৬০. ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ

৬০
ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ—মহাদেবের ঘোষণা

ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের জন্য ভীষ্ম কাশী নরেশের আয়োজিত স্বয়ংবর সভা থেকে তিন কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে এলেন। উপস্থিত রাজন্যবর্গ ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হলেন। কন্যাদের নিয়ে ভীষ্মের রথ হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলে, জ্যেষ্ঠ কন্যা অম্বা সলজ্জে ভীষ্মকে জানালেন যে, তিনি পূর্বেই রাজা শাল্বকে মনে মনে পতি হিসাবে বরণ করেছেন, মগধরাজও তাঁর প্রতি অনুরক্ত। অম্বার কথা শুনে ভীষ্ম অম্বাকে শাল্বরাজার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু শাল্ব অম্বাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে জানালেন যে, ভীষ্ম তাঁকে স্পর্শ করেছেন, অতএব তিনি অম্বাকে গ্রহণ করবেন না।

অদূরদর্শী শাল্বেরে এই প্রত্যাখ্যান অম্বার হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দিল। সে কল্পনাও করতে পারেনি, এমন ঘটনা তার জীবনে ঘটতে পারে। কিন্তু তার এই অপমানিত, প্রত্যাখ্যাত, ব্যর্থ জীবনের জন্য দায়ী কে? সে পিতৃগৃহে ফিরতে পারবে না, হস্তিনাপুরে গিয়ে বিচিত্রবীর্যকেও বরণ করতে পারবে না। শাল্বরাজাও তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? সে নিজে? দুর্ধর্ষ ভীষ্ম? রাজা শাল্ব? অথবা আমার স্বয়ংবর সভার আয়োজক পিতা? আমি মূঢ়ের মতো চরম বিপন্ন হয়ে পড়েছি। ভীষ্মকে ধিক, আমার মূঢ়চিত্ত, মন্দবুদ্ধি পিতা, যিনি বেশ্যার মতো আমাকে বীর্যপণে নিযুক্ত করেছিলেন, তাঁকেও ধিক, আমাকে ধিক, শাল্বরাজাকে ধিক এবং বিধাতাকে ধিক—যাদের দুর্ব্যবহারে আমি এই গুরুতর বিপদে পড়েছি।

অনয়স্যাস্য তু মুখং ভীষ্মঃ শান্তনবো মম ॥ উদ্‌যোগ : ১৬৩ : ৩৪ ॥

আমার এই বিপদের প্রধান কারণ শান্তনুনন্দন ভীষ্ম।

অতএব ভীষ্মের উপর প্রতিশোধ নিতে হবে। তবে স্বয়ংবর সভায় অম্বা দেখেছেন, যুদ্ধ দ্বারা ভীষ্মকে পরাজিত করার মতো রাজশক্তি নেই। একমাত্র তপস্যা করেই দেবানুগ্রহ লাভ করে ভীষ্মকে পরাজিত করা সম্ভব। এই সিদ্ধান্ত করে নবীনা যুবতী অম্বা তপোবনে প্রবেশ করলেন। বনমধ্যে উপস্থিত হয়ে উপস্থিত মুনিদের কাছে আপন দুর্দশার আদ্যন্ত বিবরণ দিলেন।

সেই মুনিদের মধ্যে শাস্ত্রে ও আরণ্যক উপনিষদে অধ্যাপক, তপোবৃদ্ধ, দৃঢ়ব্রত ও মহাত্মা ‘শৈখাবত্য’—নামে এক মুনি ছিলেন। তিনি অম্বাকে প্রশ্ন করলেন আশ্রমবাসী তপস্বীরা তার কী সাহায্য করতে পারেন? অম্বা তাঁকে বললেন, সংসারের প্রতি তার আর আসক্তি নেই, সে প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে কঠিন তপস্যা করতে চায়। অম্বা সেই মুনিদের কাছে থেকেই তপস্যা করার অনুমতি প্রার্থনা করল। মুনিরা তার প্রার্থনা শুনে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন। কেউ বললেন, একে পিতৃগৃহে নিয়ে যাওয়া হোক। কেউ বললেন, শাল্বরাজার কাছে অম্বাকে নিয়ে গিয়ে তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হোক, কেউ বললেন, অন্যায়ের মূল কারণ ভীষ্ম। তাঁরা ভীষ্মের নিন্দা করলেন। অধিকাংশ মুনির মত হল, অম্বা পিতার কাছেই ফিরে যান। তার ভালমন্দ তার পিতাই সব থেকে ভাল বুঝবেন। কারণ নারীর প্রথম গতি পতি, না হলে পিতা। পতি জীবিত ও সুস্থ থাকলে নারীর দ্বিতীয় আশ্রয়ের প্রয়োজন হয় না। আর পতির অনিষ্ট ঘটলে পিতাই আশ্রয়। অম্বা কোমলাঙ্গী এবং রাজকুমারী। তিনি আশ্রমে বাস করে তপস্যা করলে বহুতর দোষ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। আগন্তুক রাজারা এই নির্জন-গহন-বনমধ্যে অম্বাকে দেখলে অবশ্যই প্রার্থনা করবেন। সুতরাং আশ্রমে থাকার চিন্তাও অম্বার মনে আনা উচিত নয়।

অম্বা বলল যে, তার পক্ষে আর পিতৃগৃহে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। সেখানে সে পূর্বের স্নেহ তো পাবেই না, উপরন্তু পিতার গুরুতর বিপদের কারণ হবে। ইহজীবন তার বস্তুত শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী জীবনে এই রকম দুঃখময় ঘটনা যাতে না ঘটে, তাই তপস্যাই তার একমাত্র পথ।

সেই ব্রাহ্মণেরা যখন এই আলোচনা করছেন তখন আশ্রমে তপস্বী ও রাজর্ষি হোত্রবাহন উপস্থিত হলেন। যথাবিহিত সম্মানিত ও সমাদৃত হয়ে আসন গ্রহণ করলে, তাঁর উপস্থিতিতেই মুনিরা অম্বার সম্পর্কে আলোচনা করতে শুরু করলেন। হোত্ৰবাহন অম্বার মাতামহ ছিলেন। তিনি অম্বাকে কোলে তুলে নিয়ে আশ্বস্ত করলেন এবং ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা জেনে নিলেন। হোত্রবাহন অম্বাকে বললেন, “তুমি পিতৃগৃহে আর যেয়ো না, আমি তোমার মনের দুঃখ দূর করব। তুমি আমার বচন অনুসারে জমদগ্নিনন্দন তপস্বী রামের কাছে যাও। সেই রামই তোমার দুঃখ দূর করবেন। ভীষ্ম যদি তাঁর কথা না শোনেন, তবে তিনি যুদ্ধে ভীষ্মকে বধ করবেন। অতএব তুমি সেই কালাগ্নিসদৃশ পরশুরামের কাছে চলে যাও। সেই মহাতপা পরশুরামই তোমাকে অন্য নারীর সমান মর্যাদায় স্থাপন করবেন। তুমি গিয়ে তোমার মাথা তাঁর চরণে রেখে প্রণাম করবে। তোমার আগমনের উদ্দেশ্য তাঁকে জানাবে এবং আমার কথা বলবে। কন্যা, পরশুরাম আমার সখা, আমার উপরে প্রণয়শালী। তাঁর কাছে গেলে তোমার অভীষ্ট পূর্ণ হবে।”

অকৃতব্রণ নামের এক পরশুরাম অনুচর ভাগ্যক্রমে সেইস্থানে পৌঁছলেন। তিনি সংবাদ দিলেন তপস্বী হোত্ৰবাহনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য পরশুরাম পরের দিন প্রভাতেই সেই স্থানে আসবেন। তখন অকৃতব্রণ মহর্ষি হোত্ৰবাহনের কাছ থেকে অম্বার বৃত্তান্ত আনুপূর্বিক শুনলেন। অকৃতব্রণ অম্বাকে প্রশ্ন করলেন যে, তিনি ভীষ্ম অথবা শাল্ব, কার বিপক্ষে এই ঘটনার প্রতিকার চান। অম্বা বললেন যে, ভীষ্ম না জেনেই তাঁকে বলপূর্বক নিয়ে গিয়েছিলেন আবার ভীষ্ম নিয়ে গিয়েছিলেন বলেই শাল্বরাজা তাকে গ্রহণে অসম্মতি জানান। অকৃতব্রণ সমস্ত শুনে ভীষ্মের দায়িত্বই অধিক, এই বিবেচনা করলেন।

পরদিন প্রভাতে জটা ও কৌপীনধারী মুনি পরশুরাম সেই স্থানে উপস্থিত হলেন। অম্বা তাঁর চরণে মাথা রেখে প্রণাম করলেন। হোত্ৰবাহন সুগভীর মর্যাদায় পরশুরামকে তৃপ্ত করে অম্বার আনুপূর্বিক বিবরণ তাঁর কাছে প্রদান করে, প্রতিকার প্রার্থনা করলেন। রোদনপরায়ণা অম্বাকে দেখে দয়াবশত পরশুরাম তাকে প্রশ্ন করলেন যে, তার এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? অম্বা বললেন, “মহাব্রত ভীষ্মই আমার বিপদের কারণ। কারণ তিনি বলপূর্বক রথে তুলে আমাকে বশীভূত করেছিলেন। অতএব মহাবাহু ভৃগুশ্রেষ্ঠ! যাঁর জন্য আমি এই দুঃখভোগ করছি, সেই ভীষ্মকেই আপনি বধ করুন। ভীষ্ম লোভী, নীচ প্রকৃতি এবং গর্বিত। সুতরাং তার প্রতিশোধ নেওয়াই আপনার উচিত। ভীষ্ম যখন আমাকে হরণ করেন, তখন আমার মনে এই সংকল্প হয়েছিল যে আমি ভীষ্মকে বধ করাব। আপনি আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন, ইন্দ্র যেমন বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন, আপনিও সেই রকম ভীষ্মকে বধ করুন।” অম্বার সকরুণ রোদন দেখে অকৃতব্রণ পরশুরামের কাছে আবেদন করলেন, শরণাগতা অম্বাকে রক্ষা করার জন্য পরশুরাম ভীষ্মকে ‘বধ’ করুন। অকৃতব্রণ ভীষ্ম সম্পর্কে পরশুরামকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে পরশুরাম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সমবেত সকল ক্ষত্রিয়কে যিনি পরাভূত করবেন, সেই মহাবীর ক্ষত্রিয়কেও পরশুরাম বধ করবেন।

তখন পরশুরাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, অম্বাকে নিয়ে স্বয়ং ভীষ্মের কাছে যাবেন এবং প্রসন্ন, শান্তকণ্ঠে অম্বাকে গ্রহণের জন্য ভীষ্মকে আদেশ করবেন। ভীষ্ম যদি তাঁর আদেশের মর্যাদা লঙ্ঘন করেন তা হলে ভয়ংকর যুদ্ধে তিনি ভীষ্মের বিনাশ ঘটাবেন। এই চিন্তা করে পরশুরাম অম্বাকে সঙ্গে নিয়ে ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হলেন।

পরশুরাম হস্তিনাপুর রাজ্যসীমায় এসেছেন শুনেই ভীষ্ম সত্বর ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও ঋত্বিকগণের সঙ্গে একটি ধেনু নিয়ে প্রত্যুদ্‌গমন করলেন ও গুরুর পাদবন্দনা করলেন। পরশুরাম ভীষ্মের পূজা গ্রহণ করলেন এবং বললেন যে, ভীষ্ম যখন নিজে বিবাহ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন তখন তিনি অম্বাকে বলপূর্বক হরণ করেছিলেন এবং পরে আবার তাকে ত্যাগও করেছিলেন। ভীষ্ম ধরে নিয়ে আসার ফলেই শাল্বরাজা কন্যাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অতএব এই নারীকে ভীষ্মকেই গ্রহণ করতে হবে এবং তার নারী ধর্মের পূর্ণতা দিতে হবে।

ভীষ্ম দেখলেন, গুরু অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি তাঁকে প্রসন্ন করার জন্য বললেন, কন্যাটি পূর্বেই তাঁকে জানিয়েছে যে সে শাল্বরাজার প্রতি অনুরক্তা। সেই কারণেই ভীষ্ম তাকে শাল্বরাজার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অতএব কোনও কারণেই তিনি কন্যাটিকে নিয়ে ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যকে দিতে পারেন না। ক্রুদ্ধ পরশুরাম ভীষ্মকে বললেন যে, তিনি যদি তাঁর আদেশ পালন না করেন, তা হলে তিনি রাজ্যসুদ্ধ ভীষ্মকে বধ করবেন। ভীষ্ম বারবার পরশুরামকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছেন কেন? আমি আপনার শিষ্য, আপনার কাছেই আমার অস্ত্রশিক্ষা। তবু আপনি কেন আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছেন?”

ক্রোধে আরক্তনয়ন পরশুরাম বললেন, “তুমি আমাকে গুরু বলে জানো, অথচ গুরুর আদেশ পালন করছ না। তুমি এই কাশীরাজকন্যাকে গ্রহণ না করলে কোনও মতেই আমাকে শান্ত করতে পারবে না। তুমি এই কন্যাকে গ্রহণ করো এবং আপন বংশরক্ষা করো। তোমার স্পর্শদোষেই কন্যাটি উপযুক্ত পাত্র লাভ করতে পারছে না।”

ভীষ্ম সবিনয়ে বললেন, “ব্ৰহ্মর্ষি, আপনার অনুরোধেও আমি তা করতে পারব না। পরপুরুষাসক্ত নারীকে কোন পুরুষ আপন গৃহে স্থান দেয়? স্ত্রীলোকের ব্যভিচার দোষ গুরুতর বিপদ উৎপাদন করে।

ন ভয়াদ্বাসবস্যাপি ধর্মং জহ্যাং মহাব্রত।

প্রসীদ মা বা যদ্বা তে কাৰ্য্যং তৎ কুরু মা চিরম্ ॥ উদ্‌যোগ : ১৬৭ : ২৩ ॥

“অতএব মহাব্রত। আমি ইন্দ্রের ভয়েও ধর্ম ত্যাগ করব না। এতে আপনি আমার উপর প্রসন্ন হন বা না হন। কিংবা আপনার যা কর্তব্য করুন, বিলম্ব করবেন না।”

“বিশুদ্ধাত্মা মহাবুদ্ধি প্রভু! পুরাণে কথিত আছে, মহাত্মা মরুত্ত রাজা বলেছিলেন, গুরু যদি গর্বিত হন, কর্তব্য-অকর্তব্য না বোঝেন, তবে তাঁকে পরিত্যাগ করা উচিত।”

“আপনি আমার গুরু, সেই জন্য আপনাকে ক্ষমা করেছি। কিন্তু আপনি গুরুর ব্যবহার জানেন না, অতএব আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করব। আপনি গুরু, তায় ব্রাহ্মণ এবং তপোবৃদ্ধ। কিন্তু যে ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ ও যুদ্ধার্থী হয়ে অস্ত্র উত্তোলন করে আসে তাঁকে বধ করলে ব্রহ্মহত্যার পাপ হয় না। তারপর যে যেমন আচরণ করে সে তেমন ফল পায়। আপনি আমার অলৌকিক বাহুবল ও বিক্রম দর্শন করুন। কুরুক্ষেত্রের সমন্তপঞ্চক দেশে আপনার সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করব। আপনি ইচ্ছানুসারে সজ্জিত হন। আপনি যেখানে বহুবার ক্ষত্রিয়গণের রক্ত দ্বারা পিতার তর্পণ করেছিলেন, সেইখানেই আপনাকে বধ করে আমি ক্ষত্রিয়গণের তর্পণ করব। আপনার দর্প আছে যে আপনি একাকীই জগতের সকল ক্ষত্রিয়কে বধ করেছিলেন। তখনও ভীষ্মের জন্ম হয়নি। অতএব আপনার দর্প চূর্ণ হবার সময় এসেছে। এতকাল আপনি তৃণের উপর জ্বলতেন। আজ ভীষ্মের মুখোমুখি হয়ে নিজের শক্তির অল্পতা অনুভব করুন।”

অনন্তর ভীষ্ম ও পরশুরাম সমন্তপঞ্চকে যুদ্ধের জন্য সমবেত হলেন। ভীষ্ম শান্তি, স্বস্ত্যয়ন করে বহু দিব্য অস্ত্রসমেত দিব্যরথে চড়ে পরশুরামের মুখোমুখি হলেন। পরশুরাম শুক্ল বস্ত্র শুক্ল উত্তরীয় অঙ্গে ধারণ করে ভীষ্মের মুখোমুখি হলেন। দেবী গঙ্গা পুত্র ভীষ্ম ও তাঁর গুরু পরশুরামের মধ্যে আসন্ন সংগ্রাম সম্ভাবনায় বারংবার উভয়ের কাছে গিয়ে নিবৃত্ত হতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু উভয়েই তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। ভীষ্ম গুরু পরশুরামকে বললেন, “আমি রথে চড়ে ভূতলস্থিত আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। আপনি যুদ্ধ করার ইচ্ছা করলে রথে আরোহণ করুন এবং কবচ পরিধান করুন।” তখন পরশুরাম বললেন, “ভূমিই আমার রথ, চার বেদ আমার বাহন। বায়ু আমার সারথি, আর বেদমাতারা আমার কবচ।” তখন ভীষ্ম স্তম্ভিত বিস্ময়ে দেখলেন, পরশুরাম একটি রথের মধ্যে রয়েছেন, সে রথখানি পরশুরামের সংকল্পে নির্মিত, পবিত্র, একটি নগরের ন্যায় বিস্তীর্ণ, দিব্যাশ্বযুক্ত, স্বর্ণভূষিত, সুন্দর, সুসজ্জিত এবং অদ্ভুতদর্শন এবং তার মধ্যে সর্বপ্রকার অস্ত্রই আছে। পরম সুহৃদ অকৃতব্রণ পরশুরামের সারথ্যভার গ্রহণ করলেন।

তখন ভীষ্ম রথ থেকে নেমে, পায়ে হেঁটে পরশুরামের কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন এবং তাঁকে যুদ্ধে আমন্ত্রণ জানালেন। ভীষ্মের আচরণে সন্তোষ প্রকাশ করলেও পরশুরাম তাঁকে জয়ের আশীর্বাদ দিলেন না। এরপর একটানা তেইশ দিন গুরু এবং শিষ্যের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হল। কোনওদিনের যুদ্ধে পরশুরামের বাণের আঘাতে ভীষ্মের সারথি ও অশ্ব নষ্ট হল। কোনওদিন ভীষ্মের তীক্ষ্ণ শরের আঘাতে পরশুরাম মূৰ্ছিতপ্রায় হলেন। উভয়ের প্রচণ্ড অস্ত্রবর্ষণে আকাশ অস্ত্রাবৃত হয়ে গেল। এই যুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই হয় ভীষ্ম না হয় পরশুরাম— যে কোনও একজন পরাজিত হয়ে মূৰ্ছিত হয়ে পড়তেন, আবার প্রভাতে সুস্থ হয়ে পুনরায় যুদ্ধে যোগ দিতেন। টানা তেইশ দিন এইভাবে যুদ্ধ চলার পর, পরশুরামের প্রচণ্ড শরে, আহত এবং অবশ হয়ে ভীষ্ম রথ থেকে পতিত হবার উপক্রম হলে, অষ্টবসু ভীষ্মের দেহ তাঁদের হাতে ধারণ করলেন, ভীষ্মের দেহ ভূতল স্পর্শ করল না। ভীষ্মের চেতনা ফিরলে অষ্টবসু ভীষ্মকে বললেন যে, তিনি পরশুরামের প্রতি ‘প্রস্বাপন’ অস্ত্র প্রয়োগ করুন। কারণ এই দৈব অস্ত্র পরশুরাম জানেন না। আর এ অস্ত্র প্রয়োগের ফলে পরশুরামের মৃত্যু ঘটবে না কিন্তু নিদ্রিত হয়ে পড়বেন। পরে ভীষ্ম আবার ‘সম্বোধন’ অস্ত্র প্রয়োগ করলে পরশুরাম আবার জাগ্রত হয়ে উঠবেন।

পরদিন পরশুরাম যুদ্ধে প্রচণ্ড হয়ে উঠলেন। কোনও অস্ত্রেই তাঁকে নিরস্ত করা যাচ্ছে না দেখে ভীষ্ম ‘প্রস্বাপন’ অস্ত্র স্মরণ করলেন। স্মরণমাত্র অস্ত্র ভীষ্মের হাতে এসে উপস্থিত হল। বাণ ভীষ্ম ধনুতে স্থাপন করা মাত্র, সমস্ত পৃথিবী হাহাকারে পূর্ণ হয়ে গেল। নারদ যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্মের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, “ভীষ্ম, তুমি কখনও গুরু পরশুরামের প্রতি ‘প্রস্বাপন’ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না। সেটা তোমার পক্ষে চূড়ান্ত পাপজনক কাজ হবে।” ভীষ্ম ‘প্রস্বাপন’ অস্ত্র সংবরণ করলেন। ওদিকে পরশুরামের পিতৃপুরুষেরা এবং নারদ এসে বললেন, “তুমি ভীষ্মকে জয় করতে পারবে না। ভীষ্ম তোমার বধ্য নন। ইনি শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় বংশে অষ্টবসুর অংশে এর জন্ম।” দেবর্ষি, পিতৃপুরুষ ও ভীষ্মের মাতা গঙ্গা দেবী উভয়ের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। তাঁদের আদেশে পরশুরাম ও ভীষ্ম— উভয়েই অস্ত্র ত্যাগ করলেন। ভীষ্ম এসে পরশুরামের চরণ বন্দনা করলেন। পরশুরাম সস্নেহে ভীষ্মকে বললেন, “ভীষ্ম, এ জগতে তোমার তুল্য ক্ষত্রিয় নেই। এই যুদ্ধে আমাকে তুমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট করেছ। এখন যাও।”

এরপর পরশুরাম রাজকন্যা অম্বাকে ডেকে সকলের সম্মুখে বললেন—

প্রত্যক্ষমতল্লোকাণাং সবের্ষামেব ভাবিনি।

যথাশক্ত্যা ময়া যুদ্ধং কৃতং বৈ পৌরুষং পরম্ ॥ উদ্‌যোগ : ১৭৬ : ১ ॥

“—ভাবিনি! আমি পরম পুরুষকার প্রকাশপূর্বক শক্তি অনুসারে যুদ্ধ করলাম, সকল লোকই প্রত্যক্ষ করেছেন।” কিন্তু

ন চৈবমপি শক্লোমি ভীষ্মং শস্ত্রভৃতাং বরম। —“আমি সকল প্রচেষ্টা করেও ভীষ্মকে জয় করতে পারলাম না। অতএব তুমি ভীষ্মেরই শরণাপন্ন হও, তোমার অন্য উপায় নেই। কারণ ভীষ্ম মহাস্ত্র সকল নিক্ষেপ করে আমাকে জয় করেছেন।”

অম্বা পরশুরামের কথা সত্য বলে স্বীকার করে বললেন, সত্যই ভীষ্ম যুদ্ধে দেবগণেরও অজেয়। অস্ত্র দ্বারা ভীষ্মকে পরাজিত করা অসম্ভব। কিন্তু অম্বাও আর ভীষ্মের কাছে ফিরে যাবেন না। অতএব ভীষ্মের মৃত্যুর উপায় তাঁকে নিজেকেই করতে হবে। তিনি ভয়ংকর তপস্যা করার জন্য সেই স্থান থেকে প্রস্থান করলেন। ভীষ্ম অম্বার কার্যক্রম এবং গতিবিধি লক্ষ করার জন্য কয়েকজন গুপ্তচর নিযুক্ত করলেন।

অম্বা যমুনা নদীর তীরে গিয়ে ঋষিদের আশ্রমে প্রবেশ করে অলৌকিক তপস্যা করতে আৰম্ভ করলেন। তিনি নিরাহারা, বায়ুভক্ষা, কৃষ্ণা, রুক্ষা, জটাধারিণী, জলকর্দমযুক্তা, স্থাণুর মতো অচলা ও তপস্বিনী হয়ে ছ’মাস অতিক্রম করলেন। এক বৎসর নিরাহারে যমুনার জলে থেকে জলবাসব্রত সমাপ্ত করলেন। এক বৎসর চরণ অঙ্গুষ্ঠ ভূমিতে রেখে একটি মাত্র গলিত পত্র ভক্ষণ করে অতিবাহিত করলেন। স্বর্গ ও মর্ত্য সন্তপ্ত করে তিনি বারো বৎসর কঠিন তপস্যা করলেন। কেউ তাঁকে বারণ করতে পারল না। ক্রমে অম্বা নন্দাশ্রম, উলূকাশ্রম, চ্যবনাশ্রম, মানস সরোবব, প্রয়াগ, দেবযান, দেবারণ্য, ভাগীরথী, বিশ্বামিত্রাশ্রম, মাণ্ডব্যাশ্রম, দিলীপাশ্রম, রামহ্রদ, পৈলগর্গাশ্রম,— ওই সকল তীর্থে দুষ্কর ব্রত অবলম্বন করে অবগাহন করতে লাগলেন।

একদিন মহাভাগ দেবী গঙ্গা জলস্থিতা তপস্যারতা, অম্বার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, কেন তিনি এই দুশ্চর তপস্যা করছেন। উত্তরে অম্বা জানালেন, পরম পরাক্রান্ত পরশুরাম যুদ্ধে ভীষ্মকে পরাজিত করতে পারেননি, অতএব পৃথিবীর কোনও ক্ষত্রিয় বীর ভীষ্মকে বধ করতে পারবেন না। ভীষ্মবধের সংকল্প করেই অম্বা এই অতি কঠিন তপস্যা শুরু করেছেন। শুনে গঙ্গা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন এবং বললেন যে, অম্বার আচরণ অত্যন্ত কুটিল। সুতরাং তিনি কামনার ফল লাভ করতে পারবেন না। অম্বা মন্দতীর্থ নদীতে পরিণতা হবেন, কেবল বর্ষাকালেই সেই নদীতে জল থাকবে, বাকি আট মাস থাকবে না। ভয়ংকর জলজন্তু সেই নদীতে থাকবে এবং প্রাণীমাত্রেই সেই নদীকে ভয় করবে। গঙ্গার এই ভয়ংকর অভিসম্পাতেও অম্বার তপস্যা ভঙ্গ হল না। অম্বা আরও কঠিন তপস্যা শুরু করলেন। কখনও অষ্টম মাসে, কখনও দশম মাসে জল পান করা পর্যন্ত বন্ধ করলেন।

বৎসদেশে উপস্থিত অম্বা তপস্যা করা মাত্রই বর্ষাকালমাত্র সম্ভবা, জলজন্তুবহলা, মন্দতীর্থরূপে বক্রা ‘অম্বা’ নামে প্রসিদ্ধ হলেন। তিনি দেহের অর্ধাংশ নদী হলেন, অর্ধাংশ কুমারী কন্যা রূপেই তপস্যা করতে লাগলেন। তখন তপোবৃদ্ধ ঋষিরা অম্বার নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে তপস্যা ভঙ্গ করতে বললেন। অম্বা বললেন, ভীষ্মের জন্যই তাঁর এই অবস্থা।

যৎকৃতে দুঃখবসতিমিমাং প্রাপ্তাস্মি শাশ্বতীম্।

পতি লোকাৎবিহীনা চ নৈব স্ত্রী ন পুমানিহ ।। উদ্‌যোগ : ১৭৭ : ৪।।

“— যার জন্য আমি চিরদুঃখ ভোগ করলাম, আমি স্ত্রীও নই, পুরুষও নই। পতিলোক থেকে বিচ্যুত সেই ভীষ্মকে বধ না করে আমি শান্ত হব না। সুতরাং আপনারা আমাকে বারণ করবেন না।”

তখন শূলপাণি মহাদেব অম্বাকে দর্শন দিলেন। মহাদেব বরগ্রহণ করতে বললে অম্বা ভীষ্মের পরাজয় প্রার্থনা করলেন। মহাদেব বললেন, “তুমি ভীষ্মকে বধ করতে পারবে। কিন্তু বর্তমান রূপে বর্তমান জীবনে তা পারবে না। তুমি অন্য দেহ লাভ করে, প্রথমে কন্যা হয়ে পরে পুরুষত্ব লাভ করবে এবং ভীষ্মকে বধ করবে। এই জীবনের সমস্ত ঘটনা তোমার স্মরণে থাকবে। তুমি দ্রুপদরাজার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করবে। পরে দ্রুতাস্ত্রক্ষেপী, বিচিত্রযোধী, মহারথ পুরুষে রূপান্তরিত হবে এবং ভীষ্মকে বধ করতে পারবে।”

এই আশীর্বাদ করেই মহাদেব অন্তর্হিত হলেন। অম্বা তখন মহর্ষিদের সামনেই বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বিশাল চিতা নির্মাণ করে, তাতে আগুন দিয়ে, ‘আমি ভীষ্ম বধের জন্য এই দেহ ত্যাগ করছি’ বলে সেই প্রজ্বলিত অগ্নিতে প্রবেশ করলেন।

*

ভীষ্ম কর্তৃক অসম্মানিত দ্রুপদরাজের গৃহে অম্বা ‘শিখণ্ডিনী’ রূপে জন্মগ্রহণ করে, পরে স্থূণাকর্ণ নামক যক্ষের সঙ্গে লিঙ্গ বিনিময় করে ‘শিখণ্ডী’ রূপে পরিচিত হলেন। শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখেই অর্জুন তীক্ষ্ণ শরবর্ষণে ভীষ্মকে রথ থেকে ভু-পাতিত করেন। শিবের আশীর্বাদে শিখণ্ডী অতিরথ হলেন।

৬১
শত্ৰু-সংহার-কাল গণনা

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বদিন প্রভাতে কুরুরাজ দুর্যোধন সমবেত সৈন্যদের সম্মুখে গিয়ে গঙ্গানন্দন ভীষ্মকে প্রশ্ন করলেন, “পিতামহ, পাণ্ডবগণের এই যে সৈন্য যুদ্ধের জন্য উদ্যত হয়েছে, এর মধ্যে প্রচুর পদাতিক, হস্তী ও অশ্ব রয়েছে, মহারথেরা সমূহ সৈন্যকে ব্যাপৃত করে আছেন, লোকপালতুল্য ভীম, অর্জুন, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি মহাধনুর্ধারী মহাবলেরা রক্ষা করছেন, এই সৈন্য সমুদ্রের ন্যায় বিশাল ও অনিবার্য—দেবতারাও এই সৈন্যসমুদ্রকে বিক্ষুব্ধ করতে পারেন না। কিন্তু মহাতেজা গঙ্গানন্দন! আপনি কত কালে এই পাণ্ডব সৈন্যকে ধ্বংস করতে পারেন? এবং মহাতেজা মহাধনুর্ধর দ্রোণাচার্য, অতি মহাবল কৃপাচার্য, সমরশ্লাঘী কর্ণ কিংবা ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ অশ্বত্থামা কত কালে নষ্ট করতে সমর্থ হবেন? কারণ, আমার সৈন্যের মধ্যে আপনারাই দিব্যাস্ত্র জানেন। আমি এ বিষয়ে জানতে চাই। এ বিষয়ে আমার গভীর কৌতূহল আছে। আপনি আমার কাছে আপনাদের কার্য-সমাধান-সামর্থ্য বর্ণনা করুন।”

ভীষ্ম বললেন, “কৌরবশ্রেষ্ঠ রাজা তোমার প্রশ্ন অতিশয় সঙ্গত। তুমি শত্রুপক্ষের শক্তি নিরূপণ করতে চাইছ। এ তোমার উচিত প্রশ্ন। আমার চুড়ান্ত শক্তি, বহুদূর বিস্তৃত অস্ত্ৰতেজ এবং বাহুবলের অসীম ক্ষমতা, তা তোমাকে বলছি, শ্রবণ করো। যুদ্ধের কতগুলি সাধারণ নিয়ম আছে। সরল লোকের সঙ্গে সরলভাবেই যুদ্ধ করবে, কূটযোদ্ধার সঙ্গে কূটযুদ্ধ করবে, ধর্মশাস্ত্র যোদ্ধাদের এই শিক্ষাই দেয়। আমি আমার নিজের ভাগ কল্পনা করে দিনে দিনে আমার ভাগের পাণ্ডবসৈন্য বধ করব। আমি একদিনের জন্য দশ সহস্র যোদ্ধা এবং এক সহস্র রথীকে এক এক ভাগ করে নিয়ে যুদ্ধ করব। আমি মনে মনে এই ভাগ স্থির করে রেখেছি। এই নিয়ম পালন করে সজ্জিত ও উদ্‌যোগী হয়ে পাণ্ডবদের এই বিশাল সৈন্য ক্ষয় করব। আমার হিসাব অনুযায়ী শতসহস্রঘাতী মহাস্ত্র নিক্ষেপ করে আমি এক মাসের মধ্যে পাণ্ডব সৈন্যদের নিঃশেষে সংহার করতে পারব।”

রাজা দুর্যোধন সেনাপতি ভীষ্মের বক্তব্য শুনে অঙ্গিরা বংশশ্রেষ্ঠ আচার্য দ্রোণকে প্রশ্ন করলেন, “আচার্য আপনি কতকালের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের সমস্ত সৈন্য সংহার করতে পারেন?” দ্রোণ ঈষৎ হাস্য করতে করতে বললেন, “মহারাজ আমি বৃদ্ধ হয়েছি; সুতরাং আমার বাহুবল ও অঙ্গ সঞ্চালন ক্ষমতা কমে গিয়েছে। তবুও আমার ধারণা এই যে, শান্তনুনন্দন ভীষ্ম যেমন এক মাস সময়ে পাণ্ডব সৈন্য সংহার করতে পারেন, তেমনই আমিও অস্ত্রাগ্নি দ্বারা এক মাস সময়ের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের সকল সৈন্য বধ করতে পারব। এই হল আমার চূড়ান্ত ক্ষমতা, আর এই হল আমার চরম বল।” শরদ্বানের পুত্র কৃপাচার্য বললেন, “আমি দু’মাসে পারি।” অশ্বত্থামা বললেন, “আমি দশদিনের মধ্যে পাণ্ডবদের সকল সৈন্য ক্ষয় করতে পারি।” আর মহাস্ত্রবিৎ কর্ণ বললেন, “আমি পাঁচদিনে পারি।” কর্ণের সেই প্রতিজ্ঞা শুনে ভীষ্ম অট্টহাস্য করে বললেন, “কর্ণ তুমি এখনও বাণ-শঙ্খ-ধনুর্ধারী, কৃষ্ণ-সহচারী এবং রথে আরোহণ করে আগমনকারী অর্জুনের সঙ্গে কোনও যুদ্ধে মিলিত হওনি; অতএব তোমার যা ইচ্ছা মনে করতে পারো, চাই কি, যে পর্যন্ত বলেছ, তার থেকে বেশিও কল্পনা করতে পারো।”

গুপ্তচরের মুখ থেকে যুধিষ্ঠির এই সৈন্য-সংহার-কাল আলোচনা শুনতে পেলেন। বাসুদেব কৃষ্ণ ও আপন ভ্রাতাদের নির্জনে নিয়ে গিয়ে যুধিষ্ঠির বললেন, “দুর্যোধনের সৈন্যমধ্যে আমার যেসব গুপ্তচর আছে, তারা প্রভাতে এসে আমাকে জানিয়েছে যে, দুর্যোধন মহাব্রত ভীষ্মের কাছে প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনি কতদিনে এই পাণ্ডবসৈন্য বধ করতে পারেন?’ তাতে ভীষ্ম অতিদুর্মতি দুর্যোধনকে বলেছেন যে, তিনি এক মাসে পাণ্ডব সৈন্য বধ করতে পারেন। দ্রোণও ভীষ্মের মত অনুসারে জানিয়েছেন যে, তিনিও এক মাসে আমার সৈন্য বধ করতে পারেন। কৃপাচার্য বলেছেন যে, তিনি দু’মাসে পারবেন। মহাস্ত্রবিৎ অশ্বত্থামা প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, তিনি দশদিনে পাণ্ডবসৈন্য বধ করতে পারবেন। আর কর্ণও প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, তিনি পাঁচদিনে আমার সম্পূর্ণ সৈন্য ধ্বংস করবেন।”

যুধিষ্ঠির অর্জুনকে প্রশ্ন করলেন, “অর্জুন! আমি তোমার বাক্য শুনতে চাই—তুমি কতদিনে কৌরব সৈন্য নিঃশেষ করতে পারো?” যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মহারাজ এরা সকলেই মহাত্মা, অস্ত্রে সুশিক্ষিত ও বিচিত্র যোদ্ধা। সুতরাং এঁরা কথিত সময়ের মধ্যে আপনার সৈন্য সংহারে সমর্থ, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের কারণ নেই। তবে আপনি উদ্বেগ করবেন না। কারণ আমিও সত্য বলছি যে কৃষ্ণকে নিয়ে একরথে আরোহণ করে আমি একাকীই দেবগণের সঙ্গে স্থাবর ও জঙ্গমাত্মক সমগ্র ত্রিভুবন এবং ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সমস্ত বস্তু নিমেষকালের মধ্যে সংহার করতে পারি। কারণ, কিরাতরূপী মহাদেব দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় আমাকে যে ভয়ংকর মহাস্ত্র দান করেছিলেন, তা আমার কাছে আছে। মহাদেব প্রলয়কালে সমস্ত ভূত সংহার করতে যে অস্ত্র প্রয়োগ করে থাকেন, তা আমার কাছে আছে। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ বা অশ্বত্থামা সে অস্ত্র জানেন না। সুতরাং কর্ণ আর জানবেন কী করে। তবে দিব্য অস্ত্রে যুদ্ধে সাধারণ লোককে বধ করা উচিত নয়। সরলভাবে যুদ্ধ করেই শত্রুদের আমরা জয় করব। কারণ মহারাজ এই পুরুষশ্রেষ্ঠগণ আপনার সহায়। এঁরা সকলেই দিব্যাস্ত্র জানেন এবং আপনার জন্য যুদ্ধ করতে উন্মুখ হয়ে আছেন। এঁরা সকলেই বেদপাঠ করেছেন। যজ্ঞ সমাপ্ত করে স্নান করেছেন এবং কোনও যুদ্ধে পরাজিত হননি। সুতরাং এঁরা যুদ্ধে দেবসৈন্যও সংহার করতে পারেন।

“শিখণ্ডী, যুযুধান, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীমসেন, নকুল, সহদেব, যুধামন্যু, উত্তমৌজা, যুদ্ধে ভীষ্ম ও দ্রোণের মতোই। বিরাট ও দ্রুপদ, মহাবাহু শঙ্খ, মহাবল ঘটোৎকচ, তার পুত্র মহাবল ও মহাপরাক্রমশালী অঞ্জনপৰ্বা এবং মহাবাহু ও যুদ্ধনিপুণ সাত্যকি আপনার সহায়। আর বলবান অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রও আপনার সহায়। তার পর আপনি নিজেই ত্রিভুবন উৎসন্ন করতে সমর্থ। কারণ, ইন্দ্রতুল্য কুরুনন্দন! আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে আপনি ক্রোধান্বিত হয়ে যার দিকে দৃষ্টিপাত করেন, সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।”

*

আর এক দুর্লভ মুহূর্ত মহাভারতের পাঠকের কাছে উপস্থিত হল। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি উভয় পক্ষের বীরদের শক্তি সম্পর্কে রণ-বিশারদদের বিচার। এইবার আমরা দেখতে পেলাম শত্রুসৈন্য-বিনাশ-সামর্থ্য পর্যালোচনা। অস্পষ্ট একটা মানসিক প্রস্তুতিও আমাদের হল—এ যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী হবে। ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপের আপন শক্তি সম্পর্কে যথার্থ বিচার, অশ্বত্থামার উচ্চ আশা এবং কর্ণের বাগাড়ম্বর। অশ্বত্থামা এবং কর্ণের বিস্মৃতি যে, একক বৃহন্নলারূপী অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁদের দুরবস্থা। ভীষ্ম-দ্রোণ ও কৃপের বিচার যথার্থ। আপন সামর্থ্য সম্পর্কে তাঁদের চূড়ান্ত ধারণা ছিল।

অর্জুন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অতিরথ। বিশেষত মহাদেব ও অন্য দেবতাদের আশীর্বাদসহ দিব্যাস্ত্র প্রাপ্তিতে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। আপন পক্ষের বীরদের সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুত্র অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং ভীমসেনের পুত্র ঘটোৎকচের বীরত্ব সম্পর্কে অর্জুন আস্থাশালী। ভক্তি-শ্রদ্ধা-প্রীতি মিশ্রিত অর্জুন কৃষ্ণকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন, তাও ফুটে উঠেছে এই মুহূর্তে। তবু মনে হয়, একটা প্রচ্ছন্ন অহংকারও অর্জুনের আছে। কৃপাচার্যের সর্বাপেক্ষা দু’ মাস, অশ্বত্থামার দশ এবং কর্ণের পাঁচদিনের সময় যোগ করলে মোট হয় পঁচাত্তর দিন। কৌরবপক্ষের প্রধান বীর পাঁচজন। অর্থাৎ গড় হয় পনেরো দিন। মোটামুটি ঠিকই আছে। পনেরোও পরিবর্তে আঠারো দিন।

অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ‘ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ’। যুধিষ্ঠিরকে অর্জুন বিচার করেছেন ধর্মবলের ভিত্তিতে, কেবল বাহুবলের বিচারে নয়। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাতে অধর্ম দগ্ধ হবে, ত্রিভুবনে কারোর পক্ষে সম্ভব নয় যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করা। এই কাল-গণনা করে উভয়পক্ষ যুদ্ধযাত্রা করলেন।

৬২
ভীষ্ম কর্তৃক কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ

[কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রথম দু’দিন অতিক্রান্ত হল। অর্জুনের প্রচণ্ড শরক্ষেপে কৌরব সৈন্যরা বারংবার ছিন্নভিন্ন হল— কোনও রথীই অর্জুনের সামনে দাঁড়াতে পারছেন না। ভীত সন্ত্রস্ত কৌরব সৈন্যরা পালাতে লাগল। ভীষ্ম-দ্রোণ কেউ তাঁদের থামাতে পারলেন না। ভীষ্ম অবহার ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন। সেদিন রাত্রে দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে অভিযোগ জানালেন, “আপনি রণক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতে, আমার সৈন্যেরা রণভঙ্গ দিয়ে পালাচ্ছে, এ আমি উচিত মনে করছি না।” দুর্যোধনের অভিযোগে ক্ষুব্ধ ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করলেন যে, পরদিবসের যুদ্ধে একাকী তিনি পাণ্ডবপক্ষকে নিবারণ করবেন।]

পরদিন প্রভাতকালে, সূর্য সামান্য পশ্চিম দিকে গেলে, আনন্দিত পাণ্ডবগণ পূর্বদিনের জয়ের উল্লাস ঘোষণা করতে করতে এগিয়ে এলে, ভীষ্ম বিশাল সৈন্য ও দুর্যোধন ইত্যাদি ভ্রাতাগণের দ্বারা রক্ষিত হয়ে বেগযুক্ত ঘোটক চালিত রথে আরোহণ করে পাণ্ডবসৈন্যদের দিকে যাত্রা করলেন। সঞ্জয় অত্যন্ত স্পষ্ট গলায় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন যে, তাঁরই জন্য এই ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। তখন ধনুকের টংকার ও হস্তাবাপের উপর ধনুকের গুণের আঘাত হতে থাকলে, পর্বত বিদীর্ণ হবার গুরুতর শব্দ হতে লাগল (হস্তাবাপ—ধনুর গুণের আঘাত নিবারণের জন্য হস্তধৃত চর্ম আবরণ)।

“থাক, আছি, একে আঘাত করো, স্থির থাকো, স্থির থাকলাম, প্রহার করো” —এই জাতীয় শব্দে চারপাশ পূর্ণ হয়ে উঠল। স্বর্ণময় বর্ম, মুকুট ও ধ্বজের উপর শরবৃষ্টি শুরু হলে পর্বতের উপর শিলাবৃষ্টির শব্দ হতে লাগল। শত সহস্র মাথা, অলংকৃত বাহু ভূতলে পতিত হয়ে স্পন্দিত হতে লাগল। মাথা নেই, কিন্তু ধনুর্বাণ হাতে কিছুকাল সৈন্যদের দেহ ধনুর্বাণ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। হস্তী, অশ্ব, পদাতিক সৈন্যের রক্ত মিশ্রিত একটি রক্ত-নদী প্রবাহিত হতে লাগল। হস্তীর অঙ্গ সেই নদীর প্রস্তর ছিল, মাংস ও ঘনীভূত রক্ত ছিল তার কর্দম। পরলোকরূপ সমুদ্রের দিকে তাঁর যাত্রাপথ ছিল, দু’পার্শ্বে শকুনি ও শৃগাল আনন্দে চিৎকার করছিল।

তখন অশ্রুতপূর্ব এক ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হল। যুদ্ধে নিপাতিত হস্তী, যোদ্ধা ও রথে পরিপূর্ণ সে রণক্ষেত্রে যাতায়াতের পথ ছিল না। বর্মে ও উষ্ণীষে সে সমরক্ষেত্র শরৎকালীন নক্ষত্রমণ্ডলীতে পরিপূর্ণ আকাশের মতো লাগছিল। চারপাশে শোনা যাচ্ছিল যন্ত্রণার্ত কাতরোক্তি। “পিতা! আমাকে ফেলে যাবেন না”, “বন্ধু! একটু দাঁড়াও” মাতুল, ভ্রাতা, বন্ধু, বয়স্য, সখা ও ভৃত্যদের নাম ধরে পতিত সৈন্যরা আর্তনাদ করছিল। “ক্ষত্রিয়, তুমি কোথায় পালাবে? রণক্ষেত্রে ফিরে এসো, এই তোমার উপযুক্ত স্থান, যুদ্ধে ভীত হোয়ো না।”

এই সময়ে ভীষ্ম ধনুখানাকে মণ্ডলাকার করে বিষসর্পের ন্যায় ভয়ংকর বাণ চতুর্দিকে নিক্ষেপ করতে লাগলেন। নাম উল্লেখ করে করে তিনি এক একজন পাণ্ডব-প্রধানকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। সকলে দেখলেন, অত্যন্ত লঘুহস্ত ভীষ্ম রথের উপর ঘূর্ণিত অগ্নিযুক্ত কাঠের মতো চতুর্দিকে নৃত্য করছেন। ভীষ্মকে পূর্বের মুখে অস্ত্রাঘাত করতে দেখে, সৈন্যরা দেখল তিনি পশ্চিম মুখে অস্ত্ৰক্ষেপ করছেন। এক ভীষ্মকে তখন শত সহস্র ভীষ্ম বলে সৈন্যদের বোধ হতে লাগল। ভীষ্মকে উত্তর দিকে যেতে দেখে, সৈন্যরা দেখল তিনি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছেন। ভীষ্ম তখন অমানুষরূপে যুদ্ধে বিচরণ করতে থেকে বিপক্ষ বাহিনীকে আকুল করে তুললেন। পতঙ্গ যেমন দৈবপ্রেরিত হয়ে অগ্নির দিকে ছুটে যায়, শত শত পাণ্ডবরাজাও তেমনই দৈবপ্রেরিত হয়ে আপন আপন বিনাশের জন্য ভীষ্মের অভিমুখে যাত্রা করতে লাগলেন। কিন্তু কেউ আর ফিরলেন না। যুদ্ধে ভীষ্মের কোনও বাণ কোনও দিকে ব্যর্থ হয়নি। তাঁর বাণ ছিল অসংখ্য এবং তিনি অত্যন্ত দ্রুত বাণক্ষেপ করছিলেন। কঙ্ক পত্ৰযুক্ত একটি বাণে এক-একটি হস্তী বধ করতে আরম্ভ করলেন। সুনিক্ষিপ্ত নারাচ দ্বারা একই সঙ্গে দুই তিনজন গজারোহীও বধ করতে থাকলেন, যে যে নরশ্রেষ্ঠ ভীষ্মের দিকে এগোলেন, তাকে পরমুহূর্তে ভূতলশায়ী দেখা যেতে লাগল। এইভাবে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরের সমস্ত সৈন্য সহস্রভাগে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন।

ভীষ্মের শরবাণে পীড়িত পাণ্ডবমহাসেনা অর্জুন ও কৃষ্ণের সমক্ষেই কম্পিত হতে লাগল। মহারথগণ পলায়ন করতে লাগলেন। অর্জুন চেষ্টা করেও তাঁদের বারণ করতে পারলেন না। ইন্দ্রের তুল্য শক্তিশালী ভীষ্মের বাণে বিশেষ পীড়িত পাণ্ডবসেনা বিশ্লিষ্ট হয়ে গেল। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা পথে পালাতে লাগলেন। ভীষ্মের বাণে মানুষ, হস্তী ও অশ্ব সম্যক বিদ্ধ হলে, রথের ধ্বজ ও কূবর পড়ে গেলে পাণ্ডবসৈন্যগণ কর্তব্যবিমুখ হয়ে হাহাকার করতে লাগল। যুদ্ধে দৈবের প্রভাবে ভ্রমে পতিত হয়ে পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে এবং সখা প্রিয়সখাকে বধ করতে লাগল। পাণ্ডবসৈন্যরা গো-সমূহের মতো কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আর্তনাদ করছিল এবং রথীসমূহেরাও কর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলেন।

এই সময়ে কৃষ্ণ পাণ্ডবসৈন্যকে বিচ্ছিন্ন দেখে উত্তম রথখানি থামিয়ে পৃথানন্দন অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন তুমি যে সময়ের অপেক্ষা করে এসেছ, সেই সময় উপস্থিত হয়েছে; অতএব নরশ্রেষ্ঠ! তুমি যদি পূর্বের মতো মোহে মুগ্ধ না হয়ে থাকে, তবে ভীষ্মকে প্রহার করো। বীর, তুমি পূর্বে রাজাদের জানিয়েছিলে—যারা আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসবে, আমি সে সমস্ত সৈন্য ধ্বংস করব। আজ সেই বাক্য সত্য করো। অর্জুন দেখো তোমার সৈন্য নানা স্থান থেকে বিভক্ত হয়ে পলায়ন করছে। পাণ্ডবসেনার রাজারাও সিংহ দেখে ক্ষুদ্র মৃগেরা যেমন পলায়ন করে, সেইরূপ প্রকটিত বদন যমের মতো ভীষ্মকে দেখে রাজারা পলায়ন করছেন।” কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন তাঁকে বললেন, “যেখানে ভীষ্ম রয়েছেন, সেই দিকে অশ্বগুলিকে চালিত করো, আজ তাঁর সৈন্যসমুদ্রকে আলোড়ন করে দুর্ধর্ষ কুরুপিতামহকে নিপাতিত করব।”

তখন কৃষ্ণ তাঁর সূর্যের মতো দুর্ধর্ষ রথের রজতশুভ্র অশ্বকে, যেখানে ভীষ্মের রথ ছিল, সেইদিকে চালিয়ে দিলেন। অর্জুনকে ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে উদ্যত দেখে যুধিষ্ঠিরের সমস্ত সেনা আবার রণক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন। তখন কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম মুহুর্মুহু সিংহনাদ করে বাণবৃষ্টি দ্বারা অর্জুনের রথখানিকে সম্পূর্ণ আবৃত করে ফেললেন। সেই বিশাল শরবর্ষণের পরে অর্জুনের রথ ও সারথিকে আর দেখা গেল না। কিন্তু তখনও বলবান কৃষ্ণ ধৈর্য অবলম্বনপূর্বক ভীষ্মের বাণে বিদীর্ণ দেহ অশ্বগুলিকে চালাতে লাগলেন। তখন অর্জুন জলদগম্ভীরনাদী স্বর্গীয় গাণ্ডিবধনু ধারণ করে তিনটি বাণদ্বারা ভীষ্মের ধনুখানি ছেদন করে ফেললেন। ভীষ্ম পুনরায় অন্য ধনু নিয়ে নিমেষমধ্যে গুণারোপণ করলেন। দুই হাতে সেই জলদগম্ভীরনাদী সেই ধনু আকর্ষণ করে ভীষ্ম পুনরায় প্রস্তুত হলেন। ক্রুদ্ধ অর্জুন ভীষ্মের সেই ধনুকেও ছেদন করলেন। তখন ভীষ্ম অর্জুনের লঘুহস্ততার প্রশংসা করে বললেন, “পৃথানন্দন! সাধু, মহাবাহু পাণ্ডুনন্দন! সাধু! ধনঞ্জয়! এই গুরুতর কার্য তোমাতেই সম্ভব। পুত্র আমি তোমার উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো।”

এইভাবে অর্জুনের প্রশংসা করে মহাবীর ভীষ্ম অন্য বিশাল ধনু ধারণ করে অর্জুনের রথের উপর বহুতর বাণ নিক্ষেপ করলেন। এই সময়ে কৃষ্ণ অশ্ব পরিচালনায় বিশেষ দক্ষতা দেখালেন। তিনি ভীষ্মের বাণগুলিকে ব্যর্থ করে দিয়ে মণ্ডলাকারে রথ চালাতে লাগলেন। তথাপি ভীষ্ম সুতীক্ষ্ণ বাণসমূহ দ্বারা কৃষ্ণ ও অর্জুনকে সমস্ত অঙ্গে অত্যন্ত বিদ্ধ করলেন। তখন ক্রুদ্ধ দুই মহাবৃষের শৃঙ্গাঘাত পরস্পর যেমন রক্তাক্ত হয়ে শোভা পায়, তেমনই কৃষ্ণার্জুন ভীষ্মের অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত হয়ে শোভা পেতে লাগলেন। তখন ক্রুদ্ধ ভীষ্ম বহু সংখ্যক বাণ দ্বারা কৃষ্ণ ও অর্জুনের সমস্ত দিক আবৃত করলেন। তারপর বিকট হাস্য করতে থেকে তীক্ষ্ণ বাণের পীড়নে কৃষ্ণকেও বিচলিত করে তুললেন।

ভীষ্ম প্রবল পরাক্রম প্রকাশ করছেন, অথচ অর্জুন মনোযোগ না দিয়ে অল্প অল্প যুদ্ধ করছেন। তারপর ভীষ্ম উভয় সৈন্যমধ্যে এসে যুদ্ধ করছেন, সূর্যের মতো পাণ্ডবসৈন্যকে সন্তপ্ত করে তুলছেন, পাণ্ডবগণের প্রধান প্রধান সৈন্য বধ করছেন এবং যুধিষ্ঠিরের সৈন্যদের মধ্যে যেন প্রলয় ঘটাচ্ছেন—এই সকল ঘটনা দেখে মহাবাহু, অলৌকিক শক্তিশালী ও বিপক্ষ বীরহন্তা ভগবান কৃষ্ণ চিন্তা করলেন, “যুধিষ্ঠিরের বল নষ্ট হল। কারণ, ভীষ্ম যুদ্ধে একদিনেই দেবগণ ও দানবগণকে সংহার করতে পারেন, তাতে সৈন্য ও অনুচরদের যে সংহার করে পাণ্ডবপক্ষকে পরাজিত করবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যুধিষ্ঠিরের বিশাল সৈন্য পলায়ন করছে এবং কৌরবেরা সোমকদের পলায়ন করতে দেখে আনন্দ করছে এবং দ্রুত যুদ্ধ শেষ করবার জন্য চেষ্টা করছে। এদিকে আমি যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত আছি; সুতরাং আমি আজ পাণ্ডবদের জন্য ভীষ্মকে বধ করব এবং মহাত্মা পাণ্ডবগণের ভার অপনীত করব। কারণ, অর্জুন ভীষ্মের তীক্ষ্ণবাণে আহত হলেও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশত যুদ্ধের বিষয়ে তাঁর কর্তব্য বুঝতে পারছেন না।”

কৃষ্ণ এইরকম চিন্তা করছিলেন, এই অবস্থাতেও ভীষ্ম পুনরায় অর্জুনের রথের উপর বাণক্ষেপ করতে লাগলেন। ভীষ্মের বাণে চতুর্দিক আবৃত হল, এমনকী সূর্যকেও আর দেখা গেল না। তুমুল বায়ু ও ধোঁয়া বইতে থাকল এবং সকল দিক কাঁপতে লাগল। তখন দ্রোণ, বিকর্ণ, জয়দ্রথ, ভূরিশ্রবা, কৃতবর্মা, কৃপ, অম্বষ্ঠদেশাধিপতি শ্রুতায়ু বিন্দ, অনুবিন্দ ও সুদক্ষিণ এবং পূর্বদেশীয়, সৌবীরদেশীয়, বসাভিদেশীয়, ক্ষুদ্রকদেশীয় ও মালবদেশীয় যোদ্ধারা সকলে ভীষ্মের আদেশক্রমে অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন।

তখন দূর থেকে সাত্যকি দেখলেন—কুরুপক্ষের শত শত ও সহস্র সহস্র অশ্বারোহী, পদাতি, রথী ও গজারোহী এসে অর্জুনকে পরিবেষ্টন করছে। সাত্যকি সত্বর সেইদিকে অগ্রসর হলেন। পূর্বকালে বিষ্ণু যেমন বৃত্রাসুর যুদ্ধে ইন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন সেইরকমই মহাধনুর্ধর ও শিনি বংশশ্রেষ্ঠ সাত্যকি দ্রুত সেই সৈন্যগণের মধ্যে প্রবেশ করলেন। পলায়মান যুধিষ্ঠিরের সৈন্য, অশ্বারোহী, গজারোহী ও রথারোহীদের সাত্যকি বললেন, “ক্ষত্রিয়গণ আপনারা কোথায় যাবেন? প্রাচীন সজ্জনেরা এই পলায়নকে ধর্ম বলেননি। নিজেদের প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করবেন না, স্বকীয় বীরধর্মই পালন করুন।”

পাণ্ডবপক্ষের প্রধান রাজারা সকল দিকে পলায়ন করছে, অথচ অর্জুন কোমলভাবে যুদ্ধ করছেন। ভীষ্ম উৎসাহে ক্রমাগত বর্ধিত হচ্ছেন, সমগ্র কৌরবসৈন্য অর্জুনের দিকে এগিয়ে আসছেন—এই সমস্ত দেখে যদুপতি কৃষ্ণ সহ্য করতে না পেরে সাত্যকির প্রশংসা করে বললেন, “সাত্যকি যারা যাচ্ছে, তারা যাক। যারা আছে, তারাও যাক। আমিই আজ যুদ্ধে অনুচরবর্গের সঙ্গে ভীষ্ম ও দ্রোণকে রথ থেকে নিপাতিত করছি। সাত্যকি আজ কৌরব পক্ষের কোনও ব্যক্তিই যুদ্ধে ক্রুদ্ধ পার্থসারথির হাত থেকে নিবৃত্তি পাবে না। আমিই ভীষণ চক্রধারণ করে ভীষ্মের প্রাণ হরণ করব। অনুচরদের সঙ্গে ভীষ্ম ও দ্রোণকে বধ করে আজ আমি যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেবকে আনন্দিত করব। আজ আমি ধৃতরাষ্ট্রের সমস্ত পুত্রকে এবং যে সকল প্রধান রাজা রয়েছেন, তাঁদের সংহার করে আনন্দিত হয়ে রাজা যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে সংস্থাপিত করব।”

এইসব কথা বলে মহাপ্রভাবশালী কৃষ্ণ সুদর্শন চক্রকে স্মরণ করলেন এবং স্মরণ করামাত্রই সেই সুদর্শনচক্র এসে নিজেই কৃষ্ণের হস্তাগ্রে আরোহণ করল। পূর্বকালে জলশায়ী নারায়ণের নাভিমূল থেকে উৎপন্ন এবং নূতন সূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণ আদিপর্বের মতো শোভিত সেইরকম কৃষ্ণের বহুনালধৃত পদ্মতুল্য সেই সুদর্শন চক্র যুদ্ধে শোভা পেতে লাগল। তারপর বসুদেবনন্দন মহাত্মা কৃষ্ণ দক্ষিণ হস্ত দ্বারা সুন্দর নাভিযুক্ত, সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল, সহস্র বজ্রের তুল্য প্রভাবশালী ও ক্ষুরধার সেই চক্রটাকে আঘূর্ণিত করে, অশ্বগুলিকে ছেড়ে দিয়ে, রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে, চরণবিন্যাসে ভূতল কম্পিত করে, সিংহ যেমন মদমত্ত দর্পিত মহাহস্তীকে বধ করবার জন্য বেগে ধাবিত হয়, সেইরূপ বেগে ভীষ্মের দিকে ধাবিত হলেন। বিপক্ষ বিনাশকারী ও লম্বিত পীত বসনধারী কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বিপক্ষ সৈন্যস্থিত ভীষ্মের দিকে বেগে যেতে থেকে আকাশে বিদ্যুৎ পরিবেষ্টিত নূতন মেঘের মতন শোভা পেতে লাগলেন। কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে চক্রধারণ করে উচ্চ স্বরে বীর নাদ করতে করতে আসছেন দেখে সেই স্থানের লোকেরা কৌরবের বিনাশ চিন্তা করে তীব্র আর্তনাদ করতে লাগল।

জগদ্‌গুরু কৃষ্ণ চক্র ধারণ করে সমগ্র জগৎ সংহার করবেন বলেই যেন ধাবিত হয়ে, বনদহনকারী অগ্নির মতো প্রকাশ পেতে লাগলেন। কৃষ্ণ চক্রধারণ করে বেগে আগমন করছেন দেখে ভীষ্ম তখন দুই বাহুতে ধৈর্যসহকারে গাণ্ডিবের মতো আপন ধনুখানি সংকুচিত করে ফেললেন এবং স্থিরচিত্তে সেই সমরাঙ্গনে থেকেই অসীম শক্তিশালী কৃষ্ণকে বললেন, “দেবেশ্বর! জগতের আশ্রয়! আসুন আসুন, মাধব! চক্রপাণি। আপনাকে প্রণাম করি।

ত্বয়া হতস্যাপি মমাদ্য কৃষ্ণ! শ্রেয়ঃ পরশ্মিন্নিহ চৈব লোকে।

সম্ভাবিতোহস্ম্যন্ধকবৃষ্ণিনাথ! লৌকেস্ত্রিভির্বীর! তবাভিযানাৎ॥ ভীষ্ম : ৫৯ : ৯৭॥

জগদীশ্বর! সর্বশরণ্য! আপনি যুদ্ধে বলপূর্বক আমাকে রথ থেকে নিপাতিত করুন। কৃষ্ণ! আপনি আজ আমাকে বধ করলেও ইহলোকে এবং পরলোকে আমার মঙ্গল হবে। অন্ধকনাথ! বৃষ্ণিপতি! বীর! আপনি আমার প্রতি ধাবিত হয়েছেন বলেই আমি ত্রিভুবনের লোকের কাছে সম্মানিত হয়েছি।”

তখন দীর্ঘ ও স্থূলবাহু অর্জুনও রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে সত্বর কৃষ্ণের অনুসরণ করে তাঁর স্থূল ও সুন্দর দীর্ঘ বাহুযুগল ধারণ করলেন। অর্জুন ধারণ করলেও, মহাঝড় যেমন বৃক্ষকে নিয়ে বেগে গমন করে, সেইরকম আদিদেব, আত্মযোগী ও অত্যন্ত ক্রুদ্ধ কৃষ্ণ অর্জুনকে নিয়েই বেগে কিছুদূর গমন করলেন। কৃষ্ণ বেগে ভীষ্মের দিকে যাচ্ছিলেন, সেই অবস্থাতে পৃথানন্দন অর্জুন বলপূর্বক তাঁর চরণযুগল ধারণ করে দশম পাদক্ষেপের সময়ে তাঁকে থামাতে পারলেন। কৃষ্ণ দাঁড়ালে, সুবর্ণময়-বিচিত্র মাল্যধারী অর্জুন সন্তুষ্ট হয়ে প্রণাম করে কৃষ্ণকে বললেন, “কেশব তুমিই পাণ্ডবগণের উপায়; সুতরাং তুমি ক্রোধের উপসংহার করো। কৃষ্ণ আমি পুত্রগণ ও ভ্রাতৃগণের নামে শপথ করছি—আমি যে বিষয়ে তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সে কার্য আর ত্যাগ করব না এবং উপেন্দ্র, তোমার নিয়োগ অনুসারে কৌরবগণকে বিনাশ করব।”

শত্ৰুহন্তা কৃষ্ণ অর্জুনের সেই প্রতিজ্ঞা ও শপথ শুনে সন্তুষ্ট হয়ে চক্র নিয়েই পুনরায় রথে উঠলেন। বামহস্তে অশ্বরজ্জু ও দক্ষিণহস্তে শঙ্খ ধারণ করে সেই পাঞ্চজন্য শঙ্খের রবে কৃষ্ণ সমস্ত দিক ও আকাশ নিনাদিত করলেন। সেই সময়ে তাঁর কণ্ঠের হার, বাহুর কেয়ূর ও কর্ণের কুণ্ডল দুলতে লাগল, তাঁর নয়নের লোমগুলি ধূলিব্যাপ্ত ছিল, মুখের মধ্যে নির্মল দন্তগুলি দেখা যাচ্ছিল, হাতে শঙ্খ ছিল। সেই কৃষ্ণকে দেখে কুরুপক্ষের যোদ্ধারা কোলাহল করে উঠল। সমস্ত কৌরব সৈন্যমধ্যে মৃদঙ্গ, ভেরি, পটহ, রথচক্র ও দুন্দুভির শব্দ ও ভীষণ সিংহনাদ শোনা যেতে লাগল।

ক্ৰমে মেঘ গর্জনের মতো গম্ভীর অর্জুনের গাণ্ডিবধনুও সমস্ত দিকে ও আকাশে ব্যাপ্ত হতে লাগল এবং তাঁর ধনু থেকে নির্গত সরল ও নির্মল বাণসকল সমস্তদিকে ধাবিত হল। তখন দুর্যোধন, ভীষ্ম ও ভূরিশ্রবার সঙ্গে মিলিত হয়ে তৃণরাশিদহনেচ্ছু অগ্নির মতো অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। তারপর ভূরিশ্রবা সাতটা স্বর্ণপুঙ্খ বাণ, দুর্যোধন ভয়ংকর বেগশালী একটা তোমর, শল্য একটা গদা ও ভীষ্ম একটি শক্তি অর্জনের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সাত বাণে ভূরিশ্রবার সাত বাণকে, নিশিত ক্ষুরাস্ত্রে দুর্যোধন-নিক্ষিপ্ত তোমরকে অর্জুন ছেদন করলেন। ভীষ্ম-নিক্ষিপ্ত শক্তি ও শল্য-নিক্ষিপ্ত গদাকে অর্জুন দুই বাণে ছেদন করলেন। তখন অর্জুন অজ্ঞেয়প্রভাব, অতিভয়ংকর ও অদ্ভুতশক্তি মাহেন্দ্র অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। সেই অগ্নির ন্যায় পিঙ্গলবর্ণ উজ্জ্বল অস্ত্র একই সঙ্গে সমস্ত বিপক্ষকে নিবারণ করল। সেই ঐন্দ্র অস্ত্র থেকে শত সহস্ৰশর নির্গত হয়ে বিপক্ষের সমস্ত রাজাকে বর্ম ও দেহে গুরুতর ভেদ করল। রাজারা যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হলেন। অর্জুনের বাণসমূহে মেদ, বসা ও রক্ত-পরিপূর্ণ নদী সৃষ্টি হল। আপন সৈন্যদের অবস্থা দেখে ভীষ্ম সেদিন যুদ্ধে অবহার ঘোষণা করলেন। অর্জুন সেদিন যুদ্ধে দশ সহস্র রথী, সাত শত হস্তী সংহার করে পূর্বদেশীয় সৌবীর, ক্ষুদ্র ও মালবদেশীয় সকল সৈন্যকে নিপাতিত করেছিলেন।

*

মহাভারতের আর একটি দুর্লভ মুহূর্ত আমাদের চোখের সামনে উদ্‌ঘাটিত হল। ভীষ্ম যে কত বড় বীর ছিলেন, তা আমরা দেখতে পেলাম। দুর্যোধনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভীষ্ম একাই সমস্ত পাণ্ডব সৈন্যকে নিবারণ করলেন, ছত্রভঙ্গ করে দিলেন।

আমরা আরও দেখলাম, কৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষের সঙ্গে কতখানি একাত্ম। অর্জুন কিছুতেই ভীষ্মের সঙ্গে পূর্ণশক্তিতে যুদ্ধ করতে চাইছেন না—পাণ্ডবসৈন্যেরা ভীষ্মের বাণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে দেখে সুদর্শন চক্র হাতে কৃষ্ণ রথ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নামলেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। স্বয়ং নারায়ণ ভক্তকে বধ করতে সুদর্শন চক্র হাতে ছুটে চলেছেন। সমস্ত কুরুক্ষেত্র স্তম্ভিত। ভীষ্ম তো এই চেয়েছিলেন। তিনি শুনেছিলেন, কৃষ্ণ যুদ্ধে অস্ত্রগ্রহণ করবেন না। আপন বীরত্ব সম্পর্কে ভীষ্মের পরিচ্ছন্ন ধারণা ছিল। তিনি জানতেন তিনি গঙ্গাপুত্র, অষ্টম বসু ভীষ্ম। মনে মনে ভীষ্মও প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিলেন, তিনিও কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাবেন। তাঁকে অস্ত্রধারণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করবেন। ভীষ্ম তা করতে পেরেছিলেন, কৃষ্ণ ভীষ্ম বধের জন্য অস্ত্রগ্রহণ করেছিলেন। হয়তো বা ভক্তবাঞ্ছা কৃষ্ণ ভক্তের মনোরথ পূর্ণ করতেই অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন।

কিন্তু অস্ত্রপ্রয়োগ তাঁকে করতে দেননি তাঁর সখা, বন্ধু, ভক্ত অর্জুন। কারণ কৃষ্ণ অস্ত্র প্রয়োগ করলে চিরকাল অর্জুনের নামে কলঙ্ক লেগে থাকত। অর্জুন কোনও অবস্থাতেই কৃষ্ণ তাঁর প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করবেন, এ হতে দিতে পারেন না। কৃষ্ণের পা জড়িয়ে ধরে তিনি কৃষ্ণের গতিভঙ্গ করলেন।

ভীষ্ম জানতেন কৃষ্ণ ঈশ্বর, স্বয়ং নারায়ণ। রাজসূয় যজ্ঞে তাঁরই পরামর্শে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ পুরুষের অর্ঘ্য দিয়েছিলেন। সেই কৃষ্ণ অর্জুনের সারথ্য গ্রহণ করেছেন জেনেও ভীষ্ম পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অস্ত্রগ্রহণ করতে পরাঙ্মুখ হননি। যদিও যুদ্ধের পরিণাম সম্পর্কে তাঁর কোনও সন্দেহই ছিল না। বারংবার তিনি বলেছিলেন—জয়োস্তু পাণ্ডুপুত্ৰাণাং যেষাং পক্ষে জনার্দনঃ। কিন্তু তিনি খাঁটি ক্ষত্রিয় ছিলেন। দুর্যোধনের অন্নের ঋণ, তিনি জীবন দিয়ে শোধ করেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সকলের শ্রদ্ধা পেয়েছেন, ভগবান কৃষ্ণেরও।

এর পরের অংশে অর্জুনের ভূমিকা। তাঁর অন্যমনস্কতার জন্য কৃষ্ণকে অস্ত্রগ্রহণ করতে হয়েছে, এই আত্মগ্লানিতে অর্জুন সেদিন যে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন, ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা সে যুদ্ধের সম্মুখে নিতান্ত অসহায় বোধ করলেন। ভীষ্ম বাধ্য হয়ে অবহার ঘোষণা করলেন।

৬৩
ইরাবানের মৃত্যু

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অষ্টম দিন প্রভাতে বিপক্ষবীরহন্তা যদুবংশীয় হৃদিকনন্দন কৃতবর্মা সমরাঙ্গনে পাণ্ডবসৈন্যদের দিকে বেগে গমন করতে লাগলেন। তখন কম্বোজ, নদী, আরট্ট, মহী ও সিন্ধুদেশজাত সর্বপ্রকার উত্তম অশ্ব ও শুভ্রবর্ণ বনায়ুদেশজাত ও পর্বতবাসী অশ্বসমূহে সকল দিক বেষ্টিত করে বলবান ও শত্রুসন্তাপকারী অর্জুননন্দন ইরাবান অত্যন্ত আনন্দিত চিত্তে কৌরব সৈন্যদের দিকে ধাবিত হলেন। তখন ভিত্তিরি ও যবনদেশে জন্মে যে সকল অশ্ব বায়ুর মতো বেগবান হয়ে থাকে সেই সকল অশ্বও স্বর্ণভূষণে ভূষিত, বর্মাবৃত ও অন্যান্য যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ইরাবানের সঙ্গে যেতে লাগল।

এঁর নাম ‘ইরাবান’। ইনি অর্জুনের পুত্র, বলবান ও বীরশোভায় শোভিত। ইনি নাগরাজ ঐরাবতের তনয়ার গর্ভে অর্জুন কর্তৃক উৎপন্ন হয়েছিলেন (অন্য মতে, ইনি ঐরাবত-বংশীয় কৌরব্য নাগের কন্যা উলূপীর গর্ভজাত)। গরুড় এই তনয়ার পতিকে বধ করলে মহাত্মা ঐরাবত ক্ষুদ্রা, শোকার্তচিত্তা ও নিঃসন্তানা এই তনয়াটিকে অর্জুনের নিকট সমর্পণ করেছিলেন। অর্জুনও আপন কর্তব্য সম্পাদনের জন্য কামাকুলা সেই ঐরাবত তনয়াকে গ্রহণ করেছিলেন। এইভাবে ইরাবান পরপত্নীর গর্ভে অর্জুন কর্তৃক উৎপন্ন হয়েছিলেন।

সেই বালক নাগলোকেই জননী কর্তৃক পরিরক্ষিত থেকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু তার পিতৃব্য দুরাত্মা অশ্বসেন অর্জুনের প্রতি বিদ্বেষবশত তাকে পরিত্যাগ করে। তারপর রূপবান, গুণবান, বলবান ও যথার্থ বিক্রমশালী ইরাবান—পিতা অর্জুন দেবাস্ত্ৰশিক্ষার জন্য স্বর্গে গমন করেছেন—এই শুনে দ্রুত স্বর্গলোক গমন করেন। এবং তিনি মহাত্মা অর্জুনের কাছে আত্ম পরিচয় দিয়ে বলেন, “ইরাবানাস্মি ভদ্রং তে পুত্ৰশ্চাহং তব প্রভো!”—“প্রভু! আমি আপনার পুত্র এবং আমার নাম—ইরাবান; আপনার মঙ্গল হোক।”

যেভাবে আপন মাতার সঙ্গে অর্জুনের মিলন হয়েছিল, সে সমস্ত ঘটনাও ইরাবান অর্জুনের কাছে নিবেদন করলেন। তখন সে সমস্ত বৃত্তান্ত অর্জুনের স্মৃতিপথে উদিত হয়। তখন অর্জুন নিজের তুল্য গুণবান সেই পুত্রটিকে আলিঙ্গন করে আনন্দিতচিত্তে তাকে দেবরাজ ইন্দ্রের গৃহে নিয়ে যান। ইরাবান প্রশ্ন করেন, “পিতা আমাকে কী করতে হবে?” তখন অর্জুন সেই দেবলোকে বসেই আপন কার্যবিষয়ে প্রীতিপূর্বক মহাবাহু ইরাবানকে আদেশ করলেন, “প্রভাবসম্পন্ন পুত্র! তুমি যুদ্ধের সময়ে আমাদের সাহায্য কোরো।” “অবশ্যই করব” এই কথা বলে তখন ইরাবান চলে গিয়েছিলেন, এবং যুদ্ধের সময় এসেছেন।

যে সকল অশ্ব ইচ্ছানুসারে বর্ণ ও বেগ ধারণ করতে পারে, সেই সকল অশ্বে পরিবেষ্টিত হয়ে ইরাবান শোভা পেতে লাগলেন। হংসগণ যেমন মহাসমুদ্রে উৎপতিত হয়, সেইরকম স্বর্ণশেখরধারী, নানাবর্ণযুক্ত ও মনের ন্যায় বেগবান সেই সকল অশ্ব বেগে সমরাঙ্গনে উৎপতিত হল। তারপরে সেই অশ্বসকল মনের মতো বেগশালী বিপক্ষের অশ্বসমূহের কাছে উপস্থিত হয়ে ক্রোড়দ্বারা ক্রোড়ে ও নাসিকাদ্বারা নাসিকায় আঘাত করতে থেকে বেগে আহত হয়ে তৎক্ষণাৎ ভূতলে পতিত হতে থাকল।

পর্বতের উপরে গরুড় পতিত হলে যেরকম দারুণ শব্দ শোনা যায় অশ্বসমূহ পতিত হতে থাকলে সেইরকম দারুণ শব্দ শোনা যেতে লাগল। অশ্বারোহীরাও পরস্পর সম্মিলিত হয়ে ভয়ংকরভাবে পরস্পরকে বধ করতে লাগল। সেই তুমুল যুদ্ধে উভয়পক্ষের অশ্বারোহী সৈন্যরা নিহত হয়ে ভূমিতে আশ্রয় পেল। কারণ, তাঁদের বাণসকল নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, অশ্বগুলিও নিহত হয়েছিল এবং বীরেরাও পরিশ্রান্ত ও পরস্পরের অস্ত্রাঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছিলেন। তারপর উভয়পক্ষেরই অশ্বারোহী সৈন্য যুদ্ধে ক্ষয় পেয়ে কিছু অবশিষ্ট থাকলে শকুনির বীর ভ্রাতারা সমরাঙ্গনে প্রবেশ করলেন।

গজ, গবাক্ষ, বৃষক, চর্মবান, আর্জব ও শুষ্ক—শকুনির বলবান এই ছয় ভ্রাতা বায়ুবেগের দৃঢ়স্পর্শ, বায়ুর তুল্য বেগশালী, তরুণ ও বলবান উত্তম উত্তম রথে আরোহণ করে বিশাল কৌরব সৈন্যমধ্য থেকে বেরিয়ে এলেন। তখন শকুনি তাঁদের বারণ করলেন, স্বপক্ষীয় যোদ্ধারাও তাঁদের নিষেধ করলেন; তবুও যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত, যুদ্ধনিপুণ, রৌদ্রমূর্তি, মহাবল ও যুদ্ধ-দুর্ধর্ষ সেই গান্ধারদেশীয় বীরেরা জয় বা স্বর্গলাভের জন্য আনন্দিতচিত্তে বিশাল সৈন্য নিয়ে পরমদুর্জয় পাণ্ডবসৈন্য ভেদ করে তার মধ্যে প্রবেশ করলেন।

তাঁদের প্রবিষ্ট দেখে বলবান ইরাবানও বিচিত্র অশ্বারোহী আপন যোদ্ধাদের বললেন, “যাতে অনুচর ও বাহনদের সঙ্গে দুর্যোধনের এই সমস্ত যোদ্ধাকেই যুদ্ধে বধ করা যায়, আপনারা সেইরকম কৌশল অবলম্বন করুন।” “তাই হবে” এই বলে ইরাবানের সেই যোদ্ধারা সকলে, প্রচণ্ড যুদ্ধের পর দুর্জয় সেই গান্ধারসৈন্যগণকে বধ করল। বিপক্ষ সৈন্যদের হাতে গান্ধার সৈন্যসমূহ যুদ্ধে নিপাতিত দেখে, সুবলপুত্রেরা তা সহ্য করতে না পেরে সমরাঙ্গনে সকল দিক দিয়ে ইরাবানকে ঘিরে ধরলেন। সেই বীরেরা সুতীক্ষ্ণ প্রাস দ্বারা তাড়ন, পরস্পর প্রেরণ ও পাণ্ডবসৈন্যদের অত্যন্ত আকুল করতে থেকে তখন ধাবিত হলেন।

তারপর অঙ্কুশবিদ্ধ হস্তীর মতো ইরাবান, মহাশক্তিশালী সুবলপুত্রগণের তীক্ষ্ণ প্রাসের আঘাতে বিদীর্ণ ও রক্তাক্তদেহ হলেন। তখন একা ইরাবান বক্ষে, পৃষ্ঠে এবং দুই পার্শ্বে বহু ব্যক্তি কর্তৃক অত্যন্ত আহত হয়েও ধৈর্যবশত বিচলিত হলেন না। তারপর শত্রুনগরবিজয়ী ইরাবান অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তীক্ষ্ণ বাণসমূহ দ্বারা যুদ্ধে বিদ্ধ করে সকল সুবলপুত্রকেই মূৰ্ছিত করে ফেললেন। সেই অবসরে শত্রুদমনকারী ইরাবান সত্বর আপন শরীর থেকে কুন্তসকল তুলে ফেলে সেইগুলি দ্বারাই সুবলপুত্রদের বিদ্ধ করলেন। এবং তিনি বর্মধারণপূর্বক কোষ থেকে তীক্ষ্ণ তরবারি খুলে নিয়ে যুদ্ধে সুবলপুত্রগণকে বধ করার ইচ্ছায় পাদচারে দ্রুত তাঁদের দিকে অগ্রসর হলেন।

ইতোমধ্যে চৈতন্য ফিরে এলে, সেই সুবলপুত্রেরা সকলে ক্রোধাবিষ্ট হয়ে পুনরায় ইরাবানের দিকে ধাবিত হলেন। বলদর্পিত ইরাবানও তরবারিচালন দ্বারা হস্ত লাঘব দেখাতে থেকে সেই সমস্ত সুবলপুত্রের দিকে চললেন। ইরাবান দ্রুত বিচরণ করতে থাকলে, সেই সুবলপুত্রেরা সকলে দ্রুতগামী অম্বে বিচরণ করতে থেকেও তাঁকে প্রহার করবার অবকাশ পেলেন না। তারপর সুবলপুত্রেরা সকলে বারবার ইরাবানের প্রতি দৃষ্টিপাত করে সমরাঙ্গনে তাঁকে বেষ্টন করে ধরবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ক্রমে অস্ত্রধারী সুবলপুত্রেরা নিকটবর্তী হলে, তরবারি-হস্ত শত্রুহন্তা ইরাবান তাঁদের সকলের দেহ, অস্ত্র ও অলংকৃত-বাহু ছেদন করলেন। তখন তাঁরা ছিন্নদেহ ও প্রাণহীন হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। তাঁদের মধ্যে বৃষক বহুভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মহাভয়ংকর ও বীরনাশক সেই যুদ্ধ থেকে কোনওরকমে পালিয়ে বাঁচলেন।

সুবলপুত্রদের যুদ্ধেক্ষেত্রে পতিত দেখে দুর্যোধন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভীষণমূর্তি, মহাধনুর্ধর, মায়াবী, শত্রুহন্তা এবং বকরাক্ষসকে বধ করায় পূর্ববৈরী রাক্ষস অলম্বুষকে বললেন, “বীর! দেখো, বলবান ও মায়াবী অর্জুনের এই পুত্রটা আমার ভয়ংকর অপ্রিয় কার্য ও সৈন্যক্ষয় করল। বৎস এদিকে তুমিও কামগামী, মায়াতে ও অস্ত্রে বিশারদ এবং ভীম পূর্বে তোমার চূড়ান্ত শত্রুতা করছে; অতএব যুদ্ধে একে তুমি বধ করো।”

“তাই হবে” এই কথা বলে সেই ভীষণাকৃতি রাক্ষস সিংহনাদ করতে করতে যেখানে ইরাবান ছিলেন, সেইদিকে চলল; তখন নির্মল গ্রাসযোধী, যুদ্ধনিপুণ ও দারুণ প্রহারকারী বীরযোদ্ধারা এসে তাঁকে পরিবেষ্টন করল; সেই সময়ে বীরগণের আপন আপন সৈনোরাও তাদের সঙ্গে ছিল। তৎকালে হতাবশিষ্ট দুই হাজার উত্তম অশ্বারোহীও ইরাবানকে পরিবেষ্টন করেছিল। তখন পরাক্রমশালী ও শত্ৰুহন্তা ইরাবানও ক্রুদ্ধ ও ত্বরান্বিত হয়ে সেই জিঘাংসু রাক্ষসকে বারণ করতে লাগলেন। তাঁকে আসতে দেখে মহাবল রাক্ষস সত্বর মায়া প্রয়োগ করার চেষ্টা করতে লাগল। ইরাবানের যতগুলি অশ্ব ছিল, রাক্ষস ততগুলি মায়াময় অশ্ব সৃষ্টি করল এবং সেগুলির উপর শূল ও পট্টিশধারী ভয়ংকর রাক্ষসেরা আরূঢ় ছিল।

দারুণ প্রহারকারী সেই দুই সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য ক্রুদ্ধ হয়ে এসে অচিরকাল মধ্যেই পরস্পরকে যমলোকে প্রেরণ করল। সেই উভয় সৈন্যই নিহত হলে, সেই যুদ্ধদুর্ধর্ষ দুইজনই বৃত্রাসুর ও ইন্দ্রের মতো সমরাঙ্গনে অবস্থান করতে লাগলেন। যুদ্ধদুর্ধর্ষ রাক্ষস অলম্বুষকে আসতে দেখে ইরাবানও ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর দিকে ধাবিত হলেন। রাক্ষস যুদ্ধে নিকটবর্তী হলে, দুর্ধর্ষ ইরাবান তরবারি দ্বারা তার ধনু এবং উজ্জ্বল হস্তাবাপ ছেদন করলেন, (হস্তাবাপ— ধনুর গুণের আঘাত নিবারণ করবার জন্য হাতে ধরা চর্মনির্মিত আবরণ) ধনু ছিন্ন হল দেখে রাক্ষস মায়াদ্বারা ক্রুদ্ধ ইরাবানকে মুগ্ধ করেই যেন আকাশে উঠল। তারপর রাক্ষসের সমস্ত চাতুরী জানা সেই কামরূপী ও দুর্ধর্ষ ইরাবানও আকাশে উঠে আপন মায়াদ্বারা রাক্ষসকে মোহিত করে বাণদ্বারা তার সমস্ত অঙ্গ ছেদন করলেন।

তথা স রাক্ষসশ্রেষ্ঠঃ শরৈঃ কৃত্তঃ পুনঃ পুনঃ।

সংবভূব মহারাজ! সমবাপ চ যৌবনম্‌॥ ভীষ্ম : ৮৭ : ৬৩॥

“মহারাজ! সেই রাক্ষসশ্রেষ্ঠ অলম্বুষ বাণদ্বারা সেইভাবে বারবার ছিন্ন হয়েও জন্মাতে লাগল এবং যৌবনলাভ করতে লাগল।”

কারণ, রাক্ষসদের মায়া স্বাভাবিক এবং বয়স বা রূপও কামজ। এই কারণে সেই রাক্ষসের অঙ্গ বারবার ছিন্ন হয়েও বারবার জন্মাতে লাগল। ইরাবানও অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তীক্ষ্ণ পরশু দ্বারা বারবার সেই মহাবল রাক্ষসকে আঘাত করতে লাগলেন। বলবান ইরাবান বৃক্ষের মতো রাক্ষসকে আঘাত করতে থাকলে, রাক্ষস অলম্বুষ ভয়ংকর গর্জন করতে লাগল; তখন সেই শব্দ তুমুল হয়ে প্রকাশ পেতে লাগল। পরশুক্ষত রাক্ষসের দেহ থেকে বহুতর রক্ত নিঃসৃত হতে থাকল। তখন প্রবল রাক্ষস ক্রুদ্ধ হল এবং যুদ্ধের দিকে বিশেষ বেগ করল। তারপর অলম্বুষ ইরাবানকে ক্রমে বৃদ্ধি পেতে দেখে নিজে ভীষণ ও বিশাল মূর্তি ধরে যুদ্ধমধ্যে সকলের সমক্ষে অর্জুনের পুত্র বীর ও যশস্বী ইরাবানকে ধরবার উপক্রম করল। যুদ্ধে যাঁর নিবৃত্তি ঘটে না, সেই ইরাবানও ক্রুদ্ধ হয়ে মায়া সৃষ্টি করবার উপক্রম করলেন। তাঁর মাতৃবংশও তাঁর কাছে উপস্থিত হল। তারপর ইরাবান সমরাঙ্গনে বহুতর নাগকর্তৃক সকল দিকে বেষ্টিত হয়ে বিশাল শরীর অনন্তনাগের মতো অতিবৃহৎ মূর্তি ধারণ করলেন, এবং নানাবিধ নাগদ্বারা রাক্ষসকে আবৃত করলেন। রাক্ষসশ্রেষ্ঠ অলম্বুষ নাগসমূহ কর্তৃক আবৃত হতে থেকে একটু চিন্তা করে গরুড়মূর্তি ধারণপূর্বক সেই নাগসমূহকে ভক্ষণ করল।

মায়াদ্বারা ইরাবানের সেই মাতৃবংশীয় নাগগণ ভক্ষিত হলে, ইরাবান মোহিত হয়ে পড়লেন, তখন রাক্ষস তরবারি দ্বারা তাঁকে বধ করল। চন্দ্র ও পদ্মের তুল্য সুন্দর এবং কুণ্ডল ও মুকুটযুক্ত ইরাবানের মস্তকটিকে রাক্ষস ভূতলে পাতিত করল।

ইরাবানের মৃত্যুসংবাদ অর্জুন পাননি। তিনি তখন ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু ইরাবানকে যুদ্ধে নিহত দেখে ভীমসেনের পুত্র রাক্ষস ঘটোৎকচ অতিবিশাল গর্জন করে উঠল। সমস্ত পৃথিবী কম্পিত করে সে কৌরবসৈন্যকে আক্রমণ করল। দশ হাজার হস্তী নিয়ে দুর্যোধন ঘটোৎকচের দিকে ধাবিত হলেন। তখন দুর্যোধন ও ঘটোৎকচের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হল। ঘটোৎকচ নির্বিচারে কুরুপক্ষের হস্তীদের বধ করতে আরম্ভ করল। হস্তীযোধীরা পরাজিত হলে দুর্যোধন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে প্রধান প্রধান রাক্ষসকে বধ করলেন। প্রচণ্ড ক্রোধে ঘটোৎকচ দুর্যোধনকে আক্রমণ করলেন। ঘটোৎকচ প্রতিজ্ঞা করল, “আজ আমি পিতৃগণ ও মাতৃদেবীর ঋণ পরিশোধ করব। রাজা অতি নৃশংসস্বভাব তুমি, যাঁদের দীর্ঘকালের জন্য বনে নির্বাসিত করেছিলে, ছলদ্যূতে পাণ্ডবদের পরাজিত করেছিলে, রজস্বলা ও একবস্ত্রা দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণাকে নিয়ে এসে বহুপ্রকারে যে কষ্ট দিয়েছিলে এবং দুরাত্মা জয়দ্রথ তোমারই প্রিয়কার্য ইচ্ছায় আমার পিতৃগণকে অগ্রাহ্য করে আশ্রমস্থিতা দ্রৌপদীকে যে গ্রহণ করেছিল; কুরুকুলাধম! তুমি যদি সমরাঙ্গন পরিত্যাগ করে না যাও, তবে আজ আমি ওই সকল অপরাধ ও অন্যান্য অপরাধের শোধ নেব।”

“সেদিন ঘটোৎকচের আক্রমণে অত্যন্ত দুরবস্থায় পড়েছিলেন দুর্যোধন। ঘটোৎকচের নিক্ষিপ্ত শক্তি দুর্যোধনকে আঘাত করার পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গাধিপতি তাঁর বৃহৎ হস্তীটিকে দুর্যোধনের রথের সম্মুখে নিয়ে এলেন। হস্তীটি সেই শক্তির আঘাতে নিহত হল। ক্রোধে আরক্ত ঘটোৎকচ পুনরায় দুর্যোধনকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। ঘটোৎকচের প্রচণ্ড গর্জন শুনে ভীষ্ম দ্রোণের কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, “যখন রাক্ষসের এই ভয়ংকর গর্জন শোনা যাচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই ঘটোৎকচ রাজা দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধে কোনও প্রাণীই ঘটোৎকচকে জয় করতে পারবে না। অতএব আপনারা গিয়ে রাজাকে রক্ষা করুন।” ভীষ্মের কথা শুনে দ্রোণ, সোমদত্ত, বাহ্লিক, জয়দ্ৰথ, কৃপ ও ভূরিশ্রবা, শল্য, বিন্দ ও অনুবিন্দ এবং অন্যেরা দুর্যোধনকে রক্ষা করতে ছুটে গেলেন। কিন্তু সেদিন যুদ্ধে ঘটোৎকচ সমস্ত কৌরববাহিনীকে পরাজিত করলেন। দুর্যোধন সমরাঙ্গন থেকে সরে গেলেন।

*

বহু কারণেই ইরাবান প্রসঙ্গ মহাভারতের এক দুর্লভ ঘটনা। বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুরু করলে উলূপী-অর্জুনের প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সমর্থকদের মধ্যে কেউ কেউ (বিদ্যাসাগর নন) এটিকে বিশ্বের প্রথম বিধবাবিবাহের ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করেন। বিদ্যাসাগর মনুসংহিতা থেকে প্রামাণ্য তথ্য না দেওয়া পর্যন্ত বিপক্ষ পণ্ডিতবর্গ এর উল্লেখ করেছেন। মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ তাঁর ভারতকৌমুদীতে এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। বিধবাবিবাহের পর আর পরক্ষেত্র থাকে না। সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় লিখছেন, “অথ ধার্মিকঃ খল্বর্জুনঃ কথমিমাং পরস্ত্রিয়ং জগ্রাহেত্যাহ কার্যার্থমিতি। পার্থোহর্জুনশ্চ, কাৰ্যার্থং রামায়াং জাতকামায়াং প্রশস্ত হস্তধারণা ইতি স্মৃতেঃ ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন বধয়া স্বকর্তব্য সন্তানোৎপাদনার্থম, কামবশানুগা ত্বাম্ ঐরাবতসুতাং জগ্রাহা এবমনেন প্রকারেণ, এষ ইরাবান, অর্জুনাত্মজঃ সন, পরক্ষেত্রে পরপত্ন্যাং সমুৎপন্নঃ।” অর্থাৎ পরক্ষেত্রে পরপত্নীতে অর্জুন ঐরাবত দৌহিত্র ইরাবানকে উৎপাদন করেছিলেন।

ইরাবান জন্মদাতা পিতা অর্জুনের প্রতি অতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। পিতার যোগ্য করে তিনি নিজেকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। প্রবল পরাক্রান্ত বীর হিসাবে তিনি পরিগণিত হয়েছিলেন। মাতা উলূপীও এ বিষয়ে তাকে যথোচিত সহায়তা দান করেছিলেন। বিবাহিতা হোন আর নাই হোন, উলূপী অর্জুনকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। ঘটনাচক্রে তিনি সুভদ্রা অথবা দ্রৌপদীর মর্যাদা পাননি, কিন্তু অর্জুনের বীরত্ব স্মরণ রেখেই তিনি ইরাবানকে এবং অর্জুনের অপর পত্নী চিত্রাঙ্গদার পুত্র বভ্রুবাহনকে সর্বদাই পিতার বীরত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আশ্বমেধিক পর্বে তিনিই বভ্রুবাহনকে অশ্ব আটকে রেখে অর্জুনের বিরুদ্ধে পুত্র বভ্রুবাহনকে যুদ্ধে অবতীর্ণ করে দিয়েছিলেন। সে যুদ্ধে অর্জুন আপন পুত্রের কাছে পরাজিত ও নিহত হন। তখন চিত্রাঙ্গদার অনুরোধক্রমে উলূপী অর্জুনের বক্ষে সঞ্জীবনী মণি রেখে তাঁকে পুনরায় জীবিত করেন।

যাই হোক, মাতার শিক্ষায় ইরাবান অর্জুনের যোগ্যপুত্র হিসাবে গড়ে উঠেছিলেন। তিনি একাই শকুনির ভ্রাতাদের বধ করেছিলেন। শকুনির ভ্রাতা বৃষক পালিয়ে বেঁচেছিলেন। ইরাবানের মৃত্যুও বড় অদ্ভুত। উলূপীর স্বামীকে পক্ষীশ্রেষ্ঠ গরুড় ভক্ষণ করে ফেলেন। যুদ্ধে মায়াবী ইরাবান ও মায়াবী অলম্বুষ যখন মায়াযুদ্ধ শুরু করলেন, তখন ইরাবানের আঘাতে বারবার রাক্ষস অলম্বুষ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হচ্ছিলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ অলম্বুষের নূতন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত অনিবার্য নিয়তিতে ইরাবান অনন্তনাগের মূর্তি ধারণ করলেন। অলসুষ রাক্ষসও গরুড়ের মূর্তি ধারণ করে ইরাবানকে মোহিত করে ফেললেন। মায়ের বিবাহিত স্বামীর পরিণতি লাভ করলেন অর্জুনপুত্র ইরাবান। পাণ্ডবপক্ষের শ্রেষ্ঠ রথীদের মধ্যে প্রথম পতন ঘটল ইরাবানের। সেদিন ছিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অষ্টম দিন।

ইরাবানের মৃত্যুমুহূর্তে আমরা আবার দেখলাম ঘটোৎকচকে। ভীষ্ম যথার্থই বলেছিলেন, ঘটোৎকচকে বধ করার শক্তি কারও নেই। ভীষ্ম স্বয়ং ঘটোৎকচের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সম্মত ছিলেন না। ঘটোৎকচ অতিরথ। কেবলমাত্র তাই নয়—পিতৃপক্ষের প্রতি তাঁর অপরিসীম মমতা ছিল। রাক্ষস হলেও মানবভ্রাতাদের সম্পর্কে তাঁর সুগভীর প্রীতি সম্পর্ক ছিল। পাণ্ডবপক্ষের সকলের সম্পর্কে ছিল সুগভীর শ্রদ্ধা। কুন্তী দেবী তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, “তুমি জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব সন্তান।”

ঘটোৎকচ অসামান্য বীর ছিলেন। বস্তুত কৌরবপক্ষের কোনও যোদ্ধাই তাঁর মুখোমুখি হতে চাননি। এমনকী ভীষ্মও নন। তাঁর বীরত্বের সর্বাপেক্ষা বড় প্রমাণ, কিছুতেই তাঁকে পরাস্ত করতে না পেরে বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার্থে কর্ণের ইন্দ্রপ্রদত্ত একাঘ্নী বাণ প্রয়োগ। ঘটোৎকচ নিহত হলেন বটে, কিন্তু কর্ণের মৃত্যুকেও তিনি এনে দিলেন। একাঘ্নী বাণ প্রয়োগ করে কর্ণ নিঃসহায়, নিঃসম্বল হয়ে গেলেন। অর্জুনের মুখোমুখি হবার মতো কোনও অস্ত্রই তাঁর আর থাকল না।

ঘটোৎকচের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ আনন্দে নৃত্য করেছিলেন। কেবলমাত্র অর্জুনের জীবনের সবথেকে বড় বাধা নিষ্কণ্টক হয়ে গেল বলে নয়—কৃষ্ণের মতে, ঘটোৎকচ গো-ব্রাহ্মণের বিরোধী ছিলেন। মহাভারত পাঠে এর সপক্ষে কোনও ঘটনা আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু যেহেতু কৃষ্ণ বলেছেন, এবং কৃষ্ণ অহেতুক মন্তব্য করতেন না, সুতরাং এই ধরনের ঘটনা নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছিল।

হিড়িম্বা স্বামী ভীমসেনের স্মৃতি বহন করে সমস্ত জীবন কাটিয়েছিলেন। ঘটোৎকচও অসাধারণ পিতৃভক্ত ছিলেন।

৬৪
ভীষ্মের পতন

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দশম দিন। দশ দিবসেই ভীষ্ম ও অর্জুনের সম্মেলনে সর্বদাই উভয়পক্ষের অতি ভয়ানক ক্ষয় হচ্ছিল। পরমাস্ত্রবিৎ ও শত্রুসন্তাপকারী শান্তনুনন্দন ভীষ্ম সেই যুদ্ধে অযুত অযুত ও ভূরি ভূরি যোদ্ধাকে বধ করলেন। শত্রুসস্তাপকারী ভীষ্ম দশদিন যাবৎ সেইভাবে পাণ্ডবসেনার সন্তাপ জন্মিয়ে নিজের জীবনের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। এবং তিনি সম্মুখযুদ্ধে সত্বর নিজের বধ কামনা করে চিন্তা করলেন, “আমি আর যুদ্ধে সম্মুখবর্তী শ্রেষ্ঠ মানবগণকে বধ করব না।” মহাবাহু ভীষ্ম এইরূপ চিন্তা করে নিকটবর্তী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “মহাপ্রাজ্ঞ! সর্বশাস্ত্রবিশারদ! বৎস! যুধিষ্ঠির! আমি ধর্ম ও স্বৰ্গজনক বাক্য বলছি, তুমি শ্রবণ করো। ভরতনন্দন আমার এই দেহের উপর আমার অত্যন্ত বিতৃষ্ণা জন্মেছে। কারণ যুদ্ধে অতিবহু প্রাণী বধ করতে করতে আমার কাল অতীত হয়েছে। অতএব তুমি যদি আমার প্রিয় কার্য করার ইচ্ছা করো, তবে অর্জুন, পাঞ্চালগণ ও সৃঞ্জয়গণকে অগ্রবর্তী করে আমার বধে যত্ন করো।”

ভীষ্মের এই মত জেনে সত্যদর্শী রাজা যুধিষ্ঠির সৃঞ্জয়গণের সঙ্গে সমরাঙ্গনে ভীষ্মের দিকে গমন করতে লাগলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন ও যুধিষ্ঠির আপন সৈন্যগণকে বললেন,—“সৈন্যগণ সত্যপ্রতিজ্ঞ ও শত্ৰুবিজয়ী অর্জুন তোমাদের রক্ষা করবেন। সুতরাং তোমরা ধাবিত হও, যুদ্ধ করো এবং যুদ্ধে ভীষ্মকে জয় করো। মহাধনুর্ধর সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং ভীমসেনও যুদ্ধে তোমাদের রক্ষা করবেন। আজ যেন যুদ্ধে ভীষ্ম থেকে তোমাদের কোনও ভয় হয় না। আজ আমরা শিখণ্ডীকে অগ্রবর্তী করে নিশ্চয়ই ভীষ্মকে জয় করব।”

দশম দিন পাণ্ডবেরা এই সিদ্ধান্ত করে ব্রহ্মলোকপ্রার্থী ও ক্রোধে অধীর হয়ে যাত্রা শুরু করলেন। তাঁরা শিখণ্ডী ও অর্জুনকে অগ্রবর্তী করে ভীষ্মকে নিপাতিত করবার জন্য পরম যত্ন অবলম্বন করলেন। অপর পক্ষে দুর্যোধনের আদেশক্রমে মহাবলশালী নানাদেশীয় রাজারা দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও সৈন্যগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে এবং বলবান দুঃশাসন সকল সহোদরের সঙ্গে সমবেত হয়ে ভীষ্মকে রক্ষা করতে লাগলেন। তখন কৌরবপক্ষের যোদ্ধারা ভীষ্মকে অগ্রবর্তী করে শিখণ্ডীপ্রভৃতি পাণ্ডববীরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। ওদিকে অর্জুন, চেদি ও পাঞ্চালগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে শিখণ্ডীকে সামনে রেখে শান্তনুনন্দন ভীষ্মের দিকে ধাবিত হলেন।

সাত্যকি অশ্বত্থামার সঙ্গে, ধৃষ্টকেতু পুরুরাজের সঙ্গে, অভিমন্যু অমাত্যসহ দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। যুধিষ্ঠির, মহাধনুর্ধর ও সৈন্যবেষ্টিত শল্যের দিকে এবং ভীমসেন হস্তীসৈন্যদের দিকে ধাবিত হলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন সহোদরদের নিয়ে জয়ে যত্নবান হয়ে দুর্ধর্য, অনিবার্য ও সর্বশস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হলেন। সিংহধ্বজ ও শত্রুদমনকারী রাজপুত্র বৃহদ্বল, কর্ণিকারধ্বজ অভিমন্যুর দিকে চললেন। আর রাজাগণের সঙ্গে সম্মিলিত কৌরববাহিনী অর্জুন ও শিখণ্ডীকে বধের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হল। উভয়পক্ষের সৈন্যদের পদপাতে সমরভূমি কাঁপতে লাগল। তারপর উভয়পক্ষের সৈন্যরা জয়ে যত্নবান হয়ে পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শঙ্খ ও দুন্দুভির ধ্বনি, হস্তীগণের গর্জন ও সৈন্যদের সিংহনাদে বনভূমি পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। রাজাদের গলার হার, হাতের অঙ্গদ ও মাথার কিরীট ধূলির আবরণে মলিন হয়ে গেল। দু’পক্ষের সৈন্যের মাথার উপরটা প্রাস, শক্তি ও বাণসমূহে ব্যাপ্ত হয়ে গেল। সেই মহাযুদ্ধে রথী ও অশ্বারোহীরা পরস্পরের অভিমুখে ধাবিত হল এবং হস্তীসমূহ হস্তীসমূহকে আর পদাতিগণ পদাতিগণকে বধ করতে লাগল। মাংসের জন্য দুটি শ্যেনপাখির মধ্যে যে মহাযুদ্ধ হয়, ভীষ্মের জন্য পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে সেই মহাযুদ্ধ শুরু হল।

পরাক্রমশালী অভিমন্যু ভীষ্মের জন্য বিশাল সৈন্য সমন্বিত দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। তখন ক্রুদ্ধ দুর্যোধন ন’টি বাণে অভিমন্যুর বক্ষে আঘাত করলেন। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ অভিমন্যু তখন যমের ভগিনীর ন্যায় ভয়ংকর একটি শক্তি দুর্যোধনের রথের উপর নিক্ষেপ করলেন। দুর্যোধন একটি ক্ষুরপ্র দ্বারা সেটাকে দুই খণ্ডে ছেদন করলেন। শক্তি ব্যর্থ হল দেখে, অভিমন্যু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তিনটি বাণদ্বারা দুর্যোধনের বক্ষঃস্থলে ও বাহুযুগলে আঘাত করলেন। পুনরায় ভয়ংকর দশটি বাণ দ্বারা দুর্যোধনের বক্ষঃস্থলে আঘাত করলেন। ক্ষত্রিয়েরা সকলে অভিমন্যুর হস্তলাঘবের প্রশংসা করতে লাগলেন। পুত্ৰ অভিমন্যু পিতা অর্জুনের বিজয় এবং ভীষ্মের পরাজয়ের জন্য ক্রমশ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে লাগলেন। আবার দুর্যোধন ভীষ্মের পরাজয় না হতে দেওয়ার জন্য তীব্রতর যুদ্ধ আরম্ভ করলেন।

ওদিকে ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ অশ্বত্থামা ক্রুদ্ধ হয়ে নারাচ দ্বারা সাত্যকির বক্ষঃস্থলে তাড়ন করলেন। সাত্যকিও নয়টি বাণ দ্বারা অশ্বত্থামার সমস্ত বক্ষঃস্থল তাড়ন করলেন। অশ্বত্থামাও নয়টি বাণ দ্বারা সাত্যকিকে পীড়ন করে পুনরায় দ্রুত ত্রিশটি বাণদ্বারা তাঁর বাহুযুগলে ও বক্ষঃস্থলে পীড়ন করলেন। অশ্বত্থামা গুরুতর বিদ্ধ করলে, মহাধনুর্ধর ও মহাযশা সাত্যকি ভয়ংকর তিনটি বাণে অশ্বত্থামাকে আঘাত করলেন।

অন্যদিকে মহারথ পুরুরাজ সমরাঙ্গনে বহুতর বাণ দ্বারা মহাধনুর্ধর ধৃষ্টকেতুকে গুরুতর আঘাত করতে থাকলেন। ধৃষ্টকেতুও ত্রিশটি শিলাশাণিত বাণ দ্বারা যুদ্ধে পুরুরাজকে বিদ্ধ করলেন। পুরুরাজ ধৃষ্টকেতুর ধনু ছেদন করে বহুতর তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা তাঁকে বিদ্ধ করে সিংহনাদ করতে শুরু করলেন। ধৃষ্টকেতু অন্য ধনুক নিয়ে তেত্রিশটি তীক্ষ্ণমুখ বাণদ্বারা পুরুরাজকে বিদ্ধ করলেন। দুজনেরই ধেনু ছেদন হয়ে গেল, তখন উভয়ে অসি হাতে একে অপরকে আঘাত করতে থাকলেন। পুরুরাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ধৃষ্টকেতুর ললাটে আঘাত করলেন, ধৃষ্টকেতুও পুরুরাজের স্কন্ধে ক্ষিপ্র তরবারির আঘাত করলেন। দুজনেই ভূতলে পতিত হলেন। তখন দুর্যোধনের ভ্রাতা জয়ৎসেনকে এবং সহদেব ধৃষ্টকেতুকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। ওদিকে সুশর্মার সঙ্গে চিত্রসেনের ও অভিমন্যুর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হতে লাগল। ভীমসেন একাই বিরাট হস্তীবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে হস্তীবাহিনী ধ্বংস করতে থাকলেন। মহাধনুর্ধর যুধিষ্ঠির বিশাল সৈন্য সমন্বিত মদ্ররাজ শল্যকে পীড়ন করতে লাগলেন। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ ও বিরাটরাজার মধ্যে ভয়ংকর সংগ্রাম হতে থাকল।

এদিকে দ্রোণাচার্য মহাযুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতপর্ব বাহুসমূহ দ্বারা মহাযুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের বিশাল ধনু ছেদন করে পঞ্চাশটি বাণ দ্বারা তাঁকে বিদ্ধ করলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন অন্য ধনু নিয়ে দ্রোণের উপর বহুতর বাণ নিক্ষেপ করলেন। মহারথ দ্রোণ বাণবর্ষণ দ্বারা সেই বাণগুলিকে ছেদন করলেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে পাঁচটি বাণ নিক্ষেপ করলেন। তখন বিপক্ষবীর হন্তা ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্রুদ্ধ হয়ে দ্রোণের প্রতি একটি যমদণ্ড তুল্য গদা নিক্ষেপ করলেন। দ্রোণ পঞ্চাশটি বাণ দ্বারা সেই গদাটাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। গদা ব্যর্থ দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের প্রতি একটি লৌহময়ী বাণ নিক্ষেপ করলেন। দ্রোণ ন’টি বাণ দ্বারা যুদ্ধে সেই শক্তিটাকে ছেদন করলেন এবং মহাধনুর্ধর ধৃষ্টদ্যুম্নকেও পীড়ন করলেন। এইভাবে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রোণের মধ্যে মহাযুদ্ধ চলতে লাগল।

এদিকে অর্জুন ভীষ্মকে দেখে যত্নবান হয়ে তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা পীড়ন করতে আরম্ভ করলেন। মত্ত হস্তী যেমন অপর মত্ত হস্তীর দিকে ধাবিত হয়, অর্জুন তেমনই ভীষ্মের দিকে ধাবিত হলেন। তখন গজারূঢ় রাজা ভগদত্ত অর্জুনের পথ আটকাবার জন্য সামনে এসে দাঁড়ালেন। অর্জুন রৌপ্যের মতো নির্মল ও তীক্ষ্ণ লৌহময় বাণদ্বারা সেই হাতিটাকে তাড়ন করলেন। মহাবীর অর্জুন শিখণ্ডীকে “ভীষ্মের দিকে যান এবং তাঁকে বধ করুন” বলে উত্তেজিত করতে লাগলেন। অর্জুন ভগদত্তকে নিবারণ করে শিখণ্ডীকে অগ্রবর্তী করে ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হলেন। ক্রমে শিখণ্ডী ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হয়ে ধীর স্থির থেকে বহুতর বাণদ্বারা ভীষ্মকে আবৃত করে ফেললেন। রথ যার অগ্নিগৃহ, ধনু যার শিখা, বিপক্ষের তরবারি, শক্তি ও গদা যাঁর কাষ্ঠ এবং নিজের শরসমূহ যাঁর মহাপ্রজ্বলন, সেই অর্জুনরূপ অগ্নি যুদ্ধে ক্ষত্রিয়রূপ তৃণ দগ্ধ করতে লাগলেন। আবার প্রদীপ্ত বিশাল অগ্নি যেমন বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়ে তৃণসমূহমধ্যে জ্বলতে থাকে, ভীষ্মও তেমনই দিব্য অস্ত্র সকল নিক্ষেপ করে জ্বলতে থাকলেন। ক্রমে মহারথ ভীষ্ম মহাযুদ্ধে দিক ও বিদিক নিনাদিত করতে থেকে স্বর্ণপুঙ্খ, তীক্ষ্ণ ও নতপূর্ব বাণসমূহ দ্বারা অর্জুনের অনুচর সোমকদের বধ করতে লাগলেন এবং অর্জুনের সেনাগণকে নিবারণ করলেন। তিনি রথীদের ও আরোহীসহ অশ্বদের নিপাত করতে থেকে তালবন থেকে তালফলের মতো রথ থেকে রথীদের মস্তক সকল নিপাতিত করতে থাকলেন। সর্বশস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম যুদ্ধে ক্রমে হস্তী, অশ্ব, রথগুলিকে একেবারে মনুষ্যবিহীন করতে লাগলেন। সকল দিকের সৈন্যরাই বজ্রপাতধ্বনির মতো ভীষ্মের ধনুর গুণ ও হস্তাবাপের ধ্বনি শুনে কাঁপতে লাগলেন। ভীষ্মের বাণসকল অব্যর্থভাবে বিপক্ষ সৈন্যের উপর পতিত হতে লাগল এবং তাঁর প্রতিটি বাণ রথীদের দেহ বিদ্ধ করতে থাকল। আরোহীবিহীন রথগুলির অশ্ব বায়ুর ন্যায় গতিতে গমন করতে লাগল।

সদ্‌বংশজাত, দেহত্যাগে উদ্যত, অপ্রত্যাবর্তী, বীর, স্বর্ণশোভিতধ্বজ এবং মহারথ বলে বিখ্যাত চেদি, কাশী ও কুরুদেশীয় চোদ্দো হাজার যুদ্ধহস্তী, অশ্ব ও রথের সঙ্গে সমরাঙ্গনে বিকৃত বদন যমতুল্য ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হয়েই পরলোক গমন করলেন। সেই যুদ্ধে সোমকদের মধ্যে এমন কোনও মহারথ ছিলেন না, যিনি যুদ্ধে ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হয়ে জীবনের আশা করতে পারেন। ক্রমশ রণক্ষেত্রের সৈন্যরা মনে করতে লাগল, ভীষ্ম সমস্ত যোদ্ধাকেই পরলোকে প্রেরণ করে তবে থামবেন এবং কৃষ্ণসারথি পাণ্ডুনন্দন বীর অর্জুন ও অমিততেজা পাঞ্চালরাজপুত্র শিখণ্ডী ছাড়া অন্য কোনও মহারথই যুদ্ধে ভীষ্মের সামনে যেতে সমর্থ হলেন না।

শিখণ্ডী যুদ্ধে পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে পেয়ে দশটি বাণ দ্বারা তাঁর বক্ষঃস্থলে আঘাত করলেন। তখন ভীষ্ম ক্রোধজ্বলিত নেত্রে কটাক্ষ দ্বারাই দগ্ধ করে যেন শিখণ্ডীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। কিন্তু ভীষ্ম শিখণ্ডীর ভূতপূর্ব স্ত্রীত্ব স্মরণ করেই সমস্ত লোকের সামনে শিখণ্ডীকে আঘাত করলেন না। কিন্তু শিখণ্ডী তা বুঝতে পারলেন না। তখন অর্জুন শিখণ্ডীকে বললেন, “রথীশ্রেষ্ঠ শিখণ্ডী আপনি সর্বতোভাবে ভীষ্মবধে মনোযোগী হোন। আপনার কোনও কথা বলার প্রয়োজন নেই, আপনি মহারথ ভীষ্মকে বধ করুন। কারণ ধর্মরাজের সৈন্যমধ্যে অন্য কাউকেই আমি ভীষ্মহন্তা বলে দেখছি না। আপনি ভিন্ন সমরাঙ্গনে ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন, এমন কোনও বীরকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। আপনাকে একথা আমি সত্য বলছি।”

অর্জুনের কথা শুনে শিখণ্ডী অতিদ্রুত নানাবিধ বাণদ্বারা ভীষ্মকে আঘাত করতে লাগলেন। কিন্তু রথীশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম সেই বাণগুলিকে অগ্রাহ্য করে বাণদ্বারা যুদ্ধে ক্রুদ্ধ অর্জুনকে বারণ করতে থাকলেন। মহারথ ভীষ্ম তীক্ষ্ণ বাণসমূহদ্বারা সর্ববিধ পাণ্ডবসেনার কিছু কিছু সৈন্যকে পরলোকে প্রেরণ করলেন। ক্রমশ পাণ্ডবেরাও বিশাল সৈন্যে পরিবেষ্টিত হয়ে মেঘ যেমন সূর্যকে আবৃত করে, তেমনই বাণ দ্বারা ভীষ্মকে আবৃত করে ফেললেন। ভীষ্ম সকল দিকে বেষ্টিত হয়েও বহ্নির ন্যায় জ্বলতে থেকে বীরগণকে দন্ধ করতে লাগলেন।

তখন দুঃশাসন অদ্ভুত পুরুষভাব দেখিয়ে একই সঙ্গে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন, আবার ভীষ্মকেও রক্ষা করতে থাকলেন। যুদ্ধে দুঃশাসনের সেই মহাপ্রতাপ দেখে কৌরবপক্ষের সকল বীরই অত্যন্ত সন্তুষ্ট হল। দুঃশাসন একাকী সমস্ত পাণ্ডবসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন কিন্তু পাণ্ডবেরা যুদ্ধে উন্মত্তপ্রায় দুঃশাসনকে থামাতে পারছিলেন না। দুঃশাসন যুদ্ধে রথীদের বিরথ করলেন এবং অশ্বারোহী, মহাধনুর্ধর পদাতি ও মহাবল হস্তীগুলিকে বিমুখ করলেন। দুঃশাসনের তীক্ষ্ণ বাণে বিদীর্ণ হয়ে অনেক হস্তী ভূতলে পতিত হল। অন্য হস্তীগুলি তাঁর বাণে পীড়িত হয়ে নানাদিকে পালাতে লাগল। অগ্নি যেমন কাঠ পেয়ে উজ্জ্বল শিখা ধারণ করে অত্যন্ত জ্বলতে থাকে, দুঃশাসনও তেমনই পাণ্ডবসৈন্য দগ্ধ করতে থেকে জ্বলতে লাগলেন। একমাত্র ইন্দ্রপুত্র ও কৃষ্ণসারথি অর্জুন ভিন্ন কোনও পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথ দুঃশাসনকে জয় করতে পারলেন না অথবা তাঁর সম্মুখে যেতে সমর্থ হলেন না।

কিন্তু সর্বত্র বিজয়শীল অর্জুন যুদ্ধে দুঃশাসনকে জয় করে সমস্ত সৈন্যের সামনেই ভীষ্মের দিকে ধাবিত হলেন। দুঃশাসনও পরাজিত হয়ে ভীষ্মের বাহু অবলম্বন করে বারবার আশ্বস্ত হয়ে মদমত্ত অবস্থায় যুদ্ধ করতে থাকলেন। আবার অর্জুনও যুদ্ধ করতে থেকে বীরশোভায় শোভা পেতে থাকলেন। ওদিকে শিখণ্ডী বজ্রতুল্য ও সর্পবিষাক্ত শরসমূহ দ্বারা ভীষ্মকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ বাণগুলি ভীষ্মের কোনও পীড়াই জন্মাতে পারল না। তিনি মৃদু হাস্য করতে করতে সেই বাণগুলি গ্রহণ করতে লাগলেন।

যখন ভীষ্ম ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করে পাণ্ডবসৈন্য দগ্ধ করতে লাগলেন, তখন দুঃশাসন তাঁর সমস্ত সৈন্যকে আহ্বান করে বললেন, “সৈন্যগণ, তোমরা সকল দিক থেকে অর্জুনের দিকে ধাবিত হও। ভীষ্ম তোমাদের সকলকে রক্ষা করবেন। ভয় ত্যাগ করে পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করো। যুদ্ধে আগত দেবতারাও মহাত্মা ভীষ্মের সামনে দাঁড়াতে পারেন না, পাণ্ডবেরা কী করবে? যোদ্ধৃগণ তোমরা যুদ্ধে অর্জুনের দিকে ধাবিত হও। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম যুদ্ধে তোমাদের সকলকে রক্ষা করবেন। আমিও তোমাদের সঙ্গে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।” যোদ্ধারা অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। বাহ্লিক, দরদ, প্রতীচ্য, উদীচ্য, মালব, অভিযাহ, শূরসেন, শিবি, বসাতি শাল্ব, শক, ত্রিগর্ত, অম্বষ্ঠ ও কেকয়দেশীয় সৈন্যেরা পতঙ্গ যেমন করে অগ্নির উপর পতিত হয়, সেইরূপ অর্জুনের উপর পতিত হল, আর অগ্নির মতো অর্জুন পতঙ্গরূপ সৈন্যগণকে দগ্ধ করতে লাগলেন।

সেই রাজারা যখন অর্জুনের সম্মুখীন হলেন, তখন অর্জুন চিন্তা করে দিব্য অস্ত্রের প্রয়োগে একসঙ্গে সকল মহারথকে বদ্ধ করলেন। অর্জুন যখন সহস্র বাণ নিক্ষেপ করছিলেন, তখন তাঁর গাণ্ডীবধনুখানি আকাশে যেন দীপ্তিশালার মতো দেখা যাচ্ছিল। সেই রাজারা যখন অর্জুনের বাণে পীড়িত হতে লাগলেন এবং তাঁদের বিশাল ধ্বজগুলি নানাদিকে বিক্ষিপ্ত হতে থাকল, তখন তাঁরা সম্মিলিত হয়েও অর্জুনের সম্মুখবর্তী হতে পারলেন না। কৌরবসৈন্যেরা সকল দিকে পলায়ন করতে লাগল। কৌরবসৈন্যদের অপসারণ করে অর্জুন দুঃশাসনের প্রতি বহুতর বাণ নিক্ষেপ করলেন। অর্জুনের সেই লৌহমুখ বাণগুলি দুঃশাসনের দেহ ভেদ করে ভূতলে প্রবেশ করল। তারপর অর্জুন দুঃশাসনের সারথি ও রথসমেত অশ্বগুলিকে ধ্বংস করলেন। কৃপ, শল্য, দুঃশাসন, বিকর্ণ ও বিবিংশতি— এই পাঁচজন রথীকে অর্জুন বিরথ ও পরাজিত করলেন। যুদ্ধে ভীষ্ম তখনও পরাক্রম প্রকাশ করছেন দেখে দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে পারলেন না। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু জেনেও কৌরবসৈন্যেরা পাণ্ডবপক্ষীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগল।

ক্রমে সেই সমরভূমি হস্তী, অশ্ব, রথীগণের রক্তে সংসিক্ত ও আবৃত হয়ে শরতের আকাশের মত শোভা পেতে লাগল। কুকুর, কাক, শকুন, চিতাবাঘ ও বিকৃতাঙ্গ মাংসভোজী পশুপক্ষীগণ শৃগালগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে খাদ্য পেয়ে চিৎকার করতে থাকল। রাক্ষস ও অন্যান্য মাংসভোজী প্রাণী রব করতে থেকে দৃষ্টিগোচর হতে থাকল। স্বর্ণময় মালা ও মহামূল্য পতাকা বায়ুসঞ্চালনে কাঁপতে লাগল। মাটিতে শত শত শ্বেতছত্র পড়ে থাকতে দেখা গেল, হাতির দল পালাতে লাগল, সহস্র সহস্র বিশাল হস্তী বাণ ও নারাচের আঘাতে আহত হয়ে আর্তনাদ করতে থাকল।

তখন পাণ্ডবসেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন সৈন্যদের ডেকে বললেন, “সৈন্যগণ তোমাদের বিলম্ব করার প্রয়োজন নেই। ভীষ্মের প্রতি ধাবিত হও।” সেনাপতির আদেশ শুনে সৃঞ্জয় এবং সোমকেরা বাণবর্ষণ করতে করতে ভীষ্মের দিকে এগিয়ে চলল। ভীষ্মও দিব্য অস্ত্র প্রয়োগ করে সমস্ত ধনুর্ধরদের সম্মুখেই অর্জুনের দিকে অগ্রসর হলেন। সেই সময় অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত শিখণ্ডী ভীষ্মের সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন। ভীষ্মও শিখণ্ডীকে দেখে সেই অগ্নিতুল্য বাণ সংবরণ করলেন। এই সময়ে অর্জুন যেন ভীষ্মকে মোহিত করে কৌরবসৈন্য ধ্বংস করতে আরম্ভ করলেন। তখন উভয়পক্ষের মধ্যে উন্মত্তের ন্যায় যুদ্ধ শুরু হল। তখন আর নিয়মানুযায়ী যুদ্ধ হল না, পদাতির সঙ্গে অশ্বারোহীর, অশ্বারোহীর সঙ্গে রথীর এবং রথীর সঙ্গে গজারোহীর যুদ্ধ আরম্ভ হল। উভয়পক্ষের ক্ষয়ের কোনও সীমা-পরিসীমা থাকল না। তখন শল্য, কৃপ, চিত্রসেন, দুঃশাসন ও বিকর্ণ— এই পাঁচজন বীর উজ্জ্বল রথে আরোহণ করে পাণ্ডবসৈন্যদের কাঁপিয়ে তুললেন। এইসব মহাত্মারা বধ করতে থাকলে, নৌকা যেমন বায়ুবেগে জলে ঘুরতে থাকে, পাণ্ডবসেনাও সমরাঙ্গনে ঘুরতে থাকল। আর ভয়ংকর শীত যেমন গো-সমূহের মর্ম ভেদ করে, তেমনই ভীষ্মও পাণ্ডবগণকে পীড়ন করতে থাকলেন।

আবার অর্জুনও বিপক্ষ সৈন্যের নবমেঘতুল্য হস্তীগুলিকে বহুবিধ প্রহারে নিপাত করতে লাগলেন। প্রধান প্রধান পদাতি অর্জুনের তীক্ষ্ণ বাণে ছিন্ন মস্তক অলংকার-যুক্ত দেহে সমরাঙ্গন আবৃত করে ফেলল। তখন ধার্তরাষ্ট্রেরা মৃত্যু অবধারিত জেনে, স্বৰ্গকে পরমাশ্রয় ভেবে অর্জুনের দিকে ছুটে চললেন। পাণ্ডবরাও পূর্বে প্রদত্ত ক্লেশ স্মরণ করে প্রতিশোধ আকাঙ্ক্ষায় ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের দিকে অগ্রসর হলেন। এই সময়ে সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন সৃঞ্জয় ও সোমকদের পুনরায় ভীষ্মের দিকে যাবার নির্দেশ দিলেন। সৃঞ্জয় এবং সোমকেরা ভীষ্মের অস্ত্রবৃষ্টি সত্ত্বেও আহত হতে থেকে তাঁর দিকে ধাবিত হল। আবার ভীষ্মও সোমক ও সৃঞ্জয়দের বাণে আহত হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত আকুল হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। জ্ঞানী পরশুরাম পূর্বে কীর্তিমান ভীষ্মকে বিপক্ষসৈন্যনাশিনী অদ্ভুত অস্ত্রশিক্ষা দান করেছিলেন। সেই শিক্ষা অবলম্বন করে ভীষ্ম প্রতিদিন পাণ্ডবগণের দশ হাজার সৈন্য বিনাশ করতেন। সেই দশম দিনে ভীষ্ম পাঞ্চালসৈন্যের অপরিমিত হস্তী ও অশ্ব, সাতজন মহারথ, পাঁচ হাজার রথী, চোদ্দো হাজার পদাতি, বহু হাজার হস্তী-আরোহী, দশ হাজার অশ্বারোহী বধ করলেন। তারপর তিনি সকল রাজার সৈন্য ক্ষয় করে বিরাটরাজার প্রিয় ভ্রাতা শতানীককে নিপাতিত করলেন। অসাধারণ প্রতাপশালী ভীষ্ম যুদ্ধে শতানীককে বিনাশ করে ভল্লদ্বারা বহু সহস্র ক্ষত্রিয় সংহার করলেন। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধারা অত্যন্ত ভীত হয়ে অর্জুনকে ডাকতে লাগল। পাণ্ডবপক্ষের যে সকল ক্ষত্রিয় অর্জুনকে পরিবেষ্টন করে গিয়েছিলেন তাঁরা সকলেই ভীষ্মের কাছে গিয়ে যমালয়ে যাত্রা করলেন। শরসমূহদ্বারা দশ দিক আবৃত করে সকল দিকের পাণ্ডবসৈন্য মর্দন করে ভীষ্ম কৌরবসৈন্যের সম্মুখভাগে অবস্থান করতে লাগলেন। মধ্যাহ্ন সূর্যের দিকে যেমন তাকানো যায় না, তেমনই কোনও রাজাই ভীষ্মের প্রতি দৃষ্টিপাতও করতে পারলেন না।

ভীষ্মকে সেই রকম পরাক্রম প্রকাশ করতে দেখে দেবকীনন্দন কৃষ্ণ আনন্দিত চিত্তে অর্জুনকে বললেন, “অর্জুন শান্তনুনন্দন ভীষ্ম এই উভয় সৈন্যমধ্যে রয়েছেন। এঁকে বধ করলেই তোমার জয় হবে। অতএব অর্জুন যেখানে থেকে ভীষ্ম পাণ্ডবসেনা বিদীর্ণ করছেন, তাঁকে সেখানেই বলপূর্বক স্তম্ভিত করো। কারণ, তুমি ভিন্ন অপর কেউই ভীষ্মের শর সহ্য করতে পারবে না।” তখন অর্জুন বাণসমূহ দ্বারা ধ্বজ, অশ্ব, রথের সঙ্গে ভীষ্মকে অন্তর্হিত করে ফেললেন। তখন দ্রুপদ, বলবান ধৃষ্টকেতু, পাণ্ডুনন্দন ভীমসেন, পৃষ্ণনন্দন ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল, সহদেব, চেকিতান, কেকয়দেশীয় পঞ্চভ্রাতা, মহাবাহু সাত্যকি, অভিমন্যু, ঘটোৎকচ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, শিখণ্ডী, বলবান কুন্তীভোজ ও বিরাটরাজা—পাণ্ডবপক্ষের এই সকল বীর ভীষ্মের বাণে গুরুতর পীড়িত হচ্ছিলেন। অর্জুন তাঁদের রক্ষা করতে থাকলেন। তখন অর্জুন রক্ষা করতে থাকলে শিখণ্ডী উত্তম অস্ত্র ধারণ করে বেগে ভীষ্মের দিকে ধাবিত হলেন। বিপক্ষের সমস্ত রন্ধ্রাবস্থাভিজ্ঞ ও অপরাজিত অর্জুন ভীষ্মের অনুচরদের বধ করে তাঁর দিকেই ধাবিত হলেন। ক্রমে সাত্যকি, চেকিতান, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্রুপদ, নকুল, সহদেব, অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র অর্জন কর্তৃক রক্ষিত থেকে এঁরাও ভীষ্মের দিকে ছুটে চললেন। এই বীরেরা বিপক্ষের সকল বাণ বিনষ্ট করে ভীষ্মকে আবৃত করে ফেললেন। কিন্তু ভীষ্ম খেলাচ্ছলে তাঁদের বাণগুলি বিনষ্ট করতে লাগলেন। কিন্তু ভীষ্ম শিখণ্ডীর ভূতপূর্ব স্ত্রীত্ব স্মরণ করে মৃদু হাস্য করে তাঁর প্রতি বাণ সন্ধান করলেন না।

অথচ ভীষ্ম দ্রুপদরাজার সৈন্যমধ্যে সাতজন রথীকে বধ করলেন। তখন মৎস্য, পাঞ্চাল, চেদিদেশীয় সৈন্যরা কিল কিল শব্দ করতে করতে একমাত্র ভীষ্মের দিকেই ছুটে এসে ভীষ্মকে চতুর্দিকে পরিবেষ্টন করে ফেললেন এবং তাঁকে বাণ দ্বারা আবৃত করলেন। তারপর সেই দেবাসুর যুদ্ধতুল্য, ভীষ্ম ও পাণ্ডবসৈন্যের যুদ্ধে অর্জুন শিখণ্ডীকে অগ্রবর্তী করে ভীষ্মকে পীড়ন করতে থাকলেন। ভয়ংকর দিব্য অস্ত্র, গদা, নারাচ ইত্যাদি দ্বারা বীরেরা ভীষ্মকে তাড়ন করতে থাকলেন। ভীষ্মের বর্ম বিদীর্ণ হয়ে গেল, তাঁর মর্মও বিদীর্ণ হতে লাগল; তথাপি তিনি বিচলিত হলেন না।

বরং এই সময়ে ভীষ্ম প্রলয়কালীন অগ্নির রূপ ধারণ করলেন। তাঁর ধনু ও বাণ অগ্নির মতো জ্বলতে লাগল, অস্ত্র সকল বেগবান বায়ুর ন্যায় চলতে থাকল, রথচক্রের শব্দ অগ্নিতাপের ন্যায় অসহ্য হয়ে পড়ল, দারুণ অস্ত্রসমূহ অগ্নির তুল্য আবির্ভূত হতে লাগল, বিচিত্র ধনুখানা মহাশিখার মতো দেখা যেতে থাকল এবং বিপক্ষ বীরগণ বিশাল কাষ্ঠের মতো দগ্ধ হতে লাগলেন। ক্রমে দেখা গেল— ভীষ্ম ফিরে ফিরে এক একবার রথসমূহমধ্য থেকে নির্গত হচ্ছেন, আবার ক্ষত্রিয়দের মধ্যে বিচরণ করছেন। তারপর ভীষ্ম দ্রুপদ ও ধৃষ্টকেতুকে অতিক্রম করে পাণ্ডবসৈন্যদের মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

তখন ভীষ্ম শিলাশাণিত, ভয়ংকর শব্দকারী, মহাবেগশালী ও বর্মভেদী বাণে সাত্যকি, ভীমসেন, অর্জুন, দ্রুপদ, বিরাট ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে অত্যন্ত বিদ্ধ করতে থাকলেন। সেই মহারথেরাও প্রত্যেকে দশটি করে ভয়ংকর বাণে ভীষ্মকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। শিখণ্ডীর তীক্ষ্ণ বাণগুলি ভীষ্ম গ্রাহ্য করলেন না। তখন অর্জুন শিখণ্ডীকে সম্মুখে রেখে ভীষ্মের ধনু ছেদন করলেন। দ্রোণ, কৃতবর্মা, জয়দ্রথ, ভূরিশ্রবা, শল, শল্য ও ভগদত্ত ভীষ্মের ধনুছেদন সহ্য করতে পারলেন না— তাঁরা সাতজনই অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। পাণ্ডবেরাও অর্জুনকে রক্ষা করার জন্য তাঁকে চারদিকে পরিবেষ্টন করলেন। অর্জুন কর্তৃক রক্ষিত শিখণ্ডী দশটি তীক্ষ্ণবাণে ছিন্নকার্মুক ভীষ্মকে তাড়ন করলেন। তারপর শিখণ্ডী দশটি বাণে ভীষ্মের সারথিকে বিদ্ধ করে, ভীষ্মের রথের ধ্বজটিকে ছেদন করে ফেললেন। তখন ভীষ্ম আর একটি সুদৃঢ় ধনু গ্রহণ করলেন। অর্জুন তীক্ষ্ণ তিনটি বাণে সে-ধনুও ছেদন করলেন। এইভাবে ভীষ্ম বার বার ধনু গ্রহণ করতে লাগলেন, অর্জুন তা বার বার ছেদন করতে লাগলেন। তখন ছিন্নধন্বা ভীষ্ম অত্যন্ত ক্রোধে ওষ্ঠ লেহন করে পর্বতবিদারণকারী একটি ভয়ংকর শক্তি অর্জনের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। অর্জুন পাঁচটি তীক্ষ্ণ ভল্লের দ্বারা সেই শক্তিকে পাঁচখণ্ডে ছেদন করে ফেললেন। শক্তিটিকে ছিন্ন হতে দেখে ভীষ্ম মনে মনে চিন্তা করলেন, “যদি মহাবল কৃষ্ণ এঁদের রক্ষক না হতেন, তবে আমি এক ধনুদ্বারাই সমগ্র পাণ্ডবগণকে বিনাশ করতে পারতাম। তা ছাড়া, কৃষ্ণ সমস্ত লোকের অজেয়। সুতরাং দুই কারণে আমি আর পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করব না। প্রথমত, কৃষ্ণ রক্ষা করছেন বলে পাণ্ডবেরা অবধ্য। দ্বিতীয়ত, শিখণ্ডীর ভূতপূর্ব স্ত্রীত্ব। পিতৃদেব শান্তনু যখন সত্যবতীকে বিবাহ করেন, তখন তিনি সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে দুটি বর দিয়েছিলেন; তার এক— ইচ্ছামৃত্যু; দুই— যুদ্ধে অবধ্যত্ব। অতএব এখন আমি নিজের মৃত্যুকে কালোচিত বলে মনে করি।”

অমিততেজা ভীষ্মের এইরূপ কর্তব্য নিশ্চয় বুঝে আকাশস্থিত ঋষিগণ ও বসুগণ ভীষ্মকে বললেন, “বৎস! তুমি যা স্থির করেছ, তা আমাদেরও প্রিয়; অতএব মহাধনুর্ধর! তুমি তাই করো, যুদ্ধ করবার ইচ্ছা ত্যাগ করো।” এই দৈববাণী থেমে যেতেই অনুকূল সুগন্ধী বাতাস বইতে লাগল, আকাশে দেবদুন্দুভি বেজে উঠল এবং ভীষ্মের উপর পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। এই দৈববাণী ব্যাসদেবের আশীর্বাদে কেবলমাত্র সঞ্জয় শুনতে পেলেন। ভীষ্ম রথ থেকে পতিত হবেন বলে আকাশস্থিত দেবগণের অত্যন্ত ব্যস্ততা উপস্থিত হল।

দেবগণের এই বাক্য শুনে ভীষ্ম তীক্ষ্ণ ও সর্ব আবরণভেদী বাণে বিদীর্ণ হতে থেকেও আর অর্জুনের অভিমুখী হলেন না। ক্রুদ্ধ শিখণ্ডী ন’টি তীক্ষ্ণ বাণে ভীষ্মের বক্ষঃস্থলে আঘাত করলেন। কিন্তু ভীষ্ম তাতে বিচলিত হলেন না। তারপর অর্জুন হাস্য করে গাণ্ডিবধনু আকর্ষণ করলেন এবং পঁচিশটি বাণে ভীষ্মকে পীড়ন করলেন। অর্জুন ক্রুদ্ধ ও ত্বরাযুক্ত হয়ে পুনরায় বহুতর বাণ দ্বারা ভীষ্মের সমস্ত অঙ্গে ও মর্মস্থলে তাড়ন করলেন। অন্য অসংখ্য যোদ্ধাও গুরুতরভাবে ভীষ্মকে আঘাত করতে লাগলেন। ভীষ্মও শরদ্বারা তাঁদের বিদ্ধ করতে লাগলেন। শিখণ্ডীর ক্রমাগত আঘাত ভীষ্ম উপেক্ষা করছেন দেখে ক্রুদ্ধ অর্জুন শিখণ্ডীকে অগ্রবর্তী করে ভীষ্মের অভিমুখে থেকে তাঁর ধনুখানা আবার কেটে ফেললেন। তারপর অর্জুন ন’টি বাণে ভীষ্মকে আঘাত করে, একটি বাণে ভীষ্মের ধ্বজ কেটে ফেললেন। ভীষ্ম অন্য ধনু নেবার পূর্বেই অর্জুন সে ধনুকেও কেটে ফেললেন। এইভাবে অর্জুন ভীষ্মের বহুতর ধনু ছেদন করলেন। তখন শান্তনুনন্দন ভীষ্ম আর অর্জুনকে জয় করতে পারলেন না। তারপর অর্জুন আরও পঁচিশটি বাণে ভীষ্মকে বিদ্ধ করলেন। তখন মহাধনুর্ধর ভীষ্ম অত্যন্ত বিদ্ধ হয়ে দুঃশাসনকে বললেন, “পাণ্ডবপক্ষের মহারথ অর্জুন ক্রুদ্ধ হয়ে বহুসহস্র বাণ দ্বারা যুদ্ধে আমাকে আঘাত করছেন। কিন্তু স্বয়ং ইন্দ্রও যুদ্ধে অর্জুনকে জয় করতে পারেন না। বীরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠরা, দানব, রাক্ষসেরা মিলিত হয়েও যুদ্ধে আমাকে অথবা অর্জুনকে জয় করতে পারেন না। বজ্র ও বিদ্যুতের সমান স্পর্শ এবং পরস্পর সংলগ্ন— এই সকল বাণ অর্জুনই নিক্ষেপ করছেন; কিন্তু এ সকল বাণ শিখণ্ডীর নয়। আমার মর্মছেদনকারী ও দৃঢ়বর্মভেদী— এ সকল বাণ মুষলের মতো আঘাত করছে; সুতরাং এ বাণগুলি শিখণ্ডীর নয়। বজ্ৰদণ্ডসমান স্পর্শ ও বজ্রবেগের ন্যায় দুর্ধর্ষ— এ সকল বাণ আমার প্রাণ পর্যন্ত পীড়ন করছে, অতএব এ বাণ সকল শিখণ্ডীর নয়। গদা ও পরিখের মতো দৃঢ়স্পর্শ ও যমদুতের মতো আগত— এই বাণগুলি যেন আমার প্রাণ বিনাশ করছে; সুতরাং এ বাণগুলি শিখণ্ডীর নয়। গাণ্ডিবধন্বা ও কপিধ্বজ একমাত্র বীর অর্জুন ব্যতীত অন্য রাজারা সকলে মিলেও আমার এত পীড়া জন্মাতে পারেননি।”

তখন অর্জুনকে বিদ্ধ করবার জন্য ভীষ্ম এক ভয়ংকর শক্তি নিক্ষেপ করলেন। সমস্ত কুরুবীরদের সামনে অর্জুন সেই শক্তিকে তিন খণ্ডে ছেদন করে ফেললেন। তারপর ভীষ্ম— হয় মৃত্যু না হয় জয়— এর একটার প্রার্থী হয়ে ঢাল ও স্বর্ণখচিত তরবারি ধারণ করলেন। ভীষ্ম রথ থেকে নামার উপক্রম করতেই অর্জুন বহুতর বাণদ্বারা তাঁর সেই ঢালটিকে ছেদন করে ফেললেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির সকল সৈন্যকে ভীষ্মের দিকে ধাবিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। তেমনই কৌরবেরাও ভীষ্মকে রক্ষা করতে থেকে সিংহনাদ করতে লাগলেন। তখন অর্জুন অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে সমস্ত কৌরববাহিনীকে নিবারণ করে ভীষ্মকে বারংবার আঘাত করতে লাগলেন। অর্জুনের প্রচণ্ড আঘাতে দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, শল্য, শল প্রভৃতি বীরেরা ভীষ্মকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হলেন। সমস্ত কৌরবপক্ষকে জয় করে অর্জুন একা ভীষ্মকেই আঘাত করতে লাগলেন। তখনও ভীষ্ম শত শত ও সহস্র সহস্র বিপক্ষকে সংহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করছিলেন, কিন্তু তাঁর শরীরে দুই আঙুল স্থানও অবিদীর্ণ রইল না।

সূর্যমণ্ডলের কিছু অবশিষ্ট থাকতে অর্জুনের বাণে ক্ষতবিক্ষত ভীষ্ম সমস্ত কৌরবদের সামনে পূর্বশিরা হয়ে রথ থেকে সমরভূমিতে নিপতিত হলেন। ভীষ্ম রথ থেকে পতিত হলে আকাশে দেবগণের এবং ভূতলে সকল রাজার মুখ থেকে ‘হা হা’ ইত্যাদি বিশাল আর্তনাদ শোনা যেতে লাগল। মহাবাহু সর্বধনুর্ধর শ্রেষ্ঠ ভীষ্ম উত্তোলিত ইন্দ্ৰধ্বজের ন্যায় সমরভূমি শব্দিত করে পতিত হলেন; কিন্তু বাণসমূহে আবৃত থাকায় ভূতল স্পর্শ করলেন না। তাঁর দেহ ক্রমশ স্বর্গীয়ভাবে পরিপূর্ণ হল। তখন মেঘ বর্ষণ করতে থাকল, ভূমিকম্প হতে থাকল এবং তিনিও পতিত হবার সময়ে সূর্যকে দক্ষিণ দিকে দেখলেন। মহাবীর ভীষ্ম সেই অবস্থায় চিন্তা করলেন, “এটা দক্ষিণায়ন কাল, এ সময়ে মরা উচিত নয়।” তখন আকাশের সকল দিকে শোনা গেল, “মহাত্মা, সকল অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ ও মনুষ্যপ্রধান ভীষ্ম দক্ষিণায়ন থাকতে এই সময়ে কীভাবে মৃত্যুবরণ করবেন?” ভীষ্ম সেই স্বর্গীয় বাক্য শুনে বললেন, “আমি জীবিত আছি এবং ভূতলে পতিত হয়ে থাকলেও উত্তরায়ণের প্রতীক্ষা করতে থেকে প্রাণ ধারণ করব।” তখন হিমালয়দুহিতা গঙ্গা মহর্ষিগণকে হংসরূপে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। নরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম যেখানে শরশয্যায় শয়ন করেছিলেন, হংসরূপী ও মানসসরোবরবাসী সেই মহর্ষিরা সম্মিলিতভাবে ভীষ্মের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আকাশ থেকে নেমে এলেন এবং তাঁরা শরশয্যায় শায়িত কুরুকুলধুরন্ধর ভীষ্মকে দর্শন করলেন। জ্ঞানী ও হংসীরূপী মহর্ষিরা মহাত্মা ও ভরতশ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে দেখে তাঁকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং পরস্পরকে প্রশ্ন করলেন, “ভীষ্ম মহাত্মা হয়েও কেন দক্ষিণায়নে পরলোকে প্রস্থান করবেন?” তখন ভীষ্ম তাঁদের বললেন, “সূর্য দক্ষিণায়নে থাকতে আমি কিছুতেই পরলোক গমন করব না। এ আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। হংসগণ, পূর্বে আমার যে স্থান ছিল, সূর্য উত্তরায়ণে গমন করলে পর আমি সেই স্থানে গমন করব। আমি উত্তরায়ণের প্রতীক্ষা করে প্রাণ ধারণ করে থাকব। কারণ, প্রাণত্যাগের বিষয়ে আমার স্বাধীনতা আছে।”

ধারয়িষ্যাম্যহং প্রাণানুত্তরায়ণকাঙ্ক্ষয়া।

প্রাণানাঞ্চ সমুৎসর্গ ঐশ্বর্যং নিয়তং মম॥ ভীষ্ম : ১১৪ : ১০৯॥

“অতএব আমি উত্তরায়ণে মরবার ইচ্ছা নিয়েই প্রাণ ধারণ করে থাকব। আমার পিতা মহাত্মা শান্তনু আমাকে বর দিয়েছিলেন, ‘তোমার মৃত্যু তোমার ইচ্ছাধীন হবে।’ আমার প্রতি পিতার সেই বরদান সত্য হোক। সুতরাং আমার প্রাণত্যাগ নিশ্চিত হলেও সেই উত্তরায়ণ পর্যন্ত আমি প্রাণ ধারণ করব।” সেই হংসরূপী মহর্ষিগণকে এই কথা বলে ভীষ্ম তখন শরশয্যায় শয়ন করে রইলেন।

পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ সিংহনাদ করতে লাগলেন। মহাবল ভীমসেন বাহ্বাস্ফোটন ও গুরুতর সিংহনাদ করতে লাগলেন। কৃপাচার্য, দ্রোণ, দুর্যোধন প্রভৃতি নিশ্বাস ত্যাগ করে রোদন করতে লাগলেন। বিষাদবশত তাঁরা যেন দীর্ঘকাল ইন্দ্রিয়শূন্য হয়ে রইলেন। যুদ্ধ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেল। ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত হয়ে রইলেন।

*

কৌরবপক্ষে ধ্বংস আরম্ভ হল। অথচ দুর্যোধনের হিসাবে কোনও ভুল ছিল না। তিনি দেখেছিলেন তাঁর পক্ষে রয়েছেন ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম, অমর পুত্রের মৃত্যুসংবাদ না শুনলে মরবেন না, এমন গুরু দ্রোণাচার্য, অমর কৃপাচার্য, অক্ষয় কবচ-কুণ্ডলধারী মহাবীর কর্ণ। এঁদের পরাজিত করা কোনও দেববাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। পাণ্ডবপক্ষে বীর হিসাবে দেবতার আশীর্বাদ পেয়েছেন অর্জুন কিন্তু অমর, অবধ্য অথবা ইচ্ছামৃত্যু এমন কোনও বর তিনি পাননি। সুতরাং, দুর্যোধনের ধারণা ছিল যুদ্ধে তাঁর জয় অনিবার্য।

কিন্তু দুর্যোধন হিসাবের মধ্যে আনেননি যে, তাঁর পক্ষে ন্যায় ছিল না, ধর্ম ছিল না। ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ অন্নের ঋণশোধ করতে তাঁর পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করেছিলেন, তাঁরা অন্নদাস হয়ে নপুংসকের মতো যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসেছেন। এঁরা প্রত্যেকেই যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করেছিলেন, “তুমি যুদ্ধে জয়লাভ করো।” এ আশীর্বাদ বিপক্ষদলের রাজাকে কেউ করে না। এ আশীর্বাদের অর্থ আপন পরাজয় ও মৃত্যু আহ্বান করা। কৃপাচার্য যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, “যুধিষ্ঠির, আমি অবধ্য। কিন্তু প্রতিদিন প্রাতস্নানের সময় আমি তোমার জয় কামনা করব।” গান্ধারী দুর্যোধনকে বলেছিলেন, “ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, তোর অন্নের ঋণশোধ করতে প্রাণ দেবেন। কিন্তু এঁরা কেউ যুধিষ্ঠিরকে শত্রু হিসাবে দেখতে পারবেন না। কারণ সে ধর্মাচারী।”

ভীষ্মের মৃত্যু ধর্মের প্রথম আঘাত। ধর্ম ভীষ্মের মধ্যে মৃত্যুর ইচ্ছা সৃষ্টি করে দিলেন। কুরুবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। স্বয়ং অষ্টম বসু। গঙ্গাপুত্র দেবব্রত ভীষ্ম, যিনি সমগ্র ভারতভূমির রাজন্যবর্গের পরাজয় ঘটিয়ে কাশীরাজের তিন কন্যাকে ভ্রাতার জন্য একরথে তুলে এনেছিলেন। পিতার কামনাপূর্ণ করতে যিনি সারাজীবন উর্ধ্বরেতা রইলেন। প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে যিনি গুরু পরশুরামের আদেশ মান্য করে অম্বাকে গ্রহণ করলেন না। যুদ্ধে একুশবার পৃথিবী ক্ষত্রিয়শূন্যকারী পরশুরামকেও পরাস্ত করলেন। পরশুরাম জীবনে আর একবার মাত্র পরাজিত হয়েছিলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে সংগ্রামে। অম্বা স্বীকার করেছিলেন যে, ভীষ্মের থেকে বড় ক্ষত্রিয়বীর পৃথিবীতে নেই। তিনি শিবের তপস্যা করে লাভ করেছিলেন সেই দুর্লভ আশীর্বাদ। পরজন্মে স্ত্রীরূপে জন্মেও অম্বা পুরুষত্ব পাবেন এবং ভীষ্মকে বধ করতে পারবেন। শিখণ্ডিনীরূপে জন্মে কুবের-অনুচর স্থুণাকর্ণের সঙ্গে লিঙ্গ বিনিময় করে শিখণ্ডিনী পুরুষ শিখণ্ডী হলেন। এ সমস্ত ঘটনা জানতেন বলেই ভীষ্ম শিখণ্ডীকে আঘাত করেননি। সৌপ্তিক পর্বে শিখণ্ডীর মৃত্যু ঘটলে স্থূণাকর্ণ আবার পুরুষত্ব ফিরে পেয়েছিলেন।

পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম। পৃথিবীকে তাঁর কত কিছু দেবার ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্র তাঁকে ক্রমাগত ভিন্নপথে চালিত করতে থাকল। কামুক পিতার কাম নিবারণার্থে তিনি করলেন সেই কঠিন প্রতিজ্ঞা, “আজি হতে পৃথিবীর সমস্ত রমণী, আমার জননী।” কুরুবংশের অন্নগ্রহণের জন্য তিনি দুর্যোধন-দুঃশাসন-শকুনি-কর্ণের সমস্ত অপরাধ সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই বাল্যকাল থেকে তিনি দেখেছিলেন কৌরবদের ঈর্ষা, আর পাণ্ডবদের ধর্মপরায়ণতা। ভীমকে বিষদান, পাণ্ডবদের খাণ্ডবপ্রস্থে প্রেরণ, জতুগৃহ দাহ, দ্যূতক্রীড়া, দ্রৌপদীর উপর অকথ্য নির্যাতন ভীষ্মকে সহ্য করতে হয়েছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, কৌরববংশের ধ্বংস অনিবার্য। কৃষ্ণ ও পাণ্ডবদের সংযোগ হবার পর তিনি বার বার বলেছেন— “জয়োহস্তু পাণ্ড-পুত্ৰাণাম্‌ যেষাং পক্ষে জনার্দনঃ।” সারা ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয় রাজাদের তিনি জানতেন। তিনি জানতেন, অর্জুনের থেকে বড় বীর পৃথিবীতে আসেনি আর আসবেও না। যুধিষ্ঠিরকে তিনি কতটা চিনেছিলেন, তা অজ্ঞাতবাসের সময় তাঁর দুর্যোধনকে বলা কথার মধ্যেই ধরা পড়েছে।

সেই ভীষ্ম পতিত হলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের তিন-চতুর্থাংশ শেষ হল। ভীষ্মের পতন তাই মহাভারতের এক আশ্চর্য দুর্লভ মুহূর্ত।

৬৫
শরশয্যায় ভীষ্ম

কুরুপিতামহ ভীষ্ম নিপতিত হলে, সমস্ত লোকই হাহাকার করতে লাগল। সৈন্যসমূহ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল। পাণ্ডবেরা সকলে জয়লাভ করে সমরাঙ্গনে থেকে স্বর্ণভূষিত শঙ্খধ্বনি করতে লাগল। ওদিকে কৌরবপক্ষে গুরুতর মোহ উপস্থিত হল, কর্ণ ও দুর্যোধন মুহুর্মুহু নিশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন। ভীষ্মকে নিপতিত দেখে দুঃশাসন অত্যন্ত দ্রুত দ্রোণাচার্যের কাছে উপস্থিত হলেন। দুঃশাসন দ্রোণের কাছে উপস্থিত হয়ে ভীষ্মের নিধনবার্তা জানালেন। দ্রোণ সেই অপ্রিয় বার্তা শুনেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। চৈতন্য লাভ করেই দ্রোণ আপন সৈন্যদের যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করলেন। সৈন্যেরা নিবৃত্ত হলে রাজারাও বর্ম পরিত্যাগ করে ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন। দেবতারা যেমন ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হন, তেমনই শত শত সহস্র সহস্র যোদ্ধা যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হয়ে মহাত্মা ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হলেন।

সকলে অভিবাদন করে করজোড়ে সম্মুখে উপস্থিত হলে, ধর্মাত্মা শান্তনুনন্দন ভীষ্ম তাঁদের বললেন, “মহাভাগগণ‘! আপনাদের শুভাগমন হয়েছে তো? দেবতুল্যগণ! আপনাদের দর্শনে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।” ভীষ্ম এইরূপে তাঁদের অভিনন্দিত করে নিজের মাথাটা ঝুলছিল বলে বললেন, “আমার মাথাটা বড় ঝুলছে, একটা বালিশ দিন।” তখন রাজারা আপন আপন শিবির থেকে সূক্ষ্মবস্তুনির্মিত ও কোমল উত্তম উপাধান নিয়ে এলেন। কিন্তু ভীষ্ম সেগুলো গ্রহণ করলেন না। তিনি বললেন, “রাজগণ এগুলি বীরশয্যার উপযুক্ত নয়।” তারপর তিনি নরশ্রেষ্ঠ, মহাবাহু ও সমগ্র জগতের মহারথ পাণ্ডুনন্দন অর্জুনের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, “মহাবাহু বৎস ধনঞ্জয়! আমার মাথাটা ঝুলছে। সুতরাং তুমি এই বীরশয্যার উপযুক্ত উপাধান আমাকে দাও।” তখন অর্জুন ভীষ্মকে অভিবাদন করে বিশাল গাণ্ডিবে গুণ আরোপণ করে অশ্রুপূর্ণ নয়নে বললেন, “কৌরবশ্রেষ্ঠ! সর্বশস্ত্রধারিপ্রধান! দুর্ধর্ষ! পিতামহ! আমি আপনার দাস; আপনি আদেশ করুন, আমি কী করব।” তখন ভীষ্ম তাঁকে বললেন, “বৎস, আমার মাথাটা ঝুলছে, সুতরাং তুমি এই বীরশয্যার যেরূপ উপাধানকে উপযুক্ত মনে করো, তাই দাও।”

উপাধানং কুরুশ্রেষ্ঠ! উপধেহি মমার্জুন।

বীরশয্যানুরূপং বৈ শীঘ্রং বীর! প্রয়চ্ছ মে॥ ভীষ্ম : ১১৫ : ৪১॥

—“কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জুন! তুমি আমার মস্তকের নিম্নে বীরশয্যার অনুরূপ উপাধান স্থাপন করো; বীর! শীঘ্র আমাকে বালিশ দাও।”

“পৃথানন্দন! তুমি সর্বধনুর্ধরশ্রেষ্ঠ, সুতরাং তুমিই এ বিষয়ে সমর্থ, বিশেষত তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম জান এবং বুদ্ধি, মন ও নানাগুণসম্পন্ন।” “তাই হোক” বলে অর্জুনও সাহস করবার ইচ্ছা করলেন। ক্রমে তিনি গাণ্ডিবধনু ও নতপূর্ব তিনটি বাণ নিয়ে অভিমন্ত্রিত্ব করে এবং মহাত্মা ভীষ্মের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তীক্ষ্ণ ও মহাবেগশালী সেই তিনটি বাণ দ্বারা ভীষ্মের মাথাটি তুলে দিলেন। অর্জুন ভীষ্মের অভিপ্রায় বুঝলে, ধর্মাত্মা, ভরতবংশশ্রেষ্ঠ ও ধর্মার্থতত্ত্ববিৎ ভীষ্ম সন্তুষ্ট হলেন। উপাধান দান করায় তিনি অর্জুনের প্রতি আনন্দিত হলেন। তখন ভীষ্ম সমস্ত ভরতবংশীয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করে অর্জুনকে বললেন, “কুন্তীপুত্র! যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ! বন্ধুজনের প্রীতিবর্ধক! পাণ্ডব! তুমি আমার শয্যার অনুরূপ উপাধানই দিয়েছ। তুমি যদি অন্যরূপ বুঝতে তা হলে আমি তোমাকে অভিসম্পাত করতাম। মহাবাহু! ধার্মিক ক্ষত্রিয় যুদ্ধে শরশয্যায় পতিত হয়ে এইভাবেই শয়ন করে থাকেন।” তিনি অর্জুনকে এই কথা বলে সকল দিকে অবস্থিত সকল রাজা ও রাজপুত্রদের বললেন, “রাজগণ, অর্জুন আমাকে যে উপাধান দিয়েছেন, তা আপনারা দর্শন করুন। রাজগণ, সূর্য উত্তরদিকে আসা পর্যন্ত আমি এই শয্যাতেই শয়ন করে থাকব। তখন যাঁরা আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসবেন, তাঁরা আমাকে এইভাবেই দেখতে পাবেন। সূর্য যখন সমস্ত লোক সন্তপ্ত করে উজ্জ্বল রথে উত্তরদিকে যেতে আরম্ভ করবেন, তখন আমি প্রিয় বন্ধুর মতো প্রাণকে ত্যাগ করব। সুতরাং রাজগণ আপনারা আমার এই স্থানে পরিখা খনন করে দিন। আমি এইরূপ শত শত বাণপূর্ণ দেহেই সূর্যের উপাসনা করব। রাজগণ আপনারা শত্রুতা ত্যাগ করে যুদ্ধ থেকে বিরত হোন।”

তারপরে বিশেষ শিক্ষিত এবং শল্যোত্তোলনে নিপুণ বৈদ্যগণ সর্বপ্রকার উত্তম উত্তম চিকিৎসার উপকরণ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। তাঁদের দেখে ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, “দুর্যোধন এই চিকিৎসকদের দাতব্য ধন দান করে এবং সম্মানিত করে বিদায় করো। কারণ, এই অবস্থায় এখন আমার আর চিকিৎসকের কোনও প্রয়োজন নেই। কেন না, ক্ষত্রিয়ধর্মে প্রশস্ত পরম গতিই আমি লাভ করেছি। রাজগণ আমি শরশয্যায় রয়েছি। এখন চিকিৎসা করানো আমার উচিত নয়, এই বাণগুলির সঙ্গেই আমাকে আপনারা দগ্ধ করবেন।” ভীষ্মের কথা শুনে দুর্যোধন যোগ্যতা অনুসারে সম্মানিত করে বৈদ্যগণকে বিদায় করলেন।

তারপর সমবেত রাজবৃন্দ তাঁকে অভিবাদন ও তিন বার প্রদক্ষিণ করে আপন আপন শিবিরে চলে গেলেন।

ভীষ্মের পতনে আনন্দিত পাণ্ডবেরা শিবিরে প্রবেশ করলে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, “কৌরবনন্দন, ভাগ্যবশত আপনি জয়লাভ করেছেন এবং ভাগ্যবশতই মানুষের অবধ্য, সত্যপ্রতিজ্ঞ ও মহারথ ভীষ্ম নিপাতিত হয়েছেন। পৃথানন্দন! অথবা দেবতারাই সর্বশাস্ত্ৰপারগামী ভীষ্মকে নিপতিত করেছেন। কিংবা আপনি নয়নের তেজেই শত্ৰু সংহার করে থাকেন। সুতরাং ভীষ্ম আপনার কাছে এসে আপনার নয়নের তেজেই দগ্ধ হয়েছেন।” কৃষ্ণ একথা বললে, যুধিষ্ঠির উত্তরে বললেন, “কৃষ্ণ তোমার অনুগ্রহে লোকের জয় হয়, আবার ক্রোধে পরাজয় হয়ে থাকে। কৃষ্ণ তুমিই আমাদের রক্ষক এবং তুমি ভক্তদের ভয়নাশক। অতএব কেশব, তুমি যাদের উপর প্রসন্ন হও, তাদের জয়লাভ অসম্ভব নয়। তুমি যুদ্ধে সর্বদা আমাদিগকে রক্ষা করে থাক। সুতরাং নিশ্চয়ই তোমাকে পেয়ে আজ আমরা জয়লাভ করেছি। অতএব আমাদের এই বিজয়, আমার কাছে বিস্ময়ের নয়।” কৃষ্ণ একথা শুনে বললেন, “রাজশ্রেষ্ঠ এ কথা আপনার পক্ষে উপযুক্তই বটে।”

পরদিন প্রভাত হলে সমস্ত পাণ্ডব, কৌরব ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হলেন। ভীষ্মকে অভিবাদন করে তাঁরা সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সহস্র সহস্র কন্যা সেইখানে গিয়ে ভীষ্মের দেহের উপর চন্দনচূর্ণ, লাজ, সর্বপ্রকার পুষ্পমাল্য ঢেলে দিতে লাগলেন। শীতকালে প্রাণীগণ যেমন সূর্যের কাছে আসে, তেমনই স্ত্রী, বৃদ্ধ, বালক, ইতর লোক, তূর্য, নট, নর্তক এবং শিল্পীরাও ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হল। যুদ্ধসজ্জা ও অস্ত্র পরিত্যাগ করে পূর্বের ন্যায় প্রীতিসহকারে পাণ্ডব ও কৌরবেরা শত্রুবিজয়ী ভীষ্মের কাছে অবস্থান করতে থাকলেন। দেবাধিপতি ব্রহ্মার উপাসনায় প্রবৃত্ত দেবসভা যেমন বিশেষ শোভা পায়, তেমনই ভীষ্মের উপাসনায় প্রবৃত্ত সেই সভাটিও বিশেষ শোভা পেতে লাগল।

শরাঘাতে বিদীর্ণদেহ, সন্তপ্তচিত্ত এবং অস্ত্রাঘাতে মূৰ্ছিত ভীষ্ম ধৈর্যগুণে, বেদনার বেগ নিরুদ্ধ রেখে সেই রাজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “জল…।” তারপর ক্ষত্রিয়েরা সকল দিক থেকে নানাবিধ খাদ্য ও শীতলজলপূর্ণ কুম্ভ নিয়ে এলেন। তখন শান্তনুনন্দন ভীষ্ম বললেন, “বৎসগণ! এখন আমি আর মনুষ্যলোকের কোনও ভোগ্যবস্তু গ্রহণ করতে পারি না। আমি মনুষ্যলোকের বাইরে চলে এসেছি, শরশয্যায় রয়েছি, চন্দ্র ও সূর্যের গতির পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছি। রাজগণ আমি স্বর্গীয় জল পান করব, কিন্তু পৃথিবীর জল নয়। পর্জন্যাস্ত্র যোগবশত অগ্নিবর্ণ বাণের প্রভাবে স্বর্গীয় জল সম্ভবপর হবে, কিন্তু সে জল পৃথিবীর হবে না।” এই বলে বাক্যদ্বারা রাজাদের নিন্দা করে ভীষ্ম বললেন, “অর্জুনকে দেখতে চাই।” তখন মহাবাহু অর্জুন কাছে গিয়ে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, “আদেশ করুন, আমি কী করব।” অর্জুনকে সামনে দেখে ভীষ্ম সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “বৎস! তোমার বাণ আমাকে সেলাই করে ফেলেছে। শরীর যেন দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মর্ম সন্তপ্ত হচ্ছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, শরীরে দারুণ বেদনা বোধ করছি। অতএব অর্জুন আমাকে জল দাও। মহাধনুর্ধর! তুমি যথাবিধানে স্বর্গীয় জলদানে সমর্থ।” তখন অর্জুন “তাই হোক” বলে রথে আরোহণ করে গুণ আরোপ করে গাণ্ডিবধনু আকর্ষণ করলেন। বজ্রধ্বনির ন্যায় সেই গাণ্ডিবের টংকারে সমবেত সকলে কেঁপে উঠলেন। তখন রথীশ্রেষ্ঠ অর্জুন রথদ্বারা শরশয্যায় শায়িত ভরতশ্রেষ্ঠ ও সর্বশস্ত্রধারীপ্রধান ভীষ্মকে প্রদক্ষিণ করে সমস্ত লোকের সামনে মন্ত্রপাঠপূর্বক একটি উজ্জ্বল বাণ সন্ধান করে তাতে পর্জন্যাস্ত্র সংযুক্ত করে ভীষ্মের দক্ষিণপার্শ্বে ভূতল বিদ্ধ করলেন। তারপরই শীতল, অমৃততুল্য এবং স্বর্গীয় সৌরভ ও আস্বাদযুক্ত জলের নির্মল ও সুন্দর ধারা উঠতে লাগল। তখন অর্জুন সেই শীতল জলদ্বারা কৌরবশ্রেষ্ঠ, দিব্য পরাক্রম ও দিব্যভাবাপন্ন ভীষ্মকে পরিতৃপ্ত করলেন।

ইন্দ্রের মতো বিশেষ কার্যকারী অর্জুনের সেই কার্যদ্বারা রাজারা সকলেই অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। অর্জুনের সেই কার্য দেখে শীতার্ত গো-সমূহের মতো কৌরবরা কাঁপতে লাগলেন। সকল দিকের রাজারা বিস্ময়ে উত্তরীয় সঞ্চালন করতে লাগলেন। চারদিকে শঙ্খ ও দুন্দুভি বাজতে লাগল। ভীষ্মও অত্যন্ত তৃপ্তিলাভ করে ক্ষত্রিয় বীরদের সামনেই অর্জুনকে বললেন, “মহাবাহু! কৌরবনন্দন! অমিততেজা! তোমার পক্ষে এ কাজ আশ্চর্য নয়। কারণ, নারদ বলেছেন তুমি প্রাচীন ঋষি ‘নর’ স্বয়ং। দেবগণের সঙ্গে ইন্দ্র যে কাজ করতে পারেন না, কৃষ্ণকে সহায় করে তুমি নিশ্চয় সেই কার্য সাধন করবে। ত্রিকালজ্ঞ লোকেরা তোমাকে সর্বক্ষত্রিয় নিধনকারী বলে জানেন এবং পৃথিবীর মানুষের মধ্যে তুমিই ধনুর্ধরশ্রেষ্ঠ। জগতে প্রাণীগণের মধ্যে মনুষ্য শ্রেষ্ঠ, পক্ষীগণের মধ্যে গরুড় প্রধান, স্রোতোবাহী জলের মধ্যে সমুদ্র শ্রেষ্ঠ এবং চতুষ্পদ প্রাণীগণের মধ্যে গো প্রধান। তেজের মধ্যে সূর্য প্রধান, পর্বতের মধ্যে হিমালয় প্রধান, জাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, আর ধনুর্ধরদের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রধান।”

আদিত্যস্তেজসাং শ্রেষ্ঠো গিরীণাং হিমবান বরঃ।

জাতীনাং ব্রাহ্মণঃ শ্রেষ্ঠঃ শ্রেষ্ঠস্ত্বমসি ধন্বিনাম্‌॥ ভীষ্ম : ১১৬ : ৩৬॥

“দেখো, আমি সন্ধি করার কথা বলেছি, বিদুর, দ্রোণ, পরশুরাম, কৃষ্ণ এবং সঞ্জয়ও বার বার বলেছেন; তথাপি দুর্যোধন সে সকল বাক্য শোনেনি। এবং বিপরীতবুদ্ধি ও অচৈতন্যতুল্য দুর্যোধন আমার সে সব বাক্য বিশ্বাসও করে না। সুতরাং শাস্ত্ৰলঙ্ঘনকারী দুর্যোধন ভীমসেনের বলে অভিভূত ও নিহত হয়ে চিরকালের মতো শয়ন করবে।” ভীষ্মের এই কথা শুনে কুরুরাজ দুর্যোধন বিষণ্ণচিত্ত হলেন। তখন ভীষ্ম তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “রাজা শোনো, পাণ্ডবদের প্রতি ক্রোধ পরিত্যাগ করো! দুর্যোধন তুমি এই ঘটনা নিজের চোখেই দেখলে। অর্জুন অমৃতের ন্যায় সৌরভযুক্ত শীতল জলধারা উৎপাদন করলেন। এ জগতে অন্য কোনও লোক এই কার্য করতে পারে না। বিশেষত আগ্নেয়, বারুণ, সৌম্য, বায়ব্য, বৈষ্ণব, ঐন্দ্র, পাশুপত এবং ধাতা, বিশ্বকর্মা ও সূর্য এঁদের অস্ত্র এবং যমের অস্ত্র— এই সকল অস্ত্র সমগ্র মর্ত্যলোকে একমাত্র অর্জুন ও দেবকীনন্দন কৃষ্ণই জানেন—অন্য কোনও লোকই জানে না। বৎস তুমি যুদ্ধে কোনও প্রকারেই অর্জুনকে জয় করতে পারবে না। যে অর্জুন এইসব অলৌকিক কাজ করতে পারেন, সেই অধ্যবসায়শালী, যুদ্ধশোভী ও বীর সেই অর্জুনের সঙ্গে তোমার এখনই সন্ধি হোক। যে পর্যন্ত অর্জুন তোমার সমস্ত সৈন্য বিনাশ না করছেন, তার মধ্যেই তোমার সঙ্গে সন্ধি হোক। রাজা তোমার অবশিষ্ট ভ্রাতারা, অন্য যে সমস্ত রাজা এখনও জীবিত আছেন, তাঁদের জন্যই তুমি সন্ধি করো। রাজা তুমি ক্রোধ পরিত্যাগ করে পাণ্ডবদের সঙ্গে বিশেষভাবে শান্ত হও। অর্জুন যা করেছেন, তাই যথেষ্ট হয়েছে। ভীষ্মের বিনাশের পর তোমাদের সৌহার্দ্য হোক; অবশিষ্ট যোদ্ধারা জীবিত থাকুন, তুমি সর্বতোভাবে প্রসন্ন হও। পাণ্ডবদের অর্ধ রাজ্য দান করো এবং যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করুন। তা হলে তোমাকে লোকে আর মিত্রদ্রোহী নিকৃষ্ট মানবের নিন্দা করবে না। আমার বিনাশেই প্রজাদের শান্তি হোক, পিতা-পুত্রকে, ভ্রাতা-ভ্রাতাকে, মাতুল ভাগিনেয়কে লাভ করুন। আমার এই কথা যদি তুমি না শোন তবে তোমাদের সকলের শেষ বলেই জানবে।” মুমূর্ষু রোগীর যেমন ঔষধে রুচি হয় না, ভীষ্মের বাক্য শুনে দুর্যোধনেরও রুচি হল না।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে রাজারা আপন আপন শিবিরে ফিরে গেলেন। অন্যদিকে পুরুষশ্রেষ্ঠ কর্ণ ভীষ্ম নিহত শুনে অন্ধকারেই ভীষ্মের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি এসে দেখলেন পূর্বকালে জন্মমুহূর্তে প্রভাবশালী কার্তিক যেমন শুয়ে ছিলেন, ভীষ্মও তেমন করে শুয়ে আছেন। তখন মহাতেজা কর্ণ মুদ্রিতনয়ন বীর ভীষ্মের কাছে গিয়ে তাঁর দুই পা জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, “কৌরবশ্রেষ্ঠ, আমি রাধার পুত্র কর্ণ এবং আমি সর্বতোভাবে নির্দোষ হলেও আপনার অত্যন্ত বিদ্বেষের পাত্র ছিলাম। আর আমি সব সময়েই আপনার চোখের সামনেই থাকতাম।”

তা শুনে কুরুকুলবৃদ্ধ ভীষ্ম জোর করে চোখ খুললেন এবং রক্ষীগণকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে, পিতা যেমন পুত্রকে আলিঙ্গন করেন, তেমনই একহাতে কর্ণকে আলিঙ্গন করে, ধীরে ধীরে তাঁর দিকে তাকিয়ে স্নেহের সঙ্গে বললেন, “কর্ণ তুমি যে আমার সঙ্গে স্পর্ধা করে থাক, তার জন্য তোমার প্রতি আমার অপ্রিয় আচরণ নয়। সে যা হোক, তুমি যদি আমার কাছে না আসতে, তবে নিশ্চয়ই তোমার মঙ্গল হত না। মহাবাহু, তুমি কুন্তীর পুত্র, রাধার পুত্র নও এবং অধিরথও তোমার পিতা নয়! কিন্তু সূর্যদেব তোমার পিতা; একথা আমি নারদের মুখে শুনেছি। এবং বেদব্যাসের মুখেও শুনেছি, আর তোমার তেজ দেখেও বুঝেছি। সুতরাং এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তারপর স্বভাবতও তোমার উপরে আমার কোনও বিদ্বেষ নেই। তবে তোমার তেজোহানি করার জন্য আমি তোমাকে নিষ্ঠুর কথা বলেছি। কারণ আমার ধারণা তুমি সম্পূর্ণ বিনা কারণে পাণ্ডবদের উপর বিদ্বেষ করে থাক। রাজা দুর্যোধন তোমাকে পাণ্ডব বিদ্বেষে প্ররোচনা দিয়েছেন, তুমিও পাণ্ডববিদ্বেষে নিজেকে আচ্ছন্ন করেছ। তুমি ধর্মের ব্যতিক্রমে জন্মেছ। তাই তোমার স্বভাবও ধর্মবিরুদ্ধ হয়েছে। বিশেষত নীচাশয় দুর্যোধনের আশ্রয়বশত তুমি অত্যন্ত পরশ্রীকাতর হয়ে গুণিগণের উপরেও বিদ্বেষের ভাব পোষণ করো। এই জন্য আমি কৌরবসভায় তোমাকে বারবার রুক্ষ কথা বলেছি।

“বাস্তবিক পক্ষে তোমার বেদানুবর্তিতা, বীরত্ব, দানে পরম নিষ্ঠা, যুদ্ধে তোমার শক্তি শত্রুগণের দুঃসহ এ সমস্তই আমি জানি। দেবতুল্য! মানুষের মধ্যে তোমার তুল্য কোনও মানুষ নেই। তবুও বংশের মধ্যে ভেদ ঘটবে এই ভয়ে আমি সর্বদা তোমাকে নিষ্ঠুর কথা বলেছি। বাণে, অন্য অস্ত্রে, কিংবা তার সন্ধানে, দ্রুত অস্ত্র নিক্ষেপে এবং অস্ত্রশক্তিতে তুমি অর্জুনের ও মহাত্মা কৃষ্ণের তুল্য। কর্ণ তুমি কাশীনগরে গিয়ে একাকী ধনু ধারণ করে কুরুরাজের কন্যার জন্য যুদ্ধে রাজাগণকে পরাভূত করেছিলে। বলবান ও দুর্ধর্ষ রাজা জরাসন্ধও তোমার তুল্য যোদ্ধা ছিলেন না। তুমি বেদানুবর্তী, অধ্যবসায়, তেজ ও বলের সঙ্গে যুদ্ধকারী, যুদ্ধে মনুষ্যের থেকে অধিক, এমনকী তুমি যুদ্ধে দেবপুত্রের তুল্য। আমি পূর্বে তোমার প্রতি যে ক্ৰোধ করতাম, আজ তুমি তা দূর করেছ। তবে পুরুষকার দ্বারা দৈবকে কখনও দূর করা যায় না। মহাবাহু শত্রুদমন। পাণ্ডবেরা তোমার সহোদর ভ্রাতা। অতএব তুমি যদি আমার প্রিয় কার্য করতে চাও তবে গিয়ে পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হও। আমার মৃত্যুর পর উভয়পক্ষের শত্রুতার অবসান ঘটুক এবং আজ থেকে পৃথিবীর সকল রাজা নিরুপদ্রব হোন।”

কর্ণ উবাচ

জানাম্যের মহাবাহো! সর্বমেতন্ন সংশয়ঃ।

যথা বদসি দুর্ধর্ষ! কৌন্তেয়োহহং ন সূতজঃ॥ ভীষ্ম : ১১৭ : ২৩॥

কর্ণ বললেন, “মহাবাহু দুর্ধর্ষ গাঙ্গেয়! আপনি যে বলেছেন, আমি কুন্তীর পুত্র, কিন্তু সূতের পুত্র নই, এ সমস্তই আমি জানি এবং এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহও নেই।”

“তবে কুন্তী দেবী আমাকে জলে নিক্ষেপ করেছিলেন, আর অধিরথ আমাকে বড় করে তুলেছিলেন। তারপর আমি এ যাবৎ দুর্যোধনের ঐশ্বর্য ভোগ করে এখন আর তা নিষ্ফল করে দিতে পারি না। বিশেষত কৃষ্ণ যেমন পাণ্ডবগণের জয়ের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেইরূপ আমারও ধন, শরীর, পুত্র, ভার্যা ইত্যাদি সমস্তই আমি দুর্যোধনের জন্য উৎসর্গ করেছি। সুতরাং যে বিষয় অবশ্যই ঘটবে, তাকে আর ফেরানো যায় না। কারণ, কোন লোক পুরুষকার দ্বারা দৈবকে ফিরাতে পারে? তারপরে পিতামহ আপনি পৃথিবীর ক্ষয়সূচক দুর্লক্ষণ দেখেছেন এবং সভাতেও তা বলেছেন। আবার কৃষ্ণ ও অর্জুন যে অন্য লোকের অজেয়, তা আমি অত্যন্ত ভালভাবেই জানি। তবুও আমি তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই এবং যুদ্ধে তাঁদের জয় করতে চাই। কাজেই এই দারুণ শত্রুতা ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আমি স্বধর্মে থেকে সন্তুষ্টচিত্তে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব। আমি যুদ্ধে কৃতনিশ্চয়। সুতরাং আপনি আমাকে অনুমতি দান করুন। কারণ আমার ইচ্ছা, আপনার অনুমতি নিয়েই আমি যুদ্ধ করব। পিতামহ লঘু চাপল্যবশত আমি আপনাকে অনেক কটু কথা বলেছি। আপনার সম্মানহানি ঘটিয়েছি, অনিষ্ট করেছি। আপনি সে অপরাধ ক্ষমা করুন।”

ভীষ্ম বললেন, “কর্ণ তুমি যদি এই অতিদারুণ শত্রুতা ত্যাগ করতে না পার, তবে আমি তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি— তুমি ক্রোধ ও বিকট উৎসাহ ত্যাগ করে, যুদ্ধের সমস্ত নিয়ম মেনে সজ্জনের মতো ব্যবহার করে, কেবল স্বর্গলাভের ইচ্ছায় শক্তি ও উৎসাহ অনুসারে যুদ্ধ করো। কর্ণ আমি তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি—তুমি যা ইচ্ছা করো তা লাভ করো। তুমি যে ক্ষত্রিয়ধর্মবিজিত লোক লাভ করবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তুমি অহংকারশূন্য হয়ে বল ও বীর্য অবলম্বন করে যুদ্ধ করো। মনে রেখো, ধর্মসঙ্গত যুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে অন্য কোনও মঙ্গলজনক ব্যাপার নেই। কর্ণ আমি শান্তির জন্য বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।” ভীষ্ম নীরব হলেন, কর্ণ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রোদন করলেন, তারপর প্রণাম করে সেই স্থান ত্যাগ করলেন।

*

‘শরশয্যায় ভীষ্ম’ বহু কারণেই মহাভারতের এক আশ্চর্য দুর্লভ মুহূর্ত। প্রথমেই আমরা দেখতে পাই, ভীষ্মের অপার কষ্টসহিষ্ণুতা। তিনি ইচ্ছামৃত্যু, তিনি ঘোষণা করলেন, সূর্য উত্তরায়ণে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি দেহত্যাগ করবেন না। এই শরশয্যায় ভীষ্ম ছাপ্পান্ন দিন শায়িত ছিলেন। কিন্তু রথ থেকে পতিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুভব করেছিলেন, মনুষ্যলোকের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর শেষ হল। তিনি প্রয়োজনের জন্য কোনও পার্থিব বস্তু আর চাননি। উপাধান হিসাবে অর্জুনের কাছে যা প্রত্যাশা করেছিলেন, তিন শরে তাঁর মাথা তুলে দিয়ে অর্জুন তা পূর্ণ করলেন। অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হয়েও তিনি পৃথিবীর পানীয় আর গ্রহণ করেননি। এবারও অর্জুন পর্জন্যাস্ত্রে পাতাল থেকে ভোগবতীর স্বর্গীয় পানীয় তুলে এনে তাঁর তৃষ্ণার নিবারণ ঘটিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, মৃত্যু মুহূর্তেও ভীষ্ম শান্তিকামী। কৌরববংশ ধ্বংস হয়ে যাক, এ তিনি কখনও চাননি। দুর্যোধনকে শেষবারের মতো যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সন্ধি করতে বলেছেন। বলেছেন, তাঁর মৃত্যুতেই বিরোধের শেষ হোক।

তৃতীয়ত, ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু। তিনি ছাপ্পান্ন দিন সূর্যের উত্তরায়ণের প্রতীক্ষা করেছেন। এই সময়ে তিনি দিয়েছেন ভারতবর্ষের ভাবী রাজা যুধিষ্ঠিরকে বিশ্ববিদ্যা। সে বিশ্ববীক্ষণ ক্ষমতা তাঁকে দিয়েছিলেন কৃষ্ণ। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভীষ্ম একক শিক্ষক, যুধিষ্ঠির একমাত্র শিক্ষার্থী। অষ্টম বসু, গঙ্গাপুত্র দেবব্রত ভীষ্ম চিরকাল ঊর্ধ্বরেতা থাকলেন। তিনি দুর্যোধন প্রদত্ত অন্নের ঋণ পরিশোধ করলেন আপন মৃত্যুর বিনিময়ে। কিন্তু তাঁর স্নেহ, শুভেচ্ছা আশীর্বাদ লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন পাণ্ডুপুত্রেরা। কারণ তিনি জানতেন ধর্মাত্মা পাণ্ডবদের পক্ষে ঈশ্বর। তাই, ভীষ্ম বিশ্বাস করতেন “জয়োস্তু পাণ্ডু পুত্ৰাণাং যেষাম্‌ পক্ষে জনার্দনঃ।”

এই দুর্লভ মুহূর্তে আমরা আবার দেখলাম, অলৌকিক কার্যকারী পৃথিবীর সকল ক্ষত্রিয়ের শ্রেষ্ঠ অতিরথ অর্জুনকে। অস্ত্র প্রয়োগের আগে অর্জুনের মনস্তত্ত্বজ্ঞান আমাদের মুগ্ধ করে। সর্বশ্রেষ্ঠ মহারথ শান্তনুনন্দন ভীষ্ম রথ থেকে পতিত হলেন অর্জুনের তীক্ষ্ণ শরে। কিন্তু পিতামহ ভীষ্মকে অর্জুন যতটা শ্রদ্ধা করতেন, ভীষ্মও ততটাই স্নেহ করতেন অর্জুনকে। তাই ঝুলন্ত মস্তক তুলে দেওয়ার উপাধান নির্বাচনের ভার ভীষ্ম অর্জুনকেই দিয়েছিলেন। অর্জুনও বীরের যোগ্য উপাধানই তাঁকে দিয়েছিলেন। তিনটি বাণ নিক্ষেপ করে ভীষ্মের ঝুলন্ত মস্তক তুলে দিয়েছিলেন। ভীষ্ম হৃদয়ের অন্তস্তল থেকেই আশীর্বাদ করেছিলেন অর্জুনকে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল ভীষ্ম শীতল পানীয় দেবার অনুরোধ করলে। রাজাদের আনা শীতল, সুগন্ধী পানীয় ভীষ্ম প্রত্যাখ্যান করলেন। সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি অর্জুনকে দেখতে চাইলেন। অর্জুন পর্জন্যাস্ত্রে ভূতল ভেদ করে পাতাল থেকে ভোগবতীর ধারা তুলে আনলেন। ভীষ্ম তৃপ্ত হলেন। শুধু তৃপ্ত হওয়াই নয়। ভীষ্ম জানতেন ভারতবর্ষের ধনুর্ধরদের মধ্যে একা অর্জুনই পারবেন, তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ করতে। তিনি সমবেত সকলের সামনে অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

এ দুর্লভ মুহূর্তের শেষ অংশটি ভীষ্ম সমাগমে কর্ণের উপস্থিতি। অনুতপ্ত কর্ণ ক্ষমা চাইলেন, ভীষ্মকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কটূক্তি করার জন্য। ভীষ্ম ক্ষমা করলেন, কিন্তু এখনও তিনি স্পষ্টবক্তা। তিনি কর্ণকে জানালেন তিনি সূর্যপুত্র, কৌন্তেয় হওয়া সত্ত্বেও সমস্ত জীবন বিনা কারণে সহোদর ভ্রাতাদের বৈরিতা করেছেন। তাঁরা কেউ তাঁর শত্রু ছিলেন না। তিনি কর্ণকে ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হবার পরামর্শ দিলেন। বললেন, তাঁর মৃত্যুতেই এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষ হোক। কিন্তু অভিমানী কর্ণ জানালেন যে তা আর সম্ভব নয়। তিনি মাতৃ-পরিত্যক্ত একথা জানালেও, পিতার আদেশেই যে মাতা পরিত্যাগ করেছিলেন, তার উল্লেখ করলেন না। তিনি জানেন যে, যুদ্ধে কৃষ্ণার্জুন অজেয়। তবুও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ তাঁর একমাত্র কামনা। তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভীষ্মের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। ভীষ্ম অনুমতি দিলেন, কর্ণ ধর্মানুসারে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুন।

৬৬
দুর্যোধনের বর গ্রহণ

ভীষ্মের পতনের পর দুর্যোধন কর্ণের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রোণকে কৌরব সেনাপতিরূপে অভিষিক্ত করলেন। তখন দ্রোণ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে দুর্যোধনকে বললেন, “ভরতনন্দন রাজা, কৌরব-শ্রেষ্ঠ ভীষ্মের পরে আমাকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করে তুমি আজ আমাকে যে সম্মানিত করলে, সেই কার্যের অনুরূপ ফল লাভ করো। বলো, আমি তোমার কোন অভীষ্ট পূরণ করব? আজ তুমি যা ইচ্ছা করো, সেই বর গ্রহণ করো।”

তারপর রাজা দুর্যোধন কর্ণ ও দুঃশাসন প্রভৃতির সঙ্গে পরামর্শ করে দুর্ধর্ষ ও বিজয়ীশ্রেষ্ঠ দ্রোণকে বললেন, “রথীশ্রেষ্ঠ! আমাকে যদি বরই দেন, তবে জীবিত অবস্থায় যুধিষ্ঠিরকে ধরে আমার কাছে এনে দিন।” দুর্যোধনের কথা শুনে কৌরবাচার্য দ্রোণ উপস্থিত সমস্ত সৈন্যের আনন্দবর্ধন করে বললেন, “অতি দুর্ধর্ষ রাজা! যুধিষ্ঠির ধন্য। কারণ, তুমি আজ তাঁর বধের জন্য বর চাইলে না, কেবল ধরে আনবার বর চাইলে। নরশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন, কী জন্য তুমি যুধিষ্ঠির-বধ বর চাইলে না? নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বাস করো যে, আমি কিছুতেই সে কাজ করব না। অথবা সেই ধর্মরাজের কোনও বিদ্বেষী লোক নেই। এই কারণেই তুমিও চাইছ যে তিনি জীবিত থাকুন। অথবা তুমি নিজের বংশ রক্ষা করলে। এমনকী হতে পারে যে, তুমি তাঁদের রাজ্যাংশ ফিরিয়ে দিয়ে ভ্রাতৃসৌহার্দ্য ইচ্ছা করছ? সে যাই হোক, রাজা যুধিষ্ঠির ধন্য, সেই ধীমানের জন্ম সফল এবং তাঁর অজাতশত্রুতাও সত্য। সেই কারণেই তুমি তাঁর উপর সহৃদয় ব্যবহার করছ।”

দ্রোণাচার্য একথা বললে, দুর্যোধনের হৃদয়ে সর্বদা যে চিন্তা গুপ্ত ছিল, তা তৎক্ষণাৎ বাইরে চলে এল। বৃহস্পতির তুল্য লোকেরাও মনের ভাব প্রকাশ রাখতে পারেন না। তখন দুর্যোধন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বললেন, “আচার্য যুধিষ্ঠিরকে বধ করলেও আমার জয় হবে না। কারণ যুধিষ্ঠিরকে বধ করলে, নিশ্চয়ই অন্য পাণ্ডবেরা আমাদের সকলকে বধ করবে। তারপরে, দেবতারাও যুদ্ধে সমস্ত পাণ্ডবকে বধ করতে সমর্থ হবেন না; সুতরাং তাদের মধ্যে যে অবশিষ্ট থাকবে, সেই আমাদের শেষ করে ছাড়বে। কিন্তু সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে আসতে পারলে এবং তাঁকে আবার দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত করতে পারলে, তাঁর অনুগত অপর পাণ্ডবেরাও বনে যাবে। তা হলে আমার জয় নিশ্চিত ও দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে। এইজন্যই আমি যুধিষ্ঠিরকে বধ করতে ইচ্ছা করি না।”

কার্যতত্ত্বজ্ঞ ও বুদ্ধিমান দ্রোণ দুর্যোধনের কুটিল অভিপ্রায় জানতে পেরে বিশেষ চিন্তা করে, ছিদ্র বা ফাঁক রেখে দুর্যোধনকে প্রার্থিত বর দান করলেন।

দ্রোণ উবাচ

ন চেদ্‌ যুধিষ্ঠিরং বীর! পালয়েদৰ্জুনো যুধি।

মন্যস্ব পাণ্ডবশ্রেষ্ঠমানীতং বশমাত্মনঃ॥ দ্রোণ : ১০ : ২০॥

দ্রোণ বললেন, “রাজা, মহাবীর অর্জুন যদি যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা না করেন, তবে যুধিষ্ঠিরকে বশ করা হয়েছে বলে তুমি মনে করতে পারো।”

‘কারণ বৎস, ইন্দ্রের সঙ্গে দেবাসুরেরাও যুদ্ধে অর্জুনের সামনে যেতে সমর্থ হন না। সুতরাং অর্জুন উপস্থিত থাকতে আমি যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করতে পারব না। অর্জুন আমার শিষ্য এবং অস্ত্রশিক্ষায় আমি তাঁর গুরু, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবুও সে যুবক, পুণ্যবান ও যুধিষ্ঠির রক্ষায় একাগ্রচিত্ত। বিশেষত সে ইন্দ্র ও রুদ্রের কাছে থেকে নানাবিধ অস্ত্রলাভ করেছে; তারপর তোমার উপর জাতক্রোধ হয়ে আছে। অতএব তার সামনে থেকে যুধিষ্ঠিরকে ধরা যাবে না। অতএব যে উপায়ে পারো, অর্জুনকে যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে সরিয়ে নাও। অর্জুনকে সরিয়ে নিতে পারলেই তুমি যুধিষ্ঠিরকে জয় করেছ বলে মনে করতে পারবে। যুধিষ্ঠিরকে ধরতে পারলে তোমার জয় হবে, একথা ঠিক। এবং এই উপায়েই তাঁকে জয় করা যাবে। কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে বধ করলেও তোমার জয় হবে না, তাও সত্য। ইন্দ্রের সঙ্গে দেবাসুরেরা মিলিত হয়েও অর্জুনের কাছ থেকে যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করতে সমর্থ হবে না। কুন্তীনন্দন অর্জুন অপসারিত হলে যুধিষ্ঠির যদি এক মুহূর্তকালও আমার সম্মুখে থাকেন, তবে আমি সেই সত্যধর্মপরায়ণ রাজাকে আজই তোমার বশে এনে দেব, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

দ্রোণ ফাঁক রেখে যুধিষ্ঠিরকে ধরার প্রতিজ্ঞা করলে, অতিমূর্খ কৌরবেরা মনে করতে লাগল যে যুধিষ্ঠির ধরা পড়ছেনই। কিন্তু কৌরবেরা একথাও জানতেন যে, আচার্য দ্রোণ সর্ব অবস্থাতেই পাণ্ডবদের পক্ষপাতী ছিলেন; সুতরাং তাঁরা দ্রোণের প্রতিজ্ঞার ফাঁকটুকু ভরানোর জন্য সচেষ্ট হলেন এবং স্বয়ং রাজা দুর্যোধন দ্রোণের এই প্রতিজ্ঞার কথা বিশেষভাবে সৈন্যমধ্যে প্রচার করতে লাগলেন। কৌরবসৈন্যেরা রাজা দুর্যোধনের সেই ঘোষণা শুনে আনন্দে শঙ্খনাদ ও সিংহনাদ করতে লাগলে রণভূমিতে বিপুল কোলাহল উঠল।

ওদিকে যুধিষ্ঠির বিশ্বস্ত গুপ্তচর দ্বারা দ্রোণের সেই অভিপ্রেত বিষয় সমস্তই যথানিয়মে জানতে পারলেন। তখন তিনি অর্জুনসমেত সকল ভ্রাতাকে আহ্বান করলেন। যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, “পুরুষশ্রেষ্ঠ! তুমি আজ দ্রোণের অভিপ্রেত বিষয় শুনেছ তো? যাতে তা সত্য হতে না পারে, তার উপায় স্থির করো। শত্রু বিজয়ী ধনুর্ধর, দ্রোণ একটু ফাঁক রেখে প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং সে ফাঁকটুকু তিনি তোমার উপরে রেখেছেন। অতএব মহাবাহু! আজ তুমি আমার কাছে থেকে যুদ্ধ করো—যাতে দুর্যোধন কোনও প্রকারে দ্রোণের অভীষ্ট লাভ না করে।”

অর্জুন বললেন, “রাজা আচার্যকে বধ করা যেমন আমার কোনও প্রকার কর্তব্য নয়, তেমনই আপনাকে পরিত্যাগ করাও আমার কোনও প্রকার অভীষ্ট নয়। আমি যুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ করব, কিন্তু কোনও প্রকারে দ্রোণের প্রতিকূলতা করব না, কিংবা আপনাকে পরিত্যাগ করব না। দুর্যোধন যুদ্ধে আপনাকে নিগৃহীত করে যা ইচ্ছা করছে, তা সে এই পৃথিবীতে কোনওদিন পাবে না।

প্রপতেদ্দৌঃ সনক্ষত্রা পৃথিবী শকলীভবেৎ।

ন ত্বাং দ্রোণো নিগৃহ্নীয়াজ্জীবমানে ময়ি ধ্রুবম্‌॥ দ্রোণ : ১১ : ১০॥

নক্ষত্রের সঙ্গে আকাশ পড়ে যাবে, কিংবা পৃথিবী খণ্ড খণ্ড হবে। তথাপি আমি জীবিত থাকতে দ্রোণ কোনওদিন আপনাকে নিগৃহীত করতে পারবেন না।”

“সমস্ত দেবগণের সঙ্গে স্বয়ং ইন্দ্র কিংবা বিষ্ণুও যদি যুদ্ধে দ্রোণের সাহায্য করেন, তবুও যুদ্ধে তিনি আপনাকে ধরতে পারবেন না। অতএব রাজশ্রেষ্ঠ, আমি জীবিত থাকতে আপনি—সমস্ত অস্ত্রধারী বা শস্ত্রধারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ দ্ৰোণ থেকে ভয় করতে পারেন না। রাজা আর একটি কথা আপনাকে বলছি; আমার প্রতিজ্ঞা চিরকাল অক্ষুণ্ণ থাকে এবং আমি মিথ্যা বলেছি এমন কথা আমার মনে পড়ে না, আমার পরাজয় হয়েছে, এমন কথা আমার স্মরণে পড়ে না, কোনওদিন প্রতিশ্রুতি দিয়ে পালন করিনি, একথাও মনে করতে পারি না।”

অর্জুনের কথা শুনে পাণ্ডবদের শিবিরে সিংহনাদ, শঙ্খধ্বনি ও আকাশস্পর্শী অতি ভয়ংকর ধ্বনি হতে লাগল।

*

‘দুর্যোধনের বর গ্রহণ’ মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। দুর্যোধন এক পূর্ণ পাপী। কাপুরুষতা (কুৎসিত পুরুষ অর্থে) তাঁর সত্তায় সত্তায়। তিনি অত্যন্ত সংকীর্ণমনা। কপট দ্যূতখেলায় পাণ্ডবদের পরাজিত করে তেরো বছর রাজ্য থেকে নির্বাসিত করতে তাঁর বাধেনি। কিন্তু তার পরেও তিনি পাণ্ডবদের রাজ্যাংশ ফিরিয়ে দিতে রাজি নন। এ-বিষয়ে তাঁর পূর্ণ সহায়ক পিতা ধৃতরাষ্ট্র আর শকুনি, কর্ণ ও দুঃশাসন। নির্দোষ পাণ্ডবদের কিছুতেই সহ্য করতে রাজি নয় দুর্যোধন ও তাঁর দলবল। তার প্রধান কারণ দুর্যোধন ইত্যাদির হীনম্মন্যতা। বাল্যকাল থেকেই সকল গুণে পাণ্ডবেরা কৌরবদের থেকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দুর্যোধনের ঈর্ষা। খাণ্ডবপ্রস্থকে ইন্দ্রপ্রস্থে রূপান্তরিত করে পাণ্ডবেরা দুর্যোধনের ঈর্ষাকে অগ্নিময় করে তুলেছিলেন। শকুনির সহায়তায় দ্যূতক্রীড়ার কাপট্যে পাণ্ডবদের সব ঐশ্বর্য কেড়ে নিলেন দুর্যোধন। দুর্যোধন জানতেন সম্মুখ-যুদ্ধে কোনও পাণ্ডবভ্রাতাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই দ্রোণের কাছে তাঁর প্রার্থনা, যুধিষ্ঠিরকে ধরে দিতে হবে। তাঁকে দিয়ে আবার পাশা খেলাবেন তিনি। আবার সবকিছু কেড়ে নিয়ে, সহায়সম্বলহীন অবস্থায় পাণ্ডবদের বনে পাঠাবেন তিনি।

দুর্যোধন জানতেন না, যদি তাঁর প্রার্থনানুযায়ী দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনতে পারতেনও, তা হলেও শকুনি যুধিষ্ঠিরকে আর পাশা খেলায় পরাজিত করতে পারতেন না। বনবাসকালেই যুধিষ্ঠির মহর্ষি বৃহদশ্বের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন নিখিল বিশ্ব অক্ষ হৃদয়। পৃথিবীর সমস্ত অক্ষক্রীড়া জ্ঞান যুধিষ্ঠিরের হয়ে গিয়েছিল। তার প্রমাণ আমরা পাই অজ্ঞাতবাসকালে। বিরাটরাজসভায় অক্ষক্রীড়ায় প্রতিদিন তিনি জিতেছেন, জয়লব্ধ সামগ্রী ভীমসেন ও অন্য ভ্রাতাদের দান করেছিলেন। কাজেই যুধিষ্ঠির পরাজিত হতেন না।

কিন্তু যুধিষ্ঠির দ্রোণের ফাঁক রাখা বরদানের কথা শুনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। বীর হিসাবে বিপক্ষের যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, তাঁকে সরিয়ে দিয়ে বিপক্ষ রাজাকে ধরতে চাওয়া যথার্থ বীরের ধর্ম বলে যুধিষ্ঠিরের মনে হয়নি। এও তো কপট পাশাখেলার শামিল। দ্রোণ যথার্থ বীর হিসাবে পরিচয় দিতে পারতেন, যদি অর্জুন উপস্থিত থাকতেই তিনি যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনতে প্রতিজ্ঞা করতেন। তাঁর শিষ্য অর্জুন কিন্তু দ্রোণের ইচ্ছাপূরণ করতে সমস্ত সৈন্যসামন্তের মধ্যে থেকে দ্রুপদকে ধরে এনেছিলেন।

বহু কারণেই যুধিষ্ঠির দ্রোণকে অপছন্দ করতেন। তিনি মনে করতেন দ্রোণ যথার্থ ধর্মপরায়ণ নন। ব্রাহ্মণের কোনও ধর্মই তিনি পালন করেননি। একলব্যকে তিনি অন্যায়ভাবে চূড়ান্ত শক্তিহীন করেছিলেন। পাণ্ডবদের উপর সুবিচার তিনি কোনওদিন করেননি। তাঁদের সঙ্গে বনেও যাননি। সপ্তরথী-বেষ্টিত অভিমন্যু বধ দ্রোণ সেনাপতি থাকাকালীনই ঘটেছিল। ভীষ্ম সেনাপতি থাকাকালে কোনওদিন এ ঘটনা ঘটতে পারত না।

দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে ধরতে পারেননি। কারণ অর্জুনও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি জীবিত থাকতে দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে ধরতে পারবেন না। দ্রোণের সেনাপতি থাকার প্রথম দিনে অর্জুন উপস্থিত ছিলেন। কৌরবপক্ষ চুড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। এইবার দ্রোণ অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করেন। সংশপ্তকেরা অর্জুনকে আহ্বান করে যুদ্ধের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায়। অর্জুন সত্যজিতের হাতে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষার ভার দিয়ে যান। বলে যান— সত্যজিৎ নিহত হলে যুধিষ্ঠির একমুহূর্তও যুদ্ধক্ষেত্রে থাকবেন না। ঘটনা তাই ঘটেছিল। সন্ধ্যাকালে সত্যজিৎ পরাজিত ও নিহত হন। সেদিন ছিল যুদ্ধের দ্বাদশ দিন। যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিন দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করে যুধিষ্ঠিরকে ধরতে অগ্রসর হলেন। যথারীতি সংশপ্তকেরা অর্জুনকে অন্যদিকে নিয়ে গেল। অভিমন্যু চক্রব্যূহ উন্মুক্ত করে ভিতরে প্রবেশ করলেন কিন্তু মহাদেবের বরে জয়দ্রথ অন্য পাণ্ডব সকল রথীকে চক্রব্যূহের মুখে আটকে দিলেন। সমস্ত দিন যুদ্ধের পর সপ্তরথীবেষ্টিত একাকী অভিমন্যু নিহত হলেন। অর্জুন সংশপ্তক বধ করে ফিরে এসে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ শুনলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন, “আগামীকাল সূর্যাস্তের পূর্বে জয়দ্রথকে বধ করব।” অর্জুন প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন। সেটা ছিল যুদ্ধের চতুর্দশ দিন। চতুর্দশ দিনে ঘটোৎকচের অসামান্য বীরত্বে সমস্ত কৌরববাহিনী পরাজিত হল। আত্মরক্ষার কোনও উপায় না দেখে কর্ণ ইন্দ্রপ্রদত্ত একাঘ্নী বাণ ঘটোৎকচের উপর নিক্ষেপ করলেন। পঞ্চদশ দিনে সেনাপতি দ্রোণ নিহত হলেন।

কাজেই যুধিষ্ঠিরকে ধরার ইচ্ছা দ্রোণের কখনওই পূরণ হয়নি। ওদিকে ভীষ্ম ও দ্রোণের পতনের পর এবং কর্ণ একাঘ্নী বাণ ঘটোৎকচের উপর নিক্ষেপ করতে বাধ্য হলে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেল। দ্রোণের মৃত্যু সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। অর্জুন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু সে আলোচনা আমরা যথাস্থানে করব।

৬৭
অভিমন্যু-বধ

যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে ধরবার জন্য কঠিন চক্রব্যূহ রচনা করে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ গতিতে অগ্রসর হলেন। অন্য কেউই দ্রোণকে থামাতে পারবে না, এই ভেবে তিনি অভিমন্যুর উপর গুরুতর ভার অর্পণ করলেন। কৃষ্ণ ও অর্জুনের সমান শক্তিধর, অমিততেজা, বিপক্ষবীরহন্তা অভিমন্যুকে ডেকে যুধিষ্ঠির বললেন, “বৎস, অর্জুন এসে যাতে আমাদের নিন্দা না করেন, তুমি তেমন কার্য করো। আমরা কেউই চক্রব্যূহ ভেদ করতে জানি না, তুমি বা অর্জুন, কৃষ্ণ অথবা কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন, তোমরা এই চারজন মাত্র চক্রব্যূহ ভেদ করতে পারো। কিন্তু কোনও পঞ্চম ব্যক্তি পারে না। অতএব বৎস অভিমন্যু, তোমার পিতৃগণ, মাতুলগণ এবং সমস্ত সৈন্য তোমার কাছে বর প্রার্থনা করছেন, তুমি সেই বরদান করো। বৎস, অর্জুন যুদ্ধ থেকে এসে আমাদের নিন্দা করবেন, অতএব তুমি সত্বর চক্রব্যূহ ভেদ করো। আমরা তোমার পিছু পিছু ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করব।”

অভিমন্যু বললেন, “যে কাজে পিতৃকুল ও মাতৃকুলের মঙ্গল হবে, যে কাজ পিতা ধনঞ্জয় ও মাতুল কৃষ্ণের প্রীতি সম্পাদন করবে, আমি আজ সেই কাজ করব। বালক ও একাকী হয়েও দলে দলে শত্রুসৈন্য সংহার করব, সমস্ত লোক তা দেখবে।” যুধিষ্ঠির বললেন, “বৎস সুভদ্রানন্দন সাধ্য, রুদ্র ও বায়ুর সমান এবং বসু, অগ্নি ও সূর্যের তুল্য অগ্নিবিক্রমশালী, তোমার শক্তি বৃদ্ধি লাভ করুক।” অভিমন্যু যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে সারথি সুমিত্রকে বললেন, “সুমিত্র তুমি দ্রোণ সৈন্যদের দিকে রথ নিয়ে চলো।”

অভিমন্যু সারথিকে বারবার এগিয়ে যেতে বললে, সারথি অভিমন্যুকে বলল, “আয়ুষ্মন! পাণ্ডবেরা আপনার উপর গুরুতর ভার ন্যস্ত করেছেন, তবুও আপনার নিজের বুদ্ধি অনুসারে যুদ্ধ করা প্রয়োজন। কারণ, দ্রোণাচার্য যুদ্ধে সুনিপুণ, উত্তম উত্তম অস্ত্রশিক্ষায় কঠিন পরিশ্রমও করেছেন। আর আপনি একে বালক, তায় আবার যুদ্ধে সেইরকম নিপুণ নন।” তখন অভিমন্যু হাসতে হাসতে সারথিকে বললেন, “সারথি আমার কাছে এ দ্রোণ কে? সমস্ত ক্ষত্রিয়মণ্ডলীই বা কী? সম্মিলিত দেবগণের সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ করতে পারি। সুতরাং ক্ষত্রিয়গণের বিষয়ে আমার চিন্তা নেই। এই শত্রুসৈন্য আমার ষোলো ভাগের একভাগও নয়। বিশ্ববিজয়ী মাতুল কৃষ্ণকে অথবা পিতা অর্জুনকে যুদ্ধে বিপক্ষরূপে দেখলেও আমার ভয় হয় না। তুমি দ্রোণসৈন্যের দিকে চলো, বিলম্ব কোরো না।” সারথি খুব একটা সন্তুষ্ট না হয়েও রথ চালিয়ে দিলেন।

অভিমন্যুকে দ্রুত সেইভাবে আসতে দেখে দ্রোণ প্রভৃতি কৌরবেরা তাঁর অভিমুখবর্তী হলেন। অভিমন্যুর রথে উত্তম কর্ণিকারধ্বজ উত্তোলিত ছিল এবং তাঁর গায়ে ছিল স্বর্ণময় বর্ণ। সিংহশিশু যেমন হস্তীগণের দিকে ধাবিত হয়, অর্জুনপুত্র অভিমন্যু তেমনই দ্রোণ প্রভৃতি মহারথগণের দিকে ধাবিত হলেন। অভিমন্যু কুড়ি পা এগোনো মাত্রেই কৌরবেরা প্রহার করা শুরু করল। তুমুল ও অতিভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হল। অভিমন্যু দ্রোণের সামনে দিয়েই চক্রব্যূহ ভেদ করে তার মধ্যে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করেই অভিমন্যু গজারোহী, অশ্বারোহী, রথী ও পদাতিদের নির্বিচারে বধ করতে লাগলেন। তখন চারপাশে নানা প্রকার গর্জন, হুংকার ও সিংহনাদ শোনা যেতে লাগল—‘থাক থাক’, ‘যেয়ো না’, ‘দাঁড়াও’, ‘আমার দিকে এসো’, ‘এই আমি এখানে আছি’—ইত্যাদি গর্জন চারপাশে শোনা গেল। যেখানে যেখানে গর্জন শোনা গেল, অভিমন্যু বাণবর্ষণে সেখানেই রক্তের নদী সৃষ্টি করতে লাগলেন। কৌরবদের হস্তাবাপ, অঙ্গুলিত্র, ধনু, বাণ, তরবারি, ঢাল, অঙ্কুশ, অশ্বমুখরজ্জু, তোমর, পরশু, গদা, লৌহগুলিকা, ঋষ্টি, পট্টিশ, ভিন্দিপাল, চাবুক, মহাশঙ্খ, কেয়ূর ও অঙ্গদযুক্ত, মনোহরচন্দনলিপ্ত কৌরবপক্ষের সহস্র সহস্র বাহু অভিমন্যু ছেদন করতে লাগলেন। অভিমন্যু শত্রুগণের বহুতর মস্তক দ্বারাও সমরভূমি আবৃত করে ফেললেন। সে মাথাগুলির নাক, মুখ, কেশপ্রান্ত সুন্দর ছিল, সেগুলিতে কোনও ক্ষতচিহ্ন ছিল না, সুন্দর কুণ্ডল ছিল, ক্রোধে দন্তদ্বারা ওষ্ঠপুট দংশন করছিল, সেই মাথাগুলিতে সুন্দর সুগন্ধ ছিল, কেবলমাত্র মাথার নীচে কোনও দেহ ছিল না। অশ্বারোহী, পদাতি, গজারোহী, রথারোহীদের বধ করে অভিমন্যু বিষ্ণুর মতো অচিন্তনীয় অতিদুষ্কর কার্য করে শোভা পেতে লাগলেন। কতকগুলি অশ্বের লাঙ্গুল, কর্ণ ও নয়ন স্থির ছিল, কতকগুলির চামর ও মুখ বিনষ্ট হয়েছিল, কতকগুলির জিহ্বা ও নয়ন বিক্ষিপ্ত হয়েছিল, কতকগুলির নাড়ি ও যকৃৎ বার হয়ে দেহকে ব্যাপ্ত করেছিল, আবার কতকগুলির গায়ের চর্ম ও কবচ ছিন্ন হয়েছিল। কৌরবপক্ষ শুষ্কমুখ, অস্থির নয়ন, ঘর্মাক্ত দেহ, রোমাঞ্চিত শরীর, শত্রুজয়ে নিরুৎসাহ, জীবনার্থী ও পলায়নাভিলাষী হয়ে গোত্র ও নাম নিয়ে পরস্পরকে ডাকতে ডাকতে নিহত পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, আত্মীয় ও সম্বন্ধীকে পরিত্যাগ করে দ্রুত রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে লাগল।

অমিততেজা অভিমন্যু সেই কৌরবসৈন্যকে পরাভূত করছেন দেখে রাজা দুর্যোধন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে নিজেই অভিমন্যুর দিকে ধাবিত হলেন। দ্রোণ তাই দেখে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে কৌরব যোদ্ধাদের বললেন, “আপনারা রাজাকে রক্ষা করুন। বলবান অভিমন্যু আজ আমাদের সামনেই রাজা দুর্যোধনকে বধ করতে পারেন। আপনারা দ্রুত রাজাকে রক্ষা করুন।” তখন দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ, কৃতবর্মা, শকুনি, বৃহদ্বল, শল্য, ভূরি, ভূরিশ্রবা, শল, পৌরব ও বৃষসেন বাণবর্ষণ করতে করতে অভিমন্যুকে মোহিত করে তাঁর মুখের গ্রাস থেকে দুর্যোধনকে রক্ষা করলেন। কিন্তু অভিমন্যু তা সহ্য করলেন না। বিশাল শরজাল দ্বারা অশ্ব ও সারথিসমেত সেই মহারথগণকে বিমুখ করে সিংহনাদ করলেন। মাংস অভিলাষী সেই অভিমন্যুর গর্জন শুনে দ্ৰোণ প্রভৃতি রথী আর সহ্য করতে পারলেন না। তাঁরা রথসমূহ দ্বারা অভিমন্যুকে পরিবেষ্টন করে দলে দলে নানাচিহ্নযুক্ত বাণসমূহ অভিমন্যুর প্রতি নিক্ষেপ করলেন। তিরের ন্যায় এক অভিমন্যুই বাণ দ্বারা উদ্বেলিত সমুদ্রতুল্য সেই কৌরবসৈন্যকে ধারণ করলেন। কৌরবদের বাণ আকাশেই ছেদন করে অভিমন্যু তাঁদের প্রতিবিদ্ধ করতে লাগলেন। যুধ্যমান বিপক্ষ বীরগণ বা অভিমন্যুর মধ্যে কেউ পরাঙ্মুখ হলেন না। তখন দুর্যোধন ভ্রাতা দুঃসহ নয়টি বাণে, দুঃশাসন বারোটি বাণে, কৃপাচার্য তিনটি বাণে, দ্রোণ সর্প-বিষতুল্য সতেরোটি বাণে, ভূরিশ্রবা তিনটি, শল্য দুটি, শকুনি দুটি ও রাজা দুর্যোধন তিনটি বাণদ্বারা অভিমন্যুকে আঘাত করলেন। তখন চাপহস্ত ও প্রতাপশালী অভিমন্যু নাচতে নাচতে প্রত্যেক বিপক্ষ রক্ষীকে তিনটি করে বাণে আঘাত করলেন। তখন অশ্বকদেশের রাজপুত্র, ক্রুদ্ধ বেগবান গরুড়ের মতো দ্রুত অশ্ব নিয়ে অভিমন্যুর দিকে আসতেই অভিমন্যু দশটি বাণে তাঁকে প্রতিবিদ্ধ করলেন। তারপর অভিমন্যু ঈষৎ হাস্য করতে করতেই সারথিসমেত রাজা অশ্বকের মস্তক ছেদন করে ভূতলে ফেললেন।

অশ্বক রাজাকে নিহত দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ, কৃপ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, শকুনি, শল, শল্য, ভূরিশ্ৰবা, ক্ৰাত্থ, সোমদত্ত, বিবিংশতি, বৃষসেন, সুষেণ, কুণ্ডভেদী, প্রতর্দ্দন, বৃন্দারক, ললিত্থ, প্রবাহু, দীর্ঘলোচন ও দুর্যোধন একযোগে অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন। তখন অভিমন্যু মহাধনুর্ধরদের বাণে অত্যন্ত বিদ্ধ হয়ে একটি বর্ম ও দেহভেদী বাণ গ্রহণ করলেন এবং কর্ণের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণটি কর্ণের দেহ ভেদ করে সাপ যেমন উইয়ের মাটির ভিতর প্রবেশ করে, সেইরূপ বেগে ভূতলে প্রবেশ করল। কর্ণ সেই গুরুতর প্রহারে ব্যথিত ও বিহ্বলের ন্যায় ভূমিকম্পে পর্বতের মতো সমরাঙ্গনে কম্পিত হলেন। তারপর অভিমন্যু তিনটি সুতীক্ষ্ণ বাণে সুষেণ, দীর্ঘলোচন ও কুণ্ডভেদী এই তিনজনকে বধ করলেন।

তখন কর্ণ পঁচিশটি, অশ্বত্থামা কুড়িটি এবং কৃতবর্মা সাতটি নারাচ দ্বারা অভিমন্যুকে আঘাত করলেন। সর্বাঙ্গ বাণব্যাপ্ত ও ক্রুদ্ধ অভিমন্যু তখন পাশহস্ত যমের ন্যায় বিচরণ করতে লাগলেন। বাণবর্ষণ করে অভিমন্যু শল্যকে আবৃত করে ফেললেন—শল্য অভিমন্যুর আঘাতে রথের উপর উপবেশন করলেন এবং মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। সমস্ত কৌরবসৈন্য দ্রোণের সামনেই পালাতে লাগল। আকাশে দেবগণ, পিতৃগণ, চারণগণ, যক্ষগণ ও সিদ্ধগণ অভিমন্যুর প্রশংসা করতে লাগলেন। শল্যকে অত্যন্ত বিদ্ধ ও মূর্ছিত দেখে তাঁর কনিষ্ঠতম ভ্রাতা দশটি বাণ দ্বারা অভিমন্যুকে আঘাত করে ‘থাক থাক’ এই কথা বললেন। তখন লঘুহস্ত অভিমন্যু তাঁর মাথা, গ্রীবা, হাত, পা, ধনু, অশ্ব, ছত্র, ধ্বজ, সারথি ইত্যাদি সমস্ত ছেদন করে ফেললেন। তখন কোনও ব্যক্তি আর তাঁকে মনুষ্যরূপে দেখতে পেল না। তাঁর অনুচরেরা অত্যন্ত ভীত হয়ে সকল দিকে পালাতে লাগল। তখন অভিমন্যু দ্রোণের সমক্ষেই কৌরবসেনাকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করলেন। যে তাঁর দিকে আগে এল তাঁকেই বধ করতে লাগলেন। কুমার কার্তিকের ন্যায় যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করতে করতে অভিমন্যু বাণ দ্বারা দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, শল্য, অশ্বত্থামা, ভোজ, বৃহদ্বল, দুর্যোধন, ভূরিশ্ৰবা, শকুনি প্রমুখের সৈন্যকে পীড়ন করতে লাগলেন। মহাপ্রাজ্ঞ ও মহাপ্রতাপশালী দ্রোণ সমরাঙ্গনে যুদ্ধ-বিশারদ অভিমন্যুকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল নয়ন হয়ে দুর্যোধনের হৃদয় উদ্বেল করে কৃপাচার্যকে ডেকে বললেন, “এই যুবা অভিমন্যু, সমস্ত কৌরবসৈন্য জয় করে রাজা যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব, বন্ধু, সম্বন্ধী, নিরপেক্ষ লোক সকলকে আনন্দিত করে পাণ্ডবদের দিকে যাচ্ছেন। যুদ্ধে আমি এঁর তুল্য কাউকেই মনে করি না। কারণ, ইনি ইচ্ছা করলেই সমস্ত কৌরববাহিনী সংহার করতে পারেন; কিন্তু কোনও কারণবশত তা করছেন না।”

দ্রোণের কথা শুনে ক্রুদ্ধ দুর্যোধন, কর্ণ, বাহ্লিক, কৃপ, দুঃশাসন, শল্য ও অন্য মহারথগণকে বললেন, “সকল ক্ষত্রিয়ের গুরু এবং বেদজ্ঞ শ্রেষ্ঠ দ্রোণ অর্জুনের মূর্খ পুত্রটিকে বধ করতে ইচ্ছা করেন না। নতুবা বীরগণ, অস্ত্রধারী দ্রোণের যুদ্ধে যমও মুক্ত হতে পারেন না। শিষ্যের পুত্র বলে ইনি অর্জুনের পুত্রকে রক্ষা করছেন। কারণ, ধার্মিকদের কাছে শিষ্য ও পুত্র প্রিয়, এবং তাঁদের সন্তানও প্রিয়। দ্রোণ রক্ষা করছেন, তাই অভিমন্যু আপনাকে বীর মনে করছে। সুতরাং নিজেকে নিজে বীর মনে করায় ওটা একটা মূর্খ। বীরগণ আপনারা অবিলম্বে এই মূর্খটাকে বধ করুন।” তখন দুঃশাসন দুর্যোধনের কথা শুনে বললেন, “মহারাজ আমি বলছি পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণের সামনেই আমি ওকে বধ করব। রাহু যেমন সূর্যকে গ্রাস করে, সেইরকম আমি ওকে গ্রাস করব। আমি অভিমন্যুকে গ্রাস করেছি শুনে অত্যন্ত অভিমানী কৃষ্ণ ও অর্জুন নিশ্চয়ই জীবলোক ত্যাগ করে প্রেতলোক যাত্রা করবে। আবার তারা মরেছে শুনে নিশ্চয়ই পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্রগুলি দূর্বলতাবশত একদিনেই বন্ধুদের সঙ্গে জীবন ত্যাগ করবে। অতএব রাজা এই শত্রুটা নিহত হলে আপনার সমস্ত শত্রুই নিহত হবে। আপনি আমার মঙ্গল চিন্তা করুন। আমি এই আপনার শত্ৰু সংহার করছি।”

এই বলে সিংহনাদ করতে করতে ও শরবর্ষণ করতে করতে দুঃশাসন অভিমন্যুর দিকে যেতে লাগল। অভিমন্যু ছাব্বিশটি তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা তাঁর অভ্যর্থনা করলেন। মদমত্ত হস্তীর মতো দুঃশাসনও অভিমন্যুকে প্রহার করতে লাগলেন। তখন অভিমন্যু ঈষৎ হাস্য করতে করতে সম্মুখে অবস্থিত বাণবিক্ষত-দেহ শত্রু দুঃশাসনকে বললেন, “আমি আজ ভাগ্যবশত যুদ্ধে আগত অভিমানী, নিষ্ঠুর ধর্মত্যাগী এবং অন্যকে গালিদানে নিরত বীরকে দেখতে পেয়েছি। তুমি মূর্খ! সুতরাং অক্ষক্রীড়ায় জয়লাভে উন্মত্ত হয়ে বহুতর অনর্থজনক বাক্য বলে সভামধ্যে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সামনে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের যে ক্রোধ উৎপন্ন করেছিলে, সেই মহাত্মার ক্রোধের ফলেই তুমি আজ আমার সম্মুখে এসেছ। দুর্মতি! এখন সেই অধর্মের ভয়ংকর ফল ভোগ করো। আজ সমস্ত রাজার সামনে তোমাকে বাণ দ্বারা শাসন করব। আজ যুদ্ধে আমি তাঁদের ক্রোধের, কোপিতা দ্রৌপদীর এবং পিতৃদেবের আকাঙ্ক্ষিত বিষয় সম্পন্ন করব। আজ আমি যুদ্ধে ভীমসেনের ঋণও পরিশোধ করব। তুমি যদি সমরাঙ্গন ত্যাগ না করো, তবে জীবিত অবস্থায় আমার হাত থেকে মুক্ত হতে পারবে না।” এই বলে মহাবাহু ও বিপক্ষবীরহন্তা অভিমন্যু কাল, অগ্নি ও বায়ুর তুল্য মহাশক্তিশালী দুঃশাসন-নাশক একটি বাণ সন্ধান করলেন। সেই তীক্ষ্ণ বাণ দুঃশাসনের বুকের কাছে দ্রুত গিয়ে তাঁর স্কন্ধ-সন্ধিস্থান ভেদ করে পুঙ্খের সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করল। তারপর আবার অভিমন্যু অগ্নিসমস্পর্শ ও কান পর্যন্ত টেনে পঁচিশটি তীক্ষ্ণ শর দ্বারা দুঃশাসনকে পীড়ন করলেন। তখন দুঃশাসন দৃঢ়বিদ্ধ ও ব্যথিত হয়ে রথের উপর বসে পড়লেন এবং গুরুতর মূৰ্ছাপ্রাপ্ত হলেন। এই সময় তাঁর সারথি ত্বরান্বিত হয়ে অভিমন্যুর বাণে পীড়িত ও অচেতন দুঃশাসনকে সমরমধ্য থেকে সরিয়ে নিল। পাণ্ডবগণ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, বিরাট, পাঞ্চালগণ ও কেকয়গণ দূর থেকে অভিমন্যুকে দেখে সিংহনাদ করে উঠলেন। পাণ্ডবসেনার বাদ্যকারেরা আনন্দিত হয়ে সমস্ত স্থানে নানাবিধ বাজনা বাজাতে লাগলেন।

তখন দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, “কর্ণ দেখো বীর দুঃশাসন যুদ্ধে সূর্যের ন্যায় শত্রুগণকে সন্তপ্ত ও নিহত করছিলেন, সেই অবস্থায় তিনি অভিমন্যুর বশীভূত হয়েছেন। আবার অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে সিংহের মতো বলমত্ত এই পাণ্ডবেরা অভিমন্যুকে রক্ষা করবার জন্য উদ্যত হয়ে তোমাদের অভিমুখে ধাবিত হয়ে আসছে। তখন কর্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে অভিমন্যুর উপর তীক্ষ্ণবাণ বর্ষণ করতে লাগলেন। এবং বীর কর্ণ তীক্ষ্ণ ও উত্তম বাণসমূহের দ্বারা সমরাঙ্গনে অবজ্ঞাপূর্বক অভিমন্যুর অনুচরগণকেও বিদ্ধ করতে থাকলেন। মহামনা অভিমন্যুও দ্রোণের কাছে যাবার ইচ্ছা করে একুশটি বাণে কর্ণকে বিদ্ধ করলেন। পরশুরামের শিষ্য, অস্ত্রজ্ঞশ্রেষ্ঠ, প্রতাপশালী কর্ণ যুদ্ধে নানাবিধ অস্ত্র দ্বারা শত্ৰুদুর্ধর্ষ অভিমন্যুকে পীড়ন করতে লাগলেন। দেবতুল্য প্রভাবশালী অভিমন্যু কর্ণের অস্ত্রবর্ষণে সেইরূপ পীড়িত হতে থেকেও যুদ্ধে অবসন্ন হলেন না।

তখন অভিমন্যু শিলাশাণিত, তীক্ষ্ণ, নতপর্ব, ভল্লসমূহদ্বারা কর্ণ সহচর বীরগণের ধনুগুলি ছেদন করে ঈষৎ হাসতে হাসতেই ধনুক ঘোরাতে ঘোরাতে সর্পতুল্য বাণসমূহ দ্বারা ছত্র, ধ্বজ, সারথি ও অশ্বগণের সঙ্গে কর্ণকে পীড়ন করলেন। অভিমন্যু আবার কর্ণনিক্ষিপ্ত বাণগুলিও অবিচলিত চিত্তে গ্রহণ করতে থাকলেন। ক্রমে বলবান ও বীর অভিমন্যু এক এক বাণে কর্ণের ধ্বজ ও ধনু ছেদন করে ভূতলে নিপাতিত করলেন।

কর্ণ বিপদাপন্ন হয়েছেন দেখে কর্ণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধনু ধারণ করে বারবার গর্জন ও ধনুর গুণ আকর্ষণ করে কর্ণ ও অভিমন্যুর রথদ্বয়ের মধ্যস্থানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি দশটি বাণ দ্বারা ছত্র, ধ্বজ, সারথি ও অশ্বগণের সঙ্গে দুর্ধর্ষ অভিমন্যুকে সত্বর বিদ্ধ করলেন। ক্রমে অভিমন্যু ঈষৎ হাস্য করতে করতে ধনু আকর্ষণ করে একটি বাণ দ্বারা কর্ণের ভ্রাতার মস্তক ছেদন করে ভূতলে ফেলে দিলেন। ভ্রাতার মৃত্যুতে কর্ণ দারুণ ব্যথিত হলেন। অভিমন্যু বাণ দ্বারা কর্ণকেও পরাজিত করলেন। বেগবান অশ্বগণ অতি দ্রুত কর্ণকে সমরাঙ্গন থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তখন কৌরবসৈন্য সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে লাগল। রণক্ষেত্রে একা জয়দ্রথ ব্যতীত কোনও কৌরব-প্রধান অভিমন্যুর সম্মুখে থাকতে পারলেন না। অভিমন্যু একা কৌরবসৈন্য মধ্যে অবস্থান করতে লাগলেন। প্রদত্ত অগ্নি যেমন তৃণরাশি দগ্ধ করে, সেইরকম বেগে অভিমন্যু শত্রুগণকে দগ্ধ করতে লাগলেন। অভিমন্যু তখন সমস্ত দিক ও বিদিক বিচরণ করছিলেন। তবু সৈন্যগণের ধূলিজালে আবৃত থাকায় তাঁকে আর দেখা যাচ্ছিল না। ক্ষণকাল মধ্যে দেখা গেল, অভিমন্যু হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণের আয়ু হরণ করছেন এবং মধ্যাহ্নকালের সূর্যের মতো শত্রুগণকে সন্তপ্ত করছেন। কৌরবসৈন্য সম্পূর্ণ ভগ্ন হল। অবশেষে ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ ব্যতীত আর কেউ রণক্ষেত্রে রইলেন না। দ্রৌপদী হরণের পর ধরা পড়ে জয়দ্রথ ভীমের হাতে চূড়ান্ত নিগৃহীত হয়েছিলেন। ভীম অর্ধ-চন্দ্র বাণে তাঁর মাথা ইতস্তত কামিয়ে ছেড়ে দেন। জয়দ্রথ তখন মহাদেবের কঠিন আরাধনায় ব্রতী হন। শেষ পর্যন্ত মহাদেব দেখা দিয়ে বর দেন যে, অর্জুন ব্যতীত অন্য চার পাণ্ডবকে তিনি যুদ্ধে বাধা দিতে পারবেন।

জয়দ্রথ শরবর্ষণ করে সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্রুপদ, শিখণ্ডী এবং যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেবকে নিপীড়িত করতে লাগলেন। অভিমন্যু ব্যূহ প্রবেশের যে পথ করেছিলেন জয়দ্রথ তা রুদ্ধ করে দিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধারা দ্রোণসৈন্য ভেদ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু জয়দ্রথ তাঁদের বাধা দিলেন। কুরুসৈন্য বেষ্টিত হয়ে অভিমন্যু একাকী দারুণ যুদ্ধ করতে লাগলেন। শল্যপুত্র রুক্মরথ ও দুর্যোধনপুত্র লক্ষ্মণ অভিমন্যুর হাতে নিহত হলেন। লক্ষ্মণকে নিধন করবার পূর্বে অভিমন্যু এক অবিশ্বাস্য কাজ করলেন। লক্ষ্মণ তখন দুর্যোধনের নিকট অবস্থিত ছিলেন, অভিমন্যু সেইভাবে অবস্থিত লক্ষ্মণের নিকট উপস্থিত হলেন। তখন লক্ষ্মণ সুনিশ্চিত ও তীক্ষ্ণ শরসমূহ দ্বারা বিপক্ষবীরহন্তা অভিমন্যুর বাহুযুগলে ও বক্ষঃস্থলে আঘাত করলেন। দণ্ডতাড়িত সর্পের ন্যায় মহাবাহু অভিমন্যুকে লক্ষ্মণ আঘাত করলে অভিমন্যু বললেন, “লক্ষ্মণ তুমি জগৎটাকে ভাল করে দেখে নাও। কারণ, এখুনি তুমি পরলোক যাবে। তোমার আত্মীয়-স্বজন-বান্ধবদের সামনেই আমি তোমাকে যমালয়ে পাঠাব।” এই বলে মহাবাহু ও বিপক্ষবীরহন্তা অভিমন্যু খোলসশূন্য সর্পের তুল্য একটি ভল্ল নিক্ষেপ করলেন। অভিমন্যুর বাহুনিক্ষিপ্ত সেই ভল্লটা গিয়ে লক্ষ্মণের সুদৃশ্য, সুন্দর নাসিকা ও ভ্রূযুক্ত, কেশবিন্যাসে অতিমনোহর এবং কুণ্ডলসমন্বিত মস্তকটিকে হরণ করল। লক্ষ্মণের সেই মৃত্যু দেখে সেখানকার লোকেরা উচ্চ স্বরে হাহাকার করতে লাগল। প্রিয় পুত্র নিহত হলে ক্ষত্রিয়রাজ দুর্যোধন ক্ষিপ্ত হয়ে যোদ্ধাদের বললেন, “অবিলম্বে এটাকে বধ করুন।”

তখন দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃহদ্বল ও হৃদিকপুত্র কৃতবর্মা—এই ছয় রথী গিয়ে অভিমন্যুকে পরিবেষ্টন করলেন। ক্রুদ্ধ অভিমন্যু তীক্ষ্ণ বাণ দ্বারা তাঁদের আঘাত করে পরাজিত করলেন এবং বেগে জয়দ্রথের বিশাল সৈন্যের দিকে অগ্রসর হলেন। কলিঙ্গ ও নিষাদদেশীয় সৈন্যদের নিয়ে বলবান ক্ৰাথপুত্র অভিমন্যুর পথ রোধ করলেন। ক্ৰাথপুত্র হস্তীসৈন্য নিয়ে অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন। ইতোমধ্যে দ্রোণ প্রভৃতি রথীরাও ফিরে এসে অভিমন্যুকে তীক্ষ্ণ শরাঘাত করতে লাগলেন। অভিমন্যু বাণক্ষেপে রথীদের নিবৃত্ত করে ক্রাথপুত্রকে বধ করার ইচ্ছা করলেন। ক্রমে অভিমন্যু ক্ৰাথপুত্রের ধনু বাণ ও কেয়ূরযুক্ত বাহুযুগল, মুকুটশোভিত মস্তক, ছত্র, ধ্বজ, সারথি ও অশ্বগুলিকে ছেদন করে নিপাতিত করলেন। কুল, শীল, শাস্ত্রজ্ঞান, শক্তি, কীর্তি ও অস্ত্রবলসম্পন্ন ক্রাথপুত্র নিহত হলে, অন্য বীরেরাও পিছিয়ে যেতে থাকলেন।

তখন দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃহদ্বল ও হৃদিকপুত্র কৃতবর্মা—এই ছ’জন রথী আবার অভিমন্যুকে আক্রমণ করতে অগ্রসর হলেন। অভিমন্যু পঞ্চাশটি বাণ দ্বারা দ্রোণকে, কুড়িটি দ্বারা বৃহদ্বলকে, আশিটি দ্বারা কৃতবর্মাকে, ষাটটি দ্বারা কৃপাচার্যকে এবং তীক্ষ্ণ দশটি বাণ দ্বারা অশ্বত্থামাকে আঘাত করলেন। তারপর অভিমন্যু পীতবর্ণ, সুতীক্ষ্ণ কর্ণি নামক একটি উত্তম বাণদ্বারা কর্ণের কর্ণদেশে আঘাত করলেন। সমবেত রথীরা একযোগে অভিমন্যুকে আঘাত করতে লাগলেন। তখন কর্ণ একটি বাণ দ্বারা রাজপুত্র বৃহদ্বলের হৃদয় বিদীর্ণ করলেন। খড়্গ ও চর্মধারী দশ সহস্র ক্ষত্রিয় অমঙ্গলসূচক বাক্য বলতে থাকায় অভিমন্যু তাঁদেরও পরাজিত করলেন। অভিমন্যু পুনরায় একটি কর্ণি দ্বারা কর্ণের কর্ণদেশ বিদ্ধ করলেন এবং আরও পঞ্চাশটি বাণ দ্বারা কর্ণকে আঘাত করলেন। তারপর অভিমন্যু অশ্ব, সারথি, ধ্বজ ও রথের সঙ্গে কর্ণের সহচর ছয়জন বিচিত্রযোধী বীরকে বধ করলেন। তিনি ছ’টি বাণ দ্বারা চারটি অশ্ব ও সারথিসমেত মগধরাজ জয়ৎসেনের পুত্র যুবা অশ্বকেতুকে নিপাতিত করলেন। তখন দুঃশাসনের পুত্র গিয়ে চারটি বাণদ্বারা অভিমন্যুর চার অশ্বকে এবং একটি বাণ দ্বারা সারথিকে বিদ্ধ করে দশ বাণে অভিমন্যুকে বিদ্ধ করলেন। অভিমন্যু সাতটি বাণদ্বারা দুঃশাসনের পুত্রকে বিদ্ধ করে উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, “তোমার পিতা কাপুরুষের ন্যায় রণস্থল ত্যাগ করে গিয়েছেন। ভাগ্যবশত তুমি যুদ্ধ করতে জানো বটে, তবে আজ আমার হাত থেকে রক্ষা পাবে না।” তখন অভিমন্যু শিল্পী-পরিমার্জিত একটি নারাচ দুঃশাসনপুত্রের উপরে নিক্ষেপ করলেন। অশ্বত্থামা তিনটি বাণ দ্বারা সেটাকে ছেদন করলেন। অভিমন্যু অশ্বত্থামার ধ্বজ ছেদন করলেন ও তিনটি বাণ দ্বারা শল্যকে তাড়ন করলেন। অবিচলিত শল্য ন’টি বাণদ্বারা অভিমন্যুর হৃদয়ে পীড়ন করলেন। অভিমন্যু শল্যের ধ্বজ ছেদন করে, পিছনের দুই সারথিকে বধ করে ছ’টি লৌহময় বাণে শল্যকে বিদ্ধ করলেন। তখন শল্য সরে গিয়ে অন্য রথে উঠে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলেন। অভিমন্যু তখন শত্ৰুঞ্জয়, চন্দ্রকেতু, মেঘবেগ, সুবর্চা ও সূর্যভাস—এই পাঁচজন বীরকে বধ করে শকুনিকে বিদ্ধ করলেন।

তখন শকুনি তিনটি বাণ দ্বারা অভিমন্যুকে বিদ্ধ করে রাজা দুর্যোধনকে বললেন, “আমরা সকলে মিলে একে বধ করি। একা একা যুদ্ধ করলে এ সকলকে বধ করবে।”

অথাব্রবীত্তযা দ্রোণং কর্ণো বৈকৰ্ত্তনো রণে।

পুরা সর্বান প্রমথ্‌নাতি ব্ৰূহ্যস্য বধমাশু নঃ॥ দ্রোণ : ৪২ : ৪১॥

তারপর সূর্যপুত্র কর্ণও দ্রোণকে সেকথাই বললেন, “আচার্য হয়তো অভিমন্যু শেষ পর্যন্ত আমাদের সকলকেই যুদ্ধে বধ করবে। অতএব আপনি সত্বর অভিমন্যু-বধের উপায় আমাদের বলুন।”

তখন মহাধনুর্ধর দ্রোণ তাদের সকলকে বললেন, “এই কুমারটির কোনও ছিদ্র কি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন? এই নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবনন্দন পিতার ন্যায় সকল দিকে বিচরণ করে অতিদ্রুত বাণ নিক্ষেপ করছেন—এর কেবলমাত্র মণ্ডলীকৃত ধনুখানাই দেখা যাচ্ছে। বিপক্ষবীরহন্তা এই সুভদ্রানন্দন বাণ দ্বারা আমার প্রাণ ব্যথিত বা আমাকে মোহিত করেও অত্যন্ত আনন্দিত করছে। এই অভিমন্যু যুদ্ধে বিচরণ করতে থেকে আমার অত্যন্ত আনন্দ জন্মাচ্ছে। ক্রুদ্ধ মহারথেরা এর কোনও ছিদ্র দেখতে পাচ্ছেন না। লঘুহস্ত অভিমন্যু বাণ দ্বারা সকলদিক ব্যাপ্ত করছে—যুদ্ধে অর্জুনের সঙ্গে এর কোনও পার্থক্যই দেখা যাচ্ছে না।” তখন কর্ণ অভিমন্যুর বাণে পুনরায় আহত হয়ে দ্রোণকে বললেন, “আচার্য অভিমন্যু যেরকম পীড়া দিচ্ছে, তাতে আমি থাকতে হয় বলে আছি। এই তেজস্বী কুমারের অতিদারুণ ও অগ্নির মতো ওজস্বী বিশাল বাণগুলি আজ আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে দিচ্ছে।” তখন দ্রোণাচার্য মৃদু হাস্য করতে করতে কর্ণকে বললেন, “এর বর্ম অভেদ্য, এ যুবক এবং দ্রুতপরাক্রমশালী। এই বর্ম ধারণের নিয়ম এর পিতাকে আমিই বলেছিলাম। শত্রুনগরবিজয়ী এই অভিমন্যু নিশ্চয়ই সে সমস্ত জানে। বিশেষ সন্ধান করে বাণ দ্বারা এর ধনু, গুণ ও ঘোড়ার লাগাম ছেদন করা যেতে পারে এবং ঘোড়াগুলিকে ও পিছনের সারথি দুইজনকে বধ করাও সম্ভবপর।

এবৎ কুরু মহেষ্বাস! রাধেয়! যদি শক্যতে।

অথৈনং বিমুখীকৃত্য পশ্চাৎ প্রহরণং কুরু॥ দ্রোণ : ৪২ : ৫৩॥

“অতএব মহাধনুর্ধর কর্ণ! যদি পারো, তবে তাই করো; তারপর একে বিমুখ করে পিছনের দিক থেকে প্রহার করতে থাকো।”

“ও যদি ধনুযুক্ত থাকে, তবে দেব-দানবেরাও ওকে জয় করতে পারবেন না। সুতরাং ওকে যদি বধ করতে চাও, তবে ওকে রথবিহীন ও ধনুশূন্য করো।”

সূর্যপুত্র কর্ণ দ্রোণাচার্যের কথা শুনে দ্রুত পিছনের দিকে গিয়ে অভিমন্যুর ধনু ছেদন করলেন। দ্রোণ অভিমন্যুর অশ্বগুলিকে, কৃপ তাঁর পৃষ্ঠবর্তী সারথি দুজনকে বধ করলেন, আর অবশিষ্ট মহারথেরা ছিন্নকার্মুক অভিমন্যুর উপর বাণ বর্ষণ করতে লাগলেন। নির্দয় দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন এবং শকুনি এই ছয় মহারথ রথবিহীন, বালক ও একাকী অভিমন্যুর উপর অবিশ্রান্ত বাণ বর্ষণ করতে লাগলেন। তখন ছিন্নকার্মুক, রথবিহীন অথচ বীরশোভায় শোভিত অভিমন্যু ক্ষত্রিয়ধর্ম রক্ষা করেই খড়্গ ও চর্ম ধারণ করে আকাশপথে রথ থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন। শীঘ্রতা ও শক্তির গুণে গরুড়ের মতো অভিমন্যু ভূতল অপেক্ষা আকাশপথে অধিক বিচরণ করতে লাগলেন। তখন ‘তরবারিধারী অভিমন্যু আমার উপরেই পতিত হবে’—এই ভয়ে সেই মহারথেরা ঊর্ধ্বদৃষ্টি হয়ে ছিদ্র খুঁজে অভিমন্যুকে বাণ দ্বারা বিদ্ধ করতে লাগলেন। ক্রমে মহাতেজা ও শক্ৰবিজয়ী দ্রোণ ত্বরিতগতিতে একটি বাণ দ্বারা অভিমন্যুর তরবারির মণিময় মুষ্টিদেশ ছেদন করলেন। অভিমন্যুর অসি ও চর্ম নষ্ট হয়ে গেল, সমস্ত অঙ্গও বাণে পরিপূর্ণ হয়ে পড়ল, তথাপি তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে পুনরায় আকাশ থেকে ভূতলে এসে রথের চাকা তুলে দ্রোণের দিকে ধাবিত হলেন। তৎকালে অভিমন্যুর অঙ্গসকল চক্রের কিরণে উজ্জ্বল এবং ধূলিজালে শোভিত হয়েছিল। চক্ৰধারণ করায় তাঁকে চক্রধারী কৃষ্ণের মতো বোধ হচ্ছিল।

অভিমন্যুর পরিধানের বস্ত্রখানি গলিত রক্তের ধারায় রঞ্জিত হয়েছিল, ভ্রুকুটি করায় মুখমণ্ডল বিশেষ কুটিল দেখাচ্ছিল এবং তিনি গুরুত্তর সিংহনাদ করছিলেন। এই অবস্থায় অস্ত্রপ্রভাবসম্পন্ন ও মহাবল অভিমন্যু সমরাঙ্গনে বিশেষ রাজাদের মধ্যে প্রকাশ পেতে থাকলেন। তৎকালে বায়ু তাঁর কেশকলাপ সঞ্চালন করতে থাকায় তাঁর দেহটি বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল। আবার চক্রটির ভিতরের তেরচা কাঠগুলি সুন্দর সাজানো থাকায় তাও সুন্দর বলে বোধ হচ্ছিল, এবং সেই চক্রটি তিনি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর সে আকৃতির দিকে তাকানো দেবগণের পক্ষেও কঠিন ছিল। রাজারা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে সেই চক্রটিকে বহুখণ্ডে ছেদন করে ফেললেন। শত্রুরা অভিমন্যুর ধনু, রথ, তরবারি ও চক্র বিনষ্ট করলে, তিনি গদাধারণ করে অশ্বত্থামাকে আঘাত করার জন্য ধাবিত হলেন। অশ্বত্থামা বজ্রের মতো উজ্জ্বল ও উদ্যত গদা দেখে রথ থেকে নেমে তিন লাফে সরে গেলেন। গদাঘাতে অশ্বত্থামার চারটি অশ্ব ও দুই পৃষ্ঠসারথিকে বধ করে বাণব্যাপ্ত দেহে শজারুর মতো দৃষ্টিগোচর হতে লাগলেন অভিমন্যু। তারপর অভিমন্যু সুবলপুত্র কালিকেয়কে নিষ্পেষিত করলেন এবং তাঁর সাতাত্তরজন অনুচরের বিনাশ ঘটালেন। কেকয়দের সাতজন রথীকে, দশটা হাতিকে এবং দুঃশাসনপুত্রের অশ্বসহ রথকে চূর্ণ করে ফেললেন।

তারপর দুঃশাসনপুত্র ক্রুদ্ধ হয়ে গদা তুলে অভিমন্যুর দিকে ধাবিত হলেন এবং পরস্পরকে বধাকাঙ্ক্ষী হয়ে গদাঘাতে পরস্পরকে জর্জরিত করতে থাকলেন। ক্রমে শত্রুসন্তাপকারী সেই দুই ধীর গদার অগ্রভাগ দিয়ে পরস্পরকে আঘাত করতে করতে সমরমধ্যে ভূতলে পতিত হলেন। দুঃশাসনপুত্রের চেতনা আগে ফিরল, অভিমন্যু তখন ধীরে ধীরে ওঠবার চেষ্টা করছেন, দুঃশাসনপুত্র আগে উঠে তাঁর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করলেন। বিপক্ষবীরহন্তা অভিমন্যু দীর্ঘকাল যুদ্ধ করায় পরিশ্রমে ক্লান্ত ছিলেন, সেই গুরুতর আঘাত পাওয়ায় অচৈতন্য অবস্থায় ভূতলে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। অভিমন্যুকে নিহত হয়ে পতিত দেখে কৌরবপক্ষের যোদ্ধারা গিয়ে তাঁকে পরিবেষ্টন করলেন। বালক ও অপ্রাপ্তযৌবন অভিমন্যু নিহত হলে, যুধিষ্ঠিরের সামনেই সমস্ত পাণ্ডবসৈন্য পলায়ন করতে লাগল। যুধিষ্ঠির সেই যোদ্ধাদের চিৎকার করে বললেন, “যিনি পরাজিত হয়ে নিহত হননি, সেই বীর স্বর্গে গমন করেছেন। আপনারা মনস্থির করুন, ভয় করবেন না, আমরা যুদ্ধে শত্রুগণকে জয় করব। যুদ্ধে তীক্ষ্ণবিষ সর্পের তুল্য ভীষণ এবং সমবেত বহুতর রাজপুত্রকে যুদ্ধে প্রথমে বধ করে পরে অভিমন্যু তাঁদের অনুসরণ করেছেন। অভিমন্যু দশ সহস্র সৈন্য ও মহারথ বৃহদ্বলকে বধ করে নিশ্চয়ই ইন্দ্রলোকে গমন করেছেন। পুণ্যকর্মকারী অভিমন্যু সহস্র সহস্র হস্তী, অশ্ব, রথ এবং পদাতি সংহার করেও যুদ্ধে তৃপ্তিলাভ না করে পুণ্যকারিগণের পুণ্যবিজিত স্থায়ী লোকে গমন করেছেন। সুতরাং তাঁর জন্য শোক করা উচিত নয়।”

*

চন্দ্রপুত্র বৰ্চা। ভীষণ ভালবাসতেন চন্দ্রদেব তাঁর পুত্রকে। অংশাবতরণ পর্বে দানব দলনের জন্য দেবতারা যখন প্রায় সকলেই মর্ত্যভূমিতে নেমে এলেন, তখনও চন্দ্র তাঁর পুত্রকে ছাড়তে চাননি। শেষকালে কর্তব্য সম্পাদনের জন্য অতি অল্পকালের জন্য তিনি প্রিয় পুত্রকে পৃথিবীতে পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বৰ্চা সুভদ্রার গর্ভে অর্জুনের ঔরসে অভিমন্যু নাম নিয়ে জন্মালেন।

অভিমন্যুর অসামান্য বীরত্বের কথা বর্তমান কাহিনিতে প্রতিষ্ঠিত। ভীষ্ম রথী-মহারথ গণনাকালে বলেছিলেন, অভিমন্যু অতিরথ, বীরত্বে ও রণকুশলতায় পিতা অৰ্জুন অথবা মাতুল কৃষ্ণের সমকক্ষ অথবা অধিক। বর্তমান কাহিনিতে তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কৌরবপক্ষীর প্রধান রথীরা একক যুদ্ধে একজনও তাঁর সঙ্গে পারেননি। দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ, শকুনি, দুঃশাসন, দুর্যোধন, বৃহদ্বল, ক্ৰাথ—সকলেই তাঁর হাতে পরাস্ত হয়েছেন। কর্ণের কান তিনি দু’বার কেটে দিয়েছিলেন, কর্ণ রণক্ষেত্র থেকে সরে গিয়েছিলেন। অপসৃত হয়েছিলেন দুঃশাসন, অশ্বত্থামাও। দ্রোণ, দুর্যোধন, কৃপাচার্য নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়েছিলেন। নিহত হয়েছিলেন বৃহদ্বল ও ক্ৰাথ। সহস্র সহস্র কৌরবসৈন্য সংহার করেছিলেন অভিমন্যু। মহাদেবের বরে সেদিন অজেয় ছিলেন জয়দ্রথ। চক্রব্যূহ রচনা করে দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে ধরতে আসছিলেন। যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করে অগ্রসর হন। কিন্তু আর কেউ তাঁর সঙ্গী হতে পারেননি। জয়দ্রথ সবাইকে আটকে দিয়েছিলেন।

সমস্ত শত্রুসৈন্যের মধ্যে অভিমন্যু একা। কিন্তু একবারও তাঁর মুখ থেকে সঙ্গীহীনতার কোনও আক্ষেপ শোনা যায়নি। শত্রুমধ্যে একা বিচরণ করেছেন, গ্রহণ করেছেন সমস্ত কৌরবসৈন্যকে—পীড়ন করেছেন শ্রেষ্ঠ রথীদের, পরাজিত করেছেন। সহায়তার জন্য একবারও পিতা অর্জুন বা মাতুল কৃষ্ণের কথা চিন্তা করেননি।

শেষ পর্যন্ত ভীত, পরাজিত শকুনি ও কর্ণের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন সেনাপতি দ্রোণ। এই পর্বে দ্রোণ এবং কর্ণকে চূড়ান্ত খারাপ লাগে পাঠকের। কর্ণ যিনি বীরত্বের জন্য সারাজীবন শ্লাঘা বোধ করতেন, তিনি সপ্তরথীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পিছন থেকে অভিমন্যুকে অস্ত্রাঘাত করতে লাগলেন। আর সমস্ত পরামর্শ দিলেন আচার্য দ্রোণ। মনে পড়ে যায়, গুরুর ধর্ম কীভাবে দ্রোণ লঙ্ঘন করেছিলেন একলব্যের কাছে গুরুদক্ষিণা চাওয়ার সময়ে। গুরুর ধর্ম, ব্রাহ্মণের ধর্ম সমস্ত লঙ্ঘন করেছিলেন দ্রোণ—তাও সর্বাপেক্ষা প্রিয় শিষ্যের বীরপুত্রকে হত্যা করার জন্য। মহাকাল কিন্তু ছাড়েননি দ্রোণাচার্যকে। একইভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় দ্রোণাচার্যের কেশাকর্ষণ করে মুণ্ড কেটে নিয়েছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। অর্জুন ক্ষুব্ধ হওয়া সত্ত্বেও ধৃষ্টদ্যুম্নের সে আচরণ ছিল অতি স্বাভাবিক বিচার। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই, ভীষ্ম সেনাপতি থাকলে কখনওই অভিমন্যুকে এইভাবে হত্যার অনুমতি দিতেন না।

এই ঘটনার পর অর্জুনের প্রতিক্রিয়াও একটু অদ্ভুত লাগে। অর্জুন পরদিন সূর্যাস্তের পূর্বে জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞা করলেন। অর্জুন কৃষ্ণের সহায়তায় সে প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন। এই ঘটনায় যুধিষ্ঠিরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য—“অর্জুন অল্প কারণে জয়দ্রথ বধ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। আমি তাতে সন্তোষ বোধ করিনি। অর্জুনের উচিত ছিল দ্রোণ কিংবা কর্ণ বধের প্রতিজ্ঞা করা।” আমরা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে একমত। অভিমন্যুকে হত্যা করা হয়েছিল। সে হত্যা জয়দ্রথ করেননি, করেছিলেন দ্রোণ কর্ণ সমেত সপ্তরথী। এক আধুনিক কবি বড় সুন্দর লিখেছিলেন, “সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি।” এই বেহায়া ছাতি ফুলানোর লোক সেকালেও ছিল, একালেও আছে। এঁদের সমর্থকও আছে।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে প্রিয়পুত্র বৰ্চা পিতা চন্দ্রের কাছে ফিরে গেলেন। মর্ত্যভূমিতে রেখে গেলেন বিধবা স্ত্রী উত্তরা এবং তাঁর গর্ভে বেড়ে ওঠা অসম্পূর্ণ ভাবী ভারতসম্রাট পরীক্ষিৎকে।

৬৮
মৃত্যুর উৎপত্তি

[যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে ভীষণ ভালবাসতেন। অভিমন্যুর মৃত্যু তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। পৃথিবীর শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধে দীর্ঘকাল অধিকার ছিল অভিমন্যুর। যুধিষ্ঠিরের মন যখন অত্যন্ত বিচলিত, তখন মহর্ষি ব্যাস এলেন তাঁর কাছে। যুধিষ্ঠিরকে জানালেন যে, তাঁর মতো ধীরস্থির ব্যক্তির পক্ষে এতখানি উদভ্রান্ত হওয়া শোভা পায় না। যুধিষ্ঠির ব্যাসদেবকে বললেন, “এই মৃত্যু কে? এর স্বরূপ কী?” তখন মহর্ষি ব্যাস তাঁকে জানালেন অকম্পন নামক রাজশ্রেষ্ঠের কাছে বলা নারদের কাহিনি। আমরা দেবর্ষি নারদ কথিত সেই কাহিনিই বর্তমান মুহূর্তে আলোচনা করব]।

মহাতেজা ও মহাপ্রভাবশালী পিতামহ ব্রহ্মা প্রথম সৃষ্টির সময়ে প্রাণীগণকে সৃষ্টি করে এই জগৎ প্রাণীগণে পরিপূর্ণ দেখে বুঝলেন, এদের সংহারও আবশ্যক। কিন্তু তিনি চিন্তা করেও প্রাণী সংহারের উপায় স্থির করতে পারলেন না। তখন ক্রোধবশত তাঁর কর্ণ প্রভৃতি রন্ধ্র থেকে অগ্নি উত্থিত হল। সেই অগ্নি জগৎ দগ্ধ করার ইচ্ছায় সমস্ত দিক ও বিদিক ব্যাপ্ত করল। মাহাত্ম্যশালী ও দাহদক্ষ প্রবল অগ্নি গুরুতর ক্রোধের বেগে সকলের ভয় সৃষ্টি করেই যেন স্বর্গ, মর্ত্য, আকাশ—এমনকী শিখাসমূহ ব্যাপ্ত চরাচর সমগ্র জগৎ দগ্ধ করতে প্রবৃত্ত হল— তখন স্থাবর ও জঙ্গম ভূতসকল নষ্ট হতে লাগল।

ততো হরো জটী স্থাণুর্নিশাচরপতিঃ শিবঃ।

জগাম শরণং দেবং ব্রহ্মাণং পরমেষ্ঠিনম্॥ দ্রোণ : ৪৫ : ৪৩॥

“তখন জটাধারী, স্থিরস্বভাব, ভূতপতি ও মঙ্গলময় মহাদেব এসে দেবপরমেষ্ঠী ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন।”

সেই মহাদেব জগতের হিতকামনায় আগমন করলে, পরমদেবতা ও মহামুনি ব্রহ্মা তেজে জ্বলতে থেকেই যেন বললেন, “অভীষ্টপ্রাপ্তিযোগ্য পুত্র! তুমি আমার সংকল্পেই জন্মেছ; অতএব তোমার কোন কাজ করব? স্থাণু! তুমি যা ইচ্ছা করো, তা বললা; আমি তোমার সমস্ত প্রিয় কার্য করব।” তখন মহাদেব বললেন, “প্রভু! আপনি ভূতসৃষ্টির জন্য যত্ন করেছিলেন, পরে নানাবিধ ভূত সৃষ্টি করেছেন এবং সেগুলিও বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার আপনার ক্রোধে সে সমস্তই দগ্ধ হচ্ছে। তা দেখে আমার দয়া জন্মেছে। অতএব প্রভু! ভগবান! আপনি প্রসন্ন হোন।”

ব্রহ্মা বললেন, “আমি বিনা কারণে ক্রুদ্ধ হইনি। জগৎ ধ্বংস করার কোনও বাসনাও আমার ছিল না। কিন্তু পৃথিবীর হিত কামনাতেই আমার ক্রোধ জন্মেছিল। কারণ, মহাদেব! এই পৃথিবীদেবী ভারার্ত হয়ে প্রাণীগণের সংহারের জন্য সর্বদা আমাকে অনুরোধ করছেন। তখন আমি বহু প্রকার তপস্যা করি, কিন্তু তাতেও আমি অপরিমেয় জগতের সংহার উপায় খুঁজে পাইনি; তখনই আমার ক্রোধ উৎপন্ন হয়।”

মহাদেব বললেন, “জগদীশ্বর! আপনি জগৎ-সংসার নিবৃত্তির জন্য প্রসন্ন হোন, ক্রোধ করবেন না, স্থাবর-জঙ্গম প্রাণীগণকে বিনষ্ট করবেন না। ভগবন্! আপনার অনুগ্রহেই এই জগৎটা তিন ভাবে চলছে; যা পূর্বে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আপনি ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে অগ্নিকে সৃষ্টি করেছিলেন। সেই অগ্নি প্রস্তরসমূহ, বৃক্ষ, নদী, সমস্ত ক্ষুদ্র জলাশয় এবং সমগ্র তৃণ-লতা দগ্ধ করছে; ক্রমে স্থাবর জঙ্গম জগৎ নিঃশেষ করবে। অতএব ভগবন্! আপনি প্রসন্ন হোন। আপনার ক্রোধ না থাকাই আমার বর। আপনি নিবৃত্ত হোন, আপনার তেজ রূপে অগ্নি আপনাতেই বিলীন হয়ে যাক। অতএব দেব! আপনি জগতের হিতকামনা করে বিশেষ প্রসন্ন দৃষ্টিতে তা দেখুন। যাতে সকল প্রাণী ধ্বংস থেকে নিবৃত্তি পায়, তা করুন। নূতন প্রাণীর জন্ম তো হচ্ছেই না, বর্তমান যেগুলি আছে, সেগুলিকে ধ্বংস করবেন না। লোকনাশক! আপনি আমাকে জগতে দেবাধীশ্বর পদে নিযুক্ত করেছেন, আমার এই জগৎটা যেন ধ্বংস না হয়, সেই কারণেই আপনাকে এই অনুরোধ করছি।”

তখন ভগবান, প্রভাবশালী ও জগৎপূজিত ব্রহ্মা, অগ্নির উপসংহার করে কর্মকে উৎপত্তি ও বিনাশের হেতু বলে কল্পনা করলেন। মহাত্মা ব্রহ্মা যখন সেই ক্রোধাগ্নি উপসংহার করলেন, তখন তাঁর সকল ইন্দ্রিয়রন্ধ্র থেকে একটি স্ত্রী আবির্ভূত হল। কৃষ্ণ ও রক্তবর্ণের মিশ্রণে তাঁর পিঙ্গলবর্ণ এবং জিহ্বা, মুখ ও নয়ন রক্তবর্ণ ছিল। তাঁর কানে দুটি তপ্ত কাঞ্চনময় কুণ্ডল ছিল। অন্য অলংকারও ছিল তপ্তকাঞ্চনময়। সেই নারী ব্রহ্মার ইন্দ্রিয়রন্ধ্র থেকে নির্গত হয়ে ব্রহ্মা ও মহাদেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে, তাঁদের দক্ষিণ দিকে গিয়ে দাঁড়াল। ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, “মৃত্যো! তুমি প্রাণীগণকে সংহার করতে থাকো। আমার ক্রোধ থেকে তোমার জন্ম। সুতরাং আমার আদেশে মূর্খ ও পণ্ডিত সকলকে সংহার করো। তাতে তোমার মঙ্গল হবে।” ব্রহ্মার আদেশ শুনে সেই পদ্মনয়না স্ত্রীরূপিণী মৃত্যু অত্যন্ত চিন্তা ও সুস্বরে রোদন করতে লাগল। তখন ব্রহ্মা জগতের মঙ্গলের জন্য দুই হাতে সেই অশ্রুজল গ্রহণ করলেন এবং কার্যসম্পাদনের জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। তখন সেই নারী নিজেই নিজের মনোদুঃখ দূর করে কৃতাঞ্জলি হয়ে লতার মতো অবনত থেকে ব্রহ্মাকে পুনরায় বললেন, “ভগবন্‌! আপনি আমাকে নারীরূপে সৃষ্টি করলেন কেন? সমস্ত ঘটনা জেনে আমি কেমনভাবে সেই নৃশংস ও অহিত কাজ করব? আমি যে অধর্মের ভয় করি। অতএব প্রভু! আপনি প্রসন্ন হয়ে আমাকে অন্য কার্যে নিযুক্ত করুন। দেব! অনুগ্রহ করে চিন্তা করুন, প্রাণীদের প্রিয় পুত্র, বয়স্য, ভ্রাতা, মাতা, পিতা ও পতি প্রভৃতিকে সংহার করলে, তাঁদের প্রিয়জনেরা আমার অমঙ্গল চিন্তা করবে। তারা কাতর হয়ে রোদন করতে থাকলে, যে সকল অশ্রুবিন্দু পতিত হবে আমি তা থেকেই ভীত হচ্ছি। অতএব ভগবন্! আমি আপনার শরণাপন্ন হলাম। হে বরদাতা! আমি যমের ভবনে যাব না। আপনি আমার এই প্রার্থনা পূর্ণ করুন। দেব! আমি আপনার অনুগ্রহ লাভের জন্য কঠিন তপস্যা করার ইচ্ছা করি। আপনি আমাকে এই আশীর্বাদ করুন। আপনি আদেশ করলে আমি উত্তম ধেনুক মুনির আশ্রমে যাব। সেখানে গিয়ে আপনার তপস্যায় নিরত থেকে সুদীর্ঘকাল অতিবাহিত করব।”

ব্রহ্মা বললেন, “মৃত্যু! তোমাকে দিয়ে আমি প্রাণীসংহার করাব বলে স্থির করেছি। অতএব যাও, সকল প্রাণীকেই সংহার করতে থাকো। এ বিষয়ে অন্য কোনও বিচার কোরো না। কারণ এ ঘটনা এইরূপই ঘটবে। এর কোনও অন্যথা হবে না। যাও, আমার আদেশ পালন করো।”

ব্রহ্মা এই আদেশ করলে মৃত্যুদেবী ভীত হয়ে ব্রহ্মার দিকে তাকিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে রইলেন। তথাপি প্রাণীগণের হিতকামনায় তাদের সংহার করতে চাইলেন না। তখন প্রাণীগণের ঈশ্বরের ঈশ্বর ব্রহ্মা নীরব হলেন ও মনে মনে প্রসন্নতা লাভ করলেন। ব্রহ্মা প্রসন্নচিত্তে দৃষ্টিপাত করামাত্র প্রাণীগণ পূর্বের মতো হল। ভগবান ব্রহ্মার ক্রোধ নিবৃত্তি পেলে, মৃত্যুদেবী সেখান থেকে ধেনুকমুনির আশ্রমে চলে গেলেন। তিনি সেখানে গিয়ে অতিশয় উত্তম ও তীব্র তপস্যা করতে আরম্ভ করলেন। ক্রমে তিনি সেখানে দীর্ঘকাল এক চরণে দাঁড়িয়ে রইলেন।

প্রীতিজনক শব্দ স্পর্শ প্রভৃতি বিষয় থেকে কর্ণ, ত্বক প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গণকে নিবৃত্ত রেখে সেইভাবে আরও অনেক কাল থাকলেন। তারপর তিনি পুনরায় এক পাদে সপ্ত, ষট্‌, দুই, সপ্ত ও এক পদ্ম বৎসর (বহুকাল) অবস্থান করলেন। তারপর তিনি বহুকাল হরিণদের সঙ্গে বিচরণ করলেন। তারপর তিনি দীর্ঘকাল শীতল ও নির্মলজলশালিনী নন্দা নদীতে অতিবাহিত করলেন। কোনও এক নির্দিষ্ট নিয়মে শপথ করে পবিত্র কৌশিকী নদীতে গিয়ে বায়ু ও জলমাত্র আহার করতে থেকে সকল নিয়ম পালন করলেন। ক্রমে সেই পুণ্যবতী কন্যা, মৃত্যুদেবী, পঞ্চগঙ্গা ও বেতসতীর্থে গুরুতর বহু তপস্যা দ্বারা নিজের দেহ কৃশ করলেন। তারপর তিনি গঙ্গা ও প্রধান তীর্থ মহামেরুতে গিয়ে প্রাণায়ামে প্রবৃত্ত থেকে পাথরের মতো নিশ্চেষ্ট থাকলেন। মৃত্যুদেবী হিমালয় পর্বতের উপর দীর্ঘকাল চরণাঙ্গুষ্ঠে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর তিনি পুষ্কর, গো-কর্ণ, নৈমিষারণ্য ও মলয়াচলে গিয়ে অভীষ্ট নিয়ম অবলম্বন করে আপন দেহ আরও কৃশ করলেন। সমস্ত তীর্থে তিনি অন্য সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র ব্রহ্মার শরণাপন্নই থাকলেন। তখন অত্যন্ত সন্তুষ্ট ব্ৰহ্মা তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, “মৃত্যু! তুমি কী জন্যে এই গুরুতর তপস্যা করছ?” তখন মৃত্যুদেবী পুনরায় ভগবান ব্রহ্মাকে বললেন—

“দেব! প্রাণীরা সুস্থদেহে থাকবে এবং আত্মীয়স্বজনকে ডাকতে থাকবে, সেই অবস্থায় আমি তাদের সংহার করতে পারব না। দেবেশ্বর! প্রভু! আমি আপনার কাছে এই বর প্রার্থনা করছি। আমি অধর্মের ভয়ে ভীত হয়েছিলাম। তাই তপস্যা অবলম্বন করেছিলাম। আপনি এই ভীতার প্রতি অভয়দান করুন। আমি পীড়িতা ও নিরপরাধা নারী, সুতরাং আমি প্রার্থনা করি আপনি আমার উপায় হোন।”

তারপর ভূত-ভবিষ্যদ্বর্তমানজ্ঞ ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, “মৃত্যু! তুমি এই সকল প্রাণী সংহার করলেও তোমার অধর্মের ভয় নেই। আমি যা বলেছি তা কোনও প্রকারেই অসত্য হবে না। তুমি চতুর্বিধ সমস্ত প্রাণী সংহার করতে থাকো। সনাতন ধর্ম তোমাকে সর্বপ্রকারে পবিত্র করবেন। দিকপাল যম এবং রোগসমূহ তোমার সহায় হবেন। আমি ও দেবগণ তোমাকে পুনরায় বরদান করব; যাতে তুমি নিষ্পাপ ও কামক্রোধরহিত হয়ে জগতে খ্যাতিলাভ করবে।” ব্রহ্মা এই কথা বললে, মৃত্যুদেবী কৃতাঞ্জলি হয়ে এবং মস্তকদ্বারা প্রসন্ন করে পুনরায় ব্রহ্মাকে এই কথা বললেন, “প্রভু! আমি ব্যতীত যদি আপনার এই কার্য সম্পন্ন না হয়, তবে আপনার আদেশ আমি মস্তকে স্থাপন করলাম। কিন্তু যা বলব, তা শ্রবণ করুন৷ লোভ, ক্রোধ, অসূয়া, ঈর্ষা, দ্রোহ, মোহ, নির্লজ্জতা এবং পরস্পর নিষ্ঠুর বাক্য এই সকল নানাবিধ দোষ দেহীগণের দেহ ক্ষীণ করুক, তারপর আমি সংহার করব।” ব্রহ্মা বললেন, “কল্যাণী! মৃত্যু! তাই হবে, তুমি প্রাণীগণকে সম্যকভাবে সংহার করতে থাকো; তাতে তোমার অধর্ম হবে না কিংবা আমি তোমার অনিষ্ট চিন্তা করব না। তোমার যে-সকল অশ্রুবিন্দু পূর্বে আমার হাতে পতিত হয়েছিল, সেইগুলিই প্রাণীগণের দেহে ও মনে রোগের সৃষ্টি করবে। সেই সকল রোগই প্রাণীগণকে মারবে, আর তাতেই তাদের প্রাণ যাবে। সুতরাং তোমার কোনও অধর্ম হবে না। প্রাণীগণকে সংহার করলেও তোমার কোনও পাপ হবে না। বিশেষত তুমিই ধর্মস্বরূপা ও ধর্মের নিয়ন্ত্রী হবে। অতএব তুমি ধর্মে থেকে, সর্বদা ধর্মাচরণ করে এবং ধর্মরক্ষা করতে থেকে এই প্রাণীগণকে সর্বপ্রকারে ধর্মে প্রবৃত্ত করো। তুমি কাম ক্রোধ পরিত্যাগ করে সমস্ত প্রাণীর জীবন সংহার করতে থাকো। অসীম ধর্ম তোমাকে আশ্রয় করবে; বাস্তবিকপক্ষে অধর্মই মিথ্যাচারীদের সংহার করবে। তুমি সেই ধর্মদ্বারা প্রাণীগণের মৃত্যুকালে আত্মাকে পবিত্র করবে। অতএব তুমি অন্তিম কামটুকু পর্যন্ত পরিত্যাগ করে এই জগতে এখন থেকে জীবসংহার করতে থাকো।” মৃত্যুদেবী বললেন, “তাই হবে।”

*

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দ্রোণপর্বে ভয়ংকর যুদ্ধের মধ্যে হঠাৎ এই মৃত্যুর উৎপত্তির বর্ণনা করা হল কেন? এই সমস্ত কারণে কিছু কিছু বিশিষ্ট পণ্ডিত স্থির করেন যে, মহাভারত একজন কবির রচনা নয়—বিভিন্ন কবি বিভিন্ন সময়ে এই সংহিতা গ্রন্থকে সংবর্ধিত ও পরিযুক্ত করেছেন।

কিন্তু এই বিষয়টি সতর্কভাবে বিচার করলে বোঝা যায়, এই স্থানই মৃত্যুর উৎপত্তি বর্ণনার উপযুক্ততম স্থান। যুধিষ্ঠিরের জীবনে পিতা-মাতার মৃত্যুর পর নিকটতম কোনও আত্মীয়ের এই প্রথম মৃত্যু। ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত থাকলেও তিনি জীবিত ছিলেন। পরিবারের তরুণতম এক সদস্যের মৃত্যুতে যুধিষ্ঠির স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির পারিবারিক মানুষ ছিলেন। অভিমন্যু তাঁরই আদেশ পালন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বয়সে তরুণ, সদ্য বিবাহিত অভিমন্যু, বড় আদর করে বিরাটরাজার মেয়ে উত্তরার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন অভিমন্যুর। সেই অভিমন্যু চলে গেল অকালে। মৃত্যু তাকে নিয়ে গেল। মৃত্যুর স্বরূপ, আচরণ, কার্যকলাপ জানতে চাইছিলেন যুধিষ্ঠির। তখন ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরের কাছে নারদ মুনির অকম্পন রাজাকে বলা মৃত্যুর উৎপত্তি শোনালেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন যে, অকম্পন রাজা এই উত্তমার্থ প্রকাশক বাক্য শ্রবণ করে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ও বীরগণের উত্তম গতির বিষয়ে জেনে যথাকালে স্বর্গলোক গিয়েছিলেন। মহাধনুর্ধর অভিমন্যু সমরাঙ্গনে সমস্ত ধনুর্ধরদের সম্মুখে শত্রুগণকে বধ করে যুদ্ধ করতে করতে নিহত হয়েছেন। চন্দ্রের পুত্র মহারথ অভিমন্যু তরবারি, গদা, শক্তি, কামুক দ্বারা নিহত এবং দুঃখবিহীন হয়ে পিতা চন্দ্রের কাছে চলে গিয়েছেন।

যুধিষ্ঠিরের অশান্ত চিত্ত শান্ত হল। তিনি বিশেষ ধৈর্য ধারণ করে ভ্রাতাদের সঙ্গে সুসজ্জিত ও সাবধান হয়ে পুনরায় সত্বর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। একথা সত্য যে, অভিমন্যুর পূর্বে ইরাবানের মৃত্যু যুধিষ্ঠির দেখেছিলেন। কিন্তু ইরাবান পাণ্ডব-পরিবারের সন্তান ছিলেন না। এমনকী পিতা অর্জুনের সঙ্গে যুবক ইরাবানের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল স্বর্গে। দিব্যাস্ত্র সংগ্রহে পিতা অর্জুন স্বর্গে এসেছেন শুনে ইরাবান স্বর্গে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ইরাবানকে যুধিষ্ঠির প্রথম দেখেছিলেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে। এমনকী, ঘটোৎকচকেও যুধিষ্ঠির প্রয়োজনের সময় পেয়েছিলেন। অভিমন্যু ঘরের মধ্যে লালিত পালিত হয়ে উঠেছিলেন। অভিমন্যুর মৃত্যু তাই তাঁকে এত নাড়া দিয়েছিল।

৬৯
অর্জুনের প্রতিজ্ঞা

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনের সন্ধ্যা নেমে এল। রণক্ষেত্রে পড়ে রইলেন বীর অভিমন্যু। সূর্য অস্তাচল গমন করলেন। সায়াহ্নকালে উভয়পক্ষের সৈন্যরাই আপন আপন শিবিরে চলে গেলে, বীরশোভাসম্পন্ন কপিধ্বজ অর্জুন দিব্য অস্ত্রদ্বারা সংশপ্তকদের সংহার করে সেই বিজয়ী রথে আরোহণ করে আপন শিবিরের পথে ফিরতে ফিরতে দুই চোখে জল নিয়ে কৃষ্ণকে বললেন, “কৃষ্ণ! অচ্যুত! আমার হৃদয় হঠাৎ আশঙ্কিত হচ্ছে কেন? মুখে কথা আটকে যাচ্ছে, চারপাশে বহু অনিষ্ট লক্ষণ দেখছি। ভূমি, আকাশ ও সকল দিকে ভয়ংকর উৎপাত দেখতে পাচ্ছি। জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাজা যুধিষ্ঠিরের কোনও অমঙ্গল হয়নি তো?” কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন তোমার ভ্রাতা এবং অমাত্যবর্গ নিশ্চয়ই মঙ্গলে আছেন। তুমি উদ্বিগ্ন হোয়ো না। সেখানে হয়তো সামান্য কিছু অনিষ্ট হয়ে থাকবে।”

সন্ধ্যা উপাসনা সেরে কৃষ্ণ ও অর্জুন রথে চড়ে কুরুক্ষেত্র যাত্রা করলেন। তাঁরা দেখলেন কোথাও কোনও আনন্দের চিহ্ন নেই, শিবির আলোকশূন্য। শিবিরের এই বিকৃতরূপ দেখে উদ্বিগ্ন চিত্ত অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, “জনার্দন! আজ মাঙ্গলিক তূর্য বাজছে না, দুন্দুভিধ্বনি ও শঙ্খধ্বনিও হচ্ছে না। ঢাক ও করতাল শব্দের সঙ্গে বীণাও বাজছে না। স্তুতিপাঠকেরা মাঙ্গলিক গান গাইছে না, মনোহর শ্লোক সকলও পাঠ করছে না। যোদ্ধারা আমাকে দেখে মুখ নিচু করে চলে যাচ্ছে, কেউ আগের মতো অভিবাদন করে যুদ্ধবৃত্তান্ত বলছে না। কৃষ্ণ আমার ভ্রাতাদের মঙ্গল তো? আত্মীয়গণকে আকুল দেখে আমার মন যে কিছুতেই প্রসন্ন হচ্ছে না। বিরাট, দ্রুপদ কুশলে আছেন তো? আমি আজ যুদ্ধ থেকে ফিরলে, অন্য দিনের মতো, অন্য ভ্রাতাদের নিয়ে আনন্দিত চিত্তে অভিমন্যু আমার সঙ্গে দেখা করতে এল না তো।”

কৃষ্ণ ও অর্জুন এইরকম আলোচনা করতে করতে শিবিরে প্রবেশ করে দেখলেন— অত্যন্ত অসুস্থ পাণ্ডবেরা যেন অচৈতন্য হয়ে রয়েছেন। তখন অর্জুন— ভ্রাতৃগণকে ও অপর পুত্রদের মধ্যে অভিমন্যুকে না দেখে বিষন্নচিত্তে বললেন, “আপনাদের সকলেরই মুখমণ্ডল মলিন দেখছি, অভিমন্যুকে দেখছি না, আপনারাও আমার অভিনন্দন করছেন না। ওদিকে আমি শুনেছি— দ্রোণ চক্রব্যূহ নির্মাণ করেছিলেন— অথচ বালক অভিমন্যু ছাড়া আপনাদের মধ্যে আর কেউ তা ভেদ করতে সমর্থ ছিলেন না। আমি অভিমন্যুকে চক্রব্যূহভেদ করতে শিখিয়েছিলাম কিন্তু ব্যূহ থেকে নির্গমের প্রণালী শেখাইনি। সে যাই হোক, আপনারা সেই বালককে শত্রুসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেননি তো? মহাধনুর্ধর ও বিপক্ষীয় হন্তা অভিমন্যু যুদ্ধে বিপক্ষের বহু সৈন্য ভেদ করে গিয়ে নিহত হয়ে শয়ন করেনি তো? পার্বত্য সিংহের মতো রক্তনয়ন, মহাবাহু ও কৃষ্ণের তুল্য বিক্রমশালী অভিমন্যুর বিষয় আপনারা বলুন— সে কী করে যুদ্ধে নিহত হল? সুকুমার, মহাধনুর্ধর, ইন্দ্রের পুত্রের পুত্র এবং সর্বদা আমার প্রিয় অভিমন্যুর সংবাদ আপনারা বলুন— সে কী করে যুদ্ধে নিহত হল? বিক্রম, শাস্ত্রজ্ঞান ও ঔদার্যগুণে বৃষ্ণিবংশশ্রেষ্ঠ মহাত্মা কৃষ্ণের তুল্য অভিমন্যু কী করে যুদ্ধে নিহত হল?”

বাষ্ণের্য়ীদয়িতং শূরং ময়া সততলালিতম্‌।

যদি পুত্রং ন পশ্যামি যাস্যামি যমসাদনম্‌॥ দ্রোণ : ৬৪ : ২৭॥

“—হায়! যে সুভদ্রার প্রিয় ও বীর ছিল এবং যাকে আমি সর্বদা লালন করতাম, সেই পুত্রকে যদি দেখতে না পাই, তবে আমি যমভবনে যাব।”

“সুভদ্রার প্রিয়পুত্র এবং দ্রৌপদী, কৃষ্ণ ও মাতৃদেবী কুন্তীর সর্বদা প্রিয় অভিমন্যুকে কোন ব্যক্তি কাল প্রেরিত হয়ে বধ করল? যার কেশকলাপের প্রান্তভাগ কোমল ও কুঞ্চিত, নয়নযুগল হরিণশাবকের নয়নের মতো চঞ্চল, মত্তহস্তীর তুল্য বিক্রম এবং দেহ নবীন শাল বৃক্ষের সমান উন্নত ছিল। যে বালক মৃদু হাস্য করে কথা বলত, সর্বদা গুরুজনের বাক্য পালন করত, বাল্যবয়সেও পূর্ণ বয়স্কের মতো কাজ করত, সকলকেই প্রিয় বাক্য বলত এবং কারও প্রতি বিদ্বেষ করত না; যার উৎসাহ প্রবল, বাহুযুগল সবল এবং নয়নযুগল দীর্ঘ ও পদ্মের তুল্য সুন্দর ছিল; যে ভক্তের প্রতি দয়া করত, ইন্দ্রিয়গুলিকে দমনে রাখত; নীচ লোকের অনুসরণ করত না, কৃতজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিল, সমস্ত অস্ত্র শিক্ষা করেছিল, যুদ্ধে পলায়ন করত না, যুদ্ধ দেখলে আনন্দ লাভ করত, সর্বদা শত্রুপক্ষের শোক বৃদ্ধি করত, আত্মীয়গণের প্রিয় ও হিত কার্যে নিরত থাকত এবং পিতৃগণের জয় কামনা করত। আর যে বালক যুদ্ধে প্রথম প্রহার করত না, ব্যস্ত হত না, সেই শান্তস্বভাব পুত্র অভিমন্যুকে যদি দেখতে না পাই তবে আমি তার শোকে যমভবনে যাব। ভীষ্ম বৃষ্ণি প্রভৃতি গণনা করার সময়ে, যাকে মহারথ বলে গণনা করেছিলেন— যে যুদ্ধে আমার থেকে দেড়গুণ অধিক ছিল এবং প্রদ্যুম্ন, কৃষ্ণ ও আমার প্রিয়শিষ্য ছিল— সেই তরুণ ও বাহুশালী পুত্রকে যদি দেখতে না পাই, তবে তার শোকে আমি যমভবনে চলে যাব। সুন্দর নাক, সুন্দর কপাল, সুন্দর চোখ, সুন্দর ভ্রূ ও সুন্দর ওষ্ঠযুক্ত অভিমন্যুর মুখখানি দেখতে না পেলে, আমার মনের কি শান্তি হবে? তন্ত্রীর শব্দের ন্যায় সুখজনক এবং পুরুষজাতীয় কোকিলের স্বরের মতো মনোহর অভিমন্যুর কণ্ঠস্বর শুনতে না পেলে, আমার মনের কী শান্তি হবে? দেবগণের মধ্যেও দুর্লভ সেই বীরের অতুলনীয় রূপ দেখতে না পেলে, এখন আমার মনের কি শান্তি হবে? গুরুজনকে সর্বদাই নমস্কার করতে নিপুণ এবং তাঁদের আদেশ পালনে নিরত সেই অভিমন্যুকে আজ আমি যদি দেখতে না পাই, তবে আমার কি শান্তি হবে?

“আমি মনে করি— কর্ণ, দ্রোণ ও কৃপ প্রভৃতি যোদ্ধারা নানাচিহ্নযুক্ত, পরিষ্কৃত মুখ ও তীক্ষ্ণ বাণসমূহ দ্বারা পীড়িত করতে থাকলে আমার পুত্রের চৈতন্য অল্পমাত্রেই অবশিষ্ট ছিল এবং হয়তো সেই অবস্থায় সে ‘এখন আমার পিতা এসে আমাকে যদি রক্ষা করতেন’ এইভাবে বার বার বিলাপ করছিল; সেই সময়ে নৃশংসরা তাকে নিপাতিত করেছে। অথবা আমার পুত্র, কৃষ্ণের ভাগিনেয় এবং সুভদ্রার গর্ভজাত অভিমন্যু এরূপ বিলাপ করতে পারে না। হায়! আমার হৃদয় নিশ্চয়ই বজ্রসারঘটিত বলে অত্যন্ত দৃঢ়। যে হেতু দীর্ঘবাহু ও রক্তনয়ন অভিমন্যুকে দেখতে না পেয়েও বিদীর্ণ হচ্ছে না। হায়! একে বালক, তাতে আবার কৃষ্ণের ভাগিনেয় এবং আমার পুত্র। এহেন অভিমন্যুর উপরে কী করে মহাধনুর্ধর নৃশংসরা মর্মভেদী বাণ সকল নিক্ষেপ করল।

“হায়! প্রতিদিন সন্ধ্যায় আনন্দিত চিত্তে প্রত্যুদ্‌গমন করে আমাকে যে অভিনন্দিত করত, আজ আমি শত্ৰুসংহার করে ফিরে এলেও সে আমাকে দেখছে না। হায়! নিশ্চয়ই আজ সে নিপাতিত সূর্যের মতো অঙ্গ সকল দিয়ে ভূমির শোভা জন্মাতে থেকে রক্তসিক্ত অবস্থায় ভূতলে পতিত হয়ে শয়ন করে রয়েছে। যুদ্ধে অপলায়ী পুত্রকে নিহত শুনে যিনি শোকার্ত হয়ে বিনষ্ট হবেন, সেই সুভদ্রার কথা ভেবে আমি অত্যন্ত কষ্ট অনুভব করছি। সুভদ্রা ও দ্রৌপদী অভিমন্যুকে না দেখে আমাকে কী বলবেন, আমিই বা তাঁদের কী বলব। আমার হৃদয় নিশ্চয় বজ্রকঠিন। কীভাবে আমি বধূ উত্তরার সামনে গিয়েও শতধা বিদীর্ণ হৃদয় হয়ে যাব না?

“আমি দর্পান্বিত ধৃতরাষ্ট্রগণের সিংহনাদ শুনেছিলাম এবং যুযুৎসু যে কৌরববীরগণের নিন্দা করছিলেন, তা কৃষ্ণ শুনেছিলেন। অভিমন্যুকে বধ করার পর যুযুৎসু কর্ণপ্রভৃতিকে বলেছিলেন, ‘হে অধর্মজ্ঞ মহারথগণ! আপনারা অর্জুনকে জয় করতে না পেরে একটি বালককে বধ করে কেন এত সিংহনাদ করছেন, পাণ্ডবদের শক্তি দেখুন। আপনারা যুদ্ধে সেই কৃষ্ণ ও অর্জুনের অপ্রিয় কার্য করে শোকের সময়ে আনন্দিত হয়ে কেন এত সিংহনাদ করছেন?’ মহামতি যুযুৎসু ক্রুদ্ধ ও দুঃখিত হয়ে অস্ত্র পরিত্যাগ করে কর্ণপ্রভৃতির প্রতি এই কথা বলতে বলতে চলে এসেছেন। কৃষ্ণ! তুমি যুদ্ধস্থলে একথা বলনি কেন? তা হলে আমি তখনই সেই নৃশংস সমস্ত মহারথকে দগ্ধ করে ফেলতাম।”

তীব্র পুত্রশোকে পীড়িত অত্যন্ত কাতর ও শোকার্ত অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন, “অর্জুন এই রকম কোরো না। ক্ষত্রিয় যোদ্ধার চিরকাল এই একই গতি। ধর্মশাস্ত্ৰজ্ঞেরা যুদ্ধোপজীবী অথচ অপলায়ী বীরগণের এই গতিই বিধান করেছেন। কুরুনন্দন! বীরগণের যুদ্ধে মরণই নিশ্চিত। সুতরাং অভিমন্যু আপন পুণ্যসম্পাদিত লোকে গমন করেছে, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভরতশ্রেষ্ঠ, সকল বীরের এইরূপ আকাঙ্ক্ষা থাকে, ‘আমি যেন সম্মুখযুদ্ধে মৃত্যুলাভ করি।’ অতএব অভিমন্যু যুদ্ধে বীর ও মহাবল রাজপুত্রগণকে বধ করে বীরগণের আকাঙ্ক্ষিত সম্মুখযুদ্ধে মৃত্যু লাভ করেছে। তুমি শোক কোরো না। প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রকারেরা এই ক্ষত্রিয়গণের যুদ্ধে মৃত্যুরূপ সনাতন ধর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। অর্জুন এইসব শাস্ত্র তোমার জানা আছে। অতএব তুমি শোক না করে অন্য শোকার্তদের সান্ত্বনা দাও।” কৃষ্ণ একথা বললে অর্জুন আশ্বস্ত হলেন। তারপর তিনি তখন গদগদভাবে সমস্ত ভ্রাতাকে বললেন, “দীর্ঘবাহু, স্থূলস্কন্ধ এবং পদ্মতুল্য-সুন্দর-দীর্ঘ নয়ন অভিমন্যু যেভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হল, তা আমি শুনতে ইচ্ছা করি। হস্তী, অশ্ব, রথ ও অনুচরবর্গের সঙ্গে আমার পুত্রের সেই শত্রুগণকে আমি যুদ্ধে নিহত করব আপনারা দেখবেন। সমস্ত অস্ত্রে সুশিক্ষিত এবং চিরকাল অস্ত্রব্যবহারী আপনাদের সকলের সমক্ষে অভিমন্যু ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে সম্মিলিত হয়ে কী প্রকার মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে? আমি যদি পূর্বে একথা জানতে পারতাম যে, পাণ্ডব ও পাঞ্চালেরা আমার পুত্রকে রক্ষা করতে অসমর্থ হবেন, তবে আমিই তাকে রক্ষা করতাম।

“আপনারা রথে আরোহণ করে বাণ বর্ষণ করছিলেন, সেই অবস্থায় আপনাদের সামনেই শত্রুরা যুদ্ধনীতি লঙ্ঘন করে অভিমন্যুকে বধ করল? কী আশ্চর্য! আপনাদের পুরুষকারও নেই, পরাক্রমও নেই। যেহেতু আপনাদের সামনেই শত্রুরা যুদ্ধে অভিমন্যুকে নিপাতিত করেছে। আমি নিজেকেই নিন্দা করি, যেহেতু অতিদুর্বল, ভীরু এবং অকৃতনিশ্চয় আপনাদের যুধিষ্ঠির-রক্ষায় নিযুক্ত করে আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম। অথবা আপনারা আমার পুত্রকে রক্ষা করতে না পারায় আপনাদের বর্ম, অস্ত্র ও শস্ত্র কেবল ভূষণের জন্য এবং সভাতে বীরের বাক্য বলাও কেবল বীরত্ব মুখে প্রকাশের জন্য।” অর্জুন এই কথা বলে উত্তম ধনু ও তরবারি ধারণ করে দাঁড়ালে কোনও ব্যক্তিই তাঁর মুখের দিকে তাকাতে সাহস করল না। তখন অর্জুন পুত্রশোকে অত্যন্ত সন্তপ্ত, অশ্রুপূর্ণবদন ও যমের ন্যায় ক্রুদ্ধ হয়ে মুহুর্মুহু নিশ্বাস ত্যাগ করতে থাকলে, কৃষ্ণ বা যুধিষ্ঠির ছাড়া বন্ধুবর্গের অন্য কোনও ব্যক্তি তাঁকে কোনও কথা বলতে বা প্রশ্ন করতে পারলেন না। কারণ, কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির সমস্ত অবস্থাতেই অর্জুনের মনের অনুকূল অবস্থায় আছেন। অর্জুন তাঁদের অত্যন্ত সম্মান করেন এবং তাঁরাও অর্জুনের অত্যন্ত প্রিয়ভাবে চলেন। তখন পুত্রশোকে অত্যন্ত কাতর ক্রুদ্ধ ও পদ্মের ন্যায় আরক্তবর্ণ অর্জুনকে যুধিষ্ঠির বললেন, “মহাবাহু! তুমি সংশপ্তক সৈন্যের দিকে চলে গেলে, দ্রোণ আমাকে ধরবার জন্য গুরুতর চেষ্টা করতে লাগলেন। দ্ৰোণ সমরাঙ্গনে আপন সৈন্যদের ব্যূহরূপে সন্নিবেশিত করে আমাকে ধরবার জন্য এগোতে লাগলে, আমরাও পাণ্ডবসৈন্যগণকে প্রতিব্যূহরূপে স্থাপিত করে সর্বপ্রকার তাঁকে বারণ করতে লাগলাম। ক্রমে আমাদের পক্ষের রথীরা তাঁকে বারণ করতে থাকলে এবং আমাকেও সুরক্ষিত করলে, দ্রোণ তীক্ষ্ণ শরসমূহদ্বারা পীড়ন করতে থাকলে সত্বর আমাদের দিকে আসতে থাকলেন। আমরা রণক্ষেত্রে দ্রোণসৈন্যের দিকে তাকাতেও পারলাম না, ভেদ করা তো দূরের কথা। তখন আমরা সকলে বলে অতুলনীয় সেই পুত্র অভিমন্যুকে বললাম, ‘প্রভাবশালী বৎস! তুমি দ্রোণসৈন্য বিদারণ করো।’ আমরা সেই আদেশ করলে, সুশিক্ষিত অশ্বের ন্যায় বলবান অভিমন্যু একাকী সেই অসহ্য ভারও বহন করবার উপক্রম করল। তারপর গরুড় যেমন সমুদ্রে প্রবেশ করেন, সেইরূপ তোমার দত্ত অস্ত্র-শিক্ষায় শিক্ষিত এবং বলবান সেই বালক গিয়ে কৌরবসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করল। তখন সে— যে পথে গিয়ে প্রবেশ করেছিল, আমরাও সেই পথে প্রবেশ করবার ইচ্ছা করেই তার পিছনে পিছনে চললাম। কিন্তু ক্ষু্‌দ্র সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ মহাদেবের বরপ্রভাবে আমাদের সকলকেই বারণ করল। কিছুতেই আমরা চক্রব্যূহের মুখ খুলতে পারলাম না। তখন ব্যূহের মধ্যে দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃহদ্বল ও কৃতবর্মা এই ছয় জন রথী এসে অভিমন্যুকে পরিবেষ্টন করলেন। ক্রমে সেই মহারথেরা সকলে যুদ্ধে পরিবেষ্টন করলেন এবং অভিমন্যু বালক হয়েও শক্তি অনুসারে আত্মরক্ষার বিশেষ চেষ্টা করতে লাগলেন, তখন বহুতর বীর তাঁকে রথবিহীন করে ফেললেন। তারপর দুঃশাসনের পুত্র সত্বর এসে নিজের জীবনে অত্যন্ত সন্দিগ্ধ হয়ে রথবিহীন অভিমন্যুকে সংহার করলেন।

“হায়! পরমধর্মাত্মা কুমার অভিমন্যু প্রথমে বহুসহস্র হস্তী, অশ্ব, রথী ও পদাতিককে, পরে আবার আট হাজার রথী, ন’শো হস্তী, দু’ হাজার রাজপুত্র এবং অগণিত বীরসহস্রকে বধ করে, রাজা বৃহদ্বলকে স্বর্গে পাঠিয়ে দিয়ে, তারপর নিজে স্বর্গে গমন করেছে। অর্জুন! এই পর্যন্তই আমাদের শোকবৃদ্ধিজনক ব্যাপার নিষ্পন্ন হয়েছে এবং এইভাবেই সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ কুমার স্বর্গলাভ করেছে।”

যুধিষ্ঠিরের বাক্য শুনে অর্জুন ‘হা পুত্র’ বলে নিশ্বাস ত্যাগ করে শোকবেদনায় ভূতলে নিপতিত হলেন। তখন সকলেই শোকে কাতর ও বিষণ্ণবদন হয়ে অর্জুনকে ধরে নিমেষহীন নয়নে পরস্পরকে দেখতে লাগলেন। তারপর অর্জুন চৈতন্য লাভ করে, ক্রোধে মূর্ছিত হয়ে, জ্বররোগেই যেন কাঁপতে কাঁপতে মুহুর্মুহু নিশ্বাস ত্যাগ করে, হাতে হাত ঘষতে ঘষতে, উন্মত্তের মতো বিকৃত দৃষ্টিপাত সহকারে ও সাশ্রুনেত্রে এই কথাগুলি বললেন, “বীরগণ আমি আপনাদের কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি, জয়দ্রথ যদি বধের ভয়ে ভীত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের পরিত্যাগ করে না যায়, তবে আমি আগামী কালই তাকে বধ করব। জয়দ্রথ যদি আমার, কিংবা পুরুষোত্তম কৃষ্ণের অথবা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের শরণাপন্ন না হয়, তবে আগামীকালই তাকে বধ করব। যে, দুর্যোধনের প্রিয় কাজ করেছে, আমার সৌহার্দ্য বিস্মৃত হয়ে বালকবধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই পাপাত্মা জয়দ্রথকে আগামীকালই বধ করব। কাল সমরাঙ্গনে যে কেউ জয়দ্রথকে রক্ষা করার জন্য আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসেন, তাঁরা যদি দ্রোণ ও কৃপও হন, তবুও আমি বাণ দ্বারা তাঁদের আচ্ছন্ন করব। পুরুষশ্রেষ্ঠগণ! আমি যদি এ কাজ করতে না পারি, তবে আমি যেন বীরগণের অভিমত অনুযায়ী পুণ্যসম্পাদিত লোক লাভ না করি। আমি যদি আগামীকাল জয়দ্রথকে বধ না করতে পারি, তবে— মাতৃহত্যাকারী, পিতৃঘাতী, গুরুপত্নীগামী, খল, সাধুলোকের দোষাবিষ্কারকারী, পরের অপবাদ-বাদকারী, গচ্ছিতদ্রব্যহারী, বিশ্বাসঘাতী, ভুক্তপূর্বা স্ত্রীর নিন্দাকরণনিবন্ধন অযশ্বস্বী, ব্রহ্মহত্যাকারী এবং গোঘাতী, আর পরিজন বা অতিথিকে বঞ্চনা করে পায়স, যবান্ন, উত্তম শাক, তিলান্ন, সংযাব, পিষ্টক ও মাংসভোজীগণের যে যে নরক হয়, আমি যেন সদ্যই সে সকল নরকে গমন করি।

“আমি যদি জয়দ্রথকে কালই বধ করতে না পারি, তা হলে বেদপাঠী বা অত্যন্ত ব্রতপরায়ণ ব্রাহ্মণের, কিংবা বৃদ্ধ সাধু ও গুরুজনের অবজ্ঞাকারী লোক যে নরকগমন করে, আমি যেন সদ্যই সে সকল নরকে গমন করি—

অপ্সু শ্লেষ্ম পুরীষং বা মূত্রং বা মুঞ্চতাং গতিঃ।

তাং গচ্ছেয়ং গতিং ঘোরাং ন চেদ্ধন্যাং জয়দ্রথম্‌॥ দ্রোণ : ৬৫ : ৩০॥

“আমি যদি জয়দ্রথকে বধ করতে না পারি, তা হলে চরণদ্বারা ব্রাহ্মণ, গোরু কিংবা অগ্নির স্পর্শকারী লোকের যে নরক হয়, অথবা জলে বিষ্ঠা ও শ্লেষ্মা ও মূত্রত্যাগকারীর যে নরক হয়ে থাকে, আমি যেন সেই ভয়ংকর নরকে গমন করি।

“আমি যদি জয়দ্রথকে বধ করতে না পারি, তা হলে— যে নগ্ন হয়ে স্নান করে, যার গৃহ থেকে অতিথি না খেয়ে চলে যায়, যে ঘুষ গ্রহণ করে, যে সাধারণভাবে মিথ্যা কথা বলে, যে পরের প্রতারণা করে, যে কৃপণতার জন্য নিজের সুখ নষ্ট করে, যে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, যে ভৃত্য, পুত্র, পরস্ত্রী ও আশ্রিত লোকের সঙ্গে লঘু পরিহাস করে, কিংবা যে বণ্টন না করে উৎকৃষ্ট বস্তু স্বয়ং ভক্ষণ করে, তাদের যে নরক হয়, আমি যেন সেই সকল ভয়ংকর নরকে গমন করি।

“আমি যদি জয়দ্রথকে বধ করতে না পারি, তা হলে— যে সকল ব্রাহ্মণ শীতের ভয় করেন, কিংবা যে সকল ক্ষত্রিয় যুদ্ধে ভীত হয়ে থাকেন, তাঁদের গম্য ভয়ংকর নরকে যেন আমি গমন করি। যে নৃশংস প্রকৃতি লোক আশ্রিত, সাধু ও আজ্ঞাবহ ব্যক্তিকে ত্যাগ করে আর ভরণ পোষণ করে না এবং উপকারীর নিন্দা করে; যে লোক প্রতিবেশী গুণবান ব্রাহ্মণকে শাস্ত্রীয় রীতি অনুসারে শ্রদ্ধায় দ্রব্য দান করে না— অথচ নির্গুণ ব্রাহ্মণকে কিংবা শূদ্ৰাপতিকে দান করে; আর যে লোক সুরা পান করে, গুরুজনের গৌরব লঙ্ঘন করে, উপকারীর অপকার করে এবং নির্দোষ ভ্রাতার নিন্দা করে, যদি আমি জয়দ্রথকে বধ না করি তা হলে যেন তাদের গমনযোগ্য নরকে সত্বর গমন করি। এই রাত্রি প্রভাত হওয়ার পরে আগামীকাল যদি জয়দ্রথকে বধ করতে না পারি, তবে আমার আর একটা প্রতিজ্ঞার কথা আপনারা পুনরায় শুনুন।

“এই পাপাত্মা জয়দ্রথ নিহত না হওয়া পর্যন্ত যদি কাল সূর্য অস্ত যান, তা হলে আমি এই শিবিরেই প্রজ্বলিত অগ্নিতে প্রবেশ করব। দেবতা, অসুর, মানুষ, পশু, পক্ষী বা সর্প অথবা পিতৃলোক, রাক্ষস, ব্রহ্মর্ষি ও দেবর্ষিরা কিংবা স্থাবর ও জঙ্গমাত্মক এই জগৎ অথবা তা ভিন্ন যা কিছু আছে, সে সমস্ত একত্র হয়েও আমার হাত থেকে সেই শত্রুকে রক্ষা করতে পারবে না। জয়দ্রথ যদি সেই উত্তম পাতালে, আকাশে, দেবপুরে কিংবা দৈত্যপুরে গিয়ে প্রবেশ করে, তবুও আমি কাল বলপূর্বক উপস্থিত হয়ে বাণসমূহ দ্বারা তাঁর মস্তক ছেদন করব।”

অর্জুন এই বলে বাম দক্ষিণে নিয়ে গাণ্ডিবধনুর টংকার করলেন; তখন সেই ধনুর টংকার অর্জুনের কণ্ঠশব্দকে অতিক্রম করে গিয়ে আকাশ স্পর্শ করল। অর্জুন ওইরকম প্রতিজ্ঞা করলে, অত্যন্ত ক্রুদ্ধ কৃষ্ণ পাঞ্চজন্যধ্বনি করলেন এবং অর্জুনও দেবদত্ত শঙ্খ বাজালেন। তখন কৃষ্ণের পাঞ্চজন্যের নির্ঘোষ পাতাল, আকাশ, দিক ও দিকপালগণের সঙ্গে জগৎ প্রলয়কালের ন্যায় কাঁপাতে লাগল। অর্জুন সেই প্রতিজ্ঞা করলে পাণ্ডবপক্ষ থেকে নানাবিধ বাদ্যধ্বনি ও সিংহনাদ উঠল।

*

অর্জুনের স্বগ-মর্ত্য-পাতাল কাঁপানো প্রতিজ্ঞা পাঠকেরা শুনলেন। পাণ্ডবভ্রাতাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মিতবাক অর্জুন। এমনকী দূতক্রীড়ার ক্ষেত্রে দ্রৌপদীর চরম লাঞ্ছনার সময়েও অর্জুন স্তব্ধবাকই ছিলেন। অর্জন কর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। গাণ্ডিবের টংকারে প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করে দিতেই অভ্যস্ত ছিলেন অর্জুন। অভিমন্যুর মৃত্যুতে অর্জুনের নিভৃত পিতৃ-হৃদয়টি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, অনাবৃত ও উদ্‌ঘাটিত হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত ভালবাসতেন অর্জুন এই প্রিয়দর্শন পুত্রটিকে। পিতৃকুল ও মাতৃকুলের সমস্ত ভাল নিয়েই গড়ে উঠেছিলেন অভিমন্যু। কৃষ্ণের অত্যন্ত আদরের, সাত্যকির সর্বাপেক্ষা প্রিয় শিষ্য অভিমন্যু। অন্য পাণ্ডব ভ্রাতারাও অত্যন্ত স্নেহ করতেন অভিমন্যুকে। যুধিষ্ঠির তাঁকে “পুত্র অভিমন্যু” বলে ডাকতেন। সারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর, দেব দৈত্য নর— সকলে স্তম্ভিত বিস্ময়ে যে নাম উচ্চারণ করত— “অর্জুন, তুমি অর্জুন!”— সেই অর্জুন কত ভালবাসতেন তাঁর পুত্রকে, তার প্রমাণ মেলে অর্জুন জীবনে প্রথমবার আপন ভ্রাতাদের বল ও বীর্য সম্পর্কে কটুক্তি করায়। অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে দেবতার মতো ভক্তি করতেন। নিজেকে তিনি যুধিষ্ঠিরের ‘ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ এই নামেই পরিচিত করতে পছন্দ করতেন। এই প্রতিজ্ঞার সময়েও অর্জুন সেই মাত্ৰাজ্ঞানের সম্পূর্ণ পরিচয় দিয়েছেন। মর্যাদা রেখেছেন সারথিরূপে শ্রীকৃষ্ণের।

কিন্তু একটি প্রশ্নের মীমাংসা হল না। প্রশ্নটি সর্বদা পাঠকের মনের মধ্যে জেগে থাকে। পরবর্তীকালে যুধিষ্ঠিরও আমাদের সেই প্রশ্নকে সমর্থন করেছেন। অর্জুন জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞা করলেন কেন? এ কথা ঠিকই, জয়দ্রথ মহাদেবের বরপ্রভাবে চক্রব্যূহের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, অন্য কেউই চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে পারেননি, অভিমন্যুকে সহায়তা করতে যেতে পারেননি, একেবারে সহায়হীন অবস্থাতেই অভিমন্যু মারা যান। কিন্তু জয়দ্রথ নিজে অভিমন্যুকে মারেননি। মহাদেবের আশীর্বাদে অন্য পাণ্ডবদের প্রবেশদ্বার আটকে ছিলেন। অভিমন্যুকে বধ করেছিলেন অন্যায়-যুদ্ধে সপ্তরথী। তাঁদের মধ্যে প্রধান হলেন অর্জুনের গুরু দ্রোণাচার্য, অপরজন হলেন কৌরবপক্ষের শ্রেষ্ঠ বীরের দর্পকারী কর্ণ। একক যুদ্ধে এই সপ্তরথী অভিমন্যুর কাছে প্রত্যেকে পরাজিত হয়ে, রণক্ষেত্র ত্যাগ করেছেন। শেষে সপ্তরথী অভিমন্যুকে পরিবেষ্টন করে পিছন থেকে অভিমন্যুর চক্র, হস্তাবাপ, মুষ্টি, তরবারি, গদা সমস্ত ধ্বংস করে অভিমন্যুকে ‘হত্যা’ করেছেন। এই হত্যার প্রধান পাণ্ডা দ্রোণ এবং কর্ণ। যুধিষ্ঠির যথার্থ বলেছিলেন, “অর্জুন সামান্য কারণে জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তাতে আমি সন্তুষ্ট হইনি। তাঁর দ্রোণ কিংবা কর্ণকে বধের প্রতিজ্ঞা করা উচিত ছিল।”আমরা যুধিষ্ঠিরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত। অভিমন্যু নিহত হলে সর্বাপেক্ষা অধিক উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন দুর্যোধন ও কর্ণ। রবীন্দ্র-সমসাময়িক এক কবি যথার্থই লিখেছিলেন, “সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি।” তবে এই ‘বেহায়া ছাতির’ সমর্থক দল সেদিনও ছিল, আজও আছে। তবে এও ঠিক ভীষ্ম সেনাপতি থাকলে এভাবে অভিমন্যু-বধ ঘটত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *