রামমোহন রায়

রামমোহন রায়

[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]

বাল্যজীবন

১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে রামমোহন রায়ের জন্ম। মিস্ কলেটের এই মত নেবার যোগ্য।

তাঁর বালক-কালের দুইটি ব্যাপার বেশ চোখে পড়বার মতো; একটি, তাঁর মেধাশক্তি, অপরটি, গৃহে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহে ভক্তি। প্রথমটির বাঞ্ছিততম পরিণতি তাঁর পরিবর্তী জীবনে ঘটেছিল একথা সবাই জানেন; দ্বিতীয়টির পরিণতি কিছু অদ্ভুত। কোনো কোনো ইতিহাস প্রসিদ্ধ পুরুষের জীবনে এমন পরিণতি দেখতে পাওয়া গেছে, যেমন, বাল্যের চঞ্চল ও তার্কিক নিমাই হয়েছিলেন ভক্তিরসাপুত শ্রীচৈতন্য। কিন্তু অনেকের জীবনে এমন পরিণতি দেখতে পাওয়া যায় না। বালক-বুদ্ধদেবকে আমরা দেখতে পাই সহানুভূতিসম্পন্ন ও পর্যবেক্ষণশীল; বালক-মোহম্মদ সম্বন্ধে যে-সব বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় সমসাময়িক উচ্ছল জীবনের ভিতরে তাঁর স্বাতন্ত্র; আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় নাকি পুরোহিতের সন্তান হয়েও দেবতার সম্মুখে নিবেদিত নৈবেদ্য গ্রহণ করতে পারতেন না। তবে রামমোহনের বাল্যের এই ভক্তিপ্রবণতা উত্তরকালে একটি সুন্দর পরিণতিও লাভ করেছিল। রামমোহনের যোদ্ধাবেশ বন্ধুর চোখে এত মহিমময় ও শত্রুর চোখে এত নিষ্করুণ যে তার অন্তরের পরমাশ্চর্য কোমলতা তাঁদের চোখে পড়বার অবকাশ পায় না। একটি অন্তঃপ্রবাহী ভক্তিধারা তাঁর ভিতরে ছিল, শুষ্ক জ্ঞানমাগী তিনি ছিলেন না, একথা আজ সুবিদিত; তার সঙ্গে একথাও আমরা জানি যে এই পুরুষসিংহ অভিনয়ের চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারেন নি, বিগত জীবন বন্ধুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে অশ্রু-তর্পন তার জন্য ছিল অতি স্বাভাবিক। ইংল্যাণ্ডের লোকদের তাঁর সম্বন্ধে যে ধারণা হয়েছিল- The oriental gentleman, versatile, emotional yet dignified, এটি যথার্থ ধারণা। [(তিনি) একজন প্রাচ্যদেশীয় সপ্ত ব্যক্তি– বহু বিষয়ে অভি, ভাবপ্রণে, কিন্তু ভবন কথাটি মিস্ কলেটের লিখিত জীবনীতে আছে।]

এই মেধাবী বালকের ভবিষ্যৎ যাতে গৌরবোজ্জ্বল হয় পিতা রামকান্তের সে, কামনা ছিল। তকালের শ্রেষ্ঠ শিক্ষালাভের জন্য বাল্যশিক্ষা সমাপনান্তে রামমোহন পাটনায় প্রেরিত হন নয় বৎসর বয়সে।

রামমোহন ও মুসলিম-ধারণা

পাটনায় [‘রামমোহনের বিরুদ্ধ পক্ষের বক্তব্য’ দ্রষ্টব্য] কিশোর-রামমোহনের অস্থিতিকাল সুদীর্ঘ নয়। কিন্তু তাঁর জীবনের উপরে এর প্রভাব গভীর। এই প্রভাবের স্বরূপ একটু বুঝতে চেষ্টা করা যাক।

হিন্দু ও খ্রিস্টান শাস্ত্রের যে-সব আলোচনা রামমোহন করেছিলেন সৌভাগ্যক্রমে সে-সবের অধিকাংশই আমাদের জন্য রক্ষিত আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলমান-শাস্ত্র সম্বন্ধে যে-সব সুসম্বন্ধ ও বিস্তৃত আলোচনা তিনি করেছিলেন, অথবা করবেন আশা করেছিলেন, তার কিছুই আমাদের হাতে এসে পৌঁছোয় নি। তুহফাতুল-মুওহিদীন গ্রন্থে অবশ্য কোরআনের কয়েকটি বচন ও হাদিস সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য আছে; কিন্তু সে আলোচনা তিনি করেছেন শাস্ত্র বিসর্জন দিয়ে, শাস্ত্র স্বীকার করে নয়। তবু এই তুহফাতুল-মুওহহিদীন গ্রন্থ ও তাঁর রচনার নানাস্থানে ইসলাম ও মুসলমান সম্বন্ধে বিক্ষিপ্ত উক্তি-আভাস-ইঙ্গিত ইত্যাদি থেকে মুসলিম সাধনা সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব, অথবা তাঁর চিত্তের উপরে মুসলিম সাধনার প্রভাবের স্বরূপ, অনেকখানি বুঝতে পারা যায়।

অনেকেই বলেছেন, তার স্বসম্প্রদায়ের প্রতীক-উপাসনার প্রতি তাঁর যে বিতৃষ্ণা, তার মূলে রয়েছে কোরআনের শিক্ষা।–শুধু এইই নয়। খ্রিস্টান সমাজের ত্রি-বাদ, যিশুর রক্তে পাপীর পরিত্রাণ, এ সমন্তের প্রতি তার যে বিরূপতা, অথচ

যিশু খ্রিস্টের প্রতি তার যে গভীর শ্রদ্ধা, এ-সমস্তেরও মূলে রয়েছে কোরআনের শিক্ষা। যথা:

তারা বলে, আল্লাহ পুত্র গ্রহণ করেছেন। তারই প্রশংসা। তিনি পরম সমৃদ্ধ। আকাশে ও মাটিতে যা কিছু আছে সব তার। এর সমর্থক কিছু তোমাদের নেই। এমন কথা কি বলছ তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে যা তোমরা জান না? (১০:৬৮)

আর আমরা মেরী-তনয় যীশুকে পরিচ্ছন্ন নির্দেশ দান করেছিলাম ও তাকে “রুহুল কুদুস” (Holy Sprit) দ্বারা বলীয়ান করেছিলাম (২:৬৭)। যিশুর প্রার্থনা নামে কোরআনে একটি আয়াত আছে, তার অর্থ এই :

“তুমি যদি তাদের শাস্তি বিধান কর (তবে) –তারা তোমারই দাসানুদাস; আর যদি তুমি তাদের ক্ষমা কর (তবে) –তুমি মহান ও জ্ঞানময় (৫:১১৮)।”

প্রসিদ্ধি আছে যিশু খ্রিস্টের এই কোরআনোক্ত পরম নির্ভরতার প্রার্থনাটি একদা হজরত মোহাম্মদ সমস্ত রাত্রি আবৃত্তি করেছিলেন।

শুধু এই-ই নয়। কোরআনের বহু বাণী রামমোহনের মর্ম স্পর্শ করেছিলো। কোরআনের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তারা জানেন, প্রকৃতির দিকে, মানুষের ইতিহাসের দিকে, কোরআন বারবার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পরমকবিত্বপূর্ণ ভাষায় বলা হয়েছে– সূর্য চন্দ্ৰ মেঘ বৃষ্টি বসন্ত-বায়ু কেমন করে’ আল্লাহর মহিমাকীর্তন করছে, মানুষের সেবায় এ সবের নিয়োগ হয়েছে, ফলে জলে শস্যে মানুষের কেমন পরিতোষ-সাধন হচ্ছে, এবং এই সব বিশ্বপাতার অস্তিত্বের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। রামমোহন তাঁর তুহফাতুল-মুওহিদীন গ্রন্থে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে এইসব যুক্তি যথেষ্ট অনুরাগের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন।

বিধর্মীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে সে-সম্বন্ধেও কোরআনে কয়েক জায়গায় সুন্দর উপদেশ আছে, যথা :

আল্লাহ জিন্ন তারা অন্যান্য যাদের উপাসনা করে তাদের গালি দিও না, পাছে তারা অজ্ঞানবশত সীমা অতিক্রম করে আল্লাহকে গালি দেয় ……… (৬:১০৯)।

যারা… ভালোর দ্বারা মন্দ বিদূরিত করে, তারা সুর আশ্রয় লাভ করবে। (১৩:২২)। আমার ভৃত্যদের বল যা উত্তম তাই তারা বলুক (১৭:৫৩)।

তারাই পরমকারুণিকের দাম যার বিন্ত্র হয়ে ধরণীকে বিচরণ করে, আর অজ্ঞরা যখন তাদের সম্বোধন করে তখন তারা বলে, “সালাম” (শান্তি) (২৫:৬৩)।

নারীজাতির পক্ষ রামমোহন আজীবন সমর্থন করেছেন। নারীর প্রতি সুবিচার ও সদয় ব্যবহার করবার উপদেশ কোরআনে বিস্তৃতভাবে আছে। যথা :

হে বিশ্বাসীগণ, এটি তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে, নারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমরা তাদের উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করবে, আর তোমরা তাদের যা দিয়েছ তার কিছু অংশ ফিরে পাবার জন্য তাদের বিপন্ন করো না অবশ্য যদি তারা জ্বলজ্যান্তভাবে অন্যায়াচরণ না করে, আর তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার কর; এরপর যদি তোমরা তাদের ঘৃণা কর তাহলে, হতে পারে, তোমরা এমন একটি জিনিস অবজ্ঞা করলে যার ভিতরে আল্লাহ পর্যাও কল্যাণ নিহিত রেখেছেন (৪:১৯)।

নারীজাতির প্রতি শ্রদ্ধাৰিত ব্যবহার হজরত মোহাম্মদের নিজের চরিত্রেও লক্ষ্যণীয়। যখন তিনি মদীনার রাজা তখন তার ধাত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁকে দেখেই তিনি গাত্রোত্থান করলেন ও নিজের উত্তরীয় বিছিয়ে দিলেন তার বাবার জন্য।

কিন্তু কোরআন থেকে সবচেয়ে বড় জিনিস যেটি রামমোহনের লাভ হয়েছিল সেটি মনে হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বরের মহিমা সম্বন্ধে তার ধারণা। তার ব্রহ্মসঙ্গীতের অল্প কয়েকটিতে ঈশ্বরের মহিমা অতি সুন্দর রূপ লাভ করেছে, সে সবের পাশে পাশে কোরআনের কয়েকটি বচন উদ্ধৃত করা যাচ্ছে :

মন যারে নাহি পায় নয়নে কেমনে পারে।
সে অতীত গুণত্রয়
ইন্দ্রিয় বিষয় নয়,
রূপের প্রসঙ্গ তার কে সম্ভব।
ইচ্ছামাত্র করিল যে বিশ্বের প্রকাশ, ইচ্ছামতে রাখে
ইচ্ছামতে করে না, সেই সত্য এই মাত্র নিতান্ত জানিবে।

কোরআন :

…. তার তুলনা ব্যক্ত করবার মতনও কোনো কিছু নেই (৪২:১১)। আকাশ ও পৃথিবীর অপূর্ব স্রষ্টা, আর যখন তিনি কোনো কিছু সংকল্প করেন তিনি শুধু সেটিকে বলেন, হোক, আর তা প্রকাশ পায় (২:১১৭)। ভাব সেই একে জলে স্থলে শূন্যে যে সমভাবে থাকে।

যে রচিল এ সংসার
আদি অন্ত নাহি যার
যে জানে সকল, কেহ নাহি জানে তাকে।

কোরআন :

তিনি জানেন তাদের অগ্রে কি আছে ও তাদের পশ্চাতে কি আছে, তার যেটুকু অনুগ্রহ সেটুকু ন্নি তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা ধারণা করতে পারে না; তার সিংহাসন আকাশ ও পৃথিবীর উপরে বিস্তৃত, আর এই উভয়ের রক্ষণাবেক্ষণে তিনি ক্লান্ত হন না…. (২:২২৫)।

কে বুঝিবে তার মর্ম
ইন্দ্রিয়ের নহে কর্ম
গুণাতীত পত্র সকল কারণ।

কোরআন :

দৃষ্টি তাকে দর্শন করতে পারে না, কিন্তু তিনি (সব) দৃষ্টি দর্শন করেন। তিনি সৃশ্নের পরিজ্ঞাতা সদাজাগ্রত (৬:১০৪)।

ঈশ্বর, আত্মার বা প্রত্যাদেশ, ইত্যাদির স্বরূপ-চিন্তার মানুষ বিব্রত হবে এ কোরআনের অভিপ্রেত নয়, যথা :

অভিপ্রেত নয়, যথা :

“তারা তোমাকে প্রেরণা (প্রত্যাদেশ, আত্মা) সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছে, বল, আমার প্রভুর হুকুমে প্রেরণা আসে, আর জ্ঞানের অতি অল্প অংশই তোমাদের দান করা হয়েছে” (১৭:৮৫)।

ব্ৰহ্ম স্বরূপত দুয়ে, তটস্থ লক্ষণের দ্বারা তাকে বুঝতে হয়, এ কথা রামমোহন বারবার বলেছেন।

অনেকের ধারণা- কোরআনের আল্লাহ এক দোর্দন্ডপ্রতাপ অধীশ্বর, তার ভয়ে সমস্ত প্রাণী ভীত, দণ্ড বা পুরস্কার যা খুশী তাই তিনি সৃষ্ট জীবকে প্রদান করেন। এ-সব ভাব যে কোরআনে নেই তা বলবো না। কিন্তু কোরআন একটু বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়লে বুঝতে পারা যায়– কোরআনের আল্লাহ অনন্তমহিমানিত সদাজাগ্রত আর প্রেমপ্রবণ। এই আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করবার জন্য কোরআনে বারবার বলা হয়েছে–”আমানু ও আমালুস সালেহাত”–বিশ্বাস কর ও সৎকর্মশীল হও। এই সৎকর্ম বলতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সঙ্কর্মের কথাই ভাবা হয়েছে, যদিও অনেক মুসলমান-ধর্মাচার্য সঙ্কর্মের এই সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাখ্যার উপরে বেশি জোর দেন না। সকর্ম (লোকশ্রেয়ঃ) বলতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সক্কর্মের কথাই যে রামমোহন বুঝতেন সে কথা সর্বদিসম্মত।

মুসলমানের চিন্তায় কোরআনের স্থান সর্বোচ্চে। কিন্তু এই কোরআন কিভাবে বুঝতে হবে সে সম্বন্ধে সব মুসলমান নিশ্চয়ই একমত নন। মানুষের অন্তর্নিহিত বিচারবুদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যে সব মুসলমান কোরআন বুঝতে চেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মোতাজেলা-দল সুবিখ্যাত। মানুষের অন্তরের অনুভূতি বিশেষভাবে তার সত্যোপলব্ধির সহায়ক, এই মত যে-সমস্ত মুসলমান পোষণ করতেন তাদের মধ্যে সুফী সম্প্রদায়ের কোনো কোনো শাখা সুবিখ্যাত। রামমোহনের চোখে যে ইসলাম মহিমা বিস্তার করেছিল সে-ইসলাম সর্বসাধারণ মুসলমানের ইসলাম তেমন নয়। ইসলামের সেই পরিচিত রূপে যে তৃপ্ত হতে পারেন নি, তা বুঝতে পারা যায় তার Second Appeal to the Christian Public–এর এই উক্তি থেকে।

Disgusted with the puerile and unsociable system of Hindoo idolatry, and dissatisfied at the cruelty allowed by Mussalmanism against Non-Mussalmans, 1, on niy searching after the truth of Christianity, felt for a length of lime very much periplexed with the disserence of sentiments found among the followers of Christ (I mean Trinitarians and Unitarians, the grand division of thein) unul I Met with the explanation of the unity given by the divine Teacher himself as a guide to peace and happiness. (Panini Office Edition, 1906. Page-580).” [হিন্দুর অসামাজিক ও বালকেচিত পৌত্তলিকতায় বিরক্ত হয়ে আর অমুসলমানদের প্রতি মুসলমান-ধর্মের নির্মমতায় দুঃখিত হয়ে আমি খ্রিষ্টধর্মের সত্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু হই: কিন্তু খ্রিষ্টঅনুবর্তীদের মধ্যে অর্থাৎ ত্রিত্ববাদী ও একত্ববাদী এই দুই বড় দলের মধ্যে যে-মতভেদ তা দেখে বহুদিন আমার দ্বিধাসন্দেহে কাটে। অবশেষে শান্তি ও আনন্দের নির্দেশ স্বরূপ সেই স্বর্গীয় আচার্যের প্রদত্ত একত্বের ব্যাখ্যার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।]

তিনি যে ইসলাম থেকে প্রেরণা লাভ করেছিলেন সে ইসলাম মোতাজেলাদের ও শ্রেষ্ঠ সুফীদের ইসলাম।

সাদী হাফিজ প্রমুখ সুফী-সাহিত্যিকদের রচনা তাঁর চিত্তের সন্তোষ সাধন করেছিল। তার কয়েকটি অতি প্রিয় বচনের মধ্যে একটি হচ্ছে হাফিজের একটি গজলের এই দুই চরণ :

ইহকাল ও পরকালের আরাম এই এক কথায়–
বন্ধুদের নিয়ে উৎসব কর, শত্রুদের সঙ্গে আপোষ কর।

তাঁর তুহফাতুল মুহহিদীন– এ হাফিজের আরো দুইটি বাণী উদ্ধৃত হয়েছে:

বায়াত্তর দলের ঝগড়া নিরর্থক,
সত্য না বুঝে তারা খেয়াল ও মূঢ়তার পথে চলেছে।
কারো অনিষ্টাচারী হয়ো না, আর যা খুশী কর,
আমাদের পন্থায় এ ভিন্ন আর কোনো পাপ নেই ॥

আর সাদীর এই বাণীটি তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল;

জীবের সেবা ভিন্ন ধর্ম আর কিছু নয়।
তসবিহ জায়নামাজ (আসন) ও আলখাল্লায় ধর্ম পাই।।

তিনি নাকি মাঝে মাঝে ইচ্ছাপ্রকাশ করতেন, এই বচনটি যেন তার সমাধিগাত্রে উত্তীর্ণ হয়। আর ভারতীয় কৃষকদের নিদারুণ দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করে তাদের দুঃখ দূর করবার জন্য East Indian Company-র কর্মকর্তাদের তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন সাদীর এই বাণীটি উপহার দিয়ে–

প্রজাদের সঙ্গে প্রীতিবদ্ধ হও ও (এই ভাবে) তোমার
শত্রুদের যুদ্ধ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হও।
কেননা নয় পরায়ণ নরপতির সৈন্য হচ্ছে তার প্রজা।

সুফীদের যে সব–বাণী তিনি উদ্ধৃত করেছেন, সে সবের ভিতর দিয়ে তাঁর চিত্ত সুস্পষ্টভাবেই আত্মপ্রকাশ করেছে। সবাই জানেন, ঈশ্বরের স্বরূপ নির্দেশ সম্পর্কে সুফী সাহিত্যে অনেক তত্ত্বপূর্ণ কথা আছে। মৌলানা জালালুদ্দিন রুমির কবিতায় অদ্বৈত-তত্ত্ব আশ্চর্য সাহিত্যিক সার্থকতা লাভ করেছে। সে-সবে রামমোহন কতখানি আনন্দিত হতেন তা তেমন জানতে পারা যাচ্ছে না। কিন্তু শ্রেষ্ঠ সুফীদের সুগভীর মানব-প্রেম বা জীব-প্রেম যে তার পরম আনন্দের বিষয় ছিল সেটি অতি সুন্দরভাবে বুঝতে পারা যাচ্ছে।—বিশেষজ্ঞেরা আজ এ বিষয়ে একমত যে বিশ্বমানবের একত্বের ধারণা রামমোহন সুস্পষ্টভাবে করেছিলেন। সেই বিশ্বমানবের একত্ব সম্বন্ধে সাদীর এই বাণীটি সুবিখ্যাত–

আদম-সন্তানরা একে অনোর অঙ্গস্বরূপ
কেননা তাদের উৎপত্তি একই মল থেকে।
যদি এক অঙ্গে বেদনা বাজে
তাহলে অন্য অঙ্গ ও শান্তিতে থাকে না
মানুষের দুঃখ যদি তুমি না বোঝো
তাহলে মানুষ নাম নেওয়া তোমার অন্যায় হয়েছে।

সুফী-সাহিত্য রামমোহনের অন্তরকে আনন্দিত করেছিল, কিন্তু তাঁর অন্তর ও বাহির উভয়কে বীর্যবন্ত করেছিল মোতাজেলা-বাদ। তার যুক্তিবাদের কয়েকটি প্রধান সায়ক গৃহীত হয়েছিল মোতাজেলাতৃণ থেকে, যথাঃ–

১. ঈশ্বর সর্বশক্তিমান কিন্তু তিনি নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন না, তাঁর সমকক্ষ আর একজন ঈশ্বর সৃষ্ঠি করতে পারেন না।

২. ঈশ্বরের গুণ তাঁর সত্তা থেকে পৃথক নয়, গুণের স্বত সত্তা স্বীকার করলে ঈশ্বরের একত্ব নষ্ট হয়। প্রধানত এই যুক্তির দ্বারা রামমোহন বিভিন্ন দেবদেবীর ঈশ্বরত্বের দবি ধন করেছেন।

৩. রামমোহন বলেছেন বেদ নশ্বর। মোতাজেলার বলতেন, কোরআন সৃষ্টবস্তু, স্রষ্টার মতো চিরন্তন নয়। প্রধানত এই মতের জন্য মোতাজেলারা সর্বসাধারণে মুসলমানের বিরাগভাজন হন।

তবে মোতাজেলাদের সঙ্গে রামমোহনের বড় পার্থক্য হয়ত এই–মোতাজেলারা সাধারণত বিচারপন্থী পণ্ডিত, রামমোহনের পাণ্ডিত্য অনন্য সাধারণ, কিন্তু বিচারপন্থী পণ্ডিত তিনি যতখানি তার চাইতে বেশি তিনি বিচারপন্থী কর্মী– স্বদেশ প্রেমিক ও মানব-প্রেমিক।

মুসলমান নৈয়ায়িকদের কাছে রামমোহন যে বিশেষভাবে ঋণী সে কথা সবাই স্বীকার করেছেন। তাঁদের আবিষ্কৃত তর্ক-বিজ্ঞানের যথেষ্ট হেতু বাদ “তরজি বেলা মুরাজ্জেহ” (Principle of sufficient reason) আধুনিক বিজ্ঞানের এক শ্রেষ্ঠ অবলম্বন।

রামমোহন মুসলিম সাধনাকে যে দৃষ্টিতে দেখেছিলেন সেই দৃষ্টি তার সমকালে কোনো মুসলমানের ভিতরে ছিল কি না, তার পরিচয় পাওয়া যায় না। [সিয়ারুল মোতা আখেরীন এর লেখক সৈয়দ গোলাম হোসেন রামমোহনের অব্যবহিত পূর্বের লোক। তাঁর স্বদেশপ্রেম ও কাণ্ডজন প্রশংসার্হ, কিন্তু ধর্মে তিনি রামমোহনের মতো উদারহৃদয় নন।] শুধু তাঁর জীবন-চরিতে পাওয়া যাচ্ছে, মুসলমানরা তার কোনো কোনো মন্তব্যের জন্য এক সময়ে বিরক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তার কলিকাতা-বাসকালে মুসলমানদের সঙ্গে তার যথেষ্ট হৃদ্যতা জন্মেছিল। এমন কি মুসলমানদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব বেশি ছিল বলেই তার স্বসম্প্রদায়ের লোক তার উপর বিশেষভাবে অসন্তুষ্ট ছিলেন, তারা সন্দেহ করতেন, হয়ত মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর পানভোজনও চলে। তৎকালের উচ্চশ্রেণীর মুসলমান রাজকর্মচারীরা যে কৃতবিদ্য ও দক্ষ ছিলেন, বিদ্যায় বুদ্ধিতে চরিত্রবলে শারীরিক বীর্যে পোষাকে-পরিচ্ছদে তৎকালের মুসলমান যে তৎকালে হিন্দুর চাইতে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, বিলাতে সাক্ষ্যদানকালে স্পষ্টভাবেই তিনি সে কথা বলেছিলেন।

কিন্তু তবু মনে হয়, মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর এই যে সম্প্রীতি, সম-মতের সম্প্রীতি এ নয় সম-বৈদগ্ধের এ সম্প্রীতি। মুসলিম সাধনা ও তকালের মুসলিম প্রকর্ষ তাঁর প্রিয় ছিল, কিন্তু এসবের প্রতি তাঁর মোহ ছিল না। তাই পাশীর পরিবর্তে ইংরেজিকে রাজভাষা করবার পরামর্শ তিনি শাসকদের দিয়েছিলেন; উদ্দেশ্য, এর ফলে দেশের জনসাধারণের বিচারালয়ে কিছু সুবিচার পাবে, আর দেশবাসীর পক্ষে ইয়োরোপীয় বিদ্যালাভের পথ সুগম হবে।

রামমোহন ও হিন্দু-সাধনা

পাটনা থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পরে পিতার সঙ্গে রামমোহনের মতান্তর ঘটে। তার ফলে তিনি পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করেন ও তিব্বত গমন করেন। তিব্বত গমনের বাসনা হয়তো পাটনা-বাস-কালেই তার হয়েছিল, তাতে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ের সম্ভাবনা ছিল, পার্বত্য জাতিদের বিচিত্র পূজা-পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয়লাভও তার অবাঞ্ছিত ছিল না। এইভাবে নরপূজা পিশাচ-পূজা ইত্যাদি বিচিত্র অজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হয়েই নিরাকার একেশ্বরবাদের দিকে তাঁর অত প্রবণতা জন্মেছিল মনে হয়।

তিব্বত প্রভৃতি ভ্রমণের পরে তার জীবনের বড় ঘটনা হচ্ছে কিছুকাল কাশীবাস ও হিন্দুশাস্ত্র চর্চা। এই চর্চা তিনি যে গভীরভাবে করেছিলেন পণ্ডিতেরা সে কথা স্বীকার করেন। আর রামমোহন যত শাস্ত্রের চর্চা করেছিলেন তার মধ্যে হিন্দু শাস্ত্রের চর্চাই এ পর্যন্ত বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। হিন্দু-সমাজও তাঁকে আশানুরূপভাবে গ্রহণ করেন নি, তবু তারাই যে তাঁকে বেশি গ্রহণ করেছেন এ সত্য।

নগেন্দ্র-চট্টোপাধ্যায় কত রামমোহনচরিতকথায় তার হিন্দুশাস্ত্রের চর্চা বিশদভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। বেদান্তের শঙ্করভাষ্য অবলম্বন করলেও রামমোহন জোর দিয়েছেন ব্রহ্মনিষ্ঠ গার্হস্থ্যজীবনের উপরে, আর শঙ্করাচার্য জোর দিয়েছেন সন্ন্যাসের উপরে, এসব কথা বলা হয়েছে। আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল রামমোহনের ব্রহ্মজিজ্ঞাসাকে পূর্ণ অদ্বৈতবাদ না বলে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ অথবা দ্বৈতবাদ বলতে চান। কিন্তু পণ্ডিতপ্রবর রাধাকৃষ্ণন শঙ্করদর্শনের যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে মনে হয়, হিন্দু-মনীষার এই শ্রেষ্ঠ উপার্জন অদ্বৈতবাদ রামমোহন যে-ভাবে বুঝেছিলেন সেইভাবেই তা বোঝ হয়ত সঙ্গত। যথা–

Sankara does not assert an identity between God and the world but only denies the independence of the world….. If we raise question as to how the finite rises from out of the bosom of the infinite, Sankara says that it is an incomprehensible mystery, maya. We know there is the absolute reality, we know that there is the einpirical world, we know that the empirical world rests on the absolute; but the how of it is beyond our knowledge….. The greatest thinkers are those who admit the mystery (of the relation of God to the world) and comfort themselves by the idea that the human mind is not oinniscient Sankara in the East and Bradley in the West adopt this wise attitude of agnosticism. (Hindu View of Lise, pp. 66-68). [শঙ্করের মত এ নয় যে ব্রহ্ম ও জগৎ অভেদ, তিনি শুধু জগতের স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার করেন। …….. অসীম থেকে সসীমের উৎপত্তি কেমন করে হয় এ প্রশ্নের উত্তরে শঙ্কর বলেন- এ এক দুয়ে রহস্য, মায়া। আমরা জানি, শুদ্ধ সত্তা আছেন আর ব্যবহারিক জগৎ আছে, আর এই শুদ্ধ সত্তার উপরে ব্যবহারিক জগৎ নির্ভরশীল; কিন্তু কেমন করে সেটি আমাদের জ্ঞানের বাইরে। ……. শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীলেরা ব্ৰহ্ম ও জগতের এই রহস্যময় সম্বন্ধের কথা স্বীকার করেন। তারা জানেন যে মানমন সর্বভ নয়। প্রাচ্যের শঙ্কর ও পশ্চিমের ব্রাডলি জ্ঞানিজনসুলভ এই অজ্ঞেয়তাবাদের সমর্থক।]

অন্যত্র

No theory has ever asserted that life is a dream and all experience events are illusions. One or two late followers of Sankara lend countenance to this hypothesis, but it cannot be regarded as representing the main tendency of Hindu thought (p. 69). [এমন কোনো মত নেই যাতে বলা হয়েছে যে জীবন স্বপ্ন, আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতা অলক শঙ্করের বহুপরের দুই একজন শিষ্যের ভিতরে এই মতের কিছু সমর্থন পাওয়া যায়, কিন্তু সেই দিকেই যে হিন্দু-চিন্তার বিশেষ প্রবণতা তা বলা যায় না।]

রামমোহনের হিন্দু-শাস্ত্রের বিচার তাঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসুদের চির-বিস্ময়ের সামগ্রী। হিন্দুর অতলস্পর্শ অতীতের অন্তহীন শাস্ত্র-সিন্ধু মন্থন করে তিনি যে-ভাবে একমেবাদ্বিতীয় ও লোকশ্রেয়ঃ- তত্ত্ব তাদের উপহার দিয়েছেন, সেটি যে কত বড় দান সে-সম্বন্ধে তাঁর স্বসম্প্রদায়ের সর্বসাধারণ এ পর্যন্ত তেমন অবহিতচিত্ত হন নি এইজন্য যে তার সিদ্ধান্তকে তাঁরা হিন্দু সাধনা সম্বন্ধে বাস্তবিকই একটি শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত বলে ভাবতে পারেন নি। যে কারণেই হোক প্রতীক-উপাসনার সঙ্গে হিন্দু-সাধনা বহুকাল ধরে ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত রয়েছে। এই প্রতীক-উপাসনাকে কোনো কোনো হিন্দু-সাধক অপকৃষ্ট সাধনা জ্ঞান করেছেন; কিন্তু এটি সে আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য (অথবা জীবনের জন্য) হানিকর এমন নির্মম কথা রামমোহনের মতো এতখানি জোর দিয়ে আর কোনো হিন্দু-সাধক বলেছেন মনে হয় না। শ্রীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের “ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা” গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে, রামমোহনের আবির্ভাবের কিছু পূর্বে শিবনারায়ণী সম্প্রদায় বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদী ছিলেন; কিন্তু এ রকম প্রতীক উপাসনার বিরোধী একেশ্বরবাদী-দল হিন্দু-সমাজে এত কম যে এদের গণনার ভিতরে না আনলেও চলে। প্রতীক-উপাসনার প্রতি এরূপ বিরূপতার জন্যই যে রামমোহন তাঁর সমকালে তাঁর স্বসম্প্রদায়ের দ্বারা তিরস্কৃত ও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন ও বর্তমান কালেও অনেকখানি অবহেলিত হচ্ছেন এ সত্য। এর সঙ্গে তাঁর অপ্রিয় হবার আর একটি বড় কারণ হচ্ছে– তাঁর বেশভূষা হিন্দুর চিরপরিচিত চিরশ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসীর বেশভূষা নয়। রামমোহন তাঁর বেশভূষা ও আহারাদি প্রবলভাবেই সমর্থন করেছেন, তিনি তাদের বোঝাতে চেয়েছেন সুরুচিপূর্ণ বেশ মানুষের জন্য বাঞ্ছনীয়, আর মাংস-আহারাদির দ্বারা তাদের নষ্ট বীর্যের পুনরুদ্ধার হতে পারবে।

রামমোহনের হিন্দু-সাধনা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষিতদেরও তেমন শ্রদ্ধার বস্তু হয় নি হিন্দু-সাধনা সম্বন্ধে পরমহংস রামকৃষ্ণের সিদ্ধান্তের ফলে তাঁর সুবিখ্যাত বাণী “যত মত তত পথ” দেশের লোকদের অনেক বেশি স্বস্তি দিয়েছে রামমোহনের “লোকশ্রেয় ও বিচারবুদ্ধির দ্বারা পরিশোধিত শাস্ত্ৰ” এই মন্ত্র থেকে। আর “যত মত তত পথ” বাণীতে দেশের লোক শুধু স্বস্তিলাভই করে নি, একালের কোনো কোনো শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল, যেমন ফরাসী ভাবুক রোমা রোলা ও ভারতের স্বনামধন্য মহাত্মা গান্ধী, এই বাণীকে বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী বলে মত প্রকাশ করেছেন। এ সম্বন্ধে রোমা রোলার যুক্তি এই :

I have never seen anything fresher or more potent in the religious spirit of all ages than this ensolding of all the Gods existing in humanity, of all the laces of truth, of the entire body of human Dreains, in the heart and the brain, in the Paramahangsa’s great love and Vivekananda’s strong arms. ……. But you must not suppose that this immense diversity spells anarchy and confusion……. Each note has its own part…. polyphony reduced to unison with the excuse that your own part is most beautiful! Play your own part perfectly and in time, but follow with your ear the concert of the other instruments united to your own…….. And this teaching condemns all spirit of propaganda, whether clerical or lay, that wishes to mould other brains on its own model (the model of its own God or of its own Non-god who is merely God in disguise). [পরমহংসের মহান প্রেমে ও বিবেকানন্দের বীর্যে যেমন মিলন ঘটেছে বিশ্বমানবের সমস্ত উপাস্য দেবতার, সত্যের সর্ববিধ প্রকাশের মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কের সমস্ত কল্প-রূপের, যুগযুগান্তের ধর্মভাবের ইতিহাসে এর চাইতে সজীবতর ও সতেজতর কোনো কিছু আমার চোখে পড়ে নি।…. কিন্তু একথা মনে করবার হেতু নেই যে এই বিরাট বৈচিত্র্য একটি বিরাট অব্যবস্থা ও বিশ্ববলা মাত্র। …. এই সুর-সামঞ্জস্যের প্রত্যেক সুরেরই বিশিষ্ট স্থান। আছে। কোনো সুর-সমষ্টিকেই এই বলে নীরব করে দেওয়া চলবে না (তাতে বহুসুর পরিণত হবে একসুরে) যে, কোনো একজনের বাজানো সুর সব চাইতে ভাল। যার যা বাজাবার তা চমৎকার করে বাজাক, কিন্তু তার সেই সুরের সঙ্গে অন্যান্য যে-সব সুরের সঙ্গত হচ্ছে তা সে কান পেতে শুনুক। …. এই মতে সর্বপ্রকার প্রচাত–তা ধর্ম, বিষয়ক হোক বা কোনো জাগতিক বিষয়ক হোক–নিন্দনীয়; কেননা এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যের বুদ্ধি-বিচার নিজেদের ভঁচে গড়া। এক্ষেত্রে সেশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদী দুইই তুলামূল্য–নিবীশ্বরবাদ ছদ্মবেশী সেশ্বরবাদ মাত্র।]

এই সঙ্গে তিনি মহাত্মা গান্ধীর অভিমত উদ্ধৃত করেছেন :

“My veneration for other faiths is the same as for my own faith. Consequently the thought of conversion is iinpossible….. Our prayer for others ought never to be: “God, give them the light thou hast given to me!”–but “God, give the all them light and truth they need for their highest development.” [স্ব-ধর্মের প্রতি আমার যে-শ্রদ্ধা পর-ধর্মেরও প্রতি আমার সেই শ্রদ্ধা। সেই জন্য ধন্তরগ্রহণ আমার চিন্তায় অসম্ভব। আমরা যেন অন্যের জন্য এই প্রার্থনা না করি ভগবান আমাকে যে আমোক তুমি দান করেছ সে-আলোক তুমি তাদের দাও; এর পরিবর্তে আমাদের প্রার্থনা যেন এই হয়- ভগবান শ্রষ্ঠ পরিণতির জন্য যার যে-আলোক ও যে-সাত্যের প্রয়োজন তুমি সেই সব তাকে দাও।]

মানুষে মানুষে মৈত্রীকামী রোলা ও গান্ধী যে গভীর বেদনা থেকে এসব কথা বলেছেন তা বুঝতে পারা কষ্টসাধ্য নয়। রোলা স্পষ্টই বলেছেন–

Al this stage of human evolution where in both blind and conscious forces are driving all natures to draw together for “Co-operation or death”, it is absolutely essential that the human consciousness should be impregnated with it until this indispensable principle becomes an axiom: that every saith has an equal right to live, and that there is and equal duty incumbent upon every man to respect that which his neighbour respects. (Life and Gospel of Vivekananda, p. 353°55). [মানব-সমাজে ক্রম-অভিব্যক্তির এই অবস্থায় অন্ধ ও সচেতন শক্তি দুইই সমস্ত প্রকৃতির মানুষকে একত্র করেছে “সহযোগিতার জন্য অথবা ধ্বংসের জন্য” এ সময়ে শ্রেষ্ঠতম প্রয়োজন হচ্ছে মানবের অন্তর্লোকে এই আবির্ভাব ঘটা– প্রত্যেক ধর্মেরই বেচে থাকবার তুল্য অধিকার আছে, আর প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে তার প্রতিবেশীর ধর্ম-বিশ্বাস শ্রদ্ধা করে চলা। এটিকে একটি স্বতঃসিদ্ধান্তরূপে পরিণতি করা চাই।]

কিন্তু উদ্দেশ্য সাধু হলেই সব সময়ে যে কার্যসিদ্ধ হয় তা নয়। মানুষে মানুষে যে-মৈত্রীর কামনা করে এই সব মনীষী এই ব্যবস্থা সমীচীন মনে করেছেন এর প্রবর্তনের ফলে সেই মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে কি না, অথবা মানুষের জন্য এই ব্যবস্থা সত্যতার প্রয়োজন আছে কি না, সে-সবও বিচার্য।

ধর্ম যদি ললিত কলার মতো মুখ্যত মানস ব্যাপার হতো তাহলে জগতের সমস্ত ধর্মকে এমন পরম আদরে সঞ্জীবিত রাখবার চেষ্টা হতো মানুষের সভ্যতার এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন। কিন্তু সাধারণত জীবনে ও ললিতকলায় যে প্রভেদ, ধর্মে ও ললিতকলায়ও সেই প্রভেদ। ধর্ম ও জীবনের অভেদত্বের কারণ, ধর্ম একই সঙ্গে জীবনের নিয়ামক ও জীবনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; কিন্তু ললিতকলাকে তেমনিভাবে জীবনের নিয়ামক বলা যায় না। জীবন অস্থির অপূর্ণাঙ্গ ক্রমাগত পরিবর্তনশীল; ললিতকলা অচঞ্চল, পূর্ণাঙ্গ, সৌন্দর্য-লোকে অবিশ্বর; জীবন সত্য ললিতকলা স্বপ্ন। ধর্ম কখনো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের অথবা ব্যক্তি বিশেষের এমন মানস ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু সেটি স্বাভাবিক বা সাধারণ ব্যাপার নয়। স্বভাবত ধর্ম মানুষের মানস ব্যাপার ও রাজনৈতিক ব্যাপারে যেমন পূর্ণ স্বাতন্ত্র অসম্ভব ও অসত্য, ধর্মের ব্যাপারেও তেমনি নিরঙ্কুশ স্বাতন্ত্র অবাঞ্ছিত, তাতে ধর্মের যে শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য– মানুষের বৃহত্তর সমাজ-জীবনে কল্যাণের আয়োজন–তাইই ব্যাহত হয়। মানুষের বয়স কম হয়নি, অভিজ্ঞতাও কম হয় নি। সেই অভিজ্ঞতার ফলে আজ এ কথা সে বুঝেছে যে জ্ঞান ও সত্যের অভিমানের মতো বিড়ম্বনা আর নেই। কিন্তু এই নূতন জ্ঞান লাভ করে সে যদি ধর্মে ধর্মে Laissez-faire [Laissez-faire (Let alone)-যে যার পথে চলুক। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে ও অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই নীতির প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই নীতির সর্থিত ব্যক্তি বা অচিরেই সমষ্টি-বাদের দ্বারা পরাভূত হয়] নীতি অবলম্বন করে তাহলেও কম ভুল সে করবে না। জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতসারে নানা অনুকূল ও প্রতিকূল ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষের চিত্ত বিকশিত হয়। তার কর্মজীবনও বিকশিত হয়। এই ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়েই বিরাট জগতের সাহচর্য যে তার লাভ হয়, সেটি তার জন্য অমূল্য। রোঁলা ও গান্ধীর এই নূতন ব্যবস্থার যে শান্তি ও স্বস্তি, লোক-সমাজে সতেজ ও সন্ধান-তৎপর মানসিকতা সৃষ্টির সহায়ক হবার সম্ভাবনাই তার বেশি।

হয়ত বলা হবে, অন্তত বিভিন্ন জাতীয় বা সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা তো চাইই, নইলে মানুষ পরস্পরকে চিনবে ও বুঝবে কেমন করে? এই চিন্তা-ধারার মূলেও রয়েছে একটি বড় ভুল– অতীত ও কতকাংশে বর্তমানকে এ ক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে চিরকালের পরিচায়ক বলে’। অতীতে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন দুর্লঙ্ঘ্য ভৌগোলিক ক্ষেত্রে লালিত হয়েছিল। কতকটা সেই ব্যবধানের প্রভাবে তাদের স্বাতন্ত্র্য হতে পেরেছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু আজ সে-ব্যবধান চূর্ণ হবার পথে দাঁড়িয়েছে, মানুষের কৌতূহলও বর্ধিত হয়ে চলেছে, জাতিতে জাতিতে আন্তর ও বাহ্য স্বাতন্ত্র তাই পরস্পরের অজ্ঞাতসারেও নিশ্চিহ্ন হবার পথে চলেছে। মানব সভ্যতার এই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও যদি বিভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ের চিরস্থায়ী বৈশিষ্ট্য বা tope এর কথাই ভাবা হয়, তাহলে ভাবনার পরিচয় যা দেওয়া হয় তার চাইতে বেশি পরিচয় দেওয়া হয় অতীত প্রীতির। কোনো কোনো চিন্তাশীল ভবিষ্যৎ মানবসমাজের একাকারত্বের কথা ভেবে আনন্দ পান না এই ধারণা থেকে যে তেমন একাকারত্বে হবে বর্ণ ও বৈচিত্র্যহীন, সুতরাং অসুন্দর। কিন্তু কত অনাবশ্যক ও অর্থহীন বৈশিষ্ট্যের শৃঙ্খলে এখনো মানুষ বন্দী, এখনো কত অবিকশিত তার সৃষ্টিশক্তি, এ চিন্তা মনে স্থান দিতে পারলে সেই বর্ণ ও বৈচিত্রের প্রাচুর্যের কথা ভেবেই তারা আহ্লাদিত হবেন।

ধর্ম জ্ঞানেরই প্রকারভেদ, এই কথাটি তেমন স্পষ্টভাবে মনে না রাখার ফলেই ধর্ম সমস্যা মানুষের জন্য এমন অশোভন ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যুগ যুগ ভূয়োদর্শন ও অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের, অন্য কথায়, প্রত্যয়ীভূত জ্ঞানেরও, উল্কর্ষ লাভ হয়েছে। একালে ধর্মের উপরে বৈজ্ঞানিক চিন্তাপদ্ধতির প্রভাবও সেই একই সত্যের পানে অঙ্গলি নির্দেশ করছে। জীবনের অন্যান্য ব্যাপারে যেমন অপ্রতিহত সন্ধানপরতা ও কল্যাণের আয়োজন ভিন্ন আর কোনো দিকে লক্ষ্য রাখলে শেষ পর্যন্ত বিড়ম্বিতই হতে হয়, ধর্মের ব্যাপারেও তেমনি সত্য ও কল্যাণ জিজ্ঞাসাকে কিছুমাত্র শিথিল করবার প্রয়োজন আছে তা মনে হয় না। রামকৃষ্ণ ও গান্ধীর কর্মজীবনের দিকে চাইলে দেখা যায় তাঁরাও যথাসম্ভব অভিমান বিবর্জিত হয়ে তাঁদের আবিস্কৃত সত্যপথ অনুসরণ করে চলেছেন, তাতে অন্যের অন্তরে কতখানি বেদনা বাজলো সেটি তাদের চিন্তার মুখ্য বিষয় নয়।

তাই মনে হয় মানব-সভ্যতার নব সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পেরে রামমোহন যে তার দেশবাসীকে অতীত বা বর্তমান-প্রীতির পরিবর্তে লোকশ্রেয়ঃ ও বিচারবুদ্ধির মন্ত্র দান করেছিলেন, সে-মন্ত্রের যথাযোগ্য সমাদার হয় নি সেই মন্ত্রের অন্তর্নিহিত কোনো ত্রুটির জন্য নয়– তাঁর দেশবাসীর সত্যপ্রীতির ও বৃহত্তর দেশের কল্যাণকামনার অভাবের জন্যই।

রামমোহনের হিন্দুশাস্ত্র-বিচারে এত চমৎকারিত্ব রয়েছে, পাণ্ডিত্য ও বিচার বুদ্ধির এমন ফুরণ সেখানে হয়েছে যে সে-সম্বন্ধে আধুনিক শিক্ষিত বাঙালীর তেমন কৌতূহল না থাকা তার মনন-শক্তির উৎকর্ষের পরিচায়ক হয়ত নয়। এই সব বিচারে তাঁর কোনো কোনো শাস্ত্র-ব্যাখ্যা খুবই নূতন, যেমন গীতার এই সুবিখ্যাত শ্লোকের ব্যাখ্যা–

ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম।
যোজয়েৎ কর্মকর্মানি বিদ্বান যুক্তঃ সমাচরন।

গীতার গান্ধীভাষ্যে এর অর্থ লেখা হয়েছে এই : “কর্মে আসক্ত অজ্ঞানী ব্যক্তির বুদ্ধিকে জ্ঞানী যেন ওলট পালট না করে, বরঞ্চ সমত্ব রক্ষাপূর্বক ভাল রকমে কর্ম করিয়া তাহাকে যে সর্ব কর্মে প্রেরণা দেয়”।—এইটি এর প্রচলিত ব্যাখ্যা, আর ব্যাখ্যার দ্বারা প্রচলিত আচারপদ্ধতি (প্রতিমাপূজা ইত্যাদি) মান্য করতে বলা হয়। রামমোহন এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই :

“জ্ঞানবান ব্যক্তি আপনি কর্ম করিয়া অজ্ঞানী কর্মসঙ্গিকে কর্মে প্রবর্তক হইবেন, যেহেতু ওয়ানি নিষ্কাম কর্ম দেখিয়া অজ্ঞানীও সেই প্রকার কর্ম করিবেক। সুতরাং জ্ঞানির কদাপি কাম্য কর্মে অধিকার নাই তার নিষ্কাম কর্ম দেখিয়া অজ্ঞানী ও চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত নিষ্কাম কর্ম করিবেক। কা সঙ্গিদের কি প্রকার কর্ম কর্তব্য তাহা ভুরি স্থানে ঐ গীতাতে লিখিয়াছেন। কর্মণ্যেবাধিকাস্তে মা ফলেঃ কদাচান। …….. যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ পরমেশ্বরের উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে অর্থাৎ ফল কামনা করিয়া কর্ম করিলে সে ক দ্বারা লোক বন্ধন প্রাপ্ত হয়। এবং স্মার্টধত ষ্টক বচন। …. “স্বয়ং নিঃশ্রেয়সং বিদ্বান ন বায় কর্মহি। ন রাতি রোগিতে পথ্যম বাঞ্ছতেপি ভিমকতমঃ। আপনি জ্ঞানবান ব্যক্তি অানকে সকম কর্ম করিতে উপদেশ করেন না, যেন রোগী মনুষ্য কপথ্য প্রার্থনা কৰিলেও উক্ত নৈন; কপথ্য দেন না।” (গ্রন্থাবলী–পৃষ্ঠা ১১৫)

রামমোহন ও খ্রিষ্টধর্ম

রামমোহন তাঁর Precepts of Jesus: a guide to peace and happiness- এর ভূমিকায় বলেছেন, খ্রিস্টের এই যে উপদেশ, অন্যের প্রতি তেমন আচরণ কর যেমন আচরণ তুমি প্রত্যাশা কর, মানুষের নৈতিক জীবন গঠনের সহায়ক এমন পূর্ণাঙ্গ উপদেশ তিনি আর কোনো ধর্মগ্রন্থে পান নি। ধর্মশাস্ত্র হিসাবে বাইবেলের স্থান তাই অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রের চেয়ে উঙ্গে তিনি নির্দেশ করেছেন। কিন্তু তার সেই বাইবেল ত্রিত্ববাদ, খ্রিস্টের রক্তে পাপীর পরিত্রাণ, ইত্যাদি দুয়ে-তত্ত্ব বিবর্জিত বাইবেল। বলা বাহুল্য বাইবেলের এই ধরনের ভক্তের প্রতি বাইবেলের ভক্ত সাধারণের সন্তুষ্ট হওয়া অসম্ভব। খ্রিস্টান সমাজের এই অসন্তোষের ফলেই বাইবেলের প্রকৃত শিক্ষা নির্ণয়ে তিনি দীর্ঘ তিন বৎসর কাল সুকঠোর পরিশ্রম করেন। তিনখানি সুবিস্তৃত গ্রীক ও-হিব্রুবচন কন্টকিত Appeal to Christian Public তাঁর এই কঠোর পরিশ্রমের ফল। তার এই পাণ্ডিত্য দর্শনে তল্কালীন খ্রিস্টান-জগত চমকিত হয়েছিলেন।

আধুনিক খ্রিস্টান-জগত তাঁর এই খ্রিস্টানশাস্ত্র বিচারের কি মূল্য দেন দুর্ভাগ্যক্রমে সে-বিষয়ে কিছু জানি না। কিন্তু তাঁর দেশবাসীর কাছে এর মূল্য কম হওয়া উচিত নয়। তার এই খ্রিস্টানশাস্ত্র-বিচারের ভিতর দিয়ে এই কথাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে পরস্পরের প্রতি প্রেমপূর্ণ জীবনকেই তিনি কাম্যজীবন জ্ঞান করতেন।

রামমোহন সাধনা

রামমোহনের খ্রিস্টান-শাস্ত্রের বিচারে দেখা যায়, তিনি নিজেকে খ্রিস্ট-অনুবর্তী বলে প্রচার করেছেন। তার তুহফাতুল, মুওহহিদীন গ্রন্থে কিন্তু দেখা যায়, তিনি “ঈশ্বর-প্রেরিত পুরুষ” “প্রত্যাদিষ্ট গ্রন্থ” এসবের কিছুই মানেন নি। এজন্য তাঁর সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞেরা প্রায় একমত যে প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একান্ত যুক্তিবাদী, কিন্তু পরে তার সেই শাস্ত্রনিরপেক্ষ স্বাধীন যুক্তিবাদ ধর্মাশ্রিত যুক্তিবাদে পরিণত হয়েছিল; আর মানুষের জন্য এই ধর্মাশ্রিত যুক্তিবাদই তিনি কাম্য জ্ঞান করতেন।

কিন্তু রামমোহন সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত কিনা সে-সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করবার অবসর আছে। তাঁর হিন্দুশাস্ত্রের বিচারেও দেখা যায়, তিনি নিজেকে শাস্ত্রানুগামী হিন্দু বলে প্রচার করেছেন ও সেইভাবে হিন্দুর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বেদান্ত আশ্রয় করে হিন্দুর জন্য প্রকৃত শাস্ত্রজ্ঞান অপহরণের চেষ্টা করেছেন। অথচ তাঁর লর্ড আমহার্স্টকে তিনি যে পত্র লেখেন তাতে সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞানলাভের দুরূহতার কথা বলেছেন, আর বেদান্ত, মীমাংসা, ন্যায় প্রভৃতির শিক্ষাকে বেশ উপহাস করেছেন। বলা যেতে পারে, বেদান্ত মীমাংসা ন্যায় প্রভৃতি প্রচলিত ব্যাখ্যাতে তিনি উপহাস করেছেন, প্রকৃত বেদান্ত মীমাংসা ও ন্যায়কে নয়; তাহলেও একথা স্বীকার করতে হবে যে দেশের প্রাচীন ও প্রচলিত মধ্যযুগীয় জ্ঞানচর্চার চাইতে ইয়োরোপীয় বিজ্ঞান-দর্শন চর্চাকে তিনি বেশি মর্যাদা দিয়েছেন। বাইবেলের প্রতি তার কিছু বেশি শ্রদ্ধা থাকলেও এর আলোচনাকালেও তার যুক্তিবাদ বাস্তবিকই যে শিথিল হয়নি তার প্রমাণস্বরূপ এই কয়েকটি কথার উল্লেখ করা যেতে পারে : প্রথমত Precepts of Jesus- a guide to peace and happiness stana তিনি বাইবেল থেকে সংগ্রহ করেছিলেন এই উদ্দেশ্যে যে এই দুর্ভেয় তত্ত্ব বিবর্জিত সহজ সরল উপদেশ মালায় বিধাতা সম্বন্ধে মানুষের ধারণা উন্নততর হবে ও তাদের একের অন্যের প্রতি ও সমাজের প্রতি ব্যবহার সুনিয়ন্ত্রিত হবে; তার তুহফাতুল মুহহিদীন গ্রন্থে বিচার বুদ্ধির কার্যকারিতা সম্বন্ধেও তিনি এই ধরনের কথা বলেছেন যথা,সব ধর্ম আত্মা ও পরকালের বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত; যদিও এই দুয়ের স্বরূপ দুয়ে তবু এতে বিশ্বাস তেমন দোষাহ নয় কেননা মানুষ দুষ্কর্ম থেকে নিরস্ত থাকে পরলোকের ভয়ে ও রাজভয়ে। কিন্তু এই দুই প্রয়োজনীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে পান আহার পবিত্রতা শুভ অশুভ ইত্যাদি বিষয়ে শত শত অকল্যাণকর ও বুদ্ধিমানকর বিশ্বাস সম্মিলিত হয়েছে, ও তাতে মানুষের দুঃখ বেড়ে গেছে। তবু মানুষের অন্তরে এই শক্তি নিহিত আছে যে এই সব বিশ্বাস সত্ত্বেও সে যদি নিরপেক্ষভাবে বিভিন্ন জাতির ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু হয় তাহলে কি সত্য আর কিইবা অসত্য, তা সে নিরূপণ করতে পারবে আশা করা যায়; ও এইভাবে অর্থহীন ধর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এক অদ্বিতীয় মঙ্গলবিধাতার প্রতি ও সমাজকল্যাণের প্রতি মনোযোগী হতে পারবে। দ্বিতীয়ত- রামমোহনের প্রতিপক্ষ এই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, খ্রিস্টধর্মের দুর্জেয় তত্ত্বসমূহে বিশ্বাসী না হয়ে প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী হওয়া যায় না; রামমোহন দেখিয়েছিলেন, খ্রিস্টের ভিতরে যা কিছু অলৌকিক বা অসাধারণ সব ঈশ্বর প্রসাদে, তার একান্ত নির্ভর ঈশ্বরের উপরে, আর বাইবেল থেকেই প্রমাণ করা যায় যে ঈশ্বরের সমস্ত আদেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের পরস্পরের প্রতি কি কর্তব্য তাই শিক্ষা দেওয়া।

তাই আমাদের বলতে ইচ্ছা হয়, তুহফাতুল মুহহিদীন গ্রন্থে রামমোহন যে অলৌকিকতা নিরপেক্ষ একেশ্বরতত্ত্বে ও লোকশ্রেয়বাদে উপনীত হয়েছিলেন পরে এই মতের কোনো বিশেষ পরিবর্তন তার ভিতরে ঘটে নি। যারা এই পরিবর্তন দেখবার জন্য উৎকণ্ঠিত তারা বোধ হয় এই অদ্ভুত ব্যাপারটি লক্ষ্য করেন নি, তুহফাতুল মুহহিদীন গ্রন্থেও রামমোহন একদিকে যেমন প্রখরযুক্তিবাদী অন্যদিকে তেমনি সহজভাবে ঈশ্বরানুরাগী ও মানব-কল্যাণকামী।

বিলাতগমনের পূর্বে রামমোহন Unitarian (ঈশ্বরের একত্ববাদী) খ্রিস্টানদের বিশেষ বন্ধু ছিলেন ও ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টানদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ড গমনের পরে উভয় শ্রেণীর খ্রিষ্টানদের সঙ্গে তিনি আলাপ আলোচনা করেন ও উভয় দলেই তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু লাভ হয়। তার মৃত্যুর পরে কোনো কোনো ধর্মযাজক মত প্রকাশ করেছিলেন যে, তিনি ত্রিত্ববাদের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হচ্ছিলেন এবং আরো কিছুকাল বেঁচে থাকলে ত্রিত্ববাদ পূর্ণভাবেই গ্রহণ করতেন। মিস্ কলেট লিখিত জীবনীর সম্পাদক এসব কথা গণ্য করেন নি। তবে তিনি এই মত প্রকাশ করেছেন যে রামমোহনের ভিতরে ধর্ম ব্যাকুলতা চিরদিনই অত্যন্ত প্রবল ছিল; সেই ব্যাকুলতার বশে প্রথম জীবনে তিনি স্বাধীন যুক্তিবাদ গ্রহণ করেন ও পরবর্তী জীবনে যুক্তিবাদের অসম্পূর্ণতা উপলব্ধি করে “ধর্মবিশ্বাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এই মতের স্বপক্ষে তিনি এই প্রমাণটি দিয়েছেন: রামমোহন তার সর্বশেষ রচনায় উচ্চশ্রেণীর ইয়োরোপীয়দের ভারতে বসতিস্থাপন সমর্থন করেন। এই বসতি স্থাপনের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বহু তর্ক উত্থাপন করেন, সে-সবের একটি এই উচ্চশ্রেণীর ইয়োরোপীয়দের ভারতে বসতি স্থাপনের ফলে ও তাদের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে ভারতবাসীর যথেষ্ট উন্নতির সম্ভাবনা; এই উন্নত ভারতবাসীরা ও ইয়োরোপীয়েরা সম্মিলিত হয়ে ব্রিটিশের সহিত সম্বন্ধ ছেদন করতেও পারেন; তাহলেও তাদের ভিতরে বাণিজ্য-সম্পর্ক থাকবে ও এই নব-আলোকপ্রাপ্ত ভারতবর্ষ এশিয়ার শিক্ষাগুরু হবে। রামমোহনের মূল বক্তব্য এই :

Americans were driven to rebellion by misgovernment ….. The mixed community of India, so long as they are treated liberally and governed in an enlightened manner, will feel no inclination to cut off its connection with England…..yet if events should occur to effect a separation, still a friendly and highly advantageous commercial connection may be kept up between two free and Christian countries, united as they will be by resemblance of language, religion and manners. [আমেরিকা-বাসীরা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছিল কুশাসনের ফলে। …. ভারতের এই মিশ্রিত জাতি যতদিন সদয় ব্যবহার ও উদার শাসন লাভ করবে ততদিন তারা ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদন করবার কোনো প্রয়োজন অনুভব করবে না। ….. ঘটনাক্রমে সম্পর্ক যদি ছিন্নই হয় তবু এই দুই স্বাধীন ও খ্রিস্টান দেশের মধ্যে বন্ধুভাব ও পরস্পরের কল্যাণ সাপেক্ষ বাণিজ্যসম্পর্ক থাকবে– ভাষা ধর্ম ও আচার-ব্যবহারের সাদৃশ্য তখন এই দুই দেশের ভিতরে যোগ রক্ষা করবে।]

এখানে সম্পাদক মহাশয় এই যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে রামমোহন তাঁর দেশবাসীদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হবার কথা ভেবেছেন, এটি সুসিদ্ধান্ত বলে গ্রহণ করা যায় না কয়েকটি কারণে। প্রথমতঃ যে সমস্ত গণ্যমান্য ইয়োরোপীয় ভারতবর্ষে বসতিস্থাপন করবেন তাঁরা খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ও ভারতের শ্রেষ্ঠ অধিবাসী হবেন, তাঁদের অধ্যুষিত ভারতবর্ষকে রামমোহন খ্রিস্টান ভারতবর্ষ বলতে পারেন। দ্বিতীয়তঃ তাঁর প্রিয় খ্রিস্টান নীতির Do unto others as you like to be done by দ্বারা প্রভান্বিত ভারতবর্ষকে তিনি খ্রিস্টান-ভারত বলতে পারেন। তৃতীয়তঃ তাঁর দেশবাসীরা সোজাসুজি যিশুর উন্নতর ধর্মে দীক্ষিত হবে এ চিন্তা রামমোহনের জন্য একান্ত অপ্রীতিকর হয়ত ছিল না কেননা কোনো রকমে তাঁর দেশবাসীর ভালোর দিকে একটু পরিবর্তন হোক এ কামনা তিনি করতেন, তবু এই চিন্তা যে তার খুব প্রীতিকরও ছিল না তা বুঝতে পারা যায় আমেরিকার Bishop ware কে লিখিত তাঁর এই পত্রাংশ থেকে–

I am led to believe from reason, what is set forth in the scripture, that “in every nation he that feareth God and worketh righteousness is accepted with him,” in whatever form of worship he may have been taught to glorify God. [(খ্রিস্টান) শাস্ত্রে এ-কথা আছে, আর বৃদ্ধির সাহায্যেও আমি এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছি, যে, প্রত্যেক জাতির ভিতরে যারা ঈশ্বরের ভয় রাখে ও ধর্ম আচরণ করে তারা তার (যীশুর) করুণা লাভ করে, তা যে-ভাবেই তারা ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করতে শিখুক।]

Bishop Ware কে লিখিত এই পত্রে আরো একটি লক্ষ্য করবার কথা আছে। রামমোহনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ভারতে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সম্ভাবনা কিরূপ; তাতে তিনি শেষ পর্যন্ত এই উত্তর দেন বিজ্ঞান ইংরেজি সাহিত্য ও ধর্মনিরপেক্ষ সুনীতি শিক্ষার আয়োজন যদি এদেশবাসীর জন্য তারা করতে পারেন তবে সেই ভাবেই তারা এদেশবাসীর মনকে খ্রিস্ট-ধর্ম গ্রহণের উপযুক্ত করতে পারেন।

এই থেকে রামমোহনের সংস্কার চেষ্টার অথবা সমগ্র সাধনার স্বরূপ জিজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হবার প্রয়োজন হয়। এই সম্পর্কে তাঁর সাধনার দুইজন শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী, রবীন্দ্রনাথ ও আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ, যে মত প্রকাশ করেছেন তার মর্যাদা নিরূপণ প্রথমেই কর্তব্য।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিশ্বমানবের একত্ববোধ তাঁর সমকালে জগতে আর কারো ভিতরে এমন পূর্ণভাবে দেখা যায় না। বর্তমান জগৎ সহযোগিতার জগৎ, স্বদেশের প্রাচীন অবিনশ্বর যা-কিছু, তা আয়ত্ত করে অন্যান্য সাধনার দিকে তিনি সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের এই সকল কথার প্রমাণ রামমোহনের বিরাট সাধনার ভিতরে নিশ্চয়ই আছে– যদিও রামমোহনের সমকালে শুধু তাকেই বিশ্বমানবের একত্ববোধের পূর্ণ অধিকারী বলে ভাবতে আমাদের কিছু আপত্তি, কেননা রামমোহনের সমকালে, অথবা কিছু পূর্বে, মহামনীষী গ্যেটের আবির্ভাব; নবযৌবনেই তিনি নিজেকে বলেছিলেন Welt-kind (বিশ্বসন্তান); আর পরিণত বয়সে তার বিশ্বমানবতার পরিপূর্ণ বোধ সুবিদিত। তবু যিনি দূর স্পেনের জনসাধারণের রাজনৈতিক অধিকার লাভে উল্লসিত হয়ে নিজ-ব্যয়ে এক বড় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন, ও Neples-এর পরাধীনতা-দুঃখের অবসান হয়নি জানতে পেরে জগতের অত্যাচারীদের উদ্দেশ্যে এই অভিসম্পাত উচ্চারণ করেছিলেন–

I consider the cause of the Neapolitans as my own and their enemies as ours. Enemies to liberty and friends of despotims have never been, and never will be, ultimately successful. [নেপলন-বাসীদের দুঃখ আমারও দুঃখ বলে আমি জ্ঞান করি তাদের শত্রু আমাদেরও শত্রু। যারা স্বাধীনতার শত্রু ও স্বেচ্ছাতন্ত্রের সমর্থক তারা কখনো সফলকাম হয়নি আর শেষ পর্যন্ত কখনো সফলকাম হবে না।–এইটি একটি পত্রাংশ। পত্রখানি বাকিংহাম সাহেবকে লেখা, তারিখ- ১১ই আগস্ট, ১৮২১।]

মানুষের সঙ্গে তাঁর এই সহজ যোগ জাতিতে জাতিতে সহযোগিতার যোগের চাইতে নিবিড়তর বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

রামমোহনের সাধনার স্বরূপ-নির্দেশ সম্পর্কে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথের মন্তব্য পরম হৃদয়গ্রাহী, কল্পনার সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। তিনি রামমোহনকে দাঁড় করিয়েছেন জগতের বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মর্মোদঘাটক রূপে। তাঁর মতে বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতা হচ্ছে বিশ্বজনীনতার এক একটি রূপ, এর কোনটি মিথ্যা নয়, কিন্তু প্রত্যেকটির লক্ষ্য হওয়া

উচিত তার সর্বোচ্চ পরিণতির দিকে। বিভিন্ন ধর্ম-শাস্ত্রের আলোচনা করে রামমোহন তাদের সেই সর্বোচ্চ পরিণতির পথ সুগম করতে চেষ্টা করেছেন।–কিছু ভিন্ন বেশে এই চিন্তাধারার সঙ্গে আমাদের আগেই পরিচয় হয়েছে। এই চিন্তাধারা দার্শনিকবর রাধাকৃষ্ণনের লেখনীতে রূপ পেয়েছে এইভাবে

…. If we believe that every type means something final, incarnating a unique possibility, to destroy a type will be to create a void in the scheme of the world. (Hindu View of Lief). [যদি আমরা বিশ্বাস করি যে প্রত্যেক সভ্যতা হচ্ছে এক একটি চরম পরিণতি, এক অতুলনীয় সম্ভাবনা রূপ পরিগ্রহ করেছে তার ভিতরে, তবে এর একটি ধ্বংস হলে জগদবিধানে অভাব দেখা দেবে।]

এই চিন্তাধারা সম্পর্কে আমাদের বক্তব্যও নিবেদন করতে চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্মের যে-রূপ সহজভাবে প্রতিদিন আমাদের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে সেই পরিচিত রূপের পানে এঁরা তাকান নি, এঁদের আলোচিত ধর্ম ভাবলোকের ব্যাপার সেখানে কোনো type-কে পূর্ণাঙ্গ ও অবিনশ্বর ভাবলে আপত্তির কারণ তেমন ঘটে না।

এই সম্পর্কে আরো কয়েকটি কথা ভাববার আছে। আচার্য রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ “স্বাতন্ত্র”-বাদী চিন্তাশীলেরা ভারতের জাতিভেদে দেখেছেন প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বা জাতির স্বাতন্ত্র্যরক্ষার একটি প্রয়াস। হয়ত তাঁদের এই অভিমতের মূলে সত্য আছে; কিন্তু এর ফল কি হয়েছে সেটিও বিচার্য। প্রাচীন ভারতীয় সমাজের বিচ্ছিন্নতা ভারতের পতনের এক বড় কারণ অনেক মনীষী এই মত ব্যক্ত করেছেন; তারপর এই বিচ্ছিন্ন বা স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত অংশসমূহ যে কালে অসুন্দর বৈ সুন্দর হয় নি তার পরিচয় পাওয়া যায় রামমোহনের সমসাময়িক ব্রাহ্মণ-সমাজের জীবনে তারা পূর্বপুরুষের সাধনা বিস্মৃত হয়ে রামমোহনের উদ্ধৃত উপনিষৎ-বচনাবলী ভেবেছিলেন রামমোহনের নিজের রচিত শ্লোক বলে। আর হিন্দু সমাজের এই বিচ্ছিন্ন খণ্ডসমূহে শক্তি-তরঙ্গ খেলছে তখন যখন দয়ানন্দ বা বিবেকানন্দের মতো স্বতন্ত্র-ধ্বংসকারীর আবির্ভাব সেখানে ঘটেছে।।

স্বাতন্ত্র-বাদের বড় অপরাধ হয়ত এই যে এর প্রভাবে মানুষে মানুষে অপরিচয়ের, সুতরাং অপ্রেমের, সৃষ্টি হয় সৃষ্টিধর্মী কৌতূহলবৃত্তিরও খর্বতা সাধন হয়। সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্রলোভীর কোনো সার্থকতা হয়ত নেই; পারশ্য সর্বপ্রকারে আরবের বশ্যতা স্বীকার করেছিল কিন্তু জগতে পারশ্যের বিলোপ সাধন হয় নি; ব্যক্তিগত জীবনেও দেখা যায়, আমাদের মধুসূদন সর্বপ্রকারে স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বাঙালীত্ব ও মানবত্ব কিছুই পরিম্লান হয় নি– হয়ত বা উজ্জ্বলতর হয়েছে। রামমোহনকে বলা হয় প্রাচীন সত্যদৃষ্টা ঋষির যোগ্য বংশধর, কিন্তু স্বাতন্ত্র-রক্ষার প্রয়াস তিনি যা করেছেন তার চাইতে অনেক বেশি করেছেন স্বাতন্ত্র ধ্বংসের ও সর্ব অভিমানশূন্য সত্যোপলব্ধির প্রয়াস।

বাস্তবিক, হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ইত্যাদি প্রাচীন নামে রামমোহনকে পরিচিত করতে যাওয়া অসার্থক বলেই মনে হয়। তিনি ছিলেন সহজভাবে সত্যজিজ্ঞাসু আর জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা হয়ত এই সহজ পরিচয়েই পরিচিত। কিন্তু এই সহজ সত্য-জিজ্ঞাসার প্রেরণাও মানুষ ধর্ম-সংস্কারক সমাজ-সংস্কারক দার্শনিক বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি বহুকিছু হতে পারেন, রামমোহন এর কোন শ্রেণীর অর্ন্তগত? বলা বাহুল্য জীবন এক অখণ্ড ব্যাপার, তাই কোনো শক্তিমান একই সঙ্গে ধর্ম সংস্কারক সমাজ-সংস্কারক দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক হতে পারেন। তবু বিশেষ বিশেষ দিকে শক্তিমানদের প্রবণতা দেখা যায় রামমোহনের প্রবণতা কোন দিকে?

ইতিহাসে রামমোহনের পরিচয় এক ধর্ম-সম্প্রদায়ের স্থাপয়িতা রূপে, যদিও তিনি নিজে বার বার বলেছেন কোনো নূতন ধর্মমতের প্রর্বতক তিনি নন। কিন্তু চিন্তাশীল মাত্রেই নূতন কিছুর প্রবর্তক, কেননা জগৎ চিরনূতন, কাজেই তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও তাঁকে এক নূতন মতের প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে। একালের অনেক শিক্ষিত বাঙালীর অভিমত, রামমোহনকে ধার্মিক পুরুষরূপে না দেখে পাণ্ডিত্য ও প্রতিভাশালী সমাজ-সংস্কারক রূপে দেখাই সঙ্গত; কেননা, তাঁদের মতে, ধর্মভাবের যে মূল কথা বিশ্বাতীত কোনো শক্তিতে একান্ত আত্মসমর্পণ, সেই অহমিকাপরিশূন্য আত্মসমর্পণ তার বিচিত্রবাদ-প্রতিবাদের ভিতরে ভিতরে দুর্লভ। কিন্তু এই অভিমত তেমন মূল্যবান নয় বলেই মনে হয় কেননা রামমোহনের সমস্ত বাদ-প্রতিবাদের উৎস-স্বরূপ যে অবিচলিত মানবকল্যাণ-বোধ তার প্রতি এর দৃষ্টি নেই। রামমোহনের নিজের এই মন্তব্যটিও এই সম্পর্কে স্বরণীয়- “ধর্ম যদি ঈশ্বরের’, রাজনীতি তবে কি শয়তানের?”

যে-সম্প্রদায়ের তিনি নেতা তাকে বর্তমানে একটি ভক্ত-সম্প্রদায় বলা চলে; কিন্তু ধর্মজীবন সম্বন্ধে রামমোহনের নিজের ধারণা অনেক ব্যাপক, অভিনবতও তাতে কম নয়। প্রথমতঃ একটি বিশেষ ধর্মতত্ত্ব বা ঈশ্বরতত্ত্ব উদ্ভাবনের দিকে তার দৃষ্টি বেশ কম। সত্য বটে, তিনি এক নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনার কথা বলেছিলেন ও নাস্তিকতার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু এ সব বিষয়ে অনাবশ্যকভাবে ব্যস্ত তিনি ছিলেন না তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই দুইটি ব্যাপার থেকে? হিন্দুসমাজের পৌত্তলিকতার তিনি বিরোধী হয়েছিলেন কেননা তার বিশ্বাস হয়েছিল

Hindu Idolatry, more than any other pagan worship, destroys the texture of Society (Introduction to the Vedanta): [অন্যান্য পদ্ধতির প্রতীক-উপাসনার চাইতে হিন্দু-পৌত্তলিকতা সমাজ-বিধানের সমধিক ক্ষতিকর।]

কিন্তু যখন তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা বলেছিলেন তাঁরা প্রকৃতই মূর্তিপূজা করেন না, মূর্তির ব্যাপদেশে ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণের পূজা করেন, রামমোহন তাঁদের এই উক্তি যথার্থ বলে স্বীকার করেন নি, তবু বলেছিলেন, হিন্দু-সমাজের লোকেরা মূর্তিপূজার যে এমন রূপক ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করেছেন এ শুভ লক্ষণ। আর বিলাতে গমন করে ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টানদের সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গভাবে মিশেছিলেন তার কারণ মনে হয় এরূপ ধর্মবিশ্বাস সত্ত্বেও তাঁদের সমগ্র জীবনের উৎকর্ষ। দ্বিতীয়তঃ সুফীমত, যোগ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মসাধন-প্রণালী তিনি ব্যবহার করেছিলেন দেহ ও মনের উৎকর্ষ বিধানের উপাদান রূপে। কিন্তু সেই উৎকর্ষ-সমৰিত দেহমনের ব্যবহার করেছিলেন জ্ঞানান্বেষণে ও মানব সেবায়, অর্থাৎ তার চারপাশের লোকদের দৈনন্দিন জীবনের উন্নতি বিধানে। এদেশের প্রাচীন অকল্যাণকর প্রথা সমূহের বিলোপ সাধন উন্নতর শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন, মুদ্রান্ত্রের স্বাধীনতা, অত্যাচারিত কৃষকদের আর্থিক স্বাচ্ছল্যবিধান, দেশের সর্বসাধারণের জন্য উন্নততর বিচার ব্যবস্থার প্রচলন, ইত্যাদি বিষয়ে রামমোহনের অশেষ প্রয়াসের কথা সুবিদিত। শুধু দুঃখ এই, এই প্রাণপ্রদ চিরন্তন ধর্ম-ভাগ্যবান জাতির লোকেরা যার মর্যাদা উপলব্ধি করতে প্রায়ই ভুল করেন না– আমাদের দেশের ভাবুক ও কর্মীদের যথাযযাগ্য অনুধাবনের বিষয় হয়েছে এ কদাচিৎ।

গ্যেটে সম্বন্ধে ক্রোচে বলেছেন, অল্প বয়সেই তাঁর চিত্তের আশ্চর্য বিকাশ সাধন হয়েছিল, আর আমৃত্যু তা অক্ষুণ্ণ ছিল। রামমোহন সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। তার যৌবনের তুহফাতুল মুওহিদীন গ্রন্থেই তার মস্তিষ্কের পূর্ণ বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তার বিভিন্ন ধর্মের আলোচনাকে গণ্য করা যেতে পারে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে সমস্ত বক্রতা থেকে উদ্ধার করে ঋজু করাবার প্রয়াস রূপে। “তুহফাতুল মুওহিদীন” এর মস্তিষ্ক ও বিভিন্ন জনহিত-প্রচেষ্টার মানব-প্রেম ও কর্মশক্তি-রামমোহনের প্রতিভার মর্যাদা এ-সব ক্ষেত্রে অন্বেষণ না করলে তার প্রতি অবিচার করার সম্ভাবনাই বেশি।

রামমোহন শতবার্ষিকী–ঢাকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *