রাইবিলাস

রাইবিলাস

দেখিতে যে সুখ উঠে কী বলিব তা

দরশ পরশ লাগি আউলাইছে গা॥

ইউনিভার্সিটিতে পা রাখতে না রাখতেই টুপ্পুস করে কৃষ্ণেন্দুর প্রেমে পড়ে গেল রাই। কৃষ্ণেন্দু ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ানো ছাত্র সংগঠনের নেতা। ইকনমিক্স, এম এসসি ফাইনাল ইয়ার। এদিকে রাই সবে ফার্স্ট ইয়ার, তা-ও বাংলা অনার্স এবং রাজনীতির ধারকাছ মাড়ানোর পার্টি নয়। কেউ রাজনীতি নিয়ে বেশি ক্যাচরম্যাচর করলে, রাই তার পাশে বসে-বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। অন্য দিকে কৃষ্ণেন্দু প্রতিটা সিগারেট ধরায় রাজনীতির আগুন দিয়ে। রাজনীতিই খায়, রাজনীতিই মাখে। কৃষ্ণেন্দু বেশ দৃষ্টিকটু রকমের আদর্শতাড়িত। ফলে সকলেই কৃষ্ণেন্দুর কাছে একটু ঝুলে যায়। সবচেয়ে মুশকিলের কথা, কৃষ্ণেন্দু মেয়েদের ব্যাপারে একেবারে সেকেলে বা অনাগ্রহীও বলা চলে। মেয়েদের সে দ্যাখে মূলত দু’ভাবে। এক, দলের মেয়ে অথবা বিদলীয়। মেয়ে হিসেবে কোনও নম্বরই দিতে চায় না।

প্রথম দেখার পর যতবার কৃষ্ণেন্দুকে দেখেছে রাই, ততবারই কাঁপন ধরেছে তার মনে। ততই প্রস্ফুটিত হয়েছে তার প্রেমের কুসুম। প্রত্যেকবার তার মনে হয়েছে, কৃষ্ণেন্দুকে ছাড়া তার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। সে বাঁচবে না, কৃষ্ণেন্দুকে না পেলে বাঁচবে না। এক দিকে প্রেমে নিষিক্ত হতে-হতে তার হৃদয় আনন্দে ভরে ওঠে যখন, তখন অন্য দিকে মনের কোণে জমাট বাঁধে মেঘ এই ভেবে যে, কী করে নিজের হৃদয়ের অবস্থার কথা উজাড় করে নিবেদন করবে কৃষ্ণেন্দুকে। বোঝাবে কী করে যে, সে ভালবেসে ফেলেছে, কৃষ্ণেন্দুকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে। যদি প্রত্যাখ্যান করে কৃষ্ণেন্দু রাইকে, রাই এই কলেজই ছেড়ে দেবে! চলে যাবে এখান থেকে! এতখানি প্রিয় তার প্রেম তার কাছে। যদিও রাইয়ের বিশ্বাস, কৃষ্ণেন্দু মেয়েদের ব্যাপারে যতই নিরুৎসাহী হোক না কেন, রাইয়ের আত্মসমর্পণকে সে যোগ্য মর্যাদা না দিয়ে পারবে না। কারণ, কৃষ্ণেন্দু একাই কৃষ্ণতুল্য নয়, রাইও রাধিকামাধুর্যের শাশ্বত মোমরূপ ললিতা৷ কৃষ্ণেন্দু বিদ্যুচ্ছটার মতো দ্যুতিময়, তার দেহাবরণ কাজলের মতো কালো ও উজ্জ্বল, গুচ্ছ চুল যেমন বিনোদচূড়া না হলেও মাথার পিছনে ঝুটি করে বাঁধা থাকে। যখন কথা বলে কৃষ্ণেন্দু, আহ্বান করে সঙ্গীদের, তখন যেমন সকলে মুগ্ধ হয়ে শোনে তার কথা, মুগ্ধতার সঙ্গেই অনুগমন করে। রাইয়েরও ঠিক তেমনই কাঁচা সোনার মতো রং, চাঁদের মতো মুখশ্রী, অঙ্গের সুষমা, চোখের কটাক্ষ, কৃষ্ণেন্দুর প্রেমে অনুরাগ-জর্জরিত ভাব, সমস্তই শ্রীরাধিকার লক্ষণযুক্ত। রাধিকার মতোই সে এক দুর্লভ প্রেমিকারত্ন।

এই তুলনা বারবার আকাশের দিকে মুখ তুলে মনে মনে করে চলে রাই আর ভাবে, মিলন তা হলে হবে না কেন? সংশয় লেগে থাকে রাইয়ের মনে। কারণ, এক জায়গায় কৃষ্ণের সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুর ঘোর অমিল। কৃষ্ণ নানারকম লীলাখেলা সেরে রাজনীতিতে মন দিয়েছিলেন, আর কৃষ্ণেন্দু বহুজনবল্লভ হওয়া তো দূরের কথা, রাজনীতি-রাজনীতি করে একজন নায়িকাকেও জীবনে পদার্পণ করার সুযোগ দেয়নি। রাইয়ের মতো অনেকেই তার চৌকাঠের বাইরে অপেক্ষারত।

ধরি ধরি মনে করি

ধরিবারে নাহি পারি

অনুরাগে জলে ডুবেছিনু।।

দেখতে দেখতে ছ’-সাতমাস কেটে গেল, আর তো ধৈর্য রাখতে পারে না রাই! চোখের সামনে দিয়ে তার প্রেমিক যায়-আসে, অথচ তার মনের বাসনা কিছুই মেটে না। কৃষ্ণেন্দু, কৃষ্ণেন্দু, সকলের মুখে কৃষ্ণেন্দু! যেখানে কৃষ্ণেন্দু, সেখানেই জটলা, ভিড়, তর্কবিতর্ক, বাগবিতণ্ডা। কৃষ্ণেন্দুর মুখেও সব সময় আন্দোলনের কথা, প্রস্তুতি। এর মধ্যে সে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে, দারুণ টেনিস খেলে ও মহীনের ঘোড়াগুলি থেকে একটার পর একটা গান বেশ নিখুঁতভাবেই গেয়ে ওঠে। আর কৃষ্ণেন্দুকে যত দ্যাখে রাই, তত অন্তরদহন বাড়ে তার। কৃষ্ণেন্দুকে হারানোর চিন্তায় শরীর অবশ হয়ে যায়। এখনও এগিয়ে গিয়ে একটা কথা বলার সাহস হল না রাইয়ের, অথচ দেরি হয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দুর ইউনিভার্সিটি ছাড়ার সময় এগিয়ে আসছে। কেন যে তার রাধার মতো সাহস নেই মনে! আসলে রাধার সঙ্গে তারও যে এক জায়গায় বিরাট পার্থক্য। কৃষ্ণ রাধার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। জলঝড় মাথায় করে, কন্টকময় বনের পথে কৃষ্ণের অভিসারে যাওয়ার শক্তি রাধা অর্জন করতেন সেই অনুরাগ থেকে। তাঁর পা জড়িয়ে ধরত সাপ, তিনি গ্রাহ্য করতেন না। ভাবতেন, তাঁর নূপুরের শব্দ যাতে না শোনা যায়, তাই স্বয়ং ভগবানই সাপ পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু রাই এমন মনের জোর কোথা থেকে পাবে? ভালবাসা তো দূরের কথা, কৃষ্ণেন্দু রাইকে বোধ হয় চেনেই না! এই অবস্থায় কোন ভরসায় রাই গিয়ে বলবে, “আমি আর পারছি না। আমার প্রেমকে তুমি গ্রহণ করো। আমাকে জড়িয়ে নাও বুকে, তারপর আমার প্রেমের সীমা অতিক্রম করে পরাজিত করো আমাকেই..!” এসব বলবে সে? এসব বলা যায়? কৃষ্ণেন্দু তো তাকে দেখেও দ্যাখে না। ইশারা, ইঙ্গিত, চোখের ব্যাকুলতা—কিছুই পৌঁছয় না কৃষ্ণেন্দু অবধি। নানা কারণে রাইয়ের সঙ্গে বন্ধুদের তেমন সখ্য নেই যে, রাই কাউকে মাধ্যম করবে হৃদয়ের বার্তা পৌছনোর। উলটে যে-ই জানবে খবরটা, মুহূর্তে রাষ্ট্র করে দেবে ক্যাম্পাসে। তখন কী দুর্দশাই না হবে রাইয়ের! অন্তত যদি মোবাইল নম্বরটাও পাওয়া যেত! কিন্তু সেটা পাওয়াও এত সহজ কাজ নয়। কী করবে, ভেবে পায় না রাই। অথচ এই অবস্থার প্রশমন দরকার। না হলে সমূহ ক্ষতি। রাধা যেমন রাঁধতে ভুলে যেতেন, খেতে ভুলে যেতেন, সখীদের সঙ্গে গল্প করতে ভুলে যেতেন, ভুলে যেতেন চুল বাঁধা, বসনভূষণ— রাইয়েরও যেন ঠিক তাই হয়েছে। ডকে উঠেছে পড়াশোনা। বাড়িতে সে প্রায় কারও সঙ্গে বাক্যালাপই করে না, উদাস মুখ করে থাকে।

কেউ কিছু বললেই চোখের দু’কূল ছাপিয়ে জল ঝরে তার। চুলে রং করিয়েছিল কয়েক মাস আগে। পরিচর্যার অভাবে চুলগুলোর বিচ্ছিরি রুক্ষ হাল। আগে সে স্নান করে চোখে কাজল না পরে বাইরে পা রাখত না। এখন তার চোখে কাজলের রেখা, দশদিনের বাসি৷ আগে কলেজে যেতেও ঠোঁটে লিপগ্লস লাগাত রাই, এখন ঠোঁট দুটো কী এক গোপনকে চেপে রাখতে-রাখতে ক্লান্ত, করুণ! কৃষ্ণেন্দু কোনওদিন তার হবে না, কোনওদিন কৃষ্ণেন্দুকে স্পর্শ করার অধিকার পাবে না সে— ক্রমাগত এসব চিন্তায় প্রগাঢ় দুঃখের সম্ভাবনায় মর্মাহত রাই একাকী পড়ন্ত বিকেলে কলেজের সিঁড়িতে বসেই থাকে এবং তাকে এ সময় ঘিরে থাকে না চপল, চঞ্চল সখিরা স্বাভাবিকভাবেই। যে যার পড়াশোনা, বয়ফ্রেন্ড, সান্ধ্য কফিশপ, আড্ডার খাঁজে-খাঁজে হারিয়ে যায়। এক-আধদিন রাইও একা-একাই আলো-ঝলমলে মিউজিক বাজতে থাকা কাচের ঘরের কাচের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছে। চেয়ার টেনে বসেছে। দেখেছে, তার চারপাশে সকলে জোড়ায়-জোড়ায়, হাতে হাত ধরা। তারা পরস্পর মশগুল হয়ে কথা বলে। ফিসফিস করে কী দুর্বোধ শব্দ উচ্চারণ করে, আর পরমুহূর্তে রক্তিম হাসিতে ফেটে পড়ে একে অন্যের কাঁধে। উঠে যাওয়ার সময় মেয়েটার কোমর জড়িয়ে ধরে ছেলেটা। তখন তাই দেখে কী ব্যর্থ শিহরণ জেগেছে রাইয়ের বুকে! টনটন করছে বুক, দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে হৃদয়। কবে, কবে এমন করে সে-ও পাবে কৃষ্ণেন্দুকে? আদৌ কি পাবে? রাধা যেমন বাঁশির শব্দে শরীরে একই সঙ্গে তীব্র সুখ ও যন্ত্রণা পেতেন, কৃষ্ণেন্দুর চিন্তায় অষ্টপ্রহর রাইয়ের এমনই দুটো বিপরীত অনুভূতি একই সঙ্গে বয়ে চলে দেহে-মনে।

কুসুমে মধুপ কহি সেহো নহে ভুল।

না যাইলে ভ্রমর আপনি না দেয় ফুল ॥

অবশেষে সুদিন আসে রাইয়ের জীবনে। বসন্তের শেষাশেষি অনেক লজ্জায় পুড়েও চেয়েচিন্তে সে জোগাড় করতে পারল কৃষ্ণেন্দুর মোবাইল নম্বরটা। এইটুকু করতেই তার আট-দশ মাস লেগে গেল। তারপর সেদিন সকলে শুয়ে পড়ার পর, ব্যালকনিতে গুটিসুটি মেরে বসে ডায়াল করল কৃষ্ণেন্দুকে। “কৃষ্ণেন্দু বলছি…” ফোন ধরেই বলল কৃষ্ণেন্দু। বেশ কিছুক্ষণ রাই কোনও কথাই বলতে পারল না। দিশেহারা শব্দরা কে কোথায় পালাল যেন! অনেক কষ্টে বলল, “আমি রাই।”

“কে রাই?” বলল কৃষ্ণেন্দু।

‘হায় আমি অভাগিনী, না পাইলাম শ্যাম গুণমণি, সে দুঃখে হৃদয় বিদরে!’ অনিবার্য উত্তর তো এই। এই কথাটা এখনই বলতে পারলে রাইয়ের পক্ষে বড়ই ভাল হত। কিন্তু মানুষের সমাজে কোনও সহজই এত সহজে হয় না বলে পাঁচ হাজার বছরের এপারে-ওপারে দাঁড়িয়ে এক রাধা, আর এক রাইয়ের সম্বল যে প্রেম, তার মধ্যে তৈরি হয়েছে সংকটের চড়াই-উতরাই। রাধার প্রেম কোনও পরিণতি পায়নি। তার কৃষ্ণ লাভের হাহাকারকে ভক্তের ভগবান লাভের ভক্তি বলে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

“হ্যালো, রাই কে?” কৃষ্ণেন্দু আবার প্রশ্ন করল।

কথা তাকে বলতেই হবে। কথা বলবে বলেই এত কষ্ট করে ফোন নম্বর জোগাড় করা। এখনও চুপ করে থাকা অত্যন্ত মুর্খামি। রাধা কখনও এমনটা করেননি। যখন যা বলার দরকার, তা বলতে কুণ্ঠা ছিল না তাঁর। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রাই নড়েচড়ে বসল। বলল, “তুমি আমাকে চেন। কৃষ্ণেন্দু!”

“চিনি? রাই? দাঁড়াও, রাই? কোথায় আলাপ হয়েছিল বলো তো? কোনও সেমিনারে?”

“অনেক জন্মে, অনেক অনেকবার তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে সময় কোনও সেমিনার চলছিল না!” ফস করে মুখে যা এল, তাই বলে দিল রাই।

“মানে?”

“মানে যা, তাই।”

কৃষ্ণেন্দু এবার বুঝতে পেরেছে যে, এই রাই নামে মেয়েটা কোনও রাজনৈতিক কারণে, দলীয় প্রয়োজনে বা কলেজ-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের অনুরোধ নিয়ে কথা বলতে ফোন করেনি। মেয়েটা এখনই যে হেঁয়ালিটা করল, তার সাদা বাংলায় মানে দাঁড়াচ্ছে, মেয়েটা তার প্রতি বিশেষভাবে মুগ্ধ এবং আপাতত সেই মুগ্ধতার কথাই ব্যক্ত করতে ফোন করেছে। কৃষ্ণেন্দু আসলে মেয়েদের ব্যাপারে একটু সেকেলে। তার ধারণা, রাজনীতি আর মেয়ে, এই দুটো জিনিসকে একসঙ্গে যে নৌকোয় তোলা হবে, তার ডোবা অনিবার্য। এদিকে যেহেতু সে জীবনের বেশ কটা বছর রাজনীতির পিছনে খরচ করে ফেলেছে, তাই নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ার নিয়ে সে খুবই স্পর্শকাতর। কিন্তু সেদিন এত রাতে রাই নামের একটা অজ্ঞাত কোণ থেকে ভেসে আসা রেশমি গলার স্বর তাকে নারী-রহস্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলল। সে বিচলিত বোধ করল ও বলল, “প্লিজ, তুমি কে এবং কী দরকারে ফোন করেছ, তা চটপট বলে ফ্যালো। আমার সময় নষ্ট হচ্ছে!” “ঘুম পেয়েছে বুঝি?” ততক্ষণে রাইয়ের মনে একটু সাহস এসেছে। “না, আমি এখন একটু বইপত্তর খুলব,” কৃষ্ণেন্দুর কথার মধ্যে বেশ একটু দ্বিধা। কথা বলবে, না বলবে না, বুঝতে পারছে না।

“তা তো খুলতেই হবে! সারাদিন অত ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ালে, সময় নিয়ে তো টানাটানি থাকবেই!”

“বাপ রে, কী ঠাকুরমামার্কা কথা! তা, পরিচয়টা দিচ্ছ না কেন বলো তো?”

“বললাম তো, আমি রাই আর তুমি আমার বংশীবদন।”

“ইস-স! সে এক নামকরা কুমোর, হাঁড়ি-কলসি বানায়!”

“মোটেই নয়, তুমি কিছু জান না।”

“বেশ, তুমি যা জান আর যা আমাকে জানাতে চাও, তা একটু খোলসা করে বলো দেখি!”

রাই হেসে উঠল, “সত্যি বলছি, তুমিই আমার শ্রীকৃষ্ণ। বিশ্বাস করো কৃষ্ণেন্দু!”

“বিশ্বাস করলাম।” রাইয়ের হাসি কৃষ্ণেন্দুর কান বেয়ে মর্মে পৌছে নূপুরের নিক্কন তুলল যেন! এমনটা হওয়া অনুচিত। কৃষ্ণেন্দু মনে-মনে বলতে লাগল, ‘ব্রেক, ব্রেক।’

কিন্তু তা সত্ত্বেও দু’জনের মধ্যে সে রাতে কথাবার্তা ঘণ্টাখানেক গড়াল। রাই নিজের দীর্ঘতাপিত মনের যাবতীয় দুরবস্থার কথা বলতে সমর্থ হল এবং কৃষ্ণেন্দু শুনতে-শুনতে উত্তরোত্তর অবাক হতে লাগল। ঠিক হল, পরের দিনই বিকেলে দু’জনে ইন্ডিয়ান হবি সেন্টারে মিট করবে ও কফি পান করতে করতে এই প্রেমের সম্ভব-অসম্ভব নানা দিক খতিয়ে দেখবে। এমনকী, কৃষ্ণেন্দু এ-ও বলল যে, “হতে পারে আমার তোমাকে ভালই লাগবে না!” খুব সপ্রতিভ উত্তর এল রাইয়ের, “তা তো না-ই লাগতে পারে। সে ভয়ে অপ্রকাশিত থাকার কোনও মানে হয় না।” এত কথার মধ্যে বলি বলি করেও রাই এই কথাটা গোপন করে গেল যে, সে কৃষ্ণেন্দুর ইউনিভার্সিটির মেয়ে।

রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি।

বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি ॥

চার চোখের মিলনের মুহূর্তটা কল্পনায় সারাদিন ধরে যেভাবে আঁকল রাই, বাস্তবের ছবিটা হুবহু মিলে গেল তার সঙ্গে। কৃষ্ণেন্দু তাকে দেখেই ভুরু কুঁচকে বলে উঠল, “ইয়ার্কি হচ্ছে? তুমি রাই?”

রাই হেসে ফেলল, “আবার না কেন? রাই-ই তো!”

“তুমি যাদবপুরের না?”

“হ্যাঁ, যাদবপুরের! বাংলা!”

“অ্যাই, এসবের মানে কী? সিনিয়র, জুনিয়র জ্ঞান নেই? মস্করা হচ্ছে?” কৃষ্ণেন্দু ভাবল, এটা নিশ্চয়ই বিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের কোনও ষড়যন্ত্র! তার ইমেজের চেন খুলে দেওয়ার চক্রান্ত! সে আর কালবিলম্ব না করে উলটোমুখো হাঁটতে লাগল।

আর এতদূর এগিয়ে এসেও কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া হাতছাড়া হয়ে যায় দেখে, রাই মরিয়া হয়ে পিছু নিল কৃষ্ণেন্দুর।

“আশ্চর্য, কলেজের মেয়ে হলাম তো কী সাতখুনের দায়ে ধরা পড়লাম নাকি? যাদবপুরে এরকম কোনও নিয়ম আছে বলে জানি না বাবা!” রাই ঠোঁট ফোলাতে চেষ্টা করল।

এদিকে কৃষ্ণেন্দু তখন পালাতে পারলে বাঁচে। কে জানে, বিপক্ষের লোকজন আশপাশেই ঘুরছে কি না! অগত্যা রাই কৃষ্ণেন্দুর পাশে-পাশে ছুটে এসে একেবারে মুখের সামনে গতিরোধ করে দাঁড়াল। “উফ, কী অসভ্য রে বাবা! কোথাকার কে পলিটব্যুরোর সদস্য এসেছেন, একটু দাঁড়িয়ে কথা বললে কি কার্ল মার্কস ক্ষয়ে যাবেন?” প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা রাইয়ের।

“আচ্ছা মুশকিল তো!” কৃষ্ণেন্দু বাধ্য হল দাঁড়াতে।

“দ্যাখো, তুমি রাই-টাই যে-ই হও না কেন, মেয়েদের ব্যাপারে কতগুলো নিয়ম আমি রিলিজিয়াসলি মেনে চলি এবং এখনও খুব পরিষ্কারভাবে জানি যে, তুমি আমার সঙ্গে যেভাবে মিশতে চাইছ, আমার পক্ষে তোমার সঙ্গে সেভাবে মেশা সম্ভব নয়।”

“কেন সম্ভব নয়? যেহেতু আমি এক ক্যাম্পাসের মেয়ে? বেশ আমি যাদবপুর ছেড়ে দিচ্ছি, চলবে?”

“প্লিজ, বোঝার চেষ্টা করো, আমাকে যারা এতদিন একভাবে দেখেছে, তারা আমার হঠাৎ পরিবর্তনে আহত হতে পারে!”

“যুক্তিটা অদ্ভুত! তুমি বলতে চাও, রাজনীতি করো বলে তোমার কোনও ব্যক্তিগত জীবন থাকবে না? তুমি কাউকে ভালবাসতে পারবে না? কৃষ্ণেন্দু, আমি তোমার চেয়ে সব ব্যাপারেই অনেক ছোট। আমি রাজনীতিও বুঝি না। কিন্তু তবু না বলে পারছি না যে, রাজনীতিতেও ভালবাসাই মূল কথা হওয়া উচিত। অন্তত যদি তুমি রাজনীতি মানে ֹ‘মানুষ নিয়ে দাবা খেলা’ না বোঝো।”

“লুক…!” কৃষ্ণেন্দু আঙুল তুলল।

“প্লিজ…!” রাইও আঙুল তুলল সঙ্গে-সঙ্গে এবং জেদি, একগুঁয়ে, অহঙ্কারী একটা মেয়ের মতো বলে উঠল, “তোমার বুঝি আমাকে খুব একটা পছন্দ হয়নি, হুঁ?” কৃষ্ণেন্দু থমকাল ও তাকাল ভাল করে রাইয়ের মুখের দিকে। রাইয়ের লাল স্লিভলেস টপ, জিনসের স্কার্ট, চোখের বাদামি কাজল, স্ট্রবেরি সস লেগে থাকার মতো দুটো ঠোঁট, গালের রক্তিম আভা, উত্তেজনায় স্তনদ্বয়ের ওঠানামা, সব যেন নিমেষে অধিকার করে নিল কৃষ্ণেন্দুকে। সে মিউজিক ওয়ার্ল্ডের মতো জনাকীর্ণ রাস্তায় ভরভরন্ত বিকেলে রাইয়ের রূপ-যৌবন ও আবেদনের সম্মিলিত জোয়ারে ভেসে গেল এবং অনেকক্ষণ পরে রাগ-রাগ মুখ করে বলতে পারল, “ধ্যাৎ, এটা একটা কথা হল নাকি? যাদবপুরে তোমার কত ভক্ত আছে জান?” রাই চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি সে খবর রাখ নাকি?”

আলো মুঞি জানো না

জানিলে যাইতাম না কদম্বের তলে॥

দেখতে-দেখতে তিন-চারমাস কেটে গেল। কৃষ্ণেন্দুর পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। তবে নিত্য ইউনিভার্সিটিতে পা রাখায় বিরাম নেই। ক্যাম্পাসে দেখা হলে রাই আর কৃষ্ণেন্দু উভয়েই পরস্পরকে না চেনার ভান করে। দেখাসাক্ষাৎ হয় দু’জনের, তবে সবই একটু আঁটঘাট বেঁধে। মানে ওই প্রেমও হচ্ছে, আবার ছেলেবেলার প্রিয় লুকোচুরি খেলাটাও নতুন করে একটু প্র্যাকটিস করে নেওয়া হচ্ছে। এই তো সেদিন কৃষ্ণেন্দুর ডান হাত অর্ক প্রায় ‘ধাপ্পা’ দিয়ে দিচ্ছিল। একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে। রাইকে দোকানের ট্রায়াল রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে কোনওমতে সামলেছে কৃষ্ণেন্দু। তবু রাইয়ের জন্য এই ঘিঞ্জি কলকাতাই বৃন্দাবন। যদিও কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা একটা মাত্রা অবধি এগিয়েছে, তারপর যেন থমকে গিয়েছে কেমন। কারণ, কৃষ্ণেন্দুর মধ্যে সেই কিন্তু-কিন্তু ভাবটা এখনও যায়নি। ‘কে না কে দেখে ফেললে, কী না কী হবে’, সেই দুশ্চিন্তা যায়নি। রাইয়ের মাঝে মাঝে হতাশ লাগে, যখন কৃষ্ণেন্দু বলে, “দ্যাখ রাই, যেদিন সত্যি-সত্যিই কোনও পরিচিত লোকের চোখে পড়ে যাব, সেদিন মনমেজাজ ব্যাপক খারাপ হয়ে যাবে। সেদিন থেকে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ, যা কথা ফোনে।”

ফোঁস করে ওঠে রাই এই কথা শুনে, “কথাটা এমন করে বলছ, যেন দেখা না হলে তোমার কিছুই আসে-যায় না?”

কৃষ্ণেন্দুর হাসিটা এই সময় ঠিক জমে না। রাই কৃষ্ণেন্দুর এই ইমেজ-কনশাসনেস দেখে মুখ বেঁকিয়ে বলে ওঠে, “হুঁ, পলিটিশিয়ান!”

“হ্যাটা দিচ্ছিস? পলিটিশিয়ান হতে গেলে অনেক ত্যাগ করতে হয়। আর তুই তো খালি আমাকে ভোগের পথে টানছিস,” বলে রাইয়ের চুলের ঝুঁটি টেনে ধরে দমবন্ধ করার মতো দীর্ঘ সময় চুমু খায়।

সেদিন কৃষ্ণেন্দুকে খুব মুডে পেল রাই। তার তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা গায়ে না মেখে কৃষ্ণেন্দু বলল, “এই যে রাইকিশোরী, সুখবরটা পেয়েছ? খবরটা শোনার পর আর এত নাক সিঁটকোতে পারবে না।”

“কী খবর কৃষ্ণেন্দু?” চোখ বড় বড় করে জানতে চাইল রাই।

“আমাকে আমাদের সংগঠনের রাজ্য-সম্পাদক করা হচ্ছে!” প্রচণ্ড খুশিতে ফেটে পড়ে বলল কৃষ্ণেন্দু।

“ও, তাই?” খবরটায় আনন্দিত হওয়া উচিত কি না, ভেবে পেল না রাই৷ “আমি ঠিক এটাই চেয়েছিলাম। রাই, আমার টার্গেট ফুলফিল হওয়ার ক্ষেত্রে এটা একটা প্রয়োজনীয় স্টেপ।”

“কী তোমার টার্গেট কৃষ্ণেন্দু?”

“তুই জানিস না নাকি? শোন, আজ আমি ছাত্র সম্প্রদায়ের নেতা হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু চিরকালই তাই থাকব না। তখন দল আমার নেতৃত্ব মেনস্ট্রিম রাজনীতিতে ব্যবহার করবে। আমি নির্বাচনে লড়ব, বিধানসভায় যাব, লোকসভায় যাব,। আমি আমাদের জেনারেশনটাকে শুধু হৃদয় দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করব। আমার রক্ত টাটকা, তাতে কোনও দূষিত পদার্থ মেশেনি এখনও। সেই রক্ত আমি অঞ্জলি দেব দেশকে। তুই জানিস, দেশকে আমি কত ভালবাসি। আমার দাদু ফ্রিডম ফাইটার ছিল। আমার ঠাকুরমা কত ত্যাগ করেছে দাদুকে স্বাধীনতার কাজে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। দাদু, ঠাকুরমা আমায় দেশকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। বাবার দেওয়া এ সি রুম, মা’র হাতের চিংড়িমাছের মালাইকারি এককথায় ছেড়ে দিয়ে পার্টি ডাকলে আমি গ্রামেগঞ্জে চলে যেতেও রাজি। তুই হয়তো মনে মনে হাসছিস, কিন্তু এই প্রজন্ম মানেই কর্পোরেট জীবন চায়, এটা ঠিক নয়। লোনের ফ্ল্যাট, গাড়ি, গ্যাজেটস, ছিপছিপে বউ আর ইনস্টলমেন্টে সিঙ্গাপুর— এটাই সকলের লক্ষ্য নয়। এই গণ্ডিটা ছোট, আর এই গণ্ডিটা মুছে দেওয়ার দল এখনও বেশ ভারী। ত্যাগ, কৃচ্ছসাধন, এ সব শব্দ কি শুধু ডিকশনারিতেই পাওয়া যাবে ভাবিস? তাই তো তোর সঙ্গে টাইম পাস করতে এত গিল্ট ফিলিং হয় আমার! আনইজি লাগে!”

টাইম পাস শব্দটা কাঁটার মতো বিঁধল রাইকে। কিন্তু সে সহ্য করে নিল। কারণ, সত্যিই কৃষ্ণেন্দু অনেক চেষ্টা করেছে রাইকে এড়াতে। অতএব তার বলার কিছু নেই। এবং এটাও ভেবে দেখার যে, রাই কৃষ্ণেন্দুর কাছে কী চায়। শুরুতে সে হয়তো এটুকুই চেয়েছিল যে, এই পৃথিবীতে রাই নামে একটা মেয়ে কৃষ্ণেন্দুকে পাগলের মতো ভালবাসে, এই সত্য কৃষ্ণেন্দু জানুক। ওই যারা হাত ধরাধরি করে কফিশপ থেকে শপিংমল, নলবন থেকে নিশিনিলয় দিনের পর-দিন চক্কর কাটে, সে তাদেরই অনুপাতে মিলনপিয়াসী ছিল, বা আছে কি না কে জানে! তবে রাধার কাছে মিলন মানে অন্য। রাধার কাছে একটুখানি বাঁশির সুরও অনেকখানি পাওয়া! এর বেশ কিছুদিন পর অবশেষে প্রচারের কাজে সত্যিই মাসের পর মাস জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে ঘোরার দায়িত্ব নিয়ে রাইয়ের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে সদর্পে চলে গেল কৃষ্ণেন্দু। রাই জানতও, হয় এ-কারণে, নয় অন্য কোনও কারণে কৃষ্ণেন্দুকে যেতেই হবে তার পাশছাড়া হয়ে। সে প্রস্তুতই ছিল। যতটা সম্ভব হাসিমুখে বিদায় দিল কৃষ্ণেন্দুকে। তবে যেহেতু যুগটা মোবাইলের, চোখের দূরত্ব হলেও কৃষ্ণেন্দুর শত ব্যস্ততার মধ্যেও দু’জনের শব্দের, অনুভবের যোগাযোগ থেকেই গেল। দিন-পনেরো পরে একবার কলকাতায় ঘুরেও গেল কৃষ্ণেন্দু। বলল, “নির্বাচন তো নয় রাই, ব্যাটেল, ব্যাটেল!” বলল, “দিন দশেক পরে আবার আসব।” তখন রাইয়ের চোখে আবার দশদিনের বাসি কাজল। এর কামিজের সঙ্গে ওর ওড়না, পেলব ত্বকে অনাদরের আভাস, নখের কোণে ধুলো। বইখাতা অভ্যেসবশত নাড়েচাড়ে, কিন্তু একটি শব্দও অনুধাবন করতে পারে না। কৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, রাধা পাগল হয়ে অভিশাপ দিতেন কৃষ্ণকে। স্খলিতবসনা ঘুরে বেড়াতেন সেসব জায়গায়, যেখানে মিলিত হতেন তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে। কখনও প্রস্তরবৎ বসে থাকতেন একা। রাই তুলনায় অনেক শান্ত থাকল, কিন্তু তারও তো শয়নে, স্বপনে, জাগরণে শুধুই কৃষ্ণেন্দু। সে জানে কৃষ্ণেন্দু আসবে, আবার তাদের দেখা হবে, কিন্তু খুব গোপনে। সে যা বলবে, কৃষ্ণেন্দু বুঝবে না। কৃষ্ণেন্দু যা বলবে, সে বুঝবে না। নির্বাচন অচিরেই মিটে যাবে, কিন্তু রাইয়ের বুকভরা পিপাসা মিটবে না। কারণ, কৃষ্ণের জন্য যে এর পর কুরুক্ষেত্র অপেক্ষায় আছে! সত্যি, কেন যে সে রাধা হতে চাইল, কেন যে চাইল কৃষ্ণের প্রেম, কেন সে সাধাসিধে গোপিনী হল না একজন, কেন পড়ল না সরল এক রাখালের প্রেমে মাত্র! রাই যখন এসবই ভেবে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল, তখন তার সব হিসেব উলটেপালটে দিয়ে একটা এস এম এস এল কৃষ্ণেন্দুর, ‘রাই, রাজনীতি ছাড়া আমাকে তুমি ভাবতে পার? আমিও পারি না। কিন্তু এটা স্বীকার করার পক্ষে হাই টাইম যে, রাজনীতি আমার জায়গা নয়। আর ভারতবর্ষের পক্ষে সততা, সেবা, সংকল্প—এ সব একেবারে অচল, বস্তাপচা শব্দ। কয়েকদিন ধরে নিজেকেও জিজ্ঞেস করেছি সমানে, তা হলে এখন নতুন করে কী চাইব আমি জীবনের কাছে? উত্তরে বারবার তোমার নিস্পাপ চোখ দুটো ভেসে উঠেছে। ক’দিন পরেই ফিরছি। আপাতত বড্ড টায়ার্ড। তোমার কোলে মুখ গুঁজে একটু ঘুমোতে দেবে? এবার যেদিন দেখা হবে, জিনস-টিনস নয়, একটা শাড়ি পরে এসো প্লিজ। নীলাম্বরী বা ময়ূরকণ্ঠী! তারপর প্রকাশ্যে বলব…’

ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনং

ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম ॥

উনিশ কুড়ি, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *