প্যান্টি

প্যান্টি

— আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না।

— কিন্তু আমি জানতে চেয়েছিলাম, অন্ধকারে ওই ঠোঁট কার ছিল?

— অন্ধকারে ওই ঠোঁট ছিল চুম্বনের।

— কিন্তু সে তো চুম্বন করেনি!

— করেনি?

— না, সে তো ছুটে গেল নির্জন পার্ক স্ট্রিটের দিকে!

— কিন্তু আমার জিভে তো স্বাদ ছিল রক্তের।

— রক্ত নয়, ও আমার প্রিয় রাম-বল।

— প্রিয় নয়— আমার চিরকাল ভাল লেগেছে খুঁড়ে ভোলা কুয়োর প্রথম জল।

— কিন্তু মাঘ সংক্রান্তিতে সেই জল উঠে এল যে-রাত্রে সে-রাত্রে আমি তো গভীরে নিদ্রামগ্ন অবস্থায় একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। সে স্বপ্ন ভেঙেছিল চোদ্দো বছর অতিক্রান্ত করে।

— কোথায় ভেঙেছিল সে স্বপ্ন আমার?

— ভেঙেছিল একটা মাটির ভাঁড়ের পাশে। ভাঁড়টা পড়েছিল একটা চায়ের দোকানের সামনে। দোকানটা ছিল ফুটপাত যেখানে ঘুরে গেছে সেই কোণটায়। পড়েছিল আরও অনেক মাটির ভাঁড়ের ভাঙা টুকরোর সঙ্গে, নিঃসঙ্গ। জায়গাটা একটা রডোডেনড্রন বনের মতো। যদিও প্রতিটা গাছের নীচে নীচে রাখা থাকে গাড়ি।

— স্বপ্ন ভাঙার মুহূর্তে বৃষ্টি এসেছিল। তাই স্বপ্নটা হয়ে গেল কাদা। ক্রমশ তা আরও গলে যেতে ওই মাটির ভাঁড় অবধি গড়িয়ে গেল। এর ঠিক সামান্য ব্যবধানে ছিল নর্দমার ফাঁকা ফাঁকা ঢাকনা। বৃষ্টির ফলে জলের ক্ষীণ একটা স্রোত তৈরি হয়ে, স্বপ্নটাকে টেনে নিয়ে গেল নর্দমার দিকে।

— সেই স্রোত শহরের স্রোত। সেই স্রোতের মধ্যে অজস্র নিউজ পেপার কাটিং, অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, অসংখ্য নাটক-নভেল, ট্র্যাভেলগ। এবং প্রতিটি ট্র্যাভেলগই শেষ হয় নর্দমায়। কে জানে, কে বলতে পারে আসল যাত্রা তখনই শুরু হয় কি না!

— আমি সেই স্রোতকে অবজ্ঞা করে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ঠিক সেই সময় একটা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল একটা আমারই বয়সি মেয়ে। পড়ে একবার ছটফট করেই মরে গেল। আর সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দার করে নেমে এল একজন পুরুষ। ‘এ কী করলে, এ কী করলে, বাচ্চাটার কথা ভাবলে না?’ বলতে বলতে পুরুষটি আছড়ে পড়ল মেয়েটির শরীরে।

— আমি তৎক্ষণাৎ সেই মৃত্যুটিকে নিজের করে নিলাম। বললাম —‘এ আমারই মৃত্যু হল!’ বলে, সাত-আট মাস পরে কেমন ভারমুক্ত হলাম যেন, ও সম্পূর্ণ নতুন একটা পা তুলে দিলাম ফুটপাতে!

২৯

রাত এগারোটায় চাবি দিয়ে পর পর তিনটে লক খুলে আমি ঢুকেছিলাম অ্যাপার্টমেন্টটার ভেতরে। একটা বহুতলের দ্বিতীয় তলের সবটা জুড়ে এই ফ্ল্যাট। ঢুকে কিছু মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বাইরের প্যাসেজের আলোয় ঠাওর করার চেষ্টা করেছিলাম অন্দরটা। এবং ঠিক বাঁ হাতের কাছেই দেখতে পেলাম সুইচবোর্ড। দু’পা এগিয়ে গিয়ে আমি সুইচগুলোকে জ্বালালাম পরপর। ওয়ান আফটার অ্যানাদার। না, একটা আলোও জ্বলল না। তবে, একটা পাখা মাথার ওপর সাঁ সাঁ করে ঘুরতে শুরু করল যে তা টের পেলাম।

চোখটা একটু সয়ে যেতে আমি বুঝলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা হলের একেবারে শুরুতে। হলের ওপাশে যে রাজপথ তা তখন ক্রমশ নিঝুম হতে শুরু করেছে। দেখলাম, স্ট্রিট-লাইটের আলো বড় বড় কাচের জানলার মধ্যে দিয়ে এই অন্ধকার হলে এসে পড়ে একটা অন্যমনস্ক আলো-আঁধারি সৃষ্টি করেছে এবং সেটা আমার উপকারে আসছে।

বাইরের আলোর আভায় আমি এগোলাম। এগোতে বুঝলাম হলের বাঁ ও ডানদিক, দু’দিকেই ঘর রয়েছে। কী মনে করে আমি বাঁদিকের খোলা দরজাটার দিকে চললাম।

যে ঘরটায় ঢুকলাম সেটা একটা বড় মাপের বেডরুম। সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ। এবারও সুইচবোর্ডটাকে লোকেট করতে পারলাম আমি। পটাপট অন করলাম সমস্ত সুইচ। না, এবারও কোনও আলো জ্বলল না! এবং এবারও ঘরের মাঝখানে ঘুরতে লাগল পাখা।

আমি ঘরটাকে বুঝতে চেষ্টা করলাম। হলটার মতো ঘরটা অত ফাঁকা-ফাঁকা নয়। আসবাবে ভরতি। দেখলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা আয়নার সামনে। দেওয়ালজোড়া আয়না। প্রতিবিম্বটা যেন ঠিক আমার নয়। অন্য কোনও ছায়ামূর্তির যেন তা। আমি চুলে হাত দিলাম। আশ্চর্য, প্রতিবিম্ব দিল না!

আমি আমল দিলাম না। হাতের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে ফিরে চললাম হলে।

মূল দরজা ভাল করে বন্ধ করে আন্দাজে চলন্ত পাখাটাকে স্তব্ধ করে আমি আবার গিয়ে দাঁড়ালাম ওই ঘরটায়। আমার খুবই ক্লান্ত লাগছিল। ট্রেন লেট ছিল সাত ঘণ্টা। ট্যাক্সি ধরে কোনওমতে পৌঁছেছিলাম ভদ্রলোকের কাছে চাবি সংগ্রহ করতে। তিনি দুপুর থেকে অপেক্ষা করেছিলেন।

স্টেশনে ফোন করে ট্রেন যে লেট তা জানার পর বাড়ি ফিরে যান। আবার ফিরে আসেন ও আমার জন্য বসে থাকেন। চাবি হাতে দিয়েই তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, এত রাতে ক্লাবের সমস্ত রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, নইলে তিনি আমাকে ডিনার খাইয়ে দিতেন। আমি ধন্যবাদ জানাই ও বলি যে, স্টেশনে নেমেই আমি এক প্যাকেট কেক সংগ্রহ করেছি।

তিনি, মনে হল, এই শুনে নিশ্চিন্ত হন ও আমাকে এই বহুতলের গেটে ড্রপ করে দিয়ে ফিরে যান।

অন্ধকারেই আমি আন্দাজ করলাম ঘরটার ওদিকেও একটা দরজা রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে হু হু করে ঢুকতে লাগল ঠান্ডা জোলো হাওয়া, ট্যাক্সিওয়ালা বলছিল সেদিন সারাদিনই নাকি টিপটিপ বৃষ্টি পড়েছে।

আমি ব্যালকনিতে পা দিলাম। চোখের সামনে বেশ কিছু উঁচু উঁচু বাড়ি। চোদ্দোতলা, যোলো, আঠারো, একুশ তলা— যেখানে ওঠা যায় তারপর আগুন ধরে গেলে আর নামা যায় না!

তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এলাম আমি। আমার একমাত্র দরকার ছিল স্নানের। হাতড়ে তোয়ালেটা ব্যাগ থেকে বের করে আমি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম। ধীরে ধীরে চোখ সয়ে এল। স্ট্রিট-লাইটের ভেসে আসা আলোয় পোশাক খুলে আমি শাওয়ারের নব ঘুরিয়ে স্নান করতে লাগলাম। সেই সময় আশেপাশে কোথাও ঝনঝন করে ফোন বাজতে লাগল। ফোনটা বেজেই গেল, কেউ তুলল না।

চুলের জলটা চিপে চিপে মুছে তোয়ালে জড়িয়ে আমি ঘরে এসে সটান শুয়ে পড়লাম বিছানায়। একটা নতুন ও নরম চাদরের স্পর্শ পেলাম শরীরে। আমার শীত করছিল কিন্তু উঠে ফ্যানটা বন্ধ করে দেবার বা ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে দেবার মতো শক্তিও আর অবশিষ্ট ছিল না। আমি শুয়ে থাকলাম। জেগে থাকলাম।

জেগে থাকতে থাকতে দেখলাম ভোর হল। দেখলাম রং। চাদরের রং হালকা নীল। বালিশের রং হালকা নীল। দেওয়ালের রং ক্রিম, শুধু একদিকের দেওয়ালের রং বেখাপ্পা রকম, বাদামি! অন্ধকার সরে গেল তাই খাট, ওয়ার্ডরোব, কোচ, আয়না সবই একে একে দৃষ্টিগোচর হল।

চিরাচরিত রাঙা রোদ এই সময় আমার শয্যায় এসে পড়ল। মানে আর বৃষ্টি নেই। তোয়ালেটা কখন খুলে গেছিল শরীর থেকে। শুয়ে থাকতে থাকতে আমার নগ্নতার ওপর উঠে এল রোদটা।

যখন বিছানা ছেড়ে নামলাম তখন বেশ বেলা হয়েছে। খুঁজে দেখে এলাম রান্নাঘরটা। যথেষ্ট বাসনকোসন৷ কুকিং রেঞ্জ, টোস্টার, মিক্সার সবই বর্তমান। ফ্রিজটাও চলছে ডাইনিং স্পেসের। ভাবলাম ফ্ল্যাটের বাকি অংশটা একবার ঘুরে দেখি। পরমুহূর্তেই ইচ্ছেটা রইল না। আমার তো দরকার একটা মাত্র ঘর!

আমাকে সচকিত করে এই সময় হলের কোথাও ফোন বাজতে লাগল।

ঝনঝনটা ঠিক গত রাতের ফোনের ঝনঝনানির মতো। শব্দ অনুসরণ করে সাদা হ্যান্ডসেটটা খুঁজে পেলাম আমি।

ফোন তুলে বললাম, ‘হ্যালো?’

— আমি রাতে একবার ফোন করেছিলাম, সব ঠিক আছে কি না জানার জন্য। সব ঠিক আছে না? তোমার যা যা লাগতে পারে তার সম্ভাব্য একটা তালিকা তৈরি করে আমার লোককে দিয়েছিলাম আমি। সেসব পেয়েছ তো?

ভদ্রলোকের গলায় কার্টিসি।

— হ্যাঁ, হ্যাঁ । সব পেয়েছি, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! বললাম আমি, রাতে আপনি যখন ফোন করেন তখন আমি স্নান করছিলাম!

— ও, আচ্ছা। টয়লেট-ফয়লেট সব ক্লিন ছিল তো?

— পারফেক্টলি ক্লিন!

— আয়রনটা চলছে কি না দেখে নাও। ওটা খুব দরকারি!

— হ্যাঁ ঠিকই! আমি দেখে নিচ্ছি!

— সো, দেন স্টার্ট আ নিউ ডে। যা প্রয়োজন হবে ফোন করে নেবে, ওকে! সি ইউ, বাই!

ফোন ছেড়ে দিয়ে মনে পড়ল আলোর কথা তো ওঁকে বলা হল না! সবই আছে এই ফ্ল্যাটে, শুধু একটাও আলো নেই!

আবার ফোন বাজছে। হ্যাঁ, উনিই— তোমার বান্ধবীকে ফোন করে জানিয়ে দিই যে তুমি পার্টলি সেটল করে গেছ?

—না, প্লিজ। আর কিছু জানাবার দরকার নেই। বললাম আমি। আমি… আই অ্যাম লস্ট ফর এভার! পৌঁছেছি যে, সেটুকু শুধু বলে দিন।

উনি চুপ করে থাকলেন একটু। তারপর বললেন, তোমার সঙ্গে তো জিনিসপত্র কিছুই নেই! হাউ উইল ইউ ম্যানেজ?

— কিনে নেব শিগগিরি!

— ওকে দেন!

— শুনুন…! বলে থমকালাম আমি।

— ইয়েস?

— এই ফ্ল্যাটে আমি কতদিন থাকতে পারি?

— মোটামুটিভাবে যতদিন খুশি! উনি হাসলেন। যদি না আমার হঠাৎ কোনও প্রয়োজন পড়ে যায়!

— আপনার পরিবার থেকে আপত্তি উঠবে না তো?

— আপত্তি? সামান্য একটা ফ্ল্যাট নিয়ে আমার ছেলেমেয়েরা কেন মাথা ঘামাতে যাবে?

— আর আপনার স্ত্রী? কোনও অপরিচিত মেয়েকে এভাবে নিজের জায়গায় থাকতে দেওয়াটা অনেকেই ভাল ভাবে নেবে না!

— স্ত্রী? আই ডোন্ট হ্যাভ হার এনি মোর।…

— ইউ মিন…!

— শি ইজ ডেড!

দ্বিতীয় দফায় ফোনে কথা বলার সময় আলোর কথাটা আমার পরিষ্কার মনে ছিল। কিন্তু আমি বললাম না। কেন বললাম না তা চন্দ্রগুপ্ত জানেন! স্নান সেরে নেমে এলাম পথে। কলকাতা! ট্যাক্সিতে, পায়ে হেঁটে, মেট্রোয় চড়ে আমি সারাদিন ঘুরলাম অচেনা শহরটায়! একটা সিনেমা দেখে, বাইরে খেয়ে যখন ফ্ল্যাটে ফিরলাম তখন রাত এগারোটা। পর পর তিনটে লক খুলে আলোহীন অন্দরে ঢুকে গেলাম। তারপর চোখ সইয়ে অন্ধকার বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম ও পড়ে রইলাম একভাবে। জেগে রইলাম একভাবে।

পরের দিন ব্যাগটা খুললাম আমার। দুটো-একটা পোশাক, কাগজপত্র যা ছিল গুছিয়ে রাখতে গেলাম ওয়ার্ডরোবটায়। ওয়ার্ডরোবটা একেবারে খালি ছিল। শুধু এককোণে ঝুলছিল একটা হ্যাঙার। ট্রাউজারটা ঝুলিয়ে রাখতে সেটা কাজে লাগবে ভাবলাম আমি। তখনই দলা পাকানো প্যান্টিটা চোখে পড়ল।

হাতে তুলে নিলাম ওটাকে। বিদেশি জিনিস। নরম। বাঘছাল প্রিন্ট!

তৎক্ষণাৎ জানতে ইচ্ছে হল— প্যান্টিটা কার?

অনেক বছর আগে একটা হোটেলের ঘরের বেডসাইড ড্রয়ারে আমি একটা নীল কাচের বালা পেয়েছিলাম। বালাটা হাতে নিয়ে মনে হয়েছিল নীল জল ঝরছে সেটা থেকে। সেদিনও আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল— বালাটা কার?

প্যান্টিটা থেকে কেমন একটা সোঁদা গন্ধ বেরোচ্ছিল। দেখলাম ছাতা পড়ে যাওয়ার মতো সাদা দাগ ধরে আছে। একটা মেয়ের প্যান্টিতে এই দাগ আর কীসের হবে?

প্যান্টিটা নিয়ে কী করা যায় ভাবলাম আমি। আশ্চর্য, ফেলে দিতে মায়া হল! এই একার ফ্ল্যাটে প্যান্টিটা একটা দ্বিতীয় উপস্থিতি হয়ে ধরা দিল যেন! একটা সাহচর্যের অনুভব!

ফেলে দিলাম না। প্যান্টিটাকে ওয়ার্ডরোবটার নীচের দিকের একটা তাকের মধ্যে ছুড়ে দিলাম। তারপর টয়লেটে গিয়ে হাতে সাবান দিয়ে নিলাম। কাগজপত্র ঠিকমতো ফাইলবন্দি করে ফোনটা সেরে নিলাম আগে— আপনার সঙ্গে কখন দেখা হতে পারে? বললাম আমি। আপনার চিঠিটা আমার দরকার পড়বে!

— চিঠি তো রেডি আছে। তুমি আজই নিয়ে নাও। বললেন উনি। স্নান সেরে পোশাক পরতে পরতে ভাবলাম, আলোর কথাটা আজও মনে ছিল। শহরের পথে আবার নিষ্ক্রান্ত হলাম আমি। দু’-তিনটে জায়গায় সাক্ষাৎপর্ব মিটিয়ে একটা দোকানে ঢুকে সামান্য খেয়ে নিলাম। একটা পোশাকের দোকানে ঢুকে ঢলঢলে ম্যাক্সি কিনলাম একটা। এই দু’দিনের নগ্নতা ঘুচল এবার। রাত আটটায় ওঁর সঙ্গে দেখা হল ক্লাবের বারান্দায়। উনি একটা বাংলা বই পড়ছিলেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। দাগ দিচ্ছিলেন, নোট নিচ্ছিলেন। সঙ্গে একটা বেঙ্গলি টু ইংলিশ ডিকশনারিও ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম— আপনি বাংলা পড়তে পারেন? উনি হেসে মাথা নাড়লেন। ভীষণ ভাল করে পড়তে পারি! চিঠিটা নিয়ে, ওঁর সঙ্গে স্যুপ আর ব্রেড রোল ডিনারে খেয়ে পর পর তিনটে লক খুলে অধিক রাতে আবার ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম।

শুয়ে আছি, শুয়ে আছি— একটা অস্বস্তি টের পেয়ে টয়লেটে যেতে দেখলাম যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই— পিরিয়ডস্ স্টার্ট হয়ে গেছে কখন নিঃশব্দে! এবং আমার প্যান্টিটা ভিজে উঠেছে রক্তে!

আমার কাছে কোনও ন্যাপকিন নেই। এখন, এই মধ্যরাত্রে কী উপায় হবে? রক্তে ভেজা এই প্যান্টিটা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও প্যান্টিও তো নেই আমার! ম্যাক্সি কেনার সময় মনে করে করে আরও দু’-চারটে জিনিস কেনা উচিত ছিল! এই প্যান্টিটা না বদলালে আমি শোয়া তো দূরের কথা কোথাও বসতে পর্যন্ত পারব না! আমার শরীরের ধর্ম অনুযায়ী দু’-তিন ঘণ্টার মধ্যে খুব ব্লিডিং শুরু হবে। তখন এই স্রোতের মুখ কী করে আটকাব? এত রাতে কোনও দোকান কি খোলা পাব? অন্তত যদি ন্যাপকিনটাও জোগাড় হয়!

কী করি, কী করি করতে করতে আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম হ্যাঁ, রাস্তার ও-ফুটে পার্ক মেডিসিন বলে একটা ওষুধের দোকান খোলাই রয়েছে।

মাঝে মাঝে দুটো-একটা গাড়ি হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাওয়া রাস্তায় জনমনিষ্যি নেই। বরং বলা চলে রাস্তা এখন কুকুরদের দখলে চলে গেছে। এত কুকুর?

কালো ট্রাউজারটা ঘেন্না ঘেন্না করে আবার গলিয়ে নিয়ে আমি লিফটে করে নীচে নামলাম। দারোয়ানকে ডেকে গেট খোলালাম। বললাম, ওষুধ কিনে এক্ষুনি ফিরছি!

ন্যাপকিন কিনে এনেই টয়লেটে ঢুকলাম। স্ট্রিট-লাইটের আভায় দেখলাম প্যান্টিটার একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। কাল সকাল দশটার আগে কি কলকাতার কোনও দোকান খোলা পাব যেখানে আন্ডার গারমেন্টস কিনতে পাওয়া যায়? সারারাত এটাকে টলারেটই বা করব কী করে? এই রক্তেভেজা প্যান্টিতেই ফ্রেশ ন্যাপকিন আটকাতে হবে ভেবে অসহ্য লাগতে থাকল আমার। কালই একটা বাল্‌ব কিনে এনে অন্তত টয়লেটের আলোটা ঠিক করতে হবে। সকালে আমি দেখেছি ফ্ল্যাটের কোনও হোল্ডারেই বাল্‌ব নেই। সব বাল্‌ব একসঙ্গে কেন খুলে নেওয়া হল কে জানে? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব একসঙ্গে ভাবতে চেষ্টা করতে লাগলাম আর আমার ঊরু বেয়ে অন্ধকারের দিকে ঝরতে থাকল ফোঁটা ফোঁটা রক্ত!

দুঃখিত আমি শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে যেই নব ঘোরালাম আর ঠান্ডা জল ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর, আমার মনে পড়ে গেল ওয়ার্ডরোবটার ভেতরে খুঁজে পাওয়া হলুদ কালো প্যান্টিটার কথা। কিন্তু না, পরের ব্যবহৃত প্যান্টি, তাও ছাতা পড়া— আর যাই হোক সেটা কিছুতেই ব্যবহার করতে পারি না আমি। কে জানে ওটা কার? এবং কত বছর ওখানে ওভাবে পড়ে আছে?

বাঘছাল প্যান্টি পরত যে মেয়ে সে নিশ্চই খুব ওয়াইল্ড নেচারের! অন্তত যৌনতার ক্ষেত্রে। প্রশ্ন হল কতখানি ওয়াইল্ড সে। আমার থেকে বেশি না কম?

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে আমি আমার রক্তেভেজা প্যান্টিটা কল খুলে দু’হাতে ডলে ডলে ধুতে শুরু করেছি বুঝতেই পারিনি। কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে শেষে ভাল করে ধুয়ে টয়লেটের রডেই ওটা মেলে দিলাম। নিজেকে বোঝালাম এখন ওই প্যান্টিটা পরা ছাড়া আমার কোনও উপায় নেই। বোঝালাম আমি তো ওই ছাতা পড়া অংশটার ডায়রেক্ট কনট্যাক্টে আসছি না। আমি তো মাঝখানে স্যানিটারি টাওয়েল রাখছি।

তোয়ালে দিয়ে গা মুছে আমি বেডরুমে ফিরলাম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করলাম প্যান্টিটাকে। থমকালাম এক মুহূর্ত। তারপর বিছানার ওপর রাখা ন্যাপকিনটা স্টিক করে নিলাম ওটায় আর পরে নিলাম।

আমি গলিয়ে নিলাম প্যান্টিটা।

আমি জানতাম না আমি আসলে একটা মেয়েকেই গলিয়ে নিলাম।

আসলে তার নারীত্বকে গলিয়ে নিলাম আমি।

তার যৌনতাকে, তার প্রেমকে গলিয়ে নিলাম।

তার বাসনা, ব্যভিচার কিংবা পাপকে, তার অপমান এবং দুঃখকে, তার লজ্জা এবং ঘৃণাকে গলিয়ে নিলাম। আমি জানতাম না আমি তার জীবনকে গলিয়ে নিলাম। তার পরাজয়, তার ফিরে যাওয়াকেও গলিয়ে নিলাম আমি৷ আর তার দেশকেও তন্মুহূর্তে গলিয়ে নিলাম। তার পৃথিবীকে নিয়ে সামান্য কথা ভাবতে লাগলাম কত। আমি ভাবলাম মেটিরিয়ালটা খুব ভাল। সফ্‌ট। ফিটিংস নিখুঁত। যেন আমারই জন্য অর্ডার দিয়ে তৈরি! পরে নেওয়ার পর আমার আর ঘেন্না করছিল না। চুলটা বালিশে মেলে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। যদিও আমি স্বীকার করি না যে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে ঘরের মধ্যে হতে থাকা একটা শব্দে ঘুম ভেঙেছিল আমার।

ওরা আদর করছিল নিজেদের! চুম্বন করছিল! ওরা উন্মাদের মতো মিলিত হচ্ছিল! ওরা হাঁপাচ্ছিল কিন্তু খেলাটা শেষ করছিল না কিছুতেই। যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল ওভাবেই। ওই প্রক্রিয়ায়— যতক্ষণ না মূৰ্ছিত হলাম আমি।

সেই প্রথম দিন আমি ওদের বুঝতে পারিনি। নানা আশ্লেষ ধ্বনিতে চোখ মেলে তাকিয়েছিলাম আর ভয় পেয়েছিলাম— বেডরুমে এরা কারা! কিন্তু বেডরুমে কেউ ছিল না— ওরা ছিল দেওয়ালে। সেই দেওয়ালটায়, যে দেওয়ালটার রং গাঢ় বাদামি। বেমানান দেওয়ালটার মধ্যেই ওরা দু’জনে ছিল— নগ্ন, সঙ্গমরত, প্রলাপরত, ক্রন্দনরত ওরা!

ধীরে ধীরে আমি বুঝলাম ওরা সেসব দিনেই ফিরে আসে যেসব দিনে ওই প্যান্টিটা পরি আমি। ওই বাঘছাল প্যান্টিটা! আমি মেয়েটাকে বলতে শুনলাম, ‘এই একটাবার নিযুক্ত অবস্থায় কেটে যেত যদি ত্রিকাল, ক্ষয়ে যেত যদি..!’ সে আকাঙ্ক্ষার কথা শুনে আমার মনে হল আমার যোনির মধ্যে অস্থির ঘুরতে থাকা দীর্ঘ, দীর্ঘতর, দীর্ঘতম সমস্ত প্রত্যাশার মৃত্যু ঘটেছে। আমি আর তাই জীবনকে তাড়া করতে পারছি না। আমার অসুখ উৎপন্ন হচ্ছে। আমার পথ শেষ হচ্ছে ক্রমশ…!

দিন কাটতে লাগল নিরাকারভাবে। সমস্ত দিনের শেষে মনে পড়ত না ঠিক কী কী করে কাটল দিনটা। কী কাজে, কী অকাজে! রাত বারোটা বাজার আগেই সবটা দিনের কথা ভুলে যেতাম আমি।

একটা বাল্‌ব পর্যন্ত কেনা হল না!

একটা প্যান্টিও কেনা হল না!

মধ্যে মধ্যে ওদের অসহ্য লাগত আমার। আমি চাইতাম ওরা ব্যাপারটা শেষ করুক একদিন।— কিন্তু ওরা শেষ করত না। ওদের মিলন চলতেই থাকত। মরিয়া হয়ে প্যান্টিটা আমি খুলে ছুড়ে ফেলে দিতাম ব্যালকনিতে! ওরা তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে যেত।

সকাল হলে কিচেনে ঢুকে চা বানাতাম। চা খেতে খেতে আবার আমার মায়া জন্মাত। শ্লথ পায়ে ব্যালকনি থেকে প্যান্টিটা কুড়িয়ে নিয়ে এসে আবার ঠেলে দিতাম ওয়ার্ডরোবে। প্যান্টিটার মধ্যে থেকে তখন নিশ্চিন্তভাবে আমার গন্ধ বেরোত। আমার গন্ধ! আশ্চর্য!

১৫

একদিন হঠাৎ মায়া হল।

আজ এতদিন এখানে আছি কিন্তু একদিন হঠাৎ-ই মায়া হল। রোজ দেখি কীভাবে ওরা বেঁচে আছে! দেখে দেখে ভাবি ওদের জন্য রাষ্ট্র বা সরকারকে দায়ী করতে পারি না আমি। কেননা, ওরা শুয়ে থাকে। বিপজ্জনকভাবে শুয়ে থাকে।

ওরা ঘুমোয়! যখনই দেখি, ওদের তিন-চারজনের মধ্যে অন্তত তিনজন ঘুমোচ্ছে। অন্যরা শূন্য চোখে বসে আছে হাত-পা ছড়িয়ে। মুভমেন্ট বলতে মাথা চুলকানো, নাক খোঁটা, থুতু ফেলা।

এমনকী সারাদিনে ওদের কিছু খেতে দেখা যায় না! রাত সাড়ে বারোটার সময় যখন পাশের রেস্টুরেন্টের ঝাপ বন্ধ হয় তখন দোকানের বয়-বেয়ারারা প্রথমে, ওরা ফুটপাতের যে অংশে থাকে, সেখানের ডাস্টবিনে একটা ঢাউস বালতি ভরতি করে নিয়ে গিয়ে নানা সুখাদ্যের উচ্ছিষ্ট উপুড় করে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে ডাস্টবিনে ঝাঁপিয়ে পড়ে গাদাখানেক কুকুর। এই সময় ওরা যারা ঘুমোচ্ছিল তারা উঠে বসে। এর পরেই রেস্টুরেন্টের কেউ প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে বেশ অনেকটা পরিমাণে খাবার দেয় ওদের। একমাত্র তখনই ওদের খেতে দেখতে পাই! আমি জানি না ওরা কোথা থেকে এসেছে, জানি না কেন ওদের ঘর নেই! গাঁয়ে-গঞ্জে কত জমি-জায়গা তো আছে যা পতিত, যার কেউ মালিক নয়, সেসব জায়গায় চলে গিয়ে কেন ওরা ঘর বানায় না? কেন এই অন্ধ শহরে পড়ে থাকে? ফুটপাতে পড়ে থাকে? কীসের নেশায়? কেন কোনও বস্তির তিনফুট বাই চারফুট অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ছিটেবেড়ার ঘর পর্যন্ত জোটাতে পারেনি দলের ওই মেদহীন, স্বাস্থ্যবান তরতরে যুবক দুটি?

আমি জানি না, বৃষ্টি পড়লে ওরা কোথায় যায়? যখন রাতবিরেতে বৃষ্টি নামে আমি গিয়ে দাঁড়াই ব্যালকনিতে—ওদের খোঁজে। কাউকে দেখতে পাই না। যেসব বাথরুমে আরশোলা বেরোয় অন্ধকারে, আলো জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেমন কোথায় লুকোয় তা টের পাওয়া যায় না—ওরা তেমনই বৃষ্টি নামলেই যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়!

ওদের শরীরের ভাষা বলে ওরা গ্রামের লোক নয়। কোনও বন্যা বা দুর্ভিক্ষে ডুবে যাওয়া অথবা রুখাশুখা জমি, ঘর, গোয়াল, তুলসীমঞ্চ, সন্ধেবেলার পঞ্চাননতলার জমায়েত ছেড়ে, পালাগান, যাত্রার আসর ছেড়ে, আতঙ্কে; অতর্কিতে; পোঁটলায় দু’-চারটে জিনিস বেঁধেছেঁদে চলে এসে শেষে সর্বস্বান্ত হয়ে এই ফুটপাতে আশ্রয় নেওয়া ভিখিরি নয় ওরা। এমনকী ওরা ভিখিরি কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার—আমি ওদের ভিক্ষে করতে দেখিনি কখনও।

ওরা যথেষ্ট উদাস। আকাশের নীচে সে উদাসীনতা মানানসই। কংক্রিটের ফুটপাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার নীচে সহজ ওদের ঘুমোনো, জেগে ওঠা, ভাত খাওয়া, আচমন। এবং ওরা এখানেই মিলিত হয়! বড় বড় ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সেইসব রাতে শুনশান পথের অন্ধিসন্ধি পর্যন্ত দেখা যায় যখন—জানি না কোথায় ওরা আড়াল পায়! আমি এখানে এসে উঠি যে-সময়, সে-সময় এই ফুটপাতটা ফাঁকাই ছিল। তার কিছুদিন পরে এল ওরা। বউটার কোলে তখন মাস দু’-তিনের একটা মেয়ে। বছর ঘুরেছে কি ঘোরেনি—ওর কোলে এখন দশ-পনেরো দিনের বাচ্চা একটা! অতএব এই ফুটপাতেই যে ওরা সঙ্গম করে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

ওদের যে একেবারে কিছু নেই—তা কিন্তু নয়। থালা বাটি আর পলিথিনের শিট আছে। শীতে ওরা কাঁথা গায়ে দেয়। মাথার কাছে মশার ধূপ জ্বালায়। ওদের গান শোনবার ছোট একটা যন্ত্রও আছে দেখেছি আমি। একটা কাঠের প্যাকিং বাক্সের মধ্যে আরও জিনিসপত্র গোছানো আছে বলেই আমার ধারণা।

দলে ওদের দুটি পুরুষ, বয়স বাইশ-তেইশ করে হবে, একটি দশ-বারো বছরের ছেলে আর বছর যোলো থেকে কুড়ির মধ্যে দুটি সন্তানবতী ওই বউ।

আর একটি সমবয়েসি ছেলে, মেয়ে দেখি আসে যায়। ওদেরই কথাবার্তা থেকে বুঝেছি যে দুটি পুরুষের একটি বউটির স্বামী, অপরটি ভাই। কোনও যন্ত্রণার ছাপ কখনও দেখিনি ওদের চোখেমুখে। কোনও আক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। এভাবে বেঁচে থাকাকে অসার্থক বেঁচে থাকা বলে যেন ভাবছে না ওরা। যেমন দেখেছি আমি ওদের, দিনের পর দিন— পুরুষটি ঘুমোচ্ছে, বউটি বসে আছে পা ছড়িয়ে, গাছে হেলান দিয়ে, দৃষ্টি সুদূরে। বছরখানেকের মেয়েটা মায়ের নোংরা, ছেড়া ব্লাউজ সরিয়ে শীর্ণ স্তন নিজের হাতে গুঁজে দিচ্ছে মুখে। মা যে সেই সংযোগ অনুভব করছে, তাও মনে হচ্ছে না। এত জমাট, অবসন্ন, নিরুত্তেজিত চোখমুখ। তারপরই মেয়েটা হয়তো হামা দিয়ে চলে গেল ফুটপাতের ধারে—যেখানে নর্দমার ঢাকনাহীন মুখ হাঁ করে আছে। মেয়েটা যে-কোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে কিন্তু পড়ছে না! মেয়েটা যদি চঞ্চল হত তা হলে এক পা-দু’ পা দূরের ছুটে যাওয়া চলন্ত গাড়ির স্রোতের নীচে পড়ত গিয়ে। কিন্তু মেয়েটা দুর্বল, চেঁচায় না, কাঁদে না, খেতে চায় না। শুধুই ঘুমোয়। ঘুম থেকে উঠলে মায়ের স্তন হাঁটকায়। এবং ফুটপাতের শেষপ্রান্ত থেকে আবার হামা দিয়ে দিয়ে ফিরে আসে মায়ের কাছে ঠিক।

শুধু একদিনই বউটার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেছিল আমার। মাঝরাতে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম ব্যালকনিতে। দেখলাম বউটা মাটিতে গড়াচ্ছে আর পুরুষটা যে কিনা ওর স্বামী, ওর পিঠে লাথি কষাচ্ছে একটার পর একটা। বউটার ভাইটা, বেঁটেখাটো, শক্তসমর্থ—ঠিক বাধা দিচ্ছে যে তা নয়। কাকুতিমিনতি করে বলছে, ‘ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, যা করেছে করেছে আর করবে না!’

স্বামীটা বলল, ‘মাগি, আমাকে করতে দেয় না কেন, জিজ্ঞেস কর!’

ভাইটা বলল, ‘ভরা মাস, দেখছিসই তো! মারিস না, মারিস না। এখন যদি মরে যায় তা হলে তোর এই মেয়েটাকে নিয়ে তখন কী করবি বল?’ বউটা নিঃসাড়ে মার খাচ্ছিল, এবার ছিটকে উঠল, ‘মারতে দে, ঢ্যামনাটাকে মেরে ফেলতে দে আমাকে!’

আমি হতভম্ব হয়ে দেখছিলাম, এ কী, বউটা আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে না কেন?

ভাইটা চেঁচাল, ‘ওই দ্যাখ, জল ভাঙছে, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে…!’

হাতের এক টুকরো কাঠ মেয়েটার মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ে দিয়ে ছেলেটা অন্ধকারের দিকে চলে গেল। আর আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাইটা ছুটল সেদিকেই। কিছুক্ষণ পরে গায়ে-পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে স্বামীটাকে ফিরিয়ে আনল গাছতলায়। বউটা তখনও কঁকাচ্ছিল। আমি স্পষ্ট শুনলাম ভাইটা বলছে, ‘এত মাথা গরম কেন করলি তুই হঠাৎ? ওর কী অবস্থা দ্যাখ একবার! কটা দিন ধৈর্য ধর। তারপর তো তোর সুখের সংসার। মেয়ে আছে, এবারেরটা যদি ছেলে হয় সবাইকে গর্ব করে বলতে পারবি আমার এক ছেলে, এক মেয়ে! আর তোর কী চাই রে? দ্যাখা দেখি, তোর থেকে বেশি সুখী কে এখানে?’ বলে শহরের এই অভিজাত পাড়ার নিবু-নিবু আলো জ্বলা; এ. সি-র কারণে চেপে বন্ধ করা জানলার হাইরাইজগুলোর দিকে আঙুল তুলে তুলে দেখাতে লাগল। সেই আঙুল আমার ব্যালকনির দিকে ঘোরার আগেই আমি ছিটকে সরে এলাম।

সেদিনই একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। দেখলাম শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত আর কিছু নেই, শুধু টানটান হয়ে পড়ে আছে ফুটপাত! ঘর নেই, বাড়ি নেই, দোকানপাট নেই, মেট্রো নেই, ভিক্টোরিয়া নেই, যানবাহন নেই, কেবল মাইলের পর মাইল কংক্রিটের ফুটপাত অতিকায় সরীসৃপের মত পড়ে আছে। আর বদলে গেছে এ পৃথিবীর আবহাওয়া। বাতাসের শরীরে রং এসেছে, লাল রং। যেন স্বচ্ছ লাল ওড়না ভেসে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। আর সূর্যের রংও লাল। সেই লাল আলোয় কী শান্তই না দেখাচ্ছে

ফুটপাতগুলো!

এরকমই চলছিল— কিন্তু হঠাৎ মায়া হল! যখন—

বউটার আবার একটা মেয়ে হল! বউটা কচি বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে লাগল কোলে তুলে। আর আমি দেখলাম এক বছরের মেয়েটা মাটিতে উপুড় হয়ে ফোঁপাচ্ছে! শুধুই ফেঁপানো। ব্যস, আর কোনও প্রতিবাদ নেই। কেননা, যতবার মা’র বুকের কাছে গেছে মেয়েটা, মা ওকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। চড় মেরেছে। তাই মেয়েটা কাঁদছে। লাল ঝরা ঠোঁট ফুলে ফুলে উঠছে। বোঝা যাচ্ছে ছোট্ট বুকে কী দুঃখের ভার!

এতদিনের শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলাম যে আমি— তা আমি বুঝতে পারিনি! রাষ্ট্র বা সরকার কাউকে ওদের জন্য কিছু মাত্র দায়ীও করিনি আমি। এমনকী ওদের অবস্থাটাকে দুরবস্থা বলেও মনে করিনি কখনও। কেননা, আমি জানি, ওরা দিন জুড়ে ঘুমোয়। কেননা, আমি জানি, যারা খায় অথবা খায় না তারা দু’দলই মরে পৃথিবীর চাতালে পড়ে। কিন্তু আমি জানতাম না, ভাত খেতে খেতে শিশুটি যখন তাকাবে আমার দিকে তখন ওকে খুব সুন্দর দেখাবে, এত সুন্দর যে হিংসে হতে পারে!

সামান্য ভাত আর ডিমসেদ্ধ নুন ছড়িয়ে পলিপ্যাকে ভরে ফেললাম, তারপর বেডরুম পার করে ছুটলাম ব্যালকনির দিকে। চোখ পড়ল আয়নায়— দেখলাম, আমার ডানা দুটো খসে গেছে, পিঠের ব্যথাটাও আর নেই!

ওদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হল আমার—সেই প্রথম। আসলে, তখন তোমার সঙ্গেও সম্পর্কটা সুসম্পন্ন হয়েছে। আসলে তখন তোমাকে বলে ফেলেছি আমি, ‘তোমার কাছে থাকতে চাই!’

সে হাঁটছিল। শহরটার প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে আসা একটা লেন ধরে হাঁটছিল। কাজ—কাজ ফেলে রেখে উঠে এসে হাঁটছিল কখন থেকে। তখন সবে হৃষ্ট কালো হয়ে উঠছে আকাশের রং!

১১

হাঁটতে হাঁটতে সে চিন্তা করছিল দুটো শব্দ নিয়ে—বৈধতা এবং অবৈধতা! সে ভাবছিল যে সে দেখেছে মানুষের অস্তিত্ব কী প্রকটভাবে বৈধতা এবং অবৈধতা, এই দুই শব্দের ভেতরের বিরোধের কাছে আত্মসমর্পিত! অথচ অবৈধতাই বৈধতার চরম উৎকর্ষ।

বৈধতা এবং অবৈধতাকে নিরূপণ করার তাগিদে সে একদিন যেতে চেয়েছিল এমন এক শূন্য সাম্য ব্যবস্থায় যা প্রকৃতি নয় আদৌ! সে এমনটা খুঁজেছিল—কিন্তু পায়নি!

বহুক্ষণ চলার পর যখন সংবিৎ ফিরল তার তখন সে আবিষ্কার করল এই গলিটাকে। দেখল জায়গাটা তার অজানা!

গলিটা সংকীর্ণ এবং নির্জন। দু’পাশে ভাঙাচোরা বাড়ি। দেওয়ালগুলো ইট বের করা। নোনা লাগা। জানলার পাল্লাগুলো ভেঙে ঝুলে আছে, পাইপ লাইন থেকে গলে গলে পড়ছে ময়লা জল৷ সেই জলের মধ্যে থেকে প্রাণরস টেনে নিয়ে ঝাঁকিয়ে উঠছে অশ্বত্থর চারা। খানাখন্দে ভরা গলিটার প্রতিটা বাড়ির মাথায় তিন-চারটে করে অ্যান্টেনা। অ্যান্টেনাগুলোয় বসে আছে অজস্র কাক। এত কাক যে এই সব কাক একসঙ্গে ডানা মেললে শহরটা অন্ধকার হয়ে যাবে!

তখন একটা-আধটা মাত্র হাতে টানা রিকশা, সাইকেল পেরিয়ে যাচ্ছিল গলিটাকে। একটা-দুটো পথচলতি মানুষ যারা হাঁটছিল গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে। জ্বলে জ্বলে উঠছিল তাদের সিগারেটের আগুন৷ হঠাৎই একজন পথচারীকে দেখে উ-উ-উ করে ডেকে উঠল একটা কুকুর! সে আর একটু এগোতেই গলিটা ঝপ্‌ করে ঢেকে গেল নিকষ আঁধারে। লোডশেডিং একটা ব্ল্যাক প্যান্থারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে খেয়ে ফেলল গলিটাকে। সব ডুবে গেল ঘাতক অন্ধকারের থাবায়।

সে কী করবে ঠিক বুঝে পেল না। এগোবে? নাকি পিছোবে? দুটোই সমান অর্থহীন মনে হল তার। এমনকী মেধার ভেতরের অন্ধত্বকেও অনুভব করল সে।

চতুর্দিকের চরম নৈঃশব্দ্যকে খেয়াল করে বিস্মিত সে তখনই নিদারুণ চমকে উঠল এক আশ্চর্য স্পর্শকে ঠোঁটের ওপর টের পেয়ে!

ঠোঁটের ওপর, শুধুমাত্র ঠোঁটের ওপর নেমে এল কার যেন ঠোঁট! আর কোত্থাও তাকে ছুঁল না কিচ্ছুতে, আপাদমস্তক অস্পৃষ্ট ও মুক্ত থাকল যখন পুরোপুরি, তখন ঘন অন্ধকারে অচেনা কারও ঠোঁট গভীরতম ভাবে চুম্বন করল তাকে! তখন তাকে চুমু খেল কেউ এমনভাবে যে এক মৃদু দংশনজনিত ব্যথা, শোষণ, উত্তাপ, লালা এবং অপরিচিত কষ্টের হলকা সম্মিলিতভাবে ছড়িয়ে পড়ল তার ওষ্ঠে!

চুম্বন! চুম্বন! চুম্বন! —আমূল বুঝল সে চুম্বন! এই-ই চুম্বন তবে?

এই-ই চুম্বন তবে, যখন তা বাকি শরীর থেকেও মুক্ত? যখন তা হৃদয় থেকে, চৈতন্য থেকে, এমনকী জ্ঞানের বিঘ্নতা থেকেও সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে, সমস্ত পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্যুত হয়ে শুধুমাত্র একটা ঠোঁটের সঙ্গে একটা ঠোঁটের জুড়ে যাওয়া? যখন তা শুধুমাত্র দুটো ঠোঁটেরই মিলন? একক মিলন?

সেই অন্ধকারে অশরীরী দুটো ঠোঁট তার ঠোঁট, জিভ, মাংসল মুখগহ্বর সব ভরিয়ে দিতে লাগল চুমুর আস্বাদে আর সে টানটান দাঁড়িয়ে সেই মৌলিকতাকে উপভোগ করতে লাগল চোখ বুজে! তার নেশা ধরে গেল! যখন চুম্বন শেষ করে তাকে ছেড়ে চলে গেল ঠোঁটটা তখন প্রথম যা ফিরে এল তার কাছে তা শব্দ! সে লোহা পেটানোর শব্দ, বাসের চাকার শব্দ এবং কাছেই কোনও বাড়ি থেকে ভেসে আসা ঘুঙুরের শব্দ পেল একে একে। অমনিই পথবাতিগুলো জ্বলে উঠল, লোক চলাচল শুরু হল। উ-উ-উ করে ডেকে উঠল একটা কুকুর।

তার কান্না পেল। নিজের ঠোঁটের ওপর হাত রেখে সে দাঁড়িয়ে রইল বহুক্ষণ!—এতকাল সে ভেবেছে যে সে জানে চুম্বন কী? যেমন ভেবেছে সে জানে প্রেম কী, শরীর কী, শিল্প কী? অথচ আসলে সে এসব কিছুই জানে না!

ধীরে ধীরে আবার হাঁটতে শুরু করল সে। অতিক্রম করল গলিটাকে।

তখনই অকস্মাৎ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল অবৈধতার মূল মানে৷

এরপর অনেকবার সে ফিরে ফিরে এসেছে গলিটায়। সন্ধে হয় হয় সময়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। প্রতীক্ষা করেছে আলো নিভে যাওয়ার, প্রতীক্ষা করেছে চুম্বনের!

১৮

আমি চলে যেতাম। কিন্তু বর্ষায় গাছগুলো এমন বেড়ে উঠল, মায়ায় যেতে পারলাম না! সেদিন বিকেলেও তো একটা পাতলা, ঝিরঝিরে পাতার ঝাউগাছ কিনে এনেছিলাম যেদিন তুমি আমাকে চলে যেতে বললে। তুমি বললে, ‘তুমি যা বলেছ, তুমি কি সত্যিই তাই ভাব? ইউ মিন ইট?’ আমি ঝরনাটার দিকে তাকালাম, ক্লাবের বারান্দায় তখন কেউ ছিল না। বললাম, ‘হ্যাঁ!’

তুমি ভদ্‌কার গ্লাসটা উপুড় করে দিলে গলায়।

বললে, ‘যদি তাই ভাব, দেন প্রমিস মি, তুমি চলে যাবে?’

আমি তোমার দিকে চোখ ফেরালাম।

তুমি বললে, ‘অপারেশন হয়ে সুস্থ হতে তোমার সাত-আট দিন লাগবে, তারপর চলে যেয়ো তুমি!’

আমি ‘হ্যাঁ’ বললাম।

বললাম, ‘ঠিক আছে!’

‘ইটস আ ডিল…!’ বলে হাত বাড়ালে তুমি।

‘ইয়েস আ ডিল!’ বলে আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। দেখলাম, তোমার হাতটা অতিরিক্ত ঠান্ডা! আমার স্পর্শ গ্রহণে অক্ষম!

‘এই বিষয়ে আর কোনও কথা বলার প্রয়োজন শেষ হল আজ!’ বললে তুমি।

উত্তরে আমি বললাম, ‘বেশ।’

‘চলো, উঠে পড়া যাক।’ বলে টেবিল থেকে গাড়ির চাবি তুলে নিয়ে তুমি ক্লাবের হল পার হয়ে পোর্টিকোর দিকে এগোলে। আমি তোমার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলাম। হলে তখনও বেশ ভিড় ছিল। আমাদের দেখে হাত নেড়ে ‘গুডনাইট’ বলল অনেকে। কেউ বলল, ‘চলে যাচ্ছো তোমরা?’ আমি সেই সব পরিচিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নাড়লাম। মনে মনে বললাম, ‘যাওয়া, না-যাওয়া দুটোই আসলে একটা করে সিদ্ধান্ত।’

‘সিদ্ধান্ত’ শব্দটা মনে আসতে আমার তৎক্ষণাৎ একদিনের ঘটনা মনে পড়ল। একদিন তোমার বন্ধু এবং বন্ধুপত্নীর সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে ‘সিদ্ধান্ত’ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল আমাদের। তোমার বন্ধু বলেছিলেন, ‘জীবনে অনেক সময় এই ব্যাপারটা হয়েছে আমার, জানো! সামনের পথ দেখতে পাচ্ছি না। সমস্তটা যেন কুয়াশায় ঢাকা। এগোব, না পিছোব? হয়তো-বা মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে আছি একটা Y-এর মুখে। সামনে এক বা একাধিক রাস্তা। কিন্তু কোনটা বাছব সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না!

তুমি বললে, ‘তোমার আত্মা তোমাকে বলবে ঠিক, তুমি কোন পথে যাবে। তুমি আত্মার স্বর শুনতে পাবে।’

‘অনেক সময় সেটা কোনও স্পষ্ট ভাষ্য নয়।’ বললেন তোমার বন্ধু, ‘অনেক সময় কোন সিদ্ধান্ত থেকে কী ফলাফল হবে অভিজ্ঞতা তা জানে না। আত্মায় তার কোনও সূত্র জমা পড়েনি। আত্মাও তাই দ্বিধাগ্রস্ত। তখন? তখন কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবে তুমি? বলো?’

‘নিজেকে বুঝতে হবে ভাল ভাবে। নিজে কী চাইছ তা বুঝতে হবে।

আসলে, জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত জীবন শুরু হওয়ারও আগে থেকে নেওয়া থাকে আমাদের। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর সেটা কেবল মাত্র জানতে পারি আমরা। জানতে পারি যে, এই বা ওই সিদ্ধান্তটা আসলে নেওয়া ছিল আমার বা তোমার বা যার সিদ্ধান্ত তার একেবারে অবিহিতকালের শুরুতেই।’

তোমার বন্ধুপত্নী চায়ের কাপ নামিয়ে রেখেছিল। এবং উৎসুক চোখে তোমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘ব্যাখ্যা করো!’

‘ব্যাখ্যা করা মুশকিল!’ বললে তুমি, ‘হয়তো-বা অসম্ভবও। একটা উদাহরণ দিতে পারি। ধরো আমি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ চাপা দিয়ে ফেললাম কোন পথচারীকে। এবার জখম লোকটাকে নিয়ে আমি কী করব, সেই সিদ্ধান্ত আমার নেওয়া আছে আমার জন্মের শুরুতেই! আমি খালি সময়ের মুখে দাঁড়িয়ে অনুভব করব মস্তিষ্কের ভেতরে একটা মৃদু দপদপানি৷ সেখানেই আমার নেওয়া সব সিদ্ধান্তগুলো জমে আছে আর ঘটনার স্রোতে পড়ে অপেক্ষায় আছে বেরিয়ে আসার…!’

তুমি গাড়ি চালাচ্ছিলে, আমি তোমার পাশে বসে সেদিনের কথাই ভাবছিলাম। এলগিন রোড পার হতে হতে তুমি বললে, ‘ওষুধটা খেয়ে নিয়ো রাতে!’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, ‘না, আর ওষুধ খাব না।’

‘ব্যথা বাড়লে তখন কিন্তু ফোন করে কাঁদবে না৷’

‘না, কাদব না।’

‘সব ফোনের রিংগার অফ করে শুয়ে পড়ব আজ। এত মাস ধরে অনেক ডিস্টার্বেন্স সহ্য করেছি। আর নয়!’

‘দুটো-চারটে দিন সময় দাও। আমি চলে যাব।’ বললাম আমি।

তুমি ব্রেক কষলে, ‘মানে? বললাম তো অপারেশনের পরে চলে যেয়ো!’

‘আমি অপারেশন করাব না!’

তুমি অস্থির হয়ে জলের বোতলটা খুঁজতে লাগলে গাড়ির ভেতর। আমি তোমাকে কোনও সাহায্য করলাম না। জল না পেয়ে তুমি আবার স্টার্ট করলে গাড়ি। আমাকে নামিয়ে দেওয়ার পর দু’মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে উড়ে গেলে।

আমি ফ্ল্যাটে ফিরে জামা-কাপড় না বদলেই শুয়ে পড়লাম। শুতে শুতে ভাবলাম একটা আস্তানা খুঁজে বার করতে হবে দ্রুত। জিনিসপত্র প্যাক করতে হবে। একটা-দুটো করতে করতে এই দেড় বছরের মধ্যে অজস্র জিনিস এসে জড়ো হয়েছে। ভাবলাম, শুধু শুধু বোঝা বাড়ালাম! আমাকে যে চলে যেতে হবে যে-কোনওদিন একথাটা মাথায় রাখা উচিত ছিল।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল— কলকাতা শহরে কি চাইলেই বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে? স্পেস?

খুব ভোরে গিয়ে দাঁড়ালাম ব্যালকনিতে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। শান্ত দেখাচ্ছিল শহরকে। আমার নজরে পড়ল গাছগুলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতে কত গাছ এখন আমার সংগ্রহে! কেউ ঝুলে আছে, কেউ বসে আছে বিশেষ পাত্রে। এই যে প্রাতর্ভ্রমণকারী—এই শহর আর আধঘণ্টার মধ্যে জেগে উঠবে। শয়ে শয়ে মানুষ, যানবাহন বেরিয়ে পড়বে পথে। শব্দ বাড়বে। সকালে কাচা জামা বিকেলে শুকিয়ে ওঠার আগেই কালচে দেখাবে। তিন-চার দিনে গাছের পাতার ওপর ধুলো পড়বে এমন যে চেনাই মুশকিল।

কিন্তু এখন বর্ষা চলছে তাই আমার এই ব্যালকনির গাছগুলোর কোথাও লেগে নেই কোনও মালিন্য। বরং তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে সব কটাই। এখন, এই মুহূর্তে দেখে মনে হচ্ছে ওরা আমার কাছে থাকতে পেরে কত খুশি! এই ঠান্ডা হাওয়ায় যেন মাথা দুলিয়ে হাসছে সকলে।

আমার মন খারাপ লাগছে কি? এই গাছগুলোকে ফেলে রেখে চলে যেতে হবে ভেবেই মন খারাপ লাগছে কি? আমি কি একটা বাড়ি খুঁজে পাব দু’দিনে যেখানে এই গাছগুলো, বর্ষার জলে নতুন করে প্রাণ পাওয়া, ঝকঝকে গাছগুলোরও জায়গা থাকবে? আর তা যদি না হয় তা হলে কি আমি এদের ফেলেই চলে যাব আর বর্ষা পার হয়ে গেলে এরা জলাভাবে শুকিয়ে মরে যাবে? নাকি আমি দারোয়ানকে বলব যে ওদের নিয়ে যান। দিনাবসানে একটু জলই ওদের বাঁচিয়ে রাখবে—বেশি কিছু করতে হবে না!

এই দু’দিনের মধ্যে কত কী করব আমি? বাড়ি খুঁজব, জিনিস প্যাক করব, গাছেদের ব্যবস্থা…! আমি কি পারব?

সাদা কচুপাতাটা মরেই যাচ্ছিল। কত কষ্টে বাঁচালাম। এখন পাঁচটা পাতা গাছটায়। আর একটা পাতা অর্ধেক খুলেছে। যদি মুড়ে থাকা পাতাটা খুলে মেলে ধরে নিজেকে তবে বুঝব গাছটা সম্পূর্ণ সুস্থ। দু’দিনে কি সেটা সম্ভব হবে?

গাছ বিক্রেতা বলেছিল ওই ঝুলন্ত লতাটা সারা বছর নীল ফুল দেবে। সারা বছরের নীল ফুল কি স্বপ্ন? আমি কি ফুল ফোটা না দেখেই চলে যাব?— অসম্ভব!

না, দু’দিনের মধ্যে চলে যেতে পারব না আমি। আমি যাব না।

হলে ফোন বাজছে। এত ভোরে তুমি ছাড়া কে আর হবে? এই শহরে দ্বিতীয় মানুষ আমার আছেটাই বা কে? শ্লথ পায়ে ফোন ধরতে হলে ফিরলাম আমি।

‘তোমার ওপর রাগ করার কোনও মানেই হয় না। ইটস ব্যেকুফি!’ বললে তুমি৷ হাসলে তুমি, রাতে ঘুমোওনি তাই না? আমার কথা ভেবেছ, তাই না? তুমিই ফোন করতে চেয়েছ, তুমিই চাওনি ফোন করতে। তুমি লড়েছ নিজের সঙ্গে—আমি বুঝতে পারছি।

‘কী বলতে চাও?’ বললাম আমি। হাসলাম। আমিও রাতে ঘুমোইনি।

আমিও তোমার কথা ভেবেছি। আমি চলে যেতে চেয়েছি কিন্তু গাছেদের জন্য সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়েছে। গাছেদের জন্য!

‘ওষুধ খেয়েছ?’ তুমি বললে৷

‘হ্যাঁ!’ আমি বললাম।

‘আমার একটু একটু জ্বর হয়েছে মনে হয়, চোখ দুটো জ্বালা-জ্বালা করছে। মাই হোল বডি ইজ পেনিং।’

‘আমি এখনই ডক্টরকে ফোন করছি…!’

‘নেহি, জানে দো…ঠিক হয়ে যাব।’

‘আর ইউ ম্যাড অর হোয়াট, শুনছ না চারদিকে ভাইরাল ফিভার হচ্ছে?’ ‘শোনো, তোমার অপারেশনের পরে চলো বেড়াতে যাই। ধরো জঙ্গলে যাওয়া যেতে পারে…বা ধরো পাহাড়ে? অনেকদিন বেরনো হয় না।’

‘কতদিনের জন্য?’

‘এই মাসখানেক?’

‘এতদিন?’

‘কেন?’

‘আমার গাছগুলোর কী হবে?’

‘কী বলছ? কান্ট হিয়ার, লাইনটা ডিসটার্ব করছে…!’

‘ঠিক আছে, গাছগুলো প্যাসেজে বের করে রেখে যাব। দারোয়ানকে বলব রোজ জল দিয়ে দেবে!’

‘কী বলছ?’

‘কিছু না।’

‘শোনো কাল যা বলেছ তা মনে হয়েছে বলেই বলেছ নিশ্চই। এ নিয়ে আমার কোনও রাগ নেই। তোমার ওপর রাগ করেই বা কী করব? তোমাকে ছেড়ে তো আর থাকতে পারব না! ইটস নো মোর পসিবল।’

‘আসলে যাওয়া, না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত, ছেড়ে থাকা, না-থাকার সিদ্ধান্ত, সবই কোনও অবিহিতকাল আগে থেকেই নেওয়া থাকে আমাদের। ঘটনার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু সেটা একবার জানার সুযোগ হয়…!’

‘হোয়াট দা হেল ইউ আর সেয়িং ওম্যান?’

‘এবার একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো তুমি। বেলা বাড়লে ডক্টরকে কল দেব, কেমন?’

‘রাগ করে কোথাও চলে যাবে না তো?’

‘চিন্তা করছ কেন? গাছেরা কখনও যাওয়া আটকাতে পারে না। রাগ করেই বা কে কতদূর চলে যেতে পারে বলো? রাগও করে, আবার থেকেও যায়…!’

২৩

এক মেঘাচ্ছন্ন ভোরে সে দাঁড়িয়েছিল অনেক জলের সামনে৷ ছড়ানো, প্রহেলিকাময়, জটিল জল। জলের শেষে গাছের সারি। মাথার ওপর আখুটে আকাশ। জলের ধারে মগ্ন বক, জলের ওপরে হংসাবলি। মাঝে মাঝে ঘাই মারছিল জলের ভেতরের মাছ। সে এই সমস্ত দৃশ্যটা অকারণেই, আকুলতার সঙ্গে গ্রহণ করতে চাইছিল বোধে! একেবারে অকারণ!

তখনই বহু দূরে, একেবারে ওই কিনারের জলে তার চোখ কোনও আলোড়নের স্পর্শ পেল যেন। চোখকে সেখানে নিবদ্ধ রেখে সে বোঝার চেষ্টা করল তোলপাড়টা কীসের!

একটু পরেই সে দেখতে পেল কেউ একজন সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে এই দিকেই! তার দিকে?

যদিও সম্পূর্ণ মানুষটাকে দেখা যাচ্ছিল না কোনওভাবে! শুধু দুটো শক্ত হাত একবার জলের ওপরে উঠে যাচ্ছিল, আবার ডুবে যাচ্ছিল জলে। অতি দ্রুত পর্যায়ক্রমে এমনটাই ঘটছিল বারবার, ছন্দোবদ্ধভাবে, যেন এক নিদারুণ তাড়নায় এভাবে সাঁতার কাটছিল মানুষটা আর দুটো হাতের জলে ভেজা চামড়া চকচক করে উঠছিল সূর্যের আলোয়, ঝলসে উঠছিল পেশীসমূহ!

তার অদ্ভুত চাঞ্চল্য জাগল ভেতরে, নিষিদ্ধ এক ওম ছড়াতে লাগল শরীরের আনাচে-কানাচে যা অতীতের অগুনতি অভিজ্ঞতার তুলনায় আদিম!

অবগাহনের প্রতিটা স্তর পেরোতে পেরোতে তখন এগিয়ে আসছিল লুকোনো শরীর।

অবিলম্বে চোখ বুজে ফেলল সে!

চোখ বুজে ফেলে সে কি ঘুমিয়ে পড়ল?

সে কি ঘুমের ভেতর সমস্তটা কল্পনা করল একবার? যেন জল থেকে উঠে এল সে পুরুষ আর অমনি শুরু হল নারী-পুরুষের কালহীন দ্বন্দ্বাতীত খেলা, তৈরি হল দুটো বিপরীত গতির যা একে অন্যের পরিপূরক! যা সৎভাবে উৎপন্ন হলে এই ঘাসের ওপর একসময় পড়ে থাকবে বিশুদ্ধ যৌনতার তত্ত্ব যা তুমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলে—কিন্তু সে বুঝতে পারেনি ভয়ে! ভয়ে!

সে রাত জেগেছে। আসলে সে দিনও জাগেনি কি?—অপেক্ষায়? বাকি লেখাটুকুর অপেক্ষায়? বহু, বহু মাস সে কিছুই লেখেনি আসলে। কেবলই হাঁটা অভ্যেস করেছে। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত হাঁটা আবার দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে ফেরা।

একটা থলে সে জোগাড় করেছে কষ্টে। তারপর কাগজ কুড়োতে কুড়োতে হাঁটছে। কাগজ কুড়োয়, থলেতে ভরে। হাঁটে। এভাবে সে একটা লাইনই লিখতে পেরেছে। দ্বিতীয় লাইনটা লিখতে পারলেই সে ঘুমোতে যেতে পারে। দিনের দিকে, রাতের দিকে ঘুম। কিন্তু অত হেঁটেও সে দ্বিতীয় লাইনটা পায়নি।

ওই একটা লাইনই কি তবে এক জীবনের লেখা? ওই লাইনটাই কি তবে কষাঘাতে, কষাঘাতে বেরিয়ে আসা সমস্ত রক্ত?

সে হাঁটা চালিয়ে যায়। থলে যখন ভরে ওঠে কুড়োনো কাগজে, সে নদীর সামনে দাঁড়ায়। তখন হয়তো অস্ত যাচ্ছে সূর্য! জলে সে উপুড় করে দেয় থলি। বলতে চায়, এই জল সে ভালবাসে, এই তারাটি তার প্রিয়, এই ঘুরে মরা তার আকাঙ্ক্ষার ফল। এই রোগ, এই প্রতিরোধহীনতা—এই-ই আসলে তার জীবনযাপন, বেঁচে থাকা!

আর সে বলতে চায়—লেখা যা পারে, না লেখা পারে তার অধিক। যে একটা লাইন সে লিখেছে, সেই লাইনটার অভিমান স্পর্শ করেছে তাকে আজ। কেননা, সে লাইনটার এ প্রান্তে ছিল এক মহাকাল, ও প্রান্তে অনন্ত সময়। লিখে লাইনটার ভেতর সে এনে বসিয়েছে মৃত্যুবৎ স্তব্ধতা। লাইনটা ফুরিয়ে গেছে সমস্ত সম্ভাবনা সত্ত্বেও! সে সম্ভাবনা সৃষ্টির থেকে সৃষ্টির সম্ভাবনা! জীবনের থেকে জীবনের সম্ভাবনা!

নদী তাকে বলেছে—‘কাঁদো।’ আর চোখে জল আসা মাত্র তার তোমার কথা মনে পড়ল? মনে পড়ল, অনেক কাল তোমার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। ছাড়াছাড়ি হলে যেমন হয় আর কী! ‘হয়তো মৃত্যুর সময় দেখা হবে!’—বলেছিলে তুমি।

শেষ বা দ্বিতীয় লাইনটা পেয়ে গেছে ভেবে কান্না স্থগিত রেখে সে ছুটল তখনই। এবং বুঝল, তাই হয়, কবির জীবন আসলে তাই। কবির পাণ্ডুলিপি আসলে সমস্ত চেপে যাওয়া কান্না। সমস্ত ফেলে আসা কান্না। সমস্ত কান্নার ব্যর্থতা! কবি আসলে নিজের জন্য কাঁদেনি, অন্যের জন্যও কাঁদেনি। সে কেঁদেছে শুধু কবিতার জন্যে!

লিখে কী হয়? না, লিখে কোনও লাভ হয় না। কত কী যে লেখা হয়েছে পৃথিবীতে কিন্তু মানুষের তা কোনও কাজেই লাগেনি সে অর্থে। অথবা মানুষ তা কাজে লাগাতে চায়নি। পড়েছে, পড়ে ভুলে গেছে।

সেও প্রতিটা শব্দ লেখার সময় ভাবে, ‘কী কথা লিখেছিলে? বৃক্ষান্তে চলে গেল শব্দ!’ সে লিখতে লিখতে উঠে পড়ে সংশয়ে।

তারপর রাত হয়। অমনি তার মাথার পোকাগুলো কিলবিলিয়ে ওঠে। বেরিয়ে আসতে চায় চোখ, কান, নাক-মুখ দিয়ে। তার দৃষ্টি বদলে যায়। নিশ্বাসে বিষাক্ত বাষ্প, অশ্রাব্য শব্দ বলে সে, শোনে সে। আর মেঝেতে পড়ে ছটফট করে। একসময় সে স্থির হয়ে চলন্ত পাখার দিকে তাকায় আর ওড়না পেঁচায় হাতে। নাটার মতো ফাঁস প্র্যাকটিস করে।

তখন আবার যেন কে তাকে ঠেলে দেয় লেখার দিকে। সে কাঁপতে কাঁপতে লেখে। লিখতে লিখতে ঘুমোয়। ভাবে মুক্তি!

১০

দিনের শুরুতে এই খবরের কাগজ! ভোরে অর্ধঘুমন্ত শরীর যে কাগজগুলোকে স্পর্শ করল সেগুলোর প্রতিটার প্রথম পাতায় কতগুলো পোড়া দেহের ছবি। সে বিষণ্ণ ও অন্যমনস্ক বোধ করল। শিথিল দেহে সহজেই সঞ্চারিত হল শোক।

এই সব শিশু গতকাল যৌথভাবে পুড়ে গেছে তামিলনাড়ুর একটা স্কুলে। পোড়বার সময় তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিল। যেন সেটা দহনের মাত্রাকে কোনওভাবে কম করতে সাহায্য করেছে! যেন তারা এভাবে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে আমরা যদি কখনও একত্রে পোড়ার সুযোগ পাই আমরা যেন তখন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরি।

প্রথমে শোনা যাচ্ছিল বেশ কিছু টিচারও নাকি পুড়ে মারা গেছে শিশুদের সঙ্গে। কিন্তু কালক্ষেপে বোঝা গেছে যে, না—আদৌ, তারা একজনও মারাটারা যায়নি। তারা সময়-মতো পালাতে সক্ষম হয়েছে। মারা গেছে ছ’-সাত বছরের আশিটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে। আরও অসংখ্য মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে স্টেট জেনারেল হসপিটালে।

একটা ইংরিজি দৈনিকের ছবি তাকে হাঁটু ভেঙে বসিয়ে দিল মাটিতে। সে দেখল পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছে এক তামিল পিতা। কোলে একটা কালো কাঠ যা আসলে ওর সন্তান।—নাহ্, দিনের শুরুতে এই যথেষ্ট হয়েছে তার পক্ষে।

কাগজগুলো দ্রুত ভাঁজ করে সে ছুড়ে দিল বেডরুমে। চা করে খাবে ভেবে আভেন জ্বালাল। সে পালাতে চেয়েছিল খবরটা থেকে। বদলে অসহায়ের মতো আগুন লাগার আগে এবং আগুন নিভে যাওয়ার মাঝখানে ওই আশি, নব্বই, একশো শিশুর পুড়তে থাকার সময়টায় পৌঁছে গেল ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যখন কল্পনা করতে লাগল আগুনকে নিজের চামড়ায়, মাংসে, মজ্জায় তখন চায়ের জল ফুটে ফুটে নিঃশেষ হতে লাগল আভেনে।

এরপর সে জ্বালা প্রশমনে ছুটে গেল টয়লেটে ও স্নান করতে করতে নিদারুণ এক ক্ষোভে কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

তখন ফোন বাজল। সে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে এল ফোন ধরতে। জানাল যে, স্নান করছে! হ্যাঁ, নগ্ন হয়েই স্নান করছে সে। হ্যাঁ সাবান মেখেছে। আচ্ছা সে আবার তোমাকে মনে করে সাবান মাখবে আর গোপন অঙ্গে হাত রেখে তিনবার বলবে ঠিক—‘আমি তোমার, আমি তোমার, আমি তোমার!’ আর মোট দশ মিনিট লাগবে তার তৈরি হয়ে নিতে। তুমি বাড়ি থেকে বেরোও, তার মধ্যেই সে রেডি হয়ে নেমে যাবে নীচে, অপেক্ষা করবে তোমার জন্য! হ্যাঁ, তুমি এসে তাকে নিয়ে যাবে জিনিসগুলো কিনতে যা কিনে এনে, এই ফ্ল্যাটটা সাজাবে সে যাতে এই ফ্ল্যাটটা বাড়ি হয়ে ওঠে।—বাড়ি, গৃহস্থ, হোম…। তুমি তাই চাও, ‘মেক ইট ইওর হোম…।’

সে ফিরে গেল স্নানে। স্নান সেরে বের করে রাখা পোশাক পড়ল। চুল আঁচড়াল। পারফিউম ঢালল শরীরে। নীচে নামল। তুমি তাকে তুলে নিলে।

সারাদিন ঘুরে ঘুরে কত কী-ই যে কিনল সে…। তারপর তোমার সঙ্গে ডিনার সেরে অনেক রাতে ফিরে এল আস্তানায়। লকগুলো পর পর খুলে সোজা চলে গেল বেডরুমে।

যেই সে আলো জ্বালল দেখল খাটের ওপর পড়ে আছে সেই সকালের কাগজটা। প্রতিটা কাগজের প্রথম পাতার সেই ছবিগুলো যেন জেগে উঠল তাকে দেখে। সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে সে পুড়তে লাগল তখন সেই আগুনে, যে আগুন জীবনের বৃত্তের চারিদিকের এবং পালানোটা তার কেন্দ্রে অবস্থিত!

ফোন বাজছিল। তুমি ফোন করেছ ‘ঘুমিয়ে পড়ো’ বলার জন্য। সে ফোন তুলেই বলল—‘আমার একটা ছেলে ছিল, ছ’-সাত বছরের…। একদিন আমাদের হাইরাইজে আগুন লাগল। আমি সেই দুপুরে এক অল্প চেনা পুরুষের নীচে শুয়ে ছিলাম। আমি দূরে ছিলাম। ওর বাবাও দূরে ছিল। ও ছিল রাতদিনের কাজের মেয়েটার কাছে। আগুন লাগতেই মেয়েটা ওকে আটতলায় ফেলে পালিয়ে যায়। ও ফোন করেছিল আমার মোবাইলে। বলেছিল আগুনের কথা! বলেছিল ‘পায়ের’ নীচের মেঝেটা ভীষণ গরম হয়ে গেছে মা! বলেছিল কাচের জানলা দিয়ে ঢুকে এসেছে আগুন আমাদের ঘরে। ও খুব কাশছিল। কাশতে কাশতে ও তীব্র অভিমানে বলেছিল আমাকে—‘মা, তুমি কেন গেলে, কেন গেলে আমাকে ছেড়ে?’ তারপর শুধু একটা বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েছিলাম। ব্যস! ওপাশে আর কোনও শব্দ ছিল না, শুধু চড়চড় করে পুড়ছিল সব…!’

তুমি চুপ করে ছিলে। সেই কথা বলল আবার—‘আমি পালালাম। যে আগুন জীবনের বৃত্তকে ঘিরে, পালিয়ে আমি পৌঁছলাম তার কেন্দ্রে…’

২৭

বিদেশিনী, মেয়েটার গাল টিপছিল। গাল টেপবার জন্য ঝুঁকে পড়েছিল এমনভাবে যে ওর পা পর্যন্ত লম্বা স্কার্টটা গড়াগড়ি খাচ্ছিল ফুটপাতের ধুলোয়। ওরা একটা ব্যাটারির বাক্স এগিয়ে দিল তাকে বসবার জন্যে।— এটুকু দেখে আমি ঘরে ফিরে এলাম ব্যালকনি থেকে।

আবার যখন ফিরে এলাম দেখলাম বিদেশিনী তখনও যায়নি। ব্যাটারির বাক্সর ওপর বসে। আর ওরা ঘিরে বসে আছে ওকে, ফুটপাতে। মেয়েটা টলোমলো পায়ে দাঁড়িয়ে আছে আর অবাক চোখে দেখছে বিদেশিনীকে। সত্যিই সে দেখবার মতো। রোদ্দুর পড়ে তার সাদা চামড়া ঝলসে দিচ্ছে চোখ। পরনের স্কার্ট আর টপ দুটোর রং সাদা। গলায় দুলছে একটা সাতরঙা জয়পুরি ওড়না। নিখুঁত ফিগার, বলিষ্ঠ চেহারা। জার্মান হতে পারে। লাল চকচকে চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। কাঁধ থেকে ঝুলছে একটা কড়ি, আয়না বসানো রাজস্থানি ঝোলা।

বিদেশিনী হাত নেড়ে কিছু বোঝাচ্ছে বউটাকে। মেয়েটাকে কোলে টেনে নিল। একটা সিগারেট এগিয়ে দিল স্বামীটার দিকে। বাচ্চাটার নোংরা গালে এঁকে দিল চুম্বন।

কদিন আগেই ফুটপাতের ওই কোণটা থেকে রাস্তা পার হবার সময় আমি দেখেছি বাচ্চাটাকে ওরা নাক-কান বিঁধিয়ে দিয়েছে। দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। এইটুকু শিশুর ওপর এ কী জুলুম? না জানি, কতখানি কষ্ট হয়েছে নাক থেকে গড়িয়ে আসা সিক্‌নিও কিছুতেই মাকে মুছতে দিচ্ছে না। সম্ভবত এখনও ব্যথা জমে আছে জায়গাগুলোয়, বিদেশিনী দেখলাম ঝোলা থেকে পেপার ন্যাপকিন বের করে বাচ্চাটার নাক থেকে ঠোঁটে নেমে আসা ঘন সবুজ সর্দি মুছিয়ে দিল যত্ন করে।

আমার মনে হল, ও কোনও প্রস্তাব দিচ্ছে ওদের, যে প্রস্তাবে ওরা ঠিক রাজি হতে পারছে না যেন। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কেমন সংশয়জনিত হাসি হাসছে।

আমার আশঙ্কা হল, বিদেশিনী মেয়েটাকে নিয়ে নিতে চাইছে। কীভাবে নিতে চাইছে, কী শর্তে নিতে চাইছে তা আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি টের পেলাম আমার ভেতর থেকে পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে একটা! অসম্ভব রুক্ষ লাগল দৃশ্যটা, আমি সরে এলাম।

এই ক’মাসে বাচ্চাটা বেশ বড় হয়েছে। যত নোংরাই থাকুক গোলগাল হাতের মুঠোর দিকে তাকালে আদর করার ইচ্ছে হয়। ওই যে ফুল-ফুল জামাটা ও পরে আছে, ওটার ঝালরগুলোর মতোই হাসিটা ওর। আমি নীচে নামলে, ও প্রথমে আমাকে দেখে গাছের পিছনে চলে যায়। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ও লাজুক হাসি হাসে। অথচ আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে এবং চেষ্টা করে হাসি চাপতে। ওর চোখমুখ থেকে সে সময় যে-বুদ্ধির ঝলক বেরোয় তার দিকে আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। এ সময় আমার ওকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে পড়াই, লেখাই৷ পেট ভরে খেতে দিই। হাতে দিই রং তুলি। গেয়ে শুনিয়ে শিখিয়ে দিই রবীন্দ্রনাথের গান…।

ব্যালকনি থেকে সরে গিয়েও ছটফট করতে লাগলাম আমি। কী ঘটছে ওখানে? বিদেশিনী কী চায়?

বাচ্চাটাকে আমি রোজ খেতে দিই। সেই ভাতের বিনিময়ে আমি কি মনে মনে ওকে অধিকার করে ফেলেছি? নইলে এতখানি অসহিষ্ণু লাগছে কেন আমার? যদি সত্যিই আমি যা ভাবছি তাই হয়, যদি বিদেশিনী ওকে নিয়ে যায়, সন্তানবৎ প্রতিপালন করে, যদি মানুষের মতো বাঁচার একটা সুযোগ দেয় ওকে তা হলে আমার তো আনন্দ হওয়া উচিত।

কেননা, আমি কি জানি না আমার ইনভলভমেন্টটা আংশিক। তাতে এই শিশুর যা চাই তার কিছুই পূরণ হয় না। আমি কি কোনওদিন ওর জন্য একবেলার ভাতের বেশি ঝুঁকি নিতে পারব?

কিন্তু এ সত্য আমার মস্তিষ্ক অধিকার করে রাখলেও হৃদয়কে তা স্পর্শ করে না। বরং আমার গলায় বাষ্প জমা হতে থাকে। আমার ইগো অশান্ত হয়ে ওঠে। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই ও পলিপ্যাকে ভাত, ডিমসেদ্ধ ভরে ফেলি ও নীচে নেমে যাই। দুপুর বারোটার রোদের মতোই অহংকারী দেখায় বোধহয় আমাকে।

বউটা আর বিদেশি মেয়েটার মাঝখানে কৌণিকভাবে গিয়ে দাঁড়াই আমি। ও আমাকে ‘হাই’ বলে। কিন্তু বউটা লক্ষও করে না। হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নেয় ও গাছের গায়ে ঝুলিয়ে দেয়। কোনও একটা স্বপ্ন ওকে মশগুল করে রাখে। আমি বাচ্চাটার দিকে দু’পা এগোলে বাচ্চাটা ছুটে গিয়ে ঝাপায় মায়ের বুকে।

আমি দ্রুত ফিরে আসি। অধৈর্যের মতো লিফটের বোতাম টিপি। আমি তোমাকে ফোন করি। কান্নায় ভেসে যেতে যেতে টেবিলে আঘাত করি আমি—‘আজ থেকে ওর ভাত বন্ধ। ভাত বন্ধ! তুমি শুনে রাখো আজ থেকে ওর ভাত বন্ধ!’

ওর ভাত পরের দিন থেকে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর একটা একটা করে দিন কাটে। ও কোথাও যায় না। সেই বিদেশিনী ফেরত আসে না ওকে নিয়ে যেতে কোন দূর স্নেহচ্ছায়ায়, সুরক্ষিত সমৃদ্ধ জীবনে। ওর ঘুমন্ত হাতের মুঠো পড়ে থাকে ধুলোর ওপর আর তা অবলীলাক্রমে টপকে পার হয়ে যায় পথচলতি মানুষ।

সূর্য যখন মাথার ওপর ওঠে আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। লক্ষ করি ওর মা কোনও প্রত্যাশা বুকে নিয়ে এদিকে তাকায় কি না!

না, তাকায় না। আমিই উল্টে তাকিয়ে থাকি সমানে। আর স্বপ্ন দেখি কোনও অতিরিক্ত দূরে সতেজ মৃত্তিকার ওপর গোলপাতা ছাউনির ঘরের দাওয়ায় বাচ্চাটা শুয়ে থাকে আমার আঁচলের ওপর। চাঁদধোঁয়া রূপালি জলে ভেসে যায় হঠাৎ জেগে ওঠা চর। তখন নিকোনো উঠোনের এক কোণে টগবগিয়ে ভাত ফোটে। ভাতের গন্ধে, আলুর গন্ধে, কাগজিলেবুর গন্ধে গাঢ়তর হতে থাকে আমাদের ঘুম। পৃথিবীর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ জোড়া বেদনাগুলো লোপাট হয়ে যায়!

১৯

সে ফোন করেছিল। ফোন করে বলতে চেয়েছিল ব্যথাটার কথা। ব্যথা সেটাকে বলা যায় কি না তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ ছিল তার!

দিনটা ছিল বন্‌ধের। সকালে বিছানা ছাড়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। তবে সে সাত-সকালেই উঠে পড়েছিল ব্যথাটার অনুভব নিয়ে। ব্যথা মানে তার সমস্ত শরীরে একটি মাত্র স্তনবৃন্তকে কেন্দ্র করে চাক বেঁধে ওঠা এক অস্বস্তি!

ডান স্তনাগ্রে একটা শিরশিরে অনুভূতি দিয়ে শুরু হয়েছিল অসুবিধেটা। ক্রমশ সেটা বেড়ে ওঠে। সে তখন বারবার বাঁ হাতের আঙুলের নখ দিয়ে সেখানে, চারপাশটায় ছোট ছোট আঁচড় দিতে থাকে এবং বুঝতে পারে শরীরের অন্য অন্য জায়গার তুলনায় এই স্তনবৃন্ত একেবারে ভিন্ন একটি জিনিস। এর গড়ন এমন যে, একে চুলকোনো যায় না। ভাঁজ খাওয়া ত্বকের অতি ছোট এই এক টুকরো মাংসকে এভাবে কিছু করার চেষ্টা করলে জায়গাটা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও সে একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে জায়গাটাকে ঘষে দিয়ে আরাম পাওয়ার চেষ্টা করায় তার ডান স্তনবৃন্ত ও চারপাশের বাদামি ত্বক-যুক্ত-অঞ্চল ফুলে গরম হয়ে উঠল।

সামান্য অলিভ তেল নিয়ে সে তখন মালিশও করেছিল, কোনও ফল হল না।

হঠাৎই তার মনে হয়েছিল তোমার দাঁতের কথা। তার বিশ্বাস জন্মেছিল তোমার দাঁত তাকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। কল্পনা করেছিল চোখ বুজে যে, স্তনবৃন্তটি তোমার মুখ-গহ্বরের মধ্যে যত্ন পাচ্ছে। একই সঙ্গে দাঁতের ধার, লালা ও মুখের ভেতরের উত্তাপ দিয়ে তুমি ধীরে ধীরে কষ্ট দূর করছ তার। এরপরই সে তোমাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, ‘আমার কষ্ট হচ্ছে…।’

তুমি বলেছিলে, ‘কেন? কীসের কষ্ট?’

সে বলেছিল, ‘ভীষণ একা লাগছে আমার।’

শুনে তুমি বলেছিলে, ‘একা লাগে আমি জানি।’

সে তখন খানিকটা নিজের মনেই বলতে লাগল কথাগুলো, সে বলল, ‘হ্যাঁ, একা লাগে। ভয়ানক একা লাগে। ছোটবেলাতেই হঠাৎ একদিন একা হয়ে গেলাম। থাকতাম একটা অন্ধকার, অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে, পাহাড়ের ভেতরে গুহা যেন! অথচ গুহার বাইরেই লোকালয়, শব্দ, উত্থানপতন, ভেঁপু, কান্না, হাসি। কিন্তু আমার আর লোকালয়ের মাঝখানে অসম্ভব এক বজ্র, বিদ্যুৎ, বৃষ্টিপাতের স্তম্ভ ছিল। আমি ভাবতাম এক সময় না এক সময় তো শেষ হবে এ বৃষ্টিপাত আর আমি ছুটে যেতে পারব জনসমাবেশে। কিন্তু কই কোথায় থামল দুর্ভেদ্য, অঝোর বর্ষণ? কথা না বলে বলে চোয়ালে ব্যথা হয়ে গেল।—সারাদিন এ-ঘর, ও-ঘর। বন্‌ধ বলে ধুলো ধোঁয়া নেই, বিচিত্র উৎকট শব্দ নেই। প্রকট হয়ে উঠেছে শূন্যতা আরও। সকালে ফোন নেই তোমার, দুপুর গড়িয়ে গেল ফোন নেই। তুমি কেন সারাদিন কোনও খবর নাওনি আমার? ইচ্ছাকৃত?’

তুমি বললে, ‘হ্যাঁ, আমি আজ ব্যস্ত আছি কাজে!’

—তোমার কি আমার কথা মনেও পড়েনি একবারও?

—মনে কেন পড়বে না?

—তা হলে ফোন কেন করোনি?

—সময় হয়নি।

—সময় হয়নি? কেন, তুমি কি স্নান করোনি? খাওনি? কাজ বলে সেসবই কি স্থগিত আছে তোমার?

—প্লিজ, ঝগড়া কোরো না। তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে করে আমি ক্লান্ত।

—না না, ঝগড়া করতে চাই না আমি! আমি শুধু তোমাকে কাছে পেতে চাই।— বলে সে।

—এখন? বন্‌ধ যে। কী করে আসব?

—কেন? একবার তো এসেছিলে বন্‌ধের দিনে!

—সেদিন ড্রাইভারকে আগেভাগে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়নি। আমি বন্‌ধে

একা গাড়ি নিয়ে বেরোতে চাই না। তা ছাড়া সেদিন কোনও কাজ ছিল না। প্লিজ শোনো, এখন ফোন ছাড়ছি। কম্পিউটার খোলা, ই-মেল করছিলাম…!

‘নাঃ, ফোন ছেড়ো না!’ সে আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ফোন ছেড়ো না, আর একটু কথা বলো৷ কথা বলো। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ চারিদিকে অথচ আমি এমন কাঙাল? মানুষের সান্নিধ্যও কম হল শেষে? আজকাল মৃত্যুর কল্পনাতেও কোথাও কোনও মানুষ আসে না ভিড় করে। মেরি জানাজেকে পিছে তক কোই নেহি হোতা! তুমিও না। আজকাল জ্বর হয়, বমি হয় আমার। তখন এই ফ্ল্যাটটা হয়ে যায় একটা জাহাজ যার ডেকে অন্ধকার রাতের দিকে তাকিয়ে আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি! আর হাঙর ভেসে ওঠে চারিদিকে। অসংখ্য হাঙর…আর এই জাহাজটা ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে যখন ভেঙে পড়ে তখন দু’রকম মৃত্যু হয় আমার একই সঙ্গে!’

—চুপ করো, চুপ করো। তুমি পাগল হয়ে গেছ!

—মোটেই পাগল হইনি আমি। আমি সংসার পাতবার অপেক্ষায় আছি। বেসনের রুটি বানাতে শিখেছি। যা যা এখনও শিখতে পারিনি তার জন্য তুমি জানলার সার্সি কাঁপিয়ে ধমকাবে আমাকে—আমি তারও অপেক্ষায় আছি!

—সংসার পাবে না তুমি। অন্তত আমার কাছ থেকে পাবে না। যে জীবনে আছ তেমন জীবনই দিতে পারি আমি তোমাকে। তার বেশি দেওয়ার সময় আমি পার হয়ে এসেছি!

সে এরপর চুপ করে যায়। তুমি দু’-চারবার হ্যালো, হ্যালো বলে নামিয়ে রাখো ফোনটা। তোমার গলা শুনে মনে হয় তুমি উৎকণ্ঠিত।

আর তার বিশ্বাস জন্মায় যে, এইবার সে পুরো পাগল হয়েছে। পাগল হয়ে গেছে ভেবে সে হাউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়ে। এবং বারবার বলতে থাকে ‘আমি এবার তা হলে পাগল হয়ে গেলাম, আমি এবার তা হলে পাগল হয়ে গেলাম!’ বারংবার এ-কথা বলে সে নিজেকে নিজেই উন্মাদ প্রতিপন্ন করে। সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আর কারও সঙ্গে কথা বলবে না। সে খাবে না, ঘুমোবে না, স্নানও করবে না। শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে। সে জানে যে তা হলে তুমি তাকে কোনও মানসিক রুগিদের অ্যাসাইলামে পাঠিয়ে দেবে। সেখানে একবার, দু’বার যাবে তুমি। তারপর আর যাবে না। তোমাকে কেউ কোনও প্রশ্নও করবে না তাকে নিয়ে কেননা যে-কোনও মুহূর্তেই তোমার এবং তার সম্পর্ক আঁধারে তলিয়ে যাবে বলে ধারণা করাই ছিল সকলের। এরকমটাই স্বাভাবিক। অথবা এটা আরও বেশি সত্যি যে, তোমার সঙ্গে তার আদৌ কোনও সম্পর্কের কথা মানুষ জানেই না।

সম্পূর্ণ পাগলামির অনুভবে সে মেঝেতে শুয়ে ফোঁপাতে লাগল— হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে গেল বেডরুমে। তার মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। ঠিক এইসময় বেল বাজল। কলিং বেল।

সে ভাবল পাগল কখনও বেল বাজলে দরজা খোলে না। কিন্তু অনর্থক হুজ্জোতি এড়াতে সে সিদ্ধান্ত নিল দরজা খোলার। পাগল কখনও মুখ থেকে গড়িয়ে আসা নাল মুছতে পারে না তবু দরজা খোলার আগে মুখচোখ মুছে নিল সে। ভাবল দরজার ওপাশে এমন একটা লোক এমন একটা প্রয়োজনে এসেছে যে তার মুখ তুলে না তাকালেও চলে, কান খুলে না শুনলেও চলে বক্তব্যটা কী!

সে দরজা খুলে দিতেই তুমি, হ্যাঁ তুমি ঢুকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরো। নিজেকে সে মুক্ত করতে চায় যত তুমি তাকে তত জড়িয়ে ধরো আষ্টেপৃষ্ঠে। বলো, ‘সত্যি, মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি পাগলই হয়ে গেছ!’ সে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি কিন্তু আমি অ্যাসাইলামে যাব না।’ তুমি হেসে ফেল একথা শুনে, ‘অ্যাসাইলাম? তোমার পাগলামি কি কখনও সারবার যে, কোনও অ্যাসাইলামে তোমার জায়গা হবে?’ সে কেঁদে ফেলে, ‘তা হলে আমাকে কোথায় ফেলে রেখে আসতে চাও? চলো সেখানে, আজই, এখুনি!’

তুমি তাকে পাঁজরে পিষে ফেল—‘কী হয়েছে? এত কীসের দুঃখ?’ তোমার গলা আর্দ্র হয়ে ওঠে। টের পাও তার শরীর শিথিল হয়ে যাচ্ছে তোমার বাহুপাশে।

তুমি তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দাও খাটে এবং তার সঙ্গে নিজে স্নেহে, মমতায়, প্রেমে, কামে অসম্ভব লিপ্ত হয়ে আছ উপলব্ধি করো। তাই অসহায়ের মতো চুম্বন করো তুমি তাকে। তখন প্রতি আশ্লেষে ঈশ্বরকে স্মরণ করো। প্রথমে ঠোঁটে, পরে গলায় তোমার ঠোঁট নামতে থাকে। তারপর তার পোশাক সরাও যেই অমনি ডান স্তনটি তোমার হাতে উঠে আসে ও তুমি দেখ স্তনবৃন্তটি ফুলে আছে! তোমার ভুরু কুঁচকে ওঠে। তুমি বৃন্তটি দু’আঙুলে ধরো, টের পাও ঘন উত্তাপ৷ ‘একী? কী হয়েছে এখানে?’ বলে ওঠো।

সে চোখ বুজে পড়ে থাকে, অশ্রু গড়ায় চোখ থেকে তখন। বলে, ‘জানি না। শুধু শিরশিরে ব্যথা করছিল সকাল থেকে। এই বন্ধ, এই নির্জন ঘর, এই একাকিত্ব যা যন্ত্রণা দেয় সব ও নিয়েছে আজ। সব অসাড়তাকে চমকে দেওয়ার মতো একফোঁটা ছোবল এনেছে বয়ে শরীরে।’ বলে সে স্তনবৃন্তটাকে তোমার ঠোঁটের দিকে ঠেলে দেয়।

—আমি তোমাকে এই জন্য আসতে বলেছিলাম। কষ্ট হচ্ছে বলেছিলাম…! এটাকে যে চুলকোনো যায় না…!

—তোমার চোখও জলে ভরে ওঠে তৎক্ষণাৎ আর, ‘তুমি আমাকে খুলে বলোনি কেন?’ বলে প্রবল অনুকম্পায় ডান স্তনবৃন্তটির মাধ্যমে তুমি তার সমস্ত যন্ত্রণা শোষণ করে নিতে থাকো।

২৪

প্রবল লু-বাতাস বওয়া মধ্যদুপুরে একদিন হঠাৎ কিছু না বুঝে, না ভেবে সে উঠে পড়েছিল একটা লড়ঝরে বাসে। বাসটার মধ্যে তেমন ভিড় ছিল না কিন্তু সিটগুলি অধিকাংশই ছিল যাত্রীদের দখলে। ফাঁকা পেয়ে সেও একটা সিটে বসে পড়ল। তখনই তার নজরে এল যে, সে নিজে ব্যতীত বাসটায় আর কোনও মহিলা যাত্রী নেই।

ক্রমশ তার অবাস্তব রকমের ভয় জাগল এই সত্যও অনুধাবন করে যে, সে নিজে ছাড়া বাসটার সমস্ত যাত্রীরাই অন্য একটা ধর্মাবলম্বী! তাদের পরনের পোশাক, চুল, দাড়ি, পায়ের জুতো, এমনকী আঙুলের আংটি, চোখের চাউনি, শরীরের গন্ধ, গলার লকেট থেকেও যেন সেই ধর্ম প্রকট হয়ে ফুটে উঠতে লাগল তার চোখের সামনে। সেই উপস্থিতির সামনে আশঙ্কামিশ্রিত বিবশতা টের পেল সে, যেন তার শরীরে ঝিঁঝি ধরে গেছে। সে পুরুষ যাত্রীদের দিকে তাকাল কিন্তু কাউকেই ঠিক দেখতে পেল না— ভয়ে চোখ অন্ধ হয়ে গেল তার। আর বাসের প্রতিটি দেহগত অস্তিত্বের অবলম্বন ওই ধর্মের বাহ্যিক প্রকাশ তার এতদিনকার মনুষ্য-প্রকৃতিকে তীব্রভাবে আলোড়িত করতে লাগল এবং এক প্রকৃত নিরাপত্তাহীনতার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বাসের দুলুনির মধ্যেও সে বসে রইল কঠিন পাথরের মতো।

সে তখন বাইরে ঘুরিয়ে নিতে গেল মুখ আর অমনি বিস্ময়ে আর্তনাদ করে উঠে মুখে হাত চাপা দিল। সে দেখল শুধু বাসটাই নয়, রাস্তাটাও অন্য ধর্মের দ্বারা যেন সম্পূর্ণ আবৃত হয়ে গেছে। বাড়িগুলির স্থাপত্য, দোকানগুলির নাম, পণ্যগুলির কৌলীন্য, খাদ্যসম্ভার, পথ-চলতি মানুষ, নারী, পুরুষ, শিশু, ভাষা, গান, হাসি, হাঁটা, চলা, মুদ্রা, বিভঙ্গ, প্রার্থনা—সব, সব সমস্ত একেবারেই দপদপিয়ে উঠে তার চেতনার ফাটলে ফাটলে পৌঁছে দিচ্ছে একটাই চিহ্ন যার নাম অন্য ধর্ম! সেই রাস্তা আর বাসটা একটা আলাদা পৃথিবী হয়ে তার অসহায়তাকে আরও অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকল তখন।

সে যে বাসে একমাত্র নারী—এই ভয়ংকর ঘটনার থেকেও সে যে বাসে তার ধর্মমতের একমাত্র মানুষ—এই সত্যই তার শরীরে রক্তের প্রবাহ মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। তা হলে ধর্ম কি তার নারীত্বের থেকেও প্রবলতর ও আদিমতর বস্তু? শরীরের নারীত্বের থেকেও কি ধর্ম প্রাচীনতর? যখন সে বাসে উঠেছিল তখন তার কোনও ধর্ম ছিল না। কেননা সে জানত যে ধর্ম শিল্পের মতো,—যা আছে, যা স্বাভাবিকভাবে আছে তাকেই অন্যভাবে নির্মাণ করা—ফলত সে বিশ্বাস করত ধর্ম এক অতি কৃত্রিম বাধ্যতা। কিন্তু চলমান বাসের মধ্যেই তার অভিষেক ঘটল ধর্মে।

সে বুঝল যদিও ধর্মকে সে গ্রহণ করেনি কখনও, মনোবৃত্তিতে বা আচার-আচরণে গ্রহণ করেনি। তদ্‌সত্ত্বেও সে নিজে একটা ধর্মের সঙ্গে নিঃশর্তভাবে আমূল যুক্ত হয়ে আছে! এবং এই তার ধর্মটি যে কালপর্যায়ে গঠিত হয়েছিল আজ তার জীবন, বেঁচে থাকা সেই অতীত পর্যায় থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মনে মনে নিজে সে এতকাল একটা পক্ষকে ‘আমিত্বে’র সঙ্গে জুড়ে রেখেছে? এবং সেহেতু, তার ভেতরেই রয়েছে একাধিক ধর্মের মোহ! রয়েছে পক্ষপাতিত্ব, রয়েছে বিরুদ্ধ চেতনা। সে চিনে রেখেছে চিহ্নকে, ভাষাকে, আচরণকে! এত ভার এভাবে বয়েছে সে এতকাল—অজ্ঞান অবস্থাতেও? এত কৃত্রিমতার দ্বারা বাহুল্যের দ্বারা নিজের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং তারপরও উন্মাদ হয়ে যায়নি? যে ‘ধর্ম’ আসলে হয় না, তাই ধারণ করে থেকে, মিশে থাকা জলের থেকে জল আলাদা করতে করতে এত, এত কাল নিজেকে ছিন্নভিন্ন করেছে— আর বুঝতেও পারেনি যে সে একজন ছেঁড়াখোঁড়া মানুষ!

এবং সে এতসব কিছুর পরেও কোনওদিনও বোঝেনি যে ধর্ম আসলে কী? ধর্ম কাকে বলে? ধর্ম মেধা-প্রসূত নয়, ধর্ম হৃদয়বৃত্তি নয়, ধর্ম আচার-আচরণও নয়, কেননা সে নিজে কোনও আচরণবিধি মানেনি কখনও। অথচ কোনও অনুজ্ঞাকে বহন না করেও সে ধরে রেখেছে এক ধর্মীয় সতর্কতা! ধর্ম কি আসলে এক স্মৃতি মাত্র নয়? পুরনো কয়েক জাতকের স্বপ্নের স্মৃতি?

তা হলে শেষ অবধি, সে,—যার কোনও নাম নেই, পরিচয় নেই, পরিবার নেই, শহর বা গ্রাম নেই, ভূমি বা সম্পদের অধিকার মাত্রায় কোনও দখলদারি নেই পৃথিবীর ওপর—সেই তারও কীভাবে একটা ধর্ম রয়ে গেল! এই ধর্ম সে বিনা শ্রমে, বিনা দক্ষতায়, বিনা কারণে, বিনা প্রশ্নে পেয়েছে। আর এই ধর্মকে বহন করতে তাকে কোনও চেষ্টা করতে হচ্ছে না অথচ তার অস্তিত্ব থেকে সম্পর্কের মতো, হাত থেকে বস্তুর মতো খসে পড়ে যাচ্ছে না কিছুতেই—এই ধর্ম!

ক্রমশ বাসের মধ্যে বসে সে অনুভব করল, ধর্ম এই শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের রিফ্লেক্সের মতোই যেন প্রকৃত! তখন বাসটা চলতে চলতে এসে পৌঁছল এমন এক জায়গায় যেখানে আবার বদলে গেছে রাস্তার নাম, দোকানের নাম, নারীর শরীরে তার ধর্মের চিহ্ন, গাছের তলায় তার ধর্মের সাধক, খাদ্যের মধ্যে তার ধর্মের ভোগাসক্তি, মানুষের চোখে মুখে তার ধর্মের জীবন অন্বেষণ…! তার ধর্মে পূজিত এক চিরন্তন নারীর ভাঙা মাটির মূর্তিতে প্রস্রাব করতে থাকা এক কুকুরের দিক থেকে চোখ ফেরাতে ফেরাতে সে দেখল আবার উবে যাচ্ছে তার ‘ভয় পাওয়া, ভয় পাওয়ানোֹ’ সতর্কতা, সে আবার ধর্মকে অগ্রাহ্য করতে পারছে!

ফ্ল্যাটে ফিরে সে ভাবল তোমাকে বলে—ধর্মনিরপেক্ষতা কোনও বিশ্বাস নয়, একটা পরিস্থিতি মাত্র যা বদলায়, বদলাতে পারে…!

১৩

ঘুমের মধ্যে সে চিনতে পারল তার ছোটবেলার মিউজিক স্কুলটাকে! একটা প্রান্তরের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে স্কুলবাড়িটা তৈরি হচ্ছে তো হচ্ছেই—কিন্তু শেষ হচ্ছে না। মাঠ জুড়ে পড়ে আছে পাহাড় সমান বালি৷ পাঁজা পাঁজা ইট। যদি ছোট ছোট পায়ে ধসে যেতে যেতে সেই বালির পাহাড়ের চুড়োয় ওঠা যায় চোখে পড়ে স্তরে স্তরে জমিয়ে রাখা ইট। সে বালির পাহাড়ে খেলতে যায়, ইটের পাঁজার দিকে যায় না কখনও। তার ভয় করে। তার ছোট্ট জীবনের অভিজ্ঞতায় সে জানে ইটের পাঁজায় সাপ থাকে।

বালির পাহাড়ে উঠে সে পা দিয়ে গভীর চাপ দেয়। প্রায় কোমর অবধি ঢুকে যায় বালির মধ্যে কখনও কখনও। ভেতরের বালি ভিজে—টের পায়। তার মজা লাগে। সে বালির পাহাড়ে গড়িয়ে পড়া খেলা খেলে। উঠে দাঁড়ালে শরীরের সব খোলা অংশে বালি লেগে থাকে। ঝেড়ে ফেললেও কী যেন একটা চিকচিক করে জায়গাগুলোয়।

বালিতে সে ঝিনুক ও শামুকের খোল কুড়োতেও যায়। সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ক্ষুদ্রগুলো খুঁজে বের করতে বালি ঘাঁটে, তারপর সেগুলো দু’ মুঠোয় ভরে আপনমনে বাড়ি ফেরে। সে ভাবে তার সংগ্রহ সব্বাইকে দেখাবে কিন্তু কোথায় রাখে, দু’-একদিনেই সেগুলো হারিয়ে যায় সাধারণত! ঘুমের মধ্যে সে দেখতে পেল নিজেকে ঝিনুক কুড়োতে। তখন কিছুতেই অস্ত যায়নি সূর্য। বালির ওপর অদ্ভুতভাবে নেমেছে সূর্যের আলো।

চিকচিক করছে লালচে বালি। অসংখ্য ঝিনুক ও শামুকের খোল চোখে পড়ল তার। সে ব্যস্ত হল কুড়োতে। তখনই, সাপটাকে দেখতে পেল সে। ফণা তুলছে।

একেবারে বালির মতোই গাত্রবর্ণ। তেমনই চিকচিকে। সাপটাও তাকেই দেখছিল। সে ভয় পেল—নিকষ, ছিদ্রহীন ভয়। সর্বশরীরে কাঁটা দিল তার, সে উদ্‌ভ্রান্তের মতো তাকাল—সামনে বালির চুড়ো। পেছনে ইটের পাঁজা। বাঁহাতে অর্ধনির্মিত মিউজিক স্কুল। এমন কিছু নেই যাকে ‘কেউ’ বলা যায়। যাকে ডাকা যায় রক্ষা করতে। যদিও সে বুঝল তার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরচ্ছে না!

সাপটা তার থেকে কিছু দূরে আছে কিন্তু তার পক্ষে পিছু হটে পালানো অসম্ভব, কেননা বালির ওপর দিয়ে ছোটা যায় না।

সাপটা দুলছিল। দুলছিল বলে মনে হল তার। সে সাপটার দিকে ভাল করে তাকাতে পারছিল না—তার ঘেন্না করছিল। একটা হিলহিলে স্পর্শ চোখে ঢুকে আসছিল যেন। সে সূর্যের দিকে তাকিয়ে সাপটার সবটা আন্দাজ করছিল। অথচ চোখ বুজে ফেলার উপায়ও ছিল না।

সে এত ছোট যে নির্জনে, উদ্ধার-রহিত হয়েও সাপ দেখে তার ‘মৃত্যু’ মনে এল না। সে শুধু দংশনজনিত ব্যথার চিন্তা করছিল। হাতের মুঠোয় ধরা মোটা বড় ঝিনুকটা সে জোরে আঁকড়ে ধরেছিল কখন এবং ঘেমে ওঠা হাতের পাতার চাপে পিছলে পড়ে যেতে যেতে ঝিনুকটা তার নরম তালু কেটে দিয়ে খসে পড়ল বালিতে। রক্ত গড়িয়ে আসছে অনুভব করল সে কিন্তু তাকাল না সেদিকে। দৃষ্টিকে ভাসিয়ে রাখল সূর্য ও সাপের ফণার মাঝামাঝি জায়গায়।

কতক্ষণ কাটল এভাবে সে জানে না, একসময় তার মনে হল বালির চুড়োর ওপর একটা লোক।

দৃষ্টি না সরিয়েও সে বুঝতে পারল লোকটা কী করছে। লোকটা গায়ের শার্টটা খুলে ফেলল এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আচমকা এবং অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় প্রায় চাবুকের মতো করে শার্টটাকে আছড়াতে লাগল সাপটার ওপর।

সে পালাল। বালিতে ডুবে ডুবে যাওয়া পা টেনে হিঁচড়ে পালাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল মিউজিক স্কুলের ইট গাঁথা সিঁড়িতে এবং কাঁদতে লাগল।

সে যেখানে বসে ফোঁপাচ্ছিল লোকটা সেখানে এসে দাঁড়াল একটু পরে।

রোগা লোকটার গা ভর্তি বালি লেগে। চুলে বালি। লোকটা তার বাঁ হাতের রক্তপাতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বিষ নেই।’ সে মুখে শব্দ করে কেঁদে উঠল তখন।

তার ডান হাত ধরে তাকে মিউজিক স্কুলের একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল লোকটা। ঘরটার মেঝে নেই। ইট। দেওয়ালে ইট। ঘরটার জানলায় গর্ত। ঘরটা অন্ধকার। ভেতরের বাতাসটা ভিজে ভিজে, স্যাঁতসেঁতে। বাইরে তখন ডুবে গেছে সূর্য।

সে দেখল ঘরটার একটা কোণে একটা মশারি গোটানো। তার পাশে একটা কুঁজো। দেওয়াল থেকে ঝুলছে শার্ট, প্যান্ট, গামছা এসব। লোকটার গাল বসা, চোখ কোটরাগত, মাথায় উসকোখুসকো চুল।

লোকটাকে তার ভাল লাগছিল না। সে হাত ছাড়িয়ে বাড়ি যেতে চাইল কিন্তু লোকটা তাকে মুক্ত করল না। শক্ত মুঠোয় ধরে রইল তাকে।

এবার সে অন্যরকম ভয় পেল যেন। অচেনা ভয়, কিন্তু হাত ছাড়তে তবু বলতে পারল না। লোকটা তার হাত ধুয়ে দিল কুঁজোর জল দিয়ে, তারপর বসিয়ে দিল মশারিটার ওপর। দরজা নামক গর্তটার দিকে তাকিয়ে সে ভাবল ছুটতে ছুটতে সে কেন এল স্কুলবাড়িটার দিকে?

‘বাড়ি যাব’ বলল সে। লোকটা ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ল। তারপর কুঁজোর পেছন থেকে বের করে আনল একটা বই। বইটা লোকটা বাড়িয়ে দিল তার দিকে। বইটা হাতে নিয়ে চমকে উঠল সে।

বইটার সবুজ মলাটের ওপর একটা ল্যাংটো মেয়ের ছবি! বইটা পুরনো ও নোংরা। সে বইটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু লোকটা রোগা, কাঠি হাত দিয়ে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে রইল তার বাহু। সে হাঁপাতে লাগল ও কাঁদতে লাগল। লোকটা আবার এগিয়ে ধরল বইটা তার দিকে।

সে খুলে ফেলল বইটা। বাইরের অল্প নীলাভ আলোয় নানা ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো, বসা, শোয়া সোজা, উলটো নগ্ন একদল ছেলেমেয়ে যেন জীবন্ত হয়ে উঠল অমনি। সে বুঝল নিজেদের হিসির জায়গাগুলো নিয়ে অদ্ভুত কিছু করছে এরা আর সেটা সবাইকে যেন ডেকে ডেকে দেখতে বলছে। তার গা গুলোচ্ছিল, বুকে হাতুড়ি পিটছিল, গলা শুকিয়ে কাঠ কিন্তু বইটা সে ছুড়ে ফেলতে পারছিল না। তার হাত দুটো অবশ। এমনকী বাঁ হাতের কাটাটাও আর ব্যথা দিচ্ছিল না তাকে। এই সময় লোকটা তাকে ডাকল, সে তাকাতে লোকটা তাকে ইশারা করল নীচের দিকে তাকাতে। সে তাকাল। দেখল লোকটার প্যান্টটা খোলা আর সেখান থেকে বেরিয়ে রয়েছে একটা কালো, ন্যাতানো জিনিস। জিনিসটা কী তা সে দেখেই চিনতে পারল। তার মনে একটা তুলনা এল তখন। অকালে ঝরে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা পচা, চিমশোনো এঁচোড়ের মতো দেখাচ্ছিল জিনিসটাকে। লোকটা সেটাকে দু-চারবার নাড়াল চাড়াল, তারপর তাকাল তার দিকে।

লোকটা একবার করে তার দিকে, একবার করে বইয়ের ছবির দিকে, আরা একবার করে ন্যাতানো জিনিসটার দিকে তাকাচ্ছিল। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল কীসের আকাঙক্ষায়।

হঠাৎই সে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং পড়ি-মরি করে ছুটে দরজা পার হয়ে দৌড়ল। দৌড়তে দৌড়তে সে একবার পেছনে তাকাল। নাহ, কেউ তাড়া করছিল না তাকে!

এসব কথা সে কাউকে বলেনি। না সাপের কথা, না লোকটার কথা। সে মিউজিক স্কুলে কখনও যায়নি আর। বাড়ি থেকেও বেরোয়নি অনেকদিন। কিন্তু লোকটাকে দেখেছে। দূরের সজনে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বই দেখতে দেখেছে। সবুজ মলাটের বই। কিংবা বই দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে তাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে…।

ঘুমের মধ্যেই পাশ ফিরতে ফিরতে সে ভাবল বহুদিন পর্যন্ত চোখ বুজলেই সে দেখতে পেত, থোকা থোকা অন্ধকারের মধ্যে ঝুলছে একটা শুকনো, কালো, চিমশোনো এঁচোড়!

লোকটা তাকে সারাজীবনই তাড়া করেছে হাতে সবুজ মলাটের বই নিয়ে। জীবনের অনেক মোড়ে, বাঁকে, ভাঙা দেয়ালের পাশে, অন্ধকার বটের তলায়, ধসে পড়া মন্দিরের চাতালে বারবার লোকটার সঙ্গে দেখা হয়েছে তার আর সে দেখেই চিনতে পেরেছে। চিনতে পেরেই পালিয়েছে। কিন্তু আজ ঘুমের মধ্যে পালাতে পালাতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে। দ্রুত পায়ে ফিরে এল আধো অন্ধকার মিউজিক স্কুলের ওই ঘরটায় যেখানে সবুজ মলাটের বইটা সামনে রেখে প্যান্টের চেন খুলে নিজের অসুস্থ পুরুষাঙ্গটাকে বের করে বসে আছে লোকটা। এতদিনে সে তো বুঝেছে নারীর অভীষ্ট অবধি, নারীত্ব অবধি পৌঁছতে পারে এমন পুরুষাঙ্গ খুব কম পুরুষের আছে। ভয়ের কী তবে? পালানো কেন? ফিরে গিয়ে সে বইটা খুলে ধরল লোকটার সামনে। একটার পর একটা পাতা উলটে দেখাতে লাগল, ঝাঁকাতে লাগল বইটাকে। সে তীব্র স্বরে চেঁচাল—‘ইরেক্ট, ইরেক্ট…।’ আর লোকটা সিঁটিয়ে গেল, লালা ঝরতে লাগল মুখ থেকে, নিজের জড়ভরত যৌনাঙ্গের দিকে তাকিয়ে রইল শূন্য চোখে। কচি এবং সবুজ বর্ণের পুঁইডগার মতো প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে বেড়ে উঠতে থাকা একটা করে পুরুষাঙ্গ, সে, পরের স্বপ্নে প্রার্থনা করেছিল—বড় হয়ে উঠতে থাকা সমস্ত মেয়েদের জন্য!

২০

উকুনগুলো যে কোথা থেকে মাথায় এল আমি জানি না। একদিন খেতে বসেছি, হঠাৎ দেখি টুপ করে মাথা থেকে কী একটা পড়ল ভাতের ওপর। চোখ ছোট করে দেখলাম যে সেটা হাত পা নাড়ছে। বাঁ হাতে করে তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে নখ দিয়ে পিষে মারলাম। রক্ত বেরোল না। পিচপিচে রস বেরোল একটা—আমার আর ভাত খাওয়া হল না।

ছোটবেলায় মাথায় খুব উকুন হত আমার। বছরভর উকুন নিধন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উঠত মা। মাঝে মাঝে তিতিবিরক্ত হয়ে নেড়াও করে দিত। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হত না। চুল সামান্য বড় হলেই স্কুল থেকে উকুন নিয়ে ফিরতাম।

আমাদের যে বুড়ি কাজের মাসি ছিল, তার শখই ছিল উকুন মারা। হাত ফাঁকা থাকলেই সে আমাকে ডাকত—‘এসো দিনি, মাথাটা বেছে দিই।’ একদিন মা-ই আবিষ্কার করল ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকোলে উকুনগুলো মরে যায় দিব্যি। সেই থেকে উকুন হলেই পরপর কয়েকদিন স্নান করে ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকোবার নিয়ম হল। আমি এবং মা দু’জনেই বেঁচে গেলাম এতে। কেননা, কীটনাশক ব্যবহার করে করে আমাদের চুলের মান খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আমার উকুন হলে মা’রও অমনি উকুন হত— অবধারিতভাবেই।

শেষ উকুন হয়েছিল আমার বছর কুড়ি আগে। ও ছিল জন্মইস্তক আমার প্রাণের বন্ধু। আমার বাড়ির গা ঘেঁষে ছিল ওর বাড়ি। আমরা সবসময় খেলতাম।

নতুন বিয়ে হয়ে পাড়ায় এসেছিল কাকিমাটা। সবসময় কোমরে হাত দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আচার খেত, পেয়ারা চিবোত। চিবিয়ে থু থু করে ফেলত ছিবড়েগুলো। পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখলেই ডেকে ডেকে, হেসে হেসে কথা বলত। হাসতে হাসতে কিল মারত ছেলেদের পিঠে, একদিন আমরা দু’ বন্ধু হাত ধরাধরি করে ঘুরছি, কাকিমাটা ডাকল আমাদের। কিছুক্ষণ এ-কথা সে-কথার পর ফাজিল গলায় আমাকে বলল, হ্যাঁ রে, তোর চুলগুলো এমন লালচে আর রুক্ষ কেন রে? যাদের চুল লাল তারা জানিস তো খুব ঝগড়ুটে হয়। তুই বুঝি খুব ঝগড়া করতে ভালবাসিস? কীরে, ও খুব ঝগড়া করে তোর সঙ্গে? বলে ওর দিকে তাকাল কাকিমাটা।

ও তাকাল আমার দিকে। ‘হ্যাঁ, ঝগড়া তো আমাদের সবসময়ই হয় আবার ভাবও হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে…।’ বলল ও।

—তোকে তো দেখে মনে হয় না, তুই ঝগড়া করতে পারিস।

—কেন? কেন মনে হয় না? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

—দেখই না ওর চুলগুলো কেমন। কালো, পরিপাটি, সুন্দর। তোর মতো উড়ুক-ঝুড়ূক?

ও বলল—‘তাতেই সব বোঝা যায় বুঝি?’

মনে হল আমাকে এরকম বলায় ও আহত হয়েছে। কিন্তু আমার যেন ওর ওপরই রাগ হয়ে গেল কেমন।

সন্ধে নামছিল। বললাম, ‘চল, একটুখানি কালভার্টে গিয়ে বসি…।’ ও বলল, ‘জানি, তোর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। কাকিমাটা না বেড়েপাকা। মা-ও তাই বলে। তুই তো ওর কোনও ক্ষতি করিসনি। তোর মনে কষ্ট দিয়ে ওর কী লাভ হল বল তো?’

আমি চুপ করে থাকলাম।

—আমরা কখনও এরকম অসভ্য হব না কিন্তু।

কালভার্টে পাশাপাশি বসে আমি ওর মাথায় ঠেকিয়ে দিলাম আমার মাথাটা। আমি জানি, আস্তে আস্তে আমার মাথা থেকে ওর মাথায় একটা, দুটো, তিনটে, চারটে করে চলে যাচ্ছিল উকুন…!

সত্যি সত্যি, দেখতে না-দেখতে ওর মাথা বোঝাই হয়ে গেল উকুনে। চিড়বিড় করতে লাগল ও! দেখা গেল লম্বা চুলের নীচ অবধি নিকি। ওর মায়েরও খুব বড়, ঘন আর লম্বা চুল ছিল। আমি বারবার বলতে লাগলাম, ‘বেগন স্প্রে লাগিয়ে দাও না রোজ রাত্রে। ঠিক হয়ে যাবে।’

একদিন ওকে কাছে বসিয়ে ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে ওর সব চুল কেটে দিল ওর মা। তারপর নিজেরটাও কেটে ফেলল। আমি আর ও হাত ধরাধরি করে দেখতে লাগলাম ওদের অত চুলের লহমায় পুড়ে যাওয়া…! তারপর শুরু হল কীটনাশক লাগানো।

সেই আমার শেষবারের মতো উকুন হয়েছিল। তারপর আর কখনও হতে দিইনি। যত্ন করেছি, সতর্ক থেকেছি। কিন্তু আজ আবার কী করে এমন উকুন হল মাথায় সমুদ্রগুপ্ত জানেন।

আমার বিচ্ছিরি লাগছিল। সত্যিই ক’দিন ধরে খুব চুলকোচ্ছিল মাথাটা। আমি খেয়াল করিনি। কীভাবে মাথায় উকুন ঢুকল আমার, ভেবে পেলাম না। এখানে কারও সঙ্গে তো মিশি না। কোনও আত্মীয়-বন্ধু তো নেই এখানে যে মিশব? কোনও পাড়া-প্রতিবেশী নেই। কারও বাড়িতে যাওয়া নেই। বাসে, ট্রামেও চড়ি না আমি তেমন। হেঁটে হেঁটে ঘুরি বেশিরভাগ। এমন কোনও মেয়ের সঙ্গে আলাপ নেই যার মাথায় মাথা ঠেকাতে পারি—উকুন তো মেয়েদের মাথাতেই থাকে সাধারণত।

তবে কি আমার মাথায় কোনও পুরনো নিকিই থেকে গেছিল কুড়ি বছর ধরে যা এতকাল পরে জন্মাল?

যদিও এত চিন্তা করার কোনও দরকার ছিল না। এখন তো উকুন মারার শ্যাম্পু পাওয়া যায়। তাই দিয়ে চুল ধুয়ে ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিলেই সব মরে যাবে নিকিসুদ্ধ।

বিকেল হলেই বাজারে চলে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু কোথায়, তেমন কোনও প্রস্তুতি তো দেখা গেল না আমার মধ্যে। যাচ্ছি, যাব করে দিন পাঁচেক গড়িয়ে গেল। উত্তরোত্তর চুলকোতে লাগল মাথা।

শেষে সেদিন গেলাম। চোখের সামনে অসংখ্য শ্যাম্পুর শিশির মধ্যে জ্বলজ্বল করছিল উকুন মারা শ্যাম্পু। আমি কিন্তু কেমন উদাস উদাস চোখ করে তাকিয়ে দেখে বেরিয়ে এলাম স্টোরটা থেকে। ফিরতি পথে দেখলাম একজন ফুটপাতে নানারকম প্লাস্টিকের জিনিস সাজিয়ে বসেছে।

নাইলনের দড়ি, ছাঁকনি, ছোট ছোট ঝুড়ি, হ্যাঙার…। এসবের মধ্যেই চোখে পড়ল উকুন মারার ছোট সরু চিরুনি। কিনে নিলাম।

সারাদিন অপেক্ষার পর রাত বারোটা বা তারও বেশি পরে আমি সাদা স্কার্টটা পরে বিছানায় গিয়ে বসলাম। বসলাম ঠিক আলোর নীচে। সরু চিরুনিটা চালালাম চুলে। ঝরঝর করে উকুন পড়তে লাগল সাদা স্কার্টে। কিছু আটকে রইল চিরুনিতেই। আর কী মজা—এ এদিকে পালায় তো ও ওদিকে পালায়। নাহ্, কেউ-ই শেষ অবধি পালাতে পারে না— আমি পটাপট মারি। কখনও মারিও না, ধরে বসে থাকি।

কোনও-কোনওটাকে ছেড়ে দিই বিছানায়। তারপর আবার ফিরিয়ে এনে পিষে ফেলি দুই নখে।

বোধহয়, এবার আর উকুন নির্মূল হোক চাই না আমি। কেননা, আজকাল উকুন আর মারি না, খালি উকুন বাছি। বেছে বেছে আবার ফিরিয়ে দিই মাথায়। আমার রাত কেটে যায়। দিন প্রতীক্ষায় থাকে। দূরের কোনও বাড়ির চিলেকোঠায় বসে কেউ মাউথ-অর্গান বাজায় ঘোরতর রাতে একটা অস্তিত্বকে সান্ত্বনা দিতে।

সে একটা চিঠি লিখেছে। কাকে লিখেছে সে চিঠিটা? চিঠিটা সে সময়কে লিখেছে। চিঠিটা একটা বোতলে ভরে মুখটা সিল করে সে সমুদ্রে সেটাকে ভাসিয়ে দিয়ে আসবে। আর কদিন বাদেই সমুদ্রে যাবে তাই। চিঠিতে সে লিখেছে—আমি জানি না আমি কেন গেছিলাম। আমি জানি না কেন যেতাম আমি। বারবার যেতাম কেন। কেন আরও আরও যাওয়ার কথা ভাবতাম এমনকী? কেন শ্বেতকেতু, বাভ্রব্যকে ভুল মনে হত আমার? কেন বাৎস্যায়নকে অজ্ঞান মনে হত? কেন আমি বিশ্বাস করতাম—বস্তুর আইডেনটিটি খোঁজা উচিত তার ইনসিকিওরিটির জায়গাটায়? কেন ভাবতাম বস্তু তার অনিশ্চয়তাকেই অবলম্বন করে বিকশিত হয়? কেন আমি পুরুষকে বলেছিলাম আমার ভেতরে যে-ঘড়িটা আছে তাকে গ্রাহ্য করতে? কেন আমি ওদের সেসব সময় থামতে বলেছিলাম… থামতে… থামতে…

আমার কাছে এই এত প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই—আমি শুধু জানি যে জীবনে যা-ই চেয়েছি আমি, বদলে পেয়েছি শুধু ‘সম্পর্ক’!

২২

সেদিন পোশাক খুলে ফেলে সে তোমাকে ডেকেছিল৷ তুমি মাথা নেড়ে ‘না’ বলেছিলে। বলেছিলে, ‘তুমিই উঠে এসো আমার ওপরে!’ তোমার বলার মধ্যে, অন্য কিছু ছিল। সে থমকে গেছিল, যৌন-দ্বন্দ্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল তার মধ্যে। সে বুঝতে পারছিল না আসলে কী চাইছ তুমি। তখনই আবার বলেছিলে, ‘উঠে এসো। যেভাবে নারীর শরীরে আরোহণ করে পুরুষ, সেভাবে উঠে এসো আর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করো। দেখো, কীভাবে তোমার ব্যক্তিত্বের মধ্যে জাগরিত হয় পুরুষত্ব, দেখো, আমার ভেতরের নারীত্বকে তুমি তোমার নীচে শায়িত অবস্থায় খুঁজে পাও কি না!’ যে যে নিরাপত্তাহীনতার বোধগুলো তাকে আজ ‘নারী’ করে গড়ে তুলেছে তুমি তার প্রতিটা চিহ্নিত করতে পেরেছিলে অনেক আগেই! তাই ‘যৌনতার শর্ত, সম্পর্কের শর্তগুলো নারীর ক্ষেত্রে যা পুরুষের ক্ষেত্রে তাই নয়’ একথা বলেছিলে তুমি। বলেছিলে, ‘তুমি একবার নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষকে পুরুষ হিসেবে গ্রহণ করো।’

তারপর সে তোমার ওপর উঠে যায় এবং নিজেকে অশ্বারোহীর মতো চালনা করে। তখন প্রতিবার তোমার দিকে ঝুঁকে পড়ার সময় সে এক পুরুষকে টের পায় নিজের ভেতর অন্তরীণ হয়ে থাকা—দুটি স্তন সে ধরতে চায় মুঠোয় যা নেই, তোমার ঠোঁট নারীর ঠোঁটের মতো সুখদায়ী দেখায়—সে কেঁদে ফেলে আঁকড়ে ধরে তোমাকে দু বাহু দিয়ে।

আবদ্ধ যৌনতার সমস্ত জানলা, দরজা খুলে যায় সেই মুহূর্তে। সে টের পায় আলো বাতাস খেলছে। তোমার দণ্ডটিকে সে নিবিড়তম আনন্দের চোখে দেখে তখন। তার কান্না পায় আবারও, নিজের গর্ভকেশরের মতো চোখের জল ফোঁটায় ফোঁটায় ফেলে দেয় সে দণ্ডটির ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে।

আর দণ্ডটিকে শোষণ করতে থাকে। দণ্ডটি কাঁপতে থাকে, তোমাকেও কাঁপায় আর পরক্ষণেই উথলে দেয় এক আত্মনিষ্ঠ, আত্মভেদী ধারা। যা সে আগে দেখেনি কখনও, যত্ন সহকারে। দেখেনি, স্পর্শ করেনি, গন্ধ শোকেনি, আস্বাদ জানে না। তার মেধা সেই অর্ধ-তরল বস্তুকে গ্রহণ করে এরপর। সেই বীর্য সে পান করে তখন।

সে বাড়ি ফিরে যায়। এবং সেদিনই লেখে, ‘আমি জানি বীর্যের স্বাদ!’ কেমন সেই স্বাদ বর্ণনা করে সে।—‘নরম মাটিতে গমের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার দশ-বারো দিনের মাথায় যে সবুজ কচি কচি চারা মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসে, তাই তুলে এনে কুটে, পিষে পাওয়া রসের স্বাদ আর বীর্যের স্বাদ এক। সেই পানীয়ের মধ্যে যেমন ধকধক করে গেহুঁর চারার প্রাণ, বীর্যপানের মধ্যেও সেই প্রাণের তেজকে বোঝা যায় স্পষ্ট। এই তরল জিভ বেয়ে নেমে গেলে গলার নলি অবধি ছড়িয়ে পড়ে তার ঝাঁঝ!’

—এই অসামান্য স্বাদকে না জেনে মরে যাওয়া নারীজন্মের ব্যর্থতা! এই অসামান্য আস্বাদকে গ্রহণ করতে নারীকে সাহায্য করা পুরুষের ধর্ম! সেই সাহায্যের নামই ভালবাসা!

—দেশ জিনিসটা যে কী—তা কি তুমি চিনতে পেরেছ?

—হ্যাঁ। একদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই…, দেখি রাতভর বর্ষণ শেষে সমস্ত রাস্তাঘাট ঝকঝকে করে ধোয়া, নিকোনো। গাছগুলির পাতা থেকে যে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে তা এত পরিষ্কার যে ঠোঁট পেতে পান করতে ইচ্ছে করবে। তখনই আমি দেখি, পুবদিক থেকে হেঁটে আসছেন এক সন্ন্যাসী!

তাঁর চলার পথে শুয়ে থাকা যত ফুটপাতবাসী, সন্ন্যাসী সেই ভোরে তাদের প্রত্যেককে ডেকে ডেকে তুলতে লাগলেন এবং প্রত্যেকের মাথায় জপ করে দিতে লাগলেন কোনও মন্ত্র যা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। তার কাঁধে একটা অতি বড়সড় ঝোলা ছিল। যুবক সন্ন্যাসী সেটা অবলীলায় বইছিলেন। আমি ভাবছিলাম এই ঝোলা থেকে খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ এসব বের করে বিলোবেন তিনি ফুটপাতবাসীদের মধ্যে। কিন্তু তিনি সবাইকে ডেকে দিতে দিতে এগিয়ে চললেন, কাউকেই কিছু দিলেন না তার বেশি। তার চোখে দয়া, মায়া, প্রেম, ভালবাসা, সহানুভূতির লেশমাত্রও ছিল না—তার চোখে ছিল মানুষের সমস্ত প্রত্যাশার ওপর কঠিন ও নিষ্ঠুর ‘না’-এর মতো এক দৃষ্টি! তার চোখে ছিল শুধুমাত্র ‘এসো’—এই আহ্বান। যদি আসা অসম্ভব হয়, কোনও ব্যাখ্যা দ্বারা তাকে তা বোঝানো যায় না— এমন অবুঝ যেন সেই চোখের ভাষা। যদিও, কেউ তার পিছু নেয়নি। কেবল কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করেছে। আমি সেই ভোরবেলায় তাকেই দেশ বলে চিনতে পারি।

শুধু দায়ী করা, শুধু অভিযোগ, শুধু মনকে মন দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া, স্মৃতি দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া, শরীরকে শরীর দিয়ে পোড়ানো—বহু বহু দিন আমার এভাবেই কেটে গেছে। সেদিনের আগের সারাটা দিনও সম্পৃক্ত ছিল

অভিমানে। না, গাছের কোনও উলটো-সোজা নেই, সম্মুখ-পশ্চাৎভাগ নেই, তবু তার আগের সারাদিন আমার মনে হয়েছে এখানে চারপাশের প্রতিটা গাছই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ডালপালা মেলে ওরা ঘুরে গেছে উলটো দিকে! অথচ সেদিনের ভোরটা হয়ে গেল অন্যরকম! বুকের ভেতরের কোনও ক্ষোভ টেরই পাচ্ছিলাম না যেন— একটা অন্য আবেগের কষ গড়াচ্ছে, মনে হল এই সব বৃক্ষরা আমার পিতা, আমার পূর্বপুরুষ!

কী করে এমন হল? কেন মনে হল ভিজে কালো হয়ে থাকা গুঁড়িগুলোয় সঞ্চিত আছে স্নেহ—আমার জন্য!

সেদিনই বিকেলের দিকে আমি বেড়াতে গেলাম নদীর কাছে। ঘাটের সন্নিকটে গিয়ে পা আটকে যায়। দেখি ভোরের সেই নবীন সন্ন্যাসী! তখন সন্ন্যাসীর বুকের কাছে লেপ্টে থাকা এক প্রৌঢ়াকে কাঁদতে শুনি আর সেই নারীকে দেখে আমার বিভ্রম জাগে! মনে হয় আমারই ভবিষ্যৎকে দেখছি ক্রন্দনরত! কী ভয়ানক নিষ্করুণ সেই কান্না—শ্বেতপাথরের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া জলের মতো কান্না!

আমি শুনতে পাই সন্ন্যাসী তাকে প্রশ্ন করছেন, ‘দেশকে তুমি কী দিয়েছো?’ নারীটি বলে, ‘কিছু কি দিয়েছি তেমন যার ফেরত মূল্য ধরিনি!’

সন্ন্যাসী বলেন, ‘এখনও সময় আছে। নদীর এপারে তোমার দেশ! আর ওপারে শুধুই নদী, যা বহমান—যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎহীন, যা দাবিহীন। তুমি বেছে নাও কোন দিকে যাবে…।’

নারীটি বলে, ‘আমি ওপারে যাব…!’

‘তবে চলো তোমাকে পার করে দিয়ে আসি৷’ বলে সন্ন্যাসী নারীটিকে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামিয়ে নিয়ে চলেন। আমিও হতচকিত ভাব কাটিয়ে উঠে ওদের পিছু নিই। ওরা একটা নৌকোয় উঠে পড়েন। কিন্তু আমি আর একটা পা-ও বাড়াবার আগেই শুনি পেছন থেকে কে অদ্ভুত এক সুরে ডাকছে আমাকে। নিশ্চিতভাবে আমাকেই ডাকছে বলে মনে হয় যেন। ধিকিধিকি দরদে ঠাসা তার গলা ভেসে আসে— ‘ও বাউলা, বাউলা, বাউলা রে-এ-এ-এ, এ বাউলা, বাউলা, বাউলা রে-এ-এ’—যেন এ জীবনের প্রতি আমার দৃষ্টিপাতকে ঘুরিয়ে দিতেই সে ডাকতে থাকে আমাকে! তার স্বরের ভেতর প্রতি লহমায় ফেটে, জারিত হয়ে যেতে থাকে অসংখ্য মহুয়া ফলের নেশা! কী এক অমোঘ ফেরতা সেই ডাকে খুঁজে পাই আমি; মনে হয় মাথার পেছন থেকে চুলের ডগা বেয়ে উঠে চৈতন্যের ভেতরে ঢুকে পড়ছে সাউন্ড, চাপ চাপ সাউন্ড!

সেই স্বরের উৎসের সন্ধানে অন্ধকার ঘাট ছেড়ে আমি উঠে আসি এবং হাঁটতে থাকি। সেও মাদক গলায় গাইতে থাকে, ‘বাউলা, বাউলা, বাউলা রে-এ-এ-এ…!’

এক সময় আমি দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হই কেননা লতানে আগাছায় পা আটকে যায় আমার। দেখি একটা ট্রাক!

বাউলা, এই ট্রাক আজ অসংখ্য বছর দাঁড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত ব্রিজের নীচে আমার মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাবে বলে। নরম পলতা লতা জড়িয়ে ধরেছে তার চাকা। চাকা ছাড়িয়ে উঠে গেছে কাঠের রেলিংয়ে। তারপর মাথায়। মাথা বেয়ে নেমে এসেছে চোখে, হেডলাইটগুলোয়। ট্রাকটা বছরের পর বছর আমি তাকে খুঁজে বের করব এই অপেক্ষায় আছে। সে চায় লতাপাতা খুলে আমি তাকে আদর করি, ইঞ্জিন চালু করে গতি ফিরিয়ে দিই—কিন্তু বাউলা, তুমি এমন গান বেঁধেছ যে মরতে ইচ্ছে যায় না। সাধ হয় এই দেশ, এই মাটি, এই নদী, এই ধূপছায়া সব, সব পলতা লতা হয়ে জড়িয়ে ধরি—ওই সন্ন্যাসীর সামনে নতজানু হয়ে স্বীকার করি— দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে, অনেক!

বাউলা, ওই সন্ন্যাসী যিনি সর্বত্যাগী নন আর। তিনি এবার নিজেই কিছু গ্রহণ করতে চান— আমি তাকেই দেশ বলে চিনতে পেরেছি এতকাল পরে!

১৬

তার আগে আকাশ স্বাভাবিক ছিল যখন, আমরা…, ক্লাবের লম্বা টানা বারান্দাটায় গিয়ে বসেছিলাম সন্ধের পর। বড় বড় হাঁড়ির মতো কাচের ডুমগুলো অদ্ভুত এক সোনালি আলোয় জড়িয়ে রেখেছিল বারান্দাটাকে। বসেই আমি আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম আর আমার দৃষ্টি পড়েছিল অদূরের বিজ্ঞাপনহীন সাদা সাইনবোর্ডটার দিকে, যেটা চৌরঙ্গির একটা উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে ঝুলছে। একটা কালো পাখি ঠিক তখনই সাদা সাইনবোর্ডেটাকে পার করে উড়ে যাচ্ছিল। আমি যদিও সেটা বুঝতে পারিনি! এবং চূড়ান্ত বিস্মিত অবস্থায় আমি তোমার হাতে এমন টান দিয়েছিলাম যে, তোমার ফ্লিং ভদ্‌কার গ্লাস থেকে ভদ্‌কার চল্‌কে পড়ে গেছিল তোমার প্যান্টে। তুমি বলে উঠেছিলে, ‘আরে, হোয়াট হ্যাপেন্ড?’ আমি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠেছিলাম, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, সাদা সাইনবোর্ডটার সামনে দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিটাকে। দু-এক মুহূর্ত আমার মনে হল যেন সাইনবোর্ডে আঁকা একটা পাখিই হঠাৎ প্রাণ পেয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে।’

—এতখানি আশ্চর্য কথা তুমি ভাবলে কী করে?

—কী জানি! হয়তো সাইনবোর্ডটা অত সাদা, তাতে ছবি বা অক্ষর নেই বলেই পাখিটাকে সাইনবোর্ডটার অংশ বলে মনে হল।

—হ্যাঁ, হতে পারে…। বললে তুমি। ‘আসলে আমরা যাই ভাবি বা করি কোনওটাই বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাবি বা করি না তো— সঙ্গে একটা পটভূমি থাকেই। একটা সাপোর্ট থাকেই। তবে এখানে সাদা সাইনবোর্ড না পাখিটা কোনটা যে কার পটভূমি আমি তা বলতে পারব না!’

—তবে জানো, দৃশ্যটা আসলে কল্পিত। তাই মুহূর্তকাল আশ্চর্য সুখ এনে দিল আমার মনে। তুমি এ কথা শুনে আমার দিকে তাকালে। আমিও তোমার দিকে তাকালাম ও হাসলাম।

ঠিক তখনই ক্লাবের মাঠের অন্ধকার দিকটা থেকে ছুটে এল দুটো কুকুর। একটা কুকুর কালো, একটা কুকুর লাল। কালো কুকুরটা যেন এসে গড়িয়ে পড়ল আমাদের একেবারে সামনের ঘাসের ওপর।

দৃশ্যটায় নতুনত্ব কিছু নেই। এগুলো ক্লাবেরই কুকুর। প্রতিদিনই ওরা দৌড়ে দৌড়ে এভাবেই খেলা করে। আমি তাই দৃশ্যটা থেকে চোখ ফিরিয়ে কী একটা অন্য কথা তোমাকে বলতে যাচ্ছিলাম— তুমি, আমাকে থামিয়ে দিয়ে ওদিকেই তাকাতে বললে ইশারায়। ইশারার মুহূর্তে তোমার চোখ দুটোয় কী একটা চমকাল যেন। যা চমকাল তা আমার চেনা— তা নারীর জন্য পুরুষের চোখে কখনও কখনও চমকাতে দেখেছি আমি। কখনও কখনও দেখেছি— রেয়ারলি…!

আমি বিহ্বল বোধ করলাম ও কুকুর দুটোর দিকে তাকালাম ফের।

লাল কুকুরটা পা মুড়ে এলিয়ে পড়েছিল ঘাসের ওপর। কাঁপছিল যেন বা। আর কালো কুকুরটা শুঁকছিল…

কালোটার সেই নাক টানার আওয়াজ এবং সঙ্গে লালটার মৃদু, আদুরে স্বরে কুঁইকুঁই ডাক— নিমেষে, তীব্র, তীব্রভাবে আচ্ছন্ন করে দিল আমাকে। আমার পা থেকে রক্তস্রোত উঠে আসতে লাগল মাথার দিকে। তুমি আমার বাঁ হাতের প্রতিটা আঙুলের মধ্যে পুরে দিলে তোমার ডান হাতের প্রতিটা আঙুল। তারপর চাপ দিলে। ছাড়িয়ে নিলে। সামান্য সময়ের মধ্যেই তোমার ঠোঁট দুটো লাল হয়ে উঠল। আমি ভাল করে তোমাকে দেখলাম একবার। কালো প্যান্ট আর ফুলস্লিভ সিল্কের কালো শার্টে তেজি কালো ঘোড়ার মতো রোমাঞ্চকর, জাগ্রত, তপ্ত দেখাচ্ছিল তোমাকে। ফরসা গালের পাশে ধারালো ছুরির মতো এসে পড়েছিল শার্টের কলারটা। আমার কামার্তি জাগল তখন। তুমি প্রায় অশ্রুতভাবে উচ্চারণ করলে, ‘যদি লালটা তুমি হও, কালোটা অতএব আমি!’

ভাদ্রের আকাশে অমনি বিদ্যুৎ চমকাল। তাতেই চমকে উঠে লাল কুকুরটা ঝটকা মেরে উঠে ছুট লাগাল। পেছনে পেছনে ছুটল কালোটা।

তুমি বললে, ‘চেসিং…! চেসিং ফর পিওর সেক্স। অনলি সেক্স অ্যান্ড নাথিং এলস্‌!’ তুমি থামলে, তাকালে আমার দিকে, আমার চোখের দিকে, চুলের দিকে, ঠোঁট ও স্তনের দিকে তাকালে, তারপর বললে, ‘থিংক অফ মি চেসিং ইউ লাইক দ্যাট!’ আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, আমি ঢোক গিললাম। কুকুর দুটো আবার ফিরে এল এখানেই ছুটতে ছুটতে। আর লালটা দাঁড়ানো মাত্র কালোটা উঠে এল ওর ওপরে, আমি আর তুমি সব ভুলে তাকিয়ে দেখলাম কালোটা টাল সামলে নিজেকে প্রবেশ করাবার চেষ্টা করছে কীভাবে!

তোমার অসম্ভব ভারী নিশ্বাস গালে ঘষে গেল আমার। আমারও সমস্ত শরীর দপদপ করছে। তুমি ব্যস্ত গলায় আবগারকে ডাকলে, ‘সাইন করা লো…।’

আমি টের পেলাম তোমার তাগিদ—বাতাসে শ্বাস টেনে তোমার ঘ্রাণ পেলাম।

ভদ্‌কার জন্য দ্রুত সাইন করে একবার হাত ধরে আমাকে আকর্ষণ করে বড় বড় পা ফেলে তুমি পৌঁছে গেলে পোর্টিকোয়। আমি পিছু নিলাম তোমার। অধৈর্যভাবে গাড়ি স্টার্ট করলে তুমি। রাত দশটার কলকাতা ঝড়ের বেগে পিছোতে লাগল, তুমি গাড়িতে একবার মাত্র ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালে।

পরপর লক খুলে ঢুকে বেডরুমে পৌঁছতে যেটুকু দেরি! তুমি এ.সি অন করলে, চশমা খুলে রাখলে টেবিলে, মোবাইল ছুঁড়ে দিলে বিছানায়। তুমি আমাকে নগ্ন করতে চাইলে, আমি তোমার শার্টের বোতাম খুলছিলাম। তোমার পরনে তখনও ট্রাউজার আর আমি শুধুমাত্র একটা… সেই বাঘছাল প্যান্টি পরে দু হাতে স্তন আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি! যেন দাঁড়িয়ে রইলাম প্রহরের পর প্রহর। আর দেখলাম প্রথমে বিস্মিত তুমি, ধীরে ধীরে কুঁকড়ে গেলে ঘৃণায়। সেই ঘৃণা বদলে গেল রাগে, রাগ বদলে গেল হতাশায়। হতাশা থেকে উদগিরণ হল কান্নার। তুমি কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলে ফ্ল্যাট থেকে।

তার অনেক পরে বিছানায় ঢলে পড়লাম আমি। চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে বের করে দিতে লাগলাম সেই সব অশ্রুগুলোকে, যেগুলো প্রচণ্ড চেষ্টায় বহুদিন ধরে রেখেছি। কেউ শুনছিল না, কিন্তু আমি বললাম কথাগুলো, বললাম, ‘আমাদের জীবনে আর কি কখনও হতে পারে পিওর সেক্স? মানুষের জীবনে কি আদৌ কখনও তা হয়? বিশুদ্ধ সেক্স? যেমনটা ঘটে ওই লাল ও কালো কুকুরের মধ্যে— অনায়াসে।’

পরের দিন তুমি আমাকে বলেছিলে, ‘সুখ এখন ওই সাদা সাইনবোর্ডের বুক থেকে বেরিয়ে এসে উড়ে যাওয়া পাখির মতো, যা হয়তো সত্যি, হয়তো অলীক, হয়তো ভ্রম— আমরা তা জানতে চাই না!’

২১

ডক্টর বলেছিলেন অপারেশন হওয়ার মত যথেষ্ট রক্ত শরীরে আছে আমার। কিন্ত তিনি বা আমরা কেউই সে সময় একথা ভাবিনি যে অপারেশন হওয়ার সেটাই একমাত্র শর্ত নয়। 10.2% হিমোগ্লোবিন থাকলেই যে, যে-কারও অপারেশন হতে পারে তা জোর দিয়ে বলা যায় না। অনতিকাল পরেই আমরা জানতে পারি এ সত্য। জানতে পারি অপারেশন হওয়ার জন্য আর যা যা লাগে তার মধ্যে অন্যতম হল একটা সই! সইটা পেশেন্টের নিকট আত্মীয়ের হলে ভাল। না হলেও ক্ষতি নেই। বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী যে-কেউই পেশেন্টকে অপারেশন টেবিলে তোলার দায়িত্ব নিতে পারে। সইয়ের সঙ্গে দরকার হবে নাম-ঠিকানারও। কেননা, রোগীর প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সেবাকেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ তলব করবে কাকে? যদি অপারেশন চলাকালীন হঠাৎ মৃত্যু হয় রোগীর তাহলেই বা দায়িত্ব নেবে কে? বন্ডে সই করে একজনকে স্বীকার করতে হবে অপারেশনের যাবতীয় ঝুঁকি তার!

অবশ্য সে সময় এত কথা মাথায় ছিল না আমার। হয়তো তোমারও। ভোর ভোর উঠে চলে গেলাম নার্সিংহোম। বিকেলেই অপারেশন। ওরা আডমিট করার আগে ফর্মটা ফিলাপ করার জন্য এগিয়ে ধরল তোমার দিকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ওরা তোমাকে অভিভাবক ভেবেছিল আমার! তুমিও সহজভাবেই গ্রহণ করলে সেটাকে।

ফর্ম ফিলাপ করতে করতে এক জায়গায় থেমে গেলে তুমি। তাকালে আমার মুখের দিকে। বললে, ‘রিস্ক বন্ডে সই করতে হবে।’

আমি যেন দ্বিধান্বিত বোধ করলাম, ‘তাহলে কী হবে?’ বললাম আমি, ‘তুমি কি রিস্ক নিতে পারবে?’

তুমি বললে, ‘রিস্ক? যদি থেকে থাকে কিছু তা আজ, এই মুহূর্তে আমারই, দেয়ার ইজ নো ডাউট অ্যাবাউট ইট— কিন্তু ওরা সম্পর্কটা জানতে চায়। যে বন্ডে সই করছে সে রোগীর কে?’

আমার ভেতরটা শূন্য হতে শুরু করেছিল। বললাম, ‘ও, রিলেশন…!’

—হোয়াট ইজ দা রিলেশন?

—তুমি জানো না?

—আমি জানি না!

—আমিও জানি না!

—কী লিখব? বললে তুমি।

—যা খুশি লিখে দাও। কিংবা থাক, কিছুই লিখো না। অপারেশন না হয় না হবে!

আমার কি কান্না পেয়েছিল? আমি কি সেই মুহূর্তে বন্ডে সই করতে পারে এমন একটা হাত চেপে ধরতে চাইছিলাম যেভাবে পারি? আমি কি অনুধাবন করেছিলাম কোথাও-ই কোনও সম্পর্ক না থাকাটা কতখানি অসহায়জনক, মারাত্মকও কখনও কখনও! আমার তা সত্ত্বেও কি আরোগ্যের কামনা ছিল? আমি কি তার আগে বুঝেছিলাম কখনও, পৃথিবীতে সম্পর্কগুলো এমন জীবন অভিমুখী? বুঝেছিলাম বেঁচে থাকতে সম্পর্ক লাগে? সম্পর্ক লাগে শবের ভালর জন্যও— যদি চাও! তখন কি প্রবল আফসোসের সঙ্গে নার্সিংহোমের শ্বেতপাথরের মেঝে ও সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আমি ‘সম্পর্ক’ খুঁজেছিলাম, যদি কুড়িয়ে পাওয়া যায় কোনও ভাবে? নিরেট, ভারী এবং ব্যাখ্যার প্রয়োজনহীন সম্পর্কে আবার কি বিশ্বাস জন্মেছিল আমার, সম্পর্ক যা মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে পারে? যা মৃত্যুকে কোল দিতে পারে? যা অগ্নি এবং তারও পরে শীতল জলের পাত্র ধরে দিতে প্রতিশ্রুত থাকে মৃতকে? পাহাড়ে পাহাড়ে শব্দ উৎপন্ন হয়ে পাহাড়ে পাহাড়েই তা প্রতিধ্বনিত হওয়ার মতো এতখানি নিজস্ব কোনও সম্পর্কের নাম কি চেয়েছিলাম আমি আমার জন্য তখন—সেদিন? হেরে যাওয়া মানুষের মতো মাথা নিচু করে বসেছিলাম আমি লজ্জায়!

আমার কোথাও কোনও সম্পর্ক নেই বলে মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম ফিরে যাওয়ার জন্য! ফিরে যদিও যেতে হয়নি আমাকে। তুমি ফর্মে লিখেছিলে, ‘এই মানবীকে আমি ভালবাসি৷ সেও আমাকে ভালবাসে। ভালবেসে তার শরীর এবং মন সে দিয়েছে আমাকে। তাই তার এই শরীর আমার, মন আমার। অতএব, অপারেশনের আগে, পরে যা-যা ওর দরকার তার সমস্ত দায়িত্ব আমার। অপারেশনের ঝুঁকি আমার! যদি কোনও দুর্ভাগ্যজনক কারণে এখানে ওর মৃত্যু হয়, আমিই গ্রহণ করব, বহন করব ওর মৃতদেহ। নীচে আমার ঠিকানা এবং ফোন নম্বর ছাড়াও একটা অ্যাড্রেস প্রুফ…’

বৃষ্টি শুরু হয়েছিল দুপুরে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল। বিকেল পেরিয়ে রাত হয়ে সকাল, দুপুর, বিকেল গড়িয়ে গেল— বৃষ্টি তবু থামল না! ঝিমঝিম, ঝরঝর বৃষ্টি চলছে তো চলছেই। শেষে রাতে নামল অঝোর বর্ষণ— ভোরে বোঝা গেল সমস্ত শহর পিছলে যাচ্ছে জলের তলায়!

দেখলাম ওদের যাবতীয় জিনিস ডুবে গেছে জলে। যে কাঠের প্যাকিং বাক্সে সব কিছু ভরে রাখে ওরা সেই প্যাকিং বাক্সর ঢাকনা ভেসে ভেসে চলতে লাগল। ভেসে যাচ্ছিল প্লাস্টিকের শিট, জলের গ্লাস, খাবার থালা। ধর্‌ ধর্‌ করতে করতে ওরাই ছুটছিল সে সবের পেছনে আর জল ঠেলে যেতে গিয়ে আছাড় খাচ্ছিল যত, দারুণ মজায় ততই হেসে খুন সব! আমি ঝুঁকে পড়ে বাচ্চা দুটোকে খোঁজার চেষ্টা করলাম কিন্তু দেখতে পেলাম না। ঘুরে-ফিরে এলাম দু-চারবার। বেশ কিছুক্ষণ পর বউটা আমার ব্যালকনির তলায় এসে দাঁড়াল কোমরজলে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর বাচ্চা দুটো কোথায়?’

ও হাত তুলে যেদিকে দেখাল সেদিকে চোখ গেল না আমার। আবার বললাম, ‘কোথায়?’

— ওই ওদিকের রকে তুলে দিয়ে এসেছি!

আমি উদ্বিগ্ন হলাম শুনে, ‘আর কে আছে ওখানে?’

— আবার কে থাকবে…!

— সে কী রে? ছোটটা যদি পড়ে যায়-টায়…!

ও আমার কথার উত্তর না দিয়ে আবার জল ঠেলে এগোল। এবার কাউকে গালি দিল ও, সম্ভবত স্বামীকেই ‘ঢ্যামনা, চটগুলো তুলতে পারিসনি?’ বলে যে জলে দাঁড়িয়ে আছে তাতেই পিচিক্‌-পিচিক্‌ করে থুতু ফেলল দু’বার।

আমি ঘেন্না চেপে বললাম, ‘তোর মেয়ে দুটোকে সিঁড়ির কাছে রেখে যা। আমি ওপরে নিয়ে আসছি। জল নামলে নিয়ে যাস!’

এবার বাস্তবিকই বিস্মিত হল বউটা, ঘাড় তুলে ওপরে তাকিয়ে বলল, ‘কী বললে?’

‘বললাম, মেয়ে দুটোকে…!’ ও আমার দিকে অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেঁটে চলে গেল ওদিকে।

একটু পরে দুটো বাচ্চাকে বুকে জাপটে ছপাৎ ছপাৎ করে জল ভেঙে ফিরে এল ও। বলল, ‘একে নাও, এটা তো আমার দুধ না খেয়ে থাকতে পারবে না…!’

যখন ন্যাংটো বাচ্চাটাকে সিঁড়ির মুখ থেকে সংগ্রহ করলাম তখন গেটের মুখে ভিড় করে থাকা দারোয়ান আর ড্রাইভারদের দলটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। বেসমেন্টে ঢুকে যাওয়া জল নিয়ে তার আগের মুহূর্তেও চেঁচামিচি করছিল ওরা।

আমি প্রথমে তোমাকে ফোন করে জানালাম যে বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছি। তুমি বিরক্ত হয়ে বললে, ‘গল্‌ত কিয়া! ইটস নট ডান! মানুষ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট? তুম পছ্‌তাওগী। এনি ওয়ে, ট্রাই ইট আউট। এ্যাট লিস্ট ভুল তো ভাঙবে। নিজের ভুল নিজেই ভাঙানো ভাল…!’

আমি ওকে স্নান করালাম, ভাত খাওয়ালাম। টয়লেট চেনালাম। নিজে কমোডে বসে হিসি করে দেখিয়ে ওকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে হিসি পেলেই যেন ও টয়লেটে যায়। ওর রুক্ষ চুলগুলোকে ছেঁটে দিলাম কাঁচি দিয়ে, তারপর আমার ওড়না শাড়ির মতো করে পরিয়ে দিতেই ও আয়নার সামনে চলে গেল এবং ভয়ানক লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অনেক ডাকাডাকির পর দেখাল টিপ!

জল নেমে গেল পরেরদিনই কিন্তু আমার সাহস নামল না। তোমার লোক মুখ চুন করে বলে গেল, ‘বহিনজি, সাহাব হাম লোগোকো ডাঁটেগা, বোলেগা আপকা হাম খেয়াল নেহী রাখ্‌খা…!’

আমি বললাম—‘চিন্তা মত করো, তুম যাও! ম্যয়নে উন্‌কো বোল দিয়া!’ দু’-তিন দিন কেটে গেল। ওর জন্য জামা, জুতো, বেবি ক্রিম, বেবি সোপ এসব এনে ফেললাম। ওকে খুব ভাল লাগছিল আমার। ওর বড় বড় চোখ, ফোলা গাঢ় রঙের ঠোঁট আর চাপা নাক আমাকে শান্ত রাখছিল কোন একটা জাদুতে! ও কিছু কথা বলবে ভেবে আমি তাকিয়ে থাকতে লাগলাম ওর দিকে।

কিন্তু ও কোনও কথা বলছিল না। যা বলছিল সবই ইশারায়। এমনকী ওর মাকে খোঁজার ভঙ্গিমাটাও মৃদু। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়, মাকে দেখতে পেলে লজ্জা পায়, দেখতে না পেলে মাথা নিচু করে আঙুল খোঁটে, চলে আসে।

প্রতিদিনই একটু একটু করে আশা বাড়ছিল আমার। একদিন ও চামচ দিয়ে দুধ কর্নফ্লেক্স্‌ খেল! একদিন ফোনের শব্দে ডেকে দিল আমাকে! তুমিও একদিন বললে, ‘কী করছে ও?’ এমনকী ওর বাবা-মাও ওর আর খোঁজ করছিল না…।

যেদিন তুমি এলে সেদিন সবচেয়ে ভালো ফ্রকটা পরিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। তুমি ঢুকতেই ও উঠে দাঁড়ালা—হ্যাঁ, ও চিনতে পেরেছে তোমাকে— তুমি যাও-আসো, ও ফুটপাতে শুয়ে-বসে দেখো— হ্যাঁ, ও টলমল করে এগিয়ে গেল তোমার দিকে— আর তারপর ঠিক তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াল— আমি দেখলাম ও হাত পেতে বলছে, ‘ভিক্ষে দে…!’

পরের দিন দুপুরে ওকে নিয়ে বের হয়ে এলাম আমি। বললাম, ‘চল, তোকে মা’র কাছে দিয়ে আসি!’

আমি জানি না কেন লিফটের বদলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম ওর হাত ধরে। হয়তো এত কিছু করেছিলাম আমি আসলে এই ফিরিয়ে দেওয়ার মুহূর্তগুলোকে রচনা করতে, যাতে দুঃখ হয় আমার, দুঃখের সঙ্গে দুঃখ হয়, দুঃখের ওপর দুঃখ হয়— এই সময়টাকে তাই হয়তো দীর্ঘায়িত করতেই সিঁড়ি বেয়ে নামছিলাম!

ও প্রতিটা সিঁড়ি নামল আর একবার করে মাথা নাড়ল। নামে, মাথা নাড়ে। আবার নামে, আবার মাথা নাড়ে। বলতে চায়— ও যাবে না, ও থাকবে! থাকা মানে জানে না ও, যাওয়া মানে জানে না, কিন্তু বুঝে, না-বুঝে ও প্রতিবাদ করে। নীরব; শান্ত, না। নামে আর, না বলে, নামে আর মাথা নাড়ে…!’

৩০

শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দেওয়ালটাকে সে খুঁজে পেল এই ফ্ল্যাটেরই ওই প্রান্তের একটা বাথরুমে! বাথরুমটায় হঠাৎই গিয়ে পড়েছিল সে। গিয়ে দেখল বাথরুমটার সবগুলো দেওয়াল কালো টালি দিয়ে মোড়া। ফ্লোর আর বেসিন টপে কালো গ্রানাইট। কমোড এবং বেসিনটিও কালো। এমনকী ফিটিংসগুলো। জানলার কাচ, আলোকস্তম্ভ পর্যন্ত সব—যা কিছু—কালো! শুধু বেসিনের ওপরে যেখানে একটা লম্বা চওড়া আয়না থাকা উচিত ছিল সেই জায়গাটা ফাঁকা! আর শুধু ফাঁকা নয়, ইট বের করা! ইটগুলোর রং কেমন যেন ধূসর! তাতে ঝুল, ঝুলে মাকড়শা!

দেখতে দেখতে দেওয়ালটায় একটা ছোট্ট ফুটো আবিষ্কার করল সে। তার মনে হল ফুটোটা ছোট হচ্ছে, বড় হচ্ছে, আবার বড় হচ্ছে, ছোট হচ্ছে!

এরপর সে চমকে ওঠে কেননা সে একটা সর্‌সর, সর্‌সর শব্দ শুনতে পায় দেওয়ালের ভেতর থেকে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে ভেতরের কিছু নড়াচড়া করছে!

সে চিন্তা করে দাঁড়িয়ে। সে জানে দেওয়ালটার ওপাশে বেডরুম, জানে দেওয়ালটা মাত্র পাঁচ ইঞ্চির! জানে দেওয়ালটা নিরেট! তবু চিন্তা করে! সে দীর্ঘশ্বাস চাপে, কেননা সে বুঝতে পারে এই সেই মৃত্যুর দেওয়াল যার অস্তিত্বের এপাশে তার ভয়-লগ্ন জীবন।

দেওয়ালটির সামনে দাঁড়িয়ে সে তখন ভয় পায় ও ফুটোটাকে বন্ধ করতে চায় কিন্তু তার মন তাকে নিরুৎসাহিত করে। তার মন তাকে বলে, ‘সারাজীবন মৃত্যু থেকে পালাতে পালাতে কেটে গেছে— এবার তুমি মৃত্যুকে বোঝার চেষ্টা করো।’

মৃত্যুকে বোঝার চেষ্টায় সে ফুটোটার সামনে মুখ নিয়ে গিয়ে শিস দেয়। শিস দেয়। শিস দিতে দিতে টের পায় একটা থেকে বেড়ে দুটো, দুটো থেকে বেড়ে চারটে, চারটে থেকে বেড়ে ক্রমশ অসংখ্য সর্‌সর শব্দ উঠে আসছে দেওয়ালের অভ্যন্তর থেকে। সর্‌সর, সর্‌সর, সর্‌সর, সর্‌সর । সে দুঃখ পায় ও মৃত্যুর প্রতি তার মনোভাবকে বদলাতে বাথরুমের দরজা খোলা রেখে ফিরে আসে নিজের ব্যবহৃত অংশে।

বহু, বহু বছর আগে একবার এক মৃত্যু-উন্মুখ দেহের সামনে গিয়ে যেই দাঁড়িয়েছিল সে, তার অভিভাবক তাকে সরে যেতে নির্দেশ দিয়ে বলেছিল, ‘আড়ালে যাও!’ বলেছিল, ‘ভয় পাবে!’

তারপর কত কত মৃত্যুর সামনে থেকে অলক্ষ্যে কার তর্জনীর নির্দেশে সে উলটোমুখো হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে পালিয়েছে। শুধু পালানো আর পালানো। এ জীবন শুধুই মৃত্যুর তাড়া খেয়ে যেখানে পারা যায় পালানো! বাঁচা মানে শুধু মাত্র মৃত্যু থেকে বাঁচা! সে দেখেছে মৃত্যু থাকে ভয়ের আশেপাশে কোথাও। আলাদা করে তাকে দেখা যায় না। আলাদা— বিশুদ্ধ—সম্পূর্ণ করে! এই পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে প্রতি সেকেন্ডে যা ঘটে, যা ঘটেছে তার কারণ যদিও ‘মৃত্যু’, তবু যেন মৃত্যু কোনও অস্তিত্বই নয়! ভয়ই আসল।

পরের দিন সে সাঁতার কাটতে যায়! ঠান্ডা পড়ছে। বাতাসে টান। এই-ই শ্রেষ্ঠ সময় জলে নামার কেননা পুলের আশেপাশে এখন কোনও লোক থাকে না। সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। পুলের চারপাশের ঘন গাছপালায় অন্ধকার আরও গাঢ়। বড় একখানা আলো জ্বালানো সত্ত্বেও পুলের ওই প্রান্ত অন্ধকার। শুধু এদিকের জল টলটলে সোনালি!

সে জলে নেমে গেল এবং ওই প্রান্তে চলে গেল সাঁতরে এবং তারপর সে উপুড় হয়ে ভাসতে লাগল। তার চোখের নীচে বারো ফুট গভীর জল! সে নিজেকে বলল ‘মনে করো এটাই মৃত্যু! এই মৃত্যুকে তুমি বারো ফুট গভীরভাবে অনুভব করো!’— তখন আর কোনও দৃশ্য রইল না, আর কোনও শব্দ রইল না, সে নিশ্বাসও নিচ্ছিল না— তার মন একটা শঙ্কুর আকার ধারণ করে নীচের দিকে নামতে লাগল। কোনও জীবন যে সে পার হয়ে এসেছে বলে বিশ্বাসই হল না তার— মস্তিষ্ক জলে একে একে ত্যাগ করতে লাগল চেতনা, স্মৃতি, শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য, স্বাদ, আকাঙক্ষা। সে শূন্যতাকেও ছাড়িয়ে যেতে লাগল।

আর জলের ভেতরের কোনও এক গোপন উদয়ের স্থান থেকে ছড়িয়ে পড়ল রোদ। অতঃপর! কানের মধ্যে খিলখিল করে হাসতে লাগল এক বালক আর এক কবি উঠে আসতে লাগলেন জল থেকে। সে তাকে ‘বাউলা’ বলে ডাকল। জলের মধ্যে বুদবুদের সঙ্গে ফেটে গেল তার স্বর। এসবকেই সে মিলিত ভাবে বুঝে নিতে চাইল মৃত্যু বলে তখন।

ফিরে গিয়ে সে দাঁড়াল মৃত্যুর দেওয়ালটার সামনে যার এদিকে তার ভয়, তার বাঁচা, তার মরা, সমস্ত, আর ওদিকে কিছুই নেই, কিছুই ছিল না কোনওদিনও।

১৭

আমি তোমার কাছে বারবার ওর কথা শুনতে চাই। শুনতে শুনতে আমার এক ধরনের অনুভূতি হয় যার কোনও ব্যাখ্যা সম্ভবত আমি দিতে পারব না। আমার হিংসে হয়, রাগ হয়, ঘৃণা হয়, কৌতুহল হয় আর করুণাও হয়। দুঃখও পাই আমি, যন্ত্রণাও পাই আমি শুনতে শুনতে। এক-একদিন এসব শুনতে শুনতে একদম সমবেদনায় ভরে ওঠে মন, তখন যেন আমিই ‘ও’ হয়ে উঠি। নিজস্ব ভাবে ও হয়ে উঠি।

তুমি ঠিক বুঝতে পার না আমি তখন ঠিক কী চাই! প্রাথমিকভাবে অসহায় বোধ করো। আমার চোখের মধ্যে খুঁজে নিতে চাও আসলে আমি কী জানতে চাইছি তোমার কাছে। সে সময় তোমার চোখের মণির রং ঈষৎ ঘোলাটে দেখায়। তারপর তুমি বুঝে এবং না-বুঝে ওর কথা আমাকে বলতে শুরু করলে তোমার মণির রং ক্রমশ থিতোনো কালো হয়ে ওঠে। দেখে মনে হয় তোমার আর ওর সম্পর্কের সত্য কোথাও পালটায়নি। বরং আরও গাঢ় হয়েছে। তুমি পুরনো কথার মধ্যে ফেরত চলে যাও, ডুবে যাও ধীরে ধীরে আর আমি তোমার চোখের সামনে থেকে মুছে যাই!

‘শেষের সেদিন কী হল ওর কে জানে’— এভাবেই শুরু করো তুমি, হতাশ ও নিরুপায় ভাবে বলো—‘গিয়ে দেখি বেডরুমে দেওয়াল জোড়া ছবি আঁকছে। এত রং-তুলি কবে জোগাড় করেছে জানতামই না। ছিল তো মাত্র দু’মাস! একটা ছোট পিঙ্ক স্কার্ট আর সাদা ব্লাউজে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। মুখটা কিছু ক্লান্ত। যেন স্কুল-ফেরত বালিকা বলেই ভাবতে পারতাম যদি না আমার চেনা স্তন দুটো প্রকটভাবে জেগে থাকত, যদি না ধবধবে পায়ের গোছ ও হাঁটু চোখে পড়ত যা বালিকা-সুলভ নয়, যা ভীষণভাবে নারীর, যা পুরুষের অশ্রুপাতকে স্থান দিয়েছে পায়ে, ঊরুতে, জঙ্ঘায়! সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। তুলিগুলো কোমরে গোঁজা। মেঝেতে ছড়ানো ছিটোনো রং। চেয়ার এদিক-ওদিকে টেনে টেনে, বসে, দাঁড়িয়ে ছবি আঁকা চলছিল। দেওয়াল সংক্রান্ত সাময়িক আফসোস কাটিয়ে উঠে আমি মজা পেতে শুরু করলাম। দেখতে দেখতে বিশাল দেওয়ালটায় ফুটে উঠল ছবি।

অত বড় ক্যানভাসে ও আঁকল লাইফ সাইজের নারী-পুরুষ এক জোড়া। বিচিত্র এক ভঙ্গিমায় মিলিত হচ্ছিল তারা। আশ্চর্য, একই সঙ্গে প্রবল যৌনতা ও নির্লিপ্তি ফুটিয়ে তুলেছিল ও। যেন ও বলতে চাইছিল সেক্স একটা আত্মআবিষ্কার এবং নিজেকে আবিষ্কার করার মুহূর্তেই নিজেকে ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন করাই সেক্সের পরের অভিজ্ঞতা! কেননা তুমি আসলে সবসময়ই তোমার ভেতরে আর একজনকে চাও— সেক্স তোমাকে সেই অনুভূতিটুকু কিছুক্ষণ দিতে না দিতেই ফল ফাটিয়ে বীজ আলাদা করার মতো তোমাকে একা করে দেয়। সেক্সের পরের লগ্নের এই একাকিত্বই জীবনের অন্য সকল হতাশার শিকড়। তুমি চাও সংলগ্ন থাকতে, ব্যস, আর কিছুই চাও না তুমি— তার অধিক ‘ঈশ্বর’ তুমি চাইতে পার না। তুমি আর তোমার ভেতরে কেউ— এই শুধু এক জীবনব্যাপী চাহিদা জীবের!

মানুষও খায়, শোয়, বক্তৃতা করে কিন্তু আসলে তার মনের একটা অংশ নিমজ্জিত থাকে সেক্সে, সেখানে সেক্স চলতেই থাকে, একটি শিশ্ন একটি যোনির মধ্যে যায়, তার নরম মাংসপেশী ছোঁয়, অস্তিত্ব অস্তিত্বকে ছোঁয়, ফিরে আসে, আবার যায়, আবার ফিরে আসে, আবার যায়…

ছবিটা আঁকতে আঁকতে বারবার উত্তেজিত হচ্ছিল ও। আমাকে মিলনে আহ্বান জানাচ্ছিল। আমরা চূড়ান্তভাবে মিলিত হচ্ছিলাম। তখন ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে ও বলছিল—‘আমার ভাল লাগছে, আমার ভাল লাগছে।’ এক সময় মনে হল আমাদের ত্বক জুড়ে গেছে।

ছবি শেষ হতে হতে রাত হল। সেদিনই প্রথম অত রাত অবধি ওখানে ছিলাম আমি। ছিলাম, থাকতে পেরেছিলাম, কেননা আমার মনের সব সংশয় নির্বাপিত হয়েছিল ততদিনে। আমি মনঃস্থির করে ফেলেছিলাম সবাইকে ওর কথা জানাব। বৃদ্ধা মা, ছেলেমেয়েদের, ভাইবোনদের জানাব।—আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম ওকেও বলব কথাটা, আর দিন দশেক বাদে ওর জন্মদিনে বলব। যে-কথা বারবার আমার বাহু জড়িয়ে ধরে বলত ও, সে-কথা একবার আমিও বলব ওকে। বলে দেখব ওর চোখ দুটো কীভাবে বিস্মিত হয়ে ওঠে। তারপর কেঁদে ফেলে অথবা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার করে বলে, ‘আমাদের বিয়ে হবে? আমাদের বিয়ে হবে? সারারাত, সারাদিন ধরে বাজনা বাজবে?’

হয়তো এগারোটা, হয়তো আর একটু বেশি হয়েছিল রাত। জুড়ে যাওয়া ত্বক দুটোকে আলাদা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু যেতে হবেই। আমি ওর নগ্নতম ঠোঁটে জিভ দিয়ে শেষবারের মতো আদর করলাম। আমার ইচ্ছে করছিল তখনই কথাটা বলে দিই ওকে, জানিয়ে দিই সমস্ত পরিকল্পনা, ‘আমি তৈরি!’ আগেও একবার একজনকে বলব বলব করে বলা হয়ে ওঠেনি ‘ভালবাসি’ এই একটা শব্দ! সে তার আগেই ছেড়ে গেছে আমাকে। এ অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমি আরও দশদিন অপেক্ষা করতে চাইলাম ও আলতো করে ওর হাতে চাপ দিয়ে ‘বিদায়’ জানালাম। তখনই ও ধরে ফেলল আমার হাতটা। ধরেই রইল ও চেয়ে রইল৷ ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। তারপর বলল, ‘বাড়ির সবাই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ওদের আর তেমন রাগ নেই আমার ওপর। বরং ওরা আমার জন্য চিন্তিত। কাল চলে যাচ্ছি আমি! বিয়েতে মত দিয়েছি। সেই ছেলেটিই অপেক্ষায় আছে যার কারণে বাড়ি ছেড়েছিলাম। বাড়ি ছেড়ে এখানে তোমার সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষা করছিলাম। কী হাত ধরাধরি অপেক্ষা তাই না? সে আমার অপেক্ষায়, আমি তোমার অপেক্ষায়। এই অপেক্ষার বন্ধনটা ছিঁডুক এবার। আমি ফিরলেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হবে। হাতে সময় অল্প। আমার ভয় ছিল আগে—আমার যা, সবই তো তোমাকে দিয়েছিলাম। অন্যকে দেওয়ার মতো আর কীই বা ছিল যে ঘর বাঁধব? কিন্তু সে ভয় কেটে গেছে এখন—তোমাকে যা দিয়েছি আর তার বদলে তুমি আমাকে যা দিয়েছ তাই-ই নিয়ে গিয়ে অন্যকে দিতে পারি আমি! যা দিয়েছ, যা শিখিয়েছ, উজাড় করে দিতে বা গ্রহণ করতে শিখিয়েছ, শরীর শিখিয়েছ এত, আমি জানি, যে-কোনও পুরুষকেই আমি সুখে রাখতে পারব। যে-কেউই যখন সঙ্গী হবে আমার—তৃপ্ত থাকবে, আজীবন আমার দিকে মুখ করে থাকবে—যদি না…!’

‘যদি না..।’ প্রশ্ন করেছিলাম আমি।

—যদি না কালকের পর থেকে আর কখনও চিনতে পার তুমি আমাকে! আমি মুখ ঢেকেছিলাম হাতের পাতায়। ও বলেছিল, ‘শোনো, হঠাৎ দেখা হয়ে যায় যদি আমাদের, চোখেও যেন পরিচয় ঝলসে না ওঠে। মনের যে-অংশে তোমার আমি আছি আজ, এই মুহূর্তে মৃত্যু হোক সেটুকুর। আমরা এই বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে যাই নিজেদের সাধ্যমতো!’

তারপর ও কবে চলে গেল জানতে চেষ্টা করিনি আমি। বহু মাস পরে একবার ফিরে এসেছিলাম ফ্ল্যাটে। দেওয়াল জোড়া ছবিটার ওপর গাঢ় রং তখনই চাপিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি বলো সেই রং ছাপিয়ে নাকি ফুটে ওঠে ছবি, মূর্তি দুটো জ্যান্ত হয়ে যায় ও তাণ্ডব করে ঘরের মধ্যে! আমি বিশ্বাস করতে পারি না এ সত্য বলে। কেননা ও তো একেবারেই গেছে, সন্দেহাতীতভাবে গেছে—মৃতের মতো উপায়হীন যার ফিরে আসা, কথা বলা বা ভালবাসা, ভালবাসানো…!

এই শেষটুকু তোমার মুখ থেকে শুনতে শুনতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি আমি প্রতিবার। কাঁদতে কাঁদতেই এই ফ্ল্যাটে ফিরি। দুঃখের স্বরূপ শোষণ করে নেওয়ার পর আমার তখন পেতে ইচ্ছে করে তোমাকে প্রচণ্ড। তোমার দুঃখিত মুখ মুছিয়ে দিয়ে বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে করে।

আমি তখন তোমার কথা ভাবি শুয়ে শুয়ে। তোমার হৃদয়ের কথা ভাবি। তোমার ঊরু ও জঙ্ঘার কথা ভাবি, বাহু ও বাহুপাশের কথা ভাবি। কিন্তু নিজের কথা ভাবতে পারি না সেই সঙ্গে! আমার জায়গায় দেখি ও এসে পড়ে! নগ্ন, উদ্যত, ইচ্ছুক! তোমরা পরস্পরকে তৃষ্ণার্তের মতো টেনে নাও। আমি তোমাদের মিলন প্রত্যক্ষ করি। আর আমার শরীরে আনন্দ শুরু হয়। তোমাদের ভাবতে ভাবতে এক সময় সিদ্ধ হই আমি। চেঁচিয়ে বলে উঠি, ‘আমার ভাল লাগছে, আমার ভীষণ ভাল লাগছে…।’

তারপর বুঝতে পারি না, আমি বলি না কি আসলে ও-ই বলে ওঠে এই সমস্ত, ‘একদিন বিয়ে হবে আমাদের, একদিন সারাদিন, সারারাত ধরে বাজনা বাজবে! সারাদিন, সারারাত ধরে বাজার পর একসময় আপনা আপনিই থেমে যাবে সেসব বাজনা…! থেমে যাবে…হাঁপাবে…!’

প্যান্টিটা সে নিক্ষেপ করেছে আগুনে। এই নারীজন্মের প্রতি তার যাবতীয় মায়া পুড়িয়ে ফেলেছে। ফলে সে এখন খুব ক্লান্ত। ক্লান্ত হয়েই এলোমেলো পা ফেলে সে এসে দাঁড়িয়েছে এখানে— ওদিকটায় দলে দলে জ্বালামালিনী বেশ্যারা! এদিকে যে-কোনও মুহূর্তে জেগে উঠতে পারেন যিনি সেই সম্ভাবনাময়ী, মুণ্ডুমালিনী মা কালী। মাঝখানে আদিগঙ্গা—না কি একটা পঙ্কিল, ঘৃণা উদ্রেককারী গন্ধযুক্ত কালো জলের খাল!

এ ঘাটে কটা সিঁড়ি, ও ঘাটে কটা সিঁড়ি। পারাপারের জন্য ওদিকে একটা কাঠের নৌকো বাঁধা। এদিকের ঘাটের ব্যাধিগ্রস্ত জলে একটা বারকোশ ধোয়া চলছে।

সে ঠিক ঘাটের সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। চওড়া ধাপ। তার পায়ের সামনে ছড়িয়ে আছে কিছু নীল অপরাজিতা। কখন থেকে একটা ঘেয়ো কুকুর হাঁটছে তার সঙ্গে। রাত এগারোটায় এক দাতা মানুষ পাউরুটি বিলোচ্ছেন ভিখিরিদের। তার কাছে ওরা আরও খাদ্য চেয়ে হল্লা করছে। আসলে প্রত্যাশা কিছু নেই ওদের। যে-মন্দিরে ওরা দাঁড়িয়ে তার দেবীর কাছে প্রত্যাশা নেই, যে-দেশের মাটিতে ওরা দাঁড়িয়ে সেই দেশ, সেই মৃত্তিকার কাছে প্রত্যাশা নেই।

বিরামহীন খঞ্জনী বাজছে অন্ধ ভিখিরির। তাকে দেখে মনে হচ্ছে শত শত বছর ধরে সে মানুষকে এভাবেই দেখা দিয়ে এসেছে—কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারেনি! তার কাতর গান শুনে আট আনা, এক টাকা দিয়ে চলে গেছে—বুঝতে পারেনি বদলে অন্ধ তাদের কী প্রসাদ দিয়েছে ফিরিয়ে! বারবার শনি মন্দিরের ঘণ্টা বাজিয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ পুরোহিত। আরও একটা দুটো আত্মনিবেদন তিনি পৌঁছে দিতে তৈরি বড় ঠাকুরের পায়ে।

এক নারী একা-একাই ঘুরে ঘুরে রাধার পাঠ বলছে। বলছে, ‘পায়ে ধরি শ্যাম, পায়ে ধরি, রাধারানির মাথা খাও, কিন্তু ত্যাগ দিয়ে যেও না এই আঁধারে। এমন করলে আমি যমুনার তীরে এখনই নিজের চিতা সাজাব আর পুড়ে মরব। তখন যেখানেই থাকো না তুমি কালাচাঁদ, এই চিতার ধোঁয়া তোমার চোখে জ্বালা ধরাবেই, তখন যেখানেই থাকো না কেন কেঁদে ভাসাতেই হবে কালো পাষাণ বুক!’

তার আচ্ছন্ন কানের কাছে এসে কুঁজো এক বুড়ি বলে গেল, ‘বাকি দিনগুলো ঘরে দিনে-রাতে লোক নেয়, যে ক’দিন শরীর খারাপ থাকে সে ক’দিন রাধা সাজে মাগি!’

না বেশ্যা, না ঈশ্বরী—তার কারও কাছেই ক্ষমা চাইবার নেই। উভয়ের পরিচয়ই তার জীবনে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আদি গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে আর কালাতিপাত করে লাভ নেই তার। সে এবার ফিরে যাবে। ফিরে গিয়ে ছুরিকাঘাত করবে নিজের যোনিদ্বারে… বারংবার ছুরিকাঘাত করবে… সি উইল স্ট্যাব, স্ট্যাব অ্যান্ড স্ট্যাব হারসেল্ফ আনটিল ইট ডাইস!

শারদীয় দেশ, ১৪১৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *