৪০. পুত্রকামনায় অগস্ত্য-লোপামুদ্রা সম্মিলন

৪০
পুত্রকামনায় অগস্ত্য-লোপামুদ্রা সম্মিলন

ইন্দ্র কর্তৃক সম্মানিত অর্জুনের সঙ্গে স্বর্গে ইন্দ্রভবনেই দেবর্ষি নারদের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। ভ্রাতাদের বিরহে অর্জুনও কাতর হয়ে পড়েছিলেন। নারদের পশ্চাদাগত লোমশ মুনিক অর্জুন অনুরোধ করলেন, লোমশ মুনি কর্তৃক রক্ষিত হয়ে তাঁর ভ্রাতারা তীর্থ-দর্শনে পুণ্য অর্জন করুন। লোমশ মুনি সম্মত হলেন।

লোমশ মুনির সঙ্গে যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব ও দ্রৌপদী অগস্ত্যাশ্রমে গিয়ে, দুর্জয় মণিমতীপুরীতে অবস্থান করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির সসম্ভ্রমে লোমশ মুনিকে প্রশ্ন করলেন, “মহর্ষি, অগস্ত্য কী কারণে এখানে বাতাপিকে বিনাশ করেছিলেন? মানুষহন্তা সেই দৈত্যের প্রভাবই বা কেমন ছিল? মহাত্মা অগস্ত্যেরই বা কী জন্য ক্রোধ জন্মেছিল?”

লোমশ বললেন, কৌরবনন্দন, পূর্বকালে এই মণিমতীপুবে ‘ইল্বল’ নামে এক দৈত্য বাস করত; বাতাপি ছিল তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা। একদিন ইল্বল এক তপস্বী ব্রাহ্মণের নিকট একটি ইন্দ্রতুল্য পুত্র প্রার্থনা করল। কিন্তু তপস্বী ব্রাহ্মণ দৈত্য ইল্বলের ইন্দ্রতুল্য পুত্র-প্রার্থনা স্বীকার করলেন না। এতে ইল্বল সেই ব্রাহ্মণ এবং সমগ্র ব্রাহ্মণকুলের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হল। সে ব্রাহ্মণদের হত্যা করার জন্য একটি বিচিত্র মায়াবী পথ গ্রহণ করল। সে ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করত যে, তিনি কোন মাংস ভক্ষণ করতে চান, ছাগমাংস অথবা মেষমাংস? ব্রাহ্মণ তাঁর ইচ্ছা জানালে ইল্বল ভ্রাতা বাতাপিকে কখনও ছাগ বা কখনও মেষে রূপান্তরিত করত। তারপর ব্রাহ্মণের সম্মুখেই সেই ছাগ অথবা মেষকে ছেদন করে, তার মাংস রন্ধন করে ব্রাহ্মণকে খেতে দিত।

ইল্বল যে-কোনও মৃত ব্যক্তিকে মন্ত্রপাঠপূর্বক আহ্বান করলে, সেই মৃত ব্যক্তি পুনরায় জীবিত হয়ে ইল্বলের সম্মুখে এসে দাঁড়াত। সুতরাং বাতাপি ছাগল বা মেষ হলে, ইল্বল তাকে ছেদন ও রন্ধন করে ব্রাহ্মণকে ভোজন করাত। তারপর সে বাতাপিকে আহ্বান করত। ব্রাহ্মণ তখন পরিতৃপ্ত। সেই অবস্থায় বাতাপি সেই ব্রাহ্মণের পার্শ্ব ভেদ করে ইল্বলের সম্মুখে উপস্থিত হত। এইভাবে দুষ্টবুদ্ধি ইল্বল ভোজন করিয়ে ব্রাহ্মণদের বধ করতে লাগল।

এই সময়ে ভগবান অগস্ত্যমুনি একটি গর্তের ভিতর আপন পিতৃপুরুষগণকে অধোমুখে ঝুলতে দেখলেন। তিনি তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কী জন্য এই গর্তের মধ্যে ঝুলছেন?” তখন সেই বেদবাদী পিতৃগণ উত্তরে বললেন, “বংশলোপ হওয়ার সম্ভাবনায় আমরা ঝুলছি।” তারপর তাঁরা আবার অগস্ত্যকে বললেন, “আমরা তোমার নিজের পূর্বপুরুষ। আমরা পুত্রার্থী হয়ে অধোমুখে এই গর্তে ঝুলন্ত আছি। অতএব পুত্র অগস্ত্য, যদি তুমি আমাদের উত্তম বংশধর উৎপাদন করতে পারো, তবে আমাদেরও এই নরক থেকে মুক্তি লাভ হয়, আর তুমিও উত্তম গতি লাভ করতে পারো।” তখন তেজস্বী ও সত্যধর্মপরায়ণ অগস্ত্য তাঁদের বললেন, “পিতৃগণ অবশ্যই আমি আপনাদের অভিলাষপূর্ণ করব, আপনাদের মনের দুঃখ আমি দূর করব।”

পিতৃগণকে এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিলেও বহু অন্বেষণ করেও অগস্ত্য নিজের যোগ্য স্ত্রী কোথাও খুঁজে পেলেন না। তখন অগস্ত্য নিজেই নিজের যোগ্য স্ত্রী নির্মাণের সংকল্প গ্রহণ করলেন। মনে মনে প্রাণী জগতের যে যে প্রাণীর যে অঙ্গ সুন্দর, তাই গ্রহণ করে একটি সর্বোৎকৃষ্ট স্ত্রী নির্মাণ করলেন। অগস্ত্য সেই কন্যাটিকে পাত্রস্থ করার বিষয় চিন্তা করতে লাগলেন।

সেই সময়ে বিদর্ভদেশের রাজা সন্তানের জন্য তপস্যা করছিলেন। তাই মহাতপস্বী অগস্ত্য নিজের জন্য সংকল্পিত সেই স্ত্রীটি বিদর্ভরাজকে দান করলেন। সন্ধ্যাকালে বিদ্যুতের মতো সেই সুন্দরী ও সুলক্ষণমুখী এসে বিদর্ভ রাজমহিষীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করল এবং ধীরে ধীরে তার দেহ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে লাগল। কন্যাটির জন্ম হলে তার মুখ দেখে বিদর্ভরাজ অত্যন্ত আনন্দবশত সেই সংবাদ ব্রাহ্মণ প্রভৃতিদের জানালেন। ব্রাহ্মণেরা সেই কন্যার মুখ দর্শনে অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং সেই কন্যাটির নাম রাখলেন, ‘লোপামুদ্রা’। সুলক্ষণা কন্যাটি উত্তম রূপ ধারণ করে জলে পদ্মিনীর মতো এবং কাষ্ঠে অগ্নিশিখার মতো অতিদ্রুত বৃদ্ধি পেতে লাগল। ক্রমে সেই কন্যাটি যৌবনে পদার্পণ করল। বিদর্ভরাজ তার সেবাকর্মে একশত অলংকৃত কন্যা ও একশত দাসী নিযুক্ত করলেন। অলংকৃত কন্যা ও দাসীবৃন্দের মধ্যে সেই কন্যাটি আকাশে নক্ষত্রের মধ্যবর্তী রোহিণী নক্ষত্রের মতো শোভা পেতে লাগল। লোপামুদ্রা যৌবনে পদার্পণ করল। সে সুশীলা ও সদাচারসম্পন্না হলেও রাজার ভয়ে কোনও পুরুষই তাকে প্রার্থনা করতে সাহস পেত না। অপ্সরার থেকেও অধিক সুন্দরী এবং সত্যপরায়ণা সেই কন্যাটি স্বভাবগুণে পিতা ও আত্মীয়গণকে সন্তুষ্ট করতে থাকল। বিদর্ভরাজ, গুণবতী ও রূপবতী কন্যা লোপামুদ্রার যোগ্য পাত্রের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।

এদিকে অগস্ত্য যখন দেখলেন লোপামুদ্রা গৃহস্থধর্মাচরণে যোগ্য হয়ে উঠছেন, তখন বিদর্ভরাজের কাছে গিয়ে বললেন, “রাজা পুত্র জন্মদানের জন্য বর্তমানে আমার বিবাহের ইচ্ছা হয়েছে, অতএব পৃথিবীপতি, আপনার কাছে আমি প্রার্থনা করছি, আপনি লোপামুদ্রাকে আমার হাতে প্রদান করুন।” অগস্ত্যের প্রস্তাব শুনে বিদর্ভরাজ হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। তিনি অগস্ত্যের প্রার্থনা প্রত্যাখ্যানও করতে পারলেন না আবার কন্যাদান করতেও ইচ্ছা করলেন না। তখন রাজা রানির কাছে গিয়ে বললেন, “এই মহর্ষি অত্যন্ত তপঃ প্রভাবসম্পন্ন; সুতরাং শাপ দিয়ে আমার রাজ্য পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারেন। এখন রানি, তুমি কী বলো? এ বিষয়ে আমার কী করা উচিত?” কিন্তু রানি রাজার কথা শুনে কোনও কথাই বললেন না। পিতামাতাকে দুঃখিত ও চিন্তার্ত দেখে লোপামুদ্রা এসে পিতাকে বললেন, “পিতা আপনি আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমাকে অগস্ত্যের হাতে সমর্পণ করে নিজেকে ও রাজ্যকে রক্ষা করুন।” পরিণত, যৌবনবতী ও বয়স্থা কন্যার কথা শুনে বিদর্ভরাজ যথাবিধানে অগস্ত্যের হস্তে লোপামুদ্রাকে সমর্পণ করলেন।

অগস্ত্য লোপামুদ্রাকে ভার্যা লাভ করে বললেন, “তুমি এই সকল মহামূল্য বস্ত্র ও অলংকার পরিত্যাগ করো।” স্বামীর আদেশ শুনে রম্ভোরু ও আয়তনয়না লোপামুদ্রা সুদৃশ্য, মহামূল্য ও সূক্ষ্ম বস্ত্ৰসকল ত্যাগ করে ভর্তার সমান ব্রতচারিণী হলেন। তখন ভগবান অগস্ত্য গঙ্গাদ্বারে এসে অনুকূলা পত্নীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ভয়ংকর তপস্যা আরম্ভ করলেন। লোপামুদ্রা সন্তুষ্ট চিত্তে অত্যন্ত আদরের সঙ্গে স্বামীর পরিচর্যা করতেন; প্রভাবশালী অগস্ত্যও ভার্যার প্রতি অত্যন্ত ভালবাসা জানাতেন। অনেকদিন কেটে গেল। একদিন অগস্ত্য তপস্যাপ্রভাবে উজ্জ্বলাঙ্গী লোপামুদ্রাকে ঋতুস্নাতা দর্শন করলেন। লোপামুদ্রার পরিচর্যা, পবিত্রতা, ইন্দ্রিয়দমন, লাবণ্য ও সৌন্দর্যের গুণে প্রীত হয়ে অগস্ত্য তাঁকে মৈথুনের জন্য আহ্বান করলেন। অনুরাগিণী লোপামুদ্রা সলজ্জ কৃতাঞ্জলি হয়ে প্রণয়ের সঙ্গে অগস্ত্যকে বললেন, “ঋষি নিশ্চয়ই আপনি পুত্রের জন্যই আমাকে ভার্যারূপে গ্রহণ করেছেন। অতএব যাতে আমার সঙ্গে মিলনে প্রীতি জাগে, আপনি তা করুন। পিতৃগৃহে অট্টালিকার ভিতরে আমার যেমন শয্যা ছিল, তেমন শয্যাতেই আপনি আমার সঙ্গে সঙ্গম করুন। আর মাল্যধারণপূর্বক নানাবিধ অলংকারে আপনিও সজ্জিত হোন, আমিও দিব্য অলংকারে অলংকৃত হই, তারপরই আমি অভিলাষ অনুযায়ী আপনার সঙ্গে মিলিত হতে ইচ্ছা করি। না হলে, এই গৈরিক কৌপীন ধারণ করে আমি আপনার কাছে যাব না। কারণ, ব্রহ্মর্ষির এই পরিচ্ছেদকে কোনও প্রকারেই অপবিত্র করা উচিত নয়।”

অগস্ত্য বললেন, “কল্যাণী! সুমধ্যমে! লোপামুদ্রে! তোমার পিতার যেমন ধন আছে, তেমন ধন তো তোমার নেই, আমারও নেই।” লোপামুদ্রা বললেন, “তপোধন, এই জীবলোকে যত ধন আছে, তপোবলে ক্ষণকাল মধ্যেই আপনি সমস্তই নিয়ে আসতে পারেন।” অগস্ত্য বললেন, “তুমি যা বললে, তা সত্য। কিন্তু তা হলে আমার তপস্যার ক্ষয় হবে। যাতে আমার তপস্যার ক্ষতি না হয়, এমন কোনও পথ আমাকে বলো।” লোপামুদ্রা বললেন, “তপোধন, আমার এই ঋতুকাল অল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে। অথচ আমি অন্য কোনও প্রকারেই আপনার সঙ্গে মিলিত হতে চাই না। আবার, আমি আপনার ধর্মলোপও ইচ্ছা করি না। অথচ আমার অভীষ্ট আপনাকেই সম্পাদন করতে হবে।”

অগস্ত্য বললেন, “সুন্দরী তোমার বুদ্ধি যদি এই কামনাতেই স্থির হয়ে থাকে, তবে আমি ধন সংগ্রহ করতে চললাম, তুমি এইখানে থেকেই অভীষ্ট গৃহকার্য করতে থাকো।” তারপর অগস্ত্য ধন প্রার্থনার জন্য শ্রুতর্বা রাজার কাছে গেলেন, যাঁকে তিনি অন্য রাজার থেকে ধনী বলে জানতেন। অগস্ত্য তাঁর রাজ্যসীমান্তে এসেছেন জেনে শ্রুতর্বা রাজা আপন মন্ত্রীদের নিয়ে বিশেষ আদর করে অগস্ত্যকে নিয়ে এলেন। যথানিয়মে অর্ঘ্যপ্রদান করে, কৃতাঞ্জলি এবং অবনত হয়ে রাজা অগস্ত্যের আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। অগস্ত্য জানালেন যে, অন্যকে কষ্ট না দিয়ে, তিনি ধন প্রার্থনা করতে এসেছেন। রাজা তাঁকে বললেন, তাঁর আয় ও ব্যয় সমান। তবে অগস্ত্য যদি মনে করেন যে, রাজার আয় ব্যয় অপেক্ষা অধিক, তবে তিনি ইচ্ছামতো ধন গ্রহণ করতে পারেন। সর্বত্র সমজ্ঞানী অগস্ত্য দেখলেন যে, রাজার আয় ও ব্যয় সমান, সুতরাং সেখান থেকে ধন নিলে অন্যদের কষ্ট হবে। তাই তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।

সেখান থেকে অগস্ত্যমুনি শ্রুতর্বা রাজাকে সঙ্গে নিয়ে ব্ৰধ্নশ্বরাজার কাছে উপস্থিত হলেন। রাজা ব্ৰধ্নশ্ব রাজ্যসীমান্তে অগস্ত্য ও শ্রুতর্বাকে সমাদরে অর্ঘ্য দিলেন এবং তাঁদের অনুমতি নিয়ে, আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। অগস্ত্য তাঁকে বললেন তিনি ধনার্থী হয়ে রাজা ব্রধ্নশ্বর কাছে এসেছেন। ব্ৰধ্নশ্ব উত্তর দিলেন, তাঁর আয় ও ব্যয় সমান। সুতরাং অগস্ত্য বিচার করে যদি উদ্বৃত্ত দেখেন তবে তা গ্রহণ করতে পারেন। সর্বত্র সমজ্ঞানী অগস্ত্য তাঁর আয়-ব্যয় সমান দেখে, অন্যদের কষ্ট হবে বলে ব্ৰধ্নশ্ব রাজার অর্থ গ্রহণ করলেন না।

তখন অগস্ত্যমুনি এবং শ্রুতর্বা ও ব্ৰধ্নশ্ব রাজা পুরুকুৎসবংশীয় মহাধনী রাজা ত্রসদস্যুর কাছে উপস্থিত হলেন। মহামনা ত্রসদস্যু রাজাও আপন রাজ্যসীমান্তে গিয়ে যথাবিধানে তাঁদের গ্রহণ করলেন। যথানিয়মে তাঁদের পূজা করে ত্রসদস্যু আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। অগস্ত্য তাঁকেও বললেন, “রাজা আপনি অবগত হন যে, আমরা এখানে ধনপ্রার্থী হয়ে এসেছি; অতএব অন্যের কষ্ট না হয়, এমনভাবে শক্তি অনুসারে আমাদের ধন দান করুন।” ত্রসদস্যু তাঁদের জানালেন যে, তাঁর আয়-ব্যয় সমান; এ জেনেও যা উদ্বৃত্ত দেখেন, তা অনায়াসে নিতে পারেন অগস্ত্যমুনি। সর্বত্র সমজ্ঞানী অগস্ত্য দেখলেন রাজার আয়-ব্যয় সমান। সুতরাং তিনি সেখান থেকেও ধন গ্রহণ করতে চাইলেন না। তখন সেই রাজারা সকলে মিলে পর্যালোচনা করে মহর্ষি অগস্ত্যমুনিকে জানালেন, “মহর্ষি, ইল্বলদানবই জগতের মধ্যে সবথেকে ধনী; অতএব আজ আমরা সকলে তাঁর কাছে গিয়ে ধন প্রার্থনা করি।” তাঁরা সকলে ইল্বলের কাছে গেলেন।

রাজারা মহর্ষি অগস্ত্যমুনির সঙ্গে আপন রাজ্যসীমান্তে উপস্থিত হয়েছেন জেনে, ইল্বল মন্ত্রিবর্গের সঙ্গে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সম্মান জানাল। তারপর তখনই ইল্বল ভ্রাতা বাতাপিকে মেষরূপে রূপান্তরিত করে ছেদন করল ও তার মাংস রন্ধন করে মাননীয় অতিথিবর্গের সৎকার করতে প্রবৃত্ত হল। আপন ভ্রাতাকে মেষরূপে ছেদন ও রন্ধন করায় উপস্থিত রাজারা সকলেই বিষণ্ণ এবং কিংকর্তব্য নির্ধারণে অসমর্থ হয়ে পড়লেন। তখন মহর্ষি অগস্ত্য সেই বিষণ্ণ রাজাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন যে, তিনি সেই মহাসুর বাতাপিকে ভক্ষণ করবেন। মহর্ষি অগস্ত্য গিয়ে প্রধান আসনে উপবিষ্ট হলেন। ইল্বল যেন আনন্দের সঙ্গে অগস্ত্যকে মাংস পরিবেশন করতে আরম্ভ করল। অগস্ত্য বাতাপির সমস্ত মাংস একাই ভক্ষণ করলেন। তাঁর ভোজন শেষ হলে ইল্বল পূর্বের মতোই বাতাপিকে আহ্বান করল। তখন মহামেঘগর্জনের মতো একটি বায়ু মহাশব্দে মহাত্মা অগস্ত্যের অধোদেশ দিয়ে বার হয়ে গেল। “বাতাপি নির্গত হও” এই বলে ইল্বল বারবার ডাকল। তখন মুনিশ্রেষ্ঠ অগস্ত্য হাস্য করে তাকে বললেন, “বাতাপি কী করে নির্গত হবে; আমি তাকে জীর্ণ করে ফেলেছি।” বাতাপি জীর্ণ হয়ে গেছে শুনে ইল্বল অতিশয় বিষণ্ণ হল।

তখন ইল্বল তার মন্ত্রিগণের সঙ্গে কৃতাঞ্জলি হয়ে অগস্ত্যকে বলল, “আপনারা কী জন্য এসেছেন বলুন, আমি আপনাদের জন্য কী করব।” তখন অগস্ত্য উচ্চহাস্য করে বললেন, “অসুর, আমরা সকলেই জানি যে, তুমি মহাধনী এবং দান করতে সমর্থ। এই রাজারা অধিক ধনী নন, অথচ আমার গুরুতর ধন প্রয়োজন; অতএব অন্যের কষ্টসৃষ্টি না করে, এমনভাবে শক্তি অনুসারে আমাকে ধনদান করো।”

তখন ইল্বল অগস্ত্যকে অভিবাদন করে বলল, “আমি যা দিতে ইচ্ছা করেছি, তা যদি আপনি বলতে পারেন, তবেই আপনাকে ধন দান করব।” অগস্ত্য বললেন, “অসুর, তুমি এই রাজাদের এক এক জনকে দশ হাজার করে গোরু এবং দশ হাজার করে মোহর দিতে ইচ্ছা করেছ। আমাকে তুমি এদের দ্বিগুণ গোরু এবং দ্বিগুণ ধন, একটি স্বর্ণময় রথ ও মনের মতো বেগবান দুটি অশ্ব প্রদান করতে ইচ্ছা করেছ। তুমি এখনই পরীক্ষা করে দেখো, এই রথখানি স্বর্ণময়।” ইল্বল পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হওয়ামাত্র সেই রথখানি স্বর্ণময় হয়ে গেল। তখন ইল্বল অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে ইচ্ছের থেকেও অনেক বেশি ধন দান করল এবং ‘বিরাব’ ও ‘সুরাব’ নামের দু’টি অশ্ব সেই রথে সংযুক্ত করল। তখন সেই অশ্ব দুটি অগস্ত্যের সঙ্গে সমস্ত রাজা ও সেই ধনগুলি নিয়ে নিমেষের মধ্যেই যেন অগস্ত্যের আশ্রমে বহন করে নিয়ে গেল। অগস্ত্যের অনুমতিক্রমে রাজারা চলে গেলেন।

লোপামুদ্রা বললেন, “ভগবন্! আপনি আমার অভীষ্ট সমস্তই সম্পাদন করেছেন, এখন আমার গর্ভে একটি বিশেষ শক্তিশালী সন্তান উৎপাদন করুন।” অগস্ত্য বললেন—

তুষ্টোহমস্মি কল্যাণি! তব বৃত্তেন শোভনে!

বিচারাণামপত্যে তু তব রক্ষ্যামি তাং শৃণু॥

সহস্রং তেহস্তু পুণাণাং শতং বা দশসন্মিতম্‌।

দশ বা শততুল্যাঃ স্যুরেকো বাপি সহস্ৰজিৎ॥ বন : ৮৩ : ২১-২২ ॥

“কল্যাণী! শোভনে! তোমার চরিত্রে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। এখন তোমার সন্তানের বিষয়ে একটি বিবেচনার কথা বলব, তা শ্রবণ করো। তোমার এক হাজার পুত্র হবে, না—দশটি উৎকৃষ্ট পুত্রের তুল্য একশত পুত্র হবে, কিংবা শতপুত্রের তুল্য দশটি পুত্র হবে অথবা সহস্র পুত্ৰবিজয়ী একটি পুত্র হবে?”

লোপামুদ্রা বললেন, “তপোধন, সহস্র পুত্রের তুল্য একটি মাত্র পুত্রই আমার হোক। কারণ, বহু মূর্খ পুত্র অপেক্ষা একটিমাত্র বিদ্বান পুত্রও শ্রেষ্ঠ।” “তাই হোক” এই বলে অগস্ত্য মুনি বিশ্বাসশীলা ও সৎস্বভাবা লোপামুদ্রার সঙ্গে যথাসময়ে যথোচিতভাবে সঙ্গম করলেন। অগস্ত্য লোপামুদ্রার গর্ভাধান করে বনে চলে গেলেন। সাত বৎসর পর্যন্ত সেই গর্ভটি বিস্তৃত হতে লাগল এবং সাত বৎসর পরে গর্ভ-নির্গত হয়ে আপন তেজে যেন জ্বলতে লাগল। পরে তার নাম হয়েছিল দৃঢ়স্যু এবং সে মহাকবি হয়েছিল। সেই পুত্র ব্যাকরণসমেত অঙ্গশাস্ত্র জানত, বেদ ও উপনিষদ পারদর্শী হয়েছিল। সে মহাতপা, তেজস্বী ও প্রধান ব্রাহ্মণ হিসাবে পরিচিত ছিল। বালক বয়স থেকে সে পিতার জন্য বন থেকে কাষ্ঠ সংগ্রহ করে গৃহে নিয়ে আসত। এই কারণে তার আর এক নাম হয়েছিল ইধ্নবাহ। এইভাবে মহর্ষি অগস্ত্য উত্তম, গুণবান সন্তান উৎপাদন করে পিতৃপুরুষকে উদ্ধার করেছিলেন। পিতৃপুরুষেরা অভীষ্ট স্বর্গ লাভ করেছিলেন। তাই অগস্ত্যাশ্রম সমগ্র জগতে বিখ্যাত স্থান।

*

অর্জুনের বিরহে পাণ্ডবভ্রাতারা যখন কাতর তখন লোমশ মুনি যুধিষ্ঠিরাদিকে বহু তীর্থক্ষেত্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। অগস্ত্যাশ্রম তার মধ্যে প্রধান একটি। এইভাবে বনবাসের দিন কাটছিল। সঙ্গে সঙ্গে মহর্ষি দেবর্ষি রাজর্ষিদের জীবনকাহিনিও পাণ্ডবভ্রাতাদের কাছে উন্মোচিত হচ্ছিল। প্রাচীনকালে পুত্রজন্ম দান অত্যন্ত পবিত্র বিষয় বলে বিবেচিত হত। মুনি-ঋষিরাও অতি সন্তুষ্ট চিত্তে এ কর্তব্য পালন করতেন। লোমশ মুনি পাণ্ডবদের এই শিক্ষাই দিয়েছিলেন।

৪১
ক্ষত্রিয়ের কাছে পরশুরামের প্রথম পরাজয়

ব্যাসদেব প্রদত্ত ‘প্রতিস্মৃতি’ মন্ত্র যুধিষ্ঠির অর্জুনকে শিক্ষা দিয়ে তপস্যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই মন্ত্র তপস্যা করে অর্জুন দেবাদিদেব মহাদেবের সাক্ষাৎ লাভ করেন ও মহাদেবের আশীর্বাদসহ পাশুপত অস্ত্র লাভ করেন। এরপর দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে সকল দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ সমেত শিক্ষা দিলেন। স্বর্গে লোমশ মুনির সঙ্গে অর্জুনের সাক্ষাৎ হয়। অর্জুন লোমশ মুনিকে অনুরোধ করেন, বিরহকাতর তাঁর ভ্রাতাদের তীর্থ পর্যটনে নিয়ে যেতে। লোমশ মুনি সম্মত হন। অগস্ত্যাশ্রম দেখার পর লোমশ মুনি যুধিষ্ঠির ও অন্য পাণ্ডব ভ্রাতাদের ভৃগুতীর্থে নিয়ে যান।

যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে লোমশ মুনি জানান যে এই ভৃগুতীর্থ ত্রিভুবনবিখ্যাত ও মহর্ষিগণ সেবিত। জমদগ্নি মুনির পুত্র পরশুরাম এই তীর্থজলে স্নান করে দশরথপুত্র শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক হরণ করে নেওয়া তেজ পুনরায় লাভ করেছিলেন। লোমশ মুনি যুধিষ্ঠিরকে জানালেন রামচন্দ্রের সঙ্গে শত্রুতাকারী পরশুরাম যেমন ভৃগুতীর্থে স্নান করার পর আপন তেজ ফিরে পেয়েছিলেন, যুধিষ্ঠিরও তেমনই ভ্রাতৃগণ ও ভার্যার সঙ্গে এই ভৃগুতীর্থে স্নান করে আপন হৃত রাজ্য ও তেজ পুনরায় লাভ করবেন। মুনির উপদেশ অনুযায়ী যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ ও ভার্যার সঙ্গে সেই ভৃগুতীর্থে স্নান করে দেবগণ ও পিতৃগণের তর্পণ করলেন। সেই তীর্থে স্নান করার পর যুধিষ্ঠিরের রূপ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হল এবং তিনি শত্রুগণের অজেয় হলেন। তারপর যুধিষ্ঠির লোমশ মুনিকে প্রশ্ন করলেন, “হে প্রভাবসম্পন্ন মহর্ষি! রামচন্দ্র কেন পরশুরামের তেজ অপহরণ করেছিলেন? কীভাবেই বা পরশুরাম আবার সেই তেজ ফিরে পেলেন? আপনি অনুগ্রহ করে বিশদভাবে তা বলুন।”

লোমশ উবাচ।

শৃণু রামস্যা রাজেন্দ্র! ভার্গবস্য চ ধীমতঃ।

জাতো দশরথস্যাসীৎ পুত্রো রামো মহাত্মনঃ॥ বন : ৮৪ : ৭ ॥

“রাজশ্রেষ্ঠ! দশরথনন্দন রাম ও ভৃগুবংশীয় ধীমান পরশুরামের বৃত্তান্ত শ্রবণ করো।” বিষ্ণু রাবণবধের নিমিত্ত আপন শরীরে মহাত্মা দশরথের পুত্র রাম হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। লোমশ মুনি আরও বললেন যে, তিনি রামচন্দ্রকে অযোধ্যায় দেখেছিলেন।

কোনও একদিন রেণুকাগৰ্ভজাত ভৃগুবংশীয় ঋচীকনন্দন পরশুরাম, রামচন্দ্রের অসাধারণ বলবীর্যের সংবাদে কৌতূহলী হয়ে যে ধনুকের দ্বারা তিনি একুশবার পৃথিবী ক্ষত্রিয়হীন করেছিলেন, সেই ধনুক নিয়ে অযোধ্যায় গমন করলেন। তিনি নিজ রাজ্যসীমান্তে উপস্থিত হয়েছেন শুনে রাজা দশরথ আপন বীরশ্রেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্রকে সেই পরশুরামের অভ্যর্থনার জন্য পাঠালেন। তখন পরশুরাম রামচন্দ্রকে আগত ও উদ্যতাস্ত্র দেখে যেন হাসতে হাসতেই তাঁকে বললেন, “প্রভাবসম্পন্ন রাজশ্রেষ্ঠ! যদি তোমার ক্ষমতা থাকে, তবে আমার এই ক্ষত্রিয়নাশকারী ধনুতে যত্নপূর্বক গুণ আরোপ করো।” পরশুরামের কথা শুনে রামচন্দ্র বললেন, “ভগবন্‌! আপনি আমাকে নিন্দা করতে পারেন না। কারণ দ্বিজাতীয়দের মধ্যে ক্ষত্রিয়ধর্মে আমিও অধম নই। বিশেষত ইক্ষ্বাকুবংশীয়দের বাহুবলে ও বীর্যবত্তায় খ্যাতি-গৌরব চিরকালের।”

রামচন্দ্রের এই কথায় পরশুরাম বললেন, “রঘুনন্দন ছলনা কিংবা বাগবিস্তারে প্রয়োজন নেই, আমার ধনুখানি বিস্তৃত করে জ্যা আরোপ করো দেখি।” পরশুরামের এই কথায় রামচন্দ্র অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি পরশুরামের হাত থেকে তাঁর ধনুখানি গ্রহণ করলেন। লীলা কৌতুকের সঙ্গেই যেন সেই ধনুতে গুণ পরালেন এবং মন্দহাস্য করতে করতে সেই ধনুতে টংকারধ্বনি করলেন। বজ্রের ন্যায় সেই টংকারধ্বনিতে জগতের সমস্ত প্রাণীই অত্যন্ত ভীত হল। তারপর রামচন্দ্র তখনই পরশুরামকে বললেন, “ব্রাহ্মণ, ধনুতে এই গুণ আরোপণ করলাম, আপনার আর কোন ইচ্ছা পূরণ করব বলুন।” পরশুরাম একটি অলৌকিক বাণ রামচন্দ্রকে দিয়ে বললেন, “এই বাণটিকে কর্ণ পর্যন্ত আকর্ষণ করো দেখি।” পরশুরামের কথা শুনে রামচন্দ্র ক্রোধে জ্বলে উঠে বললেন, “ভৃগুনন্দন! আপনার উক্তি শুনলাম এবং আপনাকে ক্ষমাও করলাম। আপনি যথার্থই দর্পে পরিপূর্ণ হয়ে আপনার সীমা লঙ্ঘন করেছেন। ব্রহ্মার অনুগ্রহে আপনি ক্ষত্রিয়দের অধিক তেজ লাভ করেছেন এবং সেই অনুগ্রহের জন্য আমাকেও নিন্দা করছেন। পশ্য মাং স্বেন রূপেণ চক্ষুস্তে বিতরাম্যহম্।— আমি আপনাকে দিব্য চক্ষু দিচ্ছি, আপনি আমার স্বরূপ দর্শন করুন।” তখন পরশুরাম দেখলেন, রামচন্দ্রের শরীরে—আদিত্যগণ, বসুগণ, রুদ্রগণ, সাধ্যগণ, মরুদ্‌গণ, অগ্নি, পিতৃগণ, নক্ষত্রগণ, গ্রহগণ, গন্ধর্বগণ, রাক্ষসগণ, যক্ষগণ, তীর্থসমূহ, জীবন্মুক্ত সনাতন বালখিল্য ঋষিগণ, দেবর্ষিগণ, সকল সমুদ্র, সকল পর্বত, উপনিষদ, বষট্‌কার ও যজ্ঞের সঙ্গে সকল বেদ, চৈতন্যাশালী সামগান, ধনুর্বেদ, মেঘসমূহ বৃষ্টি এবং বিদ্যুৎ রয়েছে।

তারপর সেই ভগবানরূপী রামচন্দ্র, যিনি স্বয়ং বিষ্ণু, শুষ্ক বজ্রের তুল্য বেগবান ও উল্কাসমূহের মতো তেজস্বী সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন। রামনিক্ষিপ্ত সেই উজ্জ্বল বাণটি গুরুতর ধূলিবর্ষণ ও মেঘবারিবর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে ব্যাপ্ত করে, ভূমিকম্প ও ক্রমাগত ঝঞ্ঝা সৃষ্টি করে, বিশাল গর্জন করে পরশুরামকে বিহ্বল করে, তেজ দ্বারা কেবল তাঁরই চৈতন্যহরণ করে নিয়ে চলে গেল। পরশুরাম দীর্ঘকাল বিহ্বল থাকার পর আবার চৈতন্য ফিরে পেলেন। প্রাণ ফিরে পেয়ে তিনি বিষ্ণুরূপী রামচন্দ্রকে প্রণাম করলেন। তিনি রামচন্দ্রের অনুমতিক্রমে পুনরায় মহেন্দ্রপর্বতে চলে গেলেন এবং সেখানে ভীত, লজ্জিত ও মহাতপস্যায় প্রবৃত্ত হয়ে বাস করতে লাগলেন।

তারপর এক বৎসরকাল অতীত হলে, পিতৃপুরুষেরা এসে পরশুরামকে তেজোহীন, গর্বশূন্য ও দুঃখিত দেখে তাঁকে দেখলেন, “পুত্র বিষ্ণুর কাছে তোমার এই বিকার উচিত হয়নি। কারণ, তিনি ত্রিভুবনের মধ্যে সর্বদা পূজনীয় ও মাননীয়। পুত্র তুমি পবিত্র বধূসর নাম্নী নদীতে যাও। সেই তীর্থে স্নান করে তুমি পুনরায় তেজ লাভ করতে পারবে। রাম! সেই তীর্থটির নাম ‘দীপ্তোদ’। সত্যযুগে তোমার প্রপিতামহ ভৃগু সেখানে দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন।”

পরশুরাম পিতৃলোকের বাক্যানুসারে সেইভাবে স্নান করেছিলেন এবং পুনরায় এই তীর্থক্ষেত্রেই তেজলাভ করেছিলেন। সেই থেকে এই তীর্থটির নাম ‘ভৃগুতীর্থ’।

যুধিষ্ঠির ও পাণ্ডবভ্রাতাগণ, দ্রৌপদীর সঙ্গে সেই তীর্থে স্নান করে অধিক উজ্জ্বলতা লাভ করলেন।

*

পরশুরাম। এই নামটির সঙ্গে মহাভারতের পাঠকের বারবার পরিচিতি ঘটে। পরশুরাম একুশবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। ভীষ্ম পরশুরামের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু অষ্টবসুর অংশজাত এই ক্ষত্রিয়টিকে পরশুরাম যুদ্ধে পরাজিত করতে পারেননি। রাজা শাল্ব কর্তৃক প্রত্যাখ্যাতা অম্বাকে গ্রহণ করতে পরশুরাম শিষ্য ভীষ্মকে আদেশ করেছিলেন। চিরকৌমার্য ব্রতধারী ভীষ্ম সে আদেশ পালন করতে অসমর্থ হলে পরশুরাম ভীষ্মকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। তেইশ দিন একটানা যুদ্ধে পরশুরাম ভীষ্মকে পরাস্ত করতে পারেননি। বরং তাঁরই পরাজয় ঘটেছিল। মাতা গঙ্গা, বসুগণ ও নারদের মধ্যস্থতায় সে যুদ্ধের নিবৃত্তি ঘটেছিল। দ্রোণাচার্য পরশুরামের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে পারেননি, কিন্তু দান হিসাবে তিনি পরশুরামের অস্ত্রসমূহ লাভ করেছিলেন। অসত্য পরিচয় দিয়ে কর্ণ পরশুরামের শিষ্যত্ব লাভ করেছিলেন—পরশুরামও যত্নের সঙ্গে তাঁকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে কর্ণের পরিচয় মিথ্যা প্রমাণিত হলে পরশুরামের অভিশাপে জীবনের শেষ যুদ্ধে কর্ণ সব অস্ত্র বিস্মৃত হন। পরশুরাম মহাভারতের এক অতি দীপ্তিমান চরিত্র। তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মহাভারতের অনেকগুলি দুর্লভ মুহূর্ত। রামরূপী বিষ্ণুর কাছে পরশুরামের পরাজয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়ের কাছে তাঁর পরাজয়ের দুর্লভ ঘটনা।

৪২
বৃত্রসংহার

সত্যযুগে দারুণ যুদ্ধদুর্ধর্ষ “কালকেয়” নামে এক বিখ্যাত দানব সম্প্রদায় ছিল। এদের নেতা ছিল বৃত্রাসুর। ব্রহ্মার বরে বৃত্রাসুর স্বর্গ মর্ত্য পাতালে অজেয় ছিল। ত্রিস্বর্গে স্থিত কোনও অস্ত্রের দ্বারা তার মৃত্যু না ঘটার আশীর্বাদ সে সুকঠিন তপস্যার দ্বারা লাভ করেছিল। কালকেয় দানবেরা বৃত্রাসুরকে সম্মুখে রেখে নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণের দিকে সকল দিক দিয়ে ধাবিত হতে লাগল।

দেবতারা স্থির করলেন সর্বাগ্রে বৃত্রাসুরকে বধ করা প্রয়োজন। তা হলেই দানবেরা হীনবল হয়ে পড়বে। তাই উপায় নির্ধারণের জন্য তাঁরা দেবরাজ ইন্দ্রকে সম্মুখবর্তী করে ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁরা কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়ালেন। তখন ব্রহ্মা বললেন, “দেবগণ! তোমরা যে কার্যসাধনের জন্য আমার কাছে এসেছ, তাও আমি অবগত আছি। যে উপায়ে তোমরা বৃত্রাসুরকে বধ করতে পারবে, সে উপায় আমি তোমাদের বলব।

“দধীচ’ নামে এক উদারচেতা মহর্ষি আছেন। তোমরা সকলে গিয়ে সম্মিলিতভাবে তাঁর কাছে বর প্রার্থনা করো। তিনি ধর্মাত্মা, সুতরাং তিনি সন্তুষ্ট চিত্তেই তোমাদের বর দেবেন। তোমরা জয়াভিলাষীরা সম্মিলিতভাবে তাঁকে বলবে, ‘ত্রিভুবনের মঙ্গলের জন্য আপনার অস্থিগুলি দান করুন।’ তিনি দেহত্যাগ করে নিজের অস্থিগুলি দান করবেন; তাঁর অস্থি দ্বারা অতি ভয়ংকর, দৃঢ়, বৃহৎ, শত্রুঘাতী, ষট্‌কোণ ও ভীমনাদী একটা বজ্র নির্মাণ করবে। সেই বজ্ৰদ্বারাই ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে বধ করবেন। দেবগণ তোমাদের কাছে সমস্তই বললাম। তোমরা সত্বর এই কার্য করো।” ব্রহ্মা এই কথা বললে, দেবতারা ব্রহ্মার অনুমতি নিয়ে নারায়ণকে অগ্রবর্তী করে সরস্বতী নদীর অপর পারে বৃক্ষলতায় পূর্ণ দধীচমুনির আশ্রমে গেলেন।

সে আশ্রমে সামগানকারী ব্রাহ্মণগণের মতো ভ্রমরগণ গান গাইছিল। পুরুষজাতীয় কোকিলগণ ও চকোর পক্ষীগণ রব করছিল, ব্যাঘ্ৰভয়বিহীন মহিষগণ, শূকরগণ, চমরী হরিণগণ সেই স্থানে একত্রে বিচরণ করছিল। মদস্রাবী হস্তীগণ হস্তিনীগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে, সরোবরে অবগাহন করে খেলা করতে করতে সকলদিকে শব্দ করছিল; বিচরণকারী সিংহ ও ব্যাঘ্রগণ এবং গুহা ও গর্তশায়ী নিভৃত সিংহগণ ও ব্যাঘ্রগণ গুরুতর গর্জন করছিল; সেই স্থানে নবতৃণ শোভা পাচ্ছিল এবং স্বর্গের তুল্য সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছিল; দেবতারা সেই দধীচমুনির আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

তাঁরা সেই আশ্রমে ব্রহ্মার ন্যায় দেহকান্তিতে দেদীপ্যমান এবং সূর্যের তুল্য তেজস্বী দধীচ মুনিকে দর্শন করলেন। তখন দেবতারা সকলেই দধীচমুনির চরণযুগলে নমস্কার করে কৃতাঞ্জলিপুটে—ব্রহ্মা যেমন বলে দিয়েছিলেন, তেমনই বর প্রার্থনা করলেন। দেবতাদের প্রার্থনা শুনে দধীচ অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং দেবশ্রেষ্ঠগণকে বললেন, “দেবগণ! যাতে আপনাদের মঙ্গল হবে, আমি আজই তা করব, আমি আজ নিজের দেহত্যাগ করছি।”

মনুষ্যশ্রেষ্ঠ স্বাধীন দধীচমুনি এই কথা বলে যোগবলে তৎক্ষণাৎ নিজে প্রাণ পরিত্যাগ করলেন। তারপর দেবতারা ব্রহ্মার উপদেশ অনুসারে মৃত দধীচমুনির অস্থিগুলি গ্রহণ করলেন। দেবতারা তখন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে জয়লাভের জন্য বিশ্বকর্মার কাছে এসে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বললেন। বিশ্বকর্মা, দেবতাদের কথা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত ও মনোযোগী হয়ে, যত্নপূর্বক অতিভয়ংকরাকৃতি বজ্র নির্মাণ করলেন এবং সেই বজ্র দেবরাজ ইন্দ্রের হাতে দিয়ে বললেন, “দেব! আপনি এখন এই উত্তম বজ্রদ্বারা ভয়ংকর বৃত্রাসুরকে ভস্ম করুন। শত্ৰু সংহার করে স্বর্গে থেকে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সমস্ত স্বর্গরাজ্য শাসন করুন।” বিশ্বকর্মা সেই কথা বললে, দেবরাজ আনন্দিত ও অত্যন্ত সাবধান হয়ে সেই বজ্র গ্রহণ করলেন।

তারপর ইন্দ্র বজ্র ধারণ করে, বলসম্পন্ন দেবগণ কর্তৃক সকলদিকে রক্ষিত হয়ে স্বস্থান থেকে যাত্রা করে বৃত্রাসুরকে দেখতে পেলেন।

বৃত্রাসুর তখন আপন সৈন্যদের নিয়ে স্বর্গ-মর্ত্য ব্যাপ্ত করে অবস্থান করছিল, শৃঙ্গশীর্ষ পর্বতের মতো উদ্যতাস্ত্র বিশাল দেহ কালকেয় অসুরগণ সকল দিক থেকে তাকে রক্ষা করছিল। তারপর কিছুকাল দানব ও দেবতাদের মধ্যে মহাযুদ্ধ ঘটল। বীরগণ হস্তদ্বারা তরবারি সকল উত্তোলন করে বিপক্ষগণের শরীরে আঘাত করবার উপক্রম করতেই বিপক্ষীয়রা প্রত্যাঘাত করল; তৎক্ষণাৎ সে তরবারিগুলি ভগ্ন হতে থাকায় অতি তুমুল শব্দ হতে লাগল।

তখন দেখা গেল বৃন্তচ্যুত তালফলের মতো নিপতিত মস্তকে ভূতল ব্যাপ্ত হতে লাগল। কালকেয় অসুরগণ স্বর্ণময় কবচ পরিধান করে পরিঘ উত্তোলন করে দাবাগ্নির মতো পর্বতাকার দেহ নিয়ে দেবগণের দিকে ধাবিত হল। অসুরদের সেই স্পর্ধিত গর্ব ও প্রচণ্ড বেগ দেবতারা সহ্য করতে পারলেন না; তাঁরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে লাগলেন। বৃত্রাসুরের পরাক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে, দেবগণ পরাভূত হয়ে পালাচ্ছেন, দেখে দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত মোহাবিষ্ট হলেন। তিনি কালকেয় অসুরগণের ভয়ে ভীত হয়ে দ্রুত প্রভু নারায়ণের শরণাপন্ন হলেন।

ত্বং শত্রুম্‌ কশ্মলাবিষ্টং দৃষ্ট্বা বিষ্ণুঃ সনাতনঃ।

স্বতেজো ব্যদধচ্ছক্রে বলমস্য বিবৰ্দ্ধয়ন ॥ বন : ৮৬ : ১০ ॥

তখন সনাতন নারায়ণ দেবরাজকে মোহাবিষ্ট দেখে, তাঁর বলবৃদ্ধির জন্য আপন তেজ প্রদান করলেন। তারপর দেবতারা ও নিষ্পাপ ব্রহ্মর্ষিরা সকলেই দেবরাজকে বিষ্ণু কর্তৃক রক্ষিত দেখে আপন আপন তেজ তাঁর শরীরে সমর্পণ করলেন। তখন মহাভাগ দেবরাজ ইন্দ্র ঋষিগণ ও অন্য দেবগণের সঙ্গে বিষ্ণুর তেজ লাভ করে অত্যন্ত বলবান হলেন। দেবরাজ বলশালী হয়েছেন এই সংবাদে বৃত্রাসুর বিশাল সিংহনাদ করে পৃথিবী, দিকসকল, আকাশ, স্বর্গ ও পর্বত কাঁপিয়ে ভয়ংকর গর্জন করতে লাগল। বৃত্রাসুরের সেই ভয়ংকর সিংহনাদ শুনে দেবরাজ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, তাকে বধ করার জন্য অতিদ্রুত সেই বিশাল বজ্র নিক্ষেপ করলেন। স্বর্ণমাল্যধারী মহাসুর বৃত্র ইন্দ্রের বজ্রের আঘাতে পূর্বকালে বিষ্ণুর হাত থেকে যেমন মন্দর মহাপর্বত পতিত হয়েছিল, তেমনই ভূতলে পতিত হল।

দৈত্যশ্রেষ্ঠ বৃত্র নিহত হলে, ইন্দ্র ভয়বিহ্বল হয়ে সরোবরে আত্মগোপন করার জন্য ছুটে গেলেন। কারণ, ভয়বশত তিনি ধারণাই করতে পারেননি যে, বজ্র তাঁর হাত থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং বৃত্রাসুর যে নিহত হয়েছিল, তাও তিনি ভয়বশত বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এদিকে, দেবতারা ও মহর্ষিরা সকলে আনন্দিত হয়ে উৎফুল্লমুখে ইন্দ্রের প্রশংসা করতে লাগলেন। তাঁরা সকলেই বজ্রতাড়িত ভূতলপতিত পর্বতের ন্যায় নিহত বৃত্রাসুরকে দেখে তখন সম্মিলিত হয়ে ত্বরিত গতিতে বৃত্রবধসন্তপ্ত দৈত্যগণকে বধ করতে লাগলেন। দেবগণের সেই সম্মিলিত আক্রমণ দৈত্যরা সহ্য করতে পারল না। তারা আত্মগোপনের জন্য সমুদ্রে প্রবেশ করল।

*

অর্জুন কিরাতরূপী মহাদেবকে দর্শন করার পর এবং তাঁর আশীর্বাদসহ পাশুপত অস্ত্র লাভ করার পর, দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশে স্বর্গে উপস্থিত হন। সেখানে দেবরাজ ইন্দ্র অন্য অস্ত্রের সঙ্গে প্রয়োগসহ বজ্রও তাঁকে দান করেছিলেন। অর্জুনই পৃথিবীর একমাত্র রক্ষী যাঁর কাছে বজ্ৰ অস্ত্র ছিল। বৃত্রাসুর বধের জন্য সৃষ্টি ‘বজ্র’ মহাভারতের এক দুর্লভ ঘটনা।

৪৩
সত্যভামার দ্রৌপদীর কাছে বশীকরণ বিদ্যাশিক্ষার প্রস্তাব

ব্রাহ্মণেরা ও মহাত্মা পাণ্ডবেরা মার্কণ্ডেয় মুনির কাছে প্রাচীন ভারতবর্ষের বিখ্যাত রাজা ও মুনি-ঋষিদের বৃত্তান্ত শ্রবণ করছিলেন। এমন সময়ে প্রফুল্লচিত্ত দ্রৌপদী ও কৃষ্ণমহিষী সত্যভামা একত্রে সেই সভায় প্রবেশ করলেন ও মৃদুহাস্যমুখে এক প্রান্তে উপবেশন করলেন। দীর্ঘকাল পরে দুই সখীর দেখা হয়েছিল। তাই সত্যভামা ও দ্রৌপদী প্রথমে কুরুকুল ও যদুবংশ সম্পর্কে নানা আলোচনা করলেন। তারপর সত্রাজিৎ রাজার কন্যা সত্যভামা দ্রৌপদীকে নির্জনে পেয়ে প্রশ্ন করলেন, “দ্রৌপদী, দিকপাল তুল্য মহাবীর, যুবক এবং পরম লোকপ্রিয় পাণ্ডবগণের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করো? কল্যাণী কীভাবে তাঁরা তোমার বশীভূত হয়ে আছেন? কেন এঁরা তোমার প্রতি কুপিত হন না? দ্রৌপদী পাণ্ডবেরা সর্বদাই তোমার বশীভূত হয়ে রয়েছেন এবং তাঁরা সকলেই তোমার মুখাপেক্ষী আছেন; এর কারণ তুমি আমার কাছে সত্য বলো। ব্ৰত, তপস্যা, স্নান, শাস্ত্রোক্ত ঔষধ, নিজের দক্ষতার প্রয়োগ, কোনও জড়িবুটি, বৃক্ষমূল ধারণের প্রভাব, জপ, হোম এবং শাস্ত্রে অনুক্ত কোনও ঔষধ—এর সবকটি অথবা কোনটি প্রয়োগ করে তুমি এই সকল দিকপাল স্বামীকে বশ করে রেখেছ? তুমি যেমন তোমার স্বামীদের বশ করে রেখেছ, আমিও কৃষ্ণকে সর্বদা আমার অনুগত ও বশীভূত করে রাখতে চাই; তুমি আমাকে উপায় বলো।” এই বলে যশস্বিনী সত্যভামা বিরত হলেন।

তখন পতিব্রতা ও চন্দ্রভাগা দ্রৌপদী তাঁকে বলেন— “সত্যভামা তুমি অসৎ স্ত্রীলোকদের ব্যবহারের বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করছ; তাদের ব্যবহারও অসৎ হয়। অসৎ ব্যবহারের বিষয় আলোচনা করা কি সঙ্গত? এই ধরনের প্রশ্ন করা অথবা আমি আমার ভর্তাদের বশীভূত করবার জন্য কোনও উপায় অবলম্বন করি কি না—এই ধরনের কোনও সন্দেহ করাই তোমার উচিত নয়। কারণ, তুমি বুদ্ধিমতী এবং কৃষ্ণের প্রিয়তমা মহিষী। ভর্তা যখন জানতে পারেন যে তাঁকে বশীভূত করার জন্য স্ত্রী কোনও মন্ত্রপ্রয়োগ বা ঔষধ প্রয়োগে ব্যাপৃত আছেন; তখনই গৃহে সর্প প্রবেশ করলে গৃহস্থের মন যেমন উদ্বিগ্ন হয়, ভর্তার মনও তেমনই উদ্বিগ্ন হয়। মন উদ্বিগ্ন হলে গৃহে অশান্তি আসে, আর অশান্ত গৃহে সুখ থাকতে পারে না। তা ছাড়া, ভর্তা কখনও মন্ত্রাদি প্রয়োগে ভার্যার বশীভূত হন না। বরং এই জাতীয় ঘটনায় ভর্তার দেহে অতিদারুণ রোগ হয়ে দেখা দেয়। কারণ জিঘাংসু লোকেরা মূল বলে বিষ দিয়ে থাকে। পুরুষ জিহ্বা অথবা চর্মদ্বারা যে সকল ঔষধ গ্রহণ করে, তাতে প্রদত্ত বিষচুর্ণ সত্বরই সে পুরুষকে নষ্ট করে; সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ কোরো না।

“সত্যভামা আমি জানি যে, বহু স্ত্রীলোক আপন আপন পতিকে বশ করার জন্য ঔষধ প্রদান করে তাদের পতিকে জলোদর রোগী, শ্বিত্ররোগী, জরাজীর্ণ, নপুংসক, জড়, অন্ধ বা বধির করে ফেলেছে। পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের কথা অনুসারে এই পাপিষ্ঠা নারীরা তাদের ভর্তাদের দেহ-মনে নানা উপসর্গ সৃষ্টি করে থাকে; অতএব স্ত্রীলোক কোনও প্রকারেই ভর্তার অনভিপ্রেত অথবা অপ্রিয় কোনও কাজ করবে না।

“সত্যভামা আমি মহাত্মা পাণ্ডবদের সঙ্গে যে আচরণ করে থাকি, তা তোমাকে বলছি। আমি সর্বদাই অহংকার, কাম ও ক্রোধ পরিত্যাগ করে, অন্য পাণ্ডব-পত্নীদের সঙ্গে পাণ্ডবগণের পরিচর্যা করে থাকি। আমি মানশূন্য হয়ে, নিজের উপরেই নিজের ভার রেখে, অহংকার পরিত্যাগ করে, পতিদের চিত্ত রক্ষা করে, তাদের সেবা করে থাকি। ভর্তাদের কটুবাক্য, ক্রোধসূচক দৃষ্টি, কষ্টে শয়ন, কষ্টে উপবেশন, কষ্টে গমন, মন্দ অভিপ্রায়—এইগুলি বর্জন করে আমি অগ্নি ও সূর্যের তুল্য তেজস্বী, চন্দ্রের তুল্য কোমল, ভীষণ বন ও প্রতাপশালী এবং দর্শন দ্বারাই শত্ৰু সংহারকারী পাণ্ডবদের সেবা করে থাকি।

দেবো মনুষ্যো গন্ধর্বো যুবা চ পি স্বলঙ্কৃতঃ

দ্রব্যবানভিরূপো বা ন মেহন্যঃ পুরুষো মতঃ ॥ বন : ১৯৬ : ২২॥

দেবতা, গন্ধর্ব, মানুষ, যুবক, ধনী, সম্যক অলংকৃত কিংবা সুন্দরাকৃতি হলেও অন্য পুরুষ আমার অভিমত হয় না।

“আমি সর্বদাই গৃহকার্য করি এবং ভর্তা স্নান না করলে আমি স্নান করি না। ভর্তা ভোজন না করলে আমি ভোজন করি না এবং ভর্তা শয়ন না করলে আমি শয়ন করি না। ভর্তা— ক্ষেত্র, বন বা অন্য গ্রাম থেকে গৃহে ফিরে আসলে আমি উঠে আসন ও জলদান করে তাঁর সংবর্ধনা করি। খাবার বাসন পরিষ্কার করি, খাদ্যবস্তু পরিষ্কার রাখি— বুভুক্ষুকে যথাসময়ে খাদ্য দিই, সংযত হয়ে থাকি, কাউকে তিরস্কার করি না, মন্দ স্ত্রীলোকের সংসর্গ করি না। সর্বদাই পরিজনবর্গের অনুকূল থাকি এবং কখনও অলস হই না।

“পরিহাস ব্যতীত হাসি না, গৃহের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি না এবং গোপন কোনও স্থানে বা গৃহের উদ্যানে দীর্ঘকাল থাকি না। আর অত্যন্ত হাস্য, অত্যন্ত ক্রোধ, ও ক্রোধের বিষয় পরিত্যাগ করি। সত্যভামা! আমি সর্বদাই পতিসেবায় নিরত থাকি। ভর্তার কোনও প্রকার অহিতই আমার কোনও প্রকারেই অভীষ্ট হয় না। ভর্তা যখন পারিবারিক কোনও কার্যে অন্যত্র যান, তখন আমি পুষ্পমাল্য ও অনুলেপন ত্যাগ করি। ভর্তা যা পান করেন না, ভর্তা যা ব্যবহার করেন না, আমার ভর্তা যা ভোজন করেন না, আমি সে সমস্তই বর্জন করি। আমি ভর্তার উপদেশ অনুসারে ও গৃহিণীর নিয়মে চলি এবং অলংকৃতা, অত্যন্ত পবিত্রা, ও ভর্তার প্রিয় ও হিতকার্যে রতা থাকি। আমার শাশুড়ি দেবী আমার জন্য পরিজনবর্গ সম্পর্কে যে আচরণের কথা বলে দিয়েছেন এবং ভিক্ষা, উপহার, শ্রাদ্ধ, পৰ্বকালে রন্ধন, মান্য ললাকের সম্মান ও আদর এবং অন্য যে সকল গৃহনিয়ম আমার জানা আছে, আমি আলস্যবিহীন হয়ে দিবারাত্রই সেই সমস্তের অনুসরণ করি, আর সর্বদা সর্বপ্রযত্নে বিনয় ও গৃহিণীগণের নিয়ম পালন করে চলি।

“কারণ, আমার মতে— পতিসেবাধর্মই স্ত্রীলোকের সনাতন ধর্ম। স্ত্রীলোকের পক্ষে পতি দেবতা এবং পতিই গতি। কোনও স্ত্রীলোকের সেই পতির অপ্রিয় আচরণ করা উচিত নয়। আমি কোনও বিষয়েই আমার পতিদের অতিক্রম করি না, তাঁদের আহারের পূর্বে আহার করি না। কখনও শাশুড়ির নিন্দা করি না এবং গৃহকার্যে সর্বদা নিয়ন্ত্রিত থাকি। আমার গৃহকার্যের প্রতি একাগ্রতা ও সর্বদা উদ্‌যোগ এবং গুরুশ্রুশ্রূষার গুণেই ভর্তারা আমার বশীভূত হয়ে আছেন। আমি নিজেই সর্বদা কুন্তী দেবীর পান, ভোজন ও বসনাদি বহন করে তাঁর কাছে যাই এবং তাঁর পরিচর্যা করি। কুন্তী দেবী আমার কাছে পৃথিবীর তুল্যা মাননীয়া।

পূর্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের গৃহে প্রত্যহ প্রথমে আট হাজার ব্রাহ্মণ স্বর্ণপাত্রে ভোজন করতেন। অষ্টাশি হাজার নিত্যস্নায়ী গৃহস্থ ব্রাহ্মণ ছিলেন; তাঁদের আবার প্রত্যেকের ত্রিশটি করে দাসী ছিল। দশ হাজার জন ব্রহ্মচারী ছিলেন। খাদ্য, পেয়, বস্ত্রের অগ্রভাগ তুলে বেদ-বাদী ব্রাহ্মণদের আমিই খাদ্য পরিবেশন-পাত্রে তুলে দিতাম। মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের একলক্ষ দাসী ছিল; তাদের হাতে শঙ্খবলয়, কেয়ূর ও কণ্ঠে স্বর্ণহার থাকত। মহামূল্য মালা, অলংকার, মণি ও স্বর্ণভূষিতা ক্ষত্রিয় জাতীয়া মহিলা ছিলেন; তাঁরা নৃত্যগীতে পারদর্শী ছিলেন। আমি এদের প্রত্যেককে চিনতাম, নাম-ধাম ও পরিচয় জানতাম। ধীমান যুধিষ্ঠিরের একলক্ষ দাসী খাদ্যবস্তুর পাত্র হাতে দিবারাত্র অতিথিদের ভোজন করাত। মহারাজ যুধিষ্ঠির যখন ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করতেন তখন তাঁর বিহারযাত্রার সময়েও এক লক্ষ অশ্ব ও লক্ষ হস্তী অনুগমন করত। এগুলির সংখ্যা গণনা আমি করতাম এবং কর্তব্যনির্দেশ করতাম। গোরক্ষক, মেষরক্ষক ও অন্তঃপুরকামী সকল ভৃত্যের সংবাদ আমি রাখতাম। রাজার সমস্ত আয় ও ব্যয়ের বিষয় একমাত্র আমিই জানতাম। ভরতশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবেরা পোষ্যবর্গের ভার আমার উপর রেখে সম্মিলিতভাবে ধর্মোপাসনা করতেন। সমস্ত সুখভোগ ত্যাগ করে আমি দিবারাত্র সকল ভার বহন করতাম। আমি চিরদিনই সকলের আগে জাগরিত হই ও সকলের শেষে শয়ন করি। সত্যভামা! আমি এই সব গুরুতর পতি বশীকরণ করতে জানি; কিন্তু অসৎ স্ত্রীলোকদের ব্যবহার জানি না এবং শুনতেও চাই না।”

তখন সত্যভামা দ্রৌপদীর সেই ধর্মসঙ্গত বাক্য শুনে ধৰ্মচারিণী দ্রৌপদীকে বিশেষ আদর করে বললেন, “পাঞ্চাল নন্দিনী দ্রৌপদী, আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম। কারণ সখীদের পরস্পর আলাপ-আলোচনায় হাসি-ঠাট্টা-উপহাস ইত্যাদির সঙ্গে ঘটে থাকে।”

দ্রৌপদী বললেন— “সখি স্বামীর মন আকর্ষণ করার জন্য তোমার কাছে এই নির্দোষ পথের কথা বলেছি। তুমি যথানিয়মে থেকে আপন বলের দ্বারাই সপত্নীদের হাত থেকে স্বামীকে টেনে নিজের কাছে আনতে পারবে। পতির মতো দেবতা ত্রিভুবনে নেই। কারণ, তিনি অনুগ্রহ করলে জগতের সমস্ত অভীষ্ট লাভ করা যায়, আর তিনি কুপিত হলে হত্যা করতেও পারেন। পতি থেকে সন্তান, নানাবিধ ভোগ্যবস্তু, শয্যা, আসন, উত্তম বস্তু দর্শন, বস্ত্র, মাল্য, গন্ধ—স্বর্গ এবং ইহলোকের প্রচুর কীর্তি লাভ করা যায়। এ জগতে কেবল সুখদ্বারা সুখ লাভ করা যায় না। এই জন্যেই সাধ্বী স্ত্রী দুঃখ দ্বারাই সুখ লাভ করেন। তুমি সর্বদাই স্নেহ ও অনুরাগ দিয়ে যথাযথ বেশভূষা পরিধান করে কৃষ্ণের সেবা করো। মনোহর খাদ্য, উত্তম মাল্য ও নানা গন্ধদ্রব্য দান করো এবং উদারতার সঙ্গে চলতে থাকো; কৃষ্ণ যাতে সর্বদাই মনে করেন—‘এই নারীর আমি যথার্থই প্রিয়’— এই কথা মনে করে যাতে তিনি গ্রহণ করেন, সর্বদাই তাই করো। দ্বারে আগত ভর্তার কণ্ঠস্বর শুনলেই তুমি তৎক্ষণাৎ গৃহের মধ্যে প্রবেশ করবে এবং তাঁর হাত-পা ধোওয়ার জল দিয়ে সেবা করবে। গৃহে যদি কোনও দাসী না থাকে, এমন সময়ে কৃষ্ণ উপস্থিত হলে, নিজে উঠে তাঁর সব কাজ করবে। এতে কৃষ্ণ মনে করবেন— ‘এই নারী সকল অবস্থায় আমার সেবা করছেন’।

“তোমার পতি তোমার কাছে যা বলবেন, তা যদি গোপনীয় নাও হয়, তবুও তুমি তা গোপন রাখবে। না হলে, তোমার অন্য সপত্নী যদি কৃষ্ণকে তা বলে দেয়, তাতে কৃষ্ণ তোমার প্রতি বিরক্ত হতে পারেন। স্বামীর অনুরক্ত, বিশ্বাসভাজন ও হিতকারী ব্যক্তিদের ভালভাবে আহার করাবে, আর পতির বিদ্বেষের পাত্র, অহিতকারী এবং প্রতারক ব্যক্তিদের কাছ থেকে সর্বদাই দূরে থাকবে। পুরুষদের সামনে মত্ততা, অনবধানতা পরিত্যাগ করে মনের ভাব গোপন করবে; আর নির্জনে কখনও পুত্র প্রদ্যুম্ন বা শাম্বেরও সেবা করবে না। সৎকুলজাতা, পাপবিহীনা ও সতী স্ত্রীদের সঙ্গেই সখিত্ব করবে। আর, কোপনস্বভাবা, মত্তা, অধিকভোজিনী, চৌরা, দুষ্টা ও চঞ্চলা স্ত্রীদের বর্জন করবে। এই কার্যগুলি যশ, সৌভাগ্য ও স্বার্থ সম্পাদন করে এবং শত্রুকে পরাভূত করে; অতএব তুমি মহামূল্য মাল্য, অলংকার ও অঙ্গরাগ ধারণ করে এবং পবিত্র গন্ধযুক্ত হয়ে পতির পরিচর্যা করতে থাকো।”

ওদিকে কৃষ্ণ, মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ ও পাণ্ডবদের সঙ্গে কিছুকাল অনুকূল ও প্রীতিকর আলোচনার পর, সকলকে যথাযোগ্য সম্ভাষণ করে রথে উঠবার ইচ্ছায় সত্যভামাকে ডেকে পাঠালেন। তখন সত্যভামা দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করে তাঁর ইচ্ছা অনুরূপ মনোহর ও সঙ্গত বাক্য বললেন, “দ্রৌপদী রাজ্য হারিয়েছ বলে তোমার যেন উৎকণ্ঠা, মনোবেদনা ও রাত্রি জাগরণ না হয়। কারণ, তুমি— দেবতুল্য পতিগণ কর্তৃক বিজিত রাজ্য পুনরায় পাবে। নীলনয়নে! যে কষ্ট তুমি সহ্য করছ, তোমার মতো চরিত্রসম্পন্না এবং প্রশস্ত লক্ষণা নারীরা চিরকাল ভোগ করেন না। আমি ত্রিকালজ্ঞ ঋষিদের মুখে শুনেছি যে অবশ্যই তুমি ভর্তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিষ্কণ্টক ও নিরুপদ্রব এই পৃথিবী পুনরায় ভোগ করবে। দ্রৌপদী তুমি অবশ্যই দেখতে পাবে যে, যুধিষ্ঠির সমস্ত শত্রুতার প্রতিশোধ নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বধ করে পৃথিবী হস্তগত করেছেন। বনে আসার সময়ে দর্পমোহিতা যে সব কৌরব নারী তোমাকে উপহাস করেছিল, অতি অল্পকালের মধ্যেই, সেই সব কৌরবস্ত্রীকে তুমি হতভাগ্য নৈরাশ্যপূর্ণ দেখতে পাবে। তুমি দুঃখসাগরে নিমগ্ন হলে, যারা তোমার অপ্রিয় আচরণ করেছিল, তুমি সুনিশ্চিত ধারণা করতে পার যে, তারা সকলেই যমালয়ে গিয়েছে।

“তোমার পুত্র যুধিষ্ঠিরজাত প্রতিবিন্ধ্য, ভীমজাত সুতসোম, অর্জুনজাত শ্রুতকর্মা, নকুলজাত শতানীক ও সহদেবজাত শ্রুতসেন, এরা সকলেই ভাল আছে। অস্ত্রশিক্ষা করে বীর হয়েছে এবং দ্বারকানগরীতে অভিমন্যুর মতোই অত্যন্ত আনন্দিত ও প্রীতি সহকারে বাস করছে। আর, সুভদ্রাও তোমার মতো প্রীতি সহকারে ও সর্বপ্রযত্নে তোমার পুত্রদের পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তোমার প্রতি সুভদ্রার মনে কোনও বৈরী মনোভাব নেই, বরং বিশেষ প্রীতিই আছে; তোমার পুত্রদের বিষয়ে সুভদ্রার মনে কোনও সন্তাপ নেই। আপন পুত্র অভিমন্যু ও তোমার পুত্রদের মধ্যে সুভদ্রা কোনও পার্থক্য করেন না; তাই সুভদ্রা তোমার পুত্রদের দুঃখেই দুঃখ এবং সুখেই সুখ অনুভব করে থাকেন। রুক্মিণীদেবী সর্বপ্রযত্নে প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতির পরিচর্যা করেন; আর কৃষ্ণ ও ভানু প্রভৃতির থেকেও তাদের বেশি আদর করেন। আমার শ্বশুর মহাশয় তাদের খাওয়া পরা বিষয়ে সর্বদা পর্যবেক্ষণ করেন এবং বলরাম প্রভৃতি অন্ধকবংশীয় ও বৃষ্ণিবংশীয়েরা সকলেই তাদের আদর করেন। কারণ, প্রদ্যুম্ন ও প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতির উপরে তাদের সমান স্নেহ আছে।”

এইরূপ প্রিয়, সত্য, অভীষ্ট ও মনের অনুকূল অনেক কথা বলে সত্যভামা কৃষ্ণের রথের দিকে যাবার জন্য দ্রৌপদীর অনুমতি চাইলেন। তারপর কৃষ্ণমহিষী সত্যভামা দ্রৌপদীকে প্রদক্ষিণ করলেন। তারপর তিনি কৃষ্ণের রথে আরোহণ করলেন। কৃষ্ণ দ্রৌপদীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, পাণ্ডবেরা তাঁরা রথের সঙ্গে মাটিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন, কৃষ্ণ তাঁদের প্রতিনিবৃত্ত করলেন এবং আপন দ্রুতগামী অশ্ব ছুটিয়ে দ্বারকানগরে প্রস্থান করলেন।

দ্রৌপদী সত্যভামা সম্মিলন মহাভারতের এক দুর্লভতম মুহূর্ত। এই দুই নারীই বিবাহিতা, দু’জনেই রাজকন্যা এবং ভারত শ্রেষ্ঠ পুরুষের গৃহিণী। একজন ভাগ্য-বিপর্যস্তা, অন্যজন সৌভাগ্যে পরিপূর্ণ। কিন্তু দুই সখীর আচরণে কোথাও কোনও অবস্থানগত পার্থক্য ফুটে ওঠেনি। বরং ভাগ্যবতী নারীটি, দুর্ভাগা নারীকে অধিকতর মর্যাদা দিয়েছেন, তাঁকে আপন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে আপন বাক্য ও ব্যবহারে প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর কাছ থেকে বিবাহিতা নারীর কর্তব্য শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। দুই নারী পরস্পর সখী এবং তাদের সম্বন্ধও সমান। কিন্তু এই ভাগ্যবিড়ম্বিত অবস্থায়ও দ্রৌপদী প্রয়োজনবোধে সখীকে ভর্ৎসনা করতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেননি।

মহাভারত-পাঠকের দ্রৌপদীর চরিত্র সম্পর্কে আগ্রহ চিরকালের। সাধারণ ধারণা আছে, যজ্ঞবেদী সমুদ্ভূতা, এই অসাধারণ রূপবতী রাজকন্যা তেজস্বিতা, মনস্বিতায়, মহিমায় ও মর্যাদায়, বাগ্মিতায় ও বাকপটুত্বে এক শ্রেষ্ঠ নারীরত্ন। কিন্তু দ্রৌপদী ভারত-বিখ্যাত পঞ্চস্বামীর স্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন পাণ্ডবদের পট্টমহিষী। সেই স্থান তিনি কেবলমাত্র বিবাহ দ্বারা লাভ করেননি। গৃহিণীধর্ম সম্পর্কে দ্রৌপদীর ধারণার বিস্তৃতি আমাদের বিস্মিত করে। সৎ স্ত্রীর লক্ষণ ও অসৎ স্ত্রী-লক্ষণ অসাধারণভাবে বিচার করেছেন দ্রৌপদী। উচ্চ অভিজাত বংশের রমণীর ব্যবহার, কর্তব্যপরায়ণতা, ভর্তাদের সম্পর্কে আচরণ তাঁকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠা নারীতে পরিণত করেছে। কেন পাণ্ডবভ্রাতারা দ্রৌপদীর প্রতি এত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা দ্রৌপদী-সত্যভামা সম্মিলন পাঠ করলে পাঠক কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই বুঝতে পারবেন।

৪৪
ঘোষযাত্রায় পরাজিত দুর্যোধন

পাণ্ডবেরা তখন বনবাসী। হস্তিনাপুরে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র তেরো বৎসর পরে পাণ্ডবেরা ফিরে এসে যে প্রতিশোধ নেবেন সেই চিন্তায় কণ্টকিত ও চূড়ান্ত উদ্বিগ্ন। এমন সময়ে একদিন শকুনি ও কর্ণ দুর্যোধনকে বলল, “ভরতনন্দন! তুমি আপন বুদ্ধিবলে বীর পাণ্ডবদের রাজ্য থেকে নির্বাসিত করে, ইন্দ্র যেমন স্বর্গ ভোগ করে, তেমনি একাকী পৃথিবী ভোগ করছ। চারদিকে সমস্ত রাজারা তোমাকে কর দিচ্ছেন। পাণ্ডবদের রাজলক্ষ্মী তোমাকে বরণ করেছেন। অন্যান্য রাজারা তোমার অধীনতা স্বীকার করে আদেশের অপেক্ষায় আছেন। পর্বত, বন, নগর, গ্রাম, বহুতর উপবন, সমুদ্রবেষ্টিতা এই পৃথিবী তোমার অধীন। দ্বিজাতিরা তোমার স্তব করেন। রাজারা গৌরব করেন, আপন পৌরুষের দ্বারা তুমি স্বর্গে ইন্দ্রের মতো দীপ্তিমান। তুমি এখন চন্দ্রের তুল্য দীপ্তিমান, রুদ্রগণকর্তৃক রক্ষিত যমের ন্যায় স্বাধীন।

“যারা তোমার অধীনতা স্বীকার করত না, তোমার আদেশের সম্মান করত না, সেই পাণ্ডবেরা আজ শ্রীহীন, সহায়হীন এবং গৃহহীন বনবাসী। শুনতে পাই পাণ্ডবেরা বনবাসী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দ্বৈতবন নামক সরোবর-তীরে বাস করছে। মহারাজ তোমার সম্পদের অনুরূপ মহাশোভায় শোভিত হয়ে, সূর্যের মতো তেজে পাণ্ডবদের সন্তপ্ত করতে একবার দ্বৈতবন চলো। তুমি রাজপদে আছ, আর তারা রাজ্যচ্যুত; তুমি শোভাসম্পন্ন, আর তারা শোভাহীন, তুমি সমৃদ্ধিশালী আর তারা সমৃদ্ধিবিহীন। এই অবস্থায় তোমার পাণ্ডবদের দর্শন করা উচিত। মহারাজ তুমি মহাসুখ্যাতিসম্পন্ন হয়ে আনন্দিত হয়ে বাস করছ। এই অবস্থায় নহুষনন্দন যযাতির মতো তোমাকে পাণ্ডবেরা একবার দর্শন করুক। মিত্রগণ ও শত্রুগণ মানুষের যে উজ্জ্বল সম্পদ দেখতে পায়, তাতে মিত্রদের আনন্দবৃদ্ধি ও শত্রুদের বিবাদবৃদ্ধি ঘটে। পর্বতে স্থিত ব্যক্তি যেমন ভূতলস্থিত লোককে দেখে, তেমন যে সুখী লোক দুঃখী লোককে দেখে, তার তা থেকে অধিক সুখ আর কী হতে পারে?

ন পুত্রধনলাভেন ন রাজ্যেনাপি বিন্দতি।

প্রীতিং নৃপতিশার্দূল! যামমিত্রাঘদর্শনাৎ ॥ বন : ২০০ : ১৮ : ॥

“রাজশ্রেষ্ঠ! শত্রুর দুঃখ দর্শন করার যে আনন্দ, সেরূপ আনন্দ—পুত্র, ধন, রাজ্যলাভ করেও লাভ করা যায় না।

“পাণ্ডবদের নির্বাসনে তোমার প্রয়োজন সিদ্ধ হয়েছে। এখন তোমার পক্ষের লোকজন তপোবনে অর্জুনকে তরুবল্কল ও মৃগচর্মধারী দেখলে কি গভীর আনন্দবোধ করবে না? তোমার ভার্যারা উত্তম বস্ত্র, অলংকারে সজ্জিত হয়ে তরুবল্কল ও মৃগচর্মধারিণী দ্রৌপদীকে দেখুক, তোমার ভার্যাদের উত্তম বস্ত্র, অলংকার দেখে দুঃখিতা দ্রৌপদী আত্মগ্লানিতে ধনবিহীন নিজেকে ধিক্কার করতে থাকুক। দ্যূতসভায় দ্রৌপদী যত দুঃখ কষ্ট পেয়েছে, সালংকৃতা তোমার ভার্যাদের দেখলে তার থেকে অনেক বেশি দুঃখ কষ্ট পাবে।”

কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন আনন্দিত ও দুঃখিত দুই হলেন। তিনি বললেন, “কর্ণ তুমি যা বললে, আমার মনেও তাই আছে। কিন্তু আমি জানি পিতা আমাকে কিছুতেই সেখানে যেতে দেবেন না। কারণ, পিতা ধৃতরাষ্ট্র এখনও পাণ্ডবদের জন্য বিলাপ করেন। তাঁর ধারণা, সুকঠোর তপস্যা করে পাণ্ডবেরা আমাদের থেকে প্রবল হয়েছে। তিনি যদি আমাদের মনের ভাব বুঝতে পারেন, তবে ভবিষ্যতের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে আমাদের সেখানে যাবার অনুমতি দেবেন না। কারণ, তিনি মনে করবেন যে, বনবাসী পাণ্ডবদের বিনাশ করতেই আমরা দ্বৈতবনে যাত্রার অনুমতি চাইছি। তুমি জানো যে, দ্যূতক্রীড়ার সময় বিদুর আমাকে, তোমাকে ও মাতুল শকুনিকে কী বলেছিলেন। অতএব দ্বৈতবনে যাত্রা অথবা যাত্রা না করা বিষয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তবে তরুবল্কল ও মৃগচর্মধারী পাণ্ডবদের দেখে আমি যত সুখ পাব, সমস্ত পৃথিবী লাভ করলেও তত সুখ পাব না। বিশেষত বনের ভিতর দ্রুপদরাজনন্দিনী দ্রৌপদীকে আমি ভিখারিনির বেশে দেখব। পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির ও ভীম যদি আমাকে পরম শোভাসম্পন্ন দেখে, তা হলে আমার জীবন সফল হবে। কিন্তু সেই বনে যাত্রার কোনও পথ তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। অতএব তুমি, মাতুল শকুনি ও দুঃশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করে একটা উপায় উদ্ভাবন করো। আমি দ্বৈতবনে যাত্রার বা যাত্রা না-করার বিষয়ে স্থির করে কাল মহারাজের কাছে যাব। তোমরা যে উপায় স্থির করবে, তা কাল ভীষ্মের উপস্থিতিতে মহারাজের কাছে বলবে। আমি, ভীষ্ম ও রাজার আলোচনা শোনার পর রাজাকে অনুরোধ করব।”

পরদিন রাত্রি প্রভাতে কর্ণ হাস্যমুখে দূর্যোধনের কাছে গিয়ে বললেন, “রাজা আমরা আলোচনা করে যা স্থির করেছি, তা তোমাকে জানাচ্ছি। দ্বৈতবনের কাছে গো-পালকেরা তোমার প্রতীক্ষা করছে এই কথা বলে, গোপ-পল্লিতে যাওয়ার ছলে আমরা সেখানে যাব। গোপ-পল্লিতে যাওয়া রাজাদের সর্বদা উচিত। এই কথা বললে, রাজা অবশ্যই তোমাকে যেতে দেবেন।” কর্ণ ও দুর্যোধনের এই আলাপের সময় গান্ধাররাজ শকুনি এসে বললেন, “আমরা আলোচনা করে এই নিরুপদ্রব পথ স্থির করেছি। ‘গোপ-পল্লিতে যাব’ বললে রাজা অনুমতি তো দেবেনই, যেতে প্রেরণাও দেবেন। সুতরাং গোপ-পল্লিতে যাওয়ার ছলে আমরা দ্বৈতবনে যাব।” এই কথা বলে তিনজন সানন্দে পরস্পরের করমর্দন করলেন। তারপর তাঁরা তিনজন ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁদেরই নির্ধারিত ‘সমঙ্গ’ নামে একজন গোপাল রাজাকে জানাল যে, রাজার গো-সমূহ দ্বৈতবনের কাছে আছে। তখন কর্ণ ও শকুনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “কৌরবরাজ, গোপপল্লিগুলি অতি মনোহর স্থানে সন্নিবিষ্ট হয়েছে এবং গো-সমূহ গণনা ও বৎসগুলিকে চিহ্নিত করার সময় হয়েছে। আর রাজা! এই সময়ে আপনার পুত্রেরও মৃগয়া করা উচিত; সুতরাং দুর্যোধনকে সেখানে যাবার অনুমতি দিন।”

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “বৎস, মৃগয়া ভাল, গোরুগুলির পর্যবেক্ষণ করাও উচিত। কিন্তু গোপগণের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। কারণ, আমি শুনেছি যে, কাছেই নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবেরা আছেন। সেখানে তোমাদের যাবার অনুমতি আমি দিতে পারি না। কেন না, কর্ণ সেই মহারথেরা ছলনায় পরাজিত হয়েছেন, মহা দুঃখভোগ করছেন এবং মহা-তপস্যা করছেন; সুতরাং তারা তোমাদের পরাভূত করতে পারবেন। তবে, যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হবেন না; কিন্তু ভীমসেন ক্রোধ-পরায়ণ এবং দ্ৰৌপদী তো সাক্ষাৎ অগ্নি। তোমরা দর্প এবং মোহশালী; সুতরাং অবশ্যই অপরাধ করবে। তাতে তারা তোমাদের পুড়িয়ে মারবে। তারা এখন তপস্বী। তারা বীর এবং ক্রোধে অধীর হয়ে আছে। সুতরাং তরবারি ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে অস্ত্রতেজেও তোমাদের মেরে ফেলতে পারবে। পক্ষান্তরে তোমরা সংখ্যায় বেশি বলে যদি তাদের আক্রমণ করতে যাও, তবে সেটা অত্যন্ত নীচলোকের কাজ হবে এবং তাও পারবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, মহাবাহু অর্জুন ইন্দ্রলোকে থেকে স্বর্গীয় অস্ত্র শিক্ষা করে ফিরে এসেছে। দিব্যাস্ত্র লাভের পূর্বেই অর্জুন একাকী পৃথিবী জয় করেছিল—সুতরাং সে তোমাদের সংহার করতে পারবে। এমনকী, তোমরা যদি সেখানে গিয়ে আমার কথা শুনে বিরোধ না করার ব্যাপারে যত্নবানও থাকো, যদি তোমরা পাণ্ডবদের বিশ্বাসও করো, তবুও উদ্বেগের মধ্যে তোমাদের থাকতে হবে। তোমাদের কোনও সৈন্য যদি যুধিষ্ঠিরের কোনও অপকার করে, তবে সেই অপরাধের বোঝা তোমাদের উপরই চাপবে। অতএব ভরতনন্দন দুর্যোধন গো-গণনা ইত্যাদি কাজের জন্য বিশ্বস্ত রাজকর্মচারীই যান, তোমাদের সেখানে যাওয়ার দরকার নেই।”

শকুনি বললেন, “ভরতনন্দন, যুধিষ্ঠির ধর্মজ্ঞ; বিশেষত তিনি বারো বছর বনবাসের প্রতিজ্ঞা করে গিয়েছেন। ধর্মচারী অন্য পাণ্ডবেরা তাঁর অনুসরণ করে থাকেন। যুধিষ্ঠির আমাদের উপর ক্ৰোধ করবেন না। আমরাও মৃগয়া এবং গো-গণনার জন্যই যাত্রা করছি। পাণ্ডবদের দর্শন কিংবা বিরোধ করতে যাচ্ছি না।” শকুনি এই কথা বলে অনিচ্ছুক ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি সংগ্রহ করে নিলেন।

রাজা ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি লাভ করার পর, কুরুনন্দন দুর্যোধন—কর্ণ, দুঃশাসন ও অন্যান্য ভ্রাতা, শকুনির সঙ্গে মিলিত হয়ে, অসংখ্য স্ত্রীলোক ও বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে হস্তিনাপুর থেকে ‘দ্বৈতবন’ দেখার জন্য বার হলেন। পুরবাসীরাও ভার্যার সঙ্গে দুর্যোধনের অনুগমন করলেন। আট হাজার রথ, ত্রিশ হাজার হাতি, নয় হাজার ঘোড়া, বহু সহস্র পদাতিক, গাড়ি, দোকান, বেশ্যা, বণিক, স্তুতিপাঠক, শত শত মৃগয়াকারী ব্যক্তি মহাবায়ুর শব্দের মতো অতি গুরুতর কোলাহল করে পথ চলতে লাগল। মহারাজ দুর্যোধন, সেইদিন হস্তিনাপুর থেকে মাত্র ছ’ ক্রোশ পথ যেতে পারলেন, তারপর কিছুকালের মধ্যে সমস্ত বাহনের সঙ্গে দ্বৈতবনে প্রবেশ করলেন।

সেই বনে বাস করতে করতে দুর্যোধন প্রথমেই কৰ্ণ, শকুনি ও অন্য ভ্রাতার এবং নিজের জন্য বাসভবন নির্মাণ করলেন। বাসভবনের চতুর্দিক অত্যন্ত মনোহোর, সম্যক পরীক্ষিত। জল ও বৃক্ষ সমন্বিত এবং অত্যন্ত নিরাপদ স্থান হল। তারপর রাজা দুর্যোধন শত সহস্র গো-দর্শন করলেন ও সেগুলি গণনা ও চিহ্নিতকরণ করলেন। শিশু গোরুর সংখ্যা লিপিবদ্ধ করলেন, শিক্ষাযোগ্য গোরুর সংখ্যা নির্ণয় করলেন, ত্রিবর্ষ বয়স্ক গোরুগুলি স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত হল। এইভাবে গো-গণনাকার্য সম্পন্ন করে, গোপগণ পরিবেষ্টিত হয়ে আনন্দিত চিত্তে, পুরবাসী ও সৈন্যদের নিয়ে দেবতার মতো সুখে সেই বনে ক্রীড়া করতে লাগলেন। নৃত্য, গীত, বাদ্যে সুনিপুণ গোপগণ ও সু-অলংকৃত গোপকন্যাগণ দুর্যোধনের সেবা করতে লাগল। নারীরা রাজার কাছ থেকে যথাযোগ্য ধন, অন্ন ও নানাবিধ পানীয় লাভ করলেন। তখন দুর্যোধন ও তাঁর অনুচরেরা সকল দিক থেকে ব্যাঘ্র, মহিষ, মৃগ, গবয়, ভল্লুক ও শূকর বধ করতে লাগলেন। বৃহৎ হস্তীকে বিদীর্ণ করতে লাগলেন, মনোহর হরিণ ধরতে থাকলেন। মহারাজ দুর্যোধন গো-দুগ্ধ পান ও নানাবিধ ভোগ্যবস্তু উপভোগ করতে থেকে মত্ত ভ্রমর সেবিত, ময়ূর-শব্দিত মনোহর, পবিত্র দ্বৈতবনে গমন করলেন।

এদিকে ধর্মপুত্ৰ জ্ঞানী রাজা যুধিষ্ঠির সেখানে থেকে দ্বৈতবন নামক সরোবরের কাছে গৃহ নির্মাণ করে, পত্নী দ্রৌপদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে, নিষ্কামভাবে উত্তম বিধানে বন্য ফলমূল দিয়ে তখন ‘সাদ্যস্ক’ নামক রাজর্ষিযজ্ঞ করছিলেন।

দ্বৈতবনের কাছে এসে দুর্যোধন তাঁর ভৃত্যদের আদেশ দিলেন, তোমরা শীঘ্র বহু ক্রীড়াগৃহ নির্মাণ করো। সেই সময়ে কুবের ভবন থেকে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন ক্রীড়ার উদ্দেশ্যে দ্বৈতবনের সরোবরের কাছে সদলবলে অবস্থান করছিলেন। দুর্যোধনের লোকেরা দ্বৈতবনের কাছে এলেই গন্ধর্বরা তাদের বাধা দিল। এই সংবাদ পেয়ে দুর্যোধন তাঁর এক দুর্ধর্ষ সৈন্যদলকে বললেন, গন্ধর্বদের তাড়িয়ে দাও। তারা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এলে দুর্যোধন বহু সহস্রযোদ্ধা পাঠালেন। গন্ধর্বগণ মৃদুবাক্যে বারণ করলেও কুরুসৈন্য সবলে দ্বৈতবনে প্রবেশ করলেন। দুর্যোধন ও অন্যান্য ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ যখন গন্ধর্বদের নিষেধবাক্যে নিবৃত্ত হলেন না, তখন সেই গন্ধর্বরা সকলে গিয়ে তাদের রাজা চিত্রসেনকে সে-বিষয় জানাল। তখন গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে গন্ধর্বদের বললেন, “তোমরা এই অসভ্যগুলিকে শাসন করো।”

চিত্রসেনের আদেশ পেয়ে গন্ধর্বরা সকলে অস্ত্র ধারণ করে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের দিকে ধাবিত হল। অস্ত্র উঁচু করে গন্ধর্বদের আসতে দেখেই কুরুসৈন্যরা দুর্যোধনের সামনেই সকল দিকে পলায়ন করতে লাগল। দুর্যোধনের সমস্ত পুত্রকে যুদ্ধে ভীত অবস্থায় পালাতে দেখেও মহাবীর কর্ণ যুদ্ধ করতে ভয় পেলেন না। লঘুহস্ত সূতপুত্ৰ কর্ণ গন্ধর্বগণের বিশাল বাহিনীকে আসতে দেখে গুরুতর বাণবর্ষণ এবং লৌহময় ক্ষুরপ্র, শর, ভল্ল ও বর্ষদন্ত বর্ষণ করে শত শত গন্ধর্বকে আহত করে সে বাহিনীকে নিরস্ত করলেন। কর্ণ ক্রমে গন্ধর্বদের মস্তকচ্ছেদন করতে থেকে ক্ষণকালের মধ্যে চিত্রসেনের সমস্ত সৈন্যকে বিচলিত করলেন। কর্ণ বধ করতে থাকলেও শত সহস্র গন্ধর্ব পুনরায় তাঁর দিকে ধাবিত হল। সমস্ত পৃথিবী যেন গন্ধর্ব সৈন্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।

তখন রাজা দুর্যোধন, সুবলপুত্র শকুনি, দুঃশাসন, বিকর্ণ এবং ধৃতরাষ্ট্রের অন্য পুত্রেরা গরুড়তুল্য রথে আরোহণ করে গন্ধর্বসৈন্যকে সংহার করতে লাগলেন এবং কর্ণকে সামনে রেখে অনবরত বাণবর্ষণ করে চললেন।

তারপর সমস্ত গন্ধর্ব এসে কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে মিলিত হল। তখন এক রোমাঞ্চজনক অতি তুমুল যুদ্ধ হতে আরম্ভ করল। গন্ধর্বগণ ক্রমশ কৌরব আক্রমণে বাণপীড়িত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল। গন্ধর্বগণকে পীড়িত দেখে কৌরবগণ আনন্দে কোলাহল করে উঠল। তখন গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন অসহিষ্ণু হয়ে আপন আসন থেকে গাত্রোত্থান করলেন। বিচিত্র রণকৌশল অভিজ্ঞ চিত্রসেন মায়া অবলম্বন করে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন এবং তাঁর সেই মায়ায় কৌরব সৈন্যগণ মোহিত হয়ে পড়লেন। তখন দুর্যোধনের এক-একজন যোদ্ধা দশ দশ জন গন্ধর্বের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। তারা তখন বিশাল গন্ধর্বসৈন্যকর্তৃক যুদ্ধে পীড়িত ও ভীত হয়ে পলায়ন করতে লাগল। দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্য পরাজিত হলেও সূর্যপুত্র কর্ণ পর্বতের মতো অচল হয়ে রইলেন। দুর্যোধন, কর্ণ ও সুবলপুত্র শকুনি যুদ্ধে অত্যন্ত ক্ষত-বিক্ষত হওয়া সত্ত্বেও গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

তখন শত শত গন্ধর্ব কর্ণকে বধ করার ইচ্ছায় তার প্রতি ধাবিত হতে থাকল। সকল দিক থেকে অসি, পট্টিশ, শূল ও গদা নিক্ষেপ করে তারা কর্ণকে আবৃত করল। কোনও কোনও গন্ধর্ব কর্ণরথের যুগকাষ্ঠ ছেদন করল, কেউ তার ধ্বজ নিপতিত করল। অন্য গন্ধর্বেরা দণ্ড, অপরেরা অশ্বগুলি এবং আর একদল সারথিকে ছেদন করল। ক্রমে অন্যদল ছত্র ও আবরণ এবং অপর গন্ধর্বগণ রথের সন্ধিস্থানগুলি ছেদন করল। এইভাবে বহুসংখ্যক গন্ধর্ব কর্ণের রথখানিকে তিল তিল করে নষ্ট করল। তখন কর্ণ অসিচর্ম ধারণ করে রথ থেকে লাফ দিয়ে বিকর্ণের রথে উঠে আত্মরক্ষার জন্য ঘোড়াগুলিকে বাইরের দিকে চালিয়ে দিলেন।

গন্ধর্বেরা মহারথ কর্ণকে পরাভূত করলে দুর্যোধনের সামনেই কৌরবসৈন্যরা পালাতে আরম্ভ করল। দুর্যোধন তখনও যুদ্ধবিরত হননি। তিনি একাই গন্ধর্ব সৈন্যদের উপর বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন গন্ধর্বেরা চারদিক থেকে দুর্যোধনের রথ বেষ্টন করল। তারা বাণদ্বারা দুর্যোধন রথের যুগ, ঈশা, বরূথ, ধ্বজ, সারথি, অশ্ব, ত্রিবেণু ও শয্যাকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেললেন। তখন মহাবাহু চিত্রসেন দ্রুত গমন করে রথহীন ও ভূতলস্থিত দুর্যোধনকে জীবিত অবস্থায়ই গ্রহণ করলেন। দুর্যোধন বন্দি হলেন। চিত্রসেন দুর্যোধনের ভ্রাতা ও ভার্যাদের নিয়ে দ্রুত সেই স্থান থেকে প্রস্থান করলেন।

পরাজিত কৌরব সৈন্যগণ, দোকানি ও বেশ্যাগণ তখন গিয়ে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের শরণাপন্ন হল। সৈন্যরা বলল, “প্রিয়দর্শন, মহাবাহু ও মহাবল রাজা দুর্যোধনকে গন্ধর্বেরা হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। দুঃশাসন, দুর্বিষহ, দুর্মুখ, দুর্জয় ও সমস্ত রাজভার্যাকে বন্ধন করে গন্ধর্বেরা হরণ করে নিয়ে চলেছে।” দুর্যোধনের মন্ত্রীরাও তাঁর উদ্ধার কামনা করে, ব্যথিত ও কাতর হয়ে পাণ্ডবদের ডাকতে ডাকতে রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে উপস্থিত হলেন। বৃদ্ধ মন্ত্রীরা ব্যথিত ও কাতর হয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে দুর্যোধনের মুক্তির প্রার্থনা করতে থাকলে, মহাবীর ভীম তাদের বললেন, “আমরা যুদ্ধের জন্য হস্তী, অশ্বদের সুসজ্জিত করে গুরুতর চেষ্টায় যা করতাম, গন্ধর্বেরা আজ তাই করেছে। দুর্যোধন অন্য উদ্দেশ্যে প্রবৃত্ত হয়েছিল, কিন্তু ঘটনাটা অন্য প্রকার হয়ে গেছে। সুতরাং দুষ্টভাবে দ্যূতক্রীড়াকারী দুর্যোধন তার কর্ম অনুযায়ী ফল পেয়েছে। আমরা শুনেছি যে, অসমর্থ ব্যক্তিদের উপর অন্যায়কারীকে অন্য ব্যক্তি পরাভূত করে। গন্ধর্বেরা সেই প্রবাদকে সত্য প্রমাণ করে আজ অসাধ্য কাজ করেছে। ভাগ্যবশত পৃথিবীতে এখনও এমন লোক আছে, যারা আমাদের প্রিয় কার্য করে। কেন না, আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছি। এই অবস্থায় আমাদের সুখকর এই কার্য যিনি করেছেন, তিনি অতি প্রশংসার পাত্র। দুর্যোধন অতি সমৃদ্ধ অবস্থায় আছে, তাই শীত, বায়ু, রৌদ্র সহ্য করে আমরা কতটা দুরবস্থায় আছি পাপী দুর্যোধন তাই দেখতে এসেছিল। দুরাত্মা দুর্যোধনের অনুসরণকারী ও পরামর্শদাতারা তারা এখন পরাজয় দেখছে। আপনারাই সাক্ষী যে কুন্তীর পুত্রেরা নৃশংস নন এবং তাঁরা দুর্যোধনের এই অবস্থার জন্য দায়ী নন।” ভীমসেন অত্যন্ত বিকৃত স্বরে এই কথা বলছিলেন, এই অবস্থায় যুধিষ্ঠির বললেন, “এটা নিষ্ঠুর কথা বলবার সময় নয়। বৎস ভীমসেন, কৌরবপক্ষীয়েরা অত্যন্ত বিপন্ন, ভয়ার্ত ও শরণার্থী হয়ে আমাদের কাছে এসেছে। তবুও তুমি কীভাবে এরূপ বলতে পারো?

ভবন্তী ভেদা জ্ঞাতীনাং কলহাশ্চ বৃকোদর।

প্রসক্তানি চ বৈরাণি কুলধর্মো ন নশ্যতি॥ বন : ২০৫ : ২৪ ॥

জ্ঞাতিদের মধ্যে পরস্পর ভেদ হয়, বিবাদ হয় এবং শত্রুতাও হয়; কিন্তু তবুও কুলধর্ম নষ্ট হয় না”

“যখন বাইরের কোনও লোক জ্ঞাতিদের কুল নষ্ট করতে ইচ্ছা করে, তখন বাইরের সেই লোকের ধর্ষণ কখনও সজ্জনেরা উপেক্ষা করেন না। দুর্বুদ্ধি গন্ধর্বরাজ জানে যে, আমরা দীর্ঘকাল এখানে বাস করছি। তবুও সে আমাদের অবজ্ঞা করে এই অত্যন্ত অপ্রিয় কার্য করেছে। শক্তিশালী ভীম! গন্ধর্বেরা ধলপূর্বক দুর্যোধনকে গ্রহণ করায় এবং বাইরের লোকেরা কুরুকুলবধূদের হরণ করায় আমাদের কুল নষ্ট হতে বসেছে। অতএব শরণাগতরক্ষা ও কুলরক্ষার জন্য তোমরা ওঠো, সাজো, এবং বিলম্ব কোরো না। অপরাজিত অর্জুন, নকুল, সহদেব এবং তুমি—এই চারজন হৃতমর্যাদা ও হৃতকুল দুর্যোধনকে মুক্ত করো। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের রথগুলি অক্ষত আছে। এতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রও আছে, ধ্বজাও আছে, সুশিক্ষিত সারথি আছেন—এই গভীর নাদকারী রথগুলিতে আরোহণ করেই বিশেষ সতর্ক হয়ে গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধ করে কুলরক্ষা করো। ‘তুমি শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয়’। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হল, শরণাগতকে রক্ষা করা। শত্রুও শরণাগত হয়ে, কৃতাঞ্জলি হয়ে, রক্ষার আবেদন করলে তাকে রক্ষা করাই উচিত। পাণ্ডবগণ! বরলাভ, রাজ্যলাভ, পুত্রজন্ম ও বিপদ থেকে শত্রুকে উদ্ধার করা—এই চারটি বিষয়ের মধ্যে শেষেরটি প্রথম তিনটির থেকে অধিক গৌরবের। বৃকোদর, যদি আমি যজ্ঞে ব্ৰতী না থাকতাম, তবে আমি নিজেই প্রথমে যেতাম, বিন্দুমাত্র বিবেচনা করতাম না।

“কুরুনন্দন ভীম, তুমি যাতে মিষ্টি কথা বলে দুর্যোধনকে মুক্ত করতে পারো, তার সব চেষ্টাই করবে। কিন্তু যদি গন্ধর্বরাজ তোমার কথা না শোনেন, তা হলে কোমল পরাক্রম দেখিয়ে তাদের মুক্ত করবে। যদি দেখো, তাতেও গন্ধর্বরাজ দুর্যোধনকে মুক্ত করতে চাইছেন না, তবে সমস্ত উপায়ে তাদের পরাভূত করে কৌরবদের মুক্ত করবে। আমি যে যজ্ঞ আরম্ভ করেছি, তা এখনও সমাপ্ত হয়নি; আমি তাই তোমার সঙ্গে যেতে পারি না, কেবলমাত্র উপদেশ দিতে পারি।”

অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কথা শোনামাত্র প্রতিজ্ঞা করলেন, কৌরবদের মুক্ত করে আনবেন। অর্জুন বললেন, “গন্ধর্বেরা যদি আমাদের সানুনয় বাক্যে কৌরবগণকে মুক্তি না দেয়, তবে আজ ভূমি গন্ধর্বদের রক্তপান করবে।” অর্জুনের প্রতিজ্ঞা শুনে কৌরবপক্ষীয় লোকেদের মনে সাহস সঞ্চার হল। ভীমসেন আনন্দিত মুখে উঠে দাঁড়ালেন। মহারথ পাণ্ডবেরা সকলেই স্বর্ণখচিত অভেদ্য কবচ পরিধান করলেন ও নানাবিধ অলৌকিক অস্ত্র ধারণ করলেন। পাণ্ডবেরা সকলে বর্ম, ধ্বজ, ধনু ধারণ করে রথে আরোহণ করলে তাঁদের প্রজ্বলিত অগ্নির মতো মনে হতে থাকল। কৌরব ভ্রাতাদের সেই রথে উঠে পাণ্ডবভ্রাতারা রওনা হলে কৌরব সৈন্যগণ আনন্দে কোলাহল করে উঠল।

ওদিকে কৌরবদের পরাজিত করে গন্ধর্বগণ নির্ভয়ে নিজেদের আবাসে ফিরে যাচ্ছিল, রথারূঢ় পাণ্ডবদের দেখে তারা ফিরে দাঁড়াল। চার পাণ্ডব মহাবীরকে দেখে তারা ব্যূহ রচনা করে দাঁড়াল। পাণ্ডবেরা মহাবীর যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা অনুসারে গন্ধর্বদের মধুর বাক্যে অনুরোধ জানালেন। তখন পরন্তপ অর্জুনও কোমলবাক্যে গন্ধর্বদের বললেন, “গন্ধর্বগণ, আপনারা আমার ভ্রাতা রাজা দুর্যোধনকে ছেড়ে দিন।” অর্জুনের কথা শুনে গন্ধর্বগণ ঈষৎ হাস্য করে অর্জুনকে বলল, “ভরতনন্দন! আমরা জগতের মধ্যে কেবলমাত্র একজনের আদেশ পালন করে থাকি। সেই একজন যেমন আদেশ করেছেন, আমরা তেমন আচরণই করছি। দেবরাজ ইন্দ্র ব্যতীত আমাদের শাসনকর্তা নেই।” তখন অর্জুন গন্ধর্বদের বললেন, “গন্ধর্বগণ তোমরা যদি এই অনুরোধ বাক্য অগ্রাহ্য করো, তবে আমি বিক্রম প্রকাশ করে নিজেই তাদের মুক্ত করে নিয়ে যাব।” এই বলেই, পার্থ অর্জুন গন্ধর্বদের প্রতি তীক্ষ্ণ বাণ বর্ষণ করতে শুরু করলেন। বলমত্ত গন্ধর্বেরাও বাণ বর্ষণ করতে করতে পাণ্ডবদের দিকে ধাবিত হল। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ বাঁধল। গন্ধর্বগণ অলৌকিক ও দিব্য অস্ত্র প্রয়োগ করতে আরম্ভ করল। একদিকে মাত্র চারজন পাণ্ডব, অন্যদিকে অসংখ্য শত সহস্র গন্ধর্ব বীর। তা যেন এক অদ্ভুত ব্যাপার হল। গন্ধর্বেরা আগে কর্ণ ও দুর্যোধনের রথ দু’খানি বেষ্টন করে শত শত খণ্ডে ছেদন করেছিল, তেমনই পাণ্ডবদের রথ চারটিকেও ছেদন করল। শত শত গন্ধর্বকে ধাবিত দেখে পাণ্ডবেরা অসংখ্য বাণবর্ষণ করে দমিত করলেন, তারা পাণ্ডবদের নিকটবর্তী হতে পারল না।

তখন অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে গন্ধর্বদের লক্ষ্য করে স্বর্গীয় মহাস্ত্রগুলি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। আগ্নেয় অস্ত্র দ্বারা অর্জুন গন্ধর্বদের যমালয়ে প্রেরণ করতে লাগলেন। মহাধনুর্ধর বলিশ্রেষ্ঠ ভীমও শত শত গন্ধর্বকে বধ করতে লাগলেন। বলমত্ত নকুল ও সহদেব বেগে সম্মুখবর্তী গন্ধর্বদের গ্রহণ করে তীক্ষ্ণ শরবর্ষণে নির্বিচারে তাদের বধ করতে লাগলেন। পাণ্ডবেরা গন্ধর্বদের বধ করতে থাকলে তখন তারা ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের নিয়ে আকাশে উড়ে গেল। অর্জুন বিশাল শরজাল বিস্তৃত করে গন্ধর্বদের সকল পথ রুদ্ধ করে দিলেন। তারা আর উপরেও উড়তে পারল না, নীচেও নামতে পারল না, আকাশে থেকেই অর্জুনের উপর বাণবর্ষণ করতে থাকল। আপন অস্ত্রে গন্ধর্বদের অস্ত্র নিবারণ করে, অর্জুন তাদের প্রতিবিদ্ধ করতে লাগলেন। অর্জুন স্থূণাকর্ণ, ইন্দ্রজাল, সৌর, আগ্নেয় ও সৌম্য অস্ত্র ক্রমশ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ইন্দ্রের বাণে দানবেরা যেমন দগ্ধ হয়েছিল, গন্ধর্বগণও অর্জুনের বাণে সেইরকম দগ্ধ হতে থেকে অত্যন্ত বিষণ্ণ হলেন। অর্জুন গন্ধর্বগণকে ভীত, সন্ত্রস্ত করে ফেলেছেন দেখে, গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন গদা ধারণ করে অর্জুনের দিকে ধাবিত হলেন। অর্জুন বাণদ্বারা সেই লৌহময়ী গদাকে পাঁচ টুকরো করে ভেঙে ফেললেন। তখন চিত্রসেন মায়াবলে আপনাকে ঢেকে রেখে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। মহাবীর চিত্রসেন যে সমস্ত দিব্য অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন, অর্জুন সেই দিব্যাস্ত্র দ্বারাই তা প্রতিহত করতে লাগলেন। মায়াবলে চিত্রসেন অন্তর্হিত হলে, অর্জুন স্বর্গীয় অস্ত্রমন্ত্রে অভিমন্দ্রিত হয়ে চিত্রসেনকে তাড়ন করতে লাগলেন। এরপর অর্জুন শব্দভেদী বাণ ধনুকে সংযোজন করে অন্তর্হিত অবস্থায় চিত্রসেনকে বধ করতে উদ্যত হলেন। তখন চিত্রসেন নিজরূপে অর্জুনকে দেখা দিলেন এবং বললেন, “অর্জুন আমি তোমার সখা।” সখা চিত্রসেনকে দেখে এবং তিনি যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়েছেন বুঝে অর্জুন সেই অস্ত্রের উপসংহার করলেন। তখন অন্য পাণ্ডবেরাও অস্ত্র উপসংহার করলেন। রথে থেকেই তারা পরস্পরের কুশল প্রশ্ন করলেন ও মঙ্গল কামনা করলেন।

তখন মহাতেজস্বী ও মহাধনুর্ধর অর্জুন হাসতে হাসতে চিত্রসেনকে বললেন, “বীর, তুমি কী জন্যে কৌরবগণের নিগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েছ এবং কেনই বা ভার্যাদের সঙ্গে দুর্যোধনকে বন্দি করেছ?” চিত্রসেন বললেন, “ধনঞ্জয় দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গ থেকেই দুরাত্মা দুর্যোধন ও পাপাত্মা কর্ণের দুষ্ট অভিপ্রায় জানতে পেরেছিলেন। তোমরা দ্রৌপদীর সঙ্গে বনে থেকে অনাথের মতো কষ্ট পাচ্ছ, এই জেনে, এই দুষ্টেরা তোমাদের পরিহাস করার জন্য দ্বৈতবনে এসেছিল। তখন দেবরাজ আমাকে বললেন, যাও, মন্ত্রীদের সঙ্গে দুর্যোধনকে বেঁধে এখানে নিয়ে এসো। কিন্তু তুমি যুদ্ধের সময় ভ্রাতৃগণের সঙ্গে অর্জুনকে রক্ষা কোরো। কারণ, তুমি অর্জুনের প্রিয়সখা ও অর্জুন তোমার শিষ্য। আমি দেবরাজের সেই আদেশ অনুসারে এখানে এসেছিলাম এবং দুরাত্মা দুর্যোধনকে বন্দিও করেছি। এখন আমি স্বর্গে গিয়ে দেবরাজের কাছে এদের সমর্পণ করব।”

অর্জুন চিত্রসেনকে বললেন, “চিত্রসেন তুমি যদি আমার প্রীতিকর কার্য করতে চাও, তবে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের আদেশে আমাদের ভ্রাতা দুর্যোধনকে ছেড়ে দাও।” চিত্রসেন বললেন, “এই পাপাত্মা সর্বদাই গুরুতর দোষে দোষী এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর প্রতারণাকারী! সুতরাং এ মুক্তি পাবার যোগ্য নয়। তারপর, যুধিষ্ঠির এর এখানে আসার কারণ জানেন না, অতএব তাঁর কথা শুনে যা ইচ্ছা করো, তাই করো।”

তারপর তারা সকলে মিলে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন এবং দুর্যোধনের দ্বৈতবনে আসার যথার্থ কারণ তাঁর কাছে ব্যাখ্যা করলেন। তখন যুধিষ্ঠির গন্ধর্বরাজের সমস্ত কথা শুনে, দুর্যোধন প্রভৃতি সকলকে মুক্ত করিয়ে দিয়ে গন্ধর্বগণের ভূয়সী প্রশংসা করলেন, “গন্ধর্বগণ আপনারা সকলেই বলবান এবং দুর্যোধনকে বধ করতে সমর্থ ছিলেন; তবুও ভাগ্যবশত মন্ত্রী, জ্ঞাতি ও বন্ধুবর্গের সঙ্গে এই দুর্বৃত্ত দুর্যোধনকে বধ করেননি। বৎস চিত্রসেন, গন্ধর্বেরা দুর্যোধনকে মুক্ত করে দিয়ে আমার বংশের অপমান না করে আমার গুরুতর উপকার করেছেন। আপনাদের দর্শনে আমরা আনন্দিত হয়েছি। এবার আপনাদের অভীষ্ট বিষয়ে আদেশ করুন; তারপর সমস্ত অভীষ্ট লাভ করে গমন করুন, বিলম্ব করবেন না।”

বুদ্ধিমান যুধিষ্ঠির আদেশ করলে চিত্রসেন প্রভৃতি গন্ধর্বেরা আনন্দিত চিত্তে অপ্সরাদের নিয়ে চলে গেল। দেবরাজ ইন্দ্র দিব্য অমৃত বর্ষণ করে মৃত গন্ধর্বদের পুনরায় জীবিত করলেন। পাণ্ডবেরাও দুষ্কর কার্য সাধন করে সমস্ত জ্ঞাতি ও রাজ-ভার্যাদের মুক্ত করতে পারায় বিশেষ আনন্দিত হলেন। কৌরব স্ত্রী ও কুমারগণ পাণ্ডবদের গৌরব করতে থাকায় তাঁরা যজ্ঞের অগ্নির মতো শোভা পেতে থাকলেন। তখন যুধিষ্ঠির অত্যন্ত প্রীতির সঙ্গে দুর্যোধনকে বললেন—

মাস্ম তাত! পুনঃ কার্ষীরীদৃশং সাহসং ক্বচিৎ।

ন হি সাহস কৰ্ত্তারঃ সুখমেধন্তি ভারত!॥ বন : ২০৭ : ২১ ॥

“বৎস ভরতনন্দন! তুমি আর কখনও এ সাহস কোরো না। কারণ হঠকারী সাহসকারী লোকেরা অনায়াসে উন্নতি করতে পারে না। কুরুনন্দন! তুমি সকল ভ্রাতার সঙ্গে মিলিত হয়ে ইচ্ছানুসারে কুশলে গৃহে গমন করো; যে ঘটনা ঘটেছে, তা মনে রেখে দুঃখ পেয়ো না।”

যুধিষ্ঠির অনুমতি দিলে, রাজা দুর্যোধন তাঁকে নমস্কার করে নষ্টপুরুষত্বের মতো আর্ত, লজ্জিত ও দুঃখে যেন বিদীর্ণ হতে থেকে হস্তিনার দিকে প্রস্থান করলেন।

*

“গো-গণনা ও দুর্যোধন-নিগ্রহ” মহাভারতের একটি দুর্লভ মুহূর্ত। এই মুহূর্তটি আমাদের কাছে অনেকগুলি চরিত্র ও ঘটনাকে উদ্‌ঘাটিত করেছে। প্রথমেই দুষ্ট চতুষ্টয়ের সমাবেশ। দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসন একত্রে মিলিত হলেই পাণ্ডবদের ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারত না। এক্ষেত্রেও ঘটনার ব্যত্যয় ঘটেনি। গান্ধারী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হলে বলেছিলেন, “আমার পুত্র পাপী ছিল, কিন্তু তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল কর্ণ।” এ বক্তব্য পুরোপুরি সত্য। বর্তমান ক্ষেত্রেও পাণ্ডবদের দারিদ্র্য, দুরবস্থা দেখে উপহাস করতে যাবার পরামর্শ কর্ণের। দ্বিতীয়ত, ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহান্ধ আচরণ। তিনি জানতেন যে, দ্বৈতবনে উপস্থিত হলেই দুর্যোধনেরা কু-মতলব করবেনই। তা সত্ত্বেও তিনি যাত্রার অনুমতি দিয়েছিলেন। তৃতীয়ত, কৌরবদের সীমাহীন ঔদ্ধত্য, নিজশক্তি সম্পর্কে কর্ণের অতিরিক্ত গর্ব। গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধের পরিণতি কী হতে পারে তার ধারণা কৌরবপক্ষের ছিল না। ভার্যাসহ ধার্তরাষ্ট্ররা বন্দি হলেন, কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে কর্ণ পালালেন। চতুর্থত, যুধিষ্ঠিরের আশ্চর্য ঔচিত্যবোধ ও বংশমর্যাদাবোধ। জ্ঞাতিধর্ম সম্পর্কে যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য আজকেও সমান প্রাসঙ্গিক। পঞ্চমত, কৌরব কুলললনাদের রক্ষার জন্য তাঁর ভীমসেনের অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভীমার্জুন নকুল-সহদেবকে কুলললনাদের উদ্ধারে প্রেরণ। যথার্থ ক্ষত্রিয়ের আচরণ কী হওয়া উচিত, তা যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের শিখিয়েছেন। ষষ্ঠত, যুধিষ্ঠিরের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা। অমনোযোগী মহাভারত চর্চাকারেরা মন্তব্য করেন যে, যুধিষ্ঠির সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। একথা যে কতখানি ভ্রান্ত, তা বর্তমান ‘মুহূর্ত’টির আলোচনায় বোঝা যায়। যুধিষ্ঠির ঘটনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সে সিদ্ধান্ত অমোঘ, দূরদর্শিতাপূর্ণ এবং মঙ্গলজনক। এই কারণেই ভ্রাতারা তাঁর সিদ্ধান্ত অতিক্রম করতে পারেন না। তাঁর ‘ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ’ অর্জুন ও চিত্রসেন যুধিষ্ঠির সম্পর্কে বারবার একটি বিশেষণ ব্যবহার করেছেন—তিনি ‘ধর্মরাজ’।

৪৫
দুর্যোধনের প্রায়োপবেশন

ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধন মহাভারতের প্রতি নায়ক। তিনি পূর্ণ পাপী। কিন্তু তাঁর স্বাভিমান ছিল প্রচণ্ড। এই স্বাভিমান বোধ থেকেই তিনি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভাগ করে রাজ্যভোগ করতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। দুর্যোধন নিজে যথেষ্ট বীর ছিলেন এবং অসাধারণ বীরদের আপন পক্ষে পেয়েছিলেন। অর্থাৎ দুর্যোধন অভিমানী, অতি দুরাত্মা, আত্মশ্লাঘানিরত, পাপলিপ্ত, সর্বদা গর্বিত, সর্বদা পুরুষকার ও প্রচ্ছন্ন উদারতা দেখিয়ে পাণ্ডবদের অবমাননাকারী, পাপমতি ও সর্বদা অহংকারী ছিলেন।

গো-গণনা ছলে দ্বৈতবনে যাত্রার উদ্দেশ্য দুর্যোধনের একটাই ছিল। আপন সৌভাগ্য দেখিয়ে বনবাসী দুর্দশাগ্রস্ত পাণ্ডবদের ব্যঙ্গ করা। কিন্তু অধর্ম অধর্মকারীকেই আঘাত করে। যুদ্ধে গন্ধর্বেরা দুর্যোধনকে পরাজিত ও বন্দি করেছিল। কৌরব নারীরাও গন্ধর্বদের কাছে ধরা পড়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে ভীমার্জুন, নকুল ও সহদেব—চার পাণ্ডবভ্রাতা গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দুর্যোধনকে মুক্ত করেন। যুধিষ্ঠির তাঁর মুক্তির পরে কুলললনাদের নিয়ে হস্তিনায় ফিরে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্র-নন্দন দুর্যোধন লজ্জায় মাথা নিচু করে, অবসন্ন ও অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে, আপন পরাজয়ের কথা চিন্তা করতে করতে চতুরঙ্গ সৈন্যের পিছনে থেকে আপন নগরের দিকে যাত্রা করলেন।

দুঃখ ও গ্লানি দুর্যোধনের সমস্ত আত্মগৌরব নষ্ট করে দিয়েছিল। তাই তিনি পথিমধ্যে যানবাহন পরিত্যাগ করে ঘাস ও জলপূর্ণস্থানে থেকে এক উপদ্রবহীন ও মনোহর ভূমিতে হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতি সকল স্থাপন করে, যাত্রার বিশ্রাম ঘোষণা করলেন। অনন্তর রাত্রিশেষে রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের ন্যায় মলিনবদন রাজা দুর্যোধন অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বল একটি পালঙ্কে উপবিষ্ট ছিলেন; এমন সময়ে কর্ণ উপস্থিত হয়ে বললেন, “গান্ধারীনন্দন! ভাগ্যবশত তুমি জীবিত আছ, ভাগ্যবশত আবার আমাদের দেখা হল এবং ভাগ্যবশত তুমি কামরূপী গন্ধর্বদের জয় করেছ। তোমার ভ্রাতারাও জয় করার ইচ্ছা যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে শত্রুদের পরাজিত করেছে। কিন্তু রাজা! তোমার সাক্ষাতেই তোমার সৈন্যেরা ছত্রভঙ্গ হয়েছিল। আমি বারংবার ডেকেও তাদের আর জড়ো করতে পারিনি—গন্ধর্বেরা আমার পিছনে পিছনে আসছিল, আমিও শক্রর শরে অত্যন্ত ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ ও পীড়িত হয়েছিলাম; এইসব কারণে আমি পলায়ন করেছিলাম। কিন্তু তুমি বল, বাহন ও ভার্যাদের নিয়ে সেই অলৌকিক যুদ্ধজয় করে নির্বিঘ্নে ও অক্ষতদেহে ফিরে এসেছ, দেখে আমি অত্যন্ত আশ্চর্যবোধ করছি। রাজা! তুমি ভ্রাতাদের সঙ্গে যে কার্যসাধন করেছ, এমন কার্যকারী লোক পৃথিবীতে আর নেই।”

কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন মাথা নিচু করে বললেন, “কর্ণ তুমি যথার্থ ঘটনা জানো না বলে তোমার কথায় আমি দোষ দিচ্ছি না। তুমি ধারণা করেছ যে, আমিই বলপূর্বক গন্ধর্বদের জয় করেছি। আমি ও ভ্রাতারা মিলিত হয়ে গন্ধর্বদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধ করেছি এবং গন্ধর্ব সৈন্যদের দুই পাশের অংশের ক্ষয়ও করেছিলাম। তখন অত্যন্ত মায়াবী গন্ধর্বেরা আকাশে উঠে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করল, আমরা ভূতলে ছিলাম। সুতরাং সে যুদ্ধ সমান হল না। ক্রমে আমরা পরাজিত হলাম এবং বল, বাহন, ভৃত্য, অমাত্য, স্ত্রী ও পুত্রদের সঙ্গে বদ্ধ হলাম। সেই দারুণ দুঃখিত অবস্থায় গন্ধর্বেরা আমাদের উচ্চ আকাশপথ দিয়ে হরণ করে নিয়ে চলল। তখন আমাদের কিছু সৈন্য ও কয়েকজন মন্ত্রী গিয়ে কাতর হয়ে শরণাগতরক্ষক পাণ্ডবদের বললেন, ‘ধৃতরাষ্ট্রপুত্র রাজা দুর্যোধনকে ভ্রাতা, মন্ত্রী ও ভার্যাদের সঙ্গে গন্ধর্বেরা আকাশপথ দিয়ে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। অতএব রাজা দুর্যোধন ও তার অন্তঃপুরের নারীদের আপনারা রক্ষা করুন। আপনাদের মঙ্গল হবে এবং কুরুকুলবধূদের ধর্ষণও হবে না।’ তাদের এই কথা শুনে, তখনই ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির অন্য পাণ্ডবভ্রাতাদের প্রসন্ন করে আমাদের মুক্ত করতে আদেশ দিলেন। তখন পুরুষশ্রেষ্ঠ ও মহারথ পাণ্ডবেরা সেই স্থানে এসে শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও গন্ধর্বদের কাছে মধুরবাক্যে আমাদের মুক্তি প্রার্থনা করলেন। যখন অনুনীত হয়েও গন্ধর্বেরা আমাদের মুক্তি দিল না, তখন ভীম, অর্জুন ও বলমত্ত নকুল ও সহদেব বাণক্ষেপ করতে আরম্ভ করলেন।

“তারপর আনন্দিত গন্ধর্বগণ সকলে যুদ্ধ না করে কিছুসংখ্যক দীনমূর্তি আমাদের টেনে নিয়ে আকাশপথে চলতে লাগল। কর্ণ তারপর দেখলাম সমস্ত দিক শরজালে বেষ্টিত হয়েছে এবং অর্জুন অলৌকিক অস্ত্রসমূহ নিক্ষেপ করছেন। তীক্ষ্ণ বাণের দ্বারা সমস্ত আকাশপথ আবৃত করেছেন দেখে তাঁর সখা গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন দেখা দিলেন। ক্রমে চিত্রসেন অর্জুনের সঙ্গে পরস্পর আলিঙ্গন করে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, পাণ্ডবেরাও চিত্রসেনের স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর সেই মহাবীর পাণ্ডবেরা ও গন্ধর্বেরা যুদ্ধসজ্জা ত্যাগ করে পরস্পরের সঙ্গে মিলে গেলেন। তখন শত্ৰুবীরহন্তা অৰ্জুন হাসতে হাসতে চিত্রসেনকে বললেন, ‘বীর গন্ধর্বশ্রেষ্ঠ! তুমি আমার ভ্রাতৃগণকে মুক্ত করে দাও। কারণ, পাণ্ডবগণ জীবিত থাকতে তুমি বলপূর্বক এদের নিয়ে যেতে পারবে না।’ অর্জুনের কথা শুনে চিত্রসেন বললেন, ‘দ্রৌপদীর দুরবস্থা দেখার জন্য এই দুরাত্মারা দ্বৈতবনে এসেছিল।’ চিত্রসেন যখন এই কথা বলছিলেন, তখন লজ্জায় আমার ভূগর্ভে প্রবেশের ইচ্ছা হচ্ছিল। তারপর গন্ধর্ব ও পাণ্ডবেরা মিলিত হয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে আমাদের কুমন্ত্রণার বিষয় ও আমাদের বন্ধনের বিষয় জানাল। আমি স্ত্রীলোকদের সামনে কাতর, বন্দি ও শত্রুদের বশীভূত হলাম। তারপর শত্রুরা আমাকে নিয়ে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে উপহার দিল। জীবনে এর থেকে বড় দুঃখের ঘটনা আর কী ঘটতে পারে? দুর্বুদ্ধিবশত আমি সর্বদাই যাদের অপমান করেছি এবং সর্বদাই যাদের শত্রু বিবেচনা করেছি, তারাই আমাকে আজ মুক্ত করল, তারাই আবার আমার জীবন দান করল। বীর কর্ণ, আমি যদি সেই মহাযুদ্ধে নিহত হতাম, তবে আমার পক্ষে ভাল হত। কিন্তু এ অবস্থায় আমার জীবিত থাকা ভাল হয়নি। কারণ, গন্ধর্বদের হাতে আমার মৃত্যু হলে আমার যশ পৃথিবীতে বিখ্যাত হত এবং আমি স্বর্গলোকে অক্ষয় পুণ্যস্থান লাভ করতাম। অতএব হে নরশ্রেষ্ঠ, আমার সংকল্প আপনারা শুনুন। আমি এখানেই প্রায়োপবেশন করব, আপনারা গৃহে যান এবং আমার ভ্রাতারাও নিজ নিজ গৃহে গমন করুক। আর কর্ণ প্রভৃতি যেসব সুহৃদ ও বান্ধব আছেন, তাঁরাও দুঃশাসনকে অগ্রবর্তী করে রাজধানীতে ফিরে যান। শত্রুদের মান বৃদ্ধি করে, মিত্রদের মান নষ্ট করে, শত্ৰুকৃত অপমান নিয়ে আমি আর রাজ্যে ফিরব না। মিত্রদের দুঃখের এবং শত্রুদের আনন্দের এই সংবাদ হস্তিনায় গিয়ে আমি রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে কেমন করে বলব? ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিদুর, সঞ্জয়, বাহ্লিক, ভূরিশ্রবা ও অন্য যে সকল বৃদ্ধ, ব্রাহ্মণ, শ্রেণিপ্রধান ও নিরপেক্ষ লোক আছেন, তাঁরা আমাকে কী বলবেন আর আমিই বা কী উত্তর দেব? আমি চিরকাল শত্রুদের মাথায় থেকে এবং তাদের বুকের উপর বিক্রম প্রকাশ করে, এখন নিজের দোষে সেখান থেকে পতিত হয়ে ভীষ্ম প্রভৃতিকে কী বলব? আমার মতো মদগর্বিত লোকেরা সম্পদ, বিদ্যা কিংবা প্রভুত্ব লাভ করেও চিরকাল মঙ্গলে থাকতে পারে না। দুর্বুদ্ধির দোষে মোহবশত এই অযোগ্য কষ্টকর, দুর্জনের আচরণযোগ্য কাজ করে ফেলেছি। যাতে আজ আমার জীবন-সংশয় প্রাপ্তি ঘটেছে। আমার পক্ষে আর জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়, কারণ, শত্রুকর্তৃক উদ্ধৃত হয়ে কোন চৈতন্যশালী লোক কষ্টভোগ করতে পারে? আমি অভিমানী ছিলাম; কিন্তু এখন পুরুষকারবিহীন হয়ে পড়েছি। তাই শত্রুরাও আমাকে উপহাস করেছে এবং বিক্রমশালী পাণ্ডবেরাও আমাকে অবজ্ঞার সঙ্গেই দেখেছে।”

রাজা দুর্যোধন এই চিন্তা করে দুঃশাসনকে বললেন, “ভরতনন্দন দুঃশাসন! তুমি আমার কথা শোনো। আমি তোমাকে অভিষিক্ত করছি, তুমি তা স্বীকার করো, রাজা হও এবং কর্ণ ও শকুনির সহায়তায় এই বিশাল পৃথিবী শাসন করো। ইন্দ্র যেমন দেবগণকে পালন করেন, তুমি তেমনই বিশ্বস্তভাবে ভ্রাতৃগণকে পালন করো। দেবতারা যেমন ইন্দ্রকে আশ্রয় করে জীবন ধারণ করেন, বন্ধুগণও তোমাকে আশ্রয় করে জীবন ধারণ করবেন। তুমি সর্বদাই সাবধানে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ব্যবহার করবে এবং বন্ধুগণ ও মিত্রগণের অবলম্বন হবে। আর বিষ্ণু যেমন দেবতাদের পর্যবেক্ষণ করেন, তুমি তেমনই জ্ঞাতিগণকে পর্যবেক্ষণ করবে এবং গুরুজনদের রক্ষা করবে। যাও, বন্ধুদের আনন্দিত করে ও শত্রুদের তিরস্কৃত করতে থেকে পৃথিবী শাসন করো।” এই কথা বলে দুর্যোধন দুঃশাসনের কণ্ঠ আলিঙ্গন করে বললেন, “যাও।”

দুর্যোধনের সেই কথা শুনে দুঃশাসন কাতর, বাষ্পাবরুদ্ধকণ্ঠ, অতি দুঃখিত ও কৃতাঞ্জলি হয়ে প্রণাম করে জ্যেষ্ঠভ্রাতা দুর্যোধনের পায়ের উপর মাথা রেখে গদগদভাবে বললেন, “প্রসন্ন হোন।” দুঃশাসন চোখের জলে দুর্যোধনের পা ধুইয়ে দিতে দিতে বললেন, “এ ঘটনা কখনও ঘটবে না। যদি সমগ্র পৃথিবী বিদীর্ণ হয়, আকাশ খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়, সূর্য নিজের প্রভা পরিত্যাগ করেন এবং চন্দ্রও শীতল কিরণ বর্জন করেন, যদি বায়ু দ্রুত গমন ত্যাগ করেন, হিমালয় বিচলিত হয়, সমুদ্রের জল শুকিয়ে যায় এবং যদি অগ্নি উষ্ণতা ত্যাগ করেন, তবুও আমি আপনাকে ছাড়া রাজ্য শাসন করব না। আপনি প্রসন্ন হন।” দুঃশাসন এই কথা বারবার বলতে লাগলেন।

তখন কর্ণ, দুর্যোধন ও দুঃশাসনকে অত্যন্ত ব্যথিত দেখে, নিজেও ব্যথিত হয়ে তাঁদের বললেন, “কুরুনন্দনদ্বয়, তোমরা সাধারণ লোকের মতো কেন শোকগ্রস্ত হচ্ছ। শোক কখনও শোকের নিবৃত্তি করে না। শোক করে কি শোককারীর বিপদ কাটে? ধৈর্য অবলম্বন করো, শোক করে শত্রুদের আনন্দিত কোরো না।

কৰ্ত্তব্যং হি কৃতং রাজন্‌! পাণ্ডবৈস্তব মোক্ষণম্‌।

নিত্যমেব প্রিয়ং কার্যং রাজ্ঞো বিষয়বাসিভিঃ॥ বন : ২০৮ : ৬৬ ॥

রাজা! পাণ্ডবেরা যে তোমাদের মুক্ত করে দিয়েছে, সেটা তারা কর্তব্য কার্যই করেছে। কারণ, রাজ্যবাসী লোকেদের সর্বদাই রাজার প্রিয় কার্য করা উচিত।

“বিশেষত তুমি রক্ষা করছ বলেই তারা নিরুপদ্রবে বাস করছে। এই অবস্থায় সাধারণ লোকের মতো তুমি দৈন্য প্রকাশ করতে পারো না। তুমি প্রায়োপবেশনের সংকল্প করায় তোমার ভ্রাতারা অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়েছেন। অতএব তুমি ওঠো, সহোদরদের আশ্বস্ত করো এবং চলো। তোমার মঙ্গল হবে। রাজা! আজ জীবনে প্রথম তোমার হৃদয়ের দুর্বলতা দেখলাম। সে যাই হোক, তুমি সদ্য শত্রুগণের বশীভূত হয়েছিলে; এই অবস্থায় পাণ্ডবেরা তোমাকে মুক্ত করেছে, তাতে আশ্চর্যের কী আছে? কারণ, সৈন্যব্যবসায়ী লোকেরা বা রাজ্যবাসী লোকেরা, পরিচিত অপরিচিত যাই হোক, সর্বদাই রাজার প্রিয়কার্য করবে। তারপর যুদ্ধে প্রধান প্রধান লোকেরা শত্রুর হাত থেকে সৈন্যদের রক্ষা করেন, সৈন্যরাও তাঁদের মুক্ত করে থাকে। সৈন্যব্যবসায়ীরা তো বটেই, রাজ্যবাসীরাও সর্বদা রাজার উপকারের চেষ্টা করবেন। এই যদি জগতের রীতি হয়, তবে তোমার রাজ্যে বাসকারী পাণ্ডবেরা তোমাকে মুক্ত করায় বিলাপের কারণ কী আছে? বরং রাজা তুমি যখন সৈন্য নিয়ে গন্ধর্বদের আক্রমণ করতে যাচ্ছিলে, তখন পাণ্ডবেরা যে তোমার পিছনে যায়নি, এটাই তারা ভাল করেনি। বিশেষত যখন পাণ্ডবেরা পূর্বেই তোমার দাস হয়ে আছে। আরও একটা কথা তোমাকে মনে রাখতে। হবে, তুমি আজও পাণ্ডবদের সমস্ত রত্ন ভোগ করছ, তথাপি তারা কিন্তু ধৈর্য ধরেই আছে। তারা তোমার মতো প্রায়োপবেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। অতএব রাজা ওঠো, বিলম্ব কোরো না। তুমি যদি আমার কথা না শোনো, তা হলে আমি তোমার চরণযুগলের সেবা করতে এখানেই থাকব। কারণ আমি তোমাকে ছাড়া জীবনযাপন করতে পারব না। তুমি প্রায়োপবেশনে বসে অন্য রাজাদের কাছে হাস্যাস্পদ হবে।”

কর্ণের সমস্ত বক্তব্য শুনেও দুর্যোধন সংকল্প ত্যাগ করলেন না। তখন সুবলনন্দন শকুনি তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বলতে লাগলেন, “কুরুনন্দন, কর্ণের উপযুক্ত কথা তুমি শুনেছ। আমি দ্যূতক্রীড়া করে তোমাকে বিশাল সম্পদ এনে দিয়েছি। তুমি মোহ ও নিবুর্দ্ধিতাবশত তা পরিত্যাগ করে প্রাণত্যাগ করতে চাইছ কেন? বুঝলাম, তুমি বৃদ্ধের উপদেশ গ্রহণ করনি। যে লোক উপস্থিত হর্ষ বা বিষাদকে নিরুদ্ধ করতে না পারে, সে লোক সম্পদ লাভ করেও জলে কাঁচা মাটির পাত্রের মতো বিনষ্ট হয়ে যায়। অত্যন্ত ভীরু, অত্যন্ত নিস্তেজ, দীর্ঘসূত্র, সাবধান ও অত্যন্ত বিষয়াসক্ত রাজার প্রতি প্রজাদের ভক্তি থাকে না। পাণ্ডবেরা তোমার গৌরব করেছে, তোমার আনন্দ হওয়ার কথা; পাণ্ডবেরা যে ভাল কাজটা করেছে, তুমি শোক করে সেটাকে খারাপ করে দিচ্ছ। যে বিষয়ে তোমার আনন্দ করা উচিত ও পাণ্ডবদেরও আনন্দ করা উচিত, তুমি বিপরীত ব্যবহার করে সেখানেই শোক করছ। অতএব প্রসন্ন হও, প্রাণত্যাগ কোরো না, সন্তুষ্ট হয়ে পাণ্ডবদের উপকার স্মরণ করো। তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দাও এবং যশ ও ধর্ম লাভ করো। অথবা এই কার্যের আদেশ দিয়েই তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, ভ্রাতৃসৌহার্দ্য স্থাপন করে, পৈতৃক রাজ্য পাণ্ডবদের ফিরিয়ে দাও।”

দুর্যোধন শকুনির কথা শুনে, ভ্রাতৃসৌহার্দ্যে আকুল ও পদপ্রান্তে পড়ে থাকা দুঃশাসনকে দু’হাতে তুলে ধরে আলিঙ্গন করলেন ও তার মস্তকাঘ্রাণ করলেন। আর দুর্যোধন—কর্ণ ও শকুনির কথা শুনে পরিপূর্ণ আত্মগ্লানিতে জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরাশ ও বন্ধুদের বললেন, “বন্ধুগণ, ধর্ম, ধন, সুখ, প্রভুত্ব, আদেশ বা ভোগদ্বারা আমার আর কোনও প্রয়োজন নেই; আপনারা আমার সংকল্প নষ্ট করবেন না, চলে যান। আমি প্রায়োপবেশন বিষয়েই মনস্থির করেছি; আপনারা সকলে হস্তিনায় গমন করুন; আমার গুরুজনবর্গকে গৌরবের সঙ্গে রক্ষা করবেন।” দুর্যোধন এই কথা বললে, সেই বন্ধুগণ শত্রুবিজয়ী দুর্যোধনকে বললেন, “ভরতনন্দন! আপনার যে অবস্থা, আমাদেরও সেই অবস্থাই হবে। কারণ আপনাকে ছাড়া আমরা কী করে হস্তিনায় প্রবেশ করব?” শকুনি, কর্ণ, দুঃশাসন, মন্ত্রিগণ, জ্ঞাতিগণ দুর্যোধনকে সংকল্পচ্যুত করতে পারলেন না।

রাজশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন স্বর্গলাভের ইচ্ছায় পবিত্র কুশময় কৌপীন ধারণ করে ও মৌনী হয়ে স্নানপ্রভৃতি বাইরের ক্রিয়া পরিত্যাগ করে, মনে মনে ইষ্টদেবতার পূজা করে, বিশেষ নিয়ম ধারণ করে, আচমন করে, ভূতলে কুশের আস্তরণ পেতে তার উপর উপবেশন করলেন।

ওদিকে দেবগণকর্তৃক পাতালবাসী রৌদ্রমূর্তি দৈত্য ও দানবগণ দুর্যোধনের প্রায়োপবেশনের কথা জানতে পেরে, সেটা তাদের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে বিবেচনা করে দুর্যোধনকে নিজেদের কাছে আনবার জন্য বেদোক্ত যজ্ঞ আরম্ভ করল। মন্ত্রবিশারদ যাজ্ঞিকেরা তখন বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্য নির্দেশিত এবং অথর্ববেদোক্ত মন্ত্রদ্বারা—মন্ত্র ও জপযুক্ত যে সমস্ত ক্রিয়া উপনিষদে বলা আছে, সেইসব ক্রিয়া করতে আরম্ভ করলেন। আর দৃঢ়ব্রতপরায়ণ ও বেদবেদাঙ্গ পারদর্শী ব্রাহ্মণেরা বিশেষভাবে একাগ্রচিত্তে অগ্নিতে দুগ্ধ ও হবিদ্বারা হোম করতে লাগলেন। এইভাবে সেই কার্য শেষ হলে, অত্যন্ত আশ্চর্য এক কৃত্যা (অভিচারিকী দেবতা) হাঁ করে যজ্ঞভূমিতে উত্থিত হল এবং বলল, “আমি কী করব?” তখন দৈত্য ও দানবেরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে বলল, “তুমি প্রায়োপবিষ্ট রাজা দুর্যোধনকে এখানে নিয়ে এসো।”

কৃত্যা তখনই গিয়ে দুর্যোধনকে পাতালপুরীতে দৈত্য, দানবদের কাছে এনে উপস্থিত করল। তখন দানবেরা অত্যন্ত আনন্দিত চিত্তে, উৎফুল্ল নয়নে দুর্যোধনকে বলল—

ভোঃ সুবোধন! রাজেন্দ্র! ভরতাণাং কুলোদ্বহ।।

শূরৈঃ পরিবৃতো নিত্যং তথৈব চ মহাত্মভিঃ॥

অকার্ষীঃ সাহসমিদং কস্মাৎ প্রারোপবেশনম্‌।

আত্মত্যাগী হ্যধো যাতি বাচ্যতাঞ্চাযশস্করীম্॥ বন : ২০৯ : ২৯-৩০ ॥

“হে ভরতকুলধুরন্ধর রাজশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন! আপনি সর্বদাই বীর ও মহাত্মাগণে পরিবৃত থাকেন। অতএব, আপনি কী জন্যে এই প্রায়োপবেশনরূপ সাহসের কার্য করছেন? আত্মহত্যাকারী লোকের অধোগতি ও লোকনিন্দা হয়ে থাকে।

“আপনার তুল্য বুদ্ধিমান লোকেরা কর্তব্যের বিপরীত, বহু পাপজনক এবং মূলনাশক কার্যে কখনও প্রবৃত্ত হন না। অতএব রাজা ধর্ম, অর্থ, সুখ, যশ, প্রতাপ ও শক্তির নাশকারী এবং শত্রুদের আনন্দজনক এই সংকল্প ত্যাগ করুন। আপনি যথার্থ ঘটনা শ্রবণ করুন ও নিজের স্বর্গীয়তা ও শরীরনির্মাণের বিষয় অবগত হোন, তারপর ধৈর্য ধারণ করুন। আমরা দীর্ঘকাল তপস্যা করে মহাদেবের কাছ থেকে আপনাকে লাভ করেছি। তিনি বজ্রতুল্য দৃঢ় উপকরণদ্বারা আপনার দেহের নাভির উপরের অংশ নির্মাণ করেছেন। সুতরাং ওই অংশ অস্ত্রশস্ত্রের দুর্ভেদ্য। আর দেবী পার্বতী আপনার নাভির নিম্নভাগকে পুষ্পের মতো কোমল ও রূপে স্ত্রীদের মনোহর করে সৃষ্টি করেছেন। আপনার দেহ শিব-পার্বতীর নির্মিত। সুতরাং আপনি সাধারণ লোক নন—আপনি স্বর্গীয় লোক।

“তারপর শত্রুরা স্বর্গীয় অস্ত্র জানলেও, ভগদত্ত প্রভৃতি মহাবীর ক্ষত্রিয়েরা তাঁদের সংহার করবেন। সুতরাং আপনি বিষণ্ণ হবেন না এবং আপনার কোনও ভয়ও নেই। বিশেষত দানবেরা আপনাকে সাহায্য করার জন্যই ভূতলে জন্মগ্রহণ করেছেন। তারপর, অন্য অসুরেরাও ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কৃপ প্রভৃতির দেহে প্রবেশ করবেন; তার ফলে দয়া প্রভৃতি বিসর্জন দিয়ে আপনার শত্রুগণের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। তখন তাঁরা যুদ্ধে পুত্র, ভ্রাতা, বন্ধু, শিষ্য, জ্ঞাতি, বালক ও বৃদ্ধকেও প্রহার করতে ছাড়বেন না। দানবেরা এঁদের চিত্তে অবস্থান করে বিকৃত করে দেবেন, এঁরা স্নেহ দূরে বিসর্জন দিয়ে বন্ধুদেরও প্রহার করবেন।

“পুরুষকারশালী বীরগণ আত্মশ্লাঘা করতে থেকে সর্বপ্রকার অস্ত্র-শস্ত্র নিক্ষেপ করে লোকক্ষয় করবেন। সেই মহাত্মা পঞ্চপাণ্ডবও যুদ্ধ করবেন বটে; তবে দৈবশালী মহাবীরগণ তাঁদের বধ করবেন। দৈত্যগণ ও রাক্ষসগণ গিয়ে ক্ষত্রিয়যোনিতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁরা যুদ্ধে বিক্রম প্রকাশ করে গদা, মুষল, শূল ও অন্য নানাবিধ অস্ত্র দ্বারা আপনার শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। রাজা আপনার মনে যে অর্জুন সম্পর্কে ভীতি আছে, সে বিষয়েও আমরা অৰ্জুন বধের উপায় করে রেখেছি। নিহত নরকাসুরের আত্মা গিয়ে কর্ণের দেহ আশ্রয় করে আছে। সেই আত্মাই পূর্ব শত্রুতা স্মরণ করে কৃষ্ণ ও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবে।

“বিক্রমগর্বিত, যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ ও মহারথ কর্ণই যুদ্ধে অর্জুনকে এবং আপনার সমস্ত শত্রুকে জয় করবেন। এই ঘটনা বুঝতে পেরেই দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনকে রক্ষা করার জন্য ছল করে কর্ণের কবচ ও দুটি কুণ্ডল অপহরণ করবেন। আমরাও এ বিষয়ে শত শত সহস্র সহস্র দৈত্য ও রাক্ষস নিযুক্ত করে রেখেছি, যারা সংশপ্তক নামে বিখ্যাত। এই বীর সংশপ্তকেরা অর্জুনকে বধ করবেন। অতএব আপনি শোক করবেন না। কারণ আপনি এই নিষ্কণ্টক পৃথিবী ভোগ করবেন। আপনি বিষণ্ণ হবেন না, প্রায়োপবেশন আপনার পক্ষে অত্যন্ত অনুচিত কাজ। কারণ, আপনি বিনষ্ট হলে আমাদের পক্ষটাই হীন হয়ে পড়ে। আপনি হস্তিনায় যান। অন্য কোনও প্রকার বুদ্ধি করবেন না।”

দানবদৈত্যশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ দুর্যোধনকে এই কথা বলে আলিঙ্গন করে বিদায় দিল এবং তারা আশ্বাস দিল যে, দুর্যোধন জয়লাভ করবেন এবং তারপর সেই কৃত্যাই আবার দুর্যোধনকে তাঁর প্রায়োপবেশনের স্থানে নিয়ে এল। কৃত্যা বিদায় নিলে দুর্যোধন ধারণা করলেন যে তিনি যুদ্ধে জয়লাভ করবেন। সংশপ্তকেরা এবং কর্ণ অবশ্যই অর্জুনকে বধ করতে পারবেন। এইরকম স্বপ্ন দর্শন করায় পাণ্ডবদের তিনি পরাজিত করতে পারবেন বলে দুর্যোধন মনে করলেন, নরকাসুরের আত্মা কর্ণের দেহমধ্যে প্রবেশ করায় কর্ণও অর্জুনবধে কৃতসংকল্প হলেন। রাক্ষসেরা গিয়ে সংশপ্তকদের চিত্তে আবিষ্ট হওয়ায় তারাও অৰ্জুনবধের অভিলাষী হল। আবার দানবাক্রান্ত হওয়ায় ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপও পূর্বের ন্যায় পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহশীল থাকলেন না। দুর্যোধন এই স্বপ্নবৃত্তান্ত কাউকে বললেন না। রাত্রিশেষে কর্ণ গিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে ঈষৎ হাসের সঙ্গে বললেন, “মানুষ মরে গিয়ে শত্রুজয় করতে পারে না। জীবিত থাকলেই নানাবিধ মঙ্গল দেখতে পায়। তারপর এটা তোমার মরণ বা বিষাদের সময় নয়। অতএব রাজা ওঠো। তুমি চিরকাল শত্রুদের শাসন করেছ, এখন চিন্তিত হচ্ছ কেন? আমি তোমার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি যে, তেরো বছর পূর্ণ হলে আমি পাণ্ডবদের তোমার বশে এনে দেব।” কর্ণ এই কথা বলায়, দুঃশাসন প্রভৃতি প্রণাম করায় দুর্যোধন উঠে দাঁড়ালেন এবং দুর্যোধনের আদেশে শকুনি, কর্ণ, দুঃশাসন প্রভৃতি হস্তিনায় যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন। ভূরিশ্ৰবা, সোমদত্ত, মহারাজ বাহ্লিক ও অন্য কুরুবংশীয়েরা চতুরঙ্গ সৈন্য নিয়ে দুর্যোধনের পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। অল্পকালের মধ্যেই তাঁরা সকলেই হস্তিনায় প্রবেশ করলেন।

*

দুর্যোধনের প্রায়োপবেশন মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। কৃতকর্মের জন্য বিলাপ করা দুর্যোধনের স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কর্ণের মৃত্যুর পরই কেবল দুর্যোধনকে হাহাকার করতে দেখা যায়। গন্ধর্ব চিত্রসেনের নিকট পরাজিত হওয়া ও পাণ্ডবদের দ্বারা মুক্তিলাভ করায় আত্মগ্লানি দুর্যোধনকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছিল। পাণ্ডবদের দ্বারা মুক্তিলাভ করা দেহ তিনি ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রায়োপবেশন সংকল্প সাজানো ছিল না, যথার্থ ছিল। আপন ভ্রাতা ও কুলললনাদের তিনি রক্ষা করতে পারেননি। পাণ্ডবেরা তাঁর কুল রক্ষা করে দিয়েছেন। উপহাস করতে এসে তিনি নিজেই উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন। অতএব তাঁর জীবিত থাকার অধিকার নেই।

এই অংশে দুর্যোধনের চরিত্রের আরও একটি বৈশিষ্ট্য পাঠকের সামনে ফুটে ওঠে। কৃতকর্মের ফল দুর্যোধন একাই ভোগ করেছেন। তাঁর পরামর্শদাতাদের, বিশেষত শকুনি ও কর্ণকে তিনি একটিও কটু বাক্য বলেননি। কর্ণ যুদ্ধ থেকে পালিয়েছিলেন। সে কারণেও তিনি কর্ণের নিন্দা করেননি। তাঁর আত্ম-অভিমান অত্যন্ত প্রবল ছিল। ঘটনার দায়িত্ব তাঁর। কর্ণ ইত্যাদিরা তাঁর আদেশ পালন করেন মাত্র।

মহাভারতে স্বাভাবিকভাবেই পাণ্ডবদের কথা অনেক বেশি। কৌরব অন্তঃপুরে ব্যাসদেব খুব বেশি প্রবেশ করেননি। কৌরব ভ্রাতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক খুব বেশি আলোচিত হয়নি। দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার ক্ষেত্রে বিকর্ণ জ্যেষ্ঠভ্রাতার আচরণের নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষে থেকেই প্রাণ দিয়েছিলেন। দুঃশাসন ছিলেন দুর্যোধনের সকল পাপকার্যের প্রধান সহায়। কিন্তু ‘প্রায়োপবেশন’ অংশটি পাঠ করলে বোঝা যায় দুর্যোধনের প্রতি দুঃশাসনের শ্রদ্ধা, ভক্তি, কতটা গভীর ছিল। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে তিনি পিতার মতো মনে করতেন। তাঁর অভাবের কল্পনাও দুঃশাসন করতে পারতেন না। অবশ্য, এটা দ্বাপর যুগের একটা বৈশিষ্ট্যই বলা চলে। পাণ্ডবেরা চার ভাইও যুধিষ্ঠিরকে দেবতার মতো ভক্তি করতেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির তো ভক্তির পাত্র ছিলেনই। দুর্যোধনকে ভক্তি করা সাধারণ পাঠকের পক্ষে অসম্ভব। বিষ দান করে মেরে ফেলা, পুড়িয়ে মারা—এসব ঘটনা দুর্যোধনের কাছে ছেলেখেলা ছিল। কুলস্ত্রী দ্রৌপদীকে তিনি ভোগ করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবুও কৌরব ভ্রাতারা দুর্যোধনকে শ্রদ্ধা করতেন। বনবাস যাত্রার প্রাক্কালে বিদায় ভাষণ দিতে গৃহে ধৃতরাষ্ট্র বলেছিলেন, “দুর্যোধন আপনাদের প্রতি কখনও প্রতিকূল আচরণ করেনি।” ব্রাহ্মণেরা তা স্বীকার করেছিলেন। আপন ভ্রাতা, প্রজাপুঞ্জ সম্পর্কে দুর্যোধনের আচরণ আদর্শ ছিল।

শকুনির দুর্যোধনকে হিতোপদেশ ব্যঙ্গ হিসাবেই গ্রহণ করতে হবে। কর্ণ চরিত্র অতিশয় নিন্দনীয়। আপন আচরণ সম্পর্কে তাঁর কোনও লজ্জা বোধ হয়নি। দুর্যোধনকে সান্ত্বনা দেবার মধ্যেও তাঁর নির্লজ্জ মনোভাব ফুটে উঠেছে। পরাজিত হয়েও তাঁর কোনও গ্লানি নেই, তখনও কর্ণ বড় বড় কথা বলে চলেছেন। অর্জুনবধের প্রতিজ্ঞা করছেন। পাণ্ডবেরা যে কুল রক্ষা করলেন, এ বিষয়ে কোনও প্রশংসা বাক্য নয়—এটা পাণ্ডবেরা করতে বাধ্য, তাই করেছে—এই হল কর্ণের যুক্তি।

দুর্যোধন প্রায়োপবেশন সংকল্প ত্যাগ করলেন শকুনি কিংবা কর্ণের কথায় নয়। স্বপ্নে দানব ও দৈত্যদের আশ্বাসেই। দুর্যোধনের প্রতিশোধস্পৃহা আরও বাড়ল। তাঁর জীবন রক্ষার প্রয়োজন, কারণ, পাণ্ডবদের ধ্বংস করতে হবে। পাণ্ডবদের ধ্বংস না করা পর্যন্ত দুর্যোধন মরতেও পারবেন না।

৪৬
দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞ ও কর্ণের প্রতিজ্ঞা

দ্বৈতবন থেকে পরাজিত ও হতমান দুর্যোধন হস্তিনায় প্রবেশ করলে, বিশেষত বনবাসকারী পাণ্ডবদের হাত থেকে তিনি মুক্তিলাভ করায় রাজসভায় বসেই ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, “বৎস! তুমি যখন দ্বৈতবনে যাবার ইচ্ছা করেছিলে তখনই তোমাকে বলেছিলাম, তোমার দ্বৈতবনে যাত্রা আমার অভিপ্রেত নয়। তুমি আমার কথা অগ্রাহ্য করেই সেখানে গিয়েছিলে। তারপর তোমাকে গন্ধর্বেরা বলপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়েছিল এবং ধর্মজ্ঞ পাণ্ডবেরা তোমাকে মুক্ত করে দিয়েছে। তবুও তোমার কোনও লজ্জা দেখা যাচ্ছে না। গান্ধারীনন্দন! তখন সৈন্যগণের সামনে এবং তুমি সৈন্যগণকে ডাকছিলে— এই অবস্থাতেই সূতপুত্ৰ কৰ্ণ ভীত হয়ে গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছিল। সুতরাং, তুমি নিজেই মহাত্মা পাণ্ডবদের ও দুর্মতি কর্ণের বিক্রম প্রত্যক্ষ করেছ। কর্ণ ধনুর্বেদে, বীরত্বে বা ধর্মে পাণ্ডবদের ক্ষমতার এক চতুর্থ অংশেরও অধিকারী নয়। সুতরাং আমি মনে করি, কর্ণের উপর নির্ভর করে নয়, কুরুবংশের উন্নতির জন্যই মহাত্মা পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমার সন্ধি করা উচিত।”

ভীষ্মের কথা শুনে দুর্যোধন মৃদু ব্যঙ্গের হাসি হেসে শকুনির সঙ্গে সভাস্থলের বাইরে চলে গেলেন। দুর্যোধন চলে গেলেন দেখে কর্ণ ও দুঃশাসন প্রভৃতি ধনুর্ধরগণ মহাবল দুর্যোধনের অনুগমন করলেন। তাঁরা এইভাবে চরম উপেক্ষা দেখিয়ে প্রস্থান করলে কুরুপিতামহ ভীষ্ম লজ্জায় আকুল হয়ে আপন ভবনে প্রস্থান করলেন।

ভীষ্ম চলে গেলে দুর্যোধন আবার রাজসভায় ফিরে এলেন এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে মন্ত্রণা আরম্ভ করলেন। “বর্তমান সময়ে কোন কার্য আমাদের পক্ষে ভাল হয়, কোন কার্য অবশিষ্ট আছে এবং আমার যাতে হিত হবে, সেই কার্য কীভাবে সম্পাদিত হবে, সেই সব বিষয়ে এখন আমরা আলোচনা করব।”

কর্ণ বললেন, “হে কুরুকুলশ্রেষ্ঠ! অরিন্দম দুর্যোধন। আমার কথা শোনো এবং আমার কথা অনুযায়ী কাজ করলে তোমার মঙ্গল হবে। তোমার রাজ্য এখন নিষ্কণ্টক; সুতরাং ইন্দ্রের মতো উদারচিত্তে রাজ্য পালন করতে থাকো।”

কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, “পুরুষশ্রেষ্ঠ! তুমি যার সহায় এবং যার প্রতি অনুরক্ত আছ, তার পক্ষে কোনও কিছুই দুর্লভ নয়। তুমি আমার হিতসাধনে সর্বদাই উদ্‌যোগী আছ। সে যাই হোক, আমার অভিপ্রায় তুমি শ্রবণ করো। কর্ণ! যুধিষ্ঠিরের মহাযজ্ঞ রাজসূয় দেখে আমারও তা করবার ইচ্ছা হয়েছে। সুতরাং তা তুমি সম্পন্ন করো।” দুর্যোধনের কথা শুনে কর্ণ বললেন—

তবাদ্য পৃথিবী বীর! নিঃসপত্না নৃপোত্তম।

তাং পালয় যথা শক্রো হতশত্রুর্মহামনাঃ॥ বন : ২১০ : ১৬ ॥

“রাজশ্রেষ্ঠ! এখন সকল রাজাই তোমার বশীভূত আছেন। ইন্দ্র যেমন শত্ৰু পরাজিত হলে দেবতাদের পালন করেছিলেন, তুমি তেমনই করো।” ব্রাহ্মণদের আহ্বান করো এবং যথাবিধানে সেই যজ্ঞের সামগ্রী ও উপকরণ সংগ্রহ করো। বেদপারদর্শী যথোক্ত পুরোহিতেরা আহূত হয়ে শাস্ত্র অনুসারে তোমার কার্য করতে থাকুন। তোমার মহাযজ্ঞ প্রচুর খাদ্যোপযুক্ত ও মহাড়ম্বরপূর্ণ হয়ে উঠুক।”

দুর্যোধন পুরোহিতকে ডেকে এনে বললেন, “আর্য! আপনি আমার জন্য যথানিয়মে এবং যথাক্রমে যজ্ঞশ্রেষ্ঠ রাজসূয় অনুষ্ঠান করুন। সেই যজ্ঞে যাজ্ঞিকেরা প্রচুর দক্ষিণা পাবেন।”

পুরোহিত দুর্যোধনের কথা শুনে বললেন, “রাজশ্রেষ্ঠ! যুধিষ্ঠির জীবিত থাকতে আপনার বংশের আর কেউ রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারবেন না। বিশেষত আপনার পিতা রাজা ধৃতরাষ্ট্র জীবিত আছেন এবং তিনি দীর্ঘায়ু। সে জন্যও আপনার পক্ষে এ যজ্ঞ করা বিরুদ্ধ। তবে রাজসূয় যজ্ঞ্যের তুল্য আর একটি মহাযজ্ঞ আছে। আপনি সেই যজ্ঞ করুন এবং আমার কথা শুনুন। আপনার অধীনে যে সকল করদ-রাজা আছেন, তারা কর দান করুন। স্বর্ণনির্মিত বস্তু ও মূল স্বর্ণ দান করুন। আপনার লোক সেই স্বর্ণদ্বারা একখানা লাঙ্গল নির্মাণ করুক এবং সেই লাঙ্গলদ্বারা আপনার যজ্ঞবাটির ভূমি কর্ষণ করুক। সেই স্থানে যথানিয়মে সর্বাঙ্গসম্পন্ন যজ্ঞ আরম্ভ হোক, তাতে প্রচুর অর্থ লাগবে এবং কোনওদিকে ব্যয়সংকোচ করা চলবে না। এই যজ্ঞের নাম ‘বৈষ্ণবযজ্ঞ’ এবং এ যজ্ঞ কেবলমাত্র সৎপুরুষেরাই করতে পারেন। বিশেষত পূর্বে এ যজ্ঞ বিষ্ণু ব্যতীত আর কেউ করেননি, এই মহাযজ্ঞ, যজ্ঞশ্রেষ্ঠ রাজসূয়ের সঙ্গে স্পর্ধা করে, অর্থাৎ রাজসূয়যজ্ঞ ও বৈষ্ণবযজ্ঞ সমান ফলদায়ক। আমরা এই মহাযজ্ঞ করতে চাই, এতে আপনার মঙ্গল হবে এবং যজ্ঞঃ যদি নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হয়, তবে আপনার সকল অভিলাষ পূরণ হবে।”

ব্রাহ্মণেরা এই পরামর্শ দিলে, দুর্যোধন, কর্ণ-শকুনি-দুঃশাসনের সঙ্গে সমস্ত বিষয় আলোচনা করলেন। তারাও এই যজ্ঞের বিষয় সহমত হল। দুর্যোধন যথাক্রমে কার্য করতে ভৃত্যদের আদেশ দিলেন। শিল্পীরা রাজার আদেশে লাঙ্গলও নির্মাণ করলেন, আর যথাক্রমে অন্য সকল কার্যও করলেন। তারপর শিল্পীরা সকলে গিয়ে দুর্যোধনের কাছে জানাল, সমস্ত কার্যই সুসম্পন্ন হয়েছে। তখন মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর গিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “ভরতনন্দন রাজা! বৈষ্ণব নামক মহাযজ্ঞের সমস্ত আয়োজন হয়েছে এবং তা আরম্ভ করার সময়ও হয়েছে, আর মহামূল্য স্বর্ণলাঙ্গলও প্রস্তুত হয়েছে।” এই কথা শুনে রাজশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র সেই মহাযজ্ঞ শুরু করার আদেশ দিলেন।

তারপর সেই সর্বাঙ্গসুন্দর মহাযজ্ঞ আরম্ভ হল; দুর্যোধনও যথাবিধানে ও যথাক্রমে দীক্ষিত হলেন; ক্ৰমে প্রচুর অর্থ ব্যয় হতে লাগল। তখন আনন্দিত চিত্ত ধৃতরাষ্ট্র, মহাযশা বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ ও যশস্বিনী গান্ধারী দেবী রাজগণ ও ব্রাহ্মণগণকে নিমন্ত্রণ করার জন্য দ্রুতগামী দূত প্রেরণ করলেন। সেই দূতগণ দ্রুতগামী বাহনে চড়ে উপদেশানুযায়ী প্রস্থান করল। একজন বিশেষ দূতকে প্রস্থানকালে দুঃশাসন বললেন, “দূত! দ্রুত দ্বৈতবনে গমন করো এবং পাপিষ্ঠ পাণ্ডবগণকে ও সেখানকার ব্রাহ্মণগণকে যথানিয়মে নিমন্ত্রণ করো।” তারপর সেই দূত দ্বৈতবনে গিয়ে পাণ্ডবদের সকলকে প্রণাম করে বলল, “মহারাজ! রাজশ্রেষ্ঠ ও কৌরবপ্রধান দুর্যোধন আপন বাহুবল অর্জিত ধনরাশি লাভ করে যজ্ঞ করছেন। নানাস্থানের রাজপুত্র ও ব্রাহ্মণেরা সেখানে যাচ্ছেন। মহাত্মা কুরুরাজ দুর্যোধন আপনাদের নিমন্ত্রণ করতে আমাকে পাঠিয়েছেন। অতএব আপনারা গিয়ে দুর্যোধনের অভিলষিত সেই যজ্ঞ দর্শন করবেন।”

রাজা যুধিষ্ঠির দূতের সেই কথা শুনে বললেন, “পূর্বপুরুষদের কীর্তিবর্ধক রাজশ্রেষ্ঠ রাজা দুর্যোধন ভাগ্যবশত প্রধান যজ্ঞ করছেন। আমরাও সেখানে নিশ্চয়ই যাব কিন্তু কোনও মতেই এখন যাব না। কেন না, তেরো বছর আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।”

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে ভীম বললেন, “তেরো বছর পরে রাজা যুধিষ্ঠির যখন যুদ্ধযজ্ঞে অস্ত্র-শস্ত্র প্রজ্বলিত অগ্নিতে সেই দুর্যোধনকে নিক্ষেপ করবেন, তখনই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যাবেন। আর, ধার্তরাষ্ট্ররূপ কাষ্ঠ সকল অস্ত্রশস্ত্ররূপ অগ্নি দ্বারা দগ্ধ হতে থাকলে, পাণ্ডবেরা যখন ক্রোধরূপ হবি নিক্ষেপ করতে পারবেন তখন আমি যাব। দূত! এই কথাগুলি তুমি সেই দুর্যোধনকে বোলো।” অবশিষ্ট পাণ্ডবেরা কোনও অপ্রিয় কথা বললেন না; দূতও গিয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত দুর্যোধনকে জানাল।

নানা স্থানের অধিপতি রাজারা ও মহাত্মা ব্রাহ্মণেরা দুর্যোধনের যজ্ঞস্থানে আগমন করলেন। তখন দান-মান দ্বারা শাস্ত্র অনুসারে যথাবিধানে এবং যথাক্রমে গৌরবান্বিত রাজারা পরম আনন্দিত ও প্রসন্ন হলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্রও পরমানন্দিত ও সকল কৌরব পরিবেষ্টিত হয়ে বিদুরকে বললেন, “বিদুর! যজ্ঞভবনের সকল লোক যাতে অন্ন লাভ করে সুখী ও সন্তুষ্ট হয়, তা তুমি দেখো!” বিদুর সেই কথা শুনে তারতম্য অনুসারে সকল বর্ণেরই সম্মান করলেন। আগন্তুক ব্যক্তিমাত্রকেই চর্ব্য, পেয়, অন্ন, জল, সুগন্ধি মাল্য ও নানাবিধ বস্ত্র দান করলেন। এদিকে বীর ও রাজশ্রেষ্ঠ দুর্যোধন নগরের বাইরে যথাবিধানে ও যথাক্রমে বাসভবন সমূহ নির্মাণ করে এবং নানাবিধ ধনধান দান করে মধুর বাক্য বলে আগত ব্রাহ্মণ ও রাজাদের বিদায় করলেন। এইভাবে সকল রাজাকে বিদায় দিয়ে ভ্রাতৃগণে পরিবেষ্টিত হয়ে কর্ণ ও শকুনির সঙ্গে দুর্যোধন হস্তিনাপুর প্রবেশ করলেন।

দুর্যোধন হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলে স্তুতিপাঠকেরা ও অন্যসকল লোক তাঁর স্তব করতে লাগল। সেখানকার লোকেরা লাজ (খই) ও চন্দনচূর্ণ নিক্ষেপ করে বলতে লাগল, “রাজা। ভাগ্যবশত আপনার এই যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হয়েছে।”

বায়ুরোগগ্রস্ত কিছু লোক বলল, “আপনার এ যজ্ঞ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞের সমান হয়নি।”

কিছু লোক বলল, “এ যজ্ঞ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞের ষোলো ভাগের এক ভাগের সমানও হয়নি।”

তখন বন্ধুবর্গ বলল, “এ যজ্ঞ সকল যজ্ঞকে অতিক্রম করেছে। কারণ, যযাতি, নহুষ, মান্ধাতা ও ভরত এই যজ্ঞ করেই পবিত্র হয়ে স্বর্গে গিয়েছেন।” তখন দুর্যোধন রাজধানীতে আনন্দিত চিত্তে আপন গৃহে প্রবেশ করলেন। তারপর দুর্যোধন— মাতা, পিতা, ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কৃপ প্রভৃতির এবং জ্ঞানী বিদুরের চরণযুগলে প্রণাম করলেন; তারপরে কনিষ্ঠ ভ্রাতারাও তাঁকে প্রণাম করলেন। দুর্যোধন উত্তম আসনে উপবেশন করলে কর্ণ গাত্রোত্থান করে দুর্যোধনকে বললেন, “ভরতশ্রেষ্ঠ, ভাগ্যবশত তোমার এই যজ্ঞ শেষ হল। পাণ্ডবেরা নিহত হলে এবং তুমি রাজসূয় যজ্ঞ করলে, আমি তোমাকে আবার অভিনন্দন জানাব।” কর্ণ আরও বললেন, “রাজশ্রেষ্ঠ আমার কথা শ্রবণ করো— যে পর্যন্ত অর্জুন নিহত না হবে, সে পর্যন্ত আমি অন্য লোক দ্বারা পাদ-প্রক্ষালন করাব না এবং মাংস খাব না, সর্ববিধ মদ্যপান বর্জন করব, আর যে-কোনও ব্যক্তিই কোনও প্রার্থনা করুক না, আমি ‘নাই’ একথা বলব না।”

কর্ণ অর্জুনবধের প্রতিজ্ঞা করলে মহাধনুর্ধর ও মহারথ কৌরবগণ মহা কোলাহল করে উঠল এবং তাদের মনে হল, পাণ্ডবেরা পরাজিত ও নিহত হয়েছে। দুর্যোধন পরম শান্তিতে আপন গৃহে প্রবেশ করলেন।

ওদিকে দূতমুখে যুধিষ্ঠিরের কানে কর্ণের প্রতিজ্ঞা পৌঁছল। কর্ণের অভেদ্য কবচ ও কুণ্ডলের কথা চিন্তা করে যুধিষ্ঠির সামান্য উদ্বিগ্ন হলেন। ইতোমধ্যে একদিন দ্বৈতবনের মৃগেরা যুধিষ্ঠিরের কাছে প্রার্থনা করলেন যে, তাঁদের প্রত্যহ মাংসাহারের ফলে মৃগের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের, ভার্যা ও অনুচরবর্গের সঙ্গে দ্বৈতবন ত্যাগ করলেন।

*

দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞ মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। এই মুহূর্তেই কর্ণ প্রতিজ্ঞা করলে—

তমব্রবীত্তদা কর্ণঃ শৃণু মে রাজকুঞ্জর!

পাদৌ ন ধাবয়ে তাবদ্‌যাবন্ন নিহতোহর্জনঃ

কীলালজং ন খাদেয়ং চরিষ্যে চাসুরব্রতম্‌।

নাস্তীতি নৈব বক্ষ্যামি যাচিতো যেন কেনচিৎ॥ বন : ২১২ : ১৫-১৬ ॥

এই প্রতিজ্ঞাই কর্ণের জীবনের কাল হয়ে দেখা দিল। “অর্জুন না মারা যাওয়া পর্যন্ত আমি অন্য লোক দিয়ে পা ধোওয়াব না, মাংস খাব না, মদ্যপান বর্জন করব”—প্রতিজ্ঞার এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু নাস্তীতি নৈব বক্ষ্যামি যাচিতো যেন কেনচিৎ— অর্থাৎ “প্রার্থীজনের কোনও প্রার্থনায় না বলব না”— এই ঘোষণা করে দিয়েই কর্ণ পিতৃদত্ত কবচ ও কুণ্ডল খোওয়ানোর সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন। এই প্রতিজ্ঞা অর্জুনের পিতা দেবরাজ ইন্দ্রও শুনলেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা করা। ইন্দ্র এসে যথাসময়ে কবচ ও কুণ্ডল প্রার্থনা করবেন এবং কর্ণও আর অভেদ্য থাকবেন না।

কিন্তু এত বড় প্রতিজ্ঞা কর্ণ করলেন কেন? মনে হয়, গন্ধর্ব চিত্ৰসেন কর্তৃক দুর্যোধন, কৌরব ভ্রাতা ও কুরুললনাদের বন্দিত্বের কিছু দায় তাঁরও ছিল, একথা কর্ণ মনে মনে জানতেন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ীই দুর্যোধন দ্বৈতবনে গিয়েছিলেন। অথচ কর্ণ দুর্যোধনকে যুদ্ধক্ষেত্রে রেখে পালিয়েছিলেন। অর্জুন গিয়ে তাঁকে মুক্ত করে আনেন। অবশ্যই যুধিষ্ঠিরের আদেশে। অর্জুনকে পরাজিত করতে না পারলে কর্ণ দুর্যোধনের আস্থা পুরোপুরি লাভ করতে পারবেন না। তাই তাঁর এই শপথ। কিন্তু জীবনের মূল্যে যে এই শপথ তাঁকে শোধ করতে হবে, তা কর্ণ বুঝবেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঠিক পূর্বে। যখন তিনি আক্ষরিক অর্থেই রিক্ত হয়ে যাবেন। পিতৃদত্ত কবচ ও কুণ্ডল তিনি রাখতে পারবেন না। ঠিক তেমনই দেবরাজ ইন্দ্র প্রদত্ত একাঘ্নী শক্তিও তিনি যথাস্থানে প্রয়োগের জন্য রাখতে পারবেন না। নিয়তি তাঁকে নিশ্চিত পতনের দিকে নিয়ে যাবে। সেই পতনের পিছনে আছে গুরুর কাছে অসত্যভাষণ এবং ব্রাহ্মণের অভিশাপ।

৪৭
দুর্বাসার পারণ

পাণ্ডবেরা তখন কাম্যকবনে থেকে মুনিদের সঙ্গে নানাবিধ আলাপে আনন্দমগ্ন থাকতেন। আহারের অভাব তাঁদের ছিল না। যুধিষ্ঠির সূর্যের অষ্টোত্তর শত নাম তপস্যা করলে প্রীত সূর্যদেব এক অক্ষয় তাম্রস্থালী প্রদান করেছিলেন। সেই তাম্ৰস্থালীর খাদ্য দ্রৌপদীর আহার না হওয়া পর্যন্ত অক্ষয় থাকত। যারা অন্নের জন্য আসত, তাদের এবং ব্রাহ্মণদের সূর্যদত্ত অক্ষয় অন্ন দ্বারা ও নানাবিধ বন্য পশুর মাংস দ্বারা পরিতৃপ্ত করতেন, ফলে পাণ্ডবদের দিন মুনিঋষিদের সংস্পর্শে অত্যন্ত সুখেই কাটছিল।

এদিকে হস্তিনাপুরে দুষ্ট চতুষ্টয় সর্বদাই পাণ্ডবদের অনিষ্ট করার বিষয় বিশেষ সক্রিয়ভাবে চিন্তা করছিলেন। একদিন দুর্যোধন, শকুনি, কর্ণ ও দুঃশাসন মনোযোগ সহকারে এই বিষয়ে আলোচনা করছিলেন, তখন ধর্মাত্মা, তপস্বী ও অত্যন্ত যশস্বী দুর্বাসামুনি অযুত শিষ্য নিয়ে দুর্যোধন ভবনে আগমন করলেন। সুন্দরমূর্তি দুর্যোধন সেই অত্যন্ত ক্রোধী মুনিকে আগত দেখে ভ্রাতৃগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে, অভিমান ত্যাগ করে, প্রণয়ের সঙ্গে বিনীতভাবে আতিথ্যের জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন। তিনি নিজে ভৃত্যের মতো থেকে যথাবিধানে দুর্বাসার পূজা করলেন। মুনিশ্রেষ্ঠ দুর্বাসাও সেখানে কয়েকদিন কাটালেন। রাজা দুর্যোধন তখন আলস্য পরিত্যাগ করে দিবারাত্র তাঁর পরিচর্যা করতে লাগলেন। “রাজা! আমার ক্ষুধার উদ্রেক করেছে, দ্রুত খেতে দাও।” এই বলে দুর্বাসা স্নান করতে যেতেন, অথচ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে বলতেন, “আজ আমার খিদে নেই; সুতরাং খাব না।”— এই কথা বলেই চলে যেতেন, আবার হঠাৎই এসে বলতেন, “এক্ষুনি আমাকে খেতে দাও।” কোনও কোনও দিন রাত্রি দুটোর সময় খেতে চাইতেন, কিন্তু খেতেন না অথচ তিরস্কার করতেন।

দুর্বাসা এই রকম আচরণ করতে থাকলেও যখন রাজা দুর্যোধন বিরক্ত বা ক্রুদ্ধ হলেন না তখন দুর্ধর্ষ দুর্বাসা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “ভরতনন্দন! আমি তোমাকে বরদান করব। দুর্যোধন তোমার মঙ্গল হোক, যা তোমার মনে আছে, সেই বরণ গ্রহণ করো। আমি সন্তুষ্ট হয়েছি বলে যা ধর্মসঙ্গত, তা তোমার সবই প্রাপ্য।” দুর্যোধনের মনে হল তাঁর যেন পুনর্জন্ম হয়েছে। তিনি পূর্বেই শকুনি প্রভৃতির সঙ্গে আলোচনা করে রেখেছিলেন যে, দুর্বাসা সন্তুষ্ট হলে কী বর প্রার্থনা করবেন। সুতরাং তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে এই বর প্রার্থনা করলেন, “ব্রাহ্মণ! আপনি যেমন শিষ্যগণের সঙ্গে আমার অতিথি হয়েছেন, তেমনই শিষ্যগণের সঙ্গে আপনি মহারাজ যুধিষ্ঠিরেরও অতিথি হবেন। কারণ তিনি আমাদের বংশে জ্যেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ, ধার্মিক, গুণবান ও সচ্চরিত্র; এখন তিনি ভ্রাতৃগণের সঙ্গে কাম্যকবনে বাস করছেন। আর, আমার উপর অনুগ্রহ হয়ে যদি থাকে, তবে রাজপুত্রী, কোমলাঙ্গী, যশস্বিনী ও বরবর্ণিনী দ্রৌপদী যখন সমস্ত ব্রাহ্মণ ও পতিগণের ভোজনের পর নিজে ভোজন করে বিশ্রাম করবার জন্য সুখে উপবেশন করবেন, তখন আপনি সেখানে যাবেন।” “তোমার উপর সন্তোষবশত তাই করব” এই কথা দুর্যোধনকে বলে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ দুর্বাসা শিষ্যগণের সঙ্গে চলে গেলেন। দুর্যোধন তখন অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে কর্ণের করমর্দন করলেন। তিনি মনে করলেন, তিনি কৃতার্থ হয়েছেন। কর্ণ তখন কৌরব ভ্রাতাদের বললেন, “ভাগ্যবশত। আমাদের অভিলাষ পূর্ণ হল। ভাগ্যবশত দুর্যোধনের শ্রীবৃদ্ধি হল এবং ভাগ্যবশত তোমাদের শত্রুগণ দুস্তর বিপদ সাগরে মগ্ন হল। কারণ, পাণ্ডবেরা দুর্বাসার কোপানলে পতিত হল এবং তারা নিজেদের পাপেই দুস্তর অন্ধকারে মগ্ন হল।” কৌরবেরা আনন্দের সঙ্গে নিজ নিজ গৃহে প্রবেশ করল।

তারপর কোনও এক সময়ে পাণ্ডবগণ ভোজন করে সুখে উপবেশন করে আছেন। দ্রৌপদীও ভোজনান্তে বিশ্রাম গ্রহণ করছেন— এই জেনে দুর্বাসা মুনি দশ হাজার শিষ্য নিয়ে সেই বনে এলেন। সদাচারপর ও মনোহর মূর্তি রাজা যুধিষ্ঠির সেই অতিথিকে আসতে দেখে ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি দুর্বাসামুনিকে উত্তম আসনে বসিয়ে, যথাবিধানে তাঁর পূজা করে, তাঁর প্রতি কৃতাঞ্জলি হয়ে, অতিথি হবার জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন এবং বললেন, “ভগবন্‌! আপনারা আহ্নিক করে সত্বর আগমন করুন”। “যুধিষ্ঠির এখন আমাকে ও শিষ্যদের কী ভোজন করাবেন” এই চিন্তা না করেই দুর্বাসামুনি শিষ্যদের সঙ্গে স্নান করতে গেলেন এবং গিয়ে একাগ্রচিত্তে জলে নিমগ্ন হলেন। এই সময়ে নারীশ্রেষ্ঠা ও পতিব্রতা দ্রৌপদী অন্নের জন্য গুরুতর চিন্তায় আকুল হয়ে পড়লেন। চিন্তা করেও অন্ন সংগ্রহের কোনও উপায় না দেখে, মনে মনে কংসারি কৃষ্ণের চিন্তা করতে লাগলেন—

কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! মহাবাহো! দেবকীনন্দনাব্যয়।
বাসুদেব! জগন্নাথ! প্রণতাৰ্ত্তিবিনাশন॥
বিশ্বাত্মন! বিশ্বজনক! বিশ্বহর্ত্তঃ! প্রভোহব্যয়।
প্রপন্নপাল! গোপাল! প্রজাপাল! পরাৎপর!॥ বন : ২১৮ : ৭-৮ ॥

“কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! মহাবাহু! দেবকীনন্দন! অবিনশ্বর! বাসুদেব! জগন্নাথ! প্রণত লোকের পীড়ানাশক! বিশ্বাত্মা! বিশ্বজনক! প্রভু! অচল! বিপন্নরক্ষক! গোপাল! প্রজারক্ষক! পরাৎপর! আকৃতি ও চিত্তি নামক চিত্তবৃত্তির প্রবর্তক! আমি তোমার উদ্দেশে নমস্কার করছি। আমরা নিরুপায় হয়ে পড়েছি; অতএব হে বরেণ্য! হে বরদ! হে অনন্ত! তুমি আমাদের উপায় হও। তুমি পুরাণপুরুষ! প্রাণ! মনোবৃত্তি প্রভৃতির অগোচর। সর্বাধ্যক্ষ! শ্রেষ্ঠাধ্যক্ষ! আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম। কৃপা করে আমাকে রক্ষা করো। তুমি জগতের আদি ও অন্ত, তুমি পরম আশ্রয়। তুমি শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর জ্যোতি, তুমি জগতের আত্মা এবং তোমার মুখ সকল দিকেই রয়েছে। তুমি রক্ষা করলে কোনও বিপদের ভয় থাকে না। কৃষ্ণ! কৌরবসভায় দুঃশাসনের লাঞ্ছনা থেকে তোমারই ইঙ্গিতে ধর্মদেব আমাকে রক্ষা করেছিলেন। এই মহাবিপদ থেকে তুমি আমাকে রক্ষা করো।”

দ্রৌপদীর এই স্তব, ভক্তবৎসল, জগৎপতি কৃষ্ণের কানে পৌঁছল। তিনি তখন শয্যায় পার্শ্ববর্তিনী রুক্মিণীকে পরিত্যাগ করে সেই স্থানে আগমন করলেন। কারণ, প্রভাবশালী ও জগদীশ্বর কৃষ্ণের গতি অচিন্তনীয়। দ্রৌপদী কৃষ্ণকে আসতে দেখে প্রণাম করে পরম আনন্দে দুর্বাসামুনির আগমনাদির কথা বললেন। কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বললেন, “কৃষ্ণা আমি ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর। সুতরাং তুমি আমাকে সত্বর ভোজন করাও, পরে অন্য সকল করবে।” কৃষ্ণের কথা শুনে দ্রৌপদী লজ্জিত হয়ে বললেন, “সূর্যদত্ত স্থালীতে আমার ভোজন পর্যন্তই অন্ন থাকে। কিন্তু দেব! আমি ভোজন করেছি; অতএব অন্ন আর নাই।” তখন কমলনয়ন ভগবান কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বললেন, “দ্রৌপদী আমি ক্ষুধায় ও পরিশ্রমে অত্যন্ত পীড়িত; সুতরাং এটা পরিহাসের সময় নয়; অতএব সত্বর যাও, স্থালীটা এনে আমাকে দেখাও।”

যদুকুলশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ বিশেষ আগ্রহ করে স্থালী আনিয়ে তার এককোণে শাকান্ন দেখে তাই ভোজন করে দ্রৌপদীকে বললেন, “আমার এই ভোজন দ্বারাই যজ্ঞভোজী, জগদীশ্বর ও বিশ্বাত্মা নারায়ণদেব তৃপ্ত ও তুষ্ট হোন।” তারপর, জগতের ক্লেশনাশক মহাবাহু কৃষ্ণ সহদেবকে বললেন, “সহদেব! ভোজন করার জন্য এক্ষুনি মুনিগণকে আহ্বান করো।” মহাযশা সহদেব ভোজন করবার জন্য, মুনিগণকে আহ্বান করতে দ্রুত নদীর দিকে যাত্রা করলেন। ওদিকে দুর্বাসা প্রভৃতি মুনিরা তখন স্নান করবার জন্য দেবনদীতে গিয়ে জলে নেমে অঘমসৃণসূক্ত জপ করছিলেন। হঠাৎ সেই স্নানরত অবস্থায় তাঁদের কণ্ঠ পর্যন্ত ঢেকুর উঠতে লাগল। পরম তৃপ্তিযুক্ত অন্নরসের উদ্‌গার দেহ-মধ্য হতে দেখে, জল থেকে উপরে উঠে গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে পরস্পরের মুখ দেখতে লাগলেন। তখন সেই ঋষিরা সকলে দুর্বাসাকে দেখে বললেন, “মহর্ষি! আমরা রাজা দ্বারা অন্ন প্রস্তুত করিয়ে স্নান করতে এসেছিলাম। এখন বোধ হচ্ছে— যেন ভোজন করায় কণ্ঠ পর্যন্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং আমরা এখন ভোজনই বা কী করব, অনর্থক পাক করিয়েছি, সে বিষয়েই বা কী করব।” দুর্বাসা বললেন, “অনর্থক রন্ধন করিয়েছি বলে আমরা রাজর্ষি যুধিষ্ঠিরের কাছে গুরুতর অপরাধ করেছি; অতএব পাণ্ডবেরা যেন ক্রূর দৃষ্টিতে আমাদের দগ্ধ না করেন। রাজর্ষি ও জ্ঞানী অম্বরীষরাজার প্রভাব স্মরণ করে আমি হরির চরণাশ্রিত ব্যক্তিদের অত্যন্ত ভয় পাই। পাণ্ডবেরা সকলেই মহাত্মা, ধার্মিক, বীর, কৃতবিদ্য, ব্রতী, তপস্বী, সদাচারনিরত এবং সর্বদা কৃষ্ণপরায়ণ। অগ্নি যেমন তুলারাশি দগ্ধ করেন, তেমনই পাণ্ডবেরা আমাদের দগ্ধ করতে পারেন, অতএব শিষ্যগণ এদের দেখা না দিয়ে যে যেখানে পার পলায়ন করো।”

গুরু দুর্বাসা মুনি একথা বললে, সেই ব্রাহ্মণেরা সকলেই পাণ্ডবগণ সম্বন্ধে অত্যন্ত ভীত হয়ে তখনই দশ দিকে পালিয়ে গেলেন। ওদিকে সহদেব সেই দেবনদীতে এসে মুনিগণকে না দেখে, ঘাট এবং তীরবর্তী আশ্রমগুলিতে তাঁদের অন্বেষণ করতে থাকলেন। আশ্রমগুলির তপস্বীরা সহদেবকে বললেন, “তাঁরা চলে গিয়েছেন।” তপস্বীদের মুখে এই কথা শুনে সহদেব রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে সেই সংবাদ দিলেন। তখন সংযতচিত্ত পাণ্ডবেরা সকলেই সেই মুনিগণের প্রত্যাগমনের আশা করে কিছুকাল অপেক্ষা করলেন। “হয়তো, দুর্বাসামুনি গভীর রাত্রে হঠাৎ এসে আমাদের প্রতারিত করবেন; অতএব এই দৈবঘটিত বিপদ থেকে আমরা কীভাবে উদ্ধার পাব।” এই চিন্তায় আকুল পাণ্ডবেরা বারবার নিশ্বাস ত্যাগ করছেন, একথা জেনে কৃষ্ণ এসে তাঁদের বললেন, “পাণ্ডবগণ, অত্যন্ত কোপনস্বভাব দুর্বাসার কাছ থেকে আপনাদের বিপদ উপস্থিত হয়েছে, এই জেনে দ্রৌপদী আমাকে স্মরণ করেছিলেন, তাই আমি দ্রুত এখানে এসেছি। এখন সেই দুর্বাসা থেকে আপনাদের কোনও ভয় নেই। কারণ, তিনি আপনাদের প্রভাবে ভীত হয়ে আগেই পালিয়ে গিয়েছেন। যাঁরা সর্বদা ধর্ম অনুষ্ঠান করেন, তাঁরা কখনও বিপন্ন হন না। সে যাই হোক, আমি আপনাদের অনুমতি চাইছি, আমি যাব; আপনারা প্রতিমুহূর্তে মঙ্গলে থাকুন।” কৃষ্ণের কথা শুনে পাণ্ডবেরা সুস্থচিত্ত হলেন এবং নিরুদ্বেগে কৃষ্ণকে বললেন—“প্রভু! গোবিন্দ!

ত্বয়া নাথেন গোবিন্দ! দুস্তরামাপদং বিভো।
তীর্ণাঃ প্লবমিবাসাদ্য মজ্জমানা মহার্ণবে॥ বন: ২১৮: ৪৪ ॥

“মহাসমুদ্রে মজ্জমান লোক যেমন ভেলা পেয়ে উত্তীর্ণ হয়, সেইরূপ আমরা তোমাকে রক্ষক পেয়ে দুষ্কর বিপদ থেকে উত্তীর্ণ হলাম।”

“আশীর্বাদ করি— তোমার মঙ্গল হোক, তুমি যেতে পারো।” যুধিষ্ঠির এই আদেশ দিলে কৃষ্ণ দ্বারকানগরীর দিকে যাত্রা করলেন। পাণ্ডবেরাও দ্রৌপদীর সঙ্গে আনন্দিত চিত্তে এক বন থেকে অন্য বনে বিচরণ করতে থেকে কাম্যকবনে বাস করতে লাগলেন। দুর্যোধন বনবাসী পাণ্ডবদের ক্ষতি করতে বহুবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর একটিও চেষ্টা ফলবতী হয়নি।

*

‘দুর্বাসার পারণ’ মহাভারতের এক উজ্জ্বল দুর্লভ মুহূর্ত। প্রথমত দুর্যোধন ইত্যাদি দুষ্ট চতুষ্টয়ের চরিত্র উদ্‌ঘাটনে ঘটনাটি আমাদের সাহায্য করে। জন্মমুহূর্ত থেকে দুর্যোধনের জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল পাণ্ডবদের ক্ষতি করা, তাঁদের বিপন্ন করা, বিপদগ্রস্ত করা। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কপট পাশা খেলে পাণ্ডবদের বনে পাঠিয়েও দুর্যোধনের ক্রোধ ঈর্ষা শেষ হয়নি— বনবাসী অবস্থাতেও তিনি পাণ্ডবদের ক্ষতি করতে চেয়েছেন। গো-গণনা ছলে পাণ্ডবদের ব্যঙ্গ করতে গিয়ে গন্ধর্ব চিত্রসেনের হাতে বন্দি হয়েছেন দুর্যোধন। তাঁর সর্বাপেক্ষা বড় পরামর্শদাতা কর্ণ পালিয়ে বেঁচেছিলেন। এবারও দুর্যোধনের প্রার্থনা পরাজিত হল, পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন তাঁর প্রার্থনাপূরণের বরদাতা— মহামুনি দুর্বাসা।

মুনি ঋষি হলে তিনি শক্তিমান ক্ষমতাবান হতে পারেন কিন্তু সর্বক্ষেত্রে শ্রদ্ধেয় হন না। দুর্বাসার চরিত্র আমাদের এই সত্য শিক্ষা দেয়। দুর্যোধনের প্রার্থনা শুনেই দুর্বাসা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই প্রার্থনায় পাণ্ডবেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, বিপন্ন হবেন। তা সত্ত্বেও তিনি এই প্রার্থনা পূরণ করতে এসেছিলেন। ক্ষমতার দম্ভে দুর্বাসা স্বাভাবিক ছিলেন না। তপস্যাকারী শ্রেষ্ঠ মুনি হয়েও তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন পাণ্ডবের মতো সদাচারী, ধর্মপরায়ণ, সত্যাশ্রয়ী ব্যক্তিদের ক্ষতি করতে চাইলে ধর্ম তা সহ্য করেন না। পাণ্ডবদের প্রতারিত করতে এসে তাই দুর্বাসাকে পালাতে হল।

এই দুর্লভ মুহূর্তটির সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল ঘটনাটি হল— এই প্রথম কৃষ্ণের ঐশী ক্ষমতার পরিচয় পেলেন পাঠক। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় কৃষ্ণ এসেছিলেন পাণ্ডবদের জতুগৃহে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের জনশ্রুতি যাচাই করতে। ব্রাহ্মণবেশী পঞ্চপাণ্ডবকে দেখেই তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর অনুমান যথার্থ। অগ্নিদাহে পাণ্ডবদের মৃত্যু ঘটেনি। স্বয়ংবর সভায় তিনি আত্মপরিচয় দেননি। দ্রৌপদীর স্বামী নির্বাচনের অনুকূলে আপন অভিমত জ্ঞাপন করে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর পাণ্ডবদের অনুসরণ করে কুন্তীর কুটিরে যান, কুন্তীকে প্রণাম করে আপন পরিচয় দেন এবং অর্জুনের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে ফিরে যান। সেই ঘটনায় কৃষ্ণকে তীক্ষ্ণধী, অভ্রান্তবুদ্ধি মানুষরূপে আমরা চিনেছি।

খাণ্ডবদাহন কালে অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণের বন্ধুত্ব আরও গভীর হল। অগ্নিদেবকে সহায়তা করে কৃষ্ণ লাভ করলেন সুদর্শন চক্র ও কৌমোদকী গদা। অর্জুন পেলেন গাণ্ডিব ধনু, দুই অক্ষয়-তূণীর ও দেবদত্ত রথ। এখনও পর্যন্ত কৃষ্ণকে উজ্জ্বলতম এক মহাবীর, শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী ব্যক্তিরূপেই আমরা দেখি। রাজসূয় যজ্ঞে ভীষ্মের মুখে আমরা শুনি কৃষ্ণই নারায়ণ— জগৎস্রষ্টা। তিনিই বিষ্ণু। পরে ধৃতরাষ্ট্রের মুখেও আমরা শুনেছি যে, কৃষ্ণই জগৎপতি, তিনি সকল দেবতার শ্রেষ্ঠ। দেবতারা তাঁর পূজা করেন। শিশুপাল কৃষ্ণের নিন্দা করতে গিয়ে তাঁর বাল্যকালের পুতনা রাক্ষসী ইত্যাদি বধের ঘটনাগুলি ব্যঙ্গ করে বলতে আরম্ভ করলে, আমরা তাঁরই মধ্যে দিয়ে দিব্য এক মানুষের সন্ধান পাচ্ছিলাম। কিন্তু তখনও পর্যন্ত আমরা কৃষ্ণের মধ্যে এক অসাধারণ মানুষকেই দেখছিলাম। ভয়ংকর ক্রোধে কৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালের মাথা কেটে ফেললে, আমরা তাঁর ভীষণ রূপ দেখেছিলাম, তাঁর ক্রোধের সম্মুখে শিশুপাল পক্ষীয় বীরদের শিশু বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু সেই ভয়ংকর কৃষ্ণও মানুষ ছিলেন।

‘দুর্বাসার পারণ’ অংশে এসে আমরা প্রথম জগন্নাথ, ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু, বিপন্ন ভক্তের স্মরণমাত্রই আবির্ভূত হয়ে, তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে দেখি। ঐশী মহিমাতেই দুর্বাসাকে তিনি পরাস্ত করলেন। কৃপাসিন্ধু হয়ে ভক্ত দ্রৌপদীর কাছে ছুটে এলেন পার্শ্বে শায়িতা রুক্মিণীকে পরিত্যাগ করে। দ্রৌপদীর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। দুর্বাসা পাণ্ডবদের ক্ষতি করতে এসেছিলেন, তিনি ভয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন।

দুর্বাসার পলায়নের পর কৃষ্ণ আবার স্বাভাবিক মানুষ। তিনি অর্জুনের সখা, অর্জুনের থেকে ছ’মাসের বড়। কাজেই, ভীম ও যুধিষ্ঠির তাঁর থেকে বড়। তাই বয়োজ্যেষ্ঠের সম্মান তাঁদের দিয়ে যাত্রার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। যদিও সঙ্গে সঙ্গে জানালেন যে, কৃষ্ণ রক্ষক হয়ে আছেন, তাই তাঁরা এত নির্ভয়। এই দুর্লভ মুহূর্তে কৃষ্ণ একই সঙ্গে তাঁর জগদীশ্বর ও মানবশ্রেষ্ঠ রূপের সম্মিলন দেখিয়েছেন। তাই এই মুহূর্তটি এত দুর্লভ।

৪৮
দ্রৌপদী হরণে জয়দ্রথ

বনবাসকালীন পাণ্ডবগণ কিছুকাল কাম্যকবনে বাস করেছিলেন। একদিন পাণ্ডবগণ পুরোহিত ধৌম্যের অনুমতিক্রমে দ্রৌপদীকে আশ্রমে রেখে ব্রাহ্মণগণের জন্য মৃগয়া করতে সকলে চতুর্দিকে চলে গেলেন।

সেই সময়ে সিন্ধুদেশের রাজা মহাযশা জয়দ্রথ বিবাহ করার জন্য শাল্বদেশে চলেছিলেন। সেই নির্জন-বন-মধ্যে আশ্রম দ্বারে তিনি পাণ্ডবগণের প্রিয়তমা ভার্যা, যশস্বিনী, শরীর শোভায় দীপ্তিমতী ও পরম সুন্দরী দ্রৌপদীকে দেখতে পেলেন। বিদ্যুৎ যেমন নীল মেঘকে উজ্জ্বল করে, সেইরকম দ্রৌপদীও বনভূমিকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। তখন দ্রৌপদীর বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছিল।

সিন্ধুদেশের রাজা ও বৃদ্ধক্ষত্ৰনন্দন দুরাত্মা জয়দ্রথ সেই অনিন্দ্যসুন্দরী দ্রৌপদীকে দেখে অতিমাত্রায় বিস্মিত হলেন এবং মনে মনে চিন্তা করলেন, “ইনি কি অপ্সরা, না দেবকন্যা, না দৈবী মায়া।” জয়দ্রথের সঙ্গে তাঁর বন্ধু ও সহচর কোটিকাস্য ছিলেন। জয়দ্রথ কোটিকাস্যকে বললেন, “এই অনিন্দ্যসুন্দরী কার রমণী? আমার মনে হয়— ইনি মানুষী নন। এই পরমসুন্দরীকে লাভ করলে আমার আর বিবাহের কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ, আমি এঁকে নিয়েই আপন ভবনে চলে যাব। কোন কারণে এই সুন্দরী এখানে বাস করছেন, বন্ধু কোটিকাস্য, তুমি এর কাছ থেকে সবকিছু জেনে এসো। এই সুন্দর-নিতম্বা, ভুবনসুন্দরী, আয়তনয়না, মনোহরদন্তশালিনী ও ক্ষীণমধ্যা নারী আজ আমাকে ভজনা করবেন কি?”

শৃগাল যেমন লাফাতে লাফাতে ব্যাঘ্রবধূর কাছে যায়, কোটিকাস্য তেমনই রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল— “কা ত্বং কদম্‌স্য বিনাম্য শাখামেকাশ্রমে তিষ্ঠসি শোভমানা।” বায়ুকম্পিত দেদীপ্যমানা অগ্নিশিখার মতো শোভা পেতে পেতে কদম্ববৃক্ষের একটি শাখাকে নুইয়ে ধরে কে তুমি নারী বনমধ্যে আশ্রমদ্বারে একাকিনী দাঁড়িয়ে আছ? তুমি পরম রূপবতী, অথচ বনের মধ্যে ভয় পাচ্ছ না কেন? তুমি কি কোনও দেবী, না যক্ষী, না দানবী, না কোনও প্রধান অপ্সরা, কিংবা কোনও প্রধান দৈত্যের পত্নী? অথবা তুমি নাগরাজের কন্যা, মানুষীর মূর্তি ধারণ করে এসেছ, কিংবা কোনও রাক্ষসের স্ত্রী বনে বিচরণ করছ? অথবা রাজা বরুণ, যম, চন্দ্র অথবা কুবেরের পত্নী। তুমি কি প্রভু ধাতা, বিধাতা অথবা সূর্য বা শুক্রের ভবন থেকে এসেছ। তোমার অভিভাবক কে? বন্ধু কে? স্বামী কে? কোন বংশে জন্মেছ?— আমায় তোমার বিষয় সব খুলে বলো।

“আমি সুরথরাজার পুত্র কোটিকাস্য। সম্মুখস্থ স্বর্ণময় রথে ত্রিগর্তদেশের রাজা ক্ষেমঙ্কর। সুন্দরী পুষ্করিণীর নিকট ওই যে শ্যামবর্ণ সুন্দর যুবকটি দাঁড়িয়ে আছেন ইনি শত্ৰুহন্তা ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা সুবলের পুত্র। বারোজন সৌবীর রাজপুত্র রক্তবর্ণ রথে আরোহণ করে ধ্বজ ধারণপূর্বক যাঁর পিছনে পিছনে গমন করছেন এবং ছয় হাজার রথী, হস্তী, অশ্ব ও পদাতি যাঁর অনুগমন করছে, সেই সৌবীররাজ জয়দ্রথ তোমার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছেন। এখন তোমার বিষয় সব বলো।”

দ্রৌপদী বললেন, “রাজপুত্র আপন বুদ্ধিতেই আমি বুঝতে পারছি, আপনার সঙ্গে আমার কথা বলা উচিত নয়। কিন্তু এখানে অন্য কোনও পুরুষ অথবা স্ত্রীলোক না থাকায়, আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার বক্তব্য থেকে জানলাম, আপনি সুরথরাজার পুত্র কোটিকাস্য। শিবিনন্দন! আমি দ্রুপদরাজের সন্তান, লোকে আমাকে ‘কৃষ্ণা’ বলে জানে। ইন্দ্রপ্রস্থবাসী পাঁচ বীর যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব আমার পতি। আমাকে আশ্রমে রেখে তাঁরা মৃগয়া করতে গেছেন। যুধিষ্ঠির পূর্বদিকে, ভীম দক্ষিণদিকে, অর্জুন পশ্চিমদিকে ও নকুল ও সহদেব উত্তরদিকে গিয়েছেন। তাঁদের ফিরে আসার সময় হয়েছে। সুতরাং আপনি সামান্যক্ষণ অপেক্ষা করুন, তাঁরা ফিরলে আপনি যথেষ্ট সম্মানিত হয়ে যেতে পারবেন। অতিথি যাঁর অত্যন্ত প্রিয়, সেই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আপনাদের যথেষ্ট সমাদর করবেন। অতএব আপনারা যানবাহন পরিত্যাগ করে উপবেশন করুন।” এই বলে, চন্দ্রমুখী দ্রৌপদী, তাঁদের অতিথি ভেবে আপন প্রশস্ত পর্ণশালায় প্রবেশ করলেন।

কোটিকাস্য ফিরে গিয়ে জয়দ্রথ প্রমুখদের সমস্ত সংবাদ জানালেন। জয়দ্রথ বললেন, “এই রমণীপ্রধানা যখন কথা বলছিলেন, তখন আমার মন এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। মহাবাহু কোটিকাস্য এই রমণীটিকে দেখে আমার অন্য রমণীদের বানরী বলে মনে হচ্ছে। এ যদি মানবী হয় এর সম্পূর্ণ বিবরণী আমাকে বলো।” কোটিকাস্য বলল, “ইনি দ্রুপদরাজার তনয়া যশস্বিনী ‘কৃষ্ণা’ এবং ইনি পঞ্চপাণ্ডবেরই পরসম্মতা মহিষী। ইনি পাণ্ডবদের সকলের প্রীতি ও আদরের পাত্রী। অতএব সৌবীরনাথ, তুমি তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়েই সৌবীরদেশের দিকেই গমন করো।” কোটিকাস্য একথা বললে দুষ্টস্বভাব জয়দ্রথ বলল, “দ্রৌপদীকে দেখব।”

ছোট বাঘ যেমন সিংহের গুহায় প্রবেশ করে, তেমনই জয়দ্রথ ছ’জন সহচরকে নিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করে দ্রৌপদীকে বললেন “বরবর্ণিনী তোমার মঙ্গল তো? তোমার ভর্তারা সুস্থ আছেন তো? তুমি যাঁদের মঙ্গল কামনা কর, তাঁরাও ভাল আছেন তো?” দ্রৌপদী উত্তর দিলেন, “কুরুবংশজাত কুন্তীনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির, আমি ও তাঁর ভ্রাতারা সকলেই কুশলে আছি, আর আপনি অন্য যাঁদের কথা জানতে চাইছেন, তাঁরাও কুশলে আছেন। আপনার রাজপদ, রাজ্য, কোষ ও সৈন্যগণের মঙ্গল তো? আপনি একাই সমৃদ্ধ শিবিগণকে, সিন্ধুদেশের সঙ্গে সৌবীরদেশকে, আর অন্য যত দেশ আপনার নিজের বলে জানা আছে, সেগুলিকে ধর্ম অনুসারে পালন করছেন তো? রাজপুত্র, আপনি এই পাদ্য ও আসন গ্রহণ করুন, আমি আপনাকে প্রাতঃকালের খাদ্যরূপে পঞ্চাশটি হরিণ প্রদান করব। তারপর যুধিষ্ঠির ফিরে এসে আপনাকে বহুতর সুস্বাদু ও অন্য যত প্রকার মৃগ আছে, সে সকল দান করবেন।”

জয়দ্রথ বলল, “আমার ও আমার রাজ্য প্রভৃতির মঙ্গল। তুমি আমাকে যে প্রাতঃকালীন খাদ্য দিতে চেয়েছ, তা এখন থাক; তুমি এসো, আমার রথে ওঠো, আর কেবল সুখভোগ করতেই থাকো। তুমি সহায়সম্বলহীন ক্ষুদ্ৰহৃদয় পাণ্ডবদের কোনও অপেক্ষা রাখার যোগ্য নও। দেখো, বুদ্ধিমতী স্ত্রী, সমৃদ্ধিবিহীন ভর্তার সেবা করেন না, সমৃদ্ধিযুক্ত ভর্তার সেবাই করে থাকেন। ভর্তার সম্পত্তি নষ্ট হলে আর তাঁর সঙ্গে একত্র বাস করেন না। পাণ্ডবেরা বহু বৎসর যাবৎ রাজ্যভ্রষ্ট এবং সম্পত্তিশূন্য হয়ে আছে। অতএব, তাঁদের প্রতি ভক্তিবশত তুমি আর কষ্ট ভোগ কোরো না। সুনিতম্বে, তুমি আমার ভার্যা হও, পাণ্ডবদের পরিত্যাগ করো এবং অনাবিল সুখভোগ করতে থাকো।”

জয়দ্রথ এমন হৃৎকম্পজনক বাক্য বললে দ্রৌপদী ভ্রূকুটি করে সেখান থেকে চলে যান। সুমধ্যমা দ্রৌপদী মনে মনে জয়দ্রথকে বাক্যের অবজ্ঞা ও নিন্দা করে তাঁকে বললেন, “এই ধরনের কথা আর উচ্চারণও করবেন না, আপনার কি কোনও লজ্জা হয় না?” দ্রৌপদীর সুন্দর মুখখানি ক্রোধে রক্তবর্ণ ও বিকৃত হল, চোখদুটি লাল হয়ে উঠল, ভ্রূযুগল ক্রোধে উন্নত ও অবনত হতে থাকল। তিনি জয়দ্রথকে পুনরায় আক্রমণ করে বললেন, “মূর্খ। যাঁরা যশস্বী, তীক্ষ্ণবিষের ন্যায় ক্রোধশালী, মহারথ, ইন্দ্রতুল্য, স্বকর্মনিরত এবং যক্ষ-রাক্ষসগণের সঙ্গে যুদ্ধেও অবিচল, সেই পাণ্ডবদের নিন্দা করেও তুমি লজ্জাহীন অবস্থায় আছ।”

দ্রৌপদী বুঝেছিলেন জয়দ্রথ সম্ভ্রমের যোগ্য পাত্র নন৷ তাই সম্বোধনের রীতিও পরিবর্তিত করলেন। বললেন, “প্রশংসার যোগ্য লোক বনবাসী অথবা গৃহস্থ, যাই হোক না কেন সাধুব্যক্তি তাঁদের অসম্মান করেন না। কিন্তু কুকুরের তুল্য মানুষেরাই পূর্ণবিদ্যাশালী তপস্বীকে এই ধরনের তিরস্কার করতে পারেন। পর্বতের মতো বিরাট ও শক্তিশালী হস্তী যখন হিমালয় সন্নিহিতস্থানে মদমত্ত বিচরণ করে, তখন কোন মহামূর্খ শুঁড় ধরে টানতে যায়? তোমার সেই দশাই ঘটবে, কারণ তুমি ধর্মরাজকে জয় করার ইচ্ছা করেছ— জেতুমাশংসসি ধর্মরাজম্‌।”

দ্রৌপদী জয়দ্রথকে আরও বললেন, “তুমি মূর্খ বলেই পদাঘাত করে নিদ্রিত মহাবল সিংহের মুখ থেকে লোম ছিঁড়তে চাইছ। কারণ তুমি পালাতে গেলেই ক্রুদ্ধ ভীমসেনকে দেখতে পাবে। তুমি ক্রুদ্ধ ও ভীষণমূর্তি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছ, তুমি বুঝতে পারছ না— তুমি পর্বতগুহাজাত, কালক্রমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, মহাবল এবং ভীষণাকৃতি ও ভীষণ প্রকৃতি নিদ্রিত সিংহকে চরণাগ্র দিয়ে আঘাত করতে চাইছ। তুমি নির্বোধ, তাই তুমি তীক্ষ্ণবিষ ও জিহ্বাদ্বয়শালী কৃষ্ণসর্পদ্বয়কে—নকুল ও সহদেবকে, পুচ্ছদেশে আক্রমণ করতে চাইছ। আর জয়দ্রথ, বাঁশ, কলাগাছ আর নল যেমন নিজের মৃত্যুর জন্যই ফল ধারণ করে, সম্পদের জন্য নয়, কর্কটকী যেমন নিজের মৃত্যুর জন্য গর্ভধারণ করে, তুমিও তেমনই মরবার জন্যই পাণ্ডবরক্ষিত আমাকে গ্রহণ করতে চাইছ।”

জয়দ্রথ বলল, “দ্রৌপদী আমি তোমার কথার অর্থ বুঝেছি। পাণ্ডবেরা কেমন তাও বুঝেছি। কিন্তু তুমি আমাকে ভয় দেখিয়ে ভীত করতে পারবে না। আমি অকালমৃত্যুশূন্য উচ্চবংশে জন্মেছি। ছ’টি গুণই আমার মধ্যে অধিক পরিমাণে আছে। অতএব, আমি পাণ্ডবদের আমার থেকে নিকৃষ্ট বলে মনে করি। তুমি কেবল বাক্য দ্বারা আমাকে নিবারিত করতে পারবে না। অনুনয় করলে দয়া করে তোমাকে ছেড়ে দিতেও পারি। তুমি রথে কিংবা হস্তীতে আরোহণ করো, আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”

দ্রৌপদী উপহাস করে জয়দ্রথকে বললেন, “আমি মহাবলা নারী। সৌবীররাজের বোধহয় ধারণা হয়েছে আমি অবলা। আমি আপনশক্তিতে বিশ্বাস করি। সুতরাং আক্রমণের ভয়ে আমি সৌবীররাজের কাছে কাতরোক্তি করব না। কারণ কৃষ্ণ আর অর্জুন একরথে আরোহণ করে যাঁর পিছনে যাবেন, তাঁকে দেবরাজ ইন্দ্রও অপহরণ করতে পারবেন না। গ্রীষ্মকালীন তৃণরাশি দাহকারী অগ্নির মতো আমার জন্য অর্জুন তোমার সৈনামধ্যে প্রবেশ করবেন। অন্ধক, বৃষ্ণি, কেকয়বংশীয় বীরগণ কৃষ্ণের সঙ্গে আমাকে তোমার হাত থেকে অনুসরণ করে উদ্ধার করবেন। তুমি গাণ্ডিবের ধ্বনি ও নিক্ষিপ্ত বাণে তোমার সৈন্যদলের মৃত্যু দেখতে দেখতে আক্ষেপ করবে। অর্জুন নিক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ শর জর্জরিত হয়ে তুমি গদাধারী ভীমের রুদ্রমূর্তি দেখতে পাবে, নকুল-সহদেবের ক্ষমাহীন শরাঘাতে তুমি দীর্ঘকাল যন্ত্রণায় ছটফট করবে। অতএব জয়দ্রথ, তুমি আমাকে টেনে নিয়ে গেলেও আমি ভীত হব না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি স্বামীদের সঙ্গে আবার এই আশ্রমে ফিরে আসব।”

তখন জয়দ্রথ ও তাঁর ছয় অনুচর দ্রৌপদীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করলে ক্রুদ্ধা তাদের ভর্ৎসনা করে বললেন, “আমাকে স্পর্শ করিস না।”— এই বলে দ্রৌপদী পুরোহিত ধৌম্যকে ডাকলেন। জয়দ্রথ দ্রৌপদীর শাড়ির আঁচল ধরে টান দিতেই, দ্রৌপদী তাকে ধাক্কা দিলেন। পাপাত্মা জয়দ্ৰথ, ছিন্নমূল তরুর মতো পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ মহাবেগে উঠে গিয়ে জয়দ্ৰথ, দ্রৌপদীকে ধরে টানতে লাগল। তখন রাজনন্দিনী দ্রৌপদী ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করে এবং ধৌম্য পুরোহিতের চরণে প্রণাম করে অগত্যা জয়দ্রথের রথে আরোহণ করলেন।

ধৌম্য বললেন, “জয়দ্ৰথ, প্রাচীন ক্ষত্রিয় রীতি স্মরণ করো। পাণ্ডবদের জয় না করে তুমি এঁকে নিয়ে যেতে পার না। এই ক্ষুদ্রজনোচিত কাজ করে তুমি যুধিষ্ঠির প্রভৃতি মহাবীর পাণ্ডবগণের কাছে অত্যন্ত মন্দ ফল লাভ করবে, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।” এই বলে পুরোহিত ধৌম্য জয়দ্রথের রথের পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন।

ওদিকে পাঁচ পাণ্ডবভ্রাতা চারদিকে মৃগ, বরাহ, মহিষ বধ করে একস্থানে সম্মিলিত হলেন। কাম্যকবনের মধ্যে পক্ষীগণ ব্যস্ত হয়ে চিৎকার করছে শুনে যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের বললেন, “পূর্বদিকে গিয়ে পশু ও পক্ষীগণ ভয়ংকর বেদনার্ত কণ্ঠে চিৎকার করছে। ভ্রাতৃগণ, তোমরা নিবৃত্ত হও। আমার মন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। গরুড় সর্পকে হরণ করলে সরোবর যেমন হয়, শত্রুরা সমৃদ্ধি হরণ করলে অরাজক রাজ্যের যেমন অবস্থা হয়, সুরাপায়ীরা সমস্ত সুরা পান করলে সুরাকুম্ভের যে অবস্থা হয়, তেমনই কাম্যকবন আমার কাছে সর্বশূন্য বোধ হচ্ছে।”

পাণ্ডবগণ সত্বর রথে চড়ে আশ্রমাভিমুখী হলেন। এই সময়ে উচ্চরাবী শৃগালগণ পাণ্ডবদের বামপার্শ্বে গিয়ে ডাকতে লাগল। যুধিষ্ঠির সেই অবস্থা দেখে ভীম ও অর্জুনকে বললেন, “এই নিকৃষ্ট পশু আমাদের বামপার্শ্বে গিয়ে ডাকছে, আমার বোধ হচ্ছে, পাপাত্মা কৌরবগণ আমাদের অবজ্ঞা করে বলপূর্বক আমাদের আশ্রমে উৎপীড়ন করেছে।”

কাম্যকবনে আশ্রমের কাছে প্রবেশ করা মাত্র তাঁরা দেখতে পেলেন, দ্রৌপদীর দাসভার্যা বালিকা ধাত্রীতনয়া উচ্চ স্বরে রোদন করছে। যুধিষ্ঠিরের সারথি ইন্দ্রসেন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে রথ থেকে লাফিয়ে দ্রুত সেই ধাত্রীর কাছে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, “তুমি ভূতলে পড়ে রোদন করছ কেন? তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে কেন? অতিনৃশংসকর্মা পাপাত্মারা— অচিন্তনীয় সৌন্দর্যশালিনী, বিশাল নয়না এবং পাণ্ডবগণের দেহতুল্যা রাজনন্দিনী দ্রৌপদীর কোনও ক্ষতি করেনি তো? দ্রৌপদী যদি পৃথিবীর ভিতরে প্রবেশ করে থাকেন, স্বর্গেও গিয়ে থাকেন অথবা সমুদ্রে মগ্ন হয়েও থাকেন, তথাপি পাণ্ডবেরা তাঁর কাছে উপস্থিত হবেন। কারণ স্বয়ং ধর্মপুত্র সন্তপ্ত হয়েছেন।

“শত্রুমর্দনকারী, কষ্টসহিষ্ণু, সর্বত্র অপরাজিত এই মহাবীরগণের প্রাণতুল্য প্রিয়তমা, সর্বোত্তম রত্নসদৃশী দ্রৌপদীকে কোন মহামূর্খ হরণ করবার ইচ্ছা করবে? সে কি জানে না, দ্রৌপদী আজ এখানেও সনাথা ও পাণ্ডবগণের বহিশ্চরহৃদয়স্বরূপা। তীক্ষ্ণ ও ভয়ংকর শর আজ কার দেহ বিদীর্ণ করে ভূমির ভিতরে প্রবেশ করবে?”

ধাত্রেয়িকা নিজের সুন্দর মুখ মুছে সারথি ইন্দ্রসেনকে বলল, “জয়দ্ৰথ, পঞ্চপাণ্ডবকে অবজ্ঞা করে উৎপীড়নপূর্বক দ্রৌপদীকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। অপহরণকালে তারা গাছ ভাঙতে ভাঙতে নতুন পথ তৈরি করেছে। গাছের ভাঙা ডাল এখনও মলিন হয়নি। এখনও তারা দূরে যেতে পারেনি— তোমরা অবিলম্বে তার অনুসরণ করো। ব্রাহ্মণগণ অসতর্ক থাকলে কুকুর যেমন যজ্ঞের সোমরস পান করে, তুষের আগুনে যেমন ঘৃতের আহূতি দেয়, তেমনই কোনও অযোগ্য পুরুষও দ্রৌপদীকে ভোগ করতে পারে। কুকুর যেমন যজ্ঞের পুরোডাশ স্পর্শ করে, তেমনই অকার্যকারী পুরুষ যেন না আপনাদের প্রিয়তমার সুন্দর নাসিকা ও মুখখানি স্পর্শ করে।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “ভদ্রে! তুমি সরে যাও, বাক্য সংবরণ করো, আমাদের সামনে এরূপ কুৎসিত কথা আর বোলো না।” তারপর পাণ্ডবেরা সেই পথে অনুসরণ করলেন।

কিছুদূর অগ্রসর হয়েই পাণ্ডবেরা দেখলেন বিপক্ষ সৈন্যের অশ্বক্ষুরের ধূলিসমূহ উপরে উড়ছে আর পদাতিসৈন্যদের মধ্য থেকে ধৌম্য পুরোহিত “ভীম, এইদিকে এগিয়ে এসো” বলে চিৎকার করছেন। পাণ্ডবেরা ধৌম্য পুরোহিতকে আশ্বস্ত করে রথে তুলে নিলেন। মাংসলোলুপ শ্যেনপক্ষীর মতো পাণ্ডবেরা সৈন্যদের মধ্য দিয়ে ছুটে চললেন। জয়দ্রথ এবং তাঁর রথে দ্রৌপদীকে দেখে পাণ্ডবদের ক্রোধানল জ্বলে উঠল। পাণ্ডবেরা জয়দ্রথ এবং তাঁর সৈন্যদের যুদ্ধে আহ্বান করলেন। সেই আহ্বান শুনেই সৈন্যদের দিকভ্রম শুরু হল। পাণ্ডবদের রথের ধ্বজা দেখেই দুরাত্মা জয়দ্রথের তেজ নষ্ট হতে আরম্ভ করল। তিনি রথস্থিত দ্রৌপদীকে বললেন, “দ্রৌপদী এই পাঁচখানি বিশাল রথ আসছে। আমি মনে করি, এঁরাই তোমার পতি। কিন্তু আমি এঁদের চিনি না। অতএব তুমি আমার কাছে এঁদের পরিচয় দাও।” দ্রৌপদী বললেন, “মূর্খ, তুমি মৃত্যুজনক অতি ভয়ংকর কাজ করেছ। এখন এই মহাধনুর্ধরদের পরিচয় জেনে কী হবে? আমার বীর পতিগণ উপস্থিত হয়েছেন। এই যুদ্ধে তোমাদের কেউ আর অবশিষ্ট থাকবে না। তুমি মুমূর্ষু। মুমূর্ষুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই ধর্ম। আর আমি অনুজদের সঙ্গে ধর্মরাজকে দেখতে পেয়েছি, সুতরাং আমার কোনও কষ্ট বা তোমা থেকে ভয় আর নেই।

“পরস্পর সংযুক্ত ও মধুররবকারী ‘নন্দ’ ও ‘উপনন্দ’ নামে দুটি মৃদঙ্গ যাঁর ধ্বজের উপর থেকে শব্দ করছে, ক্ষত্রিয়দের ধর্ম ও অর্থ সূক্ষ্মভাবে নিরূপণ করতে পারেন বলে সকলেই যাঁর সেবা করেন, যিনি স্বর্ণের ন্যায় নির্মল গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহ ও বিশালনয়ন, যাঁর নাসিকা উন্নত— সেই কৌরবশ্রেষ্ঠকেই লোকেরা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলে জানে; ইনি আমার পতি। এই ধর্মপরায়ণ মনুষ্যবীর শরণাগত শত্রুরও প্রাণ দান করে থাকেন। সুতরাং মূর্খ! তুমি নিজের মঙ্গলের জন্য অস্ত্র পরিত্যাগ করে, কৃতাঞ্জলি হয়ে, সত্বর এঁর শরণাগত হও।

“আর শালবৃক্ষের মতো উন্নত, মহাবাহু, ওষ্ঠদংশনকারী ও ভ্রূকুটি করায় সংযুক্ত ভ্রূযুগল এই যে বীরকে রথে দেখছ, এর নাম ভীমসেন— ইনিও আমার পতি। সুশিক্ষিত, উৎসাহী, মহাবল অশ্বগণ এই বীরকে বহন করছে, এঁর সকল কর্মই অলৌকিক, পৃথিবীতে ইনি ভীম নামে প্রসিদ্ধ। অপরাধীরা এঁর কাছে অবশিষ্ট থাকেন না, ইনি কখনও শত্রুতা ভুলে যান না। অন্য লোক শত্রুতার অবসান করে শান্তি লাভ করে; কিন্তু ইনি সম্পূর্ণরূপে শত্রুতার অবসান করেও শান্তি লাভ করেন না।

“আর ইনি— ধনুর্ধর শ্রেষ্ঠ, ধৈর্যশীল, যশস্বী, জিতেন্দ্রিয়, বৃদ্ধসেবী, মনুষ্যমধ্যে বীর ও যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতা ও শিষ্য অর্জুন— ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য ধনুঞ্জয় নামো পতিৰ্মযৈষ। যিনি— ইচ্ছা, ভয় বা ক্রোধবশত ধর্ম পরিত্যাগ বা নৃশংসকার্য করেন না এবং যিনি অগ্নির তুল্য তেজস্বী, শত্রুবেগসহনক্ষম ও শত্রুদমনকারী, ইনি সেই তৃতীয় কুন্তীনন্দন অর্জুন।

“আর যিনি, সমস্ত ধর্ম ও অর্থের নিরূপণ করতে নিপুণ, ভয়ার্তগণের ভয়হর্তা ও বুদ্ধিমান, পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা রূপবান পুরুষ, প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তম ও অনুকূল বলে পাণ্ডবেরা যাঁকে রক্ষা করে থাকেন, ইনি সেই নকুল— এই বীরও আমার পতি।

“আর যিনি খড়্গযোদ্ধা এবং যুদ্ধের সময়ে যাঁর হাতখানি দ্রুতবেগে ও বিচিত্রভাবে ভ্রমণ করে থাকে এবং যিনি— উদারচেতা ও বুদ্ধিমান দ্বিতীয় সহদেব রাজার তুল্য; মূঢ়বুদ্ধি জয়দ্রথ! যুদ্ধে দৈত্যসৈন্যের মধ্যে ইন্দ্রের মতো কার্য করতে আজ তুমি যাকে দেখবে এবং যিনি বীর, অস্ত্রে সুশিক্ষিত, বুদ্ধিমান, প্রশস্তচেতা, ধর্মরাজের প্রিয়কার্যকারী, চন্দ্র ও সূর্যের তুল্য তেজস্বী এবং পাণ্ডবগণের প্রিয় ও কনিষ্ঠ, বুদ্ধিতে যাঁর তুল্য মানুষ পৃথিবীতে আর নেই, যিনি পণ্ডিতদের মধ্যে বক্তা, কার্য নিরূপণে নিপুণ, বীর, সর্বদা অসহিষ্ণু, বুদ্ধিমান ও বিদ্বান— ইনি সেই সহদেব; ইনিও আমার পতি। কুন্তীদেবীর প্রাণের তুল্য প্রিয়তম, প্রশস্তচিত্ত ও সর্বদা ক্ষত্রিয়ধর্মে নিরত এই মনুষ্যবীর বরং প্রাণ পরিত্যাগ করতেও পারেন এবং অগ্নিতেও প্রবেশ করতে পারেন, কিন্তু ধর্মবহির্ভূত বাক্য বলতে পারেন না।— এই তোমাকে আমার পঞ্চ পতির বর্ণনা দিলাম। তুমি যদি এঁদের হাত থেকে অক্ষত শরীরে মুক্তি লাভ করতে পার, তবে জীবিত থেকে পুনর্জন্ম লাভ করবে।”

তখন জয়দ্রথ সেই রাজপুত্রদের যুদ্ধ করতে উত্তেজিত করতে লাগলেন। ব্যাঘ্রের মতো বলমত্ত পাণ্ডবদের দেখে জয়দ্রথের সৈন্যদের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি দেখা দিল। গদা হাতে ভীমসেন জয়দ্রথের দিকে অগ্রসর হলেন। কোটিকাস্য ভীম ও জয়দ্রথের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভীমকে লক্ষ্য করে বহুতর শক্তি, তোমর ও নারাচ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ভীমসেন অবিচলিত চিত্তে গদা দ্বারা সম্মুখের চোদ্দোজন পদাতিককে ও আরোহীর সঙ্গে একটি হাতিকেও সংহার করলেন। অর্জুন জয়দ্রথের সৈন্যের সম্মুখভাগের পাঁচশত পার্বত্য মহারথবীরকে বধ করলেন। রাজা যুধিষ্ঠির নিমেষমধ্যে সৌবীর প্রধান এক শত যোদ্ধাকে নিহত করলেন। নকুল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে খড়্গাঘাতে চক্ররক্ষী সৈন্যগণের মস্তক সকল মুহুর্মুহু নিপাতিত করলেন। আর সহদেব নারাচ দ্বারা গজারোহীদের নিপাতিত করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠিরের অর্ধচন্দ্র বাণে ত্রিগর্তরাজের হৃদয় বিদীর্ণ হল। মৃত্যুর পূর্বে নিক্ষিপ্ত ত্রিগর্তরাজের গদার আঘাতে যুধিষ্ঠিরের রথের চারটি অশ্বই নিহত হল। যুধিষ্ঠির সহদেবের রথে গিয়ে উঠলেন। ক্ষেম, কর ও মহামুখ নামক দুই বীর নকুলকে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন নকুল পর পর দুটি বিপাঠ অস্ত্রপ্রয়োগ করে দুই বীরকে সংহার করলেন। ‘সুরথ’ নামক অপর এক ত্রিগর্তরাজের হাতি নকুলের রথ ধরে টান দিল। নকুল অসি হাতে রথ থেকে নেমে শুঁড় সমেত সেই হাতির দাঁত কেটে ফেললেন। নকুল ভীমসেনের রথে গিয়ে উঠলেন। ভীম ক্ষুরপ্র দ্বারা কোটিকাস্যর সারথির মাথা কেটে ফেললেন। একটি মুষ্টিযুক্ত প্রাস দ্বারা ভীমসেন কোটিকাস্যকে বধ করলেন।

এদিকে অর্জুন সৌবীর দেশের বারোজন বীরকেই বধ করলেন। তারপর অর্জুন শিবি ও ইক্ষ্বাকুবংশের বীরদের সংহার করলেন। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ তখন অত্যন্ত ভয় পেয়ে রথ থেকে দ্রৌপদীকে নামিয়ে দিয়ে পালাতে লাগলেন। ভীমসেন নির্বিচারে সৈন্য বধ করছিলেন, অর্জুন তাঁকে বারণ করলেন। ভীম নিবৃত্ত হলেন ও যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আপনি, নকুল-সহদেব ও দ্রৌপদীকে নিয়ে আশ্রমে যান, জয়দ্রথ পাতালে গেলেও আমার হাত থেকে মুক্তি পাবে না।” যুধিষ্ঠির বললেন, “ভীম, ভগিনী দুঃশলা ও মাতা গান্ধারীর কথা চিন্তা করে জয়দ্রথকে প্রাণে বধ কোরো না।” ক্রুদ্ধা ও লজ্জিতা দ্রৌপদী ভীমার্জুনকে বললেন, “আমার প্রিয়কার্য যদি আপনাদের কর্তব্য হয়, সেই নরাধম, পাপাত্মা, কুলদূষক নিকৃষ্ট সিন্ধুরাজকে বধই করবেন।” ভীমার্জুন জয়দ্রথের পিছনে চললেন, যুধিষ্ঠির ধৌম্য পুরোহিত ও অন্যদের নিয়ে আশ্রমে ফিরলেন। ভীমার্জুন শুনতে পেলেন জয়দ্রথ এক ক্রোশ পথ দূরে গেছে। অর্জুন সেইখান থেকেই বাণক্ষেপে জয়দ্রথের সমস্ত অশ্বকে মেরে ফেললেন। ভীত জয়দ্রথ যে পথ দিয়ে এসেছিলেন, সেই পথেই পালাতে লাগলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে ভীমার্জুন জয়দ্রথকে ধরে ফেললেন। অর্জুন পিছন থেকে বললেন “রাজপুত্র! তুমি এই বল নিয়ে পরস্ত্রী হরণ করতে এসেছিলে?” জয়দ্রথ পালাবার চেষ্টা করায় ভীমসেন দ্রুত ছুটে গিয়ে জয়দ্রথের চুলের মুঠি ধরলেন। জয়দ্রথকে মাথার উপর তুলে একটি আছাড় মেরে মাটিতে ফেললেন, তাঁর মাথা ধরে প্রচণ্ড নাড়া দিলেন। জয়দ্ৰথ উঠবার চেষ্টা করতেই ভীম তাঁর মস্তকে পদাঘাত করলেন। তারপর তাঁকে নিজের জানুর উপর রেখে হাতের কনুই দ্বারা তাঁর বুকে আঘাত করলেন। তখন অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আদেশ স্মরণ করে তাঁকে হত্যা করতে নিষেধ করলেন। ক্ষুব্ধ ভীম বললেন, “এই পাপাচারী দ্রৌপদীর অসম্মান করেছে, কাজেই এ আমার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে না। কিন্তু আমি কী করব? রাজা সর্বদাই দয়ালু আর তুমি মূর্খবুদ্ধি।” এই বলে ভীমসেন অর্ধচন্দ্র বাণ দ্বারা জয়দ্রথের মাথার চুল মধ্যে মধ্যে মুণ্ডন করে তাঁর মাথায় পাঁচটি জটা করে দিলেন। তারপর জয়দ্রথের দেহ বন্ধন করে রথে তুলে নিয়ে চললেন। ভীম জয়দ্রথকে বললেন, “তুমি যদি বাঁচতে চাও, তা হলে সর্বদা বলবে ‘আমি পাণ্ডবদের দাস’।” জয়দ্রথ স্বীকার করে বললেন, “তাই হবে।”

ভীমার্জুন জয়দ্রথকে নিয়ে আশ্রমে ফিরলেন। যুধিষ্ঠির সেই বদ্ধ অবস্থায় এবং মস্তকের অবস্থায় জয়দ্রথকে দেখে মনে মনে হাসলেন। ভীমকে বললেন, “এবার একে ছেড়ে দাও।” ভীম উত্তরে বললেন, “আপনি এই কথা দ্রৌপদীর কাছে বলুন। এই পাপাত্মা পাণ্ডবের দাস।” যুধিষ্ঠির সস্নেহে ভীমকে বললেন, “আমার কথা যদি তোমার গ্রাহ্য হয়, এই নিকৃষ্টচারীকে ছেড়ে দাও।” দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে ভীমকে বললেন, “আপনি এঁর মাথায় পাঁচ জটা করে দিয়েছেন এবং ইনি রাজার দাস হয়েছেন; এখন এঁকে আপনি মুক্ত করে দিন।” ভীমসেন মুক্ত করে দিলে জয়দ্রথ রাজা যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করে, সেখানকার মুনিদেরও নমস্কার করলেন৷ অর্জুন জয়দ্রথের হাত ধরলেন, দয়ালু ও ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির জয়দ্রথকে বললেন, “পুরুষাধম! তুমি দাসত্ব থেকে মুক্ত হলে; সুতরাং অদাস হয়েই চলে যাও। আর কখনও এই কাজ কোরো না। তুমি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রসহায়শালী এবং পরস্ত্রীকামুক। সুতরাং তোমাকে ধিক। কারণ, তুমি ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তি এই কাজ করে না।”

মৃতপ্রায়, লজ্জিত, দুঃখিত, অবনতমুখ জয়দ্রথ গঙ্গাতীরের দিকে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দীর্ঘকাল বিরূপাক্ষ ও উমাপতি মহাদেবের প্রসন্নতা লাভের জন্য গুরুতর তপস্যা করলেন। মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে দেখা দিলে জয়দ্রথ প্রার্থনা করলেন, “আমি যেন যুদ্ধে রথারোহী পঞ্চপাণ্ডবকে জয় করতে পারি।” মহাদেব বললেন “না। অর্জন পূর্বজন্মে নর ঋষি ছিলেন, নারায়ণ তাঁর সখা এবং সহায়। অর্জুন আমার কাছে ‘পাশুপত’ অস্ত্র লাভ করেছে। নারায়ণ তাঁর রথের সারথি হবেন। এই নারায়ণ দশ অবতার রূপে বারংবার পৃথিবীকে উদ্ধার করেছেন। অতএব জয়দ্রথ তুমি এক অর্জুন ব্যতীত যুধিষ্ঠিরের সমস্ত সৈন্যকে এবং অপর চারজন পাণ্ডবকে একদিন মাত্র জয় করতে পারবে।”

*

জয়দ্রথকে শিবের আশীর্বাদ মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করলে অর্জুনের আত্মস্বরূপ পুত্র সেই ব্যূহমুখ ভেদ করে ভিতরে চলে যান। মহাদেবের বরে জয়দ্রথ অন্য পাণ্ডবদের আটকে দেন। সমস্ত দিন অক্লান্ত, অলৌকিক যুদ্ধ করে— দিবাবসানে অভিমন্যু সপ্তরথী বেষ্টিত হয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় নিহত হন। নিহত পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশোধে প্রতিজ্ঞা করে অর্জুন পরদিবস সন্ধ্যার পূর্বে জয়দ্রথকে বধ করেন।

মহাভারতের কিছু সমালোচক মনে করেন, ভালমানুষ, নির্বিরোধ মানুষ হিসাবে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে অনুকম্পা করতেন। এই জাতীয় মন্তব্য ভ্রান্তধারণাপ্রসূত। দ্রৌপদী অভিজাত, সম্ভ্রান্ত, মনস্বিনী নারী ছিলেন। যুধিষ্ঠির যে মানুষ হিসাবে কত বড় ছিলেন, দ্রৌপদী তা জানতেন। নিজের পরিচয় দেবার সময় তিনি বার বার বলেছিলেন, “আমি ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের ভার্যা।” যেখানেই কোনও তৃতীয় পক্ষ উপস্থিত, সেখানেই যুধিষ্ঠির প্রসঙ্গে দ্রৌপদীর অনিঃশেষ শ্রদ্ধা উচ্চারিত হয়েছে।

একথা সত্য যে বনপর্বে এবং অজ্ঞাতবাসপর্বে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের অত্যধিক দয়া ও তিতিক্ষার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু যতটা যুধিষ্ঠির করতে দিয়েছেন, ঠিক ততটাই। বনবাসকালে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের সমালোচনা করলে যুধিষ্ঠির শান্তকণ্ঠে বলেছিলেন, “দ্রৌপদী, তুমি নাস্তিকের মতো কথা বলছ।” দ্রৌপদী তৎক্ষণাৎ ক্ষমা চেয়েছিলেন। বিরাট রাজসভায় কীচক আক্রান্ত দ্রৌপদী রাজার কাছে অভিযোগ জানাতে আসায় যুধিষ্ঠির ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “দ্রৌপদী, তুমি নটীর মতো রাজসভায় ক্রন্দন কোরো না।” এই তিরস্কারেরও প্রয়োজন ছিল। দ্রৌপদীর অসম্মানে ভীম ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। রাজসভার সদস্যরা বিস্মিত কৌতুকে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিল। ঘটনাকে আর বিন্দুমাত্র বাড়তে দিলে পাণ্ডবদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ত, অজ্ঞাতবাসের শর্তভঙ্গ হয়ে যেত।

দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের শ্রেষ্ঠত্ব মানতেন। স্বর্ণকমল থেকে অশ্বত্থামার মাথার মণি পর্যন্ত সমস্ত কিছুই তিনি শ্রেষ্ঠ মানুষ যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছিলেন।

৪৯
মল্লশ্রেষ্ঠ ভীমসেন

বনবাসের বারো বৎসর অতিক্রান্ত হল। বারো বৎসর বনবাসের শেষদিন, যক্ষরূপী ভগবান ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে চূড়ান্ত পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত অজ্ঞাতবাসে অপরিচিত থাকার আশীর্বাদ করে বলে গেলেন, মৎস্যরাজ বিরাটের আশ্রয়ে যুধিষ্ঠির, দ্রৌপদী ও ভ্রাতারা নিরাপদে থাকবেন। সেই উপদেশ অনুসারে যুধিষ্ঠির ‘কঙ্ক’ নামে, ভীমসেন ‘বল্লব’ নামে, অর্জুন ‘বৃহন্নলা’ রূপে, নকুল ‘গ্রন্থিক’ নাম ধারণ করে ও সহদেব ‘তন্তিপাল’ নামে আত্মগোপন করলেন। দ্রুপদনন্দিনী দ্রৌপদী ‘সৈরিন্ধ্রী’ নাম নিয়ে মহিষী সুদেষ্ণার অধীনে স্বাধীন নারীরূপে কেশ সংস্কার কার্যে নিযুক্ত হলেন।

অজ্ঞাতবাস কালের চতুর্থ মাসে মৎস্যদেশে নূতন ধানের নবান্ন উৎসবে পুরুষ ও নারী আনন্দ উৎসবে মেতে উঠল। সেই মহোৎসবে নানাদিক থেকে আগত, কালখঞ্জ নামক অসুরদের মতো বিশালদেহ ও মহাবল, সিংহের মতো উঁচু স্কন্ধ, ক্ষীণকটি ও স্থূলগ্রীব, সুন্দর সুন্দর বেশভূষায় অলংকৃত, প্রশস্তচেতা এবং বহুবার বিপক্ষবিজয়ী প্রসিদ্ধ মল্লযোদ্ধা বিরাট রাজার রঙ্গালয়ে এসে উপস্থিত হল। তাদের মধ্যে একজন মহামল্ল, তার নাম জীমূত, সে যুদ্ধ করবার জন্য অন্য সকল মল্লকে আহ্বান করল, কিন্তু সেই ‘জীমূত’ নামের মল্লের বিরাটদেহ, প্রচণ্ড লাফ-ঝাঁপ দেখে অন্য কোনও মল্লই তার কাছে ঘেঁষতে সাহস পেল না।

অন্য মল্লদের নিরুদ্যম দেখে বিরাটরাজা বিশালদেহী ভীমসেনকে সেই মল্লের সঙ্গে যুদ্ধ করাবার ইচ্ছা করলেন। বিরাটরাজা আদেশ করলে ভীমসেন যেন অত্যন্ত ভীত হয়েছেন এমন ভাব দেখিয়ে, রাজাদেশ প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয় এই বোধে দুঃখের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। তারপর পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীমসেন ব্যাঘ্রের ন্যায় ধীরে ধীরে গিয়ে বিরাটরাজাকে অভিবাদন জানালেন এবং মহারঙ্গে প্রবেশ করলেন। ভীমসেনকে প্রবেশ করতে দেখে অন্য মল্লেরা আনন্দ প্রকাশ করে তাঁকে উৎসাহ দিতে লাগলেন। ভীমসেন তখন কোমরের কাপড়টিকে কঠিনভাবে বেঁধে নিয়ে বৃত্রাসুরের মতো সেই মহামল্ল ‘জীমূত’কে আহ্বান করলেন। ছ’বছর বয়স্ক হাতির মতো ভীম ও জীমূত দুই জনেরই অত্যন্ত উৎসাহ ও তীব্র পরাক্রম ছিল। তাই সেই দুই নরশার্দূল মদমত্ত মহাহস্তীদ্বয়ের মতো পরম আনন্দিত পরস্পর জয়াভিলাষী হয়ে পরস্পরের ছিদ্র অনুসন্ধান করতে করতে বাহুযুদ্ধে সম্মিলিত হলেন। তখন একের আঘাতে অপরের আশ্চর্য প্রতিকার, বিষম বাহুপ্রহার, ভূতলে ফেলে দেওয়া, দেহ ধরে ঝাঁকুনি দেওয়া, দাঁড়ানো অবস্থায় প্রচণ্ড ধাক্কা দেওয়া, বরাহের মতো গর্জন করে অপরকে দূরে নিক্ষেপ, মুষ্টি-প্রহার, বজ্রাঘাতের মতো প্রচণ্ড চপেটাঘাত, কণ্ঠার তীব্র মুষ্ট্যাঘাত, ভয়ংকর পদাঘাত, প্রস্তরতুল্য শব্দকারী জানুর আঘাত, মস্তক দ্বারা অপরের মস্তকে আঘাত—অথবা কেবলমাত্র বাহুর দ্বারা একে অপরকে নিষ্পেষিত করতে লাগলেন। তাঁরা একে অপরকে দূরে ঠেলে ফেললেন, পাশে ছুড়ে দিলেন, সবলে দূরে নিক্ষেপ করতে লাগলেন।

তারপর ভীম ও জীমূত বিশাল গর্জন করে পরস্পরকে তিরস্কার করতে লাগলেন। “তখন শত্ৰুহন্তা ভীমসেন আক্রোশে গর্জন করতে থেকে ব্যাঘ্র যেমন হস্তীকে উত্তোলন করে তেমনই জীমূতকে বাহুযুগলদ্বারা উত্তোলন করে সঞ্চালিত করতে লাগলেন” —

চকর্ষ দোর্ভ্যামুৎপাট্য ভীমো মল্লমমিত্ৰহা।

বিনদন্তমভিক্রোশন শার্দূল ইব বারণম॥ বিরাট : ১২ : ২৯॥

জীমূত গর্জন করতে থাকল।

তখন ভীম দুহাতে জীমূতকে তুলে মাথার উপর ঘোরাতে লাগলেন, তাই দেখে অন্য মল্লগণ ও মৎস্যদেশের লোকেরা অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হল। মহাবাহু ভীমসেন নিশ্চেষ্ট ও অচেতন সেই মল্ল জীমূতকে মাথার উপর শতবার ঘূর্ণিত করে, মাটিতে আছড়ে ফেলে জানুদ্বারা তার কণ্ঠে চাপ দিতে শুরু করলেন। জীমূতের প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। জগদ্বিখ্যাত মল্ল জীমূত ভীম কর্তৃক নিহত হলে, বিরাটরাজা বন্ধুদের সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দ করতে লাগলেন। তারপর কুবেরের ন্যায় মহাধনী সেই বিরাটরাজা সেই মহারঙ্গ স্থানেই পারিতোষিক রূপে ভীমকে প্রচুর ধন দান করলেন। ভীমসেন এইভাবেই বহুতর মল্ল ও মহাবল পুরুষদের নিহত করে মৎস্যরাজার পরম আনন্দ সৃষ্টি করতে লাগলেন। যখন অন্য কোনও পুরুষকেই ভীমের তুল্য বলশালী দেখা গেল না, তখন থেকে বিরাটরাজা সিংহ, ব্যাঘ্র ও হস্তীর সঙ্গেও ভীমকে দিয়ে যুদ্ধ করাতে লাগলেন। আবার বিরাটরাজা অন্তঃপুরের রমণীদের সন্তোষের জন্য ভীমকে দিয়ে বৃষ, মল্ল ও মহাহস্তীগণের সঙ্গে যুদ্ধ করাতে লাগলেন। এইভাবে সমগ্র মৎস্যদেশে মহাবলী রূপে ভীমসেনের প্রতিষ্ঠা ঘটল। কেবলমাত্র অন্তঃপুরে দ্রৌপদী বিশেষ সন্তুষ্ট হলেন না। তাঁর স্বামী যে অপরের সেবা করে, অপরের আনন্দবর্ধন করে ধন উপার্জন করছেন, তাতে দ্রৌপদী বিশেষ আনন্দিত হতেন না। বরং দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করতেন।

*

ভীমসেন কর্তৃক জীমূত মল্ল নিধন, মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। সমগ্র মহাভারতে বাহুবলে ভীমসেনের তুল্য শক্তিশালী দ্বিতীয় ব্যক্তি পাওয়া যায় না। অজ্ঞাতবাস পর্বেই ভীমসেন এই বিরাটরাজ্যেই কীচক ও উপকীচক বধ করবেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বে বাহুবলে ভীম জরাসন্ধকে বধ করেছিলেন, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভাতেও মল্লশ্রেষ্ঠ শল্যরাজাকে জানুর উপর ফেলে বধ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন তাঁর মনে পড়েছিল, শল্য মাদ্রীর ভ্রাতা, নকুল-সহদেবের আপন মাতুল।

স্মরণীয় যে, যে পুরুষ দ্রৌপদীকে স্পর্শ করেছিলেন, ভীম তাঁকেই বধ করেছেন। কির্মীর রাক্ষস, জটাসুর থেকে আরম্ভ করে জয়দ্রথ পর্যন্ত কেউ ভীমসেনের হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করেননি। যুধিষ্ঠির নিষেধ না করলে জয়দ্রথের মৃত্যু অনিবার্য ছিল। দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করার অপরাধে দুঃশাসনের বক্ষোরক্ত পান করেছিলেন ভীম। বাম ঊরু দেখানোর অপরাধে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করেছিলেন, ধৃতরাষ্ট্রের একশো পুত্ৰই ভীমের হাতে নিহত হন। রাজসূয় যজ্ঞকালে ভীম অঙ্গরাজ্য জয় করেছিলেন। অঙ্গরাজ কর্ণ যুদ্ধ করতে এসে পরাজিত হয়েছিলেন ও কর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

পরাজয় ভীমসেনের ভাগ্যেও ঘটেছিল। জ্যেষ্ঠভ্রাতা হনুমানের লাঙ্গুল তিনি সর্বশক্তিতে নড়াতে পারেননি। পিতৃপুরুষ নহুষও তাঁকে সর্পরূপে বন্ধন করেছিলেন—যুদ্ধে তিনি কর্ণের কাছেও পরাজিত হয়েছিলেন। অবাধ্যতার কারণে যক্ষরূপী ধর্মের কাছে তাঁর মৃত্যুও ঘটেছিল।

ভীমসেন ছিলেন যুধিষ্ঠিরের প্রিয় ভ্রাতা, যদিও ভীমসেনের অতিরিক্ত ভোজন যুধিষ্ঠির পছন্দ করতেন না। কিন্তু যে কোনও বিপদে, বিশেষত দৈহিক শক্তির প্রকাশে ভীম ছিলেন যুধিষ্ঠিরের সর্বাপেক্ষা বড় সহায় এবং দ্ৰৌপদীরও সর্বাপেক্ষা বিশ্বাসের পাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *