৬০. গ্লাসগোর ফ্লাইট

অধ্যায় ৬০

মঙ্গলবার, ১৫ই এপ্রিল

গ্লাসগোর ফ্লাইট দুপুর ২ টার দিকে পৌঁছালো। ম্যালেভালকে দেখতে পেলো ক্যামিল, তাকে নিতে এসেছে।

“তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি খারাপ খবর আছে। এখনি কিছু বলতে হবে না।

ক্যামিলের সুটকেস হাতে নিয়ে তার দিকে লা মাটিনের একটা কপি বাড়িয়ে দিলো ম্যালেভাল।

“আবারো আঘাত হানলো ‘দ্য নভেলিস্ট’, তার তৃতীয় কিস্তি ‘লেইডলো’।”

এবার আর কোনো সন্দেহ রইলো না ক্যামিলের মনে। একমাত্র সূত্র হতে পারে : বইবিক্রেতা।

“জাহান্নামের চৌরাস্তায় যায় না কেন এই সাংবাদিক!” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে।

“আমারও প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া ছিলো খবরটা শোনার পর। তবে লুইস কিছুটা সংযত আচরণ করেছে,” বলল ম্যালেভাল।

ফোন চেক করলো ক্যামিল, দুইটা মিসকল ভেসে উঠেছে, লা গুয়েন ফোন করেছিলো। ভয়েস মেইল শোনার তাগাদাও অনুভব করলো না।

আগামীকাল সংবাদমাধ্যমে কেমন তোলপাড় শুরু হবে এই ভেবে তার মেজাজ খারাপ হলো। থামানোর কোন উপায়ও নাই। এখন লা গুয়েন আর দেশমকে না জানানোর কোন মানেই হয় না। গত দুইদিন ধরে যে তথ্য একান্তই ব্যক্তিগত ছিলো আজ সবাই জেনে গেছে। এই কেসের দায়িত্ব থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হবে তা একপ্রকার নিশ্চিত হয়েই গেলো। চার চারটা খুন হয়ে যাওয়ার পরেও সম্ভাব্য এমন কোন সূত্র খুঁজে পায়নি যা খুনির কাছাকাছি নিয়ে যাবে। সংবাদমাধ্যমের লোকজনও তার চেয়ে বেশি জানে। পুরো ক্যারিয়ারে আজকের মতো এতোটা অসহায়বোধ করেনি সে।

“আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসো,” বেশ নিচুস্বরে বলল ক্যামিল।

“আমরা ওকে খুঁজে বের করবো,” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ম্যালেভাল।

“কেউ না কেউ খুঁজে বের করবে, কিন্তু আমরা না। অন্ততপক্ষে আমি। আমার ধারণা আজ বিকালের মাঝেই আমাদেরকে এই কেসের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হবে।”

“এসব কী বলছেন আপনি?”

বুসনের লেখা আর্টিকেল পড়তে শুরু করলো ক্যামিল। মুহূর্তের মাঝেই ক্লান্তি বিরক্তিতে রূপ নিলো।

*

…ট্রেম্বলেতে যেমন জেমস এলরয়, বেভুয়ায় তেমনি ব্রেট এস্টন এলিস, সম্প্রতি পুলিশ আবিষ্কার করেছে আমাদের খুনি নভেলিস্ট ফ্রান্সের বাইরেও আঘাত হেনেছিলো। এক গোপন সূত্রে জানা গেছে ২০০১ সালের দশ জুলাই গ্লাসগোতে এক তরুণী খুন হয় স্কটিশ লেখক উইলিয়াম ম্যাকলাভ্যানির লেইডলো এর সাথে মিলে যায়।

*

“এসব কী বালছাল লিখেছে,” চিৎকার করে বলল ক্যামিল।

“তারা সবাই একই।”

“কাদের কথা বলছো?”

“সাংবাদিক।”

“আসলে আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম।”

ম্যালেভাল থেমে গেলো। কামিল ঘড়িটা দেখে নিলো একবার।

“আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে। সামনে গিয়ে ডানে ঢুকবে।”

অধ্যায় ৬১

ক্যামিলকে দোকানের সামনে নামতে দেখেই লেজ কাঁচুমাচু করতে করতে এগিয়ে এলো।

“আমি দুঃখিত, কম্যান্ড্যান্ট…বিশ্বাস করুন আমি

“তদন্তে ব্যাঘাত করে এমন কোন তথ্য আপনার ফাঁস করা উচিত হয়নি। আপনি আইন ভেঙেছেন।”

“তার মানে আপনি আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছেন। কাজটা অকৃতজ্ঞের মত হয়ে যাচ্ছে না?”

“আপনি আসলে কী চাইছেন, লেসাজ?”

“তদন্তের সাপেক্ষে হয়তো তথ্যটা গোপন করার মত কিছু হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যে কিছুই গোপন থাকে না।”

“তাই বলে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য আপনি এমন করবেন। আপনার নীতি তো পাড়ার বেশ্যার চেয়েও খারাপ।”

“সবাই জনপ্রিয়তা পছন্দ করে, কম্যান্ড্যান্ট। ওই আর্টিকেলের কোথাও আমার নাম উল্লেখ নেই।”

ক্যামিল বুঝতে পারলো লেসাজের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তার এই কাজের জন্য ক্যামিলকে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হবে তা বলে আর সময় নষ্ট করতে ইচ্ছা করলো না। কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেলো।

“আমি বাসায় লাগেজটা রেখে জামা কাপড় পাল্টে বের হবো। এরপর দুজনে মিলে একসাথে হেডকোয়ার্টারে যাবো।”

ক্যামিলের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামলো। ম্যালেভাল তার জন্য গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু অনেকটা সময় পার হলেও তার বসের কোন দেখা পেলো না। তাই তাকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলো।

এরইমাঝে ক্যামিল এসে উপস্থিত হলো।

“আমি তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।”

গাড়িতে উঠার আগে ভয়েস মেইল চেক করলো ক্যামিল। এখন তিনটা জমা হয়েছে।

প্রথমটা যেন জ্বালাময়ী এক ভাষণ : “তুমি আমাকে হতাশ করলে, ক্যামিল। সব পত্রিকার যে খবর ছড়িয়ে পড়েছে তা আমি জানিই না। এয়ারপোর্ট নেমেই আমাকে ফোন করবে।”

কিছুক্ষণ পরেই দ্বিতীয়টা পাঠানো হয়েছিলো, যা নির্দেশনামূলক

“ক্যামিল,..কেবলই জাজ দেশমের সাথে কথা হলো…যত দ্রুত সম্ভব এই বিষয় নিয়ে আমাদের কথা বলা দরকার…পরিস্থিত খুব একটা সুবিধার না। মেসেজ পাওয়ার সাথে সাথেই ফোন করবে।”

শেষেরটায় ক্যামিলের জন্য সমবেদনা পপাষণ করেছে লা গুয়েন।

“সাড়ে তিনটার দিকে জাজ দেশমের অফিসে মিটিং হবে। সরাসরি ওখানে চলে এসো।”

অধ্যায় ৬২

ক্যামিলকে রুমে ঢুকতে দেখে এগিয়ে গেলো লা গুয়েন। তার সাথে হাত মেলালো। জায়গা থেকে নড়লো না দেশম।

“কম্যান্ড্যান্ট ভেরহেভেন, নিয়মকানুন সবার জন্য সমান। আপনি জানেন আমি এর বরখেলাপ পছন্দ করি না,” ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে বলল দেশম।

পরবর্তি কথা বলার জন্য কিছুক্ষণ সময় নিলো।

“আপনার ব্যর্থতা আর দায়িত্বে অবহেলার ব্যাপারে কোন অজুহাত চলবে না। আপনাকে আগেও সতর্ক করা হয়েছে। আপনি ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে জানানোর আগে সংবাদমাধ্যমে তথ্য পাচার করেন।”

“ঘটনাটা এমন নয়, দেশমকে থামিয়ে বলল ক্যামিল।

“কিন্তু যা ঘটে গিয়েছে তা তো অস্বীকার করতে পারবেন না। আসলে কী ঘটেছিলো তা জানার কোন ইচ্ছাও নেই আমার। বলতে খারাপ লাগছে তবুও বলি, আপনাকে এই কেসের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।”

“ম্যাডাম লা জুজে…” বলল লা গুয়েন।

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো ক্যামিল।

“বাদ দাও, জেন। ম্যাডাম লা খুঁজে, আপনাকে জানাইনি কারণ আমরা তখনও গ্লাসগো হত্যাকাণ্ড আর ওই বইয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। আজকেই এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হয়েছি এবং একারণেই আপনার এখানে এসেছি।”

“আমি পুরোটাই পত্রিকা পড়ে জেনেছি এবং খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু এই কেসে কোন অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছিনা আমি। এখনো আগের জায়গাতেই পড়ে আছেন আপনি।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ক্যামিল। ব্রিফকেস খুলে একটা ম্যাগাজিন বের করে দেশমের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

“এটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন। মূলত গোয়েন্দা উপন্যাস ছাপে এরা। এছাড়াও বইয়ের রিভিউ, লেখকদের সাক্ষাৎকারও থাকে এতে।”

ম্যাগাজিনটা খুলে পাঁচ নম্বর পেজে গেলো ক্যামিল।

“পুরনো কিংবা দুর্লভ অনেক বইয়ের বিজ্ঞাপনও থাকে।”

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দেশমের দিকে ম্যাগাজিনটা বাড়িয়ে দিলো ক্যামিল।

“বাম দিকের কোণায় আমি একটা বিজ্ঞাপনে গোল দাগ দিয়েছি।”

‘বি.ই.ই’? এটার কথা বলছো? এর নিচে তোমার বাসার ঠিকানা?”

“হ্যাঁ,” বলল ক্যামিল, “বি.ই.ই মানে হচ্ছে ব্রেট এস্টন এলিস।”

“এর মানে কী?”

“আমি খুনির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি।”

“কার অনুমতিতে?”

“না, ম্যাডাম লা অঁজে। এই ব্যাপারে আমরা আগেই কথা বলেছি। নিয়মকানুন মেনে চলার ক্ষেত্রে আমি বরাবরই উদাসীন, অসতর্ক। অনেক চেষ্টা করেছি এই অভ্যাস পরিবর্তন করার। কিন্তু বারবার এমনটা হয়েই যায়।”

কোন জবাব দিলো না দেশম।

“এটা আজকে সকালে এসে পৌঁছেছে,” দেশমের দিকে কয়েকটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো সে।

.

মঁসিয়ে, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগছে। আপনার দেয়া বিজ্ঞাপন আমার জন্য স্বস্তির সুবাতাস বয়ে এনেছে। মানুষের এই অন্ধত্ব আমাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। আপনি এই নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি দিয়েছেন। অনেকদিন ধরে আমি এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছি। পুলিশ বাহিনীর কর্ম তৎপরতা দেখে তাদের জন্য মায়া জন্মে গিয়েছিলো আমার। অনেক পুলিশ অফিসার আর গোয়েন্দা দেখেছি এই সময়ের মাঝে। কিন্তু আফসোসের বিষয় এরা সবাই একেকটা অকর্মার ঢেকি। কেউ আজ অবধি চুল পরিমাণ আন্দাজ তো দূরের কথা আশেপাশেও আসতে পারেনি। আস্তে আস্তে নিজেকে অজেয় মনে হচ্ছিলো। ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম এরইমাঝে আপনার আগমন। হয়তো ঈশ্বর পাঠিয়েছেন আপনাকে আমার সাথে মোলাকাতের জন্য।

আপনার আগেও অনেকে এসেছে, কিন্তু আপনি আমার মনে আশার আলো জ্বালিয়েছেন। অন্যদের থেকে একদম আলাদা একজন অফিসার। এই কেসে আপনার হাত পড়ার পরে থেকেই আমি ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছিলাম। রহস্যের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন খুব তাড়াতাড়ি। আমার বিশ্বাস ছিলো আপনি ঠিকই পারবেন। পত্রিকায় পড়ার সাথে সাথে বুঝতে পারি এতোদিন ধরে যার অপেক্ষায় ছিলাম তাকে পেয়েছি। মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিলো তখন কেননা খুব শিগগিরই আপনার সাথে যোগাযোগ হবে।

“we.B.B, এটার কথাই তো জিজ্ঞেস করেছেন।”

সে এক বিশাল গল্প। আমার অনেক সাধের প্রজেক্ট ছিলো এটা। অনেকদিন ধরে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। যতদিন অবধি নিজেকে যোগ্য মন হয়নি ততোদিন হাত দেইনি এতে। ব্রেট এস্টন এলিস আগাগোড়া শিল্পমনস্ক এক লোক। তার একটা কাজ করার জন্য প্রচুর পরিশ্রম দরকার, নতুবা এমন একটা কাজের যোগ্য সম্মান দেয়া সম্ভব না। আমার জন্য বিরাট সৌভাগ্যের ছিলো পুরো কাজটা। আপনি কি খেয়াল করেছেন কতটা সূক্ষভাবে আমি ঘটনাস্থল তৈরি করেছি? কাজটা বেশ কঠিন ছিলো। অনেক জায়গা ঘুরে দেখেছি আমি। কোটেটের সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথেই লোকটা কেমন তা বুঝে গিয়েছিলাম। পুরোদস্তুর বোকা এক লোক, তাই না? কিন্তু তার জায়গাটা একদম উপযুক্ত ছিলো আমার কাজের জন্য। এমন লোককে ফাঁদে ফেলা খুব কঠিন কিছু না। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো কী পরিমাণ লোভী সে। আমার ভাড়া করা ভ্যানের দায়িত্ব নিতে কোনো দ্বিধাবোধ করেনি। তার আনুগত্য দেখে আমি বিমোহিত হয়েছি। এরচেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার থাকে এমন লোকের কাছ থেকে? আমার মহান এই নাটকে তারও যে ছোট একটা ভূমিকা ছিলো তা সে জানতো না। সোমবার রাতে তাকে দূরে পাঠাতে কোন কষ্টই করতে হয়নি। আপনি তার সম্পর্কে আগ্রহী হলে বলে রাখি, নিজেকে এই ঝামেলা থেকে মুক্ত করতে যে কোন কিছু করার জন্য প্রস্তুত ছিলো সে। ওই মাথামোটাকে খুন করে কোনো মজা পাইনি। তার মৃত্যুটা সময়ের দাবি ছিলো। ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ ছিলো না আমার। ‘লা ক্যালেরি’তে ওর লাশ খুঁজে পাবেন। জায়গাটা যাতে খুঁজে পেতে কষ্ট না হয়, আমি ওখানে একটা শিলাস্তূপও রেখে এসেছি। আপনার সক্ষমতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস এখনো বাকি আছে। কতটা যত্ন সহকারে আমি পুরো দৃশ্যটা একদম হুবহু বইয়ের মত করেছি আপনি তা লক্ষ্য করেছেন। সবকিছু একদম জায়গা মত ছিলো। স্বয়ং এলিস আমার কাজ দেখলে অবাক হয়ে যেতো। সুটকেস আর ভেতরের জিনিসপত্র আমি মাস দুয়েক আগে ইংল্যান্ড থেকে কিনেছিলাম। সোফাটা মঁসিয়ে কোটেটের মাধ্যমেই কেনা হয়েছিলো। সবচেয়ে ঝামেলায় পড়েছিলাম ওই ডালমেসিয়ান ওয়ালপেপার নিয়ে। কোথাও না পেয়ে আমেরিকা থেকে আনিয়েছি।

নাটকের পাত্রী জোগাড় করাটাও সহজ কাজ ছিলো না।

বইয়ের চরিত্র প্যাট্রিক বেটম্যানের মত মেয়ে দুটোর স্তন বেশ বড় হওয়াটা জরুরি ছিলো। আমি এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর দিকে নজর দিয়েছিলাম। তরুণী এভলিনকে দেখেই আমার মনে ধরে যায়। প্রথমবার তার সাথে মেলামেশা করার সময় বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হয়েছে। আমার পরিকল্পনা সফল করার জন্য এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। জোসাইনকে সাথে নিয়ে এভলিন যখন কবেভুয়ায় এলো, আমার আনন্দ দেখে কে। জোসাইনও আমার পরিকল্পনার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।

সেই রাতে আমি আচমকা আতঙ্ক অনুভব করছিলাম।

ওরা এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমি অন্যান্য কাজ গুছিয়ে নিয়েছিলাম। অনেক সাধনার পর জীবন শিল্পকে অনুসরণ করবে। শিল্প আর জীবন মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা আনন্দ করা শুরু করে দেই।

এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে যৌনতার উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠি আমরা, এই সময়টাতে আমি তাদের দিয়ে তাই করিয়েছি যা আমার পরিকল্পনার মাঝে ছিলো। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। এতোদিন ধরে অর্জন করা সমস্ত দক্ষতা আর ধৈর্যের পরীক্ষা শুরু হলো তখন। প্রথমেই আমি দাঁত দিয়ে কামড়ে এভলিনের ল্যাবিয়া ছিঁড়ে ফেলে, অমানুষিক চিৎকার বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে, ঠিক যেমনটা বইয়ে বলা ছিলো।

ওই রাতে আমি বিজয়ীর হাসি হেসেছি, ক্যামিল।

আমি সফলতার মুখ দেখেছি। আমার এই সফলতার পেছনে ওই দুই তরুণীর অবদান অনেক। ওইদিন আমি যখন ছুরি নিয়ে এভলিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন তার কান্না, নম্রতা যদি আপনাকে দেখাতে পারতাম! তাকে জীবন আর শিল্পের মাঝের যে অনবদ্য মিলন তা সরাসরি দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলাম। যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছি।

বইয়ে বর্ণিত প্রতিটি দৃশ্য আমি যথাযথভাবে উপস্থাপন করেছি। পুরো ঘটনাটা আমি ছোট্ট একটা ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করেছি। কিন্তু বইয়ে তা দেবার কথা কোথাও উল্লেখ নেই, তাই আপনাকে বঞ্চিত করতে হলো। আরেকটা দৃশ্যের কথা ভাবলে আপনার গা শিউরে উঠবে। করাত দিয়ে কাটা এভলিনের মাথা আমার হাতে নিয়ে ঘুরেছি সারারাত। এরপর খালি হাতেই মেয়েটার পেট চিড়ে ফেলি। দৃশ্যটা দেখার মত ছিল।

আমি কি কিছু বলতে ভুলে গেছি? আর কিছু জানার আছে? থাকলে আমার সাথে আবারো যোগাযোগ করতে পারেন।

–আপনার একান্ত অনুগত ভক্ত”

বিশেষ দ্রষ্টব্য : যদি আপনাকে এই কেসের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে আর কোন আশাই থাকবে না। তাদেরকে বলে দিয়েন আপনাকে ছাড়া কোনোভাবেই এই তদন্ত এগুবে না।

চিঠি পড়া শেষ করে দেশম বসে পড়লো। কিছুক্ষণ পর তা লা গুয়েনের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

“আমি আগের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছি, কম্যান্ড্যান্ট।”

“সত্যি?” বলল ক্যামিল।

“আমাকে কিছুটা সময় দিন। আমি অন্যান্য অফিসারদের সাথে কথা বলে নেই,” লা গুয়েনকে উদ্দেশ্য করে বলল দেশম।

“আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো তুমি আবারো ফিরবে। কিন্তু সেটা এতো তাড়াতাড়ি হবে তা কল্পনাও করিনি।”

অধ্যায় ৬৩

“প্রমোদভ্রমণ কেমন কাটলো?” একটু কটাক্ষ করে জিজ্ঞেস করলো আরম্যান্ড।

“খুব একটা সুখকর নয়। ভাল মন্দ মিলিয়েই ছিলো।”

প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের দিকে তাকালো আরম্যান্ড। আর একটা টান দেয়ার জো নেই তাই ফেলে দিলো।

“আমার কাছে কিছু খারাপ খবর আছে।”

“ওহ…”

করিডোর থেকে লুইসের কণ্ঠ শোনা গেলো।

“এটাই যেন শেষবারের মত হয়!” উচ্চস্বরে কাউকে বলছিলো সে।

ক্যামিল রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। লুইস কোনো কারণে ম্যালেভালের উপর ক্ষুব্ধ।

তাকে দেখে দুজনেই জবুথুবু হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। বসের আকস্মিক উপস্থিতিতে দুজনই বিব্রতবোধ করলো। কিছু না শোনার ভান করে চলে গেলো ক্যামিল।

“কাজ শুরু করো, লুইস, সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব একজায়গায় জড়ো করো।”

সবাই উপস্থিত হলে ক্যামিল তাদের মাঝে খুনির দেয়া চিঠি বণ্টন করলো।

“লা গুয়েন বেশ কয়েকজন অফিসার দিয়ে সাহায্য করবে বলে জানিয়েছে। আগামীকালকের মাঝেই তাদের এখানে চলে আসার কথা। এই মুহূর্তে লোকবল খুব দরকার।”

“ওহ,” চিঠি পড়া শেষ করে একমত পোষণ করলো আরম্যান্ড, লুইস আর ম্যালেভাল।

“খুনি তো বেশ খ্যাপাটে ধরণের,” বলল ম্যালেভাল।

“ড. ক্রেস্টকে আমি খুনির মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে বলেছি। তবে আমি তোমার সাথে একমত, খুনি আসলেই খ্যাপাটে। সামনে এগুনোর মত কিছু একটা তো পেলাম।”

“আমরা কিন্তু এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারবো না এটা খুনিই  দিয়েছে…মানে আমি বলতে চাইছি এখানে যা যা লেখা আছে তার বেশিরভাগই পত্রিকায় আছে।”

আশা করি কয়েক ঘন্টার মাঝেই আমরা কোটেটের মৃতদেহ খুঁজে পাবো। এরপর তোমার সব সন্দেহ দূর হবে।”

“চিঠিতে যা লেখা আছে তার বেশিরভাগই আমরা জানি। নতুন কিছু তো না,” পেছন থেকে বলল লুইস।

“আমিও একই জিনিস ভেবেছি। খুনি বেশ সতর্ক। এসব না ভেবে কাজের কথায় আসি। ওয়ালপেপার আমেরিকা থেকে আনা হয়েছে। আরম্যান্ড, আশা করি বুঝতে পেরেছ কী করতে হবে তোমার। খুনির ব্যবহৃত ক্যামেরাটা সম্পর্কে খোঁজ নাও।”

“আমার হাতে অফুরন্ত সময়,” উৎসাহের সাথে জবাব দিলো আরম্যান্ড।

“ওহ, ভাল কথা। আমি তো বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। চিঠিটা পোস্ট করা হয়েছে ক্যুবেভুয়া থেকে। লোকটার সাহস আছে।”

অধ্যায় ৬৪

কোটেটকে যেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে স্থানীয় পুলিশ তা ঘিরে ফেলেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই ফরেনসিকের লোকজন চলে এলো। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সেখানে চিরুনি অভিযান চললো।

রাত দশটার দিকে প্রায় অক্ষত লাশ খুঁজে পাওয়া গেলো।

গায়ে ফন স্যুট আর হলুদ রঙের শার্ট। মাথায় গুলির চিহ্ন স্পষ্ট। লাশ শনাক্ত করার জন্য কোটেটের স্ত্রীকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলো ক্যামিল।

অধ্যায় ৬৫

বুধবার, ১৬ই এপ্রিল

“আমার সহকর্মীদের যে কোনো একজন আপনার সাথে কথা বলবে, মিসেস কোটেট। কিন্তু তার আগে আপনার কাছে একটা প্রশ্ন আছে।”

হাসপাতালের মর্গের পাশে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন।

“আমি যতটুকু জানতে পেরেছি আপনার স্বামী গোয়েন্দা উপন্যাসের বেশ ভক্ত ছিলেন।”

“হ্যাঁ, টুকটাক পড়তো।”

 “এর বাইরে আপনি কিছু জানেন?”

“না। আসলে আমাদের কথাবার্তা খুব কম সময়ের জন্যেই হতো। যা সময় পেতাম একে অপরের পছন্দ নিয়ে জানার চেষ্টা করিনি কখনো।”

“শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি প্রশ্নটা করার জন্য…আপনার স্বামী কি মারধর করতেন? কখনো এমন করেছে?”

“আমার স্বামী সাহসি ছিলো না। একটু রগচটা স্বভাবের ছিলো, কিন্তু আমার গায়ে কখনো হাত তোলেনি।”

“আমি আসলে বলতে চাইছি… যৌন সম্পর্ক কেমন ছিলো আপনাদের?”

“সত্যি বলতে ও দ্রুতই ফুরিয়ে যেতো। যতদূর মনে পড়ে খামখেয়ালী ছিলো না ওর মাঝে, কল্পনাশক্তিও কম ছিলো। ওরালেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো তবে মাঝে মাঝে অ্যানাল করতে চাইতো। এরচেয়ে বেশি আর কী বলবো?”

“আপনি যথেষ্ট বলেছেন।”

“প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেটর।”

“ধন্যবাদ, মিসেস কোটেট। অনেক ধন্যবাদ।”

“আপনার সাথে কথা বলতে আমার বরাবরই ভাল লাগে।”

সাক্ষাৎকারের বাকি অংশের দায়িত্ব লুইসের কাছে ছেড়ে ছিলো ক্যামিল।

অধ্যায় ৬৬

লাঞ্চ করার জন্য লুইস আর লা গুয়েনকে দাওয়াত দিলো ক্যামিল। লুইসের পরনে নীল স্যুট, ডোরাকাটা শার্ট আর টাই। লুইসের এমন রূপে কিছুটা ঈশ্বানিত বোধ করলো লা গুয়েন।

“এখন আমাদের সামনে ভিক্টিম পাঁচজন, তিনটা বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে করা, বাকি দুজনকে এখনো পাওয়া যায়নি।”

“সাংবাদিক, তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট, মন্ত্রী, এদের কথা ভুলে গেলে চলবে না,” যোগ করলো লা গুয়েন।

“ঠিক বলেছেন।”

“গতকালকে শুধু লা মাটিনেই খবর ছাপা হয়েছিলো। কিন্তু আজকে সব পত্রিকায় ছড়িয়ে গিয়েছে। আশা করি তুমি দেখেছো-”

“আমি এই ধরণের পত্রিকা এড়িয়ে চলি।”

“এটাই তোমার ভুল। তুমি এভাবে এড়িয়ে চললে তো নভেলিস্ট কিছুদিনের মাঝেই থ্রি গনকোর জিতে যাবে। সকালে দেশমের সাথে কথা

হচ্ছিলো। তুমি শুনলে হাসবে।”

“বলুন শুনি।”

“আপাতত মন্ত্রীও কিছুটা অসুবিধা’র মাঝে আছে।”

“অসুবিধা? তাও আবার একজন মন্ত্রী? মজা করছেন!”

“মোটেও না, ক্যামিল। মন্ত্রী আসলেই ঝামেলায় পড়েছে। উপরের মহল থেকে তার উপর ক্রমাগত চাপ আসছে। এতে অবশ্য আমাদের লাভই হয়েছে। গতকাল অবধি যা অসম্ভব ছিলো আজকে তা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আজকে বিকালের মাঝেই তোমার যতজন অফিসার লাগবে সব পাবে।”

“আমি কি বাছাই করতে পারবো?”

“এতো বেশি আশা করো না। শেষে এটাও হারাবে।”

“আচ্ছা, তারপর?”

“বিকাল চারটার মাঝে আমি তিনজন অফিসার পাঠিয়ে দিবো।”

“মানে ছয়টা?”

“কাছাকাছিই হবে।”

উপস্থিত তিনজন হঠাৎ করে নিপ হয়ে গেলো।

“আপনার দেয়া বিজ্ঞাপনের কারণে আমরা বেশকিছু দূর এগুতে পেরেছি।”

“ঠিকই বলেছো কিছুদূর,” বলল ক্যামিল।

“খুনি আমাদের ঘোল খাওয়াচ্ছে,” এরইমাঝে বলে উঠলো লা গুয়েন।

“জেন, থামো। মিসেস কোটেট এমনটাই বলেছেন আজকে সকালে।”

“তার সম্পর্কে কী জানো?”

লুইসের দিকে তাকালো ক্যামিল।

“বুদ্ধিমতী মহিলা। বেশ ভাল বংশ থেকেই এসেছে। স্বামীর সাথে খুব বেশিদিন থাকেনি। স্বামীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তার ধারণা খুবই কম,” একনাগারে বলে চললল লুইস।

“তার স্বামীকে বোকা বানানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়,” বলল ক্যামিল।

“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। কোটেটের ছবি পরিচিত বেশ কয়েকজনকে দেখিয়েছে ম্যালেভাল। সবাই তাকে শনাক্ত করেছে।”

“এতোটুকু নিশ্চিত যে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছিলো।”

“আমাদের খুনি গোয়েন্দা উপন্যাসের অনুকরণে খুন করছে,” বলল লুইস।

“উপন্যাস থেকে,” লুইসকে থামিয়ে দিলো ক্যামিল। “আমাদের জানা খুনগুলো গোয়েন্দা উপন্যাস অনুকরণেই করা হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার ‘মাস্টারওয়ার্ক শেষ হয়ে গিয়েছে। কোনো এক মহিলাকে ট্রেনের নিচে ফেলে দিয়ে বলতে পারে এটা ‘আন্না কারেনিনা’ থেকে করেছে।”

আসলে তার মাথায় কী কাজ করে? এই বইগুলোই কেন বেছে নিলো? ট্রেম্বলে কেসের আগে এমন আর কতগুলো খুন করেছে সে?

“তোমার কী মনে হয়, ক্যামিল?” জিজ্ঞেস করলো লা গুয়েন।

“কোন বিষয়ে?”

“লুইস যা বলল…”

“কবকে লাগবে আমার।”

“এর সাথে কবের কী সম্পর্ক?”

“শোনো, জেন, তুমি কোন অফিসার দিবে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। কম্পিউটার সম্পর্কিত কাজের জন্য কবকে প্রয়োজন।”

ভাবার জন্য কিছু সময় নিলো লা গুয়েন।

চল্লিশে পা দিলেও সবার কাছে কিংবদন্তীতুল্য কৰ। সদ্য গঠিত ‘টেকনোলজি ক্রাইম ডিভিশনে’ যোগ দেয় সে। কম্পিউটার সম্পর্কিত কাজে তার নিপুণ দক্ষতার জন্য সবার কাছেই আলাদা সমাদর পায়।

“ঠিক আছে, আমি দেখছি। তো যাই হোক লুইসের সাথে তুমি একমত?”

“লুইস ঠিকই বলেছে। এটা তো সর্বজনস্বীকৃত।” লুইসের দিকে

তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল ক্যামিল।

অধ্যায় ৬৭

“এখানে আমরা যা নিয়েই কথা বলি তা গোপন থাকবে।”

“অবশ্যই,” বলল ফ্যাবিয়েন ব্যালাঞ্জার, তদন্ত কীভাবে পরিচালিত হয় তা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার।

“আমরা এখন চারটা খুন নিয়ে কাজ করছি।”

“শেষবার যখন কথা বলেছিলাম তখন তো সংখ্যাটা দুই ছিলো।”

“ঠিক তাই।”

“শুনতেই তো অনেক মনে হচ্ছে,” হাতের দিকে তাকিয়ে বলল ব্যালাঞ্জার।

প্রতিটি অপরাধের খুঁটিনাটি তাকে খুলে বলল ক্যামিল।

“এরমাঝে তিনটা খুন তিনটে বইয়ের অনুকরণে করা হয়েছে– আমেরিকান সাইকো, দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া এবং লেইডলো। নাম শুনেছেন নাকি?”

“হ্যাঁ, আমি তো সবগুলোই পড়েছি।”

“এদের মাঝে কি কোনো যোগসূত্র আছে?”

“তেমন তো মনে হচ্ছে না। একজন স্কটিশ, বাকি দুজন আমেরিকান লেখক। সবাই আলাদা আলাদা জনরায় কাজ করেছে। সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে তো লেইডলো আর আমেরিকান সাইকোর মাঝে আকাশ পাতাল তফাত। আমার ঠিক মনে পড়ছে না বইগুলো কবে প্রকাশিত হয়েছিলো?”

“আমার থিয়োরি যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে এদের মধ্যে কোনো না কোনো যোগসূত্র অবশ্যই আছে।”

“এমনও তো হতে পারে খুনির এই বইগুলো ভাল লাগে।”

ক্যামিল হাসি আটকে রাখতে পারলো না, একই অবস্থা ব্যালাঞ্জারেরও।

“আমি অবশ্য এমনটা ভাবিনি।”

“পড়ার ক্ষেত্রে পাঠক উদারমনস্ক হতেই পারে।”

“কিন্তু খুনিরা তেমন হয় না। তাদের কাজের পেছনে কোনো না কোনো যুক্তি অবশ্যই থাকে। যত খোঁড়া যুক্তিই হোক না সেটা।”

“তাহলে তো সমস্যা।”

“বলে ফেলুন।”

“প্রতি ক্ষেত্রে সে অসাধারন বই বাছাই করেছে।”

“বেশ, তার মানে রুচিবোধসম্পন্ন কাউকে খুঁজতে হবে,” হেসে হেসে বলল ক্যামিল।

“আপনাদের…আপনাদের খুনি…প্রচুর পড়াশোনা করে। বিশেষ করে এই জনরাতে সে রীতিমত বিশেষজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে।”

“খুনের ধরন দেখে তাই মনে হচ্ছে। খুনি ভয়াবহ ধরণের মস্তিষ্কবিকৃত একজন মানুষ। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায়; এমন আর কতদিন চলবে?”

“আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চাইছেন?”

“তার সবগুলো খুন সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। ভাগ্য সহায় হলে এর শেষও খুঁজে বের করতে পারবো। কিন্তু আমরা এটা জানি কোন উপন্যাস থেকে এই খুনগুলো শুরু হয়েছে এবং কোথায়। আর কখন।”

“আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি…” নিচুস্বরে বলল ব্যালাঞ্জার।

“গ্লাসগোর আগেও হয়তো আরো খুন করেছে সে। তার সময় এবং সুযোগ দুটোই অফুরন্ত। যতগুলো উপন্যাস আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি, আপনার কী মনে হয় এগুলো ক্লাসিক?”

“এগুলো বেশ পরিচিত। কিন্তু ক্লাসিক বলতে আমি রাজি নই।”

“যদি এমনটা হয়, তাহলে তো সমস্যা। কেননা যদি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই খুন করতো তাহলে ক্লাসিক বইগুলোই বেছে নিতো, তাই না?”

ব্যালাঞ্জারের কৌতূহল বেড়ে গেলো।

“আপনি ঠিকই বলেছেন।”

“এমন চিরায়ত বই আর কতগুলো আছে বলে মনে হয়?”

“আমি জানি না। লিস্ট তো অনেক বড় হবে। উম, এতো বড়ও হয়তো হবে না। গোয়েন্দা উপন্যাসে চিরায়ত বই বাছাই করার বিষয়টা তর্কসাপেক্ষ। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি বাছাই করার ক্ষেত্রে সামাজিক আর ঐতিহাসিক দিকেই প্রাধান্য দেয় পাঠক।”

ক্যামিল তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।

“সামাজিক বললাম কেননা পাঠক সেই বইটাকেই ‘মাস্টারপিস’ হিসেবে গ্রহণ করে যা সমালোচকের চোখে পড়ে। ঐতিহাসিক বলার করার হচ্ছে। ক্লাসিক বই যে সবসময় ‘মাস্টারপিস’ হবে তাও না। লিবারম্যানের ‘সিটি অফ ডেথ তার জীবনের সেরা কাজ কিন্তু তা ক্লাসিক বই হিসেবে গণ্য করা হয় না। উল্টোটা আবার খাটে আগাথা ক্রিস্টির ‘অ্যান্ড দেয়ার ওয়ার নান এবং ‘দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড এর ক্ষেত্রে। দুটো বই তার। জীবনের সেরা কাজ এবং একইসাথে চিরায়ত বইয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে।”

“আপনি আরেকটু বিষয়ভিত্তিক হলে ভাল হয়। সাহিত্যের ছাত্র হলে আপনার এই লেকচার আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, কিন্তু আমার কাঁধে এখন তিন তিনটা খুনের তদন্তের বোঝা ঝুলছে। এমন ‘মাস্টারপিস, ক্লাসিক বই যেটাই বলুন না কেননা, কতগুলো আছে?”

“প্রায় তিনশর কাছাকাছি হবে।”

“তিনশ? আপনি কি কোনো লিস্ট দিতে পারবেন? ওই বইগুলোর সারসংক্ষেপ কোথাও পাওয়া যাবে? তাহলে মিলিয়ে দেখতে সুবিধা হতো।”

“আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন?”

“কেননা আমার এমন কাউকে দরকার যে নির্ভুল তথ্য দিতে পারবে। আমাদের ক্রিমিনাল ব্রিগেডে এমন দক্ষ কাউকে আপনি আশা করতে পারেন না। অবশ্য এরমাঝে এক বইবিক্রেতার কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছি।”

“বুদ্ধি তো খারাপ না।”

“তা ঠিক, কিন্তু সে এতোটা…সাহায্য করতে ইচ্ছুক নয়। আমি বরং কাজটা এমন কাউকে দিতে চাচ্ছিলাম যে এই বিষয়ে খুব ভাল জানে।”

“আশা করি আমি পারবো। লিস্ট তৈরি করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।”

ক্যামিল এতে সম্মতি জানালো।

“কাজটা একা করা বেশ কষ্টসাধ্য। আমার কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে এর মাঝে জড়াতে পারি?”

“যা ভাল মনে করেন।”

অধ্যায় ৬৮

তদন্তের গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য সিনিয়র অফিসাররা প্রায়ই খেয়াল করেন কতজন লোক দেয়া হয়েছে তাদের কাজে। চাহিদামতো টিম পেয়ে গেছে ক্যামিল।

এরইমাঝে টেকনিশিয়ানরা কম্পিউটার লাগানোর কাজে নেমে গেছে। জাজ দেশম সকালে সাড়ে আটটার মিটিং এর জন্য ক্যামিলকে ডেকেছে।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে টিমের সব সদস্য একত্রিত হলো। চেয়ার কম থাকায় অনেকে বসার সুযোগ পেলো না। তাই দাঁড়িয়েই মিটিং শুরু হলো।

“পরিচয় পর্ব দিয়েই শুরু হোক। আমি কম্যান্ড্যান্ট ভেরহেভেন, ক্যামিল বলে ডাকতে পারো। লুইস সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করবে। কোন সূত্র খুঁজে পেলে সোজা তার কাছে চলে যাবে।”

সদ্য যোগ দেয়া চারজন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

“এই হচ্ছে ম্যালেভাল। তবে পুরো নাম জ ক্লদ, কিন্তু সবাই ম্যালেভাল বলেই ডাকে। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে সে। যে কোন কিছু ওকে বলবে।”

সবার দিকে তাকিয়ে উদ্ভটভাবে হাত নাড়লো সে।

“আর ওপাশে দেখতে পাচ্ছো আরম্যান্ডকে। আপাতত সে আর আমিই সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার। এমন হিসাবী অফিসার আর একজনও খুঁজে পাবে না। তদন্তের কাজ আটকে গেলে সোজা এর কাছে চলে আসবে। ওর মত মানুষ হয় না।”

এসব কথা শুনে আরম্যান্ড লজ্জা পেয়ে নিচে তাকালো।

“তো, যাই হোক নতুন যারা এসেছো…”

এই বলে পকেট থেকে কিছু কাগজপত্র বের করলো ক্যামিল।

“এলিজাবেথ…”

ট্রাউজার স্যুট পড়া পঞ্চাশোর্ধ্ব এই মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালো, চেহারায় সততার ছাপ সুস্পষ্ট।

“হাই, এখানে এসে ভালই লাগছে,” বলল সে।

কথা বলার ধরন দেখে সাথে সাথেই তাকে পছন্দ করলো ক্যামিল।

“স্বাগতম, এলিজাবেথ। এর আগে এই ধরণের কোনো কেসে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে?”

“আমি ‘ভার্সিনি কেসে কাজ করেছি।”

ক্রিমিনাল ব্রিগেডের প্রায় সকলেই ওই কেস সম্পর্কে জানে। কর্শিকান এক লোক অর দুই সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পালিয়ে যায়। আট সপ্তাহ পর পুলিশ তাকে খুঁজে পায় এবং সেখানে গোলাগুলির সময় মারা যায়। পত্রিকায় অনেকদিন যাবত এই কেস নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল।

“বেশ ভাল। আশা করি এই কেসেও সফল হতে পারবে।”

“সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”

“ফার্নান্ড?” লিস্টে থাকা পরবর্তি নাম ধরে ডাকলো ক্যামিল।

“এইতো আমি,” উচ্চস্বরে জবাব আসলো।

“আমার মনে হয় ওকে সকালের দিকের কাজে লাগানোটাই উত্তম হবে,” বলল লা গুয়েন।

“হ্যাঁ, তাই ভাল। তবে ক্রিমিনাল ব্রিগেড সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা নেই।”

“আশা করি দক্ষতার প্রমাণ দেবে এই কেসে। তুমি আরম্যাণ্ডের সাথে কাজ করবে।”

“লিস্টে সর্বশেষে থাকা নামটি হলো মেদি। তারমানে তুমিই মেদি। পঁচিশ বছর বয়সি টগবগে যুবক, পেটানো শরীর, টিশার্ট ভেদ করে। পেশিগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে। আইপডের হেডফোন গলায় ঝুলানো। প্রথম দেখাতেই কেন যেন ছেলেটাকে ভাল লেগে গেলো ক্যামিলের।

“আমি অষ্টম ব্রিগেডে কাজ করেছি কিছুদিন।”

“এই কেসের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তোমার কাজে লাগবে। তুমি ম্যালেভালের সাথে থাকবে।”

“আর এই হচ্ছে কব,” এই বলে হাতে থাকা কাগজ পকেটে চালান করে দিলো ক্যামিল। “একসাথে কাজ না করলেও আমরা একে অপরকে চিনি।”

ক্যামিলের দিকে তাকালো কব।

“আজকে থেকে একসাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে।”

“কব আমাদের টেকনিক্যাল দিকগুলো দেখবে।”

ভ্রূ নেড়ে সম্মতি জানালো কব।

“যদি আরো কিছু প্রয়োজন হয়, তাহলে ম্যালেভালকে বলবেন। ও সব ব্যবস্থা করে দিবে।”

অধ্যায় ৬৯

বৃহস্পতিবার, ১৭ই এপ্রিল

 “এখন অবধি আমরা এমন কিছু পাইনি যা আগের থিয়োরির বিপক্ষে যায়। আমরা এক ভয়াবহ নারীবিদ্বেষী খুনির বিরুদ্ধে লড়ছি।”

ঠিক সকাল সাড়ে আটটায় দেশমের উপস্থিতিতে মিটিং শুরু হলো। এদিকে ড. ক্রেস্ট ব্রিফকেস থেকে কাগজপত্র বের করে টেবিলের উপর রাখছে।

“কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন সন্দেহভাজন খুনির কাছ থেকে যে চিঠি পেয়েছেন তা নিয়ে আমি বেশ কয়েকদিন ধরে কাজ করছি। আমি যেমনটা ধারণা করেছিলাম তার সাথে অনেকটা মিলে গেছে। খুনি বেশ শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা আর অহংকারি। গোয়েন্দা উপন্যাস সম্পর্কে তার ভাল জানাশোনা আছে। সম্ভবত দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান কিংবা এই ধরণের কোন বিষয়ে তার ডিগ্রি আছে। তার এই দাম্ভিক আচরণের কারণ হচ্ছে নিজের অর্জিত জ্ঞান সে সবার মাঝে জাঁকজমকভাবে তুলে ধরতে চায়। এরপরেই আমার নজর কেড়েছে পুরো চিঠি জুড়ে তার আন্তরিকতা। সে চায় আপনি তার প্রশংসা করুন, কম্যান্ড্যান্ট। আপনাকে সে পছন্দ করে এবং ভালোমতো চেনে।”

“ব্যক্তিগতভাবে?”

“হতেও পারে। তবে আমার মনে হয় সে আপনাকে টিভিতে দেখেছে কিংবা পত্রিকায় পড়েছে।”

“শুনে ভাল লাগলো, এই বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ক্যামিল।

“আপনার ওই বিজ্ঞাপন বেশ কাজে দিয়েছে,” ক্যামিলকে উদ্দেশ্য করে বলল ড, ক্রেস্ট।

“সত্যিই?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি তার কাজ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন তাই সে সাড়া দিয়েছে। নিজেকে প্রকাশ করার এই ইচ্ছা অনেকদিন ধরেই ছিলো তার মাঝে কিন্তু উপযুক্ত সুযোগ পায়নি। আপনি সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে পরিস্থিতি খারাপ হতো যদি জানতে চাইতেন কী কারণে খুনগুলো করছে। আপনি এমনভাবে কথা আদায় করে নিয়েছেন সে ভেবেছে আপনি তা আগে থেকেই জানেন।”

“সত্যি বলতে আমি এমন কিছু ভেবে বলিনি,” মুচকি হেসে বলল ক্যামিল।

“হয়তো আপনি অবচেতন মনেই এমনটা ভেবেছেন। কিন্তু এখনো তার উদ্দেশ্য পরিস্কার নয়। তার প্রিয় লেখকদের সেরা কাজগুলো বাস্তবে রূপদান করে যাচ্ছে। তবে আমার মনে হয় নিজের প্রিয় লেখকদের পাশে ইতিহাস হয়ে থাকতে চায় সে।”

“কিন্তু কেন?” জিজ্ঞেস করলো এলিজাবেথ।

“এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন।”

“হতাশাগ্রস্থ কোনো লেখক?” এই বলে সবার দিকে তাকালো সে।

“এটা হতে পারে। আপাতত এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অনুমান বলে মনে হচ্ছে।”

“যদি সে হতাশাগ্রস্থ লেখক হয়েই থাকে তারমানে বেশ কিছু উপন্যাসও লিখেছে। আমরা প্রকাশক এবং বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে দেখতে পারি?” প্রস্তাব জানালো মেদি।

তরুণ অফিসারের এমন সাদাসিধে বক্তব্যে কেউ বিস্ময় প্রকাশ করলো না।

“ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হতাশাগ্রস্থ লেখক, মেদি। আর বাকি অর্ধেক হতাশাগ্রস্থ শিল্পী। প্যারিসে একশোরও বেশি প্রকাশক রয়েছে আর তাদের কাছে প্রতি বছর হাজারের বেশি পান্ডুলিপি জমা পড়ে। যদি বিগত পাঁচ বছরের তথ্যও নিতে চাই তাহলে…”

“আচ্ছা, আচ্ছা, আমি বুঝতে পেরেছি,” আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত তুললো মেদি।

“তার বয়স কেমন হতে পারে?” জিজ্ঞেস করলো এলিজাবেথ।

“চল্লিশ পঞ্চাশের মাঝামাঝি হবে।”

“সামাজিক অবস্থা?”

“মধ্যবিত্ত হবে বলে মনে হয়। নিজেকে চালাক প্রমাণ করার জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত সে।”

“ক্যুবেভুয়া থেকে চিঠি পাঠানোর মত?” বলল লুইস।

“ঠিক তাই! আমি এটাই বলতে চাচ্ছিলাম। সে অতিনাটকীয় কিছু করতে চায়। আর এটাই আমাদের কাজে লাগতে পারে। খুনি সতর্ক কিন্তু নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে যে কোনো সময় ভুল করে বসবে। বিখ্যাত হওয়ার একটা তীব্র বাসনা তার ভেতরে অনবরত কাজ করে। তার এমন বিরোধপূর্ণ মানসিকতার মূলে আছে এই তীব্র ইচ্ছা। অবশ্য এটাই শেষ নয়,” জবাব দিলো ড. ক্রেস্ট।

“মানে?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

“তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি না আমরা। কিন্তু একটা বিষয় আমি বুঝতে পারছি না। ম্যাকলাভ্যানির উপন্যাস অনুসরণে খুন করার জন্য গ্লাসগো কেন গেলো?”

“খুনটা ওখানেই হওয়ার কথা ছিলো! “ জবাব দিলো ক্যামিল।

“আমি সেটা ভেবেছি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমেরিকান সাইকোর অনুসরণে খুনটা আমেরিকার বদলে ক্যুবেভুয়ায় কেন?”

ক্যামিল মানতে বাধ্য হলো সে এমনটা ভেবে দেখেনি।

“একইভাবে ট্রেম্বলেতে যে খুন হয়েছে তা হওয়া উচিত ছিলো…”

“লস অ্যাঞ্জেলেসে,” ড, ক্রেস্টের কথাটা শেষ করলো লুইস।

“আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এখন এসব ভেবে লাভ নেই। আমাদের পরবর্তি বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাবতে হবে।”

“আমারও তাই মনে হয়। এটা নিয়ে ভেবেছি আমি। তার বিশ্বাস অর্জন করা খুব জরুরি। তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সব শেষ হয়ে যাবে। এতোদিনের পরিশ্রম ব্যর্থ হবে। তাকে এই বিশ্বাস দিতে হবে যে আপনি তাকে ভালোমতোই বোঝেন এবং সম্মান করেন। প্রয়োজন হলে তোষামদি করতে হবে।”

“কীভাবে করলে ভাল হয়?”

“ব্যক্তিগত কোন আক্রমণ করবেন না। কোনো একটা খুন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইতে পারেন। বাকিটা পরে দেখা যাবে।”

“ম্যাগাজিন তো আগামী সোমবার বের হবে। এতোদিন অপেক্ষা করা সম্ভব না।”

“একটা উপায় কিন্তু আছে। ওই ম্যাগাজিনের একটা ওয়েবসাইট আছে। আপনি চাইলে আজকেই অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, প্রথমাবের মত কিছু বলল কব।

এরইমাঝে মিটিং শেষ হলো। ড. ক্রেস্টের সাথে বসে বিজ্ঞাপনে কী লেখা যায় তা নিয়ে আলোচনা করলো ক্যামিল। শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো শুধু তিনটা শব্দ থাকবে : ‘তোমার ব্ল্যাক ডালিয়া?’ প্রথমটার মত এটারও শেষে ক্যামিল তার সাক্ষর দিলো ‘সি.ভি’। কব নিজের কাজে নেমে গেলো।

অধ্যায় ৭০

ফ্যাবিয়েন ব্যালাঞ্জারের দেয়া লিস্টে একশ বিশ জনের নাম রয়েছে। এরসাথে প্রতিটি বইয়ের সারসংক্ষেপও জুড়ে দেয়া আছে। গোয়েন্দা উপন্যাস নিয়ে গবেষণা করার জন্য আদর্শ হবে ব্যালাঞ্জারের দেয়া কাগজপত্র। কিন্তু তদন্তের ক্ষেত্রে এগুলো কোনো কাজেই আসবে না। তবুও কৌতূহলবশত একবার তাতে চোখ বুলালো ক্যামিল। এরমাঝে ছয়টা তার পড়া আছে আর আটটার কেবল নাম শুনেছে।

“এরমাঝে কয়টার নাম শুনেছো তুমি?” লুইসকে জিজ্ঞেস করলো।

“সঠিক জানি না। ত্রিশটার মত হবে…”

ব্যালাঞ্জারকে ফোন দিয়ে ধন্যবাদ জানালো ক্যামিল।

“বইগুলোর সারসংক্ষেপ নিয়ে আমার ছাত্রছাত্রীরা আরো কাজ করছে। ওরা একদম এরমাঝে ডুবে গেছে।”

“এ তো অনেক কাজ, প্রফেসর ব্যালাঞ্জার।”

“সমস্যা নেই, এমনিতেও ওদের কোন কাজ নেই।”

“আমি আসলে লিস্টের কথা বলছিলাম। একশ বিশটা বই নিয়ে আলাদা ভাবে কাজ করা সম্ভব না।”

“কতগুলো পারবেন?”

“সত্যি বলতে আমার কোন ধারণা নেই, প্রফেসর ব্যালাঞ্জার।”

“তাহলে আপনি কীভাবে আশা করেন আমি একা খুনিকে বের করতে পারবো?”

“ধরে নিচ্ছি খুনি তার পছন্দমত বই বাছাই করছে। খুনি যেনতেন কেউ না, এই বিষয় সম্পর্কে তার জ্ঞানের পরিধি বেশ বিস্তৃত। তাই তার লিস্টে দুই একটা ক্লাসিক বই থাকবে না এমনটা হতে পারে না। এই বইগুলোই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন।”

“তাহলে আমি একটা নতুন লিস্ট তৈরি করবো।”

ক্যামিল ধন্যবাদ জানানোর আগেই ব্যালাঞ্জার ফোন রেখে দিলো।

অধ্যায় ৭১

শুক্রবার, ১৮ই এপ্রিল

আরম্যান্ড আর ফার্নান্ডের মাঝে গলায় গলায় ভাব হলো খুব শিগগির। দুই ঘণ্টার মাঝেই তারা পুরনো বিবাহিত দম্পত্তির মত আচরণ শুরু করলো। আরম্যান্ড এরইমাঝে তার নতুন সহকর্মীর কাছে থেকে, পত্রিকা, কলম এমনকি নোটপ্যাডও ধার করেছে। এর বদলে ফার্নান্ডের অনুপস্থিতি দেখেও না দেখার ভান করে সে। লুইসের নির্দেশ অনুসারে তারা দুজন এখন ওয়ালপেপার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের নাম খোঁজা বাদ দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের দিকে নজর দিলো, খুনি যেখানে খুনের আগে ঘুরে থাকতে পারে। মেদি ক্যুবেভুয়ার পোস্ট অফিসে চলে গেছে খুনি সম্পর্কে কোনো তথ্য যদি পাওয়া যায় এই আশায়। ম্যালেভাল সাম্প্রতিক সময়ে কেনা মিনোক্স ক্যামেরা নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এরমাঝে লুইস ‘টস ব্ল্যানচেস’ ম্যাগাজিনের অফিসে চলে গেলো তাদের গ্রাহক লিস্ট সংগ্রহ করতে।

সকাল সকাল ক্যামিলের সামনে হাজির হলো প্রফেসর ব্যালাঞ্জার। “আপনার এতো ঝামেলা না পোহালেও চলবে…” বলল ক্যামিল। “আমি আরেকটা লিস্ট তৈরি করেছি।”

“অনেক ধন্যবাদ,” এই বলে ব্যালাঞ্জারের আনা কাগজপত্র হাতে নিলো ক্যামিল। লিস্টে এখন একান্নটা বই, ঠিক পাশেই প্রতিটি বইয়ের সারসংক্ষেপ দেয়া আছে।

“আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই,” হাসিমুখে বলল ক্যামিল।

“আমার নোটগুলো আরেকটু বাড়িয়ে দিবো?”

“দরকার নেই। সারসংক্ষেপ একদম পরিস্কার আমার কাছে।”

“তবুও…”

“আপনি যথেষ্ট করেছেন আমাদের জন্য। চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।”

“ঠিক আছে, আপনি যা ভাল মনে করেন।”

“ভাল থাকবেন।” ব্যালাঞ্জার বের হওয়ার সাথে সাথে কবের দিকে ছুটে গেলো ক্যামিল।

“এখানে কয়েকটা ক্লাসিক গোয়েন্দা উপন্যাসের নাম আছে।”

“তাহলে আমি…”

“বইগুলোতে বর্ণিত অপরাধের সারাংশ খুঁজে বের করে কোনো কেসের সাথে মিলে কিনা তা দেখতে হবে আমাদের।”

“আমাদের?”

“মানে আপনার,” কষ্ট করে হাসি চেপে রাখলো ক্যামিল।

হুট করে চিন্তার মাঝে ডুবে গেলো সে।

“আপনাকে আরো কিছু কাজ দিতে চাচ্ছি।”

“ক্যামিল, এই কাজ শেষ করতে কয়েক ঘন্টা লেগে যাবে।”

“হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু আপনাকে করতেই হবে। কিছু ব্যাপারে আমার সন্দেহ জাগছে।”

অসাধ্য সাধন করার আলাদা সুনাম আছে কবের।

“পুরনো কাসুন্দি ঘেটে দেখতে হবে।”

“বুঝলাম না।”।

“আগের কেসগুলোর যৌক্তিক অসংগতি, অস্পষ্ট বর্ণনা, ঘটনাস্থলে পাওয়া প্রমাণাদি যা ওই কেসের সাথে সম্পর্কহীন মনে হয়েছে। কিছু নমুনা একদম দুর্বোধ্য লেগেছে। মোট কথা যাবতীয় অসংগতি ঘেটে দেখতে হবে। খুনি তার ইচ্ছামত বই বাছাই করে খুন করছে, আমাদের লিস্টে ওই বইয়ের নাম থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই এই পদ্ধতিতে খুঁজতে চাচ্ছি আমি।”

“এমন কোন অ্যালগরিদম আমার কাছে আপাতত নেই।”

“আমি জানি। কিন্তু এটাও জানি আপনি চাইলেই পারবেন।”

“আর কিছু?”

“ধরুন গত পাঁচ বছরে ফ্রান্স শহরে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ড। “ঠিক আছে।”

“কত সময় লাগবে?”

“এখনি বলতে পারছি না। আগে অ্যালগরিদম লিখতে হবে।”

অধ্যায় ৭২

“শুরু থেকেই তার উপর সন্দেহ ছিলো তোমার,” হেসে বলল ক্যামিল।

“না, ঠিক তেমন না। কিন্তু এমন তো আগেও হয়েছে, খুন করে স্বেচ্ছায় এসে পুলিশকে সাহায্য করে।”

“আগেও বলেছো তুমি।”

“হ্যাঁ, কিন্তু এরপর আরো কিছু জিনিস আমার চোখে পড়েছে।”

“শুনছি, তুমি বলো।”

নোটবুক মেলে ধরলো লুইস।

“জেরোমে লেসাজ, বয়স ৪২, অবিবাহিত। উত্তরাধিকার সূত্রে বইয়ের দোকানটা বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। বাবা মারা গেছে ১৯৮৪ সালে। সোরবোন্নে সাহিত্য নিয়ে পড়েছে। ফলাফলও বেশ ভাল ছিলো। পরিবার বলতে শুধু এক বোন, ক্রিস্টিন, তার বয়স ৪০। দুজন একসাথে থাকে।

“মজা করছে।”

“দোকানের উপরেই থাকে দুজন। বাসাটাও উত্তরাধিকার সূত্র পাওয়া। ১৯৮৫ সালের ১১ই এপ্রিল অ্যালেইন ফ্রোসার সাথে বিয়ে হয় ক্রিস্টিন লেসাজের।”

“এতো কিছু খুঁজে বের করেছো?”

“আমি যা বলছি তার সবই সংগতিপূর্ণ। দশদিন পর সড়ক দূর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যায়, কিন্তু রেখে যায় অঢেল সম্পত্তি। ফ্রান্সের উত্তরাংশে বিশাল এক ফ্যাক্টরি ছিলো ফ্রোসার। সবকিছুর একমাত্র উত্তরাধিকার ছিলো সে। তাই তার মৃত্যুর পর সবকিছুর মালিক হয় ক্রিস্টিন। একই বছরে তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯৮৮ সালে প্যারিসে ফিরে এসে তার ভাইয়ের সাথে থাকা শুরু করে। এরপর থেকে সেখানেই থাকে।”

“এখন দেখুন আমাদের খুনিকে অবশ্যই স্বচ্ছল হতে হবে। লেসাজের হাতেও টাকার অভাব নেই। এরপর আসি সময় বিষয়ক আলোচনায়। ২০০১ সালের ১০ই জুলাই গ্লাসগোতে খুন হয় গ্রেস হবসন। জুলাই মাসের পুরোটা সময় লেসাজের দোকান বন্ধ ছিলো কারণ ভাইবোন মিলে ছুটি কাটাতে লন্ডন গিয়েছিলো। ওখানে তার এক বন্ধু থাকে আর প্রায় এক সপ্তাহ ছিলো তার সাথেই। আর লন্ডন থেকে গ্লাসগো যেতে কত সময় লাগে? বিমানে গেলে এক ঘণ্টা সময় লাগে।”

“একটু বেশি চিন্তা করে ফেললে না?”

“হয়তো, কিন্তু এটা সম্ভব। ২০০১ সালের ২১শে নভেম্বর ম্যানুয়েলা কন্সটানজা খুন হয় প্যারিসে। লেসাজের পক্ষে এই খুন করা সম্ভব, তার কোনো অ্যালিবাই নেই। এমনকি ক্যুবেভুয়া হত্যাকাণ্ডের সময়েও সে তা দেখাতে পারবে না। ক্যুবেভুয়া থেকে ট্রেলেতে গাড়িতে যেতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। মানে তার সুযোগ ছিলো।”

“তাহলে সবকিছু একদম পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সাজাতে হবে।”

“তিনটার মাঝে দুইটা বইয়ের খোঁজ সে দিয়েছে। প্রথমক্ষেত্রেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। সংবাদমাধ্যমে তথ্য ফাঁসের উদ্দেশ্যও জানতে পারিনি। যদি সে খুনি হয় তাহলে এটা তার করার কথা কেননা এরচেয়ে সহজে প্রচার পাওয়া সম্ভব না।”

“হতে পারে।”

‘ন্যুটস ব্ল্যানচেস’ এর গ্রাহক লিস্টেও তার নাম আছে,” এই বলে পকেট থেকে লিস্ট বের করে ক্যামিলকে দেখালো।

“ওহ, ইস! খোঁজ নিয়ে দেখো প্রায় সব ম্যাগাজিনের গ্রাহক লিস্টে তার নাম আছে। আরো অনেক বইয়ের দোকানের নাম পাবে সেখানে। অনেক ধরণের লোকের নাম পাবে–বইবিক্রেতা, সাংবাদিক। আমার বাবার নামও খুঁজে পেতে পারো….

আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে হাত তুললো লুইস।

“ঠিক আছে। তুমিই বলো কী করা যায়?”

“তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। যাবতীয় আয় ব্যয়ের হিসাব খতিয়ে দেখতে হবে। প্রতিটি খুন করার জন্য অনেক টাকা লেগেছে।”

কিছুক্ষণ চিন্তা করলো ক্যামিল।

“দেশমকে একটা ফোন দাও।”

অধ্যায় ৭৩

শনিবার, ১৯শে এপ্রিল

হেলেদুলে এগিয়ে আসছে আইরিন, স্ত্রীর মুখ আরো গোলাকার হওয়ায় কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেলো ক্যামিল। স্ত্রীকে কাছে পেয়েই গালে প্রগাঢ়

একটা চুমু বসিয়ে দিলো। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো আইরিন।

“ছুটির দিনগুলো কেমন কাটলো?”

“তোমাকে তো আগেই বলেছি।”

ট্যাক্সিতে চড়ে বসল দুজন। বাসায় আসার সাথে সাথেই সোফায় গা এলিয়ে দিলো আইরিন।

“কিছু লাগবে তোমার?”

“চা হলে মন্দ হয় না।” কীভাবে সময় কেটেছে বলতে শুরু করলো আইরিন।

“বাবা একটার পর একটা বিষয় নিয়ে কথা বলেছে। সারাটা দিন কথা শুনেই পার করতে হয়েছে।”

“ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো নাকি?”

“মোটেও না।”

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলো আইরিন। খুনির পাঠানো চিঠির একটা কপি স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে নিচে গেলো।

“তুমি কি রাতে খাবে না?” জিজ্ঞেস করলো আইরিন।

“মনে হয় না…” বলল ক্যামিল, মুখটা পাংশুটে হয়ে আছে তার। হাতে নতুন চিঠি, এখনো ভালা হয়নি।

প্রিয় কম্যান্ড্যান্ট,

আমার কাজ আপনি এতো গুরুত্ব সহকারে দেখছেন, এতে আমি সম্মানিত বোধ করছি।

আমি জানি আপনি এবং আপনার টিমের সব সদস্য আমাকে খুঁজে বের করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এসব করতে করতে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। যদি সম্ভব হতো তাহলে আপনার কাজ আরো সহজ করে দিতাম। কিন্তু আমারও তো একটা উদ্দেশ্য আছে। আশা করি আপনি তা জানেন।

তো যাই হোক মূল কথায় ফিরে আসি। আপনি দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।

এটা একটা অসাধারণ বই, তাই না? আপনার কী মনে হয়? আমার ডালিয়াকে খুঁজে পেতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। রাস্তায় প্রথম যখন ওই বেশ্যাকে দেখলাম সাথে সাথে আমার মনে হয়েছে এলরয়ের উপন্যাসের জন্য উপযুক্ত সে। শরীর একদম ঠিকঠাক ছিলো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এলরয় তার উপন্যাসে জীবিত মানুষের চেয়ে মৃতের উপর বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় আমি উপযুক্ত মেয়ে খুঁজেছি। হুট করেই এর দেখা পেয়ে যাই। তার হাসিটাই আমার মন কেড়ে নেয়। স্বচ্ছ জামা পড়ায় ভেতরের সব দেখা যাচ্ছিলো। দরদাম করে তাকে হোটলে নিয়ে যাই। কিন্তু পরিবেশ এতোটাই নোংরা ছিলো যে ওখানে বসার রুচি হয়নি আমার। তাই যা করার দাঁড়িয়েই করেছি।

এরপরই আমি পরিকল্পনা সাজিয়ে নেই। বিশ্বাস অর্জনের জন্য আরো কয়েকবার তার কাছে ছুটে যাই।

কিন্তু আমি বারবার একই জায়গা তো দূরের কথা একই সময়েও তার কাছে যায়নি। ওর কোন সহকর্মী তাহলে আমাকে চিনে ফেলতো।

প্রতিবার কাজ শেষ হওয়ার পর আমি তাকে নতুন জায়গায় যাওয়ার প্রস্তাব দিতাম। এরজন্য অবশ্য টাকা বেশি চাইতো। একটা সময় তো এতো টাকা চেয়ে বসলো আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। একবার ভাবলাম একে ছেড়ে দেই, কিন্তু এতোদিন ধরে সাজানো পরিকল্পনা সামান্য কয়টা টাকার জন্য ভন্ডুল করলাম না। এরইমাঝে তার মধ্যে বেলি শর্টকে কল্পনা করে ফেলেছি। ওই চরিত্রে তাকে এতোটাই মানিয়ে গিয়েছিলো যে আর ছাড়তে ইচ্ছা করলো না। এরপর দেখা হয় গরিলা ল্যাম্বার্টের সাথে। দেখার মত একটা চরিত্র! আমি জানি না তাকে কখনো দেখেছেন কিনা-ওহ, সে তো আর জীবিত নেই। পরে ওর ব্যাপারে কথা বলবো। উপন্যাস থেকে উঠে আসা একটা চরিত্র। আমাকে সবসময় অবজ্ঞার চোখে দেখতো, আমি কোনো প্রতিবাদ জানাইনি। বেশ্যার দালালের কাছ থেকে এরচেয়ে ভাল ব্যবহার আশা করাটা বোকামি। যাই হোক, মূল কথায় আসি আমি তাকে বললাম যে ম্যানুয়েলাকে আমার এক রাতের জন্য দরকার। কোথায় থাকবো, কতক্ষণ থাকবো এমন হাজারো প্রশ্ন করলো। একটা ভুয়া ঠিকানা দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করলাম।

সবকিছু আগে থেকেই তৈরি করা ছিলো। রুমে ঢোকার সাথে সাথেই আমি ওর মাথার পেছনে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করি। তীব্র চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যায় ম্যানুয়েলা। এরপর তাকে সেলারে নিয়ে আসি।

দুই ঘন্টা পর নিজেকে নগ্ন অবস্থায় চেয়ারে আবিষ্কার করে সে। ভয়ে রীতিমত কাঁপছিলো। আমার পুরো পরিকল্পনা খুলে বললাম তাকে। প্রথম কয়েক ঘণ্টা মুক্ত হবার সবাত্মক চেষ্টা চালালো। চিৎকার করার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো কেননা মুখ টেপ দিয়ে মোড়ানো ছিলো। প্রথমে বেসবল ব্যাট দিয়ে দুটো পা ভেঙ্গে দেই। বাকি কাজ খুব ধীরস্থিরভাবেই করেছি। হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর আগানোর চেষ্টাও চালিয়েছে সে। অবশ্য এতে আমারই সুবিধা হয়েছে। এরপর বইয়ের বর্ণনা অনুসরণ করে তার স্তনে সিগারেটের পোড়া দাগ বসিয়ে দেই। সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিলো হাসিটা বানানো। আমি এইক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ভুলও সহ্য করতে পারতাম না।

আপনি তো জানেন, ক্যামিল, আমার কাজে কোন খুঁত থাকে না। কানের একটু নিচে ব্লেড ঢুকিয়ে দেই। ভারসাম্য রক্ষার জন্য চুলের মুঠি ধরে মুখের একদম কোণা অবধি একটানে কেটে ফেলি। দ্বিতীয় অংশটা করার সময় আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করেছি।

ম্যানুয়েলা মারা যাওয়ার সাথে সাথে বাকি অংশের কাজ শুরু করি। কসাইয়ের ছুরি দিয়ে অন্য কাজে নেমে পড়ি। মানবদেহ সম্পর্কে আমার জানাশোনা অনেক কম ছিলো তাই মেডিকেলের বই নিয়েও কিছুদিন পড়াশোনা করেছি যাতে করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চিনতে পারি। ক্ষুদ্রান্ত, পাকস্থলী, লিভার সবই ছিলো। কিন্তু আপনি কি গল-ব্লাডার খুঁজে পেয়েছিলেন?

চুলগুলো খুব যত্ন করে ধুয়েছি। বাসায় পানির ব্যবস্থা ছিলো না। কিন্তু পাশের বাড়ির বাগানে একটা পানি ভর্তি ড্রম পড়ে ছিলো যা দিয়ে আমার কাজ হয়ে গেছে।

সকাল হতে শুরু করায় কাজ থামিয়ে দেই। খুব ক্লান্ত লাগছিলো তাই বাসায় ফিরে আসি। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই আবার কাজে নেমে পড়ি।

পুরো কাজটাতে আমার শুধুমাত্র একটাই ভুল হয়েছিলো। বাসায় ফেরার পর লক্ষ্য করি একটা মোটর সাইকেল আমার পিছু পিছু চলে এসেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝতে পারি আমি ফাঁদে পড়ে গেছি। ম্যানুয়েলার দালাল আমার পেছন পেছন বাসা অবধি চলে এসেছে। গরিলা ল্যাম্বার্ট জেনে গেলে আমি কোথায় থাকি। সাথে সাথে আমি প্যারিস ছেড়ে অন্য শহরে চলে যাই। পরেরদিন পত্রিকায় একটা খবর পড়ে আমার আত্মায় পানি ফিরে আসে। ডাকাতির জন্য ল্যাম্বার্টের আট মাসের জেল হয়। এরপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। তার জন্য নতুন পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করি আমি। প্যারোলে মুক্তি পেয়ে আমার কাছে চলে আসে গরিলা। শর্টগান দিয়ে হত্যা করে পুঁতে ফেলতে বেশি সময় লাগেনি। আশা করি ওর লাশ খোঁজার কোন তাড়া নেই…

দেখতেই পাচ্ছেন নিজের কাজের প্রতি কতোটা যত্নশীল আমি।

‘আপনার একান্ত অনুগত ভক্ত।’

অধ্যায় ৭৪

সোমবার, ২১শে এপ্রিল

লা মাটিন

গোপনে গোপনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে
‘নভেলিস্ট’র সাথে পুলিশের যোগাযোগ

‘নভেলিস্ট’র কেস দিনে দিনে আরো রহস্যময় হয়ে উঠছে। পুলিশ এরইমাঝে চারজনের লাশ উদ্ধার করেছে যাদের সবাই ‘নভেলিস্ট’র শিকার। খুনির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা না গেলেও, খুনগুলো যে বই থেকে করা হয়েছে তা শনাক্ত করা হয়েছে। খুনিকে ধরার জন্য এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেছে ক্রিমিনাল ব্রিগেড। কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন, যিনি এই কেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার, ইতিমধ্যেই খুনির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। বিজ্ঞাপনটা ছিলো এমন : ‘we.B.B কেস সম্পর্কে কিছু বলো’। যা দ্বারা মূলত ব্রেট এস্টন এলিসকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আমেরিকান সাইকো তারই লেখা বই। এটা সেই বই যা অনুসরণে ক্যুবেভুয়ায় দুইটা খুন হয়েছে। বিজ্ঞাপনটা গত সোমবার টস ব্ল্যানচেসে দেয়া হয়। খুনি আদৌ ওই বিজ্ঞাপন দেখেছে কিনা তা জানা যায়নি, তবে এটা খুবই অস্বাভাবিক একটা পদক্ষেপ। কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন এসব নিয়ে মাথা ঘামান না তাই দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনও দিয়ে দিয়েছেন : ‘তোমার ব্ল্যাক ডালিয়া?

আমরা এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

বাকিটুকু পড়ার রুচি হলো না ক্যামিলের। পত্রিকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

“লুইস, এখনি ধরে নিয়ে আসো ওকে,” চিৎকার করে বলল ক্যামিল।

“কাকে?”

“নরকের কীট বুসনকে। এখনি খুঁজে বের করে ঘাড় ধরে নিয়ে আসবে আমার কাছে।”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো লুইস। আরম্যান্ড দৃশ্যপটে হাজির হলো।

“আমার মনে হয় কাজটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না।”

“বোকামি?” হাতের সামনে যা পেলো তাই ছুঁড়ে মারতে শুরু করলো ক্যামিল।

“আপনি শান্ত হোন।”

“আমি আর সহ্য করতে পারছি না, আরম্যান্ড। এভাবে বসে থেকে কোন লাভ নেই। সাংবাদিকতা পেশার কোনো নীতি নৈতিকতা নেই? এরকম আর চলতে দেয়া যাবে না। একটা করে খবর প্রকাশ করবে আর আমরা মাথা খুটে মরবো। লুইস, এখনি যাও।”

“প্রথমে আমার…”

“তোমাকে কিছুই করতে হবে না। শুধু ওকে ধরে নিয়ে আসো। যদি মানা করে তাহলে ক্রিমিনাল ব্রিগেডের সব অফিসার পাঠাবো আমি।”

মানা করেও কোনো লাভ হবে না বুঝতে পারলো লুইস। এরইমাঝে মেদি ফোন নিয়ে আসলো ক্যামিলের সামনে “বস, লা মন্ডে থেকে একজন সাংবাদিক ফোন করেছে…”

“নিজের চরকায় তেল দিতে বলল ওকে। আর তুমি যদি আরেকবার আমাকে বস বলে ডাকো তাহলে তুমিও একই কাজ করতে পারো।”

অধ্যায় ৭৫

ক্যামিল উত্তেজিত হলেও পুরো বিষয়টা লুইস ঠাণ্ডা মাথায় সমাধান করলো। বুসনকে বলল কিছু ব্যাপারে কথা বলার জন্য কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এ প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করলো সে। বুসনকে রুমে ঢুকতে দেখেই ক্যামিলের মাথায় রক্ত উঠে গেলো।

“আপনি আসলেই একটা আবাল, বুসন,” বলল সে।

“আমার মনে হয় আপনি সাংবাদিক’ বলতে যেয়ে ভুলে আবাল বলে ফেলেছেন।”

“আপনি এসব তথ্য কোথায় পাচ্ছেন তা আমার জানা দরকার।”

“ওহ, কম্যান্ড্যান্ট, এসব খেলার সময় এবং বয়স কোনোটাই আমাদের নেই। আমার সোর্সের তথ্য জানতে চাইছেন, আপনি তো ভালোমতো…”

“এমন কিছু তথ্য আপনি প্রকাশ করেছেন যা তদন্তের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করছে।”

“আমি এক্ষেত্রে কী করতে পারি?”

“আমি চাইলেই আপনাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি। এতে খুব বেশি সময় লাগবে না।”

“আপনার পালকে আরেকটা কলঙ্ক যুক্ত হবে, কম্যান্ড্যান্ট। আপনি কি আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাঁধা দিতে চাইছেন?”

“আমার সাথে এসব আইন কপচাতে আসবেন না, বুসন।”

“আপনি আসলে কী করতে চাইছেন? প্যারিসের সকল সাংবাদিককে গ্রেফতার করবেন?”

কিছুক্ষণ বুসনের দিকে তাকিয়ে তার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করলো ক্যামিল।

“আপনি এমন কেন করছেন, বুসন? আপনি নিজেও জানেন এই কেস কতটা জটিল। তার উপর আপনার একেকটা রিপোর্ট কেসটাকে আরো জটিল করে তুলছে।”

“আপনার সাথে চুক্তিতে যেতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু আপনি তখন রাজি হননি। আর এখন…”

“কক্ষনো না। সাংবাদিকের সাথে পুলিশের কোন চুক্তি হতে পারে না।”

“আপনি হয়তো খুব দায়িত্বশীল অফিসার, কম্যান্ড্যান্ট, কিন্তু কর্মতৎপর নন।”

“এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ, মঁসিয়ে বুসন।”

“আসতে পেরে আমারও ভাল লেগেছে।”

বিকাল চারটার দিকে খবর পাওয়া গেলো লা মন্ডে পত্রিকায়ও একই আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। স্ত্রীর খবর নেয়ার জন্য বাসায় ফোন দিয়ে জানতে পারলো রেডিওতে একই খবর প্রচার হচ্ছে। দেশম এখনো ফোন করেনি যা মোটেও শুভ লক্ষণ নয়।

“ক্যামিল, আপনার একটু সময় হবে?” হুট করে উদয় হলো কব।

অধ্যায় ৭৬

“ব্যালাঞ্জারের লিস্ট থেকে প্রাথমিকভাবে এই ফলাফল পেয়েছি।”

ব্যালাঞ্জারের লিস্ট থেকে বইগুলোর সারসংক্ষেপ নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে কর। গত দশ বছরে বন্ধ হয়ে যাওয়া কেসগুলোর সাথেও মিলিয়ে দেখেছে। প্রাথমিক ধাপে পাঁচটা বইয়ের নাম এসেছে যা কেসের সাথে মিলে যায়।

চশমাটা খুলে রেখে পড়তে শুরু করলো ক্যামিল।

*

>> জুন ১৯৯৪-পেরিগ্নি-কৃষক পরিবার খুন (পিতা মাতা আর দুই সন্তান)–সম্ভাব্য বই : ‘ইন কোল্ড ব্লাড ট্রুম্যান কাঁপোট।

>>অক্টোবর ১৯৯৬-টুলুজ-বিয়ের দিন গুলি করে হত্যা করা হয় এক যুবককে-সম্ভাব্য বই : ‘দ্য ব্রাইড ওর ব্ল্যাক’-উইলিয়াম আইরিস।

>>জুলাই ২০০০-করবেল-নদী থেকে নারীর মৃতদেহ উদ্ধার সম্ভাব্য বই : ‘লা ক্রাইম ডি’অরকিভাল’-এমিল গ্যাবোরি।

>> ফেব্রুয়ারি ২০০১-প্যারিস-গ্রেফতারের সময় পুলিশ অফিসার খুন-সম্ভাব্য বই : ‘লিটল সিজার’ রিলে বার্নেট।

>> সেপ্টেম্বর ২০০১-প্যারিস-নিজ গাড়িতে আত্মহত্যা করে পুলিশ অফিসার-সম্ভাব্য বই : দ্য পোয়েট-মাইকেল কনেলি।

*

“দ্বিতীয়বার খোঁজ করে এইগুলোই পেয়েছি আমি। আপনার যৌক্তিক অসংগতি’ খুঁজে বের করতে বারোটা বেজে গেছে আমার।”

কিছুক্ষণ পরে একটা কাগজ প্রিন্ট হয়ে বের হলো। সাইত্রিশটা কেসের লিস্ট আছে সেখানে।

“কিছু খুন একদম মুহূর্তের মাঝেই হয়েছে, কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিলো না। তা বাদ দিলে থাকে পঁচিশটা। এরইমাঝে সাতটা কেসের খুনি একের অধিক। বাকি আঠারোটায় মাঝে আরো নয়টা বাদ দিতে পারি কেননা সবগুলোর পেছনে বিশেষ কারণ ছিলো। কারো ক্ষেত্রে সেটা অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক কিংবা সামাজিক। তারমানে আমাদের হাতে রইলো মাত্র নয়টা।”

“বেশ ভাল কাজ করেছেন।”

“এই যে লিস্ট।”

“আর কোনো কিছু আপনার নজর কেড়েছে?”

“বুঝলাম না।”

“না বোঝার কী আছে?”

“আসলে আমি কোন যৌক্তিক অসংগতি’ পাইনি এই কেসগুলোতে। অনেক জিনিসই অজানা আছে কিন্তু কোনটাতেই উদ্ভট সূত্র কিংবা এমন কিছু ছিল না যা আপনি খুঁজছেন।”

“সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। তোমার কী মনে হয়, এলিজাবেথ?” তার দিকে ঘুরলো ক্যামিল।

“আজকেই কেস ফাইলগুলো নিয়ে বসতে হবে।”

“ঠিক আছে, এখনই শুরু করে দাও।”

ইতস্তত বোধ করলো এলিজাবেথ। একবার ঘড়ির দিকে তাকায় আরেকবার ক্যামিলের দিকে তাকায় সে।

“সমস্যা নেই, বাসায় চলে যাও। কিন্তু কালকে সময়মত এসে কাজ শুরু করবে।”

বাসার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে ড, ক্রেস্টকে ইমেইল করলো ক্যামিল। পরবর্তি বিজ্ঞাপনের জন্য লাইনও ঠিক করে দিয়েছে :

‘তোমার আগের কাজগুলোর কী খবর? সি.ভি’

অধ্যায় ৭৭

মঙ্গলবার, ২২শে এপ্রিল

সকাল আটটার মাঝে সবাই ক্রিমিনাল ব্রিগেডের অফিসে হাজির হলো। এরইমাঝে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে হাজির হলো এলিজাবেথ। পুরনো কেসের ফাইলগুলো নিয়ে এসেছে।

“লেসাজের ব্যাপারে অগ্রগতি কতদূর?” 

“জাজ দেশমের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়া গেছে। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করার মত যথেষ্ট প্রমাণাদি হাতে নেই। তবে কব এরইমাঝে তার যাবতীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, লেনদের এসব বিষয়ে খোঁজ লাগাচ্ছে। দেখা যাক সে কী খুঁজে পায়।”

কম্পিউটারের আড়ালে কবকে দেখাই যাচ্ছে না। সারাক্ষণ কোন না কোনো কাজ করছে।

“এলিজাবেথ, আরম্যান্ড, লুইস… তোমরা এসো আমার সাথে,” বলল ক্যামিল।

চারজনে চেয়ার টেনে ডেস্কে গোল হয়ে বসলো। সামনে কেস ফাইলগুলো স্তূপ হয়ে আছে।

“এই ফাইলগুলো সেইসব অসমাপ্ত কেসের যাতে কিছু অসংগতি ছিলো কিংবা প্রাপ্ত সূত্রগুলো সম্পর্কহীন মনে হয়েছিলো। হয়তো খুনি কোনো বই অনুসরণ করে খুনগুলো করেছে। এর পেছনে খুব বেশি সময় ব্যয় করা যাবে না। তোমাদের কাজ হচ্ছে প্রতিটি কেসের সারসংক্ষেপ লিখবে দুই পেজের মাঝে। এরপর তা পাঠিয়ে দেয়া হবে প্রফেসব ব্যালাঞ্জারের কাছে। বাকিটা উনি এবং উনার ছাত্ররা মিলিয়ে দেখবে। আজকে সন্ধ্যার মাঝেই কাজটা শেষ করতে হবে।”

কিছুক্ষণের জন্য ভাবনার ডুবে গেল ক্যামিল।

“লুইস, এই ফাইলটা লেসাজের কাছে পাঠাতে পারবে? দেখি তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। যদি দুপুরের মাঝে কাজ শেষ হয় তাহলে বিকালেই অভিযানে নামতে হবে।”

“চলো কাজে নেমে পড়ি। দুপুরের মাঝেই সব শেষ করতে হবে।”

অধ্যায় ৭৮

“প্রফেসর ব্যালাঞ্জার, আমাদের ধারণা আরো নয়টা অমীমাংসিতে কেস রয়েছে যা গোয়েন্দা উপন্যাস অনুসরণে করা হয়েছে। এরমাঝে ছয়জন নারী, দুইজন পুরুষ আর একটা বাচ্চা আছে। গত দশ বছরের সব কেস নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছি আমরা। মিলিয়ে দেখার জন্য আপনার কাছে পাঠালাম।”

চিঠিতে এই কথা লিখে দিলো ক্যামিল।

কেস ১-১৩ই অক্টোবর, ১৯৯৫, প্যারিস, ছত্রিশ বছর বয়সি এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর খন্ডিত মহদেহ পাওয়া যায় তারই গোসলখানায়।

অসংগতিপূর্ণ উপাদানঃ ১. দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আলাদা আলাদা করে পুরুষের কাপড় পড়িয়ে রাখা হয়।

কেস ২-১৬ই মে, ১৯৯৬, ফন্টেইন, আটত্রিশ বছর বয়সি এক বিক্রয়কর্মীকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয় ফন্টেইনৰুয়ের বনে।

অসংগতিপূর্ণ উপাদান : ১. খুনি .২২ ক্যালিবারের কল্ট উডসম্যান ব্যবহার করেছে যা কিছুটা

অস্বাভাবিক। ২. ভিক্টিমের পরণে নিজের কাপড় ছিলো না।

কেস ৩–২৪শে মার্চ, ১৯৯৮, প্যারিস, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি গর্ভবতী মহিলার পেট কেটে নাড়িভুড়ি বের করে ফেলা হয়।

অসংগতিপূর্ণ উপাদান : ১. ঘটনাস্থলে একটা কাগজ পাওয়া যায় যাতে লেখা ছিলো আমার

প্রিয় পিতামাতার উদ্দেশ্যে, যদিও ভিক্টিম অনাথ ছিলো।

কেস ৪–২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮, মেসন অ্যালফোর্ট, আটচল্লিশ বছর বয়সি এক লোকের মৃতদেহ পাওয়া যায় গ্যারেজে। মৃত্যুর কারণ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

অসংগতিপূর্ণ উপাদান : ১. তিনজন সাক্ষীর কাছ থেকে জানা যায় তারা ভিক্টিম এবং আরো একজনকে মৃত্যুর সময় দেখেছে।

২. গ্যারেজে মৃতদেহ পাওয়ার তিনদিন আগেই ভিক্টিমকে হত্যা করা হয়।

কেস ৫-২৪শে ডিসেম্বর, ১৯৯৯, ক্যাস্টেলনাউ, নয় বছর বয়সি এক বাচ্চা মেয়েকে বাড়ি থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে চেরি গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

অসংগতিপূর্ণ উপাদান :

১. ভিক্টিমের নাভি স্ট্যানলি ছুরি দিয়ে কেটে নেওয়া হয়।

কেস ৬–৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০০০, লিল, সাতচল্লিশ বছর বয়সি এক গৃহহীন নারী হাইপোথারমিয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করে।

অসংগতিপূর্ণ উপাদান :

১. ভিক্টিমের দেহ পরিত্যক্ত হিমাগারে পাওয়া যায়। ফ্রিজের লাইন এসেছে পাশের একটা স্ট্রিটল্যাম্প থেকে।

কেস ৭–২৪শে আগস্ট, ২০০০, প্যারিস, নদীর তীরে এক নারীর নগ্ন দেহ আবিষ্কার করে কিছু লোক। মৃত্যুর কারণ : শ্বাসরোধ।

অসংগতিপূর্ণ উপাদান :

১. ভিক্টিমের বাম উরুতে ছিলো অমোচনীয় কালি দিয়ে তৈরি নকল জন্মদাগ

২. ভিক্টিমের শরীর পলি মাটি দিয়ে ঢাকা ছিলো যদিও নদীতে খনন কাজ তখনো শুরু হয়নি।

কেস ৮-৪ঠা মে, ২০০১, ক্লেমন্ট-ফেরান্ড, একাত্তর বছর বয়সি সন্তানহীন এক বিধবা নারীকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর কারণ হৃৎপিণ্ড বরাবর দুটো গুলি করা হয়েছিলো।

অসংগতিপূর্ণ উপাদান :

১. রেনো মেগানের একটা গাড়িতে ভিক্টিমের লাশ পাওয়া যায়। যার মেয়াদ আরো ছয় বছর আগেই ফুরিয়ে গিয়েছিলো।

কেস ৯-৮ই নভেম্বর, ২০০২, লা বাউলে, চব্বিশ বছর বয়সি এক নারীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।

অসংগতিপূর্ণ উপাদান :

১. সমুদ্রের পাড়ে ভিক্টিমের লাশ আবিষ্কার করে কয়েকজন পথচারী। শিল্পকারখানার অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের ড্রাই আইস দিয়ে তার শরীর ঢাকা ছিলো।

অধ্যায় ৭৯

বিকেলেও দেখা গেলো সবাই কবের লিস্ট নিয়ে কাজ করছে। লুইসের কাঁধে পড়েছে পেলিগ্নির কেস, এলজাবেথ দেখছিলো টুলুজেরটা, ম্যালেভাল প্যারিস আর আরম্যান্ড কাজ করছে করবেল কেস নিয়ে। তাদের বস প্যারিসে আত্মহত্যা করা পুলিশ অফিসারের কেস নিয়ে পড়ে আছে।

ব্যালাঞ্জারের দেয়া বইয়ের লিস্ট আর কেসগুলোর মাঝে তেমন কোনো মিল খুঁজে পেলো না কেউ। খুনি ছোট থেকে ছোট বিষয়ের প্রতি খুব যত্নশীল থাকে। কিন্তু কেস ফাইলগুলো ভালমত পড়ে দেখলো বই এর সাথে অনেক পার্থক্য রয়েছে তাতে। লুইস সবার আগে কেস ফাইল পড়া শেষ করলো, এরপর আস্তে আস্তে এলিজাবেথ, ম্যালেভালও শেষ করে ফেললো।

“কফি লাগবে সবার?”

“কফি তো নেই,” কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল আরম্যান্ড।

হুট করে রুম জুড়ে নীরবতা নেমে এলো। আরম্যাণ্ডের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।

“তুমি লা গুয়েন আর দেশমকে ফোন দাও।”

“কেন? কী হলো আবার?”

“এই যে বইটা, ‘লা ক্রাইম ডি’অরভিকাল’…”

“অরকিভাল,” শুধরে দিলো লুইস।

“অরভিকাল, অরকিভাল, যাই বলো না কেননা, কিন্তু করবেল হত্যাকাণ্ডের সাথে এই বইয়ের বর্ণনা পুরোপুরি মিলে যায়।”

এমন সময়ে ব্যালাঞ্জার ফোন করলো।

“কোন কিছু পেলেন?” উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

“তেমন কিছু পাইনি। তবে আমার এক ছাত্রের মনে হচ্ছে গর্ভবতী মহিলাকে হত্যা করার ওই কেসটা নাকি একটা বইয়ের সাথে মিলে যায়। যদিও আমি কখনো ওই বইয়ের নাম শুনিনি। শ্যাডো স্লেয়ার নামে বইটার লেখক চাব অথবা হাব নামের কেউ। লেখকের নামও অপরিচিত। অনলাইনে খুঁজেছি কিন্তু কিছুই পাইনি। আরেকটা কথা, কম্যান্ড্যান্ট; ফন্টেইনরুর বনে খুন হওয়া ওই বিক্রয়কর্মীর কেসটা পরিচিত মনে হচ্ছে। দুই একটা জিনিস বাদে বাকি সব মিলে যায় জন ডি, ম্যাকডোনাল্ড এর ‘দ্য এন্ড অফ দি নাইট’র সাথে…”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *