৮০. বিজ্ঞাপন জমা

অধ্যায় ৮০

লুইস ক্যামিলকে জানালো যে কব বিজ্ঞাপন জমা দিয়েছে। চলে যাওয়ার সময় লুইসকে থামালো ক্যামিল।

“তোমার আর ম্যালেভালের মাঝে কী চলছে?”

সাথে সাথে লুইসের মুখটা চুপসে গেলো। ক্যামিল বুঝতে পারলো তার কাছ থেকে কিছুই জানতে পারবে না।

“পুরুষদের গোপন কিছু?”

“না, ঠিক তেমন না। কিছু বিষয়ে মতের অমিল হচ্ছে।”

“আমি তোমাকে শেষবারের মত বলছি যাই করো না কেননা তার সাথে যেন কাজের কোন সম্পর্ক না থাকে।”

“অবশ্যই না।”

“সন্তুষ্ট হতে পারলাম না।”

“বিষয়টা গোপনীয়।”

“ব্যক্তিগত?”

“না, গোপনীয়।”

“আমি বরং যাই, লা গুয়েন অপেক্ষা করছে।”

অধ্যায় ৮১

ক্যামিলের আনা ফাইলগুলো পড়তে শুরু করলো লা গুয়েন।

১৯৯৬ সালের ১৬ই মে ফন্টেইন বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দুজন লোক একটা লাশ পড়ে থাকতে দেখে। কপালে গুলির চিহ্ন। পরবর্তিতে লোকজন তাকে রোল্যান্ড সোচিয়ের হিসেবে শনাক্ত করে যে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতো। ব্যালাস্টিক রিপোর্ট হতে জানা যায় গুলিটা করা হয়েছিলো .২২ ক্যালিবারের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হতে যা ফ্রান্সে খুব কম পাওয়া যায়। পুলিশের ডাটাবেজেও এব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। ভিক্টিমের মানিব্যাগও পাওয়া যাচ্ছিলো না। শুরুর দিকে অনেকে ডাকাতির ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। এই পালে আরো হাওয়া লাগে যখন পেট্রোল পাম্পের সি.সি.টি.ভি ক্যামেরায় তার গাড়িতে অন্য আরেকজনকে দেখা যায়।

এই কেসে নিয়োজিত গোয়েন্দারা দুটো জিনিস কিছুতেই মেলাতে পারছিলো না–প্রথমত, কোল্ট উডসম্যানের ব্যবহার যার উৎপাদন ১৯৭০ সালের পরেই বন্ধ হয়ে যায়।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে ভিক্টিমের গায়ে থাকা কাপড়। পরনে ছিলো নীল পোলো শার্ট আর সাদা মোকাসিনো। তার স্ত্রী লাশ শনাক্ত করার সময় এসে জানায় ওগুলো কখনোই তার স্বামীর জামাকাপড় হতে পারে না।

জন ডি, ম্যাকডোনাল্ডের বইয়ের কিছু অংশ ক্যামিলকে ফ্যাক্স করে পাঠিয়েছে ব্যালাঞ্জার।

*

পৃষ্ঠা ১২৮:

গাড়ি থেকে বিশ ফিট দূরে অনেকগুলো পাথর স্তূপাকারে পড়ে আছে। […] গাড়ি থেকে বের হয়ে হাত পা নাড়া দিলো সে। বয়স পয়ত্রিশের কাছাকাছি। […] পরনে নীল শার্ট, বগলের দিকটা ঘেমে ভিজে আছে, পায়ে সাদা কালো জুতা।

“আরেকটু সামনে খুনির বর্ণনা দেয়া আছে,” এই বলে বাকি অংশ পড়া শুরু করলো ক্যামিল।

আরেকবার লক্ষ্য স্থির করে নিলো সে। পিস্তলের মৃদু শব্দ হলো। সাথে সাথে সামনে থাকা মানুষটার কপালে গোল ছিদ্র তৈরি হলো।

*

“ঠিক আছে, বুঝলাম, একটু নালিশি ভঙ্গিতে বলল লা গুয়েন।

দুজনেই গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো।

“আপনি ঠিকই ধরেছেন, সবকিছু মিলছে না। বইয়ে ভিক্টিমকে ছোট ছুরি দিয়েও আঘাতের বর্ণনা দেয়া আছে। এছাড়াও সিগারেটের পোড়া অংশ আর হুইস্কির কথা বলা আছে যার কিছুই ফন্টেইনরুতে পাওয়া যায়নি।”

কিছু না বলে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো লা গুয়েন।

“করবেল কেসের ব্যাপারে দেশমের সাথে কথা বলতে হবে,” বলল সে।

*

পেশায় বিক্রয়কর্মী হওয়ার সুবাদে বিচেটের আলাদা করে ছুটির প্রয়োজন হতো না। জুলাই মাসে তার হাতে অফুরন্ত সময় থাকতো। ২০০০ সালের ১১ই জুলাই ছেলে লরেন্টকে নিয়ে মাছ ধরতে বের হয়। বেশিরভাগ সময় উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করে লরেন্ট। কিন্তু এবার আর তা হলো না। কিছুদূর যাওয়ার পর ছেলের আর্তচিৎকারে ঘুরে দাঁড়ায় সে। নদীর তীরে এক নারীর লাশ দেখে ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যায় দুজনের। লাশের অর্ধেকাংশ মাটিতে ঢাকা, গায়ে ধূসর রঙের জামা রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে।

সাতাশ মিনিট পর পুলিশের লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে।

ভিক্টিম, পঁচিশ বছর বয়সি ককেশিয়ান নারী, শরীরে প্রচণ্ড মারধোরের চিহ্ন স্পষ্ট। চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে আনার ফলে খুলির কিছু অংশ খালি হয়ে গেছে। ফরেনসিক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো। এছাড়াও তার শরীরে একুশটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিলো। এর ফলেই তার মৃত্যু হয়। যৌন অত্যাচারের কোন প্রমাণ মেলেনি। লাশ খুঁজে পাওয়ার আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে তাকে খুন করা

হয়েছিলো। বাম হাতের মুঠিতে ধূসর রঙের কাপড়ের ছেঁড়া টুকরো ছিলো।

ভিক্টিমের নাম ম্যারিসে পেরিন, করবেলের বাসিন্দা। লাশ খুঁজে পাওয়ার চারদিন আগে তার পিতামাতা সন্তানকে নিখোঁজ দেখিয়ে থানায় সাধারন ডায়েরি করেন। কাজিন সোফি পেরিনের সাথে আলাদা বাসায় থাকতো সে। কাজ করতো হেয়ারড্রেসার হিসেবে। তার প্রাত্যহিক রুটিন ছিলো বাঁধাধরা। প্রতিদিন সকালে বাসে করে কাজে চলে যেতো, ছুটির দিনে কাজিনের সাথে কোনো নাইট ক্লাবে সময় পার করতো। শুধু একবারই এর ব্যতিক্রম ঘটে। ৭ই জুলাই রোববার সকালে সাড়ে সাতটায় সাদা স্কার্ট, গোলাপি জ্যাকেট আর জুতা পড়ে বেরিয়ে পড়ে সে। চারদিন পর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নদীর তীরে। পরণে ছিল ধূসর জামা। এই কেস এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

এবার এমিল গ্যাবারির ‘লা ক্রাইম ডি’অরকিাভাল’র দিকে লক্ষ্য করুন। বইটা প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে। এততক্ষণ অবধি যা যা বললাম তা হুবহু মিলে যায় এই কেসের সাথে। ব্যালাঞ্জার ঠিক একই কথা বলেছে।

“এখানে তো নকল আঙুলের ছাপ নেই। অন্য ভিক্টিমের মাঝে রেখে গেছে কিন্তু এখানে কেন নেই?” জিজ্ঞেস করলো লা গুয়েন।

“গ্লাসগো হত্যাকাণ্ডের আগে খুনি নিজের স্বাক্ষর রেখে যাওয়া শুরু করেনি।”

“তাহলে সামনে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে ভাবতে হবে,” মনে মনে বলল লা গুয়েন।

অধ্যায় ৮২

নিজের জন্য ভেষজ চা তৈরি করলো আইরিন।

সন্ধ্যা থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দায় বসে এই দৃশ্য উপভোগ করছে।

“খুন করার জন্য একদম উপযুক্ত আবহাওয়া,” হেসে হেসে বলল আইরিন।

“হুট করে এই কথা বলার কারণ জানতে পারি?”

“না, এমনি বললাম।”

স্ত্রীর পাশে এসে বসলো ক্যামিল।

“ক্লান্ত…”-”ক্লান্ত?”

দুজনে একই সাথে বলে উঠলো।

“এমনটা হলে যেন তাকে কী বলে?”

“আমি ঠিক জানি না। সম্ভবত, অবচেতন মনের যোগাযোগ।”

“তুমি বিরক্ত, তাই না?”

“সময় কাটতে চায় না।”

“আগামীকাল রাতে কোথাও ঘুরতে যাবে?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

“দেখা যাক।”

অধ্যায় ৮৩

বুধবার, ২৩শে এপ্রিল

ক্যামিলের সামনে বসে আছে ক্রিস্টিন লেসাজ। দেখতে খুব একটা সুন্দর না, কিন্তু অসুন্দরও বলা যাবে না। একবার দেখেই মনে রাখার মত চেহারা। একদম তার ভাইয়ের মতো হাটুর উপর হাত দিয়ে বসে আছে। সে কি ভয় পাচ্ছে? নাকি বিস্মিত? যাই হোক না কেন তাকে যে খুব সহজে হাত করা যাবে না তা শুরুতেই বুঝে গিয়েছে ক্যামিল।

“মিস লেসাজ, আপনি জানেন আপনাকে এখানে কেন আনা হয়েছে।”

“আমি যতদূর জানি আমার ভাইয়ের বিষয়ে কথা বলার জন্যে।”

“ঠিক বলেছেন। উনার সম্পর্কে কিছু জিনিস জানার ছিলো।”

“ও তো এমন কিছু করেনি যা আপনাদেরকে কৌতূহলী করে তুলবে।”

“সব বিষয়ে আমরা খোলামেলা আলোচনা করবো। আশা করি আপনার পূর্ণ সহযোগিতা পাবো।”

“যা বলার তা অন্যান্য অফিসারকে আমি আগেই বলে দিয়েছি।”

“হ্যাঁ, আমি জানি। ওসব নিয়েই টুকটাক আলোচনা করবো।” ক্রিস্টিন বেশ বিরক্তবোধ করলো।

“২০০১ সালের জুলাই মাসে আপনারা দুজন যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন। এব্যাপারে আপনার কী বলার আছে?”

“আমরা যুক্তরাজ্যে ছিলাম না, কম্যান্ড্যান্ট, ইংল্যান্ডে ছিলাম।”

“আপনি নিশ্চিত?”

“কেন? কোন সন্দেহ আছে?”

“না, ঠিক তা নয়। সবসময় তো আর ওখানে ছিলেন না। জুলাই মাসের দুই তারিখ আপনারা লন্ডনে পৌঁছান।

“সম্ভবত।”

“এমনটাই হয়েছিলো। আট তারিখে এডিনবার্গের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সে। আবার বারো তারিখে ফিরে আসে।”

“তাই নাকি?”

“আপনার ভাই পাঁচদিন ধরে অনুপস্থিত ছিলো অথচ আপনি জানতেন না?”

“আট থেকে বারো তারিখ অবধি চারদিন হয়, পাঁচদিন না।”

“কোথায় ছিলো সে?”

“আপনিই তো বলে দিলেন এডিনবার্গে ছিলো।”

“ওখানে কী করতে গিয়েছিলো?”

“আমাদের এক পরিচিত লোক ছিলো। আমার ভাই সুযোগ পেলেই ব্যবসায়িক সহকারীদের সাথে দেখা করতেন।”

“নামটা সম্ভবত মি. সোমারভিল,” বলল ক্যামিল।

“ঠিক বলেছেন।”

 “ছোট একটা সমস্যা হয়ে গেছে, মিস, লেসাজ। আজ সকালেই এডিনবার্গের পুলিশ তাকে জেরা করেছে। তার ভাষ্যমতে আপনার ভাইয়ের সাথে শুধু আট তারিখে দেখা হয়েছিলো। নয় তারিখে সে চলে আসে। তাহলে নয় থেকে বারো তারিখের মাঝে আপনার ভাই কোথায় ছিলো?”

“হয়তো আশেপাশে কোথায় গিয়েছিলো।”

“ওহ, আচ্ছা। তাই হবে, আপনার ভাই স্কটল্যান্ডে হ্রদ, পাহাড়-পর্বত এসব দেখতে গিয়েছিলো।”

“এসব ফালতু কথাবার্তা কেন বলছেন, ইন্সপেক্টর।”

“আপনি একটু ভুল করছেন, কম্যান্ড্যান্ট হবে। আপনার কী মনে হয় না কৌতূহল আপনার ভাইকে গ্লাসগো অবধি নিয়ে যেতে পারে?”

“এব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। আর ওখানে কেনই বা যাবে?”

“সম্ভবত গ্রেস হবসনকে খুন করতে।”

খুব চিন্তা ভাবনা করে জুয়াটা খেললো ক্যামিল। এই পন্থা আগেও কাজে দিয়েছে। লেসাজকে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হচ্ছে না।

“আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”

“নামটা কি পরিচিত লাগছে আপনার কাছে?”

“পত্রিকায় পড়েছিলাম।”

“আমি আবারো বলছি, আপনার ভাই এডিনবার্গের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করে সেখানে চারদিন কাটানোর জন্য। কিন্তু সেখানে শুধুমাত্র একদিন অবস্থান করে, বাকি তিনদিন কোথায় ছিলো তা আপনি জানেন না, তাই তো?”

“হ্যাঁ, তাই।”

“তাই?”

“ঠিকই শুনেছেন। আশা করি…”

“সময় হলেই দেখা যাবে। চলুন ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে ঘুরে আসি।”

“আপনার সহকর্মী এই ব্যাপারে কথা…”

“আমি জানি, মিস, লেসাজ। শুধু মিলিয়ে দেখতে চাচ্ছি কথাগুলো। ২১শে নভেম্বর সম্পর্কে যা মনে আছে বলুন।”

“দুই বছর আগের ২১শে নভেম্বর আপনি কি করেছিলেন তা মনে আছে?”

“এখানে আমি উত্তর দেয়ার জন্য বসিনি, আপনি বসেছেন। আপনার ভাই সম্পর্কে বলুন। সে কি বেশি ঘোরাঘুরি করে?”

“কম্যান্ড্যান্ট, আমার ভাই পুরনো জিনিসপত্র আর বইয়ের ব্যবসা করে। এগুলো কিনতে সে ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে যায়, নিলামে অংশগ্রহণ করে, নানান জায়গায় যেতে হয় তার। এসব কাজ তো আর বইয়ের দোকানের এক কোণায় বসে করা সম্ভব না। এজন্যই তাকে প্রচুর ঘোরঘুরি করতে হয়।”

“তার মানে আপনি আসলেই জানতেন না আপনার ভাই কোথায় ছিলো…”

“আপনি আসলে কী জানতে চাইছেন? পরিস্কার করে বলুন, তাহলে দু’জনেরই সময় বাঁচবে।”

“খুবই সোজা প্রশ্ন, মিস, লেসাজ। আপনার ভাই আমাদেরকে ফোন করে একটা অপরাধের ব্যাপারে তথ্য দিয়েছিলো।”

“উপকারের প্রতিদান কি এভাবে দেন আপনারা?”

“আমরা কোনো সাহায্য চাইনি। উনি স্বেচ্ছায় তথ্য দিয়েছেন। ক্যুবেভুয়ার হত্যাকাণ্ড যে ব্রেট এস্টন এলিসের বইয়ের অনুকরণে করা তা আমরা উনার মাধ্যেমেই জানতে পারি। তার দেয়া তথ্য একদম নির্ভুল।”

“এটাই ওর কাজ।”

“বেশ্যাদের হত্যা করা?”

“শুনুন কমান্ড্যান্ট, আপনার কাছে যদি কোনো প্রমাণ থাকতো তাহলে আমি এসব শুনতাম। আমি জানি কোনো প্রমাণ নেই আপনার হাতে, থাকলে আমি এখানে বসে বসে প্রশ্নের উত্তর দিতাম না। এখনি কি আমি যেতে পারি?”

“আপনার ভাইয়ের ডেস্ক দেখার অনুমতি নিয়ে এসেছি আমরা। এমনিতে সে বেশ গোছানো এবং সর্তক থাকে। আমার অফিসাররা গত পাঁচ বছর ধরে তার যাবতীয় মিটিং এবং সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ চেক করেছে। এরমাঝে অনেকগুলো অসংগতি খুঁজে বের করেছে তারা। এমন গোছানো মানুষের কাছ থেকে তো এমনটা আশা করা যায় না।”

“অসংগতি?” মিস, লেসাজকে কিছুটা বিস্মিত মনে হলো।

“হ্যাঁ, ডায়েরিতে লেখা ছিলো একেকদিন একেক জায়গায় ছিলেন উনি। আদতে সেখানে ছিলেনই না। কিছু মিটিঙয়ের কথা লিখেছেন যা কখনো হয়নি। একজনের সাথে থাকার কথা বলেছে কিন্তু তাও ছিলো না।

আমরা বিস্মিত না হয়ে পারছি না।”

“কিসের জন্য বিস্মিত, কম্যান্ড্যান্ট?”

“ওই সময়গুলোতে সে কী করছিলো তাই ভাবি। ২০০১ সালে যখন তেইশ বছর বয়সি এক বেশ্যাকে দ্বিখন্ডিত করা হয় তখন সে কোথায় ছিলো। এর দুইমাস আগে সে কী করছিল যখন কবেভুয়ায় জোড়া খুন হয়। আপনার ভাই কি প্রায়ই পতিতাপল্লিতে যেতেন?”

“আসলেই জঘন্য একটা লোক।”

“আর আপনার ভাই?”

“আমার ভাই সম্পর্কে আর কিছু পাননি আপনারা—”

“না, মিস, লেসাজ। এতো টাকা দিয়ে সে কী করে তা নিয়েও কিছুটা চিন্তিত আমরা।”

ক্রিস্টিন লেসাজ ক্যামিলের দিকে অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকালো।

“ওর টাকা?”

“মানে, আপনার টাকা। আমরা জানি আপনার ভাগ্য উনিই নিয়ন্ত্রণ করেন।”

“আমার কিছুই ও নিয়ন্ত্রন করে না।”

“প্যারিসে আপনার দুইটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে, যা বর্তমানে ভাড়া দেয়া। ইতিমধ্যে আমার টিমের কয়েকজন ওখানে চলেও গিয়েছে।”

“ভিলারিয়ালে? ওখানে কেন পাঠিয়েছেন জানতে পারি?”

“আমরা দুটো লাশ খুঁজছি, মিস, লেসাজ। একটা ছোট, আরেকটা বড়। এব্যাপারে পরে কথা হবে।”

“টাকা পয়সার দিকটা আমি আমার ভাইয়ের কাছে ছেড়ে দিয়েছি কেননা আমি ওকে বিশ্বাস করি।”

“তাহলে তো বলতেই হয় আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।”

“আমার ভাই টাকা দিয়ে যা করেছে অনুমতি সাপেক্ষেই করেছে।”

অধ্যায় ৮৪

“নতুন কী পেলে?”

“সত্যি বলতে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাইবোনের সম্পর্ক বেশ অদ্ভুত।”

*

জেরোমে লেসাজ একদম সোজা হয়ে বসে আছে। দেখে বেশ শান্ত মনে হচ্ছে। খুব সহজে কাবু করা যাবে না এমন ভাব নিয়ে আছে সে।

“কিছুক্ষণ আগেই আপনার বোনের সাথে কথা হলো, সিয়ে লেসাজ।”

“আমার বোনকে এর মাঝে জড়াচ্ছেন কেন?”

“আপনাকে ভালোমতো বোঝার জন্য।”

*

“মিস লেসাজ তো ভাইয়ের ব্যাপারে উলটাপালটা কিছুই বলছে না। দুজনের মাঝে দূরত্ব তৈরি করাটা বেশ কঠিন।”

“অবাক হওয়ার কিছু নেই। দুজনেই বেশ ঘনিষ্ঠ।”

“কিন্তু সম্পর্কটা বেশ বিভ্রান্তিকর।”

“সব সম্পর্কই বিভ্রান্তিমূলক। আমার সবগুলো বৈবাহিক সম্পর্ক এমনই। ছিলো।”

*

“আপনার চালচলন নিয়ে আমরা সন্দিহান। এমনকি আপনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বোনও দেখি পুরোপুরি জানে না।”

“কোন অভিযোগ নেই। আমরা খুনের তদন্ত করছি, মঁসিয়ে লেসাজ।”

“আপনাকে সাহায্য করা উচিত হয়নি আমার।”

“কিন্তু আপনি নিজেকে রুখতে পারেননি।”

“তাও ঠিক।”

নিজের উত্তরে কিছুটা বিস্মিত মনে হলো লেসাজকে।

“পত্রিকায় যখন ক্যুবেভুয়া হত্যাকাণ্ডের খবর পড়লাম সাথে সাথে এলিসের উপন্যাসের কথা মনে পড়লো। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে খুনটা আমি করেছি।”

*

“ভাইবোন একে অপরকে রক্ষা করছে।”

“এদের সাথে কথা বলে কী লাভ হচ্ছে, ক্যামিল? কী কী পেলে তুমি?”

“লেসাজের ডায়েরিতে অনেক গোঁজামিল খুঁজে পেয়েছি আমরা।”

*

“স্কটল্যান্ডে আপনি কী কী করেছেন?”

“আসলে কী জানতে চান আপনি?”

“নয় থেকে বারো জুলাইয়ের মাঝে কী করেছিলেন? আপনার বন্ধুর সাথে আট তারিখে দেখা করে ওখান থেকে পরদিনই চলে যান। বাকি সময়টা কোথায় ছিলেন?”

“ঘুরে বেরিয়েছি।”

*

“গোঁজামিলের ব্যাপারে সে কিছু স্বীকার করেছে?”

“না, সে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে, প্রমাণ নিয়ে আমরা কখন হাজির হবো। কিন্তু সে ভালোমতোই জানে আমাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। দুজনেই সেটা জানে।”

*

“কোথায় গিয়েছিলেন ঘুরতে?”

“আশেপাশেই ঘুরেছি। ছুটির সময়ই তো বেশিরভাগ মানুষ ঘুরতে বের হয়।”

“কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ ঘোরাঘুরির সময় নারীদের খুন করে বেড়ায় না, মঁসিয়ে লেসাজ।”

“আমি কাউকে খুন করিনি!”

“আমি কিন্তু বলিনি আপনি করেছেন।”

“না, আপনি বলেননি। কিন্তু আপনার কথায় তো তাই মনে হচ্ছে।”

“আপনি কি বই লেখেন, মঁসিয়ে লেসাজ? উপন্যাস?”

“না। কখনোই না। আমি আগাগোড়া একজন পাঠক।”

“সর্বভুক পাঠক।”

“এটাই আমার কাজ। সারাদিন খুনখারাবি নিয়ে পড়ে থাকার জন্য তো আপনার সমালোচনা করিনি আমি।”

“শুনে খারাপ লাগলো আপনি লেখেন না, মঁসিয়ে লেসাজ। আপনার কল্পনাশক্তি তো অসাধারণ। যাদের কোন অস্তিত্বই নেই তাদের সাথে অবাস্তব মিটিং ঠিক করেছেন কেন? ওই সময় আপনি কী করেছেন? এতো সময় আপনি কী করেন?”

“মাঝে মাঝে কিছু সময় একা থাকতে ভাল লাগে আমার।”

“তা আপনি অনেক থাকেন বোঝা যাচ্ছে। পতিতাপল্লীতে যান নাকি?”

“মাঝে মাঝে। মনে হয় আপনার চেয়ে বেশি যাই না।”

*

“তার টাকাপয়সার হিসাবে অনেক গড়মিল আছে।”

“টাকার পরিমাণ অনেক বেশি নাকি?”

“সব হিসাব খুঁটিয়ে দেখছে কব। প্রায় দশ হাজার ইউরোর ব্যাপার। সবগুলোই নগদ লেনদেন হয়েছে।”

“কতদিন ধরে এমনটা চলছে?”

“কমপক্ষে পাঁচ বছর। এর আগের হিসাব খতিয়ে দেখার অনুমতি পাইনি আমরা।”

“মিস লেসাজ জানেও না?”

তাই তো মনে হচ্ছে।

“আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের যাবতীয় লেনদেন যাচাই বাছাই চলছে। মনে হচ্ছে আপনার বোনের জন্য বিস্ময়কর কিছু অপেক্ষা করছে।”

“আমার বোনকে এর মাঝে জড়াবেন না!” চিৎকার করে বলল লেসাজ।

লেসাজের এমন উত্তেজিত হওয়ার কারণ আঁচ করতে পারলো ক্যামিল। “ওর মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।”

“আমার কাছে তো তেমন কিছু মনে হলো না।”

“স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে ও কেমন জানি হয়ে গেছে। একারণেই আমার কাছে নিয়ে এসেছি।”

“কোনো স্বার্থ ছাড়া তো আপনি এমন করেননি। ব্যাংকে আপনার টাকার পরিমাণ দেখেই তা বোঝা যায়।”

“এটা আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়, আপনি নাক গলাবেন না।”

“পুলিশ তো সব বিষয়েই নাক গলাতে পারে, মঁসিয়ে লেসাজ।”

*

“তো, আমরা যেন কোথায় ছিলাম?

“জেন, আমরা একটা সমস্যায় পড়ে গিয়েছি…”

*

“এই ব্যাপারে কথা বলার অনেক সময় আছে, মঁসিয়ে লেসাজ।”

“এখানে থাকার কোন ইচ্ছাই নেই আমার।”

“এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আপনার নেই।”

“আমি উকিলের সাথে কথা বলবো।”

“অবশ্যই বলবেন। এখনি লাগবে?”

“আপনার মত লোকের সাথে চলতে গেলে সবারই উকিল লাগবে।”

“আর একটা প্রশ্ন ছিলো। অমীমাংসিত কেসগুলোর একটা লিস্ট আপনার কাছে পাঠানো হয়েছিলো। আপনার প্রতিক্রিয়া আমাকে কৌতূহলী করেছে।”

“কিসের প্রতিক্রিয়া?”

“এটাই তো কথা, আপনি কোন প্রতিক্রিয়াই দেখাননি।”

“আমি আগেই বলেছি আপনাদেরকে আর কোন ধরণের সাহায্য করবো না। তাহলে কিসের প্রতিক্রিয়া আশা করেন?”

“আমি জানি না। ওখানের একটা কেসের সাথে ‘দ্য এন্ড অফ দি নাইট’ বইয়ের মিল আছে। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি।

“আমি খেয়াল করেছি, কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি ওই কেসের সাথে এই বইয়ের কোন সম্পর্ক নেই। এতে অনেক অমিল আছে।” হুট করে মেজাজ হারালো লেসাজ।

“আপনি চেক করেছেন? আচ্ছা, তাই নাকি। কিন্তু আমাকে তো কিছু জানাননি, শুনে কষ্ট পেলাম!”

“ইতিমধ্যে আপনাকে দুইবার সাহায্য করেছি। এর পরিণাম তো দেখতেই পাচ্ছি। তাই ঠিক করেছি।”

“একই সাহায্য আপনি মিডিয়াকেও করেছেন। দুইবার। সম্ভবত ভাল উদ্দেশ্যেই করেছেন!”

“এর ব্যাখ্যা আমি আগেও দিয়েছি। তথ্য পাবার অধিকার সবার আছে। এতে আমি কোন আইন ভঙ্গ করিনি। আমাকে এক্ষুণি যেতে দিন।”

“তবে একটা জিনিস আমাকে খুব অবাক করেছে, গ্যাবোরির ‘লা ক্রাইম ডি’অরকিভাল’ এর মত চিরায়ত একটা বই আপনার মত জ্ঞানী লোকের নজর এড়িয়ে গেলো।”

“আপনি তো আমাকে নির্বোধ বানিয়ে ছাড়লেন, কম্যান্ড্যান্ট।”

“আমার তো উল্টোটা মনে হচ্ছে, মঁসিয়ে লেসাজ।”

“কে বলল আমার নজর এড়িয়ে গেছে?”

“তাই তো মনে হচ্ছে। নইলে আপনি তো এটার কথা আমাদের বলেননি।”

“ওটা আমি সাথে সাথেই চিনতে পেরেছি। আপনি ছাড়া যে কেউ পারবে। আরো অনেক কিছুই বলতে পারতাম আমি।”

*

“সমস্যা? তোমার কি মনে হয় না এমনিতেই আমরা অনেক সমস্যায় জড়িয়ে আছি, ক্যামিল?”

“একই কথা আমিও ভাবছি, জেন, কিন্তু একটার পর একটা সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে।”

“তো, এবার কী সমস্যা হলো?”

*

“আর কী বলতে পারতেন, মঁসিয়ে লেসাজ?”

“না বলাটাই ভাল হবে।”

“তাহলে আপনার উপর সন্দেহ আরো ঘনীভূত হবে। এমনিতেই আপনার পায়ের নিচের মাটি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।”

*

“অমীমাংসিত কেসগুলো সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে মুখ বন্ধ করে ফেলেছে। আর কিছুই বলতে চাইছে না।”

*

“এবার বলুন কী বলতে চেয়েও বলেননি।”

“কিছু বলার নেই।”

“আপনি তো বলার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন,” লেসাজকে তাড়া দিলো ক্যামিল।

“একটা কেসে ড্রেজারের কাছে এক মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো না?”

“হ্যাঁ।”

“খুন হওয়ার আগে তার পরনে সুইমস্যুট ছিলো?”

“গায়ের দাগ দেখে তো তাই মনে হচ্ছিলো। কেন?”

“আমার মনে হয়…এটা রোজেন্না।

অধ্যায় ৮৫

রাস্তাঘাটে প্রতিদিন কত মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এরমাঝে বেশিরভাগেরই কোন সমাধান হয় না। এমনটা চলতে থাকে দিনের পর দিন।

২৫শে আগস্ট, ২০০০ সাল। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে নদীর পলিমাটি আর রাবিশ সরানোর কাজ শুরু হয়।

কিছুক্ষণের মাঝে উৎসাহী লোকজন জড়ো হয়ে গেল।

সকাল সাড়ে দশটার দিকে ইঞ্জিনের গর্জন শুরু হয়। এরইমাঝে ক্রেন এসে হাজির হয়। পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে যায়। হুট করেই ক্রেন অপারেটর লুসিয়েন ব্ল্যানচাৰ্ড লক্ষ্য করে জড়ো হওয়া লোজন কিছু একটা নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ড্রেজারের বাকেট পানি থেকে কেবলি উপরে উঠানো হয়েছে। হুট করে এই উত্তেজনার কারণ বুঝতে সামনে এগিয়ে গেলো সে। নগ্ন এক মেয়ের দেহের অর্ধেকাংশ কালো আবর্জনায় ঢেকে আছে।

মেয়েটার বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশের মাঝেই হবে। ডেস্কের উপর মেয়েটার কয়েকটা ছবি মেলে রাখলো ক্যামিল। ছবি দেখে মেয়েটাকে খুব একটা সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে না। চওড়া নিতম্ব, ছোট স্তন আর তুলতুলে উরু তার। সানবেড ব্যবহার করতো সে; গায়ের কিছু অংশের রঙ এমনভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে যা সাধারণত হয় না। এছাড়াও বিকিনির দাগ ছিলো সুস্পষ্ট। শরীরের অন্য কোথাও অত্যাচারের চিহ্ন না থাকলেও কোমড় থেকে নিতম্ব অবধি সরু লাল দাগ ছিলো। গায়ে সিমেন্টের নমুনা দেখে খুব সহজেই বলা যায় তার শরীর কংক্রিটের কোন তলে রাখা হয়েছিলো। কাদামাটি আর পানিতে থাকার কারণে ত্বক অনেকটা নরম হয়ে গিয়েছিলো।

এই কেসের দায়িত্ব ছিলো লেফটেন্যান্ট ম্যারেটের হাতে। তদন্তে জানা যায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করার আগে তার উপর যৌন নিপীড়ন চলে। খুনি বর্বর হলেও কোন প্রকার অঙ্গচ্ছেদ করেনি। ভিক্টিম ধর্ষণ আর পায়ুকামিতার শিকার হয়েছিলো।

অটোপসি রিপোর্ট থেকে জানা যায় হত্যার ছয় ঘণ্টা আগে ভিক্টিম খাবার খেয়েছিলো। যার মাঝে গরুর মাংস, আলু, স্ট্রবেরী আর প্রচুর পরিমাণ দুধের নমুনা পাওয়া গিয়েছিলো।

ফরেনসিক বিভাগের মতে খুঁজে পাওয়ার বারো ঘণ্টা আগে লাশ ওখানে পোঁতা ছিলো। তবে দুটো জিনিস তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিলো। দুটো প্রশ্নের উত্তর তারা পায়নি।

প্রথমত লাশটা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো কাদা মাখা অবস্থায় যা ড্রেজারের বাকেটে ছিলো। বাকেটে কাদার উপস্থিতি কিছুটা বিস্ময়কর কেননা লাশটা ওখানে রাখা হয়েছিলো ড্রেজিং শুরু হওয়ার আগে। ড্রেজারের বাকেট কেবলি পানিতে নামানো হয়েছিলো, তখনি কাদার স্তর অবধি যায়নি। একমাত্র সন্তোষজনক ব্যাখ্যা হলো লাশ পুঁতে ফেলার পর খুনিই কাদা দিয়েছে তার উপর। কিন্তু এমনটা করার কারণ কী? ম্যারেটের কাছে কোন উত্তর ছিলো না।

ক্যামিলের মেরুদণ্ড বেয়ে উত্তেজনার শীতল সোত নেমে গেলো। বিষয়টা কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে তার কাছে। একাজের পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেলো না সে। একমাত্র কারণ হতে পারে কোন বইয়ের অনুসরণে কাজটা করেছিলো খুনি।

দ্বিতীয় যে বিষয়টা তদন্তকারী অফিসারদের ভাবিয়েছে তা হলো মেয়েটার গায়ে থাকা অস্বাভাবিক একটা দাগ। প্রথম দেখায় জন্মদাগ মনে হয় যা অনেকেরই শরীরে থাকে। কিন্তু অধিকতর তদন্তে জানা যায় ওটা নকল ছিলো। প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাস আর বাদামি কালারের ওই নকল জন্মদাগ তুলি আর অ্যাক্রোলিক পেইন্ট দিয়ে করা হয়েছিলো। আকৃতি স্পষ্ট ছিলো না তবে দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো প্রাণীরই হবে। তবে ক্যামিলই ঠিকই বুঝতে পেরেছে খুনি কেন অ্যাক্রেলিক পেইন্ট ব্যবহার করেছে। কেননা খুনি জানতে পানিতে ভিজলেও এই রঙ উঠবে না।

ওই সময়ে হারানো লোকজনের তালিকা খুঁজেও এই মেয়ের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। এমন কোন সূত্রও পাওয়া যায়নি যা তদন্তকে সামনে এগিয়ে নেবে। একসময় সবাই হাল ছেড়ে দেয়। তথ্যপ্রমাণের অভাব থাকায় কেসটাই বন্ধ হয়ে যায়।

অধ্যায় ৮৬

“এই নাম উচ্চারণ করবো কীভাবে?” জোয়েল আর ওয়ালো নাম দুটির দিকে তাকিয়ে বলল লা গুয়েন।

কোন উত্তর না দিয়ে রোজেন্নার একটা কপি খুলে পড়া শুরু করলো ক্যামিল।

পৃষ্ঠা ১৪:

* ‘শাসরোধ করে হত্যা মনে মনে ভাবলো মার্টিন বেক। আলবার্গের রেখে যাওয়া ছবিগুলো দেখতে শুরু করলো সে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ড্রেজার, বাকেট, নদীর তীরে পড়ে থাকা মৃতদেহ, আর মর্গে…মেয়েটার নগ্ন দেহ। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাড়ে হয় ইঞ্চি হবে, নীল রঙা চোখ আর বাদামি চুল। বাম উরুতে একটা জন্মদাগ ছাড়া আর কোন দাগ নেই শরীরে। বাদামি জন্মদাগ অনেকটা শূকরের আকৃতির…”

“ওকে…” তোতলাতে শুর করলো লা গুয়েন।

পড়া চালিয়ে গেলো ক্যামিল;

“মৃত্যুর পাঁচ ঘন্টা আগে খেয়েছিলো মেয়েটা।…মাংস, স্ট্রবেরি আর দুধ…। তার শরীরে কোন গয়না ছিলো না। গায়ে বিকিনির দাগ দেখে বোঝা যায় সানবাথের অভ্যাস ছিলো তার। চওড়া নিতম্ব আর তুলতুলে উরুর অধিকারিণী ছিলো সে।”

অধ্যায় ৮৭

মেয়েটার ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য জড়ো করলো লুইস আর ম্যালেভাল। কিন্তু মেয়েটার পরিচয় এখনো জানা যায়নি। খুঁজে বের করার জন্য যত ধরণের চেষ্টা করা সম্ভব তার সবই করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পঁচিশ বছর বয়সি একটা মেয়ে গায়েব হয়ে যায় আর কেউ খোঁজ নেয় না, ব্যাপারটা কিছুটা অস্বাভাবিক। তবে এর একমাত্র উত্তর হচ্ছে মেয়েটা অনায় ছিলো।

কাজের সুবিধার্থে হাতে থাকা অমীমাংসিত কেস এবং সম্ভাব্য বইয়ের একটা লিস্ট করেছে লুইস।

 ৭ই জুলাই, ২০০০: করবেল, লা ক্রাইম ডি’অরকিভাল (গ্যাবোরি) ভিক্টিম: ম্যারিসে পেরিন (২৩)

২৪শে আগস্ট, ২০০০: প্যারিস, রোজেন্না (জোয়েল এবং ওয়ালো) ভিক্টিম:?

২১শে নভেম্বর, ২০০১: টেম্বলে, দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া (এলরয়) ভিক্টিম: ম্যানুয়েলা কন্সটানজা (২৪), হেনরি ল্যাম্বার্ট (৫১)

৬ই এপ্রিল, ২০০৩: ক্যুবেভুয়া, আমেরিকান সাইকো (এলিস) ভিক্টিম: এভলিন রুভ্রে (২৩), জোসাইন ডেবেফ (২১), ফ্রাঙ্ক কোটেট

“ভিলারিয়ালে লেসাজের বাড়িতে যে টিম পাঠানো হয়েছিলো তারা এখনো কিছুই জানায়নি। বাড়ির নিচতলা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। পুরো বাড়ি ভালোমতো খুঁজে দেখতে এক মাসেরও বেশি সময় লাগবে,” জানালো লুইস।

“ক্রিস্টিন লেসাজকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি আমি,” বলল ম্যালেভাল।

দুটো টিম-মেদি আর ম্যালেভাল এবং লুইসের সাথে এলিজাবেথ লেসাজের ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য মিলিয়ে দেখছে। প্রথম টিম তার কর্মসূচি আর দ্বিতীয় টিম তার ব্যাংকের হিসাব নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছে। আরম্যান্ড এই দুই টিমের সমন্বয়কারী হিসেবে আছে। সবগুলো তথ্য যাচাই বাছাইয়ের মত জটিল কাজ তাকে দেয়া হয়েছে। আগামীকাল লেসাজকে জেরা করা হবে আর তার সফলতা নির্ভর করছে এদের উপর। কেননা যত বেশি তথ্য পাওয়া যাবে তত বেশি চাপে ফেলা যাবে তাকে। হয়তো সবকিছু স্বীকারও করে বসবে।

“কেবলই লা গুয়েনের সাথে কথা হলো আমার। জাজ দেশম নদীর তীরের ওই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জেনে গেছেন,” বলল লুইস।

“ভিক্টিমকে আমরা এখনো শনাক্ত করতে পারিনি। বিষয়টা আরো ঘোলাটে হয়ে গেলো,” হতাশা ভরা কণ্ঠে বলল ক্যামিল।

দু’জন আরো কিছুক্ষণ আলাপচারিতা চালিয়ে গেলো।

*

“আমার মনে হয় না বিজ্ঞাপন দেয়ার পদ্ধতি আর কাজে লাগবে। খুনির যে পরিচিতি দরকার ছিল তা সে পেয়ে গেছে। আমার ধারণা পরিবর্তি বিজ্ঞাপনের কোনো উত্তর পাবো না।”

“আপনার এমনটা কেন মনে হচ্ছে, কম্যান্ড্যান্ট?”

“প্রথমে এটা অনুমান ছিলো। কিন্তু এখন আমি এব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। যদি ভুল করে না থাকি তাহলে ইতিমধ্যে আমরা পুরনো সব কেস ঘেটে বের করেছি। আর কিছুই বলার নেই তার। তাছাড়া এটা অনেকটা বাঁধাধরা ব্যাপার হয়ে গেছে। একসময় বিরক্তবোধ করবে সে। আমাদের সন্দেহ করা শুরু করবে।”

“যাই হোক, আমাদের হাতে নতুন কেস এসেছে। পরবর্তি পদক্ষেপ কী হবে? আগামীকাল তো গণমাধ্যমের লোকজন আমাদের মাথা খেয়ে ফেলবে।”

“বিশেষ করে আমার মাথা।”

শুরু থেকে জাজ দেশমের কণ্ঠস্বর অনেকটা বদলে গেছে। তদন্ত কাজ যতই এগিয়েছে তার গলার স্বর ততোটাই নরম হয়েছে। ব্যাপারটা ভাল ঠেকলো না ক্যামিলের কাছে, বাসায় যাবার পূর্বে লা গুয়েনের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলো।

“লেসাজের ব্যাপারে আর কতদূর এগুলে?”

“তার বোন বছরের সব দিনের অ্যালিবাই দিচ্ছে ভাইয়ের জন্য। আগামীকালকের জেরার জন্য আমার পুরো টিম প্রস্তুত।”

“তুমি কি সারাদিনের জন্য আটকে রাখবে তাকে?”

“আশা করি আরেকটু বেশি সময় পাবো।”

“ঠিক আছে। আমি দেখছি বিষয়টা।”

ঘড়ির দিকে তাকাতেই আইরিনের কথা মনে পড়লো তার। আজ রাতে স্ত্রীকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা।

অধ্যায় ৮৮

বৃহস্পতিবার, ২৪শে এপ্রিল

লা মাটিন

ক্রিমিনাল ব্রিগেডে আতঙ্ক
‘নভেলিস্ট’-এর নতুন দুই শিকারের সন্ধান

গোয়েন্দারা এখনো ধাঁধার মাঝে।

ক্যুবেভুয়ার জোড়া খুন থেকে শুরু করে ট্রেলে হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত খুনির আরেক খুনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে গ্লাসগোতে খুন হয় গ্রেস হবসন। যা উইলিয়াম ম্যাকলাভ্যানির লেইডলো অনুসরণে করা হয়েছে।

“নভেলিস্ট’ এখানেই থেমে যায়নি।

তেইশ বছর বয়সি এক হেয়ারড্রেসারকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। তার শরীরে বিশেরও বেশি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিলো। এমিল গ্যাবোরির লা ক্রাইম ডি’অরকিভালের এক দৃশ্য হুবুহু মঞ্চায়ন করে খুনি।

সুইডিশ লেখক জোয়েল এবং ওয়ালো এর বিখ্যাত বই রোজেন্না অনুসরণ করে হত্যা করা হয়েছে আরেক নারীকে। শ্বাসরোধ করে হত্যা করার আগে ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয় ওই নারী।

পাঁচটা বইয়ের বিভিন্ন দৃশ্য অনুকরণে এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে খুনি। ছয়জন নারীকে বিভৎসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে পুলিশের লোকজন যেন লাশ গুনতে গুনতে হাঁপিয়ে উঠেছে। চোখে সর্ষেফুল দেখছে তারা। ইতিমধ্যে খুনির সাথে যোগাযোগ করার জন্য অখ্যাত এক ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপনও দেয়া শুরু করেছে। সর্বশেষ বিজ্ঞাপন ছিলো ‘তোমার আগের কাজগুলোর কী খবর…?’ এতেই বোঝা যাচ্ছে এই নৃশংস খুনির কাছে কতটা অসহায় আমাদের পুলিশ।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় পুলিশ জেরোমে লেসাজ নামে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, আপাতত এই কেসের মূল সন্দেহভাজন আসামী সে। গতকাল তার বোন ক্রিস্টিন লেসাজকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। ভাইয়ের গ্রেফতারের খবরে বেশ উত্তেজিত দেখা গেছে তাকে। সে আমাদেরকে জানিয়েছে, পুলিশ যখন দিশেহারা হয়ে ছিলো, তখন আমার ভাইয়ের দেয়া তথ্য তাদেরকে পথ দেখিয়েছে, গ্রেফতার করে তারা এখন প্রতিদান দিছে। আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকায় আমি তার মুক্তি দাবি করছি।’

আর কত খুন পুলিশের চোখ এড়িয়ে গেছে? আর কত নিরপরাধ নারী খুন হবে? ধর্ষিত হবে? পুলিশের ব্যর্থতার বলিদান আর কতজন দিবে?

অধ্যায় ৮৯

সারারাত একফোঁটাও ঘুম হয়নি লেসাজের। মুখটা একদম ফ্যাকাসে হয়ে আছে।

ক্যামিল তার সামনে এসে বসলো। টেবিলের উপর কিছু কাগজপত্র রেখে লেসাজের ভাব বোঝার চেষ্টা করলো।

“আপনার ডায়েরিতে লেখা জিনিসপত্র আরো খুঁটিয়ে দেখলাম আমরা, মঁসিয়ে লেসাজ।”

“আমার একজন উকিল লাগবে,” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল লেসাজ।

“এখনি আপনার ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে না।”

ক্যামিলের কথায় সে হতাশ হয়ে গেলো।

“যা যা জিজ্ঞেস করবো ঠিকঠাক উত্তর দিলেই আপনি যেতে পারবেন।”

চশমাটা খুলে রাখলো ক্যামিল।

“প্রথমেই আসি আপনার কর্মসূচিতে। গত কয়েক মাসে আপনি কী করেছেন আগে সেদিকে নজর দেই। ডিসেম্বরের চার তারিখে মঁসিয়ে পেলসিয়ারের সাথে আপনার দেখা করার কথা ছিল। উনি ওইদিন প্যারিসে ছিলেনই না, তারমানে উনার সাথে দেখা হয়নি। সতেরো, আঠারো এবং উনিশে ডিসেম্বর একটা নিলামে অংশ নেয়ার জন্য আপনার ম্যাকনে থাকার কথা ছিলো। কিন্তু আপনাকে কেউ দেখেইনি সেখানে। জানুয়ারির এগারো তারিখে মিস বার্টেলম্যানের সাথে মিটিঙয়ের কথা লিখে রেখেছেন। তার সাথে কথা বলে জানা গেছে ষোলো তারিখের আগে তার সাথে দেখাই হয়নি আপনার। জানুয়ারির চব্বিশ তারিখে ক্লোনে একটা বইমেলায় চারদিনের জন্য যাওয়ার কথা ছিলো আপনার। তার স্বপক্ষেও কোন প্রমাণ নেই। এরপর-”

“দয়া করে থামুন…”

“কিছু বললেন?” Bougat.com

“সবই করেছি আমার বোনের জন্য, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল লেসাজ।

“বোনকে খুশি করার জন্য আপনি ব্যবসায়িক সফরে যাওয়ার ভান করতেন, তাই না?”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো লেসাজ।

“আপনার ঘন ঘন ঘুরতে যাওয়াতে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু খুনগুলো যেদিন যেদিন হয়েছে সেই সময়গুলো আপনার সময়ের সাথে মিলে যাচ্ছে। তাই আপনার উপর সন্দেহ আসাটাই স্বাভাবিক। এর জন্য আমাদের দোষ দিতে পারেন না।”

লেসাজকে চিন্তা ভাবনা করার সময় দিলো ক্যামিল।

“একইদিনে আপনি ব্যাংক থেকে অনেক টাকা তুলেছেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে আপনার বোনের কিছু শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। স্টক মার্কেটে আপনার লেনদেনের হিসাব খুব জটিল। কমপক্ষে সাড়ে চার হাজার ইউরোর শেয়ার বিক্রি করেছেন। এতো টাকা দিয়ে কী করেছেন?”

“এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়,” রাগান্বিত সরে জবাব দিলো লেসাজ।

“কিন্তু এর সাথে যখন খুন জড়িয়ে যায় তখন আর ব্যক্তিগত থাকে না।”

“আমি খুন করিনি,” চিৎকার করে বলল লেসাজ।

“তাহলে আপনার চালচলন এবং ব্যাংক থেকে এতো টাকা উঠানোর কারণ ব্যাখ্যা করুন।”

“ওসব নিয়ে আপনি ভাবুন।”

“তাহলে তো তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে কথা বলতেই হয়, আপনার বোনকে…”

“আমার বোনকে এসবের মাঝে…”

“হ্যাঁ, বলুন?”

লেসাজকে এখন যুদ্ধে ক্লান্ত এবং পরাজিত সৈনিকের মত লাগছে।

“আপনি চান না আপনার বোন জেনে যাক কীভাবে তার টাকা উড়িয়েছেন?”

“যাই হোক। আমার বোনকে ছাড়ুন। ওকে শান্তিতে থাকতে দিন।”

“আপনার বোনের কাছ থেকে কী লুকাতে চাচ্ছেন?”

কোন জবাব না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ক্যামিল।

“তাহলে আমি আবার শুরু করি। গ্লাসগোতে যেদিন গ্রেস হবসন খুন হয় সেদিনের কোন অ্যালিবাই নেই আপনার।”

একদম নিঃশব্দে রুমে ঢুকলো লুইস, কানে ফিসফিসানি শোনার আগে ক্যামিলও তা বুঝতে পারেনি।

“একটু বাইরে আসতে পারবেন? আপনার জরুরি ফোন এসেছে।”

মাথা নিচু করে বসে আছে লেসাজ।

“মঁসিয়ে লেসাজ, আপনার মঙ্গলের জন্যেই বলছি আপনার এমন চালচলনের আসল কারণটা বলুন, নইলে সামনে আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে আপনার জন্য,” এই বলে বের হয়ে গেলো ক্যামিল।

অধ্যায় ৯০

রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলো আইরিন। হাঁটার সময় উঁচু নিচু জায়গাটা খেয়াল করেনি। তাকে পড়ে যেতে দেখেই কয়েকজন পথচারি সাহায্য করার জন্য ছুটে আসে। পাশের এক খাবারের দোকানের মালিক অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনে। কিছুক্ষণের মাঝেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আইরিনের এসব কিছুই মন নেই। তার পেটজুড়ে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।

ক্লিনিকের দোতলার এক বেডে নিজের স্ত্রীকে শুয়ে থাকতে দেখলো ক্যামিল।

“তুমি ঠিক আছে তো?”

“আমি পড়ে গিয়েছিলাম,” এমনভাবে বলল যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তার সাথে এমনটা হয়েছে।

“বেশি ব্যথা পেয়েছো? ডাক্তার কী বলল?”

“আমি পড়ে গিয়েছিলাম!”

এই বলে ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে কান্না শুরু করলো। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল ক্যামিল।

“তুমি ব্যথা পেয়েছে?” পুনরাবৃত্তি করলো ক্যামিল, “খারাপ লাগছে?” কোন জবাব না দিয়ে আইরিন কেঁদেই চললো।

“আমাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছে।”

“তার বিশাম দরকার। এখনো শকে আছে সে।”

ক্যামিলে ঘুরে তাকালো। ডাক্তারকে দেখতে প্রথম বর্ষের ছাত্রের মত মনে হচ্ছে।

“আপনি দ্রুতই সেরে উঠবেন।”

“অবশ্যই আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবো।”

“আপনি একটু ব্যথা পেয়েছেন। এর বেশি কিছু না।” ডাক্তারের কথা শুনে স্বস্তি বোধ করলো ক্যামিল।

“বাচ্চাটা এখন একটু অসুবিধায় আছে। আমার মনে হয় মায়ের কী হয়েছে তা খুঁজে বের করতে সে খুব দ্রুতই চলে আসবে।”

“সত্যি?”

“আমি নিশ্চিত। একটু তাড়াহুড়োর মাঝেই আছে সে। কয়েকঘণ্টা পর বিস্তারিত জানতে পারবো। আশা করি নতুন মেহমানের জন্য ঘর সাজিয়ে রেখেছেন।”

এলিজাবেথকে ফোন করলো লুইস। ক্যামিলের বাসায় পাঠালো তাকে। স্ত্রীকে নিয়ে ক্যামিল বাসায় ঢোকার সময় এলিজাবেথ হাজির হলো।

“তো? বাবা হতে যাচ্ছেন নাকি খুব শিগগিরই?” হেসে হেসে বলল সে।

হুট করে এমন কথায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ক্যামিল। দরজা খুলে বাসায় ঢুকলো সবাই।

আইরিনের গুছিয়ে রাখা স্যুটকেস খুঁজে বের করলো এলিজাবেথ। হাসপাতালে থাকার জন্য যা যা দরকার তার সবই আছে ভেতরে।

“এই তো পাওয়া গেছে। এখানেই তো সব আছে।”

এলিজাবেথের উপস্থিতিতে হাফ ছেড়ে বাঁচলো ক্যামিল।

“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমি আইরিনের কাছে দিয়ে আসি।”

“এলিজাবেথই পারবে,” বলল লুইস। তার হাতে নতুন চিঠি।

সবাই লুইসের হাতে থাকা খামের দিকে নজর দিলো।

অধ্যায় ৯১

প্রিয় ক্যামিল,

বরাবরের মত আপনার বিজ্ঞাপন দেখে বেশ ভাল লেগেছে। “তোমার আগের কাজগুলো…?” আপনি জানতে চেয়েছেন। আপনার কাছ থেকে আরেকটু বেশি আশা করেছিলাম আমি। আমার তৈরি করা গোলকধাঁধায় আপনি বারবার ভুল করছেন আর পথ হারাচ্ছেন। এই গোলকধাঁধা থেকে আপনি তখনি মুক্তি পাবেন যখন আমি চাইবো। আমি জানি আপনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সত্যি বলতে আপনার চেয়ে ভাল কেউ করতে পারতো না।

আপনার সর্বশেষ বিজ্ঞাপন উদ্দেশ্যমূলক ছিলো। কতটা হাস্যকর একটা কাজ করেছেন! আপনি এযাবত যতগুলো শনাক্ত করতে পেরেছেন আমি শুধু সে ব্যাপারেই কথা বলবো। বাকিগুলো বলে দিলে তো মজা থাকবে না, কী বলেন? শুধু এতটুকুই বলি আপনার জন্য আরো অনেক বিস্ময়কর জিনিস অপেক্ষা করছে।

যাই হোক মূল প্রসঙ্গে আসি। যদিও আপনি গ্লাসগো সম্পর্কে জানতে চাননি কিন্তু আমি জানি শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। পুরো প্রক্রিয়াটা খুব একটা কঠিন ছিলো না। ম্যাকলাভ্যানির অসাধারণ উপন্যাসে সবকিছুর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া ছিলো। তার ভাষ্যমতে বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বইটা লিখেছে সে।

নাইটক্লাবের সামনে গাড়ি রাখার সাথে সাথে গ্রেস হবসনের উপর চোখ পড়ে যায়। দ্বিতীয়বার না ভেবে তাকে বাছাই করে ফেলি। সে যখন বেরিয়ে আসছিল ততোক্ষণে রাত অনেক গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। আশেপাশে কেউ নেই। ভাগ্য ওইদিন আমার উপর এতোটা সহায় হয়েছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার পরিকল্পনা ছিলো তাকে অনুসরণ করে তার গতিবিধি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া এবং সময়মতো অপহরণ করা। কিন্তু সে নিজে থেকে এসে ধরা দেয়। গ্লাসগোর মানচিত্র দেখিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। তার সাবলীল ইংরেজি বুঝেও না বোঝার ভান করছিলাম আমি। আস্তে আস্তে গাড়ির দিকে নিয়ে যাই তাকে। বনেটের উপর মানচিত্র রেখে কলম আনতে চলে যাই আমি। হাতে থাকা রুমালে ক্লোরোফর্ম নিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই অজ্ঞান করে ফেলি। পুরো রাস্তা ধীরে সুস্থে চালিয়ে আসি যাতে করে তার ঘুম ভেঙে না যায়। এরপর আমার পরিকল্পনার বাইরে একটা কাজ করে ফেলি। গাড়ির পেছনে তাকে ধর্ষণ করি। যখনই আমি ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করি সাথে সাথে যে জেগে উঠে ঠিক যেমনটা বইয়ে বলা ছিলো। শ্বাসরোধ করে হত্যা করার সময়েও আমি তার ভেতরেই ছিলাম। অসাধারণ যৌন তৃপ্তি অনুভব করেছি সেদিন।

হোটেলে গিয়ে আমার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আসি। গ্রেসের পেন্টি খুলে নিতেও ভুল করিনি।

লেইডলো থেকেই আমার স্বাক্ষর করা শুরু হয়েছে। একপ্রকার বাধ্য হয়েছি কাজটা করতে। কেননা পুলিশের লোকজন কোন কূল কিনারা পাচ্ছিলো না। আমি চাচ্ছিলাম কেউ না কেউ সঠিক পথে চলুক। তাই আমার স্বাক্ষর রেখে যাওয়া শুরু করি। এরইমাঝে আমি এলরয়ের উপন্যাস নিয়ে কাজ করি যেখানে আঙুলের ছাপ দিতেই হতো।

আমি জানি আপনি এরইমাঝে সুইডিশ লেখকদ্বয়ের অসাধারণ উপন্যাস সম্পর্কে জেনে গেছেন। রোজেন্না পড়ার অভিজ্ঞতা ছিলো অসাধারণ, তাই না? এরপর আমি এদের লেখা অন্যান্য বইগুলোও পড়া শুরু করি কিন্তু রোজেন্নার মত কোনোটাই আমাকে এতোটা অভিভূত করতে পারিনি।

আমি কতটা আনন্দ অনুভব করেছি তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আগস্টের পঁচিশ তারিখ সকালে যখন নদীর তীর থেকে লাশটা তোলা হচ্ছিলো আমি তখন ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সবার উত্তেজনা উপভোগ করেছি।

জোয়েল আর ওয়ালো রোজেন্নার মৃত্যু নিয়ে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছে। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে শুধু বলেছে ‘ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা! খুনি নিষ্ঠুরতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিকৃত মানসিকতার চিহ্ন সুস্পষ্ট’। এক জায়গায় বলা আছে ‘রক্তের পরিমাণ খুব বেশি ছিলো না। মৃত্যুর পরেও তার উপর অত্যাচার থামেনি’।

কোমর থেকে নিতম্ব অবধি লাল দাগ খেয়াল করেছেন, এটার সম্পর্কে কীভাবে যে বলি?

কংক্রিটের ছোট এক টুকরা আমি নিজেই তৈরি করি এবং তা দিয়ে কাজ চালাই। লেখকদ্বয় বেঁচে থাকলে আমার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করতো।

তবে সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিলো নকল জন্মদাগ তৈরি করা। ফরেনসিক বিভাগ থেকে ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন আমি সবচেয়ে সহজলভ্য জিনিসই ব্যবহার করেছি। তবে পশুর প্রতিলিপি খুঁজে বের করতে একটু কষ্ট হয়েছিলো। হাজার হলেও আপনার আমি মতো এতো ভাল চিত্রশিল্পী না।

ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে আমি নদীর তীরে চলে যাই। আপনি জানেন আমি যে জায়গায় লাশ পুঁতে রেখেছিলাম সেখানে খনন কাজ শুরু হওয়ার জন্য এক বছর ধরে অপেক্ষা করেছি। প্রশাসনিক কাজ এতে ধীরগতির।

আমার এসব কথা শুনে আপনি হয়তো অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। এতোক্ষণ ধরে রোজেন্নার পরিচয় জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন।

বাস্তব জীবনে রোজেন্নার নাম ছিলো অ্যালিস হেজেস। আরকানসাসে অ্যালিসের পরিবারকে খুঁজে পাবেন। আমার কাজে এতো বড় অবদান রাখার জন্য একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য তার। আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন উপন্যাসে বলা আছে ভিক্টিমের পরিচয় যাতে সহজে বের করা না যায়। যদি আপনি সহজেই রোজেন্নার পরিচয় বের করে ফেলতেন তাহলে আমার সমস্ত পরিশ্রম বথা যেতো। অ্যালিসের সাথে কথা বলে জানতে পারি দুই বছর ধরে পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই তার। রোজেন্নাকে বাছাই করতে আর দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি আমার।

নিঃসন্দেহে আমাকে বাঁচাল ভাবছেন আপনি। কিন্তু কী করবো বলুন। সবার সাথে কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায় না। যখন থেকে বুঝতে পেরেছি আমাকে কতটা দরকার পৃথিবীর তখন থেকেই নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। কথা বলার সময়ই পাইনি। কিন্তু আফসোসের বিষয় কেউ বুঝতে পারেনি পৃথিবীর জন্য কত কী করতে পারি আমি। একসময় হতাশ হয়ে সব ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তো জানেন প্রতিভাবানরা কখনো থেমে থাকে না। নিঃস্বার্থভাবে কাজ করাটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। গোয়েন্দা আর রহস্য উপন্যাস পড়লেই বোঝা যায় মৃত্যুকে মানুষ কতটা উপভোগ করে। রহস্যের পেছনে তারা ছুটে যায় কিন্তু কেন ছুটছে তা জানে না। এছাড়া তাদের কাছে আর কিছু নেই। আমি তাদের অভাব পূরণ করতে এগিয়ে এসেছি। মানবজাতি এখন আর গল্প উপন্যাসে সন্তুষ্ট নেই, তারা তাজা রক্ত কামনা করে। তারা সত্যিটাকে আপন করে নিতে চায়। সেই সুযোগ আমি করে দিচ্ছি। ক্যামিল, আমি মানবজাতির রক্ষাকারী না। কোন সাধু সন্ন্যাসীও না। শুধু নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছি। সবাই আমার মত ভাবলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হয়ে যেতো।

গ্যাবোরির বইয়ের কম্যান্ড্যান্ট লেকের কথাগুলো মনে আছে আপনার? “অনেক মানুষ আছে যারা থিয়েটারে কাজ করতে চায়। কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝিনা এধরনের কাল্পনিক গল্পে তারা কী মজা পায়, বাস্তব জীবন থেকে বিস্তর ফারাক এদের মাঝে অনেকটা সূর্যের আলোর কাছে কুপি বাতির মতন। এমন শান্তশিষ্ট ভাবে মানুষকে আনন্দ দেয়া খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার, আমি বাস্তব জীবনের হাস্যরস, দুঃখগাথা দেখতে চাই। এই সমাজই আমার মঞ্চ। আমার কলাকুশলীরা সত্যিকারে হাসবে, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে অশ্রু।” এই কথাগুলো আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে। আমার অভিনেত্রীরা সত্যিকারেই কেঁদেছে। অ্যালিসের জন্য আমার খুব মায়া হয়, রোজেন্না চরিত্রটা কতটা অসাধারণভাবে করেছে।

যেমনটা আপনি ভাবছেন, আমাদের আলাপচারিতা প্রায় শেষের পথে। ভবিষ্যতে আরো কিছু বিষয়ে কথা হবে আমাদের। আমার ‘সেরা কাজ এখনো বাকি। আমি জানি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো খুব শিগগিরই। আমার উপর ভরসা রাখুন। এতোদিন ধরে গড়ে তোলা মূর্তিতে তুলির শেষ আঁচড় দেয়া এখনো বাকি। এরপরেই আমার সৃষ্টি সম্পর্কে আপনি পুরো ধারণা পাবেন। আমার জীবনের সেরা কাজ আপনাকে অবিভূত করবে।

–‘আপনার একান্ত অনুগত ভক্ত’

অধ্যায় ৯২

“ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। এখনো খিচুনি শুরু হয়নি দেখে সে কিছুটা অবাক হয়েছে।”

“আমি কিন্তু বিন্দুমাত্র অবাক হইনি। আমার বাচ্চাটা যেখানে আছে ভালই আছে। ওর কোন দোষ নেই।”

ফোনে আইরিনের হাসি শুনতে পেলো ক্যামিল।

“তো এখন কী হবে?”

“কিছুক্ষণ আগেই আলট্রাসাউন্ড করানো হয়েছে। আমাদের বাচ্চা ভালবাসা পাঠিয়েছে তোমার জন্য। কিছুক্ষণের মাঝে যদি ব্যথা শুরু না হয় তাহলে বাসায় চলে আসবে। এরপর শুধু আমাদের বাচ্চার জন্য অপেক্ষা।”

“এখন কেমন লাগছে তোমার?”

“আমার বুক কাঁপছে। এজন্যেই মনে হয় রেখে দিয়েছে।”

“আমি এখনি আসছি।”

“দরকার নেই। এলিজাবেথ খুব ভাল মেয়ে, আমার হয়ে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ো। আমার সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। তোমার কাছে নাকি আরেকটা চিঠি এসেছে। তোমার সময়ও তো ভালে যাচ্ছে না।”

“একটু চিন্তায় আছি। আমার মনটা তোমার সাথেই আছে।”

“অবশ্যই। আমি সেটা জানি।”

*

“এখনো আমাদের কাছে আটক আছে সে। মিথ্যা সাক্ষাৎকারের সময়সূচি, রহস্যজনক ভাবে টাকা উত্তোলন, আরো অনেক প্রমাণ আছে তার বিরুদ্ধে।

“তোমার কি মনে হয় গ্রেফতার হওয়ার আগেই চিঠি পাঠিয়েছে?”

“অসম্ভব কিছু তো না।”

বিকালে জাজ দেশমের সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথে তার হাতে নতুন আসা চিঠি তুলে দেয় ক্যামিল।

“বোনকে ছেড়ে দিয়েছো?”

“দুজনকে আলাদা রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য। ভাইকে সব ধরণের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত তার বোন। অন্ধ বিশ্বাসের উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত ক্রিস্টিন, “ বলল সা গুয়েন।

“ক্রিস্টিনকে সর্বোচ্চ চাপে রাখা হবে। কিন্তু দুজনকে একসাথে রাখলে এটা সম্ভব হবে না,” মতামত জানালো ক্যামিল।

“আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে লেসাজকে ছাই দিয়ে ধরেছেন।”

“এমন দ্বৈতস্বত্ত্বা নিয়ে সে অনেকদিন ধরে থাকছে। এতোদিন ধরে নিজের বোনকে যেহেতু ধোঁকা দিতে পেরেছে, তারমানে অভ্যাসটা অনেক দিনের। ড. ক্রেস্টের সাহায্য লাগবে আমার।”

“তুমি ঠিকই বলেছে। কিন্তু এখানে তো আর খুব বেশি সময় রাখতে পারবে না। এরপর তো তাদের দেখা হবেই। এখান থেকে বের হওয়ার পর তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে। আপনার লোকজন কি পারবে?”

পড়তে থাকা পত্রিকা গুটিয়ে রাখলো লা গুয়েন।

“না পারার কোন কারণ দেখছি না আমি,” বলল সে।

দেশম কোন মন্তব্য করলো না।

“চিঠিতে হুমকি দিয়েছে খুনি। হয়তো কিছুই করবে না। তবুও আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত।”

কিছু না বলে চিঠির দিকে তাকিয়ে রইলো দেশম।

“এতোদিন করে পরিকল্পনা করে কেউ খুন করছে, তার কোনো শেষ থাকবে না এমনটা আমার মনে হয় না। খুনি এক কথার মানুষ। সে যা বলে তাই করে দেখায়। চিন্তার বিষয় হচ্ছে এই পরিকল্পনা সে অনেক আগে থেকেই করে রেখেছে। শুরু থেকে এখন অবধি সে যেমন চেয়েছে তেমনি হয়েছে,” এই বলে থামলো দেশম।

“শুধু আমরাই জানি না শেষটা কোথায়,” আফসোস করে বলল ক্যামিল।

অধ্যায় ৯৩

ক্যামিল চলে যাওয়ার পর সুইস, আরম্যাড আর ম্যালেভাল মিলে লেসাজকে জেরা করার দায়িত্ব গ্রহণ করলো। জেরা করার ক্ষেত্রে সবাই ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। লুইস সবসময় যথাযথ এবং মার্জিত প্রশ্ন করে। কৌশলী উপায়ে সব বের করে আনতে সিদ্ধহস্ত সে। ম্যালেভাল স্বভাবতই অধৈর্য। যা জানার তা খুব দ্রুত বের করতে তার জুড়ি মেলা ভার। সন্দেহভাজনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে হলেও সে তথ্য বের করে আনে। আরম্যান্ড তার অন্যান্য কাজের মতো এখানেও বেশ সময় নেয়। প্রতিটি ঘটনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনবে। প্রয়োজন হলে কয়েকবার শুনতে চাইবে। আর সামনে থাকা নোটপ্যাডে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর লিখে রাখবে।

ক্যামিল পৌঁছানোর আগেই লুইস, আরম্যান্ড আর ম্যালেভালের সাথে এক ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছে লেসাজ। একে অপরের প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে দেখছিলো। তাদের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলো ক্যামিল কিন্তু কবের ইশারায় থেমে গেলো।

“খারাপ খবর আছে নাকি?”

“ভয়াবহ খারাপ।”

একে অপরের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারা। সদ্য প্রিন্ট করা একটা কাগজ ক্যামিলের হাতে তুলে দিলো কব।

“আমি দুঃখিত ক্যামিল,” বলল সে।

কাগজটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ক্যামিল।

“আমি সত্যিই দুঃখিত,” ক্যামিলকে চলে যেতে দেখে আবারো বলল কব।

অধ্যায় ৯৪

কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা লুইসের কাছে চলে গেলো ক্যামিল।

“তুমি, আমার সাথে আসো।”

কোন কিছু জিজ্ঞেস না করে ক্যামিলকে অনুসরণ করলো লুইস। পাশের একটা কফি শপে গিয়ে বসলো দুজন। এই সময়ে দুজনের মাঝে কোনো কথা বিনিময় হয়নি।

“দুটো এসপ্রেসো,” অর্ডার দিলো ক্যামিল।

“ম্যালেভালের কাছে তুমি কত টাকা পাও, লুইস?”

লুইস কোন উত্তর দেয়ার আগে ক্যামিল টেবিলে এতো জোরে ঘুসি মারলো যে কফির কাপ থেকে কিছুটা কফি ছিটকে পড়লো।

“খুব বেশি না বোধহয়, অল্পই হবে।”

“কত?”

“আমি সঠিক জানি না।”

আবারো জোরে ঘুসি মারলো ক্যামিল।

“পাঁচ হাজারের কাছাকাছি।”

ক্যামিল মনে মনে হিসাব করে দেখলো প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার ফ্রাংকের মত হবে।

“এতো ইউরো দিয়ে কী করে ম্যালেভাল?”

“জুয়া খেলে। এখন হারার মাঝেই আছে। অনেকেই টাকা পায় ওর কাছে।”

“তো কতদিন ধরে ম্যালেভালের ব্যাংক হিসেবে কাজ করছো?”

“খুব বেশিদিন হয়নি। আগেও ধার নিতে অল্প পরিমানে। সময়মত ফেরতও দিয়ে দিতে। কিন্তু ইদানীং অনেক বেশি পরিমানে নিচ্ছে। গত রবিবার আমার বাসায় এসে পনেরশো ইউরোর চেক নিয়ে গিয়েছে। আমি বলে দিয়েছি এটাই শেষবার।”

লুইসের দিকে তাকালো না ক্যামিল। একহাত পকেটে রেখে আরেকহাত দিয়ে মোবাইল নাড়াচাড়া করতে শুরু করলো সে।

“এটা তো আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এরসাথে কেসের…”

কথাটা শেষ করতে পারলো না সে। ক্যামিলের দেয়া কাগজটা পড়ে দেখলো। ক্যামিলের চোখে পানি চলে এসেছে।

“আমার পদত্যাগ চাইছেন আপনি?”

“আমাকে এমন বিপদের মাঝে ফেলে যেয়ো না, লুইস।”

অধ্যায় ৯৫

“আমার হাত পা বাঁধা, ম্যালেভাল, তোমাকে পদচ্যুত করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ম্যালেভালের। আশেপাশে আশ্রয় খুঁজতে শুরু করলো।

“তুমি জানো না এই কাজটা করতে আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে… তোমার সমস্যার কথা আগে কেন বললে না আমাকে?”

ম্যালেভাল লা মাটিনের সাংবাদিককে যতগুলো কল করেছে তারই একটা লিস্ট করা কাগজ ক্যামিলের হাতে তুলে দিয়েছিলো কব। এপ্রিলের ছয় তারিখে বুসনকে ফোন করেছিলো সে আর ওইদিন ক্যুবেভুয়ায় ভিক্টিমের লাশ উদ্ধার করা হয়। সকাল সাড়ে দশটায় প্রথম কল করা হয়েছিলো। এর আগে ওই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কারো জানা সম্ভব ছিলো না।

“এটা কতদিন ধরে চলছে?”

“গত বছরের শেষের দিক থেকে। আমার সাথে সে প্রথমে যোগাযোগ করেছিলো। শুরুর দিকে অল্প কয়েকটা তথ্যেই সন্তুষ্ট ছিলো।”

“এরপরেই জুয়া খেলার টাকা জোগাতে হিমসিম খেতে শুরু করো, তাই না?”

“অনেক টাকা হেরে যাই আমি। লুইসও সাহায্য করেছে কিন্তু তা যথেষ্ট ছিলো না।”

“তুমি জানো সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার অপরাধে আমি চাইলেই বুসনকে মুহূর্তের মাঝেই ধরে আনতে পারি।”

“হ্যাঁ জানি।”

“আর তুমি এটাও জানো তোমার খাতিরে আমি এই কাজ করবো না।”

“আমি জানি,” কৃতজ্ঞচিত্তে বলল ম্যালেভাল।

“আমি বিষয়টা গোপন রাখবো। লা গুয়েনকে ফোন করতে হবে কিন্তু বিষয়টা যাতে লোকমুখে না ছড়ায় সেই ব্যবস্থাও করবো।”

“আমি তাহলে বাসায় চলে যাই

“তুমি এখানেই থাকবে! আমার অনুমতি পেলে তারপর যাবে, তার আগে না।”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ম্যালেভাল।

“আর কত টাকা লাগবে তোমার?”

“লাগবে না।”

“এসব বলবে না আমাকে। কত লাগবে বলো?”

“এগারো হাজারের কাছাকাছি।”

“জিসাস ক্রাইস্ট!”

দুজনেই কিছুসময় নীরবতা পালন করলো।

“আমি একটা চেক লিখে দিচ্ছি।”

ম্যালেভাল কিছু বলতে যাবে এমন সময় তাকে থামিয়ে দিলো ক্যামিল।

“প্রথমে তুমি ঋণ শোধ করবে। আমার অংশ পরিশোধ করা নিয়ে এখনি ভাবতে হবে না। কিন্তু প্রশাসনিক পদক্ষেপের ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না। তুমি তো জানোই এ ব্যাপারে আমার কোন হাত নেই। তবুও ভোমার সাজা কমানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”

ম্যালেভাল কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। চোখের সামনে নিজের ধ্বংসলীলা দেখতে পেলো সে।

অধ্যায় ৯৬

ক্যামিলের রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো আরম্যান্ড। পুরো অফিস জুড়ে অদ্ৰত নীরবতা নেমে এলো। কব কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে আছে। ডেস্কের পেছনে অপরাধীর মত মুখ লুকিয়ে আছে লইস। নতুন দুই সদস্য এলিজাবেথ আর মেদি একে অপরের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে।

বিকাল সাড়ে চারটার দিকে ক্যামিলের দরজায় নক করলো লুইস। কোনো শব্দ না করে ঢুকে পড়লো। ক্যামিল কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।

“ছোট একটা সাহায্য চাইছি আমি, লা গুয়েন। এমনিতেই কেসটা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক মাতামাতি হয়েছে। এই খবর প্রকাশের ঝুঁকি নিতে চাইছি না। পুরো বিষয়টা আরো জট পাকিয়ে যাবে। শেষমেশ এটা

কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা যাচ্ছে না।”

ক্যামিলের কথা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে লাগলো লুইস।

“ঠিক আছে। আপনি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করুন। আর যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুন, কোনো কিছু করার আগে দয়া করে আমাকে জানাবেন।”

ফোন রেখে আরেকটা কল করার জন্য উদ্যত হলো ক্যামিল।

“হসপিটালে একটু খবর নেই। এততক্ষণে হয়তো আইরিন ছাড়া পেয়ে গিয়েছে।”

“একটু পরে করা যায় না?”

“কেন?”

“লেসাজের ব্যাপারে নতুন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।”

“বলল, আমি শুনছি।”

অধ্যায় ৯৭

ফ্যাবিয়েন জলি, বয়স ত্রিশের আশেপাশেই হবে, সুন্দর জামা পড়ে এসেছে। স্বর্ণকেশী নারীর চোখে সানগ্লাসও আছে। দেখতে সাধারণ মনে হলেও মেয়েটার মাঝে কিছু একটা আছে যা তাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব সহজে দমে যাবার পাত্রী সে না।

“আপনি কি জানেন যা যা বলবেন তার সব রেকর্ড করে রাখা হবে, এমনকি আপনার স্বাক্ষরও থাকবে সেখানে।”

“অবশ্যই। আমি জেনেই এসেছি।”

ক্যামিলের ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে নোট নিচ্ছে লুইস।

“সেক্ষেত্রে আমার সহকর্মীকে একটু আগে যা যা বলেছেন তা আবার বলুন।”

“আমার নাম ফ্যাবিয়েন জলি। বয়স চৌত্রিশ। আমি মূলত দোভাষী হিসেবে কাজ করি কিন্তু আপাতত বেকার। ১৯৯৭ সাল থেকে আমি আর লেসাজ একে অপরকে ভালোবাসি।”

“আর,..?”।

“লেসাজ বোনকে নিয়ে খুব চিন্তিত থাকে। তার ধারণা যদি ক্রিস্টিন আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জেনে যায় তাহলে আবারো অস্বাভাবিক হয়ে পড়বে যেমনটা হয়েছিলো স্বামীর মৃত্যুর পর। বোনকে খুব ভালোবাসে লেসাজ। আমিও এটা মেনে নিয়েছি।”

“আমি তো এর মাঝে…” কথা বলতে শুরু করলো ক্যামিল।

“আমি সব খুলে বলছি। গতকালকেই আমি পত্রিকায় পড়েছি আপনারা ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ধরে এনেছেন। আমি এটাও জানি সব কথা বলবে না সে। তাই আমি ছুটে এসেছি। ওর ডায়েরিতে যত কাল্পনিক মিটিঙয়ের কথা দেখেছেন সব আমাদের জন্যেই করা। আমার সাথে দেখা করার জন্য এমনটা করতো। ক্রিস্টিন যাতে কোনভাবেই আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে টের না পায়।”

“বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি এতে সন্তুষ্ট না।”

“আর কী জানতে চান আপনি?”

“মঁসিয়ে লেসাজ তার চালচলন সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।”

“আমাকে জিজ্ঞেস করুন।”

“২০০১ সালের জুলাই মাসে মঁসিয়ে লেসাজ এডিনবার্গে গিয়েছিলো। কিন্তু…”

“অবশ্যই, জুলাইয়ের নয় তারিখে গিয়েছিলো। সত্যি বলতে আট তারিখ বিকালে পৌঁছায় সে। আমি এর পরেরদিনই ওর কাছে চলে যাই। তিনদিন ঘোরাঘুরির পর লেসাজ বোনের কাছে ফিরে যায়।”

“আপনি সব খোলাসা করে বলে ভালই করেছেন, মিস জলি। কিন্তু লেসাজ এখন যে অবস্থায় আছে, আমার মনে হয় না শুধু আপনার বক্তব্যে কাজ হবে।”

ঢোক গিললো জলি।

“শুনতে কিছুটা অদ্ভুত মনে হতে পারে…” লজ্জায় লাল হয়ে গেলো সে।

“বলুন, সমস্যা নেই,” উৎসাহ দিলো ক্যামিল।

“আমার আবার সব কিছু লিখে রাখার অভ্যাস আছে…” এই বলে ব্যাগ থেকে গোলাপি রঙের একটা ডায়েরি বের করলো সে। “আমি জানি অনেক ছেলেমানুষি কাজ করেছি আমি। যা যা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমি তা লিখে রাখি। লেসাজের সাথে প্রথম যেখানে দেখা হয়েছিলো, যে যে জায়গায় আমরা ঘুরেছি। প্লেনের টিকেট, বাসের টিকেট, যে হোটেলে থেকেছি তার বিলের কাগজ সবই রেখে দিয়েছি আমি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *