মাধুরী আবার নাচছে

মাধুরী আবার নাচছে

মাধুরী আবার নাচছে! মাধুরী আবার!

আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না! আমি ঘোর বিভ্রান্তিতে টিভির পর্দার উপর হাত বুলোচ্ছি! নাচছে? মাধুরী আবার নাচছে? আবার ঘুঙ্গরু, ঘাগরা? চোখের মণিতে বিদ্যুৎ। আর গান ও বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত আওয়াজ ছাপিয়ে মাধুরীর শরীর থেকে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ উঠে আসছে। একেবারে বর্ষার নদীর মতো ভরাট আলোড়নের শব্দ। আমি হতচকিত, চেয়ে আছি সব ভুলে!

আর আমার অদ্ভুত সব কথা মনে পড়ে যাওয়ার মতো শিরশির শিরশির করছে শরীর। মাধুরীর চপলতাই মনে করিয়ে দিচ্ছে সব। মাধুরীর শরীর স্বয়ং অতীত লখনউ, পুরনো বেনারস, হারানো বৃন্দাবন তা আমি অনেক আগে থেকে জানতাম। জানতাম মাধুরী ছাড়া ওই ঝরে যাওয়া সময়ের পৃষ্ঠা উলটে দেওয়ার ক্ষমতা আর কারও নেই। কিন্তু মাধুরী যে নিজের সময়েরও সমস্ত মুদ্রা আর বিভঙ্গ নিয়ে ফিরে আসতে পারে তা জানা ছিল না। মাধুরী যে আমার সময়কেও ফের জাগাতে পারে, জানা ছিল না তাও! মাধুরী নাচছে, চতুর্দিকে ঘুরছে মাধুরীর ঘাগরা। নাচতে নাচতে মেক-আপ ভেদ করে মাধুরীর মুখে যত ঘামতেল ফুটে উঠছে তত মনে জোর পাচ্ছি আমি। মনের জোর আমাকে পেছন দিকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পেছন দিকে। শেষ অবধি আমি পেছন দিকে ছুটছি।

আমি পেছন দিকে ছুটছি। আমি ফিরে যাওয়ার দিকে ছুটছি। মাধুরী পারলে আমি পারব না কেন?

মাধুরীর ওপরের কঁচুলির রং লাল, নীচের ঘাগরার রং নীলচে বেগুনি। লাল রংটা যেন নাচতে পারার আনন্দে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঘাগরাটার মধ্যে রয়েছে বিপরীত এক বিষাদ। যেন মাধুরীর শরীরের কালশিটের উজ্জীবিত বিষণ্ণতা তাতে, ভয়ও এবং ব্যথাও। কীসের ভয় এত? কীসের ভয় এত মাধুরীর? কীসের ভয় এত আমারই বা কী হবে, কী হবে, যদি আমি আজ গিয়ে দাঁড়াই পীতাম্বর মিত্র রো-এর মুখটায়। ঠিক এইরকম সন্ধে হব হব সময়ে? ট্রামরাস্তা থেকে অনেক ভেতরে, ডাঁয়ে-বাঁয়ে ঘুরে, পড়ো পড়ো সব চুনসুরকির আবছায়া দেওয়ালগুলোকে পাশ কাটাতে কাটাতে গলির মুখের ওই ল্যাম্পপোস্টের তলায় পড়ে থাকা এ-বাড়ি ও-বাড়ির ভাঙাচোরা জিনিসের মতো অতীত দিনগুলোয় যদি পা ফেলি—কে আটকাবে আমাকে? কে? মৈনাক?

পাগল! মৈনাক আমাকে আটকাতে সাহস পাবে? মৈনাক আমাকে সাহস পাবে বলতে ‘মালবী চলে যাও? কেন তুমি আবার এসেছ এখানে? তুমি অপরাধী, তুমি বিশ্বাসঘাতক, এখানে তোমার কোনও জায়গা হবে না।’ হা, হা, হা—মৈনাক এসব বলবে আমাকে? মৈনাকের তো আমাকে দেখলে, সেই কোন ছোটবেলা থেকে, আমাকে দেখলেই ওর হাত-পা কাঁপত!

মৈনাক হল আসলে ‘ভোর হল দোর খোল’ ছেলে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যারা মশারি ভাঁজ করে মৈনাক তাদের দলের। চিঠি লিখতে গেলে যাদের অক্ষর বেঁকে যায়, বাঁকতে বাঁকতে বেঁকেচুরে শব্দে, আবেগে মিলেমিশে হয়ে যায় নদী, অল্পই স্রোত, হাঁটু ডুবু ডুবু জল—মৈনাক তাদের দলের। কোনও গোঁয়ারতুমি নেই। বেয়াদবি নেই। ভগ্নচিত্ত, ব্যাকুলিত, বিরক্তিকর চেয়ে থাকা ছাড়া কোনও দোষ নেই।

মৈনাক সবসময় আমার মন পেতে চেষ্টা করত। যা-যা করলে আমি ওকে ভালবেসে ফেলব, ও ওর ক্ষুদ্র সামর্থ্য, সাহস আর কল্পনা দিয়ে সে সবই করতে চাইত। মরিয়া নয়, সেসব প্রচেষ্টা ওকে করুণ করে তুলত বলা যায়। যেমন সাতসকালে, আমি পড়তে যাচ্ছি হয়তো, শীতকাল, পীতাম্বর মিত্র রো-এর বাড়িতে বাড়িতে আঁচ পড়েছে উনুনে। ধোঁয়া, কুয়াশা মিলেমিশে একটু অস্পষ্ট চারপাশ, এমন সময় ঘুমভাঙা চোখ মুখ নিয়ে হয়তো আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল মৈনাক।

কী ব্যাপার, না—‘তোমার সঙ্গে একটা দরকারি কথা আছে, মালবী!’

‘এখন এই ভোরে কী কথা মৈনাক?’

‘আমি জলপাইগুড়ি চলে যাচ্ছি! আজই দশটার ট্রেনে!’

‘জলপাইগুড়ি? হঠাৎ? কতদিনের জন্য?’

‘চিরদিনের জন্য!’

জলপাইগুড়িটা এমন কিছু দূরের নয় যে সেখানে চিরদিনের জন্য যেতে হবে! আমার হাসি পেত।

‘তা কী করতে হবে আমাকে?’

‘তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে!’

‘সে কি? কেন?’ প্রস্তাবে আমি হতবাক।

‘কোনও কারণ নেই, মালবী। আমি যাচ্ছি, তুমি যদি আমাকে ভালবাস তুমিও আমার সঙ্গে যাবে, ব্যস!’

আমি হো-হো করে হেসে ফেলতাম—‘এ বাবা, এরকম আবার হয় নাকি? পথ ছাড়ো আমার দেরি হচ্ছে মৈনাক!’

‘তা হলে এটা জেনে রাখো, আমি চলে যাব এবং আর কখনও ফেরত আসব না তোমাদের সামনে!’

‘ছিঃ, ছিঃ, মৈনাক, বাবা, মা, ভাই, বোন সব ফেলে হঠাৎ জলপাইগুড়ি যাওয়ার জেদ কেন করছ তুমি?’

‘চলে যাব’ কথাটা এত সুন্দর, এত হৃদয়স্পর্শী, এত তার ভার যে মৈনাকের বারবার ‘চলে যাব’ শুনতে আমার ভালই লাগত।

মৈনাক গোস্বামীদের হিমে ভিজে যাওয়া রকে বসে পড়ত ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সবাইকে ছাড়তে পারি, মালবী! আমার কাছে সেটা কোনও ব্যাপার নয়!’

‘কিন্তু তেমন প্রয়োজন কিছু পড়েছে বলে তো মনে হয় না!’

‘এখন বুঝবে না, আমি চলে গেলে তখন বুঝবে!’

‘কী বুঝব?’

‘কী হবে এখানে থেকে, তোমার চোখের আড়ালে চলে যাওয়াই ভাল!’

‘কী বলছ, নিজেই জান না তুমি! তবে তুমি যদি সত্যি যাও, আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসতে পারি!’ আমি শাল দিয়ে হাসি ঢাকতাম, ‘হাওড়া তো?’

‘না শিয়ালদা।’ মন দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলত মৈনাক।

‘দশটার ট্রেন বললে না?’

‘হ্যাঁ।’

এরপর ন’টার সময় বাসস্ট্যান্ডে মৈনাকের সঙ্গে দেখা হলে খুব অবাক হওয়ার ভান করে আমি জিজ্ঞেস করতাম, ‘এ কী, চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছ আর সঙ্গে কোনও মালপত্তর নেই? তোমার জামাকাপড়, বইপত্তর? রামলখন-এর ক্যাসেট এসব নেবে না?’

তখনই মৈনাক কোনও উত্তর দিত না, মুখ গোমড়া করে থাকত। ওড়না, চুল সামলাতে সামলাতে আমি মনে মনে হাসতাম, ‘কী রগড়!’

‘কাল যাব, কিংবা পরশুও যেতে পারি, দোলটা কাটিয়ে গেলেও হয়, পার্থ বলছিল অন্তত সরস্বতী পুজো অবধি থেকে যা।’

হেসে কুটোপুটি হতাম, ‘মৈনাক দোলের এখনও অনেক দেরি!’

ক’টা দিন যেতে না-যেতেই আবার পথ আটকাত মৈনাক, ‘গ্যাংটকে একটা চাকরি পেয়েছি, পরশু ভোরের ট্রেনে চলে যাচ্ছি মালবী! শেষবারের মতো জানতে চাইছি, যাবে কিনা বলো। রাত তিনটে নাগাদ তোমার জানলায় টোকা দেব, এক কাপড়ে চলে আসবে…!’

আমি হাসতাম। মৈনাক বলত, ‘কী যাবে তো আমার সঙ্গে? যাবে না?’

না মৈনাক আটকাতে পারবে না। সতেরো বছর বাদে পীতাম্বর মিত্র রো-এ ঢুকতে গেলে অন্তত মৈনাককে নিয়ে কোনও ভয় নেই!

বরং আটকালে, আটকাতে পারে মেজবউমা। মেজবউমার নাম নাকি সর্বমঙ্গলা! কিন্তু এই নামে তাকে কেউ কখনও ডাকে না। সবাই, আবালবৃদ্ধবনিতার কাছেই তিনি মেজবউমা। এই পীতাম্বর মিত্র রো, মদন ঘোষাল স্ট্রিট, মুখুজ্জেপাড়া ছাড়িয়ে নারায়ণী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার অবধি তিনি মেজবউমা নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। কী করে তিনি সর্বমঙ্গলা থেকে জগতের মেজবউমা হয়ে উঠলেন তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন আমার মাথায় কখনও চাড়া দিয়ে ওঠেনি। কারওই উঠেছে বলে মনে হয় না। কারণ জবাব খুঁজবে কার কাছে? মেজবউমা? পাগল? মেজবউমাকে ভয় পায় না কে? কাকটা, চিলটা পর্যন্ত তাকে তোয়াজ করে চলে। তার ‘লম্পট’—এই ধমক খেয়ে মিনি পায়রাকে ছেড়ে আবার মোতিবিবির কাছে ভাল ছেলের মতো ফিরে গেছিল কালুয়া। এবং জীবনে আর কখনও মুখুজ্জেবাড়ির কড়িবরগার দিকে তাকায়নি।

আমার কপালেই বা কি কম গালাগালিটা জুটেছিল মেজবউমার কাছ থেকে। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে মেজবউমাকে দেখলেই আমি লুকিয়ে পড়তাম। কিছুতেই মুখোমুখি হতে চাইতাম না। যা-তা বলত মেজবউমা আমাকে।

ত্রাস! ত্রাস হয়ে গেছিল মেজবউমা আমার কাছে। আমার রাগ হত কিন্তু নালিশ করতাম কাকে?

সেদিন, এরকমই এক সন্ধেবেলায়, আমি মেজবউমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসছি কোচিং ফেরত আর হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল! লোডশেডিং মানে ঘণ্টাখানেকের মামলা। ভীষণ আনন্দ হল। বাড়ি ফিরে আর পড়তে বসতে হবে না, বিবিধ ভারতী খুলে হিন্দি গান শুনব! তখন সবে বেরিয়েছে তেজাব, চিত্রহারে অসাধারণ দেখাচ্ছে মাধুরীকে— ‘তেরা করো গিন গিন কে, ইন্তেজার’— বলে আরক্তিম ঠোঁট থেকে ডাক দিয়েছে মাধুরী সবাইকে, আর সকলেই সেই জাদু স্বীকার করে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে দিগ্বিদিক।

আশির শেষাশেষি সমস্ত শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে পড়া মাধুরীর অসামান্য শরীর, মোহময়ী হাসি, ‘আজা পিয়া, আয়ি বাহার’—এই আহ্বান আমি আজও বিস্মৃত হইনি! অথচ সতেরো-আঠারো বছর পর ক্লোজ শটে ফুটে উঠবে এই মাধুরীরই ত্বকের দুটো-চারটে কেঁপে যাওয়া রেখা, সতেরো-আঠারো বছর পরে সেই তেজাব দেখতে বসেই পাঁচ মিনিটের বেশি ধৈর্য ধরা যাবে না, সতেরো বছর পর মাধুরী নিজেই বলবে যে ‘সারা জীবনে এমন একটা কাজের সুযোগও পাইনি আমি যা আমার পাওয়া উচিত ছিল!’ বলবে যে ‘আই ফিল ভেরি আপসেট!’ এমনটা তখন দুঃস্বপ্নেও ভাবা যেত না!

ভাবা যেত না! তবু আজ যা সত্যি, মাধুরী স্বয়ং জানে না যে কালকের মাধুর্য সেই সত্যির তুলনায় অনেক কৌশলী! সেই কাল মনের মধ্যে লেপটে থাকে। মাধুরী জানে না ‘মাধুরী’ মানে আসলে একটা সময়। একটা এলো কপাট। হু হু বাতাসে লাট খাওয়া একটা ফাঁকা বদ্রিপাখির খাঁচা, আর মেয়েদের দুপুরের ঘুমের ক্রমশ শেষ হয়ে যেতে থাকার যুগ।

মাধুরী মানে ঘোষাল স্ট্রিট ডাঁয়ে রেখে বড়বাবার মন্দির পাশ কাটিয়ে নোনা ধরা পাঁচিল ঘেরা বাড়ি, নীল টিনের ওপর সাদা দিয়ে লেখা ঠিকানা, টিমটিম করে জ্বলছে রোয়াকের আলো, কেউ একটা গাইছে ‘সাঁঝের তারকা আমি, পথ হারায়ে, এসেছি ভুলে’, কেউ বাজাচ্ছে ‘শো, গ্যয়া ইয়ে জাঁহা, শো গ্যয়া আসমা’ আর দুটোর কোনওটাই আমার কানে সুরহীন ঠেকছে না, আমার যৌবন যা শুনতে চাইছে তার দুটোই মিলেমিশে আছে তার মধ্যে।

রত্না কাকিমার চুল বাঁধা হয়ে গেল, একটু পরেই বাবা ফিরবে, ফিরে বেশ কিছুক্ষণ নিঝুম বসে থেকে গায়ের ঘাম শুকোবে, আসলে বাবা দম নেবে। কাঠের গুদামে খাতা লেখার কাজ করে বাবা, বাড়ি ফিরে স্নান সেরে সেই যে বেরিয়ে যাবে তাসের আড্ডায়, ফিরতে রাত বারোটা।

বাবা যখন ফেরে আমরা কেউ জেগে থাকি না। চার বছর হল মা মারা গেছে আমাদের। মা মারা যাওয়ায় বাবার আর মন বসে না বাড়িতে। বাবা তাই বাইরে-বাইরেই বেশি থাকে। পুতু আর আমার দিকে ভাল করে তাকাতে পারে না বাবা। তাকালে বাবার কষ্ট হয়।

অর্ধেক দিন বাজার-দোকান করতে ভুলে যায় বাবা। পাড়ার দোকান থেকে দেশি হাঁসের ডিম কিনে এনে ঝোলভাত রেঁধে ফেলি আমি। পুতু আমার ছোট বোন। ওর-ও সব দায়িত্ব বর্তায় আমার কাঁধে। ওর স্কুলড্রেস কেচে দেওয়া, চুলে বিনুনি বেঁধে দেওয়া, স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে ঘর-বার করা! সতেরো বছর আগে আমি জানতাম না আমাদের জীবনে পীতাম্বর মিত্র রো-এর এই একঘেঁয়েমি, ক্লান্তি সর্বত্র বিরাজ করে, যেখানেই যাই না কেন চোখে লেগে থাকে তার অবসন্নতা। আমি তখন মাধুরীকে দেখতাম, আর বেরিয়ে পড়তে চাইতাম পীতাম্বর মিত্র থেকে। মাধুরী আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত!

লোডশেডিং হয়ে গেল আর মেজবউমার সদর দরজার সামনে আমাকে পাকড়াও করল পিন্টো। পিন্টোর সঙ্গে তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছি আমি। একমানুষ চওড়া নকশাল গলির অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পিন্টো আর আমার কথা দেওয়া-নেওয়া হয়ে গেছে। আমার জন্য দক্ষিণেশ্বর থেকে পিন্টো নিয়ে এসেছে সিঁদুর। আমি পরার সাহস পাইনি যদিও। পিন্টোর মা মারা গেলে আমি গোপনে অশৌচ পালন করেছি। তখন প্রায়ই, বাবা এবং পুতু না থাকলে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখি। পিন্টোর ব্রণ ভরা গাল, রুক্ষ চাউনি, অমার্জিত উচ্চারণে প্রেমালাপ, আমি পাশবালিশ আঁকড়ে ধরে রোমন্থন করি সময় পেলেই। তখনও পিন্টো আমাকে চুমু খায়নি কিন্তু আমার বুকে হাত ঠেকিয়েছে। পিন্টো বলেছিল, ও ওই দুটোকে একদিন ডলে, চটকে…! কথাটা কেমন কেমন লেগেছিল আমার কিন্তু তখন অন্য এক উত্তেজনার পারদ চড়ছিল আমার মধ্যে। ওর বলার ধরনে তুমুল এক পুরুষকেই খুঁজে পেয়েছিলাম আমি, যে আমাকে সর্বঅঙ্গ ব্যথা করে দেওয়ার মতো আদর করবে। সেদিন আমার হাতে একটা খাতা ছিল। লম্বা খাতা, পিন্টো সেই খাতাটা ধরে টেনে আমাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। আমিও চোখ বন্ধ করে সমর্পণ করতে গিয়ে টের পেলাম ওর হাত অশান্ত, ওর ঠোঁট গরম।

হঠাৎ সদর খুলে কুপি হাতে বেরিয়ে এল মেজবউমা! পরনে সাদা থান, ছোট করে ছাঁটা চুল, ময়দার মতো গায়ের রং। বেরিয়েই কুপিটা তুলে ধরে চিল চিৎকার দিয়ে উঠল মেজবউমা—‘ছ্যাঃ, ছ্যাঃ, ছ্যাঃ, ছ্যাঃ, লজ্জা ঘেন্না সব মায়ের সঙ্গে চিতায় তুলে দিয়ে এসেছিস নাকি রে? ছেনাল মাগি, পথেঘাটেই জাপটাজাপটি করছিস একটা বস্তির ছেলের সঙ্গে, কুকুর-বেড়ালেরও ঘেন্না হবে যে লো, ওরে কে আছিস দ্যাখ, দ্যাখ, মা-টা মরে গিয়ে মেয়েদের কী উপকারই না করে গেছে!’

পিন্টো যে কখন সটকে পড়েছে দেখতেই পেলাম না। খাতা বুকে জড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। পা দুটো যেন কে পেরেক দিয়ে পুঁতে দিয়েছে মাটিতে, পালাতে পারছিলাম না। মেজবউমার মুখ আর বন্ধই হতে চায় না, ‘সুরেন, মেয়ে সরা এখান থেকে! নইলে এ মেয়ে সারা পাড়ার ছেলে বুড়োর চরিত্তির খেয়ে বসে থাকবে!’

সারা পাড়া শুনছে, ‘কী হয়েছে মেজবউমা, কী হয়েছে’ বলতে বলতে ধুতির গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে এল নাগজ্যাঠা, আরও একটা-দুটো স্বর মেজবউমার কুপির আগুনকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে।—‘আর বলিস কেন, লোডশেডিং যেই হয়েছে অমনি সুরেনের বড় মেয়েটাকে…’ শুনতে শুনতে ছুট লাগালাম আমি। বাড়ি পৌঁছে ঠিক করলাম বাবার কানে কথা ওঠার আগেই আত্মহত্যা করব। আত্মহত্যার কথা ভাবতে ভাবতেই রুটি করলাম, ছোলার ডাল আর কুমড়োর তরকারি গরম করলাম স্টোভে। সেদিন তাসের আড্ডা থেকে অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল বাবা।

আমাকে বলল, ‘খেতে দে’! খেতে খেতে পুতুকে ডাকল, পাশে বসতে বলল। পুতু বসলে বাবা হাত রাখল পুতুর পিঠে, ভেজা স্বরে বলল, ‘দিদির বিয়ে দিয়ে দিলে তুই মা-বাপকে দুটো রেঁধে খাওয়াতে পারবি তো?’ রেঁধে খাওয়ানো—এই মাত্র বাবার সমস্যা? ভয়ে কুঁচকে থাকা শরীর আমার কেমন অনুকম্পায় জল হয়ে গেল। বাবাকে আমি আর কখনও গ্রাহ্য করিনি। বাবাও ধীরে ধীরে পুতুকেই নির্ভর করতে শুরু করেছিল।

আমার বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ কিন্তু নিতে দেখা গেল না বাবাকে। এবং পিন্টো কী এক অপকর্মের জন্য পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দু’মাস জেল খেটে এল। যখন ফিরে এসে বারবার আমার গতিরোধ করতে লাগল পিন্টো। তখন বরং আমিই চাইছিলাম যা হোক একটা হিল্লে হোক আমার। পিন্টোকে দেখলেই পালাতাম আমি। পীতাম্বর মিত্র রো আরও দমবন্ধ করা, আরও অসহ্য হয়ে উঠল আমার কাছে।

সতেরো বছর বাদে ফিরতে চাইলে কে জানে অন্ধকার ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াবে কি না পিন্টো, কে জানে আজও জ্বলন্ত কুপি হাতে চেঁচিয়ে উঠবে কি না মেজবউমা ‘দাঁড়া’ বলে। ‘এক পা-ও এগোবি না, খবরদার, লজ্জা নেই যে আবার এই পাড়ায় ঢুকিস? কী দেখতে এসেছিস তুই, বাপ-দাদার পোড়া মুখ?’ বলে অনর্গল উগরে দেবে কি না ঘৃণা!

আর যদি মৈনাক না আটকায় আমায়, যদি পিন্টো না আটকায় আমায়, না আটকায় যদি মেজবউমাও তা হলেই কি চুপচাপ পৌঁছে যাব আমি ওই মরচে পড়া ঠিকানায়? তপতীদির মা? তপতীদির মা ছেড়ে দেবে আমাকে? যেতে দেবে? তপতীদির মা-র আমার ওপর ভীষণ রাগ!

কবে থেকেই সেই দৃশ্যে অভ্যস্ত আমরা। আমাদের ডান পাশের বাড়িটাই তপতীদিদের। লাল সিমেন্টের চওড়া উঠোন, দু’পাশে দুটো সিমেন্টের বেদি। বাঁ হাতের বেদিটা পার হয়ে ঢুকতে হয় আমাদের বাড়িতে। আর বাঁ হাতের বেদিটাতেই দিনরাত, সকাল-সন্ধে, অষ্টপ্রহর ভারী শরীরটা নিয়ে বসে থাকে তপতীদির মা। উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে থাকে গলির মুখটার দিকে। মানুষটা অতিকায়, অথচ চলৎশক্তিহীন। সজলদা, তপতীদির ভাই, অনেক বছর আগে এক ঝড়বৃষ্টির রাতে বাড়িতে ঝগড়া করে চলে গেল, আর ফেরেনি। তপতীদির মা সজলদার ফিরে আসার অপেক্ষায় বছরের পর বছর এই বেদিতে বসেই প্রহর গুনে যাচ্ছে। হতে পারে সজলদার ফিরে আসার অপেক্ষা ফিকে হয়ে পরিণত হয়েছে একটা অভ্যেসে।

তাকিয়ে থাকার অভ্যেসে।

বাড়িতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত পিতা, অসুস্থ মা, নিরুদ্দেশ ভাই— শেষে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল তপতীদিকে। আর কানাঘুষো শুরু হয়েছিল তখন থেকেই তপতীদিকে নিয়ে। কেউ জানত না তপতীদি কী করে সংসার চালাচ্ছে। কেউ বলত একটা স্কুলে পড়ায়, কেউ বলত টিউশানি করে, কেউ বলত নার্স হয়ে গেছে তপতীদি। কেউ বলত আরে, না, না, আয়া! কে একজন খবরটা বয়ে দিয়ে গেছিল পাড়ায়—তপতীদিকে কোনও এক হোটেলে যাতায়াত করতে দেখা গেছে। ট্যাক্সিতে উঠছে, ট্যাক্সি থেকে নামছে। সঙ্গে পুরুষ! আঁতকে উঠেছিল খবর শুনে জমায়েতে জমায়েতে পাড়ার মানুষ, কানে হাত চাপা দিয়ে বাড়ি পালিয়েছিল যেন কারা, কেউ সর্বসমক্ষে ছ্যাঃ ছ্যাঃ করেছিল, কেউ আবার চোখ টিপে হেসে উঠেছিল রসের মহিমায়। আমিও কথাটা কয়েকজনকে বলেছিলাম, তারা যা বলেছিল আমি মন দিয়ে শুনেছিলাম, শুনে আরও ক’জনকে বলেছিলাম। আমার পিসিমা স্নেহলতা ছিল তাদেরই একজন।

বিধবা স্নেহলতা পিসিমা ছিল মারাত্মক চুকলিখোর, আয়েস করে বসে চা, পান খেয়ে সমস্ত মন্তব্য, টীকা, টিপ্পনি সহ চাউর হওয়া কাহিনি নামিয়ে দিয়েছিল তপতীদির মায়ের কানে। তারপর হাহাকার করতে থাকা মানুষটাকে ফেলে উঠে এসেছিল।

সেই হাহাকার সবাই শুনেছিলাম আমরা! তপতীদি চলে গেছিল পাড়া ছেড়ে। মাসে একবার-আধবার রাতের অন্ধকারে এসে দেখে যেত বাপ-মাকে। কষ্ট করে, দেওয়াল ধরে ধরে থপথপ করে চলাফেরা করত তপতীদির মা। ভাত ফুটোনো, সেমিজ, শাড়ি মেলে দেওয়া। তারপর লাল বেদিটায় গলির দিকে মুখ করে ঠায় বসে থাকা। তপতীদির মা’র তখন আমাকে দেখলেই জ্বলে উঠত চোখগুলো। ডাকত, ‘অ্যাই মালবী, একবার ভেতরে আয়, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে!’ পুতুকে পেলে বলত, ‘তোর দিদির দেখিস না কী হয়!’ পুতু আর আমি তাকাতাম না, মাথা নিচু করে চলে যেতাম।

বাবা যেদিন বের করে দিল আমাকে বাড়ি থেকে, বলল, ‘যদি আর কোনওদিন এই চৌকাঠ মাড়াস, আমার মরা মুখ দেখবি, বলে রাখলাম!’—সেদিন তপতীদির মা’র কী আস্ফালন! কী ফেটে পড়া আক্রোশ! আমি কাকুতি-মিনতি করেছিলাম, ‘বাবা, বাবা। দরজা খোলো!’

তপতীদির মা আমার হাত মুচড়ে ধরে বলেছিল, ‘অত খায় না!’

আমি কঁকিয়ে উঠেছিলাম, ‘জেঠিমা হাত ছাড়ো।’

‘কি, এখন স্নেহলতার টিকির দেখা নেই কেন? অপবাদ দিয়ে মেয়েটাকে আমার তোরাই তো তাড়িয়েছিলিস, তপতী নাকি নষ্ট? তুই! তুই-ই তো মূল হোতা, বাড়ি বাড়ি ঘুরে কুৎসা গেয়েছিলিস, মনে আছে?’

না, আমি রটাইনি তপতীদি নষ্ট, কিন্তু আমি কি সত্যিই রটাইনি?

তপতীদির পাড়া ছাড়ায় আমার কোনও দায়িত্ব নেই, কিন্তু সত্যিই কি কোনও দায়িত্ব নেই? আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু আমি কি কিছুই বুঝতাম না?

সতেরো বছরের ব্যবধানে তপতীদির মা’র এইসব প্রশ্নের তীব্রতা কিছুমাত্র কমেনি বলে ভয় হচ্ছে আমার। প্রশ্নগুলো আমার ভেতরে সক্রিয় আজও। পীতাম্বর মিত্র রো-এর লাল বেদিতে হাপিত্যেশ করে বসে থাকা মহিলাকে পাশ কাটানো আজও সহজ নয়, আমার পক্ষে! তপতীদির মা যেই বলবে, ‘কে রে? কার বাড়ির মেয়ে রে? ওমা, কথা বলে না দ্যাখো?’ আমি কী উত্তর দেব?

বলব পীতাম্বর মিত্র রো-এর পাঁজরের ভেতর আবার ফিরে এসেছি আমি? আমি মালবী, পীতাম্বর মিত্রের বাইরের জগৎ থেকে আর আমার পাওয়ার কিছু নেই, আমি এই অন্ধকার, বিষণ্ণ গলিটায় আবার সেঁদোতে চাই। শাঁখ বাজবে, শীত-শীত করবে, আমি বই বুকে চেপে ফিরব, পুতু কুলের টক দিয়ে পাউরুটি খাবে, আমি ‘ছায়ালোক’ শুনে শুনে গান তুলব। জ্বাল দিতে গিয়ে কেটে যাওয়া দুধ ফেলে দিতেও মায়া হবে, ভীষণ মায়া হবে যে-জীবনে সে-জীবনে আবার ফিরব আমি জেঠিমা। বলব এসব? আমি জানি আমি ফিরতে চাইব, কিন্তু ফেরা অসম্ভব, বাবা কিছুতেই দরজা খুলবে না।

বাবা দরজা খুলবে না কারণ পীতাম্বর মিত্র রো যে-জীবনে অভ্যস্ত তার থেকে সুদূর এক আলো ঝলমলে জগতে হাঁটতে চেয়েছিলাম আমি।— আমি মাধুরী হতে চেয়েছিলাম। অথচ আলোর পেছনের অন্ধকার ভুলভুলাইয়াই গ্রাস করে নিয়েছিল আমাকে। কিছু বোঝার আগেই আমি ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত হয়েছিলাম। ফিরে এসেছিলাম তিন রাত বাড়ির বাইরে কাটানো মালবী হয়ে। বাবা আমাকে মেরেছিল। পুতুর ভবিষ্যৎ, সমাজের ভয়…, বাবা তাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে। আমি জানি দরজা ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ব কিন্তু পুরনো জীবন থেকে কেউ আর ‘আয়’ বলবে না আমাকে!

আমি জানি, মাধুরী আবার নাচছে, আবার উড়ছে ঘাগড়া, চূর্ণি ঘুরছে, মাধুরীর শরীর ভেঙে উঠে আসছে নতুন বিভঙ্গ, হয়তো নতুন কোনও পথ খুলে যাচ্ছে মাধুরীর। নাচতে পারার পথ, কিন্তু মাধুরীও জানে, আমিও জানি যে, আমরা দু’জনে কেউই আর কখনও পুরনো সময়ে ফিরে যেতে পারব না। কোনওদিন আর পীতাম্বর মিত্র রো ধরে ফেরা হবে না আমার, দু’দিকের দেওয়ালে লেগে থাকা পোস্টারগুলো থেকে আর কোনওদিন ঝরবে না মাধুরীর বুক, পেট, নাভি, ঠোঁটের তেজাব!

দেশ ২ অক্টোবর ২০০৬

প্যান্টি ও অন্যান্য গল্প • সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়

|| ই-বুকটি সমাপ্ত হল ||

www.anandapub.in

image
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *