৭০. অলৌকিক অর্জুন

৭০
অলৌকিক অর্জুন

[কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে অর্জুন জয়দ্রথ-বধের প্রতিজ্ঞা পালনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। দ্রোণ এমনভাবে ব্যূহরচনা করেছিলেন যে মুখ্য ব্যূহদ্বার থেকে ছ’ক্রোশ পিছনে এক গর্ভগৃহে জয়দ্রথ আশ্রয় নিয়েছিলেন। জয়দ্রথের সামনের প্রতিটি স্তরে শ্রেষ্ঠ মহারথ ও অতিরথেরা অবস্থান করছিলেন। ব্যূহমুখে স্বয়ং আচার্য দ্রোণ অর্জুনকে নিবারণ করার জন্য নিজেকে রেখেছিলেন। চতুর্থ স্তরের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কর্ণ ও ভূরিশ্রবা। তৃতীয় স্তরে পৌঁছতেই অর্জুনের প্রায় মধ্যাহ্ন কাল হয়ে এল। এই স্তরে দুই মহারথ বিন্দ ও অনুবিন্দকে অর্জুন সামনে পেলেন। অর্জুন বিন্দকে নিহত করলে, ভ্রাতা অনুবিন্দ এক ভয়ংকর গদা নিয়ে অর্জুনের দিকে ছুটে এসে সারথি কৃষ্ণের ললাটে আঘাত করলেন। কিন্তু কৃষ্ণ মৈনাক পর্বতের মতো অচল রইলেন, অর্জুন তীক্ষ্ণ বাণদ্বারা অনুবিন্দের দেহ খণ্ড বিখণ্ড করে ফেললেন এবং মেঘবিদীর্ণ করে আবির্ভূত সূর্যের মতো বিরাজিত হলেন]।

বিন্দ ও অনুবিন্দ নিহত হলে, তাঁদের অনুচরবাহিনী সমস্ত ক্রোধ ও উৎসাহ একত্র করে চতুর্দিক থেকে অর্জুনকে আক্রমণ করল। অর্জুন দেখলেন, কৃষ্ণ সামান্য আহত, যদিও তাঁর মুখে তার কোনও চিহ্নই নেই। অর্জুন দেখলেন, তাঁর অশ্বগুলিও সামান্য আহত। তখন অর্জুন ঈষৎ হাস্য করতে করতে কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ আমার অশ্বগুলি বাণপীড়িত ও পরিশ্রান্ত হয়েছে, অথচ জয়দ্রথ এখনও অনেক দূরে আছে। অতএব এখন কোন কার্য তোমার প্রধান বলে বোধ হয়? আমার যাতে ভাল হবে, তুমি তা বলো। তুমি চিরদিনই অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং পাণ্ডবেরা তোমার নায়কতার গুণেই যুদ্ধে শত্রুগণকে জয় করবেন। অতএব, তুমি যথার্থ হিত আমাকে বলো। কিন্তু তুমি আগে আমার মত ও বিবেচনা শুনে নাও, তারপর কর্তব্য নির্ধারণ করো। কৃষ্ণ আমার মনে হয় তুমি নির্ভয়চিত্তে অশ্বগুলি রথ থেকে মুক্ত করো এবং তাদের দেহ থেকে বাণগুলি তুলে দাও।” অর্জুন এই কথা বললে, কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন তুমি যা বললে, আমারও তাই মত।” তখন অর্জুন বললেন, “কৃষ্ণ আমি সমস্ত বিপক্ষসৈন্য নিবারণ করব। তুমি এখন যথোচিত পরকর্তব্য সম্পাদন করো।” তারপর অর্জুন রথমধ্য থেকে নেমে অবিচলিত চিত্তে গাণ্ডিবধনু ধারণ করে পর্বতের মতো অচল হয়ে দাঁড়ালেন। জয় অভিলাষী কুরুপক্ষীয় ক্ষত্রিয়েরা “এই-ই সময়। এখনি অর্জুনকে মেরে ফেলতে হবে” এই ভেবে স্বপক্ষীয়দের আহ্বান করে ভূতলস্থিত অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। তখন তাঁরা ধনু আকর্ষণ ও বাণক্ষেপ করতে করতে বিশাল রথসমূহ দ্বারা একা অর্জুনকে পরিবেষ্টন করলেন। মেঘ যেমন সূর্যকে আচ্ছাদন করে, সেই রকম সেই ক্রুদ্ধ বীরেরা ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ ও নরপ্রধান অর্জুনের প্রতি বেগে ধাবিত হলেন এবং বিচিত্র অস্ত্রসকল তাঁকে উপহার দিতে লাগলেন। মত্ত হস্তিগণ সিংহের প্রতি ধাবিত হলে, সিংহতুল্য বলবান অর্জুন তাঁর বাহুযুগলের ক্ষমতা দেখাতে লাগলেন। তিনি একা সকল দিকের ক্রুদ্ধ বহু সৈন্যকে বারণ করণ করতে থাকলেন এবং প্রভাবশালী অর্জুন আপন অস্ত্ৰদ্বারা শত্রুগণের সকল দিকের সকল অস্ত্র নিবারণ করে সত্বর বাণ দ্বারা সমস্ত বিপক্ষকে আবৃত করে ফেললেন। তখন আকাশে নিরন্তর বাণসমূহের পরস্পর সংঘর্ষে মহাশিখাযুক্ত অগ্নি উৎপন্ন হল।

ক্রমে সেই স্থানে নিশ্বাসকারী ও রক্তসিক্ত মহাধনুর্ধরগণ, অর্জুনের বাণে বিদীর্ণ চিৎকারকারী অশ্ব ও হস্তীগণ এবং শত্ৰুবিজয়ী, ক্রুদ্ধ, জয় অভিলাষী, একস্থানাস্থিত, বহুতর বিপক্ষবীরের সংঘর্ষে যেন উত্তাপ জন্মাল। তখন অর্জুন বাণসমূহের দ্বারা দুস্তর, অপরিমেয়, অপার, অক্ষোভ্য সমুদ্রের ন্যায় সেই রথগুলিকে তিরের তুল্য বারণ করতে লাগলেন। বাণ ছিল তার তরঙ্গের মতো, ধ্বজ ছিল আবর্তের মতো, হস্তী ছিল সমুদ্রের কুম্ভীরের মতো, শঙ্খ ও দুন্দুভির ধ্বনি ছিল নির্ঘোষের সমান এবং রথগুলি ছিল বিশাল তরঙ্গতুল্য, পদাতিসৈন্য ছিল সেই সমুদ্রের মৎস্য, পদাতিদের উষ্ণীষ ছিল সমুদ্রের কচ্ছপ, পতাকা ছিল সমুদ্রের ফেনা।

তখন অবিচলিত মহাবাহু কৃষ্ণ রণস্থলে পুরুষশ্রেষ্ঠ সখা অর্জুনকে বললেন, “অৰ্জুন এই সমরভূমিতে অশ্বগণের পানের উপযোগী উপযুক্ত পরিমাণে জলাশয় নেই। অথচ অশ্বগন পানীয়জল চাইছে, স্নান কিংবা অবগাহনের জন্য জল চাইছে না। ওদের পানীয়জল চাই।” “এই তো আছে” এই কথা বলে অর্জুন অবিচলিতচিত্তে অস্ত্রদ্বারা ভূতলে আঘাত করলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেখানে অশ্বগণের পানযোগ্য একটি সুন্দর জলাশয় উৎপাদিত হল। বিশ্বকর্মার ন্যায় অদ্ভুতকর্মা অর্জুন তখন বাণের বেড়া দিয়ে, বাণের স্তম্ভ গড়ে, বাণের ছাদযুক্ত বাণময় একটি অদ্ভুত গৃহ নির্মাণ করলেন।

অর্জুন সেই মহারণস্থলে বাণময় গৃহ নির্মাণ করলে, কৃষ্ণ অকৃত্রিম খুশিতে বলে উঠলেন, “সাধু সাধু!” মহাত্মা অর্জুন সেই জলোৎপাদন, শত্রুসৈন্য নিবারণ ও বাণময় গৃহ নির্মাণ করলে, মহাতেজা কৃষ্ণ রথ থেকে দ্রুত অবতীর্ণ হয়ে বিপক্ষের বাণে বিশেষ ব্যথিত অশ্বগণকে মুক্ত করলেন।

অদৃষ্টপূর্বং তদ্‌দৃষ্ট্বা সাধুবাদো মহানভূৎ।

সিদ্ধ-চারণসংঘানাং সৈনিকানাঞ্চ সর্বশঃ ॥ দ্রোণ ৮৭ : ৩ ॥

—“তৎকালে সেই অদৃষ্টপূর্ব জলাশয় ও বাণময় গৃহ দর্শন করে আকাশস্থিত সিদ্ধ ও চারণগণ এবং সমস্ত সৈন্যের মুখে বিশাল সাধুবাদ হতে লাগল।”

অর্জুন ভূমিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করলেও কৌরবপক্ষের মহারথেরা তাঁকে বারণ করতে সমর্থ হলেন না। তা যেন সকলের কাছেই অদ্ভুত বলে বোধ হতে লাগল। তখন রথসমূহ এবং প্রচুর হস্তী ও অশ্ব আসতে লাগলেও অর্জুন অবিচলিতই রইলেন। তাঁর সেই ক্ষমতা অন্য পুরুষদের অতিক্রম করে অনেক অধিক বোধ হতে লাগল। কৌরবপক্ষীয় রাজারা অর্জুনের প্রতি বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন; কিন্তু ধর্মাত্মা ও বিপক্ষবীরহন্তা অর্জুন তাতে বিশেষ ব্যথিত হলেন না। সমুদ্র যেমন নদীসমূহকে গ্রহণ করে, বলবান অর্জুনও সেইরূপ বিপক্ষের বাণসমূহ, গদা, প্রাস আসতে থাকলে, সেগুলি বিনাশ করতে লাগলেন। অর্জুন বাহুযুগলের বলে এবং অস্ত্রের গুরুতর বেগে সমস্ত রাজার সেই উত্তম বাণগুলি ধ্বংস করতে লাগলেন। এক লোভ যেমন সমস্ত গুণকে বিনাশ করে, সেই রকম এক অর্জুন ভূতলে থেকে সমস্ত রাজার সকল শক্তিকে নষ্ট করে দিতে লাগলেন। তখন কৌরবসৈনেরা অর্জুন ও কৃষ্ণ— এই দুইজনের পরমাশ্চর্য বিক্রমের প্রশংসা করতে লাগলেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, “এই রকম পরমাশ্চর্য ঘটনা জগতে কি আর কখনও হবে-না-হয়েছিল; যে অর্জুন ও কৃষ্ণ যুদ্ধমধ্যেই রথ থেকে অশ্বগুলিকে মুক্ত করেছেন এবং নরশ্রেষ্ঠ অর্জুন ও কৃষ্ণ আমাদের গুরুতর ভয় উৎপাদন করেছেন। যেহেতু তাঁরা রণস্থলেই যুদ্ধ বিষয়ে বিশ্বস্ত থেকেও অশ্বগুলির ভীষণ তেজ বিধান করলেন।” মানুষ যেমন স্ত্রীলোকদের মধ্যে খেলার ঘর নির্মাণ করে, সেইরকম অর্জুন যুদ্ধমধ্যেই তখন বাণময় গৃহ নির্মাণ করলে, পদ্মনয়ন কৃষ্ণ ঈষৎ হাস্য করে অব্যাকুলচিত্তে কৌরবপক্ষের সমস্ত সৈন্যের সামনেই সেই অশ্বগুলিকে ফিরিয়ে আনলেন, তাদের ইচ্ছামতো ভ্রমণ করালেন, অশ্বগুলির শ্রম, অবসাদ, মুখের ফেনা, কম্প ও ব্রণ—এ সমস্ত দূর করলেন। কারণ, কৃষ্ণ অশ্বপরিচর্যায় বিশেষ নিপুণ ছিলেন। তারপর কৃষ্ণ দু’হাতে অশ্বগুলির গাত্র থেকে বাণ-এর অগ্রভাগগুলি তুলে ফেললেন ও গা ধুইয়ে এবং যথানিয়মে সেগুলিকে ভ্রমণ করে জলপান করালেন। অশ্বগুলি জলপান, স্নান ও ঘাস ভক্ষণ করে গ্লানিশূন্য হলে, কৃষ্ণ আনন্দিত হয়ে সেগুলিকে নিয়ে পুনরায় উত্তমরথে সংযুক্ত করলেন। তারপর সর্বশস্ত্রধারী শ্রেষ্ঠ ও মহাতেজা কৃষ্ণ অর্জুনের সঙ্গে গিয়ে আরোহণ করে বেগে গমন করতে লাগলেন। পরিচর্যার পর অশ্বগুলি পুনরায় রথে সংযুক্ত হলে কৌরবসৈন্যের প্রধান যোদ্ধারা অত্যন্ত বিষণ্ণ হলেন। ভগ্নদন্ত সর্পগণের ন্যায় নিশ্বাস ত্যাগ করতে থেকে তারা বলতে লাগলেন— “হায়! আমাদের ধিক, হায়! অর্জুন ও কৃষ্ণ চলে গেল।”

*

মহাভারত একটি রত্নখনি! একশো নয়, হাজার দুর্লভ মুহূর্ত মহাভারতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই মুহূর্তটিতে এসে বিস্ময়ও যেন সীমারেখা পার হয়ে যায়। অর্জুন! কী অবিশ্বাস্য বীরত্বের অধিকারী অর্জুন! এ কি কোনও মানুষী ক্ষমতায় সম্ভব! এমনতর ঘটনা তো কেবলমাত্র ঐন্দ্রজালিক ঘটাতে পারেন! আর পারেন পিনাকপাণি ডমরুধর মহাদেব।

জয়দ্রথ-বধের প্রতিজ্ঞা করে অর্জুন প্রভাতে রথ নিয়ে বেরিয়ে গেছেন একাকী। সঙ্গে সারথি কৃষ্ণ। কিন্তু যোদ্ধা অর্জুন একা। তিনি শুনেছেন গুরু দ্রোণ এমনভাবে ব্যূহ সাজিয়েছেন যাতে জয়দ্রথকে ধরতে গেলে ছ’ ক্রোশ পথ যেতে হবে। প্রতি ক্রোশে অগণিত সৈন্য নিয়ে এক কিংবা একাধিক শ্রেষ্ঠ কৌরব মহারথ। এঁদের ছয় স্তর পার হতে না পারলে গর্ভগৃহে লুক্কায়িত জয়দ্রথকে পাওয়া যাবে না। সূর্যাস্তের মধ্যেই মারতে হবে জয়দ্রথকে, অন্যথায় অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দেবেন অর্জুন। অভিমুন্য বধের প্রতিবাদে এই প্রতিজ্ঞা অর্জুনের। অর্জুন যাত্রা করলেন আপন শিবির থেকে।

তৃতীয় স্তরের কাছে পৌঁছতেই মধ্যাহ্ন কাল উপস্থিত হল। কৌরবসৈন্যেরাও প্রতিপদে জয়দ্রথকে বাঁচিয়ে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার পণে মৃত্যু কামনায় যুদ্ধ করছেন। অর্জুনকে প্রতিহত করার পণ সকল কৌরবের। অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত অর্জুনের রথের ঘোড়াগুলি, তারা পরিশ্রান্ত। মৃত্যুর পূর্বে বিপক্ষ বীর অনুবিন্দ গদার আঘাত করেছেন পার্থসারথি কৃষ্ণকে। যদিও তাঁর মুখে কোনও ভাবান্তর নেই, কিন্তু অর্জুন জানেন সামান্য বিশ্রাম তাঁরও প্রয়োজন। অর্জুন অদ্ভুত এক অনুরোধ জানালেন তাঁর সারথিকে। অশ্বগুলি পরিশ্রান্ত, তাদের বিশ্রাম প্রয়োজন। অতএব কৃষ্ণ অশ্বগুলিকে রথ থেকে বিযুক্ত করে তাদের বিশ্রাম দান করুন। এ কী অবিশ্বাস্য প্রস্তাব! চতুর্দিক থেকে শত সহস্র তীক্ষ্ণ শর ছুটে আসছে। এই অবস্থায় রথ ত্যাগ করে ভূমিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করলে প্রতিপক্ষ সহস্র গুণ অধিক সুবিধা পাবে। কিন্তু দেখা গেল সারথি কৃষ্ণ অর্জুনের প্রস্তাব অনুমোদন করে রথ থেকে অশ্বগুলি বিযুক্ত করে নিয়েছেন। অর্জুন ভূমিতে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকের আগত অস্ত্রশস্ত্রকে বারণ করছেন। কৃষ্ণ বললেন, এই সমরক্ষেত্রে অশ্বগুলির উপযুক্ত পানীয় নেই। অর্জুন মুহূর্তমধ্যে তীক্ষ্ণ বাণের সহায়তায় অশ্বগুলির উপযুক্ত পানীয়ের কূপ খনন করে পানীয় তুলে আনলেন ভূগর্ভ থেকে। জলপানের ক্ষেত্রে যাতে কোনও বাধা না পড়ে সেইহেতু বাণময় একটি অশ্বশালা নির্মাণ করলেন। বাণের স্তম্ভে সে গৃহ শক্ত করলেন, বাণ দিয়ে গেঁথে দিলেন তাঁর প্রাচীর। বাণ দিয়ে রচনা করলেন তার প্রাকার। একটি পূর্ণ অশ্বশালা রচিত হল। একই সঙ্গে অর্জুন চতুর্দিক থেকে ধাবমান শত্রুসৈন্যের অস্ত্র বারণ করে চললেন। কৃষ্ণ তাঁর অশ্বের প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করলেন। তাদের ব্রণশোষণ করলেন, দেহে সংযুক্ত তিরগুলি তুলে নিলেন। জলে আহত স্থান ধুয়ে দিলেন। বিশ্রাম লাভ করে অশ্বগুলি পরিপূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠল। কৃষ্ণেরও প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ঘটল। স্বয়ং নারায়ণ বাসুদেব কৃষ্ণ অর্জুনের এই অশ্বশালা নির্মাণে, জলপানের ব্যবস্থায় চমৎকৃত হয়ে “সাধু সাধু” বলে উঠলেন। আকাশে সিদ্ধগণ ও চারণগণ প্রশংসা করতে লাগলেন।

আমরা স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম, অর্জুন কত শান্ত, অত্বরিত। গুরুতর কার্যসাধন করতে হবে তাঁকে সূর্যাস্তের পূর্বেই। তবু অর্জুন অত্যন্ত শান্ত। তাঁর হাতে যেন অফুরন্ত সময় আছে। প্রতিপক্ষের শক্তি সম্পর্কে তাঁর সম্যক উপলব্ধি আছে। নিজের সম্পর্কে আছে অনন্ত প্রত্যয়। কিছুকাল পূর্বে আমরা ভীষ্মের শরশয্যায় উপাধান ও তাঁর পানীয়ের ব্যবস্থা করতে দেখেছি। কিন্তু তখন যুদ্ধ হচ্ছিল না। অর্জুন সারাজীবন ধনুর্বাণ হাতে অসংখ্য অসাধ্য কাজ করছেন। দেব দৈত্য পরাজিত করেছেন, একাকী কৌরবসৈন্য বিজিত করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে শত্রুদের অস্ত্র বর্ষণের মধ্যে তিনি যা করলেন, তা পিনাকপাণির উক্তিকেই মনে করিয়ে দেয়, “আমি ছাড়া তোমার তুল্য রথী পৃথিবীতে হবে না।” বিশ্রাম শেষে অশ্বেরা রথে আবার সংযুক্ত হল, কৃষ্ণার্জুন সম্মুখে অগ্রসর হলেন।

৭১
ভূরিশ্রবা—বধ

[কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে জয়দ্রথকে বধ করবার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অর্জুন অভিমন্যু-বধের সংবাদ শুনে। ওদিকে সেনাপতি আচার্য দ্রোণ দুর্যোধনকে কথা দিয়েছিলেন, অর্জুন রক্ষা না করলে তিনি যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করে আনবেন। সংশপ্তক সৈন্যদের নিযুক্ত করা হল অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে সরানোর কাজে। জয়দ্রথ বধ প্রতিজ্ঞা পালনে যাত্রা করার পূর্বে অর্জুন মহাপরাক্রমশালী সাত্যকিকে ভার দিলেন যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করার। অর্জুন যাত্রা করলেন। মধ্যাহ্ন অতিক্রম করল। যুধিষ্ঠির গাণ্ডিবের টংকার, দেবদত্ত শঙ্খের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন না। শুনতে পাচ্ছেন না কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খের নিনাদও। যুধিষ্ঠির সাত্যকিকে আদেশ করলেন যে, অর্জুনের পৃষ্ঠরক্ষক হিসাবে তিনি যাত্রা করুন। সাত্যকি প্রথমদিকে গুরু অর্জুনের আদেশ অমান্য করতে চাননি, শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরের আদেশে তিনি যাত্রা করলেন। ভীমসেনকে অনুরোধ করলেন তাঁর প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করার। গুরু অর্জুনের অনুকরণে তিনি দ্রোণাচার্যকে প্রদক্ষিণ করে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ের কৌরবসৈন্য ভেদ করে চতুর্থ স্তরের দিকে যেতেই অর্জুনের গাণ্ডিব ধনুর টংকার ও কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খের ধ্বনি শুনলেন। অর্জুনও দেখতে পেলেন সাত্যকিকে, যুধিষ্ঠিরকে ত্যাগ করে আসায় তিনি অসন্তুষ্ট হলেন]।

যুদ্ধদুর্ধর্ষ সাত্যকি আসছেন দেখে ভূরিশ্রবা ক্রোধে তাঁর দিকে বেগে ধাবিত হলেন। মহাবাহু ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে বললেন, “সাত্যকি তুমি আজ ভাগ্যবশত আমার দৃষ্টির মধ্যে এসে পড়েছ। আজ আমি যুদ্ধে আমার চিরকালের অভিলাষ পূর্ণ করতে পারব। কারণ, তুমি যদি রণস্থল পরিত্যাগ না করো, তবে আজ জীবিত অবস্থায় আমার হাত থেকে মুক্তি পাবে না। সাত্যকি আমি আজ যুদ্ধে সর্বদা বীরাভিমানী তোমাকে বধ করে কুরুরাজ দুর্যোধনকে আনন্দিত করব। বীর কৃষ্ণ ও অর্জুন মিলিতভাবে আজ তোমাকে আমার বাণে নিহত ও ভূতলে পতিত দেখবেন। যিনি তোমাকে কৌরবসৈন্য মধ্যে প্রেরণ করেছেন, সেই রাজা যুধিষ্ঠির আজ তোমাকে নিহত শুনে তৎক্ষণাৎ লজ্জিত হবেন। তুমি নিহত হয়ে রক্তসিক্ত অবস্থায় ভূতলে শয়ন করলে, আজ পৃথানন্দন অর্জুন আমার বিক্রম জানতে পারবেন।

“পূর্বকালে দেবাসুর যুদ্ধে বলির সঙ্গে যুদ্ধে যেমন ইন্দ্র চির-অভিলাষী ছিলেন, তেমনই তোমার সঙ্গে যুদ্ধও আমার চির অভিলাষের বিষয়। সাত্যকি আজ আমি তোমার সঙ্গে অতি ভীষণ যুদ্ধ করব। তাতেই তুমি যথার্থরূপে আমার বল, বীর্য ও পুরুষকার জানতে পারবে।

“বাছা সাত্যকি, রামের অনুজ লক্ষ্মণের হাতে নিহত হয়ে ইন্দ্রজিৎ যেমন যমপুরীতে গিয়েছিলেন, তুমিও আজ তেমনই নিহত হয়ে যমপুরীতে যাবে। তুমি নিহত হলে কৃষ্ণ, অর্জুন ও ধর্মরাজ নিরুৎসাহ হয়ে নিশ্চয়ই যুদ্ধ পরিত্যাগ করবেন। আজ তীক্ষ্ণ শরে তোমাকে বধ করে,— তুমি যাদের যুদ্ধে বধ করেছ, তাদের স্ত্রীগণকে আনন্দিত করব। ক্ষুদ্র মৃগ সিংহের দৃষ্টি থেকে মুক্তি পায় না, তেমন তুমিও আমার দৃষ্টি থেকে মুক্তি পাবে না।”

তখন সাত্যকি হাসতে হাসতেই ভূরিশ্রবাকে বললেন, “কৌরবনন্দন, যুদ্ধে আমার ভয় নেই। কেবল বাক্যদ্বারা আমাকে ভীত করতে পারবে না। যে লোক যুদ্ধে আমাকে নিরস্ত্র করতে পারবে, সেই আমাকে বধ করতে পারবে। যে লোক আমাকে যুদ্ধে বধ করতে পারবে, সে লোক চিরকালই শত্ৰুসংহার করতে পারবে। সে যাই হোক, বৃথা বাক্যব্যয়ে ফল কী, তুমি তোমার কথাগুলি কার্যে রূপায়িত করে দেখাও। শরৎকালের মেঘের গর্জনের মতো তোমার গর্জনও নিষ্ফল। সুতরাং তোমার গর্জন শুনে আমার হাসি পাচ্ছে। কৌরব, তোমার ও আমার চিরকালের অভীপ্সিত যুদ্ধ আজ হোক। আমার মতি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী হয়েছে। পুরুষাধম! আজ আমি তোকে বধ না করে ছাড়ব না।”

অত্যন্ত ক্রুদ্ধ নরশ্রেষ্ঠ ভূরিশ্রবা ও সাত্যকি বাক্যদ্বারা উভয়কে উত্তেজিত করে যুদ্ধে পরস্পর জিঘাংসু হয়ে প্রহার করতে প্রবৃত্ত হলেন। ঋতুমতী হস্তিনীর জন্য মদমত্ত ও ক্রুদ্ধ হস্তীর মতো মহাধনুর্ধর, ক্রোধে উত্তেজিত ও পরস্পর স্পর্ধাকারী ভূরিশ্রবা এবং সাত্যকি যুদ্ধে মিলিত হলেন। ক্রমে শত্রুদমনকারী ভূরিশ্রবা ও সাত্যকি দুটি মেঘের মতো পরস্পর বাণ-বর্ষণ করতে লাগলেন। ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে বধ করবার জন্য দ্রুতগামী বাণসমূহ নিক্ষেপ করে সাত্যকিকে প্রায় ঢেকে ফেললেন এবং তীক্ষ্ণতর বাণের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলেন। সাত্যকিকে বিনাশ করার জন্য ভূরিশ্রবা দশটি বাণে তাঁকে বিদ্ধ করলেন এবং আরও তীক্ষ্ণ বাণসমূহ নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু ভূরিশ্রবার সেই তীক্ষ্ণ বাণসকল আসার পূর্বেই সাত্যকি অস্ত্র প্রয়োগে কৌশলে আকাশেই সেগুলি ছেদন করলেন। সৎকুল জাত, মহাবীর ও কুরু-বৃষ্ণিবংশের যশস্কর ভূরিশ্রবা ও সাত্যকি পৃথক পৃথক অস্ত্রবর্ষণ করে পরস্পর প্রহার করতে লাগলেন। প্রাণ দ্বারা দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত ভূরিশ্রবা ও সাত্যকি পরস্পর অঙ্গবিদারণ ও রক্ত নিঃসারণ করতে করতে পরস্পরকে আকুল করে তুললেন। তাঁরা অল্পকাল মধ্যেই ব্রহ্মলোকলাভের আশা করে কিংবা অন্য কোনও উত্তম স্থানে যাবার ইচ্ছা করে পরস্পর গর্জন করতে লাগলেন। সাত্যকি ও ভূরিশ্রবা হৃষ্ট হয়েই যেন বাণবৃষ্টি দ্বারা ধার্তরাষ্ট্রদের সমক্ষে পরস্পর প্রহার করতে লাগলেন। একটি ঋতুমতী হস্তিনীর সঙ্গমের জন্য যুদ্ধে প্রবৃত্ত দুটি যূথপতি হস্তীর তুল্য যোদ্ধাশ্রেষ্ঠ ভূরিশ্রবা ও সাত্যকিকে যুধ্যমান অবস্থায় সমস্ত লোক দেখতে থাকল। ক্রমে তাঁরা পরস্পরের অশ্ববধ কার্মুকছেদন করে রথবিহীন হয়ে অসিযুদ্ধ করবার জন্য মহাযুদ্ধে মিলিত হলেন। পরে তাঁরা বিচিত্র, বিশাল ও সুন্দর দু’খানা বৃষচর্মের ঢাল নিয়ে দু’খানি তরবারিকে কোষমুক্ত করে সমরাঙ্গনে বিচরণ করতে লাগলেন। তখন তরবারি ও বিচিত্রবর্মধারী, কণ্ঠভূষণ ও বাহুভূষণ সমম্বিত, শত্রুমর্দনসমর্থ এবং যশস্বী ভূরিশ্রবা ও সাত্যকি ক্রুদ্ধ হয়ে নানাবিধ পথে বিচরণ এবং ভাগে ভাগে মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করতে করতে ভ্রান্ত, উদ্‌ভ্রান্ত, আবিদ্ধ, আপ্লুত, বিপ্লুত, দ্রুত, সম্পাত ও সমুদীর্ণ—এই আট রকমের গতি দেখাতে থেকে পরস্পর মুহুর্মুহু আঘাত করতে লাগলেন। শত্রুদমনকারী দুই বীরই তরবারি দ্বারা পরস্পর প্রহার, ছিদ্রান্বেষণ এবং বিচিত্র, উল্লম্ফন ও প্রলম্ফন করতে লাগলেন। যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ দুইজনেই শিক্ষা, শীঘ্রতা, সমীচীনতা দেখাতে থেকে যুদ্ধে পরস্পরকে আকর্ষণ করতে লাগলেন। দুই বীরই সমস্ত সৈন্যের সম্মুখেই পরস্পরকে আঘাত করে পুনঃ পুনঃ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করতে থাকলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ ভূবিশ্রবা ও সাত্যকি তরবারি দ্বারা শতচন্দ্রচিহ্নযুক্ত ও বিচিত্র দু’খানি ঢালই ছেদন করে বাহুযুদ্ধ করতে থাকলেন। দৃঢ় ও বিশালবক্ষা, দীর্ঘবাহু ও বাহুযুদ্ধ নিপুণ ভূরিশ্রবা ও সাত্যকি লৌহময় পরিঘের তুল্য চারখানা বাহুদ্বারা পরস্পর মিলিত হয়ে থাকলেন। তাঁদের শিক্ষা ও বলসঞ্জাত বাহুপ্রহার, অপসারণ ও আকর্ষণ সকল যোদ্ধাকেই আনন্দ দিতে থাকল। রণাঙ্গনে যুধ্যমান নরশ্রেষ্ঠ ভূরিশ্রবা ও সাত্যকির গর্জনের বজ্র ও পর্বতের মতো ভীষণ ও বিশাল শব্দ হতে লাগল। কুরুবংশপ্রধান ও সাত্বতবংশশ্রেষ্ঠ— মহাত্মা ভূরিশ্রবা ও সাত্যকি— দন্ত দ্বারা দুটি হাতির মতো এবং শিং দ্বারা দুটি মহাবৃক্ষের মতো বাহুরূপ রজ্জুর দ্বারা পরস্পর বন্ধন ও মস্তকদ্বয় দ্বারা পরস্পরকে আঘাত, তোমর ও অঙ্কুশতুল্য চরণদ্বারা আকর্ষণ ও বন্ধন, চরণমধ্যদেশ দ্বারা বন্ধন, ভূতলে ভ্রমণ, প্রত্যাগমন ও আকর্ষণ এবং পাতন, উত্থান ও উল্লম্ফন করে করে যুদ্ধ করতে লাগলেন। সেই যুধ্যমান মহাবলেরা দু’জন তখন— যে বত্রিশ প্রকার মল্লযুদ্ধ আছে, তা দেখাতে থাকলেন।

ক্ষীণশস্ত্র সাত্যকি যুদ্ধ করতে থাকলে, কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন দেখো—সর্বধ- নুর্ধরশ্রেষ্ঠ সাত্যকি রথবিহীন হয়ে রণস্থলে যুদ্ধ করছেন। ইনি কৌরবসৈন্য ভেদ করে তোমার পিছনে প্রবেশ করেছেন এবং কৌরবপক্ষীয় সকল মহাবীরের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। অর্জুন যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ সাত্যকি পরিশ্রান্ত হয়ে আসছেন, সেই সময়ে ভূরিশ্রবা যুদ্ধার্থী হয়ে সাত্যকির কাছে উপস্থিত হয়েছেন। সুতরাং এই যুদ্ধ যেন সমানে সমানে হবে না বলেই মনে হচ্ছে।”

তারপর রথস্থিত ক্রুদ্ধ ও যোদ্ধৃশ্ৰষ্ঠ কৃষ্ণ ও অর্জুনের সমক্ষেই যুদ্ধদুর্ধর্ষ ভূরিশ্রবা ক্রুদ্ধ হয়ে মত্ত হস্তী যেমন অপর মত্ত হস্তীকে আঘাত করে, সেই রকমই সাত্যকিকে দু’হাতে তুলে আঘাত করতে লাগলেন। তখন মহাবাহু কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “নিস্পাপ অর্জুন, দেখো যিনি যুদ্ধে বহুসৈন্যেরও দুর্জয়, সেই বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশের শ্রেষ্ঠ সাত্যকি ভূরিশ্রবার বশীভূত হয়েছেন। অর্জুন সাত্যকি দুষ্কর কার্য করে পরিশ্রান্ত হয়ে ভূতলে পতিত হয়েছেন। অতএব তোমার শিষ্য ও বীর সাত্যকিকে রক্ষা করো। প্রবল শত্রুহন্ত্বা পুরুষশ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী অর্জুন, ইনি তোমারই জন্য এসে যাতে ভূরিশ্রবার বশীভূত না হন, দ্রুত তা করো।”

তখন অর্জুন আনন্দিত চিত্ত হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ দেখো বনমধ্যে মহাসিংহ যেমন মত্তহস্তীর সঙ্গে খেলা করে, সেইরকম কৌরবশ্রেষ্ঠ ভূরিশ্রবা বৃষ্ণিপ্রবীর সাত্যকির সঙ্গে যেন খেলা করছেন।”

মহাবাহু ভূরিশ্রবা যখন সাত্যকিকে মাথার উপরে তুলে মাটিতে ফেলে দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন, তখন সৈন্যমধ্যে বিশাল হাহাকার হতে থাকল। সিংহ যেমন হস্তীকে আকর্ষণ করে, সেইরকম প্রচুর দক্ষিণাদাতা কৌরবশ্রেষ্ঠ ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে ভূতলে আকর্ষণ করতে করতে শোভা পেতে লাগলেন। তারপর ভূরিশ্রবা কোষ থেকে তরবারি টেনে বার করে সাত্যকির মাথার কেশ ধারণ করে বক্ষে পদাঘাত করলেন। তারপর ভূরিশ্রবা সাত্যকির দেহ থেকে কুণ্ডলযুক্ত মস্তকটি ছেদন করতে প্রবৃত্ত হলেন। তৎক্ষণাৎ কুম্ভকার যেমন দন্তের সঙ্গে চাকাকে ঘোরাতে থাকে, সেইরকম সাত্যকিও কেশধারী ভূরিশ্রবার হাতের সঙ্গেই আপন মাথাটি ঘোরাতে লাগলেন। তখন সাত্যকিকে যুদ্ধে এইভাবে ঘোরাতে দেখে কৃষ্ণ আবার অর্জুনকে বললেন, “মহাবাহু, দেখো বৃষ্ণি এবং অন্ধকবংশশ্রেষ্ঠ, তোমার শিষ্য এবং তোমা অপেক্ষা ধনুর্যুদ্ধে অন্যূন সাত্যকি ভূরিশ্রবার বশীভূত হয়েছেন। শত্রুরা যাঁর বিক্রম সহ্য করতে পারে না এবং যিনি যথার্থ বিক্রমশালী, সেই বৃষ্ণিবংশীয় সাত্যকিকে ভূরিশ্রবা যুদ্ধে কাতর করে ফেলেছেন।” কৃষ্ণ একথা বললে, মহাবাহু অর্জুন মনে মনে যুদ্ধে ভূরিশ্রবার প্রশংসা করতে লাগলেন, “কুরুকুলের কীৰ্তিবর্ধক ভূরিশ্রবা যেন যুদ্ধে খেলা করতে করতে সাত্বতবংশশ্রেষ্ঠ সাত্যকিকে আকর্ষণ করে আমাকে গুরুতর আনন্দিত করেছেন। ইনি যেহেতু বৃষ্ণিবীর শ্রেষ্ঠ সাত্যকিকে বধ করবেন, সেই হেতু—বনমধ্যে সিংহ যেমন মহাহস্তীকে আকর্ষণ করে, সেইরকম সাত্যকিকে আকর্ষণ করেছেন।”

পৃথানন্দন মহাবাহু অর্জুন এইভাবে মনে মনে ভূরিশ্রবার প্রশংসা করে কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ জয়দ্রথের উপর আমার দৃষ্টি ছিল বলে আমি এযাবৎ এ অবস্থায় সাত্যকিকে দেখতে পাইনি। সে যাই হোক, সাত্যকিকে রক্ষা করার জন্য এখন দুষ্কর কাজ করছি।”

ইত্যুক্তা বচনং কুর্বণ বাসুদেবস্য পাণ্ডবঃ।

ততঃ ক্ষুরং সুনিশিতং গাণ্ডীবে সমযোজয়ৎ ॥

পার্থ বাহুবিসৃষ্টঃ স মহোল্কেব নভশ্চ্যুতা।

সখড়্গং যজ্ঞশীলস্য সাঙ্গদং বাহুমচ্ছিনৎ ॥ দ্রোণ : ১২৩ : ৬৯-৭০ ॥

“এই বলে অর্জুন কৃষ্ণের বাক্য রক্ষা করার জন্য গাণ্ডিবধনুতে একটা সুধার ক্ষুরপ্রবাণ সংযোগ করলেন। পরে অর্জুন বাহুনিক্ষিপ্ত সেই বাণটা আকাশচ্যুত বিশাল উল্কার মতো গিয়ে তরবারি ও কেয়ূরযুক্ত ভূরিশ্রবার দক্ষিণবাহু ছেদন করল।”

তরবারি ও সুন্দর কেয়ূরযুক্ত ভূরিশ্রবার সেই উত্তম বাহুখানা সমস্ত লোকের গুরুতর দুঃখ উৎপাদন করে ভূতলে পতিত হল। ভূরিশ্রবার দক্ষিণবাহু সাত্যকিকে প্রহার করবে, এমন সময়ে অর্জুন অদৃশ্য থেকে তা ছেদন করেছিলেন। সুতরাং পঞ্চমুখ সর্পের মতো বেগে তা ভূতলে পড়ল। অর্জুন তাঁর উদ্যম ব্যর্থ করেছেন দেখে ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে ত্যাগ করে ক্রোধবশত অর্জুনের নিন্দা করতে লাগলেন, “কুন্তীনন্দন, তুমি এটা গুরুতর নৃশংস কাজ করলে। যেহেতু আমি অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলাম, সুতরাং তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এই অবস্থায় তুমি আমার বাহুছেদন করলে কেন? তুমি গিয়ে রাজা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে কী বলবে? একথা বলবে যে, ভূরিশ্রবা অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন, সেই অবস্থায় আমি তাঁকে বধ করেছি। পৃথানন্দন, এই প্রকার অস্ত্রপ্রয়োগ করতে তোমাকে কি মহাত্মা ইন্দ্র শিখিয়েছিলেন? অথবা রুদ্র, দ্রোণ অথবা কৃপ শিখিয়েছিলেন? অর্জুন তুমি অন্য যোদ্ধা অপেক্ষা অধিক অস্ত্রধর্ম জান! সেই তুমি কী করে তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করছে না, এমন যোদ্ধাকে অস্ত্রাঘাত করলে? প্রশস্তচিত্ত লোকেরা অসাবধান, ভীত, রথবিহীন, অভয়প্রার্থী, বিপদাপন্ন লোকের উপর প্রহার করেন না। পৃথানন্দন, নীচজন আচরিত, অসৎপুরুষ ব্যবহৃত এবং সজ্জনের পক্ষে অতি দুষ্কর এই কাজ তুমি কী করে করলে? ধনঞ্জয় অভিজ্ঞ লোকেরা বলে থাকেন— জগতে সজ্জনের পক্ষে সজ্জনের কার্য করাই সম্ভবপর। কিন্তু সজ্জনের পক্ষে অসজ্জনের কাজ করা অতিদুষ্কর। মানুষ যেমন সংসর্গে থাকে, তার চরিত্রও তেমনই গড়ে ওঠে। তুমি রাজবংশে, বিশেষত কুরুবংশে জন্মে, সদাচারপরায়ণ হয়ে এবং তপস্যা করে শেষে ক্ষত্রিয়ধর্মচ্যুত হলে? তুমি কৃষ্ণের মতেই সাত্যকির জন্য এই নীচ কাজ করেছ। নইলে তোমার পক্ষে এ কাজ সম্ভবপর নয়। কৃষ্ণের বশীভূত ব্যক্তিরাই পরের সঙ্গে যুদ্ধরত ব্যক্তিকে আঘাত করতে পারে। বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় লোকেরা ব্রাত্যক্ষত্রিয়, তাদের যথাসময়ে উপনয়ন হয় না এবং যে কন্যা বিবাহযোগ্যা নয়— সেই কন্যাকেই তারা বিবাহ করে! তুমি সেই কৃষ্ণের কথা শুনে এই নিন্দনীয় কাজ করলে?”

মহাবাহু ও মহাযশা ভূরিশ্রবা এই বলে সাত্যকিকে ত্যাগ করে রণস্থলেই প্রায়োপবেশন করার সংকল্প করলেন। পুণ্যলক্ষণ ভূরিশ্রবা ব্রহ্মলোকে যাবার ইচ্ছা করে বামহস্ত দ্বারা ভূতলে শর বিছিয়ে আপন প্রাণবায়ুকে মহাবায়ুতে মিশিয়ে দিলেন। সূর্যে নয়ন এবং চন্দ্রে প্রসন্ন মনটিকে নিবিষ্ট করে “তত্ত্বমসি” এই মহা উপনিষদের অর্থ জীব ও ঐক্যের ধ্যান করতে করতে যোগযুক্ত ও মৌনী হলেন।

তখন সেখানে উপস্থিত সমস্ত সৈন্য কৃষ্ণ ও অর্জুনের নিন্দা এবং পুরুষশ্রেষ্ঠ ভূরিশ্রবার প্রশংসা করতে লাগলেন। নিন্দা শুনেও কৃষ্ণ ও অর্জুন কোনও অপ্রিয় কথা বললেন না, আবার প্রশংসা শুনেও ভূরিশ্রবা আনন্দিত হলেন না। কৌরবেরা বারবার অর্জুনের নিন্দা করতে থাকলে অর্জুন তাদের ও ভূরিশ্রবার বাক্য সহ্য করতে না পেরে বললেন, “রাজারা সকলেই আমার মহাব্রতের কথা জানেন যে, আমার অস্ত্রপথে যে পড়বে, সেই আমার বধ্য হবে। আমার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে ভূরিশ্রবা তুমি আমার নিন্দা করতে পার না। তা ছাড়া, তুমি অস্ত্রধারণ করে নিরস্ত্র সাত্যকিকে বধ করতে চাইছিলে, অতএব তোমার বাহু ছেদন করে আমি অন্যায় করিনি। নিরস্ত্র, বালক, রথবিহীন ও বর্মশূন্য অভিমন্যুকে তোমরা যে বধ করেছ, কোন ধার্মিক লোক তার প্রশংসা করেন?”

অর্জুন একথা বললে ভূরিশ্রবা মস্তক দিয়ে ভূমি স্পর্শ করলেন এবং বামহস্তদ্বারা ছিন্ন দক্ষিণ হস্ত অর্জুনের দিকে ছুড়ে দিলেন, কিন্তু অর্জুনের কথার কোনও উত্তর দিতে পারলেন না ভূরিশ্রবা, অধোমুখে রইলেন।

অর্জুন বললেন, “শলাগ্ৰজ! ধর্মরাজ, বলিশ্রেষ্ঠ ভীমসেন, নকুল ও সহদেবের উপর আমার যে প্রীতি আছে, তোমার উপরেও আমার সেইরূপ প্রীতি আছে। অতএব, তুমি আমার ও মহাত্মা কৃষ্ণের অনুমতিক্রমে উশীনরনন্দন শিবিরাজার মতো পুণ্যার্জিত লোকে গমন করো।”

কৃষ্ণ বললেন, “সর্বদা অগ্নিহোত্রযাগকারী ভূরিশ্রবা, আমার যে নির্মললোক চিরদিন প্রকাশ পাচ্ছে, যেখানে যাবার জন্য ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবশ্রেষ্ঠরাও ইচ্ছা করেন, তুমি সেখানে যাও, আর আমারই মতো গরুড়ের উত্তম রথে আরোহণ করে বিচরণ করো।”

সাত্যকি মূৰ্ছিত হয়ে ভূতলে পতিত হয়েছিলেন। তিনি চৈতন্যলাভ করে উঠে তরবারি নিয়ে মহাত্মা ভূরিশ্রবার মস্তক ছেদন করবার ইচ্ছা করলেন। ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবা তখন ছিন্নশুণ্ড হস্তীর ন্যায় উপবেশন করেছিলেন; সেই অবস্থায় অতিদুর্মনা হয়েও তাঁকে বধ করতে উদ্যত হলে, সমস্ত সৈন্য ধিক ধিক বলে সাত্যকির নিন্দা করতে লাগল এবং মহাত্মা কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীমসেন, অর্জুনের চক্ররক্ষক যুধামন্যু ও উত্তমৌজা, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, কর্ণ, বৃষসেন ও জয়দ্রথ বারণ করতে থাকলেন; আর সমস্ত সৈন্যই উচ্চ স্বরে “বধ করবেন না, বধ করবেন না” এই চিৎকার করতে থাকল, তথাপি সাত্যকি তরবারি দ্বারা যুদ্ধস্থলে প্রায়োপবিষ্ট ও অর্জুন কর্তৃক ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবার মস্তক ছেদন করলেন। পূর্বে অর্জুন কর্তৃক আহত ভূরিশ্রবাকে যে হেতু বধ করা হল, সেই জন্য সৈন্যরা সাত্যকির প্রশংসা করল না।

ওদিকে দেবগণ, সিদ্ধগণ, চারণগণ ও মানবগণ ইন্দ্রের তুল্য ভূরিশ্রবাকে প্রায়োপবিষ্ট অবস্থায় নিহত দেখে ও তাঁর কার্যে বিস্মিত হয়ে তাঁর প্রশংসা করতে লাগলেন; আবার সাত্যকির অনুকুলে সৈন্যরা বলতে লাগল, “এ বিষয়ে সাত্যকির কোনও অপরাধ নেই। কারণ, এঁর এইরূপই ভবিতব্য ছিল। অতএব ক্রোধ করা উচিত নয়। যেহেতু ক্রোধ মানুষের গুরুতর দুঃখের সৃষ্টি করে। বীরের শত্রুবধ করা উচিত, এ বিষয়ে কোনও বিচার করা সঙ্গত নয়। বিশেষত বিধাতাই যখন সাত্যকিকে ভূরিশ্রবার মৃত্যুজনক করে সৃষ্টি করেছেন।”

সাত্যকি বললেন, “অধার্মিকগণ! তোমরা ধর্মের বেশ ধারণ করে ধর্মকথা দ্বারা আমাকে যে ‘বধ কোরো না, বধ কোরো না’ বলছিলে, তা অত্যন্ত অসঙ্গত। যখন বালক ও অস্ত্রবিহীন অভিমন্যুকে বধ করেছিলে, তখন তোমাদের ধর্ম কোথায় ছিল? আমি কোনও শত্রুর তিরস্কারের সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, যুদ্ধে যে লোক জীবিত অবস্থায় ক্রোধবশত আমাকে নিষ্পেষণ করে পদাঘাত করবে, সে যদি মুনির মতো নিয়মশালীও হয়, তবুও আমি তাকে বধ করব। তারপর আমার বাহুযুগল ছিল। আমি ভূরিশ্রবাকে প্রত্যাঘাত করবার চেষ্টা করছিলাম, তোমাদের চক্ষুও ছিল; তোমরা যে আমাকে মৃত বলে ভেবেছিলে, সে তোমাদের বুদ্ধির ভুল। অতএব আমি সঙ্গতভাবেই ভূরিশ্রবাকে বধ করেছি। তবে অর্জুন আমাকে ভূপাতিত দেখে নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য তরবারি দিয়ে ভূরিশ্রবার বাহু ছেদন করে আমাকে বঞ্চিত করেছেন। দৈব মানুষকে তার অনুকূলে কাজ করায়। এই যুদ্ধে ভূরিশ্রবা নিহত হয়েছেন। এতে অধর্মের কী আছে? পূর্বকালে বাল্মীকি মুনি বলেছিলেন, ‘প্রঙ্গম! তুমি যে বলছ— স্ত্রীহত্যা করবে না তাতে আমি বলি, যা পীড়াজনক হবে, তা নাশ করা শত্রুর অবশ্যকর্তব্য।” কৌরবশ্রেষ্ঠরা সাত্যকির মনে মনে প্রশংসা করলেও, সংযমী ভূরিশ্রবাকে বধ করা অনুমোদন করলেন না।

*

এই দুর্লভতম মূহুর্তটি আলোচনার পূর্বে, প্রেক্ষাপটটি জানা প্রয়োজন। কারণ, কৃষ্ণ, অর্জুনকে বাদ দিলে মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর সাত্যকি। সাত্যকি অর্জুনের শিষ্য, অভিমন্যুর গুরু। অথচ ভূরিশ্রবার হাতে সাত্যকি অত্যন্ত নিগৃহীত হন। যদুবংশে কার্তবীর্য অর্জুনের তুল্য বীর ও বলবান ‘শিনি’ নামক এক ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন। শিনি মহাত্মা দেবকের কন্যা দেবকীকে স্বয়ংবর সভা থেকে বসুদেবের জন্য সকল রাজাকে পরাজিত করে গ্রহণ করেন। বীর ও মহাতেজা সোমদত্ত শিনিকে রণে আহ্বান করেন। শিনি বলপূর্বক সোমদত্তকে ভূতলে ফেলে অসি উত্তোলন করে কেশ আকর্ষণ করে পদাঘাত করেন এবং জীবনযাপন করার জন্য ছেড়ে দেন। সোমদত্ত দীর্ঘকাল মহাদেবের তপস্যা করে আশীর্বাদ লাভ করেন যে, তাঁর পুত্র শিনির পুত্রকে ভূতলে ফেলে কেশ আকর্ষণ করে পদাঘাত করবেন। সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা এই কারণে শিনির পুত্র সাত্যকিকে পরাজিত করেন ও নিগৃহীত করেন।

এই মুহূর্তটি পরম দুর্লভ মনে করার সবথেকে বড় কারণ অর্জুনের জীবনে এই রকম মুহূর্ত খুব কমই এসেছে। অর্জুন শব্দের অর্থ শুভ্র। সমস্ত যোদ্ধা জীবনে অর্জুন এই শুভ্রতা, নিষ্কলঙ্কতা বহন করেছেন। যুদ্ধকালে বীভৎস কাজ করেন না বলে তাঁর আর এক নাম বীভৎসু। সেই অর্জুন ভূরিশ্রবা যখন সাত্যকির সঙ্গে সংগ্রামরত, যখন তিনি সাত্যকিকে পূর্ণ পরাজিত করে নিধন করতে চলেছেন, তখন ভূরিশ্রবার অলক্ষ্যে থেকে তাঁর বাহুছেদন করলেন। ভূরিশ্রবা এই নিয়ে অর্জুনের নিন্দা করলে, অর্জুন অভিমন্যুর অন্যায় হত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সপ্তরথী যে অন্যায় করেছিলেন, তা অর্জুনের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না।

বিশেষত এই ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সুগভীর ক্ষোভে অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, “মহারাজ আপনি ধর্মজ্ঞ হয়েও রাজ্যলাভের জন্য মিথ্যা বলে মহাপাপ করেছেন। বালিবধের জন্য রামের যেমন অকীর্তি হয়েছে সেইরূপ দ্রোণবধের জন্য আপনার চিরস্থায়ী অকীর্তি হবে।” বোঝা যাচ্ছে, মহাভারত রচনার সময়েও রামচন্দ্রের বালিবধ বীরসমাজে অকীর্তি বিবেচিত হত। কারণ বালি সুগ্রীবের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন, এই অবস্থায় রামচন্দ্র বালিবধ করেন অলক্ষ্যে থেকে। মৃত্যুমুখী বালি রামচন্দ্রের নিন্দা করলে তিনি বলেছিলেন, “তুমি বলপূর্বক কনিষ্ঠ ভ্রাতার পত্নী রুমাকে অঙ্কশায়িনী করেছ, তাই তুমি মৃত্যুদণ্ড যোগ্য।” অর্জুন রামচন্দ্রের এই আত্মপক্ষ সমর্থনে সন্তুষ্ট ছিলেন না, বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তিনিও কি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অভিমন্যু-বধ ঘটনার আশ্রয় নিলেন না? রামচন্দ্রও বালিকে স্বর্গে যাবার আশীর্বাদ করেছিলেন, অর্জুনও ভূরিশ্রবার জন্য স্বর্গ কামনা করলেন। যদিও অর্জুনের জীবনে এমন কালির ফোঁটা পড়বার মতো মুহূর্ত খুব বেশি নেই।

এই মুহূর্তটির আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য, সাত্যকির জন্য কৃষ্ণের উদ্বেগ। অর্জুন যখন মনে মনে ভূরিশ্রবার রণনৈপুণ্যের প্রশংসা করছিলেন, কৃষ্ণ অঘটন ঘটার সম্ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠছিলেন। শেষ পর্যন্ত অর্জুন মুহূর্তমধ্যে কৃষ্ণের উদ্বেগ দূর করেছিলেন।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সাত্যকিকে এই অবস্থায় এই একবারই দেখা যায়। তিনি কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্যকে জয় করেছিলেন। যুদ্ধশেষে যে দশজন বেঁচে ছিলেন, তার মধ্যে সাত্যকি একজন। কিন্তু এই ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে গেল না। সাত্যকি ও কৃতবর্মার বাদানুবাদও এই ঘটনা নিয়ে। সেদিন যদুবংশ ধ্বংস হয়েছিল।

৭২
জয়দ্রথ-বধ

ভূরিশ্রবা নিহত হলে, মহাবাহু অর্জুন কৃষ্ণকে আদেশ করলেন, “কৃষ্ণ রাজা জয়দ্রথ যেখানে আছেন, সেদিকে ঘোড়াগুলিকে চালাও। সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, আমিও দুস্তর প্রতিজ্ঞা করেছি, ওদিকে কৌরবসৈন্যের মহারথেরা জয়দ্রথকে রক্ষা করছেন। কৃষ্ণ যাতে সুর্য অস্ত্র যাবার পূর্বে আমার প্রতিজ্ঞা সফল হয়, সেইভাবে ঘোড়াগুলিকে চালাও।”

তখন মহাবাহু ও অস্ত্রকৌশলজ্ঞ কৃষ্ণ জয়দ্রথের রথের দিকে রৌপ্যতুল্য শুভ্রবর্ণ অশ্বগুলিকে চালিয়ে দিলেন। অব্যর্থবাণ অর্জুন এগিয়ে আসতে থাকলে দুর্যোধন, কর্ণ, বৃষসেন, শল্য, অশ্বত্থামা, কৃপ এবং স্বয়ং জয়দ্রথ—এই সকল যোদ্ধারা উড়ন্ত ঘোড়ার মতো দ্রুতগামী অশ্ব নিয়ে অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। ওদিকে অর্জুন উপস্থিত হয়ে ক্রোধপ্রদীপ্ত নয়নে সম্মুখবর্তী জয়দ্রথকে যেন দগ্ধ করতে করতে দেখতে থাকলেন। রাজা দুর্যোধন অর্জুনকে জয়দ্রথের রথের দিকে যেতে দেখে কর্ণকে বললেন, “কর্ণ এই সেই যুদ্ধের সময়। অতএব মহাত্মা, নিজের শক্তি দেখাও। কর্ণ যাতে অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করতে না পারে, তার ব্যবস্থা করো। দিনের অল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে। বাণসমূহদ্বারা শত্রুকে আঘাত করতে থাকো। দিবাবসান হলে নিশ্চয়ই আমাদের জয় হবে। সূর্যাস্তগমন পর্যন্ত জয়দ্রথকে রক্ষা করতে পারলে, অর্জুনের প্রতিজ্ঞা মিথ্যা হয়ে যাবে; সুতরাং তখন অৰ্জন অগ্নিতে প্রবেশ করবে। মানীজনের সম্মানকারী কর্ণ, পৃথিবীতে অর্জুন না থাকলে, তাঁর ভ্রাতারা অনুচরদের সঙ্গে মুহূর্তকালও জীবিত থাকতে পারবে না। আর পাণ্ডবেরা বিনষ্ট হলে পর্বত, বন ও উদ্যানের সঙ্গে এই নিষ্কণ্টক পৃথিবীটা আমরাই ভোগ করতে পারব। কর্ণ, দৈবই অর্জুনকে বিনষ্ট করেছে; তাই তার বিপরীত বুদ্ধি হয়েছিল। সুতরাং ও কর্তব্য বা অকর্তব্য না বুঝে যুদ্ধ বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে। পাণ্ডুর পুত্র অর্জুন নিশ্চয়ই নিজের বিনাশের জন্য জয়দ্রথবধ বিষয়ে এই প্রতিজ্ঞা করেছে। রাধানন্দন তুমি যুদ্ধে দুর্ধর্ষ। সুতরাং তুমি জীবিত থাকতে, সূর্য অস্ত যাবার পূর্বে কী করে অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করবে? যুদ্ধের সম্মুখভাগে মদ্ররাজ শল্য এবং মহাত্মা কৃপ জয়দ্রথকে রক্ষা করছেন; এ অবস্থায় অর্জুন কী ভাবে তাঁকে বধ করবে? তার পর আমি, দুঃশাসন ও অশ্বত্থামা তাঁকে রক্ষা করছি। সুতরাং, দৈবপ্রেরিত অর্জুন কী ভাবে জয়দ্রথকে পাবে? কর্ণ বহু বীর যুদ্ধ করছেন, সূর্যও ঝুলে পড়েছেন। অতএব আশা করি, অর্জুন জয়দ্রথকে পাবেই না। অতএব অশ্বত্থামা, শল্য, কৃপ, অন্যান্য মহারথ বীর ও আমার সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশেষ যত্ন অবলম্বন করে তুমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করো।”

দুর্যোধন এই কথা বললে, কর্ণ সেই কৌরবশ্রেষ্ঠকে বললেন, “দৃঢ়াঘাতকারী, বীর ও ধনুর্ধর ভীমসেন অনেক বাণের আঘাতে যুদ্ধে আমার দেহ অত্যন্ত বিদীর্ণ করেছে। থাকতে হয় বলেই আমি এখনও যুদ্ধে আছি। কিন্তু মহাবাণে বিদীর্ণ হওয়ায় আমার অঙ্গ একটুও চলছে না। তবুও আমার জীবন তোমার জন্য বলে শক্তি অনুসারে যুদ্ধ করব; যাতে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করতে না পারে। আমি যুদ্ধে উপস্থিত থেকে তীক্ষ্ণ বাণসমূহ নিক্ষেপ করতে থাকলে নিশ্চয়ই সব্যসাচী বীর অর্জুন জয়দ্রথকে পাবে না। প্রভুর প্রতি অনুরক্ত ও হিতৈষী লোকের সর্বদা যা কর্তব্য, তা আমি করব; তবে জয় দৈবের উপর প্রতিষ্ঠিত। মহারাজ তোমার প্রীতির জন্য জয়দ্রথকে রক্ষা করার জন্য আমি বিশেষ যত্ন করব। কিন্তু জয় দৈবের অধীন। আজ আমার সমস্ত সৈন্য আমার ও অর্জুনের দারুণ ও লোমহর্ষণ যুদ্ধ দর্শন করুন।”

কর্ণ ও দুর্যোধন রণস্থলে এইরূপ বলছিলেন এমন সময়ে অর্জুন তীক্ষ্ণ বাণসমূহ দ্বারা কৌরবসেন্য সংহার করতে লাগলেন। অত্যন্ত ধারযুক্ত বাণের সাহায্যে তিনি বীরগণের রথ চূর্ণ করলেন ও হস্তীশুণ্ডের ন্যায় বাহু ছেদন করতে লাগলেন। অর্জুনের তীক্ষ্ণ বাণে চতুর্দিকে মস্তক, হস্তীশুণ্ড, অশ্বগ্রীবা ও রথচক্র ছিন্ন হয়ে পড়তে লাগল। অৰ্জুন এক একটি বাণে একসঙ্গে তিনজন করে যোদ্ধা বধ করতে লাগলেন। অগ্নি যেমন তৃণময় ভূমি দগ্ধ করে, অর্জুন তেমনই কৌরব সৈন্যবাহিনী দগ্ধ করতে থেকে অচিরকালের মধ্যে সমরভূমি রক্তময় করে ফেললেন। বলবান, যথার্থ বিক্রমশালী ও দুর্ধর্ষ অর্জুন কৌরবসৈন্যের বহুতর যোদ্ধাকে নিহত করে ক্রমে জয়দ্রথের সম্মুখে গিয়ে উপস্থিত হলেন। এই সময়ে অর্জুন— ভীমসেন ও সাত্যকি কর্তৃক রক্ষিত হয়ে প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় প্রকাশ পেতে লাগলেন। শক্তিগর্বে মত্ত কৌরব মহাধনুর্ধরেরা অর্জুনের সেই রূপ সহ্য করতে পারলেন না। যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত দুর্যোধন, কর্ণ, শল্য, বৃষসেন, কৃপ ও অশ্বত্থামা জয়দ্রথকে রক্ষা করবার জন্য অর্জুনকে পরিবেষ্টন করলেন। জয়দ্রথও তাঁদের পিছনে অগ্রসর হলেন।

তখন সূর্য রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। তাই তাঁর অস্তগমন কামনা করে কিংবা কৃষ্ণ ও অর্জুনকে বধ করবার কামনা করে জয়দ্রথকে পিছনে রেখে, সেই যুদ্ধবিশারদেরা সকলে নির্ভয়চিত্তে মুখ ব্যাদান করা যমের মতো যুদ্ধদক্ষ অর্জুনকে পরিবেষ্টন করলেন। তাঁরা প্রত্যেকে বিশাল সর্পতুল্য বাহু নিয়ে আপন ধনু আকর্ষণ করে অর্জুনের প্রতি শত শত উজ্জ্বল বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। অর্জুন আগত বাণগুলিকে ছেদন করে সেই রথীগণকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। তখন সিংহলাঙ্গুলধ্বজ কৃপাচার্য আপন শক্তি দেখাবার জন্য দশটি বাণ দ্বারা অর্জুনকে ও সাতটি বাণ দ্বারা কৃষ্ণকে বিদ্ধ করে জয়দ্রথকে রক্ষা করবার জন্য অর্জুনের রথপথে অবস্থান করতে লাগলেন। অন্য কৌরব রথীগণও জয়দ্রথকে রক্ষা করবার জন্য তীব্র ও তীক্ষ্ণ বাণক্ষেপ করতে লাগলেন। তখন অর্জুন গাণ্ডিবধনুর ও তূণ দুইটির অক্ষয়ত্ব দেখাতে থেকে অশ্বত্থামা ও কৃপাচার্যের অস্ত্র নিবারণ করে প্রত্যেক রথীকে দশটি করে বাণদ্বারা বিদ্ধ করলেন। কৌরব মহারথেরা সূর্যের অস্তগমন ইচ্ছা করে ত্বরান্বিত হয়ে আপনাদের রথগুলিকে অর্জুনের রথের সঙ্গে সংলগ্ন করে দিলেন এবং তীক্ষ্ণ গর্জন করতে করতে অর্জুনকে প্রহার করতে লাগলেন। কর্ণ ভীমসেন ও সাত্যকির সামনেই বাণ দ্বারা অর্জুনকে বারণ করতে লাগলেন। তখন অর্জুন সমরাঙ্গনে সমস্ত সৈন্যের সমক্ষে দশটি বাণ দ্বারা কর্ণকে প্রতিবিদ্ধ করলেন। ক্রমে সাত্যকি তিনটি, ভীমসেন তিনটি ও অর্জুন পুনরায় সাতটি বাণ দ্বারা কর্ণকে বিদ্ধ করলেন। মহারথ কর্ণও তাঁদের প্রত্যেককে যাট-ষাটটি বাণ দ্বারা প্রহার করলেন। অদ্ভুত রণনৈপুণ্য দেখিয়ে কর্ণ অর্জুন, ভীম ও সাত্যকিকে বারণ করতে লাগলেন। তখন মহাবাহু অর্জুন একশত বাণ দ্বারা সূর্যনন্দন কর্ণের সমস্ত দেহে আঘাত করলেন। কর্ণের সমস্ত অঙ্গ রক্তে সিক্ত হয়ে গেল, তখনও কর্ণ অর্জুনের উপরে পঞ্চাশটি তীক্ষ্ণ বাণক্ষেপ করলেন। তখন পৃথানন্দন বীর অর্জুন কর্ণের ধনু ছেদন করে নয়টি বাণ দ্বারা তার বক্ষঃস্থলে আঘাত করলেন। পরে অর্জুন আরও দ্রুত সময় কমাবার জন্য কর্ণের বধের উদ্দেশ্যে সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল একটি বাণক্ষেপণ করলেন। সেই বাণটি বেগে কর্ণের দিকে আসতে থাকলে অশ্বত্থামা একটি তীক্ষ্ণ অর্ধ-চন্দ্র বাণ দ্বারা সেই বাণটিকে ছেদন করে ভূতলে ফেললেন। তখন অর্জুন ও কর্ণের মধ্যে তুমুল সংগ্রাম হতে লাগল। দুজনেই বাণ দ্বারা দুজনকে আবৃত করে ফেললেন। তাঁরা পরস্পর বধ অভিলাষী হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

তখন দুর্যোধন কৌরব যোদ্ধাদের বললেন, “আপনারা যত্নবান হয়ে কর্ণকে রক্ষা করুন। কর্ণ আমাকে বলে গিয়েছেন যে, অর্জুনকে বধ না করে তিনি ফিরবেন না।”

এই সময়ে অর্জুন কর্ণের বিক্রম দেখে কর্ণ পর্যন্ত ধনু আকর্ষণ করে চারটি বাণে কর্ণের চারটি অশ্বকে বধ করলেন। একটি ভল্লদ্বারা কর্ণের সারথিকে রথ থেকে নিপাতিত করলেন এবং দুর্যোধনের সামনেই কর্ণকে আবৃত করে ফেললেন। অশ্ব ও সারথি নিপাতিত এবং স্বয়ং বাণ দ্বারা আবৃত কর্ণ মোহিত হয়ে পড়লেন, কর্তব্য স্থির করতে পারলেন না। অশ্বত্থামা কর্ণকে রথবিহীন দেখে নিজের রথে তুলে নিলেন, শল্য ত্রিশটি বাণ দ্বারা অর্জুনকে আঘাত করলেন। কৃপ কুড়িটি শরে কৃষ্ণকে তাড়ন করলেন। কুন্তীনন্দন অর্জুনও তাঁদের প্রতিহত করলেন। বনবাসের দ্বাদশ বর্ষের ক্লেশ স্মরণ করে অর্জুন ভয়ংকর হয়ে উঠলেন। হরধনুর তুল্য গাণ্ডিবে দ্রুতগতিতে বাণক্ষেপ করে তিনি মৃতের স্তূপ করে ফেললেন, মাংসভোজী পক্ষীরা মৃতদেহের উপর পড়তে লাগল, আকাশে যেন বহুতর উল্কা জ্বলতে লাগল। সমস্ত রাজা ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে অর্জুনের দিকে ছুটে এলেন, অর্জুন সকলের অস্ত্র ও জীবন বিনিষ্ট করে যমরাজ্যের বৃদ্ধি করতে লাগলেন। অর্জুনের গাণ্ডিবের টংকারে কৌরবসৈন্যেরা ভয়ে বিচলিত ও ত্রাসে অস্থিরচিত্ত হয়ে পড়ল। ক্রমে অর্জুন নূতন নূতন অস্ত্র আবিষ্কার করতে থেকে সমস্ত দিক এবং সকল রথীকে আকুল করে জয়দ্রথের দিকে ধাবিত হলেন এবং চৌষট্টিটি বাণে তাঁকে বিদ্ধ করলেন। বরাহধ্বজ জয়দ্রথও তিনটি নারাচ দ্বারা কৃষ্ণকে, ছ’টি নারাচ দিয়ে অর্জুনকে এবং একটি বাণে অর্জুনের ধ্বজ বিদ্ধ করলেন। অর্জুন জয়দ্রথের বাণ নিবারণ করে দুটি বাণে জয়দ্রথের সারথির মস্তক ও রথের অলংকৃত ধ্বজটি কেটে ফেললেন।

এই সময়ে সূর্য দ্রুত অস্ত্র যেতে থাকলে কৃষ্ণ ত্বরান্বিত হয়ে অর্জুনকে বললেন, “মহাবাহু পৃথানন্দন, জীবনার্থী এই জয়দ্রথ ছ’জন বীর মহারথের মধ্যে ভীত হয়ে অবস্থান করছে। জয়দ্রথ নিজেও জীবনরক্ষায় যত্নবান হয়ে আছে। সুতরাং তুমি এই যুদ্ধে এই ছ’জন রথীকে জয় না করে কিংবা কোনও ছল অবলম্বন না করে জয়দ্রথকে বধ করতে পারবে না। সুতরাং আমি সূর্যকে আবরণ করার জন্য একটা উপায় করব। তাতে জয়দ্রথ সূর্যকে অস্তগতের মতো অস্পষ্ট দেখবে। তখন জীবনার্থী দুরাচার জয়দ্রথ তোমার মৃত্যু হবে ভেবে আনন্দে কোনও প্রকার আত্মগোপন করবে না; সেই অবসরে তুমি তাকে আঘাত করবে। সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। সুতরাং মোটেই বিলম্ব কোরো না।”

তখন অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, “তাই হোক।”

তখন যোগী এবং যোগিগণের অধীশ্বর ত্রিতাপহারী কৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে সূর্যের আবরণের জন্য অন্ধকার সৃষ্টি করলেন। কৃষ্ণ অন্ধকার সৃষ্টি করলে, সূর্য অস্ত গিয়েছেন মনে করে এবং অর্জুন বিনষ্ট হবেন ভেবে কৌরবযোদ্ধারা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। সৈন্যেরা আনন্দিত হয়ে মুখ তুলেও সূর্যকে দেখতে পেল না এবং রাজা জয়দ্রথও মুখ তুলে সূর্যকে দেখতে পেলেন না। জয়দ্রথ সেইভাবে সূর্যকে দেখতে থাকলে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “বীর ভরতশ্রেষ্ঠ, দেখো— জয়দ্রথ তোমার ভয় পরিত্যাগ করে সূর্য দেখছেন। এখনই দুরাত্মাকে বধের সময়। সুতরাং তুমি সত্বর ওর মস্তক ছেদন করো ও নিজের প্রতিজ্ঞা সফল করো।” কৃষ্ণ একথা বললে, প্রতাপশালী অর্জুন সূর্য ও অগ্নির তুল্য উজ্জ্বল শরসমূহ দ্বারা কৌরবসৈন্য বধ করতে লাগলেন। ক্রমে অর্জুন কুড়িটি বাণ দ্বারা কৃপকে, পঞ্চাশটি দ্বারা কর্ণকে, ছ’টি দ্বারা শল্যকে ও দুর্যোধনকে তাড়ন করলেন। তারপর অর্জুন আটটি বাণ দ্বারা বৃষসেনকে, যাটটি দ্বারা জয়দ্রথকে এবং বহুতর বাণ দ্বারা কৌরবযোদ্ধাদের গাঢ়ভাবে বিদ্ধ করে জয়দ্রথের দিকে ধাবিত হলেন।

কৌরবেরা অনবরত শরবর্ষণ করে অর্জুনকে বারণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অর্জুন সম্মুখাগত সকল বীরকেই বধ করতে লাগলেন। তখন কৌরবেরা ভীত হয়ে জয়দ্রথকে পরিত্যাগ করে, যে যেদিকে পারলেন পালাতে লাগলেন। প্রলয়কালীন রুদ্রের মতো অর্জুন প্রাণীসংহার করলেন। সেই যুদ্ধে এমন কোনও রথী, অশ্বারোহী, হস্ত্যারোহী বা পদাতি ছিল না যে, অর্জুনের বাণে আহত হয়নি। অর্জুন নিক্ষিপ্ত বাণে বিদীর্ণ সৈন্যেরা ঘূর্ণিত, স্খলিত, পতিত, অবসন্ন ও বেদনার্ত হতে লাগল। অর্জুন এইভাবে কৌরবসৈন্যদের পীড়ন করে ভীষণ শরসমূহ দ্বারা জয়দ্রথের রক্ষীগণকেও বধ করলেন। পরে অর্জুন তীব্র শরজাল দ্বারা কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, শল্য, বৃষসেন ও দুর্যোধনকে আবৃত করলেন। অর্জুন অতিদ্রুত, অস্ত্রগ্রহণ, অস্ত্রসন্ধান ও অস্ত্ৰক্ষেপ করায় এর কোনওটিই দেখা গেল না। তখন বিজয়ীশ্রেষ্ঠ অর্জুন কর্ণ ও বৃষসেনের ধনু ছেদন করলেন এবং ভাগিনেয় অশ্বত্থামা ও মাতুল কৃপাচার্যকে গাঢ়বিদ্ধ করে একটি ভল্লদ্বারা শল্যের সারথিকে রথনীড় থেকে নিপাতিত করলেন।

তখন অর্জুন অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বল একটি ভয়ংকর বাণ তূণ থেকে বার করলেন। মহাবাহু অর্জুন—ইন্দ্রের বর্জ্যের তুল্য তেজস্বী, দিব্যমন্ত্রে অভিমন্ত্রিত, সর্ববিদারণযোগ্য এবং সর্বদা গন্ধ ও মাল্য দ্বারা পূজিত সেই বিশাল বাণটিকে যথাবিধানে বজ্রমন্ত্রে সংযুক্ত করে গাণ্ডিবধনুতে সন্ধান করলেন। অর্জুন সেই বাণটির সন্ধান করলে আকাশে বিশাল কোলাহল শোনা গেল। তখন কৃষ্ণ দ্রুত অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন দুরাত্মা জয়দ্রথকে বধ করো। সূর্য অস্তনামক পর্বতশ্রেষ্ঠে যাবার ইচ্ছা করেছেন। অতএব জয়দ্রথ বধ বিষয়ে আমার কাছে এই কর্তব্য বিষয় শ্রবণ করো। জগদ্বিখ্যাত বৃদ্ধক্ষত্র জয়দ্রথের পিতা। তিনি দীর্ঘকাল দেবতার আরাধনা করে শত্ৰুহন্তা জয়দ্রথকে পুত্ররূপে প্রাপ্ত হন। জয়দ্রথের জন্মকালে মেঘ ও দুন্দুভির ধ্বনির মতো গম্ভীর কণ্ঠে দেবপুত্র বলেছিলেন, ‘মনুষ্যশ্রেষ্ঠ রাজা! আপনার এই পুত্র কুল, শীল ও ইন্দ্রিয়দমন প্রভৃতি গুণদ্বারা মাতৃবংশ ও পিতৃবংশের উপযুক্ত, ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ ও জগতে সর্বদা বীরগণদ্বারা সম্মানিত হবে। কিন্তু এ যখন ধনুর্ধারণ করে রণস্থলে শত্রুগণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকবে, তখন কোনও ক্রুদ্ধ শত্রু প্রত্যক্ষ থেকেই সেই রণভূমিতে এর শিরচ্ছেদন করবে।’ শত্রুদমনকামী সিন্ধুরাজ বৃদ্ধক্ষত্র সেই দৈববাণী শুনে দীর্ঘকাল চিন্তা করে সমস্ত জ্ঞাতিকে এই কথা বলেছিলেন, ‘আমার পুত্র যখন সমরাঙ্গনে গুরুতর ভার বহন করে যুদ্ধ করতে থাকবে, তখন যে লোক তার মন্তক ভূতলে পাতিত করবে, তার মস্তকও শতধা বিদীর্ণ হয়ে যাবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’ এই বলে বৃদ্ধক্ষত্র যথাসময়ে জয়দ্রথকে রাজার পদে প্রতিষ্ঠিত করে বনে গিয়ে ভয়ংকর তপস্যা আরম্ভ করেন। কপিধ্বজ অর্জুন, সেই তপস্বী বৃদ্ধক্ষত্র এখন এই সমস্তপঞ্চকের বাইরে ভয়ংকর ও দুষ্কর তপস্যা করছেন। অতএব তুমি ভয়ংকর ও অদ্ভুতকার্যকারী কোনও অলৌকিক অস্ত্রদ্বারা মহাযুদ্ধে জয়দ্রথের মস্তক ছেদন করে কুণ্ডলযুক্ত সেই মস্তকটি তপস্যায় উপবিষ্ট সিন্ধুরাজ বৃদ্ধক্ষত্রের ক্রোড়ে নিপাতিত করো। পক্ষান্তরে তুমি যদি জয়দ্রথের মস্তক ভূতলে পতিত করো, তা হলে তোমার মস্তকও শতভাগে বিদীর্ণ হয়ে যাবে। তপস্যানিরত সেই রাজা যাতে এই ঘটনা জানতে না পারেন, তুমি কোনও দিব্য অস্ত্র অবলম্বন করে, তা করো। তোমার অসাধ্য কিছু নেই।”

কৃষ্ণের এই কথা শুনে অর্জুন ওষ্ঠপ্রান্ত লেহন করতে থেকে ইন্দ্রের বর্জ্যের তুল্য স্পর্শ, দিব্যমন্ত্রে অভিমন্ত্রিত, সমস্ত দুষ্করকার্য সাধক এবং চিরকাল গন্ধ ও মাল্যদ্বারা অর্চিত সেই জয়দ্রথ বধের জন্য ধরে রাখা বাণটিকে সত্বর নিক্ষেপ করলেন। তখন অর্জুনের বাহুনিক্ষিপ্ত সেই বাণটি শ্যেনপক্ষীর ন্যায় দ্রুত গিয়ে জয়দ্রথের মস্তক ছেদন করে উপরে উঠল। আবার অর্জুন নিক্ষিপ্ত অপর কতকগুলি বাণ গিয়ে জয়দ্রথের সেই মস্তকটি ঊর্ধ্বে বহন করে নিয়ে চলল। এদিকে অর্জুন কর্ণ, কৃপ, শল্য, দুর্যোধন, অশ্বত্থামা ও বৃষসেন—এ ছ’জন মহারথীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

তখন এক গুরুতর আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। অর্জুনের সেই বাণগুলি জয়দ্রথের মস্তকটিকে সে-স্থান থেকে সমস্তপঞ্চকের বাইরে নিয়ে যেতে লাগল। এই সময়ে তেজস্বী বৃদ্ধক্ষত্র রাজা সন্ধ্যার উপাসনা করছিলেন। ক্রমে সেই বাণসমূহ কৃষ্ণকেশ ও কুণ্ডলযুক্ত জয়দ্রথের মস্তকটি নিয়ে গিয়ে সন্ধ্যা উপাসনায় নিরত বৃদ্ধক্ষত্রের ক্রোড়ে নিপাতিত করল। অলক্ষিতভাবে সেই মস্তকটি ক্রোড়ে পতিত হলে বৃদ্ধক্ষত্র ভীত হয়ে যেই উঠে দাঁড়ালেন, অমনি সেই মস্তকটি ভূতলে পড়ে গেল এবং সেই বৃদ্ধক্ষত্ররাজার মস্তকও শতধা বিদীর্ণ হল।

সৈন্যরা কৃষ্ণ ও অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগলেন। কৃষ্ণ তখন সেই অন্ধকার অপসারিত করলেন। জয়দ্রথকে নিহত দেখে কৌরব রথীগণ অশ্রুমোচন করতে লাগলেন। কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য, অর্জুন দেবদত্ত, ভীমসেন, সাত্যকি, যুধামন্য ও উত্তমৌজা পৃথক পৃথক ভাবে শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই বিশাল শব্দ শুনে বুঝলেন যে, অর্জুন জয়দ্রথবধ করে প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন।

*

ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা, দুর্যোধনের ভগিনী দুঃশলার স্বামী সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের জীবনাবসান ঘটল। জয়দ্রথের সঙ্গে পাঠকের পূর্ণ পরিচয় ঘটে বনপর্বে। শাল্ব রাজকন্যার স্বয়ংবর সভায় যাত্রাকালে তিনি আশ্রমে অরক্ষিতা দ্রৌপদীর রূপমুগ্ধ হয়ে তাঁকে বলপূর্বক অপহরণ করেছিলেন। আশ্রমে ফিরে পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীহরণ বৃত্তান্ত শ্রবণ করেন ও জয়দ্রথের পশ্চাদধাবন করেন। জয়দ্রথ ভীমার্জুনের হাতে ধরা পড়েন। ভীম তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে মাতা ‘গান্ধারী ও ভগিনী দুঃশলার’ কথা স্মরণ করে যুধিষ্ঠির তাঁর প্রাণভিক্ষা দেন। ভীম অর্ধচন্দ্র বাণে যত্রতত্র জয়দ্রথের মাথার কেশ কর্তন করে ছেড়ে দেন। লাঞ্ছিত, অপমানিত জয়দ্রথ দীর্ঘকাল মহাদেবের তপস্যা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি মহাদেবের আশীর্বাদ লাভ করেন যে অর্জুন ব্যতীত অপর পাণ্ডবদের তিনি একদিন যুদ্ধে বারণ করতে পারবেন। দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করে যুধিষ্ঠিরকে ধরতে এলে, অর্জুনের আত্মস্বরূপ অভিমন্যু অনায়াসে চক্রব্যূহ ভেদ করে ভিতরে চলে যান। ব্যূহমুখ রক্ষা করছিলেন জয়দ্ৰথ। মহাদেবের আশীর্বাদ সত্য করে জয়দ্রথ অন্য সব পাণ্ডব ও পাণ্ডবপক্ষীয় রথীদের আটকে রাখেন। ব্যূহের মধ্যে সপ্তরথীবেষ্টিত অভিমন্যু নিহত হন। সন্ধ্যাকালে অন্যত্র যুদ্ধরত অর্জুন ফিরে এসে অভিমন্যুবধের ঘটনা জেনে প্রতিজ্ঞা করেন, আগামীকাল সূর্যাস্তের পূর্বে জয়দ্রথ বধ করবেন। অর্জুন প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন। দ্রোণের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় জয়দ্রথের মৃত্যুতে।

জয়দ্রথ বধের জন্য যাত্রা করা থেকে আরম্ভ করে জয়দ্রথ বধ পর্যন্ত পড়তে পড়তে মনে হয়, তিরধনুক হাতে অর্জুনের কোনও অসাধ্য নেই। ভাল মন্দ যাই হোক, ভূরিশ্রবার দক্ষিণ বাহু ছেদন করে তিনি সাত্যকিকে বাঁচালেন, পথিমধ্যে অশ্বদের বিশ্রাম দেবার জন্য জলাশয় রচনা করলেন, বিশ্রাম করার ঘর তৈরি করে ছিলেন। একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ ছয় কুরুরথীকে কৃপ, শল্য, অশ্বত্থামা, কর্ণ, দুর্যোধন, বৃষসেন—পরাজিত করে জয়দ্রথ বধ করলেন। কৃষ্ণের মুখে ভবিতব্য জেনে জয়দ্রথের মস্তক আকাশপথে উড়িয়ে নিয়ে চললেন সমন্তপঞ্চকের বাইরে— তপস্যারত জয়দ্রথের পিতা বৃদ্ধক্ষত্রের কোলের উপর নিয়ে ফেললেন জয়দ্রথের মস্তক।

আর কৃষ্ণ! জয়দ্রথ বধের ঘটনা আবার প্রমাণ করল, কৃষ্ণ ঈশ্বর স্বয়ং। তিনি সব কিছুই জানেন— সকলের জন্ম-মৃত্যু তাঁর নখদর্পণে। সখা অর্জুনের প্রয়োজনে তিনি অন্ধকার সৃষ্টি করে সুর্যকে ঢাকা দিলেন। প্রতিটি পর্যায়ে তিনি অর্জুনকে যথোচিত পরামর্শ দিয়েছেন। আর একথাও বলতে হবে, অর্জুন ঈশ্বরের পরামর্শ পাবার উপযুক্ত রথীই।

ততঃ সর্বাণি সৈন্যানি বিস্ময়ং জগ্মুরুত্তমম্।

বাসুদেবশ্চ বীভৎসুং প্রশশংস মহারথম্ ॥ দ্রোণ: ১২৭: ৭৮ ॥

“সৈন্যরা অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হল। এদিকে কৃষ্ণও মহারথ অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগলেন।”

৭৩
ঘটোৎকচ-বধ

চতুর্দশ দিনের যুদ্ধে সূর্যাস্তের ঈষৎ পূর্বে অর্জুন জয়দ্রথ বধ করলেন। সে রাত্রিতে কর্ণ ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। পাণ্ডবসৈন্য ভয়ে পালাতে লাগল। তখন অর্জুন কৃষ্ণকে কর্ণের দিকে রথ চালাতে বললেন। কৃষ্ণ বললেন, “কুন্তীনন্দন, নরশ্রেষ্ঠ ও অলৌকিক বিক্রমশালী কর্ণ দেবরাজের মতো যুদ্ধে বিচরণ করছে। তুমি বা রাক্ষস ঘটোৎকচ ছাড়া এ সময়ে কর্ণের সম্মুখে যাবার মতো কোনও বীর আমি দেখি না। কিন্তু এখন আমি কর্ণের সঙ্গে তোমার সম্মেলন সংগত মনে করি না। কারণ উজ্জ্বল ও বিশাল শক্তিটা দেবরাজ ইন্দ্র যা কর্ণকে দান করেছিলেন, তা ওর কাছে রয়েছে। তোমাকে বধ করার জন্য কর্ণ সেটি সর্বদা সঙ্গে রাখেন। অতএব মহাবল ঘটোৎকচ এখন কর্ণের অভিমুখে গমন করুক। কারণ ঘটোৎকচ বলবান ভীমসেনের পুত্র এবং দেবতার তুল্য পরাক্রমশালী; বিশেষত তার কাছে দেবতা, রাক্ষস ও অসুরগণের সমস্ত অস্ত্রই রয়েছে। আর ঘটোৎকচ সর্বদাই তোমাদের হিতৈষী ও অনুরক্ত। সুতরাং সে যুদ্ধে কর্ণকে জয় করবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।” এই বলে কৃষ্ণ ঘটোৎকচকে আহ্বান করলেন।

কবচ, ধনু, বাণ ও তরবারি ধারণ করে এসে ঘটোৎকচ কৃষ্ণ ও অর্জুনকে অভিবাদন করে কৃষ্ণকে বললেন, “আমাকে কী করতে হবে আদেশ করুন।”তখন কৃষ্ণ হাসতে হাসতে যেন সেই মেঘের তুল্য নীলবর্ণ, উজ্জ্বলমুখ ও উজ্জ্বলকুণ্ডলধারী ঘটোৎকচকে বলতে লাগলেন, “পুত্র ঘটোৎকচ, তোমাকে যা বলি, তা শ্রবণ করো। অন্য কারও নয়—তোমারই এই বিক্রম প্রকাশের সময় উপস্থিত হয়েছে।”

স ভবান্ মজ্জমানানাং বন্ধুনাং ত্বং প্লবো ভব।

বিবিধানি তবস্ত্রাণি সন্তি মায়া চ রাক্ষসী ॥ দ্রোণ: ১৫০: ৪২ ॥

“তোমার বন্ধুগণ বিপদসাগরে মগ্ন হয়েছেন। সুতরাং তুমি তাঁদের নৌকা হও। তোমার কাছে নানাবিধ অস্ত্র ও রাক্ষসী মায়া রয়েছে।”

“ঘটোৎকচ দেখো গো-পালকগণ যেমন গোরু পীড়ন করে, সেইরকম কর্ণ সমরাঙ্গনে পাণ্ডবসৈন্য পীড়ন করছেন। মহাধনুর্ধর, বুদ্ধিমান ও দৃঢ়বিক্রমশালী কর্ণ এই পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠগণকে সংহার করছেন। কর্ণ বিশাল শরবর্ষণ করছেন। তাঁর শরতেজে পীড়িত হয়ে পাণ্ডবসৈন্যেরা রণস্থলে থাকতেই পারছে না। এই অর্ধরাত্র সময়ে পাঞ্চালেরা কর্ণের শরবর্ষণে পীড়িত হয়ে সিংহের ভয়ে হরিণের মতো এইভাবে পলায়ন করছে। কর্ণ যুদ্ধে প্রবল হয়ে উঠেছেন। তুমি ছাড়া আর কেউ তাঁকে থামাতে পারবে না। তুমি এখন নিজের, মাতুলগণের, পিতৃপক্ষের, দৈহিকবলের ও অস্ত্রবলের অনুরূপ কার্য করো। ‘কে কীভাবে আমাদের দুঃখ থেকে নিস্তার করবে’ এই ভেবেই মানুষ পুত্র কামনা করে। সুতরাং তুমি সেই বন্ধুদের দুঃখ থেকে উদ্ধার করো। ভীমনন্দন, তুমি যখন রণস্থলে যুদ্ধ করতে থাকো, তখন তোমার অস্ত্রবল ভীষণ হয় এবং মায়াও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এই রাত্রিতে পাণ্ডবসৈন্যেরা কর্ণের বাণে ভগ্ন হয়ে কৌরবসৈন্যসাগরে মগ্ন হচ্ছে; তুমি তাদের অবলম্বন হও। দেখো, অমিতবিক্রমশালী রাক্ষসেরা রাত্রিতে আরও বলবান, অতিদুর্ধর্ষ, বীর ও বিক্ৰমচারী হয়ে থাকে। অতএব ঘটোৎকচ, তুমি এই রাত্রিতে যুদ্ধে মায়া করে মহাধনুর্ধর কর্ণকে বধ করো, আর পাণ্ডবেরা ধৃষ্টদ্যুম্নকে অগ্রবর্তী করে দ্রোণকে বধ করবেন।”

কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন শত্রুদমনকারী রাক্ষস ঘটোৎকচকে বললেন, “ঘটোৎকচ তুমি, দীর্ঘবাহু সাত্যকি এবং পাণ্ডব ভীমসেন এই তিনজনকেই আমি সমস্ত পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে মহাবীর বলে মনে করি। অতএব যাও, কর্ণের সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ করো। মহাবীর সাত্যকি তোমার পৃষ্ঠরক্ষক হবেন। পূর্বকালে কার্তিককে সহায়কারী নিয়ে ইন্দ্রের তারকাসুর বধের মতো, যুদ্ধে বীর কর্ণকে বধ করো।”

ঘটোৎকচ বলল, “সজ্জনশ্রেষ্ঠদ্বয়! আমি একাই কর্ণ, দ্রোণ এবং অন্যান্য শিক্ষিতাস্ত্র বলশালী ক্ষত্রিয়দের জয় করতে সমর্থ। আজ রাত্রে আমি কর্ণের সঙ্গে যেরূপ যুদ্ধ করব, যতকাল পৃথিবী থাকবে, ততকাল লোকে সেই যুদ্ধের কথা স্মরণ করবে। সেই যুদ্ধে আমি রাক্ষসধর্ম অবলম্বন করে শরণাগত বীর, ভীত বা কৃতাঞ্জলি এদের কাউকে ছাড়ব না, সকলকেই বধ করব।” মহাবাহু ও বিপক্ষবীরহন্তা ঘটোৎকচ এই বলে কৌরবসৈন্যের ভয় উৎপাদন করে তুমুল যুদ্ধে কর্ণের দিকে ধাবিত হল। ঘটোৎকচ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উজ্জ্বলমুখের সাপের মতো আসতে লাগলে, কর্ণ বাণক্ষেপ করে তাঁকে গ্রহণ করলেন। তারপর সমরাঙ্গনে ইন্দ্র ও প্রহ্লাদের মতো গর্জনকারী কর্ণ ও ঘটোৎকচের দারুণ যুদ্ধ হতে লাগল।

ঘটোৎকচ যুদ্ধে কর্ণকে বধ করতে আসছে দেখে দুর্যোধন দুঃশাসনকে বললেন, “মহারথ রাক্ষসটা যুদ্ধে কর্ণের বিক্রম দেখে দ্রুত তাঁর দিকে আসছে। তুমি ওকে বারণ করো। কর্ণ যেখানে রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আছেন, তুমি বিশাল সৈন্য নিয়ে সেইখানে যাও। তুমি সৈন্যগণে পরিবেষ্টিত হয়ে বিশেষ যত্ন সহকারে কর্ণকে রক্ষা করো। ভীষণ রাক্ষসটা যেন অনবধানতাবশত কর্ণকে বধ না করে।”

ঘটোৎকচ দেখতে বড় সাংঘাতিক ছিল। তার নয়নযুগল রক্তবর্ণ, দেহ দীর্ঘ, মুখ তাম্রবর্ণ, উদর গভীর, লোমগুলি উঁচু উঁচু, দাড়ি পিঙ্গলবর্ণ, কান দু’খানা পেরেকের মতো সরু, ওষ্ঠের নিম্নভাগ বিশাল, মুখের ফাঁক কান পর্যন্ত। দন্ত সকল তীক্ষ, অঙ্গগুলি ভীষণ, জিহ্বা ও ওষ্ঠ অতিদীর্ঘ ও তাম্রবর্ণ, ভ্রূযুগল দীর্ঘ, নাসিকা স্থূল, অঙ্গ সকল নীলবর্ণ কিন্তু গ্রীবা রক্তবর্ণ, শরীর পর্বতের ন্যায় দৃঢ়, মস্তক বৃহৎ, আকৃতি বিকৃত, দেহের স্পর্শ কঠিন, মস্তকের উপর কেশগুচ্ছ বিকটভাবে বদ্ধ, নিতম্বদ্বয় স্থূল, নাভি ক্ষুদ্র, দেহের শিরাগুলি শিথিল, হাতে বলয় ও বাহুতে কেয়ূর ছিল। মহাদেহ, মহাবাহু, মহাবল এবং মহামায়াশালী ভয়ংকর মূর্তি ঘটোৎকচ পর্বত যেমন মধ্যদেশে অগ্নিমালা ধারণ করে, সেইরকম বক্ষে স্বর্ণমালা ধারণ করেছিল। স্বর্ণময়, বিচিত্র, বহুরূপ অবয়বে শোভিত এবং তোরণের মতো বক্র একখানি শুভ্রবর্ণ মুকুট তার মাথায় শোভা পাচ্ছিল। ঘটোৎকচ কানে দুটি নবোদিত সূর্যের মতো রক্তল্লাল কুণ্ডল, কন্ঠে সুন্দর স্বর্ণময়ী মালা এবং দেহে বিশাল ও বিশেষ উজ্জ্বল একটি কাঁসার বর্ম ধারণ করেছিল।

ঘটোৎকচ একটি বিশাল রথে আরোহণ করেছিল; তার চারদিকে চারশো হাত পরিমাণ ছিল, তাতে শত শত কিঙ্কিণীর শব্দ হচ্ছিল, রক্তবর্ণের পতাকা ঝুলছিল রক্তবর্ণ ধ্বজে, তার সকল দিক ভল্লুকের চর্মে বেষ্টিত ছিল, অসংখ্য বাণ তার ভিতরে রাখা ছিল, বিশাল ধ্বজ প্রকাশ পাচ্ছিল, আটটি চক্র ঘুরছিল এবং তাতে মেঘের মতো গম্ভীর শব্দ হচ্ছিল। বলবান, শ্রমশূন্য, ভীষণাকৃতি ও অনবরত হ্রেষারকারী একশো অশ্ব সেই রথে ভীষণমূর্তি ঘটোৎকচকে বহন করছিল; সে অশ্বগুলির আকৃতি মত্ত হস্তীর মতে, নয়নগুলি রক্তবর্ম, দেহের বর্ণ কালো, গ্রীবার উপর লোমগুলি সুন্দর এবং মাথার উপরে বিশাল বিশাল জটা ছিল।

উজ্জ্বল মুখ ও উজ্জ্বল কুণ্ডলধারী বিরূপাক্ষ নামক এক রাক্ষস সারথি সূর্যকিরণের ন্যায় দীপ্তিশালী অশ্বমুখ রজ্জু ধারণ করেছিল। সূর্যের সারথি যেমন অরুণ, তেমনই ঘটোৎকচ সেই সারথির সঙ্গে রথে অবস্থান করছিল এবং বিশাল পর্বত যেমন মহামেঘের সঙ্গে মিলিত, সেইরকম ঘটোৎকচ সেই সারথির সঙ্গে মিলিত ছিল। ঘটোৎকচের রথে একটি গগনস্পর্শী অতিবিশাল ধ্বজ উত্তোলিত ছিল, তার উপর একটা রক্তবর্ণ মস্তক ও মাংসভোজী অতিভীষণ গৃধ্রপক্ষী বসেছিল।

এই রথে আরোহণ করে ঘটোৎকচ ধনু আকর্ষণ করতে করতে বাণসমূহে সকলদিক আবৃত করে সেই বীরনাশকারী রাত্রিতে কর্ণের দিকে ধাবিত হলেন। ঘটোৎকচ যখন ধনু আকর্ষণ করছিল তখন বজ্রের শব্দের মতো সেই ধনুর শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কৌরবসৈন্য ভীত হয়ে পালাতে লাগল। বিকৃত নয়ন ও ভীষণ মূর্তি সেই ঘটোৎকচকে আসতে দেখে, কর্ণ ঈষৎ হেসে বাণক্ষেপ করতে করতে ঘটোৎকচের দিকে ধাবিত হলেন। তখন ইন্দ্র আর শম্বরাসুরের মতো কর্ণ ও ঘটোৎকচের তুমুল যুদ্ধ হতে লাগল। তাঁরা তীব্র শরক্ষেপে পরস্পরকে আবৃত করে ফেললেন। ক্রমে তাঁদের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল এবং রক্তের প্রবাহে সিক্ত হতে থাকল। তথাপি তাঁরা পরস্পরকে বিচলিত করতে পারলেন না। তখন কর্ণ ও ঘটোৎকচ যেন পরস্পর প্রাণদ্বারা খেলা করছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁদের সেই রাত্রিযুদ্ধ দীর্ঘকাল যেন সমানভাবেই চলল।

অস্ত্রজ্ঞ শ্রেষ্ঠ কর্ণ যখন ঘটোৎকচকে অতিক্রম করতে পারলেন না, তখন তিনি এক অলৌকিক অস্ত্র আবিষ্কার করলেন। কর্ণ অলৌকিক অস্ত্র আবিষ্কার করেছেন দেখে পাণ্ডবনন্দন ঘটোৎকচও মহামায়া আবিষ্কার করলেন। তখন শূল, মুগুর, পাথর ও বৃক্ষধারী বিশাল রাক্ষসসৈন্য ঘটোৎকচকে পরিবেষ্টন করল। ক্রমে ঘটোৎকচ মহাধনু তুলে ভীষণ কালদণ্ডধারী যমের মতো আসছে দেখে কুরুপক্ষীয় রাজারা ভীত হয়ে পড়লেন। ঘটোৎকচের সিংহনাদে হস্তী সকল মলমূত্র ত্যাগ করতে থাকল, মানুষ ভীষণ ভীত হল। সেই অর্ধরাত্রে রাক্ষসগণ নিক্ষিপ্ত অতিভীষণ শিলাবৃষ্টি সকল দিকে পতিত হতে লাগল। লৌহচক্র, ভুশুণ্ডি, শক্তি, তোমর, শূল, শতঘ্নী ও পট্টিশ ক্রমাগত পতিত হতে লাগল। অস্ত্রবলশ্লাঘী ও অভিমানী একমাত্র কর্ণ ছাড়া ধার্তরাষ্ট্রগণ ও অন্য যোদ্ধারা যুদ্ধ থেকে অপসরণ করতে থাকল। কর্ণ বাণ দ্বারা ঘটোৎকচের মায়া বিনষ্ট করলেন। মায়া বিনষ্ট হলে ক্ষিপ্ত ঘটোৎকচ ভয়ংকর বাণ নিক্ষেপ করতে লাগল এবং সেগুলি কর্ণের দেহ ভেদ করে রক্তাক্ত ক্রুদ্ধ সর্পের মতো ভূতলে প্রবেশ করতে লাগল।

লঘুহস্ত ও প্রতাপশালী কর্ণ তখন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দশটি বাণ দ্বারা ঘটোৎকচকে বিদারণ করলেন। ভীমসেন-নন্দন ঘটোৎকচ সেই সকল বাণের আঘাতে অতিশয় ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণকে বধ করার জন্য একটি অলৌকিক ক্ষুরধার, নবোদিত সূর্যের মতো উজ্জ্বল চক্র কর্ণের উপর নিক্ষেপ করল। কিন্তু কর্ণের বাণে খণ্ডিত ও ব্যর্থ চক্রটি ভূতলে পড়ল। তখন ঘটোৎকচ রাহু যেমন সূর্যকে আবৃত করে, তেমনই বাণ দ্বারা কর্ণকে আবৃত করে ফেললেন। কর্ণ অবিচলিত থেকে বাণ দ্বারা ঘটোৎকচের রথখানাই আবৃত করে ফেললেন। ক্রুদ্ধ ঘটোৎকচ স্বর্ণভূষিত একটি গদা কর্ণের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। কর্ণের বাণে সেটিও প্রতিহত হয়ে পতিত হল। তখন বিশালদেহ ঘটোৎকচ আকাশে উঠে বড় বড় বৃক্ষ ছুড়ে মারতে লাগলেন। তখন কর্ণ বাণ দ্বারা আকাশেই ঘটোৎকচের দেহ বিদ্ধ করতে থাকলেন এবং ঘটোৎকচের সমস্ত অশ্ব বধ করে রথখানাকে শতখণ্ডে ছেদন করলেন। তখন ঘটোৎকচের শরীরের দুই আঙুল স্থানও অবিদীর্ণ অবস্থায় থাকল না, তাকে কণ্টকপূর্ণ শজারুর মতো দেখাতে লাগল। তখন ঘটোৎকচ মায়া ধারণ করে আকাশে অদৃশ্য থেকে কর্ণের উপর বাণবর্ষণ শুরু করল। তারপর ঘটোৎকচ মায়ার প্রভাবে বিবিধরূপ বহুতর মুখ আবিষ্কার করে কর্ণের বাণ সকল গ্রাস করতে লাগল। আবার দেখা গেল— বিশালদেহ ঘটোৎকচ কর্ণের বাণে শতধা বিদীর্ণ, দুর্বল ও নিরুৎসাহ হয়ে আকাশ থেকে পতিত হল। ঘটোৎকচ নিহত মনে করে কৌরবেরা আনন্দে কোলাহল করতে লাগলেন। তখন দেখা গেল ঘটোৎকচ নূতন শরীরে বিশাল দেহ, শতমস্তক, শতোদর ও বিশাল বাহু হয়ে মৈনাক পর্বতের মতো বিচরণ করছে। পুনরায় ক্ষণকাল মধ্যে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ হয়ে সমুদ্র তরঙ্গের মতো উঠে পার্শ্বে ও উপরে থাকতে লাগল। ভূমি বিদীর্ণ করে জলে পতিত হল, পুনরায় সেই জলের অন্যদিকে গিয়ে মাথা তুলল। আবার মায়ার প্রভাবে যুদ্ধ-সজ্জায় সজ্জিত হয়ে আকাশে উঠে, আবার নেমে ভূমি, গগন ও সকল দিকে বিচরণ করে মায়া-কল্পিত স্বর্ণভূষিতরথে গিয়ে অবস্থান করল। তারপরে অবিচলিতভাবে কর্ণের রথের কাছে গিয়ে, কানের কুণ্ডল দুলিয়ে কর্ণকে বলল, “সূতপুত্র, থাক, জীবিত অবস্থায় আমার কাছ থেকে কোথায় যাবে; আজ আমি তোমার যুদ্ধের সাধ চিরকালের জন্য মিটিয়ে দেব।” ক্রোধে আরক্ত নয়ন ঘটোৎকচ আকাশে উঠে উচ্চহাস্য করতে করতে সিংহ যেমন হস্তীকে আঘাত করে, তেমনই কর্ণকে আঘাত করতে থাকল। কর্ণ দূর থেকে সেই বাণসৃষ্টি নিবারণ করতে থাকলেন। তখন ঘটোৎকচ অন্যপ্রকার মায়া সৃষ্টি করল। সে বৃক্ষসমাকীর্ণ ও বহুশৃঙ্গযুক্ত একটি বিশাল পর্বত হল; তা থেকে জলের মতো শূল, প্রাস, অসি ও মুষল পতিত হতে থাকল। তখন কর্ণ এক অলৌকিক অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন; সেই অস্ত্রের প্রভাবে সেই বিশাল পর্বত বিক্ষিপ্ত হয়ে বিনষ্ট হল। তখন ঘটোৎকচ আকাশে ইন্দ্রায়ুধযুক্ত একটি অতিভীষণ নীল মেঘ হয়ে কর্ণের উপরে প্রস্তর বর্ষণ করতে লাগল। কর্ণ বায়ব্য অস্ত্র সন্ধান করে সেই কালমেঘটাকে বিনষ্ট করলেন। তখন মহাবল ঘটোৎকচ সামান্য হেসে কর্ণের প্রতি সমরাঙ্গনে আর একপ্রকার মহামায়া আবিষ্কার করল। রথীশ্রেষ্ঠ ঘটোৎকচ রথারোহণ করে বহুতর রাক্ষসে পরিবেষ্টিত হয়ে অবিচলিতভাবে পুনরায় দেবগণ বেষ্টিত ইন্দ্রের মতো আসতে লাগল। তখন সিংহ ও বাঘের তুল্য বলবান, মত্তহস্তীর মতো বিক্রমশালী, হস্তী, অশ্ব ও রথারোহী, নানাবিধ শস্ত্রধারী, নানাপ্রকার কবচ ও অলংকারযুক্ত ক্রূর প্রকৃতির সেই রাক্ষসেরা দৃষ্টিগোচর হল। ক্রমে মহাধনুর্ধর কর্ণ তাদের দেখে দেখে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তারপর ঘটোৎকচ পাঁচটি লৌহময় বাণ দ্বারা কর্ণকে বিদ্ধ করে সমস্ত রাজার ভীতি উৎপাদন করে গর্জন করতে লাগল। তারপর ঘটোৎকচ দ্রুত একটি অঞ্জলিক বাণদ্বারা বাণ ও গুণের সঙ্গে কর্ণের হস্তস্থিত ধনু ছেদন করল। তখন কর্ণ অন্য একটি ধনু দিয়ে স্বর্ণমুখ, শত্রুনাশক ও আকাশচারী কতগুলি বাণ রাক্ষসগণের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। তখন স্থূলবক্ষ রাক্ষসগণ সেই বাণসমূহে পীড়িত হয়ে সিংহপীড়িত বন্য হস্তীগণের মতো বিহ্বল হয়ে পড়ল। পূর্বকালে স্বর্গে মহাদেব যেমন ত্রিপুরাসুরকে দগ্ধ করে শোভা পেয়েছিলেন, তেমনই কর্ণ রাক্ষসদের দগ্ধ করে শোভা পেতে লাগলেন। তখন যমের ন্যায় ভীষণ বলবীর্যসম্পন্ন, মহাপ্রভাবান্বিত ও রাক্ষসশ্রেষ্ঠ একমাত্র ঘটোৎকচ ছাড়া কোনও পাণ্ডবপক্ষীয় ব্যক্তিই কর্ণের দিকে দৃষ্টিপাত করতেও সমর্থ হলেন না।

তখন দুটি বড় মশাল থেকে অগ্নিশিখাযুক্ত তৈলবিন্দুর মতো ক্রুদ্ধ ঘটোৎকচের দুই চোখ থেকে আগুন বেরুতে লাগল। ক্রুদ্ধ ঘটোৎকচ করতল দ্বারা করতলে আঘাত ও দন্তদ্বারা ওষ্ঠদংশন করে হস্তীর তুল্য বৃহৎ ও পিশাচবদন গর্দভযুক্ত এবং মায়াকল্পিত রথে আরোহণপূর্বক নিজ সারথিকে বলল, “সারথি আমাকে কর্ণের দিকে নিয়ে চলো।” তখন ঘটোৎকচ ও কর্ণের মধ্যে ভয়ংকর দ্বৈরথ যুদ্ধ শুরু হল। ঘটোৎকচ কর্ণের প্রতি একটি রুদ্র নির্মিত অষ্টচক্র ও লৌহময় মহাভয়ংকর বজ্র নিক্ষেপ করল। তখন কর্ণ নিজের বিশাল ধনুখানা রথে রেখে রথ থেকে নেমে সেই বজ্রটা গ্রহণ করলেন এবং তা আবার ঘটোৎকচের উপরেই নিক্ষেপ করলেন। সেই বজ্রটাকে আগত দেখে ঘটোৎকচও রথ থেকে লাফিয়ে পড়ল। সেই মহাশক্তিশালী বজ্রটা গিয়ে ঘটোৎকচের অশ্ব, সারথি, ধ্বজের সঙ্গে রথখানাকেও বিনষ্ট করল। কর্ণ যেহেতু দেবনির্মিত মহাবজ্র ধরে ফেললেন, সেইহেতু সমস্ত প্রাণীই কর্ণের প্রশংসা করতে লাগল। কর্ণ দিব্য অস্ত্রসমূহ প্রয়োগ করতে থাকলে ঘটোৎকচ মায়াবলে সেই অস্ত্রগুলি প্রতিহত করলেন। তখন ঘটোৎকচ আপনাকে সিংহ, ব্যাঘ্র, চিত্ৰব্যাঘ্র, অগ্নিজিহ্ব সর্প, লৌহচঞ্চু পক্ষী প্রভৃতির রূপ ধরে নানাদিক থেকে কর্ণকে আঘাত করতে এল। কর্ণ সেগুলি সংহার করতে থাকলে, ঘটোৎকচ ঐন্দ্রজালিক নগর, পর্বত, বনের ন্যায় আবারও সেইখানেই অন্তর্হিত হতে থাকল। তারপর বিকৃতমুখ বহুতর ক্ষুদ্র রাক্ষস, বৃহৎ রাক্ষস, পিশাচ, কুকুর ও কেঁদুয়া বাঘ আবির্ভূত হল। সেই রাক্ষস ও পিশাচেরা উগ্র বাক্য এবং রক্তসিক্ত ও ভয়ংকর বহুতর উত্তোলিত অস্ত্র দ্বারা কর্ণকে ত্রস্ত করে তুলল। কর্ণ দিব্য অস্ত্র দ্বারা সেই মায়াবী রাক্ষসদের বিনাশ করলেন এবং ঘটোৎকচের অশ্বগুলি বধ করতে লাগলেন। অশ্বগুলি কর্ণের বাণে ভগ্নাঙ্গ, বিক্ষতাঙ্গ ও বিদীর্ণপৃষ্ঠ হয়ে ঘটোৎকচের সামনেই পতিত হতে লাগল। সে মায়াও বিনষ্ট হলে ‘এই তোমার মৃত্যুবিধান করছি’ বলে ঘটোৎকচ অন্তর্হিত হলেন।

অলায়ুধ নামে এক রাক্ষস দুর্যোধনের কাছে এসে বলল, “মহারাজ হিড়িম্ব, বক ও কির্মীর আমার বন্ধু ছিলেন। ভীম তাদের বধ করেছে, কন্যা হিড়িম্বাকে ধর্ষণ করেছে। আমি আজ কৃষ্ণ ও পাণ্ডবগণকে সসৈন্যে হত্যা করব এবং ভক্ষণ করব।” দুর্যোধনের অনুমতি পেয়ে অলায়ুধ ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করল। ওদিকে রাত্রিতে মহাভয়ংকর ও ভীষণদর্শন কর্ণ ও ঘটোৎকচের অমানুষিক যুদ্ধ চলছিল। দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও কৃপ প্রভৃতি কুরুপক্ষীয় বীরেরা সমরাঙ্গনে ঘটোৎকচের অসাধারণ কার্যকলাপ দেখে বিচলিত হয়ে বলতে লাগলেন যে, এ কৌরবসৈন্য আর থাকল না। সমস্ত কৌরবসৈন্য উদ্বিগ্ন ও অচেতনপ্রায় হয়ে পড়ল, হাহাকার করতে লাগল এবং কর্ণের জীবনের প্রতি নিরাশ হয়ে পড়ল। দুর্যোধন কর্ণকে অত্যন্ত পীড়িত দেখে রাক্ষসশ্রেষ্ঠ অলায়ুধকে আহ্বান করে বললেন, “পাপাত্মা ঘটোৎকচ হয়তো মায়াবল অবলম্বন করে পরে কর্ণকে বশীভূত করতে পারে। আপনি বিক্রম প্রকাশ করে ঘটোৎকচকে বধ করুন।” দুর্যোধনের আদেশ অনুসারে অলায়ুধ ঘটোৎকচের দিকে ধাবিত হল। অল্পক্ষণ ভয়ংকর যুদ্ধের পর ঘটোৎকচ অলায়ুধের মুণ্ড কেটে দুর্যোধনের দিকে নিক্ষেপ করলেন। ঘটোৎকচের মায়াসৃষ্ট রাক্ষসেরা অগণিত সৈন্য বধ করতে লাগল। রাজা দুর্যোধন সৈন্যগণের সঙ্গে অলায়ুধকে নিহত দেখে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন। কারণ, অলায়ুধ ভীমের সঙ্গে গুরুতর শত্রুতার বিষয়ে স্মরণ করে নিজেই এসে দুর্যোধনের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল, “আমি যুদ্ধে ভীমকে বধ করব।” দুর্যোধন বিশ্বাস করেছিলেন যে, নিশ্চয়ই অলায়ুধ ভীমকে বধ করবে। তিনি আরও ধারণা করেছিলেন, “ভীম না থাকায় আমার ভ্রাতারা দীর্ঘকাল জীবিত থাকবে।” কিন্তু ঘটোৎকচ সেই অলায়ুধকে বধ করল দেখে দুর্যোধন মনে করলেন, “ভীমের প্রতিজ্ঞা পূর্ণই হবে।”

ওদিকে ঘটোৎকচ অলায়ুধের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে, কর্ণ পাঞ্চালগণের দিকে ধাবিত হলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, যুধামন্যু, উত্তমৌজা ও মহারথ সাত্যকি কর্ণকে থামাতে পারলেন না। অকল্পনীয় এবং অদ্ভুত অস্ত্রবর্ষণ করে কর্ণ পাঞ্চাল সৈন্যদের সংহার করতে লাগলেন। তখন সেই সৈন্যগণ অত্যন্ত ভীত হয়ে যুধিষ্ঠিরের সৈন্যমধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল। সৈন্যদের ভগ্ন ও পরাঙ্মুখ দেখে ঘটোৎকচ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সিংহগর্জন করতে করতে কর্ণের সম্মুখে গিয়ে বজ্রতুল্য বাণসমূহ দ্বারা তাঁকে বিদ্ধ করতে লাগল। অসাধারণ প্রভাবশালী কর্ণ ও ঘটোৎকচ পরস্পরকে জয় করার জন্য মনোযোগী হয়ে উত্তম উত্তম অস্ত্রদ্বারা পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন। তখন সেই যুদ্ধে কোনও ব্যক্তি সেই বীরশ্রেষ্ঠ দুজনের তারতম্য দেখতে পেল না। অস্ত্রজ্ঞশ্রেষ্ঠ কর্ণ যখন কিছুতেই ঘটোৎকচকে পরাজিত করতে পারলেন না, তখন তিনি একটি ভীষণ অস্ত্র আবিষ্কার করলেন। সেই অস্ত্র দ্বারা তিনি ঘটোৎকচের রথ, অশ্ব ও সারথিকে বিনাশ করলেন। তখন ঘটোৎকচ সত্বর অন্তর্হিত হল। ঘটোৎকচ অদৃশ্য হল দেখে কৌরবপক্ষীয়গণ ভীষণ ভীত হয়ে পড়লেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, “কূটযোধী এই রাক্ষসটা অদৃশ্য থেকে কর্ণকে বধ না করে।” একথা শুনে কর্ণ দ্রুত বাণক্ষেপ করে চারপাশ আবৃত করে ফেললেন। আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর রক্তবর্ণ মেঘের মতো প্রকাশিত এবং অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল ঘটোৎকচ দারুণ মায়া সৃষ্টি করল। সেই মায়াতে বিদ্যুৎ ও উজ্জ্বল উল্কা সকল আবির্ভূত হতে লাগল। সহস্র সহস্ৰ দুন্দুভির অতিভীষণ শব্দে আকাশ পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তারপর স্বর্ণপুঙ্খ বাণ, শক্তি, ঋষ্টি, প্ৰাস মুসল প্রভৃতি অস্ত্র আকাশ থেকে পতিত হতে লাগল। কিরণযুক্ত লৌহবদ্ধ পরিঘ, বিচিত্র গদা, তীক্ষ্ণ শূল এবং শতঘ্নীসকল সমস্ত দিকে পতিত হতে লাগল। শক্তি, পাষাণ, পরশু, তরবারি, বজ্র ও বিদ্যুৎ ও মুগুরের বৃষ্টি হতে লাগল, কর্ণ বাণসমূহ দ্বারা সে বৃষ্টি নিবারণ করতে পারলেন না। ঘটোৎকচ নানাবিধ অস্ত্র দ্বারা আঘাত করলে দুর্যোধনের সেই সৈন্যকে পীড়িত, পরাজিত, ঘূর্ণিত, হাহাকারী, পলায়মান, লুক্কায়িত ও অবসন্ন হতে দেখা গেল। সৈন্যসমূহের সেই দারুণ দশা দেখে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের গুরুতর ভয় দেখা দিল। কৌরবযোদ্ধারা সকলেই পরাজিত হয়ে এই কথা বলতে বলতে পালাতে লাগলেন, “কৌরবগণ আপনারা পলায়ন করুন, এ সৈন্য আর থাকল না। কারণ, ইন্দ্রের সঙ্গে দেবতারাও পাণ্ডবদের হয়ে আমাদের বধ করছেন।” নিয়মশূন্য সেই ভীষণ যুদ্ধে কৌরবেরা সকল দিক শূন্য দেখতে লাগলেন। একা কর্ণই কেবল বক্ষে সেই অস্ত্রবৃষ্টি ধারণ করতে থাকলেন। কর্ণ ঘটোৎকচকে বধ করতে না পেরে ঘটোৎকচের মায়া নিবারণের সমস্ত চেষ্টা করলেন, কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। তখন ঘটোৎকচ নিক্ষিপ্ত চক্রযুক্ত একটা শতঘ্নী এসে একসঙ্গে কর্ণের চারটি অশ্বকে বধ করল। কর্ণের সকল অস্ত্র ঘটোৎকচ প্রতিহত করল। কর্ণ আকুলচিত্ত হয়ে রথ থেকে নেমে চিন্তা করতে থাকলেন, আর কী কাজ করবেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না, আবার যুদ্ধ থেকে সরে আসতেও পারলেন না।

তখন কৌরবেরা সকলে ঘটোৎকচের সেই সাংঘাতিক মায়া দেখে কর্ণকে বললেন, “কর্ণ আপনি এখনই দ্রুত সেই শক্তি দ্বারা ঘটোৎকচকে বিনাশ করুন কারণ ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণ বিনষ্ট হতে বসেছেন। ভীম ও অর্জুন আমাদের কী করবে? কিন্তু রাত্রিকালে সন্তাপকারী এই পাপাত্মাকে বধ করুন। আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আজকের ভীষণ যুদ্ধ থেকে জীবিত থাকবে, সেই ব্যক্তিই সৈন্যদের সঙ্গে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। অতএব কর্ণ, আপনি ইন্দ্রদত্ত সেই শক্তি দ্বারা এই ভীষণ রাক্ষসটাকে বধ করুন। ইন্দ্রতুল্য কৌরবেরা এই রাত্রিযুদ্ধে সকলেই যেন বিনাশ লাভ না করেন।” অত্যন্ত অসহিষ্ণু স্বভাব কর্ণ কৌরবদের অবস্থা দেখে ঘটোৎকচের আঘাত আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ঘটোৎকচকে বধ করবার ইচ্ছা করে ইন্দ্রদত্ত সেই অসহ্য বৈজয়ন্তীনাম্নী একাঘ্নী শক্তি গ্রহণ করলেন। নিজের কুণ্ডল দুটি দিয়ে ইন্দ্রের কাছ থেকে যে শক্তি কর্ণ পেয়েছিলেন এবং অর্জুনকে বধ করবার জন্য যা যত্ন করে আপন তূণে রেখেছিলেন, প্রতিদিন যে অস্ত্রের প্রয়োগ যথাসময়ে করবার জন্য তিনি পূজা করতেন; সেই যমের জিহ্বার মতো লেলিহানা, উজ্জ্বলা, পাশযুক্তা, যমের ভগিনীর তুল্যা এবং প্রজ্বলিত উল্কার সদৃশী সেই শক্তিটাকে কর্ণ ঘটোৎকচের উপরে নিক্ষেপ করলেন।

ঘটোৎকচ কর্ণের হস্তস্থিতা, উজ্জ্বলা, পরদেহ বিদারিণী সেই উত্তম শক্তিটা দেখে ভীত হয়ে নিজের শরীরটা বিন্ধ্যপর্বতের তুল্য বিরাট করে পিছনে অপসরণ করতে থাকলেন।

সা তাং মায়াং ভস্ম কৃত্বা জ্বলন্তী ভিত্ত্বা গাঢ়ং হৃদয়ং রাক্ষসস্য।

ঊর্ধ্বং যযৌ দীপ্যমানা নিশায়াং নক্ষত্রাণামন্তরাশ্যাবিশন্তী ॥ দ্রোণ: ১৫৪: ৫৭ ॥

“ক্রমে উজ্জ্বলা ও তেজস্বিনী সেই শক্তিটা ঘটোৎকচের সমস্ত মায়া বিনাশ করে তার দৃঢ় বক্ষঃস্থল বিদারণ করে নক্ষত্রগণের মধ্য দিয়ে উপরের দিকে চলে গেল।”

মহাবীর ঘটোৎকচ এ যাবৎ স্বর্গীয়, মানুষীয়, রাক্ষসীয় নানাবিধ বিচিত্র অস্ত্রসমূহ দ্বারা যুদ্ধ করে বিবিধ ভীষণ গর্জন করতে করতে ইন্দ্রের শক্তির প্রভাবে প্রিয়তম প্রাণ পরিত্যাগ করল। কিন্তু মৃত্যুকালে সে আর একটা বিশেষ কাজ করল। সেই সময়ে সে-শক্তির আঘাতে বিদীর্ণহৃদয় হয়ে পর্বত ও মেঘের মতো বিশাল আকৃতি ধারণ করে প্রকাশ পেল। তারপর বিদীর্ণদেহ রাক্ষসশ্রেষ্ঠ ঘটোৎকচ বিশাল রূপ ধারণ করে প্রাণশূন্য, অধোমুখ, নিশ্চল শরীর ও মুখনির্গত জিহ্বা হয়ে আকাশ থেকে ভূতলে পড়ল এবং আপন শরীরের ভারে কৌরবসৈন্যের এক অংশ নিষ্পেষিত করল। আনন্দিত কৌরবগণ ভেরি, শঙ্খ, বাজাতে লাগলেন, সিংহনাদ করতে লাগলেন এবং ঘটোৎকচকে নিহত দেখে কর্ণের সম্মান করতে লাগল।

ঘটোৎকচকে নিহত দেখে পাণ্ডবেরা অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলেন। কিন্তু কৃষ্ণ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে সিংহনাদ করে অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন। এবং তিনি আবার বিশাল সিংহনাদ করে অশ্বরজ্জু সংহত করে ধরে বায়ু সঞ্চালিত বৃক্ষের মতো নৃত্য করতে লাগলেন। অর্জুন কৃষ্ণের আচরণে অত্যন্ত আশ্চর্যবোধ করে প্রশ্ন করলেন, “মধুসূদন ঘটোৎকচের মৃত্যুতে সমস্ত পাণ্ডব শোকার্ত, তবুও তোমাকে আমি অত্যন্ত আনন্দিত দেখছি। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি এর কারণ সত্য বলো।” কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন আমি এর অসাধারণ কারণ তোমাকে বলছি, শ্রবণ করো। ঘটোৎকচ দ্বারা কর্ণের ইন্দ্রপ্রদত্ত শক্তি ব্যয় করতে পারায় ভাবী যুদ্ধে কর্ণকে তুমি নিহত বলেই মনে করতে পারো। এ জগতে এমন পুরুষ নেই—যে যুদ্ধে কার্তিকের মতো শক্তিশালী কর্ণের সামনে দাঁড়াতে পারে। এখন ভাগ্যবশত কর্ণের অক্ষয় কবচ গিয়েছে, ভাগ্যবশত ইন্দ্র কর্ণের কুণ্ডল হরণ করেছেন এবং ভাগ্যবশত আজ আমরা ঘটোৎকচের উপর কর্ণের সেই অব্যর্থ শক্তি ব্যয় করাতে পেরেছি। কবচ-কুণ্ডলযুক্ত কর্ণ দেবগণের সঙ্গে ত্রিভুবন জয় করতে পারত। দেবরাজ ইন্দ্র, জলাধিপতি বরুণ, কিংবা যমও যুদ্ধে কর্ণের সামনে দাঁড়াতে পারতেন না। যে অবধি মহাত্মা ইন্দ্র কর্ণকে শক্তি দান করেছিলেন—যা নিক্ষিপ্ত হয়ে ঘটোৎকচের উপর ব্যয়িত হয়েছে এবং কর্ণ নিজের দুটি কুণ্ডল ও দিব্য কবচটির পরিবর্তে যা নিয়েছিল, তা প্রাপ্ত হওয়া অবধি কর্ণ সর্বদাই তোমাকে যুদ্ধে নিহত বলে মনে করত। নিস্পাপ অর্জুন, কর্ণ এখন অস্ত্রহীন, তবুও তুমি ছাড়া কেউ তাঁকে বধ করতে পারবে না। কর্ণ এখন সাধারণ মানুষ। তার উপরে তোমার সঙ্গে যুদ্ধের সময় তাঁর রথচক্র মেদিনী গ্রাস করবে। আমি তোমাকে সে সময়ে বলে দেব, তুমি কর্ণকে বধ করতে পারবে। অর্জুন তোমার জন্য আমি মহাবীর জরাসন্ধ, শিশুপাল এবং ব্যাধজাতীয় একলব্যকে বধ করেছি বা করিয়েছি। হিড়িম্ব, কির্মীর, বক, অলায়ুধ এবং ভীমকর্মা বলবান ঘটোৎকচও নিহত হয়েছে। কেন না কর্ণ, জরাসন্ধ, শিশুপাল, একলব্য দুর্যোধনের পক্ষে একত্রে যুদ্ধ করলে গোটা পৃথিবীটাই প্রকম্পিত হত। অর্জুন তুমি আমার প্রাণাপেক্ষা প্রিয়। প্রতি রাত্রে দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি ও কর্ণ প্রতিজ্ঞা করতেন তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করে তোমার উপর শক্তি প্রয়োগ করবেন। প্রতিদিন প্রভাতে আমি তাঁদের বিস্মরণ ঘটিয়ে দিতাম। এইজন্যই আমি রাত্রে যুদ্ধে ঘটোৎকচকে পাঠিয়েছিলাম। কারণ, অন্য কেউই রাত্রিযুদ্ধে কর্ণকে বারণ করতে পারত না।”

ঘটোৎকচের মৃত্যুতে যুধিষ্ঠির গভীর শোক পেয়েছিলেন। অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে তিনি স্মরণ করেছেন, সারাজীবন ঘটোৎকচ কীভাবে তাঁর সেবা করেছে। বনবাসের সময় ঘটোৎকচ নানা দুর্গম স্থান পার করে দিয়েছিলেন এবং দ্ৰৌপদীকে পৃষ্ঠে বহন করেছেন। অর্জুনের প্রত্যাগমন পর্যন্ত তিনি গন্ধমাদন পর্বতে পাণ্ডবদের সঙ্গে বাস করেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেও তিনি পাণ্ডবদের পরম উপকার করেছেন।

যুধিষ্ঠির এই প্রকার কাতর হয়ে নিজেই কর্ণবধের জন্য যুদ্ধযাত্রার স্থির করলেন। মহাঋষি ব্যাসদেব এসে তাঁকে নিবৃত্ত করলেন। বললেন যে, প্রাণীমাত্রেই মৃত্যুর অধীন। ঘটোৎকচ নিহত না হলে ইন্দ্রদত্ত শক্তিতে অর্জুনের মৃত্যু ঘটত। ব্যাসদেব ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, আজ থেকে পঞ্চম দিনে যুধিষ্ঠির পৃথিবীর রাজা হবেন।

*

ঘটোৎকচের মৃত্যু ঘটল। ভীষ্ম গণনার সময়ে বলেছিলেন, ঘটোৎকচ অতিরথ। বস্তুত মহাভারতে যতগুলি রাক্ষসের সন্ধান পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বলশালী ঘটোৎকচ। স্বয়ং ভীষ্ম ঘটোৎকচের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাননি। বলেছিলেন, “এই সন্ধ্যাবেলা সে সর্বাপেক্ষা বলশালী—এই সময়ে আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি না।”

মহাভারত পাঠ করে কৃষ্ণকে অলৌকিক রহস্যময় পুরুষ বলে মনে হয়। তিনি অসাধ্য সাধনে সমর্থ, কিন্তু কোথাও কোথাও তাঁর আচরণ কিছুটা বিকৃত মনে হয়। ঘটোৎকচের মৃত্যুর পরে রথের উপর তাঁর উদ্দাম নৃত্য আমাদের ব্যথাতুর করে তোলে। অর্জুন তাঁর প্রাণাপেক্ষা প্রিয়। সেই অর্জুনের সর্বাপেক্ষা বড় বিপদ কেটে যাওয়াতে তিনি আনন্দিত, আমরা তা বুঝতে পারি। কিন্তু ঘটোৎকচ সম্পর্কে কৃষ্ণের উক্তি, “কর্ণ যদি শক্তিদ্বারা মহাযুদ্ধে ঘটোৎকচকে বধ না করতেন, তবে আমিই তাকে বধ করতাম। কিন্তু তোমাদের প্রীতির জন্য আমি পূর্বে ওকে বধ করিনি। কারণ, এ রাক্ষসটাও ব্রাহ্মণদ্বেষী, যজ্ঞবিরোধী, ধর্মলোপী ও পাপাত্মা ছিল।” সমর্থন করার মতো কোনও ঘটনা আমরা দেখতে পাই না।

উপরন্তু ঘটোৎকচকে পাণ্ডব-সংসারের অন্তর্গত অকৃত্রিম শ্রদ্ধাশীল ও ভক্তরূপে দেখতে পাই। পাণ্ডব-গুরুজনদের যেমন অকৃত্রিম সেবা করেছে, তেমনই পাণ্ডবভ্রাতাদের সম্পর্কে তার প্রীতি এবং বিশ্বস্ততা আমাদের মুগ্ধ করে। ভ্রাতা ইরাবান, ভ্রাতা অভিমন্যু নিহত হলে ঘটোৎকচের ক্ষিপ্ত রূপ আমাদের আকর্ষণ করে।

ঘটোৎকচ অত্যন্ত বড় বীর ছিলেন। ইন্দ্রদত্ত শক্তি ব্যবহার না করা পর্যন্ত কর্ণ তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারেননি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। যে অস্ত্র চিরশত্রু অর্জুনের জন্য কর্ণ রেখে দিয়েছিলেন, সেই অস্ত্র ঘটোৎকচের উপর ব্যবহার করে কর্ণ আত্মরক্ষা করেছিলেন। বস্তুত ঘটোৎকচের উপর সেই শক্তি ব্যয় করে, কর্ণের নিজের মৃত্যুও কর্ণ আহ্বান করে নিয়েছিলেন। এই ঘটনাই ঘটোৎকচের বীরত্বের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি। পিতা ভীমসেন রাক্ষস অলায়ুধ কর্তৃক পীড়িত হচ্ছেন দেখে ঘটোৎকচ মুহূর্তমধ্যে অলায়ুধকে নিহত করেছিলেন।

ঘটোৎকচের জন্মের পর কুন্তী দেবী আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, “তুমি জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব সন্তান।” ঘটোৎকচ সারাজীবন সে-পরিচয় বহন করেছেন। যুধিষ্ঠিরের সব আদেশ তিনি নির্বিচারে পরম আনন্দে পালন করেছেন। নিজের চোখের উপর তিনি আপন পুত্র অঞ্জনপর্বাকে অশ্বত্থামার হাতে নিহত দেখেছিলেন। পিতা ভীমসেনের মতো তিনিও তা ক্ষত্রিয়ের পরিণতি হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। ইন্দ্রদত্ত শক্তি আপন দেহে গ্রহণ করে, অর্জুনকে চিরকালীন বিপদ থেকে রক্ষা করে ঘটোৎকচ পিতৃঋণ পরিশোধ করেন। আর মাতৃঋণ? সে শোধ করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব ছিল না। প্রত্যাশাহীন সেই মহীয়সী নারী, রাক্ষসী হয়েও, স্বামীর প্রতি চিরবিশ্বস্ততা বহন করে সারাজীবন স্মৃতি সম্বল করে নিঃসঙ্গতায় কাটালেন।

ঘটোৎকচ-বধ বৃত্তান্তে যথারীতি যুধিষ্ঠিরকে অত্যন্ত ভাল লাগে। অশ্রুজলে তিনি ঘটোৎকচের প্রাপ্তিহীন সেবাকে স্মরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেই কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে চেয়েছিলেন। অভিমন্যু, ঘটোৎকচ যুধিষ্ঠিরের গভীর স্নেহের পাত্র ছিলেন। পারিবারিক সম্পর্ক যুধিষ্ঠিরের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ছিল।

৭৪
দুর্যোধনের বাল্যস্মৃতি

যুদ্ধের পঞ্চদশ দিন প্রভাতে যুদ্ধদুর্ধর্ষ ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের দিকে যাচ্ছেন এবং নকুল-সহদেবও কৃতবর্মা ও দুঃশাসনের তিন সহোদর ভ্রাতা—এই চারজনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপৃত আছেন দেখে দুর্যোধন রক্তপায়ী বাণসকল নিক্ষেপ করতে করতে ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে ধাবিত হলেন।

এই সময়ে সাত্যকি পুনরায় সত্বর দুর্যোধনের অভিমুখবর্তী হলেন। তখন নরশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন ও সাত্যকি পরস্পরকে কাছে পেয়ে হাসতে হাসতে আবার যুদ্ধে মিলিত হলেন। ক্রমে তাঁরা বাল্যকালের সমস্ত ব্যবহার স্মরণ করে প্রীতিযুক্ত হয়ে পরস্পর দৃষ্টিপাত করতে থেকে বারবার মৃদু হাস্য করতে লাগলেন। তারপর রাজা দুর্যোধন নিজ ব্যবহারের নিন্দা করবার জন্য চিরকালের প্রিয় সখা সাত্যকিকে বললেন, “শিনিবংশশ্রেষ্ঠ সখা সাত্যকি! ক্রোধ, লোভ, মোহ, অসহিষ্ণুতা, ক্ষত্রিয়াচার, বল ও পুরুষকারের আমি নিন্দা করি। যেহেতু তুমি আমার প্রতি শরসন্ধান করো, আমিও তোমার প্রতি শর অনুসন্ধান করে থাকি।

“বাল্যকালে আমাদের পরস্পরের মধ্যে যে ব্যবহার ছিল, তা আমার বারবার মনে পড়ছে। তখন সর্বদাই তুমি আমার প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় ছিলে, আমিও তোমার সেইরকমই প্রিয় ছিলাম। সাত্বতবংশীয়! বর্তমান সময়ে এই যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের সে সমস্ত ব্যবহার জীর্ণ হয়ে গেছে। ক্রোধ ও লোভ ছাড়া এর আর কী কারণ হতে পারে? সে যাই হোক, আজ আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব।”

দুর্যোধন সেইরকম বললে, পরমাস্ত্রবিৎ সাত্যকি তখন হাসতে হাসতে তীক্ষ্ণবাণ উত্তোলন করে প্রত্যুত্তর করলেন, “রাজপুত্র রাজা, সেই বাল্যকালে আমরা একসঙ্গে যেখানে খেলা করতাম, এ সেই সভাও নয়, কিংবা গুরুগৃহও নয়—

নেয়ং সভা রাজপুত্র! নাচার্যস্য নিবেশনম্।

যত্ৰ ক্ৰীড়িতমস্মাভিস্তদা রাজন্! সমাগতৈঃ ॥ দ্রোণ: ১৬২; ২৬ ॥

দুর্যোধন বললেন, “শিনিবংশশ্রেষ্ঠ, আমাদের সেই বাল্যকালের একসঙ্গে খেলাধুলা করাই বা কোথায় গেল, আর এই যুদ্ধই বা কোথা থেকে উপস্থিত হল? কালকে অতিক্রম করা দুষ্করই বটে। আমরা সকলে যে ধনের লোভে সম্মিলিত হয়ে যুদ্ধ করছি, সেই ধন বা ধনের লোভে আমাদের কোন কার্য হবে?” দুর্যোধনের কথা শুনে সাত্যকি তাঁকে বললেন, “ক্ষত্রিয়ের স্বভাব চিরদিন এইরূপ যে, তাঁরা গুরুদেরও বধ করে থাকেন। রাজা আমি যদি তোমার প্রিয় হই, তবে আমাকে অবিলম্বে বন্ধ করো, বিলম্ব কোরো না; ভরতশ্রেষ্ঠ, আমি তোমার জন্য পুণ্যলোকে গমন করব। তোমার যতদূর শক্তি আছে, এবং যতবড় মানসিক বল আছে, তা এখনই আমাকে দেখাও; আমি আর এই মিত্রগণের মহাবিপদ দেখতে ইচ্ছা করি না।”

সাত্যকি এইরকম বন্ধুভাবে স্পষ্ট বলে, এবং শত্রুভাবেও স্পষ্ট বলে অব্যাকুল অবস্থায় দুর্যোধনের দিকে ধাবিত হলেন; নিজের কোনও ক্ষতি হতে পারে, এ চিন্তাও করলেন না। মহাবাহু সাত্যকি এগিয়ে এলে, রাজা দুর্যোধন তাঁকে গ্রহণ করলেন এবং তিনি বাণ দ্বারা সাত্যকিকে প্রহার করতে লাগলেন। তখন দুটি হস্তীশ্রেষ্ঠের মতো ক্রুদ্ধ দুর্যোধন ও সাত্যকির ভয়ংকর যুদ্ধ লেগে গেল। দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে ধনু পূর্ণ আকর্ষণ করে দশটি তীক্ষ্ণ বাণে সাত্যকিকে বিদ্ধ করলেন। সাত্যকি প্রথমে পঞ্চাশটি, পরে আবার ত্রিশটি ও দশটি বাণ নিক্ষেপ করে দুর্যোধনকে প্রহার করলেন। তখন দুর্যোধন হেসে আকৰ্ণ ধনু আকর্ষণ করে ত্রিশটি বাণে সাত্যকিকে তাড়ন করলেন। পরে আবার তিনি একটি ক্ষুরপ্র দিয়ে সাত্যকির ধনু দুই খণ্ডে ছেদন করে ফেললেন। সাত্যকি মুহূর্তমধ্যে অন্য একটি ধনু নিয়ে দুর্যোধনের প্রতি অসংখ্য বাণক্ষেপ করলেন। দুর্যোধন সাত্যকির সেই বাণশ্রেণি ছেদন করতে লাগলে, কুরুপক্ষের লোকেরা উচ্চ স্বরে আনন্দ কোলাহল করে উঠল। পরে দুর্যোধন স্বর্ণপুঙ্খ, শিলাশাণিত তিয়াত্তরটি তীক্ষ্ণ বাণে সাত্যকিতে পীড়ন করলেন। সাত্যকি দুর্যোধনের বাণযুক্ত ধনু কেটে ফেললেন এবং বহু বাণে দুর্যোধনকে বিদ্ধ করলেন। তখন দুর্যোধন সাত্যকির বাণে গাঢ়বিদ্ধ, পীড়িত ও ব্যথিত হয়ে রথের মধ্যে সরে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাত্যকি দুর্যোধনের থেকে অনেক প্রবল হয়ে উঠলেন। কর্ণ সাত্যকিকে প্রবলতর দেখে দুর্যোধনকে রক্ষা করবার জন্য দ্রুত সেই স্থানে ছুটে গেলেন। দুর্যোধন অন্যত্র সরে গেলেন।

*

দুর্যোধন মহাভারতের প্রতিনায়ক। তাঁর তুল্য রাজ্যলোভী বা প্রভুত্বলোভী ধর্মজ্ঞানহীন দুর্মুখ ক্রূর দুরাত্মা চরিত্র পাঠক শিল্পে-সাহিত্যে দেখতে পায়, এইধরনের চরিত্র পাঠকের সুপরিচিত। তিনি আজীবন পাণ্ডবদের অনিষ্ট করেছেন, রাজ্যের বৈধ উত্তরাধিকারী না হওয়ায় ঈর্ষা এবং বিদ্বেষ তাঁকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছে। তাঁর প্রভুত্ববোধ অসীম, সেই কারণে আত্মমর্যাদাবোধও অত্যন্ত প্রখর। হস্তিনাপুরে পাণ্ডবদের প্রবেশ তিনি সইতে পারেননি। বিষ খাইয়ে জলে ফেলে দেওয়া, সর্প দংশন করানো, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া তাঁর কাছে ছেলেখেলা মাত্র। এও সেই প্রভুত্ববোধ সঞ্জাত। ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে তাঁর ঈর্ষা, গন্ধর্ব চিত্রসেনের হাতে বন্দি হবার পর যুধিষ্ঠিরের কৃপায় মুক্তিলাভ করে তাঁর আত্মগ্লানি, এও আমাদের কাছে সুপরিচিত প্রতিক্রিয়া। দুর্যোধন ঘোর নিয়তিবাদী। উদ্‌যোগপর্বে মহর্ষি কণ্বকে তিনি বলেছিলেন, “মহর্ষি, ঈশ্বর আমাকে যেমন সৃষ্টি করেছেন এবং ভবিষ্যতে আমার যা হবে আমি সেই ভেবেই চলেছি, কেন প্রলাপ বকছেন?”

কিন্তু পৃথিবীতে অবিমিশ্র শয়তান বোধ করি হয় না। সাত্যকির সঙ্গে দ্বৈরথের পূর্বে দুর্যোধনের সংলাপে স্বাভাবিক মানুষের স্নিগ্ধ কোমলতা ফুটে ওঠে। সাত্যকিকে দেখে তাঁর বাল্য স্মৃতিচারণ আমাদের অত্যন্ত আকৃষ্ট করে। এই একটিবার দুর্যোধন তাঁর ক্ষত্রিয়াচার, রাজ্যলোভ বিষয়ে ধিক্কার উচ্চারণ করেছিলেন। প্রিয়তম বাল্যসখাকে দেখে তাঁর মনে পড়েছিল বাল্য-শৈশবের দিন, একত্রে খেলাধুলার আনন্দ। দুর্যোধন জানতেন শক্তিতে তিনি সাত্যকির তুল্য নন—কিন্তু তাঁকে যুদ্ধে-আহ্বান জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেননি, ভীত হননি। তাই এই ঘটনা মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত।

স্মৃতি সাত্যকির মধ্যেও জেগেছিল। তাই বরেণ্য বন্ধুকে তিনি মূল্যদান করে বলেছিলেন, “আমার প্রতি তোমার বিন্দুমাত্র বন্ধুপ্রীতি থাকলে অবিলম্বে আমাকে বধ করো।”

দুর্যোধনের বাল্যস্মৃতি অংশ পড়তে পড়তে আচার্য দ্রোণের বিদ্যালয় সম্পর্কেও আমাদের এক স্পষ্ট ধারণা হয়। গুরু হিসাবে দ্রোণ উদারচেতা ছিলেন। কেবল কৌরব-পাণ্ডবই নয়, ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী সাত্যকি কর্ণ দ্রোণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। এ বিষয়ে ভীষ্মের অনুমোদনও অনুমান করা যায়। সেকালে সূত বংশীয়গণ অস্ত্রশিক্ষার অধিকারী ছিলেন। শূদ্রেরা ছিলেন না। এই কারণে রাজা হিরণ্যধনুর পুত্র নিষাদ একলব্যকে শিষ্য হিসাবে দ্রোণ গ্রহণ করেননি। ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর বধের কারণ হবেন, শিখণ্ডী ভীষ্মের মৃত্যুর উপলক্ষ হবেন জেনেও দ্রোণ তাঁদের গ্রহণ করেছিলেন। অন্য শিষ্যদের সঙ্গে স্বাভাবিক শিক্ষাই দিয়েছিলেন। দ্রোণের অর্থ বিষয়ে আসক্তি ছিল। প্রয়োজনে তিনি একাধিকবার ধর্মসংগত নয়, এমন কার্য করতেও কুণ্ঠিত হননি।

৭৫
দ্রোণাচার্যের ব্রহ্মলোক প্রয়াণ

পঞ্চদশ দিবসের যুদ্ধে, মধ্যাহ্নে, পূর্বকালে ইন্দ্র যেমন যুদ্ধে দানবগণের মহামারী ঘটিয়েছিলেন, তেমনই ক্রুদ্ধ দ্রোণও পাঞ্চালগণের ঘটাতে লাগলেন। যুদ্ধে দ্ৰোণ অস্ত্র সকল বধ করতে থাকলেও পাঞ্চাল মহারথেরা দ্রোণকে ভয় পেলেন না। তাঁরা দ্রোণের প্রতি ধাবিত হলেন। কিন্তু দ্রোণের বাণবৃষ্টিতে পাঞ্চালেরা সকলদিকে আবৃত ও নিহত হতে লাগলে, তাঁরা ভয়ংকর আর্তনাদ করতে লাগলেন। মহাত্মা দ্রোণ যুদ্ধে পাঞ্চালদের বধ করতে লাগলে এবং অনবরত অস্ত্ৰক্ষেপ করতে থাকলে, পাণ্ডবেরা ভয়াবিষ্ট হলেন। যুদ্ধে অশ্ব ও পদাতিদের বিশাল ক্ষয় দেখে তখন পাণ্ডবেরা আর জয়ের আশা করলেন না। ভীত পাণ্ডবেরা বলতে লাগলেন, “শীতকাল কেটে গেলে প্রজ্বলিত অগ্নি যেমন তৃণরাশি দগ্ধ করে, সেইরকম পরম অস্ত্রজ্ঞ দ্রোণ আমাদের সকলকেই দগ্ধ করবেন না তো? যুদ্ধে কোনও ব্যক্তিই এঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করতেও সমর্থ হচ্ছে না এবং ধর্মজ্ঞ অর্জুনও কখনই এঁর প্রতিপক্ষে যুদ্ধ করবেন না।”

কূটবুদ্ধি ও পাণ্ডবগণের মঙ্গলবিধানে মনোযোগী কৃষ্ণ পাণ্ডবগণকে দ্রোণের বাণে পীড়িত ও ভীত দেখে অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন ধনুর্ধরশ্রেষ্ঠ দ্রোণ ধনু সংযুক্ত অবস্থায় থাকলে, ইন্দ্রের সঙ্গে দেবতারাও কোনওপ্রকারে তাঁকে যুদ্ধে জয় করতে পারেন না, কিন্তু তিনি অস্ত্র ত্যাগ করলে, মানুষেরাও তাঁকে বধ করতে পারে। অতএব পাণ্ডবগণ, আপনারা ধর্ম ত্যাগ করে জয়ের উপায় অবলম্বন করুন; যাতে যুদ্ধে দ্রোণ আপনাদের সকলকে বধ না করেন। আমার ধারণা, অশ্বত্থামা নিহত হলে উনি আর যুদ্ধ করবেন না। সুতরাং অশ্বত্থামা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, এই কথা কোনও লোক ওঁর কাছে বলুক।”

কৃষ্ণের এই পরামর্শ অর্জুনের সঙ্গত বলে মনে হল না, কিন্তু অন্য সকলেই তা অনুমোদন করলেন এবং যুধিষ্ঠির অতিকষ্টে স্বীকার করলেন। তারপর মহাবাহু ভীমসেন গদা দ্বারা কৌরব সৈন্যস্থিত মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার বিশাল হাতিটাকে বধ করলেন; সেটার নাম ছিল ‘অশ্বত্থামা’—সেই ভয়ংকর হাতিটা প্রবলভাবে শত্রুমর্দন করত। তারপর ভীমসেন লজ্জিতভাবে দ্রোণের কাছে গিয়ে “অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে” এই কথা উচ্চস্বরে বললেন। ‘অশ্বত্থামা’ নামে হস্তীই নিহত হয়েছে একথা মনে রেখেও ভীম দ্রোণের প্রতি তখন মিথ্যাই বললেন।

ভীমের মুখে সেই অত্যন্ত অপ্রিয় বাক্য শুনে জলে যেমন বালি গলে যায়, সেইরকম মনের শোকে দ্রোণের অঙ্গ যেন গলে গেল। কিন্তু দ্রোণ আপন পুত্র অশ্বত্থামার বীরত্ব জানতেন বলেই ভীমের মুখে “অশ্বত্থামা হত হয়েছে” একথা শুনেও তা মিথ্যা বলে ধারণা করে ধৈর্যচ্যুত হলেন না। পুত্র অশ্বত্থামা শত্রুগণের অসহ্য এই ভেবে বিশেষ ধৈর্যলাভ করে, দ্রোণ ক্ষণকাল মধ্যেই আশ্বস্ত হলেন।

তারপর দ্রোণ নিজের মৃত্যুর ভাবী কারণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করবার ইচ্ছা করে তাঁর উপরে তীক্ষ্ণ বাণসমূহ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। দ্রোণ নিজের হস্তস্থিত সাধারণ ধনু পরিত্যাগ করে ঋষি অঙ্গিরার আবিষ্কৃত অন্য অলৌকিক ধনু ও ব্রহ্মদণ্ডতুল্য বাণসকল দ্বারা ধৃষ্টদ্যুম্নকে প্রহার করতে থাকলেন। দ্রোণের সেই বিশাল বাণবর্ষণে ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত-বিক্ষত হলেন। তীক্ষ্ণ বাণদ্বারা দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নের বাণ, ধ্বজ, ধনু শতখণ্ডে ছেদন করলেন এবং তাঁর সারথিকেও নিপাতিত করলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন হাসতে হাসতে অন্য ধনু নিয়ে তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা দ্রোণের বক্ষঃস্থল প্রতিবিদ্ধ করলেন। অত্যন্ত বিদ্ধ ও বিচলিত হলেও দ্রোণ একটি অত্যন্ত ধারালো ভল্ল দ্বারা পুনরায় ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুছেদন করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের যে সকল তূণ ও ধনু ছিল, সেই সমস্তই দ্রোণ ছেদন করলেন, কিন্তু গদা ও খড়্গ ছেদন করলেন না। দ্রোণ তখন জীবনান্তকারী ন’টি তীক্ষ্ণবাণে ক্রুদ্ধ ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিদ্ধ করলেন।

মহারথ ও অজ্ঞেয় স্বভাব দ্রোণ ব্রহ্মাস্ত্র আবিষ্কার করবেন বলে নিজের রথের অশ্বগুলির সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্ন-রথের অশ্বগুলিকে সম্মিলিত করে দিলেন। বায়ুর ন্যায় বেগবান এবং গৃহকপোতের তুল্য ধূম্রবর্ণ ও রক্তবর্ণ সেই অশ্বগুলি প্রকাশ পেতে থাকল। পরে দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নের ঈশাবন্ধন, চক্ৰবন্ধন ও রথবন্ধন বিনষ্ট করে ফেললেন। ধনু ও ধ্বজ ছিন্ন এবং সারথি বিনষ্ট হলে, বীর ধৃষ্টদ্যুম্ন গুরুতর বিপদে পড়ে গদা গ্রহণ করলেন। তিনি সেই গদা নিক্ষেপ করার উপক্রম করলে, মহারথ ও যথার্থ বিক্রমশালী দ্রোণ সক্রোধে তীক্ষ্ণ ও শিখাশূন্য বাণসমূহ দ্বারা সে গদাটা বিনষ্ট করলেন। দ্রোণ বাণ দ্বারা গদা বিনষ্ট করলেন দেখে নরশ্রেষ্ঠ ধৃষ্টদ্যুম্ন নির্মল তরবারি এবং শতচন্দ্র ও উজ্জ্বল ঢাল গ্রহণ করলেন। সেই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্নের মনে নিশ্চিতভাবে দ্রোণের বধের সময় উপস্থিত হয়েছে বলে মনে হতে লাগল।

তখন মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন দুষ্কর কাজ করবার ইচ্ছা করে তরবারি ও ঢাল তুলে আপন রথের তেরচা কাঠের উপর পা রেখে রথস্থিত দ্রোণের দিকে আসলেন এবং তাঁর বক্ষ বিদারণ করবার ইচ্ছা করলেন। তখন তিনি দ্রোণের ঘোড়াগুলির পিছনের সমসুত্রপাতে তাঁর রথের তেরচা কাঠের মধ্যদেশে এক পা ও নিজরথের তেরচা কাঠের অগ্রদেশে অপর পা রেখে দাঁড়ালেন। তখন দুই পক্ষের সৈন্যরাই তাঁর সেই কাজের প্রশংসা করতে থাকলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন আপন রথের তেরচা কাঠের আগায় এবং দ্রোণের ঘোড়াগুলির পিঠের উপর দাঁড়ালেও, দ্রোণ তাঁকে প্রহার করার কোনও সুযোগই পেলেন না; তা যেন অদ্ভুত বলে বোধ হতে লাগল। মাংসলোভী দুটি শ্যেনপাখির মতো দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের মধ্যে পরস্পর দ্রুত আক্রমণ চলল। দ্রোণ নিজের রক্তবর্ণ অশ্বগুলি পরিত্যাগ করে রথের শক্তির দ্বারা এক-একটি করে ধৃষ্টদ্যুম্নের ধূম্রবর্ণ সকল অশ্বকে বিদীর্ণ করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের সেই অশ্বগুলি নিহত হয়ে ভূতলে পতিত হল। দ্রোণের রক্তবর্ণ অশ্বগুলি ধৃষ্টদ্যুম্নের রথবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেল।

দ্রোণ তাঁর অশ্বগুলি বধ করলেন দেখে যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ যজ্ঞসেননন্দন মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন সহ করলেন না। তখন খড়াধারীশ্রেষ্ঠ ধৃষ্টদ্যুম্ন রথ ছেড়ে খড়্গ নিয়ে গরুড় যেমন সাপের দিকে ধাবিত হন, সেইরকম দ্রোণের দিকে ধাবিত হলেন। পূর্বকালে হিরণ্যকশিপুকে বধ করবার সময়ে বিষ্ণুর যেমন রূপ হয়েছিল, তখন দ্রোণবধার্থী ধৃষ্টদ্যুম্নের সেই প্রকার রূপ হল। ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধে বিচরণ করতে থেকে খড়্গ যুদ্ধের যে একুশ প্রকার পথ আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ তেরো প্রকার পথ দেখাতে লাগলেন। তিনি খড়্গ ও চর্ম ধারণ করে প্রথমে ভ্রান্ত, উদ্‌ভ্রান্ত, আবিদ্ধ, আপ্লুত, প্রসৃত, সৃত, পরিবৃত্ত, নিবৃত্ত, সম্পাত ও সমুদীর্ণ এই দশ প্রকার পথ দেখালেন। পরে দ্রোণকে বধ করবার ইচ্ছায় ভারত, কৌশিক ও সাত্বত—এই তিন প্রকার পথ দেখাতে থেকে রণস্থলে বিচরণ করতে থাকলেন। খড়্গ চর্মধারী ধৃষ্টদ্যুম্ন সেই সকল বিচিত্র পথে বিচরণ করতে থাকলে, যোদ্ধারা ও সমাগত দেবতারা বিস্ময়াপন্ন হলেন। তখন দ্রোণ অনেকগুলি বাণক্ষেপ করে ধৃষ্টদ্যুম্নের হাত থেকে শতচন্দ্র চর্ম ও তরবারি নিপাতিত করলেন। দ্রোণ ‘বেতস্তিক’ নামের অসাধারণ বাণ ব্যবহার করে ধৃষ্টদ্যুম্নকে অস্ত্রচ্যুত করলেন। এই বিচিত্র বাণ দ্রোণ, কৃপ, অর্জুন, অশ্বত্থামা, কর্ণ, প্রদ্যুম্ন, সাত্যকি ও অভিমন্যু ছাড়া অন্য কোনও ধনুর্ধারীর জানা ছিল না।

তখন দ্রোণ পুত্রতুল্য শিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করবার ইচ্ছা করে দৃঢ় ও পরমসঙ্গত একটি বাণ গ্রহণ করে ধৃষ্টদ্যুম্নকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করলেন। তখন দুর্যোধন ও কর্ণের সমক্ষেই সাত্যকি তীক্ষ্ণ দশটি বাণ দ্বারা দ্রোণের সেই বাণটিকে ছেদন করে ধৃষ্টদ্যুম্নকে দ্রোণমুক্ত করলেন। এই সময়ে যথার্থ বিক্রমশালী সাত্যকি দ্রোণ, কর্ণ ও কৃপের মধ্য দিয়ে রথপথে বিচরণ করতে থেকে সকলের দিব্য অস্ত্র প্রতিহত করতে লাগলেন। সাত্যকির সেই আশ্চর্য কীর্তি দেখে কৃষ্ণ ও অর্জুন ‘সাধু সাধু’ বলে তাঁর প্রশংসা করলেন।

তারপর দ্রোণ চতুর্দিকে পাঞ্চালসৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে ক্ষত্রিয়গণকে দগ্ধ করতে থেকে যুদ্ধে বিচরণ করতে লাগলেন। তীক্ষ্ণ বাণ বর্ষণ করে দ্রোণ বিশ হাজার ক্ষত্রিয় ও লক্ষ হস্তী বধ করলেন। পরে তিনি জয়ে যত্নবান হয়ে ক্ষত্রিয়গণকে ধ্বংস করবার জন্য ব্রহ্মাস্ত্র ধারণ করে ধূমশূন্য অগ্নির মতো জ্বলতে থেকে যুদ্ধে অবস্থান করতে লাগলেন। ওদিকে রথ ও সমস্ত অস্ত্র বিনষ্ট হলে, মহাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন অতিবিষন্ন হয়ে অবস্থান করছিলেন। তখন বলবান ভীমসেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে আপন রথে তুলে নিয়ে বললেন, “পাঞ্চালরাজপুত্র, আপনি ভিন্ন অন্য কোনও পুরুষই দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ হবেন না। অতএব আপনি তাঁকে বধ করার জন্য ত্বরান্বিত হোন; পূর্ব থেকে আপনার উপর এ ভার স্থাপিত আছে।”

ভীমসেন একথা বললে, মহাবাহু ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রুত গিয়ে সত্বর সর্বভারবহ, দৃঢ় ও অস্ত্ৰশ্রেষ্ঠ একখানি ধনু গ্রহণ করলেন। ক্রমে ক্রুদ্ধ, সমরশোভী ও ধনুর্ধরশ্রেষ্ঠ দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্রহ্মাস্ত্র ও অন্যান্য অনেক অলৌকিক অস্ত্র নিক্ষেপ করে পরস্পরকে বারণ করতে লাগলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের সমস্ত অস্ত্র প্রতিহত করে উত্তম অস্ত্রসমূহে তাঁকে আবৃত করে ফেললেন এবং দ্রোণের রক্ষক বশাতি, শিবি, বাহ্লিক ও কৌরবদের পীড়ন করতে থাকলেন। সেই সময়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন সূর্যের মতো বাণসমূহ দ্বারা সমস্ত দিক আবৃত করে প্রকাশ পেতে লাগলেন। তখন দ্রোণ বাণ দ্বারা তাঁর ধনু ছেদন ও তাঁকে তাড়ন করে পুনরায় মর্মস্থানে আঘাত করলেন। তাতে, ধৃষ্টদ্যুম্ন গুরুতর ব্যথা পেলেন। দ্রোণ সেইভাবে যুদ্ধে বিচরণ করতে লাগলে পাঞ্চাল দেশের বিশ হাজার যোদ্ধা দ্রোণের উপর বাণক্ষেপ করতে লাগলেন। দ্রোণ তখন সেই পাঞ্চাল যোদ্ধাদের বধ করবার জন্য ব্রহ্মাস্ত্র আবিষ্কার করলেন। সেই ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করলে সৈন্যরা বায়ুভগ্ন বৃক্ষের মতো ভূতলে পড়তে লাগলেন। বিশ হাজার রথীকে বধ করার পর একটি ভল্ল নিয়ে দ্রোণ বসুদানের দেহ থেকে মাথা সরিয়ে দিলেন।

এইভাবে দ্রোণকে ক্ষত্রিয় ধ্বংস করতে দেখে তাঁকে ব্রহ্মলোকে নিয়ে যাবার জন্য বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, বশিষ্ঠ, কশ্যপ ও অত্রি ঋষি এবং শিকত, পৃশ্নি, গর্গ, বালখিল্য, মরীচি, ভৃগু, অঙ্গিরা অন্যান্য সূক্ষ্ম মহর্ষিরা অগ্নিদেবকে অগ্রবর্তী করে সত্বর সেখানে উপস্থিত হলেন। পরে তাঁরা সকলে দ্রোণকে বললেন, “দ্রোণ তুমি অধর্ম অনুসারে যুদ্ধ করছ। সুতরাং তোমার মৃত্যুর সময় হয়েছে। আমাদের সম্মুখে অবস্থিত থাকতে দেখে তুমি অস্ত্রত্যাগ করো। আর গুরুতর নিষ্ঠুর কার্য করতে পারো না। তুমি বেদ-বেদাঙ্গবিৎ এবং সত্যধর্মে নিরত, বিশেষত ব্রাহ্মণ। সুতরাং তোমার পক্ষে এরূপ নিষ্ঠুর কার্য সংগত নয়। অব্যর্থবাণ দ্রোণ, অস্ত্র ত্যাগ করো। চিরস্থায়ী ব্ৰহ্মলোকের পথে প্রবৃত্ত হও। তোমার মনুষ্যলোকে বাসের কাল শেষ হয়েছে। তুমি ব্ৰহ্মাস্ত্র দ্বারা ব্ৰহ্মাস্ত্র অনভিজ্ঞ লোকেদের যুদ্ধে দগ্ধ করেছ। অতএব তুমি যা করেছ, ভাল করনি। সুতরাং দ্রোণ! ব্রাহ্মণ! সত্বর অস্ত্র ত্যাগ করো, বিলম্ব কোরো না এবং পুনরায় এই পাপকার্য আর করবে না।”

দ্রোণাচার্য মহর্ষিগণের এই বাক্য, ভীমসেনের সেই বাক্য শুনে এবং সামনে ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখে যুদ্ধে অনিচ্ছুক হলেন। তিনি শোকানলে দগ্ধ ও ব্যথিত হতে থেকে পুত্র অশ্বত্থামা হত হয়েছেন কি না এই বিষয়ে কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন। কারণ দ্রোণের বিশ্বাস ছিল যে, ত্রিভুবনের রাজত্বের বিনিময়েও যুধিষ্ঠির মিথ্যা কথা বলবেন না। তারপর যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ দ্রোণ পৃথিবীটাকে পাণ্ডবশূন্য করবেন বুঝে কৃষ্ণ ব্যথিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন “মহারাজ, ক্রুদ্ধ দ্রোণ যদি আর দুই প্রহরকাল যুদ্ধ করেন, তা হলে আমি সত্য বলছি, আপনার সৈন্য একেবারে বিনষ্ট হয়ে যাবে। অতএব আপনি আমাদের দ্রোণের হাত থেকে রক্ষা করুন। এ সময়ে সত্য অপেক্ষা মিথ্যা বলাই ভাল। কারণ, মানুষ জীবনের জন্য মিথ্যা বললে মিথ্যা বলার পাপে লিপ্ত হয় না।”

কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির যখন এই আলোচনা করছিলেন তখন ভীমসেন মিথ্যাবাক্যই দ্রোণবধের উপায় বুঝে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “রাজা, মালবাধিপতি ইন্দ্রবর্মা আপনার সৈন্য আলোড়ন করছিলেন, ইন্দ্রের হস্তীর মতো তাঁর একটি বিরাট হস্তী ছিল। সেটির নাম ছিল ‘অশ্বত্থামা’। আমি যুদ্ধে বিক্রম প্রকাশ করে সেই হস্তীটিকে বধ করেছি। তারপর আমি দ্রোণকে বলেছিলাম, ‘ব্রাহ্মণ, অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে, আপনি যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হোন’, কিন্তু নিশ্চয়ই দ্রোণ আমার কথা বিশ্বাস করেননি। অতএব রাজা আপনি আমাদের জয়াভিলাষী কৃষ্ণের বাক্য স্বীকার করুন এবং দ্ৰোণকে বলুন, ‘অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে।’ কারণ, আপনি একথা বললে এই ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ আর কখনও যুদ্ধ করবেন না। নরনাথ, আপনি এই ত্রিভুবনে সত্যপরায়ণ বলে বিখ্যাত আছেন।”

যুধিষ্ঠির একে কৃষ্ণের বাক্যে প্রণোদিত হয়েছিলেন, তারপর আবার ভীমের সেই কথা শুনলেন এবং দ্রোণেরও সেইভাবে মৃত্যু হবে বলে বিধিলিপি রয়েছে। সুতরাং তিনি সেই কথাই বলবার উপক্রম করলেন। যুধিষ্ঠির একদিকে মিথ্যাভয়ে মগ্ন হচ্ছিলেন, অন্যদিকে জয়সম্পাদনে ব্যাপৃত ছিলেন। তাই উচ্চ স্বরে বললেন, “অশ্বত্থামা হতঃ” আর অস্পষ্টভাবে বললেন, “ইতি গজঃ”। পূর্বে যুধিষ্ঠিরের রথ ভূতল থেকে চার আঙুল ঊর্ধ্বে থাকত; কিন্তু তিনি সেই কথা বলায় তাঁর অশ্বগুলি ভূতল স্পর্শ করল।

এদিকে মহারথ দ্রোণ যুধিষ্ঠিরের মুখে সেই বাক্য শুনে পুত্রশোকে সন্তপ্ত হয়ে, আপন জীবনে নিরাশ হয়ে পড়লেন। ক্রমে শত্রুদমনকারী দ্রোণ পূর্বোক্ত ঋষিবাক্য শুনে মহাত্মা পাণ্ডবগণের কাছে আপনাকে অপরাধী বলে মনে করতে লাগলেন এবং পুত্র নিহত হয়েছে শুনে শোকে যেন অচেতন হয়ে পড়লেন, আর সম্মুখে ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখে অত্যন্ত ভীতও হলেন। তাই তিনি আর পূর্বের মতো যুদ্ধ করতে পারলেন না। ওদিকে পাঞ্চাল রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন অত্যন্ত ভীত ও শোকে অচেতনপ্রায় দেখে তাঁর দিকে ধাবিত হলেন। পূর্বে দ্রুপদরাজা দ্রোণ-বিনাশের জন্য মহাযজ্ঞ করে প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে যাঁকে লাভ করেছিলেন, সেই ধৃষ্টদ্যুম্ন তখন দ্রোণকে বধ করবার ইচ্ছা করে মেঘের মতো গম্ভীরধ্বনিকারী, দৃঢ়গুণযুক্ত, নূতন, অলৌকিক ও ভয়ংকর একখানি ধনু এবং তীক্ষ্ণবিষ সর্পের তুল্য একটি বাণ নিয়ে সেই ধনুতে সেই বাণ সন্ধান করলেন। বর্ষাকাল অতীত হলে, পরিধির ভিতরে দীপ্যমান সূর্যের যেমন রূপ হয়, মণ্ডলীকৃত ধনুর গুণের অভ্যন্তরে সেই বাণটারও তেমনই রূপ হয়েছিল।

ধৃষ্টদ্যুম্ন আকৃষ্ট সেই উজ্জ্বল ধনুখানা দেখে সৈন্যেরা মনে করল, দ্রোণের অন্তিম আগত। প্রতাপশালী দ্রোণও ধৃষ্টদ্যুম্ন সংহিত সেই বাণটা দেখে মনে করলেন যে, এ দেহ পরিবর্তনের সময় এসেছে। দ্রোণাচার্য সেই বাণটা নিবারণ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সে মহাত্মার তখন কোনও উপযুক্ত অস্ত্র স্মরণে এল না। কারণ তিনি অস্ত্ৰক্ষেপ করছিলেন, এই অবস্থায় চার দিন, এক রাত্রি অতীত হয়েছিল এবং পঞ্চম দিনেরও মধ্যাহ্নকাল পর্যন্ত যুদ্ধ করার তাঁর বাণ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং বাণ নিঃশেষ হওয়াতে, পুত্রশোকে পীড়িত হওয়ায়, নানাবিধ দিব্য অস্ত্র মনে না পড়ায়, বিশেষত পূর্বোক্ত ঋষিবাক্যে প্রণোদিত হওয়ায় দ্রোণ তখন অস্ত্রত্যাগ করবার ইচ্ছা করছিলেন; তবুও মনের তেজে যুদ্ধ করছিলেন কিন্তু পূর্বের মতো নয়।

তখন দৃঢ়ক্রোধ ভীম দ্রোণের সেই রথের কাছে গিয়ে বললেন, “আপনাদের কাজে অসন্তুষ্ট অথচ অস্ত্রবিদ্যায় শিক্ষিত নিকৃষ্ট ব্রাহ্মণেরা যদি যুদ্ধ না করত তবে ক্ষত্রিয় জাতিটা ক্ষয় পেত না। ধর্মজ্ঞেরা মনে করেন সমস্ত প্রাণীর প্রধান ধর্ম হল হিংসা না করা। সেই ধর্মের মূল— ব্রাহ্মণেরা; অথচ আপনি ব্রহ্মজ্ঞশ্রেষ্ঠ। ব্রাহ্মণ, এই সৈন্যেরা আপন বৃত্তিতে রয়েছে, আর আপনি ব্রাহ্মণ হয়েও অন্য বৃত্তিতে অবস্থান করছেন; তাতে আবার ব্যাধ যেমন পুত্র, ভার্যা ও ধনের লালসায় ম্লেচ্ছ ও অন্যান্য নানাবিধ মানুষ বধ করে বিচরণ করে, আপনিও তেমনই মূঢ় ও অধর্মের পালকের মতো অজ্ঞানতাবশত এক পুত্রের জন্য বহু প্রাণী বধ করে বিচরণ করছেন। আপনার এতে লজ্জা হয় না কেন? আপনি যার জন্য অস্ত্র ধারণ করে রয়েছেন এবং যাকে লক্ষ্য করে জীবন ধারণ করেন আপনার সেই পুত্ৰই আজ যুদ্ধে পতিত হয়ে শুয়ে আছে। একথা ধর্মরাজ আপনাকে পূর্বে জানিয়েছেন; তাঁর বাক্যে আপনি অবিশ্বাস করতে পারেন না।

“কর্ণ! কর্ণ! মহেষ্বাস! কৃপ! দুর্যোধনেতি চ।

সংগ্রামে ক্রিয়তাং যত্নো ব্রবীমেষ পুনঃ পুনঃ ॥

পাণ্ডবেভ্যঃ শিবং বোহস্তু শস্ত্রমভ্যুৎসৃজাম্যহম্।

ইতি তত্র মহারাজ! প্রাক্রোশদ্ দ্রৌণিমেব চ॥ দ্রোণ: ১৬৪: ৬৮-৬৯ ॥

“কর্ণ! কর্ণ! মহাধনুর্ধর! কৃপ! দুর্যোধন! এই আমি বারবার বলছি তোমরা যুদ্ধ জয় করবার যত্ন করো। পাণ্ডবদের ও তোমাদের মঙ্গল হোক; আমি অস্ত্রত্যাগ করলাম মহারাজ!” এই কথা বলে দ্রোণ তখন উচ্চ স্বরে অশ্বত্থামাকে ডাকলেন।” এবং তিনি অস্ত্র ত্যাগ করে এবং সেই অস্ত্র রথমধ্যে রেখে যোগীর মতো সমস্ত প্রাণীকে অভয় দান করলেন। এই সময়ে প্রতাপশালী ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের সেই ছিদ্র জেনে, সেই ভয়ংকর ধনু ও বাণ রথে রেখে, তখন তরবারি ধারণ করে রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে বেগে দ্রোণের দিকে ধাবিত হলেন। মানুষ ও অন্য প্রাণীরা দ্রোণকে সেই অবস্থায় ও ধৃষ্টদ্যুম্নের বশীভূত দেখে হাহাকার করতে লাগল।

উভয় পক্ষের সৈন্যেরাও গুরুতর হাহাকার করতে লাগল এবং ‘অহো ধিক’ এই কথা বলতে থাকল; দ্রোণও অস্ত্র ত্যাগ করে পরম শমগুণ অবলম্বন করলেন। এবং মহাতপা দ্রোণ সেইরকম বসে যোগ অবলম্বন করে ব্রহ্মময় হয়ে মনে মনে পুরাণ ও পরমপুরুষ বিষ্ণুকে স্মরণ করতে লাগলেন। ক্রমে মহাতপা ও তন্ময়চিত্ত দ্রোণাচার্য মুখমণ্ডল কিছুটা তুলে, সম্মুখে বক্ষঃস্থলে দৃষ্টি রেখে, মুদ্রিতনয়ন ও কেবল সত্ত্বগুণাবলম্বী হয়ে হৃদয়ে ধারণার অনুষ্ঠান করতে থেকে, ‘ওম্’ এই একাক্ষরাত্মক ব্ৰহ্মস্বরূপ, অবিনশ্বর ও পরম প্রভু নারায়ণকে স্মরণ করে সজ্জনেরও দুর্লভ ব্রহ্মলোকে গমন করলেন। তাঁর যাত্রাকালে আকাশে দুটি সূর্য বলে বোধ হল এবং তেজোপূর্ণ আকাশমণ্ডল যেন একরূপ বলে বোধ হতে লাগল। সেই দ্রোণের মৃত্যুসময়ে তাঁর তেজটা প্রথমে উল্কার মতো পৃথক হল, পরে নিমেষমাত্রে অন্তর্হিত হয়ে গেল। দ্রোণ ব্রহ্মলোকে চলে গেলে এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন মুগ্ধ হয়ে পড়লে, আনন্দিত দেবগণের মধ্যে ‘কিলকিলা’ ধ্বনি হতে লাগল। কেবলমাত্র পাঁচজন মানুষ দ্রোণের ব্রহ্মলোক যাত্রা দেখতে পেল; পৃথানন্দন অর্জুন, শরদ্বাণের পুত্র কৃপ, বৃষ্ণিবংশীয় কৃষ্ণ, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এবং গবলগণপুত্র সঞ্জয়—এই পাঁচজনই কেবল দ্রোণের মহাপ্রয়াণ দেখতে পেল। অরিন্দম দ্রোণাচার্য যোগাবলম্বন করে ঋষিশ্রেষ্ঠগণের সঙ্গে যে ব্ৰহ্মলোক চলে গেছেন, তা অজ্ঞানী লোক বুঝতে পারল না।

এদিকে দ্রোণের সমস্ত অঙ্গ বাণের আঘাতে ব্যথিত হয়েছিল, দেহ রক্তাক্ত ছিল এবং তিনি অস্ত্রত্যাগ করে উপবিষ্ট ছিলেন; এই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর দিকে ধাবিত হলে, সকলে তাঁকে ধিক্কার দিতে লাগল; তথাপি তিনি গিয়ে দ্রোণকে ধরলেন। তখন দ্রোণের প্রাণ চলে গিয়েছিল, দেহমাত্র অবশিষ্ট ছিল এবং তিনি কিছু বলতে পারেননি; সেই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন গিয়ে দ্রোণের কেশাকর্ষণ করে তরবারি দ্বারা মস্তক ছেদন করলেন। এইভাবে দ্রোণ নিপাতিত হলে, ধৃষ্টদ্যুম্ন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তরবারি ঘোরাতে ঘোরাতে সিংহনাদ করতে লাগলেন।। কান পর্যন্ত পাকা চুলে পরিপূর্ণ, দেহের বর্ণ শ্যাম, পঁচাশি বৎসর বয়সের দ্রোণাচার্য যোলো বছরের যুবকের মতো রণক্ষেত্রে বিচরণ করছিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন দ্রোণের দিকে যাচ্ছিলেন তখন মহাবাহু কুন্তীনন্দন অৰ্জুন বলেছিলেন, “দ্রুপদনন্দন, আপনি আচার্যকে বধ করবেন না, জীবিত অবস্থায় ওঁকে নিয়ে আসুন।” সৈন্যেরাও বলছিল যে, ‘বধ করবেন না, বধ করবেন না’ আর অর্জুন দয়ান্বিত হয়ে ‘বধ করবেন না, বধ করবেন না’ বলতে বলতে ধৃষ্টদ্যুম্নের পিছনে ছুটে যাচ্ছিলেন। এই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন গিয়ে রথস্থিত নরশ্রেষ্ঠ দ্রোণকে বধ করেছিলেন। তখন অস্তগামী রক্তবর্ণ সূর্যের মতো রক্তাক্ত দেহ দ্রোণাচার্য রথ থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের সেই মস্তকটা গ্রহণ করে কৌরবসৈন্যগণের সম্মুখে নিক্ষেপ করলেন। দ্রোণের কাটা মাথাটি দেখে কৌরবসৈন্যেরা দলে দলে যেদিকে পারল ছুটে পালাতে লাগল।

*

ধৃষ্টদুম্নের পিতৃকর্ম শেষ হল। বাল্য প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করে দ্রুপদ দ্রোণের প্রতি অন্যায় করেছিলেন। কৌরব-পাণ্ডব শিষ্যদের কাছে দ্রোণ গুরুদক্ষিণা চেয়েছিলেন দ্রুপদের বন্দিত্ব। ভীম-অর্জুন দ্রুপদকে বন্দি করে এনেছিলেন। দ্রোণ দ্রুপদের রাজ্যার্ধ কেড়ে নিয়ে তাঁকে সমান শক্তির অধিকারী করে দিয়েছিলেন। পরাজিত, অপমানিত দ্রুপদের ভয়ংকর যজ্ঞ থেকে উদ্ভূত হলেন দ্রোণের নিধনকারী ধৃষ্টদ্যুম্ন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দ্রুপদ নিহত হলেন দ্রোণের হাতে। পিতার অপমানকারী ও হত্যাকারী দ্রোণের মৃত্যু হল দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে। পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাব পিতৃঘাতক ধৃষ্টদ্যুম্নকে কীভাবে হত্যা করবেন দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা।

ঘটনাটি কিন্তু আকস্মিক নয়। বড় অদ্ভুত নিরাসক্ত অপক্ষপাত বিচারক ব্যাসদেব। শিষ্যত্ব না দেওয়া একলব্যের কাছে চরম গুরুদক্ষিণা গ্রহণ করেছিলেন দ্রোণ। তাঁর মৃত্যুর কারণ হবেন জেনেও দ্রোণ শিষ্যত্বে গ্রহণ করেছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে। দ্রোণের শিক্ষায় ধৃষ্টদ্যুম্ন হয়েছিলেন অতিরথ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবেরা গ্রহণ করলেন তাঁকে সেনাপতিরূপে। ধৃষ্টদ্যুম্ন হত্যা করলেন নিরস্ত্র যুদ্ধত্যাগী দ্রোণকে। একলব্যের অঙ্গুষ্ঠছেদ ও দ্রোণের মস্তক ছেদের ঘটনাকে ব্যাসদেব এক পরিণতিতে পৌঁছে দিলেন। পৃথিবীতে কৃত অপরাধের শাস্তি পৃথিবীতেই পেয়ে যেতে হবে। এই ব্যাসদেবের বিধান। অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি—দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ও শিখণ্ডীকে হত্যা করেছিলেন। উত্তরার গর্ভস্থ শিশু পরীক্ষিৎকেও দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন। অশ্বত্থামাও ফল পেয়েছিলেন। অমর হওয়া সত্ত্বেও কোনও ধর্মলোকে তাঁর স্থান হয়নি, পূতিগন্ধময় মলমূত্ররুধিরাক্ত অঞ্চলে তাঁর অমরত্ব কাল অতিবাহিত করতে হয়েছে।

দ্রোণের মহাপ্রয়াণ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে উঠে আসে যুধিষ্ঠিরের অর্ধসত্য বা অসত্য ভাষণ। “অশ্বত্থামা হতঃ ইতি গজঃ”—প্রথম দুটি শব্দে জোরে, পরের দুটি আস্তে। এই অর্ধ-সত্য উচ্চারণের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র ছল করে যুধিষ্ঠিরকে নরক-দর্শন করিয়েছিলেন, কিন্তু কীই-বা করতে পারতেন যুধিষ্ঠির। তাঁর আহ্বানে ভারতবর্ষের ‘ন্যায়-পরায়ণ’ ধর্মনিষ্ঠ রাজারা তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করতে এসেছেন। ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে দ্রোণ নির্বিচারে ব্রহ্মাস্ত্র অনভিজ্ঞ সেই সৈন্যবাহিনী ছারখার করে দিচ্ছেন। কৃষ্ণ এসে তাঁকে বারবার বলছেন, “দ্রোণ আর দুই প্রহর যুদ্ধ করলে আপনার সমস্ত সৈন্যবাহিনী ধ্বংস হবে। আপনি মিথ্যা বলুন, প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে আপনার মিথ্যা বলার পাপ হবে না।” নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেয়েও অন্যদের, পারিবারিক কনিষ্ঠদের, সাধারণ সৈন্যদের প্রাণ বাঁচানোর প্রয়োজন ছিল যুধিষ্ঠিরের।

দ্রোণের মহাপ্রয়াণ ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্লেষকের অর্জুনের ও কৃষ্ণের আচরণ বড় অদ্ভুত মনে হয়েছে। এই ঘটনায় অর্জুন ক্ষুব্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, “অন্যায়ভাবে বালিবধ করায় রামের যেমন চিরকাল অকীর্তি চলে আসছে, অন্যায়ভাবে দ্রোণবধ করায় আপনারও সচরাচর ত্রিভুবনে চিরকাল অকীর্তি থাকবে। এই পাণ্ডুনন্দন সর্বধর্মসম্পন্ন, বিশেষত আমার শিষ্য। সুতরাং এ মিথ্যা বলবে না—এই বিশ্বাস দ্রোণ আপনার উপর করতেন।”

অর্জুন দ্রোণের সর্বাপেক্ষা প্রিয় শিষ্য ছিলেন। কিন্তু দ্রোণ অর্জুনকে সর্বপেক্ষা সত্যবাদী বলে মনে করতেন না। তাই অশ্বত্থামার মৃত্যু সম্পর্কে প্রশ্ন তিনি যুধিষ্ঠিরকেই করেছিলেন। অর্জুন রামচন্দ্রের বালিবধকে অকীর্তি বলেছেন। কারণ বালি সুগ্রীবের সঙ্গে সংগ্রামরত থাকার সময়ে অদৃশ্য অবস্থায় থেকে রামচন্দ্র বালিবধ করেছিলেন। অর্জুন কি একই কাজ করেননি? ভূরিশ্রবা সাত্যকির সঙ্গে সংগ্রামরত থাকার সময়, সাত্যকি যখন পরাজিত, ভূরিশ্রবা তরবারি সমেত দক্ষিণ হস্ত তুলেছেন তাঁকে আঘাত করবেন বলে, তখন কি অর্জুন অদৃশ্য থেকে কী ভূরিশ্রবার হস্ত কেটে ফেলেননি? ভীম যথার্থই বলেছিলেন, “অর্জুন তুমি নিজপক্ষের দোষ দেখতে পাও না।”

আশ্চর্য লাগে, অর্জুন মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অতিরথ। তিনি নিজমুখেই বলেছেন, “পিনাকপাণি মহাদেব ভিন্ন আমার তুল্য ধনুর্ধর ত্রিলোকে নেই।” এবং সেকথা সত্যও। তা হলে ব্রহ্মাস্ত্র অনভিজ্ঞ সৈন্যদের ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে দ্রোণ যখন নির্বিচারে হত্যা করছেন, তখন অর্জুন আপন পক্ষের সৈন্যদের রক্ষা করছেন না কেন? তিনি তো সেদিন সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধে অন্যত্র ছিলেন না। তা হলে তিনি কি দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন? তাও তো নয়, দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও আমরা অর্জুনকে দেখেছি। তা হলে নির্বাক হয়ে দর্শকের মতো অৰ্জুন কীভাবে এ ঘটনা ঘটতে দেখলেন?

অর্জুন নিজের পরিচয় দিতেন তিনি যুধিষ্ঠিরের “ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ” বলে। অর্থাৎ যুধিষ্ঠির তাঁর ধর্মগুরু ছিলেন। দ্ৰোণ অস্ত্রগুরু। ধর্মগুরুকে দিয়ে অর্ধ-সত্য বলানোর অবস্থা অর্জুন হতে দিলেন কেন? আর কৃষ্ণ? যিনি যুদ্ধের তৃতীয় দিনে সুদর্শনচক্র নিয়ে ভীষ্মের দিকে ছুটে গেছিলেন, তিনি কেবল যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা বলার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন কেন? কেন অর্জুনের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলেন না? অর্জুনকে দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধে উত্তেজিত করলেন না?

আসলে অবচেতন মনে এঁরা সবাই যুধিষ্ঠিরকে মাটিতে নামিয়ে আনতে চাইছিলেন। যুধিষ্ঠির এতটাই উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন যে, তাঁকে স্পর্শ করাও কঠিন ছিল। যুধিষ্ঠির তখন অর্জুনের বিচার করেননি, পরে করেছেন। তাঁর আগে নিজ পক্ষকে বাঁচানো প্রয়োজন। ভীম, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, এমনকী কৃষ্ণও তাঁকে বারবার বলছেন, “আপনি মিথ্যা বলুন।” যুধিষ্ঠিরের বিচারে দ্রোণ ধর্মাচারী ছিলেন না। তিনি বহু অন্যায় করেছেন। বর্তমানেও ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে অনভিজ্ঞ সৈন্যদের সঙ্গে অন্যায় যুদ্ধ করছিলেন। ঋষিরা দ্রোণকে সেকথা বলেছিলেন। সুতরাং এই অন্যায়কে থামাতে যুধিষ্ঠিরকে বলতেই হল—“অশ্বত্থামা হতঃ ইতি গজঃ।” এ ঘটনার জন্য যুধিষ্ঠির আমাদের চোখে বিন্দুমাত্র ছোট হয়ে যাননি। অর্জুনকে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন পরে।

দ্রোণের মৃত্যুর পর পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অশ্বত্থামা নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। নারায়ণাস্ত্র বৃদ্ধি পেতে পেতে পাণ্ডবসৈন্য ক্ষয় করতে লাগল। সৈন্যেরা চৈতন্যশূন্য হয়ে পলায়ন করতে লাগল। অর্জুন সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে আছেন দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে পলায়ন করতে বললেন। কৃষ্ণ নিজের উপযুক্ত কাজ নিজেই করবেন। যুধিষ্ঠির তখন সৈন্যদের সম্বোধন করে বললেন, “হে সৈন্যগণ, আমি তোমাদের সকলকে বলছি, যুদ্ধ কোরো না; আমি ভ্রাতাদের সঙ্গে অগ্নিতে প্রবেশ করব। ভীরুজনের দুস্তর ভীষ্ম ও দ্রোণরূপ সমুদ্র পার হয়ে এখন পরিজনবর্গের সঙ্গে অশ্বত্থামারূপ গোষ্পদের জলে নিমগ্ন হব। আমার সম্পর্কে অর্জুনের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। কারণ, আমি আমাদের মঙ্গলকারী আচার্যকে যুদ্ধে নিপাতিত করেছি। যে দ্রোণ, বালক ও যুদ্ধে অপটু অভিমন্যুকে যুদ্ধনিপুণ বহুতর হিংস্র লোকদ্বারা বধ করিয়েছেন, রক্ষা করেননি। দ্রৌপদী দ্যূতসভায় গিয়ে নিজের দাসীভাব নিবারণ করার জন্য বিশেষভাবে প্রশ্ন করতে লাগলেও পুত্রের সঙ্গে যে দ্রোণ তাঁকে উপেক্ষা করেছিলেন; অর্জুনের অশ্বগুলি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লে দুর্যোধন অর্জুনকে বধ করতে চেয়েছিল, তখন যে দ্রোণ জয়দ্রথকে রক্ষা করবার ছলে সেইভাবে অক্ষয় কবচ বন্ধন করে দিয়ে দুর্যোধনকে রক্ষা করেছিলেন; ব্রহ্মাস্ত্রানভিজ্ঞ লোক সত্যজিৎ প্রভৃতি পাঞ্চালেরা যখন আমার জয়ের জন্য যুদ্ধ করছিল, তখন ব্রহ্মাস্ত্র অভিজ্ঞ যে দ্রোণ তাঁদের বধ করেছেন। কৌরবেরা অধর্ম করে আমাদের যখন রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেছিলেন, তখন যে দ্রোণ কেবলমাত্র বারণ করেছিলেন; কিন্তু আমাদের সঙ্গে আসেননি, অথচ আমরা চেয়েছিলাম যে তিনি আমাদের সঙ্গে আসুন; আমাদের সেই পরমস্নেহকারী দ্রোণ নিহত হয়েছেন কিনা, সুতরাং আমি বন্ধুবর্গের সঙ্গে তাঁর জন্য প্রাণত্যাগ করব।”

মহাভারতের কোনও স্থানে কোনও গুরুজনস্থানীয় ব্যক্তি সম্পর্কে যুধিষ্ঠির এতখানি ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। যুধিষ্ঠির আরও বলতে পারতেন যে, শর্তানুযায়ী তেরো বছর পর বনবাস ও অজ্ঞাতবাসের পর ফিরে এলেও ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ তাঁদের রাজ্য—তাঁদের নিজের রাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থও তাঁদের ফিরিয়ে দেননি। শুধু তাই নয়, তাঁদের নিজ রাজ্য ফিরিয়ে দেবার পরিবর্তে তাঁদের হত্যা করতে এসেছেন। কোনও বীরপুরুষ এ কাজ করতে পারে? কিছু কিছু মহাভারতচর্চাকার মন্তব্য করেন—যুধিষ্ঠির ছলে বলে কৌশলে রাজ্য ফিরে পেতে চেয়েছিলেন। কার রাজ্য? নিজের রাজ্য? অন্যায়কারীরা তা ফিরিয়ে না দিলে অবশ্যই বলপ্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু ছল কৌশল যুধিষ্ঠিরের ছিল না। তিনি ক্ষত্রিয় রাজা, শর্তানুসারে তাঁর রাজ্য ফিরে পাবার কথা। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ জানতেন যে, তাঁরা অন্যায়কারীর পক্ষ নিয়েছেন। তাঁরা অন্নদাসের মতো, নপুংসকের মতো পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরের জয় কামনা করতে। কৃপাচার্য অবধ্য ছিলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। যুদ্ধের পূর্বে তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, “যুধিষ্ঠির আমি অবধ্য। কিন্তু আমি প্রতিদিন প্রাতঃস্নানের সময় তোমার জয় কামনা করব।”

দ্রোণের মৃত্যু অনিবার্য ছিল। কারণ বহু কারণে দ্রোণ ধর্মচ্যুত হয়েছিলেন। সেই অস্ত্রশিক্ষার সময়ে একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ-ছেদনের ঘটনা থেকেই। এ মৃত্যু আকস্মিকও নয়— অস্বাভাবিকও নয়।

৭৬
যুধিষ্ঠির ও অর্জুন কলহ

যুধিষ্ঠির কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও আহত হয়েছেন শুনে, ভীমসেনের পরামর্শে কৃষ্ণ ও অর্জুন— যেখানে রাজা যুধিষ্ঠির ছিলেন, সেই দিকে গরুড়ের তুল্য বেগবান অশ্বগণের গুণে শীঘ্র অপেক্ষা শীঘ্রতর গমন করতে লাগলেন।

তারপর পুরুষপ্রবীর কৃষ্ণ ও অর্জুন গিয়ে একাকী শয়িত যুধিষ্ঠিরকে দেখে দুজনেই রথ থেকে নেমে তাঁর চরণযুগলে নমস্কার করলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ ও ব্যাঘ্রের ন্যায় তেজস্বী যুধিষ্ঠিরকে কুশলী দেখে, অশ্বিনীকুমারেরা যেমন ইন্দ্রের কাছে উপস্থিত হন, সেইরকম কৃষ্ণ ও অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ক্রমে সূর্য যেমন অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে অভিনন্দিত করেন এবং মহাসুর জন্তু নিহত হলে বৃহস্পতি যেমন ইন্দ্র ও বিষ্ণুকে অভিনন্দিত করেছিলেন, সেইরকম যুধিষ্ঠিরও কৃষ্ণ এবং অর্জুনকে অভিনন্দিত করলেন। তখন যুধিষ্ঠির কর্ণকে নিহত মনে করে আনন্দিত হয়ে হর্ষগদগদবাক্যে বলতে লাগলেন, “কৃষ্ণ! সুখে এসেছ তো? অর্জুন, তোমারও আসতে কোনও কষ্ট হয়নি তো? তোমাদের দু’জনকে দেখে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হচ্ছি। তোমরা অক্ষতদেহে এবং নির্বিঘ্নে কর্ণকে বধ করেছ তো? যিনি যুদ্ধে সর্পের ন্যায় তেজস্বী, সর্বশাস্ত্রবিশারদ এবং সমস্ত ধার্তরাষ্ট্রের অগ্রগামী, সুখজনক ও বর্মের মতো রক্ষক ছিলেন; ধনুর্ধর বৃষসেন ও সুষেণ যাঁকে রক্ষা করতেন। ‘মহাবল ও অস্ত্রে অতিদুর্জয় হও’, বলে পরশুরাম যাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন; যিনি ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের রক্ষক, সৈন্যসম্মুখগামী, বিপক্ষসৈন্যহন্তা ও শত্রুগণমর্দক ছিলেন; যিনি দুর্যোধনের হিতে নিরত ও আমাদের অনিষ্ট করতে উদ্যত থাকতেন। আর যিনি মহাযুদ্ধে ইন্দ্রের সঙ্গে দেবগণেরও অজেয়, তেজে অগ্নির তুল্য, বলে বায়ুর সমান, গাম্ভীর্যে পাতালের সদৃশ, বন্ধুবর্গের আনন্দবর্ধক ও শত্রুগণের পক্ষে যমের মতো ছিলেন; তোমরা মহাযুদ্ধে ভাগ্যবশত সেই কর্ণকে বধ করে অসুরবিজয়ী দুই দেবতার মতো এখানে এসেছ। কৃষ্ণ! অর্জুন! সৰ্বলোক জিঘাংসু যমের মতো কর্ণ আজ আমার সঙ্গে ভয়ংকর যুদ্ধ করছিলেন; কিন্তু আমি তাতে কাতর হইনি। বীর সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল, সহদেব, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীর পুত্রগণ ও সমস্ত পাঞ্চালদের সামনেই কর্ণ আমার ধ্বজ-ছেদন পৃষ্ঠসারথিবধ ও অশ্বগণ-বিনাশ করেছিলেন। আমি মহাযুদ্ধে জয়লাভের চেষ্টাই করছিলাম; কিন্তু মহাবীর কর্ণ সাত্যকি প্রভৃতিকে এবং অন্যান্য বহু শত্রুকে জয় করে আমাকে জয় করেছেন। পরে যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ কর্ণ আমার অনুসরণ এবং নিশ্চয়ই তিরস্কার করে সেই সেই স্থানে অনেক নিষ্ঠুর বাক্য বলেছে। অর্জুন বেশি বলে কী করব? আমি ভীমের প্রভাবে যে জীবিত আছি, তা আর সহ্য করতে পারছি না। ধনঞ্জয়, আমি আজ তেরো বৎসর যাবৎ যার ভয়ে রাত্রিতে নিদ্রা যেতে পারি না এবং দিনে কোনও সময়েই সুখ পাই না, সেই কর্ণের বিদ্বেষানলে সর্বদাই দগ্ধ হচ্ছি। মেষ বিশেষ যেমন নিজের মরণের জন্য বলিস্থানে যায়, আমিও তেমন নিজের মরণের জন্য রণস্থলে গিয়েছিলাম।

“আমি কীভাবে কর্ণকে যুদ্ধে বিনাশ করতে পারব এইরূপ চিন্তা করতে করতেই আমার এই দীর্ঘকাল অতীত হয়েছে। জাগরণ বা স্বপ্ন সব সময়েই আমি সর্বত্রই কর্ণকে দেখি, এমনকী এই জগৎটাকে আমি কর্ণময় দেখে থাকি। পার্থ যুদ্ধে অপলায়ী সেই বীর আমাকে জয় করে অশ্ব ও রথের সঙ্গে জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছেন। যুদ্ধশোভী কর্ণ আজ এরূপ তিরস্কার করায় আমার জীবনের বা কী প্রয়োজন, আর রাজ্য দিয়েই বা কী হবে? আমি পূর্বে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ থেকে যে বিড়ম্বনা পাইনি, আজ মহারথ কর্ণ থেকে সেই বিড়ম্বনা পেয়েছি। অতএব অর্জুন, আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি— আজ তুমি যেভাবে অক্ষত দেহে এসেছ এবং যেভাবে কর্ণকে বধ করেছ, সেই সমস্ত বৃত্তান্ত আমার কাছে বলো। যুদ্ধে ইন্দ্রের তুল্য বলবান, পরাক্রমে যমের সমান এবং অস্ত্রে পরশুরামের তুল্য কর্ণকে তুমি কী করে বধ করলে? কর্ণ মহারথ বলে বিখ্যাত, সর্বযুদ্ধ বিশারদ এবং সমস্ত ধনুর্ধরের মধ্যে প্রধান ও অদ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন। এ যাবৎ পুত্রগণের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র তোমাকে বধ করবার জন্যই কর্ণকে সম্মান করে এসেছেন। তুমি সেই কর্ণকে কীভাবে বধ করলে? দুর্যোধন সর্বদাই সমস্ত যুদ্ধে পুরুষশ্রেষ্ঠ কর্ণকে তোমার মৃত্যুজনক বলে মনে করেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ পার্থ, তুমি কী করে সেই কর্ণকে কাতর করলে? এবং যে প্রকারে এঁকে বধ করেছ, তা আমার কাছে বলো। ব্যাঘ্র যেমন হরিণের মস্তক হরণ করে, তুমিও সেইরকম বন্ধুগণের সামনেই যুদ্ধরত কর্ণের মস্তক হরণ করেছ তো? সূতপুত্র কর্ণ যুদ্ধে তোমাকে পাবার ইচ্ছায় সমস্ত দিক ও বিদিক অন্বেষণ করছিল এবং যে তোমাকে দেখিয়ে দেবে, তাকে একটা হাতি ও ছ’টা গোরু দিতে চেয়েছিল, সেই দুরাত্মা কর্ণ এখন তোমার সুতীক্ষ্ণ বাণে নিহত হয়ে রণস্থলে ভূমিতে শয়ন করে আছে তো? তুমি যুদ্ধে কর্ণকে বধ করে আমার পরম প্রিয় কার্য করেছ। বলমত্ত ও গর্বিত যে কর্ণ তোমাকে অন্বেষণ করবার জন্য রণস্থলের সর্বত্র ভ্রমণ করেছিল, তুমি যুদ্ধে উপস্থিত হয়ে সেই বীরাভিমানী কর্ণকে বধ করেছ তো?

“বৎস, যে তোমার সংবাদ জানার জন্য অন্যান্য লোককে হস্তী, গো, অশ্বযুক্ত স্বর্ণময় উত্তম রথ দান করতে ইচ্ছা করেছিল, যে সর্বদা তোমার সঙ্গে স্পর্ধা করত, তুমি সেই পাপাত্মা কর্ণকে যুদ্ধে নিহত করেছ তো? বীরমদে মত্ত যে কর্ণ সর্বদাই কৌরবসভায় আত্মশ্লাঘা করত এবং দুর্যোধনের অত্যন্ত প্রিয় ছিল, সেই পাপিষ্ঠ কর্ণকে তুমি বধ করেছ তো? তুমি যুদ্ধে মিলিত হয়ে গাণ্ডিবনিক্ষিপ্ত রক্তপায়ী বাণসমূহ দ্বারা কর্ণের সমস্ত অঙ্গ বিদ্ধ করেছ তো? সেই পাপাত্মা শয়ন করেছে তো? দুর্যোধনের বাহুযুগল ভগ্ন হয়েছে তো? দর্পপূর্ণ যে কর্ণ দুর্যোধনকে আনন্দিত করার জন্য রাজগণমধ্যে সর্বদা আত্মশ্লাঘা করত এবং মোহবশত বলত, ‘আমি অর্জুনকে বধ করব, তার সেই বাক্য সত্য হয়নি তো?’ ‘যে পর্যন্ত অর্জুন বেঁচে থাকবে, সে পর্যন্ত আমি পাদপ্রক্ষালন করব না’ যে অল্পবুদ্ধি কর্ণের সর্বদা এই ব্রত ছিল, সেই কর্ণকে তুমি আজ বধ করেছ তো?

“দুর্বুদ্ধি কর্ণ দ্যূতসভায় কুরুবীরগণের মধ্যে দ্রৌপদীকে বলেছিল, ‘দ্রৌপদী তুমি অতিদুর্বল, পতিত ও অধ্যবসায়হীন পাণ্ডবগণকে পরিত্যাগ করছ না কেন?’ এবং ওই যে কর্ণ তোমার বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘আমি কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনকে বধ না করে শিবিরে আর আসব না’ সেই পাপবুদ্ধি কর্ণ তোমার বাণে বিদীর্ণদেহ হয়ে শয়ন করেছে তো? সঞ্জয় ও কৌরবগণের সম্মেলন সময়ের এই যুদ্ধের বৃত্তান্ত তুমি মেনেছ তো? সেই যুদ্ধে আমি এইরূপ অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছি। আজ তুমি উপস্থিত হয়ে সেই কর্ণকে বধ করেছ তো? সব্যসাচী তুমি গাণ্ডিব নিক্ষিপ্ত উজ্জ্বল বাণসমূহ দ্বারা যুদ্ধে অতিমন্দবুদ্ধি কর্ণের দেহ থেকে কুণ্ডলযুক্ত তেজস্বী মাথাটি ছেদন করেছ তো? আমি কর্ণের বাণে পীড়িত হতে থেকে তার বধের জন্য যে তোমাকে স্মরণ করছিলাম, তুমি কর্ণকে নিপাত করে আমার সেই স্মরণ করাকে আজ সফল করেছ তো? দর্পপূর্ণ দুর্যোধন কর্ণকে আশ্রয় করেই আমাদের প্রতি যে সহাস্য দৃষ্টিপাত করত, তুমি আজ পরাক্রম প্রকাশ করে দুর্যোধনের সেই আশ্রয় ভগ্ন করেছ তো? অতিদুর্মতি ও অতিক্ৰোধী যে কর্ণ পূর্বে সভামধ্যে কৌরবগণের সামনেই আমাদের ‘যণ্ড তিল’ বলেছিল, তুমি যুদ্ধে উপস্থিত হয়ে সেই সূতপুত্র কর্ণকে বধ করেছ তো? শকুনি দূতক্রীড়ায় দ্রৌপদীকে জয় করলে, যে দুরাত্মা সূতপুত্র বিকট হাস্য করে বলেছিল, ‘দুঃশাসন তুমি নিজে গিয়ে বলপূর্বক দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এসো’, তুমি আজ সেই কর্ণকে বধ করেছ কি? পিতামহ ভীষ্ম পৃথিবীর মধ্যে অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠতম ছিলেন; তিনি অর্ধ-রথ বলে গণনা করলে, যে অল্পচেতা তাঁকে নিন্দা করেছিল, মহাত্মা! তুমি কি সেই কর্ণকে বধ করেছ? অর্জুন, অসহিষ্ণুতায় উৎপন্ন এবং পরাভবরূপ বায়ুবেগে বর্ধিত ক্রোধানল সর্বদাই আমার হৃদয়ে আছে। সুতরাং, ‘আমি আজ যুদ্ধে সেই কর্ণকে বধ করেছি’ এই কথা বলে আমার ক্রোধানল নির্বাপিত করো। তুমি আমার কাছে সেই দুর্লভ বৃত্তান্ত বলো—তুমি কী প্রকারে কর্ণকে বধ করলে? বৃত্রাসুরকে বধ করলে ভগবান ব্রহ্মা যেমন ইন্দ্রকে প্রধান বীর বলে মনে করেছিলেন, সেইরকম আমিও তোমাকে সর্বদাই প্রধান বীর বলে মনে করব।”

ক্রুদ্ধ যুধিষ্ঠিরের সেই সকল কথা শুনে অসীমশক্তিশালী ও অতিরথ, মহাত্মা অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “মহারাজ, আমি আজ সংশপ্তক সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিলাম, এমন সময়ে অশ্বত্থামা বহু সহস্র সৈন্য ও লক্ষ লক্ষ বাণ নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। অশ্বত্থামা তাঁর সঙ্গে আটখানি গোরুর গাড়ি পূর্ণ করে বাণ এনেছিলেন। তিনি আমার বিরুদ্ধে যে সমস্ত বাণ নিক্ষেপ করলেন আমিও সে সমস্ত বাণই প্রতিহত করলাম। অশ্বত্থামা শিক্ষা, অস্ত্ৰক্ষেপের শক্তি ও যত্ন অনুসার আরও অনেক বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই সময়ে অশ্বত্থামা কখন বাণগ্রহণ ও সন্ধান করছিলেন; তা আমরা জানতে পারিনি। আর কোন হাতে—ডান হাতে না বাম হাতে তিনি বাণক্ষেপ করছিলেন, তাও আমরা বুঝতে পারিনি। আমি অশ্বত্থামার সমস্ত বাণ প্রতিহত করে, তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা তাঁর শরীর আচ্ছন্ন করলাম। তখন তাঁর দেহ শজারুর মতো দেখাতে লাগল। দেখতে দেখতে অশ্বত্থামার দেহ রক্তাপ্লুত হয়ে গেল। দেহ থেকে রক্ত নিঃসরণ করতে করতে অশ্বত্থামা কর্ণের সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করলেন। এই সময় বিপক্ষবিলোড়নকারী কর্ণ পঞ্চাশজন প্রধান রথীর সঙ্গে মিলিত হয়ে দ্রুত আমার দিকে আসতে লাগলেন। আমি কর্ণের সহচরদের জয় করে কর্ণকে পরিত্যাগ করে আগে আপনাকে দেখতে এসেছি। নরনাথ! প্রভদ্রকেরা কর্ণের কাছে গিয়ে হাঁ-করা যমের সামনে গিয়ে পড়েছে। কর্ণ সাতশো প্রভদ্রক রথীকে যমালয়ে পাঠিয়েছেন। কারণ আমাকে না দেখা পর্যন্ত কর্ণ বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন হননি। কর্ণ আপনাকে দেখেছিলেন এবং আপনি তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে মিলিত হয়েছিলেন। ইতিপূর্বে অশ্বত্থামার বাণে আপনার দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল তাও আমি শুনেছি। তাই আপনাকে আমি বলতে এসেছিলাম ক্রূরস্বভাব কর্ণের কাছে আপনার যাওয়ার সময় হয়নি। মহারাজ, আমি যুদ্ধে কর্ণের সেই ভার্গবাস্ত্র দেখেছি। সঞ্জয়দের মধ্যে অন্য কোনও যোদ্ধা নেই যিনি আজ কর্ণকে জয় করতে পারেন। মহাপ্রভাবশালী রাজা, আজ আমি কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। আপনিও আসুন ও সেই যুদ্ধ নিজে দেখুন। আজ আমি যুধ্যমান কর্ণকে তার বন্ধুবর্গের সঙ্গে যদি বধ না করি তা হলে— যে ব্যক্তি কোনও কার্যের অঙ্গীকার করে, তা না করে, সেই ব্যক্তির যে গতি হয়, আমি যেন সেই কষ্টজনকগতি লাভ করি। রাজশ্রেষ্ঠ, এর পরে ধার্তরাষ্ট্রেরা আর্য ভীমসেনকে গ্রাস করতে পারে। সুতরাং আমি আপনার কাছে যুদ্ধে যাবার অনুমতি চাইছি। আপনি জয়ের আশীর্বাদ করুন; আমি যেন কর্ণকে, তাঁর সৈন্যগণকে, এবং সমস্ত শত্রুগণকে বধ করতে পারি।”

অমিততেজা পৃথানন্দন যুধিষ্ঠির কর্ণের বাণে পীড়িত ছিলেন। সুতরাং তিনি মহাবল কর্ণ অক্ষত আছেন শুনে অর্জুনের উপরে ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে বললেন, “দয়ার পাত্র! তোমার সৈন্যরা পালিয়েছে! তুমিও সৈন্য ফেলে অসঙ্গতভাবে এখানে এসেছ, কর্ণকে বধ করতে পারনি, একাকী ভীমকে শক্ৰমধ্যে রেখে পালিয়ে এসেছ। অর্জুন, তুই যখন যুদ্ধে ভীমকে ত্যাগ করে ফেলে এসেছিস এবং কর্ণকে বধ করতে পারিসনি, তখন অসাধুভাবে কুন্তীর উদরে প্রবেশ করে তাঁর গর্ভকে কলঙ্কিত করেছিস! তুই দ্বৈতবনে সেই যে বলেছিলি— আমি এক রথেই কর্ণ বধ করব। তবে আজ তুমি কর্ণকে ভয় পেয়ে তখন তাঁকে ত্যাগ করে ভীমসেনকে ছেড়ে পালিয়ে এলে? তুমি যদি দ্বৈতবনেও এই কথা বলতে, ‘রাজা, আমি কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ হব না!’ তবে আমরা তখনই কালোচিত কর্ম করতাম। তুমি আমার কাছে কর্ণবধের অঙ্গীকার করে, অঙ্গীকার পালন করলে না। অথচ তুমি আমাদের শত্রু মধ্যে এনে উপরে তুলে অগ্নিস্থাপনের স্থলে ফেলে দিলে। আমরা বহুতর মঙ্গলময় অভীষ্ট বিষয় লাভ করার জন্য তোমার উপর আশা করেছিলাম; কিন্তু ফলার্থী ব্যক্তির কাছে অধিক পুষ্পশালী ব্যক্তি যেমন বিফল হয়, সেই রকম আমাদের সে সমস্তই বিফল হয়েছে।

“আমি রাজ্যার্থী ছিলাম। জেলে যেমন বঁড়শির মুখে খাদ্য ঝুলিয়ে মাছকে ডাকে, শত্রু যেমন ভাল করে খাদ্যের মধ্যে বিষ দিয়ে ডাকে, তেমনই তুমি আমাকে রাজ্যের লোভ দেখিয়ে টেনে এনেছ। বীজ পুঁতে গৃহস্থ যেমন দেবদত্ত বৃষ্টির আশায় জীবন ধারণ করে, আমরাও তেমনই এই তেরো বৎসর যাবৎ তোমাকে লক্ষ্য করে আশায় আশায় সর্বদা জীবন ধারণ করে আছি। কিন্তু তুমি আমাদের সকলকেই নরকে ডুবিয়ে দিয়েছ। মন্দবুদ্ধি! তোমার জন্মের পর সপ্তম দিনে আকাশবাণী কুন্তী দেবীকে যা যা বলেছিল, ‘কুন্তি! তোমার এই পুত্র ইন্দ্রের তুল্য বিক্রমশালী হবে এবং সমস্ত বীর শত্রুকে জয় করবে। এই বালক যথাকালে মহাতেজা হয়ে খাণ্ডবদাহের সময়ে দেবগণ ও সকল প্রাণীকে জয় করবে; মদ্র, কেকয়, কলিঙ্গদের পরাভূত করবে এবং রাজাদের মধ্যে কৌরবসৈন্যদের বধ করবে। এর থেকে কেউ প্রধান ধনুর্ধর হবে না, কোনও প্রাণী একে জয় করতে পারবে না এবং স্বাধীনচেতা ও যথাকালে সমগ্র ধনুর্বেদবিদ্যা সমাপ্তকারী এই বালক ইচ্ছা করলে সমস্ত প্রাণীকে বশীভূত করতে পারবে। আর কুন্তী! তোমার এই পুত্র— সৌন্দর্যে চন্দ্রের, বেগে বায়ুর, ধৈর্যে সুমেরুর, ক্ষমায় পৃথিবীর, তেজে সূর্যের, সম্পদে কুবেরের, শৌর্যে ইন্দ্রের এবং বলে বিষ্ণুর ন্যায় শক্ৰহন্তা হবে। আর এই বালক যথাকালে অমিততেজা হয়ে আত্মীয়গণের জয় ও শত্রুগণের পরাজয়ের জন্য বিখ্যাত ও বংশরক্ষক হবে।’

“অর্জুন, তপস্বীরা শুনছিলেন, এই অবস্থায় শতশৃঙ্গ পর্বতের উপরে আকাশবাণী এই কথা বলেছিল। কিন্তু তোমার তা হয়নি। সুতরাং দেবতারাও মিথ্যা কথা বলেন, এই স্বীকার করে নিতে হবে। অন্যান্য প্রধান ঋষিরাও সর্বদা তোমার প্রশংসা করতেন। সুতরাং তাঁদের মুখে সেই কথা শুনেই আমি দুর্যোধনের কাছে অবনত হইনি। কিন্তু তখনও আমি জানতাম না যে, তুমি কর্ণের ভয়ে আকুল। পূর্বে দুর্যোধন বলতেন, ‘অর্জুন যুদ্ধে মহাবল কর্ণের সামনে থাকতে পারবে না; কিন্তু আমি মূর্খতাবশত তখন তা সত্য বলে বুঝতে পারিনি।’ আমি আজ শত্রুবর্গের মধ্যে নরকে প্রবেশ করেছিলাম, নরকতুল্য পরাজয় অনুভব করেছিলাম। তার জন্য গুরুতর এমনকী অপরিমেয় অনুতাপ ভোগ করতে হবে। অর্জুন, তখনই তোর আমাকে বলা উচিত ছিল যে, আমি কোনও প্রকারেই কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সমর্থ হবে না। তা হলে, আমি আর যুদ্ধ করবার জন্য সঞ্জয় ও কেকয় প্রভৃতি সুহৃদগণকে ডেকে আনতাম না। এখন এই অবস্থায় আমি কর্ণের যুদ্ধের কী উপায় করতে সমর্থ হব। এবং রাজা দুর্যোধন ও অন্য যাঁরা আমার সঙ্গে বহু যুদ্ধ করবার ইচ্ছায় এসেছেন, তাঁদের যুদ্ধেরই বা কী উপায় অবলম্বন করব। কৃষ্ণ, আমার জীবনে ধিক, যে আমি আজ কর্ণের বশীভূত হয়েছিলাম। অর্জুন তোমার পুত্র বীরশ্রেষ্ঠ অভিমন্যু বেঁচে থাকলে, সে-ই এই মহারথদের বধ করত। আমি যুদ্ধে পরাভূত হতাম না। ঘটোৎকচও যদি বেঁচে থাকত, তা হলে আমি যুদ্ধে পরাজিত হতাম না। আমি পূর্বে যে সকল প্রবল পাপ করেছিলাম, এখন যুদ্ধে সেগুলি আমার দুর্ভাগ্য রূপে পরিণত হচ্ছে। দুরাত্মা কর্ণ আজ তোমাকে তৃণের তুল্য গণনা করে আমাকে এইরূপ পরাভূত করেছে। যে-লোক বিপন্ন ও স্নেহযুক্ত লোককে বিপদ থেকে মুক্ত করে, সেই বন্ধু এবং সেই সুহৃদ, একথা প্রাচীন ঋষিরা বলে থাকেন এবং সজ্জনেরাও সর্বদাই এই নিয়মের অনুষ্ঠান করেন। স্বয়ং বিশ্বকর্মা যা নির্মাণ করেছেন এবং যার চক্রগুলি শব্দ করে না, তুমি সেই মঙ্গলময় কপিধ্বজ রথে আরোহণ করে এবং স্বর্ণপট্টবেষ্টিত তরবারি ও হস্তচতুষ্টয়প্রমাণ এই গাণ্ডিবধনু ধারণ করে কৃষ্ণকর্তৃক চালিত হয়েও কেন কর্ণের ভয়ে পালিয়ে এলে? দুরাত্মা! তুই যদি এই ধনু কৃষ্ণকে দিয়ে যুদ্ধে ওঁর সারথি হতিস, তা হলে বজ্রধারী ইন্দ্র যেমন বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন, সেইরকম কৃষ্ণ উগ্রমূর্তি কর্ণকে বধ করতেন। অর্জুন তুই যদি আজ রণস্থলে বিচরণকারী ভীষণমুর্তি কর্ণের দিকে ধাবিত হতে অসমর্থ হয়ে থাকিস, তা হলে যে রাজা তোর থেকে অস্ত্রে অধিক, তাঁকে আজই এই গাণ্ডিবধনু দান কর। পাণ্ডুনন্দন! তা হলে আমরা আর পুত্রকলত্রশূন্য হয়ে রাজ্যনাশ নিবন্ধন সমস্তসুখভ্রষ্ট হয়ে পাপীজনসেবিত অগাধ নরকে পতিত হব না, বনে যাব না, সে অবস্থায় লোকেও আমাদের দেখবে না। দুরাত্মা রাজপুত্র! তুই যদি পঞ্চম মাসে কুন্তীর গর্ভ থেকে পতিত হতিস, কিংবা গুরুতর কষ্টজনক কুন্তীর গর্ভে জন্মগ্রহণ না করতিস, তা হলে তোর ভাল হত। কেন না, তা হলে তোকে আর যুদ্ধ থেকে পালাতে হত না। অতএব তোর গাণ্ডিবে ধিক?”

যুধিষ্ঠর এরূপ বললে, কুন্তীনন্দন অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বধ করবার ইচ্ছা করে তরবারি ধারণ করলেন। তখন পরচিত্তজ্ঞ কৃষ্ণ অর্জুনের ক্রোধ দেখে বললেন, “কিমিদং পার্থ! গৃহীতঃ খড়্গ ইত্যুত।”— অর্জুন তুমি এ তরবারি ধারণ করলে কেন? “ধনঞ্জয় তোমার যুদ্ধ করবার মতো কাউকেই তো দেখছি না। কারণ, বুদ্ধিমান ভীমসেনই তো ধার্তরাষ্ট্রদের আক্রমণ করেছেন। কুন্তীনন্দন, রাজাকে দেখতে হবে বলে তুমি রণস্থল থেকে চলে এসেছ, সে রাজাকেও দেখেছ, তিনিও কুশলে আছেন। ব্যাঘ্রের ন্যায় বিক্রমশালী সে রাজশ্রেষ্ঠকে দর্শন করায় আনন্দের সময়ই উপস্থিত হয়েছে। তবে তোমার ক্রোধ এল কেন? এখানে তোমার বধ্য কোনও ব্যক্তিই দেখছি না; তবে তুমি ত্বরান্বিত হয়ে মহা তরবারি ধারণ করলে কেন? তুমি কী করবার ইচ্ছা করেছ?”

কৃষ্ণ একথা বললে ক্রুদ্ধ অর্জুন সর্পের মতো শ্বাসত্যাগ করে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণকে বললেন, “আমার গুপ্ত প্রতিজ্ঞা আছে, যে লোক আমাকে নির্দেশ করবে যে, অন্য ব্যক্তিকে গাণ্ডিব দাও—আমি তার শিরচ্ছেদ করব। অমিতপরাক্রম কৃষ্ণ, এই রাজা তোমার সমক্ষেই আমাকে তা বলেছেন। সুতরাং, আমি তা উপেক্ষা করতে পারি না। আমি ধর্মভীরু, এই রাজাকে বধ করব; এই নরশ্রেষ্ঠকে বধ করে আমি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব। যদুনন্দন জনার্দন, এই জন্যই আমি তরবারি ধারণ করেছি। আমি যুধিষ্ঠিরকে বধ করে সত্যের কাছে অঋণী, নিঃশোক ও নিঃসন্তাপ হব। তুমিই বা এই সময়ে কী উচিত মনে করো? জগৎপিতা! তুমি জগতের ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সমস্তই জানো। তুমি আমাকে যা বলবে, তাই করব।”

তখন কৃষ্ণ অর্জুনকে ‘ধিক ধিক’ বলে আবার বলতে লাগলেন, “পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন, এখন বুঝলাম— তুমি বৃদ্ধসেবা করনি। যেহেতু তুমি অসময়ে ক্রুদ্ধ হয়েছ। অর্জুন তুমি ধর্মভীরু নিশ্চয়ই, কিন্তু অপণ্ডিত। তুমি আজ যা করতে উদ্যত হয়েছিলে— ধর্মের উভয় অংশ যিনি জানেন তিনি এমন করেন না। যে লোক অসাধ্য বিহিত কার্য ও সাধ্য নিষিদ্ধ কার্য করতে উদ্যত হয়, সে পুরুষের অধম। শিষ্যেরা এসে সেবা করলে যাঁরা ধর্মানুসারে উপদেশ দিয়ে থাকেন, ধর্মের সংক্ষেপ ও বাহুল্য অভিজ্ঞ সেই সেই বৃদ্ধগণের ধর্ম নিরূপণ তুমি জানো না। সেই নিরূপণ অনভিজ্ঞ লোক কর্তব্য ও অকর্তব্য নিরূপণে অসমর্থ হয়ে ভ্রমে পতিত হয়; যেমন তুমি এখন ভ্রমে পতিত হয়েছ। দেখো—মানুষ কোনও প্রকারেই অনায়াসে কর্তব্য ও অকর্তব্য বুঝতে পারে না। কিন্তু বৃদ্ধের উপদেশ শুনে সবই বুঝতে পারে। তুমি বৃদ্ধের উপদেশ শোনোনি, তাই বুঝতে পারছ না। তুমি ধর্মবিৎ হবার চেষ্টা করছ, যথার্থ ধর্ম না জেনে ধর্মরক্ষার চেষ্টা করছ। প্রাণীবধ করা যে ধর্ম নয়, তাও তুমি বুঝতে পারছ না। বরং মিথ্যা কথা বলবে, কিন্তু প্রাণীবধ করবে না। আজ নীচবুদ্ধি ব্যক্তির মতো তুমি— জ্যেষ্ঠভ্রাতা, রাজা ও ধর্মজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে কেমন করে বধ করবে? ভরতনন্দন, অযুধ্যমান, অশত্রু, পরাঙ্মুখ, পলায়মান, শরণাগত, কৃতাঞ্জলি, বিপদাপন্ন ও অসাবধান লোককে বধ করার প্রশংসা সজ্জনেরা করেন না। অথচ সে সমস্ত অবস্থাগুলি তোমার এই জ্যেষ্ঠভ্রাতার উপরে আছে। তুমি মূর্খের ন্যায় পূর্বে ওই প্রতিজ্ঞা করেছিলে, সেই জন্যই এখন মূর্খতাবশতই অধর্মের কাজ করতে প্রবৃত্ত হয়েছ। তুমি ধর্মের সূক্ষ্ম ও দুর্গম অবস্থা না বুঝে গুরুহত্যা করতে চলেছ। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম, বিদুর, যুধিষ্ঠির বা কুন্তী দেবী যে ধর্মকথা বলতে পারেন, তোমাকে আমি সেই ধর্মকথা বলব। সত্য বলা ভাল। কেন না, সত্য অপেক্ষা উত্তম নেই। কিন্তু সজ্জনের অনুষ্ঠিত সে সত্যকে যথার্থরূপেই অতিদুর্জ্ঞেয় বলে জানবে। যে স্থলে মিথ্যা বলাটা সত্যের ন্যায় উপকারী হয়, কিন্তু সত্য বলাটা মিথ্যা বলার তুল্য অপকারী হয়ে পড়ে, সে স্থলে সত্য বলবে না, মিথ্যাই বলবে। প্রাণনাশে ও বিবাহস্থলে মিথ্যা কথা বলা যেতে পারে এবং সর্বস্বাপহরণকালে মিথ্যা বলা যেতে পারে।

বিবাহকালে রতিসম্প্রয়োগে প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে।

বিপ্রস্য চার্থে হ্যনৃতং বদেত পঞ্চানৃত্যান্যাহুর পাতকানি॥ কর্ণ: ৫১: ৩৩॥

মহর্ষিরা বলেন— বিবাহবিষয়ে, রমণসম্পর্কে, প্রাণনাশস্থলে, সর্বস্বাপহরণক্ষেত্রে এবং সজ্জনের উপকারার্থে মিথ্যা কথাও বলা চলে। এই পাঁচ বিষয়ের মিথ্যা কথা পাপ উৎপাদন করে না।

“কারণ, সেই পাঁচটি বিষয়ে মিথ্যা, সত্য বলার ন্যায় উপকারী হয় এবং সত্য বলা মিথ্যা বলার তুল্য অপকারী হয়ে থাকে। অতএব মূৰ্খলোক তাদৃশস্থলে কর্তব্য বিষয়ে ভ্রমে পতিত হয়। কারণ, যার সত্যানুষ্ঠান বাঞ্ছনীয় সে ব্যক্তি সত্য ও মিথ্যার ফলাফল নিরূপণ করে তারপর ধর্মজ্ঞ হতে পারে। কী আশ্চর্য! বলাক যেমন অন্ধকে বধ করে গুরুতর পুণ্য লাভ করেছিল, সেই রকম শিক্ষিতবুদ্ধি মানুষও অতিদারুণ হয়ে পুণ্য লাভ করে থাকে। কী আশ্চর্য! আবার নদীসঙ্গমস্থলে কৌশিক যেমন মহাপাপভাগী হয়েছিলেন, সেইরকম মূঢ়, অপণ্ডিত, অথচ ধর্মকামী লোক মহাপাপভাগী হয়ে থাকে।”

অর্জুনের অনুরোধে কৃষ্ণ বলাক ও কৌশিকের কাহিনি বিবৃত করলেন। কৃষ্ণ বললেন, “পূর্বকালে ‘বলাক’ নামে এক ব্যাধ ছিল। সে অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে পুত্ৰকলত্রাদির ভরণপোষণের জন্য পশুবধ করত। সর্বদা স্বধর্মনিরত, সত্যবাদী, অসূয়াশূন্য সেই বলাক বৃদ্ধ মাতা ও পিতার এবং অন্যান্য আশ্রিত ব্যক্তিগণের ভরণ-পোষণ করত। কোনও সময়ে সেই বলাক বনে গিয়ে অনেক চেষ্টাতেও কোনও পশু পেল না। ক্রমে ঘ্রাণ-দৃষ্টি একটি হিংস্র জন্তুকে জল পান করতে দেখল। বলাক পূর্বে সেইরূপ কোনও জন্তু না দেখলেও, সেটিকে বধ করল। সেই অন্ধ জন্তুটাকে বধ করলে আকাশ থেকে বলাকের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকল। ক্রমে সেই ব্যাধকে নিয়ে যাবার জন্য স্বর্গ থেকে অপ্সরাগণের গীতবাদ্যে নিনাদিত একটি সুন্দর বিমান আগমন করল। সেই জন্তুটা সমস্ত প্রাণীকে বিনাশ করবার জন্য তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছ থেকে সেই বরই লাভ করেছিল। কিন্তু ব্রহ্মা সেই দান করে তাকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন। সমস্ত প্রাণী-বিনাশে কৃতনিশ্চয় সেই জন্তুটাকে বধ করে বলাক স্বর্গে গিয়েছিল। এই কারণে ধর্ম অতিদুর্জ্ঞেয়।

“তপস্বী অথচ অল্পজ্ঞ কৌশিক নামে এক ব্রাহ্মণ গ্রাম থেকে অদূরবর্তী কতগুলি নদীর সঙ্গমস্থলে বাস করতেন। ‘আমি সর্বদাই সত্য কথা বলব’ এই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি তখন সত্যবাদী বলে বিখ্যাত ছিলেন। একদিন কতগুলি লোক দস্যুর ভয়ে কৌশিকের তপোবনে প্রবেশ করল; তখন ক্রুদ্ধ দস্যুরা সত্যবাদী কৌশিকের কাছে এসে বলল, ‘ভগবান! বহুতর লোক কোন পথে গেল? আমরা জিজ্ঞাসা করছি, আপনি সত্য কথা বলুন। আপনি যদি তাঁদের সংবাদ জেনে থাকেন, তবে আমাদের কাছে বলুন।’ তখন কৌশিক তাঁদের কাছে সত্য কথা বললেন, ‘সেই লোকগুলি এসে বহু বৃক্ষ, লতা ও গুল্মে পরিপূর্ণ এই বনে আশ্রয় নিয়েছে।’ কৌশিক এইভাবে দস্যুদের কাছে সেই লোকগুলির কথা বললেন। দস্যুরা তখন সেই লোকগুলিকে বধ করল। পরে যথাকালে সূক্ষ্মধর্মানভিজ্ঞ, অল্পজ্ঞ, মূঢ়, ধর্মভেদশূন্য সেই কৌশিক ওই দুষ্টবাক্যজনিত গুরুতরপাপে কষ্টজনক নরকে গমন করেছিলেন।

“অর্জুন মনীষীরা বলেন— ধর্ম মানুষগণকে রক্ষা করে। সুতরাং, সেই রক্ষা করার কাজকেই বলে ধর্ম। কোনও কথা না বললে, অন্যের আশঙ্কা হতে পারে বলে অবশ্য বলতে হলে, সে ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাই ভাল। কেন না, মিথ্যা সে অবিচারিত সত্যস্বরূপ। প্রাণবিনাশ, বিবাহ, সমস্ত জ্ঞাতিবধ ও সর্বতোভাবে আরব্ধ কার্যে মিথ্যা বললেও তা মিথ্যা উক্তি স্বরূপ হয় না। মানুষ মিথ্যা শপথ করেও দস্যুদের আক্রমণ থেকে যে মুক্তি লাভ করে, ধর্মতত্ত্বদর্শীরা তাতে অধর্ম দেখতে পান না। সুতরাং, সে স্থলে মিথ্যা বলাই ভাল। কারণ সে মিথ্যা, অবিচারিত সত্যস্বরূপ। শক্তি থাকলেও কোনও অবস্থায় পাপীদের ধন নেবে না। কারণ সে ধন দাতারও পীড়া উৎপাদন করে। মানুষ ধর্মের জন্য মিথ্যা বলে, মিথ্যা বলার পাপে লিপ্ত হন না। অর্জুন আমি যুক্তি অনুসারে তোমার কাছে এই মিথ্যা ও সত্যের লক্ষণ বললাম; এইবার বলো দেখি— যুধিষ্ঠির তোমার বধ্য হল কি না।”

অর্জুন বললেন, “কৃষ্ণ, মহাবিচক্ষণ লোক যেমন বলেন, প্রধান বুদ্ধিমান মানুষ যেমন বলে থাকেন এবং আমাদের যাতে হিত হয়, তুমি তেমন কথাই বলেছ। কৃষ্ণ তুমি আমাদের মাতার তুল্য, পিতার সমান এবং পরম আশ্রয়। সুতরাং তোমার বাক্য আমাদের পক্ষে অতিশয় উত্তম। তারপর ত্রিভুবনে কোথাও কিছু তোমার অবিদিত নেই। যথাযথভাবে সমস্ত ধর্মই তুমি বিশেষভাবে জানো। এখন আমি মনে করি, পাণ্ডবনন্দন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আমার অবধ্য। এখন তুমি ‘আমার’ সংকল্পের বিষয়ে সমাধান করে দাও। তুমি আমার প্রতিজ্ঞার বিষয় অবগত আছ— যে মানুষ আমাকে বলবে— ‘পৃথানন্দন! অন্য যে লোক তোমা অপেক্ষা অস্ত্রে বা বলে প্রধান, তুমি তাকে গাণ্ডিব দান করো’, আমি বলপূর্বক তাকে বধ করব। আবার ভীমেরও প্রতিজ্ঞা আছে যে, যে তাঁকে তূবরক (দাড়িহীন) বলবে, তিনি তাকে বধ করবেন। অথচ কেশব, তোমার সমক্ষেই ধর্মরাজ বার বার আমাকে বলেছেন, ‘গাণ্ডিব অন্যকে দাও। গাণ্ডিব অন্যকে দাও।’ অতএব ধার্মিকশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ, যাতে আমার জগৎপ্রসিদ্ধ প্রতিজ্ঞা সত্য হয় এবং যাতে যুধিষ্ঠির ও আমি উভয়েই জীবিত থাকি। তুমি এখন আমাকে সেই বুদ্ধি দাও।”

কৃষ্ণ বললেন, “বীর! রাজা যুধিষ্ঠির যুদ্ধ করায় পরিশ্রান্ত। পরাজিত হওয়ায় দুঃখিত এবং যুদ্ধে কর্ণের তীক্ষ্ণবাণে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। আবার উনি যখন যুদ্ধ না করেন তখনও কর্ণ বাণ দ্বারা ওঁকে গুরুতর তাড়ন করেছে। এইজন্যই ইনি দুঃখিত অবস্থায় ক্রোধের সঙ্গে তোমাকে অসঙ্গতভাবে এই সব কথা বলেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য এই যে, অর্জুনের ক্রোধ উৎপাদন করলে, অর্জুন যুদ্ধে কর্ণকে বধ করবেন। অর্জুন তুমি ভিন্ন অন্য কেউই জগতে পাপাত্মা কর্ণকে সহ্য করতে পারে না; তা ইনিও জানেন। এই জন্যই ইনি, অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তোমার সামনেই নিষ্ঠুর কথা বলেছেন। সর্বদা উদ্‌যোগী ও সর্বদা অসহ্য কর্ণের উপরে আজ দ্যূতক্রীড়ার মতো যুদ্ধে জয় ও পরাজয়ের পণ নিবদ্ধ আছে। সুতরাং তাকে বধ করলেই কৌরবেরা পরাজিত হবে; এই ধারণাই রাজা যুধিষ্ঠিরের আছে। অতএব যুধিষ্ঠির বধ্য হতে পারেন না, অথচ তোমারও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে হবে। অতএব ইনি জীবিত থেকেই যাতে মারা যান, তার পথ তুমি আমার কাছে শ্রবণ করো। সম্মানযোগ্য লোক যখন সম্মান লাভ করেন, তখনই তিনি জীবলোকে জীবিত থাকেন আর তিনি যখন গুরুতর অপমান ভোগ করেন, তখন তাঁকে জীবন্মৃত বলা হয়। অর্জুন তুমি, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব সর্বদাই এই রাজার সম্মান করে থাক এবং সমাজের বৃদ্ধলোক ও বীরপুরুষেরাও এঁর সম্মান করে থাকেন। অতএব তুমি এখন ঈষৎ পরিমাণে এঁর অপমান করো। ভরতনন্দন অর্জুন, তুমি পূজনীয় যুধিষ্ঠিরের প্রতি ‘তুমি’ সম্বোধন করো। গুরুজনকে ‘তুমি’ বললেই তিনি নিহত হয়ে থাকেন। শ্রুতির মধ্যে অথর্ব ও অঙ্গিরা এই কথা বলেন। তুমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি কিছু অধর্মযুক্ত বাক্য প্রয়োগ করো। অতএব আমি যা বললাম, ধর্মরাজ সম্বন্ধে তুমি তাই বলো। এইরকম বললে, এই ধর্মরাজ তোমার কাছ থেকে বধ নিজের ন্যায্য বলে মনে করবেন। তারপর তুমি ধরে অভিবাদন করে, ওঁকে সান্ত্বনা দিয়ে স্বাভাবিক কথা বলবে। এইরূপ করলেও, ভ্রাতা ও বুদ্ধিমান রাজা যুধিষ্ঠির কখনও তোমার উপর কোনও ক্রোধ করবেন না। এইভাবে তুমি প্রতিজ্ঞাভঙ্গের পাপ ও ভ্রাতৃবধের পাপ থেকে মুক্ত হয়ে হৃষ্টচিত্তে গিয়ে সূতপুত্র কর্ণকে বধ করো।”

কৃষ্ণ একথা বললে, পৃথানন্দন অর্জুন সেই সুহৃদের বাক্যের প্রশংসা করে পরে বলপূর্বক— পূর্বে যা কখনও বলেননি, সেইরকম নিষ্ঠুর বাক্য যুধিষ্ঠিরকে বলতে লাগলেন, “রাজা তুমি আমাকে এমন কথা বোলো না, বোলো না। তুমি রণস্থল থেকে এক ক্রোশ দূরে আছ। ভীমসেন আমাকে নিন্দা করতে পারেন। কারণ, তিনি রণস্থলেই সমগ্র জগতের প্রধান বীরগণের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। যিনি যথাসময়ে শত্রুগণকে পীড়নপূর্বক যুদ্ধে সেই সব বীর রাজা, প্রধান হস্তী, উত্তম রথী, শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী, অসংখ্য বীর— সমগ্র বিপক্ষ সৈন্যগণকে বধ করে— সিংহ যেমন হরিণগণকে বধ করে সিংহনাদ করে, সেইরকম গর্জন করছেন; যে বীর রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে গদা দিয়ে যুদ্ধে হস্তী, অশ্ব ও রথসকল বধ করে অতিদুষ্কর কার্য করছেন, তুমি যা কখনও করতে পার না। ইন্দ্রের তুল্য বিক্রমশালী যে ভীমসেন উত্তম তরবারি, চক্র ও ধনুদ্বারা হস্তী, অশ্ব, পদাতিক ও অন্যান্য শত্রুগণকে বিনাশ করছেন; আর অগ্রবর্তী হয়ে চরণযুগল ও বাহুযুগল দ্বারা শত্ৰু সংহার করছেন; সেই বলী, কুবের ও যমতুল্য এবং বলপূর্বক শত্রুসৈন্যহন্তা ভীমসেনই আমাকে নিন্দা করতে পারেন। কিন্তু যাঁকে সর্বদাই সুহৃদগণ রক্ষা করে থাকেন, সেই তুমি পার না।

“যিনি বিপক্ষের মহারথ, বিশাল হস্তী, অশ্ব ও প্রধান প্রধান পদাতিকগণকে আলোড়ন করে দুর্যোধন সৈন্যমধ্যে গিয়ে প্রবেশ করেছেন, সেই শত্রুদমনকারী একমাত্র ভীমসেনই আমাকে তিরস্কার করতে পারেন। যিনি কলিঙ্গ, বঙ্গ, অঙ্গ, নিষাদ ও মগধদেশীয়, সর্বদা মত্ত ও নীলবর্ণ অনেক শত্রুহস্তী বিনাশ করছেন, শত্রুদমনকারী সেই ভীমসেনই আমাকে তিরস্কার করতে পারেন। ওই সেই বীর যথাসময়ে সজ্জিত রথে আরোহণ করে বাণ দ্বারা মুষ্টি পূরণপূর্বক ধনু সঞ্চালন করতে করতে— মেঘ যেমন জলবর্ষণ করে, সেইরকম বাণদ্বারা বর্ষণ করছেন। আমি দেখেছি, ভীমসেন আজ যুদ্ধে বাণ দ্বারা কুম্ভ, শুণ্ড, শুণ্ডাগ্র ছেদন করে আটশো হস্তী বধ করেছেন, সেই শক্ৰহন্তাই আমাকে নিষ্ঠুর বাক্য বলতে পারেন। ভরতনন্দন, জ্ঞানীরা বলেন, ‘ব্রাহ্মণের বল বাক্যে, আর ক্ষত্রিয়ের বল বাহুতে।’ কিন্তু তোমার সমস্ত বল বাক্যে এবং তুমি নিষ্ঠুর। আমি কেমন, তা তুমি জানো। আমি সর্বদাই স্ত্রী, পুত্র এবং নিজের জীবন দিয়েও তোমার অভীষ্ট সম্পাদনের চেষ্টা করি। তথাপি তুমি তোমার বাক্যবাণ দিয়ে আমাকে আঘাত করো, তখন বুঝলাম— তোমার কাছ থেকে আমরা কোনও সুখ পাব না। দ্রৌপদীর শয্যায় থেকে তুমি আমাকে অবজ্ঞা কোরো না। আমি তোমার জন্য মহারথগণকে বধ করে আসছি। তাতেই তুমি বিনা আশঙ্কায় নিষ্ঠুর হয়েছ; বুঝলাম তোমার কাছ থেকে কোনও সুখ অনুভব করতে পারব না।

“সত্যপ্রতিজ্ঞ ভীষ্ম নিজেই বীর ও মহাত্মা দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডীকে নিজের মৃত্যুর পথ বলে দিয়েছিলেন; পরে আমি তোমার প্রীতির জন্য সর্বতোভাবে সেই শিখণ্ডীকে রক্ষা করছিলাম, সেই অবস্থায় শিখণ্ডী ভীষ্মকে বধ করেন। আমি তোমার সাম্রাজ্যের অনুমোদন করি না। যেহেতু তুমি অমঙ্গলের জন্যই দ্যূতক্রীড়ায় আসক্ত। তারপর তুমি নিজে অসজ্জনসেবিত পাপ করে আমাদের দ্বারা শত্রুসাগর পার হতে চাইছ। সহদেব দ্যূতক্রীড়ার যে সকল দোষ বলেছিলেন, ধর্মবিরুদ্ধ সেই বহুতর দোষ তুমি শুনেছিলে; তবুও তুমি নিজে অসজ্জনসেবিত পাপ ত্যাগ করতে ইচ্ছা করনি, আমাদের নরকে পতিত করেছ। পাণ্ডব, যখনই তুমি দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হয়েছিলে, তখনই বুঝেছিলাম, তোমার কাছ থেকে কোনও সুখ আমরা পাব না। কিন্তু তুমি নিজে দোষ করে আবার আজ আমাদের রুক্ষ কথা বলছ। আমরা যাদের বধ করেছি, সেই শত্রুসৈন্যেরা ছিন্ন দেহে আর্তনাদ করতে করতে ভূতলে শয়ন করেছে। সুতরাং সেই নৃশংস কাজ তুমিই করেছ, আমাদের শুধু প্রাণান্ত পরিশ্রম ও কৌরবপক্ষের বধ হচ্ছে। তুমিই দ্যূতক্রীড়া করেছ, তোমার জন্য আমাদের রাজ্য নষ্ট হয়েছে, তোমার জন্যই আমাদের বিপদ এসেছে। আবার অল্পভাগ্য তুমিই নিষ্ঠুর বাক্যকশাঘাত দ্বারা ব্যথিত করতে থেকে আর আমাদের ক্রোধ বাড়িয়ো না।”

স্থিরবুদ্ধি, ধর্মভীরু ও বিচক্ষণ অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে এই সমস্ত রুক্ষ ও অতিনিষ্ঠুর বাক্য বলে এই প্রকার কিছু পাপ করে অত্যন্ত বিষণ্ণ হলেন। অনুতপ্ত অর্জুন নিশ্বাস ত্যাগ করতে থেকে কোষ থেকে পুনরায় তরবারি বার করলেন। তখন কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, “একী। তুমি পুনরায় আকাশের ন্যায় নির্মল তরবারি কোষমুক্ত করলে কেন? তোমার উত্তর বাক্য পুনরায় আমাকে বলো দেখি; আমি তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায় বলব।” অতি দুঃখী অর্জুন বললেন, “কৃষ্ণ, আমি যে শরীর দ্বারা এই অমঙ্গলাচরণ করলাম, বলপূর্বক সেই নিজ শরীরই বিনষ্ট করব।” অর্জুনের কথা শুনে ধার্মিকশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, “অৰ্জুন তুমি এই রাজাকে ‘তুমি তুমি’ বলে কেন ভয়ংকর মোহাবিষ্ট হলে? শক্তহন্তা! তুমি আত্মহত্যা করবার ইচ্ছা করেছ? সজ্জনেরা এ কাজ করেন না। তুমি ধর্মভীরু হয়ে যদি তরবারি দ্বারা এই ধর্মাত্মা জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে বধ করতে, তবে এখন তোমার কী অবস্থা হত; পরে তুমি কি করতে? ধর্ম— সূক্ষ্ম; সুতরাং দুর্জ্ঞেয়; বিশেষত অজ্ঞলোকের পক্ষে। অতএব আমি বলছি, শ্রবণ করো, তুমি আপনি আপনাকে বধ করে ভ্রাতৃবধপাপ থেকেও ভয়ংকর পাপভাগী হতে। অর্জুন তুমি এখন এইখানে নিজের গুণ নিজে বলো, তাতেই আত্মহত্যা করা হবে।” অর্জুন স্বীকার করে যুধিষ্ঠিরকে বলতে আরম্ভ করলেন, “রাজা নরদেব! আপনি শ্রবণ করুন— এ জগতে দেবদেব মহাদেব ব্যতীত আমার তুল্য ধনুর্ধর নেই। আমি সেই মহাদেবের অনুমতিক্রমে, ক্ষণকালমধ্যে সমস্ত চরাচর জগৎ সংহার করতে পারি এবং রাজা আমিই রাজসূয়ের পূর্ব দিকপালগণকে সমস্ত দিকে জয় করে আপনার রাজসূয় যজ্ঞের সমাপ্তি ঘটাই এবং আমার ক্ষমতাতেই আপনার সেই দিব্যসভা নির্মিত হয়েছিল; আর আমার দক্ষিণ হস্তে বাণ ও বাম হস্তে গুণ ও বাণযুক্ত বিস্তৃত ধনু অঙ্কিত আছে। আমার চরণতলে রথ ও ধ্বজের চিহ্ন আছে; সেইজন্যই বিপক্ষেরা আমার তুল্য লোককে যুদ্ধে জয় করতে পারে না এবং আমি উত্তর, পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণদেশীয় বীরগণকে বধ করেছি। সংশপ্তকেরা অল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে, কৌরবসেনার অর্ধ আমার হাতে বিনষ্ট হয়েছে। যারা অস্ত্রজ্ঞ, তাদের আমি অস্ত্রদ্বারাই বধ করি। সেইজন্যই আমি পাশুপত অস্ত্র দ্বারা বিপক্ষদের ভস্ম করি না। সে যাই হোক, কৃষ্ণ এসো আমরা ভয়ংকর ও বিজয়ী রথে আরোহণ করে কর্ণকে বধ করবার জন্য সত্বর যাত্রা করি। আজ এই রাজা বিশেষ নিবৃত্তি লাভ করুন। আমি বাণদ্বারা কর্ণকে বধ করব। আজ আমাদ্বারা কর্ণের মাতা পুত্র হারাবেন অথবা কর্ণের দ্বারা মাতা কুন্তী অর্জুনশূন্যা হবেন। আমি সত্য বলছি— আজ আমি বাণ দ্বারা কর্ণকে বধ না করে কবচ ত্যাগ করব না।”

তরবারি কোষের মধ্যে স্থাপন করে লজ্জায় অবনত মস্তক ও কৃতাঞ্জলি হয়ে পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “রাজা আমার উক্তিগুলি ক্ষমা করে আপনি প্রসন্ন হোন। যথাসময়ে আপনি আমার কারণ জানতে পারবেন। আপনাকে নমস্কার।” যুধিষ্ঠিরকে প্রসন্ন করে অর্জুন দণ্ডায়মান হয়ে বললেন, “এই কর্ণবধ দীর্ঘকালে নয়— সত্বরই হবে। ওই কর্ণ আসছে, আমি দ্রুত ওর দিকে যাত্রা করি। আমি যুদ্ধ থেকে ভীমসেনকে উদ্ধার ও কর্ণকে বধ করবার জন্য যাত্রা করছি। রাজা আমি সত্য বলছি, তা আপনি জেনে রাখুন। আপনার প্রীতির জন্যই আমার জীবন।” এই কথা বলে তেজস্বী অর্জুন যুদ্ধে যাবার জন্য যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন।

ওদিকে পাণ্ডুনন্দন যুধিষ্ঠির-ভ্রাতা অর্জুনের পূর্বোক্ত নিষ্ঠুর বাক্য শ্রবণ করে দুঃখিত চিত্ত হয়ে সেই শয্যা থেকে উঠে অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন যা মঙ্গলজনক নয়, আমি তা করেছি। যাতে তোমাদের অতি ভীষণ বিপদ উপস্থিত হয়েছে। সুতরাং আমি বংশনাশক নরাধম। অতএব তুমি আজ আমার এই মস্তক ছেদন করো। আমি পাপাত্মা, পাপব্যসনাসক্ত, মূঢ়বুদ্ধি, অলস, ভীরু, বৃদ্ধগণের অবমাননাকারী ও নিষ্ঠুর। অতএব চিরকাল আমার রুক্ষপথ অনুসরণ করে তোমার কী ফল হবে। পাপাত্মা আমি আজই বনে যাব। তুমি আমাকে ছেড়ে সুখে থাকো; মহাত্মা ভীমসেনই তোমাদের উপযুক্ত রাজা; আমি নপুংসক; সুতরাং আমি কী রাজকার্য করব। বীর! ক্রুদ্ধ অবস্থায় তোমার এই নিষ্ঠুর উক্তিগুলি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। অপমানিত হয়ে আমার জীবনের আর প্রয়োজন নেই; ভীমই রাজা হোন।” যুধিষ্ঠির এই বলে সহসা শয্যাত্যাগ করে উঠে বনে যাবার ইচ্ছা করলেন।

কৃষ্ণ তখন তাঁর সামনে বসে অবনত হয়ে তাঁকে বললেন, “রাজা আপনার জানা আছে যে, সত্যপ্রতিজ্ঞ অর্জনের গাণ্ডিব বিষয়ে এই প্রসিদ্ধ প্রতিজ্ঞা আছে। যে ব্যক্তি এঁকে বলবে যে, তুমি অন্য লোককে গাণ্ডিব দাও, সে ব্যক্তি অর্জুনের বধ্য হবে। অথচ আপনি ওঁকে তাই বলেছেন। রাজা, তখন অর্জুন সেই সত্য প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য আমার অভিপ্রায় অনুসারেই আপনার এই অপমান করেছেন। মনস্বীরা বলেন, গুরুজনের অপমান করাই বধ। সুতরাং মহাবাহু! আমার ও অর্জুনের এই আচরণ আপনি ক্ষমা করুন। আমি ও অর্জুন দু’জনেই আপনার শরণাপন্ন হলাম। রাজা, আমি অবনত হয়ে প্রার্থনা করছি, আপনি ক্ষমা করুন। আজ সমরভূমি পাপাত্মা কর্ণের রক্ত পান করবে। আমি আপনার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি, আজ কর্ণকে নিহত বলে অবগত হোন এবং যার বধ আপনি ইচ্ছা করেন, আজ তার জীবন গিয়েছে।”

কৃষ্ণের এই কথা শুনে যুধিষ্ঠির দু’হাতে তখন তাঁকে তুলে দুই হাত জোড় করে বললেন, “কৃষ্ণ তুমি যা বললে তা সত্য। আমি গাণ্ডিব সম্পর্কে অর্জুনকে অন্যায় কথা বলেছি। গোবিন্দ তুমি অনুনয় করছ, মাধব তুমি উদ্ধার করেছ এবং অচ্যুত তুমি আমাদের ভীষণ বিপদ থেকে উদ্ধার করেছ। কৃষ্ণ আমরা আজ অজ্ঞানে মোহিত হয়েছিলাম; তোমাকে রক্ষক পেয়ে সেই ভীষণ বিপদসাগর থেকে দুজনেই উত্তীর্ণ হয়েছি। আমরা তোমার বুদ্ধি-তরণি পেয়ে দুঃখ ও শোকসাগর থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি এবং তোমার দ্বারাই আমরা অমাত্যবর্গের সঙ্গে নাথযুক্ত হয়েছি।”

ধর্মাত্মা যদুনন্দন কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের সেই প্রীতিযুক্ত বাক্য শুনে তখন অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন ধার্মিকশ্রেষ্ঠ, কৌরবপ্রধান ও ধর্মানুগামী রাজাকে প্রসন্ন করো। এই এখন আমার অভিপ্রায়।” অর্জুন কৃষ্ণের বাক্য অনুযায়ী যুধিষ্ঠিরকে অনেক অনুনয় করে মহাপাতকীর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন কৃষ্ণ হাসতে হাসতে অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন তুমি যদি তীক্ষ্ণধার তরবারি দিয়ে ধার্মিক যুধিষ্ঠিরকে বধ করতে, তা হলে কী হত বল দেখি; রাজাকে কেবল ‘তুমি’ বলেই এতটা মোহাপন্ন হয়েছ, তা হলে রাজাকে বধ করে পরে কী করতে? ধর্ম এইরকমই দুর্জ্ঞেয়, বিশেষত অল্পবুদ্ধির পক্ষে। জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে বধ করে ধর্মভীরুতাবশত গুরুতর মোহাপন্ন হয়ে তুমি নিশ্চয়ই ঘোর নরকে যেতে। অর্জুন তুমি এখন ধার্মিকশ্রেষ্ঠ, ন্যায়বান ও কৌরবপ্রধান রাজাকে প্রসন্ন করো, এই আমার মত। ভক্তিপূর্বক রাজাকে প্রসন্ন করে উনি প্রসন্ন হলে আমরা যুদ্ধ করার জন্য দ্রুত কর্ণের দিকে যাত্রা করব। তুমি আজ কর্ণকে বধ করে ধর্মরাজের প্রচুর আনন্দ উৎপাদন করবে। এই আমার এখন কালোচিত পরামর্শ। এই করলেই তোমার প্রকৃত কাজ করা হবে।”

তখন অর্জুন লজ্জিত ও অবনত হয়ে মস্তকদ্বারা যুধিষ্ঠিরের চরণযুগল স্পর্শ করে বার বার তাঁকে বললেন, “রাজা আপনি প্রসন্ন হোন, আমি ধর্মভীরু ও প্রতিজ্ঞাকারী, যা বলেছি, তা ক্ষমা করুন।” শত্রুহন্তা অৰ্জুন রোদন করতে করতে নিজের চরণযুগলে পতিত হয়েছেন দেখে ধর্মরাজ রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতা সেই অর্জুনকে উঠিয়ে সস্নেহে আলিঙ্গন করে রোদন করতে লাগলেন। অত্যন্ত তেজস্বী যুধিষ্ঠির ও অর্জুন দুই ভ্রাতা দীর্ঘকাল রোদন করে গাত্র পরিষ্কারপূর্বক সন্তুষ্ট হলেন। তারপর যুধিষ্ঠির অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ঈষৎ হাস্য করতে থেকে স্নেহবশত অর্জুনকে আলিঙ্গন ও মস্তকাঘ্রাণ করে বললেন, “মহাবাহু মহাধনুর্ধর অর্জুন, আমি যুদ্ধে জয়লাভের জন্য যত্ন করছিলাম। সেই অবস্থায় কর্ণ বাণ দ্বারা সমস্ত সৈন্যের সমক্ষে আমার কবচ, ধ্বজ, ধনু, শক্তি, অশ্ব ও বাণ সকল ছেদন করেছে। তখন আমি তার শক্তি বুঝে এবং যুদ্ধে তার কার্য দেখে দুঃখে বিশেষ অবসন্ন হয়েছি; এই অবস্থায় আমার বেঁচে থাকা প্রীতিকর হয়নি। আজ যদি তুমি যুদ্ধে এই বীরকে বধ করতে না পারো, তা হলে আমি প্রাণই পরিত্যাগ করব। কারণ, এ অবস্থায় আমার জীবনে ফল কী?”

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে অর্জুন বললেন, “নরশ্রেষ্ঠ পৃথিবীপতি রাজা! আমি আপনার কাছে সত্য, আপনার স্নেহ, ভীমসেন নকুল ও সহদেবের নামে শপথ করছি যে, আজ যুদ্ধে কর্ণকে বধ করব, কিংবা কর্ণ কর্তৃক নিহত হয়ে ভূতলে পতিত হব। এই সত্য শপথে আমি অস্ত্রও স্পর্শ করছি।” অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলে কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ আজ যুদ্ধে কর্ণকে বধ করব, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তোমার বুদ্ধিতেই সেই দুরাত্মার বধ হবে। তোমার মঙ্গল হোক।” অর্জুনের কথা শুনে কৃষ্ণ বললেন, “ভরতশ্রেষ্ঠ, তুমি মহাবল কর্ণকে বধ করতে সমর্থ এবং মহারথ! সর্বদাই আমার এই কামনা রয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ, তুমি যুদ্ধে কী প্রকারে কর্ণকে বধ করবে, সে চিন্তাও করছি।” এর পর কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “মহারাজ আপনি অর্জুনকে সান্ত্বনা দান করুন এবং আজ দুরাত্মা কর্ণকে বধ করবার জন্য অনুমতি করুন। পাণ্ডুনন্দন, আপনি কর্ণের বাণে পীড়িত হয়েছেন শুনে আমি আর অর্জুন আপনার সংবাদ গ্রহণের জন্য এখানে এসেছিলাম। নিস্পাপ রাজা, আপনি ভাগ্যবশত নিহত হননি এবং ভাগ্যবশত কর্ণকর্তৃক ধৃত হননি। এখন অর্জুনকে সান্ত্বনা দিন এবং জয়ের আশীর্বাদ করুন।” যুধিষ্ঠির বললেন “পৃথানন্দন অৰ্জুন! এসো এসো পাণ্ডুনন্দন, আমাকে আলিঙ্গন করো। তুমি আমাকে বক্তব্যে হিতের কথাই বলেছ এবং আমি যে সব কটু কথা বলেছি, তা তুমি ক্ষমা করেছ। আমি তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি, তুমি কর্ণকে বধ করো। পৃথানন্দন, আমি যেসব দারুণ কথা বলেছি, তাতে তুমি ক্রোধ কোরো না কিংবা কোনও দৈন্য বোধ কোরো না।”

তখন অর্জুন মাথা যুধিষ্ঠিরের পায়ের উপর রেখে দুই হাতে তাঁর চরণ ধরলেন। যুধিষ্ঠির অর্জুনকে উঠিয়ে গাঢ় আলিঙ্গন ও মস্তকাঘ্রাণ করে পুনরায় অর্জুনকে বললেন, “মহাবাহু ধনঞ্জয়, তুমি চিরকাল আমার গুরুতর সম্মান করে আসছ। সুতরাং তুমি চিরস্থায়ী প্রচুর যশ ও জয় লাভ করো।” অর্জুন বললেন, “আজ বলগর্বিত কর্ণকে পেয়ে বাণ দ্বারা অনুচরবর্গের সঙ্গে সেই পাপকারীকে বিনষ্ট করব। যে ধনু দৃঢ় আকর্ষণ করে বাণ দ্বারা আপনাকে পীড়ন করেছে, সেই কর্মের দারুণ ফল আজ কর্ণ লাভ করবে। আজ কর্ণকে বধ করে আপনাকে আনন্দিত করবার জন্য যুদ্ধ থেকে আসব; আপনার কাছে এই সত্য বলছি। মহারাজ আজ কর্ণকে বধ না করে মহাযুদ্ধ থেকে ফিরব না, আপনার চরণ স্পর্শ করে এই সত্য শপথ করছি।” যুধিষ্ঠির আশীর্বাদ করে বললেন, “অর্জুন তোমার যশ, জীবন অক্ষয়, অভীষ্ট লাভ, সর্বদা বীরত্ব ও শত্রুক্ষয় হোক। বৎস! যাও, দেবতারা তোমার উন্নতি বিধান করুন। আমি যা ইচ্ছা করি, তা তোমার হোক। ইন্দ্র যেমন আত্মোন্নতির জন্য বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন, তুমিও তেমন যুদ্ধে কর্ণ বধ করো, সত্বর যাও।”

*

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের এই সপ্তদশ দিনটি যুধিষ্ঠিরের জীবনের সবথেকে অশুভ দিন। ভাগ্য বিপর্যয় যুধিষ্ঠিরের জন্য এসেছে, তিনি তা অতিক্রমও করে গিয়েছেন। বনবাস পরে অলৌকিক শক্তির কাছে পরাজিত চার ভ্রাতার মৃতদেহ যুধিষ্ঠির দেখেছেন। পুনরায় তাঁদের জীবিত করে তিনি ফিরেছেন। তিনিই উপস্থিত থেকে ভীমসেনের বন্দিত্ব দশার মোচন করেছেন। তাঁরই ইঙ্গিতে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিয়েছেন ভীমসেন।

সপ্তদশ দিনে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হলেন যুধিষ্ঠির। তাঁর রথ বিনষ্ট হল, ধ্বজ পতিত হল, ধনু বাণ ধ্বংস করলেন কর্ণ। এ পর্যন্ত হলেও যুধিষ্ঠিরের এতখানি লাগত না। পরাজিত যুধিষ্ঠিরকে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, উপহাস করলেন কর্ণ। প্রাণে মারলেন না, কিন্তু মর্মস্থল পর্যন্ত অপমানে জর্জরিত করে ছেড়ে দিলেন কর্ণ। বিপর্যস্ত, অসম্মানিত যুধিষ্ঠির শিবিরে ফিরে এলেন।

সংশপ্তকদের পরাজিত করে যুদ্ধক্ষেত্রে ভীমসেনের কাছে কৃষ্ণার্জুন শুনলেন, যুধিষ্ঠির কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে আহত, বিপর্যস্ত ও লাঞ্ছিত হয়ে শিবিরে ফিরে গেছেন। দ্রুত রথ চালিয়ে কৃষ্ণার্জুন যুধিষ্ঠিরের সংবাদ নেবার জন্য শিবিরে এসে উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণার্জুনকে দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন। তাঁর ধারণা হল যে, তাঁর পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে অর্জুন কর্ণকে বধ করে যুধিষ্ঠিরের কাছে এসেছেন। যখন তিনি শুনলেন যে ঘটনা তা নয়— আহত যুধিষ্ঠিরকে দেখতেই তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে এসেছেন, তখন সমস্ত দিনের লাঞ্ছিত বিপর্যস্ত আত্মগ্লানি চূড়ান্ত ক্রোধে অর্জুনের উপর ভেঙে পড়ল। অতি সাধারণ পুরুষ, প্রায় গ্রামীণ পুরুষের ভাষায় অর্জুনকে কটু-কাটব্য করতে লাগলেন যুধিষ্ঠির। বললেন তাঁর জন্ম মিথ্যা, বীরত্ব মিথ্যা। কর্ণের ভয়ে ভীত হয়ে তিনি পালিয়ে এসেছেন। তীক্ষ্ণ ভাষায় অর্জুনকে বললেন অপেক্ষাকৃত বড় বীরের হাতে গাণ্ডিব ধনু সমর্পণ করতে। কোষমুক্ত তরবারি নিয়ে অর্জুন ছুটে গেলেন যুধিষ্ঠিরের দিকে। সেই অর্জুন, যিনি সর্বদাই পরিচয় দেন তিনি যুধিষ্ঠিরের ‘ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ’— তিনি উদ্যত অসি নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে কাটতে চলেছেন। কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় অর্জুন অসি নামালেন, কিন্তু তীব্র কণ্ঠে যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করলেন। ‘তুমি’ সম্বোধন করে যুধিষ্ঠিরের পাপের জন্যই পাণ্ডবদের এই দুরবস্থা ঘোষণা করলেন। আরও বললেন, দ্যূতক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরের অত্যন্ত আসক্তিই পাণ্ডবদের দুর্দশার মূল কারণ। আমাদের মনে পড়ে গেল, ভীমসেনের এই অভিযোগের উত্তরে যুধিষ্ঠিরকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিলেন অর্জুন। বলেছিলেন— দ্যূতক্রীড়া করে ‘মহৎ কীর্তি’ স্থাপন করেছেন যুধিষ্ঠির। কিন্তু আজ অর্জুনও ক্রোধান্ধ। যুধিষ্ঠিরের কাছে দুঃখ ছাড়া তাঁর পাবার কিছু নেই বলে ঘোষণা করলেন।

এর পর কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন আত্মপ্রশংসা শুরু করলেন। জানালেন ত্রিলোকে দেবদেব মহাদেব ভিন্ন তাঁর তুল্য অস্ত্রধারী নেই। যুধিষ্ঠিরকে তিনি জানালেন, যেখানে যা কিছু তিনি পেয়েছেন, সবই অর্জুনের বীরত্বের ফল।

অর্জুনের প্রতিটি কথা যুধিষ্ঠিরকে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছিল। তিনি জীবনে এতখানি অসম্মানিত হননি। ভ্রাতাদের কাছ থেকে, প্রজাদের কাছ থেকে সম্মান পেতেই তিনি অভ্যস্ত। অর্জুনের দিকে তিনি মস্তক এগিয়ে দিলেন। অর্জুনকে বললেন, তাঁর মাথা কেটে ফেলতে। কারণ অর্জুন যা কিছু বলেছেন, তার সব সত্য। আরও জানালেন তিনি রাজ্যলাভের পক্ষে অনুপযুক্ত। ভীমসেনই রাজা হবার উপযুক্ত। তিনি রাজ্য ত্যাগ করে ভিখারির জীবনযাপন করবেন।

আশ্বমেধিক পর্বে অশ্ব নিয়ে অর্জুন মণিপুরে পৌঁছলে পুত্র বভ্রুবাহন পিতাকে অভ্যর্থনা করতে এসেছিলেন। সেদিন কিন্তু অর্জুন ঠিক একইভাবে পুত্র বভ্রুবাহনকে ভৎসনা করেছিলেন। বলেছিলেন, “তোর জন্মে ধিক, তোর ক্ষত্রিয়ধর্মে ধিক।” তিনি পুত্রের কাছে যুদ্ধ প্রত্যাশা করেছিলেন। যুদ্ধও হয়েছিল এবং অর্জুন পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন।

কৃষ্ণ কিন্তু বুঝেছিলেন যুধিষ্ঠির কেন অর্জুনকে ধিক্কার দিয়েছেন। অর্জুনের পৌরুষকে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন যুধিষ্ঠির, তাঁকে ক্ষিপ্ত করে দিতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, অর্জুন ভিন্ন অন্য কেউ কর্ণকে বধ করতে পারবেন না।

অর্জুনের প্রচণ্ড ক্রোধের মুহূর্তে একটি বাক্য আমাদের সচকিত করে তোলে, “তুমি দ্রৌপদীর শয্যায় শুয়ে আমাকে বোলো না, বোলো না।” অবচেতন কোনও ক্ষোভ থেকে অর্জুন এ কথা বললেন?

এই আশ্চর্য মুহুর্তটিতে কৃষ্ণকে আমরা পরিপূর্ণভাবে দেখলাম। তিনি পাণ্ডবদের হিতৈষী, মঙ্গলাকাঙক্ষী। এই ধরনের কোনও পারিবারিক বন্ধু পাওয়া বহু ভাগ্যের ফল। একটি মুহূর্তের জন্যও কৃষ্ণকে উত্তেজিত হতে দেখি না। কোনও মুহূর্তেই তিনি ঘটনার উপর নিয়ন্ত্রণ হারাননি। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ অর্জুনকে নিয়ন্ত্রিত করেছেন, কিন্তু তাঁর বীরত্বের অবমাননা করেননি। ধর্মতত্ত্ব নিপুণভাবে বুঝিয়ে, সত্য-মিথ্যা প্রয়োগের ক্ষেত্রকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে অর্জুনের ক্রোধ প্রশমিত করেছেন। যুধিষ্ঠিরকে এতটুকু অসম্মানিত করেননি, কিন্তু অর্জুনের বীরত্ব তাঁর নিজ মুখেই যুধিষ্ঠিরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সবশেষে ঘটনার দায় অর্জুনের সঙ্গে নিজেও স্বীকার করে নিয়ে, যুধিষ্ঠিরের চরণের কাছে মস্তক রেখে, তাঁর ও অর্জুনের, দুজনের হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। কৃষ্ণ অর্জুনের প্রিয়তম সখা, তাঁর বুদ্ধিমত্তা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, ধর্ম বিষয়ে যথার্থ বিচক্ষণতা— মহাভারতের দুই শ্রেষ্ঠ চরিত্রের মুহুর্তের ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়েছে। প্রসন্ন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অকৃত্রিম আশীর্বাদ লাভ করেছেন অর্জুন। যে আশীর্বাদ অর্জুনের সেদিন সত্যকার প্রয়োজন ছিল।

এই দুর্লভ মুহূর্তে আমরা তিনটি শপথ একসঙ্গে শুনলাম। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে আশ্বস্ত করলেন— আজ অর্জুন কর্ণকে বধ করবেন। অর্জুন প্রতিজ্ঞা করলেন, আজ কর্ণের মাতা পুত্র হারাবেন অথবা কুন্তী তাঁর পুত্র হারাবেন। যুধিষ্ঠির প্রতিজ্ঞা করলেন— আজ কর্ণ বধ না হলে তিনি প্রাণধারণ করবেন না। আমরা কর্ণের মৃত্যুর সম্পর্কে সুনিশ্চিত হলাম।

সুদূর হস্তিনাপুরে বিদুরের ঘরে বসে এক নারী উৎকণ্ঠিত হয়ে দূতমুখে শুধু যুদ্ধের খবর শুনছেন। তাঁর তো দু’দিকেই ক্ষতি। যিনিই হারুন, কুন্তী পুত্র হারাবেন। যিনি বিজয়ী হবেন, গর্বে শঙ্খনাদ করতে করতে স্বপক্ষীয় বীরদের দ্বারা অভিনিন্দিত হতে হতে তিনি ভাবতেও পারবেন না, তাঁর হাত সহোদরের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল।

৭৭
দুঃশাসন-বধ—ভীমসেনের প্রতিজ্ঞা পূরণ

সপ্তদশ দিনের মধ্যাহ্নে কর্ণ ভয়ংকর রূপ ধারণ করলেন। তিনি নির্বিচারে পাণ্ডবসৈন্য বধ করতে লাগলেন। কোনও পাণ্ডব প্রধানরথী কর্ণের সম্মুখে দাঁড়াতেই পারলেন না। ভীমসেন প্রচণ্ড শক্তির পরিচয় দিয়ে একাই পাণ্ডবপক্ষে ভীষণতম যুদ্ধে রত ছিলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের সংবাদ নেবার জন্য কৃষ্ণার্জুনকে শিবিরে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা এখনও ফিরছেন না। ওদিকে কর্ণের প্রতাপ ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে। ভীমসেনও আগমন প্রত্যাশায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এই সময়ে সারথি বিশোক ভীমসেনকে জানালেন যে, গাণ্ডিবধনুর নির্ঘোষ শোনা যাচ্ছে, দেবদত্তর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, পাঞ্চজন্য চতুর্দিক নিনাদিত করে শত্রুসৈন্যকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলছে, অর্জুন রণক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন। অতিশয় সন্তুষ্ট হয়ে ভীমসেন দশগুণ অধিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। ভীমের নাগালের মধ্যে যে শত্রুসৈন্য প্রবেশ করল, তারা আহত হয়ে স্থানচ্যুত হতে থাকল, আর্তনাদ এবং প্রাণশূন্য হয়ে পতিত হতে থাকল।

এই সময়ে দুর্যোধনভ্রাতা দুঃশাসন নির্ভয়চিত্তে বাণক্ষেপ করতে করতে ভীমসেনের দিকে অগ্রসর হলেন। তখন মহামৃগ পেয়ে সিংহ যেমন দ্রুত তার দিকে ধাবিত হয়, সেইরকম ভীমসেন দ্রুত দুঃশাসনের দিকে ধাবিত হলেন। পূর্বকালে ইন্দ্র ও শম্বরাসুরের মধ্যে অতিদারুণ যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেইরকম জাতক্রোধ ও প্রাণদ্যূতক্রীড়াকারী ভীমসেন ও দুঃশাসনের পরস্পর অতিদারুণ যুদ্ধ হতে লাগল। ক্রমে প্রথমস্রাবী ও কামাকুলচিত্ত দুটি হস্তী যেমন ঋতুমতী হস্তিনীর সঙ্গম করার জন্য পরস্পর গুরুতর আঘাত করে, তেমনই ভীমসেন ও দুঃশাসন শরীর পীড়াজনক ও মহাবেগশালী বাণসমূহ দ্বারা পরস্পর গুরুতর আঘাত করতে লাগলেন। তখন ভীমসেন ত্বরান্বিত হয়ে দুটি ক্ষুরপ্র দ্বারা দুঃশাসনের ধনু ও ধ্বজ ছেদন করলেন, একটি বাণ দ্বারা তাঁর ললাটও বিদীর্ণ করলেন এবং সারথির দেহ থেকে মস্তক হরণ করলেন। তখন দুঃশাসন অন্য ধনু নিয়ে নিজেই অশ্বচালন করে বারোটি বাণ দ্বারা ভীমসেনকে বিদীর্ণ করলেন এবং সরলগামী বাণসমূহ দ্বারা পুনরায় ভীমসেনকে তাড়ন করতে লাগলেন।

তারপরে দুঃশাসন সূর্যকিরণের মতো উজ্জ্বল, স্বর্ণ, হীরক ও রত্নে ভূষিত ইন্দ্রের বজ্র ও বিদ্যুৎপাতের তুল্য দুঃসহ এবং ভীমের অঙ্গবিদারণ করতে সমর্থ একটি বাণ ভীমের উপর নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণে দেহ বিদীর্ণ হলে, ভীমসেন শিথিলগাত্র হয়ে প্রাণশূন্যের ন্যায় নিপতিত হলেন এবং বাহুযুগল প্রসারিত করে সেই উত্তম রথেই শয়ন করে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে আবার চৈতন্য লাভ করে গর্জন করে উঠলেন। তারপর রাজপুত্র দুঃশাসন তুমুল যুদ্ধ করতে থেকে দুষ্কর কার্যই করলেন। তিনি এক বাণে ভীমের ধেনু ছেদন করলেন। অন্য এক বাণে ভীমের সারথিকেও বিদ্ধ করলেন। বলবান ও মহাত্মা দুঃশাসন সেই কাজ করে নয় বাণে ভীমসেনকে বিদ্ধ করলেন। তারপর আবার দ্রুত বহুতর উত্তম বাণ দ্বারা ভীমসেনের দেহ বিদারণ করলেন। তখন ভীমসেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে একটি ভীষণ শক্তি দুঃশাসনের দিকে নিক্ষেপ করলেন। প্রজ্বলিত উল্কার মতো সেই মহাভীষণ শক্তিটা বেগে আসতে থাকল, মহাত্মা দুঃশাসন ধনুখানাকে কর্ণ পর্যন্ত আকর্ষণ করে পূর্ণবেগশালী দশটি বাণ দ্বারা সেই শক্তিটাকে ছেদন করলেন। তখন তাঁর সেই অতিদুষ্কর কাজ দেখে সমস্ত যোদ্ধাই আনন্দিত হয়ে তাঁর প্রশংসা করতে লাগলেন। তারপর দুঃশাসন পুনরায় একটি তীক্ষ্ণবাণে ভীমসেনকে গাঢ়বিদ্ধ করলেন। ভীমসেন পুনরায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং দুঃশাসনের প্রতি দৃষ্টিপাত করে তৎক্ষণাৎ ক্রোধে জ্বলে উঠলেন, “বীর! তুমি আজ আমাকে গুরুতর বিদ্ধ করেছ। অতএব এবার আমার গদা প্রহার সহ্য করো”— এই বলে দুঃশাসনকে বধ করবার জন্য এক ভয়ংকর গদা ধারণ করে বললেন, “দুরাত্মা! আমি আজ এই যুদ্ধমধ্যে তোর রক্ত পান করব।” ভীম এই কথা বললে দুঃশাসন মৃত্যুর ন্যায় ভীষণ একটি শক্তি বেগে ভীমের উপরে নিক্ষেপ করলেন। ক্রোধে উগ্রমূর্তি ভীমসেনও একটা গদা চারদিকে ঘুরিয়ে সজোরে দুঃশাসনের উপর নিক্ষেপ করলেন। সেই গদাটা বেগে গিয়ে দুঃশাসনের শক্তিটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দুঃশাসনের মস্তকে আঘাত করল। মদাশ্রাবী হস্তীর মতো কম্পিত কলেবর ভীমসেন তুমুল যুদ্ধমধ্যে দুঃশাসনের প্রতি যে গদা নিক্ষেপ করলেন, সেই গদাটি গিয়ে বলপূর্বক দুঃশাসনকে দশ ধনু (চল্লিশ হাত) দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলল। দুঃশাসন সেই বেগবতী গদার আঘাতে আহত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেলেন। তার সমস্ত অশ্ব নিহত হল এবং সেই গদাটা পড়তে থেকে দুঃশাসনের রথখানাকেও চুর্ণ করল।

গদাঘাতে দুঃশাসনের বর্ম, অলংকার, বস্ত্র ও মালা খুলে পড়ল এবং তিনি গুরুতর বেদনায় পীড়িত হয়ে ছটফট করতে লাগলেন। তারপর বলবান, মহাবাহু, অচিন্ত্যকর্মা ভীমসেন— কৌরবদের সমস্ত শত্রুতাপ্রয়োগ স্মরণ করে, বহুতর প্রধান যোদ্ধা সকল দিকে যুদ্ধ করতে থাকলেও, দুঃশাসনের প্রতি দৃষ্টিপাত করে এবং রজস্বলা, নিরপরাধা ও স্বামীদের সাহায্যশূন্যা, দ্রৌপদী দেবীর কেশাকর্ষণ, বস্ত্রহরণ ও অন্যান্য দুঃখ সকল স্মরণ করে ঘৃতসিক্ত অগ্নির ন্যায় ক্রোধে জ্বলে উঠে কর্ণ, দুর্যোধন, কৃপ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মাকে ডেকে বললেন, “হে সমস্ত যোদ্ধৃগণ! আজ আমি পাপাত্মা দুঃশাসনকে বধ করছি। আপনারা পারেন তো রক্ষা করুন।” এই কথা বলে মহাবল ও মহাবেগশালী ভীমসেন দুঃশাসনকে বধ করবার ইচ্ছা করে বেগে ধাবিত হলেন।

তথা তু বিক্রম্য রণে বৃকোদরো মহাগজং কেশরীবোগ্ৰবেগঃ।

নিগৃহ্য দুঃশাসনমেকবীরঃ সুযোধনস্যাধিরথেঃ সমক্ষম্॥ কর্ণ: ৬১: ৫২॥

অদ্বিতীয় বীর ভীমসেন তখন রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে যত্নপূর্বক দুঃশাসনের উপর চোখ রেখে পাদচারে ভূমি দিয়ে গমন করছিলেন।

“ক্রমে ভীষণবেগশালী সিংহ যেমন মহাহস্তীকে নিগৃহীত করে, সেইরকম ভীমসেন যুদ্ধে বিক্রমপ্রকাশ পূর্বক দুর্যোধন ও কর্ণের সমক্ষেই দুঃশাসনকে নিগৃহীত করলেন।” শুভ্র ও সুধার তরবারি তুলে স্পন্দমান দুঃশাসনের কণ্ঠদেশ ধরে এবং ভূতল পতিত দুঃশাসনের বক্ষ বিদারণ করে তাঁর ঈষদুষ্ণ রক্ত পান করলেন। তখন দুঃশাসন উঠতে চেষ্টা করলে, বুদ্ধিমান ভীমসেন তাঁকে মাটিতে ফেলে সেই তরবারি দিয়ে তাঁর মাথা কেটে ফেলে আপন প্রতিজ্ঞা সত্য করবার জন্য পুনরায় তাঁর ঈষদুষ্ণ রক্ত পান করলেন এবং চারদিকে চেয়ে ওষ্ঠলগ্ন রক্ত লেহন করে ক্রুদ্ধ অবস্থায় দুঃশাসনের উদ্দেশে এই কথা বললেন—

“মাতার স্তন্যদুগ্ধ, মধু, ঘৃত, উত্তমরূপে নির্মিত পুষ্পরসমদ্য, স্বর্গীয় জলের রস, দুগ্ধ ও দধির সঙ্গে মথিত উত্তম পেয়দ্রব্য এবং মধু ও অমৃতের ন্যায় সুস্বাদুরসযুক্ত অন্যান্য যে সকল পানীয় দ্রব্য জগতে আছে, আজ এই শত্রুরক্তের আস্বাদ সে সমস্ত থেকেই সর্বপ্রকারে শ্রেষ্ঠ বলে আমার মনে হচ্ছে।” তারপর ভীষণকার্যকারী ও রোষপূর্ণচিত্ত ভীমসেন দুঃশাসনকে গতাসু দেখে স্পষ্টস্বরে উচ্চহাস্য করে আবার বললেন, “পাপাত্মা! মৃত্যু তোকে রক্ষা করেছে, আমি আর কী করব।”

ভীমসেন দুঃশাসনের রক্তপান করে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে এই কথা বলতে বলতে পুনরায় তাঁর দিকে ধাবিত হলে, তখন যারা তাঁকে দেখল, তারাও ভয়ে আকুল হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আর যেসব মানুষ সেদিকে আসছিল, তাদের হাত থেকে অস্ত্র পতিত হল, ভয়ে অস্পষ্টস্বরে রক্ষক ডাকতে লাগল এবং চোখ ঈষৎ বন্ধ করে ভীমকে দেখতে থাকল। সকল দিক থেকে যারা তখন ভীমসেনকে দুঃশাসনের রক্ত পান করতে দেখল, তারা সকলে ভীত হয়ে “এটা মানুষ নয়, রাক্ষস” এই কথা বলতে বলতে চতুর্দিকে পালাতে লাগল। ভীমসেন সেই ঘটনা ঘটানোর পর, তাঁকে দুঃশাসনের রক্ত পান করতে দেখে যোদ্ধারা ভয়ার্ত হয়ে ভীমসেনকে ‘রাক্ষস’ বলতে বলতে কর্ণের ভ্রাতা চিত্রসেনের সঙ্গে বেগে পালাতে লাগল। এই সময়ে রাজপুত্র যুধামন্যু সৈন্যদের সঙ্গে পলায়মান চিত্রসেনের দিকে ধাবিত হলেন এবং নির্ভয়চিত্তে দ্রুত সাতটি বাণ দিয়ে তাঁকে বিদ্ধ করলেন।

তখন চরণাক্রান্তদেহ, বার বার রক্তনির্গমনকারী এবং ক্রোধে বিষ উদগার করতে অভিলাষী মহাসর্পের মতো চিত্রসেন ফিরে তিন বাণে যুধামন্যুকে ও ছয় বাণে তাঁর সারথিকে বিদ্ধ করলেন। তারপর বীর যুধামন্যু ধনুখানা কর্ণ পর্যন্ত আকর্ষণ করে একটি সুন্দর পুষ্প শোভন পক্ষীপক্ষযুক্ত ও তীক্ষ্ণবাণ সতর্ক সন্ধান করে চিত্রসেনের দিকে নিক্ষেপ করলেন এবং তাতে চিত্রসেনের মস্তক ছেদন করলেন। ভ্রাতা চিত্রসেন নিহত হলে, অমিততেজা কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে পুরুষকাব দেখাতে থেকে পাণ্ডবসৈন্য পীড়ন করতে থাকলেন; তখন নকুল তাঁর দিকে ছুটে গেলেন।

ওদিকে ভীষণ গর্জনকারী ভীমও সেই সময়েই কোপনস্বভাব দুঃশাসনকে বধ করে পুনরায় তাঁর রক্তে অঞ্জলি পূরণ করে শ্রবণকারী বীরগণের সমক্ষে উচ্চকণ্ঠে বলতে থাকলেন, “পুরুষাধম। আমি তোর কণ্ঠ থেকে এই রক্তপান করছি। এখন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে আবার ‘গোরুটা গোরুটা’ এই কথা বল দেখি। তখন যারা আমাদের লক্ষ্য করে ‘গোরু গোরু’ বলে আনন্দে নৃত্য করছিল; এখন আমরাও তাদের লক্ষ্য করে আবার ‘গোরু গোরু’ বলে প্রতি নৃত্য করব।

“প্রমাণকোটিতে শয়ন, কালকূট ভক্ষণ, কৃষ্ণসর্পদ্বারা দংশন, জতুগৃহ দাহ, দূতক্রীড়ায় রাজ্যহরণ, বনবাস, অতিদারুণ দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ, যুদ্ধে বাণ ও অন্যান্য অস্ত্রপ্রয়োগ, গৃহে দুঃখভোগ, বিরাটরাজার গৃহে নানাবিধ কষ্ট এবং শকুনি, দুর্যোধন ও কর্ণের মন্ত্রণা অনুসারে আমাদের অন্যান্য যত দুঃখভোগ হয়েছে, একমাত্র তুই-ই তার কারণ ছিলি। পুত্রের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের দুর্ব্যবহারের কারণে সর্বদাই আমরা এই সকল দুঃখই অনুভব করে এসেছি, কখনও সুখভোগ করতে পারিনি।”

বলবান ভীমসেন জয়লাভ করে এই সকল কথা বলে ঈষৎ হাস্য করে পুনরায় কৃষ্ণ ও অর্জুনকে বললেন— সেই সময়ে তাঁর সমস্ত অঙ্গ রক্তাক্ত ছিল— মুখ থেকে রক্ত নির্গত হচ্ছিল এবং তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ছিলেন। “বীর! অর্জুন! কৃষ্ণ! আমি যুদ্ধে দুঃশাসনের বিষয়ে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তা আজ সত্য করলাম। এখন অপর দ্বিতীয় দুর্যোধনরূপ যজ্ঞপশুকে বিনাশ করে রণদেবতাকে দান করব এবং কৌরবগণের সামনেই চরণদ্বারা ওই দুরাত্মার মস্তক দলন করে শান্তি লাভ করব।”

মহাবল, মহাত্মা ও রক্তাক্তদেহ ভীমসেন হৃষ্টচিত্তে এই কথা বলে উচ্চ স্বরে সিংহনাদ করলেন এবং ইন্দ্র যেমন বৃত্রাসুরকে বধ করে গর্জন করেছিলেন, তেমনই গর্জন করলেন।

*

দুঃশাসন সম্পর্কে ভীমের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হল। একেবারে বাল্যকাল থেকে দুর্যোধন আর কর্ণের আদেশে দুঃশাসন একটির পর একটি অন্যায় পাণ্ডবদের প্রতি করেছিলেন। সবথেকে অন্যায় করেছিলেন অন্তঃপুর থেকে দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে দ্যূতসভায় টেনে আনায়। দ্রৌপদী তখন একবস্ত্রা রজস্বলা ছিলেন। অন্তঃপুরে কুন্তী দেবী বারবার দুঃশাসনকে নিষেধ করেছিলেন— দুঃশাসন কর্ণপাত করেননি। তাঁর এই দুষ্কর্মের আদেশ দিয়েছিলেন কর্ণ। এইখানেই কর্ণ-দুঃশাসন ক্ষান্ত হননি। শ্বশুর এবং গুরুজনদের সামনেই কর্ণ দুঃশাসনকে দ্রৌপদীকে নগ্ন করতে আদেশ দিয়েছিলেন। কর্ণের আদেশ দুঃশাসন পালন করতে পারেননি। দ্রৌপদীর সাক্ষাৎ শ্বশুর, যুধিষ্ঠিরের পিতা ধর্ম পুত্রবধূর লাঞ্ছনা, তার শালীনতা রক্ষায় এগিয়ে এলেন। দুঃশাসন দ্রৌপদীকে নগ্ন করতে পারলেন না। কিন্তু এই অপরাধের শাস্তি ঘোষণা ভীমসেন তখনই করেছিলেন। ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, দুঃশাসনকে বধ করে তার কণ্ঠরুধির পান করবেন। ভীমসেন সেই প্রতিজ্ঞা পালন করলেন। দ্রৌপদী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে-হাতে দুঃশাসন তাঁর কেশাকর্ষণ করেছেন, সেই বাহু ছিন্ন না হলে তিনি আর কেশবন্ধন করবেন না। দ্রৌপদীর প্রতিজ্ঞাও পূর্ণ হল।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হলে, দুর্যোধনের মৃত্যুর পর গান্ধারী ভীমকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, বৃকোদর, তুমি দুঃশাসনের রুধির পান করে অতি গর্হিত অনার্যোচিত নিষ্ঠুর কর্ম করেছ। ভীম বললেন, রক্ত পান করা অনুচিত, নিজের রক্ত তো নয়ই। ভ্রাতার রক্ত নিজের রক্তেরই সমান। দুঃশাসনের রক্ত আমার দন্ত ও ওষ্ঠের নীচে নামেনি, শুধু আমার দুই হস্তই রক্তাক্ত হয়েছিল। যখন দুঃশাসন দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করেছিল, তখন আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তাই আমি ক্ষত্রিয়ধর্মানুসারে পালন করেছি। আপনার পুত্রেরা যখন আমাদের অপকার করত, তখন আপনি নিবারণ করেননি, এখন আমাদের দোষ ধরা আপনার উচিত নয়।

দুঃশাসনের জীবননাট্যের কাহিনি শেষ হল। এর পর দুর্যোধনের এই অনুগত ভ্রাতাকে আর একবার মাত্র আমরা দেখতে পাব। কুন্তী, দ্রৌপদী, গান্ধারীর আবেদনে ব্যাসদেব মৃত যোদ্ধাদের এক রাত্রি পূর্ণ জীবিত করে আনেন। স্ববেশে, স্বমূর্তিতে মৃত যোদ্ধারা আবির্ভূত হলেন। পৃথিবীর প্রিয়জনের সঙ্গে আনন্দে একরাত্রি অতিবাহিত করেছিলেন তাঁরা। দুঃশাসনও এসেছিলেন।

দুঃশাসন মহাভারতের দুষ্ট-চতুষ্টয়ের অন্যতম। মায়া-মমতা তাঁর চরিত্রে পাঠক আশা করেন না। তিনি চূড়ান্ত পাপী, ঘোর পাপাত্মা। অংশাবতরণ পর্বে পাঠক জেনেছেন দুঃশাসন রাক্ষসের অংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এমন দুঃশাসনও কিন্তু অত্যন্ত ভ্ৰাতৃভক্ত ছিলেন। গন্ধর্ব-চিত্রসেনের হাতে পরাজয়ের পর, যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছায় ভীম-অর্জুন দুর্যোধনকে মুক্ত করেছিলেন। সেই গ্লানিতে দুর্যোধন প্রায়োপবেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ও দুঃশাসনকে রাজ্য দিয়ে যান। দুর্যোধনের চরণযুগলে মাথা রেখে প্রচণ্ড ক্রন্দন করতে করতে দুঃশাসন বলেছিলেন, “এ আদেশ আমাকে করবেন না। আমি কিছুতেই আপনার সিংহাসনে বসব না।”

৭৮
বৃষসেন-বধ—অভিমন্যু বধের প্রতিশোধ

কর্ণ, কৃপ, দুর্যোধন, কৃতবর্মা, অশ্বত্থামার সমক্ষেই ভীমসেন দুঃশাসনের বক্ষরক্ত পান করেন। কৌরব সেনাপতি কর্ণ সম্পূর্ণ কর্তব্যমূঢ় হয়ে পড়লেন। পিতার এই অবস্থা দেখে কর্ণের জ্যেষ্ঠপুত্র বৃষসেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে পাণ্ডবদের দিকে ধাবিত হলেন। সারথি শল্যের মুখে এই সংবাদ শুনে কর্ণের মনের দুর্বলতা কেটে গেল। তিনি অসন্দিগ্ধভাবে যুদ্ধের স্থির অভিপ্রায় করলেন। এই সময়ে গদাধারী পাণ্ডুনন্দন ভীমসেন দণ্ডধারী যমের মতো কৌরবসেনাদের বধ করছিলেন। বৃষসেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আপন রথে থেকে ভীমসেনের দিকে অগ্রসর হলেন।

তখন বীর নকুল একটি ক্ষুরপ্র দ্বারা বৃষসেনের স্ফটিকবিন্দুখচিত ধ্বজটিকে ছেদন করলেন। মহাস্ত্রধারী বৃষসেন দ্রুত অন্য একটি ধনু নিয়ে দুঃশাসন বধের প্রতিশোধ নেবার জন্য অলৌকিক মহাস্ত্রসমূহ দ্বারা পাণ্ডুনন্দন নকুলকে বিদ্ধ করলেন। তখন মহাত্মা নকুল ক্রুদ্ধ হয়ে উল্কাতুল্য বাণসমূহ দ্বারা বৃষসেনকে আঘাত করলেন। সমস্ত অস্ত্রে সুশিক্ষিত বৃষসেনও অলৌকিক অস্ত্রসকলদ্বারা নকুলকে অত্যন্ত তাড়ন করলেন। ঘৃতাহুতিদ্বারা প্রজ্বলিত অগ্নির মতো ভীষণভাবে জ্বলে উঠে বৃষসেন নকুলের বাণাঘাতে, ক্রোধে, আপন কান্তিতে, অস্ত্ৰক্ষেপে উগ্রমূর্তি ধারণ করলেন। বৃষসেন উত্তম অস্ত্রসমূহ দ্বারা বনায়ুদেশজাত, শুভ্রবর্ণ, স্বর্ণালংকারে অলংকৃত ও বিচিত্র সুকুমারদেহ নকুলের সমস্ত অশ্ব বিনাশ করলেন।

অশ্বগুলি নিহত হলে, নকুল রথ থেকে নেমে নির্মলস্বর্ণচন্দ্রচিহ্নযুক্ত ঢাল নিয়ে এবং আকাশের মতো নির্মল তরবারি ধারণ করে পক্ষীর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে রণস্থলে বিচরণ করতে লাগলেন। নকুল বিচিত্রপথে বিচরণ করতে থেকে আকাশেই হস্তী, অশ্ব, ও প্রধান প্রধান পদাতিকে ছেদন করতে লাগলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞে ঘাতক ছেদন করলে পশুগণ যেমন ভূতলে পতিত হয়, সেইরকম নকুল তরবারি বিচ্ছিন্ন পদাতি প্রভৃতি ভূতলে পতিত হতে লাগল। একা নকুলই তখন যুদ্ধক্ষেত্রে দুই সহস্র পদাতিকে ছেদন করলেন। নকুল বেগে আসতে লাগলে, বৃষসেন তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয়ে নকুলকে বধ করার ইচ্ছা করে তীক্ষ্ণ বাণসমূহ দ্বারা তাকে সকল দিকে বিদ্ধ করলেন। বৃষসেন বাণদ্বারা বীর নকুলকে বিদ্ধ করলেন বলে ভীমসেন বেদনা অনুভব করতে থেকে ক্রুদ্ধ হলেন এবং সেই মহাভয়ের সময়ে ভ্রাতা ভীমসেন রক্ষা করতে লাগলেন বলে মহাত্মা নকুল ভীষণ কার্য করতে পারলেন।

তখন বীর নকুল একাকী প্রধান প্রধান হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিকে বিনাশ করতে থেকে যেন ক্রীড়া করতে লাগলেন, বৃষসেন ক্রুদ্ধ হয়ে আঠারোটি বাণ দ্বারা তাঁকে বিদ্ধ করলেন। মহাযুদ্ধে বৃষসেন অত্যন্ত বিদ্ধ করলে, বলবান মনুষ্যবীর নকুল ক্রুদ্ধ হয়ে বৃষসেনকে বধ করবার ইচ্ছা করে তাঁর দিকে ধাবিত হলেন। মাংসলোভী বাজপাখি যেমন পাখা ছড়িয়ে বেগে এগিয়ে আসতে থাকে, বৃষসেন তীক্ষ্ণ বাণসমূহদ্বারা তাঁকে প্রহার করতে লাগলেন।

তখন নকুল ঢাল দ্বারা বৃষসেনের বাণগুলিকে ব্যর্থ করতে থেকে বিচিত্র পথে বিচরণ করতে থাকলেন। নকুল তরবারি নিয়ে বিচিত্র পথে বিচরণ করতে থাকলে, বৃষসেন উত্তম বাণ দ্বারা তাঁর সেই সহস্রতারাযুক্ত ঢাল বিনষ্ট করলেন এবং বৃষসেন ছ’টি তীক্ষ্ণ ক্ষুরপ্র বাণ দ্বারা দ্রুত নকুলের সেই লৌহময়, শিলাশাণিত, তীক্ষ্ণধার, কোষমুক্ত, দুষ্করকার্যকারী, শত্রুশরীর নাশক ও সর্পের ন্যায় ভীষণ তরবারিখানা কেটে ফেললেন। বৃষসেন পুনরায় তীক্ষ্ণ ও রক্তপায়ী বাণসমূহ দ্বারা গাঢ়ভাবে নকুলের বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করলেন। নকুল বৃষসেনের বাণে পীড়িত হয়ে সত্বর গিয়ে ভীমসেনের রথে উঠলেন। নিজের রথের অশ্বগুলি নিহত হলে, নকুল বৃষসেনের বাণে পীড়িত হয়ে অর্জুনের সামনেই— সিংহ যেমন লাফ দিয়ে পর্বতের উপরে ওঠে, সেই রকম লাফ দিয়ে ভীমের রথে উঠেছিলেন। এই সময়ে মহারথ ভীমসেন ও নকুল একরথে মিলিত হলেন; তখন ক্রুদ্ধ, মহাবল বৃষসেন বাণ দ্বারা বিদীর্ণ করেই তাঁদের উপরে বাণজাল বর্ষণ করতে লাগলেন। বৃষসেন বাণদ্বারা দ্রুত নকুলের রথ অকর্মণ্য ও তরবারি ছিন্ন করলে, ভীমসেন অর্জুনকে ডেকে বললেন, “অর্জুন দেখো— বৃষসেন নকুলকে পীড়ন করছে এবং আমার দিকে ধাবিত হয়েছে। অতএব তুমি ওর দিকে যাও।” তখন অর্জুন ভীমের সেই কথা শুনেই উগ্রমূর্তি হয়ে ভীমের রথের কাছ দিয়ে কৃষ্ণনিয়ন্ত্রিত কপিধ্বজ রথ বৃষসেনের দিকে চালিয়ে দিলেন।

তখন কর্ণের পুত্র বৃষসেন লৌহময় তিন বাণে শতানীককে, তিন বাণে অর্জুনকে, তিন বাণে ভীমকে, সাত বাণে নকুলকে এবং বারো বাণে কৃষ্ণকে আঘাত করলেন। কৌরবেরা অলৌকিক কার্যকারী বৃষসেনের সেই কাজ দেখে তার প্রশংসা করতে লাগলেন। কিন্তু যাঁরা অর্জুনের পরাক্রম জানতেন, তাঁরা মনে করলেন যে, বৃষসেনকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়েছে। বৃষসেন লোকমধ্যে মাদ্ৰীপুত্র নরপ্রবীর নকুলের অশ্বগুলিকে বধ করেছেন এবং কৃষ্ণকে অত্যন্ত ক্ষত-বিক্ষত করেছেন, এই দেখে বিপক্ষবীরহন্তা অর্জুন তখনই কর্ণের সম্মুখস্থিত বৃষসেনের দিকে ধাবিত হলেন। বাণসহস্রধারী প্রসিদ্ধ নরবীর অর্জুন উগ্রমূর্তি হয়ে মহাযুদ্ধে আসতে দেখে, পূর্বকালে নমুচি দানব যেমন ইন্দ্রের দিকে ধাবিত হয়েছিল, সেইরকম মহারথ বৃষসেনও অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। তারপর অত্যন্ত প্রভাবশালী বৃষসেন বেগে একরথেই অগ্রবর্তী হয়ে এক বাণে অর্জুনকে বিদ্ধ করে— পূর্বকালে নমুচিদানব যেমন ইন্দ্রকে বিদ্ধ করে সিংহনাদ করেছিল, সেইরকম সিংহনাদ করলেন।

বৃষসেন পুনরায় ভীষণ কয়েকটি বাণ দ্বারা অর্জুনের বামবাহুমূলে বিদ্ধ করলেন এবং ন’টি তীক্ষ্ণ বাণে কৃষ্ণকে, আবার দশটি বাণ দ্বারা অর্জুনকে আঘাত করলেন। বৃষসেন পূর্বে বিদ্ধ করেছিলেন, আর সেই সব মহাবেগশালী বাণ দ্বারা বিদ্ধ করায় অর্জুন ঈষৎ ক্রুদ্ধ হলেন পরে বৃষসেনকে বধ করবার জন্য মনস্থির করলেন। তারপর মহাত্মা অর্জুন রণমধ্যে কোপবশত ললাটে রেখাত্রয়যুক্ত ভ্রূকুটি করে যুদ্ধে বৃষসেনকে বধ করার জন্য সত্বর কতকগুলি বাণ নিক্ষেপ করলেন।

আরক্তনেত্রোহন্তক শত্ৰুহন্তা উবাচ কর্ণ ভৃশমুৎস্ময়স্তদা।

দুর্যোধনং দ্রৌণিমুখাংশ্চ সর্বানহং রণে বৃষসেনং তমুগ্রম্॥

সংপশ্যতঃ কর্ণ! তবাদ্য সংখ্যে নয়ামি লোকংনিশ্চিতৈঃ পূয্যৎকৈঃ।

নূনঞ্চ তাবদ্ধি জনা বদন্তি সর্বৈর্ভদ্ভিৰ্মম সূনুর্হতোহসৌ।। কর্ণ : ৬২ : ৬৯-৭০॥

ক্রমে যমের ন্যায় শক্ৰহন্তা অর্জুন আরক্তনয়ন হয়ে ঈষৎ হাস্য করে উচ্চ স্বরে কর্ণ, দুর্যোধন ও অশ্বত্থামাদি সমস্ত বীরকে বললেন, কর্ণ! আজ আমি তীক্ষ্ণ বাণসমূহদ্বারা তোমাদের সামনেই তোমার পুত্র উগ্রমূর্তি বৃষসেনকে পরলোক পাঠাব। সকল লোকই নিশ্চিতভাবে বলে, ‘আমার পুত্র অভিমন্যু একমাত্র রথী ছিল। আমি কাছে ছিলাম না; সেই অবস্থায় তোমরা সকলে মিলে সেই বীরকে বধ করেছ।’ কিন্তু আমি তোমাদের সামনেই তোমার পুত্রকে বধ করব। হে রথারোহীগণ, আপনারা যদি পারেন এই কর্ণপুত্রকে রক্ষা করুন; আমি এই উগ্রমূর্তি বৃষসেনকে বধ করব।

“কর্ণ তুমি এই কলহের মূল, দুর্যোধনের নিকৃষ্ট আশ্রয়েই তোমার দর্প বেড়েছে এবং তুমি চিরদিনই অতিশয় কর্তব্যজ্ঞানহীন। অতএব বৃষসেনের বধের পরেই আমি অর্জুন আজ তোমাকেও বধ করব। আমি আজ যুদ্ধে বলপূর্বক তোমাকে বধ করব এবং যাঁর দুর্নীতিবশত এই মহালোকক্ষয় হয়ে আসছে, সেই অধম পুরুষ দুর্যোধনকে খুঁজে ভীমসেন নিশ্চয়ই বধ করবেন।”

মহাত্মা অর্জুন এই বলে ধনু মেজে নিলেন এবং বৃষসেনকে লক্ষ্য করে তাকে বধ করবার জন্য অতি দ্রুত বহুতর বাণ নিক্ষেপ করলেন। অর্জুন দশটি বাণ দ্বারা বলপূর্বক নিঃশঙ্কভাবে বৃষসেনের দশটি মর্মস্থান বিদ্ধ করলেন এবং চারটি ভীষণ ক্ষুরপ্র দ্বারা তাঁর ধনু, বাহুযুগল ও মস্তক ছেদন করলেন। তখন বহুপুষ্প সমন্বিত ও অতিবিশাল উত্তম শালবৃক্ষ যেমন বায়ুসঞ্চালিত হয়ে পর্বতশৃঙ্গ থেকে পতিত হয়, সেইরকম বৃষসেন অর্জুনের বাণে নিহত ও বাহুযুগল ও মস্তকশূন্য হয়ে রথ থেকে পতিত হলেন। বৃষসেনের পতনে কর্ণের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। তারপর ক্ষিপ্রকারী কর্ণপুত্র বৃষসেনকে অর্জুনের বাণে নিহত ও রথ থেকে পতিত হতে দেখে পুত্রশোকে সন্তপ্ত হয়ে ক্রোধে সত্বর আপন রথে অর্জুনের রথের দিকে গমন করলেন।

*

রথী-মহারথ-অতিরথ গণনাকালে ভীষ্ম জানিয়েছিলেন কর্ণপুত্র বৃষসেন উত্তম রথী। পতনের পূর্বে বৃষসেন তার প্রমাণ দিয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধে নকুলকে পরাজিত করেছিলেন। কর্ণও তাঁর পুত্রটিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তাঁর বীরত্ব নিয়ে গর্বিতও ছিলেন। কিন্তু অর্জুনের সম্মুখে একাকী বৃযসেনকে ছেড়ে দিলে, তার পরিণাম কী হতে পারে কর্ণ ভেবে দেখেননি। ভীমসেন সকল মহারথের সামনে দুঃশসানকে বধ করে, তার রুধির পান করলে, অন্য রথী মহারথের সঙ্গে কর্ণও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। পিতার এই বিচলিত অবস্থা দেখেই বৃষসেন কৌরববাহিনীর নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন।

এটিকে দুর্লভ মুর্হূত হিসাবে বেছে নেবার কারণ হল, ভীষ্মবধের পর কৌরবপক্ষের সকল রথী-মহারথ-অতিরথের থেকে অর্জুন যে কতটা শ্রেষ্ঠ, তাঁর বীরত্বের সঙ্গে বিচারবোধ কতদূর মিশ্রিত ছিল, তার সশ্রদ্ধ উল্লেখ করা। সাত্যকিকে বাঁচাবার জন্য ভূরিশ্রবার দক্ষিণবাহু ছেদন করা ভিন্ন অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করেননি।

পুত্র অভিমন্যুর সপ্তরথীবেষ্টিত অবস্থায় মৃত্যু অর্জুন কখনও ভোলেননি। অভিমনুর মৃত্যুর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্ণ। তাও সপ্তরথীবেষ্টিত অবস্থায় এবং পিছন থেকে। বৃষসেনকে কর্ণের উপস্থিতিতে পেয়ে অর্জুনের অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা, পূর্ণরূপে প্রকাশিত হল। তিনি অভিমন্যুর মৃত্যুকে স্মরণ রেখে কর্ণকে আহ্বান করলেন পুত্রকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে। বৃষসেন নিহত হলেন কর্ণের উপস্থিতিতে, চোখের সামনে। অন্য মহারথ অতিরথেরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন শুধু।

মহাভারত পাঠ করতে গিয়ে, ব্যাসদেবের বিচার পাঠকের চোখের সামনে পড়বেই। ধর্মচ্যুত হলে, অন্যায় করলে ফল পেতে হবে। ফল পেতে হবে পৃথিবীতেই। দেহ স্বর্গে বা নরকে যাবে না, যাবে আত্মা। দেহকে শোধ করে যেতে হবে ঋণ। পিতা কর্ণ অনুভব করতে পারলেন, অভিমন্যুর মৃত্যুতে অর্জুনের কেমন লেগেছিল। কিন্তু সে ছিল সহায়হীন, নিরস্ত্র। কর্ণ তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়েও পুত্রকে বাঁচাতে পারলেন না। যুধিষ্ঠির জয়দ্রথ বধে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, অর্জুনের দ্রোণ কিংবা কর্ণ বধের প্রতিজ্ঞা করা উচিত ছিল। কারণ, এঁরা দু’জনেই অভিমন্যুর মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ। বৃষসেনকে হত্যা করে অর্জুন প্রকৃতপক্ষে কর্ণকেই বধ করলেন, কারণ পুত্র আত্মস্বরূপ। কর্ণের মানসিক মৃত্যু ঘটল বৃষসেন বধে, এইবার তাঁর দৈহিকভাবে নিহত হবার পালা।

৭৯
কর্ণ-বধ

নিজের সামনেই প্রিয় পুত্র বৃষসেনকে অর্জুন কর্তৃক যুদ্ধে নিহত হতে দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ বেগে কৃষ্ণার্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। অতিবিশালদেহ, দেবগণেরও দুর্নিবারণীয় ও গর্জনকারী কর্ণকে, তীরোদ্গত সমুদ্রের মতো আসতে দেখে পুরুষশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ হাস্য করে অর্জুনকে বললেন—

“অয়ং স রথ আয়তি শ্বেতাশ্বঃ শল্যসারথিঃ।

যেন তে সহ যোদ্ধব্যং স্থিরো ভব ধনঞ্জয়!॥ কর্ণন: ৬৩: ২॥

—“অর্জুন! শ্বেতাশ্ব ও শল্যসারথি এই সেই রথ আসছে, যার সঙ্গে তোমায় যুদ্ধ করতে হবে। অতএব স্থির হও।”

“পাণ্ডবগণ, কর্ণের রথখানি দেখো— নানা সজ্জায় সজ্জিত, শ্বেতবর্ণ অশ্ব ও নানা পতাকাব্যাপ্ত এবং কিঙ্কিণীসমূহের মালা সমন্বিত রয়েছে। আকাশে শ্বেতবর্ণঘোটক চালিত বিমানের ন্যায় এই রথ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। মহাবনমধ্যে ক্রুদ্ধ সিংহকে দেখে অপর পশুগণের ন্যায় এই পাঞ্চাল মহারথেরা কর্ণকে দেখেই আপন অনুচরদের নিয়ে সরে যাচ্ছেন। কুন্তীনন্দন, তুমি সর্বপ্রযত্নে কর্ণকে বধ করো। কারণ, অন্য মানুষ কর্ণের বাণ সহ্য করতে সমর্থ নয়।

“অর্জুন আমি জানি যে, তুমি যুদ্ধে দেবতা, অসুর, গন্ধর্বগণের সঙ্গে সচরাচর ত্রিভুবন জয়ে সমর্থ। অন্য মানুষেরা ভীম, উগ্র, মহাত্মা, ত্রিলোচন, কপর্দী ও ঈশান শিবকে দেখতেই সমর্থ হয় না, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করার কথা তাঁরা চিন্তাও করতে পারে না। তুমি যুদ্ধ করে সমস্ত প্রাণীর মঙ্গলকারী ও চিরস্থায়ী মহাদেব শিবকে আরাধনা করেছ এবং দেবতারাও তোমার অভীষ্ট দান করেছিলেন। মহাবাহু-পৃথানন্দন, ইন্দ্র যেমন নমুচি দানবকে বধ করেছিলেন, তুমিও সেইরকম সেই দেবদেব মহাদেবের অনুগ্রহে কর্ণকে বধ করো। পার্থ সর্বদাই তোমার মঙ্গল হোক এবং যুদ্ধে জয়লাভ করো।”

অর্জুন বললেন, “মধুসূদন, সমগ্র জগতের গুরু তুমি যখন আমার উপরে সন্তুষ্ট আছ, তখন নিশ্চয়ই আমার জয় হবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। মহারথ হৃষীকেশ, তুমি আমার অশ্ব ও রথ সঞ্চালন করো। অর্জুন যুদ্ধে কর্ণকে বধ না করে ফিরবে না। আজ আমার এই বাণে কর্ণকে নিহত ও খণ্ডখণ্ডীকৃত দেখবে, কিংবা কর্ণের বাণে আমাকে নিহত দেখতে পাবে। যত কাল পৃথিবী থাকবে, ততকাল লোকে যে যুদ্ধের কথা বলবে, আজ ত্রিভুবনমোহনকারী সেই যুদ্ধ উপস্থিত হবে।”

একটা হাতি যেমন আর একটা হাতির দিকে দ্রুত গমন করে, তখন অর্জুন অনায়াসে কার্যকারী কৃষ্ণকে এই কথা বলতে বলতে রথারোহণে দ্রুত কর্ণের দিকে গমন করতে লাগলেন। পরে মহাতেজা অৰ্জুন শত্রুদমনকারী কৃষ্ণকে পুনরায় বললেন “হৃষীকেশ, সময় কেটে যাচ্ছে। সুতরাং অশ্বগুলিকে আরও দ্রুত চালাও।” মহাত্মা অর্জুন এই কথা বললে, কৃষ্ণ তখন জয়াশীর্বাদে অর্জুনের গৌরব করে মনের মতো বেগবান অশ্বগুলি আরও বেগে চালিয়ে দিলেন। ক্রমে অর্জুনের সেই মহাবেগশালী রথ ক্ষণকালের মধ্যে গিয়ে কর্ণের রথের সম্মুখে উপস্থিত হল।

কর্ণ বৃষসেনকে নিহত দেখে শোকার্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে দুই চোখ থেকে পুত্রশোকাশ্রু বিসর্জন করলেন। তারপর কর্ণ পুত্রশোকের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য অর্জুনের রথের দিকে গমন করলেন। লোকেরা দেখল দুটি উজ্জ্বল সূর্যের তুল্য দুটি রথ এসে মিলিত হয়েছে। ত্রিভুবন জয়ে যত্নবান ইন্দ্র ও বলির ন্যায় দুই বীরকে সমাগত দেখে সমস্ত লোক বিস্ময়াপন্ন হল। তখন সমস্ত কৌরবসৈন্য কর্ণের পাশে ও সমস্ত পাণ্ডবসৈন্য অর্জুনের রথের পাশে উপস্থিত হলেন। উভয়পক্ষের সৈন্যেরা তাঁদের নেতার জয় কামনা করে শাঁখ বাজাতে লাগলেন।

পুরুষশ্রেষ্ঠ কর্ণ ও অর্জুনকে সম্মিলিত দেখে সমস্ত লোকেরই জয় বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হল। সেই সময়ে তাঁরা দু’জন উত্তম অস্ত্র ধারণ করেছিলেন, যুদ্ধে পরিশ্রম করছিলেন এবং দু’জনেই বাহুর শব্দে আকাশ নিনাদিত করছিলেন। পুরুষকার ও শক্তির গুণে দু’জনের কার্যই জগদ্বিখ্যাত ছিল এবং দু’জনেই যুদ্ধে শম্বরাসুর ও ইন্দ্রতুল্য বলে গণ্য হচ্ছিলেন। দু’জনেই বলে বিষ্ণুর সমান এবং যুদ্ধে কার্তবীর্যার্জুন, রামচন্দ্র ও শিবের তুল্য ছিলেন। তাঁদের দু’জনের শ্বেতবর্ণ অশ্ব, উত্তম রথ এবং শ্রেষ্ঠ সারথি ছিল। আকাশস্থ সিদ্ধচারণগণ বীরশোভায় শোভিত মহারথ কর্ণ ও অর্জুনকে দেখে বিস্ময়াপন্ন হলেন।

পুরুষশ্রেষ্ঠ কর্ণ ও অর্জুনকে সম্মিলিত দেখে সমস্ত লোকেরই জয় বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হল। সেই সময়ে তাঁরা দু’জন উত্তম অস্ত্র ধারণ করেছিলেন, যুদ্ধে পরিশ্রম করছিলেন এবং দু’জনেই বাহুর শব্দে আকাশ নিনাদিত করছিলেন। পুরুষকার ও শক্তির গুণে দু’জনের কার্যই জগদ্বিখ্যাত ছিল এবং দু’জনেই যুদ্ধে শম্বরাসুর ও ইন্দ্রতুল্য বলে গণ্য হচ্ছিলেন। দু’জনেই বলে বিষ্ণুর সমান এবং যুদ্ধে কার্তবীর্যার্জুন, রামচন্দ্র ও শিবের তুল্য ছিলেন। তাঁদের দুজনের শ্বেতবর্ণ অশ্ব, উত্তম রথ এবং শ্রেষ্ঠ সারথি ছিল। আকাশস্থ সিদ্ধচারণগণ বীরশোভায় শোভিত মহারথ কর্ণ ও অর্জুনকে দেখে বিস্ময়াপন্ন হলেন।

তখন কৌরবপক্ষের যোদ্ধাদের সেই রণদ্যুতে পণ হলেন কর্ণ; আবার পাণ্ডবদের যুদ্ধদ্যূতে পণ হলেন অর্জুন। উভয়পক্ষের যোদ্ধারাই সেই রণদ্যূতে সভ্য ছিলেন এবং তাঁরাই দর্শক হলেন; আর তখনই রণদ্যূতকারী দুই পক্ষের জয় ও পরাজয় নির্দিষ্ট ছিল। রণস্থলে অবস্থিত কৌরবদের ও পাণ্ডবদের জয় বা পরাজয়ের জন্য কর্ণ ও অর্জুন যুদ্ধরূপ দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ করেছিলেন। ক্রমে যুদ্ধনিপুণ কর্ণ ও অর্জুন পরস্পরের প্রতি ক্রুদ্ধ এবং পরস্পরের বধাভিলাষী হয়ে রণস্থলে দাঁড়ালেন। উগ্রমূর্তি কর্ণ ও অর্জুন পরস্পরের প্রতি ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের ন্যায় এবং অতিধূম্রবর্ণ রাহু ও কেতুগ্রহের তুল্য পরস্পর প্রহরাভিলাষী হলেন।

তখন আকাশ ও ভূতলের প্রাণীরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে দুই পক্ষ অবলম্বন করলেন। নক্ষত্রগণের সঙ্গে আকাশ থাকল— কর্ণের পক্ষে। মাতা যেমন পুত্রের পক্ষ গ্রহণ করে তেমনই বিশালা পৃথিবী অর্জুনের পক্ষ গ্রহণ করলেন। অসুর, রাক্ষস, গুহ্যক, আকাশচর ভূত ও অমাঙ্গলিক পাখিরা কর্ণের পক্ষ আশ্রয় করল। রত্ন, সমস্ত নিধি, বেদ, ইতিহাস, উপবেদ, উপনিষদ, মন্ত্র, সংগ্রহগ্রন্থ, বাসুকি, চিত্রসেন, তক্ষক, উপতক্ষক, পর্বত, কদ্রু থেকে উৎপন্ন, সন্তান-সন্ততিযুক্ত, বিষধারী, মহাক্ৰোধী নাগেরা অর্জুনের পক্ষে গেল। ঐরাবত, সৌরভেয়, বিশালকায় নাগেরা অর্জুনের পক্ষে গমন করল। আর ক্ষুদ্র সর্পেরা কর্ণের পক্ষে গেল। কেন্দুয়া বাঘ, হিংস্র পশু, মাঙ্গলিক সমস্ত পশুপক্ষী অর্জুনের জয়লাভের জন্য তাঁর পক্ষই আশ্রয় করল। বসুগণ, মরুদ্‌গণ, সাধ্যগণ, রুদ্রগণ, বিশ্বদেবগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অগ্নি, ইন্দ্র, চন্দ্র, বায়ু এবং দশদিক অর্জুনের পক্ষে গেলেন; আর দ্বাদশ আদিত্য কর্ণের পক্ষ গ্রহণ করলেন। বৈশ্য, শূদ্র, সূত ও যারা বর্ণসংকর, তারা সকলেই কর্ণের পক্ষে গেল। পিতৃগণ, পার্শ্বচর ও অনুচরগণের সঙ্গে অপর দেবগণ এবং যম, কুবের ও বরুণ অর্জুনের পক্ষে গমন করলেন; আর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, যজ্ঞ ও দক্ষিণা অর্জুনের পক্ষ অবলম্বন করলেন। প্রেত, পিশাচ, মাংসভোজী পশু ও পাখি, রাক্ষসগণ, জলজন্তুগণ, কুকুরগণ ও শৃগালগণ কর্ণের পক্ষে গেলেন। দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিগণ এবং তুম্বুরু প্রভৃতি গন্ধর্বগণ অর্জুনের পক্ষে গমন করলেন।

মুনির পুত্র গন্ধর্ব ও অপ্সরাগণের সঙ্গে প্রবীর পুত্রগণ, হিংস্র জন্তুদের সঙ্গে ক্ষুদ্র ব্যাঘ্রগণ এবং রথ ও পদাতির সঙ্গে হস্তীগণ মেঘ ও বায়ু আরোহণ করে কর্ণ ও অর্জুনের যুদ্ধ দর্শন করবার জন্য আগমন করল। নানাবিধ বস্ত্র ও মাল্যধারী দেবগণ, দানবগণ, গন্ধর্বগণ, নাগগণ, যক্ষগণ, পক্ষীগণ, বেদজ্ঞ মহর্ষিগণ, শ্রাদ্ধান্নভোজী পিতৃগণ, তপস্বীগণ ও ঔষধিগণ নানাবিধ আলাপ করতে থেকে আকাশে অবস্থান করতে লাগলেন। ক্রমে ব্রহ্মাও— ব্রহ্মর্ষিগণ, প্রজাপতিগণ ও মহাদেবের সঙ্গে মিলিত হয়ে দিব্য বিমানে আরোহণ করে সেই স্থানে আগমন করলেন।

মহাত্মা কর্ণ ও অর্জুন রণস্থলে মিলিত হয়েছেন দেখে স্বয়ং ইন্দ্র বললেন, “অর্জুন কর্ণকে জয় করুন।” তখন সূর্য ইন্দ্রকে কললেন, “কর্ণ অর্জুনকে জয় করুন। আমার পুত্র কর্ণ অর্জুনকে বধ করে যুদ্ধে জয়লাভ করুন।” আবার ইন্দ্র বললেন, “আমার পুত্র অর্জুন আজ কর্ণকে বধ করে জয় লাভ করুন।” এইভাবে সূর্য ও ইন্দ্রের বিবাদ চলতে লাগল। পুরুষশ্রেষ্ঠ ইন্দ্র ও সূর্য দুই পক্ষে থাকলে, তখন দেবগণ ও অসুরগণের মধ্যেও দুই পক্ষ হল। ক্রমে মহাত্মা কর্ণ ও অর্জুনকে রণস্থলে মিলিত দেখে দেবতা, ঋষি ও চারণগণের সঙ্গে ত্রিভুবনই ভয়ে কাঁপতে থাকল। সমস্ত দেবগণ কাঁপতে লাগলেন এবং সমস্ত প্রাণীগণও কাঁপতে থাকল। যে দিকে অর্জুন, সেই দিকে দেবগণ এবং যে দিকে কর্ণ, সেই দিকে অসুরগণ রইলেন।

রথসমূহরক্ষক কুরুবীর কর্ণ এবং পাণ্ডববীর অর্জুনের পক্ষ দুটি দেখে দেবগণ প্রজাপতি ব্ৰহ্মাকে বললেন, “দেব, এই নরশ্রেষ্ঠ দুইজনের সমান জয় হোক। কর্ণ ও অর্জুনের বিবাদে যেন সমগ্র জগৎ নষ্ট না হয়। পিতামহ ইহাদের সমান জয় হোক এই কথা আপনি বলুন।” বুদ্ধিমানের মধ্যে প্রধান ইন্দ্র সেই কথা শুনে ব্রহ্মাকে নমস্কার করে বললেন, “ভগবান তো পূর্বেই বলেছেন যে, কৃষ্ণ ও অর্জুনের জয় সুনিশ্চিত। ভগবন্! আপনি অর্জুনের প্রতি প্রসন্ন হোন, আপনার সেই বাক্য সত্য হোক; আপনাকে নমস্কার।” তারপর ব্রহ্মা ও মহাদেব ইন্দ্রকে বললেন—

বিজয়ো ধ্রুব এবাস্তু বিজয়স্য মহাত্মনঃ।

খাণ্ডবে যেন হুতভুক্‌ তোষিতঃ সব্যসাচিনা॥

স্বর্গঞ্চ সমনুপ্রাপ্য সাহায্যং শত্রু তে কৃতম্‌।

কর্ণশ্চ দানবঃ পক্ষঃ অতঃ কার্যঃ পরাজয়ঃ॥ কর্ণ : ৬৪ : ৭১-৭২॥

—“মহাত্মা অর্জুনের জয়লাভ নিশ্চিত হোক। কেন না, যে অর্জুন খাণ্ডববন দগ্ধ করে অগ্নিকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। এবং ইন্দ্র যিনি স্বর্গে গিয়ে তোমার সাহায্য করেছিলেন। আর কর্ণ— দানবগণের পক্ষপাতী। অতএব তার পরাজয়ই করা উচিত।”

“এইরূপ করলে দেবগণের কার্যই নিশ্চিত করা হবে। দেবরাজ, আত্মকার্য সম্পাদন করা সকলের পক্ষেই শ্রেয়। বিশেষত মহাত্মা অর্জুনও সর্বদাই সত্যধর্মে নিরত। সুতরাং তাঁর জয় হবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। এবং জগতের অধীশ্বর স্বয়ং বিষ্ণু যাঁর সারথ্য করে আসছেন। বিশেষত— অর্জুন প্রশস্তহৃদয়, বলবান, বীর, সমস্ত অস্ত্রে সুশিক্ষিত এবং তপস্বী। অর্জুন মহাতেজা, সমস্ত ধনুর্বেদ ধারণ করেন এবং সর্বগুণসম্পন্ন। সুতরাং তাঁর জয়সম্পাদন করা যখন দেবকার্য, তখন তাই আমাদের কর্তব্য। বিশেষত পাণ্ডবেরা সর্বদাই বনবাসাদি দ্বারা গুরুতর ক্লেশ ভোগ করে আসছেন। তারপর পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুনও তপঃসম্পন্ন এবং নিজেই কার্যসমাপ্ত করতে সমর্থ। সুতরাং তাঁর মাহাত্ম্যে স্বয়ং দৈবও তাঁর পরাজয় ইচ্ছা করতে পারে না। কারণ তাঁর পরাজয় হলে, নিশ্চয়ই জগতের ধ্বংস হবে। কারণ, কৃষ্ণ ও অর্জুন ক্রুদ্ধ হলে, তাঁদের সম্মুখে কখনও কেউ থাকতে পারে না। কেন না, ওই পুরুষশ্রেষ্ঠরাই সর্বদা জগতের সৃষ্টিকর্তা।

“এঁরা প্রাচীন ঋষিশ্রেষ্ঠ নর ও নারায়ণ। সুতরাং এঁদের কেউ শাসন করতে পারে না। অথচ এঁরাই সকলকে শাসনে রাখেন। আবার এঁরা কারও ভয় করেন না, অথচ সকলেই এঁদের ভয় করে। স্বর্গে বা মর্ত্যে এদের সমান কেউ নেই। দেবর্ষি ও চারণগণের সঙ্গে ত্রিভুবন, সমস্ত দেবগণ এবং অন্য যে সমস্ত প্রাণী আছে— তাদের আনুগত্য এঁরা সর্বদাই পান। এমনকী সমগ্র জগৎই এঁদের প্রভাবে বিদ্যমান আছে। এই পুরুষশ্রেষ্ঠ, বীর, সূর্যনন্দন ও উৎসাহী কর্ণ প্রধান স্বর্গ লাভ করুন; কিন্তু কৃষ্ণ ও অর্জুনের জয় হোক। কর্ণ বসুলোক কিংবা বায়ুলোক লাভ করুন, অথবা ভীষ্ম ও দ্রোণের সঙ্গে সাধারণ স্বর্গলোকে অবস্থান করুন।”

ব্রহ্মা ও শিব এইরূপ বললে, ইন্দ্র সমস্ত ভূতকে সম্বোধন করে ব্রহ্মা ও শিবের এই শাসন বাক্য বললেন, “পূর্বকালে ইন্দ্র ও শম্বরাসুরের যেমন যুদ্ধ হয়েছিল, তৎকালে পরস্পর স্পর্ধাকারী কর্ণ ও অর্জুনের তেমন ভীরুজনের ভয়জনক ভীষণ যুদ্ধ হবার উপক্রম হল।” তাঁদের রথের নির্মল ধ্বজ দুটি প্রলয়কালের আকাশে রাহু ও কেতুর মতো শোভা পেতে লাগল। সর্প ও ইন্দ্রধনুর তুল্য, উত্তম রত্নময়ী ও দৃঢ় হস্তীমধ্যবন্ধন রজ্জু কর্ণের ধ্বজে প্রকাশ পেতে লাগল। আর প্রকটিতবদন, ভয়ংকর, দন্ত দ্বারা ভয়জনক এবং সূর্যের মতো দুর্নিরীক্ষ্য একটি বানরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের ধ্বজে দেখা যেতে লাগল। অর্জুনের ধ্বজস্থিত বানর যুদ্ধাভিলাষী হয়ে স্বস্থান থেকে বেগে কর্ণের ধ্বজের কাছে গমন করল। গরুড় যেমন সর্পকে আঘাত করে, সেইরূপ অর্জুনের ধ্বজস্থিত বানর মহাবেগে লাফিয়ে পড়ে কর্ণের ধ্বজস্থিত হস্তীরজ্জুকে আঘাত করল। আবার কিঙ্কিণীভূষিত, কালপাশতুল্য ও লৌহময়ী কর্ণধ্বজস্থিত হস্তীরজ্জুও যেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সেই বানরের দিকে ধাবিত হলেন। কর্ণ ও অর্জুনের দ্যূতরূপ ঘোরতর দ্বৈরথ যুদ্ধ সম্ভাবিত হলে, তাঁদের ধ্বজ দুটিতে যেন যুদ্ধ করতে লাগল এবং একজনের অশ্বগণের প্রতি অপরের অশ্বগণ হ্রেষারব করতে লাগল। কৃষ্ণ নয়নবাণে শল্যকে বিদ্ধ করতে থাকলেন, আবার শল্যও সেইরূপ কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে থাকলেন। তখন কৃষ্ণ নয়নবাণে শল্যকে জয় করলেন এবং কুন্তীনন্দন অর্জুনও কর্ণকে অভিভূত করলেন।

তারপরে কর্ণ শল্যকে সম্বোধন করে মৃদ্যুহাস্য করে বললেন, “সখে! আজ কখনও যদি অর্জুন আমাকে বধ করেন, তবে আপনার পরবর্তী কর্তব্য কী হবে? আর যদি আপনি নিহত হন, তবে আমি কৃষ্ণ ও অর্জুন দু’জনের মৃত্যু ঘটাব।” শল্য বললেন, “কর্ণ, আজ যদি অর্জুন যুদ্ধে তোমাকে বধ করেন, তবে আমি একরথেই কৃষ্ণ ও অর্জুন দু’জনকেই বধ করব।” অর্জুনও কৃষ্ণকে একই প্রশ্ন করলেন। তখন কৃষ্ণ হাস্য করে অর্জুনকে এই উত্তম বাক্য বললেন, “অর্জুন, সূর্য যদি স্বস্থান থেকে পতিত হন, পৃথিবী যদি বসুধা বিদীর্ণ হন এবং অগ্নি যদি শীতল হয়ে পড়েন, তবুও কর্ণ তোমাকে বধ করতে পারবে না। আর জগৎ উল্টে যাবার মতো এই ঘটনা যদি কোনও ভাবে ঘটে, তবে আমি আমার দুই খালি হাতেই কর্ণ ও শল্যকে বধ করব।” কৃষ্ণের কথা শুনে কপিধ্বজ অর্জুন হাসতে হাসতে কৃষ্ণকে বললেন, “জনার্দন, কর্ণ ও শল্যের পক্ষে আমিই যথেষ্ট। সুতরাং কৃষ্ণ তুমি আজ দেখবে— পতাকা, ধ্বজ, শল্য, রথ, অশ্ব, ছত্র, কবচ, শক্তি, বাণ ও ধনুর সঙ্গে কর্ণ আমার বাণে অনেক খণ্ডে ছিন্ন হয়েছে। কৃষ্ণ আজ তুমি দেখবে— হস্তী যেমন বনমধ্যে বৃক্ষ চুর্ণ করে, তেমন আমি রথ, অশ্ব, শক্তি, কবচ ও অস্ত্রের সঙ্গে কর্ণকে চূর্ণ করব। মাধব আজ কর্ণভার্যাগণের বৈধব্য উপস্থিত হয়েছে। সুতরাং নিশ্চয়ই আজ তারা স্বপ্নে অনিষ্ট দর্শন করছে। কৃষ্ণ নিশ্চয়ই আজ তুমি কর্ণভার্যাদের বিধবা দেখবে। যেহেতু এই মূঢ় ও অদূরদর্শী কর্ণ পূর্বে দ্রৌপদীকে সভায় দেখে তখন আমাদের উপহাস ও বার বার নিন্দা করতে থেকে যা করেছিল, তাতে আমার ক্রোধ নিবৃত্তিই পাচ্ছে না। তুমি আজ দেখবে— মত্তহস্তী যেমন পুষ্পিত বৃক্ষকে বিধ্বস্ত করে, আমি সেই রকম কর্ণকে বিধ্বস্ত করব। মধুসূদন, আজ কর্ণ নিপতিত হলে সেই মধুর বাক্যে শুনতে পাবে—‘বৃষ্ণিনন্দন! ভাগ্যবশত জয়লাভ করেছ।’ আজ ঋণশূন্য ও আনন্দিত হয়ে অভিমন্যুজননী সুভদ্রাকে এবং তোমার পিসিমা কুন্তী দেবীকে সান্ত্বনা দেবে। মাধব আজ অমৃততুল্য বাক্যদ্বারা সাশ্রুমুখী দ্রৌপদীকে ও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা করবে।”

তারপরে কুরুপক্ষীয় ও পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধারা সকল আনন্দিতচিত্তে শঙ্খধ্বনি সিংহনাদ ও কোলাহলে রণভূমি ও সকল দিক নিনাদিত করে পরস্পরে শত্ৰুসংহার আরম্ভ করলেন। তখন কর্ণ ও অর্জুন বাণে বাণে অন্ধকার করে ফেললে পাণ্ডব-কৌরবেরা কিছু জানতে পারল না এবং গগনপ্রসারী কিরণ যেমন চন্দ্র ও সূর্যকে আশ্রয় করে, তারাও সেইরকম কর্ণ ও অর্জুনকে আশ্রয় করল। ক্রমে বিশাল ও মণ্ডলাকারে কার্মুক যুগলের মধ্যবর্তী, মহাতেজা ও কিরণের ন্যায় বহুবাণশালী কর্ণ ও অর্জুন প্রলয়কালে চরাচরের সঙ্গে জগৎ দগ্ধ করতে প্রবৃত্ত দুটি সূর্যের ন্যায় যুদ্ধে দুঃসহ হয়ে পড়লেন। কর্ণ ও অর্জুন দুজনেই অজেয়, দুজনেই শত্রুহন্তা, দুজনেই যুদ্ধনিপুণ ও মহাবীর। তাঁরা ক্রমে জম্ভাসুরের মতো পরস্পর বধার্থী হয়ে বাণক্ষেপ করতে লাগলেন।

তারপর সিংহ বধার্থী হয়ে পশুদের দিকে অগ্রসর হলে পশুগণ যেমন দশ দিকে পলায়ন করে, তেমনই নরশ্রেষ্ঠ কর্ণ ও অর্জুন বধ করতে খাকলে, কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষের লোকেরা হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতির সঙ্গে দশ দিকে পলায়ন করতে লাগল। তারপর দুর্যোধন, কৃতবর্মা, শকুনি, কৃপাচার্য ও অশ্বত্থামা এই পাঁচজন মহারথ দেহনাশক বাণসমূহ দ্বারা কৃষ্ণ ও অর্জুনকে তাড়ন করতে থাকলেন। তখন অর্জুন বাণ দ্বারা তাঁদের ধনু, তূণ, অশ্ব, হস্তী ও সারথির সঙ্গে রথগুলিকে একসময়েই ছেদন করলেন, তাদের বিদীর্ণ করলেন এবং বারোটি উত্তম বাণ দ্বারা কর্ণকে বিদ্ধ করলেন। তখন একা অর্জুনকে বধ করবার জন্য সমস্ত কৌরবপক্ষ তাঁকে আক্রমণ করলেন। অর্জুন খুরপ্র দ্বারা হস্তস্থিত অস্ত্রের সঙ্গে মস্তক সকল ছেদন করতে থেকে উত্তমাস্ত্রধারী গজারোহী, অশ্বারোহী ও রথারোহী যুধ্যমান সেই শত্রুগণকে সত্বর নিপাতিত করলেন। তখন আনন্দিত দেবগণের সাধুবাদের সঙ্গে দেবতূর্যধ্বনি আকাশে প্রকাশ পেতে লাগল এবং বায়ুসঞ্চালিত পবিত্ৰগন্ধযুক্ত ও শুভসূচক উত্তম পুষ্পবৃষ্টি পতিত হল।

তখন অশ্বত্থামা দু’হাত দিয়ে দুর্যোধনের হাত জড়িয়ে ধরে মধুর বাক্যে বললেন, “সখে! দুর্যোধন, এখনও প্রসন্ন হও এবং শান্ত হও, পাণ্ডবদের সঙ্গে বিরোধ করবার দরকার নেই, যুদ্ধকে ধিক। ব্রহ্মার তুল্য প্রভাবশালী ও মহাস্ত্রজ্ঞ দ্রোণ এবং নরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম প্রভৃতি নিহত হয়েছেন। আমি ও আমার মাতুল কৃপ অবধ্য বলে জীবিত আছি। অতএব রাজা তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হয়ে চিরকাল রাজ্যশাসন করো। আমি বারণ করলে অর্জুন যুদ্ধ থেকে নিবৃত্তি পাবেন, কৃষ্ণ তো বিরোধের ইচ্ছাই করেন না। যুধিষ্ঠির সর্বদাই প্রাণীগণের হিতসাধনে নিরত আছেন, তারপর ভীম, নকুল ও সহদেব যুধিষ্ঠিরেরই বশীভূত। দুর্যোধন, তুমি ও পাণ্ডবগণ সন্ধির জন্য শান্তির প্রতিজ্ঞা করলে, তোমার ইচ্ছাতেই প্রজারা মঙ্গল লাভ করুক, হতাবশিষ্ট রাজারা আপন আপন রাজধানীতে চলে যান এবং সৈন্যেরা শত্রুতাশূন্য হোক। তুমি যদি আমার একথা না শোনো, তবে নিশ্চয়ই তুমি যুদ্ধে শত্রুগণ কর্তৃক দারুণ আহত হয়ে অনুতাপ করবে। সমস্ত জগদ্বাসীর সঙ্গে তুমি দেখতে পেয়েছ একা অর্জুন যুদ্ধে কী করলেন। ভগবান ইন্দ্র, যম, বরুণ এবং কুবেরও যা করতে পারেন না। অতএব অর্জুন গুণে এঁদের থেকেও বেশি। তবুও আমি অনুরোধ করলে অর্জুন অগ্রাহ্য করবেন না। পাণ্ডবেরা সর্বদাই তোমার আনুগত্য করবেন। অতএব তুমি জগতের মঙ্গলের জন্য প্রসন্ন হও। আমিও তোমাকে সর্বদা গৌরব দান করি, সেই জন্যই প্রীতিবশত তোমাকে এই অনুরোধ করছি। তুমি শান্তিকামী হলে, আমি কর্ণকেও বারণ করব। পণ্ডিতেরা বলেন মিত্র চার প্রকার— স্বাভাবিক মিত্র, মধুরবাক্য জনিত মিত্র, ধনদানকৃত মিত্র এবং প্রতাপ সম্পাদিত মিত্র। এই চার প্রকার বন্ধুত্বই তোমার ও পাণ্ডবদের মধ্যে আছে। পাণ্ডবেরা তোমার স্বাভাবিক মিত্র। মধুর বাক্য দ্বারা তাঁদের স্থির মিত্রত্ব লাভ করো। তুমি প্রসন্ন হলে, যাতে তাঁরা নিশ্চয়ই মিত্রতা লাভ করেন, তুমি সেই আচরণ করো।”

সখা অশ্বত্থামা এই রকম হিতকর বাক্য বললে, দুর্যোধন বিশেষ চিন্তা ও নিশ্বাস ত্যাগ করে দুঃখিত চিত্তে বললেন, “সখে! তুমি যা বললে, তা সত্য বটে। কিন্তু আমি যা বলছি, তা শোনো— এই দুর্মতি ভীম ব্যাঘ্রের মতো বলপূর্বক দুঃশাসনকে বধ করে যে সকল কথা বলেছে, তা আমার হৃদয়ে গাঁথা আছে, এবং তা তোমারও অজানা নয়। সুতরাং শান্তি হবে কীভাবে? ভীষণ বায়ু যেমন মহাপর্বত সুমেরুকে পাতিত করতে সমর্থ হয় না, তেমন অর্জুনও যুদ্ধে কর্ণকে পাতিত করতে পারবে না। আবার পাণ্ডবেরাও বহু শত্রুতা স্মরণ করে আমাকে বিশ্বাস করবে না। তারপর গুরুপুত্র, আপনিও কর্ণকে বলতে পারবেন না, ‘যুদ্ধ থেকে বিরত হও।’ ওদিকে অর্জুনও আজ অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়েছে। সুতরাং কর্ণ আজ অর্জুনকে বধ করবে।”

অশ্বত্থামাকে এই কথা বলে দুর্যোধন সৈন্যদের শত্রুবধ করতে উৎসাহ দিতে থাকলেন। পূর্বকালে ইন্দ্র ও বলির যেমন সংঘর্ষ হয়েছিল, সেইরকম কর্ণ ও অর্জুনের দারুণ সংঘর্ষ হতে থাকল। তাতে বাণের আঘাতে উভয়েরই অঙ্গ, সারথি ও অশ্বগণ বিদীর্ণ হতে লাগল এবং কটু রক্তজলের প্রবাহ ছুটল, আর তা অন্যের দুঃসহ হয়ে উঠল। তাঁরা দু’জনেই ইন্দ্রের তুল্য বলশালী এবং মহারথ বলে ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের ন্যায় ইন্দ্রের বজ্রতুল্য বাণ দ্বারা পরস্পর প্রহার করতে লাগলেন। কর্ণ ও অর্জুনের যুদ্ধের সময় বিচিত্র বর্ম, অলংকার, বস্ত্র ও অস্ত্রধারী উভয়পক্ষের সৈন্যেরাই হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতির সঙ্গে ভয়ে কাঁপতে লাগল এবং বিস্ময়ে মাথা তুলে দেখতে লাগল। আকাশবর্তী প্রাণীরাও ভয়ে কম্পিত হয়ে মাথা তুলতে লাগল। মত্তহস্তী যেমন মত্তহস্তীর প্রতি ধাবিত হয়, সেইরকম কর্ণ যখন অর্জুনকে বধ করবার ইচ্ছা করে তাঁর প্রতি ধাবিত হলেন, তখন যুদ্ধদর্শনার্থী কৌরবেরা আনন্দিত হয়ে সিংহনাদ করতে থেকে বস্ত্রধারণ করে হাত তুলতে লাগল। সেই সময়ে সোমকেরা সম্বোধন করে উচ্চ স্বরে বলল, “অর্জুন, যান, সত্বর হোন, কর্ণকে বিদীর্ণ করুন এবং কর্ণের মস্তক ও দুর্যোধনের রাজ্যলিপ্সা ছেদন করুন, বিলম্ব করবেন না।” কৌরবপক্ষের যোদ্ধারাও কর্ণকে বললেন, “কর্ণ যান যান, সুতীক্ষ্ণ বাণে অর্জুনকে বধ করুন, অবশিষ্ট পাণ্ডবেরা আবার চিরকালের জন্য বনে গমন করুক।”

তখন কর্ণ প্রথম দশটি বাণে অর্জুনকে তাড়ন করলেন। অর্জুনও সুধার দশটি বাণ দ্বারা বলপূর্বক কর্ণের বাহুমূলদ্বয়ের নীচে আঘাত করলেন। ক্রমে অর্জুন ও কর্ণ পরস্পরের ছিদ্র অন্বেষণ করে মুহুর্মুহু নারাচ, নালীক, বরাহকৰ্ণ, ক্ষুর, অঞ্জলিক ও অর্ধচন্দ্র বাণ সকল নিক্ষেপ করতে লাগলেন। অর্জুন সমস্ত দিকে বাণক্ষেপ করছিলেন। দিনাবসানে পাখিরা যেমন বাস করার জন্য মাথা নিচু করে বৃক্ষে প্রবেশ করে, অর্জুনের বাণগুলি সেরকম কর্ণের রথে প্রবেশ করতে লাগল। কর্ণও অর্জুন নিক্ষিপ্ত সমস্ত বাণ আপন বাণে গ্রাস করতে লাগলেন। তখন অর্জুন কর্ণের উপরে শত্রুনাশক ‘আগ্নেয়’ অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। সেই আগ্নেয় অস্ত্রের দেহ ভূমি, আকাশ, দিক ও সূর্যের পথ আবৃত করে প্রজ্বলিত হল। প্রথমে যোদ্ধাদের কাপড়ে আগুন লাগল পরে তা দগ্ধ হতে লাগল, তখন তারা সকলে বেগে পালাতে লাগল। বাঁশবনে আগুন লাগলে যেমন অতিদারুণ শব্দ হয়, তেমনই দারুণ শব্দ হতে লাগল। তখন কর্ণ আগ্নেয়াস্ত্র প্রশমিত করার জন্য বারুণাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। বেগবান মেঘ সকল থেকে অতিদারুণ বৃষ্টি হতে লাগল, সেই বৃষ্টি আগুন নিভিয়ে সকল দিককে অন্ধকারাবৃত করল। অর্জুন বায়ব্যাস্ত্র নিক্ষেপ করে চতুর্দিকের অন্ধকার দূর করলেন। তারপর ইন্দ্রের প্রিয় ঐন্দ্ৰাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। গরুড়ের ভয়ে সর্পেরা যেমন ভূতলে প্রবেশ করে, সেইরূপ অতিশয় উজ্জ্বল, অত্যন্ত বেগবান, সুতীক্ষ্ণ ও মহাপ্রভাবশালী সেই বাণ সকল গিয়ে কর্ণের অঙ্গ ভেদ করে, অশ্বে, ধনুতে, রথচক্রে ও ধ্বজে প্রবেশ করল। কর্ণের সমস্ত অঙ্গ বাণে ব্যাপ্ত হয়ে গেল, দেহ রক্তে আর্দ্র হয়ে পড়ল এবং ক্রোধে তাঁর নয়নযুগল ঘুরতে লাগল। পরে মহাত্মা কর্ণ দৃঢ়গুণযুক্ত ও সমুদ্রের মতো শব্দকারী ধনু আকর্ষণ করে ভার্গবাস্ত্র আবিষ্কার করলেন। সেই ভার্গবাস্ত্র অর্জুনের ঐন্দ্রাস্ত্রকে ছেদন করতে লাগল এবং সেই অস্ত্রের প্রয়োগে কর্ণ পাণ্ডবপক্ষের রথ হস্তী ও পদাতিগণকে সংহার করতে লাগলেন, কর্ণের বাণের প্রচণ্ড পীড়নে পাঞ্চালেরা আর্তনাদ করে ভূপতিত হয়ে প্রাণ হারাল। কর্ণ প্রধান প্রধান পাঞ্চালরথীকে বধ করলে আনন্দিত কৌরবেরা কর্ণের জয় হয়েছে মনে করে করতলধ্বনি ও সিংহনাদ করতে লাগল। তারা আরও মনে করল যে, কর্ণ যুদ্ধে কৃষ্ণার্জুনকে বশীভূত করেছেন। অন্যের অসহ্য কর্ণের সেইরূপ পরাক্রম দেখে এবং অর্জুনের ঐন্দ্রাস্ত্র কর্ণ প্রতিহত করেছেন দেখে কোপনস্বভাব বায়ুপুত্র ভীমসেন ক্রোধে আরক্ত নয়ন হয়ে হাতে হাত ঘষে শ্বাসত্যাগ করে সত্যপ্রতিজ্ঞ অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন পাপাত্মা ও ধর্মহীন এই সূতপুত্রটা আজ যুদ্ধে বলপূর্বক কী করে তোমার সামনে অনেক প্রধান পাঞ্চাল যোদ্ধাকে বধ করল? তুমি কিরাতরূপধারী সাক্ষাৎ মহাদেবের বাহুসংস্পর্শ পেয়েছিলে এবং কালকেয় অসুরেরাও তোমাকে জয় করতে পারেনি; কিন্তু ইতোপূর্বে কর্ণ দশটি বাণদ্বারা তোমাকে কী করে বিদ্ধ করল? সব্যসাচী, তুমি যে বাণসমূহ নিক্ষেপ করছিলে; তা কর্ণ প্রতিহত করেছে। এ আজ আমার আশ্চর্য বোধ হয়েছে। সে যাই হোক, তুমি দ্রৌপদীর কষ্ট স্মরণ করো এবং পাপবুদ্ধি ও দুরাত্মা এই সূতপুত্রটা সেই দ্যূতসভায় আমাদের যে ‘ষণ্ডতিল’ বলেছিল, আর দ্রৌপদীর প্রতি যে সকল কর্কশ ও তীব্র বাক্য বলেছিল, তা স্মরণ করে যুদ্ধে পাপাত্মা কর্ণকে বধ করো। কিরীটি, তুমি কেন উপেক্ষা করছ, আজ এটা তো উপেক্ষা করার সময় নয়। তুমি যে ধৈর্য দ্বারা খাণ্ডবদাহের সময় অগ্নিকে খাদ্য দেবার জন্য সমস্ত প্রাণীকে জয় করেছিলে, সেই ধৈর্য দ্বারা কর্ণকে বধ করো; আর তুমি যদি না পারো, তবে আমিই গদাঘাতে ওটাকে মাটিতে পুঁতে ফেলব।” তখন কৃষ্ণও অর্জুনের বাণগুলি প্রতিহত দেখে তাঁকে বললেন, “অর্জুন, আজ কর্ণ অস্ত্র দ্বারাই তোমার অস্ত্র সর্ব প্রকারে যে নষ্ট করেছে, এটা কী হল! বীর! তুমি কি মুগ্ধ হয়েছ, কৌরবেরা আনন্দিত হয়ে এই যে গর্জন করছে, তা কি তুমি শুনতে পাচ্ছো না? কৌরবেরা মনে করেছে, কর্ণ অস্ত্র দ্বারাই তোমাকে প্রতিহত করবে। সুতরাং তুমি যে ধৈর্যের গুণে স্থানে স্থানে রাক্ষসগণের মায়াঘটিত অস্ত্র সকল প্রতিহত করেছ এবং যুদ্ধে ভয়ংকর রাক্ষসগণকে ও দম্ভোদ্ভব নামক অসুরগণকে সংহার করেছ; সেই ধৈর্যের গুণে কর্ণকেও বধ করো। না হয়, ইন্দ্র যেমন বজ্র দ্বারা নমুচি দানবের মস্তক ছেদন করেছিলেন, তেমন তুমিও আমার প্রদত্ত এই ক্ষুরধার সুদর্শনচক্র দ্বারা বলপূর্বক আজ এই শত্রুর মস্তক ছেদন করো। তুমি যে ধৈর্যের গুণে কিরাতরূপী ভগবান মহাত্মা মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেছিলে, পুনরায় সেই ধৈর্য অবলম্বন করে অনুচরণবর্গের সঙ্গে কর্ণকে বধ করো। তারপর তুমি রাজা যুধিষ্ঠিরকে সাগরবেষ্টিতা, নগর গ্রামযুক্ত, ধনসমৃদ্ধা ও শত্ৰুশূন্যা পৃথিবী দান করে অতুলনীয় ঐশ্বর্যের অধিকারী হও।”

ভীমসেন ও কৃষ্ণ এই আদেশ করলে অর্জুন নিজের ক্ষমতা পর্যালোচনা করে এক ভয়ংকর মহাস্ত্র আবিষ্কার করে কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে সেই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন কিন্তু কর্ণ মেঘের জলধারাবর্ষণের ন্যায় বাণসমূহ বর্ষণ করে অর্জুনের সেই ব্রহ্মাস্ত্র নিবারণ করে রণক্ষেত্রে শোভা পেতে লাগলেন। কর্ণ সেই ব্রহ্মাস্ত্র প্রতিহত করেছেন দেখে অসহিষ্ণু ও বলবান ভীমসেন ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে সত্যপ্রতিজ্ঞ অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন তুমি মনের সংকল্পে আবিষ্কার্য, ভীষণ ও উত্তম ব্রহ্মাস্ত্র জানো লোকে এই বলে। অতএব সব্যসাচী, তুমি আর একটা ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করো।” ভীমসেনের কথা শুনে অর্জুন পুনরায় ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। মহাতেজা অর্জুন সর্পের ন্যায় ভীষণ ও সূর্যকিরণতুল্য উজ্জ্বল গাণ্ডিবনিক্ষিপ্ত সেই ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা দিক-বিদিক আবৃত করে ফেললেন। এক অস্ত্র কর্ণের রথখানাকে সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত করে তার থেকে অতিদারুণ শূল, পরশু, চক্র ও শত শত নারাচ নির্গত হয়ে কৌরবসৈন্যদের মস্তক ছেদন করতে লাগল। কারও দক্ষিণ বাহু, কারও বাম বাহু, কারওর মস্তক, ভূতলে পতিত হয়ে পর্বত হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু তাতেও কর্ণকে থামানো গেল না। কর্ণ নিক্ষিপ্ত সহস্র সহস্র বাণও মেঘমুক্ত জলধারার ন্যায় শব্দ করতে করতে গিয়ে পাণ্ডবপক্ষে পড়তে লাগল। অলৌকিক কার্যকারী ও ভীষণ বলশালী কর্ণ তিন তিনটি বাণ দ্বারা ভীমসেন, কৃষ্ণ ও অর্জুনকে আহত করলেন। তখন অর্জুন কর্ণের বাণে আহত হয়ে এবং ভীমসেন ও কৃষ্ণকে আহত দেখে অসহ্য ক্রোধে পুনরায় আঠারোটি বাণ নিক্ষেপ করলেন। এক বাণে সুষেণ, চার বাণে শল্যকে, তিন বাণে কর্ণকে বিদ্ধ করে, অন্য দশটি বাণে স্বর্ণবর্মধারী ‘সভাপতি’ নামের রাজপুত্রকে বধ করলেন। সভাপতি রথ থেকে পতিত হলে অর্জুন পুনরায় তিন, আট, দুই, চার ও দশটি বাণে কর্ণকে বিদ্ধ করে সহস্র অশ্ব, আট সহস্র পদাতিক বধ করলেন এবং দ্রুতগামী বাণসমূহ দ্বারা সারথি, রথ, অশ্ব ও ধ্বজের সঙ্গে কর্ণকে অদৃশ্য করে ফেললেন। কৌরবসৈন্যরা সকল দিক থেকে কর্ণকে বললেন, “কর্ণ, অর্জুন বাণ দ্বারা এরপর সমস্ত কৌরবসৈন্য সংহার করে ফেলবেন। অতএব আপনি সত্বর বাণক্ষেপ করে অর্জুনকে বধ করুন।” অস্ত্রজ্ঞ কর্ণ এই কথা শুনে বারবার বহুতর বাণক্ষেপ করে পাণ্ডব ও পাঞ্চালসৈন্য বধ করতে লাগলেন।

তখন যুধিষ্ঠির স্বর্ণময় বর্ম ধারণ করে কর্ণ ও অর্জুনের যুদ্ধ দেখবার জন্য দ্রুত সেই স্থানে উপস্থিত হলেন। শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকগণ মন্ত্র ও ঔষধদ্বারা শল্য তুলে ফেলে সমস্ত বেদনার উপশম করে দিয়েছিলেন। রাহুর মুখ থেকে নির্গত নির্মল পূর্ণচন্দ্রের মতো রণস্থলে সমাগত যুধিষ্ঠিরকে দেখে সমস্ত লোক আনন্দিত হল। তৎকালে কর্ণ ও অর্জুন পরস্পরকে উত্তম উত্তম বাণ দ্বারা প্রহার করতে থাকলে তুমুল সংঘর্ষ হতে থাকল। অত্যন্ত আকর্ষণ করতে থাকায় গাণ্ডিবের গুণ শব্দ সহকারে ছিন্ন হল। সেই অবসরে কর্ণ বহুতর ক্ষুদ্রক বাণে অর্জুনকে ব্যাপ্ত করে ফেললেন এবং তীক্ষ্ণ ষাটটি নারাচ দ্বারা কৃষ্ণকে বিদীর্ণ করলেন এবং সেই অবসরে সহস্র সহস্র সোমকদের বধ করতে লাগলেন। এই সময়ে কৌরবেরা করতালি দিতে লাগল এবং জয় হয়েছে মনে করে তীব্র সিংহনাদ করতে লাগল। কর্ণের বাণে ক্ষত-বিক্ষত দেহ অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ধনুর গুণ যোজনা করে সত্বর কর্ণের সমস্ত বাণ প্রতিহত করে কৌরবদের গ্রহণ করলেন। অর্জুন এক মুহূর্তে কর্ণ, শল্য ও সমস্ত কৌরবগণকে বিদ্ধ করলেন। অসংখ্য বাণ নিক্ষেপ করে অর্জুন আকাশ ঢেকে ফেললেন। তারপর অর্জুন হাসতে হাসতে দশটি বাণে শল্যের মর্মস্থান বিদ্ধ করলেন এবং তীক্ষ্ণ বারোটি বাণে কর্ণকে বিদ্ধ করে পুনরায় সাত বাণে তাঁকে আঘাত করলেন।

অর্জুন কর্তৃক গাণ্ডিব দ্বারা বেগে নিক্ষিপ্ত মহাবেগশালী সেই বাণসমূহে আহত হয়ে কর্ণ বিদীর্ণগাত্র ও রক্তসিক্তদেহে প্রকাশিত হলেন। তখন কর্ণ তিন বাণে অর্জুনকে এবং পাঁচ বাণে কৃষ্ণকে বর্মভেদ করে শরীরে আঘাত করলেন। কর্ণ নিক্ষিপ্ত সেই পাঁচ বাণে তক্ষকপুত্র অশ্বসেনের পক্ষবর্তী মহাসর্প লুক্কায়িত ছিল। অর্জুন প্রত্যেক সর্পকে তিন খণ্ডে ছেদন করলেন। কৃষ্ণকে আহত দেখে অর্জুন অত্যন্ত কুপিত হয়ে কর্ণের সমস্ত মর্মস্থান বিদ্ধ করলেন। দুর্যোধনের সামনেই অর্জুন কর্ণের চক্ররক্ষক, পদরক্ষক, অগ্রগামী ও পৃষ্ঠরক্ষক দুই হাজার শ্রেষ্ঠ কৌরবরথীক ক্ষণকালমধ্যে বিনাশ করলেন। তখন কৌরবেরা কর্ণকে পরিত্যাগ করে সকল দিকে পালাতে লাগলেন। দুর্যোধন বারবার আহ্বান করলেও সেই কৌরবেরা আর ফিরল না। তখন অর্জুন ক্রুদ্ধ হয়ে মহাযুদ্ধে কর্ণকে বধ করার অভিলাষে তীক্ষ্ণ অস্ত্রসকল নিক্ষেপ করতে থাকলে কর্ণ আকাশেই সেগুলি ছেদন করলেন। সেই প্রচণ্ড যুদ্ধে কখনও কর্ণকে প্রধান, আবার কখনও অর্জুনকে প্রধান বলে বোধ হতে লাগল। আকাশস্থিত প্রাণীরা কর্ণ ও অর্জুনের প্রশংসা করতে থেকে দলে দলে বলতে লাগল, “কর্ণ! সাধু, অর্জুন! সাধু।”

তক্ষক-পুত্র অশ্বসেন, খাণ্ডবদাহের সময়ে মাতৃগর্ভে ছিল। অর্জুনের বাণে মাতা দ্বিখণ্ডিত হলে অশ্বসেন পাতালে গিয়ে শয়ন করেছিল। সেই নাগবীর মাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য বাণরূপ ধারণ করে কর্ণের তূণের ভিতর গিয়ে প্রবেশ করল। কর্ণ ও অর্জুন বাণসমূহ বর্ষণ করে আকাশকে ফাঁকশূন্য করে ফেললেন। দু’জনেই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়েছিলেন। তাই দেখে স্বর্গের অপ্সরারা আকাশে থেকে চামর আন্দোলন করে বায়ুসঞ্চালন ও চন্দনজলসেক করতে লাগল এবং ইন্দ্র ও সূর্য করপদ্মদ্বারা আপন পুত্রের মুখমার্জন করে দিলেন।

কর্ণ যখন কিছুতেই অর্জুনকে কাতর করতে পারলেন না, বরং তাঁর বাণেই অত্যন্ত সন্তপ্ত হয়ে পড়লেন, তখন শরবিক্ষত দেহ বীর কর্ণ সেই বাণরূপ অশ্বসেনকে গ্রহণ করলেন। কর্ণ ধনুখানাকে আকর্ণ আকর্ষণ করে শত্রুনাশক, অতিপ্রশস্ত, সর্পমুখ, উজ্জ্বল, ভীষণ, পরিমার্জিত, অর্জুনকে বধ করার জন্য চিরকাল বিশেষভাবে রক্ষিত, সর্বদা আদৃত, চন্দনচূর্ণে স্থাপিত, স্বর্ণময় তূণমধ্যে স্থিত, মহাতেজা ও তীক্ষ্ণক্রোধ বাণটিকে অর্জুনাভিমুখে সন্ধান করলেন। সে সময়ে কর্ণ যুদ্ধে অর্জুনের মস্তক হরণ করার ইচ্ছা করেই সেই উজ্জ্বল ও ঐরাবতনাগবংশজাত সর্পরূপ বাণ সন্ধান করেছিলেন। তারপর দিকসকল ও আকাশ জ্বলে উঠল এবং ভয়ংকর উল্কাসকল ও বিদ্যুৎ পতিত হতে লাগল। কর্ণ সেই নাগময় বাণ ধনুতে যোগ করলে, ইন্দ্রের সঙ্গে দিকপালেরা হাহাকার করতে লাগলেন। কিন্তু নাগ অশ্বসেন যে যোগবলে সেই বাণে প্রবেশ করেছিল, কর্ণ তা বুঝতে পারেননি।

তারপর মহাত্মা শল্য বাণসন্ধানী কর্ণের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, “কর্ণ এই সূক্ষ্মমুখ বাণ অর্জুনের সম্পূর্ণ গ্রীবা পাবে না। সুতরাং তুমি ভাল করে দেখে তাঁর সম্পূর্ণ মস্তকবিদারণ-উপযুক্ত বাণ সন্ধান করো।” বলবান কর্ণ ক্রোধে আরক্তনয়ন হয়ে শল্যকে বললেন, “মদ্ররাজ, কর্ণ দু’বার বাণ সন্ধান করেন না এবং আমার ন্যায় বীরেরা কুটযোধী হন না।” জয়লাভের জন্য উদ্যত কর্ণ এই কথা বলে ত্বরান্বিত হয়ে বিশেষ যত্ন করে বহু বৎসর যাবৎ সর্বতোভাবে আদৃত সেই বাণটিকে নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন, “অর্জুন তুমি নিহত হলে।”

কর্ণবাহুনিক্ষিপ্ত, অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল, মহাশব্দকারী ও ভীষণমূর্তি সেই বাণটি ধনুর গুণ থেকে নির্গত হয়ে আকাশের যেন সিঁথি রচনা করে জ্বলতে জ্বলতে অগ্রসর হল। সেই উজ্জ্বল বাণটিকে আসতে দেখে কংসরিপু কৃষ্ণ ত্বরান্বিত হয়ে চরণদ্বারা লীলার সঙ্গে নিষ্পেষণ করে সেই উত্তম রথখানাকে অর্ধ-হস্ত ভূতলে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। তখন স্বর্ণালংকারে আবৃত এবং চন্দ্রকিরণের ন্যায় শুভ্রবর্ণ সেই অশ্বগণ জানু দ্বারা ভূতল স্পর্শ করল। কর্ণ নাগবাণ সন্ধান করেছেন দেখে বলিশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ বলপূর্বক চরণযুগল দ্বারা অর্জুনের রথের উপর ভর দিলেন, তখন রথখানা ভূমিতে কিছু মগ্ন হলে, কৃষ্ণের গৌরব সূচনা করে আকাশে আনন্দকোলাহল হতে লাগল এবং স্বর্গীয় সাধুবাদ, পুষ্পবৃষ্টি ও সিংহনাদ হতে থাকল। তখন সেই নাগবাণ পৃথিবী, আকাশ, স্বর্গ ও পাতালে প্রসিদ্ধ অর্জুনের মস্তকভূষণ কিরীটটিকে অর্জুনের মস্তক থেকে ভূতলে পতিত করল। এই কিরীটটি বিশেষ তপস্যা করে ব্রহ্মা ইন্দ্রের জন্য রচনা করেছিলেন। প্রীত পিতৃদেব ইন্দ্র এটি অর্জুনকে দান করেছিলেন।

কিরীট না থাকায় শ্যামবর্ণ ও যুবক অর্জুন শোভা পেতে লাগলেন না। তখন তিনি শুভ্রবস্ত্র দ্বারা কেশগুলি উপরে বন্ধন করে অব্যথিত অবস্থায় রইলেন। অর্জুন মাতার কণ্ঠ ছেদন করে যার সঙ্গে শত্রুতা করেছিলেন, অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় তেজস্বী ও বিশেষ প্রশংসিত বাণরূপধারী সেই মহানাগ অশ্বসেন অর্জুনের কিরীটটিকে আহত করে পুনরায় কর্ণের কাছে ফিরে আসল। অশ্বসেন পুনরায় তূণের মধ্যে যেতে ইচ্ছা করলে কর্ণ তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন এবং অশ্বসেন বললেন, “অর্জুন আমার মাতাকে বধ করে শত্রুতা ঘটিয়েছে এবং আমার কাছে অপরাধ করেছে। আপনি না দেখে আমাকে নিক্ষেপ করেছিলেন, অতএব আপনি সত্বর লক্ষ্য করে আমাকে নিক্ষেপ করুন, আমি আপনার ও আমার শত্রুকে বধ করব। যদি স্বয়ং ইন্দ্রও অর্জুনের রক্ষক হন, তবুও সে যমালয়ে যাবে। আপনি আমাকে অবজ্ঞা করবেন না। আমার বাক্য রক্ষা করুন, আজই আপনার শত্রুকে বধ করব, আমাকে সত্বর নিক্ষেপ করুন।” কর্ণ বললেন, “কর্ণ যুদ্ধ করার জন্য কিংবা অন্য কোনও বিষয় সম্পাদন করার জন্য অন্যের শক্তি অবলম্বন করে জয় লাভ করার ইচ্ছা করেন না। অতএব নাগ, আমি যদি শত অর্জুনকেও বধ করতে পারি, তবুও এই বাণ দু’বার সন্ধান করব না। ক্রূরাস্ত্রনিক্ষেপ, গুরুতর যত্ন ও ক্রোধের গুণেই আমি অর্জুনকে বধ করতে পারব; সুতরাং তুমি প্রসন্ন বদনে যেতে পারো।”

কর্ণ একথা বললে, অর্জুন বধার্থী উগ্রমূর্তি নাগরাজ অশ্বসেন ক্রোধে কর্ণের বাক্য সহ্য করতে না পেরে বাণরূপ ধারণ করে অর্জুনকে বধ করার জন্য নিজেই আকাশপথে গমন করতে লাগল। তখন কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন তুমি এর সঙ্গে শত্রুতা করেছিলে, সুতরাং এই মহানাগকে বধ করো।” তখন শত্রুনাশক অর্জুন বললেন, “এখন গরুড়ের মুখের মতো আমার নিকট এই যে নিজেই আসছে, এ নাগটা কে?” কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন খাণ্ডবদাহের সময়ে তুমি যখন ধনু ধারণ করে অগ্নিকে সন্তুষ্ট করছিলে, তখন যে নাগ জননীর উদরের ভিতরে প্রবেশ করে আকাশপথে যাচ্ছিল, সেই সময়ে তুমি এক ব্যক্তি মনে করে এর মাতাকে বধ করেছিলে। এই নাগ সেই শত্রুতা স্মরণ করে বধ করার জন্য তোমার দিকে আসছে। দেখো আকাশচ্যুত প্রজ্বলিত উল্কার মতো এ আসছে।”

এরপর অশ্বসেন আকাশে তির্যকভাবে আসতে থাকলে, অর্জুন ক্রোধভরে ছ’টি তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা তাঁকে ছেদন করলেন। ছিন্নগাত্র অশ্বসেন ভূতলে পতিত হল। তখন কৃষ্ণ রথ থেকে নেমে নিজেই বাহুযুগলদ্বারা পুনরায় সত্বর ভূতল থেকে সেই অর্জুনের রথখানা উত্তোলন করলেন। এই অবসরে কর্ণ অর্জুনকে দশটি বাণে আঘাত করলেন। অর্জুন অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে বারোটি তীক্ষ্ণ বাণে, কর্ণকে আঘাত করে একটি নারাচ নিক্ষেপ করলেন। সেই নারাচটি কর্ণের দেহ ভেদ করে তাঁর রক্তপান করে রক্তলিপ্ত হয়ে ভূতলে পতিত হল। তখন কর্ণ কৃষ্ণকে বারোটি ও অর্জুনকে একানব্বইটি বাণে বিদীর্ণ করে সিংহনাদ করলেন। কিন্তু অর্জুন কর্ণের হর্ষ সহ্য করলেন না। পূর্বকালে ইন্দ্র যেমন বলাসুরকে বিদীর্ণ করেছিলেন, তেমনই ইন্দ্রপুত্র অর্জুন শতাধিক বাণে কর্ণকে যেন ছিন্নভিন্ন করতে লাগলেন। কর্ণের শ্রেষ্ঠ মণি, উত্তম হীরক ও স্বর্ণদ্বারা অলংকৃত কর্ণের কিরীট ও উত্তম কুণ্ডল দুটি অর্জুন কেটে ফেললেন। তারপর অর্জুন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর বিশেষ যত্নে রচিত কর্ণের বর্মটিকে বহুখণ্ডে ছেদন করলেন। এরপর অর্জুন বর্মবিহীন কর্ণকে আরও চারটি বাণ দ্বারা বিদীর্ণ করলেন। বায়ু-পিত্ত-কফ-জ্বরে পীড়িত লোকের মতো কর্ণও গুরুতর বেদনা অনুভব করতে লাগলেন। ক্রমে অর্জুন ত্বরান্বিত হয়ে নৈপুণ্য, যত্ন ও শক্তি সহকারে নিক্ষিপ্ত, মণ্ডলীকৃত বিশাল ধনু থেকে নির্গত উত্তম, তীক্ষ্ণ বহু বাণদ্বারা কর্ণকে ক্ষত-বিক্ষত ও মর্মদেশ বিদীর্ণ করলেন। গৈরিক ধাতুরঞ্জিত পর্বত যেমন রক্তবর্ণ জলপ্রবাহ নিঃসারণ করে, অর্জুনের তীক্ষ্ণ বাণে, কর্ণের গাত্র থেকে তেমনই রক্তনিঃসারণ হতে থাকল। কর্ণ অত্যন্ত পীড়িত হয়ে পড়লেন, তাঁর মুষ্টি শিথিল হয়ে পড়ল। তিনি ধনু ও তূণ ত্যাগ করে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করতে লাগলেন, মুগ্ধ হলেন, তবুও দাঁড়িয়ে রইলেন, আবার টলে পড়তে লাগলেন। কিন্তু সাধুস্বভাব ও সৎপুরুষ-নিয়মে অবস্থিত অর্জুন সেই বিপদের সময়ে কর্ণকে বধ করতে চাইছিলেন না। তখন কৃষ্ণ ব্যস্ত হয়ে অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন তুমি কর্তব্য বিষয়ে উদাসীন হয়ে পড়েছ কেন? বুদ্ধিমান লোকেরা অতিদুর্বল শত্রুগণের অবসর প্রতীক্ষা করেন না; বিশেষত, বিচক্ষণ লোক বিপদের সময়েই শত্রুগণকে বধ করে ধর্ম ও যশ লাভ করেন। অতএব সর্বদা তোমার শত্রু এবং অদ্বিতীয় বীর কর্ণকে এখনই বধ করার জন্য ত্বরান্বিত হও। না হলে সুস্থ ও সমর্থ হয়ে কর্ণ আবার আসবে। সুতরাং ইন্দ্র যেমন নমুচি দানবকে বধ করেছিলেন, তুমিও তেমনই কর্ণকে বধ করবে।” তখন অর্জুন সর্বপ্রযত্নে স্বর্ণপুঙ্খ বৎসদন্তবাণ দ্বারা অশ্ব ও রথের সঙ্গে কর্ণকে ব্যাপ্ত করলেন এবং দিক সকল আবৃত করে ফেললেন। বৎসদন্তবাণে ব্যাপ্ত কর্ণ অশোক, পলাশ, শাল্মলি বৃক্ষসমন্বিত এবং চন্দনবনযুক্ত পর্বতের ন্যায় প্রকাশ পেতে থাকলেন। রক্তবর্ণ কিরণশালী অস্তগমনোন্মুখ রক্তবর্ণ সূর্য যেমন প্রকাশ পায়, অর্জুনের বাণজালরশ্মিযুক্ত কর্ণ বহুতর বাণক্ষেপ করতে থেকে সেইরকম প্রকাশ পেতে থাকলেন।

তারপর কর্ণ ধৈর্য লাভ করে ক্রুদ্ধ সর্পতুল্য বাণ সকল নিক্ষেপ করতে থেকে দশ বাণে অর্জুনকে এবং ছয় বাণে কৃষ্ণকে বিদ্ধ করলেন। তখন অর্জুন ইন্দ্রের বজ্রের তুল্য শব্দকারী, সর্পবিষ ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী এবং পাশুপত মহাস্ত্রের তুল্য ভীষণ একটা লৌহময় বাণ নিক্ষেপ করবার ইচ্ছা করলেন। তারপরে অদৃশ্যকাল, সেই ব্রাহ্মণের শাপ দেখাতে এবং কর্ণরথের বিপদ সূচনা করতে থেকে কর্ণের সেই বধকালে গোপনে যেন বলল, “ভূমি তোমার রথচক্র গ্রাস করছে।” কর্ণের সেই বধকাল উপস্থিত হলে, পরশুরাম কর্ণকে যে ব্রাহ্ম মহাস্ত্র দিয়েছিলেন, তা তাঁর মনে পড়ল না এবং ভূমি রথের বামচক্র গ্রাস করল। ব্রাহ্মণের শাপের প্রভাবে কর্ণের রথের পশ্চাদ্ভাগ ঘুরতে লাগল। ব্রাহ্মণের অভিশাপবশত রথখানা ঘুরতে লাগলে, পরশুরাম থেকে প্রাপ্ত অস্ত্র বিস্মৃত হলে এবং অর্জুন সেই সর্পমুখ ভয়ংকর বাণ ছেদন করলে, কর্ণ বিষন্ন হয়ে পড়লেন। তিনি সেই সমস্ত বিপদ সহ্য করতে না পেরে হস্তদ্বয় সঞ্চালন করতে থেকে ধর্মের নিন্দা করতে থাকলেন, “ধর্মজ্ঞেরা সর্বদাই বলেছেন যে, ধর্ম সমস্ত অবস্থায় ধার্মিকগণকে রক্ষা করেন। অথচ আমরা যেমন শুনেছি, তেমনভাবে শক্তি অনুসারে সর্বদা ধর্মাচরণ করে থাকি। কিন্তু সে ধর্ম তো ভক্তগণকে রক্ষা করেই না, বরং বিনাশ করে। অতএব আমি মনে করি—ধর্ম সর্বদা রক্ষা করে না।”

সারথি ও অশ্বগণ স্থানচ্যুত হলে এবং অর্জুনের বাণপতনে নিজেও বিচলিত হয়ে পড়লে এবং মর্মে মর্মে আহত হতে থাকায় কর্ণ কার্যে শিথিল হয়ে বারবার ধর্মের নিন্দা করলেন। তারপর কর্ণ অতিভীষণ তিনটি বাণ দ্বারা কৃষ্ণের হস্ত এবং সাতটি বাণ দ্বারা অর্জুনকে বিদ্ধ করলেন। তখন অর্জুন মহাবেগশালী, ইন্দ্রের বজ্রের ও অগ্নির তুল্য সতেরোটি ভীষণ বাণ নিক্ষেপ করলেন। ক্রমে দারুণবেগযুক্ত সেই বাণগুলি গিয়ে কর্ণের দেহ ভেদ করে ভূতলে পতিত হল। পরে কর্ণ কম্পিত কলেবর হয়েও শক্তি অনুসারে প্রতিপ্রহারের উদ্যম দেখাতে লাগলেন। আপনাকে স্থির করে কর্ণ ব্ৰহ্মাস্ত্র ক্ষেপ করলেন। কর্ণের ব্রহ্মাস্ত্র অর্জুন-নিক্ষিপ্ত ঐদ্রাস্ত্র দ্বারা প্রতিহত হয়ে রথের উপর পড়তে থাকলে মহারথ কর্ণ সেগুলি সব ব্যর্থ করে দিতে লাগলেন। তখন কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। কর্ণ তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা অর্জনের ধনুর গুণ ছেদন করলেন। তিনি পরপর অর্জুনের এগারোটি ধনুর গুণ ছেদন করলেন। কিন্তু অর্জুনের যে শতসংখ্যক ধনুর গুণ আছে, তা কর্ণ বোঝেননি। তবুও কর্ণ অর্জুনের অস্ত্র প্রতিহত করে অর্জুনকে আঘাত করতে থাকলেন। অর্জুনকে পরিপীড়িত দেখে কৃষ্ণ তাঁকে বারবার উৎসাহ দিতে থাকলেন। তখন অর্জুন লৌহময় এক ভীষণ বাণ অভিমন্দ্রিত করে নিক্ষেপের উপক্রম করলেন। তখন ভূমি কর্ণের রথের বাম চক্রটাকে পূর্বাপেক্ষা অধিক গ্রাস করল। ভূমি রথচক্র গ্রাস করলে, রাধানন্দন কর্ণ ক্রোধে অশ্রুপাত করে অর্জুনকে বললেন, “পাণ্ডুনন্দন, একটু কাল অপেক্ষা করো। পৃথানন্দন দৈববশত আমার এই বাম চক্রটা ভূতলে প্রবিষ্ট হয়েছে দেখে কাপুরুষের অভিসন্ধি পরিত্যাগ করো। স্খলিতকেশ, পরাঙ্মুখ, ব্রাহ্মণ, কৃতাঞ্জলি, শরণাগত, যুদ্ধবিরামাদি প্রার্থী, ন্যস্ত অস্ত্র, বাণশূন্য, ভ্ৰষ্টকবচ, পতিতশস্ত্র ও ভগ্নাস্ত্র লোকের প্রতি সাধু নিয়মস্থ বীরেরা অস্ত্ৰক্ষেপ করেন না। পাণ্ডুনন্দন, তুমি জগতে মহাবীর, সচ্চরিত্র এবং যুদ্ধধর্মে অভিজ্ঞ। অতএব তুমি আমার বিষয়ে ক্ষণকাল প্রতীক্ষা করো। আমি যাবৎ এই রথচক্র ভূমি থেকে উত্তোলন করি, তার মধ্যে তুমি রথে থেকে আমাকে আঘাত করতে পারো না। আমি— কৃষ্ণ বা তোমাকে ভয় পাই না। তুমি ক্ষত্রিয়সন্তান এবং মহাবংশবৃদ্ধিকারী। অতএব অর্জুন ধর্মোপদেশ স্মরণ করে মুহূর্তকাল অপেক্ষা করো।”

তখন কৃষ্ণ রথে থেকেই কর্ণকে বললেন, “রাধানন্দন! তুমি ভাগ্যবশত এখন ধর্ম স্মরণ করছ। নীচ লোকেরা প্রায়ই বিপৎসাগরে নিমগ্ন হয়ে দৈবের নিন্দা করে, কিন্তু নিজের দুষ্কার্যের নিন্দা করে না! (কর্ণ : ৬৬:১১১)।

“কর্ণ, তুমি দুর্যোধন, দুঃশাসন ও সুবলপুত্র শকুনি সকলে মিলে যে একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে সভায় এনেছিলে, তখন তোমার ধর্ম স্মরণ হয়নি! (কর্ণ : ৬৬: ১১২)

“দ্যূতসভায় যখন পাশাক্রীড়ানিপুণ শকুনি পাশাক্রীড়ায় অনভিজ্ঞ কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠিরকে জয় করেছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় গিয়েছিল! (কর্ণ : ৬৬: ১১৩)

“দুর্যোধন যখন তোমার মতানুসারে সর্পদংশন ও বিষযুক্ত খাদ্য দ্বারা ভীমকে মেরে ফেলবার উপক্রম করেছিল, তোমার ধর্ম তখন কোথায় গিয়েছিল! (কর্ণ : ৬৬ : ১১৪)

“কর্ণ বনবাস ও ত্রয়োদশ বৎসর অতীত হলে, তোমরা যে পাণ্ডবগণকে রাজ্য দাওনি, তখন তোমার ধর্ম কোথায় গিয়েছিল! (কর্ণ : ৬৬ : ১১৫)

“রাধানন্দন, বারণাবত নগরে জতুগৃহে নিদ্রিত পাণ্ডবগণকে, তখন যে দগ্ধ করবার উপক্রম করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় গিয়েছিল! (কর্ণ : ৬৬: ১১৬)

“কর্ণ তুমি যখন দ্যূতসভায় দুঃশাসনের বশীভূতা রজস্বলা দ্রৌপদীকে পরিহাস করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় গিয়েছিল! (কর্ণ : ৬৬ : ১১৭)

“রাধাপুত্র, দুঃশাসন অন্তঃপুরে গিয়ে নিরপরাধ দ্রৌপদীকে আকর্ষণ করতে লাগলে তুমি উদাসীনভাবে তাঁকে দেখছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় গিয়েছিল! (কর্ণ : ৬৬ : ১১৮)

“‘দ্রৌপদী পাণ্ডবেরা মরেছে এবং চিরকালের জন্য নরকে গিয়েছে। অতএব তুমি অন্য পতি বরণ করো’ এই কথা বলতে থেকে তুমি যখন গজগামিনী দ্রৌপদীর প্রতি দৃষ্টিপাত করছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় গিয়েছিল! (কর্ণ : ৬৬ : ১১৯)

“কর্ণ রাজ্যলোভী হয়ে শকুনিকে অবলম্বন করে আবার যে অনুদ্যূতে পাণ্ডবদের আহ্বান করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় গিয়েছিল! (কর্ণ : ৬৬ : ১২০)

“এবং যখন তোমরা বহুতর মহারথ মিলিত হয়ে পরিবেষ্টন করে বালক অভিমন্যুকে বধ করেছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় গিয়েছিল! (কর্ণ: ৬৬ : ১২১)

“সূত! সেই সমস্ত অবস্থায় যদি এ সকল ধর্ম না হয়ে থাকে, তবে এখন আর পরের ধর্মচিন্তায় সর্বদা তালু শুকিয়ে ফল কী? তুমি যদি আজ এখানে বহু ধর্মাচরণও কর, তথাপি জীবিত অবস্থায় মুক্তি পাবে না। পুষ্কর পাশক্রীড়ায় নলকে জয় করেছিলেন, সেইরকম পাণ্ডবেরাও বাহুবলে রাজ্যলাভ করেছেন। কারণ, এঁরা সকলেই লোভশূন্য। পাণ্ডবেরা সোমকগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধে প্রবল শত্রুগণকে বধ করে রাজ্যলাভ করবেন; আর সর্বদা সর্বপ্রকারে ধর্মরক্ষিত নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণের প্রভাবে ধার্তরাষ্ট্রগণ বিনষ্ট হবেন।” কৃষ্ণ এইরকম বলতে থাকলে, কর্ণ লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলেন, কোনও উত্তর দিতে পারলেন না।

তখন ক্রোধে কর্ণের ওষ্ঠযুগল স্পন্দিত হতে লাগল এবং সেই অবস্থায় মহাবেগ ও মহাপরাক্রমশালী কর্ণ ধনু উত্তোলন করে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রবৃত্ত হলেন। তখন কৃষ্ণ অর্জুনকে দিব্যাস্ত্র দ্বারা কর্ণকে রথ থেকে নিপাতিত করতে অনুমতি দিলেন। কর্ণের প্রতি কৃষ্ণের এতক্ষণের বক্তব্যে অর্জুন উত্তরোত্তর ক্রুদ্ধ হচ্ছিলেন, তাঁর রোমকূপ থেকে অগ্নিশিখা বার হতে লাগল। কর্ণ তা দেখে ব্ৰহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে অর্জুনকে নিবারণ করতে চেষ্টা করলেন। অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্রেই কর্ণের অস্ত্র নিবারণ করে আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, কর্ণ বারুণাস্ত্রে অর্জুনের অস্ত্র নিবারণ করলে, অর্জুন বায়ব্যাস্ত্র দ্বারা কর্ণ আনীত মেঘসমূহ অপসারিত করলেন। অর্জুনকে বধ করার জন্য কর্ণ এক মহাভীষণ বাণ ধনুতে যুক্ত করলেন। সেই অস্ত্রের প্রভাবে পৃথিবী ধূলি ধূসরিত হয়ে গেল, দেবগণ হাহাকার করতে লাগলেন। বিশালসর্প যেমন উইয়ের মৃত্তিকাস্তূপে প্রবেশ করে, তেমনই কর্ণবাহু নিক্ষিপ্ত সেই তীক্ষ্ণবাণ অর্জুনের বাহুমধ্যে প্রবেশ করল। অর্জুন গাঢ় বিদ্ধ হলেন, তাঁর মাথা ঘুরতে লাগল। হাতের গাণ্ডিবধনু শিথিল হয়ে পড়ল, তিনি ভূমিকম্পে কম্পিত পর্বতের মতো কাঁপতে লাগলেন। মহারথ কর্ণ অবসর পেয়ে ভূমিপ্রবিষ্ট রথচক্র উত্তোলন করার জন্য রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে বাহুযুগল ধারণ করে প্রচুর চেষ্টা সত্ত্বেও সে রথচক্র তুলতে পারলেন না। ইতোমধ্যে অর্জুন চৈতন্য লাভ করলে, কৃষ্ণ কর্ণ রথে ওঠার আগেই তাঁর মস্তক ছেদনের জন্য বললেন। তখন অর্জুন উজ্জ্বল এক ক্ষুরপ্র বাণ দ্বারা কর্ণের ধ্বজচিহ্ন ছেদন করলেন। সেই কর্তিত ধ্বজে হস্তীবন্ধন রজ্জুর চিহ্ন, স্বর্ণ, মুক্তা, মণি ও হীরক নিবেশিত ছিল। জগতে সেই ধ্বজ বিখ্যাত ছিল, কৌরবসৈন্যেরা সেটি দেখে উৎসাহিত হত। সেই ধ্বজের সঙ্গে কৌরবগণের যশ, দর্প, জয়াশা, সমস্ত প্রিয় এবং হৃদয়ও পতিত হল। তৎপরে অর্জুন কর্ণকে বধ করার জন্য তূণ থেকে ‘অঞ্জলিক’ নামে উত্তম বাণ গ্রহণ করলেন। সে বাণটি ইন্দ্রের বজ্র, অগ্নি ও যমদণ্ডের তুল্য ছিল। সেই অজ্ঞেয় শক্তিবাণ গাণ্ডিবে সংযুক্ত করে ধনু আকর্ষণ করে অর্জুন বললেন, “আমি যদি তপস্যা, গুরুজন সন্তোষ, যাগ ও বন্ধুবাক্য শ্রবণ করে থাকি, তা হলে আমার এই বাণটি ব্ৰহ্মাস্ত্র প্রভৃতি মহাস্ত্রের মতো আমার শত্রুর শরীর ও প্রাণের নাশকারী হোক।”

তদনন্তর মহাত্মা অর্জুন গাণ্ডিব নিক্ষিপ্ত সেই বাণ দ্বারা বহুসৈন্যকে মোহিত করে কর্ণের মহনীয় মস্তক হরণ করলেন। অর্জুন অপরাহ্ণকালে কর্ণের মস্তক ছেদন করলেন। প্রথমে সেই অঞ্জলিক বাণছিন্ন মস্তক পতিত হল, পরে কর্ণের দেহ পড়ে গেল।

রক্তবর্ণমণ্ডল সূর্য যেমন অস্তপর্বত থেকে পতিত হয়, সেইরকম উদীয়মান সূর্যের তুল্য তেজস্বী এবং শরৎকালের মধ্যগত সূর্যের তুল্য কৌরবসেনাপতি কর্ণের সেই মস্তকটি ভূতলে পতিত হল। গৃহস্বামী যেমন সুখে বাস করা বিশেষ সম্পন্ন গৃহকে ত্যাগ করেন, তেমনই উদারকর্মা কর্ণের মস্তকটি— অতিশয় সুন্দর ও সর্বদা সুখভোগযুক্ত কর্ণের দেহটিকে অতিকষ্টে ত্যাগ করল। নিপাতিত কর্ণের দেহ থেকে একটা তেজ বার হয়ে আকাশ অতিক্রম করে সূর্যমণ্ডলে গিয়ে প্রবেশ করল। সেই স্থানের সকল মানুষ ও যোদ্ধা সেই অদ্ভুত ঘটনা দেখলেন। অর্জুন কর্ণকে নিপাত করেছেন দেখে কৃষ্ণ, অর্জুন ও পাণ্ডবগণ শঙ্খধ্বনি করলেন— আর অশ্রুপূর্ণ নয়নযুগল নিয়ে শোকার্ত দুর্যোধন মুহুর্মুহু “হা কর্ণ, হা কর্ণ” বলে উচ্চ স্বরে ক্রন্দন করতে লাগলেন। রাজা যুধিষ্ঠির কর্ণকে নিহত দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে কৃষ্ণ ও অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, “গোবিন্দ, ভাগ্যে তুমি জয় করেছ, ভাগ্যে শত্রু নিপাতিত হয়েছে, এবং ভাগ্যবশতই অর্জুন বিজয়ী হয়েছেন। আমি তেরো বৎসর উদ্বেগে রাত্রি জাগরণ করেছি, আজ তোমার অনুগ্রহে রাত্রিতে সুখে নিদ্রা যাব।”

*

সপ্তদশ দিন অপরাহ্ণে অর্জুনের সঙ্গে ভয়ংকর যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত নিহত হলেন কর্ণ। কর্ণের মৃত্যু মহাভারতের এক দুর্লভতম ঘটনা। পাণ্ডবপক্ষের সবথেকে বিপজ্জনক শত্ৰু নিহত হলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপের থেকে বড় বীর কর্ণ হয়তো ছিলেন না। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ পাণ্ডবভ্রাতাদের ক্ষতি করতেন না। গান্ধারী দুর্যোধনকে বলেছিলেন, “ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ তোমার অন্নের ঋণ শোধ করতে প্রাণ দেবেন। কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে কোনও অবস্থায় শত্রু হিসাবে বিবেচনা করবেন না; কারণ সে ধর্মাচারী।”

গান্ধারী ঠিকই বুঝেছিলেন। কিন্তু কর্ণের বিচার সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। পিতৃমাতৃ পরিত্যক্ত কর্ণ সারাজীবন কুন্তীকে ক্ষমা করতে পারেননি। একই অপরাধের অংশীদার সূর্যদেবকে কিন্তু সারাজীবন পূজা করে গিয়েছেন। কর্ণ জানতেন পাণ্ডবেরা তাঁর ভ্রাতা। কিন্তু অর্জুনের বিশাল খ্যাতি কর্ণ সহ্য করতে পারেননি। তাঁর উচ্চ অভিলাষ ছিল তিনি অর্জুনের থেকে শ্রেষ্ঠ বীর হিসাবে স্বীকৃতি পাবেন। কর্ণ মহাবীর ছিলেন। কিন্তু পরশুরামের কাছে প্রাপ্তি কর্ণের জীবনের শেষ পাওয়া। কিন্তু অর্জুন তখনও প্রস্তুত হচ্ছেন। ‘প্রতিস্মৃতি’ মন্ত্র তপস্যা করে অর্জুন পেলেন দেবদেব মহাদেবের সাক্ষাৎ, আশীর্বাদ ও ‘পাশুপত’ মন্ত্রপ্রয়োগ সমেত উপসংহার পদ্ধতি। সূর্য ছাড়া অন্য সব দেবতা অর্জুনকে দিলেন প্রয়োগ সমেত তাঁদের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুলি। ইতোপূর্বে অর্জুন পেয়েছিলেন অগ্নিদেবের কাছ থেকে গাণ্ডিবধনু, দুই অক্ষয় তূণ ও দেবদত্ত শঙ্খ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে অর্জুন ছিলেন ভারতভূমির সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে স্বয়ং বাসুদেব তাঁর সারথ্য গ্রহণে সম্মতি দিয়েছিলেন। কর্ণের বীরত্বের যে পরিচয় মহাভারতে পাওয়া যায়, তার কোনওটাতেই পাণ্ডবেরা উপস্থিত ছিলেন না। কৃপাচার্য ঠিকই বলেছেন, কর্ণের আত্মশ্লাঘাও আছে, আবার একে যুদ্ধ থেকে পালাতেও দেখা যায়।

পাণ্ডবদের প্রতি কর্ণের অকারণ বিদ্বেষ ভীষ্মকে রুষ্ট করে তুলেছিল। তিনি শরশয্যায় শুয়ে কর্ণকে বলেছিলেন, “তুমি অকারণে পাণ্ডবদের দ্বেষ করো, নীচস্বভাব দুর্যোধনের আশ্রয়ে থেকে তুমি পরশ্রীকাতর হয়েছ।” কর্ণ সম্পর্কে এর থেকে ভাল মূল্যায়ন আর হয় না। দুর্যোধনকে তুষ্ট করতে কর্ণ সীমাহীন অন্যায় কাজ করেছিলেন। ছোট ভাইকে বিষদান, বিষ খাইয়ে জলে ফেলে দেওয়া, মাতা সমেত ভ্রাতাদের আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা, ভ্রাতৃবধূকে কুৎসিততম অপমান করা, তাঁকে পুরুষের সভায় শ্বশুর ও গুরুজনদের সম্মুখে ‘বেশ্যা’ বলে নগ্ন করার আদেশ দান করা, কর্ণকে কুৎসিত পুরুষ ও কাপুরুষ করে তুলেছিল। ভ্রাতৃবধূকে ‘বেশ্যা’ বলার সময়ে কর্ণের মনে ছিল না, তাঁর মাতাও পাঁচজন পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিলেন। তার জন্য মুনি ঋষিরা প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চকন্যার মধ্যে দু’জনকেই অন্তর্ভুক্ত করতে দ্বিধা করেননি। আসলে স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদীর প্রত্যাখ্যান কর্ণ কখনও ভুলতে পারেননি। কর্ণ বিবেচনা দ্বারা চালিত হলে বুঝতেন, যজ্ঞবেদি সমুত্থিতা দ্রৌপদী কখনওই ‘সূতপুত্র’কে বরণ করতে পারেন না। দ্রৌপদী কর্ণের যথার্থ পরিচয় জানতেন না।

কর্ণ যুধিষ্ঠিরকে চিনেছিলেন। কৃষ্ণের কাছে তিনি অনুরোধ করেছিলেন, তার যথার্থ পরিচয় যেন যুধিষ্ঠির জানতে না পারেন। কারণ যুধিষ্ঠির তা জানলে সমগ্র পৃথিবীর বিনিময়েও সে রাজ্য তিনি নেবেন না, কর্ণকে দিয়ে দেবেন। আবার বন্ধুর ঋণশোধ করতে কর্ণ তা দুর্যোধনকে দিয়ে দেবেন। মন দিয়ে পড়লে দেখা যায়, কর্ণের মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অন্যায়ের তালিকা দেবার সময় কৃষ্ণ জতুগৃহ দাহকালে কর্ণের মাতৃহত্যা প্রচেষ্টার উল্লেখ করেননি। প্রথমত, কৃষ্ণ কর্ণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন, কর্ণের জীবিত অবস্থায় তাঁর যথার্থ পরিচয় কাউকেই জানাননি। দ্বিতীয়ত, অভিযোগপত্রের মধ্যে “তুমি মাতৃহত্যা প্রচেষ্টাকারী” উল্লেখ করলেই গাণ্ডিবধনুতে ‘অঞ্জলিক’ বাণযুক্ত অর্জুন অবশ্যই প্রশ্ন করতেন, কর্ণের মাতৃহত্যা প্রচেষ্টার ব্যাপারটা কী? তা হলেই কর্ণের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠত। সেক্ষেত্রে যুধিষ্ঠিরের ‘ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ’ অর্জুন যুধিষ্ঠিরের বিনা অনুমতিতে কর্ণকে বধ করতেন না।

কর্ণ চরিত্র আলোচনা প্রসঙ্গে রাজশেখর বসু মন্তব্য করেছিলেন, “কাশীরাম দাসের গ্রন্থে এবং বাংলা নাটকে কর্ণচরিত্র সংশোধিত হয়েছে।” সাধারণ পাঠক এই সংশোধিত কর্ণ চরিত্রকেই চেনেন। মহাভারতের কর্ণ যথার্থরূপে তাঁদের কাছে পেশ করলেও তাঁরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

‘কর্ণবধ’ অংশটিতে অর্জুনের অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে সংযম ও ধৈর্য আমাদের মুগ্ধ করে। ভীম অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন, কৃষ্ণ উদ্বিগ্ন হয়েছেন। কিন্তু ধীর অচঞ্চল অর্জুন ধীরে ধীরে কর্ণের সব ক্ষমতা নষ্ট করেছেন।

কর্ণ মহৎ পিতামাতার পুত্র। কিন্তু অসৎ সংসর্গে লালিত পালিত হওয়ায় কর্ণের জীবনের সব শুভ নষ্ট হয়ে গেছে। বংশগতি কর্ণের অত্যন্ত ভাল ছিল, কিন্তু পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ। বিনয়, সংযমের পরিবর্তে তিনি উচ্চাভিলাষী, অশালীন ও তোষামুদে হয়ে ওঠেন। অসত্য বলার কী ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে তা পরশুরামের অভিশাপ পেয়েও কর্ণ সম্পূর্ণ বোঝেননি। তিনি দুর্যোধনের কাছেও নিজের যথার্থ পরিচয় দেননি। সম্ভবত কর্ণ ভেবেছিলেন, তাঁর যথার্থ পরিচয় পেলে দুর্যোধন তাকে আপন গোপন মন্ত্রিমণ্ডলীতে স্থান দেবেন না। কিন্তু কর্ণ হস্তিনাপুর শাসন করতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণের কাছে কর্ণ বলেছেন, “দুর্যোধনের প্রসাদে আমি তেরো বৎসর নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করেছি।” এ রাজ্য হস্তিনাপুর এবং ইন্দ্রপ্রস্থ। যা ছলনা করে পাণ্ডবদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং শর্তপূরণের তেরো বৎসর অতিক্রান্ত হলেও যা তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। এই কাপুরুষোচিত আচরণের নায়ক ছিলেন কর্ণ।

ভীষ্মকে কর্ণ “মুখ দেখলে দিন নষ্ট হয় (ভীষ্ম সন্তানহীন এই কারণে), আটকুড়ো” ইত্যাদি বলে অসম্মান করেছেন। তিনি কৃপাচার্যের জিভ ছেদন করতে চেয়েছিলেন। দুর্যোধন দ্রৌপদীকে অনাবৃত বাম ঊরু দেখালে কর্ণ উল্লসিত হয়েছিলেন। সপ্তরথী মিলে অন্যায় যুদ্ধে অভিমন্যুকে বধ করে উল্লাসে নৃত্য করেছিলেন। কর্ণের সেই উল্লাস দেখে আধুনিক বাঙালি কবির একটি চরণ মনে পড়ে— “সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি।”

একথা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে, সেনাপতি হবার পর কর্ণ কোনও ছলনার আশ্রয় নেননি। অপরের (অশ্বসেনের) সহায়তায় অর্জুনকে বধ করতে চাননি। ভিতরে ভিতরে কর্ণের বিবেক তাঁকে আঘাত করেছিল। তিনি কৃষ্ণের কাছে স্বীকার করেছিলেন, দুর্যোধনকে প্রসন্ন করার জন্য তিনি পাণ্ডবদের, বিশেষত দ্রৌপদীর প্রতি যে আচরণ করেছিলেন, তা বীরোচিত ছিল না।

হতভাগ্য কর্ণ! সূর্যের আদেশ অনুসারে যে কাল-প্রবাহে কুন্তী তাঁকে বিসর্জন দিয়েছিলেন, সে প্রবাহ তাঁকে কোনও সুস্থ, সংযত, ক্ষত্রিয়ের কাছে পৌঁছে দিল না, সূতগৃহে তিনি লালিত হলেন, বিদ্যালয়-জীবনে বন্ধুত্ব হল কতগুলি নষ্টচরিত্র বালকের সঙ্গে, অসত্য ভাষণে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন এবং পরিণামে অন্ধকারকেই টেনে আনলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *