশ্রাব্য ভাষার গালি দিত। স্ত্রীলোক বলিয়া তাহাদের কেহ মারিতে পারিত না।…শেষে তাহাকে কিছু বকশিস দিয়া তাড়াইতে হইত। এইজন্য পরস্পরে ঝগড়া হইলে বলা হইত যে, তোর দোরে ঝুমুরওয়ালী বসাব।’

কলকাতা তখন গ্রাম। বন বাদা, খোলা নর্দমা, কাদায় থই থই পথ, শেয়াল, শকুন, সব মিলিয়ে নরককুণ্ড যেন। বাঙালিটোলার সমাজ গাঁয়ের সমাজেরই মতো। দলাদলি, রেষারেষি তারই মধ্যে পাড়ায় পরস্পরের মধ্যে নিবিড় বন্ধন। পাড়ার ছেলেরাও কিন্তু তখন থেকেই বিশিষ্ট ভূমিকায়। বিয়ের পর ‘বরকর্তা’। পাড়ায় ছেলেদের খাওয়াইবার জন্য গ্রামভাটা দিত। গ্রামভাটা শব্দটার অর্থ অনুমান করা যায় যে, পাড়ার ছেলেদের ভাঁট বা মদ খাইবার জন্য কিছু দেওয়া হইত।…যেমন যাত্রা ও বাইনাচ দেখিতে ‘পেলা’ দিতে হয়, অর্থাৎ ‘পিয়ালা’, অর্থাৎ এক বাটী মদের দাম দেওয়া হয়।’ এ শহরে বলা বাহুল্য, কিছুই নতুন নয়।

সামাজিক কেতা, কানুন বা প্রথার কথা থাক। তার চেয়ে বরং আরও কিছু খুচরো সওদা করে নেওয়া ভাল। এমন পশরা, আবার বলছি, দৈবাৎ মেলে।

যে কোনও বাবু হয়তো আজ শুনলে চমকে উঠবেন, একদিন এই কলকাতায় কোনও ভদ্রজনকে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করলে তিনি রীতিমত বিরক্ত হতেন। ‘বৃদ্ধদিগকে মুখুজ্যে মশাই, ঘোষ মশাই, বোসজা মশাই ইত্যাদি বলিয়াই সম্বোধন করা হইত।…বাবু সম্বোধন ছেলেবেলায় আমরা শুনি নাই, এটা ইংরেজি পড়ার দরুন হইয়াছে। গৃহস্থবাড়ির ভৃত্যরা তখন আত্মীয়ের মতো। তবে তাদের সম্পর্কেও নানা কড়াকড়ি নিয়ম। তখনকার দিনের এক প্রথা ভৃত্য গোঁফ রাখতে পারবে না। সে মনিবের কাছে গোঁফ নেড়ে কথা কইবে এও অপমান।…কিন্তু ‘পাইকরা গোঁফ রাখিত। বাটির খানসামা গোঁফ রাখিত না।’ দরিদ্রজনের গোঁফ রাখার অধিকার মেনে নিতে এখনও নাকি ভারতের কোনও কোনও রাজ্যে উচ্চবর্ণের ঘোরতর আপত্তি। কিন্তু কলকাতার মুখুজ্যে মশাই, ঘোষ মশাইও যে একদিন গোঁফ উচ্ছেদের মহান ব্রতে মেতে ছিলেন, সে খবর ক’জন রাখেন?

এমনি অজস্র হিরে-পান্না। এবং বলতে গেলে কুড়িয়ে পাওয়া। কেননা সব মিলিয়ে দেড়শো পাতাও পড়তে হয় না। অথচ ঝাঁপি উপচে পড়ে। বিলিয়ে দিতেও গায়ে লাগে না। কেননা, সবই টুকরো কথা। জানা না থাকলে ক্ষতি নেই হয়তো, কিন্তু জানার পর খুশিতে মনটা ভরে ওঠে। বিশেষত, এসব শুধু পুরানো কলকাতার খবর নয়, বাঙালিটোলার ঘরের খবর। পুরানো কলকাতার অনেক খবরই শুনেছি আমরা। কিন্তু সেসব প্রধানত সাহেবপাড়ার খবর, ব্ল্যাকটাউন সেই কলকাতার আলোর তলায় অন্ধকার বৃত্ত নয়, খবরের ব্যাপারেও অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশের মতো। এ পুঁথির আর এক বৈশিষ্ট্য এই, সাহেবদের দিকে পুরোপুরি পিঠ ফিরিয়ে বসে লেখা। বলতে গেলে, গোরাদের কথা একেবারেই নেই। বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে বারেক জগন্নাথ ঘাটের জাহাজের ভিড় দেখেছেন মাত্র, ইংরেজ প্রসঙ্গ সেখানেই শেষ।

সুতরাং এমন বাঙালির মুখে বরফ খাওয়ার অভিজ্ঞতা, কিংবা চায়ের কথা শুনতে কার না ইচ্ছে হয়? আমরা জানি, কলকাতায় জাহাজ বোঝাই হয়ে প্রথম বরফ আসে ১৮৩৩ সালে। কলকাতার সাহেবদের তরফ থেকে লর্ড বেন্টিঙ্ক সভা করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন সেদিন মার্কিন জাহাজের ক্যাপ্টেনকে। কিন্তু বাঙালি বাড়িতে বরফের আনাগোনার খবর এই প্রথম চোখে পড়ল। ‘গৰ্মিকালে ছোটকাকা কাছারী হইতে আসবার সময় কখনও কখনও ঘোড়ার কম্বলে মুড়ে বরফ আনিতেন।…সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। যাঁহারা গোঁড়া হিন্দু তাঁহারা খাইতেন না।…আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে একটু আধটু খাইতাম।’

আর চা?

‘সেটা নিরেট কি পাতলা কখনও দেখা হয়নি। আমাদের বাড়ীতে তখন আমার কাকীর প্রসব হইলে তাঁহাকে একদিন ঔষধ হিসাবে চা খাওয়ান হইল। আমরা তখন ছোট ছেলে, ন্যাংটা, ঘিরে রইলাম। একটা কালো মিন্‌সে (কালো কেটলি) মুখে একটা নল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে কুচো পাতার কী দিলে, গরম জল দিলে, তারপর ঢাললো। একটু দুধ চিনি দিয়ে খেলে আমরা ত দেখে আশ্চর্য, যা তোক দেখা গেল, কিন্তু আস্বাদনটা তখনও জানিনি৷’

শেষ করার আগে প্রথম আপেল আস্বাদনের অভিজ্ঞতাটাও শুনিয়ে দিই। আপেল সবে বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে কলকাতায়। তখনকার কথা। ‘একবার এক টাকার চারটি আপেল আনিয়া আমরা সব ভাই বোনে একটু একটু মুখে দিলাম। পাতলা পাতলা এক চাকা করিয়া ভাগে পড়িল। কিন্তু এর বিশেষত্ব কি কিছুই বুঝতে পারিলাম না।’

এ রচনার স্বাদ অনবদ্য নয় কি? এর কাছে কোথায় লাগে তথাকথিত তথ্য সমৃদ্ধ পৃথুল ইতিহাস। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, আপেল আসরে উপস্থিতদের মধ্যে একজন ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। পরবর্তী কালে যাঁর নাম স্বামী বিবেকানন্দ। আর, আপেলের মতোই এই অতি উপাদেয় কাহিনীগুলো যিনি শুনিয়েছিলেন, তিনি তাঁরই ভাই স্বনামধন্য মহেন্দ্রনাথ দত্ত মশাই। টুকরো কথার মুক্তোর মালাটির নাম ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’।

বাবুদের সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ

বাবুদের সম্পর্কে জনৈক বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যা লিখে গেছেন, অতঃপর কোম্পানির কাগজের মতো তা ভাঙিয়েই অনায়াসে আমরা গোটা দু’ তিন শতক চালিয়ে দিতে পারতাম। কেননা, ইতিমধ্যে বঙ্গীয় বাবুকুলে মৌলিক পরিবর্তন কিছু হয়নি বলেই অত্র কলকাতার কনিষ্ঠতম বাবুটির (ইনি একটি মাঝারি সওদাগরি আপিসে ডেসপ্যাচ ক্লার্ক এবং তাঁর মাসিক রোজগার পাঁচশো টাকার উপর) বিশ্বাস। তবে জ্যেষ্ঠ এবং প্রতিষ্ঠিতরা (এঁদের কেউ কেউ গভর্নমেন্ট হাউসে বড়বাবু এবং কেউ কেউ দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত ঠিকাদার) সখেদে বলেন, ‘শুধু বঙ্কিমবাবুর সেই দশ অবতার আজ মেট্রিক সিসটেমে রাতারাতি সহস্র অবতারে পরিণত হয়ে গেল, এই যা।’

আক্ষেপের কথা হলেও কথাটা সত্যি। নানা রূপে, নানা ভাবে বাবুরা আজও জীবিত। সুতরাং তাঁদের নিয়ে যদি কোনও ‘বাবু’ আজ লিখতে বসেন, তবে তা পরচর্চা বলে গণ্য হবে না নিশ্চয়। তা ছাড়া, আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে। বঙ্কিমবাবু ‘বাবু’দের শ্রেণী-বিন্যাস করেছেন বটে, কিন্তু আদি সন্ধানে প্রবৃত্ত হননি। হয়তো তিনি জানতেন নদী, নারী এবং কলের মতো ‘বাবু’র উৎস সন্ধান করতে গেলেও বিপত্তি ঘটার সম্ভাবনা।

আজ এ সম্ভাবনা একেবারেই নেই, এমন কথা আমরা বলছি না। তবে ভরসার কথা এই, আজ উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁড়ি ভাঙলেও তা নিয়ে কোর্টকাছারি হবে না। কেননা, ‘বাবু’রা আজ চিৎপুর আর চৌরঙ্গিতেই শুধু বাস করেন না, ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ভাড়া বাড়িটির জন্যেও তাঁরা দরখাস্ত করেন এবং তা না-পেলে, খোলার বস্তিতেও আপত্তি করেন না। তা ছাড়া, আসা-যাওয়ার পথে মাইল-প্রতি গড়ে এক হাজার সাতশো ষাট জন ‘বাবু’র দেখা পাই। নিজেকে গুনলে অবশ্য এক হাজার সাতশো একষট্টি জন।

সুতরাং এমন সর্বব্যাপ্ত যে কুল, তাকে নিয়ে নির্ভাবনায় আমরা আজ আলোচনায় নামতে পারি। কেননা, পদবিটা আজ যথার্থই সর্বজনীন। এবং গণতন্ত্রের শিক্ষা, যা সর্বজনের, তা কারও নয়। সুতরাং এই অধম বাবুটিকে কুল-কুলাঙ্গার আখ্যা দেওয়ার মতো কাউকেও তাঁর কুলে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।

‘বাবু’কে আমরা যখন প্রথম দেখি, তখন তিনি ‘ফুলবাবু’ হয়ে গেছেন। তিনি ভেঁপু বাজিয়ে গঙ্গাস্নান করতে যান, বিড়ালের বিয়েতে লাখ টাকা উড়িয়ে দেন, কবির আসরে বসে নোট ছোড়েন এবং এবম্বিধ। তাঁর সর্বাঙ্গে তখন ‘বাবু’ লক্ষণ।

‘বাবু-লক্ষণ’ দু’রকমের। এক ধরনের লক্ষণগুলোকে বলা যেতে পারে শাস্ত্রীয়—অন্যগুলো লৌকিক।

লৌকিক লক্ষণের মধ্যে অগ্রগণ্য ‘বাবু’র চেহারা। গায়ের রঙ সোনালি হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। উজ্জ্বল-শ্যামবর্ণ, এমনকী ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হলেও আপত্তি নেই। তবে তৈলাভাস থাকা চাই। তার চেয়েও জরুরি কথা, সেই তৈলচিক্কণ দেহটির আবার পরম্পরা গত অ্যানাটমির বাঁধন ভাঙা চাই। প্রকৃত বাবুর উদরের সঙ্গে পদযুগলের কিংবা দৈর্ঘ্যের সঙ্গে প্রস্থের পুরোপুরি অসামঞ্জস্য থাকা চাই।

দ্বিতীয়ত, তাঁর বাক্য বা পোশাক এমন হওয়া চাই, যাতে অনায়াসে বাঙালিদের থেকে তাঁকে বেছে নেওয়া যায়। ‘বাবু’ ধুতি-চাদর পরতে পারেন। তবে সেই ধুতিটি যেন ঢাকাই ধুতি হয়। এবং তার জরির পাড়খানা যেন কদাপি ওঁর কোমরে চোট না দিতে পারে। ‘বাবু’ সব সময় একদিকের পাড় ছিঁড়ে পরবেন এবং তার কোঁচা সব সময় ‘উড়ে কোঁছা’ হবে। নয়তো ‘ত্রিকচ্ছ’। যদি তিনি ইচ্ছে করেন, তবে তাঁর পক্ষে ‘মোজা’ ওয়াকিং শুজ বা ইজারাদি পরতে বাধা নেই, কিন্তু কদাপি তেমত অবস্থায় তিনি যেন শুদ্ধ বাংলা বা ইংরেজি না বলেন। প্রকৃত বাবু ভুলেও তা বলেন না। ‘সমাচার দর্পণে’র খবর অনুসারে তিনি, ‘যেখানে বলিতে হইবে অমুক বড় কৌতুক করিয়াছে: সেখানে কহেন বা কি হন্দ মজা করিয়াছে, নিয়ে যাও স্থানে লিএজা, চুঁচুড়া চূড়া, ফরাসডাঙ্গা ফড্ডাঙ্গা (এবং) কামড়িয়েছে কেমড়েছে।’ তাঁর কাছে ‘টাকার নাম’ ট্যাকা এবং মুখের নাম বাৎ।’

‘ফড্ডাঙ্গার’ বিছাপেড়ে ধুতি পরে এই ভাষায় অতঃপর যখন তিনি বাৎচিৎ আরম্ভ করেন, সাহেবের তখন সন্দেহ থাকে না যে, তিনি কোনও অধস্তন মোগলের সঙ্গে কথা বলছেন। রাজ্যটা মোগলদের হাত থেকে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং বাবুকে খাতির করতে হয়।

এদিকে নিজের বৈঠকখানায়ও ‘বাবু’র বিলক্ষণ খ্যাতি। কেননা, এখানে তিনি কথায় কথায় ইংরেজি বাৎ বলেন। যদিচ ‘নোটের নাম লোট, বডি গার্ডের নাম বেণিগরাদ, লৌরি সাহেব নৌরি সাহেব। এবং এই প্রকার ইংরেজি শিখিয়া সর্বদাই তিনি হুট গোটেহেল ডোনকের ইত্যাদি বাক্য ব্যবহার করেন। আমার মনে হয়, এগুলো শত্রুদের রটনা। ‘বাবু’ যে এর চেয়ে অনেক ভাল ইংরেজি বলতে এবং লিখতে পারেন, তার নমুনা পরে হবে।

যা হোক, এইসব লৌকিক লক্ষণ নিয়ে ‘বাবু’র মাথাব্যথা নেই। শাস্ত্রীয় লক্ষণাদি তার মধ্যে যে পুরোপুরি বর্তমান, তাই তিনি প্রমাণ করতে চান। তিনি ‘ব্রাহ্মণের ছেল্যা’। তাঁর ইংরেজিতে দরকার নেই। গায়ত্রী শিখলেই যথেষ্ট। তিনি বিদ্যা ভিন্ন অন্য কিছু দেখাতে চান।

‘ঘুড়ী তুড়ী জস আখড়া বুলবুলি মানিয়া গান,

(আর) অষ্টাহে বনভোজন এই নবধা বাবুর লক্ষণ’

সুতরাং বাবু দিনরাত ঘুড়ি ওড়ান, তুড়ি মারেন, আখড়া সাজান এবং উদ্যোগ করে ‘বুলবুলাক্ষ্য পক্ষীর যুদ্ধ’ দেখান। অষ্টাহে বনভোজনে, তাঁর মন ভরে না। সুতরাং পানসি করে তিনি নদীপথে ভূ-ভ্রমণে বের হন। গঙ্গাসাগর অনেক দূর এবং অধিকতর বিপজ্জনক, সুতরাং মাহেশই তাঁর পছন্দ। কেন, সে কথা আর নাই বললাম। ‘হুতোমই’ যথেষ্ট।

আসল কথা, ‘বাবু’ শুধু ভোগ চান না, খ্যাতি চান। যদি ঘুড়ি উড়িয়ে হয়, ভাল, যদি শখের যাত্রায় হয় তাও ভাল। যদি তাতে না হয়, তবে অন্য কিছুতেই তাঁর আপত্তি নেই। তিনি ‘কবিতা সংগীত সংগ্রামে’র আয়োজন করতে পারেন, সুপ্রিম কোর্টে কোনও কিছু উপলক্ষ করে ব্যয়বহুল মোকদ্দমায় নামতে পারেন, দরকার হলে নিকির মতো নর্তকীকে মাসে এক হাজার টাকা ‘বেতন দিয়া চাকর’ রাখতে পারেন কিংবা যা খুশি। মোট কথা, তাঁর খ্যাতি চাই। নিম্নোক্ত ঘটনাগুলোর মধ্যে খ্যাতির পক্ষে কোনটি অধিকতর কার্যকর, তা বিচারের ভার পাঁচজনের উপরই রইল।

ভোলানাথ চন্দ্রের বিবরণ। ‘নিমাইচরণ মল্লিকের শ্রাদ্ধে তাঁর আট ছেলে মিলে নগদ আট লাখ টাকা শুধু কাঙালিবিদেয় দিয়েছিলেন। এক বামুন ঠাকুর একাই পেয়েছিলেন এক ঠেলা টাকা। (এটা অবশ্য দান নয়, টাকা বিলোতে বিলোতে একটা ঠেলা তিনি নিজের বাড়ির দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন মাত্র।)

পরবর্তী পুরুষে মল্লিকবাড়িতে আর-একটা ‘গেজেটে’ উঠবার মতো উৎসবের আয়োজন হল। এবার বিয়ে। ৺নিমাইচরণের নাতি রামরতনের বিয়ে। ভোলানাথেরই খবর: সেই উপলক্ষে চিৎপুরের দু’মাইল রাস্তা গোলাপজলে ভেজানো হয়। এবং সেই শোভাযাত্রা দেখবার জন্যে এমন ভিড় হয় যে, মাথাপিছু তিরিশ-চল্লিশ টাকা ভাড়া দিয়েও ছাদের কার্নিশে একটু জায়গা পাওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

রাজা সুখময়ের দুর্গোৎসব বা রাজা নবকৃষ্ণের মাতৃক্রিয়ার কাহিনী সর্বজনবিদিত। এখানে তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। তা ছাড়া প্রধান ক্রিয়া হলেও মাতৃশ্রাদ্ধ, নবকিষণের চতুর্থ ক্রিয়া। তাঁর একটা ছোটখাট ক্রিয়ার কথাই শুনুন।

১৭৯১ সালের কথা। খানাকুলের বসুদের মেয়ের সঙ্গে নবকিষণের ছেলে রাজকৃষ্ণের বিয়ে। খরচাপত্র বা দানসামগ্রীর কথা বলাই বাহুল্য। সেই বিয়েতে বরযাত্রী সাজলেন, ‘দেশের প্রধান শাসনকর্তা বা গভর্নর-জেনারেল, প্রধান প্রাড়বিবাক (প্রধান বিচারক) এবং অন্যান্য রাজপুরুষেরা।’ সুতরাং খ্যাতি হবে না মানে? ‘নবকৃষ্ণ রাজা বাহাদুর উপাধির সহিত মসনার পঞ্চহাজারী এবং মহারাজা বাহাদুর উপাধির সহিত মসনার সাতহাজারী মর্যাদা প্রাপ্ত হন।’ এই মর্যাদা অনুযায়ী মহারাজা বাহাদুর ইচ্ছে করলে সাকুল্যে সাত হাজার অশ্বারোহী সৈন্য রাখতে পারেন। নবকৃষ্ণ কবিদের পেট্রন। লড়িয়ে গোরার চেয়ে লড়িয়ে কবিতে তাঁর বেশি মন। তবুও তিনি বললেন, আলবত রাখব। তিনি ফোর্ট উইলিয়ম থেকে ধার করে চার হাজার সৈন্য নিয়ে এলেন। তাঁরা বিয়ের দিন বরের পিছনে মার্চ করল।

অতঃপর খ্যাতি না হওয়ার কথা নয়। অবশ্য যশ যদি এতৎসত্ত্বেও অন্যর বৈঠকখানা না ছাড়তে চায়, তবে তাঁকে ভুলিয়ে আনার অন্যতর উপায়ও আছে। সেটি দেখালেন চুঁচুড়ার স্বনামধন্য প্রাণকৃষ্ণ হালদার মশাই (১৮২৭)।

যশ কলকাতায় নজরবন্দি দেখে, তিনি চিনসুরাতে বসে কোম্পানির কাগজে চুরুট ধরালেন। দেখতে দেখতে দেশ-বিদেশে খ্যাতি রটে গেল। প্রাণকৃষ্ণ এতদ্দেশে নবম ‘বাবু’ হলেন। তাঁর পূর্ববর্তী আটজন বিখ্যাত ‘আটবাবু’। হালদার খ্যাতিটাকে চিরস্থায়ী করতে চাইলেন। তিনি দুর্গোৎসব করলেন। এমন অঢেলা উৎসব বড় একটা হয় না। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে গোটা কলকাতাকে নিমন্ত্রণ জানানো হল। খ্রিস্টান হও, মুসলমান হও, কি ফিরিঙ্গিই হও, সকলের জন্য পছন্দমতো মেনু, মনোমতো প্রমোদের বন্দোবস্ত।

প্রাণকৃষ্ণ প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যশের আরাধনায় অবতীর্ণ হলেন। যশও মিলল। তবে অন্যভাবে। জালিয়াতির অপরাধে তিনি বন্দি হলেন। কলকাতা মথিত করে মোকদ্দমা হল এবং ‘বাবু’দের হাসিয়ে ও ভক্তদের কাঁদিয়ে তিনি কারাগারে চলে গেলেন। অর্থাৎ অমর হলেন।

কৃষ্ণনগরের এক জমিদারবাবু ভাবলেন, অমরত্ব কি এতই দুর্লভ? পলাশির লড়াইয়ের মাঠটা তাঁর হাতে ছিল। কুড়ি হাজার টাকায় তাই তিনি বেচে দিলেন। তারপর সেই টাকায় সোনা এবং রুপোর কাপ গড়িয়ে দু’হাতে তাই বিলিয়ে দিলেন। লোকে খ্যাতির কাজ করে কাপ, মেডেল পায়, তিনি কাপ বিলিয়ে খ্যাতি পেলেন।

‘বাবু’র তখন ভীষণ খ্যাতি। কলকাতায়, চিনসুরায়, কৃষ্ণনগরে—সর্বত্র ‘বাবু’র জয়ঢাক। সাহেবেরা তাঁকে ‘বাবু’ বলেন, মোগলরা (!) তাঁকে ‘বাবু’ বলেন, নর্তকীরা তাঁকে ‘বাবু’ বলেন। তিনি ভিন্ন জগৎ অন্ধকার। তিনি যে শুধু মুক্তাভস্মে পান খান তাই নয়, তিনি ‘গ্রন্থমুদ্রণার্থ চাঁদার খাতায়’ নাম দেন, ‘সতীর পক্ষে বা বিপক্ষের আর্জিতে সহি দেন, ‘টৌন হলে’ মৃদুমন্দ সভা হলে বগি হাঁকিয়ে সেখানে হাজিরা দেন এবং দরকার হলে বাষ্পীয়পোত নির্মাণ বিষয়ে পর্যন্ত কথা বলেন। সুতরাং, নিজের সৃষ্টিকে দেখে সৃষ্টিকর্তারাও এবার চমকালেন। তাঁরা চোখ রগড়ে বললেন, ‘ইজ ইট?’

বলা বাহুল্য, নিজেদের হাতে বাঙালি নামক একটা অদ্ভুত জাতিকে (‘The biable plastic and receptive inhabitants of Bengal’) যারা বিশ্বকর্মার মতো ‘বাবু’ ভাবে সাজিয়েছেন তাঁরা ‘সাহেবলোগ’ (Sahiblogue)। কী করে তাঁরা এমন একটা আশ্চর্যদর্শন অদ্ভুত-স্বভাবের মনুষ্যকুল সৃষ্টি করলেন, এ বিষয়ে তাঁদের মতামতটা শোনা দরকার। কেননা, তা না হলে ‘বাবু’র বংশপরিচয় সম্পূর্ণ হয় না।

‘বাবু’রা তখন বাঙালির বেশে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, এমন সময় সহসা খবর এল, সুতানটির ঘাটে জাহাজ ভিড়েছে। ‘বাবু’ শুনলেন, জাহাজ নিয়ে যারা আসে, তাদের মাঝি বলে না। তারা ‘কাপ্তান’। কিয়ৎকাল তিনি মুর্শিদাবাদে এবং অন্যত্র মসনদ ধরার কারবার করেছেন। এবার ‘কাপ্তান ধরা’ তাঁর ব্যবসা হয়ে দাঁড়াল। অনেক বাঙালি তাতে ‘জেন্টু’ হয়ে গেলেন। তাঁরা সাহেবের সঙ্গে ভাবেভঙ্গিতে কথা বলে বিস্তর রোজগার করে ফেললেন। ইতিহাসে এঁরা ‘দোভাষী’। বিনা মূলধনের কারবারে কলকাতায় তাঁরাই প্রথম ‘বাবু’। এ শ্রেণীর বাবুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রতু সরকার এবং পোস্তার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নকু ধর, ওরফে লক্ষ্মীকান্ত ধর। বিশুদ্ধ ব্যবসা করে যাঁরা বড়লোক হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে স্বল্পখ্যাত উল্লেখযোগ্য তিনজন পীড়িতরাম ‘মাড়’ (১৭৮০), কৃষ্ণপান্তি এবং বিখ্যাত বৈষ্ণবচরণ শেঠের বাবা। পীড়িতরাম ‘মাড়’ পদবি পেয়েছিলেন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাঁশ বেচে এবং কৃষ্ণপান্তি আড়ংঘাটার ছোলা বিক্রি করে। শেঠবাবুদের ব্যবসা ছিল গঙ্গাজল এক্সপোর্ট করা।

পরবর্তী শ্রেণীর ‘বাবু’রা চাকুরে কিংবা ব্যবসায়ী, তা স্থির করা একটু কষ্টকর। কেননা, তাঁদের পদবি ‘সরকার’। তাঁরা সাহেবের কুঠিতে কাজ করেন বটে, কিন্তু মাইনে নেন না। তাঁদের একমাত্র প্রাপ্য ‘দস্তুরি’। সওদাগরি হাউসে দালালের দস্তুরি তখন টাকায় আধা পয়সা। ট্রেভিলিয়ান লিখেছেন:

‘Dustoor is the breath of a Hindoo’s nostrils, the mainspring of his actions and the staple of his conversations,’ (G.O. Travelyan).

ডাকঘরে টিকিট কিনতে গিয়েও ‘বাবু’ দস্তুরি দাবি করেন। আর একবার এক সাহেব দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তাঁর আসবাবপত্র সব বিক্রি হচ্ছে। একজন মস্ত বাবু এসেছেন সেগুলো কিনতে। দরদাম সব ঠিক হল। টাকা নিতে গিয়ে সাহেব দেখলেন, কিছু যেন কম। তিনি বললেন, ‘বাপু হে, কি ব্যাপার? (প্রসঙ্গত বলা দরকার, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে ‘বাবু’, শব্দটি ‘বাপু’ থেকে জাত এবং বঙ্গদেশে তা পশ্চিম থেকে আগত। তাঁর মতে, ‘বাপু’ মুণ্ডারি শব্দ। অবশ্য কোনও কোনও সাহেবের অনুমান, শব্দটি আসলে এসেছে পুব থেকে। জাভা বালি কিংবা ওসব এলাকা থেকে। সেকালের বাবুদের অযোগ্য উত্তরপুরুষ হলেও আমি তা মানতে নারাজ। কেননা, সন্ধান নিয়ে দেখেছি, ওদিকে ‘বাবু’ মানে এখনও মহিলা কোনও কোনও পুরুষের ভাষায় ‘মেয়ে ছেলে।’ (Female attendant’!)

যা হোক, সাহেব বললেন, কী হে বাপু, চুপ করে রইলে যে?

‘বাবু’ মাথা চুলকে উত্তর দিলেন, আমার পাওনাটা কেটে রেখেছি, মি লর্ড।

‘তোমার পাওনা?’

‘ইয়েস, মি লর্ড, মাই দস্তুর।’

সাহেব হাসলেন। হেসে আরও দুটো টাকা বখশিশ দিয়ে দিলেন। ‘বাবু’ পরমানন্দে তা পকেটে পুরে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।

ট্রেভিলিয়ান লিখছেন: কী করে বিনা পরিশ্রমে রোজগার করা যায় ‘বাবু’র কেবল সেই চিন্তা। রোজগারের জন্যে সে সব কর্মে রাজি। কেবল ইউরোপিয়ানরা যাকে বলে ‘কাজ’ (work) সেটি বাদ দিয়ে। আমি ভেবে পাই না, আমরা এদেশে আসার আগে এই মানুষগুলো কী করে পথঘাট তৈরি করত, নৌকো বানাত বা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাতায়াত করত।

‘বাবু’র এসব রহস্যালাপে কান দেওয়ার সময় নেই। তাঁর হাসি ঠাট্টার নিজস্ব সময় আছে, স্থান আছে, পদ্ধতি আছে। আপাতত তাঁর বিজনেস বা কাজ (work নয় কিন্তু) ‘বাবু’ খ্যাতিকে প্রতিষ্ঠিত করা। যথা ব্রীজমোহন। (আমরা তাকে ‘বাবু বি বানরজী’ লিখতে পারতাম, কিন্তু ‘সমাচার চন্দ্রিকা’র ‘কস্বচিৎ স্বাজাতীয়াক্ষর ত্যাগে বিরক্তস্য’ জন্য তা সম্ভব হল না। সুদূর ১৮২৯ সালে তিনি লিখেছিলেন—যাঁহার নাম কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তেঁহ K. Banerjee বা কৃ. বানরজী লিখেন। বানরজীর বা অর্থ কি?’)

ব্রীজমোহন বাবু-বিষয়ক একটি বিশিষ্ট ইংরেজি বইয়ের নায়ক (The Baboo and other Tales by Augustas Smith) তার বাবা সম্পন্ন ব্যবসায়ী ছিলেন, কিন্তু ‘বাবু’ ছিলেন না। ব্রীজমোহনের ধারণা, সে উচ্চতর উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মেছে। ভবিষ্যতের বাবু’র তালিকায় নাম লেখাতেই সে পৃথিবীতে এসেছে।

সুতরাং সাধনা শুরু হল। ‘কাপ্তেন-ধরার ব্যবসা ছেড়ে ব্রীজমোহন রাইটার এবং ফাইটার ধরার কাজে হাত দিল। গোরা সৈন্যরা যখন খুঁজে খুঁজে হন্যে’, ব্রীজমোহন তখন তাদের সামনে আর্ক এঞ্জেল-এর মতো এসে হাজির হয়। তার বেনিয়ানের তলায় দামি শেরির বোতল।

ছোকরা রাইটাররা অসময়ে ধার চায়। ব্রীজমোহন বলে, দিতে পারি, তবে এক শর্তে। প্রমোশন হলে কিন্তু কুড়ি গুণে ফেরত চাই।

‘সাহেব বলল, আলবৎ পাবে।’

‘ব্রীজমোহন বলল, তবে এই নাও’।

সাহেবদের একটা মস্ত গুণ: ওদের আর যাই থাক, কথার ঠিক আছে। যথাসময়ে টাকাটা পাওয়া যায়। তৎসহ ‘থ্যাঙ্কস’ এবং বখশিশও।

ফলে, ক’ বছর কাটাতে না কাটাতেই দেখা গেল ব্রীজমোহন ‘বাবু’ হয়ে এসেছে। অর্থাৎ তার আদি চেহারাটায় বাড়তি চার স্টোন মাংস জমে গেছে। বলা বাহুল্য, এদিকে সিন্দুকেও যথারীতি মেদবাহুল্য ঘটে গেছে।

ব্রীজমোহন একটা সিন্দুক বাঁধা রেখে একটা সরকারি চাকুরি কিনল। সে এখন কালেকটার আপিসের খাজাঞ্চি। তবে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। সুতরাং, সে আগেকার ব্যবসাও ছাড়ল না। যুগপৎ সওদাগরি কুঠির বেনিয়ান এবং অনেক সাহেবের সরকার। স্মিথ লিখছেন: সবাই তাকে ঘৃণা করে। কিন্তু ব্রীজমোহন সব সময়ই হাসে। হেসে বলে, ‘আই অ্যাম দাই স্লেভ।’

ভাববেন না, ‘ইয়োর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’-এর বেশি যাঁরা এখোন না, তাঁরা ‘বাবু’ নন। তাঁরাও ‘বাবু’। ‘হবসন-জবসন’-এর মতে ‘বাবু’ মানে, ‘এ নেটিভ ক্লার্ক হু রাইটস ইংলিশ’।

রাজনারায়ণ বসু, বা শিবনাথ শাস্ত্রী থেকে শুরু করে বিলেতের ‘পাঞ্চ’ কাগজ ইস্তক কেরানি বাবুর ইংরেজি নিয়ে অনেক হাসাহাসি করেছেন। সুতরাং, আমরা এ-বিষয়ে আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করব না। শুধু গোটা দুই নমুনা শোনাব।

বিশ্বম্ভর মিত্র জনৈক সাহেবের কাছে কেরানির কাজ করেন। সাহেব সেদিন কুঠিতে নেই। সন্ধ্যায় ভীষণ ঝড় এল। ঝড়ে সাহেবের আপিসের জানালা, দরজা সব ভেঙে গেল। বিশ্বম্ভর প্রভুকে সে সমাচার জানিয়ে লিখছেন:

‘Yesterday vesper a great hurricane the valves of the window not fasten great trapidetion and palpitation and then preciptated into the precinct, God grant master long long life and many many posts. P.S. No tranquility since valve broken. I have sent carpenter to make reunite. etc. (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী: কলিকাতা দুইশত বৎসর পূর্বে)

বিশ্বম্ভর এতটা না লিখলেও পারতেন। কেরানিদের ডাঃ জনসনের ডিকশনারিটা পুরো মুখস্থ করতে হবে এমন কথা ছিল না। তাদের কাজ ছিল নকল করা। তদুপরি কেউ যদি শ’দুই শব্দ ‘ঘোষাতে পারতেন’ তবে তো কথাই ছিল না। তবুও জনৈক বিশ্বম্ভর মিত্র কেন তাঁর ইংরেজি বিদ্যা দেখাবার এই সুযোগটা হাতছাড়া হতে দিলেন না, সেটা বুঝতে হলে আবার আমাদের ‘বাবু’ চরিত শুনতে হবে।

‘স্যার আলিবাবা ওরফে Alberigh Mackay নামে এক সাহেব এসেছিলেন এদেশে। তিনি লিখে গেছেন: প্রকৃত বাবুর লক্ষণ চারটে। (১) পায়ে পেটেন্ট চামড়ার জুতো (২) মাথায় সিল্কের ছাতা, (৩) মনে আবছা আবছি ইংরেজি ভাবাদর্শ এবং (৪) মুখে ‘ten thousand horse-power English words and phrases!’

কথাটা বিশদ করতে গিয়ে তিনি বলেন: ‘বাবু’র ভেতরটা ঠিক লড়াইয়ের পর যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। মৃতদেহের মতো এখানে ওখানে রাশি রাশি ইংরেজি শব্দ প্রবাদ প্রবচন ঠাসাঠাসি করে পড়ে আছে। কোনমতে ঠেলা বোঝাই করে সেগুলোকে সাফাই করতে পারলেই যেন তিনি বেঁচে যান। মুখ দিয়ে আগে কী বেরিয়ে গেল, পরে কী আসছে, তা নিয়ে বাবুর কোনও ভাবনা নেই।

তাঁর আসল ভাবনা কমে যা দাঁড়াল, ইংরেজদের মতো ভাবতে হবে (অর্থাৎ, রামমোহন বা দ্বারকানাথের মতো)। একান্ত যদি তা না পারা যায়, তবে ইংরেজদের মতো চলতে হবে, বলতে হবে এবং লিখতে হবে। সুতরাং পাকা লিখিয়ে বিশ্বম্ভর যখন ওই ভাষায় চিঠি লিখছেন তখন জনৈক ‘নেটিভ বয়’ খবরের কাগজের সম্পাদককে সখেদে জানাচ্ছেন:

‘…I am a poor native boy rite butiful English and rite good sirkulars for Mateland Sahib…very ceap, and gives one rupees eight annas per diem, but now a man say he makes betterer English, and put it all rong and gives me one ruppes….

অথচ কী দুঃখের কথা দেখুন। ছেলেটি যে শুধু ‘ভাল’ ইংরেজিই লিখতে পারে তাই নয়, তার অন্য গুণও আছে। সে লিখছে—

‘I make poetry (কবিতা) and country Korruspondanse.’

চিঠিটা নাকি ছাপা হয়েছিল ইংলিশম্যান কাগজে। পড়ে কে কী ভেবেছিলেন আমরা জানি না। কিন্তু একজন সাহেব ভাবিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মেকলে। তিনি বসে বসে বিশ হাজার পাউন্ড হর্সপাওয়ার-বিশিষ্ট ইংরেজি গদ্যে ‘বাবু’কে সম্পূর্ণ করার এক পরিকল্পনা রচনা করলেন। তাঁর সেই ‘মিনিট’ সর্বজনবিদিত। আমরা বরং এখানে অল্পজ্ঞাত কয়টি ‘বিশ্বকর্মার’ প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।

তাঁদের মধ্যে প্রথমেই যাঁর নাম উল্লেখযোগ্য, তিনি জর্জ ক্যাম্পবেল। টাকা দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে সর্বস্বান্ত বাবুরা মেকলের বিধান অনুযায়ী যখন ইংরেজি পদ্যে জীবন-দর্শন ঘোষণা করছেন—

‘Here today and gone tomorrow

In this vale of tear and sorrow;

Never lend, but always borrow

Kuchpurwani, Mari Jan!’

তখন এই ক্যাম্পবেল সাহেবই তাঁদের হাত ধরে স্বর্গের তোরণে এনে দাঁড় করালেন। ‘বাবু’দের তিনি সরকারি চাকরির অধিকার দান করলেন। তবে এর চেয়ে তাঁর বড় অবদান ‘বাবু’দের তিনি ফুটবল ও ফুটপাত চেনালেন। ফলে পা দু’খানা একটু পুষ্ট হল এবং উদরখানা আয়ত্তাধীনে আসার লক্ষণ দেখা গেল।

লর্ড অকল্যান্ড সদাশয় ব্যক্তি। তিনি সে পায়ে জুতো পরবার অনুমতি দিলেন এবং তাঁর পরবর্তীরা ক্রমে ক্রমে পেটভরে খাওয়ার অনুমতিটা কেড়ে নিলেন। ফলে মেকলের কারখানার প্রথম গ্র্যাজুয়েট বাবু বঙ্কিমচন্দ্র দেখলেন ‘বাবু’রা শুধু যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছেন তাই নয়, তাঁরা ভোরবেলায় জুতো পায়ে গোলদিঘির চারদিকে ঘুরে বেড়াতেও শিখেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাই দেখে লিখলেন ‘বায়ুকেই ইহারা ভক্ষণ করিবেন—ভদ্রতা করিয়া সেই দুর্ধর্ষ কার্যের নাম রাখিবেন বায়ু সেবন।’

ম্যাকে সাহেব লিখেছিলেন ‘বাবু’ হাসতে জানে না। যদি জানতেন তবে ‘সি আই ই’ নামক জীবগুলোকে দেখে নিশ্চয় তাঁর হাসি পেত। বঙ্কিম জানালেন, ‘বাবু আরও এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি নিজেকে দেখেও হাসতে শিখেছেন।’

দুঃখের বিষয়, এই অধম ‘বাবু’ আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও আজ হাসতে পারছে না। কেননা, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বাবু’দের দেখে হেসেছিলেন না কেঁদেছিলেন, তাই আজও সে ঠাহর করে উঠতে পারছে না।

অন্য বাবুরা

“এখন আর সে কাল নেই। বাঙালি বড়মানুষদের মধ্যে অনেকে সভ্য হয়েছেন। গোলাপজল দিয়ে জলশৌচ, ঢাকাই কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে পরা, মুক্তাভস্মের চুণ দিয়ে পান খাওয়া আর শোনা যায় না। কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ, যাত্রার নোট প্যালা, তেল মেখে চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান করতে যাওয়া, শহরে অতি কম হয়ে পড়েছে। আজ্ঞা হুজুর, উঁচু গদি কার্তিকের মত বাউরি চুল, একপাল বরাঘুরে মোসাহেব, রক্ষিত বেশ্যা, আর পাকন কাছা-জল স্তম্ভ আর ভূমিকম্পের মত কখনও ‘কখনো’র পাল্লায় পড়ছে।”

হুতোম এই সমাচার পেশ করেছেন উনিশ শতকের ছয়ের দশকে। কলকাতায় বাঙালি বাবুদের বিবর্তন কিন্তু শুরু হয়ে গেছে তার অনেক আগেই। বলতে গেলে শতাব্দীর প্রথম পাদে। কলির শহর কলকাতায় সেদিন ঘটনার পর ঘটনা। ১৮১৪ সালে রামমোহন স্থায়ী ভাবে আসন পাতলেন শহরে। পরের বছর প্রতিষ্ঠিত হল বাঙালির প্রথম সভা—আত্মীয় সভা। দেখা গেল, আলোচনা সেখানে আধ্যাত্মিক বিষয়ে আবদ্ধ থাকতে চাইছে না, ভূমার বদলে ভূমিতে নেমে আসছে নিয়মিত। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ। স্কুল বুক সোসাইটি। পরের বছর স্কুল সোসাইটি। প্রথম বাংলা কাগজ। মিশনারিদের ‘সমাচার দর্পণে’র সঙ্গে সঙ্গে কিছু আগে অথবা কিছু পরে, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বাঙ্গাল গেজেট’। সে বছরই প্রথম শোনা গেল সতীদাহের বিরুদ্ধে রামমোহনের যুক্তিবাদী কণ্ঠস্বর ‘…প্রবর্তক ও নিবৰ্ত্তকের সম্বাদ’ ’২১ সালে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ ’২২ সালে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’, ’২৩ সালে ‘গৌড়ীয় সমাজ’, ’২৭-২৮ সালে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন, ’২৮ সালে ব্রহ্মসভা বা ব্রাহ্মসমাজ, ’২৯ সালে সতীদাহ নিবারক আইন, ’৩০ সালে ধর্মসভা ইত্যাদি ইত্যাদি। সন্দেহ নেই, বাবুরা নতুন নেশায় পড়েছেন। রাঁড়, ভাঁড় ‘সকের কবি’ আর হাফ আখড়াইয়ের বদলে তাঁরা বিব্রত তখন ‘অ্যাসোশিয়েশান’, অ্যাড্রস মিটিং এবং ছাপাখানা’ নিয়ে। ‘কবিতা সংগীত সংগ্রামের’ বদলে তখন মেতেছেন তাঁরা অন্য লড়াইয়ে। ১৮১৫ থেকে ১৮২৯ সালের মধ্যে একা রামমোহনই বই ছাপিয়েছেন বাংলায় ২৯ খানা, ইংরেজিতে ৩৩ খানা, সংস্কৃতে ৩ খানা। সে সব বই ছাপার হরফে বোমা বারুদ। আত্মরক্ষার্থে প্রতিপক্ষকেও তর্জন গর্জন করতে হয়েছে বিস্তর। সব মিলিয়ে কলকাতা সেদিন ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের মতো। সে-লড়াই আঠারো দিনেই মিটে যায়নি। তার চেয়েও উল্লেখযোগ্য সংবাদ: দু’ তরফেই গোলন্দাজ ছিলেন কিন্তু বাবুরাই, একালের সমাজ তাত্ত্বিকদের ভাষায় ‘ভদ্রলোকেরা’। ইংরেজ পুরোপুরি দর্শকের ভূমিকায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে না থাকলেও, তাদের পৃষ্ঠপোষণা জুটেছে পরোক্ষে। বাবু যেমন সাম্রাজ্যের ভিতপুজোয় জোগানদারের ভূমিকায়, ঠিক তেমনই কোনও কোনও উপলক্ষে সাহেবদেরও দেখা গেছে বাবুদের সহযোগীর ভূমিকায়। বিশেষত, বেসরকারি সাহেবলোগদের।

আত্মীয় সভা যদি বাঙালির প্রথম অ্যাসোসিয়েশন, হিন্দু কলেজ স্থাপনা তবে বাঙালিবাবুর দীর্ঘ কৃতিত্বের ফর্দে প্রথম ‘পাবলিক ইস্যু’। একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন: তার আগেও কিছু কিছু ‘সৎকর্ম’ নিশ্চয়ই করেছেন। পুকুর কাটা, ঘাট তৈরি, দরাজ হাতে ব্রাহ্মণ বিদায় ইত্যাদিতে উৎসাহ দেখা গেছে তাঁদের। কখনও কখনও দেখা গেছে রাজদরবারে মিলিতভাবে আর্জি পেশ করতেও (যেমন ১৭৭৬ সালে গোবিন্দরাম মিত্রের পৌত্র রাধাচরণ মিত্রের ফাঁসির হুকুম রদ করার জন্য আবেদন)। কিন্তু নির্দিষ্ট সামাজিক লক্ষ্য সামনে রেখে সকলের মিলিত উদ্যোগ দেখা গেল এই হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষেই। সেদিন থেকে বাবুদের সত্যিকারের বারোয়ারি এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা অবিস্মরণীয়। প্রগতির চাকা আপন বেগেই ঘুরতে থাকে অতঃপর। একের পর এক ‘পাবলিক ইসু’। ধাক্কা দিচ্ছে বন্ধ দুয়ারে। সতী, জুরিতে বসার অধিকার, সম্পত্তি রক্ষার তাগিদ, প্রশাসনে শরিকানা, বাবুর নিশ্বাস ফেলার সময় নেই যেন। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে কালের রথ। এ রথের সারথি এবং শক্তি দুই-ই তিনি। তাঁরা উনিশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় প্রহরে কলকাতায় এই নতুন বাবু-কালচারের পিছনে রয়েছে, বলা নিষ্প্রয়োজন, নতুন নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মেষ ঘটেছিল আগের শতকেই। ‘কঞ্চিতে’ অনেক ‘বংশলোচন’ জন্মেছেন তখন: দেওয়ান, বেনিয়ান, পাইকার, দালাল, গোমস্তা, সরকার, মুনসি রীতিমত বর্ণাঢ্য তাঁদের মিছিল। সপ্তদশ কিংবা অষ্টাদশ শতকের কলকাতা শহরের বাঙালি যদি অজস্র তথা সহস্রবিধ পথে জীবনের চরিতার্থতা খুঁজে থাকেন, তবে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে তাঁদের সামনে খুলে গেছে লক্ষ অযুত পথ। শতপুষ্পের বদলে কলকাতা নামক উদ্যানে সেদিন সহস্ৰপুষ্প বিকশিত। দৃষ্টান্ত হিসাবে সাংবাদিকতার কথাই উল্লেখ করা যাক। কিংবা ছাপাখানার ব্যবসা। গঙ্গাকিশোর বা ভবানীচরণকে কিন্তু অষ্টাদশ শতকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকৃতি বিকৃত হল আর লোকগুলো মরে গেল—কবির এ ভণিতা অতএব পুরো সত্য নয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, সুপ্রিম কোর্ট, ইত্যাদি যদি নব নব বাবুর জন্ম এবং মৃত্যুর হেতু হয়ে থাকে তবে ১৮১৩ সালের মনোপলি-উচ্ছেদ আইন, ১৮১৭ সালের হিন্দু কলেজ, ৩৩ সালের সনদ সম্পর্কিত আন্দোলন, ৩৫ সালের মেকলের মিনিট, ৩৭ সালে আদালতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন ইত্যাদি জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন বাবুকে। অফিসে আদালতে, হাটে-বাজারে, বিদ্যালয়ে এবং চিকিৎসালয়ে সর্বত্র কিলবিল করছেন তাঁরা। বাবুর অতএব মৃত্যু নেই। বড়মানুষরা গঙ্গাযাত্রা করলেন বটে, কিন্তু মদনভষ্মের পর যেমন, অন্য ধরনের বাবুয়ানা ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন শহরময়। শহর স্বাধীনতা দিয়েছিল বাঙালিকে। গুটিপোকার মতো কুলবৃত্তির বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল বাঙালি। প্রজাপতির মতো ডানা মেলেছিল শহরের মুক্ত বাতাসে। আভিজাত্যের নতুন অভিধা হিসাবে স্বীকৃত হয়েছিল সেদিন অর্থ। ‘জাত আমার বাক্সের মধ্যে’ এই উদ্ধত উক্তি শহরেই সম্ভব ছিল এবং সে শুধু কলকাতা বলেই। উনিশ শতকে বাবুয়ানার নতুন শর্ত বিদ্যা। ‘ক্রমে ছোট জেতের মধ্যেও দ্বিতীয় রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর ও কেশব সেন জন্মাতে লাগলো।’ কিন্তু এই বিদ্যার জোরেই। আর ওই বিদ্যার উদ্বোধন ঘটালেনও কিন্তু বাবুরাই। হিন্দু কলেজ সে দিন থেকে বাবুদের শ্রেষ্ঠ জয়স্তম্ভ।

হিন্দু কলেজের পড়ুয়ারাও জাতে বাবু। ‘ইহারা কেহ দেওয়ানের পুত্র, কেহ কেরাণির ভাই, কেহ খাজাঞ্চির ভ্রাতুষ্পুত্র, কেহ গুদাম সরকারের পৌত্র কেহ নীলামের সেল সরকারের সম্বন্ধী ইত্যাদি প্রায় বিষয়ী লোকের আত্মীয়।’ অচিরেই দেখা গেল তাঁরা ‘কেরাণিগিরির উপযুক্ত যৎকিঞ্চিৎ ইংরাজী শিক্ষা করিতেছে।’ সুতরাং তিরিশের দশকে ‘ড্রজু সাহেবি হেঙ্গামা’র আগেও বাবুরা নানাবিধ হেঙ্গামায় পড়েছেন। জাত-কাছারির হেঙ্গামা, কালীপ্রসাদী হেঙ্গামা, নীলকমলী হেঙ্গামা, ‘সতীদ্বেষীদের নিয়ে হেঙ্গামা’ ইত্যাদি হরেক ‘হেঙ্গামা’। কিন্তু হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং তাঁর শিষ্যদলকে নিয়ে যে হেঙ্গামায় পড়লেন তাঁরা প্রকৃতিতে তা অন্যরকম। ১৮৩০ সালে সতীদাহ উচ্ছেদ উপলক্ষে একদল বাবু গড়েছিলেন ধর্মসভা। রামমোহনকে তবু ঠেকানো গেল না। তারই মধ্যে খ্রিস্টানি হুজুগ, ডাফ সাহেবের কলকাতা আগমন। তদুপরি ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর দৌরাত্ম্য। এরা ‘উপদেশের কথা হইলেই নন্‌সেন্স কহে।’ ডিরোজিও এবং ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর সাফল্য এবং ব্যর্থতার আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। ওঁদের আন্দোলন যে হুজুগ মাত্র নয়, সে কথা আজ বলতে গেলে, সবাই মেনে নিয়েছেন। ওঁরা এদেশে প্রথম বিদ্রোহী ছাত্রদল। হয়তো এই বিদ্রোহের মূলে প্রজন্মের ব্যবধানও একটা কারণ। কিন্তু পিতৃপুরুষের সঙ্গে ওঁদের ব্যবধান কি শুধু বয়সেই? চিন্তার দূরত্বও কি ছিল না? কেউ কেউ অতএব সংগত কারণেই এই নবীন বাবুদের তুলনা করেছেন প্রমিথিউসের সঙ্গে। আগুন ওঁরা মর্তলোকে বহন করে আনতে পেরেছিলেন কিনা সেটা অন্য কথা, কিন্তু মশাল যে হাতে তুলে নিয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ‘এজ অব রিজন’ যাঁদের হাতে বেদ মিল স্মিথ বেন্থাম বেদান্ত, আমাদের সমাজের পটভূমিতে তাঁদের বক্তব্যকে নিশ্চয়ই বালখিল্য চপলতা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আগেই বলা হয়েছে, উনিশ শতকের প্রথম কয়টি দশকে বাবুদের আর এক নেশা হয়ে দাঁড়ায় অ্যাসোসিয়েশন গড়া। ‘তুড়ি ঘুড়ি বুলবুলির’ বদলে সভা আর সভা। আগের শতকে বাবুয়ানা ছিল যদি নবাবিয়ানা, পরের শতকে বাবুয়ানা বলতে বাঙালি তবে বোঝে সাহেবিয়ানা। সুতরাং শুরু হল সাহেবি স্টাইলে সভায় যাওয়া আসা। সে সব সভা নবকৃষ্ণের কবিসভা বা রাজা বাদশাদের রত্নসভা ছিল না। এসব সভার মৌলিক দুটি লক্ষণ: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং সমাজবোধ। বাবু সেখানে স্বাধীনভাবে চিন্তা করেন, খোলাখুলি আলোচনার মধ্য দিয়ে ভাব বিনিময় করেন, নিয়ত চলে ধ্যান ধারণার লেনদেন। গোড়ায় আমরা কয়েকটির নাম উল্লেখ করেছি মাত্র। সেদিন আরও যে সব সভা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তার মধ্যে ছিল বঙ্গহিত সভা, অ্যাংগলো ইন্ডিয়ান হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন, জ্ঞান সন্দীপন সভা, ডিবেটিং ক্লাব, বঙ্গজনী সভা, বিজ্ঞানদায়িনী সভা, সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা, জ্ঞানচন্দ্রোদয় সভা, সোসাইটি ফর দ্য আকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ, তত্ত্ববোধিনী সভা, মেকানিকস ইনস্টিটিউট, ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলোর প্রায় সব ক’টিতেই হাজির বাবুরা। সেই সঙ্গে অভিনব-বাবু ডিরোজিওর শিষ্যরা। কোনও কোনওটিতে তাঁরাই সভার প্রাণ-স্বরূপ।

সেদিনের সমগ্র বাবুসমাজের মতামতকে সাধারণত ভাগ করা হয় তিনভাগে: এক— সনাতনপন্থী, দুই—উদারপন্থী, তিন—অতি আধুনিক চরমপন্থী। কোনও সভা গরম সভা, কোনও সভা নরম সভা। তবে তিন দলের হাতেই কাগজ ছিল কলম ছিল। তিন দলেরই পিছনে ছিল ভদ্রদল। শেষের দল অবশ্য সংখ্যায় লঘিষ্ঠ। চরমপন্থীরা প্রথম রাউন্ড লড়াই লড়েছেন রামমোহনের সঙ্গে। এমনকী ‘এগ্ৰিহার্টিকালচারাল সোসাইটিকেও রেহাই দেননি তাঁরা। সেখানে কি শুধু পেঁয়াজ আর রসুনেরই চাষ হবে? এই ছিল তাঁদের জিজ্ঞাসা। রামমোহন মঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার পর ধর্মসভার দ্বিতীয় রাউন্ড লড়াই শুরু হয় ইয়ং-বেঙ্গলের সঙ্গে। ডিরোজিওর অকাল মৃত্যু এবং ইয়ংবেঙ্গল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর সভার স্বাভাবিক মৃত্যু। ১৮৪৮ সালে গোঁড়াদের অনুরাগী ঈশ্বর গুপ্তকেও স্বীকার করতে হয়, ‘ধর্মসভা, এই শব্দ শুনিতে অতি উত্তম, কারণ ধর্ম শব্দ অতিশয় জাঁকজমকে পরিপূর্ণ, কিন্তু ইহার ভিতর ধর্ম অন্বেষণ করলে তন্মধ্যে কোনও পদার্থই দৃষ্ট হয় না।’ অন্যদিকে ব্রাহ্মসভা সে দিন ইয়ং বেঙ্গলের তোপের মুখে। তাঁদের বৈপরীত্য, আত্মখণ্ডন ইত্যাদি ইয়ং বেঙ্গল সমালোচনার তোড়ে কম্পমান। রামমোহনের অনুরাগীদের সম্পর্কে ওঁদের বক্তব্য, ওঁরা হাফ-লিবারেল। ওঁরা মেকি ‘বিফোর দি বিগটস দে আর বিগাটস। বিফোর দি লিবারেলাস দে আর লিবারেলস। হুইপদের কাছে ওঁরা হুইপ, টোরিদের কাছে ওঁরা টোরি।’

অন্তে কিন্তু দেখা গেল, বাবুরা মোটামুটি একই দলের মানুষ। বৈপরীত্য ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের মধ্যেও হয়েছে। রয়েছে আত্মখণ্ডনের প্রমাণও। উত্তেজনা আলোড়ন যখন থেমে গেল, তখন জানা গেল, সবাই বাবু। সবাই ভদ্রলোক। হিন্দু ভদ্রলোক। এক সমাজ বন্ধনে বাঁধা সবাই। মোটামুটি ভাবে এক স্বার্থবন্ধনেও। এমনকী, পরদেশি বণিকদের একাংশের স্বার্থও এঁদের সঙ্গে থাকতে পারলেই সিদ্ধ।

গৌড়ীয় সমাজ, সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা বা তত্ত্ববোধিনী সভার গোঁড়া, লিবারেল র‍্যাডিকেল—তিন শিবিরেরই অনেক চেনা মুখ চোখে পড়বে। তবে প্রধান দুই পক্ষ সনাতনপন্থী আর উদারপন্থীদের প্রথম সত্যিকারের ‘ইউনাইটেড ফ্রন্ট’ বোধহয় ১৮৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ভূম্যধিকারী সভা। দু’ দলের কাছেই ভূসম্পত্তি রক্ষার প্রশ্নই সেদিন জরুরি শাস্ত্রীয় কুটতর্কের চেয়ে। বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খাওয়ার দৃশ্য। ইয়ং বেঙ্গল নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রাখার চেষ্টা করেছিলেন ১৮৪৩ সালে বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গড়ে। ওঁদের দলের পরিচয় যদি বিত্তে, আমাদের তবে বিদ্যা-বুদ্ধিতে এই বুঝি বা ছিল তাঁদের বক্তব্য। এই স্বাতন্ত্রও কিন্তু বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হল না। ভেদাভেদ ঘুচে গিয়ে সব একাকার হয়ে গেল ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের ভিড়ে। সেখানে হাত ধরাধরি করে চলেন রাধাকান্ত দেব আর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, আশুতোষ দেবের পাশের আসনে বসে একদা অগ্নি-পুরুষ রামগোপাল ঘোষ। সমবেতভাবে তাঁরাই কালান্তরের পুরুষ, নতুন কালের নতুন বাবু। অন্য বাবু। চট্টগ্রাম থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত এই বাবুরাই সেদিন গোটা ভারতের জনমতের নিয়ন্তা—বলেছেন এক ইংরেজ। সন্দেহ নেই এঁরাই সেদিন ‘দেশের মগজ’, এঁরাই সেদিন গোটা দেশের ‘কণ্ঠস্বর’। আঠারো শতকের বাবু আঙুলে আংটি পরতেন। ‘অ্যায়সা দিন নেহি রহেগা’ ডিজাইনের আংটি। মামলা মোকদ্দমার ঝকমারি আর থাকবে না, ঋণের বোঝা কমবে—এই ছিল আংটির মনস্কামনা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পৌঁছে অবাক বিস্ময়ে তারা দেখলেন, দিন সত্যিই পালটে গেছে। এখন আর এ শহরে বসে সতীদাহের কথা ভাবা যায় না, বহু বিয়ের প্রস্তাব শুনে মাথায় খুন চেপে যায়, অন্ত্যজের সঙ্গে বসে লেখাপড়া শিখতে অপমান বোধ হয় না, অ্যাসোসিয়েশন গড়তে ভয়ে দাঁত কপাটি লাগে না। সে ভয় কিন্তু ভাঙিয়েছেন আদি বাবুদের বংশধরেরাই, আরও স্পষ্টভাবে বললে, হিন্দু কলেজের ছাত্ররা। তবু যে-নবীন বাবুর। বেশিদূর যেতে পারেননি, তার পিছনেও কারণ ছিল বই কি। প্রথমত জাগরণের এই সোনার কাঠি ছিল ‘মেড ইন ফরেন,’ সবই বিদেশির সংসর্গের ফল। দ্বিতীয়ত, বাবুদের এসব আন্দোলন ছিল একান্তভাবেই শহুরে মধ্যবিত্তের আন্দোলন। এবং হিন্দুর আন্দোলন। দেশের জনসাধারণের সঙ্গে যোগ ছিল না তার। বিশেষত মুসলিম সমাজের। তৃতীয়ত, সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্যও ছিল না তাঁদের। ছিল না কোনও সুসংগঠিত দল। ‘ইয়ংবেঙ্গল’ বলতে গেলে ভাব আন্দোলন, সুতরাং অনেকাংশেই বায়বীয়। ‘তরুণ গড়ুর সম কী মহৎ ক্ষুধার আবেশ পীড়ন করিছে তারে, কী তাহার দূরন্ত প্রার্থনা’ অথবা ‘কোন বিশ্বে করিতে রচনা আপন বিরাট নীড়’ এই অমর বিহঙ্গশিশুদের কাছে স্পষ্ট ছিল না সে স্বপ্ন। তাঁদের জানা ছিল না সনাতন সমাজের ভিত কত মজবুত, কত দুর্ভেদ্য গোঁড়ামির দুর্গ’ অন্য বাবুদের নিয়ে। গোলমাল সেখানেই। তত্ত্ববোধিনী সভায় এইসব বাবুরই একাংশকে দেখে বিচলিত দেবেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘একজন বলিলেন ঈশ্বর আনন্দস্বরূপ কিনা? যাঁহার যাঁহার আনন্দ স্বরূপে বিশ্বাস আছে, তাঁহারা হাত উঠাইলেন। এইরূপে অধিকাংশের মতে ঈশ্বরের সত্যাসত্য নির্ধারিত হইত।’

ঈশ্বরকে নিয়ে ভোটাভুটি করতে পর্যন্ত দ্বিধা ছিল না নতুনকালের নবীন বাবুর। তখনও জানা ছিল না, দৌড় তাঁর কতদূর। জানা ছিল না, কুল জাতি পাঁতি বর্ণের বন্ধন তখনও কতখানি নিবিড়। ফলে রামমোহনের চওড়া বুকে আমরা যেমন উপবীত ঝুলতে দেখি, ডিরোজিও-শিষ্যকেও তেমনই দেখি একদা-উন্নত মস্তকে শিখা ধারণ করতে। দেখি ডেভিড হেয়ারের অনুরাগী একজন ছুটেছেন তাঁর নামে গয়ায় পিণ্ডদান করতে। মেকালে আশা প্রকাশ করেছিলেন তিরিশ বছরের মধ্যে পৌত্তলিক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেখা গেল, ডাফের স্বপ্নের মতোই সব মরীচিকা। মিল বার বার হেরে যাচ্ছেন মনুর কাছে। এখনও মার্কস যেমন।

কালেজ-বয়

‘একবার তাঁহাদের মন্ত্রণা হইল, মুসলমানের দোকানের বিস্কুট খেতে হবে। কয়েক দিন মন্ত্রণাই হয়, কাজে কেহ অগ্রসর হইতে পারেন না। একদিন, অন্য এক কাৰ্য্য সমাধা করিতেই হইবে, এইরূপ স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইয়া তাঁহারা গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। মুসলমানের দোকানের সম্মুখে আইলেন, কিন্তু তাহার ভিতর প্রবেশ না করিয়া পথের উপরে সকলে দাঁড়াইয়া ভাবিতে লাগিলেন। এগিয়ে গিয়ে বিস্কুট কিনিয়া লইয়া আইসেন, তাহা কাহারও সাহস হয় না। শেষে একজন অধিক সাহসী পুরুষ এগুলেন। কিন্তু তাহার পা কাঁপিতে লাগিল। আস্তে আস্তে দোকানের ভিতরে গিয়া বিস্কুট নিয়ে যেমন তিনি বেরুলেন, অমনি তাঁহার সঙ্গিগণ তিনবার গগনভেদী স্বরে “Hip! Hip! Hurrah!” বলিয়া উঠিলেন।’

বিদ্রোহের বিবরণ দিচ্ছেন রাজনারায়ণ বসু।

খেতে হবে। এমনি করে কচ কচ করে চিবিয়ে খেতে হবে কুসংস্কারকে। ঠনঠনের সিদ্ধেশ্বরীতলায় এক চাঁদনি রাতে লুট করে খাওয়া হল উইলসনের বাড়ির রুটি। শুধু কি তাই? শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন: ‘আবার সেকালের লোকের মুখে শুনিয়াছি যে, অনেক বালক ইহা অপেক্ষা অতিরিক্ত সীমাতে যাইত, তাহারা রাজপথে যাইবার সময় মুণ্ডিতমস্তক ফোঁটাধারী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত দেখিলেই তাঁহাদিগকে বিরক্ত করিবার জন্য, ‘আমরা গ’খাইগো, আমরা গরু খাইগো,’ বলিয়া চিৎকার করিত। কেহ কেহ স্বীয় ভবনে ছাদের উপর উঠিয়া প্রতিবেশীগণকে ডাকিয়া বলিত, ‘এই দেখ, মুসলমানের জল মুখে দিতেছি’—এই বলিয়া পিতা-পিতৃব্য প্রভৃতির তামাক খাইবার টিকা মুখে দিত।’

ছেলেগুলো যেন ঠিক করেছে, খেয়ে খেয়েই শেষ করে দেবে হিন্দুধর্ম। শুধু বিস্কুট আর রুটি খেলে চলবে না। রাধানাথের দৃঢ় অভিমত: বাঙালিকে মানুষ হতে হলে নিষিদ্ধ মাংসকেই করে নিতে হবে সিদ্ধ। রাধানাথ সাহেবি খানা ধরলেন। পুত্র রামগোপালের অপরাধে বাগাতির বামুন-কায়েতরা পিতা গোবিন্দ ঘোষের নাম দিলেন, ‘গরুখেকো গোবিন্দ ঘোষ’। তাঁদের চেয়েও সক্রিয় প্রতিবাদী বলতে হয় মধ্য-কলকাতার গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের বাসিন্দাদের। তাঁরা পাড়া-ছাড়া করলেন কৃষ্ণমোহনকে। পল্লি থেকে তাড়িয়েই ক্ষান্ত হলেন না, সমাজ-ছাড়া করে তবে শান্ত হলেন।

ঘটনার সূত্রপাত ১৮৩১ সালের ২৩ আগস্ট। কৃষ্ণমোহন সেদিন বাড়ি ছিলেন না। এমন সময় তাঁর কয়েক জন বন্ধু এসে হাজির। তাঁরা তাঁর বৈঠকখানায় বসে আড্ডা দিচ্ছেন। আড্ডার বিষয় যথারীতি ধর্ম, সংস্কার ইত্যাদি। আসর সরগরম। একজন প্রস্তাব দিলেন: শুধু কথায় পেট ভরে না, আজ তবে খাওয়াই যাক। প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। ওঁরা ছুটলেন মেছুয়াবাজারের দিকে। সেখান থেকে রুটি, মাংস এনে খাওয়া হল। সেখানেই শেষ নয়। ‘আহারের পর হাড়গুলি পার্শ্বস্থ এক গৃহস্থের ভবনে ফেলিয়া দিয়া যুবকদল চীৎকার করিতে লাগিলেন, ‘ঐ গোহাড়, ঐ গোহাড়।’ আর কোথায় যায়। সমুদয় পল্লীস্থ হিন্দুগণ মার মার শব্দে বাহির হইয়া পড়িলেন।’

যাঁদের বাড়িতে হাড় পড়েছিল, তাঁদের নাম ‘ভৈরবচন্দ্র চক্রবর্তী ও শম্ভুচন্দ্র চক্রবর্তী। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটল জনৈক গৃহস্থের প্রাঙ্গণে নয়, গোটা সমাজের অঙ্গনে। কৃষ্ণমোহন বাড়ি ফিরে স্তম্ভিত। তিনি শান্তিবারি নিক্ষেপের চেষ্টা করলেন। কিন্তু পরিণতি দাঁড়াল আগুনে ঘৃতাহুতির মতো। পৈতৃক বাড়ি ত্যাগ করতে হল তাঁকে। প্রথমে তিনি আশ্রয় নিলেন বন্ধু দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে। সেখানেও টিকে থাকা দায়। বাধ্য হয়ে চলে যেতে হল চৌরঙ্গিপাড়ায়, সাহেবদের আশ্রয়ে।

সবাই যে নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করছিলেন কিংবা হাবুডুবু খাচ্ছিলেন সুরার সাগরে, এমন নয়। কিন্তু হল্লা করছিলেন প্রায় সবাই। তাঁদের শোরগোল শুনে কানে আঙুল দেন সনাতনপন্থীর দল। আর মনে মনে মুণ্ডপাত করেন ‘কালেজের।’ এঁরা সব ‘কালেজ বয়’ কিনা। তাই ছেলে ছোকরাদের ওপর যতখানি রাগ হয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ হয় কালেজের ওপর। যেমন শিক্ষা, তেমনই তো শিখবে।

কিন্তু সবাই জানেন, হিন্দু কলেজ ঘৃণায় জন্ম নেয়নি। এর জন্মের পিছনে একদিকে যদি ছিল তীব্র শূন্যতাবোধ, তবে অন্যদিকে ছিল প্রখর দূরদৃষ্টি। সে ইতিহাস আজ সকলের জানা, তাই সংক্ষেপে তার রূপরেখাটাই বোধহয় আমাদের এই আলোচনার পক্ষে যথেষ্ট। হিন্দু কলেজের আদিকল্পক কে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সার হাইড ইস্ট, না ঘড়িওয়ালা ডেভিড হেয়ার, তা নিয়ে বোধ হয় আজ আর কোনও বিতর্ক নেই। সবাই মেনে নিয়েছেন: এই কলেজের প্রধান সংগঠক যেমন ডেভিড হেয়ার, অন্যতম প্রেরণা তেমনই রাজা রামমোহন রায়। সন্ধানীরা ১৮১৫ সালের এক সন্ধ্যায় ডেভিড হেয়ারের সঙ্গে রামমোহনের এক নিবিড় বৈঠকের মধ্যেই খুঁজে পান হিন্দু কলেজের আদি ধ্যান। এ ব্যাপারে দুইয়ের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির ঐক্যের কথা সর্বজনবিদিত। নিরীশ্বরবাদী, অন্তত প্রথাগত খ্রিস্টীয় ধর্মাচারে অবিশ্বাসী, ডেভিড হেয়ার যেমন পাদরিদের শিক্ষা-পদ্ধতিতে আস্থাবান ছিলেন না, রামমোহন রায়ও তেমনই ছিলেন নিছক সংস্কৃত শিক্ষার জন্য প্রাণপাত করার বিরোধী। (স্মর্তব্য ১৮২৩ সালে লর্ড আমহার্স্টকে লেখা তাঁর ঐতিহাসিক চিঠিটি, যাতে তিনি দু’হাজার বছর আগেই জানা হয়ে গেছে যে বিদ্যা, তাই নিয়ে শূন্যগর্ভ কচ্‌কচির বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় তাঁর অভিমত জানিয়ে দিয়েছিলেন)। সেই বৈঠকের পরেই সামনে এগিয়ে এসেছিলেন বৈদ্যনাথ মুখার্জি। তিনি রামমোহন রায়ের শিষ্য এবং বন্ধু, সদ্য-প্রতিষ্ঠিত (১৮১৬) আত্মীয় সভার সদস্য। তিনি যোগাযোগ স্থাপন করলেন হাইড ইস্ট-এর সঙ্গে। ইস্ট সাহেবের ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের বাড়িতে প্রস্তাবিত কলেজ উপলক্ষে প্রথম বৈঠক ১৮১৬ সালের ১৪ মে। কলকাতার সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন সে সভায়। এমনকী, সংস্কৃত শিক্ষিত বিশিষ্ট পণ্ডিতেরাও। হাইড ইস্ট রীতিমত বিস্মিত তাঁদের উৎসাহ দেখে। সভাস্থ প্রধান পণ্ডিত মশাই নাকি বিদায় নেওয়ার সময় তাঁকে বলেছিলেন, এমন সৌভাগ্যের ক্ষণে তাঁরা বেঁচে আছেন বলে আনন্দিত। তাই বলছিলাম, হিন্দু কলেজের জন্ম ঘৃণায় নয়, ভালবাসায়।

প্রথম সভাতেই অকৃপণ হাতে চাঁদার খাতায় স্বাক্ষর করেছিলেন সমাজ-নেতারা। অনেকে সেদিন উপস্থিত ছিলেন না। তাঁদের কথা মনে রেখে দ্বিতীয় সভার আয়োজন করা হল ২২ মে, মঙ্গলবার। ধীরে ধীরে অবয়ব লাভ করতে লাগল কলেজের কল্পনা। কমিটি, সাব-কমিটি, সভা, চাঁদা নিয়ে রীতিমত সরগরম শহর কলকাতা। এখানে ইংরাজি শিক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই এমন নয়। চিৎপুরে ছিল সোরবোর্ন সাহেবের স্কুল। ধর্মতলায় ড্রামন্ডের স্কুল, বৈঠকখানায় হাটম্যানের স্কুল। তা ছাড়া, আরাটুন পিদ্রুস সাহেবেরও স্কুল ছিল একটা। ছিলেন প্রাইভেট টিউটরের দল। এসব স্কুল থেকেও নামকরা সব ছাত্ররা বের হয়েছেন বটে, কিন্তু বলা নিষ্প্রয়োজন, সেখানে নিয়মিত ইংরাজি বিদ্যার চর্চা হত না। ‘সর্বপ্রথম লোকের ইংরাজি পড়িতে হইলে টমাস ডিস প্রণীত স্পেলিং বুক, স্কুল মাস্টার, কাসরুনা ও তুতিনামা—এইসকল পুস্তক পাঠ করিতে হইত। ‘স্কুল মাস্টার’ পুস্তকে সকলই ছিল, গ্রামার, স্পেলিং ও রীডর।… যদি কেহ অধিক পড়িতেন, তবে তিনি আরবি নাইট পড়িতেন। যিনি রয়েল গ্রামার পড়িতেন, লোকে মনে করিত, তাঁহার মত বিদ্বান আর কেহ নাই।’ সে কালের ইংরাজী-চর্চা সম্পর্কে লিখছেন রাজনারায়ণ বসু। তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘তখন ঘোষাণোর রীতি ছিল। ঘোষাণের অর্থ পয়ারছন্দে গ্রন্থিত, কোন দ্রব্যশ্রেণীর অন্তর্গত সমস্ত দ্রব্যের ইংরাজী-নাম সুর করিয়া মুখস্ত বলা। আপনি এক স্কুল দেখিতে গেলেন, স্কুল মাস্টার আপনাকে জিজ্ঞাসা করলেন— কি ঘোষাবে? গার্ডেন (Garden) ঘোষাব, না স্পাইস (Spice) ঘোষাব? যদি স্থির হইল গার্ডেন ঘোষাও, তবে সর্দার-পোড়ো চেঁচিয়ে বলিল, ‘পাম্‌কিন (Pumkin) লাউ কুমড়ো।’ অমনি সকলে বলিয়া উঠিল—‘পামকিন লাউ কুমড়ো’।…এই সকল শব্দগুলি একত্র করিলে একটি কবিতা উৎপন্ন হয়। ‘পামকিন লাউ কুমড়ো, কোকোম্বর শসা। ব্রিজেল বার্ত্তাকু, প্লোমেন্ চাষা।’ শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন: ‘সে সময়ে বাক্য-রচনা-প্রণালী বা ব্যাকরণ প্রভৃতি শিক্ষার দিকে দৃষ্টি ছিল না। কেবল ইংরাজী শব্দ ও তাহার অর্থ শিখাইবার দিকে প্রধানত মনোযোগ দেওয়া হইত। যে যত অধিক সংখ্যক ইংরাজী শব্দ ও তাহার অর্থ কণ্ঠস্থ করিত, ইংরাজী ভাষায় সুশিক্ষিত বলিয়া তাহার তত খ্যাতি-প্রতিপত্তি হইত। এরূপ শোনা যায়, শ্রীরামপুরের মিশনারীগণ সে সময়ে এই বলিয়া তাহাদের আশ্রিত ব্যক্তিদিগকে সার্টিফিকেট দিতেন যে, এই ব্যক্তি দুইশত বা তিন শত ইংরাজী শব্দ শিখিয়াছে। এই কারণ সে-সময়ে কোনও কোনও বালক ইংরাজী অভিধান মুখস্ত করিত।’ শহরে যখন সেই সব ওয়াকিং ডিকশনারি বা চলমান অভিধানেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখনই শোনা গেল, নতুন এক ইংরাজি বিদ্যালয় স্থাপিত হতে চলেছে এই কলকাতায়, তার নাম ‘দ্য হিন্দু কলেজ অব ক্যালকাটা।’

হিন্দু কলেজের জন্ম তারিখ, ২০ জানুয়ারি, ১৮১৭। কলেজের আদি কমিটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দশজন ছিলেন ইউরোপিয়ান, উনিশ জন স্বদেশীয়। স্বদেশি সদস্যদের মধ্যে চারজন ছিলেন আবার ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য চাঁদাও দিয়েছিলেন স্বদেশি বিত্তবানেরাই। চাঁদা উঠেছিল এক লক্ষ তেরো হাজার একশো ঊনআশি টাকা। বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর আর কলকাতার গুণীমোহন ঠাকুর দিয়েছিলেন দশ হাজার টাকা করে। কলেজের তহবিলদার নিযুক্ত হয়েছিল ব্যারোটো অ্যান্ড সন্‌স নামে একটি বাণিজ্য-সংস্থা। নতুন এই বিদ্যামন্দিরের জন্য ঠিকানা নির্দেশিত হয়েছিল সেদিনের নগরীর প্রাণকেন্দ্র উত্তর কলকাতায় ৩০৪ নম্বর আপার চিৎপুর রোড। ‘প্রথম গরাণহাটার গোরাচাঁদ বসাক-এর বাড়িতে (যেখানে এক্ষণে ওরিয়েন্টাল সেমিনারী আছে সেইখানে) স্কুলটি সংস্থাপিত হয়। তাহার পর ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়ীতে (এক্ষণে যাহা বাবু হরনাথ মল্লিকের বাটী ও যেখানে সর্বপ্রথম ব্রাহ্ম সমাজ কিছুদিন হইয়াছিল) লইয়া যাওয়া হয়, তথা হইতে স্কুল টিরিটী বাজারে স্থানান্তরিত হয়।’ কলেজের বাড়ি-বদলের এ-খবর রাজনারায়ণ বসুর। প্যারীচাঁদ মিত্র লিখছেন, গোরাচাঁদ বসাকের বাড়ি থেকে কলেজ উঠে আসে চিৎপুরে রূপচরণ রায়ের বাড়িতে, তারপর সেখান থেকে যায় ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে। সেখান থেকে ১৮২৬ সালে হিন্দু কলেজ সরিয়ে আনা হয় গোলদিঘির পারে সংস্কৃত কলেজের নতুন ভবনে। পটলডাঙায় এ বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৮২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সেখানে থাকতে থাকতে ১৮৫৫ সালের ১৫ জুন তারিখে হিন্দু কলেজ কেমন করে নাম পালটে প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়েছিল, কেমন করে রাস্তা পার হয়ে চলে গিয়েছিল অন্য বাড়িতে, সে আর এক কাহিনী। সে কাহিনী এখানে অনাবশ্যক। আমরা তার আগে আদ্যিকালের হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মুখগুলো একবার দেখে নিই।

কেউ বলতেন, হিন্দু কলেজ। কেউ বলতেন, হিন্দু বিদ্যালয়। কেউ কেউ ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কলেজ। যে নামেই ডাকি, হিন্দু কলেজ বাংলা তথা ভারতের নব জাগরণের সাধনপীঠ। উদ্বোধনী উৎসবে বৈদ্যনাথ মুখার্জি নাকি তুলনা করেছিলেন একে বটবৃক্ষের বীজের সঙ্গে। তাঁর আশা ছিল, এই চারাগাছটিই একদিন ফুলে-পল্লবে সুশোভিত হয়ে উঠবে। সে প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়নি। হিন্দু কলেজ যাত্রা শুরু করেছিল মাত্র কুড়ি জন ছাত্র নিয়ে। নামে কলেজ হলেও তাতে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল। জুনিয়ার এবং সিনিয়ার। একাংশ পাঠশালা, অন্য অংশ মহাপাঠশালা। প্রথম বিভাগে যারা পড়ত তাদের বয়স আট থেকে বারোর মধ্যে। বারো বছর বয়স থেকে দ্বিতীয় বিভাগে বসার অধিকার। চৌদ্দর পর কলেজে প্রবেশ নিষেধ।

পড়ার বিষয় অনেক। নীচের ক্লাসে ইংরেজি ভাষা এবং ব্যাকরণ ছাড়াও অংক, ভূগোল, ইত্যাদি পড়তে হত। ওপরের ক্লাসে পড়তে হত ন্যাচারাল ফিলজফি, কবিতা, ইতিহাস, কেমিস্ট্রি অ্যালজেব্রা ইত্যাদি। বাংলা থেকে ইংরাজি করাও পড়ুয়ার চর্চার বিষয় ছিল। মাসে দু’ তিন বার ইংরাজিতে মৌলিক রচনা লিখতে হত। কলেজের ছাত্রদের কিছু দিন সংস্কৃত পড়ানো হয়েছিল। সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, কলেজ-বাড়িতে ইংরাজি পড়ুয়া ‘বাবু’দের সঙ্গে সংস্কৃত পড়ুয়া পণ্ডিতদের মেলামেশার সুযোগও ছিল বন্ধ। গোলদিঘি পারের বাড়িতে এক ছাতের তলায় সবাই পড়লেও, দুই কলেজের মধ্যে ছিল মজবুত লোহার রেলিং। এই রেলিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন নাকি উইলসন সাহেব। ‘এই দুই শ্রেণীর লোকের মধ্যে পরস্পর স্বভাবতঃ বিদ্বেষভাব থাকা নিবন্ধন সর্বদা বিবাদের আশংকা করিয়া তিনি প্রত্যেক কলেজের চতুর্দিকে শক্ত করিয়া রেল দিয়াছিলেন। কলেজের ছাত্রদের ফারসি পড়ানো হত। আদালতে এবং সরকারি কাজে ফারসির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় ১৮২৪ সালে। অবশ্য তার পরও হিন্দু কলেজে ফারসি পড়ানো হয়েছে কয়েক বছর। সে রেওয়াজ বন্ধ করা হয় ১৮৪১ সালে। তারপর থেকে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের পড়াশুনা অর্থাৎ ইংরাজি আর বাংলায়। ব্যাপকভাবে বিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয় ১৮২৪ সালে। ১৮২৭ সালে ড্রয়িং বা চিত্রবিদ্যার ক্লাসও নাকি খোলা হয়েছিল। ১৮৪৭ সালে ব্যবস্থা করা হয়েছিল সংগীত চর্চার।

হিন্দু কলেজের পাঠক্রমের দিকে একনজর তাকালেই বোঝা যায়, নামে যদিও হিন্দু কলেজ, গোড়া থেকেই এই বিদ্যালয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল সম্পূর্ণ সেকুলার, ধর্মনিরপেক্ষ। মুসলমান ছাত্রদের অবশ্য এখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। নানা ঐতিহাসিক এবং সামাজিক কারণে ইংরাজি শিক্ষার প্রতি তাঁদের আসক্তিও ছিল তখন কম। ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মাদ্রাসায় ১৮২৯ সালে ইংরাজি শেখারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বাইশ বছরের চেষ্টায় দু’ জন মাত্র ইংরাজির জন্য জুনিয়ার স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এই ইংরাজি পড়ানো নিয়েই ১৮৫১ সালে মাদ্রাসায় বিক্ষোভ, হট্টগোল।

কিন্তু হিন্দু সন্তানদের সামনে হঠাৎ যেন উন্মোচিত হল এক নতুন জগৎ। তিন মাসের মধ্যে হিন্দু কলেজের ছাত্রসংখ্যা কুড়ি থেকে ঊনষাট। ১৮৩১ সালে মাথা গুনতি করে দেখা গেল, কলেজে ছাত্রসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০২ জনে। ১৮৩৯ সালে পড়ুয়ার সংখ্যা ৫৩৯, নিচু শ্রেণীতে অর্থাৎ পাঠশালায় পড়ে ৩৭২ জন। হিন্দু কলেজ যখন প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়ে গেছে (১৮৫৫), তখন স্কুলের এগারোটি ক্লাসে ২৯৩ জন ছাত্র। ১৮৬৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রসংখ্যা ১৩২ জন। ইংরাজির প্রতি আগ্রহ যে দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে, তাতে আর সন্দেহ কী।

সূচনায় যা ছিল, বলতে গেলে সম্পূর্ণ বে-সরকারি উদ্যোগ, ক্রমে কী করে তা ধীরে ধীরে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে গেল, এবং নিয়ন্ত্রণ ক্রমে পরিণত হল প্রত্যক্ষ পরিচালনায়, এখানে তা বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। পিছনে তার একাধিক কারণ ছিল। সংক্ষেপে বললে, এক কারণ অর্থাভাব। ১৮২৩ সালে ব্যারেটো কোম্পানির গণেশ উলটায়। ফলে কলেজের সর্বনাশ। তহবিলে থেকে যায় মাত্র ষাট হাজার টাকা। ইতিমধ্যে ইংরাজি শিক্ষা বনাম সংস্কৃত শিক্ষা তথা পূর্বের আলো, না পশ্চিমের আলো সে তর্কের মীমাংসা হয়ে গেছে। ‘১৮৩৫ সালের ৭ই মে দিবসীয় এক অবধারণ দ্বারা স্থিরীকৃত হয় যে, ইংরাজী শিক্ষার প্রতি অধিক মনোযোগ প্রদান করা কর্তব্য।’ তারপর ১৮৫৩ সালে মাদ্রাসায় গোলমাল। সরকারি শিক্ষানীতির সঙ্গে পরিবেশ পরিস্থিতিও ক্রমে পালটেছে মাত্র।

প্রশ্ন এই: কলেজের দুয়ার খোলামাত্র সেখানে ছাত্রের ভিড় জমে গেল কেন? এর অনেক উত্তর হতে পারে। অভিভাবকরা জেনেছিলেন, রাজত্ব যখন ইংরাজের তখন ইংরাজি শেখানোই ভাল। তাতে মেলামেশার সুবিধা। হয়তো বা রাজকার্যে সুযোগ মিলতে পারে। তবে সে সুযোগ ইংরাজি-নবিশরা ১৮৪৪ সালের আগে বিশেষ পাননি। সমসাময়িক কাগজগুলোতে, আদালতে ফারসি ভাষার চল বন্ধ করার জন্য, রীতিমতো সওয়াল করা হয়েছে। ১৮২৮ সালে একটি কাগজে লেখা হয়েছিল ‘এখন বাঙ্গালা দেশের মধ্যে তাবৎ আদালতে পারসি ভাষা চলিতেছে তাহা জজ সাহেবের ভাষা উকীলদের ভাষা নয় আসামী ফরিয়াদীর ভাষা নয় এবং সাক্ষিদের ভাষাও নয়। আমাদের বিবেচনায় এই হয় যে যদি আদালতে কোন বিদেশীয় ভাষা চালান উচিত হয় তবে ইংরাজী ভাষা চালান উপযুক্ত।…কলিকাতায় হিন্দু কলেজে চারিশত বালক ইংরাজী শিক্ষা করিতেছে তদ্ভিন্ন কলিকাতার মধ্যে অন্য ২ ইস্কুলে যত বালক ইংরাজী শিখিতেছে তাহাদের সংখ্যা যোগ করিলে এক হাজারের ন্যূন হইবে না এবং তাহারা এমত ইংরাজী শিক্ষা করিতেছে যে আদালতের মধ্যে সওয়াল জবাব করিতে তাহাদের আটক হয় না।’ ১৮৩৪ সালে ইংরাজি জানা বঙ্গসন্তানদের দুর্দশার কথা আলোচনা করে সখেদে বলা হয়েছে, এরা চাকুরি পায় না বলেই আগ্রা-এলাহবাদ এলাকায় এখনও ইংরাজীর বদলে ফারসিরই চর্চা চলছে। কেননা, তারা জানে, ‘ইঙ্গুরেজী বিদ্যাতে কিছুমাত্র লাভ নাই, সম্রম ও উপায়ের বিদ্যাই পারস্য।’ বস্তুত বাঙালি মেয়েরা ব্রতকথায় বহুদিন পর্যন্ত জানিয়ে এসেছেন এই প্রার্থনা: আরশি আরশি, আমার স্বামী পড়ুক ফারসি। অ্যাডামের শিক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্টে (১৮৩৯-৪০) জানানো হয়েছে, মুর্শিদাবাদ জেলা এবং শহরে ফারসি শিখবার স্কুল রয়েছে ১৯টি। তাতে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু ছাত্রই দলে ভারী। বর্ধমানে ফার্সি বিদ্যালয় ৯৩টি। সেখানে হিন্দু আর মুসলমান পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় সমান-সমান। ১৮৩৭ সালে আদালতে ফারসির ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেলেও, ১৮৪৪ সালের সরকারি ঘোষণার আগে পর্যন্ত ইংরাজি বিদ্যার ভবিষ্যৎ ছিল চাকুরিজীবীর চোখে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। সুতরাং, শুধু রাজকার্যে সুযোগের সন্ধানে কলকাতার তরুণেরা হিন্দু কলেজে ভিড় জমিয়েছিলেন, এমন কথা বলা যায় না। জন কলভিন লিখেছেন: হিন্দু সন্তানদের এই আগ্রহের পিছনে কারণ আর কিছু নয়, হিন্দুর মন ছিল শূন্য, সেখানে যা খুশি লিখতে কোনও অসুবিধা ছিল না। কিছু পণ্ডিতকে বাদ দিলে সাধারণ হিন্দু সংস্কৃত জানেন না। বাংলা সাহিত্যও সবে গড়ে উঠছে মাত্র, এবং তাও বয়স্কদের জন্য রচিত সাহিত্য। সুতরাং ‘The Hindu is ready to give his son, his mind a blank page, as soon as he is of age to go, to our school.

একজন বাঙালি ঐতিহাসিক এ সম্পর্কে আলোচনা করে দেখিয়েছেন, রাজার ভাষা বলে নয়, রাজকার্যের পুরস্কার লোভে নয়, মন ওদের পরিচ্ছন্ন স্লেটের মতো ছিল বলেই নয়, হিন্দু কলেজে ভিড়ের কারণ পশ্চিমী নব্য-বিদ্যার প্রতি আগ্রহ। পনেরো হাজার ছাত্র ও পণ্ডিতমশাই তখন এই বাংলায় যে বিদ্যার চর্চা করছেন, নতুন পরিবেশে তার অন্তঃসারশূন্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, রামমোহন যাকে বলেছেন ‘Vain and empty subtleties’ তার মূল্য কত অল্প। হিন্দু কলেজ তথা ইংরাজি বিদ্যালয়গুলোতে ভিড় অতএব স্বাভাবিক।

কারা পড়তে এসেছিলেন সেখানে? সূচনায় যে বিদ্রোহী দলের কথা বলেছি আমরা, ওঁরা কারা? ১৮৩০ সালে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ লিখেছে: ‘হিন্দু কালেজাদি নানা পাঠশালা দ্বারা অনেক বিষয়ী লোকের সন্তানেরা ইংরেজী বিদ্যায় পারগ হইয়াছে হইতেছে ও হইবেক। ইহারা কেহ দেওয়ানের পুত্র কেহ কেরানির ভাই কেহ খাজাঞ্চির ভ্রাতুষ্পুত্র কেহ গুদাম সরকারের পৌত্র কেহ নীলামের সেল সরকারের সম্বন্ধী ইত্যাদি প্রায় বিষয়ী ললাকের আত্মীয় তাহারদিগকে কর্মে উক্ত ব্যক্তিরাই অবশ্য নিযুক্ত করিয়া দিবেন।…’

কথাটা সত্যি। হিন্দু কলেজ সূচনায় নিশ্চয়ই গরিবের ছেলেদের কলেজ ছিল না। ইংরাজি শিক্ষার জন্য তাগিদ অনুভব করলেও নিম্নবিত্তের পক্ষে সম্ভব ছিল না এই কলেজে ছেলে পাঠানো। কারণ হিন্দু কলেজ অবৈতনিক কলেজ নয়। ১৮৫৫ সালে ছাত্রদের মাসিক মাইনে ছিল পাঁচ টাকা। মাঝখানে কিছুদিন অবশ্য নিখরচায় ছাত্র পড়ানো হত, কিন্তু সে ব্যবস্থা বেশিদিন দিন চালু ছিল না। ১৯৩১ সালে কলেজে বেতন দিয়ে পড়তেন যাঁরা, তাঁদের সংখ্যা যদি তিনশো, তবে অবৈতনিক ছাত্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ষাট জন। ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে স্থাপিত স্কুল সোসাইটি অবশ্য কিছু ছাত্রের পড়ার খরচ জোগাতেন, পয়সাওয়ালা বাবুরাও পাঠাতেন কাউকে কাউকে। এক সময় নিয়ম ছিল এককালীন চারশো টাকা দান করলে একটি ছেলেকে কলেজে ছ’বছর পড়ানো যাবে। এই প্রকল্প খুব সহজ হয়েছিল বলে মনে হয় না। হলেও, দাতারা যে গরিবের ছেলেদের পড়তে পাঠাতেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়? প্রথম যুগের হিন্দু কলেজকে অতএব ধনবানদের কলেজ বলে স্বীকার করে নেওয়া ভাল। দ্বিতীয় যে শ্রেণী সেখানে ঠাঁই করে নিতে পেরেছিল, তা হল শহরের নতুন মধ্যবিত্ত। বিত্তে তাঁরা শহরের সম্রান্ত পরিবারগুলোর সমান না হলেও, অন্য কোনও না কোনও লক্ষণে ছিলেন বিশিষ্ট। গভর্নর-জেনারেল (১৮৩৬-৪২) লর্ড অকল্যান্ডের বোন এমিলি ইডেন হিন্দু কলেজের দুটি ছাত্রের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। একটি ছেলে সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য: মিঃ কপ্‌সের একজন আশ্রিত (a protege of Mr. Kops.) দ্বিতীয় পড়ুয়াটি সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত বিশদ বিবরণ রেখে গেছেন তিনি। লিখেছেন: হিন্দু কলেজের প্রধান ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন এই নেটিভ বালককে নিয়ে এসেছিলেন, তার ছবি আঁকাবার জন্য। সে উচ্চতম বর্ণের হিন্দু ঘরের সন্তান। তার পোশাক-পরিচ্ছদ দেখবার মতো। তার অঙ্গে মুক্তা এবং সোনার গহনা। সে আমাকে বোঝাতে চায় এগুলো তারই, তার বাবার নয়। ছবিতে যাতে গহনাগুলো বাদ না পড়ে, সে জন্য তার বিশেষ অনুরোধ। প্রধানত এঁদের নিয়েই আমাদের আদ্যিকালের হিন্দু কলেজ। এঁদের শরীরে যদি দামি অলংকার, আমাদের সে দিনের হতশ্রী সমাজদেহে ওঁরাই তবে জড়োয়া গহনা।

কালেজ-বয় মানেই, বলা নিষ্প্রয়োজন, জ্ঞান-তাপস নয়, অধ্যয়নং তপঃ এই মন্ত্র সেকালেও সব কালেজ-বয় কানে তুলেছিলেন বলে মনে হয় না। ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এর পাতায় খুঁজলে এখনও দেখা যাবে ছাত্র বিক্ষোভের খবর। ১৮২৩ সালে হার্টফোর্ড-এ কোম্পানির সিভিলিয়ান তৈরির কলেজে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল শ্বেতাঙ্গ ছাত্ররা। তাঁদের বয়স ছিল চৌদ্দ থেকে আঠেরোর মধ্যে। যে কোনও কারণেই হোক, খেপে তারা নাকি সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অনেক ছেলেকে কলেজ থেকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করতে বাধ্য হয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। কলকাতায় কোম্পানির কালেজ অর্থাৎ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজেও ছাত্রদের দুর্বিনীত আচরণের কাহিনী অনেক। একজন পণ্ডিত মশাই কেনেডি নামে তাঁর এক সাহেব-ছাত্র সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানাচ্ছেন ১৮৪০ সালে। “২৫ নবম্বর শনিবার নিরপরাধে আমাকে অনেক ঘুষা ও থাবড়া এমন মারিয়াছেন যে আমি দুই দিবস শয্যাগত ছিলাম…।’ শিক্ষককে যে সম্মান দেখাতে হয়, তাও নাকি জানা ছিল না কেনেডি সাহেবের। এ ছাড়া, কলকাতা মাদ্রাসায় ছাত্র-বিক্ষোভের (১৮৫৩) কথা আগেই বলা হয়েছে। আর হিন্দু কলেজে ছাত্রদের অশিষ্ট আচরণের একটি কাহিনীই আমার নজরে পড়েছে। ১৮৩১ সালে বাংলা সমাচারপত্রে ছাপা হয়েছিল সংবাদটি। বক্তব্য: মাধব মল্লিক নামে একজন ছাত্র এক পণ্ডিত মশাইকে কটুকথা বলেছিলেন। কলেজ কমিটি তার বিচার করে ‘তজ্জন্য তাহার সমুচিত দণ্ড করিয়াছেন অর্থাৎ ঐ তেলিপো ব্রাহ্মণ ঠাকুরের পদ ধরিয়া কহিয়াছে এমত কুকর্ম আর করিব না এবার অপরাধ মার্জ্জনা কর।’

একালের মতো সে কালেও কালেজ-বয়রা কখনও কখনও ছেলেমানুষি করেছেন। অংকের শিক্ষক টাইলার সাহেব—রাজনারায়ণ বসু যাঁকে বলেছেন ‘একসেনট্রিক (eccentric) বা কেন্দ্ৰ-বর্জ্জিনী ভাব বিশিষ্ট’ তাঁকে নিয়ে ক্লাসে নানা রসিকতা করেছেন তাঁরা। রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ভি. রস-কে নাম দিয়েছিলেন তাঁরা ‘সোডা সাহেব’। কৃষ্ণমোহন একটা চিঠিতেও নাকি লিখেছিলেন—‘soda and his pupils’. পরবর্তী কালে (১৮৫৬) হিন্দু কলেজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে পরিচালকমণ্ডলীর একাংশ যখন সিন্দুরিয়াপট্টিতে গোপাললাল মল্লিকের বাড়িতে হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ স্থাপন করেন, তখন সেখানকার একজন শিক্ষক যদুনাথ দে-কে নিয়ে ছড়া বানিয়েছিলেন ছাত্ররা, ‘আইকাম বাইকাম তাড়াতাড়ি যদু মাস্টারের শ্বশুরবাড়ি রেল কাম ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম।’ বুঝতে অসুবিধা নেই, এ সব বালসুলভ চাপল্য মাত্র। অশ্রদ্ধা বা অভব্যতার কোনও নজির নয়। এবং বিপরীত আচরণের স্বাক্ষরও রেখে গেছেন দু’একজন শিক্ষক। হেডমাস্টার ডি’ অ্যানসেলেম কলেজের চতুর্থ শিক্ষক ডিরোজিওকে কীভাবে একদিন অপমান করেছিলেন, প্যারীচাঁদ মিত্র তা শুনিয়ে গেছেন। ডেভিড হেয়ারের সামনেই নাকি তিনি ডিরোজিওকে আঘাত করতে উদ্যত হয়েছিলেন। বাধা দিয়েছিলেন বলে খেপে গিয়ে হেয়ারকেও তিনি অপমান করতে দ্বিধা করেননি। আর একজন অধ্যাপক ‘অধ্যক্ষ মেংলাজ’ সাহেবের কীর্তিকথা রয়েছে সমসাময়িক সংবাদপত্রে। তিনি রাস্তায় কোচম্যানদের নাকি চাবুক মারতেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ জানাচ্ছে, ‘এমত জনরব যে ঐ কোচম্যানও তৎকালে সাহেবের রাঙ্গামুখ দেখিয়া ভয় পায় নাই, উপযুক্ত রূপে উত্তর প্রদান করিয়াছিল, সাহেব যেমন সপ্‌ করিয়া প্রহার করিলেন সে ব্যক্তিগত তৎক্ষণাৎ সপাৎ করিয়া সেলামি দাখিল করিয়াছিল।’ এই উপলক্ষে প্রভাকর সম্পাদকের ছড়া—‘নাহিক লাজের লেশ, লোকে বলে লাজ। সকল সংহারকারী, নাম ধর্মরাজ।’ ইত্যাদি। কালেজ-বয় কিন্তু এ ধরনের লজ্জাকর কোনও ঘটনার নায়ক হননি।

হিন্দু কলেজে নানা সময়ে নানা উপলক্ষে প্রভূত উত্তেজনা দেখা গেছে। শিক্ষক ডিরোজিওকে অপসারণের দিনগুলোর কথা সর্বজনবিদিত। সেই ঐতিহাসিক ঘটনা ১৮৩১ সালের কথা। ‘তৎপরে ১৮৫৩ সালে হিন্দু কলেজের শিক্ষক কৈলাস চন্দ্র বসু খৃস্টীয়ান হইয়া যাওয়াতে কলেজ কমিটির এতদ্দেশীয় সভ্যরা তাঁহাকে কর্মচ্যুত করিবার এবং ইংরাজ সভ্যরা তাঁহাকে রাখিবার অভিপ্রায় করাতে তাঁহাদিগের মধ্যে ঘোরতর বিবাদ উপস্থিত হইল।’ সঙ্গে সঙ্গে বিবাদের আর এক উপলক্ষ হয়ে দাঁড়াল ‘হীরা বুলবুল নাম্নী এক পশ্চিমা গণিকার পুত্রকে’ হিন্দু কলেজে ভর্তি করা নিয়ে। ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রে ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন, ‘এই বিষয় লিখিতে লিখিতে আমাদের কাটের কলম কাট হইতেছে।’ লিখেছিলেন ‘এই স্থলে হিন্দু কলেজ’ এই শব্দটি উল্লেখ করিয়াই চতুর্দ্দিগ শূন্য দেখিতেছি।’ পাঠকদের তিনি সগর্বে জানাচ্ছেন: ‘প্রভাকরের জন্মকালীন ড্রোজু সাহেবি’ হেঙ্গামায় একবার হিন্দু কলেজের বিরুদ্ধে লেখনী ধরিতে হইয়াছিল, এইক্ষণে ২২ বছরের পর পুনরায় ‘মুসলীম’ ‘খ্রীস্টানি’ এবং ‘জারজী’—এই ত্রিদোষ জন্য লেখনীকে আবার করসদনে নৃত্য করাইতে হইল।’ এ জাতীয় নর্তন-কুর্দনে মুখ্য ভূমিকা, বলাই বাহুল্য, কলেজ পরিচালক এবং অভিভাবকদের, ছাত্রদের নয়। কালেজ বয় এ সব তর্ক-বিতর্কে দর্শকমাত্র। অবশ্য ভূতপূর্ব কালেজ বয়রা নন, শিক্ষিত সমাজের অগ্রগণ্য হিসাবে তাঁরা নানা সময়ে নানা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছেন। হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজের প্রতিষ্ঠায়ও তাঁদের একাংশের অনেক অবদান।

কালেজ বয়ের খ্যাতি-অখ্যাতি সবই সম্পূর্ণ অন্য কারণে। মুসলমানের দোকানের রুটি-বিস্কুট খাওয়াতেই, কিংবা কৃষ্ণমোহনদের বাড়িতে সেই ভোজসভার অনুষ্ঠানেই শেষ হয়ে যায়নি তাদের দুঃসাহসিকতার কাহিনী। কালেজ-বয়, বলতে গেলে, সেদিন প্রত্যহ চাঞ্চল্যকর খবর।

রসিককৃষ্ণ মল্লিক নামে হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন একজন। আদালতে একবার সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল তাঁকে। তখন নিয়ম ছিল, হিন্দু সাক্ষীদের তামা-তুলসী, বেলপাতা আর গঙ্গাজল হাতে নিয়ে শপথ নিতে হবে। রসিককৃষ্ণের সামনে যখন গঙ্গাজলের পাত্রটি ধরা হল, তখন আদালত-সুদ্ধ লোককে চমকে দিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, আমি গঙ্গাজলের পবিত্রতায় বিশ্বাস করি না। ‘যখন ইন্টারপ্রিটার উচ্চৈস্বরে ইংরাজিতে অনুবাদ করিয়া জজকে শুনাইলেন— ‘I do not believe in the sacredness of the Ganges.’

তখন একেবারে চারিদিকে ‘ইস্‌ ইস্‌’ শব্দ উঠিয়া গেল, হিন্দু শ্রোতৃগণ কানে হাত দিলেন। অর্থ দণ্ডের মধ্যে এই সংবাদ শহরে ছড়াইয়া পড়িল।

আর এক কালেজ বয়, নাম তাঁর মাধব মল্লিক, প্রকাশ্য স্বনামে লিখলেন—

‘If there is anything that we hate from the bottom of our heart, it is Hinduism.’

ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখেছেন তখন হিন্দুর ছেলে ‘ধবলাঙ্গী তাম্রকেশী বিড়াল-লোচনা বিবাহ করিব সুখে ইংরেজ ললনা।’

শুধু মৌখিক আস্ফালন নয়, ব্যক্তিগত আচার-আচরণেও কালেজ-বয় স্পষ্টতই অন্য রকম। লাল বিহারী দে ওঁদের পোশাক সম্পর্কে লিখেছেন: বৈচিত্র্যে ওদের পোশাকের বুঝি তুলনা হয় না। আশ্চর্য সে সব পরিচ্ছদ। একের সঙ্গে অন্যের কোনও মিল নেই। লন্ডনে ফ্যাশনের নিয়ামক যাঁরা, তাঁরা এঁদের এক-একজনকে নমুনা হিসাবে অনায়াসে গ্রহণ করতে পারতেন। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক দেশের জাতীয় পরিচ্ছদের কিছু-না-কিছু অংশ খুঁজে পাওয়া যাবে এঁদের পোশাকে। আর খাদ্যাখাদ্য? দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায় তাঁর আত্মচরিতে লিখেছেন ‘হিন্দু কলেজের শিক্ষিত ছাত্রগণের মধ্যে যাঁহারা এ-দেশের সমাজ সংস্কার করিতে ব্ৰতী হইয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই সুরাপান করিতেন। পূর্বে বলিয়াছি, হিন্দু কলেজের সুশিক্ষিত মাধবচন্দ্র মল্লিক এখানে (কৃষ্ণনগরে) ডেপুটী কালেকটর ছিলেন এবং আমাদের প্রতি যথেষ্ট স্নেহ করিতেন। আমরা চারি-পাঁচজন আত্মীয় কখনও কখনও তাঁহার বাসায় আহারের সঙ্গে মৃদু মদিরা পান করিতাম এবং বড়ই সুখী হইতাম।’ শিবনাথ শাস্ত্রী রাজনারায়ণ বসুর মদ্যপানের চমকপ্রদ উপাখ্যান শুনিয়েছেন। রাজনারায়ণ সুরাসক্ত হয়েছিলেন হিন্দু কলেজে পড়ুয়া থাকা কালেই। তখন তার বয়স নাকি যোল-সতেরর বেশি নয়। বাবা নন্দকিশোর বসু তা জানতে পেরে ‘আলমারি খুলিয়া একটি বোতল ও একটি মদের গ্লাস বাহির করিলেন এবং কিঞ্চিৎ সুরা ঢালিয়া পুত্রকে পান করিতে দিলেন এবং নিজে একটু পান করিলেন। বলিলেন—‘যখনি সুরা পান করিবে তখনি আমার সঙ্গে পান করিবে, অন্যত্র পান করিবে না।’ রাজনারায়ণ বসু লিখেছেন, ‘তখনকার সময়গুণে ডিরোজিওর যুবক শিষ্যদিগের এমনি সংস্কার হইয়াছিল যে, মদ খাওয়া ও খানা খাওয়া, সংস্কৃত ও জ্ঞানালোকসম্পন্ন মনের কার্য। তাঁরা মনে করিতেন এক গ্লাস মদ খাওয়া কুসংস্কারের উপর জয়লাভ করা।’

পোশাক এবং খানাপিনায় যে বিরুদ্ধাচার, কালেজ-বয় তাই দেখাতে লাগলেন ব্যক্তিগত আচার-আচরণেও। ব্রাহ্মণ-সন্তান গলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিলেন পইতে। বললেন, আমি সন্ধ্যা-আহ্নিক করতে পারব না। সে কী কথা? হিন্দুর ছেলে আচার বিচার মানবে না? বাবা জোর করে জেলেকে ঢোকালেন ঠাকুর-ঘরে। তার পর বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন দরজাটি। ছেলে ভেতরে বসে শুরু করল—শাস্ত্র পাঠ। অবশ্য সে শাস্ত্র গীতা নয়, হোমারের ‘ইলিয়ড’।

গোঁড়া বাপ-মায়েরা বিপদে পড়লেন। যাঁরা একটু জবরদস্ত প্রকৃতির, তাঁরা বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন। রসিককৃষ্ণ মল্লিক নামক সেই ছেলেটিকে বাইরে চালান দেওয়া স্থির হল। সজ্ঞানে তা সম্ভব নয়। সুতরাং, ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করা হল তাঁকে। কিন্তু ‘ইয়ং বেঙ্গলের’ হার্ট, কবরেজি ওষুধ ধরল না। অসময়ে জ্ঞান ফিরে এল রসিকের। তিনি বাড়ি ছেড়ে পালালেন।

‘অনেকেই গৃহত্যাগী হবে গো, ক্রমে ক্রমে অনেকেই হবে।’ দুই চোখ কপালে তুলে এইমাত্র মৌলালিতে কী দেখে এসেছেন তারই বিবরণ দিয়ে ফিরতেন বৃন্দাবন ঘোষাল নামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। হিন্দু পল্লীতে ঘোষাল ভ্রাম্যমান খবরের কাগজ। ডিরোজিও স্বয়ং তাঁর অপপ্রচারের কথা উল্লেখ করেছেন উইলসনের কাছে লেখা সেই ঐতিহাসিক চিঠিতে। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, ‘সে ব্রাহ্মণের কাজ-কর্ম কিছু ছিল না, প্রাতে গঙ্গাস্নান সারিয়া ধনীদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরিত এবং এই সকল সংবাদ ঘরে ঘরে দিয়া আসিত। সে বলিয়া বেড়াইত যে, ডিরোজিও ছেলেদিগকে বলেন, পিতাকে মান্য করা অবশ্য কর্তব্য নয়, ঈশ্বর নাই, ধর্মাধর্ম নাই, মাতা-পিতাকে মান্য করা অবশ্য কর্তব্য নয়, ভাইবোনে বিবাহ হওয়াতে দোষ নাই, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সহিত ডিরোজিওর ভগিনীর বিবাহ হইবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্রমে শহরে একটা হুলুস্থুল পড়িয়া গেল।’

হুলুস্থুলুর পেছনে কারণ ছিল একাধিক। একদিকে দেওয়ানজি মশাইয়ের সমাজ, অন্যদিকে হিন্দু কালেজ, ডিরোজিও এবং তাঁর অনুগামী এই সব কালেজ-বয়। তদুপরি পাদরিদের বক্তৃতা। রামমোহনের কাছে একবার কে একজন নাকি নালিশ করেছিলেন, দেওয়ানজি, আমাদের অমুক আগে ছিল polytheist, তারপর হয়েছিল deist, এখন হয়েছে atheist. রামমোহন শুনে উত্তর দিয়েছিলেন, শেষে বোধহয় হবে beast. রামমোহন হেসে উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা, কিন্তু ক্রোধে অন্ধ হয়ে পড়লেন অন্যরা। শুরু হল কালেজ বয়দের ওপর আক্রমণ। সেই সঙ্গে তাঁদের মন্ত্রদাতা হিন্দু কলেজের প্রাণপুরুষ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওকে (১৮০৯-১৮৩১) কলেজ থেকে বিতাড়ণের চেষ্টা। ‘সতীদ্বেষী’দের নেতা হিসাবে রামমোহনের বিরুদ্ধেও আক্রমণ কম চলেনি। একবার চিৎপুরের রাস্তায় ইট মারা হয়েছিল তাঁর গাড়িতে। দরজাটা টেনে দিয়ে রামমোহন নাকি কোচম্যানকে বলেছিলেন ‘হেঁকে যাও’। আপন খুশিতে বুক উঁচিয়ে হেঁকেই গেলেন তিনি সনাতন সমাজের উঠোন দিয়ে। বিদ্যাসাগরও তাই করেছেন পরবর্তী কালে। পিছু হটানো সম্ভব হয়নি ডিরোজিওকে এবং তাঁর শিষ্যবর্গদেরও। কিন্তু সকলেই জানেন, রক্ষণশীলদের চাপে কলেজ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। এসব ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসের কথা। হিন্দু কলেজের পরিচালক সমিতির সদস্যরা জরুরি সভায় সমবেত হয়ে স্থির করলেন ডিরোজিওকে কলেজ থেকে বিদায় করাই কর্তব্য। ডিরোজিও ‘শিক্ষক হিসাবে অযোগ্য—’ এ অপবাদ তাঁকে দেওয়া গেল না। ন’জনের মধ্যে ছ’জন সদস্যই বললেন, শিক্ষক হিসাবে ডিরোজিওর যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্নই উঠতে পারে না। কিন্তু হিন্দু সমাজের মধ্যে যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিত ডিরোজিওকে কলেজে রাখা সঙ্গত কি না, এই প্রশ্নে সনাতনীরাই জয়ী হলেন। উইলসন এবং হেয়ার সাহেব নীরব রইলেন কারণ প্রশ্নটা যখন একান্তভাবে হিন্দু সমাজের মনস্তুষ্টি নিয়ে, তখন তাঁদের পক্ষে মুখ না খোলাই সঙ্গত। ডিরোজিও বিদায় নিতে বাধ্য হলেন। তবে বিনা প্রতিবাদে নয়। পদত্যাগ-পত্রে তিনি লিখেছিলেন: যে অপরাধী তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হল না, সে জানতেও পারল না কী তার অপরাধ। অথচ একতরফা বিচার এবং দণ্ডদান দুই-ই শেষ। এইচ এইচ উইলসনের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে তাঁর দীর্ঘ জবাব আজ এক ঐতিহাসিক সনদ বলে গণ্য। শুধু ডিরোজিও নন, তাঁর শিষ্যদল তথা উনিশ শতকের ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বা ‘ইয়ং ক্যালকাটা’ গোষ্ঠীর মানসিকতা বোঝার পক্ষেও অতিশয় মূল্যবান সেই দলিল। তিনি লিখেছিলেন অন্ধ ধর্মীয় গোঁড়ামিই আমার প্রতি তাঁদের বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলেছে। তা যদি না হত, তা হলে এরকম অভিনব কৌশলে সমস্ত সৌজন্য ও শালীনতা বোধ জলাঞ্জলি দিয়ে এভাবে তাঁরা আমাকে পদত্যাগে বাধ্য করতেন না। প্রকাশ্যে এ অবিচারের প্রতিবাদ জানাতেও আমার প্রবৃত্তি হয় না, কারণ এতে পরোক্ষে ওঁদের মতামতকেই মর্যাদা দেওয়া হবে। আমি মনে করি না এই মর্যাদাটুকুও তাঁদের প্রাপ্য।

ডিরোজিও হিন্দু কলেজে যোগ দেন ১৮২৬ সালের মে মাসে, আর পদত্যাগ করেন ১৮৩১ সালের এপ্রিলে। হিন্দু কলেজের জীবনে এই ক’টি বছর যেমন সুফলা, তেমন বুঝি আর কখনও নয়। হিন্দু কলেজে অনেক বিশিষ্ট শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু বাঙালি তরুণের হৃদয়ের রাজা যদি কাউকে বলা যায়, তবে তিনি ডিরোজিও। তাঁর হাতেই ছিল সেই সোনার কাঠি, যার স্পর্শে ঘুম ভাঙিয়েছিলেন তিনি এই তন্দ্রাতুর জাতির। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, ‘ডিরোজিও চতুর্থ শ্রেণীর সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক হইলেন বটে, কিন্তু চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে তেমনি তিনিও অপরাপর শ্রেণীর বালকদিগকে আকৃষ্ট করিলেন। তিনি স্কুলে পদার্পণ করিবামাত্র বালকগণ তাঁহার চারিদিকে ঘুরিত। তিনি তাহাদিগের সহিত কথা বলিতে ভাল বাসিতেন। স্কুলে ছুটি হইয়া গেলেও অনেকক্ষণ বসিয়া তাহাদিগের পাঠে সাহায্য করিতেন, এবং নানা বিষয়ে তাহাদের সহিত কথোপকথন করিতেন। তিনি কেবল স্কুলের ছুটির পর বালকদিগের সহিত কথোপকথন করিয়া তৃপ্ত হইতেন না, তাহাদিগকে আপনার বাড়ি যাইতে বলিতেন। সেখানে তাহাদিগের সহিত বয়স্যভাবে মিশিতেন…।’ বিখ্যাত বিতর্কসভা অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮২৮) তাঁরই কীর্তি। হিন্দু কলেজের পড়ুয়াদের মুখপাত্র ‘পার্থেনন’-এর (১৮৩০) পিছনেও প্রেরণা তিনিই। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের আলোচনা ধারা, পার্থেনন-এর বক্তব্য এবং ডিরোজিও-শিষ্যদের চালচলন ও ক্রিয়াকলাপ—সব মিলিয়ে আমাদের গোবর-লেপা আঙিনায় সেদিন যেন ভূমিকম্প। আজকের একজামিনে পাওয়া, নোট-পড়া, ক্ষীণতনু কালেজ বয়দের সঙ্গে তুলনা চলে না সেদিনের বিদ্রোহীদের। তাদের মাথায় যেমন মগজ, কলজেয় তেমনই সাহস। হাল আমলে সত্তরের দশকের বিদ্রোহী তরুণেরা কেউ কেউ আজ সগর্বে বলেন—তাঁরা ডিরোজিওরই উত্তরসাধক।

হিন্দু কলেজের ছাত্রদের রচনাবলির মর্ম মাঝে মাঝে প্রকাশিত হত ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ। ১৮২৮ সনে রচনার বিষয় ছিল: উত্তমাশা অন্তরীপের পথে কার লাভ বেশি, ইউরোপের না এশিয়ার? এক জন ছাত্র যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে ফরাসি এবং ইংরেজরাই লাভবান হচ্ছেন বেশি। আর এক জন লিখলেন, জ্ঞাত পৃথিবীতে এশিয়াই সবচেয়ে বেশি সম্পদের অধিকারী, সুতরাং, ধনস্রোত পশ্চিমগামী। তা ছাড়া, ইউরোপের নৌ-শক্তি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করছে এশিয়া। আর একজনের বক্তব্য: ইউরোপের লাভ আর্থিক, আমাদের মানসিক,। ‘পার্থেনন’-এর পাতায় আলোচনার বিষয় ছিল স্ত্রী-শিক্ষা, স্বল্প খরচে ন্যায়-বিচার লাভের প্রয়োজনীয়তা, কুসংস্কার ইত্যাদি ইত্যাদি। কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাগজটির প্রকাশ বন্ধ করতে হয়। বস্তুত দ্বিতীয় সংখ্যাটি নাকি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলেন ওঁরা। লালবিহারীর কথায় বললে: অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠকে শোনা যেত বাংলার সিংহশিশুদের গর্জন—‘ডাউন উইথ হিন্দুইজম। ডাউন উইথ অরথোডকসি৷’ সেখানে ইতিহাস আলোচনার সময় কালেজ-বয়দের মুখে শোনা যেত মুহুর্মুহু গিবন এবং রবার্টসন থেকে উদ্ধৃতি, রাজনৈতিক আলোচনায় অ্যাডাম স্মিথ এবং জেরেমি বেনথামের টান পড়ত, বিজ্ঞানে নিউটন, ডার্ভি। ধর্মীয় বক্তব্য বিশদ করতেন ওঁরা হিউম এবং টম পেইনের সাহায্যে, দর্শনের কথা লক, ব্রাউন যোগে। আর প্রসঙ্গ যখন সাহিত্য, তখন কথায়-কথায় এসে পড়তেন বায়রন, ওয়ালটার স্কট এবং রবার্ট বার্নস। প্রবীণেরা পর্যন্ত অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতেন ছেলেগুলোর মুখের দিকে। মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগানবাড়িতে প্রতি সপ্তাহে যে অতিথিরা হাজির থাকতেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ডেভিড হেয়ারের নাম। সবুজ রঙের কোট পরে আসতেন তিনি। তরুণদের সংসর্গে তিনিও যে তরুণ।

ডিরোজিওর কথা—‘টু লিভ অ্যান্ড টু ডাই ফর ট্রুথ’। জীবন উৎসর্গ করতে হবে সত্যের সাধনায়। তাঁর অনুগামী দল এই মন্ত্র গ্রহণ করেছিলেন মনে-প্রাণে। সত্যের প্রতি এই যে আগ্রহ, পাপাচারের প্রতি এই যে ঘৃণা তার একমাত্র প্রেরণা ছিলেন ডিরোজিও—কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করেছেন রাধানাথ শিকদার। রাম গোপাল ঘোষ ঘোষণা করেছেন ডিরোজিয়ানদের মন্ত্র ‘He who will not reason is a bigot, he who cannot, is a fool, and he who does not, is a slave.’

সেদিনের কালেজ-বয় এই মন্ত্রেই বুঝি জ্ঞান-তাপসের আশ্চর্য এক দল। টম পেইনের এজ অব রিজ্‌ন-এর একটি কপি সংগ্রহ করার জন্য তাঁরা সে দিন আট টাকা খরচ করতেও রাজি। একজন প্রকাশক নাকি পাঁচ টাকা দরে একশো বই বেচেছিলেন। অথচ বইটির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল ন্যায্য মূল্য একটাকা। ডাফ লিখে গেছেন ওদের কাছে বেদবাক্য ছিল হিউম আর পেইনের বক্তব্য। এসব শুনে আমেরিকার এক ‘হীনমনা প্রকাশক’ জাহাজ বোঝাই করে এসব বই পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। সস্তা সংস্করণও নাকি পাঠিয়েছিলেন ওঁরা। ১৮৩৬ সালে কলকাতার একটা ইংরাজি কাগজ লিখেছিল: এঁরা সবাই চরমপন্থী, বেনথামের অনুগামী। ওঁরা অ্যাডাম স্মিথের ভক্ত, অতএব ‘টোরি’ এই শব্দটাই ওঁদের কাছে অশ্রাব্য। সেদিনের নবীন পড়ুয়াদের পড়ার আগ্রহ সম্পর্কে এক অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনিয়েছেন সি ই ট্রেভিলিয়ান তাঁর ১৮৩৮ সালের শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিবেদনে। গঙ্গায় ফেরি স্টিমার দেখলেই ছেলেরা নাকি ঘিরে ধরতেন সাহেবদের, বই ভিক্ষা করতেন। একবার এক জন ইংরেজ তাঁদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন, ‘কোয়ার্টারলি রিভিউ’-এর পাতা ছিঁড়ে ভাগাভাগি করে প্রত্যেকের হাতে তুলে দিয়ে।

ছাত্র হিসাবে কেমন ছিলেন ওঁরা? সেদিনের কালেজ-বয় বিদ্যাবুদ্ধিতে আজও প্রবাদপ্রতিম। এমিলি ইডেন একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ইটনের ষষ্ঠ শ্রেণীর যে কোনও ছাত্রকে এরা কাত করে দেবে অংকে। আর যদি ইতিহাস হয়, তবে যে কোনও বৃদ্ধকেও। আশ্চর্য এদের স্মৃতিশক্তি। ‘They asked them to give an account of the first Syracusan War, of the Greek Schools and their founders, when the Septennial Bill was passed and why, what Pope thought of Dryden, what school of philosophy Trojan belonged to, in short, dodged them about in this way- and they gave most detailed and correct answers.’ জনশিক্ষা বিষয়ক কমিটিও তাঁদের প্রতিবেদনে একই কথা বলেছেন হিন্দু কলেজের পড়ুয়াদের সম্পর্কে। ১৮৩১ সালেই তাঁরা কবুল করেছিলেন: ইংরাজি ভাষা এবং সাহিত্য সম্পর্কে এদের জ্ঞান ইউরোপের যে কোনও বিদ্যালয়ের ছাত্রদের চেয়ে বেশি। শুধু জ্ঞানের পরিধি দেখে নয়, সনাতন সমাজ আরও বিচলিত নবলব্ধ এই জ্ঞানের আলোতে ওঁরা সমাজ সংসার তথা ধর্ম, রীতি-নীতি, সংস্কার—সব কিছুকেই যাচাই করতে বসেছেন দেখে। ১৮২৮ সালে ‘সমাচার দর্পণ’ লিখেছিল, ‘পূর্ব্বে ইংরাজেরা এমত বুঝিতেন যে বাঙ্গালিরা কেবল কেরাণীগিরির উপযুক্ত যৎকিঞ্চিৎ ইংরাজী শিক্ষা করে কিন্তু এখন দেখা গেল তাহারা আপনাদের দেশভাষার ন্যায় ইংরাজী শিক্ষা করিতেছে।’ মেকলে চেয়েছিলেন, শাসক এবং শাসিতের মধ্যে এক দল মধ্যবর্তী, অর্থাৎ কিনা, দোভাষী শ্রেণী গড়ে উঠুক। তাঁর মিনিট-এ (১৮৩৫) স্পষ্টই তিনি লিখেছিলেন: ‘We must do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern; a class of persons Indian in blood and colour but English in tastes, in opinion, in morals and in intellect.’ কিন্তু কলেজ-বয় এই গণ্ডির মধ্যে থাকতে রাজি হলেন কোথায়? লক্ষণ কিন্তু আগেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, এঁরা শুধু হিন্দু ধর্মকেই’ যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিরস্ত হবেন না, পা বাড়াতে চাইবেন অন্য এলাকায়ও। সার চার্লস উড সে সব দেখেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন লর্ড ডালহৌসিকে: ‘Your Bengalees reading Bacon and Shakespeare—future detractors, opponents and gurmblers.’

১৮৩০ সালের ‘ইন্ডিয়া গেজেট’-এ হিন্দু কলেজের এক পড়ুয়া সওয়াল করলেন, এদেশে ইংরেজদের স্থায়ী ভাবে বসবাসের বিরুদ্ধে। সে-বছর ডিসেম্বরে টাউনহলে জুলাই-বিপ্লবের স্মরণ সভায় সদলবল হাজির হলেন তাঁরা। বড়দিনে দেখা গেল, মনুমেন্টের মাথায় উড়ছে ফরাসি বিপ্লবের তেরঙা পতাকা।

ডিরোজিও বিদায় নেওয়ার পরও স্তব্ধ হল না তাঁদের গর্জন। যে সভায় ডিরোজিওকে অপসারণের ব্যবস্থা হয়, সেখানেই ছাত্রদের সম্পর্কে গৃহীত হয়েছিল কিছু নির্দেশ। যেমন: যাদের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে অভিযোগ এসেছে, তাদের কলেজ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। যারা ভোজসভায় যোগ দেয়, কিংবা যারা এদেশের সামাজিক প্রথা মেনে চলে না তাঁদেরও আর কলেজে রাখা হবে না। বিদ্যালয় ছুটির পর ছাত্রদের কলেজ এলাকায় থাকতে দেওয়া হবে না। ছাত্ররা বাইরের কোনও সভা-সমিতিতে যোগ দিতে পারবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শুরু হল কাগজে কাগজে আক্রমণ। ওঁরা জানিয়ে দিলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনও অধিকার নেই কলেজের বাইরে ছাত্রদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করার। অর্থাৎ কিনা, কালেজ-বয় যথাপূর্ব ডিরোজিওর অনুরাগী রয়ে গেলেন।

অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন বেঁচে ছিল ১৮৩৯ সাল অবধি। ডিরোজিওর মৃত্যুর (ডিসেম্বর ১৮৩১) পরে এর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ডেভিড হেয়ার। বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে কৃষ্ণমোহন বের করলেন তাঁর প্রসিদ্ধ কাগজ ‘এনক্যোয়ারার’। রসিককৃষ্ণ মল্লিক ছাপতে শুরু করলেন ‘জ্ঞানান্বেষণ’। বাংলায় সে কাগজের মূল মন্ত্র ‘বাঞ্ছা হয় জ্ঞান তুমি, কর আগমন দয়া সত্য উভয়কে করিয়া স্থাপন লোকের অজ্ঞান রূপ হয় অন্ধকার। একেবারে শঠতার করহ সংহার।’ ডিরোজিও নিজে প্রকাশ করলেন ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়ান’, তারপর আরও অনেক কাগজ ‘বেঙ্গল স্পেক্‌টেটর’, ‘কুইল’ ইত্যাদি। একদিকে সনাতনপন্থীদের কুৎসা, অন্যদিকে ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর যুক্তিবাদী প্রতি-আক্রমণ। লড়াই চলেছিল ডিরোজিওর তিরোভাবের পরেও, এক যুগ অবধি।

শুধু কুসংস্কার বনাম যুক্তিবাদ নয়, আগেই বলা হয়েছে সেদিনের কালেজ-বয় কলম হাতে পা বাড়িয়েছিলেন বৃহত্তর অঙ্গনে।

১৮৩৩ সালে রসিককৃষ্ণ মল্লিক প্রবন্ধ লিখলেন পুলিশের মধ্যে দুর্নীতি সম্পর্কে। ১৮৪২ সনে তারাচাঁদ সওয়াল করলেন: সরকারি উদ্যোগে আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। ১৮৪৯ সালে ‘ব্ল্যাক বিল’-এর বিরুদ্ধে রাম গোপাল ঘোষের বজ্রনির্ঘোষ আজও বাঙালির মনে ঐতিহাসিক স্মৃতি। যেন ফৌজদারি বালাখানায় সে দিন হাজির ছিলাম আমরাও। ১৮৪৩ সালে বিচার-ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন দক্ষিণারঞ্জন, প্যারীচাঁদ মিত্র ১৮৪৬ সালে রায়তের স্বার্থরক্ষার জন্য লেখালেখি করেছেন, কুলিনগ্রিহের কাহিনী বর্ণনা করেছেন রাধানাথ শিকদার বেঙ্গল স্পেকটেটরের পাতায়। সেকালে যত সভাসমিতি হত, সর্বত্র ওঁরা। হয় উদ্যোক্তা, না হয় পরিচালকের ভূমিকায়। ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ থেকে শুরু করে ১৮৪৩ সালে স্থাপিত— বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি। কোথায় নেই ওঁরা?

কালেজ-বয় অকুতোভয়। ১৮৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। হিন্দু কলেজের সভাকক্ষে সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার বৈঠক বসেছে। প্রবন্ধ পড়বেন দক্ষিণারঞ্জন। অতিথি হিসাবে উপস্থিত রিচার্ডসন সাহেব। দক্ষিণারঞ্জনের আলোচ্য বিষয়, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে,—বিচার ব্যবস্থা। তিনি আদালতে দুর্নীতি, আমলাদের যথেচ্ছাচারের কথাও বাদ দিলেন না। ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এখানে রাজদ্রোহের কথাবার্তা বলতে দিতে পারব না। কিন্তু সভাপতি তারাচাঁদ রসিয়ে দিলেন তাঁকে। অতিথির কোনও অধিকার নেই সভার কাজে বাধা দেওয়ার। কালেজ-বয়দের এই বক্তব্য। হট্টগোলের মধ্যে সেদিনের সভা শেষ হল। দক্ষিণারঞ্জনের অসমাপ্ত রচনা পড়া হল অন্য সভায়।

এই যাঁদের মনোভঙ্গি সনাতনপন্থীদের আক্রমণে তাঁরা রণেভঙ্গ দেবেন, এমন আশা করা যায় না। এনক্যোয়ারারের পৃষ্ঠায় কৃষ্ণমোহন লিখেছিলেন, ‘Blessed are we, that we are to reform the Hindu nation, we have blown the trumpet, and we must continue to blow on. We have attacked Hinduism, and we will persevere in attacking it, until we finally seal our triumph.

১৮৩০ সালে ওঁদের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘ চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য়। অভিযোগ: কলেজে পড়ুয়া হওয়ার পর ছেলে বিগড়ে গেছে। ‘ঐ সন্তানকে দেশানুসারে পোশাক দিলে কহে আমি জগঝম্পওয়ালা বা কীর্তনের পাইল নহি যে এমন পোশাক পরিব। বলে আমি মোজা ওয়াকিংশুজ ও ইজারআদি চাহি’। শুধু তাই নয়, ‘ইহারা কেহ নাস্তিক কেহ বা চার্ব্বাক কেহ এক আত্মবাদী কেহ বা দ্বৈতবাদী নিশ্চিত আচারব্যবহার-দ্বেষী যাহা ভাল বোধ হয় সেই গ্রাহ্য ইঙ্গরেজী ব্যবহার ও চলনে অসীম ভক্তি বিষয়কৰ্ম আর অন্য প্রকরণে সুপ্তি এবং অমনোযোগী কিন্তু যখন হাঁটে ইংরেজের মত মস ২ করিয়া দ্রুত চলে…ইত্যাদি।’ উত্তরে ‘কস্যচিৎ যথার্থবাদিন:’ এই ছদ্মনামে প্রশ্ন তুলেছিলেন কালেজ বয়: দোষ কি কালেজের? কালেজ স্থাপিত হওনোর পূর্বে এতদ্দেশীয় কয়েকজন বাঁকা বাবুরা তাঁহারদিগের স্ব স্ব পিতৃবিয়োগের পর পৈত্রিক ধন্যধিকারী হইয়া ধনযৌবন এবং মূর্খতাপ্রযুক্ত মদ্যপান এবং যবনীগমনাদি কোন অবৈধ কর্ম না করিয়াছেন?’

যেমন তীক্ষ্ণ ওঁদের সওয়াল জবাবের ধারা, তেমনই চরিত্রেও যেন অন্য প্রজাতির মানুষ ওঁরা। তারাচাঁদের দুর্দিন। খবর পেলেন দক্ষিণারঞ্জন। বেনামিতে টাকা পাঠিয়ে দিলেন তক্ষুনি। হারুচন্দ্র মুনসেফ হয়েছিলেন বাঁকুড়ায়। একশো বছর তাঁর কথা মুখে মুখে বলাবলি করেছে বাঁকুড়াবাসী। অমৃতলাল সরকারি চাকুরি পেলেন। তোষাখানার অধিকর্তা। লোকে ভাবল, এবার আর তাঁকে পায় কে? কিন্তু চাকুরি ছেড়ে যখন বাড়ি ফিরেছেন বেচারা, তখন দেখা গেল অবস্থা তাঁর ফিরেছে বটে, তবে মন্দের দিকে। সুদূর পশ্চিমে এক দেশীয় রাজ্যে দুর্ভিক্ষ। প্রজাদের কষ্ট নিয়ে কাগজে লেখালেখি জুড়লেন অজ্ঞাতনামা এক সন্ন্যাসী। স্থানীয় রাজা বিদ্রোহে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে কয়েদ করলেন তাঁকে। পরে শোনা গিয়েছিল তিনিও কালেজ-বয়, ডিরোজিওর ছাত্র।

কালেজ-বয় সব পারে। আসক্তি তার শুধু মদ্য, খাদ্য আর ইংরাজি পদ্যে নয়, সমান ব্যাকুলতা তাঁর আলোর জন্য। কিশোরীচাঁদ মিত্র সমসাময়িক একটি ইংরাজি কাগজের পৃষ্ঠা থেকে ব্যঙ্গাত্মক একটি বাক্য উদ্ধৃত করেছেন। হিন্দু কলেজের ছেলেরা নাকি ‘Cutting their way through ham and beef and wading to liberalism through tumblers of beer.’ সন্দেহ নেই কিছুটা উচ্ছ্বাস তাঁদের মধ্যে ছিল। ছিল নানা বৈপরীত্য। আত্মখণ্ডনের দৃষ্টান্তও হয়তো অলভ্য নয়। কিন্তু ‘ইয়ং বেঙ্গল’ অথবা ‘ইয়ং ক্যালকাটা’ গোষ্ঠীকে নিছক হুজুগ বলে গণ্য করলে, বিচার-বিভ্রাটের দায় এড়ানো শক্ত। ‘ওঁরা ময়ূরপুচ্ছধারী দাঁড়কাক’ এই অপবাদও সম্ভবত শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি, প্যারীচাঁদ মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিংবা পরবর্তী কালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অথবা রাজনারায়ণ বসু—আপন সম্প্রদায়ের ভাষা ভাব ভাবনা এবং সংস্কৃতিক্ষেত্রে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের অবদান কে না জানেন? আপন আচরণে কালেজ-বয়রা বার বার জানিয়েছেন, তাঁরা নিষিদ্ধ মাংস খেতে পারেন বটে, কিন্তু পারেন না যুক্তিহীন কাজ করতে। হিন্দু কলেজের কেরানিবাবু লিখে গেছেন। ‘It was a general belief and saying amongst us that such and such a boy is incapable of falsehood, because he is a college boy.’

মন ওঁদের যুক্তিবাদী। সুতরাং, ব্যক্তিগত জীবনে সেই যুক্তিকে প্রয়োগ করে নানা চমকপ্রদ সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন কেউ কেউ। দু’ জন খ্রিস্টান হয়ে গেলেন। মহেশচন্দ্র ঘোষ আর কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। (ঈশ্বর গুপ্তের খেদোক্তি: ‘কিছু বুঝি নাহি পাও চারিদিকে চেয়ে এবারে ভরাবে পেট হিন্দুধর্ম খেয়ে’)। রাধানাথ শিকদার দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, তিনি নাবালিকা বিয়ে করবেন না। রামতনু লাহিড়ী পইতে ত্যাগ করলেন। কোনও কোনও কালেজ-বয় যদি ব্রাহ্মধর্মে আগ্রহী হলেন, অন্যরা তবে ব্রাহ্মদের ব্যক্তিগত আচরণে বৈপরীত্য দেখে সমালোচকের ভূমিকা গ্রহণ করলেন। প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বাড়িতে দুর্গোৎসবের ঘটা দেখে ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিবাদের কাহিনী প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য। আদর্শের জন্য লড়াইয়ে কালেজ-বয় যেমন আপসহীন, আদর্শ পুরুষদের প্রতি তাঁরা তেমনই শ্রদ্ধাশীল। ১৮৩০ সালে জোড়াসাঁকোর মাধবচন্দ্র মল্লিকের বাড়িতে সভা করে তাঁরাই প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন হেয়ারকে সম্মান জানাতে। ১৮৩১ সালে হেয়ারের জন্মদিনে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যে পাঁচশো চৌষট্টি জন তরুণ তাঁর হাতে অভিনন্দনপত্র তুলে দিয়েছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন নাকি কালেজ-বয়। হেয়ারের মৃত্যুর পর বছরের পর বছর নিয়মিতভাবে স্মৃতিসভার উদ্যোক্তাও তাঁরাই। শুধু তাই নয়, হেয়ারের মৃত্যুর পর হিন্দু কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাজেন্দ্র দত্ত যা করেছিলেন, তার বুঝি তুলনা হয় না। ‘রাজেন্দ্র দত্ত গয়ায় গিয়া হেয়ারের পিণ্ড দিয়াছিলেন। এখানে পাণ্ডারা আপত্তি করিলে তিনি পাণ্ডাদের আশ্রয়ে থাকিবেন না এবং ফল্গুতে বালুর পিণ্ড দিবেন বলেন। রাজেন্দ্রের জিদ…দেখিয়া ও প্রাপ্যে বঞ্চিত হইবার আশংকা করিয়া পাণ্ডারা অবশেষে তাঁহাকে অনুমতি দিলেন।’ ডিরোজিওর প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার কাহিনী তো সকলের জানা। তাঁর তিরোভাবের পর একটি বাংলা কাগজ লিখেছিল, ‘ড্রোজু সাহেবের উপদেশ যে ক এক জন বালক নষ্ট হইয়াছে এক্ষণে তাহারা বড় বিপদগ্রস্ত হইল কেননা তাহারদিগের জ্ঞান ছিল ড্রোজু হর্তাকর্তা বিধাতা…ড্রোজুর মরণে তাহারা জীবন্মৃতপ্রায় হইয়া থাকিবে।’

এই আমাদের কালেজ-বয়। হিন্দু কলেজ সম্পর্কে একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন: হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠাই এদেশের মানুষের মধ্যে প্রথম কোনও সর্বজনীন উদ্যোগ। এই কলেজ উপলক্ষেই প্রথম চাঁদার খাতা দেখা গেল। ‘পাবলিক লাইফ’, ‘পাবলিক স্পিরিট’ সবই এই প্রথম। তার আগে ছিল ঘাট বাঁধানো, দেবালয় প্রতিষ্ঠা, ধর্মশালা স্থাপন, দানসাগর শ্রাদ্ধ ইত্যাদি। যাকে বলে ‘পাবলিক কোশ্চেন’ অর্থাৎ সর্বসাধারণের স্বার্থঘটিত প্রশ্ন, তা প্রথম শোনা গেল এই হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষেই। হিন্দু কলেজ সেদিক থেকে নবযুগের ভোরের তারা, কালেজ-বয় কালান্তরের চারণ-কবি। বাবু আংটি পরতেন। ‘অ্যায়সা দিন নেহি রহেগা’ ডিজাইনের আংটি। মামলা-মোকদ্দমা টানাটানির দিন আর থাকবে না এই ছিল আংটির পিছনে মনস্কামনা। দেখা গেল, দিন সত্যই পালটে যাচ্ছে, এবং বড্ড তাড়াতাড়ি। শুধু তাই নয়, সচকিত হয়ে দেখলেন তিনি, কালের গতি অন্য দিকে। তিনিও পা বাড়াতে চাইলেন। অবশ্য কেউ কেউ চেষ্টা করেছিলেন প্রগতির রথকে থামাতে। কিন্তু ব্যর্থ হলেন তাঁরা। সাফল্য এবং ব্যর্থতা: ফলাফল যাই হোক না কেন, এই লড়াই উপলক্ষে শুরু হল আর এক ধরনের নববাবু বিলাস। ছাপাখানা চালাও, মিটিং বসাও, স্কুল খোলো, প্রতিবাদ সভা করো, অ্যাসোসিয়েশন গড়ো।

কালেজ-বয় সেই উচ্ছ্বসিত উদ্বেলিত প্রাণগঙ্গার ভগীরথ। তাঁরাই নতুন ধ্যান-ধারণার প্লাবন এনেছিলেন সেদিন নিস্তরঙ্গ বাঙালি-জীবনে। সুতানুটি-গোবিন্দপুরের অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে তাঁরাই ঘটিয়েছিলেন সূর্যোদয়। মৃত্যুর আগে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশ করে ডিরোজিও কবিতা লিখেছিলেন একটি। বক্তব্য: আমি দেখতে পাচ্ছি নবীন পুষ্পের পাঁপড়ি মেলার মতো ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে তোমাদের মনের দুয়ার, যে মোহের বন্ধনে আবদ্ধ তোমাদের ধীশক্তি, উদ্যম এবং সামর্থ্য ক্রমে শিথিল হয়ে আসছে তা। গ্রীষ্মের ভোরে পাখির ছানার মতো ডানা মেলছ তোমরা, পরখ করে দেখতে চাইছ নিজেদের বল, ইত্যাদি। এই অমর বিহঙ্গশিশুর দল তরুণ গড়ুর সম কী মহৎ ক্ষুধার আবেশে তাড়িত হয়েছিলেন, কী ছিল তাঁদের দুরন্ত প্রার্থনা, আজ তা উপলব্ধি করা একদিকে যেমন অপেক্ষাকৃত সহজ, অন্যদিকে তেমনিই বোধহয় দুরূহ। সময়ের দূরত্ব যেমন কালেজ-বয়কে কালের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে যথাযথ পরিপ্রেক্ষিত থেকে তার দিকে তাকাতে সাহায্য করে, অন্যদিকে কিঞ্চিৎ অসুবিধা সৃষ্টি করে বোধ হয়, নানা রঙের আলোয় উদ্ভাসিত দর্শকের গ্যালারিগুলো। সেখান থেকে কিছুই বুঝি আর চোখে লাগে না, মনে ধরে না। মনে হয়, সবই বুঝি গল্পকথা, ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে বলা। কালেজ-বয়ের বিদ্রোহ, সে কি তবে অর্থহীন আস্ফালন মাত্র? তার কণ্ঠে মুহুর্মুহু বজ্রনিনাদ, সে কি তবে নিছক অন্তঃসারশূন্য প্রগলভতা? অবশ্যই নয়। মনে পড়ছে কিশোরীচাঁদ মিত্রের উক্তি: হিন্দু কলেজের ছেলেরা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার মতো। ভোরের প্রথম আলো প্রতিফলিত হয়েছিল তারই শীর্ষে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে নেমে এসেছিল সমতলে…।

ডিরোজিওর শেষ ইচ্ছাপত্র

‘আমরা খেদপূর্বক প্রকাশ করিতেছি গত ২৬ ডিসেম্বর সোমবার বেলা দশ ঘণ্টাতীত সময়ে ড্রোজু সাহেবের মরণ হইয়াছে। ইহাতে আমরা দুঃখিত হইয়াছি যেহেতু তাঁহার অত্যল্প বয়স অর্থাৎ চব্বিশ পঁচিশ বৎসরের অধিক নহে ইহার মধ্যে তিনি অনেক কীর্তি করিয়াছিলেন…’

বাঙ্গালা সমাচার পত্রের মর্ম উদ্ধৃত করে ডিরোজিওর মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করছেন আর এক বাংলা সমাচার পত্র ‘সমাচার দর্পণ’। সেদিন ১৮৩২ সালের ৭ জানুয়ারি। একই দিনে ওই কাগজে বিগত বছরের বর্ষফলে বলা হয়েছে: ডিসেম্বর ২৬। ইস্টিন্ডিয়ান সম্বাদপত্রের সম্পাদক অতি বিচক্ষণ ড্রজু সাহেব ওলাওঠা রোগে কালবশীভূত হন এবং সকলেই তাহাতে অতি খেদান্বিত।’ সুতরাং জানতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই, ডিরোজিও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ১৮৩১ সনের ২৬ ডিসেম্বর সোমবার। বস্তুত সেদিনই সন্ধ্যায় ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ Deaths শিরোনামায় লেখা হয়:—

‘At Calcutta, on the 26th December, Henry Louis Vivjan Derozio, Esq. aged 23 years 8 months and 8 days.’

আশ্চর্য, তবু নানা কলমে ডিরোজিওর তিরোভাব-তারিখ লিখিত হয়ে আসছে ২৩ ডিসেম্বর। ভুল সংশোধনের জন্য আমাদের অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়েছে, বলতে গেলে প্রায় একশো বছর। প্রথম এদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির এলিয়ট ওয়ালটার ম্যাজ ১৯০৪ সালে তাঁর ডিরোজিও বিষয়ক বক্তৃতায় বক্তব্যটি তৎকালে মুদ্রিত হয়েছিল। কিছুকাল আগে (১৯৬৭) সুবীর রায়চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে পুনর্মুদ্রিত হয় এটি। তা ছাড়া ১৮০৯ সালে ম্যাজের তথ্যাবলির ভিত্তিতে ‘বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’ পত্রিকায় ডিরোজিওর জন্ম মৃত্যুর সঠিক তারিখ প্রকাশিত হয়। পরিষ্কার বলে দেওয়া হয় তাঁর জন্ম ১৮ এপ্রিল (১০ এপ্রিল নয়), ১৮০৯ সালে এবং মৃত্যু—২৬ ডিসেম্বর (২৩ ডিসেম্বর নয়) ১৮৩১ সালে। সে বছরই (১৯০৯) ডিরোজিওর সমাধিতে নতুন করে স্থাপন করা হয় এক স্মৃতিলিপি। তাতেও খোদাই করা ছিল এই সংশোধিত তারিখ। ভুল কিন্তু তবু চলছেই চলছে। দায় অবশ্য দুটি প্রধান সূত্রের ‘বেঙ্গল অবিচুয়ারি’ (১৮৪৮) এবং টমাস এডোয়ার্ড লিখিত ডিরোজিও জীবনী ‘হেনরি ডিরোজিও দ্য ইউরেশিয়ান পোয়েট টিচার অ্যান্ড জার্নালিস্ট (১৮৮৪)।’

এটা ঠিক তিন দিন আগে অথবা পরে কেউ ভূমিষ্ঠ হলে কিংবা মারা গেলে ইতিহাসের চোখে খুব একটা হেরফের ঘটে না। তবু যে এই খুঁত ধরা বুড়োর মতো প্রথমেই সন তারিখ কচকচি শুরু করতে হল, তার কারণ এই নয় যে, আমরা অতিশয় পঞ্জিকাভক্ত কিংবা তিথি-নক্ষত্রে আসক্ত। আসলে এর সঙ্গে বোধ হয় জড়িয়ে আছে গবেষণায় নিষ্ঠার প্রশ্নও। যে ভুল অতি সহজে সংশোধন করা সম্ভব, তা আঁকড়ে পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। বিশেষত, বয়সে তরুণ হলেও ডিরোজিও যুগপুরুষ। উনিশ শতকের তৃতীয় প্রহরে হাতে জিয়নকাঠি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর কণ্ঠেই বাঙালি তরুণ প্রথম শুনেছিলেন নবযুগের নতুন জাগরণী সঙ্গীত। ডিরোজিও ‘ইয়ং বেঙ্গল’- এর হৃদয়ের রাজা, নবীনের নয়নের মণি। তার সম্পর্কে অহেতুক কোনও অস্পষ্টতা না থাকাই কাম্য, হোক না তুচ্ছ কোনও তারিখ।

মৃত্যুকালে, সবাই জানেন ডিরোজিও কোনও অজ্ঞাতকুলশীল কিংবা অজ্ঞাত মানুষ ছিলেন না। বরং ছিলেন এই শহরে রীতিমত প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। সাহেবপাড়া বাঙালিটোলা এবং মধ্যবর্তী ইউরোপিয়ান বা অ্যাংগ্‌লো ইন্ডিয়ান-পল্লী—তিন সমাজেই প্রভূত খ্যাতি তাঁর। অবশ্য ত্রিবিধ কারণে। খাঁটি সাহেবদের একাংশের কাছে তিনি ‘ইউরেশিয়ান’ বা অ্যাংগ্‌লো-ইন্ডিয়ানদের একজন মুখপাত্র। অ্যাংগ্‌লো-ইন্ডিয়ান নেতা জন রিকেটসের অন্যতম সহযোগী সহকর্মী তিনি। ‘দ্য ইস্ট ইন্ডিয়ান’ কাগজের সম্পাদক ডিরোজিওর বক্তব্য পাক্কা-সাহেবদের পক্ষে অস্বস্তিকর। অ্যাংগ্‌লো- ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের কাছে তিনি শুধু আপনজন নন, ডিরোজিওর প্রতিভা তাঁদের কাছে গৌরবের ধন। আর, বাঙালি পল্লীতে ডিরোজিও যে কী ছিলেন, উনিশ শতকের তৃতীয় এবং চতুর্থ দশকের আবহাওয়া সংবাদ সম্পর্কে যাঁরা অবহিত, তাঁরা তা জানেন। একদল তরুণের কাছে তিনি যদি দেবতা, সনাতন-পন্থীদের চোখে তবে জাগ্রত অপদেবতা। ডিরোজিওর চালচলন সম্পর্কে অতএব সব মহলেরই তীক্ষ্ণ নজর, সমান আগ্রহ। তিনি কোন স্কুলের পুরস্কার বিতরণী সভায় যোগ দিয়েছিলেন, বিলেতে গিয়ে অ্যাংগ্‌লো ইন্ডিয়ানদের দাবিপত্র পেশ করে রিকেটস ফিরে আসার পর তাঁর সংবর্ধনা-সভায় ডিরোজিও কী বলেছিলেন—খবরের কাগজে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে সে- সব বিবরণ। বাইশ বছরের একজন যুবা সম্পর্কে এই আগ্রহ অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। স্বভাবতই ডিরোজিওর আকস্মিক অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পরও কাগজে কাগজে বিস্তর লেখালেখি। বলতে গেলে প্রধান-অপ্রধান, কলকাতার প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রই সবিস্তার আলোচনা করেছে মৃত্যুর পর ডিরোজিও-চরিত। বস্তুত, তাঁর নিজের কাগজ ‘দ্য ইস্ট ইন্ডিয়ান’-এর পাতায় নাকি দিনের পর দিন চলে জনতার শোকোচ্ছ্বাস। তাই নিয়ে সমালোচনা করেছেন ‘বেঙ্গল হরকরা সম্পাদক’—বাড়াবাড়ি হচ্ছে না কি? বিশেষ করে ওঁর আপন সম্প্রদায়ের শোকার্তরা যে-সব বিশেষণ ব্যবহার করছেন, বেঙ্গল হরকরা সম্পাদক মনে করেন, ডিরোজিও বেঁচে থাকলে কিছুতেই সে সব অনুমোদন করতেন না। লক্ষণীয় ব্যাপার এই, ‘বেঙ্গল হরকরা’ নিজেও কিন্তু প্রকাশ করেছে বিরাট প্রশস্তি। তারপর ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’-এর সম্পাদকীয় পুনর্মুদ্রণ করে আলোচনাচ্ছলে আবার জানিয়েছেন—ডিরোজিওর প্রশংসায় তাঁরাও পঞ্চমুখ। তবে তাঁকে শেকসপিয়ার মিলটনের সঙ্গে তুলনা করেননি এই যা।

জন-হৃদয়ে এমন অনুরাগের আসন পাতা ছিল যাঁর জন্য, তাঁর মৃত্যুশয্যার চারপাশে যে উৎকণ্ঠিত ভিড় গড়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। ডিরোজিওর জীবনীকার টমাস এডোয়ার্ড লিখেছেন, কলেরা সম্পর্কে কারও মনে ভয় নেই কেন। ডিরোজিওর রোগশয্যা ঘিরে তাঁর হিন্দু কলেজের ছাত্রবন্ধুরা কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, আরও কতজন। তাঁরা ডিরোজিওর মা আর বোন আমেলিয়ার উদ্বেগ আর ক্লান্তির শরিক। এ ছাড়া রয়েছেন পাদ্রি মিঃ হিল। ডাঃ টাইটলার, ডাঃ উইলসন, ডেভিড হেয়ার, জে ডব্লিউ রিকেটস, ডাঃ গ্রান্ট প্রভৃতি বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। কেউ কাব্য পাঠ করে শোনাচ্ছেন। কেউ পরলোকের কথা বলছেন। ডিরোজিও নাকি তখনও জ্ঞানের জন্য সমান ব্যাকুল, মন তাঁর সম্মান অনুসন্ধানী। এক সময় চিকিৎসকরা নাকি আশা দিয়েছিলেন হয়তো তিনি বেঁচে উঠবেন। কিন্তু সব আশা ব্যর্থ হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। ছ’দিন শয্যাশায়ী থেকে বিদায় নিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক। নবযুগের বাংলার নবীন নায়ক। একটি বাংলা কাগজ লিখছে ‘ড্রোজু সাহেবের উপদেশে যে ক’একজন বালক নষ্ট হইয়াছে, এক্ষণে তাহারা বড় বিপদগ্রস্ত হইল কেননা তাহার দিগের জ্ঞান ছিল ড্রোজু, হর্তাকর্তা বিধাতা ঐ অবোধেরা পিতামাতার বাক্য হেলন করিয়াও ড্রোজুর আজ্ঞানুবর্তী হইয়াছিল ইহাতে কেহ জ্ঞাতস্তরও হইয়াছে তাহাতেও তাহারা দুঃখী নহে ড্রোজুর মরণে তাহারা জীবন্মৃত প্রায় হইয়া থাকিবেক…।’

এই জীবন্মৃতপ্রায় তরুণ দল কি জানতেন, তাঁদের বন্ধু তাত্ত্বিক এবং পথপ্রদর্শক যখন রোগ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন, তখনই মাঝপথে এক সময় ডাক পড়েছিল কালি-কলমের? তাঁর সামনে মেলে ধরা হয়েছিল একখণ্ড কাগজ, আর তাতেই পালকের কলমে নিজের হাতে নির্ভুল গদ্যে ডিরোজিও লিখেছিলেন তাঁর শেষ লেখা, তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্র। সম্ভবত নয়। সত্যি বলতে কী, ডিরোজিওকে নিয়ে এ-পর্যন্ত অনেক কিছুই লেখা হয়েছে। শুধু এডোয়ার্ড আর ম্যাজ নন, একালেও বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষক আন্তরিক চেষ্টা করেছেন ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর মন্ত্রগুরু ডিরোজিওর মূল্যায়নের। কিন্তু এই উইলটি কেউ দেখেছেন বলে মনে হয় না। কোনও রচনায় তার উল্লেখ অন্তত আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। অথচ ‘ডিরোজিও’ নামে যে বিয়োগান্ত জীবন-নাট্য, তাতে আড়াই পৃষ্ঠার এই ইচ্ছাপত্রটিও অনায়াসে যুক্ত হতে পারে আরও একটি হৃদয়-বিদারক দলিল হিসাবে। বিশেষত, এই উইলের পরবর্তী ঘটনাবলি সত্যই মর্মান্তিক।

উইলটি যে এতকাল গবেষকদের ফাঁকি দিতে পেরেছে, তার পিছনে অবশ্য একটা কারণ ছিল। ডিরোজিও ত্রস্ত হাতে এই ইচ্ছাপত্র লেখেন মৃত্যুর তিন দিন আগে, ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে। আর তার তিন দিন পরে, কবরের মাটি শুকোতে না শুকোতে দেখি উইলে উক্ত কর্মকর্তাদের একজন ছুটতে ছুটতে সেটি নিয়ে জমা দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের হাতে। তিনি অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে নিজের দায়দায়িত্বের কথা ঘোষণা করছেন, আইনজীবী নিযুক্ত করছেন। হরেক কৃত্য তৎক্ষণাৎ সম্পূর্ণ। তারিখ সবে তখন ২৯ ডিসেম্বর, ১৮৩১। পরদিন, অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর তারিখে সব কাগজপত্র দেখে আদালত মেনে নিলেন উইলের অন্যতম নিয়ামক হিসাবে তাঁর অধিকার। তারপর থেকে এই দলিল সুপ্রিম কোর্টের জীবনকাল পর্যন্ত তাঁদের হাতেই ছিল। পরবর্তী কালে তাঁদের হেফাজত থেকে স্থানান্তরিত হয় হাইকোর্টের মহাফেজখানায়। অগণিত দলিল দস্তাবেজের ভিড়ে এতকাল সেখানেই হারিয়ে ছিল হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর আপন হাতে লেখা এই কাগজের টুকরোখানি। সম্প্রতি আরও কিছু মূল্যবান ঐতিহাসিক নথিপত্রের সঙ্গে দৃশ্যত অকিঞ্চিৎকর এই উইলটিও এসেছে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের হেফাজতে। তাঁদের সৌজন্যেই আমরা সুযোগ পেয়েছিলাম এটি দেখবার এবং খুঁটিয়ে পরখ করবার। এ জন্য ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ, মেমোরিয়ালের তদানীন্তন কিউরেটার- সেক্রেটারি নিশীথরঞ্জন রায় মশাইয়ের কাছে। তাঁর সাহায্য এবং সহযোগিতা ছাড়া উইলটির পাঠোদ্ধার সহজ ছিল না। কেন না, উইলের সর্বাঙ্গে কালের নখচিহ্ন, কাগজ জীর্ণ, লিপি বিবর্ণ। সুতরাং পাঠে কিছু ভুলভ্রান্তি থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। সে সব শোধরাবার দায়িত্ব ডিরোজিও গবেষকদের উপর রইল। আপাতত আমরা কাগজখানার ওপর চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি মাত্র।

তার আগে সংক্ষেপে ডিরোজিওর জীবন সম্পর্কে অনেকবার শোনা তথ্যগুলো আর একবার শুনে নিতে দোষ নেই। বরং তাতে উইলের পাত্রপাত্রীদের চট করে চেনার পক্ষে সুবিধা। সবাই জানেন, ডিরোজিওর পূর্বপুরুষ পর্তুগিজ। তাঁর ধমনীতে পূর্ব আর পশ্চিমের রক্ত। বাবা ফ্রান্সিস ডিরোজিও সিনিয়র ছিলেন কলকাতার ‘জেমস স্কট অ্যান্ড কোং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবরক্ষক। সম্পন্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। ১৫৫ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডে ওঁদের নিজস্ব বাড়ি। মায়ের নাম সোফিয়া জনসন। ফ্রান্সিস ডিরোজিওর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ১৮০৬ সালে। পাঁচটি ছেলেমেয়ে রেখে সোফিয়া মারা যান ১৮১৫ সালে। পরের বছর ফ্রান্সিস ডিরোজিও অবশ্য আনা মারিয়া নামে একজন বয়স্ক ইংরেজ মহিলাকে বিয়ে করেন। তাঁর নিজের কোনও সন্তান ছিল না। স্বামীর আগের তরফের সন্তানেরাই আপন ছেলেমেয়ের মতো। এই আনা স্বামী হারান বিয়ের চৌদ্দ বছর পরে। অর্থাৎ ফ্রান্সিস ডিরোজিওর মৃত্যু হয় ১৮৩০ সালে।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সকলের বড় ছিল ভাই ফ্রাংক। সে নাকি সংগীতে কৃতবিদ্য ছিল। শোনা যায়, বয়স যখন কুড়ির কাছাকাছি তখন সে আত্মঘাতী হয়। দ্বিতীয় ভাই-ই হেনরি ডিরোজিও, যাঁর জন্য একদিন আলোড়িত বাঙালির সমাজ-সংসার, কলকাতার মনোরাজ্য তোলপাড়। তৃতীয় হলেন ক্লাডিয়াস গিলবার্ট অ্যাসমোর। লেখাপড়া শিখতে সে বিদেশ যাত্রী হয়েছিল। ক’ বছর পরে স্কটল্যান্ড থেকে এদেশে ফিরে এসে সেও চলে গেল জীবনমৃত্যুর পরপারে (১৮৩৬)। তখন তাঁর বয়স মোটে বাইশ। বোন ছিল দুটি। বড় সোফিয়া মারা যায় সতেরো বছর বয়সে, ১৮২৭ সালে। ভাই হেনরি যখন মারা যান, বাড়িতে তখন মা ছাড়া রয়েছে শুধু ছোট ভাই ক্লডিয়াস আর প্রিয় বোন অ্যামেলিয়া, যাঁকে নিয়ে বৃন্দাবন ঘোষালের মুখে নানা রটনা, যাঁর প্রশ্নের উত্তরে একদিন সকালে খাবার টেবিলে ডিরোজিও নিঃশব্দে রেখে গিয়েছিলেন সেই কবিতা—‘এ সিসটার ইন-ল’, ‘মাই সিসটার ডিয়ার এ সিসটার ইন-ল ফর দী?’ এই বোনটির কথা পরে।

লক্ষণীয় ব্যাপার, এই ডিরোজিও এবং তাঁর ভাইবোনরা কেউ দীর্ঘজীবী হননি। সেদিক থেকে খুবই দুঃখী পরিবার ওঁদের। ম্যাজ একটি কাহিনী শুনিয়েছেন ডিরোজিও সম্পর্কে। একবার তাঁর কোনও ছাত্র নাকি ডিরোজিওকে পরিচয় করিয়ে দেন একজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে। সন্ন্যাসী পরে সেই ছাত্রটিকে বলেন, দেখো তোমাদের গুরুর নাম আমি জানি না। তবে এটা বলে দিচ্ছি, তাঁর নামে যত অক্ষর আছে তার চেয়ে বেশি বছর সে বাঁচবে না। ইংরাজিতে ‘হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও’ লিখতে অক্ষর লাগে তেইশটি। এবং ডিরোজিও তেইশতম বছরেই মারা যান।

ডিরোজিওর জন্ম কর্ম সবই এই কলকাতায়। চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া শিখেছেন ডেভিড ড্রামন্ড সাহেবের ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে। ড্রামন্ড ধর্মে সংশয়বাদী, আদর্শে যুক্তিপন্থী। তিনি অন্য ধরনের শিক্ষক। অনেকেই মনে করেন, ডিরোজিও যে ডিরোজিও হলেন—সে এই গুরুর জন্যই। স্কুলের পড়া চুকিয়ে হেনরি কিছুদিন কাজ করেছিলেন বাবার অফিসে, জেমস স্কট কোম্পানিতে। কিন্তু ভাল লাগল না। কাজ ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেলেন ভাগলপুরে এক পিসেমশাইয়ের কাছে। তিনি নীলকুঠির মালিক ছিলেন। জীবনীকাররা বলেন—ডিরোজিওর কাব্য- প্রতিভা মুকুলিত হয় সেখানেই, ভাগলপুরের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে। সেখান থেকেই ‘জুভেনিস’ নামে কলকাতার কাগজে কবিতা পাঠাতেন তিনি। বিশেষ করে ‘দ্য ইন্ডিয়া গেজেট’-এ। তারপর কলকাতায় ফিরে এসে পরিপূর্ণ চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ। ডিরোজিও ইন্ডিয়া গেজেটের সাব-এডিটর। তিনি কবি। তাঁর প্রথম কবিতার বই ছাপা হচ্ছে। তিনি ‘দি হেসপিয়াস’ নামে একটি সান্ধ্য কাগজ সম্পাদনা করেন। তিনি শিক্ষক হিসাবে যোগ দিচ্ছেন হিন্দু কলেজে। সমাচার দর্পণের খবর (১৩ মে ১৮২৬): ‘ইংরাজী পাঠশালায় ডিয়ানম্যান নামক একজন গোরা আর ডিরোজী সাহেব এই দুই জন শিক্ষক নিযুক্ত হইয়াছেন।’

ডিরোজিও কলেজের চতুর্থ শিক্ষক। মাসে মাইনে তাঁর দেড়শো টাকা। তখন তাঁর বয়স মোটে সতের বছর।

চতুর্থ শিক্ষক কী করে কার্যত প্রায় একমাত্র শিক্ষকের ঠাঁই করে নিয়েছিলেন হিন্দু কলেজের ছাত্রদের হৃদয়ে, সে কাহিনী এখানে অবান্তর। একটি ছাড়পত্রের কাজ করেছে অবশ্য বয়স। গুরুর সঙ্গে প্রধান শিষ্যদের বয়সের দূরত্ব ছিল যৎসামান্য। ডিরোজিওর বয়স যখন বাইশ বছর, কৃষ্ণমোহনের বয়স তখন আঠারো, দক্ষিণারঞ্জনের সতেরো, রামগোপালের ষোল। তা ছাড়া, তহবিলে ছিল বিদ্যা, বুদ্ধি, সাহস। সর্বোপরি প্রতিভা। সুতরাং এলাম, দেখলাম, জয় করলাম, এমনই তাঁর ভঙ্গিটি।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিতর্ক ভঙ্গি সভা ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’, বা ‘পার্থেনন’ নামক কাগজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা—এসব নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। আরও হবে। আলোচনার অবকাশ এখনও অনেক। আমরা উইলটি মেলে ধরার আগে তার জীবনের একটা রূপরেখা দিয়েই ক্ষান্ত থাকতে চাই। কলেজে যোগ দেওয়ার চার বছরের মধ্যে ঝড়, ভূমিকম্প। সংস্কারে আচ্ছাদিত আমাদের কুটিরগুলো বুঝি মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। সনাতন ভিতে চিড় ধরার উপক্রম। সুতরাং, ওঁরা প্রত্যাঘাত হানলেন। ডিরোজিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। অবশ্য নীরবে নয়। প্রতিবাদসহ। হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষবর্গ এবং কলেজের ভিজিটার এইচ এস উইলসনের কাছে লেখা তাঁর চিঠিগুলো স্মরণীয় ঐতিহাসিক জবানবন্দি। বাংলা খবরের কাগজে যখন লেখা হচ্ছে ২৮ এপ্রিল, ১৮৩১ তারিখে, শুনিয়াছি (কর্মাধ্যক্ষরা) শ্ৰীযুক্ত ড্রোজু নামক একজন টিচার অর্থাৎ শিক্ষককে কর্ম হইতে রহিত করিয়াছেন।’ ডিরোজিও তখন হিন্দু কলেজের ম্যানেজিং কমিটিকে পদত্যাগ পাঠাতে বসে লিখছেন: অপরাধী যে, তাকে জেরা করা হল না, সে জানল না কী তার অপরাধ। অথচ একতরফা বিচার হয়ে গেল। দণ্ডদানের পর্বও শেষ। আশা করি, এসব সত্য বলে স্বীকার করতে আপনারা সংকোচ বোধ করবেন না। তা হলেই আমি খুশি।

১৮৩১ সালের এপ্রিলে পদত্যাগ, ডিসেম্বরে মৃত্যু, মাঝখানের কয়টি মাসও চুপচাপ বসে ছিলেন না ডিরোজিও। ইতিমধ্যে দু-দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। কবি হিসাবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। সমালোচকরাও স্বীকার করেন, প্রতিভার স্বাক্ষর রয়েছে তাঁর কবিতায়। ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর কাগজ এনক্যোয়ারার-এর পিছনে অন্যতম প্রেরণা তিনি। তখনও তিনি তাঁদের মন্ত্রদাতা। জুন মাসের ১ তারিখে শোনা গেল ‘ইনস্টিন্ডিয়ান’ নামক এক সংবাদপত্রের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করেন। সেপ্টেম্বরে ইস্ট ইন্ডিয়া সম্পাদককে দেখা গেল উত্তর কলকাতায় হিন্দু ফ্রি স্কুলের প্রথম ত্রৈমাসিক পরীক্ষার দিনে। স্কুলটি হিন্দু স্কুলের একজন ছাত্রের প্রতিষ্ঠিত। কাগজ লিখছে, হাজির ছিলেন ‘শ্রীযুক্ত হের সাহেব ও শ্রীযুক্ত দ্রাজু সাহেব’। কেউ কেউ লিখেছেন জনসমক্ষে তাঁর শেষ উপস্থিতি ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে, প্যারেন্‌টাল অ্যাকাডেমির নবম পুরস্কার বিতরণী সভায়। কিন্তু ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে ধর্মতলায় নিজের পুরানো স্কুলের ছাত্রদের পরীক্ষা নিয়েছেন তিনি। ছাত্রদের একটি অ্যাক্‌ট ও স্পিচ ইত্যাদি অবলোকন করে নাকি আমোদিত হয়েছেন। তারপর হঠাৎ অসুস্থতা। রোগশয্যা। মৃত্যু। তার মৃত্যুর তিন দিন আগে কাগজ টেনে নিয়ে দোয়াতে কলম ডুবিয়ে টানা হাতে লিখে যাওয়া ‘দিস ইজ দি লাস্ট উইল অ্যান্ড টেস্টামেন্ট অব মিঃ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও অব সার্কুলার রোড ক্যালকাটা ইন দ্য প্রভিন্স অব বেঙ্গল অ্যান্ড অব নাম্বার ৯ কসাইটোলা স্ট্রিট ইন দ্য ট্যউন অব ক্যালকাটা ইন সেইড প্রভিন্স অব বেঙ্গল…’

ডিরোজিওর কোনও রচনার সঙ্গে মিল নেই তাঁর এই গদ্যের। নিতান্ত আইনের ভাষা। তিনি এখানে কবি নন, সাংবাদিক নন, প্রতিবাদী কোনও তুখোড় পত্রলেখক নন, নিছক একজন গৃহস্থ। উইলসন বা হিন্দু কলেজের কর্তাদের কাছে লেখা চিঠিগুলোর তুলনায় এই উইলের ভাষা অত্যন্ত সাদামাঠা। বক্তব্যও একান্তভাবেই ঘরোয়া, পাঁচজনকে শোনানোর মতো কিছু নয়। তবু যে এটি খুলে বসার কৌতূহল, সে অন্য কারণে। আমাদের পরিচিত যে ডিরোজিও, তাঁর কিছুই কি খুঁজে পাব না এতে?

সাদা বাংলায় উইলের বক্তব্য: ‘আমার মৃত পিতা আমাকে শর্তাধীনে কিছু সম্পত্তি দিয়ে গেছেন। আমার ইচ্ছা সেই সব শর্ত পূরণ না করা পর্যন্ত যেন সেই অংশ বিক্রি করা না হয়। সম্প্রতি আমি ‘দ্য ইস্ট ইন্ডিয়ান’ নামে যে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করেছি, আমার ইচ্ছা: আমার ভাই ক্ল্যাডিয়াস গিলবার্ট অ্যাসমোর ডিরোজিও তা পরিচালনা করেন। তবে শর্ত এই, কাগজের যে ঋণ আছে এবং ভবিষ্যতে যে ঋণ হতে পারে, তার দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে। আমার সব ন্যায্য ঋণ মিটিয়ে দেওয়ার পর আমার সম্পত্তির যা অবশিষ্ট থাকবে, তা আমার ভাই ক্লডিয়াস গিলবাট অ্যাসমোর ডিরোজিও এবং বোন অ্যামেলিয়া ডিরোজিওর মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতে হবে। আমার ভাই তাঁর অংশ পাবে একুশ বছর বয়সে পৌঁছালে আর বোন তাঁর অংশ পাবে একুশ পূর্ণ হলে, বা তার বিয়ের দিনে, যা আগে ঘটে। আমার ইচ্ছা: আমার ভাই ক্লডিয়াস গিলবার্ট অ্যাসমোর ডিরোজিও আমার মৃত পিতার বিধবা আনা মারিয়া ডিরোজিওর ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যদি তা না করেন তবে আমি তাঁকে যে সম্পত্তি দিচ্ছি, তার এক-তৃতীয়াংশ থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন, এবং ওই অংশ পাবেন আমার মৃত পিতার বিধবা আনা মারিয়া ডিরোজিও। এতদ্দ্বারা জেমস ক্যালডন এসকোয়ার ডানিয়েল মিকিনস কিং এবং একুশ উত্তীর্ণ হওয়ার পর ক্লডিয়াস গিলবার্ট অ্যাসমোর ডিরোজিওকে আমার এই শেষ ইচ্ছা পত্রের কার্যকারক নিযুক্ত করছি আমি এবং ইতিপূর্বে সম্পাদিত আমার অন্য সব ইচ্ছাপত্র বাতিল বলে ঘোষণা করছি।’ তারপরই টানা হাতে বিখ্যাত সেই স্বাক্ষর ‘এইচ এল ভি ডিরোজিও’। বাঁ পাশে সই করেছেন সাক্ষীরা। ড্যানিয়েল মিকিনস কিং, জনৈক রয়…(বাকি নামটুকু পড়তে পারিনি) এবং আনা ডিরোজিও। উইলের তারিখ ‘টোয়েনটি থার্ড অব ডিসেম্বর ওয়ান থাউজেন্ড এইট হানড্রেড অ্যান্ড থারটি ওয়ান’, সইয়ের একপাশে লাল সিলমোহর। একটু নজর করলেই বোঝা যায়, গালার ওপর বুড়ো আঙুলের ছাপ, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও টিপসহি৷

এই উইলটি কি নিছক একটি পারিবারিক দলিল? ডিরোজিও কি এতে আমাদের জন্য কিছুই রেখে যাননি? খুঁটিয়ে পড়লে কিন্তু একেবারে শূন্য হাতে ফিরতে হয় না আমাদের। অন্তত শেষবারের মতো বিদ্রোহী সেই তরুণটিকে একবার দেখার সুযোগ পাই আমরা এই ছিন্নপত্রে। সুযোগ পাই আরও একবার তাঁকে নিবিড়ভাবে জানবার।

ডিরোজিওর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত ছিল না। হিন্দু কলেজের দেশীয় অধ্যক্ষরা উন্মত্তের মতো তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগই এনেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল: ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের মা-বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য উসকানি দিচ্ছেন। উইলসন তাঁর চিঠিতে কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফে ডিরোজিওর মুখের ওপর সরাসরি যে তিনটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, তার একটি ছিল, তুমি কি মনে কর যে, মা-বাবার আদেশ মান্য করা বা তাঁদের শ্রদ্ধাভক্তি করা নৈতিক কর্তব্য নয়? ডিরোজিও তাঁর দীর্ঘ উত্তরে অনেক কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন আমি পিতৃহারা। তা না হলে আমার বাবাই সমুচিত জবাব দিতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন যে-ছেলে মা-বাবার প্রতি কর্তব্যপালনে কখনও চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেনি, তার পক্ষে এমন পরামর্শ দেওয়া কী করে সম্ভব? এখনও আমার মা বেঁচে আছেন, তিনিও বলতে পারবেন এই অভিযোগ আমার চরিত্রের সঙ্গে কত অসঙ্গতিপূর্ণ ইত্যাদি। মৃত্যুর পরে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন পুত্র ভাই এবং বন্ধু হিসাবে ডিরোজিওর তুলনা হয় না। একটি কাগজ লিখেছিল, তিনি স্নেহশীল পুত্র, হৃদয়বান ভ্রাতা, অন্তরঙ্গ বন্ধু।

ডিরোজিওর উইল বোধ হয় তার সপক্ষে আর এক দফা প্রমাণ। এই ইচ্ছাপত্রে অবশ্য কোনও বন্ধু বা শিষ্যের উল্লেখ নেই। কিন্তু যে ভাবে তিনি পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলি-বণ্টন করছেন, তাতে বোঝা যায় পরিবারের সকলের সঙ্গে তাঁর কেমন ভালবাসার সম্পর্ক। বোন অ্যামেলিয়ার সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতার কথা আমরা জানি। দাদার অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন তিনি। অ্যামেলিয়ার কাছে আবার দাদাই ছিলেন সব। উইলেও তিনি উপস্থিত। ডিরোজিও যখন মারা যান, অ্যামেলিয়ার বয়স তখন আঠেরো। মা আছেন, ভাই আছে, অনায়াসে এই ভাগাভাগি থেকে দূরে রাখতে পারতেন তাঁকে। কিন্তু ডিরোজিও তা করেননি। লক্ষণীয়, উইলে পরিবারের একজনই সাক্ষী। তিনি আনা ডিরোজিও। হেনরির বিমাতা। উইলে এমনকী বিমাতার ভবিষ্যৎ চিন্তায়ও রীতিমত উদ্বিগ্ন যেন ডিরোজিও। ভাইয়ের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেই তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না, ভাই যদি কর্তব্য পালন না করে সেক্ষেত্রে কী হবে, তাও স্পষ্টভাষায় জানিয়ে যাচ্ছেন।

তবে এসবের চেয়েও চমকপ্রদ বোধ হয় উইলে ঈশ্বরের অনুপস্থিতি। শেষ ইচ্ছাপত্র। কিন্তু কোথাও নেই ঈশ্বরের নামে কোনও শপথবাক্য। এটা কি ইচ্ছাকৃত? জানি না। তবে সবাই জানেন, ডিরোজিওর ধর্মমত ছিল তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম উপলক্ষ। উইলসনের প্রসিদ্ধ তিন প্রশ্নের একটি ছিল—তুমি কি নাস্তিক? উত্তরে ডিরোজিও যে বাক্যগুলো লিখেছিলেন, তার যুক্তির ধারা এবং বক্তব্যের গভীরতা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। একসময় নাকি তিনি কান্টের আলোচনা করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হিন্দু কলেজে শিক্ষকতাকালে লেখা তাঁর ‘অবজেকশানস টু দ্য ফিলজফি অব ইমানুয়েল কান্ট’ পড়ে একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ নাকি মন্তব্য করেছিলেন—প্রতিভাশালী দার্শনিকের পক্ষেও এ রচনা গৌরবজনক। চিঠির এই অংশটি পড়লেও সন্দেহ থাকে না, বাইশ বছরের তরুণের স্কন্ধে স্থাপিত মাথাটি ছিল প্রবীণ প্রাজ্ঞের। নিপুণ হাতে বোনা তাঁর যুক্তিতর্কের জালটি এড়িয়ে দু’-একটি বাক্য মাত্র পড়ে শোনাচ্ছি। উইলসনকে তিনি লিখছেন:—

I am neither afraid nor ashamed to confess having stated the doubts of philosophers upon the existence of a God, because I have also stated the solution of those doubts…that I shall be called a sceptic and an infidel is not surprising as these names are always given to persons who dare think for themselves in relegion.

মৃত্যুশয্যায় ডিরোজিও নাকি রিকেটসকে অনুরোধ করেছিলেন পাদরি হিলকে একবার পাঠিয়ে দিতে। ডিরোজিও নাকি জীবনের শেষ মুহুর্তে স্বীকার করেন তিনি খ্রিস্টান। তিনি বিশ্বাসী। ডিরোজিওর শিষ্যদের একজন মহেশচন্দ্র অবশ্য অন্য কথা বলে গেছেন। তিনি নিজে খ্রিস্টান হয়েছিলেন। তাঁর সাক্ষ্য: মৃত্যুশয্যায়ও ডিরোজিওর কথা ছিল: ধর্ম বা ঈশ্বর সম্পর্কে চূড়ান্ত সত্য কী, তা আমি এখনও জানি না। আমার অনুসন্ধান এখনও শেষ হয়নি। তবে মৃত্যুর পর কাগজে কাগজে বলা হয়েছে—অন্তিমকালে ডিরোজিও আস্তিক হয়েছিলেন। ‘ইন্ডিয়ান গেজেট’ থেকে ১৮৩২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘ক্যালকাটা গেজেট’ ডিরোজিও সম্পর্কে যে দীর্ঘ প্রবন্ধটি উদ্ধৃত করেছেন, তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে এ সংবাদে খ্রিস্টান মাত্রই আনন্দিত হবেন। তবে কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন: এটুকুই কি যথেষ্ট? তার উত্তরে গেজেটের বক্তব্য, পরিত্রাণের পক্ষে এটুকুই পর্যাপ্ত। এসব আলোচনার ভিত্তিতেই বোধ হয়, ‘ড্রোজু পূর্বাপেক্ষা ইদানীং এমত হইয়াছিলেন ঈশ্বর একজন আছেন ইহা প্রায় স্বীকার করিয়াছিলেন।’

মৃত্যুর তিন দিন আগে লেখা উইলে সে ধরনের কোনও স্বীকৃতি নেই। হয়তো এ জাতীয় ইচ্ছাপত্রে তার কোনও সুযোগ ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু একই উইল আদালতে পেশ করতে গিয়ে ড্যানিয়েল মিকিনস্‌ কিং কিন্তু ধর্মপ্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন একজন ‘খ্রিস্টান প্রজা’ হিসাবে। সুতরাং, সেদিনের ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বা ডিরোজিয়ান-রা হয়তো এই ইচ্ছাপত্রটিকে বুকে আঁকড়ে ধরতেন, সগর্বে বলে বেড়াতেন ডিরোজিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি, মৃত্যুদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন সত্যসন্ধানী। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠীর ধর্মচেতনা বিষয়ে কৃষ্ণদাস পাল বলেছিলেন তার ধর্ম রিলিজিয়ন অব হার্ট, হৃদয়ের ধর্ম। আপন ঘরই তার কাছে মন্দির, সে নিজেই তার পুরোহিত। যে সুগন্ধি ধূপে আমোদিত তার ঘর তার নাম আন্তরিকতা, আর অর্ঘ্য ভালবাসা। সৌভ্রাতৃসুলভ সে-প্রেম সর্বজনীন, স্বর্গীয়। শিষ্য প্যারীচাঁদ মিত্র এবং কিশোরীচাঁদ মিত্রের ধর্ম সম্বন্ধীয় আলোচনাতেও একই উদার মানবধর্মের প্রতিধ্বনি। সুতরাং, ডিরোজিওর উইল এবং টেস্টামেন্টে কোনও বিশেষ ধর্মের প্রতি আস্থার কথা থাকা না-থাকার মধ্যে কিছু পার্থক্য হয়তো নিশ্চয়ই খুঁজে পেতেন তাঁর প্রিয় শিষ্যবর্গ, সংশয় আর সন্দেহের দোলায় সেদিন দোদুল্যমান যাঁদের হৃদয়-মন। তাই বলছিলাম, আপাতদৃষ্টিতে অকিঞ্চিৎকর হলেও ডিরোজিওর এই শেষ ইচ্ছাপত্র বোধহয় তাঁর অনুরাগীদের কাছে একেবারে তাৎপর্যহীন নয়।

উইলের কথা আপাতত এখানেই শেষ। কিন্তু তারপর? আমরা জানি, ডিরোজিওর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠীর রণধ্বনি হাওয়ায় বিলীন হয়ে যায়নি। কেন না, নিছক একটা হুজুগ নয়। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ কেবলই নিষিদ্ধ খাদ্য আর মদ্য নয়। ডিরোজিও এবং তাঁর অনুরাগীরা যে বাতাস থেকে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন তাতে অফুরন্ত সুবাস। ফরাসি বিপ্লব। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ। ইংল্যান্ডে র‍্যাডিকেলইজম-এর অভ্যুদয়। ভাসতে ভাসতে দূর গঙ্গাতীরেও এসে পৌঁছেছিল প্রস্ফুটিত সেই সব পুষ্পের রেণু। ‘ইয়ং বেঙ্গল হার্ড ড্রিঙ্কিং’ আর ‘ইয়ং বেঙ্গল হার্ড রিডিং’কে দুটি আলাদাভাবে ভাগ করছেন একজন ডিরোজিয়ান। দ্বিতীয় দলের হাতে হাতে ফিরছে তখন বেকন, হিউম, টম পেইন। ‘এজ অব রিজন’-এর জন্য কাড়াকাড়ি লেগে যায় তাদের মধ্যে। ডিরোজিওর আকস্মিক মৃত্যু সন্দেহ নেই, তাঁদের পক্ষে প্রচণ্ড এক আঘাত, কিন্তু তবু তাঁরা রণে ভঙ্গ দিলেন না, এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন সামনে দিকে। পিছনে তাকালে আজকের সন্ধানীর যেমন চোখ এড়াবে না ডিরোজিওর আবির্ভাবের অব্যবহিত আগে রামমোহনের আন্দোলনের ফলে রচিত পটভূমিখানি, ঠিক তেমনই ডিরোজিওর পরবর্তী অধ্যায়ের দিকে পা বাড়াতে চাইলে তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় অবহেলা ভরে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠীটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। কোনও কোনও পর্যবেক্ষক মনে করেন, ডিরোজিও এদেশে প্রথম জাতীয়তাবাদী। তিনি এদেশের প্রথম দেশপ্রেমিক। তাঁর মৃত্যুর পর ডিরোজিও-শিষ্যরাও কিন্তু অগ্রণী নানা ক্ষেত্রে। ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর তৎপরতা অবশ্য বন্ধ হয়ে যায় ডিরোজিওর জীবৎকালেই। ১৮৩৮ সালে ওঁরা স্থাপন করেন ‘সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ’ বা সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা। ১৮৩৮ সালে তাঁদের উদ্যোগেই স্থাপিত হয় ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’; পরবর্তী কালে যা রূপান্তরিত হয় ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এ। সমসাময়িক ল্যান্ডহোল্ডারস অ্যাসোসিয়েশন বা, ‘জমিদারি সভা’ যদি পয়সাওয়ালাদের আড্ডা, তবে এঁদের পড়া প্রথম সংগঠনটিতে মাথাওয়ালাদেরই ভিড়। এই সব সংগঠনের ঐতিহাসিক ভূমিকা অস্বীকার করতে পারেন না কেউ। বস্তুত দাস-বিরোধী আন্দোলনের নেতা জর্জ টমসনকে নিয়ে কলকাতায় যে হই-হল্লা, তার পুরোভাগে যেমন ‘ইয়ং বেঙ্গল’, তেমনই ধর্মের নামে চড়কে নিষ্ঠুরতা, বা হোলিতে অসভ্যতা থেকে শুরু করে অন্তর্জলির মতো প্রথার বিরুদ্ধেও তাঁরাই মুখর। স্ত্রী-শিক্ষার প্রসারে কিংবা বিধবা-বিবাহ আন্দোলনে—কোথায় নেই ওঁরা? ওঁদের মুখপত্র ‘এনক্যোয়ারার’, ‘জ্ঞানান্বেষণ’ কিংবা ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’-এর সওয়ালধারা, যুক্তির তীক্ষ্ণতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা দেখলে বোধ হয় সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, ডিরোজিওর সার্থক উত্তরাধিকারী ছিলেন ওঁরা। মৃত্যুর পরও ডিরোজিও অনেক দিন বেঁচেছিলেন ওঁদের মধ্যে।

কিন্তু উইলের পাত্র-পাত্রীরা? ডিরোজিওর পরিজন-পরিবার? তাঁদের কান্না কিন্তু ১৮৩১ সালের সেই শীতের সকালেই শেষ হয়ে যায়নি। ওঁদের দুঃখের রজনী অতি দীর্ঘ। সত্যি বলতে কী, সে রাত্রি কোনও দিন আর ভোর হয়নি ১৫৫ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডের ওই বাড়িটিতে, ওঁদের পারিবারিক ভদ্রাসনে, যেখানে হেনরির জন্ম এবং মৃত্যু।

শোকের আঘাত সামলাতে না সামলাতে ওঁদের চোখের সামনে পলকে তছনছ হয়ে গেল সব। হেনরির স্মৃতিরক্ষা তো পরের কথা, অতঃপর নিজেদেরও বুঝি আর রক্ষা করা যাবে না। উইলের মতোই মর্মান্তিক তার পরের অধ্যায়। সে-কাহিনীর আগে ডিরোজিওর স্মৃতিরক্ষা উপলক্ষে বন্ধু এবং শিষ্যদের যে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রসঙ্গত তাও উল্লেখযোগ্য।

ডিরোজিওর তিরোভাবের মাত্র কয়দিন পরে শহরে আয়োজিত হয় এক বিরাট শোকসভার। ১৮৩২ সালের ১১ জানুয়ারি ‘সমাচার দর্পণ’ জানাচ্ছে: গত ৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার অপরাহ্ণে মৃত ড্রজু সাহেবের স্মরণার্থ চিহ্ন স্থাপনকরণ বিষয়ে পারেন্তাল আকাদেমিতে অনেকের সমাগম হয়। তাহাতে শ্ৰীযুত বাবু মহেশচন্দ্র ঘোষ এই প্রস্তাব করিলেন যে, সরকারী চাঁদার দ্বারা যে মৃত ড্রজু সাহেবের বিষয়ে আমরা সকলেই এইক্ষণে খেদার্ণবে মগ্ন তাহার চিরস্মরণার্থ চিহ্নস্বরূপ এক প্রস্তরময় কবর নির্মাণ করা যায় এবং তদুপরি তদপ্রযুক্ত কথা-প্রবন্ধ ক্ষোদিত থাকে, তাহাতে শ্ৰীযুত উএলবর্ণ সাহেব পৌষ্টিকতা করিলেন এবং আরও সকলে সম্মত হইলেন। তৎপর এই প্রস্তাব হইল যে, কবরের খরচ করিয়া যদি চাঁদার টাকা কিছু উদ্ধৃত থাকে, তবে তাহা ড্রজু সাহেবের পরিজনেরদিগকে প্রদানার্থ প্রস্তাব করা যায়। তদনন্তর চাঁদা বহী সকলে দর্শান গেল এবং সেই স্থানেই ৯০০ টাকায় স্বাক্ষর হইল।’

১৮৩২ সালের ৯ জানুয়ারি তারিখে ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ এই সভার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন আসলে ইউরেশিয়ান অথবা অ্যাংগ্‌লো ইন্ডিয়ান নেতা জে ডব্লিউ রিকেটস। মহেশচন্দ্র ঘোষ স্মরণচিহ্ন স্থাপন বিষয়ক প্রস্তাবের উত্থাপক। ডিরোজিও শিষ্যদের মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় স্মৃতিরক্ষা কমিটিতে ছিলেন। ছিলেন ডেভিড হেয়ারও। সভায় মিঃ স্টেপলটন নামে একজন শিল্পীর একখানি চিঠি পড়ে শোনানো হয়েছিল। তাতে তিনি জানিয়েছিলেন স্মৃতি তহবিলের জন্য ডিরোজিওর একখানা লিথোগ্রাফিক প্রতিকৃতি তিনি তৈরি করে দেবেন।

কোথায় গেল সেই প্রতিকৃতি, কোথায়ই বা স্মৃতিচিহ্ন। আমরা ডিরোজিওর যে ছবিটি দেখে অভ্যস্ত, সেটি নাকি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৩ সালের অক্টোবরের ‘দি বেঙ্গল ম্যাগাজিন’-এ। ওঁরা জানিয়েছিলেন ওটা বিশ্বস্ত প্রতিকৃতি। এঁকেছিলেন মিঃ জে বেনেট, লিথোগ্রাফিক প্রক্রিয়ায় তা থেকে মুদ্রিত করেছেন মিঃ এইচ এম স্মিথ। স্টেপলটন সাহেবের লিথোগ্রাফ তবে কোথায় গেল? স্মরণচিহ্ন স্থাপন সম্পর্কে ওই কাগজে এবং ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল অবিচ্যুয়ারি’-তে বলা হয়েছে, চাঁদা উঠেছিল আটশো টাকা। কে বা কারা সে অর্থ আত্মসাৎ করে। ফলে ডিরোজিওর কবর হারিয়ে আছে সাউথ পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে অসংখ্য কবরের ভিড়ে। অথচ ১৮৩২ সালের এপ্রিলেও দেখি, উদ্যোক্তারা হাল ছেড়ে দেননি তখনও। ‘সমাচার দর্পণ’ লিখছে— ‘…যে কমিটি নিযুক্ত হইয়াছিলেন তাঁহারা চাঁদার স্বাক্ষরকারী মহাশয়দিগকে জ্ঞাপন করিয়াছেন যে, তাঁহার কবরস্থানোপরি চণ্ডালগড়ের প্রস্তর নির্মিত এক স্তম্ভ প্রস্তুত হওনার্থ বন্দোবস্ত করিয়াছেন। ঐ স্তম্ভ গ্রন্থনের ব্যয় ১৫২৪॥৮ হইবে। আমরা শুনিয়া কিঞ্চিচ্চমৎকৃত হইলাম যে ১৫৫৪ টাকার চাঁদা হইয়াছে বটে, কিন্তু তন্মধ্যে কেবল ৬১৪ টাকা আদায় হইয়াছে।…’ সে অংক হয়তো আটশোতে পৌঁছেছিল, কিন্তু তস্করেরা সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল। অথচ ‘বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’ (জানুয়ারি-জুলাই ১৯১০) জানাচ্ছেন কল্পিত সেই স্তম্ভে কী লেখা থাকবে, তাও স্থির হয়ে গিয়েছিল। ১৮৩২ সালের ২৯ মার্চ তারিখের ‘গভর্নমেন্ট গেজেট’ থেকে প্রস্তাবিত শিলালেখটিও উদ্ধার করে প্রকাশ করেছেন ওঁরা। তবু এমনই মন্দ কপাল ডিরোজিও-অনুরাগীদের যে, দীর্ঘ ষাট বছর ধরে ডিরোজিওর কবর ছিল অবহেলিত, অচিহ্নিত। শেষ পর্যন্ত সে কলংক মোচন করেন উকিল দুর্গামোহন দাস। নিজের পয়সায় তিনি তার ওপর একটি বেদী নির্মাণ করে তাতে সংক্ষিপ্ত পরিচয়লিপি খোদাই করেন। সেটি জীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ১৯০৯ সালে ডিরোজিওর জন্মশতবার্ষিকীতে সংস্কারের কাজে হাত দেন খ্রিশ্চিয়ান বেরিয়াল বোর্ডের সেক্রেটারি মিঃ জর্জ ওকোনেল। কবরের চারপাশে বসানো হয় রেলিং। রেলিং ঘিরে বাহারি গাছপালার সারি। আর মাঝখানে কবরের বুকে শ্বেতপাথরে খোদাই করা সংক্ষিপ্ত স্মৃতিলিপি। সবই করেছিলেন তিনি ডিরোজিওর প্রতি ব্যক্তিগত অনুরাগবশত, নিজের অর্থব্যয়ে। সে শিলালিপিও আজ অপহৃত। ডিরোজিওর কবর আজ আবার জরাজীর্ণ। সেটিকে খুঁজে বের করাও নাকি শক্ত। অথচ চারদিকে আজ উনিশ শতক নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। ডিরোজিওর অনুরাগী-সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে বই কমছে না। শেষ পর্যন্ত তাঁদের উৎসাহেই পুনরুদ্ধার করা হয়েছে ডিরোজিওর স্মৃতি।

১৫৫ নম্বর লোয়ার সার্কুলার রোডের ইতিবৃত্ত বোধ হয় আরও করুণ। ১৮৩১ সাল থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত বাড়িটি কীভাবে হাতবদল হয়েছে, তার ফিরিস্তি দিয়েছেন ওয়াল্টার ম্যাজ। এখন হয়তো সে বাড়ি অন্য হাতে। অথচ ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত নানা ঘরবাড়ি গ্রহণের উদ্যোগ যে আদৌ দেখা যায়নি এমন নয়। কিন্তু নব্য বাংলার দীক্ষাগুরু ডিরোজিওর এইসব স্পর্শগ্রাহ্য স্মৃতিচিহ্নগুলোকে যেন বেমালুম ভুলে গেছি আমরা। ডিরোজিওর না ছিল কোনও মূর্তি, না কোনও ভাল প্রতিকৃতি। এমনকী স্মৃতিরক্ষার যে সরলতম পথ বেছে নিয়েছিলাম আমরা, অর্থাৎ পথের নামবদল, ডিরোজিওর বেলায় সেখানেও দেখি বিস্ময়কর কার্পণ্য অথচ তাঁর প্রাপ্য ছিল কিন্তু অনেক।

ডিরোজিওর জীবনীকার এডোয়ার্ড লিখেছেন: হেনরির মৃত্যুর পর দেখতে না দেখতে সব লণ্ডভণ্ড। লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়ি, কসাইটোলার কাগজের অফিস তো বটেই, এমনকী ডিরোজিও পরিবার পর্যন্ত ছত্রখান। ডিরোজিওর কাগজ এবং পরিবার পরিজন নাকি এমন একজনের হাতে পড়েছিল যে, তাদের বাঁচিয়ে রাখে এমন সাধ্য কারও ছিল না। কিছুকাল পরে অ্যামেলিয়ার সঙ্গে কৃষ্ণমোহনের হঠাৎ নাকি দেখা হয়েছিল শ্রীরামপুরে। তারপর যে কোথায় হারিয়ে গেল মেয়েটি, কে জানে।

ম্যাজ অনেক পরিশ্রম করে ডিরোজিওর মা ও ভাইবোনদের সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। ভাই ক্লডিয়াসের কথা আগেই বলা হয়েছে। কলকাতার বাড়ি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর মিসেস ডিরোজিও অ্যামেলিয়াকে নিয়ে চলে যান শ্রীরামপুরে। তবে তার আগে ওঁরা যে কলকাতায় থাকবার চেষ্টা করেছেন, সেটাও ঠিক। মিসেস ডিরোজিও কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন—ছাত্র চাই। অ্যামেলিয়া বিজ্ঞাপনে জানিয়েছিলেন তিনি তাঁর ভাইয়ের এক স্মৃতিকথা প্রকাশ করতে উদ্যোগী হয়েছেন, জনসাধারণের সহযোগিতা চান। মনে হয় দুজনের উদ্যোগই ব্যর্থ হয়ে যায়। চোখের জল মুছতে মুছতে নিঃশব্দে ওঁরা চলে যান শ্রীরামপুরে। সেখানেই ১৮৩৩ সালের ২৫ অক্টোবর অ্যামেলিয়ার সঙ্গে আর্থার ডিরোজিও জনসনের বিয়ে হয়ে গেল। জনসন ছিলেন ওঁর ‘ফাস্ট কাজিন’। তিনি কোটার মহারাজার শিক্ষক এবং একান্ত সচিব নিযুক্ত হলেন। অ্যামেলিয়াকে নিয়ে চলে গেলেন দূর রাজপুতানায়। সেখানেই ১৮৩৫ সালে অ্যামেলিয়ার মৃত্যু। তাঁর বয়স তখন মোটে বাইশ। তিনি সন্তানেরও জননী হয়েছিলেন। কিন্তু সেও বাঁচেনি। মিসেস ডিরোজিও অবশ্য মারা গেছেন অনেক পরে, ১৮৫১ সালে, হাওড়ায়। ডিরোজিও পরিবারের ইতিহাস এখানেই শেষ।

পরিবারটির ভাগ্য বিপর্যয়ের ইতিহাস কিন্তু উইল সংক্রান্ত অন্যান্য কাগজপত্রেও রীতিমতো স্পষ্ট। আগেই বলা হয়েছে উইলের কর্মকারকদের একজন ড্যানিয়েল মিকিনস্‌ কিং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আদালতে সেটি পেশ করেন। (পরদিন ৩০ ডিসেম্বর) আদালত থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়—ছ’ মাসের মধ্যে ডিরোজিওর বিষয়আশয়ের বিবরণ আদালতে পেশ করতে হবে। ১৮৩২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দাখিল করতে হবে হিসাবপত্র। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ডিরোজিওর উইলের সঙ্গে এই সব নথিপত্রও রক্ষিত আছে। দলিলগুলো খুঁটিয়ে পড়লে অনেক তথ্যই মিলতে পারে।

কিং সাহেব আদালতে ডিরোজিওর সম্পত্তির যে তালিকা পেশ করেছেন, তার মধ্যে ছিল:— ছাপাখানা এবং টাইপ। (তবে তিনি জানাচ্ছেন জনৈক তারকনাথ চ্যাটার্জির সঙ্গে তাঁর মামলার ফলে এসব শেরিফের হুকুমে দখল করে নেওয়া হয়েছে)।

লাইব্রেরি। (এটিও শেরিফের লোকেরা দখল করে নিয়েছে)।

গাড়ি ঘোড়া এবং অন্যান্য সাজসরঞ্জাম।

চারটি চিত্র।

চারটি টেবিল।

দুই ডজন চেয়ার।

একটা পুরনো স্ট্যানহোপ, বগি এবং ঘোড়া।

একটা সাইডবোর্ড।

একটা ব্রেড বাসকেট।

চারটি পুরানো টুল।

একটা পুরানো বুক শেলফ।

একটা পুরানো ওয়াস স্ট্যান্ড।

এক সেট ওয়াল সেড।

একখানা টেবিল।

কিছু ছাপার কাগজ।

ব্যস, ফর্দ এখানেই শেষ।

কিং এই তালিকা পেশ করেন ১৮৩৩ সালের ১৬ মার্চ তারিখে। বোঝা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে! কসাইটোলায় (বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট) ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়ান’ কাগজের ছাপাখানা জব্দ। কিং মামলা করেও শেরিফের লোকেদের ঠেকাতে পারেননি। তালিকার শেষে অসহায়ের মতো তিনি জানাচ্ছেন, ডিরোজিওর হিসাবপত্র সব তাঁর সরকার মদনগোপাল বোসের কাছে আছে। তিনি তাঁর হদিশ পাচ্ছেন না। মিসেস ডিরোজিও কিংবা ডিরোজিওর বেনিয়ান পার্বতীর কাছ থেকে ওঁর বাড়ির ঠিকানা জানা যেতে পারে।

মনে হয় যেন লুটের বাজার। যার যেমন ইচ্ছা—তাই করছেন। কিং একটা জমাখরচের হিসাবও দাখিল করেছেন আদালতে। খরচের তালিকায় আছে—ছাপাখানার কর্মীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ ৬০০০ টাকা। প্রেসের জন্য জল-নিরোধক কাপড় ২০ টাকা, ইন্ডিয়া গেজেটে বিজ্ঞাপন ১৫ টাকা, ব্যারিস্টারের জন্য মিঃ ম্যাকলিওডকে দেওয়া হয়েছে ২৪ টাকা, ডাক ২৫০ টাকা, মোমবাতি এবং অফিসের জন্য ১০০ টাকা, পিওনের বেতন এবং লিখবার কাগজ ২০ টাকা, সহিস ৪০ টাকা, সার্কুলার রোডে গুদাম ভাড়া ৬০ টাকা, বরকন্দাজের মাইনে ৩৬ টাকা, উইলের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে মিঃ ম্যাকলিওডকে দেওয়া হয়েছে ৭৯ টাকা, শেষকৃত্য বাবদে রেঃ মিঃ ইয়েলসকে দেওয়া হয়েছে ৮২ টাকা, কোচম্যানের বেতন ২৮ টাকা, কসাইটোলার বাড়ি ভাড়া ৫৮০ টাকা, কুলি ভাড়া ৫ টাকা, বেয়ারাদের বেতন ৫০ টাকা ১০ আনা, কসাইটোলায় বাড়ি ভাড়া ২৪০ টাকা, এস অ্যান্ড্রুকে দেয় বাড়তি বেতন ১৬ টাকা, দপ্তরির বেতন ৪০ টাকা, জে ডেব্রুজকে দেয় বাড়তি বেতন ২৪৪ টাকা, দপ্তরির বেতন ২০ টাকা, ই ফ্লিনকে দেয় বাড়তি বেতন ১৭ টাকা ৮ আনা, কসাইটোলায় বাড়ি ভাড়া ১২০ টাকা, বার্নার্ড ২৫ টাকা, এস বাওয়ার ১৪ টাকা, এ লরেন্স ৪৫ টাকা ৬ আনা ৬ পাই, জে উইলিয়ামস ১৬ টাকা, এ লরেন্স ১৩ টাকা ৯ আনা ৬ পাই ঐ—২০ টাকা (এসব সব বাড়তি বেতন পেয়েছেন), মিঃ হাডসনের ছাপার কাজের জন্য বাড়তি লোকের বাবদে ৩০ টাকা, ক্যাপ্টেন স্মিথের জন্য ৫০ টাকা, মিঃ রিডের জন্য ৩০ টাকা।…

জমার ঘরে আছে:

বই বিক্রি ৩০ টাকা, ফার্নিচার ৪০ টাকা, শেরিফ যে সব বই আটক করেছিল, সেগুলি বিক্রি করে পাওয়া গেছে ৫০ টাকা, গাড়ি এবং ঘোড়া বিক্রি ১২০ টাকা, ফার্নিচার বিক্রি ৫০ টাকা, স্ট্যানহোপ- ঘোড়া, ছবি, টেবিল ১৩৫ টাকা, পুরানো আসবাবপত্র ৫০ টাকা, ঐ ২০ টাকা, চেয়ার এবং ছাপার কাগজ ইত্যাদি ৩৪ টাকা, ক্যাপ্টেন স্মিথ ছাপা বাবদে দিয়েছেন ১৭৬ টাকা, মিঃ রিড দিয়েছেন ১১৫ টাকা, জমার অংক এখানেই শেষ। সুতরাং উইলের কর্মকারক ড্যানিয়েল মেকিনস কিং জানাচ্ছেন তিনি পাবেন ৮৪৩৬ টাকা ৭ আনা ৬ পাই।

নিয়তি কোনদিকে ঠেলে দিচ্ছে ডিরোজিও পরিবারকে বুঝতে কোনও অসুবিধা নেই। একই দিনে আদালতে দেয় কী তার দীর্ঘ তালিকাও পেশ করেছেন কিং। প্রাপ্তিযোগের ঘর বলতে গেলে প্রায় শূন্য। জানাচ্ছেন ৯০ টাকা পাওয়া যাবে ‘এনক্যোয়ার’ সম্পাদক কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জির কাছ থেকে। বেনিয়ান পার্বতী কত টাকার বিল আদায় করেছে, তার জানা নেই। সরকার মদনগোপাল ঘোষ সম্পর্কেও একই কথা। অথচ টাকা পাবে অনেকেই। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রেস এবং কিছু বাঙালির নাম। গভর্নমেন্ট গেজেটকে দিতে হবে নাকি ১১৩ টাকা ৬ আনা ৬ পাই, ইন্ডিয়া গেজেট প্রেসকে ১১৪ টাকা, ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেসকে ১২৫২ টাকা ২ আনা ৬ পাই, চার্চ মিশন প্রেসকে ৮১ টাকা, জন বুল-এর মালিকদের ১৬ টাকা। বাঙালিদের মধ্যে টাকা পেয়েছেন দেখছি—মদন সরকার ১২০০ টাকা, আর গোপীকৃষ্ণ বসু ৫০০ টাকা। কয়েকজন পাওনাদার বিশেষভাবে আকর্ষণ করে আমাদের। যেমন ওসটেল ব্রিটিশ লাইব্রেরি পাবে ১০০ টাকার মতো। ডিরোজিও কি বই কিনতেন ওঁদের কাছ থেকে? তাঁর কী কী বই নিলাম হল? মুনু দরজি পাবে ১৫ টাকা ৮ আনা। ডিরোজিও কি পোশাক তৈরি করিয়েছিলেন ওর কাছে? ওয়াচমেকার গ্রে পাবেন ২২ টাকা। ডিরোজিও কি তাঁর ঘড়ি সারাই করাতেন ওঁকে দিয়ে? এক জায়গায় শুধু দেখছি ডিরোজিওর মায়ের নামে ধরা আছে ২৫০ টাকা। ভদ্রমহিলা কি এই সামান্য অর্থই পেয়েছিলেন? মনে হয় না কিং ডিরোজিও পরিবারকে তার চেয়ে বেশি কিছু দিয়েছিলেন বা দিতে পেরেছিলেন। কারণ, তাঁর দাখিল করা দেয়-তালিকায় শেষ যোগফল ৩০৭৮৪ টাকা ১০ আনা। এই অংকটি কিন্তু পেনসিলে লেখা।

বস্তুত, এমন এলোমেলো হিসাব কদাচিৎ দেখা যায়। কীসের সঙ্গে কী জুড়ে দিচ্ছেন কিং, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। বোঝা যায়, মৃত্যুর পরদিন থেকেই ডিরোজিও পরিবার অগাধ জলে, ভরাডুবির আর দেরি নেই। তবু এই সব এলোপাথাড়ি হিসাব, প্রাণহীন অংকে থেকে থেকে কিন্তু আমরা ডিরোজিওর দেখা পাই। দেখা পাই প্রাণবন্ত সেই তরুণের—যিনি কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, নায়ক। গ্রন্থক্ষুধার মতোই প্রসিদ্ধ যাঁর বিলাসিতা আর বাবুয়ানার কথা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা লিখে গেছেন: ডিরোজিও খুবই বাবু ছিলেন। তিনি জাঁকজমকপূর্ণ বাহারি পোশাক পরতেন। তাঁর অনেক শিষ্যের বৈশিষ্ট্য ছিল এটা। ওঁরা বিশিষ্ট হতে চাইতেন। চাইতেন নিজেদের স্বাতন্ত্র দেখাতে। মৃত্যুর পর ঘোড়াসমেত যে স্ট্যানহোপ গাড়িটি বিক্রি হয়ে গেল ১৩৫ টাকায় (তৎসহ ফাউ হিসাবে কিছু ছবি, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি), একজন দর্শক লিখেছেন ডিরোজিও যখন সেজেগুজে ওই হলুদ রঙের গাড়িটি চড়ে পথে বের হতেন, তখন দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো দৃশ্য বই কি। তিনি মাথায় কখনও টুপি পরতেন না, ঝাঁকড়া চুল মাঝখানে দু ভাগ করা ছোটখাটো এই মানুষটিই যখন হাঁটু পর্যন্ত বুট পরে তেজী আরবি ঘোড়ার পিঠে চেপে ময়দানে হাওয়া খেতে বের হতেন, তখন তাঁকে দেখলে নাকি হাসি চেপে রাখা দায়। সে ঘোড়াও কিং-এর হিসাবের খাতায় একটি দুই অংকের সংখ্যা মাত্র।

হিন্দু কলেজে ডিরোজিও মাসে মাইনে পেতেন দেড়শো টাকা। কিন্তু খরচপত্রের ব্যাপারে ধনীদের সঙ্গে নাকি পাল্লা দিতেন তিনি। বাড়িতে তাঁর এলাহি ব্যাপার। সকলের জন্য খোলা তাঁর দরজা, খাওয়ার টেবিলে প্রত্যহ অতিথির ঝাঁক। সুতরাং ঋণ তো হতেই পারে। নেশা ছিল তাঁর বই কেনা। বই পড়া। হিসাবের খাতায় তারও নিশানা। ঋণের দায়ে লাইব্রেরি চলে গেল। কী বই ছিল সেখানে আমরা জানি না। কিং নামগুলো টুকে রাখা প্রয়োজন মনে করেননি। বইয়ের দোকানকে কোন কোন বইয়ের জন্য টাকা দিতে হবে, তাঁর হিসাবে তাও উহ্য। আমরা শুধু জানতে পারছি, ঘরে তাঁর বই ছিল, ছবি ছিল। আস্তাবলে ছিল একাধিক গাড়ি, ঘোড়া। অনুমানে বুঝতে পারছি, যে দুটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন তিনি, তার জন্য ছাপাখানার বকেয়া টাকা তখনও মেটাতে পারেননি। ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস ছাড়াও আরও ছাপাখানার কাছে অনেক দেনা তাঁর। অথচ এই বইগুলো নিয়ে চারদিকে কত না শোরগোল। এমনকী বিলাতেও নাকি মৃত্যুতরঙ্গ। কিং-এর হিসাবপত্রগুলো নাড়াচাড়া করতে বসলে চোখে জল এসে যায়। এমন নিষ্ঠুর দলিল বোধহয় সত্যিই বেশি দেখা যায় না। তবু ভাল লাগে—যখন দেখি, মৃত্যুর পরেও কেউ কেউ আসছেন, বিক্রির আর কী আছে তার খোঁজ নিতে নয়, কবিতার বই পাওয়া যেতে পারে কিনা, তা-ই জানতে। কিং শুধু বাড়ি-গাড়ি আসবাব নয়, কবিতার বইও বিক্রি করেছেন তিরিশ টাকায়। লোয়ার সার্কুলার রোডের বাসিন্দা ডিরোজিওর শেষ উইলের একসিকিউটার ড্যানিয়েল মিকিন্‌স কিং কি জানতেন বাইশ বছর বয়সের এই কবির যে বই হেলাফেলা করে বিক্রি করে দিচ্ছেন, তিনি একদিন বন্দিত হবেন নবযুগের নবচেতনার প্রথম কবি হিসাবে? স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্ন দেখার গৌরবে একদিন ভূষিত হবেন এই কবি!

গরম সভা, নরম সভা

‘ভাল মহাশয় তোমাকে জিজ্ঞাসা করি এই কলিকাতার মধ্যে ভদ্রলোকেরদিগের চারি পাঁচ জল আছে ইহাতে আমার অনেক সন্দেহ হইয়াছে। ১ প্র.। এই যে অনৈক্য না হইলে দল হয় না ইহাতে ভদ্রলোকের অনৈক্যতার কারণ কি। ২ প্র.। দলপতি মহাশয়েরা কি চেষ্টা করিয়া দল করেন। ৩ প্র.। দলপতির ইহাতে লভ্য কি। ৪ প্র.। দলপতিরদিগের দলস্থ সকলকে বশীভূত রাখিতে কিছু ব্যয় হয় কি না। ৫ প্র.। দলস্থ সকলে দলপতির সহিত কিরূপ ব্যবহার করেন। ৬ প্র.। দল করিবার ফল কি। ৭ প্র.। কোন লোক যদি কাহার দলাক্রান্ত না-হয়, তাহাতে ক্ষতি কি। ৮ প্র.। এক ব্যক্তি কোন দলভুক্ত আছে সে ব্যক্তি সে দল পরিত্যাগ করিয়া অন্য দলে যাইতে পারে কি না। ৯ প্র.। দলপতিরা আপনা স্বেচ্ছায় কাহাকেও ত্যাগ করেন কি না। ১০ প্র.। এক ২ জাতির কি এক ২ দল। ১১ প্র.। ব্রাহ্মণেরা কি দলপতি কি ধনীলোক বা রাজদত্ত সম্মানিত ব্যক্তি দলপতি হইয়া থাকেন এই দলের বিষয়ে মহাশয়কে বিশেষ মনোযোগপূৰ্ব্বক উত্তর করিতে হইবেক ইহার অনেক ঘোট হইয়া থাকে এবং হইবেক।’

হঠাৎ মনে হতে পারে, এই প্রশ্নাবলি বুঝি বা হাল আমলের রাজনৈতিক দলাদলি নিয়েই। কিন্তু আসলে তা নয়। উদ্ধৃতিটি ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা কমলালয়’ থেকে নেওয়া। তার প্রকাশকাল ১২৩০ বঙ্গাব্দ। অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ ১৮২৩। তার মানে দেড়শো বছরেরও আগেকার ব্যাপার। সুতরাং, খোলাখুলি আলোচনায় দোষ নেই। এক সঙ্গে এগারোটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন যিনি কলকাতা শহরে, তিনি নবাগত। এখানে এসে দেখেন, চারদিকে দল আর দল। সুতরাং, কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলেন না তিনি। নগরবাসী এক বিজ্ঞকে ধরে পড়লেন, ভিতরের ব্যাপারটা তাঁকে বুঝিয়ে দেবার জন্য।

উত্তরে ভবানীচরণ কী বলেছিলেন, এখানে তার বিস্তারিত আলোচনা অবান্তর। আজকের পাঠক শুনে হয়তো তাজ্জব বনে যাবেন, সেদিনের দলাদলির একমাত্র উপলক্ষ ছিল জাতপাত, দেশাচার, কুলাচার ইত্যাদি। ৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে নগরবাসী বলছেন— ‘দলের ফল শুন দল থাকিলে লোকের জাতি ও ধৰ্ম্ম থাকে যেহেতু কোন ব্যক্তি কুকৰ্ম্ম করিলে তাহার বাটীতে কেহ জলস্পর্শ করে না এবং পদার্পণও করে না তাহার সহিত কাহার নৈকট্যতা বা কুটুম্বতা কিংবা আত্মীয়তা থাকিলেও দলস্থ লোকের ও দলপতির অনুমতি না হইলে যাইতে পারেন না ইহাতে শংকিত হইয়া লোক আহার ব্যবহার করেন তাহাতে ধৰ্ম্ম রক্ষা পায় আর কেহ যদি মিথ্যাপবাদে পতিত হয় তবে দলপতি আপন গণকে বল্যে তাহাকে উদ্ধার করেন ইহাতে তাহার জাতি রক্ষা পায়, অতএব দলাদলের ফল আপনি বিবেচনা কর।’

‘কলিকাতা কমলালয়’ প্রকাশিত হওয়ার আগে এবং পরে বহুদিন পর্যন্ত এই কলির শহরে দলাদলির অন্যতম উপজীব্য ছিল তথাকথিত এই ধর্ম। ধর্মরক্ষা, সমাজ রক্ষার নামে সুসংগঠিত উদ্যোগ অবশ্য প্রথম দেখা যায় ১৮৩০ সালে শহরে ধর্মসভা প্রতিষ্ঠায়। তার আগে ১৮১৫ সালে রামমোহন রায় স্থাপন করেছেন তাঁর ‘আত্মীয় সভা’। কিন্তু তার চেহারা চরিত্র অন্যরকম, ধর্মসভার সঙ্গে কোনও তুলনা চলে না তার। আত্মীয় সভা ক্লাবের মতো প্রথম প্রথম সপ্তাহে একদিন রামমোহনের মানিকতলার বাড়িতে বৈঠক বসত তার। আলোচনা চলত ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে। এ ছাড়া, জাতিভেদ প্রথা, সতীদাহ, বহুবিবাহ, বিধবা বিবাহের মতো সামাজিক সমস্যা নিয়েও সেখানে আলাপ আলোচনা চলত। এমনকী চলত শাস্ত্রীয় বিচার বিতর্কও। তবু ‘ধর্মসভা’র তুলনায় ‘আত্মীয় সভা’ যেন নিতান্তই শীতল সভা। তা ছাড়া, ১৮১৯ সালে একেবারে শীতল হয়ে যায় এই সভা। রামমোহনের বিরুদ্ধে গোঁড়া সনাতনপন্থীরা যুথবদ্ধ হয়েই আন্দোলন চালাচ্ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁদের কৌশল ছিল অন্যরকম, প্রতিবাদে তখনও কোনও গরম সভা স্থাপনের কথা ভাবতে পারেননি ওঁরা। কিন্তু সতীদাহ নিরোধক আইন পাস হয়ে যাওয়ার পর আর স্থির থাকতে পারলেন না তাঁরা। জন্ম নিল গরম সভা ‘ধর্মসভা’। লক্ষ্য: ধর্ম এবং সমাজ রক্ষা ‘সতীদ্বেষীদের’ ঠাণ্ডা করা।

সমাজরক্ষার জন্য ‘ধর্মসভা’ কী করেছিল, সে প্রসঙ্গ পরে। তার আগে পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া ভাল হুঁকো নাপিত বন্ধ করে সামাজিক শৃংখলা রক্ষা তথা সমাজের মোড়লদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার প্রয়াস কিন্তু এ শহরে আগেও ছিল। সত্যি বলতে কী, গাঁয়ের পঞ্চায়েত নিয়েই যাত্রা শুরু আমাদের এই নবীন শহরের। অষ্টাদশ শতকেই আমরা শুনি, শহরে ‘জাত কাছারি’ বা জাতিমালা কাছারির কথা। সে কাছারির হর্তাকর্তা-বিধাতা মুনসি নবকৃষ্ণ। ১৭৬৭ সালের এপ্রিলে দেখি, কোম্পানির প্রভুদের কাছে তিনি এক দীর্ঘ আবেদনপত্র পেশ করেছেন। বক্তব্য: জাতকাছারি চালাতে গিয়ে বড্ড নাজেহাল হচ্ছেন। সে সময়ে একটি মেয়ের বিচার করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরেই শুনছেন ব্রাহ্মণ বধূর সতীত্বনাশের পালটা অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। নবকৃষ্ণ বলছেন এসব ঈর্ষাপরায়ণ শত্রুপক্ষের কাজ। এ-মামলা সাজানো। তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। তার আগের বছর (১৭৬৬) দেখি, শহরের গণ্যমান্য বা পয়সাওয়ালা লোকেরা কোম্পানির কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করছেন—শহরের প্রথম ‘ব্ল্যাক জমিদার’ গোবিন্দরাম মিত্রের নাতি রাধাচরণ মিত্রের ফাঁসির হুকুম রদ করার জন্য। পঁচানব্বই জন মাথালো মাথালো লোকের সই রয়েছে সে-আবেদনে। সুতরাং, নবকৃষ্ণ ছাড়া না পেলে হয়তো, তাঁর দলের লোকেরাও অনুকম্পার জন্য আর্জি পেশ করতেন প্রভুকুলের দরবারে। তবে তার দরকার হয়নি। বেকসুর খালাস হয়েছিলেন তিনি। পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন আবার নিজের পদে। পদ তাঁর, দুই নয়, অনেক। তার মধ্যে একটি, এই জাতকাছারি পরিচালনা।

কাছারি যে অসীম শক্তিধর ছিল, সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তা বলে সমাজ কর্তারাই যে সর্বশক্তিমান ছিলেন, একথা তবুও বলা যাবে না। রামমোহনকে সমাজ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি তাঁরা। তিনি আপন অনুরাগীদের নিয়ে স্বচ্ছন্দে বাস করে গেছেন এই শহরে, সমাজপতিদের কোনও পাঁতি স্পর্শ করতে পারেনি তাঁকে। অন্য বিদ্রোহীও দেখা গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ‘কালীপ্রসাদী হেঙ্গাম’-এর কথা। সে হাঙ্গামার বিবরণ দিচ্ছেন রাজনারায়ণ বসু ‘হাটখোলার বিখ্যাত দত্তবংশীয় কালীপ্রসাদ দত্ত সর্বনীতিবিরুদ্ধ এক কাৰ্য্য করেন, তাহাতে তিনি জাত্যন্তরিত হয়েন ও তাঁহার পক্ষীয় লোকেরা তাঁহাকে সমন্বয় করিয়া জাতিতে তুলেন। তাহাতেই কালীপ্রসাদী হেঙ্গামের উৎপত্তি হয়। ঐ কাৰ্য্য বিবি আনর নামক একজন পরমাসুন্দরী উপপত্নী রাখিয়া তাহার গৃহে কিছুদিন বাস করা।’

কালীপ্রসাদ যে শুধু লখনউয়ের মুসলমান রমণীকে নিয়ে বেলেঘাটার বাগানবাড়িতে বাস করেছিলেন তাই নয়, ‘সমাচার দর্পণে’ প্রকাশিত (৫ এপ্রিল, ১৮৩৪) একটি চিঠিতে বলা হয়েছে— ‘কিয়ৎকাল হইল কোন প্রধান বংশোদ্ভব পরম মান্যব্যক্তি স্বেচ্ছাপূর্বক সর্ব্বান্তঃকরণের সহিত ত্বকচ্ছেদ ইত্যাদিপূর্বক জবন ধর্মাবলম্বন করিয়া আনারোনাম্নি বজান রমণীকে মহম্মদীয়ন শরার মতে বিবাহ করেন ও জবনেরা তাঁহার হিন্দু নাম পরিবর্তে এজ্জতআলী খাঁ নামকরণ করে তিনি ঐ জবানি স্ত্রী সমাভব্যাহারে যথারীতিক্রমে রোজা নমাজে তৎপর হইয়া বহুদিবস ঘর বসত করেন…।’ ইত্যাদি।

সেই কালীপ্রসাদকেই কিন্তু হিন্দু সমাজের কোলে আবার ফিরিয়ে আনেন রামদুলাল দে। যাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ওই দত্ত পরিবারের আশ্রয়েই। সমাজের অভিভাবক হিসাবে শোভাবাজারের রাজারা তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঠেকাতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন জাত আমার বাক্সে। শোনা যায়, কালীপ্রসাদকে উদ্ধার করার জন্য তিনি লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। সমাজপতি এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, সমন্বয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য। ফলত অনেকেই এসে হাজির হয়েছিলেন সিমুলিয়ায় রামদুলালের বাড়িতে। সেখান থেকে শোভাযাত্রা করে তাঁরা চললেন নিমতলায় কালীপ্রসাদ দত্তের বাড়ির দিকে। সে নাকি দেখবার মতো দৃশ্য। মিছিলের মুখ যখন নিমতলায় দত্তদের বাড়িতে, লেজ তখনও রামদুলালের উঠোনে।

একঘরে করেও রামমোহনকে যেমন শায়েস্তা করা যায়নি, সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দিয়েও তেমনই ঠেকানো যায়নি পতিত কালীপ্রসাদের পুনর্বাসন। এর এক কারণ, ঘটনাস্থল শহর। এখানে গ্রামীণ সমাজের রীতিনীতি চালু রাখা শক্ত। দ্বিতীয় কারণ, অর্থবল। লক্ষ্মী এখানে চঞ্চলা। কখন কার ঘরে প্রবেশ করবেন তিনি, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আর পয়সা যাঁর বাক্সে আছে, জাত যে তার বাক্সে থাকবে, সমাজপতিরা কি নিজেরাই তা জানেন না? কলিকাতা কমলালয়-এর সেই গ্রাম্য লোকটি যখন শুনলেন যে শহরে ব্রাহ্মণ কায়স্থ ও নবসাক সম্বলিত যত দল দেখিতে পাও ইহার দলপতি ব্রাহ্মণ আর কায়স্থ ব্যতিরেকে অন্য জাতি নহে, তখন মূঢ়ের মতো মন্তব্য করে বসেছিলেন: ‘কিন্তু শূদ্রে ব্রাহ্মণের দলপতি হইয়া থাকেন ইহা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়াছি তাহাতে ব্রাহ্মণ ঠাকুর মহাশয়েরা কি আপন স্বেচ্ছাপূর্বক তাঁহারদিগের দলভুক্ত থাকেন কি তাঁহারা ভয় কিংবা লোভ দর্শাইয়া আপন দলভুক্ত বলেছিলেন। শুধু বলতে পারেননি যে, শহরে এটাই নিয়ম। শূদ্রের যদি যথেষ্ট অর্থবিত্ত এবং প্রতিপত্তি থাকে, তবে ব্রাহ্মণের সমাজেও তাঁর নেতৃত্বপদ-গ্রহণে বিন্দুমাত্র অসুবিধে নেই। অর্থের পর, শহরে সনাতন নীতি নিয়মকে শিথিল করে তুলছে যা—সে আধুনিক ইংরাজি শিক্ষা। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শহরের হাওয়া ক্রমে অন্যরকম। কালীপ্রসাদী হাঙ্গামা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজনারায়ণ বসু লিখেছেন—ডিরোজিওর ছাত্ররা জাতির বন্ধন শিথিল করেন। কলকাতা শুধু কমলালয় নয়, ইংরাজি শিক্ষার দৌলতে কলকাতা যেন আর এক শ্রীক্ষেত্রের মতোও বটে। এখানে নানা জাতের মধ্যে মেলামেশায় অসুবিধা নেই, অসুবিধা নেই যে কোনও বিষয়ে আলোচনায় বসে যেতে।

ফলে একদা যেখানে বলতে গেলে জাতকাছারি ছাড়া কিছুই প্রায় ছিল না, উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকেই দেখি, সেখানে আবির্ভূত হয়েছে অন্য ধরনের সভা, আত্মীয়সভা, তৃতীয় দশকে গৌড়ীয় সমাজ, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন আরও কত কী। কলকাতায় সভা সমিতির পথ প্রদর্শক অবশ্য ইংরাজরা। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে তাঁদের উদ্যোগেই স্থাপিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি। তারপর কৃষিসমাজ ইত্যাদি। বাঙালিটোলায় এ জাতীয় উদ্যোগ প্রথম দেখা যায় ১৮২৩ সনে, গৌড়ীয় সমাজ-এর প্রতিষ্ঠায়। যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল দেশবাসীর ভিতরে জ্ঞানের উন্নতি ও প্রসার। সমাজের অনুষ্ঠানপত্রে বলা হয়েছিল এই উদ্দেশ্য সাধনকল্পে বিভিন্ন ভাষা হইতে বাংলা ভাষায় গ্রন্থাদি অনুবাদ করাইয়া সমাজের ব্যয়ে প্রকাশ করিতে হইবে। দেশবাসীর মধ্যে নীতি ও শাস্ত্র বিগর্হিত নীতি ও শাস্ত্র বিগর্হিত কার্য দমন ও নিরোধ কল্পে সমাজ যত্নবান থাকিবেন। ইত্যাদি। যদিও প্রসন্নকুমার ঠাকুর, তারাচাঁদ চক্রবর্তীর মতো নব্যশিক্ষিতরা এই সমাজে ছিলেন, তবু বোঝা যায়, ধর্ম এবং সমাজকে খ্রিস্টানি এবং ইংরেজি-শিক্ষিতদের হামলা থেকে বাঁচাননাও ছিল এই সমাজের অন্যতম লক্ষ্য। কেন না, সমাজে সমাজপতিরাও যোগ দিয়েছিলেন সমান উৎসাহ নিয়ে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, রক্ষণশীলরা সর্বব্যাপারেই রক্ষণশীল। বা নব্যশিক্ষিতরা সবাই সর্বক্ষেত্রে সমান প্রগতিপন্থী। বৈপরীত্য দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই ছিল। এখানে সেসব আলোচনার অবকাশ নেই, বোধ হয়, খুব দরকারও নেই। আপাতত জরুরি এ খবরটুকুই যে, উনিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে যেন সভার নেশায় পেয়ে বসেছে আমাদের। শহরে সে কী ব্যস্ততা।

সেকালের বিখ্যাত সভাগুলোর মধ্যে ছিল: গৌড়ীয় সমাজ, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন, সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা, স্কুল সোসাইটি, স্কুল বুক সোসাইটি, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা, সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা, তত্ত্ববোধিনী সভা, পরিসিভিয়ারেন্স সোসাইটি, সর্বশুভঙ্করী সভা, সুরাপান নিবারণী সভা, বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ, বেথুন সোসাইটি, শিল্পবিদ্যোৎসাহিনী সভা, জ্ঞানচন্দ্রোদয়, বিদ্যোৎসাহিনী সভা, সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, গার্হস্থ্য সাহিত্য সমাজ, অন্তঃপুর স্ত্রী শিক্ষা, বামাবোধিনী সভা, হেয়ার প্রাইজ বন্ড কমিটি, উত্তরপাড়া হিতকারী সভা, বঙ্গীয় সমাজ বিজ্ঞান সভা, বামাহিতৈষিণী সভা, ইত্যাদি ইত্যাদি। শহরময় তখন সভা আর সভা। কার কী কাজ নাম থেকেই অনেকটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে তার। এতকাল বাবুদের নেশা ছিল যদি তুড়ি-ঘুড়ি-বুলবুলি, আখড়াই হাফ আখড়াই, এবার তবে আর এক নেশা এই সভা। জুড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে তিনি সভায় চললেন।

আমাদের ঘুম ভাঙার কাহিনীতে এই সব সভাসমিতির গুরুত্ব সকলের জানা। কিছু না কিছু অবদান রয়েছে প্রায় প্রত্যেকটিরই। কোনও কোনও সভাকে কেন্দ্র করে সে কী আলোড়ন আর উত্তেজনা। দু’-একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার এক বৈঠক বসেছে সংস্কৃত কলেজের হলে। শ্রোতাদের মধ্যে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন হিন্দু কলেজের স্বনামধন্য শিক্ষক রিচার্ডসন সাহেব। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় সেখানে একটি প্রবন্ধ পড়ছেন। বিষয়: বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা এবং পুলিশ। প্রবন্ধটিতে রাজরোষের গন্ধ পেলেন ক্যাপটেন রিচার্ডসন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন। সভাপতি বাধা দিলেন তাঁকে। বললেন, আপনার অধিকার নেই এভাবে প্রতিবাদের। আপনি আমন্ত্রিত শ্রোতামাত্র। তুমুল বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে সাঙ্গ হল সভা। কাগজে কাগজে তাই নিয়ে বিস্তর লেখালেখি। দক্ষিণারঞ্জন কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রবন্ধ পড়েছিলেন অন্য আর একদিনের সভায়।

তত্ত্ববোধিনী সভায়ও উত্তেজনামূলক নানা ঘটনা। প্রসিদ্ধ এই সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঠাকুরবাড়ির দশজন যুবা। সে ১৮৩৯ সালের কথা। এ সভার পুরোভাগে ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কথা ছিল—‘বিবিধ উপায় দ্বারা তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করিবেন।’ কিন্তু ক্রমে দেখা গেল, সেই লক্ষ্য ছাপিয়ে জাতীয়তার ব্যাপক এবং উদার আদর্শের প্লাবন তত্ত্ববোধিনী সভার তত্ত্বস্রোতে। নানা দলের নানা মতের মানুষ মিলিত হয়েছেন সেখানে। সভার কাগজ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় সর্ব বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা। দশজন সভ্য নিয়ে যে সভার সূচনা ক্রমে তার সভ্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটশো জন (১৮৫৩)। স্বভাবতই মতভেদ। সভা যেন ক্রমেই দেবেন্দ্রনাথের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তত্ত্ববোধিনী সভার নানা বিভাগ পরিচালনার জন্য একাধিক কমিটি ছিল। গ্রন্থাধ্যক্ষরা একবার ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ে রাজনারায়ণ বসুর একটি রচনা প্রকাশ করতে অসম্মত ছিলেন। তাই শুনে রাজনারায়ণকে মহর্ষির চিঠি—কতকগুলি নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে ইহাদিগকে এ-পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে আর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের সুবিধা হইবে না। তত্ত্ববোধিনী সভা স্তব্ধ হয়ে যায় ১৮৫৯ সালে।

এ ধরনের উত্তেজনা, আদর্শের সংঘাত, নবীন প্রবীণের দ্বন্দ্ব উনিশ শতকের অনেক সভাতেই দেখা গেছে। তবে ডিরোজিওর অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন এবং পরবর্তী কালে সতীদাহ উচ্ছেদ আন্দোলন উপলক্ষে যে-সব কাণ্ড ঘটেছে, তার বুঝি তুলনা হয় না।

হিন্দু কলেজের নবীন শিক্ষক হেনরি ডিরোজিও কলেজের বাইরেও তার ছাত্রদের নিয়ে নানা বিষয়ে আলোচনা চালাতেন। তারই পরিণতি ১৮২৮ সনে স্থাপিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। প্রথম প্রথম সভা বসত নাকি লোয়ার সার্কুলার রোডে ডিরোজিও বাড়িতে। তারপর মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগানবাড়িতে। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, মাধবচন্দ্র মল্লিক প্রমুখ ইয়ং-বেঙ্গলের বাঘা বাঘা তরুণরা ছাড়া ডেভিড হেয়ার থেকে শুরু করে অনেক বিশিষ্ট বিদ্যোৎসাহী ইংরেজই উপস্থিত থাকতেন সেই আলোচনা সভায়। সভা পরিচালনা করতেন ছাত্র এবং শিষ্যদের প্রায় সমবয়সী ডিরোজিও নিজে। যুগের পটভূমিতে রীতিমতো বিপ্লবাত্মকসভা। সমাজকে যুক্তির আলোয় বিচার করার আয়োজন। কোনও দ্বিধা নেই, জড়তা নেই। স্বাধীন ইচ্ছা, অদৃষ্ট, প্রত্যয়, পবিত্র সত্য, পাপের নীচতা, স্বদেশপ্রেমের মহত্ত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, পৌত্তলিকতার অসারতা, ইত্যাদি প্রচলিত ধ্যান-ধারণা এবং আচার ব্যবহার, কিছুই তাঁদের বিচারের বাইরে নয়। ১৮৩০ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হল তাঁদের মুখপত্র পার্থেনন। সেখানেও অনেক ‘নিষিদ্ধ’ বিষয় নিয়ে খোলাখুলি লেখালেখি। ফলে শহরময় চাঞ্চল্য। নানা মহল থেকে ক্রুর আক্রমণ। ‘পার্থেনন’-এর দ্বিতীয় সংখ্যা ছাপা হলেও বিলি করা আর সম্ভব হল না। কলেজ থেকে অনেকে তাদের ছেলেদের ছাড়িয়ে নিলেন। এবং ক্রমশ রক্ষণশীলদের চাপে পড়ে হিন্দু কলেজ থেকে বিদায় নিতে হল ডিরোজিওকে।

এই আলোড়ন অনিবার্য। কারণ, বলতে গেলে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। ‘নবযুগের বৈপ্লবিক চিন্তার প্রথম প্রবর্তক’-ই। রামমোহন স্থাপিত আত্মীয় সভাতেও (১৮১৫) নানা সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা চলত। তবু যে তাকে ঘিরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি, তার কারণ সম্পর্কে একালের একজন পর্যবেক্ষক লিখছেন: ‘১৮১৫-২০ থেকে ১৮২৫-৩০ সালের মধ্যে কালের ব্যবধান মাত্র দশ-পনেরো বছরের হলেও, সামাজিক পরিবেশের আনুপাতিক ব্যবধান ঘটে গিয়েছিল অনেক বেশী।’ তা ছাড়া ‘আত্মীয় সভায় ছিল বিত্তের দিক থেকে ধনী এবং বয়সের দিক থেকে মধ্যবয়সীদের প্রাধান্য।…ডিরোজিও-যুগে সমাজের আকারে বেশ বড় রকমের একটা পরিবর্তন ঘটল। সর্বপ্রথম বাংলাদেশে নতুন পাশ্চাত্য বিদায় শিক্ষিত একদল মধ্যবিত্ত যুবকের আবির্ভাব হল সমাজে। নবযুগের বাংলায় এটা যুগান্তকারী ঘটনা।’ এঁদের বেশভূষা, কথাবার্তা, চালচলন সবই অন্যরকম। ফলে সনাতন সমাজ সভয়ে তাকাত ওঁদের দিকে। তারই মধ্যে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর বেন্টিংকের সতীদাহ নিরোধক আইন। বিস্ফোরণ। যার পরিণাম হিসাবে ১৮৩০ সালের ৭ জানুয়ারি জন্ম নিল গরম সভা, ‘ধর্মসভা’। লক্ষ্য: স্বধর্ম ও সদাচার ও সদ্ব্যবহারাদি রক্ষা।

একদিকে সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ, ‘অন্যদিকে ডাফ’ হিল প্রভৃতি খ্রিস্টান প্রচারকদের আন্দোলন তদুপরি হিন্দু কলেজের তরুণ দলের আক্রমণ। অন্ধক্রোধে দিশাহারা ধর্মসভা সেদিন যা করেছিলেন সে এক ইতিহাস। সতীদাহ বন্ধ করার পক্ষে যাঁরা, ধর্মসভার চোখে তাঁরা ‘সতীদ্বেষী’। বেন্টিংকের আইনের বিরুদ্ধে তাঁরা আরজি পেশ করলেন। চাঁদা উঠল ঘড়া ঘড়া টাকা। বেথি নামের এক সাহেবকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত আপিল করা হল বিলেতে। এদিকে ঘরেও চলল তার কঠোর শাসন। নতুন করে আবার ‘জাত বাহারি’ যেন। পান থেকে চুন খসলেই সাজা, শাস্ত্র অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্তের বিধান। উল্লেখযোগ্য: ‘কলিকাতা কমলালয়’-এর লেখক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এই গরম সভার সম্পাদক। তাঁর সম্পাদিত কাগজ ‘সমাচার চন্দ্রিকা’র পৃষ্ঠায় ইয়ং বেঙ্গলের বিরুদ্ধে সে কী অপপ্রচারের ধুম। কখনও বা আস্ফালন, তর্জন গর্জন। ইয়ংবেঙ্গলও একেবারে ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার নয়। তাঁদেরও রয়েছে খানকয় কাগজ এনক্যোয়ারার, ইস্ট ইন্ডিয়ান, আর জ্ঞানান্বেষণ। তবে গরমসভার মুখপত্রগুলোর অনুপাতে ওঁদের ভাষা বেশ শীতল। যুক্তির লক্ষণই বোধ হয় তাই। আক্রমণের জবাবে ‘এনক্যোয়ারার’-এ কৃষ্ণমোহন লিখেছিলেন (১৮৩১): ‘The heat of the Gurum Shabha is violent and they know not what they are doing. Excommunication is the cry of the fanatic: We hope perseverance will be the liberal’s answer. The Gurum Shabha is high, let it ascend to the boiling point. The orthodox are in a rage; let them burst fourth into a flame.’

সত্যিই ক্রোধে ফেটে পড়েছিল গরমসভা। কিন্তু ফলং? শুধু যে ইতিহাসের রথের চাকা থামাতে ব্যর্থ হলেন তাঁরা, তাই নয়, অচিরে সভার সর্বাঙ্গ দিয়ে ফুটে বের হল নানা বৈপরীত্য, আত্মখণ্ডনের নানা চিহ্ন। সতীদাহ চালিয়ে যাওয়ার অধিকার অর্জন করতে পারলেন না ওঁরা। আন্দোলন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এদিকে দলের মধ্যে গড়ে উঠতে লাগল নানা উপদল। কে কার বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেয়েছে, কার ছেলের সঙ্গে কার মেয়ের বিয়ে হতে যাচ্ছে, কার বিধবা তেরাত্র কাটিয়ে এসেছেন কোন জাহাজে— এসব কচকচিতেই ব্যস্ত তাঁরা। দেখা গেল, সনাতনীরা ঘর সামলাতেই নাজেহাল। শুনলে অবাক না হয়ে পারা যায় না, শুধু দলাদলির বিবরণ নিয়েই তখন (১৮৩২) প্রকাশিত হত একখানা কাগজ। বোধ হয়, সাপ্তাহিক। নাম ছিল তার ‘দলবৃত্তান্ত।’

১৮৩৬ সালে ইয়ংবেঙ্গলের মুখপত্র ‘জ্ঞানান্বেষণ’ কাগজে একজন পত্রলেখক লিখছেন— ‘সতীদাহ বিষয়ে নিরাশ হইয়া ধর্মসভা প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন রামমোহন রায়ের মতস্থ লোকেরদের ছায়া স্পর্শ করিবেন না কিন্তু ঐ সভার প্রধান এক সভ্য শ্ৰীযুত বাবু ভগবতীচরণ মিত্র যিনি ব্রাহ্মগণকে প্রণাম করিতে কপালে শালগ্রাম করিয়াছেন তিনিই শ্ৰীযুত মথুরানাথ মল্লিকের ঘরে কন্যাদান করিলেন এবং সিংহের দল যাহার নামে ধর্মসভা বিষ্ণু স্মরণ করেন ঐ দলস্থ রসিকলাল সেনের ভায়াকে ঐ মিত্রবাবু অন্য কন্যা দিয়াছেন…অতএব ক্রমশ ধর্মসভার শেষাবস্থাই ঘটিল এইক্ষণে আমি জিজ্ঞাসা করি ধর্ম্মসভার সর্ব্বধন বেথি সাহেবের গর্ভেতেই গিয়াছে না সঞ্চিত কিঞ্চিৎ আছে যদি থাকে তবে সভাচিরস্মরণীয় কোন কীর্তি স্থাপন করুন চতুর্দ্দিকে পাঁচ সাত ক্রোশ ব্যাপিয়া যাহার অধিকার উত্তরকালীন লোকেরা কোন চিহ্ন দেখিয়া তাহাকে স্মরণ করিবেন।’

এমনকী, ১৮৪৮ সালে ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রকেও বলতে শুনি—

‘কিন্তু জগদীশ্বরের কি আশ্চর্য্য ইচ্ছা, সত্যের কি নির্মল প্রতিভা, দলাধ্যক্ষ মহাশয়েরা যে অভিপ্রায়ে সভা করিয়া দ্বেষানলে দগ্ধ হইলেন, সে ব্যাপারে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলেন না, ‘ধৰ্ম্ম’ আপনি আপনার রক্ষক হইয়া তাঁহারদিগের মর্ম্মভেদ ও শৰ্ম্মভেদ করিলেন, অর্থাৎ মৃত মহাতনা লর্ড বেন্টিংক বাহাদুরের বিরুদ্ধে বিলাতে যে আপিল করেন, সেই আপিলের মোকদ্দমায় পরাজয় হইলেন, চাঁদার দ্বারা যে প্রচুরার্থ সংগৃহীত হইয়াছিল, তাহা ন দেবায় ন ধর্মায়, জলে ফেলিলে বরং ভুড়ভুড়ি কাটিতে, তাহা না হইয়া কেবল ধৰ্ম্মসভার ব্যাথার ব্যথী সাহেবের উদরায় স্বাহা হইল, মূল আশাভঙ্গ হইলে স্থূলবুদ্ধি সভ্যেরা আর কি করেন, কিছুই ভাবিয়া পান না, সভার কাঁদুনি করিয়া ছাঁদুনি ও বাঁধুনি মাত্র সার হইল…।’ ঈশ্বর গুপ্ত মশাই আরও লিখছেন ‘তৎকালীন চন্দ্রিকা পত্রে এক ২ দিন দলঘটিত যে যে বিষয় প্রকটিত হইত তাহা পাঠ করিয়া আমরা হাস্য সম্বরণে অক্ষম হইতাম।’

সংক্ষেপে এই হচ্ছে গরম সভা ধর্মসভার ইতিবৃত্ত। তার কার্যবিবরণ পড়তে বসলে একালের পাঠকের পক্ষেও হয়তো হাসি চেপে রাখা শক্ত হবে। অন্যদিকে তথাকথিত নরম সভাগুলোর ইতিহাস কিন্তু অন্যরকম। কালের সহযাত্রী হয়ে রূপান্তরিত হতে হতে তারা বোধ হয় পৌঁছেছে একেবারে একালেও। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সমসাময়িক সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার কথাই ধরা যাক। ভূমধ্যকারী সভা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটি তথা পরবর্তী কালের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁদের অবদান। ঠিক তেমনই তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে তত্ত্বধারা পৌঁছেছে নানা ক্ষেত্রে, পল্লবিত হয়ে উঠেছে নানা ধ্যান ধারণা। নরম সভা পঙ্কোদ্ধারে ব্রতী, গরম সভা বদ্ধ জলার মায়া কাটাতে নারাজ।

শুধু সতীদাহ উপলক্ষে নয়, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দেখি নরম সভার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে গরম সভা। বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর শহরে ছড়িয়ে পড়ে নতুন ছড়া—“বাধিয়াছে দলাদলি, লাগিয়াছে গোল।/ বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোলা॥” আন্দোলনের সমর্থকরা যদি গান ধরেন— ‘বেঁচে থাকুন বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’, তবে গরম দলের তরফে প্যারোডি বাঁধা হয়—‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে’। বহু বিবাহ উচ্ছেদ, বালবিবাহ নিরোধ ইত্যাদি উপলক্ষে নরম বনাম গরমের কোলাহল। প্রহসনে একটি মেয়ের মুখে বলা হয়—‘আচ্ছা, মাগ ভাতারের ঘর করবে, তার দশ বছরের হক, রাজার কী?’ একজন পণ্ডিত বলছেন—‘এমন কি একটা নিয়ম হতে পারে যে, ১৫ই জ্যৈষ্ঠ আঁব খাবে, সেই দিন সবাই পাকা আঁব খেতে আরম্ভ করবে?’ শতক তখন ফুরিয়ে আসছে, তারই মধ্যে গরম সভা আরও গরম,— অশ্লীলতায়ও আপত্তি নেই সভাসদদের। নরম সভা বাক্যে গরম হলেও শীতল যুক্তি আর তথ্য নির্ভর, গরম সভা—যুক্তিহীন কুসংস্কারাচ্ছন্নদের আড্ডা যেন।

তবে পরবর্তী কালের কর্মকাণ্ডে সনাতনপন্থীদের ধ্যানধারণা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত একথা বোধহয় জোর দিয়ে বলা যায় না। সংঘাত ক্রমে শান্ত হয়েছে সমন্বয়ে। এই সমন্বয় অবশ্য সর্বক্ষেত্রে কাম্য ছিল না। কোনও কোনও পর্যবেক্ষক তাকে সমন্বয় বলতেও রাজি নন। কেন না, বিপরীত দুই মতের মধ্যে বিরোধ এবং সংঘাতের ফলে তৃতীয় কোনও উচ্চতর মতাদর্শের জন্ম দেয়নি তা। একের মধ্যে অন্য আশ্রয় এবং প্রশ্রয় লাভ করেছে, এই যা। এর নাম আপস, এর নাম সহাবস্থান। হিউমের সঙ্গে মনু যেন। তবু নরম এবং গরম এই সভাগুলোর কথা ভুলতে পারিনি আমরা, কেন না, দুইই আমাদের অন্য জন্মের উপাখ্যান। আমরা আজ যা করছি তার সঙ্গেও বোধ হয় অতীতের এই সব কাহিনীর নিবিড় সম্পর্ক।

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়—এখনও গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেই ভাবের ত্রিধারা বহমান সমাজে। একদল-র‍্যাডিকেল, একদল-লিবারেল, আর একদল কনজারভেটিভ। বামপন্থী, উদারপন্থী, আর প্রাচীনপন্থী গোঁড়ার দল,—সবাই কি এখনও সক্রিয় নয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *