বিষাদ-সিন্ধু

বিষাদ-সিন্ধু

[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]

অনেকের ধারণা, মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ জঙ্গনামা ও এই জাতীয় অন্যান্য পুঁথির সাধুভাষায় রূপান্তর মাত্র। লেখক নিজে বলেছেন: “পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া ‘বিষাদ সিন্ধু’ বিরচিত হইল।” তা উপকরণ যেখান থেকেই তিনি সংগ্রহ করুন, এই বইখানিতে তাঁর যে-কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে তা অনন্য সাধারণ।

পুঁথি-সাহিত্যের লেখকদের সঙ্গে ‘বিষাদ সিন্ধু’-লেখকের বড় মিল হয়ত এইখানে যে দৈব-বলের অদ্ভুতত্বে বিশ্বাস তার ভিতরে প্রবল দেখা যাচ্ছে। দৈববলে বিশ্বাস মাত্রই সাহিত্যে বা জীবনে দোষাই নয়; কিন্তু এই বিশ্বাসের সঙ্গে যখন যোগ ঘটে অজ্ঞানের ও ভয়বিহ্বলতার, তখন তা হয়ে ওঠে জীবনের জন্য। অভিশাপ- সাহিত্যেও একান্ত অবাঞ্ছিত। এই বিশ্বাসের জন্য বিষাদ সিন্ধু’ কাব্যের সাহিত্যিক ক্ষমতা যে অনেক জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে; বিশেষ করে ধর্ম বোধ সম্বন্ধে অতি-অকিঞ্চিতকর ধারণার পরিচয় তিনি যে অনেক জায়গায় দিয়েছেন, সে-সব সবিস্তারে বলবার প্রয়োজন করে না।

অথচ জীবন, ধর্ম ইত্যাদি সম্বন্ধে তার ধারণা যে অগভীর তা নয়। আজকের মুখে তিনি বলেছেন “ধার্মিকের হৃদয় এক, ঈশ্বরভক্তের মন এক, আত্মা এক।” মানবজীবনের জটিলতার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও যথেষ্ট।

তাঁর প্রতিভার স্বাভাবিক প্রবণতা আর ধর্ম পরকাল ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁর ধারণা, এই দুয়ের ভিতরে যে একটি বিরোধ দেখা যাচ্ছে, এটি তাঁর সম্বন্ধে বেশ ভাববার বিষয়। শোনা যায়, বহু সাহিত্য-ব্রতীর মতো তারও যৌবন উচ্ছলতায় কেটেছিল। হতে পারে ‘বিষাদ সিন্ধু’তে তাঁর যে নিয়তি পূজা দেখা যাচ্ছে, তা সেই উচ্ছলতার এক প্রতিক্রিয়া। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ, বিশেষ করে তাঁর গাজী মিয়ার বস্তানি’ খানি পাওয়া গেলে তাঁর চিত্তের পুরোপুরি পরিচয় পাওয়া অনেকটা সহজ হতো। যাই হোক, তার এই অসার্থক নিয়তি পূজার কথা ভুলে তাঁর সাহিত্যিক শক্তির স্বাভাবিক বিকাশ যাতে লাভ হয়েছে তারই অনুসরণ কর্তব্য। কেউ কেউ বলতে পারেন, কারবালার নিদারুণ প্রান্তরে কাসেম ও ইমাম হোসেনের যে বীরমূর্তি তিনি দাঁড় করিয়েছেন, ‘নিয়তি’র নিষ্ঠুর লীলা তাতে প্রকট। কিন্তু এখানে ‘নিয়তি’র লীলা না দেখে এটি মানবজীবনের এক করুণ কিন্তু সাধারণ পরিস্থিতি, একথাও ভাবা যেতে পারে। ইমাম-পরিবার ও তাঁদের সহচর বর্গের যে ভাগ্য-বিড়ম্বনা কারবালায় এসে উপস্থিত হয়েছেন এ তাঁরা জানেন, কিন্তু বাস্তবিকই তেমন গভীর করে জানেন না; কারবালায় তাঁদের অবস্থিতি এক সঙ্কটময় স্থানে অবস্থিতি মাত্র। মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্রের যুগে মীর মোশাররফ হোসেনের জন্ম। তাঁদের সঙ্গে তাঁর যোগ যে কত ঘনিষ্ঠ নানাদিক দিয়ে তা বিচার করে দেখা যেতে পারে। তাঁর বাক্যের গঠন বঙ্কিমচন্দ্রের অনুযায়ী- অবশ্য কিছু বেশি বাক-বাহুল্য তাতে আছে; তার মন্ত্রী ও সেনাপতিদের মন্ত্রণায়, ঘটনার নাটকীয় বিন্যাসে এবং স্বাধীনতার জন্য দরদেও বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব বুঝতে পারা যায়। কিন্তু তাঁর নিবিড়তম যোগ মধুসূদনের সঙ্গেই। বিষাদ-সিন্ধু গদ্যে লিখিত হলেও গদ্য লেখকের পরিচ্ছন্নতা লেখকের দৃষ্টিতে নেই- তাঁর চোখে বরং কবির স্বাপ্নিকতা; আর এর যা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, যেমন এজিদ-চরিত্র, ইমাম হোসেন, কাসেম ও মোহাম্মদ হানিফার বিক্রম, সবই কাব্যসৌন্দর্য-মাখা।

মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধকাব্যে’র বর্ণনার ছায়া যে মাঝে মাঝে ‘বিষাদ সিন্ধু’র উপরে পড়েছে শুধু তাই নয়, ‘মেঘনাদবধের দুইটি চরিত্রের পরিকল্পনার সঙ্গে এর দুইটি চরিত্রের পরিকল্পনার গভীর মিল রয়েছে। ‘মেঘনাদবধে’র শ্রেষ্ঠ চরিত্র রাবণ; তার শক্তি যেমন অপরিসীম, দুঃখও তেননি অফুরন্ত। রাবণের মতনই এজিদ শক্তিমান, কিন্তু তাঁর কামনার ধন জয়নবকে তিনি লাভ করতে পারেন নি এই দুঃখে তাঁর সমস্ত শক্তি বিপর্যস্ত অস্থিরচিত্ততা তাঁর একমাত্র পরিচয়। তেমনিভাবে ‘মেঘনাদবধের সীতা চরিত্রের মাধুর্য ও কোমলতার অনেকখানি সমাবেশ ঘটেছে ‘বিষাদ সিন্ধু’র জয়নব-চরিত্রে। গ্রন্থের শেষের দিকে জয়নবের যে দীর্ঘ আত্মবিলাপ রয়েছে তার সঙ্গে সীতা ও সরমার কথোপকথনের সাদৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে।

রোমান্টিক কবির যে ভাবোস– একই সঙ্গে সেইটি বিষাদ সিন্ধু’ কাব্যের শক্তি ও দুর্বলতার কারণ। ভাবোচ্ছাসের জন্যই তাঁর গ্রন্থ চরিত্রের বৈচিত্র্যের পরিচয় যথেষ্ট থাকলেও পূর্ণাঙ্গ চরিত্র-সৃষ্টি কমই সম্ভবপর হয়েছে। এর মধ্যে যাদের তিনি দোষে-গুণে মানুষ অথবা বিচক্ষণ সাংসারিক মানুষ রূপে আঁকতে চেয়েছেন, যেমন এজিদ, ওৎবেঅলীদ, আবদুল্লাহ-জেয়াদ, মারওয়ান, জাএদা, গাজী রহমান, তাঁরা অনেকাংশে এক একটি মানুষ রূপে আঁকতে চেয়েছেন, যেমন এজিদের পিতা মাবিয়া, ইমাম পরিবারের নরনারী, মদিনাবাসিগণ ও মোহাম্মদ হানিফার যোদ্ধাবৃন্দ, তাঁদের বীরত্বের প্রকাশ মাঝে মাঝে মনোরম হলেও ইমাম হাসান ও জয়নব ব্যতীত তাঁরা প্রায় সবাই মোটের উপর কথা ও ধর্মাচারের সমষ্টিমাত্র হয়ে উঠেছেন। জয়নবের কথা আগেই বলা হয়েছে; ইমাম হাসানের চরিত্র বাস্তবিক বড় মধুর করে ‘বিষাদ-সিন্ধুকার’ এঁকেছেন। যে বৃদ্ধ নিজের মনের বিষে তাঁকে বর্শা ফেলে মেরেছিল তার প্রতি ও তাঁর প্রাণঘাতি স্ত্রী জা-এদার প্রতি তাঁর যে ব্যবহার তা বড় সৌজন্যময়। সেকালের পীরবাদ ও সুফীমতবাদ প্রভাবান্বিত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে লেখকের জন্ম, ইমাম হোসেনের চরিত্রে যে স্নেহ ও সৌজন্য তিনি অঙ্কিত করতে পেরেছেন তা আমাদের একালের ওহাবী প্রভাবান্বিত সমাজে দুর্লভ হলেও সেকালের সমাজে দুর্লভ ছিল না। চরিত্রের পরিকল্পনায় এই লেখকের বিশেষ কৃতিত্বও প্রকাশ পেয়েছে; তাঁর সমস্ত নায়ক নায়িকাই স্বাভাবিক মানুষ, এক সীমার ব্যতীত অমানুষ “শয়তান” কেউই হয়ে ওঠে নি যদিও তিনি শয়তান’ বিশেষণে তিনি বহু নায়ক নায়িকাকে বিশেষিত করেছেন। চরিত্র হিসাবে সীমার অবশ্য কোনো বৈশিষ্ট্য ফোটে নি, সে যেন নিয়তির হাতের যন্ত্র মাত্র।

জনসাধারণের যে সমাদর, এই শক্তিমান সাহিত্যিক নিজের বলেই তা লাভ করেছেন। তার সমস্ত রচনা ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করে তাঁর প্রতিভার প্রতি যোগ্য শ্রদ্ধানিবেদন এখন সাহিত্যরসিকদের কর্তব্য।

১৩৪১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *